ভিজিটিং আওয়ার্স কেটে গেছে। রিসেপশনের বেশির ভাগ আলোই নেভানো। একটিমাত্র মেয়ে রিসেপশন সামলাচ্ছে। তার সামনে শিবদাস দাঁড়ানো, সঙ্গে আরও দু-জন উর্দিধারী লোক।
শিবদাস যে। কী ব্যাপার?
আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।
আসুন, আমার ঘরে আসুন।
নার্সিং হোমে নিজের সুন্দর করে সাজানো অফিসে নিয়ে গিয়ে শিবদাসকে বসিয়ে নিজের রিভলভিং চেয়ারে গিয়ে বসে বিশ্বদেব।
বলুন।
আজ একটা গুরুতর কথা বলতে আসা।
বলুন না।
রিগার্ডিং বাবলু।
বাবলুকে নিয়ে আবার কী হল?
আপনি কি জানেন যে বাবলু ওয়াজ ইন লাভ উইথ রাখী?
ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তির সঙ্গে বিশ্বদেব বলে, হ্যাঁ, এরকম একটা উড়ো খবর শুনেছি।
উড়ো খবর নয়। বাবলুর বন্ধুরা কবুল করেছে যে, ব্যাপারটা সত্যি।
এরকম হওয়া বিচিত্র নয়। তবে ডিসগাস্টিং।
কথাটা হল, মার্ডার বা সুইসাইড বা যেকোনো চেষ্টা হয়ে থাকলে আমাদের একটা নিয়মমাফিক এনকোয়ারি করতেই হবে। সে ক্ষেত্রে লাভ অ্যাঙ্গেল বাদ যাবে না।
মেয়েটা সেরে উঠবে শিবদাস, ডাক্তাররা সেরকমই ভরসা দিচ্ছে। জ্ঞান ফিরলে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখলে হবে।
তবু কথাটা আপনাকে জানিয়ে রাখছি। পাবলিসিটি হয়তো পুরোটা এড়ানো যাবে না। বাবুলকে আমি একটু সাবধান করে দিয়েছি।
বাবলু কলকাতায় থাকে, এ ব্যাপারে তার দায় কতটা তা ভেবে দেখার ব্যাপার।
ইদানিং নাকি মেয়েটা বাবলুকে অ্যাভয়েড করছিল। বাবলু তাতে খুবই অ্যাজিটেটেড। ও মেয়েটাকে ছাড়তে চায় না। আমি ওকে বলেছি মেয়েটা যখন চাইছে না তখন ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। আপনিও বাবা হিসেবে ওকে কথাটা বুঝিয়ে দেবেন।
ঠিক আছে। আর কিছু?
হ্যাঁ, রিগার্ডিং সিকিউরিটি।
সিকিউরিটি!
হ্যাঁ। মৃন্ময়ী বলছেন এটা অ্যাটেম্পট অভ মার্ডার। যদি তাই হয়, তাহলে রাখী হয়তো আততায়ীকে চেনে। সে ক্ষেত্রে যদি রাখী সারভাইভ করে, তাহলে আততায়ীর বিপদ। তাই আততায়ী রাখীকে আর একবার মার্ডার করার চেষ্টা করবে না কে বলতে পারে।
মাই গড, আমি তো এ-দিকটা ভাবিনি।
ভাববেন কেন? এসব ভাবনা পুলিশের জন্য। আর আপনার নার্সিং হোমে পুলিশ মোতায়েন করার সুবিধে নেই। বড্ড ইজি অ্যাকসেস। হাসপাতালে একটা আইসোলেশনে হাই সিকিউরিটি ওয়ার্ড আছে। এখানে তো জানালায় গ্রিল অবধি নেই।
তা ঠিক, কিন্তু ট্রিটমেন্টটা এখানে বেটার হবে। যদি বলেন তো আমি চব্বিশ ঘন্টা নজরদারির ব্যবস্থা করতে পারি।
রিস্ক তবু থাকবেই। ডাক্তারেরা অবশ্য রিমুভ করতে বারণ করছে। পয়জনিংয়ের ফলে নাকি হার্টটা খুব উইক। সামান্য শকে ফ্যাটালিটি ঘটতে পারে।
হ্যাঁ। কেসটা এখনও পুরো কন্ট্রোলে নেই।
শিবদাস বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর বিশ্বদেব রাখীর কেবিনে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে রাখীর দিকে চেয়ে রইল। চোখে একটু জল চিকচিক করছে।
একজন ডাক্তার এবং নার্স পিউ মজুমদার ঘরে ঢুকলে বিশ্বদেব অশস্তি বোধ করে।
ডাক্তার তাকে দেখে হেসে বলে, গুড মর্নিং স্যার। কেমন আছেন?
আপনিই তো একে দেখছেন।
হ্যাঁ।
কেমন মনে হচ্ছে?
বেঁচে যাবে বলেই তো মনে হয়।
সেটা কতদিনে বোঝা যাবে?
বলা মুশকিল। কোমাটা না কাটলে অ্যাসুয়েরেন্স দেওয়া যাচ্ছে না। হার্টটা নিয়েই প্রবলেম। কিডনি বেশ খানিকটা ড্যামেজড। তবে শি ইজ অ্যাপারেন্টলি ইমপ্রুভিং।
কোনো কথাটথা কি বলেছে?
না। কথা বলার মতো সিচুয়েশন আসেনি।
সারভাইভ্যাল চান্স কতটা?
ফিফটি টু সিক্সটি পারসেন্ট।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর পিউ বলল, একটা কথা বলব স্যার?
বলো।
রাগ করবেন না। রাখী বেশ ভালো মেয়ে।
আমি জানি।
বাবলু ওকে ভালোবাসে।
বিশ্বদেব হঠাৎ হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলে, ওসব ভালোবাসাসির কথা আর বোলো না। আজকাল পাঁচ বছর প্রেম করার পর যে বিয়ে হয় তা পাঁচমাস টিকছে না। অল বোগাস।
কিন্তু
বিশ্বদেব হাত তুলে পিউকে থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বিরক্তির সঙ্গে বলল, আজকাল এত ভালোবাসার কথা শুনি যে আমার অ্যালার্জি হওয়ার জোগাড়। মেয়েটা এখনও সিরিয়াস কণ্ডিশনে পড়ে আছে, এটা কি ওসব কথা বলার সময়? তোমার কান্ডজ্ঞান কবে হবে?
পিউ থতমত খেয়ে বলে, সরি স্যার। বাবলু খুব ভেঙে পড়েছে দেখে বলে ফেলেছি।
আমি জানি, বাবলুর প্রতি তোমার একটা দিদিসুলভ টান আছে। ওকে বরং বুঝিয়ে বোলো, এখন এসব রোমান্টিক চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ক্যারিয়ারে মন দিক। কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশে যাবে, সেখানে বিস্তর পড়াশুনো করতে হবে। অন্য দিকে মন পড়ে থাকলে কী করে দাঁড়াবে? হৃদয়দৌর্বল্য কোনো কাজের জিনিস নয়, জঞ্জালবিশেষ। মানুষের বারোটা বাজায়, তার বিনিময়ে দেয় না কিছুই।
ঠিক আছে স্যার, আমি বাবলুকে বোঝানোর চেষ্টা করব।
বাড়িতে ফিরে বিশ্বদেব কিছুক্ষণ বাইরের খোলা অন্ধকার বারান্দায় চুপচাপ বসে রইল। পরিস্থিতি কি একটু ঘোরালো হয়ে উঠছে? কর্মফল বলে কিছু একটা আছে, যার ফল এখন নানাভাবে ফলছে! বিচক্ষণ বিশ্বদেব কখনো তাকে আর মৃন্ময়ীকে নিয়ে রসালো গুজব সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ দেয়নি। তাদের নিয়ে কোনো গুঞ্জন ওঠেনি এ শহরে। এতটাই সাবধান ছিল বিশ্বদেব। কিন্তু মেয়েটার মুখে তার অবিকল প্রতিকৃতি ফুটে উঠেছে। লোকে মিলিয়ে দেখলে অবাক হবে। তারপর রাখীর হঠাৎ আত্মহত্যার এই চেষ্টা কি কোনোভাবে সেই অতীতকে আরও উন্মোচিত করে দেবে? এবং সেই সঙ্গে বিস্মৃতপ্রায় অতীত থেকে অলোকের হাত ধরে রমেন ভট্টাচার্যের পুনরাবির্ভাব কোন সংকেত দিচ্ছে? ঘটনাবলির যে প্যাটার্ন অবলোকন করছে বিশ্বদেব তাতে মনে হয়, রাশ তার হাতে নেই। নিয়তিনির্দিষ্টভাবেই একটা নাটকীয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কি তার জীবন?
গেটের বাইরে একটা মোটরবাইক এসে থামল। তারপর ফটক খুলে লম্বাপানা একটি যুবক সবল পায়ে এগিয়ে এল বারান্দার দিকে। অলোক! আশ্চর্য, বিশ্বদেব ভুলেই গিয়েছিল যে, তার বাড়িতে আজ অলোকের ডিনারের নেমন্তন্ন।
বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিয়ে বিশ্বদেব একটা উচ্চাঙ্গের হাসিতে তার উদ্বিগ্ন মুখের ছবি ঢাকা দিয়ে বলল, আরে এসো, এসো। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
অলোক একটা বেতের সোফায় বসে বলল, আমি এমন কিছু ইম্পর্ট্যান্ট লোক নই যে, আমার জন্য আপনি বারান্দায় বসে অপেক্ষা করবেন।
বারান্দাটা আমার খুব প্রিয় জায়গা। এখান থেকে বাগনটা দেখা যায়। সারাদিন মানুষ চরিয়ে এসে একটু নির্জনে বসতে ইচ্ছে করে।
হ্যাঁ, আপনি যা ব্যস্ত মানুষ।
আজকাল ভাবি এত কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে না পড়লেও পারতাম। পৌরসভা, ব্যবসা, নার্সিং হোম, সভাসমিতি। এখন বোরিং লাগে। তোমার মতো একটা কাজ নিয়ে থাকতে পারলে ভালো হত। পৃথিবী নিয়ে আর কতজন ভাবে বল। আমার ভাবনার দৌড় বড়োজোর এই শহরটা।
এ শহরটা নিয়েও তো কাউকে ভাবতে হবে। সবাই পৃথিবীর সংকট নিয়ে ভাবতে গেলে তো চলবে না।
সেও ঠিক কথা। তোমার কাজের কতদূর?
কাজ! সে তো অনন্ত। কাজের কোনো শেষ নেই।
তোমার সার্ভে শেষ হয়েছে?
প্রফেশনাল সার্ভেয়াররা কাজে নেমেছেন। পাহাড় জঙ্গল ঘুরে সার্ভে এবং ম্যাপিং বেশ। কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর ম্যানপাওয়ারও দরকার। আমরা গ্রামবাসীদের কিছু কাজে লাগিয়েছি। হঠাৎ রোজগারের সুযোগ পেয়ে তারা খুব খুশি।
আর উগ্রপন্থীরা?
আমরা তাদের অ্যাডভাইজার হিসেবে রাখছি। পার্টি ফাণ্ডে চাঁদাও দেওয়া হয়েছে। তারাও আপত্তি করছে না।
তোমার কিন্তু দুর্জয় সাহস।
না না। এসব হ্যাজার্ড সর্বত্র আছে। আমরা নেগোশিয়েট করতে শিখেছি। আমাদের তো পলিটিক্যাল অবলিগেশন নেই। সেই দিক দিয়ে গ্লোবাল ফ্রেণ্ড কারা শত্রু নয়।
আমি ইন্টারনেট থেকে তোমাদের কোম্পানির কথা জেনেছি।
ভালো করেছেন।
তোমার সম্পর্কেও খোঁজ নিয়েছি।
অলোক হেসে বলল, বেশ করেছেন। নেওয়াই উচিত।
তুমি আমেরিকায় থাক, বলনি তো?
বলার মতো কিছু নয়। কাজের জন্য থাকতে হয়।
বিয়ে করেছ?
না, আমি বিয়ে করলে বউ পালিয়ে যাবে। কারণ তার সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ এতই কম হবে যে, বাড়ি ফিরলে সে আমাকে হয়তো প্রথমে চিনতেই পারবে না। আমার মায়ের বয়স এখন বাষট্টি। আমি কুপুত্র বলে মায়ের সঙ্গেও সম্পর্ক প্রায় ছিলই না। আমার দুই দাদা আর দিদি বাইরে থাকেন। মা তাদের কাছেও যেতে চান না। অবশেষে চন্দননগরের বাড়িটার একতলায় ভাড়াটে বসিয়ে মাকে প্রায় জোর করে সিয়াটলে নিয়ে গেছি।
একা থাকতে পারেন?
সেটাই তো প্রবলেম ছিল। বুদ্ধি খাঁটিয়ে মাকে এই বুড়ো বয়সে একটা দোকান করে দিয়েছি। গ্রসারি শপ। বাড়ি থেকে এক ব্লক দূরে। আশ্চর্যের বিষয় মা কিন্তু দোকান পেয়ে মহা খুশি। গাড়ি লাগে না, সকালে ব্রেকফাস্ট করে দোকানে গিয়ে বসেন। খদ্দের সামলান, এবং ব্যাপারটা এনজয় করেন। আমিও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।
বিশ্বদেব হেসে বলল, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে।
প্র্যাকটিক্যাল বলতে পারেন।
চা খাবে?
আমার কিন্তু চায়ের নেশা নেই।
ড্রিংক কর?
না।
তাহলে শুধু কাজের নেশা?
আমার কাজটা ইন্টারেস্টিং।
এখানে তোমার থাকা খাওয়ার অসুবিধে হচ্ছে না তো?
অসুবিধে যেটা হয় তার কারণ আমি ভেজিটেরিয়ান।
সে কী? আগে বলনি কেন? আজ তো বোধহয় আমাদের বাড়িতে মাংস আর মাছের আইটেমই হয়েছে।
নো প্রবলেম। আমি ডাল ভীষণ ভালোবাসি। ডাল ভাতই যথেষ্ট।
দূর পাগল! দাঁড়াও ভিতরে গিয়ে খবর দিয়ে আসি।
আমি সিম্পল খাওয়াই পছন্দ করি। একটু অসুবিধে হয় ট্রাইবাল এরিয়ায়।
তুমি ভেজিটেরিয়ান কেন?
বাই চয়েস। আমার পশু-পাখি খেতে ইচ্ছে করে না।
এ নোবল কজ!
বলতে পারেন। তবে অনিচ্ছেটা জেনুইন।
দাঁড়াও বাপু, গিন্নিকে বলে আসি। নইলে ডিনার টেবিলে উনি লজ্জায় পড়বেন।
কিন্তু কথাটা বলতে গিয়ে বিশ্বদেবকে আহাম্মক বনতে হল। শর্মিলা মৃদু হেসে বলল, উনি যে ভেজিটেরিয়ান সে তো আমরা জানি।
জানো! কী করে জানো?
শমির্লা হেসে কুটিপাটি হয়ে বলল, স্বস্তি খবর এনেছে।
আহা, স্বস্তিই বা জানবে কী করে?
রুচিরা গম্ভীর হয়ে বলে, কেউ ওকে বলেছে হয়তো। তুমি ব্যস্ত হোয়ো না, তোমার অতিথির সম্মানে আজ আমাদের পুরো ভেজিটেরিয়ান ডিনারই হচ্ছে। আর তাতে আমাদের তেওয়ারি ভীষণ খুশি।
যাক, একটা দুশ্চিন্তা গেল।
ফের বরান্দায় ফিরে এসে বিশ্বদেব দেখল, অলোক নিঝুম হয়ে বসে আছে।
কী ভাবছ?
কিছুই না।
বোধহয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কথা!
সেটা ভাবতে হয় না, সর্বদাই মনে একটা ভয়ের মতো বাস করে। তুমি বরং একটা সফট ড্রিংক নাও। শুধু মুখে বসে থাকছ ভালো দেখাচ্ছে না।
ব্যস্ত হবেন না। অনেক জায়গায় আমাদের দিনের পর দিন খাবার জোটে না। সফট ড্রিংকস আপনারাও খাবেন না। আল্টিমেটলি ওতে চিনি ছাড়া কোনো বিভারেজই থাকে না।
জানি। তবু তো সবাই বোতল বোতল খাচ্ছে।
তা ঠিক। তবে দেশে আগে যে সোড়া বা লেমোনেড পাওয়া যেত তা অনেক ভালো ছিল।
ঠিকই বলেছ। সেই স্বাদ ভোলার নয়।
ফটক খুলে একটি মেয়ে ঢুকল।
স্বস্তি! কোথায় গিয়েছিলি?
একটি নীল চুড়িদারে স্বস্তিকে দারুণ দেখাচ্ছে। মুখে তেমন কোনো দৃশ্যমান প্রসাধন নেই, বাঁ-হাতের কবজিতে একটা পুরুষালি ঘড়ি ছাড়া কোনো আভরণও নেই। মিষ্টি গলায় বলল, নার্সিং হোমে। রাখীকে দেখে এলাম।
ও। কেমন দেখলি?
তুমি তো গিয়েছিলে আজ, পিউদি বলছিল।
হ্যাঁ
একটু একটু তাকাচ্ছে কিন্তু। মনে হয় বেঁচে যাবে, না?
বাঁচবে।
ডাক্তাররা তোমাকে বলেছে?
হ্যাঁ। বয়সের জোর তো আছে, কমপ্লিকেশন কাটিয়ে উঠবে।
কিন্তু ওকে যদি হাসপাতালে শিফট করে?
দেখা যাক। শিবদাস অবিবেচক লোক নয়। ইচ্ছে করলে ওরা নার্সিং হোমে সিপাই রাখতে পারে। আমার আপত্তি নেই। এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই আয়।
আমি ওকে চিনি। যদিও আলাপ নেই।
আলাপ কর না। ও হচ্ছে
জানি। তোমার কাছেই তো শুনেছি! রাখীর কাছেও।
অলোক মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ, রাখীর সঙ্গে আমার একটা চান্স মিটিং হয়ে যায়, তারপর উই বিকেম ফ্রেণ্ডস।
রাখী আপনার কথা আমাদের কাছে বলেছে। আপনি নাকি খুব মিশুক মানুষ।
তা বলতে পারেন। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করারই চেষ্টা করি। আমরা যে গ্লোবাল ফ্রেণ্ডস।
আপনি রাখীর বন্ধু, রাখী কেন সুইসাইড করার চেষ্টা করল তা জানেন?
সেটা তো আমার জানার কথা নয়।
আন্দাজ করতে পারেন না?
না। উই আর নট দ্যাট ক্লোজ।
রাখী কিন্তু অন্য কথা বলে।
স্বস্তির গলা উপরে চড়ছে দেখে বিশ্বদেব অস্বস্তি বোধ করে বলে, ও কী স্বস্তি? তুমি কি রাখীর কারণে একে চার্জ করছ নাকি? ভুলে যেও না, অলোক আজ আমাদের অতিথি।
স্বস্তি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, সরি বাবা। আই অ্যাপোলোজাইজ। যাচ্ছি।
বলে স্বস্তি এক ঝটকায় পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।
বিশ্বদেব বলল, কিছু মনে কোরো না অলোক। আমার ছোটো মেয়ে একটু মুডি।
না। মনে করার কী আছে। উনি হয়তো আর কিছু ভেবে নিয়েছেন। রাখী ভালো মেয়ে।
খুব তেজিও। জানো বোধহয়!
রাখীর সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশিদিনের নয়। পাহাড়ে একদল মেয়ে পিকনিক করতে গিয়েছিল, আমি তখন তাঁবুতে থাকতাম। সেই সময়ে হঠাৎ আলাপ হয়। আমার মিশন জেনে উনি আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন। খুব ইন্টেলিজেন্ট প্রশ্ন। তারপর কয়েকবার বাড়িতে চা খেতে ডাকেন। এভাবেই একটা চেনাজানা তৈরি হয়ে যায়। আপনার মেয়ে হয়তো মনে করে সম্পর্কটা তার চেয়েও গভীর কিছু।
তাহলেই বা ক্ষতি কী?
ক্ষতি আছে।
কী ক্ষতি অলোক?
আমি ঠিক ওরকম নই।
তোমাকে দেখেও আমার মনে হয়েছে তুমি লঘুচিত্ত নও। তুমি একজন ডেডিকেটেড ভলান্টিয়ার। এ কারেজিয়াস ম্যান। ইগনোর স্বস্তি, ওর কথায় কান দিও না।
ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি।
একটু বাদে খাওয়ার টেবিলে যখন দেখা হল তখন স্বস্তির মুখখানা থমথমে, তবে সে অলোককে উপেক্ষার ভাব দেখাল না। প্রথমেই বলল, জানেন তো আপনার সম্মানে আমরা সবাই আজ নিরামিষ খাব।
অলোক বিস্মিত হয়ে বলল, তা কেন? আপনারা মাছ-মাংস খেতেই পারেন।
নাঃ, আপনার একটা সম্মান আছে না?
আছে বুঝি! বলে অলোক হো হো করে হাসল।
আর লজ্জায় রাঙা হয়ে কুঁকড়ে গেল স্বস্তি।
টুলু খুব মন দিয়ে লক্ষ করছিল অলোককে। বলল, আপনি সিয়াটলে থাকেন?
ওটা আমার আস্তানা বলতে পারেন। কিন্তু থাকা আর হয় কই? কেবল ছোটাছুটি করে বেড়াতে হয়।
কোথায় কোথায় যেতে হয় আপনাকে?
যেখানে জল সেখানেই আমি। খাল, বিল, সমুদ্র, গ্লেসিয়ার, প্রাইমা ফ্রস্ট সবই আমার বিষয়।
জল নিয়ে গবেষণাটা কী ব্যাপার বুঝিয়ে বলবেন?
জলই তো ভবিষ্যতে সমস্যা হয়ে উঠবে। অতি-জল এবং জলহীনতা। ভূপৃষ্ঠ থেকে কয়েকটা দেশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ডাঙায় দেখা দেবে জলকষ্ট। আবহাওয়া যাবে পালটে, এই ওলটপালটের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস। সভ্যতার বেহিসেবি অগ্রগমনের খাজনা দিতে হবে মানুষকে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ব্যাপার তো!
হ্যাঁ। ঠেকাতে পারবেন?
মানুষের চৈতন্য হলে ঠেকানো যাবে।
আপনি যে দেশে থাকেন সেই আমেরিকাই তো সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস বাতাসে ছাড়ে।
হ্যাঁ। তারা কোনো নিয়ন্ত্রণ মানতে চায় না। ভোগবাদ টসকালে তারা বিগড়ে যায়।
আপনি প্রাইমা ফ্রস্টের কথা বললেন। কিন্তু সে তো শুধু পোলার রিজিয়নে পাওয়া যায় শুনেছি। তার মানে আপনি পোলার রিজিয়নেও গেছেন?
না গেলে চলবে কেন?
তার মানে গেছেন?
হ্যাঁ।
কোনটাতে?
অলোক মৃদু হেসে বলে, দুটোতেই।
এবং অনেক বার।
মাই গড!
পৃথিবীর যথার্থ অবস্থা বুঝতে গেলে দুটো পোলেই যাওয়া দরকার।
গিয়ে কী বুঝলেন?
আমি তো একা যাইনি। টিমের সঙ্গে গিয়েছিলাম। দলে অনেক বিশেষজ্ঞ ছিলেন। নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হয়েছে। আমার কাজ ছিল কিছু অ্যানালাইসিস।
তাঁবু খাঁটিয়ে থাকতে হত?
দক্ষিণমেরুতে অনেক নিষেধাজ্ঞা আছে। খুব সাবধানে চলতে ফিরতে হয়। কোনো জন্তু জানোয়ারের কাছে যাওয়া যায় না, কোনো বর্জ্য ফেলা যাবে না। এমনকী স্পিটিং-ও চলবে না। একজন মুখের চুইংগাম ফেলেছিল বলে তাকে দেড় ঘন্টা ধরে সেটা খুঁজে বের করে পকেটস্থ করতে হয়েছিল। আমরা জাহাজে থাকতাম, তবে মোটোর স্লেড-এ করে অনেকটা ভেতরে যেতে হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের একটা স্থায়ী ক্যাম্পও ওখানে আছে। সেখানেও কিছুদিন থেকেছি। অ্যান্টার্কটিকা ইজ এ ম্যাগনিফিসেন্ট প্লেস।
আর ঠাণ্ডা?
সাংঘাতিক। ঈশ্বরের কাছে আমাদের সকলের প্রার্থনা, আর্কটিকা বা অ্যান্টার্কটিকা যেন কখনো তার শীতলতা না হারায়, বরং আরও শীতল হয়। পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য তাদের ঠাণ্ডা থাকা দরকার।
এসব আমরা কিছু কিছু জানি। আপনার কোম্পানি এর অ্যান্টিডোট হিসেবে কী করতে চায়?
শুধু আমাদের কোম্পানি কেন, পৃথিবীর বহু সায়েন্টিস্ট এবং সায়েন্টিফিক অর্গানাইজেশন কাজ করছে। কিন্তু হিউম্যান হ্যাবিটস এবং বিহেভিয়র নিয়ন্ত্রিত না হলে কিছুই হওয়ার নয়। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে, বিশেষ করে থার্ড ওয়ার্ল্ডে হিউম্যান হ্যাঁবিট্যাট বাড়ছে, নগরায়ণ হচ্ছে, জঙ্গল সাফ করা চলছে। এমনকী ব্রাজিলের রেইন ফরেস্ট-ও রেহাই পাচ্ছে না। এর ফল ভয়াবহ। এখনও যদি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, গাছ কাটা বন্ধ না করা যায় তাহলে পৃথিবীর সাংঘাতিক বিপদ। ম্যালথাসের থিওরি অনুযায়ী প্রকৃতিই নির্মমভাবে লোকক্ষয় ঘটিয়ে ভারসাম্য আনবে। আমরা প্ল্যান করে জনসংখ্যা যদি না কমাতে পারি তাহলে প্রকৃতিই তা করবে, তবে সেটা ঘটবে অতি নিষ্ঠুরভাবে।
আপনি তো ভয় ধরিয়ে দিচ্ছেন মশাই!
হ্যাঁ, আমরা সাধারণ মানুষরা তো ভয় পাচ্ছিই, কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানরা যে পাচ্ছেন না। আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ মানতে চায় না, ইউরোপ মানতে চায় না, পশ্চিম এশিয়া মানতে চায় না। এই পশ্চিমবঙ্গেই তো ইণ্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন যত ইণ্ডাস্ট্রি তৈরি হবে ততই জমি, তৃণভূমি, জঙ্গল লোপাট হবে, ততই ক্ষতি হবে পৃথিবীর।
আপনি জল নিয়ে কাজ করেন শুনেছি।
হ্যাঁ, জল আমাদের বন্ধু, আবার শত্রুও।
আপনি কি সায়েন্টিস্ট?
মৃদু একটু হেসে অলোক বলল, সায়েন্টিস্ট বললে বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। যেটুকু সায়েন্স জানলে চাকরিটা বজায় রাখা যায় সেটুকু জানি। আমরা উদ্বাস্তু, গরিব, বাবা আমাকে যথাসাধ্য লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যতটা সচ্ছলতার প্রয়োজন ছিল, তা তো আমাদের ছিল না। ফলে লেখাপড়া বারবার বাধা পেয়েছে।
গ্লোবাল ফ্রেণ্ড ইনকরপোরেটেড কি খুব বড়ো কনসার্ন?
হ্যাঁ। বিগ কনসার্ন।
টেকনিক্যাল লোক না হয়েও আপনি এখানে চাকরি পেলেন কীভাবে?
সে একটা মজার গল্প।
মজার গল্প? মজার গল্প শুনতে আমরা সবাই ভালোবাসি।
বিশ্বদেব এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার সেও বলল, হ্যাঁ, মজার গল্পটা শুনিয়ে দাও।
অলোক বলল, রসায়নে এম.এস.সি. পাশ করে আমি একটা ছোটো মফস্সল শহরের কলেজে অধ্যাপনা করতাম। কিন্তু অধ্যাপনা মানেই সিলেবাসে আটকে যাওয়া। বিশ্বের বিজ্ঞানে রোজ নতুন নতুন থিয়োরি আসছে, পুরনো সংজ্ঞা পালটে যাচ্ছে, কত কী আবিস্কার হচ্ছে। অধ্যাপনার জালে আটকে গিয়ে আর সেসবের খবরই রাখা হচ্ছিল না। তবে পাগলামিবশত আমি বিদেশি জারনালে আমার নানা ভাবনাচিন্তার কথা লিখে পাঠাতাম। বেশির ভাগই ছাপা হত না। তবে একটা-দুটো বেরিয়েও যেত। গ্লোবাল ফ্রেণ্ডেরও বেশ কয়েকটি পত্রিকা বেরোয় আমেরিকায়। আমি তাদের পত্রিকাতেও লেখা পাঠাই। রিসার্চ গ্রুপের এক কর্তা হঠাৎ আমাকে একটা চিঠি লিখে জানালেন যে, তিনি কলকাতায় আসছেন, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করলে খুশি হবেন। আমি গিয়েছিলাম। দেখলাম, ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ, প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষ। আমার সঙ্গে ঘণ্টাখানেক গল্প করলেন। তার মধ্যে তিনি বারবার আমার ভাবনাচিন্তা সম্পর্কে প্রশ্ন করছিলেন। আমি তখনও বুঝতে পারিনি যে, উনি আসলে আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। শেষে আমাকে বললেন, আমাদের কোম্পানি কিছু পাগলকে রিক্রুট করতে চায়, যেসব পাগলের চিন্তার ধারা কোনো পূর্বসিদ্ধান্তের দ্বারা শৃঙ্খলিত নয়। মনে আছে তিনি ওয়াইল্ড থিংকার শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন।
তারপরই চাকরি?
প্রায় বারো মাস বাদে আমাকে চাকরি দেওয়া হয়।
কোথায় জয়েন করলেন?
সিয়াটলে।
সেখানেই সেটল করবেন?
জানি না। তবে থাকা তো আর হয় না। যেখানে যেখানে কোম্পানি কাজ পায়, সেখানেই ছুটতে হয়।
আর আপনার মা? তিনি কোথায় থাকবেন?
মায়ের কথা আর কী বলব। আমি কুপুত্র, তাই এই বুড়োবয়সে, যখন আমাকে তাঁর সবচেয়ে বেশি দরকার, তখন আমি তাঁর কাছে থাকতে পারি না। আর আমাকে ছাড়া মা-ও বড় অসহায় বোধ করত। সেইজন্য মাকে আমি সিয়াটলে একটা দোকান করে বসিয়ে রেখেছি। ছোটো গ্রসারি শপ এখন দেখছি, এই বাষট্টি বছর বয়সে মা দোকানটা নিয়ে দিব্যি মেতে আছেন। দোকান থেকে এক ব্লক দুরে আমাদের বাড়ি। কাজেই গাড়ি চালাতে না জানলেও মা-র অসুবিধে হয় না।
আপনি গ্রিনকার্ড হোল্ডার না সিটিজেন?
গ্রিনকার্ড। সিটিজেন হওয়ার ইচ্ছে নেই।
ফিরে আসার ইচ্ছে আছে তাহলে?
যাওয়া বা ফেরার কথা ভাবি না। আমি তো সারা দুনিয়ায় দৌড়ে বেড়াচ্ছি। যাওয়া বা ফেরা কোনোটাই বুঝতে পারি না। আর এই ছোটাছুটি করতে করতে কোনো বিশেষ দেশ নয়, পৃথিবীটাকেই আমার বড় ভালো লাগে। গোটা পৃথিবীটাই যেন আমার দেশ।
বিশ্বদেব বলল, দ্যাটস এ নোবেল থট। আসলে পৃথিবীটাই তো আমাদের দেশ হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা ছোটো করে ভাবি বলে যত গন্ডগোল।
হঠাৎ টুলুর দিকে চেয়ে অলোক বলল, আপনার রুগির কী খবর?
রুগি! কে রুগি বলুন তো!
আমি রাখীর কথা জিজ্ঞেস করছি।
রাখী ঠিক আমার আণ্ডারে নেই। মেডিসিনের লোকদের আণ্ডারে আছে। তবে অপারেশনের দরকার হলে অন্য কথা। কেন, আপনি কি রাখীকে চেনেন নাকি?
ঠিক সে-রকম চেনা নয়। উনি একটা দলের সঙ্গে পিকনিক করতে জঙ্গলে গিয়েছিলেন। আমরা তখন সেখানে তাঁবু মেলে কাজ করছিলাম। উনি কৌতূহলী হয়ে এসে আলাপ করেন।
শুধু আলাপ?
হ্যাঁ। উনি আমাদের মোড অফ অপারেশনস জানতে চেয়েছিলেন।
এটা কবেকার ঘটনা?
মাস খানেক আগে। তখনই মনে হয়েছিল কোনো কারণে উনি খুব আপসেট। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন।
টুলু অবাক হয়ে বলল, কেন আপসেট তা বলেছিল?
নট ইন সো মাচ ওয়ার্ডস। সদ্য চেনা কাউকে বলবেই বা কেন? আমিও ভদ্রতাবশে কৌতূহল দেখাইনি। শুধু বলেছিলাম, ওয়াচ ইওর স্টেপস। আপনি খুব আনমাইণ্ডফুল আছেন। উনি বলেছিলেন, হ্যাঁ, সেটা ঠিক কথা।
আর কিছু নয়?
না। শুধু বলেছিলেন, একজন লোক ওর জীবনটাকে নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কারো নাম বলেননি।
মাই গড! এসব তো আমরা জানতাম না।
.
খাওয়ার পর অলোক বিদায় নিতেই স্বস্তি ঘোষণা করল, লোকটা চালিয়াৎ, মোটেই সত্যি কথা বলেনি।
শর্মিলা অবাক হয়ে বলে, কী করে বুঝলি?
কেমন ক্যাবলা টাইপের দেখলে না! গুলগল্প ঝেড়ে গেল। পোশাক দেখলেই তো বোঝা যায়, একদম গোবরগণেশ। খোঁজ নিয়ে দেখো, মোটেই সিয়াটলে থাকে না।
বিশ্বদেব খুব শান্ত গলায় বলল, খোঁজ আমার নেওয়া হয়ে গেছে। আমি আজ সকাল দশটায় এদের দিল্লি অফিসে ই-মেইল করে অলোকের পজিশন জানতে চাই। তারা যে-জবাব পাঠিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, অলোক সিয়াটলে থাকে। গ্লোবাল ফ্রেণ্ডের রিসার্চ গ্রুপের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট। আমেরিকায় ডক্টরেট করেছে।
স্বস্তি একটু লাল হয়ে বলল, তাহলেই-বা কী? মোটেই ভালো লোক নয়। কেমন যেন দেমাকি।
শর্মিলা হেসে ফেলে বলল, স্বস্তি, সত্যি করে বলো তো, ছেলেটাকে তোমার পছন্দ হয়ে যায়নি তো!
যাঃ, কী যে বল বউদি!
বলেই স্বস্তি পালিয়ে গেল।
বিশ্বদেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ছেলেটা মন্দ নয়। বুঝলে রুচিরা, স্বস্তির জন্য ভাবছিলাম। কিন্তু এ-ছেলে তো সংসারধর্মই করতে পারবে না। সারাবছর বাইরে বাইরে থাকলে সংসার করবে কখন?
তা হোক? আমার অপছন্দ নয়।
শর্মিলা বলল, আমারও খুব পছন্দ বাবা।
টুলু ভ্রূ কুঁচকে কী ভাবছিল। বলল, আমি ভাবছি অন্য কথা।
বিশ্বদেব বলল, কী কথা?
রাখীর সঙ্গে ছোকরা আবার ঝুলে পড়েনি তো? রাখীর সুইসাইডের অ্যাটেম্পটে এ ছোকরারও অবদান থাকতে পারে। এ হয়তো রিফিউজ করেছে।
শর্মিলা অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বলে, হতেই পারে না।
কেন পারে না?
রাখী কখনো ওর প্রেমে পড়েনি।
বলতে চাও অন্য কারো প্রেমে পড়েছে?
হ্যাঁ।
সে কে?
সেটা বলা যাবে না।
.
হোটেলের ঘর। রমেন ভট্টাচার্য আর মৃন্ময়ী।
রমেন বলল, মৃন্ময়ী, আমি তোমাকে ব্ল্যাকমেল করতে আসিনি। এসেছি অফিসের কাজে। যদি প্রজেক্টটা হয়, তবে হয়তো আগামী দু-তিন বছর আমাকে এখানে ঘন ঘন আসতে হবে এবং বেশ অনেকদিন করে থাকতে হবে। সেটা কথা নয়। আসল কথা আমি সব জেনে এবং বুঝেও তোমার সঙ্গে একটা আপসরফায় আসতে চাই। তুমি ভেবে দেখো।
কীরকম আপসরফা চাও তুমি?
রিকনসিলিয়েশন।
সেটা কি সম্ভব! এতদিন পরে?
সেটাই তো ভেবে দেখতে বলছি তোমাকে।
আর রাখী?
রাখী আমার সন্তান নয় জানি। কিন্তু ওর প্রতি মায়া আছে।
আছে?
হাঁ। ওর দু-তিন বছর বয়স পর্যন্ত নিজের মেয়ে মনে করে ওকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু বড়ো হওয়ার পর দেখলাম ওর মুখে আমার বা তোমার আদল নেই। তৃতীয় ব্যক্তির আদল। সেই ব্যক্তি বিশ্বদেব। তখনই আমি ডিভোর্স করি।
সব মনে আছে।
অভিযোগ তুমিও অস্বীকার করনি।
কেন করব? আজকাল ডি.এন.এ. টেস্টে সত্য গোপন থাকে না।
ঠিক কথা। কিন্তু এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পর ভেবে দেখলাম দুনিয়ায় একা বাঁচা যায় না। আমার তো কেউ নেই। তুমি-আমি দু-জনেই অনেক বদলে গেছি।
আমাকে কি তোমার আর বিশ্বাস হবে?
বললাম তো, এ-বয়সে মানুষের দায়বদ্ধতা এসে যায়। ভেবে দেখো।
বিয়ে করনি কেন?
ভয়ে। নতুন মানুষ এনে ফের যদি বিপাকে পড়ি?
নারীহীন জীবন?
তা বলতে পারি না। ওসব কথা থাক। আমি সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।
আমি ভাবব, মেয়েটার জন্যে উদ্বেগে আমার মাথার ঠিক নেই।
জানি, মেয়েটা কি আমার কথা বলত?
খুব। তারপর ধীরে ধীরে অ্যাডজাস্ট করে নিল। তুমি কি ওকে নিজের মেয়ের মতো ভাবতে পারবে?
নিজের মেয়ে তো নেই, তাই সেটা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ওই তো বললাম, ওকে অ্যাকসেপ্ট করতে অসুবিধে হবে না।
.
সকালে বিশ্বদেব যখন বারান্দায় বসে খবরের কাগজ দেখছে, তখন রুচিরা এল, পরনে হাউসকোট।
তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।
বলো।
ওই অলোক ছেলেটিকে তোমার কেমন লাগে?
ভারি ভালো।
কত মাইনে পায় জান?
হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
স্বস্তির জন্যে ভাবছি।
আরে স্বস্তি তো এখনও নাবালিকা।
তোমার নাবালিকা মেয়ের বয়স আঠারো পেরিয়েছে।
তাতে কী? বিয়ের কথা ভাববার বয়স তো নয়।
শোনো, স্বস্তি লেখাপড়ায় তেমন ভালো নয়, মন নেই। আমার মনে হয় ও বেসিক্যালি হাউসওয়াইফ টাইপ। ঘর-সংসার করার আগ্রহ বেশি।
স্বস্তি কি ওর প্রতি ইন্টারেস্টেড?
অ্যাপারেন্টলি না। বরং উলটোই।
কীরকম?
বউমাকে বলেছে, ছেলেটাকে ওর নাকি একটুও ভালো লাগে না। কেমন জংলি টাইপ, বোকা-বোকা, আনমনা, এইসব।
তাতে বোঝা গেল ওর পছন্দ নয়।
আবার উলটো বুঝলে। ওসব বলা মানেই ও ইন্টারেস্টেড। একটু বেশিই ইন্টারেস্টেড, সেটা ঢাকা দিতেই ওসব বলছে।
উঃ বাপ রে! এ তো দেখছি সাংঘাতিক ভুলভুলাইয়া!
এবার বলো, অলোক কত মাইনে পায়?
মাইনে তোমার মনোমতো না হলে কি পাত্র খারিজ?
না, তা নয়। ওকে আমার ভারি ভালো লেগেছে।
তাহলে মাইনে-ফাইনে গুলি মেরে বিয়ে লাগিয়ে দিলেই তো হয়। পুরুষমানুষ যেমন করেই হোক বউকে ঠিকই খাওয়াতে পারবে। কিন্তু কথা হল অলোকের মতটাও তো নেওয়া দরকার।
সেটার জন্যই তোমাকে লাগবে। ওর মতটা জেনে নাও।
বড্ড তাড়াহুড়ো করছ। অলোক সম্পর্কে আরও একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার।
তাড়াহুড়ো করব কেন? প্রস্তাবটা দিয়ে রাখলাম। এখন খোঁজখবর যা করার তুমিই করো।
টুলু আর শর্মিলা কি জানে?
খুব জানে। শর্মিলাই তো আমাকে বলল, মা, স্বস্তি কিন্তু বেহেড।
.
নার্সিং হোমে রাত্রি বেলা একা ঘরে হঠাৎ রাখীর জ্ঞান সামান্য সময়ের জন্যে ফিরে আসে। কিন্তু চোখের দৃষ্টি শূন্য, কর্তব্যরত নার্স গিয়ে ডাক্তারকে খবর দেয়। ডাক্তার আসে।
মিস ভট্টাচার্য। কেমন আছেন?
রাখী জবাব দেয় না। চেয়ে থাকে।
ডাক্তার আরও কিছু প্রশ্ন করে। আঙুল দেখিয়ে কটা আঙুল জিজ্ঞেস করে। রাখী নিরুত্তর।
কিছুক্ষণ পর রাখী ফের আচ্ছন্নতায় ডুবে যায়।
ডাক্তার চিন্তিত মুখে বলে, লস অফ মেমরি মনে হচ্ছে। নার্স, সাইকিয়াট্রিস্ট মুকুল সেনকে কল দিয়ে রাখুন।
সকালে মুকুল সেন আসে, আবার রাখীর জ্ঞান ফিরে এলে, মুকুল সেন কিছু প্রশ্ন করে। রাখী জবাব দেয় না। কিন্তু চারদিকে তাকায়। অস্থিরতা প্রকাশ করে।
মৃন্ময়ী এবং রমেন ভট্টাচার্য একসঙ্গে ঘরে ঢোকেন।
রাখী মৃন্ময়ীকে চিনতে পারে না। কিন্তু কিছুক্ষণ রমেনের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ফের আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
ডাক্তার মুকুল সেন বললেন, টেমপোরারি মেমোরি লস বলেই মনে হচ্ছে।
রমেন জিজ্ঞেস করে, চান্স অফ সারভাইভ্যাল কতটা?
মুকুল সেন বলেন, শি উইল কাম অ্যারাউণ্ড।
মেডিসিনের ডাক্তার বললেন, শি ইজ ইমপ্রুভিং, কনটিনিউয়াস ইসিজি চলছে। এখনও পর্যন্ত অ্যালার্মিং কিছু পাওয়া যায়নি। তবে হার্ট ইজ উইক।
ডাক্তাররা বেরিয়ে গেলে রমেন আর মৃন্ময়ী পরস্পরের দিকে তাকায়।
মৃন্ময়ী হঠাৎ বলে, রাখী তোমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল কেন বলো তো!
রমেন মাথা নেড়ে বলে, জানি না, তবে দেখলাম তাকিয়ে যেন চেনার চেষ্টা করেছিল। অথচ আমি ওর কেউ নই। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত।
বাড়ি চলো।
দাঁড়াও। সবে তো এলাম। আবার হয়তো জ্ঞান ফিরবে।
না। বাড়ি চলো। আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি। তোমাকে বলা দরকার।
এখনই?
হ্যাঁ। আমার মন বলছে রাখীর জন্যে আর চিন্তা নেই। ও বাঁচবে। চলো, আমাদের কথাটা জরুরি।
চলো। নার্স, প্লিজ মেয়েটার ওপর নজর রাখবেন।
নার্স হেসে বলল, চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখা হচ্ছে। এটা আই.সি.ইউ., কাজেই নজর রাখাই নিয়ম। তার ওপর সাদা পোশাকের পুলিশও আছে বাইরে।
পুলিশ! পুলিশ কেন?
তা, জানি না। বোধহয় জ্ঞান ফিরলে ওকে ইন্টারোগেট করা হবে।
দু-জনে বেরিয়ে আসে।
মৃন্ময়ী বাড়িতে এসে প্রথমে রমেনের জন্য কফি করে আনে। তারপর কাছাকাছি বসে বলে, শোনো, তুমি হয়তো জানো না যে, রাখী বিশ্বদেবের ছোটো ছেলে বাবলুর প্রেমে পড়েছে।
রমেনের হাতের কফির কাপ খানিকটা চলকে যায়। সে অবাক হয়ে বলে, মাই গড! বায়োলজিক্যালি ওরা ভাই-বোন।
আমার মাথা চিন্তায়-চিন্তায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বদেব জানে?
হ্যাঁ। কিন্তু জেনে কী হবে? আমি ছেলেটার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছি। কিন্তু তাতে তো ঠেকানো যাবে না।
কী করতে চাও?
আমাদের এখানকার পাট তুলে দিতে হবে।
পারবে?
রাখীর জন্যে পারতেই হবে। দরকার হলে চাকরি ছেড়ে দেব। আর তোমার প্রস্তাবে রাজি। ভেবে দেখেছি। এটাই বেস্ট অলটারনেটিভ।
দাঁড়াও। আমি যে আমার কোম্পানির কাজে এখানেই পোস্টেড।
তাহলে তুমিও চাকরি ছাড়। আমাদের অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।
তোমার ডিসিশনটা হেস্টি হয়ে যাচ্ছে। রাখী যদি যেতে না চায়?
ওর মেমরি কাজ করছে না। এখন যদি চলে যাই, তাহলে আপত্তি করতে পারবে না।
উদ্বেগে তোমার মাথা কাজ করছে না। মেমরি ফিরে এলে তখন ও মানবে কেন এই সিদ্ধান্ত।
আমি যে কিছুই ভাবতে পারছি না।
যেটা সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন সেটা হল, রাখী সুইসাইড করতে চাইল কেন?
জানি না। সত্যিই জানি না। সুইসাইড বলে আমার মনে হয় না। ওকে কেউ খুন করতে চেয়েছিল।
কেন তা চাইবে?
ও তখন বাড়িতে একা ছিল। আমার মনে হয় কোনো চেনা মানুষ এসে ওকে ছাদে নিয়ে যায়। মাথায় কিছু দিয়ে মেরে অজ্ঞান করে মুখে বিষ ঢেলে দিয়ে চলে যায়।
মৃন্ময়ী, খুনের তো মোটিভ থাকবে। উদ্দেশ্যহীন খুন তো লজিক্যাল নয়।
তুমি ঠাণ্ডা মাথার লোক। তোমার কী মনে হয়?
কোনোভাবে ও হয়তো জানতে পেরেছে ওর বাবা কে।
তুমি, আমি আর বিশ্বদেব ছাড়া আর কেউ এ-কথাটা জানে না।
ঠিক বলছ?
হ্যাঁ।
রমেন মাথা নেড়ে বলে, অঙ্ক মিলছে না।
.
বিশ্বদেবের অফিসঘরে বিশ্বদেব আর অলোক মুখোমুখি।
বিশ্বদেব বলে, বাই দি ওয়ে, তুমি কি রমেন ভট্টাচার্যকে চেনো?
কেন চিনব না? উনি আমাদের বস। আগে তা এখানেই থাকতেন। ওঁর স্ত্রী এখনও—
বিশ্বদেব হাত তুলে বাধা দিয়ে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি। রমেনের পজিশন কীরকম?
উনি সিনিয়র পোস্টে আছেন। ম্যানেজেরিয়াল র্যাঙ্ক।
শুনলাম সে এখানে এসেছে। আমার সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি। উই ওয়ার ক্লোজ ফ্রেণ্ডস।
প্রজেক্ট হলে উনি এখানেই থাকবেন। ভেরি কমপিটেন্ট ম্যান।
হঠাৎ বিশ্বদেব প্রসঙ্গ পালটে বলে, শোনো অলোক, আজ রাতেও তুমি আমাদের সঙ্গেই খাবে।
আরে, তার কী দরকার? রোজ রোজ আপনার অন্ন ধ্বংস করতে যাব কেন?
তোমার মাসিমার ইচ্ছে।
উঠে দাঁড়ায় অলোক, বলে, ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে এখন একটু সাইটগুলোতে যেতে হবে টিম নিয়ে। ফিরতে দেরি হবে।
হোক। আমরা অপেক্ষা করব।
একটু বাদেই রমেন ভট্টাচার্যকে মোটরবাইকের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলের রাস্তায় দেখা যায় অলোককে।
রমেন বলে, অলোক, প্লিজ সাবধানে চালাও। তোমার রাশড্রাইভ করার বদ অভ্যাস কেন?
অলোক তবু স্পিড কমায় না। এক জায়গায় বাইক দাঁড় করিয়ে সে তার প্ল্যান বোঝাতে থাকে।
রমেন দু-চারটি প্রশ্ন করে।
তারপর দুজনে একটা গাছতলায় বসে।
অলোক জিজ্ঞেস করে, ভট্টাচার্যদা, বউদিকে ডির্ভোস করেছিলেন কেন?
রমেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সে অনেক কথা! সব শুনতে চেও না। মেয়েরা যখন ক্যারিয়ারকে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে, তখনই সংসারের ভিত আলগা হতে শুরু করে।
মৃন্ময়ী অত্যন্ত অ্যাকমপ্লিশড হেডমিস্ট্রেসবলে শুনেছি।
ঠিকই শুনেছ, তবে শি ওয়াজ নট দ্যাট অ্যাকমপ্লিশড হাউজওয়াইফ।
আপনি সেই পুরোনো মেল শোভিনিস্টের মত কথা বলছেন।
না রে ভাই, সংসার বা পরিবার যদি গুরুত্বহীন ব্যাপার হত তাহলে মানুষ চিরকাল নোম্যাডস থাকত। পরিবার তৈরি হয়েছিল গুরুতর প্রয়োজনেই।
ফের বিয়ে করলেন না কেন?
ভয় হয়েছিল, দাম্পত্য বোধহয় আমার সইবে না। আমি অচল মুদ্রা।
এখনও তাই ভাবছেন?
হ্যাঁ। তবে আমি মৃন্ময়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।
করেছেন? সেটা আগে বলবেন তো!
মৃন্ময়ীর একটা ক্রাইসিস যাচ্ছে, জানো বোধহয়? ওর মেয়ে
অলোক অবাক হয়ে বলে, তার মানে? সে তো আপনারও মেয়ে!
কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে রমেন বলে, তোমাকে আমি খুব বিশ্বাস করি, তাই বলছি। মেয়েটি আমার নয়। কার তা জিজ্ঞেস কোরো না। কিন্তু মেয়েটাকে আমার কখনো ঘেন্না করতে ইচ্ছে হয়নি।
সরি ভট্টাচার্যদা, বোধহয় একটা সেনসিটিভ প্রসঙ্গ তুলে ফেললাম।
না যা সত্য তাকে কি আর চিরকাল চাপা দিয়ে রাখা যায়? মেয়েটা কেন সুইসাইড করতে চেয়েছিল সেটা জানা দরকার। আরেকটা কথা, মৃন্ময়ীর সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়াও হয়েছে।
সত্যি! কনগ্রাচুলেশনস।
ইট ইজ অ্যান অ্যাগ্রিমেন্ট ইন ক্রাইসিস। মৃন্ময়ীর বোধহয় এখন আমাকেই দরকার। আমারও দরকার মৃন্ময়ীকে। লাইক দ্যাট।
অন্যমনস্ক অলোক বলে, মানুষকেই তো মানুষের দরকার।
সন্ধ্যেবেলা নার্সিং হোমে রাখীর কেবিনে ঢুকল মৃন্ময়ী আর রমেন।
নার্স বলল, রাখীর আজ বিকেলে জ্ঞান ফিরেছিল।
মৃন্ময়ী : কিছু বলছিল?
হ্যাঁ, আজই প্রথম দু-একাটা কথা বলল। তবে বোঝা গেল না। শুধু দু-একবার বলল, ফোটো! ফোটো!
ফোটো! কীসের ফটো?
তা বলল না। কয়েকবার উঃ আঃ করেছিল। প্রায় দশ মিনিটের মতো জ্ঞান ছিল। তারপর ফের আগের অবস্থা।
মৃন্ময়ী রমেনের দিকে চাইল। রমেন মাথা নেড়ে জানায়, সেও ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না।
কিছুক্ষণ রাখীর পাশে বসে তারা পরস্পর কথা বলল। রাখীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, রাখীর ছেলেবেলার কথা।
বেরিয়ে আসার পর মৃন্ময়ী বলল, হোটেলে না-থেকে বাড়িতেই এসে থাকো না কেন? আমি যে ভরসা পাই।
সেটা কি ভালো দেখাবে মৃন্ময়ী?
খারাপই বা দেখানোর কী আছে? আমরা তো স্বামী-স্ত্রীই ছিলাম। আবার হয়তো তাই হব।
তুমি এ-শহরের মান্যগণ্য মহিলা। তোমার কোনো বদনাম হলে দুঃখের ব্যাপার হবে। স্বামী-স্ত্রী হতে গেলে লোককে জানিয়েই হওয়া ভালো।
তাই হোক, দিনের কিছুটা সময় আমার কাছে থেকো। কী জানি, কেন তুমি আসার পর আমি প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে তুমি আসায় বেঁচেছি। জোর পাচ্ছি।
লোকে তোমাকে প্রশ্ন করছে না আমাকে নিয়ে?
না। লোকে তো রাখীর কথা জানে, তাই আমাকে বেশি বিরক্ত করতে চায় না। স্কুল থেকে ছুটিও নিয়েছি। ফোটোর কথা কেন বলছিল বলো তো!
বুঝতে পারছি না। খুব সংকোচের সঙ্গে, একটা কথা জিজ্ঞেস করব তোমাকে?
করোই না।
খারাপ ভাবে নিও না। অদম্য কৌতূহল থেকে বলছি।
বলো। কিছু খারাপ ভাবব না।
রাখীর সঙ্গে বিশ্বদেবের মুখের আদল ভীষণভাবে মিলে যায়, তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু ওকথা কেন?
জানতে চাইছি, এ-ব্যাপারে কেউ কি মিলটা লক্ষ করে তোমাকে কিছু বলেনি কখনো?
না। লোকে অত লক্ষ করে না আজকাল। আর মিলটা বোধহয় এখন আর ততটা নেই। রাখী বড়ো হওয়ার পর ওর চুল বড়ো হয়েছে, ভ্রূ প্লাক করে, মেকআপ নেয়। না, এখন চট করে আদল ধরা যায় না, খুব মন দিয়ে লক্ষ না করলে।
লোকে লক্ষ না করুক, রাখী কি লক্ষ করেছে?
না। রাখী আমার বন্ধুর মতো। সব কথা বলে। লক্ষ করলে বলত।
সেটাই বাঁচোয়া।
ভোর বেলা রাখী চোখ মেলেই বাবলুকে দেখতে পেল। চমকাল না, অবাক হল না। ব্যথাতুর মুখে একটু হাসল।
কেমন আছ রাখী?
ভালো।
আমি তোমার জন্যে ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছি।
আমি ভালো আছি। বলেই ফের চোখ বুজল রাখী।
তোমার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার ছিল।
রাখী চোখ খুলল না। নিস্তেজ গলায় বলল, এখন কোনো কথা শুনতে আমার ইচ্ছে করছে না। আমি একটু চুপচাপ থাকতে চাই, তুমি এখন যাও।
যাচ্ছি। কিন্তু আমার কথাও একটু ভেব। আমি যে খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছি।
জীবনে যা কিছু ঘটে তার সব কিছুর লাগাম আমাদের হাতে নেই। অন্যের পাপ এবং তার ফল আউট আমাদের বহন করতে হয়। তুমি যাও বাবলু, কে কোন খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, তা ভাবনার কোনো আগ্রহ নেই আমার। দয়া করে চলে যাও।
একটি অল্পবয়সী নার্স ঘরে ঢুকে বাবলুকে দেখে একটু ভ্রূ কুঁচকে বলল, এটা ভিজিটিং আওয়ার নয়। আপনি কী করে ঢুকে পড়লেন।
রাখী চোখ না খুলেই একটু টেনে টেনে বলল, রুপু, উনি হলেন নার্সিং হোমের মালিকের ছেলে। ওঁর নিয়ম-কানুন মানবার দরকার হয় না। বরং আপনার চাকরি যেতে পারে।
নার্সটি থতমত খেয়ে বলল, ওঃ সরি। আমি তো আপনাকে চিনতাম না।
বাবলু গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল।
রুপু গরম জলে তুলো ভিজিয়ে রাখীর মুখ স্পঞ্জ করতে করতে বলল, চোখে জল কেন?
চোখের জলের পেছনে অনেক কারণ আছে রুপু। জীবন যে কত অদ্ভুত খেলা দেখায়!
তা খুব সত্যি।
বিষ খেয়েছিলাম, কিন্তু মরলাম না। কেন কে জানে! মরাও হল না, আবার এখন লোকের বিদ্রূপের পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকার জ্বালা সইতে হবে।
ওসব কেন ভাবছেন? আমাদের কার জীবনে দুঃখ নেই বলুন তো, তবু বেঁচে থাকার জন্য কী না করতে হয় বলুন? মরলে জ্বালা জুড়োয় হয়তো, কিন্তু জীবনের সবটাই তো আর জ্বালা-যন্ত্রণা নয়। মাঝেমধ্যে আশ্চর্য সুখ, অবাক করা অভিজ্ঞতাও তো হয়। মাস দুই আগে এক মহিলার খুব সেবা করেছিলাম। যাওয়ার সময় উনি আমাকে একছড়া সোনার হার দিলেন জোর করে। বললেন, তুমি প্রফেশনাল নার্স, কিন্তু মেয়ের মতো সেবা করেছ। আমার নিজের ছেলে বিদেশে থাকে, কেবল টাকা পাঠিয়ে খালাস। আপনজনরা তো আপন হল না, তুমি পর হয়েও আপনজনের মতো সেবা করলে।
রাখী চুপ করে শুয়ে রইল, কথা বলল না।
সকাল আটটার পর রমেন আর মৃন্ময়ী এল। মুখে একটু খুশির ভাব।
তোকে নাকি আজ বিকেলে ছেড়ে দেবে।
জানি না।
তার মাথায় হাত রেখে মৃন্ময়ী বলে, খুশি হোসনি?
রাখী চোখ খুলে স্লান একটু হেসে বলল, খুশি হব কেন? নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেলেই কি মুক্তি? কত কর্মফলের বন্ধন আমাদের আটকে রেখেছে, তা থেকে মুক্তি কোথায় বল!
মৃন্ময়ীর মুখটা শুকিয়ে গেল। চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, আমার দোষ, আমার অপরাধ তো স্খলন হওয়ার নয় মা। কিন্তু মানুষ তো কত প্রতিকূলতা নিয়েও বাঁচে। রমেন অবধি আজ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ ওর সঙ্গেই তো আমি সবচেয়ে বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম।
রাখী স্তিমিত গলায় বলে, তোমার দোষ বা অপরাধ নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না মা।
আমি শুধু ভাবি, আমার জন্ম অন্যের ইচ্ছাধীন, আমার কর্মফল অন্যের কর্মফলের পরিণতি, আমার স্বাধীন সত্তা বলে কিছু নেই। তাহলে আমরা স্বাধীনতার কথা বলি কেন? কত কত মানুষের রক্ত আমার শরীরে বল তো!
ওসব ভাবিস না মা। আমরা ঠিক করেছি, অন্য কোথাও চলে যাব। তোকে নিয়ে।
পালাবে? তা কেন মা? আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকব। এই শহরে জন্মেছি, বড়ো হয়েছি, এর প্রতিটি ইঞ্চি আমার চেনা। এ-জায়গা থেকে আমি পালাব কেন? যা সত্যি তার কাছ থেকে কি পালানো যায়? না সেটা উচিত?
মৃন্ময়ী আর রমেন পরস্পরের দিকে একবার তাকাল।
মৃন্ময়ী বলল, তাহলে কী করতে বলিস আমাদের?
কপালদোষে আমার দুটো বাবা, একজন জন্মদাতা, অন্যজন পালনকর্তা। জীবনটাকে নতুন ছকে, অন্য প্যাটার্নে আবার নতুন করে ভাবব মা। সে-জীবন অন্যরকম হবে, আর পাঁচজনের মতো নয়। আমি সত্যকে গোপন করব না, পালাব না, মরতে গিয়েও মরা যখন হল না, তখন নতুন আলাদা রকমের একটী জীবনযাপন করার চেষ্টা করতে হবে। তোমাকেও পালাতে দেব না, যা সত্য তা স্বীকার করে এখানেই থাকতে হবে তোমাকে, পারবে না? মৃন্ময়ী কাঁদছিল। মেয়ের মাথায় আরেকবার হাত রেখে বলল, পারব।