৩০
গোয়ালন্দ মঠে দূর্গাপূজা মণ্ডপ। মণ্ডপের পাশে বিশাল করে বানানো হয়েছে থিয়েটার প্যান্ডেল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে পূজা দেখতে। তার সাথে বাড়তি আকর্ষণ থিয়েটারের পালা। আজ সপ্তমী। সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমী তিন দিন ধরে চলবে যাত্রাপালা। কলকাতা থেকে এসে পড়েছে নট-নটীরা।
মঠের অধিকর্তা অবিনাশ বাবু। তাঁদের বাড়িসংলগ্ন পূজামণ্ডপ। খরচ বাবুদের, কিন্তু পরিচালনা করেন ভৈরব ডাক্তার। অবিনাশ বাবু ডাক্তার ছাড়া কিছুই বোঝেন না। কোনো সমস্যা নিয়ে তার কাছে গেলে, তিনি তা শোনার আগেই বলে দেন-ওসব যায়ে ডাক্তারের কাছে কও গে। উনি যেরম সাব্যস্ত করে দেন, সেরম করেই কাজ করবা।
সন্ধ্যা থেকেই গ্রিনরুমে চলছে সাজসজ্জা। একজন একজন করে মেক আপ নিচ্ছে। শেষ হলে পাশে গিয়ে আয়নায় নিজের সজ্জা পরখ করে দেখে নিচ্ছে। সবার শেষে হবে রাজার মেকআপ। রাজার ভূমিকায় অভিনয় করবেন স্বয়ং ভৈরব ডাক্তার। আজ নতুন নয়। বরাবর রাজার ভুমিকায় তিনিই অভিনয় করেন।
প্রথম কনসার্ট শেষ। এখন চলছে দ্বিতীয়। তৃতীয় কনসার্ট শেষ হলে শুরু হবে যাত্রাপালা। ভৈরব ডাক্তার এখনও গ্রিনরুমে এসে পৌঁছাতে পারেননি। অবশ্য তা নিয়ে মেক-আপম্যান বা অন্যদের তেমন উৎকণ্ঠাও নেই। ভৈরব ডাক্তারের চেহারাখানাই রাজার মতো। একবার তো মেক আপ ছাড়াই দিব্যি স্টেজে উঠে পড়েছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল সত্যিকারের রাজা বুঝি উঠে এসেছেন ইতিহাসের পাতা থেকে।
স্টেজের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে আছে ভবানী শঙ্কর। সে উপস্থিত থাকার অর্থ হলো, কেউ টু শব্দটিও করবে না। শৃঙ্খলা বজায় থাকবে পুরোটা সময় ধরে। তার সামনে উঁচু গলায় কথা বলার সাহস এ তল্লাটে কেউ রাখে না। ভবানী কাউকে পরোয়া করে না। উচিত কথা বলতেও ভয় পায় না। এলাকার ডাকাত, গুন্ডাপান্ডারাও তাঁকে সমীহ করে চলে।
মেজো ছেলে অবনীশঙ্করও ঘুরে ঘুরে তদারকি করছে, দেখছে কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা।
ছোট ছেলে অজিত শঙ্কর আবার এসবের মধ্যে নেই। সে ব্যস্ত তার লেখাপড়া নিয়ে। বিএ পাস করতেই হবে–এই তার পণ। কে নাকি এক হাজারি এর মধ্যেই বিএ পাস করে ফেলেছে। বাহবা দিতে হয় তাকে।
আহা প্রথম ব্যক্তিটি যদি সে নিজে হতে পারত, তাহলে বেশ হত। কিন্তু সে তো এখনও স্কুলের গন্ডিই পার হতে পারেনি। কুছ পরোয়া নেই। ইচ্ছে আছে একদিন গিয়ে তার সাথে দেখা করে আসবে। পড়াশুনাও কিছু বুঝে আসবে। মেজোদার বন্ধু অবনীদার বাড়ি তো সেদিকেই। হঠাৎ করেই তার মনে পড়ে গেল অবনীদার তো পুজো উপলক্ষ্যে এখানে আসার কথা।
অজিত শঙ্কর বই-খাতা ঠেলে রেখে উঠে পড়ল অবনীদার খোঁজে।
অবনী চক্রবর্তীর বাড়ি বালিয়াকান্দি থানার মেগচামি গ্রামে। আর হাজারির বাড়ি তার পাশের গ্রাম মধুপুরে। ভৈরব ডাক্তারের মেজো ছেলের নামে নাম। তাই ডাক্তার বাবু তাকে আরেক ছেলে বলেই মানেন। অবনী শঙ্করও তাকে মিতা বলে ডাকে।
ভালোভাবেই শেষ হয়ে গেছে দুর্গাপূজা। যাত্রা-থিয়েটার এবার বেশ ভালোই জমেছে। অবনী এ ক’দিন এ বাড়িতেই ছিল। আজ চলে যাবে। বিদায় নিতে এসেছে ভৈরব ডাক্তারের কাছে। পিছনে পিছনে এসেছে খনা। ডাক্তার বাবুর সেজো মেয়ে। বড় আদরের মেয়ে তার খনা।
বাবা দ্যাকিচো, অবনী দাদারে কত করে বলতেছি আজকের দিনটা থাকে যাতি। কিন্তু কিছুতেই থাকতেছে না। বাবা, তুমি এট্টু ভালো করে কয়ে দ্যাও তো। আব্দার করল খনা।
খনার আব্দার ফেলে দেয়া বড়ই কঠিন কাজ। বিচলিত হয়ে ভৈরব ডাক্তার বললেন–অবনী, ক্যান বাবা, কী হইচে যে আজই তুমি চলে যাবা। খনা যখন বলতেছে তখন থাকেই যাও আজকের দিনটা।
তা না কাকাবাবু, এট্টু জরুরি কাজ আছে বাড়িতে। কিন্তু তা তো হবে না। আমার খনা মা বলিচে, এর তো কোনো অন্যথা হতি পারে না বাবা। আজকে তো তোমার থাকেই যাতি হবি।
ঠিক হইছে, ভালো হইছে। এখন যাও তো দেখি অবনী দাদা, কীরম যাতি পারো। আনন্দে হাততালি দিতে দিতে খনা বলল।
তারপর দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে চারিদিকে আলো ছড়াতে ছড়াতে চলে গেল। সেদিকে সস্নেহে তাকিয়ে রইলেন ভৈরব ডাক্তার।
একসময় আস্তে আস্তে বললেন–বুঝলে অবনী, এই মেয়েডারে শ্বশুর বাড়ি পাঠায়ে আমি থাকপো কীরম করে কও তো? মেয়ে বড় হচ্ছে। বিয়েও দিতি হবি। অবনী, পারলি একটা ভালো পাত্র দেখো তত বাবা।
তা ঠিকই বলেছেন কাকাবাবু। আমার নিজের বোনও এতখানি করে না কোনোদিন। খনা আছে বলেই এ বাড়িতে আসার তাগিদ বেশি করে অনুভব করি। খনা যেন আমার নিজের মায়ের পেটের বোন। ওকে নিজের হাতে বিদায় দিতে আপনার বড় কষ্ট হবে কাকাবাবু।
তা ঠিকই কইচো। বলতে বলতে চোখ মুছলেন ভৈরব ডাক্তার।
কান্না বড় ছোঁয়াচে রোগ। অকারণেই তা ছড়িয়ে পড়ে উপস্থিত সবার মাঝে।
ওরে আমরা বিয়ে দেব না বাবা। ও থাকপি আমাগের বাড়ির লক্ষ্মী হয়ে। কার না কার হাতে যায়ে পড়বি।
কখন যেন ভবানী এসে উপস্থিত হয়েছে।
চোখ মুছতে মুছতে স্বগতোক্তির মতো আবার বলল–কী যে আবার পড়ল পোড়া চোখের মদ্যি।
তা কি হয় রে পাগল। মেয়ে হয়ে জম্মিছে। বিয়ে তো দুয়াই লাগবি। তয় সেরম ভালো পাত্রের খোঁজ করো তোমরা। যে-সে ছেলের সাথে আমি মেয়ে বিয়ে দেব না। একটা শিক্ষিত ছেলে খোঁজ, যেন ভালো মনের হয়। হোক সে গরিব, না থাক তার কিছু। শুধু আমার খনা মায়ের মনডা যেন বুজতি পারে।
আছে কাকাবাবু, আছে। খুব দ্রুতই বলল অবনী। এ রকম একটা ছেলে আছে আমাদের এলাকায়। হীরের টুকরো ছেলে। বাপ-মা নাই, গরিব, কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছে। বিএ পাস করে মাস্টারি করছে হাই স্কুলে। শিক্ষার আলো নমশুদ্র সমাজের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেবার ব্রত নিয়েছে। মেধাবী ভালো ছেলে-মেয়ে খুঁজে বের করে, তাদের লেখাপড়ায় উৎসাহ দেয়, অভিভাবকদের বোঝায়। কাকাবাবু, ছেলেটাকে একবার দেখতে পারেন।
ছেলেডা কিডা? নাম কী, বাড়ি কুন জাগায়?
বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামেই, মধুপুর। ছেলের নাম হিমাংশু। তবে হাজারি নামেই চেনে সবাই।
দাঁড়াও, দাঁড়াও। ছেলে কি সমাধিনগর স্কুলি মাস্টারি করে?
হ্যাঁ, কাকাবাবু, ঠিকই ধরেছেন। চেনেন নাকি তাকে?
না, ঠিক চিনি বললি ভুল হবি। তয় দেখিচি তারে। ওই যে সেবার সমাধিনগর স্কুলে মিটিং করতি গেলাম। ও, তুমি তো আবার তখন কলকাতায় গিছিলে। ছেলেটার সাথে তখন পরিচয় হইছিল। দেখে তো আমার ভালোই লাগিছে। মনে হইছে বেশ বুদ্ধিমান, সহজ-সরল। দেকতিও মন্দ না। প্রথম দর্শন হিসেবে বলব, আমার পছন্দ। আর অবনী তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, এখানে আগানো যায়। তয় ওগের কী ইচ্ছে সিডাও তো জানা দরকার।
ভৈরব ডাক্তার ভবানীর দিকে ফিরে বললেন–তুমি বড় ভাই, তুমিই বিষয় দ্যাখো। কাল যাও অবনীর সাথে। ছেলেডারে দেখে আসো। বাড়ির খোঁজখবর ন্যাও। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলি এই ফাল্গুনেই আমি খনার বিয়ে দিতি চাই।
ভবানী দা, আপনি চলেন আমার সাথে। পুজোর ছুটিতে এখন সে বাড়িই আছে। তাছাড়া আমার কাছে সে সবসময়ই আসে, বুদ্ধি-পরামর্শ নেয়। আপনি চিন্তা করবেন না কাকাবাবু। উপযুক্ত ছেলেই আমরা পেয়েছি। বোন আমাদের সুখেই থাকবে। অবনী বলল দৃঢ় স্বরে।
৩১
গোয়ালন্দ থানায় দারোগা বাবুর সামনে বসে আছে ভবানী। সে এসেছে রহমত ডাকাতের জন্য তদবির করতে। রহমত দামি আসামি। চর এলাকায় ডাকাতি হয়ে গেছে কদিন আগে। সেই কেসে গত রাতে তাকে ধরে এনে হাজতে পুরেছে দারোগা বাবু। রহমত ভবানীর অতি বন্ধু মানুষ। একসাথে তাদের ওঠাবসা। বাঈজী পাড়ায় নাচ-গানের আসরে। মদের আড্ডায়। সবখানে।
ভবানীকে দেখে দারোগা বাবু খুবই বিরক্ত হয়েছেন। শুকনো গলায় বললেন–চা খান, ভবানী বাবু। এই কে আছিস, চা আর সিঙ্গারা নিয়ে আয়।
তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে আনমনে কবুতরের একটা পালক কানের মধ্যে ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চুলকাতে লাগলেন। স্পষ্টত উপেক্ষায়, অপমানে ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠতে লাগল ভবানী।
তাহলে দারোগা বাবু, রহমত ছাড়া পাচ্ছে কখন? অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল ভবানী।
কী যে করেন ভবানী বাবু। আপনারা মানি লোক। ওঠাবসা করবেন উঁচু লেবেলের লোকজনের সাথে। আমাদের এখানে আসবেন, দুটো ভালো কথা বলবেন। তা না, আপনি থানায় আসেন শুধু চোর-চোট্টার দরবার নিয়ে।
খামোশ… রাগে গড়গড় করতে করতে বলে উঠলো ভবানী। তুই ব্যাটা দারোগা, তোর কারবার চোর-ছ্যাচ্চোরের সাথে। তোর কাছে চোরের দরবার নিয়ে আসবো না তো কি সাধুর দরবার নিয়ে আসব? কী আমার মহাপুরুষ, একেবারে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব!
অপমানে, ক্রোধে নীল হয়ে গেলেন দারোগা বাবু। থানার ওসি সে। তার সামনে বসে তারই মুখের উপরে এত বড় আস্পর্ধার কথা! ইচ্ছে হলো পোঁদের উপর সজোরে রুলার চালিয়ে দেন। হাড়গোড় ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেন। কিন্তু না, তা করা যাবে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলেন তিনি। রাগ, অপমান সব হজম করে যেতে হবে। ভবানী বাবুকে চটানো যাবে না। তাহলে এখানে চাকরি করাই কঠিন হয়ে যাবে।
রাগ হবেন না ভবানী বাবু। আপনারা রাগ হলে আমরা যাব কোথায়? যতটা সম্ভব গলায় মধু ঢেলে বলার চেষ্টা করলেন দারোগা বাবু।
না, রাগ হবো না, তোমারে চুমা খাব হারামজাদা। তোমার সাথে তো আমার ঠাট্টা-ইয়ার্কির সম্পর্ক।
না, না ভবানী বাবু। দোষ ধরবেন না। পুলিশের চাকরি, নানা রকম ঝুট ঝামেলায় থাকি। সবসময় কি আর মাথার ঠিক থাকে? কী বলতে কী বলে ফেলেছি। মাফ করে দ্যান।
হারামজাদা, জতো মারে গরু দান। তুই কীরম করে এ জায়গায় চাকরি করিস তা আমি দেখে নেব। আমি যাচ্ছি ফরিদপুরে এসপি সাহেবের কাছে। রহমতের চিন্তা তোর করা লাগবে না। তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নাই তোর কাছে। কারণ ঘটনার রাতে সে আমার সাথে ছিল। আর তুই নিজিও ছিলি সে আসরে। তারপরও রহমতরে ধরে আঁকে রাখিছিস। তারে তো তুই ছাড়বিই। এখন তোর উপায় কী হবি সিডা নিয়ে ভাব।
উঠে দাঁড়ায় ভবানী শঙ্কর। মনে মনে প্রমাদ গুনলেন দারোগা বাবু। তিনি জানেন এসপি সাহেব ভবানী বাবুর বিশেষ বন্ধু। প্রয়োজনে ভবানী তার মিতা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভবানী শঙ্কর বিশ্বাসের কাছেও চলে যেতে পারে। একই নামে নাম। না, তাকে চটানো ঠিক হয় নাই।
হাত কচলে বিনয়ের অবতার সেজে দারোগা বাবু বললেন–মাপ করে দ্যান ভবানী বাবু। মনটা বড় অস্থির, মাথার ঠিক নাই। আপনি সত্যি কথাই বলেছেন। চোর-চোট্টা আর রাজ্যের খারাপ মানুষ নিয়েই আমাদের কারবার। ভালো কথা কি আমাদের মুখে মানায়?
এই কে আছিস, রহমতকে এক্ষুনি ছেড়ে দে। যান ভবানী বাবু, আপনার। বন্ধুকে নিয়ে বাড়ি যান।
৩২
অবনী চক্রবর্তী এলাকায় অবন ঠাকুর নামেই পরিচিত। জানাশোনা মানুষ হিসেবে এলাকায় অবন ঠাকুরের যথেষ্ট সুনাম। সে রাজনীতি করে। ভৈরব ডাক্তারের সাথে সেই সূত্রেই পরিচয়। পরিচয় থেকেই যোগাযোগ, ওঠাবসা। আর এখন তো বলতে গেলে ভৈরব ডাক্তারের ঘরের ছেলেই।
ভবানী আর অবনী দুই ভাই-ই এসেছে তার সাথে হাজারিকে দেখতে। অবন ঠাকুর খবর পাঠাল হাজারিকে।
দাদা কখন ফিরিছেন? শুনলাম গোয়ালন্দ গিছিলেন, ভৈরব ডাক্তারের বাড়ি। খবর পেয়েই ছুটে এসেছে হাজারি।
হ্যাঁ, এই তো কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছি। তোমাকে ডাকলাম পরিচয় করিয়ে দিতে। এই যে ইনি, ভৈরব ডাক্তারের বড় ছেলে ভবানী দা, ভবানী শঙ্কর। নাম শুনেছো নিশ্চয়ই। আর এ হলো অবনী শঙ্কর, ডাক্তার বাবুর মেজো ছেলে। আমার নামে নাম। তাই বুঝতেই পারছো, আমরা মিতা।
হ্যাঁ দাদা। তেনাদের নাম এ তল্লাটের সবাই জানে। বলেই ভবানীকে প্রণাম করতে গেল হাজারি।
করো কী! করো কী! বলে হা হা করে উঠল ভবানী শঙ্কর। হাত ধরে তাকে টেনে তুলল। বলল–বসো। তোমার নাম আমি অবনীর কাছে শুনিচি। তুমি এই ইলাকার নমশূদ্দুরগের মদ্যি প্রথম বিএ পাস করিছো জানে খুবই খুশি হইচি। তাই তোমার সাথে আলাপ করতি আলাম। তা তোমার বাড়ি আর কি কি আছে?
বাড়িতি দাদারা আছে। বাবা-মা স্বর্গবাসী হইছেন সেই ছোটবেলায়। বড়দাই মানুষ করিছেন আমারে। আমরা গরিব মানুষ। তবু যদি দাদা, এই অধমের বাড়ি এট্টু পায়ের ধুলো দেতেন তালি ধন্য হতাম।
না না, এরম করে কোয়ে না। তুমি গরিব হবা ক্যান? তুমি যা অর্জন করিছো তা আমাগের নাই। সব সুযোগ পায়ে আমি ম্যাট্রিকটাও পাস করতি পারি নেই। আর তুমি কত কষ্ট করে বিএ পাস করে ফেলিচো। তুমিই তো আসল মানুষ। ভগবান তোমারে আরো বড় করুক, এই আশীর্বাদ করি।
বলতে বলতে আড়চোখে তাকাল অবনী ঠাকুরের দিকে। অবন হা-সূচক ইঙ্গিত দিল।
ঠিক আছে। তুমি যখন ওরকম করে বলতিছো, তখন অবশ্যই যাব তোমাদের বাড়ি।
কোন সময় আসবেন?
বিকেলের দিক।
খুবই খুশি হলাম। আমি তাহলে আসি, দাদা?
হ্যাঁ এসো।
চলে গেল হাজারি। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল ভবানী শংকর। ভালো লেগেছে তার।
অবনীকে জিজ্ঞেস করল–কেমন বুঝলি?
ভালো ছেলে বলেই তো মনে হচ্ছে দাদা। নম্র, ভদ্র, ভক্তি-জ্ঞান আছে। এ জাগায় কাজ করা যায়। কী কও মিতে?
আমি তো আগেই বলেছি। খনা বোনের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত পাত্র আর এ তল্লাটে নাই। চলো ওদের বাড়ির উপর যাই। আগেই বলে রাখি, বাড়িঘর দেখে পছন্দ হবে না। তবে বাড়িঘর হতে কতক্ষণ। কাকাবাবু চেষ্টা করলেই একটা সরকারি চাকরি জোগাড় করে দিতে পারবেন।
খারাপ কও নাই। বাবার কাছে বলে দেখি।
প্রীত হলো ভবানী শঙ্কর। বাবার চিন্তা দূর হবে। বোনটা তার ভালো ঘরেই পড়বে।
৩৩
কলকাতায় একটা সস্তা দরের হোটেলে উঠেছে অবনী শঙ্কর। দুই মাস আগে কলকাতায় এসেছে সে। গায়িকা-নায়িকা কাননবালা দেবীর কাছে গান শিখবে–এই তার স্বপ্ন। কিন্তু নানাভাবে চেষ্টা করেও কোনো সুবিধা করে উঠতে পারেনি। কাননবালার দেখা পায়নি সে। তাই বলে হাল ছেড়ে দেয়নি। কথা আছে আগামী পরশু তাঁর সাক্ষাৎ মিলবে। এবার নাকি মিস হবে না কোনোভাবেই। বাবার পকেট মেরে বিস্তর টাকা-পয়সা নিয়ে সে গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে উঠেছিল। লাল রঙের ‘ঢাকা মেইল’ সোজা কলকাতা চলে আসে দর্শনা হয়ে, থামে শিয়ালদহ স্টেশনে।
হোটেলের বারান্দায় বসে আছে অবনী। বাবা কী করছেন এখন? বাবা কি তাকে ক্ষমা করবেন? আজ দুই মাস হতে চলল বাড়ির সাথে তার কোনো যোগাযোগ নাই। নিশ্চয়ই খুব চিন্তায় আছে সবাই। না, কাজটা ঠিক হয়নি। ঝোঁকের মাথায় এভাবে কাউকে না বলে পালিয়ে চলে আসাটা মোটেও ঠিক হয়নি। পরশু যদি কাননবালার দেখা না পাওয়া যায় তাহলে বাড়ি চলে যাবে সে।
পরদিন সকালেই রথীন দা এসে হাজির। বললেন–কি রে অবনী, এখনও রেডি হোসনি? তাড়াতাড়ি কর।
একসাথে বেরিয়ে পড়ে দুজনে। অবনীর বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাড়, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই কি আরাধ্য দেবীর সাক্ষাৎ পাবে সে? কানন দেবীর পদতলে বসে গান শেখার সুযোগ কি হবে তার?
মনে মনে ভাবতে থাকে অবনী। যদি সত্যি সত্যিই কানন দেবীর দেখা মেলে তাহলে কী করবে? ধপ করে প্রণামটাই আগে সেরে নিতে হবে।
ভক্তিতে মেলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর–এই তত্ত্বে সে খুবই বিশ্বাস করে। হ্যাঁ তাই করবে সে।
পুরনো একটা বাড়ির সামনে ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামল দুজনে। রথীন দা বললেন–এ বাড়িতেই কানন দেবী থাকেন। দুরুদুরু বক্ষে দুজনে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল। গেটে দারোয়ানের সাথে কথাবার্তা যা বলার রথীন দাই বললেন। শেষমেশ বৈঠকখানায় পৌঁছে রংচটা একটা পুরনো সোফায় বসে ঘামতে লাগল অবনী।
আধা ঘণ্টা পরে নাকি শতবর্ষ পরে সত্যিসত্যি কানন দেবী ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। অবনী উঠে প্রায় দৌড়ে গিয়ে কানন দেবীর পদতলে উপুড় হয়ে পড়ল। গড় প্রণাম করে বলল–মা, আমি তোমার কাছে গান শেকপো। আমারে শিকোতিই হবি। সেই কবের তে আশায় বুক বাঁধে বসে আছি। তোমারে আমি কিছুতিই ছাড়ব না মা।
অবনীর আকুতি মনে হয় স্পর্শ করল কানন দেবীকে। অবনীকে পায়ের উপর থেকে টেনে তুললেন। বললেন–কে বাবা তুমি? বাড়ি কোথায়?
আমি আইচি গোয়ালন্দর তে। যে জাগার তে ঢাকা মেইল ছাড়ে সোজা কলকাতা চলে আসে।
হ্যাঁ বাবা, গোয়ালন্দ আমি চিনি। কলকাতা থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ এবং গোয়ালন্দ ঘাট থেকে স্টিমারে করে ঢাকায় গেছি দু’তিনবার।
আমাগের বাড়ি গোয়ালন্দ বাজারের সাথেই। আমার বাবার নাম ডাক্তার ভৈরব চন্দ্র বিশ্বাস। বাজারে আমাগের ইলিশ মাছের আড়ত আছে।
তাই নাকি! তাহলে তো আর ইলিশ নিয়ে চিন্তা নেই।
অবশ্যই নাই। আমি থাকতি আমার মার ইলিশ মাছের অভাব কোনোদিনই হবি নে। যত দরকার হবি, পাঠায়ে দেব।
তা না হয় দিলে। কিন্তু গান যে শিখবে, জানো কিছু গানটান?
না জানার মতোই একটু-আধটু শিকিচি। তয় সুযোগ পালি দেখায়ে দিতি পারব, তা আমি এখনই বলে রাকতেছি।
তাই নাকি! বেশ, গাও দেখি একখানা।
খালি গলায়?
তা-ই গাও। খালি গলায়ই গাও।
নজরুল গীতি ধরি।
ধরো। তা-ই ধরো। স্মিতহাস্যে বললেন কানন দেবী।
গান ধরল অবনী। কিন্তু গলা দিয়ে তার সুর বের হতে চায় না। যতই চেষ্টা করে ততই আঁকে যায় গলার মধ্যে। কানন দেবীর সামনে তার মতো অবনীর গান গাওয়া যে কত কঠিন কাজ, তা সে হাড়ে-হাড়ে অনুভব করল।
শাওন রাতে যদি… কাঁপতে লাগল তার গলা।
স্মরণে… আসে,.. মোরে… স্বরগ্রামটা একটু একটু করে উপরে উঠতে লাগল।
বাহিরে… ঝড়… বহে… কণ্ঠের জড়তা যেন কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
নয়নে… বারি… ঝরে… এতক্ষণে গলাটা ছাড়তে পারল সে। দরদ ঢেলে গাইতে শুরু করল অবনী।
চোখ বন্ধ করে একমনে গান শুনছেন কানন দেবী। আর ছোট্ট ছোট্ট করে পায়ে তাল দিচ্ছেন। একসময় শেষ হলো অবনীর গান। কানন দেবী ইশারা করলেন আর একটি ধরার জন্যে। অবনী শুরু করল–
এনেছি আমার শত জনমের প্রেম… আঁখিজলে গাঁথা মালা…
এবারও কানন দেবী মন দিয়ে শুনলেন অবনীর গান। শেষ হলে বললেন–আর একটি গাও তো দেখি বাবা।
অবনী কোনটা গাইবে তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। তারপর ধরল—
মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম…।
অবনীর গলায় কাজ আছে। সুর কেঁপে কেঁপে উপরে উঠতে লাগল। বৈঠকখানার পুরো ঘরজুড়ে সেই সুরের মূর্ঘনা তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ল। একসময় থামল অবনী। তার দু চোখে নেমেছে জলের ধারা। কানন দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে লজ্জা পেল।
তাড়াতাড়ি চোখ মুছে অবনী বলল–ভয়ের মধ্যি ছিলাম তো। তাই ভালো করে গাতি পারলাম না। তয় তুমি যদি শিকোও। শিখাবে তো মা?
হ্যাঁরে পাগল শেখাব। গানের মধ্যে যে এভাবে ডুবে যেতে পারে তাকে শেখাব না তো আর কাকে শেখাব! তোর চোখের জলই বলে দেয়, তোকে দিয়ে হবে। গান হলো সাধনা। মন-প্রাণ ঢেলে দিতে হয়। পারবি তো?
পারব মা, আমারে পারতিই হবি।
ঠিক আছে। যা, তোকে আমি আমার ছেলে হিসেবেই নিলাম।
সত্যি মা? ইডা যে আমার কত বড় ভাগ্যি। বলে তাড়াতাড়ি আবার সে প্রণাম করে কানন দেবীকে।
তালি মা, কবের থে শেকপো?
আজ থেকে। এখন থেকেই নয় কেন?
কিন্তু আমার যে একবার বাড়ি যাওয়াই লাগৰি। বাড়ির তে টাকা-পয়সা নিয়ে আসতি হবি। নালি খাবো কী, চলবোই বা কীরম করে?
কেন রে, তোর মায়ের কি এমনই পোড়া কপাল যে, তার ছেলেকে খাওয়াতে পারবে না!
তা তো অবশ্যই পারবা। কিন্তু আমি সেই দুই মাস আগে টাকা-পয়সা চুরি করে কাউরে না বলে বাড়ির তে পলায়ে আইচি। বাবা-মা বড় চিন্তার মদ্যি আছে।
তুই সত্য কথা বলেছিস। তাই খুশি হলাম। কিন্তু কাজটা ভালো করিস নাই। কালই বাড়ি ফিরে যা। যত তাড়াতাড়ি পারিস, বাবা-মার অনুমতি নিয়ে চলে আসবি। গান হলো সাধনা, বাবা-মার আশীর্বাদ ছাড়া সাধনা পূর্ণ হয় না।
একটুক্ষণ চুপ থেকে আবার তিনি বললেন–তবে এমনভাবে আসবি, যেন দুই বছরের মধ্যে আর বাড়ির কথা মনে না পড়ে। কেমন?
উঠে পড়লেন কানন দেবী।
আবার প্রণাম করে অবনী বলে–আমারে আশীর্বাদ করো মা।
গলার সুর তোর অক্ষয় থোক। বলে অবনীর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন কানন দেবী।
বাড়ির বাইরে এসে বুক ভরে নিশ্বাস নিল অবনী শঙ্কর। সবটুকুই যেন ঘটে গেল স্বপ্নের ঘোরে। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তার স্বয়ং কানন দেবী তাকে আশীর্বাদ করেছেন, রাজি হয়েছেন তাকে গান শেখাতে।
৩৪
অবন ঠাকুর গিয়েছিল যশোরে। দুদিন আগে বাড়ি ফিরেছে। একটু অবসর পেতেই সে ডেকে পাঠিয়েছে হাজারিকে। খবর পেয়েই হাজারি অবনী ঠাকুরের বাড়িতে এসে পৌঁছুল।
দাদা, কেমন আছেন? আমারে ডাকিছেন? হাজারি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার অভ্যাস করছে। কিন্তু আঞ্চলিক টান কিছু এসেই যায়।
হ্যাঁ, ডেকেছি। তোমার সাথে একটা বিশেষ আলাপ আছে। একটু গোপনীয়। চলো মাঠের দিকে যাই।
তা যাচ্ছি, তবে দাদা ঢাকার খবর কী? আপনি তো শহর থেকে আলেন।
খবর ভালো না। ভাষা নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী আর সাধারণ মানুষ মিলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে। গুলি চালিয়েছে পুলিশ, রক্তে লাল হয়ে গেছে রাজপথ। অনেক মানুষ মারা গিয়েছে। সবার পরিচয় এখনও জানা যায় নাই। তবে কয়েকজনের নাম আমি যশোর থেকে শুনে এসেছি–বরকত, শফিক, ছালাম, জব্বার…।
বলেন কি দাদা, এত কাণ্ড হয়ে গেছে!
শুধু তাই না। আগুনে ঘি পড়েছে, দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে সবাই। সে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। মেডিক্যালের পাশে রাতারাতি শহিদ মিনার বানিয়ে ফেলেছে ছাত্ররা। বুঝলে হাজারি, গুলি করুক আর যাই করুক, বাংলায় কথা বলার অধিকার কেউ আমাদের কেড়ে নিতে পারবে না। এত ক্ষমতা কারো নাই। জিন্নাহ হুকুম করল আর অমনিই আমরা সুরসুর করে উর্দুতে কথা বলতে শুরু করে দিলাম!
মামার বাড়ির আবদার নাকি? বলে হাজারি।
ঠিক বলেছো। বাঙালিরে তো চেনে না! এইবার হাড়ে হাড়ে চিনবে।
উত্তেজিত অবনী আবার বলতে শুরু করল–নিজের ভাষায় কথা বলার জন্যে বুকের রক্ত ঢেলে দেবার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম। আর কোনোদিন হবে কি না তাও জানি না। তোমাকে বলে রাখলাম হাজারি, একদিন বিশ্বজুড়ে এই আত্মত্যাগের ঠিক মূল্যায়ন হবে।
অবশ্যই হবে দাদা। কোনো ত্যাগই বৃথা যায় না। আর এ তো ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্যে আন্দোলন। আচ্ছা দাদা, আমরা কিছু করতি পারি নে!
অবশ্যই পারো। তোমাদের স্কুলে শহিদ মিনার বানাও। পাক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে দাও। প্রতিবাদ জানাও। আমরাও থাকবো তোমার সাথে।
আজই সমাধিনগর চলে যাব। রাতের মধ্যে শহিদ মিনার বানায়ে ফেলব, সভা করব। দাদা, ভৈরব ডাক্তারকে বক্তৃতা করার জন্যে নিয়ে আসা যায় না?
যাবে না কেন? অবশ্যই যায়।
ভৈরব ডাক্তারের নাম উঠতেই অবন ঠাকুরের মনে পড়ে গেল, হাজারিকে সে একটা বিশেষ কথা বলার জন্যে ডেকেছিল। তাই বলল–সব হবে। তার আগে চলো নিরিবিলি কোনো জায়গায় যাই। যে জন্য তোমাকে ডেকেছি সেটা আগে সেরে ফেলি।
হাজারি উঠে পড়ে। একটু চিন্তায় পড়ে গেছে সে। অবন দা কী এমন গোপন কথা বলবেন তাকে, যার জন্যে ফাঁকা মাঠে যেতে হবে!
দুজনে মাঠের মধ্যে গিয়ে আইলের তে-মাথার উপরে বসল।
বিয়ে করার কথা কিছু ভেবেছো নাকি হাজারি? ইতস্তত করে বলে অবন ঠাকুর।
না দাদা, এখনও ঠিক ভাবি নাই। তবে বিয়ে তো একদিন করতিই হবে। বড়দা অবশ্য উঠেপড়ে লেগে গেছে।
তা তো বটেই। তোমার দাদাকে তো তার কর্তব্য পালন করতে হবে।
হ্যাঁ, সেজন্যে দাদা মেয়ে দেখছেন বিভিন্ন জায়গায়। দাদার এক কথা, দুই-চার ক্লাস লেখাপড়া না জানলি সে মেয়ে আনা যাবে না। তা দাদা, আপনি হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞাসা করছেন?
কারণ তো আছেই। তবে বলি কি বিয়ে তো জীবনে একবারই করবে। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়াই ভালো। কী বলে?
তা তো অবশ্যই দাদা। আপনার মতামত তো আমাকে নিতেই হবে।
না, না, তা কেন। তোমার বাড়ির লোকজনের মতামতটাই আসল।
আপনি হলেন দাদা আমাদের এই বিল সিংহনাথ মৌজার সবচাইতে বুঝমান মানুষ। আমার বড়দাও বলেছেন, অবনের সাথে আলাপ না করে পাত্রী ঠিক করা যাবে না।
তাই! তাহলে তো ভালোই হলো।
একটুক্ষণ চুপ থেকে কী যেন ভাবলেন অবনী ঠাকুর।
তারপর নরম গলায় বললেন–ধরো, ভৈরব ডাক্তার তোমাকে জামাই করতে চাইলেন। তখন তুমি কী করবে?
হাজারি থতমত খেয়ে অবনী ঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক কী বলল, যেন ভালো শুনতে পায়নি সে।
কিছু বলো হাজারি। চুপ করে আছো যে?
কী বলব দাদা। ঠিক বুঝতে পারছি না।
শোনো, সেবার যে ভবানী দা এসেছিলেন, মনে আছে? আসলে তিনি এসেছিলেন তোমাকে দেখতে। আর কাকাবাবু মানে ডাক্তার বাবুর সাথে নাকি তোমার সমাধিনগরে পরিচয় হয়েছিল?
হ্যাঁ, তেনার সাথে আলাপ হয়েছিল বটে। তবে সে বড় ক্ষণিকের পরিচয়। আমাকে তো তার মনে থাকার কথা না।
উনি কোনো কিছু ভোলেন না। এত বড় মানুষ তো আর এমনি এমনিই হন নাই।
তা ঠিক। দাদা সত্যি কথা বলতি কী, উনার মতো মানুষের জামাই হতে পারা তো ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু, উনারা আমার সাথে মেয়ে বিয়ে দেবেন কেন? বাড়ি-ঘর নাই, জমি-জমা নাই, ভোররা বিলের মধ্যে আমাদের গ্রাম, রাস্তা-ঘাট নাই।
হাসল অবন ঠাকুর।
বলল–ভৈরব ডাক্তার মেয়ে বিয়ে দেবেন একজন শিক্ষিত, ভদ্র ছেলের সাথে। জায়গা-জমির সাথে না। যে ছেলের ভবিষ্যৎ আছে, সম্ভাবনা আছে সেরকম ছেলেই কাকাবাবু খুঁজছেন। কাকাবাবুর সেজো মেয়ে খনা, তার নয়নের মণি রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। বলতে পারো রাজকন্যা খনার মতোই সে বিচক্ষণ। তার বুদ্ধি আর আন্তরিকতার কাছে আমরাও হার মানি।
আমার কোনো আপত্তি নাই দাদা।
তাহলে চল মেয়ে দেখে আসি। দিন-তারিখ ঠিক করি।
মেয়ে আর কী দেখব। আপনি যে বর্ণনা দিলেন তা-ই আমার কাছে। যথেষ্ট। তার উপরে ভৈরব ডাক্তারের মেয়ে। বরং আমিই তাদের উপযুক্ত না।
না, না, তা কি হয়? সামাজিকতার ব্যাপার আছে না! চল যাই, তোমার দাদার সাথে কথা বলি।
দুজনে আলের উপর থেকে উঠে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
৩৫
আজ সেই দিন সমাগত। কয়েক দিন ধরেই এলাকাজুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। কাজিয়া হবে। বড় বড় লাঠিয়ালদের সমাগম হয়েছে। মেচে তা দিয়ে তারা আয়োজন করে সকাল-বিকাল মোটা মোটা লাঠিতে তেল মাখাচ্ছে। সে আয়োজন দেখার মতো। কাজিয়া হবে হিন্দু-মুসলমানে।
দেশভাগ হয়ে পাকিস্তান হয়ে গেছে সেই কবে। তারপর জমিদারি উচ্ছেদ হয়েছে। প্রজারাই হবে জমির মালিক। মাঠে মাঠে জরিপ চলছে। কৃষকদের নামে জমির নামজারি হবে।
কিন্তু নতুন চর জাগলে সে জমি হবে খাস। গায়ের জোরে যে দখল নিতে পারে, ভোগ করে সেই। গড়াই নদীর বাঁকে নতুন একটা চর একটু একটু করে জেগে উঠছে। সেটার দখল নিয়ে অনেক দিন ধরেই পায়তারা চলছিল। জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে দখল কায়েমের লক্ষ্যে কাজিয়ার দিন তারিখ ধার্য হয়ে গেছে মাসখানেক আগেই।
পাকিস্তান হয়ে গেলেও এই এলাকার নমশূদ্রদের দাপট কম নয়। তারা সংখ্যায় অনেক বেশি। গ্রামের পর গ্রামজুড়ে একসাথে তাদের বসবাস। তাদের মধ্যে আছে একতা। জীবনের সাথে অবিরত যুদ্ধ তাদের। যুদ্ধজয়ের দুর্নিবার সাহস তাদের চওড়া বুকজুড়ে। লাঠি খেলা, ঢাল-সড়কি চালানো সবকিছুতেই তাদের জুড়ি মেলা ভার। তাই তাদেরকে সমীহ করে চলতে বাধ্য সবাই।
জয়া পাগল হিন্দু লাঠিয়াল দলের সর্দার। শ্রুতি আছে জয়া পাগল তন্ত্রমন্ত্র জানে, কালী সাধক। তার লাঠি যখন চলে তখন নাকি চোখে কিছুই দেখা যায় না। সে সময় মা কালী স্বয়ং তার উপরে ভর করে।
বিশাল একহারা গড়ন জয়া পাগলার। লম্বায় ছ ফুটের উপরেও ইঞ্চি খানেক বেশি, চওড়ায়ও তেমনি। বাবরি চুল নেমে এসেছে কাঁধ অবধি। গায়ের রং একসময় যে ফর্সা ছিল তা বোঝা যায়। রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে এখন। পরনে সাদা ধুতি ভাঁজ করে লুঙ্গির মতো পরা। খালি গা। মাথায় লাল রঙের মোটা কাপড় বাধা। কপালজুড়ে বিশাল লম্বা সিঁদুরের ফোঁটা। দুই চোখের নিচে উপরে রাক্ষসের মতো করে কড়া আলতা টানা। বেজির লেজের মতো তাগড়াই গোঁফ মুখে। বিশাল চওড়া কাঁধ। ডান হাতে রুপোর মোটা বালা আর বাম হাতের বাহুতে তাগা দিয়ে বাঁধা বড় চারকোনা একটা মাদুলি। তেল চকচকে মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে সে যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, বিপক্ষ দলের লাঠিয়ালদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে তখন।
খাওয়া-দাওয়া শেষ। মা কালীর চরণতলে অর্ঘ্য নিবেদনও শেষ। পাঁঠা বলি হয়ে গেছে। সেই রক্তে আঙুল ডুবিয়ে একে একে লাঠিয়ালরা কপালে তিলকের মতো ফোঁটা পড়ে নিল। পরনে নেংটি, মালকোচা মারা। খ্যাপা শুয়োরের মতো দৃষ্টি। দাপাতে দাপাতে, গজরাতে গজরাতে তারা দলে বলে রওনা হলো জয়া পাগলের নেতৃত্বে।
জয়, মা কালী…
জয়, মা কালী…
কালী রে কালী…
জয়, মা কালী…
ক্রমেই বাড়তে থাকে উত্তেজনা। বাড়তে থাকে উন্মত্ততা। হিংস্র পশুর রূপ ধারণ করে তারা। তাদের চিৎকারে গর্জনে নমশুদ্র এলাকার আকাশ-বাতাস মাটি কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে। সাধারণ নমশূদ্ররাও তাদের সাথে জয় মা কালী… চিত্তারে শামিল হয়ে যায়।
নমশূদ্রদের এ চিরাচরিত যুদ্ধ। যেন এই যুদ্ধে জয় মানেই জীবনের সকল যুদ্ধে জয়লাভ করা। এই যুদ্ধে এরা জয়কে জয় করে, পরাজয়কে স্বীকার করে। এই যুদ্ধে শুধু পুরুষরাই নয়, মেয়ে বন্ধুরাও হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে কোমর ঘষে, দা-বঁটি হাতে এক একটা চামুন্ডা হয়ে ওঠে। পেছন থেকে প্রয়োজনে পুরুষদের ঢাল-সড়কি, ইট-পাটকেল জোগান দেয় তারা।
অপর পক্ষও এগোতে থাকে। সে দলের নেতা আবুল। তাদের কণ্ঠেও চিৎকার…
নারায়ে তাকবির…
আল্লাহু আকবর…
নারায়ে তাকবির…
আল্লাহু আকবর…
চিৎকারে, হুঙ্কারে ক্রমশ একটু একটু করে মুখোমুখি এগোতে থাকে দু পক্ষের লাঠিয়ালরা। রামদা, সড়কি, বল্লম, ঊ্যাটা, জুতি ইত্যাদিতে সজ্জিত হয়ে পজিশনে চলে গেছে দুই পক্ষই ঢাল-সড়কির আবরণে যে যার অবস্থানে। ভেসে আসছে তাদের রূঢ় কণ্ঠের গর্জন।
এর মধ্যেই দূর থেকে দৈববাণীর মতো ভেসে এল-থামো তোমরা..
সে চিৎকার আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে প্রান্তরে মিলিয়ে যেতে না যেতেই আবার চিৎকার–
থামো তোমরা, থামো। আমার কথা শোনো…
শব্দটা আসছে গড়াই নদীর বাঁকের পেছন দিক থেকে। হতচকিত সবাই তাকিয়ে থাকে সেদিকে। একটু পরেই দেখা গেল বাঁক ঘুরে বাঁধের রাস্তা ধরে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে লাল রঙের সেই চেনা ঘোড়া। ঘোড়ার খুড়ের খটখট শব্দ একটু একটু করে স্পষ্ট হতে থাকে। সকলেই বুঝতে পারে, আর কেউ নয়। ইনি ভৈরব ডাক্তার।
সাড়া পড়ে যায় দর্শকদের মধ্যে। গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে লাঠিয়ালদের মধ্যেও।
ভগমান ডাক্তার বাবুরে পাঠায়ে দেছে। আর সমিস্যে নাই। দু করে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানায় উপস্থিত সকল মানুষ।
উন্মত্ততার মধ্যেই লাল ঘোড়াটা দু পক্ষের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায় ঢুকে পড়ে। ঘর্মাক্ত কলেবরে ঘোড়ার পিঠে বসেই হাত উঁচু করে আবার বলেন তিনি বললেন–”থামো। নিজিগের মদ্যি মারামারি করে মরতেছো কেন তোমরা? আমার কথা শোনো। চর হলো গে সরকারি সম্পত্তি। এই চরের দখল কিডা পাবি তা ঠিক করে দিবি সরকার। সেজন্য ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব স্বয়ং আসতেছেন পুলিশ নিয়ে। ইডা তাগের কাজ, তোমাগের না। তোমরা কেন মারামারি করে মরবা? তুমরা মরে গিলি ছাওয়ালপালগের খাওয়াবি কি? আমি কতা দিচ্ছি, তোমাগের টাকা-পয়সা যাতে তোমরা ঠিকমতোন বুঝে পাও, সিডা আমি দ্যাকপো। দায়িত্ব আমি নিলাম।
কই রে জয়া, কই রে আমার পাগল? আয় আমার বুকে আয়। আবুল উঠে আয়, বাবা… আমার বুকে আয়…
জয় মা কালী… বলে জয়া পাগল দলবল নিয়ে ভৈরব ডাক্তারের দিকে এগিয়ে যায়। সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। একে একে লাঠিসোটা, বল্লম, সড়কি সৰ নামিয়ে রাখে ভৈরব ডাক্তারের পায়ের কাছে।
আবুল সর্দারও এগিয়ে আসে ধীরপদে অন্যদিক থেকে। মাথা নিচু করে দাঁড়ায় দলবলসহ। ঘোড়া থেকে নেমে জয়া পাগল আর আবুল সর্দারকে আশীর্বাদ করেন ভৈরব ডাক্তার। তারপর দুজনকে জড়িয়ে ধরেন বুকের মধ্যে।
চারিদিকে তখন সমবেত কণ্ঠে ধ্বনি… জয়, ভৈরব ডাক্তারের জয়…
উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা।
৩৬
রেললাইন ধরে ধীরপদে এগিয়ে চলেছে ভবানী শঙ্কর। উদ্দেশ্য গোয়ালন্দ বাজার। তার অতি প্রিয় হেঁই দেয়া ইলিশ আর রাতের কড়কড়া ভাত ভরপেট খেয়ে রওনা হয়েছে সে। মনটা তাই বেশ খুশ হয়ে আছে।
ভানে… ভানে রে…
অনেকটা দূর থেকে ভেসে আসছে শব্দটা। ভবানীকে সংক্ষেপে ভানে বলেই ডাকে এলাকার মানুষ। কে ডাকে তাকে!
পেছন ফিরে তাকায় ভবানী। হাত উঁচু করে কে যেন দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে রেললাইন ধরে। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে থাকে, কে হতে পারে!
বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির হলো তারে দা, মানে তারকেশ্বর বিশ্বাস।
আমার সব্বনাশ হয়ে গেছে রে ভানে… মহা সব্বনাশ! বাঁচা, আমারে ধনে পিরানে বাঁচা। ভানে রে… তোর পায় ধরি।
সত্যি সত্যি ভবানীর পা জড়িয়ে ধরতে গেল তারে দা।
আরে করো কী! করো কী! ওঠো, শান্ত হও। কও তো দেখি কী হইছে?
তোর বৌদি রে এহনি ফরেতপুরির হাসপাতালে নিয়ে যাতি হবি। নালি সেও বাঁচপেন না, প্যাটেরডারেও বাঁচান পেন না। কোবরেজ করে দেচে। এই সুমায় ভরেব ডাক্তার রইচে ঢাকা। এহন আমি কী করি… ঘুড়ার গাড়ি ভাড়া করুতি হবি। ওষুদ-পত্যি, ডাক্তার দেহানে… কনে পাবো আমি এত টাহা! তুই আমারে বাঁচা ভানে…
কিন্তু এখন তো আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নাই। আড়তেও যাতি পারব না আমি। কয়দিন আগেই ক্যাশ ভাঙে কলকাতা গিচিলাম। খরচ খচ্চা করে ঘুরে আইচি। তালি এহন কী করা যাবি! দাঁড়াও, দেখি বুদ্ধি একখান খুঁজে বার করি।
মাথা চুলকে চিন্তা করতে করতে ভবানী বলল। সামনে নটবর মন্ডলকে দেখেই সে সমাধান পেয়ে গেল।
দরাজ গলায় বলল–এই যে নটা কাহাচকের উত্তরের বড় দাগের ঐ তেরো পাখি জমি তুমি খাও গে। আর তারেদা রে এহনি পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে দ্যাও। বৌদিরে তো বাঁচাতি হবি, না কি কও?
তুমি যহন বাপু কইচো, তুমার কতা তো আর ফেলতি পারবান না। তয় তুমি যে আমারে জমিডা খাতি দিলে সিডা তো অন্য মানষি জানবি নে। কলমের এট্টা খোঁচা মারে দিলি জিনিসটা ভালো হত না।
সুযোগ বুঝে হাত কচলে বলে ফেলে নটবর।
নটবর মন্ডল ভালো করেই জানে ভবানী উদার হস্ত। তার দিল ভৈরব ডাক্তারের চেয়েও দরাজ। ভৈরব ডাক্তারের দান-ধ্যান করতি হয় নিজির কষ্টের উপার্জনের টাকায়। আর ভবানী করে বাপের ধনে পোদ্দারি। কষ্ট করে উপার্জন করলি না টাকার মর্ম বুঝবি, মায়া জন্মাবি।
ঠিক আছে, দলিল বানায়ে নিয়ে আসে নে, সই করে দিবানে।
ভবানীর মুখের কথাই যথেষ্ট। বলেছে যখন, সই অবশ্যই করে দেবে সে।
অনেক মানুষ জমে গেছে এর মধ্যেই। তাদেরকে না সরিয়ে এগোেনোর উপায় নেই। ভিড়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে যাবার পথ খুঁজতে লাগল সে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তারকেশ্বর জড়িয়ে ধরল ভবানীকে।
ভানে রে… তুই মানুষ না, তুই দ্যাব। তুই আছিস দেহে আমরাও বাঁচে আচি। ভগমান তোর ভালো করবি।
বিরক্তই হলো ভবানী মনে মনে। যথেষ্ট হয়েছে, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করল সে।
অনেক দিন গানবাজনার আসর হয় না। আজ সন্ধ্যায়ই অয়োজন করতে হবে।
কিন্তু পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে বাবার সামনে পড়া ঠিক হবে না। রাগে ফুঁসছেন তিনি। তবে বাবার হৃদয় অতি কোমল। রাগ বেশি দিন ধরে রাখতে পারেন না। মাথা ঠান্ডা হওয়া পর্যন্ত কয়েকটা দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলেই চলবে।
কিন্তু হাতটান অবস্থা এখন। তালি টাকা পাবো কোথায়? কী করা যায়… কী করা যায়…
ভানে দা, কলকাতা গিছিলে না? কবে আলে? ভ্যাজালের প্রশ্নে চমক ভাঙে ভবানীর।
এই তো আলাম।
আসো এট্টু বসে যাও। কেবল রসগোল্লা নামাইছি। গরম গরম চারডে খাও।
না রে… এখন না। পরে একসময় আসপানে।
এট্ট দরকারও ছিল। আসো ভানে দা, কত দিন আমার দোকানের পর বসো না। এট্টু বসে যাও, গরম রসগোল্লা দেই, খাও। দ্যাহো কীরম বানাইছি। সাথে কথাড়াও সারে নিতাম।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভবানী ভ্যাজালের মিষ্টির দোকানে ঢুকে বেঞ্চের উপর বসে পড়ল। সে ভালো করেই জানে, এদের দরকার মানেই ভবানীর পকেট থেকে টাকা খসা। এমনিতেই পকেট এখন গড়ের মাঠ। সেজন্যে মন-মেজাজ ভালো নেই। তার উপরে আবার এদের উৎপাত। কিন্তু ভবানী কাউকেই বলতে পারে না।
ক, তোর কী দরকার। রসগোল্লা খেতে খেতে বলল ভবানী। টসটসে গরম রসগোল্লা। খেতে বেশ লাগছে।
দে তো আর দুডে। ভালোই তো বানাইছিস। দুধে আবার ভ্যাজাল ট্যাজাল দ্যাস নাই তো?
কী যে কও দাদা। নাম আমার ভ্যাজালে হতি পারে, কিন্তুক তুমাগের কিপায় কামে এহেবারে আসল। আমার দুকানে কোনো ভ্যাজাল পাবা না।
কথাটা সত্যি। ভ্যাজালের দোকানের সুনাম ইতোমধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তার দোকানের মিষ্টি স্টিমারে করে ঢাকা যায়, ট্রেনে করে কলকাতা পর্যন্ত চলে যায়। বাবুরা আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখে।
হইছে, এখন কী কবি তাড়াতাড়ি ক। আমার হাতে সময় নাই।
না, সিরম কিছু না। দুকানের বেচাকিনা তো ভালোই হতেচে এহন। কতি পারো মাল দিয়ে সুমোর পাচ্ছি নে। যুদি আর কয়ড়া টাহা ধার দিতে, তয় ব্যবসাডা ভালো কোরে কত্তি পাত্তাম।
তুই তো টাকা নুয়ার সময় কোস যে ধার নিলাম। কিন্তু ফেরত দুয়ার নাম তো আর করোস না। ধার নিয়ে দোকান বানালি, পরে আরো তিন-চার বার ধার নিলি, কলি পুঁজির অভাব। আবার সেই সুর তুলিছিস। বিষয়ডা কী তোর?
মিত্যে কতা কব না ভানে দা। তুমি না থাকলি তো না খায়ে মরতাম। তুমি যে কয়বার টাকা দেচো সে কয়বারই তা কাজে লাগাইচি। দোকানের দিক তাকায়ে দ্যাখো, তালিই বুজতি পারবা।
কথাটা যে সত্য, তা দোকানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। নতুন বেঞ্চ-টেবিল, পদ্মপাতার জায়গায় এসেছে প্লেট-গ্লাস-চামচ। ঘরটা পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে, তকতকে। না, ছেলেটার এলেম আছে। সততার সাথেই ব্যবসা করে। একে টাকা দিলে কাজে লাগবে, নষ্ট হবে না। মনে মনে ঠিক করে ফেলল ভবানী, ভ্যাজালেকে আরো কিছু টাকা সে দেবে। টাকা ফেরত পাবার আশা ভবানী করে না। মুখে সে ধারের কথা বলে বটে, তবে ভ্যাজালেও জানে, এ টাকা তাকে কোনোদিনই আর ফেরত দিতে হবে না।
এখন তো টাকা কাছে নাই। পরে দিয়ে দিবা নে। বলে ভবানী বের হবার উদ্যোগ নিল।
কিন্তু না, আজ তার কপালই খারাপ। এর মধ্যে এসে ধরে ফেলল কাঞ্চি বুড়ি। কাঞ্চি বুড়ির একটা মেয়ে ছাড়া ভব সংসারে আর কেউ নেই। কখনও পরের বাড়ি কাজ করে। কখনও চেয়ে-চিন্তে, ভিক্ষেসিক্যে করে কোনোমতে সংসারটা চালায়। সে ভবানীর বেজায় ভক্ত।
ভানে কো রে…, কনে আমার ভানে…। বাবারে তোর পত চায়ে বসে আচি সেই কবের তে। কলকাতা না কনে বোলে গিচিলি। আর আমি এদিক মরতেছি আমার জ্বালায়। বলতে বলতে এসে বুড়ি ভবানীকে জড়িয়ে ধরল।
কী হইচে খুড়ি, আমারে খুজতেচো ক্যান?
খুজতেচি কি আর সাধে রে বাবা?
ক্যান, কী হইছে।
কুন ভাগ্যি য্যান তোর বুন কমলাডার এট্টা বিয়ের কাম জুটে গেছে। ছাওয়ালডা ভালোই পাইচি। এহন বিয়ে কিডা উটো দিবি? তুই ছাড়া আমার
আর কিডা আচে? তুই আসে পড়িচিস, ধড়ে পিরানডা ফিরে পাইচি।
তাই নাকি? তা বিয়ে কবে?
এই তো সামনের বিষুদবার। লগনো ম্যালা রাত্তিরি।
ঠিক আছে, তুমি ভাবে না খুড়ি। বিয়ের সব দায়িত্ব আমি নিলাম।
তার খরচের খাতা ক্রমেই বড় হচ্ছে। হোক, তবু ভবানী খুশি মনে মনে। গ্রামের হতদরিদ্র একটা মেয়ের গতি হতে যাচ্ছে। তাছাড়া কমলা মেয়েটাও বড় লক্ষ্মী। গ্রামের সবাই তাকে ভালোবাসে।
মনে মনে ঠিক করে ফেলে ভবানী, বিয়েটা ধুমধাম করেই দিতে হবে। শ্বশুর বাড়ির লোকের কাছে কমলার মাথা যেন হেঁট না হয়। বিয়েতে বাদ্য বাজাতি হবি, হ্যাঁজাক বাতি জ্বালাতি হবি, বরযাত্রীগের যত্ন-আত্তি করতি হবি। প্রত্যেক বরযাত্রীরে এট্টা করে আস্ত ইলিশ খাওয়াতি হবি। সবাই যাতে কয়, হা বিয়ে হলো বটে একখান।
কিন্তু পকেট তো শূন্য। ভবানী মনে মনে ফন্দি আঁটতে লাগল কীভাবে টাকা জোগাড় করা যায়।
৩৬
অবনী মাথা নিচু করে গোঁজ হয়ে বসে আছে বারান্দায়। তার মা ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে ঘরের মধ্যে।
বোন খনা বারবার চোখ মুছে বলতে লাগল–যাস নে রে দাদা। বাপ-মার মনে কি কষ্ট দিতি আছে? বাবা কইছে আগে লেখাপড়া শেষ করতি। সিডা আগে কর। তা না করে উনি যাচ্ছেন কলকাতা গান শিকতি। দুই বছরের মদ্যি বোলে বাড়ি আসা যাবি নে। সিডা আবার কীরম কতা?
খনা ছোট মানুষ হয়ে বুজতি পারতেছে, আর তুই এত বড় আধ দামড়া হয়েও বুঝিস নে? বাবা তোরে কলকাতা যাতি না করিছে। তারপরও কি তোর যাওয়া চলে? মা-বাবার আশীর্বাদ ছাড়া কি গান হয় রে পাগল। যদি যাওয়াই লাগে তালি এট্টু ধৈর্য ধরা লাগবি। ব্যাগটা রাখে চল দুই ভাই মিলে বাজারে যাই। চিন্তা করিস নে। তোর কলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা আমি করে দিবা নে। ভবানী এসে অবনীর কাঁধে হাত রেখে বলল।
ছোট ভাই অজিত অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল।
সুযোগ পেয়ে বলল–বুঝলে মেজোদা, বড়দার কথা শোনো। ভবিষ্যতে কাজে দিবি। কবি বলে গেছেন ‘দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মোহিতে। ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’ বুজলে না?
তোর কাব্যি থামাবি? আমি মরতেচি বোলে আমার নিজির জ্বালায়। স্বয়ং কাননবালা আমারে ছেলে মানিছেন। নিজি আমারে গান শিকোতি রাজি হইচেন। এরম সুযোগ কি আর এ জীবনে আসপি? চোখ মুছতে মুছতে অবনী ব্যাগটা ঘরে রেখে এলো।
চল ভাই। ভাবিস নে। সময় বুঝে কায়দা-কানুন করে ঠিকই বাবারে রাজি করায়ে ফ্যালবা নে। তোর এত ভালো গানের গলা। যা, কথা দিলাম। যেরম করে পারি তোর কলকাতায় যায়ে গান শিকার ব্যবস্থা আমি করেই দেবো। ভবানী সস্নেহে বলল।
দাদার কথায় অবনী খুব একটা ভরসা পেল না। কিন্তু বুঝল এই মুহূর্তে এই পরামর্শ গ্রহণ করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় নাই। তবে সে হাল ছাড়বে না, লেগে থাকবে। এর শেষ সে দেখেই ছাড়বে।
৩৭
গোটা গ্রামের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।
কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিমু চুরি হয়ে গেছে। নিমু ভৈরব ডাক্তারের সেই লাল রঙের ঘোড়াটা। নিস্তব্ধ, নির্বাক বসে আছেন ভৈরব ডাক্তার। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না, তার নিমুকে কেউ চুরি করে নিয়ে যেতে পারে।
এমন পাষাণ হৃদয় কার হবে? ভেবে কোনো কূল-কিনারা করতে পারছেন না তিনি।
একসময় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন ভৈরব ডাক্তার। নিমুকে উদ্ধার করতেই হবে। বের করতেই হবে কে তার ঘোড়া চুরি করেছে। নিমু তার অতি প্রিয়। নিমু বলে ডাক দিলেই সে উত্তর নেয়, দৌড়ে চলে আসে। মাথা নিচু করে ভৈরব ডাক্তারের কোমরের কাছে মাথা ঘসতে থাকে। সুতরাং একা কোথাও চলে যেতে পারে না নিমু। গ্রামের এবং আশেপাশের লোকজন স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই চারিদিকে বেরিয়ে পড়ল নিম্নর খোঁজে।
নিমুরে আমার চাই। এর জন্যি যা করা লাগবি, আমি তা-ই করব। যত টাকা লাগে লাগুক। ঘোষণা দিলেন ভৈরব ডাক্তার।
নিজে চললেন থানায় বড়বাবুর সাথে কথা বলতে। সব শুনে দারোগা বাবু বললেন–এ তল্লাটে কোন শালার ব্যাটার এত বড় সাহস যে আপনার ঘোড়া চুরি করে? আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ডাক্তার বাবু। চোর তো ধরা পড়বেই, আর ওর পোঁদের ভিতর দিয়ে রুল… বলতে বলতে থেমে যান দারোগা বাবু। ভৈরব ডাক্তার মানী লোক। তার সামনে অশ্লীল কথা বলা শোভনীয় নয়।
সারাটা দিন পার হয়ে গেল। নিমুর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। যেন রাতারাতি ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেছে ঘোড়াটা। কিন্তু তা কি করে সম্ভব?
পদ্মা পার করে নিয়ে যায় নাই তো? গণশা বলল।
নদী পার করে নিয়ে যাওয়া কি সুজা কতা? হরে উত্তর দিল।
কিন্তুক, আর তো কোনো উপায়ও দেকতি পাচ্চি নে। পদ্মা নদীর ওপারে আরিচা, না হয় ঝিটকা বাজারে একবার খোঁজ নিয়ে দেখা যাতি পারে।
আমি তাই যাব। নিমুকে আমার চাই-ই চাই। আমার সাথে আর কিড়া কিডা যাবি। রাত পোহালিই আমি ঘাট পার হব। অনেকেই লাফিয়ে উঠল–আমি যাব, আমি যাব।
সগলেরই একদিক যাওয়ার দরকার নাই। উপেন, রতন আর হারাধন কাল তোরা কুষ্টিয়া লাইনে যা। সুকুমার তুই তিন-চারজন নিয়ে ফরিদপুরির দিক যাবি। আর ভরের দিক যা স্বপন, রঞ্জে। ভালো করে খোঁজ লাগা চারদিক।
আরিচা ঘাট পার হয়ে সামান্য এগিয়ে একটা মুদি দোকানের সামনে বসে আছেন ভৈরব ডাক্তার। সাথে বিলাল আর মুকুন্দ মজুমদার। গোয়ালন্দ থানার দারোগা বাবু এপারের শিবালয় থানায় টেলিগ্রাফ করে দিয়েছেন। মুড়ি আর সবরি কলা খেতে খেতে মুকুন্দ দোকানদারকে বলল–ঘুড়া কেনব বুলে উপারের তে আইচি। শুনলাম তোমাগের ইদিক নাকি ভালো ঘুড়া পাওয়া যায়। খোঁজে আছে নাহি সেরম কোনো?
ঘোড়া কেনবেন বাবু? ইস, আর একটু আগে আলেন না ক্যান? এই তো ঘণ্টা খানিক আগে খুবই সস্তায়, মানে কতি গেলি জলের দামে সুন্দর একটা ঘোড়া বিক্রি হয়ে গেল।
কীরম ঘুড়া? গায়ের রঙ কী? দেখতি কেমুন?
বিশাল ঘোড়া, এই এত্তো বড়। দুই হাত যতদূর সম্ভব প্রসারিত করে দেখাল দোকানদার। তারপর একটু দম নিয়ে বলল–লাল টুকটুকে ঘোড়া। কী সুন্দর ত্যালতেলে। দেকলিই আদর করবার ইচ্ছে করে। এরকম ঘোড়া বাপের জনে দেখি নাই।
তাই? কুন জাগায়, কুন সুমায়? কিডা কিনিছে ঘোড়াডা? কুন দিক গেছে? উত্তেজনায় কাঁপছেন ভৈরব ডাক্তার।
এই তো এইদিক। মনে হয় ঝিটকের হাটে নিয়ে গেছে।
কিডা বিক্রি করে গেচে তা কতি পারো? চেনো তারে?
না, তা চিনি না। কুনোদিন দেখি নাই। লম্বা মতোন, ঝাটার মতোন মেচ। গা’র রঙ কালো, মুখে পক্সের দাগ। নাকটা বিশাল লম্বা। আর কতা কয় নাকে নাকে।
দাদা, সুমায় নষ্ট করা যাবি নে। তাড়াতাড়ি চল ঝিটকার হাটে যাই। বিক্রির জন্যি হাটে উটোলি ঘুড়াডা পায়েও যাতি পারি।
তা ঠিক। তুমরা তাড়াতাড়ি হাটে চলে যাও। আমি থানা হয়ে আসতেছি।
ক্যান দাদা, কি হইছে? দোকানদার তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল।
ওই ঘুড়াডা আমাগের। মানে এই যে ইনার। ইনি হচ্চেন গোয়ালন্দর ভৈরব ডাক্তার। উনার ঘুড়াডা চুরি হয়ে গেছে।
কন কী! উনি ভৈরব ডাক্তার! পেন্নাম ডাক্তার বাবু। কত নাম শুনিচি আপনার। ঠিকই কইচেন মশায়, ওই ঘোড়া ডাক্তার বাবুর হলিই মানায়। শখের ঘোড়া না হলি কি অত সুন্দর হয়? আমার তখুনই সন্দেহ হইছিল যে, ওড়া চোরাই ঘোড়া। তা মশায়, আমি যদি আপনাগের সাথে আসি, যদি কুনো উপকারে লাগি, তালি নিজিরি ধন্য মনে করতাম।
আপনি যদি সাথে যান, তালি তো ভালোই হয়। চলেন, চলেন।
ঝিটকা মানিকগঞ্জ মহকুমার মধ্যে নামকরা গরুর হাট। তবে গরু ছাড়াও এখানে মোষ, ঘোড়া, ছাগলসহ অন্যান্য পশুও মেলে। দোকানদারকে নিয়ে বিষ্ণু আর মুকুন্দ হাটে পৌঁছে গেল। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করল।
ওই তো, ওই তো আমাগের ঘোড়া। ওই যে লাটিম গাছে বাঁধা। মুকুন্দ চিৎকার করে বলে। বিষ্ণু তাকাল সেদিকে। তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
দোকানদারও আঙুল দেখিয়ে সায় দিল–হ, ওইডেই, ওই ঘোড়াড়াই।
লোকজন জমে গেল।
কী ব্যাপার! ঘটনা কী? চোরাই ঘোড়া! নানা জনে নানা রকম মন্তব্য করতে লাগল।
বিপদ আঁচ করে ব্যাপারি বারবার বলতে লাগল–ল্যায্য টাকা দিয়ে ঘোড়া কিনিচি। চোরাই কলিই তো আর হবি নে। ইডার মালিক এহন আমি। ঘোড়া যে আপনাগের তার প্রমাণ কী?
এর মধ্যেই ভৈরব ডাক্তার এসে উপস্থিত হলেন। সাথে থানার বড়বাবু স্বয়ং। মুকুন্দ দৌড়ে চলে এলো তাদের সামনে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–পাওয়া গেছে। আমাগের ঘোড়া পাওয়া গেছে।
কুন জাগায়?
ওই তো, ওই যে গাছের তলায় জটলা, ওইখানে। তাড়াতাড়ি চলেন দারোগা বাবু। ওরা কয়, ঘোড়াডা যে আমাগের তার প্রমাণ কী?
প্রমাণ! প্রমাণ চায় কোন শালা? দাঁতে দাঁত পিষে বললেন দারোগা বাবু। প্রমাণ একেবারে ঢুকায়ে দেবো… বলতে বলতে তাকালেন ভৈরব ডাক্তারের দিকে। লজ্জা পেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি বললেন–কৈ, চলো তো দেখি।
তার আগেই দ্রুতপায়ে এগোলেন ভৈরব ডাক্তার, পেছনে দারোগা বাবু।
নিমু… নিমু… নিমু… চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন ভৈরব ডাক্তার।
তখনই ঘটল এক অভাবনীয় ঘটনা। চিহি, চিহি করে সাড়া দিল নিমু।
নিমু… রে… বলে দৌড়াতে শুরু করলেন ভৈরব ডাক্তার। নিমু… নিমু…
নিমু ততক্ষণে অস্থির, চঞ্চল হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আবার তার কানে ডাক পৌঁছাতেই সে ছুটে যাওয়ার জন্যে চেষ্টা করল। পারল না। দু পা উঁচু করে ঘাড় বাঁকিয়ে দড়ি ছেঁড়ার জন্যে সে প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। একসময় এক হেঁচকা টানে সত্যি সত্যি নিমু দড়ি ছিঁড়ে ফেলল। তারপর দৌড় শুরু করল। লোকজন দ্রুত সরে জায়গা করে দিল।
এদিক থেকে দৌড়ে যাচ্ছেন ভৈরব ডাক্তার, ওদিক থেকে ছুটে আসছে নিমু।
নিমু রে… আয় আমার বুকে আয়… বাবা…
নিমু যেন নিমেষেই তার ভাষা বুঝে ফেলল। দৌড়ে এসে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভৈরব ডাক্তারের কোলের মধ্যে। তারপর সে চিহি চিহি করতে লাগল আর ডাক্তারের কোলে মুখ ঘষতে লাগল। দু হাত দিয়ে নিমুর গলা জড়িয়ে ধরে বসে পড়লেন ভৈরব ডাক্তার। তার চোখ ভেজা। নিমুর দু চোখেও তখন জলের ধারা। আশেপাশের সমস্ত লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল অভূতপূর্ব সেই স্বর্গীয় মিলন দৃশ্য। তাদেরও চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে।
কোন শালা প্রমাণ চায়, ডাক তারে। পাছার মধ্যি প্রমাণ ঢুকায়ে দেই। এবার আর লজ্জা পেলেন না দারোগা বাবু।
না, না। এর চাইতে বড় প্রমাণ আর কী হতি পারে। উপস্থিত সবাই একবাক্যে বলতে লাগল।
আর কোনো প্রমাণ লাগবি নে। আহা চোখ দুড়ো য্যান জুড়ায়ে গেল। এই না হলি ভৈরব ডাক্তার। এতদিন খালি নামই শুনিচি, আজ দেখে সার্থক হলাম। অবলা প্রাণী এরম করে কারো বশ হয়?
কিন্তুক বাবু, আমি তো ল্যায্য টাকা দিয়ে কিনিছি ঘোড়াডা। ব্যাপারি করুণভাবে আবেদন জানাল।
সপাং করে বেতের বাড়ি পড়ল তার পিঠে।
হারামজাদা, কিনেছিস না চুরি করেছিস? যেটাই করিস, অপরাধ একই। চোরাই মালসহ ধরা পড়েছিস। এবার হাজতে বসে বুঝবি কত ধানে কত চাল। হাউ মেনি প্যাডি, হাউ মেনি রাইচ। ওঃ, তুই তো আবার ইংরেজি বুঝিস না। তবে ঝুলিয়ে দেবো, থ্রি ফিফটি ধারায় একেবারে ঝুলিয়ে দেবো হারামজাদা। দারোগা বাবুর হম্বিতম্বিতে তটস্থ হয়ে পড়ল সবাই।
না, না, থাক। ওরে আর হাজতে ঢোকানোর দরকার নাই। আমার নিমুরে আমি পায়ে গিছি। তাই ওরে মাফ করে দিলাম। ওসি সাহেব ওরে ছাড়ে দ্যান। আর তোমার কত টাকা কও, আমি দিয়ে দিচ্ছি।
না, না ডাক্তার বাবু। অমন কাজটি করতে যাবেন না। এতে অপরাধীরা আরও লাই পেয়ে যাবে। ওরে যদি অ্যারেস্ট না করি তাহলে আসল চোরকে .. খুঁজে বের করা যাবে না। আইন অনুযায়ী তাই ওকে গ্রেফতার করতেই হবে।
কিন্তু…
ভাববেন না ডাক্তার বাবু। আপনার সম্পর্কে গোয়ালন্দ থানার ওসি আমাকে বলেছে। তাছাড়া আমিও কিছু কিছু শুনেছি আপনার কথা। ওকে যদি একান্তই সাহায্য করতে চান, তবে ইনভেস্টিগেশনের পরে করবেন। এখন আমাকে আমার কাজ করতে দিন।
ঠিক আছে। তালি আমরা এখন চলি। আপনারা অনেক কষ্ট করিছেন আমাগের জন্যি। আপনাগের সগলেরই অনেক ধন্যবাদ।
হাজারখানেক লোক আরিচা ঘাটে এসে ভিড় করেছে। উদ্ধার করা নিমুকে নিয়ে নৌকায় করে পদ্মা নদী পার হবেন ভৈরব ডাক্তার। অপেক্ষা করছেন তিনি। লোকজন ঘোড়াটাকে আদর করছে। নিমু নিমু বলে ডাকছে, তাকে নানা রকম খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। ওদের ডাক নিমু তেমন গ্রাহ্যের মধ্যে নিচ্ছে না, গ্রীবা বাঁকিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আর ওদের দেয়া খাবারগুলো মুখে পুরে নিতান্ত অবহেলাভরে একমনে তা চিবিয়ে যাচ্ছে।
৩৮
তু..ই.. তুই চুরি করিছিস নিমুরে!
অবাক বিস্ময়ে ভৈরব ডাক্তার তাকিয়ে থাকেন জগার মুখের দিকে। কিছুতেই তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না, জগা তার নিমুকে চুরি করতে পারে। জগা মানে জগবন্ধু নিমুর দেখাশুনা করে। ঘাস খাওয়ায়, ছোলা খাওয়ায়, যত্ন করে, স্নান করায়। বলতে গেলে সে-ই নিমুর সারাক্ষণের সঙ্গী।
কীরম করে করলি তুই? কুন প্রাণে করতি পারলি এরম কাজ! দারোগা বাবু, সত্যি কি জগা চুরি করিছে আমার নিমুরে? আমি যে কিছুতিই বিশ্বাস করতি পারতিছি নে। কী দেই নাই আমি তোরে। যখন যা চাইছিস, তাই দিছি। তোরে নিজির ছেলের মতোই দেখিছি।
বিজ্ঞের হাসি হাসেন দারোগা বাবু। মোচে তা দিয়ে দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলেন–এ জগৎ বড় বিচিত্র ডাক্তার বাবু। কে যে কী করতে পারে, আর না পারে তা বোঝা বড়ই দুষ্কর। কোনো সন্দেহ নেই যে, আপনার জগাই এই দুষ্কর্মটি করেছে। প্রমাণ একেবারে হাতেনাতে। বাবা ব্যাপারি, খুলে বলো তো সব কথা ডাক্তার বাবুকে।
হ্যাঁ গো ডাক্তার বাবু। এই যে ইনি, এনার কাছেরতেই আমি আপনার ঘোড়াডা নগত চল্লিশ টাকায় কিনিচিলাম। চুরি করল ওই শালার ব্যাটা, আর হাজত খাটে মরলাম আমি। এই গরিবির একটা বিহিত করে দেন ডাক্তার বাবু।
আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। আপনি মনে কষ্ট পাবেন ভেবে কিছু বলিনি ডাক্তার বাবু।
বিজয়ের হাসি হেসে আবার বললেন দারোগা বাবু–আমরা পুলিশের লোক। আমাদের কাজই হলো সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখা। চুরি সংঘটিত হতে গেলে কাছের কাউকে না কাউকে থাকতেই হবে। তা না হলে চুরি করে হজম করা যায় না। নিমুর সবচেয়ে কাছের হলো জগা। সে-ই ছিল আমার প্রথম সাসপেক্ট। ব্যাপারিকে রিমান্ডে নিতেই হড়হড় করে সে সব সত্যি কথা বলে দিল। বর্ণনা শুনেই নিশ্চিত হয়ে গেলাম, সে আপনার জগা ছাড়া আর কেউ নয়।
বল ব্যাটা, কেন চুরি করেছিস? ডাক্তার বাবু তোকে নিজের ছেলের মতোন দেখেন। তার ঘোড়া ক্যান চুরি করলি, বল? নইলে পিটিয়ে হোর হাড়গোড় ভেঙে দেব। বলেই সপাং করে পিঠের উপর রুলার চালিয়ে দিলেন।
জগা ভৈরব ডাক্তারের দু-পা জড়িয়ে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল–আমারে মাপ করে দ্যাও তুমরা। এ জেবনে আর এরম কম্ম করব না। যে কাম আমি করিচি তার কোনো মাপ নাই। তাই মাপ আমারে দিতি হবি। নালি আমি পা ছাড়বো না। ছাওয়াল ভুল করিছে। ভুল বুঝতি পারিছে। মাফ তারে দিতিই হবি।
ভৈরব ডাক্তারের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
বিশ্বাস কেন এমন করে ভঙ্গ হয়! কেন এরা করে এরকম? কোন পাপে? পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন তিনি।
পা ছাড়ানোর কোনো চেষ্টা করলেন না ভৈরব ডাক্তার। কী করবেন, তাও ঠাহর করে উঠতে পারেন না। জগা ততক্ষণে শক্ত করে বুকের মধ্যে পা দুটো আঁকড়ে ধরেছে। কাজ হচ্ছে না বুঝতে পেরে এবার সে মাথা ঠুকতে শুরু করল।
মাপ না দিলি এ জেবন আমি রাকপো না। ভাস্যি করে দেব সব। বাবা ভুলানাথের চরণে এ জেবন উছুগ্যে করে দেব।
জীবন না হয় উৎসর্গ করলি, কিন্তু আমার বিশ্বাস যে ভাঙ্গে দিলি, সিডা জুড়া লাগাবি কীরম করে? আগে উত্তর দে। তারপর তোরে মাপ করব কি করবো না ভাবে দ্যাকপো। নিরাসক্ত, নিস্পৃহ গলায় ডাক্তার বললেন।
রক্তারক্তি কাণ্ড করে ফেলাবো আমি। সজোরে মাথা ঠুকতে শুরু করল জগা। বুহির রক্ত ঢালে দে পিরাচিত্তির করব। এ জেবন আর রাকপো না…
বলেই সে সামনে পড়ে থাকা আধভাঙা থান ইটটা তুলে নিয়ে মাথায় বাড়ি দিল।
ওঠ, যা তোরে মাফ করে দিলাম। কিন্তু তোর মুখ আমি আর দেকতি চাই নে। দূর হয়ে যা আমার সামনের তে। বললেন ভৈরব ডাক্তার।
কিন্তু ডাক্তার বাবু, ওকে অ্যারেস্ট করা আমার দায়িত্ব। দারোগার কণ্ঠে উদ্বেগ ফুটে ওঠে।
থাক, দারোগা বাবু। নিজির ছেলের মতো দেখিছি, ওরে ছাড়ে দ্যান। ব্যাপারিরেও ছাড়ে দ্যান। এই ন্যাও, চল্লিশ টাকা তোমার খরচ। বাকি তোমার কষ্টের দাম। বলে পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে ব্যাপারির দিকে এগিয়ে দিলেন ভৈরব ডাক্তার।
ঠিক আছে। আপনি যা বলবেন তাই হবে। জগার দিকে ঘুরে দারোগা বাবু আবার বললেন–দ্যাখ রে হারামজাদা, দ্যাখ। এমন মানুষের সাথে তুই বেইমানি করলি। নরকেও তোর ঠাঁই হবে না। পুলিশের চাকরি করি। জীবনে কত কিছু দেখলাম। কিন্তু এমন মানুষ আর দেখি নাই। আসি ডাক্তার বাবু-নমস্কার।
তা হবে না। বসেন, খালি মুখি যাতি পারবেন না। কই রে দারোগা বাবুর জন্যি জলখাবার নিয়ে আয়। বলে ডাইনে ঘুরতেই চোখ পড়ল জগার উপর–তুই এহনও বসে আছিস কুন আশায়? আমার চোখের সামনের তে দূর হয়ে যা। এই তোরা ওরে সরায়ে নে আমার সামনের তে।
কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। ধুতির কোচা দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন তিনি।
মহিন আর রমেন এগিয়ে এসে জগাকে ধরে নিয়ে গেল। কিন্তু তারা জানে, জগাকে চলে যেতে হবে না। ভৈরব ডাক্তার পুরোপুরিই মাফ করে দিয়েছেন তাকে। জগাই আবার বহাল হবে নিমুর দেখাশুনার জন্য। ভৈরব ডাক্তারের অন্তর মমতায় ভরা, মন তার মাখনের মতো নরম।
সেই মাখন গলতে শুরু করেছে।
৩৯
পদ্মার বুকে রাতের অন্ধকার চিরে এগিয়ে চলেছে স্টিমার। মাঝে মাঝে ভো আওয়াজ। সে আওয়াজ কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে নদীর সীমানা পেরিয়ে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে সেই কোন সন্ধ্যায় ছেড়ে এসেছে স্টিমার। ডেকের উপরে রেলিঙ ঘেঁষে বিছানো ময়লা চাদরের উপরে হাত-পা গুটিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ভবানী। এগুলো খালাসির কাছ থেকে আঁ আনায় ভাড়া করেছে সে। আড়তের ক্যাশ ভেঙে অনেক টাকা পয়সা নিয়ে বন্ধুদের সাথে ঢাকায় গিয়েছিল সেই মাসখানেক আগে। আনন্দ ফুর্তি বেশ ভালোই জমেছিল।
কিন্তু হঠাৎ করেই ঢাকার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। মার্শাল ল জারি হয়েছে। কয়েক দিন ধরেই কথা শোনা যাচ্ছিল, আইয়ুব খান ক্ষমতা নিয়ে নেবে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, চেকপোস্ট বসেছে মোড়ে মোড়ে। আর্মিরা গাড়িতে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। মানুষজন ভয়ের মধ্যে ঘরে বসে দিন কাটাচ্ছে আর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। নেহায়েত দায় না ঠেকলে কেউ বাইরে যায় না। যারা চাকরি-বাকরি করে তাদেরকে আইডেন্টিটি কার্ড দেয়া হচ্ছে।
খুবই কড়াকড়ি অবস্থা। চুল লম্বা থাকলে দোষ, জোরে হাঁটলে দোষ, কাশি দিলে দোষ, এদিক-ওদিক তাকালে দোষ-দোষের অন্ত নাই। দোষ পেলেই ধরপাকড়, ধরা পড়লেই জেল-জরিমানা। রসভঙ্গের কষ্ট নিয়ে তাই বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরছে ভবানী। সদরঘাটে আসার পথে পকেটমার হয়ে গেল। বুক পকেটে ছিল খুচরা মিলিয়ে সাড়ে চার টাকার মতো। সে কারণে ভবানী হয়েছে ডেকের যাত্রী।
প্রথম শ্রেণির কোনো এক যাত্রীর কী নাকি একটা চুরি হয়ে গেছে। গোটা স্টিমারে তল্লাশি করতে করতে পুলিশ এসে লাঠির একটা বাড়ি দিল ভবানীর কম্বলের উপরে।
এই ব্যাটা ওঠ। দেখি কী আছে তোর কাছে?
ভবানী ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠে বসল। সে ঠিক বুঝতে পারছে না ঘটনাটা কী!
এর মধ্যে আবার লাঠি ওঠাল আরেক পুলিশ-ব্যাগ দেখা হারামজাদা। স্যার, এর ব্যাগেই নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে চোরাই মাল। দ্যাখেন না, কেমন কম্বল মুড়ি দিয়ে মা মেরে পড়ে আছে। ব্যাটা চোরের বাচ্চা চোর, ব্যাগ খোল তাড়াতাড়ি।
মুখ সামলে কথা বল। জানিস, আমি কে? ভবানী রেগে বলল।
শালা, চোরের মার বড় গলা। দ্যাখেন স্যার চুরি করে আবার কেমন তড়পাচ্ছে। দেবো নাকি স্যার পোদের উপর আরো দু ঘা বসিয়ে। বলে সিপাইটা আবার লাঠি উঁচু করল।
চোখের পলকে ভবানী লাঠি কেড়ে নিল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে জোড়া পায়ে পুলিশটার বুক লক্ষ্য করে লাথি কষাল। তিন-চার হাত দূরে ছিটকে গিয়ে রেলিঙের সাথে আঁকে গেল সে। নইলে নদীতে গিয়ে পড়ত। স্টিমারের ঘূর্ণায়মান কাঠের চাকায় জড়িয়ে নিশ্চিত সলিল সমাধি হত তার। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল সবাই। তারপরও ভবানী উঠে গিয়ে কলার ধরে ফেলল পুলিশটার। চিৎকার করে বলল–পছন্দ হয় না, না? তোর মতো একশো এট্টা পুলিশ থাকে এই ভবানীর পকেটে। আমারে কোস চোর, আমার গায়ে হাত উঠোস? এত বড় সাহস! তোরে আজ মারেই ফেলাবো হারামজাদা।
ইতোমধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়েছে গোটা স্টিমারে। বড় কর্তারা চলে এলো, অ্যারেষ্ট করলো ভবানীকে। ভবানী ভালো করেই জানে, পুলিশের গায়ে হাত তুললে ছাড়া সে পাবে না। হোক অ্যারেস্ট, কুছ পরোয়া নেই। কারণ এরপরই স্টিমার গিয়ে ভিড়বে গোয়ালন্দ ঘাটে। নিয়ম অনুযায়ী তাকে গোয়ালন্দ থানায় জমা করে দিতে হবে।
এখন শুধু একটাই বিষয়। এরা যেন তাকে মারধর করতে না পারে। সেজন্যে অ্যারেস্ট মেনে নিলেও চোটপাট বন্ধ করল না ভবানী। যাতে ওরা বোঝে সে কেউকেটাদের একজন, এলিতেলি কেউ না।
একবার নামি গোয়ালন্দ ঘাটে। তারপর দেখায়ে দেবো কার ঘাড়ে কয়ডা মাথা। আমারে অ্যারেস্ট করে! চিৎকার করে বারবার বলতে থাকল ভবানী।
স্টিমারের বড়কর্তা আর পুলিশের লোকজন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, কী করবে এই লোকটাকে নিয়ে। কিছুটা বিভ্রান্তও বটে তারা। অন্য কেউ হলে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলত এতক্ষণে। কিন্তু এভাবে যখন শাসাচ্ছে, নিশ্চয়ই সে ক্ষমতাধর কেউ। থাক, গায়ে আর হাত দেবার দরকার নেই। যা করার গোয়ালন্দ থানাই করুক।
ভোরের আলো ফুটে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। স্টিমার এসে ভিড়েছে গোয়ালন্দ ঘাটে। বিশাল কাঠের ডাবল সিঁড়ি ফেলা হয়েছে। সেই সিঁড়ি বেয়ে লোকজন নামতে শুরু করেছে। লাল জামা পরা, পিতলের তকমা আঁটা রেজিস্টার্ড কুলিরা ছুটে বেড়াচ্ছে সারা স্টিমারজুড়ে। যে মাল যে আগে গিয়ে ধরতে পারবে, সে-ই সেটা মাথায় করে নিচে নামানোর সুযোগ পাবে। ভবানীকে বসিয়ে রাখা হয়েছে দোতলার সিকিউরিটি রুমের সামনে ফ্লোরের উপরে। তার দুই হাত একটা গামছা দিয়ে বাঁধা। রাগে ফুঁসছে ভবানী শঙ্কর।
ওসি সাহেব নিজেই এসেছেন। আসামি নাকি দুর্ধর্ষ। স্টিমারের সমস্ত পুলিশকে মেরে সে নাকি নদীতে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিল। সম্মিলিত চেষ্টায় অবশেষে তাকে আঁক করা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং এহেন ডাকাতকে নিয়ে যেতে তিনি দুইজন সাব-ইন্সপেক্টর এবং দশজন কনস্টেবল নিয়ে এসেছেন।
ওসি সাহেব গটগট করে উপরে উঠে এলেন। ভাবলেন এত বড় ঔদ্ধত্য যে দেখিয়েছে, তাকে আগে কষে একটা লাথি মারতে হবে। তারপর হাতকড়া পরিয়ে লোকজনের সামনে দিয়ে পেটাতে পেটাতে থানায় নিয়ে যেতে হবে। এত বড় সাহস!
কৈ সে হারামজাদা কোথায়? এত বড় বুকের পাটা। পুলিশের গায়ে হাত তোলে? এত বড় আস্পর্ধা…।
এই যে এখানে বেঁধে রেখেছি। আসেন, আসেন বড় বাবু।
ওসি সাহেব সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। সাঁই করে রুলটা ওঠালেন। কিন্তু আসামির মুখের দিকে তাকিয়ে ধাক্কা খেলেন তিনি।
ভবানী বাবু, আপনি? এই কী ব্যাপার? উনাকে বেঁধে রেখেছো কেন?
চেনেন নাকি স্যার? একরাশ প্রশ্ন নিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল সবাই।
চিনি না মানে? উনি তো ভবানী বাবু। ভৈরব ডাক্তার বাবুর ছেলে। এই শিগগিরই উনার হাত খোল।
তাড়াতাড়ি দুজন সিপাই এগিয়ে এসে ভবানীর হাত খুলে দিল।
কিন্তু উনিই তো পুলিশকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছেন। আরেকটু হলে তো নদীতে পড়ে মারাই যেত। এ মহা গুন্ডা। হাজতে নিয়ে ঠিকমতো ধোলাই দেন বড়বাবু।
চুপ। আর একটাও কথা না। বুঝলাম, লাথি উনি মেরেছেন। কিন্তু কেন মেরেছেন, কী কারণে? উনার সাথে নিশ্চয়ই খারাপ ব্যবহার করেছ তোমরা? ওসি সাহেব ভবানীর দিকে ফিরে তাকালেন।
আপনিই বলেন তো ভবানী বাবু। প্রকৃত ঘটনাটা কী?
ভবানী মনে মনে ওসি সাহেবের উপরে প্রীত হলো। রাগ তার অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। তাই পুরো সত্যটাই খুলে বলল।
সে ভালো করেই জানে পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। তাই বিষয়টা মিটিয়ে ফেলাই ভালো। কিন্তু ওদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে সে কোনো এলেবেলে মানুষ না। সে হলো ভবানী শঙ্কর। তার নির্দেশে ফরিদপুর-কুষ্টিয়ার গোটা এলাকাজুড়ে বাঘে-হরিণে একঘাটে জল খায়। তার সাথে দুর্ব্যবহার?
কাজটা তোমরা ঠিক করো নাই। উনার মতো সম্মানী মানুষরে চোর বলেছো, তুই-তোকারি করেছে, লাঠি দিয়ে পিটিয়েছো পর্যন্ত। আরো যে কী করেছে তা কে জানে? উনি ভদ্রলোক, তাই হয়তো মান-সম্মানের ভয়ে সবটুকু বলেন নাই।
না, স্যার উনি যা বলেছেন তাই। এর বেশি এক বিন্দু খারাপ ব্যবহার আমরা করি নাই। ত্রস্ত হয়ে স্টিমার পুলিশরা বলল।
ভবানী বুঝল, যা করার দারোগা বাবুই করবেন। তাকে আর কিছুই করতে হবে না। সে যতখানি ভেবেছিল, দারোগাটা তার চেয়েও অনেক বেশি চৌকস। সুযোগমতো এই ব্যাটার জন্যে কিছু একটা করতে হবে।
আপনি কিছু মনে রাখবেন না। আমরা হলাম গে জাতে পুলিশ, মানুষ তো। তাই মানুষের মানসম্মান আমরা দেবো কীভাবে? এই হারামজাদারা মাফ চা ভবানী বাবুর কাছে। মাফ যদি করেন তো ভালো। নইলে যে কি হবে, তা ভাবতেও পারছি না। দারোগা বাবু বলতে থাকেন।
উত্তেজনা প্রশমন করে দারোগা বাবু কণ্ঠ মোলায়েম করে ফেলেন–ভবানী বাবু, মাফ করে দেন এই অর্বাচীনদের। এরা বুঝতে পারে নাই। স্টিমার পুলিশের লোকজন একে একে এগিয়ে এসে ভবানীর হাত ধরে মাফ চাইতে শুরু করল।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। দারোগা বাবুর কথা আমি ফেলতি পারলাম না। তাই মাফ করে দিলাম। মানুষরে তো তোমরা মানুষ বলে মনে করো না।
তার মুখ সুরসুর করছিল, শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দেবার জন্য। কিন্তু নিজেকে অনেক কষ্টে সামলাল।
তার পরিবর্তে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল–ভবিষ্যতে এমন ভুল যেন আর কুনোদিন না হয়।
চলেন ভবানী বাবু। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে এদের। আর কোনোদিন এরা এমনটা করবে না।
ভবানীকে সম্মানে সাথে নিয়ে স্টিমার থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চলেন দারোগা বাবু।