৪.১ ওয়ানডা সেলডন

চতুর্থ পর্ব : ওয়ানডা সেলডন

সেলডন, ওয়ানডা-… জীবনের শেষ নিঃসঙ্গ বছরগুলোতে হ্যারি সেলডন তার নাতনী ওয়ানডা সেলডনের সাথেই বেশী ঘনিষ্ঠ (আসলে পুরোপুরি নির্ভরশীল) হয়ে পড়েন। ছোট বেলাতেই বাবা মাকে হারিয়ে ওয়ানডা সেলডন তার পিতামহ হ্যারি সেলডনের সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টে নিজের বাকী জীবনটা উৎসর্গ করে দেয়, ইউগো এমারিলের মৃত্যুর পর যে শূন্যস্থান তৈরি হয় তা পূরণ করে সে… সাইকোহিস্টোরি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ওয়ানডা সেলডনের মূল দায়িত্ব কি ছিল তার পুরোটাই রহস্যাবৃত কারণ সে গবেষণা করত পুরোপুরি একা। মাত্র যে দুজন ব্যক্তি তার গবেষণাগারে প্রবেশ করতে পারত তারা হলেন হ্যারি নিজে এবং স্ট্যাটিন পালভার (তারই এক বংশধর প্রীম পালভারের হাতে চারশ বছর পরে মহাবিপর্যয়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে ট্রানটরের পুনর্জন্ম হয় [৩০০ এফ. ই]) … যদিও ফাউণ্ডেশনে ওয়ানডা সেলডনের অবদানের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায় নি, কিন্তু নিঃসন্দেহে তা ছিল অত্যন্ত বড় মাপের…

–এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা

.

১.

হেঁটে গ্যালাকটিক লাইব্রেরিতে প্রবেশ করলেন হ্যারি সেলডন (এখন আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না, একটু খোঁড়ান)। তার লক্ষ্য দেয়াল ঘেষে দাঁড় করানো স্কিটারগুলো। এই বিশাল কমপ্লেক্সের অন্তহীন করিডোরে চলাচলের জন্য এই বাহনগুলো ব্যবহার হয়।

তিন তরুণকে দেখে একটু থামলেন। তিনজনই গ্যালকটোগ্রাফে পুরো গ্যালাক্সির ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি তৈরি করে বসে আছে। দেখা যাচ্ছে প্রতিটি গ্রহ ডানদিক থেকে কেন্দ্রকে আবর্তন করছে।

যেখানে দাঁড়িয়েছেন সেখান থেকেই দেখতে পেলেন সীমান্তের এ্যানক্রিয়ন প্রদেশ উজ্জ্বল লাল বর্ণে জ্বল জ্বল করছে। এই প্রদেশ গ্যালাক্সির শেষ প্রান্তে এবং বিশাল এলাকা নিয়ে বিস্তৃত ঐতিহ্য বা ধন সম্পদের জন্য প্রসিদ্ধ নয় বরং প্রসিদ্ধ ট্র্যানটর থেকে দূরত্বের কারণে। প্রায় দশ হাজার পারসেক দূরে।

কৌতূহলের বশেই, তিনজনের কাছাকাছি একটা কম্পিউটার কনসোলের সামনে বসে পড়লেন সেলডন, কম্পিউটারে র‍্যানডম সার্চ শুরু করলেন যা তিনি জানেন যে শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। তার মন বলছে এ্যানাক্ৰিয়নের প্রতি এই প্রবল আগ্রহের কারণ নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক–গ্যালাক্সিতে অবস্থানের কারণেই এই প্রদেশ বর্তমান ইম্পেরিয়াল শাসনের সবচেয়ে দুর্বল অংশে পরিণত হয়েছে। তার দৃষ্টি স্ক্রীণের উপর কিন্তু কান খাড়া করে শুনছেন তাদের আলোচনা। লাইব্রেরীতে রাজনৈতিক আলোচনা শোনা যায় না। কারণ তা নিষিদ্ধ।

তিনজনের একজনকেও চেনেন না সেলডন। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। হাতে গোনা যে দুএকজন নিয়মিত এখানে আসে তাদের অনেককেই চেহারায় চেনেন দুএকজনের সাথে কথাও বলেছেন–কিন্তু লাইব্রেরী সব নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত। যোগ্যতার কোনো ব্যাপার নেই। যে কেউই আসতে পারে এবং সুযোগ সুবিধাগুলো ব্যবহার করতে পারে। (তবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নির্বাচিত কয়েকজন, যেমন সেলডন, এখানে নিজেদের দোকান সাজিয়ে বসার অনুমতি পান। একটা অফিস বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এখানে সেলডনকে এবং তিনি লাইব্রেরীর সকল সুযোগ সুবিধা। ইচ্ছেমাফিক ব্যবহার করতে পারেন।)

তিনজনের একজন (যথার্থ কারণেই সেলডন তার নাম দিয়েছেন সাড়াশি নাক) নিচু আর্তস্বরে কথা বলছে।

“বাদ দাও,” সে বলল। “বাদ দাও। এই প্রদেশ ধরে রাখার জন্য পুরো একটা সেনাবাহিনী মোতায়েন করে রাখতে হচ্ছে। সফল হলেই বা কি লাভ। সেনাবাহিনী যতদিন থাকবে ততদিন সব ঠিক, সেনাবাহিনী চলে আসলে অবস্থা আবার আগের মতো।”

কোন বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে সেলডন বুঝতে পারলেন। খবরটা তিনদিন আগে ট্র্যানটর ভীশনে প্রচার করা হয়। এ্যানক্রিয়নের বেয়ারা গভর্নরকে শায়েস্তা করার জন্য শক্তি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। সেলডনের নিজস্ব সাইকোহিস্টোরিক্যাল অ্যানালাইসিস প্রমাণ করেছে যে তা হবে একটা অর্থহীন পদক্ষেপ। কিন্তু সরকার যখন আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে তখন আর যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না। সাড়াশি নাকের মুখে নিজের মনের কথা শুনে আপন মনেই হাসলেন তিনি। আর তরুণ কথাগুলো বলেছে সাইকোহিস্টোরির সাহায্য ছাড়াই।

সাড়াশি নাক এখনো কথা বলছে। “এ্যানক্রিয়ন ছেড়ে দিলে কি ক্ষতি হবে? গ্রহটা তারপরেও ওখানেই থাকবে সবসময় যেখানে ছিল, এম্পায়ারের শেষ প্রান্তে। কেউ তুলে ওটাকে এ্যান্ড্রোমিডায় রেখে আসতে পারবে না, পারবে? কাজেই আমাদের সাথে তার বাণিজ্য করতেই হবে। ওরা সম্রাটকে সম্মান করল কি করল না তাতে কি আসে যায়? পার্থক্যটা কখনোই বলা যাবে না।”

দ্বিতীয় ব্যক্তি, আরো যথার্থ কারণে সেলডন যার নাম দিয়েছেন টেকো, বলল, “একটাতে তো শেষ হবে না। এ্যানক্রিয়ন ছেড়ে দিলে অন্য সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো ছেড়ে দিতে হবে। ভেঙ্গে যাবে এম্পায়ার।”

“তাতে কি?” প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল সাড়াশি নাক। “এম্পায়ার আর কখনোই কোনোভাবেই আকাঙ্ক্ষিত পথে চলতে পারবে না। এর আয়তন অতি বিশাল। কাজেই সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো ছেড়ে দেয়াই ভালো পারলে নিজেদের ব্যবস্থা ওরা নিজেরাই করুক। ইনার ওয়ার্ল্ডগুলো তারপরেও শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত থাকবে। সীমান্তের প্রদেশগুলো রাজনৈতিক ভাবে না হলেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমাদের দখলে থাকবে ঠিকই।”

এবার তৃতীয় ব্যক্তি (গোলাপি গাল) বলল, “আশা করি তোমার কথাই ঠিক কিন্তু আমার মতে ঘটনা সেভাবে এগোবে না। যদি সীমান্তের প্রদেশগুলো স্বাধীনতা পেয়ে যায় তারা প্রথম যে কাজটা করবে তা হলো নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা। এবং সেজন্য প্রতিবেশীদের উপর চড়াও হবে। সীমা ছাড়িয়ে যাবে যুদ্ধ আর রক্তপাত, সম্রাট হওয়ার স্বপ্ন দেখবে প্রত্যেক গভর্নর। অবস্থা দাঁড়াবে কিংডম অব ট্রানটরের পূর্ববর্তী বর্বর যুগের মতো–যে বর্বর যুগের স্থায়িত্ব হবে হাজার হাজার বছর।”

টেকো বলল, “নিশ্চয়ই পরিস্থিতি এত খারাপ হবে না। এম্পায়ার হয়তো ভেঙ্গে যাবে, কিন্তু দ্রুত আবার একত্রিত হবে যখন জনগণ বুঝতে পারবে যে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানেই যুদ্ধ আর প্রাণহানি। অবিচ্ছিন্ন এম্পায়ারের স্বর্ণালী দিনগুলোর কথা মনে করেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তো আর বর্বর নই। কোনো না কোনো পথ ঠিকই পাওয়া যাবে।”

“নিঃসন্দেহে।” বলল সাড়াশি নাক। মনে রাখতে হবে যে এম্পায়ার শুরু থেকেই বারবার ক্রাইসিসের মুখে পড়েছে আর বারবারই তা সামাল দিতে পেরেছে।”

কিন্তু গোলাপি গাল মাথা নেড়ে বলল, “এটা শুধু নতুন একটা ক্রাইসিস নয় বরং আরো খারাপ। কয়েক প্রজন্ম আগেই এম্পায়ারে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। জান্তার দশ বছরের শাসনে অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে পুরোপুরি, জান্তার পতনের পর নতুন সম্রাটের আমলে এম্পায়ার এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে পেরিফেরির গভর্নরদের কিছুই করতে হবে না, নিজের ওজনেই মুখ থুবড়ে পড়বে।”

“কিন্তু সম্রাটের প্রতি আনুগত্য–“ সাড়াশি নাক শুরু করল।

“কিসের আনুগত্য?” বলল গোলাপি গাল। “ক্লীয়নের হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ অনেকগুলো বছর আমরা সম্রাট ছাড়াই চলেছি এবং ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাই নি। আর নতুন সম্রাট তো কাঠের পুতুল। সে কিছুই করতে পারবে না। কেউই পারবে না। এটা নতুন কোনো ক্রাইসিস নয়। এটা সমাপ্তি।”

বাকী দুজন ভুরু কুঁচকে গোলাপি গালের দিকে তাকিয়ে আছে। টেকো বলল, “তুমি সত্যিই কথাগুলো বিশ্বাস কর! ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্ট হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, কিছুই করবে না?”

“হ্যাঁ, তোমাদের দুজনের মতোই ওরাও বাস্তব বুঝতে চাইছে না। যখন বুঝবে তখন অনেক দেরী হয়ে যাবে।”

“যদি বিশ্বাস করে তাহলে তোমার মতে ওদের কি করা উচিত?” টেকো জিজ্ঞেস করল।

গোলাপি গাল একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে গ্যালাক্টোগ্রাফের দিকে, যেন ওখান থেকেই প্রশ্নের উত্তর পাবে। “আমি জানি না। দেখো, যখন সময় হবে আমি মারা যাব; হয়তো পরিস্থিতি তখনো খারাপ হয়ে উঠবে না। পরবর্তীতে যখন খারাপ হবে তখন অন্যরা মাথা ঘামাবে। আমি তো আর থাকব না। আগের সেই সুখের দিনগুলোও থাকবে না। হয়তো চিরতরেই হারিয়ে যাবে। আর শুধু আমি একাই এই কথা ভাবছি না। হ্যারি সেলডনের নাম শুনেছ?”

“নিশ্চয়ই,” সাথে সাথে জবাব দিল সাড়াশী নাক। “ক্লীয়নের ফাস্ট মিনিস্টার ছিলেন, তাই না?”

“হ্যাঁ,” বলল গোলাপি গাল, “বিজ্ঞানী। কয়েক মাস আগে তার বক্তৃতা শুনেছি। এম্পায়ার যে ভেঙ্গে যাচ্ছে এই কথা আমি ছাড়া আরো অনেকেই বিশ্বাস করে। সে বলেছে–“

“সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তারপর চিরস্থায়ী অন্ধকার যুগ শুরু হবে?” মাঝখানে নাক গলাল টেকো।”

“ঠিক এইভাবে বলে নি,” গোলাপি গাল বলল। “লোকটা বেশ সাবধানী। সে বলেছে যে হতে পারে, কিন্তু ভুল বলেছে। হবেই।”

যথেষ্ট শুনেছেন সেলডন। খোঁড়াতে খোঁড়াতে তিনজনের দিকে এগিয়ে গেলেন। গোলাপি গালের কাঁধে হাত রাখলেন।

“স্যার,” বললেন তিনি, “তোমার সাথে কথা বলা যাবে?”

একটু চমকে মাথা তুলল গোলাপি গাল, বলল, “হেই, আপনি প্রফেসর সেলডন না?”

“সবসময়ই ছিলাম,” ছবি লাগানো রেফারেন্স টাইল বের করে দেখালেন। “পরশুদিন বিকাল চারটায় আমার লাইব্রেরী অফিসে এসো। সম্ভব?”

“কাজ আছে।”

“অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নাও। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ।”

“কথা দিতে পারছি না, স্যার।”

“আসতেই হবে। যদি কোনো সমস্যা হয় আমি দেখব। যাই হোক, গ্যালাক্সি সিমুলেশনটা কিছুক্ষণ দেখলে তোমরা কিছু মনে করবে না তো। শেষবার দেখেছি তাও অনেকদিন হয়ে গেল।”

নীরবে মাথা নাড়ল তিনজনেই, প্রাক্তন ফার্স্ট মিনিস্টারের উপস্থিতিতে কিছুটা বিব্রত বোধ করছে। একে একে পিছিয়ে গিয়ে সেলডনকে গ্যালাকটোগ্রাফের কন্ট্রোল ধরার সুযোগ করে দিল।

একটা কন্ট্রোল চাপতেই এ্যানক্রিয়ন প্রদেশকে চিহ্নিত করে রাখা লাল আলোটা নিভে গেল। এখন আর গ্যালাক্সির কোনো বিশেষ অংশ চিহ্নিত নেই, শুধু ঠিক কেন্দ্রে গোল আকৃতির হালকা কুয়াশা ধীর গতিতে আবর্তিত হচ্ছে, তার পিছনেই রয়েছে গ্যালাকটিক কৃষ্ণ গহ্বর।

দৃশ্যটা পরিবর্ধিত না করলে প্রতিটি নক্ষত্র পৃথকভাবে বোঝা যাবে না, কিন্তু তখন শুধু গ্যালাক্সির যে কোনো একটা অংশ ফুটিয়ে তোলা যাবে স্ক্রীণে আর সেলডন পুরোটাই দেখতে চান–যে সুবিশাল এম্পায়ার ভেঙ্গে যাচ্ছে তার সবটাই।

একটা কন্টাক্ট চাপলেন তিনি। গ্যালাকটিক ইমেজে ধারাবাহিক অনেকগুলো হলুদ বিন্দু ফুটে উঠল। এগুলো সবই বাসযোগ্য গ্রহ–পঁচিশ মিলিয়ন। গ্যালাক্সির প্রান্তসীমা নির্দেশক হালকা কুয়াশার মাঝে পৃথক বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে। কেন্দ্রের কাছাকাছি গ্রহগুলো আরো নিবিড়ভাবে সন্নিবিষ্ট। নিখাদ একটা হলুদ বেল্ট (যদিও দৃশ্যটাকে পরিবর্ধিত করলে প্রতিটি বিন্দুই পৃথকভাবে চোখে পড়বে) কেন্দ্রের উজ্জ্বলতাকে ঘিরে রেখেছে। কেন্দ্রের উজ্জ্বলতা এখনো সাদা এবং ওই অংশে কোনো গ্রহ বা নক্ষত্র চিহ্নিত হয় নি। স্বাভাবিক। কেন্দ্রের সীমাহীন শক্তিক্ষেত্রের মাঝে কোনো বাসযোগ্য গ্রহ থাকতে পারে না।

হলুদ বিন্দুর আধিক্য সত্ত্বেও সেলডন জানেন যে প্রতি দশ হাজার নক্ষত্রের মাঝে একটা নক্ষত্রকে ঘিরে প্রদক্ষিণরত গ্রহগুলোর কোনো একটা বাসযোগ্য হতে পারে। বৈরি একটা গ্রহকে পরিবর্তন করে বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষমতা মানুষের থাকার পরেও আজ পর্যন্ত গ্যালক্সির সবগুলো প্রচেষ্টা দ্বারাও অধিকাংশ গ্রহকেই বাসযোগ্য করে তোলা যায় নি।

হলুদ বিন্দুগুলো মুছে দিলেন সেলডন, তার বদলে ক্ষুদ্র একটা অঞ্চল নীল রঙে আলোকিত হলো : ট্র্যানটর এবং এই গ্রহের উপর সরাসরি নির্ভরশীল অন্যান্য গ্রহ। কেন্দ্রের সবচেয়ে কাছে এবং সাধারণত: এই গ্রহের অবস্থানের ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে “সেন্টার অব দ্য গ্যালাক্সি,” যদিও তা সত্যি নয়। স্বাভাবিকভাবেই অবাক হতে হয় যে বিশাল মহাবিশ্বের মাঝে ট্র্যানটর কত ক্ষুদ্র একটা বিন্দু অথচ এখানেই গড়ে উঠেছে মানব ইতিহাসের নজিরবিহীন সম্পদের ভাণ্ডার, ঐতিহ্য এবং অবিশ্বাস্য জটিল প্রশাসনিক কাঠামো।

আর সেটাও এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

মনে হলো যেন তিনজনেই সেলড়নের মনের কথা পড়তে পেরেছে অথবা তার মুখের বিষণ্ণ ভাব দেখে সব আঁচ করেছে।

“এম্পায়ার কি আসলেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে?” নরম সুরে জিজ্ঞেস করল টেকো।

তারচেয়েও নরম সুরে জবাব দিলেন সেলডন, “হতে পারে। হতে পারে। অনেক কিছুই হতে পারে।”

তিনজনের উদ্দেশ্যে একটু হেসে নিজের গন্তব্যে রওয়ানা দিলেন তিনি, কিন্তু তার মনের ভেতর চলছে আর্তচীৎকার : ধ্বংস হবেই! ধ্বংস হবেই!

.

২.

দেয়াল ঘেঁষে সাড়িবদ্ধভাবে অনেকগুলো স্কিটার দাঁড় করানো। একটা বেছে নিলেন সেলডন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একটা সময় ছিল, মাত্র কয়েকবছর আগেই, যখন তিনি লাইব্রেরীর অন্তহীন করিডোরগুলোতে খুশিমনেই হেঁটে বেড়াতেন। মনকে প্রবোধ দিতেন এই বলে যে ষাটোর্ধ্ব বয়সেও তিনি অনেক পরিশ্রম করতে পারেন।

কিন্তু এখন, সত্তর বছর বয়সে, তার পা আর দেহের বোঝা বইতে চায় না। কমবয়সীরা স্কিটার ব্যবহার করে কারণ এই বাহন তাদের সমস্যা কমায়, আর সেলডন ব্যবহার করেন কারণ তিনি নিরুপায়–এখানেই পার্থক্য।

গন্তব্য পাঞ্চ করে একটা বোতামে চাপ দিলেন সেলডন, স্কিটারটা মেঝে থেকে এক ইঞ্চির চেয়েও কম উপরে উঠে মাঝারি মসৃণ গতিতে এবং নিঃশব্দে চলতে শুরু করল। হেলান দিয়ে বসে করিডোরের দেয়াল, অন্য স্কিটারগুলো এবং দুএকজন পদব্রজীকে দেখছেন তিনি।

অনেক লাইব্রেরীয়ানকেও দেখলেন এবং এতগুলো বছর পরেও তাদেরকে দেখলে না হেসে পারেন না। ওরা হচ্ছে এম্পায়ারের সবচাইতে প্রাচীন সংঘ, যাদের রয়েছে সবচাইতে পবিত্র ঐতিহ্য, এবং এমন এক জীবন ধারা পালন করে যা কয়েক শতাব্দী পূর্বে প্রচলিত ছিল–হয়তো বা সহস্রাব্দ পূর্বে।

তাদের পোশাক রেশমের তৈরি এবং হালকা সাদা রঙের। এতটাই ঢোলা যে অনেকটা গাউনের মতো দেখায়, ঘাড়ের নিচ থেকে একসাথে পুরোটাই পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নেমে এসেছে।

পুরুষদের ক্ষেত্রে অন্যান্য গ্রহের মতো, ট্র্যানটরও দাড়ি গোঁফ রাখা এবং দাড়ি গোঁফ পরিষ্কারভাবে কামিয়ে ফেলা এই দুই দলে বিভক্ত। ট্র্যানটরের মানুষ অথবা এই গ্রহের প্রায় সকল সেক্টরের মানুষ দাড়ি গোঁফ কামিয়ে অভ্যস্ত। নিয়মটা তারা পালন করে আসছে কোন প্রাচীন কাল থেকে তার কোনো হিসাব নেই। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, যেমন ডালাইটদের গোঁফ, তার পালক পুত্র রাইখের মতো।

লাইব্রেরীয়ানরা প্রাচীনকাল থেকেই দাড়ি রাখার নিয়ম পালন করে আসছে। প্রত্যেক লাইব্রেরীয়ানই ছোট এবং সুন্দরভাবে ছাটা দাড়ি রাখে। এক কানের নীচ থেকে শুরু হয়ে আরেক কানের নীচে গিয়ে শেষ হয়েছে। ঠোঁটের উপরে কিছু নেই। এই একটা জিনিসই তাদের পৃথকত্ব বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। এক দঙ্গল লাইব্রেরীয়ানের মাঝে নিখুঁত কামানো মুখ মণ্ডল নিয়ে সেলডন কিছুটা অস্বস্তিই বোধ করতে লাগলেন।

কিন্তু তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বস্তু হচ্ছে তারা যে টুপি মাথায় পড়ে (সেলডনের ধারণা যে সম্ভবত ঘুমানোর সময়ও খোলে না)। বর্গাকার মখমল জাতীয় বস্তু দিয়ে তৈরি, চারটা পৃথক অংশ, চূড়ায় একটা বোতামের সাহায্যে আটকে রাখা হয়। কত হাজারো রঙের টুপি আছে তার কোনো হিসাব নেই এবং প্রতিটি রঙেরই রয়েছে পৃথক অর্থ। লাইব্রেরীয়ান সমাজের সাথে পরিচয় থাকলে টুপির রং দেখেই একজন লাইব্রেরীয়ান কতদিন এই পেশায় আছে, কোন বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য, কি তার অবদান ইত্যাদি আরো অনেক কিছু সহজেই বলে দেয়া যাবে। একজন। লাইব্রেরীয়ান আরেকজন লাইব্রেরীয়ানের টুপির দিকে এক পলক তাকিয়েই বলে দিতে পারবে সে সম্মান পাওয়ার যোগ্য কিনা (হলেও কতখানি) নাকি তার উপর কর্তৃত্ব খাটানো যাবে (এবং কতখানি)।

গ্যালাকটিক লাইব্রেরী ট্র্যানটরের সর্ববৃহৎ একক কাঠামো (সম্ভবত পুরো গ্যালাক্সিতেই সর্ববৃহৎ), এমন কি আয়তনে ইম্পেরিয়াল প্যালেসের চাইতেও অনেক অনেক বড়, বিশালত্বের অহংকার এবং আভিজাত্যের দীপ্তিতে সর্বদা ঝলমল করত। কিন্তু এখন তা হয়ে পড়েছে এম্পায়ারের মতোই বিবর্ণ আর ধূসর। যেন এক সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধা এমন এক দেহে চাকচিক্যময় অলংকার ধারণ করে রেখেছে যে দেহ শীর্ণ আর দীর্ণ হয়ে গেছে বহু বছর আগেই।

চীফ লাইব্রেরীয়ানের অলংকৃত দরজার সামনে স্কিটার থেমে দাঁড়াল।

হাসি মুখে সেলডনকে আমন্ত্রণ জানাল ল্যাস জিনো। “এসো, মাই ফ্রেণ্ড,” সুরেলা উচ্চ কণ্ঠে বলল সে। (সেলডনের জানার ভীষণ আগ্রহ যে লোকটা তরুণ বয়সে কখনো সপ্ত সুরে সঙ্গীত চর্চা করেছে কিনা, যদিও প্রশ্ন করার সাহস হয় নি। চীফ লাইব্রেরীয়ানের পদ অত্যন্ত সম্মানজনক একটা পদ। এই ধরনের প্রশ্ন অপমানজনক হতে পারে।)

“অভিনন্দন,” সেলডন বললেন। জিনোর দাঁড়ি ধূসর বর্ণের, তবে প্রায় সাদা হতে চলেছে, আর তার টুপি পুরোপুরি সাদা। কোনো রকম ব্যাখ্যা ছাড়াই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন সেলডন। সম্পূর্ণ বিপরীত প্রদর্শনী। রঙ এর অনুপস্থিতির অর্থ সর্বোচ্চ পদমর্যাদা।

হাতে হাতে ঘষল জিনো, ভেতরের খুশি খুশি ভাবের বহি:প্রকাশ। “তোমাকে ডেকেছি, হ্যারি, কারণ তোমার জন্য সুসংবাদ আছে।–আমরা পেয়েছি।”

“অর্থাৎ–“

“উপযুক্ত একটা গ্রহ। তুমি অনেক দূরে চেয়েছিলে। সম্ভবত আমরা আদর্শ একটা গ্রহ খুঁজে পেয়েছি।” মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো। “লাইব্রেরীর হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দাও, হ্যারি। যা চাও তাই বের করে দিতে পারব।”

“সেই ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। গ্রহটার ব্যাপারে বল।”

“প্রথমে তোমাকে অবস্থান দেখাই।” দেয়ালের কিছু অংশ একপাশে সরে গেল। নিভু নিভু হয়ে গেল কামরার আলো, তার মাঝে ফুটে উঠল গ্যালাক্সির ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি। এখানেও লাল বর্ণ দ্বারা এ্যানক্রিয়ন প্রদেশ চিহ্নিত হয়ে আছে, ফলে তিন তরুণের সাথে একটু আগের আলাপচারিতা আবার মনে পড়ল।

তারপর এ্যানক্রিয়ন প্রদেশের সীমানার বাইরে নীল বর্ণের একটা বিন্দু ফুটে উঠল। “এটাই,” জিনো বলল। “পুরোপুরি উপযুক্ত। নিখুঁত আয়তন, পর্যাপ্ত পানি, চমৎকার অক্সিজেন বায়ুমন্ডল, উদ্ভিদ। বৈচিত্র্যপূর্ণ সি-লাইফ। তৈরি হয়েই আছে শুধু গিয়ে কাজ শুরু করলেই হবে। কোনোরকম প্ল্যানেট মোল্ডিং* বা টেরাফর্মিং** এর প্রয়োজন নেই–বসবাসের জন্য একেবারে তেরি হয়েই আছে।”

“এই গ্রহে মানুষ বাস করে না, ল্যাস?”

“না, একজনও না।”

“কিন্তু কেন–অর্থাৎ গ্রহটা যদি এতই আদর্শ হয়? আমার ধারণা ওই গ্রহেও অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল। তাহলে কলোনি তৈরি করা হয়নি কেন?”

“অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল, কিন্তু মনুষ্যবিহীন ভোব এর সাহায্যে। আর কলোনি স্থাপন করা হয়নি। কারণ সম্ভবত দূরত্ব। গ্রহটা এমন এক নক্ষত্র প্রদক্ষিণ করে যা কেন্দ্রের কৃষ্ণ গহ্বর থেকে অন্যান্য গ্রহ সাধারণত: যত দূরে তার চেয়েও অনেক অনেক দূরে–কল্পনাতীত দূরে। কিন্তু আমার মনে হয় তোমার জন্য অনেক দূরে নয়। তুমি বলেছিলে, যত দূরে, ততই ভালো।”

“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে বললেন সেলডন। “এখনো তাই বলব। গ্রহটার কোনো নাম আছে নাকি শুধু বর্ণ অর সংখ্যার সমষ্টি?”

“বিশ্বাস কর আর না-ই কর, নাম একটা আছে। যারা পোব পাঠিয়েছিল তারাই গ্রহটার নাম দিয়েছে টার্মিনাস, অতি প্রাচীন একটা শব্দ যার অর্থ ‘শেষ প্রান্ত। এবং আসলেই তাই।”

“গ্রহটা কি এ্যানক্রিয়ন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত?”

“না, লক্ষ্য করে দেখো, টার্মিনাসের নীল বিন্দু এ্যানাক্ৰিয়নের সীমানা নির্দেশকারী লাল রেখা থেকে কিছুটা দূরে–আসল হিসাবে পঞ্চাশ আলোকবর্ষ দূরে। টার্মিনাস কারোরই না। এমনকি এম্পায়ারেরও অংশ না।

“ঠিকই বলেছ, ল্যাস, বোধহয় এইরকম একটা গ্রহই আমার দরকার।”

জিনো আবারো হাত ঘষল। “কি চমৎকার পরিকল্পনা। অনেক অনেক দূরে, বাকী মহাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরোপুরি নিঃসঙ্গ অবস্থায় আনকোরা নতুন এক গ্রহে বিশাল এক প্রজেক্ট শুরু করা যেন বছরের পর বছর এবং দশকের পর দশক সাধনা করে মানবজাতির যাবতীয় জ্ঞানের এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করা যায়। এই লাইব্রেরীতে যা আছে তার সার সংক্ষেপ। বয়স আরো কম হলে আমিও এই অভিযানে যোগ দিতাম।”

“তোমার বয়স আমার চেয়ে বিশ বছর কম।” বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন সেলডন। (প্রায় সবাই বয়সে আমার চেয়ে তরুণ, ততোধিক বিষণ্ণ মনে কথাটা ভাবলেন।)

“ও, হ্যাঁ, শুনেছি সত্তর বছর পার হয়ে এসেছ। আশা করি উৎসব উপভোগ করেছ।”

“আমি জন্মদিন পালন করি না।”

“কেন, আমি তোমার ষাটতম জন্মদিনের কথা শুনেছি। বিখ্যাত ঘটনা।”

প্রচণ্ড দুঃখবোধে আচ্ছন্ন হলেন সেলডন, এতটাই গভীর যেন তার জীবনের সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনাটা মাত্র গতকালই ঘটেছে। দয়া করে এই ব্যাপারে কোনো কথা বলল না।”

জিনো লজ্জা পেল। “দুঃখিত। অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি।–তুমি যে ধরনের গ্রহ খুঁজছ যদি সেটা টার্মিনাস হয়, তাহলে আমার মতে তোমার এনসাইক্লোপিডিয়া প্রজেক্টের প্রাথমিক কাজের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেল। মনে রেখো, লাইব্রেরী তোমাকে সবরকম সহযোগীতা দিতে প্রস্তুত।”

“আমি জানি, ল্যাস। তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।”

উঠে দাঁড়ালেন তিনি। দশ বছর আগের জন্মদিনের উৎসবের কথা মনে হওয়াতে যে প্রচণ্ড দুঃখবোধে আচ্ছন্ন হয়েছে সে জন্য মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারলেন না। বললেন, “আসি, কাজ চালিয়ে যেতে হবে।”

তিনি যা করছেন সেজন্য কিছুটা বিবেকের তাড়না বোধ করলেন। কারণ তার আসল উদ্দেশ্য কি সেই ব্যাপারে ল্যাস জিনোর বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

——
* প্ল্যানেট মোল্ডিং–জীবন ধারণের অনুপযোগী কোনো গ্রহকে রূপান্তরিত করে বাস যোগ্য করে তোলা।

**টেরাফর্মিং জীবন ধারনের অনুপযোগী পরিবেশকে বাসযোগ্য করে তোলা।

.

৩.

ছোট কামরা কিন্তু আরামদায়ক। এটাই গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে হ্যারি সেলডনের অফিস। গত কয়েক বছর থেকে এখানেই তিনি তার অধিকাংশ সময় কাজে ব্যস্ত থাকেন। লাইব্রেরীর মতো এই কামরার অবয়বও বিবর্ণ ধূসর, ক্লান্ত মনে হয় কোনো একটা বস্তু দীর্ঘদিন এক জায়গাতেই পড়ে আছে। সেলডন জানেন বস্তুটা তারপরেও এখানেই থাকবে, একই জায়গাতে, আরো একশ বছর অথবা প্রয়োজনীয় মেরামত করে নিলে আরো এক হাজার বছর।

এখানে তিনি কিভাবে এলেন?

বার বার, অতীতের স্মৃতি তার মনে দোলা দেয়, জীবনের উত্থান-পতন, সুখ দুঃখ, হাসি-কান্না মনের অলিতে গলিতে নিরন্তর প্রবাহিত হয়ে চলে। কোনো সন্দেহ নেই বুড়ো হচ্ছেন বলেই এমন স্মৃতি কাতরতা। অতীতে কত কিছু ছিল, ভবিষ্যতে কিছুই নেই, আর তাই সামনের অনিশ্চয়তা থেকে মুখ ফিরিয়ে যা হারিয়ে গেছে তার মাঝে মন নিরাপত্তা পেতে চায়।

যদিও তার ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে সাইকোহিস্টোরির যে অগ্রগতি হয়েছে সেটাকে সরল রেখার সাথে তুলনা করা যায়। অগ্রগতি ছিল ধীর, কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে সরল পথে এগিয়েছে। তারপর ছয় বছর আগে সোজা পথটা ডানদিকে মোড় নেয়। একেবারে অপ্রত্যাশিত ভাবে।

সেলডনের মনে আছে কিভাবে তা হয়েছিল। কিভাবে কতগুলো ঘটনার সমন্বয়ে তা সম্ভব হয়েছিল।

ওয়ানডা, সেলডনের নাতনী। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলেন তিনি। ছয় বছর আগের ঘটনাগুলোর ছবি একে একে পরিষ্কার মানশ্চক্ষে ফুটে উঠল।

ওয়ানডা তখন বারো বছরের কিশোরী, তখন খানিকটা নিঃসঙ্গ, সঙ্গী হারা হয়ে পড়েছিল। তার মা, মানীলা নতুন এক শিশুর জন্ম দিয়েছে। এবারও মেয়ে, নাম রাখা হয়েছে বেলিস। অর ওই সময় নতুন শিশুই সবার মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়।

তার বাবা, রাইখ, হোম সেক্টর ডালের উপর বই লিখে শেষ করেছে। বইটা মোটামুটি সাড়া জাগিয়ে তুলে, নিজেও ছোটখাটো সেলিব্রিটিতে পরিণত হয়। অনেক জায়গাতে তাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হতে থাকে, বিষয়টাতে সে এত বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, ফলশ্রুতিতে অধিকাংশ সময়ই তাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হতো। বাড়িতে থাকলেও নতুন শিশুকেই পুরো সময় দিত।

আর ডর্স–চলে গেছে চিরতরে–সেলডনের জন্য সেই আঘাত এখনও দগদগে তাজা। তিনি একটা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলেন। ওয়ানডার স্বপ্ন থেকেই ঘটনার শুরু যার সমাপ্তি ডর্সের বিদায়।

ওয়ানডার এখানে কোনো দোষ নেই–সেলডন ভালো করেই জানেন। তারপরেও তিনি বাচ্চা মেয়েটাকে দূরে ঠেলে দিলেন। নতুন শিশু জন্ম নেয়াতে তার যে নিঃসঙ্গতা তৈরি হয় তাতে তিনি কোনো সাহায্য করতে পারলেন না।

আর ওয়ানডা বিষণ্ণ মন নিয়ে সেই মানুষটার কাছে গেল যে মানুষটা তাকে দেখলে ভীষণ খুশি হয়, যে মানুষটাকে সে ভীষণ পছন্দ করে। আর সে হচ্ছে। ইউগো এমারিল, সাইকোহিস্টোরি ডেভেলপম্যান্টে হ্যারি সেলডনের পরেই তার অবস্থান কিন্তু এই অগ্রগতিতে দিন রাত যে শ্রম সে দিয়েছে তাতে হ্যারি সেলডনকেও ছাড়িয়ে গেছে। হ্যারি সেলডনের ছিল ডর্স, আছে রাইখ, কিন্তু সাইকোহিস্টোরিই ইউগোর জীবন, তার স্ত্রী নেই, সন্তান নেই। তাই ওয়ানডা যখনই আসে কিসের যেন একটা অভাব বোধ করে সে। বাচ্চা মেয়েটার প্রতি অসম্ভব ভালোবাসার এটাই হয়তো মূল কারণ। ওয়ানডাকে সে ছোটখাট বয়স্ক মানুষ মনে করে, ওয়ানডাও ব্যাপারটা পছন্দ করে।

ছয় বছর আগে ওয়ানডা এসেছিল ইউগোর অফিসে। ইউগো তার নতুন সংস্থাপিত চোখে ঘুম ঘুম দৃষ্টি নিয়ে তাকাল, অভ্যাসবশত কিছুটা সময় লাগল চিনতে।

তারপর বলল, “আরে আমার ছোট বন্ধু, ওয়ানডা–কিন্তু মন এতো খারাপ কেন?”

ওয়ানডার নিচের ঠোঁট কাঁপতে লাগল। বলল, “কেউ আমাকে ভালোবাসে না।”

“কি বলছ, এটা সত্যি নয়।”

“সবাই নতুন বাচ্চাটাকে ভালোবাসে, আমাকে না।”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

“তাহলে, আঙ্কল ইউগো, শুধু তুমিই,” যেহেতু এখন আর ছোটবেলার মতো ইউগোর কোলে চড়ে বসতে পারে না, তাই তার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল ওয়ানডা।

এইরকম পরিস্থিতিতে কি করতে হয় এমারিলের কোনো ধারণা নেই। ওয়ানডাকে দুহাতে জড়িয়ে বলতে লাগল, “কেঁদো না। কেঁদো না।” প্রচণ্ড স্নেহে তার মনটা আর্দ্র হয়ে গেল। যেহেতু কাঁদবার মতো ঘটনা তার জীবনে বলতে গেলে নেই, টের পেল যে তার চোখের পানিও গাল বেয়ে নামছে।

হঠাৎ উজ্জীবিত হয়ে বলল, “ওয়ানডা, মজার একটা জিনিস দেখবে?”

“কি?” ফোঁপাতে ফোঁপাতে জিজ্ঞেস করল ওয়ানডা।

এমারিল শুধু একটা বিষয়ই জানে আর মহাবিশ্ব সত্যিই সুন্দর। “তুমি কখনো প্রাইম রেডিয়্যান্ট দেখেছ?”

“না। ওটা কি?”

“জিনিসটা নিয়ে তোমার দাদু আর আমি কাজ করি। দেখেছ? ওই যে ওখানে।”

ডেস্কের উপর কালো ছোট ত্রিকোণ বস্তুটা দেখে মুখ বাঁকিয়ে ওয়ানডা বলল, “সুন্দর না।”

“এখন সুন্দর দেখাচ্ছে না, একমত হলো এমারিল। “কিন্তু দেখ না চালু করলে কি হয়।”

অন্ধকার হয়ে গেল কামরাটা। নানা রঙের আলোর বিন্দু আর ঝলকানি ফুটে উঠল। “দেখেছ? এখন আমরা এটাকে পরিবর্ধিত করব। তাহলে বিন্দুগুলো গাণিতিক চিহ্নে পরিণত হবে।”

মনে হলো অনেকগুলো বস্তু একযোগে তাদের দিকে ছুটে আসছে, চারপাশে শূন্যে ঝুলে আছে হাজারো রকমের চিহ্ন, বর্ণ, সংখ্যা, তীরচিহ্ন, আকৃতি, জীবনে এগুলো কখনো দেখে নি ওয়ানডা।

“সুন্দর না?” এমারিল জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, সুন্দর,” জবাব দিল ওয়ানডা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সমীকরণগুলোর দিকে। যদিও সে জানত না যে এই সমীকারণগুলোই সম্ভাব্য ভবিষ্যত তৈরি করবে। এটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। মনে হয় ভুল।” তার ডান দিকের একটা বর্ণিল সমীকরণের দিকে আঙ্গুল তুলল সে।

“ভুল? ভুল মনে হচ্ছে কেন?” ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল এমারিল।

“কারণ এটা… সুন্দর না। আমি অন্যভাবে করতাম।”

গলা পরিষ্কার করল এমারিল। “ঠিক আছে। আমি ঠিক করার চেষ্টা করব।” কাছে এগিয়ে সমীকরণটার দিকে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে রইল।

“ধন্যবাদ, আঙ্কল ইউগো, সুন্দর একটা জিনিস দেখানোর জন্য। হয়তো একদিন আমি এগুলোর অর্থও বুঝতে পারব।”

“ঠিক আছে। আশা করি এখন তোমার ভালো লাগছে।”

“কিছুটা, ধন্যবাদ।” চট করে একটু হেসে চলে গেল সে।

মনে কষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এমারিল, প্রাইম রেডিয়েন্টের উপাদান নিয়ে কোনো ধরনের সমালোচনা তার সহ্য হয় না। আর সেটা যদি হয় বারো বছরের শিশুর কাছ থেকে তাহলে তো কথাই নেই।

কিন্তু সে বুঝতেই পারল না যে সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে।

.

৪.

ওইদিন দুপুরে এমারিল সেলডনের স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয় অফিসে গেল। অবাক করার মতো ঘটনা, কারণ এমারিল কখনো নিজের অফিস থেকে বেরোয় না, এমনকি পাশের কামরায় যাওয়ার জন্যও না।

“হ্যারি,” ভুরু কুঁচকানো, চেহারায় একটা দ্বিধাগ্রস্ততা। “অস্বাভাবিক একটা ঘটনা ঘটেছে। খুবই অদ্ভুত।”

এমারিলকে দেখে সেলডন আরো বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সেই কেমন বুড়ো হয়ে গেছে সে, হাঁটার সময় কুঁজো হয়ে হাঁটে, শুকিয়ে কংকালসার হয়ে গেছে। জোর করলে মাঝেমাঝে চিকিৎসকের কাছে যায়। চিকিৎসকরা বলেছে যে তাকে কিছুদিনের জন্য কাজ থেকে (দুএকজন বলেছে পুরোপুরি) ছুটি নিতে হবে, তবেই স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে পারে, অন্যথায় হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নেড়েছেন সেলডন। “কাজ থেকে সরিয়ে নিলে আরো তাড়াতাড়িই মারা যাবে এবং মনে কষ্ট নিয়ে মরবে। আমাদের কোনো উপায় নেই।”

তারপর খেয়াল করলেন যে তিনি আসলে এমারিলের কথা শুনছেন না।

“দুঃখিত, ইউগো। একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। আবার বল।”

“আমি বলছি যে অস্বাভাবিক একটা ঘটনা ঘটেছে। খুবই অদ্ভুত।”

“কি হয়েছে, ইউগো?”

“ওয়ানডা। আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল–ভীষণ মন খারাপ, বিষণ্ণ।”

“কেন?”

“নতুন বাচ্চাটার কারণে।”

“ও হ্যাঁ,” অপরাধবোধ ঝড়ে পড়ল সেলডনের কণ্ঠে।

“আমার কাঁধে মাথা রেখে কান্নাকাটি করল–আমিও একটু কেঁদেছি, হ্যারি। তারপর ভাবলাম ওর মন ভালো করার জন্য প্রাইম রেডিয়্যান্ট দেখাই।” এই পর্যায়ে এমারিল খানিকটা ইতস্ততঃ করতে লাগল, পরের কথাগুলো কিভাবে বলবে ভাবছে।

“বল, ইউগো। কি হয়েছিল?”।

“আলোর বিন্দু দেখে সে বেশ খুশি হয়। আমি একটা অংশ পরিবর্ধিত করি। আসলে ওটা ছিল সেকশন ৪২ R ২৫৪। তুমি সমীকরণটার সাথে পরিচিত?”

মুচকি হাসলেন সেলডন। “না, ইউগো। তোমার মতো করে আমি সমীকরণগুলো মনে রাখতে পারি না।”

“পারা উচিত,” বিরক্ত হয়ে বলল এমারিল। “ভালো কাজ কিভাবে করবে যদি যাই হোক বাদ দাও। আমি যা বলতে চাইছি সেটা হলো ওয়ানডা একটা অংশ দেখিয়ে বলল এটা ভালো না। সুন্দর না।”

“বলতেই পারে। আমাদের সবারই ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ আছে।”

“অবশ্যই আছে, কিন্তু পরে আমি ওই সমীকরণটা পরীক্ষা করে দেখেছি, হ্যারি, এবং ওখানে আসলেই কিছু সমস্যা আছে। প্রোগ্রামিং নিখুঁত নয় আর ওয়ানডা ঠিক যে অংশটা দেখিয়েছিল তা আসলেই ভালো না। এবং সত্যিই সুন্দর না।”

সোজা হয়ে বসলেন সেলডন, ভুরু কুঁচকে ফেলেছেন। “ঠিকমতো বুঝতে দাও ইউগো। এলোপাতাড়িভাবে সে একটা কিছু দেখিয়ে বলল এটা ভালো না আর তার কথাই সত্যি হলো?”

“হ্যাঁ, সে দেখিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এলোপাতাড়িভাবে নয়; নিশ্চিত হয়ে দেখিয়েছে।”

“অসম্ভব।”

“কিন্তু তাই হয়েছে। আমি ওখানে ছিলাম।”                                                  

“ঘটে নি যে তা তো বলি নি। বলছি যে পুরোটাই একটা বেপরোয়া কো ইন্সিডেন্স।”

“তাই? সাইকোহিস্টোরির সকল জ্ঞান একত্রিত করে বলতো নতুন কতগুলো সমীকরণের দিকে এক পলক তাকিয়েই তুমি বলে দিতে পারবে এই অংশটা ভালো না।”

“ঠিক আছে, ইউগো, সমীকরণ থেকে ঠিক ওই অংশটাই পরিবর্ধিত করলে কেন তুমি? কেন বেছে নিলে?”

কাঁধ নাড়ল ইউগো। “চাইলে তুমি কো-ইন্সিডেন্স বলতে পার।”

“ওটা কো-ইন্সিডেন্স হতেই পারে না।” বিড়বিড় করে বললেন সেলডন। চিন্তায় ডুবে গেলেন। তারপর যে প্রশ্নটা করলেন তাতেই ওয়ানডার শুরু করা সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিপ্লবের চাকা ঘুরতে শুরু করল।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ইউগো, এই সমীকরণগুলো নিয়ে তোমার মনে আগে কোনো সন্দেহ ছিল? কোনো কারণে বিশ্বাস করতে ওগুলোতে সমস্যা আছে?”

কিছুটা বিব্রত ভঙ্গীতে ইউগো তার পোশাকের কিনারা খুটছে। “হ্যাঁ, মনে হয় ছিল। তুমি–“

“মনে হয় ছিল?”

“অবশ্যই সন্দেহ ছিল। নতুন সমীকরণ–সেটআপের সময় আমি ছিলাম। এখন মনে পড়ছে ওই সময় ঠিক মনে হলেও আমার সন্দেহ ছিল কোনো একটা গোলমাল আছে। অন্য কাজের চাপে আবার পরীক্ষা করে দেখতে ভুলে যাই। কিন্তু ওয়ানডা ঠিক ওই অংশটা দেখিয়ে দেয়ায় আমি পরীক্ষা করে দেখি–অন্যথায় হয়তো বাচ্চা মানুষের মন্তব্য ধরে নিয়ে ভুলে যেতাম।”

“আর তুমি ওয়ানডাকে দেখানোর জন্য ঠিক ওই সমীকরণটাই বের করে আনলে। যেন তোমার অবচেতন মনে এটা ছিল।”

এমারিল কাঁধ নাড়ল। “কে জানে?”

“আর তার একটু আগেই তোমরা খুব কাছাকাছি ছিলে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ছিলে, কাঁদছিলে।

আবারো কাঁধ নাড়ল এমারিল, আরো বেশী বিব্রত দেখাচ্ছে তাকে।

“আমি বুঝে ফেলেছি, ইউগো, কি হয়েছে। ওয়ানডা তোমার মাইন্ড রিড করেছে।”

লাফ দিয়ে উঠল এমারিল যেন কেউ তাকে আঘাত করেছে। “অসম্ভব!”

ধীরে ধীরে সেলডন বললেন, “একসময় আমি একজনকে চিনতাম যার এই ধরনের মেন্টাল পাওয়ার ছিল-” ইটো ডেমারজেল (অথবা ডানীল, যে গোপন নামটা শুধু সেলডনই জানেন) এর কথা মনে পড়ল।–“সে আসলে মানুষ ছিল না। কিন্তু মানুষের মাইন্ড বোঝা, তাদের ভেতরের চিন্তা অনুভব করা, তাদেরকে নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করা–এগুলো সবই মেন্টাল এ্যাবিলিটি। আমার ধারণা ওয়ানডা কোনোভাবে সেই এ্যাবিলিটি নিয়ে জন্মেছে।”

“আমি বিশ্বাস করি না।”

“আমি করি। কিন্তু জানি না কি করব।” হালকাভাবে সাইকোহিস্টোরিক্যাল গবেষণায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন তিনি টের পাচ্ছেন– কিন্তু ভীষণ হালকাভাবে।

.

৫.

“বাবা,” দুঃশ্চিন্তার সুরে বলল রাইখ, “তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”

“হ্যাঁ,” জবাব দিলেন সেলডন। “ক্লান্ত। তোমার কি খবর?” রাইখের বয়স এখন চুয়াল্লিশ। চুল ধূসর হতে শুরু করেছে। তবে তার গোঁফ এখনো ডালাইটদের মতোই ঘন আর কালো। সেলডনের ধারণা কলপ ব্যবহার করে, কিন্তু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না।

“লেকচারের জন্য আবারো দূরে কোথাও যাবে?” জিজ্ঞেস কররেন তিনি।

“হ্যাঁ, বেশী দিনের জন্য না। বাড়ি ফিরে বেলিস, মানীলা আর ওয়ানডাকে দেখলে ভীষণ ভালো লাগে। আর তোমাকে।”

“ধন্যবাদ। কিন্তু তোমার জন্য খবর আছে, রাইখ। লেকচার বাদ। এখানে তোমাকে আমার প্রয়োজন।”

ভুরু কুঁচকালো রাইখ। “কেন?” এর আগেও দুইবার জটিল মিশনে যেতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তখন ছিল জোরামাইট আন্দোলনের যুগ। যতদূর জানে এখন তেমন কোনো ঝামেলা নেই, বিশেষ করে জান্তার পতন এবং তুলনামূলকভাবে দুর্বল নতুন সম্রাটের ক্ষমতায় আরোহন।

“ব্যাপারটা ওয়ানডাকে নিয়ে,” বললেন সেলডন।

“ওয়ানডাকে নিয়ে? কি হয়েছে ওর?”

“কিছুই হয় নি, কিন্তু ওর একটা কমপ্লিট জেনোম* তৈরি করতে চাই–সেই। সাথে তোমার এবং মানীলার এবং নতুন বাচ্চাটারও।”

“বেলিসের জন্যও? কি হচ্ছে এসব?”

ইতস্ততঃ করছেন সেলডন। “রাইখ, তুমি জানো আমি আর তোমার মা বিশ্বাস করি তোমার মাঝে অদ্ভুত কিছু গুণাবলী আছে। এমন একটা গুণ যা সহজেই মানুষের বিশ্বাস আর ভালোবাসা অর্জনে সক্ষম।”

“জানি, অনেকবারই আমাকে বলেছ, বিশেষ করে যখন কঠিন কোনো কাজ করিয়ে নেয়ার দরকার হয়। কিন্তু সত্যি বলছি, আমি কখনো অনুভব করি নি।”

“না, প্রথম দিনই তুমি আমার আর… ডর্সের (চার বছর হয়ে গেল ডর্স ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু এখনো এই নামটা উচ্চারণ করতে গেলে ভীষণ কষ্ট হয় সেলডনের) বিশ্বাস অর্জন করে ফেল। রিশেলীর মন জয় করতে সক্ষম হও। জোরানিউম। মানীলা। এগুলোর ব্যাখ্যা দেবে কিভাবে?”

“বুদ্ধি এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।” দাঁত বের করা হাসি দিয়ে রাইখ বলল। “কখনো মনে হয়েছে তুমি আসলে ওদের–আমাদের মাইন্ড স্পর্শ করেছ?”

“না, কখনো মনে হয় নি। কিছু মনে করো না, বাবা, যা বললে তা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়।”

“যদি বলি যে ওয়ানডা একটা সমস্যার মুহূর্তে ইউগোর মাইন্ড পড়তে পেরেছিল?”

“আমি বলব কো-ইন্সিডেন্স এবং কল্পনা।”

“রাইখ, আমি একজনকে চিনতাম যে মানুষের মাইন্ড কন্ট্রোল করতে পারত যেভাবে আমি আর তুমি যে কোনো আলোচনার গতি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।”

“কে?”

“বলা যাবে না। কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস কর।”

“বেশ–” রাইখের কণ্ঠে সন্দেহের সুর।

“গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে খোঁজ খবর করে কৌতূহল জাগানোর মতো একটা ঘটনা জানতে পেরেছি। বিশ হাজার বছরের পুরনো গল্প, তখনো হাইপারস্পেশাল ট্রাভেল শুরু হয় নি। ওয়ানডার বয়সী এক মেয়ের গল্প। মেয়েটা নেমেসিস নামের এক নক্ষত্র প্রদক্ষিণরত পুরো একটা গ্রহের সাথে যোগাযোগ করতে পারত।”

“নিঃসন্দেহে রূপকথা।”

“হ্যাঁ, এবং অসম্পূর্ণ গল্প। কিন্তু ওয়ানডার সাথে তার মিলটা অবাক করার মতো।”

“বাবা, কি করতে চাইছ তুমি?”

“জানি না, রাইখ। জেনোমে কি পাওয়া যায় দেখি। ওয়ানডার মতো আরো যারা আছে তাদেরকে খুঁজে বের করতে চাই। আমি জানি এই ধরনের মেন্টাল এ্যাবিলিটি নিয়ে শিশু জন্মাচ্ছে–সংখ্যায় হয়তো কম। ক্ষমতাটা তাদের জন্য সমস্যা তৈরি করে বলে তারা এটা লুকিয়ে রাখতে শিখে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের এই ক্ষমতা, মেধা মনের গহীনে চাপা পড়ে যায় অনেকটা অবচেতন ভাবে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টার মতো। নিশ্চয়ই এম্পায়ারে বা শুধু ট্র্যানটরের চারশ কোটি মানুষের মাঝে ওয়ানডার মতো আরো অনেকেই আছে। ওয়ানডার জেনোম পেলে ওদেরকে খুঁজে বের করা সহজ হবে।”

“খুঁজে পাওয়ার পর ওদেরকে নিয়ে কি করবে?”

“আমার মনে হচ্ছে সাইকোহিস্টোরির পরবর্তী অগ্রগতির জন্য এই মানুষগুলোকেই দরকার।”

“আর প্রথমেই খুঁজে পেলে ওয়ানডাকে এবং তাকে তুমি সাইকোহিস্টোরিয়ান বানাতে চাও?”

“হয়তো।”

“ইউগোর মতো।–না, বাবা!”

“কেন?”

“আমি চাই ওয়ানডা গ্যালাক্সির আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো বেড়ে উঠবে। দিনরাত প্রাইম রেডিয়্যান্টের সামনে বসে থেকে সাইকোহিস্টোরিক্যাল গণিতের জীবন্ত স্মৃতিসৌধ হয়ে উঠুক তা চাই না।”

“সেরকম নাও হতে পারে, রাইখ, কিন্তু ওয়ানডার জেনোম তৈরি করতেই হবে। তুমি তো জানই হাজার বছর ধরে প্রতিটি মানুষের জেনোম ফাইল তৈরি করার কথা বলা হচ্ছে। শুধুমাত্র অত্যধিক খরচের কারণেই ব্যাপকহারে প্রচলন করা যাচ্ছে না; কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কারো মনে সন্দেহ নেই। সুবিধা যে কত তুমিও বুঝতে পারছ। অস্বাভাবিক কিছু না পেলেও, বিভিন্ন রকম মানসিক পরিস্থিতিতে ওয়ানডার আচরণ কেমন হবে সেটা আমরা জানতে পারব। যদি ইউগোর জেনোম তৈরি করে রাখতাম তাহলে আমার বিশ্বাস সে এভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে পারত না।

“হয়তো, বাবা, কিন্তু বাজী ধরে বলতে পারি যে মানীলা আমার চেয়েও বেশী বাধা দেবে।”

“ঠিক আছে। কিন্তু মনে রেখ, আগামী কিছুদিন দূরে কোথাও যেতে পারবে না। এখানে তোমাকে আমার প্রয়োজন।”

“দেখা যাবে,” এই কথাটা বলেই চলে গেল রাইখ।

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে ছিলেন সেলডন। একজনকেই তিনি চিনতেন–ইটো ডেমারজেল–যে মাইন্ড হ্যান্ডল করতে পারত। সে কাছে থাকলে এখন বলে দিতে পারত কি করা উচিত। ডর্স তার অমানবীয় জ্ঞান দ্বারা বলে দিতে পারত এখন কি করা উচিত।

আর তিনি, হালকা কুয়াশার মতো ঝাপসা একটা ছবি মনের মাঝে তৈরি হচ্ছে বুঝতে পারছেন–শুধুই ঝাপসা একটা ছবি–নতুন এক সাইকোহিস্টোরির ধারণা।

—-
* জেনোম–পিতা মাতার কাছ থেকে সন্তানের দেহে পরিবাহিত গুণাবলীর বিস্তারিত জেনেটিক বিবরণী তৈরি করার প্রক্রিয়া। বিশেষ করে ক্রোমোসম বিশ্লেষণ।

.

৬.

ওয়ানডার কমপ্লিট জেনোম তৈরি করাটা সহজ ছিল না। প্রথমত: জেনোম করার প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি আছে এমন বায়োফিজিসিস্ট এর সংখ্যা হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। যারা আছে তারাও অসম্ভব ব্যস্ত থাকে।

আবার বায়োফিজিসিস্টরা যেন বেশী কৌতূহলী না হয় সেজন্য তার মূল প্রয়োজনের কথাটা সরাসরি বলাও সম্ভব ছিল না। সেলডন অনুভব করছেন যে কারণে তিনি ওয়ানডার মেন্টাল পাওয়ারের ব্যাপারে আগ্রহী তা গ্যালাক্সির সবার কাছে গোপন রাখা অত্যন্ত জরুরী।

আর যদি অন্য কোনো কারণের দরকার হয় সেটা হলো পুরো প্রক্রিয়াটা অসম্ভব ব্যয়বহুল।

বায়োফিজিসিস্ট এর নাম মিয়ান এন্ডলেকি। সেলডন মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এত ব্যয়বহুল কেন ড, এন্ডলেকি? যদিও আমি এই ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ নই, তবে যতদূর জানি যে পুরো প্রক্রিয়াটা কম্পিউটারাইজড। ত্বকের একটা কোষ বের করে নিতে পারলে জেনোম সম্পন্ন করে বিশ্লেষণ করা একদিনের ব্যাপার।”

“কথাটা সত্যি। কিন্তু ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক এসিড অনুগুলো যখন লাখ লাখ নিউক্লিওটাইডস এ বিভাজিত হয় তখন প্রতিটি পিউরিং এবং পিরিমিডাইন জায়গামতো রাখা অসম্ভব ব্যাপার। এখানেই শেষ নয়, প্রফেসর সেলডন। তারপর প্রতিটি বিশ্লেষণ করে একটা মাপকাঠির সাথে তুলনা করতে হয়।

“এবার ভেবে দেখুন, যদিও কমপ্লিট জেনোমের রেকর্ড আমাদের আছে কিন্তু সেটা বাস্তবে যে পরিমাণ জেনোম আছে তার ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। কাজেই নিশ্চিত হয়ে বলা যাবে না এই মাপকাঠি কতখানি বিশ্বাসযোগ্য।”

“এত কম কেন?”

“অনেক কারণে। অত্যধিক ব্যয় একটা কারণ। অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন না হলে খুব কম লোকই এই ব্যয় বহন করতে চায়। আর তেমন কোনো কারণ না থাকলেও ভয়েই অনেক সময় করতে চায় না। যদি মারাত্মক কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে। আপনি সত্যিই আপনার নাতনীর জেনোম করতে চান?”

“হ্যাঁ, চাই। জরুরী।”

“কেন? তার মাঝে কি অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?”

“না, বরং উল্টোটা। তার চরিত্রের বৈশিষ্ট সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা এবং আমি জানতে চাই কেন।”

“কোনদিক দিয়ে আলাদা?”

“মেন্টালি, ঠিক ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না যেহেতু আমি নিজেই ভালোমতো বুঝতে পারছি না। হয়তো জেনোম হলে বলতে পারব।”

“বয়স কত?”

“বারো। কিছুদিন পরেই তেরতে পা দেবে।”

“সেক্ষেত্রে তার বাবা মার অনুমতি লাগবে।”

কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিলেন সেলডন। “সেটা একটু কঠিন হবে। আমি ওর দাদা। আমার অনুমতি যথেষ্ট নয়?

“আমার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আমি আইনের কথা বলছি। লাইসেন্স হারাতে চাই না।”

বাধ্য হয়ে সেলডন আবারও রাইখের দ্বারস্থ হলেন। এবার সে আরো বেশী আপত্তি জানাল তার সাথে যোগ দিল মানীলা। তাদের এক কথা। ওয়ানডা স্বাভাবিক মানুষের মতোই বড় হবে। যদি জেনোমে অস্বাভাবিক কিছু বের হয়ে পড়ে? যদি তাকে বাবা মার কাছ থেকে আলাদা করে ল্যাবেরটরীতে গবেষণার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়? যদি সেলডন তাকে সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টে অন্তর্ভুক্ত করে এমন এক জীবনে ঠেলে দেন যেখানে দিনরাত শুধু কাজ, অন্য কোনো আনন্দ নেই, যদি তাকে সমবয়সী সঙ্গী সাথীদের কাছ থেকে আলাদা করে দেয়া হয়? কিন্তু সেলডন ছিলেন নাছোড়বান্দা।

“বিশ্বাস কর, রাইখ। ওয়ানডার ক্ষতি হতে পারে এমন কাজ আমি কখনোই করব না। কিন্তু ওয়ানডার জেনোম আমাকে জানতেই হবে। ওয়ানডার বৈশিষ্ট্য আমাকে জানতেই হবে। যদি আমার সন্দেহ সঠিক হয় তাহলে আমরা সাইকোহিস্টোরি নতুন এক পথে পরিচালিত করতে পারব, সেই সাথে গ্যালাক্সির ভবিষ্যত।”

কাজেই রাইখকে রাজী হতে হলো। মানীলাকেও রাজী করিয়ে ফেলল সে। বয়স্ক তিনজন মিলে ওয়ানডাকে নিয়ে গেল ড. এভলেকির অফিসে।

দরজাতেই হাসিমুখে তাদের অভ্যর্থনা জানাল মিয়ান এন্ডলেকি। তার চুল সবগুলোই সাদা কিন্তু চেহারায় বয়সের কোনো ছাপ নেই।

ওয়ানডা কৌতূহলী দৃষ্টিতে চারপাশে দেখতে দেখতে ভেতরে ঢুকল, ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই তার চেহারায়।

তার দিকে একবার তাকিয়ে ড. এন্ডলেকি বলল, “বাবা, মা এবং দাদা–ঠিক বলেছি?”

“কোনো ভুল হয় নি।” জবাব দিলেন সেলডন। রাইখের চেহারায় একটা লাজুক ভাব। মানীলা ভীষণ গম্ভীর, চোখ দুটো লাল আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।

“তোমার নাম,” ডাক্তার শুরু করলেন, “ওয়ানডা, তাই না?”

“হ্যাঁ, ম্যাম,” পরিষ্কার কণ্ঠে জবাব দিল ওয়ানডা।

“বেশ, তোমার বা বাহুতে এ্যানেস্থেশিয়া স্প্রে করব। ঠাণ্ডা বাতাসের মতো লাগবে। ব্যস। তারপর সামান্য একটু চামড়া কেটে নেব খুবই সামান্য। ব্যথা পাবে না, রক্ত বের হবে না, পরে কোনো দাগও থাকবে না। মাত্র কয়েক মিনিট লাগবে। ঠিক আছে?”

“নিশ্চয়ই,” জবাব দেয়ার সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে দিল ওয়ানডা।

কাজ শেষ করে ড. এন্ডলেকি বলল, “এবার এটাকে মাইক্রোস্কোপের নীচে রাখব উপযুক্ত একটা কোষ বেছে নেয়ার জন্য, তারপর প্রতিটি নিওক্লিওটাইড চিহ্নিত করার জন্য কম্পিউটারাইজড জিন অ্যানালাইজারে ঢোকাব, কিন্তু নিওক্লিওটাইডের সংখ্যা দশ লাখেরও বেশী। সারাদিন যাবে শুধু এই কাজেই। অবশ্য পুরো প্রক্রিয়াটা স্বয়ংক্রিয়, কাজেই আমাকে এখানে বসে থাকতে হবে না আপনাদেরও থাকার দরকার নেই।

“জেনোম তৈরি হয়ে গেলে সেটা বিশ্লেষণ করতে সময় লাগবে আরো বেশী। যদি সম্পূর্ণ রিপোর্ট চান তাহলে দুই থেকে তিন সপ্তাহ লাগতে পারে। এই কারণেই এত ব্যয়বহুল। কাজটা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। তৈরি হলে আমি আপনাকে খবর দেব।” কথা শেষ করে ঘুরল সে, যেন পুরো পরিবারটাকেই বিদায় জানাল, ব্যস্ত হয়ে পড়ল বিভিন্ন রকম যন্ত্রপাতি নিয়ে।

সেলডন বললেন, “যদি অস্বাভাবিক কিছু পান তাহলে সাথে সাথে আমাকে জানাবেন? মানে বলতে চাইছি যদি শুরুতেই কিছু পেয়ে যান তাহলে আর সম্পূর্ণ বিশ্লেষণের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই।”

“শুরুতেই কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য, তবে কথা দিচ্ছি, প্রফেসর সেলডন, প্রয়োজন হলে আমি সাথে সাথে আপনার সাথে যোগাযোগ করব।”

ওয়ানডার হাত ধরে বিজয়ীর ভঙ্গীতে বেরিয়ে গেল মানীলা, তার পায়ে পায়ে গেল রাইখ। সেলডন আরেকটু অপেক্ষা করে বললেন, “আপনি যা ভাবছেন ব্যাপারটা তারচেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ, ড. এন্ডলেকি।”

“কারণ যাই হোক, প্রফেসর, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব।”

সেলডনও বেরিয়ে পড়লেন। ঠোঁট দুটো পরস্পরের সাথে জোরে চেপে রেখেছেন। তিনি যে কেন ভেবেছিলেন মাত্র পাঁচ মিনিটেই জেনোম তৈরি হয়ে যাবে এবং পরবর্তী পাঁচ মিনিটেই সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন, বলতে পারবেন না। এখন কি পাওয়া যাবে সেটা না জেনেই তাকে দুই থেকে তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।

দাঁতে দাঁত ঘষলেন। তার নবতর ব্রেইন চাইল্ড, দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন, কখনো কি প্রতিষ্ঠা করা যাবে, নাকি এটা এমনই এক স্বপ্ন যা কোনোদিনই পূরণ হবে না।

.

৭.

মুখে উদ্বিগ্ন হাসি নিয়ে ড. এভলেকির অফিসে ঢুকলেন হ্যারি সেলডন।

“আপনি বলেছিলেন দুই তিন সপ্তাহ লাগবে, ডক্টর। কিন্তু এক মাসের বেশী হয়ে গেছে।”

মাথা নাড়ল ড. এন্ডলেকি। “দুঃখিত, প্রফেসর সেলডন। কিন্তু আপনি সব কিছু নিখুঁত ভাবে চেয়েছেন আর আমি তাই করার চেষ্টা করছি।”

“বেশ,” সেলডনের চেহারা থেকে উৎকণ্ঠা দূর হলো না। “কি পেয়েছেন আপনি?”

“একশ বা তার কিছু বেশী ত্রুটিপূর্ণ জিন।”

“কি? ত্রুটিপূর্ণ জিন? আপনি সত্যি বলছেন, ডক্টর?”

“অবশ্যই। না হওয়ার কি আছে? এমন কোনো জেনোম নেই যেখানে কমপক্ষে একশ ত্রুটিপূর্ণ জিন থাকে না। সাধারণত: আরো বেশী থাকে। কথাটা শুনতে যতটা খারাপ শোনায় আসলে কিন্তু ততটা খারাপ নয়, আপনিও জানেন।”

“না। জানি না। আমি নই, এই ক্ষেত্রে আপনিই বিশেষজ্ঞ।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসল ড, এন্ডলেকি। “আপনি আসলে জেনেটিক এর ব্যাপারে কিছুই জানেন না, তাই না, প্রফেসর?”

“না। জানি না। একজন মানুষ তো আর সব জানতে পারে না।”

“ঠিকই বলেছেন। আমিও আপনার কি যেন নাম?–সাইকোহিস্টোরির কিছুই জানি না। যদি কোনো একটা অংশ বোঝাতে চান তাহলে প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। তারপরেও হয়তো বুঝব না। জেনেটিক এর ক্ষেত্রে–“

“বেশ?”

“ক্রটিপূর্ণ জিন তেমন কোনো সমস্যা নয়। তবে মাঝে মাঝে হঠাৎ এমন কিছু ত্রুটিপূর্ণ জিন পাওয়া যায়–এত বেশী ত্রুটিপূর্ণ যা সত্যিকার অর্থেই ক্ষতিকর। তবে এমন ঘটনাও খুব দুর্লভ। বেশীর ভাগ ত্রুটিপূর্ণ জিনের ক্ষেত্রে বলা যায় যে ওগুলো শুধু নিখুঁত ভাবে কাজ করে না। অনেকটা ভারসাম্যহীন চাকার মতো। আমাদের গাড়ি চলবে, ঝাঁকুনি লাগবে, কিন্তু সামনে এগিয়ে যাবে ঠিকই।”

“ওয়ানডার জেনোমে শুধু এই পাওয়া গেছে?”

“হ্যাঁ। আসলে প্রতিটি জিন যদি নিখুঁত হতো তাহলে প্রতিটি মানুষের চেহারা হতো একইরকম, আচরণ হতো একইরকম। জিনের কারণেই মানুষে মানুষে এত পার্থক্য।”

“বয়স বাড়ার সাথে সাথে এগুলো আরো খারাপ হয়ে উঠবে না?”

“হ্যাঁ। বুড়ো হলে আমাদের সবারই নানারকম শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়। আপনাকে আমি খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছি। কেন?”

“নিতম্ব আর ঊরুর মাংসপেশীতে ব্যথা,” বিড়বিড় করে জবাব দিলেন সেলডন।

“সারাজীবনই কি এমন ছিল?”

“অবশ্যই না।”

“তার কারণ বয়স বাড়ার সাথে সাথে আপনার কিছু জিন আরো খারাপ হয়ে গেছে আর তাই এখন খোঁড়াচ্ছেন।”

“ওয়ানডার বেলায় কি হবে?”

“জানি না। আমি ভবিষ্যত বলতে পারি না, প্রফেসর। ওটা আপনার বিশেষত্ব। তবে যদি কষ্ট করে অনুমান করতে হয়, তাহলে বলব, ওয়ানডার তেমন কিছুই হবে না–অন্তত জেনেটিক্যালি–শুধু বৃদ্ধ বয়সের গতানুগতিক সমস্যা ছাড়া।”

“আপনি নিশ্চিত?”

“আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন। ওয়ানডার জেনোম করাতে গিয়ে আপনি ঝুঁকি নিয়েছেন। এমন কিছু জেনে ফেলেছেন যা আসলে জানা উচিত ছিল না। যাই হোক, আমার মতে ওয়ানডার তেমন কোনো ভয়ানক সমস্যা তৈরি হবে না।”

“ত্রুটিপূর্ণ জিনগুলো–ওগুলো কি সারিয়ে তোলা উচিত? সারিয়ে তোলা যাবে?”

“না। প্রথম কারণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দ্বিতীয় কারণ সারিয়ে তুললেই যে ঠিক থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এবং শেষ কারণ, জনগণ এর বিরুদ্ধে।”

“কিন্তু কেন?”

“কারণ সবাই এখন বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে। এই কথাটা অন্য সবার চেয়ে আপনারই ভালো জানা উচিত, প্রফেসর। বিশেষ করে ক্লীয়নের মৃত্যুর পর, মিস্টিসিজম জোরালোভাবে আসন গেড়ে বসেছে। মানুষ এখন বিজ্ঞানের সাহায্যে নয় বরং আধ্যাত্মিক উপায়ে ত্রুটিযুক্ত জিন সারিয়ে তুলতে চায়। সত্যি বলছি, আমাদের এখন কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। পর্যাপ্ত আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না।”

একমত হয়ে মাথা নাড়লেন সেলডন। “আমিও জানি। সাইকোহিস্টোরি এই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছে, কিন্তু আমি কখনোই বিশ্বাস করি নি যে পরিস্থিতি এত দ্রুত গতিতে এতটা খারাপ হয়ে উঠবে। আমার কাজের ধরনটাই এমন যে চারপাশের সমস্যাগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখা।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। “ত্রিশটা বছর থেকে দেখছি গ্যালাকটিক এম্পায়ার ধীরে ধীরে ভেঙ্গে যাচ্ছে–আর এখন ভাঙ্গনের গতি আরো দ্রুত হয়েছে। আমি জানি না কিভাবে এটা ঠেকানো যাবে।”

“আপনি ঠেকানোর চেষ্টা করছেন?” ড. এভলেকির চেহারা দেখে মনে হলো সে মজা পেয়েছে।

“হ্যাঁ, চেষ্টা করছি।”

“আপনার সৌভাগ্য কামনা করি।–আপনার শরীরের নিম্নাংশে যে ব্যথা, পঞ্চাশ বছর আগে তা সহজেই নিরাময় করা যেত। এখন সম্ভব না।”

“কেন?”

“যে ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হতো সেগুলো আর নেই। যারা সেগুলো চালাত তারা এখন অন্য কাজ করে। ওষুধ আর আগের মতো উৎপাদিত হয় না।”

“বাকী সবকিছুর মতো,” সেলডনও মজা পেলেন এই কথায়।–যাই হোক, ওয়ানডার বিষয়ে ফিরে আসা যাক। আমি মনে করি ওয়ানডা কিছুটা ব্যতিক্রম এবং তার মস্তিষ্ক অন্য সবার চেয়ে আলাদা। ওর জিন থেকে মস্তিষ্কের ব্যাপারে কোনো তথ্য পেয়েছেন?”

ড. এভলেকি তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। “প্রফেসর সেলডন, আপনি কি জানেন, কতগুলো জিন মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের সাথে জড়িত?”

“না।”

“আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, মানব দেহের সকল কার্যকলাপের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকলাপই সবচেয়ে জটিল। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের জানা মতে মহাবিশ্বে আর কোনো উপাদান নেই যা মানব মস্তিষ্কের মতো জটিল। কাজেই আপনি অবাক হবেন না যদি বলি যে কয়েক হাজার জিন মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে।”

“কয়েক হাজার?”

“হ্যাঁ। এবং মস্তিষ্কে ব্যতিক্রমী কিছু আছে কিনা তা বের করার জন্য প্রতিটি জিন পরীক্ষা করে দেখা অসম্ভব। ওয়ানডার ব্যাপারে আপনার কথা আমি মেনে নিচ্ছি। সে কিছুটা ব্যতিক্রমী, তার মস্তিষ্ক অন্য সবার চেয়ে আলাদা, কিন্তু তার জিনে আমি এমন কিছু পাই নি।”

“এমন মানুষদের আপনি খুঁজে বের করতে পারবেন যাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপের জিনগুলো ওয়ানডার মতো, একই রকম ব্রেইন প্যাটার্ন?”

“আমার সন্দেহ আছে। অন্য কারো মস্তিষ্ক তার মতো হলেও, জিনে ব্যাপক পার্থক্য থাকবে। মিল খুঁজে লাভ নেই। প্রফেসর, ওয়ানডার মাঝে এমন কি আছে যার জন্য আপনি তাকে ব্যতিক্রমী ভাবছেন।”

মাথা নাড়লেন সেলডন। “দুঃখিত। বলতে পারব না।”

“সেক্ষেত্রে, বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমিও কিছু বের করে দিতে পারব না। কিভাবে আপনি বুঝতে পারলেন যে তার মস্তিষ্ক অন্যদের চেয়ে ভিন্নরকম–যে ব্যতিক্রম আপনি আমার সাথে আলোচনা করতে পারছেন না।”

“দুর্ঘটনাক্রমে,” বিড় বিড় করে বললেন সেলডন। “পুরোটাই দুর্ঘটনা।”

“সেক্ষেত্রে ওয়ানডার মতো অন্যদেরও খুঁজে বের করতে হবে–দুর্ঘটনাক্রমে। আর কোনো উপায় নেই।”

নীরবতা নেমে এল দুজনের মাঝে। তারপর সেলডন বললেন, “আমাকে আর কিছু বলার আছে আপনার?”

“না, কিছু বলার নেই। বিল পাঠিয়ে দেব।”

কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালেন সেলডন। ব্যথাটা তাকে ভীষণ ভোগাচ্ছে। “ঠিক আছে, ধন্যবাদ, ডক্টর। বিল পাঠিয়ে দেবেন। আমি পেমেন্ট করে দেব।”

এখন কি করবেন এই ভাবনাটা মাথায় নিয়ে ডাক্তারের অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি।

.

৮.

আর সব পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতোই হ্যারি সেলডনও গ্যালাকটিক লাইব্রেরীর সকল সুযোগ সুবিধার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে চলেছেন। অধিকাংশ কাজই করেন নিজের অফিসে বসে কম্পিউটারের মাধ্যমে, তবে মাঝে মাঝে সশরীরে চলে আসেন। তার মূল কারণ, সাইকোহিস্টোরি প্রজেক্টের বিশাল চাপ থেকে কিছু সময়ের মুক্তি। তাছাড়া যেহেতু ওয়ানডার মতো আরো অনেককে খুঁজে বের করার পরিকল্পনা করেছেন, তাই লাইব্রেরীতেই ছোট একটা অফিস নিয়েছেন যেন প্রয়োজন হলেই লাইব্রেরীর বিশাল তথ্য ভাণ্ডার ব্যবহার করা যায়। এমনকি পার্শ্ববর্তী সেক্টরের গম্বুজের নিচে একটা অ্যাপার্টমেন্টও ভাড়া নিয়েছেন। যদি স্ট্রিলিং-এ ফিরে যাওয়ার মতো সময় না থাকে তখন ওই অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে থাকেন। খুব বেশী দূরে না। হেঁটেই লাইব্রেরীতে আসা যাওয়া করতে পারেন।

যাইহোক, তার পরিকল্পনা নতুন দিকে মোড় নিয়েছে, তাই ল্যাস জিনো’র সাথে দেখা করবেন বলে মনস্থির করলেন। এই প্রথমবার তার সাথে সামনাসামনি দেখা হবে।

গ্যালাকটিক লাইব্রেরীর চীফ লাইব্রেরীয়ানের সাথে দেখা করা খুব একটা সহজ নয়। কারণ এই পদ এবং দায়িত্ব গ্যালাক্সির মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। শোনা যায় যে, এমনকি সম্রাটের নিজেরও যদি চীফ লাইব্রেরীয়ানের সাথে কোনো পরামর্শের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাকে সশরীরে লাইব্রেরীতে এসে তার পালা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

সেলডনের অবশ্য কোনো সমস্যা হলো না। জিনো তাকে ভালোভাবেই চেনে যদিও সামনাসামনি দেখা হয় নি কখনো। “বিরল সম্মান, ফার্স্ট মিনিস্টার।” এভাবেই অভ্যর্থনা জানাল সে।

মুচকি হাসলেন সেলডন। “নিশ্চয়ই জানেন যে ষোল বছর আগেই আমি এই পদ থেকে অবসর নিয়েছি।”

“সম্মানটা এখনো আপনার প্রাপ্য। তাছাড়া জান্তা যখন বারবার জ্ঞান চর্চার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছে, তখন আপনি আমাদের অনেক উপকার করেছেন।”

(আচ্ছা, এই কারণেই তাহলে দেখা করার জন্য সহজে রাজী হয়েছে।)

“শুধুই গুজব,” বললেন তিনি।

“বলুন,” বলল জিনো, চট করে আড় চোখে একবার টাইম ব্যাণ্ডের দিকে তাকাল, “আপনার জন্য কি করতে পারি?”,

“চীফ লাইব্রেরীয়ান, আমি যা চাই তা খুব একটা সহজ কিছু না। লাইব্রেরীতে আরো বড় অফিস দরকার আমার। আমার কয়েকজন সহকর্মীকে স্থায়ীভাবে এখানে নিয়ে আসার অনুমতি চাই। বিশাল, সময়সাপেক্ষ এবং সীমাহীন গুরুত্বপূর্ণ এক কর্মসূচী বাস্তবায়নের অনুমতি চাই।”

জিনোর চেহারায় খানিকটা বিরক্তি ফুটে উঠল। “অনেক কিছু চাইছেন। জানতে পারি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা কি?”

“নিশ্চয়ই। এম্পায়ার ভেঙ্গে যাচ্ছে।”

দীর্ঘ সময়ের নীরবতা। তারপর জিনো বলল, “আপনার সাইকোহিস্টোরি গবেষণার কথা শুনেছি। শুনেছি যে এই নতুন বিজ্ঞান ভবিষ্যত পরিগণনা করতে পারবে। যা বললেন সেটা কি সাইকোহিস্টোরিক্যাল পরিগণনা?”

“না। এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছাই নি যেখানে সাইকোহিস্টোরির সাহায্যে নিশ্চিত ভবিষ্যত বলা যাবে। কিন্তু এম্পায়ার যে ভেঙ্গে যাচ্ছে সেটা বোঝার জন্য সাইকোহিস্টোরির প্রয়োজন নেই আপনার। চারপাশে অজস্র প্রমাণ রয়েছে।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জিনো। “এত কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়, তাই আর অন্য কোনো বিষয়ে মনযোগ দিতে পারি না। রাজনীতি আর সমাজনীতির বিষয়ে আমি শিশু।”

“ইচ্ছে হলে আপনি এই লাইব্রেরী থেকেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। পুরো গ্যালাকটিক এম্পায়ারের সকল তথ্য এখানে জমা হয়।”

“সত্যি কথা বলতে কি আমি জানতে পারি সবার পরে।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাসল জিনো। “প্রাচীন প্রবাদটা আপনি জানেন : মুচির ছেলে কখনো জুতো পরে না। তবে আমি ভেবেছিলাম এম্পায়ার আবার সংগঠিত হচ্ছে যেহেতু নতুন সম্রাট দায়িত্ব নিয়েছেন।”

“নামে মাত্র, সম্রাট, চীফ লাইব্রেরীয়ান। অধিকাংশ সীমান্তবর্তী প্রদেশে প্রথাগত কিছু অনুষ্ঠানেই শুধু সম্রাটের নাম উচ্চারিত হয়, কিন্তু তাদের কার্যকলাপে সম্রাটের কোনো ভূমিকা নেই। আউটার ওয়ার্ল্ডগুলো চলছে আপন মর্জিতে, সবচেয়ে বড় কথা, স্থানীয় আর্মড ফোর্সগুলো তারা নিয়ন্ত্রণ করে, যা সম্রাটের কর্তৃত্বের বাইরে। ইনার ওয়ার্ল্ডগুলোর বাইরে কোথাও যদি সম্রাট কর্তৃত্ব খাটানোর চেষ্টা করেন নিঃসন্দেহে ব্যর্থ হবেন। আমার ধারণা আগামী বিশ বছরের মধ্যে আউটার ওয়ার্ল্ডগুলো নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করবে।”

আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জিনো। “আপনার কথা সত্যি হলে, এম্পায়ারে এখন সবচেয়ে খারাপ সময় চলছে। কিন্তু আরো বড় অফিস এবং আরো সহকর্মীদের এখানে নিয়ে আসতে চাওয়ার সাথে এর কি সম্পর্ক?”

“যদি এম্পায়ার ভেঙ্গে পড়ে তাহলে গ্যালাকটিক লাইব্রেরীও হয়তো সেই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে না।”

“পেতেই হবে,” আন্তরিক সুরে বলল জিনো। “খারাপ সময় আগেও এসেছে, কিন্তু সবসময়ই একটা বিষয়ে সবাই লক্ষ্য রেখেছে, ট্র্যানটরের গ্যালাকটিক লাইব্রেরী, মানবজাতির অর্জিত সমুদয় জ্ঞানের ভাণ্ডার, যেন এটার কোনো ক্ষতি না হয়। ভবিষ্যতেও তাই হবে।”

“নাও হতে পারে। আপনিই বলেছেন যে জান্তা অনেকবারই লাইব্রেরীর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে।”

“তেমন ক্ষতিকর কিছু ছিল না।”

“পরের বার ক্ষতিকর হতে পারে। মানবজাতির জ্ঞানভাণ্ডার আমরা ধ্বংস হতে দিতে পারি না।”

“এখানে আপনার বর্ধিত উপস্থিতি সেটা কিভাবে ঠেকাবে?”

“আমার উপস্থিতি ঠেকাবে না। কিন্তু আমি যে প্রজেক্ট নিয়ে ভাবছি সেটা ঠেকাবে। আমি একটা বিশাল এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করতে চাই, যার অন্তর্ভুক্ত থাকবে সেইসব জ্ঞান যা পুনরায় সভ্যতা গড়ে তোলার জন্য মানবজাতির প্রয়োজন হবে–আপনি এটাকে বলতে পারেন এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা। লাইব্রেরীতে যে তথ্য আছে তার সব আমাদের দরকার নেই। অধিকাংশই গুরুত্বহীন। প্রাদেশিক লাইব্রেরীগুলো হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে, যদি না হয় তাহলে গ্যালাকটিক লাইব্রেরীর সাথে কম্পিউটারাইজড সংযোগের কারণে অধিকাংশ স্থানীয় তথ্য সংগ্রহ করা যাবে। সুতরাং আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীনভাবে শুধু সেই তথ্যগুলো বেছে নেয়া, যতদূর সম্ভব সংক্ষিপ্ত আকারে, যা মানবজাতির প্রয়োজন হবে।”

“যদি সেটাও ধ্বংস হয়ে যায়?”

“আশা করি হবে না। এখান থেকে অনেক অনেক দূরে, গ্যালাক্সির শেষ প্রান্তে একটা গ্রহ খুঁজে বের করে আমার এনসাইক্লোপেডিস্টদের সেখানে পাঠিয়ে দেব। সেখানে ওরা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারবে। কিন্তু সেইরকম একটা গ্রহ না পাওয়া পর্যন্ত আমি চাইছি এখান থেকেই কাজ শুরু হোক। লাইব্রেরীর সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে এনসাইক্লোপেডিস্টরা ঠিক করে রাখুক কোন কোন তথ্য প্রজেক্টের জন্য প্রয়োজন হবে।”

গম্ভীর হয়ে গেল জিনো। “আপনার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছি, প্রফেসর সেলডন, কিন্তু কোনো সাহায্য হয়তো করতে পারব না।”

“কেন, চীফ লাইব্রেরীয়ান?”

“কারণ চীফ লাইব্রেরীয়ান হলেও সব সিদ্ধান্ত আমি একা নিতে পারি না। অনেক বড় একটা পরিচালনা পরিষদ আছে–নীতি নির্ধারক কমিটি–কাজেই ভাববেন না যে আপনার এনসাইক্লোপিডিয়া প্রজেক্টে আমি সাহায্য করতে পারব।”

“অবাক হলাম।”

“আমি আসলে জনপ্রিয় চীফ লাইব্রেরীয়ান নই। বোর্ড গত কয়েক বছর থেকেই লাইব্রেরীতে প্রবেশাধিকার সীমিত করার বিষয়ে আমার উপর চাপ সৃষ্টি করে। চলেছে। আমি এখনো বাধা দিয়ে যাচ্ছি। আপনাকে ছোট অফিস বরাদ্দ করার জন্যও ওরা আমার উপর মনঃক্ষুণ্ণ।”

“প্রবেশাধিকার সীমিত করে দেবেন?”

“ঠিক তাই। যদি কোনো ব্যক্তির কোনো তথ্যের প্রয়োজন হয়, তখন সে একজন লাইব্রেরীয়ানের সাথে যোগাযোগ করবে। ওই লাইব্রেরীয়ানই তাকে প্রয়োজনীয় তথ্যটা বের করে দেবে। বোর্ড চাইছে না মানুষ যখন তখন লাইব্রেরীতে ঢুকে ইচ্ছেমতো কম্পিউটার ব্যবহার করে। তাদের মতে কম্পিউটার এবং লাইব্রেরীর অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার উপযোগী রাখার খরচ দিনে দিনে অসম্ভব হয়ে পড়ছে।”

“কিন্তু সেটা অসম্ভব। গ্যালাকটিক লাইব্রেরী সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এটা হাজার বছরের নিয়ম।”

“জানি নিয়মটা অনেক প্রাচীনকাল থেকেই মেনে আসা হচ্ছে, কিন্তু বর্তমানে লাইব্রেরীতে প্রদেয় আর্থিক সহযোগিতা ধাপে ধাপে শুধু কমছেই। প্রয়োজনীয় তহবিল আমরা পাচ্ছি না। যন্ত্রপাতিগুলো চালু রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”

চোয়াল ঘষলেন সেলডন। “কিন্তু তহবিল হ্রাস পেলে আপনাকে নিশ্চয়ই কর্মীদের বেতন কমাতে হয়েছে, অনেককে ছাটাই করতে হয়েছে–অথবা অন্তত নতুন লোক নিয়োগ বন্ধ করতে হয়েছে।”

“পুরোপুরিই ঠিক বলেছেন।”

“সেক্ষেত্রে, সীমিত কর্মীদের দিয়ে মানুষের বিপুল চাহিদা মোতাবেক তথ্য সরবরাহ করবেন কিভাবে?”

“একটু কৌশল অবলম্বন করে। মানুষ যে তথ্যগুলো চাইবে তার সবই আমরা দেব না, দেব শুধু সেইগুলোই যা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হবে।”

“তার মানে শুধু যে লাইব্রেরীতে প্রবেশ বন্ধ করছেন তাই নয়, আসলে পুরো লাইব্রেরীটাই বন্ধ করে দিচ্ছেন?”

“আমারও তাই মনে হয়।”

“বিশ্বাসই হচ্ছে না যে কোনো লাইব্রেরীয়ান এটা চাইতে পারে।”

“জিনাররা মামেরিকে আপনি চেনেন না, প্রফেসর সেলডন।” সেলডনের ফাঁকা দৃষ্টি দেখে জিনো কথা চালিয়ে যেতে লাগল। “ভাবছেন কে সে? বোর্ডের যে অংশ। লাইব্রেরী বন্ধ করে দিতে চায় সেই অংশের নেতা। দিনে দিনে তার দল ভারী হচ্ছে। আমার ক্ষমতাবলে যদি আপনাকে এবং আপনার সহকর্মীদের এখানে কাজ করার সুযোগ বাড়িয়ে দেই, তাহলে এতদিন যারা মামেরির পক্ষে ছিল না তারাও মরিয়া হয়ে লাইব্রেরীর অংশবিশেষ বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেবে এবং তার দলে যোগ দেবে। পদত্যাগ করতে বাধ্য হব আমি।”

“শুনুন, হঠাৎ প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে বললেন সেলডন। “লাইব্রেরী বন্ধ করে দেয়া, প্রবেশাধিকার সীমিত করা, তথ্য সরবরাহে অস্বীকৃতি, ক্রমহাসমান অর্থায়ন সবকিছুই হচ্ছে এম্পায়ার ভেঙ্গে পড়ার প্রমাণ। আপনি বুঝতে পারছেন না?”

“এভাবে ভাবলে হয়তো আপনার কথাই ঠিক।”

“তাহলে আমাকে বোর্ডের সামনে কথা বলতে দিন। ভবিষ্যতে কি আছে সেটা ব্যাখ্যা করে বলার সুযোগ দিন। আশা করি আপনাকে যেমন বোঝাতে পেরেছি ওদেরকেও পারব।”

কিছুক্ষণ ভাবল জিনো, “আপনাকে সুযোগ দিতে আমার আপত্তি নেই কিন্তু ধরে নিন যে কোননা লাভ হবে না।”

“চেষ্টা করে দেখি। দয়া করে ব্যবস্থা করুন এবং আমাকে জানান কবে, কখন এবং কোথায় বোর্ডের সাথে দেখা করা যাবে।”

জিনোকে অস্বস্তির মাঝে রেখে চলে গেলেন এসেছিলেন। চীফ লাইব্রেরীয়ানকে যা বলেছেন তার সবই সত্যি–এবং গুরুত্বহীন। লাইব্রেরী ব্যবহার করতে চাওয়ার আসল উদ্দেশ্য তিনি গোপন করেছেন।

আংশিক কারণ তিনি নিজেই এখনো পরিষ্কার জানেন না। ইউগো এমারিলের বিছানার পাশে বসে আছেন হ্যারি সেলডন–ধৈর্য সহকারে বিষণ্ণ মনে। ইউগো পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। সে চাইলেও এখন আর কোনো চিকিৎসাতেই কাজ হবে না, অবশ্য সে চাইছেও না।

মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়স। সেলডন ছেষট্টি বছর বয়সেও এখনো যথেষ্ট সুস্থ সবল, শুধু নিতম্ব আর উরুর ব্যথাটা তাকে মাঝে মাঝে পঙ্গু করে দেয়।

চোখ খুলল এমারিল। “এখনো আছ, হ্যারি?”

মাথা নাড়লেন সেলডন। “আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না।”

“মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত?”

“হ্যাঁ।” তারপর প্রচণ্ড শোক নিয়ে বললেন, “কেন এমন করলে, ইউগো। একটু যত্ন নিলে হয়তো আরো বিশ থেকে ত্রিশ বছর বাঁচতে।”

দুর্বল একটু হাসল এমারিল। “যত্ন নিয়ে বাঁচা? অর্থাৎ কাজ থেকে খানিক বিরতি? অবকাশ কেন্দ্রে যাওয়া? নানা রকম আমোদ প্রমোদ করা?”

“হ্যাঁ। হ্যাঁ।”

“তখন হয় আমার মনটা কাজে ফিরে আসার জন্য অস্থির হয়ে থাকত অথবা সময় নষ্ট করা শিখতাম, আর যে অতিরিক্ত বিশ-ত্রিশ বছরের কথা বলছ, সেই সময়ে আমি বেশী কিছু করতে পারতাম না। তোমার অবস্থা তো দেখছি।”

“আমার কোন অবস্থা?”

“দশ বছর তুমি ক্লীয়নের ফার্স্ট মিনিস্টার ছিলে, ওই সময়ে বিজ্ঞানের কাজ কতটুকু করেছ তুমি?”

“আমার জীবনের চার ভাগের এক অংশ সাইকোহিস্টোরি গবেষণায় কাটিয়েছি।” মোলায়েম সুরে বললেন সেলডন।

“বড়াই করো না। আমি না থাকলে সাইকোহিস্টোরির অগ্রগতি অনেক আগেই থেমে যেত।”

মাথা নাড়লেন সেলডন। “ঠিক বলেছ, ইউগো, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।”

“আর যখন দিনের অধিকাংশ সময়টাতে প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকতে তখন কে করত–আসল কাজগুলো? হ্যাঁ?”

“তুমি, ইউগো।”

“অবশ্যই।” আবার চোখ বুজল সে।

সেলডন বললেন, “কিন্তু আমার মৃত্যুর পর তুমি বরাবরই এই প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে চেয়েছ।”

“না। আমি প্রজেক্টের নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিলাম যেন তা সঠিক পথে এগিয়ে চলে, তবে প্রশাসনিক কাজগুলোও আমি সামলাতে পারতাম।”

নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এমারিলের, চোখ মেলে সরাসরি তাকাল সেলডনের দিকে। “আমি চলে গেলে সাইকোহিস্টোরির কি হবে? ভেবেছ কিছু?”

“হ্যাঁ, ভেবেছি। এই বিষয়ে তোমার সাথে কথা বলতে চাই। তুমি খুশি হবে। ইউগো, আমার বিশ্বাস সাইকোহিস্টোরিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।”

সামান্য ভুরু কুঁচকাল এমারিল। “কেমন করে? আমার পছন্দ হচ্ছে না।”

“শোনো। বুদ্ধিটা তোমারই ছিল। কয়েক বছর আগে তুমিই বলেছিলে যে দুটো ফাউণ্ডেশন তৈরি করা উচিত। আলাদাভাবে–সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিরাপদ যেন ওগুলোই সম্ভাব্য দ্বিতীয় গ্যালাকটিক এম্পায়ারের নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করতে পারে। মনে আছে?”

“সাইকোহিস্টোরিক সমীকরণ–“

“আমি জানি। সমীকরণ প্রমাণ করেছে। এখন আমি এই কাজেই ব্যস্ত, ইউগো। গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে একটা অফিসের ব্যবস্থা করেছি–“

“গ্যালাকটিক লাইব্রেরী,” এমারিলের কুঁচকানো ভুরু আরো গম্ভীর হলো। “ওদেরকে আমি পছন্দ করি না। অহংকারী বোকার দল।”

“চীফ লাইব্রেরীয়ান ল্যাস জিনো অত খারাপ নয়, ইউগো।”

“মামেরি নামের লাইব্রেরীয়ানের সাথে দেখা হয়েছে তোমার? জিনাররা মামেরি?”

“না, তবে শুনেছি ওর কথা।”

“খাটাশ টাইপের লোক। আমার সাথে লেগে গিয়েছিল একবার। বলেছিল যে আমি নাকি লাইব্রেরীতে জিনিসপত্র এলোমেলো করে রাখছি, অথচ ওরকম কিছুই করি নি। মাথা গরম হয়ে যায়। মনে হয়েছিল যেন আবার ডালে ফিরে গেছি। ডাল একটা ক্ষেত্রে ভীষণ সমৃদ্ধ, হ্যারি, সেটা হচ্ছে গালি। সেখান থেকে বাছা বাছা কিছু গালি ঝেড়ে দিয়ে বলি যে তুমি সাইকোহিস্টোরিতে নাক গলাচ্ছ এবং ইতিহাসে তুমি খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হবে। অবশ্য ঠিক খলনায়ক’ বলি নি। ব্যাটা একেবারে বোবা হয়ে যায়।”

হঠাৎ করেই সেলডন বুঝতে পারলেন কেন মামেরি বহিরাগত বিশেষ করে সাইকোহিস্টোরির উপর এত খেপে আছে–কিন্তু কিছু বললেন না।

“আসল কথা হচ্ছে, ইউগো, তুমি দুটো ফাউণ্ডেশন চেয়েছিলে যেন একটা ব্যর্থ হলে আরেকটা কাজ চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এখন আমরা আরো বড় কিছু করতে চাইছি।”

“যেমন?”

“মনে আছে দুইবছর আগে ওয়ান্ডা তোমার মাইন্ড রিড করে দেখিয়েছিল যে প্রাইম রেডিয়্যান্টের একটা সমীকরণের অংশবিশেষে খুত আছে?”

“হ্যাঁ, মনে আছে।”

“বেশ, ওয়ানডার মতো আরো অনেককে খুঁজে বের করব। একটা ফাউণ্ডেশন তৈরি করব বস্তুবাদী বিজ্ঞানীদের নিয়ে, তারা মানবজাতির সমুদয় জ্ঞান সংরক্ষণ করবে এবং দ্বিতীয় এম্পায়ারের নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করবে। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন হবে শুধুমাত্র সাইকোহিস্টোরিয়ানদের নিয়ে–মেন্টালিস্ট, মাইণ্ড টাচিং সাইকোহিস্টোরিয়ান–যারা বহুবিদ মননশীল পদ্ধতিতে সাইকোহিস্টোরি নিয়ে কাজ করবে এবং একক চিন্তাবিদের চেয়ে বহুগুণ দ্রুত অগ্রগতি করতে পারবে। তারা কাজ করবে দলবদ্ধ হয়ে। মূল দায়িত্ব হবে ইতিহাসের গতিপথে নিখুঁত সমন্বয় সাধন। সবসময় পর্দার অন্তরালে থাকবে, লক্ষ্য রাখবে। তারা হবে এম্পায়ারের অভিভাবক।”

“চমৎকার!” দুর্বল গলায় বলল এমারিল। “চমৎকার। দেখেছ, মরার জন্য ভালো একটা সময় বেছে নিয়েছি আমি। আমার আর কিছু করার বাকী নেই।”

“এভাবে বলো না, ইউগো।”

“মন খারাপ করবে না, হ্যারি। আমি ভীষণ ক্লান্ত, আর কিছু করার সামর্থ নেই। ধন্যবাদ–ধন্যবাদ আমাকে বলার জন্য।” কণ্ঠস্বর আরো দুর্বল হয়ে পড়ল তার “এই বিপ্লবের কথা। আমি খুশি। “

এই ছিল ইউগো এমারিলের জীবনের শেষ বাক্য।

মাথা নিচু করে বসে রইলেন সেলডন। চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

আরেকজন পুরনো বন্ধু চলে গেল। ডেমারজেল, ক্লীয়ন, ডর্স, আর এইমাত্র ইউগো… তিনি বুড়ো হচ্ছেন আর তাকে আরো নিঃসঙ্গ করে দিয়ে একে একে সবাই চলে যাচ্ছে।

আর যে বিপ্লবের কথা মৃত্যুর পূর্বে এমারিলের মুখে হাসি ফুটিয়েছে তা কি আদৌ সম্ভব হবে। তিনি কি গ্যালাকটিক লাইব্রেরী ব্যবহার করতে পারবেন? ওয়ানডার মতো আরো অনেককে খুঁজে বের করতে পারবেন? সবচেয়ে বড় কথা, কত সময় লাগবে?”

সেলডনের বয়স এখন ছেষট্টি। যদি বত্রিশ বছর বয়সে, যখন তিনি ব্র্যানটরে আসেন, তখন এই বিপ্লব শুরু করতে পারতেন…

এখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে।

.

১০.

জিনারো মামেরি তাকে অপেক্ষা করাচ্ছেন। ইচ্ছাকৃত অভদ্রতা, এমনকি অপমানজনক, হ্যারি সেলডন শান্ত থাকলেন।

হাজার হোক মামেরিকে তার ভীষণ প্রয়োজন। লাইব্রেরীয়ানের উপর রাগ করলে নিজেরই ক্ষতি। তার রাগ দেখে মামেরিও খুশি হবে।

অবশেষে মামেরির দেখা পাওয়া গেল। সেলডন তাকে আগেও দেখেছেন–তবে দূর থেকে। এই প্রথম সামনাসামনি কথা বলবেন।

মামেরি বেটে এবং মোটা, গোলাকার মুখ, গাঢ় রঙের ছোট দাড়ি। মুখে হাসি, কিন্তু সেলডনের ধারণা এই অর্থহীন হাসিটা তার মুখে স্থায়ী হয়ে গেছে। মামেরির দাঁতের রং হলুদ, টুপির রংও হলুদ, হালকা বাদামী রংও আছে, মনে হয় যেন প্যাচিয়ে ধরেছে সাপের মতো।

সেলডনের গা গুলিয়ে উঠল। মনে হলো মামেরিকে তার পছন্দ হবে না, কোনো কারণ ছাড়াই।

কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই মামেরি বলল, “তো, প্রফেসর, কি করতে পারি আপনার জন্য?” আড় চোখে দেয়ালে ঝোলানো টাইমস্ট্রিপের দিকে তাকাল, কিন্তু দেরীর জন্য দুঃখ প্রকাশ করল না।

“লাইব্রেরীতে আমার কাজ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আপনি যে বিরোধিতা করছেন, আমি সেটা থামানোর অনুরোধ করছি।”

দুপাশে হাত ছড়াল মামেরি। “দুবছর হয়ে গেল এখানে কাজ করছেন। কোন বিরোধিতার কথা বলছেন?”

“আপনি বোর্ডের যে অংশের প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং যারা আপনার মতে বিশ্বাসী তারা এখন পর্যন্ত ভোটাভুটির মাধ্যমে চীফ লাইব্রেরীয়ানকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারেন নি, কিন্তু শুনলাম আগামী মাসে আরেকটা মিটিং এবং ল্যাস জিনো আমাকে জানিয়েছেন যে ফলাফলের ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।”

“আমিও নিশ্চিত নই। আপনার লীজ–যদি ব্যাপারটাকে আমরা এইভাবে দেখি–হয়তো নবায়ন করা যাবে।”

“কিন্তু আমার আরো বেশী সাহায্য প্রয়োজন, লাইব্রেরীয়ান মামেরি। আমি কয়েকজন সহকর্মীকে এখানে নিয়ে আসতে চাই। যে প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি একটা বিশেষ এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরির প্রাথমিক প্রস্তুতি–একজনের কাজ নয় সেটা।”

“আপনার সহকর্মীরা যেখানে খুশি সেখানে কাজ করতে পারে। ট্র্যানটর সুবিশাল এক বিশ্ব।”

“আমাদেরকে লাইব্রেরীতেই কাজ করতে হবে। আমি বৃদ্ধ মানুষ, স্যার। কাজগুলো আমাকে দ্রুত শেষ করতে হবে।”

“সময়ের হাত থেকে কে বাঁচতে পারে? আমার মনে হয় না বোর্ড আপনার সহকর্মীদের ব্যাপারে অনুমতি দেবে। আপনার ছোট দাবী পরবর্তীতে অনেক বড় আকার ধারণ করতে পারে, প্রফেসর।”

(হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, সেলডন মনে মনে ভাবলেন। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না)

মামেরি বলল, “আপনাকে আমি লাইব্রেরী থেকে দূরে রাখতে পারি নি। কিন্তু আশা করি আপনার সহকর্মীদের দূরে রাখতে পারব।”

কোনো লাভ হচ্ছে না বুঝতে পারলেন সেলডন। কণ্ঠে আরো আন্তরিকতা মিশিয়ে বললেন, “লাইব্রেরীয়ান মামেরি, আমার প্রতি আপনার বিদ্বেষ নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত কিছু নয়। আশা করি আমার কাজের গুরুত্ব আপনি বুঝতে পেরেছেন।”

“অর্থাৎ, সাইকোহিস্টোরি। ত্রিশ বছর গবেষণা করে কি ফল পেয়েছেন?”

“কথা তো সেখানেই। এখন হয়তো ফলাফল পেতে পারি।”

“তাহলে সেটা স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই করুন। গ্যালাকটিক লাইব্রেরীতে করতে হবে কেন?”

“লাইব্রেরীয়ান মামেরি, আপনি লাইব্রেরী সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ করে দিতে চাইছেন। প্রাচীন এক ঐতিহ্যকে আপনি শেষ করে দিতে চাইছেন। সেই সাহস আপনার আছে?”

“প্রশ্নটা সাহসের নয়। অর্থের, চীফ লাইব্রেরীয়ান নিশ্চয়ই আমাদের দুর্বলতার কথাগুলো বলার সময় আপনার কাঁধে মাথা রেখে চোখের পানিও ফেলেছে। আর্থিক সাহায্য কমে গেছে, বেতন কমাতে হয়েছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং মেরামত হয়

বহুদিন। কি করতে পারি আমরা? যে সেবা দিতে পারতাম তা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হয়েছে। এই অবস্থায় আপনাকে এবং আপনার সহকর্মীদের অফিস এবং যন্ত্রপাতি দিয়ে সহায়তা অব্যাহত রাখা অসম্ভব।”

“সম্রাটকে জানিয়েছেন?”

“আপনি স্বপ্ন দেখছেন, প্রফেসর। এম্পায়ার ভেঙ্গে যাচ্ছে এবং আপনার সাইকোহিস্টোরিই সেটা বলেছে, তাই না? শুনেছি আপনাকে ডাকা হয় র‍্যাভেন সেলডন, প্রাচীন যুগের এক অশুভ পাখি।”

“এই কথা সত্যি যে আমরা একটা খারাপ সময়ের ভেতর প্রবেশ করতে যাচ্ছি।”

“আপনার কি ধারণা লাইব্রেরী সেই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে? প্রফেসর, লাইব্রেরী আমার জীবন এবং আমি এটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে চাই, কিন্তু তা অসম্ভব যদি প্রয়োজনীয় তহবিল না পাওয়া যায়। অথচ আপনি আরো অধিক সুযোগ সুবিধার দাবী নিয়ে এসেছেন। সম্ভব না, প্রফেসর। কোনোভাবেই সম্ভব না।”

“যদি আমি আপনার জন্য ক্রেডিটের ব্যবস্থা করে দিতে পারি?” মরিয়া হয়ে বললেন সেলডন।

“তাই। কিভাবে?”

“যদি সম্রাটকে অনুরোধ করি? আমি প্রাক্তন ফার্স্ট মিনিস্টার এবং তিনি আমার অনুরোধ রাখতেও পারেন।”

“আপনি তার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য আনবেন?” অট্টহাসির সাথে মামেরি বলল।

“যদি পারি, যদি আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ বাড়াতে পারি, তাহলে আমার সহকর্মীরা এখানে এসে কাজ করতে পারবে?”

“প্রথমে ক্রেডিট নিয়ে আসুন। তারপর দেখব কি করা যায়। তবে মনে হয় না পারবেন।”

মামেরিকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হলো এবং সেলডন অবাক হলেন এই ভেবে যে গ্যালাকটিক লাইব্রেরী এরই মধ্যে কতবার সম্রাটের কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে ব্যর্থ হয়েছে।

আর তার নিজের আবেদনেও কি কোনো লাভ হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *