১.৪ প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে

১৬.

প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে শুনছে রাইখ যদিও চেহারায় তা প্রকাশ হতে দিল না। তাকে ধরে এনে নতুন তৈরি করা একটা সেলে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অসংখ্য অলিগলির ভেতর দিয়ে এসেছে যদিও কোনোটাই চিনতে পারে নি। (রাইখ, যে কিনা একসময় বিলিবটনের গলি, তস্য গলি নিজের হাতের তালুর মতোই চিনত, মুহূর্তের মধ্যে যে কোনো অনুসরণকারীকে হটিয়ে দিতে পারত।

গার্ডের পরনে সবুজ রঙের জোরানুমাইট ইউনিফর্ম। লোকটা হয় একজন মিশনারী, অথবা মানুষের মস্তিষ্ক ধোলাই তার কাজ অথবা বেশী কথা বলা তার অভ্যাস। যাই হোক লোকটা নিজেকে স্যান্ডার নী বলে ঘোষণা করল এবং হালকা ডাহ্‌লাইট বাচনভঙ্গীতে দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু করল। পরিষ্কার বোঝা যায় ডাহলাইট বাচনভঙ্গী সে পরিশ্রম করে রপ্ত করেছে।

“যদি ডাহুলের জনগণ সমান অধিকার ভোগ করতে চায় তাহলে প্রমাণ করতে হবে যে তারা এর উপযুক্ত। সঠিক নিয়ম, ভদ্র আচরণ, রুচিশীল বিনোদন এগুলোই হচ্ছে সেই প্রমাণ। ঝগড়া বিবাদ, ছুরি হাতে লড়াই করা এই ব্যাপারগুলোই অন্যদের সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের অবজ্ঞা করার। আমাদেরকে যেমন কথায় সৎ থাকতে হবে, তেমনি–“

বাধা দিল রাইখ। “তোমার সাথে আমি একমত, গার্ডসমেন নী, তোমার প্রতিটি শব্দ আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু মি. জোরানিউম এর সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে।”

“সম্ভব হবে না। অনুমতি বা নিদেনপক্ষে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো লাগবেই।”

“শোনো, আমি স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা এক অধ্যাপকের ছেলে, গণিতের অধ্যাপক।”

“আমি কোনো অধ্যাপককে চিনি না। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তুমি ডাহ্‌লাইট।”

“অবশ্যই ডাহ্‌লাইট। কথা শুনে বুঝতে পারছ না?”

“অথচ তোমার বাবা বিখ্যাত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক? ঠিক মিলছে না।”

“আসলে উনি আমার পালক পিতা।” তথ্যটা হজম করল গার্ডসমেন, তারপর জিজ্ঞেস করল, “ডাহলে কাউকে চেন তুমি?”

“মাদার রিটা, উনি আমাকে চিনবেন।” (যখন তাকে চিনত তখনই মাদার রিটার অনেক বয়স। এখন হয়তো একেবারেই অথর্ব হয়ে গেছে হয়তো বা মারাই গেছে।)

“কখনো নাম শুনি নি।”

(আর কে আছে? এমন কোনো মানুষকে সে কখনোই চিনত না যার নাম শুনলে সামনে দাঁড়ানো নির্বোধ লোকটাকে বোঝানো যাবে। যে ছেলেটার সাথে সবচাইতে বেশী ঘনিষ্ঠতা ছিল সেও ছিল তারই মতো ভবঘুরে। নাম স্মৃজি–অন্তত এই নামেই সে পরিচিত ছিল। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে রাইখ যতই মরিয়া হোক না কেন তারপরেও সে বলতে পারল না, “তুমি কি সুজি নামে কাউকে চেন, বয়স আমার সমান?”)

শেষ পর্যন্ত বলল, “ইউগো এমারিল।”

নামটা শুনেই বোধহয় নীর দৃষ্টিতে খানিকটা উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। “কে?”

“ইউগো এমারিল,” রাইখের মনে আশা জাগতে শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে আমার পালক বাবার অধীনে কাজ করে।”

“সেও ডাহ্লাইটঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই কি ডালাইট নাকি?”

“মাত্র দুজন। সে আর আমি। সে ছিল হিটসিঙ্কার।”

“বিশ্ববিদ্যালয়ে কি করছে?”

“আমার বাবা আট বছর আগে ওকে হিটসিঙ্ক থেকে বের করে নিয়ে যায়।”

“বেশ–কাউকে পাঠাচ্ছি আমি।”

অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এখান থেকে পালালেও কোনো লাভ হবে না। ধরা না পড়ে বিলিবটনের এই জটিল গোলকধাঁধায় কতক্ষণ সে মুক্ত থাকতে পারবে?”

বিশ মিনিট পার হয়ে গেল। তারপর যে কর্পোরাল রাইখকে গ্রেপ্তার করেছিল তাকে নিয়ে ফিরে এল নী। আশান্বিত হলো রাইখ। কর্পোরালের ঘটে খানিকটা হলেও বুদ্ধি আছে।

“কোন ডালাইটকে তুমি চেন?” জিজ্ঞেস করল কর্পোরাল।

“ইউগো এমারিল, কর্পোরাল, একজন হিটসিষ্কার যার সাথে আমার বাবার এই ডাহলে দেখা হয় এবং আমার বাবা তাকে স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যান।”

“কেন?”

“আমার বাবা ভেবে নেন যে ইউগো হিটসিঙ্কে কাজ করার চেয়ে আরো বড় কাজ করার উপযুক্ত, কর্পোরাল।”

“যেমন?”

“গণিত। সে–“

কর্পোরাল হাত তুলে বাধা দিল। “কোন হিটসিঙ্কে কাজ করত সে?”

কিছুক্ষণ ভাবল রাইখ। “তখন খুব ছোট ছিলাম আমি, তবে মনে হয় সি টু।”

“কাছাকাছি। সি-থ্রি।”

“তাহলে আপনি ওর কথা জানেন, কর্পোরাল?”

“পরিচয় নেই, তবে গল্পটা হিটসিঙ্কের সবাই জানে আর আমিও ওখানে কাজ করেছি। তুমিও হয়তো লোকমুখে শুনেছ। ইউগো এমারিলকে যে চেন সেরকম কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”

“শুনুন। আমি কি করতে পারি সেটা আপনাকে বলি। একটা কাগজে আমার নাম, আমার বাবার নাম আর একটা শব্দ লিখে দিচ্ছি। যেভাবে পারেন মি. জোরানিউম এর দলের কোনো অফিসারের সাথে যোগাযোগ করুন–মি. জোরানিউম আগামীকাল এখানে আসছেন–আমার নাম, আমার বাবার নাম আর যে শব্দটা লিখে দেব সেটা তার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করুন। যদি কিছু না ঘটে তাহলে পচে গলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করব, যদিও আমার মনে হয় না তার আর দরকার হবে। বরং আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিন সেকেন্ডের মধ্যে তিনি আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবেন এবং সময়মতো তথ্যটা পৌঁছে দেয়ার জন্য আপনার পদোন্নতি হবে। যদি না করেন, তাহলে যখন ওরা জানবে যে আমি এখানে, জানবে তো অবশ্যই, তখন আপনি ভয়ানক বিপদে পড়বেন। মনে রাখবেন ইউগো এমারিল এক ক্ষমতাবান গণিতবিদের সাথে এখান থেকে চলে গিয়েছিল এবং সেই ক্ষমতাবান গণিতবিদ আমার বাবা। নাম হ্যারি সেলডন।”

কর্পোরালের চেহারা দেখে বোঝা গেল নামটা তার অপরিচিত নয়।

“তুমি যে শব্দটা লিখে দেবে সেটা কি?”

“সাইকোহিস্টোরি।”

ভুরু কোঁচকালো কর্পোরাল। “ওটা আবার কি জিনিস?”

“সেটা কোনো ব্যাপার না। শুধু খবরটা পৌঁছে দিন। তারপর দেখুন কি ঘটে।” কর্পোরাল নোটবুক থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে দিল। “ঠিক আছে, লিখে দাও। দেখি কি ঘটে।”

লেখার সময় হাত কাঁপতে লাগল রাইখের। সেও অধীর হয়ে আছে কি ঘটে তা দেখার জন্য। নির্ভর করছে কর্পোরাল খবরটা কার কাছে পৌঁছায় তার উপর এবং এই শব্দটার যাদুকরী ক্ষমতা কতখানি।

.

১৭.

ইম্পেরিয়াল গ্রাউন্ড কারের জানালায় বৃষ্টির ফোঁটা দেখে হ্যারি সেলডনের মনে আট বছর আগের স্মৃতিগুলো ভিড় জমাতে শুরু করল।

এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তিনি ট্রানটরের একমাত্র উন্মুক্ত অঞ্চলে সম্রাটের সাথে দেখা করার নির্দেশ পেলেন এবং দুইবারই আবহাওয়ার অবস্থা ছিল ভীষণ খারাপ। প্রথমবার, ট্র্যানটরে আসার কিছুদিন পরেই, খারাপ আবহাওয়া তাকে সামান্যই বিরক্ত করতে পেরেছিল। এতে তিনি কোনো বিশেষ মাহাত্ম খুঁজে পান নি। তার নিজের গ্রহ হ্যাঁলিকনে প্রায়ই ঝড় বৃষ্টি হয়, বিশেষ করে তিনি যেখানে বাস করতেন সেই অঞ্চলে।

কিন্তু গত আট বছর তিনি বাস করছেন একটা তৈরি করা আবহাওয়ায়, যেখানে নিয়মিত ব্যবধানে কম্পিউটারের তৈরি করা মেঘের সাহায্যে সহনীয় ঝড় তৈরি করা। হয়। মানুষের ঘুমানোর সময়গুলোতে সবসময়ই হালকা বৃষ্টিপাত হয়। জোরালো বাতাসের পরিবর্তে মৃদুমন্দ পশ্চিমা বাতাস বয়ে চলে আর চরম ঠাণ্ডা বা চরম গরম কখনোই অনুভূত হয় না। শুধুই অতি সামান্য একটু পরিবর্তন যার কারণে কেবল শার্টের জিপার একটু নামিয়ে রাখতে হয় বা বড়জোর হালকা জ্যাকেটটা খুলে ফেলতে হয়। অথচ সামান্য এই পরিবর্তন নিয়েও অনেক অভিযোগ শুনেছেন সেলডন।

কিন্তু এখন তিনি দেখছেন ঠান্ডা আকাশ থেকে নেমে আসা সত্যিকারের বৃষ্টির ফোঁটা–অনেকদিন এই দৃশ্য দেখেন নি। তার ভালো লাগল। হ্যাঁলিকনের কথা, তরুণ বয়স আর তুলনামূলকভাবে ভাবলেশহীন দিনগুলোর কথা ভাবলেন। ভাবলেন চালককে বলবেন যে পথ দিয়ে গেলে বেশী ঘোরা হয় সেই পথ দিয়ে যেতে।

অসম্ভব। সম্রাট তাকে দেখা করতে বলেছেন, এবং ট্রাফিকহীন সোজা পথ ধরলেও গ্রাউন্ড কারের জন্য প্রাসাদ অনেক দূরের পথ। সম্রাট নিশ্চয়ই তার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবেন না।

আট বছর আগে সেলডন যে ক্লীয়নকে দেখেছিলেন তার সাথে এই ক্লীয়নের কোনো মিল নেই। শরীরের ওজন কমেছে প্রায় দশ পাউন্ড, মুখে ভারিক্কি ভাব চলে এসেছে। যদিও চোখের চারপাশে এবং চিবুকের কাছে চামড়া কুঁচকানো, অনেকবার মাইক্রো অ্যাডজাস্টমেন্টর ফল। ক্লীয়নের জন্য দুঃখ বোধ করলেন সেলডন প্রবল প্রতাপ এবং ঐশ্বর্য থাকার পরেও সময়ের কাছে স্মাট পরাজিত।

এবারও একা দেখা করলেন ক্লীয়ন–একই রকম সাধাসিধে কামরা। রীতি অনুযায়ী অপেক্ষা করছেন সেলডন।

খানিকক্ষণ সেলডনকে খুঁটিয়ে দেখে সম্রাট স্বাভাবিক গলায় বললেন, “তোমাকে দেখে খুশী হলাম, প্রফেসর। প্রথম সাক্ষাতের মতো এবারও আনুষ্ঠানিকতা বাদ।”

“জ্বী, সায়ার, কাষ্ঠ গলায় বললেন সেলডন। সম্রাট অনুমতি দেয়ার পরেও সবসময় আনুষ্ঠানিকতা বাদ দেয়া সম্ভব নয়, বিশেষ করে এই সময়ে।

সম্রাট একটু ইশারা দিতেই কামরার ভেতর প্রাণচাঞ্চল্য শুরু হলো। স্বয়ংক্রিয়ভাবে টেবিল এবং খাবারের পাত্র আসতে শুরু করেছে। বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন সেলডন, ঘটনাটায় মনযোগ দিতে পারলেন না।

“তুমি আমার সাথে ডিনার করবে?” প্রশ্নের মতো শোনালেও এটা একটা আদেশ।

“এটা আমার জন্য বিরল সম্মান, সায়ার।” জবাব দিলেন সেলডন। সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালেন চারপাশে। ভালো করেই জানেন সম্রাটকে কখনো প্রশ্ন করা যায় না, কিন্তু ধরে রাখতে পারলেন না নিজেকে, জিজ্ঞেস করেই ফেললেন। অবশ্য যতদূর সম্ভব চেষ্টা করলেন যেন প্রশ্নের মতো না শোনায়। “ফাস্ট মিনিস্টার আমাদের সাথে ডিনার করবেন না?”

“না, ওর অন্য কাজ আছে। তাছাড়া আমি তোমার সাথে একা কথা বলতে চাই।”

কিছুক্ষণ নীরবে খাওয়া দাওয়া করলেন দুজন, ক্লীয়ন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে আর তিনি একটু পরপরই বিব্রত ভঙ্গীতে হাসছেন। দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বা নিষ্ঠুরতার কোনো দুর্নাম ক্লীয়নের নেই। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তিনি সেলডনকে নগণ্য কোনো অভিযোগে গ্রেপ্তার করতে পারেন, আর সম্রাট যদি তার প্রভাব খাটান তাহলে বিনা বিচারেই শাস্তি হয়ে যাবে। তাই সম্রাটের দৃষ্টি এড়িয়ে থাকাই নিরাপদ। কিন্তু এই মুহূর্তে সেলডন তা পারছেন না।

নিঃসন্দেহে আট বছর আগে পরিস্থিতি আরো খারাপ ছিল কারণ তখন সশস্ত্র গার্ড ধরে নিয়ে এসেছিল তাকে–যদিও চিন্তাটা সেলডনকে আশ্বস্ত করতে পারল না।

আলোচনা শুরু করলেন ক্লীয়ন। “সেলডন,” তিনি বললেন, “ফাস্ট মিনিস্টার আমার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, তারপরেও মাঝে মাঝে আমার মনে হয় যে জনগণ মনে করে আমার বুদ্ধি বিবেচনা কিছু নেই। তোমারও কি তাই মনে হয়?”

“কখনোই না, সায়ার।” এর বেশী প্রতিবাদ করা উচিত মনে হলো না।

“বিশ্বাস হলো না। যাই হোক, বুদ্ধি আমার আছে এবং মনে আছে যে তুমি প্রথম যখন ট্রানটরে আস তখন সাইকোহিস্টোরি নিয়ে একটা খেলা শুরু করেছিলে।”

“আমার বিশ্বাস এই কথাটাও আপনার মনে আছে, সায়ার,” মৃদু গলায় বললেন সেলডন, “যে সাইকোহিস্টোরি আসলে একটা গাণিতিক তত্ত্ব যার কোনো বাস্তব প্রয়োগ নেই।”

“হ্যাঁ, বলেছিলে। এখনো কি তাই বলবে?”

“জ্বী, সায়ার।”

“তারপর বিষয়টা নিয়ে আর কখনো কাজ করেছ?”

“মাঝে মাঝে। কোনো লাভ হয় নি। সময়টা এতো বেশী বিশৃঙ্খল আর প্রেডিকটিবিলিটি আসলে–“

বাধা দিলেন ক্লীয়ন। “আমি চাই তুমি শুধু একটা নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান করে দাও।–ডেজার্ট নাও, সেলডন, ভালো লাগবে।”

“কোনো সমস্যা, সায়ার?”

“জোরানিউম। ডেমারজেল বলেছে–হ্যাঁ, বেশ নরম সুরেই বলেছে–যে আমি তাকে গ্রেপ্তার করতে পারব না, আর্মড ফোর্স দিয়ে তার অনুসারীদের দমাতে পারব না। কারণ এতে নাকি পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।”

“ফার্স্ট মিনিস্টার যদি এই কথা বলে থাকেন, তাহলে আমারও তাই মনে হয়।”

“কিন্তু আমি জোরানিউম নামের এই সমস্যাটা চাই না… কোনো অবস্থাতেই আমি তার হাতের পুতুল হতে চাই না। ডেমারজেলও কিছু করছে না।”

“আমার বিশ্বাস তিনি তার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন, সায়ার।”

“করলেও, নিঃসন্দেহে আমাকে জানায় নি।”

“হতে পারে, সায়ার। আপনাকে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্যই হয়তো জানায়নি। হয়তো ফার্স্ট মিনিস্টার মনে করছেন যদি জোরানিউম–যদি–“

“ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারে,” সীমাহীন বিতৃষ্ণা নিয়ে ক্লীয়ন বললেন।

“জ্বী, সায়ার। তখন চেষ্টা করতে হবে কেউ যেন বুঝতে না পারে যে আপনি ব্যক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে ছিলেন। এম্পায়ারের স্থিতিশীলতার জন্য আপনাকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে।”

“জোরানিউমকে ছাড়া এম্পায়ারের স্থিতিশীলতা আমি আরো ভালোভাবে ধরে রাখতে পারব। তোমার কি পরামর্শ, সেলডন?”

“আমার, সায়ার?”

“তোমার, সেলডন,” অধৈর্য সুরে বললেন ক্লীয়ন। “শোনো, সাইকোহিস্টোরি একটা গাণিতিক ধাঁধা তোমার এই কথা আমি বিশ্বাস করি নি। ডেমারজেল তোমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে। কি মনে কর আমাকে? আমি এতোই বোকা যে এই কথাটা জানব না। সে তোমার কাছে একটা কিছু চায়। সে তোমার কাছে সাইকোহিস্টোরি চায় আর যেহেতু আমি বোকা নই আমিও তা চাই।–সেলডন, তুমি কি জোরানিউমের পক্ষে? সত্যি কথা বল।”

“না, সায়ার। আমি জোরানিউমের পক্ষে নই, বরং তাকে এম্পায়ারের জন্য ভয়ানক হুমকি বলে মনে করি।”

“বেশ, বিশ্বাস করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমি একাই সম্ভাব্য জোরামাইট দাঙ্গা থামিয়ে দিয়েছিলে।”

“আমি আসলে কোনোকিছু না ভেবেই করেছিলাম, সায়ার।”

“কোনো বোকা মানুষকে কথাগুলো বলল, আমাকে না। তুমি সাইকোহিস্টোরির সাহায্যে আগেই সমাধান করে রেখেছিলে।”

“সায়ার!”

“অস্বীকার করো না। জোরানিউমের ব্যাপারে কি করছ তুমি? এম্পায়ারের পক্ষে থাকলে অবশ্যই কিছু একটা করছ।”

“সায়ার,” সতর্কভাবে বললেন সেলডন, আসলে সম্রাট কতটুকু জানেন তা বোঝার চেষ্টা করছেন। “আমি আমার ছেলেকে ডাল সেক্টরে পাঠিয়েছি জোরানিউমের সাথে দেখা করার জন্য।”

“কেন?”

“আমার ছেলে একজন ডাহ্‌লাইট এবং বিচক্ষণ। আমাদের কাজে লাগতে পারে এমন কোনো তথ্য হয়তো সে বের করে আনতে পারবে।”

“হয়তো?”

“হয়তো, সায়ার।”

“যখন যে তথ্য পাবে সাথে সাথে আমাকে জানাবে?”

“জ্বী, সায়ার।”

“আর, সেলডন, কখনো বলবে না যে সাইকোহিস্টোরি একটা গাণিতিক খেলা, ওটার কোনো অস্তিত্ব নেই। এই কথাগুলো আর শুনতে চাই না। আমি চাই জোরানিউমকে থামানোর জন্য তুমি কিছু কর। কি করবে, কিভাবে করবে আমি জানি না, কিন্তু ওকে থামাও। আর নয়তো সাইকোহিস্টোরি আমি পাব না। এবার তুমি যেতে পার।”

আসার সময় যে পরিমাণ দুঃশ্চিন্তা ছিল তার দ্বিগুণ দুঃশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলেন সেলডন। ক্লীয়নের কথাতে একটা বিষয় পরিষ্কার যে ব্যর্থতা তিনি মেনে নেবেন না।

সব এখন নির্ভর করছে রাইখের উপর।

.

১৮.

একটা সরকারী ভবনের দর্শনার্থী কক্ষে বসে আছে রাইখ। আগে কখনো এখানে আসেনি এবং ডালে থাকলে মনে হয় না এখানে পা দেয়ার সুযোগ কোনোদিন হতো। সত্যি কথা বলতে কি অস্বস্তি বোধ করছে সে, নিজেকে মনে হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী।

নিজেকে প্রশান্ত, বিশ্বাসী আর প্রিয়পাত্র করে তোলার চেষ্টা করল।

বাবা বলেছে এই গুণগুলো তার চরিত্রেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, যদিও সে কখনো টের পায় নি। যা তার চরিত্রের সাথে মিশে আছে তা জোর করে ফুটিয়ে তুলতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল সে একই সাথে নজর রাখল ডেস্কে কম্পিউটার নিয়ে কাজে ব্যস্ত অফিসারের দিকে। অফিসার ডাহ্‌লাইট নয়, সে হচ্ছে গ্যাম্বল ডিন নামাত্রি।

নামাত্রি কিছুক্ষণ পরপরই বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিতে রাইখের দিকে তাকাচ্ছে। রাইখ তার চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে নামাত্রির মন জয় করতে পারছে না এটা পরিষ্কার।

মধুর হাসি দিয়ে নামাত্রির বিদ্বেষের মোকাবেলা করার চেষ্টা করল না রাইখ। সেটা ভান মনে হতে পারে। শুধু অপেক্ষা করতে লাগল। অনেক দূর আসতে পেরেছে সে। যদি জোরানিউম আসে, আশা করছে আসবে। তখন হয়তো কথা বলার সুযোগ পাবে।

শেষ পর্যন্ত জোরানিউম এল, দৃঢ় পদক্ষেপে, মুখে মন ভোলানো উষ্ণ হাসি। নামাত্রি হাত তুলতেই থামল জোরানিউম। দুজনে নিচু গলায় কথা বলতে লাগল। রাইখ বুঝতে পারছে নামাত্রি তার সাথে দেখা করার ব্যাপারে জোরানিউমকে নিষেধ করছে। খানিকটা দমে গেল সে।

তারপর জোরানিউম রাইখের দিকে তাকাল, হাসল, নামাত্রিকে ঠেলে সরিয়ে দিল একপাশে। হঠাৎ রাইখের মনে হলো নামাত্রি যদিও দলের মস্তিষ্ক, আসল ক্যারিশমা রয়েছে জোরানিউমের।

জোরানিউম তার দিকে এগিয়ে এল, চর্বিবহুল, খানিকটা ভেজা হাত বাড়িয়ে দিল। “বেশ, বেশ। প্রফেসর সেলডনের ছেলে। কেমন আছো?”

“চমৎকার, ধন্যবাদ, স্যার।”

“বুঝতে পারছি, এখানে আসতে তোমার অনেক সমস্যা হয়েছে।”

“তেমন কিছু না, স্যার।”

“এবং আমার বিশ্বাস তুমি তোমার বাবার কাছ থেকে সুসংবাদ নিয়ে এসেছ। আশা করি তিনি তার সিদ্ধান্ত পুনঃ বিবেচনা করেছেন এবং এখন থেকে মহৎ যুদ্ধে আমাকে সাহায্য করবেন।”

“মনে হয় না, স্যার।”

ভুরু কুঁচকালো জোরানিউম। “তুমি কি তাকে না জানিয়েই এসেছ?”

“না, স্যার। তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন।”

“তাই।–ক্ষুধার্ত?”

“জি না, স্যার।”

“আমি যদি খাই তুমি কিছু মনে করবে না তো? আসলে জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পুরণ করার সময় পাই না।” গাল ভরা হাসি দিয়ে বলল সে।

“আমার কোনো সমস্যা নেই, স্যার।” দুজনে টেবিলে গিয়ে বসল। স্যান্ডউইচের মোড়ক খুলে কামড় বসালো জোরানিউম। মুখে খাবার নিয়েই জিজ্ঞেস করল, “তো, তিনি তোমাকে কেন পাঠিয়েছেন?”

“বাবা ভাবছেন আমি কোনো তথ্য বের করতে পারব যা তিনি আপনার বিরুদ্ধে কাজে লাগাবেন। আসলে তিনি মনে প্রাণে ফার্স্ট মিনিস্টারকে সমর্থন করেন।”

“তুমি কর না?”

“না, স্যার। আমি একজন ডাহ্‌লাইট।“

“জানি, মি. সেলডন। কিন্তু তাতে কি বোঝা গেল?”

“বোঝা গেল যে আমি শোষিত, তাই আমি আপনাকে সমর্থন করি এবং আপনাকে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু সেটা বাবাকে জানাতে চাই না।”

“জানানোর কোনো কারণও নেই। কিভাবে, আমাকে সাহায্য করবে?” দ্রুত একবার নামাত্রির দিকে তাকালো সে। “সাইকোহিস্টোরির ব্যাপারে কিছু জানো তুমি?”

“না, স্যার। বাবা কখনো এই বিষয়ে আমার সাথে কথা বলেন না। আর বললেও বুঝতাম না কিছুই। তবে মনে হয় তিনি সফল হতে পারছেন না।”

“তুমি নিশ্চিত?”

“আমি নিশ্চিত। বাবার সহকারী ইউগো এমারিল, সেও একজন ডাহ্‌লাইট, মাঝে মাঝে এই বিষয়ে আমার সাথে কথা বলে। কোনো সন্দেহ নেই যে তাদের গবেষণা ব্যর্থ।”

“আহ্! তোমার কি মনে হয়, এই ইউগো এমারিলের সাথে আমি কখনো দেখা করতে পারব?”

“অসম্ভব, ইউগো হয়তো ডেমারজেলকে পছন্দ করে না, কিন্তু আমার বাবাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।”

“কিন্তু তুমি করবে?”

মুখ কালো করে ফেলল রাইখ, কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল, “আমি একজন ডালাইট।”

গলা পরিষ্কার করল জোরানিউম। “তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছি। তুমি কিভাবে আমাদের সাহায্য করবে, ইয়ং ম্যান?”

“আমার কাছে একটা তথ্য আছে। শোনার পর আপনি বিশ্বাস নাও করতে পারেন।”

“তাই? বল। বিশ্বাস না হলে, সত্যি কথাই বলব তোমাকে।”

অস্বস্তি নিয়ে চারপাশে তাকালো রাইখ, “কেউ আমাদের কথা শুনে ফেলবে না তো?”

“শুধু আমি আর নামাত্রি।”

“বিষয়টা ফার্স্ট মিনিস্টার ইটো ডেমারজেলকে নিয়ে।”

“বল।”

“ঠিক আছে, শুনুন। ডেমারজেল আসলে মানুষ নয়। সে একটা রোবট।”

“কি!” বিস্ময়ে চীৎকার করে উঠল জোরানিউম।

ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন মনে করল রাইখ। “রোবট আসলে যান্ত্রিক মানব, স্যার। রক্তমাংসের মানুষ নয়। ওগুলো সব যন্ত্র।”

ব্যস্ত হয়ে বাধা দিল নামাত্রি। “জো-জো, এইসব হাস্যকর কথা বিশ্বাস করো না।”

কিন্তু জোরানিউম আদেশের ভঙ্গীতে একটা হাত উঁচু করল। তার চোখগুলো জ্বল জ্বল করছে। “কিভাবে বুঝলে?”

“আমার বাবা কিছুদিন মাইকোজেনে ছিলেন। উনি আমাকে সব বলেছেন। মাইকোজেনের বাসিন্দারা রোবটের ব্যাপারে অনেক কিছু জানে।”

“হ্যাঁ, আমি জানি। মানে শুনেছি আর কি।”

“মাইকোজেনিয়ানরা বিশ্বাস করে তাদের পূর্বপুরুষদের সমাজে রোবট স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল, কিন্তু পরে ওগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়।”

“কিন্তু তুমি কেমন করে বুঝলে যে ডেমারজেল রোবট?” চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল নামাত্রি। “আমি যতদূর শুনেছি, রোবট ধাতুর তৈরি, তাই না?”

“ঠিক তাই,” আগ্রহের সাথে বলল রাইখ। “কিন্তু আমি শুনেছি যে হাতে গোনা কয়েকটা রোবট ছিল দেখতে একেবারেই মানুষের মতো, এবং ওগুলোর কার্যক্ষমতা ছিল অবিনশ্বর অর্থাৎ ওগুলো অমর–“

জোরে জোরে মাথা নাড়ল নামাত্রি। “কিংবদন্তি। হাস্যকর কিংবদন্তি। জো-জো, কেন এগুলো শুনছি–“

কিন্তু জোরানিউম তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল। “না, জি. ডি.। শোনা দরকার। এই কিংবদন্তিগুলো আমিও শুনেছি।”

“কিন্তু এগুলো হাস্যকর।”

“না ভেবেই কোনোকিছু হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিও না। আর হলেই বা কি, জনগণ ঠিকই বিশ্বাস করবে।–বল, ইয়ং ম্যান, কেন তোমার মনে হলো ডেমারজেল একটা রোবট। ধরা যাক রোবটের অস্তিত্ব আছে। কেন তোমার মনে হলো ডেমারজেল রোবট। ও তোমাকে বলেছে?”

“না, স্যার।”

“তোমার বাবা বলেছে?”

“না, স্যার। এটা আমার ধারণা। তবে আমি নিশ্চিত।”

“কেন? কেন তুমি এতো নিশ্চিত?”

“ওকে দেখলে কেমন একটা অনুভূতি হয়। তার কোনো পরিবর্তন নেই। তার বয়স বাড়ে না। আবেগ বা ভাবের কোনো প্রকাশ নেই। দেখলে কেন যেন মনে হয় সে ধাতুর তৈরি।”

হেলান দিয়ে বসে অনেকক্ষণ রাইখকে পর্যবেক্ষণ করল জোরানিউম। তার মাথার ভেতরে কি চিন্তার ঝর বইছে সেটা বোঝা অসাধ্য।

তারপর বলল, “ধরা যাক সে একটা রোবট, ইয়ং ম্যান। তাতে তোমার কি? কি আসে যায় তোমার?”

“অবশ্যই আসে যায়। আমি মানুষ। আমি চাই না কোনো রোবট এম্পায়ারের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে।”

অনুমোদনের ভঙ্গীতে নামাত্রির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল জোরানিউম। “শুনেছ, জি-ডি? আমি মানুষ। আমি চাই না কোনো রোবট এম্পায়ারের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। ওকে হলোভশনের সামনে দাঁড় করিয়ে ওর মুখ দিয়ে এই কথাগুলো বলাও। বারবার প্রচার কর। যতক্ষণ পর্যন্ত না এই কথাগুলো ট্রানটরের প্রত্যেকটা মানুষের কানে ঢাকের শব্দের মতো বাজতে থাকে।”

“হেই,” বাধা দিল রাইখ। “অসম্ভব। তাহলে আমার বাবা জেনে যাবে–“

“না, অবশ্যই না,” দ্রুত বলল জোরানিউম। “সেটা হতে দেয়া যাবে না। শুধু তোমার এই বাক্যটা ব্যবহার করব। অন্য কোনো ডালাইটকে খুঁজে নেব। প্রত্যেক সেক্টর থেকেই একজনকে বেছে নেব। হলোভশনের সামনে দাঁড়িয়ে যার যার বাচনভঙ্গীতে শুধু এই কথাগুলোই বলবে : আমি চাই না কোনো রোবট এম্পায়ারের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে।”

“আর যখন ডেমারজেল প্রমাণ করবে যে সে রোবট নয়, তখন কি হবে?” জিজ্ঞেস করল নামাত্রি।

“তাই নাকি? কিভাবে প্রমাণ করবে? সেটা তার জন্য অসম্ভব। সাইকোলজিক্যালি অসম্ভব। দ্য গ্রেট ডেমারজেল, ক্ষমতার পিছনের মূল ক্ষমতা, যে লোকটা প্রথম ক্লীয়নকে দড়িতে বাধা পুতুলের মতো নাচাচ্ছে, তার আগে নাচিয়েছিল ক্লীয়নের বাবাকে? এখন কি সে রাস্তায় নেমে এসে সবাইকে বলবে যে সে মানুষ? এই কাজ করতে গেলে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। সে রোবট তা প্রমাণ হলেও ধ্বংস হয়ে যাবে। খলনায়কটাকে আমরা এবার বাগে পেয়েছি এবং তার পুরো কৃতিত্ব এই তরুণের।”

প্রশংসা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল রাইখ।

“তোমার নাম রাইখ, তাই না?” জোরানিউম বলল। “আমাদের দল ক্ষমতায় যাওয়ার পর ডাহলের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হবে। তোমাকেও দলে একটা ভালো। পদ দেয়া হবে। হয়তো একদিন তুমিই হবে ডাহুলের সেক্টর লীডার। যা করেছে তার জন্য কখনো অনুতাপ করতে হবে না। নাকি তোমার অনুতাপ হচ্ছে?”

“মোটেই না, স্যার।” অনুগত কণ্ঠে বলল রাইখ।

“তাহলে ফিরে যাও। যেভাবে খুশি সেভাবে তোমার বাবাকে বোঝও যে আমরা তার কোনো ক্ষতি করব না, বরং আমরা তাকে যথেষ্ট মূল্য দেই। আর যদি তুমি এমন কোনো তথ্য পাও যা আমরা কাজে লাগাতে পারব–বিশেষ করে সাইকোহিস্টোরির ব্যাপারে, আমাকে সেটা জানাও।”

“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, স্যার। কিন্তু আপনি সত্যিই ডাহুলের জন্য কিছু করবেন?”

“অবশ্যই। প্রত্যেক সেক্টরের জন্য সমান অধিকার, মাই বয়। প্রত্যেক গ্রহের জন্য সমান সুবিধা। আমরা নতুন একটা এম্পায়ার গড়ে তুলব যেখানে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য বিশেষ সুবিধা এবং ভেদাভেদ বলে কিছু থাকবে না।”

প্রচন্ড বেগে মাথা নাড়ল রাইখ। “সেটাই আমি চাই।”

.

১৯.

ক্লীয়ন, গ্যালাক্সির সম্রাট, তার ছোট প্রাসাদের শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে খিলান ঢাকা পথ দিয়ে দ্রুত বেগে হেঁটে চলেছেন কর্মচারীদের সুবিশাল অফিসের দিকে। এই কর্মচারীরা ইম্পেরিয়াল প্যালেসেরই বিভিন্ন অংশে বাস করে। এটাই এম্পায়ারের নার্ভ সেন্টার।

ব্যক্তিগত সহকারীরা দুঃশ্চিন্তা এবং চেহারায় হতচকিত ভাব নিয়ে তার পিছন পিছন আসতে লাগল। সম্রাট হেঁটে কখনো কোনো কর্মচারীর কাছে যান না। তিনি শুধু ইশারা করেন, সবাই তার কাছে পৌঁছে যায়। হাঁটলেও তিনি কখনো চেহারায় দুঃশ্চিন্তা বা আমোদ কিছুই প্রকাশ করেন না। কিভাবেই বা করবেন? তিনি সম্রাট, এবং সবগুলো গ্রহের কাছেই তিনি মানুষ নন একটা প্রতীক।

অথচ এখন তাকে মানুষই মনে হচ্ছে। অধৈর্য ভঙ্গীতে ডান হাত নেড়ে সবাইকে সরে যেতে বললেন। তার বা হাতে একটা চকচকে হলোগ্রাম।

“ফার্স্ট মিনিস্টার,” দীর্ঘ অনুশীলনের পর তৈরি করা পরিশিলীত রাজকীয় কণ্ঠে নয়, বরং গলা টিপে ধরলে যেমন কণ্ঠ বেরোয় সেরকম শ্বাস রুদ্ধকর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, “কোথায় সে?”

অত্যন্ত উঁচু পদের কয়েকজন কর্মচারী হাত বাড়িয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করল কিন্তু সফল হলো না। সবাইকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন তিনি। সবারই মনে হলো তারা একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে।

অবশেষে ফার্স্ট মিনিস্টারের অফিসে পৌঁছলেন। আস্তে করে দরজা খুললেন, এবং চীৎকার করলেন–আক্ষরিক অর্থেই চীৎকার করলেন–“ডেমারজেল!”

বিস্মিত হলো ডেমারজেল। দ্রুত উঠে দাঁড়ালো, কারণ সম্রাটের সামনে কেউ বসতে পারে না।

সম্রাট ডেমারজেলের ডেস্কে হলোগ্রামটা ছুঁড়ে ফেললেন “এটা কি? আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে?”

মাথা নামিয়ে সম্রাটের দেয়া জিনিসটা দেখল ডেমারজেল। চমৎকার একটা হলোগ্রাম, ঝকঝকে, জীবন্ত। বাচ্চা ছেলেটা–সম্ভবত দশ বছর হবে–কি বলছে সবাই পরিষ্কার শুনতে পারবে। একই সাথে শিরোনামও প্রদর্শিত হচ্ছে : “আমি চাই না কোনো রোবট এম্পায়ারের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে।”

“সায়ার, আমিও এটা পেয়েছি।” শান্ত সুরে বলল ডেমারজেল। “আর কে কে পেয়েছ?”

“সায়ার, আমি যতদূর বুঝতে পেরেছি এটা একটা গুজব এবং অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ট্র্যানটরে ছড়িয়ে পড়েছে।”

“হ্যাঁ, আর তুমি কি বুঝতে পারছ ওই ছোকরা কার দিকে তাকিয়ে আছে?” তিনি রাজকীয় তর্জনী তুলে দেখালেন। “তোমার দিকে, তাই নয় কি?”

“মিলটা সত্যিই বিস্ময়কর, সায়ার।”

“যদি অনুমান করে নেই যে তোমার এই তথাকথিত গুজবের উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমাকে রোবট হিসেবে অভিযুক্ত করা তাহলে কি আমার ভুল হবে?”

“ওদের সেরকমই উদ্দেশ্য মনে হচ্ছে, সায়ার।”

“বেশ, আমার কোথাও ভুল হলে থামিয়ে দিও, কিন্তু রোবট হচ্ছে কিংবদন্তীর যান্ত্রিক মানব যা শুধু থ্রিলার আর ছোটদের গল্পেই পাওয়া যায়, ঠিক?”

“এটা মাইকোজেনিয়ানদের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি। রোবট–“

“মাইকোজেনিয়ানদের বিশ্বাস নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। ওরা তোমাকে রোবট হিসেবে অভিযুক্ত করছে কেন?”

“নিঃসন্দেহে একটা রূপক হিসেবে ব্যবহার করছে, সায়ার। ওরা বোঝাতে চাইছে আমার হৃদয় বলে কিছু নেই। আমার দৃষ্টিভঙ্গী–যন্ত্রের নিরাবেগ হিসাবের মতো।”

“তারচেয়েও বেশী কিছু, ডেমারজেল। আমি বোকা নই।” আবারও হলোগ্রামটার উপর টোকা দিলেন তিনি। “ওরা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছে তুমি আসলেই একটা রোবট।”

“মানুষ যদি এই গুজব বিশ্বাস করতে চায় তাহলে আমরা তা ঠেকাতে পারব না, সায়ার।”

“কোনো ঝুঁকি নেয়া যাবে না। এটা তোমার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে। তারচেয়েও খারাপ এটা সম্রাটের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে। এতে প্রমাণ হয় যে আমি–আমি ফার্স্ট মিনিস্টার হিসেবে একটা যন্ত্র বেছে নিয়েছি। ব্যাপারটা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না। শোনো, ডেমারজেল, সম্রাটের কর্মচারীদের মানহানির বিরুদ্ধে একটা আইন আছে, তাই না?”

“জ্বী, সায়ার, আছে–কঠিন একটা আইন। অনেক প্রাচীন। আবুরামিস এর তৈরি করা সবচেয়ে ভালো আইনগুলোর একটা।”

“এবং সম্রাটের মানহানী করা একটা ভয়ংকর অপরাধ, তাই না?”

“মৃত্যুদন্ডই একমাত্র শাস্তি, সায়ার, জ্বী।”

“বেশ, এতে শুধু তোমারই মানহানি হয় নি, আমারও মানহানি হয়েছে। যে করেছে তার এই মুহূর্তে শাস্তি হওয়া দরকার। এবং এই অপকর্মের মূল হোতা জোরানিউম।”

“কোনো সন্দেহ নেই, সায়ার। কিন্তু প্রমাণ করা কঠিন হবে।”

“বোকা! যথেষ্ট প্রমান আছে। এই মুহূর্তে ওকে শাস্তি দিতে চাই আমি।”

“সমস্যা হচ্ছে, সায়ার, আইনটা কখনো সেভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। এই শতাব্দীতে তো নয়ই।”

“আর তাই সমাজের আজকে এই অবস্থা, সম্রাটের এতো অসম্মান। আইনগুলো এখনো বাতিল হয় নি। কাজেই প্রয়োগ কর।”

“ভেবে দেখুন, সায়ার, সেটা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে কি না। এর ফলে আপনি নিষ্ঠুর রক্তলোপ শাসক হিসেবে পরিচিত হবেন। দয়ালু এবং বিবেচক শাসক হিসেবে আপনি সফল–“

“হ্যাঁ, এবং দেখ কী লাভ হয়েছে তাতে। তার চেয়ে আমাকে ভালোবাসার বদলে এখন থেকে ভয় পেতে শুরু করুক। একটা পরিবর্তন আসবে।”

“এখনো বলব কাজটা করা উচিত হবে না। হয়তো এটাই ছোট একটা স্ফুলিঙ্গ যা দাবানলের মতো বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেবে।”

“কি করবে তাহলে? মানুষের কাছে গিয়ে বলবে, “দেখো আমাকে, আমি রোবট নই।”

“না, সায়ার। এতে আমার সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে। সবচেয়ে বড় কথা আপনার মর্যদাহানি ঘটবে।”

“তাহলে?”

“বুঝতে পারছি না, সায়ার। এখনো ঠিকমতো ভেবে দেখি নি।”

“ভেবে দেখো নি।–সেলডনের সাথে যোগাযোগ কর।”

“সায়ার?”

“আমার আদেশ বুঝতে এতো সমস্যা হচ্ছে কেন? সেলডনের সাথে যোগাযোগ কর?”

“আপনি চান ওকে আমি প্রাসাদে ডেকে আনি।”

“অতো সময় নেই। তুমি নিশ্চয়ই ওর সাথে কথা বলার জন্য নিরাপদ যোগাযোগ লাইনের ব্যবস্থা করতে পারবে যা কেউ আড়ি পেতে শুনতে পারবে না।”

“অবশ্যই, সায়ার।”

“তাহলে কর। এখনি।”

.

২০.

ডেমারজেলের মতো ধীর স্থির থাকতে পারেন না সেলডন কারণ তিনি রক্ত মাংসের তৈরি মানুষ। অফিসের স্ক্র্যাম্বলারটা বেজে উঠতেই বুঝলেন যে অস্বাভাবিক কিছু একটা হয়েছে। নিরাপদ যোগাযোগ লাইনে আগেও কথা বলেছেন কিন্তু উঁচু পর্যায়ের ইম্পেরিয়াল সিকিউরিটির অভিজ্ঞতা কখনো হয় নি।

ধরে নিয়েছিলেন যে ডেমারজেলের বদলে কোনো সরকারী কর্মকর্তা তার সাথে যোগাযোগ করবে, বিষয়টা অবশ্যই রোবট নিয়ে গুজব, এর বেশী কিছু তিনি আশা করেন নি।

কিন্তু যা দেখলেন সেটাও তিনি আশা করেন নি। যখন স্ক্র্যাম্বলার ফিল্ডের মাঝখানে স্বয়ং সম্রাটের প্রতিচ্ছবি তার অফিসে পা দিল তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন।

বিরক্ত ভঙ্গীতে হাত নেড়ে তাকে বসে থাকতে বললেন ক্লীয়ন। “কি ঘটছে সেটা তোমার জানা দরকার।”

“রোবট গুজবের কথা বলছেন, সায়ার?”

“ঠিক। কি করা যায়?”

বসে থাকার আদেশ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়ালেন সেলডন। “আরো খবর আছে, সায়ার। জোরানিউম রোবট ইস্যু নিয়ে পুরো ট্র্যানটরে র‍্যালির আয়োজন করছে। অন্তত নিউজকাস্টে তাই শুনেছি।”

“আমাকে এখনো জানানো হয় নি। অবশ্যই না। সম্রাটকে জানানোর দরকার কি।”

“খবরটা সম্রাটকে জানানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, সায়ার। আমি নিশ্চিত যে ফার্স্ট মিনিস্টার–“

“ফার্স্ট মিনিস্টার কিছুই করছে না। এমন কি আমাকে কিছু জানায়ও না। তুমি আর তোমার সাইকোহিস্টোরিই ভরসা। বল কি করা যায়?”

“সায়ার?”

“খেলা করার সময় নেই। আট বছর তুমি সাইকোহিস্টোরি নিয়ে কাজ করছ। ফার্স্ট মিনিস্টার বলছে জোরানিউমের বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। তাহলে কি করব?”

তোতলাতে লাগলেন সেলডন। “স্য-সায়ার। কিছুই না।”

“তোমার কোনো পরামর্শ নেই?”

“না, সায়ার, আমি তা বলছি না। আপনি কিছুই করবেন না। কিছুই না। ফাস্ট মিনিস্টার ঠিকই বলেছেন। এতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।”

“বেশ। কি করলে পরিস্থিতি ভালো হবে?”

“আপনি কিছু না করলে। ফার্স্ট মিনিস্টার কিছু না করলে। জোরানিউমকে তার ইচ্ছামতো চলতে দিলে।”

“কি লাভ হবে তাতে?”

সেলডন তার গলার বেপরোয়া ভাবটা লুকানোর চেষ্টা করে বললেন, “খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারবেন।”

হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলেন সম্রাট, মনে হলো তার সমস্ত দুঃশ্চিন্তা আর রাগ নিমেষেই উবে গেছে। “আহ! বুঝতে পেরেছি। পরিস্থিতি তোমার নিয়ন্ত্রণে।”

“সায়ার! আমি তা বলি নি–“

“বলার দরকার নেই। পরিস্থিতি তোমার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, কিন্তু আমি ফলাফল চাই। ইম্পেরিয়াল গার্ড আর আর্মড ফোর্স এখনো আমার অনুগত। প্রয়োজন হলে একটুও দ্বিধা করব না। কিন্তু তোমাকে সুযোগ দিতে চাই।”

সম্রাটের ইমেজ অদৃশ্য হয়ে গেল আর সেলডন ফাঁকা দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন।

.

২১.

পরের দুইদিন জোরানিউম আক্ষরিক অর্থেই ট্র্যানটরে ঝড় বইয়ে দিল। আংশিক নিজে, আংশিক তার লেফটেন্যান্টদের মাধ্যমে, ডর্সের কাছে তার সামরিক দক্ষতার প্রশংসা করলেন সেলডন। “পুরনো যুগে সে একজন দক্ষ ওয়ার এ্যাডমিরাল হতে পারত।” বললেন তিনি। “রাজনীতিতে ঢুকে সে তার প্রতিভা নষ্ট করছে।”

“নষ্ট করছে।” বলল ডর্স। “যে ভাবে এগোচ্ছে তাতে এক সপ্তাহের মধ্যেই সে ফার্স্ট মিনিস্টার হবে। চাইলে দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্রাট। শুনেছি যে এরই মধ্যে কয়েকটা মিলিটারি গ্যারিসন তাকে নিয়ে আনন্দ উল্লাস শুরু করেছে।”

মাথা নাড়লেন সেলডন। “বেশীদিন থাকবে না, ডর্স।”

“কোনটা? জোরানিউমের পার্টি না এম্পায়ার?”

“জোরানিউমের পার্টি। রোবটের গল্প একটা ঝড় তৈরি করেছে ঠিকই, একটু শান্ত হলেই, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলেই জনগণ বুঝতে পারবে এটা কত হাস্যকর অভিযোগ।”

“কিন্তু হ্যারি, আমার সাথে অভিনয় করার দরকার নেই। এটা হাস্যকর কোননা গল্প নয়। জোরানিউম কিভাবে জানল যে ডেমারজেল একটা রোবট।”

“কেন রাইখ বলেছে।”

“রাইখ!”

“হ্যাঁ। সে তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেছে এবং নিরাপদে ফিরে এসেছে। সেই সাথে প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছে যে সে একদিন ডাহুলের সেক্টর লীডার হবে। সবাই ওকে বিশ্বাস করেছে। আমি জানতাম করবে।”

“অর্থাৎ তুমি রাইখকে সত্যি কথাটা বলে দিয়েছ যেন সে জোরানিউমকে জানাতে পারে।” ডর্সের চেহারায় আতংক।

“না, সেটা অসম্ভব। তুমি জানো আমি রাইখকে বা অন্য কাউকে কোনোদিন বলতে পারব না যে ডেমারজেল রোবট। বরং ওকে উল্টোটাই বুঝিয়েছি। কিন্তু বলেছি যে জোরানিউমকে যেন জানায় যে ডেমারজেল একটা রোবট। রাইখ বিশ্বাস করে যে সে জোরানিউমকে মিথ্যে কথা বলেছে।”

“কিন্তু কেন, হ্যারি? কেন?”

“এটা সাইকোহিস্টোরি নয়। সম্রাটের মতো তুমিও ভাবতে শুরু করো না যে আমি যাদু জানি। শুধু চেয়েছিলাম যে জোরানিউম যেন বিশ্বাস করে ডেমারজেল একটা রোবট। জন্মসূত্রে সে একজন মাইকোজেনিয়ান। কাজেই বিশ্বাস সে করবেই এবং ধরে নেবে যে জনগণও বিশ্বাস করবে।”

“বেশ, তাই তো করেছে।”

“না। প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেলেই জনগণ বুঝতে পারবে যে এগুলো সব পাগলের প্রলাপ–অন্তত সেভাবেই ভাবতে শুরু করবে। ডেমারজেলকে আমি রাজি করিয়েছি। সাব ইথারিক হলোভশনে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য। এই সাক্ষাৎকার এম্পায়ার এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশে এবং পুরো ট্রানটরে প্রচার করা হবে। অনেক বিষয়েই কথা বলবে সে, কারণ সমস্যার তো শেষ নেই। শুধু রোবটের গুজব বাদ দিয়ে। একেবারে শেষে তাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। তাকে কোনো উত্তর দিতে হবে না। শুধু একটু হাসতে হবে।”

“হাসবে? ডেমারজেলকে কখনো হাসতে দেখি নি। ও কখনো হাসে নি।”

“এবার, ডর্স, সে হাসবে। রোবটের বিষয়ে এই একটা বিষয় মানুষ কখনো কল্পনা করে না। হলোগ্রাফিক ফ্যান্টাসিতে তুমি রোবট দেখেছ, তাই না? সব সময় দেখানো হয় রোবট আবেগহীন, অমানবিক।–মানুষ বাস্তবেও ঠিক তাই আশা করবে। কাজেই ডেমারজেলকে শুধু হাসতে হবে। তাছাড়া সানমাস্টার ফোরটিন এর কথা তোমার মনে আছে?”

“আছে। আবেগহীন, অমানবিক। কখনো হাসে না।”

“এবারও হাসবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশটা পন্ড করার পর জোরানিউমের ব্যাপারে আমি যথেষ্ট খোঁজ খবর করেছি। এখন আমি জানি ওর আসল নাম, কোথায় জন্মেছে, কোথায় ট্রেনিং পেয়েছে। সব প্রমাণ আছে। ওগুলো সানমাস্টার এর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। মনে হয় না সানমাস্টার দল ত্যাগীদের পছন্দ করে।”

“কিন্তু আমার ধারণা ছিল তুমি কোনো ধরনের অন্ধবিশ্বাস ছড়ানোর বিপক্ষে।”

“তা করছিও না। যদি হলোভশনে প্রচার করতাম তাহলে অন্ধবিশ্বাস ছড়ানো হতো। তথ্যগুলো শুধু জায়গামতো পাঠিয়ে দিয়েছি। সানমাস্টারের কাছে।”

“সে এখন অন্ধবিশ্বাস ছড়াবে।”

“না, পারবে না। সানমাস্টারের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।”

“তাহলে কি ঘটবে?”

“দেখা যাক কি ঘটে। আমার কাছে কোনো সাইকোহিস্টোরিক্যাল এ্যানালাইসিস নেই, আদৌ সম্ভব কি না তাও জানি না। শুধু আশা করছি আমার বিচার বিশ্লেষণ যেন ভুল না হয়।”

.

২.

হাসল ডেমারজেল। একাধিক বার। হ্যারি সেলডন এবং ডর্স ভেনাবিলিরি সাথে একটা নিরাপদ কামরায় বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর সেলডনের ইশারা পেয়ে সে হাসছে। মাঝে মাঝে হেলান দিয়ে গলা ছেড়ে হাসছে। কিন্তু সেলডন মাথা নেড়ে বললেন, “এতে মানুষের মন গলবে না।”

কাজেই ডেমারজেল হাসল। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বশালী মানুষের মতো হাসল। মুখ বাকালেন সেলডন। “আমি পাগল হয়ে যাব। তোমাকে হাসির গল্প বলে কোনো লাভ নেই। তোমাকে শব্দটা মনে রাখতে হবে।”

“হলোগ্রাফিক লাফট্রেক ব্যবহার করলে কেমন হয়?” জিজ্ঞেস করল ডর্স।

“না, সেটা ডেমারজেলের হাসি হবে না। শুধু বোকা মানুষেরাই তাতে বিশ্বাস করবে, আমি তা চাই না। আবার চেষ্টা কর ডেমারজেল।”

আবার চেষ্টা করল ডেমারজেল যতক্ষণ পর্যন্ত না সেলডন বললেন “ঠিক আছে। শব্দটা মনে রাখবে এবং প্রশ্নটা করার পর এটাকেই রিপ্রোডিউস করবে। জোরে হাসবে না, যতদূর সম্ভব গম্ভীর থাকবে। ছোট একটু হাসি, খুবই ছোট। মুখের কোণাগুলো একটু বাঁকা কর।” ধীরে ধীরে ডেমারজেলের মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠল। “খারাপ নয়। দৃষ্টিতে খানিকটা জ্বল জ্বলে ভাব আনতে পারবে?”

“জ্বল জ্বলে বলতে কি বোঝাচ্ছ?” বিরক্ত সুরে জিজ্ঞেস করল ডর্স। “কেউ তার চোখ জ্বল জ্বলে করে তুলতে পারে না। ওটা একটা কাল্পনিক অনুভূতি।”

“অনেক কারণেই মানুষের চোখে পানি আসে–দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, বিস্ময় যাই। হোক–আর সেই তরলের উপর আলো প্রতিফলিত হয়েই জ্বল জ্বল ভাবটা তৈরি হয়।”

“তুমি কি ডেমারজেলকে চোখে পানি আনতে বলছ?”

ডেমারজেল নিরাবেগ সুরে বলল, “আমার চোখে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মাঝে মাঝে পানি আসে। কিন্তু খুব কম পরিমাণে, শুধু চোখগুলোকে পরিষ্কার রাখার জন্য।”

“বেশ, চেষ্টা কর।

কাজেই আলোর গতিতে ডেমারজেলের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ল দূর দূরান্তে। দায়িত্ববান প্রশাসকের মতো গম্ভীর, বাহুল্য বর্জন করে তথ্যবহুল বক্তব্য পেশ করল সে। সাক্ষাৎকার পর্বে রোবট বাদে আর সবকিছুর আলোচনাই ছিল–সবশেষে ডেমারজেল সরাসরি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য তৈরি হলো।

বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। প্রথম প্রশ্নটাই ছিল, “মি. ফার্স্ট মিনিস্টার, আপনি কি রোবট?”

শান্ত ভাবে শুধু তাকিয়ে রইল ডেমারজেল, সবার মাঝে টেনশন বেড়ে উঠতে দিল। তারপর সে হাসল, তার দেহ কেঁপে উঠল খানিকটা, সে হাসল। সেটা উচ্চৈস্বরের হাসি ছিল না, বরং তা ছিল মর্যাদাবান মানুষের আমুদে হাসি। ছোঁয়াচে রোগের মতো সবাইকে আক্রান্ত করে ফেলল, দর্শকদের সবাই হেসে উঠল তার সাথে।

আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ডেমারজেল, তারপর বলল, “উত্তর কি দিতেই হবে? তার কি কোনো প্রয়োজন আছে?” স্ক্রীণের আলো নিভে যাওয়ার সময়ও সে হাসছিল।

.

২৩.

“আমি নিশ্চিত যে কাজ হয়েছে,” সেলডন বললেন। “এখনি সব ঠিক হয়ে যাবে না, তবে সঠিক পথে আসতে শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নামাত্রি যখন ভাষণ দিচ্ছিল তখন ছাত্র ছাত্রীরা প্রথম দিকে তার পক্ষেই ছিল। কিন্তু আমি প্রতিবাদ করাতে এবং আসল সত্যটা বুঝিয়ে দিতেই সবাই পক্ষ ত্যাগ করতে শুরু করে।”

“এটাও কি তোমার কাছে অনুরূপ সমাধান বলে মনে হয়।” সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করল ডর্স।”

“অবশ্যই। সাইকোহিস্টোরি না থাকলেও আমি এ্যানালগি ব্যবহার করতে পারি–সেই সাথে জন্মের সময় সাথে নিয়ে আসা বুদ্ধি। আমার মতে চারপাশ থেকে অভিযোগের স্বীকার ফাস্ট মিনিস্টার শুধু একটু হাসি দিয়েই সমস্ত অভিযোগের মোকাবেলা করল। তার হাসিটাই ছিল জবাব। ফলে তার প্রতি সবার সমব্যদনা জাগতে শুরু করে, কেউ তা থামাতে পারত না। তবে এটা মাত্র শুরু। আমাদেরকে এখনো সানমাস্টার এর জবাবের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

“এই ব্যাপারেও কি তুমি আশাবাদী?”

“নিশ্চয়ই।”

.

২৪.

টেনিস হ্যারির প্রিয় খেলা। তবে দর্শকের আসনে বসে দেখতে নয় বরং নিজে খেলতেই বেশী পছন্দ করেন। কাজেই সম্রাট ক্লীয়নের খেলা দেখে তিনি অধৈর্য হয়ে পরলেন। এটা মূল খেলার একটা ইম্পেরিয়াল ভার্সন, কারণ এই খেলা সম্রাটেরও ভীষণ প্রিয়। একটা কম্পিউটারাইজড র‍্যাকেট ব্যবহার করছেন সম্রাট যার হাতলে চাপ প্রয়োগ করে এ্যাঙ্গেল সামান্য পাল্টানো যায়। সেলডন এই র‍্যাকেটে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু সেজন্য প্রচুর অনুশীলনের প্রয়োজন। আর হ্যারি সেলডনের সময় অত্যন্ত মূল্যবান।

দারুণ একটা শট মেরে খেলায় জিতে গেলেন ক্লীয়ন। দর্শকদের নিয়ন্ত্রিত করতালির মধ্যে টেনিস কোর্ট থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। “অভিনন্দন, সায়ার।” সেলডন বললেন, “চমৎকার খেলেছেন।”

“তোমার তাই মনে হয়, সেলডন?” নিরাসক্ত গলায় জবাব দিলেন ক্লীয়ন। “ওরা সবাই কৌশলে আমাকে জিতিয়ে দেয়। এতে কোনো আনন্দ নেই।”

“সেক্ষেত্রে, সায়ার, প্রতিপক্ষকে নিয়মমতো খেলার আদেশ দিতে পারেন আপনি।”

“তাতেও লাভ হবে না। অন্য কোনো কৌশলে ওরা ঠিকই হেরে যাবে। তাছাড়া অর্থহীনভাবে জেতার মাঝে যেমন আনন্দ নেই তেমনি হেরে যাওয়াতেও আনন্দ নেই। সম্রাট হওয়ার মূল্য তো দিতেই হবে। জোরানিউম সেটা টের পেত হাড়ে হাড়ে–যদি এতদূর আসতে পারত সে।”

ব্যক্তিগত গোসলখানায় ঢুকলেন তিনি। বেরিয়ে এলেন কিছুক্ষণ পরেই পরিচ্ছন্ন এবং অতি সাধারণ পোশাক পরে।

“এবার, সেলডন,” হাত নেড়ে পরিষদদের দূরে থাকতে বললেন তিনি। “টেনিস কোর্ট প্রাণ খুলে কথা বলার জন্য উপযুক্ত, তাছাড়া আবহাওয়াও চমৎকার। কাজেই ভেতরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। মাইকোজেনের সানমাস্টার ফোরটিন এর পাঠানো বার্তা আমি পড়েছি। এতে কাজ হবে?”

“অবশ্যই, সায়ার। জোরানিউমকে দলত্যাগী এবং ভয়ংকর ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করেছে মাইকোজেন।”

“লোকটা তাহলে শেষ হয়ে গেছে?”

“এতে তার গুরুত্ব কমে গেছে মারাত্মকভাবে, সায়ার। ফার্স্ট মিনিস্টার রোবট এই কথাটা এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। তাছাড়া সবাই জেনে ফেলেছে যে জোরানিউম মিথ্যাবাদী এবং কপট আর কপটতা করতে গিয়ে সে ধরা পড়ে গেছে।”

“ধরা পড়ে গেছে,” চিন্তিতভাবে বললেন ক্লীয়ন। “অর্থাৎ তার ধুর্তামী আর ছলনা গোপন থাকলেই সবাই তাকে পছন্দ করত, কিন্তু যেহেতু প্রকাশ হয়ে গেছে। তার প্রতি মানুষের আর সমর্থন নেই।”

“ঠিকই বলেছেন সায়ার।”

“তাহলে জোরানিউম আমাদের জন্য আর কোনো বিপদ নয়।”

“সেটা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই, এখনো সে বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারে। তার সংগঠন এখনো আছে, অনুসারীরা এখনো তার অনুগত। ইতিহাসে অনেক নর নারীর কথা বলা হয়েছে যারা এর চেয়েও বড় বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল এবং সফল হয়েছিল।”

“সেক্ষেত্রে ওর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করছি না কেন, সেলডন?”

মাথা নাড়লেন সেলডন। “এই কাজ করার পরামর্শ কখনোই আপনাকে দেব না। জোরানিউমকে কি আপনি শহীদ বিপ্লবী বানাতে চান, নাকি নিজেকে রক্তলোলুপ প্রমাণ করতে চান?”

ভুরু কুঁচকালেন ক্লীয়ন। “ডেমারজেলের মতো কথা বলছ। যখনই আমি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চাই সে আমাকে ভয় দেখায় যে আমি নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে পরিচিত হব। আমার আগে অনেক সম্রাটই শক্তি প্রয়োগ করে প্রশংসিত হয়েছেন এবং সফল হয়েছেন।”

“নিঃসন্দেহে, সায়ার, কিন্তু আমরা জটিল সময়ে বাস করছি। মৃত্যুদন্ডের কোনো। প্রয়োজন নেই। আপনি এমনভাবে উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবেন যাতে করে আপনাকে বিচক্ষণ এবং সদয় মনে হবে।”

“বিচক্ষণ মনে হবে?”

“আপনার বিচক্ষণতা আরো ফুটে উঠবে, সায়ার। আমি ভুল বলেছি। জোরানিউমের মৃত্যুদন্ড আসলে প্রতিশোধ নেয়া, সেটা হয়তো কেউ ভালো চোখে দেখবে না। সম্রাট হিসেবে আপনাকে প্রত্যেকটা মানুষের বিশ্বাসের প্রতি দয়ালু ক্ষেত্র বিশেষে পিতৃসুলভ মনোভাব পোষণ করতে হবে। আপনি কোনো ভেদাভেদ করতে পারবেন না কারণ আপনি তাদের সম্রাট।”

“কি বোঝাতে চাও তুমি?”

“অর্থাৎ, সায়ার, মাইকোজেনে জন্ম নিয়ে সেই সমাজের নিয়মনীতি ভঙ্গ করেছে জোরানিউম, তার সেই অপরাধে আপনি মর্মাহত। আপনি তাকে মাইকোজেনের হাতে তুলে না দিয়ে আর কি করতে পারেন। এই বিচক্ষণতার জন্য আপনি আরো বেশী বেশী প্রশংসিত হবেন।”

“তাহলে মাইকোজেনিয়ানরাই ওর মৃত্যুদন্ড দেবে।”

“হয় তো সায়ার। ওদের আইনে ধর্মদ্রোহীতার শাস্তি ভীষণ কড়া। কম করে হলেও সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদন্ড।”

হাসলেন ক্লীয়ন। “চমৎকার, বিচক্ষণতার জন্য আমি পাব প্রশংসা আর নোংরা কাজটা করে দেবে ওরা।”

“করবে, সায়ার, যদি আপনি সত্যি সত্যি জোরানিউমকে ওদের হাতে তুলে দেন। তাতেও সে শহীদ বিপ্লবীর মর্যাদা পাবে।”

“এবার তুমি আমাকে দ্বন্ধের মধ্যে ফেলে দিচ্ছ। তুমি আসলে আমাকে দিয়ে কি করাতে চাও?”

“জোরানিউমকে বেছে নেয়ার সুযোগ দিন। বলুন এম্পায়ারের খাতিরে আপনার উচিত তাকে বিচারের জন্য মাইকোজেনের হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু মানবতা বোধ আপনাকে সেটা করতে বাধা দিচ্ছে। কারণ মাইকোজেন নিষ্ঠুর শাস্তির পদক্ষেপ নেবে। কাজেই বিকল্প হিসেবে সে চলে যেতে পারে নিশায়াতে। যে অনুন্নত গ্রহ থেকে এসেছে বলে সে দাবী করছিল এতদিন। বাকী জীবনটা ওখানে নিভৃতে এবং শান্তিতে কাটিয়ে দেবে। আপনি অবশ্যই তাকে পাহারা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা করবেন।”

“এতে সমাধান হবে?”

“অবশ্যই। মাইকোজেনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে জোরানিউম আসলে আত্মহত্যা করবে আর তাকে সেরকম সাহসী মনে হয় নি আমার কাছে। সে অবশ্যই নিশায়া বেছে নেবে। কাজটা যুক্তিসঙ্গত হলেও একই সাথে কাপুরুষোচিত। নিশায়াতে নির্বাসিত থাকাকালীন এম্পায়ারের শীর্ষ ক্ষমতায় পৌঁছানোর মতো বড় কোনো আন্দোলন সে তৈরি করতে পারবে না। তার সংগঠনটা ভেঙ্গে যাবে। একজন শহীদ বিপ্লবীকে আন্তরিকতার সাথে অনুসরণ করা যায় কিন্তু একজন কাপুরুষকে অনুসরণ করা সত্যিই অসম্ভব।”

“চমৎকার! এমন একটা পরিকল্পনা কিভাবে করলে, সেলডন।” ক্লীয়নের কণ্ঠে প্রশংসা।

“আসলে আমার মনে হয়েছে–“

“বাদ দাও,” বাধা দিলেন ক্লীয়ন। “জানি তুমি আমাকে সব খুলে বলবে না, বললেও বুঝব না। তবে একটা কথা তোমাকে জানানো দরকার। ডেমারজেল দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছে। সর্বশেষ ক্রাইসিসটা প্রমাণ করেছে যে সে আর দায়িত্ব পালন করার মতো দক্ষ নয়। আমিও একমত যে এবার তার অবসর নেয়া উচিত। কিন্তু ফার্স্ট মিনিস্টার ছাড়া আমি চলতে পারব না। এই মুহূর্ত থেকে তুমি সেই দায়িত্ব পালন করবে।”

“সায়ার!” বিস্ময় এবং আতংক মিশ্রিত কণ্ঠে চীৎকার করলেন সেলডন।

“ফার্স্ট মিনিস্টার হ্যারি সেলডন,” শান্ত সুরে বললেন ক্লীয়ন, “এটা সম্রাটের ইচ্ছা।”

.

২৫.

“অবাক হয়ো না,” ডেমারজেল বলল। “পরামর্শটা আমার। অনেকদিন হয়ে গেল এখানে আছি আর ক্রাইসিসটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে রোবটিক্সের তিন আইন আমাকে পঙ্গু করে দেয়। তুমিই যথার্থ উত্তরসূরি।”

“আমি যথার্থ উত্তরসূরি নই,” উম্মা প্রকাশ করলেন সেলডন। “এম্পায়ার চালানোর আমি কি জানি? সম্রাট বোকার মতো বিশ্বাস করে বসে আছেন যে এই ক্রাইসিসটা আমি সাইকোহিস্টোরি দিয়ে সমাধান করেছি। অবশ্যই আমি তা করি নি।”

“তাতে কিছু আসে যায় না, হ্যারি। সে যদি বিশ্বাস করে তোমার কাছে সাইকোহিস্টোরি আছে নিজের আগ্রহেই সে তোমাকে অনুসরণ করবে। এভাবেই তুমি ভালো একজন ফার্স্ট মিনিস্টার হয়ে উঠবে।”

“আমাকে অনুসরণ করে সে হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে।”

“আমি মনে করি তোমার অনুভূতি অথবা অন্তৰ্জান–তোমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে… সাইকোহিস্টোরি থাকুক বা না থাকুন।”

“কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি কি করব–ডানীল?”

“ওই নামে ডাকার জন্য ধন্যবাদ। আমি আর ডেমারজেল নই, শুধু ডানীল। আর আমাকে ছাড়া কি করবে–জোরানিউমের ধারণাগুলো কাজে পরিণত করতে পারো। সে হয়তো কোনোদিন করত না, শুধু মানুষের মন জয় করার জন্যই বলেছে। কিন্তু ধারণাগুলো চমৎকার। এভাবে রাইখকেও সাহায্য করা হবে। জোরানিউমের ধারণাগুলো সমর্থন করার পরেও সে তোমাকে সাহায্য করেছে। নিজেকে হয়তো সে বিশ্বাসঘাতক মনে করছে। তুমি প্রমাণ দাও যে আসলে সে তা নয়। তাছাড়া তুমি এখন আরো নিরাপদে সাইকোহিস্টোরি নিয়ে কাজ করতে পারবে যেহেতু সম্রাট স্বয়ং তোমাকে সমর্থন দিয়ে যাবে।”

“কিন্তু তুমি কি করবে, ডানীল?”

“গ্যালাক্সিতে আরো অনেক বিষয় আছে যেখানে আমার মনযোগ দেয়া উচিত। তাছাড়া জিরোয়েথ ল এখনো বিদ্যমান এবং আমাকে মানবতার জন্য যা ভালো তাই করে যেতে হবে। তাছাড়া, হ্যারি–“

“বল, ডানীল।”

“ডর্স এখনো তোমার সাথে আছে।”

মাথা নাড়লেন সেলডন। “হ্যাঁ, ডর্স এখনো আমার সাথে আছে।” ডানীলের মজবুত হাতটা ধরে একটু বিরতি নিলেন তিনি। “বিদায়, ডানীল।”

“বিদায়, হ্যারি।” ডানীল জবাব দিল।

তারপর ঘুরে প্যালেসের হলওয়েতে অদৃশ্য হয়ে গেল রোবট, ফার্স্ট মিনিস্টারের ভারী আলখাল্লা তার হাঁটার সাথে মেঝেতে ঘষটাতে লাগল।

ডানীল চলে যাওয়ার পরও দাঁড়িয়ে রইলেন সেলডন। হারিয়ে গেছেন গভীর চিন্তায়। হঠাৎ করেই তিনি ফার্স্ট মিনিস্টারের কামরার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। ডানীলকে একটা কথা এখনো বলা হয় নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা।

ভেতরে ঢোকার আগে হলওয়ের মৃদু আলোতে কিছুক্ষণ দ্বিধা করলেন সেলডন। কামরা খালি। কালো আলখাল্লা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে একটা চেয়ারের উপর। রোবটের উদ্দেশ্যে বলা হ্যারি সেলডনের কথাগুলো ফার্স্ট মিনিস্টারের চেম্বারে প্রতিধ্বনি তুলল: “বিদায় বন্ধু।” চলে গেছে ইটো ডেমারজেল, অদৃশ্য হয়ে গেছে আর. ডানীল অলিভো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *