ছোটাচ্চু সোফায় দুই পা তুলে বসে একটা বই পড়ছে–কিংবা ঠিক করে বললে বলা উচিত একটা বই পড়ার চেষ্টা করছে। তার কাছাকাছি মেঝেতে বসে এই বাসার বাচ্চারা মিলে কিছু একটা খেলছে। খেলাটা লুডু হতে পারত কিন্তু লুডু খেলায় একজনের সাথে আরেকজনের হাতাহাতি হবার কথা না কিন্তু এখানে প্রচণ্ড হাতাহাতি হচ্ছে। মাঝে মাঝেই লুডুর বোর্ড কিংবা খুঁটি উড়ে যাচ্ছে কিন্তু সেজন্যে খেলার কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রত্যেকবার ছক্কা পড়ার পর সবাই মিলে যেভাবে চিষ্কার করছে সেটা শুনে মনে হতে পারে কেউ একজন ওয়ার্ল্ড কাপ খেলায় পেনাল্টি কিক করে গোল দিয়ে ফেলেছে।
ছোটাচ্চু বই পড়ায় খুব বেশিত্রগুতে পারছিল না, বাচ্চারা আবার একটা কান ফাটানো চিৎকার করার পর ছোটাচ্চু ধমক দিয়ে বলল, “তোরা কী শুরু করেছিস?
একজন বলল, “খেলছি ছোটাচ্চু।”
“এইটা খেলার নমুনা! এরকম ষাড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?”
আরেকজন বলল, “ষাড় কখনো চেঁচায় না। ষাঁড় ডাকে।” তারপর ষাঁড় কেমন করে ডাকে সেটা দেখানোর চেষ্টা করল। সেটা শুনে সব বাচ্চারা হেসে গড়াগড়ি দিতে লাগল।
ঠিক তখন ছোটাছুর টেলিফোনটা বাজল, এই হট্টগোলে টেলিফোনে কথা বলা যাবে না জেনেও ছোটাচ্চু সেটা ধরল, “হ্যালো।”
“এটা কি ডিটেকটিভ অফিস?”
“জি এটা আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস।” কথা ভালো করে শোনার জন্যে ছোটাচ্চু হাত দিয়ে সবাইকে থামানোর চেষ্টা করল, কোনো লাভ হলো না।
টেলিফোনের অন্য পাশ থেকে বলল, “আমি মাহী কাঞ্চন বলছি।”
ছোটাচ্চু বলল, “কী বললেন? মাহী কাঞ্চন?”
একমুহূর্তে বাচ্চাগুলো পুরোপুরি নিঃশব্দ হয়ে গেল। তাদের চোখ বড় হয়ে যায় এবং নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। ফিসফিস করে তারা উচ্চারণ করল, “মা—হী–কা—ঞ্চ–ন?” তারপর সবাই লাফ দিয়ে উঠে ছোটাচ্চুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল। ছোটাচ্চু এবং অন্য পাশ থেকে মাহী কাঞ্চন কী বলে শোনার জন্যে সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল।
তাদেরকে দোষ দেওয়া যায় না। মাহী কাঞ্চন এই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গায়ক। তার গান শুনলে কম বয়সী মেয়েদের হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। কয়েক মাস আগে তার একটা অটোগ্রাফের জন্যে ভক্তদের ভেতর এত মারামারি শুরু হয়ে গিয়েছিল যে পুলিশের লাঠিচার্জ করে থামাতে হয়েছিল। মাহী কাঞ্চনের কনসার্টের ঘোষণা হওয়ার দশ মিনিটের ভেতর সব টিকেট বিক্রি হয়ে যায়। জোছনা রাতে তার গান শুনে পুরোপুরি মাথা আউলে গিয়েছে এরকম অনেক মানুষ আছে। সেই মাহী কাঞ্চন নিজে ছোটাচ্চুকে ফোন করেছে। সেটা নিজের কানে শুনেও বাচ্চাদের বিশ্বাস হতে চায় না। মাহী কাঞ্চন ছোটাচ্চুকে কী বলছে সেটা শোনার জন্যে বাচ্চারা ছোটাচ্চুর কানের কাছে নিজেদের কান লাগানোর জন্যে নিঃশব্দে নিজেদের ভেতর ধাক্কাধাক্কি করতে লাগল।
টেলিফোনের অন্য পাশ থেকে মাহী কাঞ্চন বলল, “আমি গান গাই।”
ছোটাচ্চু বলল, “সেটা আপনাকে বলতে হবে না, আমরা সবাই জানি। মাহী কাঞ্চনকে দেশের সবাই চিনে।”
মাহী কাঞ্চন বলল, “আমি একটা বিশেষ দরকারে আপনাকে ফোন করেছি।”
“কী দরকার?”
“আপনার তো একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি আছে, তাই না?”
“জি, আছে।”
“আপনার এজেন্সির সাথে আমার একটু কথা বলার দরকার।”
ছোটাচ্চুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল, তার টেলিফোনের সাথে কান লাগিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে যারা মাহী কাঞ্চনের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছিল তাদের চোখও বড় বড় হয়ে গেল।
ছোটাচ্চু বলল, “আমার এজেন্সির সাথে দেখা করবেন?”
“হ্যাঁ। সত্যি কথা বলতে কী, আমি গোপনে দেখা করতে চাই।”
ছোটাচ্চু বলল, “সেটা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা সব রকম গোপনীয়তা বজায় রাখি। আমার ক্লায়েন্টদের কথা কেউ জানে না। পুরোপুরি গোপন।”
মাহী কাঞ্চন বলল, “আমার ব্যাপারটা একটু অন্য রকম। আমি ডিটেকটিভ এজেন্সির সাথে দেখা করেছি কথাটা জানাজানি হলে ফেসবুকে তুলকালাম হয়ে যাবে। সেখান থেকে পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেল সব জায়গায় হইচই শুরু হয়ে যাবে।”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি জানি। আপনার মতো সেলিব্রেটিদের সবসময় খুব সাবধান থাকতে হয়।”
“মিডিয়া জান খেয়ে ফেলে। তাই খুব গোপনে আপনাদের সাথে কথা বলতে চাই।”
“ঠিক আছে। কীভাবে কথা বলতে চান?”
“টেলিফোনে বলা যাবে না। সামনাসামনি বলতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় আপনাদের অফিসে কথা না বলে গোপনে যদি আপনার বাসায় দেখা করতে পারি।”
মাহী কাঞ্চন বাসায় চলে আসতে চায় শুনে বাচ্চারা নিঃশব্দে আনন্দে চিৎকার করার ভঙ্গি করতে লাগল। এখনো তাদের বিশ্বাস হচ্ছে না মাহী কাঞ্চন নিজে ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলছে!
ছোটাচ্চু বলল, “কোনো সমস্যা নেই। আপনি কখন আমার বাসায় আসতে চান?” তার যে আসলে কোনো অফিস নেই, দেখা করতে হলে যে বাসাতেই দেখা করতে হবে সেই কথাটা আর বলল না।
মাহী কাঞ্চন বলল, “এখনই।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “এখনই?” সেটা শুনে সব বাচ্চার প্রায় হার্টফেল করার মতো অবস্থা হলো, তারা নিঃশব্দে দাপাদাপি করতে থাকে।
মাহী কাঞ্চন বলল, “হ্যাঁ, এখনই।”
“ঠিক আছে।”
“আমি একা আসব। কাউকে না জানিয়ে।”
“ঠিক আছে।”
“আমাকে সিকিউরিটি দেবার জন্যে লোকজন থাকে, খুব বিরক্ত করে। তাদেরকে না জানিয়ে গোপনে আসব।”
“ঠিক আছে।”
“আপনার বাসার ঠিকানাটা দেন।”
ছোটাচ্চু বাসার ঠিকানা দিয়ে টেলিফোনটা রাখার পর বাচ্চারা প্রথমবার তাদের বুকের ভিতর আটকে রাখা কথাগুলো গগনবিদারি চিৎকার হিসেবে বের করল। সেই ভয়াবহ চিৎকার শুনে তিনতলা থেকে বড় ভাই, দুইতলা থেকে দাদি এবং মেজ ভাবি, চারতলা থেকে ঝুমু খালা আর ছোট ভাবি ছুটতে ছুটতে চলে এলো। কোনো অঘটন ঘটেনি, মাহী কাঞ্চন ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করতে এসেছে শোনার পর তারা শান্ত হলো, কিন্তু তারাও বাচ্চাদের থেকে কম অবাক হলো না।
ছোটাচ্চু তাড়াতাড়ি গিয়ে শেভ করল, একটা জিন্সের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরল। বাচ্চারা তার ঘরটা পরিষ্কার করে দিল। মাহী কাঞ্চন কোথায় বসে ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলবে কেউ জানে না, তাই তারা বাইরের ঘরটাও পরিষ্কার করে দিল। মেহমানকে কী খেতে দিবে সেটা ঝুমু খালা কয়েকবার জিজ্ঞেস করে জেনে নিল, তারপর ঝাঁটা নিয়ে বাইরে গিয়ে পুরো সিঁড়িটা ঝাড় দিয়ে দিল।
তারপর বাচ্চারা সবাই জানালায় মুখ লাগিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। প্রত্যেকবার একটা গাড়ি রাস্তা দিয়ে আসে তারা তখন উত্তেজিত হয়ে ওঠে, গাড়িটা যখন বাসার সামনে না থেমে এগিয়ে যায় তখন সবাই একসাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঘণ্টাখানেক পর বাচ্চারা যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছে তখন বাসার সামনে একটা স্কুটার এসে থামল। মাহী কাঞ্চনের মতো এত বড় একজন গায়ক তো আর স্কুটারে করে আসবে না তাই তারা স্কুটারটাকে কোনো গুরুত্ব দিল না, একটা গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে থাকল। যদি গুরুত্ব দিত তাহলে দেখত স্কুটার থেকে মাহী কাঞ্চন নেমে এদিক-সেদিক তাকিয়ে তাদের বিল্ডিংয়ের ভেতর ঢুকে গেছে।
মাহী কাঞ্চন যখন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে তখন বাচ্চারা সবাই দেখল বড় একটা সাদা গাড়ি তাদের বাসার কাছাকাছি এসে থেমেছে। তারা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে এটা নিশ্চয়ই মাহী কাঞ্চনের গাড়ি কিন্তু দেখল গাড়ি থেকে কেউ নামল না। দেখা যাচ্ছে গাড়ির ভেতরে কেউ বসে আছে কিন্তু কেউই সেখান থেকে নামছে না। বিষয়টা যথেষ্ট সন্দেহজনক কিন্তু ঠিক তখন তাদের কলিংবেল বেজে উঠল। বাচ্চারা সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল, তারপর একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে দরজার দিকে ছুটে যায়। সবাই মিলে একে অন্যকে ঠেলে দরজার ছিটকানি খুলে দিল। দেখল দরজার বাইরে মাহী কাঞ্চন দাঁড়িয়ে আছে।
বাচ্চারা ঠিক করে রেখেছিল তারা মাহী কাঞ্চনকে দেখে কোনো বাড়াবাড়ি করবে না, তাই কেউ বাড়াবাড়ি করল না, শুধু চোখ বড় বড় করে সবাই নিঃশব্দে মাহী কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন তারা একটা জীন, পরী কিংবা ভূতের দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমি নিজেকে সামলাতে পারল না। সে হঠাৎ “ই-ই-ই-ই—” করে একটা চিৎকার করে উঠল এবং সেটা একটা চেইন রি-একশান শুরু করার মতো কাজ করল। তখন একসাথে সবাই “ই-ই-ই-ই-” করে চিৎকার করে ওঠে। সেই চিৎকার এত বিকট যে মনে হলো বাসার ছাদ ধসে পড়বে কিন্তু মাহী কাঞ্চন ঘাবড়ে গেল না, চোখ বড় বড় করে শান্ত মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হয় আগেও অনেকবার এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে।
বাচ্চারা কতক্ষণ চিৎকার করত জানা নেই, ছোটাচ্চু তাদের ধমক দিয়ে থামানোর চেষ্টা করল, বলল, “এই তোরা থামবি? কী শুরু করেছিস পাগলের মতো।“ তারপর মাহী কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আসেন। আপনি ভিতরে আসেন।”
মাহী কাঞ্চন ভিতরে না ঢুকে ভুরু কুঁচকে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, “আপনি ডিটেকটিভ?”
“জি।”
“আপনাকে দেখে মনে হয় ক্লাশ টেনে পড়েন।”
মাহী কাঞ্চনের কথা শুনে বাচ্চারা হি হি করে হেসে উঠল, ছোটাচ্চুর কান একটু লাল হয়ে উঠল, তারপরও মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলল, “না আমি ক্লাশ টেনে পড়ি না। গত বছর মাস্টার্স পাস করেছি।”
মাহী কাঞ্চন বলল, “আমি ভেবেছিলাম প্রাইভেট ডিটেকটিভরা বুড়ো হয়। চোখে বাই ফোকাল চশমা পরে, চুরুট না হলে পাইপ খায়।”
শান্ত বলল, “ছোটাচ্চুর একটা জিরো পাওয়ারের চশমা আছে। যখন বয়স্ক দেখাতে চায় তখন সেটা চোখে দেয়।”
টুম্পা বলল, “একটা টাইও আছে। লাল রঙের।”
শান্ত বলল, “কিন্তু টাইয়ের নট বাঁধতে পারে না। তাই সেটা সব সময় নট বাঁধা থাকে। তাই না ছোটাচ্চু?”
ছোটাচ্চু দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, “তোরা চুপ করবি?”
মাহী কাঞ্চন কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ছোটাচ্চু কে?”
ছোটাচ্চু একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “আমি।”
“আপনার ছেলে-মেয়েরা আপনাকে বাবা না ডেকে ছোটাচ্চু ডাকে কেন?”
ছোটাচ্চু লাল হয়ে বলল, “এরা আমার ছেলে-মেয়ে না। এরা আমার ভাই-বোনের ছেলে-মেয়ে।”
মাহী কাঞ্চন পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে সেরকমভাবে কয়েকবার মাথা নাড়ল, তারপর আবার তার ভুরু কুঁচকে উঠল। জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু তাহলে তো আপনাকে চাচা কিংবা মামা ডাকবে। ছোটাচ্চু ডাকে কেন?”
প্রমি উত্তর দিল, বলল, “আমরা ছোট চাচ্চুকে শর্টকাট করে ছোটাচ্চু বলি।”
“আর যাদের ছোট মামা?”
“তারাও ছোটাচ্চু বলি।”
শান্ত ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করে দিল, বলল, “ছোটাচ্চুর যখন বিয়ে হবে আর যখন ছেলে-মেয়ে হবে তখন তারাও ছোটাচ্চুকে আব্দু না ডেকে ছোটাচ্চু ডাকবে। তাই না রে?”
বাচ্চারা সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল। টুম্পা বলল, “আমরা সবাই একসাথে থাকি। তাই যে যেটা ডাকে আমরাও সেটা ডাকি। চাচাকে মামা ডাকি, দাদিকে নানি ডাকি, চাচিকে ভাবি ডাকি, খালাকে আপু ডাকি-”
মাহী কাঞ্চন এবারে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেল, অবাক হয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি এই জটিল আলাপটা থামানোর
জন্যে বলল, “আপনি ভিতরে আসবেন না?”
“আসব?”
সব বাচ্চারা চিৎকার করে উঠল, “হ্যা”, তারপর দরজা থেকে সরে তাকে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিল।
মাহী কাঞ্চন কেমন যেন একটু ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকল, ঢুকে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল কিন্তু সব সময়েই বাচ্চাদের দিকে একটা চোখ রাখল।
ছোটাচ্চু বলল, “বসেন।”
মাহী কাঞ্চন কেমন যেন ভয়ে ভয়ে বলল, “বসব?”
ছোটাচ্চু কিছু বলার আগেই বাচ্চারা চিৎকার করে বলল, “বসেন।”
মাহী কাঞ্চন সাবধানে একটা সোফায় বসল। বাচ্চারা তাকে ঘিরে এগিয়ে আসে, মাহী কাঞ্চন কেমন যেন ভয়ে ভয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু তাদেরকে বলল, “তোরা এখন যা। আমাদের এখন জরুরি কথা আছে।”
টুম্পা বলল, “আমরা বসে থাকি? একটুও ডিস্টার্ব করব না।”
ছোটাচ্চু গলা উঁচিয়ে বলল, “না। ভাগ এখান থেকে। ভাগ।”
“একটু থাকি?”
“না। একটুও না। ভাগ।”
বাচ্চারা মনমরা হয়ে বের হতে থাকে। টুম্পা দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মাহী কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখি?”
মাহী কাঞ্চন কেমন যেন চমকে উঠল, বলল, “ছুঁয়ে দেখবে? আমাকে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“গায়কেরা কী রকম হয় দেখতাম। টিপে দেখতাম।”
“টিপে দেখতে?”
ছোটাচ্চু বলল, “না টিপে দেখতে হবে না। একজন মানুষকে আবার টিপে দেখে কেমন করে? যা, ভাগ এখান থেকে।”
“তাহলে ছুঁয়ে দেখি!”
মাহী কাঞ্চন কিছু বলার আগেই ছোটাচ্চু বলল, “না ছুঁয়েও দেখতে হবে না। যা তোরা, আমাদের কথা বলতে দে।”
টুম্পা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “এই একটুখানি। প্লিজ।”
মাহী কাঞ্চন ভয়ে ভয়ে তার ডান হাতটা টুম্পার দিকে বাড়িয়ে দিল, তখন টুম্পার সাথে সাথে অন্য সবাইও তার হাতটাকে খাবলে ধরল। ছোটাচ্চুকে রীতিমতো যুদ্ধ করে তাদের হাত থেকে মাহী কাঞ্চনের হাতকে ছুটিয়ে আনতে হলো। ছোটাচ্চু তারপর সবাইকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ওহ! এই বাচ্চা-কাচ্চাদের যন্ত্রণায় জীবন শেষ। সবগুলো একটা করে ইবলিশ।”
মাহী কাঞ্চন ভয়ে ভয়ে তার মুক্ত করে আনা হাতটাকে পরীক্ষা করে বলল, “কাজটা ঠিক করলাম কি না বুঝতে পারছি না।”
“কোন কাজটা?”
“এই যে হঠাৎ করে চলে এসেছি। আমি ভেবেছিলাম মোটাসোটা বয়স্ক একজন ডিটেকটিভ হবে, কিন্তু আপনি এত বাচ্চা!”
ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “বয়সটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। আমার বয়স কম হতে পারে কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা অনেক। আমি অনেক কেস সলভ করেছি। টেলিভিশনে সেটা নিয়ে নিউজ পর্যন্ত করেছে। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা পুরস্কারও পেয়েছি।”
মাহী কাঞ্চন বলল, “জানি। সেই জন্যেই এসেছি। কিন্তু ভাবছিলাম আপনি আরো মোটা হবেন। মোটা আর বয়স্ক।”
ছোটাচ্চু এই প্রথম আরো মোটা না হওয়ার জন্যে একটুখানি হতাশা অনুভব করল কিন্তু কী বলবে বুঝতে পারল না। মাহী কাঞ্চন বলল, “কোনো মানুষের সাথে কথা বললেই আমার মাথায় তার একটা চেহারা ভেসে ওঠে, যদি সেই চেহারার সাথে তার আসল চেহারা না মিলে তখন খুব অস্থির লাগে।”
ছোটাচ্চু দেখল আসলেই মাহী কাঞ্চনকে বেশ অস্থির লাগছে। ভয়ে ভয়ে বলল, “ফ্যানটা ছেড়ে দেব?”
“না। ফ্যান ছাড়তে হবে না।” মাহী কাঞ্চন সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে রইল। মনে হলো মাথার মাঝে বয়স্ক এবং মোটা ছোটাচ্চুর চেহারাটা সরিয়ে তার নূতন চেহারাটা ঢোকানোর চেষ্টা করছে। ছোটাচ্চু কী করবে বুঝতে না পেরে পাশে চুপচাপ বসে রইল। ঠিক তখন বন্ধ করে রাখা দরজাটায় শব্দ হলো এবং মাহী কাঞ্চন চমকে উঠে চোখ খুলে বলল, “কে? কী? কী হয়েছে?”
ছোটাচ্চু বলল, “কিছু না। মনে হয় আমাদের জন্যে চা এনেছে।” তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দিল, সত্যি সত্যি ঝুমু খালা একটা ট্রেতে চা এবং তার সাথে নানা রকম খাবার নিয়ে এসেছে। ঝুমু খালা ভেতরে ঢুকে টেবিলে চা-নাস্তা সাজিয়ে রাখে, মাহী কাঞ্চন কেমন যেন ভয় পাওয়া চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে বলে, “চা নাস্তা কেন? আমি চা-নাস্তা খাই না।”
ঝুমু খালা কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে বলল, “আপনি খান না বললেই হবে নাকি? আপনাকে খেতে হবে।”
“কেন? কেন আমাকে খেতে হবে?” মাহী কাঞ্চন কেমন জানি একটু ভয় পেয়ে যায়।
“আমার ডাইল পুরি দুনিয়ার মাঝে ফার্স্ট ক্লাশ। আমরিকার প্রেসিডেন্ট বারেক মিয়া যদি একবার খায়–”
ছোটাচ্চু বলল, “বারেক মিয়া না। বারাক ওবামা।”
“একই কথা। যদি খায় তাহলে আমারে নোবেল পুরস্কার দিব।”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে ঝুমু। তুমি যাও। আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নোবেল পুরস্কার দেয় না। ডাল পুরি বানানোর জন্যে নোবেল পুরস্কার নাই।”
ঝুমু খালা বলল, “একই কথা।” তারপর তেজি ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মাহী কাঞ্চন একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আপনাদের পরিবারের মানুষজন একটু অন্য রকম।”
অন্য রকম মানে ভালো না খারাপ ছোটাচ্চু বুঝতে পারল না বলে কোনো কথা বলল না।
মাহী কাঞ্চন বলল, “আপনাকে বলি আমি কেন এসেছি।”
“বলেন।”
মাহী কাঞ্চন এদিক-সেদিক তাকাল তারপর গলা নামিয়ে বলল, “কেউ একজন আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করছে।”
ছোটাচ্চু চমকে উঠে বলল, “কিডন্যাপ? আপনাকে?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি কেমন করে জানেন?”
“আমি যেখানেই যাই–আমার মনে হয়–”
“কী মনে হয়?”
“মনে হয় একটা সাদা গাড়ি আমার পিছু পিছু যায়।”
“আপনি আপনার ফ্যামিলির লোকজনকে বলেননি?”
মাহী কাঞ্চন কেমন যেন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “বলেছি। লাভ হয় নাই। সে জন্যেই তো আপনার কাছে গোপনে আসতে হলো।”
ছোটাচ্চু বলল, “কিন্তু আপনার ফ্যামিলিকে বলে লাভ হলো না কেন?”
“তারা আমার কথাকে কোনো গুরুত্ব দেয় না।”
“আপনি এত বড় গায়ক। আপনাকে দেখলে একটা আস্ত জেনারেশান পাগল হয়ে যায়। আর আপনার ফ্যামিলি আপনাকে গুরুত্ব দেয় না এটা কেমন কথা! কেন গুরুত্ব দেয় না?”
মাহী কাঞ্চন কেমন যেন মাছের মতো চোখের পাতি না ফেলে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “কারণ আছে।”
“কী কারণ?”
“বলা যাবে না।”
ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “ও।”
.
ঘরের ভেতরে যখন ছোটাচ্চু আর মাহী কাঞ্চন কথা বলছে ঠিক তখন টুনি খুব সাবধানে দরজায় কান পেতে ভিতরে কী আলাপ হচ্ছে শোনার চেষ্টা করছিল। পরিষ্কার শোনা না গেলেও টুনি দরকারি কথাগুলো শুনে ফেলল, মাহী কাঞ্চনকে একটা সাদা গাড়ি অনুসরণ করে, সেই সাদা গাড়ির লোকজন মাহী কাঞ্চনকে কিডন্যাপ করবে। টুনির সারা শরীর শিউরে উঠল, কারণ তারা সবাই যখন জানালায় মুখ লাগিয়ে মাহী কাঞ্চনের গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছিল তখন সে দেখেছে একটা সাদা গাড়ি এসে তাদের বাসার সামনে থেমেছে। সেই গাড়ি থেকে কেউ নামেনি, গাড়িতে অপেক্ষা করছে। মনে হয় তারা মাহী কাঞ্চনকে কিডন্যাপ করবে। আজকে। এখানে। একটু পরে। টুনির গলা শুকিয়ে গেল। সে এখন কী করবে? ছোটাচ্চুকে বলবে? ছোটাচ্চু কি তার কথা বিশ্বাস করবে?
ঠিক তখন শান্ত এদিক দিয়ে হেঁটে আসছিল, টুনিকে দেখে থেমে গেল। বলল, “তোর কী হয়েছে?।”
“সর্বনাশ হয়েছে।”
শান্ত ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী সর্বনাশ হয়েছে?”
“মাহী কাঞ্চন কেন এসেছে জানো?”
“কেন?”
“তাকে কিডন্যাপ করে নিবে, সেটা ছোটাচ্চুকে বলার জন্যে।”
“কে কিডন্যাপ করে নিবে?”
“একটা সাদা গাড়িতে করে এসে অনেকগুলো ক্রিমিনাল।”
শান্ত ভুরু কুঁচকে বলল, “তুই কেমন করে জানিস?”
“আমি দরজার মাঝে কান লাগিয়ে কথা শুনছিলাম।”
শান্ত হাল ছেড়ে দেবার মতো ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “পুলিশকে বলে না কেন? তাহলেই তো পুলিশ পাহারা দিবে। মাহী কাঞ্চনের ভয় কী? সে কত বিখ্যাত জানিস?”
“জানি।”
“তুই না ডিটেকটিভ! এই একটা কথা শুনে তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন?”
টুনি বলল, “আমি কেন ভয় পেয়েছি শুনবে?”
“কেন?”
“মাহী কাঞ্চন যে সাদা গাড়িটার কথা বলেছে সেই সাদা গাড়িটা এখন আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে!”
শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বললি?”
“মনে নাই একটা গাড়ি এসে থামল-”
“কিন্তু–”
টুনি বলল, “কলিংবেলের শব্দ শুনে তোমরা সবাই চলে গেলে, আমি একটু পরে গিয়েছি, আমি দেখেছি কেউ নামে নাই গাড়ি থেকে। সবাই গাড়িতে বসে আছে।”
“সত্যি?”
টুনি বলল, “হ্যাঁ সত্যি। আমার কথা বিশ্বাস না করলে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দেখো।”
শান্ত টুনির সাথে শোয়ার ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল সত্যি সত্যি বাসার সামনে একটা সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে পুরো দেখা যায় না কিন্তু বোঝা যায় গাড়ির ভিতরে কয়েকজন চুপ করে বসে আছে। মাহী কাঞ্চন বের হলেই মনে হয় তাকে জাপটে ধরে গাড়িতে তুলে নেবে।
টুনি বলল, “বিশ্বাস হলো?”
শান্ত বলল, “দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।”
টুনি ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী করবে শান্ত ভাইয়া?”
শান্ত বলল, “মজা বোঝাচ্ছি আমি কিডন্যাপারদের। তুই দাঁড়া এখানে।”
শান্ত কী করবে টুনি জানে না কিন্তু সেটা যে খুব ভালো কাজ হবে না, সেটা বুঝতে টুনির দেরি হলো না। সে খানিকটা ভয় নিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। দেখল শান্ত খুব সাবধানে পা টিপে টিপে গাড়ির পিছনে নিচু হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর মনে হলো চিৎ হয়ে শুয়ে গাড়ির নিচে ঢুকে গেল। টুনির বুক ধকধক করতে থাকে, যদি শান্ত ধরা পড়ে যায় তখন কী হবে?
শান্ত ধরা পড়ল না, কিছুক্ষণের মাঝেই সে ফিরে এলো। তাকে অবশ্যি শান্ত হিসেবে চেনা যায় না। গাড়ির নিচে যত ময়লা ছিল সবকিছু তার পিছনে লেগে আছে। শুধু তা-ই নয়, তার কপালে গ্রিজ এবং নাকের উপর কালি। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী করেছ শান্ত ভাইয়া?”
“গাড়ির নিচে ঢুকে চারটা চাকার হাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।”
“ওরা বুঝতে পারেনি?”
“গাড়ি স্টার্ট না করা পর্যন্ত মনে হয় টের পাবে না।”
“ওদের কথা শুনেছ কিছু?”
“শুনেছি।“
“কী বলছে?”
“মাহী কাঞ্চনের উপর খুব বিরক্ত হচ্ছে। বলছে তার মাথায় কোনো বুদ্ধি-শুদ্ধি নাই!”
“তাই বলছে? কী আশ্চর্য!”
“হ্যাঁ, মাহী কাঞ্চনকে গালি দিচ্ছে।“
“কেন?”
“সময় নষ্ট করার জন্য।“
“কী আশ্চর্য!”
শান্ত এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “এই ঘরটার মাঝে এত পচা গন্ধ কেন? মনে হয় কেউ বাথরুম করে রেখেছে!”
টুনি ভয়ে ভয়ে বলল, “শান্ত ভাইয়া?”
“কী?”
“আসলে পচা গন্ধটা আসছে তোমার শরীর থেকে।”
“আমার শরীর থেকে?”
“হ্যাঁ! তোমার পিছনটা তো দেখতে পাচ্ছি না তাই জানো না। সেখানে অনেক কিছু আছে। তোমার এখনই গরম পানি আর সাবান দিয়ে গোসল করা উচিত।”
“কেন? কী আছে আমার পিছনে?”
“মনে হয় কুকুরের ইয়ে। মানুষেরও হতে পারে–”
শান্ত তখন একটা ভয়ের শব্দ করল, কাকে যেন খুব খারাপ ভাষায় গালি দিল। তারপর নাক-মুখ কুঁচকে ছুটল গোসল করতে। একটু পরেই উপর থেকে শান্ত ভাইয়ার আম্মুর চিৎকার শোনা যেতে থাকল। এটা অবশ্যি নূতন কোনো বিষয় না–শান্ত ভাইয়ের আম্মুকে অনেক চিৎকার করতে হয়।
.
কথাবার্তা শেষ করে মাহী কাঞ্চন যখন চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে তখন বাচ্চারা আবার তাকে ঘিরে ধরল। তাদের সাথে মাহী কাঞ্চনের ছবি তুলতে হলো। প্রথমে গ্রুপ, তারপর আলাদা, শেষে সেলফি। তারপর সবাইকে অটোগ্রাফ দিতে হলো।
বাসার বড় মানুষেরাও মাহী কাঞ্চনকে একনজর দেখে গেল এবং একসাথে ছবি তুলে গেল। টুনির ভেতর অবশ্যি খুবই অশান্তি। সে মোটামুটি নিশ্চিত যে, ঘর থেকে বের হবার সাথে সাথে সাদা গাড়ি থেকে মানুষগুলো এসে মাহী কাঞ্চনকে টেনে গাড়িতে তুলে নেবে। তবে গাড়ি স্টার্ট করে বেশি দূর যেতে পারবে না, একটা হইচই চিৎকার শুরু হবে, তখন সবাই মিলে হয়তো মাহী কাঞ্চনকে উদ্ধার করবে। পুরো ব্যাপারটা হবে খুবই ভয়ঙ্কর, খুবই ভয়ের এবং খুবই বিপদের। ছোটাচ্চুকে একটু জানিয়ে রাখতে পারলে খুব ভালো হতো কিন্তু সে কোনো সুযোগই পেল না।
তখন হঠাৎ করে টুনির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সব বাচ্চাদের সাথে নিয়ে গেলে কেমন হয়? মাহী কাঞ্চনকে সব বাচ্চারা ঘিরে থাকলে কিডন্যাপ করা নিশ্চয়ই এত সোজা হবে না! টুনি তাই হঠাৎ করে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো আমরা মাহী কাঞ্চন চাচ্চুকে আগিয়ে দিই। স্কুটারে না হয় ক্যাবে তুলে দিই।”
সব বাচ্চারা হইহই করে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। এরকম সুযোগ তারা আর কখন পাবে? ছোটাচ্চু ইতস্তত করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সুযোগ পেল না, তার আগেই সব বাচ্চা মাহী কাঞ্চনকে ঘিরে তাকে নিয়ে নিচে নামতে শুরু করেছে। শুরুতে তাদের সাথে শান্ত ছিল না কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে সেও চলে এলো, গোসল করে জামা-কাপড় পাল্টে এসেছে।
বাসা থেকে বের হবার সময় টুনির বুক ধকধক করতে থাকে, এক্ষুনি নিশ্চয়ই গাড়িটা স্টার্ট করে পাশে এসে দাঁড়াবে, ঝপাং করে গাড়ির দরজা খুলে যাবে, কয়েকজন মুশকো জোয়ান বের হয়ে আসবে, তারপর বাচ্চাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মাহী কাঞ্চনকে ধরে টেনে নিয়ে যাবে। মানুষগুলোর হাতে কি বন্দুক-পিস্তল-ছোরা-চাকু কিছু থাকবে? যদি থাকে তাহলে কী হবে?
টুনি চোখের কোনা দিয়ে সাদা গাড়িটা দেখল, এখনো সেটা দাঁড়িয়ে আছে, স্টার্ট করেনি। কখন স্টার্ট করবে?
ছোটাচ্চু মাহী কাঞ্চনকে বলল, “আমরা একটু হেঁটে যাই। রাস্তার মোড়ে সিএনজি পাওয়া যায়। ভাগ্য ভালো থাকলে একটা ক্যাবও পাওয়া যেতে পারে।”
মাহী কাঞ্চন বলল, “চলেন যাই।”
“আপনাকে কেউ চিনে ফেললে সমস্যায় পড়ে যাব।”
“চিনবে না। যেখানে আমার থাকার কথা না সেখানে আমাকে কেউ চিনে না!”
বাচ্চারা মাহী কাঞ্চনকে ঘিরে এগুতে থাকে। অন্ধকারে টুনি আর শান্তর একটু চোখাচোখি হলো কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। পুরো দলটা যখন আরো এগিয়ে গেল তখন হঠাৎ টুনি শুনতে পেল গাড়িটা স্টার্ট করেছে, হেড লাইট জ্বলেছে, তারপর খুব ধীরে ধীরে এগুতে শুরু করেছে। টুনির বুকটা ধকধক করতে থাকে, আড়চোখে তাকিয়ে দেখল শান্তর শরীরটাও শক্ত হয়ে গেছে। কিডন্যাপাররা সত্যি এসে গেলে অন্যেরা কেউ কিছু না করলেও শান্ত নিশ্চয়ই একটা মারপিট শুরু করে দেবে। কী ভয়ঙ্কর! কী সাংঘাতিক!
টুনি দেখল গাড়িটা গুঁড়ি মেরে খানিকটা এসে হঠাৎ করে থেমে গেল। গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভার নেমে গাড়ির চাকাগুলো পরীক্ষা করে মাথায় হাত দিল। চাপা গলায় কিছু একটা বলল কিন্তু এত দূর থেকে কথাগুলো শোনা গেল না। গাড়ি খুলে তখন আরো দুজন মানুষ নেমেছে, তারাও গাড়িটা ঘুরে দেখছে। হতাশভাবে মাথা নাড়ছে। যার অর্থ গাড়িটা অচল, কিডন্যাপাররা আর গাড়ি নিয়ে আসতে পারবে না। টুনি বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিল।
মাহী কাঞ্চনকে নিয়ে পুরো দলটি তখন রাস্তার মোড়ে চলে এসেছে। সেখানে বেশ কয়েকটা সিএনজি আর একটা ক্যাব দাঁড়িয়ে আছে। ছোটাচ্চু বলল, “আপনাকে ক্যাবে তুলে দিই?”
মাহী কাঞ্চন মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিক আছে।”
ছোটাচ্চু তখন ক্যাব ঠিক করতে এগিয়ে গেল, ক্যাবের ড্রাইভারের সাথে কথা বলে ফিরে এসে বলল, “আসেন।”
মাহী কাঞ্চন ঠিক যখন ক্যাবে উঠতে যাবে তখন টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার সাথে যাওয়া উচিত–ওনার একা যাওয়া ঠিক হবে না।”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিকই বলেছিস।”
মাহী কাঞ্চন ব্যস্ত হয়ে বলল, “না না। কোনো দরকার নেই। আমি চলে যেতে পারব।”
ছোটাচ্চু বলল, “সেটা তো নিশ্চয়ই পারবেন। কিন্তু আপনার মতো এত বড় একজন মানুষকে একা যেতে দেওয়া ঠিক না। আমি সাথে আসি, বাসাটাও চিনে আসি।”
ছোটাচ্চু তখন মাহী কাঞ্চনের সাথে ক্যাবের পিছনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ক্যাব চলে যাবার সময় সব বাচ্চারা মিলে হাত নাড়ল, গাড়ির ভেতর থেকে মাহী কাঞ্চন আর তার দেখাদেখি ছোটাচ্চুও হাত নাড়তে থাকল।
.
বচ্চাদের ছোট দলটি যখন ফিরে আসছে তখন তারা দেখল সাদা গাড়িটাকে রাস্তার পাশে দাঁড়া করানো হয়েছে। বাচ্চাদের দেখে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ এগিয়ে এলো, তাদেরকে জিজ্ঞেস করল, “মাহী চলে গেছে?”
টুনি অবাক হয়ে বলল, “আপনারা কারা?”
মানুষটা বলল, “আমরা মাহীর বডি গার্ড। তাকে সব সময় পাহারা দেই। আজকে কোন হারামজাদা এসে গাড়ির চারটা চাকার হাওয়া ছেড়ে দিয়েছে–তাই তার পিছন পিছন যেতে পারলাম না!”
টুনির মুখ হাঁ হয়ে গেল। মানুষটা বলল, “মাহী কাঞ্চন অনেক বড় গায়ক হতে পারে কিন্তু তার মাথায় ঘিলু বলে কিছু নাই! মাত্র কয়দিন আগে ড্রাগ রিহ্যাব থেকে বের হয়েছে, কখন আবার কোন ছাগল তার হাতে ড্রাগ ধরিয়ে দেবে সেই জন্যে সব সময় তার পিছু পিছু থাকতে হয়। তাকে জানতে দেই না তাহলে চেঁচামেচি করে জান খেয়ে ফেলবে।”
টুনি বলল, “কিন্তু কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
টুনি কী বলবে বুঝতে পারল না। মানুষটা বলল, “তোমাদের বাসায় কেন এসেছিল পাগলটা?”
টুনি বলল, “আমার ছোটাচ্চু একজন ডিটেকটিভ। তাই তার কাছে এসেছিলেন।”
“ডিটেকটিভ? সত্যিকারের ডিটেকটিভ?”
“হ্যাঁ।”
“মাহী পাগলা এসে কী বলেছে তোমার ডিটেকটিভ চাচাকে?”
কী জন্যে এসেছিল সেটা টুনির জানার কথা না তাই ইতস্তত করে বলল, “সেটা তো ঠিক জানি না।”
গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন বলল, “পাগল মানুষ। কখন তার মাথায় কী চিন্তা আসবে কে জানে!”
প্রথম মানুষটি পকেট থেকে ফোন বের করে কোথায় জানি ফোন করল, তারপর বলল, “শোনো। আমরা মাহীকে ফলো করতে পারছি না। কোন হারামজাদা গাড়ির চারটা চাকা ফ্ল্যাট করে দিয়ে গেছে। যাই হোক, চিন্তা কোরো না, মাহী নিশ্চয়ই কিছুক্ষণে বাসায় পৌঁছে যাবে। একা যায় নাই, সাথে একজন ডিটেকটিভও গেছে। তাই চিন্তার কিছু নাই।”
অন্য পাশ থেকে ফোন করে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করল পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে। মানুষটি বলল, “খুব বেশি হলে আধ ঘণ্টা। যদি আধ ঘণ্টার মাঝে না পৌঁছায় আমাকে ফোন কোরো।”
তারপর ফোনটা পকেটে রেখে ড্রাইভারকে বলল, “গাড়ির চাকা ঠিক করার একটা দোকান খুঁজে বের করো। আমরা গাড়ির সাথে আছি। তুমি যাও।”
ড্রাইভার চলে গেল। বাচ্চার দলের সাথে টুনি আর শান্তও ফিরে এলো। শান্ত টুনিকে ফিসফিস করে বলল, “মানুষটার কী মুখ খারাপ দেখেছিস? কী খারাপভাবে আমাকে গালি দিল! ছিঃ!”
.
আধ ঘণ্টা পরও মাহী কাঞ্চন তার বাসায় পৌঁছাল না। ট্রাফিক জ্যামে আটকে গিয়েছে ভেবে আর দশ মিনিট অপেক্ষা করা হলো, তবুও মাহী তার বাসায় পৌঁছাল না। তখন মাহীকে ফোন করা হলো, দেখা গেল মাহীর ফোন বন্ধ। মাহী কাঞ্চনের বডি গার্ড দুজন তখন ছুটে এলো টুনিদের বাসায়। ততক্ষণে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। দেখা গেল ছোটাচ্চু বাসায় ফিরেনি। ছোটাচ্চুকে ফোন করা হলো, দেখা গেল তার ফোনও বন্ধ। হঠাৎ করে সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
.
ক্যাবে ওঠার পর ছোটাচ্চু বা মাহী কাঞ্চনের কেউই বুঝতে পারল যে, তারা খুব বড় একটা বিপদে পড়তে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা অবশ্যি সেটা আঁচ করতে পারল, কারণ ক্যাবটা হঠাৎ করে মাহী কাঞ্চনের বাসার দিকে না গিয়ে উল্টো দিকে যেতে শুরু করল। ছোটাচ্চু চিৎকার করে বলল, “কী হচ্ছে? কোন দিকে যাচ্ছেন?”
ড্রাইভার কোনো কথা বলল না, ক্যাব চালিয়ে যেতে লাগল। ছোটাচ্চু এবারে ধমক দিয়ে বলল, “কী হলো, কই যাচ্ছেন আপনি?”
ড্রাইভার এবারেও কোনো কথা বলল না। ছোটাচ্চু বলল, “গাড়ি থামান। আমরা নেমে যাব।”
এবারে ড্রাইভার কথা বলল, “আমি থামাতে পারি। আপনি নামতে পারবেন?” তারপর হা হা করে হাসতে লাগল।
ক্যাবের ড্রাইভার কেন হাসছে ছোটাচ্চু সাথে সাথেই বুঝতে পারল, কারণ ক্যাবের ভেতর দরজা খোলার হ্যাঁন্ডেলগুলো নেই। ভেতর থেকে যেন কেউ খুলতে না পারে সে জন্যে খুলে রাখা হয়েছে। ছোটাচ্চু শুধু শুধু দরজায় কয়েকটা ধাক্কা দিল। কোনো লাভ হলো না, দরজা খুলল না। খুললেও কোনো লাভ হতো না, চলন্ত গাড়ি থেকে ছোটাচ্চু কিংবা মাহী কাঞ্চন কেউই নামতে পারত না।
ছোটাচ্চু মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, সে এই নিয়ে তৃতীয়বার ছিনতাই হতে যাচ্ছে। প্রথমবার খুব ভয় পেয়েছিল, দ্বিতীয়বার সেরকম ভয় পায়নি। এবারে ব্যাপারটা তার কাছে খুবই স্বাভাবিক মনে হতে থাকে। এরপর কী করা হবে ছোটাচ্চু সবকিছু জানে, কাজেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে জুতোর ভিতরে ঢুকিয়ে নিল–অন্য কিছু করে লাভ নেই, বিপদ হয়ে যেতে পারে। মোবাইল ফোনের সিমটা খুলে নিতে পারে কিন্তু সেটা সাধারণত ছিনতাইকারীরা নিজেরাই করে দেয়। তাদের জন্যেও কিছু কাজ রাখা দরকার।
ক্যাবটা তখন উল্টো দিকে যাচ্ছে, মোটামুটি একটা নির্জন জায়গায় ক্যাবটা থামবে, তখন দুই পাশ থেকে আসল ছিনতাইকারীরা উঠবে। তাদেরকে ছিনতাই করে চোখে মলম লাগিয়ে দেবে। ছিনতাইকারীরা কী রকম, তার উপর নির্ভর করে তাদের সাথে কী রকম ব্যবহার করবে। সাধারণত খুবই খারাপ ব্যবহার করে–ছিনতাই হওয়ার এটা হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ অংশ, সে জন্যে অনেক দিন মন-মেজাজ খারাপ থাকে। মানুষ যখন মানুষকে সম্মান করে কথা না বলে, তার থেকে বড় অপমান আর কিছু নেই।
ছোটাচ্চু হঠাৎ দেখল তার পাশে মাহী কাঞ্চন থরথর করে কাঁপছে। মানুষটা মনে হয় খুব ভয় পেয়েছে। ছোটাচ্চু তাকে ধরে ডাকল, “কাঞ্চন ভাই।”
মাহী কাঞ্চন কোনো উত্তর দিল না, থরথর করে কাঁপতেই লাগল। ছোটাচ্চু মাহী কাঞ্চনকে ধরে একটা ছোট ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কাঞ্চন ভাই, কথা বলেন।”
মাহী কাঞ্চন কোনো কথা বলল না, রথর করে কাঁপতেই থাকল। ছোটাচ্চু বলল, “আপনি কি ভয় পেয়েছেন? ভয়ের কিছু নাই। আমি আছি।”
মাহী কাঞ্চন এবারে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু কথাগুলো বোঝা গেল না, অবোধ্য বিলাপের মতো শোনা গেল। ছোটাচ্চু মাহী কাঞ্চনের হাতটা ধরে রেখে ফিসফিস করে বলতে লাগল, “কোনো ভয় নাই। আপনার কোনো ভয় নাই। আমি আছি। আমি আপনাকে দেখে শুনে রাখব। টাকা-পয়সা নিয়ে যাবে, আর কিছু হবে না। আপনার আর কোনো ক্ষতি হবে না! আমি থাকতে আপনার গায়ে আর কেউ হাত দিতে পারবে না।”
হঠাৎ করে ক্যাবটা থেমে গেল, ড্রাইভার বলল, “এই যে থামালাম। নামতে চাইলে নামো।” আগে আপনি করে বলছিল এখন তুমি করে বলছে। একটু পরে তুই করে বলবে। ক্যাবের ড্রাইভার কথা শেষ করে হা হা করে হাসতে থাকল, যেন খুব একটা উঁচুদরের রসিকতা করেছে। ছোটাচ্চু যেরকম ভেবেছিল ঠিক সে রকম দুই পাশ থেকে দুইজন এসে গাড়ির দরজা খুলে ঢুকে গেল আর সাথে সাথে ক্যাবটা ছেড়ে দেয়।
মানুষ দুইজন হাতে লুকানো দুটো চাকু বের করে, কোথায় চাপ দিতেই চাকুর কলা বের হয়ে আসে, ভয় দেখানোর অনেক পুরানো কায়দা। ছোটাচ্চুর জন্যে ঠিক আছে কিন্তু মাহী কাঞ্চনের জন্যে এটা ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ করে তার সারা শরীরে খিচুনির মতো শুরু হয়ে গেল, মনে হলো মুখ থেকে ফেনা বের হয়ে আসছে। মানুষটির মনে হয় হার্ট এটাক হয়ে যাবে।
ছিনতাইকারী দুইজন অবশ্যি এর কিছুই লক্ষ করল না, একজন চাকুটা মাহী কাঞ্চনের মুখের উপর নাড়াতে নাড়াতে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, “আজকের মক্কেল কী রকম ওস্তাদ?”
“হাতে ব্যাগ নাই, ল্যাপটপ-ক্যামেরা নাই।”
“ফকিরনীর পুতদের দিয়া বউনি?”
“হ।“
ছোটাচ্চু মাথা ঠাণ্ডা রাখল। ছিনতাইকারীদের কুৎসিত গালাগাল ঠাণ্ডা মাথায় হজম করল, নিজের মানি ব্যাগ, মোবাইল ফোন তুলে দিল, মাহী কাঞ্চনের পকেট থেকে মানি ব্যাগ, মোবাইল বের করে দিতে সাহায্য করল। মাহী কাঞ্চন কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো হয়েছিল, ব্যাপারটা বুঝতেই পারল না। ছোটাচ্চু সারাক্ষণ মাহী কাঞ্চনের হাত ধরে রেখে ফিসফিস করে তার কানের কাছে বলতে লাগল, “ভয় নাই। কোনো ভয় নাই। আমি আছি। আপনার কোনো কিছু হতে দিব না, আপনাকে রক্ষা করব–”
মাহী কাঞ্চন ছোটাচ্চুর কোনো কথা শুনল বলে মনে হলো না। ছিনতাইকারী দুজন নেবার মতো যা কিছু আছে তা নিয়ে পকেট থেকে মলমের কৌটা বের করল, কোনো লাভ হবে না জেনেও ছোটাচ্চু নরম গলায় একটু অনুরোধ করল, বলল, “এটা না দিলে হয় না! আমাদের যা ছিল সব তো দিয়েই দিয়েছি! অন্ধকারে তো এমনিতেই কিছু দেখছি না।”
ছোটাচ্চুর পাশে বসে থাকা ছিনতাইকারী হা হা করে হেসে বলল, “কী কইতাছস তুই বেকুবের মতো! এইটা হচ্ছে আমাগো বিজনেসের ট্রেড মার্ক। এইটা না দিলে হয়?”
তারপর প্রথমে খপ করে মাহী কাঞ্চনের চুলের ঝুঁটি ধরে জোর করে চোখের পাতা খুলে এক দলা মলম ঢুকিয়ে দিল। প্রথমে বাম চোখে তারপর ডান চোখে। মাহী কাঞ্চন প্রথমে কেমন যেন গোঙানোর মতো শব্দ করল, তারপর দুই চোখ বন্ধ করে চুপ হয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
ছোটাচ্চুর দুই চোখেও মলম ঢুকিয়ে দিল, বাধা দিয়ে লাভ নেই জেনেও ছোটাচ্চু নিজের অজান্তেই খানিকক্ষণ নিজের চোখকে বাঁচানোর চেষ্টা করল, কোনো লাভ হলো না। উল্টো ধারালো চাকুর খোঁচায় কব্জির কাছে খানিকটা কেটে গেল। কী দিয়ে এই মলম তৈরি করে কে জানে–চোখের ভেতরে দেয়া মাত্রই দুই চোখ ভয়ঙ্করভাবে জ্বলতে থাকে, কিছুতেই আর চোখ খোলা রাখতে পারে না।
গাড়ির সামনে থেকে ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, “মক্কেলগো রেডি করছস?”
“জে ওস্তাদ। মক্কেল রেডি।”
“গাড়ি থামাই?”
“থামান ওস্তাদ।”
ছোটাচ্চু টের পেল হঠাৎ করে ক্যাবটা থেমে গেছে। বাম পাশের দরজাটা খোলার শব্দ হলো, তারপর ধাক্কা দিয়ে মাহী কাঞ্চন আর ছোটাচ্চুকে তারা রাস্তার পাশে কাঁদার মাঝে ফেলে দিল। প্রায় সাথে সাথেই ঝপাং শব্দ করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো, তারপর গাড়িটা মুহূর্তের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ছোটাচ্চু বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে মাহী কাঞ্চনকে টেনে দাঁড় করাল। বলল, “কাঞ্চন ভাই, আর কোনো ভয় নাই। বদমাইশগুলো পালিয়েছে।”
মাহী কাঞ্চন কথাগুলো শুনল কি না বোঝা গেল না। শুনলেও বুঝল কি না সেটাও বোঝা গেল না। থরথর করে কাঁপতেই লাগল। ছোটাচ্চু বলল, “চোখের মলম নিয়ে ভয়ের কিছু নাই, ডাক্তারের কাছে গেলেই চোখ ওয়াশ করে দিবে।”
মাহী কাঞ্চন এই কথাগুলোও শুনল বলে মনে হলো না, থরথর করে কাঁপতেই থাকল। ছোটাচ্চু বলল, “কাঞ্চন ভাই, এখন আর ভয় নাই। চলেন হাঁটি, মানুষজন পেয়ে যাব। আপনাকে দেখলেই সবাই পাগল হয়ে যাবে।”
মাহী কাঞ্চন দাঁড়িয়েই রইল, ছোটাচ্চু তখন তাকে ধরে টেনে টেনে নিতে থাকে। চোখ জ্বালা করছে বলে চোখ খুলে দেখতে পারছে না, তার মাঝে কষ্ট করে মাঝে মাঝে চোখটা একটু খুলে আন্দাজ করার চেষ্টা করল কোন দিকে যাচ্ছে। ছোটাচ্চু জানে যে কোনো দিকে একটু হাঁটলেই মানুষজন, দোকানপাট কিছু একটা পেয়ে যাবে। মাহী কাঞ্চনের জন্যে হঠাৎ করে তার কেমন যেন দুশ্চিন্তা হতে থাকে, এই মানুষটি নিশ্চয়ই কখনো এরকম ভয়ঙ্কর অবস্থায় পড়েনি।
হঠাৎ করে মাহী কাঞ্চন দাঁড়িয়ে গেল, তারপর বলল, “গান!”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “কীসের গান?”
মাহী কাঞ্চনের কাঁপুনি হঠাৎ করে কমে আসে, প্রথমবার সে পরিষ্কার শান্ত গলায় বলল, “আমার গান।”
“আপনার গান?”
“হ্যাঁ, নিশি রাইতে চান্দের আলো-” বলেই গুনগুন করে সে গানটা দুই লাইন গেয়ে ফেলল, সাথে সাথে ছোটাচ্চুর গানটা মনে পড়ে যায়, কতবার শুনেছে! এই গানটা গেয়েই মাহী কাঞ্চন রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন হঠাৎ করে মাহী কাঞ্চন এই গানটার কথা বলছে কেন? ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “এই গানটার কী হয়েছে?”
“বাজাচ্ছে।”
“কে বাজাচ্ছে?”
“জানি না। শুনতে পাচ্ছ না?”
ছোটাচ্চু তখন কান পেতে শোনার চেষ্টা করল এবং হঠাৎ মনে হলো সত্যিই দূর থেকে খুব অস্পষ্টভাবে গানটা শোনা যাচ্ছে। আশেপাশে কোথাও গানটি বাজছে। ছোটাচ্চু বলল, “চলেন যাই, কোথায় গান বাজছে দেখি। মানুষজন পাওয়া যাবে সেখানে।”
মাহী কাঞ্চন বলল, “চলো।”
মাহী কাঞ্চন তাকে আপনি করে বলত, হঠাৎ তুমি করে বলতে শুরু করেছে! ছোটাচ্চু অবশ্যি কিছু মনে করল না, প্রায় তার সমবয়সী কিংবা এক-দুই বছর বড় হতে পারে, তুমি করে ডাকতেই পারে। ছোটাচ্চু মাহী কাঞ্চনের হাত ধরে বলল, “চোখ বন্ধ করে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে না তো?”
“তা হচ্ছে। তুমি পারলে আমিও পারব।”
গানের শব্দ শুনে শুনে তারা কিছুক্ষণের মাঝেই রাস্তার পাশে একটা ছোট টংয়ে হাজির হলো। টংয়ের ভেতর একটা ছোট টেলিভিশন, সেখানে মাহী কাঞ্চন একটা গিটার হাতে নিয়ে নিশি রাইতে চান্দের আলো’ গান গাইছে। টংয়ের সামনের বেঞ্চে বসে কয়েকজন মানুষ চা খেতে খেতে গান শুনছে। আবছা আলোতেও ছোটাচ্চু আর মাহী কাঞ্চনের চেহারা দেখে সবাই বুঝে গেল কিছু একটা সমস্যা হয়েছে, কয়েকজন দাঁড়িয়ে বলল, “কী হইছে আপনাগো?”
ছোটাচ্চু বলল, “মলম পার্টি।”
আর কিছুই বলতে হলো না, সাথে সাথে সবাই কী হয়েছে বুঝে গেল। একজন মানুষ প্রায় আর্তনাদের মতো শব্দ করে বলল, “কী হইল দেশটার? এই সপ্তাহে আপনারা এইখানে দুই নম্বর পার্টি!”
টংয়ে বসে থাকা মানুষটা কাকে যেন ডেকে বলল, “এই শামসু, এক বালতি পানি আন তাড়াতাড়ি। আর সাবান।” তারপর ছোটাচ্চু আর মাহী কাঞ্চনকে বলল, “আপনারা বসেন। আপনাগো আর কোনো ভয় নাই। আমরা আছি।”
টেলিভিশনে মাহী কাঞ্চনের গান শেষ হবার সাথে সাথে একজন উপস্থাপিকা মিষ্টি গলায় বলল, “আপনারা এতক্ষণ আপনাদের প্রিয় মাহী কাঞ্চনের গান শুনছিলেন। এই মাত্র আমরা খোঁজ পেয়েছি জনপ্রিয় গায়ক মাহী কাঞ্চন নিখোঁজ। তিনি এবং তার এক সহযোগী সম্ভবত দুবৃত্তদের কবলে পড়েছেন। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ এবং র্যাবের তল্লাশি চলছে।”
ছোটাচ্চু প্রায় চিৎকার করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, মাহী কাঞ্চন ছোটাচ্চুকে থামাল।
টেলিভিশনের উপস্থাপিকা বলল, “আমাদের রিপোর্টার ফয়সল খান মাহী কাঞ্চনের বাসভবনে আছেন, আমরা এখন তার মুখ থেকে সরাসরি শুনতে পাচ্ছি।”
মাহী কাঞ্চন ছোটাচ্চুর হাত ধরে বলল, “প্লিজ, আপনি এখানে আমার পরিচয় দেবেন না!”
“কেন?”
“সাংবাদিক-পুলিশ আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।”
“আপনি তো কোনো দোষ করেননি। আপনার সমস্যা কী? যা হয়েছে বলবেন!”
মাহী কাঞ্চন মাথা নেড়ে বলল, “তুমি বুঝতে পারছ না। কী হয়েছে আমার কিছু মনে নাই!”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “কিছু মনে নাই?”
“না। আবছা মনে আছে কেউ একজন একটা চাকু নাচাচ্ছে–তারপর দেখলাম আমি চোখ বন্ধ করে রাস্তায় কাদার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি, অনেক দূর থেকে একটা গান শোনা যাচ্ছে নিশি রাইতে চান্দের আলো–এর মাঝখানে কী হয়েছে আমি কিছু জানি না!”
“কী আশ্চর্য!”
“তাই বলছিলাম তুমি আমাকে বাঁচাও। সাংবাদিক-পুলিশের হাত থেকে বাঁচাও।”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে দেখছি!”
ততক্ষণে একটা ছোট ছেলে কাছাকাছি টিউবওয়েল থেকে এক বালতি পানি আর ছোট একটা নতুন সাবান নিয়ে এসেছে। ছোটাচ্চু আর মাহী কাঞ্চন দুজনে মিলে তখন চোখে পানি দিতে লাগল, চোখ দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ থোয়ার পর চোখে একটু আরাম হলো, দুজনেই তখন চোখ মেলে একটু একটু দেখতে শুরু করল।
টংয়ের মানুষটি দুই কাপ চা বানিয়ে এনেছে। দুজনের কারোরই এখন চা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু মানুষটির আন্তরিকতা দেখে আর করতে পারল না।
ছোটাচ্চু চা খেতে খেতে বলল, “আপনারা আমাদের বিশ্বাসী একজন রিকশাওয়ালা কিংবা সিএনজি ড্রাইভার দিতে পারবেন?”
পাশের বেঞ্চে বসে শক্ত-সমর্থ একজন মানুষ চা খাচ্ছিল, বলল, “আমি আপনাগো আমার রিকশা দিয়া নিয়া যামু। কোনো চিন্তা নাই।”
আশেপাশে দাঁড়িয়ে-বসে থাকা মানুষগুলো মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, মফিজ তুই-ই সাহেবদের লইয়া যা। তোর ধারে-কাছে কোনো সন্ত্রাসী আইব না।”
তাই কিছুক্ষণের মাঝে মফিজ নামের শক্ত-সমর্থ রিকশাওয়ালা তার নতুন রিকশায় ছোটাচ্চু আর মাহী কাঞ্চনকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চলল। কার সাধ্যি আছে তার ধারে-কাছে কেউ আসে?
রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ছোটাচ্চু মাহী কাঞ্চনকে নিয়ে তাদের বাসায় পৌঁছাল, দুজনকে দেখে বাচ্চারা যেভাবে চিৎকার করে উঠেছিল সেটা শুনে আশেপাশে কয়েকটা বাসার ছোট বাচ্চারা চমকে ঘুম থেকে উঠে তাদের কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিল।
রাত বারোটার সময় সব টেলিভিশন চ্যানেলে একটা বিশেষ বুলেটিনে জানানো হলো মাহী কাঞ্চন নিরাপদে ফিরে এসে একটা অজ্ঞাত প্রাইভেট ক্লিনিকে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তিনি সুস্থ আছেন এবং ডাক্তারের নির্দেশে তিনি কারো সাথে কথা বলছেন না।
ঠিক তখন আসলে মাহী কাঞ্চন ছোটাচ্চুর একটা লুঙ্গি আর টি-শার্ট পরে খেতে বসেছে। দুশ্চিন্তায় বাসায় কারো খাওয়ার কথা মনে ছিল না, খেতে বসে দেখা গেল সবার প্রচও খিদে। ঝুমু খালা বলে পুরো খাওয়ার পর্বটা সামলে নেয়া গেল তবে সেও হিমশিম খেয়ে গিয়েছিল। মাহী কাঞ্চন যখন বলল ঝুমুর রান্না করা টাকি মাছের ভর্তার মতো সুস্বাদু খাবার সে জীবনে খায়নি তখন ঝুমু খালার মুখে যে হাসিটা ফুটে উঠেছিল সেটা দেখার মর্তে একটা বিষয় ছিল।
রাত একটার দিকে সবাইকে শুতে পাঠানোর চেষ্টা শুরু হলো কিন্তু কাউকে শুতে পাঠানো গেল না। মাহী কাঞ্চনও জানাল সে এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারে না। তখন তাকে একটা গান গাওয়ার অনুরোধ করা হলে সে সানন্দে রাজি হয়ে গেল। তিনতলায় মেজ চাচির হারমোনিয়াম নিয়ে আসা হলো এবং মাহী কাঞ্চন রাত তিনটা পর্যন্ত সবাইকে গান গেয়ে শোনাল। (শান্ত মনে মনে হিসেব করে বের করল এই গানগুলো যদি রেকর্ড করে সিডি বানিয়ে বিক্রি করতে পারত তাহলে তার নিট লাভ হতো সাড়ে তিন লক্ষ টাকা!)
রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাচ্চাদেরকে জোর করে বিছানায় পাঠানো হলো। তার আগে সবার সাথে মাহী কাঞ্চনের নূতন করে আরো একবার সেলফি তুলতে হলো। মলম লাগানোর কারণে টকটকে লাল চোখের সেলফির নাকি গুরুত্ব অন্য রকম।
ভোররাত চারটার দিকে মাহী কাঞ্চন ছোটাচ্চুর বিছানায় এবং ছোটাচ্চু সোফায় শুতে গেল। (ছোটাচ্চু নিজেও লক্ষ করেনি ঠিক কখন থেকে সে মাহী কাঞ্চনকে ‘তুমি’ বলতে শুরু করেছে।
ঘুম আসছিল না বলে টুনি ভোররাতে একবার উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। সে দেখল তাদের বাসার সামনে একটা সাদা গাড়ি। দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছিল গাড়ির ভেতর কয়েকজন মানুষ বসে আছে।
.
দুই সপ্তাহ পর মাহী কাঞ্চন তার একটা কনসার্ট শুরু করার আগে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল, “আজকের এই কনসার্টটি আমি উৎসর্গ করতে চাই এমন একজন মানুষকে, যে আমার জীবন বাঁচিয়েছে বলে আমি আজ আপনাদের সামনে হাজির হতে পেরেছি। নিজের জীবন বিপন্ন করে যে মানুষটি আমার জীবন বাঁচিয়েছে তার নাম শাহরিয়ার, মানুষটি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি নামে বাংলাদেশের প্রথম ডিটেকটিভ এজেন্সি শুরু করেছে। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা। আমার কৃতজ্ঞতা এবং আমার ভালোবাসা।”
বলাই বাহুল্য, এরপর ছোটাচ্চুকে বনানীতে একটা অফিস ভাড়া করতে হয়েছে, একজন অফিস সহকারীসহ তিনজন মানুষকে নিতে হয়েছে। দুইজন পুরুষ, একজন মেয়ে। তারপরও তারা কাজ করে কুলাতে পারছে না। মনে হয় আরো বড় অফিস, আরো কিছু মানুষ নিতে হবে। একটা গাড়ি কিনতে হবে, সাথে একজন ড্রাইভার।
সব মিলিয়ে টুনিও খুব ব্যস্ত।