অধ্যায় ৫৪ – মিশরের অ্যাসিরীয়রা
৬৮১ থেকে ৬৫৩ সালের মধ্যে বর্বরদের হাতে ফ্রিজিয়ার পতন হয়, অ্যাসিরীয়রা ব্যাবিলনের পুনর্নির্মাণ করে এবং মিশর তাদের হাতছাড়া হয়।
নাবু’র মন্দিরে সেন্নাশেরিব মারা যাওয়ার পর অ্যাসিরীয়া গভীর দুর্যোগে পড়ে যায়।
বাইবেলের বুক অব ইজাইয়াহ-এর মাঝে সংরক্ষিত বর্ণনা মতে, সেন্নাশেরিবের হত্যাকারী দুই আততায়ী ‘আরারাতের ভূখণ্ডে পালিয়ে যান’। এর অর্থ খুব সম্ভবত এটাই যে, তারা উত্তরাভিমুখে পালিয়ে যান, যেখানে উরারতু’র পর্বতময় অঞ্চল অবস্থিত ছিল। প্রথম রুসাসের আত্মহত্যার পর এই রাজত্ব ধীরে ধীরে নিজেদের ফিরে পাচ্ছিল। নতুন রাজা দ্বিতীয় রুসাস (প্রথম জনের নাতি) তার সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি অ্যাসিরীয়দের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজার হত্যাকারীদের আশ্রয় দিলেন।
ইতোমধ্যে সেন্নাশেরিবের বাকি ছেলেদের মধ্যে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে তীব্র যুদ্ধ দেখা দিল। অবশেষে জয়ী হলেন সবচেয়ে ছোটছেলে এসারহাদোন। তিনি একটি প্রিজমের উপর (পাথরের তৈরি পিলার, যার ৬ থেকে ১০টি পাশ ছিল) লেখা তার বার্তা ছিল এরকম :
ভাইদের মধ্যে আমি সবার চেয়ে ছোট ছিলাম। কিন্তু আশুর ও শমেশ, বেল ও নাবু’র আদেশ মতে আমার বাবা আমাকে আমার ভাইদের মাঝে নির্বাসন দেন।
তিনি শমেশকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এটাই কি আমার উত্তরাধিকারী?
দেবতারা উত্তর দিলেন, ‘তিনি আপনার দ্বিতীয় সত্তা’।
একথা শুনে আমার ভাইদের মাথা পাগল হয়ে গেল।
তারা দেবতাদের অবজ্ঞা করে তরবারি উঁচু করলেন, এই নিনেভেহ’র মধ্যখানে।
কিন্তু আশুর, শমেশ, বেল, নাবু, ইশতার—সকল দেবতা এসব দুষ্কৃতিকারীর এহেন কর্মকাণ্ডে ক্রোধ দেখালেন এবং তাদের শক্তিমত্তা, দুর্বলতায় রূপান্তরিত হল। সবাই আমার কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেন।
.
নিঃসন্দেহে এসারহাদোন রাজমুকুট জিতে নিলেন। তবে তার বৃদ্ধ পিতার হত্যাকাণ্ডের আগেই তাকে উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার গল্পটায় সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বরং মনে হয়, তার সিংহাসনে আরোহণকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই এ গল্প উদ্ভাবন করা হয়েছে।
সিংহাসনে বসার পর এসারহাদোন টের পেলেন, তার সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ক্ষয় দেখা দিয়েছে। সরকারি চিঠি থেকে জানা যায়, প্রায় অ্যাসিরীয় প্রদেশগুলোতে অবস্থিত ১৫-১৬টি গুরুত্বপূর্ণ শহর দীর্ঘদিন ধরে নজরানা পাঠাচ্ছে না। সেন্নাশেরিব তাদের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ের কোনো চেষ্টাই করেননি। এছাড়াও, সেন্নাশেরিবের মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ব্যাবিলনের ধ্বংসস্তূপকে ঘিরে চালদিয়ান বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে। বলাই বাহুল্য, এর নেতৃত্বে ছিলেন আমাদের প্রিয় মেরোদাক-বালাদানের ছেলে। তার নাম ছিল নাবু-জেরকেত্তি-লিশার এবং তিনি উপসাগরের মাথায় বসে কয়েক বছর ধরে বিট-ইয়াকিন শাসন করছিলেন। তিনি সকল গোত্র থেকে সেনা সংগ্রহ করলেন এবং পুরনো ব্যাবিলন সাম্রাজ্য দখলের ইচ্ছা নিয়ে প্রথম শহর হিসেবে উর দখল করতে এলেন।
এসারহাদোন অনুধাবন করলেন, মেরোদাক-বালাদানের ‘অতৃপ্ত আত্মা অ্যাসিরীয়ার রাজাদের বিরক্ত করতেই থাকবে। তাই এ সমস্যার পাকাপাকি সমাধান করতে তিনি সেনা পাঠালেন। নাবু-জেরকেত্তি-লিশার এলামে পালালেন। কিন্তু অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে তিনি আবিষ্কার করলেন, এলামের সদ্য-অভিষিক্ত নতুন রাজা নতুন অ্যাসিরীয় শাসককে চটাতে আগ্রহী ছিলেন না। নাবু-জেরকেত্তি- লিশারকে গ্রেপ্তার করা হল এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল।
একইসঙ্গে এসারহাদোন প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাবিলনের উদ্দেশে টাকা ও জনবল বিনিয়োগ করতে লাগলেন।
সেন্নাশেরিবের উন্মত্ত ধ্বংসযজ্ঞের পরিণাম ভালো ছিল না। ব্যাবিলনের মতো পবিত্র ও প্রাচীন শহর ধ্বংসের ঘটনার তার নিজের সভাসদরাও খুশি ছিলেন না। এমনকি দেশের জনগণও নয়। ব্যাবিলনের দেবতারা তাদেরও অনেক কাছের জন। ব্যাবিলন থেকে মারদুকের মূর্তি সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টিকে অনেকেই দেবতাদের প্রতি অপমান হিসেবে দেখেন এবং স্বর্গ থেকে যেকোনো মুহূর্তে শাস্তি নেমে আসতে পারে, এই ভয়ে তারা ভীত ছিলেন।
এসারহাদোনের নিজস্ব নথি মতে, তিনি মারদুকের প্রতি ভালোবাসা থেকে ব্যাবিলন পুনর্নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে এ সিদ্ধান্ত তার জন্য কিছুটা ঝামেলার ছিল। তিনি যদি মারদুকের প্রতি অপমানের প্রতিকারের প্রতি অনেক বেশি সময় দিয়ে ফেলেন, তাহলে সেটি একাধারে তার পিতার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করা হয়। সেক্ষেত্রে তিনি ‘স্বর্গীয় ক্ষমতায়’ রাজা হওয়ার যে অজুহাত ব্যবহার করছিলেন, সেটাতে সন্দেহের অবকাশ দেখা দেবে।
এই সমস্যার সমাধানে তিনি ব্যাবিলন ধ্বংসের বিষয়টি ব্যাখ্যা করার সময় তার পিতার কথা একেবারেই চেপে গেলেন। ব্যাবিলনের ‘বন্যার’ বর্ণনায় তিনি ‘মানুষের হাত এ থাকার বিষয়টি উপেক্ষা করলেন এভাবে :
আগের কোনো এক রাজার রাজত্বে,
ব্যাবিলনে ছিল অশুভ লক্ষণ।
সেখানে ছিল অপরাধ, অবিচার, মিথ্যে,
বাসিন্দারা দেবতাদের অবমাননা করতেন।
নিয়মিত পূজাও করতেন না, ভেটও দিতেন না,
তারা এলামের ঋণ পরিশোধ করতে মন্দিরের সম্পদ লুঠ করতেন,
ব্যাবিলনের সব সম্পদ তারা অন্যদের দেওয়ার হন্য হাতিয়ে নিলেন।
আমার সময়কালের আগে, মারদুক ব্যাবিলনের ওপর ক্ষিপ্ত হলেন,
আরাহতু নদীতে এল জলোচ্ছ্বাস এবং শহর পরিণত হল এক ধ্বংসস্তূপে,
ব্যাবিলন পরিণত হল এক মৃতনগরীতে,
নলখাগড়া আর পপলার গাছ জন্মাল সেই পরিত্যক্ত নগরীতে,
দেব-দেবীরা তাদের উদ্দেশে নিবেদিত মিনারকে ত্যাজ্য করলেন,
বাসিন্দারা অন্যত্র আশ্রয় নিতে ছুটলেন।
নিঃসন্দেহে এটি এক ভয়াবহ ইতিহাস ছিল। কিন্তু একইসঙ্গে এটি একধরনের অসামান্য অপপ্রচারও ছিল। ‘আমার কালের আগে’ কথাটি খুবই অর্থবহ; এর মাধ্যমে এসারহাদোন তার নিজের কাছ থেকে যেমন দায় সরালেন, তেমনি পিতাকেও কলুষযুক্ত রাখলেন। দেবতারা রাগ করে ব্যাবিলন ছেড়ে চলে গেছেন, এই বর্ণনা বাস্তব সত্য ‘গরুর গাড়িতে করে তাদেরকে (মূর্তি) অ্যাসিরীয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে’-এর চেয়ে অনেক শ্রুতিমধুর ছিল। এলামের কাছে ধর্না দেওয়ায় মারদুক ক্ষিপ্ত হয়েছেন, ‘আগের রাজার’ ওপর দোষ চাপানো, ‘আরাহতুর জলোচ্ছ্বাস’–এ সবই সুনিপুণ মিথ্যের জালে তৈরি রোমান্টিক ইতিহাস।
মারদুকের মূর্তি অ্যাসিরীয়াতেই থেকে গেল। ফলে ব্যাবিলনের বাসিন্দারা বুঝতে পারলেন, তাদের দেবতা ব্যাবিলনের বৈধ রাজার সঙ্গেই আছেন। ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে এসারহাদোন মন্দির ও বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ করলেন এবং রাস্তাগুলোকে নতুন করে পাকা করলেন। তিনি প্রতিটি সড়কে তার নিজের উদ্দেশে স্তুতিবাক্য লেখানোর ব্যবস্থা করলেন। এসাগিলার মন্দির কমপ্লেক্স পর্যন্ত সড়কের ওপর অসংখ্য ইটে লেখা ছিল, ‘মারদুকের দেবতার উদ্দেশে—এসারহাদোন, সমগ্র বিশ্বের রাজা, অ্যাসিরীয়া ও ব্যাবিলনের রাজা।
মেরোদাক-বালাদানের বিট-ইয়াকিন গোত্রের ভ্রাতৃসম গোত্র বিট-ডাক্কুরি গোত্র অবস্থা বেগতিক দেখে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে উদ্যত হল। তারা ব্যাবিলনে একটি চিঠি পাঠিয়ে নিজেদের বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করল। তবে এসারহাদোন চালদিয়ানদের বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি বেশ মজার একটি উত্তর পাঠালেন।
চিঠির শুরুতে লিখলেন : ‘রাজার কাছ থেকে অ-ব্যাবিলনীয়দের প্রতি বার্তা।
আমি তোমাদের কাছে পুরোপুরি অর্থহীন এই চিঠি ফেরত পাঠাচ্ছি। এমনকি, এর সিল-গালাও খোলা হয়নি। তোমরা হয়তো বলবে, ‘কেন তিনি এটা আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিলেন?’।
যখন ব্যাবিলনের নাগরিকরা, যারা আমার অনুগত ও যারা আমাকে ভালোবাসে, তারা আমার কাছে চিঠি পাঠায়, তখন আমি তাদের চিঠি খুলে পড়ি। কিন্তু কেন আমি অপরাধীদের হাতে লেখা চিঠি গ্রহণ করব, আর কেনইবা সেটা আমি পড়ব?
এই চিঠি পাঠানোর পর এসারহাদোন চালদিয়ানদের ব্যাবিলনের দক্ষিণ ভূখণ্ড থেকে বিতাড়ন করার জন্য সেনা পাঠালেন। তাদের উদ্দেশ্য, চালদিয়ানদের তাদের আদি নিবাস, অর্থাৎ জলাভূমিতে পাঠিয়ে দেওয়া।
ইতোমধ্যে উত্তর-পূর্ব দিকে এক নতুন হুমকির সৃষ্টি হচ্ছিল। কাস্পিয়ান সাগরে দীর্ঘদিন ধরে ঘুরে-বেড়ানো যাযাবর গোত্রের সদস্যরা একীভূত হচ্ছিল অ্যাসিরীয়রা এই নবাগতদের জিমিররাই বলে অভিহিত করে। পরবর্তীতে ইতিহাসবিদরা তাদেরকে সিম্মেরিয়ান নামে অভিহিত করে।
পর্বত থেকে আসা আরও অসংখ্য যাযাবরদের মতো, সিম্মেরিয়ানরাও অন্য সবকিছুর চেয়ে যুদ্ধ-সক্ষমতায় এগিয়ে ছিল। অ্যাসিরীয়ার উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়ে তাদের অভিযান এশিয়া মাইনরের একপ্রান্তে অবস্থিত সিলিসিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তারা উরারতিয়ান রাজা দ্বিতীয় রুসাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে সক্ষম হয়। এ ঘটনা এসারহাদোনের নজরে আসে। সিম্মেরিয়ান ও উরারতিয়ান জোট তার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
উত্তরের সীমান্তকে আরও বলিষ্ঠ করতে এসারহাদোন ককেশাস পর্বতমালা থেকে নেমে আসা দ্বিতীয় আরেক দল যাযাবরের সঙ্গে একটি সাময়িক জোট গঠন করেন। এক সিম্মেরিয়ান ও উরারতিয়ানদের বিরুদ্ধে এই স্কাইথিয়ানরা একটি বাড়তি ‘হাত’ হিসেবে বিবেচিত হলেও, এসারহাদোন তাদেরকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন না। এসারহাদোনের আমলে সূর্যদেবতা শামাশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল, যার উদাহরণ হিসেবে কিছু ট্যাবলেট আজও টিকে আছে। সেখানে বলা হয় :
হে মহান প্রভু শামাশ, উরারতুর রাজা রুসাস কি সেনা নিয়ে আসবে, এবং সিম্মেরিয়ান (বা তাদের কোনো মিত্র) কি যুদ্ধ, হত্যা ও লুটপাট করবে?
হে মহান প্রভু শামাশ, আমি যদি আমার কোনো এক কন্যাকে স্কাইথিয়ানদের রাজার সঙ্গে বিয়ে দিই, তবে কি তিনি আমাকে নিয়ে ভালো ভালো কথা বলবেন? শান্তি নিয়ে সত্য ও সৎ কথাবার্তা বলবেন? তিনি কি আমার মৈত্রীচুক্তির প্রতি সম্মান রাখবেন এবং আমাকে যা তুষ্ট করে, তা বলবেন?
হে মহান প্রভু শামাশ, সিম্মেরিয়ান অথবা মেদেস বা অন্য কোনো শত্রুর বাহিনী কি আক্রমণ করবে? তারা কি সুড়ঙ্গপথে, মই বেয়ে অথবা মিথ্যে মৈত্রীচুক্তির মাধ্যমে শহরগুলো দখল করে নেওয়ার চেষ্টা চালাবে?
তবে এসব প্রশ্নের কোনো সোজাসাপ্টা উত্তর ছিল না।
পরিশেষে এসারহাদোন খ্রিস্টপূর্ব ৬৭৬ সালে যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য হলে। সিম্মেরিয়ান যাযাবররা পশ্চিমে অনেক দূর এগিয়ে এসে ফ্রিজিয়ার সীমান্তে হাজির হলে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
সমৃদ্ধশালী ফ্রিজিয়ানরা অসহায় ছিলেন না। তাদের গ্রামগুলো পাহাড়ের চূড়ায় ছিল এবং বাড়িগুলো পাথরের তৈরি শক্ত ভিত্তির উপর নির্মাণ করা হয়। হাজারো বছর পরেও প্রতিরক্ষার কথা মাথায় রেখে নির্মিত এই বাসভবনগুলো টিকে রয়েছে। মাইডাস শহরের মাইডাস স্মৃতিস্তম্ভটি উদীয়মান সূর্যের দিকে মুখ করে নির্মাণ করা হয়। বাকি সব উঁচু দালানগুলোও একই নকশায় নির্মিত। সূর্যোদয়ের সময় এর ধূসর পৃষ্ঠ কিছু সময়ের জন্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং নকল দরজাগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকে।
কিন্তু এত সতর্কতার পরেও সিম্মেরিয়ানদের অতর্কিত হামলা তাদেরকে শশব্যস্ত করে তুলল। ফ্রিজিয়ান সেনাবাহিনী পিছিয়ে এসে রাজধানী গরডিয়ান্সে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। শহরতলি ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠী ও শহরগুলোতে ভিড় জমাতে শুরু করল-তাদের প্রত্যাশা, শহরের উঁচু প্রাচীর তাদেরকে সুরক্ষা দেবে। কিন্তু সিম্মেরিয়ানরা প্রাচীর পেরিয়ে এপারে চলে আসে এবং পুরো শহরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তাদের রাজা মাইডাস (তিগলাথ- পিলেসারের আমলের মাইডাসের নাতি) বুঝতে পারলেন, পরাজয় অবধারিত।
রাজপ্রাসাদের ভেতরে তিনি আত্মহত্যা করলেন। রোমের ইতিহাসবিদ প্রায় ৬০০ বছর পর আমাদের জানান, তিনি ষাঁড়ের রক্ত পান করে আত্মহত্যা করেন। নিঃসন্দেহে মরিয়া হয়েই তিনি এ-ধরনের অদ্ভুত মৃত্যু বেছে নেন।
এসারহাদোন এই হুমকির মুখোমুখি হতে তার সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সিলিসিয়ার যুদ্ধে এসারহাদোন জয়ী হলেন। তিনি সিমেরীয় রাজা তিউশপাকে নিজহাতে হত্যা করেন। এ বিষয়ে তিনি শিলালিপিতে গর্ব প্রকাশ করেন।
এসারহাদোনের আক্রমণে সিমেরীয় আগ্রাসন প্রতিহত হল এবং এশিয়া মাইনরের পশ্চিম অঞ্চলটি ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গেল। তবে ফ্রিজিয়ার পতন হল। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়া গ্রামগুলো আর কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এককালে ফ্রিজিয়ান বণিকদের পদচারণায় মুখরিত বাণিজ্যিক রুটগুলো আরও পশ্চিমের গ্রামবাসীদের দখলে চলে গেল। তারা লিডিয়ান নামে পরিচিত ছিলেন। পূর্বাঞ্চলের সমতলভূমি ধ্বংসের পার তাদের রাজা গাইগেস এশিয়া মাইনরের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেন।
ততদিনে ২৫তম রাজবংশের নুবিয়ান ফারাওদের অধীনে মিশর কমবেশি একতাবদ্ধ হয়েছে। ৮ বছর ধরে এই স্থিতিশীল অবস্থা বজায় থেকেছে। বেশ কয়েক বছর আগে সেন্নাশেরিবের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন তিরহাকাহ। সে-যুদ্ধে কোনো ফল আসেনি। সেই রাজপুত্র তিরহাকাহ এখন রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসেছেন। এসারহাদোন তার পিতার শুরু করা অভিযানের পরিসমাপ্তি চেয়েছিলেন।
এসারহাদোনের সপ্তম বছরে দেবতার আশীর্বাদসহ তিনি সমগ্র অ্যাসিরীয় বাহিনী নিয়ে মিশরের উদ্দেশে রওনা হলেন।
তিরহাকাহ দীর্ঘ অপেক্ষার পর ক্ষমতা পেয়েছিলেন। তিনি এসারহাদোনের অপেক্ষায় হাত-পা ছেড়ে বসে থাকার লোক ছিলেন না। মিশরীয় বাহিনী ফিলিস্তিনি শহর আশকেলনের উদ্দেশে রওনা হয়। সেখানে আশকেলনের যোদ্ধারা তাদের সঙ্গে যোগ দেন এবং এই যৌথবাহিনী এসারহাদোনের মোকাবিলা করার জন্য অপেক্ষায় থাকে। যতক্ষণে অ্যাসিরীয়রা সেখানে এসে পৌঁছায়, ততক্ষণে তারা ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। দক্ষিণের উদ্দেশে এই দীর্ঘ পদযাত্রায় তারা যাযাবর আরব-গোত্রদের মোকাবিলা করতে বাধ্য হন। যাযাবররা অ্যাসিরীয়দের খাদ্য ও অস্ত্রের ভালো অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করেছিল।
যুদ্ধ খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। অল্প সময়ের মাঝেই তিরহাকাহ’র বাহিনী জয়ী হয়।
বদ্বীপ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন এসারহাদোন। তিরহাকাহ মিশরে ফিরে গেলেন এবং বেশকিছু অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে হাত দিলেন। আগের ফারাওদের মতো তিনিও এসব প্রকল্পের মাধ্যমে তার মাহাত্ম্যের প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করেন। এসব প্রকল্পের মাঝে ছিল নুবিয়ায় অবস্থিত আমুনের সুবিশাল মন্দির।
কিন্তু এসারহাদোন পুরোপুরি পিঠটান দেননি। তিনি নতুন করে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। দুই বছর পর, খ্রিস্টপূর্ব ৬৭১ সালে তিনি আবারও ফিরে আসেন। এবার তার বিশ্রাম নিয়ে এবং নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সতেজ বাহিনী নিয়ে আসেন তিনি। মিশরের প্রতিরক্ষাব্যূহকে দুমড়েমুচড়ে সামনে এগিয়ে যান তিনি। তার বাহিনী বদ্বীপ থেকে প্রতিপক্ষকে তাড়া করে মেমফিস পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেখানে মিশরের তিরহাকাহ তার সর্বশক্তি নিয়ে শেষবারের মতো নিজ ভূখণ্ডের প্রতিরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা চালান।
যখন তিনি বুঝলেন, যুদ্ধে অ্যাসিরীয় বাহিনীর জয় অবধারিত, তখন তিরহাকাহ যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পিঠটান দিলেন এবং দক্ষিণে তার পূর্বপুরুষদের ভূখণ্ডের দিকে চলে গেলেন।
এসারহাদোন তার স্ত্রী ও পুত্রসহ পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে আটক করলেন। তিনি বেশ কয়েকজন সভাসদকে হত্যা করলেন এবং পুরো দলটিকে বন্দি করে নিনেভেহ শহরে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। তিরহাকাহর পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি তিনি অভিজাত বংশীয় বেশকিছু মানুষকে বন্দি করলেন, যাদের মধ্যে ছিলে সাইসের রাজার ছেলে। তিনি তাদের সবাইকে নিনেভেহতে নিয়ে অ্যাসিরীয় হওয়ার দীক্ষা দেওয়ানোর ব্যবস্থা নিলেন।
তিনি বিশ্বস্ত গভর্নরদের হাতে মিশরের দায়ভার দিয়েছিলেন। তবে এই ‘বিশ্বস্ততা খুব বেশিদিন টেকেনি। এসারহাদোন নিনেভেহ পৌঁছানোর আগেই তাদের আসল রূপ প্রকাশ পায়। সাইসের গভর্নরের নাম ছিল নেচো। তিনিই শুধু বিশ্বস্ত থেকে যান, কারণ তার ছেলে তখনো এসারহাদোনের হাতে জিম্মি ছিলেন। তবে অন্যান্য শহরের রাজ-প্রতিনিধিরা খুব শিগগির অ্যাসিরীয়ার নির্দেশ অবজ্ঞা করতে লাগলেন।
খবর পেয়ে নিনেভেহ থেকে আবারও মিশরের উদ্দেশে রওনা হলেন এসারহাদোন। তবে পথিমধ্যেই তার মৃত্যু হয়।
এসারহাদোনের প্রয়াণের পর সিংহাসনে বসলেন তার প্রিয় ছেলে এবং তার নিজের হাতে নির্বাচিত উত্তরাধিকারী আশুরবানিপাল। তবে একইসঙ্গে তিনি তার আরেক তরুণ সন্তান শামাশ-শুম-উকিনকে ব্যাবিলনের ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি তার বড়ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে একজন সার্বভৌম শাসক হিসেবে ব্যাবিলন শাসন করতে লাগলেন। আশুরবানিপালের আনুষ্ঠানিক অভিষেকের এক বছর পর ব্যাবিলনে তার অভিষেক হয়। শহরে প্রবেশের সময় তার সঙ্গে ছিল দেবতা মারদুকের ছবি, যিনি অবশেষে ‘নিজ শহরে’ ফিরে আসছিলেন। আশুরবানিপাল এক শিলালিপিতে এটা লেখানোর ব্যবস্থা করেন : ‘এসবই ঘটে আমার শাসনামলে’।
মহান দেবতা, সবার প্রভু-মারদুক আনন্দ-উল্লাসের মাঝে ব্যাবিলনে প্রবেশ করলেন এবং তার বাসা খুঁজে নিলেন এবং আমি ব্যাবিলনের সম্মানজনক অবস্থান ফিরিয়ে দিলাম এবং আমি শামাশ-শুম-উকিন, আমার প্রিয় ভাইকে ব্যাবিলনের রাজা বানালাম।
তারপর তিনি তার পিতার পথ অনুসরণ করে মিশরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। ততদিন তিরহাকাহ আবারও নিজ সিংহাসন ফিরে পাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছেন। আশুরবানিপাল মিশরের ভেতর ঝড়ের বেগে আগ্রাসন চালিয়ে দক্ষিণের থেবেসে পৌঁছে গেলেন। তিনি অ্যাসিরীয়দের প্রতি অনুগত নন এরকম প্রতিটি রাজাকে হত্যা করেন। শুধু অ্যাসিরীয়াপন্থী সাইসের রাজা নেচোকে ছাড় দিলেন তিনি। তার পিতা যেসব মিশরীয় অভিজাত পরিবারের সন্তানদের নিনেভেহ শহরে ধরে নিয়ে গেছিলেন, তিনি তাদের থেকে ৩ জনকে মিশরের প্রতিনিধি-রাজার পদ দিলেন। নেচোর পুত্র সাম্মেটিকাসকে অ্যাসিরীয়া থেকে ফিরিয়ে এনে তার পিতার শহরের অপরপ্রান্তে অবস্থিত পূর্বাঞ্চলীয় শহর আথরিবিসের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হল।
পিতা ও পুত্র সম্মিলিতভাবে বাকি সব শহর শাসনের দায়িত্ব পেলেন।
তিরহাকাহ তখনো বেঁচে ছিলেন। এবার তিনি দক্ষিণের একেবারে শেষপ্রান্তে উচ্চ নুবিয়ায় চলে যেতে বাধ্য হন। তিনি চতুর্থ ক্যাটারাক্টের কাছাকাছি অবস্থিত নাপাতা শহরে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি তার চাচাতো ভাইকে উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচন করেন। ধারণা করা হয়, তার নিজ পুত্রকে নিনেভেহ শহরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তিরহাকাহর মৃত্যুর পর তার চাচাতো ভাই তানতামানি এমন এক রাজ্যের রাজত্ব পেলেন, যেটি অ্যাসিরীয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
কিন্তু তারপর তাতানামি একটি স্বপ্ন দেখলেন।
অভিষেকের ১ বছর পর, রাজা রাতের ঘুমের সময় স্বপ্নে দেখলেন, তার ২ কাঁধের ওপর ২টি সাপ বসে আছে। তখন তিনি জেগে উঠলেন, কিন্তু সাপগুলোকে আর খুঁজে পেলেন না (স্বভাবতই)।
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা আমি কেন দেখলাম?’
তার কাছে উত্তর এল, ‘দক্ষিণের ভূখণ্ড আপনার; উত্তরাঞ্চলকেও আপনি নিজের করে নিন। দুই দেবী আপনাকে আশীর্বাদ দিয়েছে। এই ভূখণ্ড পুরোপুরি, অবিভক্তভাবে আপনার।’
এই দৈব নির্দেশনা পেয়ে ঘুম থেকে উঠে গেলেন তিনি। সিদ্ধান্ত নিলেন, মিশরকে অ্যাসিরীয়া ও প্রতিনিধি রাজাদের করায়ত্ত থেকে ছিনিয়ে আনতে হবে।
প্রথম কয়েকটি যুদ্ধ তিনি খুব সহজেই জিতে নিলেন। অ্যাসিরীয়রা আবারও প্রস্থান করেছিল এবং স্থানীয়রা অ্যাসিরীয় গভর্নরদের শাসন মেনে নিতে ইচ্ছুক ছিল না।
নীলনদের তীর ধরে তাতানামি আগাতে লাগলেন। প্রায় প্রতিটি শহরেই তাকে স্বাগত জানানো হল এবং তিনি মিত্রদের কাছ থেকে বাড়তি সেনাও পেলেন।
মেমফিসে এসে তিনি তার প্রথম, প্রকৃত বাধার মুখে পড়লেন। সাইস রাজত্বের নেচো এই নুবিয়ান যোদ্ধাকে ঠেকানোর জন্য তড়িঘড়ি করে অ্যাসিরীয় সৈন্যসমৃদ্ধ একটি জোড়াতালি দেওয়া বাহিনী নিয়ে দক্ষিণের দিকে রওনা হয়েছিলেন।
পরবর্তী যুদ্ধে নেচোর পতন হল। তার ছেলে সাম্মেটিকাস যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে তিনি নিজেকে বদ্বীপের অভিজাতদের মাঝে চরম অজনপ্রিয় হিসেবে আবিষ্কার করলেন। তারা অ্যাসিরীয় শাসনের পরিবর্তে নুবিয়ার শাসনকে শ্রেয় মনে করত। হেরোডোটাস জানান, একপর্যায়ে সাম্মেটিকাস বদ্বীপ এলাকার ১১ শাসকের হাত থেকে বাঁচার জন্য জলাভূমিতে আশ্রয় নেন। অবশেষে তার স্থান হয় সাইস অঞ্চলে, অ্যাসিরীয় ঘাঁটির পেছনের অংশে অবরুদ্ধ অবস্থায়।
ইতোমধ্যে সমগ্র বদ্বীপ জুড়ে উৎসব শুরু হয় আর তানতামানি আমুন দেবতার কাছে জয়ের জন্য প্রার্থনা করছিলেন। এ বিষয়টি একটি স্মারক স্টেলেতে খোদাই করা হয়েছে এভাবে, ‘আমুনের নির্দেশনা চলে কেউ দিকভ্রান্ত হতে পারে না!”
শিগগির আশুরবানিপাল ফিরে এলেন। সঙ্গে আনলেন সুবিশাল বাহিনী। খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৩ সালে তিনি সাম্মেটিকাসের মুমূর্ষু বাহিনীর সঙ্গে তার নিজ বাহিনী যুক্ত করলেন। এই সম্মিলিত বাহিনী পুরো বদ্বীপ জুড়ে তাণ্ডব চালাল। দ্বিতীয়বারের মতো দক্ষিণে পালাতে বাধ্য হলেন তানতামানি এবং মানবজাতির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো থেবেস শহর লুটপাটের শিকার হল এবং এই শহরে যৌথবাহিনী আগুন ধরিয়ে দিল। আমুনের মন্দির ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হল। এর মধ্যে থাকা ধনসম্পদ লুট করা হল, প্রাচীরগুলো ধ্বংস করা হল এবং এর দরজার মুখে থাকা রুপার তৈরি ২টি মিনার বহন করে নিনেভেহ শহরে নিয়ে যাওয়া হল। থেবেসের ধ্বংসযজ্ঞ এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে, দীর্ঘদিন ধরে এই ঘটনা ‘অ্যাসিরীয়দের অমান্য করার পরিণামের’ উদাহরণ হিসেবে প্রচারিত হত।
তারপর আশুরবানিপাল সব প্রতিনিধি রাজাদের বরখাস্ত করলেন এবং সাম্মেটিকাসকে মিশরের একমাত্র ফারাও হিসেবে নিয়োগ দিলেন। তবে অ্যাসিরীয়া থেকে মিশর এতটাই দূরে ছিল যে, সেখানে বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়েন করা বেশ দুষ্কর ছিল। আশুরবানিপালকে এই দেশটি নিজের করায়ত্তে রাখতে হলে অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও অনড় একজন প্রতিনিধি প্রয়োজন ছিল।
তবে দীর্ঘদিন ধরে অ্যাসিরীয়দের সঙ্গে ওঠাবসা করলেও, সাম্মেটিকাস অতটা বিশ্বস্ত ছিলেন না।
আশুরবানিপালের পক্ষে যুদ্ধের লড়ার স্বপক্ষে তার একমাত্র যুক্তি ছিল ‘কৌশল’। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি তার জীবনের বড় একটি অংশ শত্রুদের বেষ্টনীতে কাটিয়েছেন। সেসময় তার ছিল না কোনো ক্ষমতা, এবং ছিল না কোনো নিজের থাকার জায়গা। তিনি পুরোপুরি শত্রুর কৃপার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। ক্ষমতা হাতে পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধীরে ধীরে অ্যাসিরীয়ার প্রভাবমুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলেন।
খ্রিস্টপূর্ব ৬৫৮ নাগাদ সাম্মেটিকাস লিডিয়ার রাজা গাইজেসের কাছে গোপন দূত পাঠাতে লাগলেন। তখন তিনিই ছিলেন এশিয়া মাইনরের একমাত্র ক্ষমতাধর সার্বভৌম শাসক। গাইজেস মিশরীয়দের পুনরুত্থানের বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। মূলত, অ্যাসিরীয়দের ক্ষমতা খর্ব হয়, এরকম যেকোনো উদ্যোগের সঙ্গে তিনি থাকতে চাইতেন। গাইজেস সাম্মেটিকাসকে সাহায্য করার জন্য মিশরে বাড়তি সেনা পাঠালেন। যুদ্ধ কবে শুরু হবে, এই অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তারা বিরক্ত হয়ে বিভিন্ন দেওয়া গ্রাফিতি এঁকে রাখে। এসব গ্রাফিতি আজও ওয়াদি আলফার মন্দিরের দেয়ালে দেখা যায়।
আরও ৫ বছর পর, খ্রিস্টপূর্ব ৬৫৩ সালে তিনি বিদ্রোহ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত মনে করেন। বদ্বীপে মোতায়েন করা অ্যাসিরীয় সেনাদের বিরুদ্ধে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করলেন এবং তাদের মেরে কেটে পশ্চিমে সেমাইটদের অঞ্চলে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর তিনি সাইসকে তার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিলেন এবং থেবেসের সবচেয়ে শক্তিমান অভিজাত পরিবারে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিলেন। এতে তার প্রতিপত্তি প্রথম ক্যাটারাক্ট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল (ক্যাটারাক্ট বিষয়ে জানতে এ বইয়ের প্রথম খণ্ড পড়ুন)।
আরও দক্ষিণে নুবিয়ার ক্ষমতা বারবার স্থানীয় শাসকদের হাতবদল হতে লাগল। মিশরের তেমন কোনো প্রভাব এ অঞ্চলের ওপর পড়েনি। প্রথম ক্যাটারাক্টের উত্তরে মিশর আরও একবার একজন প্রকৃত ফারাওর (যদিও তিনি অ্যাসিরীয় হিসেবে বড় হয়েছেন) আওতায় চলে এল। তিনিও পুরনো অনেক ফারাওর মতো নিজেকে ‘দুই ভূখণ্ডের একীভূতকারীর’ হিসেবে দাবি করলেন এবং নিজেকে মিশরের প্রধান দেবতাদের আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবে ঘোষণা দিলেন। মিশরে অনেক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ‘মাআত’ বা স্বর্গীয় আইন ফিরে এল। জন্মভূমি সাইস শহরকে ঘিরে সাম্মেটিকাসের সাই রাজবংশ বা মিশরের ২৬তম রাজবংশের শাসনামল এভাবেই শুরু হল।
মিশরের বিদ্রোহে গাইজেসের তেমন কোনো সুবিধা হয়নি। সিম্মেরিয়ানরা নিজেদের পুনর্গঠিত করে পশ্চিমের দিকে পদযাত্রা শুরু করে। এবার অ্যাসিরীয়রা এই সংঘাতে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। আশুরবানিপাল গাইজেসের ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন; সেই লিডিয়া থেকে মিশরে সেনা পাঠানো বিষয়ে। রাজা ডুগডাম্মের অধীনস্থ সিম্মেরিয়ান বাহিনী লিডিয়ার সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে গাইজেসের মৃত্যু হয় এবং সারডিস শহরে অবাধ লুটতরাজ চলে। ডুগডাম্মে আরও দক্ষিণে এগিয়ে যান। এতে তার বাহিনী অ্যাসিরীয় ভূখণ্ডের বেশি কাছে চলে আসে। আশুরবানিপাল চেয়েছিলেন সিম্মেরিয়ানরা অপর এক জাতিকে শিক্ষা দিক, কিন্তু তাদেরকে নিজ ভূখণ্ডের ধারে কাছেও ভিড়তে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা তার ছিল না।
তিনি উত্তরে যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তখন রাজসভার পুরোহিতরা এক দৈববাণী শুনালেন, যা শুনে তিনি বেশ ভড়কে গেলেন।
তারা তাদের রাজাকে বললেন, ‘আপনার ভূমির ওপর আসবে হামলা, এবং সমগ্র ভূখণ্ড ধ্বংস হয়ে যাবে।’ তবে আশুরবানিপালের সৌভাগ্য, সারডিসে লুটপাট চালানোর অল্পদিন পর ডুগডাম্মে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই রোগের উপসর্গ হিসেবে তার পুরুষাঙ্গে গ্যাংগ্রিন হয় এবং তার বমির সঙ্গে রক্ত বের হতে থাকে। এই রোগের কারণে তিনি তার দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আশুরবানিপাল তার উত্তরের যুদ্ধযাত্রা বাতিল করেন।