নার্সিং হোমটার মালিক যদিও তার বাবা, তবু কর্মচারীরা সবাই চন্দ্রজিৎ ওরফে বাবলুকে চেনে না। সে কলকাতায় থাকে, এখানে এলেও কদাচিৎ নার্সিংহোমে আসে। সেটা একদিক দিয়ে রক্ষে।
সে রিসেপশনে গিয়ে দাঁড়াল। এ শহরের সবচেয়ে নামজাদা এবং ব্যস্ত নার্সিংহোম। ফলে রিসেপশনে বেশ কয়েকজন লোকের জমাট ভিড়। একটু অপেক্ষা করে সে অবশেষে কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারল, আমি পিউ মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
তরুণী রিসেপশনিস্ট খুব একটা পাত্তা দিল না, বলল, একটু অপেক্ষা করুন। উনি এখন রাউণ্ডে আছেন। সময়মতো খবর দেওয়া হবে।
আমি ওর কাছে যেতে চাই।
সেটা সম্ভব নয়। ভিতরে যাওয়ার নিয়ম নেই।
আমি একজন ডাক্তার, একটু বিশেষ দরকার ছিল। ওঁর সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
মেয়েটি ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, বলছি তো, রাউণ্ড শেষ হলেই খবর দেব।
বাবলু কথা বাড়াতে সাহস পেল না। নিজের পরিচয় দিয়ে সে ঢুকতে পারে বটে, কিন্তু ব্যাপারটা জানাজানি হবে। সে রিসেপশন থেকে বেরিয়ে এসে মোবাইলে পিউকে ধরল।
পিউদি, প্রবলেম।
কী হল?
রিসেপশন আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না।
আচ্ছা, তুমি কী বলো তো! নিজের পরিচয় দিয়েই তো গটগট করে ঢুকতে পারো, কে বারণ করবে?
না না, বাবা আমাদের প্রোটোকল মানতে শিখিয়েছেন। ওটা করা ঠিক হবে না। এটা ভিজিটিং আওয়ার্সও নয়।
দাঁড়াও, আমি নীচে আসছি।
আসতে হবে না। রাখীর কণ্ডিশনটা কী?
ডাক্তারি ভাষায় বলব?
বলো।
সেমি কোমাটিক। ব্লাড টেস্টে পয়জন অ্যানালাইজিং এখনও হয়নি। মনে হয় ওভারডোজ অফ অ্যালজোলাম।
রেসপণ্ড করছে?
না। এখনও ক্রিটিক্যাল। কেবিনে যাবে?
কেউ দেখে ফেলবে না তো।
না যাওয়াই ভালো। মৃন্ময়ীদি এখনও বোধহয় রাখীর কেবিনে রয়ে গেছেন। ভিজিটিং আওয়ার্স চল্লিশ মিনিট আগে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু জানোই তো, উনি ইনফ্লুয়েনশিয়াল মানুষ, ওকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। আমিও তো ওঁর ছাত্রী।
মৃন্ময়ীদি নাকি বলছেন যে, এটা অ্যাটেম্পট টু মার্ডার?
তাই তো শুনছি।
পুলিশ কী বলছ?
পুলিশ কী কিছু বলে? গোমড়া মুখে আসে যায়। শিবদাস দারোগা হল গোমড়ামুখোদের মধ্যেও যেন আরও গোমড়ামুখো। লোকটাকে কখনো হাসতে দেখিনি।
রাখীর মাথার উণ্ডটা দেখেছে?
হ্যাঁ। ডীপ উণ্ড।
স্ক্যান হয়েছে?
হয়েছে। রিপোর্ট দেয়নি এখনও। অত ভেবো না। পেটে যা টকসিন ছিল তা বের করে দেওয়া হয়েছে। স্যালাইন গ্লুকোজ চলছে। ইউরিনের সঙ্গে খানিকটা বেরোবে। অ্যান্টিডোট দেওয়া হচ্ছে। বয়স কম, শী উইল কাম অ্যারাউণ্ড। ডায়ালিসিস আরম্ভ হয়েছে।
জানি। কেসটা হয়তো ফ্যাটাল নয়। কিন্তু আমার কেসটা ফ্যাটাল।
তোমার আবার কী কেস?
বুঝতে পারছি না রাখীর এই ঘটনার কারণ আমি হতে পারি কিনা। আমাকে মৃন্ময়ী কোনোদিন পছন্দ করতেন না। ইদানিং রাখী করছে না। ব্যাপারটা কী পিউদি?
ভাবছ কেন? মেয়েটা সেরে উঠুক তারপর কথা বলে দেখো।
আমাকে কালকেই ফিরে যেতে হবে। উপায় নেই।
চলে যাও। টেনশন কোরো না। ফোনে আমার কাছ থেকে জেনে নিও।
সে তো-জানবই। কিন্তু আমার অনেক হিসেব নিকেশ উলটে গেল।
কিছু উলটে যায়নি। এ বয়সে ওরকম মনে হয়। মন খারাপ কোরো না তো।
ঠিক আছে পিউদি।
শোনো, বেলা দুটো আড়াইটের সময় একবার এসো। আমি ব্যবস্থা করে রাখব, যাতে চুপটি করে রাখীকে দেখে যেতে পারবে।
ঠিক আছে। ধন্যবাদ।
বাবলু নার্সিং হোমের বাইরে এসে একবার বাড়িটার দিকে ফিরে তাকাল। চারতলা চমৎকার আধুনিক প্ল্যানিং-এর বাড়ি। তিনটে উইং। ভিতরে অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতিতে সাজানো ব্যবস্থা। শোনা যাচ্ছে, আরও সব যন্ত্রপাতি আসছে। নিজের জ্যেষ্ঠপুত্র ডাক্তার নভোজিৎকে দেশে আটকে রাখার জন্যই তার বাবা বিশ্বদেব নার্সিং হোমটা করেছেন। বাবলুর এখনও বড়ো ডাক্তার হতে ঢের দেরি। তবে সে বিদেশেই সেটল করবে বলে ঠিক করে রেখেছে।
নার্সিং হোমের সামনে বিস্তীর্ণ বাগান। চমৎকার ফুল-টুল ফুটে আছে।
মাঝখানে চওড়া কংক্রিটের রাস্তা। অত্যন্ত দেখনসই ব্যাপার। নার্সিং হোমটা চলেও বেজায় ভালো। চট করে জায়গা পাওয়া যায় না।
বাবলু নার্সিং হোমটার দিকে কিছুক্ষণ অর্থহীন চেয়ে রইল। তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল।
বাড়িতে ঢোকবার মুখে পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রূ কোঁচকাল সে। পুলিশ এল নাকি?
বারান্দায় দু-জন সাদা পোশাকের অফিসার। এদের চেনে বাবলু। রমেন আর দীপক।
একটু থমকে বলল, কী হয়েছে?
রমেন গম্ভীর মুখে বলল, বড়োবাবু ভেতরে অপেক্ষা করছেন। যাও।
শিবদাসের চেহারাটা একটু রুক্ষ এবং শুষ্ক। বেশ লম্বা হাড়ে-মাসে চেহারা, উঁড়ো গোঁফ আছে। মুখে হাসি বা স্মিতভাব কখনও দেখা যায় না। চেহারার মতো স্বভাবটাও কেঠো এবং রসকষহীন। তবে হাঁকডাক নেই, রগচটা মানুষ নন, ঠাণ্ডা মাথার বিচক্ষণ মানুষ।
অন্য সোফায় মা, বউদি আর স্বস্তিও বসে আছে। চুপ, উদ্বিগ্ন।
শিবদাস বললেন, তোর জন্যই বসে আছি।
কেন শিবদাসকাকু, কী হয়েছে?
তেমন কিছু নয়। কয়েকটা কথা জানার আছে। তবে এখানে নয়, একটু বাইরে চল।
মা উদ্বেগের গলায় বলে, কোনো চার্জ নেই তো।
শিবদাস উদার গলায় বলেন, আরে না, ওসব নয়। কতগুলো ক্লারিফিকেশনের ব্যাপার আছে। কিছু চিন্তা করবেন না। আধঘণ্টা বাদেই ফেরত আসবে।
বাবলু শিবদাসের পিছু পিছু গিয়ে জিপে উঠল।
থানায় নিজের ঘরে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে শিবদাস বলল, ব্যাপারটা কী রে?
কোন ব্যাপার?
তোর আর রাখীর মধ্যে কোনো অ্যাফেয়ার আছে নাকি?
বাবলু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ছিল।
ছিল মানে, এখন নেই?
হ্যাঁ।
পরিষ্কার করে বল, তোদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে?
না। রাখী অ্যাভয়েড করছে।
কেন?
জানি না।
তুই কাল ঠিক কখন রাখীদের বাড়ি গিয়েছিলি?
বেলা দেড়টা-দুটো।
কী হয়েছিল? এনি শো-ডাউন?
না। ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
কিন্তু রাখী তো বাড়িতে ছিল।
ছিল, কিন্তু দরজা খোলেনি, সম্ভবত কি-হোল দিয়ে আমাকে দেখতে পেয়েছিল।
ভালো করে ভেবে দেখিস, কোনও খাড়াখাড়ি হয়েছিল কিনা, মেয়েটা তো অকারণে সুইসাইড অ্যাটেম্পট করতে পারে না।
ও কেন এ কাজ করল আমি জানি না। বেশ কিছুদিন হল আমি ফোন করলে ও দু-একটা কাটাকাটা কথা বলে ফোন রেখে দেয়।
যদি মেয়েটা বেঁচে যায় তাহলে ঝামেলা নেই। কিন্তু বাইচান্স মারা গেলে তোকে আবার ডাকতে হবে। মৃন্ময়ী দিদিমণি এটাকে মার্ডার মনে করছেন।
ও ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।
কলকাতায় যাচ্ছিস কবে?
কালই যেতে হবে।
যা। আর মনে রাখিস, রাখী বেঁচে উঠলেও এখন কিছুদিন ওর সঙ্গে কমিউনিকেট করিস না।
কেন কাকু?
ব্যাপারটা কমপ্লিকেটেড হয়ে উঠতে পারে।
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
কতগুলো সত্য আছে যা খুব ক্রুয়েল। এই যেমন তোর আর রাখীর ব্যাপারটা। রাখী যদি তোকে না চায় তাহলে স্পোর্টসম্যানের মতো ব্যাপারটা মেনে নেওয়াই তো ভালো। না হলে তোর বিরুদ্ধে আমাকে ব্যবস্থা নিতে হয়। ইভটিজিং-এর দায়ে। সেটা তার ফ্যামিলির পক্ষে সম্মানজনক হবে কি?
কেউ কি এরকম কোনো কমপ্লেন করেছে?
মৃন্ময়ী দিদিমণি ওরকমই একটা হিন্ট দিয়ে রেখেছেন।
উনি আমাকে পছন্দ করেন না জানি। কিন্তু এতটা করবেন তা জানা ছিল না।
তুই একজন ব্রাইট ইয়ংম্যান। কাঁচা বয়স। এসব কাফ লাভের তেমন কোনো দাম নেই। বরং কিছুদিন দূরে থাক, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আপনি বলছিলেন, রাখী মারা গেলে ব্যাপারটা কমপ্লিকেটেড হবে। কেন কাকু?
সেক্ষেত্রে সুইসাইড না হয়ে মার্ডার বলে প্রমাণ হলে আমাদের তদন্ত করতে হবে। তখন বোধহয় তোকেও ফের টেনে এনে নতুন অ্যাঙ্গেলে তদন্ত করার প্রয়োজন দেখা দেবে। তবে রাখী বেঁচে যাবে বলেই মনে হয়। তোকে সাবধান করে দেওয়া দরকার বলেই ডেকে এনেছি। কিপ অ্যাওয়ে ফ্রম হার।
আমি এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না।
আমিও না। এখন বাড়ি যা।
আমার অ্যাবসেন্সে এমন কি ঘটল যে সব সম্পর্ক পালটে গেল। আমাকেই বা আপনি এসব বলছেন কেন? কাকু, ব্যাপারটা খোলাখুলি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন।
বোঝানোর কিছু নেই রে পাগলা। শুধু বলি, কলকাতায় ফিরে যা, লেখাপড়ায় মন দে, এখানকার ঘটনা-টটনা ভুলে যা।
তাই কি হয় নাকি কাকু? ইচ্ছে করলেই সব ভুলে যাওয়া যায়?
চেষ্টা কর। তুই তো মানী লোকের ছেলে। আত্মসম্মানবোধ তো তোরও আছে। একটা মেয়ে যখন তোকে রিফিউজ করছে তখন তুই তার পেছনে লেগে থাকবি কেন? কাজকর্মে মন দে, হৃদয়ের ব্যাপার-স্যাপার ভুলে যেতে সময় লাগবে না।
আমি বাচ্চা ছেলে নই কাকু যে, ওভাবে আমাকে ডাইভার্ট করবেন। রাখীকে না হয় আমি ডিস্টার্ব করব না, ব্যাপারটাও ভোলবার চেষ্টা করব, কিন্তু তা বলে কারণটা না জেনে তো সেটা করতে পারি না। এর কারণটা কী তা আমাকে জানতেই হবে।
এখন বাড়ি যা, মাথা ঠাণ্ডা কর।