চপল জোর গলায় বলল, আবারও, ‘আমার মনে হচ্ছে আমি জানি, দাদি কোথায় আছে। সবাই চলো আমার সঙ্গে।’
স্বাধীন বলল, ‘আমার ঠোঁট থেকে রক্ত পড়ছে। আগে একটু ডাক্তার নাজনিনকে খবর দিলে হতো না?’
শিশির বলল, ‘না না, আগে দাদিকে উদ্ধার করতে হবে।’
চপল বলল, ‘হ্যাঁ, সেটাই। দাদিকে আগে উদ্ধার করতে হবে।’
শিশির বলল, ‘দাদি কোথায় আছে, আপনি জানেন বলছিলেন। কোথায় আছে?’
চপল বলল, ‘ফলো মি। কাদের, তুমি আমার আগে আগে চলো।’
কাদের বলল, ‘চলেন। কোন দিকে যাব?’
‘তোমার ঘরের দিকে। ড্রাইভার’স কোয়ার্টার’—চপল বলল আদেশের সুরে।
‘চলেন’—কাদের আগে আগে যায়। পেছনে সবাই চলেছে একে একে। স্বাধীন বলল, আমি তো নড়তেই পারছি না। তোমরা যাও। আমি বরং ডাক্তার নাজনিনকে ফোন করি।
স্বাধীন গেস্টহাউসের দিকে এগোতে লাগল। মোবাইল ফোনে সে ডাক্তার নাজনিনের নম্বর খুঁজছে।
ড্রাইভারদের থাকার রুমটা পশ্চিম কোণে। চপলের হাতে টর্চলাইট। সে চারদিকে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগোচ্ছে। বলা যায় না, কোথা থেকে কে এসে আঘাত করে বসে কাকে।
ইটের দেয়ালের ওপরে ঢেউটিন। দুই রুমের একটা বাড়ি।
চপল বলল, কাদের, দরজা খোলো।
কাদের দরজা খুলল।
‘লাইট জ্বালো।’
ঘরে একটাই তক্তপোষ। আর কোনো আসবাব নেই। তার নিচে টর্চ ফেলে দেখল চপল।
শিশির আর জাহিন বাইরে। তারা নজর রাখছে পাশের ঘরটায়।
চপল বলল, ‘কাদের, এবার পাশের ঘরে চলো।’
পাশের ঘরে থাকে কেয়ারটেকার কামাল। দরজাটা বাইরে থেকে ভাঁজ করা ছিল। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, এই ঘরেও কেউ নেই।
চপল হতাশমুখে বেরিয়ে এল। কাদেরের মুখে হাসি। বাইরের বাঁশের খুঁটির ওপরে ঝোলানো বিদ্যুৎবাতির আলোয় শিশির স্পষ্ট দেখতে পেল।
শিশির বলল, দাদি কোথায়?
চপল বলল, পাওয়া গেল না। তবে যাবে।
কাদের বলল, আজাইরা এতক্ষণ খাটাখাটি হইল। আপনেরা কি আমারে সন্দেহ করেন?
চপল বলল, মোটেও না।
ডাক্তার নাজনিন চলে এসেছে। স্বাধীনের ঠোঁট থেকে তখনো রক্ত বের হচ্ছে। নাজনিন তুলোয় ডেটল ভিজিয়ে নিয়ে স্বাধীনের ঠোঁট মুছে দিল।
স্বাধীনের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরছে।
নাজনিন বলল, কী হলো? কাঁদছেন কেন?
স্বাধীন বলল, কই, কাঁদছি না তো। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে—এবার সে হেঁচকি দিয়ে উঠল। কান্না গোপন করতে পারছে না।
নাজনিন বলল, কী হলো?
স্বাধীন বলল, আপনি এত ভালো কেন? আপনি এত ভালো কেন?
নাজনিন বলল, ওরা সবাই কই?
স্বাধীন বলল, শিশিরের দাদিকে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই তাকে খুঁজতে গেছে।
নাজনিন বলল, কী সর্বনেশে কথা! তো আপনি গেলেন না?
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘আমার জন্য? কেন?’
‘আপনি ডাক্তার। আমি রোগী। তাই না?’
‘হ্যাঁ। আমি ডাক্তার বটে। তবে আপনি কি রোগী?’
‘রোগী না! দেখুন ঠোঁট কেটে গেছে। ঘাড়ের পেছনেও খুব আঘাত লেগেছে।’
‘দেখি কোথায়?’
‘না। না। দেখতে হবে না। ঘরে কেউ নেই।’
‘আরে আমি ডাক্তার না? আপনি রোগী না?’
এই সময় বাইরে অনেকগুলো পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। চপলদের দল ফিরে এসেছে।
বারান্দার লম্বা বেঞ্চটায় বসে পড়ল শিশির। তারপর গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল।
চপল বলল, স্বাধীন, তুই আবার ঢাকায় ফোন কর তো! পুলিশের সঙ্গে কি যোগাযোগ করা গেছে? পুলিশ কখন আসবে?
স্বাধীন বলল, আহা রে। আমি একজন রোগী। ডাক্তারের চিকিৎসাধীন আছি। আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার কি এটা সময়?
চপল হাসল। তুই তো ছিলি স্বাধীন। এখন হয়েছিস চিকিৎ স্বাধীন।
মানে? স্বাধীন জানতে চাইল।
তুই বললি না, চিকিৎসাধীন। আজ থেকে তোকে আমরা ডাকব চিকিৎ স্বাধীন বলে। সংক্ষেপে চিকা স্বাধীনও বলতে পারি।
শিশির বলল, এই চপল ভাই, আমার দাদিকে না খুঁজে আপনি ইয়ার্কি-ফাজলামো করেই চলেছেন। নিশ্চয় আপনিই লুকিয়ে রেখেছেন।
চপল বলল, না না, আমি লুকিয়ে রাখিনি। ব্যাপারটা আমার জানাশোনার বাইরে হচ্ছে।
শিশির বলল, তাহলে আপনি কেন বললেন, চলো সবাই, আমি জানি, দাদি কোথায় আছে। নিশ্চয়ই আপনিই লুকিয়ে রেখেছেন।
চপল বলল, আমি লুকিয়ে রাখিনি। আমি জানিও না দাদিকে কে বা কারা লুকিয়ে রেখেছে। আমি একটা অনুমান করেছিলাম। সেটা ঠিক হয়নি। এখন পুলিশের হেল্প ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। এই স্বাধীন আবার ফোন দে।
স্বাধীন মোবাইল ফোন থেকে আবার ফোন করল তার ঢাকা অফিসের সাংবাদিক কামরুল হাসানকে।
হ্যালো, কামরুল ভাই, কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন?
ওপাশ থেকে কামরুল হাসান বললেন, জি ভাইজান, পুলিশ আর তিন মিনিটের মধ্যেই আপনাদের কাছে এসে হাজির হবে।
তিন মিনিট। আচ্ছা।
শোনেন, আমি আপনাকে একজন ডিবি পুলিশের নম্বর দিচ্ছি। উনি আসবেন আপনাদের কাছে। তাঁর নাম আবু নাসের ভুঁইয়া।
আচ্ছা দেন নম্বরটা। এসএমএস করে পাঠিয়ে দেন।
স্বাধীনের মোবাইল ফোনে এসএমএস চলে এসেছে।
তারা সবাই বসে আছে বারান্দায়। এই সময় দেখা গেল, কোট-প্যান্ট পরা রহস্যময় ভিক্ষুকটা বাইরের গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকছে।
জাহিন আঁতকে উঠে শিশিরের হাত ধরে ফেলল। ওরে বাবারে, ওই…ওই…ভূত…লোকটা…
শিশির বলল, কোন ভূত?
জাহিন শিশিরের হাত আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, ইংরেজি জানা ভূত।
স্বাধীনও খানিকটা ভয় পেয়ে গেছে।
পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের আবু নাসের ভুঁইয়া আসছেন না কেন?
স্বাধীন তাঁর মোবাইল নম্বরে কল করল। রিং হচ্ছে।
হ্যালো…ওপাশ থেকে গলা শোনা গেল।
স্বাধীন বলল, ডিবি অফিসার আবু নাসের ভুঁইয়া বলছেন?
হ্যাঁ, বলছি।
আমি স্বাধীন। আপনার নম্বর আমাকে দিয়েছেন ক্রাইম রিপোর্টার কামরুল হাসান। আপনার না বাগানবাড়িতে আসার কথা?
এই তো আমি ভেতরে…
তখন স্বাধীন বুঝতে পারল, ইংরেজি জানা এই ভূত অথবা ভিক্ষুক আসলে ডিবির লোক।
স্বাধীন এগিয়ে গেল, নাসের সাহেব, আসুন আসুন। আসুন।
স্বাধীন গলা উঁচু করে সবার সামনে ঘোষণা করল, জাহিন, চপল, শিশির, নাজনিন, তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি ডিবির গোয়েন্দা আবু নাসের ভুঁইয়ার। আমার নাম স্বাধীন।
চপল বলল, ওর নাম চিকিৎ স্বাধীন সংক্ষেপে চিকা স্বাধীন।
শিশির বলল, চপল ভাই, আপনি সব সময় ইয়ার্কি করেন কেন? আমার দাদিকে ধরে নিয়ে গেছে আর আপনি কিনা…
চপল বলল, নাসের সাহেব, আপনি বসুন। এই চেয়ারটায় বসুন। শুনেছেন নিশ্চয়ই ঘটনা। এনার নাম শিশির। এর দাদি ওই দোলনাটায় বসেছিলেন। প্রায় আধঘণ্টা আগে তাঁকে একটা রোমশ প্রাণী, ভালুকের মতো, ধরে নিয়ে গেছে।
জাহিন বলল, ভালুক কি মানুষ খায়, ডিবি সাহেব?
ডিবি অফিসার বললেন, এই জঙ্গলে কোনো ভালুক নেই। কাজেই ভালুকে ধরেনি। ভালুকের পোশাক পরে কোনো মানুষ ধরে নিয়ে গেছে।
শিশির বলল, কিন্তু কেন?
ডিবি অফিসার বললেন, কেন, সেটা আমি পরে বলব। আগে ভদ্রমহিলাকে উদ্ধার করতে হবে।
চপল বলল, কাজটা খুব কঠিন হবে না। তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কে সাহায্য করেছে, এটা আমি জানি। কোথায় রেখেছে, সেটা জানার জন্য আপনার এক্সপারটাইজ কাজে লাগবে।
সবাই একযোগে বলে উঠল, কে? কে সাহায্য করেছে?
চপল বলল, কাদের। এদিকে আসো।
শিশির, আপনি একটা কাজ করুন। আপনার দাদি যে পারফিউমটা ব্যবহার করেন, সেটা একটু ভেতর থেকে নিয়ে আসুন।
শিশির বলল, কেন?
আনুন না।
এবার চপল বলল, কাদেরের শার্টের কাছে সবাই যান। ওর গা থেকে কী ঘ্রাণ আসছে সবাই একটু শুঁকুন।
পাচ্ছেন কোনো ঘ্রাণ?
হ্যাঁ। পাওয়া যাচ্ছে। জাহিন বলল, হুঁ। যাচ্ছে।
স্বাধীন বলল, আমিও পাচ্ছি।
ডিবি অফিসার বললেন, হুঁ, আমিও পাচ্ছি বটে।
শিশির বলল, এবার আমি দাদির পারফিউম আনতে যাই।
জাহিন বলল, একা একা যেয়ো না। আমিও সঙ্গে যাই।
তারা দুজনে মিলে নিয়ে এল দাদির পারফিউমের শিশিটা। চপল সেটা স্প্রে করল নিজের কবজিতে।
সবাই বলে উঠল, এক্সাক্ট সেইম ঘ্রাণ। একই গন্ধ।
কাদের বলল, আজিব কথা। আমারে চোর বানাইতেছেন।
চপল বলল, কাদের মিয়া, তোমার বোতামের সঙ্গে দাদির চাদরের সুতা লেগে আছে। দেখো। এমনকি তাঁর চাদরের ওপরে যে চুমকি বসানো, তার দুইটা তোমার কাঁধে এখনো লেপ্টে আছে। জাহিন, দাদির চাদরটা যেটা উদ্ধার করা হলো, সেটা আন তো। ওই যে চেয়ারের পেছনে ঝোলানো আছে। ওইটা।
চপল কাদেরের কাঁধের কাছ থেকে দুটো চুমকি উদ্ধার করে ডিবি অফিসারের হাতে দিল। চাদরটা আনল জাহিন। দেখা গেল, ওই চাদরে একই চুমকি বসানো আছে।
ডিবি অফিসার আবু নাসের ভুঁইয়া যে এত ক্ষিপ্রগতির দক্ষ মানুষ, কে জানত। তিনি এক ঝটকায় কাদেরকে ধরে মাটিতে ফেলে দিলেন, আর তার হাত দুটো পেছনে বেঁধে ফেললেন।
কাদের আর্তনাদ করে উঠল।
ডিবি অফিসার বললেন, কই রেখেছিস ভদ্রমহিলাকে?
কাদের বলল, জঙ্গলের মধ্যে একটা চালাঘর আছে। সেইখানে।
সঙ্গে কে আছে?
জাহাঙ্গীর ভাই আছে।
জাহাঙ্গীর ভাইটা কে? চপল জিগ্যেস করল।
ডিবি অফিসার বললেন, সেটা না হয় একটু পরেই জানা যাবে। আগে চলুন, ভদ্রমহিলাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।
চপল, জাহিন, স্বাধীন আর ডিবি অফিসার চলল কাদেরকে সঙ্গে নিয়ে।
ডিবি অফিসার বললেন, আপনারা দুজন ভদ্রমহিলা একলা একলা থাকবেন, ভয় করবেন না তো?
ডা. নাজনিন বললেন, প্রশ্নই আসে না। আমি একা একা চলাচল করছি না এখানে? কতবার এলাম-গেলাম। নারী হলেও আমরা ভয় পাই না, নিজেকে দুর্বলও মনে করি না।
চালাঘরটা বেশি দূরে নয়। তবে ঘন একটা জঙ্গলের আড়ালে। একটা ছোট টিলা পেরিয়ে যেতে হয়। রাতের অন্ধকারে সেই পথে হাঁটতে জাহিনের বুক ধড়ফড় করে কাঁপছে।
ডিবি অফিসার বললেন, জাহাঙ্গীর লোকটাকে আমিই সামলাব। আপনারা ভদ্রমহিলাকে দেখবেন। বলা তো যায় না, আরও কেউ থাকতে পারে। আবার অস্ত্রটস্ত্রও থাকতে পারে।
ডিবি অফিসার কোমরের নিচ থেকে একটা ছোট্ট রিভলবার বের করে দুহাতে ধরলেন। তারপর চালাঘরের বাঁশের বেড়ার দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন ভেতরে। চপল টর্চ জ্বালাল।
মাটিতে খড় বিছানো। সেখানেই বসে আছেন দাদি। তার মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা। হাতও পেছন দিকে বাঁধা। এক পাশে একটা ভালুক।
ডিবি অফিসার বললেন, হ্যান্ডস আপ। জাহাঙ্গীর মিয়া, হাত ওপরে তোলো। একটু নড়াচড়া করবা তো স্ট্রেইট গুলি করে দেব।
ভালুকটা হাত ওপরে তুলে দাঁড়াল।
তার মুখটা খোলা।
একেবারে মানুষের মুখ।
ডিবি অফিসার বললেন, শীতটা আজকে একটু বেশিই পড়েছে, তাই না। ভালুকের পোশাক পরে থাকতে আরামই লাগছে। তাই না জাহাঙ্গীর?
ডিবি অফিসার জাহাঙ্গীরেরও হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেললেন। এসব ব্যাপারে তাঁর ক্ষিপ্রতা দেখে কে বলবে, এই লোকই সেই লোক, যিনি চপলদের গাড়ির কাছে এসে ইংরেজিতে ভিক্ষা চাইতেন।
কাদের আর জাহাঙ্গীরকে সামনে রিভলবার দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে তাঁরা পথ চলছেন। আর জাহিন, স্বাধীন, চপল দাদির হাত ধরে নিয়ে আসছে।
দাদি বলছেন, ধরতে হবে না। আমি হাঁটতে পারব।
তাঁরা ফিরে এলেন বাগানবাড়িতে।
ডাইনিং টেবিলে গোল হয়ে বসল সবাই।
এক পাশে মাটিতে বসে আছে হাত বাঁধা কাদের আর জাহাঙ্গীর।
চপল বলল, কাদের মিয়া, তুমি এই লোককে আগে থেকে চিনতে?
কাদের বলল, আমার বাপ-মায়ের কসম, কোনো দিন চিনতাম না।
তাহলে?
কাদের বলল, এইখানে আইসা আপনার বুদ্ধিতে আপনার জিনিসপাতি দিয়া ভয় দেখাই। জঙ্গলে যাই। আগুন জ্বালাই। সেই সব করতে গিয়া দেখি ওইখানে একটা চালাঘর। সেইখানে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। উনি আমারে জিগান, আপনে কী করেন?
আমি কই, মানষেরে ভয় দেখাই। আগুন জ্বালামু। ঢিল মারুম।
জাহাঙ্গীর ভাই কন, ক্যান, এই সব ক্যান করবেন?
আমি কই, চপল স্যারে মানষেরে ভয় দেখায়া মজা পায়।
উনি কন, আরে মিয়া ভয় দেখায়া মজা পায়া লাভ কী? আসেন। সত্যিকারের ভয় দেখাই। তাইলে আপনেরে টাকা দিমু।
চপল বলল, দিয়েছে টাকা?
কাদের বলে, খালি এক হাজার পাইছি। দাদিরে নিয়া যাইতে সাহায্য করলে দশ হাজার টাকা দিব কইছিল।
তাই তুমি দাদিকে কাঁধে তুলেছিলে?
হ। উনি তো ভালুকের ড্রেস পরা। হাঁটতে পারে না। হাতে ধরতে পারে না। অসুবিধা হয়।
ডিবি অফিসার বললেন, আপনাদের ধন্যবাদ। আপনারা আমার একটা বড় রহস্য উন্মোচনে অনেক বড় হেল্প করলেন। এবার জাহাঙ্গীর বলো, তোমাকে কে রিক্রুট করেছে? মানে তোমাকে এই কাজ কে দিয়েছে?
জাহাঙ্গীর বলল, স্যার, আপনে তো জানেনই স্যার। মন্টু মিয়া জায়গাটা দখল করতে চান। মালিক লন্ডনে থাকে। বাগানবাড়ি চালায়। তো বাগানবাড়িতে ভূতের আসর আছে, জায়গাটা ভালো না বললে বাগানবাড়ি উইঠা যাইব। মালিক আর খোঁজ লইব না। তখন মন্টু মিয়া এইটা দখল করব। পেছনের জমিনটা তার। কিন্তু সেইটায় যাওনের রাস্তা নেই। এই জমিটা পাইলে তার জমির দাম কত বাইড়া যাইব ভাবেন।
তাই আমারে লাগায়া রাখছে। এই বাগানবাড়িতে গেস্ট আইলেই আমার কাম হইল ভয় দেখানো। তবে খুনখারাবি আমি কখনো করিনি। খালি ভয় দেখাইছি। আগুন জ্বালাইছি। ঢিল মারছি। তবে এই স্যারেরা দেখি আরও নানা রকমের ভয় দেখানোর বুদ্ধি জানে। এইবারে মন্টু সাবে কইল, ওই যে মুরব্বি মহিলা। এইটারে গায়েব করতে হইব। তাইলে লন্ডনে খবর হয়া যাইব। তাইলে জমিটা না বেইচা পারবই না।
এর মধ্যে বাইরে একটা টেম্পো এসে দাঁড়াল।
মোবাইল ফোনে কথা বললেন ডিবি অফিসার। বললেন, লোকাল থানা থেকে পুলিশ এসেছে।
ডিবি অফিসার এগিয়ে গেলেন। পুলিশের তিনজন সদস্যকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। পুলিশ কাদের আর ভালুকের পোশাক পরা জাহাঙ্গীরকে নিয়ে গেল।
ডিবি অফিসার বললেন, আপনারা ঘুমোতে যান। আর কোনো ভয়ের ঘটনা ঘটবে না আশা করি।
দাদি বললেন, মন্টু মিয়া যদি আবারও কাউকে পাঠায় রাতের বেলা?
ডিবি অফিসার বললেন, থানার লোক বাগানবাড়ি পাহারা দেবে। আপনারা চিন্তা করবেন না।
ডাক্তার নাজনিন বলল, আমি তাহলে এবার যাই।
স্বাধীন বলল, চলুন, আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
***
রাতের বেলা জাহিনের ঘুম ভেঙে গেল।
শিশিরদের ঘর থেকে নারীকণ্ঠের চিৎকার ভেসে আসছে বাঁচাও বাঁচাও বলে।
জাহিন ভয় পেয়ে গেল। ব্যাপার কী?
তার পাশে শুয়ে আছে চপল। চপলকে কি সে ডাকবে?
আবার আর্তনাদ। নারীকণ্ঠ বলেই চলেছে, বাঁচাও বাঁচাও।
শিশিরের কোনো বিপদ হয়েছে নিশ্চয়ই। জাহিন উঠে দৌড়ে গেল শিশিরদের ঘরের সামনে।
সত্যি ভেতর থেকে নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে আসছে।
হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ হলো।
শিশিরদের দরজার নিচ দিয়ে রক্ত এসে পড়ছে বারান্দায়।
জাহিন সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল শিশিরদের দরজায়।
ভেতর থেকে শিশিরের গলা, কে?
আমি জাহিন। শিশির কী হয়েছে?
কী হয়েছে মানে?
রক্ত কেন?
শিশির খিলখিল করে হাসছে। এই বাগানবাড়ি সত্যি একটা ভূতের বাড়ি। জাহিন এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে।
শিশির দরজা খুলল।
সে ভাঙা কাচের টুকরা কুড়াচ্ছে। বলল, আরে কোকের বোতলটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল। দেখো, কোক পড়ে ঘরের কী অবস্থা।
বাঁচাও বাঁচাও বলে কে চিৎকার করছিল?—জাহিন ভয়-পাওয়া গলায় বলল।
শিশির সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে হাসছে।
ওই যে টেলিভিশনের নায়িকা। তাকে ভূতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এটা একটা হরর নাটক। বাংলা হরর তো। ভয়ের বদলে খালি হাসি পায়।
একটা ভূতের সাজে সজ্জিত লোক—তার কপালে চোখ আঁকা—একটা তরুণীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কাঁধে করে। সে চেঁচাচ্ছে—বাঁচাও, বাঁচাও। জাহিন দেখতে পেল টিভি পর্দায়।
দাদি কই? জাহিন জিগ্যেস করল।
দাদি বাথরুমে। শাওয়ার নিচ্ছেন। তাঁকে ময়লা খড়ের গাদায় রাখা হয়েছিল। তিনি এক ঘণ্টার কম গোসল করবেনই না।
হঠাৎ শিশির চিৎকার করে উঠল ওরে বাবারে বলে।
লাফিয়ে এসে পড়ল জাহিনের ঘাড়ের ওপরে।
জাহিনও ভয় পেয়ে গেছে? কী?
ওই যে ওই যে…
জাহিন তাকিয়ে দেখল একটা তেলাপোকা।
সে হেসে ফেলল খিলখিল করে।
(শেষ)