৫০
বছর খানেক হলো খুলনা জেলার পাটকেলঘাটায় ফুড ইন্সপেক্টর হিসেবে পোস্টিং নিয়ে এসেছে হাজারি।
বাসা নিয়েছে কপোতাক্ষ নদ-এর এপারে কুমিরা গ্রামে। গ্রামটিতে মূলতঃ অভিজাত ব্রাহ্মণ, কায়স্থদের বাস। বেশ কয়েকটা বিল্ডিং-দোতলা, একতলা। বাকি সব পাকা দেয়ালের টিনের বাড়ি সংলগ্ন উঠোন, পুকুর, গাছ-গাছালি, ফল বাগান ইত্যাদি মিলে অনেক জায়গা নিয়ে বাড়িগুলো।
একতলা বাড়ির বড় একটা কামরা ভাড়া নিয়ে সংসার পেতেছে হাজারি। এই গ্রামে শুধু প্রাইমারিই নয়, হাই স্কুলও আছে একটা নামকরা। কুমিরা হাই স্কুল ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত। গোটা এলাকাজুড়ে স্কুলের সুনাম। এ কারণেই হাজারির এই গ্রামে বাসা নেয়া। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে সে অতি সচেতন। দুই ছেলেকে ভর্তি করে দিয়েছে এই স্কুলে।
হেডমাস্টার পশুপতি ঘোষ আশায় বুক বেঁধে আছেন। তাঁর গোটা শিক্ষকতা জীবনে এমন মেধাবী ছাত্র কখনও পাননি। ইন্সপেক্টর বাবুর বড় ছেলে কানু ক্লাস এইটে আর মেঝো ছেলে দুলাল ক্লাস ফাইভে। তার দৃঢ় বিশ্বাস এরা দুজনেই তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন সার্থক করে দেবে।
কুমিরা স্কুল থেকে এখনও পর্যন্ত কেউ বৃত্তি পায়নি। না ক্লাস ফাইভে, না ক্লাস এইটে। এবার ওরা দুই ভাই বৃত্তি এনে দেবে। ক্লাস এইটে আরো একজন মেধাবী ছেলে আছে। তার নাম তুলসী। ক্লাস ফাইভে আছে প্রীতিলতা। সে হিসাবে এবারের দুটো ব্যাচই ভালো।
স্বপ্ন দ্যাখেন পশুপতি বাবু। এবার প্রাইমারি আর মাধ্যমিক দুই স্তরেই বৃত্তি পাবে তার স্কুল।
পশুপতি বাবু মির্জাপুরের জমিদার বাড়ির বড় ছেলে। কলকাতা থেকে বিএ পাস করেছেন সেই ব্রিটিশ আমলে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পেয়েছিলেন, কিন্তু করেননি। এসে যোগ দিলেন এই কুমিরা স্কুলে শিক্ষক হিসেবে। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী পশুপতি বাবু ন্যায়নিষ্ঠ স্বাত্ত্বিক মানুষ। ছাত্ররা তার কাছে সন্তানবৎ। তার ধ্যান, জ্ঞান, স্বপ্ন সব এই ছাত্ররাই।
পশুপতি বাবু পোশাকে-আশাকেও অনন্য। সদ্য পাট ভাঙা সাদা ফিনফিনে ধুতি আর পাঞ্জাবি পরেন তিনি। কাঁধের উপরে থাকে ভাজ করা ঘিয়ে রঙের দামি কাশ্মীরি শাল। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সারা বছর ধরেই এই একই পোশাক। অন্য কোনো পোশাকে কেউ কোনোদিন তাকে দেখেছে বলে মনে হয় না।
সকালে ক্লাস শুরু হবার পর তিনি গম্ভীর মুখে টহলে বের হন। ধীরপায়ে পুরো স্কুলটা ঘোরেন। সাথে থাকে জোড়া বেত হাতে চাপরাশি ভুবনেশ্বর। এই বেত কোনোদিন কারো উপরে ব্যবহার হয়েছে বলে কেউ শোনেনি। কিন্তু তিনি যখন টহলে বের হন তখন গোটা স্কুলজুড়ে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা, থথমে হয়ে যায় পরিবেশ। অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপতে থাকে ছাত্রদের। নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভুলে যায় সবাই।
সাবধানতা অবলম্বন করলেন পশুপতি বাবু। ক্লাস এইট আর ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কোচিং-এর ব্যবস্থা করলেন। মোট আঁজন পরীক্ষার্থী। টিচাররা এর জন্যে আলাদা করে কিছুই পাবে না। সিনিয়র টিচার কালি বাবু কিছু একটা বলার চেষ্টা করেছিলেন। পশুপতি বাবু এমন কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলেন যে, কালি বাবুর অন্তরাত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।
দম নিয়ে একটু পরে শান্ত গলায় পশুপতি বাবু বলেছিলেন–স্কুলের সুনাম সবার আগে। হিমাংশু বাবুর ছেলে দুটোকে দিয়েই স্কুলে বৃত্তি আনতে হবে। এই সুযোগ আর কোনোদিন আসবে কি না জানি না। তাই এ ব্যাপারে আমি দ্বিতীয় কোনো কথা শুনতে চাই না।
সবাই বুঝে গিয়েছিল কী করতে হবে। কাজে নেমে পড়েন শিক্ষকরা। মহা সমারোহে শুরু হয়ে গেল কোচিং। কে কার চেয়ে কত ভালো করবেন, সেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল সবাই।
সন্ধ্যায় পশুপতি বাবু বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ঘোরেন। পড়াশুনা ঠিকমতো হচ্ছে কি না দ্যাখেন। কথা বলেন অভিভাবকদের সাথে। তাদেরকে বোঝান শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। ঘুরেফিরে সবার শেষে এসে বসেন তার প্রিয় ছাত্র কানুদের বাসার বারান্দায়। এখানে এসে বড় আরাম বোধ করেন তিনি। হিমাংশু বাবুর সাথে বসে নানা বিষয়ে কথা বলেন। পরামর্শ নেন। তিনিও শিক্ষক ছিলেন একদা। তাই আলাপটা জমে ভালো।
রাতের বেলা এখন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আছে। কাশ্মীরের আধিপত্য নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে গেছে। এটা বর্ডার এলাকা। ইন্ডিয়ার প্লেন সুযোগ পেলেই বর্ডার ক্রস করে পাকিস্তানের সীমানায় ঢুকে পড়ে, বোমাবর্ষণ করে। আলোর নিশানা ধরে বোমা ফেলতে পারে তাই রাতে আলো জ্বালানো নিষেধ, বাইরে চলাচলও নিষেধ। সরকার থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, রেডিওতে ইন্ডিয়ার কোনো স্টেশন ধরা যাবে না, খবর শোনা যাবে না। ধরা পড়লে কঠিন শাস্তি। সন্ধ্যার পরে পুলিশের টিকটিকিরা সাদা পোশাকে চারদিকে ঘুরঘুর করে।
কিন্তু হেডমাস্টার পশুপতিবাবু এসব কেয়ার করেন না। তিনি বের হয়ে পড়েন। প্রথম দিকে দু’একবার পুলিশ তাকে ধরলেও এখন তাকে চিনে গেছে সবাই। তিনি এলাকার অতি সম্মানী মানুষ। আর যাই হোক পাকিস্তানবিরোধী। কোনো কাজের সাথে তিনি সম্পৃক্ত নন। ওসি সাহেবের নির্দেশ, উনাকে কিছু বলা যাবে না। তাই সালাম দিয়ে পুলিশের লোকেরা বলে–স্যার, সময় ভালো না। বেশিক্ষণ বাইরে না থাকাই মঙ্গল। ছাত্রদের দেখে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান স্যার।
পশুপতি বাবু ব্রাহ্মণ নন, কায়স্থ। তবু এলাকার রীতি অনুযায়ী নমশূদ্রের ঘরে তার ভাত খাওয়া চলে না। অন্নপাপ হয়। কিন্তু লুচি মাংসে দোষ নাই। তাই হেডমাস্টার বাবুর জন্যে হাজারি আলাদা ব্যবস্থা রাখে। আলুর দম শেষ করে মাংস দিয়ে লুচি চিবুতে চিবুতে পশুপতি বাবু বললেন–বৌদির হাতের রান্নার কোনো তুলনা হয় না। একেবারে মুখে লেগে থাকে।
খনা আর একটু মাংস পাতে তুলে দিয়ে বলল–মাস্টেরমশাই, আমার অনেক ভাগ্যি যে, আপনার মতো মানষিরি নিজির হাতে রাধে খাওয়াতি পারতেছি।
না, না অমন করে বলবেন না, বৌদি। লোভ আরো বেড়ে যাবে। শেষে দেখবেন, প্রতিদিন এসে পাত পাড়ছি আপনার এখানে। বলে হাঃ হাঃ করে হাসলেন পশুপতি বাবু।
বিরক্ত কেন বলতেছেন? সেরম হলি তো আমি খুশিই হতাম। খনা বিগলিত হয়ে বলল।
খেতে খেতে পশুপতি বাবু লক্ষ করেন নিবিষ্ট মনে পড়ায় রত কানুকে। ফর্সা সুন্দর মুখখানা, মাথাভরা কোঁকড়া চুল। তিনি স্বপ্ন দ্যাখেন, এই ছেলে তার স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে। এইটের বৃত্তি তো পাবেই, এসএসসি পরীক্ষাতেও সে স্ট্যান্ড করবে।
পাশাপাশি দ্যাখেন অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরা দুরন্ত আর এক শিশুকে। তার নাম দুলাল। পিঠাপিঠি দুই ভাই। কিন্তু না আছে তাদের চেহারায় মিল, না আছে আচার-আচরণে। দুলালের গায়ের রং শ্যামলা। চুলগুলো খাড়া খাড়া। স্কুলের সবকিছুর সাথেই আছে সে। সারাদিন কাটে তার খেলাধুলা, মারামারি, হৈচৈ, দৌড়, সাঁতার, ফুটবল, হা-ডু-ডু এসব নিয়ে। টিফিন পিরিয়ডেও সে বসে থাকে। ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে সে ক্লাসে এসে ঢোকে। টিচার বকা দেয়, সে হাসে।
বলে–এখনই শুকোয়ে যাবে নে স্যার। এর এটা কেড়ে নেয়, ওকে ধম করে একটা ঘুষি মেরে দেয়। টিচার শাস্তি দিলে দিব্যি মাথা পেতে নেয়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এত কিছুর পরেও সে ক্লাসের ফার্স্ট বয়। স্যাররা ব্যস্ত থাকলে তাকে ক্লাসে পড়ানোর দায়িত্ব দিয়ে যান। এর সুফল দুটো। প্রথমত টিচার নিশ্চিত থাকেন যে, ক্লাসে আর কোনো হৈচৈ অথবা মারামারি হবে না। যে গণ্ডগোল করবে সে-ই তো পড়ানোর কাজে ব্যস্ত। দ্বিতীয়ত সে চমৎকার করে বুঝিয়ে পড়াতেও পারে।
লম্বা সময় ধরে পড়ার ধৈর্য দুলালের নেই। সে কানুকে খোঁচা দিচ্ছে, নানাভাবে বিরক্ত করছে তাকে। কানু বিরক্ত হলেও কিছু বলে না। সে বড় ভালোবাসে তার এই দুরন্ত ছোট ভাইটাকে। উপলব্ধি করলেন পশুপতি বাবু, পড়ার মাদুর থেকে উঠে যাবার জন্যে উশখুশ করছে দুলাল। তার ভয়ে উঠতে পারছে না। খানিকটা মায়া হলো তার, দুষ্টু এই ছেলেটার জন্যে। তিনি পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন, সত্যি সত্যি সৰ পড়া সে শেষ করেছে কি না।
এই যে, এদিকে এসো তো।
দুলাল উঠে এগিয়ে যায়।
পড়া হয়ে গেছে?
আজ্ঞে স্যার।
বাড়ির অংক করেছো?
হ্যাঁ, স্যার।
কৈ আনো তো দেখি।
আনতি হবে না স্যার। অনুশীলনী এগার-এর ষোল থেকে পঁচিশ নম্বর পর্যন্ত ঐকিক নিয়ম। সব কয়ডা করে ফেলিছি। ষোল নম্বর অংকের উত্তর সাতাশ দিন। সতের-এর উত্তর আঁ ঘণ্টা। আঠারো-এর উত্তর…
হয়েছে, হয়েছে। আর বলতে হবে না, কাছে এসো।
কাছে আসতেই তিনি দুলালের মাথায় হাত রেখে বলেন–আশীর্বাদ করি জীবনে অনেক বড় হও। বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করো। যাও, আর বসে থাকতে হবে না।
তারপর বায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন–বুঝলেন ইন্সপেক্টর বাবু, কানু আমাদের সবার প্রিয়। কিন্তু এ হলো আসল ট্যালেন্ট। কিন্তু বড়ই অস্থির। ঠিকমতো হ্যাঁন্ডেল করতে হবে।
ঠিকই বলেছেন আপনি। ওর সব দিকে আগ্রহ, খালি পড়াশুনাটা বাদে। অথচ কী অবাক কাণ্ড দ্যাখেন। সেদিন মারামারি করে এসেছে। বাড়ি বয়ে নালিশ দিয়ে গেল বোস গিন্নি। ভাবলাম পড়াশুনায় তো মন নাই, পড়া ধরেই ওকে একটু শায়েস্তা করি। ভাইপোকে বললাম কঞ্চি কেটে নিয়ে আসতে। কিন্তু বিশ্বাস করেন, সেই কঞ্চি আমি ব্যবহার করার সুযোগই পেলাম না। না অংক, না ইংরেজি–কোনো সাবজেক্টেই তাকে আঁকাতে পারলাম না। পড়াশুনার নামগন্ধ নাই। সারাদিন শুধু খেলা আর মারামারি। অথচ সব পড়া তার মুখস্থ। বড় ভাবনা আমার ওকে নিয়ে।
চিন্তা করবেন না। বড় হলে দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। সায় দিয়ে বলেন হেডমাস্টার।
তারপর অপত্য স্নেহের দৃষ্টি মেলে তিনি তাকিয়ে থাকেন তিনি দুলালের দিকে।
৫১
কোলাহল আর চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল হাজারির।
অনেক দিন পর বাড়ি এসেছে সে। রাতে কয়েকজন মিলে মাছ ধরতে গিয়েছিল বিলে। সন্ধ্যায় জাল পেতে এসেছিল। খাওয়া-দাওয়া সেরে সদলবলে নৌকায় চলে গিয়েছিল। কাজের মধ্যে মাঝে মাঝে জাল দেখা, জালে আঁকানো মাছ ছাড়িয়ে নৌকার খোলের মধ্যে ফেলে দেয়া। আর সারারাত জেগে বসে টুয়েন্টি নাইন খেলা, আড্ডা মারা, গালগপ্প করা।
হাজারির অবিশ্যি আর একটি উদ্দেশ্য ছিল। গ্রামে একটা সমিতি গড়ে তোলার চেষ্টায় আছে সে। ওদের সাথে সেটা নিয়ে পরামর্শ করেছে। নামও ঠিক করে ফেলেছে সমিতির। মধুপুর যুব সমিতি। চাঁদা তুলে একটা তহবিল গঠন করতে হবে। সেই তহবিল থেকে যার প্রয়োজন সে ঋণ নেবে, কাজে লাগাবে, তারপর সুদসহ ফেরত দেবে। সুদের হার হবে কম। এভাবেই একদিন বড় অংকের টাকা হবে। সেই টাকায় নৌকা কিনে ভাড়া খাটানো হবে, সাথে থাকবে রাখি মালের ব্যবসা। এসব আলোচনা করে শেষরাতে ওরা বাড়ি ফিরেছে। তাই ঘুমাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।
আবার ভেসে এলো সেই চিৎকার-বাঁচাও। ও মাগো, মারে ফেলালো, তুমরা কিডা কনে আচো, আমারে বাঁচাও…।
এ তো চিৎকার নয়, রীতিমতো আর্তনাদ। কান খাড়া করে সে বোঝার চেষ্টা করল কোন দিক থেকে আসছে। ঘটনাটা কী হতে পারে!
শব্দটা ভেসে আসছে পুব পাড়া থেকে। মহিলা কণ্ঠের আর্তচিৎকার।
তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল হাজারি। দোর খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। বৌদিরা উঠোনে গোবর ছড়া দিচ্ছে। নির্বিকার সবাই। যেন কিছুই হয়নি। এর ভিতরে আবার আর্তনাদ।
কী হইচে মাঝে বৌদি? চিৎকার করে কাঁদে কিডা?
কিডা আবার, দীনোর বৌ। দীনো মানে দীনবন্ধু।
ক্যান, কী হইছে?
হবি আবার কি! রানতি দেরি অইচে। মাঠের তে দীনো আসে দ্যাহে ভাত হয় নাই। বৌরে গাল পাড়িছিল। বৌও তার সাথে চোপা করিচে। আর যাবি কনে? সাথে সাথে হালোর নটি দিয়ে বসান দেচে।
বুঝলাম। তা, কেউ ঠেকাতি পারতেছে না!
ঠেকাবি ক্যা? তার বৌরি সে মারতেচে। কবারই বা যাবি কিডা, ঠ্যাহাবারই বা যাবি কিন্ডা!
কও কী বৌদি! এট্টা মানুষরে এরকম করে মারবি, কেউ তারে ঠেকাতিউ যাবি নে?
মিয়া মানুষ, এট্টু চুপ করে থাহলিই তো পারে। মুহি মুহি এত চোপা করার দরকার কী?
দৌড় দিল হাজারি। বাড়ির উঠোনে গরু তাড়ানোর লাঠি দিয়ে সমানে পিটিয়ে যাচ্ছে দীনবন্ধু তার বৌকে। তার চিৎকার আর আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। অনেক মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। কেউ ঠেকানোর চেষ্টাও করছে না।
শালীর মাগি, মুহির পর কথা কোস, এত বড় সাহস! হালোর পাঁচন দে বাড়ায়ে তোর চোপা ভাঙে ফ্যালাবো। বলেই আর এক বাড়ি কষাল দীনো।
ও মাগো, মারে ফেলল। এট্টাও কি মানুষ নাই এ দ্যাশে, আমারে বাঁচায়!
কুন শালা তোরে বাঁচাতি আসপি? কেউ বাঁচাতি পারবি নে। আজ তোরে খুন করে ফাঁসি যাব।
সাথে সাথে আরেকটা বাড়ি দিল সে। কিন্তু সপাং শব্দটা আর হলো না। অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই দীনবন্ধু দেখল তার হাতে লাঠি নাই। লাঠিটা হাজারির হাতে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সপাং শব্দটা হলো দীনোর পিঠে। একের পর এক সে শব্দ বাড়তেই থাকল। ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছে। তাকে হাজারি। বিস্ময়ে হতবাক দীনো বুঝতে পারছে না, হচ্ছেটা কী? কী তার অপরাধ! হতবাক উপস্থিত সকলেই। অকারণে হাজারি মারছে কেন দীনোকে!
হাজরা, বাবাজি করো কী? থামো। উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন রসিক খুড়ো।
সপাং করে এবারের বাড়িটা পড়ল রসিকলের পিঠে। অস্ফুট শব্দ বের হয়ে এলো সকলের মুখ থেকে। গুরুজনের গায়ে হাত তোলার চল বিল সিংহনাথের সমাজে নাই। এ বড় কঠিন অপরাধ। এ সাহস কেউ কখনও করে না। কিন্তু হাজারি নির্বিকার, কারো দিকে ফিরেও তাকাল না। ঘুরে আবার সে পেটানো শুরু করল দীনোকে। বাড়ির পর বাড়ি পড়তে থাকে তার পিঠে। রসিকের পরিণতির পরে আর কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। কিন্তু অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে সকলের মধ্যে। হাজারি কি পাগল হয়ে গেল?
দীনোর বৌ এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে। সে বুঝতে পারে, তার স্বামীকে হাজারি লাঠিপেটা করছে। সে কাকুতি-মিনতি শুরু করল–ঠাউর পো, ওরে ছাড়ে দ্যাও। তোমার পায়ে ধরি ঠাউর পো। সত্যি সত্যি সে হাজারির পা জড়িয়ে ধরল।
থামল হাজারি। তার চোখ-মুখ রাগে গনগন করছে। এই অনাচার, এই অবিচার সে আর সহ্য করবে না।
দ্যাখ হারামজাদা। তুই যারে গরুর মতো পিটাচ্ছিলি, যার জন্যি তোর কোনো দয়ামায়া নাই, সেই তোরে বাঁচানের জন্যি কান্নাকাটি করতেচে। শেক হারামজাদা, ভালো করে শেক। মেয়ে মানষির কাছের তে শেক।
তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলে–বাঁচে গিলি আজ। তোর বৌর জন্যে বাঁচে গিলি তুই।
লাঠিটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় হাজারি।
শোনো তোমরা সবাই ভালো করে শুনে রাখো। আজকের তে মধুপুর গ্রামে মেয়ে মানষির গায় হাত তোলা নিষেধ। আমারে তো ভালো করে চেনো। কাউরে রেয়াত করব না আমি। রসিক খুড়োরে দেখেই তো বুজতি পারতিছো। কেন মারিছি খুড়োরে! মারিছি তার কারণ, অন্যায়ভাবে একজন গরুর মতো বৌরে পিটাচ্ছে, আর সে গুরুজন হয়ে তোমাগের সাথে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে মজা দেখতেচে। নিষেধ করতেছে না, ঠেকাচ্ছেও না। আবার আমারে জিজ্ঞেস করে, আমি ক্যান দীনোরে মারলাম।
তার বৌরে সে মারিছে। আমরা ঠেকাঁপো কোন অধিকারে?
যে অধিকারে দীনোরে ঠেকাতি গিছিলে, সেই অধিকারে। দীনো একজন মানুষ। তার বৌও একজন মানুষ। আগে সে মানুষ, তারপর সে বৌ। তাই বৌ হলিও তারে এরম করে গরুর মতো মারা যাবি নে। এট্টা চোর রে মারলিও মানষির মনে মায়া হয়। আর তোমরা? আবার জিজ্ঞেস করো কিসির অধিকারে! মেয়েরা হলো, মায়ের জাত। মায়ের গায় হাত তুলা যাবি নে। দেশে আইন আছে, নারী নির্যাতন করলি কঠিন সাজা। দীনোর বৌ তো আর মামলা করার সাহস পাবি নে। তাতে কী হইছে? মামলা করব আমি। জেলের ভাত খাওয়াব সব কয়ডারে। এট্টারেও ছাড়ে দেবো না।
কেউ কোনো কথা বলার সাহস পায় না। কিন্তু খুশিও হয় না। মনে মনে গুমরে মরে তারা। উঠোন পেরিয়ে আস্তে আস্তে হাজারি মাঠের দিকে যেতে থাকে।
দূরে আইলের তে-মাথার উপর গিয়ে বসে হাজারি। সামনে দিগন্ত প্রসারিত মাঠ। ঘাসের উপরে জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো রোদে শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। এখনও তার অবশিষ্টাংশ মাখামাখি হয়ে আছে। ক্রমেই রোদ চড়ে যাচ্ছে। কিন্তু হাজারির রাগ কিছুতেই কমছে না। তার চোখের সামনে এখনও ভাসছে দীনবন্ধুর বৌ-এর মার খেয়ে উঠোনে পড়ে কাতরানোর সেই দৃশ্য।
বড় অসহায় মনে হয় নিজেকে। সে একা। এই গ্রামের, শুধু এই গ্রামের কেন, গোটা এলাকার মানুষের বিশ্বাস, বৌ হলো গরু-ছাগলের মতোই সম্পত্তি বিশেষ। আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই তার।
কান্না পায় হাজারির। সেই কবে বিদ্যাসাগর মেয়েদের কষ্টে কেঁদেছিলেন। শত প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি ব্রিটিশদের দিয়ে বিধবা বিয়ে আইন পাস করিয়েছিলেন। নারী সমাজের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্যে নারী শিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারও কত বছর আগে রাজা রামমোহন সতীদাহ প্রথা দূর করেছিলেন। আর আজ শত বছর পরও নারীদের দুর্দশার সেই একই চিত্র। কবে বুঝবে এরা, মানুষ সবই এক!
মনের মধ্যে তার রক্তক্ষরণ হতে থাকে। চোখ জ্বালা করেতে লাগল। না! কিছু একটা করতে হবে, অবশ্যই করতে হবে। বোঝাতে হবে, জাগাতে হবে,
অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসতে হবে নমশূদ্র সমাজকে।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে হাজারি।
৫২
পশুপতি বাবুর দীর্ঘদিনের লালায়িত স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে।
সেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটছেন তিনি। গন্তব্য, ক্লাস নাইন। গোটা স্কুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কী ব্যাপার, কী হলো আজ? হেড স্যারের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?
এইটের স্কলারশিপ পরীক্ষায় তার কানু খুলনা ডিভিশনের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এ আনন্দ তিনি রাখবেন কোথায়? আজ তার শিক্ষক জীবন সার্থক।
আনন্দের আতিশয্যে তিনি স্কুলে এক দিনের ছুটি ঘোষণা করে দিলেন।
খবরটা নিয়ে এসেছেন বিজ্ঞানের শিক্ষক অনাথবন্ধু বোস। তিনি খুলনা গিয়েছিলেন স্কুলের কাজে। সেখানে বসেই শুনতে পান, ক্লাস এইটের বৃত্তির রেজাল্ট বেরিয়েছে। সাথে সাথেই ছুটে যান শিক্ষা অফিসে। ননাটিশ বোর্ডে টাঙানো তালিকার নিচের দিক থেকে নাম দেখতে শুরু করলেন। সাধারণ বৃত্তির তালিকায় তুলসীর নাম খুঁজে পেলেন তিনি। কিন্তু তার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রটির নাম তো নেই। এই খবর নিয়ে তিনি কীভাবে স্কুলে যাবেন? হতাশায় মন ভরে গেল। বের হয়ে চলে আসছিলেন তিনি।
অজপাড়াগাঁয়ের স্কুল থেকে ফার্স্ট হলো কীভাবে? পাস দিয়ে চলে যেতে যেতে একজন বলল।
কোন স্কুল? সাথের জন পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
আরে কুমিরা স্কুল না কী যেন একটা নাম। তালা থানার।
কথাগুলো কানে আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন অনাথ বাবু। কী শুনলেন তিনি! একি সত্যি হতে পারে! ছুটলেন তিনি আবার নোটিশ বোর্ডের দিকে। সাধারণ বৃত্তির বেশি তাদের স্কুল থেকে কেউ পেতে পারে তা তার চিন্তাতেও আসেনি। এজন্যে তিনি ট্যালেন্টপুলের নামগুলোই দেখেননি। ফাস্ট-সেকেন্ড দেখার তো প্রশ্নই ওঠে না।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেন না অনাথ বাবু। প্রথম নামটিই বিভাংশু কুমার বিশ্বাস, কুমিরা হাই স্কুল, থানা-তালা, মহকুমা-সাতক্ষীরা। কানুর স্কুলের নাম এটাই। সন্দেহ করার আর কোনো কারণ নেই। তবু আরো কয়েকবার পড়লেন তিনি নামটা। ভাবলেন, পশুপতি বাবু সত্যিই পাকা জহুরী। এজন্যেই কোচিং-এর ব্যবস্থা করেছিলেন।
না, আর দেরী নয়। এখনই রওনা দিতে হবে। সুখবরটা তাড়াতাড়ি স্কুলে পৌঁছানো দরকার। তর সইছে না আর। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে উঠে পড়লেন তিনি।
পশুপতি বাবু তাঁর কক্ষেই বসে ছিলেন। গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন একটা দেখছিলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকে পড়লেন অনাথ বাবু।
স্যার, সুখবর। এমন সুখবর যা স্বপ্নেও আমরা কোনোদিন ভাবি নাই।
কী খবর? মাথা নিচু করেই গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন হেডমাস্টার।
দারুণ খবর স্যার, দারুণ খবর।
ভণিতা না করে বলে ফেলল। দেখতেই তো পাচ্ছো, আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছি।
স্যার, রাখেন আপনার কাজ। এইটের বৃত্তির রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি নিজের চোখে খুলনা শিক্ষা অফিসে দেখে এসেছি।
তাই নাকি? আমাদের কোনো খবর আছে?
সেই কথাই তো বলছি স্যার। দারুণ খবর। আমাদের কানু আর তুলসী দুজনেই বৃত্তি পেয়েছে।
বলো কী? উত্তেজনায় তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
স্যার, এ খবর তো কিছুই না। এর চাইতেও বড় খবর আছে।
কী রকম?
আমাদের কানু খুলনা ডিভিশনের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে।
বলো কী!
বিস্ময়ে বিমূঢ় পশুপতি বাবু। তাঁর মুখে কথা সরে না। এ কি সত্যিই সম্ভব? কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
ঠিক দেখেছো তো?
হা স্যার, ঠিক দেখেছি। প্রথমে আমারও বিশ্বাস হচ্ছিল না। বারবার করে দেখে তবে নিশ্চিত হয়ে এসেছি। ভুল হবার কোনো কারণ নেই স্যার।
কৈ কোথায় সে, কোথায় আমার কানু…।
দৌড় শুরু করলেন তিনি। পেছনে অনাথবাবু, ইরফান মল্লিক, শ্রীপতি ঘোষ, দুলাল বাবু, আঃ হক–আরো সব টিচাররাও দৌড়োচ্ছেন। গোটা স্কুল বিস্ময়ে বিমূঢ়। ভয়ে সবার বুক শুকিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই মারাত্মক কিছু ঘটেছে, নাহলে হেড স্যার দৌড়োচ্ছেন কেন? অন্য টিচাররাই বা তার পেছন পেছন কেন? বিভিন্ন ক্লাস থেকে শিক্ষক আর ছাত্ররা বেরিয়ে আসতে শুরু করল।
পশুপতি বাবু এসে থামলেন ক্লাস নাইনের সামনে। ননীবাবু ছিলেন ক্লাসে। তিনি অবাক হলেন সদলবলে হেড স্যারকে দেখে। পশুপতি বাবু ছুটে গিয়ে পাজাকোলা করে তুলে নিলেন কানুকে জড়িয়ে ধরলেন তাকে বুকের মধ্যে।
মান রেখেছিস তুই। আমার স্বপ্ন পূরণ করেছিস রে ব্যাটা। চোখ মুছতে মুছতে বললেন পশুপতি বাবু।
হাউ হাউ করে কাঁদছেন তিনি। বড় আনন্দের, বড় সুখের এ কান্না। সবাই অবাক হয়ে দেখছে। কিন্তু তিনি লজ্জা পাচ্ছেন না। রোগা-পটকা ছেলেটাকে কোলের মধ্যে নিয়ে তিনি সারা স্কুল ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
ক্লাসে ক্লাসে ঢুকে গর্বের সাথে তিনি কানুকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন–এই হলো বিভাংশু, আমার কানু। এবার এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় খুলনা ডিভিশনে ফাস্ট হয়েছে সে…
দিন পনেরো পরে প্রাইমারি স্কুলের বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্টও বের হলো। প্রাইমারিতেও এই স্কুল থেকে দুইজন বৃত্তি পেয়েছে। সে হলো দুলাল আর প্রীতিলতা।
সবাই বলাবলি করতে লাগল, ইন্সপেক্টর বাবু ভাগ্যবান বটে! দুটো রত্ন ছেলের বাবা তিনি।
৫৩
নিশুতি রাতের অন্ধকার কেটে এগিয়ে চলেছে খুলনা মেইল।
জানালার ধারে মাথা রেখে বসে আছে খনা। পাশের কামরায় উঠেছে হাজারি। পুরুষ কামরায় বসার জায়গা নেই বলে খনাকে লেডিস কামরায় তুলে দেয়া হয়েছে। সে কাঁদছে আর বারে বারে চোখ মুছছে। সাথে তার ছোট দুই বাচ্চা। তারা মায়ের কান্না অসহায় চোখে দেখছে। ভৈরব ডাক্তার মৃত্যুশয্যায়, আদৌ বেঁচে আছেন কি না তাও সে জানে না।
বাবার সাথে কি শেষ দেখাটা হবে না তার!
আরজেন্ট টেলিগ্রাম পাওয়ার সাথে সাথেই খনা খুলনা থেকে রওনা দিয়েছে সেই সকালে। গোডাউন ইন্সপেকশনে এসেছেন ঊর্ধ্বতন কর্তারা। তা সত্ত্বেও সে চলে এসেছে। এজন্যে ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলেন স্যার।
মৃত্যুশয্যায় শ্বশুর, বাবা তো নয়? ইন্সপেকশন সেরে একদিন পরে গেলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? সাব-ডিভিশনাল কন্ট্রোলার বিরক্ত হয়ে বললেন।
স্যার তিনি আমার শুধু শ্বশুরই নন, আমার নিজের বাবার চাইতেও বেশি। ওনার সাথে শেষ দেখাটা আমার করতেই হবে। অনুমতি না দিলে প্রয়োজনে আমি চাকরি ছেড়ে দেব। তবু যেতেই হবে আমাকে। তাকে কথা দিয়েছি। আমি। সে কথার বরখেলাপ করতে পারব না।
একটু থেমে আবার বলে হাজারি-আমার শ্বশুর নামকরা মানুষ স্যার। অনেক মন্ত্রী-মিনিস্টার আসবেন বাড়িতে।
তাই নাকি? তা আপনাদের বাড়ি কোথায়? আর শ্বশুরের নামই বা কী? সূক্ষ্ম বিদ্রূপ ঝরে পড়ে স্যারের কণ্ঠে।
আমাদের বাড়ি স্যার ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দ মহকুমায়। আমার শ্বশুরের নাম ডা. ভৈরব চন্দ্র বিশ্বাস। সবাই তাকে ভৈরব ডাক্তার বলেই জানে। গোয়ালন্দ বাজারে স্যার….
দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনি ভৈরব বাবুর জামাই? তা আগে বলবেন তো? রাখেন আপনার ইন্সপেকশন। উনি যে আমার কি উপকার করেছেন, সে আমি বলে বোঝাতে পারব না। চিরকৃতজ্ঞ হয়ে আছি। সেসব পরে বলব সুযোগমতো। আপনি এখনই রওনা হয়ে যান।
ট্রেন ছুটছে।
আর কি দেখা পাবো? মন বলছে না। কিন্তু দেখা তাকে পেতেই হবে।
সেবার অসুখের সময় শ্বশুরমশাই তাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন-হিমাংশু, তোমার সাথে আমার বিশেষ কথা আছে। আমার অনেক কাজ, অনেক স্বপ্ন ছিল। পূরণ করে যাতি পারলাম না। তাতে দুঃখ নাই। কিন্তু মনের মধ্যি বড় কষ্ট। সে আমি কাউরে বলতি পারি নে। শুধু তোমারে বলব। মরণের আগে নিশ্চয়ই তোমারে বলে যাব। বলে আমার বুকটা হালকা করে যাব।
এখন বললেই তো ভালো হয় বাবা। কখন কোথায় থাকি তার তো কোনো ঠিক নাই।
না, বাবা। তুমি যে জাগায়ই থাকো, আমার মরণের কালে অবশ্যই আসপা। এতে যানি কোনো ভুল না হয়। কথা দাও বাবা।
ঠিক আছে বাবা, তাই হবে। কথা দিলাম। ভগবান যদি আমারে বাঁচায়ে রাখে তালি অবশ্যই আমি আসব।
হাজারির মনে হচ্ছে এই সেই সময়। যেভাবেই হোক না কেন মৃত্যুর আগেই তাকে শ্বশুরের কাছে পৌঁছাতে হবে।
খনার বুকের মধ্যে হাতুড়ির শব্দ। কিছুতেই সে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। তার দুচোখে জলের ধারা। মনে মনে সে বলল–তোমারে কি আর দেকতি পাবো না বাবা! ভগবান, তুমি আমার বাবারে বাঁচায়ে দ্যাও। তারে শেষ দেখার সুযোগটা আমারে দ্যাও ঠাকুর।
খনার চোখের সামনে ভাসে বাবার স্নেহময় কোমল মুখখানা। বাবার চোখ দুটো নিশ্চয়ই তাকে খুঁজে ফিরছে।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না খনা। হু হু করে কেঁদে ওঠে। বাচ্চা দুটোও মায়ের সাথে সাথে কাঁদতে থাকে। খনা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয়। বাচ্চা দুটোকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে। ধৈর্য আর বাধ মানতে চায় না। কখন সে বাড়ইডাঙ্গা পৌঁছবে, ঝাঁপিয়ে পড়বে বাবার বুকের উপরে…
ট্রেন এসে দাঁড়াল রাজবাড়ী স্টেশনে। পরের স্টেশন পাঁচুরিয়া। পাঁচুরিয়া পার হলেই গোয়ালন্দ ঘাট। কিন্তু কেন যেন দেরি হচ্ছে। ট্রেনটা ছাড়ছে না। কারণটা বোঝার জন্যে হাজারি বাইরে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে জানালা দিয়ে। তার নজরে পড়ে, প্রথম শ্রেণির ওয়েটিংরুম থেকে এক ভদ্রমহিলা হেঁটে আসছেন ট্রেনের দিকে। তার বাঁ হাতে হ্যান্ডব্যাগ আর ডান হাতে চামড়ার একটা স্যুটকেস। এই হাঁটাটা যেন তার চেনা। আরে তাই তো, মৃনয়ী দিদি হাঁটতেন এমন দৃঢ়পদে।
মুখের দিকে তাকাল হাজারি। হ্যাঁ ঠিক, মৃন্ময়ী দিদিই তো। স্বাস্থ্য একটু ভালো হয়েছে, তাতে যেন দিদিকে আরো সুন্দর লাগছে। ট্রেন থেকে নেমে দৌড়ে হাজারি মৃন্ময়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
দিদি… হাঁপাতে হাঁপাতে ডাক দিল হাজারি।
চমকে ওঠে মৃন্ময়ী। সে বোধকরি কিছু একটা ভাবতে ভাবতে যাচ্ছিল। হাজারির মুখের দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে গেল।
আরে, হিমাংশু কেমন আছো? কোথায় আছো, কী করছ?
ভালো আছি দিদি। ফুড ইন্সপেক্টর পদে চাকরি করছি, পোস্টিং খুলনায়। আপনি কেমন আছেন দিদি? কোথায় আছেন? আমার বিয়ের সময় আপনাকে কত খুঁজেছি। কিন্তু কোনোভাবেই আপনার ঠিকানা জোগাড় করতে পারি নাই।
তাই? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ভুলেই গেছো। বিয়ে করেছো জেনে খুশি হলাম। হাসতে হাসতে বলে মৃন্ময়ী।
আপনাকে কি ভুলে যেতে পারি? অনেক খুঁজেছি আপনাকে। পাই নাই।
না না, এমনিই বললাম। পাবে কী করে? হঠাৎই কো-অপারেটিভের সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে ঢাকায় জয়েন করলাম। ব্যস্ত হয়ে গেলাম কাজ নিয়ে। এজন্যেই খোঁজ পাওনি। ভালোই আছি সবকিছু মিলে।
কোথায় যাবেন দিদি? এই ট্রেনে উঠবেন?
হ্যাঁ, এই ট্রেনেই উঠব। যাবো গোয়ালন্দ। ভৈরব ডাক্তার বাবুর নাম জানো তো? উনি মৃত্যুশয্যায়। তাকে দেখতে যাচ্ছি। দেখা করার জন্য আমাকে খবর পাঠিয়েছেন তিনি।
হ্যাঁ দিদি চিনি। আমিও ছুটে এসেছি তাকেই শেষবারের মতো দেখার জন্যে। উনি আমার শ্বশুর।
একটু অবাক হয়েই বলে হাজারি। দিদিকে কেন খবর পাঠিয়েছেন শ্বশুর মশাই! তার সাথে কি সম্পর্ক মৃন্ময়ী দিদির!
তাই নাকি? এতবড় একটা খবর, আর আমি জানি না! সে যাক। খুবই ভালো হয়েছে। ভৈরব বাবু আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন। উনার উৎসাহেই সমবায়ের কাজে নেমেছি। তোমার মনে নেই? সেই যে মন্বন্তরের সময় আমরা উনার নেতৃত্বে কাজ করেছিলাম। তখন ফরিদপুরে স্বেচ্ছাসেবক দল গড়েছিলাম।
মৃন্ময়ী তার রিজার্ভ করা ফার্স্ট ক্লাসের কামরায় উঠে পড়ল। গার্ডের সাথে আলাপ করে বলল–ফাঁকাই আছে। তুমিও এখানে চলে এসো।
না দিদি। গোয়ালন্দ গিয়েই আপনার সাথে দেখা করব। কারণ আমার বৌ-বাচ্চারাও রয়েছে সাথে। ওরা আছে লেডিজ কামরায়।
তাই নাকি? আগে বলোনি কেন? ওদেরকেও নিয়ে এসো। না, চলো তোমার সাথে আমিও যাই।
আপনি বসেন দিদি। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
না, না। তা কেন? মেয়েটা কত কষ্টের মধ্যে আছে। ওকে ধরে নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া বাক্স-প্যাটরা আছে, বাচ্চারা আছে। তাড়াতাড়ি করো। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।
ওদের সবাইকে ফার্স্ট ক্লাসের কামরায় নিয়ে এলো মৃন্ময়ী।
এই হলো আমার দিদি, মৃন্ময়ী দিদি। যার কথা তোমাকে বলেছি। দিদি না থাকলে বিএ পাস আমার কোনোদিনও হত না। দিদিও বাবাকে দেখতে যাচ্ছেন।
আপনি আমার বাবাকে চেনেন?
চিনব না কেন? তোমাদের বাড়িতেও আমি গেছি। মন্বন্তরের সময় তোমাদের বাড়িতে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল মনে আছে?
হ্যাঁ দিদি মনে আছে।
তখন চাল নিয়ে গিয়েছিলাম। আর একবার গিয়েছিলাম দলের কাজে।
আপনি আমার বাবারে দেকতি যাচ্ছেন। বাবা মনে হয় আর বাঁচে নাই…
খনা হু হু করে কেঁদে ফেলে। পরম আদরে মৃন্ময়ী তাকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বোলাতে থাকে।
ট্রেন ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে।
৫৪
লোকে লোকারণ্য বাড়ইডাঙ্গা। ভৈরব ডাক্তারে যখন-তখন অবস্থা। খবর পেয়ে দলে দলে লোক আসতে শুরু করেছে। হিন্দু, মুসলমান কেউ বাদ নেই। জেলেরা খবর শুনে জালটাল গুটিয়ে রেখে নদী থেকেই চলে এসেছে। গোয়ালন্দ বাজারের সব দোকানপাট বন্ধ। সবাই ছুটে এসেছে ডাক্তারকে শেষবারের মতো একনজর দেখার জন্যে।
ভৈরব ডাক্তারে কথা বন্ধ হয়ে গেছে গত পরশু সকাল থেকে। তিনি বারবার কাকে যেন খুঁজছেন। ইঙ্গিতে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন। সবাই এসে গেছে। ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন সবাই শিয়রে বসে আছে। শুধুমাত্র খনা এসে পৌঁছোয়নি এখনো। তাকে আনতে পাঁচ-ছয়জনের একটা দল গেছে স্টেশনে। সবাই অনুমান করছে ডাক্তার শেষবারের মতো তার প্রিয় কন্যা খনাকেই খুঁজছেন। সে আসছে, এই এসে পড়ল বলে–আকার-ইঙ্গিতে এরকমটা বোঝনোর চেষ্টা করতে লাগল সবাই।
হারান কবিরাজ সপ্তাহ ধরে ভৈরব ডাক্তারের শিয়রে বসে আছেন।
রাজবাড়ী থেকে গতকাল এসেছেন এলএমএফ ডাক্তার। তারা ওষুধ দিচ্ছেন, পথ্য দিচ্ছেন। আর বারবার হতাশভাবে মাথা নাড়ছেন…
ফরিদপুর থেকে এসে পড়েছেন ডা. দীলিপ সোম। তিনি এই এলাকার সবচেয়ে নামকরা এমবিবিএস ডাক্তার। তিনিও গতিক ভালো বুঝছেন না। ভৈরব ডাক্তারের বুকের মধ্যে ঘরঘর শব্দ হচ্ছে। শব্দটা ভালো নয়। ভবানীকে একপাশে ডেকে নিয়ে ডা. সোম আস্তে আস্তে বললেন–কলকাতা না হয় ঢাকা মেডিকেলে নিতে পারলে ভালো হত। সময় আর বেশি নাই।
গোয়ালন্দ রেল স্টেশন মাস্টারের কাছে টেলিগ্রাফ এসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভবানী শঙ্কর বিশ্বাস পাঁচজন ডাক্তারের সমন্বয়ে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেছেন। সেই ডাক্তারদের নিয়ে তিনি ঢাকা থেকে স্টিমারে রওনা দিয়েছেন। মেডিক্যাল টিমে একজন সাহেব ডাক্তারও আছে। মন্ত্রী ভবানীর বিশেষ বন্ধু। ঢাকায় গেলে ভবানী তাঁর বাসায়ই ওঠে। নামের সাথে হবহু মিল থাকায় বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়েছে।
একদল স্টিমার ঘাটে গেছে মন্ত্রীকে এগিয়ে আনতে।
বিকালবেলা ভৈরব ডাক্তারকে বাইরের ঘরে এনে শুইয়ে দেয়া হলো। লোকজন যাতে শেষবারের মতো তাকে দেখতে পারে।
কীর্তনের দল এসে পড়েছে। তারা হরি নাম শোনাচ্ছে ভৈরব ডাক্তারকে।
মোহন মিয়া ঢাকায় ছিলেন। তিনিও আসছেন মন্ত্রীর সাথে। খবর পাওয়া গেল, কিছুক্ষণ আগে স্টিমার এসে ঘাটে ভিড়েছে। মন্ত্রী ভবানী শঙ্কর আর মোহন মিয়া নেমেছেন গোয়ালন্দ ঘাটে। সেখান থেকেই তারা সোজা চলে এলেন বাড়ইডাঙ্গা। সাথে অনেক লোকজন। কেউ ঢাকা থেকে এসেছেন, কেউবা এদিকেরই। সাহেব ডাক্তার নাড়ি পরীক্ষা করলেন ভৈরব ডাক্তারের। হতাশা ফুটে উঠল তার চেহারায়। অস্ফুটে টেনে টেনে বললেন–টু লেট…
খনা আছড়ে পড়ল বাবার বুকের উপ মৃন্ময়ী খনাকে ধরে আছে। ভৈরব ডাক্তার খনার মাথায় হাত রাখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। খনার হাতটা তিনি মৃন্ময়ীর হাতে ধরিয়ে দিলেন। চোখভরা মিনতি নিয়ে ভৈরব ডাক্তার মৃন্ময়ীর দিকে তাকালেন। মৃন্ময়ী বুঝল তার ইচ্ছেটা। চোখের ভাষায় আর হাতের ইশারায় সে আশ্বস্ত করে তাকে।
ভৈরব ডাক্তারের দৃষ্টি তখনও অস্থির। যেন আরো কাউকে খুঁজছেন তিনি।
পেছন পেছন ধীরপায়ে হাজারি ঢুকল। শান্ত হলেন ভৈরব ডাক্তার। ইশারায় তাকেও মৃন্ময়ীর কাছে আসতে বললেন। তারপর হাজারি আর খনার হাত এক করে মৃন্ময়ীর হাতে সঁপে দিলেন।
এতক্ষণে হাজারি বুঝল, কেন দিদিকে খবর দিয়েছিলেন শ্বশুরমশাই।
তিনি ইঙ্গিতে হাজারিকে আরো কাছে সরে আসতে বললেন। তারপর সবাইকে বাইরে যাওয়ার ইঙ্গিত করলেন। এমনকি খনাকেও।
বিস্মিত সবাই বাইরে চলে গেল। এবার তিনি তার বুক পকেটের দিকে চোখ দেখালেন। হাজারি পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটি খাম বের করে আনল। ভৈরব ডাক্তার ইঙ্গিতে বললেন, পড়বে এটা।
তারপর পরম শান্তিতে চোখ বুজলেন।
৫৫
হাজারির দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এত কষ্ট মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন ভৈরব ডাক্তার। অথচ কোনোদিন কাউকে বুঝতে দেননি। সারাটা জীবন পরের জন্য উৎসর্গ করলেন, কিন্তু নিজের কষ্টের ভাগ তিনি কাউকে দিলেন না।
মাঠ পাড়ি দিয়ে অনেকখানি পথ পার হয়ে হাজারি রেললাইনের পাশে এসে বসল। তার নিরিবিলি পরিবেশ দরকার। শ্বশুরমশাইএর রেখে যাওয়া খামটা পড়তে শুরু করল সে।
অনেক গোপনীয়তা অবলম্বন করেছেন তিনি। মুখে বলতে না পেরে লিখে রেখে গেছেন। তাও জীবদ্দশায় যাতে হাজারি জানতে না পারে সেজন্যে তিনি তার মৃত্যুশয্যায় খামটি গোপনে দিয়ে গেছেন।
মৃত্যুপথযাত্রী একজনের লিখে যাওয়া একান্ত গোপন কথা সকলের অগোচরেই পড়া উচিত।
শ্বশুরমশাই লিখে গেছেন, তার নিজের কোনো চাওয়া-পাওয়া কোনোদিনই ছিল না। শুধু চেয়েছিলেন এলাকার মানুষের মঙ্গল। তার স্বপ্ন ছিল নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসা। সারাটা জীবন সংগ্রাম করলেন, পেলেন না কিছুই। কেউ তার ব্যথা বুঝল না। এমনকি তার সন্তানরাও না।
সাধ করে বড় মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার ছেলের সাথে। দুঃখ পেলেন সেখানে। ভেবেছিলেন, বড় ছেলে ভবানী শঙ্কর হাল ধরবেন তার ব্যবসা, বাণিজ্য, গোটা সংসারের। আশা ছিল, মেজো ছেলে তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু না, কিছুই হলো না। হলো উল্টোটা। সমস্ত সম্পত্তি দু ভাই মিলে উড়িয়ে দিল।
কেউ জানে না, ভিতরে ভিতরে নিঃস্ব হয়ে গেছেন তিনি। কখন কোন সুযোগে তাকে দিয়ে চেকে সই করিয়ে ভবানী ব্যাংকের সমস্ত টাকাও তুলে উড়িয়ে দিয়েছে। তার সাথে যোগ হয়েছে দুই ভাইয়ের ধারদেনা। এখানে সেখানে নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা, এমনকি নটিপাড়ার দোকানগুলোতেও দেনা শোধ করতে করতে তার বাদবাকি যা ছিল সব শেষ। আজ তিনি কপর্দকহীন।
অর্থের অভাবে তিনি পদ্মার বাঁক লিজ নিতে পারেননি গত বছর। আড়তে মাল কেনার টাকা নেই। জমিজমা প্রায় সব হয় বন্ধক না হয় বিক্রি করে দিয়েছে ভবানী। ধারদেনায় আকণ্ঠ ডুবে গেছেন তিনি।
কিন্তু ভৈরব ডাক্তার জ্ঞাতসারে ঋণ রেখে মরতে পারেন না। সহায় সম্পত্তি যেটুকু বেঁচে ছিল, বিক্রি করে সমস্ত দেনা শোধ করেছেন গোপনে।
শুধু একটা সম্পত্তির কথা কেউ জানে না। কামারখালি বাজারে তার বড় একটা পাটের আড়ত আছে। আড়তের উপার্জিত সমস্ত অর্থ নমশূদ্র সম্প্রদায়ের সকলের জন্য, আর হিন্দু-মুসলমান অন্যদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মেধাবী গরিব ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার পেছনে ব্যয় হয়। আড়তের মালিকানা দলিল করে দিয়ে গেছেন হিমাংশুর নামে।
তিনি লিখে গেছেন, মৃন্ময়ীর সাথে পরামর্শক্রমে হিমাংশু যেন উপার্জিত অর্থ সকাজে ব্যয় করে। পারলে তহবিলের আয় যেন আরো বাড়ানোর চেষ্টা করে। বৃত্তিপ্রাপ্তদের নামের একটা তালিকাও রাখা আছে আড়তের আয়রন চেস্টে। আর মৃন্ময়ীর সহায়তায় হিমাংশু যেন গ্রামে গ্রামে সমবায় সমিতি গড়ে তোলে। পারলে ভবানী-অবনীকেও যেন এই কাজের সাথে যুক্ত করে। তারা অবুঝ, কিন্তু অন্তর তাদের বড়।
লিখেছেন, তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার মতো টাকাও বোধকরি ঘরে থাকবে না। হিমাংশু যেন সব দায়িত্ব নেয়। সে যেন ছোট ছেলে ছবির পড়াশুনার ব্যবস্থা করে। আর ছোট মেয়ে গীতার বিয়েটা যেন ভালো শিক্ষিত ছেলের সাথে দেয়।
এতসব লিখে যাওয়ার দরকার ছিল না। হাজারি নিজের দায়িত্ব মনে করেই সবকিছু করত।
তিনি লিখে গেছেন, সম্পত্তি নিয়ে তার কোনো দুঃখ নেই। তার চিন্তা, নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। হিমাংশুর পক্ষে কি সম্ভব হবে তাদের খোঁজখবর রাখা!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাজারি মনে মনে বলল–আপনি ভাববেন না বাবা। আপনার সব স্বপ্ন, সব ইচ্ছে পূরণ করব আমি। নমশূদ্ররা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে। আপনার নাতি-নাতনিরাও মানুষ হবে। আপনার সব দায়িত্ব আমি কাঁধে তুলে নিলাম। আপনি শান্ত হোন, বাবা। আপনার আত্মা তৃপ্ত হোক।
ভৈরব ডাক্তার লিখে গেছেন, তার ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কথা। সারা জীবন তিনি এলাকার সকলের দায়িত্ব নিয়েছেন, কিন্তু তার নিজের সংসারের দায়িত্ব নেবার মতো আজ কেউ নেই। এই জগৎ সংসারের উপর থেকে তাই সমস্ত টান তার উঠে গেছে। তার সকল স্বপ্ন, সকল ইচ্ছে নিঃশেষে মিলিয়ে গেছে।
ছেলেদের জীবন-যাপন ধারা তার পছন্দ নয়। অথচ হে এমনই বস্তু, যত রাগ, যত ঘৃণাই থাক, সেই সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে শিউরে ওঠেন তিনি। নির্মোহ হতে পারেন না কোনোভাবেই। এই কষ্টের কথা তিনি কারো সাথে শেয়ার করতে পারেননি। এত অপরাধ করার পরেও তিনি ছেলেদেরকে শাস্তি দিতে পারেননি। ব্যর্থতার এই অভিমান, এই কষ্ট বুকের মধ্যে নিয়েই তিনি চিরতরে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
হাজারির দু চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এলো।
না, ভবানীদার সাথে একবার বসতে হবে। গোটা বিষয়টা নিয়ে তার সাথে আলোচনা করা দরকার। তিনি ভালোভাবে নেবেন তো শ্বশুরমশাই-এর এই চিঠি আর তাকে দায়িত্ব দিয়ে যাবার বিষয়টি? তবু তাকে জানাতে হবে। তিনিই এখন এই পরিবারের কর্তা। কথা বলতে হবে দিদির সাথেও। এমন দিদি মাথার উপরে থাকলে আর চিন্তা কিসের?
দাদা, কাল সকালে তো চলে যেতে হবে। একটু কথা বলতাম আপনার সাথে।
জানি, তুমি কী কতি চাও। বাবার চিঠি আমি পড়িছি। ঠিকই করিচেন, ঠিক মানষির কাছেই বাবা দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। আমি তো তার কুসন্তান। চোখ মুছতে লাগল ভবানী।
কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাঙা গলায় বলল–বাবার মৃত্যুর জন্যি আমিই দায়ী। এখন বুজতেছি, কী করিছি আমি। তয় বুজেই বা আর এহন কী হবি। সর্বনাশ যা করার তা তো করেই ফেলাইচি।
শান্ত হন দাদা।
আর কী শান্ত হব! তুমি হয়তো ভাবতেছো, বাবার চিঠি পড়ে আমি দুঃখ পাইচি। না হিমাংশু, আমি মোটেই দুঃখ পাই নেই। বরং খুশি হইচি। স্বভাব আমার নষ্ট হতি পারি, কিন্তু মনডা পচে-গলে যায় নেই যে গন্ধ বার হবি।
কিন্তু দাদা, দূরদেশে চাকরি-বাকরি করে আমিই বা কতটুকু কী করতে পারব, বুঝতে পারছি না। নিজের সংসার চালাতেই তো আমার হিমশিম খাবার জোগাড়।
চিন্তা কোরো না। বাবা তো পথ দেখায়েই দিয়ে গেছে। মৃন্ময়ী থাকতি চিন্তা কিসির? আর আমি সবসময় আছি তুমাগের সাথে। খালি দ্যাকপা, বাবার চাওয়া যেন বৃথা না যায়।
হাজারির কাঁধে মাথা রেখে হু হু করে কাঁদতে লাগল ভবানী।
শুধু চোখের জলে হবে না দাদা, কাজে নেমে পড়তে হবে। কাকাবাবুর ইচ্ছে পূরণ করতে হবে। নিঃশব্দে কখন মৃন্ময়ী এসে দাঁড়িয়েছে দুজনের মাঝে।
দিদি আপনার কথাই ভাবছিলাম।
সেজন্যেই তো চলে এসেছি। ভবানীদার কাছে সব শুনেছি। শ্রাদ্ধ-শান্তি শেষ হোক। তারপর সবকিছু নিয়ে বসব আমরা। কিন্তু ভবানীদা, হিমাংশু আর আমি তো তো থাকব দূরে। কাজ কিন্তু করতে হবে আপনাকেই।
তাই হবে বোন। চিন্তা কোরো না। ভবানী চোখ মুছে বলল।
হাজারি কৃতজ্ঞচিত্তে দিদির মুখের দিকে তাকাল। মৃদু হাসি ছড়িয়ে রয়েছে দিদির সারা মুখে।
যেন অভয়বাণী তার দৃষ্টিতে–ভয় নেই, আছি তোমার সাথে… এগিয়ে এসে হাজারির মাথায় হাত রাখেন তিনি।
কোমল পরশে জুড়িয়ে গেল হাজারির উত্তপ্ত হৃদয়।
৫৬
শেষকৃত্য সম্পন্ন করে কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছে হাজারি। ট্রেনের জানালায় মুখ রেখে সে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সাদা সাদা মেঘ উড়ে চলে যাচ্ছে কোথায়, কত দূরে, কে জানে… কোন অজানা গন্তব্যে…
ঘরবাড়ি, গাছপালা, টেলিগ্রাফের তার, খুঁটি, ফসলের মাঠ সব ঘুরে ঘুরে দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। সব কিছু পেছনে ফেলে হুইসেল বাজিয়ে ঝিকঝিক করে এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। হাজারির মনে হচ্ছে, তার নিজের এই যাত্রাও যেন মেঘের মতোই অনিশ্চিত, উদ্দেশ্যবিহীন…
তার মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। বাইনদের পুকুর চালার পাঠশালার কথা, মাস্টারমশাই জ্ঞানেন্দ্রনাথ বাইনের কথা।
মাথার উপরে ভগমান আছে… দেখিস, তুই বিএ পাস করবি… এমএ পাস করবি… অনেক বড় হবি তুই… নমশূদুরির মুখ উজ্জ্বল করবি…
মনে পড়ে পিতৃসম বড়দাদার কথা। মারা যাবার সময় হাজারির হাত ধরে বলেছিলেন-নিজি বিদ্যান হইচো। আরো দশজনরে বিদ্যান বানাবা। তুমার কাঁচে এই আমার চাওয়া…
বড়দাদা নিঃসন্তান। না হলে তার ছেলেমেয়েদের অবশ্যই মানুষ করত হাজারি। কিছুটা হলেও ঋণ শোধ হতো। তাই ঠিক করল, অন্য ভাইদের বাচ্চাদের নিজের কাছে রেখে লেখাপড়া করাবে সে।
ভৈরব ডাক্তারও স্বপ্ন দেখতেন নমশূদ্রদের ঘরে ঘরে থাকবে শিক্ষিত ছেলেমেয়ে। কিন্তু দুঃখ তার, নিজের সন্তানদেরই তিনি মানুষ করে যেতে পারেননি। হাজারি নিজেও পারেনি মাস্টারমশাই-এর কথা রাখতে। সে এমএ পাস করতে পারেনি। বড় কোনো চাকরিও সে করে না। সে হয়েছে সামান্য ফুড ইন্সপেক্টর।
কিন্তু না, এখানে থেমে যাওয়া চলবে না। ভৈরব ডাক্তারের পাটের আড়তের আয়, নিজের বেতনের একটা অংশ আর বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে শিক্ষা তহবিল গড়ে তুলবে সে। তাই দিয়ে এলাকার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাবে, মেধাবীদের জন্যে বৃত্তির ব্যবস্থা করবে। খুঁজে খুঁজে ভালো ছেলেমেয়ে বের করতে হবে। তারা রাজেন্দ্র কলেজে যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে নমশূদ্ররা।
মাস্টারমশাই-এর নেতৃত্বে গ্রামে গ্রামে পাঠশালা গড়ে তুলতে হবে। তাঁকে সংসার চালানোর চিন্তা থেকে মুক্ত করে দিতে হবে, তার জন্যে উপযুক্ত মাসিক সম্মানীর ব্যবস্থা করতে হবে…
মৃন্ময়ী দিদিকে পেয়েছে সে। সমবায় সমিতির মাধ্যমে একত্রিত করতে হবে নমশূদ্রদের… অনেক কাজ…
ভৈরব ডাক্তার যেখানে শেষ করেছেন, সেখান থেকেই হবে তার শুরু…
সে ঠিক করে ফেলে মাস্টারমশাই-এর আশা, ভৈরব ডাক্তারের স্বপ্ন, বড়দাদার ইচ্ছে পূরণে অচিরেই কাজে নেমে পড়বে। তার সন্তানরা মেধাবী। তাদেরকে সেভাবে গড়ে তুলবে। ভৈরব ডাক্তারের নাতিদের মানুষ করবে সে। বিল সিংহনাথ এলাকাজুড়েই এখন এবাড়ি-ওবাড়ির দু-একজন করে স্কুলে পড়ছে, কলেজে যাচ্ছে, তাদেরকে ঠিকমতো গাইড করবে সে। এরাই একদিন ধরবে নমশূদ্র সমাজের হাল…।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে হাজারি।
ভাবে, এই প্রজন্ম পারেনি। আরেক প্রজন্য পারবে।
স্বপ্ন পূরণ হবে, নিশ্চয়ই হবে, একদিন না একদিন…