২. মাধবমাঝির বিবরণ

মাধবমাঝির বিবরণ

 তুমি তো সঙ্গে ছিলে, মাধবমাঝি, তবু কেন এ-রকম হল?

 মাধব মাঝি এমন উত্তেজিত যে তার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে, চোখ দু’টি অন্ধকারে বেড়ালের চোখের মতো, মাথার চুলগুলো খাড়া খাড়া, কথা বলতে গিয়ে তোতলাচ্ছে।

আমি…আমি… শালা, বাপের জন্মে এমন কাণ্ড দেখি নাই, কখনও শুনি নাই। কেউ.. আমরা কেউ দ্যাখলাম না, একটা পাতা পড়ার শ-শ শব্দ শুনলাম না, আর একটা মানুষ মইধ্যখান থিকা…

মধুভাঙতে, কাঠ কাটতে যে-দলটি গিয়েছিল জঙ্গলে, তারা অসময়ে ফিরে এসেছে। মাধব ছাড়া আর বাকি ক’জন মাটিলেপা দেয়ালের মত মুখ করে বসে আছে ঠায়। কাঁদছে ডলি, কবিতা, বাসনা আর প্রতিবেশীদের কয়েকটি স্ত্রীলোক। মনোরঞ্জন ফেরেনি।

এত রাতেও নাজনেখালির মাতব্বর ব্যক্তিরা এসে জড়ো হয়েছে এ বাড়িতে। এ-রকম সংবাদ শুনলে সবাই আসে। একেবারে শেষে এল নৌকোর মালিক মহাদেব মিস্তিরি। প্রত্যেক বার নতুন করে বিবৃত হচ্ছে পুরো কাহিনি। পুরুষরা কেউ কাঁদে না, কারণ এমন কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, সুন্দরবনের আসল জঙ্গলে গেলে এক-আধ জনকে বাঘের মুখে পড়তে হবে, এতে অবার হবার কী আছে? যারা চোরাই কাঠ আনে, তাদের সঙ্গে কারবার আছে মহাদেব মিস্তিরির। এই তো গত মাসেই সে-রকম একটা দলের রফিকুল মোল্লা খতম হয়ে গেল। নাড়িভুড়ি বার করা অবস্থা রফিকুল মোল্লার লাশ নামানো হয়েছিল ন্যাজাট জেটিতে। গোসাবার কাছে একটা গ্রামের নামই বিধবা গ্রাম হয়ে গেছে না? কাঠ কাটা কেন, যত জেলে মাছ ধরতে যায়, তারা সবাই কি ফেরে?

কিন্তু এরা তো গিয়েছিল পারমিট নিয়ে, আইনসম্মত ভাবে। বাঘ বুঝি আইন মানে, পারমিট থাকলে কাছে ঘেঁষে না, সে-কথা হচ্ছে না। সুন্দরবনের কাঠ কেটে সুন্দরবনের অর্ধেক মানুষের পেট চলে। অথচ জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেললে বাঘ বাঁচবে কী করে? আমাদের ভবিষ্যৎবংশধররা বাঘ দেখবে না? সেই জন্য তৈরি হয়েছে টাইগার প্রজেক্ট। সরকার বিভিন্ন জঙ্গলের বিশেষ বিশেষ অংশ ‘কোর এরিয়া’ বলে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। সেখানে শুধু বাঘ থাকবে, মানুষের প্রবেশ নিষেধ। বাকি জঙ্গলে পারমিট নিয়ে যার খুশি কাঠ বা মধু আনতে যাক না! চুরি করে কাঠ কাটতে গেলে তো ধরা পড়লে নৌকো বাজেয়াপ্ত হবেই, জেলও খাটতে হবে। যে-কোনও চুরিরই শাস্তি আছে। কার জিনিস কে চুরি করছে, সে আলাদা কথা!

একটা ছোটখাটো পাহাড়ের মতো চেহারা মহাদেব মিস্তিরির। পয়সার জোর, বন্দুকের জোর আর গায়ের জোর আছে বলেই না লোকে তাকে মানে। তবে নিজের গ্রামের লোকের রক্ত শুষে সে টাকা বানিয়েছে, এমন অপবাদ তাকে কেউ দিতে পাবে না। তার চালের ব্যবসা, কাঠের ব্যবসা সবই বাইরের লোকের সঙ্গে।

মহাদেব মিস্তিরিকে দেখে কবিতা কাঁদতে কাঁদতেই একখানা চাটাই এনে উঠোনে পেতে দিল। মহাদেব মিস্তিরি মাধব মাঝির সামনে গ্যাট হয়ে বসল, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। গাঁজার কল্কে টানার মতো হাত মুঠো করে সিগারেট টানলে তার আঙুলের চারটি আংটি দেখা যায়।

ছেলে-ছোকরাদের না হয় মাথা গরম, কিন্তু মাধব, তুমি তো পোড় খাওয়া মানুষ। তুমি কী বলে এমন আহাম্মকি করলে?

আপনে, আপনে বিশ্বাস করেন মহাদেবদা, ঠাকুর ফরেস্টে আমি আগে কতবার গেছি, কোনও দিন কিছু হয় নাই ।

ঠাকুর ফরেস্টে বাঘ? তুমি বলো কী মাধব? সেখানে তো একটা শিয়ালও নেই।

দয়াপুরে বাঘ আছে? ছোট মোল্লাখালিতে বাঘ আসে ক্যামনে, আপনে আমারে কন তো? আসে নাই সেখানে বাঘ?

মিস্তিরি সম্প্রদায়ের সকলেই বৈষ্ণব। মহাদেবের গলায় কণ্ঠী আছে। হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে মহাদেব বলল, শ্রীবিষ্ণু! শ্রীবিষ্ণু! ছোট মোল্লাখালিতে যে-দিন বাঘ আসে, সে-দিন সেখানে মহাদেব উপস্থিত। হাটের কাজকর্ম সেরে সে রাত্তিরে-রাত্তিরেই নৌকোয় উঠেছিল। ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে যে, তার নৌকোর পাশ দিয়েই বাঘটা সাঁতরে গিয়েছিল ছোট মোল্লাখালির দিকে।

আসল কাহিনি ভুলে গিয়ে সকলে কিছুক্ষণের জন্য ছোট মোল্লাখালির সেই বাঘ আসার দিনটির গল্পে মগ্ন হয়। দয়াপুর গ্রামের বাঘটাকে তো ধরে নিয়ে রাখা হয়েছে কলকাতার চিড়িয়াখানায়। কী যেন একটা শখের নাম রাখা হয়েছে সেই বাঘটার, দয়ারাম না সুন্দরলাল?

কাঁদতে কাঁদতে একটু থেমে গিয়ে ডলি হঠাৎ দাঁত কিড়মিড় করে বাসনাকে বলল, রাক্ষুসী, তুই-ই তো আমার ছেলেটাকে খেলি। হারামজাদিবিয়ের পর এখনও বছর ঘোরেনি, এরমধ্যে কেউ সোয়ামিকে জঙ্গলে পাঠায়? কতবার বলিছি, রাত্তিরে চুল খোলা রাখবি না, তা ঢঙি বউ সেকথাই শোনেনা! স্বামীর অকল্যাণের কথা যে না ভাবে… ছোটলোকের ঘরের মেয়ে… বিয়ের সময় একখানা শাড়ি দিয়েছে, শাড়ি তো নয় গামছা–

বলতে বলতে উঠে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডলি বাসনার চুল ধরে টেনে ফেলে দিল মাটিতে। আজ বিকেল পর্যন্ত ছেলের বউ ছিল তার আদরের পুতুল। মাতৃস্নেহ তাকে হঠাৎ উন্মাদিনী করেছে।

অন্য স্ত্রীলোকেরা ডলিকে জোর করে ছাড়িয়ে দিল।

ডলি তখনও চিৎকার করছে, বনবিবির পুজো দেবে? কেন, জয়মণিপুরে বনবিবির থান নেই? খালিসপুরে নেই? উজিয়ে সেই বাঘের মুখে যেতে হবে? শতেকখোয়ারি মাগি, ছোটলোকের ঘরের মেয়ে…কোনও রকম হায়া জ্ঞান নেই…।

ডলিকে দুজনে টানতে টানতে নিয়ে গেল অন্য দিকে।

পুরুষের দল কথা থামিয়ে এ-দিকে চুপ করে চেয়ে ছিল। মেয়ে ছেলেদের ব্যাপারে তারা মাথা ঘামায় না।

তারপর গোড়া থেকে সব খুলে বলল তো?

আমি বলছি।

তুই থাম সাধুচরণ, মাধবের মুখ থেকে শুনব।

হাঁটু দুটো দুহাত দিয়ে ঘিরে বসে আছে মাধব। ডান হাতটা মুঠো করে পাকানো আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরা একটা বিড়ি টানার কথা খেয়াল নেই। বিনা দোষে প্রচণ্ড শাস্তি পাওয়া মানুষের মতো তার মুখ। সে প্রায়ই ভাবছে নিজের কথা। মনোরঞ্জন মারা গেছে, কিন্তু সে নিজেই কি মরেনি? কাঠ বা মধু কিছুই আনা হল না, ফিরতে হল খালি হাতে, অথচ পরিমল মাস্টারের কো-অপ দোকানে ধার রয়ে গেল। এই ধার কী করে এখন শুধবে? মনোরঞ্জনের জন্য আপশোস করলে এখন তার নিজের পেটের জ্বালা মিটবে?

তাহলে শোনেন, প্রথম রাইতটা তো আমরা কাটাইলাম দত্ত ফরেস্টে, ফরেস্ট-অফিসের ধারেই। বড়বাবু ঘুমায়ে পড়েছিলেন, তেনারে তো জাগানো যায় না, পরদিন সকালে পারমিট দেখাতে হবে। সে-রাইতে রান্না করল সাধুচরণ আর বিদ্যুৎ, মনোরঞ্জন আমাগো দুই-তিনখান গান শোনাইল..আহা কী যেন একখান, ভারি সুন্দর গান গেয়েছিল..আমরা কইলাম, মনোরঞ্জন, আর একবার গা, আর একবার…।

পরদিন সকালে ভাটা, তাই বসে থাকতে হল দুপুর পর্যন্ত। তারপর ওরা যেতে লাগল মরিচঝাঁপির পাশ দিয়ে। হাল একজন, বৈঠা একজন, অন্য চার জন তাস পেটায়। সন্ধের কাছাকাছি একটা খাড়ির মুখে নৌকো বেঁধে কতক খেপলা জাল ফেলে দেখা হল মাছের আশায়। জোয়ারের সময় মাছ পাওয়ার আশা খুব কম, শুধু শুধু পণ্ডশ্রম হতে হতেও শেষবারে সাধুচরণের হাতে উঠল একটা কচ্ছপ। বিদ্যুৎ ক্ষীণ আপত্তি তুলেছিল। কচ্ছপ অযাত্রা। সে-কথায় কেউ পাত্তা দেয়নি। নোনা জলের কচ্ছপের স্বাদই আলাদা।

নৌকোয় একটা মুরগি রয়েছে অবশ্য, কিন্তু সেটি ছোঁয়া যাবেনা। ওটা বনবিবির কাছে মনোরঞ্জনের মানত করা।

রাত্তিরে নৌকো চালানো হবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছিল। ছ’জনের মধ্যে চার জনই এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে, কিন্তু দলনেতা হিসেবে মাধব বলেছিল, না। এরপর আর কোনও জনবসতি নেই, এখানে ডাকাতদের অবাধ স্বাধীনতা। প্রথম কয়েকটা রাত অন্তত হাল-গতিক বুঝে নেওয়া দরকার।

খুব ছোট একটা খাড়ির মধ্যে ঢুকে এমন ভাবে নৌকো বাঁধা হল, যাতে বাইরে থেকে দেখাই যাবে না। দুজন দু’জন পালা করে রাত জেগে পাহারা দেবে। কচ্ছপের মাংসটা জমে গেল দারুণ, ভাত কম পড়ে গেল মাধবের, যেটুকু ঝোল বাকি ছিল তাতেই সে আর এক থালা ভাত মেরে দিতে পারত।

গান গাওয়া নিষেধ বলেই ঘুমিয়ে পড়ল মনোরঞ্জন, সে আর নিরাপদ পাহারা দেবার পালা নিয়েছে শেষ রাত্রে। কিন্তু মাঝরাতেই জেগে উঠতে হল সবাইকে। বিদ্যুৎ জাগিয়ে দিল, খুব কাছ দিয়ে নৌকো যাচ্ছে দু’খানা। বিদ্যুতের ফিসফিসে গলা কেঁপে যাচ্ছে ভয়ে। সাধুচরণ আরমনোরঞ্জন পাটাতনের তলা থেকে বার করল দু’খানা লাঠি। কিন্তু ঘুমচোখেই মাধব নৌকো দু’খানা এক নজর দেখে নিয়ে বলল, কী আপদ! এর জইন্যে কাঁচা ঘুমড়া ভাঙাইয়া দিলি। ও কিছু না, অরা চোরাই কাঠের ব্যাপারী।

মাধব ভুক্তভোগী, সে ডাকাতেব নৌকো চেনে। একটা দল এ-দিকে ডাকাতি করে পালিয়ে যায় জবাংলায়, আবার জয়বাংলায় ডাকাতি করে চলে আসে এ-দিকে। ওদের হাতে পড়লে এই লাঠিতে কুলোবে না, ওদের কাছে বন্দুক থাকে।

নির্বিঘ্নে রাত কেটে গেল। আবার যাত্রা। মরিচঝাঁপি থেকে কিছু শুকনো ডালপালা তুলে নেওয়া হল, জ্বালানির জন্য। এ জঙ্গলে ভাল জাতের কাঠ বিশেষ কিছু বাকি নেই, বাঙাল-রিফিউজিরাই কেটে সাফ করে দিয়ে গেছে প্রায়।

এবার আসল দিনটার কথা। সেটা চতুর্থ দিন। তার আগে এক দিন মাঝনদীতে পেট্রোলের লঞ্চ অর্থাৎ পুলিশ পেট্রল ওদের নৌকো আটকায়। সেদিন বড় আনন্দ হয়েছিল মাধবের। পুলিশের নাকের ডগায় দেখিয়ে দিল পারমিটের কাগজখানা। এর আগে আর কোনও বার সে এমন গর্বোন্নত মুখে পুলিশের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। পুলিশরাও চিনতে পেরেছে মাধবকে। তাকে বেকায়দায় না পেয়ে বড়ই নিরাশ হয়েছিল তারা।

এরপর কাহিনির মধ্যে খানিকটা কারচুপি আছে। মাধব মিথ্যে কথা তেমন ভাল করে সাজিয়ে বলতে পারে না বলে সে হঠাৎ কাশতে শুরু করে দিল। কাশির দমকে বেঁকে গিয়ে কোনওক্রমে বলল, এবার থেকে তুই বল, সাধু… আপনেরা অর মুখ থেইক্যা শোনেন।

সাধুচরণ বলল, মঙ্গলবার দিনকে সকাল ন’টায় পৌঁছে আমরা প্রথমে বনবিবির পুজো দিলাম। সে-বেলাটা আর কাজে হাত না দিয়ে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর… প্রথমেই শুভ লক্ষণ…দেখি যে সামনের একটা গরাণ গাছের মাথায় বসে আছে একটা কাঁক, এই অ্যাত্ত বড়।

কাক নয়, কাঁক। খুবলম্বা গলাওয়ালা একজাতীয় পাখি, সাদায় কালোয় মেশানো, কাটলে অন্তত সোয়া কেজি মাংস হবে, বড় লোভনীয়, খুব সুস্বাদু। এ-দিকে কাঁক প্রায় দেখাই যায় না। সুতরাং কাঁকের নাম শুনে এই শোকের উঠোনেও শ্রোতাদের মন আনচান করে উঠল।

মারতে পারলি সেটাকে?

নাঃ! নিরাপদ গুলতি নিয়ে গেল, কিন্তু টিপ করার আগেই সে সুম্বন্ধির ভাই উড়ে পালাল।

সুন্দরবনের সব জঙ্গলই বাইরে থেকে দেখতে এক রকম। নৌকোয় বা লঞ্চে চেপে পাশ দিয়ে গেলে তিন নম্বর ব্লক বা সাত নম্বর ব্লকে কোনও তফাত নেই। তবে পারমিটের এলাকা মানেই বারোয়ারি। আর পাঁচ জন আগে থেকেই এসে সেখানকার ভাল ভাল মাল তুলে নিয়ে গেছে। ওদের পারমিট ছিল ওই তিন নম্বর ব্লকে গাছ কাটার।

কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে আসল জঙ্গল হল সাত নম্বর ব্লক। শুধু কাঁক কেন, শামুকখোল, কাস্তেচরা, বাটাম পাখির ছড়াছড়ি সেখানে। ঝাঁকের পর ঝাঁক, গুলতি চালালে একটা-দুটো মরবেই। আর ভাল ভাল জাতের কাঠও আছে এই সাত নম্বরেই। মোটা মোটা হেঁতাল আর গরাণ– এই দুই জাতের কাঠের ভাল দাম পাওয়া যায়। সুন্দরী গাছ এ তল্লাটে নেই বললেই চলে, সবই পড়েছে বাংলাদেশের সুন্দরবনে, এ-দিকে যা কিছু আছে তা ওই সাত নম্বর ব্লকেই।

পৃথিবীর অন্যান্য সব নিষিদ্ধ দ্রব্যের মতোই নিষিদ্ধ জঙ্গলের প্রতিই মানুষের বেশি আকর্ষণ। আর, তিন নম্বর ব্লক থেকে সাত নম্বর ব্লক কতটুকুই বা দূর, আড়াআড়ি দুটো নদী পার হয়ে তিনটে ব্ল্যাক ছাড়ালেই হয়। এদিকে পেট্রোলের লঞ্চ বা নৌকোও তেমন আসে না। তিন নম্বর ব্লকে বনবিবির পুজো দিয়ে ওরা রওনা হয়েছিল সাত নম্বর ব্লকের দিকে। সুতরাং ওদের অভিযান সাত নম্বর ব্লকে হলেও সাধুচরণ সুকৌশলে বর্ণনা দিতে লাগল তিন নম্বরের নিরীহ জঙ্গলের।

তিন নম্বরে বাঘ নেই। সাত নম্বরে যদি বাঘ না থাকবে, তাহলে সেটা নিষিদ্ধ জঙ্গল হবে কেন? সাত নম্বর একেবারে কোর-এরিয়ার মধ্যিখানে। তবু পাঁচ-পাঁচটা জোয়ান ছেলে যদি সেখানে যেতে চায়, মাধব আপত্তি করতে পারে কি? মাধব পুলিশের ভয় পায়, ফরেস্ট অফিসের বাবুদের ভয় পায়, এমনকী ডাকাতদেরও ভয় পায়। কিন্তু কোনও জঙ্গলকেই সে ভয় পায় না। সে একলা যমেরও মুখোমুখি হতে পারে, যদি যম প্রকৃত বীরপুরুষের মতো খালি হাতে একা লড়তে আসেন তার সঙ্গে। যদি তিনি বড়মিঞার ছদ্মবেশে আসেন, তাতেও মাধবের কুছ পরোয়া নেই।

মাধব বার বার ওদের বাজিয়ে নিয়েছিল। সাধুচরণ, বিদ্যুৎ, নিরাপদ, সুভাষ আর মনোরঞ্জন একবাক্যে রাজি। একে তো পাখির মাংস খাওয়ার লোভ, তাছাড়া, এত কষ্ট করে এসেছে যখন, তখন নৌকো ভর্তি ভাল ভাল কাঠ নিয়ে না ফিরতে পারলে আর লাভ কী? এই লাভের চিন্তাটাই মাধবকে বেশি টানে।

নিয়ম হল, নৌকো বাঁধবার পর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জলটা বুঝে নিতে হয়। সাত নম্বর ব্লকে অনেক বাঁদর আছে, এই বাঁদরের ডাকের ধবন শুনে টের পাওয়া যায় বাঘের গতিবিধির। সব লক্ষণই বেশ ভাল।

আশ্চর্য ব্যাপার। বাঘের নামে যেমন গা ছম ছম করে, তেমনি আকর্ষণও করে। দেরি সহ্য হয় না, মনে হয়, কখন জঙ্গলে নামবে। সাধুচরণ আর নিরাপদ অস্থির হয়ে বলেছিল, জঙ্গল তো একেবারে পরিষ্কার। তা বলে এবার…। মাধব তাদের ধমকে বলেছিল, দাঁড়া। এত হুড়াহুড়ি কীসের?

নদী এখানে খুব চওড়া। এ-পারে ও-পারে বনের সবুজ রেখা। আকাশ যেন এখানে বিশাল ডানা মেলে আছে। পাড়ের থকথকে কাদার মধ্যেও উঁচু উঁচু হয়ে আছে বড় বড় শূল। তারপর ছোট ছোট হেঁতালের ঝোঁপ। জোয়ারের সময় ওই গাছগুলোর অর্ধেকপর্যন্ত জলে ডুবে যায়। আর এই হেঁতালের হলুদ-সবুজ ঝোপের আড়ালেই বাঘের লুকিয়ে থাকার সব চেয়ে ভাল জায়গা।

সন্ধের সময় পৌঁছে ওরা পাড় থেকে অনেক দূরে নৌকো বেঁধে রইল। বাঘ সাঁতরেও আসতে পারে বটে, কিন্তু ওরা তো দু’জন দু’জন পালা করে জেগে থাকবেই। আসুক না একবার সাঁতরে, জলের বাঘকে পিটিয়ে মারা বড় আরামের। ওদের প্রত্যেকেই মনে একবার অন্তত একটা বাঘ মারার ব্যাপারে অংশ নেওয়ার সুখস্বপ্ন লুকিয়ে আছে। বাদা অঞ্চলে এমন মানুষ একটিও নেই যে পাশ ফিরে পড়ে থাকা নিহত বাঘের মুখ দেখে জীবনে অন্তত একবার আমোদ করতে চায় না। এরা জানে না, ডেনমার্কের যুবরাজের মনের খবর।

সারা রাত জঙ্গল একেবারে নিস্তব্ধ। এমনকী বাঁদরদের হুপোহুপিও নেই। শুধু সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল জলতরঙ্গ পাখির ডাক। ট-র-র-র। ট-র-র-র। ট-র-র-র! কেউ কোনও দিন এই জলতরঙ্গ পাখি চোখে দেখেনি। শুধু রাত্তিরবেলা এদের ডাক শোনা যায়।

ভোরবেলা কিছু দূরে মানুষের গলার আওয়াজ শুনে ওরা একেবারে তাজ্জব। মাধব তক্ষুনি চার হাতে বৈঠা চালিয়ে পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু সামনের বাঁক ঘুরে একটি নৌকো এ-দিকে আসতেই ওরা আশ্বস্ত হল। পুলিশ বা বনরক্ষী নয়, ডাকাতও নয়, অন্য নৌকোটির হাল ধরে আছে কুমিরমারির দাউদ শেখ, ওদের সবারই চেনা। বেশ বড় একটা পার্টি নিয়ে এসেছে দাউদ শেখ, এদেরও চোরাই কাঠের ধান্দা। দু’টি নৌকো পাশাপাশি এসে বিড়ি ও শুভেচ্ছা বিনিময় হল। ওদের দলে এক জন মউলে রয়েছে, সে মধুর সন্ধান দিতে পারবে।

তাহলে তো একেবারে নিশ্চিন্ত। এত মানুষজন দেখলে বড় মিঞার বাবাও এ-দিকে আর ঘেঁষবে না। মাধব তক্ষুনি ঠিক করে নিল, খুব চটপট কাজ সারতে হবে, এখানে দু’দিনের বেশি থাকা নয়, সারাদিন খেটে এখান থেকে সংগ্রহ করতে হবে বাবো আনা মতো কাঠ। বাকি চার আনার জন্য ফিরে যেতে হবে তিন নম্বর ব্লকে, সেখানে থেকে আবার কিছু কাঠ কেটে সেই কাঠ চাপা দিতে হবে ওপরে।

দাউদ শেখের নৌকো খুঁটি গাড়ল ওদের দৃষ্টিসীমার দূরত্বের মধ্যেই। তবে ওরা যাবে বাঁ-দিকে। আর এরা যাবে ডান দিকে, যাতে জঙ্গলের মধ্যে নেমে দু’দলে গুতাগুতি না হয়। শুধু মৌচাকের সন্ধান যে-দলই পাক, অন্য দলকে তার সন্ধান দিয়ে অর্ধেক ভাগ দিতে হবে, এই রইল মৌখিক চুক্তি।

যত সহজ ভাবা গিয়েছিল, তত সহজ নয় পাখি মারা। যে কাঁক পাখিটার কথা সাধুচরণ বলল তিন নম্বরে দেখেছে, আসলে তো সেটা ছিল সাত নম্বরে একটা গরাণ গাছের মাথায়। এই পাখিগুলোর অদ্ভুত স্বভাব, এরা গাছের মগডাল ছাড়া বসে না। নিরাপদ গুলতি চালিয়ে সেটাকে তো মারতেই পারল না, বরং সেই তোড়জোড়ে উড়ে গেল কাছাকাছি চরের ওপরে বসে থাকে একঝাঁক কাস্তে চরা।

রাতের হিমেল হাওয়া লেগে সুভাষের গায়ে বেশ জ্বর এসে গেছে। এবং এক রাতের জ্বরেই মুখটা বেশ ফুলে গেছে তার, চোখ দুটো পাকা করমচার মতো। বেশ চিন্তার ব্যাপার। এই অবস্থায় তার পক্ষে গাছ কাটতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আবার তাকে নৌকোয় একা রেখে যাওয়া যায়ই-বা কী করে? এক জন কেউ থেকে যাবে তার সঙ্গে? কে থাকবে, মনোরঞ্জন! বিদ্যুৎ! সবাই এ-ওর মুখের দিকে তাকায়। অর্থাৎ কারুরই থাকার ইচ্ছে নেই। জঙ্গলে পা দেওয়ার জন্য চাপা উত্তেজনা যেন আর দমন করতে পারছে না। সুভাষ বলল, না, নয় আমি একাই থাকব! দিনেরবেলা…হেঃ…তাতে আবার ভয়? সত্যিই দিনের আলোয় কোনও ভয় মনে আসে না। সুভাষকে রেখে যাওয়া হল নৌকোয়, রান্নাবান্নার ব্যবস্থা সে-ই করবে।

কুড়ুল আর করাত নিয়ে বাকিরা নেমে পড়ে নৌকো থেকে। লুঙ্গি পরা খালি গা, খালি পা। এদের মধ্যে একমাত্র মাধব ছাড়া বাকি চার জনই কিন্তু মাঝে-মাঝে শৌখিন জামা গায়ে দেয়, সাধুচরণ এবং মনোরঞ্জন ফুল প্যান্টও পরে। ক্যানিং-এ কখনও সিনেমা দেখতে গেলে ওরা বেশ সাজগোজ করেই যায়। মনোরঞ্জন শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিল বিয়ের সময় কাবলি জুতো পায়ে দিয়ে।

হাঁটু পর্যন্ত থকথকে কাদার মধ্যে দিয়ে ওরা বেশ ফুর্তির সঙ্গেই এগিয়ে যায়। শূলগুলো বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে গেলেও ভাঙা শামুক-ঝিনুকে একটু আধটু পা কাটবেই। ওপরে উঠে আসার পর বোঝা যায় বনটি বেশ নিবিড়, এগোতে হবে ঝোপঝাড় ঠেলে। সামনের প্রথম সারির হেঁতালের ঝোপের ওপর কয়েক বার কুড়ুলের ঘা দিতেই ভন ভন করে ওড়ে ঝাঁক ঝাঁক মশা। একটা ছোট গো-সাপ সরসরিয়ে জলে নেমে পড়ে। এ সবই ভাল লক্ষণ।

জঙ্গলের মধ্যে এগোতে হয় লাইন করে। মাধবই সব চেয়ে ভাল চেনে জঙ্গল, সেই জন্য সে আগে আগে যায় পথ তৈরি কবে। কোথাও কোনও শব্দ নেই, তাদের পায়ের শব্দ ছাড়া। ভাল গাছের জন্য যেতে হবে একটু ভেতরে, যত দূর পর্যন্ত জোয়ারের জল ওঠে সেই সীমারেখা ছাড়িয়ে।

দাউদ শেখের পার্টি এখনও পাড়ে নামেনি। এখান থেকে শোনা যাচ্ছে ওদের কথাবার্তা। ওদের তুলনায় মাধবের দলটির অবস্থা অনেক ভাল, যদি দৈবাৎ পেট্রলের নৌকো এসেও পড়ে, ওরা পারমিট দেখিয়ে বলবে, ভুল করে তিন নম্বরের বদলে সাত নম্বব ব্লকে এসেছে, নদী চিনতে পারেনি। তার জন্য বড় জোর দশ-বিশ টাকা প্রণামি দিতে হবে, নৌকো কেড়ে নেবেনা, জেলেও দেবে না। দাউদ শেখ এ-সব ব্যাপারে একেবারে বেপরোয়া।

একটা গাছেও কোপ মারেনি। মাধব আগাছা সাফ করতে করতে অনেকটা এগিয়ে গেছে। তারপর সাধুচরণ, তারপর বিদ্যুৎ, তারপর মনোরঞ্জন, সব শেষে নিরাপদ। নিরাপদর কোমরে গুলতিটা গোঁজা। তার দু’চোখ এদিকে ও-দিক ঘুরছে পাখির সন্ধানে। একটু বুঝি সে অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিল।

মাথায় খুব জোর কেউ ঘুষি মারলে চোখের সামনে যেমন খানিকটা হলুদ দেখা যায়, সেই রকমই একটা হলুদের ঝিলিক শুধু দেখতে পেল নিরাপদ, তারপর একটু দূরের একটা ঝোপে হুড়মুড় শব্দ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তুমুল শোরগোল শোনা গেল দাউদ শেখের নৌকো থেকে।

কী হয়েছে ঠিক বুঝতে না পেরেই নিরাপদ চেঁচিয়ে উঠল, ওরে বাবা রে! মা রে! সাধুচরণের বর্ণনায় এইখানে বাধা দিয়ে মাধব বলল, আমি যেই সেই চিখখৈর শুনিছি, অমনি আর চোক্ষের পলক না ফেইল্যা পিছন ফিরাই রোকেলের মতো (লোকাল ট্রেনের মতো) ছুটে আসিছি। দেখি যে নেরাপদডা ভেউ ভেউ কইরা কান্দে। আমি যত জিগাই কান্দোস ক্যান– ।

বিদ্যুৎ বলল, এই যে দেখুন নিরাপদটা এই রকম একটা বাঁশপাতার মতো থরথর করে কাঁপছিল।

নিরাপদ বলল, আমি কী করব। কিছুই ঠিক দেখিনি। কিছুই ঠিক বুঝিনি, তবু এমনি এমনিই আমার শরীরটা কাঁপতে লাগল, মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না, কিন্তু চোখ দিয়ে জল পড়ে। এমন আমার জীবনে কখনও হয়নি।

সাধুচরণ বলল, আমরা তখনও ভাবছি দাউদ শেখদেরই কোনও বিপদ হয়েছে।

সুভাষ বলল, আমিও নৌকো থেকে শুনছি দাউদ শেখরাই চ্যাঁচাচ্ছে বেশি। ওরা শুধু বলছে বড় মামা! বড় মামা! সেই শুনে তো আমারও কাঁপুনি ধরে গেছে।

মাধব বলল, আমিই প্রথম কইলাম, মনা কই? মনোরঞ্জন?

সবাই ঠিকঠাক আছে, শুধু মনোরঞ্জন নেই। সে সকলের সামনে ছিল না, একেবারে পিছনেও ছিল না, তবু বাঘ তাকেই বেছে নিল।

বর্ণনা শুনতে শুনতে মহাদেব মিস্তিরি বলে উঠল, অ্যাঁ? বলিস কী? শ্রীবিষ্ণু! শ্রীবিষ্ণু!

বিস্মিত হবারই কথা। কাহিনিটি যে এত সংক্ষিপ্ত হবে, তা কেউই কল্পনা করতে পারেনি। বাঘের গর্জন নেই, ঝটাপটি, লড়ালড়ি কিছু হল না, এরমধ্যে সব শেষ হয়ে গেল? ওদের অভিযান শুরু হতে না-হতেই সারা?

এই সময় আবার ডুকরে কেঁদে উঠল মেয়েমহলে। কামোট-কুমির, জোঁক-সাপ-বাঘ, ভূত-পেত্নি কলেরা নিয়ে ঘর করতে হয় বাদার মানুষদের, অপঘাতে মৃত্যুর মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু যার বিয়ের পর এক বছরও পেরোনি, সেই মনোরঞ্জনকেই টেনে নিল নিয়তি?

মহাদেব মিস্তিরি ঠোনা মেরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কিস্যু করতে পারলে না?

মাধব উত্তর না দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

 সাধুচরণ আবার শুরু করল তার বিবরণ।

সম্বিত ফিরতেই সকলে হাঁপর ঝাঁপড় করে দৌড়ে এল নৌকোয়। কিন্তু এ-কথা সবাই এক বাক্যে সাক্ষী দেবে যে শুধু একলা মাধব ফেরেনি। আরলুশ কাঠের মতো শক্ত হাতে কুডুলটা উঁচু করে তুলে সে পাগলের মতো চিৎকার করছিল, কোথায় গেলি শশালা, আয়াওরে পুঙ্গীর ভাই, ওরে চুতমারানির ব্যাটা, আয়। ওরে হারামজাদা, ওরে শুয়ারকি বাচ্চা, শোগামারানি..।

দক্ষযজ্ঞের মহাদেবের মতন সে তাণ্ডব নাচতে থাকল বনেব মধ্যে। আর গালাগালির ঝড় তার মুখে। সবাই মাধবের নাম ধরে ডাকছে। সে শুনতেই পাচ্ছে না। তারপর খানিক বাদে দাউদ শেখের দল আর সাধুচরণরা এক সঙ্গে মিলে গেল মাধবের কাছে। মাধবের তখন চোখ দুটি লাল, টকটকে, মুখের পাশ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে। সকলে গা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল প্রবল ভাবে। এ-রকম শুনলে বাঘ শিকার ফেলে পালায়।

কিন্তু অত চেঁচামেচি কিংবা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মনোরঞ্জনের লাশ পাওয়া যায়নি।

সাধুচরণ বা মাধবরা তো কেউ বাঘটাকে চোখেও দেখেনি, নিরাপদ পাখি-খোঁজায় একটু অন্য মনস্ক ছিল, সে শুধু দেখেছে একটা হলুদ ঝলক। দাউদ শেখ দাবি করে যে সে বাঘের পেছন দিকটা একবার দেখেছে ঝোপের মধ্যে। ওই রকম সা-জোয়ান চেহারা মনোরঞ্জনের, তাকে মুখে নিয়ে বাঘটা একেবারে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল?

কিন্তু তুমি তো গুণিন, মাধব? তুমি থাকতে সেখানে বাঘ এল। তুমি আগে মন্তর পড়ে জঙ্গল আটক করোনি?

একথা ঠিক, মাধব এক জন গুণিনও বটে। সে সাপের বিষ ঝাড়ার মন্ত্রও জানে। সেই জন্যই তো সে জঙ্গলকে ভয় পায় না।

মাধব পিছনের অন্ধকারের দিকে মুখ ফিরিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে বলল, হ, আটক করেছিলাম। আমার মন্তর খাটে নাই।

খাটেনি তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কেন এমন হল?

 এবার মাধব একটা অদ্ভুত যুক্তি উপস্থিত করল।

 সে চিক করে বাঁ-পাশে থুতু ফেলে বলল, কী জানি! বোধ হয় সেই দিন আমার জন্মদিন আছিল

জন্মদিন?

হ। আপনে জানেন না, জন্মদিনে কোনও গুণিনেরই মন্তব খাটে না?

তা তোমার যে সে-দিন জন্মদিন, তুমি আগে জানতে না?

ক্যামনে জানব? মায় মরেছে সেই কোন ছুটকালে, আর আমার বাপে আমারে দুই চক্ষে দ্যাখতে পারত না। আমারে খ্যাদাইয়া দিছিল। আমারে আমার জন্মদিনের কথা কে কইয়া দেবে? জন্মদিন তো দূরে থাক, নিজের জন্মবারটাই জানি না। আমি আদাড়-ছাদাড়ের মানুষ, কোনও রকমে খুদ কুড়ো খেইয়ে এতগুলান দিন বেঁচে আছি আর কত দিন টানতে পারব কে জানে…।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেকে গেল মাধব। তারপর মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইল অন্ধকারের দিকে।

.

বাসনার বাসা বদল

পরিমল মাস্টারের ঘুম ভাঙল ধুম জ্বর নিয়ে। এই জন্যই সারা রাত ভাল করে ঘুম আসেনি, এ পাশ ওপাশ ছটফট করেছে। বড় বিচ্ছিরি এই দখনে জ্বর, যখন তখন আছে, একবার ধরলে সহজে ছাড়তে চায় না।

চোখ মেলার পর একটা হাত দিয়ে কপালটা অনুভব করেই তার ঠোঁট তেতো হয়ে গেল। তার পরই তাঁর মনে পড়ল, আজ অরুণাংশু আসবে। যদি ভোরের ট্রেনেই রওনা দেয় তা হলে এখানে পৌঁছতে পৌঁছতে আড়াইটে-তিনটে হবে। কতটা দূরত্ব হবে কলকাতা থেকে? মাইলের হিসেবে ষাট-সত্তর মাইল, বড় জোর আশি, পাখি-ওড়া মাপে এই দূরত্ব পেরুতেই পাক্কা দশ ঘণ্টা লাশে, তা-ও যদি ঠিকঠাক লঞ্চ ধরা যায় ক্যানিং থেকে। একটা লঞ্চ না পেলেই সারা দিন কাবার।

সুলেখা তখনও জাগেনি। ভোরবেলা উঠে বাগানে পায়চারি করা পরিমল মাস্টারের স্বভাব। মানুষের শরীরে বিদ্যুৎ থাকে, শিশিরভেজা মাটির ওপর খালি পায়ে হাঁটলে তা চলে যায়, মন প্রসন্ন হয়। আজ সকালে বাগানে যাওয়া হবে না। বাগান মানে কাঁচা লঙ্কা ও বেগুনের খেত, অন্য সময় হয় উচ্ছে বা শশা বা ঢ্যাঁড়শ, সামনের দিকে কয়েকটা জবাফুলের গাছও আছে অবশ্য।

আজ অরুণাংশু না এলেই ভাল হত। শহরের সংস্পর্শ পেতে আজ পরিমলের একটুও ইচ্ছে করছেনা। আবার চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করল। ঘুম নয় একটু আরল্লী আসে, তাতে চলচ্চিত্রের মতো ছোট ছোট স্বপ্ন।

তোমার চা।

এরই মধ্যে কখন স্নান সারা হয়ে গেছে সুলেখার। তাঁর ভিজে চুলের প্রান্ত থেকে জল ঝরছে। স্নানের ঠিক পর সব মেয়েকেই কেমন যেন পুণ্যবতী পুণ্যবতী দেখায়। সুলেখার দিকে তাকিয়ে শীত করে উঠল পরিমলের।

চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিয়ে সিগারেটের টানটা ফিরে এল। সুলেখার সামনে উচ্চারণও করা যাবেনা। অরুণাংশু এলে অবশ্য প্রচুর সিগারেট খেতে হবে। অরুণাংশু নিজে যতগুলো খায়, অন্যদেরও খেতেই হবে ততগুলো। নিজের প্যাকেটই হোক আর অন্যের প্যাকেটই হোক, হাতের সামনের প্যাকেট খুলে সে মুড়ি মুড়কির মতো সিগারেট ছড়ায়।

সুলেখার নিষেধের জন্যই নয়, পরিমল নিজেই চায় সিগারেট ছাড়তে। স্বাস্থ্যের ব্যাপার তো আছেই, তা ছাড়া অযথা বাজে খরচ, এবং কেন এই নেশার দাসত্ব? কিন্তু সিগারেট যেন ঠিক মশার মতো। বন্দুক দিয়ে বাঘ-ভালুক মারা যায়। কিন্তু মশা যেমন শেষ করা যায় না, তেমনি ছাড়া যায় না এইসব চেয়ে ছোট নেশাটা।

পরিমল অপেক্ষা করছে কখন সুলেখা নিজে থেকে বুঝতে পারবে। তার আগে সে বলবে না তার জ্বর হয়েছে।

একসময় খবরের কাগজ ছাড়া সকালের চা খাওয়া কল্পনাই করা যেত না। এখানে কাগজ আসে দুপুর তিনটের লঞ্চে। না পড়লেও হয় সে-কাগজ।

হাতঘড়ির পাশের টেবিলের ট্রানজিস্টর রেডিয়োটা সে চালিয়ে দিল। রেডিয়োতে যে এত চাষবাস নিয়ে কথাবার্তা হয়, শহরে থাকতে কোনও দিন তা টের পাওয়াই যায়নি। অথবা এতটা বোধহয় আগে হত না। মন দিয়ে সে শুনতে লাগল চাষিভাইদের জন্য পাট চাষ বিষয়ে পরামর্শ। খুব একটা ভুল বলে না, অভিজ্ঞ লোকদেরই ডাকে রেডিয়ো। শুধু একটা জিনিস ওরা বোঝে না। যেখানে বৃষ্টি হয়নি, বিদ্যুৎ নেই বলে যেখানে পাম্প চলে না, নদীর নোনা জল সেখানে চাষের কাজে লাগাবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, সেখানকার চাষিরা রেডিয়োতে অভিজ্ঞ লোকদের মুখে সময় মতো জলসেচের পরামর্শ শুনে কতটা উপকৃত হবে?

তুমি উঠবে না?

 হ্যাঁ এই আর একটু। ক’টা বাজে?

সময় জানবার জন্য ঘড়ি দেখতে হয় না। রেডিয়োর অনুষ্ঠানগুলো প্রতি দিন এত ছক বাঁধা, বাংলা খবরের পর রবীন্দ্রসঙ্গীত, অর্থাৎ পৌনে আটটা। এতক্ষণ কোনও দিন শুয়ে থাকেনা পরিমল।

তোমার জ্বর হয়েছে?

গায়ে হাত না দিয়েও কী করে টের পেল সুলেখা? সত্যিই কি মেয়েদের সপ্তম ইন্দ্রিয় বলে কিছু ব্যাপার আছে? আসলে সুলেখারও একটু একটু জ্বর হয়েছে। প্রথম দু’এক দিন এ-রকম জ্বরকে উপেক্ষা করে সুলেখা, সেই জন্যই জোর করে স্নান করেছে। পরিমলের অসুখ-ভীতি বেশি, তাই স্বামীর স্পর্শ এড়িয়ে চলছে সুলেখা।

কী জানি, গাটা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে।

গ্রামসেবকদের মিটিং ক’টায়? এগারোটায় না?

যদি শরীরটা এ-রকম থাকে তাহলে ওদের একটা খবর পাঠাতে হবে, মিটিংটা বন্ধ রাখার দরকার নেই, ওরা নিজেরাই আলোচনা করুক।

বাইরের বারান্দায় দু’জন লোক বসে আছে। ওরা কোনও খবর দেয় না, নিজেদের উপস্থিতির কথাও জানায় না, বিড়ি ধরিয়ে উবু হয়ে বসে থাকে চুপচাপ। মাস্টারমশাই কিংবা দিদিমণি যখন বাইরে বেরুবে, তখন তো কথা হবেই।

ইলা নামে একটি তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়ে এ বাড়িতে কাজ করে। সে দাসী নয়, সে স্কুলে যায়, রাত্তিরবেলা হ্যারিকেন জ্বেলে সে পড়তেও বসে। মহিলা সমিতিতে সেলাইয়ের কাজও শেখে, আবার রান্না-বান্নায় সুলেখাকে সাহায্য করে। ইলার বাবা ছিল বিখ্যাত ডাকাত বীরু গোলদার।

সেই বীরু গোলদারের নামে কত রোমহর্ষক কাহিনি প্রচলিত আছে এখনও। পুলিশের গুলি খেয়ে রায়মঙ্গল নদীতে লাফিয়ে পড়েছিল বীরু গোলদার, তারপর আর তাকে দেখতে পাওয়া যায়নি। অনেকের ধারণা সে আজও বেঁচে আছে, ঘাপটি মেরে আছে কোথাও। পাঁচ বছর বয়সের অনাথা মেয়ে ইলাকে আশ্রয় দিয়েছিল সুলেখা। এখন সে বাড়ির মেয়ের মতো।

বাইরের লোকদুটিকে দেখতে পেয়েছে ইলা। সকাল ন’টার মধ্যে যারা এ বাড়িতে আসে, তারা চা পাবার অধিকারী। বিশেষ দরকার না থাকলে কেউ মাস্টারমশাইয়ের বারান্দায় এমন ভাবে এসে বসবেও না। এটা তো আড্ডাখানা নয়।

দুটি গেলাসে করে চা এনে ইলা ওদের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। ওরা তবু মুখ খোলে না। এমনকী নিজেদের মধ্যেও কোনও কথা বলে না, কারণ বলবার মতো কিছুই নেই। একেবারে চুপ। শুধু সুলুপ সুলুপ শব্দে চায়ে চুমুক দেয়।

প্রায় এক ঘণ্টা বাদে সুলেখা একবার বাইরে এলে ওদের মধ্যে এক জন বলল, দিদিমণি আমরা একবার নাজনেখালিতে যাস্যি, মাস্টারমশাই কি যাবেন?

কেন সেখানে কী আছে? নাজনেখালিতে পরশুদিন পাড়া-মিটিং হয়ে গেছেনা?

তা তো হয়ে গিয়েছে। আমরা যাব একবার বিষ্টুপদ খাঁড়ার বাড়িতে। তার ছেলে, সেই যে একবার ভাস্কর পণ্ডিতের পার্ট করেছিল, আমাদের হাটখোলায় যাত্রা হল, আপনিও দেইখে ছিলেন।

হ্যাঁ কী হয়েছে তার?

তাকে বাঘে নিয়ে গিয়েছে নাকি।

এমন আলতো ভাবেওরা সংবাদটি দেয়, যেন কারুর বাড়ির গাভিন গোরুর বাচ্চা হওয়া কিংবা সরষে খেতে শুঁয়োপোকা লাগার মতো নৈমিত্তিক ব্যাপার!

সুলেখার প্রথমেই মনে পড়ে গত রাত্রির সেই নদী-পেরুনো কান্নার আওয়াজের কথা। নাজনেখালির দিক থেকেই আসছিল বটে।

সুলেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে দ্বিতীয় জন খবরটিকে আরও একটু বিশ্বাসযোগ্য করে বলল, জঙ্গল মহলে গেসলো, মাধব মাঝির পার্টির সঙ্গে। এই তো সিদিনকে বিয়ে হল মনোরঞ্জনের।

তোমরা কার কাছে খবর পেলে?

প্রথম খেয়ার মাঝি এসে খবর দিল।

 এ-ভাবেই খবর ছড়ায়। এতক্ষণে গোসাবা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে নিশ্চয়ই।

লোক দু’টিকে সুলেখা ডেকে আনল শোয়ার ঘরে। পরিমল মাস্টার কাহিনিটা শুনতে শুনতেই খাট থেকে নেমে এল, দেয়ালের তাক থেকে ব্রাশ নিয়ে তাতে পেস্ট মাখাল। ভেতরের উঠোনের টিউবওয়েল থেকে দ্রুত দাঁত মেজে এসে তিনি বলল, ইলা, আমাকে একটা জামা দে তো মা।

নিজের ঈষদুষ্ণ ডান হাতটি এবার স্বামীর কপালে ছুঁইয়ে সুলেখা বলল, তোমার তো অনেক জ্বর দেখছি।

ও কিছু হবে না, ঘুরে আসি একবার।

সুলেখা লোক দু’টিকে জিজ্ঞেস করল, এখন ভাটার সময় না?

কোনও রূপক নয়। একেবারে আক্ষরিক অর্থে নদীর জোয়ার-ভাটা অনুসারে এখানকার জীবন চলে। প্রতি দিন জলের দিক পরিবর্তনের সময় তাই এদের সকলের মুখস্থ।

হ্যাঁ, ভাটা পইড়ে গিয়েছে।

 সুলেখা স্বামীকে বলল, তোমাকে যেতে হবে না, আমি যাচ্ছি ওদের সঙ্গে।

না না, আমার সেরকম কিছু হয়নি। আমি একবার চট করে ঘুরে আসব।

সরাসরি নৌকোয় গেলে এই ভাটার সময় শুধু যাওয়া আসাতেই সময় লাগবে অন্তত ছ’ঘণ্টা। কারণ নদীপথ অনেক ঘুরে। আর এখান থেকে কোনাকুনি কালী নদী পর্যন্ত হেঁটে গেলে, তারপর খেয়া পেরিয়ে আবার ও-পারে হাঁটা, তাতেও লাগবে প্রায় চার ঘণ্টা। যাওয়া মাত্র ফিরে আসা যায় না। অর্থাৎ এবেলা ওবেলার ধাক্কা।

জোয়ারের সময় নদীর জল কানায় কানায় ভরা থাকে বলে জেটি থেকেই নৌবেয়ে ওঠা যায়। আর ভাটার সময় অন্তত এক হাঁটু কাদা ভাঙতেই হবে দুটো খেয়াঘাটেই। সেই জন্যই এত জ্বর গায়ে স্বামীকে পাঠাতে দিতে রাজি নয় সুলেখা।

গত আট-দশ বছরের মধ্যে আশপাশের গ্রামের যে-কোনও পরিবারের বিপদে আপদে পরিমল মাস্টার গিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। নাজনেখালির লোকেরা ধরেই নিয়েছে যে যে-কোনও সময় পরিমলমাস্টার এসে পড়বেন। সাধুচরণ তাই সকালেই গা-ঢাকা দিয়েছে।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খানিকক্ষণ যুক্তি বিনিময় হল। ইলা সুলেখার পক্ষে। সে পরিমল মাস্টারকে যেতে দিতে চায় না, তাই জামা বার করে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতে হল পরিমলকেই। আজ স্কুলে ছুটি, আজকের দিনটা বিশ্রাম নিলে পরিমল হয়তো কাল সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। নয়তো আজ অসুস্থ অবস্থায় এত হাঁটাহাঁটি করলে কাল আরও শরীর খারাপ হবেই।

পরিমল থেকে যেতে রাজি হলে আরও এ জন্য যে হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, বিকেলের দিকে অরুণাংশু আসতে পারে। তার অনুপস্থিতিতে অরুণাংশু এখানে এসে যদি কোনও গণ্ডগোল বাধায়? এই সব দিনে এই গ্রামের মধ্যে শহরের উপস্থিতি একেবারেই মানায় না।

সুলেখা ইলাকে বলল, আলু সেদ্ধ দিয়ে ফেনা-ভাত চাপিয়ে দিত নিজে বাড়ির অন্যান্য কাজ গুছিয়ে ফেলতে লাগল দ্রুত। এক ফাঁকে মহিলা সমিতি থেকেও ঘুরে এল। পাঁচটি মেয়ে সেখানে সেলাই কলে বসে লুঙ্গি বানাচ্ছে।

খানিকটা আপত্তি জানিয়ে তারপর সেই লোক দুটিও ফেনা-ভাত আলুসেদ্ধ খেয়ে নিল সুলেখার সঙ্গে। ওরা বেরুবার সময় পরিমল মাস্টার এক জনকে বলল, সাধুচরণকে পরে আনিস আমার কাছে। ওর সঙ্গে আমার দরকার আছে।

ওরা চলে যাবার অন্তত আধ ঘণ্টা পরে একটা বই পড়তে পড়তে হঠাৎ মুখ তুলে পরিমল মাস্টার ভাবল, ইস, একটা খুব জরুরি কথা তো ওদের বলে দেওয়া হয়নি। আচ্ছা, থাক, এখন আর অন্য লোক পাঠাবার দরকার নেই, দু-এক দিন পর নিজে গিয়েই বলবে।

এক ঘণ্টা হেঁটে সুলেখা পৌঁছল কালী নদীর খেয়াঘাটে। সেখানে একেবারে ভিড়ে ছয়লাপ। খেয়ায় পারানি মাত্র পাঁচ পয়সা, তা-ও ধার রাখা যায়। নিয়মিত খেয়ার নৌকোটি ছাড়া একটি স্পেশ্যালও চালু হয়েছে। কারুর তো কোনও কাজ নেই, তাই এ-দিকের গ্রাম উজাড় করে সবাই চলেছে নাজনেখালিতে। সেখানে বাঘ নেই। সেখানে বাঘে-ধরা মানুষটার লাশও নেই, তবু তো বাতাসে ভাসছে রোমাঞ্চকর গল্পটি।

ছেলে-ছোকরারা হুড়োহুড়ি লাগিয়েছে আগে খেয়া পার হবার জন্য। সুলেখা ভিড় ঠেলে একেবারে সামনে চলে এল। তাঁকে সবাই চেনে, সবাই একটু ভয়-ভয় করে। বুড়ো মাঝির বদলে তার দুই ছেলে, এক জনের বয়েস তেরো-চোদ্দ, অন্য জনের বয়েস দশের বেশি না। এরা চালাচ্ছে নৌকো। বড় ছেলেটির দিকে চেয়ে সুলেখা বলল, এই, তোর-খেয়ায় কজন লোক যাওয়ার নিয়ম রে?

সে-রকম ধরাবাঁধা নিয়ম কিছু নেই। বারো-চোদ্দো জন লোক উঠলেই নৌকো মোটামুটি ভর্তি হয়ে যায়। সেটা জেনে নিয়ে সুলেখা বলল, খবরদার, বারো জনের বেশি লোক একবারে নিবি না। এই করেই নৌকো ডোবে।

ভিড়ের মধ্যে কয়েকটি যুবকের দিকে তাকিয়ে সে বলল, তোমরা ভাই একটা কাজ করো না। তোমরা দাঁড়িয়ে থেকে একটা বন্দোবস্ত করো, যাতে এক নৌকোয় বারো জনের বেশি না ওঠে। গত মাসেই একবার খেয়ার নৌকো ডুবেছিল ।

সঙ্গের এক জন লোকের কাঁধে হাত দিয়ে, শাড়ি উঁচু করে, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত থকথকে কাদার মধ্য দিয়ে গিয়ে সুলেখা নৌকোয় উঠল। পা ধুল না। ও-পারে গিয়ে তো আবার কাদায় নামতেই হবে।

মাথার কয়েকটা সাদা চুল ঝিলিক মারতে শুরু করলেও সুলেখার বয়েস যে ছেচল্লিশ হয়ে গেছে, তা বোঝা যায় না। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। পরনে হলুদ-কালো মেলানো তাঁতের শাড়ি। কারুকে বকুনি দেবার সময়েও সুলেখার মুখখানি হাসি হাসি করে রাখে।

একটা লঞ্চ যাচ্ছে, বড় বড় ঢেউয়ে দুলে উঠছে খেয়ার নৌকো। লঞ্চটার নাম পড়ে সুলেখা জিজ্ঞেস করল, মহারানি এ-দিক দিয়ে যাচ্ছে কেন?

যাত্রীদেরই এক জন উত্তর দিল, মহারানি তো এক মাস ধরে ভাড়া খাটছে টুরিস্ট ডিপার্টে।

কোনও কোনও রুটের সার্ভিস লঞ্চ মাঝে মাঝে সরকারের হয়ে মাসিক ভাড়া খাটে। আশ্চর্য কিছু নয়। সাধারণ যাত্রী কমে গেলে বাঁধা নির্দিষ্ট আয়ের গ্যারান্টি পাওয়া যায়।

ছুটির দিন, একদল শহরের ভ্রমণকারী লঞ্চে চেপে এসেছে সুন্দরবন দেখতে। এই দিকে কিছু দূর গেলেই সজনেখালি পাখিরালায়। যদিও মানসের হাঁসেরা শীতের শেষে অধিকাংশই উড়ে চলে গেছে। সজনেখালির টাওয়ারের ওপর উঠে এই সব নারী-পুরুষ উৎসুক ভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকবে যদি বনের বাঘকে এক পলক দেখা যায়। দেখতে পেলে কত আনন্দ, কত বড় অভিজ্ঞতা। সুলেখা এ-কথা না ভেবে পারল না যে, ঠিক এই সময়ই সে চলেছে একটি বাঘে-খাওয়া মানুষের বাড়িতে। সে এর মধ্যেই শুনে নিয়েছে যে, সেই ছেলেটি মাত্র কিছুদিন আগেই একটি কচি মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে। বাদা অঞ্চলে বিধবা হওয়া যে কী ব্যাপার, তা সুলেখা এর মধ্যে অনেক দেখেছে।

যদি বছর খানেকের মধ্যেই শোনা না যায় যে, ওই বাসনা নামের বিধবা মেয়েটি গর্ভবতী হয়েছে, তাহলে সেটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার হবে। অবশ্য মেয়েটি যদি বাঁজা না হয়।

সুলেখা দেখতে এল শোকের বাড়ি, এসে দেখল সেখানে বিপুল ঝগড়া চলছে।

ডলির একেবারেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে মনে হয়। পুত্র-শোক এখন দু’টুকরো হয়ে রূপ নিয়েছে হিংসে আর রাগের। বাসনাকে আর সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। তাকেই এই সর্বনাশের মূল মনে করে সে বাসনাকে এই দণ্ডেই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। বার বার সে বাসনাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বাড়ির বার করে দিচ্ছে, আবার অন্যরা ফিরিয়ে আনছে তাকে। কুৎসিত গালাগালির ঝড় বইয়ে দিচ্ছে ডলি। বাসনার শ্বশুর থাকতে না পেরে পুত্রবধুর পক্ষ নিয়ে দু’একটা কথা বলতে গিয়েছিল ডলিকে। আর যায় কোথায়, আগুনে যেন ঘৃতাহুতি পড়ল। স্বামীকেও যা নয় গালাগালি শুরু করে দিল, এমনকী ডলি এমন ইঙ্গিতও করল যে, ছেলে মারা যাওয়ায় বাপ খুশি হয়েছে, তা তো খুশি হবেই, এমন ঢলানি বেওয়া মাগির জন্য…।

বাড়ির চারপাশে গিসগিস করছে ভিড়, অনেকে গাছে উঠে দেখছে। বাঘের গল্প এখন দূরে থাক, দুই স্ত্রীলোকের মারামারির মতো এমন মনোহরণ দৃশ্য আর হয় নাকি? টানাটানির সময় ওদের কাপড়চোপড় তো বেসামাল হচ্ছেই, তাছাড়া স্ত্রীলোকের মুখে যৌন-কথা পুরুষেরা বেশি উপভোগ করে।

বাসনাও একেবারে চুপটি করে নেই। কাল শেষরাত থেকে বেশ কয়েকবার মারধোর খাবার পর সে-ও মুখ খুলেছে। কবিতা বেচারি মা ও বউদির মধ্যে পড়ে থামাবার চেষ্টা করছে প্রাণপণে, কিন্তু কে শোনে কার কথা। অন্য প্রতিবেশিনীরাও একেবারে হয়রান হয়ে গেছে। কর্তাব্যক্তিরা সব চুপ। মেয়েদের ঝগড়া তারা কী করে থামাবে?

 এর মধ্যে এসে দাঁড়াল সুলেখা।

যে-সব গালিগালাজ বার্ষিত হচ্ছে, তা শুনলে সুলেখার মতো অন্য যে-কোনও ইউনিভার্সিটিতে পড়া নারীর কান লাল তো হবেই, সঙ্গে সঙ্গে কানে হাত চাপা দিয়ে দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে হবে। সুলেখা কিন্তু একটুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝে নিল। খুব যে আশ্চর্য হয়েছে, তা-ও নয়।

বিষ্টুপদ যেন খুব ভরসা পেল সুলেখাকে দেখে। কাছে এসে সারা শরীর মুচড়ে বলল, দ্যাখেন তো দিদিমণি, কী পেড়ার! মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গিয়েছে। যত বলি, অন্তত শ্রাদ্ধ-শান্তিটা চুকুক, তারপর না হয় বউকে বাপের বাড়ি… কিছুই শোনে না। আপনি একটু বুঝ দিয়ে বলেন।

সুলেখা কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ডলি তাকেও একটা জঘন্য গালাগালি দিয়ে বসল।

তিন-চার জন স্ত্রীলোক জোর করে জাপটে ধরে আছে ডলিকে। সুলেখা তীব্র দৃষ্টিতে ডলির দিকে তাকিয়ে থেকে তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে ওকে বশ করার চেষ্টা করল। কিন্তু তাতে কোনও ফল হল না, গালাগালির স্রোত চলতেই লাগল। ডলি সত্যিই যেন খ্যাপা হয়ে গেছে।

এবার সুলেখা বিষ্টুপদর দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, হাঁ করে দেখছেন কী? দরকার হলে ওকে বেঁধে রাখতে হবে, এই কি পাগলামী করবার সময়? এখন অনেক কাজ আছে না?

দিদিমণির কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে বিষ্টুপদ এবার চেপে ধরল তার বউয়ের চুলের মুঠি, তারপর মনের সাধ মিটিয়ে দু’খানা বিরাট চড় কষাল। তারপর সকলে মিলে ডলিকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের মধ্যে। বাইরে থেকে দরজায় শিকল তুলে দিল বিষ্টুপদ। এখন ও চেঁচাক যত খুশি।

দক্ষ সেনাপতির মতো সুলেখা এবার ভার নিল সব কিছুর। সাধুচরণকে পাওয়া না গেলেও মাধব, সুভাষ, বিদ্যুৎ আর নিরাপদকে খবর পাঠিয়ে ডেকে আনা গেল। এ বাড়িতে এত ভিড়ের মধ্যে কোনও কাজ হবে না, তাই মহাদেব মিস্তিরির পুকুরের বাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসল সুলেখা। মাধবের মুখ থেকে সমস্ত বিবরণটা আবার শুনে যাচাই করে নিল, কতটা সত্যি, কতটা অতিরঞ্জিত। মাধব যেখানে দ্বিধা করছিল, সেখানে খেই ধরছিল নিরাপদ।

সব শোনার পর সুলেখা অত্যন্ত পরিষ্কার উচ্চারণে বলল, বেশ, এবার আমি আপনাদের বলছি যে, আপনারা চক্রান্ত করে মনোরঞ্জনকে খুন করে তার লাশনদীতে ভাসিয়ে দিয়ে এখানে এসে রটিয়ে দিয়েছেন যে তাকে বাঘে নিয়ে গেছে।

ওরা চারজন স্তম্ভিতের মতন চেয়ে রইল সুলেখার দিকে। এই লেখাপড়া জানা, চশমা-পরা মেয়েছেলেটি এ কী সর্বনাশের কথা বলে?

নিরাপদ প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমরা ..আমরা মনোরঞ্জনকে খু..খুন করিছি? কেন?

সে আপনারাই ভাল জানেন!

আপনি এ কী বলছেন দিদিমণি। মনোরঞ্জন আমাদের বন্ধু, তাকে হঠাৎ কেন খুন করতে যাব?

বন্ধু বুঝি কখনও বন্ধুকে খুন করেনা? শেফালির সঙ্গে বিয়ে হবার আগে সুরেন্দ্রর সঙ্গে নিরাপদর গলায় গলায় বন্ধুত্ব ছিল না?

সে-নিরাপদ অন্য নিরাপদ, অন্য গ্রামের! সুরেন্দ্রকে খুন করে চালান হয়ে গেছে। তবু দিদিমণির মুখে খুনি নিরাপদর নাম শুনে এই নিরাপদর বুক কেঁপে ওঠে। তার ইচ্ছে করে দিদিমণির পা দুটি চেপে ধরতে।

নিজের স্বভাব অনুযায়ী মাধব তীব্র চোখে চেয়ে আছে সুলেখার দিকে। সে ধরেই রেখেছিল, মাস্টারমশাইয়ের বউ কো-অপের ধারের প্রসঙ্গ তুলবেন। কিন্তু এ আবার কোন নতুন ঝামেলা? তবু তার অভিজ্ঞ কানে যেন মনে হয়, দিদিমণি মুখে যা বলছেন, আসলে তা বলতে চাইছেন না।

আপনি কী কইতাছেন খুইল্যা কন তো! একই গেরামের এক চাষিরে শুধাশুধি খুন করব, আমাগো কি মাথা খারাপ হইছে?

বিদ্যুৎ বলল, মনোরঞ্জনকে বাঘে নিয়ে গেল, আমরা চোখের সামনে দেখিছি। টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করতে পাইরল না ।

সুলেখা বলল, যে-বনে বাঘ নেই, সেবন থেকে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে বাঘে ধরে নিয়ে গেল? একথা কেউ বিশ্বাস করবে? তোমরা এই ক’জন ছাড়া আর কেউ সাক্ষী আছে?

এবার দু-তিন জন এক সঙ্গে বলে উঠল, আছে, আছে। দাউদ শেখ আর তার দলের লোকজন ছিল —

সুলেখা বলল, তাই যদি সত্যি হয়, তোমরা সেকথা ফরেস্ট অফিসে জানিয়েছ? থানায় খবর দিয়েছ?

সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। বাদা অঞ্চলে বাঘে মানুষ ধরার সংবাদ হাওয়ার আগে রটে যায়। ফেরার পথে যতগুলো নৌকোর সঙ্গে দেখা হয়েছে সবাই শুনেছে। তারাই তো বার্তাবাহক। এ ছাড়া দত্তফরেস্ট অফিসে আসবার পথে ওরা থেমে এসেছে। সেখানকার বাবুরা জানেন।

কিন্তু কানে শোনা খবর দিয়ে কোনও সরকারি অফিসের কাজ চলে না। সেজন্য সুলেখা তৈরি হয়েই এসেছে। কাঁধের ঝোলানো ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বার করে সে বললে, থানায় আর ফরেস্ট অফিসে তোমাদের সকলের সই করা লিখিত দরখাস্ত দিতে হবে। তারপর সেই দরখাস্তের কপি পাঠাতে হবে রাইটার্স বিল্ডিংস-এ। সরকার বাঘ পোষার জন্য অনেক টাকা খরচ করছেন, সেই আদূরে বাঘ যদি কোনও মানুষ মারে, তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারকে। তা ছাড়া, যে-জঙ্গলে কাঠ কাটার জন্য সরকার পারমিট দিয়েছেন, সেখানেও যদি বাঘ চলে আসে, তাহলে সেই দায়িত্ব সরকারের কাঁধেই বর্তায়।

বাংলায় দরখাস্তের বয়ান লিখে ওদের পড়ে শোনাল সুলেখা।

অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেও মাধব জিজ্ঞেস করল, ক্ষতিপূরণ কে পাবে? আমরা কিছু পামু? আমাগো কি ক্ষতি কম হইছে।

সুলেখা বলল, আপনাদের কি নিজেদের কারুর নামে পারমিট আছে? নেই? আপনারা ভাড়া খাটা লোক, আপনাদের কিছু দেবেনা। মনোরঞ্জনের জন্যই কতটা কী পাওয়া যাবে, কে জানে। তবু চেষ্টা তো করতে হবে।

মাধব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, সবদিক থেকেই হেরে যাওয়ার ব্যাপার। কেন যে ছেলে-ছোকরাদের কথায় সে নেচে উঠেছিল! সই দিয়েই মাধব উঠে পড়ল। তার তো বসে থাকলে চলবে না, তাকে দিনের খোরাকি জোগাড় করতে হবে।

সাধুচরণের সই না পেলে চলবে না। সে কোথায় লুকিয়ে আছে, বিদ্যুৎ জানে। সে গিয়ে ডাকতেই সুড় সুড় করে চলে এল সাধুচরণ।

সে এসেই টিপ করে প্রণাম করল সুলেখার পায়ে। সুলেখা একটুক্ষণ বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে রইল সাধুচরণের মুখের দিকে। সে জানেন, তার স্বামী এই লোকটিকে বিশেষ পছন্দ করে। সাধুচরণকে জমি চাষের জন্য ঋণ দিতে চেয়েছে পরিমল, এমনকী একটা চাকরি পাইয়ে দেবারও আশ্বাস দিয়েছে, তবু এই লোকটি তাদের বাড়িতে যেতে চায় না কেন? দশবার খবর পাঠালে একবার আসে।

সাধুচরণ অনুতপ্তকণ্ঠে বলল, মাস্টারমশাইকে বলবেন, আমি কালই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব।

সুলেখা জিজ্ঞেস করল, মনোরঞ্জনের বাবার নিজস্ব জমি কতখানি?

 তিন বিঘে না চার বিঘে রে নিরাপদ?

 তিন বিঘেটাক হবে।

সুলেখা মনে মনে হিসেব কষে নিল। তিন বিঘে এক-ফসলি জমি চাষ করে চার জনের নারী পুরুষের একটা সংসার সারা বছর চালানো যায় না। মনোরঞ্জন ছিল জোয়ান চেহারারযুবক, সেবছরে কয়েক মাস জন-মজুরি খেটে কিংবা মাঝের সিজনে বাগদা-পোনা ধরে আরও কিছু টাকা রোজগার করত। মনোরঞ্জনের বাবা বিচরণ যথেষ্ট বৃদ্ধ, তার পক্ষে একা নিজের জমি চষে ওঠাই শক্ত। পরিবারের আর তিন জনই স্ত্রীলোক। এ ছাড়া বিচরণকে শিগগিরই মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। জমি বিক্রি না হলে মেয়ের বিয়ে হয় না।

সুলেখার বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। জ্বর বাড়লে এ-রকম হয়। অনেকখানি পথ হেঁটে ফিরতে হবে।

মনোরঞ্জনের বাড়িতে আবার তাঁকে যেতে হল একবার। আলাদা একটি দরখাস্তে বাসনার সই লাগবে। বাঘের মুখে নিহত ব্যক্তির পত্নী হিসেবে সে সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন করছে।

কাজ সেরে উঠে দাঁড়িয়ে সে বাসনার দিকে চেয়ে নরম কণ্ঠে বলল, তুমি আমার সঙ্গে যাবে, না এখানেই থাকতে পারবে?

এই একটি মাত্র সহানুভূতির কথায় বাসনার শোকসাগর আবার উত্তাল হয়ে উঠল। সে সুলেখাকে জড়িয়ে ধরে আকুল ভাবে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ও দিদিমণি, আমাকে এ যমপুরীতে ফেলে যাবেন না। ও দিদিমণি!

তাহলে তুমি চলো আমার সঙ্গে।

কিন্তু মনোরঞ্জনের শ্রাদ্ধ-শান্তি হবার আগেই তার বিধবা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, তা-ও কি হয়? সবই হয়, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

ডলি যখন বাসনাকে সহ্য করতে পারছেই না, তখন কয়েকটা দিন অন্তত দু’জনের দূরে দূরে থাকাই ভাল। বিষ্টুচরণ ও প্রতিবেশী স্ত্রীলোককে এই কথা বোঝাল সুলেখা। সে জয়মণিপুরের মহিলা সমিতিতে দু-এক দিন থাকুক, দরকার হয় সেখান থেকে তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। শ্রাদ্ধের দিন না হয় এখানে আসবে আবার!

দুখানা করে শাড়ি-ব্লাউজ-শায়া পুঁটলিতে বেঁধে নিযে বাসনা চলল সুলেখার সঙ্গে। এক দল লোক অকারণেই আবার আসতে লাগল পিছুপিছু। এত হই-হল্লায় বিরক্ত বোধ করছে সুলেখা, কিন্তু সে জানে, কিছু বলে লাভ হবে না। হাতে কারুর কোনও কাজ নেই বলেই এ-রকম একটা উত্তেজক ঘটনা ওরা তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে দিতে চায় না। মাথার ওপর গন গন করছে রোদ। যদি দু-এক দিন আগে বৃষ্টি নামত, তাহলে আর এত লোক হত না, অনেকেই ব্যস্ত হয়ে উঠত মাঠের কাজে।

ঠিক সময়ে বৃষ্টি নামলে মনোরঞ্জন আর তার বন্ধুরা হতো যেতই না জঙ্গলে। অকালে-বেঘোরে প্রাণটা দিতে হত না তাকে। প্রকৃতির সামান্য অন্য মনস্কতার ওপরেও অনেকখানি নির্ভর করে মানুষের নিয়তি।

খেয়াঘাটেও এত ভিড় জমল যে নৌকোয় ওঠাই মুশকিল। সবাই বাসনাকে দেখতে চায়। যে-মানুষটাকে কয়েক দিন আগে বাঘে খেয়েছে, তার যুবতী বিধবা স্ত্রীও তো কম দর্শনীয় নয়!

ছায়া ঢলে-পড়া শেষ বেলায় বাড়ি ফিরে সুলেখা দেখল, জ্বরের ঘোরে পরিমল অজ্ঞান হয়ে আছে। তাঁর কপালে জলপট্টি লাগিয়ে পাশে বসে হাওয়া করছে ইলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *