৪.০৬ ইয়ামামা হতে রওয়ানা

॥ ছয় ॥

৬৩৩ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ ১২ হিজরীর মুহাররম মাস। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে ইয়ামামা হতে রওয়ানা হন। তারও গতি ছিল দ্রুততর।

হুরমুজ সৈন্য নিয়ে সীমান্ত হতে বহুদূর কাজিমা নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছে এবং সৈন্যদের সেখানেই তাঁবু স্থাপন করতে বলে। এ স্থানটি ইয়ামামা ও উবলার মাঝখানে ছিল। হুরমুজের জানা ছিল না যে, তার প্রতিটি অবস্থার মনিটরিং করা হচ্ছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কাজিমা হতে বহু দূরে থাকতেই ইরাকের দিক হতে দু’ উষ্ট্রারোহীকে এগিয়ে আসতে দেখেন। তারা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জানান যে, হুরমুজ বাহিনী-কাজিমায় এসে ছাউনী ফেলেছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সেখান থেকে রাস্তা বদল করেন। সংবাদবাহক উষ্ট্রারোহীরা হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু কতৃক প্রেরিত ছিল। তারা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কে অনুরোধ করেন, যেন তিনি হুরমুজ বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়েই হাফীরে গিয়ে পৌঁছেন। তারা এ সুসংবাদও শুনান যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য আট হাজার সৈন্য অপেক্ষা করছে। মুসান্না বিন হারেছা, মাজউর বিন আদী, হুরমূলা এবং সুলামা প্রত্যেকেই দুই দুই হাজার যোদ্ধা সংগ্রহ করায় এ আট হাজার সৈন্যের ব্যবস্থা হয়। এভাবে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর সৈন্য সংখ্যা ১৮ হাজার গিয়ে পৌঁছে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিরাপদে হাফীরে পৌঁছতে কাজিমার বহুদূর দিয়ে এগিয়ে চলেন। হুরমুজের চর মরু এলাকায় ছড়িয়ে ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্যদেরকে দূর রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে তারা দেখতে পায়। হুরমুজ ছাউনি উঠিয়ে দ্রুত হাফীরে মার্চ করে যাবার নির্দেশ দেয়। হাফীরের চতুর্দিকে পানির কূপ বিদ্যমান ছিল। হুরমুজ সেখানে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পূর্বেই পৌঁছে গিয়ে ছাউনি তৈরি করে ফেলে। এভাবে হাফীরের সকল পানির কূপ ইরানীদের কব্জায় চলে যায়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হাফীরে পৌঁছার পূর্বেই পথিমধ্যে আবার ঐ দু’ উষ্ট্রারোহীর উদয় হয়। তারা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জানায় যে, ইতোমধ্যে হাফীরের সকল পানির এলাকা হুরমুজের কব্জায় চলে গেছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সামনে আরো এগিয়ে গিয়ে এমন এক স্থানে ছাউনি ফেলার নির্দেশ দেন যার আশে পাশের কোথাও পানির ছিটা ফোঁটা ছিল না। সৈন্যরা সেখানে ছাউনি ফেললেও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কে অবহিত করা হয় যে, সৈন্যদের মাঝে মৃদু এ গুঞ্জন উঠছে যে, এমন এক স্থানে ছাউনি ফেলা হয়েছে যার আশে পাশে কোথাও পানির নাম-গন্ধ পর্যন্ত নেই।

“আমি ভেবে চিন্তে এখানে ছাউনি ফেলেছি”– হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “সৈন্যদের জানিয়ে দাও যে, শত্রুরা পানি কব্জা করে ফেললেও তাতে পেরেশানীর কিছু নেই। আমাদের প্রথম লড়াই পানি উদ্ধারের জন্যই হবে। পানি সেই পাবে, যে জীবন বাজি রেখে লড়াই করবে। তোমরা দুশমনের কবল থেকে পানি ছিনিয়ে নিতে পারলে বুঝবে যুদ্ধ তোমরাই জিতে নিয়েছ।”

সর্বাধিনায়কের এ নির্দেশ মুহুর্তে ছাউনীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পৌঁছে যায়। প্রতিটি সৈন্য যুদ্ধ প্রেরণায় উদ্দীপ্ত ও প্রস্তুত হয়ে যায়।

ইতোমধ্যে মুসান্না ও তার সাথীদের সংগৃহীত ৮ হাজার সৈন্য হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীর সাথে এসে মিলিত হয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর যে দূত হুমুজের দরবারে গিয়েছিল তিনিও এ সময় এসে পৌঁছান। হুরমুজ তার সাথে যে অপমানজনক আচরণ করেছে তা তিনি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে খুলে বলেন।

“এক লক্ষ দেরহামের টুপিই তার মাথা খারাপ করে দিয়েছে, সেখানে উপবিষ্ট হযরত মুসান্না বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন–মানুষের মাথায় কি আছে আল্লাহ তা দেখেন না; তিনি দেখেন ঐ মাথার মধ্যে কি আছে। তার উদ্দেশ্য কি। অভিপ্রায় কি। কোন ধ্যান-ধারণা নিয়ে সে চলে।”

“এক লক্ষ্য দেরহামের টুপি?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন–“হুরমুজ সত্যই এত দামী টুপি পরে?”

“পারস্য সাম্রাজ্যের একটি নিয়ম আছে” মুসান্না বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন–“বংশকৌলিন্য, প্রভাব প্রতিপত্তি এবং পদমর্যাদা বিবেচনায় তাদেরকে বিভিন্ন টুপি পরিধান করানো হয়। এটা রাষ্ট্রের পক্ষ হতে দেয়া হয়। অধিক মূল্যবান টুপি তারাই পরে যাদের বংশ মর্যাদা উন্নত এবং যারা প্রজাদের নিকট ও শাহী দরবারেও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। বর্তমানে হুরমুজের টুপির মূল্যই সবচেয়ে বেশি। এক লক্ষ দেরহামের টুপি বর্তমানে আর কারো পরার অধিকার নেই।” “এই টুপি বহু মূল্যবান হীরা-পান্না খচিত। টুপির শীর্ষ পালকও বেশ দামী।” ফেরাউনও তার মাথায় খোদায়ী টুপি ধারণ করেছিল” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “কিন্তু আজ সে কোথায়? কোথায় গেল তার টুপি…কারো দামী টুপি আমাকে প্রভাবিত করবে না এবং কোন টুপি তরবারির আঘাত প্রতিহত করতে পারবে না। এর চেয়ে আমাকে বলো, অগ্নিপূজারীরা লড়াইয়ে কেমন এবং রণাঙ্গনে তারা কত দ্রুততার সাথে স্থান পরিবর্তন করে করে অসি চালাতে পারে?”

“পারস্য সিপাহীদের বর্ম এবং অস্ত্র দেখলে অন্তরে ভয় লাগে” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অবগত করেন, “মস্তকে জিঞ্জির বিশিষ্ট শিরস্ত্রাণ, বাহুতে বিশেষ ধাতুর খোলস, পায়ের নলার দিক মোটা চামড়া কিংবা অন্য কোন ধাতু দ্বারা সংরক্ষিত। যুদ্ধাস্ত্র অনেক। প্রতিটি সিপাহীর কাছে একটি বর্শা, একটি তরবারী, একটি ভারী লৌহগদা, একটি ধনুক এবং তীর ভর্তি একটি তূনীর থাকে। সাধারণত প্রতিটি তূনীরে ত্রিশটি তীর থাকে।”

“আর লড়াই করতে কেমন পটু?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞাসা করেন। “বীরত্ব এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে লড়ে তারা” মুসান্না বিন হারেছা জবাবে বলেন–“তাদের বীরত্বের কথা সর্বজনবিদিত।”

“মুসান্না!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “ইরান সিপাহীদের দুর্বলতার পরিমাণ তুমি অনুমান করতে পারনি? তাদের বীরত্বের পরিধি অনুধাবন করনি? … তাদের বীরত্বের পরিধি শিরস্ত্রাণ, বায়ুবন্ধ এবং হাঁটুর নীচের অংশ রক্ষার্থে ধাতু নির্মিত খোলস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তারা জানেনা যে, জযবা ও প্রেরণা লৌহ কেটে দু’ভাগ করে দিতে পারে। কিন্তু লোহার তরবারী এবং বর্শার ফলা প্রেরণা খণ্ডিত করতে পারেনা। বর্ম এবং ধাতু কিংবা চামড়ার খোল আত্মরক্ষার কৃত্রিম মাধ্যম। একটি খোল কেটে গেলে সিপাহী নিজেকে অরক্ষিত মনে করতে থাকে। এর পরে তার মাঝে কেবল এতটুকু সাহস থাকে যে, সে কোনভাবে আত্মরক্ষা করতে এবং রণাঙ্গন ছেড়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। আল্লাহর সৈন্যদের বর্ম হলো তার চেতনা এবং ইস্পাতদৃঢ় ঈমান। পারস্যদের আরেক দুর্বলতা তোমাদের দেখাব?” এর পর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এক দূতকে ডেকে বলেন “সালার এবং কমান্ডারদের এখনি আসতে বল।”

“এখনই কাজিমা লক্ষ্যে সৈন্য মার্চ করাও” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নির্দেশ দিয়ে বলেন–“এবং সৈন্যদের চলার গতি অত্যন্ত দ্রুত হওয়া চাই।”

হুরমুজ হাফীরায় ছাউনী ফেলে অবস্থান করছিল। সে কাজিমা থেকে স্বীয় বাহিনী এখানে এনেছিল। কেননা, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী হাফীরা এসে গিয়েছিল। এখন সৈন্যরা আবার কাজিমা অভিমুখে রওনা হয়। উভয় ফৌজের কয়েক অশ্বারোহী পরস্পরের তাঁবুর উপর গভীর নজর রেখেছিল। হুরমুজ যখন খবর পায় যে, মুসলিম বাহিনী আবার কাজিমার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেছে। তখন হুরমুজও তার বাহিনীকে কাজিমার উদ্দেশে মার্চ করার নির্দেশ দেয়।

হুরমুজের চিন্তা ছিল উবলা এলাকা নিয়ে। এটা ইরানী সাম্রাজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর ছিল। বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল এটা। হিন্দুস্থানের বণিক কাফেলাদের আনাগোনা এ স্থানেই বেশী হত। বিশেষ করে সিন্ধুর পণ্যসামগ্রী এখানেই এসে পৌঁছত। এখানে ইরানী সেনাবাহিনীর হেড কোয়াটারও অবস্থিত ছিল। অত্র এলাকায় বসবাসরত মুসলমানদের দাবিয়ে রাখতে উবলায় সবসময় রিজার্ভ বাহিনী থাকত। হুরমুজ চাচ্ছিল খালিদ বাহিনী যেন কোন ভাবেই উবলায় পৌঁছতে না পারে। হুরমুজের কাছে উবলা এখন পূর্বের তুলনায় অধিক বিপদাপন্ন মনে হতে থাকে। কারণ, মুসলমানদের গতি এখন উবলার দক্ষিণে কাজিমার প্রতি ছিল।

মুসলমানদের জন্য পুনরায় কাজিমা যাওয়া এত কঠিন ছিল না, যত কঠিন ছিল হুরমুজ বাহিনীর জন্য। মুসলমানদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ উট ঘোড়া ছিল। সৈন্যরাও সকলে হাল্কা-পাতলা অস্ত্রধারী ছিল। তারা অতি সহজে দ্রুত চলতে পারত। পক্ষান্তরে ইরানী সৈন্যরা বর্ম এবং অস্ত্র-শস্ত্রে ঠাসা ছিল। যার ফলে দ্রুত চলা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনা। তারপরও মাত্র একদিন পূর্বে তারা কাজিমা হতে হাফীরা এসেছিল সে সফরের ক্লান্তি কাটিয়ে না উঠতেই তাদের আবার কাজিমার উদ্দেশ্যে মার্চ করতে হয়। তাও আবার অতি দ্রুত। কেননা মুসলমানদের সেখানে পৌঁছার পূর্বেই তারা পৌঁছতে চায়। ফলে সৈন্যরা পথিমধ্যেই দারুণ হাফিয়ে ওঠে। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে যেতে থাকে তাদের শরীর। হুরমুজের বাহিনী কাজিমায় যখন মুসলমানদের মোকাবিলায় পৌঁছে তখন তাদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। মুসলিম সৈন্যরা মরুযুদ্ধ এবং মরুভূমিতে চলাফেরা করায় অভ্যস্ত ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু শত্রুদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সময় দেন না। শত্রুরা কাজিমায় পৌঁছতেই হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার বাহিনীকে পুরোপুরি যুদ্ধ সাজে বিন্যস্ত করে ফেলেন। তিনি পুরো বাহিনীকে তিন অংশে বিভক্ত করে নিজে মধ্যম বাহিনীতে থাকেন। ডান এবং বাম বাহিনীর নেতৃত্বে থাকেন যথাক্রমে হযরত আছেম বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আদী বিন হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু। হযরত কা’কা’ বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সহোদর ছিলেন হযরত আলী বিন হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি গোত্রের সর্দার ছিলেন। তিনি বড় উঁচু লম্বা এবং বলিষ্ঠ শরীরের বীর বাহাদুর ছিলেন।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সৈন্য বিন্যস্ত করতে দেখে হুরমুজও তার বাহিনীকে তিন অংশে বিভক্ত করে। মধ্যম বাহিনীতে সে নিজে থাকে। অপর দু’ অংশের নেতৃত্বে থাকে কুববাজ এবং আনুশযান নামক শাহী খান্দানের দুই ব্যক্তি। হুরমুজ ঠিকই দেখে যে, তার ফৌজ ঘামে নেয়ে যাচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত বইছে। তাদের রেষ্টের খুব প্রয়োজন। কিন্তু মুসলমানরা যুদ্ধ প্রস্তুতিতে থাকায় বাধ্য হয়ে তাকেও সৈন্য বিন্যস্ত করতে হয়। হুরমুজ তার বাহিনীকে এমনভাবে বিন্যস্ত করে যে, কাজিমা শহর তার ফৌজের পশ্চাতে এসে যায়। তাদের সামনে ধু ধু মরুভূমি ছিল। আর আরেক দিকে ঘন ঝোঁপ-ঝাড়পূর্ণ টিলা বিশিষ্ট সারি সারি পাহাড় ছিল।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় বাহিনীকে এমনভাবে এগিয়ে নিয়ে যায় যে, পাহাড়ের সারিগুলো সব তাঁর বাহিনীর পশ্চাতে চলে যায়।

৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। এ সময়ে প্রথমবারের মত মুসলমানরা অগ্নিপূজক ইরানীদের মোকাবিলা করে।

“খালিদ বিন ওলীদ মারা গেলে এ যুদ্ধ কোনরূপ সংঘর্ষ ছাড়াই শেষ হতে পারে” হুরমুজের এক সেনাপতি তাকে বলে। মুসলমানরা অনেক দূর থেকে এসেছে। সেনাপতির মৃত্যুর পর বেশিক্ষণ তারা আমাদের মোকাবেলায় টিকে থাকতে পারবে না।”

“সৈন্যদেরকে জিঞ্জিরে আবদ্ধ হতে বল” হুমুজ সালারকে বলে ‘আমি তাদের সেনাপতির ব্যবস্থা করছি। সর্বাগ্রে সেই নিহত হবে।” এর পর সে সালারকে পাঠিয়ে বডিগার্ড বাহিনীকে ডেকে পাঠায় এবং তাদেরকে কিছু নির্দেশনা দেয়। জিঞ্জিরে আবদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, পাঁচ পাঁচজন বা দশ দশজন করে ইরানী সৈন্যরা একটি লম্বা শিকলে নিজেদের আবদ্ধ করত। তবে প্রতি দু’জনের মাঝখানে এতটুকু দূরত্ব থাকত, যাতে সৈন্যটি ইচ্ছামত নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লড়াই করতে পারে। শিকল বাঁধার একটি লাভ এই ছিল যে, কোন সৈন্য রণাঙ্গনে থেকে পালাতে পারত না। আরেকটি ফায়দা ছিল, শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী তাদের উপর চড়াও হলে তারা শিকল জমিন থেকে উঁচু করে ধরত। যার ফলে ঘোড়া শিকলে বেঁধে পড়ে যেত। কিন্তু শিকল বাঁধার একটি বড় ক্ষতি এই ছিল যে, শৃঙ্খলিত সৈন্যদের কেউ নিহত বা আহত হলে বাকী সবাই বিরাট সমস্যায় পড়ত। তখন মারা যাওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর থাকত না। সহজে শত্রুপক্ষ তাদের প্রাণ হরণ করতে পারত।

ইরান সৈন্যরা এভাবে ব্যাপকভাবে নিজেদেরকে শিকলে আবদ্ধ করে নেয়ায় হুরমুজ বাহিনী বনাম হযরত খালিদ বাহিনীর মাঝে সংঘটিত এ যুদ্ধের নাম হয়ে যায় জলে সালাসীল বা ‘শিকলযুদ্ধ’।

মুসলিম বাহিনী ইরানীদেরকে এভাবে শৃঙ্খলিত হতে দেখে বিস্মিত হয়ে ওঠে। এক ব্যক্তি জোরে চিৎকার করে বলে “দেখ দেখ, ইরানীরা আমাদের জন্য নিজেদেরকে বাঁধছে।

‘বিজয় আমাদেরই হবে ইনশাআল্লাহ’ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উচ্চকণ্ঠে বলেন– “আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যে উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে কাজিমা থেকে হাফিরা এবং আবার হাফীরা থেকে কাজিমায় আসেন তা পদে পদে বাস্তবায়িত হতে দেখেন। ভারী অস্ত্রে বোঝাই হুরমুজ বাহিনী লড়াই শুরু হওয়ার পূর্বেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দেননা। তদুপরি ইরানীরা নিজেদেরকে শিকলে আবদ্ধ করে নেয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে কি চাল চালবেন এবং ইরানীদের কিভাবে লড়াবেন।

হুরমুজ অশ্ব ছুটিয়ে দেয় এবং উভয় বাহিনীর মধ্যখানে এমন এক স্থানে এসে ঘোড়া দাঁড় করায় যেখানে জমিন উঁচু নীচু এবং ইতস্তত টিলা ছড়িয়ে ছিল। তার বডিগার্ড বাহিনী কিছুদূর এগিয়ে থেমে যায়।

“কোথায় সে খালিদ!” হুরমুজ হুঙ্কার দিয়ে বলে “আয়, প্রথমে তোর আর আমার মাঝে মোকাবিলা হয়ে যাক।”

তৎকালীন যুগের যুদ্ধ রীতি এই ছিল যে, মূল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে উভয় পক্ষের সেনাপতি মল্লযুদ্ধের আহ্বান করত। উভয় সৈন্য বাহিনী হতে এক একজন এসে পরস্পরের সাথে তরবারীর লড়াই করত আবার কুস্তিও লড়ত। এটাকে বলা হত মল্লযুদ্ধ। এ যুদ্ধে দু’জনের একজনের মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। এই যুদ্ধে হুরমুজ নিজেই এসে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে মল্ল যুদ্ধে যুদ্ধে লড়তে আহবান করে। হুরমুজ নামকরা বীর বাহাদুর ছিল। তরবারী চালনায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াও তার দেহে গণ্ডারের মত শক্তি ছিল।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বয়স ৪৮ ছুঁই ছুঁই। তিনি অদ্বিতীয় সমর কুশলী ছিলেন। তাঁর দেহে তখনও প্রচুর শক্তি ছিল। তবে শক্তির পরিমাপে হুরমুজের পাল্লাই ছিল ভারী। হুরমুজের আহবান শুনে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অশ্ব ছুটিয়ে দেন এবং সোজা হুরমুজের সামনে এসে দাঁড়ান। হুরমুজও অশ্ব থেকে নেমে আসে এবং হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কেও নামার জন্য ইশারা করে। উভয়ের হাতে “নাঙ্গা তলোয়ার।”

শুরু হয় আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ। লড়ে চলে উভয়ের তরবারী এবং ঢাল তরবারী সংঘর্ষের ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ আর মাঝপথে এসে বাধ সাধা ঢালের ঠাস ঠাস শব্দে মুহূর্তে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মরুভূমি। উভয়ের একে অপরের দিকে এগিয়ে গিয়ে আক্রমণ করে। চাল পরিবর্তন করে। ঘুরে ঘুরে একে অপরের উপর চড়াও হয়। কিন্তু সকল আঘাত প্রতিঘাত তরবারীদ্বয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। যে কোন আঘাত একে অপরে ভাগ করে নিতে থাকে। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাত খুলে যায়। এবং চালে চমক আসতে থাকে। সাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে তার মধ্যে। উভয় বাহিনী দূরে দাঁড়িয়ে অনিমেষ লোচনে উপভোগ করছিল দুই মহা সেনাপতির মল্লযুদ্ধ। উভয় বাহিনীতে চাঁপা উত্তেজনা; উদ্বেগে চেয়ে থাকা চোখগুলোতে একটিই প্রশ্ন ঝরে পড়ছিল যে, এই সেয়ানে সেয়ানে লড়াইয়ে কে হারবে, কে পরবে বিজয়ের বরমাল্য? উভয় বাহিনী থেকে থেকে স্লোগান তুলছিল। হুরমুজ অভিজ্ঞ বীর ছিল। সে নিশ্চিত হয়ে যায় যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তরবারি তাকে ক্ষমা করবে না। তরবারির গতিই বলে দিচ্ছিল তার প্রাণ সংহার নিশ্চিত। সে নিজেকে বাঁচাতে কূট কৌশলের আশ্রয় নেয়। দ্রুত পিছনে সরে গিয়ে তলোয়ার দূরে ছুঁড়ে দেয়।

“তলোয়ারের চূড়ান্ত ফায়সালা হবেনা”– হুরমুজ বলে– “আয় খালিদ! তরবারি ফেলে আয় এবং কুস্তি লড়।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তলোয়ার দূরে ছুড়ে দিয়ে কুস্তি লড়তে সামনে অগ্রসর হন এবং উভয়ে একে অপরকে জাপটে ধরে। কুস্তিতে হুরমুজের পাল্লা ভারী হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু ঐতিহাসিকদের অভিমত হচ্ছে, কুস্তি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে হুরমুজের মতলব ভিন্ন। হুরমুজ তার বডিগার্ড বাহিনীকে বলে রেখেছিল যে, যখন সে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে এমন দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে যে, তার নড়া চড়ার কোন শক্তি থাকবে না তখন তারা চতুর্দিক দিয়ে তাদেরকে এমনভাবে ঘিরে দাঁড়াবে, যেন তাদের হাভ-ভাবে কারো সন্দেহের সৃষ্টি না করে। অর্থাৎ তারা আমোদী দর্শকের মতই আঁচার-আচরণ প্রকাশ করবে। কিন্তু তার মধ্যে কৌশলে এক মুহাফিজ (দেহরক্ষী) খঞ্জর বের করে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর পেটে আমূল বসিয়ে দেবে। প্রকৃত যোদ্ধা কখনো প্রতিপক্ষকে এমন ধোঁকা দেয় না। কিন্তু হুরমুজ এতই জঘন্য প্রকৃতির ছিল যে, সে একজন নামকরা যোদ্ধা হয়েও এমন প্রতারণামূলক ষড়যন্ত্র করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে কোন রকমে বাগে পেয়েই দুরাচারী হুরমুজ দেহরক্ষী বাহিনীকে এগিয়ে আসতে ইশারা করে। দেহরক্ষীরা এগিয়ে আসতে থাকে। এবং শ্লোগান দিতে দিতে বৃত্তের আকারে রূপ নিতে থাকে। তারা এ সময় ঘোড়ায় সওয়ার ছিল না। তারা ক্রমেই বৃত্ত সংকীর্ণ করে আনতে আনতে কুস্তি লড়াকুদ্বয়ের নিকটে চলে আসে। দেহরক্ষীদের কাছে আসতে দেখে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দৃষ্টি দু’দিকে বিভক্ত হয়ে যায়। ক্ষণিকের জন্য যে অন্যমনষ্কতা তার মাঝে সৃষ্টি হয় হুরমুজ তাকে লুফে নেয় এবং এই সুযোগে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহুদ্বয় এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরে যে, তার হস্ত দ্বয় হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর বগলে ছিল। ইতোমধ্যে দেহরক্ষীরা আরো নিকটে চলে আসে।

হুরমুজ দেহরক্ষীদের লক্ষ্য করে মুখে কি যেন বলে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার ভাষা না বুঝলেও ইশারা ঠিকই অনুধাবন করেন। তিনি নিজেকে বিপদের সম্মুখীন দেখে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন এবং শরীরের সমস্ত শক্তি এক স্থানে জমা করে এমন জোরে ঘুরতে থাকেন যে, হুরমুজকেও নিজের সাথে নিয়ে ঘুরেন। অতঃপর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এক স্থানে দাঁড়িয়ে ঘুরতে থাকেন। প্রচণ্ড ঘূর্ণনের কারণে হুরমুজের পা মাটিশূন্য হয়ে যায়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হুরমুজের বাহু নিজের বগলে চেপে ধরে তার বগলে নিজের হাত রেখে তাকে শূন্যে ঘুরাতে থাকেন। এভাবে ঘূর্ণনের ফলে দেহরক্ষীদের বৃত্ত প্রসারিত হতে থাকে এবং কেউ আগে বেড়ে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর আক্রমণ করার সুযোগ পায় না। কিন্তু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঘূর্ণন কৌশল বেশীক্ষণ টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। কারণ, দীর্ঘ পরিশ্রমে তিনি যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

আচমকা এক প্রান্ত হতে একটি অশ্ব ছুটে আসে। আত্মরক্ষার্থে ব্যস্ত দেহরক্ষীরা এ অশ্ব দেখতে পায় না। অশ্ব বিদ্যুৎগতিতে দেহরক্ষীদের বৃত্ত কাটতে কাটতে আগে বেরিয়ে যায়। তিন দেহরক্ষী মাটিতে লুটিয়ে ছটফট করতে থাকে। তাদের একজন অশ্বের পদতলে পিষ্ট হয় আর বাকী দু’জন আগন্তুক অশ্বারেহীর তলোয়ারে দ্বিখণ্ডিত হয়। ঘাতক অশ্ব কিছুদূর গিয়ে আবার পিছনে মোড় নেয় এবং পুনরায় হুরমুজের দেহরক্ষীদের লক্ষ্যে এগিয়ে আসে। দেহরক্ষীরা নিজেদের বাঁচাতে সাধ্যমত চেষ্টা করলেও আবারও তিন দেহরক্ষী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চোখের পলকে ৬ সাথীর এভাবে নির্মম নিহত হতে দেখে তারা ভড়কে যায় এবং পালিয়ে মূল বাহিনীতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

এই আগন্তুক অশ্বারোহী ছিলেন হযরত কা’কা’ বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাহায্য হিসেবে পাঠিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন “যে পক্ষে কা’কার মত দূরন্ত যোদ্ধা থাকবে তারা হারবে না।”

ক্ষণিকের জন্য দর্শকের দৃষ্টি হযরত কা’কা’ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চোখ ধাঁধানো দৃশ্যের দিকে নিবদ্ধ হলেও আবার সবার দৃষ্টি হুরমুজ ও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দিকে ফিরে যায়। সকলের চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময় নেমে আসে। যে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রাণ যায় যায় করছিল তিনিই এখন চেঁপে বসা পাপীষ্ঠ হুরমুজের বুকে, আর হুরমুজ নিযর নিস্তব্ধ দেহে চিৎ হয়ে মাটিতে পড়েছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খঞ্জর এক সময় হুরমুজের বুক থেকে বেরিয়ে আসে। খঞ্জর থেকে রক্ত টপ টপ করে পড়ছিল।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হুরমুজের আহবানে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হতে গেলে হযরত কা’কা বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘটনা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকেন। হুরমুজের দেহরক্ষীদের বৃত্তাকারে এগিয়ে আসতে দেখে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জীবনের ব্যাপারে তাঁর মনে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। তিনি এগিয়ে যান এবং বাস্তবে যখন হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জীবন সংকটাপন্ন এবং তিনি নিজেকে বাঁচাতে প্রানান্ত প্রয়াসরত, তখন তিনি কারো নির্দেশ কিংবা অনুমান ছাড়াই ঘোড়া ছুটিয়ে দেন এবং দেহরক্ষীদের উপর আক্রমণ করে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জীবনরক্ষা করেন।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হুরমুজের লাশের উপর থেকে উঠে দাঁড়ান। এখন এক লক্ষ দেরহাম মূল্যের টুপি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে। এবং তার রক্তে রঞ্জিত খঞ্জর উঁচু করে তুলে ধরে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাহিনীকে মূল যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তার পূর্বের দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী মুসলিম বাহিনীর দুই অংশ দুই দিক থেকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ডান ও বাম দিক থেকে তারা ইরানী বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে। ইরানীরা হুরমুজের মত সেনাপতির মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়লেও স্বীয় ঐতিহ্যজাত বীরত্বের কারণে তারা অস্ত্র ত্যাগ করেনা। তাদের সংখ্যাও মুসলমানদের তুলনায় অনেক বেশী ছিল। যুদ্ধ সামগ্রী অস্ত্র, অশ্বের কোন কমতি তাদের ছিল না। মুসলমানদের মোকাবিলায় তারা দারুণ রুখে দাঁড়ায়। পরিস্থিতি এমন হয়ে ওঠে যে, ইরানীদের পরাজিত করা সম্ভব নয়; আর হলেও তা হবে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। ইরানী সৈন্যরা পাঁচজন, সাতজন দশজন করে এক এক শিকলে বাঁধা ছিল। তারা চতুর্মুখী আক্রমণ প্রতিহত করে যাচ্ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের ক্লান্ত করে তোলার জন্য অশ্বারোহীদের ব্যবহার করেন। অশ্বারোহীরা তাদের পদাতিক তীব্রগতির আক্রমণ শুরু করে যে, তাদের প্রাণ বাঁচাতে ডানে বামে ছুটোছুটি করতে হয়। পদাতিক বাহিনীকেও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এমনিভাবে লড়িয়ে যান। ইরানী পদাতিকরা দিশেহারা হয়ে পলায়নের সহজ পথ খুঁজতে থাকে। এর বিপরীতে মুসলমানরা হাল্কা অস্ত্র সজ্জিত হওয়ায় দ্রুততার সাথে স্থান পরিবর্তন করে যেভাবে ইচ্ছা লড়াই করছিল।

কিছুক্ষণ পর ইরানীদের মাঝে ক্লান্তি আর অবসাদের ছাঁপ সুস্পষ্ট প্রতিভাত হতে থাকে। ঐতিহ্যগত ধারা হিসেবে তারা নিজেদেরকে যে শিকলে আবদ্ধ করেছিল পরে তা তাদের পায়ের বেড়িতে পরিণত হয়। ভারী অস্ত্রের বোঝাই তাদের জীবনের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। ইরানীদের শৃঙ্খলা ও সুসংঘবদ্ধতায় ফাটল সৃষ্টি হতে থাকে। তাদের মধ্যম বাহিনীর কমাণ্ড হুরমুজের মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। পার্শ্ব বাহিনীদ্বয়ের কমান্ডার কুববায এবং আনুশযান পরাজয় নিশ্চিত অনুধাবন করে সৈন্যদের পিছু হটার নির্দেশ দেয়। পিছু হটা কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব ছিল যারা শিকলে বাঁধা ছিল না। এদের অধিকাংশই ছিল অশ্বারোহী। কুববায এবং অনুশাযান নিজ নিজ পার্শ্ব বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য নিরাপদে পিছে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেও মধ্যম বাহিনী শৃঙ্খলিত থাকায় তাদের হাজার হাজার সৈন্য মুসলমানদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। শৃঙ্খলিত সৈন্যদের উপর এটা ছিল এক ধরনের পাইকারী হত্যা, যা সূর্য অস্ত মিত হওয়ার পরেও চলতে থাকে। রাত বেশ গাঢ় হলে হত্যাযজ্ঞের ধারা বন্ধ হয়।

সাত

এক বিরাট শক্তিশালী শত্রুকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে দুনিয়ার সামনে মুসলমানরা এই নজির স্থাপন করে যে, সংখ্যাধিক্য এবং উন্নত হাতিয়ার হলেই যুদ্ধজয় করা যায় না। জযবা এবং প্রেরণাসিক্ত লড়াই করেই যুদ্ধ জিতে নিতে হয়। পরের দিন গনীমতের মাল জমা করা হয়। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পুরো মাল পাচ ভাগে বিভক্ত করেন। চার ভাগ সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দেন আর একভাগ বাইতুল মালে জমা দেয়ার জন্য মদীনায় খলীফা আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এর বরাবর পাঠিয়ে দেন। হুরমুজের এক লক্ষ্য দেরহাম মূল্যের টুপিও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু খলিফার নিকট পাঠিয়ে দেন। খলীফা এই টুপি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ফেরৎ পাঠান। কারণ, মল্লযুদ্ধে হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির সমস্ত মাল-সম্পদের প্রাপক হয়ে থাকে। ফলে মল্লযুদ্ধে হুরমুজকে হত্যা করায় তার এ টুপির মালিক হয়ে যান হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু।

“দেখ দেখ বাইরে বেরিয়ে এসে দেখ এটা আবার কি!”

মদিনার অলি গলিতে এমনি ধরনের আওয়াজ ক্রমশই উচ্চারিত হতে থাকে। মানুষ পাল্লা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে শুরু করে কে কার আগে যাবে এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়।

“এটা কোন প্রাণী হবে” জনতার বুক চিরে এক আওয়াজ।

“না… খোদার কসম, এমন প্রাণী কখনো আমরা দেখিনি” প্রথম আওয়াজ প্রত্যাখ্যান করে দ্বিতীয় আওয়াজ।

“এটা কোন প্রাণী নয়… আল্লাহর বিস্ময়কর এক সৃষ্টি” কিছুটা বিজ্ঞতা ভাব মিশ্রিত তৃতীয় আওয়াজ আসে।

ঘরের মহিলা ও শিশুরাও ছুটে আসে। সবার চোখে প্রশ্ন, চেহরায় বিস্ময়ের ছাঁপ। ছোটরা এক নজরে দেখেই ভয়ে মায়ের আঁচল কিংবা পিতার পিছনে গিয়ে লুকায়। যারা আল্লাহর এই আজব প্রাণী ধরে রেখেছিলেন তারা জনতার উৎসুক হাবভাব দেখে মুচকি হাসছিলেন। আজব প্রাণীর পিঠে যারা বসা ছিল তাদের মুখেও হাসি শোভা পাচ্ছিল।

“এটা কি?” জনতা জানতে চায় “এটাকে কি বলে?

“একে হাতি বলে” হাতির সাথে সাথে গমনকারী এক ব্যক্তি উচ্চ আওয়াজে বলে–“এটা একটা যুদ্ধ প্রাণী। ইরানীদের থেকে এটা আমরা ছিনিয়ে নিয়েছি।”

শিকলযুদ্ধে ইরানী বাহিনী পশ্চাদপসারণ করলে এ হাতিটি মুসলমানদের হস্ত গত হয়। প্রায় সকল ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গনীমতের মালের যে এক পঞ্চমাংশ খলীফা বরাবর পাঠিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি হাতিও ছিল। মদীনাবাসী ইতোপূর্বে হাতি দেখেনি। হাতিটি মদীনার শহর নগরসহ প্রতিটি অলি-গলিতে প্রদর্শনী করে ফিরান হয়। সবাইকে প্রাণীটি বিস্মিত করে। অনেকে ভীতও হয়ে পড়ে। তারা একে প্রাণী নয়; আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি বলত। হাতির সাথে তার ইরানী মাহুতও ছিল।

হাতিটি মদীনায় কয়েকদিন রাখা হয়। বসে বসে খাওয়া ছাড়া তার অন্য কোন কাজ ছিল না। হাতি থেকে কাজ নেয়ার পদ্ধতিও মদীনাবাসীদের জানা ছিল না। আর জানলেও মাত্র একটি হাতি দিয়ে আর কিইবা করা যায়। আমীরুল মু’মিনীন মাহুত সহ হাতিটি আযাদ করে দেন। কোন ইতিহাসে এ তথ্য উল্লিখিত হয়নি যে, হাতিটি মদীনা হতে কোথায় চলে যায়।

দজলা এবং ফোরাত আজও প্রবহমান। এক হাজার তিনশ বায়ান্ন বছর পূর্বেও প্রবাহমান ছিল। তবে সেদিনের প্রবাহ আর আজকের প্রবাহের মাঝে ব্যবধান আকাশপাতাল। সাড়ে তেরশ বছর পূর্বে দজলা এবং ফোরাতের লহরে ইসলামের বীর মুজাহিদদের প্রেরণা এবং জযবার কলতান উঠত। এ সকল দরিয়ার পানিতে শহীদদের তাজা খুন মিশ্রিত ছিল। রেসালাত চেরাগের প্রেমিকগণ দজলা এবং ফোরাতের উপকূল বেয়ে ইসলামকে শুধু সম্মুখপানে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এদিকে যরথুস্ত্রের আগুনের শিখা লাফিয়ে লাফিয়ে মুসলমানদের গতিরোধ করতে থাকে। কিন্তু মুসলমানরা দুর্বার গতিতে সকল বাধা পেরিয়ে শুধু এগিয়েই চলতে থাকে।

মুসলমানদের জন্য সামনে এগিয়ে চলা সহজ ছিল না। তারা ইরান সাম্রাজ্যের লেজে পাড়া দিয়েছিল। মুসলমানদের সংখ্যা কম এবং তেজোদ্যম হ্রাস পেতে থাকে। অপরদিকে শত্রুদের সমর শক্তি ছিল রীতিমত উদ্বেগজনক পরিমাণ। পরিস্থিতি কখনো এমন দাঁড়াত যে, মনে হত ইরানীদের বিশাল সমরশক্তি মুসলমানদের মুষ্টিমেয় সৈন্যদেরকে তাদের বিশাল পেটে টেনে নিচ্ছে।

পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল মাদায়েন। সম্রাট উরদূশের সিংহাসনে উপবিষ্ট। গর্বে মাথা স্বাভাবিকতার চেয়েও কয়েক ইঞ্চি উঁচু ছিল তার। সিংহাসনের ডানে-বামে ভবন মোহিনী শাহী পাখা আলতো দোলাচ্ছিল। সম্রাট সিংহাসন থেকে উঠছিল ইতোমধ্যে তাকে জানানো হয় যে, উবলা রণাঙ্গন থেকে দূত এসেছে।

“এখনি নিয়ে এস” উরদূশের বাদশাহী ভঙ্গিতে বলে– “সে এ ছাড়া আর কিইবা খবর নিয়ে আসবে যে, হুরমুজ মুসলমানদের কচুকাটা কেটেছে।… আরবের ঐ বর্বর ও বুদ্দুরা আর কতটুকুই বা শক্তি রাখে যারা খেজুর এবং যব ছাড়া আর কোন খাদ্য বস্তু চোখেই দেখেনি।” দূত দরবারে প্রবেশ করলে তার চেহারা এবং ভঙ্গিই বলে দেয় যে, সে কোন শুভ সংবাদ আনেনি। দূত ভেতরে ঢুকেই এক বাহু সোজা উপরে তুলে ধরে এবং নতশির হয়ে ঝুঁকে পড়ে।

“সোজা হয়ে দাঁড়াও” উরদূশের বিজয়ীর ভঙ্গিতে বলে “শুভ সংবাদ শুনতে এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারি না। …মুসলমানদের নারীদেরও কি বন্দী করা হয়েছে?…জবাব দাও… তুমি এভাবে নীরব কেন?” “ইরানের সিংহাসন অমর হোক”, দূত রাজদরবারের শিষ্টাচার হিসেবে বলে–“সম্রাট উরদূশেরের সাম্রাজ্য…।”

“কি খবর এনেছ, তাই বল” উরদূশের গর্জে ওঠে বলে। রাজাধিরাজ! হুরমুজ সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে” দূত বলে।

“হুরমুজ?” উরদূশের চমকে উঠে সামনে ঝুঁকে পড়ে এবং একরাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করে সাহায্য চেয়েছে?… সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়ছে না?

সে কি যুদ্ধে টিকে উঠতে পারছে না? … আমি তো শুনেছি, মুসলমানরা লুটেরাদের একটি গ্রুপের মত বৈ নয়। তাহলে হুরমুজের হলটা কি? যুদ্ধের পূর্বে সে সৈন্যদের শিকলাবদ্ধ করেনি?… বল, জবাব দাও।” সারা দরবারে নীরবতা নেমে আসে। যেন সেখানে কোন মানব-জন নেই;চারপাশের দেয়ালগুলো নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে।

‘ইরান সাম্রাজ্য দুনিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ব্যাপৃত হোক”, দূত বলে–“শিকল বাঁধা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু মুসলমানরা এমন চাল চালে যে, পরবর্তীতে ঐ শিকল তাদের পায়ের বেড়িতে পরিণত হয়।”

“মদীনাবাসীদের সংখ্যা কত?” সম্রাট জানতে চায়।

“মহারাজ! খুবই কম” দূত জবাবে বলে “আমাদের সংখ্যার কাছে তাদের সংখ্যা গণনার বাইরে ছিল কিন্তু …।”

“দূর হ সামনে থেকে” সম্রাট ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং পরে একটু শান্ত হয়ে বলে “কারেনকে ডাক।”

ইরান ফৌজের আরেক নামকরা বীর সালার কারেন বিন করয়ানুসা। শাহী দরবারে তার যথেষ্ট কদর ছিল। হুরমুজের মত তার মস্তকেও এক লক্ষ দেরহাম মূল্যের রাজকীয় টুপি শোভা পেত। সম্রাটের আজ্ঞা পেয়েই সে ছুটে আসে।

“কারেন!” উরদূশের বলে “এ কথা তোমার বিশ্বাস হয় যে, হুমুজ মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইরত অবস্থায় সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে?” এরপর উরদূশের দরবারের আমত্যবর্গের প্রতি দৃষ্টি প্রদক্ষিণ করালে তারা উঠে দাঁড়ায় এবং সম্মান প্রদর্শনার্থে মাথা ঝুঁকিয়ে এক এক করে বাইরে বেরিয়ে যায়। উরদূশের একান্তে কারেনের সাথে কথা বলতে চায় “দূত মুসলমান পক্ষের হয়ে আমাদের ধোঁকা দিতে আসেনি তো?”

“মুসলমানরা এতদূর স্পর্ধা দেখাতে পারে না”– কারেন বলে– “রণাঙ্গনে সামান্য ভুলেই চিত্র পাল্টে যায়। হুরমুজ সাহায্য চেয়ে পাঠালে তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তার বাস্তবেই সাহায্যের প্রয়োজন এবং তার থেকে কোন ভুল হয়ে গেছে।”

‘মুসলমানদের মধ্যে এই হিম্মত আছে যে তারা আমাদের ফৌজ পিছপা করে দেবে?” উরদূশের জিজ্ঞাসা করে।

তাদের মধ্যে শুধু হিম্মতই নয়, প্রচুর সাহসও রয়েছে”–কারেন বলে–“তারা ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লড়ে। উবলা এলাকায় আমরা মুসলমানদের এমন নীচু অবস্থায় রেখেছিলাম যে, তারা পোকা-মাকড়ের মত জীবনযাপন করত। কিন্তু তারা মারাত্মক আক্রমণ করে এবং একের পর এক গুপ্ত হামলা চালিয়ে অত্র এলাকার চৌকিগুলো লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে… আজ পর্যন্ত তারা যত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে তার একটিতেও পরাজিত হয়নি। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল, প্রতিটি যুদ্ধে প্রতিপক্ষের তুলনায় তাদের সৈন্যসংখ্যা কম ছিল। আর তাদের কাছে ঘোড়াও বেশি একটা ছিল না।” “তাদের যোদ্ধারাও এমনি সাধারণ পর্যায়ের হবে”– সম্রাট উরদূশের বলে–“তাদের পক্ষে আমাদের সৈন্যের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।”

“কিন্তু তারা তো ইতোমধ্যেই মোকাবিলা করে ফেলেছে”– কারেন বলে “এবং আমাদের এত বড় অভিজ্ঞ সেনাপতি হুরমুজ সাহায্য চেয়ে আবেদন করতে বাধ্য হয়েছে।… মহামান্য সম্রাট! শত্রুকে এত ছোট ও তুচ্ছ করে দেখা ঠিক নয়। আমাদের অযথা দাম্ভিকতা দেখানো ঠিক হবে না। বাস্তব অবস্থা সামনে রেখে কথা বলতে হবে। বাস্তবতা তলিয়ে দেখতে হবে। পারস্যের দাপট রয়েছে ঠিকই কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, রোমকরা আমাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিল। এবং এখনো আমরা রোমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে বিব্রতবোধ করি। তাই সৃষ্ট এ নয়া পরিস্থিতি ও আমাদের বাস্তবতা দিয়ে বিচার করতে হবে। হুরমুজ আসলেই সাহায্য চেয়ে পাঠালে তার অর্থ হলো, মুসলমানরা তাকে কাবু করে ফেলেছে।”

“আমি তোমাকে এজন্যই ডেকে পাঠিয়েছি যে, তুমিই হুরমুজের সাহায্যে এগিয়ে যাবে”–উরদূশের বলে–“হুরমুজ ঘাবড়ে গিয়ে থাকলে তার সাহায্যার্থে তার চেয়ে ভাল না হোক অন্তত তার মতই এক সেনাপতি যাওয়া দরকার। তুমি এমন বাহিনী তৈরি কর, যাদের দেখলেই মুসলমানরা মদিনায় ভেগে যাবে না কি যুদ্ধ করবে” পুনঃ বিবেচনা করতে বাধ্য হয়।… জলদি কারেন! দ্রুত রওয়ানা হয়ে যাও।”

কারেন সামনে কোন কথা বাড়ায় না। বিদায়ী কুর্নিস করেই লম্বা লম্বা পা ফেলে দরবার থেকে প্রস্থান করে।

ইরানী সেনাপতি কারেন বিশাল বাহিনী নিয়ে উবলার উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। সে এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়েই চলে যে, মুসলমানদের নাম নিশানা মিটিয়েই তবে ফিরবেন। দজলার বাম কিনারা দিয়ে সে তার বাহিনীকে নিয়ে যায়। সৈন্যদের চলার গতি ছিল দ্রুত। সে মাজার নামক স্থানে গিয়ে সৈন্যদের দজলা পার করায় এবং দক্ষিণে মা’কাল দরিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যায়। দরিয়া মা’কাল পাড়ি দিয়ে ওপারে পৌঁছলে হুরমুজের পরাজিত বাহিনীকে দলে দলে ফিরে আসতে দেখতে পায়। সৈন্যদের অবস্থা ছিল বড় করুণ।

“যরথুস্ত্রের গজব পড়ুক তোমাদের উপর।” কারেন প্রথম ফিরতি দলটি থামিয়ে এবং তাদের দুর্দশা দেখে বলে– “মুসলমানদের ভয়ে তোমরা পালিয়ে যাচ্ছ?”

“সেনাপতি হুরমুজ নিহত” ফিরতিদের মধ্য হতে এক সৈন্য বলে–“দু’পার্শ্ব বাহিনীর কমান্ডার কুববায এবং আনুশযানও রণাঙ্গন ছেড়ে এসেছে। তারা হয়তবা পিছনেই আসছে।”

কারেন হুরমুজের মৃত্যুর সংবাদ শুনে থ মেরে যায়। এটুকু জিজ্ঞাসা করার হিম্মতও তার হয় না যে, সে কিভাবে মারা গেল? কারেনের মাথা হেট হয়ে গিয়েছিল। একটু পর যখন সে মাথা উঠায় তখন জনস্রোতের মত ইরানীদের ফিরে আসতে দেখে। নতুন বাহিনী দেখে পলায়নপর সৈন্যরা সেখানে জমা হতে থাকে। এ সময়ে হুরমুজের দু’ কমান্ডার কুববায এবং আনুশযানও এসে পৌঁছে। তাদেরকে দূর হতে আসতে দেখেই কারেন অশ্বের বাগে ঝাঁকি দেয়। ঘোড়া চলতে শুরু করে। পরাজিত দু’ কমান্ডারের কাছে গিয়ে সে ঘোড়া থামায়।

“হুরমুজের নিহত হওয়ার সংবাদ আমি ইতোমধ্যেই পেয়েছি”– কারেন বলে–

“কিন্তু তাই বলে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, তোমরা দু’জন রণাঙ্গন ছেড়ে পালিয়ে এসেছ। বর্বর এবং বুদ্দু ঐ আরবদের কাছে তোমরা পরাজিত হয়েছ? আমি এর বেশি বলতে চাইনে যে, তোমরা কাপুরুষ এবং ফৌজে যে পদে তোমরা আছ সে পদের যোগ্য তোমরা নও।… তোমরা মুসলমানদের ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ণ করতে চাও না?”

“কেন চাইব না?” কুববায বলে– “কৌশল হিসেবে আমরা পিছু হটে আসিনি, হুরমুজের আস্ফালনই আমাদের এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আমরা স্বীকার করি যে, ইসলামী সৈন্যদের মাঝে বহুত নামী দামী ও বীর বাহাদুর সেনাপতি আছে। কিন্তু তাই বলে তারা আমাদের এভাবে পশ্চাদপসারণের যোগ্য ছিল না।”

“কারেন!” আনুশযান বলে–“আমাদের ফৌজি নেতৃত্বে এটাই বড় দুর্বলতা, যা আপনার থেকেও প্রকাশ পেয়েছে। আপনি আরবের মুসলমানদেরকে গোয়ার এবং মূর্খ বলেছেন। হুরমুজও এমন বলত। কিন্তু আমরা রণাঙ্গনে তাদেরকে এর বিপরীত পেয়েছি।”

“তোমরা তাদের মাঝে এমন কোন গুণ দেখেছ, যা আমাদের মাঝে নেই”–কারেন জিজ্ঞাসা করে।

“তার চেয়ে জিজ্ঞাসা করুন, আমাদের মাঝে কোন ত্রুটি রয়েছে, যা তাদের মধ্যে নেই”–আনুশযান বলে–“আমরা দশজন, বারজন সৈন্যকে এক শিকলে বাঁধি যেন তারা দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করে। ভাগতে না পারে। এভাবে শিকলবদ্ধ হওয়ায় সামনাসামনি যুদ্ধ করতে হয়। মুসলমানরা আমাদেরকে শিকল বদ্ধ হতে দেখে ডানে-বামে আক্রমণের কৌশল অবলম্বন করে। আমাদের সৈন্যরা এদিক ওদিক ঘুরে লড়াই করতে অপারগ ছিল। বস্তুত, এ কারণেই সংখ্যায় কয়েকগুণ বেশী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সৈন্যরা পরাজয় বরণ করে।”

“আমাদের কথা বলার সময় নেই”–কুববায বলে–“মুসলমানরা আমাদের পশ্চাদ্ধাবনে আসছে।”

সত্যই তাদের পশ্চাদ্ধাবনে হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু দুই হাজার সৈন্য নিয়ে এসেছিলেন। হযরত মুসান্না বিন হারেছা ইসলামের ঐ প্রেমিকের নাম, যিনি ইরানীদের বিরুদ্ধে গেরিলা হামলা চালিয়ে ইরানীদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে তাঁরই অনুরোধক্রমে আমীরুল মু’মিনীন হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে ইরানীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে প্রেরণা দিয়েছিলেন। ইরানীদের পশ্চাদ্ধাবনে যাওয়া অসাধারণ বীরত্বমূলক পদক্ষেপ ছিল। কারণ এখানে পশ্চাদ্ধাবনের অর্থ ছিল, নিজেদের স্থান থেকে ক্রমান্বয়ে শত্রুর পেটের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। কেননা মুসলমানরা যতই এগিয়ে যাবে চতুর্দিক হতে ঘেরার মধ্যে পড়ার ততই সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এটা ছিল সেনাপতি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশ এবং ইরানীদের বিরুদ্ধে হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর একরাশ ঘৃণার ফসল, যা ইরানীদের প্রতি তাঁর অন্তরে ভরপুর ছিল।

জঙ্গে সালাসিল সমাপ্ত হলে এবং ইরানীরা পিছু হটে গেলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দেখেন যে, তার সাথে আগত সৈন্যরা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তিনি হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে পাঠান।

“ইবনে হারেছা।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন–“এভাবে পালিয়ে ইরানীরা যদি জীবিত ফিরে যায় তবে কি তুমি এটাকে পূর্ণ বিজয় জ্ঞান করবে?”

“খোদার কসম, জনাব খালিদ।” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু আবেগভরা কণ্ঠে বলেন– “আমার শুধু নির্দেশের প্রয়োজন। এরা আমার শিকার।”

“বেরিয়ে পড়”–হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন”–“দুই হাজার সৈন্য সাথে নিয়ে যাও। অধিকহারে ইরানীদের বন্দী করতে চেষ্টা করবে। যারা মোকাবিলায় অস্ত্র ধরবে তাদের হত্যা করে ফেলবে।… আমি জানি, আমার জানবায সাথীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কিন্তু ইরান সম্রাটকে জানিয়ে দিতে চাই যে, আমরা ভূ-পৃষ্ঠের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তাদের পশ্চাদ্ধাবন করব।”

হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু ২ হাজার সৈন্য নিয়ে যান এবং পলায়নপর ইরানীদের পিছু নেন। ইরানীরা যখন দূর থেকে লক্ষ্য করে যে, তাদের পিছু নেয়া হচ্ছে তখন তারা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা বোঝা হাল্কা করতে লৌহগদা এবং অস্ত্র ফেলে দেয়। পশ্চাদ্ধাবন করে ইরানীদের পাকড়াও করা হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ ইরানীরা দলে দলে বিক্ষিপ্ত হলেও পরবর্তীতে তারা এক একজন করে ভাগতে থাকে। তাদের পশ্চাতে পশ্চাতে মুসান্নার সাথীরাও সঙ্গীহীন হয়ে যায়।

আট

কিছুদূর যাওয়ার পর একটি কেল্লা সামনে এসে পড়ায় হযরত মুসান্নাকে তাঁর বাহিনী একত্রিত করতে হয়। ‘নারীদূর্গ’ নামে কেল্লাটি প্রসিদ্ধ ছিল। কেল্লাটি জনৈক মহিলার হওয়ায় তার নাম হয়ে যায় নারীদূর্গ। ইরানীরা এই কেল্লায় আশ্রয় নিতে পারে। এই ধারণাকে সামনে রেখে হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু কেল্লাটি অবরোধ করেন। কেল্লা হতে প্রতিরোধের হাবভাব দেখা যায়। দু’দিন অবরোধের পর হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মনে পড়ে যে, তিনি যে উদ্দেশ্যে এসেছেন তা চাপা পড়ে গেছে। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ভাই মুআন্না তার সাথেই ছিল।

“মুআন্না!”–মুসান্না বিন হারেছা তাকে বলে “তুমি কি বিষয়টি উপলব্ধি করেছ যে, আমি ইরানীদের পশ্চাদ্ধাবনে এসেছিলাম কিন্তু এই কেল্লাটি আমার পথ আগলে ধরেছে?”

“ভাই মুসান্না!” মুআন্না বলে–“আমি সবকিছুই দেখছি। আর আমি এটাও অনুভব করছি যে, আমার উপর আপনি আস্থা রাখতে পারছেন না। যদি আস্থা রাখতেন তাহলে বলতেন, কেল্লাটি তুমি অবরোধ করে রাখ, আমি ইরানীদের পিছু ধাওয়া করছি।”

“হ্যাঁ মুআন্না!” হযরত মুসান্না বলেন–“তোমার উপর সত্যই আমার আস্থা নেই। এই কেল্লাটি এক যুবতি নারীর। আর তুমিও একজন যুবক পুরুষ। খোদার কসম! আমি এক কেল্লা দখলদারীদেরকে এক নারীর মায়াবী দৃষ্টিতে পরাভূত হতে দেখেছি।

‘প্রিয় ভাই!” মুআন্না বলে–“আমার উপর আস্থা রাখুন এবং সামনে অগ্রসর হোন। আমাকে সামান্য কিছু সৈন্য দিয়ে যান এরপর দেখবেন, কে কার কাছে পরাভূত হয়।… কেল্লা না আমি… আপনি এখানে আটকে থাকলে ইরানীরা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।”

“আমার মাথা সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার উপযোগী থাকলে আমি বলব, আমি ভিন্ন কিছু চিন্তায় এদিকে এসেছি”– মুসান্না বিন হারেছা বলে–“আমি আল্লাহর অফুরন্ত শুকরিয়া আদায় করছি; তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ বড় দয়া করে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মত সেনাপতি আমাদের দান করেছেন। মদীনার খেলাফত হতে তাঁর প্রতি যে নির্দেশ ছিল তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে দেখিয়েছেন। কিন্তু তিনি এতেই আশ্বস্ত নন, তৃপ্ত নন। তিনি পারস্য হতে সম্রাটগিরি সমূলে উৎখাত করতে চান। তিনি মাদায়েনের এক একটি ইট খুলে নিতে বদ্ধপরিকর।”

“ইচ্ছা ভিন্ন জিনিস প্রিয় ভাই!” মুআন্না বলে–“ইচ্ছা করা সহজ কিন্তু তা পূরণ করা বড়ই কঠিন। আপনি দেখেছেন নিশ্চিয় যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তীরগতিতে সামনে অগ্রসর হচ্ছেন। কিন্তু তীর অনেক সময় লক্ষ্যভ্রষ্টও হয়। … প্রিয় ভাই! সামান্য বাধা ঐ তীরকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।”

“তবে কি তুমি বলতে চাও, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য ঐ স্থানেই থেকে যাওয়া উচিত যেখানে তিনি ইরানীদের পরাজিত করেছেন?” মুসান্না বলে–“খোদার কসম! তুমি একটি কথা ভুলে গেছ। আর তা হল, ইরান সম্রাটের স্বীয় রাজত্বের চিন্তা আছে। আর আমাদের আছে আল্লাহর অসন্তুষ্টির ভয়। উরদূশের নিজ সিংহাসন রক্ষা করতে চায় কিন্তু আমরা দোজাহানে সর্দার হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মান-মর্যাদা রক্ষার খাতিরে লড়ছি… বোঝার চেষ্টা কর স্নেহের ভাই।

আমাদের লড়াই সাধারণ রাজা বাদশাহদের লড়াই নয়; এটা আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনা রক্ষার লড়াই। আমাদের প্রতি আল্লাহপাকের এ নির্দেশ রয়েছে যে, যেন আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আহ্বান দুনিয়ার কোণায় কোণায় পৌঁছে দিই। আমাদের শয্যা হবে এই বালু এবং বালিশ হবে পাথর। আমরা সিংহাসন চাইনা।”

“ধন্যবাদ, প্রিয় ভাই।” মুআন্না বলে–“আমি বুঝে গেছি।” না’, মুসান্না বলেন– “তুমি পুরো ব্যাপারটা এখনো বোঝনি। তুমি ভুলে গেছ, আমাদেরকে ঐ সকল মুসলমানদের রক্তের প্রতিটি ফোটার প্রতিশোধ নিতে হবে, যারা ইরানীদের তোপের মুখে ছিল এবং ইরানীরা যাদের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পারস্যের এই নির্মম আচরণ কখনো ক্ষমা করবেন না।… আমি তোমাকে বলছিলাম, আমি মূলত পলায়নপর ইরানীদের পিছু নিতে আসিনি। আমি ইরানীদের ঐ ফৌজের অন্বেষণে এসেছি, যারা হুরমুজ বাহিনীর পরাজিত সৈন্যদের সাহায্যার্থে এসেছে। আমি তাদেরকে পথিমধ্যেই প্রতিরোধ করব।”

“তাহলে আর কথা বাড়াবেন না”–মুআন্না বলে “আমার অধীনে কিছু সৈন্য রেখে বাকী সৈন্য নিয়ে আপনি চলে যান।… তবে মনে রাখবেন, সাহায্যকারী দল যদি সত্যই আসে, তবে তাদের সংখ্যা ও শক্তি পূর্বের তুলনায় অধিক হবে। সামনা-সামনি সংঘর্ষে লিপ্ত হবেন না। প্রাণ প্রিয় ভাই। আল্লাহ আপনার সহায় হোন।” কোন ঐতিহাসিকের কলম ঐ সঠিক সংখ্যা লেখে নাই যা হযরত মুসান্না তাঁর ভাই মুআন্নাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। তবে তাদের বক্তব্য হতে এতটুকু অনুমান করা যায়, ঐ সৈন্যসংখ্যা ৩০০-এর কম এবং ৪০০-এর বেশী ছিল না। মুআন্না এই সৈন্য দ্বারাই কেল্লা অবরোধ করে রাখেন এবং কেল্লার ফটকের এত কাছে চলে যান, যেখান থেকে অতি সহজে তিনি তীরের শিকার হতে পারতেন। ফটকের উপরে পাহারা কক্ষ ছিল। সেখান থেকে এক অনিন্দ্য সুন্দর রমনীর অভ্যুদয় হয়।

“তোমরা কারা এবং এখানে কোন্ উদ্দেশ্যেই বা এসেছ?” যুবতী বড় জোর গলায় মুআন্নার কাছে জানতে চায়”।

“আমরা মুসলমান!” মুআন্না তার চেয়ে উচ্চ আওয়াজে জবাব দেন রণাঙ্গন থেকে পলায়নপর ইরানী সৈন্যদের পশ্চাদ্ধাবনে আমরা এসেছি।

তুমি এ কেল্লায় তাদের আশ্রয় দিয়ে থাকলে তাদেরকে আমাদের হাতে তুলে দাও। আমরা নিয়েই চলে যাব।”

“এটা আমার কেল্লা”– যুবতী বলে– “পলায়নপর সৈন্যদের আশ্রয় স্থল নয়। এখানে কোন ইরান সৈন্য নেই।”

“ভদ্র মহিলা” মুআন্না বলে–“আপনার সম্মান রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। আমরা মুসলমান। কোন মহিলার মর্যাদা ক্ষুন্ন করা আমাদের নিকটে হারাম। চাই তিনি কেল্লার মালিকও হন না কেন। যদি আপনি ইরানের সমর শক্তির ভয়ে সৈন্যদেরকে আমাদের হাতে তুলে দিতে ইতস্তত করেন তাহলে মনে রাখবেন, আমরা ইরান বাহিনীর শক্তি চূর্ণ বিচূর্ণ করে শোচনীয়ভাবে তাদের পরাস্ত করেছি। আপনাদের সাথে কঠোর ব্যবহার করতে চাই না। আমরা ঐ ফৌজের অগ্রবর্তী বাহিনী, যারা পিছে আসছে।”

“আমি মুসলমানদের কি ক্ষতি করেছি?” যুবতী বলে–“আমার কেল্লা আপনাদের যাওয়ার পথে অন্তরায় হতে পারে না।”

“আপনার কেল্লা নিরাপদ থাকবে”–মুআন্না বলে– “কিন্তু শর্ত হল, কেল্লার দ্বার খুলে দিন। আমরা ভেতরে ঢুকে তল্লাশি চালাব মাত্র। আপনাদের কোন ব্যক্তি কিংবা বস্তুতে আমার সৈন্যরা হাত লাগাবে না, আমরা নিশ্চিত হয়েই চলে যাব। এই শর্ত পূরণ না করলে আপনাদের লাশ এই কেল্লার আশে পাশে পচে গলে পড়ে থাকবে।”

“কেল্লার দরজা খুলে দাও”– যুবতীর শাসকসুলভ নির্দেশ শোনা গেল। এই আওয়াজের সাথে সাথে কেল্লার ফটক খুলে যায়। মুআন্না তার সৈন্যদের ইশারা দিলে তিনশ থেকে চারশ সৈন্য ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়।

মুআন্না তাদেরকে শুধু এতটুকু বলে যে, কেবল তল্লাশি হবে। কোন ব্যক্তি কিংবা বস্তু স্পর্শ করা যাবে না। মুআন্নার ঘোড়া কেল্লার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। অধীনস্থ সকল অশ্বারোহীও তার পিছুপিছু আসতে থাকে। মুআন্না এক স্থানে থেমে কেল্লার চতুর্দিকে দৃষ্টি ঘুরায়। সর্বত্র তীরন্দাজ বাহিনী পজিশন নিয়ে ছিল। নীচে কোথাও কোন সৈন্য তার চোখে পড়েনা। মুআন্নার সৈন্যরা কেল্লার অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে।

“আপনি সত্যই বলেছিলেন”–যুবতী মুআন্নাকে বলে–“আমি ইরানীদের ভয় করি। এ কেল্লায় যে শক্তিশালী সৈন্যই আসবে আমি তাদের দয়ার ভিখারী হব।… মুসলমানদের এই প্রথমবারের মত আমি দেখছি।”

“আপনি তাদের কথা জীবনভর মনে রাখবেন”–মুআন্না বলে– “খোদার কসম! আপনি সারা জীবন তাদের অপেক্ষায় পার করবেন।… মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ আছে, নিষ্প্রাণ কেল্লা নয়, কেল্লাবাসীদের অন্তর জয় কর। কিন্তু কেল্লাবাসীদের অন্তর যদি কেল্লার প্রাচীরের মত কঠিন হয় তখন আবার আমাদের প্রতি ভিন্ন আদেশ আছে। আমরা যখন এই নির্দেশ পালনে লিপ্ত হই তখন পারস্য শক্তিও আমাদের সামনে টিকতে পারে না। আপনি তাদের পালিয়ে যেতে দেখেন নি? তারা এখান দিয়ে যায় নি?”

“অবশ্যই গেছে”–কেল্লাদার যুবতী বলে–“ক্ষণিকের জন্য এখানে যাত্রাবিরতিও করেছিল। তারাই বলেছিল যে, আমরা মুসলমানদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছি। আমি তখন এই ভেবে অবাক হয়ে ছিলাম যে, সে আবার কোন শক্তি, যা পারস্য বাহিনীকে পর্যন্ত পর্যুদস্ত করে ছাড়ে। আপনি যখন জানালেন যে, আপনারাই তারা, যারা ইরানীদের পরাজিত করেছে। তখন আমার হিম্মত শেষ হয়ে যায়। আমি ভীত হয়ে কেল্লার দরজা খুলে দিতে বলি। আমি আপনার সৈন্যদের থেকে ভাল আচরণের প্রত্যাশা রাখতে পারছি না। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে, আপনারা যা যা বলছেন তা সত্য বলছেন কিনা।!”

কেল্লাদার মহিলা কথা বলতে বলতে মুআন্নাকে নিজের মহলে নিয়ে যায়। সেটা ছিল রীতিমত আলীশান শিশমহল। তার ইঙ্গিতে দুই ভৃত্য শরাব এবং ভুনা গোশত মুআন্নার সামনে পরিবেশন করে। মুআন্না এই খাদ্য পানীয় ঠেলে দূরে সরিয়ে দেন।

“আমরা শরাব পান করিনা”–মুআন্না বলে–“আর এ খাদ্য আমি এজন্য খাব না যে, আপনি আমাকে এক শক্তিশালী বাহিনীর লোক মনে করে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তা পেশ করছেন। ফলে এটাকেও আমি অনুচিত মনে করছি।”

“তবে কি আমাকেও হারাম মনে করছেন?” এই অনিন্দ্য সুন্দরী এবং যুবতী নারী এমন আকর্ষণীয় মুচকি হাসি দেয়, যা থেকে তাকে ব্যবহারের আহ্বান ঝরে পড়ছিল।

“হ্যাঁ”, মুআন্না বলে–“নারীকে আমরা মদের মতই হারাম মনে করি। যতক্ষণ তারা স্বেচ্ছায় আমাদের সাথে প্রণয় সূত্রে আবদ্ধ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তাকে হারামই মনে করি।”

ইতোমধ্যে মুআন্নাকে জানানো হয় যে, তার সৈন্যরা পুরো কেল্লা তল্লাশি চালিয়ে ফিরে এসেছে। মুআন্না তাদের ফিরে আসার সংবাদ পেয়েই দ্রুত উঠে পড়েন এবং দ্রুতগতিতেই কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যান।

সৈন্যদের কমান্ডার মুআন্নাকে তল্লাশি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত করান। কিভাবে তল্লাশি করে, কোথাও সন্দেহজনক কিছু দেখেছে কিনা সব তাকে জানায়। সে মুআন্নাকে জানায় যে, কোথাও কোন ইরানী সৈন্যর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কেল্লাদার নারীর গোত্র তীর বর্শায় সজ্জিত ছিল। কিন্তু মুআন্নার সৈন্যদের সাথে তাদের লড়াই করার হিম্মত ছিল না। কেল্লার মালিক তাদের যুদ্ধ করার অনুমতিও দিয়েছিল না। এ কেল্লাটি কব্জা করা কিংবা নিজেদের আনুগত্যে নিয়ে নেয়া খুবই প্রয়োজন ছিল। কেননা, ইরানীদের যে কোন সময় এই কেল্লাটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সম্ভাবনা ছিল। মুআন্না এদিক ওদিক-তাকায়। কেল্লাদার নারী তার নজরে পড়ে না। মুআন্না অন্দরে প্রবেশ করে।

“আমার কেল্লা থেকে কিছু পেলেন কি?” যুবতী জিজ্ঞাসা করে। “না”, মুআন্না জবাবে বলে–“সন্দেহ নিরসন করা আমার জন্য জরুরী ছিল। আর এখন একথা জিজ্ঞাসা করা উচিত মনে করছি যে, আমার কোন সৈন্য এখানকার কোন পুরুষ কিংবা নারী অথবা আমি আপনার কোন কষ্ট দেইনি তো?”

“না”, যুবতী নেতিবাচক জবাব দেয়। অতঃপর একটু চিন্তা করে বলে “কিন্তু আপনি চলে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে।”

“আপনি ইরানীদের পক্ষ হতে ভয়ের আশংকা করছেন?” মুআন্না জানতে চায় “নাকি আপনার অন্তর মুসলমানদের ভয়ে ভীত?”

“এ দু‘টোর কোনটিই নয়” যুবতী জবাবে বলে “একাকীত্বের ভয় আমার। আপনি চলে গেলে আমি বড় একা হয়ে যাব। অথচ এ ব্যাধিটা আপনার আসার পূর্বে ছিল না।”

মুআন্না যুবতীর প্রতি প্রশ্নঝরা দৃষ্টিতে তাকায়। তার চোখ তাকে অনেক কিছু বলে দেয়। তিনি চোখ ফিরিয়ে নেন।

“আপনি দায়িত্ব পালনে এতই বিভোর যে, আপনার এ খেয়াল পর্যন্ত নেই যে, আপনি একজন যুবকও বটে”–যুবতী বলে–“বিজয়ী সর্বপ্রথম আমার মত নারীকে খেলনা বানায়। আমি আপনার মত পুরুষ জীবনে দেখিনি। এখন দেখে মন চাচ্ছে যে, সারা জীবন ধরে শুধু দেখতেই থাকি… আমাকে আপনার পছন্দ হয় না?”

মুআন্না গভীর দৃষ্টিতে তাকে দেখেন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার, পুনরায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত। এ সময় তার ভেতর থেকে একটি আওয়াজ আসে খোদার কসম! আমি কেল্লা বিজয়ীদেরকে এক নারীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং চাহনীতে পরাভূত হতে দেখেছি।”

“আপনি হুশে আছেন তো?”–যুবতী বলে–“নাকি বেহুশ হয়ে গেলেন। কোন কথা বলছেন না।”

“সম্ভবত প্রয়োজনের তুলনায় অধিক হুশে আছি’ মুআন্না বলেন “তোমাকে আমার ভাল লাগে কি লাগে না সেটা পরের কথা। এখন তোমার কেল্লা আমার খুব প্রিয়।”

“আমার এই উপহার কবুল করবেন না?” যুবতী জিজ্ঞাসা করে– “শক্তি খরচ করে কেল্লা দখল করে নেয়ার চেয়ে ভালবাসার বিনিময়ে এই কেল্লা আমার থেকে নিলে ভাল হয় না?” “ভালবাসা!” মুআন্না অস্ফুট কণ্ঠে বলেন, মুহূর্তে গা ঝাড়া দেয়ার মত মাথা উঁচু করে বলেন “ভালবাসার সময় নেই। আমি তোমাকে বিবাহ করে নিতে পারি। তুমি রাজি হলে প্রথমে কেল্লার সকল বাসিন্দাসহ ইসলাম গ্রহণ কর।”

“আমি কবুল করলাম”–যুবতি বলে–“আমি সে ধর্মের জন্য জীবন দিতেও রাজি, আপনি যে ধর্মের অনুসারী।”

আল্লামা তবারী এবং ইবনে রুসতা দুই ঐতিহাসিক কিছুটা বিস্তারিতভাবে এই ভদ্র মহিলার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কেউ তার নাম উল্লেখ করেননি।

নয়

পারস্য সম্রাট উরদূশের রাগে ফেটে পড়ছিল। হুরমুজের প্রতি ছিল তার যত সব রাগ। হুরমুজ সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিল। কিন্তু সাহায্য প্রেরণের পর অনেকদিন গত হলেও রণাঙ্গনের অবস্থা সম্বন্ধে তাকে কিছুই জানানো হয় না। সে দরবারে বসলে মনে হত মানুষ নয়; বরং রাগ কুণ্ড পাকিয়ে বসে আছে। মহলের কোথাও থাকলে তার অবস্থা এই দাঁড়াত যে, বসতে বসতে হঠাৎ উঠে দাঁড়াত এবং দ্রুত সারা মহল পায়চারি করে ফিরত। পথে কেউ সামনে পড়লে বিনা কারণে তার উপর রাগ ঝাড়ত। একদিন সে উদাস মনে শাহী বাগিচায় পায়চারি করছিল। হঠাৎ তাকে জানানো হয় যে, কারেনের দূত এসেছে। সে দ্রুত এসেছে। সে দূতকে ডেকে পাঠাবার পরিবর্তে নিজেই এক প্রকার তার দিকে ছুটে যায়।

“কারেন ঐ মরুশিয়ালদের পিষে ফেলেছে?” উরদূশের জানতে চায়।

“মহামান্য সম্রাট।”– দূত বলে–“জীবন ভিক্ষা চাই; জনাবের এই গোলাম কোন শুভ সংবাদ বয়ে আনেনি।”

“তবে কি কারেনও সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে?” উরদূশের কণ্ঠে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে।

“না, মহামান্য সম্রাট” দূত বলে–“সেনাপতি হুরমুজ মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছে।”

“নিহত হয়েছে?” উরদূশের রাজ্যের বিস্ময় চোখে-মুখে টেনে জিজ্ঞাসা করে “কি হুরমুজও মারা যেতে পারে?… না, না, এটা ভুল সংবাদ এটা নির্জ্জলা মিথ্যা”। এরপর সে গর্জে উঠে দূতকে জিজ্ঞাসা করে “তোমাকে এ সংবাদ কে দিয়েছে?”

“সেনাপতি কারেন” দূত বলে–“আমাদের দুই কমান্ডার কুববায এবং আনুশযান পিছপা হয়ে ফিরে আসছিল। প্রাণে বেঁচে যাওয়া সৈন্যরাও একজন, দুইজন করে তাদের পিছু পিছু আসছিল। মা’কাল দরিয়ার কূলে তাদের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। তারাই জানায় যে, হুরমুজ মুসলমানদেরকে মল্লযুদ্ধ লড়ার আহবান জানালে তাদের সেনাপতি খালিদ বিন ওলীদ আমাদের সেনাপতির মোকাবিলায় আসে। সেনাপতি হুরমুজ তার দেহরক্ষীদের আশে পাশেই লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের দায়িত্ব ছিল মুসলমানদের সেনাপতিকে ঘেরাও করে হত্যা করা। তারা তাকে কৌশলে বৃত্তাকারে ঘিরেও নিয়েছিল। কিন্তু আচমকা এক অশ্বারোহীর উদয় হয়। তার একহাতে বর্শা আর অপর হাতে তরবারী ছিল। চোখের পলকে ঐ অশ্বারোহী হুরমুজের দেহরক্ষীদের ৬/৭ জনকে খতম করে দেয়। ঠিক এ সময় মুসলমানদের সেনাপতি হুরমুজকে কাবু করে জমিনে আছড়ে ফেলে এবং খঞ্জর দ্বারা তাকে হত্যা করে।”

উরদূশেরের মাথা নীচু হয়ে যায়। সে ধীর পদক্ষেপে মহল লক্ষ্যে এগিয়ে চলে। সে মহলে পৌঁছে এমনভাবে দেয়াল আকড়ে ধরে, যেন কোন কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে ঘুরে পড়া থেকে বাঁচতে দেয়ালের আশ্রয় নিয়েছে। সে নিজ কক্ষে দেয়ালে ভর দিয়ে দিয়ে পৌঁছে। একটু পর মহলে রীতিমত হুলস্থুল পড়ে যায়। শাহী ডাক্তার দৌড়ে আসে। অজ্ঞাত রোগে উরদূশের হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এটা ছিল আঘাতের ফল। পারস্য সম্রাট পরাজয়ের সাথে পরিচিত ছিল না। প্রথমবারের মত তারা মার খায় রোমকদের হাতে এবং রাজ্যের কিছু অংশ তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। আর এবার তারা মার খায় এমন লোকদের হাতে উরদূশের যাদেরকে মানুষ বলেই মনে করতনা। উরদূশের জন্য এই আঘাত সাধারণ ছিল না।

কারেন বিন করয়ানুস তখনও মা’কাল দরিয়ার কিনারে ছাউনী ফেলে ছিল। সে এতদিন পর্যন্ত এখানে এ জন্য অবস্থান করতে থাকে যে, হুরমুজের বাহিনীর পলায়নপর কমান্ডার এবং সিপাহীরা তখনও আসতেছিল। কারেন তাদেরকে নিজ বাহিনীতে শামিল করছিল। হুরমুজের দুই সেনাপতি কুববায এবং আনুশযান কারেনের সাথেই ছিল। সে পরাজয়ের কঠিন প্রতিশোধ নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। তাদের মন্তব্যে কারেন সামনে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল।

অবস্থানের দিনগুলোতে কারেনের গোয়েন্দারা তাকে মুসলমানদের গতিবিধি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে রীতিমত অবগত করতে থাকে। গোয়েন্দা তথ্য মোতাবেক সে নিশ্চিত হয়ে যায় যে, মুসলমানরা যুদ্ধজয় করেই ফিরে যাবে না, বরং সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জঙ্গে সালাসিল জয়ের পর কাজিমা, উবলা সহ ছোট ছোট এলাকাগুলোর প্রশাসনিক ব্যবস্থাদি নিজ হাতে নিয়ে নেন। যখন তিনি সর্বপ্রথম ঐ এলাকায় পৌঁছান তখন অত্র এলাকার মুসলমানরা আনন্দে চিৎকার করে করে “হযরত খালিদ জিন্দাবাদ… ইসলাম জিন্দাবাদ … খেলাফত জিন্দাবাদ… এর স্লোগান দিতে থাকে। এলাকাটি সবুজ শ্যামল এবং বড়ই আকর্ষণীয় ছিল। মহিলারা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং তাঁর দেহরক্ষীদের পথে ফুল বিছিয়ে দিতে থাকে।

এই এলাকার মুসলমানরা এক লম্বা সময়ের পর ইরানীদের অত্যাচার এবং গোলামী থেকে মুক্তি পায়।

“জনাব খালিদ! আপনি আমাদের ইজ্জতের প্রতিশোধ নিবেন?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর লক্ষ্যে কয়েক নারীর কণ্ঠ ছুটে আসে।

“আমাদের যুবতী কন্যাদের রক্তের প্রতিশোধ… প্রতিশোধ … প্রতিশোধ… চাই”–এটা এক আওয়াজ এবং আবেদন ছিল। আর হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই আওয়াজে মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হতে থাকেন।

“আমরা ফিরে যেতে আসিনি”–হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসলমানদের উদ্দেশে বলেন “আমরা প্রতিশোধ নিতেই এসেছি।”

মুসলমানদের একটি প্রতিনিধি দল হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আগাম সতর্ক করে দেয় যে, তিনি যেন এ এলাকার অমুসলিমদের উপর ভরসা না রাখেন।

“এরা সবাই ইরানীদের সাহায্যকারী”– প্রতিনিধি দল হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে জানায়–“অগ্নিপূজকরা সর্বদা আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তি করেছে। আমাদের ছেলেরা ইরানীদের কোন চৌকিতে গেরিলা হামলা চালালে অগ্নিপূজকরা গোয়েন্দাগিরি করে তাদের ধরিয়ে দিত।”

“সকল ইহুদী এবং খ্রিস্টানদের গ্রেপ্তার কর”– হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নির্দেশ দেন “আর মুসলমানদের মধ্য হতে যারা ইসলামী বাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক তারা চলে আসতে পারে।”

“তারা ইতিপূর্বেই মুসান্না বিন হারেছার সাথে চলে গেছে” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাব পান।

তৎক্ষণাৎ অগ্নিপূজারীসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর পাকড় শুরু হয়ে যায়। তাদের মধ্য হতে কেবল তাদেরকেই যুদ্ধবন্দী করা হয় যাদের ব্যাপারে এই সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল যে, তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভূমিকা নিয়েছিল অথবা গুপ্তচরবৃত্তি করেছিল।

শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কিছু লোক কাজিমায় রেখে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সামনে এগিয়ে যান। এবার তার চলায় তেমন গতি ছিল না। কারণ, যে কোন স্থানে ইরানীদের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অত্র এলাকার কিছু লোককে গোয়েন্দা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে সম্মুখে এবং ডানে বামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

হযরত মুসান্না দূর্বার গতিতে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। তিনি মা’কাল দরিয়া পার হতে চান কিন্তু দূর হতে ইরানীদের ছাউনী তার চোখে পড়ে। ছাউনীই বলে দেয়, তারা সংখ্যায় অনেক ছিল। হযরত মুসান্নার কাছে দেড় হাজার থেকে কিছু বেশী সৈন্য ছিল। মুষ্টিমেয় এ সৈন্য নিয়ে এক বিশাল বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া সম্ভব ছিল না।

“আমাদের এখান থেকেই পিছু হটা উচিত”–মুসান্নার এক সাথী বলে “ইরানী এ বাহিনী আমাদেরকে সহজেই তাদের ঘেরাওয়ে নিয়ে হত্যা করতে পারে।”

“একটু বুঝার চেষ্টা কর”– হযরত মুসান্না বলেন–“আমরা পিছু হটে গেলে ইরানীদের সাহস বেড়ে যাবে। আমাদের সেনাধ্যক্ষ বলেছিলেন, ইরানীদের অন্তর থেকে আমাদের ভীতি শেষ হওয়ার পূর্বেই আমরা তাদের উপর আক্রমণ করে যাব। যে ভীতি তাদের মাঝে ছড়িয়ে গেছে তা বিদ্যমান রাখতে হবে আমাদের। আমরা অগ্নিপূজক ফৌজকে এটা বুঝাতে চেষ্টা করব যে, এটা আমাদের অগ্রবর্তী বাহিনী মাত্র। অবশ্য আমরা লড়ার জন্য প্রস্তুত থাকব। যদি তাদের সাথে যুদ্ধ বেঁধেই যায় তবে ঐ প্রক্রিয়ায় লড়ব, যা এক যুগ ধরে লড়ে আসছিলাম। আর তা হলো, সামনাসামনি আক্রমন না করে হঠাৎ আক্রমন করে আবার উধাও হয়ে যাওয়া … তোমরা এভাবে লড়াই করতে পারবেতো?” এর পর মুসান্না এক অশ্বারোহীকে ডাক দেন এবং বলেন “ঘোড়া ছুটিয়ে দাও। সেনাপতি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কাজিমা বা উবলার কোন একস্থানে আছেন। তাঁকে বলবে, মা’কালের কূলে এক ইরানী বাহিনী ছাউনী ফেলে আছে। তাকে জানাবে যে, আমি ঐ বাহিনীকে আগে যেতে দিব না। সেখানে আপনার পৌঁছানো একান্ত জরুরী।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইতোমধ্যেই কাজিমা ছেড়ে গিয়েছিলেন। ঘোড়া, উট এবং সৈন্যদের আহারাদির কোন কমতি ছিল না। অত্র এলাকার মুসলমানরা সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পথ কিছুটা ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছিল। তিনি উবলার কিছুদূরে এক ভগ্নপ্রাসাদের পার্শ্ব অতিক্রম করছিলেন। সামনের দিক হতে এক অশ্বারোহী দ্রুতবেগে ছুটে আসছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর দু’দেহরক্ষীকে বলেন, সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখ, এ অশ্বারোহী কে?

দেহরক্ষী ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় এবং আগত অশ্বারোহীকে পথেই পেয়ে যায়। আগন্তুক ঘোড়া থামায় না। দেহরক্ষীদ্বয় নিজ নিজ ঘোড়া তার ঘোড়ার দু’ পাশে আনে এবং তার সাথে চলতে থাকে।

“মুসান্না বিন হারেছার পয়গাম নিয়ে এসেছে”–দূর থেকে এক মুহাফিজ বলে।

“পারস্যের এক তেজোদ্যম বাহিনী মা’কালের কিনারে ছাউনী ফেলে আছে মুসান্নার দূত হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকটে এসে থামতে থামতে বলে–

তবে আপনার এবং মুসান্নার সম্মিলিত বাহিনীর থেকে ৭/৮ গুণ বেশী হবে। ইরানীদের পলায়ন পর সৈন্যরাও তাদের সাথে আছে।

“মুসান্না এখন কোথায়?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।

“ইরানীদের সামনে”–দূত বলে–“মুসান্না নির্দেশ দিয়েছেন, যেন কোন সৈন্য পিছু না হটে এবং আমরা ইরানীদের এটা বুঝাতে চেষ্টা করব যে, আমরা সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রবর্তী দল মাত্র।…মুসান্না আপনাকে জলদি পৌঁছতে অনুরোধ করেছেন।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের চলার গতি দ্রুততর করেন এবং ঐ দিকে চলতে থাকেন যে দিকে মুসান্না বিন হারেছা অবস্থান করছেন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সৈন্যরা মুসান্নার সৈন্যদের সাথে গিয়ে মিলিত হন। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সর্বাগ্রে শত্রুর গতিবিধি ও তাদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। তিনি মুসান্নার সাথে এক উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শত্রুদের যুদ্ধ প্রস্তুতি সমাপ্তি পর্যায়ে ছিল।

“ইরানীরা আমাদেরকে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াতে চায়”–হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসান্নাকে বলেন: “দেখছ ইবনে হারেছা?…তারা দরিয়া নিজেদের পশ্চাতে রেখেছে।”

“ইরানীরা কেবল সম্মুখ যুদ্ধই করতে পারে”–মুসান্না বলেন–“আমরা তাদের এক বন্দী থেকে জানতে পেরেছি যে, তাদের দুই সেনাপতি, যাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়েছি জীবিত পিছু হটে আসে। একজনের নাম কুববায আর অপরজনের নাম আনুশাযান। তারা এ নয়া সালারকে বলে দেবে নিশ্চয় যে, আমাদের যুদ্ধের কৌশল ও ভেঙ্গ কেমন। এ জন্য তারা পশ্চাৎভাগকে আমাদের থেকে হেফাজত করতে পিছনে দরিয়া রেখেছে।… বেশী চিন্তা করবেননা জনাব খালিদ। আমি তাদের বিরুদ্ধে জমিন ফুঁড়েও লড়েছি।”

“আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুক ইবনে হারেছা।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন–“আল্লাহ নিশ্চয় তোমার সাথে আছেন।… আমি এটাও ভেবে দেখলাম যে, দরিয়া পাড়ি দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”

“আল্লাহকে স্মরণ করুন জনাব খালিদ!” মুসান্না বলেন “আমি আশাবাদী যে, আমরা তাদের সৈন্য সারি এভাবে বিধ্বস্ত করে দিতে সক্ষম হব যে, তাদের পাশ কেটে সামনে এগিয়ে যাওয়া এবং পশ্চাৎ হতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ আমাদের ঘটবে। আমার সৈন্যরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ে না; ঘুরে ফিরে লড়াই করে। তাদেরকে আগে ঠেলে পাঠানোর প্রয়োজন হবে না। তাদেরকে পিছে ফিরিয়ে আনাই মূল সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। কারণ, তারা ইরানীদের দেখলেই তেলে বেগুনে জ্বলে যায়। ইরানীদের হাতে তারা অনেক জর্জরিত হয়েছে। আপনি জানেন না, তারা কেমন দাসত্বের জিঞ্জিরে আবদ্ধ ছিল। ইরানীরা তাদেরকে মানুষ হিসেবে ন্যূনতম অধিকারটুকুও প্রদান করত না। মানবাধিকার থেকে তারা ছিল সম্পূর্ণ বঞ্চিত।”

“যরথুস্ত্র যে আগুনের পূজা করে আমরা সে আগুন নিভিয়ে দিব ইবনে হারেছা?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন–“একসময় তারা নিজেরাই স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহপাক। … এস। আমি বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে চাই না। তারা যেভাবে চুপচাপ আছে তাতে প্রতীয়মান হয় যে, তারা যথেষ্ট সতর্ক এবং তাদের উপর আমাদের গভীর প্রভাব পড়েছে।… তুমি নিজ সৈন্যদের সাথে মধ্যম বাহিনীতে থাকবে।”

ঐতিহাসিকগণ লেখেন যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সম্ভাব্য কৌশল সম্পর্কে অনেক ভাবেন। কিন্তু ইরানীদের বর্তমান সেনাপতি কারেন বড়ই সেয়ান ছিল। সে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর লড়াইয়ের কৌশল সম্পর্কে জেনে গিয়েছিল। কারেন পরাজিত দু’ সালার কুববায এবং আনুশযানকে দুই পার্শ্ব বাহিনীর দায়িত্বে রেখে নিজের বাহিনীকে সামনে নিয়ে যায়। তার বাহিনীর ভাবই ছিল আলাদা। দেখলেই বুঝা যেত শাহী ফৌজ। তাদের পায়ের নীচের মাটি প্রকম্পিত হত।

এদিকে ইয়াসরিবের সাদা-মাটা বাহিনী ছিল। বাহ্যিকভাবে তাদের মাঝে কোন ভাব ছিলনা। ইরানীদের বিপরীতে মুসলমানদের হাতিয়ারও কম ছিল। পোশাকও সাদামাটা। ইরানীদের মোকাবিলায় তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় বাহিনীকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলে হাজারো পায়ের উত্থান পতন এবং ঘোড়ার ঘন্টাধ্বনির সাথে সাথে কালেমায়ে তৈয়্যেবার গুরুগম্ভীর আওয়াজ এক ভিন্ন প্রভাব সৃষ্টি করছিল। মুসলমানরা ক্লান্ত অবসন্ন, পক্ষান্তরে ইরানীরা ছিল সম্পূর্ণ তেজোদ্যম।

উভয় বাহিনীর মাঝে সামান্য দূরত্ব থাকতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাহিনীকে থামতে বলেন। মুসান্না বিন হারেছা তাঁর বাহিনীসহ হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর পিছনে ছিলেন। ডান এবং বাম বাহিনীতে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিয়োগ করা দুই সালার হযরত আছেম ইবনে আমর এবং হযরত আদী ইবনে হাতেম ছিলেন। তৎকালীন সময়ের যুদ্ধরীতি অনুযায়ী ইরান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কারেন সামনে এগিয়ে আসে এবং মল্লযুদ্ধ লড়তে মুসলমানদের আহ্বান করে।

“মদীনার কোন উষ্ট্রারোহী আমার মোকাবিলা করার হিম্মত রাখে?” সে উভয় বাহিনীর মধ্যখানে এসে হুঙ্কার ছেড়ে বলে–“আমার সামনে আসার আগে একটু চিন্তা করে নিও যে, আমি ইরান সম্রাটের সেনাপতি।”

“তোর মোকাবিলায় আমি আসছি”–হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়া সামনে এনে হুঙ্কার দিয়ে বলেন–“কারেন… আয় এবং তোদের সেনাপতি হুরমুজের কতলের প্রতিশোধ নে। আমিই তার হত্যাকারী।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তখনও কারেন থেকে কিছুটা দূরে ছিলেন। ইতোমধ্যে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পশ্চাৎ হতে একটি ঘোড়া তীব্র গতিতে বেরিয়ে আসে এবং তার পাশ দিয়ে চলে যায়।

“পিছনে থাকুন জনাব খালিদ!” বাতাসে ভেসে আসে অশ্বারোহীর আওয়াজ “অগ্নিপূজক এই সালার আমার শিকার।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উড়ন্ত ঘোড়ার দিকে চেয়ে থাকেন। অশ্বারোহী ছিল মা’কাল বিন আয়শা নামক এক মুসলমান। বীরত্বে এবং তরবারি চালনায় তার বড়ই দক্ষতা এবং নাম-ডাক ছিল। এটা নিয়ম বহির্ভূত ছিল যে, কোন সিপাহী বা অশ্বারোহী নিজের সেনাপতির উপর মর্যাদা লাভ করতে চেষ্টা করবে। কিন্তু এ সময়টা এমনই নাজুক ছিল যে, ভৃত্য-মনিব এবং ধনী-গরীব সবাই এক হয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি সিপাহী এবং অশ্বারোহী জিহাদের লক্ষ্য বুঝত। যে প্রেরণা সাধারণ সিপাহীদের মধ্যে ছিল তা একজন সালারের মাঝেও ছিল। মা’কাল ইবনে আয়শা এটা সহ্য করতে পারেনা যে, তার সালার এক অগ্নিপূজকের হাতে আহত কিংবা নিহত হবেন।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর প্রতিটি সৈন্যের জযবা অনুধাবন করতেন। তিনি থেমে যান। তিনি ঐ সৈন্যের জযবা আহত করতে চাননা।

মা’কালের ঘোড়ায় বিদ্যুৎগতি ছিল। ঘোড়া ইরান দলপতি কারেনকে ছেড়ে যায়। মা’কাল আগে গিয়ে ঘোড়া পিছন দিকে ফিরান এবং কারেনকে আহ্বান জানান। কারেন প্রথম থেকেই হাতে তলোয়ার নিয়ে প্রস্তুত ছিল। তার মাথায় জিঞ্জির বিশিষ্ট শিরস্ত্রাণ এবং শরীরের উপরাংশ বর্মাচ্ছাদিত ছিল। তার পায়ে মোটা চামড়ার আবরণ জড়ানো ছিল। তার চেহারায় প্রতিশোধের নিদর্শনের পরিবর্তে অহংকার ঠিকরে পড়ছিল। যেন তার এ নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, শরীরস্থ লোহা এবং চামড়ার এই পোশাক তাকে মুসলমানদের তলোয়ার থেকে অবশ্যই রক্ষা করবে।

কারেন ঘোড়ার বাগে হাল্কা ঝাঁকি দেয়। উভয়ের ঘোড়া পরস্পরকে ঘিরে এক দু’ বার চক্কর দিয়ে মুখোমুখী এসে দাঁড়ায়।

“আয় আগুন পূজারী।” মা’কাল অতি উচ্চ আওয়াজে বলে “আমি এক সাধারণ সিপাহী মাত্র, সালার নই।”

কারেনের চেহারায় অহমিকার চিহ্ন আরো গভীরভাবে ফুটে ওঠে। এক ঘোড়া আরেক ঘোড়ার দিকে এগিয়ে যায়। দু’জনেরই তলোয়ার উঁচু হয়। প্রথম আঘাত উভয়েরই তলোয়ারে তলোয়ারে হয় এবং দু’জনই পিছনে সরে যায়। দ্বিতীয়বারের মত তারা আবার মুখোমুখী হয়। বাতাসে তলোয়ারের আরেকবার সংঘর্ষ হয়। এরপরে ঘোড়া থেকে থেকে পিছনে এবং ঘুরে ঘুরে একে অপরের দিকে আসে। উভয় উভয়ের প্রতি আক্রমণ করতে থাকে। শেষবার কারেন তলোয়ার উঁচু করলে মা’কাল তার আক্রমণ ঠেকানোর পরিবর্তে তার বগল বর্ম থেকে খালি দেখে তলোয়ার বর্শার মত করে তার বগলে এত জোরে মারে যে, তলোয়ার কারেনের শরীরের অনেক ভেতরে চলে যায়। কারেনের এই হাতেই তলোয়ার থাকায় তলোয়ার তার হাত থেকে দূরে ছিটকে পড়ে। কারেন ঘোড়ার এক দিকে কাত হয়ে যায়। ঝুঁকে যাওয়ার দরুণ কারেনের গর্দান মা’কাল দেখে ফেলে। শিরস্ত্রাণের ঝুলন্ত জিঞ্জির তখন গলা থেকে সরে গিয়েছিল। মা’কাল মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করে না। দেহের সমস্ত শক্তি হাতে জমা করে তার গর্দান লক্ষ্যে এমন ভীম আঘাত করে যে, গর্ব আর অহমিকাপূর্ণ গর্দান কেটে আলাদা হয়ে যায়। মুসলিম শিবির থেকে ধন্যবাদ, প্রশংসা এবং আল্লাহু আকবার নারার গগন বিদারী বজ্রধ্বনি উঠতে থাকে।

কারেনের ধড়শূন্য কর্তিত মস্তক জমিনে পড়ে ছিল। তার জিঞ্জিরবিশিষ্ট শিরস্ত্রাণের নীচে রাষ্ট্রীয় মর্যাদাসূচক এক লক্ষ্য দেরহাম মূল্যের টুপি ছিল। এমন দামী টুপি হুরমুজের মাথায়ও ছিল। কারেনের মুণ্ডুশূন্য দেহ ঘোড়ার পিঠ থেকে হেলে পড়ে। কিন্তু তার এক পা ঘোড়ার পাদানিতে আটকে যায়। মা’কাল কারেনের ঘোড়ায় মৃদু আঘাত করে। ঘোড়া আঘাত খেয়ে দৌড়াতে শুরু করে এবং কারেনের লাশ জমিনে টেনে হিঁচড়ে ফিরতে থাকে। ঘোড়া ছিল নিয়ন্ত্রণহীন। ইরান সিপাহসালারের এমন নির্মম মৃত্যু ও পরিণতি দেখে ইরান শিবিরে মৃত্যুর নীরবতা ছেয়ে যায়।

অগ্নিপুজারীদের কাতার ডিঙ্গিয়ে দু’টি ঘোড়া সামনে আসে। একটিতে চেপে ছিল ইরান সালার কুববায আর অপর ঘোড়ায় বসা ছিল সেনাপতি আনুশযান।

কার বুকের পাটা আছে আমাদের মোকাবিলা করার।” দু’ অশ্বারোহীর একজনের হুঙ্কার ভেসে আসে–“আমরা সেনাপতি হত্যার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

“আমি একাই তোদের দু’জনার জন্য যথেষ্ট”– হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু শত্রুদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলেন এবং ঘোড়া ছুটিয়ে দেন।

আচমকা হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পশ্চাৎ হতে দুটি ঘোড়া এসে তাঁর ডান-বাম দিক দিয়ে দ্রুত সামনে বেরিয়ে যায়। এক অশ্বারোহীর এই আহ্বান হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কানে এসে পৌঁছে “পিছে থাকুন জনাব খালিদ। এ দু’ সালার আমাদের বাহু বল একবার প্রদর্শন করেছে।”

“এবার আমরা তাদের পালাবার সুযোগ দিব না” অপর অশ্বারোহীর উক্তি বাতাস বয়ে এনে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কানে পৌঁছে দেয়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ছুটন্ত দু’ অশ্বারোহীকে চিনতে চেষ্টা করেন। তারা ছিল তাঁরই ডান এবং বাম বাহিনীর কমান্ডার হযরত আছেম বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আদী ইবনে হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু। তাদের পরনে সাধারণ পোশাক ছিল। কিন্তু তাদের প্রতিপক্ষের সারা দেহ লৌহাবরণে আচ্ছাদিত ছিল। মুসলমানদের ভরশা ছিল আল্লাহর উপর। আর ইরানীদের আস্থা ছিল লৌহাবরণের উপর। তাদের জানা ছিল না যে, তরবারির আঘাত লৌহ ইস্পাত নয়; একমাত্র আকীদা বিশ্বাস এবং চেতনা প্রতিহত করতে পারে।

উভয় পক্ষের অভিজ্ঞ সেনাপতিরা এখন মল্লযুদ্ধের ময়দানে। সবাই তরবারি চালনায় সমান দক্ষ এবং প্রসিদ্ধ। তলোয়ারে তলোয়ারে তীব্র সংঘর্ষ চলে। প্রতিটি সংঘর্ষের পরেই তীব্র আলোর ঝলকানি ও স্ফুলিঙ্গ ওঠে। মুসলমানদের তলোয়ার ইরানীদের লোহার প্রাচীর ভেদ করতে অপারগ ছিল। ফলে তারা সতর্ক হয়ে আক্রমণ করত যেন তরবারি তাদের কোন ক্ষতি করতে না পারে। হযরত আছেম এবং হযরত আদী রাযিয়াল্লাহু আনহু এই আশায় থাকেন যে, শত্রুর কোন দুর্বল এবং অরক্ষিত স্থান প্রকাশ পেলে হযরত মা’কালের মত তাঁরা সেখানে আক্রমণ করবেন। পরিশেষে তারা পালাক্রমে শত্রুর নিকটে এগিয়ে গিয়ে তাদেরকে উপর দিক হতে আক্রমণের সুযোগ করে দেন। অগ্নিপূজক উভয় সালার ঐ ভুলই করে যা ইতোপূর্বে কারেন করেছিল। তারা আক্রমণ করতে তরবারি উঁচু করলে মুসলিম সালারদের তরবারি সোজা তাদের বগলে ঢুকে যায় এবং তাদের উঁচু করা তরবারি উপর থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ে। প্রতিপক্ষের উপর তা পতিত হয় না।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন দেখেন যে, ইরানীদের সর্বাধিনায়ক নিহত এবং দুই পার্শ্ব বাহিনীর ঐ সালারদ্বয়ও নিহত যাদের দায়িত্ব ছিল পুরো ফৌজকে সুশৃঙ্খলভাবে লড়ানো তখন তিনি তাঁর বাহিনীকে একযোগে ইরানীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন।

পূর্ব পরাজয়ের গভীর ক্ষত এবং তার মারাত্মক প্রভাব তখনো ইরানীদের অন্ত রে গেঁথে ছিল। সেই সাথে এবার চোখের সামনে তাদের সর্বোচ্চ তিন নেতাকে এভাবে চরম ও নির্মমভাবে নিহত হতে দেখে তাদের পূর্বভীতি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। দেখতে দেখতে সমস্ত সৈন্যদের মাঝে উদ্বেগ ও ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। ভাঙ্গা হৃদয় হলেও মুসলমানদের এগিয়ে আসতে দেখে তারাও দাঁড়িয়ে যায়। তাদের এক বাড়তি শক্তি এই ছিল যে, পশ্চাতে দরিয়া থাকায় তারা পিছন দিক থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। আরেকটি লাভ এই ছিল যে, দরিয়ায় অসংখ্য নৌযান নোঙ্গর করা ছিল। এগুলো চড়েই তারা এপার এসেছিল। বিপর্যয়কর অবস্থা দেখা দিলে এই নৌযানে চড়ে তারা নিরাপদ এলাকায় চলে যেতে পারবে বলে ভেবে রাখে। তাদের বিন্দুমাত্র এই ধারণাও ছিল না যে, মুসলমানরা পিছন দিকে থেকেও আসতে পারে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আক্রমণের ভঙ্গি এক যোগে চড়াও হওয়া কিংবা এলোপাতাড়ি ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল না। তিনি পুরো বাহিনীকে প্রথম চোঁটেই ব্যবহার করেন না। তিনি মধ্যম বাহিনীকে পালাক্রমে সামনে পাঠান এবং তাদেরকে এই কৌশল শিখিয়ে দেন যে, শত্রুদের বেশী ভেতরে যাবে না; বরং তাদেরকে টোপ দিয়ে সাথে আনার চেষ্টা করবে।

এর সাথে সাথে তিনি দু’পার্শ্ব বাহিনীকে এমনভাবে ছড়িয়ে দেন যেন তারা গিয়ে শত্রুপক্ষের পার্শ্ব বাহিনীতে আঘাত হানতে পারে। আক্রমণের ভীড়ে শত্রুবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং দুই জাদরেল সালারের লাশ ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হতে থাকে। এটা ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অহমিকা-গর্ব, যা মুসলমানদের ঘোড়ার পায়ের নীচে নিষ্পেষিত হতে থাকে। এমনি পরিস্থিতিতে শত্রুদের উদ্যমে ভাটা পড়তে পারে, উদ্দীপনা সৃষ্টি হতে পারে না। মুসলমানদের নারাধ্বনি এবং হুঙ্কার তাদের রীতিমত দিশেহারা করে তুলছিল।

“যরথুস্ত্রের অনুসারীরা। আল্লাহকে মেনে নাও।”

আমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আশেকান ভক্তকুল।”

“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার” নারাধ্বনিতে রণাঙ্গন কাঁপছিল। মুসান্না বিন হারেছার সৈন্যদের প্রেরণা ও আবেগ ছিল আরো তুঙ্গে। তাদের হুঙ্কার ছিল কিছুটা ভিন্ন কণ্ঠের।

“তোমাদের এককালের গোলামদের বাহুবল দেখ।”

“আজ কড়ায় গণ্ডায় এতদিনে ঝরানো রক্তের প্রতিশোধ নিব।”

“ডেকে আন উরদূশেরকে।”

“যরথুস্ত্রকে ডাক, কোথায় সে?”

মুসলমানদের একদিকে তীব্র আক্রমণ অপরদিকে হৃদয় কাঁপানো এমনি গর্জন তর্জনে তাদের অবশিষ্ট শক্তিও নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। হাতিয়ারের বোঝাও তাদের ক্লান্ত করে ফেলেছিল। তারা হাড়ে-হাড়ে ক্লান্তি অনুভব করে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু লড়াই করতে করতেই অনুধাবন করতে থাকেন যে, ইরানীরা ক্রমে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। তারা যে ধারায় আক্রমণ প্রথম থেকে প্রতিহত করছিল, এখন তাদের মাঝে সেই গতি আর নেই। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের এই দুর্বলতা লুফে নেন। দ্রুত এক দূত ডেকে পার্শ্ব বাহিনীর কমান্ডার হযরত আছেম ও হযরত আদী বরাবর এই নির্দেশ দিয়ে পাঠান যে নিজ নিজ বাহিনীকে আরো বাইরে এনে তারপর একযোগে শত্রুর পার্শ্ব বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়।

এর সাথে সাথে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মধ্যম বাহিনীর সংরক্ষিত দলকে শত্রুর মধ্যম বাহিনীর উপর হামলা করার নির্দেশ দেন। যারা ইতোপূর্বে উর্মিমালার মত ছন্দময় ভঙ্গিতে আক্রমণ করছিল। তাদেরকে পিছনে সরিয়ে আনেন। যেন তারা আবেগে উদ্বেলিত হয়ে দুর্বলতার এমন পর্যায়ে পৌঁছে না যায়, যা সহ্য করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।

ইরানীরা মুসলিম বাহিনীর নয়া তুফান সহ্য করতে পারে না। এরই মধ্যে তাদের প্রচুর প্রাণহানি হয়েছিল। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে থাকে। পিছনে থাকা ইরানীদেরকে মুসলমানরা দরিয়ার দিকে দৌড়ে যেতে দেখে। তারা এর কারণ উদঘাটনে মনোযোগ দিলে দরিয়ার তীরে অসংখ্য নৌযান ভিড়ানো দেখতে পায়।

“নৌযান গুঁড়িয়ে দাও”–এক মুসলমানের কণ্ঠ শোনা যায়।

“শত্রুরা পালাতে নৌযান সাথে নিয়ে এসেছে”–আরেকটি কণ্ঠস্বর ওঠে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই আওয়াজ শুনে ডান ও বাম দিকের বাহিনীর প্রতি এই নির্দেশ দিয়ে দূত পাঠান যে, দ্রুত তাদেরকে শত্রুর পিছনে যেতে চেষ্টা কর এবং তাদের নৌযান ভেঙ্গে দাও। সেগুলো কব্জা কর। কব্জা করতে পারলে তা মুসলিম বাহিনীর পার হওয়ার কাজে আসবে।

এই নির্দেশ সালার এবং সালারের মুখ ঘুরে সমস্ত সৈন্যের কানে গিয়ে পৌঁছে তখন চতুর্দিকে একই আওয়াজ উঠতে থাকে যে, “নৌকার কাছে যাও।… নৌকা অকেজো করে দাও… নৌযান কব্জা কর।”

এই চতুর্মুখী আওয়াজ ইরানীদের বাহু ভেঙ্গে দেয়। প্রাণ বাঁচানোর এই একটি পন্থাই ছিল, যা মুসলমানদের চোখে পড়ে যায়। ইরানীরা এবার যুদ্ধ বন্ধ করে নদীমুখী হয়। কে কার আগে নৌযানে উঠবে এই প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। তাদের অবস্থা ভয়ার্ত ভেড়ার পালের মত ছিল, যারা ভয় পেয়ে একে অন্যের আড়ালে লুকাতে চেষ্টা করে। ইরানী সৈন্যরা নৌযানে উঠতে ঘোড়া ছেড়ে যায়। অথচ নৌযান এত বড় ছিল যে ঘোড়াসহ তারা তাতে উঠতে পারত।

এ সময় মুসলমানদের হাতে অগ্নিপূজকদের গণহত্যা হতে থাকে। তারা নৌযানে উঠতে ভীড় করায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খায়। যারা নৌযানে উঠতে এবং নৌযান কূল থেকে দূর পানিতে নিয়ে যেতে পেরেছিল তাদের অধিকাংশই মুসলমানদের তীরের শিকার হয়। তারপরেও কিছুলোক ভাগ্যক্রমে বেঁচে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের অভিমত, এই যুদ্ধে ৩০ হাজার ইরানী সৈন্য মারা যায়। আহতদের সংখ্যা কেউ উল্লেখ করেন নি। তবে অনুমান করতে বেগ পেতে হয় না যে, যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা এত পরিমাণ সেখানে আহতের সংখ্যা এর থেকে বেশী না হলেও অন্তত কম হবে না। যার অর্থ এই ছিল যে, পারস্য সম্রাট যে সমর শক্তি নিয়ে গর্ব করত তার সে গর্বের চূঁড়া সহসা ধ্বসে পড়েছিল। মুসলমানদের হাতে দাফন হয়ে গিয়েছিল তার দম্ভ। নিজেদেরকে অজেয় মনে করার ফানুস গিয়েছিল ফুটো হয়ে। বিশাল সৈন্য আর প্রচুর হাতিয়ার রসদ সবই মুসলমানদের জিহাদী প্রেরণার কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে। যে মুসলমানদের তারা বর্বর বলে উড়িয়ে দিত আজ তাদের হাতেই ইরান সাম্রাজ্যের ভিত কেঁপে ওঠে। মা’কাল নদীর তীর বহুদূর পর্যন্ত রক্তরাঙ্গা ছিল। রণাঙ্গনের দৃশ্য ছিল বড়ই ভয়ংকর। দৃষ্টি যতদূর যায় ততদূর শুধু লাশ আর লাশ ছিল। ইতস্তত আহতদের ছটফটও করতে দেখা যায়। আহত ঘোড়া এদিক ওদিক ছুটতে থাকে আর আহতদের পিষে মারতে থাকে। মুজাহিদরা আহত সাথী এবং শহীদ ভাইদের লাশ উদ্ধার করছিল। রণাঙ্গন ঢাকা পড়েছিল তাজা রক্তের চাদরে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পার্শ্ববর্তী একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে রণাঙ্গনের দৃশ্য দেখছিলেন। এক দিক হতে এক অশ্বারোহী অশ্ব ছুটিয়ে আসেন। তিনি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে এসে ঘোড়া থামান। তিনি ছিলেন মুসান্না বিন হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু। ঘোড়া হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ঘোড়ার পাশে নিয়ে হযরত মুসান্না ঘোড়ার উপর থেকেই হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন।

“জনাব খালিদ!” হযরত মুসান্না আবেগঝরা কণ্ঠে বলেন “আজ আমি মজলুম মুসলমানের রক্তের প্রতিশোধ নিয়েছি।”

“প্রতিশোধের এখানেই শেষ নয় ইবনে হারেছা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু স্বাভাবিকতার চেয়ে একটু গম্ভীর কণ্ঠে বলেন “কেবল তো শুরু; আমাদের আসল বিপদ এরপরে আসবে। তুমি তাদের নৌকার সংখ্যা দেখনি? দেখনি তাদের নৌকা কত বিরাট এবং কত মজবুত? তাদের যুদ্ধাস্ত্র এবং রসদেরও কোন কমতি নেই। অথচ আমরা স্বদেশ ছেড়ে কত দূরে। এখন আমাকে তাদের থেকেই হাতিয়ার এবং রসদ ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের প্রয়োজন মিটাতে হবে। এটা এত সহজ কাজ নয় ইবনে হারেছা? আর আমার পক্ষে এটাও সম্ভব নয় যে, তাদের এতসব প্রাচুর্য এবং আমাদের অপ্রতুলতা দেখে ঘাবড়ে ফিরে যাব।”

“আমরা কখনো ফিরে যাব না ইবনে ওলীদ।” হযরত মুসান্না অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে বলেন–“কিসরার শিশমহলে এক একটি ইট আমরা খুলে নিব। আমরা তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিব যে, তাদের মিথ্যা খোদার রাজত্ব বেশিদিন চলতে পারে না। সত্যের নির্মম কশাঘাতে মিথ্যার পতন অনিবার্য”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সেনাপতিদের ডেকে পাঠান। তিনি এর পূর্বে গনীমতের মাল জমা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। “আমাদের কঠিন সময় শুরু হয়েছে”– হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উপস্থিত সেনাপতিদের উদ্দেশে বলেন–“আমরা বর্তমান শত্রুর ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে। এখানকার প্রতিটি বৃক্ষ, প্রতিটি পাথর এবং মাটির প্রতিটি অংশ পর্যন্ত আমাদের শত্রু। এখানকার লোকেরা আমাদের জন্য অপরিচিত। তাদের অন্তরে পারস্য সাম্রাজ্যের নীতি প্রবল। তারা উরদুশেরকে ফেরআউন মনে করে। তাদের এ কথা বিশ্বাস করাতে বড়ই বেগ পেতে হবে যে, এমন শক্তিও আছে যা পারস্য সাম্রাজ্যের ভিত ভেঙ্গে দিয়েছে।…

প্রিয় বন্ধুরা এখানকার লোকদের সাথে না নিয়ে আমরা এখানে এক কদমও সামনে বাড়তে পারি না। আমরা কারো কাছে ভিক্ষার হাত পাতব না। আমরা তাদেরকে ভালবাসা দিয়ে আপন করে নিতে চেষ্টা করব। আমাদেরকে প্রকাশ্যভাবে কিংবা গোপনে ক্ষতি করতে চেষ্টা করছে এ ব্যপারে কারো উপর বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে আমরা তাকে বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করব। আমরা কাউকে গোলাম বানাতে আসিনি এবং তাদেরকে অন্যের গোলামী এবং ভ্রান্ত আকীদা বিশ্বাস হতে উদ্ধার করতে এসেছি। যে সকল এলাকা আমাদের অধিকারে এসেছে তার নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় এখনই আমাদের মনোযোগী হতে হবে। বিজিত এলাকায় মুসলিম বসতিও আছে। নিশ্চিত তারা আমাদের সহায়তা করবে। কিন্তু বন্ধুগণ কারো উপর শুধু এ কারণে আস্থা রাখা যাবে না যে, সে মুসলমান। কারণ, গোলামী এমন খারাপ জিনিস যা মানুষের প্রবৃত্তিকেই পাল্টে দেয়। হিতাহিত জ্ঞান হ্রাস করে। এখানকার লোকদের মাঝে আস্থা সৃষ্টি করে তাদের থেকে জেনে নিতে হবে যে, তাদের মধ্যে বা এই এলাকায় ইরানীদের সমর্থক কে কে আছে। তাদের যাচাই করে স্তর নির্ধারণ করতে হবে। যার উপর সামান্য সন্দেহ হবে তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। যে সকল অমুসলিম আন্তরিকভাবে আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে।… আমি কয়েকটি শ্রেণীতে জনতাকে ভাগ করতে চাই।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বিজিত এলাকার লোকদের প্রতি সবচেয়ে গুরুত্ব দেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, যে সকল অমুসলিম মুসলমানদের অনুগত হয়ে থাকবে তাদের থেকে ট্যাক্স উসুল করা হবে। বিনিময়ে মুসলমানরা তাদের নিরাপত্তা দিবে। তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং জান-মালের নিরাপত্তা দেয়া হবে।

এই ঘোষণার পরপরই অনেক অমুসলিম মুসলমানদের আশ্রয়ে চলে আসে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই এলাকা হতে কর, ট্যাক্স উঠাতে একটি দল গঠন করেন। এ দলের নেতৃত্বে থাকে সাবীদ বিন মুকরিন। আরেকটি অত্যাবশ্যকীয় টিম গঠিত হয় গোয়েন্দা টিম নামে। কারণ, এখন থেকে নিয়মিত এবং প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা দলের প্রয়োজন আছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গোয়েন্দা দল গঠন করেই তাদেরকে ফোরাত নদীর ওপারে পাঠিয়ে দেন। তাদের কাজ ও দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়।

গনীমতের যে মাল সংগ্রহ করা হয় তা জঙ্গে সালাসিলের তুলনায় অনেক বেশী ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সম্পূর্ণ গনীমত পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেন। চার ভাগ সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দেন আর এক ভাগ মদীনায় পাঠিয়ে দেন।

ঐতিহাসিকরা লেখেন, এরপর থেকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এত চিন্তিত ও গম্ভীর হয়ে যান, যা ইতোপূর্বে তার জীবনে দেখা যায় নি।

দশ

৬৩৩ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ। ১২ হিজরীর সফর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। যরথুস্ত্রের অনুসারীদের জন্য ফোরাতের সবুজ শ্যামল এলাকাটি এদিন জাহান্নামে পরিণত হয়।

সমর শক্তি, রসদ সামগ্রী উট ঘোড়া এবং হাতিয়ার নিয়ে ইরানীদের গর্বের শেষ ছিল না। তারা নিজেরদেরকে ফেরআউনের সমকক্ষ বলেও দাবী করত। আর কিসরা তো ত্রাসের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। দজলা এবং ফোরাতের মিলন মোহনায় আল্লাহর তরবারি বলে খ্যাত হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ইরানীদের এক শোচনীয় পরাজয়ের স্বাদ জোর করে আস্বাদন করান। হুরমুজ, কারেন, আনুশাযান এবং কুববাযের মত নামকরা সালারদের মৃত্যুর দুয়ারে নিক্ষেপ করেছিলেন। কিন্তু তারপরেও কিসরা উরদূশের পরাজয় স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল না। তার অধীনে এখনও প্রচুর সৈন্য ছিল এবং মদীনার মুজাহিদদেরকে সে এখনো বুদ্দু এবং মরুডাকাত বলে মনে করত।

পরাজয় স্বীকার না করলেও পরাজয় এবং জাদরেল সালারদের নিহত হওয়ায় সে অন্তরে যে বিরাট আঘাত পায় তা লুকাতে পারে না। হুরমুজের মৃত্যুর সংবাদ দেয়া হলে সে বুকে হাত রেখে সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলে নেয়ার বহু চেষ্টা সে করেছিল কিন্তু এক অজ্ঞাত রোগে সে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। রোগের আক্রমণ এত তীব্র ছিল যে, তাকে সিংহাসন হতে দূরশয্যায় আছড়ে ফেলে। ঐতিহাসিকগণ এই রোগের কারণ পরাজয়ের আঘাত লিখেছেন।

“পরাজয় এবং পশ্চাদপসারণ ছাড়া আমার জন্য আর কোন সংবাদ নেই কি?” সে শয্যা থেকে বসে গর্জে উঠে বলে “মদীনার মুসলমানরা কি তাহলে জিন? কারো চোখে পড়ে না, ফাঁকে আক্রমণ করে চলে যায়?”

শাহী ডাক্তার, উরদূশেরের চোখের পুত্তলীসম দুই যুবতী স্ত্রী এবং এক উজীর বিস্মিত এবং নির্বাকভাবে ঐ দূতের দিকে চেয়েছিল, যে ইরানীদের আরেকটি পরাজয় এবং পিছু হটার সংবাদ নিয়ে এসেছিল। দূত আসার সংবাদ দেয়া হলে প্রথমে ডাক্তার বাইরে এসে দূতকে জিজ্ঞাসা করে যে, সে কি সংবাদ নিয়ে এসেছে। দূত সংবাদ জানালে ডাক্তার তাকে বলেছিল, সে যেন কিসরাকে এখনই এই খারাপ সংবাদ না জানায়। কারণ, সে এ মর্মান্তিক খবর সহ্য করতে পারবে না। কিন্ত এই দূত কোন সাধারণ সিপাহী ছিল না যে, ডাক্তার যা বলবে, তাই শুনবে। সে ছিল সাবেক কমান্ডার। তার পদমর্যাদা সালার থেকে দুই স্তর কম ছিল। তাকে কোন সালার প্রেরণ করে নাই। আর তাকে প্রেরণের জন্য কোনই সালার জীবিতও ছিল না।

চিকিৎসকের বলায় দূত থামে না; সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, তার কাছে কিসরার সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ নয়; পারস্য সাম্রাজ্য এবং যরথুস্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করাই বড় কথা। সম্রাট উরদূশেরকে দজলা এবং ফোরাতের যুদ্ধের বর্ণনা পূর্ণরূপে অবগত না করালে ক’দিন বাদেই মুসলমানরা মাদায়েনের ফটকে এসে নক করবে। দূত চিকিৎসকের আর কোন কথা শোনে না। সোজা ভেতরে চলে যায় এবং উরদূশেরকে জানায় যে, মুসলমানরা ইরানীদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছে। উরদূশের শায়িত ছিল; সংবাদ শুনে উঠে বসে। রাগে তার ঠোঁট এবং হাত কাঁপছিল।

“মহামান্য সম্রাট!” কমান্ডার বলে–“মদীনাবাসী জ্বিন নয়; সকলে তাদের দেখতে পায়। কিন্তু…!”

“তা কারেন কি মরে গিয়েছিল?” উরদূশের তার কথা শেষ করতে না দিয়েই ক্রোধে ফেটে পড়ে জিজ্ঞাসা করে।

“জ্বি হা!” কমান্ডার জবাব দেয়–“তিনি মল্লযুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। তার পক্ষে উভয় বাহিনীর সংঘর্ষ দেখা সম্ভব হয় নি।”

“আমাকে জানানো হয়েছিল যে, কুববায এবং আনুশযানও তাদের সাথে ছিল” উরদূশের এ কথা বলে তাদের সম্পর্কে জানতে চায়।

“তারাও কারেনের ভাগ্য বরণ করে”– কমান্ডার বলে–“তারা কারেন হত্যার প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। উভয়ই একসাথে গিয়ে মদীনার সালারদেরকে আহ্বান করে এবং তুমুল সংঘর্ষে উভয় মারা যায়।… মহামান্য সম্রাট। মহান পারস্য সাম্রাজ্যের এই অবস্থা কি চলতে পারে? না… না…যদি মহামান্য সম্রাট বেদনায় এভাবে নিজেকে রোগাক্রান্ত করে ফেলে তবে কি আমরা যরথুস্ত্রের মান-মর্যাদা মদীনার বুদ্দুদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারব?”

“তোমার পরিচয় কি?” উরদূশের জানতে চায়।

“আমি কমান্ডার মাত্র”–কমান্ডার জবাব দেয়–“আমি কারো প্রেরিত দূত নই। আমি যরথুস্ত্রের আত্ম নিবেদিত গোলাম।”

“প্রহরীকে ডাক”–উরদূশের নির্দেশ দেয়–“তুমি আমাকে নয়া প্রেরণায় উজ্জীবিত করেছ।… আমাকে বল, মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা কোথায় বেশী? তাদের কাছে ঘোড়া বেশী? আর কি কি আছে তাদের কাছে?

প্রহরী ভেতরে আসে এবং নির্দেশের অপেক্ষায় নতশিরে ঝুঁকে থাকে। “সেনাপতি আন্দারযগারকে ডাক” উরদূশের প্রহরীকে বলে এবং কমান্ডারের কাছে জানতে চায় “তাদের কাছে কি কি আছে এবং কি কি নেই… সব খুলে আমাকে বল।”

“আমাদের অনুপাতে তাদের কাছে কিছুই নেই” কমান্ডার জবাবে বলে, “তাদের মাঝে লড়ার প্রেরণা আছে। আমি তাদের নারা ধ্বনি শুনেছি। তারা নারার মাঝে নিজেদের প্রভু এবং রাসূলকে স্মরণ করে। আমি তাদের মাঝে অবর্ণনীয় ধর্মীয় টান দেখেছি। তারা নিজ বিশ্বাস ও চেতনায় অত্যন্ত পক্ক। আর এটাই তাদের মূলশক্তি। প্রতিটি রণাঙ্গনে তাদের সৈন্যসংখ্যা খুবই কম থাকে।”

“থাম!” উরদূশের বলে, “আন্দারযগার আসছে। এ সেনাপতির উপর আমার আস্থা আছে। তাকে জানাবে, আমাদের বাহিনীতে কোন্ কোন্ দুর্বলতা আছে যার কাছে সংখ্যায় বেশী হয়েও তাদের পালাতে হচ্ছে?”

***

“আন্দারযগার!” উরদূশের শয্যায় অর্ধমৃত অবস্থায় পড়েছিল। সে শুয়ে থেকেই তার এক নামকরা সালারকে বলছিল “তুমি এ সংবাদ শুনেছ যে, কারেনও মারা গেছে? অপর দুই সালার কুববায এবং আনুশযানও নিহত?”

আন্দারযগারের চোখ স্থির হয়ে যায়। রাজ্যের বিস্ময় তাকে ক্ষণিকের জন্য নির্বাক করে দেয়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু।

“তাকে সব খুলে বল কমান্ডার!” উরদূশের কমান্ডার বলে “এভাবে একের পর এক পরাজয়ের সংবাদ আসতে থাকলে কতক্ষণ আমার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে?”

মুসলমানরা মা’কাল দরিয়ার কূলে তাদেরকে কিভাবে পরাজিত করে তা বিস্তারিতভাবে কমান্ডার সালার আন্দারযগারকে জানায়। সে তাকে ইরানীদের পশ্চাদপসারণের দৃশ্যও খুলে খুলে বলে।

“আন্দারযগার!” উরদূশের বলে “আমি আর কোন পরাজয়ের ঝুঁকি নিতে চাই না। মুসলমানদের থেকে পরাজয়ের শুধু প্রতিশোধই নিবে না; তাদের হত্যা করে করে ফোরাতের স্রোতে ভাসিয়ে দিতে হবে। আর এটা কেবল তখনই সম্ভব হতে পারে যদি তুমি বেশীর থেকে বেশী সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হতে পার। অত্র এলাকা তোমার চেনা আছে। তুমিই ভাল বুঝবে, মুসলমানদের ফাঁদে ফেলে কোথায় লড়ানো দরকার।

“তারা মরুভূমির অধিবাসী” আন্দারযগার বলে “এবং তারা মরুভূমিতেই লড়াই করতে অভ্যস্ত। আমি তাদেরকে উর্বর এবং সবুজ-শ্যামলিমা স্থানে আসার সুযোগ দিব অতঃপর তাদের উপর হামলা করব। আমার দৃষ্টিতে ওলযা উপযুক্ত স্থান।” এরপর সে কমান্ডারকে জিজ্ঞাসা করে তাদের অশ্বারোহীরা কেমন?”

“অশ্বারোহীরাই তাদের মূল শক্তি” কমান্ডার বলে “তাদের অশ্বারোহীরা বড়ই দ্রুতগতির এবং সতর্ক। ছুটন্ত ঘোড়া হতে নিক্ষিপ্ত বর্শা টার্গেট মিস করে না। চোখের পলকে তারা এই হামলা করে। তারা স্থির হয়ে লড়ে না। আক্রমণের সূচনা ঘটিয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে।”

“এটাই সূক্ষ্ম বিজয়, যা আমাদের সালার বুঝে উঠতে পারেন নি।” আন্দারযগার নিজের উরুতে হাত মেরে বলে ‘মুসলমানরা মুখোমুখী লড়তেই পারে না। আমরা তাদের থেকে কয়েকগুণ বেশী সৈন্য নিয়ে যাব। আমি তাদেরকে আমার সৈন্যদের আওতার মধ্যে নিয়ে সামনা-সামনি লড়তে তাদেরকে বাধ্য করব। জীবন বাঁচাতে তখন তাদের এমনটি করতেই হবে। তারা এবার বুঝবে যুদ্ধ কারে কয়।”

“আন্দারযগার!” উরদূশের বলে “এখানে বসে পরিকল্পনা তৈরি করা সহজ কিন্তু তা বাস্তবে পরিণত করা বড়ই কঠিন। এই কমান্ডার একটি তথ্য দিয়েছে; এ ব্যাপারে চিন্তা করে দেখ। সে বলেছে মুসলমানরা নিজ নিজ ধর্ম ও বিশ্বাসে অত্যন্ত বলীয়ান। তারা আল্লাহ এবং রাসূলের নাম নিয়ে লড়াই করে। আমাদের সৈন্যদের মাঝে কি এই ধর্মীয় চেতনাবোধ আছে?… ঐ পরিমাণ নেই, যা মুসলমানদের মধ্যে আছে।… এবং এ দিকটাও খেয়াল কর আন্দারযগার। মুসলমানরা স্বদেশ ছেড়ে বহু দূরে এখন। এটা তাদের আরেক দুর্বলতা। এখানকার লোকেরা তাদের বিরোধী হবে।”

“না রাজাধিরাজ!” কমান্ডার বলে “পারস্যের যে এলাকা মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে, সেখানকার লোকেরা তাদের মেনে নিয়েছে। তাদের আচার-ব্যবহার এত অমায়িক যে, তাদেরকে তারা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে শুরু করেছে। তারা তাদের উপরই কেবল হাত উঠায়, যাদের আচরণ সন্দেহপূর্ণ হয়।”

“এখানকার আরব ইহুদীরা তাদের সমর্থন করতে পারে না। আন্দারযগার বলে “আমার অন্তরে তাদের প্রতি যে মহব্বত রয়েছে সে সম্পর্কে তারা ভালভাবে অবগত। আমি তাদেরকে আমার ফৌজে শামিল করে নেব। এখানকার মুসলমানদের উপর আমার আস্থা নেই। তারা চিরদিন অবাধ্য এবং বিদ্রোহী। তাদের উপর আমাদের কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। মদীনাবাসীদের সাথে তাদের যাবতীয় সেতুবন্ধন।”

“এ সকল মুসলমানের সাথে পূর্বের তুলনায় অধিক খারাপ আচরণ করে” উরদূশের বলে “তাদেরকে মাথা উঁচু করার সুযোগ দিবে না।”

“আমরা তাদেরকে পশুর পর্যায়ে রেখেছি” আন্দারযগার বলে “তাদের ক্ষুধার্ত রেখেছি, তাদের ক্ষেতের ফসল আমরা সংগ্রহ করে নিয়ে আসি। জীবন ধারনের জন্য সামান্য কিছু দিয়ে আসি মাত্র। তারপরেও তারা ইসলাম থেকে হাত গুটিয়ে নেয় না। ক্ষুধায় তিলে তিলে মরতে রাজি তবে ইসলাম ছাড়তে প্রস্তুত নয়।”

“এটাই তাদের আত্মিক শক্তি” কমান্ডার বলে– “নতুবা এক ব্যক্তি কখনো দশজনের মোকাবিলা করতে পারে না। কাপড়ের বস্ত্র পরিহিত বর্মাচ্ছাদিতকে হত্যা করতে পারে না। মুসলমানরা এটা বাস্তবে পরিণত করে দেখিয়েছে।”

“আমি এই শক্তি মাটির সাথে পিষে ফেলব” উরদূশের উচ্চ আওয়াজে বলে আন্দারযগার! এক্ষুণি ঐ মুসলমানদের কিছু বলো না, যারা আমাদের প্রজা হয়ে সেখানে আছে। তাদের এই প্রতারণার জালে আটকে রাখ যে, আমরা তোমাদের গুরুত্ব দিই; তোমাদের সাহায্য চাই। যারা আমাদের রাজত্বে পা রাখার সাহস দেখিয়েছে আগে তাদের শায়েস্তা কর। পরে ঐ নরপশুদের কচুকাটা কাটব যারা আমাদের আশ্রয়ে থেকে সাপের মত প্রতিপালিত হচ্ছে। তাদের বিষদাঁত আমরা এক একটা করে তুলে ফেলব। বড় নির্মমভাবে তাদের হত্যা করব।”

কিছু সময়ের ব্যবধানে ঐ দিনই উরদূশের মন্ত্রী, আন্দারযগার এবং তার অধীনস্থ সালারদের ডেকে পাঠায়। তারা উপস্থিত হলে সে বলে “যেখানে হামলা আমাদের করার ছিল অর্থাৎ মদীনা আক্রমণ করে সেখানেই ইসলাম ধুলিস্যাৎ করা উচিত ছিল, সেখানে হামলার সূচনা তারাই করে এবং আমাদের সৈন্যরা তাদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”

“মাত্র দু’ রণাঙ্গনেই আমাদের চার জাদরেল সালার মারা গেছে” উরদূশের বলে “এই চার সালারকে আমার সমরশক্তির স্তম্ভ মনে করতাম। কিন্তু তাদের মারা যাওয়ার দরুণ কিসরার শক্তি মরে যায় নি। সবাই কান খুলে শোন, যে সেনাপতি বা সহসেনাপতি পরাজিত হয়ে ফিরে আসবে তাকে আমি জল্লাদের হাতে তুলে দিব। এর চেয়ে এটাই ভাল যে, সে নিজেই নিজেকে হত্যা করবে। কিংবা অন্য কোথাও চলে যাবে। ইরানের সীমায় যেন না থাকে।….

“আন্দারযগার। মাদায়েন এবং তার আশ-পাশ থেকে যত সৈন্য চাও নিয়ে যাও। সেনাপতি বাহমানকে আমি খবর পাঠিয়েছি যে, সে যেন সমস্ত ফৌজ নিয়ে ফোরাতের উপকূলবর্তী ওলযা নামক স্থানে এসে পৌঁছে। তুমি তার থেকেও দ্রুত ওলযায় যাও। সেখানে ছাউনী ফেলে বাহমানের অপেক্ষা করবে। সে এলেই উভয় বাহিনী মুসলমানদের ঘিরে নিতে চেষ্টা করবে। তাদের একজন সৈন্য এবং কোন পশু যেন জীবিত না থাকে। তাদের সংখ্যা তোমাদের তুলনায় কিছুই নয়। আমি কোন বন্দী মুসলমান দেখতে চাইনা। তাদের লাশ দেখতে চাই। আমাকে তাদের লাশ উপহার দিবে। আমি তাদের ঐ লাশ দেখতে আসব, যা মৃত উট ও ঘোড়ার মাঝে একাকার হয়ে থাকবে। হয় জয় নয়ত মৃত্যু এই দুয়ের উপর যরথুস্ত্রের নামে তোমাদের শপথ করতে হবে। …

“আন্দারযগার উভয় বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবে। … আন্দারযগার! তোমার মাথায় কোন সংশয় এবং ধোঁকার অস্তিত্ব না থাকা চাই। মনে রেখ মুসলমানরা যদি আরো এগিয়ে আসার সুযোগ পায় এবং আমাদের আরো একবার পরাজিত করতে পারে তবে রোমকরাও আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে এগিয়ে আসবে।”

“মহামান্য সম্রাট! পরাজয় শব্দ আর আপনার কান স্পর্শ করবে না” সর্বাধিনায়ক আন্দারযগার বলে “ইহুদী শক্তিকেও দলে ভিড়িয়ে নেয়ার অনুমতি আমায় দিন। তাদের যোগদানে ফৌজ বেশ স্ফীত হবে বলে আশা করি।”

“তুমি যা ভাল বোঝ কর” উরদূশের বলে “কিন্তু আমি সময় নষ্ট করার অনুমতি দিব না। ইহুদীদের প্রতি তোমার আস্থা থাকলে তাদেরও সঙ্গে নিতে পার।”

ইরাকের একটি অঞ্চলে ইহুদীদের একটি বড় গোত্র বকর বিন ওয়ায়েল বসবাসরত। এরা মূলত আরবের অধিবাসী। ইসলামের সম্প্রসারণ কালে যে সকল ইহুদী ইসলাম কবুল করতে অস্বীকৃতি জানায় তারা এক এক করে এসে এখানে আবাস গড়ে তোলে। তাদের মধ্যে এমন লোকও ছিল, যারা কোন সময় ইরানীদের বিরুদ্ধে লড়তে এসে যুদ্ধবন্ধী হয়েছিল। ইরানীরা তাদেরকে আযাদ করে এই এলাকায় বাস করতে দেয়। এখানকার কিছু লোক মুসলমানও ছিল। মুসান্না বিন হারেছার মত তুখোড় নেতা তারা লাভ করেছিল। ফলে তার মাধ্যমে তারা পাক্কা মুসলমান হতে পেরেছিল। মুসলমানদের উপর ইরানীরা সীমাহীন জুলুম করলেও ইহুদীদের সাথে আচরণ কিছুটা ভিন্নতর ছিল। ঐতিহাসিকদের অভিমত, সেনাপতি আন্দারযগার হুরমুজের মত জালিম ছিল না। মুসলমানদের উপর সে জুলুম না করলেও তাদের ভাল চোখে দেখত না। ইহুদীদের সাথে তার ছিল দহরম-মহরম। এ পর্যায়ে সে ইহুদীদের সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সে বকর বিন ওয়ায়েলের সর্বোচ্চ নেতাদের ডেকে পাঠায়। তারা খবর পেয়েই ছুটে আসে।

“আমার বিরুদ্ধে তোমাদের কারো কোন অভিযোগ থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে পার” আন্দারযগার বলে “আমি সে অভিযোগ দূর করব।”

“কোন ভূমিকা না টেনে আমাদের ডেকে পাঠানোর উদ্দেশ্য সরাসরি বললে ভাল হয়না?” এক বৃদ্ধ বলে “আমরা আপনাদের প্রজা। আমাদের অভিযোগ থাকলেও তা মুখে আনব না।”

“আমাদের কোন অভিযোগ নেই” আরেকজন বলে “আপনার যা বলার বলতে পারেন।”

“মুসলমানরা ক্রমেই এগিয়ে আসছে” আন্দারযগার বলে “পারস্য বাহিনী তাদেরকে ফোরাত নদীতে ডুবিয়ে মারবে। কিন্তু আমরা তোমাদের প্রয়োজন অনুভব করছি। তোমাদের নওজোয়ানদের আমাদের খুব প্রয়োজন।

“পারস্য বাহিনীই যখন মুসলমানদেরকে ফোরাতে ডুবাতে সক্ষম তখন আমাদের নওজোয়ানদের আবার প্রয়োজন পড়ল কেন? প্রতিনিধি দলের এক বয়োবৃদ্ধ নেতা তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করে “আমরা শুনতে পেরেছি, ইরান সৈন্যদের চার সালার ইতোমধ্যে মারা গেছে। এমতাবস্থায় আমাদেরকে জিজ্ঞাসার কি প্রয়োজন? আমরা আপনাদের প্রজা। নির্দেশ দিন। আমরা অবাধ্যতা প্রদর্শনের সাহস রাখি না।”

“আমি কাউকে নির্দেশ বলে ময়দানে নিতে চাইনা” আন্দারযগার বলে “আমি তোমাদেরকে তোমাদের মাজহাবী নামেই শামিল করতে চাই। পৃথিবীর কোন ভূখণ্ডের জন্য নয় নিজের ধর্ম এবং চেতনা রক্ষার জন্য আমি লড়াই করব। মুসলমানরা একের পর এক যুদ্ধ জয়ের কারণ হলো তারা নিজ ধর্ম ও বিশ্বাসের চেতনা নিয়ে লড়ে। তারা যে এলাকা জয় করে সেখানকার লোকদের ইসলাম কবুল করতে বলে। ইসলাম কবুল না করলে তাদের থেকে ট্যাক্স উসুল করে।…

এটা কি সত্য নয় যে, তোমাদের মাঝে এমন লোকও আছে যারা ইসলাম কবুল করবে না বলেই স্বীয় ঘর-বাড়ী ছেড়ে এসেছিল? তোমরা কি চাও যে, মুসলমানরা আসুক এবং তোমাদের উপসনালয়ের দরজা বন্ধ হয়ে যাক? মুসলমানরা তোমাদের কন্যাদের বাঁদী বানিয়ে সাথে নিয়ে গেলে তোমরা সহ্য করতে পারবে?… একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারবে যে, তোমাদেরকে আমাদের নয়, বরং আমাদেরকেই তোমাদের বেশী প্রয়োজন। আমি তোমাদেরকে একটি ফৌজ দিচ্ছি। তাদেরকে আরো শক্তিশালী কর এবং স্বীয় মাজহাবকে এক ভিত্তিহীন ধর্ম থেকে বাঁচাও।”

আন্দারযগার ইহুদীদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমনভাবে উত্তেজিত করে তোলে যে, তারা তৎক্ষণাৎ এলাকায় ফিরে যায় এবং ইহুদী গোত্রের প্রতিটি বসতিতে গিয়ে এই ঘোষণা করে যে, মুসলমানদের বিরাট বাহিনী হত্যা-লুটতরাজ চালাতে চালাতে আসছে। তাদের হাত থেকে তারাই কেবল রেহাই পায় যারা তাদের ধর্ম গ্রহণ করে। তারা ফিরে যাবার সময় যুবতী ও তরুণী নারীদের সাথে নিয়ে যাবে।

“নিজ নিজ কন্যা লুকিয়ে ফেল।”

“ধন-সম্পদ মাটিবক্ষে চাপা দাও।”

স্ত্রী-পরিজনদের নিয়ে জঙ্গলে চলে যাও।”

“যুবকরা হাতিয়ার, ঘোড়া এবং উট নিয়ে আমাদের সাথে এস।”

“সম্রাটের সৈন্যরা আমাদের সাথে আছে।”

“ঈসা-মসীহের শপথ! আমরা ইজ্জত রক্ষায় জীবন বাজি রাখব।”

“তবুও ধর্ম বিশ্বাস ছাড়ব না।”

দিকে দিকে একটি আওয়াজ ওঠে, আহ্বান ভেসে আসে, যা ঘুর্ণিঝড়ের মত পাহাড়-পর্বত আর জ্বিন ইনসানকে ব্যাপৃত করে ছুটে আসে। কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ হয় না যে, এসব কি হচ্ছে? মুসলমানরা সত্যই আসছে কি? কোন দিক থেকে আসছে? উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। ইহুদী মায়েরা যুবক পুত্রকে বিদায় জানাতে থাকে। স্ত্রী স্বামীকে বোন ভাইকে আল বিদা জানায়। কিছু সময়ের মধ্যে একটি ফৌজ তৈরি হয়ে যায়। ফৌজের সংখ্যা সময়ের তালে তালে বাড়তে থাকে। কিসরার ফৌজের কমান্ডার প্রমুখ এসে গিয়েছিল। তারা স্বেচ্ছাসেবকদের এক স্থানে সমবেত করছিল। মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়তে ইরানী বাহিনীর সাথে যোগ দিতে তাদের সংগ্রহ করা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *