৫. গ্রীষ্মের প্রচণ্ডতা

শালঘেরিতে গ্রীষ্মের প্রচণ্ডতা দেখা দিল। সূর্যোদয় হতে না হতেই যেন জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো মাটি তেতে ওঠে। ঘরের বাইরে এক মুহূর্ত চোখ রাখা যায় না। দৃষ্টি ঝলসে যায়। চারদিক সাদা আগুনের শিখা কাঁপতে থাকে, সাপের মতো ফণা তুলে দোলে। শালঘেরির কাঁকুরে পাথুরে রক্তাক্ত মাটি জ্বলন্ত উনুনের মতো গনগন করে। তার সঙ্গে লু। এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত ঝলসে দিয়ে যায়। মানুষ পশু পাখি পতঙ্গ সকলেই ছায়ান্ধকার খুঁজে ফেরে।

এ সময়ে শ্রমজীবী মেয়েপুরুষেরা তাড়ি আর আমানির সহায় নেয়। আমাদের এখন প্রায় প্রতি দিনই ঠাণ্ডা কড়ায়ের ডাল, আলু-পোস্ত, পোস্তর বড়া আর পুরনো তেঁতুলের অম্বল। আর কিছু ভালও লাগে না।

গ্রীষ্মের এই রুদ্র দাহের পর এল বর্ষা। গাছগুলি কৃষ্ণ সবুজ হয়ে চিকচিক করতে লাগল। মাটি গাঢ় লাল, কিন্তু স্নিগ্ধ দেখাল। তারপর দুরে শাল বনের দিকে তাকিয়ে, একদিন শরতের আবির্ভাব দেখতে পেলাম।

এই যে দিনগুলি যায়, এই দিনগুলিকে কাজহীন জীবনে দীর্ঘতর মনে হওয়াই তো উচিত ছিল। কিন্তু অস্বীকার করি কেমন করে, তা মনে হয় না। বিচারের অবসর পেলাম না, যাচাইয়ের উৎসাহ পেলাম না, কী একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে দিন কেটে যায়। কিংবা সেই অবসর আর উৎসাহকেই ভয় পেয়েছি, সরিয়ে রেখেছি দু হাত দিয়ে। একটা স্বপ্নের মধ্যে যেন নিবিড় নিবিড়তর হয়ে ডুবে যাচ্ছি।

একদা ছিল পুব পাড়ার হাতছানি। এখন দক্ষিণ। কিন্তু একটু কি চোখ চেয়ে দেখি নে, সকল ব্যাপ্তি কত জটিল বেড়ায় আমাকে ঘিরে ফেলেছে?

এদিকে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। সিন্ধু উপত্যকার অভিজ্ঞ কর্মী প্রত্ন ও নৃ-জ্ঞানী গোবিন্দ সিংহ চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তামাইয়ের মাটির অন্তরহস্য জানবার আগে আমি যেন আরও অনুসন্ধান করে নিশ্চিন্ত হই। মাটি খোঁড়ার কাজটা যখন খুশিই শুরু করা যায়। তার আগে জানা দরকার, হিসেবে কোথাও ভুল হচ্ছে কি না। আমি আরও নিদর্শন সংগ্রহের চেষ্টায় আছি। গোবিন্দবাবুর সাহচর্য নিয়ে প্রথম মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু করব। ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের জন্য গভর্নমেন্টের কাছ থেকে একটি লাইসেন্স গ্রহণ করতে হয়। গোবিন্দবাবুই তা আমাকে সংগ্রহ করে দেবেন।

মাঝে মাঝে বিজনে যাই। অর্থাৎ আমাদের শালঘেরির স্টেশনমাস্টার বিজন ঘোষের ওখানে। উনি বলেছিলেন, সময় পেলে বিজনে আসবেন মাঝে মাঝে। আমি আর ভবেন, দুজনেই যাই।

মিথ্যে নয় সত্যি সেটা ঘোর বিজন। সেই বিজনে আলো আছে, বাতাস আছে। আকাশে অনেক রং। কিন্তু ভদ্রলোকের রুদ্ধ কক্ষে কোথায় একটি কষে বাঁধা তারে টং টং করে একটি সচকিত আর্ত সুর বেজে ওঠে মাঝে মাঝে টের পাইনে।

বাড়ি খাস কলকাতাতেই। এখানে নাকি পালিয়ে এসেছেন। এবং পালিয়ে এসে বেঁচেছেন। এখান থেকে আর কোথাও যেতে চান না। এই নাকি ভাল। ভোরে পাখিরা যায়। সন্ধ্যায় পাখিরা ফিরে আসে। গাড়ি যায়, গাড়ি আসে। উনি নিশান দেখিয়ে খালাস।

তবে এই অদৃশ্য রুদ্ধ কক্ষে তারটাকে কে আঙুল দিয়ে টং টং করে? করুক। উনি কি খোঁজ রাখেন? এই নিরালায় আছেন বেশ। তবে মাঝে মধ্যে কেউ এলে একটু পরীক্ষা করে নিতে পারেন যে একেবারে বোবা হয়ে যাননি।

ভবেনের খুবই ভাল লেগেছে ভদ্রলোককে। আগে তো যেত সে। আমার বলতে ইচ্ছে করছিল, বিজনে আছেন বিজনবাবু। সে কথাটা এক বারও ভুলতে পারছেন না। একটু স্বজনে গিয়ে বরং ভুলে থাকুন বেঁচে যেতে পারেন।

আর বিজনবাবুর সবচেয়ে বড় অভিযোগ বচনের ওপর। বলেন, মশাই, ওই লোকটা আমাকে এখান থেকে ভাগিয়ে ছাড়বে। জানেন, লোকটা বদ্ধ মাতাল। আর আমাকে খালি বলে, বাবু, বেথা যদি না করে থাকেন, গিয়ে করে ফেলুন তাড়াতাড়ি। আপনার ব্যাপার খুব সুবিধার বুঝছি না। কত বড় সাহস দেখুন দিখি?

আমি হাসি চাপতে পারিনি। এ হেন বাণী নিতান্ত বচনের না হয়ে যায় না। ওর কথার মধ্যে একটা সত্য যেন কৌতুকের বেশে মিশে থাকে। বিজনবাবু বলেছেন, আবার কী বলে লোকটা জানেন? বলে, বাবু, কাউকে যদি ঠিক করে থাকেন বেকরবেন বলে, তালে দেরি করবেন না। মেয়েমানুষের মন, এ বেলা হ্যাঁ, ওবেলা না। জোর করে ধরে নিয়ে আসবেন।কত বড় পাজি বলুন তো।

ভবেন আর আমি দুজনেই মুখোমুখি হেসে উঠেছি হা হা করে দেখে বিজনবাবুই কেমন যেন অবাক হয়ে যান। তবু ভবেনের আর আমার হাসিটা থামতে অনেক সময় লাগে। তারপরে সন্দেহ হয়, আমরা বোধ হয় হাসি না।

বিজনবাবুর স্টেশনমাস্টারের গলাবন্ধ কোটের পকেট থেকে প্রায়ই সিলার-শেলি, গ্যেটে বায়রন ইয়েটস এলিঅটের কবিতার বই বেরিয়ে পড়ে। বলেন, যদি কিছু মনে না করেন, তবে একটু আবৃত্তি করি।

আমরা সানন্দে সম্মতি দিই। বিজনবাবু কবিতা পড়েন। ওঁর গলাটি সুন্দর, উচ্চারণ ততোধিক। আবৃত্তির সময় ওঁর বাহ্যজ্ঞান থাকে না। গলার স্বর আশ্চর্য ছন্দে ওঠা নামা করে, কাঁপে কখনও। কখনও হাসেন, চোখের কোণে বড় বড় ফোঁটায় জল জমে ওঠে। আমি আর ভবেন মুখোমুখি, চোখে চোখে চেয়ে থাকি। হাসতে যাই, হাসতে পারি নে। একটা বিস্মিত জিজ্ঞাসা দুজনের চোখে চিকচিক করতে থাকে। কখন যেন, চোখে আমাদেরও জল দেখা দেয়। এক সময়ে কবিতা পড়া শেষ হয়ে যায়। কিন্তু স্তব্ধতা ভাঙে না। তিনজনেই নীরব হয়ে বসে থাকি।

এই নীরবতার মধ্যে অনুভব করি, আমাদের সঙ্গে বিজনবাবুর একটা নিবিড় সম্পর্কে দাঁড়িয়ে গেছে। এবং এমনি নীরব নিবিড়তার মধ্যেই একদিন ধ্বনিত হল, এই দুর নির্জনে নির্বাসনের, ছোট সাধারণ একটি কাহিনী। একজনকে ভুলে থাকার সহজ কাহিনী। অসহজ শুধু এই, বিজনবাবুর মনে হয়, এই বিশাল নির্জনতাটাও সেই ভুলে থাকতে চাওয়ার মানুষটিতেই পরিপূর্ণ। এমনটা নাকি হত না। একদা যার সঙ্গে মনের মানুষ পাতিয়েছিলেন, সে দেহ নিয়ে অন্য কোথা ছুটেছিল। তারপরে হঠাৎ সে সংবাদ দিয়েছিল, ভুল হয়েছে, ভয়ংকর ভুল। ফিরে যাবার পথ কি আছে?

না। পথ ছিল না। নেই এখনও। তাই নিজেকেই নির্বাসন খুঁজে নিতে হল।

সে দিন আমি আর ভবেন চোখাচোখি করে, হঠাৎ হেসে ফেললাম। বিজনবাবু অবাক হলেন, তাকিয়ে রইলেন কিন্তু কিছু বললেন না।

কেবল বচন মাহাতত তার কালো কুচকুচে নতুন যুবতী সঙ্গিনীটির কাঁধে হাত রেখে, দুর থেকে তাকিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, অই, ইস্টিশনটা পাগলা গারদ হয়ে উঠলে গ।

গড়াইতে মহাদেববাবুর ওখানে ইচ্ছে করলেও যাইনি। ওঁর ব্যাপার যা শুনেছি, সেটাও ভাল লাগেনি। আর, অনিরুদ্ধ যে নেই।

.

আমার বুকের মধ্যে একটা দুরু দুরু শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। সে যে কীসের সংকেত, কার আগমনের অগ্রিম বার্তা জানাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারিনে। কেবল এইটুকু বুঝি, আমার অয়ন চলন একটা কক্ষপথে নির্ধারিত। আর ঝিনুক যেন একটা কেন্দ্রে বসে, সেই কক্ষের গতি নির্দেশ করছে।

পুবপাড়ার সেই ফুলটি যেন এতদিনে তার সব দল মেলেছে। এসে যে রূপ দেখেছিলাম ঝিনুকের, এখন তার চেয়ে আরও বেশি রূপ যেন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে সর্বাঙ্গে। যেন নতুন করে খোলস ছেড়েছে সে। কেন এমন হয়, তা বুঝিনে।

এই আমার শালঘেরি ফিরে আসা। মহাকালের যে ধ্বনি বিরতিতে শোনা যেত, সে এখন অষ্টপ্রহর বাজে আমার কানে। প্রত্যহের যে রাগিণী ছন্দ ও আবেগের সঞ্চারে আমার শালঘেরির জীবনকে হাসাবে কাঁদাবে ভেবেছিলাম, সে রাগিণী বাজল না। মহাকালের গুরু গুরু ধ্বনি আমাকে প্রতিনিয়ত জটিল ও রূঢ় চেতনার সীমায় রাখলে দাঁড় করিয়ে। তারই পায়ের চিহ্ন হাতের বেষ্টনীকে আমি দেখতে পেলাম ঝিনুকের হাতে পায়ে, শালঘেরির আকাশ মাটি ঘিরে।

ভবেনের সংসারে আমি প্রত্যহের তৃতীয় ব্যক্তি। ভবেন বলে, ভুল বলছিস টোপন। শুরু থেকে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে আমি আছি। শুধুমাত্র সময়ের কুটিল চালে একটা অনিয়ম ঘটে গেছে।

এমন সহজ উক্তিতে আমি থমকে যাই। মেনে নিতে পারিনে। অথচ প্রতিবাদ করার মতো কথা মেলে না। তর্ক বৃথা। কারণ, মনে হয় বিচারের অবকাশ রাখেনি ঝিনুক।

ভবেনের বাগানে ফুল ফোটেনি। যদি এমন বলতে পারতাম, কার বাগানে বা ফুটেছে? আমার বাগান নেই। ঝিনুকের বাগানেও কি সে ফুল ফোঁটাতে পেরেছে?

কিন্তু এমন বলা, ভাবা, সবটাই অবান্তর। সংসারে এমন একটি অনিয়মের ব্যাপার কারুর মনঃপূত নয়। কিন্তু সংসার কবে কার মনের মতো হয়েছে?

কালের মতো সংসার নিরবধি। তার সামাজিক আবর্তে আমরা ঘুরছি। সেইখানে আমরা চিত্রিত। বিচিত্রের এ কারসাজি সেখানে লক্ষ্যণীয় নয়।

তাই তামাইয়ের ধারে দাঁড়িয়ে যখন ওপারের শালবনের দিকে তাকাই, তখনও অকৃতজ্ঞ হয়ে মুখ ভার করে থাকিনে। আমার নিজেরই রক্ত দিয়ে গড়া জীবনদেবতাকে নমস্কার করি। কারণ, জীবন বয়ে চলবে। তার সঙ্গে অন্তস্রোতের এ আবর্তও থামবে না।

তবু, তবু ভয়ংকর অস্থিরতা চেপে ধরছে অতি মন্থরে, ক্রমেই যেন একটা ফাঁস শক্ত হয়ে উঠছে। আমি যেন ভবেনের মুখের দিকে তাকাতে পারিনে। নিজের ওপর ক্রুদ্ধ বিরক্ত হয়ে উঠি। অথচ তাতে আমার পথের নির্দেশ বদলায় না।

ঝিনুক এখন মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতেও আসে। পিসিকে সে খুশি করার চেষ্টা করে। কিন্তু পিসি খুশি হবেন না। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, কুসুমের ওপর ঝিনুক খুব সদয় নয়। কারণ, কুসুমের সঙ্গে সে খুব কম কথা বলে। লোকের সঙ্গে ব্যবহারে ঝিনুক কখনও খারাপ নয়। কিন্তু হরলালকাকার ওপর খুবই বিরক্ত। সংসারটাকে তিনি নষ্ট করেছেন বলেই হয়তো।

কিন্তু ঝিনুক যখন কুসুমকে তার পুজোপাট উপোস নিয়ে গম্ভীরভাবে বিদ্রূপ করে, তখন আমি অবাক হই, অস্বস্তিবোধ করি। বিশেষ করে পিসির সামনে তা একেবারে অনুচিত। তাতে পিসি ঝিনুকের ওপর আরও বেশি রুষ্টই হন।

কুসুমের প্রতিবাদ করার সাহস নেই। বরং দেখি, ঝিনুকের সামনে কুসুম যেন বড় বেশি গুটিয়ে যায়। ঝিনুকের সামনে থেকে সরে থাকতে চায়। যেন ঝিনুককে ও ভয় পায়। এতে ঝিনুকের দায়িত্বও বেশি। সে কি একটু স্নেহ করে, সহৃদয়ভাবে কথা বলতে পারে না? কিন্তু আমি ঝিনুককে এ বিষয়ে শেখাব, তা সম্ভব নয়। কারণ, ঝিনুক অচেতন নয়।

ঝিনুক এসে বলে, কী রে কুসি, পাকা বুড়ি, তোর ডেঙা শিবের মতিগতি কেমন?

কুসুম মুখ নিচু করে থাকে। কোনও জবাব দেয় না। কথাগুলি নিতান্তই ঠাট্টার, ঝিনুক বলতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে যদি হুলের খোঁচা থাকে তা হলে অস্বস্তি না হয়ে যায় না। তখন হয়তো পিসি ডেকে বলে ওঠেন, কুসি, সলতে পাকাবার ন্যাকড়া কোথায় আছে, একটু দেখে দে তো।

বুঝতে পারি, পিসি ইচ্ছে করেই কুসুমকে ডেকে সরিয়ে নিয়ে যান। ঝিনুক এলে, অধিকাংশ দিন বিকেলেই আসে। বাহন হিসেবে ইন্দির আসে। সে পিসির সঙ্গে বকবক করে। কুসুমকে আরবি ঘোড়ার গল্প শোনায়। যদিও আরবি ঘোড়া সে কখনও দেখেছে কি না সন্দেহ। কিন্তু সে যে একদা ঘোষালদের গাড়ি চালাত, এই অধিকারে, স্বচক্ষে পক্ষীরাজ দেখার কথাও বলতে পারে। কোথায় দেখেছে সে আরবি ঘোড়া? আঃ! হরোঠাকুরের বিটি কী বোকা গ! ক্যানে, বরিশের জমিদার মুখুজ্জে মশায়দের বাড়িতেই তো আরবি ঘোড়া ছিল। পেকাণ্ড ঘোড়া, দু মানুষ সমান উঁচা, আর সি জীবের কী বা গড়ন, কী বা বরণ! চকচকে সোনার মতন রং, উদিকে ল্যাজে ঝাপটা মারলেন ত গটা শরীলে ঢেউ খেলে গেল।

তবে মুশকিল এই, ঘোড়াটি বুনো, বদ ভারী বেয়াদপ ছিল। ইন্দিরকেই তো মুখুজ্জেরা ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন আরবিকে বাগ মানাতে। ঘোড়া আজ একে লাথি মারে, কাল ওকে চাট মারে, পিঠে কেউ চাপতে গেলে জগঝম্প নাচ।

কিন্তু ইন্দিরের কাছে ও সব চালাকি করলে চলবে না। তুমি ঘোড়া, আমি মানুষ। তোমার পিঠে আমি সওয়ার হবই। তা সে তুমি যত বেয়াদপিই করো। ইন্দির বলে আমি আমার মনিবের হুকুম নিয়ে গেলাম। নিজের হাতে আচ্ছা করে বেটাকে খাওয়ালাম। গা হাত পা ডলে মেজে দিলাম। কিন্তুক চখের লজরটি সুবিধের দেখলাম নাই। ত, পেথমে খুব চেঁচিয়ে হেঁকে গালাগাল দিলাম, শালো, বানচত, ইঁদুরের বাচ্চা! শালো, আরবি না খচ্চর তুই! লজ্জা নাই রে তোর, পাপের ফলে ঘোড়া হয়ে জন্মিছিস। তোর চাইতে একটা কুত্তাও ভাল, সেও কথা শোনে। আর এত বড় শরীলটা তোর, ঘোড়া বলে কথা, তুই চখ পাকাচ্ছিস?

লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চেঁচিয়ে কুঁদে এমন বললাম, আরবি কান খাড়া করে, ভয় ভয় চখে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি আস্তে আস্তে কাছে গেলাম, মাথাটা নামিয়ে নিয়ে এসে, কানে কানে একটা মন্তর দিলাম। সে মন্তর কাউকে বলতে নাই। দেখলাম, সমীহের ভাব এসেছে। তা পরে গদি এঁটে রেকাব পরালাম, লাগাম বাঁধলাম। আপত্তি করলে না। হাতে চাবুক নিয়ে লাফ দিয়ে উঠলাম। পেথমটা শান্ত কিন্তুক শালো লড়বে না। পা দিয়ে পেটে গুতা মারলাম। পেছুকার দু পা দিয়ে লাফিয়ে উঠল। সামনের দিকে হড়কে পড়েই যেতাম। তার আগেই লাগামে জোরে টান, আর চিহাঁ হাঁ হাঁ ডাক। ডাক দিয়েই দে ছুট। সি মানে তুমার, গুলতির গুলির মতন ছুটলে। দুটো কাঁদর লাফিয়ে পার। বাবুদের সব লোক, বরিশের তাবৎ মানুষ হায় হায় করতে লাগল, আমার মরণ আর ঠেকাবে কে। কিন্তু আমি ইন্দির সহিস। তুমাকে দিয়ে আমি গাড়ি টানাই, আর এখন ত ঘাড়ে চেপে আছি। ফ্যাল দিকি নীচে। লাগাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাইরে নিয়ে গেলাম। সি কী দৌড়। আরবির পা নাকি দেখা যাচ্ছিল নাই। মাঠ মাটি পাথর, কিছু বাকি রাখে নাই। আমি গায়ের চামটির মতন পিঠে চেপে রইলাম। তাপর ঝাড়া তিন ঘণ্টা দৌড়ে লাফিয়ে বাছাধনের হাঁপ ধরল, শান্ত হল। কিন্তুক আমি ছাড়বার পাত্তর নই, এই সুযোগ। দোষ করেছ, শাস্তি লাও। একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে খুব চাবকালাম। আবার গালাগাল দিলাম। পিঠে চেপে ফিরে এলাম, আস্তাবলে। ছিমান তখন ঠাণ্ডা মেরে গেছে। কিন্তুক তাড়াতাড়ি নিজের হাতে আবার খেতে দিলাম, গা ডলে ঘষে খুব আরাম দিলাম। সাত দিন! বুঝলে গ দিদি, সাত দিনে আরবি মানুষ হয়ে গেল।

এমনি নানান গল্প সে কুসুমকে শোনায়। কুসুম বড় বড় চোখে হা করে শোনে। আমার সামনে অবশ্য ইন্দির গল্প বলার তেমন উৎসাহ পায় না। বুঝতে পারি, তার মন আর আবেগ দিয়ে আমাকে যেমনটি দেখতে চেয়েছিল, তেমন আমি নই। আমি তার অপছন্দের তালিকায় স্থান পেয়েছি।

গল্প বলার জন্য কুসুমকে বা পিসিকে না পেলে ঝিনুকের অনুমতি নিয়ে ইস্টিশনের পাকা রাস্তায় একটু পাক দিয়ে আসে। ঝিনুক সরাসরি আমার ঘরে চলে আসে। নিজের কাছে অস্বীকার করতে পারিনে, আমি অস্বস্তিবোধ করতে থাকি। সারা বাড়ির মধ্যেই একটা অস্বস্তি ঘিরে আসে।

ঝিনুক নিশ্চয় তা বোঝে। কিন্তু মেনে নিতে চায় না। আমি বলি, তুমি আবার এলে কেন। আমিই তো যেতাম। ঝিনুক বলে, মাঝে মাঝে ফাঁক দাও বলেই, ভয় পাই, আজ বুঝি এলে না। তাই আগে আগে চলে এলাম।

এমনি করে বললে কোনও কথা বলতে পারিনে। শুধু ঝিনুকের চোখের দিকে তাকাই। সেখানে উপহাস বিদ্রুপের কোনও চিহ্নই নেই। বরং ঝিনুকের সেই চোখের দিকে তাকিয়ে, আমার বুকের মধ্যে যেন একটা তীর বেঁধা পাখি পাখা ঝাপটাতে থাকে। চোখ ফিরিয়ে নিই। আবেগ ও যাতনার সংঘর্ষে, কথা আসে না মুখে।

ঝিনুক কিন্তু রেহাই দেয় না। বলে, মুখ ফিরিয়ে নাও যে? আমি তাড়াতাড়ি বলি, ভবেন ইস্কুল থেকে বাড়ি এসেছে?

ঝিনুক বলে, না। আনিদিকে বলে এসেছি। খবর পেয়ে সেও এখানেই চলে আসবে।

তাই আসে ভবেন। ঝিনুক এলে অধিকাংশ দিন ভবেনও আসে। রাত্রে আমরা তিন জনে একসঙ্গে ফিরে যাই।

ঝিনুক কথার খেই হারায় না। বলে, কিন্তু এ কথা কেন বলো? আমি কি তোমার বাড়িতে আসব না?

ঝিনুক তোমার বাড়ি বলে, তোমাদের বাড়ি বলে না। আমি বলি, তা কেন? তুমি আবার এলে কষ্ট করে।

-কষ্ট?

ঝিনুক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে যেন। তারপর অন্যমনস্কের মতোই আপন মনে বলে, কষ্ট!ক বছর তো কোথাও বেরুইনি। তখন যে জোর করে বেরোইনি তা নয়। সেটাও যেমন ইচ্ছে করে নয়, এটাও তেমনি ইচ্ছে করে নয়। সব আপনি আপনি হয়ে যায়। এর মধ্যে কষ্ট আছে কি না আমি জানি না। কিন্তু তুমি তো সে জন্যে বলনি।

আমি ফিরে তাকাই।

— ঝিনুক আবার বলে, তুমি বলো পিসির জন্যে, পাড়ার লোকের জন্যে। তোমার অস্বস্তি হয়। আমার অস্বস্তি হয় না, আমার এ সব মনে হয় না। তোমার যে অস্বস্তি হয়, এও আমার সয় না। সংসারে সকলের জীবন কি এক রকম হয়? হয় না। তবে আর সকলের কথা ভাবি কেন? কারু কথা ভাবব না। তুমি যদি বারণ করো, আলাদা কথা।

বলে আমার চোখের দিকে তাকায়। যেন আমার ভিতর অবধি দেখে নিতে চায়। আমি মনে মনে বলি, সকল বারণের পথ আগলে রেখে, এ কথা বললে, আমি কি তার জবাব দিতে পারি? জানি, ঝিনুক বারণ বলে কিছু রাখতে রাজি নয়। আমার সব কথা তো সেখানেই ফুরায়। আমার সব প্রশ্নের সেখানেই অবসান।

তবু সেই যে আমার বুকের মধ্যে দুরু দুরু গুরু গুরু ধ্বনি, তাতে যেন অজস্র বারণের সংকেত আমাকে ইশারা করে। অনেক বারণ, অনেক বারণ। অথচ সে বারণ আমার মতোই অসহায়।

এ সব কথা প্রথম প্রথম হত, এখন আর হয় না। এখন ঝিনুকের আসাটা সকল কথার ঊর্ধ্বে চলে গেছে। কিন্তু ঝিনুক সাঁঝবেলায় এসে যখন, কুসুমের হাত থেকে রান্নার দায়িত্বটা নিয়ে, হেঁসেলে পড়ে বসে, তখন পিসির কাষ্ঠ হাসি দেখে আমিও বিব্রত হয়ে পড়ি। পিসি বলেন, আ হা হা, তাই কি হয়, তুমি এ বাড়িতে এসে রান্নার খেসমত খাটবে।

কথার সুরে পিসির অনিচ্ছাটাই ফোটে। কিন্তু ঝিনুক এত সহজে সব চালিয়ে যায়, কিছু বলা যায় না আর। বলে, শুধু বসে গল্প করব তার চেয়ে টোপনদার রান্নাটা করে দিয়ে যাই।

আমি তাড়াতাড়ি হেসে বলি, তা হলে ভবেন আর তুমিও এখানেই খেয়ে যেয়ো, সেই ভাবে বেঁধে। আমি বরং আনিদিকে বলে আসি। ভবেনকেও ডেকে নিয়ে আসি।

ঝিনুক খুব সহজভাবেই বলে, যাবে আর আসবে, একটুও দেরি করতে পারবে না।

এ রকম নির্দেশে যে পিসির আপত্তি আছে, বুঝতে পারি, যখন তিনি বলেন, ওরে, ওরা পুরুষ মানুষ, ওদের কি ওভাবে বলা যায়, না, ওরা তা শোনে?

ঝিনুক অন্য দিকে মুখ রেখে শুধু বলে, শুনতে হবে পিসি।

পিসি নীরব হয়ে যান, আমি বেরিয়ে যাই। কিন্তু রান্নার দায়িত্ব থেকে যাকে মুক্তি দেওয়া হয়, সেই কুসুমের অবস্থা অবর্ণনীয়। এ রকম ক্ষেত্রে, প্রথম দু-একবার পিসিকে বলে কুসুম তৎক্ষণাৎ বাড়ি চলে গেছে। আমি না জেনে যখন খোঁজ-খবর করেছি, তখন পিসি জানিয়েছেন, কুসুম তো নেই, ওর মার কাছে গেছে। আজ রাত্রে একেবারে খেয়ে দেয়ে শুতে আসবে।  

আমি অবাক হয়ে বলেছি, তাই নাকি? কখন গেল, আমাকে কিছু বলেনি তো।

 পিসি জবাব দিয়েছেন, আমাকে বলে গেছে। তুই ব্যস্ত ছিলি তাই তোকে আর বলে যেতে পারেনি।

সত্যি ব্যস্ত ছিলাম কি না, ভেবে নিজেই থমকে যাই। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। পরে কুসুমকে জিজ্ঞেস করেও এক রকমই জবাব পেয়েছি, ঝিনুকদি রাঁধবে দেখে ভাবলাম, আজ মার কাছে। চলে যাই।

আমি এক মুহূর্ত কুসুমের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করেছি, রাগ করেছিস নাকি?

অমনি কুসুমের মুখ নত হয়েছে। নিঃশব্দে ঘাড় নেড়েছে, ও রাগ করেনি। পরে বুঝেছি, রাগ নয়, কুসুমের কষ্ট হয়। ঝিনুকদি রাঁধে বলে নয়, ওর কোনও সাহায্যেরও প্রয়োজন হয় না। ঝিনুক ওকে একেবারে রান্নাঘর ছাড়া করে দেয়। যেখানে ওরই পরিপূর্ণ অধিকার, সেখান থেকে মাঝে মাঝে বিনা নোটিশে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ মেনে নিতে পারে না। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া যে কুসুমের কাছে মর্মান্তিক, তা বুঝতে পারলাম, এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করে ওকে কাঁদতে দেখে। কিন্তু এ কান্নার কোনও যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাইনে। এমন একটা তুচ্ছ ব্যাপার, এক ফোঁটা মেয়ে কাঁদে কেন? আমার বিরক্ত হওয়া দেখে, কুসুম আর কাঁদেনি। বাড়িতে ওর মায়ের কাছে পালিয়েও যায় না। লক্ষ্মী মেয়ের মতো বই নিয়ে পড়তে বসে। তাতে আমি খুশি হতে চেয়েছি, কিন্তু স্বস্তি বোধ করি না।

ক্রমে দেখছি, ঝিনুককে কুসুম সত্যি ভয় পেতে আরম্ভ করেছে। সেই ভয়ের মধ্যে যেন একটা সম্মোহনের ভাব। ভয় পায় অথচ অবহেলা করতে পারে না।

একদিন ভবেন বলল, কুসুমের এ ভয় পাওয়াটা ভাল নয়।

-কেন?

–ভয় যদি কোনওদিন ভাঙে, সেটা বড় দুর্দিন হবে।

 আমি বিশ্বাস করিনে। কিংবা বলা চলে, কুসুমের ভয়ের ততোধিক মূল্য দিতে চাইনে।

ঝিনুকের আসার চেয়ে, তবু আমার যাওয়াটাই বেশি।

নিজের কাছে অস্বীকার করে লাভ নেই, ঝিনুকের কাছে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নিজের মনেই এত বাধার কাঁটা-তারের জটলা যে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মরি। এ আসলে আমার সেই, শালঘেরির ধুলো ছিটিয়ে না হাসতে পারা। বনের আড়ালে গিয়ে না কাঁদতে পারা।

আমাকে ঘিরে জমে উঠছে নানান দেশি বিদেশি প্রত্নতত্ত্বের বই। সম্প্রতি সাঁওতাল পাড়ার করিক টুডু জুটেছে। তামাইয়ের ধারে ও আশেপাশে প্রাচীন বস্তুর সন্ধানে, সে আমার সঙ্গে থাকে। তাকে নিয়েই ঘোরাফেরা করি। কিন্তু ঝিনুক আমার পড়া ও কাজকে যেন তেমন আমল দিতে চায় না। ইন্দিরকে দিয়ে যখন তখন ডেকে পাঠায়। ইন্দিরের ওপর এমন নির্দেশও থাকে, বাড়িতে না পেলে, যেখান থেকে তোক খুঁজে সংবাদ দিতে হবে। বুঝতে পারি, ইন্দিরের কাছে এ কাজটা মোটেই পছন্দসই নয় বরং আপত্তিকর?

ঝিনুককে গিয়ে রুষ্ট হয়েই বলি, এরকম যখন-তখন ডেকে পাঠাও কেন?

 ঝিনুক চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখা যায়।

 বলে, আমি ডাকি আমার দায়ে, তোমার যদি ইচ্ছে না হয় এসো না।

আমি তখন বলি, কথা বললেই তো দেখছি রাগ করো।

সত্যি কথায় রাগারাগি কী আছে?

তারপরে আমাকে চুপ করতে হয়।

 ঝিনুক হয়তো বলে, একটু চা করে দেব?

কিংবা বলে, কাজের মানুষ হয়েছ, কাজ করো না এখানে বসে বসে।

যদি বলি, এখন তামাইয়ের ধারে যাব, কাজ আছে।

ঝিনুক বলে, নিয়ে যাবে সঙ্গে?

ঝিনুকের চোখের দিকে তখন তাকিয়ে দেখেছি, সেখানে কোনও মিথ্যে ঠাট্টার কৌতূহল নেই। কিন্তু সে আহ্বান আমি কোনওদিনই করতে পারব না।

উপীনকাকার বাড়িতেও মাঝে মাঝে দেখা হয় ঝিনুকের সঙ্গে। আমি হেঁতালগাছটার দিকে তাকালে ঝিনুক আমাকে জিজ্ঞেস করে, যাবে?

–কোথায়?

–ওখানে?

যেন একটি দূরাগত রহস্যের ইশারার মতো হেঁতালগাছের তলায় আঙুল দেখায় সে।

আমি তাকাই ঝিনুকের দিকে। তার দেহের রৌদ্রচ্ছটায় আমার চোখ ঝলকায়। রক্তে রক্তে সঞ্চারিত হয় সেই রোদ। আমি দেখি, তার রক্তাভ ঠোঁটে, দূরবিসারী চোখে, আকাশের সেই কবেকার খসে-পড়া। তারার আলোছায়ার খেলা। তার দুই প্রতীক্ষিত বাহুতে নিটুট যৌবনের দৃপ্তভারে, কোন অজানা আদিমকাল থেকে স্তম্ভিত তার গুরু ও বলিষ্ঠ নিম্ন শরীরে এক রুদ্ধশ্বাস স্তব্ধতা। এ কবেকার প্রতীক্ষা? সেই আদিম অজানা কালের বয়স কত? তার ওপর থেকে একটি স্পর্শের অতি প্রত্যক্ষ চেনা অনুভূতি আমার রক্তের মধ্যে দাপাদাপি করে। একটা দুঃসহ সুখে ও যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন চোখে যেন স্বপ্নের মতো, বিস্রস্ত বেশ, সুঠাম তনুর প্রত্যঙ্গ ভেসে ওঠে। গভীর তৃষ্ণায় মুখ নামিয়ে, দুটি রক্তাভ ঠোঁটের উষ্ণ ভেজা কম্পিত কপাটে, নিশ্বাসে, রক্তের ও প্রাণের তীব্র মদির গন্ধ পাই। আমার ভিতরটা কাঁপতে থাকে।

চোখ ফিরিয়ে হেঁতালগাছের দিকে তাকাই আবার। আর দূর থেকে যেমন দুরু দুরু শব্দে ঢাকের দগর ভেসে আসে, তেমনি আমার বুকের ভিতরে শব্দ বেজে ওঠে। সেই শব্দের ভিতর দিয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভবেনের মুখ। রুদ্ধশ্বাস হয়ে বলি, না, যেতে পারব না ঝিনুক।

–কেন টোপনদা!

–ওইটিই আমার সান্ত্বনা ঝিনুক।

 আজকাল ভবেনের মুখখানি প্রায়ই, আচমকা আমার চোখে ভেসে ওঠে। যখন একলা থাকি, যখন পড়ি, যখন চলি, হঠাৎ দেখতে পাই, ভবেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন একটি বিব্রত বিভ্রান্ত হাসি ওর মুখে। আমার এই দেখার ভিতর দিয়েই আবিষ্কার করি, ওর চোখের কোল বসে গেছে। ওর মুখের রেখাগুলি গম্ভীর হয়ে উঠছে, শরীরটা শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখতে পাই, আর সেই বিষাণের গুরু গুরু ধ্বনি প্রবল হয়ে ওঠে। ভবেনের মুখের সঙ্গে আমার সেই গুরু গুরু ধ্বনির কী একটা যোগাযোগ যেন আছে।

তখন আর আমি স্থির থাকতে পারিনে। ভবেনের কাছে ছুটে যাই। কাছে গিয়ে বাস্তবেও দেখি, ভবেনের চেহারায় ভাঙন। লক্ষ পড়ে ওর চুলে পাক ধরেছে। কিছু বলতে পারিনে। শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।

ভবেন বলে, কী রে?

আমি বলি, কিছু নয়। তার কাছে আসতে ইচ্ছে করল।

তারপর দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকি, আর হঠাৎ দুজনেই হো হো করে হাসতে থাকি। আমি বলি, উল্লুক, হাসিস না।

ভবেন বলে, রাস্কেল, তুই তো হাসছিস।

তখন আমাদের কেউ দেখলে, পাগল ছাড়া আর কিছু ভাববে না। কিন্তু আমি যেন কী বলতে চাই, বলতে পারিনে। কেউ যেন আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছে। অথচ, কী একটা যেন আসন্ন হয়ে উঠছে। একটা ভয়ংকর কিছু।

মাঝে মাঝে আমি আর ভবেন দাবা নিয়ে বসি অবসর সময়ে। আমাদের দুজনের মাঝখানে বসে ঝিনুক। ওকে দেখলে কেউ বুঝবে না যে ও দাবা খেলা জানে। কারণ, দাবার ছকের থেকে, আমাদের দুজনের মুখের ওপরেই ওর দৃষ্টি বেশি চলে ফিরে বেড়ায়।

আমি আর ভবেন খুব ভাল চালের খেলোয়াড় নই। মোটামুটি। ঝিনুক শুধু মাঝে মাঝে তার চুড়ি-পরা হাতখানি বাড়িয়ে, সহসা একটি করে চাল দিয়ে দেয়। কখনও আমার হয়ে, কখনও ভবেনের হয়ে। কিন্তু যার হয়ে যখনই দেয়, তখনই উলটোপক্ষের নিশ্চিত মাত।

আর এমন বিস্ময়কর সেই চাল দেওয়া ও মাত করা, আমরা দুজনেই অগম্য বুদ্ধি নিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। যদি জিজ্ঞেস করি, এটা কেমন করে ঘটল?

ঝিনুক হয়তো তখনই উঠে যেতে যেতে বলে, ওই ভদ্রলোক তো (অর্থাৎ ভবেন) বোড়ের চাল ছাড়া কিছু দেবেন না বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু তোমার ঘোড়া যে ওত পেতে আছে, তা লক্ষ করেননি। তুমি দিব্যি বোড়েগুলো গাপ করছিলে। তাই ডান দিকে ওঁর গজ সরালাম পেছনে। তারপর ঘোড়া মন্ত্রী সরিয়ে, বোড়ে দিয়েই কিস্তি মাত করলাম। ভুল হয়নি তো আমার!

ভুল? আমরা দুজনেই সেই আশ্চর্য নির্ভুল, নিশ্চিত মাত করা দেখে নির্বাক হয়ে থাকি। ঝিনুক চলে যায়।

আসলে দাবার ছকটি একটি যুদ্ধক্ষেত্রের মতো পুরোপুরি ঝিনুকেরই আয়ত্তে।

প্রথম দিন খেতে বসে ভেবেছিলাম, ঝিনুক যেন মহারানি, আমি আর ভবেন তার বশংবদ প্রজা। সেটা যেন একটা নিষ্ঠুর সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে।

কিন্তু কুসুমের প্রতি ঝিনুকের বিরূপতা সমান। হয়তো, কুসুম যে আমার খাওয়া-শোয়ার রক্ষণাবেক্ষণে আছে, এটা ঝিনুকের মনঃপূত নয়। আমার বিশ্বাস, কুসুমের জায়গায় যে কেউই থাকত তাকেই ঝিনুকের ভাল লাগত না। এটা কি অপ্রতিরোধ্য?

সবচেয়ে বাড়াবাড়ি হয়েছিল একদিন। কুসুমের বুঝি মাঝে কী ব্রত হয়েছিল, যা কুসুমের মতো মেয়েরাই করে থাকে। সেই উপলক্ষে একজন ব্রাহ্মণ ভোজনের নিমন্ত্রণটা দ্বিপ্রহরে কুসুম আমাকেই করেছিল। যদিও নিমন্ত্রণটা আমাদেরই বাড়িতে এবং পিসি তাঁর থলি থেকে ও বাবদে ভালই খরচ করেছিলেন।

কিন্তু সেইদিন ঝিনুকও দুপুরেই নিমন্ত্রণ করে বসল। ঝিনুক সাধারণত রাত্রেই নিমন্ত্রণ করে। যদিও অবশ্য নিমন্ত্রণ কথাটার কোনও অর্থ হয় না। ঝিনুকের ইচ্ছেই নিমন্ত্রণ। কুসুমকে রাতের আশ্বাস দিয়ে আমি ঝিনুকের নিমন্ত্রণই রক্ষা করেছিলাম। কিন্তু বিরক্তিটা আমি চাপতে পারিনি। বলেছিলাম, তোমার কোনও উপলক্ষ নেই। ও বেচারির একটা উপলক্ষ ছিল।

ঝিনুক বলেছিল, বিনা উপলক্ষ কারুরই নেই। আমি দেখছি, এ সব ব্যাপারে কুসুমকে তুমিও প্রশ্রয় দিচ্ছ।

ঝিনুকের কথায় একেবারে অবিশ্বাসও করতে পারিনি। কুসুমকে যে পড়াশোনা করতে বলি, তাতে ওর তেমন উৎসাহ তো দেখতে পাইনে।

সেইদিন রাতে খেতে বসে কুসুমকে বলেছিলাম, এ সব গেঁয়োমিগিরি তো খুব করছিস কুসুম। তোর দ্বারা কিছু আর হবে না। এবার ওই তারককে ডেকে সত্যি দুহাতে এক করে দিই, মিটে যাক।

সেই মুহূর্তেই কুসুমের চোখ থেকে সব উৎসবের আলো নিভে গিয়েছিল। মন বিমর্ষ হলেও, আমি নরম হইনি।

এখন কুসুম রোজই একটু পড়াশোনা করে। আমার পড়ার তাড়া, পিসির সংসারের তাড়া, দুয়ের মাঝে ছুটোছুটি কুসুমের।

.

বছর ঘুরে আবার বসন্ত এসেছে শালঘেরিতে। এই যে ধুলো ওড়া, পাতা খসা, মাঝে মাঝে একটু রং-এর ছোপ লাগা শালঘেরি, দেখলেই কেন যেন আমার মনে হয়, পৃথিবীর কোথায় একটা শক্ত বাঁধনে ভীষণ মোচড় লাগছে।

সেদিন প্রায় সন্ধ্যাবেলা সাঁওতাল সর্দার করিক টুডুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে তামাইয়ের ধারে চলে গেলাম। ইতিমধ্যে আরও কয়েকটি জিনিস আমার সংগ্রহে এসেছে। মাটির কয়েকটি ছোট পাত্র এবং দু-একটি অলংকারের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছি। গোবিন্দ সিংহ ও মিহিরবাবুকে সে সংবাদ জানিয়েছি। গোবিন্দবাবুর আশা এখন অনেক বেড়েছে। তিনিও আমার মতোই প্রায় নিশ্চিত এখন, তামাইয়ের গর্ভ হয়তো একবারে শূন্য নয়। আমি তাই প্রতি দিন, এই পড়ন্ত বেলায়, দিনের শেষে এক বার তামাইয়ের ধারে না এসে পারিনে।

করিক চলে গেল তামাই পার হয়ে। শালবনের দক্ষিণে ওদের বস্তি। আমি সেই পাথরটার কাছে বসে রইলাম। অন্ধকার নামার আগে, নির্জন তামাইয়ের ধারে পাখিরা জটলা করছে।

শাল-তালের ফাঁকে ফাঁকে এত পলাশের জটলা অন্য সময় টের পাওয়া যায় না। তামাইয়ের দুপারেই পলাশের অজস্র রক্তিম ঠোঁট আকাশের দিকে মুখ বাড়িয়ে আছে। শালবনে এখন ঝিঁঝির ডাক ডুবিয়ে অষ্টপ্রহর বাতাসের গর্জন। রক্তধূলার ছড়াছড়ি।

সহসা পিছনে পায়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি ঝিনুক।

–এখানে কেন ঝিনুক।

–দেখলাম, তুমি এলে এদিকে।

–কোথা থেকে দেখলে।

–আমাদের বাড়ির জানালা থেকে।

অর্থাৎ উপীনকাকার বাড়ি থেকে। জিজ্ঞেস করলাম, ভবেন ফেরেনি স্কুল থেকে!

–তোমারই কাজে নাকি গেছে জেলা শহরে। ক্যামেরার ফিল্ম আনতে।

কিন্তু ও নিজে গেল কেন? কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিলেই তো পারত। আমি তো তাই বলেছিলাম।

–তা জানি না।

যে সব জিনিস তামাইয়ের ধারে কাছে পেয়েছি তার ফটো তোলার জন্যেই ফিৰ্ম দরকার।

দেখলাম, ঝিনুক তামাইয়ের ওপারে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমি আর স্বস্তি পেলাম না। ইদানীং শালঘেরিতে আমাদের বিষয় কথা হয়। গ্রামবাসীর কৌতূহল জেগে উঠেছে। আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থা আর নেই।

বললাম, এভাবে হঠাৎ এসে পড়লে কেন? কেউ যদি আসে এখন এদিকে?

ঝিনুক বলল, এখন কেউ আসবে না।

–তুমি জেনে বসে আছ, না?

ঝিনুক তাকাল আমার দিকে। বলল, লুকিয়ে পড়ব পাথরের আড়ালে। এত বড় পাথরের আড়ালে লুকোনো যাবে না?

বলে ঝিনুক আমার মাথার ওপর দিয়ে পাথরটার দিকে তাকাল।

ঝিনুক আজ চুল বাঁধেনি। আঁচড়ায়ওনি বোধ হয় ভাল করে। চোখের কোলগুলি বসা। গাল দুটি অতিরিক্ত লাল দেখাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে একটু ক্লান্ত হাসি যেন এলিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু চোখ দুটিতে গাঢ় ছায়া।

বললাম, আড়াল করবার মতো এ পাথর নয় ঝিনুক, চলে যাও।

ঝিনুক এগিয়ে গেল জলের দিকে। গিয়ে বসল। খোলা চুল পিঠ বেয়ে মাটিতে পড়ল তার। হাত দিয়ে সে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিতে লাগল স্রোতের বুকে। যেন কী এক খেয়ালি তর্পণে সে ব্যস্ত।

এখন জল আরও কম। হাঁটুও নয়। পাথরে বাধা-পাওয়া স্রোতের শব্দ খুবই ক্ষীণ। শালবনের বাতাসে শোনাও যায় না।

ঝিনুক এক বার ফিরে তাকাল। তারপর বাঁ হাতের আঙুল তুলে শালবনের দিকে দেখাল। আমার স্তব্ধ বুকে সহসা সেই গুরু গুরু ধ্বনি বেজে উঠল।

ঝিনুক জলে নামল। কিছু বলতে না বলতেই দেখলাম, ঝিনুক ওপারের কাছাকাছি। উঠে ডাকলাম, ঝিনুক।

ঝিনুক ফিরে তাকিয়ে হাসল, কিন্তু থামল না।

আমি জলের ধারে গিয়ে ডাকলাম, ঝিনুক কী হচ্ছে এটা? অন্ধকার হয়ে আসছে।

ঝিনুক শালবনের উঁচুতে পা বাড়িয়েছে তখন। বনের ফাঁকে ফাঁকে ইতিমধ্যেই অন্ধকার তার থাবা বাড়িয়েছে। বাতাসের ঝাপটায় কোটি কোটি শালফুল নাচছে বাতাসে তাল দিয়ে দিয়ে। ঝিনুককে পেয়েই যেন তাদের এত উন্মত্ততা।

একদা শালবনের ওই সীমানা লঙ্ঘন করে, তার নিবিড় জটাজুট ছায়ায়, ঝিনুকের সংকেতে হারিয়ে যাবার জন্যে ছুটে গিয়েছি। শুকনো পাতার শয়ানে ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে, সময় কোথা দিয়ে গেছে, টের পাইনি। এখন আমার বুক কাঁপছে। গলায় স্বর নেই।

আমি আবার ডাকলাম, ঝিনুক।

ঝিনুক ক্রমেই বনের দিকে পা বাড়াচ্ছে। ঢুকলে আমি আর ওকে খুঁজে পাব না হয়তো। গাছের জটলার কোন অন্ধকারে আমিও হয়তো পথ হারাব। সংসারের কাছে ঝিনুক আমাকে সেইখানে বেঁধেছে, যেখান থেকে আমি এর কোনও কৈফিয়ত দিতে পারব না।

আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গেলাম জল পার হয়ে। ওপরে উঠে বনের হাতায় ঝিনুকের সামনে গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ালাম।

ঝিনুক দাঁড়াল, কিন্তু মুখ তুলল না। দেখলাম, আমরা দুজনেই হাঁপাচ্ছি।

তারপর আস্তে আস্তে আমাদের নিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল।

ঝিনুক চোখ তুলল। আমার দিকে তাকাল। তারপর বনের গভীরে অস্পষ্ট অন্ধকারের প্রতি দৃষ্টিপাত করল।

আমি বললাম, ফিরে চলল ঝিনুক।

ওর পিছনে পিছনে নামবার আগে, আমি এক বার বনের দিকে না তাকিয়ে পারলাম না।

অন্ধকার তখন নেমেছে। উপীনকাকার বাড়ির দরজার বাইরে আমি দাঁড়ালাম। ভিতরে ইন্দিরের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। ইন্দিরের গলার স্বর শুনে থমকে গেলাম। আর এই বোধ হয় প্রথম থমকে যাওয়া। কোথায় যেন একটা দ্বিধাবোধ আমায় বাধা দিল। অস্ফুট গলায় বললাম, যাচ্ছি।

ঝিনুককে বাড়ির দরজায় রেখে, হেঁতালের তলা দিয়ে এলাম আমি। তখন আমার বুকের মধ্যে গুরু গুরু ধ্বনি এত প্রবল হয়ে উঠেছে, যেন বাইরে একটা শব্দ করে ফেটে পড়বে। কিন্তু আমি শান্ত হতে পারলাম না। একদিকে মাথার ভিতরে একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা দুঃসহ যন্ত্রণায় মাথা ঘুরতে লাগল। বর্তমান ঝিনুক এবং অতীতের স্মৃতি, সব কিছুই আমার প্রাণের মূল থেকে, রক্ত মাংসের প্রবাহে যেন অতি তীক্ষ্ণ ভয়ংকর আয়ুধসহ সংগ্রামে নেমেছে। আর একদিকে অসহ্য আত্মগ্লানি। এই দুয়ের মাঝখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে, কেবল শুনছি সেই গুরু গুরু দুর গর্জনের শব্দ। আর বারে বারেই, এই শব্দের মধ্যে ভবেনকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। মনে হয় এর মধ্যে যেন মহাকালের বিশেষ একটা ইঙ্গিত আছে। এটা নিতান্তই তার ভয়। দেখানো নয়। এই বুক কাঁপানোর মধ্যে কী একটা অসম্ভবেরর সংকেত যেন ফুটে উঠে।

ঝিনুককে ছেড়ে, বাড়ি এসে আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম। বাতি কমানো আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এ সব ভাবতে ভাবতে, সহসা একটা বীভৎস দুঃস্বপ্নের ঘোরে যেন আমি কাঁপতে লাগলাম। অসহায় পতিতের মতো, দারুণ বিপদগ্রস্তের মতো, আমি ফিসফিস করে বলে উঠলাম, আমাকে রাস্তা দেখতে দাও, আমাকে দিক নির্দেশ কর।…বলে আমি দু হাতে মুখ ঢাকলাম। আমি যে এই দুঃস্বপ্নের মধ্যে শুধু অকারণ অভিশপ্ত ভবেনকে এক বালিয়াড়ির বুকে কাঁটাঝোপে দেখতে পেলাম, তাই নয়। দেখলাম, সে বুক চাপড়ে হাহাকার করছে। এই দেখার সঙ্গে, আমার নিজের সকল যন্ত্রণা মিলে, একটা অলৌকিক নির্দেশের আশঙ্কায় চোখ ঢেকে অন্ধকারে ডুবে রইলাম।

এমন সময়ে কুসুমের ভয় ভয় সংকুচিত, একটু বিস্মিত গলা আমার কানে এল, যা ভেবেছি ঠিক তাই! আলো উসকে দেব টোপনদা?

আমি তাড়াতাড়ি, প্রায় চুপিচুপি গলাতেই বলে উঠলাম, না থাক।

 তাতে বিপরীত ফল হল। কুসুম ঘরের মধ্যে ঢুকে চলে এল। উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, কখন এসেছ? তোমার শরীর খারাপ হয়েছে নাকি?

আমি বলে উঠলাম, না না।

তবে অমন করে ভূতের মতো মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছ যে?

সহসা আমি একেবারে ফেটে পড়লাম, তুই যা এখান থেকে, যা বলছি! পালা।

 কুসুম চকিতে ছায়ার মতো অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই মুহূর্তেই আমি আমার ব্যবহারে অনুতপ্ত হয়ে উঠলাম। কিন্তু এ অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হল না। একটা শূন্যতায় আমি ডুবে গেলাম। কী করব, ভেবে না পেয়েই যেন আবার বাড়ির বাইরে চলে গেলাম। কোথায় যাচ্ছি, কোন দিকে যাচ্ছি, কিছুই জানি না। আমার কানে এল, দুরে কে যেন মত্ত সুরে চিৎকার করে গান করছে,

এ বড় সোখের রস ছিল,
 কী দিয়ে করলে চোলাই
 প্রাণে যেয়ে যাতনা হল।

হঠাৎ গান থেমে গেল। দুটি অস্পষ্ট মূর্তি আমার পাশ ঘেঁষে উলটো দিকে চলে গেল। সন্দেহ হল, হরোকাকা আর তারক। হয়তো হরোকাকা আমাদের বাড়িতেই যাচ্ছেন। তারকই হয়তো চেঁচিয়ে গান ধরেছিল।

শেষ পর্যন্ত আমি তামাইয়ের ধারে চলে এলাম। দেখলাম, আমার সামনে সেই কালো পাথরটা! পাথরের গায়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলাম যেন।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে আমার নিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। আমি বসলাম। তামাইয়ের কুলু কুলু শব্দ কানে আসছে। যে শব্দ সম্বন্ধে ছেলেবেলা থেকে আমি অনেক কল্প কাহিনী শুনে আসছি। এপারের অন্ধকার শালবন থেকে অস্পষ্ট শালফুলের গন্ধ আসছে। চারপাশের অন্ধকারের নিবিড়তা কেটে গিয়ে, একটা অস্পষ্ট আলোয় আমি যেন আশেপাশের সবই দেখতে পাচ্ছি।

ক্রমেই আমার ভিতরের উত্তেজনা শান্ত হয়ে এল। আমি যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম, আমার ভিতরের যত আলোড়ন, সবই আমার নিজের প্রতি অবিশ্বাস ও ভয়। ঝিনুককে যেমন আমার জীবনে অস্বীকার করা যায় না, আমার ভিতরে যেখানে তার অবস্থান, সেখান থেকে যেমন তাকে সরানো যায় না, তেমনি এই অবিশ্বাসের সঙ্গে প্রতিনিয়তই লড়তে হবে। এই ভয়কে সাহস দিয়ে জয় করতে হবে। আর আমার অন্তর‍্যামী বলে যদি কেউ থাকে তবে সে-ই জানে, ভবেন আর ঝিনুককে যদি খুশি দেখতে পাই, তা হলে আমার দ্বিধাহীন সাহস পরিপূর্ণ হবে। আমি বারে বারে উচ্চারণ করতে লাগলাম, সাহস, সাহস, সাহস।

এই সময়ে, সহসা আমার অন্তরাবদ্ধ দৃষ্টি সচকিত হল। একটু দূরে বাবলা ঝোঁপের কাছে যেন কিছু একটা নড়ে উঠতে দেখলাম। ভাবলাম, শেয়াল। কিন্তু মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েও শেয়াল যে ঝোঁপের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকবে তা সম্ভব নয়। সন্দেহ হল, অন্য কোনও জানোয়ার হবে। কারণ ঝোঁপের কাছে তার নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে। যেন একবার আড়াল ছেড়ে বাইরে আসছে, আবার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে আলো নেই, এক গাছা লাঠিও নেই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে রইলাম। আর দেখলাম, জানোয়ার নয়। ছায়াটা উঠে দাঁড়াতে টের পাওয়া গেল, মানুষের মূর্তি।

জিজ্ঞেস করলাম, কে? ওখানে কে?

আঁয়ি।

একটু ভয় মেশানো সংকোচে, ভাঙা ভাঙা সরু গলায় আমি শব্দটা সেরকমই শোনা গেল। বললাম, আমি কে।

জবাব এল, তারক।

তারক! তারকা? বললাম, তারক? তা ওখানে কী করছ?

কোনও জবাব নেই। ডেকে বললাম, এদিকে এসো।

তারক মাথা নিচু করে সামনে এসে দাঁড়াল। তারকই বটে। রোগা সরু শরীর, একেবারে খালি গা, চুলের বোঝাতেই মাথাটা বড় দেখায়। জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কী করছিলে?

তারক পা দিয়ে পা ঘষে বলল, এই আপনার কাছে একটু এসেছিলাম। দেখলাম, একলাটি ইদিকে আসছেন, তাই মানে–

কথা শেষ করল না। বললাম, পাহারা দিতে এসেছিলে?

তারক তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলল, না না। টোপনদার যে কী কথা।

 প্রায় মেয়েদের মতোই সলজ্জ সুরে বলল তারক। অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না। যদিও ওর মুখটা আমি মনে করতে পারছি। কুসুমের সঙ্গে এক সকালবেলার সেই দৃশ্য আমার মনে পড়ল। হাসি চাপতে কষ্ট হল। কিন্তু তারক হঠাৎ আমাকে একলাটি আসতে দেখে তামাইয়ের ধারে কেন? বললাম, কিছু বলবে নাকি?

মনে হল তারকের সমস্ত শরীরটা হেলে দুলে মোচড় দিয়ে উঠল। বলল, হ্যাঁ। শুনে রাগ করবেন না তো?

একটু সন্ত্রস্তই হলাম তারকের ভূমিকা দেখে। বললাম, রাগের কথা তুমি বলবে কেন?

তারক চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। অস্বস্তি আর দ্বিধাতেই বোধ হয় ওর শরীর বারে বারে দুলে দুলে উঠল। তারপর বলল, অই মানে কুসির কথা বলছিলাম।

রাগ করব ভেবেও রাগ করতে পারলাম না। বরং একটু কৌতূহলই হল। বললাম, কী কথা?

আবার একটু চুপচাপ। তারপর বলল, বের কথা, কুসির বে।

ব্যাপারটা বোধগম্য হতে আর আমার দেরি হল না। রাগ করতে চেয়েও আমার কৌতুকের মাত্রাই বাড়ল। বললাম, কুসুমের বিয়ে? কেন, কোনও ছেলেটেলে দেখা আছে নাকি তোমার?

তারক আমতা আমতা করে বলল, দেখা? হ্যাঁ, তা দেখা বলতে পারেন।

–কিন্তু কুসুম তো এখনও খুব ছোট, ছেলেমানুষ।

তারক অবাক সুরে বলল, টোপনদা যে কী বলেন। কুসি এই চৈতে পনেরোয় পড়ছে, আর কত ধাড়ি হবে?

তা বটে, তারকের কাছে এটাই যথেষ্ট। যদিও, চক্ষুষ্মন কোনও মানুষই বোধ হয় কুসুমুকে পনেরো বছরের মেয়ে বলবে না। আর বিবাহ সম্বন্ধ প্রস্তাবের কী উপযুক্ত সময় ও স্থান! কিন্তু এ ছাড়া তারকের উপায়ই বা কী ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, তা ছেলেটি কী করে, বয়স কত?

তারক ঢোক গিলল। একটা চাপা উত্তেজনা তার গলায়। বলল, তা ছেলের বয়স একুশ-বাইশ হবে। বাপের কিছু জোতজমি আছে, এক ছেলে, সুখে দুঃখে একরকম চলে যাবে, বুঝলেন কিনা টোপনদা।

–কোথায় থাকে, নাম কী, কার ছেলে।

প্রশ্ন করে আমারই নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল। তারকেরও জবাব দিতে দেরি হল। বলল, পাত্তর আমি নিজেই। মানে, কথাবার্তা একরকম হয়েছে..

আমি ততক্ষণ হাঁটতে আরম্ভ করেছি। তারক আমার পিছনে পিছনে চলেছে। পাছে হাসতে হাসতেই ধমকে উঠি, তাই চলা ছাড়া উপায় ছিল না। বললাম, ও! তা কথাবার্তা কি হয়েছে?

কুসির বাবা, মানে হরোকা’র সঙ্গে।

–রাজি হয়েছেন?

–এখুনি।

তবে আর অসুবিধে কী?

 তারক আবার চুপ। তারপরে বলল, আপনার অনুমতি না হলে কুসি বে করবে না।

এবার আমাকেই চুপ করতে হল। তামাইয়ের বিস্তীর্ণ ঢালু প্রান্তর পার হয়ে গ্রামের কাছে এসে পড়েছি তখন। আমি দাঁড়ালাম। তারককে ধমক দিতে আমার ইচ্ছে করল না। জানি, এক কথায় তারককে ধমকে তাড়ানো সবথেকে সোজা। আর সেটাই বোধ হয় সংসারের যথার্থতা। তারকের প্রেম খাঁটি কি না জানিনে। হতে পারে। পৃথিবীতে মানুষের সব অধিকার হরণ করা যায়। ভালবাসার অধিকার হরণ করা যায় না। তা সে তারক হলেও নয়। যাই হোক, নিয়মের যথার্থতা সবখানে চাপানো যায় না। তার চেয়ে, উপলব্ধিই ভাল। বললাম, বলে ভালই করেছ, কথাটা আমিও শুনেছিলাম। আমার কথা শুনবে?

-হ্যাঁ।

কুসুমকে তুমি বিয়ে কোরো না।

–কেন?

–যে তোমাকে বিয়ে করতে চায় না, তাকে বিয়ে করে কী লাভ। তুমি যাকে চাও না, তাকে কি তোমার বিয়ে করতে ইচ্ছে করে?

তারক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। বলল, কিন্তু আমি কী দোষ করেছি। আমি, একটা ব্যাটাছেলে বটে তো, নাকি?

বললাম, তা যদি বলো, দোষ তো তোমার অনেক, তুমি লেখাপড়া শেখনি, তার ওপরে নেশাভাং কর।

তারক সঙ্গে সঙ্গে, ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, তা বলতে পারেন।

–নেশাভাং করে শরীরটাকে জাহান্নামে দিয়েছ। এই বয়সে কিছু আর বাকি রাখোনি। তোমাকে তো ধাক্কা মারলে পড়ে যাবে।

–তা যাব না। এই সিদিনেও এক বস্তা ধান বই করেছি। তবে হ্যাঁ, ডাক্তারে বলেছে, আমার লিভারটি পোকা খেয়ে গেছে।

তবেই বোঝ, এ বয়সে লিভার পোকা খেয়ে যাওয়া মানে, তার আর কী রইল। তার চেয়ে আমি বলি, তুমি একটু ভাল হবার চেষ্টা করে। বিয়ে থার কথা ভেবো না এখন।

তারক বেশ সহজ হয়ে এসেছে। বলল, না বেথা আর কী, কুসিকে নিয়ে কথা। তা আপনি ঠিক জানেন তো টোপনদা, কুসির মন নাই?

তারককে রীতিমতো করুণ মনে হল। আমি সত্যি বলতে দ্বিধা করলাম না, না, মন নেই। ডেঙা শিবের কাছে সে মানতে করেছে শুনেছি, যাতে তোমার সঙ্গে বিয়ে না হয়।

–অ!

তারক আরও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি যখন বলছেন, তখন ঠিক। হরোকা বলেছিল কিনা, মেয়েমানুষের কথায় কিছু যায় আসে না।

আমি বললাম, ওঁর কথা তুমি বিশ্বাস কোরো না।

তার সঙ্গে সঙ্গে বলল, তা হলে হয়রাকা যে ঋণ করলে শুধবে কেমন করে?

–সে দোষ তো কুসুমের নয়। আর তুমি ভদ্রলোক, বামুনের ছেলে, তুমি কি পণ দিয়ে মেয়ে নেবে? সে আবার কেমন কথা?

–তা বটে।

 একটু থেমে আবার বলল, তবে কুসি বলে কথা। কিন্তু আপনি ঠিক বলেছেন টোপনদা, যে আমাকে চায় না তাকে বে করে কী লাভ। এ রকম কথা আমাকে কেউ কখনও বলে নাই কিনা। সত্যি তো, বে বলে কথা, স্বামী ইস্তিরি সম্পর্ক। তালে আপনি ঠিক জানেন তো টোপনদা, কুসি যে মুখনাড়া দেয়, ওগুলোন মিছে নয়?

এ কি আমারই মনের অবস্থার জন্যে, না কি তারকের সংশয় ও কষ্ট দেখে, জানিনে, জবাব দিতে এক বার থামতে হল। কিন্তু তারককে নিরস্ত করাই উচিত ভেবে বললাম, ঠিক জানি, ও সবই সত্যি, তুমি বোঝ না?

তারক টেনে টেনে বলল, বুঝি। তবে মানুষের মন। আচ্ছা, যাচ্ছি টোপনদা।

–হ্যাঁ এসো।

অন্ধকারে কয়েক পা গিয়ে তারক দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, জানেন টোপনদা, অমন একটা ভাল মেয়ে সারা শালঘেরিতে নাই।

আমার হাসির মুখে প্রায় একটা উঁচ বিধিয়ে ব্যথা করে দিল তারক। বললাম, তাই বুঝি?

–হ্যাঁ। ওকে আমি খুব জ্বালাতন করি, আর করব না। জানেন টোপনদা, যা বলব, হ্যাঁ, অমন তেজালো মেয়ে আর দুটি দেখি না।

তাই নাকি?

–হ্যাঁ, মিছে বললে আমার জিভ খসে যাবে না। যাচ্ছি টোপনদা।

এসো।

অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল তারক। হঠাৎ ওকে আমার মহৎ মনে হল। জানিনে ভাল এবং তেজালো বলতে ওর ধারণা কী। কুসুমের এখনও চরিত্র বিচারের সে সময় এসেছে বলে মনে করিনে। কিন্তু তারকের কথাগুলোতে কুসুমের সৌভাগ্য মানাই উচিত। অল্প বয়সে মদ্যপ, রুগ্ন, মূর্খ, আমার চিরবিতৃষ্ণা, উঞ্ছ ছেলেটার জন্য মনটা সহসা বড় বিষণ্ণ হয়ে উঠল। একটা জায়গায় কি বিশ্ব সংসারের সকল মানুষই এক, যখন সে ভালবাসে?

.

তামাইয়ের অভ্যন্তরের রহস্য জানবার জন্যে আমি নিজেকে আরও বেশি ন্যস্ত করতে চাইলাম। জানবার ব্যাকুলতা তো আছেই। আমার নিজের মনে হল, যেন ততোধিক মনোযোগ আমি দিচ্ছিনে। বিশেষ করে মনে হওয়ার কারণ এই, আজকাল আমাদের জেলা, জেলার বাইরে থেকে বহু চিঠি-পত্র আমার কাছে আসে। তামাই সম্পর্কে নানান জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল সেই সব চিঠিতে। অনেকেই আমার প্রতিদিনের কাজ জানতে চায়। আমি কত দূর অগ্রসর হয়েছি, এ সম্পর্কে তাদের ব্যর্থ কৌতূহল ও উৎসাহ, কেন আমির্জসাধারণের কাছে সব সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছি না। অনেকে স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে কাজ করতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে। শালঘেরি ও আশেপাশে গ্রামের কোনও কোনও ছেলে আজকাল আমার কাছে যাতায়াত কর। মাটি বা পাথরেরও এমনকী লোহা ও তামার কোনও জিনিস পেলেই আমার কাছে নিয়ে আসে। তার অধিকাংশই বর্তমান জীবন-যাপনের পরিত্যক্ত ভাঙা জিনিস। ওদের দোষ নেই, চিনতে পারে না।

এই সময়ে গোবিন্দ সিংহের একটি চিঠি পেলাম। আমি ওঁর জন্যেই বিশেষ করে অপেক্ষা করছি। গোবিন্দবাবু লিখেছে; আমি বুঝতে পারছি আপনি আমার অপেক্ষায় খুবই ব্যস্ত হয়েছেন। সংবাদপত্রের দিকে চোখ দিলেই বুঝতে পারবেন, রাজনৈতিক আবহাওয়াতে কী রকম ঘূর্ণি লেগেছে। সম্ভবত আমাদের চির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আগত। যে রকম ব্যাপার–দূতীয়ালি ও আলাপ আলোচনা চলেছে, তাতে কেমন একটা ভয় ধরা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। রাজনীতির সঙ্গে বরাবর সম্পর্ক রেখে এসেছি, সে জন্যে হঠাৎ এ সব ছেড়ে এই মুহূর্তে কোথাও যেতে পারছি না। আপনি আর কিছুকাল অপেক্ষা করুন, যদি আমার জন্য অপেক্ষা করা প্রয়োজন বোধ করেন। অন্যথায় আপনি কাজে হাত লাগাতে পারেন আমি পরে গিয়ে আপনার সঙ্গে যোগ দেব।

আমি জানি না, গত বছরের কলকাতার বীভৎস দাঙ্গার ঢেউ আপনাদের অঞ্চলগুলোতে কী পরিমাণ আঘাত করেছে। কলকাতার সর্বনাশ করে দিয়েছে। আর এ সবই ঠাণ্ডা মাথায় বেশ ষড়যন্ত্র করে, ভেবেচিন্তেই ঘটানো হয়েছে। ফলে বাংলা বিভাগ ঠেকানো যাবে না, স্বাধীনতার সঙ্গেই সেটা আসন্ন। ভবিষ্যৎ যা দেখতে পাচ্ছি, তাতে কোনও আশা বা উৎসাহ পাচ্ছিনে। মনের এ অবস্থা বাইরে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আপনিই বা কী মনে করছেন জানি না। কারণ সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন প্রবল আলোড়ন চলছে, সকলেই নতুন কিছুর জন্যে ব্যাকুল ও উন্মুখ। কিন্তু কোথায় তাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বুঝতে পারছি না।

কিন্তু এ সব কথা লিখে আপনাকে অকারণ আর বিব্রত করব না। আমাদের পার্টিই যখন নিশ্চিতভাবে সরকার গঠন করতে চলেছে, তখন আমার মনের এ অবস্থায় কী রকম থাকতে পারি, সেটা জানাবার জন্যেই লেখা। যাই হোক, আপনি ইতিমধ্যে একটা কাজ করতে পারেন। গ্রীষ্ম এল, বর্ষারও বড় বিশেষ দেরি নেই। এ সময়টার মধ্যে, তামাইয়ের যে সব অঞ্চল আপনার এখনও দেখা হয়নি, সেগুলো দেখে নিতে পারেন। আপনি মোটামুটি শালঘেরির কাছাকাছি অঞ্চলই দেখেছেন। আমি পুরনো ম্যাপ সংগ্রহ করে, তামাইয়ের উপত্যকা সীমানা দেখেছি। আপনি পশ্চিম দিগন্তে, বিশ-পঁচিশ মাইল অঞ্চল একবার ঘুরে আসতে পারেন। হয়তো সে ঘোরা একেবারেই ব্যর্থ যাবে, তবু ক্ষতি নেই। সংবাদপত্রে লেখালেখি সত্ত্বেও, সকলের কাছে হয়তো সংবাদ পৌঁছায়নি, পৌঁছুলেও অনেকের নিদ্রাভঙ্গ হয়নি। এক বার ঘুরে এলে হয়তো নতুন কিছু সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন।

আপনি লিখেছেন, মাটি সম্পর্কে মানুষের এমন নিদারুণ মোহ, কেউ বিনামূল্যে সুচাগ্র ভূমিও ছাড়বেন না। সেটা খুবই স্বাভাবিক। আর দেশের বর্তমান আবহাওয়া এমন যে, এ সময়ে সরকারি আনুকূল্যের আশা আপনি করতে পারেন না। অবিশ্যি ব্যক্তিগত চেষ্টায় তামাই উপত্যকার ছোটখাটো কোনও অংশ আপনি খনন করাতে পারেন। তাতে জমি কেনার যে খরচ পড়বে, তা ভবিষ্যতে ফেরত পাবেন কি না কে জানে। আর যদি আশা সফল হয়, তবে সর্বত্রই উৎসাহের সঞ্চার হবে। তাই বলছিলাম, আর একটু দেখে নিন। ইত্যাদি ইত্যাদি।…

গোবিন্দবাবুর চিঠি আমার কাছে একটি সম্পদ স্বরূপ। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে কোথায় যেন আমার একটা যোগসূত্র আছে। কলকাতার দাঙ্গা সম্পর্কে তিনি যে সব কথা লিখেছেন, তাতে আমি এক মত। আমাদের এ অঞ্চলেও সেই বিষের হাওয়া পৌঁছেছিল। কিন্তু মুসলমানের সংখ্যা এত অল্প যে, কোনও কিছুই ঘটেনি। কলকাতা থেকে মোল্লা মৌলবিরা মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামে আসছে, গোটা দেশটাই পাকিস্তান হয়ে যাবে, এ ধরনের নানান উত্তেজিত সংবাদ ও আলোচনার আলোড়ন কিছু চলছে। শালঘেরিতে এমন সব লোককে রাজনীতি নিয়ে মাতামাতি করতে দেখছি, যারা কোনও দিন এ জগতের সীমানায় পা দেয়নি। স্বয়ং অঘোর জ্যাঠা সভায় সভাপতিত্ব করছেন। হরলালকাকাকে এক দিন দেখলাম বাজারের কাছে কয়েক জনকে হাত-পা নেড়ে আসন্ন স্বাধীনতার কথা বোঝাচ্ছেন। বিয়াল্লিশে যে পতাকা বেআইনি ছিল, এখন হাতে হাতে সেই পতাকা ঘুরছে। অবস্থার যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কোথায়, কোথায় টেনে নিয়ে চলেছে।

আমি যেন দেখছি, মানুষ স্বাধীনতা বলতে রাতারাতি হাতে হাতে একটা প্রত্যক্ষ ফলের আশায় উদগ্রীব। যেন ম্যাজিকের মতো কিছু একটা পরিবর্তনের প্রত্যাশা। ভয় হয়, অবুঝ উত্তেজনার পরে, একটা ব্যর্থ অবসন্নতা যেন অবশ্যম্ভাবী।

এক দিন অঘোর জ্যাঠা আমাকে বোঝাতে এলেন, এ সময়ে আমি যদি তামাইয়ের বিষয় ছেড়ে একটু রাজনৈতিক বিষয়ে উঠেপড়ে লাগি, তবে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে। বললেন, আমাদের এ সব জায়গায় সৎ শিক্ষিত লোক তেমন নেই, যারা জেল খেটেছে দেশের জন্য, লোকের শ্রদ্ধা ভক্তি তাঁদের প্রতি অচলা। এ সময়ে যদি একটু এদিকে মনোযোগ দাও, তুমি অনেক উঁচুতে উঠবে বাবা। লোকে তোমাকে চায়।

আমি সৎ কি না জানিনে। হিসেব অনুযায়ী শিক্ষিতের কোঠায় পড়ি। মুশকিল এই, অঘোর জ্যাঠাকে বোঝানো যায় না, পৃথিবীর অধিকাংশ সৎ শিক্ষিত লোকেরাই রাজনীতি করেন না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অসৎ অশিক্ষিত লোকেরাই হয়তো ও বিষয়ে যথেষ্ট প্রতিভাশালী হয়ে ওঠে। দেশ বিদেশের ইতিহাসে তার নজির একেবারে দুর্নিরীক্ষ্য নয়।

অঘোর জ্যাঠা যা বললেন, হয়তো এ বিষয়ে তাঁর দূরদৃষ্টি গভীর। আমার উপায় নেই। যে কাজে কোনও আকর্ষণ আনন্দ বা কৌতূহলই বোধ করিনে, তার মধ্যে আমি যাব না। বললাম, আমি তা পারি না। কয়েক দিনের জন্যে তামাইয়ের দু পার ধরে একটু ঘুরতে চলেছি। ভাবছি, সাঁকোটের পাহাড় অবধি মাইল তিরিশ যাব।

অঘোর জ্যাঠা খুশি হলেন না। বললেন, কিছুকাল এ কাজ থামিয়ে রাখলেই বা ক্ষতি কী। আমি তোমাকে যা বলছি, তা যদি তুমি করতে পার, এ সব কাজ তোমার পড়ে থাকবে না। বরং আরও ভালভাবে হবে।

বললাম, আমাকে মাপ করুন জ্যাঠামশায়।

অঘোর জ্যাঠা হতাশ হয়ে বললেন, আর কিছুনয় টোপন, হয়তো চোখের সামনে দেখতে হবে, যত উঞ্ছেরা দেশের সরকারের মুরুব্বি হয়ে বসবে এখানে। তখন তোমরাই রাগ করে গাল দেবে।

হয়তো হেসেই ফেলতাম অঘোর জ্যাঠার কথা শুনে। তিনি আহত হবেন ভেবেই সামলাতে হল। যারা চায় না, তাদের অভাবে যদি স্থানীয় উঞ্জুেরা সরকারের হোমরা চোমরা হয়ে বসে জনতার প্রতিনিধি হয়ে বসে, তা হলে লোকে তো খারাপ বলবেই। কিন্তু উঞ্ছের দল কি এতই ভারী হয়ে গেছে? ভাল লোক কি নেই?

শুধু অঘোর জ্যাঠা নয়, এ কথা তো আগেই জানা গেছে, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করার দরুন অনেকেই আমাকে নিয়ে হতাশ হয়েছে। বিরূপ হয়েছে। বর্ষীয়সী মহিলাদের মধ্যে অনেকে বলেছেন, তবে ঢং করে জেল খাটতে যাওয়া কেন বাপু? এ সব কথার কোনও জবাব নেই।

একটা ব্যাপার লক্ষ করা গেল। রেণু রাজনীতির আসরে প্রবেশ করেছে। তাতে বোঝা গেল, কালের হাওয়ায় একটা দিক পরিবর্তনের ধাক্কা লেগেছে। একদা রেণুর যে ভবিষ্যৎ চিন্তা করা গিয়েছিল, আজ আর তা সত্য নয়। এতে রেণুকে কোথায় টেনে নিয়ে যাবে জানিনে, কিন্তু আমি খুশি হয়েছি। যেখানেই নিয়ে যাক, শালঘেরির মেয়ে এই প্রথম গ্রামের কর্তা ব্যক্তিদের সমর্থন ও সহায়তায় রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছে।

.

পায়ে হেঁটে হেঁটে সাঁকোট পাহাড়ে যাবার কথা শুনে পিসি তো থ। দু ঘণ্টা রেলগাড়িতে গিয়ে যেখানে হেঁটে যাওয়া যায়, সেখানে এ অভিনব পন্থার কারণ কী। আমার কথা শুনে চুপ করে গেলেন। বুঝতে পারি পিসি ক্রমেই ভাবিত হচ্ছেন, ভয় পাচ্ছেন আমার মতিগতি দেখে। জেল থেকে আসার পর তিনি যে একটি কল্পনার ছবি দেখেছিলেন তা ক্রমেই বিলীয়মান। আমি কষ্ট বোধ করি কিন্তু সংসার কোথাও কারুর মনোমত হয় না।

কুসুম জিজ্ঞেস করল, গোরুর গাড়িতে যাবে বুঝি?

না, পায়ে হেঁটে।

 ওমা! পথে ঘাটে খাবে কী? মালপত্তর নিয়ে যাবে কীসে?

 –মালপত্তর আবার কী রে?

চাল ডাল সবই? পথে পথে তো দোকানপাট নেই যে কিনে নেবে?

 বললাম, দোকানপাট নেই, গাঁ ঘর তো আছে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবেই।

 কুসুম খুব বেশি ভরসা পেল না। তারপরে ঝপ করে বলে বসল, আমাকে নিয়ে চলো না টোপনদা, তুমি ঘুরে ঘুরে কাজ কর আমি রান্নাবান্না করব।

মন্দ বলেনি কুসুম। পথ চলাটা সে রকম খেয়ে দেয়ে গড়িয়ে চড়ুইভাতি করতে করতে যাওয়া যায়। তাতে কাজ হোক বা না হোক। গম্ভীর হয়ে বললাম, দাঁড়া, কাজ কর্ম মিটুক, তারপর ওরকম বেড়াতে যাওয়া যাবে।

গাম্ভীর্য দেখে একটু সংশয়ে কুসুম আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল যেন, ও কিছু সন্ধান করছে আমার চোখে মুখে। এটা কুসুমের নতুন। কথা কম বলে, দ্যাখে বেশি। তবু না বলে পারল না, একলা যাবে।

বললাম, হ্যাঁ।

 কুসুম ছায়া ভরা মুখে বলল, বাড়িটা খুব ফাঁকা লাগবে।

বাড়ি গেলাম। ভবেন তো রেগে চিৎকার করেই উঠল, কাল রাত্রেও তুই কিছু বলিস নাই? তা হলে আমিও যেতাম।

ঝিনুক কোনও কথা না বলে, দূর থেকে তাকিয়ে ছিল। ভবেনই তাকে বলল, শুনেছ, বাবু হাঁটতে হাঁটতে সাঁকোটে চললেন।

ঝিনুক দূর থেকেই বলল, শুনেছি।

কিন্তু ঝিনুক আমার মুখ থেকে চোখ সরাল না। আমি ভবেনকে বললাম, তুই সংসারী মানুষ, তোর কি যখন তখন বেরুলেই হল।

ভবেন বলে উঠল, রাস্কেলের মতন কথা বলিস না। তোর কাছে আমি সংসার করা শিখব, না? আর তুই একলা এই পথ ঘুরে আসবি।

আমি হেসে বললাম, ঘুরে আসি একটু।

ভবেন বলল, যাও, মর গে এই গরমে। কিন্তু আজকাল খুব চাপতে শিখেছিস যা হোক। কাল তো এক বারও মুখ খুললি না?

আমি হাসতে লাগলাম। কিন্তু ঝিনুক উঠোনের যে প্রান্তে ছিল, সেদিকে চোখ তুলে তাকালাম না। ভবেন আবার বলল, মাঝখান থেকে ঝিনুকের মেজাজটা বিগড়ে দিলি। এ বাড়ির হাওয়া খারাপ হল।

–এতে বেগড়াবার কী আছে?

–বলিস নাই কেন? জানিস তো ওকে।

 ভবেনের এরকম কথায় বিব্রত হতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে উঠলাম। এবং সে বিরক্তি আসলে ঝিনুকের ওপর। বললাম, তুই অর্থহীন কথা বললে আমি তা মানতে পারি না।

বলে, ঝিনুকের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখলাম, ও সেখানে নেই। ভবেন কিন্তু ব্যাপারটাকে গুরুগম্ভীর হতে দিল না। ঘুষি উচিয়ে, চোখ পাকিয়ে মুখটা অদ্ভুত করে নিচু স্বরে বলল, এবার বোঝ ঠ্যালা।

আমি আবার হাসলাম। কিন্তু ভবেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা টনটনিয়ে উঠল। ভবেন আবার বলল, মনে করেছিস, তোর নিজের ইচ্ছে মতনই সব হবে।

কেন, ঝিনুক কি নিয়তির মতো আমার সবকিছু নিয়ন্ত্রিত করবে? ভাবনা শেষ হতে না হতেই, ঝিনুক দুহাতে দুটি চায়ের কাপ নিয়ে এসে দাঁড়াল। বলল, ধরো।

আমি আর ভবেন, দুজনেই চা নিলাম। ঝিনুক বলল, কবে ফিরবে?

কদিন আর। দিন দশেক লাগবে হয়তো।

আনিদি এসে আর এক কাপ চা ঝিনুকের হাতে তুলে দিয়ে গেল। ঝিনুক যেন গরম চায়ের কাপে নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখছিল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, মুখ না তুলেই বলল, শুধু এই ঝোলা কাঁধে করেই চললে?

-হ্যাঁ।

তার মানে, কদিন সব রকমের অত্যাচার হবে।

আমি বললাম, ও সব ঠিক হয়ে যাবে।

 ঝিনুক বলল, তা বুঝেছি। কিন্তু কাল রাত্রে বললেও, তোমার কাজে আমি বাগড়া দিতাম না। তাড়াতাড়ি চলে এসো।

ভবেন ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, দাঁড়া জামাটা চাপিয়ে আসি, একটুখানি সঙ্গে যাই।

 ঝিনুক চোখ তুলে বলে উঠল, শালঘেরি থেকে চলে যাবার মহড়া দিচ্ছ নাকি?

 ঝিনুকের এই প্রশ্নের মধ্যে যে সত্য একেবারে ছিল না, তা নয়। মনে মনে এমনি একটা চিন্তা ছিল, আমার কয়েকদিনের অনুপস্থিতির একটা অভিজ্ঞতা দরকার। তাতে অন্তত ভবেনের অবস্থাটা কিছু বুঝতে পারব। কারণ ইদানীং একটা সংবাদে অত্যন্ত অস্বস্তি ও বিমূঢ়তা বোধ করছিলাম। ঝিনুকের মুখেই শুনেছি, ভবেন আচমকা এক এক দিন থেকে ইস্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে। কিন্তু ছুটি নিয়ে বাড়ি আসেনি। ছুটির কথা বাড়িতেও বলেনি, আমাকেও না। সময়গুলি তার কোথায় কেটেছে কেউ জানতে পারেনি। শুনে থমকে গিয়েছি। ভবেন বলেনি বলেই ওকে জিজ্ঞেস করতেও বেধেছে। তখন থেকে অনেক বার ভেবেছি, আমি শালঘেরিতে না থাকলে হয়তো ভবেন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়।

কিন্তু ঝিনুকের চোখের দিকে তাকিয়ে সে চিন্তার কথা আমি বলতে পারলাম না। বললাম, তা কেন? কাজেই যাচ্ছি।

ঝিনুক চুপ করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই আয়ত চোখ দুটির দিকে আমি তাকিয়ে থাকতে পারিনে। ভবেন বেরিয়ে এল। ঝিনুক হাত বাড়িয়ে আমার চায়ের কাপ নিল। আমরা দুজনে বেরিয়ে গেলাম।

বাইরে এসে ভবেনকে বললাম, তুই আর কেন আসছিস?

ভবেন গম্ভীর স্বরে বলল, একটা কথা বলতে।

অবাক হয়ে বললাম, কী রে, কী কথা?

 ভবেন বলল, তুই আজকাল কপটতা শিখেছিস টোপন।

মনের ভিতরটা যেন দপ করে নিভে গেল। বললাম, কী রকম?

–তুই আমাকেও চাপতে শিখেছিস? আমাকেও বলিস না?

 হেসে বললাম, তুই একটা উল্লুক। তুই যেতে চাইবি বলেই তো বলিনি। বরং শোন, এ কদিন ইস্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাক।

ভবেন ওর কোল বসা ঈষৎ লাল চোখ তুলে বলল, কেন?

–কেন আবার? ঝিনুকের সঙ্গে দাবা খেলবি।

ভবেন আমার চোখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে হো হো করে হেসে বলল, তুই একটা রাস্কেল টোপন, রাস্কেল! ঝিনুক কি আর এখন খ্যালে? তুই আর আমি খেলি, ঝিনুক দ্যাখে।

বললাম, ভুল বললি। ঝিনুক খ্যালে, তুই আর আমি দেখি।

শুনে ভবেন হাসতে লাগল, আমিও হাসতে লাগলাম। দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সে হাসি যেন শেষ হতে চায় না।

.

প্রথম দিন ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যাবেলা যে গ্রামে পৌঁছুলাম, তার নাম নাবোল। সারা দিনে পথে বা দুটি গ্রামে খোঁজ করে তেমন কিছু পাইনি। নাবোলে আমার পরিচয় দিতে, আশ্রয় একটা মিলে গেল। পরের রাত্রি ওঝাইগড়। তৃতীয় রাত্রি ভক্তবিষাণ।

এই তৃতীয় রাত্রিতে আর নিজেকে ফাঁকি দিতে পারলাম না। অনুভব করছি ভিতরের একটা শূন্যতা যেন আমাকে গিলতে আসে। সন্ধ্যা হলেই উড়তে না পারা পক্ষী শাবকের মতো, বুকের মধ্যে যেন ডানা ঝটপট করে। আর আসন্ন রাত্রির ছায়াঘন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে, নিজেকে আশ্রয়হীন, ভয়ংকর একাকী মনে হতে থাকে। আমার প্রাণস্পন্দনের তালে তালে নাম বাজতে থাকে, ঝিনুক ঝিনুক ঝিনুক।….

আমার অনুপস্থিতি শালঘেরিতে কী ঘটাচ্ছে, সে অভিজ্ঞতার আগেই, আত্ম-দর্শনের বিস্ময়ে ও যাতনায় অভিভূত হয়ে যাই। জানিনে, সেই চোখ দুটির ভিতর দিয়ে কী সুধা পান করি। একটু কথা, মর্মে কী দ্যোতনা সৃষ্টি করে। এখন দেখছি শালঘেরির প্রায় প্রত্যহের সন্ধ্যা আমার রন্ধ্রগত হয়ে গেছে। দীর্ঘকাল জেলে থাকতেও আমার এমন অসহায় অবস্থার কথা জানতে পারিনি। ঝিনুক আমার সবকিছু নিয়ে বসে আছে। এমন সর্বব্যাপ্ত বলেই কি ওকে নিয়তির মতো মনে হয়।

পঞ্চমদিনে সাঁকোটে পৌঁছে আর একটা কাঁপন আমাকে নাড়িয়ে দিল। সাঁকোটের পাহাড়, এই তো আমাদের সেই ছেলেবেলার বোম্বাবুড়ো। পরিষ্কার আকাশের বুকে যখন পাহাড় তার কিতাকৃতি নিয়ে জেগে উঠত, মা শান্ত করার জন্যে বলত, ওই দ্যাখ বোম্বাবুড়ো, বেয়াড়াবিত্তি করলে ধরবে এসে।

আজ প্রাক-সন্ধ্যায় সাঁকোটের আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে, সহসা চোখে পড়ল, নিরিবিলি এক শালগাছের তলায়, নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় বসে আছে একটি আদিবাসী দম্পতী। ওরা আমাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু আমি নড়তে পারলাম না। জীবনে তো এমন কত দেখেছি। আমাদের গোটা জেলায় এই সব আদিবাসীদের সংখ্যা অনেক। চাষবাসের কাজ ওদের ওপরেই অনেকখানি নির্ভরশীল। এমন নির্জনে, সারাটা আতপ্ত দিনের কাজের শেষে, এর উরতের ওপর ওর পা, মেয়েটি পিঠ চুলকে দেয়, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে পুট পুট করে ঘামাচি মারে, আর ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কী যেন বলে, এবং পুরুষটির হাত এলিয়ে পরে থাকে কৃষ্ণা মানুবীটির কোলে, তার মুগ্ধ দৃষ্টি নারীর চোখের দিকে নয়, দূর আকাশের দিকে, দেখে মনে হয়, এই নিবিড়তাটুকু নিয়ে সংসার পারাবারের বাইরে গিয়ে বসে আছে। অনেক দিন দেখেছি, কিন্তু কখনও, সহসা এমন তীরবিদ্ধ চকিত কল্পনায় ও ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়ে যাইনি। আর এক জনের সঙ্গে আমার নিজেকে এমন নির্জন, নিবিড়তায় কল্পনা করে, আহত যন্ত্রণায় কেঁপে মরিনি। বোম্বাবুড়ো ছেলেবেলায় ভয় দেখিয়েছে, আজ যৌবনে, প্রাণের দুয়ার ভেদী অন্ধকারের স্তব্ধ স্বপ্নকে চোখের সামনে তুলে দিয়ে, আর একবার ভয় দেখাচ্ছে।

.

বারো দিন পরে বৃষ্টি মাথায় করে শালঘেরিতে ফিরে এলাম। একেবারে শূন্য হাতে ফিরিনি। কয়েকটি ছোট ছোট মূর্তি পেয়েছি। তার মধ্যে দুটি নিঃসন্দেহে গণপতির। একটি মাতৃমূর্তি, প্রাগৈতিহাসিক মাতৃমূর্তির সঙ্গে যার মিল রয়েছে স্তনে ও নিম্নাঙ্গে। মূতিগুলি দেখলে সহসা মনে হয়, এ যুগের নিতান্তই রংহীন গ্রাম্য খেলার পুতুল। কিন্তু এদের দেহে বয়সের চিহ্ন বর্তমান। এক ভদ্রলোক একটি পাথরের অস্ত্র, দুটি শীলমোহর জাতীয় মাটির জিনিস দিয়েছেন। কোথায় পেয়েছেন, তার জায়গাও নির্দেশ করেছেন। ওঝাইগড়ের পরপারে, আকোন গ্রামের জঙ্গলাকীর্ণ প্রান্তেই এ সব সংগ্রহ করা গেছে। আকোন আমার ফেরার পথে পড়েছিল। শালঘেরি থেকে দূরত্ব প্রায় এগারো মাইল। শালঘেরির মতোই আকোনকে আমার গভীর সন্দেহ হয়েছে। ওখানেও মাটির তলায় বোধ হয়, অতীত অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে।

কুসুম ছুটে এসে আমার কাঁধের ঝোলা নিল। পিসি বললেন, অরে, টুপান, আরশিতে একবারটি নিজেকে দেখ, চেহারাটা কী করেছিস।

বললাম, বাইরে বাইরে ঘুরেছি তো। এ কিছু নয় পিসি।

কুসুম একটা ছুট দিল দালান দিয়ে। বলে গেল, চা করছি টোপনদা।

 কিন্তু কুসুমের চেহারাটা তেমন ভাল দেখলাম না। চোখের কোল বসা, চুল উশকো খুশকো। বর্ষা দেখে বোধ হয় স্নান করেনি। পিসি তাড়াতাড়ি শুকনো কাপড় এনে দিলেন। বললেন, আর চান করিস না, মেলাই ভিজেছিস। একটু তেল গরম করে দিই, হাতে পায়ে মাখ।

কুসুম চা নিয়ে এসে বলল, তোমার কাজ হয়েছে টোপনদা। বললাম, এই হয়েছে একটু আধটু।

–কিছু পেলে?

 কুসুম বুঝুক না বুঝুক, উৎসাহের অন্ত নেই। ঠাট্টা করে বললাম, পেয়েছি।

কী পেলে?

 কুসি বামনির একটা বর।

কুসুম অমনি মুখ ভেংচে বলল, অ্যা হ্যাঁ হ্যাঁ। আর বামুনঠাকুরের একটা বউ খুঁজে পাওনি?

বললাম, তাও পেয়েছি।

বলে ব্যাগ থেকে খুলে মাতৃমূর্তিটা দেখালাম। কুসুম হেসে গড়িয়ে পড়ল। আপাত দৃষ্টিতে মাতৃমূর্তির চেহারাটি হাস্যকর বটে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, দুটি ছোট পায়ার ওপর একটি ত্রিকোণ অঙ্গ, তার ওপরেই গোল স্ফীত উদর, উদরের ওপরে দুটি বৃহৎ স্তন, একটি ছোট্ট মুণ্ড। বর্তমান চোখে অনেকটা বিদঘুটে হাস্যকর। কিন্তু ঊর্ধ্ব মধ্য অধঃ, এই তিনের মধ্যেই প্রজননের চিহ্নগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মাতৃমূর্তি আসলে উৎপাদনেরই প্রতীক। এই সব সংকেত জানা না থাকলে, এর চেয়ে হাস্যকর মূর্তি আর কী থাকতে পারে।

এমন সময়ে টোকা মাথায় দিয়ে ইন্দির ঢুকল দরজা দিয়ে। কুসুম বলল, কদিন ধরে ও রোজ দুবেলা তোমার খবর নিতে আসে, তুমি এসেছ কি না।

ইন্দির আসে না, তাকে পাঠানো হয়। সে দালানের সামনে বারান্দায় উঠে এল। দালানের ভিতরে, কাছেই ছিলাম আমি। দেখতে পেয়ে বলল, এসেছ? যাক বড় বউমা আর বড়দা রোজ খোঁজ করছে তোমার।

আমি বললাম, টোকা রেখে ভেতরে এসো।

কুসুম বলল, চা খাবে?

ইন্দির দালানে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তা এই বাদলা দিনে।

কুসুম চলে গেল। ইন্দির বলল, বড় বউমা বুলে দিয়েছেন, তাড়াতাড়ি একবার দেখা করতে।

জিজ্ঞেস করলাম, ভবেন কোথায়?

–ইস্কুলে। বড় বউ মা বুলছেন, জরুরি দরকার, এসে থাকলে যেন দেরি না করেন।

জানি পিসি ভিতর ঘর থেকে ইন্দিরের কথাতেই কান রেখেছেন। হয়তো ওদিক থেকে কুসুমও। বড় বউমার প্রসঙ্গ চাপা দেবার জন্যে বললাম, সে হবে খন, তুমি বসো।

আমি উঠে ঘরের ভিতরে গিয়ে, বাগানের দিকে জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির অঝোর ধারা গাছের ও বাঁশ ঝাড়ের মাথা ধুইয়ে ঝরে পড়ছে। লাল মাটি জমাট রক্তের মতো থই থই করছে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে পাচ্ছিনে। ব্যাং ডাকছে, ক্যাঁ-কো। ক্যাঁ-কো।

আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, দোতলার বারান্দায় ঝিনুক দাঁড়িয়ে। ওর অজ্ঞাত চুল ভোলা, তামাইয়ের ওপারে শালবনের আকাশে দৃষ্টি হারিয়ে গেছে। আর ভবেন? ওকি ইস্কুলে, নাকি অন্য কোথাও গিয়ে বসে আছে?

.

বাড়ি থেকে ইস্কুলের ঢং ঢং ঢং ছুটির ঘণ্টা শুনেই বেরিয়েছিলাম কিন্তু ভবেনদের বাড়ি এসে ভবেনের কোনও সাড়া-শব্দ পেলাম না। কারুরই কোনও সাড়া-শব্দ নেই। বাইরের দরজাটা খোলা। উঠানটা ফাঁকা। রান্না ঘরের দরজা বন্ধ। নীচের মাটির ঘর ও পাকা ঘরের দরজাও ভেজানো। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলাম। বারান্দায় কেউ নেই। কিন্তু দুটো ঘরের দরজাই হা করে খোলা। বারান্দার রেলিংএর চওড়া কাঠের উপর এক জায়গায় দেখলাম, চুলের ফিতে আর কাঁটা পড়ে আছে। এক পাশে শাড়ি শায়া জড়ো করা।

এখন আর বৃষ্টি নেই। ভেজা বাতাস বইছে। আকাশ মেঘ মেদুর। পূর্ব দিগন্তে কালো আকাশের পটে শালবন দুলছে।

আমি ডাকলাম, ভব আছিস নাকি?

কোনও এক ঘর থেকে ঝিনুকের গলা শোনা গেল, না। ঘরে এসো।

এরকম এসেই থাকি, দ্বিধার কিছু নেই। অনেক দিন ভবেন এসে দেখেছে, আমরা ঘরে বসে কথা বলছি। তবু সাঁকোট থেকে ফিরে, আমার পায়ে যেন আড়ষ্টতা বোধ করছি। ওখান থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, কোন ঘরে।

–তোমার বন্ধুর ঘরে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। মনে করেছিলাম, গিয়ে দেখব, ঝিনুক কোনও জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দেখলাম, মেঝেতে মাদুর বিছানো। ঝিনুক তাতে কাত হয়ে এলিয়ে, কনুয়ে ভর দিয়ে, গালে হাত রেখে, সামনে দাবার ছকে নিবিষ্ট হয়ে আছে। তার খোলা রুখু চুল মাদুরে এলানো। একটি মোটা লাল পাড় শাড়ি পরা, গায়ে একটি পুরনো রং-ওঠা বিবর্ণ জামা। আঁচল বুকের নীচে মাদুরে পড়ে রয়েছে। কাত হয়ে রয়েছে, তাই গলার সরু হারগাছা জামার এক পাশ দিয়ে ভিতরে চলে গেছে। কপালে সিঁদুর নেই, সিঁথেয় গতকালের অস্পষ্ট দাগ। একটি কালো রংএর বোড়ে নিয়ে, ছকের ওপর এক জায়গায় রেখে চোখ না তুলে ঝিনুক বলল, এসো।

কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেন স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কী একটা তীব্র আনন্দ, আর একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। তার সঙ্গেই সেই গুরু গুরু শব্দের গর্জন ভেসে আসতে লাগল। আমার নিজের প্রতি সেই ভয় আর অবিশ্বাস। এক বার মনে হল, ফিরে যাই। পরমুহূর্তেই আমার ভিতরে যেন

কে নাড়া দিয়ে উঠল। আমি হেসে উঠলাম, কী ব্যাপার একলাই পেড়ে বসেছ।

ঘরে ঢুকলাম আমি। ঝিনুক তেমনি চোখ না তুলে বলল, দোকলা আর পাচ্ছি কোথায় বলো।

 বলে উঠলাম, কেন, ভবকে যে বলেছিলাম ছুটি নিয়ে বাড়ি থাকতে?

ঝিনুক চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। বলল, বলেছিলে বুঝি? কই, জানি না তো।

ঝিনুক আবার চোখ নামিয়ে নিল। বললাম, কিন্তু ও এখনও ফেরেনি কেন? ছুটি তো অনেকক্ষণ হয়েছে।

–হয়তো তোমার ওখানেই গেছে। বসো, এখানে এসে বসো ছকের সামনে, একটু খেলি।

ঝিনুক তেমনি ভাবেই বলল। আমি উলটো দিকে মেঝেয় বসে বললাম, কিন্তু একলা একলা দুদিক। চালছ কী করে? এমনি লড়া যায়?

ঝিনুক বলল, নিরুপায় হলে লড়তেই হয়।

আমি চোখ তুলতেই, ঝিনুকের সঙ্গে চোখাচোখি হল। আমার বুকে নিশ্বাস আটকে এল হঠাৎ। ঝিনুকের চোখে যেন জ্বরের ঘোর। ও আবার বলল, এবার তুমি এসেছ, একটু লড়ো।

আমি তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিয়ে এলাম। খেলার কথা নয়, অন্য কিছু অর্থ যেন ঝিনুকের কথায়। নিজের দিকে চেয়ে, নিজের প্রতিই যেন দীন ভিখারির মতো প্রার্থনা করলাম, তাড়াতাড়ি খেলায় মনোযোগ দাও, খেলায় ডুবে যাও।

বেশ খানিকক্ষণ একেবারে নিবিষ্ট থেকে বললাম, কিন্তু একী, এ যে দেখছি প্রায় সবই সাজানো, কী খেলছ তা হলে?

ঝিনুক যে চোখ নামায়নি আর, তা আমি জানি। বলল, এতক্ষণে দেখতে পেলে? একলা কি খেলা যায়? শুধু পেতে বসা যায়।

ঝিনুকের সেই সন্ধ্যাভাষা। নিশূপে নিচ্ছিদ্রের ভিতর দিয়ে সহসা আবির্ভূত হয়ে মর্মে এসে ঢোকে। তাড়াতাড়ি বললাম, তা হলে।

কথা শেষ হল না। ঝিনুক বলল, কেমন কাজ করে এলে টোপনদা?

বললাম, ভাল। না গেলে সত্যি ক্ষতি হত। অনেক জিনিস পেয়েছি। তা হলে তোমার বোড়ে তিনটে দাও, সাজিয়ে নিয়ে একেবারে নতুন–

দেখলাম, ঝিনুকের গালে রাখা হাতটি আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল। ওর মাথা মাদুরে এলামনা। প্রায় শ্বাসরুদ্ধ গলায় বললাম, কী হয়েছে ঝিনুক।

ঝিনুক প্রায় চুপিচুপি স্বরে বলল, আমার হাতটা একটু ছোঁও।

আমার বুকের মধ্যে সহসা সেই দুরন্ত কাঁপুনি এল। তবু ওর হাত ধরলাম। ঝিনুকের হাত, ঝিনুকের! ঝিনুক যেন হাঁপাচ্ছে। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। ওর হাত ঠাণ্ডা। আর একটি হাত দিয়ে মাদুর আঁকড়ে ধরে আছে, নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে, শরীর শক্ত হয়ে উঠছে। ওর রৌদ্ররং শরীরের খোলা অংশে রক্তাভা দেখছি যেন। কাত করা রক্তাভ মুখের পাশ দিয়ে চুলের রাশির জটলা। ওর চোখ আমার হাতের দিকে, যে হাত দিয়ে ওর হাত ধরে আছি।

আমি স্খলিত গলায় ডাকলাম, ঝিনুক।

ঝিনুক তেমনি স্বরে বলল, টোপনদা, এখন বুঝতে পারি না, তুমি জেলে থাকতে কেমন করে ছিলাম?

আমার ভিতরে, যেন এক সংক্রান্তিকালের ইশারায় মহাকালের ভেরিতে প্রবল রব উঠল। বাইরে থাকাকালীন কয়েক দিনের সব কথা আমার জিহ্বার ওপরে এসে দাপাদাপি করতে লাগল। আর তৎক্ষণাৎ মনে হল, কী সর্বনাশ। আমি প্লাবনের মুখ খুলে দিতে যাচ্ছি। যেন ভয়ে শিউরে উঠলাম আমি। বললাম, ঝিনুক, মানুষ অনেক কিছু পারে।

ঝিনুক আরও জোরে আমার হাত চেপে ধরল। বলল, আবার অনেক কিছু পারে না টোপনদা।

–তুমি পার ঝিনুক, আমি জানি।

 ঝিনুক কী ভাবল, ও আমার চোখের দিকে তাকাল। আমি আবার বললাম, না পারলে চলে না। ঝিনুক উঠে বসো।

ঝিনুক চোখ নামাল না আমার চোখ থেকে। কথা বলল না। কয়েক মুহূর্তের পরে ঝিনুক উঠে বসল। আমি ওর হাত ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ও বিস্রস্ত বেশ গোছাল না। ইচ্ছে করল, আমি নিজেই ঠিক করে দিই। তা আমি পারব না। বিচারের অবসর ছিল না, শুধু ঝিনুকের সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গেও ছলনা করছি কি না! আমি সাঁকোটে এক রকম ভেবেছিলাম, এখন আর একরকম। উঠে দাঁড়িয়ে কী যে করতে চাইলাম, জানিনে। বাইরে যাব কি না, একবার ভাবলাম। তারপর আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। যেন নিজেকেই বলবার জন্য আবার আমি উচ্চারণ করলাম, ঝিনুক সংসারে কোনও কোনও মানুষকে পরীক্ষা দেবার জন্যেই থাকতে হয়। তাদের জন্মের সময়ে গ্রহ নক্ষত্র কে কীভাবে ছিল, কে জানে, হয়তো সামান্য একটু এদিক ওদিকের জন্যে, সারা জীবনের ছকে বাঁধা পড়ে গেছে। নতুন কোনও কিস্তি মাতের উপায় নেই আর।

এমন সময়ে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ শোনা গেল। ভবেনের গলাও উচ্চকিত হল, আনিদি, আমাদের চা দাও। তিন জনের মতন দিয়ো।

আমি ঝিনুকের দিকে তাকালাম। ঝিনুক তাকাল না, ঠায় তেমনি বসে রইল। ভবেনের কথা শুনেই বুঝলাম, আমি এসেছি সে ধরেই নিয়েছে। নইলে তিন জনের চায়ের কথা বলত না। দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভবেন এগিয়ে এসে আমাকে দেখে বলল, আমি তোদের বাড়ি ঘুরে এলাম। কুসুমের মুখে শুনে বুঝলাম এখানেই এসেছিস। কিন্তু এ কদিনে চেহারাটা তো বাগিয়ে এসেছিস।

বললাম, একটু কালো হয়েছি।

ঝিনুক চুল এলো খোঁপায় বেঁধে উঠে দাঁড়াল। তারপর কোনও কথা না বলে, আমাদের দুজনের মাঝখান দিয়ে বাইরে চলে গেল। বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল।

ভবেন তাকাল আমার দিকে। আমিও ভবেনের দিকেই। ভবেন বলল, কী হয়েছে, তোরা ঝগড়া করেছিস নাকি?

বললাম, না। ওকে কয়েকটা কথা বলছিলাম।

ভবেন ঝিনুকের যাওয়ার পথের দিকে কয়েক মুহূর্ত যেন মুগ্ধ স্নেহে তাকিয়ে রইল। বলল, কদিন জ্বরে ভুগল ঝিনুক। নগেন ডাক্তার এসেছিল, বলল, ও খুব দুর্বল হয়ে গেছে।

তারপরে ভবেন আমার মুখের দিকে তাকাল। কী দেখল জানি না। আমার হাত ধরে বলল, আয়, ভেতরে বসি। সাঁকোটে কী কাজ হল শুনি।

আমার যেন মনে হল, ভবেনের বুকের মধ্যে একটা দীর্ঘশ্বাস আটকে রয়েছে। আমি সহসা কোনও কথা বলতে পারলাম না। আমার নিজেকেই সবথেকে বেশি বিড়ম্বিত মনে হতে লাগল।

.

সাকোটের পথের কথা, বিশেষ করে আকোনের কথা সব লিখে পাঠালাম গোবিন্দবাবুকে। নতুন পাওয়া মূর্তি ও চিহ্নগুলির ফটোও সেই সঙ্গে। গোবিন্দবাবু উৎসাহিত হয়ে জবাব দিলেন। জানালেন, শালঘেরি এবং আকোন এ দু জায়গাতে লক্ষ্য দিতে হবে।

ইতিমধ্যে স্বাধীনতা ঘোষিত হল। শালঘেরিতে উৎসবের আয়োজন মন্দ হয়নি। বাড়িতে বাড়িতে পতাকা উড়ল। জেলা শহরের উৎসব দেখতে গেল অনেকে। বৃষ্টি বাদলাতেই যা একটু অসুবিধে হল। তবু শালঘেরি থেকে গড়াই অবধি একটা মিছিল গিয়েছিল। ইন্দির একটা পতাকা নিয়ে সামনের সারিতেই ছিল। সে ঘড়ঘড়ে বুড়ো গলায় চিৎকার করছিল, বন্দে মাতোরং!

সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এলেন গোবিন্দবাবু। প্রৌঢ় ভদ্রলোককে দেখে মনে হল, একটা বিভ্রান্তির ঘোরে আছেন। এবং সেটা যে রাজনৈতিক জটিলতার ঘোর, তা বুঝতে পারলাম। আমার সঙ্গে তামাইয়ের ধারে ঘুরতে ঘুরতে, কাজের কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে যান। কেবলি মনে হয়, অনেক দূর অবধি তাকিয়ে কী দেখে যেন সংশয়ে ও হতাশায় ডুবে যাচ্ছেন।

মাটি কাটার কাজ যেদিন শুরু করার কথা, সেদিন সকালবেলা হঠাৎ আমাকে বললেন, সীমন্তবাবু, স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি ঠিকই। একটা জোয়ার বোধ হয় শুরু হল, কিন্তু পঁচিশ বছর ধরে বেনো জলের ধাক্কায় যে ময়লা আর গ্লানিটা এখন আসবে, আমি শুধু তাই দেখে যাব।

হয়তো গোবিন্দবাবুর ভাবনার সঙ্গে আমার কিছুটা মিল ছিল। কিন্তু সময়ের কথা শুনে বললাম, পঁচিশ বছর বলছেন?

–হ্যাঁ, পঁচিশ বছর। অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ দেখতে পাবেন। কারণ বহু, বহুযুগ পরে আবার আমাদের স্মরণ করতে হচ্ছে, আমরা ভারতবাসী। আত্মবিস্মৃতির মার না খেয়ে আমাদের উপায় নেই। নিজেদের সঠিক পরিচয়টা জানতেই এই বছরগুলো কেটে যাবে। বিভ্রান্তিই অবক্ষয়কে টেনে আনবে। আর উনিশ শতকে যে জ্ঞানের আর মুক্তির আশ্রয়টা বিদেশ আমাদের দিয়েছিল, তারও কোনও আশা নেই আর। তারা আমাদের থেকেও বোধ হয় দেউলিয়া হয়ে গেছে। এবার আসুন, নিজেরা নিজেদের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে, একেবারে হাড়ের মধ্যে পৌঁছে, নিজেদের পরিচয়কে খুঁজি।

হেসে উঠে বললেন, এতে ভয়ের কিছু নেই, এ ছাড়া রাস্তা নেই। এখন যে নিজেদের সব করতে হবে।

মাটি কাটার কাজ আরম্ভ হয়ে গেল।

গোবিন্দবাবু করিক টুডুদের মাটি কাটার ধরনটা দেখিয়ে দিলেন। যতক্ষণ মাটি কাটা হয় আমি প্রতিটি শাবল কোদালের আঘাতের মুখে চেয়ে থাকি। গ্রামের এবং আমাদের গাঁয়ের লোকেরা কৌতূহলিত হয়ে খানিকটা মজা দেখার মন নিয়ে এসে ভিড় করে। বার্তা রটে গেছে, টোপন চাটুয্যে বিঘা বিঘা জমি নিয়ে মাটি খোঁড়াচ্ছে, মানুষের কঙ্কাল খুঁজছে। কেউ কেউ বলছে, গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে।

গোবিন্দবাবু সাত দিনের জন্য আপাতত এসেছিলেন। আরও তিন দিনের মেয়াদ বাড়িয়ে, দশ দিন থাকলেন। আস্তে আস্তে তাঁর কপালে আমি কয়েকটা হতাশার রেখা ফুটে উঠতে দেখলাম। বাড়ি ফিরে এসে তিনি রোজই খুঁজে পাওয়া মাটির ও পাথরের মূর্তি এবং সামগ্রীগুলি দেখেন, আপন মনে বিড়বিড় করেন। একদিন আমাকে নিয়ে আকোন গেলেন।

আমার ভিতরেও একটা সংশয়ের অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগল। তবু একটা অটল বিশ্বাস যেন আমার মনের মধ্যে অনড়, নিশ্চল, শক্ত হয়ে বসে আছে।

দশ দিন পর গোবিন্দবাবু যাবার আগে জানিয়ে গেলেন, যে জায়গাটা আমি বেছেছি, ওখানে আর কোনও আশা নেই। আর একটু ভেবে জায়গা ঠিক করতে হবে।

মাঝে মাঝে বর্ষায় কাজ প্রায় বন্ধ যেতে লাগল।

গোবিন্দবাবুর সঙ্গে চিঠি আদান প্রদান চলছিল। শেষ চিঠিতে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন, আপনি যে অস্ত্র এবং পাথরের মাটির অগণিত মূর্তি বা অন্যান্য সামগ্রী পেয়েছেন সেগুলি অন্য কোনওভাবেও ওখানে আসতে পারে। সাঁওতাল বস্তিতে খোঁজ করে দেখবেন ওরা ওরকম কোনও কিছু পেয়েছে কি না। না পেয়ে থাকলে আর অকারণ কষ্ট করবেন না। কারণ যদিও শালঘেরির মৃত্তিকায় একটি ইশারা দেখা গিয়েছিল আজ পর্যন্ত বাংলার অন্য স্থানের সঙ্গে সেও বোধ হয় একাত্মা। অনেক কিছুই হয়তো ছড়িয়ে আছে। কিন্তু কোথায়, এখনও জানা যাচ্ছে না।

খোঁজ করে সাঁওতালদের কাছে কিছুই পাইনি। ওরা পেয়ে থাকলেও বোধ হয় ভয়েই কিছু জানায়নি আমাকে।

বিঘা বিঘা মাটি কাটা হল। বড় বড় পুকুর হল। বর্ষার জল জমল তাতে। অল্পদিনের মধ্যে কিছু আগাছাও জন্মাল। আবিষ্কার হল না কিছুই।

পিসি তো প্রায় কথা বন্ধ করেছেন। কারণ তাঁর সহোদরের সঞ্চিত টাকা এভাবে নষ্ট হতে দেখে, ভয়ের অন্ত নেই। অন্ত নেই আমার ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার। পাড়ার সবাইকে দিয়ে বলিয়ে আমাকে নিরস্ত করতে চেয়েছেন। পারেননি। পিসিকে অনেক বুঝিয়েছি যে সার্থক হলে এ জন্যে আর দুঃখ করতে হবে না।

পিসির কোনও কারণ নেই বোঝবার।

কুসুম যেন শিশু গাভীটির মতো অসহায় দুই চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। ওর বেশি কথা বলতে সাহস হয় না। কেবল, তামাইয়ের ধার থেকে ফিরলে এক বার জিজ্ঞেস করে, কিছু পেলে টোপনদা?

সবদিন মনটন একরকম থাকে না। মাঝে মাঝে এ অনধিকার চর্চা করতে বারণ করি। তখন কুসুম আর আগের মতো সরে গিয়ে, পরে কৌতুকোচ্ছলে উঁকি মারে না। আজকাল ওর অসুখ হলে আমি ফিরে দেখার সময় পাইনে। কত দিন অসুখ অবস্থাতে আমাকে দরজা খুলে দিয়েছে রাতে। ডেকে জিজ্ঞেস করবার মন ছিল না আমার। ও যে অন্ধকারে লেপটে থেকে আমার দিকে সভয় করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে, তা যেন আমি দেখেও দেখিনে।

আমি তামাইয়ের মাটির তলায় প্রাগৈতিহাসিক তামাই সভ্যতার সন্ধানে ফিরি। আর সেই আবিষ্কারের ইন্ধন খুঁজতে কি প্রতি সন্ধ্যায় যাই ঝিনুকের কাছে?

আমাকে তামাইয়ের মাটি প্রতি দিন যেমন নতুন নতুন স্তরে ডাক দেয়, তেমনি করেই ঝিনুক আমার চোখে চোখ দিয়ে, নিঃশব্দে, বাতাসে আমার দৃষ্টি তুলে নিয়ে গেছে হেঁতালের তলায়। তামাইয়ের ওপারে শালবনে।

আমি মাটির রন্ধ্র খুঁজেছি। আমি শালবনে যাইনি। আমার মাটির তলায় আবিষ্কারের সাহস আছে। তামাইয়ের শালবনে যাবার উপায় নেই। সকল দিক থেকে যেন একটা বিরোধের বেড়াজালে আমাকে। কষে বাঁধছে।

তামাইয়ে এখনও বর্ষার জল ভরা, টান একটুও কমেনি। তার ওপরে কার্তিক মাসে প্রবল বৃষ্টি হল। তামাই যেন কেমন ভয়ংকরী হয়ে উঠল। আমার কাটা জায়গাগুলি ভরতি হয়ে গেল তামাইয়ের তাম্রাভ জলে। পুবের কূলে মাটি ভাঙতে লাগল।

.

প্রথম যেদিন বৃষ্টি হল, কুসুমের সেদিন অসুখ। একটু বাড়াবাড়ির লক্ষণ। নগেনবাবু এসে কেমন বিমর্ষ হয়ে গেলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, জ্বরটা তো অনেক দিন এসেছে। খবর দাওনি কেন টোপন?

বললাম, কুসুম তো আমাকে কিছু বলে না। পিসি

–তোমার পিসিও খবর দিতে পারতেন। বড় দেরি করেছ।

ইঞ্জেকশন দিলেন। খাবার ওষুধও লিখে দিলেন। যাবার সময়, বাইরে গিয়ে আমাকে বললেন, এত দূর খারাপ অবস্থায় এসেছে যে, কী বলব, বুঝতে পারছি না। বড় ভাল মেয়েটি।

আমি তাড়াতাড়ি কুসুমের কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কুসুম, কেমন লাগছে?

কুসুম আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ভাল।

বড় মায়া লাগল। কুসুমের এই নীরব অভিমানের কাছে কেমন যেন অপরাধী মনে হল নিজেকে। নগেন ডাক্তারকে দেরি করে খবর দেবার কথা শুনেছে ও। পিসির মুখ সবসময় থমথমে। কুসুমের অসুখ তো তাঁরও যেন সংসারের সব খেলার কোলাহল নীরব। জানি, নিঃসন্তানা পিসির আমি যা, তার চেয়ে কুসুম অনেক বেশি।

বিকেলে কুসুম একটু ঘুমিয়েছিল। আমি ভবেনদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ভবেন তখন বাইরের ঘরে কয়েকটি আগামী ম্যাট্রিকের ছাত্রকে পড়াচ্ছিল। ঝিনুক আমার মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

ওকে বললাম কুসুমের অসুখের কথা। নগেন ডাক্তারের শেষ কথাও উল্লেখ করলাম।

ঝিনুক একবার আমার চোখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, কুসুম তোমাকে ভালবাসে টোপনদা।

বললাম, সেটা কি আজ নতুন নাকি?

ঝিনুক আমার দিকে আবার তাকাল। ওর মুখে হঠাৎ এক ঝলক রক্ত এসে পড়ল। বলল, তুমি যা ভাবছ তা নয়। আমি বলছি, ও তোমাকে–তোমাকে–

একটা চমকিত বিস্ময়ের ভ্রূ কুঁচকে উঠল আমার। জিজ্ঞেস করলাম, কী আমাকে?

ঝিনুক বলল, একজন মেয়ে যেমন করে একজন পুরুষকে ভালবাসে, তেমনি।

একটা চমকিত বিস্ময়ের সঙ্গে বিরক্তি আমি চাপতে পারলাম না। বললাম, ঝিনুক ও বেচারির ওপর অমন অবিচার কোরো না। ও অত্যন্ত ছেলেমানুষ।

–অবিচার?

 ঝিনুক আমার সামনে এল। বলল, প্রথম যেদিন আমাকে দেখেছিলে টোপনদা, সে দিন কি আমি খুব বড় ছিলাম?

–সেদিন আমিও ছোট ছিলাম ঝিনুক।

ঝিনুকের মুখে অতীতের ফেলে-আসা লজ্জার ছায়া দেখতে পেলাম আজ। বলল, টোপনদা সেদিন তুমি ছোট হলে যা হত, বড় হলেও তাই হত।

তবু দু চোখে আমার বিস্ময়। বুকভরা অবিশ্বাস। বললাম, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই ঝিনুক।

–অবিশ্বাস করতে পার, আমি একটা সত্য কথা বললাম। টোপনদা, সংসারের সবই কি বিশ্বাসযোগ্য?

ঝিনুক জানালার কাছে গেল। সেখান থেকে বলল, টোপনদা, তুমি, আমি এ সব কি বিশ্বাসের? তুমি বলেছ, তোমার যা সান্ত্বনা, আমারও সেই সান্ত্বনা থাক। বলো তো, এ কষ্ট কি লোকে সত্যি বলে জানে?

নিজেকে সে কথা জিজ্ঞেস করবার সাহস নেই আমার। করতে পারলে এক দিন বুঝি শালবনে যেতে পারতাম। এক সন্ধ্যায় হয়তো গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম হেঁতালের তলায়। কিংবা ত্যাগ করতে পারতাম শালঘেরি।

কিন্তু ঝিনুকের কথায় অবিশ্বাসে তেমনি মনটা বেঁকে রইল আমার। কেন না, প্রবৃত্তিও ছিল না বিশ্বাসের। ঝিনুকের গলায় যে সুর কোনওদিন শুনিনি, সেই ভয়চাপা রুদ্ধ গলা শুনতে পেলাম। ঝিনুক বলল, কুসুমকে দেখে বুঝি আমারও বুক কেঁপেছিল টোপনদা। কুসুমকে দেখেই বুঝি আর পেছুতে পারিনি।

আমি আর্তস্বরে ডাকলাম, ঝিনুক!

না, তোমাকে কোনওদিন খাটো করিনি টোপনদা।

কুসুমের প্রতি ঝিনুকের ব্যবহারগুলি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তবু একী অবিশ্বাস্য কথা! এ কথা কেমন করে মানি।

ঝিনুক হঠাৎ দ্রুত বলে উঠল, টোপনদা, তুমি তাড়াতাড়ি কুসুমের কাছে যাও।

 ভবেন এল এ সময়ে। বলল, কী হল, তোরা আবার ঝগড়াটগড়া করেছিস নাকি?

আমি বললাম, না। কিন্তু ঝিনুক কী বলছে শোন। আমি চলি।

.

চলে এলাম। শালঘেরির রক্তমৃত্তিকা বৃষ্টির জলে গাঢ় রক্তের মতো হয়েছে। পুবে বাতাস বইছে। শালবনের আকাশে গাঢ় কালো মেঘ আছে থমকে। বাকি আকাশটার কোথাও কোথাও, ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে অস্পষ্ট নক্ষত্র দেখা যায়।

বাড়ি ফিরে এলাম। দূর থেকে লুকিয়ে কুসুমকে দেখার ইচ্ছে হল আমার। ঝিনুক এত অবিশ্বাসের কথাও বলতে পারে।

দরজার কাছে এসে দেখলাম, হরলালকাকা আর তারক উঁকি মারছে বাড়ির দিকে। আমাকে দেখে থতিয়ে গেল দুজনেই।

হরলালকাকা বললেন, এই যে টোপন, কুসি কেমন আছে?

বললাম, ঘুমোচ্ছে।

তারক অনেকখানি সরে গেছে আমাকে দেখেই।

হরলালকাকার মুখে মদের গন্ধ। বললাম, হরকাকা, কুসুমের শরীর খুবই খারাপ। আপনি আজকে যান।

হরলালকাকা বোধ হয় একটু বিব্রত হলেন। বললেন, খারাপ তো হবেই। নগেন শুদুরটাই আমার মেয়েকে মারবে।

আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। বাইরে থেকে হরলালকাকার গলা শোনা গেল, আচ্ছা, আমিও মেয়ের বাপ, একবার দেখে নেব।

দেখলাম, পিসি কুসুমের একটি শাড়ি জড়িয়ে পাকা মাথাটি বের করে আমার জন্য রান্নায় বসেছেন। পিসির বড় দুর্গতি।

জিজ্ঞেস করলাম, পিসি, কেমন আছে কুসুম।

পিসি বললেন, ঘুমোচ্ছে।

আমি পিসির ঘরে গেলাম। কুসুম এ ঘরেই আছে। একটি হ্যারিকেন একটু কমানো। তাতে সবই দেখা যায়। গিয়ে দেখলাম, কুসুমের চোখ বোজা। অপুষ্ট শীর্ণ শরীর থেকে কাঁথার ঢাকনা খুলে গেছে। কষ্টের একটি অস্পষ্ট ছাপ তাতে মুখে।

ঝিনুকের কথা কী অবিশ্বাস্য! এই তো কুসুম। অসুখে পড়েছে তাই, নইলে পিসির সঙ্গে এখন কিছু একটা বায়না নিয়ে থাকত। ঝগড়া চলত, দৌড়াদৌড়ি হত। হয়তো এর মধ্যে বারকয়েক ছুটে ভাইবোনেদের কাছে ঘুরে আসত গিয়ে। উচ্চকিত হাসিতে ডুবে যেত পিসির গলার স্বর।

কুসুমের দিকে তাকিয়ে আমার মন যেন অনেকখানি স্বচ্ছ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বসে থেকে আমি ওর কপালে হাত দিলাম। জ্বরটা কমেনি। বরং বেড়েছে যেন। কাঁথাটা টেনে দিলাম গলা অবধি। দিয়ে উঠে, চলে যাচ্ছিলাম।

কুসুমের গলা শুনলাম, টোপনদা।

 কুসুম ঘুমোয়নি? ফিরে বললাম, ঘুমোসনি কুসুম?

অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম, কুসুমের ঈষৎ রক্তাভ দুটি বড় বড় চোখ। করুণ দূরবিসারী অন্ধকারে দুটি আলোর মতো নিরুদ্দেশে খুঁজে ফেরা দৃষ্টি যেন। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কুসুম ঘুমোসনি?

ওর গলাটা মোটা আর চাপা শোনাল। বলল, ঘুম আসছে না। টোপনদা!

-কী বলছিস?

 তুমি কি তামাইয়ে যাচ্ছ?

না।

–টোপনদা, বাবা এসেছিল?

 আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। বললাম, হরকাকা এসেছিলেন, চলে গেছেন। কেন?

–এমনি।

কুসুমের চোখ তেমনি ভোলা। কিন্তু ওর মুখ ক্রমেই লাল হয়ে যাচ্ছে।

আমি পিসিকে ডাকলাম। পিসি এলেন। এসে দেখেই বললেন, জল, তাড়াতাড়ি জল দিতে হবে মাথায়।

পিসিই তাড়াতাড়ি জল নিয়ে এলেন। আমি ঢেলে দিলাম। পিসি কুসুমের গায়ে হাত বুলোতে লাগলেন।

মাথা ধোয়ার পর আমি নগেন ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এলাম আর একবার। নগেন ডাক্তার দেখে মুখ কালো করে বললেন, টাইফয়েড রোগ, বড্ড বেঁকে দাঁড়িয়েছে।

ইঞ্জেকশন দিয়ে চলে যাবার আগে বললেন, শরীরে তো দেখছি রেজিস্ট করবার ক্ষমতা একটুও নাই। ওর বাবা মাকে একটু খবর দিয়ে রাখো।

পিসির কাছে খবর পেয়ে ওর মা এলেন। দেখলেন অসহায়ভাবে। পিসিকে বললেন, সেজদি, দেখে কী করব। আপনার মেয়ে আপনি বুঝুন।

তারপর ওপর দিকে তাকিয়ে, কড় গুনে গুনে কী যেন বিড়বিড় করলেন। বললেন, পনরো পূর্ণ হয়ে, ষোলোয় পড়েছে দু মাস।

বলে চলে গেলেন। ছায়ার মতো এসেছিল কুসুমের ভাইবোনেরা। ওরাও মায়ের সঙ্গে চলে গেল।

 পিসি দালানে গিয়ে জপে বসলেন সব সেরে।

কুসুম আবার ডাকল, টোপনদা।

বাতিটা কাছেই। কুসুমের মুখটি যেন ঘাম ঘাম চকচকে লাগছে।

বললাম, কী বলছিস কুসুম?

কুসুমের চোখ তেমনি রক্তাভ। কিন্তু চোখের পাতা আনত। চুলগুলি বালিশ ছাড়িয়ে মেঝেয় পড়েছে। লাল কাঁচের চুড়ি পরা একটি হাত বুকের ওপরে।

বলল, তুমি কি ঝিনুকদির কাছে যাচ্ছ?

 ঝিনুকদির কাছে কেন ঝিনুকদিদের বাড়িতেই তো যাব কুসুম। কিংবা আজ ঝিনুকের কথা শুনে, আমার কানে লাগছে ওরকম।

বললাম, না। কেন রে?

 কুসুম এক বার তাকাল আমার মুখের দিকে। বলল, আমার অসুখ বলে যেতে পারছ না, না?

কুসুম যেন হাসল। যেন সুস্থ চকিত চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি মরে যাব, না?

আমার বুকের মধ্যে চমকে উঠল। কুসুমের পাশে বসে বললাম, না। অবাধ্য হোসনি কুসুম। চুপ করে ঘুমো।

কুসুম চোখ বুজল। কিন্তু ওর নাসারন্ধ্র ফুলছে বারে বারে। বুকের ওপর হাতখানি ওঠানামা করছে।

আমি মুখ ফিরিয়ে গালে হাত দিয়ে বসলাম। কুসুমের অসুখে আমাকে বড় একটা বসতে হয়নি কোনওদিন।

বাইরে বুঝি বৃষ্টি নেমেছে আবার।

সহসা আমার কোলে স্পর্শ পেতে চমকে ফিরলাম। কুসুমের হাত। কুসুম তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

কীরে কুসুম?

কুসুম আমার হাত টেনে নিল ওর কপালের ওপর। কিছু বলল না। আমার কানে ঝিনুকের কথাগুলি বাজতে লাগল। কুসুম যেন মৃত্যুর বিশ্বাসে কেমন বদলে গেল।

পরমুহূর্তেই দেখি, কুসুমের সর্বাঙ্গ কাঁপছে, ফুলছে।

কুসুম!

দেখলাম, কুসুম আমার হাত ওর মুখে চেপে ধরে কাঁদছে ফুলে ফুলে। ওর জ্বরতপ্ত মুখগহ্বরে, বিষম। জ্বরের শুকনো জ্বিহা ঠেকছে আমার আঙুলে।

কুসুমের মাথায় হাত দিয়ে আমি ভীত রুদ্ধ গলায় ডাকলাম কুসুম! কুসুম! কী হয়েছে।

 রোরুদ্যমান গলায় কুসুম অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি মরে যাব টোপনদা। আমি আর থাকতে পাব না।

না কুসুম, মরবি না। কুসুম।

কিন্তু কুসুম শান্ত হল না। পিসি ছুটে এলেন জপ ফেলে। ডাকলেন, কুসি অ কুসু।

কুসুমের সরু আঙুল আমার হাতে কঠিন শক্তিতে যেন বিদ্ধ হতে লাগল। ওর চোখের দৃষ্টি অস্থির। ও যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শ্বাসরুদ্ধ গলায় ডাকল, টোপনদা!

আমি দুহাত দিয়ে কুসুমকে সাপটে ধরলাম। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, বল কুসুম।

কুসুম তেমনি গলায় বলল, ঝিনুকদি। ঝিনুকদি।

ঝিনুকদি নেই এখানে কুসুম।

ঝিনুকদি..রাগ…করবে টোপনদা।

বলতে বলতে কুসুম প্রায় উঠে পড়ল। আমি জোরে ডাকলাম, কুসুম!

কুসুম চমকে ফিরে তাকাল আমার দিকে। দৃষ্টিটা সহসা স্বচ্ছ দেখাল আবার। তারপর আস্তে আস্তে আচ্ছন্ন হতে লাগল।

শুইয়ে দিলাম। ওর গা অত্যন্ত দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। দেখলাম, আমার জামা ওর মুঠিতে।

 সামনে তাকিয়ে দেখি পিসি নোনা দেয়ালে মুখ গুঁজে আছেন। সেই ফাটা পুরানো দেওয়ালের অভ্যন্তর থেকে একটি সরু গলার কান্নার স্বর আস্তে আস্তে নির্গত হচ্ছে।

কুসুমের রক্ত তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হতে লাগল।

আমার ভিতর থেকে কে যেন চুপিচুপি বলে উঠল, কুসুম তা হলে আমার সঙ্গে বুঝি তামাইয়ের ওপারে শালবনে বেড়াতে যেতে চেয়েছিল। কুসুমের প্রতিদিনের প্রতিটি হাসি, চাউনি, কথা আমার মনে পড়তে লাগল। কখনও তো কিছু বুঝতে পারিনি। এখনও যেন পারছি না।

কুসুমের মুঠি শিথিল হয়ে গেল। আমার কোলেই ওর শেষ নিশ্বাস পড়ল। তারক কোথায়? তারকের এক বার আসা উচিত এখন। সে তার তেজালো ভাল মেয়েটিকে এক বার দেখে যাক।

৫. গ্রীষ্মের প্রচণ্ডতা

৫. গ্রীষ্মের প্রচণ্ডতা

শালঘেরিতে গ্রীষ্মের প্রচণ্ডতা দেখা দিল। সূর্যোদয় হতে না হতেই যেন জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো মাটি তেতে ওঠে। ঘরের বাইরে এক মুহূর্ত চোখ রাখা যায় না। দৃষ্টি ঝলসে যায়। চারদিক সাদা আগুনের শিখা কাঁপতে থাকে, সাপের মতো ফণা তুলে দোলে। শালঘেরির কাঁকুরে পাথুরে রক্তাক্ত মাটি জ্বলন্ত উনুনের মতো গনগন করে। তার সঙ্গে লু। এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত ঝলসে দিয়ে যায়। মানুষ পশু পাখি পতঙ্গ সকলেই ছায়ান্ধকার খুঁজে ফেরে।

এ সময়ে শ্রমজীবী মেয়েপুরুষেরা তাড়ি আর আমানির সহায় নেয়। আমাদের এখন প্রায় প্রতি দিনই ঠাণ্ডা কড়ায়ের ডাল, আলু-পোস্ত, পোস্তর বড়া আর পুরনো তেঁতুলের অম্বল। আর কিছু ভালও লাগে না।

গ্রীষ্মের এই রুদ্র দাহের পর এল বর্ষা। গাছগুলি কৃষ্ণ সবুজ হয়ে চিকচিক করতে লাগল। মাটি গাঢ় লাল, কিন্তু স্নিগ্ধ দেখাল। তারপর দুরে শাল বনের দিকে তাকিয়ে, একদিন শরতের আবির্ভাব দেখতে পেলাম।

এই যে দিনগুলি যায়, এই দিনগুলিকে কাজহীন জীবনে দীর্ঘতর মনে হওয়াই তো উচিত ছিল। কিন্তু অস্বীকার করি কেমন করে, তা মনে হয় না। বিচারের অবসর পেলাম না, যাচাইয়ের উৎসাহ পেলাম না, কী একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে দিন কেটে যায়। কিংবা সেই অবসর আর উৎসাহকেই ভয় পেয়েছি, সরিয়ে রেখেছি দু হাত দিয়ে। একটা স্বপ্নের মধ্যে যেন নিবিড় নিবিড়তর হয়ে ডুবে যাচ্ছি।

একদা ছিল পুব পাড়ার হাতছানি। এখন দক্ষিণ। কিন্তু একটু কি চোখ চেয়ে দেখি নে, সকল ব্যাপ্তি কত জটিল বেড়ায় আমাকে ঘিরে ফেলেছে?

এদিকে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। সিন্ধু উপত্যকার অভিজ্ঞ কর্মী প্রত্ন ও নৃ-জ্ঞানী গোবিন্দ সিংহ চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তামাইয়ের মাটির অন্তরহস্য জানবার আগে আমি যেন আরও অনুসন্ধান করে নিশ্চিন্ত হই। মাটি খোঁড়ার কাজটা যখন খুশিই শুরু করা যায়। তার আগে জানা দরকার, হিসেবে কোথাও ভুল হচ্ছে কি না। আমি আরও নিদর্শন সংগ্রহের চেষ্টায় আছি। গোবিন্দবাবুর সাহচর্য নিয়ে প্রথম মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু করব। ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের জন্য গভর্নমেন্টের কাছ থেকে একটি লাইসেন্স গ্রহণ করতে হয়। গোবিন্দবাবুই তা আমাকে সংগ্রহ করে দেবেন।

মাঝে মাঝে বিজনে যাই। অর্থাৎ আমাদের শালঘেরির স্টেশনমাস্টার বিজন ঘোষের ওখানে। উনি বলেছিলেন, সময় পেলে বিজনে আসবেন মাঝে মাঝে। আমি আর ভবেন, দুজনেই যাই।

মিথ্যে নয় সত্যি সেটা ঘোর বিজন। সেই বিজনে আলো আছে, বাতাস আছে। আকাশে অনেক রং। কিন্তু ভদ্রলোকের রুদ্ধ কক্ষে কোথায় একটি কষে বাঁধা তারে টং টং করে একটি সচকিত আর্ত সুর বেজে ওঠে মাঝে মাঝে টের পাইনে।

বাড়ি খাস কলকাতাতেই। এখানে নাকি পালিয়ে এসেছেন। এবং পালিয়ে এসে বেঁচেছেন। এখান থেকে আর কোথাও যেতে চান না। এই নাকি ভাল। ভোরে পাখিরা যায়। সন্ধ্যায় পাখিরা ফিরে আসে। গাড়ি যায়, গাড়ি আসে। উনি নিশান দেখিয়ে খালাস।

তবে এই অদৃশ্য রুদ্ধ কক্ষে তারটাকে কে আঙুল দিয়ে টং টং করে? করুক। উনি কি খোঁজ রাখেন? এই নিরালায় আছেন বেশ। তবে মাঝে মধ্যে কেউ এলে একটু পরীক্ষা করে নিতে পারেন যে একেবারে বোবা হয়ে যাননি।

ভবেনের খুবই ভাল লেগেছে ভদ্রলোককে। আগে তো যেত সে। আমার বলতে ইচ্ছে করছিল, বিজনে আছেন বিজনবাবু। সে কথাটা এক বারও ভুলতে পারছেন না। একটু স্বজনে গিয়ে বরং ভুলে থাকুন বেঁচে যেতে পারেন।

আর বিজনবাবুর সবচেয়ে বড় অভিযোগ বচনের ওপর। বলেন, মশাই, ওই লোকটা আমাকে এখান থেকে ভাগিয়ে ছাড়বে। জানেন, লোকটা বদ্ধ মাতাল। আর আমাকে খালি বলে, বাবু, বেথা যদি না করে থাকেন, গিয়ে করে ফেলুন তাড়াতাড়ি। আপনার ব্যাপার খুব সুবিধার বুঝছি না। কত বড় সাহস দেখুন দিখি?

আমি হাসি চাপতে পারিনি। এ হেন বাণী নিতান্ত বচনের না হয়ে যায় না। ওর কথার মধ্যে একটা সত্য যেন কৌতুকের বেশে মিশে থাকে। বিজনবাবু বলেছেন, আবার কী বলে লোকটা জানেন? বলে, বাবু, কাউকে যদি ঠিক করে থাকেন বেকরবেন বলে, তালে দেরি করবেন না। মেয়েমানুষের মন, এ বেলা হ্যাঁ, ওবেলা না। জোর করে ধরে নিয়ে আসবেন।কত বড় পাজি বলুন তো।

ভবেন আর আমি দুজনেই মুখোমুখি হেসে উঠেছি হা হা করে দেখে বিজনবাবুই কেমন যেন অবাক হয়ে যান। তবু ভবেনের আর আমার হাসিটা থামতে অনেক সময় লাগে। তারপরে সন্দেহ হয়, আমরা বোধ হয় হাসি না।

বিজনবাবুর স্টেশনমাস্টারের গলাবন্ধ কোটের পকেট থেকে প্রায়ই সিলার-শেলি, গ্যেটে বায়রন ইয়েটস এলিঅটের কবিতার বই বেরিয়ে পড়ে। বলেন, যদি কিছু মনে না করেন, তবে একটু আবৃত্তি করি।

আমরা সানন্দে সম্মতি দিই। বিজনবাবু কবিতা পড়েন। ওঁর গলাটি সুন্দর, উচ্চারণ ততোধিক। আবৃত্তির সময় ওঁর বাহ্যজ্ঞান থাকে না। গলার স্বর আশ্চর্য ছন্দে ওঠা নামা করে, কাঁপে কখনও। কখনও হাসেন, চোখের কোণে বড় বড় ফোঁটায় জল জমে ওঠে। আমি আর ভবেন মুখোমুখি, চোখে চোখে চেয়ে থাকি। হাসতে যাই, হাসতে পারি নে। একটা বিস্মিত জিজ্ঞাসা দুজনের চোখে চিকচিক করতে থাকে। কখন যেন, চোখে আমাদেরও জল দেখা দেয়। এক সময়ে কবিতা পড়া শেষ হয়ে যায়। কিন্তু স্তব্ধতা ভাঙে না। তিনজনেই নীরব হয়ে বসে থাকি।

এই নীরবতার মধ্যে অনুভব করি, আমাদের সঙ্গে বিজনবাবুর একটা নিবিড় সম্পর্কে দাঁড়িয়ে গেছে। এবং এমনি নীরব নিবিড়তার মধ্যেই একদিন ধ্বনিত হল, এই দুর নির্জনে নির্বাসনের, ছোট সাধারণ একটি কাহিনী। একজনকে ভুলে থাকার সহজ কাহিনী। অসহজ শুধু এই, বিজনবাবুর মনে হয়, এই বিশাল নির্জনতাটাও সেই ভুলে থাকতে চাওয়ার মানুষটিতেই পরিপূর্ণ। এমনটা নাকি হত না। একদা যার সঙ্গে মনের মানুষ পাতিয়েছিলেন, সে দেহ নিয়ে অন্য কোথা ছুটেছিল। তারপরে হঠাৎ সে সংবাদ দিয়েছিল, ভুল হয়েছে, ভয়ংকর ভুল। ফিরে যাবার পথ কি আছে?

না। পথ ছিল না। নেই এখনও। তাই নিজেকেই নির্বাসন খুঁজে নিতে হল।

সে দিন আমি আর ভবেন চোখাচোখি করে, হঠাৎ হেসে ফেললাম। বিজনবাবু অবাক হলেন, তাকিয়ে রইলেন কিন্তু কিছু বললেন না।

কেবল বচন মাহাতত তার কালো কুচকুচে নতুন যুবতী সঙ্গিনীটির কাঁধে হাত রেখে, দুর থেকে তাকিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, অই, ইস্টিশনটা পাগলা গারদ হয়ে উঠলে গ।

গড়াইতে মহাদেববাবুর ওখানে ইচ্ছে করলেও যাইনি। ওঁর ব্যাপার যা শুনেছি, সেটাও ভাল লাগেনি। আর, অনিরুদ্ধ যে নেই।

.

আমার বুকের মধ্যে একটা দুরু দুরু শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। সে যে কীসের সংকেত, কার আগমনের অগ্রিম বার্তা জানাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারিনে। কেবল এইটুকু বুঝি, আমার অয়ন চলন একটা কক্ষপথে নির্ধারিত। আর ঝিনুক যেন একটা কেন্দ্রে বসে, সেই কক্ষের গতি নির্দেশ করছে।

পুবপাড়ার সেই ফুলটি যেন এতদিনে তার সব দল মেলেছে। এসে যে রূপ দেখেছিলাম ঝিনুকের, এখন তার চেয়ে আরও বেশি রূপ যেন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে সর্বাঙ্গে। যেন নতুন করে খোলস ছেড়েছে সে। কেন এমন হয়, তা বুঝিনে।

এই আমার শালঘেরি ফিরে আসা। মহাকালের যে ধ্বনি বিরতিতে শোনা যেত, সে এখন অষ্টপ্রহর বাজে আমার কানে। প্রত্যহের যে রাগিণী ছন্দ ও আবেগের সঞ্চারে আমার শালঘেরির জীবনকে হাসাবে কাঁদাবে ভেবেছিলাম, সে রাগিণী বাজল না। মহাকালের গুরু গুরু ধ্বনি আমাকে প্রতিনিয়ত জটিল ও রূঢ় চেতনার সীমায় রাখলে দাঁড় করিয়ে। তারই পায়ের চিহ্ন হাতের বেষ্টনীকে আমি দেখতে পেলাম ঝিনুকের হাতে পায়ে, শালঘেরির আকাশ মাটি ঘিরে।

ভবেনের সংসারে আমি প্রত্যহের তৃতীয় ব্যক্তি। ভবেন বলে, ভুল বলছিস টোপন। শুরু থেকে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে আমি আছি। শুধুমাত্র সময়ের কুটিল চালে একটা অনিয়ম ঘটে গেছে।

এমন সহজ উক্তিতে আমি থমকে যাই। মেনে নিতে পারিনে। অথচ প্রতিবাদ করার মতো কথা মেলে না। তর্ক বৃথা। কারণ, মনে হয় বিচারের অবকাশ রাখেনি ঝিনুক।

ভবেনের বাগানে ফুল ফোটেনি। যদি এমন বলতে পারতাম, কার বাগানে বা ফুটেছে? আমার বাগান নেই। ঝিনুকের বাগানেও কি সে ফুল ফোঁটাতে পেরেছে?

কিন্তু এমন বলা, ভাবা, সবটাই অবান্তর। সংসারে এমন একটি অনিয়মের ব্যাপার কারুর মনঃপূত নয়। কিন্তু সংসার কবে কার মনের মতো হয়েছে?

কালের মতো সংসার নিরবধি। তার সামাজিক আবর্তে আমরা ঘুরছি। সেইখানে আমরা চিত্রিত। বিচিত্রের এ কারসাজি সেখানে লক্ষ্যণীয় নয়।

তাই তামাইয়ের ধারে দাঁড়িয়ে যখন ওপারের শালবনের দিকে তাকাই, তখনও অকৃতজ্ঞ হয়ে মুখ ভার করে থাকিনে। আমার নিজেরই রক্ত দিয়ে গড়া জীবনদেবতাকে নমস্কার করি। কারণ, জীবন বয়ে চলবে। তার সঙ্গে অন্তস্রোতের এ আবর্তও থামবে না।

তবু, তবু ভয়ংকর অস্থিরতা চেপে ধরছে অতি মন্থরে, ক্রমেই যেন একটা ফাঁস শক্ত হয়ে উঠছে। আমি যেন ভবেনের মুখের দিকে তাকাতে পারিনে। নিজের ওপর ক্রুদ্ধ বিরক্ত হয়ে উঠি। অথচ তাতে আমার পথের নির্দেশ বদলায় না।

ঝিনুক এখন মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতেও আসে। পিসিকে সে খুশি করার চেষ্টা করে। কিন্তু পিসি খুশি হবেন না। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, কুসুমের ওপর ঝিনুক খুব সদয় নয়। কারণ, কুসুমের সঙ্গে সে খুব কম কথা বলে। লোকের সঙ্গে ব্যবহারে ঝিনুক কখনও খারাপ নয়। কিন্তু হরলালকাকার ওপর খুবই বিরক্ত। সংসারটাকে তিনি নষ্ট করেছেন বলেই হয়তো।

কিন্তু ঝিনুক যখন কুসুমকে তার পুজোপাট উপোস নিয়ে গম্ভীরভাবে বিদ্রূপ করে, তখন আমি অবাক হই, অস্বস্তিবোধ করি। বিশেষ করে পিসির সামনে তা একেবারে অনুচিত। তাতে পিসি ঝিনুকের ওপর আরও বেশি রুষ্টই হন।

কুসুমের প্রতিবাদ করার সাহস নেই। বরং দেখি, ঝিনুকের সামনে কুসুম যেন বড় বেশি গুটিয়ে যায়। ঝিনুকের সামনে থেকে সরে থাকতে চায়। যেন ঝিনুককে ও ভয় পায়। এতে ঝিনুকের দায়িত্বও বেশি। সে কি একটু স্নেহ করে, সহৃদয়ভাবে কথা বলতে পারে না? কিন্তু আমি ঝিনুককে এ বিষয়ে শেখাব, তা সম্ভব নয়। কারণ, ঝিনুক অচেতন নয়।

ঝিনুক এসে বলে, কী রে কুসি, পাকা বুড়ি, তোর ডেঙা শিবের মতিগতি কেমন?

কুসুম মুখ নিচু করে থাকে। কোনও জবাব দেয় না। কথাগুলি নিতান্তই ঠাট্টার, ঝিনুক বলতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে যদি হুলের খোঁচা থাকে তা হলে অস্বস্তি না হয়ে যায় না। তখন হয়তো পিসি ডেকে বলে ওঠেন, কুসি, সলতে পাকাবার ন্যাকড়া কোথায় আছে, একটু দেখে দে তো।

বুঝতে পারি, পিসি ইচ্ছে করেই কুসুমকে ডেকে সরিয়ে নিয়ে যান। ঝিনুক এলে, অধিকাংশ দিন বিকেলেই আসে। বাহন হিসেবে ইন্দির আসে। সে পিসির সঙ্গে বকবক করে। কুসুমকে আরবি ঘোড়ার গল্প শোনায়। যদিও আরবি ঘোড়া সে কখনও দেখেছে কি না সন্দেহ। কিন্তু সে যে একদা ঘোষালদের গাড়ি চালাত, এই অধিকারে, স্বচক্ষে পক্ষীরাজ দেখার কথাও বলতে পারে। কোথায় দেখেছে সে আরবি ঘোড়া? আঃ! হরোঠাকুরের বিটি কী বোকা গ! ক্যানে, বরিশের জমিদার মুখুজ্জে মশায়দের বাড়িতেই তো আরবি ঘোড়া ছিল। পেকাণ্ড ঘোড়া, দু মানুষ সমান উঁচা, আর সি জীবের কী বা গড়ন, কী বা বরণ! চকচকে সোনার মতন রং, উদিকে ল্যাজে ঝাপটা মারলেন ত গটা শরীলে ঢেউ খেলে গেল।

তবে মুশকিল এই, ঘোড়াটি বুনো, বদ ভারী বেয়াদপ ছিল। ইন্দিরকেই তো মুখুজ্জেরা ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন আরবিকে বাগ মানাতে। ঘোড়া আজ একে লাথি মারে, কাল ওকে চাট মারে, পিঠে কেউ চাপতে গেলে জগঝম্প নাচ।

কিন্তু ইন্দিরের কাছে ও সব চালাকি করলে চলবে না। তুমি ঘোড়া, আমি মানুষ। তোমার পিঠে আমি সওয়ার হবই। তা সে তুমি যত বেয়াদপিই করো। ইন্দির বলে আমি আমার মনিবের হুকুম নিয়ে গেলাম। নিজের হাতে আচ্ছা করে বেটাকে খাওয়ালাম। গা হাত পা ডলে মেজে দিলাম। কিন্তুক চখের লজরটি সুবিধের দেখলাম নাই। ত, পেথমে খুব চেঁচিয়ে হেঁকে গালাগাল দিলাম, শালো, বানচত, ইঁদুরের বাচ্চা! শালো, আরবি না খচ্চর তুই! লজ্জা নাই রে তোর, পাপের ফলে ঘোড়া হয়ে জন্মিছিস। তোর চাইতে একটা কুত্তাও ভাল, সেও কথা শোনে। আর এত বড় শরীলটা তোর, ঘোড়া বলে কথা, তুই চখ পাকাচ্ছিস?

লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চেঁচিয়ে কুঁদে এমন বললাম, আরবি কান খাড়া করে, ভয় ভয় চখে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি আস্তে আস্তে কাছে গেলাম, মাথাটা নামিয়ে নিয়ে এসে, কানে কানে একটা মন্তর দিলাম। সে মন্তর কাউকে বলতে নাই। দেখলাম, সমীহের ভাব এসেছে। তা পরে গদি এঁটে রেকাব পরালাম, লাগাম বাঁধলাম। আপত্তি করলে না। হাতে চাবুক নিয়ে লাফ দিয়ে উঠলাম। পেথমটা শান্ত কিন্তুক শালো লড়বে না। পা দিয়ে পেটে গুতা মারলাম। পেছুকার দু পা দিয়ে লাফিয়ে উঠল। সামনের দিকে হড়কে পড়েই যেতাম। তার আগেই লাগামে জোরে টান, আর চিহাঁ হাঁ হাঁ ডাক। ডাক দিয়েই দে ছুট। সি মানে তুমার, গুলতির গুলির মতন ছুটলে। দুটো কাঁদর লাফিয়ে পার। বাবুদের সব লোক, বরিশের তাবৎ মানুষ হায় হায় করতে লাগল, আমার মরণ আর ঠেকাবে কে। কিন্তু আমি ইন্দির সহিস। তুমাকে দিয়ে আমি গাড়ি টানাই, আর এখন ত ঘাড়ে চেপে আছি। ফ্যাল দিকি নীচে। লাগাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাইরে নিয়ে গেলাম। সি কী দৌড়। আরবির পা নাকি দেখা যাচ্ছিল নাই। মাঠ মাটি পাথর, কিছু বাকি রাখে নাই। আমি গায়ের চামটির মতন পিঠে চেপে রইলাম। তাপর ঝাড়া তিন ঘণ্টা দৌড়ে লাফিয়ে বাছাধনের হাঁপ ধরল, শান্ত হল। কিন্তুক আমি ছাড়বার পাত্তর নই, এই সুযোগ। দোষ করেছ, শাস্তি লাও। একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে খুব চাবকালাম। আবার গালাগাল দিলাম। পিঠে চেপে ফিরে এলাম, আস্তাবলে। ছিমান তখন ঠাণ্ডা মেরে গেছে। কিন্তুক তাড়াতাড়ি নিজের হাতে আবার খেতে দিলাম, গা ডলে ঘষে খুব আরাম দিলাম। সাত দিন! বুঝলে গ দিদি, সাত দিনে আরবি মানুষ হয়ে গেল।

এমনি নানান গল্প সে কুসুমকে শোনায়। কুসুম বড় বড় চোখে হা করে শোনে। আমার সামনে অবশ্য ইন্দির গল্প বলার তেমন উৎসাহ পায় না। বুঝতে পারি, তার মন আর আবেগ দিয়ে আমাকে যেমনটি দেখতে চেয়েছিল, তেমন আমি নই। আমি তার অপছন্দের তালিকায় স্থান পেয়েছি।

গল্প বলার জন্য কুসুমকে বা পিসিকে না পেলে ঝিনুকের অনুমতি নিয়ে ইস্টিশনের পাকা রাস্তায় একটু পাক দিয়ে আসে। ঝিনুক সরাসরি আমার ঘরে চলে আসে। নিজের কাছে অস্বীকার করতে পারিনে, আমি অস্বস্তিবোধ করতে থাকি। সারা বাড়ির মধ্যেই একটা অস্বস্তি ঘিরে আসে।

ঝিনুক নিশ্চয় তা বোঝে। কিন্তু মেনে নিতে চায় না। আমি বলি, তুমি আবার এলে কেন। আমিই তো যেতাম। ঝিনুক বলে, মাঝে মাঝে ফাঁক দাও বলেই, ভয় পাই, আজ বুঝি এলে না। তাই আগে আগে চলে এলাম।

এমনি করে বললে কোনও কথা বলতে পারিনে। শুধু ঝিনুকের চোখের দিকে তাকাই। সেখানে উপহাস বিদ্রুপের কোনও চিহ্নই নেই। বরং ঝিনুকের সেই চোখের দিকে তাকিয়ে, আমার বুকের মধ্যে যেন একটা তীর বেঁধা পাখি পাখা ঝাপটাতে থাকে। চোখ ফিরিয়ে নিই। আবেগ ও যাতনার সংঘর্ষে, কথা আসে না মুখে।

ঝিনুক কিন্তু রেহাই দেয় না। বলে, মুখ ফিরিয়ে নাও যে? আমি তাড়াতাড়ি বলি, ভবেন ইস্কুল থেকে বাড়ি এসেছে?

ঝিনুক বলে, না। আনিদিকে বলে এসেছি। খবর পেয়ে সেও এখানেই চলে আসবে।

তাই আসে ভবেন। ঝিনুক এলে অধিকাংশ দিন ভবেনও আসে। রাত্রে আমরা তিন জনে একসঙ্গে ফিরে যাই।

ঝিনুক কথার খেই হারায় না। বলে, কিন্তু এ কথা কেন বলো? আমি কি তোমার বাড়িতে আসব না?

ঝিনুক তোমার বাড়ি বলে, তোমাদের বাড়ি বলে না। আমি বলি, তা কেন? তুমি আবার এলে কষ্ট করে।

-কষ্ট?

ঝিনুক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে যেন। তারপর অন্যমনস্কের মতোই আপন মনে বলে, কষ্ট!ক বছর তো কোথাও বেরুইনি। তখন যে জোর করে বেরোইনি তা নয়। সেটাও যেমন ইচ্ছে করে নয়, এটাও তেমনি ইচ্ছে করে নয়। সব আপনি আপনি হয়ে যায়। এর মধ্যে কষ্ট আছে কি না আমি জানি না। কিন্তু তুমি তো সে জন্যে বলনি।

আমি ফিরে তাকাই।

— ঝিনুক আবার বলে, তুমি বলো পিসির জন্যে, পাড়ার লোকের জন্যে। তোমার অস্বস্তি হয়। আমার অস্বস্তি হয় না, আমার এ সব মনে হয় না। তোমার যে অস্বস্তি হয়, এও আমার সয় না। সংসারে সকলের জীবন কি এক রকম হয়? হয় না। তবে আর সকলের কথা ভাবি কেন? কারু কথা ভাবব না। তুমি যদি বারণ করো, আলাদা কথা।

বলে আমার চোখের দিকে তাকায়। যেন আমার ভিতর অবধি দেখে নিতে চায়। আমি মনে মনে বলি, সকল বারণের পথ আগলে রেখে, এ কথা বললে, আমি কি তার জবাব দিতে পারি? জানি, ঝিনুক বারণ বলে কিছু রাখতে রাজি নয়। আমার সব কথা তো সেখানেই ফুরায়। আমার সব প্রশ্নের সেখানেই অবসান।

তবু সেই যে আমার বুকের মধ্যে দুরু দুরু গুরু গুরু ধ্বনি, তাতে যেন অজস্র বারণের সংকেত আমাকে ইশারা করে। অনেক বারণ, অনেক বারণ। অথচ সে বারণ আমার মতোই অসহায়।

এ সব কথা প্রথম প্রথম হত, এখন আর হয় না। এখন ঝিনুকের আসাটা সকল কথার ঊর্ধ্বে চলে গেছে। কিন্তু ঝিনুক সাঁঝবেলায় এসে যখন, কুসুমের হাত থেকে রান্নার দায়িত্বটা নিয়ে, হেঁসেলে পড়ে বসে, তখন পিসির কাষ্ঠ হাসি দেখে আমিও বিব্রত হয়ে পড়ি। পিসি বলেন, আ হা হা, তাই কি হয়, তুমি এ বাড়িতে এসে রান্নার খেসমত খাটবে।

কথার সুরে পিসির অনিচ্ছাটাই ফোটে। কিন্তু ঝিনুক এত সহজে সব চালিয়ে যায়, কিছু বলা যায় না আর। বলে, শুধু বসে গল্প করব তার চেয়ে টোপনদার রান্নাটা করে দিয়ে যাই।

আমি তাড়াতাড়ি হেসে বলি, তা হলে ভবেন আর তুমিও এখানেই খেয়ে যেয়ো, সেই ভাবে বেঁধে। আমি বরং আনিদিকে বলে আসি। ভবেনকেও ডেকে নিয়ে আসি।

ঝিনুক খুব সহজভাবেই বলে, যাবে আর আসবে, একটুও দেরি করতে পারবে না।

এ রকম নির্দেশে যে পিসির আপত্তি আছে, বুঝতে পারি, যখন তিনি বলেন, ওরে, ওরা পুরুষ মানুষ, ওদের কি ওভাবে বলা যায়, না, ওরা তা শোনে?

ঝিনুক অন্য দিকে মুখ রেখে শুধু বলে, শুনতে হবে পিসি।

পিসি নীরব হয়ে যান, আমি বেরিয়ে যাই। কিন্তু রান্নার দায়িত্ব থেকে যাকে মুক্তি দেওয়া হয়, সেই কুসুমের অবস্থা অবর্ণনীয়। এ রকম ক্ষেত্রে, প্রথম দু-একবার পিসিকে বলে কুসুম তৎক্ষণাৎ বাড়ি চলে গেছে। আমি না জেনে যখন খোঁজ-খবর করেছি, তখন পিসি জানিয়েছেন, কুসুম তো নেই, ওর মার কাছে গেছে। আজ রাত্রে একেবারে খেয়ে দেয়ে শুতে আসবে।  

আমি অবাক হয়ে বলেছি, তাই নাকি? কখন গেল, আমাকে কিছু বলেনি তো।

 পিসি জবাব দিয়েছেন, আমাকে বলে গেছে। তুই ব্যস্ত ছিলি তাই তোকে আর বলে যেতে পারেনি।

সত্যি ব্যস্ত ছিলাম কি না, ভেবে নিজেই থমকে যাই। ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। পরে কুসুমকে জিজ্ঞেস করেও এক রকমই জবাব পেয়েছি, ঝিনুকদি রাঁধবে দেখে ভাবলাম, আজ মার কাছে। চলে যাই।

আমি এক মুহূর্ত কুসুমের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করেছি, রাগ করেছিস নাকি?

অমনি কুসুমের মুখ নত হয়েছে। নিঃশব্দে ঘাড় নেড়েছে, ও রাগ করেনি। পরে বুঝেছি, রাগ নয়, কুসুমের কষ্ট হয়। ঝিনুকদি রাঁধে বলে নয়, ওর কোনও সাহায্যেরও প্রয়োজন হয় না। ঝিনুক ওকে একেবারে রান্নাঘর ছাড়া করে দেয়। যেখানে ওরই পরিপূর্ণ অধিকার, সেখান থেকে মাঝে মাঝে বিনা নোটিশে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ মেনে নিতে পারে না। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া যে কুসুমের কাছে মর্মান্তিক, তা বুঝতে পারলাম, এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করে ওকে কাঁদতে দেখে। কিন্তু এ কান্নার কোনও যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাইনে। এমন একটা তুচ্ছ ব্যাপার, এক ফোঁটা মেয়ে কাঁদে কেন? আমার বিরক্ত হওয়া দেখে, কুসুম আর কাঁদেনি। বাড়িতে ওর মায়ের কাছে পালিয়েও যায় না। লক্ষ্মী মেয়ের মতো বই নিয়ে পড়তে বসে। তাতে আমি খুশি হতে চেয়েছি, কিন্তু স্বস্তি বোধ করি না।

ক্রমে দেখছি, ঝিনুককে কুসুম সত্যি ভয় পেতে আরম্ভ করেছে। সেই ভয়ের মধ্যে যেন একটা সম্মোহনের ভাব। ভয় পায় অথচ অবহেলা করতে পারে না।

একদিন ভবেন বলল, কুসুমের এ ভয় পাওয়াটা ভাল নয়।

-কেন?

–ভয় যদি কোনওদিন ভাঙে, সেটা বড় দুর্দিন হবে।

 আমি বিশ্বাস করিনে। কিংবা বলা চলে, কুসুমের ভয়ের ততোধিক মূল্য দিতে চাইনে।

ঝিনুকের আসার চেয়ে, তবু আমার যাওয়াটাই বেশি।

নিজের কাছে অস্বীকার করে লাভ নেই, ঝিনুকের কাছে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নিজের মনেই এত বাধার কাঁটা-তারের জটলা যে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মরি। এ আসলে আমার সেই, শালঘেরির ধুলো ছিটিয়ে না হাসতে পারা। বনের আড়ালে গিয়ে না কাঁদতে পারা।

আমাকে ঘিরে জমে উঠছে নানান দেশি বিদেশি প্রত্নতত্ত্বের বই। সম্প্রতি সাঁওতাল পাড়ার করিক টুডু জুটেছে। তামাইয়ের ধারে ও আশেপাশে প্রাচীন বস্তুর সন্ধানে, সে আমার সঙ্গে থাকে। তাকে নিয়েই ঘোরাফেরা করি। কিন্তু ঝিনুক আমার পড়া ও কাজকে যেন তেমন আমল দিতে চায় না। ইন্দিরকে দিয়ে যখন তখন ডেকে পাঠায়। ইন্দিরের ওপর এমন নির্দেশও থাকে, বাড়িতে না পেলে, যেখান থেকে তোক খুঁজে সংবাদ দিতে হবে। বুঝতে পারি, ইন্দিরের কাছে এ কাজটা মোটেই পছন্দসই নয় বরং আপত্তিকর?

ঝিনুককে গিয়ে রুষ্ট হয়েই বলি, এরকম যখন-তখন ডেকে পাঠাও কেন?

 ঝিনুক চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখা যায়।

 বলে, আমি ডাকি আমার দায়ে, তোমার যদি ইচ্ছে না হয় এসো না।

আমি তখন বলি, কথা বললেই তো দেখছি রাগ করো।

সত্যি কথায় রাগারাগি কী আছে?

তারপরে আমাকে চুপ করতে হয়।

 ঝিনুক হয়তো বলে, একটু চা করে দেব?

কিংবা বলে, কাজের মানুষ হয়েছ, কাজ করো না এখানে বসে বসে।

যদি বলি, এখন তামাইয়ের ধারে যাব, কাজ আছে।

ঝিনুক বলে, নিয়ে যাবে সঙ্গে?

ঝিনুকের চোখের দিকে তখন তাকিয়ে দেখেছি, সেখানে কোনও মিথ্যে ঠাট্টার কৌতূহল নেই। কিন্তু সে আহ্বান আমি কোনওদিনই করতে পারব না।

উপীনকাকার বাড়িতেও মাঝে মাঝে দেখা হয় ঝিনুকের সঙ্গে। আমি হেঁতালগাছটার দিকে তাকালে ঝিনুক আমাকে জিজ্ঞেস করে, যাবে?

–কোথায়?

–ওখানে?

যেন একটি দূরাগত রহস্যের ইশারার মতো হেঁতালগাছের তলায় আঙুল দেখায় সে।

আমি তাকাই ঝিনুকের দিকে। তার দেহের রৌদ্রচ্ছটায় আমার চোখ ঝলকায়। রক্তে রক্তে সঞ্চারিত হয় সেই রোদ। আমি দেখি, তার রক্তাভ ঠোঁটে, দূরবিসারী চোখে, আকাশের সেই কবেকার খসে-পড়া। তারার আলোছায়ার খেলা। তার দুই প্রতীক্ষিত বাহুতে নিটুট যৌবনের দৃপ্তভারে, কোন অজানা আদিমকাল থেকে স্তম্ভিত তার গুরু ও বলিষ্ঠ নিম্ন শরীরে এক রুদ্ধশ্বাস স্তব্ধতা। এ কবেকার প্রতীক্ষা? সেই আদিম অজানা কালের বয়স কত? তার ওপর থেকে একটি স্পর্শের অতি প্রত্যক্ষ চেনা অনুভূতি আমার রক্তের মধ্যে দাপাদাপি করে। একটা দুঃসহ সুখে ও যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন চোখে যেন স্বপ্নের মতো, বিস্রস্ত বেশ, সুঠাম তনুর প্রত্যঙ্গ ভেসে ওঠে। গভীর তৃষ্ণায় মুখ নামিয়ে, দুটি রক্তাভ ঠোঁটের উষ্ণ ভেজা কম্পিত কপাটে, নিশ্বাসে, রক্তের ও প্রাণের তীব্র মদির গন্ধ পাই। আমার ভিতরটা কাঁপতে থাকে।

চোখ ফিরিয়ে হেঁতালগাছের দিকে তাকাই আবার। আর দূর থেকে যেমন দুরু দুরু শব্দে ঢাকের দগর ভেসে আসে, তেমনি আমার বুকের ভিতরে শব্দ বেজে ওঠে। সেই শব্দের ভিতর দিয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভবেনের মুখ। রুদ্ধশ্বাস হয়ে বলি, না, যেতে পারব না ঝিনুক।

–কেন টোপনদা!

–ওইটিই আমার সান্ত্বনা ঝিনুক।

 আজকাল ভবেনের মুখখানি প্রায়ই, আচমকা আমার চোখে ভেসে ওঠে। যখন একলা থাকি, যখন পড়ি, যখন চলি, হঠাৎ দেখতে পাই, ভবেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন একটি বিব্রত বিভ্রান্ত হাসি ওর মুখে। আমার এই দেখার ভিতর দিয়েই আবিষ্কার করি, ওর চোখের কোল বসে গেছে। ওর মুখের রেখাগুলি গম্ভীর হয়ে উঠছে, শরীরটা শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমি দেখতে পাই, আর সেই বিষাণের গুরু গুরু ধ্বনি প্রবল হয়ে ওঠে। ভবেনের মুখের সঙ্গে আমার সেই গুরু গুরু ধ্বনির কী একটা যোগাযোগ যেন আছে।

তখন আর আমি স্থির থাকতে পারিনে। ভবেনের কাছে ছুটে যাই। কাছে গিয়ে বাস্তবেও দেখি, ভবেনের চেহারায় ভাঙন। লক্ষ পড়ে ওর চুলে পাক ধরেছে। কিছু বলতে পারিনে। শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।

ভবেন বলে, কী রে?

আমি বলি, কিছু নয়। তার কাছে আসতে ইচ্ছে করল।

তারপর দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকি, আর হঠাৎ দুজনেই হো হো করে হাসতে থাকি। আমি বলি, উল্লুক, হাসিস না।

ভবেন বলে, রাস্কেল, তুই তো হাসছিস।

তখন আমাদের কেউ দেখলে, পাগল ছাড়া আর কিছু ভাববে না। কিন্তু আমি যেন কী বলতে চাই, বলতে পারিনে। কেউ যেন আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছে। অথচ, কী একটা যেন আসন্ন হয়ে উঠছে। একটা ভয়ংকর কিছু।

মাঝে মাঝে আমি আর ভবেন দাবা নিয়ে বসি অবসর সময়ে। আমাদের দুজনের মাঝখানে বসে ঝিনুক। ওকে দেখলে কেউ বুঝবে না যে ও দাবা খেলা জানে। কারণ, দাবার ছকের থেকে, আমাদের দুজনের মুখের ওপরেই ওর দৃষ্টি বেশি চলে ফিরে বেড়ায়।

আমি আর ভবেন খুব ভাল চালের খেলোয়াড় নই। মোটামুটি। ঝিনুক শুধু মাঝে মাঝে তার চুড়ি-পরা হাতখানি বাড়িয়ে, সহসা একটি করে চাল দিয়ে দেয়। কখনও আমার হয়ে, কখনও ভবেনের হয়ে। কিন্তু যার হয়ে যখনই দেয়, তখনই উলটোপক্ষের নিশ্চিত মাত।

আর এমন বিস্ময়কর সেই চাল দেওয়া ও মাত করা, আমরা দুজনেই অগম্য বুদ্ধি নিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। যদি জিজ্ঞেস করি, এটা কেমন করে ঘটল?

ঝিনুক হয়তো তখনই উঠে যেতে যেতে বলে, ওই ভদ্রলোক তো (অর্থাৎ ভবেন) বোড়ের চাল ছাড়া কিছু দেবেন না বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু তোমার ঘোড়া যে ওত পেতে আছে, তা লক্ষ করেননি। তুমি দিব্যি বোড়েগুলো গাপ করছিলে। তাই ডান দিকে ওঁর গজ সরালাম পেছনে। তারপর ঘোড়া মন্ত্রী সরিয়ে, বোড়ে দিয়েই কিস্তি মাত করলাম। ভুল হয়নি তো আমার!

ভুল? আমরা দুজনেই সেই আশ্চর্য নির্ভুল, নিশ্চিত মাত করা দেখে নির্বাক হয়ে থাকি। ঝিনুক চলে যায়।

আসলে দাবার ছকটি একটি যুদ্ধক্ষেত্রের মতো পুরোপুরি ঝিনুকেরই আয়ত্তে।

প্রথম দিন খেতে বসে ভেবেছিলাম, ঝিনুক যেন মহারানি, আমি আর ভবেন তার বশংবদ প্রজা। সেটা যেন একটা নিষ্ঠুর সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে।

কিন্তু কুসুমের প্রতি ঝিনুকের বিরূপতা সমান। হয়তো, কুসুম যে আমার খাওয়া-শোয়ার রক্ষণাবেক্ষণে আছে, এটা ঝিনুকের মনঃপূত নয়। আমার বিশ্বাস, কুসুমের জায়গায় যে কেউই থাকত তাকেই ঝিনুকের ভাল লাগত না। এটা কি অপ্রতিরোধ্য?

সবচেয়ে বাড়াবাড়ি হয়েছিল একদিন। কুসুমের বুঝি মাঝে কী ব্রত হয়েছিল, যা কুসুমের মতো মেয়েরাই করে থাকে। সেই উপলক্ষে একজন ব্রাহ্মণ ভোজনের নিমন্ত্রণটা দ্বিপ্রহরে কুসুম আমাকেই করেছিল। যদিও নিমন্ত্রণটা আমাদেরই বাড়িতে এবং পিসি তাঁর থলি থেকে ও বাবদে ভালই খরচ করেছিলেন।

কিন্তু সেইদিন ঝিনুকও দুপুরেই নিমন্ত্রণ করে বসল। ঝিনুক সাধারণত রাত্রেই নিমন্ত্রণ করে। যদিও অবশ্য নিমন্ত্রণ কথাটার কোনও অর্থ হয় না। ঝিনুকের ইচ্ছেই নিমন্ত্রণ। কুসুমকে রাতের আশ্বাস দিয়ে আমি ঝিনুকের নিমন্ত্রণই রক্ষা করেছিলাম। কিন্তু বিরক্তিটা আমি চাপতে পারিনি। বলেছিলাম, তোমার কোনও উপলক্ষ নেই। ও বেচারির একটা উপলক্ষ ছিল।

ঝিনুক বলেছিল, বিনা উপলক্ষ কারুরই নেই। আমি দেখছি, এ সব ব্যাপারে কুসুমকে তুমিও প্রশ্রয় দিচ্ছ।

ঝিনুকের কথায় একেবারে অবিশ্বাসও করতে পারিনি। কুসুমকে যে পড়াশোনা করতে বলি, তাতে ওর তেমন উৎসাহ তো দেখতে পাইনে।

সেইদিন রাতে খেতে বসে কুসুমকে বলেছিলাম, এ সব গেঁয়োমিগিরি তো খুব করছিস কুসুম। তোর দ্বারা কিছু আর হবে না। এবার ওই তারককে ডেকে সত্যি দুহাতে এক করে দিই, মিটে যাক।

সেই মুহূর্তেই কুসুমের চোখ থেকে সব উৎসবের আলো নিভে গিয়েছিল। মন বিমর্ষ হলেও, আমি নরম হইনি।

এখন কুসুম রোজই একটু পড়াশোনা করে। আমার পড়ার তাড়া, পিসির সংসারের তাড়া, দুয়ের মাঝে ছুটোছুটি কুসুমের।

.

বছর ঘুরে আবার বসন্ত এসেছে শালঘেরিতে। এই যে ধুলো ওড়া, পাতা খসা, মাঝে মাঝে একটু রং-এর ছোপ লাগা শালঘেরি, দেখলেই কেন যেন আমার মনে হয়, পৃথিবীর কোথায় একটা শক্ত বাঁধনে ভীষণ মোচড় লাগছে।

সেদিন প্রায় সন্ধ্যাবেলা সাঁওতাল সর্দার করিক টুডুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে তামাইয়ের ধারে চলে গেলাম। ইতিমধ্যে আরও কয়েকটি জিনিস আমার সংগ্রহে এসেছে। মাটির কয়েকটি ছোট পাত্র এবং দু-একটি অলংকারের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছি। গোবিন্দ সিংহ ও মিহিরবাবুকে সে সংবাদ জানিয়েছি। গোবিন্দবাবুর আশা এখন অনেক বেড়েছে। তিনিও আমার মতোই প্রায় নিশ্চিত এখন, তামাইয়ের গর্ভ হয়তো একবারে শূন্য নয়। আমি তাই প্রতি দিন, এই পড়ন্ত বেলায়, দিনের শেষে এক বার তামাইয়ের ধারে না এসে পারিনে।

করিক চলে গেল তামাই পার হয়ে। শালবনের দক্ষিণে ওদের বস্তি। আমি সেই পাথরটার কাছে বসে রইলাম। অন্ধকার নামার আগে, নির্জন তামাইয়ের ধারে পাখিরা জটলা করছে।

শাল-তালের ফাঁকে ফাঁকে এত পলাশের জটলা অন্য সময় টের পাওয়া যায় না। তামাইয়ের দুপারেই পলাশের অজস্র রক্তিম ঠোঁট আকাশের দিকে মুখ বাড়িয়ে আছে। শালবনে এখন ঝিঁঝির ডাক ডুবিয়ে অষ্টপ্রহর বাতাসের গর্জন। রক্তধূলার ছড়াছড়ি।

সহসা পিছনে পায়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি ঝিনুক।

–এখানে কেন ঝিনুক।

–দেখলাম, তুমি এলে এদিকে।

–কোথা থেকে দেখলে।

–আমাদের বাড়ির জানালা থেকে।

অর্থাৎ উপীনকাকার বাড়ি থেকে। জিজ্ঞেস করলাম, ভবেন ফেরেনি স্কুল থেকে!

–তোমারই কাজে নাকি গেছে জেলা শহরে। ক্যামেরার ফিল্ম আনতে।

কিন্তু ও নিজে গেল কেন? কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিলেই তো পারত। আমি তো তাই বলেছিলাম।

–তা জানি না।

যে সব জিনিস তামাইয়ের ধারে কাছে পেয়েছি তার ফটো তোলার জন্যেই ফিৰ্ম দরকার।

দেখলাম, ঝিনুক তামাইয়ের ওপারে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমি আর স্বস্তি পেলাম না। ইদানীং শালঘেরিতে আমাদের বিষয় কথা হয়। গ্রামবাসীর কৌতূহল জেগে উঠেছে। আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থা আর নেই।

বললাম, এভাবে হঠাৎ এসে পড়লে কেন? কেউ যদি আসে এখন এদিকে?

ঝিনুক বলল, এখন কেউ আসবে না।

–তুমি জেনে বসে আছ, না?

ঝিনুক তাকাল আমার দিকে। বলল, লুকিয়ে পড়ব পাথরের আড়ালে। এত বড় পাথরের আড়ালে লুকোনো যাবে না?

বলে ঝিনুক আমার মাথার ওপর দিয়ে পাথরটার দিকে তাকাল।

ঝিনুক আজ চুল বাঁধেনি। আঁচড়ায়ওনি বোধ হয় ভাল করে। চোখের কোলগুলি বসা। গাল দুটি অতিরিক্ত লাল দেখাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে একটু ক্লান্ত হাসি যেন এলিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু চোখ দুটিতে গাঢ় ছায়া।

বললাম, আড়াল করবার মতো এ পাথর নয় ঝিনুক, চলে যাও।

ঝিনুক এগিয়ে গেল জলের দিকে। গিয়ে বসল। খোলা চুল পিঠ বেয়ে মাটিতে পড়ল তার। হাত দিয়ে সে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিতে লাগল স্রোতের বুকে। যেন কী এক খেয়ালি তর্পণে সে ব্যস্ত।

এখন জল আরও কম। হাঁটুও নয়। পাথরে বাধা-পাওয়া স্রোতের শব্দ খুবই ক্ষীণ। শালবনের বাতাসে শোনাও যায় না।

ঝিনুক এক বার ফিরে তাকাল। তারপর বাঁ হাতের আঙুল তুলে শালবনের দিকে দেখাল। আমার স্তব্ধ বুকে সহসা সেই গুরু গুরু ধ্বনি বেজে উঠল।

ঝিনুক জলে নামল। কিছু বলতে না বলতেই দেখলাম, ঝিনুক ওপারের কাছাকাছি। উঠে ডাকলাম, ঝিনুক।

ঝিনুক ফিরে তাকিয়ে হাসল, কিন্তু থামল না।

আমি জলের ধারে গিয়ে ডাকলাম, ঝিনুক কী হচ্ছে এটা? অন্ধকার হয়ে আসছে।

ঝিনুক শালবনের উঁচুতে পা বাড়িয়েছে তখন। বনের ফাঁকে ফাঁকে ইতিমধ্যেই অন্ধকার তার থাবা বাড়িয়েছে। বাতাসের ঝাপটায় কোটি কোটি শালফুল নাচছে বাতাসে তাল দিয়ে দিয়ে। ঝিনুককে পেয়েই যেন তাদের এত উন্মত্ততা।

একদা শালবনের ওই সীমানা লঙ্ঘন করে, তার নিবিড় জটাজুট ছায়ায়, ঝিনুকের সংকেতে হারিয়ে যাবার জন্যে ছুটে গিয়েছি। শুকনো পাতার শয়ানে ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে, সময় কোথা দিয়ে গেছে, টের পাইনি। এখন আমার বুক কাঁপছে। গলায় স্বর নেই।

আমি আবার ডাকলাম, ঝিনুক।

ঝিনুক ক্রমেই বনের দিকে পা বাড়াচ্ছে। ঢুকলে আমি আর ওকে খুঁজে পাব না হয়তো। গাছের জটলার কোন অন্ধকারে আমিও হয়তো পথ হারাব। সংসারের কাছে ঝিনুক আমাকে সেইখানে বেঁধেছে, যেখান থেকে আমি এর কোনও কৈফিয়ত দিতে পারব না।

আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গেলাম জল পার হয়ে। ওপরে উঠে বনের হাতায় ঝিনুকের সামনে গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ালাম।

ঝিনুক দাঁড়াল, কিন্তু মুখ তুলল না। দেখলাম, আমরা দুজনেই হাঁপাচ্ছি।

তারপর আস্তে আস্তে আমাদের নিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল।

ঝিনুক চোখ তুলল। আমার দিকে তাকাল। তারপর বনের গভীরে অস্পষ্ট অন্ধকারের প্রতি দৃষ্টিপাত করল।

আমি বললাম, ফিরে চলল ঝিনুক।

ওর পিছনে পিছনে নামবার আগে, আমি এক বার বনের দিকে না তাকিয়ে পারলাম না।

অন্ধকার তখন নেমেছে। উপীনকাকার বাড়ির দরজার বাইরে আমি দাঁড়ালাম। ভিতরে ইন্দিরের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। ইন্দিরের গলার স্বর শুনে থমকে গেলাম। আর এই বোধ হয় প্রথম থমকে যাওয়া। কোথায় যেন একটা দ্বিধাবোধ আমায় বাধা দিল। অস্ফুট গলায় বললাম, যাচ্ছি।

ঝিনুককে বাড়ির দরজায় রেখে, হেঁতালের তলা দিয়ে এলাম আমি। তখন আমার বুকের মধ্যে গুরু গুরু ধ্বনি এত প্রবল হয়ে উঠেছে, যেন বাইরে একটা শব্দ করে ফেটে পড়বে। কিন্তু আমি শান্ত হতে পারলাম না। একদিকে মাথার ভিতরে একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা দুঃসহ যন্ত্রণায় মাথা ঘুরতে লাগল। বর্তমান ঝিনুক এবং অতীতের স্মৃতি, সব কিছুই আমার প্রাণের মূল থেকে, রক্ত মাংসের প্রবাহে যেন অতি তীক্ষ্ণ ভয়ংকর আয়ুধসহ সংগ্রামে নেমেছে। আর একদিকে অসহ্য আত্মগ্লানি। এই দুয়ের মাঝখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে, কেবল শুনছি সেই গুরু গুরু দুর গর্জনের শব্দ। আর বারে বারেই, এই শব্দের মধ্যে ভবেনকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। মনে হয় এর মধ্যে যেন মহাকালের বিশেষ একটা ইঙ্গিত আছে। এটা নিতান্তই তার ভয়। দেখানো নয়। এই বুক কাঁপানোর মধ্যে কী একটা অসম্ভবেরর সংকেত যেন ফুটে উঠে।

ঝিনুককে ছেড়ে, বাড়ি এসে আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম। বাতি কমানো আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এ সব ভাবতে ভাবতে, সহসা একটা বীভৎস দুঃস্বপ্নের ঘোরে যেন আমি কাঁপতে লাগলাম। অসহায় পতিতের মতো, দারুণ বিপদগ্রস্তের মতো, আমি ফিসফিস করে বলে উঠলাম, আমাকে রাস্তা দেখতে দাও, আমাকে দিক নির্দেশ কর।…বলে আমি দু হাতে মুখ ঢাকলাম। আমি যে এই দুঃস্বপ্নের মধ্যে শুধু অকারণ অভিশপ্ত ভবেনকে এক বালিয়াড়ির বুকে কাঁটাঝোপে দেখতে পেলাম, তাই নয়। দেখলাম, সে বুক চাপড়ে হাহাকার করছে। এই দেখার সঙ্গে, আমার নিজের সকল যন্ত্রণা মিলে, একটা অলৌকিক নির্দেশের আশঙ্কায় চোখ ঢেকে অন্ধকারে ডুবে রইলাম।

এমন সময়ে কুসুমের ভয় ভয় সংকুচিত, একটু বিস্মিত গলা আমার কানে এল, যা ভেবেছি ঠিক তাই! আলো উসকে দেব টোপনদা?

আমি তাড়াতাড়ি, প্রায় চুপিচুপি গলাতেই বলে উঠলাম, না থাক।

 তাতে বিপরীত ফল হল। কুসুম ঘরের মধ্যে ঢুকে চলে এল। উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, কখন এসেছ? তোমার শরীর খারাপ হয়েছে নাকি?

আমি বলে উঠলাম, না না।

তবে অমন করে ভূতের মতো মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছ যে?

সহসা আমি একেবারে ফেটে পড়লাম, তুই যা এখান থেকে, যা বলছি! পালা।

 কুসুম চকিতে ছায়ার মতো অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই মুহূর্তেই আমি আমার ব্যবহারে অনুতপ্ত হয়ে উঠলাম। কিন্তু এ অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হল না। একটা শূন্যতায় আমি ডুবে গেলাম। কী করব, ভেবে না পেয়েই যেন আবার বাড়ির বাইরে চলে গেলাম। কোথায় যাচ্ছি, কোন দিকে যাচ্ছি, কিছুই জানি না। আমার কানে এল, দুরে কে যেন মত্ত সুরে চিৎকার করে গান করছে,

এ বড় সোখের রস ছিল,
 কী দিয়ে করলে চোলাই
 প্রাণে যেয়ে যাতনা হল।

হঠাৎ গান থেমে গেল। দুটি অস্পষ্ট মূর্তি আমার পাশ ঘেঁষে উলটো দিকে চলে গেল। সন্দেহ হল, হরোকাকা আর তারক। হয়তো হরোকাকা আমাদের বাড়িতেই যাচ্ছেন। তারকই হয়তো চেঁচিয়ে গান ধরেছিল।

শেষ পর্যন্ত আমি তামাইয়ের ধারে চলে এলাম। দেখলাম, আমার সামনে সেই কালো পাথরটা! পাথরের গায়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলাম যেন।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে আমার নিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। আমি বসলাম। তামাইয়ের কুলু কুলু শব্দ কানে আসছে। যে শব্দ সম্বন্ধে ছেলেবেলা থেকে আমি অনেক কল্প কাহিনী শুনে আসছি। এপারের অন্ধকার শালবন থেকে অস্পষ্ট শালফুলের গন্ধ আসছে। চারপাশের অন্ধকারের নিবিড়তা কেটে গিয়ে, একটা অস্পষ্ট আলোয় আমি যেন আশেপাশের সবই দেখতে পাচ্ছি।

ক্রমেই আমার ভিতরের উত্তেজনা শান্ত হয়ে এল। আমি যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম, আমার ভিতরের যত আলোড়ন, সবই আমার নিজের প্রতি অবিশ্বাস ও ভয়। ঝিনুককে যেমন আমার জীবনে অস্বীকার করা যায় না, আমার ভিতরে যেখানে তার অবস্থান, সেখান থেকে যেমন তাকে সরানো যায় না, তেমনি এই অবিশ্বাসের সঙ্গে প্রতিনিয়তই লড়তে হবে। এই ভয়কে সাহস দিয়ে জয় করতে হবে। আর আমার অন্তর‍্যামী বলে যদি কেউ থাকে তবে সে-ই জানে, ভবেন আর ঝিনুককে যদি খুশি দেখতে পাই, তা হলে আমার দ্বিধাহীন সাহস পরিপূর্ণ হবে। আমি বারে বারে উচ্চারণ করতে লাগলাম, সাহস, সাহস, সাহস।

এই সময়ে, সহসা আমার অন্তরাবদ্ধ দৃষ্টি সচকিত হল। একটু দূরে বাবলা ঝোঁপের কাছে যেন কিছু একটা নড়ে উঠতে দেখলাম। ভাবলাম, শেয়াল। কিন্তু মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েও শেয়াল যে ঝোঁপের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকবে তা সম্ভব নয়। সন্দেহ হল, অন্য কোনও জানোয়ার হবে। কারণ ঝোঁপের কাছে তার নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে। যেন একবার আড়াল ছেড়ে বাইরে আসছে, আবার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে আলো নেই, এক গাছা লাঠিও নেই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে রইলাম। আর দেখলাম, জানোয়ার নয়। ছায়াটা উঠে দাঁড়াতে টের পাওয়া গেল, মানুষের মূর্তি।

জিজ্ঞেস করলাম, কে? ওখানে কে?

আঁয়ি।

একটু ভয় মেশানো সংকোচে, ভাঙা ভাঙা সরু গলায় আমি শব্দটা সেরকমই শোনা গেল। বললাম, আমি কে।

জবাব এল, তারক।

তারক! তারকা? বললাম, তারক? তা ওখানে কী করছ?

কোনও জবাব নেই। ডেকে বললাম, এদিকে এসো।

তারক মাথা নিচু করে সামনে এসে দাঁড়াল। তারকই বটে। রোগা সরু শরীর, একেবারে খালি গা, চুলের বোঝাতেই মাথাটা বড় দেখায়। জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কী করছিলে?

তারক পা দিয়ে পা ঘষে বলল, এই আপনার কাছে একটু এসেছিলাম। দেখলাম, একলাটি ইদিকে আসছেন, তাই মানে–

কথা শেষ করল না। বললাম, পাহারা দিতে এসেছিলে?

তারক তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলল, না না। টোপনদার যে কী কথা।

 প্রায় মেয়েদের মতোই সলজ্জ সুরে বলল তারক। অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না। যদিও ওর মুখটা আমি মনে করতে পারছি। কুসুমের সঙ্গে এক সকালবেলার সেই দৃশ্য আমার মনে পড়ল। হাসি চাপতে কষ্ট হল। কিন্তু তারক হঠাৎ আমাকে একলাটি আসতে দেখে তামাইয়ের ধারে কেন? বললাম, কিছু বলবে নাকি?

মনে হল তারকের সমস্ত শরীরটা হেলে দুলে মোচড় দিয়ে উঠল। বলল, হ্যাঁ। শুনে রাগ করবেন না তো?

একটু সন্ত্রস্তই হলাম তারকের ভূমিকা দেখে। বললাম, রাগের কথা তুমি বলবে কেন?

তারক চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। অস্বস্তি আর দ্বিধাতেই বোধ হয় ওর শরীর বারে বারে দুলে দুলে উঠল। তারপর বলল, অই মানে কুসির কথা বলছিলাম।

রাগ করব ভেবেও রাগ করতে পারলাম না। বরং একটু কৌতূহলই হল। বললাম, কী কথা?

আবার একটু চুপচাপ। তারপর বলল, বের কথা, কুসির বে।

ব্যাপারটা বোধগম্য হতে আর আমার দেরি হল না। রাগ করতে চেয়েও আমার কৌতুকের মাত্রাই বাড়ল। বললাম, কুসুমের বিয়ে? কেন, কোনও ছেলেটেলে দেখা আছে নাকি তোমার?

তারক আমতা আমতা করে বলল, দেখা? হ্যাঁ, তা দেখা বলতে পারেন।

–কিন্তু কুসুম তো এখনও খুব ছোট, ছেলেমানুষ।

তারক অবাক সুরে বলল, টোপনদা যে কী বলেন। কুসি এই চৈতে পনেরোয় পড়ছে, আর কত ধাড়ি হবে?

তা বটে, তারকের কাছে এটাই যথেষ্ট। যদিও, চক্ষুষ্মন কোনও মানুষই বোধ হয় কুসুমুকে পনেরো বছরের মেয়ে বলবে না। আর বিবাহ সম্বন্ধ প্রস্তাবের কী উপযুক্ত সময় ও স্থান! কিন্তু এ ছাড়া তারকের উপায়ই বা কী ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, তা ছেলেটি কী করে, বয়স কত?

তারক ঢোক গিলল। একটা চাপা উত্তেজনা তার গলায়। বলল, তা ছেলের বয়স একুশ-বাইশ হবে। বাপের কিছু জোতজমি আছে, এক ছেলে, সুখে দুঃখে একরকম চলে যাবে, বুঝলেন কিনা টোপনদা।

–কোথায় থাকে, নাম কী, কার ছেলে।

প্রশ্ন করে আমারই নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল। তারকেরও জবাব দিতে দেরি হল। বলল, পাত্তর আমি নিজেই। মানে, কথাবার্তা একরকম হয়েছে..

আমি ততক্ষণ হাঁটতে আরম্ভ করেছি। তারক আমার পিছনে পিছনে চলেছে। পাছে হাসতে হাসতেই ধমকে উঠি, তাই চলা ছাড়া উপায় ছিল না। বললাম, ও! তা কথাবার্তা কি হয়েছে?

কুসির বাবা, মানে হরোকা’র সঙ্গে।

–রাজি হয়েছেন?

–এখুনি।

তবে আর অসুবিধে কী?

 তারক আবার চুপ। তারপরে বলল, আপনার অনুমতি না হলে কুসি বে করবে না।

এবার আমাকেই চুপ করতে হল। তামাইয়ের বিস্তীর্ণ ঢালু প্রান্তর পার হয়ে গ্রামের কাছে এসে পড়েছি তখন। আমি দাঁড়ালাম। তারককে ধমক দিতে আমার ইচ্ছে করল না। জানি, এক কথায় তারককে ধমকে তাড়ানো সবথেকে সোজা। আর সেটাই বোধ হয় সংসারের যথার্থতা। তারকের প্রেম খাঁটি কি না জানিনে। হতে পারে। পৃথিবীতে মানুষের সব অধিকার হরণ করা যায়। ভালবাসার অধিকার হরণ করা যায় না। তা সে তারক হলেও নয়। যাই হোক, নিয়মের যথার্থতা সবখানে চাপানো যায় না। তার চেয়ে, উপলব্ধিই ভাল। বললাম, বলে ভালই করেছ, কথাটা আমিও শুনেছিলাম। আমার কথা শুনবে?

-হ্যাঁ।

কুসুমকে তুমি বিয়ে কোরো না।

–কেন?

–যে তোমাকে বিয়ে করতে চায় না, তাকে বিয়ে করে কী লাভ। তুমি যাকে চাও না, তাকে কি তোমার বিয়ে করতে ইচ্ছে করে?

তারক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। বলল, কিন্তু আমি কী দোষ করেছি। আমি, একটা ব্যাটাছেলে বটে তো, নাকি?

বললাম, তা যদি বলো, দোষ তো তোমার অনেক, তুমি লেখাপড়া শেখনি, তার ওপরে নেশাভাং কর।

তারক সঙ্গে সঙ্গে, ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, তা বলতে পারেন।

–নেশাভাং করে শরীরটাকে জাহান্নামে দিয়েছ। এই বয়সে কিছু আর বাকি রাখোনি। তোমাকে তো ধাক্কা মারলে পড়ে যাবে।

–তা যাব না। এই সিদিনেও এক বস্তা ধান বই করেছি। তবে হ্যাঁ, ডাক্তারে বলেছে, আমার লিভারটি পোকা খেয়ে গেছে।

তবেই বোঝ, এ বয়সে লিভার পোকা খেয়ে যাওয়া মানে, তার আর কী রইল। তার চেয়ে আমি বলি, তুমি একটু ভাল হবার চেষ্টা করে। বিয়ে থার কথা ভেবো না এখন।

তারক বেশ সহজ হয়ে এসেছে। বলল, না বেথা আর কী, কুসিকে নিয়ে কথা। তা আপনি ঠিক জানেন তো টোপনদা, কুসির মন নাই?

তারককে রীতিমতো করুণ মনে হল। আমি সত্যি বলতে দ্বিধা করলাম না, না, মন নেই। ডেঙা শিবের কাছে সে মানতে করেছে শুনেছি, যাতে তোমার সঙ্গে বিয়ে না হয়।

–অ!

তারক আরও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি যখন বলছেন, তখন ঠিক। হরোকা বলেছিল কিনা, মেয়েমানুষের কথায় কিছু যায় আসে না।

আমি বললাম, ওঁর কথা তুমি বিশ্বাস কোরো না।

তার সঙ্গে সঙ্গে বলল, তা হলে হয়রাকা যে ঋণ করলে শুধবে কেমন করে?

–সে দোষ তো কুসুমের নয়। আর তুমি ভদ্রলোক, বামুনের ছেলে, তুমি কি পণ দিয়ে মেয়ে নেবে? সে আবার কেমন কথা?

–তা বটে।

 একটু থেমে আবার বলল, তবে কুসি বলে কথা। কিন্তু আপনি ঠিক বলেছেন টোপনদা, যে আমাকে চায় না তাকে বে করে কী লাভ। এ রকম কথা আমাকে কেউ কখনও বলে নাই কিনা। সত্যি তো, বে বলে কথা, স্বামী ইস্তিরি সম্পর্ক। তালে আপনি ঠিক জানেন তো টোপনদা, কুসি যে মুখনাড়া দেয়, ওগুলোন মিছে নয়?

এ কি আমারই মনের অবস্থার জন্যে, না কি তারকের সংশয় ও কষ্ট দেখে, জানিনে, জবাব দিতে এক বার থামতে হল। কিন্তু তারককে নিরস্ত করাই উচিত ভেবে বললাম, ঠিক জানি, ও সবই সত্যি, তুমি বোঝ না?

তারক টেনে টেনে বলল, বুঝি। তবে মানুষের মন। আচ্ছা, যাচ্ছি টোপনদা।

–হ্যাঁ এসো।

অন্ধকারে কয়েক পা গিয়ে তারক দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, জানেন টোপনদা, অমন একটা ভাল মেয়ে সারা শালঘেরিতে নাই।

আমার হাসির মুখে প্রায় একটা উঁচ বিধিয়ে ব্যথা করে দিল তারক। বললাম, তাই বুঝি?

–হ্যাঁ। ওকে আমি খুব জ্বালাতন করি, আর করব না। জানেন টোপনদা, যা বলব, হ্যাঁ, অমন তেজালো মেয়ে আর দুটি দেখি না।

তাই নাকি?

–হ্যাঁ, মিছে বললে আমার জিভ খসে যাবে না। যাচ্ছি টোপনদা।

এসো।

অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল তারক। হঠাৎ ওকে আমার মহৎ মনে হল। জানিনে ভাল এবং তেজালো বলতে ওর ধারণা কী। কুসুমের এখনও চরিত্র বিচারের সে সময় এসেছে বলে মনে করিনে। কিন্তু তারকের কথাগুলোতে কুসুমের সৌভাগ্য মানাই উচিত। অল্প বয়সে মদ্যপ, রুগ্ন, মূর্খ, আমার চিরবিতৃষ্ণা, উঞ্ছ ছেলেটার জন্য মনটা সহসা বড় বিষণ্ণ হয়ে উঠল। একটা জায়গায় কি বিশ্ব সংসারের সকল মানুষই এক, যখন সে ভালবাসে?

.

তামাইয়ের অভ্যন্তরের রহস্য জানবার জন্যে আমি নিজেকে আরও বেশি ন্যস্ত করতে চাইলাম। জানবার ব্যাকুলতা তো আছেই। আমার নিজের মনে হল, যেন ততোধিক মনোযোগ আমি দিচ্ছিনে। বিশেষ করে মনে হওয়ার কারণ এই, আজকাল আমাদের জেলা, জেলার বাইরে থেকে বহু চিঠি-পত্র আমার কাছে আসে। তামাই সম্পর্কে নানান জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল সেই সব চিঠিতে। অনেকেই আমার প্রতিদিনের কাজ জানতে চায়। আমি কত দূর অগ্রসর হয়েছি, এ সম্পর্কে তাদের ব্যর্থ কৌতূহল ও উৎসাহ, কেন আমির্জসাধারণের কাছে সব সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছি না। অনেকে স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে কাজ করতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে। শালঘেরি ও আশেপাশে গ্রামের কোনও কোনও ছেলে আজকাল আমার কাছে যাতায়াত কর। মাটি বা পাথরেরও এমনকী লোহা ও তামার কোনও জিনিস পেলেই আমার কাছে নিয়ে আসে। তার অধিকাংশই বর্তমান জীবন-যাপনের পরিত্যক্ত ভাঙা জিনিস। ওদের দোষ নেই, চিনতে পারে না।

এই সময়ে গোবিন্দ সিংহের একটি চিঠি পেলাম। আমি ওঁর জন্যেই বিশেষ করে অপেক্ষা করছি। গোবিন্দবাবু লিখেছে; আমি বুঝতে পারছি আপনি আমার অপেক্ষায় খুবই ব্যস্ত হয়েছেন। সংবাদপত্রের দিকে চোখ দিলেই বুঝতে পারবেন, রাজনৈতিক আবহাওয়াতে কী রকম ঘূর্ণি লেগেছে। সম্ভবত আমাদের চির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আগত। যে রকম ব্যাপার–দূতীয়ালি ও আলাপ আলোচনা চলেছে, তাতে কেমন একটা ভয় ধরা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। রাজনীতির সঙ্গে বরাবর সম্পর্ক রেখে এসেছি, সে জন্যে হঠাৎ এ সব ছেড়ে এই মুহূর্তে কোথাও যেতে পারছি না। আপনি আর কিছুকাল অপেক্ষা করুন, যদি আমার জন্য অপেক্ষা করা প্রয়োজন বোধ করেন। অন্যথায় আপনি কাজে হাত লাগাতে পারেন আমি পরে গিয়ে আপনার সঙ্গে যোগ দেব।

আমি জানি না, গত বছরের কলকাতার বীভৎস দাঙ্গার ঢেউ আপনাদের অঞ্চলগুলোতে কী পরিমাণ আঘাত করেছে। কলকাতার সর্বনাশ করে দিয়েছে। আর এ সবই ঠাণ্ডা মাথায় বেশ ষড়যন্ত্র করে, ভেবেচিন্তেই ঘটানো হয়েছে। ফলে বাংলা বিভাগ ঠেকানো যাবে না, স্বাধীনতার সঙ্গেই সেটা আসন্ন। ভবিষ্যৎ যা দেখতে পাচ্ছি, তাতে কোনও আশা বা উৎসাহ পাচ্ছিনে। মনের এ অবস্থা বাইরে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আপনিই বা কী মনে করছেন জানি না। কারণ সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন প্রবল আলোড়ন চলছে, সকলেই নতুন কিছুর জন্যে ব্যাকুল ও উন্মুখ। কিন্তু কোথায় তাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বুঝতে পারছি না।

কিন্তু এ সব কথা লিখে আপনাকে অকারণ আর বিব্রত করব না। আমাদের পার্টিই যখন নিশ্চিতভাবে সরকার গঠন করতে চলেছে, তখন আমার মনের এ অবস্থায় কী রকম থাকতে পারি, সেটা জানাবার জন্যেই লেখা। যাই হোক, আপনি ইতিমধ্যে একটা কাজ করতে পারেন। গ্রীষ্ম এল, বর্ষারও বড় বিশেষ দেরি নেই। এ সময়টার মধ্যে, তামাইয়ের যে সব অঞ্চল আপনার এখনও দেখা হয়নি, সেগুলো দেখে নিতে পারেন। আপনি মোটামুটি শালঘেরির কাছাকাছি অঞ্চলই দেখেছেন। আমি পুরনো ম্যাপ সংগ্রহ করে, তামাইয়ের উপত্যকা সীমানা দেখেছি। আপনি পশ্চিম দিগন্তে, বিশ-পঁচিশ মাইল অঞ্চল একবার ঘুরে আসতে পারেন। হয়তো সে ঘোরা একেবারেই ব্যর্থ যাবে, তবু ক্ষতি নেই। সংবাদপত্রে লেখালেখি সত্ত্বেও, সকলের কাছে হয়তো সংবাদ পৌঁছায়নি, পৌঁছুলেও অনেকের নিদ্রাভঙ্গ হয়নি। এক বার ঘুরে এলে হয়তো নতুন কিছু সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন।

আপনি লিখেছেন, মাটি সম্পর্কে মানুষের এমন নিদারুণ মোহ, কেউ বিনামূল্যে সুচাগ্র ভূমিও ছাড়বেন না। সেটা খুবই স্বাভাবিক। আর দেশের বর্তমান আবহাওয়া এমন যে, এ সময়ে সরকারি আনুকূল্যের আশা আপনি করতে পারেন না। অবিশ্যি ব্যক্তিগত চেষ্টায় তামাই উপত্যকার ছোটখাটো কোনও অংশ আপনি খনন করাতে পারেন। তাতে জমি কেনার যে খরচ পড়বে, তা ভবিষ্যতে ফেরত পাবেন কি না কে জানে। আর যদি আশা সফল হয়, তবে সর্বত্রই উৎসাহের সঞ্চার হবে। তাই বলছিলাম, আর একটু দেখে নিন। ইত্যাদি ইত্যাদি।…

গোবিন্দবাবুর চিঠি আমার কাছে একটি সম্পদ স্বরূপ। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে কোথায় যেন আমার একটা যোগসূত্র আছে। কলকাতার দাঙ্গা সম্পর্কে তিনি যে সব কথা লিখেছেন, তাতে আমি এক মত। আমাদের এ অঞ্চলেও সেই বিষের হাওয়া পৌঁছেছিল। কিন্তু মুসলমানের সংখ্যা এত অল্প যে, কোনও কিছুই ঘটেনি। কলকাতা থেকে মোল্লা মৌলবিরা মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামে আসছে, গোটা দেশটাই পাকিস্তান হয়ে যাবে, এ ধরনের নানান উত্তেজিত সংবাদ ও আলোচনার আলোড়ন কিছু চলছে। শালঘেরিতে এমন সব লোককে রাজনীতি নিয়ে মাতামাতি করতে দেখছি, যারা কোনও দিন এ জগতের সীমানায় পা দেয়নি। স্বয়ং অঘোর জ্যাঠা সভায় সভাপতিত্ব করছেন। হরলালকাকাকে এক দিন দেখলাম বাজারের কাছে কয়েক জনকে হাত-পা নেড়ে আসন্ন স্বাধীনতার কথা বোঝাচ্ছেন। বিয়াল্লিশে যে পতাকা বেআইনি ছিল, এখন হাতে হাতে সেই পতাকা ঘুরছে। অবস্থার যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কোথায়, কোথায় টেনে নিয়ে চলেছে।

আমি যেন দেখছি, মানুষ স্বাধীনতা বলতে রাতারাতি হাতে হাতে একটা প্রত্যক্ষ ফলের আশায় উদগ্রীব। যেন ম্যাজিকের মতো কিছু একটা পরিবর্তনের প্রত্যাশা। ভয় হয়, অবুঝ উত্তেজনার পরে, একটা ব্যর্থ অবসন্নতা যেন অবশ্যম্ভাবী।

এক দিন অঘোর জ্যাঠা আমাকে বোঝাতে এলেন, এ সময়ে আমি যদি তামাইয়ের বিষয় ছেড়ে একটু রাজনৈতিক বিষয়ে উঠেপড়ে লাগি, তবে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে। বললেন, আমাদের এ সব জায়গায় সৎ শিক্ষিত লোক তেমন নেই, যারা জেল খেটেছে দেশের জন্য, লোকের শ্রদ্ধা ভক্তি তাঁদের প্রতি অচলা। এ সময়ে যদি একটু এদিকে মনোযোগ দাও, তুমি অনেক উঁচুতে উঠবে বাবা। লোকে তোমাকে চায়।

আমি সৎ কি না জানিনে। হিসেব অনুযায়ী শিক্ষিতের কোঠায় পড়ি। মুশকিল এই, অঘোর জ্যাঠাকে বোঝানো যায় না, পৃথিবীর অধিকাংশ সৎ শিক্ষিত লোকেরাই রাজনীতি করেন না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অসৎ অশিক্ষিত লোকেরাই হয়তো ও বিষয়ে যথেষ্ট প্রতিভাশালী হয়ে ওঠে। দেশ বিদেশের ইতিহাসে তার নজির একেবারে দুর্নিরীক্ষ্য নয়।

অঘোর জ্যাঠা যা বললেন, হয়তো এ বিষয়ে তাঁর দূরদৃষ্টি গভীর। আমার উপায় নেই। যে কাজে কোনও আকর্ষণ আনন্দ বা কৌতূহলই বোধ করিনে, তার মধ্যে আমি যাব না। বললাম, আমি তা পারি না। কয়েক দিনের জন্যে তামাইয়ের দু পার ধরে একটু ঘুরতে চলেছি। ভাবছি, সাঁকোটের পাহাড় অবধি মাইল তিরিশ যাব।

অঘোর জ্যাঠা খুশি হলেন না। বললেন, কিছুকাল এ কাজ থামিয়ে রাখলেই বা ক্ষতি কী। আমি তোমাকে যা বলছি, তা যদি তুমি করতে পার, এ সব কাজ তোমার পড়ে থাকবে না। বরং আরও ভালভাবে হবে।

বললাম, আমাকে মাপ করুন জ্যাঠামশায়।

অঘোর জ্যাঠা হতাশ হয়ে বললেন, আর কিছুনয় টোপন, হয়তো চোখের সামনে দেখতে হবে, যত উঞ্ছেরা দেশের সরকারের মুরুব্বি হয়ে বসবে এখানে। তখন তোমরাই রাগ করে গাল দেবে।

হয়তো হেসেই ফেলতাম অঘোর জ্যাঠার কথা শুনে। তিনি আহত হবেন ভেবেই সামলাতে হল। যারা চায় না, তাদের অভাবে যদি স্থানীয় উঞ্জুেরা সরকারের হোমরা চোমরা হয়ে বসে জনতার প্রতিনিধি হয়ে বসে, তা হলে লোকে তো খারাপ বলবেই। কিন্তু উঞ্ছের দল কি এতই ভারী হয়ে গেছে? ভাল লোক কি নেই?

শুধু অঘোর জ্যাঠা নয়, এ কথা তো আগেই জানা গেছে, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করার দরুন অনেকেই আমাকে নিয়ে হতাশ হয়েছে। বিরূপ হয়েছে। বর্ষীয়সী মহিলাদের মধ্যে অনেকে বলেছেন, তবে ঢং করে জেল খাটতে যাওয়া কেন বাপু? এ সব কথার কোনও জবাব নেই।

একটা ব্যাপার লক্ষ করা গেল। রেণু রাজনীতির আসরে প্রবেশ করেছে। তাতে বোঝা গেল, কালের হাওয়ায় একটা দিক পরিবর্তনের ধাক্কা লেগেছে। একদা রেণুর যে ভবিষ্যৎ চিন্তা করা গিয়েছিল, আজ আর তা সত্য নয়। এতে রেণুকে কোথায় টেনে নিয়ে যাবে জানিনে, কিন্তু আমি খুশি হয়েছি। যেখানেই নিয়ে যাক, শালঘেরির মেয়ে এই প্রথম গ্রামের কর্তা ব্যক্তিদের সমর্থন ও সহায়তায় রাজনীতির পথে পা বাড়িয়েছে।

.

পায়ে হেঁটে হেঁটে সাঁকোট পাহাড়ে যাবার কথা শুনে পিসি তো থ। দু ঘণ্টা রেলগাড়িতে গিয়ে যেখানে হেঁটে যাওয়া যায়, সেখানে এ অভিনব পন্থার কারণ কী। আমার কথা শুনে চুপ করে গেলেন। বুঝতে পারি পিসি ক্রমেই ভাবিত হচ্ছেন, ভয় পাচ্ছেন আমার মতিগতি দেখে। জেল থেকে আসার পর তিনি যে একটি কল্পনার ছবি দেখেছিলেন তা ক্রমেই বিলীয়মান। আমি কষ্ট বোধ করি কিন্তু সংসার কোথাও কারুর মনোমত হয় না।

কুসুম জিজ্ঞেস করল, গোরুর গাড়িতে যাবে বুঝি?

না, পায়ে হেঁটে।

 ওমা! পথে ঘাটে খাবে কী? মালপত্তর নিয়ে যাবে কীসে?

 –মালপত্তর আবার কী রে?

চাল ডাল সবই? পথে পথে তো দোকানপাট নেই যে কিনে নেবে?

 বললাম, দোকানপাট নেই, গাঁ ঘর তো আছে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবেই।

 কুসুম খুব বেশি ভরসা পেল না। তারপরে ঝপ করে বলে বসল, আমাকে নিয়ে চলো না টোপনদা, তুমি ঘুরে ঘুরে কাজ কর আমি রান্নাবান্না করব।

মন্দ বলেনি কুসুম। পথ চলাটা সে রকম খেয়ে দেয়ে গড়িয়ে চড়ুইভাতি করতে করতে যাওয়া যায়। তাতে কাজ হোক বা না হোক। গম্ভীর হয়ে বললাম, দাঁড়া, কাজ কর্ম মিটুক, তারপর ওরকম বেড়াতে যাওয়া যাবে।

গাম্ভীর্য দেখে একটু সংশয়ে কুসুম আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল যেন, ও কিছু সন্ধান করছে আমার চোখে মুখে। এটা কুসুমের নতুন। কথা কম বলে, দ্যাখে বেশি। তবু না বলে পারল না, একলা যাবে।

বললাম, হ্যাঁ।

 কুসুম ছায়া ভরা মুখে বলল, বাড়িটা খুব ফাঁকা লাগবে।

বাড়ি গেলাম। ভবেন তো রেগে চিৎকার করেই উঠল, কাল রাত্রেও তুই কিছু বলিস নাই? তা হলে আমিও যেতাম।

ঝিনুক কোনও কথা না বলে, দূর থেকে তাকিয়ে ছিল। ভবেনই তাকে বলল, শুনেছ, বাবু হাঁটতে হাঁটতে সাঁকোটে চললেন।

ঝিনুক দূর থেকেই বলল, শুনেছি।

কিন্তু ঝিনুক আমার মুখ থেকে চোখ সরাল না। আমি ভবেনকে বললাম, তুই সংসারী মানুষ, তোর কি যখন তখন বেরুলেই হল।

ভবেন বলে উঠল, রাস্কেলের মতন কথা বলিস না। তোর কাছে আমি সংসার করা শিখব, না? আর তুই একলা এই পথ ঘুরে আসবি।

আমি হেসে বললাম, ঘুরে আসি একটু।

ভবেন বলল, যাও, মর গে এই গরমে। কিন্তু আজকাল খুব চাপতে শিখেছিস যা হোক। কাল তো এক বারও মুখ খুললি না?

আমি হাসতে লাগলাম। কিন্তু ঝিনুক উঠোনের যে প্রান্তে ছিল, সেদিকে চোখ তুলে তাকালাম না। ভবেন আবার বলল, মাঝখান থেকে ঝিনুকের মেজাজটা বিগড়ে দিলি। এ বাড়ির হাওয়া খারাপ হল।

–এতে বেগড়াবার কী আছে?

–বলিস নাই কেন? জানিস তো ওকে।

 ভবেনের এরকম কথায় বিব্রত হতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে উঠলাম। এবং সে বিরক্তি আসলে ঝিনুকের ওপর। বললাম, তুই অর্থহীন কথা বললে আমি তা মানতে পারি না।

বলে, ঝিনুকের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখলাম, ও সেখানে নেই। ভবেন কিন্তু ব্যাপারটাকে গুরুগম্ভীর হতে দিল না। ঘুষি উচিয়ে, চোখ পাকিয়ে মুখটা অদ্ভুত করে নিচু স্বরে বলল, এবার বোঝ ঠ্যালা।

আমি আবার হাসলাম। কিন্তু ভবেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা টনটনিয়ে উঠল। ভবেন আবার বলল, মনে করেছিস, তোর নিজের ইচ্ছে মতনই সব হবে।

কেন, ঝিনুক কি নিয়তির মতো আমার সবকিছু নিয়ন্ত্রিত করবে? ভাবনা শেষ হতে না হতেই, ঝিনুক দুহাতে দুটি চায়ের কাপ নিয়ে এসে দাঁড়াল। বলল, ধরো।

আমি আর ভবেন, দুজনেই চা নিলাম। ঝিনুক বলল, কবে ফিরবে?

কদিন আর। দিন দশেক লাগবে হয়তো।

আনিদি এসে আর এক কাপ চা ঝিনুকের হাতে তুলে দিয়ে গেল। ঝিনুক যেন গরম চায়ের কাপে নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখছিল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, মুখ না তুলেই বলল, শুধু এই ঝোলা কাঁধে করেই চললে?

-হ্যাঁ।

তার মানে, কদিন সব রকমের অত্যাচার হবে।

আমি বললাম, ও সব ঠিক হয়ে যাবে।

 ঝিনুক বলল, তা বুঝেছি। কিন্তু কাল রাত্রে বললেও, তোমার কাজে আমি বাগড়া দিতাম না। তাড়াতাড়ি চলে এসো।

ভবেন ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, দাঁড়া জামাটা চাপিয়ে আসি, একটুখানি সঙ্গে যাই।

 ঝিনুক চোখ তুলে বলে উঠল, শালঘেরি থেকে চলে যাবার মহড়া দিচ্ছ নাকি?

 ঝিনুকের এই প্রশ্নের মধ্যে যে সত্য একেবারে ছিল না, তা নয়। মনে মনে এমনি একটা চিন্তা ছিল, আমার কয়েকদিনের অনুপস্থিতির একটা অভিজ্ঞতা দরকার। তাতে অন্তত ভবেনের অবস্থাটা কিছু বুঝতে পারব। কারণ ইদানীং একটা সংবাদে অত্যন্ত অস্বস্তি ও বিমূঢ়তা বোধ করছিলাম। ঝিনুকের মুখেই শুনেছি, ভবেন আচমকা এক এক দিন থেকে ইস্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে। কিন্তু ছুটি নিয়ে বাড়ি আসেনি। ছুটির কথা বাড়িতেও বলেনি, আমাকেও না। সময়গুলি তার কোথায় কেটেছে কেউ জানতে পারেনি। শুনে থমকে গিয়েছি। ভবেন বলেনি বলেই ওকে জিজ্ঞেস করতেও বেধেছে। তখন থেকে অনেক বার ভেবেছি, আমি শালঘেরিতে না থাকলে হয়তো ভবেন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়।

কিন্তু ঝিনুকের চোখের দিকে তাকিয়ে সে চিন্তার কথা আমি বলতে পারলাম না। বললাম, তা কেন? কাজেই যাচ্ছি।

ঝিনুক চুপ করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই আয়ত চোখ দুটির দিকে আমি তাকিয়ে থাকতে পারিনে। ভবেন বেরিয়ে এল। ঝিনুক হাত বাড়িয়ে আমার চায়ের কাপ নিল। আমরা দুজনে বেরিয়ে গেলাম।

বাইরে এসে ভবেনকে বললাম, তুই আর কেন আসছিস?

ভবেন গম্ভীর স্বরে বলল, একটা কথা বলতে।

অবাক হয়ে বললাম, কী রে, কী কথা?

 ভবেন বলল, তুই আজকাল কপটতা শিখেছিস টোপন।

মনের ভিতরটা যেন দপ করে নিভে গেল। বললাম, কী রকম?

–তুই আমাকেও চাপতে শিখেছিস? আমাকেও বলিস না?

 হেসে বললাম, তুই একটা উল্লুক। তুই যেতে চাইবি বলেই তো বলিনি। বরং শোন, এ কদিন ইস্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে থাক।

ভবেন ওর কোল বসা ঈষৎ লাল চোখ তুলে বলল, কেন?

–কেন আবার? ঝিনুকের সঙ্গে দাবা খেলবি।

ভবেন আমার চোখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে হো হো করে হেসে বলল, তুই একটা রাস্কেল টোপন, রাস্কেল! ঝিনুক কি আর এখন খ্যালে? তুই আর আমি খেলি, ঝিনুক দ্যাখে।

বললাম, ভুল বললি। ঝিনুক খ্যালে, তুই আর আমি দেখি।

শুনে ভবেন হাসতে লাগল, আমিও হাসতে লাগলাম। দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সে হাসি যেন শেষ হতে চায় না।

.

প্রথম দিন ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যাবেলা যে গ্রামে পৌঁছুলাম, তার নাম নাবোল। সারা দিনে পথে বা দুটি গ্রামে খোঁজ করে তেমন কিছু পাইনি। নাবোলে আমার পরিচয় দিতে, আশ্রয় একটা মিলে গেল। পরের রাত্রি ওঝাইগড়। তৃতীয় রাত্রি ভক্তবিষাণ।

এই তৃতীয় রাত্রিতে আর নিজেকে ফাঁকি দিতে পারলাম না। অনুভব করছি ভিতরের একটা শূন্যতা যেন আমাকে গিলতে আসে। সন্ধ্যা হলেই উড়তে না পারা পক্ষী শাবকের মতো, বুকের মধ্যে যেন ডানা ঝটপট করে। আর আসন্ন রাত্রির ছায়াঘন পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে, নিজেকে আশ্রয়হীন, ভয়ংকর একাকী মনে হতে থাকে। আমার প্রাণস্পন্দনের তালে তালে নাম বাজতে থাকে, ঝিনুক ঝিনুক ঝিনুক।….

আমার অনুপস্থিতি শালঘেরিতে কী ঘটাচ্ছে, সে অভিজ্ঞতার আগেই, আত্ম-দর্শনের বিস্ময়ে ও যাতনায় অভিভূত হয়ে যাই। জানিনে, সেই চোখ দুটির ভিতর দিয়ে কী সুধা পান করি। একটু কথা, মর্মে কী দ্যোতনা সৃষ্টি করে। এখন দেখছি শালঘেরির প্রায় প্রত্যহের সন্ধ্যা আমার রন্ধ্রগত হয়ে গেছে। দীর্ঘকাল জেলে থাকতেও আমার এমন অসহায় অবস্থার কথা জানতে পারিনি। ঝিনুক আমার সবকিছু নিয়ে বসে আছে। এমন সর্বব্যাপ্ত বলেই কি ওকে নিয়তির মতো মনে হয়।

পঞ্চমদিনে সাঁকোটে পৌঁছে আর একটা কাঁপন আমাকে নাড়িয়ে দিল। সাঁকোটের পাহাড়, এই তো আমাদের সেই ছেলেবেলার বোম্বাবুড়ো। পরিষ্কার আকাশের বুকে যখন পাহাড় তার কিতাকৃতি নিয়ে জেগে উঠত, মা শান্ত করার জন্যে বলত, ওই দ্যাখ বোম্বাবুড়ো, বেয়াড়াবিত্তি করলে ধরবে এসে।

আজ প্রাক-সন্ধ্যায় সাঁকোটের আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে, সহসা চোখে পড়ল, নিরিবিলি এক শালগাছের তলায়, নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় বসে আছে একটি আদিবাসী দম্পতী। ওরা আমাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু আমি নড়তে পারলাম না। জীবনে তো এমন কত দেখেছি। আমাদের গোটা জেলায় এই সব আদিবাসীদের সংখ্যা অনেক। চাষবাসের কাজ ওদের ওপরেই অনেকখানি নির্ভরশীল। এমন নির্জনে, সারাটা আতপ্ত দিনের কাজের শেষে, এর উরতের ওপর ওর পা, মেয়েটি পিঠ চুলকে দেয়, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে পুট পুট করে ঘামাচি মারে, আর ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কী যেন বলে, এবং পুরুষটির হাত এলিয়ে পরে থাকে কৃষ্ণা মানুবীটির কোলে, তার মুগ্ধ দৃষ্টি নারীর চোখের দিকে নয়, দূর আকাশের দিকে, দেখে মনে হয়, এই নিবিড়তাটুকু নিয়ে সংসার পারাবারের বাইরে গিয়ে বসে আছে। অনেক দিন দেখেছি, কিন্তু কখনও, সহসা এমন তীরবিদ্ধ চকিত কল্পনায় ও ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়ে যাইনি। আর এক জনের সঙ্গে আমার নিজেকে এমন নির্জন, নিবিড়তায় কল্পনা করে, আহত যন্ত্রণায় কেঁপে মরিনি। বোম্বাবুড়ো ছেলেবেলায় ভয় দেখিয়েছে, আজ যৌবনে, প্রাণের দুয়ার ভেদী অন্ধকারের স্তব্ধ স্বপ্নকে চোখের সামনে তুলে দিয়ে, আর একবার ভয় দেখাচ্ছে।

.

বারো দিন পরে বৃষ্টি মাথায় করে শালঘেরিতে ফিরে এলাম। একেবারে শূন্য হাতে ফিরিনি। কয়েকটি ছোট ছোট মূর্তি পেয়েছি। তার মধ্যে দুটি নিঃসন্দেহে গণপতির। একটি মাতৃমূর্তি, প্রাগৈতিহাসিক মাতৃমূর্তির সঙ্গে যার মিল রয়েছে স্তনে ও নিম্নাঙ্গে। মূতিগুলি দেখলে সহসা মনে হয়, এ যুগের নিতান্তই রংহীন গ্রাম্য খেলার পুতুল। কিন্তু এদের দেহে বয়সের চিহ্ন বর্তমান। এক ভদ্রলোক একটি পাথরের অস্ত্র, দুটি শীলমোহর জাতীয় মাটির জিনিস দিয়েছেন। কোথায় পেয়েছেন, তার জায়গাও নির্দেশ করেছেন। ওঝাইগড়ের পরপারে, আকোন গ্রামের জঙ্গলাকীর্ণ প্রান্তেই এ সব সংগ্রহ করা গেছে। আকোন আমার ফেরার পথে পড়েছিল। শালঘেরি থেকে দূরত্ব প্রায় এগারো মাইল। শালঘেরির মতোই আকোনকে আমার গভীর সন্দেহ হয়েছে। ওখানেও মাটির তলায় বোধ হয়, অতীত অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে।

কুসুম ছুটে এসে আমার কাঁধের ঝোলা নিল। পিসি বললেন, অরে, টুপান, আরশিতে একবারটি নিজেকে দেখ, চেহারাটা কী করেছিস।

বললাম, বাইরে বাইরে ঘুরেছি তো। এ কিছু নয় পিসি।

কুসুম একটা ছুট দিল দালান দিয়ে। বলে গেল, চা করছি টোপনদা।

 কিন্তু কুসুমের চেহারাটা তেমন ভাল দেখলাম না। চোখের কোল বসা, চুল উশকো খুশকো। বর্ষা দেখে বোধ হয় স্নান করেনি। পিসি তাড়াতাড়ি শুকনো কাপড় এনে দিলেন। বললেন, আর চান করিস না, মেলাই ভিজেছিস। একটু তেল গরম করে দিই, হাতে পায়ে মাখ।

কুসুম চা নিয়ে এসে বলল, তোমার কাজ হয়েছে টোপনদা। বললাম, এই হয়েছে একটু আধটু।

–কিছু পেলে?

 কুসুম বুঝুক না বুঝুক, উৎসাহের অন্ত নেই। ঠাট্টা করে বললাম, পেয়েছি।

কী পেলে?

 কুসি বামনির একটা বর।

কুসুম অমনি মুখ ভেংচে বলল, অ্যা হ্যাঁ হ্যাঁ। আর বামুনঠাকুরের একটা বউ খুঁজে পাওনি?

বললাম, তাও পেয়েছি।

বলে ব্যাগ থেকে খুলে মাতৃমূর্তিটা দেখালাম। কুসুম হেসে গড়িয়ে পড়ল। আপাত দৃষ্টিতে মাতৃমূর্তির চেহারাটি হাস্যকর বটে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, দুটি ছোট পায়ার ওপর একটি ত্রিকোণ অঙ্গ, তার ওপরেই গোল স্ফীত উদর, উদরের ওপরে দুটি বৃহৎ স্তন, একটি ছোট্ট মুণ্ড। বর্তমান চোখে অনেকটা বিদঘুটে হাস্যকর। কিন্তু ঊর্ধ্ব মধ্য অধঃ, এই তিনের মধ্যেই প্রজননের চিহ্নগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মাতৃমূর্তি আসলে উৎপাদনেরই প্রতীক। এই সব সংকেত জানা না থাকলে, এর চেয়ে হাস্যকর মূর্তি আর কী থাকতে পারে।

এমন সময়ে টোকা মাথায় দিয়ে ইন্দির ঢুকল দরজা দিয়ে। কুসুম বলল, কদিন ধরে ও রোজ দুবেলা তোমার খবর নিতে আসে, তুমি এসেছ কি না।

ইন্দির আসে না, তাকে পাঠানো হয়। সে দালানের সামনে বারান্দায় উঠে এল। দালানের ভিতরে, কাছেই ছিলাম আমি। দেখতে পেয়ে বলল, এসেছ? যাক বড় বউমা আর বড়দা রোজ খোঁজ করছে তোমার।

আমি বললাম, টোকা রেখে ভেতরে এসো।

কুসুম বলল, চা খাবে?

ইন্দির দালানে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তা এই বাদলা দিনে।

কুসুম চলে গেল। ইন্দির বলল, বড় বউমা বুলে দিয়েছেন, তাড়াতাড়ি একবার দেখা করতে।

জিজ্ঞেস করলাম, ভবেন কোথায়?

–ইস্কুলে। বড় বউ মা বুলছেন, জরুরি দরকার, এসে থাকলে যেন দেরি না করেন।

জানি পিসি ভিতর ঘর থেকে ইন্দিরের কথাতেই কান রেখেছেন। হয়তো ওদিক থেকে কুসুমও। বড় বউমার প্রসঙ্গ চাপা দেবার জন্যে বললাম, সে হবে খন, তুমি বসো।

আমি উঠে ঘরের ভিতরে গিয়ে, বাগানের দিকে জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির অঝোর ধারা গাছের ও বাঁশ ঝাড়ের মাথা ধুইয়ে ঝরে পড়ছে। লাল মাটি জমাট রক্তের মতো থই থই করছে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে পাচ্ছিনে। ব্যাং ডাকছে, ক্যাঁ-কো। ক্যাঁ-কো।

আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, দোতলার বারান্দায় ঝিনুক দাঁড়িয়ে। ওর অজ্ঞাত চুল ভোলা, তামাইয়ের ওপারে শালবনের আকাশে দৃষ্টি হারিয়ে গেছে। আর ভবেন? ওকি ইস্কুলে, নাকি অন্য কোথাও গিয়ে বসে আছে?

.

বাড়ি থেকে ইস্কুলের ঢং ঢং ঢং ছুটির ঘণ্টা শুনেই বেরিয়েছিলাম কিন্তু ভবেনদের বাড়ি এসে ভবেনের কোনও সাড়া-শব্দ পেলাম না। কারুরই কোনও সাড়া-শব্দ নেই। বাইরের দরজাটা খোলা। উঠানটা ফাঁকা। রান্না ঘরের দরজা বন্ধ। নীচের মাটির ঘর ও পাকা ঘরের দরজাও ভেজানো। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলাম। বারান্দায় কেউ নেই। কিন্তু দুটো ঘরের দরজাই হা করে খোলা। বারান্দার রেলিংএর চওড়া কাঠের উপর এক জায়গায় দেখলাম, চুলের ফিতে আর কাঁটা পড়ে আছে। এক পাশে শাড়ি শায়া জড়ো করা।

এখন আর বৃষ্টি নেই। ভেজা বাতাস বইছে। আকাশ মেঘ মেদুর। পূর্ব দিগন্তে কালো আকাশের পটে শালবন দুলছে।

আমি ডাকলাম, ভব আছিস নাকি?

কোনও এক ঘর থেকে ঝিনুকের গলা শোনা গেল, না। ঘরে এসো।

এরকম এসেই থাকি, দ্বিধার কিছু নেই। অনেক দিন ভবেন এসে দেখেছে, আমরা ঘরে বসে কথা বলছি। তবু সাঁকোট থেকে ফিরে, আমার পায়ে যেন আড়ষ্টতা বোধ করছি। ওখান থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, কোন ঘরে।

–তোমার বন্ধুর ঘরে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। মনে করেছিলাম, গিয়ে দেখব, ঝিনুক কোনও জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু দেখলাম, মেঝেতে মাদুর বিছানো। ঝিনুক তাতে কাত হয়ে এলিয়ে, কনুয়ে ভর দিয়ে, গালে হাত রেখে, সামনে দাবার ছকে নিবিষ্ট হয়ে আছে। তার খোলা রুখু চুল মাদুরে এলানো। একটি মোটা লাল পাড় শাড়ি পরা, গায়ে একটি পুরনো রং-ওঠা বিবর্ণ জামা। আঁচল বুকের নীচে মাদুরে পড়ে রয়েছে। কাত হয়ে রয়েছে, তাই গলার সরু হারগাছা জামার এক পাশ দিয়ে ভিতরে চলে গেছে। কপালে সিঁদুর নেই, সিঁথেয় গতকালের অস্পষ্ট দাগ। একটি কালো রংএর বোড়ে নিয়ে, ছকের ওপর এক জায়গায় রেখে চোখ না তুলে ঝিনুক বলল, এসো।

কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেন স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কী একটা তীব্র আনন্দ, আর একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। তার সঙ্গেই সেই গুরু গুরু শব্দের গর্জন ভেসে আসতে লাগল। আমার নিজের প্রতি সেই ভয় আর অবিশ্বাস। এক বার মনে হল, ফিরে যাই। পরমুহূর্তেই আমার ভিতরে যেন

কে নাড়া দিয়ে উঠল। আমি হেসে উঠলাম, কী ব্যাপার একলাই পেড়ে বসেছ।

ঘরে ঢুকলাম আমি। ঝিনুক তেমনি চোখ না তুলে বলল, দোকলা আর পাচ্ছি কোথায় বলো।

 বলে উঠলাম, কেন, ভবকে যে বলেছিলাম ছুটি নিয়ে বাড়ি থাকতে?

ঝিনুক চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। বলল, বলেছিলে বুঝি? কই, জানি না তো।

ঝিনুক আবার চোখ নামিয়ে নিল। বললাম, কিন্তু ও এখনও ফেরেনি কেন? ছুটি তো অনেকক্ষণ হয়েছে।

–হয়তো তোমার ওখানেই গেছে। বসো, এখানে এসে বসো ছকের সামনে, একটু খেলি।

ঝিনুক তেমনি ভাবেই বলল। আমি উলটো দিকে মেঝেয় বসে বললাম, কিন্তু একলা একলা দুদিক। চালছ কী করে? এমনি লড়া যায়?

ঝিনুক বলল, নিরুপায় হলে লড়তেই হয়।

আমি চোখ তুলতেই, ঝিনুকের সঙ্গে চোখাচোখি হল। আমার বুকে নিশ্বাস আটকে এল হঠাৎ। ঝিনুকের চোখে যেন জ্বরের ঘোর। ও আবার বলল, এবার তুমি এসেছ, একটু লড়ো।

আমি তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিয়ে এলাম। খেলার কথা নয়, অন্য কিছু অর্থ যেন ঝিনুকের কথায়। নিজের দিকে চেয়ে, নিজের প্রতিই যেন দীন ভিখারির মতো প্রার্থনা করলাম, তাড়াতাড়ি খেলায় মনোযোগ দাও, খেলায় ডুবে যাও।

বেশ খানিকক্ষণ একেবারে নিবিষ্ট থেকে বললাম, কিন্তু একী, এ যে দেখছি প্রায় সবই সাজানো, কী খেলছ তা হলে?

ঝিনুক যে চোখ নামায়নি আর, তা আমি জানি। বলল, এতক্ষণে দেখতে পেলে? একলা কি খেলা যায়? শুধু পেতে বসা যায়।

ঝিনুকের সেই সন্ধ্যাভাষা। নিশূপে নিচ্ছিদ্রের ভিতর দিয়ে সহসা আবির্ভূত হয়ে মর্মে এসে ঢোকে। তাড়াতাড়ি বললাম, তা হলে।

কথা শেষ হল না। ঝিনুক বলল, কেমন কাজ করে এলে টোপনদা?

বললাম, ভাল। না গেলে সত্যি ক্ষতি হত। অনেক জিনিস পেয়েছি। তা হলে তোমার বোড়ে তিনটে দাও, সাজিয়ে নিয়ে একেবারে নতুন–

দেখলাম, ঝিনুকের গালে রাখা হাতটি আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল। ওর মাথা মাদুরে এলামনা। প্রায় শ্বাসরুদ্ধ গলায় বললাম, কী হয়েছে ঝিনুক।

ঝিনুক প্রায় চুপিচুপি স্বরে বলল, আমার হাতটা একটু ছোঁও।

আমার বুকের মধ্যে সহসা সেই দুরন্ত কাঁপুনি এল। তবু ওর হাত ধরলাম। ঝিনুকের হাত, ঝিনুকের! ঝিনুক যেন হাঁপাচ্ছে। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। ওর হাত ঠাণ্ডা। আর একটি হাত দিয়ে মাদুর আঁকড়ে ধরে আছে, নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে, শরীর শক্ত হয়ে উঠছে। ওর রৌদ্ররং শরীরের খোলা অংশে রক্তাভা দেখছি যেন। কাত করা রক্তাভ মুখের পাশ দিয়ে চুলের রাশির জটলা। ওর চোখ আমার হাতের দিকে, যে হাত দিয়ে ওর হাত ধরে আছি।

আমি স্খলিত গলায় ডাকলাম, ঝিনুক।

ঝিনুক তেমনি স্বরে বলল, টোপনদা, এখন বুঝতে পারি না, তুমি জেলে থাকতে কেমন করে ছিলাম?

আমার ভিতরে, যেন এক সংক্রান্তিকালের ইশারায় মহাকালের ভেরিতে প্রবল রব উঠল। বাইরে থাকাকালীন কয়েক দিনের সব কথা আমার জিহ্বার ওপরে এসে দাপাদাপি করতে লাগল। আর তৎক্ষণাৎ মনে হল, কী সর্বনাশ। আমি প্লাবনের মুখ খুলে দিতে যাচ্ছি। যেন ভয়ে শিউরে উঠলাম আমি। বললাম, ঝিনুক, মানুষ অনেক কিছু পারে।

ঝিনুক আরও জোরে আমার হাত চেপে ধরল। বলল, আবার অনেক কিছু পারে না টোপনদা।

–তুমি পার ঝিনুক, আমি জানি।

 ঝিনুক কী ভাবল, ও আমার চোখের দিকে তাকাল। আমি আবার বললাম, না পারলে চলে না। ঝিনুক উঠে বসো।

ঝিনুক চোখ নামাল না আমার চোখ থেকে। কথা বলল না। কয়েক মুহূর্তের পরে ঝিনুক উঠে বসল। আমি ওর হাত ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ও বিস্রস্ত বেশ গোছাল না। ইচ্ছে করল, আমি নিজেই ঠিক করে দিই। তা আমি পারব না। বিচারের অবসর ছিল না, শুধু ঝিনুকের সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গেও ছলনা করছি কি না! আমি সাঁকোটে এক রকম ভেবেছিলাম, এখন আর একরকম। উঠে দাঁড়িয়ে কী যে করতে চাইলাম, জানিনে। বাইরে যাব কি না, একবার ভাবলাম। তারপর আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। যেন নিজেকেই বলবার জন্য আবার আমি উচ্চারণ করলাম, ঝিনুক সংসারে কোনও কোনও মানুষকে পরীক্ষা দেবার জন্যেই থাকতে হয়। তাদের জন্মের সময়ে গ্রহ নক্ষত্র কে কীভাবে ছিল, কে জানে, হয়তো সামান্য একটু এদিক ওদিকের জন্যে, সারা জীবনের ছকে বাঁধা পড়ে গেছে। নতুন কোনও কিস্তি মাতের উপায় নেই আর।

এমন সময়ে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ শোনা গেল। ভবেনের গলাও উচ্চকিত হল, আনিদি, আমাদের চা দাও। তিন জনের মতন দিয়ো।

আমি ঝিনুকের দিকে তাকালাম। ঝিনুক তাকাল না, ঠায় তেমনি বসে রইল। ভবেনের কথা শুনেই বুঝলাম, আমি এসেছি সে ধরেই নিয়েছে। নইলে তিন জনের চায়ের কথা বলত না। দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভবেন এগিয়ে এসে আমাকে দেখে বলল, আমি তোদের বাড়ি ঘুরে এলাম। কুসুমের মুখে শুনে বুঝলাম এখানেই এসেছিস। কিন্তু এ কদিনে চেহারাটা তো বাগিয়ে এসেছিস।

বললাম, একটু কালো হয়েছি।

ঝিনুক চুল এলো খোঁপায় বেঁধে উঠে দাঁড়াল। তারপর কোনও কথা না বলে, আমাদের দুজনের মাঝখান দিয়ে বাইরে চলে গেল। বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল।

ভবেন তাকাল আমার দিকে। আমিও ভবেনের দিকেই। ভবেন বলল, কী হয়েছে, তোরা ঝগড়া করেছিস নাকি?

বললাম, না। ওকে কয়েকটা কথা বলছিলাম।

ভবেন ঝিনুকের যাওয়ার পথের দিকে কয়েক মুহূর্ত যেন মুগ্ধ স্নেহে তাকিয়ে রইল। বলল, কদিন জ্বরে ভুগল ঝিনুক। নগেন ডাক্তার এসেছিল, বলল, ও খুব দুর্বল হয়ে গেছে।

তারপরে ভবেন আমার মুখের দিকে তাকাল। কী দেখল জানি না। আমার হাত ধরে বলল, আয়, ভেতরে বসি। সাঁকোটে কী কাজ হল শুনি।

আমার যেন মনে হল, ভবেনের বুকের মধ্যে একটা দীর্ঘশ্বাস আটকে রয়েছে। আমি সহসা কোনও কথা বলতে পারলাম না। আমার নিজেকেই সবথেকে বেশি বিড়ম্বিত মনে হতে লাগল।

.

সাকোটের পথের কথা, বিশেষ করে আকোনের কথা সব লিখে পাঠালাম গোবিন্দবাবুকে। নতুন পাওয়া মূর্তি ও চিহ্নগুলির ফটোও সেই সঙ্গে। গোবিন্দবাবু উৎসাহিত হয়ে জবাব দিলেন। জানালেন, শালঘেরি এবং আকোন এ দু জায়গাতে লক্ষ্য দিতে হবে।

ইতিমধ্যে স্বাধীনতা ঘোষিত হল। শালঘেরিতে উৎসবের আয়োজন মন্দ হয়নি। বাড়িতে বাড়িতে পতাকা উড়ল। জেলা শহরের উৎসব দেখতে গেল অনেকে। বৃষ্টি বাদলাতেই যা একটু অসুবিধে হল। তবু শালঘেরি থেকে গড়াই অবধি একটা মিছিল গিয়েছিল। ইন্দির একটা পতাকা নিয়ে সামনের সারিতেই ছিল। সে ঘড়ঘড়ে বুড়ো গলায় চিৎকার করছিল, বন্দে মাতোরং!

সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এলেন গোবিন্দবাবু। প্রৌঢ় ভদ্রলোককে দেখে মনে হল, একটা বিভ্রান্তির ঘোরে আছেন। এবং সেটা যে রাজনৈতিক জটিলতার ঘোর, তা বুঝতে পারলাম। আমার সঙ্গে তামাইয়ের ধারে ঘুরতে ঘুরতে, কাজের কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে যান। কেবলি মনে হয়, অনেক দূর অবধি তাকিয়ে কী দেখে যেন সংশয়ে ও হতাশায় ডুবে যাচ্ছেন।

মাটি কাটার কাজ যেদিন শুরু করার কথা, সেদিন সকালবেলা হঠাৎ আমাকে বললেন, সীমন্তবাবু, স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি ঠিকই। একটা জোয়ার বোধ হয় শুরু হল, কিন্তু পঁচিশ বছর ধরে বেনো জলের ধাক্কায় যে ময়লা আর গ্লানিটা এখন আসবে, আমি শুধু তাই দেখে যাব।

হয়তো গোবিন্দবাবুর ভাবনার সঙ্গে আমার কিছুটা মিল ছিল। কিন্তু সময়ের কথা শুনে বললাম, পঁচিশ বছর বলছেন?

–হ্যাঁ, পঁচিশ বছর। অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ দেখতে পাবেন। কারণ বহু, বহুযুগ পরে আবার আমাদের স্মরণ করতে হচ্ছে, আমরা ভারতবাসী। আত্মবিস্মৃতির মার না খেয়ে আমাদের উপায় নেই। নিজেদের সঠিক পরিচয়টা জানতেই এই বছরগুলো কেটে যাবে। বিভ্রান্তিই অবক্ষয়কে টেনে আনবে। আর উনিশ শতকে যে জ্ঞানের আর মুক্তির আশ্রয়টা বিদেশ আমাদের দিয়েছিল, তারও কোনও আশা নেই আর। তারা আমাদের থেকেও বোধ হয় দেউলিয়া হয়ে গেছে। এবার আসুন, নিজেরা নিজেদের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে, একেবারে হাড়ের মধ্যে পৌঁছে, নিজেদের পরিচয়কে খুঁজি।

হেসে উঠে বললেন, এতে ভয়ের কিছু নেই, এ ছাড়া রাস্তা নেই। এখন যে নিজেদের সব করতে হবে।

মাটি কাটার কাজ আরম্ভ হয়ে গেল।

গোবিন্দবাবু করিক টুডুদের মাটি কাটার ধরনটা দেখিয়ে দিলেন। যতক্ষণ মাটি কাটা হয় আমি প্রতিটি শাবল কোদালের আঘাতের মুখে চেয়ে থাকি। গ্রামের এবং আমাদের গাঁয়ের লোকেরা কৌতূহলিত হয়ে খানিকটা মজা দেখার মন নিয়ে এসে ভিড় করে। বার্তা রটে গেছে, টোপন চাটুয্যে বিঘা বিঘা জমি নিয়ে মাটি খোঁড়াচ্ছে, মানুষের কঙ্কাল খুঁজছে। কেউ কেউ বলছে, গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে।

গোবিন্দবাবু সাত দিনের জন্য আপাতত এসেছিলেন। আরও তিন দিনের মেয়াদ বাড়িয়ে, দশ দিন থাকলেন। আস্তে আস্তে তাঁর কপালে আমি কয়েকটা হতাশার রেখা ফুটে উঠতে দেখলাম। বাড়ি ফিরে এসে তিনি রোজই খুঁজে পাওয়া মাটির ও পাথরের মূর্তি এবং সামগ্রীগুলি দেখেন, আপন মনে বিড়বিড় করেন। একদিন আমাকে নিয়ে আকোন গেলেন।

আমার ভিতরেও একটা সংশয়ের অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগল। তবু একটা অটল বিশ্বাস যেন আমার মনের মধ্যে অনড়, নিশ্চল, শক্ত হয়ে বসে আছে।

দশ দিন পর গোবিন্দবাবু যাবার আগে জানিয়ে গেলেন, যে জায়গাটা আমি বেছেছি, ওখানে আর কোনও আশা নেই। আর একটু ভেবে জায়গা ঠিক করতে হবে।

মাঝে মাঝে বর্ষায় কাজ প্রায় বন্ধ যেতে লাগল।

গোবিন্দবাবুর সঙ্গে চিঠি আদান প্রদান চলছিল। শেষ চিঠিতে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন, আপনি যে অস্ত্র এবং পাথরের মাটির অগণিত মূর্তি বা অন্যান্য সামগ্রী পেয়েছেন সেগুলি অন্য কোনওভাবেও ওখানে আসতে পারে। সাঁওতাল বস্তিতে খোঁজ করে দেখবেন ওরা ওরকম কোনও কিছু পেয়েছে কি না। না পেয়ে থাকলে আর অকারণ কষ্ট করবেন না। কারণ যদিও শালঘেরির মৃত্তিকায় একটি ইশারা দেখা গিয়েছিল আজ পর্যন্ত বাংলার অন্য স্থানের সঙ্গে সেও বোধ হয় একাত্মা। অনেক কিছুই হয়তো ছড়িয়ে আছে। কিন্তু কোথায়, এখনও জানা যাচ্ছে না।

খোঁজ করে সাঁওতালদের কাছে কিছুই পাইনি। ওরা পেয়ে থাকলেও বোধ হয় ভয়েই কিছু জানায়নি আমাকে।

বিঘা বিঘা মাটি কাটা হল। বড় বড় পুকুর হল। বর্ষার জল জমল তাতে। অল্পদিনের মধ্যে কিছু আগাছাও জন্মাল। আবিষ্কার হল না কিছুই।

পিসি তো প্রায় কথা বন্ধ করেছেন। কারণ তাঁর সহোদরের সঞ্চিত টাকা এভাবে নষ্ট হতে দেখে, ভয়ের অন্ত নেই। অন্ত নেই আমার ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার। পাড়ার সবাইকে দিয়ে বলিয়ে আমাকে নিরস্ত করতে চেয়েছেন। পারেননি। পিসিকে অনেক বুঝিয়েছি যে সার্থক হলে এ জন্যে আর দুঃখ করতে হবে না।

পিসির কোনও কারণ নেই বোঝবার।

কুসুম যেন শিশু গাভীটির মতো অসহায় দুই চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। ওর বেশি কথা বলতে সাহস হয় না। কেবল, তামাইয়ের ধার থেকে ফিরলে এক বার জিজ্ঞেস করে, কিছু পেলে টোপনদা?

সবদিন মনটন একরকম থাকে না। মাঝে মাঝে এ অনধিকার চর্চা করতে বারণ করি। তখন কুসুম আর আগের মতো সরে গিয়ে, পরে কৌতুকোচ্ছলে উঁকি মারে না। আজকাল ওর অসুখ হলে আমি ফিরে দেখার সময় পাইনে। কত দিন অসুখ অবস্থাতে আমাকে দরজা খুলে দিয়েছে রাতে। ডেকে জিজ্ঞেস করবার মন ছিল না আমার। ও যে অন্ধকারে লেপটে থেকে আমার দিকে সভয় করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে, তা যেন আমি দেখেও দেখিনে।

আমি তামাইয়ের মাটির তলায় প্রাগৈতিহাসিক তামাই সভ্যতার সন্ধানে ফিরি। আর সেই আবিষ্কারের ইন্ধন খুঁজতে কি প্রতি সন্ধ্যায় যাই ঝিনুকের কাছে?

আমাকে তামাইয়ের মাটি প্রতি দিন যেমন নতুন নতুন স্তরে ডাক দেয়, তেমনি করেই ঝিনুক আমার চোখে চোখ দিয়ে, নিঃশব্দে, বাতাসে আমার দৃষ্টি তুলে নিয়ে গেছে হেঁতালের তলায়। তামাইয়ের ওপারে শালবনে।

আমি মাটির রন্ধ্র খুঁজেছি। আমি শালবনে যাইনি। আমার মাটির তলায় আবিষ্কারের সাহস আছে। তামাইয়ের শালবনে যাবার উপায় নেই। সকল দিক থেকে যেন একটা বিরোধের বেড়াজালে আমাকে। কষে বাঁধছে।

তামাইয়ে এখনও বর্ষার জল ভরা, টান একটুও কমেনি। তার ওপরে কার্তিক মাসে প্রবল বৃষ্টি হল। তামাই যেন কেমন ভয়ংকরী হয়ে উঠল। আমার কাটা জায়গাগুলি ভরতি হয়ে গেল তামাইয়ের তাম্রাভ জলে। পুবের কূলে মাটি ভাঙতে লাগল।

.

প্রথম যেদিন বৃষ্টি হল, কুসুমের সেদিন অসুখ। একটু বাড়াবাড়ির লক্ষণ। নগেনবাবু এসে কেমন বিমর্ষ হয়ে গেলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, জ্বরটা তো অনেক দিন এসেছে। খবর দাওনি কেন টোপন?

বললাম, কুসুম তো আমাকে কিছু বলে না। পিসি

–তোমার পিসিও খবর দিতে পারতেন। বড় দেরি করেছ।

ইঞ্জেকশন দিলেন। খাবার ওষুধও লিখে দিলেন। যাবার সময়, বাইরে গিয়ে আমাকে বললেন, এত দূর খারাপ অবস্থায় এসেছে যে, কী বলব, বুঝতে পারছি না। বড় ভাল মেয়েটি।

আমি তাড়াতাড়ি কুসুমের কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কুসুম, কেমন লাগছে?

কুসুম আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ভাল।

বড় মায়া লাগল। কুসুমের এই নীরব অভিমানের কাছে কেমন যেন অপরাধী মনে হল নিজেকে। নগেন ডাক্তারকে দেরি করে খবর দেবার কথা শুনেছে ও। পিসির মুখ সবসময় থমথমে। কুসুমের অসুখ তো তাঁরও যেন সংসারের সব খেলার কোলাহল নীরব। জানি, নিঃসন্তানা পিসির আমি যা, তার চেয়ে কুসুম অনেক বেশি।

বিকেলে কুসুম একটু ঘুমিয়েছিল। আমি ভবেনদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ভবেন তখন বাইরের ঘরে কয়েকটি আগামী ম্যাট্রিকের ছাত্রকে পড়াচ্ছিল। ঝিনুক আমার মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

ওকে বললাম কুসুমের অসুখের কথা। নগেন ডাক্তারের শেষ কথাও উল্লেখ করলাম।

ঝিনুক একবার আমার চোখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, কুসুম তোমাকে ভালবাসে টোপনদা।

বললাম, সেটা কি আজ নতুন নাকি?

ঝিনুক আমার দিকে আবার তাকাল। ওর মুখে হঠাৎ এক ঝলক রক্ত এসে পড়ল। বলল, তুমি যা ভাবছ তা নয়। আমি বলছি, ও তোমাকে–তোমাকে–

একটা চমকিত বিস্ময়ের ভ্রূ কুঁচকে উঠল আমার। জিজ্ঞেস করলাম, কী আমাকে?

ঝিনুক বলল, একজন মেয়ে যেমন করে একজন পুরুষকে ভালবাসে, তেমনি।

একটা চমকিত বিস্ময়ের সঙ্গে বিরক্তি আমি চাপতে পারলাম না। বললাম, ঝিনুক ও বেচারির ওপর অমন অবিচার কোরো না। ও অত্যন্ত ছেলেমানুষ।

–অবিচার?

 ঝিনুক আমার সামনে এল। বলল, প্রথম যেদিন আমাকে দেখেছিলে টোপনদা, সে দিন কি আমি খুব বড় ছিলাম?

–সেদিন আমিও ছোট ছিলাম ঝিনুক।

ঝিনুকের মুখে অতীতের ফেলে-আসা লজ্জার ছায়া দেখতে পেলাম আজ। বলল, টোপনদা সেদিন তুমি ছোট হলে যা হত, বড় হলেও তাই হত।

তবু দু চোখে আমার বিস্ময়। বুকভরা অবিশ্বাস। বললাম, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই ঝিনুক।

–অবিশ্বাস করতে পার, আমি একটা সত্য কথা বললাম। টোপনদা, সংসারের সবই কি বিশ্বাসযোগ্য?

ঝিনুক জানালার কাছে গেল। সেখান থেকে বলল, টোপনদা, তুমি, আমি এ সব কি বিশ্বাসের? তুমি বলেছ, তোমার যা সান্ত্বনা, আমারও সেই সান্ত্বনা থাক। বলো তো, এ কষ্ট কি লোকে সত্যি বলে জানে?

নিজেকে সে কথা জিজ্ঞেস করবার সাহস নেই আমার। করতে পারলে এক দিন বুঝি শালবনে যেতে পারতাম। এক সন্ধ্যায় হয়তো গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম হেঁতালের তলায়। কিংবা ত্যাগ করতে পারতাম শালঘেরি।

কিন্তু ঝিনুকের কথায় অবিশ্বাসে তেমনি মনটা বেঁকে রইল আমার। কেন না, প্রবৃত্তিও ছিল না বিশ্বাসের। ঝিনুকের গলায় যে সুর কোনওদিন শুনিনি, সেই ভয়চাপা রুদ্ধ গলা শুনতে পেলাম। ঝিনুক বলল, কুসুমকে দেখে বুঝি আমারও বুক কেঁপেছিল টোপনদা। কুসুমকে দেখেই বুঝি আর পেছুতে পারিনি।

আমি আর্তস্বরে ডাকলাম, ঝিনুক!

না, তোমাকে কোনওদিন খাটো করিনি টোপনদা।

কুসুমের প্রতি ঝিনুকের ব্যবহারগুলি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তবু একী অবিশ্বাস্য কথা! এ কথা কেমন করে মানি।

ঝিনুক হঠাৎ দ্রুত বলে উঠল, টোপনদা, তুমি তাড়াতাড়ি কুসুমের কাছে যাও।

 ভবেন এল এ সময়ে। বলল, কী হল, তোরা আবার ঝগড়াটগড়া করেছিস নাকি?

আমি বললাম, না। কিন্তু ঝিনুক কী বলছে শোন। আমি চলি।

.

চলে এলাম। শালঘেরির রক্তমৃত্তিকা বৃষ্টির জলে গাঢ় রক্তের মতো হয়েছে। পুবে বাতাস বইছে। শালবনের আকাশে গাঢ় কালো মেঘ আছে থমকে। বাকি আকাশটার কোথাও কোথাও, ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে অস্পষ্ট নক্ষত্র দেখা যায়।

বাড়ি ফিরে এলাম। দূর থেকে লুকিয়ে কুসুমকে দেখার ইচ্ছে হল আমার। ঝিনুক এত অবিশ্বাসের কথাও বলতে পারে।

দরজার কাছে এসে দেখলাম, হরলালকাকা আর তারক উঁকি মারছে বাড়ির দিকে। আমাকে দেখে থতিয়ে গেল দুজনেই।

হরলালকাকা বললেন, এই যে টোপন, কুসি কেমন আছে?

বললাম, ঘুমোচ্ছে।

তারক অনেকখানি সরে গেছে আমাকে দেখেই।

হরলালকাকার মুখে মদের গন্ধ। বললাম, হরকাকা, কুসুমের শরীর খুবই খারাপ। আপনি আজকে যান।

হরলালকাকা বোধ হয় একটু বিব্রত হলেন। বললেন, খারাপ তো হবেই। নগেন শুদুরটাই আমার মেয়েকে মারবে।

আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। বাইরে থেকে হরলালকাকার গলা শোনা গেল, আচ্ছা, আমিও মেয়ের বাপ, একবার দেখে নেব।

দেখলাম, পিসি কুসুমের একটি শাড়ি জড়িয়ে পাকা মাথাটি বের করে আমার জন্য রান্নায় বসেছেন। পিসির বড় দুর্গতি।

জিজ্ঞেস করলাম, পিসি, কেমন আছে কুসুম।

পিসি বললেন, ঘুমোচ্ছে।

আমি পিসির ঘরে গেলাম। কুসুম এ ঘরেই আছে। একটি হ্যারিকেন একটু কমানো। তাতে সবই দেখা যায়। গিয়ে দেখলাম, কুসুমের চোখ বোজা। অপুষ্ট শীর্ণ শরীর থেকে কাঁথার ঢাকনা খুলে গেছে। কষ্টের একটি অস্পষ্ট ছাপ তাতে মুখে।

ঝিনুকের কথা কী অবিশ্বাস্য! এই তো কুসুম। অসুখে পড়েছে তাই, নইলে পিসির সঙ্গে এখন কিছু একটা বায়না নিয়ে থাকত। ঝগড়া চলত, দৌড়াদৌড়ি হত। হয়তো এর মধ্যে বারকয়েক ছুটে ভাইবোনেদের কাছে ঘুরে আসত গিয়ে। উচ্চকিত হাসিতে ডুবে যেত পিসির গলার স্বর।

কুসুমের দিকে তাকিয়ে আমার মন যেন অনেকখানি স্বচ্ছ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বসে থেকে আমি ওর কপালে হাত দিলাম। জ্বরটা কমেনি। বরং বেড়েছে যেন। কাঁথাটা টেনে দিলাম গলা অবধি। দিয়ে উঠে, চলে যাচ্ছিলাম।

কুসুমের গলা শুনলাম, টোপনদা।

 কুসুম ঘুমোয়নি? ফিরে বললাম, ঘুমোসনি কুসুম?

অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম, কুসুমের ঈষৎ রক্তাভ দুটি বড় বড় চোখ। করুণ দূরবিসারী অন্ধকারে দুটি আলোর মতো নিরুদ্দেশে খুঁজে ফেরা দৃষ্টি যেন। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কুসুম ঘুমোসনি?

ওর গলাটা মোটা আর চাপা শোনাল। বলল, ঘুম আসছে না। টোপনদা!

-কী বলছিস?

 তুমি কি তামাইয়ে যাচ্ছ?

না।

–টোপনদা, বাবা এসেছিল?

 আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। বললাম, হরকাকা এসেছিলেন, চলে গেছেন। কেন?

–এমনি।

কুসুমের চোখ তেমনি ভোলা। কিন্তু ওর মুখ ক্রমেই লাল হয়ে যাচ্ছে।

আমি পিসিকে ডাকলাম। পিসি এলেন। এসে দেখেই বললেন, জল, তাড়াতাড়ি জল দিতে হবে মাথায়।

পিসিই তাড়াতাড়ি জল নিয়ে এলেন। আমি ঢেলে দিলাম। পিসি কুসুমের গায়ে হাত বুলোতে লাগলেন।

মাথা ধোয়ার পর আমি নগেন ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এলাম আর একবার। নগেন ডাক্তার দেখে মুখ কালো করে বললেন, টাইফয়েড রোগ, বড্ড বেঁকে দাঁড়িয়েছে।

ইঞ্জেকশন দিয়ে চলে যাবার আগে বললেন, শরীরে তো দেখছি রেজিস্ট করবার ক্ষমতা একটুও নাই। ওর বাবা মাকে একটু খবর দিয়ে রাখো।

পিসির কাছে খবর পেয়ে ওর মা এলেন। দেখলেন অসহায়ভাবে। পিসিকে বললেন, সেজদি, দেখে কী করব। আপনার মেয়ে আপনি বুঝুন।

তারপর ওপর দিকে তাকিয়ে, কড় গুনে গুনে কী যেন বিড়বিড় করলেন। বললেন, পনরো পূর্ণ হয়ে, ষোলোয় পড়েছে দু মাস।

বলে চলে গেলেন। ছায়ার মতো এসেছিল কুসুমের ভাইবোনেরা। ওরাও মায়ের সঙ্গে চলে গেল।

 পিসি দালানে গিয়ে জপে বসলেন সব সেরে।

কুসুম আবার ডাকল, টোপনদা।

বাতিটা কাছেই। কুসুমের মুখটি যেন ঘাম ঘাম চকচকে লাগছে।

বললাম, কী বলছিস কুসুম?

কুসুমের চোখ তেমনি রক্তাভ। কিন্তু চোখের পাতা আনত। চুলগুলি বালিশ ছাড়িয়ে মেঝেয় পড়েছে। লাল কাঁচের চুড়ি পরা একটি হাত বুকের ওপরে।

বলল, তুমি কি ঝিনুকদির কাছে যাচ্ছ?

 ঝিনুকদির কাছে কেন ঝিনুকদিদের বাড়িতেই তো যাব কুসুম। কিংবা আজ ঝিনুকের কথা শুনে, আমার কানে লাগছে ওরকম।

বললাম, না। কেন রে?

 কুসুম এক বার তাকাল আমার মুখের দিকে। বলল, আমার অসুখ বলে যেতে পারছ না, না?

কুসুম যেন হাসল। যেন সুস্থ চকিত চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি মরে যাব, না?

আমার বুকের মধ্যে চমকে উঠল। কুসুমের পাশে বসে বললাম, না। অবাধ্য হোসনি কুসুম। চুপ করে ঘুমো।

কুসুম চোখ বুজল। কিন্তু ওর নাসারন্ধ্র ফুলছে বারে বারে। বুকের ওপর হাতখানি ওঠানামা করছে।

আমি মুখ ফিরিয়ে গালে হাত দিয়ে বসলাম। কুসুমের অসুখে আমাকে বড় একটা বসতে হয়নি কোনওদিন।

বাইরে বুঝি বৃষ্টি নেমেছে আবার।

সহসা আমার কোলে স্পর্শ পেতে চমকে ফিরলাম। কুসুমের হাত। কুসুম তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

কীরে কুসুম?

কুসুম আমার হাত টেনে নিল ওর কপালের ওপর। কিছু বলল না। আমার কানে ঝিনুকের কথাগুলি বাজতে লাগল। কুসুম যেন মৃত্যুর বিশ্বাসে কেমন বদলে গেল।

পরমুহূর্তেই দেখি, কুসুমের সর্বাঙ্গ কাঁপছে, ফুলছে।

কুসুম!

দেখলাম, কুসুম আমার হাত ওর মুখে চেপে ধরে কাঁদছে ফুলে ফুলে। ওর জ্বরতপ্ত মুখগহ্বরে, বিষম। জ্বরের শুকনো জ্বিহা ঠেকছে আমার আঙুলে।

কুসুমের মাথায় হাত দিয়ে আমি ভীত রুদ্ধ গলায় ডাকলাম কুসুম! কুসুম! কী হয়েছে।

 রোরুদ্যমান গলায় কুসুম অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি মরে যাব টোপনদা। আমি আর থাকতে পাব না।

না কুসুম, মরবি না। কুসুম।

কিন্তু কুসুম শান্ত হল না। পিসি ছুটে এলেন জপ ফেলে। ডাকলেন, কুসি অ কুসু।

কুসুমের সরু আঙুল আমার হাতে কঠিন শক্তিতে যেন বিদ্ধ হতে লাগল। ওর চোখের দৃষ্টি অস্থির। ও যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শ্বাসরুদ্ধ গলায় ডাকল, টোপনদা!

আমি দুহাত দিয়ে কুসুমকে সাপটে ধরলাম। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, বল কুসুম।

কুসুম তেমনি গলায় বলল, ঝিনুকদি। ঝিনুকদি।

ঝিনুকদি নেই এখানে কুসুম।

ঝিনুকদি..রাগ…করবে টোপনদা।

বলতে বলতে কুসুম প্রায় উঠে পড়ল। আমি জোরে ডাকলাম, কুসুম!

কুসুম চমকে ফিরে তাকাল আমার দিকে। দৃষ্টিটা সহসা স্বচ্ছ দেখাল আবার। তারপর আস্তে আস্তে আচ্ছন্ন হতে লাগল।

শুইয়ে দিলাম। ওর গা অত্যন্ত দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। দেখলাম, আমার জামা ওর মুঠিতে।

 সামনে তাকিয়ে দেখি পিসি নোনা দেয়ালে মুখ গুঁজে আছেন। সেই ফাটা পুরানো দেওয়ালের অভ্যন্তর থেকে একটি সরু গলার কান্নার স্বর আস্তে আস্তে নির্গত হচ্ছে।

কুসুমের রক্ত তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হতে লাগল।

আমার ভিতর থেকে কে যেন চুপিচুপি বলে উঠল, কুসুম তা হলে আমার সঙ্গে বুঝি তামাইয়ের ওপারে শালবনে বেড়াতে যেতে চেয়েছিল। কুসুমের প্রতিদিনের প্রতিটি হাসি, চাউনি, কথা আমার মনে পড়তে লাগল। কখনও তো কিছু বুঝতে পারিনি। এখনও যেন পারছি না।

কুসুমের মুঠি শিথিল হয়ে গেল। আমার কোলেই ওর শেষ নিশ্বাস পড়ল। তারক কোথায়? তারকের এক বার আসা উচিত এখন। সে তার তেজালো ভাল মেয়েটিকে এক বার দেখে যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *