৪. টিফিনের ছুটিতে সব ছেলে-মেয়েরা

টিফিনের ছুটিতে সব ছেলে-মেয়েরা ছুটোছুটি করে খেলছে, টুনি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। তারপর একটু হাঁটতেই চোখে পড়ল স্কুল বিল্ডিংয়ের শেষ মাথায় সিঁড়িতে কে যেন একা একা বসে আছে। জায়গাটা একটু নির্জন, কয়েকটা বড় বড় গাছ দিয়ে আবছা অন্ধকার, সাধারণত এখানে কেউ বসে না। মানুষটা কে হতে পারে দেখার জন্যে টুনি একটু এগিয়ে গেল, একটু কাছে যেতেই সে মানুষটাকে চিনতে পারল, তাদের স্কুলের শাপলা আপু।

শাপলা আপু টুনিদের স্কুলের সবচেয়ে তেজি মেয়ে, এই স্কুলে যা কিছু হয় সেখানে শাপলা আপু থাকে। সেই শাপলা আপু এখানে একা একা বসে আছে সেটা অবাক ব্যাপার। শাপলা আপু টুনিকে দেখে ডাকল, “এই টুনি, আয়, এদিকে আয়।”

টুনি এগিয়ে যেতেই শাপলা আপু একটু সরে টুনিকে বসার জায়গা দিয়ে বলল, “আয়। বস আমার সাথে।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে একা একা বসে আছ কেন শাপলা আপু।”

“মনটা খারাপ সেই জন্যে।”

“তোমার কেন মন খারাপ শাপলা আপু?”

“অংক পরীক্ষায় গোল্লা পেয়েছি।”

টুনি অবাক হয়ে শাপলা আপুর দিকে তাকাল, শাপলা আপু অন্য কিছুতে গোল্লা পেলে সে অবাক হতো না কিন্তু অংকে তার গোল্লা পাওয়ার কথা না। গত বছর শাপলা আপু গণিত অলিম্পিয়াডে মেডেল পেয়েছে।

শাপলা টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস হলো না?”

টুনি মাথা নাড়ল, তখন শাপলা তার হাতে ধরে রাখা খাতাটা খুলে দেখাল, বলল, “এই দেখ!”

টুনি দেখল খাতার ওপর বড় বড় করে লাল কালিতে দুইটা শূন্য দেওয়া আছে। খাতায় যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেখানেও লাল কালিতে কাটাকাটি। দেখে মনে হয় রীতিমতো রক্তারক্তি ব্যাপার। টুনি কী বলবে বুঝতে পারল না, সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “শাপলা আপু, এইবার তোমার কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে। তুমি অংকে এত ভালো, পরের বার দেখো–”

শাপলা টুনিকে কথা শেষ করতে দিল না, জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, না টুনি, তুই আসল ব্যাপারটাই বুঝতে পারিসনি।”

টুনি বলল, “আসল ব্যাপারটা কী?”

“আসল ব্যাপার হচ্ছে, আমার অংক একটাও ভুল হয় নাই।”

টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “তোমার একটা অংকও ভুল হয় নাই, তাহলে তোমাকে পোল্লা দিয়েছে কেন?”

শাপলা হাত তুলে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো করে বলল, “বাদ দে! তুই ছোট মানুষ বুঝবি না।”

টুনি ব্যস্ত হয়ে বলল, “বুঝব শাপলা আপু। আমি বুঝব, তুমি বলো।”

শাপলা বলল, “এর চাইতে একটা সিগারেট খাই।”

টুনি আঁতকে উঠে বলল, “সিগারেট?”

শাপলা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ সিগারেট। আমার যখন মন খারাপ হয় তখন এইখানে বসে বসে আমি সিগারেট খাই।”

টুনি বলল, “কেউ দেখে নাই?”

“এখনো দেখে নাই।”

“যদি দেখে–”

“দেখলে দেখবে।” বলে শাপলা কোথায় জানি হাত ঢুকিয়ে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে আনল। তারপর খুব সাবধানে প্যাকেটটা খুলে একটা সিগারেট বের করে মুখে দিয়ে দুই ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে একটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে সিগারেটটা জ্বালিয়ে বুক ভরে একটা টান দিয়ে নাক দিয়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল।

টুনি মুগ্ধ হয়ে শাপলা আপুর দিকে তাকিয়ে রইল, কারণ আসলে তার কাছে কোনো সিগারেটের প্যাকেট, সিগারেট, ম্যাচ কিছু নেই। পুরোটা মিছিমিছি। শাপলা আপু তার অদৃশ্য সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই খাবি একটা?”

টুনি বলল, “আমি তোমার মতো করে খেতে পারব না।”

“চেষ্টা করে দেখ। লজ্জার কী আছে?” শাপলা তার অদৃশ্য সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা অদৃশ্য সিগারেট বের করে টুনিকে দিল। টুনি একটু লজ্জা পাচ্ছিল, তারপরেও শাপলার দেখাদেখি কাল্পনিক সিগারেটটা ঠোঁটে লাগিয়ে টান দেওয়ার ভান করল।

শাপলা বলল, “বুঝলি টুনি, যখন আমার মন খারাপ হয় তখন এখানে বসে বসে সিগারেট টানি। কোনো কোনোদিন আস্ত একটা প্যাকেট শেষ করে ফেলি।”

টুনি বলল, “এত সিগারেট খাওয়া ভালো না শাপলা আপু।”

“জানি।” শাপলা আপু বলল, “কী করব বল। মনটা ভালো নাই।”

“তোমার সব অংক শুদ্ধ তার পরেও তোমাকে গোল্লা কেন দিল?”

“তুই শুনে কী করবি? তোর মন খারাপ হবে।”

“হবে না। তুমি বলো।

শাপলা তার কাল্পনিক সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, “আমাদের অংক করান ফাক্কু স্যার।”

ফাক্কু স্যারের নিশ্চয়ই অন্য কোনো নাম আছে, তার বাবা-মা নিশ্চয়ই তার ছেলের নাম ফাক্কু রাখেননি কিন্তু সেই নামটা স্কুলের কোনো ছাত্রছাত্রী জানে বলে মনে হয় না।

শাপলা বলল, “ফাক্কু স্যার আমাকে চ্যালেঞ্জও দিয়েছে যে আমি কোনোদিন তার পরীক্ষায় পাস করতে পারব না।”

“কেন?”

“আমি ফাক্কু স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ি না সেই জন্যে।”

“তুমি কার কাছে প্রাইভেট পড়ো?”

“আমি কারো কাছে প্রাইভেট পড়ি না।”

“অ।”

“ফাক্কু স্যারের কাছে প্রাইভেট না পড়লে অংকে ফেল। আমার বেলা শাস্তিটা একটু বেশি কঠিন। পুরোপুরি গোল্লা

“তুমি কাউকে বলো নাই?”

“কাকে বলব? ফাক্কু স্যার হচ্ছে স্কুল কমিটির প্রেসিডেন্টের আপন শালা। আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম পর্যন্ত ফাক্কু স্যারকে ভয় পায়।”

“তোমার আব্বকে বলো না কেন?”

“লাভ নাই। আবু দেখে আর হাসে।”

টুনি অবাক হয়ে বলল, “হাসে? হাসে কেন?”

“আব্দুর ধারণা এই রকম মানুষের সাথে পরিচয় হওয়া ভালো। তাদের সাথে ধাক্কাধাক্কি করলে নাকি মানসিক শক্তি হয়।”

“মানসিক শক্তি?”

“হ্যাঁ। মানসিক শক্তি। চারিত্রিক গুণ। আত্মবিশ্বাস। বাস্তবতাবোধ।”

“এত কিছু?”

“আরো আছে। সবগুলো মনে নাই।“

টুনি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, তাহলে তোমার আম্মুকে বলল কেন?”

“বলেছি। প্রত্যেক রাত্রে ঘুমানোর সময় বলি।”

“তোমার আম্মু কিছু করবেন না?”

“করলে তো ভালো।”

“কী করবেন?”

শাপলা আপু মুখ গম্ভীর করে বলল, “বলেছি কোনো একটা অমাবস্যার রাতে ফাক্কু স্যারের ঘাড়টা মটকে দিতে।”

“ঘাড় মটকে দিতে?”

“হ্যাঁ। আমার আম্মু তো মরে গেছে। মানুষ মরে গেলে ভূত হয়–আমার আম্মু নিশ্চয়ই ভূত হয়ে আছে। ইচ্ছা করলেই ঘাড় মটকাতে পারে। কেন যে ফাক্কু স্যারের ঘাড় মটকাচ্ছে না!”

টুনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে করে শাপলা আপুর হাতটা ছুঁয়ে বলল, “আপু, আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি জানতাম না তোমার আম্মু মারা গেছেন।”

“কেমন করে জানবি? আমি কি সবাইকে বলে বেড়াই নাকি?”

টুনি কিছু বলল না, শাপলা আপু তখন আরেকটা সিগারেট ধরাল। লম্বা টান দিয়ে বলল, “বার্ষিক পরীক্ষা আসছে তো, এইটা হচ্ছে ফাক্কু স্যারের সিজন।”

“সিজন?”

“হ্যাঁ, যারা ফাক্কু স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে তাদের সবাইকে বাড়তি এক হাজার টাকা দিতে হবে।”

“এক হাজার টাকা?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“অংক পরীক্ষার সাজেশন।”

টুনি অবাক হয়ে বলল, “সাজেশনের জন্য এক হাজার টাকা?”

“মুখে বলে সাজেশন আসলে ফাক্কু স্যার পুরো প্রশ্নটা বলে দেয়, একেবারে দাড়ি-কমাসহ।”

“সত্যি?”

“সত্যি না তো মিথ্যা নাকি?”

“কাজটা ঠিক হচ্ছে না।”

টুনি বলল, “একেবারেই ঠিক হচ্ছে।”

“আমি কি ঠিক করেছি জানিস?”

“কী?”

“বোমা মেরে ফাক্কু স্যারের বাড়িটা উড়িয়ে দেব।”

টুনি শাপলা আপুর দিকে তাকাল, এটাও নিশ্চয়ই তার সিগারেট খাওয়ার মতো ব্যাপার। শাপলা মুখটা গম্ভীর করে বলল, “দশ কেজি প্লস্টিক এক্সপ্লোসিভ অর্ডার দিয়েছি।”

টুনি হাসি চেপে বলল, “কোথা থেকে অর্ডার দিয়েছ?”

“একেবারে সরাসরি সি.আই.এ.র কাছে।”

“সি.আই.এ. তোমাকে পাস্টিক এক্সপ্লেসিভ দিল?”

“প্রথমে দিতে চায় নাই, তারপর যখন নিউক্লিয়ার বোমার একটা ডিজাইন দিলাম তখন দিয়ে দিল।

টুনি শাপলার মুখের দিকে তাকিয়ে হি হি করে হেসে ফেলল, বলল, “তুমি কখন ফাক্কু স্যারের বাড়িটা ওড়াবে?”

“এখনো ঠিক করি নাই, সমস্যাটা কি জানিস?”

“কী?”

“ফাকু স্যারের বউ-বাচ্চা। তারা তো কোনো দোষ করে নাই, ফাক্কু স্যারের দোষের জন্যে বউ-বাচ্চাকে কষ্ট দেওয়া কি ঠিক হবে?” শাপলা খুব চিন্তিত মুখে সিগারেট টানতে থাকে, টুনি মুগ্ধ চোখে শাপলার দিকে তাকিয়ে থাকে। স্কুলের সবাই জানে শাপলা আপু খুব মজার মেয়ে কিন্তু এত মজার মেয়ে টুনি জানত না। নিজের কষ্ট নিয়েও মজা করতে পারে–এরকম মানুষ কয়জন আছে?

.

সেদিন রাত্রি বেলা শান্ত ঘোষণা দিল সে লেখাপড়া ছেড়ে দেবে। একজন জিজ্ঞেস করল, “কেন লেখাপড়া ছেড়ে দিবে?”

“মানুষ লেখাপড়া করে সার্টিফিকেটের জন্যে। আমি এর মাঝে সার্টিফিকেট পেয়ে গেছি। হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি.।”

সে কীভাবে এই সার্টিফিকেট পেয়েছে সেটা মোটামুটিভাবে সবাই এত দিনে জেনে গেছে, তাই কেউই বেশি অবাক হলো না। একজন সন্দেহপ্রবণ বাচ্চা জিজ্ঞেস করল কিন্তু তোমার তো এস.এস.সি. না হয় এইচ.এস.সি. সার্টিফিকেট নাই।”

“পি-এইচডি, সার্টিফিকেট থাকলে আর কিছু লাগে না। পি-এইচডি, হচ্ছে সব লেখাপড়ার বাবা।”

লেখাপড়া নিয়ে শান্তর কথাবার্তা নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করল না, শুধু টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুমি সত্যি লেখাপড়া ছেড়ে দেবে?”

“হ্যাঁ। ছেড়ে দিতেই হবে। আমাদের একজন অংকের ম্যাডাম এসেছে, তার উৎপাতে আমাদের সবার লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হবে।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন? কী করেছে অংক ম্যাডাম?”

শান্ত বিশাল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কী করে নাই? প্রথম দিনেই এসে বলে কোনো কিছু মুখস্থ করা যাবে না। সবকিছু বুঝে বুঝে পড়তে হবে!”

টুনি দুর্বলভাবে বলল, “মনে হয়তো ঠিকই বলেছেন।”

শান্ত চিৎকার করে বলল, “কী বললি? ঠিকই বলেছেন? এর মাঝে কোন জিনিসটা তোর ঠিক মনে হচ্ছে?”

টুনি আমতা আমতা করে বলল, “বুঝে বুঝেই তো পড়তে হয়!”

শান্ত তার দুই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, “কাঁচকলা! লেখাপড়া করতে করতেই জান শেষ আর এখন সেটা বুঝতেও হবে? আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই?”

শান্তর মেজাজ গরম দেখে একজন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কীভাবে লেখাপড়া করবে?”

“ঝাড়া মুখস্থ। কী পড়তে হবে বলে দেবে, সেটা ঝাড়া মুখস্থ করব। পরীক্ষার সময় লিখে দিয়ে আসব।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “অংকও মুখস্থ করবে?”

“একশ’বার। সবার আগে অংক মুখস্থ করব। দশটা অংক দেখিয়ে দেবে, সেগুলো ঝাড়া মুখস্থ করে রাখব। পরীক্ষায় সেই অংকগুলো দেবে আর আমরা সেগুলো লিখে দেব।”

শান্তর লেখাপড়ার পদ্ধতির বিরুদ্ধে কারো কথা বলার সাহস হলো। শান্ত নিজেই খানিকক্ষণ গজগজ করে বলল, “আর আমাদের অংক ম্যাডাম বলে সব বুঝে বুঝে পড়তে হবে! বুঝে বুঝে অংক করতে হবে! সপ্তাহে সপ্তাহে অংক পরীক্ষা। ফাইনাল পরীক্ষার আগে প্রশ্নটা কেমন হবে দেখানোর জন্যে আরেকটা পরীক্ষা নিয়েছে। সেই প্রশ্নটা একবার দেখবি?”

শান্তর প্রশ্ন দেখার কারো কৌতূহল ছিল না কিন্তু শান্ত তার ব্যাগ ঘেঁটেঘুঁটে একটা প্রশ্ন বের করে সবাইকে দেখানোর জন্যে এগিয়ে দিল। কেউ সেটা দেখার জন্যে নিচ্ছে না দেখে টুনি হাতে নিল।

শান্ত বলল, “তুই খালি একবার প্রশ্নটা দেখ! এটা কী রকম প্রশ্ন? এই প্রশ্ন করার জন্য অংক ম্যাডামের নামে মামলা করা দরকার ছিল।”

টুনি কিছু বলল না। শান্ত বলল, “আমি কি ঠিক করেছি জানিস?”

“কী?”

“আমাদের ক্লাশ থেকে আন্দোলন করব, প্রথমে মানববন্ধন তারপর গাড়ি ভাংচুর। কী কী স্লোগান দিব সেইটাও ঠিক করে ফেলেছি।”

স্লোগানের কথা শুনে অনেকেই উৎসাহী হলো, একজন জিজ্ঞেস করল, “কী স্লোগান?”

শান্ত মুখ সুচালো করে বলল, “একটা হচ্ছে :

মুখস্থ করতে চাই
নইলে কারো রক্ষা নাই।

আরেকটা হচ্ছে :

গাড়ির চাকা ঘুরবে না
বোঝাবুঝি চলবে না।

আরেকটা হচ্ছে :

হাইফাই ফিটফাট
পড়াশোনা শর্টকাট।”

বাচ্চা-কাচ্চা যারা ছিল তারা সবাই মাথা নেড়ে স্বীকার করল শ্লোগানগুলো বেশ ভালো হয়েছে। ভালো স্লোগান না হলে আন্দোলন করা যায় না।

টুনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার ক্লাশের ছেলে-মেয়েরা সবাই আন্দোলন করতে রাজি হয়েছে?”

শান্ত মুখ ভেঁতা করে বলল, “সেইটাই হয়েছে মুশকিল। সবগুলো। ছেলে-মেয়ে ভ্যাবলা টাইপের, কারো ভেতর কোনো তেজ নাই। সহজে রাজি হতে চায় না। কিছু কিছু আছে দালাল, ম্যাডামকে খুশি করার জন্যে বলে, বুঝে বুঝে লেখাপজ করাই হচ্ছে আসল লেখাপড়া। এই ছেলে-মেয়েগুলো হচ্ছে বড় সমস্যা–এদের জন্যে দেশের কোনো উন্নতি হয় না!”

শান্ত কথা শেষ করে রেগেমেগে চলে গেল। টুনির হাতে তখনো শান্তর স্কুলের অংক ম্যাডামের প্রশ্ন, যেটা মুখস্থ করে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব না। প্রশ্নটা কী করবে বুঝতে না পেরে টুনি সেটা আপাতত নিজের কাছেই রেখে দিল। সে তখনো জানত না এই প্রশ্নটা কয়দিনের মাঝেই তার কাজে লেগে যাবে।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা টুনি ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ছোটাচ্চু, একজন মানুষ যদি অন্যায় কাজ করে তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে কি আরেকটা অন্যায় কাজ করা যায়?”

ছোটাচ্চুর মনে হলো প্রশ্নটা খুব পছন্দ হয়েছে, প্রশ্নটা শুনেই তার মুখ একশ ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল, চোখগুলো উত্তেজনায় চকচক করতে লাগল। সোজা হয়ে বসে বলল, “তুই একটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন করেছিস। তোর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাদের আগে বুঝতে হবে আমরা অন্যায় বলতে কী বোঝাই। এটা কি মানুষের চোখে অন্যায় নাকি দেশের আইনের চোখে অন্যায়। তুই যদি বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করিস তাহলে কি দেখবি জানিস? দেখবি শাসকগোষ্ঠী নিজেদের রক্ষা করার জন্যে কিছু কিছু কাজকে বলে অন্যায়। তাদের স্বার্থে যখন আঘাত করে—”

ছোটাচ্চু এই ভাষায় টানা পনেরো মিনিট কথা বলে গেল। টুনি প্রথম কয়েক মিনিট ছোটাচ্চুর কথা বোঝার চেষ্টা করল তারপর হাল ছেড়ে দিল। সে ছোটাচ্চুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, কথা শোনার ভান করল, মাঝে মাঝে মাথা নাড়ল কিন্তু তার কোনো কথাই শুনল না।

বসার ঘরে প্রমির সাথে দেখা হলো, প্রমি এই বাসার বাচ্চাদের মাঝে মোটামুটি জ্ঞানী-গুণী মানুষ। টুনি তাকে একই প্রশ্ন করল, “আচ্ছা প্রমি আপু, একজন মানুষ যদি অন্যায় কাজ করে তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে কি আরেকটা অন্যায় কাজ করা যায়?”

প্রমি আপু কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে।’ তার অর্থ কী? তার অর্থ তুই যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ না করিস তোকে সবাই ঘৃণা করবে। কাজেই তোকে কিছু একটা করতেই হবে। কবিগুরু পরিষ্কার করে বলেন নাই তুই সে জন্যে আরেকটা অন্যায় করতে পারবি কি না–”

টুনি বলল, “আমি ঠিক কবিগুরুর মতামত জানতে চাচ্ছিলাম না, তোমার মতামত জানতে চাচ্ছিলাম।”

প্রমি মুখ শক্ত করে বলল, “আমার মতামত জানতে হলে তোকে সুনির্দিষ্টভাবে পুরো বিষয়টা বলতে হবে। প্রথম অন্যায়টা কী সেটা বলতে হবে। মানুষটা কে বলতে হবে, তাকে কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে সেটা জানতে হবে, সেই শাস্তি দেওয়ার জন্যে কী অন্যায় করা হবে সেটাও জানতে হবে।”

টুনির পক্ষে এত কিছু বলা সম্ভব না, তাই প্রমির মতামত জানা হলো না। শান্তকে এই প্রশ্ন করে খুব একটা লাভ হবে না জেনেও টুনি একটু চেষ্টা করল, শান্ত পুরো প্রশ্নটা না শুনেই বলল, “পিটিয়ে তক্তা করে দে।” টুনি যখন টুম্পাকে এই প্রশ্নটা করল তখন টুম্পা তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, “তুমি কি রবিন হুডের কথা বলছ?” টুনি রবিন হুডের কথা জিজ্ঞেস করছিল না কিন্তু বুঝতে পারল টুম্পা ঠিকই বলছে, রবিন হুড ছিল ডাকাত কিন্তু কেউ তাকে খারাপ বলে না, কারণ সে অত্যাচারী বড়লোক থেকে টাকা ডাকাতি করে গরিবদের দিত! গল্পে সবই সম্ভব।

টুনি কারো কাছ থেকে পরিষ্কার উত্তর পাচ্ছিল না, শেষ পর্যন্ত পরিষ্কার করে উত্তর দিল ঝুমু খালা, রান্নাঘরে পরাটা ভাজতে ভাজতে বলল, “ধরা না পড়লে ঠিক আছে।”

কাজেই টুনি সিদ্ধান্ত নিল ফাক্কু স্যারকে একটু সাইজ করার চেষ্টা করবে। কাজটা শেষ পর্যন্ত করতে পারবে কি না জানে না, কিন্তু তাতে সমস্যা নেই, সে যে এটা করার চেষ্টা করছে সেটাও কেউ জানে না। ধরা পড়ার কোনো প্রশ্নই নাই।

পরদিন স্কুলে গিয়ে সে স্কুলের অফিসে হাজির হলো। তাদের স্কুলের অফিসে যে কয়েকজন কাজ করে তার একজন হচ্ছে রওশন খালা, মাঝবয়সী হাসি-খুশি মহিলা। টুনিকে দেখে রওশন খালা কাগজপত্র থেকে চোখ তুলে তাকলি। টুনি বলল, “আপনি কি খুব ব্যস্ত?”

রওশন খালা বলল, “আমি সব সময়েই খুব ব্যস্ত–তাতে সমস্যা নাই। কী বলবে বলো।”

“এই স্কুলে কি এডভান্স ছুটি নেওয়া যায়?”

রওশান খালা অবাক হয়ে বলল, “এডভান্স ছুটি? সেটা আবার কী?”

“আমরা যদি স্কুলে না আসি তাহলে আব্দু-আম্মুর চিঠি আনতে হয়। আগেই চিঠিটা এনে পরে স্কুলে না আসলে কি হবে?”

“স্কুলে আসতে চাও না কেন?”

“না–মানে–আল্লু সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চায়।” কথাটা সত্যি নয় কিন্তু তথ্য বের করার জন্যে এরকম প্রশ্ন করা মনে হয় ঠিকই আছে।

রওশন খালা মুখটা গম্ভীর করে বলল, “পড়াশোনার ক্ষতি করে বেড়ানো ঠিক না। যখন ছুটি হয় তখন যাও।”

টুনি বলল, “আমিও তো তাই বলি। আব্ব বুঝতে চায় না।”

রওশন খালা মুখটা আরো গম্ভীর করে বলল, “না না, এটা না বুঝলে হবে না। এটা বুঝতে হবে। পড়ালেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ…” এরপর রওশন খালা লেখাপড়ার গুরুত্বের ওপর উপদেশ দিতে শুরু করল। টুনিও গম্ভীর মুখে উপদেশটা শুনতে থাকে, মাঝে মাঝে মাথা নাড়ে। একজন বড় মানুষকে খুশি করার এইটা হচ্ছে সবচেয়ে সোজা উপায়, তাকে উপদেশ দেওয়ার একটা সুযোগ করে দেয়া। একজন বড় মানুষ ছোট একজন ছেলে-মেয়েকে যত বেশি উপদেশ দিতে পারবে সে তার উপর তত খুশি হয়ে উঠবে। কাজেই উপদেশ দেয়া শেষ করে রওশন খালা টুনির উপর খুব খুশি হয়ে উঠল।

টুনি উপদেশগুলো শুনে চলে যেতে যেতে থেমে গিয়ে বলল, “এখন আপনাদের অনেক বেশি পরিশ্রম তাই না রওশন খালা?”

রওশন খালা হেসে বলল, “আমাদের সব সময় পরিশ্রম।”

“কিন্তু এখন তো ফাইনাল পরীক্ষা আসছে, তাই অনেক বেশি পরিশ্রম। এতগুলো ক্লাশের এতগুলো প্রশ্ন ছাপাতে হবে।”

রওশন খালা মাথা নাড়ল, বলল, “না। প্রশ্ন আমাদের ছাপাতে হয় না। ওগুলো টিচারেরা ছাপেন। এগুলো স্কুলেও ছাপায় না, বাইরে থেকে ছাপিয়ে নেয়!”

টুনি ব্যাপারটা শুনে খুব খুশি হলো। ভান করে বলল, “যাক বাবা! আপনাদের এই ঝামেলা করতে হয় না!” কিন্তু এখন জানা দরকার কোথা থেকে প্রশ্নগুলো ছাপানো হয়। সরাসরি কিছুতেই সেটা জিজ্ঞেস করা যাবে না, তাই সে আজকের মতো এখানেই শেষ করে দিল।

পরের দিন টুনি আবার রওশন খালার কাছে হাজির হলো, বলল, “রওশন খালা, আপনাকে আমি প্রত্যেক দিন ডিস্টার্ব করছি, আপনি আমার উপরে রাগ হচ্ছেন না তো?”

রওশন খালা হেসে বলল, “না রাগ হচ্ছি না। বলো কী বলবে?”

“আমাদের ক্লাশ টিচার হচ্ছেন ফৌজিয়া ম্যাডাম। ফৌজিয়া ম্যাডাম খুবই সুইট।”

“হ্যাঁ, খুবই সুইট। খুবই এনার্জেটিক।”

“আমরা ম্যাডামের বার্থডেতে তাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই। সব ছেলে-মেয়ে সাইন করে একটা কার্ড বানিয়ে তার ই-মেইলে পাঠিয়ে দেব। ঠিক রাত বারোটা এক মিনিটে।”

“খুবই ভালো আইডিয়া।”

“ম্যাডামের ই-মেইলটা জানি না, আপনি কি দিতে পারবেন একটু কষ্ট করে? ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করলে ম্যাডাম বুঝতে পারবে।”

রওশন খালা বলল, “অবশ্যই দিতে পারব।” তারপর উঠে কোথা থেকে একটা ফাইল এনে সেটা খুলে একটা লিস্ট বের করল। সেখানে স্কুলের সব টিচারদের ই-মেইল এড্রেস লেখা। রওশন খালা যখন ফৌজিয়া ম্যাডামের ই-মেইল এড্রেসটা একটা ছোট কাগজে লিখে দিচ্ছে তখন টুনি তার ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি দিয়ে ফাকু স্যারের ই-মেইল এড্রেসটা দেখে নিল। তারা আসলেই ফৌজিয়া ম্যাডামের কাছে একটা বার্থডে কার্ড পাঠাবে কিন্তু এই মুহূর্তে তার ফাক্কু স্যারের ই-মেইল এড্রেসটা দরকার। কেন দরকার সে এখনো জানে না, কিন্তু দরকার।

সন্ধ্যেবেলা টুনি শান্তকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা শান্ত ভাইয়া, তুমি যদি একজন মানুষের ই-মেইল এড্রেস জানো তাহলে কি তার ই মেইলগুলো দেখতে পারবে?”

“অবশ্যই পারব। না পারার কী আছে!”

“কীভাবে?”

“দশ টাকা।”

অন্য যেকোনো মানুষ হলে শান্তর কথা শুনে থতমত খেয়ে যেত কিন্তু টুনি যেহেতু শান্তকে চিনে তাই সে থতমত খেলো না, বুঝতে পারল এই প্রশ্নের উত্তর শুনতে হলে দশ টাকা দিতে হবে। টুনি বলল, “দুই টাকা।”

“পাঁচ টাকার এক পয়সা কম না।”

টুনি তার ব্যাগ থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে শান্তকে দিয়ে বলল, “নাও।”

শান্ত পাঁচ টাকার নোটটা ভালো করে দেখে পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “কাজটা খুবই সোজা। প্রথমে মেইল আইডি লিখবি তারপর পাসওয়ার্ড লিখবি। তখন সব ই-মেইল দেখতে পাবি।”

টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “এইটা তো সবাই জানে। আমি কি এইটা জানতে চেয়েছি নাকি? আমি জানতে চাচ্ছি পাসওয়ার্ড না জানলে অন্যের ই-মেইলে ঢোকা যায় নাকি।”

“সেটা তুই আগে বলিসনি।”

টুনি বলল, “আমার টাকা ফেরত দাও।”

শান্ত দাঁত বের করে হেসে বলল, “টাকা হচ্ছে যৌবনের মতন, একবার বের হয়ে গেলে আর ফিরে আসে না।”

“এটা চোট্টামি।”

“আর তুই যেটা জিজ্ঞেস করেছিস সেটা হচ্ছে সাইবার ক্রাইম। আমি চোর হলে তুই ডাকাত।”

“টাকা ফেরত দাও শান্ত ভাইয়া।”

“টাকা ফেরত পাবি না কিন্তু তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি।”

শান্ত এখন কোন ধরনের চোট্টামি করবে জানা নেই, টুনি তাই কোনো কথা না বলে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত বলল, “অন্যের ই-মেইলে ঢোকা হচ্ছে হ্যাঁকিং। যারা ভালো হ্যাঁকার তারা করতে পারে। আমার পরিচিত একজন সুপারডুপার হ্যাঁকার আছে। আদনান ভাই, কলেজে পড়ে। ফার্স্ট ইয়ার। আদনান ভাই হ্যাঁক করে গভমেন্টের ওয়েবসাইটে স্টুকে মন্ত্রীদের নাম উল্টাপাল্টা করে দিয়েছিল।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। সেইটা করে খুব বিপদে পড়েছে।”

“কী বিপদ?”

“পুলিশ আর র‍্যাব ধরে নিয়ে গেছে। জামিনে ছাড়া পেলে তোর কথা বলতে পারি। আগে থেকে বলে রাখছি, আদনান ভাইয়ের রেট কিন্তু খুব হাই।”

টুনি বলল, “থাক দরকার নাই।”

টুনি যখন চলে যাচ্ছিল তখন শান্ত বলল, “যে মানুষের ই-মেইল হ্যাঁক করবি সেই মানুষটা যদি গাধা টাইপের হয় তাহলে তুই নিজেও হ্যাঁক করার চেষ্টা করতে পারিস।”

“আমি নিজে?”

“হ্যাঁ। গাধা টাইপের মানুষদের পাসওয়ার্ড খুব সোজা হয়। বেশিরভাগ সময় নিজের বাচ্চার নাম দিয়ে পাসওয়ার্ড তৈরি করে। বাচ্চার নাম যদি ছোট হয় নামের শেষে ওয়ান টু থ্রি লিখে লম্বা করে। আট অক্ষরের পাসওয়ার্ড বানায়।

শান্ত ঠাট্টা করছে নাকি সত্যি বলছে টুনি বুঝতে পারল না। যদি সত্যি বলে থাকে তাহলে এইটুকু তথ্যের জন্যে পাঁচ টাকা খরচ করা যায়। কাজেই সে আর পাঁচ টাকা ফেরত দেওয়ার জন্যে চাপাচাপি করল না। করেও কোনো লাভ হতো না, শান্ত ঠিকই বলেছে, টাকা হচ্ছে যৌবনের মতো–একবার বের হয়ে গেলে আর ফিরে আসে না, বিশেষ করে সেটা যদি শান্তর কাছে যায়।

পরদিন স্কুলে গিয়ে টুনি শাপলাকে খুঁজে বের করল। শাপলাকে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন না, টিফিন ছুটিতে যেখানে সবচেয়ে বেশি হইচই হয় সেখানেই শাপলা থাকে। আজকে শাপলাকে পাওয়া গেল ক্লাশ সিক্সের ছেলে-মেয়েদের মাঝে, ক্রিকেট খেলা নিয়ে সেখানে প্রায় খুনোখুনি হয়ে যাচ্ছিল, শাপলা সেটা কোনোমতে সামলে নিয়েছে। আবার যখন খেলা শুরু হলো তখন টুনি শাপলার কাছে গিয়ে বলল, “শাপলা আপু।”

“কী হলো?”

“তুমি কি আমাকে একটা জিনিস বলতে পারবে? জিনিসটা সিক্রেট।”

“উহ। আমি কাকে বিয়ে করব আর কাকে মার্ডার করব সেই সিক্রেট জিনিসগুলো তোকে বলতে পারব না।”

টুনি হেসে ফেলল, বলল, “না। আমি এই দুইটা সিক্রেট জিনিস জানতে চাচ্ছি না।”

“তাহলে বল।”

টুনি ফিসফিস করে বলল, “ফাক্কু স্যারের বউ আর ছেলে-মেয়ের নামগুলো আমাকে বলতে পারবে?”

শাপলা অবাক হয়ে বলল, “কী করবি?”

“আমার একটা খুবই সিক্রেট প্রজেক্ট আছে, সেটার জন্যে দরকার।”

শাপলা মুখ সুচালো করে বলল, “আমার জানা নাই। কিন্তু আমাদের ক্লাশের সব ছেলে-মেয়ে এই স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে, তারা প্রত্যেক দিন স্যারের বাসায় যায়। তারা নিশ্চয়ই জানে। শুনেছি বউটা ভালো। ছেলে-মেয়েগুলো ছোট ছোট কিন্তু দুইটাই পাজি। মেয়েটা মিচকি শয়তান আর ছেলেটা খুবই দুষ্ট। ফাক্কু স্যার ছেলেটাকে লাই দিয়ে দিয়ে মিনি সন্ত্রাসী বানিয়ে ফেলেছে।”

টুনি বলল, “আমার শুধু নামগুলো দরকার।”

“ভালো নাম, না ডাকনাম?”

“ডাকনাম বেশি দরকার।”

“ঠিক আছে, এখনই তোকে বলছি।”

টুনি ব্যস্ত হয়ে বলল, “তোমায় এখনই বলতে হবে না। এক-দুই দিন পরে হলেও হবে!”

শাপলা বলল, “আমি কোনো কাজ ফেলে রাখি না। ঝটপট করে ফেলি।”

কাজেই পাঁচ মিনিটের মাঝে শাপলা ফাক্কু স্যারের বউ-বাচ্চার নাম নিয়ে এলো। বউয়ের নাম নীলুফার, ফাক্কু স্যার শর্টকাট করে ডাকে নীলু। মেয়েটার নাম ফারজানা, ফাক্কু স্যার আদর করে ডাকে ফারু আর যখন রেগে যায় তখন ডাকে ফারজাইন্যা! ছেলেটা ছোট, নাম ফয়সল, ফাক্কু স্যার আদর করে ডাকে ফপু। শাপলার ক্লাশের যে ছেলে-মেয়েরা ফয়সলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ, তারা তাকে ডাকে ফয়জন–পয়জনের কাছাকাছি শোনায় সেই জন্যে।

টুনি কাগজে নামগুলো লিখে নিল।

.

সেই রাতেই টুনি ছোটাচ্চুর ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেল। ই-মেইল এড্রেসটা টাইপ করে সে পাসওয়ার্ডের জায়গাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সেখানে ফাক্কু স্যারের ছেলে ফয়সলের নাম লিখে সেটাকে আট অক্ষর বানানোর জন্যে শেষে ওয়ান আর টু লিখে প্রথমবার চেষ্টা করে। টুনি ধরেই নিয়েছিল এখন লেখা হবে ভুল পাসওয়ার্ড, তখন সে আরেকটা কিছু লিখবে, তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা। শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না-কিন্তু সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না, যখন দেখল পাসওয়ার্ড সঠিক আর সে ফাকু স্যারের ই-মেইলের ভেতর ঢুকে গেছে। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!! তার মানে শান্ত ভাইয়া ঠিকই বলেছে। গাধা টাইপের মানুষেরা নিজের ছেলে-মেয়েদের নাম দিয়ে পাসওয়ার্ড তৈরি করে। টুনি দেখল তার সামনে ফাক্কু স্যারের কাছে পাঠানো সবগুলো ই-মেইল। কিছু কিছু ফাক্কু স্যার খুলে দেখেছে কিছু খুলে দেখেনি। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! সে একবারে পাসওয়ার্ডটা আন্দাজ করে ফেলতে পারবে স্বপ্নেও ভাবেনি। উত্তেজনায় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হলো। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে সে ল্যাপটপের মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে। নানান জায়গা থেকে নানা ধরনের ই-মেইল এসেছে, তার মাঝে হঠাৎ করে একটা ই-মেইলে তার দৃষ্টি আটকে গেল। ই মেইলের টাইটেল, ছাপানোর জন্যে গণিতের প্রশ্ন।

যার অর্থ স্কুল যাদের কাছ থেকে প্রশ্ন ছাপিয়ে আনে তাদের কেউ একজন ফাক্কু স্যারের কাছে কোনো কারণে একটা ই-মেইল পাঠিয়েছে। ফাক্কু স্যার প্রশ্নটা খুলে দেখেছে, কাজেই আরো একবার খুলে দেখলে কোনো ক্ষতি নেই। টুনি ই-মেইলটা খুলে পড়ল, প্রশ্ন টাইপ করতে গিয়ে কোনো একটা শব্দ পড়তে পারছে না, সেটা জিজ্ঞেস করে একটা ই-মেইল পাঠিয়েছে এবং সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে টুনির মাধাঁয় ফাক্কু স্যারকে সঠিক শাস্তি দেওয়ার জন্যে চমৎকার একটা আইডিয়া হাজির হলো। আইডিয়াটা কাজ করতেও পারে আবার শেষ মুহূর্তে কচলেও যেতে পারে, কিন্তু পদ্ধতিটা খুবই নিরাপদ। যদি এবারে কাজ না করে ভবিষ্যতে আরো একবার অন্যভাবে চেষ্টা করতে পারবে, একজন মানুষের ই-মেইলের পাসওয়ার্ড জানা থাকলে অনেক কিছু করা যেতে পারে!

পরের কয়েক দিনে টুনি অনেক কষ্ট করে শান্তর স্কুলের অংক ম্যাডামের প্রশ্নটি টাইপ করে ফেলল। শান্ত আর শাপলা একই ক্লাশে পড়ে, কাজেই এই প্রশ্নটি শান্তর ক্লাশের উপযোগী হলে নিশ্চয়ই শাপলাদের ক্লাশেরও উপযোগী হবে। প্রশ্নটির শেষে সে অবশ্য একটি বাড়তি প্রশ্ন জুড়ে দিল, সব মিলিয়ে এগারোটি প্রশ্ন ছিল, তারটি হলো বারো নম্বর প্রশ্ন। তারপর টাইপ করা এই প্রশ্নটা সে যারা স্কুলের জন্যে প্রশ্ন ছাপায় তাদের কাছে পাঠিয়ে দিল। সাথে লিখে দিল–

আপনাদের যেহেতু হাতে লেখা প্রশ্ন টাইপ করতে সমস্যা হচ্ছে কাজেই আমি পুরোটা নিজেই টাইপ করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনারা যদি এর মাঝে কোনো কিছু টাইপ করে ফেলে থাকেন তাহলে সেটা ব্যবহার না করে আমার টাইপ করা প্রশ্নটি ব্যবহার করুন। এখানে কোনো ভুল থাকবে না।
সহযোগিতার জন্যে
ধন্যবাদ

টুনি নিচে ফাক্কু স্যারের আসল নাম লিখে দিল।

যদি আসল ব্যাপারটা কেউ ধরতে না পারে তাহলে শাপলাদের অংক পরীক্ষার সময় ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়বে। তাদের ক্লাশের ছেলে-মেয়েরা সবাই অংক প্রশ্নের জন্যে এক হাজার করে টাকা দিয়ে রেখেছে, সে জন্যে তারা সাজেশন হিসেবে আসল প্রশ্নটা পেয়েও গেছে। সবাই সেগুলো মুখস্থ করে এসে পরীক্ষার হলে আবিষ্কার করবে সম্পূর্ণ নতুন প্রশ্ন। তখন ফাটাফাটি একটা মজা হলেও হতে পারে।

আর যদি আসল ব্যাপারটা ধরা পড়ে যায় তাহলে কিছু করার নেই, তখন নতুন করে একেবারে গোড়া থেকে আরেকবার শুরু করতে হবে। টুনির সময়ের অভাব নেই,মাথাতে বুদ্ধিরও অভাব নেই। আগে হোক পরে হোক ফাক্কু স্যারকে সে একদিন ধরবে। ধরবেই ধরবে।

দুই সপ্তাহ পর শাপলাদের ক্লাশে অংক পরীক্ষার দিন যা একটা ঘটনা ঘটল সেটা বলার মতো না। ছাত্রছাত্রীরা সবাই একধরনের ফুরফুরে মেজাজে পরীক্ষা দিতে বসেছে, অন্যান্য পরীক্ষায় পড়াশোনা করতে হয়–এই পরীক্ষায় কী আসবে সবাই জানে তাই বেশি লেখাপড়া করতে হয় না। ফাক্কু স্যারের বাসায় সবাই পরীক্ষার প্রশ্ন কয়েকবার প্র্যাকটিসও করে এসেছে।

প্রশ্নটা হাতে পাওয়ার পর সারা ক্লাশে প্রথমে একটা গুঞ্জন শুরু হলো তারপর দেখতে দেখতে হট্টগোল শুরু হলো। যেসব স্যার আর ম্যাডাম পরীক্ষায় গার্ড দিতে এসেছে তারা অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

চুলে জেল দেয় এরকম গাট্টাগোট্টা একটা ছেলে–যে এর মাঝে শেভ করা শুরু করেছে–দাঁড়িয়ে বলল, “ভুল প্রশ্ন দিয়েছে। এই প্রশ্ন দেওয়ার কথা না!”

“ভুল প্রশ্ন? অন্য সাবজেক্টের?”

“না।”

“তাহলে অন্য ক্লাশের?”

“না।”

“তাহলে তোমরা কীভাবে জানো এটা ভুল প্রশ্ন?”

“আমরা জানি। এইটা ভুল প্রশ্ন।”

অন্য অনেকে তখন হইচই শুরু করল, টেবিলে থাবা দিতে লাগল, চিৎকার করতে লাগল। একজন মানুষ একা কখনো যে কাজটা করতে সাহস পায় না একসাথে অনেকে মিলে সেটা খুব সহজেই করে ফেলে। কাজেই সেকশানের প্রায় শ’ দেড়েক ছেলেমেয়ে হঠাৎ করে একসাথে চেঁচামেচি শুরু করল। তারা টেবিলে থাবা দিয়ে লাফাতে শুরু করল, কাগজপত্র ছুঁড়ে মারতে লাগল, একজন জানালার একটা কাঁচ ভেঙে ফেলার পর আরো অনেকে জানালার কাঁচ ভাঙতে শুরু করল। স্কুলের অন্য স্যার-ম্যাডামেরা ছুটে এলো এবং তাদের সাথে ফাক্কু স্যারও হাজির হয়ে গেল।

প্রিন্সিপাল আতঙ্কিত দৃষ্টিতে হলঘর বোঝাই চিৎকার করতে থাকা লাফাতে থাকা, জিনিসপত্র ছোঁড়াছুঁড়ি করতে থাকা, জানালার কাঁচ ভাঙতে থাকা ছেলে-মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে এখানে?”

একটু আগেই যে ছেলে-মেয়েরা শান্তশিষ্ট ছেলে-মেয়ে ছিল এখন তাদের ভিতর এড্রেনেলাইন হরমোন বের হতে শুরু করেছে, সবাই এখন ছোট ছোট একেকটি ইবলিশ। তারা প্রিন্সিপালের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চিৎকার করতে থাকল, চেঁচামেচি করতে থাকল, দাপাদাপি করতে থাকল।

প্রিন্সিপাল আর অন্যান্য স্যার দুই হাত তুলে সবাইকে থামানোর চেষ্টা করতে থাকল কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ফাক্কু স্যার একটা প্রশ্ন হাতে নিয়ে সেটার উপর চোখ বুলিয়ে চমকে উঠল। ঠিক তখন পিছন থেকে একটা ছাত্র তার প্রশ্নটা পাকিয়ে গোল করে ফাক্কু স্যারের দিকে ছুঁড়ে দিল, সেটা পুরোপুরি লক্ষ্যভেদ করতে না পারলেও অন্যেরাও কিছুক্ষণের মাঝে তাদের প্রশ্ন গোল্লা পাকিয়ে ফাক্কু স্যারের দিকে ছুঁড়তে লাগল এবং কিছু কিছু একেবারে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করতে শুরু করল। বাড়াবাড়ি রকম রেগে যাওয়া একজন তার জ্যামিতি বাক্স ছুঁড়ে মারল, তখন অন্যেরাও উৎসাহ পেয়ে তাদের জ্যামিতি বাক্স ছুঁড়ে মারতে লাগল, তখন ঝনঝন শব্দে হলঘর কেঁপে উঠতে থাকে। ছেলে-মেয়েরা একটু পরেই তাদের বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়, তারপর হলঘরের মাঝে ছোটাচ্চুটি করতে শুরু করে। স্যার-ম্যাডামেরা তখন ভয় পেয়ে এবারে ক্লাশ রুম থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ফ্যাকাসে মুখে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? ব্যাপারটা কী? ছেলে-মেয়েগুলো এভাবে ক্ষেপে গেছে কেন?”

গার্ড দিতে আসা একজন স্যার বলল, “প্রশ্নটা পেয়েই ছেলে মেয়েগুলো ক্ষেপে গেল। বলতে লাগল এটা তাদের প্রশ্ন না। এটা ভুল প্রশ্ন।”

“অন্য সাবজেক্টের প্রশ্ন?”

“না না, এটা গণিতেরই প্রশ্ন।“

“অন্য ক্লাশের প্রশ্ন?”

“না। তাদের ক্লাশেরই প্রশ্ন।”

“তাহলে তারা বুঝল কেমন করে এটা ভুল প্রশ্ন?”

“সেইটাই তো বুঝতে পারছি না।”

কাছেই ফাক্কু স্যার একটা প্রশ্ন হাতে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখ-মুখ ফ্যাকাসে। প্রশ্নটা হাতে নিয়ে একটু পর পর সেঁক গিলছে, প্রিন্সিপাল তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এদের অংক টিচার না?”

ফাক্কু স্যার দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম জিজ্ঞেস করল, “আপনি প্রশ্ন করেছেন না?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে সমস্যাটা কী?”

“এইটা আসলে আমার প্রশ্ন না।”

“আপনার প্রশ্ন না?”

“না।”

“তাহলে কার প্রশ্ন?”

“সেইটাই তো বুঝতে পারছি না।”

“কেমন করে হলো?”

“যাদেরকে প্রশ্ন ছাপাতে দিয়েছি তারা ভুল করে অন্য স্কুলের প্রশ্ন দিয়ে দিয়েছে।”

পাশে দাঁড়ানো একজন স্যার বলল, “প্রশ্নের উপর আমাদের স্কুলের নাম, ক্লাশ, পরীক্ষার তারিখ সব ঠিক আছে।”

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে ফাক্কু স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু আমার সমস্যা অন্য জায়গায়। ছাত্রছাত্রীরা কেমন করে জানল এটা ভুল প্রশ্ন! এটা অন্য প্রশ্ন?”

ফাক্কু স্যার তার মাথা চুলকাতে থাকে, কোনো উত্তর দেয় না। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সরু চোখে ফাক্কু স্যারের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “ছেলে-মেয়েরা যদি বলত প্রশ্ন কঠিন হয়েছে, বুঝতে পারছে না তাহলে একটা কথা ছিল কিন্তু তা তো বলছে না ছেলে-মেয়েরা বলছে ভুল প্রশ্ন! তার মানে একটা শুদ্ধ প্রশ্ন আছে সেই শুদ্ধ প্রশ্নটার কথা তারা কেমন করে জানল?”

ফাক্কু স্যার ডাঙায় ভোলা মাছের মতো খাবি খেতে লাগল। এবারেও কোনো উত্তর দিল না।

হলঘরের ভেতর তখন তুলকালাম কাণ্ড ঘটছে এবং বাইরে থেকে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর শব্দ শোনা যেতে লাগল। কম বয়সী একজন শিক্ষক বলল, “মনে হয় পুলিশ ডাকতে হবে।”

আরেকজন বলল, “পুলিশে হবে না। মিলিটারি ডাকতে হবে।”

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বলল, “এটা চলতে দেওয়া যাবে না। এদের থামাতে হবে।”

কমবয়সী শিক্ষক বলল, “কেমন করে থামাব? উঁচু ক্লাশের ছেলে মেয়ে, বড় হয়ে গেছে। এরা এখন রীতিমতো মব। মব খুব ভয়ঙ্কর।”

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বলল, “জানি। কিন্তু এভাবে তো উচ্ছল হতে দেওয়া যাবে না। ভিতরে ঢুকতে হবে। আসেন সবাই আমার সাথে।”

সবাই তখন আবার হলঘরে গিয়ে ঢুকল এবং তাদের দেখে ছেলে মেয়েরা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাদের চিৎকার-হইচই এবারে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম খামোখাই তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল, কোনো লাভ হলো না।

পুরো হলঘরে শুধুমাত্র শাপলা তার সিটে চুপচাপ বসে ছিল। শুধু যে বসে ছিল তা না, এই ভয়ঙ্কর হইচই-চেঁচামেচি-গোলমালের মাঝে একটা প্রশ্নের উত্তর পর্যন্ত লিখে ফেলেছে। এইবারে সে খাতা বন্ধ করে তার সিট থেকে উঠে হলঘরের প্রিন্সিপালের কাছে এসে দাঁড়াল, বলল, “ম্যাডাম আমি একটু চেষ্টা করে দেখব এদের শান্ত করা যায় কি না?”

“তুমি? পারবে?”

“চেষ্টা করে দেখি?”

“ঠিক আছে দেখো।”

শাপলা তখন লাফ দিয়ে হলঘরের সামনে রাখা টেবিলের উপর উঠে গেল, তারপর দুই হাত উপরে তুলে নাড়াতে শুরু করে।

ছেলে-মেয়েদের শান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। এবারে তারা শাপলার দিকে হাতের কাছে যা পাওয়া গেল সেটা ছুঁড়তে শুরু করল। শাপলা সাবধানে নিজেকে রক্ষা করতে করতে চেঁচাতে লাগল, “বারো নম্বর, বারো নম্বর, বারো নম্বর!”

তার চিৎকার শেষ পর্যন্ত কাজে লাগল, ছাত্রছাত্রীরা একটু শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “বারো নম্বর কী?”

“তোরা কি বারো নম্বর প্রশ্নটা দেখেছিস?”

ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্নটা হাতে পেয়েই ক্ষেপে উঠেছিল, পুরোটা পড়ে দেখার সময় পায় নাই। এবারে তারা বারো নম্বর প্রশ্নটা দেখতে চেষ্টা করল, কিন্তু তাদের কারো হাতেই প্রশ্ন নেই, সবাই প্রশ্নটা গোল্লা বানিয়ে তারা ফাক্কু স্যারের দিকে ছুঁড়ে মারতে চেষ্টা করেছিল। শাপলা বলল, “আমার কাছে প্রশ্নটা আছে। তোদের পড়ে শোনাই?”

ছাত্রছাত্রীরা এবারে পুরোপুরি শান্ত হয়ে বারো নম্বর প্রশ্নটা শোনার জন্যে শাপলার দিকে তাকিয়ে থাকে। শাপলা তখন টুনির নিজের থেকে লেখা বারো নম্বর প্রশ্নটা পড়ে শোনাতে শুরু করে। সে বলল, “এই প্রশ্নটা সোজা, তোরা সবাই এর উত্তর দিতে পারবি। প্রশ্নটা হচ্ছে এরকম : জনৈক দুর্নীতিবাজ শিক্ষক তার কাছে প্রাইভেট না পড়লে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়। ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্ন বলে দেয়ার জন্যে এই শিক্ষক প্রতি ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে এক হাজার করে টাকা নিয়েছে, ক্লাশে সর্বমোট একশ’ পঞ্চাশ জন ছাত্রছাত্রী থাকলে ফাইনাল পরীক্ষা উপলক্ষে এই দুর্নীতিবাজ শিক্ষকের কত টাকা উপার্জন হয়েছে?”

হলঘরের সব ছাত্রছাত্রী আবার একসাথে চিৎকার করে উঠল। শাপলা হাত তুলে তাদের থামানোর চেষ্টা করতে থাকে, এবারে ছাত্রছাত্রীরা বেশ সহজেই থেমে গেল। শাপলা বলল, “তোরা যদি সবাই মিলে চিৎকার করিস তাহলে কোনো লাভ হবে না। যদি স্যার ম্যাডামদের সাথে কথা বলতে চাস, একজন দাঁড়িয়ে কথা বল। একজন। সবাই না। শুধু একজন।”

মোটাসোটা একটা মেয়ে বলল, “তুই-ই বল আমাদের হয়ে।”

শাপলা বলল, “আমি অংক স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ি না, সেই জন্যে আমি কিছু জানি না। এই প্রশ্নটা তো আমার কাছে ভালোই লাগছে। বারো নম্বরটা তো মুখে মুখে করা যায়। দুর্নীতিবাজ শিক্ষকের এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা উপার্জন হয়েছে।”

হলঘরের সব ছেলে-মেয়ে একসাথে হেসে উঠল, ভয়ঙ্কর এক ধরনের হাসি, শুনলে আত্মশুকিয়ে যায়। শাপলা হাত তুলতেই আবার সবাই থেমে গেল। শাপলা বলল, “ভিতরের ব্যাপার আমি কিছু জানি না, জানলে আমি বলতাম। তোরা কেউ একজন বল।”

তখন চশমা পরা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে আমি বলব।”

শাপলা বলল, “ভেরি গুড।” তারপর টেবিল থেকে নিচে নেমে প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামকে বলল, “ম্যাডাম, আপনি এখন এদের মুখ থেকে শুনেন।”

সবাই শান্ত হয়েছে, হইচই, দাপাদাপি, চিৎকার-চেঁচামেচি থেমেছে, তাই প্রিন্সিপাল ম্যাডামের একটু সাহস ফিরে এলো। দুই পা এগিয়ে গিয়ে বলল, “বলো ছেলে কী বলবে।”

চশমা পরা ছেলেটা গলা পরিষ্কার করে বলল, “আমরা সবাই ঠিকভাবে লেখাপড়া করতে চাই। আমরা টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দিতে চাই না। প্রশ্ন মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে চাই না। কিন্তু আমাদের অংক স্যার আমাদের সেটা করতে বাধ্য করেছেন। ক্লাশের সবাইকে তার কাছে প্রাইভেট পড়তে হয়। যারা তার কাছে প্রাইভেট পড়ে না, স্যার তাদেরকে ফেল করিয়ে দেন। আমাদের ক্লাশে শুধু শাপলা অংক স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে না–শুধু শাপলার সাহস আছে আমাদের নাই। আমাদের আব্দু-আম্মুরা ভয় পায়। প্রাইভেট পড়ে না বলে শাপলার কত যন্ত্রণা হয় আপনারা সেইটা জানেন না। ক্লাশে স্যার সব সময় শাপলাকে অপমান করেন, শাস্তি দেন। শাপলা আমাদের ক্লাশে সবচেয়ে ভালো গণিত জানে, গণিত অলিম্পিয়াডে মেডেল পায়–ক্লাশের পরীক্ষায় স্যার সব সময় তাকে গোল্লা দেন। শাপলা সেটা সহ্য করে। কাউকে কিছু বলে না।”

ছেলেটা একটু দম নিয়ে বলল, “প্রত্যেক পরীক্ষার আগে স্যারকে সাজেশনের জন্যে টাকা দিতে হয়। নামে সাজেশন, আসলে স্যার পুরো প্রশ্নটা বলে দেন। আমরা সেই প্রশ্ন মুখস্থ করে পরীক্ষা দেই। পরীক্ষায় সবাই এ প্লাস পাই। কেউ কোনো গণিত শিখি না।

“এইবারও ফাইনাল পরীক্ষার আগে স্যার সবার কাছে এক হাজার করে টাকা চেয়েছেন, আমরা টাকা দিয়েছি। যাদের টাকা-পয়সার টানাটানি তাদের আব্দু-আম্মু ধার-কর্জ করে টাকা দিয়েছে। সেই টাকা নিয়ে স্যার অংক পরীক্ষার সাজেশন দিয়েছেন। আমরা সবাই সেই সাজেশন মুখস্থ করে এসেছি। এসে দেখি অন্য প্রশ্ন! সেটা দেখে সবার মাথা গরম হয়ে গেছে।”

হলঘরের অন্যান্যরাও তখন একসাথে কথা বলতে শুরু করল, আগের মতো হইচই করে নয়, শান্তভাবে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তখন হাত তুলে তাদের শান্ত করে একজন একজন করে সবার কথা শুনল। সবার বক্তব্য মোটামুটি একরকম। কথা বলতে বলতে কয়েকজনের গলা ভেঙে গেল। কয়েকজন হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল, তারপর হলঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি দেখছি কী করা যায়। তোমরা আজকে বাসায় যাও। আজকের পরীক্ষাটা অন্য একদিন নেওয়া হবে।”

ছাত্রছাত্রীরা বের হবার সময় লক্ষ করল, টেলিভিশনের ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিকেরা চলে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি তারা কেমন করে খবর পেল?

.

এক সপ্তাহ পর দেখা গেল স্কুলের কোনায় গাছের ছায়ায় ঢাকা সিঁড়িতে শাপলা আর টুনি বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে। আজকাল টুনিও শাপলার মতো কায়দা করে সিগারেট খাওয়া শিখে গেছে। সিগারেট খেতে খেতে দুইজন হেসে কুটি কুটি হচ্ছে, শাপলা টুনির পিঠে থাবা দিয়ে বলল, বুঝলি টুনি, তোকে একটা গোল্ড মেডেল দিব ঠিক

করেছি। চব্বিশ ক্যারটের খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি দশ ভরি সোনার মেডেল।”

টুনি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, “কখন দিবে শাপলা আপু?”

“এখনই দিব। সাথে নিয়ে এসেছি।যে ফাক্কু স্যারকে স্কুল থেকে বিদায় করতে পারে তাকে এর চাইতে বড় মেডেল দেওয়া দরকার।”

টুনি বলল, “দশ ভরি মেডেল, অনেক বড়। এর চাইতে বড় দরকার নেই শাপলা আপু।”

“ঠিক আছে।” বলে শাপলা তার পকেট থেকে চব্বিশ ক্যারটের দশ ভরি ওজনের সোনার মেডেলটা বের করে টুনির গলায় পরিয়ে দিল। টুনি মেডেলটা দেখে একেবারে হতবাক হয়ে গেল।

সিগারেটের মতো মেডেলটাও মিছিমিছি–তাতে কী আছে? আনন্দটা তো মিছিমিছি নয়। আনন্দটা একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট খাঁটি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *