৫. বিকেলবেলা দোতলার বারান্দায় বসে

বিকেলবেলা দোতলার বারান্দায় বসে আছে সুমি।

এই বারান্দায় তিন চারটা বেতের চেয়ার আর নীচু ধরনের বেতের গ্লাসটপ টেবিল আছে। বিকেলবেলা কখনও কখনও এখানে বসে চা খায় সবাই।

আজ কেউ নেই। আজ সুমি একা।

আজকাল একা থাকলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সুমি। কী যে ভাবে তা সে নিজেই জানে। পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে কিংবা কেউ এসে দাঁড়ালে সহজে দেখতেই পায় না।

এখনও পেল না।

কয়েক মুহূর্ত সুমির পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে মৃদুশব্দে গলা খাঁকাড়ি দিল মিলা।

এই শব্দে সুমি যে খুব একটা চমকালো তা নয়, তবে পেছনে মুখ ফেরাল সে। কিন্তু মিলাকে দেখে মুখের তেমন ভাবান্তর হলো না। নির্বিকার গলায় বলল, কখন এলি?

এই মাত্র।

আয়, বোস।

সুমির মুখোমুখি চেয়ারে বসল মিলা। তীক্ষ্ণচোখে সুমির মুখের দিকে তাকাল। কী হয়েছে তোর?

কই?

চেহারা কী রকম ভেঙে গেছে। চোখ ঢুকে গেছে গর্তে। চোখের কোলে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। মনে হচ্ছে চোখে কাজল দিয়েছিস তুই।

রাতেরবেলা একদম ঘুম হয় না আমার।

কেন?

প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল সুমি। চা খাবি?

না। চা খেয়ে বেরিয়েছি।

অনেকদিন পর এলি। অনেকদিন পর তোর সঙ্গে দেখা হলো।

মিলা মাথা নীচু করে বলল, হ্যাঁ।

তুই ভাল আছিস তো?

আছি।

সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, অন্যান্য খবর কী?

এই তো চলছে।

তোদের বাড়ির সবাই ভাল?

হ্যাঁ।

তারপর দুজনেই চুপচাপ হয়ে গেল। যেন কথা ফুরিয়ে গেছে তাদের। যেন কথা খুঁজে পাচ্ছে না কেউ।

এই রকম অস্বস্তিকর পরিবেশে বেশ খানিকটা সময় কাটল। তারপর মিলা এক সময় বলল, আমি তোর সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি, সুমি।

মিলার দিকে তাকাল না সুমি। বলল, কী কথা?

তোর আর আমার ব্যাপারে।

বল।

মাঝখানে অবশ্য আরেকজন লোক আছে।

এই ব্যাপারটায় আমি কোনও কথা বলতে চাই না।

তুই বলতে না চাইলেও আমাকে যে বলতেই হবে।

কেন?

কারণ তোদের দুজনার মাঝখানে আমি কাঁটার মতো ফুটে আছি।

এবার মুখ ঘুরিয়ে মিলার দিকে তাকাল সুমি। এতদিন পর আজ একথা তোর কেন মনে হলো?

এতদিন পর মানে?

ব্যাপারটা তো আড়াই তিনমাসের পুরনো।

তা হোক। আড়াই তিনমাস এমন কিছু সময় নয়।

এতদিন এসব বলতে তুই আসিসনি কেন?

তোর ওপর আমার খুব রাগ হয়েছিল।

উল্টো বলছিস।

কেমন?

রাগ তো তোর ওপর আমার হওয়ার কথা।

তা তো তুই হয়েইছিলি এবং খুবই অপমানকর কথাবার্তা বলেছিলি আমাকে। সেজন্য আমারও রাগ হয়েছে। আসলে তুই আমাকে অযথা ভুল বুঝেছিলি। আমার তো কোনও দোষ ছিল না। আমি তোর সঙ্গে তোর লাভারের ওখানে গেছি, তারপর সে যদি আমাকে প্রপোজ করে তাতে আমার কী করার থাকে বল তো?

তখন হয়তো ছিল না। কিন্তু তারপর তুই তাকে প্রশ্রয় দিয়েছিস।

ওটা আমি তোর ওপর রাগ করে করেছি।

প্রকৃত বন্ধু বন্ধুর ওপর রাগ করে কি বন্ধুর প্রেমিক কিংবা প্রেমিকাকে ভাগিয়ে নিতে পারে?

না তা পারে না। সেটা উচিত নয়।

তাহলে?

কিন্তু একটা কথা তুই ঠাণ্ডামাথায় ভাব তো, আমার মধ্যে যদি সত্যি কোনও শয়তানি থাকতো, যদি সত্যি জয়কে আমি চাইতাম তাহলে কি সে আমাকে প্রপোজ করার পর সেকথা তোকে আমি বলতাম?

সুমি কথা বলল না।

মিলা বলল, আমি তোকে বলেছিলাম তুই আমার প্রিয়বন্ধু বলেই। বলার উদ্দেশ্যটা ছিল জয়ের ব্যাপারে তোকে সাবধান করে দেয়া। অর্থাৎ বলতে চেয়েছি এই ধরনের পুরুষকে শক্ত হাতে ধরে রাখতে হয়। কিন্তু তুই উল্টো আমার ওপর রেগে গেলি।

আর এই রাগের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তুই তার সঙ্গে ঢলাঢলি করতে শুরু করলি?

মিলা মুখ কালো করে বলল, ছিঃ সুমি! তোর মুখে এই ধরনের শব্দ মানায় না।

সুমি একটু লজ্জা পেল। কথা বলল না।

মিলা বলল, তারপরও আমি কিছু মনে করলাম না। কারণ আমি আজ এসেছি ভুল বোঝাবুঝিটা মিটিয়ে ফেলতে।

সুমি মন খারাপ করা গলায় বলল, এখন আর মিটিয়ে ফেলবার কিছু নেই। সব শেষ হয়ে গেছে।

না কিছুই শেষ হয়নি। সব ঠিক আছে। তোর জয় তোরই আছে।

চোখ তুলে মিলার দিকে তাকাল সুমি। এই কথাটি তুই আর কক্ষনো আমার সামনে উচ্চারণ করবি না।

মিলা হাসল। কিন্তু করতে আমাকে হবেই।

কেন?

তোদের দুজনার ভালোর জন্য।

ওকে নিয়ে ভালমন্দ কোনও কিছুরই দরকার নেই আমার। তুই তো একটা মেয়ে, তুই কি আসলে বুঝতে পেরেছিস কতো বড় অপমান সে আমাকে করেছে? যে বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আমি আমার ভালবাসার মানুষের সঙ্গে দেখা করতে গেছি, মানুষটি আমাকে পাত্তা না দিয়ে, আমার কথা না ভেবে আমার। বন্ধুকে প্রস্তাব দিল! একবারও আমার কথা ভাবল না, একবারও বুঝল না ব্যাপারটা আমার জন্য কত অপমানকর! আমি যদি বিশ্বসুন্দরী সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, আমি যত কুৎসিতই হই, আমার প্রেমিক কি আমাকে রেখে ওই বিশ্ব সুন্দরী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে? এটা হয় নাকি?

না এটা আসলে অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়।

তাহলে?

কিন্তু ব্যাপারটা তো ছিল ফান।

সুমি যেন বেশ বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল। কী?

হ্যাঁ। জয় আমাকে বলেছে, ওটা ছিল ঠাট্টা। মজা করার জন্য সে এমন করেছে। এটা তার স্বভাব।

এসব হাস্যকর কথা বলে কোনও লাভ নেই। এই ধরনের ফান কখনও কেউ করে না।

তুই বিশ্বাস কর, সত্যি এটা ফান।

মিলার চোখের দিকে তাকিয়ে সুমি বলল, বুঝলাম জয়ের দিক থেকে এটা ফান ছিল। আর তোর দিক থেকে?

মিলা চুপ করে রইল।

চুপ করে আছিস কেন? কথা বল।

আমি আজ তোর সঙ্গে মিথ্যে বলব না। তোর ওপর রাগ করে আমি জয়কে প্রায়ই ফোন করেছি, জয়ের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি, চারবার। আমাদের দেখা হয়েছে, আমি বেশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম ওর ওপর, জয়ও বোধহয় আমাকে একটু প্রশ্রয় দিচ্ছিল। সবকিছু পরিষ্কার বোঝার জন্য কয়েকদিন আগে আমি ওদের উত্তরার বাড়িতে গিয়েছিলাম…।

মিলার কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি বলল, ব্যাস, আমি আর শুনতে চাই না।

কিন্তু শুনতে তোকে আজ হবেই।

সুমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

মিলা বলল, ওই যাওয়াটায় যে কী উপকার হয়েছে আমার, আমি ছাড়া কেউ তা বুঝতে পারবে না। পুরো ভুল বোঝাবুঝিটা শেষ হয়েছে। জয়ের ব্যাপারে আমার মধ্যে তৈরি হওয়া দুর্বলতাটুকু কেটে গেছে এবং আমি তোর কাছে ফিরে আসার সাহস পেয়েছি।

সুমি কথা বলল না।

হাত বাড়িয়ে সুমির একটা হাত ধরল মিলা। সুমি, জয় তোকে খুব ভালবাসে। খুব। তুই হয়তো জানিসই না কী রকম ভাল সে তোকে বাসে। জীবনের সবকিছু সে তোর জন্য রেখে দিয়েছে।

কিন্তু আমি খুব চেষ্টা করছি আমার মন থেকে ওকে মুছে ফেলতে।

এই চেষ্টা করাটা তোর ভুল হবে।

কেন?

মনের দিক দিয়ে জয় খুবই অসাধারণ মানুষ। ওদের বয়সী ছেলেদের মতো মেয়েদের ব্যাপারে ওর কোনও লোভ নেই। বিন্দুমাত্র লোভ নেই।

কেন তুই আমাকে এসব বলার চেষ্টা করছিস?

আমি চাই তুই আবার আগের মতো হয়ে যা। তুই আবার জয়ের কাছে ফের। আমার কাছে ফের।

না, ব্যাপরগুলো এমন দাগ ফেলে দিয়েছে আমার মনে, চাইলেও মন থেকে আমি তা মুছতে পারব না। তারচে’ এই ভাল। আস্তেধীরে সব শেষ হয়ে যাওয়া ভাল।

তাতে দুজন মানুষেরই কষ্ট। যেমন তোর, তেমন জয়ের। আর মাঝখান থেকে সারাজীবন ব্যাপারটা নিয়ে আমি সাফার করব।

কথা বলতে বলতে শেষদিকে গলা ধরে এল মিলার।

সুমি তখন আবার আকাশের দিকে তাকিয়েছে। আবার নির্বিকার হয়ে গেছে।

এই ফাঁকে নিজেকে একটু যেন গুছালো মিলা। তারপর সুমির দিকে তাকাল। তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

মিলার দিকে তাকাল না সুমি। বলল, বল।

তুই আমাকে কতটা বুঝিস?

কথাটা শুনে সামান্য চমকাল সুমি। চট করে মিলার দিকে তাকাল। কতটা বুঝি মানে?

মানে আমি জানতে চাইছি তুই তো আমার ছোটবেলার বন্ধু। ক্লাশ ওয়ান থেকে এস এস সি পর্যন্ত ভিকারুন নিসায় পড়েছি আমরা। তারপর কলেজ ইউনিভার্সিটি বদলে গেছে আমাদের। কিন্তু দেখা সাক্ষাৎ, যোগাযোগ, বন্ধুত্ব সবই সেই ছেলেবেলার মতোই রয়ে গেছে। দিন সাতেক দেখা না হলে আমরা দুজন দুজনার জন্য পাগল হয়ে যাই।

যাই না, বল যেতাম। এখন আর সেই অবস্থাটা নেই। প্রায় তিনমাস হতে চলল।

হ্যাঁ এতবড় গ্যাপ আমাদের বন্ধুত্বের জীবনে নেই। দেখা সাক্ষাত কোনও সপ্তাহে না হলেও দু একদিন পর পর ফোনে কথা হতো আমাদের। প্রতিদিন কী

কী ঘটছে সব খুঁটিনাটি দুজন দুজনকে বলতাম আমরা।

মিলা একটু থামল। এতকিছুর পর আজ আমি জানতে চাইছি, তুই বল আমাকে তুই কতটা বুঝিস? কেমন মেয়ে আমি?

বাদ দে, এসব বলতে আমার ভাল লাগছে না।

কিন্তু আজ আমি এসব কথা বলার জন্যই এসেছি।

তাহলে তার আগে তুই আমাকে বল, আমি কেমন মেয়ে? আমাকে কতটা বুঝিস তুই?

তোকে কিন্তু আমি মোটামুটি বুঝি।

তাহলে বল।

তুই খুব আত্মমগ্ন ধরনের মেয়ে। একবার মনের মধ্যে কোনও কিছু গেঁথে গেলে, কোনও দাগ পড়ে গেলে কিছুতেই তুই তা মুছতে পারিস না। দিনরাত ওই নিয়ে ভাবিস। ভাবতে ভাবতে অসুস্থও হয়ে যেতে পারিস তুই।

হ্যাঁ। তাই, ঠিক তাই।

আর কখনও কোনও ডিসিসান নিয়ে ফেললে তুই সহজে তা বদলাতে পারিস না।

সুমি কথা বলল না।

সবার সঙ্গে মিশতেও পারিস না তুই। যাকে ভাল না লাগে সে যেই হোক তুই তার সঙ্গে কথা বলতে চাস না। ঠাট্টা মশকরা তুই তেমন পছন্দ করিস না। ঠাট্টা জিনিসটা তেমন বুঝিসও না। কেউ করলে বিরক্ত হয়ে যাস।

আর তুই হচ্ছিস এসবের উল্টো। কেউ ঠাট্টা করলে তুইও করিস। খুব সহজে মানুষের সঙ্গে মিশে যাস। তোর পেটে কোনও কথা থাকে না। গড়গড় করে সবাইকে সব বলে দিস। তোর আচরণে যে কেউ তোকে একটু সহজলভ্য মেয়ে ভাবতে পারে।

তোর সবগুলো কথা ঠিক নয়। কোনও কোনওটা ঠিক। হ্যাঁ আমি ঠাট্টাপ্রিয় মেয়ে। ঠাট্টা মশকরা, ইয়ার্কি ফাজলামো আমি একটু পছন্দ করি। সহজে মানুষের সঙ্গে মিশি, কথা বলি কিন্তু আমাকে কেউ সহজলভ্য মেয়ে ভাবতে পারে এই ধারণা আমার ছিল না।

আমারও ছিল না।

তাহলে বললি কেন?

জয় তোকে প্রপোজ করেছে দেখে আমার মনে হয়েছে।

কিন্তু ওতে আমার কী দোষ?

তোকে সহজলভ্য ভেবেছে বলেই প্রপোজ করার সাহস পেয়েছে।

মিলা চিন্তিত চোখে সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু সুমি আর কিছু বলল না।

খানিক চুপ করে থেকে মিলা বলল, আর তোর ধারণা আমার পেটে কোনও কথা থাকে না?

হ্যাঁ। তোর এই ধারণাটাও ঠিক না।

আমি মনে করি আমার ধারণাটা ঠিক। মানে তোকে আমি আমার সবকথা বলেছি বলে এটা তোর মনে হচ্ছে?

সুমি আবার মিলার চোখের দিকে তাকাল। সব কথা তো তুই আমাকে বলিসনি। মানে জয়ের সঙ্গে গত তিনমাসে তোর কী কী হয়েছে…।

তারপরই মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠল সুমির। অবশ্য আমি ওসব জানতে চাইও না।

ঠিক আছে তা না চাইলি, কিন্তু এসবের আগের জীবনে, অর্থাৎ তোর ধারণা ক্লাস ওয়ান থেকে তিনমাস আগ পর্যন্ত আমার সবকথা আমি তোকে বলেছি? তুই সব জানিস?

আমার মনে হয় বলেছিস।

না বলিনি।

কী বলিসনি?

আমার মেয়ে জীবনের সবচে’ মর্মান্তিক ঘটনাটার কথাই তোকে আমি বলিনি।

সুমি চোখ তুলে মিলার দিকে তাকাল। মর্মান্তিক ঘটনা মানে?

মিলা মাথা নীচু করল। আমি রেপড হয়েছিলাম।

কথাটা যেন বুঝতে পারল না সুমি। থতমত খেল। কী?

হ্যাঁ।

কী বলছিস তুই?

আমি সত্য কথা বলছি।

শুনে হঠাৎ করে এতটা উত্তেজিত হলো সুমি, হাত পা কাঁপতে লাগল তার। বুক কাঁপতে লাগলো। দম যেন বন্ধ হয়ে এল। কোনও রকমে সে শুধু বলল, কবে? কীভাবে?

আমাকে নিয়ে তুই যখন জয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাস ঠিক তার কয়েকদিন আগে।

বলিস কী?

হ্যাঁ।

কিন্তু তখন তো তোর সঙ্গে আমার কোনও মনোমালিন্য নেই, তুই আমাকে বলিসনি কেন?

আমি এতটাই শকড ছিলাম, নিজের কাছেই ব্যাপারটা আমার অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। কয়েকদিন পর্যন্ত আমি নিজেই বিশ্বাস করিনি সত্যি সত্যি ঘটনাটা ঘটেছে। আমার জীবনেই ঘটেছে। তোর তখন দিনের তিনচার ঘণ্টা কাটে জয়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে। আমার সঙ্গে কথা বলায় একটু গ্যাপ যাচ্ছিল।

সুমি ফ্যাল ফ্যাল করে মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মিলা বলল,গ্যাপ না হলেও বোধহয় তোকে আমি একথা বলতাম না। পৃথিবীর কাউকে বলতাম না।

তার মানে এটা কেউ জানে না?

যে করেছে সে জানে।

সে তো জানবেই।

এছাড়া আর কেউ জানে না।

আজ তাহলে আমাকে বললি কেন?

না বললে আমাকে তুই বুঝতে পারবি না।

আমি যে বললাম তোর পেটে কোনও কথা থাকে না, কথা যে থাকে সেটা প্রমাণ করার জন্য বললি?

কিছুটা সেজন্য কিন্তু বেশির ভাগটাই অন্য কারণে।

কী কারণ?

জয়কে কেন আমি অতটা প্রশ্রয় দিয়েছিলাম এই ব্যাপারটির সঙ্গে কিছুটা হলেও তা জড়িত। আসলে ব্যাপারটি তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে কিছুটা, কিছুটা নয় অনেকখানি বদলে দিয়েছিল। অন্যরকম করে দিয়েছিল। নিজেকে যেন আমি আর চিনতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা ভোলার জন্য আমি যা নই তাই হয়ে যাব, নীতিগতভাবে যে সমস্ত কাজ মানুষের করা উচিত নয়, আমি তাই করব। অর্থাৎ উল্টোপাল্টা সবকিছু।

এজন্যই জয়ের প্রপোজাল একসেপ্ট করেছিলি?

মনে হয়।

তাহলে সে কথা আবার আমাকে বললি কেন?

সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু বলিনি।

তাহলে?

বেশ কয়েকদিন পরে বলেছি।

কেন?

মনে হলো সবচে’ প্রিয় বন্ধুটিকে জানাই। এমন একটা জায়গায় আঘাত দিই তার, সে দিনরাত জ্বলুক।

বলিস কী? তুই তো সাইকিক পেসেন্ট হয়ে গিয়েছিলি!

সত্যি আমি তাই হয়ে গিয়েছিলাম। তবে জয় খুব ভালছেলে।

কেমন?

সে যদি তখন কোনও রকমের বাড়াবাড়ি করতো, অর্থাৎ ফিজিক্যালি আমাকে চাইতো আমি বোধহয় রাজি হয়ে যেতাম।

বলিস কী?

সত্যি। কিন্তু জয়ের সবকিছু ওই মুখে মুখে। কাছাকাছি গেলে সে অতি দ্র। হাতটাত ধরা তো দূরের কথা, আমার দিকে ভাল করে তাকিয়েও দেখেনি। শুধু মজার মজার কথা আর কথা। জয়ের কথা শুনতে শুনতেই আসলে নিজের মধ্যে ফিরে আসতে পেরেছি আমি। তোর কাছে আজ ফিরে আসতে পেরেছি।

একথা শুনে সুমি আবার উদাস হলো। জয়কে ঘিরে মনের ভেতর জমে থাকা কিছু কথা মনে পড়তে চাইল। জোর করে তা দমিয়ে রাখল সুমি। মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ঘটনাটা কীভাবে ঘটল আমাকে বল। কে ঘটাল?

মিলা বলল, না বলব না।

কেন?

আমি ভুলে যেতে চাই। আমি সব ভুলে যেতে চাই। ও রকম ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছিল, আমি ভুলে যেতে চাই। আমি গত তিন সাড়ে তিনমাস

সময়কেই আমার জীবন থেকে মুছে ফেলতে চাই। তোর সঙ্গে আমার আচরণ, জয়ের সঙ্গে নীতিহীন মেলামেশা, আমি সব ভুলে যেতে চাই। আমি এখন থেকে আবার তোর সেই বন্ধু। আমি আর কেউ না।

বলে হু হু করে কাঁদতে লাগল মিলা।

মিলার কান্না দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল সুমি। তারপর উঠে মিলার পাশে এসে দাঁড়াল। দুহাতে মিলার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল, কাঁদিস না, কাঁদিস না। মানুষের জীবনে কত কী ঘটে! খারাপ স্মৃতি ভুলে যাওয়াই ভাল। আমিও ভুলে যাব সব। আমি এই খারাপ সময়টার কথা মনে রাখব না।

বিকেলবেলার আকাশ তখন একটু যেন বেশি উজ্জ্বল হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *