৫. কামুক ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র
কালীপ্রসন্নর সঙ্গে বঙ্কিম চাটুজ্জের এক জায়গায় মিল। ঋষি বঙ্কিমও এঁচড় অবস্থাতেই পাকলেন! যুগে—যুগেই ঋষিরা অকালপক্ব। তাঁদের নানাবিধ জ্যাঠামি, ডেঁপোমি, কেঁড়েলি, বয়াটেপনা—সবই তাঁদের মূলত ওই এঁচড়পাকামি— প্রসূত।
কোনও—না—কোনও অর্থে জগতের সব ঋষিই অকালকুসুম। যেন অকালিক পক্বতাই ঋষিত্বের অভিজ্ঞান।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও যে এঁচড় অবস্থাতেই পক্ব পনস হয়ে ওঠার চেষ্টা করবেন, তাতে আশ্চষ্যির কিছু নেই। চোদ্দো বছরের কৈশোরিক বয়েসেই তো সে ঋষি—ইন—দ্য—মেকিং!
এঁচড় অবস্থায় কণ্টকীফল হওয়ার প্রচেষ্টায় প্রায়—বালক বঙ্কিমের মধ্যে যে—রস উপচে পড়ল, তা শৃঙ্গার বা আদিরস। চোদ্দো বছর বয়েসেই সে পর্যাপ্তভাবে ভাবছে নারীর শরীর নিয়ে। সে বিশেষভাবে স্তনাগ্রহী। এই বয়েসেই সে নারী শরীরের এই দু’টি উচ্চচরব স্তনন বা ঘোষণাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত, বর্ণিত ও রঞ্জিত করছে।
বালক বঙ্কিম একটি কবিতা লিখেছে। নামটিও বেড়ে রেখেছে—’বর্ষা—বর্ণনাছলে দম্পতির রসালাপ’। এ—ছেলে ভবিষ্যতে ‘ঋষি’ হবে না তো হবে কে?
তখনও চোদ্দোয় পড়েনি বঙ্কিম। নারীর বুক দেখে তার ডালিম ফলের কথা মনে আসে! তখনও বক্ষবন্ধনীর ব্যবহার জানে না বাঙালি মেয়ে। তারা আদুল অঙ্গেই শাড়ি পরে। কমবয়েসি মেয়েদেরও সেইভাবেই দেখে বঙ্কিম।
দেখে এঁচড়েপাকা গাঢ় রসের দৃষ্টিতেই :
বরষার মনোহর তরু শোভাকর।
দাড়িম্ব দেখিল ধনি, তব পয়োধর।
বর্ষায় নারীর স্তনের রূপই আলাদা! সেই শোভা ধরা পড়ে বালক বঙ্কিমের চোখে। সেই ভাব লেখায় প্রকাশ করতে এতটুকু দ্বিধা নেই: বর্ষার স্তন যেন ডালিমফল। বৈষ্ণব পদাবলিতে রাধার স্তন শিশিরভেজা বেল। আর বছর চোদ্দোর বঙ্কিমের চোখে যুবতীর স্তনের ডৌল বেলের মতো নয়, বর্ষায় মনোহর ডালিমফল যেন! ডালিমের মতো এই স্তন দেখে হাতিও উত্তেজিত: হেরি তব পয়োধরে চিৎকার করিছে কুজর!
বালক বঙ্কিম এতটা লিখেও সন্তুষ্ট নয়। তার স্তনাসক্তির পূর্ণ প্রকাশ যেন ঘটল না। সে আরও স্পষ্ট হতে চায় কামের উচ্চচারণে। রতির প্রকাশে কোনও কুণ্ঠা নেই এই এঁচড়পক্ব বালকের।
সে জানে ডালিম বর্ষার গর্ব। কিন্তু তার মনে হল, বাঙালি কিশোরীর যে—স্তনকে সে ডালিমের সঙ্গে তুলনা করেছে, বর্ষার এই ‘গর্বের সার’ ডালিম, স্তনের কাছে শেষ পর্যন্ত হেরেই গেল। ডালিমের গর্ব নাশ করে বাঙালি কিশোরীর স্তন!
সে দাড়িম্ব বরষার, সকল গর্বের সার,
তব কুচে পূর্ণ মাননাশ।
ঠিক কেমন বাঙালি নারীর স্তনের এই ডালিম—লাবণ্য? ডালিমের উপরটি লালচে হয়। যেমন ঠিক মেঘের ঢাকনা সরিয়ে আড়াল থেকে ধরা দেয় মেঘে—ঢাকা সূর্যের লালচে লাবণ্য, তেমনই নারীর স্তন। ঢেকে রাখার উপায় নেই। লিখছে চোদ্দো বছরের বঙ্কিম।
না, এতেও সন্তুষ্ট হল না বালক বঙ্কিম। যে—স্তনশোভা সে বর্ণনা করছে, তাকে ‘ডালিম’ বললে যে বড্ড কম বলা হয়। লালচে ডালিমলাবণ্য—তাতে যে নারীর স্তনের উগ্র ঔদ্ধত্যের কিছুই ধরা পড়ল না।
চোদ্দো বছরের বঙ্কিম স্তন দু’টিকে আরও গভীর ও একাগ্রভাবে ধ্যান করে।
তারপর সে লিখে ফেলে বর্ষার পাহাড়ের বর্ণনা:
গরিপরি নব লতা শোভে এ সময়।
ব্যস, আর তাকে ভাবতে হয় না, এবার সে পেয়ে গিয়েছে যুবতী—স্তনের সঠিক রূপবর্ণন। স্তন নয় তো, যেন দু’টি পাহাড়। আর পাহাড়ের উপর লতা তার হারটি:
সে গিরি তোমার কুচ, হার লতা হয়।
বালক বঙ্কিম কিন্তু এখানেই থামার পাত্র নয়। সে তো এতক্ষণ নারীটিকে দেখেছে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। বালক—পুরুষ জানাচ্ছে:
অপরূপ দেখ এটি শরীরে তোমার।
একঠাঁই ষড়ঋতু করিছে বিহার।।
এবার এই নারী চাইছে যৌনমিলন!
শুধু ডালিমসম স্তনে আদর নয়। নারী চাইছে সঙ্গম। এবং সে—কথা সে পুরুষটিকে বলছে সংকেতে, ইঙ্গিতে। বালক বঙ্কিম জানে সেই নির্ভুল ইশারা, সেই অমোঘ প্রশ্ন:
কেন ফণিবর প্রবেশি বিবর
পাতালে গমন করে?
বালক বঙ্কিমের নারী বলছে এই কথা? বঙ্কিম তার মুখে বসিয়েছে এই প্রশ্ন?
নারী পুরুষটিকে বলছে, এতক্ষণ তো আদর করলে আমার শরীর। সেই শরীর এবার জাগ্রত। বোঝো, কী চাইছে সেই শরীর? জানো কি কেন সাপটিকে ঢুকতে হয় সুড়ঙ্গে, কেন তাকে যেতে হয় অন্ধকার পাতালে?
এরপর চোদ্দো বছরের ‘পুরুষ’ বঙ্কিম কী বলে?
স্তম্ভিত হতে হয় আমাদের। সে নারীটিকে বলে, ধনি, যদি বলো আমার এই ফণিবর দূর হলে, অর্থাৎ তার সব বিষ উগরে দিয়ে পলাতক হলে পৃথিবীতে আর বিষ থাকবে না, তা হলে শোনো, তোমার চোখের বিষের কাছে আমার এই ফণিবরের হলাহল কিছুই না। ধরণীর বিষ থেকেই যাবে তোমার ওই দৃষ্টিপাতে। আর তারই আহ্বানে বারবার জাগবে ফণিবর! ‘তা নয়, তা নয়, বিষ রয়, তোমার নয়নে প্রাণ।’
ভাবলে বিস্ময় লাগে, কামুকতার এই উগ্র প্রকাশ ঘটেছে প্রায় বালকের কলমে!
বঙ্কিমের এই অকালপক্বতার একটি কারণ: ১৮৪৯—এ মাত্র দশ বছর বয়সে তার বিয়ে! ছেলের মনে ও শরীরে যে এঁচড় অবস্থাতেই পাক ধরেছে, বাবা যাদবচন্দ্রের, মা দুর্গাসুন্দরীর কাছে এই আঁচ পৌঁছনোই স্বাভাবিক। শরীরজাগৃতির আগেই, বাল্যের শেষ হওয়ামাত্র বঙ্কিমের বিয়ে ঠিক করে ফেলল তারা।
কাঁটালপাড়ার কাছেই নারায়ণপুর গ্রাম। সেই গ্রামের নবকুমার চক্রবর্তীর পাঁচ বছরের মেয়ে মোহিনী। সার্থক নাম এই পুঁচকে মেয়ের। পাঁচ বছর বয়েসেই সে ভুবনমনমোহিনী!
একটু ডাগর হলে এই মেয়ের রূপ থই—থই করবে, নিশ্চিত যাদব ও দুর্গা।
পাঁচ বছরের মোহিনীর সঙ্গে বিয়ে হল দশ বছরের বঙ্কিমের। যাদব—দুর্গা দু’জনেই ভারি খুশি। তাদের ছেলেও কিছু কম সুন্দর নয়। একেবারে রাজযোটক, দুর্গাসুন্দরী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে বঙ্কিম আর মোহিনীর দিকে।
আহা, দু’জনে পাশপাশি ঘুমিয়ে পড়েছে খেলতে—খেলতে। মনে হয় দু’টি দেবশিশু।
দেখতে—দেখতে ওরা বড় হয়ে গেল। বঙ্কিম সবে তেরো পেরিয়েছে। দুর্গা— সুন্দরী লক্ষ করে, চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে বঙ্কিম। তার শরীরের চল, কথার ধরন, দৃষ্টিপাতের ভঙ্গি, ছোট—ছোট ইশারা—ইঙ্গিত—সংকেত, সব পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত। দুর্গা তাকায় আট বছরের মোহিনীর দিকে।
কে বলবে এ—মেয়ের বয়েস আট! এরই মধ্যে যে মল্লিকাবনে কলি ধরতে শুরু করেছে গো! দু’টোই অকালপাকা, মনে—মনে হাসে দুর্গাসুন্দরী।
বঙ্কিমের কবিতার খাতাটা একদিন খুলে দেখে যাদবচন্দ্র। তেরো বছরের ছেলে এসব লিখেছে!
স্ত্রী : কহ না কী হেতু কান্ত শশী অস্তে চলে?
পুরুষ : তব মুখে মূক হয়ে চলে অস্তাচলে।
স্ত্রী : দশদিগ কেন প্রাণ প্রকাশিত হয়?
পুরুষ : তব মুখ আলোকেতে হয় প্রভাময়।
স্ত্রী : কী হেতু কোকিলকুল, কুহু কুহু করে?
পুরুষ: তোমার মধুর স্বর পাইবার তরে।
স্ত্রী : গন্ধবহ গন্ধ বহে, ভ্রমে কী কারণ?
পুরুষ : তব মুখপদ্মগন্ধ, করিবে গ্রহণ।
স্ত্রী : অনিল অনল সম, কেন হয় জ্ঞান?
পুরুষ : পরস্পর সখা তারা জান না কি প্রাণ?
স্ত্রী : সখা হলে একাঙ্গ কি হয় গুণমণি?
পুরুষ : ভাবের এমনি ভাব, এ ভাব এমনি।
স্ত্রী : তবে কেন তুমি আমি এক অঙ্গ নই?
পুরুষ : দেহে যদি নই, কিন্তু অন্তরেতে হই।
যাদবচন্দ্র লাইনগুলি পড়তে—পড়তে বঙ্কিম ও মোহিনীর কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। যেন দেখতেও পায় ওদের।
ওরা যে পূর্ণ নারী—পুরুষ! সম্পূর্ণ স্বামী—স্ত্রী! কিছু যে বাকি নেই আর! বিস্মিত যাদবচন্দ্রের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে একটাই শব্দ: ভাগিস! বিয়েটা ঠিক সময়ে না—দিলে বঙ্কিমটা যে উচ্ছন্নে যেত, তাতে সন্দেহ নেই যাদবের মনে।
তারপর তার মনে আসে আর—একটি কথা। মোহিনী ছাড়া বছর আটের আর কোনও মেয়ে আমার এঁচড়েপাকা ছেলেটার যোগ্য বউ হতে পারত না। ও—ই পারবে ওকে সামলে রাখতে।
কাঁটালপাড়ায় জন্মাবে না এঁচড়েপাকা বঙ্কিম তো জন্মাবে কোথায়? বঙ্কিমের কাঁটালপাড়ায় জন্ম তা—ই খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
প্রশ্ন হল, বঙ্কিমের এই অকালপাকামোতে তার জিন বা বংশানুর অবদান কতখানি?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ কাজ নয়। কারণ ঋষি—মহর্ষিদের ক্রোমোজোম বা বংশধারার সাংকেতিক জীবকোষ নিয়ে মাথা ঘামানোর তেমন কোনও ঐতিহ্য এদেশে আছে বলে মনে হয় না। তবে বঙ্কিমের পূর্বপুরুষদের কথা একটু জেনে রাখলে মন্দ হয় না, তার বংশানুক্রমের প্রসঙ্গ যখন উঠলই।
বঙ্কিমের মেধা ও স্বভাবের অনেকটাই এসেছিল বাবা যাদবচন্দ্রের কাছ থেকে, এইটুকু বলতে দ্বিধা নেই। মা দুর্গাসুন্দরী মারা যায় বঙ্কিমের বত্তিরিশ বছর বয়েসে। পাঁচ সন্তানের মধ্যে দুর্গাসুন্দরী বঙ্কিমকেই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। বঙ্কিমের চরিত্রে ও স্বভাবে বাবা—মা’র দ্বৈত অবদান কম নয়।
এবার দু’—তিনপুরুষ আগে যাওয়ার চেষ্টা করা যাক। তা হলে বংশানুক্রমের অনেকটাই ঠাওর হবে।
বঙ্কিমের পূর্বপুরুষরা ফুলিয়ার কুলীন। সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবার, সন্দেহ নেই। সুতরাং লেখাপড়ার চর্চাটা বংশে আছে। গঙ্গানন্দ চট্টোপাধ্যায় এই ‘আদি’ পুরুষদের একজন। থাকে হুগলির দেশমুখোয়। আরও সহজ করে বলতে, গঙ্গানন্দ থাকে কোন্নগরের কাছে।
গঙ্গানন্দর ‘জিন’ যে বঙ্কিমের মধ্যে প্রবাহিত, সে—কথা দ্বিধাহীনভাবেই বলতে পারি। এই মানুষটি ‘ব্রাহ্মণ পণ্ডিত’ বলতে যা বোঝায়, তা—ই। সংস্কৃত জানে, নিয়মিত সংস্কৃত ব্যাকরণ—সাহিত্য চর্চা করে এবং নিজেই খুলেছে চতুষ্পাঠী। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনাই গঙ্গাপদর একমাত্র কাজ। কোন্নগরের মানুষ তাকে ‘গঙ্গাপণ্ডিত’ নামে চেনে।
গঙ্গানন্দর এক বংশধর রামজীবন। রামজীবনের বড় ছেলে রামহরি। রামহরি পেয়ে গেল দাদামশাইয়ের বিষয় সম্পত্তি। সেসব কাঁটালপাড়ায়। তাই রামহরি কোন্নগরের পাঠ তুলে চলে এল কাঁটালপাড়া।
রামহরি চাটুজ্জে হল বঙ্কিমের ঠাকুরদা শিবনারায়ণের বাপ। আর, শিবনারায়ণের মেজো ছেলে যাবদচন্দ্র বঙ্কিমের বাপ।
শিবনারায়ণ সেকালের তুখড় বাঙালি। এই মানুষটি কীভাবে মেজো ছেলে যাদবের ঘাড়ে চেপে শেষজীবন কাটাতে চাইছে, একটি চিঠি থেকে বোঝা যায়। তার টাকাপয়সার জ্ঞান টনটনে। আর অন্যের ঘাড়ে কী করে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়, সেই কায়দাও তার বেশ জানা আছে।
সেই ‘ঐতিহাসিক’ পত্রাঘাতের কিছু অংশ এখানে পড়ে নিলে মন্দ হয় না। ছেলেকে লেখা চিঠির সম্বোধনেই কিছুটা আঁচ করা যায় বাপটি কত দূর চতুর এবং তোষামোদি ভাষায় কতটা পটু:
‘প্রাণধিক প্রিয়তম শ্রীযুক্ত রায় যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বাহাদুর বাবাজীবনেষু, মোকাম বর্দ্ধমান। প্রাণশধিক প্রিয়তম পরম শুভাশীর্বাদ— বিজ্ঞাপন বিশেষ বাবাজীউর মঙ্গল ও দীর্ঘ আটপ্রহর সদা সর্বদা শ্রী শ্রী স্থানে প্রার্থনা করিতেছি তাহাতেই অত্র সনাতন তোমার পত্র পাইয়া সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম।’
এইবার শিবনারায়ণের আসল খেলা। সে বলতে চাইছে, বাবা যাদব, তুমি আমার ঋণ শোধ করে আমাকে হালকা করেছ। বাকি ঋণও ঈশ্বরের কৃপায় তুমিই শোধ করবে। আামাকে বাবা আমবাগানটা বিক্রি করে ধার শোধ করতে বোলো না! কারণ ওই আমবাগানের আম আমি ঠাকুরকে দিই। পড়শি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের দিই। তা ছাড়া, আত্মাকেও দিই। অর্থাৎ ওই আমবাগানের আম খেয়ে আমার আত্মা তৃপ্ত হয়:
‘একদা আমার রিণ আদি হওণে জন্য তোমাকে তার অন্যায় করিয়াছিলাম তাহাতে মুক্ত হইয়াছি, আর বাকি যাহা আছে সে তোমার তুমি নানারূপে বিধাতা দিয়াছেন। আমবাগান ছাড়িয়া দিলে আমি অতেষ্ট মনোকষ্ট পাই, কারণ এই যে কাহাকে কাহাকে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ ফল অর্পণ করিয়া থাকি শ্রী শ্রী দিগের ভোগে লাগে এবং আত্মাকে কিছু কিছু দিয়ে থাকি। তাহা বঞ্চনা হইল এমন কষ্ট অতেষ্ট হইবেক!— এক্ষণে যে তুমি ভরসা যাহা করহ তাহা হইবেক অন্য অন্য বিষয় মিথ্যা।’
এবার চিঠির শেষে একটি মোক্ষম ‘পুনশ্চ’। বাপ শিবনারায়ণ, ছেলে যাদবকে পরিষ্কার নির্দেশ দিচ্ছে সেই ‘পুনশ্চ’—র মধ্যে, ঠিক কী করতে হবে। ছেলে যে বউ—বাচ্চচা নিয়ে সংসার করছে, তাদের পিছনেই টাকা ঢালছে তা বাপের পছন্দ নয়।
শিবনারায়ণ লিখছে:
‘তোমার পরিবার বালক স্ত্রীলোক সদা সর্বদা ইহাদের একত্র উচিৎ হয় না। তোমাকে সকল বিষয়ে বিধাতা দান করিয়াছেন। আমি প্রাচীন আর অর্থহীন তোমার অন্নদাস হইয়া রহিয়াছি। অতএব আমি যে কয় দিবস বাঁচিয়ে থাকিব তোমার কল্যাণে ভোগ করিব।’
চিঠিটা পড়ে বেশ বোঝা যায় যে, শিবনারায়ণ চতুর, লোভী, তুখড় মিথ্যাবাদী, প্রয়োজনে ছেলের স্তাবকতা, তোষামোদেও সে কুন্ঠাহীন এবং সে প্রবল অশিক্ষিত। চিঠির শেষে ছেলেকে যে উপদেশটি সে দিচ্ছে, তাও কোনওভাবেই ‘সৎ’ উপদেশ নয়।
সেই সময়ে ভয়ংকর পুরুষ—শাসন ও সমাজে মেয়েমানুষের অবস্থান বোঝা যায় শিবনারায়ণে ওই ছোট্ট ‘পুনশ্চ’ থেকে।
যাদবচন্দ্র কিন্তু বাপ শিবনারায়ণের মতো নয়। সে নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছে। সে যে গঙ্গানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বংশধর, তা বুঝিয়ে দেয় তার মেধা ও লেখাপড়ার দিকে স্বাভাবিক ঝোঁক। গঙ্গানন্দের ‘জিন’ যাদবচন্দ্রের মাধ্যমে এসে পৌঁছেছে বঙ্কিমে। যাবদচন্দ্রের মধ্যে দেখা দিয়েছে কিছু বেপরোয়া সাহস। তাও মিশেছে বঙ্কিমের স্বভাবে। বঙ্কিমকে বুঝতে, যাদবচন্দ্রকে কিছুটা বুঝতে হবে বইকি।
যাদব ছেলেবেলা থেকেই খুব রুগণ। তার কথায়—কথায় ঠান্ডা লাগে। অমনি সর্দিজ্বরে ভোগে। বিছানায় শুয়ে—শুয়ে তো আর খেলা করা যায় না। যাদবের অসুখ করলেই সে বই পড়ে। বইপড়া তার ‘নেশা’ হয়ে গেল।
বারো বছর বয়সে সে ফারসি শিখতে শুরু করল। দু’বছর এই ভাষাটা কিছুটা শেখার পর যাদব ভাবল এবার ইংরেজিটা শিখে নেওয়া যাক। কিছু দিন ইংরেজি শিখে আবার ফারসি। এবার দু’টো ভাষাই পাশাপাশি।
গুরুও জুটে গেল, যে—মানুষ দু’টো ভাষাই দিব্য জানে। তারপর যাদবের এক ‘নতুন অসুখ’ করল। এই অসুখের নাম ‘ভাল্লাগেনা’ ব্যামো।
যাদবের মনের মধ্যে জেগেছে আচমকা ছটফটানি। কী চাইছে তার মন? পালাতে চাইছে। বারো বছরের যাদব একদিন বাড়ি থেকে পালাল।
বাবা—মা জানতেও পারল না তাদের ছেলে কটকের দিকে পা বাড়িয়েছে। কিন্তু কটক কেন? কারণ, যাদব পুরী গিয়ে জগন্নাথদর্শন করতে চায়!
হঠাৎ কি যাদব ভক্তিভাবে মেতে উঠেছে? না—না, যাদব যে কেন জগন্নাথদর্শনের জন্য পুরী যাচ্ছে, সে নিজেও জানে না। তার কিছুই ‘ভাল্লাগছে না’, তাই পুরী যাচ্ছে। তার জগন্নাথের কথা মনে পড়ল, তাই পুরী যাচ্ছে। তার ‘অ্যাডভেঞ্চার’ করতে ইচ্ছে হল, তাই হাঁটতে—হাঁটতে কটক। সেখান থেকে পুরী। সোজা ব্যাপার। কিন্তু কে জানত এত দীর্ঘ পথ! এবং হাঁটার এত কষ্ট?
সে পথ—মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার সারা গা জ্বলছে। বাঃ, সামনে কী সুন্দর জলাশয়! বারো বছরের যাদবের পরনে একটি ধুতি আর উড়ানি। ধুতির খুঁটে কয়েকটি টাকা বাঁধা। সে সব খুলে রেখে জলে নেমে গেল। তারপর অনেকক্ষণ পরে জল থেকে উঠে এসে দেখল, তার ধুতি—চাদর—টাকা, সব চুরি হয়ে গিয়েছে। অসহায় যাদব এবার কেঁদে ফেলল।
—তুমি কে বাবা? কাঁদছ কেন? জিগ্যেস করল এক পথচারী।
—আমার ধুতি—উড়নি—টাকা, সব চুরি গিয়েছে।
—কী নাম তোমার?
—যাদব, যাদবচন্দ্র।
—কোথায় থাকো?
—কাঁটালপাড়া।
—সে তো অনেক দূর। তো যাচ্ছিলে কোথা?
—কটক।
—কটক! কটক কেন?
—পুরী গিয়ে জগন্নাথ দেখব, তা—ই।
—শোনো যাদব। আমি ঠাকুরচরণ রায়। কাঁচড়াপাড়ার লোক। কটকে দারোগার চাকরি করি।
শেষ পর্যন্ত কাঁচরাপাড়ার ঠাকুরচরণের সুবাদে কাঁটালপাড়ার বালক যাদবচন্দ্রের জগন্নাথদর্শন হল। যাদবের জগন্নাথদর্শনের পুণ্যে তার দাদার চাকরিতে উন্নতি হল। তারপর আঠারো বছর বয়েসে যাদবেরও চাকরি হয়ে গেল, জাজপুরে চৌকিদারের চাকরি। কিছু দিনের মধ্যেই বালিহন্তায় বদলি।
কয়েক বছরের মধ্যে বদনাম রটল, যাদব ঘুষ নেয়। রিকেটসায়েব যাদবকে তলব করল বালেশ্বরে। যাদব আর রিকেট মুখোমুখি।
—কী হে ছোকরা, তুমি ঘুষ নাও?
—ঘুষ! যাবাব্বা, ঘুষ নিয়ে কে—কোথায়—কবে স্বীকার করেছে? প্রশ্ন করে যাদব।
—গঙ্গাজল ছুঁয়ে হলফ করে বলো তুমি ঘুষ নাওনি! রিকেট গঙ্গাজল এগিয়ে দেয় যাদবের দিকে।
—এই রে, তুমি তো সাহেব! ম্লেচ্ছ। গঙ্গাজল ছুঁলে সেই গঙ্গাজল মহত্ত্ব হারায়। তাহলে ওটা ছুঁয়ে মিথ্যে এখন বলাই যায়।
—এসব জানলে কী করে? তুমি কি পণ্ডিত?
—পণ্ডিত নই, তবে আমার যেখানে বাড়ি তার চারপাশে অনেক পণ্ডিত বাস করে।
—হলফ মকুব হল, বলল রিকেট। তার গলা কাঁপছে। হিন্দু পণ্ডিতদের রীতিমতো ভয় পায় রিকেট। তার কাছে নিজে পণ্ডিত হওয়া আর পণ্ডিতদের পাড়ায় বসবাস করা একই ব্যাপার। এ—ছেলেকে ঘাঁটিয়ে কাজ নেই।
এহেন যাদবচন্দ্রের ‘যোগ্য’ পুত্র যে বঙ্কিমচন্দ্র তাতে সন্দেহ নেই। যাদবচন্দ্র প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, বঙ্কিমচন্দ্রের পিতা একজন মহাপুরুষ! কেমন ‘মহাপুরুষ’?
নিজে রসগ্রাহী লোক, অন্যকে রসগ্রহণের পদ্ধতি—প্রকরণ দেখিয়ে দিতে আনন্দ বোধ করে। যাদব চট্টোপাধ্যায়ের রসপরিগ্রহণ নাকি সকল বিষয়েই সমান ছিল। বাবার এই রসগ্রহণের ক্ষমতা বঙ্কিমেও সঞ্চারিত হল। এবং বঙ্কিমে যে অকালে পাক ধরল, তা রসাধিক্যর জন্যও বটে। কিছুটা ‘জেনেটিক’, বলতে দ্বিধা নেই।
কিশোর বঙ্কিম তনুপরশ আর মিলনরসের ক্লান্তিহীন অন্বেষী। ঘরে তার পরমাসুন্দরী বউ। বাইরে রসের অশেষ ভাণ্ডার প্রকৃতি। সে নিজেকে রসগ্রাহী ‘কবি’ ভাবতেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। ইংরেজ রোমান্টিক কবিরাই পথ দেখায় তার কল্পনা ও অভিপ্রায়কে।
তবে সত্যি কথা বলতে, সুদর্শনা স্ত্রী মোহিনীই বঙ্কিমের প্রধান প্রেরণা। মোহিনী যত ডাগর হচ্ছে, যত খোলতাই আসছে তার লবঙ্গলতায়, বঙ্কিম ততই খুঁজে পাচ্ছে তার প্রিয় কবি কালিদাসের নারী। সে মোহিনীর শরীরের সেই ক্রম—প্রকাশের পানে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
—আর—একটু, আর—একটু দ্যাখাও, এখুনি ঢেকো না—
—যাহ অসভ্য! ভারি নির্লজ্জ তুমি, বলে মোহিনী।
—এইরকমই তো বর্ণনা। হুবহু মিলে যাচ্ছে…
—কার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে গো?
—শকুন্তলার বুকের সঙ্গে।
—কাল যে বললে ‘মেঘদূত’?
—দাঁড়াও—দাঁড়াও, শেজের আলোটা আর—একটু উসকে দিই, তা হলেই ‘মেঘদূত’—এর বর্ণনায় নারীর স্তনভারের সঙ্গে মিলে যাবে।
বঙ্কিম সলতেটা একটু উঁচু করে দেয়। আলোটা আরও উজ্জ্বল হয়ে কাঁপতে থাকে মোহিনীর সবে উত্তল দু’টি বুকের উপর। বঙ্কিম মৃদুকণ্ঠের নির্ভুল উচ্চচারণে সংস্কৃতে বলে:
‘নূনং যাস্যত্যমরমিথুনপ্রেক্ষণীয়ামবস্থাং
মধ্যে শ্যামঃ স্তন ইব ভুবঃ শেষবিস্তারপাণ্ডুঃ।।’
—কী বলছ গো? মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছি না যে…।
—বাংলায় বললে তুমি লজ্জা পাবে। আর অমনি এই স্বর্গসুখ কেড়ে নেবে। কালিদাস হজম করার শক্তি বাঙালি মেয়ের নেই মোহিনী।
—তাই! আমার আছে। বলো তুমি বাংলায়। দেখি, পারি কি না হজম করতে।
—বঙ্কিম হেসে ফেলে। আলতো চুমু বসায় বৃন্ত দু’টির উপর। তারপর ধীরে— ধীরে বলে, মোহিনী, এই দু’টি যেন পৃথিবীর স্তন। এর কোনও মৃত্যু নেই। মৃত্যুহীন, নিরন্তর রতির বাসভূমি তোমার এই দু’টি বৃন্ত। স্বয়ং মদন আমার মধ্যে জাগ্রত হয়ে ভোগ করবে চিরকাল।
—চিরকাল! একটা সত্যি বলবে?
—এখন আবার অন্য কোন সত্যির প্রয়োজন হল?
—যদি আমি না—থাকি, হঠাৎ মরে যাই, বিয়ে করে আবার এই কথাগুলো তোমার সেই নতুন বউকেও বলবে তো?
—তুমি মরবে কেন মোহিনী! তুমি ঠিক এইভাবেই থাকবে আমার জীবনে। আমার সন্তানের মা হতে হবে না তোমাকে? তখন তোমার বুক দু’টো কেমন হবে জানো?
—সে—কথাও বুঝি বলে গিয়েছে তোমার কবি?
—কবি যা বলে গিয়েছে তার সঙ্গে শেজের আলো মিশিয়ে দিচ্ছে তার নিজের রচনা। এই আলো—আঁধারে তোমার দু’টি বৃন্ত আরও যেন কালো। আর সেই কালো দু’টি বৃন্ত ক্রমশ শেষবিস্তারে পীতরাগ হয়ে আমাকে ডাকছে। পেটে বাচ্চচা এলে শুনেছি স্তন দু’টির বৃন্ত গাঢ় শ্যাম হয়ে প্রান্তে পাণ্ডুর হয়ে যায়।
—এসব কথাই হুবহু তোমার ওই সংস্কৃত কবির?
—তা কেন হবে? তা হলে আর আমি বঙ্কিম হলুম কেন? বুকটা হঠাৎ আঁচল দিয়ে ঢেকে মোহিনী বলে, তা রসের সাগর, তোমার দীক্ষাগুরুটি কে?
—ভাটপাড়ার বিখ্যাত পণ্ডিত শ্রীরাম শিরোমণি। তিনিই ‘কুমারসম্ভব’—এর স্মরোদ্দীপনা, ‘মেঘদূত’—এর অন্বয়বাসনা, শকুন্তলার সুরতি আর শৃঙ্গার—সব নিংড়ে দিয়েছেন আমাকে। আমি সেই রস পান করে তোমার যোগ্য হয়ে উঠেছি মোহিনী।
—শোনো, তুমি পণ্ডিত, কিন্তু তোমার মোহিনী মূর্খ। এই কথাটা মনে রেখো। ‘স্মরোদ্দীপনা’ না কী যেন বললে, তারপর অন্বয়বাসনা, এসব কী? বুঝিয়ে দাও।
—’স্মর’ হল কামদেব মদনের নাম। স্মরোদ্দীপনা হল কামের উত্তেজনা, বুঝেছ মোহিনী? আর কাম জাগলে কীসের ইচ্ছে হয়?
—কীসের গো?
—মিলন, সঙ্গম, আমার শরীর চায় তোমার শরীরের সঙ্গে ‘এক’ হতে। ‘অন্বয়’ মানে ‘মিল’। আরও বোঝাতে হবে?
বঙ্কিম আবার সরিয়ে দেয় মোহিনীর আঁচল। মোহিনী বাধা দেয় না। বঙ্কিমের মনে হয়, মোহিনীর মধ্যেও ফুঁসে উঠছে কাম। ঠিক তারই মতো মোহিনীর মিলন আকাঙক্ষা। বঙ্কিম আরও একবার শেজের মৃদু আলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেয় কালিদাসের রতিরস:
‘শ্যামাস্বঙ্গং চকিতহরিণীপ্রেক্ষণে দৃষ্টিপাতং
রক্তচ্ছায়াং শশিনি শিখিনাং বর্হভরেষু কেশান।
উৎপশ্যামি প্রতনুষু নদীবীচিষু ভ্রূবিলাসান…
—কী দেখছি জানো মোহিনী?
—কী?
—আমার আঙুল এই দ্যাখো স্পর্শ করছে তোমার দেহের সবটুকু। তোমার অঙ্গের সব গোপন কথা জানছে আমার এই ছোঁয়া। তোমার মুখের আরশিতে মোহিনী চাঁদের ছায়া! তোমার চুলগুলি ময়ূরপুচ্ছের মতো বিস্তার করছে তাদের মায়া! কী সুন্দর তুমি মোহিনী! তোমার সমস্ত শরীরটি যে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে, শীর্ণ একটি নদীর মতো। মেদ নেই কিন্তু ঢেউ আছে। যেমন থাকে তিরতিরে তটিনীতে। আর তোমার ভ্রূবিলাসে ডাক আছে মোহিনী। সেই ডাক আমি শুনতে পেয়েছি। আমার সাড়া তুমি গ্রহণ করো।
বঙ্কিমের বাড়ির ডানদিকে একটি খাল। আর সেই খাল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ। তার আশপাশে লতায়—পাতায় ঘন কয়েকটি ঝোপ। বঙ্কিম নিশ্চিত, এমনই ছিল যমুনার ধারে। রাধা—কৃষ্ণর মিলন হত এই ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে, লোকচক্ষুর অন্তরালে।
বঙ্কিম ভালোবাসে এই মুক্ত প্রান্তরের শষ্পশয্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে চিত হয়ে শুয়ে দিবাস্বপ্ন দেখতে। বিশেষ করে, যখন বিকেল ঢলে পড়ে সন্ধের দিকে, আকাশে ছড়িয়ে পড়ে রক্তিম আভা, প্রান্তর ভরে যায় বাসায় ফেরা পাখির ডাকে, বঙ্কিম প্রাণভরে উপভোগ করে।
ঝরে পড়া পাতার শব্দে কৃষ্ণ যেমন চমকে উঠত, ভাবত ওই বুঝি রাধার পায়ের শব্দ, বঙ্কিমও তেমনই পাতার শব্দে যেন শোনে মোহিনীর পদশব্দ। কিন্তু মোহিনী কী করে আসবে প্রান্তরের শেষে ওই ঝোপের ধারে? তার যে একলা বাড়ি থেকে বেরনোর কোনও উপায় নেই! কিন্তু যদি কোনও দিন এমন হয়, মোহিনী পালিয়ে এল? এসে সে অন্ধকার প্রান্তরে, আকাশভরা তারার তলায়, ঝাঁপিয়ে পড়ল বঙ্কিমের বুকের উপর?
ঠিক কৃষ্ণ যেমন আদরের আঁচড়ে ভরিয়ে দিত রাধার শরীর, বঙ্কিম ঠিক তেমনই আদরের চিহ্নে ঢেকে দেবে মোহিনীর তনুলতা। তারাভরা খোলা আকাশের নিচে যে—আদর সম্ভব, সে—আদর অসম্ভব ঘরের শয্যায়। বঙ্কিম নিশ্চিত এ—বিষয়ে।
১৮৫৮। প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন পড়ছে বঙ্কিম। ওই বছরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিএ পরীক্ষার প্রবর্তন। বঙ্কিমের হাতে সময় বেশি নেই। তবু সে বসে গেল পরীক্ষায়। মোট দশজন পরীক্ষার্থী। পাস করল দু’জন। বঙ্কিম ছুটে এল কাঁটালপাড়ায়। মোহিনী কোথায়?
—সে তো ছাদে ভিজে কাপড় মেলছে, কে যেন বলল।
বঙ্কিম দৌড়ে গেল ছাদে। সিঁড়ির মুখে দেখা হল দু’জনের। বঙ্কিম মোহিনীকে জড়িয়ে ধরে টেনে নেয় বুকের মধ্যে।
—এই কী করছ! তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে না কি?
—মোহিনী, আমি বিএ পাস করেছি। কলকাতা ইউনিভার্সিটির প্রথম গ্র্যাজুয়েট।
—সে তো খুব শক্ত পরীক্ষা, না গো!
—বলছি, আগে ঘরে চলো। কিন্তু তুমি একা ছাদে এসেছ কেন?
—একা ছাদেও আসতে পারব না? হেসে ফেলে মোহিনী।
—না, পারবে না। আমি চাই না তোমার উপর পরপুরুষের দৃষ্টি পড়ুক। তুমি খুব সুন্দরী মোহিনী। তোমাকে অন্য পুরুষ মনে—মনে চাইলেও আমি তা সহ্য করতে পারব না।
১৮৫৮—র ৬ আগস্ট। বঙ্কিমের কাছে খবর এল, সে চাকরি পেয়েছে। যশোরে ‘ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট’—এর চাকরি। তাকে যশোরে চলে যেতে হবে। মোহিনীকে ছেড়ে থাকবে কী করে? কিছু দিনের মধ্যেই সে যশোরেই সংসার পাতবে মোহিনীর সঙ্গে, শুধু তো কয়েক দিনের বিচ্ছেদ।
—একটু গুছিয়ে নিয়েই আমি তোমাকে নিয়ে যাব মোহিনী।
—ঠিক তো? না কি ভুলেই যাবে তোমার মোহিনীকে?
—ভুলে যাব? আমি তোমাকে ভুলে যাব? তুমি এ—কথা ভাবতে পারলে?
—পুরুষের মন, কখন যে কী হয়! আমি হয়তো পদ্মপাতায় জলের মতো ঝরে যাব। চোখের আড়াল হলেই…।
—আমি তোমাকে একটা চিঠি লিখেছি মোহিনী।
—চিঠি! আমাকে? কই, দেখি, বঙ্কিমের হাত থেকে কাগজের টুকরোটা কেড়ে নেয় মোহিনী। তারপর বিছানার পাশে শেজের আলোয় চিঠিটা ধরে সে পড়ে:
‘যদি দেহে প্রাণ ধরি আসিব হে ত্বরা করি,
তোরে ফেলে প্রাণে মরি, রহে না লো রহে না।
অন্তরে প্রণয় ডোরে, যে দৃঢ় গেঁথেছে মোরে,
প্রাণেতে তাজিতে তোরে, সহে না লো সহে না।
কিন্তু লো তরুণ করে, প্রকাশিল প্রভাকরে,
আর কথা পরাপরে কহে না লো কহে না।
তবে যাই সুনয়নী, যাই লো হৃদয়মণি,
যাই কিন্তু পদধ্বনি, বহে না লো বহে না।’
চিঠিটি পড়া শেষ করে মোহিনী তাকায় বঙ্কিমের দিকে। তারপর ক্ষীণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কবে যাবে ঠিক করেছ?’
—কাল! সকালে।
—কাল? মানে আজই আমাদের একসঙ্গে শেষ রাত? কান্নায় বঙ্কিমের বুকের উপর ভেঙে পড়ে মোহিনী।
—একটা কথা মোহিনী।
—বলো।
—প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
—বেশ, দিলুম।
—তুমি ছাদে যাবে না। কাপড় মেলতেও না।
মোহিনী অবাক হয়ে তাকায় বঙ্কিমের দিকে। বঙ্কিম বলে, এক পড়শি সেদিন আমাকে বলল, তোর সুন্দরী বউকে আমি কিন্তু দেখে ফেলেছি। আমি বললুম, কোথায়, কীভাবে, কখন দেখলে?
সে বলল, কেন, ছাদে তো রোজ কাপড় মেলতে ওঠে। তখন দেখেছি।
আমার কথাটা শুনে পর্যন্ত সমস্ত শরীর রাগে রি—রি করছে।
—আচ্ছা, আচ্ছা। আমি আর ছাদে যাব না। তোমাকে কথা দিলুম। তুমি ওই লোকটাকে কিছু বলোনি তো?
—যা রাগ হয়েছিল, কিছু না—বলে থাকতে পারিনি।
—কী বলেছ?
—বলেছি, তোর মুখে হাগি।
১৮৫৯। বঙ্কিম যশোরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করছে। ১৮৫৮—র আগস্টে বিশ বছরের বঙ্কিম কাঁটালপাড়া ছেড়ে চলে এসেছে যশোরে। প্রায় একটি বছর হতে চলল মোহিনীর সঙ্গ থেকে সে বিচ্ছিন্ন।
ভেবেছিল চাকরির জায়গায় সে গুছিয়ে বসে বউকে খুব তাড়াতাড়ি নিজের কাছে নিয়ে আসবে। কিন্তু কাজটা যত সহজ মনে হয়েছিল, তাতো নয়। অনেক জট ছাড়ানোর ব্যাপার আছে।
সবথেকে বড় বাধা, বাবা—মা’র অনিচ্ছা। বঙ্কিমের ক্রমশ মনে হয়েছে, সে মোহিনীকে কাঁটালপাড়ায় রেখে চাকরির জায়গায় একাই থাকুক, এটাই তার বাবা—মা’র অভিপ্রায়।
দিনের বেলা কাজের চাপে মোহিনীকে এতদিন কাছে না—পাওয়ার যন্ত্রণা হয়তো ভুলে থাকা যায়। কিন্তু সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে বঙ্কিমের মনে হয়, মোহিনীর জন্য মনকেমনের কষ্ট সে আর সহ্য করতে পারছে না।
হারিকেনের টিমটিমে আলোয় সে একা বসে থাকে ঘরের বাইরে ছোট্ট বারান্দায়। কৃষ্ণপক্ষের রাত তবু সহনীয়। চাঁদের আলোয় যখন ভেসে যায় বারান্দা, বঙ্কিমের মনে হয়, এখুনি চাকুরি ছেড়ে মোহিনীর কাছে চলে যাওয়াই সঠিক কাজ।
কিন্তু সেই ‘সঠিক’ কাজটি সে কিছুতেই করে উঠতে পারে না। তার সমস্ত মন চায় মোহিনীকে আদর করতে। তার সমস্ত শরীর ডুকরে ওঠে মোহিনীর শরীরের জন্য।
প্রায় একটি বছর হতে যাচ্ছে, মোহিনীকে দেখেনি বঙ্কিম। আরও কি ডাগর হয়েছে সে? নিশ্চয় সর্বাঙ্গে তার চুঁইয়ে নামছে যৌবন।
ষোলো বছরের মোহিনী, বঙ্কিমের কল্পনা একটি ছবি আঁকে। জীবন্ত সেই ছবি, রেখায়—রেখায় উপচে পড়ছে! চাঁদের আলোর শাড়ি পরে কল্পনার মোহিনী এসে দাঁড়ায় বারান্দার এক কোণে।
—ওখানে, অ্যাতো দূরে কেন মোহিনী? কাছে এসো।
—আমি কত দূরের পথ পেরিয়ে এলুম তোমার কাছে, আর তুমি চেয়ার থেকে উঠে দু’—পা হেঁটে আসতে পারছ না আমার কাছে?
—আর আমি যে তোমার জন্য এইভাবে একা—একা প্রতিদিন অপেক্ষা করি? মোহিনী, সমস্ত রাত আমার শরীর তোমার শরীর চায়। সমস্ত রাত তোমাকে না—পাওয়ার দহন আমাকে পোড়ায় মোহিনী।
—তুমি নিশ্চয় ভাবো, আমি দিব্য আছি তোমাকে ছেড়ে। তোমার মোহিনীর কোনও মন নেই, কোনও শরীর নেই। তার তেষ্টা পায় না, খিদে পায় না।
—যেন ‘নভ রবি শশী তারা মেঘহীন/আশা ভয় সুখ বিনা যাবে তার দিন।/মোহিনী কুসুম কলি হৃদয়ে পালিল/কণ্টক কাননে কেন ছিঁড়িয়া ফেলিল!’
—তোমার লেখা? এই কবিতা তুমি লিখেছ! চাঁদের আলোর শাড়ি পরে মোহিনী দাঁড়ায় বঙ্কিমের পাশে।
বঙ্কিম মুগ্ধ হয়ে দেখে তার শরীররেখা। কিছুই ঢেকে রাখেনি চাঁদের আলোর শাড়ি।
ষোলো বছরের নারী—শরীরকে আড়ালে রাখবে কোন আবরণ?
ষোড়শীর শরীর তো শুধু রেখায়—রেখায় উদ্ভাসিত আহ্বান নয়। ষোড়শীর শরীর তো আলোর তরঙ্গ, নদীর ঢেউ, মায়াময় এক উঁচু—নিচু উপত্যকা।
বঙ্কিম বলে, মোহিনী কাছে এসো, পাশে বোসো, আমি ছুঁতে চাই, আদর করতে চাই তোমাকে।
মোহিনী আরও কাছে আসে। এবার হাত বাড়ালেই তাকে পাওয়া যাবে। বঙ্কিম হঠাৎ উঠে ধরতে যায় মোহিনীকে। মোহিনী চাঁদের আলোর আঁচল উড়িয়ে চকিতে সরে যায়।
বঙ্কিম বলে :
দুজনে দুজনে পেয়ে, দুজনের মুখ চেয়ে
অনিমিক ঝরিছে নয়ন।
হৃদয় ভাঙিয়ে হৃদি, কেন কেন আরে বিধি
সে সময় এল না মরণ।।
কপাল কি হয় কবে আর কি কখন হবে,
এমন অচেত সুখক্ষণ।
হেন সুখ জপি মনে, দুঃখের গভীর বনে,
একা ভয় না হয় কখন।।
—কে ওখানে?
—পোস্ট আপিস থেকে আসছি স্যর। জরুরি চিঠি আছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায়ের নামে।
এ কী! কোথায় গেল চাঁদের আলোর শাড়ি! কোথায় গেল মোহিনী! চারিধার শুনশান। একা চাঁদ আকাশে।
বিষণ্ণ পূর্ণিমা ছড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ বারান্দায়।
বঙ্কিম বারান্দা থেকে নামে, চিঠিটি নেয়। জরুরি চিঠি, তাই সন্ধ্যার ডাকে এসেছে। চিঠিটি বঙ্কিমের হাতে দিয়ে চাঁদের আলোয় যেন মিলিয়ে গেল পোস্টম্যান।
পোস্টকার্ডের গায়ে লেখা একটি লাইনের উপর স্থির হয়ে যায় বঙ্কিমের চোখ।
চাঁদের আলোয় বারবার পড়ে বঙ্কিম। সে ঠিক দেখছে তো? বাবা যাদবচন্দ্রের চিঠি।
‘মোহিনী তিন দিনের জ্বরে মারা গিয়াছে।’
আশ্চর্য দৃঢ়তার সঙ্গে এই তীব্র শোক নিজের মধ্যে ধরে রাখল বঙ্কিম। কোনও আর্ত প্রকাশ ঘটল না সেই শোকের।
চাপা ঠোঁট দু’টি আরও চাপা। চোয়াল আরও শক্ত। বঙ্কিমের বিশ বছরের কঠিন পৌরুষ শোককে পরিণত করল অশ্রুবিহীন কান্নায়।
সে লিখল তার দিনলিপিতে এমন কয়েকটি লাইন—যা হয়তো সে একদিন ব্যবহার করবে তার কোনও প্রবন্ধে: যে বাল্যকালের ক্রীড়ার সঙ্গিনী, কৈশোরে জীবন সুখের প্রথম শিক্ষাদাত্রী, যৌবনে যে সংসারসৌন্দর্যের প্রতিমা,—ভাল বাসুক বা না বাসুক, কে সে স্ত্রীকে ত্যাগ করিতে পারে? গৃহে যে দাসী, শয়নে যে অপ্সরা, বিপদে যে বন্ধু, রোগে যে বৈদ্য, কার্যে যে মন্ত্রী, ক্রীড়ায় যে সখী, বিদ্যায় যে শিষ্য, ধর্মে যে গুরু,—ভাল বাসুক না বাসুক, কে সে স্ত্রীকে সহজে বিসর্জন করিতে পারে? আর যে ভালবাসে, পত্নী বিসর্জন তাহার পক্ষে কি ভয়ানক দুর্ঘটনা।
পড়িলাম কাল লিপি মস্তক ঘুরিল।
যেন ধরা অন্ধকারে ঘুরিতে লাগিল।।
জানিতে পারিনে পরে কী হল আমার।
ছিল কি জীবন মম ছিল কি সংসার।।
প্রলয় পবনে যদি ব্রহ্মাণ্ড ফাটিত।
আমার গভীর মোহ ভাঙ্গিতে নারিত।।
ভাবি নাই কাঁদি নাই কথা নাহি আর।
ছাড়ি নাই দীর্ঘ শ্বাস, ছাড়িনে হুঙ্কার।।
দেখি নাই, শুনি নাই, হলেম পাথর।
জানি নাই নভ নদী ছিল শোভাকর।।
চেয়ে দেখি ধরা পানে প্রান্তর প্রকার।
জীবহীন, তরুহীন, কর্কশ, আধার।।
ললিতা কাননে? বালা, একা এ যামিনী।
আমারে সুঁপিয়া প্রাণ কাননে কামিনী।।
আমারি লাগিয়া বনে গেছে প্রেমাধার।
হা ধরণি খণ্ডে খণ্ডে হও রে বিদার।।
বাকি জীবনটা কি মোহিনীর স্মৃতি নিয়েই কাটবে? না, কাউকে কোনও দিন বিয়ে করে সংসার পাতা সম্ভব নয়, বঙ্কিম এ—বিষয়ে নিশ্চিত। তাকে আচ্ছন্ন করে আছে মোহিনীর সুখস্মৃতি—
একদিন রাত্তির বেলা। মোহিনী হঠাৎ এল ঘরে। বঙ্কিম পড়ছে স্কটের একখানি নভেল। মনে পড়ে বঙ্কিমের, সে পড়ছে আর ভাবছে, বাংলায় কেন এমন নভেল নেই, একদিন সে লিখবে ঠিক এমন বই, বাংলাতেই!
মোহিনী ঘরে এল। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। তারপর নিঃশব্দে আবার দরজার দিকে পা বাড়াল।
—কিছু বলবে? বই থেকে মুখ তুলে জিগ্যেস করে বঙ্কিম।
—না, কিছু না, এমনি এসেছিলুম, তুমি বই পড়ো।
—কাছে এসো, আমার কিছু বলার আছে, বলে বঙ্কিম। কাছে আসে মোহিনী।
বঙ্কিম দেখে, মোহিনী পরেছে মল্লিকা কোরকের বালা। দেখি, দেখি তোমার হাতটা, বলে বলে বঙ্কিম।
মোহিনী বাড়িয়ে দেয় হাত। বঙ্কিম মোহিনীর হাতটি ধরে বিস্মিতের মতো হাতের পানে চেয়ে থাকে।
—কী দেখছ অমন করে? যেন আগে কখনও দ্যাখোনি, বলে মোহিনী।
বঙ্কিম কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর মোহিনীকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, মল্লিকাফুলের চেয়ে মানুষ সুন্দর, এই প্রথম দেখলাম মোহিনী।
মোহিনী কথাটা শুনে কপট লজ্জা পেল। সে হাত ছাড়িয়ে পালাতে যাবে, বঙ্কিম বলল, এখুনি চলে যেও না মোহিনী, একটু দাঁড়াও, তুমি আজ উপযাচিকা, অভিসারিকা হয়ে এসেছ, আমাকে আদর করার একটু অবসর দেবে না?
—তুমি এখন বই পড়ছ, পড়ো, আমাকে গপ্পোটা বলবে কিন্তু, আবার পালাতে যায় মোহিনী।
বঙ্কিম তার আঁচল ধরে টান দেয়। তারপর অপলক তাকিয়ে বলে, এমন রূপ মানুষে দেখিনি মোহিনী। আমি তোমার রূপ দেখে পাগল হয়েছি। এমন রূপ আমি সত্যিই আগে দেখিনি। একটু দাঁড়াও। আর—একটু দেখি।
মোহিনী দাঁড়ায়। বঙ্কিম কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সে যেন মোহিনীর দিকে তাকিয়েও অনেক দূরের পথ দেখতে পাচ্ছে। সে হঠাৎ বলে, মোহিনী, আমি তোমার রূপের কথা একটা গল্পে লিখব, কোনও একদিন…।
—গল্প লিখবে তুমি! মোহিনী বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে।
—মল্লিকাকোরকের বালা—পরা তোমার হাতটি থাকবে সেই গল্পে।
—আর কী থাকবে?
—আর থাকবে আমার ওই কথাগুলি, মল্লিকাফুলের চেয়ে মানুষ সুন্দর এই প্রথম দেখলুম, আমি তোমার রূপ দেখে পাগল হয়েছি মোহিনী।
—এমা! লজ্জায় যে মুখ দেখাতে পারব না। সবাই বুঝে ফেলবে তুমি আমার…
—নামটা বদলে দেব।
—নতুন নামটা কী হবে গো?
—ইন্দিরা!
—আর গপ্পোটার কী নাম দেবে?
—কেন! ইন্দিরা! হেসে বলে বঙ্কিম।
পাঁচ বছর বয়েস থেকে মোহিনীকে ধীরে—ধীরে ফুলের মতো ফুটে উঠতে দেখেছে বঙ্কিম। ফুটফুটে, ছটফটে বালিকা থেকে ডাগর কিশোরী। গায়ের রং যেন পাকা সোনা। এমন ঢলঢলে যে বঙ্কিম একদিন মোহিনীকে না—বলে পারল না—তুমি ‘বৈষ্ণবপদাবলী’—র সরোবরময়ী।
কাজ থেকে বাড়ি ফিরে বঙ্কিম একা বসে থাকে ঘরের পাশের বারান্দায়। ভাবে মোহিনীর কথা। ঠিক ভাবে না, ছবি দেখে। রেখায়—রংয়ের স্পষ্ট ছবি, শুনতে পায় অতীতের শব্দ, কথা। ভেসে আসে সেই সব হারিয়ে যাওয়া দিনের সুবাস।
ছোট্ট মোহিনী। বিয়ের পরে সবে এসেছে সে শ্বশুরবাড়ি। মোহিনী নিজে সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে। তার ঠাকুরদা রামমোহন চক্রবর্তী নারায়ণপুর গ্রামের নামকরা বড়লোক। নিজের রোজগারের টাকায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে রামমোহন। তারই বড় ছেলে নবকুমারের মেয়ে মোহিনী। রামমোহনের আদরের নাতনি।
বঙ্কিমের মনে পড়ে, ছোট্ট মোহিনীকে। সে তাদের বিশাল বাড়িতে এসে প্রথমে কেমন যেন হকচকিয়ে গেল। বঙ্কিমের বাবা ডেপুটি কালেক্টর ‘রায়বাহাদুর’ যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে—সে মানুষ নন। বিপুল বাড়ি, বিশাল প্রতিপত্তি। অর্থের হাঁকডাক আছে বইকি বাড়িতে। যেমন আত্মীয়স্বজনের ভিড়, তেমনই কাজের লোকের থইথই। বাড়ির অন্দরমহলে সর্বদা খাওয়াদাওয়া উৎসব, আনন্দ লেগেই আছে।
গৃহদেবতা রাধাবল্লভের মন্দিরেও বিস্তারিত আয়োজন। উপচে পড়ছে বিচিত্র পালাপার্বণের হইহই। গোষ্ঠযাত্রা থেকে জন্মাষ্টমী, সাবিত্রীব্রত থেকে রথের মেলা—কিছুই বাদ যায় না যাদবচন্দ্রর অট্টালিকায়।
কৃষ্ণবর্ণা এবং নধর দেহের অধিকারিণী দুর্গাসুন্দরী প্রথম থেকেই ভারি ভালোবাসল মোহিনীকে। বঙ্কিম স্পষ্ট দেখতে পায় সেই ছবি চোখ বুজলেই—তার মা লাল কাস্তাপেড়ে শাড়ি পরে বাউটি ঝুলিয়ে ফাঁদিনথ নাকে দিয়ে গৃহিনীপনা করছে আর মোহিনী তার কোলে সারা বাড়ি ঘুরতে—ঘুরতে কখন—বা ঘুমিয়ে পড়ছে।
সেদিন রথ। যাদবচন্দ্রর বাড়ির রীতি হল, সবার আগে রথের রশি স্পর্শ করবে বাড়ির গিন্নি। দুর্গাসুন্দরী কিন্তু অন্দরমহল থেকে বাইরে যেতে নারাজ।
সুতরাং রথের দীর্ঘ রশিটিকে নিয়ে যাওয়া হল অন্তঃপুরে। এবার দুর্গাসুন্দরী রথের দড়ি ছুঁলেই রথ চলতে শুরু করবে গড়গড় করে।
পাশেই দাঁড়িয়ে মোহিনী। তিন বছর হল তার বিয়ে হয়েছে। সে আট বছরে পড়েছে। দুর্গাসুন্দরী ঝপ করে মোহিনীকে কোলে তুলে তার হাতে ধরিয়ে দেয় রথের রশি। বলে, ‘এমন সুন্দর গিন্নি কোন বাড়িতে আছে তোরাই বল?’ সবার ভারি আহ্লাদ হয় দুর্গাসুন্দরীর কথায়।
ছুঁয়েছেন, গিন্নিমা ছুঁয়েছেন—রব উঠে গিয়েছে ততক্ষণে। সেই বছর থেকে মোহিনীর স্পর্শেই যাদবচন্দ্রের বাড়ির রথযাত্রা শুরু হয়ে গেল।
বঙ্কিমের সমস্যা মোহিনীর ঠাকুরদা রামমোহন। নাতনিকে বেশি দিন ছেড়ে থাকতে পারে না বৃদ্ধ ঠাকুরদা। ”ওরে মোহিনীকে নিয়ে আয়, দু’দিন কাটিয়ে যাক আমার কাছে।”
দুর্গাসুন্দরী বা যাদবচন্দ্র, কারও আপত্তি নেই মোহিনীর ঘন—ঘন বাপের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে। আপত্তি সদ্যকিশোর বঙ্কিমের।
মোহিনীকে রাতে কাছে না—পেলে অসহনীয় কষ্ট পায় সে। এবং বাড়ির কারও বুঝতে বাকি থাকে না বঙ্কিমের বিরহ যন্ত্রণা।
না, এক রাত্তিরও তার পক্ষে মোহিনীকে ছেড়ে থাকা অসম্ভব। মোহিনী পাশে নেই। বঙ্কিমের চোখেও ঘুম নেই। নারায়ণপুর, কাঁটালপাড়া থেকে এমন কিছু দূরের রাস্তা নয়। সকালে গিয়ে মোহিনী রাত্তিরে ফিরে আসতেই পারত। আটকে রেখেছে ওই সব নষ্টের গোড়া ঠাকুরদা রামমোহন।
নিশুতি রাত। চারধার শুনশান। বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে। বঙ্কিম নিঃশব্দে দরজা খুলে দিল দৌড়। নারায়ণপুর থেকে কাঁটালপাড়া—এক দৌড়ে সমস্ত রাস্তাটা পেরিয়েছে সে। এবার যেতেই হবে মোহিনীর বিছানায়।
সে—ও যে উদগ্রীব প্রতীক্ষায়—কখন আসবে তার বর। দরজা খুলে নিঃশব্দে তাকে নিয়ে যায় নিজের বিছানায়। বছর বারোর মোহিনী। বছর সতেরোর বঙ্কিম।
—মোহিনী, কৃষ্ণও বোধহয় তার রাধার জন্য এতখানি পথ এক ছুটে পেরোয়নি কোনওদিন, বলে বঙ্কিম।
—আর কৃষ্ণের রাধা কি কোনও দিন তাকে লুকিয়ে নিজের বিছানায় নিয়ে গিয়েছে?
—কৃষ্ণ ছিল রাধার পরপুরুষ। আমি তোমার বর। ধরা পড়লে কি এক শাস্তি?
—একটা কথা বলব? রাগ করবে না তো?
—কী কথা? রাগ করব কেন?
—এইভাবে লুকিয়ে তুমি আমার বিছানায় এলে অনেক বেশি ইয়ে হয় আমার।
—’ইয়ে হয়’ মানে?
—ভাল্লাগে, গায়ে কাঁটা দেয়, বুক ধড়ফড় করে, ভয় করে, কিন্তু খুব ভাল্লাগে।
—ওটাকে কী বলে জানো মোহিনী, তোমার এই ভাবটিকে?
—কী?
—একেই বলে স্মরোদ্দীপনা। লুকোনো মিলনে কামের উত্তেজনা অনেক বেশি মোহিনী।
মোহিনী আর সময় নষ্ট করতে চায় না। তার বরকে যে ভোরের আলো ফোটার আগেই ফিরতে হবে।
সে নিজেকে বিছিয়ে দেয়। তার সেই উজাড়ের মধ্যে থাকে সব আড়াল—সরানো ডাক।
বঙ্কিমের সতেরো বছরের উত্তাল ঝড় তছনছ করে মোহিনীকে। মোহিনীর ভালোলাগে এই তছনছ, এই আছড়ে পড়া, এই উদ্দামতা, এই প্লাবন, এই ভেসে যাওয়া।
রাত ফিকে হয়। ভোরের আলো দেখা দিল বলে। এখুনি দাস—দাসী সব উঠে পড়বে। তারপর ঠাকুরদা বাগানে হাঁটতে বেরোবে।
—পালাও তুমি এবার, পালাও।
বারান্দার পাশেই গাছ। গাছ বেয়ে মুহূর্তে নিচে নেমে যায় বঙ্কিম। তারপর পিছনের পাঁচিল টপকে দৌড়।
যাদবচন্দ্র তো রাত্তিরে বঙ্কিমকে পড়তে দেখেই শুতে গিয়েছে। আর ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই দেখে বঙ্কিম পড়ছে।
—শুতে যাসনি? শরীর খারাপ হবে যে।
বঙ্কিম বাবার দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বই বন্ধ করে।
হাতের কাছে একটা জুতসই বিছানার প্রয়োজন। এবং এখুনি। অপেক্ষা করতে শেখেনি মোহিনী। যা চাই, তা চাই এই মুহূর্তে। কাছেই টেবিলের উপর একগুচ্ছ কাগজ। বাঃ! চমৎকার বিছানা হবে এই কাগজগুলো দিয়ে।
মোহিনী টেবিল থেকে নামিয়ে নেয় বেশ কিছু কাগজ। কুচিকুচি করে সেগুলিকে। তারপর কুচি কাগজ দিয়ে সে তৈরি করে নেয় ছোট সুন্দর একটা বিছানা।
তারপর মেয়ে—পুতুলটাকে সেই বিছানায় রেখে বলে, ‘মোহিনী, চুপ করে শুয়ে থাকো। তোমার বর এল বলে। সে অনেক দূর ছুটতে—ছুটতে আসছে। লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি ঘুমিয়ে প’ড়ো না যেন। জেগে—জেগে অপেক্ষা করো।’
এরপর মোহনী হাতে তুলে নেয় একটা ছেলে—পুতুল। তাকে বলে ‘ওই দ্যাখো, তোমার মোহিনী, এত রাত্তিরে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে, ছুটে চলে যাও ওর বিছানায়।’
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে ঢোকে বঙ্কিম। আঁতকে ওঠে মোহিনীর দিকে তাকিয়ে।
—এ কী করেছ মোহিনী! তুমি আমার পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে পুতুলের বিছানা করেছ!
—ছিঁড়েছি তো কী হয়েছে! আবার নতুন করে লেখো। পারবে না?
—এর চেয়ে আমার জামাকাপড় ছিঁড়লে না কেন?
—জামাকাপড় ছিঁড়লে তুমি কি আবার সেলাই করে সেগুলোকে ঠিক করতে পারতে? তুমি কি দরজি?
—মোহিনী, একজন লেখকের কাছে জামাকাপড়ের থেকে তার লেখার দাম অনেক বেশি। চিৎকার করে ওঠে বঙ্কিম, কিছুতেই রাগ সামলাতে পারে না।
—বুঝেছি, তুমি ওগুলোকে আর গুছিয়ে লিখতে পারবে না, এই তো? কেমন লেখক তুমি?
—মোহিনী, কী বলছ তুমি! লিখতে পারব না মানে! দেখবে আমার ক্ষমতা?
—দ্যাখাও দেখি।
বঙ্কিম তখুনি টেবিলে বসে যায়। খসখস করে লিখতে শুরু করে। মোহিনীকে দেখাতেই হবে তার লেখার বাহাদুরি। জেদ চেপে গিয়েছে।
মোহিনীর ভাবটি এমন, বঙ্কিমের লেখার চেয়ে তার পুতুলখেলার গুরুত্ব অনেক বেশি।
বঙ্কিম একমনে কিছুক্ষণ লেখে। লিখতে—লিখতে তার রাগটা পড়ে যায়। মন শান্ত হয়। সে বলে, ‘মোহিনী, এই দ্যাখো, কেমন তরতর করে লিখে ফেললুম।’
—শোনাও দেখি কী লিখলে।
পুতুল খেলতে—খেলতে বলে মোহিনী। বঙ্কিম গম্ভীর হয়ে পড়ে : নাথ ভুজে মাথা দিয়ে পড়েছে মোহিনী।
—দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি কি আমাকে নিয়ে কাব্য লিখেছ নাকি?
—একরকম তা—ই মোহিনী।
—মানে এই যে কাগজগুলো, যা কুচিকুচি করে পুতুলের বিছানা বানিয়েছি, তার মধ্যে রয়েছে তোমার মোহিনীকে নিয়ে তোমার কবিতা?
—তা—ই বটে মোহিনী।
—ও মাগো! আমাকে নিয়ে তুমি কাব্য লিখেছ! আর আমি কিনা তা কুচিকুচি করে পুতুলের বিছানা করেছি!
—এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই বউ।
—আরেকবার বলো, ওই শব্দটা।
—কোন শব্দ?
—আগে কখনও বলোনি তো! বলো না আরেকবার।
—বউ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে মোহিনী। কাছে এগিয়ে আসে বঙ্কিম। মোহিনী বঙ্কিমের চোখে চোখ রাখে। বলে, ‘এই ছেঁড়া কাগজগুলোর মধ্যে আছে এমন কোনও কবিতা, যা তোমার মনে পড়ছে?’
—’ধূলি হয়ে কুঞ্জবনে মন্মথ—মোহিনী নাথ সনে’। এই লাইনটাও কুচি—কুচি করে তুমি চিরদিনের জন্য ধূলিতে মিশিয়ে দিয়েছ মোহিনী!
১৮৬০—এর জুন মাস। সবে শুরু হয়েছে বর্ষা। বঙ্কিম বাইশ। সে বদ্ধপরিকর, বিয়ে করবে না। সারাজীবন থাকবে মোহিনীর স্মৃতির সঙ্গে।
কিন্তু বঙ্কিমের মন ছায়ার সঙ্গে কোনওরকমে হয়তো মানিয়ে নেয়, হয়তো কিছু দিনের জন্য। তার বাইশ বছরের শরীর যে চায় কায়া। চায় তাড়নার রেচন ও উপশম
মোহিনী তাকে দিয়েছে যে—রস ও তাপের স্বাদ, যে—উদ্দীপন ও সন্দীপ্তির সম্মোহন, তারই জন্য পিপাসু সারাক্ষণ বঙ্কিমের শরীর। তাই মোহিনীর মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যেই কনে খুঁজতে বেরল বঙ্কিম। তার মনে চিরদিনের জন্য রইল মোহিনী।
এই তো সেদিন মোহিনী গেল। বিয়ে করব না আর কোনও দিন, ভীষ্মের পণ বঙ্কিমের। সেই বঙ্কিম এত তাড়াতাড়ি বিয়েতে রাজি!
যেন মোহিনী নামের কেউ কোনও দিনই আসেনি বঙ্কিমের জীবনে। যেন প্রথম বিয়ে করতে চলেছে বঙ্কিম। ইতিমধ্যে যশোর থেকে বদলি হয়ে সে মেদিনীপুরের কাঁথিতে। চাকরি জীবনে তার আরও রমরমা। এমন পাত্রর বিয়ে। চাট্টিখানি কথা! ঘটকের দল বেরিয়ে পড়ল পাত্রীর সন্ধানে।
কিন্তু নিজের পাত্রী নিজেই খুঁজতে চায় বঙ্কিম! এই কর্মের আলাদা রস। ঘটকদের সে—রস দেব কেন? আমার বউ খোঁজার রস নিজেই পান করব আকণ্ঠ, বন্ধুদের এ—কথা বোঝাতে দেরি হয় না বঙ্কিমের।
সে কী! অবাক বঙ্কিমের বাবা—মা, যাদবচন্দ্র আর দুর্গাসুন্দরী। তারপর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বঙ্কিম হয়তো মোহিনীর মতোই সুন্দরী বউ ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। তাই সে নিজের বউ নিজেই খুঁজতে চায়। কিন্তু পাবে কি?
—সে কী রে! তুই নিজের পাত্রী নিজেই খুঁজতে যাবি? মোহিনীকে কি তুই খুঁজেছিলি? প্রশ্ন করে চার বছরের বড় ভাই সঞ্জীবচন্দ্র।
—ঘটকরা রসের কী বোঝে? বঙ্কিমের ঠোঁটে বাঁকা হাসি।
—তুই আর—একটা মোহিনী চাস, তা—ই তো?
বঙ্কিম নীরব। তীব্র দৃষ্টিতে তাকায় অগ্রজের দিকে। সঞ্জীব কেমন ধাঁধিয়ে যায় সেই চাউনির সামনে।
সঞ্জীবচন্দ্রর বন্ধু দীনবন্ধু মিত্র। বাপ নাম রেখেছিল গন্ধর্বনারায়ণ, কলকাতায় পালিয়ে এসে লংসায়েবের স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় নিজের নামটাই দিল বদলে। নদিয়ার ছেলে দীনবন্ধুর সঙ্গে সঞ্জীবচন্দ্রর আলাপ নদিয়াতেই। চাকরিসূত্রে তখন সঞ্জীবচন্দ্র সেখানে। সঞ্জীব ও দীনবন্ধু গলায়—গলায়। এই সখ্যর মূলে দু’টি কারণ। এক, দু’জনেই ভালোবাসে পড়তে। দুই, দু’জনেই লেখক।
—বঙ্কিমের মাথায় ভূত চেপেছে, দীনবন্ধুকে বলল সঞ্জীব।
—এই তো নামল মোহিনী, আবার কোন ভূত?
—বঙ্কিম বিয়ে করবে।
—তা বেশ। সাত—আট মাস তো শোক করল। আর কদ্দিন! এটাই তো স্বাভাবিক সঞ্জীব।
—বিয়ে করাটাকে ভূত বলব কেন? যতবার খুশি বিয়ে করুক। কিন্তু বলছে, আমার বউ খোঁজার রস ঘটকদের দেব? তা হয় না দাদা!
—বেড়ে বলেছে তো বঙ্কিম। যুগ বদলাচ্ছে ভায়া। বঙ্কিম আমাদের থেকে অনেক ছোট। আমার থেকে তো বছর আটের ছোট হবেই। অন্য জেনারেশন। ইংরেজি শিক্ষার ফল, বুঝলি? নতুন যুগ আসছে রে।
—শুনলে অবাক হবি বঙ্কিম কী বলেছে।
—কী বলেছে? শুনি একবার।
—বলেছে, ঘটকগুলোকে তাড়া।
—বাঃ চমৎকার কথা। কিন্তু তারপর?
—বলেছে, দাদা. একটা খুব বড়সড় বজরা ভাড়া কর। যার মধ্যে বসবাস করতে পারব। সেই বজরায় বেরিয়ে পড়ব বউ খুঁজতে। দরকার হলে সাত সমুদ্দুর পেরবো। হইহই করে পাত্রী খুঁজব আমি। চারধারে যেন সাড়া পড়ে যায়। আমার ‘যোগ্য’ পাত্রী চট করে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। সন্ধানের উত্তেজনা চলবে অনেক দিন।
দীনবন্ধু চুপ করে যায় বেশ কিছুক্ষণ। তারপর বলে, বঙ্কিমের সঙ্গে আমরাও যাব। তুই আর আমি।
—আমরা!
—হ্যাঁ, আমরা। নিজের পাত্রী নিজে খোঁজার মধ্যে কোথাও একটা মর্যাদাবোধ, গৌরব আছে সঞ্জীব। নতুন ভাবনার আলো। অন্ধকার কাটছে সঞ্জীব। চল, আমরাও বঙ্কিমের সঙ্গী হই।
—রাজি হবে কি?
—ও বুঝবে ওর গৌরবের ভাগীদার আমরা। নিশ্চয় রাজি হবে।
বঙ্কিম এককথায় রাজি।
সেজেছে বজরা। এ যেন এক নতুন বাঙালি উৎসব। ঘটকের বালাই নেই।
বর নিজে যাচ্ছে বউ খুঁজতে।
সঙ্গে দাদা আর দাদার বন্ধু।
বিকেলবেলা এক আকাশ মেঘ আর বাদলবাতাসের মধ্যে পাল তুলল বজরা।
বজরা নয় তো, ছোটখাটো একটা বাড়ি।
ভেসে চলেছে তিন ভাবুক ও সাহিত্যিককে নিয়ে এই জায়াসন্ধানী জলযান।
যত বাড়ে রাত, তত ঘন হয় মেঘ।
বাদল বাতাস ফুঁসিয়ে উঠল ঝোড়ো তর্জনে।
মাঝি বলল, নোঙর ফেলতেই হবে।
—কাছেই তো হালিশহর। আর বাঁশবেড়েতে আমার শ্বশুরবাড়ি। ওখানেই রাত্রিযাপন, বলল দীনবন্ধু।
—তবে তাই হোক। কাল সকালে আবার পাড়ি দেওয়া যাবে, বলল বঙ্কিম।
—পাত্রীর খোঁজে বেরিয়েছেন আর হাতের কাছে মেয়েটিকে না—দেখেই চলে যাবেন?
—কে আপনি? জানতে চায় বিস্মিত ও বিরক্ত বঙ্কিম।
—আজ্ঞে, আমি তারানাথ।
—নিবাস?
—কাছেই। হালিশহরে। শুনলাম আপনি পাত্রীর সন্ধানে এখুনি আবার বজরায় উঠে পাড়ি দেবেন। তাই সাতসকালে ছুটে এলুম।
—ঠিক কী বলতে চাইছেন আপনি? প্রশ্ন করে সঞ্জীবচন্দ্র।
—বলতে চাইছি, আমার সন্ধানে একটি মেয়ে আছে। দেখলে হয়তো আপনাদের পছন্দ হবে। দয়া করে যদি একটিবার…
—অসম্ভব। আমরা রূপবতী রাজকন্যের সন্ধানে বেরিয়েছি, কাঁটালপাড়ায় কি মেয়ের অভাব? কিন্তু হাতের কাছে পাত্রী নিয়ে আমাদের চলবে না। এই পাত্র সাধারণ পাত্র নয় তারানাথ, বলে দীনবন্ধু।
—জানি বাবু, ওঁর পরিচয় আমরা জানি। কত বড় বাড়ির ছেলে। ইংরেজ সরকারের কত বড় চাকরি করেন, তাও জানি। তবু অন্য কোথাও যাওয়ার আগে একবার আমাদের গ্রামের মেয়েটাকে দেখে যান।
—এ আপনার অন্যায় অনুরোধ। কাল রাত্তিরে ঝড়—বৃষ্টির জন্য আমরা বাঁশবেড়েতে রাত কাটাতে বাধ্য হই। তা বলে এখানে পাত্রী দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমাদের, বলে সঞ্জীবচন্দ্র।
—দাদা, বজরায় ওঠার আগে একবার ঢুঁ মেরেই না—হয় যাওয়া যাক, দেখি কীরকম মেয়ের সন্ধান দিচ্ছেন তারানাথ। সবাইকে অবাক করে বলে বঙ্কিম!
ওরে, তিন—তিনজন জোয়ান মদ্দ এসেছে পাত্রী দেখতে। ছেলের বাপ—জ্যাঠা নয়। স্বয়ং বরও আছে ওদের মধ্যে। তার কী চোখ—ঝলসানো রূপ! আর দেখলেই মনে হয়, খুব লেখাপড়া জানা লোক।
হালিশহরের বিখ্যাত চৌধুরিবাড়ির অন্দরমহলে এ—খবর গিয়ে পৌঁছল মেয়েদের মুখে—মুখে।
রাজলক্ষ্মী বছর বারোর মেয়ে। সবে উঠেছে বিছানা থেকে দীর্ঘ অসুখের পর। কালো সিড়িঙ্গে। কিন্তু চোখে কী যেন আছে এই মেয়ের।
বাইশ বছরের বঙ্কিম তাকায় বারো বছরের রাজলক্ষ্মীর দিকে। কোথায় মোহিনী! আর কোথায় এই মেয়ে!
—কী নাম তোমার, জিগগেস করে বঙ্কিম।
—রাজ। আমার নাম রাজ। বড় নাম রাজলক্ষ্মী।
সঞ্জীব আর দীনবন্ধু দু’জনেই অবাক এই উত্তরে। লজ্জাশরম নেই নাকি মেয়েটার!
বারো বছরের ধেড়ে মেয়ে সম্পূর্ণ অজানা—অচেনা পুরুষের সঙ্গে এভাবে কথা বলল!
আর একদণ্ড নয় এখানে। দীনবন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে যায় সঞ্জীবচন্দ্র।
—জানি আপনাদের পছন্দ হয়নি, তবু যে একবার দেখে গেলেন… বঙ্কিমকে বলেন তারানাথ।
—কে বললে পছন্দ হয়নি? আশ্চর্য গম্ভীরভাবে এই মধুর কথাটা বলে বঙ্কিম।
তারানাথ করজোড়ে তাকিয়ে।
—এই মেয়েটিকেই আমি বিয়ে করব, কথা দিয়ে বেরিয়ে যায় বঙ্কিম।
চৌধুরিবাড়ির সদরে তার জন্য অপেক্ষা করছে দীনবন্ধু আর সঞ্জীব।
—চ, এবার আবার বেরিয়ে পড়ি। বজরা রেডি, বলে সঞ্জীব।
—চলো, বাড়ির পথে, বলে বঙ্কিম।
—মানে! অবাক দীনবন্ধু।
—মানে, আমি রাজকেই বিয়ে করব।
—কী বলছিস তুই! ওই রুগণ, রোগা, কালো মেয়েটাকে বিয়ে করবি! এই তোর পছন্দ? মোহিনীর পরে রাজলক্ষ্মী? কোনও তুলনা হয়? বলে সঞ্জীব।
—দাদা, মোহিনী স্বপ্ন। স্বপ্নের সঙ্গে সংসার করা যায় না।
—আর রাজলক্ষ্মী রিয়েলিটি! কী বলো বঙ্কিম? হাসে দীনবন্ধু।
তারপর বলে, কিন্তু মোহিনীর কাছে তুমি যে—সুখ পেয়েছো, সেই সুখ এই রুগণ—রোগা মেয়ে তোমাকে দিতে পারবে?
—আপনি আমার দাদার চেয়েও বয়েসে বড়, তবু জানতে যখন চাইলেন বলি, রাজকে দেখে আমি বুঝেছি, ও একদিন আমার সন্তানের মা হবে, আমাকে একটা পূর্ণ সংসার দেবে, শরীর—মনের সুখও কিছু কম দেবে না আমাকে। মোহিনীর মতো রূপসীকে নিয়ে আমি হয়তো কোনও দিনই সুখী হতে পারতুম না।
—এর মধ্যেই মোহিনীকে ভুলে গেলি?
—মোহিনীকে আমি কোনও দিনই ভুলব না দাদা। কিন্তু একটা কথা তোমাদের দু’জনকেই বলছি, আমি যা চাইছি, রাজলক্ষ্মী তা—ই।
—কী চাইছিস তুই?
—চাইছি এমন জীবনসঙ্গিনী যে আমার সমস্ত ভ্রম—প্রমাদ জানবে, মেনে নেবে। যা কিছু আমি জানব আমার সম্পর্কে, সে—ও জানবে। আসল বঙ্কিমকে জানার মনের বল যার থাকবে। আর ধরো যদি কেউ কোনও দিন আমার জীবনী লিখতে চায়, যেন তার কাছেই যেতে হয়। সে আমার সম্পর্কে সব সত্যি বলার সাহসও দেখাবে।
—বারো বছরের রাজলক্ষ্মীর মধ্যে তুই এমন নারীকে দেখতে পেয়েছিস?
—হ্যাঁ দাদা, ঠিক তা—ই!
এগুলো লুকিয়ে রেখেছ কেন গো? কার জন্যে? কী সুন্দর! আমাকে তো দাওনি!
বঙ্কিমের সঙ্গে বিয়ের মাত্র ক’মাস কেটেছে। স্ত্রী রাজলক্ষ্মীর মুখে এ—প্রশ্ন শুনে চমকে ওঠে বঙ্কিমচন্দ্র।
তাকায় স্ত্রী’র দিকে। এতক্ষণ সে মন দিয়ে লিখছিল। স্ত্রী আলমারি খুলে কী যেন করছে। খেয়াল করেনি বঙ্কিম।
বঙ্কিম দেখল, রাজলক্ষ্মীর হাতে দু’টি দুল আর একটি সোনার কাঁটা। বঙ্কিম নীরব। কিছুটা থতমত। কী বলবে, কী বলতে হয় এমন মুহূর্তে, সে জানে না। সে লেখার টেবিল থেকে উঠে পড়ে। গায়ের শালটাকে ছুড়ে দেয় বিছানার দিকে।
দাঁড়ায় গিয়ে রাজলক্ষ্মীর সামনে।
এই দুল, খোঁপায় পরার এই সোনার কাঁটা সে উপহার দিয়েছিল মোহিনীকে। মোহিনীর মৃত্যুর পরে এই সামান্য অলংকার নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে। রাজলক্ষ্মীর হাতে যে সেগুলি পড়তে পারে, কেন ভাবেনি বঙ্কিম?
রাজলক্ষ্মী বুদ্ধিমতী। মোহিনীর মতো বেশি কথার মানুষ নয়। বরং ঠিক উল্টো। বয়েসের তুলনায় তার গাম্ভীর্য চোখে পড়ার মতো।
—রাজ, তোমার তো অলংকারের অভাব নেই। গা—ভর্তি গয়না তোমার। এ—দু’টি দুল আর সোনার কাঁটা নিতান্তই সামান্য। যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দাও না কেন? কী প্রয়োজন তোমার ওই অলংকারের?
রাজলক্ষ্মী আর কথা বাড়ায় না। সে বঙ্কিমের কথাই শোনে।
বঙ্কিম লক্ষ করে, রাজলক্ষ্মীর চোখ সামান্য যেন ছলছল করছে।
—রাজ, ডাকে বঙ্কিম।
রাজলক্ষ্মী সাড়া দেয় না। শুধু তাকায়। স্ত্রীর ব্যক্তিত্ব বঙ্কিমকে মুগ্ধ করে।
—আমি তোমার কাছে কিছু লুকোতে চাই না। তোমাকে মিথ্যাও বলতে চাই না। তবে এ—গয়না এখন তোমাকে দেব না। আমার কাছেই থাকল। অন্য কারও জন্য নয়। তোমারই জন্য রাজ। যেদিন তোমায় ভালোবাসব, সেদিন দেব।
—আমাকে তুমি এখন ভালোবাস না? রাজলক্ষ্মী বিস্মিত।
বঙ্কিম চুপ।
রাজলক্ষ্মী গায়ে আঁচল টেনে পিছনে ফেরে। সে সোনার দু’টি দুল আর সোনার কাঁটাটি আলমারির এক কোণে সযত্নে রেখে দেয়।
বঙ্কিম দেখে পিছন থেকে।
রাজলক্ষ্মীর গ্রীবাটি চোখে পড়ার মতো সুন্দর। গায়ের রং চাপা। যেমন হয় বাঙালি মেয়েদের। শ্যামল স্নিগ্ধ। তার সঙ্গে মিশেছে তনুর ছিপছিপেমি।
রাজকে বুকের কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে করে বঙ্কিমের। ইচ্ছে করে আদর করতে। গ্রীবাটি ভারি লোভন। বঙ্কিম দমন করে চুমুর বাসনা। ধীরে ফিরে যায় লেখার টেবিলে।
এই ঘটনার পর চার বছর কেটে গিয়েছে।
১৮৬৪ সাল। বঙ্কিম ২৬। রাজলক্ষ্মী ১৬। এই বয়সেই মোহিনী চলে গিয়েছে।
রাজলক্ষ্মীর কোলে এসেছে তাদের প্রথম সন্তান। ভারি ফুটফুটে এক মেয়ে।
বঙ্কিম নাম রেখেছে শরৎকুমারী।
ডাকনাম শরৎ।
শরৎকে পেয়ে মন ভরে গিয়েছে বঙ্কিমের। জীবনে সে প্রথম সুখী, ভরপুর, কোনও অভাববোধ নেই আর।
শরতের জন্মের পর দেখতে—দেখতে তিন মাস কেটে গেল।
বঙ্কিম রাজলক্ষ্মীকে নিয়ে ভেসে চলেছে বজরায়।
শরতের জন্মের পরেই সে যে রাজলক্ষ্মীকে নতুন করে পেয়েছে, এই কথাটুকু সে জানাতে চায়।
নদীর বুকে ঝিলমিল করছে বিকেলের আলো। বসন্তের বিকেল। পালে লেগেছে হু হু বাতাস।
পাশে স্ত্রীকে নিয়ে বঙ্কিম বসে আছে বজরার ডেক—এ। জলের শব্দ চারিদিকের নিরিবিলিকে আরও যেন বাড়িয়ে দিয়েছে।
—রাজ, ডাকে বঙ্কিম।
রাজলক্ষ্মী তাকায়।
বঙ্কিম কাছে টেনে নেয় তার রাজকে। নিজের হাতে তার কান থেকে খুলে নেয় হীরের ফুল। পরিয়ে দেয় মোহিনীকে দেওয়া সেই দু’টি হালকা সোনার দুল।
—পিছন ফেরো রাজ।
রাজলক্ষ্মী পিছন ফেরে।
বঙ্কিম তার খোঁপায় পরিয়ে দেয় মোহিনীর সোনার কাঁটা।
তারপর একটি আলতো স্পর্শময় চুমু খায় রাজলক্ষ্মীর শ্যামল স্নিগ্ধ লোভনীয় গ্রীবায়।
রাজলক্ষ্মী সামান্য শিউরে ওঠে। তার গায়ে কাঁটা দেয়। সে সামনে ফেরে। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। চোখে জল।
—তা হলে আজ ভালোবাসলে? বলে রাজলক্ষ্মী।
বঙ্কিম নীরব। রাজলক্ষ্মীর চোখে চোখ রাখে।
এমন মায়াডোর ভুবনে আর নেই, মনে হয় বঙ্কিমের।
দু’বছরের মধ্যে আরও একটি মেয়ে হল বঙ্কিম—রাজলক্ষ্মীর। শরৎকুমারীর মতোই সুন্দর।
—রাজ, এ তো তোমার কোলে পদ্মফুল! বলে বঙ্কিম।
—না—না, চাঁদের টুকরো।
—একই সঙ্গে নীল পদ্ম আর নীলচে চাঁদ। তোমার কথা রইল। আমারও।
—কী নাম দেবে মেয়ের?
—খুব সহজ। নীলাব্জকুমারী।
—এই তোমার সহজ নাম? মানে কী গো?
—’অব্জ’ মানে একই সঙ্গে চাঁদ এবং পদ্ম।
—তা—ই! তাহলে নীলাব্জই একেবারে ঠিক নাম।
—কিন্তু ডাকব কী নামে?
—নীল!
—বাঃ। বেশ তো!
আরও একটি মেয়ে হয়েছে রাজলক্ষ্মী আর বঙ্কিমের। পর পর তিন মেয়ে।
—এবার নিশ্চয় ছেলে আশা করেছিলে, তা—ই না?
—না তো!
—আমার ভয় করছে।
—কীসের ভয়?
—যদি তুমি বংশরক্ষার জন্য পুত্রসন্তানের মুখ দেখতে আবার বিয়ে করো।
বঙ্কিম হতবাক। বেশ কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে রাজলক্ষ্মীর দিকে।
তারপর বলে, ছিঃ রাজ ছিঃ। তুমি আমাকে এত বড় পাষণ্ড ভাবতে পারলে?
—কিন্তু আমাদের পড়শি রাম গোঁসাই তো ছেলের মুখ দেখতে তিন—তিনবার…
—রাজ, আমি রাম গোঁসাই নই। আমি ইংরেজি—জানা শিক্ষিত বাঙালি। সন্তান আমার কাছে সন্তান। ছেলে, না মেয়ে তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।
বঙ্কিম তাকায় সদ্যেজাত কন্যার দিকে। বলে, রাজ, আমার ঘরে আর পিদিম জ্বালানোর দরকার নেই। তোমার তিন মেয়ে যে রূপের ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে।
—এ মেয়েও তো পদ্মের মতোই গো।
—চোখ দু’টি দ্যাখো, যেন পদ্মপাতা।
—এবার কী নাম দেবে?
—উৎপলকুমারী।
—আমি ‘উৎপল’ মানে জানি, পদ্ম।
বঙ্কিম হেসে বলে, তুমি ওর ডাক নামের মানেও জানো।
রাজলক্ষ্মী তাকায় বঙ্কিমের দিকে।
বঙ্কিম রাজলক্ষ্মীর কোল থেকে মেয়েকে নিজের কোলে নিয়ে বারবার বলতে থাকে—পলা, পলা, পলা।
তিন মেয়েরই বালিকা বয়েসে বিয়ে দিল বঙ্কিম। শরৎকুমারীর বিয়ে হল হালিশহরের রাখালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। রাখালকে ‘ঘরজামাই’ করে নিজের কাছেই রেখে দিল বঙ্কিম। তার চাকরির ব্যবস্থাও করে দিল নিজের প্রভাব খাটিয়ে। মেজো মেয়ে নীলাব্জর বিয়ে হল উত্তরপাড়ার জমিদার বাড়ির ছেলে সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ছোট মেয়ে উৎপলকুমারীর বিয়ের বেলা ভুল খেলল বঙ্কিম। ঠিকুজি, কোষ্ঠী মিলিয়ে কলকাতার বাঁশতলার এক বখাটে ছোকরার সঙ্গে পলার বিয়ে দিল সে। ভালো করে খোঁজখবর নিলে জানা যেত, বাপ—মা হারা মতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ঠাকুরদার আদরে বাঁদর হয়েছে। সে মাতাল, লোভী, বেশ্যাসক্ত।
পলার সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছে সে। সে এত দূর কামুক ও মাতাল যে, পাশের বাড়ির এক যুবতীর সঙ্গে অশালীন আচরণ করল। পাড়ায় কেলেঙ্কারি চাপা থাকল না। বঙ্কিম লজ্জায় এবং মেয়ের কাছে অপরাধবোধে মাটিতে মিশে গেল। কিন্তু পলার মুখে বঙ্কিম একটিবারও শুনল না স্বামীর নিন্দা। সে ফিরে গেল শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর সঙ্গেই।
রাজলক্ষ্মী কাঁদতে—কাঁদতে লুটিয়ে পড়ল বিছানায়।
বঙ্কিমের ভাষা নেই তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার।
১৮৮৭। বঙ্কিম ৪৯।
খ্যাতি ও প্রতিপত্তির শিখরে। বদলি হয়েছে মেদিনীপুরে। রাজলক্ষ্মী সঙ্গে যাচ্ছে। তবে অত গয়নাগাঁটি সঙ্গে না—রাখাই ভালো। আবার ভুল করল বঙ্কিম। গয়নাগচ্ছিত রাখল বড় আদরের ছোট মেয়ে পলার কাছে।
মাতাল লম্পট মতীন্দ্রর কাছে এ—খবর পৌঁছল অচিরে। সে থিয়েটারের নটীদের সঙ্গে ফুর্তি করে রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে পলাকে বলল, কোথায় রেখেছিস তোর মায়ের গয়নাগুলো? দে আমাকে।
—না—না, ও গয়নায় তুমি হাত দিও না। আমার তো সব গয়না নিয়েছ। বাকি যা আছে তা—ও নাও। মা—র গয়নায় হাত দিও না।
—শোন মাগি, তোকে একটা কথা বলি। আমাদের কোনও ছেলেপিলে হয়নি। তার মানে জানিস? আমি শ্বশুরবাড়ির কোনও সম্পত্তি পাব না। শাশুড়ির গয়নাগুলো আমাকে দিয়ে দে। ওগুলোর ওপর আমার অধিকার আছে। তুই বাঁজা। তোর কারণে আমার ছেলেপিলে হল না। তার শাস্তি আমি ভোগ করব কেন?
—তুমি তো রাত—দিন মদ খেয়ে অন্য জায়গায় পড়ে থাকো। আমার ছেলেমেয়ে হবে কী করে?
—নির্লজ্জ বেহায়া মাগি। কোনও কথাই তোর মুখে আটকায় না! ভাবছিস তোর ম্যাজিস্ট্রেট বাপ, মহাপণ্ডিত সাহিত্যিক বাপ তোকে বাঁচাবে? তুই মতীন্দ্র মুখুজ্জেকে চিনিস না। আজই তোকে খতম করব।
নভেম্বরের রাত। বেশ শীত পড়েছে। চারধারে শুনশান। পলা কাঁদতে—কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। এই সুযোগ। পাড়ায় থাকে বিনোদ ডাক্তার। মতীন্দ্রর এক—গেলাসের বন্ধু। বেশ্যাবাড়িতেও আনাগোনা আছে ডাক্তারের। ডাক্তারকে ডেকে পাঠায় মতীন্দ্র।
ছুটে আসে বিনোদ। টাকার লোভ দেখায় মতীন্দ্র। বিনোদ রাজি হয়ে যায়। ওষুধে বিষ মিশিয়ে দেয় বিনোদ। সেই ওষুধ দু’জনে জোর করে ঢেলে দেয় বিষাদে আচ্ছন্ন ঘুমন্ত পলার মুখে। পলার দেহ মারাত্মক বিষে অসাড় হয়ে যায়। তারপর সে মরে। তারপর বিনোদ আর মতীন্দ্র পলার দেহটাকে ঝুলিয়ে দেয় কড়িবরগায়।
বঙ্কিম তখন মেদিনীপুরে। তার কলকাতার বাড়িতে আছে বড় জামাই রাখালচন্দ্র। রাখালের কাছে খবর এল। পলা আত্মহত্যা করেছে।
রাখাল ছুটল কাঁটালপাড়ায় সঞ্জীবচন্দ্রের কাছে। এ—খবর রাখাল একা মেদিনীপুরে গিয়ে জানাতে পারবে না বঙ্কিমকে। আপনি সঙ্গে চলুন, তবেই শ্বশুরমশাইকে সামলাতে পারব, বলে রাখাল।
সঞ্জীব রাখালকে সঙ্গে নিয়ে মেদিনীপুরে গিয়ে এই মর্মান্তিক সংবাদটি দেয় বঙ্কিম আর রাজলক্ষ্মীকে। রাজলক্ষ্মী অসুস্থ হয়ে পড়ে। বঙ্কিম কলকাতায় এসে খবর পায়, পলা আত্মহত্যা করেনি। তাকে খুন করা হয়েছে।
সঞ্জীবচন্দ্রের ছেলে জ্যোতিশ্চন্দ্রের স্ত্রী মোতিরানির দু’টি চিঠি পড়ে নিশ্চিত বঙ্কিম, কী নির্মমভাবে মতীন্দ্র বাধ্য করেছে পলাকে মরতে। বঙ্কিম নিজে পুলিশের কাছে সব খোঁজখবর নিয়ে হত্যার নির্ভুল প্রমাণ পেয়ে যায় হাতে। তার একটি কথায় মতীন্দ্রের ফাঁসি হতে পারে। বিনোদ ডাক্তারও ছাড়া পাবে না।
বঙ্কিম কাঠগড়ায়। গীতা—গঙ্গাজল ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে, যা জানি সব সত্য, তা—ই বলব।
—বলুন, যা জানেন আপনি।
বঙ্কিম নীরব।
—কী হল, মুখ খুলছেন না কেন?
বঙ্কিম তবু নীরব।
—তা হলে আদালত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছে যে উৎপলকুমারী আত্মহত্যা করেছে। তাকে খুন করা হয়নি।
বঙ্কিম নীরবে নেমে গেল কাঠগড়া থেকে। সে মিথ্যা বলল না বটে। সত্যিটা চেপে গেল বেমালুম। মেয়ে মরেছে মরুক। সে তো ফিরবে না। জামাইয়ের জেল বা ফাঁসি হলে পারিবারিক সম্মান ধুলোয় লুটোবে। মিথ্যে সাক্ষী দিল বঙ্কিম।
ছাড়া পেয়ে গেল খুনের আসামি মতীন্দ্র। বাঁচল পারিবারিক কেলেঙ্কারি।
বঙ্কিমের আভিজাত্যে টোল পড়ল না।
বঙ্কিম ৪৬ : আরও দশ বছর সে বাঁচবে। ইতিমধ্যে যশ ও ক্ষমতার শিখরে। নিটোল তার সামাজিক ভাবমূর্তি। কী সাহিত্যে, কী বাংলা ভাষার সৃজনে, কী প্রসারিত বৈদগ্ধ্য আর মৌলিক মননে, সন্দেহাতীত তার প্রতিভা।
সে লিখে ফেলেছে ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘মৃণালিনী’। এই তিনটি উপন্যাস লেখার পরেই সে নবজাগ্রত বঙ্গের মধ্যমণি। ‘বঙ্গদর্শন’—এ প্রকাশিত হয়েছে তার ‘কমলাকান্তের দপ্তর’। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এমন স্বাদ বাঙালি আগে পায়নি। ‘আনন্দমঠ’—ও লেখা হয়ে গিয়েছে।
দশ বছর বয়েস হয়েছে তার লেখা ‘বন্দে মাতরম’—এর। স্বয়ং যদু ভট্টের কাছে গান শিখেছে সে। তার গানেও আছে নিজস্ব বাহার।
এহেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অধরলাল সেনের বাড়িতে এল ১৮৮৪—র ৬ ডিসেম্বর। সেদিন শনিবার, ছুটির দিন। অধর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। তিনিও সেদিন অধরের বাড়িতে। বঙ্কিমকে রামকৃষ্ণের সামনে নিয়ে এল অধর। বলল, ইনি খুব পণ্ডিত। অনেক বইটই লিখেছেন। আপনাকে দেখতে এসেছেন। এঁর নাম, বঙ্কিমবাবু।
ঠাকুর তাকালেন। তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই, বঙ্কিমের নাম তিনি আদৌ শুনেছেন কি না। হেসে জিগ্যেস করলেন, বঙ্কিম! তুমি আবার কার ভারে বাঁকা গো?
রামকৃষ্ণের প্রশ্নে কিছুটা থতমত বঙ্কিম। একজন তথাকথিত প্রায় মূর্খ মানুষের কাছে প্রথম আলাপেই এমন প্রশ্ন আশা করেনি বঙ্কিম। নিজেকে পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলল, আরে মশাই জুতোর চোটে, সাহেবের জুতোর চোটে বাঁকা।
রামকৃষ্ণ বুঝলেন, বঙ্কিম তার চাকরি—জীবনে অহরহ অপমানের কথা বলছে। যতই উপরে ওঠো, সাহেবের তলায় থাকতেই হবে।
হেসে বললেন, না গো, সাহেবের জুতোর চোটে বাঁকা হবে কেন? শ্রীকৃষ্ণ তো প্রেমে বঙ্কিম হয়েছিলেন। শ্রীমতীর প্রেমে ত্রিভঙ্গ। শ্রীকৃষ্ণ কালো কেন জানো?
কী সহজ প্রশ্ন! অন্তত আপাতভাবে। অথচ মহাপণ্ডিত বঙ্কিম বাকরহিত। উত্তর দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু কথা সরে না। রামকৃষ্ণ বললেন, যতক্ষণ ঈশ্বর দূরে ততক্ষণ কালো। সমুদ্দুরের জল গো। দূর থেকে নীল। কাছে গিয়ে জল হাতে তুলে দ্যাখো। দেখবে সাদা।
তেমনই ঈশ্বরের স্বরূপ ঠিক জানতে পারলে আর কালো থাকে না। তবে সে অনেক দূরের কথা গো বঙ্কিমবাবু। সমাধিস্থ না—হলে ঈশ্বরের স্বরূপ জানা যায় না। যতক্ষণ তোমার মধ্যে আমি—তুমি আছে, ততক্ষণ ঈশ্বর অনেক দূরের। ততক্ষণ তিনি নানা রূপে প্রকাশ হন। কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না।
বঙ্কিম কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে শুনতে থাকে। কী অনর্গল এই মূর্খ সন্ন্যাসী! বঙ্কিম কিছু বলার আগেই রামকৃষ্ণ আর—একটি প্রশ্ন করেন—রাধাকৃষ্ণ, এই ‘যুগলমূর্তি’—র মানে জানো বঙ্কিমবাবু?
বঙ্কিম সত্যিই বাক্যহারা। কিছুতেই উত্তর মনে পড়ে না তার। উত্তর দেন রামকৃষ্ণ নিজেই, শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ, শ্রীমতী তাঁর শক্তি—আদ্যাশক্তি। পুরুষ আর প্রকৃতি।
ইশ! কেন বলতে পারলুম না! ভাবে বঙ্কিম।
রামকৃষ্ণ বলেন, ‘পুরুষ’ আর ‘প্রকৃতি’ অভেদ। মধ্যে কোনও ভেদ নেই গো। বঙ্কিম রামকৃষ্ণের এই অভেদতত্ত্বটি গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করে। রামকৃষ্ণ মুহূর্তে ব্যাখ্যা করে দেন, পুরুষ, প্রকৃতি না—হলে থাকতে পারে না। প্রকৃতিও, পুরুষ না—হলে থাকতে পারে না।
বঙ্কিম মনে—মনে ভাবে, এই সন্ন্যাসী কি তাহলে নারী—পুরুষের সম্পর্কের কথা, কামনাবাসনার কথা বলছে? অবাক হয় সে!
পরক্ষণেই রামকৃষ্ণ এমন কথা বলেন, বঙ্কিম বোঝে, এ—কথা গভীর দর্শনের। রামকৃষ্ণ বলেন, শোনো বঙ্কিমবাবু, কৃষ্ণ আর রাধা, পুরুষ ও প্রকৃতি কেমন জানো? যেমন আগুন আর দাহিকাশক্তি।
বঙ্কিম বিস্মিত। হয়তো মুগ্ধও। কেমন যেন ঘোর লাগে তার। রামকৃষ্ণ বলতে থাকেন, দাহিকাশক্তি ছাড়া আগুনকে ভাবতে পারো? আবার আগুন ছাড়া দাহিকাশক্তি ভাবতে পারো?
তাই তো ‘যুগলমূর্তি’—তে কৃষ্ণের দৃষ্টি শ্রীমতীর দিকে, শ্রীমতীর দৃষ্টি কৃষ্ণের দিকে। কৃষ্ণ নীল। তাই রাধা নীলাম্বর পরেছেন। অঙ্গ সাজিয়েছেন নীলকান্ত মণি দিয়ে। প্রকৃতি আর পুরুষে অন্তরে—বাইরে মিল গো বঙ্কিমবাবু।
হঠাৎ বঙ্কিম পাশের লোকটিকে কী যেন বলে ইংরেজিতে। তারপর শুরু হয় ইংরেজিতে গুঞ্জন। হয়তো কিঞ্চিৎ হাসিঠাট্টা।
ইংরেজি বুঝতে পারেন না রামকৃষ্ণ। কিন্তু বালকের সারল্য তাঁর। এতটুকু রাগ নেই। নেই কোনও মান—অপমান বোধ। বলেন, একটা গপ্প মনে পড়ে আমার হাসি পাচ্ছে। গপ্পটা শোনো তোমরা।
একজন নাপিত কামাতে গিয়েছে। কামাতে—কামাতে ভদ্দলোককে সে একটু লাগিয়ে দিয়েছে। আর সে লোক অমনি বলে উঠেছে, ড্যাম। নাপিত তো ‘ড্যাম’—এর মানে জানে না। সে অমনি ক্ষুরটুর রেখে, রেগেমেগে জামার আস্তিন গুটিয়ে বলল, ‘ড্যাম’ মানে যদি ভালো হয় তা হলে আমি ড্যাম, আমার বাবা ড্যাম, আমার চোদ্দোপুরুষ ড্যাম। আর ‘ড্যাম’ মানে যদি খারাপ হয়, তা হলে তুমি ড্যাম, তোমার বাবা ড্যাম, তোমার চোদ্দোপুরুষ ড্যাম। আর শুধু ড্যাম নয়। ড্যাম ড্যাম ড্যাম ড্যাম ড্যাম!
বঙ্কিমের মুখ লাল হয়ে উঠল। সে সকলের হাসিতে যোগ দিতে পারল না। হঠাৎ তার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল একটি প্রশ্ন, মশাই, আপনি প্রচার করেন না কেন?
রামকৃষ্ণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকান বঙ্কিমের দিকে। সকলের হাসি মুহূর্তে থেমে যায়।
বঙ্কিম রামকৃষ্ণের চোখে চোখ রাখতে পারে না।
চোখ নামিয়ে নেয় সে।
রামকৃষ্ণ ধীর—স্থির কণ্ঠে বলেন, প্রচার! তোমার কথা আমার ভালোলাগল না গো বঙ্কিমবাবু। এ তো অভিমানের কথা। অহংকারের কথা। মানুষ তো ক্ষুদ্র জীব। প্রচার তো তিনিই করবেন গো বঙ্কিমবাবু—যিনি চন্দ্র—সূর্য সৃষ্টি করে এই জগৎ প্রকাশ করেছেন। প্রচার করা কি সামান্য কথা? তিনি স্বয়ং আদেশ না—দিলে প্রচার হয় না।
তবে বঙ্কিমবাবু, যেমন—তেমন প্রচার হয় বইকি! এই ধরো, তাঁর আদেশ হয়নি তোমার উপর। তবু তুমি বকে যাচ্ছ। ভাবছ, ভারি প্রচার হচ্ছে। লোকে দু’দিন শুনবে। তারপর ভুলে যাবে। যেমন একটা হুজুগ আর কী! ওটা প্রচার নয় বঙ্কিমবাবু। যতক্ষণ তুমি বলবে ততক্ষণ লোকে শুনবে। আহা, ইনি বেশ বলছেন, বেশ লিখছেন। কিন্তু তুমি ধরো তাঁর আদেশ পাওনি। তা—ই যেই তুমি থামবে, দেখবে কোথাও কিছু নেই।
বঙ্কিম কী যেন বলতে চায়! কিন্তু তার গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না।
রামকৃষ্ণ জিগ্যেস করেন, বঙ্কিমবাবু, তাঁর আদেশ ছাড়া প্রচারের রূপ জানো তুমি?
বঙ্কিম নীরব। কী বলবে সে? ঠিক ভেবে পায় না।
বলেন রামকৃষ্ণ, যতক্ষণ দুধের নীচে আগুনের জ্বাল রয়েছে ততক্ষণ দুধটা ফোঁস করে ফুলে উঠছে। জ্বাল টেনে নাও। দুধও যেমন তেমনি। আর ফুলে উঠছে না। ওই জ্বালটাই তাঁর আদেশ, বুঝেছ বঙ্কিমবাবু?
সবাই নীরব। এই নীরবতা অসহনীয় লাগে বঙ্কিমের। সে পালাতে পারলে বাঁচে। কিন্তু পালানোর পথ নেই। সকলে যে তার দিকেই তাকিয়ে।
হঠাৎ রামকৃষ্ণ সরাসরি বঙ্কিমকেই বলেন, আচ্ছা, তুমি তো খুব পণ্ডিত। কত বই লিখেছ। তা তুমিই বলো বঙ্কিমবাবু, মানুষের কর্তব্য কী? পরকাল তো আছে। কী সঙ্গে যাবে তার?
—পরকাল! সে আবার কী? কিছুটা উদ্ধত অবিশ্বাসে জানতে চায় বঙ্কিম। এই অহংকার দেখিয়ে সে যেন কিছুটা ফিরে পায় তার পায়ের নীচে জমি।
রামকৃষ্ণ গভীর প্রত্যয় থেকে বলেন, বঙ্কিমবাবু, একমাত্র ‘তাঁকে’ জানলে আর পুনর্জন্ম হয় না। তিনিই একমাত্র বিদ্যা। অন্য সব জ্ঞান অবিদ্যা।
যতক্ষণ না সেই বিদ্যা লাভ হচ্ছে, ঈশ্বরজ্ঞান হচ্ছে, ততক্ষণ যে এই সংসারে বারবার ফিরে আসতেই হবে বঙ্কিমবাবু। কোনও মতে নিস্তার নেই। ততক্ষণ পরকাল আছেই আছে।
শুধু ঈশ্বরদর্শন হলে মুক্তি হয়ে যায়। আর আসতে হয় না। সিধোনো—ধান পুঁতলে কি গাছ হয় গো বঙ্কিমবাবু? হয় না। তেমনি ঈশ্বর—জ্ঞানাগ্নিতে যদি কেউ সিদ্ধ হয়, তাকে নিয়ে আর সৃষ্টির খেলা হয় না। তার তো আর কামিনীকাঞ্চনে আসক্তি নেই। তাই এই সৃষ্টির খেলাতে তার ফিরে এসে লাভ কী?
বঙ্কিমবাবু, এখনও হয়তো তুমি সবটুকু বুঝতে পারোনি। তোমার মতো কেশব সেনও একদিন আমাকে প্রশ্ন করল, পরকাল কি আছে?
কেশব সেনের নামে বঙ্কিম নতুন আগ্রহ নিয়ে তাকায় রামকৃষ্ণর দিকে।
কেশব সেনকে কী বলেছিলেন আপনি? জানতে চায় বঙ্কিম।
—তেমন কিছু না। শুধু একটা গল্প বলেছিলুম।
—কী গল্প?
—বললুম, এক কুমোর হাঁড়ি শুকোতে দিয়েছে। তা তার মধ্যে পাকা হাঁড়িও আছে, কাঁচা হাঁড়িও আছে। হঠাৎ একটা গরু এসে হাঁড়িগুলো মাড়িয়ে দিল।
পাকা হাঁড়িগুলো গেল সব ভেঙে। সেগুলো আর কোনও কাজে লাগবে না। কুমোর সেগুলো ফেলে দিল। কিন্তু কাঁচা হাঁড়িগুলোকে কুমোর ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে এনে সেগুলোকে জল দিয়ে মেখে আবার চাকে দিয়ে নতুন হাঁড়ি বানাল।
এবার বুঝলে বঙ্কিমবাবু, যতক্ষণ কাঁচা থাকবে, কুমোর ছাড়বে না। যতক্ষণ না জ্ঞানলাভ হয়, যতক্ষণ না ঈশ্বর দর্শন হয়, ততক্ষণ ওই কুমোর তোমাকে আবার চাকে দেবে গো। ছাড়বে না কিছুতেই। ফিরে—ফিরে এই সংসারেই আসতে হবে। তাঁকে লাভ করলে তবেই তোমার মুক্তি। তখনই তোমার সত্যিই জ্ঞানলাভ হল গো। তখন মায়াকে পার হয়ে গেলে। ওই কুমোর তখন তোমাকে ছেড়ে দেবে। তখন তুমি যে পাকা হাঁড়ি। আর তোমাকে দিয়ে সৃষ্টির কোনও কাজ হবে না। মায়ার সংসারে কোনও কাজে লাগবে না তুমি।
সকলে স্তব্ধ। বঙ্কিম বিহ্বল। বিন্দু—বিন্দু ঘাম জমেছে তার কপালে, ডিসেম্বরের শীতেও। সে দামি শালটা গা থেকে নামিয়ে রাখে।
রামকৃষ্ণ ভোলেননি তাঁর সেই প্রশ্ন—আবার জানতে চাইলেন, বঙ্কিমবাবু, তুমি তো কত বই লিখেছ, কত বই পড়েছ, মহাপণ্ডিত তুমি, তুমিই আমাকে বলো, মানুষের কর্তব্য কী?
বঙ্কিম তার সমস্ত ব্যক্তিত্ব ও সাহস জড়ো করে রামকৃষ্ণ এবং ঘরের সকলকে চমকে দিতে চাইল। বলল, আজ্ঞে, তা যদি বলেন, তা হলে বলব মানুষের কর্তব্য আহার, নিদ্রা, মৈথুন।
ঘরে যেন বজ্রপাত হল।
সকলের ভিতরটা নীরবে ছি—ছি করে উঠল। কারও মুখে হাসি নেই। শুধু বঙ্কিম হাসছে।
রামাকৃষ্ণ তাকালেন বঙ্কিমের দিকে।
কোনও অপমানবোধ নেই সেই দৃষ্টিতে। তিনি বঙ্কিমের ভিতরটা দেখতে পেয়েছেন। শীতলকণ্ঠে বললেন, বঙ্কিমবাবু, মানুষ মুলো খেলে মুলোর ঢেকুর তোলে। তুমি রাতদিন কামিনীকাঞ্চনে রয়েছ, স্বভাব তোমার, তাই—ই ওই কথাই মুখ থেকে বেরুচ্ছে। এঃ! বঙ্কিমবাবু, তুমি বড় ছ্যাঁচড়া।