৫. সাধারণ মেয়ে

৫. সাধারণ মেয়ে

ইয়াকুব স্যার বইটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন, “চীন পূর্ব- এশিয়ার একটি দেশ। অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ- এর রাষ্ট্রীয় নাম গণপ্রজাতন্ত্রী চীন অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ…

যদি ক্লাসে এসে বইটা হাতে নিয়ে স্যার রিডিং পড়েই শোনাবেন তাহলে স্যারের ক্লাসে আসার দরকার কী? দপ্তরিকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিলেই হয়, সবাই এত পৃষ্ঠা থেকে এত পৃষ্ঠা রিডিং পড়ে নাও। তাহলে সবাই নিজেরা নিজেরা রিডিং পড়ে নেবে। স্যার অবশ্যি রিডিং পড়ানোর সময় মাঝে মাঝে অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ শব্দ করেন, সেই শব্দগুলো বইয়ে নাই। স্যার শুধু সেইটা বইয়ের বাইরে থেকে করেন। মনে হয় সেই জন্যেই স্যারের ক্লাসে আসতে হয়–ঠিক কোথায় কোথায় অ্যাঁ অ্যা করতে হবে সেইটা আগে থেকে কেউ জানে না। টুনি স্যারের রিডিং শুনতে শুনতে অনুমান করার চেষ্টা করে ঠিক কোন কোন জায়গায় ইয়াকুব স্যার অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ করবেন–বেশিরভাগ সময়ে টুনির অনুমান মিলে না। মাঝে মাঝে যখন মিলে যায় তখন তার ইচ্ছা করে আনন্দে একটা চিৎকার দিতে–কিন্তু সত্যি সত্যি তো আর সেটা করা সম্ভব না তাই টুনি বসে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ইয়াকুব স্যারের ক্লাস থেকে বিরক্তিকর কোনো ঘটনা পৃথিবীতে আর কিছু আছে কি না টুনি চিন্তা করে পায় না। প্রথম পাঁচ মিনিট পরেই তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট এভাবে সময় কাটাতে হবে। কেমন করে সে এই সময়টা কাটাবে?

কাজেই সময় কাটানোর জন্য তাকে একটা খেলা আবিষ্কার করতে হয়। টুনি একেকদিন একেক ধরনের খেলা আবিষ্কার করে। আজকের খেলাটা খুবই সহজ। ক্লাসের একটা ছেলে কিংবা মেয়ের দিকে তাকায়, তারপরে কল্পনা করার চেষ্টা করে সে কী ভাবছে। সে শুরু করল রাজুকে দিয়ে। রাজু তাদের ফার্স্ট বয়। সে কী ভাবছে সেটা কল্পনা করা সহজ। সে নিশ্চয়ই ভাবছে, ক্লাসে চীন দেশ পড়ানোর কী আছে? আমি চীন দেশের সবকিছু জানি। এটা কত বড় দেশ, এই দেশে কতজন মানুষ, তারা কী করে, কী খায়, কেমন করে ঘুমায় সেটাও আমার মুখস্থ। ধুর! স্যার পড়াতে খুবই দেরি করছে। এত দেরিতে আমার পোষাবে না–তার চাইতে আমি নিজে অনেক ফাস্ট পুরা চ্যাপ্টার শেষ করে ফেলি। মুখস্থ করে ফেলি। কণ্ঠস্থ করে ফেলি। ঠোঁটস্থ করে ফেলি। তারপর রাজু নিশ্চয়ই ঝড়ের বেগে পুরো বই শেষ করে ফেলেছে। রাজুর অসাধ্য কিছু নাই!

রাজুকে শেষ করে টুনি মৌটুসির দিকে তাকাল। মৌটুসি কী ভাবছে সেটা কল্পনা করা ইন্টারেস্টিং হবে। সে দেখতে সুন্দরী, পড়ালেখায় ভালো। শুধু পড়ালেখায় ভালো তা নয়। সে গান গাইতে পারে, আবৃত্তি করতে পারে, নাচতেও পারে। সমস্যা একটাই–সে অহঙ্কারী। কাজেই সে নিশ্চয়ই ভাবছে, ইশ! আজকে আমাকে দেখতে নিশ্চয়ই কত্তো সুন্দর লাগছে! একেবারে ফুলপরির মতো! স্যার কেন ভ্যাদর ভ্যাদর করছে? ভ্যাদর ভ্যাদর না করে চুপ করে থাকলেই তো আমি মিষ্টি গলায় একটা গান গাইতে পারতাম আর ক্লাসের সবার বুক হিংসায় ফেটে যেত! ইশ! আমার মতো সুন্দর কেউ নাই। লেখাপড়াতেও আমার থেকে ভালো কেউ নাই। আমি সবার সেরা। সবার সেরা সুন্দরী-মৌটুসী সুন্দরী! ইশ যদি আমার আয়নাটা বের করতে পারতাম তাহলে এক ঝলক নিজেকে দেখে নিতাম। আর বলতাম– আহা কী সুন্দর কী সুন্দর!

মৌটুসীকে শেষ করে টুনি সবুজের দিকে তাকাল। সবুজ হচ্ছে তাদের ক্লাসের মাস্তান। এক সময় দুষ্টু ছিল। এখন দুষ্টু থেকে প্রমোশন হয়ে পাজি হয়েছে! সে কী ভাবছে করছে সেটাও মনে হয় কল্পনা করা যাবে। সে ভাবছে, ইশ! আমি কখন আরেকটু বড় হব? গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর নাকের নিচে মোচ কখন উঠবে? হাতে-পায়ে গুটি গুটি মাসল হবে আর আমি যখন খুশি যাকে ইচ্ছা তার নাকে গদাম করে ঘুষি মেরে দিতে পারব! স্যার কথা বলে বলে মেজাজটা গরম করে দিচ্ছে! যখন আমি শীর্ষ সন্ত্রাসী হব তখন কেউ কথা বলে বলে আমার মেজাজ গরম করে দিতে পারবে না। দিলেই আমি ধমক দিয়ে বলব, চোপ! সাথে সাথে সে চুপ করে যাবে। বড় হয়ে প্রথমেই আমি একটা পিস্তল কিনব। তারপর সেই পিস্তল দিয়ে ছিনতাই করব। কী মজাটাই না হবে! ছিনতাই করে যে টাকা হবে সেটা দিয়ে একটা দামি স্মার্ট ফোন কিনব। তারপর সেই স্মার্ট ফোন দিয়ে সেলফির পর সেলফি তুলব। কটাস কটাস কটাস…।

সবুজকে শেষ করে কাকে নিয়ে কল্পনা করার যখন চিন্তা করছে তখন সালমাকে চোখে পড়ল। সব ক্লাসেই সালমার মতো এক- দুইজন ছেলে কিংবা মেয়ে থাকে যারা কোনো কিছুতেই ভালো না। লেখাপড়াতে ভালো না, খেলাধুলাতে ভালো না। নাচ, গান, আবৃত্তিও করতে পারে না। ভালো করে কথাও বলতে পারে না। ক্লাসে যখন স্যার কিংবা ম্যাডাম কিছু জিজ্ঞেস করেন তখন তারা সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। এমনভাবে স্যার কিংবা ম্যাডামের দিকে তাকায় যে দেখে মনে হয় বুঝি প্রশ্নটা বুঝতেই পারে নাই। স্যার কিংবা ম্যাডাম যখন বকা দিতে শুরু করে তখন তারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্লাসে তাদের কোনো বন্ধু থাকে না। একা একা ক্লাসের পিছনে বসে থাকে। তাদের চেহারা হয় সাধারণ, জামা-কাপড় হয় সাধারণ, কাজকর্মও হয় সাধারণ। কখনোই কেউ তাদের আলাদা করে দেখে না। টুনি যখন সালমার দিকে তাকাল তখন তার মনে হলো আজকে প্রথম কেউ আলাদা করে তার দিকে তাকিয়েছে। রোল কল করার সময় প্রত্যেক দিন তার নামটা ডাকা হয় বলে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তার নাম জানে। এছাড়া কেউ কোনোদিন তার নামও জানতে পারত না ৷

টুনি কি কল্পনা করার চেষ্টা করবে সালমা কী ভাবছে? টুনি কয়েক সেকেন্ড সালমার দিকে তাকিয়ে রইল তখন হঠাৎ করে দেখল সালমার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর সে প্রাণপণে সেগুলো খোলা রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ৷ মানুষ যখন বসে থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়ে তখন তাকে কী হাস্যকর দেখায়! টুনি সালমার দিকে তাকিয়ে রইল। সালমার চোখ বন্ধ হয়ে মাথাটা নিচু হয়ে আসছে। সত্যি সত্যি যদি ঘুমিয়ে যায় তাহলে একটা মজা হবে। সালমা হঠাৎ ধড়মড় করে জেগে উঠল। তাকে কেউ দেখে ফেলেছে কি না সেটা বোঝার জন্য এদিক-সেদিক তাকাল। তারপর নড়েচড়ে বসে ইয়াকুব স্যারের অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ শোনার চেষ্টা করতে লাগল। টুনি দেখল আবার সালমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে! কী হাস্যকর একটি দৃশ্য! টুনি চোখ বড় বড় করে দেখতে লাগল, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়।

কী কপাল, হঠাৎ করে ইয়াকুব স্যার মুখ তুলে তাকালেন আর সালমাকে দেখে ফেললেন। স্যার তখন ধমক দিয়ে উঠলেন, “এই মেয়ে! এই মেয়ে!”

সালমা একেবারে ধড়মড় করে জেগে উঠল, বিড়বিড় করে বলল, “জি স্যার। জি স্যার।”

“তুমি ক্লাসে বসে ঘুমাচ্ছ কেন?”

সালমা মাথা নেড়ে বলল, “না স্যার, না স্যার– মানে স্যার –“না মানে কী? সারা রাত কী করো? জেগে জেগে বাড়ি বাড়ি চুরি করতে যাও?”

“না স্যার। না স্যার” বলে মেয়েটা বোকার মতো মাথা নাড়তে থাকে।

“খবরদার ক্লাসে বসে ঘুমাবে না। বেয়াদব মেয়ে–” বলে ইয়াকুব স্যার আবার অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ করে রিডিং পড়তে লাগলেন। ধমক খেয়ে সালমার ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙে গেছে। এবার সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। কী ভাবছে এই মেয়েটা? পুরো ক্লাসের সামনে যখন কাউকে লজ্জা দেওয়া হয় তখন তার কেমন লাগে?

টুনি চিন্তা করে সেটা বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু হঠাৎ করে তার আর এই খেলাটা খেলার ইচ্ছা করল না। সময় কাটানোর জন্য এখন অন্য একটা খেলা আবিষ্কার করতে হবে। কী খেলা আবিষ্কার করা যায় টুনি বসে বসে সেটা ভাবতে থাকে।

শেষ পর্যন্ত ইয়াকুব স্যারের ক্লাস শেষ হলো। তারপর নাসরীন ম্যাডামের ক্লাস, নাসরীন ম্যাডামের পর অঞ্জনা ম্যাডামের ক্লাস। টুনি সবার ক্লাস চলার সময়েই চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল সারাক্ষণই সালমা ঘুমে ঢলে ঢলে পড়ছে। কোনো একটা কারণে মনে হয় এই মেয়েটা বাসায় ঘুমাতে পারেনি।

.

পরের দিন ভোরবেলা এসেমব্লির সময় হেড ম্যাডাম অনেক দিন পর পুরো স্কুলের সামনে একটা বিশাল লেকচার দিলেন। লেকচারের বিষয়বস্তু ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে হাজির না থাকা। ম্যাডাম বললেন, “আমি সেদিন সব ক্লাসের রিপোর্ট নিয়েছি, রিপোর্ট দেখে আমি হরিফাইড। আমি পেটরিফাইড।”

ম্যাডামের প্রিয় শব্দ হচ্ছে পেটরিফাইড। কিছু একটা হলেই এই ম্যাডাম ‘পেটরিফাইড’ হয়ে যান। প্রথম প্রথম ছাত্রছাত্রীরা পেটরিফাইড শব্দের অর্থ জানত না। পরে ডিকশনারি দেখে বের করেছে পেটরিফাইড মানে পাথর হয়ে যাওয়া। কিছু একটা হলেই এই হেড ম্যাডাম জমে পাথর হয়ে যান!

ম্যাডাম বললেন, “আমি দেখলাম ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে না। যদি স্কুলে না আসে তাহলে ছেলেমেয়েরা কোথায় যায়? কী করে? আমি সব ক্লাস টিচারদের বলেছি নিজেদের ক্লাসে ক্লাসে খোঁজ নিতে। কেউ হাজির না থাকলেই বাবা-মাকে ফোন করতে। যদি দেখা যায় বিনা কারণে অনুপস্থিত তার কপালে অনেক দুঃখ আছে আমি এখনই সাবধান করে দিলাম।” বলে হেড ম্যাডাম তার মুখটাকে ভয়ঙ্কর করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হেড ম্যাডাম আসলে খুবই হাসি-খুশি মানুষ, ছেলেমেয়েদের অনেক আদর করেন। তাই মুখটাকে ভয়ঙ্কর করার চেষ্টা করলেও সেটাকেও মোটেই ভয়ঙ্কর দেখাল না। বরং ম্যাডামের মুখ দেখে কে যেন খুকখুক করে হেসে ফেলল।

হেড ম্যাডাম চোখ পাকিয়ে বললেন, “কে হাসে? কে?”

কেউ স্বীকার করল না, শুধু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চশমা পরা ছোট একটা ছেলে রিনরিনে গলার স্বরে জিজ্ঞাস করল “স্কুলে হাজির না থাকলে আপনি কী করবেন ম্যাডাম?”

“সেটা তোমরা সময় হলেই দেখবে। আমি আশা করব সেটা যেন তোমাদের কারো নিজের চোখে দেখতে না হয়।”

চশমা পরা রিনরিনে গলার ছেলেটা এবারে জিজ্ঞেস করল, “আর আমরা যদি সবাই ক্লাসে হাজির থাকি?”

ম্যাডামের মুখটা সাথে সাথে হাসি হাসি হয়ে গেল, ম্যাডাম বললেন, “তাহলে থাকবে তোমাদের জন্য পুরস্কার।”

এবারে অনেকেই জানতে চাইল, “কী পুরস্কার ম্যাডাম? কী পুরস্কার?”

একজন ম্যাডামকে বুদ্ধি দিল, “তাদের পরীক্ষা দিতে হবে না!”

ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “না, এত বড় পুরস্কার দেওয়া ঠিক হবে না! কিন্তু অন্য পুরস্কার দিতে পারি। যেমন মনে করো যদি দেখি কোনো ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে পরপর তিন দিন সবাই হাজির আছে তাহলে তারা এক দিন সবাই মিলে চিড়িয়াখানায় যেতে পারে, কিংবা মিউজিয়ামে যেতে পারে। কিংবা বইমেলায় যেতে পারে কিংবা পিকনিকে যেতে পারে। শুধু তা-ই না, আমাদের যে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হবে সেই অনুষ্ঠানে তাদের ক্লাসকে পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে।

ক্লাসের ছেলেমেয়েরা এবারে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।

.

স্কুলের স্যার-ম্যাডামেরা অনেক কিছু বলেন। বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর সেগুলো তাদের এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। তবে টুনিদের ক্লাসে রাজুর কথা আলাদা, তার কান দিয়ে সবকিছু ঢোকে এবং কোনোটাই অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায় না। সবকিছুই তার ভেতরে জমা হয়ে থাকে। কাজেই সব ছেলেমেয়ের ক্লাসে হাজির থাকার ব্যাপারটা অন্য সবাই ভুলে গেলেও রাজুর মাথার মাঝে বিষয়টা পাকাপাকিভাবে ঢুকে গেল। যখনই ক্লাসের তিন-চারজন ছেলেমেয়ে এক জায়গায় হয়েছে তখনই রাজু বিড়বিড় করে বলেছে, “ব্যাপারটা আমাদের দেখা উচিত!”

অন্যেরা জিজ্ঞেস করেছে, “কী দেখা উচিত?”

“সবাই ক্লাসে হাজির থাকা।”

“ও।” বলে একজন একজন করে সরে পড়েছে। কীভাবে ক্লাসের সব ছেলেকে ক্লাসে হাজির করা যায় সেটা নিয়ে কারো খুব বেশি মাথা ব্যথা নেই ৷

শেষে একদিন রাজু টুনিকে বলল, “টুনি। তোর কি মনে হয় না আমাদের ক্লাসের সবার ক্লাসে হাজির থাকা উচিত?”

টুনি ভদ্রতা করে বলল, “উচিত।”

“আমরা যদি পরপর তিন দিন সবাই হাজির থাকি তাহলে আমরা মিউজিয়াম যেতে পারব।”

ক্লাসে তিন দিন হাজির না থেকেই যে কেউ যখন খুশি মিউজিয়ামে যেতে পারে। কিন্তু টুনি সেটা রাজুকে মনে করিয়ে দিল না।

রাজু বলল, “কিংবা আমরা পুরো ক্লাস মিলে চিড়িয়াখানায় যেতে পারি। একসাথে পুরো ক্লাস যেতে অন্য রকম আনন্দ।“

টুনি মাথা নাড়ল।

“আমাদের ক্লাসকে দেখে তখন অন্য ক্লাসের ছেলেমেয়েরাও পুরো ক্লাস হাজির থাকতে পারে।”

টুনি মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু কাজটা অনেক কঠিন। ক্লাসে এতগুলো ছেলেমেয়ে, কারো না কারো ঝামেলা থাকবেই। কারো নিজের অসুখ, কারো মায়ের অসুখ, কারো ভাইয়ের বিয়ে, কেউ আবার ফাঁকিবাজ–”

রাজু মুখ শক্ত করে বলল, “এইটাই তো চ্যালেঞ্জ। আমরা চাইলেই পারব। পারব না?”

টুনি কী আর বলবে, মাথা নেড়ে বলল, “পারব।“

“তুই থাকবি আমায় সাথে। তুই আর আমি মিলে করে ফেলব।”

টুনি মিনমিন করে বলল, “ঠিক আছে।”

.

সত্যি সত্যি রাজু একদিন ক্লাসের মিটিং ডেকে ফেলল। টুনি ভেবেছিল মিটিংয়ে সে আর রাজু ছাড়া অন্য কেউ থাকবে না। কিন্তু দেখা গেল অনেকেই আছে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার মৌটুসীও আছে। মৌটুসী থাকা মানেই বিপদের লক্ষণ, সে ক্লাসের কোনো কিছুতে থাকে না। নিশ্চয়ই এসেছে একটা ঝামেলা পাকানোর জন্য। কিন্তু একজন হাজির হলে তাকে তো আর বের করে দেওয়া যায় না। তাই তাকেও মিটিংয়ে রাখতে হলো। রাজু খুবই গম্ভীর হয়ে শুরু করল, “আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। আমরা সবাই সেদিন হেড ম্যাডামের কাছে শুনেছি–”

সবুজ রাজুকে থামিয়ে বলল, “মিটিংয়ে চা-নাস্তা দিবি না?”

রাজু থতমত খেয়ে বলল, “চা-নাস্তা?”

“হ্যাঁ। মিটিংয়ে সবসময় চা-নাস্তা দিতে হয়।”

রাজু এদিক-সেদিক তাকাল, টুনি বলল, “সবুজ তোর চা-নাস্তা খাওয়ার ইচ্ছা করলে ক্যান্টিনে গিয়ে খেয়ে আয়।”

সবুজ গজগজ করতে লাগল, “এইটা কী রকম মিটিং যে কোনো রকম চা-নাস্তা নাই। চা-নাস্তা ছাড়া আবার মিটিং হয় নাকি?”

সবুজের কথাকে কেউ বেশি পাত্তা দেয় না, তাই এখানেও কেউ পাত্তা দিল না। আবার মিটিং শুরু হয়ে গেল।

রাজু সবার আগে হেড ম্যাডামের কথা দিয়ে শুরু করল। এসেমব্লিতে সবার হাজির থাকার যে কথাটা হেড ম্যাডাম বলেছিলেন সেইটা যে কত জরুরি কথা সেইটা নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলল।

সবুজ কথার মাঝখানে হাই তুলে বলল, “এই ভ্যাদর ভ্যাদর বাদ দিয়ে কী করতে চাস সেটা বলে ফ্যাল। চা-নাস্তা ছাড়া মিটিং লম্বা করে লাভ নাই।“

রাজু তখন ক্লাসের ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা রিপোর্ট দিল। কারা ক্লাসে নিয়মিত হাজির থাকে কারা থাকে না তাদের নাম বলল। সবুজ সবচেয়ে কম হাজির থাকে শুনে গরম হয়ে বলল, “মিথ্যা কথা। আমি সব ক্লাসে হাজির থাকি। খোদার কসম। যদি হাজির না থাকি তাহলে বুঝতে হবে আমার চিকুনগুনিয়া না হলে ডেঙ্গু কিংবা টাইফয়েড হয়েছিল।” সবুজের কথা কেউ পাত্তা দেয় না। এবারেও দিল না।

রাজু তখন বলল যারা ক্লাসে কম হাজির থাকে তাদের সবাইকে খুব ভালো করে বোঝাতে হবে যেন তারা ক্লাসে আসে। তাহলেই সবাইকে নিয়ে আসা যাবে। রাজুর কথা শেষ হওয়ার পর অন্য সবাই কথা বলতে থাকে। সবাইকে কীভাবে ক্লাসে আনা যায় সেটা নিয়ে সবারই নিজের মতো একটা আইডিয়া আছে। সবচেয়ে আজব আইডিয়াটা ছিল সবুজের। সে বলল, সবাই যদি রাজি থাকে তাহলে যারা ক্লাসে আসতে চায় না সে তাদের বাসায় গিয়ে গিয়ে হুমকি দিতে পারে। যে ক্লাসে না এলে সে তাদের ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে। তবে এর জন্য একটু খরচাপাতি করতে হবে। যেহেতু সবুজের কথাকে কেউ পাত্তা দেয় না তাই তার এই কথাটাকেও কেউ পাত্তা দিল না।

তবে সবচেয়ে ভালো আইডিয়াটা বের হলো মাধুরীর মাথা থেকে। সে ক্লাসের সবচেয়ে শান্তশিষ্ট মেয়ে। সবকিছু ঠান্ডাভাবে চিন্তা করতে পারে। মাধুরী বলল, ক্লাসে এতগুলো ছেলেমেয়ে তাই কখনোই সবাইকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসা যাবে না। কাজেই আগে থেকে একটা দিন টার্গেট করতে হবে। তারপর সবাইকে সেই দিন হাজির করার চেষ্টা করতে হবে। যারা সাধারণত স্কুলে আসে না, আগে থেকে তাদের বাসায় যেতে হবে, একজন একজন করে তাদের সবার কাছ থেকে সেই দিন ক্লাসে হাজির থাকার কথা আদায় করে নিতে হবে। কেউ যদি বলে সে আসতে পারবে না তাহলে নতুন আরেকটা দিন ঠিক করতে হবে।

মাধুরীর আইডিয়াটা সবারই পছন্দ হলো। সবাই মিলে তখন তখনই একটা দিন ঠিক করে ফেলল। ঠিক হলো সেই দিন সবাইকে ক্লাসে হাজির করে নিয়ে আসা হবে। ক্লাসে সবাইকে মনে করিয়ে দিতে হবে যে সেই দিন কেউ অনুপস্থিত থাকতে পারবে না। কেউ যদি ক্লাসে না আসে তার বাসায় গিয়ে বলে আসতে হবে। রাজুর লিস্ট দেখে কে কাকে মনে করিয়ে দেবে সেই দায়িত্বটা ভাগাভাগি করে দেওয়া হলো।

টুনির ভাগে পড়ল সালমা। অনেকেই ভালো করে সালমাকে চিনতে পারল না, টুনির অবশ্য সমস্যা হলো না, ইয়াকুব স্যারের ক্লাসে সেদিন সে সালমাকে আলাদা করে লক্ষ করেছিল। ক্লাসে বসে বসে সে ঘুমিয়ে যাচ্ছিল, হয় তার ঘুম বেশি তা না হলে বাসায় সে ঘুমায় না। তবে কারণ যেটাই হোক সে যে ক্লাসে কম আসে সে ব্যাপারে কারো সন্দেহ নেই।

যাই হোক, মিটিং যখন শেষ হলো তখন সবাই শুনল মোটুসী তার নাক দিয়ে কেমন অদ্ভুত একটা শব্দ করল। শুধু তাই না, মুখটাও কেমন জানি বাঁকা করে সে খুবই খারাপ ধরনের একটা হাসির ভান করল। তখন হঠাৎ করে সবাই বুঝতে পারল এতক্ষণ ধরে যে সবাই নানা রকম কথা বলেছে তার মাঝে মৌটুসী একটা কথাও বলে নাই। মুখ বন্ধ করে বসে ছিল।

মাধুরী জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে মৌটুসী?”

“তোমরা ভাবছো এইভাবে সবাইকে তোমরা ক্লাসে নিয়ে আসতে পারবে?”

ক্লাসের প্রায় সবাই একজন আরেকজনকে তুই করে বলে তবে মৌটুসীর কথা আলাদা। সে বলতে গেলে প্রায় কারো সাথে মিশে না তাই কারো সাথেই তার আন্তরিক সম্পর্ক নেই। কেউ তাকে তুই করে বলে না, সেও কাউকে তুই করে বলে না।

মাধুরী বলল, “সবাইকে আনতে পারব কি না জানি না, কিন্তু চেষ্টা করে দেখি।”

“কোনোদিন পারবে না।” বলে মৌটুসী আবার মুখ বাঁকা করে হাসল।

মাধুরী একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

“সবাই যদি হাজির থাকেও আমি সেদিন ইচ্ছা করে হাজির থাকব না!”

সবাই চমকে উঠে, বলে কী মৌটুসী? রাজু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন? তুমি হাজির থাকবে না কেন?”

“আমি তোমাদের সাথে নাই।”

“কেন? তুমি আমাদের সাথে নাই কেন?”

“তোমরা সবাই সবসময় আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করো, আমাকে হিংসা করো সেই জন্য আমি তোমাদের সাথে নাই। “

সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। টুনি বলল, “কখন আমরা খারাপ ব্যবহার করলাম? হিংসা করলাম?”

মাধুরী বলল, “আমরা সবাই মিলে একটা কাজ করতে চাচ্ছি আর তুমি আমাদের সাথে থাকবে না?”

“না। তোমরা সবাই মিলে কী করছো? সব ভুল।”

মাধুরী অবাক হয়ে বলল, “ভুল?”

“হ্যাঁ, একটা মিটিং করেছো। সেই মিটিংয়ে কোনো সভাপতি পর্যন্ত নাই। কারো সিগনেচার নাও নাই। মিটিং করেছো। তার কোনো প্রমাণ পর্যন্ত নাই। এই মিটিংয়ের কথা মানতে হবে কে বলেছে? আমি মানি না।”

কথা শেষ করে মৌটুসী উঠে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। অন্য সবাই হাঁ করে বসে থাকল! রাজু অনেকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “এইটা কী হলো?”

মাধুরী বলল, “একজনও যদি রাজি না থাকে তাহলে হবে না। আর যদি ইচ্ছা করে কেউ না আসে তাহলে খামোখা সবাইকে হাজির করার চেষ্টা করে লাভ নেই। পুরো প্রজেক্ট ফেইল।”

সবুজ বলল, “বুঝেছি। আমার ঠ্যাঙ ভাঙা হুমকিটাই দিতে হবে। “ সত্যি কথা বলতে কী এই প্রথমবার অনেকের মনে হলো সবুজ হয়তো ঠিকই বলছে।

টুনি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, বলল “তোরা অপেক্ষা কর। আমি একটু চেষ্টা করে দেখি। “

মাধুরী জিজ্ঞেস করল, “কী চেষ্টা করবি?”

“দেখি মৌটুসীকে ফিরিয়ে আনা যায় কি না।”

রাজু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “লাভ নাই ৷’

“দেখি চেষ্টা করে, দরকার হলে বলব সে হচ্ছে সভাপতি!” মাধুরী বলল, “যেটা বলতে হয় সেটা বল। শুধু চেষ্টা করে দ্যাখ তাকে ফিরিয়ে আনতে পারিস কি না।”

টুনি মৌটুসীকে খুঁজতে গেল। ক্লাস রুম থেকে বের হয়েই টুনি মৌটুসীকে দেখতে পেল। সে বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। টুনি এগিয়ে গিয়ে বলল, “এই যে মৌটুসী, তোমার সাথে কথা আছে।”

মৌটুসী মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, টুনিকে দেখেই তার মুখ শক্ত হয়ে গেল। বলল, “কী কথা?”

“তুমি একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি কথা বলেছো।”

মৌটুসী থতমত খেয়ে গেল, চোখ বড় বড় করে বলল, “আ-আমি?”

“হ্যাঁ। তুমি যেটা বলেছো সেটা পুরোপুরি সত্যি। আমাদের মিটিংটার কিছুই হয় নাই। সব ভুলভাল।”

“ভুলভাল?”

“হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলেছো। একজন সভাপতি ছাড়া মিটিং করলে সেই মিটিং হয় না।“

মৌটুসী ভুরু কুঁচকে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, সে টুনির কথা ঠিক বুঝতে পারছে না।

টুনি বলল, “তাই আমরা ঠিক করেছি আমাদের মিটিংটার জন্য একজন সভাপতি ঠিক করে নিব।”

মৌটুসী জিজ্ঞেস করল, “কে হবে সভাপতি?”

“কেন? তুমি।”

মৌটুসী সরু চোখে তাকাল, বলল, “আমি? আমি কেন?”

“আর কে হবে? তুমি ছাড়া আর কেউ তো এগুলো জানে না। তুমিই তো প্রথম আমাদের বলেছ যে মিটিং করলে সভাপতি থাকতে হয়। সবার সিগনেচার নিতে হয়। আমরা তো এগুলো জানতামই না।”

মৌটুসী টুনির কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করল না। সন্দেহের চোখে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।

মৌটুসীকে রাজি করিয়ে নিতে না পারলে তাদের পুরো প্রজেক্ট ভেসে যাবে। তাই টুনি এবারে অন্যভাবে চেষ্টা করল। বলল, “তোমাকে আমাদের সভাপতি করার আরেকটা কারণ আছে।”

“কী কারণ?”

“আমরা যদি পুরো ক্লাস পরপর তিন দিন হাজির থাকি তাহলে বার্ষিক পুরস্কারের দিন আমাদের পুরস্কার দেওয়া হবে। ক্লাসের পক্ষ থেকে সেই পুরস্কারটা কে নেবে?”

“কে নেবে?”

“তুমি। শুনেছি টেলিভিশন চ্যালেন আসবে। এই চ্যানেলের সামনে আমরা কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলব! তুমি যদি থাকো তাহলে ঠিক করে পুরস্কারটা নিয়ে ঠিকভাবে কথাবার্তা বলতে পারবে –“

টেলিভিশন চ্যানেলের কথা শুনে মৌটুসী শেষ পর্যন্ত নরম হলো। টুনি তখন আরও কিছুক্ষণ আগড়ম-বাগড়ম কথা বলে মৌটুসীকে ক্লাস রুমে নিয়ে এল। একটা কাগজ বের করে তখন সেখানে সবাই সাইন করল। নামের শেষে মৌটুসীর নাম লিখে তার পাশে বড় বড় করে লেখা হলো সভাপতি। মৌটুসী তখন খুবই গম্ভীরভাবে সেখানে সাইন করল। যারা উপস্থিত ছিল তারা খুবই সাবধানে বুকের ভেতর থেকে স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলল। যে সভাপতি সে আর যা কিছুই করুক নিশ্চয়ই নিজের ক্লাসের সর্বনাশ করবে না!

.

ক্লাসের সবাইকে হাজির করার জন্য সামনের মঙ্গলবার দিনটা ঠিক করা হয়েছে। প্রথমে রাজুর উৎসাহে শুরু করা হয়েছিল। শুরু করার পর দেখা গেল পুরো ক্লাসেরই ব্যাপারটা নিয়ে উৎসাহ। সবুজ উৎসাহে টগবগ করছে। মৌটুসী পর্যন্ত আগ্রহ নিয়ে সবার সাথে কথাবার্তা বলছে। ক্লাসের প্রায় সবার সাথে কথা বলা হয়েছে। সবাই কথা দিয়েছে সামনের মঙ্গলবার তারা ক্লাসে হাজির থাকবে। শুধু সালমার সাথে এখনও যোগাযোগ করা যায়নি, সে অনেক দিন থেকে ক্লাসে আসছে না। তাই একদিন টুনি স্কুলের অফিস থেকে সালমার বাসার ঠিকানা লিখে নিল, ঠিক করল সে নিজেই সালমার বাসায় চলে যাবে। তাছাড়া মিটিংয়ে তাকেই সালমাকে ক্লাসে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

পরের দিন বিকালবেলা স্কুল ছুটির পর ঠিকানা হাতে নিয়ে সে সত্যি সত্যি সালমার বাসাটা খুঁজে বের করে ফেলল। ঢাকা শহরে এরকম বাসা আছে টুনি জানত না, অনেকগুলো বাসা পাশাপাশি। ইটের বাসা, কিন্তু টিনের ছাদ। বাসাগুলো গায়ে গায়ে লাগানো, তবে সবগুলো বাসার মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে। বাসাগুলো ভেঙে কেন সেখানে বড় বিল্ডিং তুলে এখনও ফ্ল্যাট বানিয়ে ফেলেনি সেটাই আশ্চর্য!

টুনি ঠিকানাটা আরেকবার মিলিয়ে নিয়ে দরজার কড়া নাড়ল। বাসাটা পুরনো আমলের, দরজার সামনে সত্যি সত্যি দুটো গোল গোল কড়া। ভেতরে একটা বাচ্চার কান্না শোনা যাচ্ছিল। কড়া নাড়ানোয় শব্দের সাথে সাথে কান্না থেমে গেল। একটু পরে কেউ একজন ছিটকিনি খুলে দিল। টুনি দেখল তার সামনে সালমা দাঁড়িয়ে আছে, পরনে একটা ঢলঢলে রং-ওঠা টি-শার্ট। চুলগুলো কেমন জানি অদ্ভুতভাবে মাথার উপর চূড়ার মতো বেঁধে রেখেছে। তার কপালে এবং নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম।

সালমা টুনিকে দেখে এত অবাক হলো যে সেটি বলার মতো নয় ৷ মুখ হাঁ করে বলল, “টু-টুনি? তু-তুমি? মানে তু-তু-ই? আমার বাসায়?” টুনি মুখটা হাসি হাসি করে বলল, “হ্যাঁ আমি। তোর বাসায়। সমস্যা আছে?”

“না-না। সমস্যা কেন থাকবে?” সালমা দরজা থেকে সরে একেবারে টুনির হাত ধরে ভিতরে ঢোকাল। বলল, “কী আশ্চর্য!”

“এর মাঝে আশ্চর্যের কী আছে? আমি তোর বাসায় আসতে পারি না?”

তাদের কথা শুনে সাত আট বছরের একটা ছেলে ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছে। ছেলেটার মাথায় এলোমেলো বড় বড় চুল। চোখের পানি এখনও শুকায়নি, মনে হয় তার কান্নার শব্দই টুনি শুনছিল।

সালমা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবু! মনে আছে তোকে বলেছিলাম আমাদের ক্লাসে একটা সত্যিকার ডিটেকটিভ আছে? যার মাথার মাঝে খালি বুদ্ধি আর বুদ্ধি? মনে আছে?”

ছেলেটা অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়ল। সালমা বলল, “সব-সময় তার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়! এই হচ্ছে সেই মেয়ে? এর নাম হচ্ছে টুনি! আমাদের বাসায় এসেছে! চিন্তা করতে পারিস? কী মজা!”

টুনি একটু অবাক হয়ে সালমার দিকে তাকাল। সালমা ক্লাসে কোনোদিন নিজ থেকে মুখ ফুটে একটা শব্দ করে না। দেখে মনে হয় কথা বলতে পারে না, কিন্তু এখন কী সুন্দর করে তেজিভাবে ছোট ভাইটার সাথে কথা বলছে!

সালমা টুনির হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসে। ঘরের মাঝে একটা পুরোনো সোফা, এক পাশে বিছানা। বিছানায় এলোমেলো চাদর- বালিশ, সোফার উপর জামা-কাপড়, বই, ঘরের মেঝেতে একটা ভাঙা খেলনা, চায়ের কাপ, কাগজপত্র। সব মিলিয়ে কেমন জানি হতচ্ছাড়া পরিবেশ।

অন্য যে কেউ হলে এরকম অগোছালো এলোমেলো একটা বাসায় তার ক্লাসের একজন বন্ধু চলে এলে একটুখানি লজ্জা পেত কিন্তু মনে হলো সালমা লজ্জা পেল না, অপ্রস্তুতও হলো না। টুনির দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “বাসার অবস্থাটা দেখেছিস? একেবারে বিকাল হয়ে গেছে, এখনও গোছাতে পারি নাই। তুই দুই মিনিট সময় দে। আমি ঠিক করে ফেলি।”

টুনি বলল, “না, না–আমার জন্য কিছুই ঠিক করতে হবে না। আমাদের বাসা সব সময় এরকম।“

সালমা তার মাঝে ঝটপট কাজ শুরু করে দিয়েছে। চোখের পলকে বিছানাটা ঠিক করে ফেলল। সোফার উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিস সরিয়ে ফেলল। মেঝেতে পড়ে থাকা জিনিস তুলে ফেলল, ভেতর থেকে একটা ঝাড়ু নিয়ে এসে ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে ফেলল, সত্যি সত্যি দুই মিনিটের মাঝে ঘরটা একেবারে ঝকঝক-তকতক করতে লাগল। মনে হয় মেয়েটা ম্যাজিক জানে! যখন সে ঘরটা পরিষ্কার করছিল তখন কিন্তু সে চুপ করে নেই, মুখে কথা বলে যাচ্ছিল, “বুঝলি টুনি, বাসার কিন্তু এরকম অবস্থা থাকে না। আমি পরিষ্কার করে ফেলি। কিন্তু বাবুটার কয়দিন থেকে জ্বর, তার মন- মেজাজ ভালো না, খেতে চায় না, দিন-রাত কাঁদে। তার পিছনেই সময় চলে যাচ্ছে। কী যে বাজে রকমের ভাইরাস বের হয়েছে, একবার ধরলে টানা দশ দিন বিছানায়! হায় হায় আমি তখন থেকে নিজেই বকবক করে যাচ্ছি, তুই কিছু বলছিস না। হঠাৎ করে আমার বাসায় কেন? বাসাটা তুই খুঁজে বের করেছিস কেমন করে? কেউ তো খুঁজে পায় না!’

টুনি বলল, “না, আমার বাসা খুঁজে বের করতে কোনো অসুবিধা হয় না। তুই অনেক দিন স্কুলে যাস না। সেই জন্য খোঁজ নিতে এসেছি।”

সালমা হি হি করে হাসল, বলল, “শুধু এই জন্য আসিসনি–অন্য কোনো কারণ আছে! আমি তো মাঝে মাঝেই স্কুলে যেতে পারি না তখন তো কেউ আমার খোঁজ নেয় না। আজকে নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ আছে!”

টুনি একটু লজ্জা পেল তারপর মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আসলে অন্য আরেকটা কারণও আছে।”

“ঠিক আছে। অন্য কারণটা শুনব তোর কাছে। তার আগে বল তুই কী খাবি। স্কুল থেকে এসেছিস, তোর নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।”

“না, না, আমায় খিদে পায় নাই।’

“মিছে কথা বলবি না, আমি যখন স্কুল থেকে বাসায় আসি তখন রাক্ষসের মতো খিদে পায়।”

টুনি বলল, “তুই এত ব্যস্ত হবি না, আমার খাওয়া নিয়ে তোকে ব্যস্ত হতে হবে কেন?”

সালমা হাসল, বলল, “তাহলে কে ব্যস্ত হবে? তুই? জোহরা এক্ষুনি স্কুল থেকে আসবে, দেখিস এসেই খাই খাই শুরু করবে–”

“জোহরা কে?”

“আমার ছোট বোন, আমরা তিন ভাই-বোন। “

“তোর আম্মু–”

“আমার আম্মু নাই। মরে গেছে। আম্মুটার কোনো আক্কেল নাই, ঠাস করে একদিন মরে গেল, এখন সব ঝামেলা আমার ওপর!”

টুনি একটা ধাক্কা খেল, সে অবাক হয়ে সালমার দিকে তাকিয়ে রইল। একটা বাসার সব ঝামেলা বারো তেরো বছরের একটা মেয়ের ওপর? তার বয়সী একটা মেয়েকে ছোট ভাই-বোনদের দেখে রাখতে হচ্ছে? হঠাৎ করে তার কাছে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। কেন এই মেয়েটা স্কুলে আসে না, কেন ক্লাসের মাঝে ঘুমে ঢলে পড়তে থাকে, কেন চোখের পলকে ঘর পরিষ্কার করে ফেলে, ছোট ভাইটাকে কেমন করে দেখে রাখে কোনো কিছুই বুঝতে বাকি থাকে না।

সালমা উঠে দাঁড়াল, বলল, “তুই আমাকে দুই মিনিট সময় দে। আমি তোর জন্য নুডলস তৈরি করে আনি, আমি খুব ভালো নুডলস তৈরি করতে পারি।*

টুনিও দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “না, না–”

সালমা বলল, “তুই ভদ্রতা করে না না করছিস, জোহরা এসে তো কোনো ভদ্রতা করবে না, একটু দেরি হলেই জানটা খেয়ে ফেলবে। তুই দাঁড়া–”

টুনি বলল, “ঠিক আছে, আয় তাহলে আমি তোকে হেল্প করি–”

“তুই আমাকে হেল্প করবি?” বিষয়টা যেন খুবই মজার এরকম ভান করে সালমা হি হি করে হাসতে শুরু করে।

“কেন? আমি তোকে হেল্প করতে পারব না? দেখতে চাস?”

সালমা কয়েক সেকেন্ড টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তোর কথা অবশ্য আলাদা। ঠিক আছে আয়। রান্নাঘরের অবস্থা কিন্তু খুবই খারাপ, এখন পর্যন্ত বাসন ধোয়ার সময় পাই নাই।”

টুনি বলল, “আমি তোকে বাসন ধুতে হেল্প করব। আয়।”

সালমা টুনিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। ছোট ভাইটার হাতে একটা দুধের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলল, “বাবু, ঝট করে দুধটা খেয়ে নে। তুই কিন্তু আর ছোট বাচ্চা না যে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হবে।”

বাবু বলল, “আমার দুধ ভালো লাগে না।”

“দুধ কারো ভালো লাগে না, কিন্তু তারপরেও খেতে হয়। আম্মু কিন্তু ওপর থেকে দেখছে, দুধ না খেলে অনেক রাগ হবে–”

“আম্মু কখনো রাগ হয় না।”

“ঠিক আছে। অনেক দুঃখ পাবে–”

বাবু মনে হয় এই যুক্তিটা ফেলে দিতে পারল না। সে নাক কুঁচকে দুধের গ্লাসটা মুখের কাছে তুলে নিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।

সালমা নুডলস বানানোর জন্য চুলায় পানি গরম করতে দিয়ে বলল, “বাবু, এখন হাত-মুখ ধুয়ে ঝটপট কাপড় বদলে নে। তোর বুদ্ধির কোনো প্রশ্ন থাকলে রেডি কর। এই টুনি আপুর মাথার মাঝে খালি বুদ্ধি গজগজ করছে, যেটা জিজ্ঞেস করবি সেটাই বলে দেবে। কেমন করে ডাকাতের দল ধরেছে সেইটাও জিজ্ঞেস করতে পারিস-

টুনি ইতস্তত করে বলল, “আমি কখনো ডাকাতের দল ধরি নাই—”

“ঠিক আছে ধরিস নাই তো কী হয়েছে? ধরবি। অন্য কিছু তো ধরেছিস।”

টুনি রান্নাঘরে সালমার পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখে মেয়েটা একেবারে মেশিনের মতো কাজ করে যাচ্ছে, একটা চুলার মাঝে নুডলস দিয়ে একটা সসপ্যানে দুটো ডিম ভেজে ফেলল ৷ কোথা থেকে জানি মটরশুঁটি বের করে নুডলসের মাঝে দিয়ে দেয়। কথা বলতে বলতে কয়েকটা প্লেট ধুয়ে ফেলল। টুনি তখন সালমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে–তবে সে যতক্ষণে ছোট একটা কাজ করে দেয় সালমা তার ভেতর দশটা বড় বড় কাজ করে ফেলে।

নুডলস বানিয়ে শেষ করার আগে সত্যি সত্যি সালমার ছোট বোন জোহরা এসে গেল, লম্বায় প্রায় সালমার সমান, চোখে চশমা। সালমা জোহরাকে ডাকল, বলল, “জোহরা দেখে যা কে এসেছে!”

জোহরা রান্নাঘরে টুনিকে দেখে একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সালমা বলল, “বল দেখি এটা কে?”

জোহরা মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না।”

সালমা একেবারে রাজ্য জয় করার ভঙ্গি করে বলল, “এ হচ্ছে টুনি। আমাদের ক্লাসে পড়ে, মাথার মাঝে খালি বুদ্ধি আর বুদ্ধি। সত্যিকারের ডিটেকটিভ–”

টুনি চেষ্টা করেও সালমাকে থামাতে পারল না। সালমা হাত উপরে তুলে বলল, “এ হচ্ছে বিখ্যাত ডিটেকটিভ টুনি। পত্রিকায় তার ওপর বিশাল ফিচার বের হয়েছিল!”

জোহরা বলল, “আর তুমি তাকে দিয়ে তোমার বাসন ধুইয়ে নিচ্ছ?”

সালমা বলল, “আমি কী করব? টুনি জোর করল সে আমাকে হেল্প করবে।”

টুনি বলল, “আমি আসলে কিছুই করছি না। হেল্প করার ভান করছি।”

সালমা বলল, “অনেক হয়েছে, এখন আর কিছুই করতে হবে না। সবাই আয় আমরা নুডলস খাব।”

তারপর টেবিলে বসে সবাই নুডলস খেল, সালমা ভুল বলেনি সত্যি সত্যি নুডলসটা খেতে অনেক মজা হয়েছে। খাওয়ার পর সালমা জোহরা আর বাবুকে বাইরে খেলতে পাঠিয়ে দিল। তখন টুনি প্রথমবার সালমার সাথে নিরিবিলি কথা বলার সুযোগ পেল। সালমা এক গাদা কাপড় নিয়ে টুনির পাশে বসে। কাপড়গুলো ভাঁজ করতে করতে টুনিকে বলল, “এখন বল, তুই কেন এসেছিস?”

টুনি বলল, “যখন আমি এসেছিলাম তখন মনে হয়েছিল কাজটা খুব ইম্পরট্যান্ট। তোকে দেখে এখন কাজটা আর ইম্পরট্যান্ট মনে হচ্ছে না।”

সালমা বলল, “তবু শুনি।”

টুনি তখন পুরো ক্লাসের সব ছেলেমেয়েকে সামনের মঙ্গলবার হাজির করার প্রজেক্টের কথাটা বলল। সবার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে শুধু সালমার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি বলে সে তাকে জানাতে এসেছে।

সালমা বলল, “ততদিনে বাবুর জ্বর কমে যাবে– তোরা চিন্তা করিস না, আমি চলে আসব।”

টুনি বলল, “আসতে পারলে আসবি, না পারলে নাই! তুই আমার সমান কিন্তু তোকে তোর বাসার সবকিছু দেখতে হচ্ছে এটা কি বিশ্বাস করা সম্ভব? আমি যদি আজকে নিজের চোখে না দেখতাম আমি কি বিশ্বাস করতাম? কেমন করে করছিস?”

হঠাৎ করে সালমার মুখটা কেমন যেন দুঃখী দুঃখী হয়ে যায়। এই প্রথমবার ভাঙা গলায় বলল, “পারছি না রে! সত্যি আমি পারছি না! বুঝলি টুনি, আম্মু যেদিন মরে গেল আমি সেদিনও কাঁদার সময় পাই নাই। আমার আব্বুটা জানি কেমন হয়ে গেছে। অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে- অনেক রাতে বাসায় এসে চুপচাপ বসে থাকে। বাবুটা এখনও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নাই–আমি স্কুলে যাওয়ার সময় পাই না, ঘুমানোর সময় পাই না। আমি কী করব, বল?”

টুনি সালমার গায়ে হাত দিয়ে বলল, “ঠিক হয়ে যাবে সালমা, দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে– তুই কত ভালো করে সবকিছু করছিস!”

“সারাদিন আমি সবার সাথে মজা করি, হাসাহাসি করি। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে যায় আমি বালিশে মুখ চেপে কাঁদি আর আম্মুকে গালি দেই-আম্মু তুমি কেমন করে এটা করতে পারলে? কেমন করে পারলে?”

টুনি আবার বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“হবে না। আমি জানি। কেমন করে হবে? আমার লেখাপড়া হবে না। দেখি বাবু আর জোহরার লেখাপড়াটা ঠিক করে করাতে পারি কি না-তিনজনের ভিতর দুইজন খারাপ কী?”

টুনি যখন বাসায় ফিরে এলো পুরো রাস্তাটা তার মনে হলো সালমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছে, “হবে না! হবে না! আমার লেখাপড়া হবে না। লেখাপড়া হবে না।“

.

পরদিন স্কুলে এসেই টুনি তাদের হেড ম্যাডামের ঘরে উঁকি দিল। ম্যাডাম গম্ভীর মুখে কী একটা কাগজ দেখছিলেন। টুনি পর্দা সরিয়ে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “আসতে পারি ম্যাডাম?”

ম্যাডাম চশমার উপর দিয়ে টুনির দিকে তাকালেন, তারপর একটু অবাক হয়ে বললেন, “আসো।”

হেড ম্যাডাম হাসি-খুশি মানুষ, ছেলেমেয়েদের আদর করেন। কিন্তু তারপরও ছাত্রছাত্রীরা যখন খুশি তার অফিসে ঢোকার সাহস পায় না।

টুনি ভিতরে ঢুকে হেড ম্যাডামের কাছে গিয়ে বলল, “ম্যাডাম আমি আপনার সাথে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই।”

“কী বিষয়?”

“আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে নিয়ে কথা বলতে চাই।”

“কী হয়েছে সেই মেয়ের?”

টুনি এক সেকেন্ড চিন্তা করল, তারপর বলল, “এই মেয়েটা আমাদের ক্লাসে পড়ে। তার আম্মু হঠাৎ করে মারা গেছেন। এখন বাসার সবার দায়িত্ব তার ওপর। তার আব্বু থেকে শুরু করে ছোট ভাই-বোন সবার। সবাইকে তার দেখে শুনে রাখতে হয়, রান্না করতে হয়, বাসন ধুতে হয়। ছোট ভাইয়ের অসুখ হলে দেখতে হয়। সবাইকে সান্ত্বনা দিতে হয়। সে এখন স্কুলে আসার সময় পায় না, লেখাপাড়া করার সময় পায় না। মনে হয় আর লেখাপড়া করতে পারবে না। “

হেড ম্যাডাম কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কেমন করে জানো?”

“আমি তার বাসায় গিয়েছিলাম। নিজের চোখে দেখেছি ম্যাডাম। *

ম্যাডাম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। টুনির সাথে সালমাকে নিয়ে আরও কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ আমাকে এটা জানানোর জন্য। মেয়েটার নাম- ঠিকানা দিয়ে যাও। আমি দেখব।”

“সে কি আবার পড়াশোনা করতে পারবে ম্যাডাম?”

“পারবে। অবশ্যই পারবে। আমাদের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম।”

টুনি একটা কাগজে সালমার নাম-ঠিকানা লিখে চলে আসার পর ম্যাডাম কাগজের টুকরাটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।

.

পরের মঙ্গলবার সত্যি সত্যি টুনিদের ক্লাসের সব ছাত্র-ছাত্রী হাজির হলো। ছেলেমেয়েরা তাদের ক্লাস টিচারকে সেটা জানিয়ে দিল। ক্লাস টিচার সেটা হেড ম্যাডামকে জানালেন। স্কুল অ্যাসেমব্লিতে সেটা ঘোষণা করা হলো। শুধু তাই-না, সবার আগে পুরো ক্লাসকে হাজির করার জন্য টুনিদের পুরো ক্লাসকে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণীতে একটা পুরস্কার দেওয়া হবে বলে হেড ম্যাডাম একটা ঘোষণা দিলেন। টুনিদের পুরো ক্লাস তখন একটা গগন বিদারি চিৎকার দিল।

টুনি ক্লাস করতে করতে মাঝে মাঝেই সালমাকে লক্ষ করল। আজকে সে একটু পরে পরে ঘুমে ঢলে পড়ছে না। মাঝে মাঝে তার টুনির সাথে চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছিল, তখন সালমা তার দিকে তাকিয়ে হাসল। কেন হাসল কে জানে!

স্কুল ছুটির পর যখন সবাই ক্লাস থেকে বের হচ্ছে তখন সালমা হঠাৎ টুনির কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “টুনি, হেড ম্যাডাম আজকে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।”

“কী বলেছেন?”

“অনেক কিছু।” বলে সে দাঁত বের করে হাসল। তারপর বলল, “তুই ম্যাডামকে সবকিছু বলেছিস?”

টুনি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, বলেছি।”

“ম্যাডাম বলেছে আজ রাতে বাসায় গিয়ে আব্বুর সাথে কথা বলবে।

টুনি বলল, “গুড।”

“ম্যাডাম বলেছেন, সবকিছু ঠিক করে দেবেন।

টুনি বলল, “ভেরি গুড।”

“আমাকে বলেছেন আমি যেন কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা না করি।”

টুনি বলল, “ভেরি ভেরি গুড।”

দুই সপ্তাহ পরে স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণীতে বিশাল উত্তেজনা। গত কয়েক সপ্তাহ নানা ধরনের প্রতিযোগিতা হয়েছে তার পুরস্কার বিতরণী। এই দিনগুলোতে অহঙ্কারে মৌটুসীর পা মাটিতে পড়ে না। পড়ালেখায় সে রাজুর সাথে পারে না, কিন্তু অন্য সবকিছুতে সে প্রথম। নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সংগীত, কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা সবকিছুতে সে চ্যাম্পিয়ন। প্রতি বছর চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন্স পুরস্কারটা সে পায়। এই বছর সভাপতি হিসেবে পুরো ক্লাসের পক্ষ থেকে সবাই হাজির থাকার পুরস্কারটাও সে নেবে। এত পুরস্কার সে কেমন করে নেবে কে জানে!

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে টেবিলের উপর পুরস্কারগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মৌটুসী অনুমান করার চেষ্টা করতে থাকে এর মাঝে সে কোনটা কোনটা নেবে।

সবাই এসে গেছে তবুও অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছে না। কারণ প্রধান অতিথি তখনও এসে পৌঁছাননি! শেষ পর্যন্ত প্রধান অতিথি এসে হাজির হলেন। তখন অনুষ্ঠান শুরু হলো। প্রথমে বক্তৃতা। একজনের পর একজন বক্তৃতা দিয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা দাঁতে দাঁত চেপে কোনোভাবে সেই বক্তৃতা শুনে গেল! সবার শেষে প্রধান অতিথির বক্তৃতা। পুরস্কার পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ না, অংশগ্রহণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ– প্রধান অতিথি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই কথাটা অনেক বার বললেন। তার কথাটা অবশ্য কেউ বিশ্বাস করল না। সব পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেই এই কথাটা সবসময় বলা হয়। কিন্তু সবাই জানে এটা বলা হয় শুধুমাত্র ভদ্রতা করে। যারা কখনো পুরস্কার পায় না তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে যে আসলে পুরস্কার পাওয়াটাই বড় কথা, অংশগ্রহণ করার কোনো গুরুত্ব নাই! সে জন্য যারা পুরস্কার পায় না হিংসায় তাদের বুকটা ফেটে যায়। বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটা মোটেও আনন্দের অনুষ্ঠান না, এটা হচ্ছে মন খারাপ করা অনুষ্ঠান। যারা পুরস্কার পায় সেরকম অল্প কয়জনের জন্য আনন্দ, অন্য সবার জন্য মন খারাপের ব্যবস্থা।

প্রধান অতিথির লম্বা বক্তৃতা শেষ হলো তারপর পুরস্কার দেওয়া শুরু হলো। একেবারে ছোট ক্লাস থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে বড় ক্লাসের ছেলেমেয়েদের জন্য পুরস্কার। যখন নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতার জন্য পুরস্কার দেওয়া শুরু হলো তখন মৌটুসী ঘন ঘন স্টেজে উঠতে এবং নামতে লাগল। এতবার সে পুরস্কার পেল যে প্রধান অতিথি পর্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন।

সব পুরস্কার বিতরণ শেষ হওয়ার পর সবাই হাজির থাকার জন্য টুনিদের ক্লাসের বিশেষ পুরস্কার। হেড ম্যাডাম তখন তাদের ক্লাসের কয়েকজনকে চলে আসতে বললেন, তখন মৌটুসীর সাথে রাজু আর মাধুরীও উঠে গেল। মোটুসীর ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হলো না, কিন্তু সে কী আর করবে? সবুজকে কেউ ডাকে নাই কিন্তু কীভাবে কীভাবে সেও মঞ্চে উঠে গেল। শুধু তা-ই না, সবার সামনে দাঁড়িয়ে প্রধান অতিথির কাছ থেকে পুরস্কারটা নিয়ে নিল! মৌটুসী যা বিরক্ত হলো সেটা আর বলার মতো নয়। কিন্তু স্টেজে দাঁড়িয়ে তো আর কাড়াকাড়ি করতে পারে না তাই মৌটুসীকে সেটা হজম করতে হলো! তবে সে বিষয়টা সহ্য করল কারণ এর পরেই দেওয়া হবে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন্স পুরস্কার। মোটুসী হিসাব করে বের করেছে এটা তার ছাড়া আর কারো পাওয়ার কথা না। তারপরও এটা যেহেতু আগে থেকে ঘোষণা করা হয় না তাই প্রতি বছরই পুরস্কারটা কে পাবে সেটা নিয়ে সবার একটা কৌতূহল থাকে ৷

চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন্স পুরস্কার ঘোষণা করার জন্য হেড ম্যাডাম মাইক্রোফোনটা হাতে নিলেন, তারপর বললেন, “এখন আমাদের সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট পুরস্কার, এবারকার চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন্স! প্রত্যেক বছর আমরা এই পুরস্কারটা দিই যে নাকি লেখাপড়ার বাইরে অন্য কিছুতে সবার সেরা। ছেলেমেয়েদের কত রকম কোয়ালিটি থাকে, কেউ খেলাধুলায় ভালো, কেউ সাহিত্যে, কেউ সংগীতে, কেউ আবার চিত্রকলায়। আবার কেউ কেউ এর বাইরেও কোনো কিছুতে ভালো থাকে, আমরা যার খোঁজ রাখি না। এই বছর আমরা এই পুরস্কারটি দেব এমন একটি মেয়েকে যার বয়স মাত্র তেরো কিন্তু তার মায়ের অকালমৃত্যুর পর সে একা তার বাবা, তার ভাই-বোনের সবার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। আমরা নাচ গান আবৃত্তি খেলাধুলা কিংবা লেখাপড়া এই ধরনের গুণের কথা জানি, কিন্তু ছোট একটি মেয়ে পুরো পরিবারকে রক্ষা করার মতো অসাধারণ একটা কাজ করে যাচ্ছে, আমরা তার খোঁজ রাখি না!”

সমস্ত ছেলেমেয়ে হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে গেল। হেড ম্যাডাম ডাকলেন, “আমি সপ্তম শ্রেণির সালমা রহমানকে এই বছরের চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন্স স্বর্ণ পদকটি নেওয়ার জন্যে মঞ্চে আহ্বান করছি।“

টুনি শান্তশিষ্ট মেয়ে, সাধারণত সে হইচই করে না। কিন্তু হঠাৎ তার কী হলো কে জানে, চিলের মতো শব্দ করে একটা চিৎকার দিল। সালমা তার পাশেই বসে ছিল। তাকে দেখে মনে হলো সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কেমন যেন হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে এদিক- সেদিক তাকাতে লাগল। তারপর হঠাৎ করে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল।

টুনি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, ফিসফিস করে বলে, “বলেছিলাম না তোকে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে! বলেছিলাম না?”

তারপর তাকে দাঁড় করিয়ে টেনে টেনে মঞ্চের দিকে নিতে থাকে।

প্রায় হাজার খানেক ছেলেমেয়ে প্রথমে নিঃশব্দে বসে থাকে। তখন হঠাৎ একজন হাততালি দিল, তারপর আরেকজন তারপর আরও কয়েকজন। তারপর পুরো হল ঘরের সবাই হাততালি দিতে থাকে, সেই হাততালি থামতেই চায় না।

টুনি সালমাকে টেনে নিতে নিতে ফিসফিস করে বলে, “চোখ মুছে ফ্যাল বোকা মেয়ে। তোর আম্মু ওপর থেকে দেখছেন!”

সালমা চোখ মুছল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *