দ্বিতীয় পর্ব
২.০১
এখন থেকে সবার কাছে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াল প্লেগ। এতদিন শহরবাসী ওদের চারপাশে বিচিত্র ঘটনা ঘটতে দেখে বিস্ময় বোধ করলেও যতদূর সম্ভব তারই ভেতর নিজেদের স্বাভাবিক কাজ-কর্ম চালিয়ে গেছে। কিন্তু শহরের ফটক বন্ধ করে দেয়ার পর ওদের সম্মুখীন হতে হলো বঞ্চনার। মাত্র কয়েকদিন আগেও পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় ওরা ধরে নিয়েছিল ওদের এই ছাড়াছাড়ি সাময়িক। প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে সামান্য দু-একটা মামুলি কথাবার্তা বলে, একটু চুমু খাওয়াখাওয়ি করে বিদায় নিয়েছে ওরা, ধরে নিয়েছিল মাত্র কয়েকদিন পরেই আবার দেখা হবে ওদের। এখন হঠাৎ দেখল, বড় অসহায়ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সবাই।
লোকজন ব্যাপারটা বোঝার বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই বন্ধ করে দেয়া হয় শহরের ফটক, তাই ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করার কোন অবকাশই পায়নি কেউ। ফলে ওরা এমন আচরণ করতে বাধ্য হলো যা থেকে মনে হলো ব্যক্তিগত অনুভূতি বলতে কিছুই নেই ওদের। শহর ছাড়ার আবেদনপত্র নিয়ে প্রিফেক্ট এর অফিস ঘেরাও করল জনতা। কিন্তু কাউকেই বাইরে যাবার অনুমতি দেয়া হলো না।
চিঠি লেখার আনন্দ থেকেও বঞ্চিত করা হলো শহরবাসীকে। কর্তৃপক্ষ মনে করলেন এর ফলে রোগের জীবাণু শহরের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রথমদিকে অন্যান্য শহরের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের ব্যাপারে কোন বাধা-নিষেধ ছিল না, কিন্তু এর পরে টেলিফোন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় এত বেড়ে গেল যে কয়েক দিনের জন্যে বন্ধ করে দেয়া হলো এই যোগাযোগ ব্যবস্থা। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ রক্ষার একমাত্র মাধ্যম হলো টেলিগ্রাম। হৃদয়ের গভীর আর্তিগুলো সীমাবদ্ধ হলো কয়েকটি শব্দে তোমার শরীর ভাল, কিংবা সব সময় তোমার কথা মনে পড়ে, প্রিয়।
কিছুদিন এভাবে কাটবার পর যখন সবাই পরিষ্কার বুঝতে পারল, কারুরই আর শহর ছেড়ে বাইরে যাবার বিন্দুমাত্র আশা নেই, তখন প্রশ্ন উঠল প্লেগ শুরু হওয়ার আগে যারা বাইরে গিয়েছিল তাদের ফিরে আসার অনুমতি দেয়া হবে কিনা? কিছুদিন আলাপ-আলোচনার পর কর্তৃপক্ষ জানালেন এই অনুমতি দিতে তাদের আপত্তি নেই। সেই সঙ্গে এটাও জানিয়ে দিলেন, একবার যারা ফিরে আসবে কোন অবস্থাতেই তাদের আর শহর ছেড়ে যেতে দেয়া হবে না। ইতিমধ্যে প্লেগের কবলে যারা পড়েছিল তারা উপলব্ধি করল এই ব্যবস্থার ফলে পরিবারের লোকদের অকারণে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে টেনে আনা হবে; তাই, অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও, ওদের অনুপস্থিতিকেই মেনে নিল ওরা।
মানুষ হয়ে উঠল সন্দেহপরায়ণ। যে-সব স্বামী এতদিন স্ত্রীর ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখে এসেছে, তারাই হঠাৎ নিজের স্ত্রীর ওপর ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠল। প্রেমিকদের ক্ষেত্রেও ঘটল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
শহরের অধিবাসীরা বন্ধ করে দিল সামাজিক মেলামেশা। শহরের ক্ষুদ্র গণ্ডীর ভেতর প্রাণহীন রুটিন মেনে চলে, একই রাস্তায় বারবার ঘুরেফিরে বেড়িয়ে, দিনের পর দিন একই অতীত স্মৃতির রোমন্থন করে মিথ্যা সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা করার ভেতর সীমাবদ্ধ হলো ওদের জীবন।
এভাবে প্লেগ শহরবাসীকে ঠেলে দিল নির্বাসিত জীবনে। সুখের যত স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল সবাই। ভাবল, বাইরে ছিল যে প্রিয়জন সে ফিরে এসেছে, এখনই দরজায় বেল বাজবে, একটু পরে সিঁড়িতে শোনা যাবে পরিচিত পায়ের শব্দ। অতীত ছাড়া কিছুই থাকল না ওদের। উদ্দেশ্যহীনভাবে দিন কাটানো এবং নিষ্ফল স্মৃতিচারণ এই দুই অসহায় অবস্থার শিকার হয়ে এক নির্মম সঙ্কটের মধ্যে বাস করতে লাগল ওরা।
.
২.০২
দুই শহরবাসীকে এই আকস্মিক বিচ্ছিন্ন অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়ে শহরের ফটকে পাহারাদার হয়ে বসল প্লেগ নিজেই। ফিরিয়ে দিতে লাগল বন্দরে নোঙর করতে আসা বাইরের জাহাজগুলোকে। কোন যানবাহনই আর ভেতরে ঢুকতে পারে না। বুলভার্দের চূড়া থেকে নিচে তাকালে শহরের দৃশ্য অদ্ভুত মনে হয়; মনে হয় শহরের সবগুলো গাড়ি যেন একটানা একটা বৃত্তাকার পথে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে। রোগের সংক্রমণ যাতে বাইরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, ।তার জন্যে যে কয়েকটা জাহাজ আটকে রাখা হয়েছিল, শুধু সেগুলোকেই চোখে পড়ে সাগরে নোঙর করা অবস্থায়। জেটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিরাট বিকট চেহারার ক্রেন, এখানে ওখানে কাত হয়ে পড়ে ছোট বড় ওয়াগম।
ব্যুরো থেকে ঘোষণা করা হলো, প্লেগের আবির্ভাবে তৃতীয় সপ্তাহে, শহরে তিনশো দুজন লোকের মৃত্যু হয়েছে। পাঁচ সপ্তাহ পরে মৃতের সংখ্যা দেখা গেল তিনশো একুশ। ছসপ্তাহ পরে তা উঠল তিনশো পঁয়তাল্লিশে।
যানবাহন চলাচল এবং খাদ্য সবরাহের নিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রিফেক্ট কিছু ব্যবস্থা চালু করলেন। রেশনিং ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হলো পেট্রল, খাদ্যবস্তুর বিক্রয়ের ওপর আরোপিত হলো নিয়ন্ত্রণ। বিদ্যুতের ব্যবহারও চলে এল নিয়ন্ত্রণের আওতায়। শুধুমাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলোকে ছাড়পত্র দেয়া হলো শহরে ঢোকার যানবাহন চলাচল দ্রুত হারে হালকা হতে হতে এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছাল যখন শহরের রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ি বলতে কিছুই চোখে পড়ছে না আর।
রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেল বিলাসবহুল সামগ্রীর সব দোকান। রাস্তাঘাটে পথচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেল বহুগুণ। এবং যে সময়ে কাজকর্মের চাপ সাধারণত কম থাকে, সে সময়ে রাস্তাঘাটে এবং কাফেতে প্রচণ্ড ভিড় জমতে লাগল, কারণ দোকানপাট এবং বেশ কিছু সরকারি অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেককেই নিষ্ক্রিয়ভাবে সময় কাটাতে হচ্ছে। এর ফলে লাভবান হলো সিনেমাহলের মালিক এবং মদের ব্যবসায়ীরা। সিনেমা দেখা, কিংবা মদ খাওয়া ছাড়া কোন বিকল্প রইল না শহরবাসীর। যদিও প্রতিটি সিনেমা হলে একই ছবি চলছিল দিনের পর দিন ধরে, তবু দর্শকের ভিড় কমতে দেখা গেল না কোথাও। মদ্যপানের পরিমাণটাও বেড়ে গেল আগের চেয়ে। এক কাফের মালিক দোকানের সামনে একটা স্লোগান লিখে দিল: রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে চাইলে প্রয়োজন বড় এক বোতল মদ।
এখন প্রতিদিনই রাত দুটোর দিকে দেখা যায় বেশ কিছুসংখ্যক মাতাল, বিভিন্ন কাফে থেকে যাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, টলতে টলতে বাড়ির দিকে হাঁটছে আর তারস্বরে চেঁচিয়ে শোনাচ্ছে জীবন সম্পর্কে আশাবাদের কথা।
শহরের ফটক বন্ধ করে দেয়ার দুদিন পর, ডাক্তার রিও ফিরছে হাসপাতাল থেকে, পথে দেখা হলো কটার্ড-এর সঙ্গে। কটার্ড-এর চেহারা থেকে উপচে পড়ছে খুশি। ওকে সুস্থ দেখে অভিন্দন জানাল রিও।
এই যে অভিশপ্ত মহামারী, এ-সম্পর্কে আপনার কী ধারণা, ডাক্তার সাহেব? ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তাই না? প্রশ্ন করল কটার্ড। ঘাড় নেড়ে ওকে সমর্থন করল রিও।
দুজন একসঙ্গে কিছুটা পথ হাঁটল। এক মুদির গল্প শোনাল কটার্ড। পরে বেশি মুনাফায় বিক্রি করবে বলে প্রচুর টিনজাত খাদ্যসামগ্রী মুজদ করে রেখেছিল লোকটা। কিন্তু ওর সে-আশা পূরণ হয়নি, তার আগেই মারা গেছে হাসপাতালে।
প্লেগের ছুতোয় কেউ যে কিছু টাকা কামিয়ে নেবে তারও কোন সুযোগ নেই, মন্তব্য করল কার্ড।
আরও একজন মানুষের গল্প বলল ও। লোকটার শরীরে তখন এই রোগের সমস্ত লক্ষণ ফুটে উঠেছে। দেহে ভীষণ জ্বর। সেই অবস্থায় ও ঘর থেকে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে আসে, এবং সেখানে প্রথমেই যে স্ত্রীলোকটিকে দেখতে পায়, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে থাকে, আমাকেও ধরেছে এবার।
সেদিনই বিকেলে গ্রাঁদ ওর মনের সমস্ত বেদনা প্রকাশ করল রিও-র কাছে। এই প্রথম ডাক্তারের সামনে বেশ কিছুটা প্রগলভ, হয়ে উঠল ও। শব্দ চয়নের ব্যাপারে ওর যে অসুবিধা সেটা অবশ্য এখনও আছে, কিন্তু প্রয়োজন মত উপযুক্ত শব্দ ওর মুখ দিয়ে আপনা-আপনি বেরিয়ে আসতে লাগল। গ্রাঁদ বলল, একেবারে নাবালক বয়সে ও প্রতিবেশী এক দরিদ্র পরিবারের খুব অল্প বয়স্ক এক মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করে। মেয়েটির নাম ছিল জেনি। এই বিয়ের জন্যেই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরি নিতে বাধ্য হয় ও
এরপর ওদের জীবনের যা কাহিনী তা অত্যন্ত সরল। সব, স্বামী-স্ত্রীর জীবনে যা ঘটে ওদের ভাগ্যেও তাই ঘটল। বিয়ের পর দুজন পরস্পরকে ভালবাসে, সেই সঙ্গে চলতে থাকে নিয়মিত কাজকর্ম; তারপর কাজের চাপ দিন দিন এতই বাড়তে থাকে যে তখন ভালবাসার অনুভূতি ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল মনের ভেতর। জেনিকেও চাকরি নিতে হলো। অফিসে সারাদিন ধকলজনিত অবসাদের ফলে ক্রমেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে থাকে গ্রাঁদ। স্ত্রীকে শোনানোর মত কথাও আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসে ওর। হঠাৎ একদিন ওকে ছেড়ে চলে গেল জেনি। যাবার সময় একটা চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিল ও।
সত্যিই একদিন গভীরভাবে ভালবাসতাম তোমাকে, কিন্তু এখন নিজেকে বড় ক্লান্ত মনে হয়, তাই তোমাকে ছেড়ে যাওয়াটা মোটেই সুখের নয়; কিন্তু জীবন যখন আমাকে আবার নতুন করেই আরম্ভ করতে হবে, তখন আর সুখের কথা নাই বা ভাবলাম।
গ্রাঁদ ওর পকেট থেকে তোয়ালের মত কী একটা বের করে বেশ শব্দ করে তাতে নাক ঝাড়ল। গোঁফজোড়াও ঠিক করে নিল মুছে। নীরবে, একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল রিও। গেট বন্ধ করে দেয়ার সপ্তাহ তিনেক বাদে একদিন সন্ধেবেলা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার সময় রিও লক্ষ করল একজন যুবক রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে. ওর জন্যে।
আমাকে চিনতে পারছেন তো? এই মহামারী শুরু হওয়ার ঠিক আগে আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমার নাম র্যাঁবেয়া, যুবকটি বলল।
ও হ্যাঁ। অবশ্যই মনে পড়ছে। আপনার কাগজে লেখা পাঠাবার মত অনেক উপকরণ এখন পেতে পারেন।
ঠিক সে-ব্যাপারে আপনার কাছে আসিনি। দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে আমি দুঃখিত।
রিও বলল, শহরের এক ডিসপেনসারিতে আমাকে একটু যেতে হবে। চলুন, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাবে।
নিগ্রো এলাকার ভেতর দিয়ে সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল ওরা। সন্ধ্যা নামছে চারদিকে। এ-সময় শহরটা সাধারণত কোলাহলমুখর থাকে, কিন্তু আজ অদ্ভুত রকমের শান্ত বলে মনে হচ্ছে। শব্দের মধ্যে ছিল শুধু দূরাগত বিউগলের আওয়াজ, পড়ন্ত সূর্যেরর সোনা-মাখানো বাতাসে ভেসে আসছে সেই আওয়াজ। সেনাবাহিনী, যে তাদের কাজকর্ম নিয়মিত করে যাচ্ছে, এই রকম একটা ভাব বাইরে বজায় রাখার চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। চারপাশে গোলাপী, ফিকে লাল এবং হলুদ দেয়াল। তারই ভেতর দিয়ে সোজা, সরু রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে ওরা। অবিরাম বকর-বকর করছে র্যাঁবেয়া। মনে হচ্ছে ওর শরীরের সবগুলো স্নায়ু যেন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।
র্যাঁবেয়া জানাল, স্ত্রীকে ফেলে এসেছে প্যারিসে ও। যেদিন থেকে বাইরের সাথে এই শহরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে, সেদিনই ও একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল ওকে। তখন ওর ধারণা ছিল শহরের এই অবস্থা খুবই সাময়িক। কিন্তু পরের দিনই ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর ওর মনে হলো, এই বিপর্যস্ত অবস্থা কতদিন চলবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং তক্ষুণি ও শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওর পেশাগত মর্যাদার সুবাদে ওপরতলায় এখানে-ওখানে সাড়া দিয়ে প্রিফেক্ট-এর অফিসে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার লাভে সক্ষম হয় ও। র্যাঁবেয়া ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বলে ওরাওঁ-এ ওর উপস্থিতি সম্পূর্ণ আকস্মিক ব্যাপার। এই শহরের সঙ্গে কোন ব্যাপারেই ওর কোন যোগসুত্র নেই। এ-অবস্থায় নিশ্চয় ও শহর ছেড়ে বাইরে যাবার অনুমতি পাওয়ার আশা করতে পারে। ভদ্রলোক উত্তরে র্যাঁবেয়াকে জানান, যদিও তিনি ওর অবস্থা বুঝতে পেরেছেন এবং ওর জন্যে যথেষ্ট সহানুভূতি বোধ করছেন, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আইনের কোনরকম ব্যতিক্রম ঘটানোর ক্ষমতা তার নেই। শেষে তিনি র্যাঁবেয়াকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে, যেহেতু ও একজন সাংবাদিক, তাই ওর লেখার উপযোগী চমৎকার চমৎকার উপকরণ ও এখন ওরাওঁ-এ পেতে পারে। এরপর দার্শনিকের মত মন্তব্য করেছিল ও, পৃথিবীতে এমন কিছু কখনও ঘটে না যার কোন শুভ দিক নেই।
ইতিমধ্যে শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে গিয়েছিল ওরা। ভেবে দেখুন তো, ডাক্তার সাহেব, কী রকম মূর্খের মত কথাবার্তা বলে এরা। কিছুতেই বুঝতে চায় না, শুধুমাত্র সংবাদপত্রে নিবন্ধ লেখার। জন্যে পৃথিবীতে আমার জন্ম হয়নি। বরং একজন, নারীকে ভালবাসব, তাকে নিয়ে একসঙ্গে বাস করব, এজন্যই আমি জন্মেছি। সেটাই তো সঙ্গত, তাই না?
রিও অত্যন্ত সতর্কতার সাথে জবাব দিল, আপনি যে-সব কথাবার্তা বলছেন তার মধ্যে ভেবে দেখবার মত নিশ্চয় কিছু থাকতে পারে।
শহরের প্রধান বুলভার্দে সবসময় যেমন জনসমাগম দেখা যায়, আজ তার কিছুই চোখে পড়ল না। রিও ভাবল, র্যান্সডক ব্যুরো থেকে সর্বশেষ যে ঘোষণাটা দেয়া হয়েছে এটা হয়তো.তারই ফল। মৃত্যের সংখ্যা ঘোষণার দিনটাতে সবাই কেমন সন্ত্রস্ত থাকে। চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে যাবার পর শহরের অধিবাসীরা আবার সহজ এবং আশান্বিত বোধ করতে শুরু করে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের পরিচয় খুবই অল্প দিনের, র্যাঁবেয়া আবার কথা আরম্ভ করল, কিন্তু আপনাকে আমার খুব ভাল। লেগেছে। কোন সাড়াশব্দ দিল না রিও। বুঝেছি, আপনি খুব বিরক্ত বোধ করছেন। সত্যি, আমি দুঃখিত। আমি শুধু জানতে এসেছিলাম, এই অশিপ্ত রোগটা আমার দেহে সংক্রমিত হয়নি, এই বলে আপনি আমাকে একটা সার্টিফিকেট দিতে পারেন কি না। তাতে আমার যাওয়ার ব্যাপারটা একটু সহজ হত।
মাথা নাড়ল রিও। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ওর পায়ের ওপর ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। ও উবু হয়ে ছেলেটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল রাস্তার ওপর। হাঁটতে হাঁটতে ওরা এসে পৌঁছল প্যালেস দ্য আর্মস-এর কাছে। শাখা-প্রশাখা এলিয়ে দিয়ে স্ট্যাচু অভ রিপাবলিকের চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে ধুলিধূসর উইলো আর ডুমুর গাছের সারি। র্যাঁবেয়া-র চেহারার মধ্যে কেমন একটা অপ্রসন্ন এবং কঠিন একগুঁয়ে ভাব ফুটে উঠল।
আমি আপনার অবস্থা বুঝিনি, এমন সন্দেহ করবেন না, বলল রিও, কিন্তু আপনি যে যুক্তিগুলো দেখাতে চাইছেন সেগুলো শেষ, পর্যন্ত টেকানো শক্ত। আমি যদি আপনাকে সার্টিফিকেট দেই তাতেও আপনার কোন লাভ হবে না।
কেন?
কারণ, এই শহরে আরও হাজার হাজার লোক রয়েছে যাদের অবস্থা আপনারই মত, কিন্তু তাদের সবাইকে তো আর শহর ছেড়ে যাবার অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়।
তাদের দেহে প্লেগের জীবাণু সংক্রমিত হয়নি, তা জানা সত্ত্বেও তাদের শহর ছেড়ে যাবার অনুমতি দেয়া সম্ভব হবে না বলে আপনি, মনে করেন?
দেখুন, রোগ সংক্রমিত হয়নি এটা জানাই তো তাদের শহর ছেড়ে যাবার অনুমতি দেবার পক্ষে যথেষ্ট কারণ নয়।
কিন্তু আমি এই শহরের অধিবাসী নই।
দুঃখের সাথে জানাচ্ছি এখন থেকে নিজেকে আপনার এই শহরের একজন বলেই মনে করতে হবে।
এবার গলার স্বর একটু চড়িয়ে দিল র্যাঁবেয়া। গোল্লায় যাক। কিন্তু, ডাক্তার, আপনি কি বোঝেন না এটা মানুষের সাধারণ অনুভূতির ব্যাপার? বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কি আপনি অনুভব করেন না?
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রিও। তারপর বলল, আমি সবকিছুই অনুভব করি। আমি চাই সবাই আপনজনদের সঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পাক। কিন্তু আইন আইনই। শহরে প্লেগ দেখা দিয়েছে, তাই এ-ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী আমার যা কর্তব্য আমাকে তা করতেই হবে।
না, আমার মনে হচ্ছে আপনি কিছুই বোঝেন না, তিক্ততার সঙ্গে বলল র্যাঁবেয়া, কারণ আপনি যেসব কথা বলছেন সেগুলো যুক্তির কথা, বুদ্ধি বিবেচনার কথা, হৃদয়ের কথা নয়। আপনি বাস করেন বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক কল্পনার রাজ্যে।
স্ট্যাচু অভ রিপাবলিকের দিকে চোখ তুলে রিও বলল, আমি বাস্তব নিয়ে কথা বলছি।
র্যাঁবেয়া ওর টাই সোজা করতে করতে বলল, অর্থাৎ আপনার কাছ থেকে কোন সাহায্যের আশা করা আমার উচিত হবে না, এই তো? কিন্তু জেনে রাখুন, এ-শহর ছেড়ে আমি যাবই।
রিও আবারও বলল, আমি সব জানি এবং বুঝি। কিন্তু আমার। করার কিছুই নেই।
মাফ করবেন। শুনেছি এটা আপনারই কাজ, র্যাঁবেয়ার গলার। স্বর আবার চড়ল, শুনেছি যে-নির্দেশ জারি করা হয়েছে তার খসড়া আপনারই দেয়া। ভেবেছিলাম, যে-আইন তৈরি করতে আপনি সাহায্য করেছেন, অন্তত একটা বিশেষ ক্ষেত্রে তা ভঙ্গ করার ব্যাপারে আপনার কাছ থেকে কিছুটা সাহায্য পাব। কিন্তু আমার কথার কোন গুরুত্বই দিলেন না আপনি। বিচ্ছেদের বেদনা যে কী তা অনুভব করার কোন চেষ্টাই করছেন না আপনি। এ রিও স্বীকার করল, র্যাঁবেয়ার অভিযোগ কিছুটা সত্যি। তবে এসব কথা চিন্তা না করাই ও এখন শ্রেয় বলে মনে করে।
ঝাঁজাল কণ্ঠে র্যাঁবেয়া বলল, এরপর নিশ্চয় জনসাধারণের
বৃহত্তর স্বার্থের দৃষ্টান্ত দেবেন। কিন্তু জনসাধারণের কল্যাণ আমাদের সবার কল্যাণের যোগফল।
এতক্ষণ পর হঠাৎ যেন একটা স্বপ্নের ভেতর থেকে জেগে উঠল রিও। বেশ, বেশ। একটু হাঁটুন দেখি। কথাটা ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু ভাববার আছে, বলল ও। কিন্তু আপনি রাগ করছেন কেন? আপনি এ-শহর থেকে মুক্তি পেলে আমি অত্যন্ত। খুশি হব। তবে সরকারি দায়িত্বের খাতিরে অনেক জিনিস আমি। করে উঠতে পারছিনে।
মাথা ঝাঁকিয়ে র্যাঁবেয়া বলল, ধন্যবাদ। আসলে এতটা বিরক্তি দেখানো আমার ভুল হয়েছে। আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম, কিছু মনে করবেন না।
আপনার পরিকল্পনার কাজ কেমন চলছে? আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না, আশা করি কিছু মনে করবেন না। তবে আমার বিশ্বাস এমন কিছু ব্যাপার আছে যেখানে আমরা দুজনে একমত হতে পারব।
হঠাৎ কেমন যেন অপ্রতিভ হয়ে পড়ল র্যাঁবেয়া। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, হ্যাঁ, আমারও সেই রকম মনে হয়। এরপর মাথার টুপিটা টেনে চোখের ওপর নামিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে রাস্তার ওপাশে চলে গেল। রিও দেখল, যে-হোটেলে জ তারিউ থাকে সেটাতেই ঢুকল ও।
মাথাটা সামান্য একটু নড়ল রিও-র। মনের ভেতর জেগে উঠল প্রশ্ন। নিজের সুখভোগের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে অস্বীকার করে ঠিকই করেছে র্যাঁবেয়া। কিন্তু ও যে রিওকে দোষারোপ করেছে অবাস্তব চিন্তার মানুষ বলে, এটা কি ঠিক? শহরে প্লেগ এখন নিয়মিতভাবে তার পেট ভর্তি করে স্ফীত হচ্ছে, তার শিকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সপ্তাহে পাঁচশো। ওকে দিনের পর দিন কাটাতে হচ্ছে হাসপাতালে, এটা কি অবাস্তব? একটা অস্থায়ী হাসপাতাল পরিচালনা করতে হচ্ছে ওকে, হাসপাতালটার সব দায়িত্ব ওর। এ রকম তিনটে হাসপাতাল আছে ওর তত্ত্বাবধানে, এটা কি খুব সহজ দায়িত্ব?
হাসপাতালের একটা ঘর, সুন্দর করে গুছিয়ে যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে রিওকে। ঘরের মেঝেটো সম্পূর্ণ ঝেড়ে-মুছে। পানি আর ক্রিসটালিক অ্যাসিড দিয়ে বানানো হয়েছে একটা ছোট্ট হ্রদ। ওই হ্রদের মাঝখানে ইট দিয়ে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে ক্ষুদ্র একটা দ্বীপ। রোগী হাসপাতালে এসে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তাকে তোলা হয় ওই দ্বীপের ওপর। তার পরনের কাপড় দ্রুত ছাড়িয়ে নিয়ে ডুবিয়ে দেয়া হয় চারপাশের রোগজীবাণুনাশক পানির মধ্যে। তারপর রোগীর দেহ পরিষ্কার করে ধুয়ে, শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে, হাসপাতালের পোশাক পরিয়ে রিও-র কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, পরীক্ষার জন্যে; সেখান থেকে তাকে পৌঁছে দেয়া হয় তার নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে।
রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো থেকে শুরু করে সব কাজ নিজে তদারক করে রিও। সিরাম ইনজেকশন দিয়ে, দেহের স্ফীতিগুলো চিরে চিরে তা থেকে পুঁজ বের করে। রোগীর সংখ্যা। গুনে মিলিয়ে নেয় ও, এবং বিকেলে আবার আসে তাদের অবস্থা দেখার জন্যে। রাত নামতে না নামতেই বেরিয়ে পড়ে বাসায় বাসায় রোগী দেখতে। রোগীকে পরীক্ষার পর যদি দেখা যায় রোগ সংক্রমিত হয়েছে তাহলে তক্ষুণি তাকে পাঠানো হয় হাসপাতালে। এরপর শুরু হয় রোগীর পরিবারে ধস্তাধস্তির পালা। কেননা সবাই জানে রোগী একবার হাসপাতালে গেলে তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কেউই তার মুখ দেখতে পাবে না।
একটু দয়ামায়া তো আপনার কাছ থেকে আশা করতে পারি, ডাক্তার, এই বলে অনুনয় করে রোগীর মা-রা। কিন্তু এতে কোন কাজ হয় না। যদিও করুণা সে অবশ্যই বোধ করে।
হাসপাতালে টেলিফোন করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না ওর। এরপর শব্দ শোনা যায় অ্যাম্বুলেন্সের। প্রথম প্রথম অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ পেলে প্রতিবেশীরা জানালা খুলে চেয়ে চেয়ে দেখত, কিন্তু ইদানীং ওই শব্দ শুনতে পেলেই দ্রুত জানালা বন্ধ করে দেয় সরাই। তারপর শুরু হয় রোগীকে নিয়ে বিরোধ, অশ্রুবর্ষণ, আর কাকুতিমিনতির পালা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোগীকে যেতেই হয় হাসপাতালে। তারপর বিদায় নেয় রিও।
প্রথম দিকে হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে টেলিফোন করে দিয়েই অন্য রোগী দেখার জন্য বেরিয়ে পড়ত ও, অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে অপেক্ষা করত না। এতে পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে হয়ে উঠছিল। ও চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর আত্মীয়স্বজনরা তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দিত বাড়ির দরজা, যেন অ্যাম্বুলেন্স এসে রোগীকে নিয়ে যেতে না পারে। তারপর শুরু হত দরজার ওপর প্রবল আঘাত। কান্নাকাটি। পুলিসের আগমন। এবং শেষে সৈনিকের আবির্ভাব। সবরকমের বাধা তছনছ করে রোগীকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হত হাসপাতালে। এখন প্রত্যেক ডাক্তারের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে একজন পুলিস অফিসারও রোগীর বাসায় আসছে। ফলে এখন আর অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে অপেক্ষা করতে হয় না রিওকে। একজনকে দেখেই অন্য রোগীর বাসায় চলে যায় ও।
এ-ভাবে কেটে গেল একটার পর একটা অবসাদময় সপ্তাহ। পার হলো সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা.। উদ্দেশ্যহীনভাবে জীবন কাটাতে লাগল শহরের অধিবাসীরা। মানুষ বুঝল দয়ামায়া শব্দগুলো অর্থহীন। হৃদয়ের বেদনা প্রকাশ করা নিরর্থক। এক ধরনের নির্লিপ্ততা আচ্ছন্ন করে ফেলল ওদের চেতনাকে।
.
২.০৩
প্রথম মাসের শেষের দিকে চার্চ কর্তৃপক্ষ স্থির করলেন প্লেগের বিরুদ্ধে এক সংগ্রাম আরম্ভ করবেন তাঁরা। এই উপলক্ষে জনসাধারণকে ধর্মীয়বাণী শোনাবার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হলো ফাদার প্যানালুকে। আয়োজন করা হলো একটা প্রার্থনা সপ্তাহ এর।
প্রথম দুতিন দিন অনেকেই দাঁড়িয়ে রইল গির্জার বারান্দার বাইরে অপেক্ষা করল বারান্দার সামনের পথে, ডালিম গাছের তলায়। দূর থেকে শুনল গির্জার ভেতর মিলিত কণ্ঠের প্রার্থনা। এরপর দেখতে দেখতে সবাই ঢুতে শুরু করল গির্জার ভেতর। কণ্ঠ মেলাতে লাগল প্রার্থনা এবং আহ্বানে।
রোববারে, ফাদার প্যানালুর বাণী শোনার সময় দেখা গেল উপাসনাকারীরা গির্জার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আশেপাশের সমস্ত সংলগ্ন স্থান ভরে ফেলেছে। আগের দিন থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, সেদিন সকাল থেকে আরম্ভ হলো প্রবল বর্ষণ। যারা গির্জার বাইরে দাঁড়িয়েছিল তারা সবাই মাথার উপর মেলে ধরল ছাতা। গির্জার ভেতরটা ভরে উঠল ধূপের মৃদু সুবাস, এবং ভেজা জামাকাপড়ের গন্ধে। মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন ফাদার প্যানালু।
উদাত্ত কণ্ঠে বাণী প্রচার করতে শুরু করলেন তিনিঃ ভায়েরা, এক কঠিন বিপদ নেমে এসেছে আপনাদের ওপর। কিন্তু, ভায়েরা, এই বিপর্যয় আপনাদেরই কৃতকর্মের প্রতিফল। ইতিহাসে যখন এই বিপর্যয়ের আবির্ভাব হয়, তখন একে ব্যবহার করা হয়েছিল আঘাত হানার অস্ত্র হিসেবে। ফেরাউন স্রষ্টার ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিল, তাই প্লেগের বিপর্যয় নেমে এসেছিল তার ওপর; যেন সে স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে অনুনয় জানাতে বাধ্য হয়।
এ-ভাবে সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে যারা স্রষ্টার আদেশ এবং নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চেয়েছে তাদের অপমান করার জন্যে, তাদের দর্পচূর্ণ করার জন্যে স্রষ্টার অভিশাপ হিসেবে পাঠানো হয়েছে প্লেগকে। বন্ধুগণ, আপনারা গভীরভাবে এ-বিষয়টি চিন্তা করুন, এবং আসুন আমরা নতজানু হয়ে স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করি।
ইতিমধ্যে বাইরে শুরু হয়েছে প্রবল বৃষ্টিপাত, গির্জার পুবদিকে জানালার ওপর অবিরাম বর্ষণের ফলে চারপাশের স্তব্ধতা হয়ে, উঠেছে আরও গভীর এবং আরও প্রকট।
আমাদের ভেবে দেখতে হবে কেন আবির্ভাব হয়েছে প্লেগের? যারা ন্যায় এবং সত্যের পথে চলেন, তাদের শঙ্কিত হবার কিছু নেই। যারা অন্যায় এবং অবৈধ কাজে লিপ্ত, তাদের হৃদয় এখন কাঁপবেই। আপনাদের মনে রাখতে হবে, সমগ্র পৃথিবীটা স্রষ্টার কাছে একটা শস্য মাড়াইয়ের বিরাট খামার, আর এই প্লেগ হচ্ছে সে শস্য মাড়াইয়ের দণ্ড। যতদিন না তিনি শস্য ঝেড়ে আবর্জনামুক্ত করতে পারছেন, ততদিন তাঁর ইচ্ছা অনুসারে চলবে এই দণ্ডমাড়াইয়ের কাজ। দীর্ঘদিন ধরে আমরা অন্যায় এবং অসত্যকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছি, দীর্ঘদিন ধরে আমরা নির্ভর করে এসেছি স্রষ্টার অপার করুণা এবং তার স্বেচ্ছাকৃত ক্ষমার ওপর। ভেবেছি অনুশোচনা করলেই সবকিছু পাওয়া যাবে। আমাদের ভেতর বিধি নিষেধ বলে কিছু নেই। আমরা সবাই একটা তৃপ্তিদায়ক নিশ্চিত আশ্বাসের মধ্যে বসবাস করছি।
দীর্ঘদিন ধরে অপার করুণার দৃষ্টিতে তিনি চেয়ে থেকেছেন এই শহরের দিকে। কিন্তু কতদিন আর তিনি অপেক্ষা করতে পারেন? তাঁর যে-চিরন্তন আশা, তা আমরা দীর্ঘদিন ধরে পূরণ হতে দেইনি; তারই ফলে আজ তিনি ভয়ঙ্কর রুষ্ট হয়েছেন।
অশান্ত ঘোড়া অনেকক্ষণ ধরে বাঁধা থাকলে যেমন থেকে থেকে নাক দিয়ে শব্দ করে, সমবেত উপাসনাকারীদের ভিড়ের ভেতর থেকে কে যেন তেমনি একটা ছোট্ট শব্দ করে উঠল। এদিক ওদিক চেয়ে ক্ষণিকের বিরতি দিলেন ফাদার প্যানালু। তারপর কিছুটা নিম্নস্বরে আবার শুরু করলেন ধর্মকথা।
রাজা আমবার্টোর আমলে সারা ইতালি জুড়ে এক ভয়ঙ্কর প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তার নিষ্ঠুরতম ধ্বংসলীলা চলেছিল রোম এবং প্যাভিয়ায়। লাশ কবরস্থ করার মত যথেষ্ট লোক আর জীবিত ছিল না তখন। এমন সময় সেখানে নেমে আসে দুজন স্বর্গীয় দূত। একজন সৎ, অন্যজন অসৎ। সৎ প্রকৃতির দূতটা বিভিন্ন বাড়িতে, আঘাত হানার আদেশ করত অসৎ প্রকৃতির দূতটাকে। অসৎ দূতটার হাতে থাকত মস্ত বড় এক বর্শা। সে ওর ওই বর্শা দিয়ে। একটা বাড়িতে যতবার আঘাত হানত, সে-বাড়ি থেকে ঠিক ততটা লাশ আপনা-আপনি অদৃশ্য হয়ে যেত।
এই পর্যায়ে ফাদার প্যানালু তাঁর ছোট হাত দুখানা প্রসারিত করলেন খোলা, বারান্দার দিকে। বাইরের অঝোর বৃষ্টির আড়ালে, কোন কিছুর প্রতি ইঙ্গিত করলেন যেন। তারপর উচ্চস্বরে খেই ধরলেন: ভায়েরা, সৈই ভয়াবহ শিকার শুরু হয়েছে আবার। শহরের পথে পথে ছড়িয়ে আছে তারই ধ্বংসলীলা। ওই দেখুন, আপনাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে মহামারীর স্বর্গীয় দূত, লুসিকারের দেহকান্তি, সাক্ষাৎ শয়তান যেন। আপনাদেরই বাড়ির ছাদের ওপর ঘুরছে সে। তার দক্ষিণ হাতে প্রকাণ্ড এক বর্ষা, যে কোন মুহূর্তে আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুত। হয়তো এ-মুহূর্তে আপনাদের কারও দরজার দিকেই চেয়ে রয়েছে তার আঙুল, লাল বর্শটা ভেঙে ফেলেছে কবাট, আর বাঁ হাতটা বাড়িয়ে রেখেছে অন্য কারও বাড়ির দিকে। আর প্লেগ এতক্ষণে আপনার শোবার ঘরে ঢুকে অপেক্ষা করছে আপনার ফেরার।
এরপর ফাদার প্যানা বক্তৃতা হয়ে উঠল উচ্ছল, আবেগময়। কল্পনা করুন, বিরাট আকারের একটা কাঠের দণ্ড যেন সারাক্ষণ এই শহরের ওপর বনবন ঘুরছে, সামনে যা-কিছু পাচ্ছে এলোপাতাড়ি আঘাত হানছে তাতে। আবার ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে সেই দণ্ড, আর বৃষ্টির ধারার মত তার গা থেকে চারদিকে ছিটিয়ে পড়ছে শোণিতের ধারা। ( একটানা দীর্ঘ বক্তৃতার পর কিছুক্ষণের জন্যে থামলেন ফাদার প্যানালু। মাথার চুল বিক্ষিপ্ত হয়ে এসে পড়েছে কপালের ওপর, সারা শরীর কাঁপছে থরথর; আর তাঁর হাত বেয়ে সেই কম্পন ছড়িয়ে পড়ছে মঞ্চ অবধি। আবার যখন বক্তৃতা আরম্ভ করলেন, তিনি, তখন দেখা গেল অনেক খাদে নেমে গেছে তার কণ্ঠস্বর, কিন্তু আগের মতই কাঁপছে অভিযোগের আবেগে।
দেখুন, নিজেদের সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে আমাদের সামনে। আমরা বরাবর বিশ্বাস করে এসেছি যদি, রবিবারৈ গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা-সভায় যোগ দেই, তাহলে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর জন্যে আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত, যথেচ্ছভাবে চলাফেরা করতে আর কোন বাধা নেই। কিন্তু স্রষ্টা এ-ধরনের উপহাসের পাত্র নন। তিনি আরও ঘন ঘন এবং আরও দীর্ঘ সময় ধরে কাছে পেতে চান আমাদের। এটাই তার ভালবাসার ধরন।
বাইরে থেকে আর্দ্র বাতাসের একটা ঝাঁপটা এসে ঢুকল গির্জার ভেতর। নুয়ে পড়ল বাতির শিখাগুলো, কেঁপে কেঁপে উঠছে থেকে থেকে। মোম পোড়ার ঝাঁঝাল গন্ধ, কাশি ও চাপা হাসির শব্দ ভেসে আসছে এক সঙ্গে। ফাদার প্যানালু আবার ফিরে এলেন। তাঁর বক্তৃতায় আমার লক্ষ্য, আপনাদের সত্যের পথে নিয়ে যাওয়া। কিভাবে এই বিশ্ব সৃষ্টির মহা আনন্দে শরিক হতে হয় আমি সবাইকে সেটাই শেখাতে চাই। কয়েকশো বছর আগে আবিসিনিয়ার খ্রিস্টানরা একবার এই প্লেগের মধ্যে দেখতে পেয়েছিল বিধি-নির্দেশিত পথ। যাদের প্লেগে ধরেনি এমন বহু মানুষ তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যে যে বিছানায় প্লেগের রোগী মারা গেছে তা থেকে চাদর তুলে নিয়ে নিজেদের শরীরে জড়িয়েছে। এটা বাড়াবাড়ি, ধৃষ্টতা, নিন্দনীয়। কোন কিছুর জন্যে স্রষ্টাকে বাধ্য করতে চাওয়া সঙ্গত
গির্জার ভেতর সবাই ভাবল ফাদার প্যানালুর উপদেশ বোধহয়। এখানেই শেষ। বাইরে ইতিমধ্যে থেমে গেছে বৃষ্টি। হলুদ দেখাচ্ছে গির্জার সবকটা বাগান। রাস্তা থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট কথা বার্তার আওয়াজ, গাড়ি চলার চাপা গুঞ্জন। উপাসনাকারীরা খুব সাবধানে গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেদের জিনিসপত্র। কিন্তু ফাদার, প্যানালুর বলা তখনও শেষ হয়নি।
আমি আশা করি বর্তমান দুর্যোগের এই বিভীষিকা, এবং লক্ষ লক্ষ যন্ত্রণাকাতর মানুষের করুণ আর্তনাদ সত্ত্বেও আপনারা সবাই মিলিতভাবে স্রষ্টার কাছে হাত তুলে একবার প্রার্থনা জানাবেন। আর এরপরের যা কিছু তা স্থির করার সব দায়িত্ব স্রষ্টার নিজের।
.
২.০৪
যে রবিবারে ফাদার প্যানালু তাঁর উপদেশবাণী শোনালেন সেদিন থেকেই শহরের সবখানে একটা বড় রকমের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই বলল, একটা সম্পূর্ণ অজানা অপরাধের কারণে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে।
একদিন শহরতলিতে রোগী দেখতে যাচ্ছে রিও। গাঁদও আছে ওর সঙ্গে। দুজন কথা বলতে বলতে, হাঁটছে, এমন সময় অন্ধকারের ভেতর একজন মানুষের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল রিও। লোকটা ফুটপাথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার ডানে আর একবার। বাঁয়ে ঝুঁকে পড়ছে, কিন্তু সামনে এগুনোর কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না ওর মধ্যে। ঠিক তখুনি জ্বলে উঠল রাস্তার আলো। ওরা দেখল, লোকটার চোখ বন্ধ, আর মুখ বুজে হাসছে নিঃশব্দে। মুখের ভঙ্গিটাও কেমন বিকৃত। দুপাশ দিয়ে দরদর করে গড়িয়ে পড়ছে। ঘাম।
আরে, এ যে দেখছি একটা বদ্ধ পাগল, ছাড়া পেল কিভাবে? মন্তব্য করল গ্ৰাঁদ।
গ্রাঁদ-এর একটা হাত চেপে ধরে ওকে সামনের দিকে ঠেলার সময় রিও, দেখল থরথর করে কাঁপছে কেরানির শরীর।
আর কিছুদিন এমন চললে সারা শহরটাই পরিণত হবে পাগলা গারদে, মন্তব্য করল রিও। অনুভব করল ওর শরীরও ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে, শুকিয়ে আসছে গলার ভেতরটা।
গ্রাঁদ বলল, চলুন, কোথাও কিছু একটা খাই
একটা কাফেয় ঢুকল ওরা দুজনে। যে জায়গায় মদ বিক্রি হয় শুধু সেই কাউন্টারে বাতি জ্বলছে একটা। ঘরের ভেতর বাতাস ভারি, দম আটকে আসার মত অবস্থা। আশেপাশের সবাই কথা বলছে চাপাস্বরে।
গ্রাঁদ ঢুকেই ফরমাশ দিল মদের, এবং একচুমুকে খালি করে ফেলল পেয়ালা। দেখে অবাক হয়ে গেল রিও। যেদিক দিয়ে যায়, একেবারে আগুনের মত জ্বলতে থাকে, মন্তব্য করল গ্রাঁদ। কিন্তু কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই বাইরে যাবার জন্যে রিওকে তাগাদা দিতে লাগল ও।
রাস্তায় নেমে চারদিকের অন্ধকারের ভেতর কেমন একটা অদ্ভুত ফিসফিসানির শব্দ শুনতে পেল রিও। রাস্তার আলোর সংক্ষিপ্ত সীমানার ওপরে যে অথৈ অন্ধকার তার ভেতর থেকে ভেসে আসছে শাঁ শাঁ শব্দ। ফাদার প্যানালু যে শস্য মাড়াইয়ের দণ্ডের কথা বলেছিলেন, হঠাৎ রিও-র মনে পড়ল সেটার কথা। চারদিকের ওই শূন্য অন্ধকারের মাঝে যেন অবিরাম কাজ করে চলেছে সেই অদৃশ্য দণ্ডটি। এই ভীতিজনক পরিস্থিতি এড়াবার জন্যে রিও গ্রাঁদ-এর কাছে জানতে চাইল ওর লেখা কতদূর এগিয়েছে।
হ্যাঁ। নিশ্চয় কিছুটা এগিয়েছি বলতেই হবে।
এখনও তাহলে অনেক কিছু বাকি আছে?
তা এখন কিভাবে বলব, বলুন। তবে, ডাক্তার সাহেব, লেখাটাই কিন্তু আসল জিনিস নয়।
চারপাশের অন্ধকার এখন বেশ গম্ভীর হয়ে এসেছে। কাছের কিছুও দেখার উপায় নেই। তবু রিও অনুভব করল, কথা বলার সময় গ্রাঁদ ওর হাত দুটি খুব সুজোরে নাড়ছে। মনে হলো ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে লোকটা। কথাগুলো যেন, ঠেলাঠেলি করে একসঙ্গে ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
আমার এখন একটাই আকাক্ষা; আমি যেদিন আমার পাণ্ডুলিপি শেষ করে কোন প্রকাশকের হাতে দেব, তখন সে সঙ্গে সঙ্গে সেটা পড়া শেষ করে তাঁর কর্মচারীকে বলবে আপনারা সবাই টুপি খুলে ওকে সম্মান দেখান।
কথাটা শুনে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল রিও। দেখল, গ্রাঁদ সত্যি সত্যি ওর টুপি খুলে অদৃশ্য কাউকে সালাম দিচ্ছে। অন্ধকারের ভেতর আকস্মিকভাবে বেড়ে গেল হিসহিস শব্দ।
এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কাজটা কতখানি নিখুঁত হওয়া দরকার, বলল গ্ৰাঁদ।
সাহিত্য সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নেই রিও-র। তাই নীরব থাকাই সমীচীন মনে করল ও। মাথার ভেতর তখনও ওর ফিসফিস করছে ওই অদ্ভুত ভীতিজনক শব্দটা। ইতিমধ্যে গ্রাঁদ-এর মহল্লায় পৌঁছে গেছে ওরা। জায়গাটা যেহেতু রাস্তা থেকে সামান্য একটু উঁচুতে, গালে হিমেল হাওয়ার পরশ পেল ওরা, আবার সেই সঙ্গে টের পেল বাতাসের ধাক্কায় শহরের কোলাহল হারিয়ে যাচ্ছে দূরে।
এখনও আপন মনে বসে যাচ্ছে গ্লাদ। কিন্তু কোন কথাই কানে ঢুকছে না রিও-র।
শুধুমাত্র একটা উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাওয়ার জন্যে গোটা একটা সন্ধ্যা, কখনও কখনও গোটা সপ্তাহই কেটে যায়, তাহলেই বুঝুন ব্যাপারটা।
আচ্ছা, এতক্ষণে বুঝলাম আপনার কথা, বলল রিও।
বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গঁদ বলল, অনুগ্রহ করে আমার বাসায় যদি আসেন, খুব খুশি হতাম।
খাবার ঘরে ঢুকল ওরা দুজন। টেবিলের পাশে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল গ্রাঁদ। সারা টেবিলের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কাগজ।
বসুন এবার, পড়ে শোনান দেখি কী লিখছেন।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করল গ্রাঁদ। তারপর ঝপ করে বসে পড়ল চেয়ারে।
নিচের রাস্তা থেকে একটা অদ্ভুত ভন ভন শব্দ উঠে আসছে ওপরে। মনে হচ্ছে যেন প্লেগের শোঁ শোঁ শব্দের জবাব ওটা। পড়তে আরম্ভ করল গ্রাঁদ: মে মাসের এক সুন্দর প্রভাতে অনেককেই হয়তো রুচিসম্পন্না এক যুবতী অশ্বারোহিণীকে পাটল রঙের সুন্দর একটি মাদি ঘোড়ায় চড়ে দুপাশে পুষ্পিত বৃক্ষ ঘেরা বল্গনা অ্যাভিন ধরে যেতে দেখে থাকবেন।
থামল গ্ৰাঁদ। নিচের যন্ত্রণাকাতর অসহায় শহর থেকে ভেসে আসছে অস্পষ্ট কোলাহল। রিও-র দিকে মুখ তুলল ও।
কেমন হয়েছে?
রীতিমত কৌতূহল জাগছে। শেষে কী হবে সেটা জানার তাগিদ অনুভব করছি।
শুনে, টেবিলের ওপর থাপ্পড় মেরে গ্রাঁদ বলল, আপনি কি বোঝেননি। এটা একটা যেমন-তেমন খসড়া। আমি যে মোহময় বিভ্রম সৃষ্টি করতে চাইছি, সে পর্যায়ে যেতে হলে এখনও অনেক পরিশ্রম করতে হবে।
রিও দেখতে পেল, জানালার নিচে, রাস্তায় লোকজন ছুটোছুটি করছে। দ্রুত সিঁড়ির বেয়ে পথে নেমে এল, ও। হঠাৎ দুজন মানুষ ওর গায়ে ধাক্কা খেয়ে সামনের দিকে ছুটতে লাগল। মনে হলো শহরের কোন না কোন ফটকের দিকে ছুটছে ওরা।
প্রায় প্রতি রাতেই ইদানীং এমন ঘটনা ঘটছে। অনেকেই চেষ্টা করছে ফটকের দারোয়ানের দৃষ্টি এড়িয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে। এখানে-ওখানে হচ্ছে মারামারি, হাতাহাতি। একদিকে নিদারুণ গরম, অন্যদিকে প্লেগের নানা বিপর্যয়-এসব দেখতে দেখতে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়েছে শহরবাসীর।
.
২.০৫
আরও অনেকের মত এ-শহরের আতঙ্ক থেকে পালাবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করছে র্যাঁবেয়া। দিনের পর দিন বিভিন্ন অফিসে ধরনা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ও। অবশ্য এর ফলে, একটা লাভ হয়েছে, ওর; সময়টা কেটে যাচ্ছে, তাই সাময়িকভাবে হলেও সংকটের চিন্তা থেকে মনটাকে সরিয়ে রাখতে পারছে ও।
এর মাঝেই হঠাৎ একদিন আশার ক্ষীণ আলো দেখতে পেল। ও। প্রিফেক্ট-এর অফিস থেকে একটা ছাপানো ফরম এল ওর কাছে। নিজের পরিচয়, আর আয়ের বর্তমান এবং অতীত উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফরমের শূন্য ঘরগুলো পূরণ করে দিতে হবে। কিন্তু অনুসন্ধান করে র্যাঁবেয়া জানতে পারল এর সঙ্গে ওর শহর ছেড়ে যাবার কোন সম্পর্ক নেই। এই ফরমের উদ্দেশ্য। আলাদা। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তার পরিবারকে খবর দেয়া এবং হাসপাতালে তার চিকিৎসার খরচ মিউনিসিপ্যালিটি না তার আত্মীয়স্বজন বহন করবে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে এই ফরম পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
কিছুই করার থাকল না র্যাঁবেয়ার, ফুঁ মেরে বেড়াতে লাগল এক কাফে থেকে আরেক কাফেয়। সকালবেলায় বারান্দায় বসে দৈনিক কাগজের পাতা উল্টায়। মনে মনে আশা করে এমন কোন ইঙ্গিত খুঁজে পাবে যা থেকে মনে হবে আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে সঙ্কট। কখনও কখনও দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে পথচারীদের মুখ দেখে। কিন্তু একটানা বিষণ্ণ চেহারা দেখে দেখে মুখ ফেরাতে বাধ্য হয় সে। এরপর দোকানের সাইনবোর্ড এবং বিজ্ঞপ্তিগুলো পড়া শেষ করে নেমে পড়ে শূন্য রাস্তায়। এভাবে দুপুরের রোদে নির্জন রাস্তায় ঘোরা তার কোন কাপে বা রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুঁ দেয়, এইভাবে সময় কাটিয়ে দেয় সন্ধ্যে পর্যন্ত।
একদিন সন্ধ্যায়, রিও ওকে এক কাফের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে দেখল, যেন ঢুকবে কিনা সে ব্যাপারে মনস্থির করতে পারছে না। অবশেষে ভৈতরে ঢুকে পিছন দিকের একটা টেবিলে বসল ও। তখন ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে সন্ধ্যার। ধূসরতা; দেয়ালের আয়নাগুলোয় কাঁপছে অস্তাচলগামী সূর্যের লালিমা; ঘনায়মান অন্ধকারে ঝকঝক করছে শ্বেতপাথরের টেবিলগুলো। নির্জন ঘরে ছায়ার মত বিষণ্ণ হয়ে বসে রইল র্যাঁবেয়া। দুশ্চিন্তায় মুখখানা করুণ দেখাচ্ছে। রিও ভাবল, এইসব মুহূর্তে নিশ্চয় ভীষণ নিঃসঙ্গ বোধ করে ও।
কখনও কখনও এ-সময়টায় স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা করে র্যাঁবেয়া। বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দেয় ট্রেনের টাইম টেবিল, প্ল্যাটফর্মের ওপর থুতু ফেলা নিষেধ এবং যাত্রীসাধারণের চলাফেরা সম্পর্কে বিভিন্ন নির্দেশ-পড়ে পড়ে। এগুলো পড়া শেষ হলে ওয়েটিং রুমে নির্বিকারভাবে বসে থাকে ও। ওই কামরার ঠিক মাঝখানে, একটা লোহার পুরানো স্টোভ রয়েছে। বেশ কয়েক মাস ওতে আগুন জ্বলেনি, গায়ে চায়ের ছোপ ছোপ দাগ। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে রঙ-চঙে পোস্টার, তাতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ক্যানেস বা ব্যান্ডলে অবসর কাটানোর।
ওয়েটিং রুমের নির্জন কোণে বসে এক ধরনের স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করে র্যাঁবেয়া। ওর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে প্যারিসের পুরানো জীবনের কথা। আগে কখনও র্যাঁবেয়া অনুভব করেনি ওই জীবনকে সে কত ভালবাসে।
.
২.০৬
ফাদার প্যানালু বক্তৃতা দেয়ার পরদিন থেকেই শহরে আরম্ভ হলো। উৎকট গরম। সূর্য যেন উঠে এল বাড়িঘরের মাথার ওপর, আর সেখান থেকে ছাড়াতে লাগল আগুনের হল্কা। একদিন সারাক্ষণ বইল লু হাওয়া। শুকিয়ে ঠনঠনে হয়ে উঠল শহরের সব দেয়াল। একমাত্র বাড়ির ভেতরে ছাড়া, শহরের বাসিন্দাদের প্রতিটি অলিগলি, এমনকি প্রতিটি নির্জন স্থানেও অনুসরণ করতে লাগল সূর্য। যেখানে পেল সেখানেই আঘাত হানল ওদের ওপর।
প্লেগের আক্রমণও বেড়ে গেল আশ্চর্যজনকভাবে। প্রথম সপ্তাহে। মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল সাতশোর কাছাকাছি। শহরে নেমে এল গভীর অবসাদ। শহরতলির দীর্ঘ রাস্তা আর সিঁড়ি থেকে হারিয়ে গেল প্রাণের চিহ্ন। প্রতিটি বাড়ির দরজাই সব সময় বন্ধ অবস্থায় দেখা যায় এখন, জানালাগুলো খোলা থাকলেও সেগুলোতে, ঝোলে পর্দা। মাঝে মাঝে কোন কোন বাড়ি থেকে ভেসে আসে আকস্মিক কান্নার শব্দ, আর্তনাদ। প্রথম প্রথম বাড়ির বাইরে রীতিমত ভিড় জমে উঠত লোকজনের। সবাই জানার চেষ্টা করত কী ঘটেছে? কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই বিপর্যয়ের মাঝে বাস করতে করতে সবার মন কঠিন হয়ে উঠল। এখন কেউই আর ওই ধরনের দৃশ্যে কিংবা শব্দে বিচলিত বোধ করে না, খুব সহজে পাশ কাটিয়ে যায়। করুণ আর্তনাদকে ওদের মনে হয় মামুলি কোন কথাবার্তা।
শহরের ফটকের সামনে প্রতিদিন মারামারি হয়। তা ঠেকানোর জন্যে পুলিসকে অনেক সময় আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়। এই সংঘর্ষের ফলে নিয়মিত কেউ না কেউ আহত হচ্ছেই। শুধু ফটকের সামনেই নয় শহরের সবখানে বিরাজ করছে একটা থমথমে উত্তেজনা।
তাই, পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্যে বন্দোবস্ত করা হলো। এক নতুন ধরনের পাহারার। রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে আরম্ভ করল অশ্বারোহী পুলিস; নুড়িবিছানো শূন্য রাস্তায় শোনা যেতে লাগল ঘোড়ার খুরের শব্দ। আর মাঝে মাঝে শোনা যায় গোলাগুলির আওয়াজ। রোগের সংক্রমণ যাতে ছড়াতে না পারে সেজন্যে শহরের সমস্ত কুকুর আর বেড়াল মারার একটা ব্রিগেড তৈরি করা হয়েছে; গোলাগুলির আওয়াজ ওই ব্রিগেডের কর্মতৎপরতার ফল।
আরও একটি কারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল শহরবাসীরা। সবাই। আশঙ্কা করছে গ্রীষ্মকালে মহামারীর প্রকোপ আরও বেড়ে যাবে। আর গ্রীষ্ম যে এসে গেছে চারদিকে তার ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে সুস্পষ্টভাবে। ছাদের ওপর ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে চামচিকের সংখ্যা, সেই সঙ্গে চিঁ-চিঁ চিৎকার।
জাঁ তারিউ তখনও লিখে যাচ্ছে ওর ডাইরি। প্লেগের দুরবস্থার কথা বর্ণনা করতে করতে এক জায়গায় ও মন্তব্য করল: যেদিন থেকে বেতারে মূতের সাপ্তাহিক সংখ্যা ঘোষণার বদলে রোজকার সংখ্যা ঘোষণা শুরু হলো, সেদিন থেকে মহামারীর এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়েছে; মনে হচ্ছে সংবাদপত্র এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ প্লেগের সঙ্গে এক ফুটবল প্রতিযোগিতা খেলতে নেমেছেন; কেননা শুধু মাত্র সংখ্যা দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, দিনে। একশো ত্রিশটি মৃতের সংখ্যা সাপ্তাহিক নশো দশটি মৃত্যুর চেয়ে অনেক কম; সুতরাং তারা ভেবে আনন্দ পাচ্ছেন, এ প্রতিযোগিতায় তারাই জিতেছেন।
এছাড়াও, মহামারীজনিত যেসব অপ্রত্যাশিত বা চমকপ্রদ ঘটনা। পথচলতি চোখে পড়ছিল তারিউ-এর সেগুলোরও উল্লেখ আছে ওর ডাইরিতে। যেমন একদিন, এক জনশূন্য রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে ও, এমন সময় ঠিক ওর মাথার ওপর তিনতলার এক অন্ধকার, শোবার ঘরের জানালা আকস্মিকভাবে খুলে গেল এবং তার ভেতর থেকে একজন মহিলা বার দুই চিৎকার করার পর জানালাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল তেমনিভাবে।
তারিউ ওর ডাইরির আর এক জায়গায় লিখেছে: হঠাৎ শহরের সমস্ত দোকান থেকে পিপারমেন্ট লজেন্স উধাও হয়ে গেল, কারণ মানুষ বিশ্বাস করে এই লজেন্স মুখে রাখলে প্লেগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
আগের মতই সামনের বারান্দায় ওর সেই প্রিয় প্রাণীটির গতিবিধি লক্ষ্য করে যাচ্ছে ও। তারিউ-এর মনে হলো, দুর্ভাগ্য এই অবলা-পশু শিকারীকেও স্পর্শ করেছে। একদিন সকালে রাস্তায় বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল; গুলির আঘাতে বেশির ভাগ বেড়ালই মারা পড়ল, বাকিগুলো উধাও হয়ে গেল প্রাণের ভয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন ছোটখাট শরীরের বুড়ো মানুষটা। তার মুখে দেখা গেল বিস্ময়ের ভাব, শেষে রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে পড়ে এদিকে-ওদিকে তিনি খুঁজতে লাগলেন বেড়ালগুলোকে। এইভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হাতে যে কয়েক টুকরো কাগজ ছিল সেগুলোকে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ভদ্রলোক ফিরে গেলেন ঘরে। তারপর আবার ফিরে এলেন। বারান্দায়, এবার আগের চেয়ে বেশি সময় অপেক্ষা করে ফের চলে গেলেন ঘরে ঢুকেই বন্ধ করে দিলেন সমস্ত জানালা। এক সপ্তাহ ধরে এই কাণ্ডই করলেন বৃদ্ধ। যতই দিন যেতে লাগল তাঁর চেহারায় ফুটে উঠল কেমন একটা বিষাদ আর হতবুদ্ধির ভাব। আট দিনের দিন তাকে আর দেখা গেল না, শহরের আর সকলের মত তিনিও বন্ধ করে রাখলেন জানালা।
জাঁ তারিউ তার ডাইরিতে লিখেছে: রোজ সন্ধ্যায় বাইরে থেকে হোটেলে ফেরার পর চোখে পড়ে হোটেলের দারোয়ান বন্দুক হাতে প্রহরীর মত গেটের এমাথা-ওমাথা পায়চারি করছে। কারও সঙ্গে, কথা হলেই লোকটা বলে, এসব যে ঘটবে তা সে আগেই জানত। আমি ওকে মনে করিয়ে দিলাম, সে ভূমিকম্প সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ও বলে উঠল, এর চেয়ে ভূমিকম্প হলেই ভাল, হত, একবারেই সবকিছু ওলট-পালট করে দিত।
হোটেলের ম্যানেজারকেও হতাশাগ্রস্ত, বিষণ্ণ দেখায়। মহামারীর প্রথম দিকে যারা বাইরে থেকে এসে হোটেলে উঠেছিল, শহর ছেড়ে যাবার কোন উপায় নেই দেখে তাদের অনেকেই হোটেলে থেকে গিয়েছিল। কিন্তু ওরা যখন দেখছে প্লেগ কমার! কোন লক্ষণই নেই, তখন সবাই, একে একে, বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের বাসায় উঠে যাচ্ছে। যে দুএকজন হোটেলে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছে আমি তাদের একজন। আমার সঙ্গে দেখা হলেই ম্যানেজার বলেন, অতিথি ভদ্রলোকদের কাউকে তিনি অসুবিধায় ফেলতে চান না, নাহলে অনেক আগেই হোটেল বন্ধ করে দিতেন। তিনি প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, মহামারী কতদিন ধরে চলবে বলে আমার ধারণা? আমি বলি, লোকে বলে শীতে এসব রোগ আপনা থেকেই বিদায় নেয়। শুনে উনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। বলেন, কিন্তু আমাদের এখানে তো তেমন শীত পড়ে না।
কদিন অনুপস্থিতির পর হোটেলে আবার দেখা গেল প্যাঁচামুখো ভদ্রলোককে। সঙ্গে দম-দেয়া পুতুলের মত নড়াচড়া করছে ছেলেমেয়ে দুটি। কিন্তু ওর স্ত্রী আসেননি। শুনতে পেলাম তার মা প্লেগে আক্রান্ত, তাই তাঁর সেবাশুশ্রূষা নিয়ে তিনি ব্যস্ত। ম্যানেজার এই পরিবারটির হোটেলে আসাটাকে ভাল চোখে দেখেন না। বলেন, এই পরিবারের সবাইকে তিনি সন্দেহ করেন। কিন্তু মি. অথন তার এতদিনের অভ্যাস প্লেগের ভয়ে পরিত্যাগ করেননি। আগের মতই নিজের স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে বসেন খাবার টেবিলে। ছেলেমেয়ে দুটো বসে সামনে। উদাসীন কণ্ঠে তিনি ওদের আচার-আচরণ নিয়ে কথা বলেন, উপদেশ দেন। দারোয়ানও মি. অথনকে পছন্দ করে না। আমাকে ও প্রায়ই বলে, এই যে ফিটফাট ভদ্রলোকটাকে দেখছেন, মরবার সময়ও উনি অমনি সাজগোছ নিয়েই মরবেন, ভাবখানা এমন যেন জামাজুতো পরে তৈরি হয়েই আছেন, এখন শুধু ডাক এলেই হয়, আবার যে কেউ ওকে অন্য কাপড় পরাবে সে সুযোগ উনি দেবেন না।
একদিন ডাক্তার রিও-র সঙ্গে বেড়াতে গেলাম ওর হাঁপানি রোগীর বাসায়। আমাকে অভ্যর্থনা জানাবার সময় হাত দুটো কচলাতে শুরু করলেন ভদ্রলোক, এটাই তাঁর চিরদিনের অভ্যেস। বৃদ্ধ তখন তার বিছানায় শুয়ে ছিলেন, বরাবর যেমন থাকে তেমনি তাঁর সামনে রাখা ছিল দুটো মটরদানা ভর্তি পাত্র। আমাকে দেখে মৃন্তব্য করলেন, এই যে আরও একজন এসেছেন, পৃথিবীতে সবকিছুই উল্টে-পাল্টে গেছে দেখছি, এখন দেখছি রোগীর চেয়ে ডাক্তারের সংখ্যাই বেশি।
ওই বৃদ্ধ একজন ব্যবসায়ী। পঞ্চাশে পা দিয়ে তিনি অনুভব করলেন একজন মানুষের জীবনে যতটুকু পরিশ্রম করা প্রয়োজন ইতিমধ্যে তিনি তার সবটুকু সেরে ফেলেছেন। তারপর থেকে বিছানা নিয়েছেন তিনি।
সামান্য একটা বাঁধা আয় তাঁর আছে, আর সেটাই সম্বল করে তিনি তার এতদিনের খরচপত্র চালিয়ে এসেছেন। এখন তাঁর বয়েস পঁচাত্তর। ঘড়ি একদম সহ্য করতে পারেন না। তাঁর মতে, ঘড়ি মূর্খদের প্রয়োজন, অথচ দামও অনেক। তিনি সময় হিসেব করেন। দুটো পাত্রে রাখা মটরদানার সাহায্যে। সকালে তাঁর সামনে দুটো পাত্র রাখা হয়; একটা মটরদানায় ভর্তি, অন্যটা খালি। ঘুম থেকে উঠেই তিনি ভর্তি পাত্রটা থেকে মটরদানা তুলে খালি পাটাতে রাখতে শুরু করেন। এইভাবে দুটো পাত্র আর মটরদানার সাহায্যে সময় নির্ণয় করেন তিনি। পরপর পনেরোবার ভরা শেষ হলে দুপুরের খাবার সময় হয় তার। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, স্রষ্টা বলে কেউ নেই বোধহয়, থাকলে পাদ্রিদের থাকার প্রয়োজন হত না।
শুধু ডাইরিই নয়, প্লেগ-আক্রান্ত জীবনযাত্রার এক দীর্ঘ রচনায় হাত দিয়েছিল জঁ তারিউ। ভূমিকায় লেখা আছে: মাতাল ছাড়া। এখন আর এই শহরে কাউকে হাসতে দেখা যায় না; আর হাসতে আরম্ভ করলে তাদের কোন মাত্ৰাজ্ঞান থাকে না।
একদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে ও লিখেছে: সকাল থেকে রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ নির্জন। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। সারারাত ধরে। প্লেগ তার শিকারের পালা শেষ করে নতুন করে শিকার ধরার আগে এই ফাঁকটুকুতে একটু বিশ্রাম নেয়। চারপাশের দোকানগুলোতে নোটিস ঝুলছে প্লেগের জন্যে বন্ধ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে শুয়ে আছে ভিক্ষুকের দল। ঘুমের ভেতর মানুষ যেমন হাঁটে, তেমনিভাবে খবরকাগজ হাতে এগিয়ে যাচ্ছে হকাররা। একটু পরে শুরু হলো ট্রাম চলাচল, অমনি সারা শহরে ঘুম থেকে জেগে উঠল প্লেগ। সংবাদপত্রের বড় বড় স্পষ্ট হরফে লেখা প্লেগের শিরোনামে সবাই পড়ল, আজ মৃতের সংখ্যা ১২৪।
এখন শহরে চলাচলের একমাত্র বাহন ট্রাম। ফুটবোর্ডের ওপর যেমন লোক দাঁড়িয়ে থাকে তেমনি ঝোলে হাতল ধরে। ট্রামগুলোর চলতে খুব কষ্ট হয়। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ট্রামের ভেতর প্যাসেঞ্জারেরা পরস্পরের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। উদ্দেশ্য, সংক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচানো। ট্রাম থেকে রাস্তায় নামার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকেই চেষ্টা করে এমন একটা জায়গায় দাঁড়াতে যেখানে তার সঙ্গে নিকটতম ব্যক্তিটির নিরাপদ একটি দূরত্ব বজায় থাকে।
প্রথম ট্রামগুলো চলে যাবার পর আস্তে আস্তে জেগে ওঠে শহর। সকালে যে দোকানগুলোতে ভিড় হয় খুলে যায় সেগুলোর দরজা। কাউন্টারে দেখা যায় অসংখ্য রকমের কার্ড! কোনটায় লেখা-কফির ব্যবস্থা নেই, কোটায়-চিনি সঙ্গে আনবেন।
দুপুরে ভরে যায় সমস্ত রেস্তোরাঁ। যারা বসবার জায়গা পায় না। তারা দাঁড়িয়ে থাকে দরজার সামনে, বাইরের সামিয়ানার তলায়। রেস্তোরাঁয় নোটিস ঝোলানো আছে এখানে প্লেট বাদে, অন্য সব জিনিস, কাঁটাচামচ এগুলো জীবাণুমুক্ত করার জন্যে নিয়মিত ধুইয়ে নেয়া হয়। তাই খাবার সময় দেখা যায় প্রত্যেকে নিজের প্লেট ঠিকমত দেখে শুনে মুছে নিচ্ছে।
সন্ধ্যায়, স্রোতের মত বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকে মানুষ। আর বকবক করতে থাকে। কেউ মেতে ওঠে যুক্তিতর্কে, কেউ তন্ময় হয়ে ডুবে যায় প্রেম বিনিময়ে। শহরের অধিবাসীরা উপলব্ধি করেছে এক কঠিন বিপদ তাদের সামনে অপেক্ষা করছে; তাই ওরা সন্ধ্যায় নিজেদের ডুবিয়ে দিতে চায় সম্পূর্ণ আনন্দ-ফুর্তির মধ্যে, বিকারগ্রস্ত উল্লাসে।
.
২.০৭
আঁ তারিউ-এর ডাইরিতে ডাক্তার রিও-র সঙ্গে ওর একটা সাক্ষাৎকারের উল্লেখ আছে। সাক্ষাৎকারটি নেয়ার জন্যে রিও-র বাসায় যায় সে। তারিউ পৌঁছবার ঠিক আগে রিও ওর মা-র মুখের দিকে তাকাল। খাবার ঘরের এক কোণে বসে আছেন ওর মা। চোখ দুটো পড়ে আছে বাইরে শূন্য রাস্তার ওপর। মহামারীর পর থেকে রাস্তার আলো তিনভাগের দুইভাগ কমানো হয়েছে।
প্লেগ না থামা পর্যন্ত রাস্তায় আলো এমনই থাকবে, না? জিজ্ঞেস করলেন মাদাম রিও।
হ্যাঁ, মা।
রিও দেখল ওর মা-র দৃষ্টি এসে পড়েছে ওর কপালের ওপর।
নিশ্চয় গত কয়েকদিনের অতিরিক্ত খাটুনি আর উৎকণ্ঠার ফলে ওর কপালে ক্লান্তির ছাপ দেখা দিয়েছে।
আজকের দিনটা কেমন গেল? জানতে চাইলেন মা।
আগের মতই।
ঠিকই বলেছে রিও। প্যারিস থেকে আনা নতুন সিরামগুলো আগের সিরামের মত কাজ দিচ্ছে না, ফলে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। রোগীর দেহের কেঁড়াগুলো সহজে ফাটতে চাইছে না। সুপারির মত শক্ত হয়ে উঠছে। এদিকে মহামারী নতুন রূপ নিচ্ছে। প্লেগ থেকে দেখা দিচ্ছে নিউমোনিয়া। ডাক্তারদের পরামর্শে প্রিফেক্ট কিছু নতুন আইন-কানুন প্রবর্তন করেছেন, কিন্তু অবস্থার তাতে কোন পরিবর্তন। হয়নি।
ছোটবেলায় মায়ের বাদামী কোমল চোখের দিকে তাকালে রিও একধরনের ভালবাসা অনুভব করত, আজও মায়ের দিকে চেয়ে ওর স্মৃতির সেই অনুভূতিটি জেগে উঠল।
মা, তুমি ভয় পাও না?
এই বয়সে আর ভয় পাবার কি আছে রে!
আমি ঠিকমত প্রায়ই বাসায় ফিরতে পারি না।
তুই ফিরে আসবি, এটা ভাবলে আমার অপেক্ষা করতে খারাপ লাগে না। আর কোন খবর আছে?
তোমার বউমা ওর শেষ টেলিগ্রামে লিখেছে সবকিছু ঠিকমত চলছে। জানো মা, আমি যাতে উদ্বিগ্ন হয়ে না পড়ি, সেজন্যেই ও অমন লেখে।
দরজায় বেল বেজে উঠল। দরজা খোলার জন্যে এগিয়ে গেল। রিও। তারিউকে একটা ধূসর রঙা প্রকাণ্ড ভালুকের মত দেখাচ্ছে। ওকে বসার জন্যে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল রিও।
তারিউ সরাসরি ওর বক্তব্য শুরু করল। বড়জোর পনেরো দিন কি একমাস, তারপর সবকিছু আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
আমারও তাই মনে হয়।
শুনছি বাধ্যতামূলকভাবে সবল দেহের সব মানুষকেই নাকি মহামারী প্রতিরোধের কাজে সাহায্য করতে হবে?
কর্তৃপক্ষ তাই ভাবছেন, কিন্তু লোকে ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখবে না।
তাহলে স্বেচ্ছাসেবকের আহ্বান জানাতে পারেন।
হয়েছে, কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি।
সেটা তো সরকারিভাবে করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের ও দায়িত্ব দেয়া উচিত।
কী করতে বলেন আপনি এই অবস্থায়?
যারা স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে চায়, এমন কিছুসংখ্যক মানুষকে নিয়ে কয়েকটা দল গড়ে তোলার একটা প্ল্যান তৈরি করেছি আমি। প্ল্যানটাকে যাতে কার্যকর করা যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে আপনাকে।
নিশ্চয়ই। কর্তৃপক্ষকে দিয়ে আপনার প্ল্যান অনুমোদন করিয়ে নেয়ার সমস্ত দায়িত্ব আমার। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চয় আপনার অজানা নেই, এই কাজে যারা সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে চায়, তাদের নিজেদের জীবন বিপন্ন হবারও কিছুটা আশঙ্কা রয়েছে তাতে। আপনি এই বিপদের সম্ভাবনা ভালভাবে চিন্তা করে দেখেছেন তো?
এই মুহূর্তে আমি শুধু এইটুকু জানিঃ শহরে বহুলোক অসুস্থ, তাদের চিকিৎসা এবং সেবার প্রয়োজন। আমি তাদের রক্ষা করার জন্যে সাধ্যমত চেষ্টা করছি। আমার জন্য এটুকুই কি যথেষ্ট নয়?
তারিউ কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টে চেয়ে রইল রিও-র মুখের দিকে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। রিও অনুসরণ করল ওকে।
রাস্তায় নেমে ওদের মনে হলো, অনেক রাত হয়েছে, এগারোটা বাজে বোধহয়। একটা অস্পষ্ট খসখসে শব্দ ছাড়া শহরের চারদিক শান্ত। দূরে, শোনা যাচ্ছে একটা অ্যাম্বুলেন্সের ঘণ্টার ক্ষীণ শব্দ। দুজনে গাড়িতে ঢুকল, এঞ্জিন স্টার্ট দিল রিও।
কাল একবার হাসপাতালে আসবেন। এই দুঃসাহসিক কাজে নামার আগে একটা ইনজেকশন দেব আপনাকে। মনে রাখবেন, আপনার মৃত্যুর আশঙ্কা তিন আর বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র এক।
প্রায় একশো বছর আগে প্লেগের আক্রমণে পারস্যের এক শহরে সমস্ত লোক নির্মূল হয়ে যায়, বেঁচেছিল শুধু একজন। ওই মানুষটির কাজ ছিল প্লেগে যারা মারা যেত তাদের গোসল এবং দাফন করা।
.
২.০৮
পরের দিন থেকেই কাজ শুরু করে দিল তারিউ। কিছু সংখ্যক লোককে নিয়ে গড়ে তুলল একটা স্যানিটারি দল। পরে, ওর পরিচালনায় আরও এই ধরনের অনেক দল গড়ে উঠল। এই স্কোয়াডগুলো শহরবাসীদের দুর্যোগ মোকাবিলায় সাহায্য করল, সেই সঙ্গে তাদের মনে এই উপলব্ধিও জাগাল, প্লেগকে পরাজিত করার জন্যে যা কিছু করা দরকার তার সবটাই নির্ভর করছে তাদের ওপর।
ঠিক এই সময়ে শহরে এক শ্রেণীর নীতিবাগিশ গজিয়ে উঠল। তারা প্রচার করতে শুরু করল, মহামারীর বিরুদ্ধে করার কিছুই নেই, এটাকে মেনে নিতে হবে। জাঁ তারিউ, রিও এবং ওদের বন্ধু বান্ধবরা অবশ্য অটল রইল নিজেদের সিদ্ধান্তে। সে-সময়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ হয়ে উঠল, আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা, আর খুব বেশি লোক যাতে তাদের প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না পারে তার উপযোগী ব্যবস্থা নেয়া। এবং ওরা তাই করে চলল।
ডাক্তার ক্যাসেলও ওই অবস্থায় সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজটি। করতে এগিয়ে এল। হাতের কাছে যেসব যন্ত্রপাতি পেল সেগুলো দিয়েই অটল বিশ্বাসে প্রস্তুত করতে লাগল সিরাম, নিজের শরীরের দিকে ক্রুক্ষেপ না করে।
গ্রাঁদও সোৎসাহে স্যানিটারি স্কোয়াডে সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতে এগিয়ে এল। এতটুকু ইতস্তত করতে দেখা গেল না ওকে। শুধু একটাই অনুরোধ করল সে, একটু হালকা ধরনের কাজ যেন দেয়া হয় তাকে, কারণ এই বয়েসে কঠিন কাজ করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ওকে কাজ দেয়া হলো রিপোর্ট প্রস্তুত করা এবং পরিসংখ্যান রাখার। * কোন কোন দিন সন্ধ্যায় রিপোর্ট প্রস্তুত করা এবং পরিসংখ্যানের কাজ শেষ হয়ে যায়। তখন গ্রাঁদ আর রিও গল্প জুড়ে দেয়। কিছুদিন পরে তারিউও ওদের গল্পে যোগ দিতে লাগল নিয়মিতভাবে। এখন আগের চেয়ে অনেক সহজভাবে এ দুই বন্ধুর কাছে জীবনের সুখ-দুঃখের গল্প করে গ্রাঁদ।
আপনার সেই অশ্বারোহিণী ভদ্রমহিলা কতদূর এগুলো? তারিউ মাঝেমাঝে জিজ্ঞেস করে গ্রাঁদকে। গ্রাঁদ হেসে জবাব দেয়, ঘোড়া কদমে চলেছে। সত্যিই। একদিন সন্ধ্যায় গ্রাঁদ ঘোষণা করল, আমি আমার অশ্বারোহিণী নায়িকার আগে রুচিসম্পন্না এক যুবতী শব্দগুলো ব্যবহার না করে তন্বী শব্দটি ব্যবহার করব।
কিছুদিন পর প্রকাশ পেল, অফিসের কাজে অমনোযোগী হয়ে, উঠেছে গ্রাঁদ। একদিন, দফতরের প্রধান ওকে ডেকে ভীষণ ধমকালেন। আসলে গ্ৰাঁদ ক্রমেই পরিশ্রান্ত এবং দুর্বল হয়ে পড়ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ও স্যানিটারি স্কোয়াডের জন্যে পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা, অফিসের হিসেবপত্র ঠিক রাখা, এসব কাজগুলো ঠিকমত করে। যাচ্ছিল।
.
২.০৯
র্যাঁবেয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিছুতেই প্লেগের কাছে পরাভব মানবে না। এবং তার জন্যে সংগ্রামও করছিল ও। যখন বুঝতে পারল ও বৈধ উপায়ে শহরের বাইরে যাওয়া সম্ভব হবে না, তখন ঠিক করল ভিন্ন রাস্তায় চেষ্টা করতে হবে।
প্রথমে ও যোগাযোগ করল বিভিন্ন কাফের ওয়েটারদের সঙ্গে। প্রতি শহরেই দৃষ্টির আড়ালে কোথায় কী ঘটছে তার খবর রাখে কাপের ওয়েটাররা।
প্রথমে যার সঙ্গে ওর কথা হলো সে জানাল পালাবার চেষ্টা করলে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। পরে অন্য একটা কাফের ওয়েটাররা ওকে চর ভেবে বসল, এবং বের করে দিল কাফে থেকে।
একদিন রিও-র বাসায় এ নিয়ে কথা বলছে র্যাঁবেয়া, এমন সময় সেখানে এল কার্ড। ওদের কথাবার্তা শুনে ফেলল ও। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ কটার্ড-এর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলো স্নাবেয়া-র। বেশ আন্তরিকতার সাথে ওকে অভ্যর্থনা জানাল কটার্ড।
এই বইটি বাংলাপিডিএফ-নেট এর সৌজন্যে নির্মিত। বইটি ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই এর একটি কপি আপনার নিকটবর্তী বুকস্টল অথবা হকারের কাছ থেকে আজই সংগ্রহ করবেন। লেখক অথবা প্রকাশনা সংস্থার কোন ক্ষতি হোক, তা আমরা চাই না।
আরে র্যাঁবেয়া যে। এখনও কিছু করতে পারেননি মনে হচ্ছে।
না, কিছুই না।
এরপর কটার্ড যা বলল তাতে থ হয়ে গেল র্যাঁবেয়া। কিছুদিন হলো শহরের বিভিন্ন কাফেতে ঢু মেরে বেড়ানোই কটার্ড-এর একমাত্র কাজ হয়ে উঠেছে। এতে বেশ কিছু লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে ওর। তাদের কাছ থেকে ও জানতে পেরেছে লোক পাচার করার একটা সংস্থা নাকি শহরে আছে।
সত্যিই আপনি খবর দিতে পারবেন? জিজ্ঞেস করল র্যাঁবেয়া।
অবশ্যই। এরকম একটা প্রস্তাব এসেছিল আমার কাছে।
ওদের সাথে যোগাযোগ করার উপায় কী?
সেটা অবশ্য খুব সহজ নয়। আচ্ছা, আসুন দেখি আমার সঙ্গে।
তখন বিকেল চারটা। মাথার ওপর গুমোট আকাশ। অসহ্য গরম পড়েছে। পথেঘাটে, কোথাও প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই। দোকানপাটের সামনে পর্দা টানানো। ছায়াঘেরা একটা রাস্তা ধরে বেশ কিছুদূর নীরবে হাঁটল ওরা দুজন।
র্যাঁবেয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে কটার্ড বলল, রাস্তায় কুকুর। চোখে পড়ছে না। সাধারণত এ-সময় কুকুরগুলোকে দেখা যায় দরজার সামনে ক্লান্তভাবে গড়াতে, এবং লম্বা জিভ বের করে হাঁফাতে,
দুজনে বুলেভার্দে দ্য পালামিয়ার সামনে দিয়ে এগিয়ে, প্যালেস দ্য আর্মসকে পিছনে ফেলে আরও কিছুদূর হাঁটার পর মোড় নিল ডকইয়ার্ডের দিকে। বাঁ হাতে পড়ল সবুজ রঙের একটা কাফে। সামনে একটা হলুদ রঙের সামিয়ানা টানানো। একেবারে রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছে সামিয়ানাটা।
ভেতরে ঢুকে কপালের ঘাম মুছল ওরা। চারপাশে কয়েকটা টেবিল। সেগুলোও সবুজ রঙের। ভেতরে কোন লোক নেই। ভনভন করছে, মাছি। মদ বিক্রির কাউন্টারে বসে আছে একটা তোতা পাখি। দেয়ালে ঝুলছে মাকড়সার জালে ঢাকা কতকগুলো পুরানো ছবি।
প্রত্যেকটা টেবিলে পাখির শুকনো বিষ্ঠা ছড়ানো। র্যাঁবেয়া ভাবছে এগুলো এল কোত্থেকে, এই সময়ে ঘরের এক অন্ধকার কোণ থেকে ডানা ঝাঁপটিয়ে লাফাতে লাফাতে ওর সামনে এসে দাঁড়াল সুন্দর একটা মোরগ।
কটার্ড গা থেকে কোট খুলে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে, বারকয়েক জোরে জোরে ঘা দিল টেবিলে। খুলে গেল পিছনের দরজাটা। বেরিয়ে এল গলাবন্দ নীল অ্যাপ্রন পরা এক লোক। বেঁটে। প্রায় চিৎকার করে কার্ডকে অভিবাদন জানাল ও। লাথি মেরে মোরগটাকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় নিজে এসে দাঁড়াল। ওর গলার জলদগম্ভীর আওয়াজে চাপা পড়ে গেল মোরগটার কঁক কঁ শব্দ। মদের ফরমাশ দিয়ে কটার্ড জানতে চাইল, গ্রাসিয়া কোথায়? বামন জানাল, গত কয়েকদিন থেকে গ্রাসিয়াকে কাফেতে দেখা যায়নি।
আজ সন্ধ্যায় আসবে?
কী করে বলি। সে কি তার সব গোপন কথা আমাকে জানায়। আপনিই তো ভাল জানেন কখন আসবে বা আসবে না।
না, তা নয়। আমি আমার এই বন্ধুর সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
বামন ওদের পাশে বসে ভেজা হাত দুটো পরনের অ্যাপ্রনে মুছল।
এই ভদ্রলোকও আপনার মত ব্যবসা করে?
হ্যাঁ। সংক্ষেপে জবাব দিল কার্ড।
দেখা যাক। সন্ধ্যার দিকে একবার আসুন। ছেলেটাকে দিয়ে। ওকে না হয় খবর পাঠাব।
কাফে থেকে বেরিয়ে র্যাঁবেয়া কটার্ড-এর কাছে জানতে চাইল, লোকটা কিসের ব্যবসার কথা বলছিল?
চোরাচালানের কথা। ফটকের পাহারাদারকে ফাঁকি দিয়ে কিছু জিনিস ওরা শহরের ভেতর পাচার করে। এতে প্রচুর টাকা।
বুঝলাম। তাহলে কোর্ট-কাছারিতে নিশ্চয় ওদের অনেক জানাশোনা লোক আছে।
ঠিক ধরেছেন।
সন্ধ্যার দিকে কাফেতে ফিরে ওরা দেখল সামিয়ানা গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। খাঁচার ভেতর চেঁচাচ্ছে তোতা পাখিটা। লোকজনের ভিড় জমে উঠেছে টেবিলগুলোর চারপাশে। কিন্তু কারও গায়েই শার্ট ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ছে না। কটার্ডকে দেখেই একজন উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। ওর শার্টের বোতাম সব ভোলা। বুকের প্রায়। সবটাই দেখা যাচ্ছে, লাল ইটের মত রঙ। মার্থায় শোলার টুপি। রোদে পোড়া মুখটা তামাটে রঙের। চোখ দুটো ছোট, রঙ কালো। দাঁতগুলো সাদা ঝকমকে। আঙুলে তিনটি আংটি। নাকটা বেশ মোটা। মুখটা ভরাট। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। এরই নাম গ্রাসিয়া।
বাহ, র্যাঁবেয়ার উপস্থিতি উপেক্ষা করে কটার্ডকে বলল গ্রাসিয়া, চলুন, দুএক গ্লাস টানা যাক।
ওরা নীরবে বসে মদ্যপান করল। চলুন, একটু বাইরে হাঁটি, প্রস্তাব করল গ্রাসিয়া।
তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে বন্দরের দিকে এগোল। গ্রাসিয়া জানতে চাইল, কাজটা কী ধরনের? কটার্ড বলল, র্যাঁবেয়া শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে চায়। সিগারেট টানতে টানতে আগে আগে হাঁটছে গ্রাসিয়া। র্যাঁবেয়া সম্পর্কে ও কিছু প্রশ্ন করল।
কেন, পালাতে চান কেন?
ওর স্ত্রী ফ্রান্সে থাকে।
কী করেন ভদ্রলোক?
সাংবাদিকর্তা।
এখনও? সাংবাদিকরা কিছু গোপন রাখতে পারে না।
আগেই বলেছি, উনি আমার বন্ধু।
হাঁটতে হাঁটতে জেটির কাছাকাছি এসে পড়ল ওরা। চারপাশে বেড়া, ঢোকার পথ বন্ধ। মোড় নিয়ে এবার ওরা এগিয়ে গেল একটা তাড়িখানার দিকে। মাছ ভাজার গন্ধ ভেসে আসছে ওখান থেকে।
যা হোক, বলল গ্রাসিয়া, এ-ব্যাপারে সরাসরি আমি সাহায্য করতে পারব না। রাউল এজন্যে উপযুক্ত লোক। কথা বলে দেখব। কাজটা কিন্তু সোজা নয়।
বেশ, আগ্রহ দেখাল কার্ড।
গ্রাসিয়া আর কিছু বলল না। তাড়িখানায় ঢোকার আগে থামল ও। এবং এই পথম সরাসরি সমোধন করল র্যাঁবেয়াকে।
পরশু বেলা এগারোটায় শহরের উপকণ্ঠে, কাস্টমস ব্যারাকের সামনে দেখা হবে, এই বলে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল গ্রাসিয়া, কিন্তু পরক্ষণে হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে এ-ভাবে বলল, মনে রাখবেন, কিছু মালকড়ি খরচ করতে হবে।
জানি, সম্মতি জানাল র্যাঁবেয়া।
দুদিন পর। শহর থেকে যে বড় রাস্তাটা বাইরে চলে গেছে সেই রাস্তায় দেখা গেল কার্ড আর র্যাঁবেয়াকে। পথের দুপাশে কোন গাছপালা নেই। কাস্টমস ব্যারাকের একটা অংশকে রূপান্তরিত করা হয়েছে হাসপাতালে। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু লোক, হয়তো রোগী দেখার অনুমতির জন্যে অপেক্ষা করছে।
আমি ঠিক বুঝছি না, আপনি বাইরে যেতে চাইছেন কেন? এখানে তো বেশ কৌতূহল জাগানোর মত ব্যাপার ঘটছে, বলল কটার্ড।
না, এ-সব ব্যাপারে আমার কোন কৌতূহল নেই, জানাল র্যাঁবেয়া।
অবশ্য থাকলে বিপদের ঝুঁকি আছে।
ঠিক তখুনি রিও-র গাড়ি এসে থামল ওদের পাশে। গাড়ি চালাচ্ছে তারিউ, ঘুম-ঘুম চোখে বসে আছে রিও। র্যাঁবেয়াকে শহরে পৌঁছে দিতে চাইল তারিউ।
ধন্যবাদ। এখানে একজনের সঙ্গে দেখা করব, বলল র্যাঁবেয়া।।
ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিও। সত্যিই, দেখা করব একজনের সঙ্গে, নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করল র্যাঁবেয়া।
ডাক্তার সাহেবও ব্যাপারটা জানেন নাকি? কটার্ড বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল।
আস্তে। ওই যে মাজিস্ট্রেট দাঁড়িয়ে আছে, কটার্ডকে বলল তারিউ।
নিমেষে বদলে গেল কটার্ড-এর চাহনি। দ্রুত পায়ে হেঁটে এলেন এম অথন। কাছে এসে টুপি নামালেন মাথা থেকে। সুপ্রভাত। জানাল তারিউ। ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমে অভিবাদন জানালেন গাড়ির ভেতরের দুজনকে, তারপর রাস্তায় দাঁড়ানো দুজনের দিকে ফিরে সামান্য একটু মাথা নোয়ালেন। এম অথন-এর সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল তারিউ। আকাশের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অথন। তারপর মন্তব্য করলেন, সত্যি, বড় দুঃসময় যাচ্ছে। মঁসিয়ে তারিউ, আপনার কাজ সত্যিই এক মহৎ দৃষ্টান্ত। আচ্ছা, ডাক্তার, মহামারী কি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে?
রিও বলল, প্রত্যেকেরই কামনা করা উচিত এর চেয়ে খারাপ কিছু ঘটবে না।
তারিউ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জানতে চাইল, আপনার কাজ-কর্ম কি এখন বেড়ে গেছে?
যা ভাবছেন ঠিক তার উল্টো। মারাত্মক ক্রিমিন্যাল কেসগুলো কমে এসেছে। আইন-কানুন মানুষ এখন অনেক ভালভাবে মেনে চলে।
চলে গেলেন অথন। গাড়িতে স্টার্ট দিল তারিউ। কিছুক্ষণ পর কটার্ড এবং র্যাঁবেয়া লক্ষ করল ওদের দিকে এগিয়ে আসছে গ্রাসিয়া। কাছে এসে বলল, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
চারপাশের ভিড়ের ভেতর মেয়েমানুষের সংখ্যাই বেশি। প্রত্যেকের হাতে পুটুলি। আশা করছে হয়তো জিনিসটা পৌঁছে দিতে পারবে অসুস্থ স্বজনের কাছে। ব্যারাকের ফটকে সশস্ত্র পাহারা। ব্যারাক আর ফটকের মাঝখানে একটা আঙিনার মত। সেখান থেকে কিছুক্ষণ পর পর শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত ভূতুড়ে চিৎকার। ভিড় জমানোলোকজন তখন উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ভেতরের রোগীদের ওয়ার্ডের দিকে।
ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওইসব দেখতে লাগল। খানিক, বাদে ওদের পিছনে এক কণ্ঠস্বর সুপ্রভাত বলতেই একসঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল তিনজনেই। এত গরমেও রাউল-এর পরনে কালো সুট, মাথায় ফেল্ট ক্যাপ। সুগঠিত দীর্ঘ দেহ ওর। চেহারাটা কেমন বিমর্ষ। ঠোঁটজোড়া না নড়িয়ে খুব দ্রুত আর পরিষ্কার ভাষায় বলল, চলুন, একটু সেন্টারের দিকে হাঁটা যাক। গ্রাসিয়া, তোমাকে আর দরকার নেই।
একটা সিগারেট ধরিয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে রইল গ্রাসিয়া। ওরা তিনজন হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। র্যাঁবেয়া আর কটার্ড দুপাশে, মাঝখানে রাউল।
গ্রাসিয়া আমাকে সব বলেছে, বলল রাউল, ব্যবস্থা একটা হতে পারে। কিন্তু আগেই বলছি, পুরো দশ হাজার লাগবে।
আমি রাজি, জানাল র্যাঁবেয়া।
ডকের কাছাকাছি একটা স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ আছে। কাল দুপুরে ওখানে আমরা খাব।
র্যাঁবেয়া বলল, বেশ। তাই হবে। এই প্রথম হাসল রাউল। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করল। ও চলে যাবার পর কটার্ড বলল, কাল দুপুরে আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারব না। একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আর তাছাড়া, আমাকে আপনার দরকারও হবে না।
.
হলুদ রঙের ছোট্ট একটা রাস্তা। ওই রাস্তা থেকে কিছুটা নিচে অন্ধকার ঘরে স্প্যানিশ রেস্তারাঁ। নিয়মিত খদ্দেররা অধিকাংশই স্প্যানিশ বংশোদ্ভুত, অন্তত ওদের চোখের রঙ তাই বলে। র্যাঁবেয়া রেস্তোরাঁয় ঢোকার পর সবাই ওর দিকে সকৌতূহলে তাকাল। রাউল ভেতর থেকে ইশারা করতেই ওর দিকে এগিয়ে গেল র্যাঁবেয়া। সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখ থেকে উড়ে গেল কৌতূহল। নিজের নিজের প্লেটের ওপর ঝুঁকে পড়ল ওরা। রাউল-এর পাশে আজ বসে আছে লম্বাটে, লিকলিকে চেহারার একজন। দাড়ি-গোঁফ বিশ্রীভাবে কামানো। কাঁধ অসম্ভব রকমের চওড়া। মুখটা ঘোড়ার মুখের মত লম্বা। মাথার চুল পাতলা। জামার হাতা কনুই অবধি গোটানো। হাত দুটোয় মাংস বলতে কিছু নেই। কান পুরু লোমে ঢাকা। পরিচয়ের পালা চুকে যাবার পর ধীরে ধীরে পরপর তিনবার মাথা নোয়াল লোকটা। ওর নাম অবশ্যি বলল না রাউল, লোকটার প্রসঙ্গ উঠলে ওকে আমাদের বন্ধু বলে উল্লেখ করল।
আমাদের এই বন্ধুর ধারণা ও হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। ও… বাঁবেয়া কী খাবে সে ফরমাশ নিতে টেবিলের সামনে এক ওয়েটার এসে দাঁড়াতেই আচমকা মাঝপথে থেমে গেল রাউল।
ও আমাদের অন্য দুইজন বন্ধুর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেবে। ওরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবে ফটকের কয়েকজন পাহারাদারকে। তবে তার মানে এই না যে আপনি সাথে সাথে রওনা হতে পারবেন। কখন পালাতে পারবেন সেটা পাহারাদারেরাই ঠিক করে দেবে। ওদের কারও বাসায় আপনি কয়েক রাত থাকতে পারলে ব্যাপারটা আপনার জন্য সহজ হবে। ওদের বাসা ফটকের কাছেই। এখন আমাদের এই বন্ধুর কাজ হবে খুব তাড়াতাড়ি ওদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়া। এসব যখন শেষ হবে, তখন আপনি ওর সঙ্গে টাকা-পয়সা লেনদেনের ব্যাপারে পাকাপাকি কথা বলবেন।
ঘোড়ামুখো বন্ধু লোকটা, মুহূর্তের জন্যেও টম্যাটোর সালাদ চিবানো বন্ধ না করে, আবারও বার কয়েক তার ছুঁচলো মাথাটা ওপর-নিচে করল। তারপর যখন শেষ হলো খাওয়া তখন শুরু করল কথা। উচ্চারণে, স্প্যানিশ টান। পরের দিন সকাল আটটায় শহরের গির্জার বারান্দায় র্যাঁবেয়াকে দেখা করতে বলল ও।
তাহলে অন্তত আরও দুদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে, মন্তব্য করল র্যাঁবেয়া।
দেখুন, আপনি যা ভাবছেন ব্যাপারটা অত সহজ নয়। ওদেরও চারদিকে খোঁজ-খবর নিতে হবে, উত্তর দিল রাউল।
ঘোড়ামুখো বন্ধু আরেকবার আস্তে করে মাথা নেড়ে সমর্থন করল রাউলকে। কথা বলতে বলতে র্যাঁবেয়া জানল ঘোড়ামুখো লোকটা একজন উৎসাহী ফুটবল খেলোয়াড়। ও নিজেও একসময়। ফুটবল খেলোয়াড় ছিল, আর ফুটবলের প্রতি ওর আগ্রহও যথেষ্ট। খাওয়া শেষ হওয়ার পর দেখা গেল ওদের মধ্যে বেশ একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এবং অচিরেই ঘোড়ামুখো র্যাঁবেয়াকে ঠাট্টাচ্ছলে বুড়ো খোকা বলে ডাকতে আরম্ভ করল। বলল, ফুটবল মাঠে একমাত্র সেন্টার-হাফরাই খেলা দেখাবার সুযোগ পেয়ে থাকে।
র্যাঁবেয়া ওর মত সমর্থন করল, যদিও সে নিজে খেলেছে সেন্টার ফরওয়ার্ড পজিশনে। মোটামুটি একটা শান্ত পরিবেশের মধ্যেই এগুচ্ছিল ওদের কথাবার্তা, হঠাৎ বেজে উঠল রেডিও। কয়েকটা হালকা গান শেষ হবার পর ঘোষণা করা হলো, আগের দিন প্লেগে মারা গেছে দুশো সাত জন। রেস্তোরাঁর কেউই বিচলিত, হলো না খবরটা শুনে। একমাত্র ঘোড়ামুখো বন্ধুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল। রাউল এবং র্যাঁবেয়াও উঠে পড়ল এই সঙ্গে।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরুবার পথে র্যাঁবেয়ার ডান হাত বন্ধু নিজের মুঠোয় নিয়ে বেশ জোরে ঝাঁকানি দিয়ে বলল, আমার নাম গনজালেস।
পরের দুটো দিন র্যাঁবেয়ার কাছে মনে হলো যেন অনন্তকাল। রিওকে খুঁজে বের করে সমস্ত ঘটনা শোনল ও। রিও তখন রোগী দেখার জন্যে বাইরে যাচ্ছিল; সে-ও চলল ওর সঙ্গে। এক রোগীর বাসায় পৌঁছুল ওরা।
তারিউ ঠিকমত পৌঁছলেই হয়, বলল রিও। ওকে তখন বেশ পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল।
মহামারী কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে? প্রশ্ন করল, র্যাঁবেয়া।
রিও বলল, ঠিক তা নয়, তবে পরিস্থিতি সামলানোর মত
যন্ত্রপাতি এবং লোকের বড় অভাব।
বাইরে থেকে ডাক্তার বা অ্যাসিস্টান্ট আসেনি?
এসেছে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। অবস্থার অবনতি ঘটলে আমরা সামলাতে পারব না।
আমি কিন্তু সে-ভয়ে পালাতে চাইছি না। আমি কাপুরুষ নই। কিন্তু দীর্ঘদিন প্রেমিকাকে ছেড়ে থাকতে হবে, এটা কিছুতেই ভাবতে পারি না। অবশ্য আমি জানি না, জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণা কী।
রিও বলতে যাচ্ছিল ওর উপলব্ধিও অনেকটা এই রকমই, ঠিক এ-সময় এসে পড়ল তারিউ। ওর মুখে কেমন একটা উত্তেজনার ভাব।
ফাদার প্যানালুকে আমাদের কাজে যোগ দেয়ার কথা বলেছিলাম। উনি রাজি হয়েছেন।
বাহ। মুখে যাই বলুন, কাজের সময় তো বাস্তববাদী মনে হচ্ছে। আমি খুশি হয়েছি, বলল রিও।
মাফ করবেন, এবার আমি বিদায় নেব, বলল র্যাঁবেয়া।
.
বুধবার, অর্থাৎ যেদিন সাক্ষাতের কথা, আটটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই গির্জায় পৌঁছে গেল র্যাঁবেয়া। অন্যদিনের তুলনায় আজ বাতাস এখনও কিছুটা ঠাণ্ডা। আকাশে হালকা তুলোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ। ভেসে আসছে শিশিরের মৃদু গন্ধ।
গির্জার ঘড়িতে আটটা বাজল। শূন্য বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল র্যাঁবেয়া। ভেতর থেকে ভেসে আসছে ধূপের সুবাস। সঙ্গীতের সুর আস্তে আস্তে স্তিমিত হতে হতে একেবারে থেমে গেল। জনা দশেক লোক গির্জার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে শহরের দিকে হাঁটতে থাকল। অধৈর্য হয়ে উঠল র্যাঁবেয়া। আবার কিছু লোক সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল র্যাঁবেয়া, হঠাৎ ভাবল এখানে সিগারেট টানা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
আটটা দশে বেজে উঠল অর্গান। ভেতরে ঢুকল ও। প্রথমে আবছা আলোয় কিছুই ঠাহর করতে পারল না। সামনে একটা বেদী, তার ওপর একটা মূর্তি। হাঁটু-গেড়ে বসা মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে জমাট-বাঁধা অন্ধকারের কতকগুলো ছোপ।
বাইরে এসে র্যাঁবেয়া দেখে, সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে গনজালেস। ওকে দেখে বলল, এই যে, বুড়ো খোকা, আমি ভেবেছিলাম আপনি এতক্ষণে চলে গেছেন। অনেক দেরি করে ফেলেছি। এরপর দেরি হওয়ার কারণটা জানাল ও, আটটা বাজার দশ মিনিট আগে বাসা থেকে বেরিয়েছি। যেখানে ওদের সঙ্গে দেখা, করার কথা, সেখানে অপেক্ষা করেছি বিশ মিনিট। কিন্তু তবু পাত্তা পেলাম না কারও। নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। এই লাইনে কাজ করতে গেলে পদে পদে বিপদ।
পরের দিন, একই সময়ে ওয়ার মেমোরিয়ালের সামনে দেখা হবে বলে কথা দিল গনজালেস। দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুপিটা পিছনের দিকে ঠেলে দিল র্যাঁবেয়া।
ওয়ার মেমোরিয়াল জায়গাটা পাহাড়ের চূড়ার কাছে একটা পার্কের মত দেখতে।
ওখান থেকে সমুদ্র চোখে পড়ে। পরের দিনও ওরা আসার আগেই নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছুল বাঁবেয়া। সময় কাটানোর জন্যে পড়ল শহীদদের নামের তালিকা। কয়েক মিনিট পর দুজন লোক হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এল ওর দিকে। কেমন একটা নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে, তারপর পার্কের দেয়ালে হাত রেখে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখতে লাগল নিচের জনশূন্য বন্দর। দুটো লোকের পরনেই একই রকম ফতুয়া আর নীল প্যান্ট। দুজনের উচ্চতাও সমান। একটু সামনে এগিয়ে একটা পাথরের বেঞ্চিতে বসল র্যাঁবেয়া। এমন সময় ওর দিকে হেঁটে এল গনজালেস। এর মধ্যে নিশ্চয় আপনাদের আলাপ হয়ে গেছে। এবার তাহলে কাজের কথায় আসা যাক, বলল ও।
ওদের একজনের নাম মার্সেল, অন্যজনের লুই। একজন বলল, দুদিনের মধ্যেই পোর্টে আমাদের ডিউটি শুরু হবে। তখন পুরো সপ্তাহ আমরা ওখানেই থাকব। সে-সময় দেখব কোন রাতটায় সুবিধে হবে। কিন্তু বিপদ আছে একটা। আমাদের সঙ্গে আরও দুজন পাহারায় থাকবে, ওরা সৈনিক। যতদূর সম্ভব, ওদের এসবের বাইরে রাখা ভাল। কোন কোন দিন সন্ধ্যায় ওরা কাছের একটা গুঁড়িখানায় যায়। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা মারে। এ-সময়টায় আপনি যদি আমাদের বাসায় থাকেন তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়। আমাদের বাসা ফটক থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। তবে ঝটপট সবকিছু সেরে ফেলতে হবে। ফটকের সামনে আরও একটা পাহারা বসানোর কথাবার্তা চলছে।
সম্মতি জানাল র্যাঁবেয়া। পকেটের সবকটা সিগারেট ওদের দিয়ে দিল। ওদের ভেতর যে লোকটা এতক্ষণ কথা বলেনি সে গনজালেসকে জিজ্ঞেস করল, টাকা-পয়সার লেনদেন সম্পর্কে কথা হয়েছে?
না, এখনও হয়নি, বলল গনজালেস, তবে ওসব নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। উনি আমার বিশিষ্ট বন্ধু। টাকা পয়সা যা দেবার যাওয়ার সময় দেবেন। একদিন পর, রাতের খাওয়ার সময় সবাইকে স্প্যানিশ রোশায় আসতে বলল ও। এরপর র্যাঁবেয়াকে বলল, বুড়ো খোকা, চিন্তার কিছু নেই। প্রথম রাতে আমি আপনার সঙ্গে থাকব।
পরের দিন, হোটেলে নিজের ঘরে ফিরছে র্যাঁবেয়া। সিঁড়িতে দেখা হয়ে গেল তারিউ-এর সঙ্গে। আমার সঙ্গে যাবেন? ডাক্তার রিও-র কাছে যাচ্ছি, বলল তারিউ।
একটু ইতস্তত করল র্যাঁবেয়া। যাওয়াটা কি উচিত হবে। আমার কেবলই মনে হয় ওকে নিশ্চয় খুব বিরক্ত করছি।
আপনি উতলা হবেন না। আপনার অনেক কথা শুনেছি ওর কাছে।
কিছুক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করল র্যাঁবেয়া। তারপর বলল, তার চেয়ে এক, কাজ করুন না বরং। রাতের খাওয়ার পর আমার। এখানে দুজনেই চলে আসুন। একসঙ্গে গলা ভেজানোনা যাবে।
সেটা নির্ভর করছে ডাক্তার রিও-র ওপর। দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে বলল তারিউ। আর প্লেগের ওপর তো বটেই।
রাত এগারোটায় হোটেলের ছোট্ট বারে ঢুকল রিও এবং তারিউ। প্রায় তিরিশজনের মত লোক তখন বসেছিল ওখানে, চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে কথা বলছে সবাই। আর বাইরে প্লেগ আক্রান্ত থমথমে শহর। কিছুটা থতমত খেয়ে গেল ওরা দুজন। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ঢোকার পথে। কিন্তু যখন দেখল বারে মদ বিক্রি হচ্ছে তখন হৈ-চৈ-এর কারণ বোধগম্য হলো।
এক কোণে একটা টুলের ওপর বসে আছে র্যাঁবেয়া। ওদের। দেখেই ইশারা করল। আর পাশে দাঁড়ানো যে লোকটা হৈ-চৈ করছিল তাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে সরাল ওদেরকে এগোনোর পথ করে দেয়ার জন্যে।
কড়া কিছু টানতে আপত্তি নেই তো, প্রস্তাব দিল ও।
না, সাড়া দিল তারিউ।
মদের ঝাঁঝাল গন্ধ শুঁকল রিও। চারদিকের চিৎকারে কারও কথা শোনা যাচ্ছে না। র্যাঁবেয়াকে দেখে মনে হচ্ছে মদ খাওয়া নিয়েই মগ্ন হয়ে আছে ও। বারের বাইরের অবশিষ্ট জায়গাটুকুতে দুখানা টেবিল পাতা। একটায় বসে আছে একজন নৌবাহিনীর অফিসার, দুপাশে দুজন যুবতী। সামনে বসা-লালচে-মুখো মোটাসোটা এক ভদ্রলোককে টাইফয়েড যেবার কায়রোতে মহামারীর আকারে দেখা দিয়েছিল সে-গল্প শোনাচ্ছিল অফিসার। অন্য টেবিলটায় রয়েছে একদল যুবক। ঠিক ওদের মাথার ওপরেই লাউডস্পীকার থেকে ভেসে আসছে একঘেয়ে সঙ্গীতের গর্জন। তাই ওদের কথা শোনা যাচ্ছে না।
কিছু হলো? একটু চেঁচিয়ে র্যাঁবেয়াকে জিজ্ঞেস করল রিও।
সম্ভবত এই সপ্তাহের মধ্যে কিছু একটা হয়ে যাবে।
বড়ই দুঃখের কথা, চিৎকার করে উঠল তারিউ।
কেন? আপনি অমন ভাবছেন কেন?
না। না। এমনি, বলল রিও, ওর ধারণা আপনি থাকলে আমাদের অনেক সাহায্য হত। কিন্তু আমি আপনার অবস্থা বুঝি।
আর এক দফা মদ নিল ওরা। এবারের খরচটা তারিউ-এর।
টুল থেকে নেমে পড়ল র্যাঁবেয়া। এই প্রথম তারিউ-এর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জানতে চাইল, কীভাবে আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারি?
কেন, মদের গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে শান্ত গলায় বলল তারিউ, আপনি আমাদের যে কোন একটা স্যানিটারি স্কোয়াডের সঙ্গে কাজ আরম্ভ করতে পারেন।
একটা একগুঁয়েমি ভাব ফুটে উঠল র্যাঁবেয়ার চেহারায়। আবার টুলে উঠে বসল ও।
আপনার কি মনে হয়? স্কোয়াডগুলো ভাল কাজ করছে না?
মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জানতে চাইল তারিউ।
না, একথা বলার মত কোন কারণ দেখছি না আমি। র্যাঁবেয়া তার মদ শেষ করল।
রিও লক্ষ করল ওর হাত কাঁপছে। নিশ্চয় মাতাল হয়ে গেছে, র্যাঁবেয়া।
পরের দিন স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় পৌঁছে র্যাঁবেয়া দেখল, সামনের ফুটপাথের ওপর অনেক লোক চেয়ার পেতে বসে আছে। চারপাশে সোনালি আর সবুজ আলো ঝিকমিক করছে। ওদের অনেকের মুখ থেকেই ভেসে আসছে কড়া চুরুটের ঝাঁঝাল গন্ধ। ভিড় ঠেলে রেস্তোরাঁয় ঢুকল ও। ভেতরটা একেবারে খালি। সেদিন গনজালেস যে-টেবিলে বসেছিল সেদিকে এগিয়ে গেল র্যাঁবেয়া। পরিচারিকাকে জানাল, খাবারের ফরমাশ দিতে একটু দেরি হবে। ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা বাজে।
বাইরে যারা হাওয়া খাচ্ছিল ওদের মধ্যে থেকে দুএকজন করে, ভেতরে ঢুকতে শুরু করল। টেবিলে ঘুরে ঘুরে খাবার দিতে লাগল পরিচারিকা। আস্তে আস্তে কোলাহলে ভরে উঠল ঘরটা।
আটটা বাজল। একে একে জ্বলে উঠল ভেতরের সবগুলো আলো। ওর টেবিলের চারপাশের চেয়ার দখল করে বসল অপরিচিত একদল লোক। ডিনারের ফরমাশ দিল র্যাঁবেয়া।
সাড়ে আটটায় ওর খাওয়া শেষ হবার পরও গনজালেস বা সেই পাহারাদার দুজনের কেউ এল না। আস্তে আস্তে খালি হতে আরম্ভ করল রেস্তোরাঁ। নটায় একেবারে খালি হয়ে গেল। পরিচারিকা অদ্ভুতদৃষ্টিতে ওকে লক্ষ করছে। দেখে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ল র্যাঁবেয়া।
রাস্তার ও-পারে তখনও একটা কাফে খোলা ছিল। সেখানে ঢুকে এমন একটা জায়গা বেছে নিল ও, যেখান থেকে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁর দরজার ওপর ভালভাবে নজর রাখা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ এল না। রাত সাড়ে নটায় রাস্তায় বেরিয়ে নিজের হোটেলের দিকে ধীর পায়ে হাঁটা দিল র্যাঁবেয়া।
গনজালেস-এর ঠিকানা ও রাখেনি। লোকটাকে আবার কীভাবে খুঁজে বের করবে সেটাই এখন ওর চিন্তার বিষয়। হয়তো আবার গোড়া থেকেই সবকিছু শুরু করতে হবে।
ওর চারপাশ দিয়ে ছুটোছুটি করছে অ্যাম্বুলেন্স। একসময় হঠাৎ র্যাঁবেয়া সবিস্ময়ে অনুভব করল, ওর আর ওর প্রেমিকার মাঝখানে প্লেগ যে-দেয়াল তুলেছে, সেই দেয়ালের বাইরে যাবার সমস্ত পথ ওর জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। অকস্মাৎ প্রেমিকাকে দেখার এক প্রবল আকাক্ষা ওর হৃদয়ে প্রচণ্ড গতিতে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে শুরু হলো জ্বালা। দাবানলের মত শিরা-উপশিরা বেয়ে রক্ত প্রবাহের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। হোটেলের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল র্যাঁবেয়া।
পরের দিন খুব সকালে রিও-র বাসায় গেল ও। জানতে চাইল কটার্ডকে কোথায় পাওয়া যাবে।
কাল রাত দশটায় কটার্ড-এর এখানে আসার কথা। তারিউ আসতে বলেছে। আপনি সাড়ে দশটায় আসুন, বলল রিও।
পরের দিন রাতে কটার্ড পৌঁছে দেখে রিও এবং তারিউ একজন রোগীর ব্যাপারে আলাপ করছে। ওরা ভেবেছিল লোকটা মারা : যাবে, কিন্তু সে বেঁচে আছে এখনও। রিও এরপর বিভিন্ন রিপোর্ট। নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তারিউ ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল কার্ড-এর দিকে।
মঁসিয়ে কটার্ড, বলুন তো, আপনি কেন এখনও আমাদের দলে যোগ দিচ্ছেন না?
কটার্ড টুপি হাতে উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। বোঝাই যায় আঁতে ঘা লেগেছে তার। এগুলো আমার কাজ বলে আমি মনে করি না। আর তাছাড়া, প্লেগের ফলে আমার কিছু সুবিধাই হয়েছে। তাই আমি একে বাধা দিতে চাই না।
হ্যাঁ, তা তো বটেই। প্লেগ শুরু না হলে আপনাকে অনেক আগেই হাজতে যেতে হত।
ভীষণ চমকে উঠল কটার্ড। চেয়ারের পিছনটা ধরে সামলে নিল নিজেকে। কে বলেছে আপনাকে এ-কথা?
কেন, আপনি নিজেই বলেছিলেন। ভুলে গেছেন এরই মধ্যে?
মানসিক ভারসাম্য হারাল কটার্ড। অশ্রাব্য গালিগালাজ আরম্ভ করল ও।
দেখুন, অত উত্তেজিত হবার কিছু নেই, শান্ত গলায় বলল তারিউ, আমি কিংবা রিও, আমরা কেউই পুলিসের কাছে আপনার কথা জানাব, না। আর আপনি কী করেন না করেন তা নিয়েও আমাদের মাথাব্যথা নেই। শান্ত হন, বসুন।
ইতস্তত করে বসে পড়ল কটার্ড। সঙ্গে সঙ্গে ওর বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘনিশ্বাস।
আমার একটা পুরনো ব্যাপার আবার খুঁচিয়ে তোলা হয়েছে। ভেবেছিলাম সবাই এতদিনে ভুলে গেছে ওটা। থানা থেকে কয়েকদিন আগে আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। আমাকে জানানো হয়, ব্যাপারটার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন এক পা-ও না নড়ি কোথাও। শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে ধরবেই।
গুরুতর কিছু? জানতে চাইল, তারিউ।
গুরুতর বলতে আপনি কী বোঝেন সেটা না জানলে কী বলব বলুন? তবে খুন বা ওই ধরনের কিছু নয়।
কটার্ডকে দেখে রিও আর তারিউ উভয়েরই করুণা হলো ভীষণ। ভাগ্য ভাল হলে শুধু হাজতবাসের ওপর দিয়েই পার পেয়ে যেতে পারি। হঠাৎ আবার উত্তেজিত হয়ে উঠল ও। একটা ভুলের জন্যে ব্যাপারটা ঘটেছিল। ভুল তো সবাই করে, করে না? কিন্তু তারই জন্যে শাস্তি পেতে হবে আমাকে?
তাহলে এজন্যেই আপনি গলায় দড়ি দিয়েছিলেন? আবার প্রশ্ন করল তারিউ।
হ্যাঁ। তবে সেটাও একটা ভুল ছিল।
কটার্ডকে আশ্বাস দিল রিও। বলল, আপনার ব্যাপারটা এতদিনে বুঝতে পারলাম। আমার বিশ্বাস আপনার কোন বিপদ, হবে না।
তা আমিও জানি। এ-মুহূর্তে আমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এতক্ষণে বুঝলাম কেন আপনি আমাদের কাজে যোগ দিচ্ছেন না, বলল তারিউ।
মঁসিয়ে তারিউ, আমার বিরুদ্ধে নিশ্চয় আপনার কোন আক্রোশ নেই?
অবশ্যই না। তবে একটাই অনুরোধ, চারদিকে এই রোগের জীবাণু ছড়িয়ে বেড়াবেন না।
কটার্ড প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, আমি নিজে কোন দিন এটা চাইনি। প্লেগ শুরু হয়েছে, সেটা দৈব ব্যাপার। এর জন্যে কিছু ব্যক্তিগত সুবিধা আমার হয়েছে সত্যি, কিন্তু সেটা আমার বরাত। তাই বলে প্লেগের জন্যে আমাকে দায়ী করা উচিত নয়। কথাবার্তায় মনে হলো ইতিমধ্যে বেশ সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছে ও। এমন সময় ওখানে ঢুকল র্যাঁবেয়া। ওকে দেখে আবার ফুঁসে উঠল কটার্ড। রীতিমত চিৎকার করে বলল, আমি বিশ্বাস করি না, আপনারা যে-সব ব্যবস্থা নিয়েছেন তাতে কোন ফল হবে।
র্যাঁবেয়া কটার্ডকে প্রশ্ন করে জানল, গনজালেস-এর ঠিকানা ও জানে না। শুনে বিরক্তি আর হতাশায় ভরে উঠল ওর মন। এরপর কটার্ডকে সে বলল, সেই ছোট্ট কাফেটাতে আমরা আর একবার গেলে কেমন হয়? ঠিক হলো পরের দিন ওরা যাবে সেখানে।
রিও র্যাঁবেয়াকে বলল, আপনার কী হলো সে-খবর কিন্তু আমাকে দিতে ভুলবেন না।
র্যাঁবেয়া জানাল, আপনি এবং তারিউ যদি এ-সপ্তাহের শেষে হোটেলে এসে আমার খোঁজ নেন, তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়। বেশি, রাত হলেও অসুবিধে হবে না, আমি আমার ঘরেই থাকব।
পরের দিন সকালে সেই ছোট্ট কাফেটাতে গেল র্যাঁবেয়া এবং কটার্ড বলে এল, আজ সন্ধ্যায় অথবা কাল সকালে যেন গ্রাসিয়া ওদের সঙ্গে কাফেতে দেখা করে। সেদিন সন্ধ্যায় ওদের অপেক্ষা বৃথা গেল। পরের দিন এল গ্রাসিয়া। সবকিছু শুনে বলল, কী ঘটেছে আমি ঠিক জানি না। শুনেছিলাম, শহরের কয়েকটা অঞ্চল ঘেরাও করা হয়েছিল। প্রতিটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে। হয়তো ওরা এই ঘেরাও থেকে ঠিকমত পালাতে পারেনি। আমি রাউল-এর সঙ্গে আবার আপনাদের দেখা করিয়ে দিতে পারি। তবে পরশুর আগে সময় করে উঠতে পারব না।
পরের দিন এক রাস্তার মোড়ে হঠাৎ করেই রাউল-এর সঙ্গে দেখা হলো র্যাঁবেয়ার। শুনল, গ্রাসিয়ার অনুমান ঠিক। শহরের নিচু এলাকাগুলো এখনও ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। এরপর ওদের কাজ হলো গনজালেস-এর সঙ্গে যোগাযোগ করা। দুদিন পর স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাওয়ার সময় ফুটবলারের সঙ্গে দেখা হলো : র্যাঁবেয়া-র।
না, এটা বোকামি হয়ে গেছে, গনজালেস জানাল, আপনার অবশ্যই উচিত ছিল ওদের সঙ্গে যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা ঠিক করে রাখা।
নিজের ভুল স্বীকার করল র্যাঁবেয়া। যেভাবে হোক কাল সকালে ছোকরা দুটোকে খুঁজে বের করব, বলল গনজালেস, তারপর দেখা যাবে কী করা যায়।
পরের দিন ওরা গিয়ে দেখে দুই পাহারাদার আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। একটা চিরকুটে লিখে রেখে গেছে, পরদিন দুপুর বেলা হাইস্কুলের মাঠে দেখা করবে।
র্যাঁবেয়া হোটেলে ফেরার পর ওর চেহারা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল তারিউ।
আপনার শরীর ভাল তো? প্রশ্ন না করে পারল না ও।
না, শরীর ঠিক আছে। কিন্তু কাজটা আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে, এটা ভেবেই মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। কাল রাতে আপনারা আসছেন তো?
রাতে রিও এবং তারিউ ঘরে ঢুকে দেখে বিছানায় শুয়ে আছে। র্যাঁবেয়া। ওদের দেখেই বিছানা ছেড়ে সামনের সাজানো গ্লাসগুলোয় মদ ঢালল ও।
গ্লাসে চুমুক দেবার আগে রিও জিজ্ঞেস করল, আপনার কতদূর এগুলো?
র্যাঁবেয়া বলল, সবকিছু প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। হয়তো দু-একদিনের মধ্যে শেষ পর্যায়ের দেখা-সাক্ষাৎ হবে। এরপর নিজের গ্লাসে চুমুক দিয়ে হতাশ কণ্ঠে মন্তব্য করল, হয়তো ঠিক সময়ে দেখা যাবে ওরা আসেনি।
এ কথা ভাবছেন কেন? একবার হয়েছে বলে এবারও অমন হবে, তার কোন মানে নেই।
তাহলে আপনি এখনও ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল র্যাঁবেয়া।
মানে?
প্লেগ। প্লেগের কথা বলছি।
আচ্ছা? চেঁচিয়ে উঠল রিও।
হ্যাঁ। আপনি এর চরিত্র এখনও বুঝতে পারেননি। এর অর্থ হচ্ছে, একই জিনিসের বারবার পুনরাবৃত্তি হওয়া। র্যাঁবেয়া উঠে ঘরের কোণে একটা ছোট গ্রামোফোন চালিয়ে দিল। এমন সময় বাইরে শোনা গেল গুলির আওয়াজ।
কুকুর মারা পড়ল, নাকি কেউ পালিয়ে যাচ্ছিল?
কয়েক মিনিট পর থেমে গেল রেকর্ড। জানালার নিচে, রাস্তায়। শোনা গেল অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেল আওয়াজটা।
কেমন বিরক্তিকর ওই রেকর্ড, মন্তব্য করল র্যাঁবেয়া, তবু আজ এই নিয়ে দশবার বাজালাম।
এত ভাল লাগে?
ভাল লাগার তো কথা নয়। কিন্তু আছে যে মাত্র একটাই।। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারিউ বলল, তাহলে ব্যাপার ওটাই।
একই জিনিস বারবার ঘটে।
রিওকে জিজ্ঞেস করল র্যাঁবেয়া, আপনাদের স্যানিটারি স্কোয়াড কেমন কাজ করছে?
আপাতত পাঁচটা দল কাজ করছে। আশা করছি শিগগিরই এদের সংখ্যা বাড়বে।
ডাক্তার, এসব নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। এখনও আমি কেন যোগ দিইনি, তার কারণ আছে। নিজের জীবনকে বিপন্ন করতে আমার ভয় নেই। আমি স্পেনের গৃহযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম।
কোন্ পক্ষে? প্রশ্ন করল তারিউ।
যে পক্ষকে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছিল। আমি মনে করি, মহৎ কিছু করার ক্ষমতা সব মানুষেরই আছে। কিন্তু মহৎ অনুভূতি যার নেই তাদের কাছে যেতে আমার মন সাড়া দেয় না।
কিন্তু আমার তো মনে হয় সবকিছুই হয়তো আমরা করতে পারি, মন্তব্য করল তারিউ।
না, এটা ঠিক নয়। মানুষ একটানা যেমন দুঃখভোগ করতে পারে না, তেমনি সুখভোগও করতে পারে না। এর অর্থ, সত্যিকারের মহৎ বা মূল্যবান কাজ করার ক্ষমতা মানুষের নেই।
র্যাঁবেয়া ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে এবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা, তারিউ, আপনি কী ভালবাসার জন্যে প্রাণ দিতে পারবেন?
বলা কঠিন। কিন্তু এ-মুহূর্তে পারব না।
তাহলে দেখুন। অথচ প্লেগের জন্যে প্রাণ দেবার সাহস আপনার আছে। কিন্তু আমি দেখতে চাই মানুষ শুধু ভালবাসার জন্যেই বাঁচবে কিংবা মরবে। এখন এতেই আমার আগ্রহ।
রিও উঠে বলল, আমরা এখন যা করছি সে-সবের ভেতর সত্যি কোন বীরত্ব নেই। অন্তত আমরা সেভাবে চিন্তা করি না। আমাদের এই কাজের পিছনে আছে একটি সাধারণ অনুভূতি, যার নাম শালীনতাবোধ।
কিন্তু শালীনতাবোধটা আসলে কী? র্যাঁবেয়ার গলার স্বর বেশ গম্ভীর মনে হলো এবার।
নিজের দায়িত্বটুকু যথাযথভাবে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা।
নিজের দায়িত্ব? কিন্তু হায়, আমি যদি জানতে পারতাম কোনটা। আমার নিজের দায়িত্ব। জানি না, ভালবাসাকে মানুষের জীবনে এতটা গুরুত্ব দিয়ে আমি ভুল করেছি কিনা!
না, না, তা ভাবছেন কেন? আপনি মোটেই ভুল করেননি।
আমার ধারণা এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আপনাদের দুজনের কারোরই সত্যিকারের হারাবার কিছু নেই। তাই এই পথে যেতে আপনাদের বাধাও নেই।
রিও গ্লাসের বাকি মদটুকু খেয়ে তারিউকে বলল, চলুন, আমাদের অনেক কাজ পড়ে রয়েছে।
ওকে অনুসরণ করল তারিউ। কিন্তু দরজায় পৌঁছে থেমে গেল। ও। ঘুরে র্যাঁবেয়াকে বলল, আপনি হয়তো জানেন না, রিও-র স্ত্রী এখন এক স্যানাটোরিয়ামে আছেন, চিকিৎসা চলছে ওর। এখান থেকে শখানেক মাইল দূরে ওই স্বাস্থ্যনিবাস।
হঠাৎ থ হয়ে গেল র্যাঁবেয়া। কী যেন বলতে চাইল, কিন্তু, ততক্ষণে ঘর ছেড়ে চলে গেছে তারিউ।
পরের দিন খুব সকালে রিওকে ফোন করল র্যাঁবেয়া, শহর ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। আপনারা রাজি?
এক মিনিটের মত কেটে গেল নীরবে। এরপর দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিল রিও, অবশ্যই, র্যাঁবেয়া। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।