চপল চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। ‘কে…কে…’ বলতে বলতে সে ছুটে চলে যায় বাইরে।
কে এই ছায়ামূর্তি? তাকে চপল ধরতে চায়? নাকি সে অভিনয় করছে? স্বাধীন ভাবে।
জাহিনের চোখে-মুখে আতঙ্ক।
দিনের বেলা বলেই হয়তো ভয়ে সে মূর্ছা যায়নি। তবে এত গাছগাছড়া বাড়িটার চারদিকে, দিনের বেলাতেও এলাকাটা অন্ধকার হয়ে আছে। কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব। ডাইনিং রুমের পেছনের জানালাটার ওপারে গাছ আর গাছ। শেওলা জমে আছে মাটিতে, দেয়ালে। নানা ধরনের লতা-গুল্ম। ভূত-প্রেত না থাকুক, সাপখোপ যে আছে, তাতে জাহিনের অন্তত সন্দেহ নাই।
স্বাধীন উঠে এগিয়ে যায় দরজা পর্যন্ত, জাহিন ভয়ে ছিটকে গিয়ে হাত ধরে ফেলে শিশিরের।
তখন বাইরে খুব জোরে একটা শব্দ হয়, আর তার পরেই আসতে থাকে শিশুর কান্নার আওয়াজ।
শব্দটা এত জোরে হয় যে শিশিরও জাহিনের হাত খামচে ধরে।
ওদিকে ততক্ষণে চপল বাইরে ভবনটার পেছনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। কলাগাছের পাতা সরিয়ে এগোয়। খসখস ধপধপ শব্দ হয়।
স্বাধীন আর চপল বারান্দায় পাশাপাশি বসা। দুটো বেতের চেয়ার। এখানে বসলে পাহাড়ের ভিউটা ভালো দেখা যায়।
স্বাধীন বলে, চপল, তোর মাথায় এত দুষ্টুমি বুদ্ধি কী করে আসে?
চপল হাসে। আমার বুদ্ধি মোটেও দুষ্টুমি বুদ্ধি নয়। সব কাজের বুদ্ধি।
কাজের বুদ্ধি?
হ্যাঁ।
স্বাধীন বলে, আচ্ছা বল তো, বাচ্চার কান্নার আওয়াজটা কোত্থেকে আসে?
কোন বাচ্চার আওয়াজ?
একটা বাচ্চা কেঁদে ওঠে। আমিও শুনেছি। জাহিনও বলছিল। গাড়িতে নাকি সে শুনেছে একটা বাচ্চা কাঁদছে।
চপল বলে, ওই দেখ, কী সুন্দর একটা ফুল। নীল রঙের ফুল দেখতে আমার যা ভালো লাগে না। এক কাজ কর তো। একটা ফুল আর দুটো পাতা তুলে আন।
কী করবি?
শিশির মেয়েটাকে দেব।
তুই দিবি। তুই আন। আমাকে দিয়ে খাটাচ্ছিস কেন?
আরে আন না। এই ফুল দেব জাহিনকে। বলব, শিশির তোকে দিয়েছে।
ব্যাপারটার মধ্যে একটা মজা মজা গন্ধ পায় স্বাধীন। সে ফুল তুলতে এগিয়ে যায়। বারান্দা থেকে নেমে ঘাসের ওপরে পা রাখে। ফুলটা সত্যি সুন্দর। কী গাছ এটা? ঝাঁকড়া একটা পাতাওয়ালা গাছ।
এরই মধ্যে সে হঠাৎ শোনে, একটা মানবশিশু কেঁদে উঠল।
কোত্থেকে এল এই কান্নার আওয়াজ। স্বাধীন ভয় পেয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে পড়েছে লনটায়। চারদিকে ভয়হীনতার আশ্বাস। এর মধ্যে একটা বাচ্চা কাঁদে কোথায়? কার বাচ্চা?
স্বাধীন কোনো কিছু ঠাওর করতে পারে না।
স্বাধীনের ভয় পাওয়া দেখে চপল হাসে।
আয়, এদিকে আয়। ফুলটা নিয়ে আয়—চপল বলে।
স্বাধীন কাছে আসতেই আবারও শিশুকণ্ঠে কান্নার আওয়াজ।
যন্ত্রণা তো।
চপল হাসতে হাসতে বলে, আরে গাধা। এইটা আমার সেকেন্ড মোবাইল সেটের রিংটোন। এটাতে যখনই আমি রিং করি, বাচ্চা ছেলে কেঁদে ওঠে। ওই যে ওইখানে পেপারের আড়ালে বাজছে। এইটাই গাড়িতে রেখে দিয়েছিলাম জাহিনকে ভয় দেখানোর জন্য। যখনই যেখানে কান্নার আওয়াজ দরকার হয়, এটাতে রিং দিই। হা হা হা…
স্বাধীনও হেসে ওঠে। কিছুটা নিজের বোকামিতে, কিছুটা চপলের বুদ্ধির তারিফ হিসেবে। কিছুটা চপলের হাসিতে সংক্রমিত হয়ে।
স্বাধীন বলে, ওই সময় বিল্ডিংয়ের পেছনে কে এসেছিল রে চপল?
চপল বলে, বুঝলাম না। আমি ভাবলাম কাদের। কিন্তু বেরিয়ে দেখি, কাদের গাড়ি মুছছে। ওটা কাদের ছিল না।
স্বাধীন বলে, কাদের না থাকলে কে হতে পারে?
চপল গম্ভীর মুখে বলে, এইটাই তো এখন ভাবনার কথা।
স্বাধীন বলে, তোর যে কত কিছু ভাবতে হয়। দোস্ত, এত রসিকতা তুই কোথায় জমিয়ে রাখিস। মাথায় না পেটে?
চপল বলে, না না, সিরিয়াসলি, তখন বারান্দায় কে এসেছিল, আমি কিছুই জানি না। জানার চেষ্টা করছি।
স্বাধীন বলে, আর দোস্ত, তোর ওই ইংরেজ সাহেবের ঘোড়া গুলি করেছে, এই গল্পটা বেশি গাঁজাখুরি হয়ে গেছে। তুই কিন্তু যতটা রসিক আছিস, গল্পকার হিসেবে ততটা ভালো না। আরও কিছু গল্পের বই তোকে পড়তে হবে।
আরে আমি বানিয়ে গল্প বলেছি নাকি। কক্ষনো না। এটা যে কেউ জানে। তুই কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস কর।
আচ্ছা আচ্ছা করব জিজ্ঞেস, ঘোড়া গুলি করেছে না বলে তুই বাঁদর গুলি করেছে বলতে পারিস। তোর গল্পটা অবশ্য ‘দ্য বেল অব জাস্টিস’ নামের একটা গল্পের সঙ্গে মিলে যায়। একটা ঘোড়াকে তার মালিক পরিত্যাগ করে। ঘোড়াটার না খেয়ে মরার অবস্থা। তখন সে একটা লতা খেতে শুরু করল। সেই লতার সঙ্গে বাঁধা ছিল শহরের ন্যায়বিচারের ঘণ্টা। ঘণ্টা বেজে উঠল। তখন নগর কর্তৃপক্ষ ছুটে এল। ঘোড়ার মালিককে বলা হলো, ঘোড়াটাকে ঠিকমতো খেতে দাও। কিন্তু ঘোড়া গুলি করতে পারে, এই গল্পটা একদমই বিশ্বাসযোগ্য হয়নি চপল, বলে স্বাধীন বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়তে লাগল।
শিশিরের খামচিতে দাগ বসে গেছে জাহিনের কবজিতে। তাতে অবশ্য জাহিন খুশিই।
খানিক পরে সে হাজির হয় শিশির আর তার দাদির রুমের দরজায়। নক করে, কাশি দেয়।
দাদি বলেন, কী ব্যাপার জাহিন, তোমার কি সর্দি-কাশি হয়েছে নাকি?
জাহিন বলে, না সর্দি-কাশি হয়নি।
হলে বোলো। আমার কাছে নানা ধরনের ওষুধ আছে।
সেই জন্যই এসেছি, জাহিন বলে। স্যাভলন ক্রিম হবে?
স্যাভলন ক্রিম দিয়ে কী করবে? দাদি বলেন।
এই যে এখানে একটু ছড়ে গেছে। দেখুন কী রকম লাল দাগ হয়ে গেছে?
কীভাবে হলো? দাদি আঁতকে ওঠেন।
এই তো একটু ব্যথা পেয়েছি।
ঘরের ভেতরে শিশির, চোখ সরু করে ঘটনা দেখছে আর ওদের কথা শুনছে। জাহিন কবজির দাগ দেখাচ্ছে দাদিকে। সে খানিকটা লজ্জা পেল বলেই মনে হয়!
বিকেলবেলাটা ভালোই যায়। ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট এনেছিল ওরা। চারজনে মিলে ব্যাডমিন্টন খেলে। শিশির আর জাহিন এক দল। চপল আর স্বাধীন আরেক দল। জাহিন খুব ভালো পারে না ব্যাডমিন্টন। তার তুলনায় শিশিরই দেখা যাচ্ছে ভালো খেলে।
চপল খেলায় মন দেয়, নতুন কোনো দুষ্টুমি বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটায় না।
দাদি চেয়ারে বসে খেলা দেখেন।
শীতের বিকেল। দ্রুত ফুরিয়ে আসে। ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে।
ওরা দুপুরেই কেয়ারটেকারকে বলে রেখেছিল বারবিকিউ হবে। মুরগি কিনে আনা হয়েছে। মুরগির প্রসেস করা হচ্ছে। কেয়ারটেকার আর তার সঙ্গে আরেকজন সহকারী রান্নাবান্নার কাজ করছে।
দাদি পেছনে দুহাত বেঁধে পায়চারি করছেন আর রান্নার তদারক করছেন।
মাথার ওপরে ঢেউটিনের ছাদ। উঁচু বড় বারান্দা। ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছে। তার চারপাশে উড়ছে নানা ধরনের পোকা। ঝিঁঝি ডাকছে। ডাকছে নানা ধরনের পোকা। বিচিত্র ধরনের শব্দ আসছে, একটানা। একটু আগে অনেক পাখি ডাকছিল।
বারবিকিউয়ের জন্য কয়লায় আগুন ধরানো হয়েছে। কেয়ারটেকার আর তার সহকারী বাতাসের জন্য সেখানে ইলেকট্রিক ফ্যান লাগিয়ে দিয়েছে। মাংস ধীরে ধীরে পুড়ছে। খুব সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে।
শিশির বলে, সামনের শীতে কোথায় থাকব কে জানে।
জাহিন তার পাশেই বসে ছিল।
বলে, সামনের শীতে আপনার কোথায় যাওয়ার কথা?
শিশির বলে, সেটাই তো জানি না। লন্ডনে যেতে পারি ব্যারিস্টারি পড়তে। নিউইয়র্কেও যেতে পারি চাচার ওখানে। আবার দেশেও পড়তে পারি। জানি না।
জাহিন বলে, বাপ রে! এত অপশন! এত অপশন থাকলে তো মাথার চারদিকে চোখ লাগবে।
মানে?
মানে হলো, আপনি যদি ডানে যেতে চান, বাঁয়েও যেতে চান, পেছনেও যেতে চান, তখন চারদিকটা একবারে যাচাই করতে হলে মাথার চারদিকে মোট আটটা চোখ লাগবে।
চপল এসে সেই আড্ডায় ঢুকে পড়ে, আর হতে পারে, ঘাড়ের ওপরে মাথাটা একটা বিয়ারিংয়ের ওপরে বসানো। মাথাটা বনবন করে ঘুরতে পারে। চারদিকে সব দেখতে পায়। হা হা হা…
স্বাধীনও এসে আলাপে যোগ দেয়। বলে, কার্টুন ছবির মতো। মাথা চক্কর খাচ্ছে…
শিশির বলে, কী থেকে আলাপ কোথায় গেল।
জাহিন বলে, গল্পের গরু গাছে ওঠে। আচ্ছা শিশির, ঢাকায় আপনার বাসা কোথায়?
শিশির বলে, উত্তরায়।
জাহিন বলে, আচ্ছা, এয়ারপোর্টের কাছেই। লন্ডনে কিংবা নিউইয়র্কে যেতে আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। বাসার কাছে এয়ারপোর্ট থাকা ভালো।
এই সময় সবাই একযোগে নিশ্চুপ হয়ে যায়।
কেউ কথা বলছে না।
শিশিরের দাদি তখন বলেন, মাথার ওপর দিয়ে পরি উড়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে পরি উড়ে গেলেই কেবল সবাই একসঙ্গে চুপ হয়ে যায়!
চপল বলে, মাথার ওপর দিয়ে পরি উড়ে গেল! নাকি কোনো অশরীরী প্রেতাত্মা!
চপল যে হঠাৎ হঠাৎ কী সব কথা বলে!
সবাই আবার নীরব হয়ে যায়।
স্বাভাবিক একটা সন্ধ্যা হঠাৎ অস্বাভাবিক হয়ে আসে। সবাই যেন নিজের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছে, এই রকম অস্বাভাবিক নীরবতা!
ওই ওখানে বারবিকিউয়ের চুলায় আগুন জ্বলছে, ফ্যান ঘুরছে, তেল পুড়ছে, সেসবের শব্দও কেমন যেন তীব্র।
ঠিক তখনই দূরে ঘন জঙ্গলের ওই কালো কালো অন্ধকার স্তূপের ওই পারে কী যেন নড়ছে।
ইয়া লম্বা সাদা…মনে হচ্ছে কোনো অতিকায় অশরীরী…তার লম্বা হাত লম্বা পা…এক গাছের মাথায় এক পা আরেক গাছের পাতায় আরেক পা।
হঠাৎ দূরে একটা গাছের কাছে দেখা গেল একটা অতি লম্বা সাদা কাপড় দিয়ে বানানো মানবশরীর। বাঁশের ডগায় সাদা কাপড় জড়িয়ে এটা বানানো হয়েছে। দূর থেকে অন্ধকারে দেখতে ভূতের মতো দেখা যাচ্ছে।
কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে যাচ্ছে সেদিকে।
কতগুলো বাদুড় একযোগে আকাশে উড়ে ঝাপ্টাতে থাকে পাখা।
সেদিকটায় তাকিয়ে আউ করে চিৎকার করে ওঠে চপল।
স্বাধীনও তাকায় সেদিকটায়। উল্টে পড়ে যায় চেয়ার থেকে।
সবার আগে নিজের রুমের দিকে দৌড় ধরেন দাদি। কোনো কথা না বলে তাঁর পেছন পেছন ছুটতে থাকে শিশির।
পুরো ঘটনা ঘটে চোখের পলকে।
স্বাধীন মাটিতে ঠেস দিয়ে উঠে বসে।
আর জাহিন তার চেয়ারে বসা অবস্থাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। কেয়ারটেকার দৌড়ে আসে, কী হইছে?
চপল বলে, পানি আনেন তো। জাহিন ছেলেটার মনে হচ্ছে ফিটের ব্যামো আছে। বারবার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে।
কেয়ারটেকার জগে করে পানি আনে। চপল জাহিনের চোখে-মুখে পানি ছিটায়।
কিন্তু জাহিনের জ্ঞান ফেরে না।
চপল বলে, স্বাধীন, আয় তো। ধর একে। রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিই।
চপল আর স্বাধীন পাঁজাকোলা করে ধরে জাহিনকে নিয়ে যায় রুমে।
চপল বলে, এ তো ভারি মুশকিল হলো। এই ব্যাটা না আবার মরে টরে যায়।
স্বাধীন বলে, এখন কী করবি?
চপল বলে, এই রকম ভিতুর ডিমের সঙ্গে আর কোথাও আসব না কোনো দিন।
স্বাধীন বলে, বেঁচে যদি থাকে, তাহলে না আরেকবার আসার কথা ভাবা যাবে। কিন্তু মরে টরে যদি যায়!
চপল বলে, মরে গেলে খবরই আছে। ভূত হয়ে এসে আমার ঘাড় ভাঙবে সবার আগে।
স্বাধীনের খুব মন খারাপ হয়। তাদেরই তো বন্ধু। এভাবে নিজেদের দুষ্টুমির কারণে জ্ঞান হারিয়ে মরে টরে যাবে, সেটা কি খুব একটা কাজের কথা হলো?
চপল জাহিনের চোখে-মুখে পানির ছিটা দিচ্ছে।
কোনো লাভ হচ্ছে না।
স্বাধীন বলে, কোথাও কোনো ডাক্তার পাই কি না দেখব?
চপল বলে, হ্যাঁ দেখ। অবস্থা সুবিধার মনে হচ্ছে না।
স্বাধীন দ্রুত পায়ে বেরোয় ঘর থেকে। কেয়ারটেকারের কাছে যায়। কামাল ভাই, আশপাশে কোনো ডাক্তার আছে?
কেয়ারটেকার বলেন, ডাক্তার নাই। তয় একজন আছে। মেডিক্যাল কলেজে পড়ে।
স্বাধীনের তখন চিন্তা করার শক্তি নেই, সময়ও নেই। সে বলে, চলেন কামাল ভাই, তার কাছেই যাই। তিনি তো বলতে পারবেন আশপাশে কারও কাছে কোনো হেলপ পাওয়া যাবে কি না!
কেয়ারটেকার বলে, কিন্তু আমার পাকশাক তো শ্যাষ হইল না।
পরে শেষ করবেন। আগে তো মানুষ বাঁচাতে হবে। চলেন।
কেয়ারটেকার আগে আগে যাচ্ছে। পেছন পেছন ছুটছে স্বাধীন।
তখন মুহূর্তেই স্বাধীনের ভয়ডর সব উবে যায়। এই সব জঙ্গলি পায়ে চলা পথ মাড়িয়ে সে ছুটে চলে কেয়ারটেকারের পিছু পিছু।
তার হাতে একটা টর্চলাইট। তার হাতের সঙ্গে টর্চলাইটটা আগুপিছু করছে। আলোটাও দুলছে।
খানিকটা পথ পেরুনোর পরে একটা গাছগাছালি ছাওয়া বাসা চোখে পড়ে।
বাইরে ইলেকট্রিক আলো। কতগুলো আমগাছ লিচুগাছের ফাঁকে ফাঁকে লাইটপোস্ট। টিনের চালের ওপরেও আলো এসে পড়েছে। গ্রিলঘেরা বারান্দা। সাদা দেয়ালের বাসা।
কেয়ারটেকার দরজা ধাক্কায় আর বলে, ডাক্তার আপা আছেন নাকি? ডাক্তার আপা?
স্বাধীন বলে, আপা? লেডি ডাক্তার নাকি?
কেয়ারটেকার বলেন, হ। লেডিস ডাক্তার।
একটু পরে একজন তরুণী বের হয়। হালকা-পাতলা। খুব বেশি লম্বাও নয়, বেঁটেও নয়। তার চোখে ইয়া বড় চশমা। সে বলে, কী অবস্থা, কালাম ভাই? রাতের বেলা?
স্বাধীন তোতলাতে তোতলাতে বলে, আমাদের একজন ফ্রেন্ড সেন্সলেস হয়ে গেছে। গেস্টহাউসে। আপনাকে একটু আসতে হবে।
তরুণী বলে, আমি তো পুরোপুরি ডাক্তার নই।
স্বাধীন বলে, তাহলে উপায়?
তরুণী বলে, চলেন যাই। আমি ট্রিটমেন্ট করতে পারব না। তবে আপনাদের হয়তো সাহস দিতে পারব। চলেন দেখি।
তরুণী ভেতরে যায়। একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে।
কেয়ারটেকার এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিতে চায়। তরুণী রাজি হয় না। তারা দ্রুত পায়ে হেঁটে আসতে থাকে বাংলোর দিকে।
স্বাধীন হাঁপাচ্ছে। সে বলে, আমার নাম স্বাধীন। আমরা তিন বন্ধু বেড়াতে এসেছি এখানে।
ইন্টার্নি ডাক্তার বলে, আচ্ছা।
সে তো আর কিছুই বলছে না। অগত্যা স্বাধীন বলে, আপনার নামটা জানতে পারি?
দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটি বলে, নিশ্চয়ই। আমার নাম নাজনিন।
স্বাধীন বলে, আচ্ছা আচ্ছা। খুব সুন্দর নাম।
কথাটা বোকার মতো শোনায়।
নাজনিন বলে, রোগীর কী অবস্থা? এর আগেও কি সেন্সলেস হওয়ার হিস্ট্রি আছে?
স্বাধীন নিজেকে বুদ্ধিমান বা স্মার্ট প্রমাণ করার চেষ্টা করে, বলে, হিস্ট্রিতে আছে কি না জানি না। জিওগ্রাফিতে তো নাই।
নাজনিন বলে, মানে?
অনেক আগে কখনো অজ্ঞান হয়েছিল কি না জানি না। তবে এর মধ্যে একবার হয়েছে। আমরা ওকে ভূতের ভয় দেখিয়েছিলাম?
ভূতের ভয়?
হ্যাঁ। মানে আমি আর আমার বন্ধু চপল মিলে ভূত সেজে অন্ধকারে ওকে ভয় দেখাই। তখন ও অজ্ঞান হয়ে যায়। সেটা তো গত রাতের কথা। আজকে আবার হয়েছে।
আজকে কি আবার ভয় দেখিয়েছেন?
হ্যাঁ। বড় বড় ভূত, ইয়া বড় বড় পা, এক গাছে এক পা আরেক গাছে আরেক পা…
এই সব বলে তাকে ভয় দেখিয়েছেন?
কিছু বলে। কিছু অ্যাক্টিং করে। কিছু জিনিসপত্র লাগে, নাটকের প্রপসের মতো…
কাজটা আপনারা ঠিক করেননি। ওনার তো প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে মনে হচ্ছে।
সেটা কী জিনিস?
ওই তো ভয় পাওয়া। কিন্তু প্যানিক অ্যাটাক থেকে বারবার ফেইন্ট হয়ে যাওয়া তো ভালো কথা না।
ডা. নাজনিনকে নিয়ে স্বাধীন গেস্টহাউসে জাহিনের রুমে প্রবেশ করে। জাহিন শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে, এখনো অচেতন। চপল তার শিয়রের কাছে বসে আছে।
স্বাধীন বলে, চপল, এই যে ডাক্তার আপা এসেছেন। ডাক্তার নাজনিন। খুব ভালো ডাক্তার।
নাজনিন এগিয়ে যায় রোগীর কাছে। প্রথমেই জাহিনের কবজি ধরে। নাড়ি দেখে। তারপর কানে স্টেথোস্কোপ লাগায়। জাহিনের বুক পরীক্ষা করে।
স্বাধীন মনে মনে বলে, আরে জাহিন বজ্জাতটার তো কপাল ভালো। কী রকম যত্ন পাচ্ছে।
নাজনিন বলে, একটু তেল গরম করে আনুন তো।
স্বাধীন দৌড়ায়। বাইরে বারবিকিউ হচ্ছে। সেখানে সে কামালকে বলে, কামাল ভাই, গরম তেল দেন তো?
কামাল বলে, কী তেল?
কী তেল মানে?
সরিষার তেল নাকি সয়াবিন?
মুশকিল তো। সরিষার তেলই দেন।
কতটুকুন লাগবে? এক লিটার নাকি এক ছটাক?
স্বাধীন আবারও মুশকিলে পড়ে। বলে, এক চামচ দেন।
কেয়ারটেকার বলেন, কত বড় চামচ? ভাতের চামচ নাকি চা-চামচ?
আপনি তরকারির চামচে দেন।
কেয়ারটেকার চামচে তেল গরম করে চুলার গনগনে আগুনে। তারপর সেটা দেয় স্বাধীনের হাতে। সেই চামচভরা তেল নিয়ে স্বাধীন এগিয়ে যায়। তাকে সাবধানে পা ফেলতে হয়। চামচ থেকে তেল যেন পড়ে না যায়!
স্বাধীন সেই গরম তেলের চামচ তুলে দেয় নাজনিনের হাতে।
নাজনিন জাহিনের পায়ে তেল ডলে দেয়।
স্বাধীন বিড়বিড় করে, কী কপাল। এই রকম একটা ডাক্তার ম্যাডাম জাহিনের পায়ে তেল মাখছে। আগামীকাল যদি আমি নিজে অজ্ঞান না হয়েছি তো আমি শালা স্বাধীনই না!
আস্তে আস্তে জাহিনের জ্ঞান ফেরে।
জাহিন দেখে তার শিয়রে একটা সুন্দরী মেয়ে।
জাহিন বলে, আমি কোথায়? আপনি কে? আমি কি ভূত-পরির দেশে? আপনি কি পরি?
চপল বলে, ওরে বদের ডিম। চোখে পরি দেখো, না? তুই এখনো ধূলির ধরণিতেই আছিস।
নাজনিন বলে, আপনারা ওকে সাবধানে রাখবেন। আমি একটু ওষুধ লিখে দিই। একটা কাগজ দেন।
ওরা খুঁজে পেতে একটা কাগজ বের করে দেয়।
নাজনিন বলে, রোগীর নাম কী?
জাহিন আহমেদ। চপল বলে।
নাজনিন বলে, এক নম্বর ওষুধ হলো, আপনারা ওনাকে ভয় দেখাবেন না। আপনারা বেশি বাড়াবাড়ি করেছেন। জাহিন সাহেব, আপনার বন্ধুরা আপনাকে ভয় দেখায়। তারা ভূতের অভিনয় করে। আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য তারা নানা ধরনের জিনিসপাতি ঢাকা থেকে নিয়েই এসেছে। আপনি ভয় পাবেন না। বুঝলেন?
জাহিন বলে, আমাকে ওরা ভয় দেখাচ্ছে? সব অভিনয়!
চপল খিকখিক করে হাসে।
জাহিন বলে, বাচ্চার কান্না আসে কোথা থেকে?
চপল তখন মোবাইল বের করে। তার কাছে আরেকটা মোবাইল আছে। সেটা থেকে এই মোবাইলে কল দিলে রিংটোন হিসেবে বাচ্চা শিশুর কান্না শোনা যায়। এই যে বাচ্চার কান্না?
জাহিন বলে, ভূতগুলো যে নাচল? সেসব?
নাজনিন বলে, আপনারা কী কী দিয়ে ভূত সেজেছেন, জাহিন সাহেবকে দেখান। ওনার ভয় দূর করতে হবে।
চপল বলে, আচ্ছা আমি আনছি কিছু জিনিস। চপল ফোন করে কাদেরকে। কাদের ভাই, গাড়ির পেছন থেকে ওই ভূতের প্রপসগুলো আনেন তো। উল্টা ঠোঙাগুলো আনেন আগে।
কাদের আসে ঠোঙা নিয়ে, এই সব ক্যান আনতে হইব?
চপল বলে, কাদের ভাই, পরেন তো একটা ঠোঙা।
কাদের ঠোঙা পরলে তাকে সত্যি একটা ভূতের মতোই দেখায়।
স্বাধীন আর চপল খিলখিল করে হাসে। তাই দেখে জাহিনও হেসে ফেলে।
নাজনিন বলে, শোনেন জাহিন সাহেব, এই যে আপনার ভূত। আর ভয় পাবেন না।
জাহিন বলে, না না আর ভয় পাব না। থ্যাংক ইউ।
ডাক্তার নাজনিন বিদায় নিচ্ছেন।
স্বাধীন বলে, আপনার ফিস কত?
নাজনিন বলে, না না, ফিস লাগবে না। আমি তো ইন্টার্নি। আমি তো প্র্যাকটিস করতে পারি না।
স্বাধীন বলে, চলেন তাহলে, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
নাজনিন বলে, না না, আমি একাই যেতে পারব।
স্বাধীন বলে, তা তো পারবেনই। কিন্তু আমি তো আপনাকে একা যেতে দেব না।
স্বাধীন আর নাজনিন আবারও সেই একই পথে ফিরে যায় নাজনিনের বাড়ির দিকে।
যেতে যেতে দুজনে গল্প করে।
স্বাধীন বলে, ড. নাজনিন। আপনি পড়াশোনা করেছেন কোন কলেজে।
নাজনিন হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট্ট গাছের পাতা হাতে তুলে নিয়ে বলে, ডিএমসি।
জি?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ।
ও আচ্ছা। খুব ভালো মেডিকেল কলেজ।
আপনি?
আমি এমবিএ করছি।
আচ্ছা।
তো আপনি ঢাকায় পড়াশোনা করে এখানে কেন?
এখানে এসেছি চা-বাগানের শ্রমিকদের একটা হেলথ প্রোগ্রামে। কিছু রিসার্চ করছি।
আচ্ছা আচ্ছা, ইয়ে মানে আপনার মোবাইল নম্বরটা একটু পেতে পারি? আমাদের ওখানে যা সব কাণ্ড হচ্ছে, আবার কে না কে অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন আপনাকে মোবাইল ফোনে কল করে ডেকে আনা যাবে।
আচ্ছা লিখে নিন.জিরো…
রাতের খাওয়া তাদের ভালোই হলো। বারবিকিউটা ভালো হয়েছে।
শিশির আর দাদিও এসে যোগ দিল ডাইনিং টেবিলে।
চপল বর্ণনা করতে লাগল, কীভাবে তারা জাহিনকে ভয় দেখানোর জিনিসপত্র জোগাড় করেছে, কীভাবে কাদের অভিনয় করেছে। জাহিন বিস্মিত।
চপল আর স্বাধীন হেসেই খুন।
আর শিশির যাচ্ছে রেগে। জাহিন ছেলেটা ভালো। তাকে এভাবে ভয় দেখানোর কী হলো?
রাত ১২টার দিকে চপল ঘুমিয়ে পড়েছে।
হঠাৎ সে শুনতে পায়, বাইরে কে যেন করুণ সুরে কাঁদছে।
চপল উঠে পড়ে। ভূতগ্রস্তের মতো সে বাইরে আসে।
কোনো কিছু অস্বাভাবিক দেখা যাচ্ছে না।
কে কাঁদে।
ওই গাছের নিচে?
সে এগিয়ে যায়?
তখনই কে যেন পেছন থেকে এসে তার ঘাড়ে প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে বসে।
চপল পড়ে যায়। এবং জ্ঞান হারায়।
আকাশ অন্ধকার। সব নিশ্চুপ। কয়েকটা ইলেকট্রিক বাতি সেই অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বাগানের ঘাসের ওপরে পড়ে আছে চপলের নিঃসাড় দেহ।