পঞ্চম পর্ব
৫.০১
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে একটা ঠাণ্ডা আবহাওয়া টানা বেশ কয়েকদিন আঁকড়ে ধরে রাখল শহরটাকে। ধবধবে হয়ে উঠল রাস্তাঘাটের চেহারা। হিম শীতল বাতাসে ঝিমিয়ে পড়ল প্লেগের প্রকোপ। পরপর তিন সপ্তাহের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেল মৃত্যুর হার সত্যিই কমে গেছে। মনে হলো প্লেগ তার স্বৈরাচারী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ডাক্তার ক্যাসেল-এর তৈরি সিরাম ব্যবহার করলে এখন অনেক ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এই চরম প্রত্যাশার মুহূর্তেও কেউ কেউ প্রাণ হারায়। কোয়ারেনটাইন ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়া ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয়ে অথন তাদেরই একজন।
আগের মত এখনও দিনের বেলায় রাস্তাঘাট শূন্য থাকে। কিন্তু রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে আবার লোকজনে ভরে ওঠে ওগুলো। সবার গায়ে ওভারকোট। একটু ভালভাবে লক্ষ করলে চোখে পড়ে, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার ছাপ মুছে গেছে সবার চেহারা থেকে। মাঝে মাঝে হাসতে দেখা যায় ওদের। তবে এখনও কিছু কিছু লোক ফটকের পাহারাদারদের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে শহর থেকে পালাবার চেষ্টা করে।
জিনিসপত্রের দাম খুব তাড়াতাড়ি নামতে শুরু করল। যেসব মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল তাদের আবার এক সঙ্গে বাস করার সুযোগ দেয়া হলো। সৈনিকরা ফিরে গেল ব্যারাকে।
পঁচিশ তারিখের আগেই সাপ্তাহিক মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেল। কর্তৃপক্ষ মেডিকেল বোর্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে ঘোষণা করলেন: মহামারীকে আমরা সম্পূর্ণরূপে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসেছি। সরকারি ইস্তেহারে বলা হলো: আরও দুসপ্তাহের জন্যে শহরের ফটক বন্ধ রাখা হবে; এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যেসব বিধিনিষেধ এতদিন ধরে চালু রয়েছে, সেগুলো আরও এক মাস বলবৎ থাকবে। পঁচিশ জানুয়ারির রাত একটা উৎসবের রাতে পরিণত হলো।
প্রিফেক্ট নিজেও এই আনন্দে যোগ দিলেন এবং ঘোষণা করলেন: আজ থেকে রাস্তার সমস্ত আলো জ্বালানো হবে।
আলোকিত শহরের রাস্তায় দলে দলে নেমে পড়ল কোলাহল মুখর উষ্ণু জনতা। প্রচণ্ড উল্লাসে গান ধরল ওরা। কল্পনায় ওরা শুনতে পেল: হুইসেল দিতে দিতে ট্রেন ছুটে চলেছে শহর ছেড়ে বাইরের পৃথিবীতে, সীমাহীন দূরত্বের সন্ধানে; হুঙ্কার দিতে দিতে বন্দর ছেড়ে জাহাজ ভেসে যাচ্ছে ইস্পাতের মত চকচকে সমুদ্রের বুকে।
সেদিন রাতে, তারিউ, রিও, র্যাঁবেয়া এবং ওদের অন্যান্য সহকর্মী এসে দাঁড়াল ওই আনন্দমুখর জনতার মাঝে। তখন ওদের মনে হলো একটা শূন্যতার ভেতর দিয়ে ভেসে চলেছে ওরা। বাড়ি ফেরার সময়েও ওদের কানে বাজতে লাগল জনতার উল্লাস।
এক সময় দূরে, বড় রাস্তার ওপর, জনতার উল্লাসধ্বনি ফেটে পড়ল সমুদ্র গর্জনের মত। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল তারিউ। দেখতে পেল ছোট্ট একটা উজ্জ্বল চকচকে প্রাণী লাফিয়ে লাফিয়ে পার হচ্ছে বড় রাস্তাটা। বিড়াল। বসন্তের পর এই প্রথম। বিড়াল চোখে পড়ল ওর। বিড়ালটা রাস্তার মাঝখানে থামল একবার, ইতস্তত করল কিছুক্ষণ, একটা পা তুলে চাইল কয়েকবার, তারপর সেই পা-টাকে ডান কানের ওপর দিয়ে খুব দ্রুত ঘুরিয়ে আনল; আবার এগুতে লাগল সামনের দিকে এবং হারিয়ে গেল অন্ধকারে। হাসল তারিউ। ভাবল: ব্যালকনির সেই বুড়ো দৃশ্যটা দেখতে পেলে নিশ্চয় খুব খুশি হতেন।
.
৫.০২
পঁচিশ জানুয়ারির কয়েকদিন পর তারিউ এক দুপুরে সেই ছোট্ট রাস্তাটার মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন বুড়ো, ভদ্রলোক ব্যালকনিতে বেরিয়ে আসবেন। বিড়ালগুলোকে দেখতে পেল ও। নিজের জায়গায় আবার ফিরে এসেছে ওরা, ব্যালকনির ছায়ায় শুয়ে শুয়ে বোদ পোয়াচ্ছে। কিন্তু এ সময় ব্যালকনির আশেপাশের যে জানালাগুলো খোলা থাকার কথা, সেগুলো তখনও বন্ধ আছে। তারিউ আর কোনদিন জানালাগুলোকে খুলতে দেখেনি। এ থেকে ও ধারণা করে বুড়ো ভদ্রলোক হয় মারা গেছেন, নয়তো অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন।
সবাই যখন ভাবছেন প্লেগ পরাজিতের মত পিছু হটতে শুরু করেছে, আত্মগোপন করতে চাইছে পালিয়ে, সেই অন্ধকার গুহায় যেখান থেকে সে একদিন বেরিয়ে এসেছিল, তখন একজন মানুষ প্লেগের এই পরাজয়ে ভয় পেয়ে গেল। সেই মানুষটার নাম কার্ড।
মৃত্যুর সংখ্যা যখন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কমতে আরম্ভ করল, তখন কটার্ড বেশ কয়েকবার বিভিন্ন অজুহাতে রিও-র সঙ্গে দেখা করে। ওর উদ্দেশ্য ছিল মহামারীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আসল খবর জানা। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে রিও ওকে আশার কথা শোনাতে লাগল। কিন্তু এ ধরনের উত্তর ভাল লাগত না ওর, এবং নানা রকমের বিরূপ মানসিক প্রতিক্রিয়াও হত। কখনও ক্রোধ প্রকাশ করত, কখনও ভেঙে পড়ত নিরাশায়। কটার্ড-এর এই অবস্থা দেখে একদিন ওকে করুণা দেখানোর জন্যে বাধ্য হয়ে রিও বলল, মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখে মনে হচ্ছে মহামারী দ্রুত গতিতে পিছু হটছে, তবু আমরা যে সত্যি সত্যি সঙ্কট পেরিয়ে এসেছি সে। কথা এখুনি নিশ্চিত করে বলা কঠিন। রিও-র এই মতামত সাধারণ মানুষের ভেতর ছড়িয়ে দেবার জন্যে উঠে-পড়ে লাগল কটার্ড। যে অঞ্চলে ও বাস করে সেখানকার দোকানদারকেও কটার্ড এগুলো শোনাল। তবু হতাশা কাটল না ওর। একদিন তারিউকে সে বলল, এবার যে-কোনদিন ফটক খুলে দেয়া হবে। তখন দেখবেন সবাই আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
জানুয়ারির প্রথম তিন সপ্তাহে খুব ঘন ঘন পরিবর্তন হলো কটার্ড-এর চালচলনে। কখনও কখনও প্রতিবেশী এবং পরিচিত মানুষদের ভেতর নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করল ও, সে সময় ওদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতে লাগল। আবার মাঝে মাঝে দিনের পর দিন সবাইকে এড়িয়ে চলল। এ সময়ে ও নিজের বাসায় আত্মগোপন করে রইল। তখন ওকে রেস্তোরাঁ, থিয়েটার হল, কাফে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। চুপচাপ বাসায় পড়ে থাকে; পাশের, একটা রেস্তোরাঁর সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিয়েছিল, তারাই ওকে সময়মত খাবার পৌঁছে দিত। টুকিটাকি কিছু কেনার দরকার পড়লে রাতের বেলায় বাইরে যেত ও। আর কেনাকাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে, যে-পথে লোকজনের চলাচল কম, আলোর ব্যবস্থা ভাল নয়, সেই পথ দিয়ে চুপি চুপি বাসায় ফিরে আসত। এই লুকিয়ে লুকিয়ে ফেরার পথে কয়েকবার তারিউ-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ওর। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তারিউ কিছু রূঢ় শব্দ ছাড়া অন্য কোন কথা বের করতে পারেনি ওর মুখ দিয়ে। কয়েকদিন যেতে না যেতে হঠাৎ করে আবার পাল্টে যেত ওর আচরণ। তখন সবার সঙ্গে মেলামেশা আরম্ভ করে ও। মেতে ওঠে প্লেগ নিয়ে আলোচনায়। জানতে চায় মানুষের মতামত। মিশে যায় রাস্তার জনসমুদ্রে।
পঁচিশ জানুয়ারি থেকে আবার আত্মগোপন করল কটা। এর দুদিন পরে হঠাৎ করে দেখা হলো তারিউ-এর সঙ্গে। একটা নির্জন গলিতে একা একা পায়চারি করছিল ও। কটার্ড তারিউকে ওর বাসায় যাবার প্রস্তাব দিল।
হাঁটতে হাঁটতে কটার্ড প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, সরকারি ইস্তেহারের অর্থ কি এই যে প্লেগের দ্রুত উপশম হচ্ছে; আপনার কি ধারণা?
এটা ঠিক যে সরকারি ইস্তেহার প্রচার করলেই প্লেগের উপশম হয় না। তবে এটাও ঠিক যদি তেমন কোন দুর্ঘটনা না ঘটে তাহলে প্লেগ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিদায় নেবে। বাইরের অবস্থা দেখে তাই মনে হচ্ছে, উত্তর দিল তারিউ।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। যদি তেমন কোন দুর্ঘটনা না ঘটে তাহলেই এমনটা হওয়া সম্ভব। কিন্তু দুর্ঘটনা, কিছু না কিছু তো ঘটবেই। তাই না?
সে কথা চিন্তা করেই কর্তৃপক্ষ ফটক আরও পনেরো দিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছেন। তবে সবকিছু যেভাবে এগুচ্ছে তাতে কর্তৃপক্ষকে এই ঘোষণা বাতিল করতে হবে।
সে রকম কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে। কিন্তু আমার বিশ্বাস শহরের ফটক আবার খুলে দেয়া হবে। এবং সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে, এই সম্ভাবনাই বেশি। ১. আপনার কথা না হয় মানলাম, কিন্তু সবকিছু আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে, একথায় আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
তারিউ হাসল। সিনেমাহলে নতুন ছবি আসবে।
কিন্তু কার্ড-এর মুখে কোন হাসি দেখা গেল না। প্রশ্ন করল, এত বড় দুর্ঘটনার পরও শহরের জীবনযাত্রার কোনরকম পরিবর্তন হবে না?
আমার ধারণা, প্লেগের ফলে শহরের অনেক কিছুই বদলে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে তা নাও হতে পারে। কেননা, মানুষ ভাবতে চাইবে যে কিছুই ঘটেনি, এবং সেভাবেই জীবন শুরু করবে তারা। অবশ্য এটাও ঠিক মানুষ সত্যি সত্যি সব ভুলতে পারে না। মানুষের মনে প্লেগের কিছু স্মৃতি থেকে যাবেই।
মানুষের মন নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। আমি জানতে চাই সরকার এবং শাসন ব্যবস্থার কথা। সেগুলোও কি আগের মত চলবে?
ওসব ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তবে আমার ব্যক্তিগত ধারণা এত বড় আকস্মিক দুর্ঘটনার পর শাসনযন্ত্রকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বেশ সময় লাগবে। তাছাড়া এখনকার অবস্থায় কিছু নতুন সমস্যা দেখা দেবে, সেগুলো সামলাবার জন্যে শাসন ব্যবস্থায় কিছু না কিছু রদবদল করতেই হবে।
এবার কটার্ডকে বেশ খুশি-খুশি মনে হলো। তারিউ-এর মন্তব্য ভাল লেগেছে ওর। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন। সবাইকে আবার নতুন করে জীবন আরম্ভ করতে হবে।
ইতিমধ্যে কটার্ড-এর বাসার কাছে পৌঁছে গিয়েছে ওরা। কটার্ডকে আগের চেয়ে অনেক উৎফুল্ল মনে হলো। মনে হলো। ভবিষ্যৎকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করার মত মনোবল ফিরে পেয়েছে। হয়তো কল্পনা করতে শুরু করেছে: অতীতকে সম্পূর্ণরূপে, মুছে ফেলে শহরে একেবারে নতুনভাবে জীবন শুরু হতে যাচ্ছে, সবকিছু নতুন ভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে।
তারিউ আবার হাসল। দেখবেন, আপনারও সমস্ত অপরাধ ধুয়ে মুছে গেছে। আপনার জন্যেও নতুন সুযোগ আসবে।
কটার্ড-এর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে হাত মেলাল দুজনে। এখন মনে হচ্ছে আপনার কথাই ঠিক, বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল কটার্ড, সবাই আবার নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ পাবে।
সামনের অন্ধকার থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল দুজন লোক। অস্পষ্টভাবে তারিউ শুনতে পেল কার্ড সবিস্ময়ে বলছে, এই দুই। চিড়িয়া আবার কোত্থেকে আমদানি হলো? কী চায় এরা? অপরিচিত দুজনের ভেতর থেকে একজন কটার্ডাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কটার্ড?
একটা চাপা অস্ফুট শব্দ বের হলো কটার্ড-এর মুখ দিয়ে। এবং দেখতে না দেখতে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল ও।
তারিউ এবং অপরিচিত লোক দুজন বিস্ময়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারিউ ওদের প্রশ্ন করল, কী চান আপনারা?
কটার্ড-এর কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে চাই, দায়সারা উত্তর দিল লোক দুটো।
বাসায় ফিরে তারিউ ওর ডাইরিতে এই অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ লিখতে গিয়ে মন্তব্য করল: আজ রাতে বড় ক্লান্ত বোধ করছি।
ওর ডাইরির শেষে এই কথাগুলো লেখা আছে: রাত এবং দিনের মধ্যে এমন কতকগুলো নির্দিষ্ট সময় আছে যখন মানুষের শক্তি এবং সাহস নিঃশেষিত হয়ে আসে। এই সব সময়কে আমি ভীষণ ভয় করি।
.
৫.০৩
শহরের ফটক খোলার কয়েকদিন আগের ঘটনা। দুপুরে বাসায় ফিরছিল রিও। কদিন ধরেই স্ত্রীর কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম আশা করছে ও। মনে মনে ভাবছে টেলিগ্রামটা আসল কিনা। সবাই আবার নতুন করে জীবন আরম্ভ করতে যাচ্ছে, এ অনুভূতিটা তখন ওর ভেতরও জেগে উঠেছে।
দারোয়ানের ঘর পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল ও। বুড়ো মিশেল-এর জায়গায় নতুন যে দারোয়ানটা এসেছে সে তখন জানালায় মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে দেখে একটু হাসল লোকটা। সিঁড়ি বেয়ে ওপর পানে রওনা হলো রিও। চোখের সামনে। ভাসছে দারোয়ানের হাসি হাসি মুখখানা।
ফ্ল্যাটের বাইরের দরজা খোলার সময় রিও দেখল মা হলঘর পেরিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছেন। কাছে এসে বললেন, তারিউ অসুস্থ বোধ করছে। মাকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হলো রিও-র। তাড়াতাড়ি বলল, খুব সম্ভব এটা মারাত্মক কিছু নয়।
বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে তারিউ। বালিশের মধ্যে ডুবে গেছে মাথা। চাদরের নিচে ওর প্রশস্ত বুকটা বেশ উঁচু দেখাচ্ছে। একটু পর পর বাড়ছে জ্বর, সেই সঙ্গে মাথার যন্ত্রণা। লক্ষণগুলো তেমন সুস্পষ্ট নয়। তবে প্লেগ হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই, রিওকে বলল তারিউ।
ওর শরীর পরীক্ষা করে রিও বলল, না। তেমন সুস্পষ্ট কোন, লক্ষণ এখনও দেখছি না।
কিন্তু ঘন ঘন প্রচণ্ড পিপাসা পাচ্ছিল তারিউ-এর। ঘরের বাইরে এসে রিও ওর মাকে বলল, মনে হচ্ছে ওর প্লেগই হয়েছে।
বলিস কী, আঁতকে উঠলেন মা। তা কী করে সম্ভব, অন্তত এখন? তারপর একটু ভেবে বললেন, বার্নার্ড, আমার মনে হয়, ওকে আমাদের কাছে রাখাই ভাল।
কিছুক্ষণ চিন্তা করল রিও। মা, সবকিছু মেনে চললে ওকে আমরা বাসায় রাখতে পারি না। তবে কয়েকদিন পরেই শহরের ফটক খুলে দেয়া হবে, সে সময় তুমি যদি শহরের বাইরে চলে যাও, তাহলে আমি তারিউ-এর দায়িত্ব নিতে পারি।
বার্নার্ড, আমার কথা শোনো। তারিউও থাকুক, আমিও থাকি। এই তো সেদিন আমি টিকা নিলাম।
রিও মাকে বুঝিয়ে বলল, মা, তারিউও টিকা নিয়েছিল। তবে এমন হতে পারে শেষবারের টিকা নিতে হয়তো ও ভুলে গেছে, কিংবা অন্যান্য ব্যাপারেও সাবধান ছিল না।
কথা বলতে বলতে রিও ওর সার্জারি রুমের দিকে এগিয়ে গেল। যখন ফিরে এল, তারিউ দেখল ওর হাতে সিরামের বাক্স।
আচ্ছা, এতক্ষণে বুঝলাম। তাহলে আমাকে প্লেগই ধরেছে, বলল তারিউ।
তা নাও হতে পারে। তবে কোনরকম ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না, তাই।
কোন কথা না বলে টিকা নেয়ার জন্যে ওর একটা হাত রিও-র দিকে বাড়িয়ে দিল তারিউ। এই টিকা ও নিজেও বহু লোককে দিয়েছে। অনেক সময় লাগে।
সন্ধ্যার দিকে বোঝা যাবে ব্যাপারটা কী? ওর চোখের দিকে তাকাল রিও।
কিন্তু আমাকে আলাদা রাখার কী ব্যবস্থা করছ?
এখনই সে প্রশ্ন উঠছে না। তোমার প্লেগ হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
কষ্টের হাসি হাসল তারিউ। রিও, বোধ হয় এই প্রথম কোন রোগীকে আলাদা না করে তুমি টিকা দিলে।
ওর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল রিও। দেখো, তুমি এখানে। থাকলে তোমার দেখাশোনাটা ভাল হবে। মা এবং আমি দুজনেই তোমার পাশে থাকতে পারব।
কোন তর্ক করল না তারিউ। সিরামের বাক্স গুছিয়ে নিল রিও। তখনও মুখ ফিরিয়ে আছে ও। আশা করছে কিছু বলবে তারিউ। কিন্তু কোন সাড়া দিল না সে। ওর বিছানার পাশে এল রিও। তারিউ-এর চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে ওর দিকে। চেহারা মলিন। হলেও, ধূসর চোখগুলো তখনও শান্ত।
রিও হাসল। তারিউ, ঘুমোনোর চেষ্টা করো। আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। কথাগুলো বলেই কয়েক পা এগিয়ে গেল ও। এমন সময় শুনতে পেল তারিউ ওকে ডাকছে। আবার ফিরে এল রিও। তারিউ-এর ভাবভঙ্গি ওর কাছে কেমন অদ্ভুত ঠেকল। রিও দেখল, তারিউ কিছু একটা বলার জন্যে নিজের ভেতর প্রচণ্ড তাড়না অনুভব করছে, অথচ কিছুতেই সে কথা বলতে চাচ্ছে
রিও, মুখ খুলল তারিউ, আশা করি তুমি আমাকে সব কথা খুলে বলবে। এটুকু নিশ্চয় তোমার কাছ থেকে আশা করতে পারি।
হ্যাঁ, তারিউ। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
স্বাভাবিক হয়ে এল তারিউ-এর গম্ভীর মুখটা। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, রিও। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ আমি আমার মৃত্যু কামনা করছি না। মৃত্যুকে বাধা দেবার জন্যে আমি আমার সাধ্যমত সব চেষ্টা করে যাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি হেরেই যাই; তাহলে আমার একটাই বাসনা, আমার মৃত্যুটা যেন ভালভাবে, হয়।
তারিউ-এর ওপর ঝুঁকে ওর কাঁধে একটু চাপ দিল রিও। না, না, মৃত্যু নয়, তারিউ। তুমি যেন মহাপুরুষ হয়ে উঠতে পারো, সে জন্যে তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে। তারিউ, সংগ্রাম করে যাও।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে গায়ে ওভারকোট নিয়েই তারিউ-এর ঘরে ঢুকল রিও। ওর অবস্থা আগের মতই। জ্বরের প্রকোপে ঠোঁট দুটো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
কেমন আছ, তারিউ? জানতে চাইল রিও।
চাদরে ঢাকা কাঁধ দুটো একটু উঁচু করল তারিউ। মনে হয় সংগ্রামে হেরে যাচ্ছি।
ওর ওপর ঝুঁকে পড়ল রিও। শরীরের অনেক জায়গায় গ্রন্থিস্ফীতি দেখা যাচ্ছে। বুকের ভেতর একটা ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে। দু-ধরনের প্লেগের লক্ষণই ফুটে উঠেছে ওর শরীরে।
সোজা হয়ে দাঁড়াল রিও। বলল, সিরামের কাজ এখনও শুরু হয়নি। কী যেন বলতে চাচ্ছিল তারিউ। কিন্তু জ্বরের ঘোরে কিছুই বলতে পারল না।
রাতের খাওয়ার পর রিও এবং মা রোগীর পাশে এসে বসলেন। রিও ইনজেকশনের সাহায্যে উত্তেজক কিছু ঔষধ তারিউ-এর শরীরে ঢুকিয়ে ওর কেঁড়াগুলোকে খুব দ্রুত ফাটিয়ে দিতে চাইছিল, যদিও এতদিনের ব্যর্থ অভিজ্ঞতার ফলে ও জানে এগুলোর কার্যকারিতা কতটুকু।
সারা রাত ধরে একটার পর একটা প্লেগের আক্রমণ প্রতিহত করল তারিউ। একবারও ওর ভেতর কোন চঞ্চলতা বা উদ্বেগ দেখা গেল না। কথা বলারও চেষ্টা করল না। অত বড় শরীরটায়। বোধশক্তি বলতে কিছুই নেই তখন। আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে কখনও কখনও হেরে যাচ্ছে ও। রিও সেটা বুঝতে পারছে ওর চোখ দেখে। কখনও কখনও চোখাচোখি হচ্ছে ওদের দুজনের সঙ্গে। সে সময় জোর করে হাসছে তারিউ।
হঠাৎ আরম্ভ হলো প্রবল বর্ষণ, আর সেই সাথে শিল পড়া। মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যাচ্ছে রিও। সেটা কেটে যেতেই অন্ধকারের এপার থেকে চোখ দুটোকে মেলে ধরছে তারিউ-এর ওপর। মা ওর পাশে বসে কী যেন একটা বুনছেন, আর মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন ওর দিকে। বৃষ্টি থেমে যাবার পর ঘরের ভেতর আরও বেড়ে গেল নীরবতা। রিও অনুভব করল, উত্তেজনায় দপদপ করছে ওর সমস্ত স্নায়ু। ইশারায় মাকে বিছানায় যেতে বলল ও। মা নীরবে মাথা নাড়লেন, তার চোখ দুটো হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গভীর মনোযোগ দিয়ে ছুঁচের ডগাটা দেখতে লাগলেন তিনি। উঠে তারিউ এর মুখে একটু পানি দিল রিও, তারপর আবার ফিরে এল নিজের জায়গায়।
তখন ভোর হয়-হয়। রিও মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, মা, তুমি যাও। এবার একটু বিশ্রাম নাও। সকাল আটটায় তোমাকে আবার এখানে আসতে হবে। তখন আমি থাকব না। আর শোনো, শোয়ার আগে চোখে কয়েক ফোঁটা ওষুধ দিতে ভুলে যেয়ো না।
উঠলেন মাদাম রিও। হাতের জিনিসগুলো গুছিয়ে তারিউ-এর বিছানার পাশে দাঁড়ালেন। অনেকক্ষণ হলো চোখ বন্ধ করে আছে তারিউ। কুঁচকে গেছে কপাল, ঘামে জট পাকানো চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে এর চারপাশে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাদাম রিও। ছোখ মেলে তাকে দেখল তারিউ। দেখল, শান্ত স্নেহভরা সেই মাতৃমুখ ঝুঁকে আছে ওর ওপর। ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ফুটুল ওর, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো আবার বন্ধ হয়ে গেল। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। মা-র ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটাতে বসল রিও।
ঝিমুচ্ছিল রিও। রাস্তার গাড়ির শব্দে তন্দ্রা ছুটে গেল। শিরশির করে উঠল ওর শরীর। সঙ্গে সঙ্গে চোখ গেল তারিউ-এর দিকে। চেহারায় একটা অবসাদের ভাব ফিরে এসেছে ওর। মনে হলো ঘুমুচ্ছে। ওর পাশে দাঁড়াল রিও। তখনই একটা শূন্য দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকাল তারিউ। তখনও ঘুমের ঘোর পুরোপুরি। কাটেনি।
ঘুমুচ্ছিলে, না? কথা বলল রিও।
হ্যাঁ, হয়তো।
শ্বাস নিতে এখনও কষ্ট হচ্ছে?
একটু একটু। এ থেকে কিছু অনুমান করতে পারবে?
না, তারিউ। তুমি তো জানো সকালের দিকে বেগ একটু কমে আসে।
ধন্যবাদ। সত্যিকারের অবস্থা কখন কী রকম থাকে আমাকে সবসময় তা জানতে দেবে, এ আশাটুকু আমি তোমার কাছ থেকে করতে পারি নিশ্চয়।
ওর বিছানায় বসল রিও। তারিউ-এর পা দুটোকে মনে হলো লাশের পা-র মত শক্ত। ফের শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হলো তারিউ এর।
আবার জ্বর উঠবে, তাই না, রিও?
হয়তো। দুপুরের দিকে বুঝতে পারব সত্যিকারের অবস্থা কী।
চোখ বন্ধ করল তারিউ। মনে হলো নিজের ভেতর শক্তি সঞ্চয় করতে চাইছে। যখন চোখ খুলল তখন দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে গেছে ওর। তখন রিও একটা গ্লাস হাতে ওর ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ছিল। সেটা দেখে দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর।
এটা খাও।
গ্লাসের পানি খেয়ে ফেলল তারিউ। আস্তে আস্তে আবার মাথাটা রাখল বালিশের ওপর। আমার বেলায় অনেক সময় নিচ্ছে, তাই না, রিও, অস্কুটভাবে বলল ও।
ওর একটা হাত জড়িয়ে ধরল রিও। বন্যার দুর্বার স্রোতের মত জ্বর উঠছে। লাল হয়ে উঠল দুই গাল, কপাল। ওর দিকে চোখ ফেরাল তারিউ। ঝুঁকে পড়ে রিও ওকে উৎসাহ দিল। হাসার চেষ্টা করল ও। কিন্তু মুখ শুকিয়ে যাওয়ায় চোয়াল আর ঠোঁট আটকে গেল, হাসি বেরুল না। শুধু চোখ দুটোকে তখনও মনে হচ্ছে জীবন্ত, সাহসে ভরা।
সকাল সাতটার দিকে এলেন মাদাম রিও। রিও ওর সার্জারি রুমে গিয়ে টেলিফোন করল হাসপাতালে। ওর জায়গায় অন্য একজন ডাক্তারের ডিউটির ব্যবস্থা করল, প্রতিদিন সকালে ডাক্তারদের সঙ্গে যে পরামর্শ হত সেটাও বাতিল করে দিল ও। এরপর খাটের ওপর শুয়ে পড়ল। মিনিট পাঁচেক পরে আবার, তারিউ-এর ঘরে ঢুকল ও। বিছানার পাশেই বসে আছেন মাদাম রিও। তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে তারিউ। হঠাৎ বিস্ফারিত হলো ওর দৃষ্টি। সেটা দেখে নিজের ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে চেয়ার থেকে উঠে বিছানার পাশের বাতিটা নিভিয়ে দিলেন মাদাম রিও। একটা হাত রাখলেন ওর ঘামে ভেজা জট পাকানো চুলে। অনেক দূর থেকে একটা চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এল তাঁর কানে, ধন্যবাদ। এখন মোটামুটি ভাল লাগছে। আবার চেয়ারে এসে বসলেন মাদাম রিও। তখন দেখতে পেলেন, চোখ বন্ধ করে ফেলেছে তারিউ। ওর মুখটাও বন্ধ হয়ে আছে। বিকৃত হয়ে, উঠেছে চেহারা। তবু একটা কোমল হাসি খেলা করছে মুখের চারপাশে।
দুপুরে জ্বর বাড়তে বাড়তে চরমে উঠল। রক্ত উঠে এল থুতুর সাথে। কাশির ফাঁকে ফাঁকে ও তখনও ওদের দিকে তাকাচ্ছে। আস্তে আস্তে কমে এল ওর চোখ খোলার পালা। বিধ্বস্ত চেহারায় যে উজ্জ্বল আভাটা ফুটে উঠছিল সেটাও ম্লান হয়ে এল ক্রমশ। মারা গেল তারিউ। তার আগে কখন ও দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, কখন একটা আর্তনাদ করে নিজেকে সঁপে দিয়েছে মৃত্যুর হাতে, রিও সেসবের কিছুই লক্ষ করেনি। দুচোখ ছাপিয়ে অশ্রুর বন্যা নেমে এল ওর। সে অশ্রু অসহায় ক্রোধের।
রাতে মা ও ছেলে লাশ পাহারা দিতে বসল। মাঝে মাঝে স্ত্রীর কথা মনে পড়তে চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে রিও-র। থেকে থেকে ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন, মাদাম রিও। চোখাচোখি হতেই হাসছে রিও।
বার্নার্ড?
বলো, মা।
খুব ক্লান্তি লাগছে?
না, মা।
চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন মাদাম রিও। মা-র দিকে তাকিয়ে হাসল রিও। তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল, সত্যিই ও ক্লান্ত বোধ করছে না। ছেলের দিকে তাকিয়ে মা বললেন, এবার দূরে পাহাড়ী কোন স্বাস্থ্যনিবাসে গিয়ে তোর কিছুদিন বিশ্রাম নেয়া দরকার।
হ্যাঁ, মা। তাই করব এবার।
পরের দিন সকালে নিজের সার্জারিতে কাজ করছিল রিও, ছুটতে ছুটতে ভেতরে ঢুকে ওকে একটা টেলিগ্রাম দিলেন মাদাম রিও। এরপর, যে ছেলেটা টেলিগ্রাম এনে দিয়েছে তাকে বকশিশ দেয়ার জন্যে ফিরে গেলেন তিনি।
ফিরে এসে তিনি দেখলেন, খোলা টেলিগ্রাম হাতে বসে আছে রিও। তাঁকে দেখে জানালার বাইরে চোখ মেলে দিল ও।
বার্নার্ড।
ঘুরে দাঁড়িয়ে মা-র দিকে তাকাল রিও। তাঁর মনে হলো একজন অপরিচিত মানুষকে দেখছেন তিনি।
খবর কী?
ওহ্। হ্যাঁ, সেই একই খবর। এক সপ্তাহ আগে মারা গেছে ও মাদাম রিও নিজেও জানালার দিকে মুখ ফেরালেন। মাকে কাঁদতে বারণ করল রিও। গত কয়েকমাস হলো, বিশেষ করে গত দুদিন থেকে এই দুঃখের ব্যথা সইতে হচ্ছে ওকে।
.
৫.০৪
চার ফেব্রুয়ারির এক ঝলমলে সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হলো শহরের সবগুলো ফটক। সেদিন উৎসবের আয়োজন করা হলো শহরে। স্টেশনে, ইঞ্জিন থেকে উঠল ধোয়া; জাহাজ এসে পৌঁছল বন্দরে। যারা ফিরছে তাদের হৃদয় কাঁপছে অজানা আশঙ্কায়। শহরের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তারা তখনও কিছুই জানে না। মনে মনে এক বিভীষিকার চিত্র কল্পনা করে রেখেছে সবাই। বিচ্ছেদের দিনগুলোতে তাদের সময় কিছুতেই কাটতে চাইত না, তখন কামনা করত দ্রুত পার হয়ে যাক সময়। আজ শহরের কাছাকাছি পৌঁছে তারা চাইছে সময়ের গতি আরও মন্থর হোক। ওদিকে, যারা বাসায় কিংবা প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিল, তারা ধীরে ধীরে অধৈর্য হয়ে পড়ল; আশঙ্কায় কাঁপতে শুরু করল বুক। র্যাঁবেয়াও এসেছে স্টেশনে। প্রথম ট্রেনেই আসছে ওর প্রেমিকা। ও নিজেও বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে, ওর-ও বুক কাঁপছিল।
কিন্তু ইঞ্জিনের ধোঁয়া চোখে পড়তেই মুহূর্তের মধ্যে একটা দুর্বার উন্মত্ত আনন্দে ভরে উঠল সবার মন। ট্রেন স্টেশনে এসে থামতেই শত শত হাত দীর্ঘদিনের বঞ্চিত অধিকার ফিরে পাবার ব্যাকুল আগ্রহে এমন সব শরীরকে জড়িয়ে ধরতে এগিয়ে গেল সময়ের ব্যবধানে যাদের চেহারাও ওদের মনে নেই। র্যাঁবেয়ার বেলায়ও একই ঘটনা ঘটল। যে রমণী ওর দিকে ছুটে এল, তার শরীরের দিকে একবার ভাল করে তাকাবারও সুযোগ হলো না ওর, তার আগেই ওর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর প্রেমিকা।
দুহাতে প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরল র্যাঁবেয়া। মাথাটা চেপে ধরল কাঁধের ওপর। পরিচিত চুলগুলো ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। এরপর ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অবরুদ্ধ অশ্রু। কিন্তু বুঝতে পারল না এই অশ্রু সেই মুহূর্তের আনন্দের, নাকি দীর্ঘদিনের চাপা দুঃখের। পরস্পরকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। নিজের নিজের বাসার দিকে ফিরে চলল মানুষ। কিন্তু সবার ভাগ্যেই এই ঘটনা ঘটল না। কিছু কিছু লোক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখল তাদের জন্যে কেউ অপেক্ষা করে নেই।
রাস্তায়, পার্কে নাচতে শুরু করল মানুষ। রাস্তা ভরে গেল গাড়িতে গাড়িতে। সারাটা বিকেল ধরে গির্জার ঘণ্টা বেজে চলল পুরোদমে। ভরে উঠল আনন্দ ফুর্তির আঙ্গুলো। প্রতিটা কাফেয় বের করা হলো মদের শেষ বোতলটাও। প্রত্যেক পান্থশালার সামনে উন্মত্ত হয়ে উঠল মাতাল জনতা; তাদের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকাও আছে, সবার চোখের সামনে পরস্পরকে আদর করছে ওরা, কে কী ভাবছে সেটা খেয়াল করেও দেখছে না কেউ।
গির্জার ঘণ্টা, বন্দুকের গর্জন, বাজনার সুমধুর ছন্দ, কানে তালা লাগানো বহু কণ্ঠের চিৎকার ইত্যাদির মিলিত গর্জনের ভেতর দিয়ে সেদিন পড়ন্ত বেলায় সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায় শহরের উপকণ্ঠের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল রিও। আলোকিত হয়ে উঠেছে শহর, ভেসে আসছে কাবাব, আর মদের গন্ধ। ওর চারপাশে উফুল্ল জনতা তাকিয়ে দেখছে উজ্জ্বল আকাশ। আলিঙ্গনরত নারীপুরুষের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসছে কামনার অস্ফুট শীৎকার।
হেঁটে চলল রিও। যতই সামনে এগোচ্ছে ততই বাড়ছে ভিড়। আর সেই সাথে শোরগোল। ওর মনে হলো গন্তব্য ওর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। এ সময় বিচিত্র এক অনুভূতি জেগে উঠল ওর ভেতর। ওই কলকণ্ঠ উন্মত্ত জনতার মাঝে মিশে যাবার একটা দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করল ও।
গ্রাঁদ এবং কটার্ড যেখানে থাকে সে রাস্তাটার মোড় ঘুরতেই রিও উপলব্ধি করল যাদের কামনা ব্যক্তি-মানুষ আর তার ভালবাসাকে পাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সবসময়ের জন্যে না হলেও মাঝে মাঝে তাদের সেই বাসনা পূরণ হওয়া উচিত।
.
৫.০৫
পাঁচ গ্রাঁদ এবং কটার্ড-এর বাসায় যাওয়ার রাস্তাটায় ঢুকতেই রিও দেখল পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে একদল পুলিস। দূর থেকে ভেসে আসছে আনন্দ ফুর্তির উল্লাসধ্বনি। সে কারণে এই শান্ত অঞ্চলটাকে আরও শান্ত মনে হচ্ছে।
মাফ করবেন, ডাক্তার সাহেব, বলল একজন পুলিস, আপনাকে ওদিকে যেতে দিতে পারব না। একজন পাগল বন্দুক নিয়ে যাকে দেখছে তাকেই গুলি করছে। আপনি এখানেই থাকুন। আপনার সাহায্যের দরকার হতে পারে।
রিও দেখল ওর দিকে এগিয়ে আসছে গ্রাঁদ। কী ঘটেছে সে। সম্পর্কে গ্রাঁদ কিছুই জানে না। পুলিস ওকেও সামনে যেতে দেয়নি। ওরা ওকে জানিয়েছে গুলি ওর বাসার দিক থেকেই আসছে।
সামনে যে পুলিসের দল ওদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের থেকে কিছু দূরে আর একদল পুলিস ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনের রাস্তাটা নির্জন। জনশূন্য মোড়ের ওপর পড়ে আছে একটা টুপি আর এক টুকরো নোংরা ছেঁড়া কাপড়। রিভলভার হাতে বাড়ির দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বেশ কিছু পুলিস। তিনতলার একটা জানালা ছাড়া বাড়ির অন্যান্য জানালা বন্ধ।
মনে হচ্ছে জানালার পাল্লাটা আলগাভাবে ঝুলছে একটা কজার ওপর।
হঠাৎ ওরা শুনতে পেল দুটো রিভলভারের আওয়াজ। গ্রাঁদ-এর বাড়ির বিপরীত দিকের বাড়িটা থেকে ভেসে এল সেই শব্দ। তিন তলার সেই জানালাটা থেকে ছিটকে পড়ল কয়েকটা টুকরো। আবার নীরব হয়ে গেল চারদিক। সারা দিনের উৎসবের পর রিও-র কাছে ব্যাপারটা মনে হলো অবাস্তব।
আরে, ওটা তো কটার্ড-এর জানালা, চিৎকার করে উঠল, গ্রাঁদ।
আপনারা ওভাবে গুলি করছেন কেন? সামনের পুলিসটাকে জিজ্ঞেস করল রিও।
লোকটাকে ব্যস্ত রাখছি। আমরা একটা পুলিসের গাড়ি আসার অপেক্ষা করছি। বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেখলেই গুলি করছে পাগল লোকটা। কিছুক্ষণ আগে একজন পুলিসকে জখম করেছে ও।
কিন্তু ওর এভাবে গুলি করার কারণ কী?
আমারও প্রশ্ন ওটাই। রাস্তার ওপর কিছু লোক আনন্দ ফুর্তি করছিল, এমন সময় ছাদ থেকে কে একজন ওদের দিকে গুলি ছোঁড়ে। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি ওরা। কিছুক্ষণ পর আবার গুলি হয়, তখন চিৎকার করতে করতে ওরা এদিক ওদিক ছুটতে থাকে; ওদের ভেতর আহত হয় একজন, অন্যরা পালিয়ে যায়। মনে, হয় লোকটার মাথা হঠাৎ বিগড়ে গেছে।
রাস্তায় একটা কুকুর বেরিয়ে এল। একটা রোগা স্প্যানিয়েল। কয়েক মাস পর এই প্রথম কুকুর দেখল রিও। হয়তো ওর মনিব এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল ওকে। দেয়ালের গা ঘেঁষে ধীরে ধীরে পা ফেলে কটার্ড-এর বাড়ির দরজার সামনে থামল সারমেয় জন্তুটা। তারপর রাস্তার ওপর বসে পড়ে মাছি তাড়াতে লাগল। পুলিসদের কয়েকজন শিস দিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করল ওটাকে। মাথা তুলল কুকুরটা, এগিয়ে গেল সামনের রাস্তার ওপর, বার কয়েক শুকল পড়ে থাকা টুপিটা। এমন সময় তিনতলার সেই জানালাটা থেকে রিভলভারের গুলি এসে বিধল ওর গায়ে। শূন্যে একটা ডিগবাজি খেলো কুকুরটা, তারপর কাত হয়ে পড়ে গেল একপাশে। রিও-র পিছনে ব্রেক কষার শব্দ হলো, থামল একটা গাড়ি। গাড়ি।
এই যে এসে পড়েছে, বলল একজন পুলিস।
গাড়ির ভেতর থেকে রাস্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কয়েকজন পুলিস অফিসার। গাড়ি থেকে নামাল দড়ি, মই, দুটি মোড়ক। ঢুকে পড়ল বিপরীত দিকের বাড়িঘরের পিছনের একটা গলিতে। তখন থেমে গেছে কুকুরটার নড়াচড়া। চকচক করছে, চারপাশে জমা কালো রক্ত।
অকস্মাৎ উল্টো দিকের একটা বাড়ির জানালা থেকে বেরিয়ে এল এক ঝাক মেশিনগানের গুলি। তিনতলার সেই জানালাটা টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে গেল। দেয়ালে তৈরি হলো মস্ত বড় এক ফাঁক। অন্য একটা বাড়ি থেকে গুলি ঢুকল ওই ফাঁকটায়। ফুটপাথের ওপর ভেঙে পড়ল ইট, চুন, সুরকি। তিনজন পুলিস অফিসার গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঢুকে পড়ল কটার্ড-এর বাড়ির দরজায়। বাড়ির ভেতর দুটো বিস্ফোরণের শব্দ হলো। তারপর শুরু হলো ছোটাছুটি। কিছুক্ষণ পর দরজায় দেখা গেল ছোটখাট একটা লোক প্রাণপণে চিৎকার করছে, আর পুলিস তাকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে আনার চেষ্টা করছে।
একসঙ্গে খুলে গেল আশেপাশের বাড়িঘরের সমস্ত জানালা। প্রত্যেক জানালায় দেখা দিল উৎসুক মুখ। দরজা খুলে রাস্তায় নেমে এল লোকজন। রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বামন লোকটাকে। দুই হাত পিঠ মোড়া করে ধরে রেখেছে দুইজন পুলিস অফিসার। অনবরত চিৎকার করছে লোকটা। একজন পুলিস এগিয়ে এসে বিরাশি সিক্কা ওজনের দুটো ঘুসি বসিয়ে দিল ওর। চোয়ালে।
ও তো কটার্ড, উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল গ্রাঁদ। কটার্ড শেষ। পর্যন্ত পাগল হয়ে গেল।
রাস্তার ওপর চিত হয়ে শুয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল কটার্ড। সজোরে লাথি মারল একজন পুলিস। ভিড় ঠেলে ওর দিকে এগিয়ে গেল জনতার একটা ক্ষুদ্র অংশ। সরে দাঁড়ান, গর্জে উঠল পুলিসের লোকটা।
একে একে রিও-র পাশ দিয়ে চলে গেল কটার্ড, পুলিস, জনতা। চোখ ফিরিয়ে রাখল ও।
অবশেষে হাঁটতে আরম্ভ করল রিও। তখন রাত নামছে। এই অঞ্চলটা বরাবর নির্জন থাকে। কিন্তু কার্ড-এর ঘটনার পর রাস্তায় ভিড় জমে উঠেছে। বাসার দরজায় পৌঁছে ওকে শুভরাত্রি জানাল গ্রাঁদ। বলল, এখন থেকে আবার সন্ধ্যার কাজ শুরু করব। এরপর সিঁড়িতে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াল ও। বলল, জেনিকে চিঠি লিখেছি। মনটা এখন আগের চেয়ে অনেক হালকা লাগে। সেই কথাটা আবার নতুন করে লেখায় হাত দিয়েছি। এবার বিশেষণগুলো রাখব না। চোখ দুটো হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর। মাথা থেকে টুপি খুলে ধীরে ধীরে অভিবাদনের ভঙ্গিতে নামিয়ে আনল টুপিসুদ্ধ হাতটা। হাঁপানি রোগীর বাসার দিকে পা বাড়াল রিও। বুড়ো তখন তার অভ্যাসমত এক পাত্র থেকে আর এক পাত্রে গুনে গুনে রাখছে মটর দানা।
এখন এই যে সবাই আনন্দ ফুর্তি করছে, মনে হয় ঠিকই করছে ওরা, বলল বুড়ো। তারপর জানতে চাইল, আচ্ছা, ডাক্তার সাহেব, তারিউ-এর খবর কী?
মারা গেছে। মনোযোগ দিয়ে বুড়োর বুকের ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে লাগল রিও।
সত্যি? বেশ বিব্রত বোধ করল হাঁপানি বুড়ো।
হ্যাঁ। প্লেগে।
এক মিনিট নীরব থাকার পর বুড়ো বলল, পৃথিবীতে দেখি যারা ভাল মানুষ তারাই তাড়াতাড়ি মারা যায়। খুব কাজের মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক।
হঠাৎ এসব কথা বলছেন কেন? স্টেথোটা গুছিয়ে নিল রিও।
বাজে কথা পছন্দ করতেন না একদম। আমার খুব ভাল লেগেছিল তাকে। লোকে এখন বলাবলি করছে শহরে প্লেগ এসেছিল। এমন ভাব করছে যেন এজন্যে ওদের মেডেল পাওয়া উচিত। কিন্তু আমার কথা, প্লেগ জিনিসটা আসলে কী জীবনেরই একটা অংশ-এর বেশি কিছু নয়।
ফুসফুসের যে ওষুধটা দিয়েছি সেটা নিয়মিত টানবেন।
ডাক্তার সাহেব, আমাকে নিয়ে অত চিন্তা করবেন না। কিভাবে বাঁচতে হয়, আমি জানি।
ঘর থেকে বেরুবার সময় হঠাৎ মাঝপথে থমকে দাঁড়াল রিও। বলল, আপনার ছাদে একটু যেতে চাই, কিছু মনে করবেন না নিশ্চয়।
অবশ্যই না। আচ্ছা, শুনছি যারা প্লেগে মারা গেছে তাদের জন্যে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হবে। সত্যি?
কাগজে তো তাই লিখেছে।
এমন কিছু একটা হবে সেটা আমি আগেই জানতাম। নিশ্চয় সেখানে বক্তৃতা দেয়ার ব্যবস্থাও হবে? বক্তৃতায় কী বলা হবে সেটা আমি এখনই শুনতে পাচ্ছি: আমাদের প্রিয়জনদের মৃত্যুর.. । তারপর যে যার ঘরে ফিরে আরাম করে খাবে-দাবে, তাই না?
রিও তখন সিঁড়ি বেয়ে অর্ধেক পথ উপরে উঠেছে। মাথার ওপর ঝলমল করছে শান্ত সুদূর আকাশ। দূরে পাহাড়ের ওপর ছিটকে পড়ছে নক্ষত্রের আলো। প্লেগের কথা ভুলে থাকার জন্যে সেদিন রাতে ছাদে উঠে যেমন দেখেছিল আজকের রাতেও চারপাশের পরিবেশটা তেমনি। কেবল আজ রাতে সমুদ্রের ঢেউগুলো আরও প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে। আবহাওয়া আরও স্বচ্ছ, শান্ত। বাতাসে নেই সমুদ্রের সেই লোনা গন্ধ। শহরে কোলাহল উপলসৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মত শোনা যাচ্ছে এখনও, তবে আজ রাতে বিদ্রোহের কথা বলছে না ওগুলো, বলছে মুক্তির কথা। দূর-আকাশে, মূল শহরের মাথার ওপর ঝুলে আছে। লাল একটা আভা। আজকের এই সদ্যোজাত স্বাধীনতার রাতে আকাক্ষা বাধা মানছে না কোন, আর এরই নিনাদ পৌঁছুল রিও-র কানে।
রাতে, মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ আতসবাজি পোড়ানোর আয়োজন করেছিলেন। অন্ধকার বন্দর থেকে তারই প্রথম ফানুস নিক্ষেপ করা হলো আকাশে। শহরবাসীরা উল্লাসের ভেতর দিয়ে স্বাগত জানাল তাকে।
চারদিক থেকে তুমুল হর্ষধ্বনির এক একটা বিরাট তরঙ্গ উত্তাল ঊর্মিমালার মত ছুটে এসে আঘাত করছে ছাদে, বারান্দায়, দেয়ালে। গর্জে ফুলে ফুলে, উঠছে সেই ঢেউ। বিশাল থেকে। বিশালতর হচ্ছে ওগুলোর আকার। আর উঁচু পর্বতের শীর্ষ থেকে উজ্জ্বল আলো জলপ্রপাতের মত অজস্র ধারায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে শূন্য অন্ধকারের ভেতর।
দূর শহর থেকে ভেসে আসা তুমুল হর্ষধ্বনি শুনতে শুনতে রিও ভাবল, মানুষের এই বিজয় উল্লাস যে-কোন দিন আবার হয়তো বিপন্ন হবে। সেটাই হয়তো নিয়ম। কেননা প্লেগের জীবাণু কখনোই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় না, অদৃশ্যও হয় না চিরতরে বছরের পর বছর এই জীবাণু সুপ্ত থাকে আসবাবপত্রের মাঝে, কাপড়চোপড়ের বাক্সের ভেতর; ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করে শোবার ঘরে, ভাঁড়ারে, বড় বড় ট্রাংক, বইয়ের শেলফে; তারপর সেই দিনটি আসে যেদিন এই জীবাণু মানুষের সর্বনাশ এবং শিক্ষার জন্যে আবার তার ইঁদুরগুলোকে জাগিয়ে উত্তেজিত করে মরবার জন্যে, এবং ঝাঁকে ঝাঁকে ওদেরকে পাঠিয়ে দেয় আনন্দমুখর কোন শহরে।
***
nice