৫. মশা
দরজায় টুং টাং শব্দ শুনে টুনি দরজা খুলে দেখল ফারিহা আপু দাঁড়িয়ে আছে। ফারিহা আপুকে দেখলেই টুনি খুশি হয়ে যায়, আজকেও খুশি হয়ে গেল। প্রত্যেকবারই ফারিহা আপু নতুন একটা চেহারা নিয়ে আসে, আজকেও এসেছে। চুলগুলো বেগুনি! টুনি ছোট একটা চিৎকার করে বলল, “ফারিহা আপু! তুমি! তোমাকে আজকে কী সুন্দর লাগছে।“
ফারিহা আপু ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আমাকে দেখলেই তুমি বলো কী সুন্দর লাগছে! আমার মনে হয় তুমি আসলে বলতে চাও কী আজব লাগছে, সেটা তো আর বলা যায় না তাই বল, কী সুন্দর লাগছে!”
“না ফারিহা আপু! আজব লাগবে কেন? তোমাকে একেবারে অন্যরকম লাগছে, চুলগুলোর এই রংটাতে তোমাকে যা মানিয়েছে না!”
ফারিহা আপু সোফায় বসতে বসতে বলল, “পৃথিবীর অনেক দেশে চুলের কত রকম রং হয়। কালো, বাদামি, সোনালি–আমাদের দেশে খালি কালো রং। কী বোরিং, সেজন্য একটু অন্য রং চেষ্টা করে দেখলাম।”
“ভালো করেছ ফারিহা আপু।”
ফারিহা হাত দিয়ে নিজের চুলগুলোতে একবার হাত বুলিয়ে বলল, “শাহরিয়ার দেখে কী বলবে মনে হয়?”
“ছোটাচ্চু ভান করবে সে লক্ষই করেনি। আর যদি লক্ষ করে তাহলে খুবই খোঁচা মেরে কিছু বলবে।”
“ঠিকই বলেছ! দেখি কী বলে। একটু ডেকে আনো না প্লিজ!”
টুনি ছোটাচ্চুকে ডেকে আনল। ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকেই ফারিহা আপুকে দেখে চমকে উঠল, বলল, “তোমার কী হয়েছে?”
ফারিহা আপু বলল, “ঢং করো না। অনেক টাকা দিয়ে রং করিয়েছি কেমন লাগছে বল।”
“সত্যি সত্যি বলব?”
“সত্যি বলবে না তো মিথ্যা বলবে নাকি? বল।”
“মনে হয়েছে মাথায় আগুন লেগে চুলগুলো পুড়ে এরকম বেগুনি হয়ে গেছে!”
টুনি হি হি করে হেসে বলল, “দেখেছ ফারিহা আপু, তোমাকে বলেছিলাম কিনা!”
ছোটাচ্চু সোফায় বসতে বসতে বলল, “কী বলেছিলি?”
ফারিহা আপু উত্তর দিয়ে বলল, “টুনি বলেছিল তুমি খোঁচা মেরে একটা কমেন্ট করবে, সেটাই করেছ।”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি মোটেও খোঁচা মারিনি, যেটা সত্যি সেটা বলেছি।”
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু তুমি এখন পুরান মডেলের, মানুষের চুল যে অনেক রঙের হতে পারে তুমি সেটা জান না।”
ছোটাচ্চু বলল, “থাক থাক! এতো বেশি জেনে কাজ নেই। কয়েক দিন দেখলে অভ্যাস হয়ে যাবে। বগলে ফোঁড়া উঠলেও আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যায়!”
ফারিহা আপু ছোটাচ্চুকে একটা ছোট ঘুষি দিয়ে বলল, “আমার চুলকে তুমি ফোঁড়ার সাথে তুলনা করছ? তোমার এতো বড় সাহস?”
ছোটাচ্চু নিজেকে রক্ষা করার জন্য একটু সরে গিয়ে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে আর বলব না। শুধু এর পরের বার থেকে আমাকে আগে থেকে একটু ওয়ার্নিং দিয়ে রেখো যেন ধাক্কাটা বেশি বড় না হয়!
“এই ধাক্কাতেই তুমি কাহিল হয়ে যাচ্ছ? দেখবে ভবিষ্যতে আরো কত দিক থেকে ধাক্কা আসবে।
ছোটাচ্চু ভয়ের ভঙ্গী করে বলল, “সর্বনাশ!”
ফারিহা আপু বলল, “অনেক হয়েছে। এখন চল, শওকত সাহেব কী বলতে চান শুনে আসি!”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “শওকত সাহেব কে?”
ছোটাচ্চু দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমি উনার ওয়াইফের এক সেট গয়না চুরির কেস সলভ্ করে দিয়েছিলাম! শওকত সাহেব নিজে সেটা চুরি করেছিলেন! মনে আছে?”
টুনি আর ফারিহা একসাথে মাথা নাড়ল, তাদের মনে আছে!
টুনি বলল, “তোমার বুদ্ধিটা খুবই কিউট ছিল ছোটাচ্চু! আর শওকত সাহেব মানুষটা খুবই ফানি। কেউ কখনো নিজের বউয়ের গয়না চুরি করে?”
ফারিহা আপু বলল, “ধরা পড়ে তার কী আনন্দ!”
ছোটাচ্চু জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলল, “মনে আছে শওকত সাহেবের ওয়াইফ চোর ধরে দেওয়ার জন্য পেটমোটা একটা খাম দিয়েছিলেন। ভিতরে কচকচ করছিল খালি হাজার টাকার নোট? ইশ!”
“হ্যাঁ! তুমি ভদ্রতা করে নিলে না!” ফারিহা আপুও জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলল, “এতোগুলো টাকা!”
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার মনে হয় খুব ক্ষতি হবে না। তোমাকে যখন আবার ডেকে পাঠিয়েছেন তার মানে নিশ্চয়ই তোমাকে কোনো একটা কাজ দেবেন। সেটা যদি করতে পার তাহলেই তো হলো।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “সেটা ঠিক। এখন দেখা যাক কী কাজ দেয়।”
ফারিহাপু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল যাই।”
ছোটাচ্চু বলল, “একটু চা খেয়ে যাবে না?”
“নাহ্! একটা কফি হাউজে যখন দেখা করতে চাইছেন তখন সেখানে চা কফি সব পাওয়া যাবে।”
ছোটাচ্চু দাঁড়িয়ে বলল, “তা ঠিক। কিন্তু” বলে সে ভুরু কুঁচকে ফারিহার দিকে তাকাল।
ফারিহা জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী?”
“তোমার এই চুল দেখে আবার ঘাবড়ে না যান!”
ফারিহা আপা একটা ঘুষি দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “আরেকবার আমার চুল নিয়ে একটা কথা বললে ঘুষি মেরে তোমার চ্যাপ্টা টাইপের নাকটা আরো চ্যাপ্টা করে দেব।”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে বলব না।” একটু পর নিজের নাকটা একটু টেনে বলল, “আমার নাকটা কী আসলেই চ্যাপ্টা টাইপ?”
কেউ উত্তর দিল না, টুনি শুধু হি হি করে হাসল। ছোটাচ্চুর নাক মোটেও চ্যাপ্টা না।
.
কফি হাউজে শওকত সাহেবকে খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগল, যদিও তিনি একেবারে সামনে বসেছিলেন। আসলে ছোটাচ্চু আর ফারিহা শেষবার যখন তার বাসায় তাকে দেখেছিল তখন তিনি ছিলেন প্রায় ঘুমের পোশাক পরে একেবারে এলোমেলো অবস্থায়। ছোটাচ্চু আর ফারিহার মনের মধ্যে সেই ছবিটাই রয়ে গেছে। তারা টাকপড়া মোটাসোটা একজন ঢিলেঢালা মানুষ খুঁজে যাচ্ছিল। কিন্তু আজকে শওকত সাহেব একেবারে স্যুট টাই পরা চোখে চশমা ফিটফাট মানুষ, দেখে চেনারই উপায় নেই। শওকত সাহেবই ছোটাচ্চু আর ফারিহাকে প্রথম দেখে ডাকলেন, “এই যে ইয়ংম্যান এন্ড ইয়ং লেডি- আমি এখানে।”
ছোটাচ্চু আর ফারিহা এগিয়ে গেল, সালাম করে তার সামনে বসল ৷ শওকত সাহেব তার হাতের পত্রিকাটা ভাঁজ করে পাশে রেখে তাদের দিকে তাকিয়ে হাসিহাসি মুখে বললেন, “তারপর কী খবর তোমাদের? লং টাইম নো সি।”
ফারিহা বলল, “আমার সেরকম কোনো খবর নাই। অফিসে যাই ফেরত আসি। কাজকর্ম নাই কিন্তু বেতন দিয়ে যাচ্ছে।”
ছোটাচ্চু বলল, “আমার জীবন আরো সহজ। কাজকর্ম নাই বেতন ও নাই। থাকা খাওয়া ফ্রী সেজন্যে চিন্তাও নাই।”
একটা ফাটাফাটি রসিকতা শুনেছেন সেরকম ভাব দেখিয়ে শওকত সাহেব শব্দ করে হাসলেন, আশপাশে অনেকেই মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে রসিকতাটা কী নিয়ে বোঝার অনুমান করল। শওকত সাহেব এক সময় হাসি থামিয়ে বললেন, “তোমাদের দুজনকেই খুব চমৎকার দেখাচ্ছে। ইয়ং, এনার্জেটিক এন্ড ফ্রেশ!”
ছোটাচ্চু তার গালের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “জী, কাজ কর্ম না থাকলে সব সময় ফ্রেশ থাকা যায়!”
“এরকম সৌভাগ্য সবার হয় না। যতদিন পার এনজয় করে নাও!”
ফারিহা বলল, “বেশি এনজয় করে ফেলছে বলে মনে হচ্ছে!”
শওকত সাহেব ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার চুলের রংটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে! আমার মাথায় যদি গোটা পঞ্চাশেক চুলও থাকতো তাহলে তোমার মতো রং করে ফেলতাম!”
ছোটাচ্চু একটু কল্পনা করে দেখার চেষ্টা করল, শওকত সাহেবের মাথায় অনেক চুল এবং সেই চুলের রং বেগুনি! কল্পনাটা সে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারল না–শওকত সাহেব বললেন, “তোমরা কী খাবে? এখানে খুব ভালো চিজ কেক তৈরি করে।
ফারিহা বলল, “ভালো না মন্দ তাতে কিছু আসে যায় না। চিজ কেক হলেই আমি খাব।”
ছোটাচ্চু বলল, “যে কোনো জিনিস মিষ্টি হলেই আমি খেতে পারি।”
শওকত সাহেব বললেন, “আমার মিষ্টি খাওয়া নিষেধ, কিন্তু ধরে নিচ্ছি তোমরা আমাকে চাপ দিয়ে জোর করে খাওয়াচ্ছ। চিজ কেকের সাথে কফির কোনো তুলনা নেই। ব্ল্যাক হলে আরো ভালো।
ছোটাচ্চু কফি খেতে পারে না, বিশেষ করে কালো কফি তার দুই চোখের বিষ কিন্তু এখন না করতে পারল না।
কফি এবং কেকের কথা বলে শওকত সাহেব কাজের কথায় চলে এলেন। কোনো রকম ভূমিকা না করে শুরু করে দিলেন, বললেন, “ডিটেকটিভ শাহরিয়ার তোমাকে আমি একটা জরুরি কাজে ডেকেছি।”
ছোটাচ্চু জরুরি কাজের উপযোগী একটা ভাব মুখে ধরার চেষ্টা করতে লাগল। বলল, “বলেন, দেখি আমি সাহায্য করতে পারি কিনা।”
শওকত সাহেব একবার ফারিহার দিকে তাকালেন তারপর বললেন, “সত্যি বলতে কী, আমি চাইব শাহরিয়ার সাহেবের সাথে ফারিহাও যেন থাকে, দুইজনের টিম হলে আরো ভালো।”
ফারিহা বলল, “আমি যেহেতু একটা চাকরি করছি তাই অন্য জায়গায় সময় দিতে পারব না। তাছাড়া শাহরিয়ারের কাজকর্মে আমার কিছু করার নেই। আমি গাড়ি চালিয়ে শাহরিয়ারকে মাঝে মাঝে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাই। এ ছাড়া আর কিছু করার ক্ষমতা আমার নাই।”
ছোটাচ্চু বলল, “এবং মাঝে মাঝে আমাকে টাকা ধার দাও।”
“ধার?” ফারিহা চোখ কপালে তুলে বলল, “যে টাকাটা ফেরত দেওয়া হয় সেটা হচ্ছে ধার! “
“ফেরত দেওয়া হয় নাই বলে যে ফেরত দেওয়া হবে না সেটা কেন ধরে নিচ্ছ?”
শওকত সাহেব বললেন, “আমার প্রস্তাবটায় তুমি যদি রাজি হও তাহলে তোমার টাকা ধার এবং টাকা শোধের ব্যাপারটারও একটা সমাধান হয়ে যাবে। আমি যে কোনো সার্ভিসের উপযুক্ত মূল্য দেওয়া বিশ্বাস করি।”
ছোটাচ্চু দুর্বল গলায় বলল, “এখনও কাজটা কী সেটা বলেন নাই। আমি করতে পারব কিনা সেটা এখনও জানি না।“
“তুমি পারবে। তুমি না পারলে আমি তোমাকে বলতাম না।”
ছোটাচ্চু চুপ করে রইল। শওকত সাহেব বললেন, “তোমার কাজ মোটামুটি সহজ। মতিঝিলে আমার বিজনেসের যে বিল্ডিং আছে সেখানে তোমাকে একটা অফিস রুম দেব, তুমি মাঝে মাঝে এসে সেই অফিসে বসবে। চা কফি খাবে, আমার সাথে এবং আমার স্টাফদের সাথে মাঝে মাঝে কথা বলবে। কম্পিউটারের সামনে বসবে। কিছু সময় কাটাবে, তারপর চলে যাবে।“
ছোটাচ্চু বলল, “কিন্তু কী করতে হবে?”
“কিছু করতে হবে না।
ছোটাচ্চু মুখটা হা করে কিছু একটা বলতে গেল, কিন্তু কী বলবে সেটা বুঝতে না পেরে মুখটা হা করে বসে রইল। সেই দৃশ্য দেখে ফারিহা হঠাৎ হি হি করে হাসতে শুরু করল, হাসি আর থামাতে পারে না।
শওকত সাহেব একটু অবাক হয়ে একবার ছোটাচ্চুর দিকে আরেকবার ফারিহার দিকে তাকালেন তারপর বললেন, “কী হলো? হাসছ কেন?”
ছোটাচ্চু কথা বলার চেষ্টা করল, “মা-মা-মানে — “
ফারিহা হাসি থামিয়ে ছোটাচ্চু যেটা বলার চেষ্টা করছে সেটা বলে দিল, “মানে, শাহরিয়ার বলতে চাইছে, শুধু মাঝে মাঝে চা খাওয়ার জন্য আপনি তাকে অফিস দেবেন, টাকা-পয়সা দিবেন এটা সে বুঝতে পারছে না! তাই না শাহরিয়ার?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কোনো কিছু না করা কেমন করে একটা কাজ হয়।”
শওকত সাহেব হাসি হাসি মুখে বললেন, “ঠিক আছে আমি তোমাকে বোঝাই। প্রথম কথা হচ্ছে মাঝে মাঝে আমার অফিস বিল্ডিংয়ে গিয়ে চা খাওয়ার এই কাজটা কিন্তু আমি যদু মধুঁকে দিব না, তোমাকে দিচ্ছি। তার কারণ তুমি হচ্ছ বিখ্যাত ডিটেকটিভ শাহরিয়ার- “
ছোটাচ্চু দুর্বলভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল, “আমি আসলে ঠিক বিখ্যাত কোনো ডিটেকটিভ না, সখে–”
শওকত সাহেব ছোটাচ্চুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি বড় ডিটেকটিভ না ছোট ডিটেকটিভ সেটা আমার আলাপের বিষয় না। আমার যেরকম মানুষ দরকার তুমি হচ্ছ সেরকম একজন মানুষ। তুমি যে স্টাইলে আমার স্ত্রীর গয়নার সেটের চোরকে ধরেছিলে সেটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল।” শওকত সাহেব তখন হা হা করে আবার অনেক জোরে জোরে শব্দ করে হাসতে শুরু করলেন। শুধু আশপাশের না, কফি হাউজের প্রায় সবাই তখন মাথা ঘুরিয়ে শওকত সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসির কারণটা অনুমান করার চেষ্টা করল। শওকত সাহেব একসময় হাসি থামিয়ে বললেন, “আমি একটু খোঁজ-খবরও নিয়েছি, পত্রপত্রিকায় ও টেলিভিশনে তোমার ওপর যে খবর বের হয়েছে আমি সেগুলোও দেখেছি। ছোট বাচ্চাদের সাথেও তুমি খুব ফ্রি, তোমার একজন ভাইঝি না হয় ভাগ্নীকে নিয়েও তুমি কাজ কর সেটা খুবই ইন্টারেস্টিং!”
শওকত সাহেব তার কফিতে চুমুক দেওয়ার জন্য একটু থামলেন, তখন ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ আমার এই ভাতিঝিটা খুবই ব্রাইট! নাম টুনি আমি মাঝে মাঝে টুনটুনি ডাকি!”
ফারিহা বলল, “আমার ধারণা টুনির আইকিউ একশ পঞ্চাশ না হয় একশ ষাট হবে। আরো বেশিও হতে পারে?“
শওকত সাহেব বললেন, “আমার আইকিউ টেনেটুনে চল্লিশ হবে কিনা সন্দেহ। যাক, যেটা বলছিলাম। আমার মোটামুটি একটা বড় বিজনেস হাউজ আছে, সেখানে এমপ্লয়ি প্রায় শ খানেক। কিসের বিজনেস, কেমন করে বিজনেস করতে হয়, কত টাকা টার্ন ওভার, এসেট কত, ক্যাশ ফ্লো কত সেগুলো কিছুই আমি তোমাকে বলছি না–
ছোটাচ্চু বলল, “থ্যাংক ইউ। বললেও আমি কিছু বুঝতাম না।”
“তোমার বোঝার দরকারও নাই। যাই হোক, যে কোনো বিজনেসে
কিছু বিজনেস সিক্রেট থাকে। আমারও আছে। কিছু কিছু সিক্রেট আছে যেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না। কিছু আছে হয়তো টপ লেভেলের চার পাঁচ জন জানে। কিছু আছে যেটা মিডলেভের পনেরো কুড়ি জন জানে। কিছু হয়তো অনেকেই জানে। একটা বড় বিজনেস চালাতে হলে এভাবেই থাকতে হয় এবং অনেক দিন এভাবেই চলেছে। কিন্তু –”
“কিন্তু কী? “
“আমার মনে হচ্ছে আমার এই সিস্টেমে ফাটল ধরেছে। আমার কিছু সিক্রেট আর সিক্রেট থাকছে না। এটা একটা বড় সমস্যা। কে বা কারা এটা করছে, কীভাবে করছে আমি ধরতে পারছি না। আমি সেজন্য তোমার সাহায্য নিচ্ছি।”
ছোটাচ্চু বলল, “আ-আমার সেই মানুষগুলোকে ধরতে হবে?”
“না। তুমি শুধু আমার অফিসে মানুষগুলোকে ধরার ভান করবে। তাতেই কাজ হবে। মানুষগুলো ভয় পেয়ে সাবধান হয়ে যাবে। আপাতত এটুকু হলেই আমার কাজ চলে যাবে!”
“কাজ চলে যাবে?”
“হ্যাঁ। আগামী এক দুই মাসে আমার একটা অনেক বড় ডিল ফাইনাল হবে, এই সময়ে আমি কোনো ঝামেলা চাই না। আমি একটু নিশ্চিন্তে কাজ করতে চাই।”
“আপনার ধারণা আমি আপনার অফিসে গিয়ে চা কফি খেলেই সেটা হয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ। আমি আগে থেকে সবাইকে জানিয়ে রাখব বিখ্যাত ডিটেকটিভ শাহরিয়ারকে অনেক কষ্টে আমি রাজি করিয়েছি, সে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করবে, আমার কোম্পানিটাকে পরিশুদ্ধ করে দেবে। সবাই যেন তাকে সাহায্য করে, সে যে তথ্য জানতে চায় সেটাই যেন তাকে জানানো হয়।”
ছোটাচ্চু বলল, “তার মানে আপনার পুরো অফিসের সবাইকে আমার ধোঁকা দিয়ে যেতে হবে?”
শওকত সাহেব হাসলেন, “আমার বাসায় আমি দেখেছি এই কাজটা তুমি খুব ভালো পার!
ফারিহা আবার হিহি করে হাসতে শুরু করল। ছোটাচ্চু একটু রেগে বলল, “কী হলো? তুমি হাসছ কেন?”
ফারিহা কষ্ট করে হাসিটাকে থামিয়ে বলল, “শেষ পর্যন্ত তোমার আসল গুণের একটু কদর হলো! তুমি যেটা সবচেয়ে ভালো পার সেটাই তুমি করার সুযোগ পেলে।” কথা শেষ করে ফারিহা আবার হি হি করে হাসতে লাগল!
ছোটাচ্চু চোখ পাকিয়ে বলল, “ফারিহা, সব কিছু নিয়ে ঠাট্টা করা তোমার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে! আমরা একটা জরুরি ব্যাপার নিয়ে কথা বলছিলাম তার মাঝে তুমি হি হি করে হাসতে শুরু করলে!’
ফারিহা হাসি থামিয়ে বলল, “ঠিক আছে হাসি থামাচ্ছি!”
ছোটাচ্চু তখন আবার শওকত সাহেবের দিকে তাকালো তারপর বলল, “কিন্তু শওকত সাহেব, আপনাদের এতো হাইফাই অফিস, কত রকম ড্রেস কোড, কখন কী পরবে তার নিয়ম-কানুন, কথা বলার কতো রকম স্টাইল তার মাঝে আমি সম্পূর্ণ বেমানান, আমি জীবনে টাই পরিনি, কীভাবে টাইয়ের নট বাঁধতে হয় সেটাও জানি না!”
শওকত সাহেব আবার শব্দ করে হাসলেন, বললেন, “তোমাকে আমি এই দায়িত্বটা দিতে যাচ্ছি তার একটা বড় কারণ হচ্ছে তোমার পোশাক! তুমি যেভাবে থাকো ঠিক সেভাবে আসবে যেন অফিসের সবার মাঝে তোমাকে আলাদাভাবে দেখা যায়–একটা মূর্তিমান ব্যতিক্রম। মাঝে মাঝে যদি ফারিহা আসতে পারে আরো ভালো। তরুণ বেপরোয়া ডিটেকটিভ এবং তার বেগুনি চুলের সহকর্মী!”
ফারিহা চমকে উঠল, “আমার বেগুনি চুল?”
“হ্যাঁ। তোমাকে দেখেই মনে হয়েছে এটাই তো দরকার! নতুন জেনারেশনের ক্যাজুয়েল পোশাক, ক্যাজুয়াল ব্যবহার কিন্তু অসাধারণ কাজ! তোমরা কী দেখেছ নতুন জেনারেশনের সব বড় বড় মানুষ জিন্স টি-শার্ট পরে বড় বড় কাজ করে?”
ছোটাচ্চু দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল। ফারিহা আবার হাসতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে থেমে গেল। শওকত সাহেব ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে কী আমি ধরে নিতে পারি তোমাকে পাচ্ছি?”
ছোটাচ্চু একটু ইতস্তত করছিল কিন্তু ফারিহা বলল, “হ্যাঁ পাচ্ছেন! আপনি চিন্তা করবেন না। শাহরিয়ার গাইগুই করলেও আমি ধরে নিয়ে যাব!”
“ভেরি গুড। এখন তাহলে শেষ কাজটা বাকি রয়েছে। সেটা হচ্ছে শাহরিয়ারের ব্যাংক একাউন্ট নম্বর।”
ছোটাচ্চু বলল, “ব্যাংক একাউন্ট নম্বর?”
“হ্যাঁ। আমার বাসায় রওশন একটা খামে করে তোমাকে তোমার ফি দিতে চেয়েছিল তুমি নাওনি। আমি চিন্তা করে দেখেছি কারো হাতে টাকা
দেওয়াটা রুচিহীন কাজ। এটা সরাসরি ব্যাংক একাউন্টে চলে যাওয়া উচিত।”
ছোটাচ্চু বলল, “কিন্তু আমার তো ব্যাংক একাউন্টের নম্বর মনে নেই!” ফারিহা বলল, “আমার মনে আছে।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “তোমার মনে আছে? কেমন করে? “দুইদিন পর পর যদি তোমার বেকার ডিটেকটিভ বন্ধুকে টাকা ধার দিতে হতো তাহলে তোমারও মনে থাকতো।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “তুমি একেবারে নম্বরটা মুখস্ত করে ফেলেছ?”
“হ্যাঁ। তাহলে সময় বাঁচে।”
ফারিহা একটা কাগজে ছোটাচ্চু ব্যাংক নম্বরটা লিখে দিল। শওকত সাহেব কাগজটা এক নজর দেখে তার পকেটে রেখে বললেন, “তাহলে এভাবেই ঠিক হলো, আমি আমার কোম্পানি থেকে তোমাকে একটা চিঠি পাঠাব কনসাল্টটেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য। তুমি সেটাতে রাজি হয়ে আমাকে জানানোর পর কাজ শুরু করে দেবে।”
ছোটাচ্চু একবার ফারিহার দিকে তাকালো, ফারিহা মুখ টিপে হেসে বুড়ো আঙুল উঁচু করে ছোটাচ্চুকে সাহস দিল। ছোটাচ্চু শওকত সাহেবের দিকে তাকিয়ে দুর্বল গলায় বলল, “ঠিক আছে!”
.
শওকত সাহেবের ফার্মে কাজ করার জন্য ছোটাচ্চু রেডি হতে শুরু করল। শেভ করা বন্ধ করে দিয়ে মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজাতে দিল। চুল আঁচড়ানো বন্ধ করে দিল, খুব দরকার হলে আঙুল দিয়ে চুলগুলো একটু গুছিয়ে নেয়। কালো রঙের ভুসভুসে একটা টি-শার্ট খুঁজে বের করে সেটাকে আরো কুঁচকানোর জন্য সেটা পরে ঘুমাতে শুরু করল। তার জিন্সের প্যান্টের একটা হাঁটু দেওয়ালের সাথে ঘষে ঘষে প্রায় ছিঁড়ে ফেলল। তার পুরানো টেনিস সু বের করে ময়লা জমার জন্যে ছাদে ফেলে রাখল। দামি একটা গগলস আর ব্যাকপেক কিনে আনল। দামি ব্যাক পেকটা শাহানাকে দিয়ে শাহানার পুরানো এবং ময়লা ব্যাকপেকটা নিয়ে নিল। শাহানা অবশ্য তার ব্যাকপেকটা দিতে চাইছিল না। ছোটাচ্চু বলল দরকার হলে সে যখন খুশি তার ব্যাকপেকটা নিয়ে নিতে পারে। গগলসটা নিয়ে একটু সমস্যা হলো, গগলস পরার অভ্যাস না থাকায় এটা চোখে দিয়ে ঘরের ভিতরে হাঁটাহাঁটি করার সময় ছোটাচ্চু এখানে সেখানে ধাক্কা খেতে লাগল!
শুধু যে তার বাইরের চেহারাটা পরিবর্তন করল তা নয় সে তার চলাফেরারও পরিবর্তন করতে শুরু করল। একটা চেয়ারে বসলেই পা দুটো টেবিলের উপর তুলে দিতে লাগল। কারো সাথে দেখা হলে তার সাথে হ্যান্ডশেক না করে “হাই ফাইভ” কিংবা “ফিস্ট বাম্প” করা প্র্যাকটিস করতে লাগল। যখন সে মোটামুটি তার চেহারা এবং চালচলনে অভ্যস্ত হয়ে গেল তখন শওকত সাহেবকে ফোন করে জানাল সে পরের দিন আসছে। শওকত সাহেব রাজি হওয়ার পর ছোটাচ্চু ফারিহাকে ফোন করল, প্রথম দিন সে ফারিহাকেও সাথে নিয়ে যেতে চায়।
.
শওকত সাহেবের অফিস বিল্ডিংটার গেটের মানুষটা ছোটাচ্চু আর ফারিহাকে দেখা মাত্র লাফ দিয়ে উঠে বিশাল বড় একটা সালাম দিয়ে গেট খুলে দাঁড়াল। ছোটাচ্চু হালকা একটা শিস দিতে দিতে গগলসটা মাথার উপর তুলে লিফটের সামনে দাঁড়াল। গেটে দাঁড়ানো মানুষটা বিনয়ে একেবারে মাটির সাথে মিশে গিয়ে বলল, “স্যার চার তলায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। লিফটের তিন।”
ছোটাচ্চু আর ফারিহা লিফটের তিন টিপে চার তলায় পৌঁছল। লিফট থেকে বের হয়ে কাঁচের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটি প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মিস্টার শাহরিয়ার এন্ড মিস ফারিহা?”
ছোটাচ্চু বলল, “ইয়াপ!” সেটা শুনে ফারিহা পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল!
রিসেপশনিস্ট মেয়েটা বলল, “আসেন প্লিজ। স্যার আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।”
ছোটাচ্চু আর ফরিহা মেয়েটার পিছু পিছু গেল। বড় একটা অফিস ঘরের দরজা খুলে মেয়েটা মাথা ঢুকিয়ে বলল, “স্যার, উনারা চলে এসেছেন।”
শওকত সাহেব বলল, “নিয়ে আস।”
মেয়েটা দরজা থেকে সরে তাদের ভিতরে ঢুকতে ইঙ্গিত করল। ছোটাচ্চু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে ভিতরে ঢুকল। বিশাল অফিস রুম, সামনে স্যুট টাই পরা আরো দুইজন বসেছিল। শওকত সাহেবের সাথে সাথে এই মানুষ দুইজনও দাঁড়িয়ে গেল! শওকত সাহেব হাসি হাসি মুখে বললেন, “হ্যালো ডিটেকটিভ শাহরিয়ার এন্ড ফারিহা ম্যাডাম! ওয়েলকাম টু আওয়ার প্রেস!”
ছোটাচ্চু এগিয়ে গিয়ে তার সাথে ফিস্ট বাম্প করে, তারপর ব্যাকপেকটা নিচে রেখে একটা চেয়ারে বসে পড়ল!
শওকত সাহেব বললেন, “শাহরিয়ার আমার ফার্মে একটু সময় দেওয়ার জন্য তোমাকে যে কীভাবে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না।“
শাহরিয়ার বলল, “নো প্রবলেম!”
শওকত সাহেব ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ফারিহা তোমাকেও ধন্যবাদ শাহরিয়ারকে রাজি করানোর জন্য!”
ফারিহা বলল, “আশা করছি যে জন্য শাহরিয়ারকে এনেছেন সেটা যেন সে করতে পারে।“
“পারবে, পারবে। নিশ্চয়ই পারবে। শাহরিয়ার হাত দিয়েছে আর সমস্যা সমধান হয়নি, আমি এখনো দেখিনি।” শওকত সাহেব এবার তার সামনে বসে থাকা দুজনকে দেখিয়ে বলল, “এরা আমার সিনিয়ার ম্যানেজমেন্টের দুইজন। আর আপনারা তো বুঝতেই পারছেন ইনি হচ্ছেন ডিটেকটিভ শাহরিয়ার, যার কথা আপনাদের বলেছিলাম।”
স্যুট পরা মানুষ দুইজন জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “জী জী বুঝতে পারছি। স্যার আমাদেরকে আপনার কথা বলেছেন।”
শওকত সাহেব বললেন, “আপনারা সবাইকে আমাদের কনফারেন্স রুমে আসতে বলেন, ছোট একটা টি-ব্রেক। আমি শাহরিয়ার আর ফারিহাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।”
ফারিহা বলল, “না, না, আমাকে পরিচয় করাতে হবে না। আমি এখন যাব, অফিসের কাজ ফেলে এসেছি।”
“এক কাপ চা না হয় কফি খেয়ে যাও।”
“আরেক দিন খাব, আজ যাই।”
“তাহলে অন্তত শাহরিয়ারের অফিসটা দেখে যাও।”
ফারিহা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ। সেটা দেখে যেতে পারি।”
স্যুট পরা দুইজন উঠে বের হয়ে যাওয়া মাত্রই শওকত সাহেব হা হা করে হেসে শাহরিয়ারকে বললেন, “তোমার পোশাকটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এই টি-শার্টটা কোথা থেকে ম্যানেজ করলে?”
“সোফার নিচে পড়েছিল।”
“ফ্যান্টাস্টিক! আর জিন্সটা?”
“ঘষে ঘষে হাঁটুটা ছিঁড়েছি।”
শওকত সাহেব হা হা করে হেসে বললেন, “সবচেয়ে ভালো হয়েছে তোমার ফিস্ট বাম্পটা!”
“আমি নিজেও এটা শিখেছি মাত্র কয়েকদিন হলো, বাচ্চারা আমাকে শিখিয়েছে! হাই ফাইভও জায়গা মতো দেব।”
শওকত সাহেব বললেন, “শুরুটা খুব ভালো হয়েছে। এখন চালিয়ে যাও।”
ফারিহা বলল, “এটা ডিটেকটিভ কাজ হচ্ছে নাকি টিভি সিরিয়াল হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না!”
শওকত সাহেব বললেন, “দুটোই, এটা হচ্ছে ডিটেকটিভ কাজের সিরিয়াল।”
শওকত সাহেব শাহরিয়ার এবং ফারিহাকে নিয়ে তার অফিস থেকে বের হলেন। করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে অফিসের বিভিন্ন অংশ দেখাতে দেখাতে এক পাশে চলে এসে একটা ঘরের সামনে থামলেন। দরজা থেকে চাবি ঝুলছে, চাবিটা বের করে শাহরিয়ারের হাতে দিয়ে বললেন, “ তোমার অফিসের চাবি।”
শাহরিয়ার বলল, “থ্যাংক ইউ। কাজ শুরু করার আগেই অফিসের চাবি পেয়ে গেলাম।”
“তুমি টের পাচ্ছ না কিন্তু আসলে তুমি কাজ শুরু করে দিয়েছ শাহরিয়ার।”
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে ছোটাচ্চু মুগ্ধ হয়ে গেল। বড় একটা রুম, মাঝখানে সেক্রেটারিয়েট টেবিল, দামি চেয়ার, জানালা থেকে ভারী পর্দা ঝুলছে। টেবিলের উপর একটা দামি ল্যাপটপ। পিছনে ফাইল কেবিনেট, একটা শেলফ, একপাশে একটা দরজা। ছোটাচ্চু দরজা খুলে দেখল একটা সুন্দর বাথরুম। সে অবাক হয়ে শওকত সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা আমার অফিস?”
“হ্যাঁ। পছন্দ হয়েছে?”
“পছন্দ হবে না মানে? মনে হচ্ছে একটা স্লিপিং ব্যাগ কিনে এনে এখানে থাকা শুরু করি!”
“মোস্ট ওয়েলকাম। করতেই পার।”
ফারিহা অফিসটা ঘুরে একটু দেখে বলল, “এতো সুন্দর অফিসে শাহরিয়ারকে মোটেও মানাবে না!”
ছোটাচ্চু বলল, “তুমি বুঝতে পারছ না সেটাই হচ্ছে মূল আইডিয়া! যত বেমানান তত ভালো।“
ফারিহা ঘড়িটা দেখে বলল, “আমি এখন তাহলে যাই? দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
শওকত সাহেব বললেন, “চল, আমি তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।” ফারিহা বলল, “কোনো প্রয়োজন নেই। আমি চলে যেতে পারব। ছোটাচ্চু তার দুমড়ানো মোচড়ানো ব্যাকপেকটা টেবিলের উপর রেখে তার চেয়ারে বসল। শওকত সাহেব বললেন, “তুমি তোমার অফিসে একটু অভ্যস্ত হয়ে নাও আমি একটু পরে তোমাকে আমাদের কনফারেন্স রুমে নিয়ে যাব। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।”
“ঠিক আছে।”
সন্ধেবেলা যখন সবাই দাদির (কিংবা নানির) রুমে বসে হুটোপুটি করছে এবং দাদি একটু পরে পরে ধমক দিয়ে সবাইকে চুপ করার কথা বলছেন তখন ছোটাচ্চু কয়েকটা কেকের বাক্স নিয়ে ঢুকলো। একসাথে সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল, একজন জিজ্ঞেস করল, “কী এনেছ ছোটাচ্চু?”
আরেকজন বলল, “ছোটাচ্চু তুমি তো খাবার দাবার আনতে ভুলেই গিয়েছিলে! শেষ পর্যন্ত আবার এনেছ?”
আরেকজন বলল, “হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? দাও, খাই।”
আরেকজন বলল, “রাক্ষসের মতো খিদে পেয়েছে।“
আরেকজন সুর করে বলল, “হাউ মাউ খাউ, খাবারের গন্ধ পাউ।”
শুধু দাদি চোখ কপালে তুলে বললেন, “শাহরিয়ার তোর এ কী চেহারা হয়েছে জংলীর মতন? ডাকাতের মতো দাড়ি? চুল আঁচড়াসনি, ময়লা একটা টি-শার্ট পরেছিস? ছেঁড়া প্যান্ট? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তোর হয়েছেটা কী?“
ছোটাচ্চু বলল, “বড় একটা কোম্পানির বড় একটা কাজ করে দিচ্ছি তো, এটা হচ্ছে সেই কোম্পানির পোশাক!”
দাদি (কিংবা নানি) রেগে উঠলেন, বললেন, “আমার সাথে ইয়ারকি করিস? দেবো একটা থাপ্পড়।”
শান্ত বলল, “দাদি, তুমি বুঝতে পারছ না, ছোটাচ্চুর এই পোশাক হচ্ছে আজকালকার মডার্ন পোশাক!”
দাদি দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “চুলোয় যাক মডার্ন পোশাক! এই যদি মডার্ন পোশাকের অবস্থা হয় তাহলে মডার্ন হওয়ার কোনো দরকার নাই ৷”
মুনিয়া বলল, “দাদি, আমরা ছোটাচ্চু কী এনেছে সেটা খেতে খেতে কথা বলি?”
দাদি গজগজ করতে লাগলেন। ছোটাচ্চু দাদির দিকে তাকিয়ে হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, “মা, তুমি যদি চাও, তাহলে কেন এই পোশাক পরেছি, এই চেহারা করেছি বলতে পারি–”
“কোনো দরকার নাই, ভদ্র কাপড় পরে আয় তাহলেই হবে!”
“ঠিক আছে, আগে বাচ্চাদের কেকগুলো দিয়ে যাই।”
একজন জানতে চাইল, “কী কেক ছোটাচ্চু?”
“এটা হচ্ছে চীজ কেক। একটা বেহেশতি খাবার। তোরা যদি বেহেশতে যাস তাহলে বেহেশতের দরজায় এই কেকের একটা টুকরা খেতে দেবে, তোরা সেটা খেতে খেতে ভিতরে ঢুকবি।”
প্রমি বলল, “শান্ত তুই বেশি করে খেয়ে নে। তুই তো পরকালে এই কেক খাওয়ার সুযোগ পাবি না!”
প্রমির কথা শুনে সবাই হি হি করে হাসতে লাগল।
ছোটাচ্চু কেকের বাক্সগুলো নিচে রাখল এবং সব বাচ্চারা কেকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ছোটাচ্চু যখন তার ঘরে গিয়েছে তখন টুনিও তার পিছনে পিছনে এসেছে। ছোটাচ্চু টুনিকে দেখে বলল, “কিছু বলবি?”
“হ্যাঁ।”
“তাড়াতাড়ি বল, আমার গোসল করতে হবে।”
“তুমি বলেছ যে বড় একটা কোম্পানির কাজ করে দিচ্ছ। কী কাজ? “
“ময়লা টি-শার্ট পরে একটা হাইফাই অফিসে টেবিলের উপর পা তুলে বসে থাকা।“
“ঠাট্টা করো না ছোটাচ্চু, সত্যি সত্যি বল।
ছোটাচ্চু বলল, “আমি মোটেও ঠাট্টা করছি না। মাঝে মাঝে একজন সিনিয়র মানুষকে মুখ গম্ভীর করে বলেছি, আপনি আমার রুমে একটু আসেন। মানুষটা তার সব কাজ ফেলে দিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে চলে এসেছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।”
“কী জিজ্ঞাসাবাদ করেছ?”
“বউ বাচ্চা কী করে। প্রিয় লেখক কে? এই সব–“
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “ছোটাচ্চু তোমার কথার কোনো মাথামুণ্ডু নাই। এসব কাজ করার জন্য কোনো কোম্পানি কাউকে ডাকে না।”
ছোটাচ্চু বুকে টোকা দিয়ে নাটকের ডায়ালগের ভঙ্গীতে গলা কাঁপিয়ে বলল, “এই বান্দাকে ডাকে। কারণ আমি যদু মধু না, আমি হচ্ছি বিখ্যাত তরুণ ডিটেকটিভ মিস্টার শাহরিয়ার! যার উপস্থিতিতে চোর-ডাকাত- ষড়যন্ত্রকারীরা থরথর করে কাঁপে-”
টুনি এবারে কাতর গলায় বলল, “ছোটাচ্চু প্লিজ প্লিজ তুমি ঠিক করে বল তোমাকে কেন এত টাকা ফি দিয়ে নিয়েছে, তোমার কী করতে হয়? তুমি কী করবে? প্লিজ প্লিজ–“
ছোটাচ্চুর তখন টুনির জন্য মায়া হলো। তাই শওকত সাহেব কেন তাকে তার কোম্পানিতে নিয়েছেন, তার কী করতে হবে সেটা অল্প কথায় বুঝিয়ে দিল। শুনে টুনি খুশিতে হাততালি দিয়ে বলল, “বাহ কী মজা! খালি তোমার চেহারা দেখিয়েই কাজ হয়ে যাবে?”
“শওকত সাহেব তো তাই মনে করেন।”
টুনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, “কিন্তু তুমি যদি আসলেই তার কোম্পানির দুই নম্বুরি মানুষগুলোকে ধরে ফেল তাহলে আরো মজা হবে, তাই না?“
“হবে। কিন্তু দরকার কী? দুই নম্বুরি মানুষ যদি ভয় পেয়ে দুই নম্বুরি কাজ না করে তাহলেই তো হলো!”
টুনি বলল, “তা ঠিক। কিন্তু–” টুনি থেমে গিয়ে কিছু একটা চিন্তা করতে লাগল।
ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী?”
“ছোটাচ্চু তুমি কী জান, গোপন কথাগুলো দুই নম্বুরি মানুষেরা কেমন করে জানে?”
ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “তার উপায় হচ্ছে তিনটা। কথাবার্তা গোপনে শোনা, কম্পিউটার থেকে জানা আর কাগজপত্র কিংবা ফাইল থেকে জানা। কথাবার্তা গোপনে শুনতে হলে গোপন মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে হবে, কম্পিউটারে দেখতে হলে হ্যাঁক করতে হবে, কাজেই সোজা পদ্ধতি হচ্ছে ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি।
টুনি মাথা নাড়ল। তারপর কিছু একটা চিন্তা করতে লাগল। চিন্তা করতে করতেই সে ছোটাচ্চুর ঘর থেকে বের হয়ে এল।
.
শওকত সাহেবের অফিসে কাজ করতে শুরু করার পর ছোটাচ্চু মাঝে মাঝেই বাচ্চাদের জন্য খাবার-দাবার নিয়ে আসতে থাকলো। সেটা নিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে অনেক আনন্দ কিন্তু দাদি (কিংবা নানি) প্রত্যেকবার ছোটাচ্চুকে দেখেন আর রেগে ওঠেন! ছোটাচ্চু মনে হয় তার মাকে রাগিয়ে এক ধরনের আনন্দ পেতে শুরু করেছে। চুল যতখানি এলোমেলো হলেই কাজ চলে যায় ইচ্ছে করে তার থেকে বেশি এলোমেলো করে রাখে! দাদির কাছে যাওয়ার আগে জামা কাপড় বদলে এলেই অনেক সমস্যা মিটে যায় কিন্তু ছোটাচ্চু সেটা করার চেষ্টা করে না। দাদি (বা নানি) যত রেগে চেঁচামেচি করেন ছোটাচ্চু তত জোরে হা হা করে হাসে!
টুনি প্রায় প্রত্যেকদিনই ছোটাচ্চুর কাছ থেকে খুঁটিনাটি খবর নেয়। তার থেকে খবর নিতে নিতে শওকত সাহেবের অফিসের অনেককেই সে চিনতে শুরু করেছে। নিচ তলার গার্ড নাকি সবসময় মিলিটারি কায়দায় সেল্যুট দেয় এবং তার চেহারাও মেজর জেনারেলের মতো। রিসেপশনিস্ট মেয়েটির হাসির রোগ আছে এবং সব সময় হি হি করে হাসছে। শওকত সাহেবের পার্সোনাল সেক্রেটারি সব সময় প্রমিত বাংলায় কথা বলে, বেশির ভাগ শব্দ নাক দিয়ে উচ্চারণ করে। একাউন্টেট ‘প’ উচ্চারণ করতে পারে না ‘প্রথম’কে বলে ‘ফ্রতম’। সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার একজন মহিলা, কখনও কথা বলে না, কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয় না। স্টোর কিপারের চেহারা রাসপুটিনের মতো। কাজেই ছোটাচ্চু যখন অফিসের গল্প করে তখন টুনি তাদের চিনতে কোনো ভুল করে না।
১০৯
তবে এই মানুষগুলো অফিসের মানুষ, তারা দুই নম্বুরি হলেও শতকত সাহেবের বিজনেসের জন্যে বিপজ্জনক নয়। তার বিজনেসের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে সবচেয়ে সিনিয়র কয়েকজন অফিসার। শওকত সাহেবের সাথে আলাপ আলোচনা করে সেরকম ছয়জন পাওয়া গেছে। টুনি এখন তাদের কথাও জেনে গেছে, তবে তাদের আসল নাম সে জানে না ৷ ছোটাচ্চু তাদেরকে যে নাম দিয়েছে সেই নাম দিয়ে চিনে। তারা হচ্ছে :
মি. নাদুস নুদুস : মানুষটা মনে হয় একটু মোটাসোটা সেইজন্য এই নাম! ছোটাচ্চু দাবি করে এই মানুষটা যখন হাসে তখন তার ভুঁড়িটা উপরে নিচে নাচে। এটা সত্যি সম্ভব কিনা টুনি জানে না, কিন্তু ছোটাচ্চু দাবি করেছে এটা সত্যি!
মি. চিকন-চাকন : একজন মিস্টার নাদুস নুদুস থাকলে একজন মিস্টার চিকন-চাকন থাকতেই হবে। তাই ছোটাচ্চু এই মানুষটাকে এই নামে ডাকে। মানুষটা আসলেই চিকন- চাকন কিনা টুনি জানে না, হয়তো মিস্টার নাদুস নুদুসের পাশে তাকে একটু শুকনো দেখায়।
খালাম্মা : খালাম্মাদের আলাদা কোনো চেহারা হয় কিনা কে জানে? টুনি অনেক কম বয়সী টিশটাশ খালা দেখেছে কিন্তু কোনো মহিলার বয়স একটু বেশি হলেই মনে হয় ছোটাচ্চু তাকে খালাম্মা ডাকে!
মি. ইটিস-মিটিস : এই মানুষটা নাকি সব সময় মুখ বাঁকা করে ইংরেজিতে কথা বলে। তাই তার নাম দেওয়া হয়েছে মিস্টার ইটিস-মিটিস। বাংলাতে যখন কথা বলে তখনও সেটাকে নাকি ইংরেজির মতো শোনায়!
মি. এলার্জি ম্যান : এই মানুষটা নাকি সব সময় হাঁচি দেয়, টিস্যু দিয়ে নাক মুছতে থাকে। তার হাতে নাকি সব সময় একটা টিস্যুর বাক্স থাকে। টিস্যু দিয়ে সব সময় ঘঁষাঘষির কারণে তার নাক নাকি টমেটোর মতো লাল হয়ে থাকে, তাই ছোটাচ্চু তার নাম দিয়েছে মিস্টার এলার্জি ম্যান!
মি. সিরিয়াল কিলার : ছোটাচ্চু দাবি করে এই মানুষটার চেহারা নাকি সিরিয়াল কিলারের মতো। টুনি তার আম্মুর ইংরেজি সাইকোলজির বইয়ে অনেকগুলো সিরিয়াল কিলারের ছবি দেখেছিল। চেহারা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে তারা সিরিয়াল কিলার। তাদের সবার হাসিখুশি ভালো মানুষের মতো চেহারা! কাজেই একজন মানুষের চেহারা কেমন করে সিরিয়াল কিলারের মতো হয় টুনি সেটা ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করেছিল। ছোটাচ্চু বলেছিল কোটরের ভিতরে ছোট ছোট চোখ, উঁচু চোয়াল আর চিকন ঠোঁট। মুখে কোনো হাসি নেই, তাকালেই নাকি ভয় লাগে।
কাজেই ছোটাচ্চুর কাছে টুনি এই মানুষগুলোর গল্প শোনে। কোনটা বিশ্বাস করবে কোনটা বিশ্বাস করবে না বুঝতে পারবে না। কারণ ছোটাচ্চুর গল্পগুলো হয় এরকম : “বুঝলি টুনি আজকে কী হয়েছে? আমি আমার অফিসে বসে কাজ করছি, টেবিলের উপর পা তুলে রেখেছি তখন হঠাৎ করে আমার অফিসে সিরিয়াল কিলার এসে ঢুকল। হাত পিছনে, আমি একেবারে শিওর ছিলাম সেই হাতে একটা পিস্তল। এক্ষুণি সেটা বের করে আমার মাথায় গুলি করবে দুম দুম দুম–আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য টেবিলের তলায় একটা ডাইভ প্রায় দিয়েই দিয়েছিলাম তখন সিরিয়াল কিলার বলল—”
টুনি ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী বলল?”
“বলল গুড মরনিং শাহরিয়ার সাহেব। “
“ব্যস? আর কিছু না?”
“নাহ। আর কিছু না।”
গল্পের কোনো মাথা মুণ্ডু নেই। একদিন ছোটাচ্চু বলল, “আজকে খালাম্মা অফিসে আমাকে একটা ঝাড়ি দিল!”
টুনি বলল, “ঝাড়ি দিল? খালাম্মা?”
“হ্যাঁ।”
“কী বলে ঝাড়ি দিয়েছে?”
“আমার অফিসে এসে বলেছে, এতো গরম পড়েছে আপনি এসি চালাচ্ছেন না কেন? “
“এইটা ঝাড়ি?”
“অফ কোর্স এইটা ঝাড়ি। আমার ব্যক্তিগত কাজকর্মে আরেকজন কথা বলবে কেন?”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী বলেছ?”
“আমি কিছু বলি নাই, এসিটা চালু করে দিয়েছি। তারপর খালাম্মা চলে গেলে আবার এসি বন্ধ করে দিয়েছি।”
টুনি এই গল্পেরও কোনো মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না। তারপর একদিন ছোটাচ্চু বলল, “আজকে করিডোরে মিস্টার ইটিস-মিটিসের সাথে দেখা।”
টুনির পরের অংশটা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ছোটাচ্চু আর কিছু বলল না দেখে টুনি নিজেই জিজ্ঞেস করল, “তারপর?”
“ইটিস-মিটিস বলল ইটিস মিটিস কিটিস চিটিস…”
“মানে?”
“মানে জানি না।”
“তখন তুমি কী করলে?”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি বললাম কিটিস মিটিস টিটিস ফিটিস..”
“তার মানে?
“জানি না!”
টুনি হা করে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চুর গল্পগুলো তার মতোই মাথামুণ্ডুহীন!
.
দুদিন পর টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে গিয়ে তাকে একটা ছোট শিশি দিয়ে বলল, ছোটাচ্চু, “এইটা আমি তোমার জন্য রেডি করেছি।”
ছোটাচ্চু শিশিটা হাতে নিয়ে বলল, “এইটা কী?’
“মশা।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে দেখল শিশিটার তলায় সত্যি সত্যি বেশ কিছু মশা মরে পড়ে আছে। অবাক হয়ে বলল, “মশা? মশা কী জন্য?”
“মনে আছে তুমি বলেছিলেন দুই নম্বুরি মানুষেরা গোপন খবরগুলো পায় ফাইল থেকে?”
“হ্যাঁ। মনে আছে।”
টুনি বলল, “এটা সত্যি কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য এই মশা।”
“মশা দিয়ে কীভাবে পরীক্ষা করা হবে?”
“তুমি ফাইলের ভেতরে পয়লা পৃষ্ঠায় কয়েকটা মশা দিয়ে রাখবে। কেউ ফাইল খুলে নাড়াচাড়া করলে মশা নিচে পড়ে যাবে। তাই তুমি পরে ফাইল খুলে দেখবে মশা আছে নাকি নেই। যদি না থাকে তাহলে বুঝতে পারবে কেউ ফাইল খুলে নাড়াচাড়া করেছে।”
ছোটাচ্চু চোখ বড় বড় করে বলল, “তোর ধারণা এটা কাজ করবে?”
“কেন করবে না? চেষ্টা করে দেখ। শুধু শওকত সাহেবকে আগে থেকে বলে রেখো, ফাইলগুলো খোলার সময় যেন সাবধানে খুলেন, মশাগুলো যেন আবার আগের মতো রেখে দেন।“
.
পরের দিন ছোটাচ্চু শওকত সাহেবের অফিসে গেল একটা শার্ট পরে তবে তার গলায় একটা টকটকে লাল গামছা ঝুলছে। তাকে দেখে গার্ড একটু হকচকিয়ে গেলেও বিশাল বড় একটা সেল্যুট দিল। রিসেপসনিস্ট মেয়েটি তার অভ্যাস মতো হি হি করে হাসতে লাগল। শাহরিয়ার বলল, কেন?”
মেয়েটি এই কয়দিনে শাহরিয়ারের সাথে অনেক সহজ হয়েছে। হাসি থামিয়ে বলল, “গামছাটা আপনাকে অনেক মানিয়েছে।”
ছোটাচ্চু বলল, “শুধু তোমাদের শাড়ির আঁচল থাকবে, ওড়না থাকবে আর আমাদের কিছু থাকবে না এটা হতে পারে না। এটা আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য।”
করিডোরে সিরিয়াল কিলারের সাথে দেখা হলো, সে কিছু না বলে সরু চোখে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু থেমে গিয়ে বলল, “কিছু বলবেন?”
সিরিয়াল কিলার বলল, “আপনার গামছার রংটা খুব সুন্দর।
ছোটাচ্চু বলল, “আপনার টাইয়ের রংটাও সুন্দর।”
সিরিয়াল কিলার বলল, “থ্যাংক ইউ।” তারপর হেঁটে চলে গেল।
যখন শওকত সাহেবের রুমে কেউ নেই তখন ছোটাচ্চু তার অফিসে গেল। শওকত সাহেব হাসি হাসি মুখে বললেন, “তোমার নতুন পোশাকে খুব মানিয়েছে শাহরিয়ার। গুড আইডিয়া।“
“থ্যাংক ইউ। কিন্ত আইডিয়ায় টানাটানি পড়ে যাচ্ছে।”
“সমস্যা নেই। এক আইডিয়া অনেকদিন চালানো যায়।”
হাতের কাগজটা টেবিলে রেখে বললেন, “কিছু বলবে।”
“জী।“
“বস। বসে বল।”
ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আপনার গোপন তথ্য বের হওয়ার যে পথগুলো আছে সেগুলো এখন একটা একটা করে পরীক্ষা করে দেখতে চাই। শুরু করব ফাইল দিয়ে।”
শওকত সাহেব বললেন, “ভেরি গুড।”
ছোটাচ্চু পকেট থেকে টুনির দেওয়া শিশিটা বের করে বলল, “ফাইলের মাঝে সেনসিটিভ ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস লাগানো যায় কিন্তু আমি তার বদলে চেষ্টা করতে চাই দেশীয় প্রযুক্তি। মশা।”
শওকত সাহেব চোখ কপালে তুলে বললেন, “মশা?”
“জী।” ছোটাচ্চু শিশিটা দেখিয়ে বলল, “অনেকগুলো মশা মেরে এই শিশিতে করে নিয়ে এসেছি। আপনার যতগুলো গোপন ফাইল আছে আমি সেই ফাইলগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় কয়েকটা করে মশা দিয়ে রাখব। যদি কেউ ফাইলগুলো নাড়াচড়া করে তাহলে মশাগুলো পড়ে যাবে। আমরা বুঝব কেউ না কেউ ফাইল খুলেছে–”
শওকত সাহেব বললেন, “কিন্তু আমি নিজেই মাঝে মাঝে ফাইলগুলো খুলি। মাঝে মাঝে বাসাতেও নিই।”
আপনি যেহেতু জানেন তাই ফাইলগুলো খুব সাবধানে খুলবেন। বন্ধ করার সময় মশাগুলো আগের জায়গায় রেখে তারপর ফাইলটা বন্ধ করবেন।”
“ঠিক আছে শাহরিয়ার। আমি চেষ্টা করব তোমার মূল্যবান মশাগুলো রক্ষা করে ফাইলগুলো খুলতে এবং বন্ধ করতে!”
“এখন তাহলে আপনার গোপন ফাইলগুলো বের করেন, আমরা মশা দিয়ে রেডি করে নিই।
শওকত সাহেব চাবি বের করে তার ফাইল কেবিনেট খুলে অনেকগুলো ফাইল বের করলেন, বেশির ভাগ ফাইলের উপর লেখা গোপনীয়। অনেকগুলো ফাইলের ভেতর থেকে গোপনীয় লেখা লাল স্টিকার বের হয়ে আছে। ছোটাচ্চু আর শওকত সাহেব মিলে ফাইলের গোপনীয় অংশগুলো বের করে সেখানে গুণে গুণে পাঁচটা মশা রেখে ফাইল বন্ধ করে দিতে লাগলেন। তারপর সবগুলো আবার ফাইল কেবিনেটে রেখে সেটা তালা বন্ধ করে দেওয়া হলো।
ছোটাচ্চু বাসায় তার লাল গামছা গলায় বাচ্চাদের সাথে কথা বলছিল। বাচ্চারা সবাই গামছাটা পছন্দ করেছে এবং ছোটাচ্চুকে অনুরোধ করেছে তাদের সবাইকে একটা করে গামছা কিনে দেওয়ার জন্য। ছোটাচ্চু রাজি হয়েছে কিন্তু বলেছে তার আগে সবার বাবা মায়ের কাছ থেকে লিখিত চিঠি আনতে হবে যে এ ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
দাদি তার সিরিয়াল দেখার ফাঁকে এই কথাটা শুনে ফেলে রেগে উঠলেন, বললেন, “বাচ্চাদের সবার চিঠি আনতে হবে? আর তুই গলায় গামছা দেওয়ার আগে আমার কাছ থেকে চিঠি নিয়েছিস?”
ছোটাচ্চু হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমি তো বড় হয়ে গেছি!”
দাদি (কিংবা নানি) আরো রেগে উঠলেন, বললেন, “তুই বড় হয়ে গেছিস? আমাকে সেই কথা বিশ্বাস করতে বলিস?”
ছোটাচ্চু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন তার টেলিফোনটা বেজে উঠল। ছোটাচ্চু দেখল শওকত সাহেব ফোন করেছেন। এতো রাতে শওকত সাহেব কেন ফোন করেছেন ছোটাচ্চু অনুমান করতে পারল না। টেলিফোনটা কানে লাগিয়ে সে কথা বলার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বলল, “হ্যালো”
ছোটাচ্চু শুনল শওকত সাহেব উত্তেজিত গলায় বলছেন, “তুমি বিশ্বাস করবে না কী হয়েছে।”
“কী হয়েছে?”
“কাল পরশু ছুটি দেখে আমি আমার পাঁচটা ফাইল বাসায় এনেছি। সবগুলো গোপন ফাইল। গাড়ি থেকে নামার সময় আমি একটা ফাইল হাতে করে নিয়ে ড্রাইভারকে বলেছি বাকি ফাইলগুলো নামিয়ে নিতে। ড্রাইভার বলেছে সে গাড়িটা গ্যারাজে রেখে ফাইলগুলো নিয়ে আসছে। তারপর কী হয়েছে জান?”
ছোটাচ্চু বলল, “কী হয়েছে?
শওকত সাহেব উত্তেজিত গলায় বললেন, “যে ফাইলটা আমি হাতে করে এনেছি সেটার ভেতর মশাগুলো আছে। পাঁচটাই। আর ড্রাইভার যেগুলো নামিয়েছে তার ভেতর কোনো মশা নেই, একটার ভেতরে শুধু একটা আধমরা মশা ঝুলে আছে।”
“তার মানে? ড্রাইভার?”
“হ্যাঁ। আমার ড্রাইভার হচ্ছে ঘরের শত্রু বিভীষণ। সে ফাইলগুলো খুলে দেখেছে! কিন্তু এই ড্রাইভার লেখাপড়া জানে না, ফাইল দেখে সে কী বুঝবে?”
ছোটাচ্চু বলল, “আপনি বুঝতে পারছেন না? তার কাছে নিশ্চয়ই ভালো ক্যামেরা আছে! সে ঝটপট ছবি তুলে নিয়েছে, অন্য কাউকে সে ছবিগুলো পাঠায়!”
শওকত সাহেব চিৎকার করে বললেন, “ইয়েস! আমি দেখেছি তার কাছে মহা দামি মোবাইল। আমি তখনই তাকে জিজ্ঞেস করেছি এতো দামি মোবাইল দিয়ে তুমি কী কর? সে অ্যাঁ অ্যাঁ করে কথা ঘুরিয়ে ফেলল। ব্যাটা বদমাইশ। আমার টাকায় সে আমার সাথে দুই নম্বুরি? ডি.এম.পি. কমিশনার আমার বন্ধু–আমি এক্ষুণি তাকে ফোন করছি– ধরে নিয়ে যাক–“
ছোটাচ্চু হা হা করে উঠল, বলল, “না, না, না–ড্রাইভার ইম্পরট্যান্ট না, তাকে যে ব্যবহার করছে সে হচ্ছে ইম্পরট্যান্ট!”
“ড্রাইভারকে ধরে কেঁচকি দিলে সব বের হয়ে যাবে–
ছোটাচ্চু বলল, “না, না–আপনি কিছু করবেন না। এমন ভান করেন যে কিছুই হয়নি। কেউ যেন কিছু সন্দেহ না করে। প্রথম স্টেপ শেষ হয়েছে এখন সেকেন্ড স্টেপ!”
শওকত সাহেবের মনে হলো একটু মন খারাপ হলো, বললেন, “কিছু করব না? ডেকে ধমকও দিতে পারব না?”
“না না। আসল ক্রিমিনালকে সাবধান হতে দেবেন না। কেউ যেন কিছু সন্দেহ না করে
শওকত সাহেব মনমরা হয়ে বললেন, “ঠিক আছে! তুমি যদি তাই বল। তুমি হচ্ছ ডিটেকটিভ!”
ছোটাচ্চু ফোন পকেটে রেখে দাদির ঘরে গেল। শান্ত তার ডান পা’টা ঘাড়ের উপরে তোলার চেষ্টা করছে। অন্যেরা তাকে উৎসাহ দিচ্ছে। ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?”
টুম্পা বলল, “যোগ ব্যায়াম।”
ছোটাচ্চু ধমক দিয়ে বলল, “এটা কী রকম যোগ ব্যায়াম?”
শান্ত বলল, “এটার নাম কর্কট আসন। এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আরেকটা পা ঘাড়ের উপর তুলতে হয়।”
ঝুমু খালা দাদির পায়ের কাছে বসে দাদির (কিংবা নানির) সাথে সিরিয়াল দেখছিল, এবারে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঘাড়ের উপর ঠ্যাং তোলা ঠিক না। আমাগো গ্রামে একজন একবার তার ঠ্যাং ঘাড়ে তুলেছিল তারপর আর নামাতে পারে নাই। “
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হয়েছে?”
“ঐ রকমই আছে।”
“ঐ রকমই আছে?”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল। বলল, “এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এক পা ঘাড়ে নিয়েই থাকে, অন্য পা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলাচল করে। লোকজন দেখতে আসে। ভালো ইনকাম। বিয়ে-শাদী করেছে। বাচ্চা কাচ্চা আছে।“
ঝুমু খালার কথা শুনে বাচ্চা-কাচ্চারা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। ঝুমু খালা বলল, “কী হলো? আমার কথা বিশ্বাস হলো না? চল আমাগো গ্রামে।”
ছোটাচ্চু বলল, “থাক! এখন কারো ঘাড়ে ঠ্যাং তোলার দরকার নাই আর কারো গ্রামে যাওয়ারও দরকার নাই!” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “টুনি, তোর খেলা শেষ হলে আমার রুমে একবার আসিস।”
সব বাচ্চা তখন জানতে চাইল, “কেন? কেন টুনি একা তোমার রুমে যাবে? আমরা কেন যেতে পারব না?”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে, চাইলে তোরাও আসিস।”
ছোটাচ্চু তখন পুরো বাচ্চাদের দলকে নিয়ে নিজের রুমে রওনা দিল। ঝুমু খালা বলল, “শেষ পর্যন্ত একটু শান্তিমতো সিরিয়ালটা দেখতে পারমু। এই পোলাপানের ক্যাচম্যাচ ক্যাচমেচের যন্ত্রণায় একটা জরুরি কাম পর্যন্ত করতে পারি না।”
ছোটাচ্চুর ঘরে যাবার পর ছোটাচ্চু তার চেয়ারে পা তুলে বসল। বাচ্চারা কেউ বিছানায়, কেউ দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ছোটাচ্চু গলা খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল, “তোরা সবাই জানিস শওকত সাহেব তার ফার্মে আমাকে সিকিউরিটি কনসালটেন্ট হিসেবে রেখেছেন। তার ফার্মে কিছু বড় সমস্যা হচ্ছিল, গোপন তথ্য পাচার হয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত একটা মেজর ব্রেকথ্রু হয়েছে। কীভাবে গোপন তথ্য পাচার হয়ে যাচ্ছে সেটা ধরা গেছে।”
বাচ্চারা চিৎকার করে বলল, “ইয়া ইয়া ইয়াহু … জয় জয় ছোটাচ্চুর জয় ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক–”
ছোটাচ্চু একটু ইতস্তত করে বলল, “বুদ্ধিটা অবশ্য টুনির, টুনি খুব সুন্দর একটা আইডিয়া দিয়েছিল মশা দিয়ে।”
বাচ্চারা আবার চিৎকার করল। “জয় জয় টুনি আপুর জয়, জয় জয় মশার জয়-ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক–”
কে ধ্বংস হোক কেন ধ্বংস হোক সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না। চিৎকার করলেই শেষে ‘ধ্বংস হোক’ বলা সবার অভ্যাস হয়ে গেছে, ভালো হোক খারাপ হোক সেটা বিষয় নয়।
মশা দিয়ে কীভাবে শওকত সাহেবের ড্রাইভারকে ধরা হয়েছে ছোটাচ্চু সবাইকে তার কাহিনী বলল। এখনও যে আসল মানুষকে ধরা হয় নাই সেটাও সবাই জেনে গেল। বাচ্চারা তখন চেঁচামেচি শুরু করল, সবার আগে সবচেয়ে গলা উঁচিয়ে কথা বলল শান্ত, “ছোটাচ্চু তুমি এখনো বসে আছে কেন? ড্রাইভারকে ধরে আন? হুমকি ধামকি দাও। তুমি যদি না পার আমাকে বল, আমি খুব ভালো হুমকি ধামকি দিতে পারি। সেইদিন রাস্তায়–” শান্ত হঠাৎ করে থেমে গেল।
“রাস্তায় কী?”
শান্ত উদাস মুখে বলল, “না, কিছু না।”
বোঝা গেল সেইদিন রাস্তায় শান্ত যে ঘটনাটা ঘটিয়েছে সেটা সবার সামনে বলার মতো না।
বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হচ্ছে মুনিয়া। সে বলল, “হুমকি ধামকিতে কাজ হবে না। বাঁশ ডলা দিতে হবে, বাঁশ ডলা দিলে সবকিছু বলে দিবে।”
“বাঁশ ডলা কীভাবে দেয়?”
“জানি না।”
“তাহলে?”
“ঝুমা খালার কাছে শুনেছি। ঝুমু খালার গ্রামে কারো কাছ থেকে কথা বের করতে হলে তাকে বাঁশ ডলা দেয়।”
ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “ঝুমু কী বলে না বলে তার কোনো মাথামুণ্ডু নাই। “
প্রমি বলল, “পুলিশ দিতে ঝামেলা কী? পুলিশ বের করে নিবে শাহানা বলল, “লাই ডিটেক্টর লাগিয়ে দুই একটা প্রশ্ন করলেই তো হয়। কোর্ট অবশ্য এটা মানবে না—”
আরো অনেক রকম আলোচনা এবং অনেক রকম উপদেশ দিয়ে সবাই চলে গেল। যাওয়ার আগে এক বিষয়ে সবাই একমত হলো, ছোটাচ্চু যে টাকাটা পাচ্ছে তার অর্ধেক টুনিকে দিতে হবে। টুনিকে বলা হলো, এতো টাকা দিয়ে সে কী করবে? সেটা সে সব বাচ্চাদের মাঝে সমানভাবে ভাগ করে দিতে পারে।
পুরো সময়টাতে টুনি কোনো কথা বলেনি। সবাই চলে গেলে টুনি বলল, “তুমি যে শওকত সাহেবকে বলেছ ব্যাপারটা গোপন রাখতে, কেউ যেন কিছু সন্দেহ না করে সেটা খুবই ভালো একটা কাজ হয়েছে।
ছোটাচ্চু বলল, “তাড়াহুড়া করার কোনো দরকার নেই।”
টুনি বলল, “হ্যাঁ। তাছাড়া বিষয়টা এখনো ঠিকভাবে প্রমাণ হয় নাই। এমনও তো হতে পারে ড্রাইভার ফাইলগুলো নেওয়ার সময় খাড়াভাবে ধরে নিয়েছে। ঝাঁকাঝাঁকি করেছে তাই মশাগুলো পড়ে গেছে, আসলে সে নির্দোষ তাই ব্যাপারটা আরো ঠিকভাবে পরীক্ষা করতে হবে।”
ছোটাচ্চু গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “আমিও তাই ভাবছিলাম।”
ছোটাচ্চুর মুখে দেখে অবশ্য বোঝা গেল ছোটাচ্চু আসলে মোটেও সেটা ভাবছিল না কিন্তু টুনি সেটা বলল না। টুনি বলল, “আমার কী মনে হয় জান ছোটাচ্চু, এখন খারাপ মানুষটাকে ফাঁদে ফেলতে হবে।”
ছোটাচ্চু বলল, “ফাঁদ। ইয়েস। কঠিন ফাঁদে ফেলতে হবে।”
“কীভাবে ফাঁদে ফেলা যায় চিন্তা করেছ?”
“এখনও চিন্তা করি নাই। চিন্তা করতে হবে। তুই কিছু চিন্তা করেছিস?”
টুনি বলল, “আমি একটা চিন্তা করেছিলাম-
ছোটাচ্চু আগ্রহ নিয়ে বলল, “কী চিন্তা করছিলি?”
“মনে করো শওকত সাহেব একটা গোপন ফাইল বাসায় নিয়ে গেছেন, সেই গোপন ফাইলে কিছু একটা কথা লেখা থাকলো যেটা আসলে মিছিমিছি লেখা হয়েছে। সেটাকে সত্যি মনে করে কাজ করতে গিয়ে সেই লোকটা ধরা পড়ে গেল।”
“ইয়েস! ইয়েস! গুড আইডিয়া। মিছিমিছি কী লেখা যায় বল দেখি।”
টুনি একটু চিন্তা করে বলল, “ছোট বাচ্চা হলে বলতে পারতাম। যেমন তাহলে লেখা যেতো, ভালো বাচ্চারা শুধু চকলেট খায় কিংবা ভালো ছেলেরা শুধু সায়েন্স ফিকশন পড়ে কিংবা ভালো ছেলেরা শুধু দাবা খেলে, তারপর দেখতাম হঠাৎ করে কেউ শুধু চকলেট খাচ্ছে কিনা, সায়েন্স ফিকশান পড়ছে কিনা কিংবা দাবা খেলা শুরু করেছে কিনা!”
ছোটাচ্চু বলল, “বুঝেছি। তুই আসলে মানুষটার চালচলনের একটা পার্থক্যের কথা বলছিস!”
“আমি ঠিক জানি না এইটাই সবচেয়ে ভালো আইডিয়া কিনা, তুমি চিন্তা করে দেখো। ফারিহাপুর সাথেও কথা বলা যায়। এই রকম আইডিয়া ফারিহাপুর খুব ভালো।”
“ঠিকই বলেছিস, এগুলোর ব্যাপারে ফারিহার আইডিয়া খুব ভালো। দেখি ফারিহার সাথে কথা বলে দেখি।”
.
ফারিহার সাথে কথা বলে ছোটাচ্চু শওকত সাহেবকে একটা ভূয়া রিপোর্ট দিল। শওকত সাহেবের ফার্মটা কীভাবে আরো ভালোভাবে চালানো যায় শুরুতে তার ওপর বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। যারা কাজ করে তার মাঝে কারা বিশ্বাসী এবং কাদেরকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না, তার ওপর একটা চ্যাপ্টার রয়েছে। কাদেরকে বিশ্বাস করা যায় মনোবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গীতে তাদের প্রোফাইল কেমন হয় সেই চ্যাপ্টারটি এরকম :
ক. যারা সৎ এবং বিশ্বাসী তারা সাধারণত নীল রং পছন্দ করেন এবং নীল রঙের কাপড় পছন্দ করেন। এই বিষয়টি জন হপকিন্সের ল্যাবরেটরির একটি গবেষণায় দেখা গেছে। তথ্য সূত্র : (এর পরে একটা ভূয়া রেফারেন্স)
খ. কার্নেগি মিলানের মনোবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণায় দেখা গেছে (তথ্য সূত্র : এখানে ভূয়া একটি তথ্য সূত্র) সৎ এবং বিশ্বাসী মানুষেরা শিশুদের জন্য লেখা বই পড়তে পছন্দ করেন। তারা প্রায় সর্বক্ষণ রোল্ড ডাল, মার্ক টোয়েন, জে কে রোলিংস এদের লেখা বই নিজেদের কাছে রাখেন।
গ. নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অভ মেডিকেল সায়েন্সে প্রকাশিত গবেষণা পত্র অনুযায়ী (একটি ভূয়া রেফারেন্স) যারা নিজের মস্তিষ্ক সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন তারা কফির পরিবর্তে লেবু চা গ্রহণ করে থাকেন।
চ্যাপ্টারটি এখানেও শেষ হয়নি এরপর এরকম আরো তিনটি বিষয় বলা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে খাবারে শর্করাজাতীয় খাবার উল্লেখযোগ্যভাবে কম, যোগ ব্যায়াম করা এবং ক্লাসিক্যাল মিউজিক শোনা।
এই রিপোর্টটা একটা ফাইলের মাঝে রেখে ফাইলের উপরে বড় বড় করে লেখা হলো ‘একান্ত গোপনীয়’ তারপর ফাইলটা শওকত সাহেবকে দেওয়া হলো। তাকে বলা হলো তিনি যেন ভুল করে ফাইলটা গাড়িতে ফেলে চলে যান এবং ড্রাইভার যেন পরে এসে তাকে ফাইলটা দেয়। ড্রাইভারকে অনেক সময় দেওয়া হবে যেন সে চাইলে ভালো করে ফাইলের ভিতরে ছোটাচ্চু রিপোর্টটা ছবি তুলে যার কাছে পাঠানোর কথা সেখানে পাঠাতে পারে।
.
এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। শওকত সাহেব ফারিহাকেও ডেকে পাঠিয়েছেন। ফারিহা শওকত সাহেবের অফিসে গিয়ে দেখল সেখানে ছোটাচ্চু এবং আরো কয়েকজন বসে আছে। তাদের এক নজর দেখেই সে বুঝতে পারল এই ছয়জন নিশ্চয়ই সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের ছয়জন। ছোটাচ্চু টুনিকে যেভাবে এই মানুষগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, ফারিহাকেও ঠিক সেভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তাই তাদের দেখেই ফারিহার হাসি পেয়ে গেল। কারণ সত্যি সত্যি একজন মোটাসোটা, একজন হালকা পাতলা–ছোটাচ্চুর ভাষায় মি. নাদুস-নুদুস এবং মি. চিকন-চাকন। সত্যি সত্যি একজন–নাকে টিস্যু চেপে হাঁচি দিল, খালাম্মাকেও চিনতে পারল। অন্য দুইজনের একজন নিশ্চয়ই ছোটাচ্চুর সিরিয়াল কিলার আর ইংরেজি বলা ইটিস-মিটিস!
ফারিহাকে দেখে শওকত সাহেব একেবারে দাঁড়িয়ে উঠে তাকে নিয়ে এসে তার পাশে বসালেন। খুশিতে টগবগ করতে করতে বললেন, “শাহরিয়ার বলেছে তার রিপোর্টটা লিখতে তুমি সাহায্য করেছ। সেই জন্য আমি তোমাকেও ডেকেছি। তোমাদের রিপোর্টটা অসাধারণ কাজ করেছে!”
“কাজ করেছে?”
“হ্যাঁ।”
মি. নাদুস-নুদুস জিজ্ঞেস করল, “কোন রিপোর্ট স্যার?”
শওকত সাহেব হাসিহাসি মুখে বললেন, “এটা আপনাদের জানার কথা না। খুবই সিক্রেট রিপোর্ট, শুধু আমি দেখেছি। এবং–”
মি. চিকন-চাকন জিজ্ঞেস করল, “এবং?”
“এবং আপনাদের ভিতর থেকে যদি কেউ আমার গোপন রিপোর্ট লুকিয়ে দেখে থাকেন। দেখেছেন নাকি?”
সবাই মাথা নাড়ল। একজন বলল, “না স্যার কেমন করে দেখব?”
“সেখানে লেখা ছিল, “সৎ এবং বিশ্বাসী মানুষেরা নীল কাপড় পরে, বাচ্চাদের বই পড়ে, লেবু চা খায়!”
ছোটাচ্চু বলল, “সব ভূয়া। বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি।”
শওকত সাহেব মি. এলার্জিম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি কিন্তু বুঝেন নাই এটা একটা ট্র্যাপ! ভূয়া। বিশ্বাস করে বসে থেকে নীল শার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হাতের বইটা হ্যারি পটারের বই না? বাচ্চাদের বই। চাটাও নিশ্চয়ই লেবু চা?”
মি. এলার্জিম্যানের নাকটা সাধারণত লাল হয়, এখন পুরো মুখটাই লাল হয়ে উঠল। থমথমে গলায় বলল, “স্যার! আপনি কী বলছেন স্যার? আপনি কী বোঝাতে চাইছেন আমি গোপনে আপনার ফাইল পড়ি?”
শওকত সাহেব বললেন, “আই অ্যাম সরি। আমার ভুল হতেও পারে। সবাই কখনো না কখনো নীল সার্ট পরে। হ্যারি পটার কে পড়ে নাই! সর্দি কাশি হলে লেবু চা খুবই উপকারী। আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলাটা আমার ভুল হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না।” শওকত সাহেব হঠাৎ সুর পাল্টে বললেন, “তবে—”
সবাই চুপ করে রইল। শওকত সাহেব সবার মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে বললেন, “তবে আমার ড্রাইভার ব্যাটা ভারী বজ্জাত। গোপনে আমার টপ সিক্রেট ফাইলের ছবি তুলে রেখেছে। পুলিশকে জানিয়েছিলাম। আজ সকালে তাকে জেরা করতে নিয়ে গেছে। সেখান থেকে জানিয়েছে তার মোবাইলে আমার ফাইলের ছবি পাওয়া গেছে। যার কাছে পাঠিয়েছে তার নম্বরও পেয়েছে। বারোটার সময় ড্রাইভারের নম্বর থেকে সেই নম্বর ফোন দেবে। বারোটা কী বেজেছে?”
মি. নাদুস-নুদুস বলল, “আর দুই মিনিট স্যার।
মি. এলার্জিম্যান হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “আমার একটা জরুরি কাজ আছে স্যার। এক্ষুণি যেতে হবে।”
“অবশ্যই যাবেন, কিন্তু দুই মিনিট পরে। বসেন।” এলার্জিম্যান বসল না, চলে যেতে চেষ্টা করল, তখন সিরিয়াল কিলার হুংকার দিয়ে বলল, “স্যার আপনাকে বসতে বলেছে শুনেন নাই? আপনি কি চান আমি আপনকে ধরে এনে জোর করে বসাই?”
মি. এলার্জিম্যান এবারে এসে তার চেয়ারে মাথা নিচু করে বসল। ঘরে কেউ কোনো কথা বলছে না, একেবারে সত্যিকারের পিনপতন নিঃশব্দতা। ঠিক তখন মি. এলার্জিম্যানের টেলিফোনটা বেজে উঠল, শওকত সাহেব শান্ত গলায় বললেন, “দেখেন তো কে টেলিফোন করেছে। আমার ড্রাইভার কিনা-
ফারিহা তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার মনে হয় আমার এখানে থাকা ঠিক হবে না, যদি অনুমতি দেন আমি যেতে চাই।”
ছোটাচ্চু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “সেটাই ভালো, আমিও ফারিহাকে পৌঁছে দেই।”
শওকত সাহেব কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন, তারপর বললেন, “ঠিক আছে পরে কথা হবে।“
.
এক সপ্তাহ পরে একটা আইসক্রিম পার্লারে শওকত সাহেব তার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। ছোটাচ্চুর ফারিহা এবং টুনিকে নিয়ে আসার কথা কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাসার সব বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে!
শওকত সাহেব সব বাচ্চাদের জন্য গিফট কিনে রেখেছেন। কোনটা কার বলা নেই, যার যেটা ইচ্ছা সেটা নিতে পারে। বার্গার খাওয়ার পর আইসক্রিম খাওয়া হবে তার আগে গিফট খোলা যাবে না। নানা সাইজের বাক্স, কোনটার ভিতরে কী আছে কেউ জানে না তারপরেও কে কোনটা নেবে আগে থেকে ঠিক করার চেষ্টা করছে।
কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে বাক্স নিয়ে প্রচণ্ড কাড়াকাড়ি এবং মারামারি হবে। আইসক্রিম পার্লারে সেটা নিয়ে ভয়ংকর টেনশান!
টুনির ভিতরে অবশ্য কোনো টেনশন নেই। তার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য শওকত সাহেব সব বাচ্চাদের এখানে নিয়ে এসেছেন। কাজেই তার ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করা মানায় না।
সে বার্গারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে একটা মশার পিনপিন শব্দ শুনল। এতো হাইফাই আইসক্রিম পার্লারে একটা মশা ঢুকে গেছে, মশাটা খুবই চালু তাতে সন্দেহ নেই। মশাটা টুনির হাতে বসেছে এক থাবায় সেটাকে শেষ করে দেওয়া যায়। টুনি অবশ্য মশাটাকে শেষ করল না, টোকা দিয়ে উড়িয়ে দিল। এই মশা দিয়ে সে রহস্যভেদ করেছে তাই তাদেরকে একটু মায়া নিশ্চয়ই করা যায়।