২. তলায়-তলায় বিদ্যাসাগর
প্রথমেই ঝেড়ে কাশা যাক।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তলায়—তলায় মাইকেল মধুসূদনের লেখা পছন্দ করেন না।
অথচ ভান, যেন করেন!
কেন পছন্দ করেন না?
সে—যুগের প্রখ্যাত পণ্ডিত, কঁৎ—এর পজিটিভিজম—দর্শনের অভিঘাতে তীক্ষ্নধী নাস্তিক কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, যিনি বিদ্যাসাগরকে ঘনিষ্ঠভাবে জানেন, জানাচ্ছেন যে বিদ্যাসাগর সহ্য করতে পারেন না অন্য কোনও ব্যক্তির সাহিত্যখ্যাতি তাঁর খ্যাতিকে কোনওভাবে দুয়ো দিক!
এই প্রসঙ্গে কৃষ্ণকমলের কলমের কথার খাঁটি স্বাদ এই রকম :
বিদ্যাসাগরকে আমি যত ঘনিষ্ঠভাবে জানি,
তেমন আর কেহ জানেনা।
কেমন এই কাছ—থেকে—দেখা বিদ্যাসাগর?
সাহিত্যক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর তাঁহার রাজতক্তের নিকট আর কাহারও আসন হইতে পারে, একথা কল্পনা করিতেও পারিতেন না। তাঁহার এই literary jealousy সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নাই। বিদ্যাসাগরের ওই একটা প্রধান দোষ ছিল, তাঁহার narrowness, তাঁহার bigotry, তাঁহার ‘বামুনপণ্ডিতি’ ভাব। এক হিসাবে catholicity তাঁহার ছিল না।
এই সংকীর্ণ, গোঁড়া, অনুদার বিদ্যাসাগরকে আমরা চিনি না।
অথচ তিনিও বিদ্যমান। তলায়—তলায়। চোরাস্রোতে! সমসময়ের আরও অনেকের মতোই এই অচেনা ‘অন্য’ বিদ্যাসাগরের খুব কাছের পরিচয় কৃষ্ণকমল পেয়েছেন। অন্যেরা অপ্রিয় সত্য চেপে গেছেন।
কৃষ্ণকমল উগরে দিয়েছেন:
He could not bear a brother near the throne.
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একাই বিরাজ করবেন রাজসিংহাসনে। পাশে কোনও ‘ভাইটি’ এসে বসবেন, এই হটকারিতা তাঁর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়।
বিদ্যাসাগর অবশ্যই সেই সময়ের বঙ্গসমাজে একজন হোমরাচোমরা—ই। এবং তিনি নিজেকে সেইভাবে ভাবতেও ভালোবাসতেন!
অনেকটা শেক্সপিয়র—এর নাটকে জুলিয়াস সিজার—এর মতন। সিজার কখনও বলেন না, আমি মনে করছি, আমি পছন্দ করি না, আমার সন্দেহ হয়। বলেন, সিজার মনে করে, সিজার পছন্দ করে না, সিজারের সন্দেহ হয়। এই হল সেই হোমরাচোমরার ভাষা ও ভাব যে নিজেকে হোমরাচোমরা ভাবতেই চায়—
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সবে বানিয়েছেন তাঁর স্বপ্নের ‘সারস্বত সমাজ’। সভায় তিনি ডাক দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। বড় শ্রদ্ধার আন্তরিক আহ্বান—বিদ্যাসাগর তাঁর পিতৃবন্ধু! এল বিদ্যাসাগরের উত্তর :
আমাদের মতো লোককে পরিত্যাগ করো। হোমরা—চোমরাদের লইয়া কোনও কাজ হইবে না।
সন্দেহ নেই এই উক্তিতে ঘটেছে বিদ্যাসাগরের আত্মশ্লাঘার বিস্ফোরণ।
‘ভারতসভা’ প্রতিষ্ঠা করলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু। তাঁরা একান্তভাবে চান বিদ্যাসাগর গ্রহণ করুন সভাপতির পদ। কিন্তু বিদ্যাসাগর যে হোমরাচোমরা। দশজনের সঙ্গে কাজ করতে অরুচি তাঁর! তিনি বিশ্বাসী—ই করেন না মিলিত হয়ে কাজ করায়!
হাত মেলালেন না শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহনের সঙ্গে। ‘ভারতসভা’ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলেন অবিরাম আত্মগরিমা থেকে।
শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর বাবার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বেশ কিছু মিল দেখতে পেলেন। দুজনের মধ্যেই কাজের ফলাফলের প্রতি দৃষ্টির অভাব। দুজনেই আত্মসমীক্ষা করতে চান না। দুজনের মধ্যেই আত্মসংশোধনের কোনও প্রচেষ্টা নেই। একথা তিনি লিখেছেন তাঁর ‘আত্মচরিত’—এ।
শ্যামাচরণ সরকার একটি বাংলা ব্যাকরণ লিখলেন। তিনি পাঁচটি ভাষায় দক্ষ : ল্যাটিন, গ্রিক, ফরাশি, ইংরেজি ও ইটালিয়ান। এছাড়া উর্দু ও আরবিটাও মন্দ জানেন না। তিনি লিখেছেন বাংলা ব্যাকরণ। বইটি প্রকাশিতও হয়েছে। এবং বাস্তবিকই ভালো বই। অন্তত তেমন মন্দ নয় তো বটেই।
শ্যামাচরণ খুব নম্রতার সঙ্গেই ছ’ বছরের ছোট ঈশ্বরচন্দ্রের হাতে একদিন তুলে দিলেন বইখানি। উপহার হিসেবেই।
—ছিঃ ছিঃ, এটা তো একেবারেই নিকৃষ্টমানের বই! এ—বই ছাপিয়ে বের করলেন! Pooh! Pooh!
সবার সামনেই স্বয়ং বিদ্যাসাগর বললেন একথা। কেউ শ্যামাচরণের পাশে দাঁড়ানোর সাহস পেল না। বলতে পারল না, বিদ্যাসাগরমশাই, বইটা কিন্তু মন্দ হয়নি, আপনি সময় করে একটু পড়ে দেখবেন।
বরং অনেকেই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে যোগ দিয়ে বইটির নিন্দেই করল। শ্যামাচরণ মাথা হেঁট করলেন। তাঁর চোখ দুটি জলে ভরে এল। তিনি মাথা আর তুলতে পারলেন না।
আচ্ছা, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা কি পছন্দ করেন বিদ্যাসাগর? না, করেন না। তলায়—তলায় অপছন্দই করেন। আর ঈশ্বরগুপ্তের লেখা?
বিদ্যাসাগরের সামনে ওই নামটা না করাই ভালো। দু—চোখে দেখতে পারেন না ঈশ্বরচন্দ্র ঈশ্বরগুপ্ত—কে!
তাহলে কার লেখা পছন্দ করেন উনি?
তাঁদের লেখা যাঁরা বিদ্যাসাগরের ভাষার অর্বাচীন অনুকরণে লেখক হিসেবে হাবুডুবু খেতে খেতে তলিয়ে যাচ্ছে, তাদের লেখাকে ‘বেশ বেশ’ বলেন তিনি! ‘যে তাঁহার প্রদর্শিত পথ না লইল, তিনি তাহাকে নগন্য মনে করিলেন, যে তাঁহার অনবরতবিগলিতবাষ্পাকুলিতলোচনের মত ভাষার প্রয়োগ না করিল, তাহার উপর তিনি খড়্গ—হস্ত।’ এবং যারা বিদ্যাসাগরের ভাষা অনুকরণ করে তলিয়ে গেল লেখক হিসেবে, তলায়—তলায় মুচকি হেসে তাদের বাহবা দিলেন তিনি!
ঈশ্বরগুপ্তকে যে—বিদ্যাসাগর দু—চোখে দেখতে পারেন না, তার অবিশ্যি বেশ বড় কারণ আছে। বিধবাবিবাহের জন্যে বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের প্রতি কটূক্তি করে কবিতা আর গান লিখেছেন ঈশ্বরগুপ্ত। আবার তাঁর মতো করে লিখে অন্য কবিরা আরও অশ্লীল গাল দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। বিদ্যাসাগরের মনে হয়েছে, এও নিশ্চয় ঈশ্বরগুপ্তেরই লেখা, স্টাইলটা এতই এক রকম:
পরাশর প্রমাণেতে বিধি বলে কেউ,
কেউ বলে এ যে দেখি সাগরের ঢেউ,
অনেকেই এই মত লতেছে বিধান,
‘অক্ষতযোনি’র বটে বিবাহ বিধান,
কেহ বলে ক্ষতাক্ষত কেবা আর আছে.
একেবারে তরে যাক যত রাঁড়ি আছে।
এ—জিনিস হজম করে রাগ ঘৃণা বিদ্বেষ না দেখিয়ে চুপ করে থাকা স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পক্ষেও সম্ভব হল না!
বিদ্যাসাগরকে চিনে ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণের মুখের কথা শোনা যাক বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে :
বিদ্যেসাগরের এক কথায় তাকে চিনেছি, কতদূর তার বিদ্যের দৌড়। বিদ্যেসাগর আমাকে জিগ্যেস করল, ভগবান কি কারুকে বেশি শক্তি আর কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন? আমি অমনি বললুম তা দিয়েছেন বইকি। শক্তি কম বেশি না হলে তোমার নাম এত বেশি হবে কেন? তোমার বিদ্যে, তোমার দয়া, এসব শুনে তো আমরা এসেছি। তোমার দুটো শিং বেরিয়েছে বলে তো আসিনি।
দ্যাখো, তার এত বিদ্যে, এত নাম, কিন্তু কী কাঁচা কথা বলে ফেলল! ভগবান কি কাউকে বেশি, কাউকে কম শক্তি দেন?
কী জানো? জালে প্রথমে বড় বড় মাছ পড়ে, রুই, কাতলা। তারপর জেলেরা পাঁকটা পা দিয়ে ঘেঁটে দেয়। তখন চুনো পুঁটি, পাঁকাল এই সব মাছ বেরয়। ভগবানকে না জানলে আমাদের ভেতরের ওই চুনোপুঁটিই শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যায়।
শুধু বই পড়ে পণ্ডিত হলে কি হবে? বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্য আছে, দয়া আছে, কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি নেই।
পণ্ডিত আর সাধু অনেক তফাৎ। পণ্ডিতের কামিনীকাঞ্চনে মন আছে। সাধুর মন হরিপাদপদ্মে। পণ্ডিত বলে এক আর করে এক। বিদ্যেসাগর সত্যি কথা বলে না কেন? সেদিন বললে, এখানে আসবে। কিন্তু এল না।
শ্রীরামকৃষ্ণ ছাড়া বিদ্যাসাগরের তলায়—তলায় ওই চুনোপুঁটিকে আর কেউ সনাক্ত করতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই।
বিদ্যাসাগর নাস্তিক না আস্তিক?
এ—প্রশ্নেরও কোনও সঠিক উত্তর নেই।
মনে হয় তিনি এক মানুষ ওপরে। অন্য মানুষ নীচে।
হয়তো নিজেও জানেন না তিনি আস্তিক না নাস্তিক।
মজার ব্যাপার, বিদ্যাসাগর চিঠির মাথায় শ্রীহরি বা শ্রীদুর্গা লেখেন। তিনি পৈতেও পরেন। আবার মুখে বলেন, ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্য স্বরূপ।
এসব শুনলে মনে হয় তিনি একই সঙ্গে দুটো বা একাধিক মানুষ।
কোনটি তাঁর সত্য চেহারা, কে বলবে? ধর্ম বা ঈশ্বর নিয়ে এই দ্বিচারিতা তিনি আজীবন বহন করলেন।
রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে কিছুটা চিনতে পেরে বললেন, বিদ্যাসাগর ওই এক রকমের নাস্তিক, যাকে বলে অজ্ঞেয়বাদী। এই অজ্ঞেয়বাদীকে আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারি না।
নীরদচন্দ্র চৌধুরী বিদ্যাসাগর—প্রসঙ্গে অবিস্মরণীয় লেখা লিখেছেন। যাঁরা পড়েছেন সেই লেখা এবং যাঁরা পড়েননি, তাঁদের জন্যে এই সারাৎসার—
১। বিদ্যাসাগর যে নতুন ধরনের বাংলা গদ্যের প্রবর্তন করলেন তা উৎকটভাবে সংস্কৃত গদ্যের অনুকারী। সংস্কৃতধারা বর্জন করে বরং অন্যেরা স্বাভাবিক বাংলা লেখার চেষ্টা করলেন। সেই চেষ্টার নিদর্শন ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ এবং ‘আলালের ঘরের দুলাল।’
২। বিদ্যাসাগর নন, বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা গদ্যের নিজের রূপ প্রকাশ করলেন। বিদ্যাসাগরের গদ্য সংস্কৃত গদ্যের অনুকারী, কিন্তু তাতে সংস্কৃত ভাষার সৌন্দর্য নেই।
৩। বিদ্যাসাগরের বর্ণমালা গ্রন্থে বাঙালির মানসিক শিক্ষা হল কোথায়? বরঞ্চ ‘সুবোধ’ গোপাল হাস্যাস্পদই হয়েছে।
তাহলে কোন প্রাথমিক বই থেকে বাঙালির মানসিক শিক্ষার শুরু? অক্ষয়কুমার দত্তের ‘চারুপাঠ’। বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার একেবারেই সমবয়সী। অক্ষয়কুমার বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরুষ। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে তিনি লিখলেন ‘অনঙ্গমোহন’ কাব্যগ্রন্থ। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই অক্ষয় দত্তরই নাতি।
৪। ঈশ্বরচন্দ্রের ‘কথামালা’? কেমন বই? ইহা মৌলিক রচনা নয়, লিখলেন নীরদ চৌধুরী।
৫। তাহলে বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ ও ‘শকুন্তলা’?’ এরা কেমন? নীরদবাবুর উত্তর, প্রথমটি ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিতে’—র বাংলা। দ্বিতীয়টি কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটকের বাংলা।
৬। বাঙালিকে সংস্কৃত শেখাবার প্রথম বই ‘উপক্রমণিকা’ তো বিদ্যাসাগরই লিখলেন? তারপর এল তাঁর ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’। এই দুটি তো একেবারেই মৌলিক লেখা, তাই না? নীরদবাবু জানাচ্ছেন, ব্যাকরণ পুস্তকগুলি ব্যোপদেবের ‘মুগ্ধবোধ’ অবলম্বন করিয়া লিখিত হইয়াছিল। উহা বাঙালির মধ্যেই প্রচলিত ছিল।
কিন্তু একটি ব্যাপারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মৌলিক। লিখছেন নীরদবাবু, সারা জীবনেও তাঁহার ভুঁড়ি হয় নাই। অথচ ভুঁড়িবিহীন সংস্কৃত পণ্ডিত অকল্পনীয়, এইরূপ পণ্ডিতের লৌকিক আখ্যাই ছিল, ‘ভুঁড়ে ভটচাজ’।
বিদ্যাসাগর পরনিন্দা করেন তারিয়ে—তারিয়ে। মানে ভদ্রতার ভড়ং দেখিয়ে মুখটি মুছে থাকেন। কিন্তু আড়াল পেলেই তলায়—তলায় পরনিন্দা, পরচর্চা পছন্দ করেন। শ্যামপুরের কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি পরে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন, বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, বহুভাষায় সুপণ্ডিত, ক্রিশ্চান ধর্মের প্রচারক, যিনি ১৩ খণ্ডের ‘বিদ্যাকল্পদ্রুম’ লিখেছেন, এবং যিনি বিদ্যাসাগরের চেয়ে অন্তত ছ’বছরের বড়, তাঁর সম্পর্কে বিদ্যাসাগর রটিয়ে বেড়ান—লোকটার রকম দেখেছো? টুলো পণ্ডিতের মতো কথায় কথায় ভট্টির শ্লোক আউড়ায়।
রাজেন্দ্রলাল মিত্র বেলেঘাটার ছেলে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাস চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ বঙ্গদেশে, পুরাতত্ত্ববিদ, এশিয়াটিক সোসাইটির সহকারি সম্পাদক, এবং বিদ্যাসাগরের থেকে বয়েসে ছোটই হবেন, তাঁকে মুখে যাই বলুন, তলায়—তলায় দেখতে পারেন না বিদ্যাসাগর। বলে বেড়ান, লোকটি ইংরেজিতে ধনুর্ধর পণ্ডিত, কিন্তু সায়েবদের কাছে বলে ইংরাজি আমি যৎসামান্যই জানি। যদি কিছু আমার জানাশোনা থাকে তো সেটা সংস্কৃত শাস্ত্র! কী চালাক ভাবো লোকটা! সায়েবরা ভাবে, ব্যস রে, ইংরাজিতে এত সুপণ্ডিত হয়ে যখন সেই বিদ্যেকে যৎসামান্য বলে, তখন না জানি সংস্কৃততে এর কতই বিদ্যে আছে!
ঈশ্বরচন্দ্র কানপাতলা। তাঁর পাতলা কান ভারি করা খুবই সহজ। নরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর স্কুলে মাস্টারি করেন। দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন এই সুপণ্ডিত, সুবক্তা, সুদর্শন, মৌলিকভাবনার নরেন্দ্র।
ঈশ্বরচন্দ্রের জামাই স্কুলের দেখাশোনা করেন। শ্বশুরের দয়ায় তাঁর হাতে কিছু ক্ষমতা এসেছে। তিনি ভয় পেলেন নরেন্দ্রর পাণ্ডিত্য ও জনপ্রিয়তাকে। কানভারি করলেন শ্বশুরমশাই বিদ্যাসাগরের।
কানপাতলা বিদ্যাসাগর বিশ্বাস করলেন জামাইয়ের কথা। কী বললে, নরেন দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে পড়ে থাকে? ঠিক মতো ক্লাস নেয় না? কথায়—কথায় কামাই? বলে দাও নরেন দত্তকে, কাল থেকে যেন আর না আসে।
বিদ্যাসাগরের চেয়ে তেতাল্লিশ বছরের ছোট নরেন্দ্র। ছেলেটাকে একবার ডেকে জিগ্যেসও তো করতে পারতেন। একবার দেখা করলে কী দোষ হত? জামাইয়ের কথাই যথেষ্ট?
নরেন্দ্র কে? কেমন? এসব আর কিছু জানবার প্রয়োজন নেই বিদ্যাসাগরের। তিনি যে বিপুল হোমরাচোমরা। তাই ছেলেটার চাকরি খেতে তাঁর এতটুকু বাধল না।
অবিশ্যি একথাও ঠিক নরেন্দ্রনাথ দত্ত তো মেট্রোপলিটান স্কুলে মাস্টারি করার জন্যে ধরাধামে অবতীর্ণ হননি। তাঁকে যে হতে হবে স্বামী বিবেকানন্দ!
আমাদের ছোটবেলায়, ১৯৪০—এর মাঝামাঝি থেকে ১৯৫০—এর মাঝামাঝি, কোনও বাঙালি বাচ্চচা ছিল না যে এই চারটে লাইন না মুখস্থ করেছে :
পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল।
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।
রাখাল গরুর পাল নিয়ে যায় মাঠে।
শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।
আশ্চর্য্যি, ছেলেবেলায় অনেক বড়দের মুখে শুনেছি, কী সুন্দর ছড়া বলতো? বিদ্যেসাগরের লেখা তো!
তখনই কিন্তু এই ছড়ার আসল লেখক মদনমোহন তর্কালঙ্কার বেশ আড়ালে চলে গেছেন। আর এখন তো তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ লোপাট।
আমরাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নন্দিতন্যাতা দিয়ে তাঁকে এঁটোকাঁটার মতো মুছে দিয়েছি!
মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে যে আর আমাদের একেবারেই মনে পড়ে না, তার একটা বড় কারণ, তাঁর কোনও ছবি নেই। বাংলা ছবিপুজোর দেশ। একটা ছবি পেলে অন্তত জন্মদিন—মৃত্যুদিন করা যেত। ছবি নেই তো ফ্রেম নেই তো তিনি নেই। চুকে গেছে ল্যাটা।
রামমোহন, দ্বারকানাথ, চোখ বুঝলেই দেখতে পাই তাঁদের। বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিম, শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীমা, বিবেকানন্দ—কেমন দেখতে এঁরা, বাঙালি জানে। এঁরা তো ঘরের লোকই হয়ে গেছেন, স্রেফ ছবির সৌজন্যে। মদনমোহনের ছবি নেই। তাঁকে তাই ভাবতে পারি না।
একটা ছবি তাঁর পাওয়া গেছে। অধিকাংশ বাঙালিই এই ছবিটা জানে না। ছবিটা তুলিতে আঁকা বা ক্যামেরায় তোলা নয়। হুবহু বর্ণনার ছবি।
গপ্পটা এইভাবে শুরু করা যাক : ১৮৪৩ সাল। পুজোর ছুটি। সতেরো বছরের রাজনারায়ণ বসু হিন্দু কলেজের ছাত্র। ডিরোজিওর বিখ্যাত ছাত্র রামগোপাল ঘোষ তাঁর বন্ধু।
রাজনারায়ণ আর রামগোপাল দুজনে স্টিমারে করে বেড়াতে বেরলেন। স্টিমার ভিড়ল বিল্বগ্রামের ঘাটে। এবং এহেন দুই নব্য বাঙালি, ডিরোজিওর হিন্দুবিরোধী আদর্শে দীক্ষিত, তাঁরা বিল্বগ্রাম থেকে তুলে নিলেন আর এক বন্ধুকে। বন্ধুটির নাম মদনমোহন তর্কালঙ্কার। তর্কালঙ্কার হওয়ার আগে অবিশ্যি ‘চট্টোপাধ্যায়।’
মদনমোহনের বয়েস ছাব্বিশ। অর্থাৎ তিনি রামগোপালের সমবয়সী। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রবল পণ্ডিত শিক্ষক। ইতিমধ্যেই ‘কবিরত্ন’ ও ‘তর্কালঙ্কার’ উপাধিতে ভূষিত। ভয়ঙ্কর এঁচোড়েপাকা মদনমোহন ছাত্রাবস্থাতেই লিখেছেন রতিরসে টইটম্বুর একটি কাব্য। নামটিও চমৎকার: ‘রসতরঙ্গিনী।’
বিল্বগ্রাম থেকে তো স্টিমারে উঠলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। কী পরে আছেন তিনি? রাজনারায়ণ বসুর মুখ থেকেই শোনা যাক সেই ছবির মতো বর্ণনা :
‘তর্কালঙ্কার মহাশয় একটি হস্তিতে উপবিষ্ট।
কোট ও পেন্টুলন পরা, হাতে বন্দুক, কিন্তু মাথায় টিকি ফরফর করিয়া বাতাসে উড়িতেছে।
দৃশ্যটি দেখিতে অতি মনোহর।
মদনমোহন তর্কালঙ্কারের এই একটি মাত্র ছবিই আমরা পেয়েছি। এই ব্যাকরণ বহির্ভূত বোহিমিয়ান পণ্ডিত কি বিদ্যাসাগর মশাইয়ের বন্ধু হতে পারেন?
অথচ ওঁরা ক্লাসফ্রেন্ড! দুজনেই সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। ঈশ্বরচন্দ্র তিন বছরের ছোট মদনমোহনের থেকে। কিন্তু পাল্লা দিচ্ছেন মদনমোহনের সঙ্গে। প্রতিভায় ও মেধায় কেউ কারও চেয়ে কম নন।
গভীর বন্ধুত্ব হল দুজনের। তাঁরা একসঙ্গে সংস্কৃত কলেজে পড়েছেন, পড়িয়েছেন। কেমন অধ্যাপক মদনমোহন? জানাচ্ছেন তারাধন তর্কভূষণ, সুপ্রসিদ্ধ জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ভিন্ন অপর কেহ এ—পর্যন্ত উক্ত বিদ্যামন্দিরে সাহিত্য অধ্যাপনায় মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মত যশোলাভ করিতে পারেন নাই।
এই প্রশংসা কি বিদ্যাসাগরের কানে সুধাবর্ষণ করেছিল? সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতির সঙ্গে যেই বন্ধুত্বে চিড় ধরল বিদ্যাসাগরের, অমনি তাঁর ভিতর থেকে বেরিয়ে এল চাপা ক্রোধ, বিপুল বিদ্বেষ! তারানাথের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বন্ধুত্ব—বিচ্ছেদের কারণ বহুবিবাহ বা কৌলিন্য প্রথার বিষয়ে দুজনের মতান্তর। বহুবিবাহ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বইতে বিদ্যাসাগর বসালেন থাবা :
অনেকেই বলিয়া থাকেন তর্কবাচস্পতি মহাশয়ের বুদ্ধি আছে, কিন্তু বুদ্ধির স্থিরতা নাই। নানা শাস্ত্রে দৃষ্টি আছে কিন্তু কোনও শাস্ত্রে প্রবেশ নাই। বিতণ্ডা করিবার বিলক্ষণ শক্তি আছে। কিন্তু মীমাংসা করিবার তাদৃশী ক্ষমতা নাই।
এখানেই থামলেন না বিদ্যাসাগর। তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে হেয় করার জন্যে লিখলেন আরও দুটি লেখা, ‘অতি অল্প হইল’ এবং ‘আবার অতি অল্প হইল’—যে লেখায় ঈশ্বরচন্দ্র নিজের মনের গোপন তলানিটা উপুড় করে দিয়েছেন এইসব শব্দে—পণ্ডিতমূর্খ, অতি অপদার্থ, বেহুদা পণ্ডিত, লজ্জাশরম কম, গায়ে মানুষের চামড়া নাই, দুইপদ বিশিষ্ট জন্তু, প্রকৃত বক্কেশ্বর।
তর্কবাচস্পতির এই নিন্দায় প্রকাশ পেল তলায়—তলায় বন্ধু মদনমোহনকেও কতখানি ঈর্ষা করেন বিদ্যাসাগর!
শিক্ষক হিসেবে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জনপ্রিয়তাও অর্জন করতে পারেননি বিদ্যাসাগর। সহজেই কান ভাঙানো গেল কানপাতলা বিদ্যাসাগরের।
মদনমোহন তর্কালঙ্কার কী পড়ান কে জানে? তাঁর ক্লাসের ছেলেরা তো পাশের বাড়ির ছাদে মেয়েদের দেখে।
সে কী! অগ্নিশর্মা ঈশ্বরচন্দ্র ছুটে গেলেন মদনমোহনের ক্লাসে। সরাসরি ছাত্রদের সামনেই প্রশ্ন করলেন, এসব কী শুনছি মদন? উত্তর দিলেন চিররসিক ভালোমানুষ মদনমোহন: ঈশ্বর, এটা বসন্তকাল। পড়াচ্ছি কালিদাসের মেঘদূতম। পড়াচ্ছে স্বয়ং মদন। সুতরাং ছাত্রেরা চঞ্চল হলে তাদের আর দোষ কোথায়?
দোষ ছাত্রদের নয়। যত দোষ শিক্ষক হিসেবে মদনমোহনের অভূতপূর্ব সাফল্যের। সেই সাফল্যে ঈর্ষিত বিদ্যাসাগর মদনমোহনের ক্লাসরুমের জানলা কাঠ দিয়ে চিরদিনের জন্যে বন্ধ করে দিলেন। বন্ধুর অনন্য রসিকতার কানাকড়িও দাম দিলেন না। বুঝিয়ে দিলেন অপদার্থ মদনমোহন ছাত্রদের শাসন করতে পারেন না। শিক্ষক হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হতে পারেন, কিন্তু শ্রদ্ধাযোগ্য বা সফল নন।
বাঙালি শিশুর লেখাপড়ার জন্য বাংলা ‘প্রাইমার’ কেমন হওয়া উচিত, প্রথম দেখালেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার ১৮৪৯ সালে। প্রকাশিত হল তাঁর ‘শিশুশিক্ষা’। আর বেরিয়েই সুপারহিট বই।
ছ’বছর পরে ‘বর্ণপরিচয়’ নিয়ে মাঠে নামলেন বিদ্যাসাগর। ততদিনে বিদ্যাসাগর আর তর্কালঙ্কারের ঝগড়া হয়ে গেছে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না। বিদ্যাসাগর লিখলেন : ক্রমে ক্রমে এরূপ কতকগুলি কারণ উপস্থিত হইল যে, তর্কালঙ্কারের সহিত কোনও বিষয়ে সংস্রব রাখা উচিত নহে।
সেই কারণগুলি আজও স্পষ্ট নয়। এর মূল কারণ কি মদনমোহনের ঈর্ষণীয় সাফল্য? সম্ভবত তলায়—তলায় অন্য এক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না। আর মদনমোহন কী করলেন? তিনি ছেলেবেলার বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়ায় গেলেন না। অভিমানে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে ১৮৫৫ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নিলেন। এবং একটি চিঠিতে জানালেন:
পরমবান্ধব বিদ্যাসাগর আজ ৬ মাস কাল হইতে আমার সহিত বাক্যালাপ করে নাই, আমি কেবল জীবন্মৃতের ন্যায় হইয়া আছি।
বেশিদিন কষ্ট পেতে হয়নি মদনমোহনকে। মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে মারা গেলেন তিনি, ১৮৫৮ সালের ৯ মার্চ মুরশিদাবাদে। এক অপূর্ব বর্ণময় রসিক যেন নিপাতনে সিদ্ধ প্রথাবিরোধী পণ্ডিত ও নিঃস্ব বাঙালি! তাঁর অকাল মৃত্যুর পিছনে কি ঈশ্বরের ঈর্ষার অবদান নেই? রেখে গেলেন তিন মাসের অন্তসত্তা স্ত্রী’কে—যাঁকে ‘বৌদি’ ডাকেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। আর বিদ্যাসাগরকে মদনমোহনের স্ত্রী ডাকেন ‘ঠাকুরপো’।
এত ভাব দু’জনে, একদিন দুপুরে একই পাত থেকে মদনমোহনের বাড়িতে তাঁরা ভাত খাচ্ছেন। এমন সময় মদনের আবির্ভাব। স্ত্রী—র পাত থেকে ঈশ্বরের ওইভাবে ভাত খেতে দেখে মধুরভাবে মদন বলেন, আ রে, করো কী বিদ্যাসাগর, সকল মহাপ্রসাদ তুমি খেলে, আমি কী খাব?
মদনমোহনের মৃত্যুর পর জন্মাল তাঁর অষ্টম কন্যা মালতীমালা। দুই মেয়ের অবিশ্যি শিশু অবস্থাতেই মৃত্যু হয়েছে।
ছ’মেয়েকে নিয়ে অথৈ জলে পড়লেন মদনমোহনের স্ত্রী। কী করে সংসার চালাবেন? হাতে তো কানাকড়িও নেই। মুর্শিদাবাদে মারা যাওয়া মদনমোহন—কলকাতার সারস্বত সমাজে প্রায় লুপ্ত। সেখানে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বিদ্যাসাগর। তিনি তাঁর বন্ধুকে কলকাতার স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনতে কিছুই করলেন না। এই কথাটিও কেউ মনে করল না যে, মদনমোহন তর্কালঙ্কার বঙ্গ নবজাগরণের এক পুরোধা, বিশেষ করে বঙ্গদেশে স্ত্রী—শিক্ষার তিনিই তো ঋত্বিক এবং প্রাণন।
শেষ পর্যন্ত মদনমোহনের স্ত্রী’কে হাত পাততে হল ঠাকুরপো বিদ্যাসাগরের কাছে। তিনি জানেন, ১৮৪৭ সালে তাঁর স্বামী আর ‘ঠাকুরপো’ বিদ্যাসাগর একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছেন বই—ছাপানোর ‘সংস্কৃত যন্ত্র’। তিন বছর একসঙ্গে ব্যবসা করেছেন তাঁরা। তারপর ঠাকুরপোর সঙ্গে তাঁর স্বামীর মনোমালিন্য। সব প্রাপ্য ছেড়ে অভিমানে চলে এলেন মদনমোহন। তাঁর স্ত্রী জানেন, বিদ্যাসাগরে কাছ থেকে তাঁর স্বামীর কিছু টাকা আজও প্রাপ্য আছে ওই যৌথ ব্যবসার সুবাদে। ঠাকুরপো কি দেবেন সেই টাকা? মদনমোহনের দরিদ্র্য স্ত্রী প্রার্থী হয়ে দাঁড়ালেন বিদ্যাসাগরের কাছে।
বিদ্যাসাগর হিসেব করলেন, ঠিক কত টাকা।
সেইটুকু মিটিয়েও দিলেন বইকি।
তারপর নিজেই লিখলেন, শেষ পর্যন্ত নিষ্কৃতি লাভ হল।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কি সত্যিই নাস্তিক হতে পেরেছিলেন? নাকি তলায়—তলায় তিনি আজীবন আটকে থাকলেন বিশ্বাস—অবিশ্বাসের বিরোধাভাসে? দোলাচলে?
১৮৮২—র ৫ আগস্ট।
শনিবার।
তিথি, শ্রাবণমাসের কৃষ্ণাষষ্ঠী।
সময়, বিকেল চারটে।
স্থান, কলকাতার বাদুড়বাগান।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস জানেন, সাগরদর্শনের এ এক পরমলগ্ন।
এ সাগর যে সে সাগর নয়।
বিদ্যার সাগর।
শ্রীরামকৃষ্ণ একটি ঠিকে গাড়ি ভাড়া করেছেন।
কলকাতার রাজপথ পেরিয়ে তিনি চলেছেন বাদুড়বাগানের দিকে।
তাঁর সমস্ত মন সাগরময় হয়ে আছে।
তিনি অনন্যের চৈতন্যে নিমগ্ন।
দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো? সাগরদর্শনের সঠিক সময় যে বিকেল চারটে। সঠিক সময়টি ঠাকুরই বেচেছেন। তিনি যে আজ ভিতরের বিদ্যাসাগরকে বুঝতে চান। তাঁর সামান্য একটু পরীক্ষা নিতে চান? দেখা যাক না কতই বা তাঁর বিদ্যেবুদ্ধি!
ঘোড়া আরও জোরে ছুটছে না কেন? জিগ্যেস করেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
সাগরদর্শনের পরম লগ্নটি যে দীপ্যমান হয়ে উঠেছে ঠাকুরের ধ্যানের মধ্যে।
শ্রীরামকৃষ্ণের ঠিকে গাড়ি এইমাত্র পেরোচ্ছে আমহার্স্ট স্ট্রিটে রামমোহন রায়ের বাগান বাড়ি। চারটে বাজতে এখনও কয়েক মিনিট বাকি।
গাড়ি ছেড়েছে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ি থেকে। অনেক দূরের পথ।
পোল পার হয়ে, শ্যামবাজার পার হয়ে গাড়ি আমহার্স্ট স্ট্রিটে পৌঁছেছে।
ঠাকুরের সঙ্গে রয়েছেন তিন ভক্ত, ভবনাথ, হাজরা আর মাস্টার (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত)।
একজন বললেন, বাদুড়বাগান এসে গেল বলে।
আর একজন ঠাকুরকে বললেন, দেখুন, দেখুন, রাজা রামমোহনের কত বড় বাগানবাড়ি।
শ্রীরামকৃষ্ণ বেশ বিরক্ত হলেন। বললেন, ওসব ভোগবিলাসের কথা ভালোলাগছে না গো।
তিনি ভাবাবিষ্ট হয়ে আছেন সাগরচৈতন্যে। সাগর তো অনন্ত।
তিনি অনন্তে ডুবে আছেন।
রামমোহনের বাগানবাড়ি দেখার কোনও সাধ নেই তাঁর।
শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মভূমি হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রাম।
আর বিদ্যাসাগরের জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রাম।
কামারপুকুর থেকে বীরসিংহ খুব দূরের পথ নয়। সেই কারণেই হয়তো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে খুব কাছের মানুষ মনে হয় শ্রীরামকৃষ্ণের।
শুধুই মনে মনে এই নৈকট্য বোধ।
ঠাকুরের মনে ভারি ইচ্ছে, বীরসিংহ গ্রামের সিংহটির সঙ্গে একবার অন্তত দেখা করার।
সেই সুযোগ এল, যখন মাস্টার বিদ্যাসাগরের স্কুলে মাস্টারি শুরু করলেন।
‘মাস্টার’ অর্থাৎ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের রচয়িতা শ্রীম।
পুরোনাম, মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। ঠাকুরের পরম ভক্ত।
ঠাকুরই মাস্টারকে জিগ্যেস করলেন, আমাকে বিদ্যাসাগরের কাছে একদিন নিয়ে যাবে? আহা, দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে থাকতে—থাকতে বিদ্যে আর দয়ার কথা কত শুনেছি। তিনি বিদ্যেরও সাগর, দয়ারও সাগর।
মহেন্দ্রগুপ্ত বিদ্যাসাগরকে বললেন, দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণ আপনার সঙ্গে একদিন দেখা করতে চান। ভারি ইচ্ছে তাঁর আপনার সঙ্গে আলাপ করার।
বিদ্যাসাগর গণ্যমান্য। মুখে যাই বলুন, বিদ্যের দেমাক তলায়—তলায় আছে বৈ কি! হেসে বললেন, তুমি তো জানো মাস্টার, আমি নাস্তিক মানুষ। ঈশ্বর সত্যিই আছেন কি না, সে—বিষয়ে আমার গভীর সন্দেহ। ভাবটি এমন, তিনি ভগবানে বিশ্বাস করলে ভগবান কৃতার্থ হবেন।
সত্যি কথা বলতে, ভগবানের ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহই নেই। সুতরাং সাধুসন্ন্যাসীদের কাছ থেকেও আমি দূরে থাকি।
মাস্টার বিদ্যাসাগরের কথা শুনে নীরব রইলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন তিনি মহেন্দ্রকে আঘাত করেছেন। জিগ্যেস করলেন, বলো তো মাস্টার, ইনি কীরকম পরমহংস? তিনি কি গেরুয়াপরা সন্ন্যাসী? প্রশ্নে ফুটিয়ে তুললেন তাচ্ছিল্য, বিদ্যার অহং এবং নাস্তিক—নাস্তিক ভাব।
মাস্টার এবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চোখে চোখ রেখে কিঞ্চিৎ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, আজ্ঞে না। তিনি এক অদ্ভুত পুরুষ। লালপেড়ে কাপড় পরেন। জামা পরেন। বার্নিশ—করা চটি জুতো পরেন।
আরও যদি জানতে চান তো বলি, রাসমণির কালীবাড়িতে একটি ঘরের ভেতর বাস করেন। সেই ঘরে তক্তপোশ পাতা আছে। তার ওপর বিছানা। মশারিও আছে। সেই বিছানায় তিনি শয়ন করেন। তিনি যে সন্ন্যাসী, তার কোনও বাহ্যিক চিহ্ন নেই। সাধারণত সন্ন্যাসী বলতে আপনি যা বোঝেন তিনি তা নন। তবে ঈশ্বর বই আর কিছু জানেন না। রাত্রিদিন তাঁরই চিন্তা করেন।
বিদ্যাসাগর মহেন্দ্রনাথের কথায় হেসে ফেললেন। বললেন, বেশ বেশ। তাহলে তাঁকে নিয়ে এসো একদিন। সামান্য শ্লেষ যেন বিদ্যাসাগরের কথায়।
আপনি কবে যাবেন? বিদ্যাসাগর আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে বললেন মহেন্দ্র।
শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের মধ্যে ডুব দিলেন। তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠল দৈব উদ্ভাস।
শ্রীরামকৃষ্ণ মধুর কণ্ঠে বললেন, এই শনিবার, সেদিন শ্রাবণের কৃষ্ণাষষ্ঠী। সাগরদর্শনের লগ্ন বিকেল চারটে।
বিদ্যাসাগরের বয়েস ঠিক বাষট্টি।
শ্রীরামকৃষ্ণ ষোলো বছরের ছোট।
তিনি ছেচল্লিশ।
বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর হৃদয়ে বড় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
বিকেল ঠিক চারটে।
শ্রীরামকৃষ্ণের ঠিকে গাড়ি এসে দাঁড়াল বিদ্যাসাগরের বাড়ির সামনে।
ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে আছেন।
মহেন্দ্র বললেন, এবার নামতে হবে। আমরা এসে গেছি।
ঠাকুর ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামলেন। মাস্টার পথ দেখিয়ে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছেন।
উঠোনে ফুলগাছ। ঠাকুর মুগ্ধ হয়ে বাড়িটি দেখছেন।
কী সুন্দর বাড়ি!
শান্তির নীড়। সমস্ত বাড়িটি যেন ধ্যানের মন্দির, মনে হল শ্রীরামকৃষ্ণের।
তিনি শুনেছেন ঈশ্বরচন্দ্র নাকি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না।
মৃদু হাসি ফুটে উঠল শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে।
চলতে চলতে হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। মহেন্দ্র জিগ্যেস করলেন, কী হল, থামলেন কেন?
ঠাকুর নিজের জামার বোতামে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
বালকের সারল্য তাঁর মুখে।
তিনি জিগ্যেস করলেন, মাস্টার, আমার জামার বোতামটা যে খোলা রয়েছে, এতে কোনও দোষ হবে না তো?
শ্রীরামকৃষ্ণের গায়ে একটি লংক্লথের জামা। পরনে লালপেড়ে কাপড়। কাপড়ের কোঁচাটি কাঁধে ফেলা। পায়ে বার্নিশ করা চটিজুতো।
মাস্টার বললেন, আপনি খোলাবোতাম নিয়ে ভাববেন না। আপনার বোতাম দেবার দরকার নেই। আপনার কিছুতে দোষ হবে না।
বালককে বুঝিয়ে বললে সে যেমন নিশ্চিন্ত হয়, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তেমনি নিশ্চিন্ত হলেন। তিনি চলতে শুরু করলেন মহেন্দ্রর পিছন পিছন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাড়িটি দোতলা। অধিকাংশ বাঙালি বাড়ির মতো নয়। এ—বাড়ি দেখলে ইংরেজের পছন্দ হবে।
তবে বাড়তি বিলাসিতার চিহ্নও কোথাও নেই। বাড়িটি দেখলেই মনে হয়, বাড়িটি যাঁর তিনি বিলাস বিরোধী, তাঁর আত্মপ্রত্যয় ও সংযম এতই বেশি যে তিনি নিজেকে কোনওভাবে জাহির করতে চান না।
তিনি পছন্দ করেন নিভৃতি।
উপভোগ করেন নির্জনতা।
তিনি কাজের জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা করে রাখতে চান।
তিনি একাধিকত্বপ্রিয়। এবং অহংকারীও বটে। জ্ঞানের অহংকার। খ্যাতিরও।
বিদ্যাসাগরের বাড়ির চারপাশে অনেকখানি খোলা জমি।
জমিটি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।
বাড়ির পশ্চিম দিকে সদর দরজা। বেশ বড় গেটওলা বাড়ি। দেখলেই বোঝা যায় বাড়ির মালিক ধনী না হয়েও সমাজের হোমরাচোমরাদের একজন।
পশ্চিমদিকের প্রাচীর আর বাড়ির মাঝখানে একটি ফুলের বাগান।
শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন সেই ফুলগুলির দিকে। বিদ্যাসাগর ফুল ভালোবাসেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝতে পারেন। মানুষটির ওপর যতই কঠিন হোক, ভেতরটা নরম।
মাস্টার বলেন, এই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে আসুন।
পশ্চিম দিকে নীচে একটা ঘর আছে। সেই ঘর থেকে ওপরে যাবার সিঁড়ি।
শ্রীরামকৃষ্ণ প্রথম ধাপটিতে পা রাখলেন।
মহেন্দ্র দেখলেন, তাঁর চোখ দুটি এক আশ্চর্য আলোয় ঝলমল করছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ জানেন, কী হতে চলেছে।
তাঁর তৃতীয় নেত্র দেখতে পাচ্ছে ভবিষ্যৎ।
দোতলায় থাকেন বিদ্যাসাগর।
সিঁড়ি দিয়ে উঠেই উত্তরে একটি কামরা।
তার পুব দিকে হলঘর।
হলঘরের দক্ষিণ—পুবে বিদ্যাসাগরের শোবার ঘর।
তাঁর দক্ষিণে আরও একটি কামরা। এই কামরাগুলি বহুমূল্য পুস্তকে পরিপূর্ণ।
দেওয়ালের কাছে সারি সারি অনেকগুলি পুস্তকাধার।
তাতে বাঁধানো বইগুলো কী সুন্দরভাবে সাজানো! একসঙ্গে এত বই!
বালকের মতো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
এত জেনেও মানুষটি ‘এক’—কে জানেনি!
‘এক’—কে জানাই তো সব জানা।
তাঁকে না জানলে আর সব জানাই তো বৃথা।
তিনি এগিয়ে চলেন বিদ্যাসাগরের ঘরের দিকে।
হলঘরটির পুব দিকে একেবারে শেষে একটি টেবিল ও চেয়ার।
বিদ্যাসাগর যখন কাজ করেন তখন এখানে তিনি পশ্চিমাস্য হয়ে বসেন।
টেবিলের চারধারে চেয়ার।
যাঁরা কাজের সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তাঁরা সেই চেয়ারে বসেন।
বিদ্যাসাগরের টেবিলে লেখাপড়ার অনেক সামগ্রী— কাগজ, কলম, দোয়াত, কালি, ব্লটিং—পেপার, হিসাবপত্রের বাঁধানো খাতা, দু—চারখানি বিদ্যাসাগর প্রণীত পাঠ্যপুস্তকও আছে।
এই কাজের ঘরের ঠিক দক্ষিণে, বিদ্যাসাগরের কাঠের চেয়ারটির ঠিক পাশেই বলা যায় তাঁর বিছানা। কাজের শেষে তাঁর বিশ্রাম ও নিদ্রার জায়গা।
বিদ্যাসাগরের টেবিলে অন্যান্য জিনিসের মধ্যে ছড়ানো আছে অনেক চিঠিপত্রও। চিঠিগুলির দিকে এবার একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক—
কোনও বিধবা লিখেছে, আমার অপগণ্ড শিশু অনাথ, দেখবার কেউ নেই, আপনাকে দেখতে হবে।
আর একজন লিখেছে, আপনি কারমাটায় চলে গিয়েছিলেন, তাই আমরা মাসোহারা ঠিক সময়ে পাইনি। বড় কষ্ট হচ্ছে।
এক গরিব ছাত্র লিখেছে, আপনার স্কুলে ফ্রি ভর্তি হয়েছি, কিন্তু আমার বই কেনবার ক্ষমতা নেই।
কেউ বা লিখেছে, আমার পরিবারবর্গ খেতে পাচ্ছে না, আমাকে একটা চাকরি করে দিতে হবে।
বিদ্যাসাগরের স্কুলের এক শিক্ষকের চিঠিও আছে— আমার ভগিনী বিধবা হয়েছে, তার সমস্ত ভার আমাকে নিতে হয়েছে। এ বেতনে আমার চলে না।
কেউ লিখছেন, অমুক তারিখে সালিসির দিন নির্ধারিত।
আপনি সেদিন এসে আমাদের বিবাদ মিটিয়ে দিন।
একটি ইংরেজি চিঠি এসেছে বিলেত থেকে। নির্ভুল, সুঠাম ইংরেজিতে পত্রদাতার বক্তব্য—আমি এই প্রবাসে বিপদগ্রস্ত, ঋণে আকণ্ঠ ডুবে আছি, উপবাসে কাটছে, আপনি দীনের বন্ধু, দয়ার সাগর, কিছু টাকা পাঠিয়ে বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করুন।
করুণাময় বিদ্যাসাগরের হৃদয় কাঁদে সকলের জন্য। কাউকে তিনি ‘না’ বলতে পারেন না।
সাহায্যপ্রার্থীর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারেন না কখনও। কিন্তু কোথায় যেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পিছনে তলায়—তলায় অদৃশ্য অক্ষরে মিশে থাকে একটি ঘোষণা— আমি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর!
শ্রীরামকৃষ্ণের মনে একটি প্রশ্ন—প্রথম দেখা হওয়ার সময় বিদ্যাসাগর দক্ষিণমুখী হয়ে বসবে তো?
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
উঠে এসেই প্রবেশ করলেন উত্তরের ঘরটিতে। ভক্তেরাও এল সঙ্গে।
ঠাকুর দেখলেন, বিদ্যাসাগর আজ দক্ষিণাস্য হয়েই বসে আছেন।
ঠাকুর একবার শুধু বললেন, জয় মা।
বিদ্যাসাগর ঘরের উত্তর কোণে দক্ষিণমুখী।
তাঁর সামনে চারকোনা লম্বা পালিশ করা টেবিল।
টেবিলের পুব দিকে একখানি বেঞ্চ।
দক্ষিণে ও পশ্চিমে কয়েকটি চেয়ার।
বিদ্যাসাগর কাজ করছেন না, তাই তিনি পশ্চিমাস্য নন।
তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য অপেক্ষা করছেন আর দক্ষিণাস্য হয়ে দু—একটি বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছেন।
ঠাকুর প্রবেশ করতেই বিদ্যাসাগর দাঁড়িয়ে উঠে তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন।
ঠাকুর একদৃষ্টে বিদ্যাসাগরের দিকে তাকিয়ে। তাঁরা যেন পূর্বপরিচিত। ঠাকুরের চোখে ফুটে উঠল সেই ভাবটি।
ঠাকুরের মুখে মধুর হাসি।
বিদ্যাসাগর চুপ করে দাঁড়িয়ে।
তাঁর পরনে থান কাপড়। পায়ে চটিজুতো। গায়ে একটি হাতকাটা ফ্লানেলের ফতুয়া। মাথার চারপাশ কামানো। তিনি একটু হাসলেন। দাঁতগুলি উজ্জ্বল।
সমস্তই বাঁধানো দাঁত। ঠাকুর লক্ষ করলেন সেই নকল দাঁত। এক ঝিলিক মজা চমকে উঠল তাঁর চোখে।
বিদ্যাসাগরের মাথাটি অস্বাভাবিক বড়। উন্নত ললাট।
বিদ্যাসাগর বেশ বেঁটে।
গলায় মোটা উপবীত, ফতুয়ার পাশ থেকে বেরিয়ে আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট। তিনি একইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ভাব সংবরণ করবার জন্যে মধ্যে মধ্যে বলছেন, জল খাব। দেখতে—দেখতে বাড়ির ছেলেরা ও আত্মীয় বন্ধুরা এসে দাঁড়ালেন। বিদ্যাসাগর ভাবলেন, তাঁর সামনে পরমহংস নার্ভাস। তাঁর অহংবোধে কে যেন মালিশ করল।
ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে বেঞ্চে বসে পড়লেন। আর সঙ্গে—সঙ্গে তাঁর শরীরে জ্বালা ধরল।
একটি সতেরো—আঠারো বছরের ছেলে সেই বেঞ্চিতে বসে আছে। বিদ্যাসাগরের কাছে পড়াশোনার সাহায্য প্রার্থনা করতে এসেছে ছেলেটি।
ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। ঋষির অন্তর্দৃষ্টি তাঁর। ছেলেটির অন্তরের ভাব তিনি বুঝে ফেলেছেন। তাই তাঁর শরীরে জ্বালা।
ঠাকুর ছেলেটির কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন। বললেন, মা, এ ছেলের বড় লোভ। সংসার ছাড়া কিছু বোঝে না। মা গো, তোমার অবিদ্যার সংসার। এ অবিদ্যার সন্তান।
যে—ব্যক্তি ব্রহ্মবিদ্যার জন্য ব্যাকুল নয়, শুধু চায় অর্থকরী বিদ্যা, ঠাকুর তাকেই বলছেন অবিদ্যার সংসারে অবিদ্যার সন্তাস। তাহলে বিদ্যাসাগর অন্তরে কী? তলায়—তলায় কেমন?
বিদ্যাসাগর ধাক্কা খেলেন। এক ধাক্কাতেই চিড় ধরল তাঁর প্রত্যয়ে।
তিনি নিজেও তো ব্রহ্মবিদ্যার কথা ভাবেন না কখনও।
বিদ্যাসাগর ব্যস্ত হয়ে একজনকে জল আনতে বললেন। ঈশ্বরচন্দ্র কি নিজেই নার্ভাস?
তারপর মহেন্দ্রকে জিগ্যেস করলেন, মাস্টার, কিছু খাবার আনালে ইনি খাবেন কি? ঈশ্বরচন্দ্রের কণ্ঠে কম্পন কেন? তাঁর ভিতরের মানুষটি কি ধরা পড়ে যাবে? তাকে আর লুকিয়ে রাখা যাবে না?
মহেন্দ্র বললেন, আজ্ঞে আনুন না।
বিদ্যাসাগর নিজেই ভিতরে গিয়ে কতকগুলি মিঠাই আনলেন। বললেন, এগুলি বর্ধমান থেকে এসেছে।
ঠাকুর কিছু খেলেন। হাজরা, ভবনাথও কিছু খেলেন। বিদ্যাসাগর মহেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো ঘরের ছেলে।
ঠাকুর মিষ্টিমুখ করছেন আর বালকের মতো হাসছেন।
দেখতে—দেখতে একঘর লোক হয়ে গেল। কেউ বসে। কেউ দাঁড়িয়ে।
ঠাকুর এতক্ষণ বিশেষ কথা বলেননি। এবার একঘর লোকের সামনে বিদ্যাসাগরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ সাগরে এসে মিশলুম। এতদিন খাল—বিল—হদ্দ—নদী দেখেছি। এইবার সাগর দেখছি।
ঠাকুরের এই প্রাণখোলা বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতায় সবাই হাসতে আরম্ভ করল।
বিদ্যাসাগর কম যান না। তিনি সহাস্যে বললেন, তাহলে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান। ঠাকুর এই স্মার্ট উত্তর বুঝবেন তো?
ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না গো। নোনা জল কেন? তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও। বিদ্যার সাগর। তুমি ক্ষীরসমুদ্র। ঘরের সকলে হেসে উঠলেন।
বিদ্যাসাগর দেখলেন ঠাকুরের সঙ্গে কথায় পারবেন না। শুধু বললেন, ক্ষীরসমুদ্র? তা বলতে পারেন বটে!
বিদ্যাসাগর চুপ।
কথা বলছেন শ্রীরামকৃষ্ণ! বিদ্যাসাগর শুনছেন!
মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করছেন আগ্রহী ছাত্রের মতো।
ঠাকুর একেবারেই লেখাপড়া জানেন না। নিজের নামটিও সই করতে পারেন না তেমন যুৎসই ভাবে। তবু ঠাকুর বলছেন। আর শুনছেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর! বিদ্যাসাগরের মনে হচ্ছে, বেদান্ত উচ্চচারিত হচ্ছে ঠাকুরের কণ্ঠে। ভিতরের বিদ্যাসাগর কি ধরা পড়ে যাচ্ছেন?
কী সহজ সরল শ্রীরামকৃষ্ণের মুখের ভাষা। শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, তোমার কর্ম সাত্ত্বিক কর্ম। সত্ত্বগুণ থেকে দয়া হয়। দয়ার জন্য যে—কর্ম করা যায়, সে রাজসিক কর্ম বটে, কিন্তু এ রজোগুণ সত্যের রজোগুণ, এতে দোষ নেই। শুকদেবাদি লোকশিক্ষার জন্য দয়া রেখেছিলেন। ঈশ্বর—বিষয় শিক্ষা দেবার জন্যে। তুমি বিদ্যাদান, অন্নদান করছ, এও ভালো। নিষ্কাম কর্ম করতে পারলেই এতে ভগবান লাভ হয়। কেউ কেউ করে নামের জন্যে, কেউ করে পুণ্যের জন্যে। তাদের কর্ম নিষ্কাম নয়। আর সিদ্ধ তো তুমি আছোই।
বিদ্যাসাগর শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ কথাটার অর্থ ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না। জিগ্যেস করলেন, আমি সিদ্ধ? কেমন করে?
শ্রীরামকৃষ্ণ ভারি মিঠে করে উত্তর দিলেন, আলু পটল সিদ্ধ হলে তো নরম হয়। তা তুমি তো খুব নরম। তোমার অত দয়া!
সকলে হেসে উঠলেন।
বিদ্যাসাগর রসিক মানুষ। কিন্তু হাসতে পারলেন না। বেশ চালাক—চালাক উত্তর দিয়ে মুহূর্তে বললেন, কলাই বাটা সিদ্ধ কিন্তু শক্তই হয়।
আবার সকলের হাসি।
এবার ঠাকুর কী বলবেন?
ঠাকুর বললেন, তুমি তা নও গো। ‘শুধু’ পণ্ডিতগুলো দরকচাপড়া। তুমি তো ‘শুধু’ পণ্ডিত নও। তুমি বিদ্যার সমুদ্র। ‘শুধু’ পণ্ডিতগুলোর না এদিক, না ওদিক।
শকুনি খুব উঁচুতে ওঠে। কিন্তু নজর ভাগাড়ে। যারা ‘শুধু’ পণ্ডিত, শুনতেই পণ্ডিত। কিন্তু তাদের কামিনীকাঞ্চনে আসক্তি—শকুনের মতো পচামড়া খুঁজছে।
আসক্তি অবিদ্যার সংসারে! দয়া, ভক্তি, বৈরাগ্য, বিদ্যার ঐশ্বর্য।
বিদ্যাসাগর নীরব। তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন এক আনন্দময় পুরুষের দিকে। পান করছেন তাঁর কথামৃত। এমন অবস্থায় আগে কখনও পড়েননি বিদ্যাসাগর। হালে পানি পাচ্ছেন না স্বয়ং তিনি!
বিদ্যাসাগর মহাপণ্ডিত।
তিনি ষড়দর্শন পাঠ করেছেন।
জানতে চেয়েছেন ঈশ্বরকে। আর এইটুকু বুঝতে পেরেছেন যে, ঈশ্বরের বিষয়ে কিছু জানা যায় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ তাকালেন বিদ্যাসাগরের দিকে। যেন বুঝতে পারলেন বিদ্যাসাগরের মনের কথা। বললেন, ব্রহ্ম বিদ্যা ও অবিদ্যার পার। তিনি মায়াতীত।
মহাপণ্ডিত বিদ্যাসাগর শুনছেন মুগ্ধ বিস্ময়ে। বলে চলেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ—
এই জগতে বিদ্যামায়া—অবিদ্যামায়া, দুই আছে। জ্ঞান—ভক্তি আছে আবার কামিনীকাঞ্চনও আছে। সৎ—ও আছে। আবার অসৎ—ও আছে। ভালো আছে। আবার মন্দও আছে। কিন্তু ব্রহ্ম নির্লিপ্ত। ভালোমন্দ জীবের পক্ষে। সৎ—অসৎ জীবের পক্ষে। ব্রহ্মের ওতে কিছু হয় না।
স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বোধ ও বুদ্ধি ঠোক্কর খেল। তিনি নিজের ‘আসল আমি’—কে সামলাবেন কী করে? নম্র কণ্ঠে বললেন, একটু ব্যাখ্যা করে, আরও সহজ করে বুঝিয়ে দিন।
শ্রীরামকৃষ্ণ সহজ সরল হাসি হেসে বললেন, প্রদীপ যেমন নির্লিপ্ত, ব্রহ্মও সেই রকম। প্রদীপের সামনে কেউ ভাগবত পড়ছে, আর কেউ বা দলিল জাল করছে। প্রদীপের তাতে কিছু যায় আসে না। কোনও কাজটির সঙ্গেই প্রদীপ যুক্ত হচ্ছে না। সে নির্লিপ্তভাবে শুধু জ্বলছে।
যদি বলো দুঃখ, পাপ, অশান্তি এসকল তবে কী? তার উত্তর এই যে ওসব জীবের পক্ষে। ব্রহ্ম নির্লিপ্ত। যেমন ধরো, সাপের মধ্যে বিষ আছে। অন্যকে কামড়ালে মরে যায়। সাপের কিন্তু কিছু হয় না।
বিদ্যাসাগরের মুখে রা নেই। তিনি ক্রমে বুঝতে পারছেন, এক নিরক্ষর ব্রাহ্মণের মুখে বেদান্ত কী সহজ সরল ভাষায় উচ্চচারিত হচ্ছে!
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, ব্রহ্ম যে কী বা কেমন, মুখে বলা যায় না।
সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে।
বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, ষড়দর্শন, সব এঁটো।
থামলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাকালেন বিদ্যাসাগরের মুখের দিকে।
বিস্মিত বিদ্যাসাগর প্রশ্ন করলেন, এঁটো কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে উত্তর দিলেন, মুখে পড়া হয়েছে, মুখে উচ্চচারণ হয়েছে, তাই এঁটো হয়ে গেছে।
কিন্তু একটা জিনিস কেবল উচ্ছিষ্ট হয়নি গো বিদ্যেসাগর!
সেই জিনিসটি ব্রহ্ম।
ব্রহ্ম যে কী, আজ পর্যন্ত কেউ মুখে বলতে পারেনি।
বিদ্যাসাগরের বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠল।
আবেগে কাঁপছে তাঁর শরীর।
শ্রীরামকৃষ্ণ বয়েসে অনেক ছোট, তবু বিদ্যাসাগরের ইচ্ছে হল, তাঁর কাছে নতজানু হওয়ার।
তিনি শুধু কম্পিত কণ্ঠে বললেন, আজ একটি নতুন কথা শিখলাম।
ব্রহ্ম উচ্ছিষ্ট হননি!
ঘরে তখন অনেক মানুষের ভিড় হয়ে গেছে।
সবাই শুনছে ঠাকুরের কথা।
কী সহজ, কী প্রাণস্পর্শী, কী গভীর!
ঠাকুর কী অনায়াসে আড়াল সরিয়ে দিচ্ছেন!
ফুটে উঠছে নতুন আলো।
জাগ্রত হচ্ছে নব চেতনা।
উদঘাটিত হচ্ছে সত্যের মুখ।
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, এবার একটা গপ্প বলছি, শোনো।
বিদ্যাসাগর ভয় পেলেন। এবার কোন সত্য উদ্ঘাটিত হবে? তাঁর বিষয়ে কোনও অপ্রিয় সত্য নয় তো? নিজেকে কেন এমন দুর্বল মনে হচ্ছে তাঁর?
এক বাপের দুটি ছেলে। শ্রীরামকৃষ্ণ শুরু করলেন গল্প।
ব্রহ্মবিদ্যা শেখবার জন্যে ছেলে দুটোকে বাপ আচার্যের হাতে দিলেন।
কয়েক বছর পরে তারা গুরুগৃহ থেকে ফিরে এল। এসে বাপকে প্রণাম করলে।
বাপের এবার ইচ্ছে হল, এদের ব্রহ্মজ্ঞান কেমন হয়েছে একটু বাজিয়ে দেখবার।
বড় ছেলেকে জিগ্যেস করলেন, বাপ! তুমি তো সব পড়েছ। ব্রহ্ম কী রূপ বলো দেখি।
বড় ছেলেটি বেদ থেকে নানা শ্লোক বলে বলে ব্রহ্মের স্বরূপ বোঝাতে লাগল।
বাপ শুনলেন। কোনও কথা বললেন না। বড় ছেলে বাপের মনের ভাব বুঝতে পারল না।
এবার বাপ ছোট ছেলেকে বললেন, তুমি বলো দেখি ব্রহ্মের কী রূপ।
ছোট ছেলের মুখে কোনও কথা নেই।
সে হেঁট মুখে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল।
বাপ প্রসন্ন হয়ে ছোট ছেলেকে বললেন, বাপু, তুমি একটু বুঝেছ। ব্রহ্ম যে কী তা মুখে বলা যায় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুক্ষণ থামলেন। তিনি জানেন, সাধারণ মানুষকে তাঁর কথার মর্ম বুঝতে একটু সময় দিতে হয়।
তারপর তাঁর গল্পটির সূত্র ধরে বললেন, মানুষ মনে করে আমরা তাঁকে জেনে ফেলেছি।
কিন্তু সত্যি কি জানা যায়?
জানা গেলেও কতটুকুই বা জানা যায় তাঁকে? বিদ্যাসাগর নিবিষ্ট হয়ে শুনছেন। আর অপলক তাকিয়ে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে। আর কারও কথা শুনে কখনও এমন ঘোর লাগেনি তাঁর।
শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের মুখের দিকে তাকিয়েই বললেন, আর একটা গপ্প বলছি, শোনো। একটা পিঁপড়ে চিনির পাহাড়ে গিছল।
এক দানা খেয়ে পেট ভরে গেল। আর এক দানা মুখে করে সে বাসার পথে চলেছে।
যাবার সময় ভাবল, এবার এসে সব পাহাড়টা নিয়ে যাব।
ক্ষুদ্র জীবেরা এই সব মনে করে।
জানে না ব্রহ্ম বাক্যমনের অতীত।
যে যতই বড় হোক না কেন, তাঁকে জানা যায় না।
বিচলিত বোধ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। শ্রীরামকৃষ্ণ কি তাঁর বিদ্যার প্রতি সংশয় প্রকাশ করলেন? তাঁকে কোনওভাবে বিদ্রূপ করলেন এত মানুষের সামনে?
শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে বললেন, শুকদেবাদি না হয় ডেও পিঁপড়ে।
চিনির আট—ন’টা দানা না হয় মুখে করেছে। তার বেশি নয়। অসহায় ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, তাঁকে ডেও পিঁপড়ের সঙ্গে তুলনা করা হল! তিনি সব পাণ্ডিত্য আর খ্যাতি নিয়েও তার বেশি কিছু নন!
ঘরে অত মানুষ। তবু পিন পড়লে শব্দ পাওয়া যাবে।
রোজ কত পণ্ডিত মানুষের আসা—যাওয়া বিদ্যাসাগরের বাড়িতে।
কিন্তু এমন জীবন্ত বেদান্ত কখনও দেখিনি। শ্রীরামকৃষ্ণের কথা শুনছেন আর ভাবছেন বিদ্যাসাগর।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলতে লাগলেন, তবে বেদে পুরাণে যা বলেছে, সে কী রকম বলা জানো?
বিদ্যাসাগর বুঝলেন, ঘরের মধ্যে আর কেউ না বুঝুক তিনি অন্তত ধারণা করতে পারলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠে নতুনভাবে ব্যাখাত হতে চলেছে, বেদ ও পুরাণ। তিনি উদগ্রীব হয়ে শুনছেন।
ঠাকুর বললেন, একজন সাগর দেখে এলে কেউ যদি জিগ্যেস করে, কেমন দেখলে, সে লোক মুখ হাঁ করে বলে,—ও! কী দেখলুম! কী হিল্লোল, কল্লোল। ব্রহ্মের কথাও সেই রকম। বেদে আছে তিনি আনন্দস্বরূপ। সচিচদানন্দ।
বিস্মিত বিদ্যাসাগর। শ্রীরামকৃষ্ণ বেদ পড়েছেন! তিনি তো নিরক্ষর।
বিদ্যাসাগর কী ভাবছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ যেন বুঝতে পারলেন।
বললেন, শুকদেবাদি এক ব্রহ্মসাগর—তটে দাঁড়িয়ে দর্শন— স্পর্শন করেছিলেন মাত্র।
তাঁরা কিন্তু ব্রহ্মসাগরে নামেননি।
এ—সাগরে নামলে আর ফেরবার যো নেই গো।
ঠাকুরের কথায় চমকে উঠলেন বিদ্যাসাগর। এ তো একেবারে নতুন কথা।
অথচ কী অবলীলায় কথাটি বললেন পরমহংস।
বিদ্যাসাগর প্রশ্ন করলেন, তাহলে ব্রহ্মজ্ঞান হওয়ার উপায়?
ঠাকুর উত্তর দিলেন, সমাধিস্থ হলে ব্রহ্মজ্ঞান হয়, ব্রহ্মদর্শন হয়।
সেই অবস্থায় বিচার একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ চুপ হয়ে যায়।
ব্রহ্ম কী বস্তু, মুখে বলবার শক্তি থাকে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ আর একটা গল্প বললেন—নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিছল।
কত গভীর জল সেই খবরটা সে দিতে চেয়েছিল।
কিন্তু খবর দেওয়া আর হল না।
যেই নামল জলে, অমনি গেল গলে।
কে আর খবর দেবে?
একজন প্রশ্ন করলেন, সমাধিস্থ ব্যক্তি, যাঁর ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে, তিনি কি আর কথা কন না?
বিদ্যাসাগরকে চমকে দিল ঠাকুরের বিদ্যুতের মতো উত্তর—
শঙ্করাচার্য লোকশিক্ষার জন্য বিদ্যার ‘আমি’ রেখেছিলেন।
বিদ্যাসাগর এই কথার গভীর অর্থটুকু বুঝতে পারলেন। আপাত অশিক্ষিত একটি মানুষের জ্ঞানের ব্যাপ্তি ও গভীরতা দেখে তিনি স্তম্ভিত। শ্রীরামকৃষ্ণ শঙ্করাচার্য পড়েছেন? কোথাও তো ফাঁকি নেই এই মানুষটির লেখাপড়ায়!
শ্রীরামকৃষ্ণ এবার আরও সহজ করে তাঁর বক্তব্যের সারাৎসার তুলে ধরলেন—
ব্রহ্মদর্শন হলে মানুষ চুপ হয়ে যায়। যতক্ষণ দর্শন না হয়, ততক্ষণই বিচার।
ঘি যতক্ষণ কাঁচা থাকে ততক্ষণই কলকলানি। পাকা ঘি—র কোনও শব্দ নেই।
কিন্তু যখন পাকা ঘিয়ে আবার কাঁচা লুচি পড়ে, তখন আর একবার ছ্যাঁক কলকল করে।
যখন কাঁচা লুচিকে পাকা করে ফেলে, তখন আবার চুপ হয়ে যায়।
তেমনি সমাধিস্থ পুরুষ—লোকশিক্ষা দেবার জন্য আবার নেমে আসে, আবার কথা কয়।
বিদ্যাসাগরের চোখে একই সঙ্গে ফুটে ওঠে মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধা।
তাঁর মন বলে ওঠে, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, সেই পুরুষ তো তুমি নিজে। সমাধিস্থ হয়েও লোকশিক্ষার জন্যে নেমে এসেছ, কথা বলছ।
শ্রীরামকৃষ্ণ এবার ব্রহ্মজ্ঞানের স্বরূপ অন্যভাবে ফুটিয়ে তোলেন—
যতক্ষণ মৌমাছি ফুলে না বসে, ততক্ষণ ভনভন করে। ফুলে বসে মধুপান করতে আরম্ভ করলে চুপ হয়ে যায়।
মধুপান করে মাতাল হবার পর আবার কখনও—কখনও গুনগুন করে।
পুকুরে কলসিতে জল ভরার সময় ভক ভক শব্দ হয়। পূর্ণ হয়ে গেলে আর শব্দ নেই। তবে আর এক কলসিতে যদি ঢালাঢালি হয়, তাহলে আবার শব্দ হয়।
একজন হঠাৎ বললেন, ঋষিদের কি ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছিল?
শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, হয়েছিল। বিষয়বুদ্ধির লেশমাত্র থাকলে এই ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। ঋষিরা দেখা—শোনা—ছোঁয়া এসবের বিষয় থেকে মনকে আলাদা রাখত। সমস্ত দিন ধ্যান করে কাটাত। তবে ব্রহ্মকে অন্তরে বোধ করত।
এবার সরাসরি বিদ্যাসাগরের দিকে তাকালেন ঠাকুর। বললেন, কলিতে অন্নগত প্রাণ। দেহবুদ্ধি যায় না। যারা বিষয় ত্যাগ করতে পারে না, তাদের ‘আমি’ কোনওভাবে যায় না।
তাঁদের বরং ‘আমি ব্রহ্ম’ না বলে বলা উচিত আমি ভক্ত, আমি দাস।
এই অভিমান ভালো।
ভক্তিপথে থাকলেও তাঁকে পাওয়া যায়।
বিদ্যাসাগরকে যেন সরাসরি বলছেন ঠাকুর—
জ্ঞানীর পথও পথ। আবার জ্ঞান—ভক্তির পথও পথ। আবার ভক্তির পথও পথ।
জ্ঞানযোগও সত্য। ভক্তির পথও সত্য। সব পথ দিয়েই তাঁর কাছে যাওয় যায়।
কিন্তু যতক্ষণ তিনি ‘আমি’ রেখেছেন আমাদের মধ্যে, ততক্ষণ ভক্তিপথই সোজা।
শ্রীরামকৃষ্ণ এবার যেন শুধু বিদ্যাসাগরকেই দেখছেন। তিনি এই মহাপণ্ডিতকে বললেন, বিজ্ঞানী কী বলে? বিজ্ঞানী বলে, যিনি ব্রহ্ম তিনিই ভগবান।
অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছি।
ব্রহ্ম নির্গুণ। তিনি গুণাতীত।
ভগবান ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ।
এই জীবজগৎ, মন বুদ্ধি, বৈরাগ্য, জ্ঞান, এসব তাঁর ঐশ্বর্য।
দেখো না, এই জগৎ কী চমৎকার। কত রকম জিনিস, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র। কত রকম জীব। বড়, ছোট, ভালোমন্দ। কারু বেশি শক্তি, কারু কম শক্তি।
ব্রহ্মই ভগবান হয়েছেন।
যিনি নিরাকার তিনিই সাকার।
যিনি নির্গুণ তিনিই ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ।
বিদ্যাসাগর হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, তিনিই কি কাউকে বেশি শক্তি, কাউকে কম শক্তি দিয়েছেন?
উত্তর দিলেন পরমহংস—
তিনি বিভুরূপে সর্বভূতে আছেন। বিভু মানেই তো পরমেশ্বর। আবার বিভু মানে সর্বব্যাপী।
পিঁপড়ের মধ্যেও তিনি আছেন। আবার বিরাট পাহাড়ও তাঁরই প্রকাশ। সর্বত্র তিনি।
কিন্তু শক্তির তারতম্য তো আছেই।
ঠাকুর এবার বিদ্যাসাগরকেই বললেন—এই যেমন তুমি। তোমাকেই বা সবাই মানে কেন?
তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো?
তোমাকে মানে তার কারণ তোমার দয়া, তোমার বিদ্যে আছে। অন্যের চেয়ে অনেক বেশি।
তুমি একথা মানো কি না?
বিদ্যাসাগর লজ্জা পেলেন। তাকে যে কেউ বলতে পারে এমন সহজভাবে, তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো, একথা ভাবতে পারেননি তিনি। আর সেই মানুষটি আপাত অশিক্ষিত। এবং বয়েসে তাঁর চেয়ে অনেক ছোট!
শ্রীরামকৃষ্ণ এবার বিদ্যাসাগরকে বললেন—এক ঘর লোকের সামনে বিদ্যাসাগরকে একথা বলার সাহস দেখালেন তিনি,—ঠাকুর বললেন, শুধু পাণ্ডিত্যে কিছু হয় না। মনে রেখো, তাঁকে জানবার জন্যেই বই পড়া।
তাঁকে জানাই একমাত্র জানা। তাঁকে জানাই সব জানা। আর সব বিদ্যা আসলে অবিদ্যা।
এবার প্রশ্ন করলেন বিদ্যাসাগরকে, গীতার অর্থ কী?
কী বলবেন বিদ্যাসাগর? গীতার অর্থ এককথায় বলা যায়?
চুপ করে থাকলেন বিদ্যাসাগর।
বললেন শ্রীরামকৃষ্ণ, গীতার অর্থ দশবার ‘গীতা’ বললে যা হয়, তাই। দশবার ‘গীতা’ বলতে গেলে ‘ত্যাগী’, ‘ত্যাগী’ হয়ে যায়।
গীতার শিক্ষা হল, হে জীব, সব ত্যাগ করে ভগবানকে লাভ করার চেষ্টা করো। সাধুই হও আর সংসারী হও, মন থেকে সব আসক্তি ত্যাগ করতে হবে।
এবার বিদ্যাসাগরের দিকে তাকালেন শ্রীরামকৃষ্ণ। ঘরে যেন আর কেউ নেই। বললেন, অনেক পড়লেই কিছু হয় না গো। অন্তরের কথাটি বুঝতে হবে। শুধু পাণ্ডিত্য নয়। ভক্তি চাই। তাঁকে ভালোবাসতে হবে।
তোমাকে একটা গপ্প বলছি। গপ্পটা বুঝতে পারলে সব হবে।
চৈতন্যদেব তখন দক্ষিণে তীর্থভ্রমণ করছিলেন।
দেখলেন একজন গীতা পড়ছে।
আর একজন একটু দূরে বসে শুনছে আর কাঁদছে।
কেঁদে চোখ ভেসে যাচ্ছে।
চৈতন্যদেব জিগ্যেস করলেন, তুমি এসব বুঝতে পারছ?
সে বললে, ঠাকুর, আমি এসব শ্লোক কিছুই বুঝতে পারছি না।
চৈতন্যদেব জিগ্যেস করলেন, তবে কাঁদছ কেন?
ভক্তটি তখন বললে, আমি দেখছি অর্জুনের রথ। আর আমার সামনে কৃষ্ণ আর অর্জুন কথা কচ্চেচন। তাই দেখে আমি কাঁদছি।
বিদ্যাসাগরের বুকের শিরায় টান ধরল। তাঁর চোখ ভরে এল জলে।
মন ভরে গেল গভীর কৃতজ্ঞতায়। নতুন চেতনায় উত্তীর্ণ হলেন তিনি।
বিদ্যাসাগরকে বলতে লাগলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। মনে মনে বিদ্যাসাগর নতজানু, করজোড়। শুনছেন তিনি। নিষ্কম্প শিখার মতো তাঁর মনোযোগ।
ঠাকুর বলতে লাগলেন—
তাঁকে কি শুকনো পাণ্ডিত্য দিয়ে বিচার করে জানা যায় গো?
তাঁর দাস হয়ে তাঁকে ডাকো। মনে রেখো, ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই দুটি অজ্ঞান। আমার বাড়ি, আমার টাকা, আমার বিদ্যা, আমার এইসব ঐশ্বর্য, এই যে ভাবো, এটি অজ্ঞান থেকে হয়।
আর যদি ভাবো, হে ঈশ্বর, তুমিই কর্তা, এসব জিনিস তোমার, আমার টাকাকড়ি, আমার বিদ্যা, আমার ঐশ্বর্য, আমার পরিবার, সব কিছুই তোমার, আমার বলতে কিছু নেই,—এই ভাব জ্ঞান থেকে হয়।
বিদ্যাসাগর, তোমার কোন ভাব গো? হঠাৎ জানতে চাইলেন ঠাকুর।
বিদ্যাসাগর কিছুটা অপ্রস্তুত। খুব মৃদু স্বরে বললেন, আপনাকে সেকথা একলা একদিন বলব।
ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে এবার তাঁর অন্তরকথা, তাঁর নিজস্ব ভাবটি বলার জন্য গান ধরলেন—
কে জানে কালী কেমন?
ষড়দর্শনে না পায় দরশন।
মুলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন।
কালী পদ্মবনে হংস সনে, হংসী রূপে করে রমণ।।
আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন।
তিনি ঘটে ঘটে বিরাজ করেন ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।।
মায়ের উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা জান কেমন।
মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন।।
প্রসাদ ভাসে লোকে হাসে, সন্তরণে সিন্ধু তরণ।
আমার মন বুঝেছে প্রাণ বুঝে না ধরবে শশী হয়ে বামন।।
গান শেষ করে শুধু একটি কথা বললেন শ্রীরামকৃষ্ণ, ষড়দর্শনে না পায় দরশন, পাণ্ডিত্যে তাঁকে পাওয়া যায় না গো।
এরপর ঠাকুর কিছুক্ষণ সমাধিস্থ।
চেতনায় ফিরে এসে জিগ্যেস করলেন, ক’টা বাজে গো?
বিদ্যাসাগর বললেন, রাত ন’টা।
এবার যে উঠতে হবে। ফিরতে হবে সেই দক্ষিণেশ্বরে। শ্রীরামকৃষ্ণকে বিদায় দিতে মন চাইছে না বিদ্যাসাগরের। কেন তাঁর এমন হল?
ঠাকুর লাবণ্যময় কণ্ঠে বিদ্যাসাগরকে বললেন, একবার বাগান দেখতে যেও। রাসমণির বাগান। ভারি চমৎকার জায়গা। বিদ্যাসাগর বললেন, যাব বই কী। আপনি এলেন আর আমি যাব না?
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমার কাছে! ছি! ছি!
বিদ্যাসাগর—সে কী! এমন কথা বললেন কেন? আমায় বুঝিয়ে দিন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—আমরা জেলেডিঙ্গি। খালবিল আবার বড় নদীতেও যেতে পারি। কিন্তু তুমি তো জাহাজ গো। কী জানি যেতে গিয়ে চড়ায় পাছে লেগে যায়।
বিদ্যাসাগর খোঁচাটা হজম করলেন। কোনও উত্তর জানা নেই তাঁর। তিনি ধরা পড়ে গেছেন!
শ্রীরামকৃষ্ণই এগিয়ে এলেন বিদ্যাসাগরকে উদ্ধার করতে।
বললেন, তবে এসময়ে জাহাজও যেতে পারে।
বিদ্যাসাগর ইঙ্গিতটি ধরতে পারলেন। হেসে বললেন, হ্যাঁ, এটা বর্ষাকাল বটে।
মহেন্দ্র গুপ্ত টিপ্পুনি কাটলেন, এ তো নবানুরাগের বর্ষা।
নবানুরাগের সময় মান—অপমান বোধ থাকে না বটে!
শ্রীরামকৃষ্ণ ইতিমধ্যে উঠে পড়েছেন।
তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। একজন ভক্তের হাত ধরে আছেন।
বিদ্যাসাগর আগে আগে চলেছেন। বাতি হাতে পথ দেখাচ্ছেন তিনি।
শ্রাবণ কৃষ্ণাষষ্ঠী। এখনও চাঁদ ওঠেনি। দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। বাতাস ভিজে ভিজে মিঠে। বাতাসে ভেজা ঘাস—পাতা—মাটির সুবাস।
তমসাবৃত উদ্যানভূমির মধ্যে দিয়ে চলেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
বাতির ক্ষীণালোক বহন করে ফটকের সামনে এলেন বিদ্যাসাগর। শ্রীরামকৃষ্ণ ফটকে পৌঁছোতেই সামনে এসে দাঁড়াল এক গৌরবর্ণ শ্মশ্রুধারী, বাঙালি পোশাক—পরা যুবক। যুবক শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করল।
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, বলরাম! তুমি এখানে এত রাতে?
বলরাম—আমি অনেকক্ষণ এসেছি। এখানেই দাঁড়িয়েছিলাম।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ভেতরে যাওনি কেন?
বলরাম—আজ্ঞে, সকলে আপনার কথাবার্তা শুনছেন, সেখানে গিয়ে বিরক্ত করিনি।
শ্রীরামকৃষ্ণ এবার তাঁর ভাড়াকরা ঘোড়ার গাড়িতে উঠে পড়লেন।
বিদ্যাসাগর প্রায় চুপিচুপি মহেন্দ্রকে জিগ্যেস করলেন, ভাড়া কি দেব?
মহেন্দ্র বললেন, আজ্ঞে না, ও হয়ে গেছে।
বিদ্যাসাগর ঘোড়ার গাড়ির দরজায় এগিয়ে গেলেন।
তাঁর হাতে বাতিটি ধরা। বাতির মৃদু আলোয় ঠাকুরের মুখটি দেখলেন।
তার সমস্ত অন্তর লুটিয়ে পড়ল শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রীচরণে এক দীর্ঘায়িত প্রণামে।
শ্রীরামকৃষ্ণের গাড়ি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল বিদ্যাসাগরের দৃষ্টি থেকে।
তিনি একা ঠাকুরের প্রস্থানের পথের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন।
নাস্তিক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মনে হল, ভগবান এসেছিলেন, এক ঝলক দেখা দিয়ে চলে গেলেন।
তাঁর আশীর্বাদ হয়ে যেন স্বর্গ থেকে নেমে এল ঝিরঝিরে বৃষ্টি।
বৃষ্টির জলে নিভে গেল বিদ্যাসাগরের হাতের বাতিটি। অন্ধকারে একা বিদ্যাসাগর।
রামকৃষ্ণধারায় কতদিন পরে এমনভাবে প্রাণ জুড়াচ্ছে তাঁর! তিনি কিন্তু প্রবল নাস্তিক। সে তো ওপরের ব্যাপার। তলায়—তলায় তিনি ঠিক কী কেমন? জানেন কি নিজেও? নাস্তিকতাকে আর ভড়ং করে ধরে রাখতে পারবেন কি?