সামান্যই ঘটনা, তবু মনে পড়ে গেল। গত চারমাস শুধু এইরকম কত ঘটনা মনে করে-করে বেঁচে থাকলাম আমি। শুধুই স্মৃতির মধ্যে বেঁচে থাকা। বর্তমান যেন থেমে গিয়েছে আমার জন্যে। শুধু মনে পড়ে, মন কেমন করে, অতীতই হয়ে ওঠে বর্তমান বেঁচে ছিলাম সেইভাবেই। তোমার বিয়ের পরে চারটে মাস আমার কেটেছে অতীতে। ক্রমশ মনে হল, কী লাভ অতীতের মধ্যে বেঁচে থেকে। এরচেয়ে মরে যাওয়াই তো ভালো।
যে-ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছিলাম—একদিন বিকেলবেলা জানলার ধারে চুপ করে বসে মালা গাঁথতে-গাঁথতে ঘুমিয়ে পড়েছি, তুমি এলে আমার ঘরে।
আমার উড়ুক্কু চুলগুলি কপাল থেকে সরিয়ে আমার পিঠের ওপর হাতটি রেখে নরম করে ডাকলে, নতুনবউঠান।
আমি তাকালাম তোমার পানে। তুমি বললে, যেভাবে এ-ভুবনে শুধু তুমিই বলতে পারো, মনে হল কবিতা, মনে হল গান, মনে হল প্রেম—আমাকেই নিবেদন করলে তুমি।
ভেবেছিলাম হয়তো বা ভুলে গেছি। কিন্তু ভোলা কি যায় ঠাকুরপো। তোমার কথাগুলি যে ঝরে পড়ছিল ফুলের মতো আমার মনোভূমিতে।
তুমি বললে, ‘নতুনবউঠান, মালা গাঁথতে-গাঁথতে জানলার কাছে বসে কার কথা ভাবছ অমনভাবে করতলে রাখি মাথা? তোমার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে, তুমি ভুলে গেছ মালা গাঁথা!’ ঠাকুরপো, তোমার হাতটিকে আমার গালের উপর চেপে বলেছিলাম, ‘তোমারই জন্যে মালা গাঁথছি ঠাকুরপো, তোমারই কথা ভাবতে-ভাবতে ভুলে গেছি মালা গাঁথতে। ‘
তুমি বললে, ‘আমার কথা ভেবে মালা গাঁথতে ভোলোনি। ভুলেছ ওই যে ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায় আর কানে কানে কী যে কহে যায়—সেই জন্যে। ওই যে চোখের ওপর ভেসে যাচ্ছে মেঘ, উড়ে যাচ্ছে পাখি আর সারাদিন ধরে বকুলের ফুল ঝরে পড়ছে থাকি-থাকি, ভুলেছ সেই জন্যে।
আমি তোমার কথা শুনে কেমন বিহ্বল হয়ে গেলাম। তুমি আমার আদ্দেক গাঁথা মালাটি নিলে আমার কোল থেকে তুলে। দিলে আমার বেণীর সঙ্গে জড়িয়ে। তারপর একটু নীচু হয়ে কানের কাছে মুখ এনে বললে, ‘নতুনবউঠান, লোভন হয়েছে গ্রীবাটি তোমার। ‘ আচমকা তোমার ঠোঁট আদর করল আমার উন্মুখ গ্রীবা। তুমি আমার কানে-কানে বললে, ‘নতুন বউঠান, তোমার এই মধুর অলস, এই মধুর আবেশ, মধুর মুখের এই হাসি—আমার প্রেমের মধ্যে থেকে গেল তাদের মূল্যের পরিমাণ। ‘
ঠাকুরপো, আমার হাসি, যার জন্যে তুমি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলে একদিন, সেই হাসি দেখার জন্যে তোমার কত না কথা, কত দুষ্টুমি, ফন্দি, কৌতুক,—সত্যি করে বলো ঠাকুরপো সেই হাসির কথা তোমার আজও মনে পড়ে?
তুমিই তো একদিন আমাকে বলেছিলে, ‘ধীরে ধীরে প্রাণে আমার এসো হে, মধুর হাসিয়ে ভালোবেসো হে। ‘ সেই গান আর একদিন তোমার নতুন বউয়ের দিকে তাকিয়ে তুমি গাইতে পারলে! মনে পড়ে, দক্ষিণের বারান্দায় সেদিন কেউ ছিল না। শুধু তুমি আর আমি। বিকেলবেলা গা ধুয়ে ছাদে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছি, তুমি এলে ছুটে। আমার চিবুক ধরে মুখটি তুলে ধরলে। আমার দৃষ্টি আটকে গেল তোমার চোখে।
তুমি কী বলেছিলে ভুলিনি। বলেছিলে, ‘তোমার এই চকিতের চাউনির দান সংসারের আর সমস্তকে ছাড়িয়ে আমারই হাতে এসে পৌঁছেছে। নতুনবউঠান, একে আমি রাখব গানে গেঁথে, ছন্দে বেঁধে। আমি একে রাখব সৌন্দর্যের অমরাবতীতে। ‘
আমি বললাম, ‘ঠাকুরপো, আমার চোখের জলে সেই অমৃত নেই যাতে এক নিমেষের চাউনিকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে পারে। মেঘের সকল সোনার রং যে-সন্ধ্যায় মিলিয়ে যায়, একদিন সেই চাউনিও সেই সন্ধ্যায় মিলিয়ে যাবে। হাজার কথার আবর্জনা, হাজার বেদনার স্তুপে তুমি। আজকের এই মুহূর্তটিকেও হারিয়ে ফেলবে একদিন। ‘
তুমি আমার কথার উত্তরে তেমন কিছুই বললে না। বললে অনেক রাতে, ছাদের অন্ধকারে। কী বলেছিলে আজ তোমার মনে নেই। বলেছিলে, ‘নতুনবউঠান, আমি চাইনে রাজার প্রতাপ। আমি চাইনে ধনীর ঐশ্বর্য। তোমার চোখের মায়াই আমার চিরদিনের ধন। তাই দিয়েই আমি অসীমের গলার হার গাঁথি।
বন্ধু, কত কথা যে মনে পড়ছে। যত এগিয়ে আসছে সময়, ততই যেন কোনও কোনও মুহূর্তকে। আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে। আবার এই মুহূর্তগুলোর জন্যই বেঁচে থাকার কষ্ট আর সহ্য করার শক্তি নেই আমার। মনে পড়ছে সেই দুপুরবেলাটি। বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। কখনও-কখনও কমে আসছে বৃষ্টি। আবার দমকা হাওয়া তাকে মাতিয়ে তুলছে।
ঘরে দিনের বেলাতেই বাতি জ্বালিয়ে রেখেছি। হাওয়ার দাপটে কাঁপছে তার শিখা। কিছুতেই কাজে মন যাচ্ছে না। হঠাৎ তুমি তোমার ঘরে বর্ষার গানে লাগালে মল্লারের সুর।
তখন তোমার-আমার জীবন ছিল অন্যরকম। তখন তোমার ঘর ছিল শুধু তোমারই ঘর। সেই ঘরে আমার গতিবিধি ছিল অবাধ। কোনও কুণ্ঠার পরদা ছিল না মাঝখানে।
তোমার মল্লার আমাকে ডাকল। যেমন করে গাইছিল আকাশ, ঠিক তেমনি করেই গাইলে তুমি। পাশের ঘর থেকে একবার এলেম তোমার দুয়ার পর্যন্ত।
আবার ফিরে গেলাম। আবার একবার বাইরে এসে দাঁড়ালাম। তারপর তোমার মগ্ন মল্লারের টানে ভিতরে না এসে পারলাম না। ধীরে ধীরে ভিতরে এসে বসলাম তোমার পাশটিতে। তোমার মনে আছে ঠাকুরপো? না কি সব ভুলে গেছ?
হাতে ছিল আমার সেলাইয়ের কাজ। আমি মাথা নীচু করে তোমার পাশে বসে সেলাই করতে লাগলুম। তোমার আকাশের মতো গান, তার সমস্ত মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়-বিদ্যুৎ নিয়ে, আমার সমস্ত শরীরের ওপর ছড়িয়ে দিল আদর। এমন আদর তোমার কাছ থেকে আমি কোনওদিন পাইনি।
বৃষ্টি ধরে এল। তোমার গান থামল। আমি আমার সেলাই বন্ধ করে জানলার বাইরে ঝাপসা গাছগুলোর দিকে চেয়ে রইলুম। মনে হল, আমার জীবনের মতোই ঝাপসা ওরা।
তারপর একটিও কথা না বলে আমি আমার ঘরে ফিরে এলাম চুল বাঁধতে। ঠাকুরপো, সেদিন আমি গা ধুইনি। পাছে ধুয়ে যায় তোমার আদর। যেমন ধুয়ে যায় নাগকেশরের সোনালি রেণু বৃষ্টিতে।
ঠাকুরপো, আমি তোমাকে চিনি, জানি, কাছে পেয়েছি, ভালোবেসেছি সতেরো বছর ধরে।
কেমন করে তোমাকে ছেড়ে থাকব ঠাকুরপো? তুমি বিলেত চলে যাবে, তোমাকে ছেড়ে থাকতে হবে, কেমন করে সেই যন্ত্রণা ঠাকুরবাড়ির বন্ধুহীন পরিবেশে আমি সহ্য করব—সে-কথা ভেবে আমি চেষ্টা করেছিলাম আত্মহত্যার। কিন্তু মরতে পারিনি। তোমারই জন্যে হয়তো পারিনি ঠাকুরপো।
এবার পারব তো? মৃত্যুর পরে তোমাকে ছেড়ে থাকব কেমন করে ঠাকুরপো?
তোমার বিয়ের কথা যখন সব পাকা হয়ে গেল, যখন আর ফেরবার পথ নেই তোমার, যখন আমি জানলাম, তোমাকে হারিয়েছি আমি চিরদিনের জন্যে, আমার রবি এখন অন্যের, আমার সঙ্গে এলে দাবা খেলতে।
আমার সঙ্গে দাবার খেলায় জিততে পারতে না কখনও। ভাব দেখাতে যেন ইচ্ছে করেই হেরেছ।
আমি বললাম, ‘আমি হেরে গেছি রবি। আর আমি খেলব না। ‘
তুমি বললে, ‘তুমিই তো জিতে গেলে বউঠান। আমার জীবনটাই হয়ে যাবে ওলোটপালোট। নতুন বউঠান, তুমি তবু একলা থাকতে পারবে এত বছরের তোমার-আমার কত আসাযাওয়ার, কত দেখাদেখির, কত বলাবলির, তারই আশেপাশে কত স্বপ্ন, কত অনুমান, কত ইশারার স্মৃতি নিয়ে। আমার জীবন থেকে একাকিত্বের সেই গৌরবটুকুও হারিয়ে যাবে। ইচ্ছে করলেও আমি। তোমার চোখের শুকতারার আলো, তোমার চুলের চামেলি ফুলের গন্ধ, তোমার হাসির ইশারার স্মৃতির সঙ্গে একলা হতে পারব না। নতুন সম্পর্কের চাহিদার ভিড়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। ‘
ঠাকুরপো তোমার কথা শুনে আমার চোখে জল এল। কিছুতেই লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। বেদনা।
তুমি আমার ঘরে খাটে এসে বসে রইলে অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ আমার হাত দুটি তোমার বুকে চেপে ধরে বললে, ‘কতভাবে তুমি আমার নাম ধরে ডেকেছ বউঠান! ওই নামে, ওই ডাকে যে-মানুষ এতকাল সাড়া দিয়েছে সে তো শুধু বিধাতার রচনা নয়। নতুনবউঠান, সে-মানুষ যে তোমারও রচনা। ‘
আমি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ভেঙে পড়লাম কান্নায় তোমার বুকের ওপর।
তোমার কথাগুলি মিশে গেল তোমার গভীর আলিঙ্গনে। আমার মনে আছে সেই কথা, ‘নতুনবউঠান, কখনও আদরে, কখনও অনাদরে, কখনও কাজে, কখনও অকাজে, কখনও সবার সামনে, কখনও একলা আড়ালে, কেবল একটি মানুষের মনে মনে জানা দিয়ে গড়া এই আমি। আর যে-মানুষটি এত বছর ধরে আমাকে গড়ল, সে তুমি বউঠান, সে তুমি। ‘
ঠাকুরপো, সেদিন তোমার কথার উত্তরে কোনও কথা বলতে পারিনি আমি। বেদনার আচ্ছন্নতায় ডুবে গিয়েছিলাম। আজ যাওয়ার বেলায় তোমাকে বলি, ‘এই যে তোমাদের সতেরো বছরের জীবন, কত মনে পড়া, কত টাটকা গন্ধ, কত ক্লান্ত সুর, কত বৃষ্টির মতো আদর,—এসব থাকবে কোথায়? তুমি তো আর তাদের ডেকে নিয়ে গিয়ে ঘরে রাখতে পারবে না। ঠাকুরপো, আমার সঙ্গে তাদেরও বিদায় জানিও। ওরা উড়ে চলে যাক বাতাসে। ওদের আর খুঁজতে বেরিও না।
রবি মনে আছে তোমার, তুমি পানতাভাত খেতে ভালোবাসতে? চিংড়িমাছের চচ্চড়ির সঙ্গে পানতাভাত! ইস্কুল থেকে ফিরেই খুব খিদে পেত তোমার। তখন খেতে পানতাভাত। আর খেতে দিতে হত আমাকে। না হলে তোমার মুখে রুচত না।
বিলেত থেকে ফিরেই তুমি খেতে চাইলে পানতাভাত আর চিংড়ি চচ্চড়ি। আমি তো অবাক। বললাম, ‘ঠাকুরপো, কত ভালো ভালো রান্না খেয়ে এসেছ, মেমসাহেবদের হাতের রান্না, এখন। কি আমার তৈরি পানতাভাত আর চিংড়ির চচ্চড়ি তোমার ভালো লাগবে?’
তুমি হেসে বললে, ‘নতুনবউঠান, সারা ভুবন ভ্রমিয়া যে-স্বাদ পাইনি সে তোমার মেখে দেওয়া পানতাভাতের স্বাদ। ঠিক যেমন দিতে ছেলেবেলায় তেমনি দাও তো, চিংড়িমাছের চচ্চড়ির সঙ্গে পানতাভাত অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে। ওই আভাসটুকু যেন হয় তোমার হাতের। অমন আর কেউ পারে না নতুনবউঠান। ‘
কত কথা যে মনে পড়ছে ঠাকুরপো! এলোমেলোভাবে। তা হোক। মনটা আলগা করে দিয়েছি। জীর্ণ মনটা নিজেকে হালকা করুক। ভার বহন করতে আর যে পারছে না। তুমি যাকে বলতে, নীচের তলার চোরাকোনা দেয়ালের প্যাকবাক্স’, যেখানে আমাদের মতো গরিব আত্মীয়স্বজন আটক পড়েছে, সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে যখন ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে এলাম তোমাদের বাড়ির অন্দরমহলে, দেখলাম এ-বাড়ির চালচলন একেবারে অন্যরকম। ক্রমশ সেই ঠাকুরবাড়িও বদলে গেল। এখন এখানে আর নিশ্বাস নেওয়া যায় না। অন্তত আমি পারি না। আমার কাছে। জোড়াসাঁকোর বাড়ি যেন এক প্রেতপুরী—এখানে আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি, তাই অনেক সময় বুঝতে পারি না। এ-বাড়ির সব আনন্দ, সমারোহ, নিভে গেছে, অন্তত আমার জন্যে। গান বাজনার যে-আসর এ-বাড়িতে বসত, কত নাটক, কবিতা, গল্পের আসর, সব উধাও। শুনেছি মেজবউঠাকরুণের বাড়িতে এখন সাহিত্যসভা হয়। যত আলো সেখানে। আমার ঘরে সামান্য বাতিটুকুই আমার সম্বল। মেজবউঠাকরুণের মজলিসে আমায় ডাকে না।
হঠাৎ মনে পড়ছে তোমার মা, আমার শাশুড়িঠাকরুণকে। ভিতরের পাঁচিল ঘেরা ছাদে তিনি বসেছেন সন্ধেবেলায় মাদুর পেতে। তাঁর সঙ্গিনীরা বসেছেন তাঁকে চারদিকে ঘিরে। হালকা হাসিতামাশা আর পরচর্চা। আমার শাশুড়িঠাকরুণের সঙ্গিনীদের কেউ-কেউ ছিলেন পরের বাড়ির খবর সরবরাহে বিশেষ পারদর্শিনী। এঁদের মধ্যে একজনকে ডাকা হত আচার্জিনী নামে। তিনি। জনৈকব্রজ আচার্জির বোন। তিনি যেসব খবর জোগাড় করে আনতেন তার বোধহয় অধিকাংশই শোনা খবর। বা স্রেফ বানানো। কিন্তু শাশুড়িঠাকরুণ বিশেষ পছন্দ করতেন তাঁকেই তাঁর রসালো গল্পের জন্যে। আমার অবিশ্যি প্রবেশাধিকার ছিল না ছাদের সেই বৈঠকে। কিন্তু তুমি এক একদিন ঢুকে পড়তে তোমার বিদ্যেবুদ্ধি জাহির করতে ওই মহিলামহলে।
ঠাকুরপো, তখন তুমি-আমি একই সঙ্গে লেখাপড়া শিখছি। তোমার নতুন শেখা বিদ্যে জাহির করার একটা সহজ জায়গা তোমার মায়ের সঙ্গিনীদের ওই বিকেলবেলার আড্ডাতেই। তোমার টাটকা পুঁথিপড়া বিদ্যে নিয়ে প্রায়ই ছুটে যেতে সেখানে। কখনও এই তথ্য পরিবেশন করে। মায়ের সঙ্গিনীদের তাক লাগিয়ে দিতে যে সূর্য পৃথিবী থেকে ন’কোটি মাইল দূরে। আবার কখনও ঋজুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ থেকে আউড়ে যেতে বাল্মিকী-রামায়ণের টুকরো। তোমার এই বিদ্যেবুদ্ধি জাহিরের ব্যাপারটায় আমি খুব মজা পেতাম।
বাড়ির ভিতরের ছাদটাকে দখল করে নিয়েছিল ঠাকুরবাড়ির মহিলামহল। এই ছাদটা ছিল ঠাকুরবাড়ির ভাঁড়ার ঘরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। মেয়েরা দুপুরবেলা ছাদে যেত অনেক কাজ একসঙ্গে করতে। রোদে শুকোতো এলো চুল। জারক নেবুও জারিয়ে নিত ওই রোদে। পিতলের গামলা ভরা কলাইবাটা নিয়ে তারা বড়ি দিত ছাদেই।
ওই মেয়েদের ছাদেই তোমার সঙ্গে আমার প্রথম বন্ধুত্ব ঠাকুরপো। তখন তোমার বয়েস সাত। আমি তোমার চেয়ে দু’বছরের বড়। কাঁচা আম ফালি করে কেটে আমসি শুকোনো হত। তোমার নজর ছিল সেই দিকে। তুমি ঘুরঘুর করতে রোদ খাওয়া সরষের তেলে মজে-ওঠা ইঁচড়ের। আচারের পাত্রগুলির পাশেও। ধরা পড়বার সম্ভাবনা দেখলেই ভান করতে, যেন তোমার ছাদে আসার প্রধান উদ্দেশ্য কাক তাড়িয়ে আমাকে সাহায্য করা।
ঠাকুরপো, আজ তুমি সবই ভুলেছ, ভুলতে পারলাম না আমি। বাড়িতে তুমিই ছিলে আমার একমাত্র দেওর। আমাদের বন্ধুত্বের শুরু আমসত্বের হাত ধরে নিশ্চয় মনে পড়ে না তোমার। তোমাকে নিযুক্ত করেছিলাম আমি আমার আমসত্বের পাহারাদার। তখন থেকেই তোমাকে মনে মনে খুব ভালোবেসেছিলুম আমি। তোমাকে চাইতাম আমার সব খুচরো কাজের সাথি করে। তুমিও ছিলে এক পা বাড়িয়ে। ইস্কুলে যেতে তুমি একেবারে চাইতে না। কারণটা যে ছিল আমার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্বের টান, সে কি আমি বুঝতাম না ভেবেছ। তুমি ইস্কুল ছুটি হলেই সোজা চলে আসতে আমার ঘরে সেখানে আমিই তোমাকে শিখিয়েছিলুম জাঁতি দিয়ে সুপুরি কাটতে। খুব সরু করে সুপুরি কাটতে পারতে তুমি। আমি যেই তোমার সুপুরি কাটার প্রশংসা করতাম, অমনি আরও তাড়াতাড়ি আরও সরু করে সুপুরি কাটতে তুমি। আমি মনে মনে বেশ মজা পেতাম।
ঠাকুরপো, এ-বাড়ির বউ হয়ে আসার পর তুমিই আমাকে দিলে মুক্তির প্রথম স্বাদ, চেনালে আমার প্রথম ছুটির দেশ। আমাকে ভোরবেলা একদিন নিয়ে গেলে বাইরের ছাদে।
বলেছিলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অনেক ভোরবেলা যেন আমি তোমার সঙ্গে দেখা করি তেতলার বাবামশায়ের ঘরের সামনে। তাই করলাম আমি। চুপিচুপি গেলাম সেখানে।
দেখলাম, তুমি সেখানে দাঁড়িয়ে। বললে, আর দেরি করলে দেখতে পেতে না। আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি।
আমি তো অবাক। কাকে দেখব এত সকালবেলা! তুমি আমাকে হাত ধরে ছুটিয়ে নিয়ে গেলে বাইরের ছাদে। চিলেকোঠার আড়ালে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখলাম, সূর্য উঠছে।
আমার জীবনে সেই প্রথম সূর্যোদয়। তোমার হাত ধরে।
আমার জীবনে সেই সূর্য আজ নিভে যাবে। আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা বাকি। তুমি কোথায় ঠাকুরপো?
ঠাকুরপো, মনে আছে তোমার, কারণে-অকারণে কত চিঠি লিখতে আমাকে। একই বাড়িতে একই ছাদের তলায় আমি, তবু লিখেছ চিঠি! যে কথা মুখে বলতে না, বলতে চিঠিতে। আমিও যে লিখিনি তোমাকে, তা নয়। তবে তোমার মতন কি লিখতে পারি আমি? তোমার দুঃখ, তোমাকে আমি চিঠির উত্তরে সব সময়ে লিখতাম না বলে। তা ছাড়া, আমার চিঠি হত ছোট সেটাও ছিল তোমার দুঃখের কারণ। আজ তোমার সেই দুঃখ হয়তো কিছুটা মিটিয়ে দিয়ে গেলাম।
আমার রবি, তুমি যত চিঠি লিখেছ আমাকে, আমি তোমাকে লিখেছি যত চিঠি, সব ছিল আমার কাছে, আমার আলমারির গোপন ড্রয়ারে। যেখানে কারও হাত পৌঁছবার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। তোমার বিয়ের ক’দিন আগে তুমি এলে আমার ঘরে। নির্জন দুপুরে, যেমন আসতে তুমি, আমার সঙ্গে কত সময় কাটিয়েছ তুমি আলস্যের দুপুরবেলায়। সেদিন তোমার চোখ দেখেই বুঝলাম, আজকের দুপুর অন্যরকম হতে চলেছে। গভীর বেদনাবোধ আর হতাশা ফুটে উঠেছিল তোমার চোখে।
তুমি এসেই আমার হাতে ধরিয়ে দিলে হাতির দাঁতের কাজ করা একটি কাঠের বাক্স। বললে, নতুনবউঠান, এই বাক্সে আছে আমাকে লেখা তোমার সব চিঠি। আজ থেকে তুমিই এদের আশ্রয় দিও। আমার মনে হল, কান্না চেপে কথাগুলি বললে আমাকে। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেলে আমার ঘর থেকে।
সেদিনের পরে আর কখনও চিঠি লেখোনি আমাকে। আমি রোজ ভাবতাম, আজ তোমার চিঠি পাব নিশ্চয়। কিন্তু আর কোনওদিন একটিও চিঠি এল না। হঠাৎ যেন তোমার ভালোবাসা মরুপথে হারাল ধারা। কিংবা বেঁকে গেল অন্য কারও জন্যে অন্য কোনও পথে।
আজ তোমার-আমার সব চিঠি ছড়িয়ে দিয়েছি আমার লেখার টেবিলে। তাদের আমি মুক্তি দিয়ে গেলাম ঠাকুরপো। আমার চিতার আগুনে আমারই সঙ্গে তারাও শেষ হোক—এই আমার শেষ বাসনা।
ঠাকুরপো, একটি চিঠিতে তুমি লিখেছ—চিঠিটা লিখেছিলে বিলেত থেকে ফিরেই লিখেছ তুমি, ‘আমার নতুন বউঠান, দু-বছর পরে বিলেত থেকে ফিরে এসে দেখলেম, যে উনিশবছরের মেয়েটিকে ফেলে গিয়েছিলেম আর যে একুশ বছরের মেয়ের কাছে ফিরে এলেম, তারা যেন এক মেয়ে নয়। সত্যি কথা বলবে বউঠান—তুমি কি আমার ফিরে আসার পথ চেয়ে বসে থাকনি?
ফিরে এসে ক্রমশ বুঝতে পারছি ঠাকুরবাড়িতে একুশ বছরের তুমি কত একা! তোমাকে যে। আমাদের কর্মচারী শ্যাম গাঙ্গুলির মেয়ে বলে আমাদের বাড়ির মহিলামহলে কত গঞ্জনা শুনতে হয়, সে-কথা বুঝতে পেরেছি আমি। তোমাকে কথা শুনতে হয় তোমার গায়ের রং কালো বলেও। অথচ তোমার ওই লাবণ্যময় শ্যামলবর্ণ আমার কত আদরের তা তো তুমি জানো। তুমি নিঃসন্তান বলেও তোমাকে খোঁটা দিতে সবাই সুযোগ খোঁজে। নতুনবউঠান, যতই দেখছি এ-বাড়িতে। তোমার প্রত্যহের কষ্ট, ততই যেন আরও বেশি ভালোবাসছি তোমাকে। তোমার প্রতি আমার এই ভালোবাসা ঠাকুরবাড়ির হৃদয়হীনতার বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদও বলতে পারো।
এইসব প্রতিকূলতা সত্বেও আমি বিলেত থেকে ফিরে আসতেই আমাদের দু’জনের জীবনে যেন। উজান এসেছে। আমার উনিশ আর তোমার একুশ ভেসে যাচ্ছে সেই উজানে,—বন্ধনহীনগ্রন্থিতে আমরা বাঁধা পড়েছি দু’জন দু’জনের সঙ্গে, কোনও বাধা নেই কোথাও। এই যে যৌবনের আরম্ভেই বাংলাদেশে ফিরে এসেছি—এ ঘটনা ঘটেছে তোমার-আমার ভাগ্যের টানে। অন্যরকম কিছুতেই হতে পারত না। ফিরে এসেই তোমাকে পেলাম—অন্য তুমি। পেয়েছি সেই ছাদ, সেই চাঁদ, সেই নিজের মনের বিজন স্বপ্ন, সেই ধীরে-ধীরে ক্রমে-ক্রমে চারদিক থেকে ঘনিয়ে ওঠা, প্রসারিত সহস্র বন্ধন! নতুনবউঠান—এ তোমার বন্ধন। মুক্তি চাইনে আমি। কোনওদিন চাইব না। আমি বিলেত থেকে ফিরে অব্দি তোমার নাগপাশে জড়িত বেষ্টিত হয়ে চুপ করে বসে আছি। আমার খুব ভালো লাগছে নতুনবউঠান।
ঠাকুরপো, এই তো আর একটা চিঠি। সারা চিঠিতে শুধু দুষ্টুমি। সত্যিই তুমি এত ভালোবাসতে আমাকে? লিখেছ ‘নতুনবউঠান, এত ছলচাতুরি, প্রেমের এতরকমের খেলা তুমি শিখলে কোথায় বলোতো? সেদিন সবাই আমরা বসেছি খেতে। জ্যোতিদাদা, আমি, সেজদাদা। মেজবউঠাকরুণ আর তুমি করছ পরিবেশন। কী যে সুন্দর দেখাচ্ছে তোমার লালপাড় ডুরে শাড়িতে। তুমি আমার কাছাকাছি এসেই তুললে তোমার কনক কাঁকনের তরঙ্গ। কত ছলভরে যে বাজাতে পারো তুমি তোমার সোনার চুড়ির গোছা। কে কি বুঝল জানি না, আমি বুঝলাম, এই কঙ্কনঝংকার আমার। জন্যে। আর তখুনি আমার মনে হল, তুমি শ্রীরাধা। মুহূর্তে আমার চোখের সামনে বদলে গেল দৃশ্য। দেখলাম তুমি যমুনার জলে কনককলসে জল ভরছ আর ইচ্ছে করে আমারই জন্যে কত ছলভরে বাজাচ্ছ তোমার কাঁকনগুচ্ছ। আমার মন যেন যমুনার জল নতুনবউঠান। সেই জলে নেমেছ তুমি। তোমার দিকে তাকিয়ে, তোমার চুড়ির শব্দ শুনে, আমার মন বলে উঠল, কেন বাজাও কাঁকন কত ছলভরে। তুমি যেন আমার মনের কথা বুঝলে। আমার পাতে পরিবেশন শেষ করে তুমি এগিয়ে গেলে বটে মেজদাদার দিকে, চকিত নয়নে আমার দিকে তাকানো তোমার। ফুরল না। আমার মন যেন জল। তুমি পায়ে-পায়ে এগিয়ে যাও। অথচ আমার মনে হয় তুমি সাঁতার কাটছ আমার মনের স্রোতে। জলে ঢেউ তুলে তুলে খেলা করছ। এক সময়ে খাওয়াদাওয়া শেষ হল। আমি ফিরে এলাম আমার ঘরে। তবু সেই যে ঢেউ তুললে তুমি আমার মনে, সেই সব। হাসিভরা ঢেউ কলস্বরে কানাকানি করতেই থাকল মনের মধ্যে। জানলা দিয়ে দেখলাম আকাশে ক্রমে জমছে মেঘমালা। মনে হল, সেই মেঘ বাগানকিনারে তোমারই মুখপানে তাকিয়ে। নতুনবউঠান, হঠাৎ তোমার উদ্দেশ্যে মনের মধ্যে ভেসে উঠল দুটি সহজ সরল লাইন—
প্রকাশ করি কিসের ছলে মনের কথা
তোমার রঙিন পাতায় লিখব প্রাণের কোন বারতা।