৫১.
পরদিন সকালে স্যাম, রেমি, ল্যাজলো, ফারগো সবাই আবার গুহার দিকে রওনা হলো। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর দ্বীপ আবার শান্ত হয়ে গেছে। আপাতত দাঙ্গা নিয়ে কারও দুশ্চিন্তা নেই।
মিতসুবিশি গাড়িটা নিয়ে ফরেনসিক ভ্যানের কাছে রাখল স্যাম। এখানে আরও একডজন ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে, সাংবাদিকদের। গাছের ছায়ার সাংবাদিকরা বসে আছে। পুলিশ নজর রাখছে তাদের উপর।
স্যাম এক অফিসারের দিকে এগিয়ে গেল। চিফ ফ্লেমিং আছেন? আমাদেরকে আসতে বলেছিলেন উনি।
“উপরে আছেন। আপনাদের পরিচয়?’ অফিসারের হাতে রেডিও শোভা পাচ্ছে।
বলবেন, ফারগো’রা এসেছে।
অফিসারের চেহারা মুহূর্তেই বদলে গেল। ও আচ্ছা! আপনারা! যান, যান, উপরে যান। কোনো সমস্যা নেই।
গুহামুখের সামনে দু’জন অফিসারকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশ চিফ। ওদেরকে দেখে এগিয়ে এলো।
‘আসার জন্য ধন্যবাদ।’ বলল পুলিশ চিফ।
‘ওয়েলকাম। এখানকার কী অবস্থা? স্যাম জানতে চাইল।
ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা নিখোঁজ হওয়া সবার লিস্ট তৈরি করেছি। ফরেনসিক খুব শীঘ্রই ওদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে ফেলবে।
‘দারুণ। আচ্ছা, ডা. ভ্যানা মুখ খুলেছে?’ প্রশ্ন করল রেমি।
‘আমি তদন্ত চলাকালীন কোনো কেস নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। তবে এতটুকু বলতে পারি সে এখনও কিছু স্বীকার করেনি। এপর্যন্ত তিনবার নিজের বানানো গল্প বদল করেছে। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই স্বীকার করবে।’
আপনাদের লিস্টে কতজন নিখোঁজ হওয়ার তথ্য আছে?’ ল্যাজলোর প্রশ্ন।
‘বিগত ৬ বছরে প্রায় ৩৮ টা কেস ফাইল করা হয়েছে। অবশ্য এর বাইরেও ধারণা করা হচ্ছে হাসপাতালে সেবা নিতে আসা বিভিন্ন রোগীর উপর লুকিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিল ডা. ভ্যানা। হয়তো তারা মারাও গেছে।’
খুব সহজেই সেটা সম্ভব। ডাক্তার ভুল ওষুধ দিলেও এখানকার কেউ সেটা দেখতে আসবে না।’ বলল রেমি।
তবে এখন কিন্তু খবর আছে। যাদের সন্তানরা মারা গেছে তারা খুব ক্ষেপে আছে তার উপর। স্যাম মনে করিয়ে দিল।
‘ঠিক বলেছেন… আদালত এটা নিয়ে খুব চিন্তিত। ভ্যানাকে হাতের কাছে পেলে বাবা-মায়েরা তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
‘সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এজন্য আপনাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে তাকে!’ বলল ল্যাজলো।
‘আরেকটা নতুন তথ্য পেয়েছি আমরা। ফ্লেমিঙের চেহারা গম্ভীর। ডা. ভ্যানা’র হয়ে যারা কাজ করতো তাদের সবাইকে ড্রাগ আসক্ত ছিল। বিশেষ ধরনের ড্রাগ দিয়ে ওদেরকে হাতের মুঠোয় রেখেছিল ভ্যানা। ড্রাগের নেশায় পড়ে তার কথা শুনতে ওরা।
‘আমার তো মনে হয়, ভ্যানা এর পাশাপাশি ওদেরকে বড়লোক হওয়ার স্বপ্নও দেখিয়েছিল। স্যাম বলল।
‘আচ্ছা, এখনও পর্যন্ত কোনো কঙ্কালের পরিচয় বের করতে পেরেছেন? জানতে চাইল রেমি।
হ্যাঁ, আকারে বড় কঙ্কালগুলো থেকে কাজ শুরু করা হয়েছে। একটা ছিল অর্ধগলিত। ওটার পরিচয় পাওয়া গেছে। অল্পবয়স্ক ছেলেটার নাম আলডো কসভ। ডা. ভ্যানা’র অধীনে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা নিচ্ছিল। বাকিদেরও পরিচয় বের করার চেষ্টা চলছে। তবে লিলি’র ভাগ্য ভাল বলতে হবে। আপনারা ওকে সময়মতো উদ্ধার করতে পেরেছিলেন।
ধন্যবাদ। আমরা তথ্য পেয়েছি বেশি পুরানো কঙ্কালগুলো যুদ্ধের সময়কার। ভ্যানার দাদা তখন জাপানিদের সাথে মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট করেছিল।
‘যেমন দাদা তেমন নাতনি। কী জঘন্য…’ গুহার দিকে তাকিয়ে বলল ফ্লেমিং। মজার বিষয় দেখুন, ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এসব গুহায় ভূত থাকে, জায়ান্ট থাকে, দানব থাকে। অথচ কখনও বুঝতেই পারিনি আসল দানবরা সবসময় আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু থামল সে। ‘পুরানো কঙ্কালগুলোর সুরাহা দ্রুত করার জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে টিম আসার কথা আছে। তারা যুদ্ধকালীন সময়ে কে কে মারা গেছে সেগুলোর সাথে কঙ্কালগুলো মেলাবে।
তারপর ফ্লেমিং ওদের প্রত্যেক মুখ থেকে পুরো ঘটনার জবানবন্দি নিল। ভ্যানার বিরুদ্ধে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করবে।
পুলিশ চিফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গুহার যে অংশে গোলাগুলি হয়েছিল সেখানে ঢুকল ওরা। গুহায় এখন গুণ্ডাদের কোনো লাশ নেই। যেখানে লাশ পড়েছিল সেখানে সাদা চক দিয়ে ক্রাইম সিন মার্ক করে রাখা হয়েছে। দিনের আলোতে প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে ভেতরটা ঘুরে দেখার পর বাইরে বের হলো সবাই।
‘আমি একটা গাধা! আস্ত গাধা! হঠাৎ বলে উঠল ল্যাজলো।
কী বলছেন এসব? লিও প্রশ্ন করল।
‘নোটবুক। ওখানকার কিছু একটা আমার মাথায় খচখচ করছিল কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না জিনিসটা কী। এবার বুঝতে পেরেছি।’
ওর দিকে তাকাল রেমি। তারপর?
‘আমার অনুবাদে গলদ আছে। একটা শব্দের অনুবাদ করতে গিয়ে ভুল করেছি।’
‘গুলিয়ে ফেলেছেন? ভ্রূ উঁচু করে স্যাম জিজ্ঞেস করল।
হুম।
‘এত ভণিতা না করে আসল কথাটা বলছেন না কেন?’ বলল রেমি।
‘আমি অনুবাদ করেছিলাম ঝরনার ওপাশে। আসলে হবে ঝরনার ভেতর দিয়ে। ল্যাজলো বলল।
‘ভেতর দিয়ে?’ রেমি পুনরাবৃত্তি করল, অবাক হয়েছে।
হ্যাঁ, ঝরনার ভেতর দিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঝরনার ওপাশে নয়।’
.
৫২.
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
জেফরি গ্রিমস তার এক্সকিউটিভ চেয়ারে বসে আসন্ন দুর্দিনের কথা ভাবছে। সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়েছে গোয়ালক্যানেলে। এতদিন ধরে গোছানো পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে মুহূর্তের মধ্যে। প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছিল জেফরি। সব জলে গেছে। বড়ধরনের লাভের আশায় বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিল জেফরি গ্রিমস। জীবনে প্রথমবারের মতো ঝুঁকি নিয়ে ধরা খেল। জেফরি এখন চোখে সর্ষেফুল দেখছে। ব্যাংক থেকে অনেক অর্থ লোন নিয়েছিল, ভেবেছিল দ্বীপের খনিজ সম্পদগুলোর দখল পেলে সেখান থেকে অঢেল উপার্জন হবে। অনায়াসে লোনগুলো চুকিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু এখন কী হবে? ওর অ্যাপার্টমেন্ট বন্ধক রেখে অ্যাপার্টমেন্টের দ্বিগুণ অর্থ লোন নিয়েছিল। তারমানে এবার ওকে পথে নামতে হবে? এবার থাকল ওর বিজনেস কোম্পানী। যেভাবে হোক এটাকে আকড়ে ধরে এই বিপদটা পাড়ি দিতে হবে। অ্যাপার্টমেন্ট হারালে হারাক, ভাড়া বাসায় উঠবে ও। তাছাড়া ইয়টটাতো আছেই। ওটা কোথাও বন্ধক রাখেনি বলে রক্ষা।
জেফরি আজ কোম্পানীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে একটা মিটিং ডেকেছে। কী করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করবে।
***
ঘণ্টাখানেক পর মিটিঙে ভাষণ দিচ্ছে জেফরি। এমন সময় রুমে একজন দশাসই ব্যক্তি প্রবেশ করল।
‘জেফরি গ্রিমস?
‘কে আপনি? মিটিঙের মধ্যে ঢুকে ডিস্টার্ব করছেন কেন?’ জেফরি জানতে চাইল।
‘আমি চিফ ইন্সপেকটর কলিন্স। অস্ট্রেলিয়ান ক্রাইম কমিশন। আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।
‘গ্রেফতার? আমার অপরাধ?
‘অর্থ পাচার, খুনের সহায়তা, অপহরণের প্ররোচনা, আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গসহ আরও অনেক অপরাধ আছে। থানায় চলুন সব জানতে পারবেন।
‘আশ্চর্য কথাবার্তা!
রুমে উপস্থিত কর্মকর্তাদের দিকে তাকাল কলিন্স। এখনও বসে আছেন কেন আপনারা? মিটিং শেষ। আপনাদের বসকে গুড বাই বলে যান। হয়তো তার সাথে আর আপনাদের দেখা হবে না।’
‘আমি আমার উকিলকে চাই।’ দাবি করল জেফরি।
‘অবশই চাইবেন। এখন উনি, আগে হাতকড়াটা পরাই।”
‘তার দরকার নেই। আমি এমনিই আপনার সাথে যাচ্ছি। চলুন।
‘মিস্টার গ্রিমস, যা বলছি তাই করুন। নইলে সবার সামনে কলার ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিতে বাধ্য হব! শেষবারের মতো সর্তক করলাম। হাত দিন।
কয়েক মিনিট পর জেফরি’র হাতে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ ভ্যানে তোলা হলো।
পুলিশ হেডকোয়ার্টারের কেউ জেফরি’র সাথে কথা বলল না, আগে আসামীর উকিল আসবে তারপর হবে সব।
চার ঘণ্টা পর তাড়াহুড়ো করে এক ব্যক্তি হেডকোয়ার্টারে ঢুকল। সিমন হুইশটক। জেফরি’র উকিল। সোজা আসামীর কাছে চলে গেল সে।
সিমন? কী হচ্ছে এসব? জেফরি জানতে চাইল।
নিজের গোল রিমের চশমা ঠিক করল সিমন। আপনার মামলার বিচারকার্যে যারা থাকবে তাদের সাথে দুইঘণ্টা আলোচনা করে এলাম। তাদের মধ্যে দু’জন আবার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু…’ সিমন ইতস্তত করল। কেসটা অনেক কঠিন।’
বাজে কথা!
‘দেখুন, আপনি চাইলেও তথ্য-প্রমাণগুলো অস্বীকার করতে পারবেন না। সলোমন আইল্যাণ্ডে আপনি যত অর্থ পাঠিয়েছেন সবগুলো আপনার কোম্পানীর কোনো না কোনো অ্যাকাউন্ট থেকে। পুলিশের কাছে একদম সলিড প্রমাণ আছে। আচ্ছা, ডা. ভ্যানাকে চেনেন?
মাথা নাড়ল জেফরি। এই লোকের নাম কখনও শুনিনি।’
‘লোক নয়… মহিলা। আপনার পাঠানো সব অর্থ তার কাছে যেত। সে ইতিমধ্যে এব্যাপারে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। জানা গেছে, সে একটা বিশেষ ফোন ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়া কল করত। টেলিকমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট নিশ্চিত করেছে সে যে ফোনে কল করত সেটা আপনার অফিসের ফোন।
কী! এটা তোমাকে সামাল দিতে হবে। দিতেই হবে।
‘আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। ডা. ভ্যানা ওখানে অনেক শিশুকে খুন-গুম করেছে। নিজে বিদ্রোহী দল গঠন করে খুন করেছে অস্ট্রেলিয়ান পর্যটকদের। সে ওখানকার সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করছিল যাতে আপনার কোম্পানী ওখানে গিয়ে লাভ করতে পারে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, আপনি এসবে জড়ালেন কীভাবে?
‘সিমন, আমি নিজেও জানি না…’
চোখ থেকে চশমা খুলে চুলে আঙুল চালাল সিমন। আপনার বিরুদ্ধে কঠিন চার্জ আনা হবে শুনলাম।
‘এসব থামাতে হবে। যেভাবে হোক।
কিন্তু বিষয়টা তো অনেক বড়। এখান থেকে দ্বীপে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এত বড় জিনিস সামাল দেয়ার খরচাটাও বেশি। এই ধরুন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার যদি আমাকে দেন তাহলে আমি কেসটা লড়তে পারব।’
‘২০ লাখ ডলার। এতে রীতিমতো ডাকাতি!
‘আপনার জীবনের মূল্য কত? ২ মিলিয়ন ডলার সেটার কাছে কিছুই না। মামলা একবার শুরু হয়ে গেলে আর কিছু করা সম্ভব হবে না। যতই অর্থ দেন না কেন। আমি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি এই লাইনে…’।
‘ঠিক আছে। নিজের সেফের কম্বিনেশনটা সিমনকে দিল জেফরি গ্রিমস। ‘সেফের ভেতরে সবমিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন ডলার পাবে। আশা করি, তোমার চার্জসহ যাবতীয় খরচের জন্য এটুকুই যথেষ্ট হবে। আচ্ছা, জামিন কবে পাব?
‘জামিন পাবেন না। অনেক মানুষ মারা গেছে আপনার জন্য। পুরো মানবতা সংক্রান্ত কেস। তার সাথে আছে অর্থ পাচার মামলার রায়ে আপনার ফাঁসি না হলেও যাবজ্জীবন হবে, নিশ্চিত।
কথাটা শুনে জেফরির শ্বাস নিতে কষ্ট হতে শুরু করল। বাতাসকে খুব ভারি মনে হচ্ছে। ঘাম গড়াতে শুরু করল কপাল বেয়ে। যাবজ্জীবন!
ক্লায়েন্টের এরকম করুণ অবস্থা দেখে সিমন কোনো করুণাবোধ করল না। কারণ ওর যেটা কাজ ছিল সেটা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। সাড়ে তিন মিলিয়ন ডলার… অনেক অর্থ। সিমন এখন একটু স্বস্তিবোধ করছে। হয়তো এই ক্লায়েন্টের হয়ে ওকে লড়তে হবে না। আর লড়েও খুব একটা লাভ হবে না।
‘সিমন, আমাকে এই বিপদ থেকে বের করতেই হবে। তার জন্য যা দরকার হয় করো। আমি সারাজীবন জেলে পঁচতে পারব না। ওর হাতের তালু ঘেমে গেছে।
মাথা নাড়ল সিমন। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। কিন্তু আপনি বেশ কঠিন গ্যাড়াকলে পড়েছেন।
রুম থেকে বেরিয়ে গেল সিমন।
হঠাৎ জেফরির মনে হলো ও আর কখনও এই বিপদ থেকে মুক্তি পাবে না। সিমনের কথার মাঝে আগের মতো কনফিডেন্স দেখতে পায়নি। ধীরে ধীরে ঘাম বাড়তে লাগল জেফরির। দুশ্চিন্তার কারণে ওর হৃৎপিণ্ডের উপর চাপ পড়ছে। ওর মনে হচ্ছে বুকটা বোধহয় ফেটে যাবে। বুকের ব্যথায় চেয়ার থেকে পড়ে গেল একসময়ের ধনকুবের জেফরি গ্রিমস। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় এক হাত দিয়ে বুকের বাম পাশ চেপে ধরে আছে।
অবশেষে যখন মেডিক্যাল টিম এসে উপস্থিত হলো, জেফরি’র শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ততক্ষণে।
.
৫৩.
গোয়াডালক্যানেল, সলোমন আইল্যান্ড
স্যাম, রেমি, লিও আর ল্যাজলো এখন প্রথমে দেখা সেই বড় ঝরনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
‘মিস্টার ল্যাজলো, আপনি নিশ্চিত তো? রেমি প্রশ্ন করল।
“হুম, এরচেয়ে আর বেশি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না।
‘তাহলে বলুন, কীভাবে ভেতরে যাওয়া যাবে?
“দেখুন, ঝরনার ঠিক ডান কিনারা দিয়ে বেশ কিছু বড় বড় পাথর পড়ে আছে। আমার মনে হয় ওগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে আমরা ঝরনার দোরগোড়ায় পৌঁছে যেতে পারব।
‘ভাল বলেছেন। তাহলে আপনিই আমার পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে চলুন।’ বলল স্যাম।
প্রতিবার আমাকেই এভাবে বিপদের সামনে যেতে হবে?
‘আপনি এখন ঝরনার ভেতর দিয়ে গিয়ে জাস্ট এতটুকু দেখে আসুন ওপাশে কোনো গুহা আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে ফিরে আসবেন। সবাই একসাথে ভেতরে ঢুকব। কঠিন কিছু না তো।’
‘আচ্ছা, আমার আসতে যদি অস্বাভাবিক সময় লাগে তাহলে সাহায্য করতে চলে আসবেন কিন্তু।
‘সমস্যা নেই। আছি আমরা। দরকার হলে দুই দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করব। লিও মশকরা করল।
ওদেরকে পেছনে রেখে ঝরনারধারার দিকে এগোল ল্যাজলো। ফিরে এলো কয়েকমিনিট পর। ভিজে গেছে।
হ্যাঁ, ওপাশে গুহা আছে। চলুন, যাওয়া যাক।’ বলল সে।
‘বাক্স-টাক্স নেই?’ রেমি জানতে চাইল।
‘আমি শুধু দেখে এসেছি গুহা আছে কিনা। বাক্সের খোঁজ করিনি।
ল্যাজলোর পেছন পেছন ঝরনাধারা ভেতরে ঢুকল ওরা। পানিটুকু পার হওয়ার পর দেখল ওরা এখন ৫ ফুট চওড়া একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে বেশ অন্ধকার।
পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাক নামিয়ে ফ্ল্যাশলাইট বের করল রেমি। ওর দেখাদেখি বাকিরাও ফ্ল্যাশলাইট বের করল। লাইট জ্বালিয়ে এগোলো সামনে।
আস্তে আস্তে চওড়া অংশ বাড়তে শুরু করল। সেইসাথে ভূমিও খাড়া হয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর ল্যাজলো’র হাত টেনে ধরল স্যাম।
‘দাঁড়ান।
ঝুঁকে মেঝে দেখল স্যাম। টর্চের আলো ফেলল দেয়ালে।
কী?’ ল্যাজলো জানতে চাইল।
‘বুবি ট্র্যাপ! হয়তো এখন অকেজো হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। পকেট থেকে সুইস আর্মি নাইফ বের করল স্যাম।
‘নিশ্চিতভাবে অকেজো করে দিতে পারবে?’ রেমি প্রশ্ন করল।
‘দেখে তো মনে হচ্ছে তারের সাহায্যে কাজ করবে এটা। এখন তারটা কেটে দিলেই অকেজো হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার আগে চেক করতে হবে তার কাটলে কোনো স্প্রিং ট্র্যাপ চালু হয়ে যাবে কিনা। যদি কোনো স্প্রিং ট্র্যাপ না থাকে তাহলে সহজেই সম্ভব।’
মনে হচ্ছে, আমরা ঠিক পথে এগোচ্ছি।’ বলল লিও।
হতে পারে। আমি তাহলে আমার কাজ শুরু করি।’ স্যাম খুব সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করল কোনো স্প্রিং ট্র্যাপ আছে কিনা। নিশ্চিত হওয়ার পর তারগুলো কাটতে শুরু করল।
‘এখানে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট বাক্স দেখতে পাচ্ছি। সবগুলো ধূলোয় ঢাকা, অনেক অংশে পচন ধরে গেছে। ওদিকে সাবধান। হতে পারে ওগুলোর গায়ে বোম সেট করা আছে কিংবা বিষাক্ত কিছু মাখানো আছে। কেউ আগেই কিছুতে হাত দিয়ো না কিন্তু। তাছাড়া পায়ের দিকেও খেয়াল রেখো। ট্র্যাপের তার থাকতে পারে।’
ওরা সাবধানে গুহা দেখতে শুরু করল। একটু পর লিও রেমি’র দিকে তাকিয়ে হাসল। চলুন আমি একটা জিনিস পেয়েছি।’
মাথা নেড়ে লিও’র পিছু নিল রেমি। ওর পেছন পেছন স্যাম আর ল্যাজলোও রওনা হলো।
মানুষ নির্মিত একটা ছোট কৃত্রিম গুহা দেখতে পেল ওরা। ওখানে কম করে হলেও ১৫ টা কাঠের বাক্স আছে, সবগুলো একটার উপর একটা রেখে স্তূপ করা। প্রত্যেকটা ২ ফুট বাই ২ ফুট সাইজের।
ল্যাজলো বাক্সগুলোর কাছে এগিয়ে গিয়ে একঅংশের ধূলো পরিষ্কার করে একটা লেখা পড়ল।
‘এটা তো কানজি ভাষা। এখানে বলছে এগুলো রাজা লক-এর সম্পত্তি।
‘এখন কীভাবে খোলা যায় সেটা জানতে চাচ্ছি।’ বলল লিও।
কাধ থেকে ব্যাকপ্যাক নামাল স্যাম। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।’ ব্যাগ থেকে বাক্স খোলার জন্য ক্রোবার ও ম্যাচেটি বের করল।
‘এটা দিয়ে শুরু করতে পারো।’ রেমি একটা বাক্স দেখিয়ে দিল।
“ঠিক আছে। আমার প্ল্যান হচ্ছে, বাক্সের উপরের পুরো কভারটা না খুলে বরং উপরের একটা অংশ ফুটো করে দেখব ভেতরে কী আছে। বিষয়টা নিরাপদ হবে।
ম্যাচেটি আর ক্রোবার নিয়ে কাজ নেমে পড়ল স্যাম। বাক্সের উপরের অংশে হাতের কব্জি সাইজের একটা গর্ত তৈরি করল। ভেতরে টর্চ লাইট তাক করে দেখল কী আছে।
কী দেখলে? খুব আগ্রহ নিয়ে লিও জানতে চাইল করল।
কাপড়। মখমলের কাপড়। তবে আমার মনে হচ্ছে কাপড়টা দিয়ে কিছু একটা ঢেকে রাখা হয়েছে। দাঁড়াও দেখছি। আগে বাক্সের উপরে থাকা ধূলোবালি পরিষ্কার করতে হবে।’
সবাই মিলে পরিষ্কার করল বাক্সটা। এবার ছুরি দিয়ে ভেতরের কাপড়টা কাটল স্যাম। দেখে নিল ভেতরে কী আছে।
‘এবার কী দেখলে? জিজ্ঞেস করল রেমি।
‘নিজের চোখেই দেখে নাও।’ রেমিকে জায়গা করে দিয়ে স্যাম সরে বসল।
দেখা শেষে রেমি বলল, “এটাই জগতের নিয়ম। কখনও হারতে হয়, কখনও জিততে হয়।’
‘তোমরা কী দেখছ? বলছ না কেন?’ রেমি সরে যেতেই গর্ত দিয়ে চোখ দিল লিও।
এতক্ষণে হাসল স্যাম। সোনা! বন্ধু, সোনা! বাক্সগুলো সোনায় ভরা!
.
৫৪.
তিন দিন পর
ঝরনার সামনে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছে। সাংবাদিক, পুলিশ, সাধারণ লোক… সেইসাথে স্যাম, রেমি, লিও, ল্যাজলো তো আছেই। সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আবার এখানে ফিরে আসতে বাড়তি সময় লেগেছে। ওদের। তবে কাজ চলছে পুরোদমে।
একটু পর গুহার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো ল্যাজলো, মুখে বিজয়ের হাসি। ওর পিছু পিছু লিওকেও দেখা গেল। স্যাম আর রেমি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছিল। এমন সময় ল্যাজলো বলল, কথার মাঝে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত তবে সুখবর হচ্ছে, আমরা তিন বাক্স হীরা আর রুবি পেয়েছি।
ওদের পামে পুলিশ চিফ দাঁড়িয়ে ছিল। নিঃসন্দেহে ভাল খবর। চালিয়ে যান।
‘আচ্ছা, চিফ, ডা. ভ্যানা’র দাদার কোনো হদিস জানতে পেরেছেন? জানতে চাইল রেমি।
‘হ্যাঁ, আমরা বিস্তর খোঁজ নিয়ে তথ্য পেয়েছি সে ১৯৮৮ সালে মারা গেছে। যুদ্ধের পর নিজের নাম বদলিয়ে এক অস্ট্রেলিয়ান র্যাঞ্চে গিয়ে কাজ নিয়েছিল।
ল্যাজলো’র দিকে তাকাল স্যাম। আপনি এবার ভাষণ দেয়ার প্রস্তুতি নিন।
‘ভাষণ? কেন? কী বলব?
“আরে, আপনি তো এখানকার জাতীয় হিরো হতে যাচ্ছেন। এই উদ্ধার করা গুপ্তধনগুলো দিয়ে এখানে স্কুল-কলেজ হবে, নতুন হাসপাতাল হবে, রাস্তা হবে। গুপ্তধনগুলোত আপনাকে ছাড়া খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতো না। অবশ্য এজন্য আপনার পাশাপাশি আমরাও গুপ্তধন থেকে একটা অংশ পুরষ্কার পাব।’
হা হয়ে গেল ল্যাজলো। “গুপ্তধনের অংশ? পুরষ্কার?
‘কেন? আপনাকে এখনও বলা হয়নি? সরকার ঘোষণা করেছে আমাদেরকে মোট গুপ্তধনের ১০% পুরষ্কার হিসেবে দেবে। ডলারের অংকে সেটা কয়েক লাখ হবে।’ বলল রেমি।
ব্যাপক ব্যাপার।
স্যাম হাসল। জমিদারি হালে জীবনযাপন করার প্রস্তুতি নিন, লর্ড ল্যাজলো সাহেব!
‘এসব লিও জানে?
না, এখনও জানে না। বলব..’
‘আমি স্বচক্ষে দেখতে চাই এত বড় খুশির সংবাদ শোনার পর তার হুতুম পেঁচা মার্কা মুখভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয় কিনা।
লিও একটা পাথরের গায়ে থাকা চিত্র দেখছিল। রেমি গিয়ে খুশির খবরটা দিল ওকে। এদিকে স্যাম আর ল্যাজলো খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে লিও’র চেহারার দিকে। কিন্তু রাশিয়ানের চেহারার মাঝে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না।
স্যাম কনুই দিয়ে লিও-কে গুঁতো দিল। কী ব্যাপার? খুশি হওনি?
আরে ধুর, আগামী ৫ বছর যদি সাগরের নিচের ওই শ্যাওলা পরিষ্কার করে ইমারত বের করতে হয় তাহলে কী করব এত অর্থ দিয়ে?
ভবিষ্যতে বিভিন্ন অভিযানের কাজে ব্যয় করতে পারবে। রেমি বলল।
‘যে জিনিস দেখতে পাইনি সেটা আমি বিশ্বাস করি না।’
বন্ধু, নিশ্চিত থাকো, ডলারগুলো তুমি পাচ্ছ।’ ওকে আশ্বস্ত করল স্যাম।
‘দেখো, সোনা থেকে ডলারে মূল্যমান পরিবর্তন করার সময় সুযোগে কম করে দেবে।’
মনে হয় না।’ স্যাম আপত্তি করল।
“ঠিক আছে। সময় আসুক। দেখো।
লিও’র কথা শুনে হেসে ফেলল সবাই।
চাপড় দিয়ে একটা মশা মারল লিও। এইখানে আর কয়েকদিন থাকলে আমারও ম্যালেরিয়া হয়ে যাবে। তারপর চিকিৎসা করাতেই খরচ হবে সব ডলার!
‘ভাল দিক চিন্তা করো। হয়তো নিজের একটা রিসার্চ শিপও কিনে ফেলতে পারো।’ বলল স্যাম।
তা হচ্ছে না। আমার হাতে ডলার এসেছে শুনলে দেখবে কত কাজিন। এসে খাতির জমাতে চাইবে। পুরানো বান্ধবীগুলো উদয় হবে। যারা এতদিন ভুলেও আমার খোঁজ নেয়নি। এমনকি দেখা যাবে তাদের অনেককে আমার মনেই নেই।
ওরা সবাই বুঝল বড়লোক হিসেবে লিও’র ভাগ্য খুব একটা ভাল যাবে না হয়তো। অর্থ কারও কাছে উপভোগের আবার কারও কাছে বোঝ।
‘এই যে মিসেস ফারগো, আমার সাথে ভেতরে যাবে? ভেতরে একটা প্যাসেজ আছে। ওটায় এখনও কেউ যায়নি। চলো, দেখে আসি। প্রস্তাব দিল লিও।
‘আমাকে কেন নিতে চাইছ? রেমি জানতে চাইল।
‘তোমার আদরের স্বামী তো এখন সেলিব্রেটি। সাংবাদিকদেরকে সাক্ষাৎকার দিতেই ব্যস্ত। তাই তোমাকে নিতে চাচ্ছি। তাছাড়া ওদের চেয়ে তোমার সঙ্গই আমার বেশি ভাল লাগে।’
‘যাও, যাও। মুচকি হেসে বলল স্যাম। তবে কোনো সমস্যা হলে একটু চিৎকার কোরো। আমি, পুলিশ চিফ আর ল্যাজলো হাজির হয়ে যাব।
লিও আর রেমি ঢুকল গুহার ভেতরে। একটা বিশাল পাথরের সামনে থামল লিও।
‘এই যে, এই পাথরটায় সংকেত দেয়া আছে। আরেকটা প্যাসেজ আছে এখানে।’
হাতের লাইটটা পাথরের দিকে ধরল রেমি। আমি তো কোনো সংকেত দেখতে পাচ্ছি না।’
‘এটা একটা দরজা। খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল লিও। পাথরটার একপাশে কাঁধ ঠেকিয়ে শক্তি খাটাল ও।
‘লিও, তুমি অযথা সময় আর শক্তি নষ্ট করছ। এই পাথরটার সাইজ দেখেছ? কম করে হলেও ২০ ফুট লম্বা। ওজন হবে কয়েক টন…’।
এমন সময় ধীরে ধীরে পাথরটা দরজার মতো একপাশে সরে গেল। ব্যাপারটা কোনো এক যান্ত্রিক শক্তির সাহায্যে হয়েছে বলে মনে হলো।
“আরে এটা তো একটা টানেল। ফিসফিস করে বলল রেমি।
‘তুমি স্লিম আছো। তুমিই আগে ঢোকো।’
আপত্তি না তুলে রেমি ঢুকল ভেতরে। এটা দিয়ে কতদূর গিয়েছিলে?”
‘বেশি না। মোটামুটি ৬০ ফুটের মতো। তারপর আমার টর্চের ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই অন্ধকারে আর এগোয়নি।
রেমি টর্চ নিয়ে এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “লিও!!
যাক দেখতে পেয়েছ তাহলে। এবার বুঝেছ কেন তোমাকে নিয়ে এসেছি?’
লিও আমি ভূতুড়ে আলো দেখতে পেয়েছি… কী ছিল ওটা?’
‘আমার মনে হয় কোনো পাথরে টর্চের আলো প্রতিফলিত হয়ে হয়েছে ওটা।
না, না। আমি নিশ্চিত ওটা একদম বাস্তব। কোনো প্রতিফলন নয়।
“ঠিক আছে। তাহলে তোমার হাতের টর্চ বন্ধ করে দাও। তারপর দেখো, ওই আলো আর দেখতে পাও কিনা।’
কথামতো টর্চ বন্ধ করল রেমি। কয়েকমিনিট কিছুই হলো না। তারপর হঠাৎ…
‘লিও, দেখো… আবার!
‘হুম দেখলাম। লিও এমনভাবে জবাব দিল যেন এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
‘বিষয়টা তদন্ত করতে হবে। তাগাদা দিল রেমি।
লিও কয়েকমুহূর্ত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ঝাঁকি দিল ওর হাতে থাকা টর্চ লাইটে। নিভু নিভু আলো নিয়ে জ্বলে উঠল ওটা।
‘তুমি এখানেই অপেক্ষা করো। আমি ওদেরকে নিয়ে আসছি।’
রেমি আপত্তি করল না।
প্রথমে আস্তে আস্তে পা ফেললেও পরে দ্রুত পা চালাল লিও। প্রতি পদক্ষেপে ওর দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
***
স্যাম ও ল্যাজলোকে নিয়ে গুহার ভেতরে ঢুকল লিও। সাথে আছে রব আর গ্রেগ। ওদের হাতে টর্চ।
‘রেমি কোথায়? জানতে চাইল স্যাম।
লিও হতভম্ব। রেমিকে ও যেখানে রেখে গিয়েছিল সেখানে কেউ নেই! ‘আমি ওকে এখানে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। আমার মনে হয় সে একাই ভূতুড়ে আলোর তদন্ত করতে সামনে এগিয়ে গেছে।
লিও’র দিকে চোখ গরম করে তাকাল স্যাম। ভূতুড়ে আলো? তুমি তো এব্যাপারে এরআগে কিছু বলোনি?
‘টানেলের ওই মাথায় আলো প্রতিফলিত হয়। মানে টর্চ বন্ধ করার পরেও প্রতিফলিত হয় আরকী। আমি ভেবেছিলাম ওটা তেমন কিছু না…’।
‘আমাদের ওকে খুঁজে বের করতে হবে। চলোলা। আর সময় নষ্ট করা যাবে না।
সবার সাথে এগোচ্ছে স্যাম। যত সামনে এগোচ্ছে ভয়ে, দুশ্চিন্তায় ওর গলা শুকিয়ে আসছে। রেমিকে ও অনেক ভালবাসে। রেমি’র কিছু হয়ে গেলে সহ্য করতে পারবে না। এগোতে এগোতে মৃদু একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো টানেলের গভীর থেকে।
‘স্যা,…ম? স্যা….ম!
‘রেমি! চিৎকার করে উঠল স্যাম। ছুটে গেল শব্দের উৎসের দিকে। কোনো সম্ভাব্য বিপদের কথা মাথায় রেখে কোনো সতর্কতা অবলম্বন করার প্রয়োজনবোধ করল না।
‘রেমি! আমি তোমার ফ্ল্যাশলাইটের আলো দেখতে পাচ্ছি না। বলল স্যাম।
‘দেখবে কীভাবে? ব্যাটারি শেষ।’ রেমি অন্ধকারের আড়াল থেকে জবাব দিল।
কয়েক সেকেণ্ড পর রেমিকে দেখতে পেল স্যাম। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে। ঠোঁটে কষে চুমো খেলো।
“লিও তোমাকে যেখানে রেখে গিয়েছিল তুমি ওখানে অপেক্ষা করলে না কেন? জানতে চাইল স্যাম।
‘আমি তো জানি ও তোমাদেরকে নিয়ে চলেই আসবে। ভাবলাম এই ফাঁকে একটু ঘুরে দেখি।’ রেমি সোজাসাপ্টা জবাব দিল।
স্ত্রী’র খুকির মতো জবাব শুনে হেসে ফেলল স্যাম। যা করেছ, করেছ। আর কখনও এমন করবে না। আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রেমিকে।
লিও সামনে এগিয়ে এসে কাশি দিল। এহেম, এহেম, রোমিও জুলিয়েটকে আবার একসাথে দেখে আমরা সবাই খুশি। এবার একটু কাজের কথা বলি। রেমি, ইন্টারেস্টিং কিছু দেখতে পেলে?
মাথা নেড়ে সায় দিল রেমি। এখান থেকে ৫০ ফুট সামনে টানেলটা পুরোপুরি মানুষের নির্মিত। একদম মসৃণ। ওটা বেশ উজ্জ্বল। আলোটা ওখান থেকেই আসে।
সামনে এগিয়ে গেল ওরা।
মসৃণ টানেলের মেঝের দিকে ঝুঁকল লিও। এটা দেখে তো মনে হচ্ছে। পালিশ করা।
‘বড় অদ্ভুত। এরআগে কখনও এরকম টানেল দেখিনি।’ ল্যাজলো বলল বিড়বিড় করে।
টানেলের পরে অন্ধকার। সেদিকে টর্চ তাক করল রেমি। এগিয়ে গেল। ওর পিছু নিল স্যাম। কিন্তু আচমকা রেমি ছুটে ফিরে এলো ওদিক থেকে। ওর চেহারা থেকে যেন সব রক্ত সরে গেছে।
কী হয়েছে, রেমি? কী দেখেছ?’ স্যাম জানতে চাইল।
“ওহ, স্যাম! ওই চেম্বারটা মরা মানুষে ভর্তি।
.
৫৫.
রব ও গ্রেগ চেম্বারের ভেতরে জেনারেটর বসিয়ে ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে দিল। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হলো পুরো চেম্বার। ধাধিয়ে উঠল টানেল।
ক্যামেরা বসানো হয়েছে? জানতে চাইল স্যাম।
‘হ্যাঁ, ভিডিও করে রাখা হচ্ছে সব।’ রব সায় দিল।
কিছুক্ষণ পর উজ্জ্বল আলোতে ওদের চোখ সয়ে আসার পর পরীক্ষা করে দেখতে পেল টানেলটা সিলিকা দিয়ে তৈরি। তাই এভাবে আলো প্রতিফলন করে দিতে পারে।
রেমি আরও একটু ভাল করে পরীক্ষা করে বলল। সিলিকার সাথে সোনার দানাও আছে।’
অর্থাৎ, দানাদার সিলিকা ও সোনার মিশ্রণ দিয়ে এই টানেলটা তৈরি করা হয়েছিল।
‘রেমি ঠিকই বলেছে।’ সায় দিল লিও। অবশ্যই এরকম মিশ্রণযুক্ত খনি পৃথিবীতে খুব কমই আছে। গহনা তৈরির জন্য এগুলোর অনেক চাহিদা।
চেম্বারের গভীরে বৃত্তাকারে প্রায় ১০০ টা মমি বসিয়ে রাখা আছে। তবে মমিগুলোর গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। অর্থাৎ, এরা সবাই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছিল।
সামনে একটা বড় ভল্ট দেখাচ্ছে। সবাই সেদিকে এগিয়ে গেল।
‘ও খোদা, এই ব্যক্তির মমি তো ১৭ ফুট লম্বা!’ আঁতকে উঠে বলল স্যাম।
‘তার পাশে থাকা নারী মমিটাও প্রায় কাছাকাছি দৈর্ঘ্যের।’ রেমি বলল।
বিড়বিড় করল লিও। জায়ান্ট… সত্যিকারের জায়ান্ট। লোককাহিনিগুলো সত্য। আচ্ছা, এগুলোর বয়স কত হবে?
‘প্রায় দুই-তিন হাজার বছর। এদেরকে সম্ভবত দেবতা হিসেবে পূজা করা হতো। জবাব দিল স্যাম।
‘কিন্তু অত বছর আগে তারা সাগরের মাঝখানে থাকা এই দ্বীপে এলো কীভাবে? রেমি জানতে চাইল।
‘সেটা বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবে।’
মমিগুলোর অধিকাংশ নারী। তাদের পোশাকগুলো বেশ সুন্দর। সারা শরীর বিভিন্ন দামী রত্নের গহনায় ভরা।’
হাসল স্যাম। তখনকার দিনে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা পাথরের মতো মূল্যবান রত্ন খুব সহজেই পাওয়া যেত। তাই সবাই পরত ওগুলো।
এদের পরিচয় কীভাবে জানব আমরা? জানতে চাইল গ্রেগ।
যা দেখছি এরচেয়ে বেশি হয়তো জানা সম্ভব হবে না। তবে এখন আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে এটাকে গোপন রাখা। এখানকার সরকার যতদিন না পর্যন্ত এই মমিগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার মতো ল্যাব বা জাদুঘর তৈরি করার মতো অবস্থায় না যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত বিষয়টা গোপনই রাখতে হবে। নইলে নষ্ট হয়ে যাবে এগুলো।
‘ভাল বলেছ।’ রেমি সায় দিল। সরকার গুপ্তধন পেয়েছে এবার সেটাকে যথাযথ ব্যয় করার জন্য আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র পেল।
কী দরকার জাদুঘর করার? এখানেই তো ভাল আছে এতগুলো বছর ধরে।’ বলল লিও।
‘না, এদের বিষয়ে সবার জানা উচিত। তাই জাদুঘরের প্রয়োজন আছে। স্যাম নিচু গলায় বলল। আজ আমরা এখানে শুধু একটা ঐতিহাসিক স্থানই আবিষ্কার করেনি, সেইসাথে এমন একটা জাতি আবিষ্কার করেছি যেটার কথা কেউ জানতো না পর্যন্ত। সোনা, মূল্যবান রত্ন, তৎকালীন সময়ের চেয়ে উন্নত সমাজ… এবং জায়ান্ট; লোককাহিনিগুলো সব সত্য।
গল্প মানে এমনই হওয়া দরকার। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে টান টান উত্তেজনা। অনিবাদ কারককে অনেক ধন্যবাদ জানাই এইরূপ একটি বই অনুবাদ করে আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।
Wow that’s awesome. Thank you so much.