দ্বিতীয় অধ্যায় – বাঙলার নৃতাত্ত্বিক বনিয়াদ
এক.
যদিও উচ্চশ্রেণির বাঙালিরা ‘অ্যালপাইন’ বা ‘আলপীয়’ পর্যায়ভুক্ত, তথাপি তাদের নিয়েই বাঙলার নৃতাত্ত্বিক সত্তা গঠিত হয়নি। আলপীয়রা ছিল বাঙলায় আগন্তুক জাতি। সুতরাং তাদের আসবার আগেও, বাঙলায় লোক বাস করত। তারা কোন জাতিভুক্ত? তারই আলোচনা আমরা এখাণে করব।
বাঙলার আদিম অধিবাসীরা ছিল প্রাক্-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোক। নৃতত্ত্বের ভাষায় তাদের বলা হয় আদি-অস্ত্রাল। আদি অস্ত্রাল বলবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের দৈহিক গঠনের মিল আছে। দৈহিক গঠনের মিল ছাড়া, অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের রক্তের মিলও আছে। মানুষের রক্ত সাধারণত চার শ্রেণিতে ভাগ করা হয়— ‘ও’, ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘এ-বি’। ভারতের প্রাক্-দ্রাবিড় ও অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসী এই উভয়ের রক্তেই ‘এ’ এগ্ল টিনোজেনের (‘A’ Agglutinogen) শতকরা হার খুব বেশি। তা থেকেই উভয়ের রক্তের সাদৃশ্য বোঝা যায়।
এক সময় আদি-অস্ত্রালদের ব্যাপ্তি উত্তর-ভারত থেকে প্ৰশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত ছিল। নৃতত্ত্ববিদ্গণ মনে করেন যে, আনুমানিক ৩০,০০০ বৎসর পূর্বে তারা ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে গিয়ে প্রথম পৌছায়।
আদি-অস্ত্রাল জাতির লোকেরা খর্বাকার ও তাদের মাথার খুলি লম্বা থেকে মাঝারি, নাক চওড়া ও চ্যাপ্টা, গায়ের রঙ কালো ও মাথার চুল ঢেউখেলান। তিনেভেলী জেলায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের যে সকল মাথার খুলি পাওয়া গেছে, তার মধ্যে এই শ্রেণির খুলিও আছে। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে আমরা ‘নিষাদ’-জাতির উল্লেখ পাই। সেখানে বলা হয়েছে যে তারা অনাস, তাদের গায়ের রঙ কালো ও তাদের আচার-ব্যবহার ও ভাষা অদ্ভুত। সুতরাং প্রাচীন সাহিত্যের নিষাদরাই যে আদি-অস্ত্রাল গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত কোনো উপজাতি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মনে হয়, এই মূল-জাতির এক শাখা দক্ষিণ-ভারত ত্যাগ করে, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, ও মেলেনেশিয়ায় যায় ও সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে পৌছায়।
বাঙলার আদিম অধিবাসীরা এই গোষ্ঠীরই লোক। এদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল আগন্তুক দ্রাবিড় ভাষাভাষী কোনো কোনো উপজাতি। দ্রাবিড়- ভাষা ভাষীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল আলপীয়দের আসার আগে। এই দ্রাবিড় ভাষাভাষী লোকদের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জাতিসমূহের মিল আছে। সেজন্য নৃতত্ত্বের ভাষায় এদের ‘ভূমধ্য’ বা ‘মেডিটেরেনিয়া ‘ নরগোষ্ঠীর লোক বলা হয়। এদের আকৃতি মধ্যাকার এবং মাথা লম্বা, গড়ন পাতলা, নাক ছোট, ও ময়লা। আদি-মিশরীয়দের সঙ্গে এ জাতির বেশি মিল আছে। অন্ধ্রপ্রদেশের আদিতান্নালুর অঞ্চলে প্রাপ্ত সমাধিপাত্রে ও দক্ষিণ-ভারতের সমাধিস্তূপগুলোতে যেসকল নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে, তাদের অধিকাংশই ভূমধ্য-নরগোষ্ঠীর লোক। খুব সম্ভবত বৈদিক সাহিত্যে উক্ত ‘পনি’রা এই গোষ্ঠীরই লোক ছিল।
এই আদি অস্ত্রাল ও ভূমধ্য-নরগোষ্ঠীর লোকদের সংমিশ্রণেই বাঙলার নৃতাত্ত্বিক বনিয়াদ গঠিত হয়েছিল। এরা উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলত। আদি-অস্ত্রালরা যে ভাষায় কথা বলত সে ভাষাকে বলা হয় ‘অস্ট্রিক’। এই ‘অস্ট্রিক’ ভাষাই বাঙলা ভাষার ভিত্তি স্থাপন করে। কেননা, বাঙলা ভাষার অন্তর্ভুক্ত এই ভাষার শব্দসমূহের প্রাচুর্য তার সাক্ষ্য বহন করছে। ভারতে এই ভাষার বর্তমান প্রতিভূ হচ্ছে ‘মুণ্ডারী’ ভাষা—যে ভাষা সাঁওতাল, মুণ্ডা কোরওয়া, জুয়াঙ, কোরবু প্রভৃতি জাতিসমূহ ব্যবহার করে। যদিও অস্ট্রিক ভাষার শব্দসমূহ ভারতের সব ভাষার মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়, তবুও বাঙলা ভাষায় এর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অস্ট্রিক ভাষাভাষী জাতিসমূহের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে ‘কুড়ি’ সংখ্যাকে ভিত্তি করে উচ্চতর সংখ্যা প্রকাশ করা।
অনুরুপভাবে আমরা বাঙলা ভাষায় দ্রাবিড় ভাষারও অনেক শব্দ পাই। দ্রাবিড় ভাষা-ভাষী লোকেরা যে-কোনো এক সময় পূর্ব ও মধ্য- ভারতে ছিল, তা ওড়িশার কুইবা কন্ট পারজি ও ওল্লার, বিহারের কুরুখ ও ওঁরাও, রাজমহল পাহাড়ের মালতো মধ্যপ্রদেশের কোলামি জাতিসমূহের ভাষা থেকে বুঝতে পারা যায়। এগুলো সবই দ্রাবিড়জাতীয় ভাষা হতে উদ্ভূত।
বাঙলার আদিম অধিবাসীদের বংশধর হচ্ছে বাঙলার উপজাতিসমূহ। এ ছাড়া, হিন্দু সমাজের তথাকথিত ‘অন্ত্যজ’ জাতিসমূহও এই গোষ্ঠীর লোক। বাঙলার এইসকল জাতিসমূহকে আগে ‘অনুন্নত’ সম্প্রদায় বলে অভিহিত করা হতো। কিন্তু ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন-বিধানে হিন্দুসমাজভুক্ত উনুন্নত সম্প্রদায়গুলোকে ‘তফসীলভুক্ত জাতি’ বলে বর্ণনা করা হয়। অনুরূপভাবে উপজাতিসমূহকে ‘অনুন্নত উপজাতি’ বলা হতো। স্বাধীনতা লাভের পর যখন ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হয়, তখন এদের নামকরণ করা হয় ‘তফসীলভুক্ত উপজাতি’। তফসীলভুক্ত উপজাতিসমূহের কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ আছে যথা— ১. উপজাতি হতে তাদের জন্ম ২. আদিম জীবনযাত্রা-প্রণালি ৩. দুরধিগম্য স্থানে বাস ও ৪. অনুন্নত অবস্থা।
১৯৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ‘তফসীলভুক্ত’ জাতিসমূহের লোকসংখ্যা ছিল ৬৮,৯০,৩১৪, আর ‘তপসীলভুক্ত উপজাতি’ লোকের সংখ্যা ছিল ২০,৫৮,০৮১। সুতরাং উভয়ে মিলে দেশজ জাতিসমূহের লোকসংখ্যা ছিল ৮৯,৪৪,৩৯৫ বা পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মোট জনসংখ্যার ২৫.৫ শতাংশ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মোট হিন্দু জনসংখ্যার তারা ছিল ৩২.৪৯ শতাংশ। তার মানে, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুজনগণের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন হচ্ছে এই পর্যায়ভুক্ত।
দুই.
পশ্চিমবঙ্গের উপজাতিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে সাঁওতালরা। তাদের সংখ্যা ১২,০০,০১৯। তার পরেই হচ্ছে ওঁরাওরা। তাদের সংখ্যা হচ্ছে ২,৯৭,৩৯৪। আর তার পরে হচ্ছে মুণ্ডা। তাদের সংখ্যা হচ্ছে ১,৬০,২৪৫। পশ্চিমবঙ্গে মোট ৪১টি উপজাতি আছে। সাঁওতাল, মুণ্ডা ও ওঁরাওদের বাদ দিলে বাকি ৩৮টি উপজাতিসমূহের প্রত্যেকটির লোকসংখ্যা এক লক্ষের কম। এদের মধ্যে আবার অনেকের সংখ্যা একেবারে নগণ্য। যেমন বৈগাদের সংখ্যা হচ্ছে মাত্র ৪, আর কিষাণদের হচ্ছে ৩। তবে মুণ্ডাদের পরে যাদের সংখ্যাগরিমা আছে, তারা হচ্ছে যথাক্রমে ভূমিজ, কোরা ও লোধা। ভূমিজদের সংখ্যা হচ্ছে ৯১,২৮৯, কোরাদের ৬২,০২৯ ও লোধাদের ৪০,৮৯৮। এরা সকলেই বাঙলার আদিম অধিবাসী। আর অন্যান্য যেসকল সংখ্যালঘু উপজাতি আছে, তারা মনে হয়, অন্য অঞ্চল থেকে বাঙলায় প্রবেশ করে এখানে বাস করছে।
সাঁওতালরাই হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যা-গরিষ্ঠ উপজাতি। সুতরাং প্রথমেই সাঁওতালদের কথা বলা যাক। সাঁওতালরা প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, হুগলী ও মালদহ জেলায় বাস করে। কিন্তু সাঁওতালদের বাসস্থানের পরিধি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই নিবদ্ধ নয়। পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালদের যে সংখ্যা, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক সাঁওতাল বাস করে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে, বিহারের ঝাড়খণ্ডে (সাঁওতাল- পরগণা, হাজারিবাগ, মানভূম ও সিংভূম জেলায়)। অবশ্য এসব অঞ্চলগুলো পূর্বে বাঙলাদেশেরই অন্তভুক্ত ছিল। ১৮৫৪-৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বঙ্গদেশের অন্তর্ভূক্ত ভাগলপুর জেলার অন্তর্গত দামিন-ই-কো অঞ্চল থেকে বীরভূম পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল, তাকে খেরওয়ারী-হুল’ বা সাঁওতাল-বিদ্রোহ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। খেরওয়ারী-হুল বলবার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাঁওতালরা অস্ট্রিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত খেরওয়ারী ভাষায় কথা বলে। মনে হয় প্রাচীন অঙ্গদেশেই সাঁওতালদের আদি বাসস্থান ছিল। পরে তারা বাঙলাদেশের মেদিনীপুর পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম ও মালদহ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। কেননা, সাঁওতালদের মধ্যে যে কিংবদন্তী প্রচলিত আছে, সেই কিংবদন্তী অনুযায়ী পূর্বে তাদের নাম ছিল খারবার। ‘খর’ শব্দ ‘হর’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘হর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘মানুষ’। পরে তারা যখন মেদিনীপুর জেলার সাঁওতাল পরগনায় এসে বসবাস শুরু করে, তখন তাদের নাম হয় সাঁওতাল। বর্তমানেও পশ্চিমবঙ্গের জেলাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাঁওতাল বাস করে মেদিনীপুর জেলায়। এ থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে পশ্চিমবঙ্গে মেদিনীপুরের সাঁওতাল পরগনাতেই তাদের প্রথম বাস।
সাঁওতালরা আদি অস্ত্রাল প্রাক্-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোক। তাদের উৎপত্তি সম্বন্ধে তাদের মধ্যে যে কিংবদন্তী প্রচলিত আছে তা হচ্ছে এই যে, সূদূর অতীতে কোনো এক সময় এক হাঁসডাক (বন্যহাঁস) দুটি ডিম প্রসব করেছিল। এই ডিম দুটি হতে পিলচু হরস ও পিলচু বুড়ি নামে যথাক্রমে এক পুত্র ও এক জন্যা জন্ম গ্রহণ করে। তারাই সাঁওতাল জাতির আদি পুরুষ ও তাদের থেকেই সাঁওতালদের সাতটি উপশাখার উৎপত্তি হয়। বর্তমানে সাঁওতালদের মধ্যে ১১টি বহির্বিবাহের গোষ্ঠী আছে, এক সময় নাকি আরও একটি ছিল, কিন্তু সেটি লুপ্ত হয়ে গেছে। সাঁওতালদের মধ্যে কিস্কু বা মুরমু গোষ্ঠীর মর্যাদা অন্য গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক উচ্চ।
আরও, সাঁওতালদের নিজেদের মধ্যে যে কিংবদন্তা প্রচলিত আছে, সে অনুযায়া সাঁওতালদের আদি বাসস্থান ছিল হিহিরি বা অহিরিপেরি-তে। ক্রেস্রাডের (Skresrud) মতে এটা ‘ছিল’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, কিন্তু অন্যান্য পণ্ডিতগণের মতে, এটা হাজারিবাগ জেলার অন্তর্ভূক্ত অহুরি- পরগনাকে ইঙ্গিত করে। যা হোক, এই আদি বাসস্থান থেকে তারা পশ্চিম দিকে খোজকামান নামে এক স্থানে গিয়েছিল, কিন্তু সেখানে অগ্নিবৃষ্টির ফলে তারা সকলেই বিনষ্ট হয়েছিল। মাত্র একটি দম্পতি হর নামক পর্বতের ফাঁকে আটকে গিয়ে রক্ষা পেয়েছিল। হর পর্বত থেকে তারা সাওঙবেরা নামে নদীর উপত্যকায় এসে আশ্রয় লাভ করে, এবং পরে জরপি নামক স্থানে গিয়ে পৌছায়। সেখানে তারা মরাঙবুড় নামে এক পাহাড়ের সম্মুখীন হয়। সেটা তারা সহজে ভেদ করতে অক্ষম হয়। পাহাড়ের দেবতাকে তারা বলিদান দ্বারা প্রশমিত করে, এবং একটা গিরিপথ দেখতে পায়। এই গিরিপথের ভিতর দিয়েই তারা আহির দেশে এসে উপস্থিত হয়, এবং সেখানে কিছুকাল বাস করে। পরে তারা সেখান থেকে যথাক্রমে কেনদী, চৈ ও চম্পায় এসে উপস্থিত হয়। চম্পায় তারা অনেক পুরুষ বাস করে, এবং পরে যখন হিন্দুরা তাদের তাড়িয়ে দেয়, তখন তারা সাঁওতাল পরগনায় এসে উপস্থিত হয়। এ থেকে একটা কথা প্রমাণিত হয়, তা হচ্ছে যে তখন সাঁওতাল পরগনায় হিন্দুপ্রাধান্য বিশেষ ছিল না।
মুণ্ডারা ওঁরাওদের চেয়ে সংখ্যায় কম হলেও, সাঁওতালদের সঙ্গে তাদের ভাষা একই গোত্রভুক্ত। সাঁওতাল এবং মুণ্ডা—এই উভয় জাতিই অস্ট্রিক ভাষার উপশাখায় কথা বলে। কিন্তু ওঁরাওরা দ্রাবিড় ভাষার অন্তর্ভুক্ত কুরুখ ভাষায় কথা বলে। মুণ্ডারা বিশেষভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে বর্ধমান, চব্বিশপরগনা, পশ্চিম-দিনাজপুর, দাজিলিং, জলপাইগুড়ি, মেদিনীপুর ও পুরুলিয়া জেলায়। তবে সংখ্যায় তারা সবচেয়ে বেশি বাস করে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলায়।
সাঁওতালদের আদি-বাসস্থান যেখানেই হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গে তাদের বর্তমান অবস্থান দেখলে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে তারা মূলত রাঢ়দেশের বা ভাগীরথার পশ্চিমভাগস্থ অঞ্চলের লোক। কেননা পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালদের মোট সংখ্যার (১২,০০,০১৯) ৭৩.৭৩ শতাংশ বাস করে মেদিনীপুর (২,৩৩,৭৯৮), পুরুলিয়া (১,৭৬, ৭৯৯), বর্ধমান (১,৫৪,৬৫৭), বাঁকুড়া (১,৫২,২৫৪), বীরভূম (৯৩,৩২৬) ও হুগলী (৭৩,৭৮১) জেলায়। অন্যত্র সবচেয়ে বেশি বাস করে পশ্চিমদিনাজপুর (১,২২,২৯২), মালদহ (৮৪,২০৭), ও জলপাইগুড়ি (৩৮,৫৬০) জেলায়। অন্তর্বর্তী জেলাসমূহে তাঁদের বসবাস খুবই কম। বস্তুত তাদের বর্তমান অবস্থান দেখলে মনে হয় যে, তারা প্রথমে মেদিনপুর, বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলী ও পুরুলিয়া অঞ্চলেই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল, এবং সেখান থেকে তারা নিজেদের চতুর্দিকে বিস্তৃত করেছিল। চব্বিশপরগনায় তাদের জনসংখ্যা হচ্ছে ৩১,৬৫৪। মনে হয় কোনো এক সময় তাদের এক অংশ ভাগীরথী অতিক্রম করে চব্বিশপরগনায় এসে বসবাস শুরু করেছিল, আর অপর এক অংশ নিজেদের উত্তর-বাঙলায় বিস্তৃত করেছিল। তবে কবে এবং কি কারণে, এবং কিসের চাপে তারা নিজেদের রাঢ়দেশের আদি বাসভূমি পরিহার করে অন্য অঞ্চলসমূহে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল, তা আমাদের জানা নেই। তবে সাঁওতালদের সম্বন্ধে একটা প্রশ্ন স্বভাবত মনে জাগে। সাঁওতালরা নিজেদের উৎপত্তি হাঁস থেকে নিরূপিত করে। তার মানে, হাঁসই তাদের টোটেম ছিল। হাঁস পক্ষী-বিশেষ। বৈদিক আর্যরা বাঙলাদেশের লোকেদের পক্ষা-বিশেষ বলে বর্ণনা করেছে। তারা কি সাঁওতাল বা অনুরূপ কোনো জাতি?
তবে এরূপ অনুমান করবার সপক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে যে, কোনো এক সময় দক্ষিণ-বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চল (এক সময় এ অঞ্চল বাঙলাদেশেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল) থেকে কোনো কারণবশত ওঁরাও ও মুণ্ডারা নিজেদের বিস্তারিত করেছিল ভাগীরথীর পূর্বতীরস্থ অঞ্চলসমূহে, এবং তাদেরই অনুগমনে সাঁওতালরা কেন্দ্রাতিগ হয়ে পড়েছিল। সে কারণটা রাজনৈতিক চঞ্চলতা, না দুর্ভিক্ষ, না হিন্দুদের অত্যাচার, না নীলচাষের জন্য শ্রম নিয়োগ, তা বলা কঠিন। বর্তমান যুগে চা-বাগানে উপজাতীয় শ্রম নিয়োগও এর কারণ হতে পারে।
আগেই বলা হয়েছে যে, সাঁওতালদের সঙ্গে মুণ্ডাদেরই ভাষাগত ঐক্য আছে, ওরাঁওদের সঙ্গে নেই। মুণ্ডারা অধিক সংখ্যায় বাস করে জলপাইগুড়ি (৫৩,৮৮১) ও চব্বিশপরগনা (৪২,২৫৬) জেলায়। এক কথায়, পশ্চিমবঙ্গের মোট মুণ্ডা জনসংখ্যার (১,৬০, ২৪৫) ৬০,১৮ শতাংশ এই জেলায় অবস্থিত। তারা যে এই দুই জেলায় আগন্তুক, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এদের মধ্যে কত সংখ্যক চিরস্থায়ী বাসিন্দা এবং কত সংখ্যক ভাসমান শ্রমিক জনকুণ্ডলী, তা বলা কঠিন। পশ্চিমবঙ্গের বাকি জেলাসমূহে মুণ্ডাদের সংখ্যা হচ্ছে ৬০,১০৮ বা মোট মুণ্ডা জনসংখ্যার মাত্র ৩৯.৮২ শতাংশ। ওরাঁওদের বেশি পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায় জলপাইগুড়ি (১,৮১,৭৪৯), দার্জিলিং (২৮,৩৩৮), পশ্চিমদিনাজপুর (২২,২৮৭) ও চব্বিশপরগনায় (২৪,৭০৭)। এই চার জেলায় ওরাঁওদের সংখ্যা ২,৬৪,৮৩১, তার মানে পশ্চিমবঙ্গের মোট ওঁরাও জনসংখ্যার (২,৯৭,৩৯৪) ৮৯.০৪ শতাংশ।
সাঁওতালরাই যে পশ্চিমবঙ্গের আদিম অধিবাসী ও আদি-অস্ত্রাল জাতিভুক্ত, আর বাকি অন্যান্য উপজাতিরা এখানে আগন্তুক মাত্র, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সংখ্যা-গরিমার দিক থেকে প্রথম ছয়টি উপজাতির জনসংখ্যার নিচে যে তালিকা দেওয়া হলো, তা থেকে এটা স্বতই প্রমাণিত হয়-
উপজাতি | পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যা | মোট মোট জনসংখ্যার শতাংশ |
১. সাঁওতাল | ১২,০০,০১৯ | ৫৮.৪২ |
২. ওঁরাও | ২,৯৭,৩৯৪ | ১৪.৪৮ |
৩. মুণ্ডা | ১,৬০,২৪৫ | ৭.৮০ |
৪. ভূমিজ | ৯১,২৮৯ | ৪.৪৪ |
৫. কোরা | ৬২,০২৯ | ৩.০২ |
৬. খেরিয়া বা লোধা | ৪০,৮৯৮ | ১.৯৯ |
৭. বাকি ৩৫টি উপজাতি | ২,০২,২০৭ | ৯.৮৫ |
মোট উপজাতি | ২০,৫৪,০৮১ | ১০০ |
দেখা যাচ্ছে যে, বাঙলার উপজাতিসমূহের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ২০,৫৪,০৮১। আর তার মধ্যে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, ভুমিজ, কোরা ও লোধাদের সমষ্টিগত সংখ্যা হচ্ছে ১৮,৫১,৮৭৪। সুতরাং এই ছয়টি উপজাতির জনসংখ্যা হচ্ছে, বাঙলার উপজাতিসমূহের মোট জনসংখ্যার ৯০.১৫ শতাংশ। বাকি ৩৫টি উপজাতির সংখ্যা হচ্ছে ২,০২,২০৭ বা মোট উপজাতি জনসংখ্যার ৯.৮৫ শতাংশ। সংখ্যা-প্রধান প্রথম ছয়টি উপজাতির মধ্যে সাঁওতাল ও মুণ্ডাদের কথা আগেই বলা হয়েছে। ওঁরাওদের অবস্থান হচ্ছে জলপাইগুড়ি (৬১.১ শতাংশ), দার্জিলিং (৯.৫ শতাংশ) ও চব্বিশপরগণা (৮.৩ শতাংশ) জেলায়। অন্যান্য জেলাসমূহে ওঁরাও উপজাতি সমষ্টিগতভাবে মাত্র ২১.১ শতাংশ বাস করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মুণ্ডাদের মতো ওঁরান্ডরা ভাগীরথীর পূর্ব-অঞ্চলেই কেন্দ্রীভূত।
ভুমিজরা কিন্তু রাঢ় দেশের বা বাগীরথীর পশ্চিম-অঞ্চলের লোক। এদের বাসস্থান প্রধানত, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর চব্বিশপরগণা ও পুরুলিয়া জেলায়।
যদিও জলপাইগুড়ি জেলায় কিছু সংখ্যক কোরার সাক্ষাৎ মেলে, তা হলেও কোরাদের অবস্থিতি মোটামুটি ভাগীরথীর পশ্চিম-অঞ্চলে, বর্ধমান, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম ও হুগলী জেলায়। লোধাদের বাসস্থান হচ্ছে ভাগীরথীর পশ্চিম অঞ্চলে-মেদিনীপুর, পুরলিয়া ও বাঁকুড়া জেলায়। কিন্তু তাদের কেন্দ্রীভূত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় সংলগ্ন ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলায়।
আগেই বলা হয়েছে যে, বাকি ৩৫টি উপজাতির জনসংখ্যা হচ্ছে নগণ্য। তাদের মোটামুটি দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে—১. আদি- অস্ত্রাল ও ২. মঙ্গোলীয়। প্রথম গোষ্ঠীর অন্তভুক্ত হচ্ছে বেদিয়া, বিরহর, চেরো, গোল্ড, গোরাইত, হো, করমালী, খারওয়ার, কোরওয়া, লোহারা, মহালী, মালপাহাড়িয়া, নাগেসিয়া, পারহাইয়া, সওরিয়া, পাহাড়িয়া ও শবর। আর দ্বিতীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ভুটিয়া, চাকমা গারো, হাজাঙ, লেপ্চা, মগ, মেচ, মুরু ও লভা। এই দ্বিতীয় গোষ্ঠীর বাসস্থান হচ্ছে প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে ও পূর্ব সামান্ত অঞ্চলে।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, মঙ্গোল জাতিসমূহের মাথা সাধারণত গোল কিন্তু আসাম ও ভারত-ব্রহ্মসীমান্তের উপজাতিসমূহের মাথা গোল নয়। তাদের মধ্যে লম্বা ও মাঝারি উভয় রকম মাথারই প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া অন্যান্য দীর্ঘ-শির বা দীর্ঘ-কপাল জাতিসমূহের ন্যায় তাদের ঘাড়ের উপর মাথার খুলির অংশ (Occiput) পিছন দিকে বেশি বের করা। ঘন ও ঈষৎ পিঙ্গল এবং এই দুই রঙের মাঝামাঝি সবরকম গায়ের রংই এদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। এদের ভ্রূ অনুচ্চ, মুখের পরিধি ছোট ও চিবুকের হাড় বেশ উঁচু। এদের নাকের গড়ন মাঝারি, এবং তা খাঁটি ‘মঙ্গোল’ নাকের মতো চ্যাপ্টা। এদের মুখে ও গায়ে অল্প লোম, ও চোখের খোল বাঁকা। দৈর্ঘ্যে এরা মাঝারি।
যদিও আদি-অস্ত্রাল ও মঙ্গোলীয় উপজাতিসমূহ দুই ভিন্ন নরগোষ্ঠীর লোক, তথাপি তাদের মধ্যে ভাষার ঐক্য আছে। উভয়েই অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলে। অস্ট্রিক ভাষাভাষীদের দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়—১. মুণ্ডারী ও ২. মোন্-ধূমের। ভারতের উপজাতিসমূহ, যথা—সাঁওতাল, মুণ্ডা প্রভৃতি মুণ্ডারী ভাষায় কথা বলে। আর আসাম ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তের উপজাতিরা মোন্-খমের গোষ্ঠীর ভাষায় কথা বলে।
আদি-অস্ত্রাল ও মঙ্গোলীয় জাতিদ্বয়ের মধ্যে ভাষার ঐক্য থাকলেও, তাদের দেহিক বৈশিষ্ট্য, আচার-অনুষ্ঠান, সমাজের গঠন, ও অন্যান্য রীতিনীতি সম্পূর্ণ পৃথক। যেমন, আসামের খাসিয়া সমাজে গৃহকর্ত্রীর মেয়েরাই সম্পত্তির উত্তরাধিকাররিণী হয় ও গৃহকর্ত্রীর নাম ও গোত্র পায়। বাঙলার সাঁওতালসমাজে কিন্তু পুরুষেরাই সম্পত্তির মালিক হয় ও পুত্র-পৌত্রাদি পিতামহের গোত্র বা কুল-নাম পায়। এ ছাড়া, আগেই বলা হয়েছে যে দৈহিক আকার ও লক্ষণের দিক থেকে সাঁওতালদের সঙ্গে মঙ্গোলীয় জাতিসমূহের কোনো মিল নেই।
ভৌগোলিক পরিবেশের দিক থেকে উপজাতিসমূহের লোক সবচেয়ে বেশি বাস করে জলপাইগুড়ি জেলায় (৩,৫৪,৭৪১)। তারপর জনসংখ্যার ক্রম-হ্রাসমানতা অনুযায়ী, তারা বাস করে মেদিনীপুর (৩,২৯৭৩৬), পুরুলিয়া (২,৬২,৮৫৮), বর্ধমান (১,৮০,১৪৩), বাঁকুড়া (১,৭৩,৩৮৯), পশ্চিমদিনাজপুর (১,৭০,১৪৯), চব্বিশপরগনা (১,১৯,৩১৮), বীরভূম (১,০৬,৮৬০), মালদহ (৯৯,৫২২), দাজিলিং (৯৬,৪৪৪ ) হুগলী ৯০,১০৬), মুরশিদাবাদ (৩১,৪৫), নদীয়া (২১,৯২৩), কুচবিহার (৮,৮০৯), হাওড়া (৬,১১১) জেলাসমূহে। কলিকাতা অঞ্চলেও কিছুসংখ্যক উপজাতি গোষ্ঠীর লোক আছে। তাদের সংখ্যা হচ্ছে ২,৫২০।
তিন.
পশ্চিমবঙ্গে মোট ৬৩টি তপসীলভুক্ত জাতি আছে তাদের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ৬৮,৯০,৩১৪। ক্রম-হ্রাসমান সংখ্যা-গরিমার দিক থেকে তাদের মধ্যে যারা প্রধান, তারা হচ্ছে রাজবংশী (১২,০৬,৭১৭), বাগদী (১০,৯৩,৮৮৫), পোদ (৮,৭৫,৫২৫), নমঃশূদ্র (৭,২৯,০৫৭), বাউরী (৫,০১,২৬৯), চামার বা মুচি (৩,৯৬,৫৯১), ধোবা (১,৫৪,৭৯১), ডোম (১,৫১,৮১৮), হাড়ী (১,২৫,৮৫০), কেওড়া (১,১৭,৯২৯) জেলে কৈবত (১,১৭৩৮৪), মাল (১,১৭,৭০৪), শুঁড়ি (১,০৬,৮৭০), লোহার ৮৩,৫৪৫), পলিয়া (৭৩,৯৯৭), ঝালোমালো (৬৮,৭৫৭), খয়রা (৬৭,৯১৩), ও ভূঁইয়া (৫৩,৩২৯)। তপসীলভুক্ত জাতিসমূহের মোট জনসংখ্যা (৬৮,৯০,৩১৪), এর হচ্ছে সমষ্টিগতভাবে ৮৭.৬৭ শতাংশ। বাকি ৪৫টি তপসীলভূক্ত জাতির প্রত্যেকটির জনসংখ্যা হচ্ছে ৫০,০০০- এর কম। আবার অনেক তপসীলভুক্ত জাতির জনসংখ্যা হচ্ছে এক হাজারেরও কম। যা হোক, সমষ্টিগতভাবে এদের জনসংখ্যার অনুপাত হচ্ছে মোট তপসীলভুক্ত জাতিসমূহের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২.৩২ শতাংশ।
সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের তপসীলভুক্ত জাতির জনসংখ্যার তুলনায় সবচেয়ে বেশি তপসীলভুক্ত জনসংখ্যা দেখতে পাওয়া যায় চব্বিশপরগনায় (১৫,২৪,৯২২)। এর পর ক্রম-হ্রাসমান অবস্থায় স্থান পায়, বর্ধমান (৭,৫৩,৮৮৩), মেদিনীপুর (৫,৬৩,৪০৬), ও বাঁকুড়া (৪,৯২,৭০০)। কুচবিহার, চব্বিশপরগণা, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া— এই পাঁচটি জেলায় তপসীলভুক্ত জাতিসমূহের মোট জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ বাস করে। আর পুরুলিয়া, মালদহ, কলিকাতা ও দার্জিলিঙ এই চারটি জেলায় বাস করে মাত্র ৮ শতাংশ তপসীলভুক্ত জাতির লোক। পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার তুলানায় সবচেয়ে বেশি তপসীলভুক্ত লোকসংখ্যা দেখতে পাওয়া যায় কুচবিহারে (৪৬.৯০ শতাংশ)। এরপর স্থান পায় জলপাইগুড়ি (৩০.৮০ শতাংশ), বাঁকুড়া (২৯.৬০ শতাংশ), বীরভূম (২৯.১৪ শতাংশ), বর্ধমান (২৪.৫ শতাংশ) ও চব্বিশপরগনা (২৪.২৮ শতাংশ)।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে তপসীলভুক্ত জাতিসমূহের উৎপত্তি হয়েছে উপজাতিসমূহ হতে। মাত্র হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত হবার পর থেকেই, তারা বর্ণ ও জাতি সম্বন্ধে বিশেষভাবে সচেতন হয়েছে। রাজবংশীদের উৎপত্তি সম্বন্ধে বলা হয় যে, তাদের উৎপত্তি হয়েছে কোচ-উপজাতি থেকে। রীজলি বলেছিলেন যে, রাজবংশী কোচ ও পলিয়াদের উৎপত্তি একই উৎস থেকে হয়েছে। রাজবংশীদের প্রধানত দেখতে পাওয়া যায় কুচবিহার, পশ্চিমদিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও চব্বিশ পরগনায়। পোদেরা এখন নিজেদের পৌণ্ড ক্ষত্রিয় বলে দাবি করে। মনে হয় প্রাচীন সাহিত্যে উক্ত পুণ্ডজাতি হতে তারা অভিন্ন। পোদেদের আবাসস্থল প্রধানত মেদিনীপুর, হাওড়া ও চব্বিশপরগনা। বাগ্দীরাও এখন নিজেদের ব্যগ্রক্ষত্রিয় বলে দাবি করে। ওল্ডহামের মত অনুযায়ী তারা মাল-জাতিরই এক উপশাখা মাত্র। তবে বাগ্দীরা যে ভাবে নিজেদের গোষ্ঠীবিভাগ করে (যেমন তেঁতুলিয়া, দুলিয়া, মাটিয়া) তা থেকে মনে হয়, যে, এগুলো এক সময় উপজাতি-সংক্রান্ত ‘টোটেম’ ছিল। উত্তরবঙ্গ ছাড়া বাগ্দীদের পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়। সেন বংশীয় রাজা বল্লালসেনের রাজ্যের এক অংশের (দক্ষিণবঙ্গের) নাম ছিল বাগড়ি। মনে হয়, এটা বাগদী-অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল। নমঃশূদ্রের বাস হচ্ছে বর্ধমান, মেদিনীপুর, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, চব্বিশপরগণা ও কুচবিহার জেলায়। রীজলির মত অনুযায়ী পোদ, কয়াল, কোটাল, নুলিয়া, ও ও বেরুয়া—এরা সকলেই হচ্ছে নমঃশূদ্র-গোষ্ঠীর উপশাখা। অনেকে নমঃশূদ্র ও চণ্ডাল সমার্থবোধক শব্দ বলে দাবি করেন; কিন্তু নমঃশূদ্ররা নিজেদের চণ্ডাল থেকে উচ্চ সম্প্রদায়ের লোক বলে মনে করে। বাউরীরা প্রধানত রাঢ়দেশের লোক। তাদের বর্তমান আবাসস্থল হচ্ছে বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, হুগলী ও পুরুলিয়া জেলায়। তাদের জনসংখ্যা হচ্ছে ৫,০১,২৬৯ বা সমগ্র তপসীলভুক্ত জাতিসমূহের জনসংখ্যার ৭.২৭ শতাংশ। তাদের উৎপত্তি সম্বন্ধে তারা দাবি করে যে, দেবগণের খাদ্য অপহরণ করার অপরাধে তাদের বাউরী জাতি হিসাবে জন্মাতে হয়েছে। বস্তুত দেশজ উপজাতিসমূহ যখন হিন্দুধর্মে দীক্ষিত হয়ে হিন্দুসমাজে অনুপ্রবেশ করে, তখন তারা সকলেই এক একটা উপকথা সৃষ্টি করে নিজেদের গৌরবান্বিত করার চেষ্টা করে। যেমন, চামাররা নিজেদের রামানন্দের শিষ্য রবিদাস বা রুইদাস-এর বংশধর বলে দাবি করে। মুচিরা নিজেদের ঋষি বলে আখ্যাত করে। অনুরূপভাবে ধোবারা নিজেদের নেতামুনি বা নেতা-ধোপানির বংশধর বলে দাবি করে। কিন্তু স্কন্দপুরাণ ও অন্যান্য কয়েকটি পুরাণ অনুযায়ী ধোবারা ধীবর পিতার ঔরসে তিবর মাতার গর্ভে উৎপন্ন হয়। অবশ্য অনুরূপ উৎপত্তি-কাহিনি ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণসমূহে মাত্র ধোবাদের সম্বন্ধেও লেখা নেই, অন্যান্য জাতি সম্বন্ধেও লেখা আছে। আমরা তা পরের অধ্যায়ে আলোচনা করব। অনুরূপভাবে হাড়িরা দাবি করে যে, তারা ব্রহ্মার হাতের ময়লা হতে উৎপন্ন হয়েছে। তবে বর্তমান জাতিবিন্যাস ব্যবস্থিত হবার পূর্বে, এইসকল ‘অন্ত্যজ’ জাতির সমাজে যে অন্যরূপ স্থান ছিল, তা মধ্যযুগের চর্যাগানসমূহে ডোম জাতির ভূমিকা থেকে বুঝতে পারা যায়।
রাজবংশী, বাগ্দী, পোদ, নমঃশূদ্র, বাউরী, চামার, ধোবা, ডোম ও হাড়ি ছাড়া আর যে প্রধান প্রধান তফশীলভুক্ত জাতি আছে, তারা হচ্ছে কেওড়া (১,১৭,৯২৯), কেওট (২৩,১৭৪), জেলে-কৈবত (১,১৭,৩৮৪), মাল (৬৮,৭৫৯), গুঁড়ি (১,০৬,৮৭০), লোহার (৮৩,৫৪৫), পলিয়া (৭৩,৯৯৭), ঝালোমালো (৬৮,৭৫৭), খয়রা (৬৭,৯১৩), ভূঁইয়া (৫৩,৩২৯), কোনাই (৪৩,১০১) ও ভুঁইমালী (৩৯,১৮১)। [বন্ধনীর মধ্যে এদের জনসংখ্যা উল্লিখিত হয়েছে]।
আগেই বলা হয়েছে যে, ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ভারত শাসন-আইন অনুযায়ী এদের সকলকেই তফশীলভুক্ত জাতি বলে অভিহিত করা হয়। তার পূর্বে হিন্দু সমাজের জাতিবিন্যাসে এদের এক নির্দিষ্ট স্থান ছিল। বৃহদ্ধর্মপুরাণে আমরা তার একটা আভাস পাই। বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী রজক (ধোবা), ধীবর (জেলে-কৈর্বত), শৌণ্ডিক (শুঁড়ি) প্রভৃতি জাতি হচ্ছে ধ্যম সংকর জাতি, আর চণ্ডাল, চর্মকার (চামার বা মুচি), ডোরাবাহী (বাগ্দী), মল্ল (মাল), প্রভৃতি জাতি হচ্ছে ‘অন্ত্যজ’ জাতি।
চেহারার সাদৃশ্য থেকে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে, তফশীলভুক্ত জাতিসমূহ উপজাতিসমূহ থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। কোচ রাজবংশীদের কিছু অংশ মঙ্গোলীয় উপজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কিন্তু বাকি উপজাতিসমূহ আদি-অস্ত্রাল নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই আদি-অস্ত্রাল উপজাতিসমূহ যে বাঙলার নৃতাত্ত্বিক বনিয়াদ গঠনেই সাহায্য করেছে তা নয়, তারা উচ্চশ্রেণির বাঙালির আচার-ব্যবহার রীতি-নীতি, ও সংস্কার রচনাতেও যথেষ্ট উপাদান জুগিয়েছে। এদের ভাষার শব্দসমূহ যে বাঙলাভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তা ছাড়া, কুলকেতুর (টটেম) পূজাসংক্রান্ত আচার-ব্যবহার, শুভ-কাজে তেল- হলুদের ব্যবহার, ঝাড়-ফুঁক, খাদ্য সম্বন্ধে নানা প্রকার বিধি-নিষেধ, যাদুতে বিশ্বাস, পংক্তি ভোজন, সগোত্র-বিবাহ সম্বন্ধে বিধি-নিষেধ, বর্ণভেদ প্রথার মূলকথা, ধান্যের চাষ, হস্তিবিদ্যা প্রভৃতি আদি-অস্ত্রাল উপজাতিসমূহের নিকট হতে বাঙালি সমাজে গৃহীত হয়েছে।
এ গুলো আরো বিস্তারিত থাকলে ভালো হয়