খালিদ ইউহাওয়াকে বলেন– “তোমরা মুসলমানদেরকে সাফল্যের সাথে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছ।” “মুগীছের কওমের লোকেরাও তোমাদেরকে জাদুগীর বলছে। কিন্তু এ পন্থা আমার পছন্দ নয়।”
“মনোযোগ সহকারে আমার কথা শোন খালিদ!” ইউহাওয়া তার গা ঘেঁষে বসে এবং তার উরুর উপর হাত রেখে বলে– “এটা সত্য যে, তুমি একজন বিশিষ্ট বীর যোদ্ধা। কিন্তু তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি এখনও পরিপক্ক হয়নি। দুশমনকে প্রতিহত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তা তলোয়ারের মাধ্যমেই হোক, তীরের মাধ্যমেই হোক কিংবা দৃষ্টি-বাণ নিক্ষেপণের মাধ্যমেই হোক। তীর-তরবারি ছাড়া দুশমনকে বস বানানো আমার মত মহিলাই কেবল পারে।”
খালিদ ইউহাওয়ার শরীরের উত্তাপ অনুভব করেন। ইউহাওয়া তার এত শরীর ঘেঁষে বসেছিল যে, একবার ইউহাওযার চেহারা খালিদের দিকে ঘুরালে তুলার ন্যায় তার মোলায়েম গাল খালিদের গাল স্পর্শ করে। কিন্তু তারপরেও কোন খেয়ালে যেন একটু সরে বসেন।
দীর্ঘ চার বছর পর মরুভূমি পারাপারের সময় খালিদ পুনরায় তার গালে ইউহাওয়ার গালের স্পর্শ অনুভব করেন। ইহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের পাশে আছে– বিষয়টি তাকে খুশী করলেও তিনি ভাল করেই জানতেন যে, মুসলমানদের বিরোধিতায় ইহুদীরা তাদের জোট বাঁধলেও তাদের জাতীয় স্বার্থও এর সাথে জড়িত আছে। অবশ্য এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হন যে, ইউহাওয়া জাদুবাজ না হলেও তার আপাদমস্তক অবশ্যই জাদুস্নাত।
খালিদের ঘোড়া মদীনার দিকে চলছে। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কথা আবার তার স্মরণ হয়। নিলাম স্থলে মানুষ উচদর হাঁকছিল। এক সময় বিক্রি হয়ে যায়। দু’কুরাইশ প্রচুর স্বর্ণের বিনিময়ে তাদেরকে কিনে নেয়। ক্রেতাদ্বয় দু’সাহাবীকে আবু সুফিয়ানের নিকট নিয়ে যায়।
ক্রেতাদ্বয় বলে– “আমরা দু’মুরতাদকে কিনেছি শুধু উহুদে নিহত কুরাইশদের রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য।” “আমরা তাদেরকে আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি। আপনি আমাদের সিপাহসালার।”
আবু সুফিয়ান বলে “হ্যাঁ”। মক্কাভূমি মুসলমানদের রক্ত পিয়াসী। তাদের রক্ত দ্বারা জমিনের পিপাসা মিটাও।… কিন্তু এখনই এটা সম্ভব নয়। কারণ, চলতি মাস আমাদের দেবতা হুবল ও উযযার সম্মানিত মাস। এ মাস সমাপ্ত হতে দাও। আর মাত্র একদিন বাকী। আগামীকাল উন্মুক্ত প্রান্তরে একটি খুঁটির সাথে তাদেরকে বেঁধে আমাকে খবর দিও।”
খালিদ আবু সুফিয়ানের এই নির্দেশ শুনে তার কাছে যান।
খালিদ আবু সুফিয়ানকে বলে– “আপনার এই সিদ্ধান্ত আমার পছন্দনীয় নয়।” সংখ্যায় দ্বিগুণ, তিনগুণ হওয়া সত্ত্বেও যদি আমরা লড়াইয়ের মাধ্যমে মাতৃভূমিকে মুসলমানদের রক্ত পান না করাতে পারি তাহলে প্রতারণা করে দুই মুসলিমকে ধরে এনে রক্ত ঝরানোর অধিকার রাখি না।… আবু সুফিয়ান! মুসলমানদের প্রতারণার মধ্যে তিন-চারজন মহিলারও দখল রয়েছে? তুমি কি চাও যে, দুশমন এ কথা বলার সুযোগ পাক যে, কুরাইশরা এখন মাঠে ময়দানে নারীদের নামিয়ে নিজেরা প্রাণ ভয়ে ঘরে বসে আছে?”
গম্ভীরকণ্ঠে আবু সুফিয়ান বলে– “খালিদ!” “খুবাইব এবং যায়েদকে আমিও এক সময় তোমার মত কাছের মনে করতাম। তুমি এখনও তাদের আগের দৃষ্টিতেই দেখছ। অথচ তুমি ভুলে গেছ যে, তারা এখন আমাদের প্রাণের দুশমনে পরিণত হয়েছে। একান্তই যদি তাদেরকে মুক্ত করতে চাও তাহলে দ্বিগুণ স্বর্ণের বিনিময়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে তাদেরকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পার।”
“না।” পর্দার অন্তরাল থেকে ক্রুদ্ধ এক নারীর আওয়াজ শোনা যায়। এটা ছিল আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার আওয়াজ। সে ক্রোধ কম্পিত হয়ে বলে– “হামযার কলিজা চিবিয়েও আমার আত্মা শান্ত হয়নি। দুনিয়ার সমস্ত স্বর্ণের বিনিময়ে হলেও আমি এ দু মুসলমানকে মুক্ত করতে দিব না।”
খালিদ বলেন– “আবু সুফিয়ান!” “যদি আমার স্ত্রী আমার কথার উপর এভাবে বলত, তাহলে আমি তার জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলতাম।”
“স্ত্রীর জিহ্বা তুমি টেনে ছিড়তে পার?” হিন্দার প্রত্যুত্তর – “যুদ্ধে তোমার পিতা, চাচা ও পুত্র মারা যায়নি। এক ভাই বন্দি হলে তাও মদীনায় গিয়ে মুসলমানদের নির্ধারিত মুক্তিপণ দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে এনেছ। যে আগুন আমার অন্তরে জ্বলছে তার তীব্রতা তোমার জানা নেই।”
খালিদ আবু সুফিয়ানের দিকে তাকান। তার চেহারাতে পৌরুষ সুলভ দীপ্ততা ও একজন দক্ষ সেনানায়কের বলিষ্ঠতার পাশাপাশি এক স্বামীর অসহায়ত্বের ছাপও স্পষ্ট ছিল।
আবু সুফিয়ান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে– “হ্যাঁ খালিদ!” “বেদনাক্লিষ্ট ব্যক্তির অন্তরের অবস্থা তোমা থেকে ভিন্ন। কাউকে দুশমন ভাবা অনেক সহজ। কিন্তু আপনজনের রক্তের মোকাবিলায় কোন দুশমনকে মাফ করা অনেক কঠিন। এ দু’মুসলমানের প্রাণ বাঁচানোর ব্যাপারে কতজনকে রাজি করাতে পারবে? তুমি অনর্থক অনুরোধ করো না খালিদ। তাদের গোত্রের দয়া-মায়ার উপর তাদেরকে হাওলা করে দাও।”
খালিদ নীরবে প্রস্থান করেন।
এরপর খালিদের একটি ভয়ঙ্কর দৃশ্যের কথা স্মরণ হয়ে যায়। উম্মুক্ত প্রান্তরে দু’ খাম্বার সাথে দুবন্দি বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। হর্ষোৎফুল্ল জনতা হৈ-হুল্লোড় করে মাঠের চারপাশে জমায়েত হয়। এক সময় আবু সুফিয়ান ও হিন্দা অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে সমবেত জনতার মাঝে উপস্থিত হলে উত্তেজনাকর শ্লোগান এবং উচ্চকিত প্রতিশোধমূলক বাক্য তীব্রতর উচ্চকিত হতে থাকে। এই জনসমুদ্রের মধ্যে কেউ যদি নীরব থাকেন তবে তিনি ছিলেন একমাত্র খালিদ।
আবু সুফিয়ান ঘোড়ায় চড়ে বন্দিদের কাছে যায়। তারা শেষবারের মত নামায আদায় করতে চান। আবু সুফিয়ান অনুমতি প্রদান করে।
খালিদ মদীনার পথে যাওয়ার সময় যখন তার সেই অতীত স্মৃতি মনে পড়ে যে, বন্দিদ্বয়কে বন্ধন মুক্ত করলে তারা অত্যন্ত স্থিরচিত্তে কেবলামুখী হয়ে নামায আদায় করেন, তখন এর যে গভীর প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে প্রভাব ফেলে, দীর্ঘ চার বছর পরও তিনি সে প্রতিক্রিয়া আবার অনুভব করেন। ঘোড়ার পিঠে বসেই তার মস্তক অবনত হয়ে আসে।
হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত যায়েদ বিন দাছানা রাযিয়াল্লাহু আনহু জনগণের কলরব উপেক্ষা এবং মৃত্যুভয় এড়িয়ে নিবিষ্টমনে নামাযে হারিয়ে যান। নিরুদ্বেগ ও ধিরস্থিরভাবে নামাজ আদায় করেন। দোয়ার জন্য হাত উঠান। আল্লাহর দরবারে তাদের শেষ আরজি কি ছিল, তা কেউ বলতে পারে না। ইতিহাসও এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি। তবে দুশমনের হাত থেকে মুক্তির আবেদন করেননি।
নামাজ শেষে তারা নিজেরাই নির্দিষ্ট খুঁটিতে গিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে যান।
আবু সুফিয়ান হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে লক্ষ্য করে ঝাঝালো কণ্ঠে বলে– “বদ কিসমত মুসলমান।” “তোমাদের ভাগ্য এবং বাঁচা-মরা এখন আমার হাতে। বাঁচতে চাইলে বল, আমরা ইসলাম ত্যাগ করে কুরাইশদের দলে ভীড়েছি এবং ৩৬০ মূর্তিকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি … এতে রাজী না হলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। মনে রেখ, তোমাদের মৃত্যু সহজ হবে না।”
হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গর্জে ওঠেন– “বাতিলের পূজারী আবু সুফিয়ান!” “পাথর দ্বারা নির্মিত ঐ মূর্তির উপর অভিশাপ, যারা নিজের শরীরে বসা মাছি পর্যন্ত তাড়াতে পারেনা। উযযা এবং হুবল মূর্তির উপর অভিশাপ দিই, যারা পরকালে তোমাদের জাহান্নামের কারণ হবে। আমরা এক ও অদ্বিতীয় পরম দয়ালু ও করুণাময়ের গোলামী করি এবং তাঁর প্রেরিত রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রাণাধিক ভালবাসি।”
“আমিও ঐ পথের পথিক যায়েদ যে পথ তোমাকে দেখিয়েছে।” হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলিষ্ঠ কণ্ঠে জানিয়ে দেন– “হে মক্কাবাসী! চিরন্তন সত্তা তিনিই, যার নামে আমরা জান কুরবান করতে যাচ্ছি। এতে আমাদের প্রাণ বিসর্জন হবে না, বরং আমরা লাভ করব এক নতুন জীবন, যা বর্তমান জীবন থেকে আরো সুন্দর, আরো উন্নত।”
আবু সুফিয়ান নির্দেশ দেয়– “খুঁটির সাথে তাদের বেঁধে ফেল।” “এরা জীবন নয়; মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদনে আগ্রহী।”
বন্দিদ্বয়ের হাত পিছমোড়া করে খুঁটির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে দেয়া হয়। আবু সুফিয়ান ঘোড়া ঘুরিয়ে উপস্থিত জনতার দিকে এগিয়ে যায়।
আবু সুফিয়ান জলদগম্ভীর স্বরে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে উচ্চারণ করে– “উযযা এবং হুবলের কসম!” –“মুহাম্মাদের অনুসারীরা যেরূপভাবে মুহাম্মাদের মহব্বতে হেসে-খেলে জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত অন্য কোন নেতার জন্য তার অনুসারীদের একজনও এমন পাওয়া যাবে না।”
ঘোড়ার পিঠে হিন্দা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার আশে-পাশে কয়েকজন গোলামও ছিল। এক গোলাম মনিবকে খুশি করার জন্য অতি উৎসাহ দেখায়। সে কারো নির্দেশ ব্যতীতই বর্শা হাতে দু’বন্দির দিকে দ্রুত ছুটে যায় এবং খুঁটির সাথে বাঁধা হযরত যায়েদ বিন দাছানা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বুক লক্ষ্য করে এমন প্রচণ্ডবেগে আঘাত করে যে, বর্শার ফলা তাঁর পিঠ ভেদ করে চলে যায়। তিনি তৎক্ষণাৎ শাহাদাত বরণ করেন।
গোলামটি ধন্যবাদ পাবার জন্য বুক ফুলিয়ে জনতার দিকে তাকায়। কিন্তু তারা ধন্যবাদ না দিয়ে চরম হৈ চৈ শুরু করে। আনন্দপ্রেমী দর্শকরা আক্ষেপ করে বলে, এটা আকর্ষণীয় কোন কিছু হল না। নিহত মুসলমান এমন সহজ মৃত্যুর উপযোগী ছিল না। আমরা আকর্ষণীয় কিছু দেখতে চাই।
“এত সহজে যে গোলাম এক মুসলমানকে হত্যা করল তাকে হত্যা কর।” উত্তেজিত কণ্ঠে হিন্দা বলে।
কয়েকজন তরবারি এবং বর্শা ঘুরাতে ঘুরাতে এ গোলামের দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু অপর কয়েকজন গোলামের সামনে এসে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
“খবরদার! সামনে এগুবে না।” অশ্বারোহী এক ব্যক্তি হুঙ্কার ছেড়ে বলে– “আরবের রক্ত এত শীতল নয় যে, দু’ব্যক্তিকে বেঁধে হত্যা করতে কুরাইশরা সকলে এসে জমায়েত হয়েছে। খোদার শপথ! আবু সুফিয়ানের স্থানে আমি হলে বন্দিদ্বয়কে মুক্ত করে দিতাম। এরা তো আমাদেরই রক্ত, আমাদেরই অতিথি। তাদের সাথে লড়তে হলে ময়দানে নেমেই লড়ব।”
“ঠিক! ঠিক!” জনতার ভীড় ফাঁক করে একাধিক আওয়াজ আসে– “দুশমনকে বাঁধা অবস্থায় কতল করা আরবের নীতি বিরুদ্ধ কাজ।”
সমবেত জনতার মধ্য থেকে অসংখ্য আওয়াজ এমন আসে যে, আমরা আকর্ষণীয় কিছু দেখতে চাই। আমরা শত্রুকে এমনভাবে হত্যা করতে চাই, যেন সে মরতে মরতে বাঁচে।”
কিছুক্ষণ পর জনতা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগে হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু এর হত্যার বিরোধী ছিল। কারণ, তারা এভাবে হত্যা করাকে আরব নীতির বিরুদ্ধ মনে করে। দ্বিতীয় ভাগটি হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে হত্যার জোর শ্লোগান তোলে। খালিদ জনতাকে এভাবে দু’ভাগে বিভক্ত হতে এবং একদল অপর দলের বিপক্ষে শ্লোগান দিতে দেখে দ্রুত আবু সুফিয়ানের কাছে চলে যায়।
খালিদ বলেন– “দেখেছ আবু সুফিয়ান! “দেখেছ এখানে আমার কত সমর্থক লোক রয়েছে। একজনকে হত্যা করেছ, এখন অপরজনকে মুক্ত করে দাও। অন্যথায় কুরাইশদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
হিন্দা আবু সুফিয়ানের কাছে খালিদকে দাঁড়ানো দেখে বুঝে ফেলে যে, সে খুবাইবের মুক্তির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। হিন্দা দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে তাদের কাছে এসে হাজির হয়।
হিন্দা কঠোর ভাষায় বলে – “খালিদ!” –“আমি জানি তুমি কি চাও। আবু সুফিয়ানকে তুমি নেতা বলে স্বীকার কর না? না করলে এখান থেকে চলে যাও। আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবেই।”
আবু সুফিয়ান বলে, “খালিদ!” আমার সিদ্ধান্ত সঠিক না হলেও বাস্ত বায়িত হতে দাও। এখন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিলে সেটা হবে আমার দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। এরপর মানুষ আমার প্রতিটি নির্দেশের সাথে সাথে তা প্রত্যাহারেরও ধারণা রাখবে।
মদীনার যাত্রা পথে এসব স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে তার আফসোসও হয় যে, তিনি কেন সেদিন আবু সুফিয়ানের সিদ্ধান্ত মেনে নেন। খালিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গুণ ছিল সু-শৃঙ্খল সৈন্য পরিচালনা ও নেতার প্রতি আনুগত্য। সেদিন তিনি বুকে পাথর বেঁধে আবু সুফিয়ানের সিদ্ধান্ত শুধু এ কারণে মেনে নেন যে, যাতে কুরাইশদের মধ্যে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ধারা তার থেকে চালু না হয়।
“মক্কাবাসী!” দু’শিবিরে বিভক্ত জনতাকে লক্ষ্য করে আবু সুফিয়ান উচ্চকণ্ঠে বলে– “দু’জন মুসলিম হত্যার প্রশ্নে যদি এখানে আমরা এভাবে দু’শিবিরে বিভক্ত হয়ে যাই, তাহলে রণাঙ্গনেও কোন সাধারণ ব্যাপার নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যেতে পারি। তখন শত্রুদেরই বিজয় হবে। যদি নেতার আনুগত্য করতে এভাবে সরে যাও তাহলে তোমাদের পরিণাম হবে ভয়াবহ।”
জনতার হৈ চৈ ও উত্তেজনা হ্রাস পায়। তবে কয়েক নেতাকে মুখ ভার করে ফিরে যেতে দেখে সে। নেতাদের পিছু পিছু অনেক দর্শকও বাড়িতে চলে যেতে থাকে।
অবশ্য খালিদও এখানে থাকতে সম্মত নন। ঘটনা গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নেয়ার আশঙ্কা করছিলেন তিনি। তার কওমের অনেক লোক দর্শক হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিল। গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিলে তিনি অন্তত নিজ কওমের লোকদের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন।
হিন্দা বিনোদনের সকল ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করে রাখে। তার হাতের ইশারায় বর্শা হাতে চল্লিশজন অল্পবয়স্ক বালক হৈ চৈ করতে করতে দৌড়ে জনতার ভীড় থেকে বের হয় এবং হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পাশে গিয়ে তাকে ঘিরে নাচতে থাকে। কয়েকজন বালক বর্শা নিয়ে হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত গিয়ে বর্শা উঁচু করে নিক্ষেপ করত। কিন্তু বর্শা তাঁকে আঘাত করার পূর্বেই আবার হাত গুটিয়ে নিত। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু চমকে উঠে শ্লোগান দিয়ে উঠতেন– “আমার আল্লাহ্ সত্য এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।”
একদলের পর আরেকদল এসে এমন ভঙ্গিতে হামলা করত যেন এখনই হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দেহ চালনী হয়ে যাবে। কিন্ত তারা আঘাত মাঝপথেই ফিরিয়ে নিতে থাকে। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু বারংবার চমকে উঠায় উপস্থিত জনতা বালকদের ধন্য ধন্য করে ওঠে এবং খিল খিল করে হাসতে থাকে।
বালকদের এ খেলা কিছুক্ষণ চলতে থাকে। দ্বিতীয় পর্বে এসে তারা এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে যে, বর্শা এভাবে মারে যে, বল্লমের ফলা হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর চামড়া সামান্য ভেদ করে। দীর্ঘক্ষণ এ ধারা চলতে থাকে। দর্শকরা ধন্যবাদ জানাত আর হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু “আল্লাহ আকবার”, “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” বলতে থাকেন। এরই মধ্যে হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পরিধেয় বস্ত্র রক্তে লাল হয়ে যায়।
আবু জেহেল তনয় ইকরামা বর্শা হাতে বালকদের কাছে যায় এবং তাদেরকে বিভিন্ন কলা-কৌশল শিখাতে থাকে। বালকেরা এবার বর্শার ফলা হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শরীরে আমূল বিদ্ধ করতে থাকে। তারা বৃত্তাকারে নেচে-গেয়ে বল্লম বিদ্ধ করছিল। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর শরীর বর্শার আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। দেহের এমন কোন স্থান ছিল না, যেখানে বর্শা বিদ্ধ হয়নি এবং সেখান থেকে রক্ত টপটপ করে পড়েনি। মুখমণ্ডলেও বর্শার আঘাত করা হয়। অনেকক্ষণ ধরে ছেলেরা এভাবে নাচতে নাচতে এবং বর্শা মারতে মারতে হাফিয়ে উঠলে তখন ইকরামা এসে তাদের দূরে সরিয়ে দেয়। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন রক্তস্নাত। দেহে তখনও প্রাণ ছিল। চোখ ঘুরিয়ে চতুর্দিকে নজর বুলাচ্ছিলেন। শত জখমের মাঝেও মুখে শ্লোগান ঠিকই অব্যাহত ছিল। ইকরামা এবার তাঁর বরাবর এসে দাঁড়ায় এবং বর্শা উঁচু করে হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বুকে তীব্র বেগে আঘাত করে। ব্যবধান কম থাকায় বর্শা তার বক্ষ এফোঁড়-ফোড় করে দেয়। তিনি শহীদ হয়ে যান।
♣♣♣
৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের এক নৃশংস ঘটনা। অতীত এ ঘটনা স্মরণ হওয়ায় খালিদ হৃদয়ে এক গভীর বেদনা অনুভব করেন। হযরত খুবাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হত্যা কুরাইশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করছিল। শেষবারের মত তাদের নামায আদায় এবং ইসলাম ত্যাগের উপর মৃত্যুকে অগ্রাধিকার দান কুরাইশদের কয়েক সর্দারের অন্তরে গভীর দাগ কাটে। স্বয়ং খালিদ মনে মনে হযরত খুবাইব ও হযরত যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। মূলত এ ঘটনা থেকেই আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী হিন্দার প্রতি তার হৃদয়ে অসম্মান ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
খালিদ মনে মনে বলেন– “এটা বীরের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য নয়”, “এটা কাপুরুষোচিত আচরণ, বীরের ক্ষেত্রে অশোভনীয়।”
যে সমস্ত কুরাইশ নেতারা শহীদ সাহাবীদ্বয়ের হত্যার বিরোধী ছিল তাদের আহূত এক বৈঠকে খালিদ হাজির ছিলেন।
“আপনারা জানেন কি, সেদিন যাদেরকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হল, তারা মাত্র দু’জন ছিলেন না; বরং ছয়জন ছিলেন?” খালিদ নেতৃবৃন্দকে জিজ্ঞেস করেন।
এক নেতা জবাবে বলে “হ্যাঁ”, “এটা শারযা বিন মুগীছের কারসাজি ছিল। সে-ই এই ছয় মুসলমানকে প্রতারণাপূর্বক ফাঁদে ফেলে।”
“আর এর পিছনে মক্কার ইহুদীদের মস্তিষ্ক কাজ করে। খালিদ বলেন, ইউহাওয়া নাম্নী এক মহিলার সাথে আরও দু’তিন ইহুদী নারী নিয়ে গিয়ে তাদেরকে রূপের জাদুতে ঘায়েল করে।”
এক নেতা মন্তব্য করে– “ইউহাওয়া একজন জাদুকর মহিলা।”, “সে ইচ্ছা করলে ভাইকে ভাইয়ের হাতে খুন করাতে পারে।”
“এটা কি ভয়ের কারণ নয় যে, ইহুদীরা আমাদের একে অপরের দুশমনে পরিণত করবে?” আরেক নেতা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলে।
“না।” এক বয়োবৃদ্ধ নেতা বলে– “ইহুদীরা আমাদের মতই মুহাম্মাদের শত্রু। ইহুদীদের স্বার্থ নিহিত যে, তারা আমাদের আর মুসলমানদের মধ্যে বৈরীতা এত তীব্র করবে, যাতে আমরা মুসলমানদের নাম-নিশানা মিটিয়ে দিই।”
“এই মুহূর্তে ইহুদীদের প্রতি সন্ধিহান হওয়া উচিত হবে না।” এ নেতা বলে– “বরং উচিত হল, গোপনে ইহুদীদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা।”
“তবে সেটা এমন নয়; যেমনটি শারযা করেছে।” খালিদ বলেন– “আবার এমন নয়, যেমনটি দেখিয়েছে আবু সুফিয়ান এবং তার স্ত্রী।”
“এ খবর কেউ রাখ কি যে, ইউহাওয়া মক্কার কয়েকজন ইহুদীকে নিয়ে মদীনায় গেছে?” প্রবীণ নেতা অন্যান্যদের এ কথা জিজ্ঞেস করে নিজেই আবার বলে– “সে মদীনা ও মদীনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ইহুদী এবং অন্যান্য গোত্রকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে। ইহুদীরা ইসলামের প্রচার-প্রসারকে ‘ঈশান কোণে কালো মেঘ’ মনে করছে। যদি এভাবে মুহাম্মাদের আকীদা-বিশ্বাস প্রসারিত হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে মুহাম্মাদের অনুসারীরা বীরত্বের ধারা অব্যাহত রাখে, তাহলে ইহুদীদের সূর্য নিঃসন্দেহে ডুবে যাবে।”
খালিদ বলেন– “কিন্তু ইহুদীরা তো যুদ্ধবাজ জাতি নয়, তারা যুদ্ধের মাঠে আমাদের পাশে থাকার যোগ্য নয়।”
“যুদ্ধের মাঠে তারা মুসলমানদের জন্য বেশি ভয়ঙ্কর প্রমাণিত হবে।” আরেকজন মন্তব্য করে– “তারা ইউহাওয়ার ন্যায় আকর্ষণীয় ললনাদের মাধ্যমে মুসলিম নেতা এবং অধিনায়কদেরকে রণাঙ্গনে অবতরণের যোগ্যতা রাখবে না।”
খালিদের চিন্তা-চেতনায় ইউহাওয়া আবার চরে বসে এবং চার বছর পূর্বের কথা তার কানে গুঞ্জন হতে থাকে। তিনি মদীনার দিকে যতই অগ্রসর হন, উহুদের পাহাড় ততই মাথা উঁচু করে দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। অতঃপর এক সময় পাহাড়গুলো এক এক করে চোখের দৃষ্টি হতে হারিয়ে যেতে থাকে। তার ঘোড়াটি গিরিপথ অতিক্রম করছিল। এটা এক মাইল দৈর্ঘ্য এবং ২২০ গজ বা তার চেয়ে কিছু বেশি চওড়া একটি বিস্তৃত নিম্নাঞ্চল। গম্ভুজের অনেক টিলা এর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। এগুলোর সবাই বালু মাটির। এক স্থানে এসে খালিদ কার যেন পদধ্বনি শুনতে পান তিনি চমকে পিছনে ফিরে তাকান এবং হাত চলে যায় তরবারির বাটে। কিন্তু এ আওয়াজ মানুষের পদধ্বনি ছিল না। চার-পাঁচটি হরিণ ছিল, যারা নিচের দিকে দৌড়ে যায়। কিছুদূর গিয়ে একটি হরিণ আরেকটি হরিণকে গুতো মারে। এতে একে অপরের মোকাবিলা করতে শুরু করে। কিছুক্ষণ শিংয়ে-শিংয়ে দুই হরিণের লড়াই চলে। অন্যান্য হরিণগুলো দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতে থাকে।
এত সুন্দর প্রাণীর এভাবে লড়াই করাটা ভাল মানায় না। খালিদ তবুও দেখতে থাকেন। তার অশ্বটি এক দর্শক হরিণের চোখে পড়ে যায়। সে সাথে সাথে গলা লম্বা এবং পা দ্বারা মাটিতে আঘাত করতে থাকে। লড়াইরত হরিণদ্বয় যে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় থেমে যায়। মুহূর্তে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সকল হরিণ এক দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায় এবং খালিদের চোখের আড়ালে চলে যায়।
কুরাইশ নেতারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। পরস্পরের মধ্যে বৈরীতা সৃষ্টি না হলেও পূর্বের মত একতা, আন্তরিকতা ও হৃদ্যতা ছিল না। সবাই তখনও বাহ্যিকভাবে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্ব মেনে চলছিল। কিন্তু ভিতরে অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। যখন সিসাঢালা ঐক্য প্রয়োজন তখন তারা দ্বিমুখী আচরণ শুরু করে। এ অবস্থা খালিদ কে অত্যন্ত বেদনাহত করে।
“নিজেদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হলে তা শত্রুদের শক্তি বৃদ্ধি করে” খালিদ একদিন আবু সুফিয়ানকে বলেন– “অনৈক্যকে ঐক্যে রূপ দেয়ার উপায় নিয়ে কখনও ভেবেছো কি?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবু সুফিয়ান বলে– “অনেক ভেবেছি খালিদ। পূর্বের ন্যায় সকলেই এখনও আমার সাথে উঠা-বসা এবং কথাবার্তা বললেও অনেকের অন্তর আমার নিকট পরিষ্কার মনে হচ্ছে না।… এমন কোন উপায় উদ্ভাবন করতে পার যা অন্তরের পঙ্কিলতা দূরীভূত করে দেয়?”
খালিদ বলেন– “হ্যাঁ, আমার মাথায় একটি উপায় রয়েছে।” “নেতাদের অন্তরে ফাটল সৃষ্টি হওয়ার আসল কারণ, হচ্ছে তাদের ভুল ধারণা। তারা ভাবছে, আমরা এখন কাগুজে বীর। আমাদের হৃদয় মুসলমানদের ভয়ে ভীত। বিশেষ করে শারযা ধোঁকা দিয়ে ছয়জন মুসলমানকে এনে এবং তাদের দু’জনকে আমাদের হাতে হত্যা করিয়ে আমাদের ঐতিহ্যকেই যেন বদলে দিয়েছে। এর প্রতিবিধান আমার মতে এভাবে করা যেতে পারে যে, আমরা হয়ত মদীনা আক্রমণ করব নতুবা মুসলমানদেরকে কোন রণাঙ্গনে আহ্বান করে আমরা প্রমাণ করব যে, আমরা কাগুজে বীর নই, আমরা প্রকৃতই বীর। মুসলমানদের মূলোৎপাটন না করা পর্যন্ত আমাদের এ যুদ্ধসাজ থাকবেই।”
“আমাদের কাছে এর যুক্তিও রয়েছে।” আবু সুফিয়ান গদ গদ কণ্ঠে বলে– “উহুদ যুদ্ধ শেষে আমি মুহাম্মাদকে আহ্বান করে বলেছিলাম, বদরে পরাজয়ের প্রতিশোধ আমরা উহুদে নিয়েছি। আমি তাকে আরো বলেছিলাম, কুরাইশদের অন্তরে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতেই থাকবে। আগামী বছরেই আমরা তোমাদেরকে বদর প্রান্তরে ডাকব।”
খালিদ বলেন– “হ্যাঁ, মনে আছে।” “ওমর জবাবে বলেছিল, আমাদেরও ইচ্ছা যে, আমাদের এবং তোমাদের মধ্যে পরবর্তী সাক্ষাৎ বদরেই হোক।”
আবু সুফিয়ান বলে– “ঘোষণা ওমর করলেও কথাগুলো কিন্তু মুহাম্মাদেরই।” “মুহাম্মাদ মারাত্মক আহত ছিল। জোরে কথা বলার শক্তি তার ছিল না।… আমি এখনই মুহাম্মাদের কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠাচ্ছি যে, অমুক দিন বদর প্রান্তরে এস; দেখবে যুদ্ধ কাকে বলে।”
অতঃপর উভয়ে পরামর্শক্রমে একটি দিনক্ষণ ধার্য করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ ব্যাপারে জানাতে কোন ইহুদীকে মদীনায় পাঠানো হবে।
পরের দিন আবু সুফিয়ান কুরাইশের সকল নেতৃবৃন্দকে তার বাসভবনে ডেকে এনে বড় উচ্ছ্বাস ও আনন্দের সাথে ঘোষণা করে যে, সে মুসলমানদেরকে যুদ্ধের জন্য বদরে আহ্বান করছে। কুরাইশরা এমন একটি সংবাদ শুনতে অপেক্ষায় ছিল। আত্মীয়-স্বজনের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। তাদের অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি বৈরীতা বারুদের ন্যায় উত্তপ্ত ছিল, যা একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের অপেক্ষায় ছিল। তাদের ক্ষোভের মূল কারণ, মুহাম্মাদ পিতা-পুত্র এবং ভাই-ভাইকে পরস্পরের দুশমনে পরিণত করেছে।
আবু সুফিয়ানের এই ঘোষণা সবাইকে এক প্লাটফর্মে এনে দাঁড় করায়। সব ধরনের মন-মালিন্য দূর করে দেয়। সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে যুদ্ধ প্রস্তুতির আলোচনা করে। এক বিচক্ষণ ইহুদীর উপর বার্তা প্রেরণের দায়িত্ব অর্পণ করে বলা হয়, সে যেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বার্তা হস্তান্তর করে এবং দ্রুত ফিরতি উত্তর নিয়ে আসে।
কুরাইশ নেতৃবৃন্দের অন্তর থেকে যেদিন পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনৈক্যের পর্দা দূর হয় সেদিন খালিদ মনে মনে খুবই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। তিনি বাগাড়ম্বরী ছিলেন না, তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিজ হাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কতল করবেন।
ইহুদী দূত সংবাদ নিয়ে আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানের প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেছেন। ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের একটি দিন যুদ্ধের জন্য নির্ধারিত হয়। কিন্তু আবহাওয়া বাঁধার কারণ হয়। মৌসুমে সাধারণত যতটুকু বৃষ্টি হত এ বছর তার থেকে অনেক কম হয়। যার ফলে মৌসুমটি এক প্রকার ভীষণ খরার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। মার্চ মাসেই প্রচণ্ড গরম পড়ে, যা অন্য বছর আরো ২/৩ মাস পড়ে হয়। আবু সুফিয়ান তাই পূর্ব নির্ধারিত দিনে যুদ্ধ করা সমীচীন মনে করে না।
স্মৃতির এ হিসাবটি তাকে লজ্জিত করে। কেননা আবু সুফিয়ান গ্রীষ্ম মৌসুমের ছুতায় যুদ্ধ বিলম্ব করেছিল।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে সা’দ লিখেন, আবু সুফিয়ান কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে একত্র করে বলে, সে সৈন্য পাঠানোর আগে মুসলমানদের ভীত-সন্ত্রস্ত করতে চায়। সে এ লক্ষ্যে ইহুদীদের হাত করে এবং দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিয়ে ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে তাদেরকে মদীনায় প্রেরণ করে। তাদের দায়িত্ব ছিল, মদীনায় গিয়ে এই গুজব রটিয়ে দেয়া যে, কুরাইশরা বিশাল বাহিনী নিয়ে বদরে আসছে, যা ইতোপূর্বে মুসলমানরা কখনো দেখেনি।
এক ঐতিহাসিকের বর্ণনা মতে মদীনায় এই গুজবকে সত্য বলে বিশ্বাস করা হয় এবং মুসলমানদের চেহারাতে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত এই গুজব পৌঁছলে এবং তাকে সাহাবায়ে কেরামের ভীতির কথা জানানো হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে একত্র করে এক হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দেন–
“সংখ্যায় বেশির কথা শুনে আল্লাহর সৈনিকরা এত ভীত কেন? আল্লাহ্ পূজারীরা কি আজ মূর্তি-পূজারীদের ভয়ে সন্ত্রস্ত? যদি তোমরা কুরাইশদের ভয়ে এত ভীত হয়ে পড় যে, তাদের যুদ্ধ– আহ্বানে সাড়া দেয়ার হিম্মত না হয়, তাহলে যে সত্তা আমাকে রাসুল করে প্রেরণ করেছেন তাঁর নামে শপথ করে বলছি, কেউ না গেলেও আমি একাই তাদের মোকাবিলায় বদরে যাব।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুক্ষণ থেমে আরো কিছু বলতে চান; কিন্তু রাসূল-প্রেমিকদের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করা আবেগ-উত্তেজনাকর শ্লোগানে ঘুমন্ত মরু সিংহের দল জেগে ওঠে। ছড়ানো গুজবের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এক ভাষণেই গুজবের প্রতিক্রিয়া দূরীভূত হয়ে যায়। এবং মুসলমানরা সানন্দে যুদ্ধ-প্রস্তুতি নিতে থাকে। হাতে সময় ছিল কম। সীমিত এ সময়ের মধ্যেই তারা যথাসম্ভব প্রস্তুতি নেয়। সৈন্যরা যখন বদর অভিমুখে রওনা হয় তখন তাদের সংখ্যা ছিল দেড় হাজার। আর ছিল পঞ্চাশ জন অশ্বারোহী।
গুজব ছড়ানোর দায়িত্ব দিয়ে যে সমস্ত ইহুদীকে মদীনায় প্রেরণ করা হয়, তারা ফিরে এসে প্রতিবেদন দেয় যে, প্রথমে গুজব আশাতীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কিন্তু একদিন মুহাম্মাদ মুসলমানদের সমবেত করে কয়েকটি কথা বলতেই সবাই এক পায়ে বদরে যেতে তৈরি হয়ে যায়। মদীনায় আমরা থাকা কালেই তাদের সংখ্যা দেড় হাজার পৌঁছেছিল। যতটুকু ধারণা এ সংখ্যা কমবেশী হবে না।
আজ মদীনা যেতে যেতে সে ঘটনা স্মরণ হওয়ায় খালিদ-এ জন্য লজ্জিত হন যে, তিনি সেদিন অনুমান করেন যে, আবু সুফিয়ান নাম মাত্র অজুহাতে মুসলমানদের মোকাবিলা থেকে পিছু থাকতে চায়। খালিদ মুসলমানদের সংখ্যা সম্পর্কে জানতে পেরে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আবু সুফিয়ানের কাছে আসেন।
হযরত খালিদ বলেন– “আবু সুফিয়ান!” “নেতার আনুগত্যের ব্যাপারে আমরা শ্রদ্ধাশীল। আমি কুরাইশদের মাঝে নেতার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ধারা চালু করতে চাই না। কিন্তু তাই বলে কুরাইশ জাতির মান-মর্যাদা জলাঞ্জলী দিতে পারি না। আপনি আপনার অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করুন। কুরাইশদের মান-মর্যাদার প্রশ্নটি আমার অন্তরে তীব্রভাবে উজ্জীবিত হবে, যার ফলে আপনার নির্দেশ মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এমনটি যেন না হয়।”
আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করে– মদীনায় ইহুদীদের পাঠানোর কারণ তুমি জান না?” “যুদ্ধের আগে আমি মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাই..।”
হযরত খালিদ তার কথা শেষ না হতেই বলে উঠেন – “আবু সুফিয়ান!” “প্রকৃত যোদ্ধারা কখনও ভয় দেখায় না। মাত্র কয়েকজন মুসলমানকে লড়তে আপনি দেখেন নি? কুরাইশদের শত বর্শাঘাতের মুখে খুবাইব ও যায়েদকে তাকবীরধ্বনি দিতে শুনেন নি?… আমি শুধু এ কথাই বলতে এসেছি যে, আপন নেতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা করুন এবং বদরে রওনা হওয়ার বাস্তব উদ্যেগ নিন।
♣♣♣
পরদিনই ফলাও হয়ে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, মুসলমানরা যুদ্ধ সামগ্রী নিয়ে মদীনা থেকে বদর অভিমুখে যাত্রা করেছে। সৈন্যদের রওয়ানা করার নির্দেশ ব্যতীত এরপর আবু সুফিয়ানের জন্য বিকল্প কোন রাস্তা খোলা ছিল না। সর্বমোট কুরাইশ সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় দুই হাজার পদাতিক আর একশ অশ্বারোহী। সেনাপতির দায়িত্ব ছিল আবু সুফিয়ানের হাতেই। ইকরামা, সফওয়ান এবং খালিদ ছিলেন আবু সুফিয়ানের উপসেনাপতি। পূর্বের ন্যায় এবারও আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা, কতিপয় দাসী এবং সঙ্গীত শিল্পীরা সৈন্যদের সাথে থাকে।
৬২৬ খিষ্টাব্দের ৪ঠা এপ্রিল, বুধবার। পূর্ব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মুসলিম বাহিনী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে বদর ময়দানে পৌঁছে যান।
এ সময় কুরাইশরা আসফান নামক স্থানে এসে উপস্থিত হয়। তারা সেখানেই রাত যাপন করে। ভোরেই তাদের সম্মুখে এগিয়ে যাবার কথা কিন্তু পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আবু সুফিয়ান সকালে সৈন্যদের সম্মুখে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেয়ার পরিবর্তে এক স্থানে জমা করে বলেন–
“কুরাইশ বাহাদুরগণ! মুসলমানরা তোমাদের নাম শুনতেই আঁৎকে ওঠে। এটা হবে তাদের সাথে আমাদের চূড়ান্ত যুদ্ধ। মুষ্টিমেয় মুসলমানকে আমরা নিশ্চিহ্ন করে দেব। এরপরে দুনিয়ার বুকে কোন মুহাম্মাদ থাকবে না, থাকবে না তাকে স্মরণ করার কেউ। কি যে অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যুদ্ধে চলেছি, তা আমাদের অনুকূল নয়। যা আমাদের পরাজয় ডেকে আনতে পারে। তোমরা জান, রসদ পত্র আমরা পরিমিত আনতে পারিনি। সম্মুখে রসদ পাবার সম্ভাবনাও নেই।স্মরণকালের ভয়াবহ খরা দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তারপরে রোদ্রের প্রখরতা তো আছেই। আমি আমার বীর-বাহাদুর ভাইদেরকে ক্ষুধা-পিপাসায় তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না; আমি চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য সুযোগের অপেক্ষা করব। আমি সম্মুখে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিব না; বরং মক্কায় ফিরে চল।”
হযরত খালিদের মনে পড়ে, আবু সুফিয়ানের ভাষণের পর সৈন্যদের মধ্যে হতে দু’ধরনের শ্লোগান ওঠে। এক অংশ তার মনের কথার প্রতিধ্বনি করছিল যে, আমরা এ অবস্থায়ই মুসলমানদের মোকাবিলা করব। অপর অংশ আবু সুফিয়ানের সিদ্ধান্তকেই মেনে নেয়। প্রত্যাবর্তনের এই নির্দেশ ছিল স্বয়ং প্রধান সেনাপতির। তাই সবার জন্য তার আদেশই ছিল শিরোধার্য। কিন্তু খালিদ, ইকরামা এবং সফওয়ান আবু সুফিয়ানের এ নির্দেশ মানতে রাজি নয়। কিন্তু আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে তাদের এই বিদ্রোহ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহী তিন উপসেনাপতি সৈন্যদের উপর তাৎক্ষণিক এক জরীপ চালিয়ে তাদের পক্ষে কতজন আছে তা জানতে চেষ্টা করে। কিন্তু এ জরীপের ফলাফলও তাদের বিরুদ্ধে যায়। অধিকাংশ সৈন্য আবু সুফিয়ানের নির্দেশে মক্কায় ফেরত যায়। ফলে বাধ্য হয়ে বিদ্রোহীরাও সমমনা সৈন্যদের নিয়ে আবু সুফিয়ানের বাহিনীর পিছু পিছু চলে আসতে হয়।
হযরত খালিদের স্পষ্ট মনে পড়ে, সেদিন এভাবে মক্কায় ফিরে আসার সময় তার মস্তক ছিল অবনত। উপসেনাপতিদের কেউ একে অপরের প্রতি তাকাবার অবস্থা ছিল না। লজ্জা যেন সকলকে গ্রাস করে নিয়েছিল। হযরত খালিদের বারবার মনে হচ্ছিল। যুদ্ধে যদি তার একটি পা, বা একটি হাত দু’টি চোখ নষ্ট হয়ে গেলে তেমন দুঃখ হত না, যেমনটি আজ বিনা যুদ্ধে প্রত্যাবর্তনের কারণে হচ্ছে। তিনি অনুভব করেন, তার অস্তিত্ব বলতে এতদিন যা কিছু ছিল তা মৃত্যুবরণ করেছে। এখন অশ্ব পৃষ্ঠে তাঁর মরদেহ মক্কায় ফিরে যাচ্ছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হত্যা ছিল তার প্রধান টার্গেট; যা পূরণ না করে সে ফিরে চলছে। এই ব্যর্থতাই তাকে অব্যাহতভাবে দংশন করে চলছিল।
খালিদের অতীত ছিল স্মৃতির অভিধান। যার বর্ণনা শেষ হবার নয়। বনূ নযীর, বনু কুরাইজা এবং বনূ কায়নুকা তিন ইহুদী গোত্রের কথা তার স্মরণ হয়। তারা কুরাইশদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। কিন্তু আবু সুফিয়ান তাদের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয় নি। খালিদ চিন্তা করে আবিষ্কার করতে পারেননি যে, আবু সুফিয়ানের দুরভিসন্ধি কি? মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম শুনে তার এই ঘাবড়ানোর কারণ কি?
চলতি বছরেরই শীত মৌসুমের শুরুতে খায়বারের কতক ইহুদী মক্কায় যায়। তাদের নেতার নাম হুয়াই বিন আখতার। এ লোকটি ইহুদী গোত্র বনু নষীরের নেতাও ছিল। ইহুদীরা ছিল প্রচুর স্বর্ণ-রৌপ্যের মালিক। এই ইহুদী দলটি আবু সুফিয়ান ও অন্যান্য কুরাইশ নেতৃবৃন্দের জন্য মূল্যবান উপহার সামগ্রী নিয়ে যায়। সাথে ছিল সুন্দরী-রূপসী ললনা।
ইহুদীরা মক্কায় প্রথমে আবু সুফিয়ানের সাথে দেখা করে। তাকে মূল্যবান উপহার প্রদান করে এবং রাতে নৃত্যশিল্পীদের দ্বারা মনোজ্ঞ নৃত্য পরিবেশন করেও দেখায়। এরপর হুয়াই বিন আখতার খালিদ, ইকরামা ও সফওয়ানের উপস্থিতিতে আবু সুফিয়ানকে বলে তারা যদি এখনই মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন না করে এবং তাদের অগ্রসরমান যাত্রার গতিরোধ না করে তাহলে ইয়ামামাকেও একদিন তারা দখল করে নিবে। আর তাদের পা একবার ইয়ামামার মাটি স্পর্শ করতে পারলে, তখন আপনাতেই বাহরাইন ও ইরাক মুখী কুরাইশদের বাণিজ্যের রাস্তাও চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে। বাণিজ্যের এ রাস্তাটি ছিল কুরাইশদের শাহরগ এবং অর্থনীতির প্রতীক।
হুয়াইবিন আখতার বলে– “আপনারা যদি আমাদের সাথে থাকেন।”, “তাহলে আমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি।”
আবু সুফিয়ান বলে– “আমরা সংখ্যায় দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদেরকে পরাস্ত করতে পারিনি, তিনগুণ বেশি হলেও তাদের পরাস্ত করা সম্ভব নয়। কিছু গোত্র আমাদের সাথে এসে যোগ দিলেই কেবল আমরা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে পারি।”
হুয়াই বিন আখতার বলে– “এ ব্যবস্থা আমরা ইতোমধ্যেই করে রেখেছি, গাতফান এবং বনু আসাদ গোত্র আপনাদের সাথে থাকবে। আমাদের প্রচেষ্টার ফলে আরো কয়েকটি গোত্র আপনাদের সঙ্গে চলে আসবে।”
খালিদের স্মৃতির আয়নায় কোন কিছুই অস্পষ্ট নয়। বিগত দিনের সব কিছুই তার স্মৃতিপটে ভাসতে থাকে। তার মনে পড়ে আবু সুফিয়ানের ভীতু চেহারা। আবু সুফিয়ান ভাল করেই জানতেন, কুরাইশদেরকে এভাবে উত্তেজিত করার পেছনে ইহুদীদের বড় স্বার্থ হল, তারা ইসলামের উত্থানকে ইহুদীবাদের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ বলে আশঙ্কা করত। কিন্তু চতুর ইহুদীরা এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে আবু সুফিয়ানের কাছে এমন চিত্র তুলে ধরে, যার মধ্যে মুসলমানদের হাতে কুরাইশদের ধ্বংস ছিল ভোরের আলোর ন্যায় স্পষ্ট। তাছাড়া আবু সুফিয়ানের উপর খালিদ, ইকরামা এবং সফওয়ানের ক্রমবর্ধমান চাপও ছিল উল্লেখযোগ্য।
ঋতুচক্রের প্রতিকূলতা এবং দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও যদি মুসলমানরা যুদ্ধ করতে পারে তাহলে আমরাও যুদ্ধ করতে পারতাম।”
“আপনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমাদেরকে প্রতারিত করেছেন।”
আবু সুফিয়ান ভীরু…। সে পুরো গোত্রকেই কাপুরুষ বানিয়েছে।
এখন মুহাম্মাদের অনুসারীরা আমাদের মাথার উপর লাফিয়ে পড়বে।”
এ জাতীয় তিরস্কার ও বিদ্রুপাত্মক বিভিন্ন কথাবার্তা শহরের অলি-গলিতে ফলাও হয়ে প্রচারিত হতে থাকে। এ আওয়াজ উঠার পেছনে ইহুদীদের হাত ছিল। কিন্তু কুরাইশদের স্বকীয়তা এবং প্রতিশোধ স্পৃহা তাদেরকে অস্থির করে তোলে আবু সুফিয়ানের অবস্থা এতই নাজুক হয়ে পড়ে যে, তিনি বাইরে বের হওয়াই ছেড়ে দেন।
খালিদের ঐ দিনের কথা স্মরণ হয় যেদিন আবু সুফিয়ান তাকে তার বাসভবনে ডেকে পাঠায়। আবু সুফিয়ানের প্রতি একদিন যে শ্রদ্ধা ও মর্যাদাবোধ তার অন্তরে ছিল তখন তা ছিল না। আবু সুফিয়ান যেহেতু তখনও সর্বোচ্চ নেতার আসনে সমাসীন ছিল তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন। তিনি সেখানে গিয়ে ইকরামা ও সফওয়ানকে দেখতে পান।
আবু সুফিয়ান বলে–“খালিদ! আমি মদীনায় হামলা করার স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” খালিদের মনে হয়েছিল, তিনি যেন ভুল শুনছেন। বিস্মিত নয়নে ইকরামা এবং সফওয়ানের দিকে তাকান। তাদের উভয়ের ঠোঁটে ছিল মুচকি হাসি।
আবু সুফিয়ান বলে–“হ্যাঁ, খালিদ! যত দ্রুত সম্ভব লোকদেরকে মদীনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত কর।”
যে সমস্ত গোত্রকে ইহুদীরা কুরাইশদের সহযোগিতা করতে রাজি করিয়েছিল সে সকল গোত্রের কাছে বার্তা প্রেরণ করা হল।
৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস। এ সময় বিভিন্ন গোত্রের যোদ্ধারা দলে দলে মক্কায় জমায়েত হতে থাকে। গাতফান গোত্রের সৈন্য ছিল বেশি। তারা প্রায় তিন হাজার। মুনিয়া নামক এক ব্যক্তি ছিল তাদের অধিনায়ক। বনূ সালেম ৭০০ সৈন্য প্রেরণ করে। বনূ আসাদও তুলাইহা বিন খুয়াইলাদের নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্য প্রেরণ করে। কুরাইশদের নিজস্ব সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪ হাজার পদাতিক, ৩‘শ অশ্বারোহী এবং দেড় হাজার উষ্ট্রারোহী। অবশেষে ১০ হাজারের বিশাল বাহিনী মদীনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়। আবু সুফিয়ান ছিল এ সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। সে এ বাহিনীর নাম দেয় বহুজাতিক বাহিনী।
কয়েকটি গোত্র মক্কায় আসেনি। তারা খবর পাঠায়, বহুজাতিক বাহিনী মদীনা অভিমুখে যাত্রা করলে তারা পথিমধ্যে মূল বাহিনীর সাথে যোগ দিবে। বহুজাতিক বাহিনীর মদীনাভিমুখে যাত্রা করার ঐতিহাসিক সময়ের কথা খালিদের স্মৃতিতে ভেসে উঠে। এ বিশাল বাহিনীর একাংশের অধিনায়ক খালিদ ছিলেন অপেক্ষাকৃত একটি উঁচু স্থানে। অশ্বপৃষ্ঠে বসে সৈন্যদের দিকে তিনি তাকান। বাহিনী এত বিশাল ছিল যে, শুরু এবং শেষ তার নজরে আসে না। যতদূর দৃষ্টি যায় সৈন্যদের অগ্রযাত্রার দৃশ্যই শুধু দেখতে পান। বিভিন্ন বাদ্য-যন্ত্র, রণ-সঙ্গীত এবং সৈন্যদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস খালিদের রক্তে শিহরণ তুলছিল। তিনি গর্দান সোজা করে মনে মনে বলতে থাকেন, এবার মুসলমানরা নিশ্চয় পিষ্ট হয়ে যাবে। আর ইসলামের অণুকণা আরবের বালুর সাথে একাকার হয়ে চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এটা ছিল তার বদ্ধমূল বিশ্বাস।
৬২৭ খিষ্টাব্দের ২৪শে ফ্রেব্রুয়ারি বহুজাতিক বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে গিয়ে হাজির হয়। উহুদের পূর্ববর্তী অবস্থান স্থলে গিয়ে কুরাইশরা এবারও তাঁবু ফেলে। এটি ছিল বিপরীত দিক দিয়ে আসা দু’টি নদীর মিলন মোহনা। কুরাইশ ব্যতীত অন্যান্য সৈন্যরা উহুদের পূর্বপ্রান্তে শিবির স্থাপন করে।
মদীনাবাসী কুরাইশদের আগমন বার্তা জানে কি-না তা পরীক্ষা করতে তারা দু’গুপ্তচরকে ব্যবসায়ী সাজিয়ে মদীনায় প্রেরণ করে। আবু সুফিয়ানসহ অন্যান্য উপসেনাপতিদের ইচ্ছা ছিল মদীনাবাসীদের অজান্তেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু পর দিনই কুরাইশদের প্রেরিত এক ইহুদী গুপ্তচর মদীনা হতে ফিরে এসে আবু সুফিয়ানকে জানায় যে, মুসলমানরা তাদের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল।
“মুসলমানদের মধ্যে ভয় আর ভীতি এবং উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল।” ইহুদী গুপ্তচর বলে–“সারা শহরে ভয় আর আতঙ্ক ছেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুহাম্মাদ ও তাঁর একান্ত সহযোগিদের বক্তৃতায় মুসলমানরা সীসাঢালা প্রাচীরের মত হয়ে যায়। শহরের অলি-গলিতে ঘোষক যুদ্ধের প্রতি আহবান করে ফিরছে। এতে সবার মধ্যে বিপুল সাড়া জেগেছে। সবাই যুদ্ধ করতে সমবেত হচ্ছে। আমার ধারণা মতে তাদের সংখ্যা তিন হাজারের অধিক হবে না।”
ঐতিহাসিকগণ লিখেন, প্রকৃতই মুসলমানদের সংখ্যা তিন হাজার ছিল। তারা আগেভাগেই জানতে পেরেছিলেন যে, শত্রুবাহিনীর সংখ্যা দশ হাজার। অশ্বারোহী এবং উষ্ট্রারোহীর সংখ্যা অনেক। ইতোপূর্বে আরবের মাটি একসাথে এত লোকের সমাবেশ আর কখনো দেখেনি।
সৈন্যসংখ্যা এবং যুদ্ধাস্ত্রের দিক বিবেচনা করলে যুদ্ধ না করেই মুসলমানদের আত্মসমর্পণ করা কিংবা রাতের অন্ধকারে মদীনা ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকা উচিত ছিল। কেউ ভাবতেও পারে না যে, তিন হাজার মুসলমান দশ হাজার সৈন্যের মোকাবিলায় মুহূর্তের জন্য দাঁড়াতে পারবে। দশ হাজার মানুষ মদীনার ইট একটি একটি করে খুলে নিবে অনায়াসে। কিন্তু এটা ছিল হক ও বাতিলের যুদ্ধ। আল্লাহ্ পূজারী ও মূর্তি পূজারীদের যুদ্ধ। সত্যের বিজয় সুনিশ্চিত করা ছিল অনিবার্য। ঐ মহান আহ্বানের মর্যাদা রক্ষাও ছিল অবশ্যকর্তব্য, যা আল্লাহ্ পাক হেরা গুহায় এক আরব রত্নের মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে সম্প্রচার করেছিলেন এবং তাকে নবুওয়াতের মর্যাদায় বিভূষিত করেছিলেন।
“যারা সত্য এবং সততার উপর থাকে আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন।” মদীনার অলি-গলিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বাণী গুঞ্জন তুলে ফিরছিল– “কিন্তু মনে রেখ, আল্লাহর সাহায্য তখনই লাভ করবে, যখন অন্তর থেকে ভয়-ভীতি দূর করে একে অপরের হাত ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে। এবং আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গের দৃঢ় শপথ করবে। যারা রব হিসেবে একমাত্র আল্লাহকে বিশ্বাস করে না এবং ইসলামের সত্যতা স্বীকার করে না তারা আমাদের দুশমন। তাদেরকে হত্যা করা ফরয। মনে রেখ, আঘাত করতে গেলে অনেক সময় আঘাত খেতেও হয়। ঈমান থেকে শক্তিশালী এমন কোন শক্তি নেই যা শত্রুর হাত থেকে তোমাদেরকে বাঁচাতে পারে। মদীনা নয়, লালিত চেতনা ও ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস রক্ষা করাই এখন প্রধান কাজ। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হলে তখন ১০ হাজারের মোকাবিলা করেও বিজয় ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হবে। হতবল এবং ভীতুদের পক্ষে আল্লাহ পাক কখনো স্বীয় কুদরত প্রদর্শন করেন না। আকীদা রক্ষা এবং স্বীয় ভূখণ্ড রক্ষায় তোমাদেরই সর্বোচ্চ নৈপুণ্য ও বীরত্বের চমক দেখাতে হবে।”
এভাবে ভাষণের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনাবাসীদের মধ্যে বিদ্যুৎপ্রবাহ সঞ্চার এবং তাদের সাহস এমন পর্বতসম করে দেন যে, তারা এর চেয়েও বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করতে তৈরী হয়ে যায়। আগত বিশাল জনস্রোতের হাত থেকে মদীনাকে রক্ষার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পেরেশানীর অন্ত ছিল না। আল্লাহ্ পাক সাহায্য করবেন নিশ্চিত। কিন্তু কি করা যায়? চিন্তার সাগরে ডুবে যান তিনি। কিন্তু না, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করা যায় এমন কোন পরিকল্পনা তার মাথায় আসে না।
♣♣♣
আল্লাহ তায়ালা এক ব্যাক্তির মাধ্যমে মুসলমানদের সাহায্যের ব্যবস্থা পূর্বেই করে রেখেছিলেন। লোকটি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। লোকটির নাম ছিল সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু। সালমান ফার্সী প্রথমে অগ্নিপূজকদের ধর্মীয় গুরু ছিলেন। কিন্তু অহর্নিশি সত্যের সন্ধানে ব্যাকুল থাকেন। তিনি আগুন পূজারী ছিলেন বটে কিন্তু আগুনের স্ফুলিঙ্গ এবং তার শিখায় ঐ রহস্য উদঘাটন করতে পারছিলেন না। যে কারণে তিনি বড়ই উদগ্রীব ও উতলা ছিলেন। পাণ্ডিত্য এবং বিচক্ষণতায় তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। অগ্নিপূজকরা আগুনের ন্যায় তারও পূজা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা করত।
সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন বার্ধক্য অতিক্রম করেন তখন তার কর্ণে আরব ভূখণ্ডের এক ব্যতিক্রমধর্মী আওয়াজ পৌঁছে– “আল্লাহ এক। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল।” স্বদেশে থাকা কালে এ আহ্বান তার কানে পৌঁছেনি, বরং জ্ঞানের তালাশে তিনি জীবনভর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি এক সময় একটি বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে সিরিয়া আসেন। এখানে ব্যবসার উদ্দেশ্যে কুরাইশ ও মুসলমান ব্যবসায়ীদের আনাগোনা হত। কুরাইশ ব্যবসায়ীরাই সর্বপ্রথম ঠাট্টাচ্ছলে তার কানে এ খবর পৌঁছায় যে, তাদের গোত্রের এক ব্যক্তির মাথা খারাপ হয়েছে। সে নিজেকে নবী বলে দাবী করে।
দু’একজন মুসলমান ধর্মীয় টানে সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আকীদাহ ও তার শিক্ষা সম্পর্কে অবগত করেন। তিনি মনোযোগ সহ তাদের কথা শুনে চমকে ওঠেন। তিনি আগ্রহ ভরে মুসলমান ব্যাবসায়ীদের নিকট আরো কিছু জানতে চান। তারা তাদের জানা কথা তাকে জানিয়ে দেন।
কিন্তু এতে তার পিপাসা মিটে না। তিনি এতই প্রভাবিত হয়ে পড়েন যে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছতে চান। দিন, রাত, মাস, বছর পেরিয়ে সময় নিজ গতিতে চলতে থাকে অবশেষে তিনি নবীজির হস্ত মোবারকে ইসলাম কবুল করেন। অনেক ত্যাগ, সীমাহীন কুরবানী দিতে হয়। এ সময় হযরত সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন বার্ধক্যের সর্বশেষ সোপান অতিক্রমকারী তৎকালীন বিশ্বের সর্বাধিক বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্ব।
নিজদেশে সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু শুধু ধর্মীয় গুরুই ছিলেন না, যুদ্ধ বিদ্যায়ও ছিলেন অদ্বিতীয়। তৎকালীন যুগে ধর্মগুরুও যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং শক্তি পরীক্ষায় পারদর্শী ছিলেন। প্রত্যেক বিজ্ঞ আলেমও সৈনিক হতেন। তবে আল্লাহ্ পাক সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অপূর্ব রণকুশল প্রতিভা দান করেছিলেন। বিপদ মুহূর্তে অভূতপূর্ব পরিকল্পনা প্রণয়ন করে প্রতিপক্ষকে বোকা ও অসহায় করতে তাঁর তুলনা ছিল না। স্বদেশে কোন যুদ্ধ বাঁধলে কিংবা বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে তৎক্ষণাৎ বাদশা সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে পাঠাতেন। সামগ্রিক পরিস্থিতি তাকে জ্ঞাত করে জরুরী পরামর্শ চাইতেন। প্রখ্যাত সেনাপতিরাও তাঁর শিষ্য ছিল।
সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু এ সময় মদীনায়। তখন তিনি একজন সম্মানিত সাহাবী ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অপূর্ব রণ-কুশল সম্পর্কে জানতে পেরে পুরো পরিস্থিতি তাঁর সামনে তুলে ধরেন।
গভীর চিন্তা-ভাবনা শেষে মন্তব্য করতে গিয়ে হযরত সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “শহর পরিবেষ্টনকারী পরিখা খনন করলে ভাল হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সেখানে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম এবং কমান্ডারগণ পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। হযরত সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু কি বলেন। কারণ, আরবের লোকেরা পরিখা সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন না। পারস্যে পরিখা খননের প্রচলন ছিল। পরিখার কথা শুনে সবাইকে অবাক হতে দেখে সালমান ফার্সী রাযিয়াল্লাহু আনহু পরিখার বিস্তারিত বিবরণ ও প্রতিরক্ষার কথা বৈঠকে তুলে ধরেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মত ঐতিহাসিক রণকুশলী সেনাপতি অতি সহজেই পরিখার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম হন। কিন্তু রাসূলের সেনাপতিগণ পড়েন দোটানায়। বিস্তৃত এ শহরের চারপাশে বেশ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থবিশিষ্ট গভীর খন্দক খনন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব মনে হয়। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দক খননেরই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে তাদের আপত্তির কোন অবকাশ রইল না। খন্দকের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতার পরিমাপ করা হয়। খননকারীদের সংখ্যাও হিসাব করা হয়। খননযোগ্য স্থান এবং খননকারীদের সংখ্যাকে সামনে নিয়ে হিসেব করে কতজন কতটুকু জায়গা খনন করবে তা ভাগ করে দেয়া হয়। এ বণ্টন হিসেবে প্রতি ১১০ জনের ভাগে ৪০ হাত খননের দায়িত্ব পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝতে পারলেন খন্দক কি লোকেরা এখনো বুঝতে পারছেনা এবং পরিখা খনন করতে তারা কেমন যেন ইতস্তত করছে। তিনি কোন কথা বলেন না। কোদাল নিয়ে খনন করতে শুরু করেন।
এ দৃশ্য দেখে সাহাবায়ে কেরামের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়। তারা কোদাল-বেলচা নিয়ে তাকবীরধ্বনি দিয়ে মাটি সরাতে থাকেন। এ সময় কবি হাসসান বিন সা‘বত রাযিয়াল্লাহু আনহু চলে আসেন। নাতের জগতে তিনি ছিলেন অতুলনীয় নক্ষত্র। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সাথে রাখতেন। পরিখা খননকালে হযরত হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু এমন আকর্ষণীয় কণ্ঠে গজল পরিবেশন করতে শুরু করেন যে, খননকারীদের মধ্যে গভীর অনুরাগ ও জোশের সৃষ্টি হয়। পরিখার দৈর্ঘ্য কয়েক গজ ছিল না; বরং কয়েক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শাইখাইন পর্বত থেকে বনী উবাইদ পর্বত পর্যন্ত খনন করা লক্ষ্য ছিল। মাটি ছিল কোথাও নরম এবং কোথায় পাথুরে। দুশমন কাছাকাছি থাকায় এ খনন প্রকল্প অতি দ্রুত সম্পন্ন করা আবশ্যক হয়ে পড়েছিল।
কুরাইশ বাহিনী এই অভূতপূর্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অবস্থায় উহুদ পর্বতের অপর প্রান্তে ক্যাম্প করে অবস্থান করছিল।
“এর পেছনে অবশ্যই ইহুদীদের হাত ছিল।” চলতে চলতে খালিদের মন বলে ওঠে– “কুরাইশরা তো এক প্রকার হালই ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের অন্তরে মুসলমান-ভয় ভর করেছিল।”
আপন মনে চলছিল ঘোড়া। মদীনা এখনও বেশ দূর। হঠাৎ খালিদের শরীরে লজ্জার শিহরণ বয়ে যায়। কুরাইশদের কাপুরুষোচিত যুদ্ধ-নীতি তাকে মারাত্মক লজ্জিত করেছিল। তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না যে, ইহুদীদের জোর প্রচেষ্টার পর কুরাইশ সেনাপতি আবু সুফিয়ান মদীনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য লড়াইয়ের সংবাদে তিনি খুব খুশি হন। ইহুদীদের প্রচেষ্টার ফলে আরব ভূমিতে এটাই সর্বপ্রথম বৃহৎ সৈন্য-সমাবেশ হলেও খালিদ সৈন্য-সমাবেশের পয়েন্টে খুবই খুশী ছিলেন।
এ কথা ভেবে মনে মনে বড়ই আনন্দিত হন যে, বিশাল এ সেনাবাহিনী দেখেই মুসলমানরা মদীনা ছেড়ে পালাবে। আর যদিও বা সাহস করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তবে খুব অল্প সময়েই তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে। উহুদের অপর প্রান্তে সৈন্যরা ক্যাম্পে অবস্থানকালে তিনি অত্যন্ত উৎফুল্ল ছিলেন। যে প্রভাতে আক্রমণের কথা ছিল। তার পূর্বরাতে তার মধ্যে এমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় যে, তিনি নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। চতুর্দিকে মুসলমানদের ছড়িয়ে থাকা লাশ আর লাশ তিনি কল্পনার চোখে দেখতে থাকেন।
পরদিন প্রত্যুষে বহুজাতিক বাহিনীর ১০ হাজার সৈন্য মদীনা আক্রমণ করতে উহুদকে পেছনে ফেলে মদীনার দিকে এগিয়ে চলে সারিবদ্ধভাবে। বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে পৌঁছে হঠাৎ থেমে যায়। গভীর পরিখা তাদের পথ আগলে দাঁড়ায়। সেনাপতি আবু সুফিয়ান সৈন্যদের মধ্যভাগে ছিল। হঠাৎ সৈন্যদের থেমে যেতে দেখে সে দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছে।
কুরাইশদের বাহাদুর বাহিনী! থেমে গেলে কেন?” আবু সুফিয়ান উচ্চঃস্বরে বলছিল– “তুফানের মত অগ্রসর হও এবং মুহাম্মাদের অনুসারী মুসলমানদেরকে পিষ্ট করে ফেল।.. শহরের প্রতিটি ইট খুলে ফেল।”
আবু সুফিয়ান সামনে অগ্রসর হলে সে নিজেই ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে এবং সৈন্যদের ঘোড়ার ন্যায় তার ঘোড়াও থেমে যায়। সামনে পরিখা দেখে সে থমকে যায়। নীরবতা তাকে ছেয়ে ফেলে।
“আল্লাহর কসম! এটি একটি নতুন জিনিস যা আমার চোখ কখনো দেখেনি।” আবু সুফিয়ান ক্রোধ-কম্পিত কণ্ঠে বলে– “আরবের যোদ্ধারা বিস্তৃত ময়দানে লড়াই করে আসছে।.. খালিদ বিন ওলীদকে ডাক।… ইকরামা এবং সফওয়ানকেও ডাক।”
আবু সুফিয়ান পরিখার কিনারা দিয়ে ঘোড়া নিয়ে চক্কর দিতে থাকে। পরিখা অতিক্রম করতে পারে এমন কোন জায়গা তার চোখে পড়ে না। শাইখাইন নামক উঁচু পর্বত থেকে নিয়ে বনু উবাইদ এর উপর দিয়ে পশ্চাৎভাগ পর্যন্ত ছিল পরিখা। মদীনার পূর্ব দিক শাইখাইন ও অন্যান্য পাহাড় কুদরতিভাবে মদীনাকে নিরাপদ রাখে।
আবু সুফিয়ান অনেক দূর পর্যন্ত পরিখার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। পরিখার ওপাড়ে সতর্ক প্রহরীর মত মুসলমানরা টহল দিচ্ছিল। সে কিছুক্ষণ পায়চারি করে ঘোড়া ঘুরিয়ে সৈন্যদের কাছে ফিরে আসে। উল্টো দিক থেকে তিনটি ঘোড়া দৌড়ে এসে তার পাশে এসে থেমে যায়। খালিদ, ইকরামা ও সফওয়ান-এর ঘোড়া।
“দেখলে, মুসলমানরা কত ভীতু?” আবু সুফিয়ান তিনজনকে লক্ষ্য করে বলে– “পথিমধ্যে গতিরোধ করে কিংবা রাস্তায় গর্ত খনন করে দুশমনের সাথে কখনো লড়েছ?”
সেদিন আবু সুফিয়ানের কথা শুনে খালিদ নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন। আজ মদিনার দিকে গমনকালে তার সে কথা স্মরণ হয় যে, সেদিন তার চুপ থাকার কারণ এই ছিল না যে, আবু সুফিয়ান মুসলমানদেরকে যে ‘ভীতু বলেছিল– তা ঠিকই ছিল; বরং তিনি নীরবতা অবলম্বন করে এই চিন্তা করছিলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিখা খনন কোন ভীতুর পরিচয় ছিল না; বরং বুদ্ধিমানের পরিচয় ছিল। শহর প্রতিরক্ষার উপায় হিসেবে এ পরিকল্পনা যিনি করেছেন তিনি কোন সাধারণ মেধার লোক নন। ইতোপূর্বেও তিনি টের পেয়েছিলেন যে, মুসলমানরা লড়াইয়ের ক্ষেত্রে শুধু দৈহিক শক্তির উপর নির্ভর করে না; মেধা এবং বিচক্ষণতাকেও ব্যবহার করে। খালিদের দেমাগও এ ধরনের যুদ্ধ-কৌশল জন্ম দিত। মুসলমানরা সংখ্যায় স্বল্প হওয়া সত্ত্বেও বদর যুদ্ধে বিশাল কুরাইশ বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিল। খালিদ পরবর্তীতে একাকী বসে এ পরাজয়ের কারণ বের করতে চেষ্টা করেন। মুসলমানদের বিজয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল প্রতিটি মুসলিম যোদ্ধার অপূর্ব বিচক্ষণতা।
উহুদের যুদ্ধেও মুসলমানদের নিশ্চিত পরাজয় ছিল। কিন্তু এরপরেও মুসলমানদের মেধা ও বিচক্ষণতার দরুন অবশেষে জয়-পরাজয় ছাড়াই যুদ্ধ শেষ হয়।
“আরো ব্যাপার ছিল খালিদ!” খালিদ নিজেই নিজের জবাবে বলেন– “যা কিছু থাকুক না কেন, আমি এটা মানতে পারব না যে, মুহাম্মাদের জাদু বলেই এমনটি সম্ভব হয়েছে কিংবা তার হাতে কোন যাদু আছে। আমাদের জ্ঞান-বিবেক যে কোন কিছু বুঝতে পারে না তাকে জাদু বলে চালিয়ে দেই। কুরাইশদের মাঝে এমন বিচক্ষণ লোক একজনও নেই, যে মুসলমানদের মত দৃঢ়তা নিয়ে কুরাইশদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে এবং এমন যুদ্ধ পরিকল্পনা উদ্ভাবন করবে, যা মুসলমানদের চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিবে।”
“আল্লাহর কসম! মুসলমানরা আমাদের পথে খন্দক খনন করায় আমরা ফিরে যাব না।” আবু সুফিয়ান, খালিদ, ইকরামা ও সফওয়ানকে বলে। কিছুক্ষণ পর সে আবার তাদেরকে জিজ্ঞেস করে– “খন্দক অতিক্রমের কোন উপায় উদ্ভাবন করা যায় কি?”
খালিদ উপায় উদ্ভাবনে গভীর চিন্তায় ডুবে যান। কিন্তু হঠাৎ তার মনে এ সন্দেহও সৃষ্টি হয় যে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সৈন্যরা পরিখা অতিক্রম করলেও মুসলমানদেরকে পরাজিত করা তত সহজ হবে না। তাদের সংখ্যা যতই কম হোক না কেন। যারা অল্প সময়ে পাথুরে জমীনের বুক চিরে গভীর পরিখার সৃষ্টি করতে পারে, অনেক কষ্টের পরেই কেবল কোন বিশাল বাহিনী তাদের পরাস্ত করতে পারে।
“কি ভাবছ? ওলীদের বেটা!” আবু সুফিয়ান খালিদকে গভীর চিন্তামগ্ন দেখে জিজ্ঞেস করে– “আমাদের চিন্তা করারও সময় নেই। আমাদের বিলম্ব দেখে মুসলমানরা এমনটি যেন মনে করার সুযোগ না পায় যে, আমরা স্তম্ভিত।”
“পরিখা পুরোটাই নিরীক্ষা করা দরকার।” ইকরামা বলল। “এমন কোন জায়গা অবশ্যই আবিষ্কৃত হবে, যেখান দিয়ে আমরা খন্দক অতিক্রম করতে পারব।” সফওয়ান বলে।
“অবরোধ।” খালিদ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেন– মুসলমানরা পরিখা খনন করে ভিতরে অবস্থান করছে। আমরাও অবরোধ করে বাইরে অবস্থান করব। ক্ষুধা-পিপাসায় অস্থির হয়ে একদিন অবশ্যই তাদের পরিখার এপার আসতে হবে।
“ঠিক আছে।” আবু সুফিয়ান সমর্থনের ভঙ্গিতে বলে– “এ ছাড়া অন্য কোন উপায় দেখি না, যা পরিখা অতিক্রম করে এ পারে এসে মুসলমানদেরকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করবে।”
আবু সুফিয়ান তিন উপসেনাপতিকে নিয়ে পরিখার কিনার দিয়ে পুরো পরিখা পর্যবেক্ষণ করতে বনূ উবাইদ পর্বতের দিকে রওনা হয়। মদীনা ও বনু উবাইদ পর্বতের মধ্যবর্তী স্থলে ‘সালা’ নামক একটি পাহাড় ছিল। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে এখানেই ছিল মুসলমানদের মূল ক্যাম্প। মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা কম দেখে আবু সুফিয়ানের ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি দেখা যায়। সে এখান থেকে সম্মুখে অগ্রসর হলে দ্রুত ধাবমান একটি ঘোড়া তার কাছে এসে ব্রেক কষে। অশ্বারোহী আবু সুফিয়ানের পরিচিত। লোকটি একজন ইহুদী। বণিকবেশে সে মদীনায় গিয়েছিল। পাহাড়ের দীর্ঘ সারি অতিক্রম করে করে সে মদীনা থেকে পরিখার এ পারে এসে কুরাইশ সৈন্যদের মাঝে পৌছে।
“ওপার থেকে এমন কোন সংবাদ নিয়ে আসতে পেরেছ, যা আমাদের কাজে আসতে পারে?” আবু সুফিয়ান ইহুদীকে জিজ্ঞেস করে এবং বলে– “আমাদের সাথে যেতে থাক এবং সংবাদ একটু জোরে বল, যাতে আমার এই তিন কমান্ডারও শুনতে পারে।”
ইহুদী বলতে থাকে– “শহর রক্ষা ও আবাসিক এলাকা রক্ষার জন্য মুসলমানদের গৃহীত পদক্ষেপ হল এই, আপনারা সকলেই জানেন যে, মদীনা ছোট কেল্লাবিশিষ্ট এবং পরস্পর লাগোয়া কতক পল্লী ও আবাসিক এলাকার নাম। মহিলা, শিশু ও দুর্বলদেরকে মুসলমানরা সর্বপশ্চাৎ কেল্লায় পাঠিয়েছে। পরিখার উপর সতর্ক নজর রাখতে একটি দল গঠন করা হয়েছে। এ দলের সদস্য ২০০ থেকে ২৫০ এর মত হবে। তাদের প্রত্যেকেই তলোয়ার, বর্শা এবং তীর-ধনুকে সজ্জিত। পরিখাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রহরী দলটি সারাদিন সারা রাত পুরো পরিখা টহল দিয়ে ফিরছে। যেখান দিয়েই আপনারা পরিখা অতিক্রম করতে চাইবেন মুহূর্তেই সেখানে পর্যাপ্ত মুসলমান পৌছে যাবে এবং ঝাঁকে ঝাঁকে তীর বর্ষণ করে আপনাদের পিছু হটতে বাধ্য করবে। শুধু তাই নয়, এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, রাতের অন্ধকারে মুসলমানরা পরিখার এ পার এসে গেরিলা হামলা করে আবার ফিরে যাবে।”
“তাহলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই কি করেছে?” আবু সুফিয়ান উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করে।
ইহুদী গুপ্তচর বলে– “হে কুরাইশ নেতা!” “জীবনের অনেক বছর অতিবাহিত হলেও মানুষ চেনার যোগ্যতা এখনও আপনার হয়নি। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই একজন কপটচারী লোক। মুসলমানদের কাছে সে মুনাফিক সর্দার হিসেবে পরিচিত। আমরাও তাকে ইহুদীদের একজন গাদ্দার বলে জানি। সে মুসলমান হয়ে আমাদের সাথে গাদ্দারী করেছিল। এবং আপনাদের স্বার্থেও সে তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। উহুদে আপনারা বিজয় অর্জন করলে সে নিজেকে আপনাদেরই একজন বলে প্রচার করত। কিন্তু মুসলমানদের পাল্লা ভারী দেখে সে আপনাদের এবং ইহুদীদের থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। যার কোন ধর্ম নেই এবং যে বিশ্বস্ত নয় তার উপর নির্ভর করা আদৌ ঠিক নয়।”
“হুয়াই ইবনে আখতার কোথায়?” আবু সুফিয়ান জানতে চায়।
সে যথাসম্ভব চেষ্টারত।” ইহুদী গুপ্তচর জবাবে বলে – মদীনায় আমার আরো সঙ্গী রয়েছে। তারা সম্ভবত মুসলমানদের ক্ষতি করতে থাকবে।”
মদীনায় গমনকালে এ কথা ভেবে খালিদের নিজের কাছে নিজেকে খুব হাল্কা মনে হয় যে, মক্কা থেকে রওনা হওয়ার পর দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর চলার দৃশ্য দেখে তার গর্দান উঁচু এবং গর্বে বুক ফুলে গিয়েছিল। কিন্তু মদীনার কাছাকাছি এসে সেই বাহিনীকেই বালুর টিলার ন্যায় নিষ্প্রাণ ও জড় পদার্থ বলে মনে হয়। অবরোধের চিত্রও তার মনে পড়ে। সৈন্যদের যে অংশটি তার নেতৃত্বাধীন ছিল, তাদেরকে তিনি অতীব নৈপুণ্যের সাথে অবরোধ কর্মে বিন্যস্ত করে রেখেছিলেন।
দীর্ঘ বাইশ দিন অবরোধ অব্যাহত থাকে। দশদিন যেতে না যেতেই মদীনার মুসলমানরা খাদ্য-সংকটে পড়ে। কিন্তু এতে কুরাইশরা তেমন লাভবান হল না। কেননা, তাদেরও রসদ-সামগ্রী পরিমাণে কম ছিল। তারা ভাবতে পারেনি যে, মুসলমানদের অবরোধে তাদেরকে এক দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে হবে। খাদ্য-সংকট মদীনার মুসলমানরা যেমনিভাবে অনুভব করে তার থেকে কোন অংশেই কুরাইশদের খাদ্য-সংকট কম ছিল না। তীব্র খাদ্য-সংকটে সৈন্যদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে থাকে।
ঐতিহাসিক ইবনে হিশাম লিখেন, মদীনায় যখন খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুদ ছিল না এবং জনগণকে দৈনিক প্রয়োজনের খাদ্য আহার দেয়া হচ্ছিল, ঠিক সেই স্পর্শকাতর মুহূর্তে মুনাফিক ও ইহুদীরা চক্রান্তে মেতে ওঠে। সর্ব প্রথম এ কথা আবিষ্কার করে তার খোঁজ পাওয়া না গেলেও শহরের সর্বত্র গুঞ্জরিত হতে থাকে যে, মুহাম্মাদ আমাদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছে। কারণ, সে মুখে এ কথা বললেও অচিরেই কায়সার ও কিসরার ধনাগার যে আমাদের করতলগত হবে’; এখনও পর্যন্ত তার নবুওয়াতের স্বপক্ষে এ প্রমাণটুকু পেশ করতে পারেনি যে, খাদ্য-সংকটের এ মুহুর্তে আমাদের জন্য আকাশ থেকে খাদ্য সামগ্রী আসবে।”
ইসলাম গ্রহণ করলেও মানুষ তো রক্ত-মাংসেরই গড়া ছিল। উদরপূর্তির প্রশ্নটি ছিল তাদের দুর্বল পয়েন্ট। এ পয়েন্টে এসে তাদের মধ্যে শহরের ঐ গুঞ্জনটি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। অনেকের চেহারায় হতাশার চিহ্ন ফুটে ওঠে। এমতাবস্থায় আরেকটি আহ্বান তাদেরকে পেটের ভূতের হাত থেকে রক্ষা করে।
“তোমরা কি আল্লাহর সম্মুখে এ কথা বলতে চাও যে, আমরা আল্লাহ পূজার চেয়ে অধিক পেটপূজারী ছিলাম। এটা ছিল এক বজ্রধ্বনি, যা শহরের অলি-গলিতে প্রতিধ্বনি তোলে– “আজ আল্লাহর প্রিয়পাত্র তারাই গণ্য হবে, যারা আল্লাহর রাসূলের সাথে ক্ষুধা-তৃষ্ণার্ত অবস্থায় জীবনবাজি রাখবে।… আল্লাহর কসম! এর থেকে বড় কাপুরুষতা এবং বেইজ্জতি মদীনাবাসীদের জন্য আর কি হতে পারে যে, আমরা মক্কাবাসীদের পদতলে লুটিয়ে পড়ব এবং দু’হাত জোড় করে বলব, আমরা তোমাদের গোলাম, আমাদেরকে কিছু খেতে দাও।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহর রক্ষায় এমন ব্যস্ত ছিলেন যে, তার দিন রাত সব একাকার হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর প্রিয়নবী। তিনি ইচ্ছা করলে মোজেযাস্বরূপ কিছু দেখাতে পারতেন। কিন্তু তার এই সতর্ক অনুভূতি ছিল যে, আমি নবী হলেও অন্য মানুষ তো আর নবী নয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নতুন নবী আসবেনা, তাই মানুষের নিকট এমন দৃষ্টান্ত রেখে যেতে হবে যে, মানুষ তার আল্লাহ প্রদত্ত নশ্বর দেহ এবং আত্মিক শক্তি দৃঢ়তার সাথে পূর্ণ কাজে লাগালে মোজেযার মত চমক দেখাতে পারে। অবরোধকালীন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কর্মতৎপরতা এবং তার অবস্থা একজন সেনাপতির পাশাপাশি একজন সৈনিকের মতও ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এহেন তৎপরতা দেখে মুসলমানরা তাদের ক্ষুধা-পিপাসার কথা একদম ভুলে যায়। তাদের মধ্যে এমন জোঁশ ও প্রেরণা সৃষ্টি হয় যে, অনেকে আবেগতাড়িত হয়ে পরিখার একদম কাছে চলে আসত এবং কুরাইশদেরকে কাপুরুষ বলে বিদ্রুপ করত।
♣♣♣
৬২৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ। আবু সুফিয়ান বিষন্ন মনে হুয়াই বিন আখতাবকে ডেকে আনার নির্দেশ দেয়। তার বিষন্নতার কারণ, দশদিনেই তার সৈন্যদের খাদ্য রসদ বহু কমে যায়। সৈন্যরা আশেপাশের বস্তিগুলো থেকে লুটপাট করে কিছু খাদ্য সংগ্রহ করে। কিন্তু মরুভূমির বস্তিগুলোতেও বিশেষ কোন খাদ্য সঞ্চিত ছিল না। খাদ্য-সংকটে যৌথবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ফুঁসে উঠতে থাকে। সৈন্যদের নাজুক অবস্থা দেখে আবু সুফিয়ান এক ইহুদী গোত্রপ্রধান হুয়াই বিন আখতারকে জরুরী ভিত্তিতে ডেকে পাঠায়। হুয়াই পূর্ব থেকেই কুরাইশদের সাহায্যের উদ্দেশে নিকটে কোথাও অবস্থান করেছিল। সে কুরাইশদের আহ্বান ও তার কাছে সাহায্যের অপেক্ষায় ছিল।
মদীনার অনতিদূরে বনূ কুরাইযা ইহুদী গোত্রের বস্তি ছিল। এই গোত্রের নেতা কা’ব বিন আসাদ এ বস্তিতেই অবস্থান করছিল। রাতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ করে দরজায় জোরে জোরে নক হওয়ায় তার মিলানো চোখের পাতা দু’টো এদিক-ওদিক সরে যায়। গোলামকে ডেকে বলে– “দেখতো বাইরে কে?”
গোলাম দরজার ছিদ্র দিয়ে দেখে বলে– “হুয়াই বিন আখতাব এসেছেন।”
“এই গভীর রজনীতে ব্যক্তিগত কোন স্বার্থের জন্যই সে এসেছে।” একটু রাগত স্বরে কা’ব বিন আসাদ বলে– “তাকে বলে দাও, আমার পক্ষ থেকে এখন আমি তার কোন উপকার করতে পারব না। দিনে আসলে চেষ্টা করা যেতে পারে।”
ইহুদীদের ঐ গোত্রের নাম বনু কুরাইযা, যারা মুসলমানদের সাথে মিত্রতা ও একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করার চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। বনু কায়নুকা এবং বনু নযীরও চুক্তিবদ্ধ ছিল। কিন্তু ইতোপূর্বেই তারা মুসলমানদের সাথে গাদ্দারী করার কারণে মুসলমানরা তাদেরকে নির্বাসনে পাঠায়। সিরিয়া গিয়ে তারা আস্তানা গাড়ে। একমাত্র বনূ কুরাইজা সম্মানের সাথে চুক্তি বহাল রাখে। একনিষ্ঠভাবে সন্ধি ফলো করায় পরিখা যুদ্ধে বনূ কুরাইযার কাছ থেকে কোনরূপ ক্ষতির আশঙ্কা মুসলমানদের ছিল না। বনু কুরাইজার মনেও কোন দুরভিসন্ধি ছিল না। কিন্তু হুয়াই বিন আখতাব তাদের প্ররোচিত করে এবং চুক্তির উপর অটল থাকতে দেয়নি। হুয়াই বিন আখতাব ছিল ইহুদী। সে কা’ব বিন আসাদকে একই ধর্মানুসারী মনে করে তার কাছে যায়। উদ্দেশ্য, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাকে প্ররোচিত করা এবং চুক্তি ভঙ্গ করতে উৎসাহিত করা। তাই কা’বের গোলামের কথা শুনেও সে চলে যায়নি। যে কোন মূল্যে কা’বের সাথে দেখা করতে চায়। অবশেষে বাধ্য হয়ে কা’ব নাছোড়বান্দা হুয়াইকে ভেতরে আসার অনুমতি দেয়।
“এ অসময়ে তোমার আগমনের উদ্দেশ্য জানতে আমার বাকী নেই।” কা’ব বিন আসাদ হুয়াইকে বলে– “তুমি আবু সুফিয়ানের তরফ থেকে এলে তাকে গিয়ে বলবে, আমরা মুসলমানদের সাথে যে চুক্তিতে আবদ্ধ আছি, মুসলমানরা যথাযথভাবে তার উপর আছেন। তারা আমাদেরকে মূলতই মিত্র বলে জানে এবং চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্য অধিকার সবই দিচ্ছে।”
“কা’ব বিন আসাদ! ঠাণ্ডা মাথায় কথা বল।” হুয়াই বিন আখতাব বলে–“বনূ কায়নুকা এবং বনূ নযীরের পরিণতি দেখ। এ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয় নিশ্চিত। ইহুদীদের খোদার শপথ! দশ হাজার সৈন্য মুসলমানদেরকে পিষ্ট করে ফেলবে। যুদ্ধে মুসলমানরা টিকতে না পেরে ইহুদীদেরকে এ পরাজয়ের কারণ মনে করে বদলা নিতে তোমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।”
“তোমার মনের ভাব খুলে বল হুয়াই।” কা’ব বিন আসাদ ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়।
পাহাড়ের পেছন দিক দিয়ে কুরাইশ সৈন্যদের একটি অংশ তোমাদের নিকট আসবে।” হুয়াই বলে যায়– “তোমাদের বর্তমানে এই গোপন বাহিনী পেছন দিক হতে মুসলমানদের উপর হামলা করতে পারে না। তুমি সগোত্র গিয়ে কুরাইশদের সাথে মিলে যাও। কৌশলে মুসলমানদের উপর এভাবে হামলা চালাও যে, শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঠিকই কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ময়দানে টিকে থাকবে না; বরং সুযোগ বুঝে পিছু হঁটে আসবে। এতে কুরাইশদের এই উপকার হবে যে, মুসলমানদের দৃষ্টি পরিখা থেকে ঘুরে যাবে আর এই সুযোগে কুরাইশরা পরিখা পার হয়ে চলে আসবে।”
“তোমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার পর যদি আমরা ঘটনাক্রমে অকৃতকার্য হই, তখন আমাদের সাথে মুসলমানদের আচরণ কেমন হবে বলে তুমি মনে কর?” কা’ব বিন আসাদ বলে– “মুসলমানদের কঠোরতা ও ক্রোধ সম্বন্ধে তোমরা নিশ্চয় জান। বনু কায়নুকা এবং বনু নযীরের কাউকে তোমাদের চোখের সামনে দেখ কি?”
“আবু সুফিয়ান সবদিক ভেবেই তোমার দিকে চুক্তির হাত প্রসারিত করেছে।” হুয়াই বিন আখতাব বলে– “সত্যই যদি মুসলমানদের ক্রোধ ও কঠোরতা তোমাদের উপর নেমে আসে, তাহলে কুরাইশদের একটি বাহিনী তোমাদের রক্ষার জন্য শাইখাইনসহ পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে অবস্থান করবে। তারা গেরিলা আক্রমণে খুবই পারদর্শী। এই চৌকস বাহিনী ক্ষিপ্র গতিতে ‘যখন-তখন’, ‘এখানে-ওখানে’ আক্রমণ করে মুসলমানদের এমন অস্থির করে রাখবে যে, তারা তোমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবারও সময় পাবে না।”
“তুমি আমাকে এমন সঙ্কটে ফেলেছ, যা আমার পুরো গোত্রকে ধ্বংস করে দিবে।” কা’ব বিন আসাদ বলে।
“তোমার গোত্র ধ্বংস হোক বা না হোক কুরাইশরা এই চুক্তির পরিবর্তে এত মূল্য দেবে যা তোমরা কল্পনাও করনি।” হুয়াই বলে– “অথবা সহযোগিতার মূল্য নিজেই বল… যা বলবে, যেভাবেই চাবে তা পেয়ে যাবে। এছাড়া তোমার গোত্র পাবে পূর্ণ নিরাপত্তা। মুসলমানরা অল্পদিনের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাদের সাথে সখ্যতা গড়, যারা জীবিত থাকবে এবং যাদের হাতে থাকবে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা ও শক্তি।”
কা’ব বিন আসাদ সৎ থাকলেও ধর্মীয়ভাবে সে ছিল ইহুদী ধর্মীয়। স্বর্ণ-রৌপ্য এবং মণি-মাণিক্যের টোপে সে শেষ পর্যন্ত হুয়াই বিন আখতাবের সাথে হাত মিলায়।
কা’ব বিন আসাদ বলে– “কোন কুরাইশ সৈন্যের আমাদের এলাকায় আসার দরকার নেই।” “আমার লোকেরাই মুসলমানদের উপর গেরিলা হামলা করবে। রাতের আঁধারেই এ পরিকল্পিত হামলা হবে। যাতে মুসলমানরা মোটেও টের না পায় যে, গেরিলারা বনু কুরাইযা … আর হুয়াই!” কা’ব মুচকি হেসে বলে– “তুমি নিজেই দেখেছ, আমি এখানে একাকী পড়ে থাকি এভাবে আমার রাত একাকী কেটে যায়।”
“আজকের রাতটি একাকী কাটাও।” হুয়াই বলে– “কাল থেকে আর নিঃসঙ্গ রাত কাটাতে হবে না।”
“আমি দশ দিন সময় চাই।” কা’ব বলে– “গোত্রকে তৈরি করতে হবে আমার।”
এভাবে হুয়াই বিন আখতাবের প্রচেষ্টার কালে কুরাইশ এবং বনু কুরাইযার মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি হয়।
হযরত সা’দ বিন আতীক ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। মদীনায় তার তেমন কোন প্রভাব ছিল না। খঞ্জর এবং তলোয়ার শান দেয়াই ছিল তার পেশা। তার কণ্ঠস্বর ছিল খুবই আকর্ষণীয়। রাতে কোন অনুষ্ঠানে সে গান গাইলে মানুষ ঘরে বসে থাকতে পারত না। বাইরে এসে বাতাসে কান পেতে থাকত। কখনো তিনি শহরের বাইরে গিয়ে নিরিবিলি গান গাইতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করে আসার পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
এক রাতে তিনি শহরের বাইরে কোথাও আকর্ষণীয় কণ্ঠে গান শুরু করেন। তার সুরের মূর্ছনায় অভিভূত হয়ে এক রূপসী যুবতী তাঁর সামনে এমনভাবে এসে দাঁড়ায়, যেন কোন জান্নাতী হুর আসমান থেকে মাটির পৃথিবীতে নেমে এসেছে। ভয়ে সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কন্ঠ বন্ধ হয়ে আসে। থেমে যায় সুরের লহর।
“যে মায়াবিনী কণ্ঠ আমাকে ঘর থেকে টেনে এখানে এনেছে তা থেকে বঞ্চিত করো না। মেয়েটি আবেদনের ভঙ্গিতে বলে– “আমাকে দেখার কারণে যদি গান গাওয়া বন্ধ করে থাক, তাহলে আমি তোমার দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছি। তোমার গানকে হত্যা কর না।… তোমার কণ্ঠে বিরহ ঝড়ে পড়ছে, যেন কারো বিচ্ছেদে তুমি এ গান গাইছ।”
সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “তুমি কে? “তুমি পরী কি-না সত্য বল।”
এ কথায় জলতরঙ্গের ন্যায় মেয়েটির হাসি আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। মরুভূমির নিষ্কলংক পূর্ণিমা তার যুগলনয়ন হীরার মত চমকাতে থাকে।
মেয়েটি তাকে জানায়– “আমি বনূ কুরাইযার এক ইহুদীর মেয়ে।”
“আর আমি মুসলমান। সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন।
‘মাঝখানে ধর্মকে টেনে এনো না।” ইহুদী কন্যা বলে – সঙ্গীতের কোন ধর্ম নেই। আমি তোমার জন্য নয়; তোমার কণ্ঠে অভিভূত হয়ে এসেছি।”
হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু মেয়েটির রূপে বিমুগ্ধ আর ইহুদী মেয়েটি তার কণ্ঠে মোহিত হয়। সুরের জাদু মেয়েটিকে এমন বন্ধনে আবদ্ধ করেছে, মৃত্যুও যে বন্ধন মুক্ত করতে পারে না। এ রজনীর পরেও তারা পরস্পরে প্রেমালাপে মিলিত হয়। একে অপরের মাঝে বন্দি হয়ে যায়। একদিন ইহুদী মেয়েটি তাকে জানায়, হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু চাইলে সে তার নিকট চলে আসবে এবং ইসলাম গ্রহণ করবে।
মাত্র দু-তিন দিন হয় কুরাইশরা মদীনা ঘেরাও করেছে। যুদ্ধের সাজসাজ রব পড়ে যাওয়ায় হযরত সা’দ বিন আতীকের কাজও বেড়ে যায়। তার কাছে মানুষ দলে দলে এসে তলোয়ার, খঞ্জর এবং বর্শার মাথা সূতীক্ষ্ণ করতে ভীর জমাতে থাকে। কাজের চাপে রাতেও তাকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়।
একদিন ইহুদী মেয়েটি তার পিতার তরবারিটি নিয়ে হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট আসে।
“তরবারি সান দেয়ার বাহানায় এসেছি।” মেয়েটি বলে– “আজ রাতেই পালিয়ে কোথাও চলে যাও, নতুবা আর কখনো আমাদের সাক্ষাৎ হবে না।”
‘ব্যাপার কি?” উৎকণ্ঠা নিয়ে হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।
“গত পরশু রাতে পিতা আমাকে বলেন, গোত্রপ্রধান কা’ব বিন আসাদ তাকে চায়” ইহুদী কন্যা বলে– “পিতা হুয়াই বিন আখতাবের কথাও বলে। আমি কা’বের বাসায় যাই। সেখানে হুয়াই বিন আখতাব ছাড়াও আরো দু’জন ছিল। তাদের আলোচনা হতে যতদূর বুঝলাম তাতে মনে হল, মুসলমানদের অন্তিম মুহুর্ত চলে এসেছে।
কা’ব বিন আসাদ, হুয়াই বিন আখতাব এবং কুরাইশদের মাঝে এই কন্যার উপস্থিতিতেই চুক্তি সম্পন্ন হয়। এবং পেছন দিক থেকে মুসলমানদের উপর আক্রমণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইহুদী কন্যা রাতভর কা’বের কাছে কাটায় সকালে সে স্বগৃহে ফিরে আসে। মুসলমানদের ব্যাপারে মেয়েটির কোনই আগ্রহ ছিল না। তার ভালবাসা ছিল শুধু সা’দকে নিয়ে। তার কানে এ খবরও আসে যে, কা’ব তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে নিজের ঘরে চিরদিনের জন্য রেখে দিবে।
হযরত সা’দ রাযিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধ-ব্যস্ততা হেতু ইহুদী মেয়েটির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। মেয়েটি কিন্তু তাকে ভুলেনি। অস্ত্র ধারের বাহানা দিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। কিন্তু সা’দ তাকে পূর্বের ন্যায় পাত্তা দেন না। তাকে ফিরে যেতে বলেন। এক ইহুদী কন্যাসূত্রে প্রাপ্ত সংবাদ তিনি বিশিষ্ট এক মুসলমানকে জানিয়ে দেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ এ সংবাদ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে দেন। সেখান থেকে সদর দফতরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কানে এ খবর পৌঁছে যে, বনূ কুরায়যা অপর ইহুদী গোত্রদ্বয় বনু কায়নুকা ও বনু নাযীরের মত চুক্তি ভঙ্গ করে শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলিয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরায়যা গোত্রপ্রধান কা’ব বিন আসাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে খবরটির সত্যতা যাচাই করা জরুরী বলে মনে করেন। বনু কুরাইযা যে বাস্তবেই কুরাইশদের সাথে নতুন গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ নিয়েই তিনি তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চান।
আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় বান্দাদের সাহায্য করতে থাকেন। এরই মাঝে এমন এক ঘটনা ঘটে যায় যাতে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, বনূ কুরাইযা এবং কুরাইশদের মাঝে প্রকৃতই এক ভয়ানক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে নিঃসন্দেহে।
ঘটনা এই ঘটে যে, খন্দকের একটু দূরে অবস্থিত বিভিন্ন ছোট ছোট কেল্লায় মহিলা ও শিশুদের স্থানান্তর করা হয়। একটি কেল্লায় কিছুসংখ্যক নারী ও শিশুদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফুফু হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহাও ছিলেন। একদিন তিনি কেল্লার ছাদের উপর পায়চারি করতে করতে কি মনে করে হঠাৎ নিচের দিকে তাকাতেই প্রাচীরের সাথে সেঁটে থাকা এক ব্যক্তির প্রতি তার দৃষ্টি পড়ে। তার চলার গতি ছিল সন্দেহপূর্ণ। একটু থেমে আবার কিছুদূর চলতে চলতে সে কেল্লার প্রাচীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল। হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা অলক্ষ্যে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। পরক্ষণেই তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আগন্তক কেল্লার ভিতরে প্রবেশের কোন বিকল্প পথ কিংবা উপায় বের করা যায় কি-না তা যাচাই করে দেখছে।
হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর প্রবল সন্দেহ হওয়ার কারণ হলো, তিনি জানতেন যে, শহরের সমস্ত পুরুষ পরিখার নিকটবর্তী ঘাঁটিতে অবস্থান করছে কিংবা যুদ্ধ বিষয়ক কোন কাজে ব্যস্ত। সন্দেহভাজন ব্যক্তি যদি নিজেদের লোক হত এবং বিশেষ কোন প্রয়োজনে আসত তাহলে গোপন বা বিকল্প পথ না খুঁজে মেইন গেটে নক করত।
পুরো কেল্লায় শিশু ও নারীদের সাথে মাত্র একজন পুরুষ ছিলেন আরব-খ্যাত কবি হাসসান বিন সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু। হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা-ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে এখনই এর প্রতিবিধান করার জন্য হযরত হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে ছুটে যান এবং তাকে বলেন, নিচে এক সন্দেহভাজন প্রাচীরের গা ঘেঁষে ঘেঁষে চলছে।
“আমার সন্দেহ, লোকটি ইহুদী।” হযরত সাফিয়্যাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা হযরত হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন– “হাসসান! তুমি জান যে, বনু কুরাইযা মৈত্রীচুক্তি ভঙ্গ করেছে। এ ব্যক্তিকে ইহুদীদের গুপ্তচর বলে মনে হচ্ছে, বনু কুরাইযা পেছন হতে আমাদের উপর হামলা করতে চায়, যাতে পরিখার নিকটে অবস্থানরত পুরুষদের দৃষ্টি পরিখা হতে সরে যায় এবং তারা আমাদেরকে রক্ষা করতে পিছু হঁটে আসে। পুরুষদেরকে পরিখা হতে দূরে সরানোর এই পরিকল্পনা তখনই কার্যকর হতে পারে, যখন তারা নারী ও শিশু ভরপুর এই কেল্লায় হামলা করবে।… দ্রুত নিচে যাও হাসসান! আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। সন্দেহভাজনের গতিরোধ কর। সে যদি প্রকৃতই ইহুদী হয়ে থাকে তাহলে তাকে সেখানেই হত্যা করবে। মনে রেখ, তার হাতে বর্শা আছে। আলখেল্লার অভ্যন্তরে লুকানো তরবারিও থাকতে পারে।”
কবি হাসসান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন– “সম্মানিত ভদ্র মহিলা!” “আপনার কি জানা নেই যে, আমি একজন কবি আমি মানুষের রক্তে আগুন ধরিয়ে উজ্জীবিত করতে পারি; কিন্তু নিজের মাঝে আলোড়ন তুলতে পারি না। এমন একজন কবি থেকে এই আশা করবেন না যে, সে একাকী বাইরে গিয়ে এমন এক ব্যক্তির মোকাবিলা করবে, যে সাহস প্রদর্শন করে কেল্লা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে।”