৫. বাঙালি মুসলমানের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়

পঞ্চম অধ্যায় – বাঙালি মুসলমানের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়

এক.

আগের অধ্যায়গুলোতে আমরা বাঙলার উপজাতি ও হিন্দু জাতিসমূহ সম্বন্ধেই আলোচনা করেছি। মুসলমানদের সম্বন্ধে কিছু বলিনি। এবার আমরা মুসলমানদের সম্বন্ধে কিছু বলব।

বাঙলার মুসলমানদের তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। যথা—

১. আগন্তুক মুসলমান।

২. ধর্মান্তরিত মুসলমান, ও

৩. উভয়ের মধ্যে সংমিশ্রিত মুসলামন।

প্রথম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বাঙলার মুসলমান শাসকগণ ও পাঠান সুলতানগণ কর্তৃক রাজ্যের উচ্চপদসমূহে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আনীত বিদেশী মুসলমানগণের বংশ-ধরগণ। দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তভুক্ত হচ্ছে যারা স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল বা যাদের বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল, তাদের বংশধরগণ। তৃতীয় শ্রেণি হচ্ছে উপরিউক্ত দুই শ্রেণির সংমিশ্রণে উৎপন্ন মুসলমানগণের বংশধরগণ। এদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির সংখ্যাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

বাঙলায় মুসলমানসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, বাঙলা মুসলমানগণ কর্তৃক বিজিত হওয়ার পর। ১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি প্রথম বাঙলা জয় করেন। সেই সময় থেকে শুরু করে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ কর্তৃক দেওয়ানি গ্রহণের সময় পর্যন্ত এই সার্ধ পাঁচশত বৎসর বাঙলা মুসলমানগণের অধীনে থাকে। আগন্তুক মুসলমানই বলুন, আর ধর্মান্তরিত মুসলমানই বলুন, আর এই দুইয়ের সংমিশ্রণে উৎপন্ন মুসলমানই বলুন, তাদের সকলেরই উদ্ভব হয়েছিল এই সার্ধ পাঁচশ বছরের মধ্যে। তবে এর পর যে কেউ মুসলমান হয়নি, এমন কথাও সত্য নয়। এর পরও হিন্দু মুসলমান হয়েছে, তবে তাদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। সেরূপ মুসলমানেরা সকলেই দেশজ মুসলমান।

বর্তমান শতাব্দীর প্রারন্তে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে গৃহীত আদম-শুমারীর সময় মুসলমানরা দাবি করেছিল যে তারা দেশজ-সম্প্রদায় নয়, তারা সকলেই বাঙলায় আগন্তুক মুসলমানদের বংশধর। তার মানে তারা সকলেই সৈয়দ, মুঘল ও আফগান শাসকমণ্ডলীর বংশধর। সে দাবিটা যে সম্পূর্ণ অমূলক ও অলীক, তা তৎকালীন আদম-শুমারির কমিশনার ই. এ. গেট (E. A. Gait) প্রমাণ করেন। তিনি বলেন যে, যে সকল রাজকীয় মুসলমান কর্মচারীদের এদেশে আনা হয়েছিল তারা তৎকালীন রাজধানীসমূহ যথা গৌড়, পাণ্ডুয়া, রাজমহল, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি শহরের নিকট এসে বসবাস করেছিল। তারা তৎকালীন সুলতান ও নবাবদের কাছ থেকে বসবাসের জন্য ভূমিদানও পেয়েছিল। সেইসকল ভূমিদানসংক্রান্ত দলিলাদি পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে ওই সকল ভূমিদান তারা গৌড়, পাণ্ডুয়া ও মুর্শিদাবাদের নিকটেই পেয়েছিল। কিন্তু বাঙলার মুসলমান জনসংখ্যার বিন্যাস দেখলে দেখতে পাওয়া যাবে, যে যদিও এরূপ ভূমিদানসংক্রান্ত দলিলাদি উত্তর ও পূর্ব বঙ্গে খুবই কম, তথাপি বাঙলার এই দুই অংশেই মুসলমানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বর্তমান শতাব্দীর প্রারম্ভে বাঙলাদেশে মুসলমানদের যে জনিবিন্যাস ছিল, সেই সর্কিত পরিসংখ্যান থেকেও তা পরিষ্কার বোঝা যায়। যথা—

অঞ্চলমুসলমান জনসংখ্যাপ্রতি ১০,০০০ জনসংখ্যার অনুপাতে মুসলমানের সংখ্যা
পশ্চিমবঙ্গ১,০৮৪,৪২০১,৩১৭
মধ্যবঙ্গ৩,৭৭৩,২১৪,৮৭৫
উত্তরবঙ্গ৫,৮৭৬,৪০৮৫,৮৭৩
পূর্ববঙ্গ১১,২২০,৪২৭৬,৬১৭

উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতিটা বুকানন হ্যামিলটনও (Buchanan Hamilton) লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে উত্তরবঙ্গের মুসলমানরা যে বাঙলায় আগন্তুক মুসলমানগণের বংশধর, এরূপ বিবেচনা করার সপক্ষে বিশেষ কিছু প্রমাণ নেই। তিনি বলেছিলেন যে, তারা ধর্মান্তরিত দেশজ মুসলমান ছাড়া আর কিছুই নয়। পরবর্তী কালে একজন মুসলমান লেখকও এই উক্তিরই প্রতিধ্বনি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন— ‘আমি প্রায়ই লক্ষ্য করেছি যে, উত্তরবঙ্গের মুসলমানরা মঙ্গোলীয় কোচ জাতির দৈহিক লক্ষণসমূহ বহন করে।’ তার মানে তারা ধর্মান্তরিত কোচ (বর্তমানে রাজবংশী) জাতি হতে উদ্ভূত। পূর্ববঙ্গের মুসলমানরাও যে ধর্মান্তরিত দেশজ হিন্দুজাতিসমূহ হতে উদ্ভূত, তা ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ড: ওয়াইজ-ও (Dr. Wise) বলেছিলেন।

দুই.

বস্তুত চতুদশ শতাব্দীতে কিছুকালের জন্য মুসলমান সুলতানরা পূর্ববঙ্গের সোনারগাঁ হতে রাজত্ব করেছিরেন। তাঁরা পীর, দরবেশ ও মোল্লা নিযুক্ত করে পূর্ববঙ্গের নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের পাইকারি হারে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সুলতান জালালুদ্দিনের সময় (১০১৪- ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে) এই ধর্মান্তরিত করার অভিযান তুঙ্গে উঠেছিল। দুর্বল নিম্নসম্প্রদায় হিন্দুদের কাছে দুটি প্রস্তাব রাখা হয়েছিল—’হয় কোরাণ গ্রহণ কর, আর তা নয়ত মৃত্যু বরণ কর।’ প্রাণ ভয়ে অনেকেই মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। যারা অশ্বীকৃত হয়েছিল, তারা কামরূপ, আসাম ও কাছাড়ের জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ধর্মান্তরিতকরণ সম্বন্ধে বানিয়ার (Bernier) তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে এক কাহিনি উল্লেখ করে গেছেন। ধর্মান্তরিত মুসলমানদের নিশানা ছিল, ঘরের চালের উপর একটা ‘বদনা’ বসিয়ে রাখা। একবার এক মৌলবি কিছুদিনের জন্য দেশান্তরে গিয়েছিলেন, তিনি ফিরে এসে এক ধর্মান্তরিত মুসলমানের ঘরের চালে আর ‘বদনা’ দেখতে পান না। অনুসন্ধানে জানলেন যে, লোকটা আবার হিন্দুসমাজের অন্ত্যজ জাতিভুক্ত হয়েছে। ক্রোধান্বিত হয়ে তিনি নবাবের নিকট ফেজ পাঠানোর আবেদন জানান। নবাব একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। ওই সৈন্যদলের সাহায্যে মৌলবি সমগ্র গ্রামের লোকেদের মুসলমান ধর্মগ্রহণ করতে বাধ্য করেন।

বাঙলার মুসলমানগণ যে আগন্তুক মুসলমান নন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, মুসলমান ইতিহাসকারগণ কেউই লিখে যাননি যে, কোনো কালে উত্তরভারত থেকে দলবদ্ধভাবে মুসলমানরা এসে বাঙলাদেশে বসতি স্থাপন করেছিল। বরং আমরা জানতে পারি যে, বাঙলা দেশে যেসকল পাঠান ও আফগান মুসলমান ছিল, তারা সম্রাট আকবর কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে ওড়িশায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। মুঘল যুগেও পূর্ববাঙলাকে অস্বাস্থ্যকর জায়গা বলে মনে করা হতো, এবং যেসকল রাজকীয় কর্মচারী এখানে আসতেন, তাঁরা দু পয়সা কামাবার পর, আবার দিল্লি কিংবা আগ্রায় ফিরে যেতেন। একমাত্র যেখানে কিছুসংখ্যক বিদেশি মুসলমান ছিল, সে জায়গাটা হচ্ছে চট্টগ্রাম। বাণিজ্য উপলক্ষে আরবদেশীয় যেসকল মুসলমান বণিক চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিল, তারা হচ্ছে তাদের বংশধর।

তিন.

জোরজুলুম করেই যে মুসলমান করা হতো, তা নয়। অনেক হিন্দু স্বেচ্ছায়ও মুসলমান হতো। এরা অধিকাংশই হিন্দুসমাজের অবহেলিত নিম্নসম্প্রদায়ের লোক। নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজ এদরে হেয় চক্ষে দেখতেন। এসকল সম্প্রদায় ইসলামের সাম্যনীতির দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিল। তারা মুসলমান শাসকগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘খানকা’ দ্বারাও আকৃষ্ট হতো। খানকাগুলো ছিল মসজিদ ও দরগার সংলগ্ন প্রতিষ্ঠান যেখানে আশ্রয় ও খাওয়া-দাওয়া দুইই পাওয়া যেত। এছাড়া ছিল পদস্খলিতা হিন্দু সধবা ও বিধবা। হিন্দু-সমাজে এদের কোনো স্থান ছিল না। যদি হিন্দু রমণী মুসলমানের সহিত ভ্রষ্ট হতো, তা হলে সে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে, তার মুসলমান উপপতির পরিবারে বিবির স্থান পেত। এ ছাড়া ছিল, দেশে দাসদাসীর ব্যবসা। অসময়ে দুঃস্থ জনসাধারণ তাদের ধর্মান্তরিত ছেলে- মেয়ে বেচে দিত। যখন মুসলমানরা তাদের কিনত, তখন তারা তাদের ধর্মান্তরিত করত।

উচ্চশ্রেণির বর্ণহিন্দুরা খুব কমই ধর্মান্তরিত হতো। তবে যাদের যখন যবন-দোষ ঘটত (নিষ্ঠাবান সমাজের পাতি অনুযায়ী মুসলমানের খাদ্য আঘ্রাণ করলেও যবন-দোষ ঘটত), নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজ তাদের একঘরে করত। তাদের মধ্যে অনেকেই মর্যাদা পাওয়ার জন্য মুসলমান হয়ে যেত। এ ছাড়া, মুর্শিদকুলি খানের আমলে কোনো জমিদার বা ভূস্বামী যদি রাজস্ব দিতে অক্ষম হতেন, তা হলে তাঁকে সপরিবারে মুসলমান ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হতো।

বাঙলার মুসলমানরা যে হিন্দুসমাজ থেকেই ধর্মান্তরিত, তা তাদের আচার-বব্যহার থেকে বুঝতে পারা যায়। এসকল আচার-ব্যবহার বর্তমান শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। প্রথমত, তারা ধর্মান্তরিত হওয়ার পূর্বে হিন্দুসমাজে যেসকল কৌলিক বৃত্তি বা পেশা অনুসরণ করত, মুসলমান হবার পরেও তাই করত। দ্বিতীয়, এদের ভাষা ও সাহিত্য থেকেও তাই প্রকাশ পায়। তৃতীয়, তাদের নামকরণ থেকেও তাই বুঝতে পারা যায় যেমন— কালি শেখ, কালাচাঁদ শেখ, ব্ৰজ শেখ, গোপাল মণ্ডল, হারু শেখ ইত্যাদি। চতুর্থ, ধর্মান্তরিত হওয়ার পরেও তারা হিন্দুর অনেক সংস্কার ও লৌকিক পূজাদি অনুসরণ করত। যেমন দুর্গাপূজার সময় তারা হিন্দুদের মতো নতুন কাপড়-জামা পরে পূজা-বাড়িতে প্রতিমা দর্শন করতে যেত। ছেলে-মেয়ের বিবাহের সময়ও তারা হিন্দু জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে বিয়ের দিন ঠিক করত। দৈনন্দিন জীবনেও তারা হিন্দুর বিধি-নিষেধ মানত ও হিন্দুর পঞ্জিকা অনুসরণ করত। এ ছাড়া, মহামারীর সময় শীতলা, রক্ষাকালী প্রভৃতির পূজা করত, ও শিশু ভূমিষ্ট হলে ষষ্ঠী-পূজা করত। এমন কি, অনেক জায়গায় বিবাহের পর মেয়েরা সীমন্তে সিঁদুরও পরত। এসকল আচার- ব্যবহার সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ও মোল্লাদের প্ররোচনায় ক্রমশ বর্জিত হয়েছে।

চার

মোট কথা, বাঙালি মুসলমান মূলত বাঙলাদেশেরই সন্তান। আজ যে স্বাধীনতা লাভের পর পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দেয়, তার পিছনে যথেষ্ট ঐতিহাসিক সত্য আছে।

নৃতাত্ত্বিক পরিমাপের দিক দিয়েও ঐতিহাসিক সত্য প্রমাণিত হয়। রিজলি যে পরিমাপ গ্রহণ করেছিলেন তা থেকে দেখা যায় যে, পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের শিরাকার-সূচক-সংখ্যা ঠিক ওই অঞ্চলের নমঃশূদ্রদের শিরাকার-সূচক-সংখ্যার সহিত একেবারে অভিন্ন। এইসকল মুসলমানদের নাসিকাকার-সূচক সংখ্যা নমঃশূদ্রের চেয়ে বেশি, কিন্তু পোদদের চেয়ে বেশি তফাৎ নয়। নিচে এই তিন গোষ্ঠীর সূচক-সংখ্যা দেওয়া হলো-

জাতিশিরাকার-সূচক-সংখ্যানাসিকা-সূচক-সংখ্যা
মুসলমান৭৭.৯৭৭.৫
নমঃশূদ্র৭৮.১৭৪.২
পোদ৭৭.৮৭৬.৪

পূর্ববঙ্গ ছাড়াও, বাঙলার অন্য অঞ্চল হতে যে পরিমাপ ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় গ্রহণ করেছিলেন, তা হচ্ছে—

অঞ্চলশিরাকার-সূচক-সংখ্যাদেহ-দৈর্ঘ্য মিঃ মিঃ
রাঢ়৭৮.৬১৬৬৩
বরেন্দ্র৭৮.৬১৬৬৪
বঙ্গ৭৮.৮১৬৫১
চট্টল৭৯.৭১৬৫৫
সমতট৮০.৩১৬০৮
কলিকাতা৮০.০১৬৬০
সমষ্টিগত গড়৭৯.৭১৬৫৪

এইসকল সূচক-সংখ্যা থেকে পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পারা যায় যে, বাঙালি মুসলমান বাঙলার অন্যান্য জাতির ন্যায় বিস্তৃত-শিরস্ক জাতি। উত্তর ভারতের দীর্ঘশিরস্ক জাতিসমূহের সহিত তাদের সংমিশ্রণ খুব কমই ঘটেছে। এক কথায়, বাঙালি মুসলমান বাঙালিই, তারা আগন্তুক নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *