৪. কাচু কবিরাজ
দাদির (কিংবা নানির) ঘরে ঢুকেই টুনি ঝট করে ঘুরে বের হয়ে আসতে চাইছিল কিন্তু পারল না। দাদি বললেন, “এই টুনি! শুনে যা।”
টুনিকে বাধ্য হয়ে ঢুকতে হলো। টুনি যে কারণে বের হতে চাইছিল সেই মানুষটি একটি চেয়ারে একটা পা তুলে বসে আছে। থুতনিতে ছাগল দাড়ি, গলায় মাফলার প্যাচানো। মুখে পান, সেটা বিপজ্জনকভাবে চিবিয়ে যাচ্ছে, পাশে একটা স্যুটকেস। টুনি শেষবার কবে এরকম স্যুটকেস দেখেছে মনে করতে পারে না। স্যুটকেসের পাশে দুইটা মুরগি, পা বাঁধা মুরগি দুটো উল্টো হয়ে ঝুলে আছে। এর মধ্যে যদি দাদির ঘরে বাথরুম করে না থাকে যে কোনো সময় করে ফেলবে।
গ্রাম থেকে দাদির কাছে প্রায়ই এরকম মানুষ আসে। কেউ চিকিৎসার জন্য আসে, কেউ মামলার জন্য, কেউ মোবাইল ফোন কেনার জন্য। একবার একজন এসেছিল চিড়িয়াখানা দেখার জন্য। দাদির (কিংবা নানির) অসীম ধৈর্য্য, যে যেটা করতে চায় কীভাবে কীভাবে জানি সেটা করিয়ে ফেলেন!
এই মানুষটার স্যুটকেস দেখে বোঝা যাচ্ছে কিছুদিন থাকার জন্য এসেছে। মুরগি দুটো দেখে বোঝা যাচ্ছে খালি হাতে আসা ভালো দেখায় না বলে মানুষটি এই মুরগিগুলো এনেছে।
দাদি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই মানুষটা বলল, “এইডা কেডা? শাহানা? ইয়া মাবুদ, বড় হয় নাই দেখি। চিমসে লাইগা আছে? মাছ গোশত খায় না?”
টুনি আপত্তি করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না। এই মানুষটাকে কিছু বলার মনে হয় কোনো মানে হয় না।
দাদি বললেন, “না, না। এইটা শাহানা না। শাহানা তো আমার সবচেয়ে বড় নাতনি। এ অনেক ছোট।”
মানুষটা মুখটা একটু উপরে তুলে বলল, “নাম কী? বয়স কত?”
মুখটা উপরে তুলে রাখার জন্য পানের পিকটা মুখ থেকে বের হয়ে তার থুতনি, দাড়ি কিংবা গলার মাফলারে মাখামাখি হয়ে গেল না। মুখের ভেতরে সেটা ছলাৎ ছলাৎ করতে লাগল।
টুনি উত্তর দেওয়ার আগেই দাদি বললেন, “আমরা টুনি বলে ডাকি মনে হয় তেরো বছর বয়স হলো। তাই না রে টুনি?”
টুনি মাথা নাড়ল। মানুষটা পানের পিকটা রক্ষা করে মুখের পানটা কয়েকবার চিবিয়ে নিয়ে বলল, “ইয়া মাবুদ! তেরো বছর তো বালেগা। বিয়ার বয়স। আমার মেয়ের বিয়া দিছি।”
বালেগা শব্দের অর্থ টুনি জানে না, কিন্তু মনে হলো শব্দটা বড় হওয়া বোঝায়। শব্দটার ব্যবহারটা টুনির মোটেও পছন্দ হলো না। টুনি এই প্রথম কথা বলল, “আঠারো বছরের আগে বিয়ে দেওয়া বেআইনি। আপনাকে পুলিশের ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। নেয় নাই?”
মানুষটা থতমত খেয়ে গেল। মনে হয় টুনির কথায় অবাক হয়ে একটা বিষম খেল এবং টুনি যে আশংকা করেছিল সেটাই ঘটে গেল, পানের পিক মুখ থেকে বের হয়ে দাড়ি বেয়ে গলায় মাফলার পর্যন্ত চলে এলো। দেখে টুনির মনে হলো সে বমি করে দিবে।
মানুষটা অবশ্য মোটেও বিচলিত হলো না। টুনি এবারে গলার মাফলারের গুরুত্বটা বুঝতে পারল। মানুষটা মাফলারের মাথাটা দিয়ে পানের পিকটা মুখে ফেলার চেষ্টা করতে থাকল। টুনির মনে হলো মাফলারটা অন্য রংয়ের ছিল এই খয়েরি রংটা নিশ্চয়ই পানের পিকের কারণে হয়েছে।
টুনি এবারে দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদি, আমাকে কেন ডেকেছ?”
“যা দেখি, ঝুমুকে ডেকে আন ৷”
মানুষটা শেষ পর্যন্ত তার পানের পিকটা সামলে নিয়েছে, টুনির দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু টুনি তাকে কোনো সুযোগ দিল না, শুট করে বের হয়ে গেল। বের হওয়ার সময় শুনতে পেল আজকালকার ছেলেমেয়েদের আদর-লেহাজের কত সমস্যা সেইটা নিয়ে মানুষটা কিছু একটা বলছে। টুনি মোটেও পাত্তা দিল না। এই রকম মানুষকে গুরুত্ব দিয়ে লাভ নেই।
ঝুমু খালাকে স্টোর রুমে পাওয়া গেল। সেখানকার নানা ধরনের টিন এবং কৌটা খুলে খুলে কিছু একটা দেখছে। টুনিকে দেখে বলল, “এই বাড়িতে কোনো শৃঙ্খলা নাই। দেখে মনে হয়, পাগলের বাড়ি
টুনি বলল, “শৃঙ্খলা আনার জন্যই তো তুমি আছ।”
“শৃঙ্খলা এনে লাভ নাই।“
“কেন ঝুমু খালা?
“তাহলে কেউ টিকতে পারবে না। শৃঙ্খলা নাই বলে টিকে আছে।” তারপর কৌটাগুলো খুলে ভেতরে তাকাতে লাগল এবং হতাশভাবে মাথা নাড়তে লাগল। কিসের জন্য এই হতাশা টুনি আন্দাজ করার চেষ্টা করল কিন্তু অনুমান করতে পারল না।
টুনি বলল, “ঝুমু খালা, দাদি তোমাকে ডাকে।”
“সিরিয়াল শুরু হইছে?”
“সিরিয়াল দেখার জন্য না, মনে হয় অন্য কাজ আছে।
“কী কাজ?”
“গ্রাম থেকে গেস্ট এসেছে, মনে হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।“
ঝুমু খালা ভুরু কুঁচকে বলল, “কোন পদের গেস্ট? সাদাসিদা নাকি পিছলা?”
টুনি বলল, “মনে হয় পিছলা। দুইটা মুরগি নিয়ে এনেছে।”
“মুরগি?”
“হ্যাঁ।”
ঝুমু খালা তার হাতের কৌটার ভেতরে একবার শুঁকে রেখে দিয়ে বলল, “বুঝছি। কেস জটিল। চল। যাই।”
“আমি যাব না।”
“কেন?”
“তুমি যাও, তাহলে নিজেই বুঝতে পারবে।”
ঝুমু নিজের বুকে থাবা দিয়ে বলল, “তোমার কুনু ভয় নাই। আস আমার সাথে।” বলে গটগট কর রওনা দিল। যেতে যেতে টুম্পাকেও পেয়ে গেল, তাকেও সাথে নিয়ে নিল।
দাদির ঘরে ঢুকে ঝুমু খালা মানুষটার দিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে দাদিকে জিজ্ঞেস করল, “খালা, আমারে ডাকছেন?”
দাদি (কিংবা নানি) বললেন, “হ্যাঁ ঝুমু। আমাদের গ্রাম থেকে একজন গেস্ট এসেছে, তার থাকার ব্যবস্থা করে দাও। গেস্ট রুমটা খুলে একটু গোছগাছ করে দিও।”
ঝুমু খালা এবারে এমন ভান করল যে প্রথমবার মানুষটাকে দেখেছে। এক নজর দেখেই সে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল, মুরগি দুইটার দিকে তাকিয়ে রীতিমতো হুংকার দিয়ে বলল, “এই গুলান কী? “
মানুষটা তার চিবানো বন্ধ করে পানের পিক রক্ষা করে চিঁ চিঁ করে বলল, “মুরগি।”
“সেইটা তো দেখছি। আনছেন কেন?”
“ভাবলাম খালার জন্য নিয়ে যাই। গ্রামের ফ্রেশ মুরগি।”
ঝুমু খালা নিচু হয়ে মুরগি দুটোর পা ধরে টান দিয়ে উপরে তুলে চোখের সামনে ধরে রেখে মুখটা বিকৃত করে ফেলল। বলল, “ইয়া মাবুদ। এইগুলা কী মুরগি আনছেন?”
মানুষটা থতমত খেয়ে খেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“দেখছেন না এইগুলো বুড়া মুরগি? এই বুড়া মুরগি কে খাবে? এই বাসায় আমরা কচি মুরগি খাই। এই মুরগি কেউ ছুবে না।”
নিজের কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্য ঝুমু খালা টুনি আর টুম্পার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাই না?”
টুনি আর টুম্পা কী বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নাড়ল। দাদি তখন একটু আপত্তি করার চেষ্টা করলেন। বললেন, “এগুলো তুমি কী বলছ ঝুমু। মানুষটা আমার জন্য গ্রাম থেকে দুইটা মুরগি এনেছে–”
ঝুমু খালা দাদিকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিল, “না না–খালা আমি সবার জন্য রান্ধি–এই বাড়িতে কে কী খায় আমি জানি। এই বুড়া মুরগির ঠ্যাং কেউ ছুঁইয়াও দেখব না।” তারপর মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি গ্রামে যাবার সময় ফেরত নিয়ে যাবেন। এখন আমি আপনার ঘরে খাটের নিচে রেখে দিব। নেন, উঠেন–”
এবারে দাদি ঝুমু খালাকে একটা ধমক দিয়ে বললেন, “কী আবোল তাবোল বলছ। খাটের নিচে মুরগি রেখে দিবে মানে? যাও–রান্না ঘরে নিয়ে যাও।”
ঝুমু হলে ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গী করে বলল, “আপনি বললে তো নিতেই হবে। কিন্তুক খালাম্মা পরে আমারে দুষ দিয়েন না। এর গুশত সিদ্ধ না হইলে কিন্তুক আমার দুষ নাই–”
দাদি বললেন, “সে দেখা যাবে।” তারপর মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে ঠিক আছে কাচু কবিরাজ, তুমি বিশ্রাম নেও। সকালে কথা হবে।“
ঝুমু খালা এইবারে চোখ বড় বড় করে ফেলল, “আপনি কবিরাজ? কবিরাজি চিকিৎসা করেন?”
মানুষটা ঝুমু খালাকে একটু একটু ভয় পেতে শুরু করেছে। পান চিবানো বন্ধ করে মাথা নাড়ল। ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “আপনি কিসের কবিরাজি করেন?”
“এইতো রোগ শোকের। নানারকম ব্যারামের—”
“জীন ভূতে পাওয়া মানুষ? সাপে কাটা? মৃগী ব্যারাম?”
মানুষটা দুর্বলভাবে হাসল, বলল, “এইতো–” কিন্তু পরিষ্কার উত্তর দিল না।
ঝুমু খালার মুখে এবারে হাসি ফুটে উঠল। মাথা নেড়ে বলল, “ভালো হইছে একটা কবিরাজ পাইছি! আমার সব সমস্যার চিকিৎসা করতে পারবেন।”
টুনি বলল, “তোমার আবার কী সমস্যা ঝুমু খালা?”
“সমস্যার কী অভাব আছে? মাঝে মাঝে কোমরে টাশ মারে। রগে টান
পড়ে। মাথার সব চুল উঠে টাক পড়ে পড়ে অবস্থা–”
টুম্পা হি হি করে হাসল, বলল, “তোমার মোটেও চুল পড়ে নাই ঝুমু খালা! তোমার মাথায় কত চুল!”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কোমরে টাশ কেমন করে মারে?”
“আমারে জিজ্ঞেস করে কী হবে, কবিরাজ চাচারে জিজ্ঞেস কর।”
টুনি কবিরাজ চাচাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। ঝুমু খালা তখন দুই মুরগি হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল। তার পিছু পিছু টুনি আর টুম্পা ৷ সবার পিছনে স্যুটকেস হাতে কাচু কবিরাজ। ঝুমু খালার সাথে সাক্ষাতের পর তার তেজ অনেকটুকু কমে গেছে।
.
দাদির কাছে অনেকেই আসে, এই বাসার বাচ্চা কাচ্চারা তার খবর রাখে না। কিন্তু এই কাচু কবিরাজের কথা বাচ্চারা সবাই বেশ ভালোভাবে টের পেল। তার এক নম্বর কারণ রাতের বেলা পড়ালেখা শেষে (কিংবা পড়ালেখার ভান শেষে) সবাই যখন দাদির ঘরে একত্র হয় হৈ চৈ চেঁচামেচি করে তখন কাচু কবিরাজও সেখানে এসে বসে থাকে। শুধু সে বসে তাকে তা নয়, তাদের কথাবার্তার মাঝে নাক গলায়, তাদের আদব লেহাজ শেখানোর চেষ্টা করে। আজকেও সেটা ঘটছে। সবাই মিলে দাবা খেলছে, দাবার থেকে একাগ্র মনে খেলার মতো অন্য কোনো খেলা পৃথিবীতে নেই। কিন্তু এখানে তার সম্পূর্ণ বিপরীত, তুমুল হট্টগোল চলছে। তার কারণ দাবার বোর্ডে পরিচিত রাজা মন্ত্রী ঘোড়া এসব ছাড়াও নতুন গুটি বসানো হয়েছে সেগুলো হচ্ছে জেনারেল, শিক্ষামন্ত্রী এবং স্পাই। দুইজন সন্ত্রাসীও আছে তারা খেলার মাঝখানে কখন কী করে ফেলে তার ঠিক নেই। আট ঘরের দাবার বোর্ডে সবাইকে আঁটানো যাচ্ছে না বলে পাশাপাশি দুইটা বোর্ড রেখে বোর্ডের সাইজ বাড়ানো হয়েছে। খেলার মাঝে তুমুল উত্তেজনা এবং চেঁচামেচি। একটা সন্ত্রাসী গুটি বিপক্ষ দলের রাজাকে ড্রোন দিয়ে আক্রমণ করে মেরে ফেলার পরে চেঁচামেচি অনেক বেড়ে গেল তখন চু কবিরাজ হতাশভাবে মাথা নেড়ে দাদিকে (কিংবা নানিকে) বলল, “আপনার বাড়িতে পুলাপান ঠিক করে মানুষ হয় নাই। “
বাচ্চাগুলো কাচু কবিরাজের কথা শুনে আরো উত্তেজিত হয়ে দাদিকে বলল, “ঠিক কথা! একেবারে ঠিক কথা! দাদি, তুমি কী রকম দাদি হয়েছ যে নাতিদের মানুষ করতে পার নাই?”
আরেকজন বলল, “ছেলে পিলে নষ্ট করার জন্য তোমার বিরুদ্ধে মামলা করে দেওয়া দরকার!”
আরেকজন বলল, “মেয়েদের এতো বয়স হলো, এখনও বিয়ে দাও নাই! ছিঃ ছিঃ দাদি। ছিঃ ছিঃ নানি!”
শান্ত বলল, “ছেলেদেরও বিয়ে দিতে পার দাদি, আমাদের কোনো আপত্তি নাই।”
তখন সবাই আনন্দে হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “শান্ত ভাইয়াকেই সবার আগে বিয়ে দিয়ে দাও।” তারপর সবাই মিলে শান্তকে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে।
কাচু কবিরাজের কথাটাকে নিয়ে সবাই এতো হাসি তামাশা করছে দেখে সে মুখটা কালো করে ফেলল। তারপর বলল, “পুলাপান কন্ট্রোল করার তাবিজ আছে। এই পুলাপানদের তাবিজ দেওয়া দরকার। অনেক সময় জীন- ভূতের আছর থাকলে পুলাপান এই রকম হয়।”
কাচু কবিরাজের কথা শুনে একসাথে সবাই লাফিয়ে উঠল। আনন্দে চিৎকার করে বলল, “তাবিজ! তাবিজ!” তারপর কাচু কবিরাকে ঘিরে হাত পেতে চিৎকার করতে লাগল, “দেন! দেন! তাবিজ দেন! আমাকে একটা কবিরাজি তাবিজ দেন!”
ছোট-বড় সবাই হাত পেতে বলতে লাগল, “আমাকে একটা! আমাকে একটা!”
শুধু শান্ত বলল, “আমাকে দশটা! আমাকে দশটা!”
টুনি জানতে চাইল, “তুমি দশটা দিয়ে কী করবে?”
“হাতে পায়ে কোমরে, গলায় সব জায়গায় একটা করে লাগবে। দশ গুণ একশান!”
প্রমি বলল, “আমারটা হবে ডিজাইনার তাবিজ!”
তখন অন্যরাও বলতে লাগল, “আমারটাও! আমারটাও!”
শান্ত জানতে চাইল, “কবিরাজ চাচা। এই তাবিজ বিছানায় পিশাব বন্ধ করবে তো?”
সবাই থেমে গিয়ে এবারে শান্তর দিকে তাকাল। একজন সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “বিছানায় পেশাব? তুমি কী এখনও বিছানায় পেশাব কর?”
শান্ত দাঁত বের করে হেসে বলল, “করি না। কিন্তু যদি ডাবল একশন তাবিজ থাকে তাহলে চেষ্টা করে দেখব কী হয়!”
সবাই মুখ বিকৃত করে বলতে থাকল, “শান্ত ভাইয়া, তুমি এতো নোংরা কথা বলতে পার! ছিঃ! ছিঃ!”
দাদি বললেন, “ছিঃ শান্ত! তুই সব সময় আজেবাজে কথা বলিস।”
কিন্তু শান্তর কথাটাতে কাজ হলো। কাচু কবিরাজ মুখ কালো করে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে তাদের ভয়ংকর দাবা খেলায় ফিরে গেল!
.
টুনি অবশ্য কাচু কবিরাজের অন্য একটা বিষয় নিয়ে খুবই কৌতূহলী হলো, মানুষটা এখানে এসে কী করছে? সকাল বেলা বের হয়ে যায়, সারাদিন শেষে সন্ধেবেলার দিকে নানা রকম পোটলা নিয়ে ফেরত আসে। তার ভিতরে কী আছে সেটা বোঝা যায় না। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। তারপর যখনই বের হয় ঘরে একটা তালা লাগিয়ে রাখে। এই বাসায় কেউ কখনো কারো রুমে তালা লাগাতে দেখেছে বলে টুনি মনে করতে পারে না। রহস্যের সেখানেই শেষ না, গভীর রাত পর্যন্ত কাচু কবিরাজের ঘর থেকে ঠুকঠুক শব্দ শোনা যায়। সে কী করে কে বলতে পারবে?
একদিন শুধু কাচু কবিরাজ ঝুমু খালাকে জিজ্ঞেস করেছে তার কাছে কোনো খালি কৌটা আছে কি না। এই বাসায় খালি কৌটার কোনো অভাব নেই তাই ঝুমু খালা তাকে অনেকগুলো খালি কৌটা দিয়েছে সেখান থেকে বেছে বেছে বড় কয়েকটা কৌটা নিয়েছে। এই কৌটায় কোনো একটা জিনিস রাখা হবে। কী রাখা হবে সেটাই টুনি জানতে চায়।
কাচু কবিরাজ যেহেতু একজন কবিরাজ তাই তার কবিরাজি জিনিসপত্র তৈরি করার জন্য মালমসলা কিনতেই পারে, কৌটায় ভরে সেগুলো নিতেই পারে কিন্তু এরকম গোপন রাখার অর্থ কী? কেউ যদি কিছু গোপন রাখার চেষ্টা করে তাহলে প্রথমেই মনে হয় কোনো একটা বেআইনি কাজ করছে কিংবা অন্যায় কাজ করছে। তাহলে কি কাচু কবিরাজও অন্যায় কাজ করছে? যদি করে থাকে তাহলে সেটা কী হতে পারে? টুনি চিন্তা করে পায় না।
সবচেয়ে সোজা হতো যদি ছোটাচ্চুর গোপন ভিডিও ক্যামেরাটা ঘরে রেখে দেওয়া যেতো। কিন্তু ডিটেকটিভ কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে সেই ভিডিও ক্যামেরার কোনো খোঁজ নেই। আরো একটা উপায় হচ্ছে মানুষটার পিছু পিছু গিয়ে দেখা সে সারাদিন কী করে, কোথায় যায়। কিন্তু টুনির পক্ষে সেটা কঠিন কাজ! ছোটাচ্চু চাইলে করতে পারতো কিন্তু ছোটাচ্চু এই কবিরাজ নিয়ে কেন মাথা ঘামাবে?
তাই টুনি নিজেই সাধারণ কাজগুলো করছে। এই ঘর থেকে ময়লা ফেলার ঝুড়িটা কোনোভাবে বের করা যায় কিনা সেটা চেষ্টা করে দেখছে। সেখানে সাধারণত অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষটা মনে হচ্ছে সেটাও বের করছে না। বাড়ী চলে যাবার পর ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হলে মনে হয় কিছু অনুমান করা যাবে।
আপাতত টুনি কাচু কবিরাজকে চোখে চোখে রাখছে। সে কি করে না করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ঘরটাতে একবার কিছুক্ষণের জন্য ঢুকতে পারলেই কাজ হয়ে যাবে, টুনি শেষ পর্যন্ত সেটাই করার জন্য একটা বুদ্ধি বের করল।
প্রথমে কয়েকটা কাঁচের টুকরা জোগাড় করল। কাজটা খুব সহজ হলো না; একটা পুরানো লাইট বাল্ব একটা পলিথিনের ব্যাগের ভিতর রেখে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সেটাকে ভাঙল। সেখান থেকে পাতলা পাতলা কয়েকটা টুকরো নিয়ে কাচু কবিরাজের ঘরে গেল। কাচু কবিরাজ বাইরে গেছে, তার ঘরের দরজা বন্ধ, সেখান বিশাল একটা তালা ঝুলছে দরজার নিচে শুধুমাত্র একটুখানি ফাঁক। টুনি সেই ফাঁক দিয়ে পাতলা পাতলা কাঁচের টুকরোগুলো ঠোকা দিয়ে ভিতরে পাঠিয়ে দিল।
তারপর গেল ঝুমু খালার কাছে। মুখ কাচুমাচু করে বলল, “ঝুমু খালা-”
ঝুমু খালা চোখ পাকিয়ে বলল, “এখন কী হইছে?”
“আমার একটা সায়েন্স প্রজেক্টের জন্য একটা লাইট বাল্বের দরকার ছিল।”
“সেইটা দরকার?”
“না ৷ আমি একটা বাল্ব পেয়েছি, নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন–”
“তখন কী?”
“তখন হঠাৎ হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল।”
ঝুমু খালা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “একটা লাইট বল হাত দিয়ে ধরে রাখতে পার না?”
“লাইট বল না, লাইট বাল্ব –“
ঝুমু খালা ধমক দিয়ে বলল, “একই কথা–”
“আমি ধরেই রেখেছিলাম তারপরেও কীভাবে জানি পড়ে গেল।”
“এখন?”
“পড়ে ভেঙে গিয়ে কাঁচের টুকরা সব দিকে ছড়িয়ে গেছে–”
ঝুমু খালা হুংকার দিয়ে বলল, “সেই কাঁচে পা দিয়া পা কাটছ?” ঝুমু খালা উবু হয়ে টুনির পায়ের দিকে তাকাল।
“না, না, পা কাটে নাই।”
“তাহলে?“
“আমি ঝাড়ু দিয়ে সব পরিষ্কার করে ফেলেছি।”
“আমারে ডাক দিলা না কেন? মাতবরি করার দরকার কী ছিল? এর পরে আমারে বলবা।”
“ঠিক আছে। কিন্তু–”
“কিন্তু কী? “
টুনি মাথা চুলকে বলল, “লাইট বাল্বটা ভেঙেছে ঠিক গেস্ট রুমের সামনে–যেখানে কবিরাজ চাচা আছে।”
“তয়?”
“মনে হয় কয়টা কাঁচের টুকরা দরজায় তলা দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেছে। এখন–”
“এখন কী?”
“কবিরাজ চাচা আসার পরে যদি খালি পায়ে হেঁটে–”
“ঘর ঝাড়ু দিতে হবে।” ঝুমু খালা মাথা নাড়ল।
“দরজায় এতো বড় তালা, ঝাড়ু দিবে কেমন করে?”
ঝুমু খালা ভুরু কুঁচকে বলল, “এই কবিরাজ কী করে ঘরের ভিতর? দরজায় তালা মারে কেন?”
“সেইটা জানি না। যখন কবিরাজ চাচা আসবে তখন তুমি কি একটু
ঘরটা ঝাড়ু দিতে পারবে?”
“ঠিক আছে। কোন সময় আসবে সেইটাও তো জানি না।“
“আমি তোমাকে বলে দেব।“
“ঠিক আছে।”
টুনি মুখটা গম্ভীর করে বের হয়ে এলো। কবিরাজ চাচার ঘরে ঢোকায় একটা ব্যবস্থা করা হলো। আর যাকেই আটকানো যাক না কেন, ঝাড়ু হাতে ঝুমু খালাকে দুনিয়ার কেউ আটকাতে পারবে না। ঝুমু খালা এই ঘরে ঢুকবেই! তখন কোনো একটা কায়দা করে সেও ঢুকে যাবে!
কাচু কবিরাজ সন্ধেবেলা দুই হাতে অনেক বড় বড় দুইটা কাগজের প্যাকেট নিয়ে ফিরে এলো। টুনি চোখ খোলা রেখেছিল এবং ফেরার সাথে সাথে সেটা ঝুমু খালাকে জানিয়ে এলো। ঝুমু খালাও দেরি করল না, একটা ঝাড়ু নিয়ে কাচু কবিরাজের ঘরে হাজির হলো। কাচু কবিরাজ তার বিশাল তালা খুলে ঘরে ঢুকে হাতের প্যাকেটগুলো নিচে রেখে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ঝুমু খালা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেছে। টুনি বাইরে থেকে শুনল, ঝুমু খালা বলছে, “কবিরাজ সাহেব, যেখানে আছেন সেইখানে খাড়াইয়া থাকেন। এক পাও নড়বেন না।”
কাচু কবিরাজ অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“ঘরে ভাঙা কাঁচ, নড়লেই পায়ে লাগব।“
কাচু কবিরাজ বলল, “আমার পায়ে জুতা, সমস্যা নাই।”
“আপনার সমস্যা নাই কিন্তুক আমার আছে। আপনার জুতা দিয়ে কাঁচের টুকরা সারা বাসায় ছড়াইব। এই বাসায় পুলাপান খালি পায়ে দৌড়াদৌড়ি করে। তাদের পা কাটব।”
কাচু কবিরাজ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঝুমু খালা সুযোগ দিল না। বলল, “দুই পা সামনে গিয়া দাঁড়ান, আমি কাঁচের টুকরাগুলো দেখছি ৷ ঝাড়ু দিয়া সরাইয়া নেই।”
কাচু কবিরাজ নিশ্চয়ই দুই পা সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, ঝুমু খালা মাত্র ঝাড়ু দেওয়া শুরু করেছে তখন টুনি খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল এবং তাকে দেখে কাচু কবিরাজ কেমন যেন আঁতকে উঠল। টুনি এমন ভান করল যেন সে কাচু কবিরাজকে দেখেইনি। ঝুমু খালাকে বলল, “ঝুমু খালা তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম।”
ঝুমু খালা ঝাড়ু দেওয়া বন্ধ করে চোখ কটমট করে টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “সাবধান! কাছে আইস না। ঘর ভর্তি ভাঙা কাঁচ।”
“একটা জিনিস জিজ্ঞেস করে চলে যাব।” টুনি কথা বলার সময় সোজাসুজি তাকাল না, চোখের কোণা দিয়ে ঘরটা দেখতে লাগল। ঘরময় ছড়ানো ট্যাবলেটের পাতা, ট্যাবলেটগুলো বের করে খালি পাতাগুলো মেঝেতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। টেবিলে একটা হামান দিস্তা, তার পাশে কয়েকটা কৌটা। সেখানে নানা রকম পাউডার, মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই ট্যাবলেটের গুড়ো।
ঝুমু খালা বলল, “কী জিজ্ঞেস করবা?”
“ডিম সিদ্ধ করতে কতক্ষণ লাগে?”
“হাফ বয়েল না ফুল বয়েল?”
ডিম সিদ্ধ করারও যে হাফ বয়েল ফুল বয়েল আছে টুনি জানতো না। ইতঃস্তত করে বলল, “মনে কর হাফ বয়েল।”
“ডিম কী ফিরিজ থেকে বের করছ না বাইরে আছে?”
টুনি দেখল কাচু কবিরাজ তার কৌটাগুলো চোখের আড়াল করার চেষ্টা করছে। হামান দিস্তাটাও একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলল। ট্যাবলেটের খালি পাতাগুলো পা দিয়ে ঠেলে বিছানার নিচে সরানোর চেষ্টা করছে। টুনি এসব কিছুই দেখেনি ভান করে ঝুনু খালার প্রশ্নের উত্তর দিল, “মনে কর ডিম ফ্রিজে নাই, বাইরে আছে।“
“হাঁস না মুরগি?”
“মুরগি।”
“ছোট সাইজ না বড় সাইজ?”
টুনি জীবনেও কল্পনা করে নাই একটা ডিম সিদ্ধ করার মধ্যে এতো কিছু থাকতে পারে। মাথা চুলকে বলল, “মাঝারি।”
ঝুমু খালা বলল, “পানি ফোঁটার পর সাড়ে তিন মিনিট। তারপরে পানি থেকে বের করে ফেলতে হবে। তা না হলে বেশি সিদ্ধ হয়ে যাবে।”
“থ্যাংকু ঝুমু খালা। আমার একটা সায়েন্স প্রজেক্টে ডিম সিদ্ধ করতে
হবে। তোমার কাছ থেকে জেনে গেলাম
“ডিম হচ্ছে খাওয়ার জিনিস। এই গুলান খায়। এই গুলান দিয়ে সান্সি মান্সি করা ঠিক না!”
“সান্সি মান্সি না। সায়েন্স প্রজেক্ট।”
“একই কথা।
টুনি যেটা দেখতে চেয়েছিল সেটা দেখে ফেলেছে। এখন সে চলে যেতে পারে। কিন্তু সে ভান করল হঠাৎ করে সে কাগজের প্যাকেটগুলো দেখেছে। উত্তেজিত হয়েছে ভান করে এগিয়ে বলল, “এগুলা কি কবিরাজ চাচা?”
কাচু কবিরাজ বলল, “হ্যাঁ-হ্যাঁ-ইয়ে মানে ইয়ে—”
“আপনার বিজ্ঞাপন? “
কাচু কবিরাজ আবার মাথা চুলকে বলল, “মানে ইয়ে-ইয়ে-“
টুনি বলল, “আমি এক কপি নেই?” বলে মতি কবিরাজকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্যাকেটের ফাঁক দিয়ে এক কপি টেনে বের করে নিল। রঙিন লিফলেট, সেখানে কাচু কবিরাজের ছবি। চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে। একজন মানুষ কোথাও ছবি দিতে হলে এরকম চোখ পাকানো ছবি দেয় কেন? হাসি খুশি ছবি দিলে কী হয়?
লিফলেটের উপর বড় বড় করে কাচু কবিরাজের নাম, তার নিচে কাচু কবিরাজ স্বপ্নে প্রাপ্ত মহৌষধ দিয়ে কী কী অসুখের চিকিৎসা করতে পারে তার বর্ণনা। টুনি কাগজটা নিয়ে বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে রওনা দিল। যাওয়ার সময় পা দিয়ে ঠেলে একটা ওষুধের পাতাও বের করে আনল!
বাইরে বের হয়ে টুনি ওষুধের পাতাটা হাতে তুলে নেয়। কটমটে একটা নাম, কিসের ওষুধ কে জানে। শাহানা আপুকে দেখালে নিশ্চয়ই বের করে ফেলবে। সে ওষুধের খালি পাতাটা নিয়ে উপর তলায় রওনা দিল।
.
ওষুধের পাতাটা দেখে শাহানা আপু বলল, “কোথায় পেয়েছিস?”
“তোমাকে বলব। কিন্তু আগে বল এটা কিসের ওষুধ।”
শাহানা আপু কটমটে নামটা পড়ে বলল, “মনে হয় কোনো একটা এন্টিবায়েটিক। পেনিসিলিন গ্রুপের মনে হয়।”
তারপর পাশে রাখা ল্যাপটপটা অন করে সেখানে খোঁজা শুরু করল একটু পরে বলল, “ঠিকই বলেছি, “এটা একটা স্ট্রং এন্টিবায়োটিক—- পেনিসিলিন গ্রুপের। সাবধানে খেতে হয় অনেক সাইড এফেক্ট হতে পারে। কে খায় এটা?”
টুনি বলল, “কেউ খায় না।”
শাহানা আপু পাতাটা উল্টে পাল্টে বলল, “কেউ খায় না মানে? এই যে খালি পাতা–কেউ নিশ্চয়ই খেয়েছে ৷
“উহুঁ ৷” টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “কেউ খায় নাই। ওষুধগুলো বের করে গুড়া করে কৌটায় মাঝে রেখেছে।”
শাহানা আপু চোখ বড় বড় করে বলল, “সে কী? কেন?”
“মনে হয় অন্য একটা নাম দিয়ে কাউকে খেতে দিবে।“
“কী বলছিস আবোল তাবোল? কে এটাকে অন্য নাম দিয়ে খেতে দেবে?”
“বিখ্যাত কাচু কবিরাজ। এইটাই মনে হলো স্বপ্ন প্রাপ্ত মহৌষধ।” শাহানা বলল, “কী বলবি পরিষ্কার করে বল। উকিলের মতো প্যাচিয়ে কথা বলিস না!”
শাহানা তখন তার হাতের লিফলেটটা শাহানা আপুকে পড়তে দিল। পড়তে গিয়ে শাহানা আপুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বলল, “কী সর্বনাশ! এই লোক এইভাবে এই এন্টিবায়োটিকটা স্বপ্নে প্রাপ্ত মহৌষধ হিসেবে খাওয়াচ্ছে? কত বড় দুই নম্বুরি। কত ডেঞ্জারাস।”
টুনি মাথা নাড়ল। শাহানা আপু আরো উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল, “প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক কেনার কথা না। কত রকম সাইড এফেক্ট হতে পারে। শুধু কী তাই? ফুল কোর্স শেষ না করলে জার্মগুলো আরো তেজি হয়ে যায়। তখন কোনো এন্টিবয়োটিক দিয়ে কাজ হয় না।”
টুনি আবার মাথা নাড়ল ৷
শাহানা আপু বলল, “এই লোককে পুলিশে দেওয়া দরকার। “
টুনি এবারে জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
শাহানা আপু নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এই লোকের কত বড় সাহস! আমাদের বাসায় বসে এই দুই নম্বুরি কাজ করে যাচ্ছে!” হঠাৎ করে থেমে গিয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু তুই কেমন করে এগুলো বের করলি?”
টুনি লাজুক মুখে হাসল, বলল, “এই তো একটু কায়দা করে। ঝুমু খালা একটু সাহায্য করেছে।”
শাহানা আপু মাথা নাড়ল, “তুই আসলেই ডিটেকটিভ। এখন কী করবি ঠিক করেছিস?”
“না। কিন্তু –”
“কিন্তু কী?”
“মানুষটা দাদির গ্রামের মানুষ। এইখানে কয়দিনের জন্য থাকতে এসেছে। এখন আমরা যদি তাকে কিছু করি দাদির একটু খারাপ লাগতে পারে।“
“তাহলে আমরা কিছু করব না? তাকে এভাবে এইগুলা করতে দিব?”
টুনি জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমি সেইটা বলি নাই। আমি বলছিলাম মানুষটা নিজেই যদি সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যায় তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়।”
“নিজে সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যাবে কেন?”
“যদি ভয় দেখানো যায়।”
শাহানা অপু ভুরু কুঁচকে বলল, “ভয়? ভয় দেখাবি কীভাবে?”
“আমি একা পারব না। তুমি যদি একটু সাহায্য কর।”
“আমি?”
“হ্যাঁ।”
“কীভাবে?”
টুনি মাথা চুলকে একটু হাসার ভঙ্গী করল, তারপর তার বুদ্ধিটা সে শাহানা আপুকে বলতে শুরু করে।
.
রাত্রিবেলা দাদির ঘরে সবাই একত্র হয়েছে। দাদি তার সিরিয়াল দেখছেন, দাদির কাছে ঝুমু খালা বসে আছে, সিরিয়ালের চরিত্রগুলোর কাজকর্ম দেখে খুবই বিরক্ত হয়ে সে মাথা নাড়ছে। বাচ্চারা কান ধরে টানাটানির একটা বিপজ্জনক খেলা আবিষ্কার করেছে, সবাই সেটা দেখেও না দেখার ভান করছে। কাচু কবিরাজ একটা চেয়ারে বসে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে মাথা নাড়ছে। কাছাকাছি আরেকটা চেয়ারে শাহানা আপু বসে একটা বই পড়ছে। শাহানা আপু হঠাৎ তার টেলিফোনটা বের করে সেটার দিকে তাকালো, সেখানে কিছু একটা দেখে টেলিফোনে কোথাও ডায়াল করে সে কানে লাগালো।
টুনি ছাড়া আর কেউ শাহানা আপুর কাজকর্ম লক্ষ করছে না, লক্ষ করার কথাও না। শাহানা আপু নিচু গলায় দুই একটা কথা বলল, তারপর কিছু একটা শুনল এবং হঠাৎ করে প্রায় চিৎকার করে বলল, “কী বললি?”
এবারে ঘরের সবাই মাথা ঘুরিয়ে শাহানা আপুর দিকে তাকালো। বাচ্চারা খেলা বন্ধ করে শাহানা আপুর কথা শোনার চেষ্টা করল। শাহানা কিছু একটা শুনল, তারপর প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “কী সর্বনাশ! ইম্পসিবল!”
শাহানা আপু এবারে ফোন কানে লাগিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, “না-না-না হতেই পারে না।” তারপর টেলিফোন কানে লাগিয়ে কিছু একটা শুনতে শুনতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং সব বাচ্চা খেলা বন্ধ করে তাদের শাহানা আপুর পিছু পিছু যেতে লাগল।
দাদি পর্যন্ত তার সিরিয়াল দেখা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন, হয়েছে?”
ঝুমু খালা মাথা নেড়ে বলল, “কবে কেডা? অবস্থা জটিল মনে হয়।”
সবাই শাহানা আপুর টেলিফোন শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। শাহানা আপু শেষ পর্যন্ত টেলিফোনে কথা শেষ করে ঘরে ঢুকলো, দাদির (কিংবা নানি) দিকে তাকিয়ে বলল, “নানি, তোমার সাথে কথা বলতে হবে।”
“কী কথা?”
“নিরিবিলি হলে ভালো হয়।”
“এই বাসায় নিরিবিলি কই পাবি? যা বলতে হয় বলে ফেল।
বাচ্চারা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “বলে ফেল শাহানা আপু।
শাহানা বলল, “আমার এক বন্ধুর বাবা র্যাবের খুব বড় অফিসার। সে ফোন করে বলল, র্যাব আমাদের বাসা রেইড করতে আসছে।”
একসাথে সবাই চিৎকার করে উঠল, “র্যাব? “
“হ্যাঁ। দেশে এন্টিবায়োটিকের উল্টাপাল্টা ব্যবহার করার কারণে সব জার্ম আস্তে আস্তে সুপার জার্ম হয়ে যাচ্ছে। কোনো ওষুধ এখন কাজ করে না। র্যাব অনেকদিন থেকে বের করার চেষ্টা করছে কারা এটা করে।
দাদি চোখ কপালে তুলে বললেন, “কিন্তু সেই জন্য র্যাব আমাদের বাসায় আসবে কেন?”
“তাদের কাছে পজিটিভ ইন্টেলিজেন্ট
পজিটিভ ইন্টেলিজেন্ট আছে যে এই বাসায় এন্টিবয়োটিক দিয়ে উল্টাপাল্টা কাজ হয়। প্রেসক্রিপশান ছাড়া এন্টিবায়োটিক আনা হয়।
দাদি মাথা নাড়লেন, “কিছু একটা ভুল হয়েছে।”
অন্যরাও মাথা নাড়ল, বলল, “ভুল ভুল।”
শুধু টুম্পা শান্তকে জিজ্ঞেস করল, “শান্ত ভাইয়া তুমি কিছু কর নাই তো?”
শান্ত রেগে টুম্পার মাথায় চাটি মারতে চেষ্টা করে বলল, “খবরদার ইয়ার্কি করবি না।”
ঝুমু খালা বলল, “যাইবার দেন খালা। এই বাসায় আইসা কিছু পাইব না তখন চা-নাস্তা খেয়ে চইলা যাইব।“
দাদি বললেন, “কিন্তু কী রকম বেইজ্জতি, এলাকায় সব মানুষ দেখবে র্যাব এই বাসা রেইড করছে–”
অন্য কেউ কাচু কবিরাজকে লক্ষ করছিল না, শুধু টুনি তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। সে দেখল শাহানা আপুর কথা শুনে তার মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তার নিচের ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। হঠাৎ করে সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তোতলাতে তোতলাতে বলল, “আ-আ-আমার যেতে হবে। এক্ষুণি যেতে হবে।
দাদি (কিংবা নানি), অবাক হয়ে বললেন, “কোথায় যেতে হবে?”
“বা-বাড়ি।”
“বাড়িতে তো যাবেই। কিন্তু এখন কেন?”
“এ-এ-এখনই যাইতে হবে। এখনই––আমার বউয়ের শরীর খারাপ “এখন হঠাৎ করে টের পেলে তোমার বউয়ের শরীর খারাপ?”
কাচু কবিরাজ প্রশ্নের উত্তর দিল না। কোনোমতে পায়ে স্যান্ডেল ঢুকিয়ে রীতিমতো ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাচ্চারাও উঠে গেল, সবাই তার পিছনে পিছনে গেল।
ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “কবিরাজ সাহেব, আপনে কই যান? কই যান?”
কাচু কবিরাজ তার কথারও উত্তর দিল না। ছুটতে ছুটতে তার ঘরে গিয়ে তালা খুলে ঢুকল। বাচ্চারা তার ঘরের বাইরে এসে ভীড় করেছে। শুনল ভিতরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। তারপর হঠাৎ টয়লেট ফ্ল্যাশ করার শব্দ শোনা যেতে লাগল। একের পর এক। শান্ত দাঁত বের করে হাসি হাসি মুখে বলল, “মনে হচ্ছে কবিরাজ চাচার পেট নেমে গেছে।“
শুধু টুনি বুঝতে পারল আসলে কবিরাজ চাচা তার এন্টিবায়োটিক ট্যাবলেটের গুড়া টয়লেটে ফ্ল্যাশ করে দিচ্ছে।
ভিতরে কিছুক্ষণ খুটখাট শব্দ হলো। মনে হলো কিছু ঝাড়াপোছা করা হচ্ছে। তারপর কাচু কবিরাজ উদভ্রান্তের মতো চেহারায় ঘর থেকে বের হয়ে এলো। তাকে একটা ঝড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছে!
এক হাতে স্যুটকেস, অন্য হাতে তার কাগজের দুটি বান্ডিল নিয়ে কাচু কবিরাজ রীতিমতো ছুটতে থাকে। পিছন থেকে ঝুমু খালা বলল, “আরে! আপনি খায়া যাবেন না?”
কাচু কবিরাজ ছুটতে ছুটতে বলল, “না, না।”
“আপনার মুরগি পাকাইছি। সকাল থেকে সিদ্ধ দিছি। নরম হইছে কিনা টেস্ট কইরা যান।“
“না, না, সময় নাই আমার।”
ঝুমু খালা পিছনে যেতে যেতে বলল, “তাহলে পেলাসটিকের বাটিতে ভইরা দিয়া দেই। লইয়া যান, বউরে খাওয়াইবেন।”
“না। না। দরকার নাই।“
কাচু কবিরাজ দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছুটে যেতে থাকে। মানুষটা আছাড় খেয়ে পড়ে কিনা কে জানে!
ঝুমু খালা মাথা নেড়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মানুষটা ভাত পর্যন্ত খাইল না।
সবাই হেঁটে হেঁটে দাদির ঘরে ফিরে আসে। ঘরে শুধু শাহানা আপু তার টেলিফোন হাতে বসে আছে। শান্ত জিজ্ঞেস করল, “শাহানা আপু, র্যাব কখন আসবে?”
“জানি না।“
টুনি বলল, “শাহানা আপু তুমি তোমার বন্ধুকে একটু বুঝিয়ে বল যে আমাদের বাসায় এরকম কিছু নাই। সে যেন তার আব্বুকে বুঝিয়ে বলে।
দাদি বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটু চেষ্টা করে দেখ। তোরা না পারলে বড় কাউকে বল। শাহরিয়ারকে বল কথা বলতে। বাসায় র্যাব রেইড করবে এটা কী রকম ব্যাপার? কতো বড় লজ্জার ব্যাপার! এটা কি চোর-ডাকাতের বাসা নাকি?
শুধু শান্ত বলল, “না না শাহানা আপু, কিছু বলার দরকার নাই। আসতে দাও। র্যাব এসে ঢুকলে একটা ফাটাফাটি ব্যাপার হবে। এরা কী দরজা ভেঙে ঢুকবে?”
কেউ তার কথাকে বেশি গুরুত্ব দিল না। শাহানা আপু তার টেলিফোনটা নিয়ে কথা বলার জন্য উঠে গেল।
ঝুমু খালা মাথা নেড়ে বলল, “কার ভিতরে কী আছে বলা খুবই মুশকিল।”
টুম্পা জানতে চাইল, “কেন ঝুমু খালা?”
“এই যে কবিরাজ মানুষটারে আমি বেশি ভালো পাই নাই। কিন্তু দেখো তার মনের ভিতর বউয়ের জন্য কী রকম মহব্বত। হঠাৎ করে বুঝল যে বউয়ের নিশ্চয়ই শরীর খারাপ হয়েছে, সব কিছু ফালায়া তখন ছুঁইটা গেছে! খায় নাই পর্যন্ত।”
বাচ্চাদের ভিতর সবচেয়ে ছোট হচ্ছে মুনিয়া। সে তার রিনরিনে গলায় বলল, “তুমি বুঝ নাই ঝুমু খালা। তুমি খুবই বোকা।”
“আমি কী বুঝি নাই? “
“কবিরাজ চাচা আসলে এন্টিবান্টি ওষুধ দিয়ে দুই নম্বুরি কাজ করে। সেই জন্যে ভয়ে পালিয়ে গেছে।”
ঝুমু খালা চোখে কপালে তুলে বলল, “কী কইলা তুমি?? কী কইলা?”
“ঠিকই বলেছি।”
টুনি হাসি গোপন করে মুনিয়াকে বলল, “মুনিয়া শব্দটা এন্টিবান্টি না। শব্দটা হচ্ছে এন্টিবায়োটিক।”
মুনিয়া বলল, “একই কথা!” তারপর দাঁত বের করে হাসল।