৪. সন্ন্যাসীর শরীর

সন্ন্যাসীর শরীর

শরীরম্‌ ব্যাধিমন্দিরম্‌! এদেশের কোন মহাপুরুষ কথাটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন তা আমার জানা নেই। স্বামী বিবেকানন্দের অসুখবিসুখ সম্বন্ধে খবরাখবর নিতে গেলেই কথাটা কিন্তু বারবার মনে পড়ে যায়। আমার পিতৃদেব অকালে মৃত হয়েছিলেন, সেই থেকে পিতৃস্থানীয়দের অকালপ্রয়াণ এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর ওই ধরনের দুর্ঘটনার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাকে আজও নাড়া দেয়। এই মানসিকতা থেকেই নরেন্দ্রনাথ দত্ত ওরফে স্বামী বিবেকানন্দের শরীর-স্বাস্থ্য আমার অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

নরেন্দ্রনাথের পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্তর মৃত্যু হয় ১৮৮৪ সালে, ৫২ বছর বয়সে। তার জ্যেষ্ঠপুত্রের বয়স তখন ২১ বছর।

কর্পোরেশন ডেথ রেজিস্টার অনুযায়ী বিশ্বনাথ দত্তের মৃত্যুর কারণ বহুমূত্ররোগ, দেহাবসানের তারিখ ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪। স্বামী গম্ভীরানন্দের বিবরণ সামান্য আলাদা : “১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে ফেব্রুয়ারি সোমবার অপরাহ্নে তিনি (নরেন্দ্র) বরাহনগরে আগমনপূর্বক সঙ্গীতাদিতে রাত্রি প্রায় এগারটা পর্যন্ত কাটাইয়া শয্যাগ্রহণানান্তে বন্ধুদের সহিত নানাবিধ আলাপে নিযুক্ত আছেন, এমন সময় তাহার বন্ধু ‘হেমালী রাত্রি প্রায় দুইটার সময় সেখানে আসিয়া খবর দিলেন, তাঁহার পিতা অকস্মাৎ ইহলোক ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন।” বিভিন্ন সূত্র থেকেই হৃদরোগকে বিশ্বনাথ দত্তের মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে।

পিতৃদেবের স্বাস্থ্যের ইতিহাসটি ভাল নয়। মৃত্যুর একমাস আগেই ডায়াবিটিসের রোগী বিশ্বনাথের হৃদরোগ দেখা দেয় এবং মৃত্যুর দিনে তিনি স্ত্রীকে বলেন, “তিনি হৃদয়ে বেদনা অনুভব করিতেছেন। অতঃপর রাত্রে আহারের পর বুকে ঔষধ মালিশ করাইয়া তামাক সেবন করিতে করিতে তিনি কিছু লেখাপড়ার কাজে মন দেন; নয়টায় উঠিয়া বমি করেন এবং তারপরেই রাত্রি দশটায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া যায়।”

মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের স্মৃতি অনুযায়ী নরেন্দ্রনাথ বরাহনগর থেকে সোজা নিমতলা ঘাটে চলে আসেন। শ্মশানের মিউনিসিপ্যাল ডেথ রেজিস্টারে নরেন্দ্রনাথ তার পুরো নাম ইংরিজিতে লেখেন।

পৈত্রিক দিক থেকে দীর্ঘজীবী হওয়ার তেমন কোনো প্রমাণ স্বামীজির বংশতালিকায় পাওয়া যাচ্ছে না। দশভাইবোনের সংসারেও অনেকেই অকালে দেহরক্ষা করেছেন। তবে তাঁর দিদি স্বর্ণলতা, মেজভাই মহেন্দ্রনাথ এবং ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ দীর্ঘজীবনের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। জননী ভুবনেশ্বরী শোকতাপে জর্জরিত হয়েও বাহাত্তর বছর বেঁচেছিলেন, তার মৃত্যুর কারণ যে মেনিনজাইটিস তা আমাদের অজানা নয়। ভুবনেশ্বরী-জননী রঘুমণি দেবী বেঁচেছিলেন ৯০ বছর, তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে মিউনিসিপ্যালিটির খাতায় লেখা আছে ‘বার্ধক্যজনিত দৌর্বল্য’। জীবিতকালে তাঁর শেষ আশ্রয় নিমতলা গঙ্গাযাত্রীনিবাস।

স্বামীজির স্বল্পায়ুকে চেষ্টা করে পুরোপুরি বংশধারার সঙ্গে যুক্ত করাও সুবিবেচনার কাজ হবে না, কারণ দিদি স্বর্ণময়ী বেঁচেছিলেন ৭২ বছর। কর্পোরেশন মৃত্যু-রেজিস্টার অনুযায়ী স্বর্ণময়ীর দেহাবসান ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২, আনুমানিক বয়স ৭০। মেজভাই মহিম বেঁচেছিলেন ৮৮ বছর এবং ছোট ভূপেন্দ্রনাথ ৮১ বছর। তবু পারিবারিক ব্যাধি ডায়াবিটিস ও হার্ট অ্যাটাকের কথা মনে রেখেই স্বামীজির শরীর ও রোগের মানচিত্র আমাদের আঁকতে হবে।

সেই সঙ্গে সকলকে জানানো দরকার কী-ধরনের শারীরিক জ্বালাযন্ত্রণার মধ্যে তিনি কী সব কাজ এই পৃথিবীতে করে গেলেন। অসম্ভব যেভাবে তার জীবনে সম্ভব হয়েছে তা পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হতে পারে।

নরেন্দ্রনাথের শৈশবকাল থেকে ৪ জুলাই ১৯০২ পর্যন্ত দেশে-বিদেশে বিভিন্নভাবে শরীর সংক্রান্ত যেসব খবরাখবর ছড়িয়ে রয়েছে তা এবার সাজিয়ে না ফেললে অনেক মূল্যবান ছোটখাট বিবরণ চিরদিনের মতন অনুসন্ধিৎসুদের দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে পারে।

ব্যাধির প্রসঙ্গে ঢোকবার আগে স্বামীজির অবয়ব সম্বন্ধে কিছু জানবার আগ্রহ সর্বস্তরেই রয়েছে। কেমন দেখতে ছিলেন মানুষটি? কত ছিল তার উচ্চতা? ওজন কত? গায়ের রঙ কী রকম? পায়ের জুতোর সাইজ কত? এসব বিষয়েও সম্পূর্ণ তথ্য সবসময় আমাদের হাতের গোড়ায় নেই।

সমকালের ভারতীয়দের মস্ত দোষ, তারা একজন স্মরণীয় মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে নানাবিধ মন্তব্য করেন, কেমন দেখতে তাও বলেন, কিন্তু তথ্যভিত্তিক বিবরণ দেন না।

প্রমথনাথ বসু তাঁর বইতে বিবেকানন্দ সম্বন্ধে বলেছেন, সুগঠিত অবয়ব, তার মধ্যে সিংহাবয়বের সৌন্দর্য। কিন্তু স্বামীজির শরীরের মাপজোখের জন্য আমাদের শরণাপন্ন হতে হবে রোমাঁ রোলাঁর। সাবধানী ইউরোপীয় ও আমেরিকান লেখকরা যথা সময়ে কলম না ধরলে আমরা অনেক বিবরণ জানতে পারতাম না।

রোলাঁ তার বিখ্যাত বইয়ের শুরুতেই লিখছেন : “বিবেকানন্দের দেহ ছিল মল্লযোদ্ধার মত সুদৃঢ় ও শক্তিশালী। তাহা রামকৃষ্ণের কোমল ও ক্ষীণদেহের ছিল ঠিক বিপরীত। বিবেকানন্দের ছিল সুদীর্ঘ দেহ (পাঁচফুট সাড়ে আট ইঞ্চি), প্রশস্ত গ্রীবা, বিস্তৃত বক্ষ, সুদৃঢ় গঠন, কর্মিষ্ঠ পেশল বাহু, শ্যামল চিক্কণ ত্বক, পরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, সুবিস্তৃত ললাট, কঠিন চোয়াল, আর অপূর্ব আয়ত পল্লবভারে অবনত ঘনকৃষ্ণ দুটি চক্ষু।”

ভারতীয় অপেক্ষা তাতারদের সঙ্গেই তার চোয়ালের সাদৃশ্য ছিল বেশি। বিবেকানন্দর কণ্ঠস্বর ছিল ভায়লিনচেলো বাদ্যযন্ত্রের মতো। তাতে উত্থানপতনের বৈপরীত্য ছিল না, ছিল গাম্ভীর্য, তবে তার ঝঙ্কার সমগ্র সভাকক্ষে সকল শ্রোতার হৃদয়ে। ফরাসি গায়িকা এমা কালভে বলেন, তিনি ছিলেন চমৎকার ব্যারিটোন, গলার সুর ছিল চীনা গঙের আওয়াজের মতো। রোমাঁ রোলাঁর বর্ণনা অনুযায়ী বিবেকানন্দর ওজন ১৭০ পাউন্ড।

এই ওজন কি মাঝে-মাঝেই ওঠা-নামা করতো? কারণ অন্য এক পরিপ্রেক্ষিতে জনৈক মার্কিনী সাংবাদিক আন্দাজ করেছেন, স্বামীজির ওজন ২২৫ পাউন্ড। আবার কখনও দেখা যাচ্ছে, স্বামীজি নিজেই ওজন কমাবার জন্য কৃতসংকল্প হয়ে উঠেছেন। মনে হয়, ঝপ করেই তার ওজন বাড়তো আবার একটু চেষ্টাতেই আয়ত্তে এসে যেত।

প্রথমবার মার্কিন প্রবাসকালে নিউইয়র্ক থেকেডায়েটিংসম্বন্ধেবিবেকানন্দ লিখেছেন, “আজকাল দুধ, ফল, বাদাম–এই সব আমার আহার। ভাল লাগে, আছিও বেশ। এই গ্রীষ্মের মধ্যেই মনে হয় শরীরের ওজন ৩০৪০ পাউন্ড কমবে, শরীরের আকার অনুসারে ওজন ঠিকই হবে।”

প্রথমবার যখন স্বামীজি আমেরিকায় যান তখন “ফ্রেনলজিক্যাল জার্নাল অব নিউ ইয়র্কে” তাঁর শরীরের মাপ প্রকাশিত হয়।

নিজের ওজন নিয়ে স্বামীজির রসরসিকতার অন্ত ছিল না। আমেরিকায় একবার বক্তৃতার পর জনৈক মুগ্ধ ভক্ত তাঁকে প্রশ্ন করলেন,”স্বামীজি, আপনি কি ভগবানকে দেখেছেন?” স্বামীজির তাৎক্ষণিক উত্তর : “বলেন কি? আমাকে আমার মতন একজন মোটা লোককে দেখে কি তাই মনে হয়?”

কারও শারীরিক ওজনের উত্থান-পতনের গ্রাফের দিকে সাবধানী নজর রাখা দেহান্তের এতোদিন পরে সহজ কাজ নয়। আমাদের কাছে উপাদানের মধ্যে তখনকার মানুষের কিছু স্মৃতিকথা, ইংরিজি, বাংলা, সংস্কৃত ও ফরাসিতে লেখা তাঁর চিঠিপত্র এবং বিভিন্ন সময়ে তোলা কিছু ফটো, যা দেখলে সহজেই বোঝা যায় কোনো অজ্ঞাত কারণে তার ওজন সব সময় স্থির থাকছে না। এর পিছনে অদৃশ্য ডায়াবিটিস এবং কিডনির ব্যাধি কতটুকু কাজ করেছে তা নিয়ে ডাক্তারি অনুধ্যান করলে মন্দ হয় না।

১৮৯৯ সালে দ্বিতীয়বার বিদেশ যাবার সময় কলকাতায় তোলা ফটোগ্রাফে স্বামীজিকে উদ্বেগজনকভাবে শীর্ণ দেখাচ্ছে। কিন্তু লন্ডন হয়ে কয়েকমাস পরেই যখন তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় উপস্থিত হলেন, তখন ওজন আবার বেশ বেড়ে গিয়েছে।

রসিকচূড়ামণি বিবেকানন্দ তখন প্রায়ই নিজেকে ফ্যাট বা মোটকা মহারাজ বলতেন। আরও কয়েকমাস পরে বিবেকানন্দ যখন প্যারিসে হাজির হলেন তখন তার ওজন হুড়মুড় করে তিরিশ পাউন্ড কমে গিয়েছে। ব্যাপারটা মার্কিনী ভক্তদের সাবধানী নজর এড়ায়নি।

প্যারিস থেকে মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড তার বান্ধবী সারা বুলকে লিখছেন, “ওজন কমে যাওয়ায়, স্বামীজিকে বালকের মতন দেখাচ্ছে।” মার্কিনী ভক্তরা স্বামীজির বিভিন্ন ফটো দেখে আরও কিছু বিশ্লেষণ করেছেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় ভোলা ছবিগুলোতে তাকে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর দেখাচ্ছে। “উল্লেখযোগ্যভাবে হ্যাঁন্ডসাম”, এই শব্দটি তার সম্পর্কে ব্যবহার করা হয়েছে।

এ-বিষয়ে আরও আলোচনার আগে, বিবেকানন্দর ওজন ও অবয়ব নিয়ে আরও এক সরল মন্তব্যের আনন্দ উপভোগ করা যেতে পারে। প্রথমবার আমেরিকা থেকে ফিরে স্বামীজি অসুস্থ অবস্থায় কিছুদিন আলমোড়ায় ছিলেন। সেখান থেকে মেরি হেলবয়েস্টারকে তিনি লিখছেন, “…চিকিৎসকের ব্যবস্থামতো আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে সরলোলা দুধ খেতে হয়েছিল, আর তার ফলেই আমি পিছনের চেয়ে সামনের দিকে বেশি এগিয়ে গিয়েছি। যদিও আমি সবসময়ই আগুয়ান–কিন্তু এখনই এতোটা অগ্রগতি চাই না, তাই দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।”

স্বামীজির বিদেশি জীবনীকাররা মোটামুটি একমত যে তাঁর ওজনের ওঠানামা কখনই আয়ত্তে আনা যায়নি, যদিও মাঝে মাঝে তিনি খাওয়া দাওয়া বিপজ্জনকভাবে কমিয়ে দিতেন। তথ্যাভিজ্ঞদের মতে, ঐতিহাসিক শিকাগো বক্তৃতার সময় (১৮৯৩) তার ওজন মোটেই বাড়তির দিকে ছিল না, কিন্তু সম্ভবত তার পরেই ওজন স্বামীজির বাড়তে থাকে।

এর কিছুদিন পরেই মিস্টার হেলের বাড়িতে একটা ঘরে তোলা ছবিতে স্বামীজিকে বেশ মোটাসোটা দেখাচ্ছে, যদিও ক্যামেরা অনেকসময় দৃষ্টিবিভ্রম ঘটিয়ে মোটাকে রোগা এবং রোগাকে মোটা দেখাতে পারে। তবে এই সময় বল্টিমোরের এক সাংবাদিক তাঁর লেখায় ইঙ্গিত করেন, স্বামীজির ওজন ২২৫ পাউন্ড হবে।

কেমন ছিল স্বামীজির গায়ের রঙ? রোমাঁ রোলার বর্ণনা অনুযায়ী অলিভ। মনে হয় উজ্জ্বল গৌর বলতে পশ্চিমীরা যা বোঝেন তা তাকে বলা চলে না। এবিষয়ে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ একটি চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করেছেন। স্বামীজির দেহের রঙের পরিবর্তন ঘটতো–কোনদিন মনে হত একটু ময়লা, কোনদিন আরও ফরসা, কিন্তু সবসময় তাতে একটু আভা দেখা যেত যাকে সোনালি বলা চলে। স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ আরও জানিয়েছেন, তার “হস্তদ্বয় যে কোন নারীর হস্তের তুলনায় সুন্দর ছিল।”

বিবেকানন্দের শরীরের রঙ সম্বন্ধে নানা মুনির নানা মত–”কালোও নন প্রচণ্ড ফর্সাও নন”, “অলিভ”, “বেশ চাপা”, “লাইট”,”মুখে স্বাভা” ইত্যাদি, যা এতোদিন পরে ঠিকমতন আন্দাজ করা বোধ হয় সম্ভব নয়। তবে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ যে পরিবর্তনের কথা বলেছেন তা বেশ নির্ভরযোগ্য।

স্বামীজির মুখের আকার সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তোলা বিভিন্ন ফটোগ্রাফ কিছুটা দৃষ্টিবিভ্রম ঘটায়–বোঝা যায় কেন অনেকে তাঁর পরিপুষ্ট গোল মুখের কথা বলেছেন। আবার কারও নজর কেড়ে নিয়েছে তার শক্তিময় চিবুক।

স্বামীজির ঘন চুলের ঐশ্বর্য সম্পর্কে কিছু ধারণা কয়েকটা ছবি থেকে আমরা পাই। কোকড়া নয়, ঢেউ খেলানো বাবরি চুলের অরণ্য। এই ঘন কালো চুলের সামান্য একটু অংশ আচমকা মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউড একবার কেটে নিয়ে তার অস্বস্তির সৃষ্টি করেছিলেন। সেই চুলের অংশটুকু স্বর্ণালঙ্কারে ঢুকিয়ে মিস্ ম্যাকলাউড় সারাক্ষণ নিজের কাছে রাখতেন। দেশে ফিরে এসে বেলুড়মঠে মস্তক মুণ্ডনের সময়েও স্বামীজি নিজের চুল নিয়ে রসিকতা করেছেন। অমন সুন্দর চুল যা বিদেশে বক্তৃতাকালে কপাল পেরিয়ে প্রায় চোখের ওপর এসে পড়তো তা স্বদেশে ফিরে এসেই তিনি ফেলে দিলেন।

আমরা জানি বেলুড়মঠে তিনি প্রতি মাসে মস্তক মুণ্ডন করতেন। বেলুড় মঠে মাথা কামাচ্ছেন, যখন নাপিত চুলগুলো তাল পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, তখন তিনি সহাস্য মন্তব্য করলেন, “ওরে দেখছিস কি! এরপরে বিবেকানন্দর একগোছা চুলের জন্য ওয়ার্লডে ‘ক্ল্যামার’ পড়ে যাবে।”

নরেন্দ্র-অবয়ব সম্বন্ধে যখন নানা তথ্য একত্রিত করছি তখন বলে রাখি তাঁর ছিল ট্যাপারিং ফিঙ্গার’, বাংলায় মহেন্দ্রনাথ দত্ত যাকে চাপারকলি আঙুল বলেছেন। এই ধরনের আঙুল দ্বিধাশূন্য নিশ্চয়াত্মিক মানসিকতার ইঙ্গিত দেয়। তার নখ ছিল ঈষৎ রক্তবর্ণাভ এবং নখের মাথাটি ছিল ঈষৎ অর্ধচন্দ্রাকার। সংস্কৃতে এই দুর্লভ নখকে নখমণি’ বলে।

মহেন্দ্রনাথতার দাদারপদবিক্ষেপসম্বন্ধেওইঙ্গিত রেখেগিয়েছে–অতি দ্রুত বা অতি শ্লথ ছিল না, যেন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থেকে বিজয়াকাঙ্ক্ষায় অতি দৃঢ় সুনিশ্চিতভাবে ভূপৃষ্ঠে পদবিক্ষেপ করে চলতেন।

বক্তৃতা দেবার সময়ে বিবেকানন্দ ডান হাতের আঙুল প্রথমে সংযত করে হঠাৎ ছড়িয়ে দিতেন। মনে যেমন যেমন ভাব উঠতে “অঙ্গুলি সঞ্চালনও তদনুরূপ হইত।”

.

অবয়বের যে অংশ নিয়ে দেশে বিদেশে ভক্তদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই তা হলো স্বামীজির চোখ। যাঁরাই তার কাছে এসেছেন তারা এই সম্মোহিনী আঁখিপদ্মের জয়গানে মুখর হয়েছে।

“ভেরি লার্জ অ্যান্ড ব্রিলিয়ান্ট” এই কথাটি বারবার এসে পড়েছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে ও বিভিন্ন স্মৃতিকথায়। আরও কয়েকটি দুর্লভ ইংরিজি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে : “ফ্লোয়িং, গ্রেসফুল, ব্রাইট, রেডিয়ান্ট, ফাইন, ফুল অফ ফ্ল্যাশিং লাইট।” নিন্দুকরাও প্রকারান্তরে তার চরিত্রহননের ব্যর্থচেষ্টা করে আমেরিকায় গুজব ছড়িয়েছেন–মার্কিনী মহিলারা তার আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে পতঙ্গের মতন ছুটে আসছেন না, তাঁরা আসছেন তার আঁখিপদ্মের চৌম্বকশক্তিতে।

রোমাঁ রোলাঁও স্বামীজির পদ্মপলাশলোচনের রাজকীয় মহিমা বর্ণনার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।”বুদ্ধিতে, ব্যঞ্জনায়, পরিহাসে, করুণায় দৃপ্ত প্রখর ছিল সে চোখ, ভাবাবেগে ছিল তন্ময়, চেতনার গভীরে তা অবলীলায় অবগাহন করতো, রোষে হয়ে উঠতো অগ্নিবর্ষী, সে দৃষ্টির ইন্দ্রজাল থেকে কারও অব্যাহতি ছিল না।”

স্বামীজির চোখের বর্ণনায় ভারতীয়রাও তেমন পিছিয়ে থাকেননি। শুনুন স্বামী নির্লেপানন্দের মন্তব্য : “সে আঁখির তুলনা হয় না। স্বামী সারদানন্দ একদিন মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, সে যে কি চোখ–কি আর বলবো!..একজন বলেন, তিনি যখন বলরামবাবুর হলঘরে ঘুমিয়ে থাকতেন, দেখেছি, তখনও চোখ সবটা বুজতো না। পাতায় পাতায় কখনও জোড়া লেগে মুড়তো না। শিবনেত্র–সত্য সত্য।”

এই শিবনেত্রের জয়গান বিশ্বভুবনের প্রান্তে প্রান্তে। এই নেত্ৰবহ্নি যেমন সময়ে অসময়ে সমস্ত মায়ালোককে দগ্ধ করেছে, তেমন মুগ্ধ করেছে। সত্যানুসন্ধানী ভক্তজনকে। কিন্তু এই চোখে যে ঘুম আসতো না সেই বেদনাদায়ক সত্যটুকুর সঙ্গেও আমাদের পরিচয় প্রয়োজন।

এই ঘুমের ব্যাপারে কলকাতার শশী ডাক্তারকে (ঘোষ) আলমোড়া থেকে ১৮৯৭ সালে স্বামীজি লিখেছিলেন, “জীবনে কখনও শোবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমুতে পারি না; অন্তত দু’ঘণ্টা এপাশ-ওপাশ করতে হয়। কেবলমাত্র মাদ্রাজ থেকে দার্জিলিং-এর প্রথম মাস পর্যন্ত বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসত। সেই সুলভ নিদ্রার ভাব এখন একেবারে চলে গেছে। আর আমার সেই পুরানো এপাশ ওপাশ করার ধাত এবং রাত্রে আহারের পর. গরম বোধ করার ভাব আবার ফিরে এসেছে।”

অথচ স্বামীজি যে চিরকাল বিনিদ্র থাকতেন না তার প্রমাণ তিনি নিজেই রেখে গিয়েছেন।

ছাত্রাবস্থায় কীভাবে রাত জেগে পড়াশোনা করতেন তার চমৎকার বর্ণনা স্বামীজি নিজেই দিয়েছেন, : “আমি ঘরের ভিতর বই নিয়ে বসতাম, আর পাশেই রাত্রে গরম চা বা কফি থাকতো; ঘুম পেলেই পায়ে একটি দড়ি বাঁধতাম, তারপর ঘুমে বেহুশ হয়ে পড়লে যেই পায়ের দড়িতে টান পড়তো অমনি জেগে উঠতুম।”

এই বিবেকানন্দই পরবর্তীকালে তাঁর কনিষ্ঠতম সন্ন্যাসীশিষ্য স্বামী অচলানন্দকে করুণভাবে বলেছিলেন, “বেশ, তুই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারিস? তুই যা চাস তোকে আমি তাই দেব।” অচলানন্দ আমাদের জানিয়েছেন, “তার তখন নিদ্রা বেশি হতো না। শারীরিক কষ্ট ছিল যথেষ্ট, তিনি আমাকে বললেন, জ্ঞান হওয়ার পর হতে আমি জীবনে কখনও চারঘণ্টার বেশি ঘুমোইনি। ইদানিং তো তার একেবারেই ঘুম হতো না।”

নিদ্রা বা নিদ্রাহীনতা সম্পর্কে লিখতে গেলেই বালক নরেন্দ্রনাথের নিদ্রাভ্যাস সম্বন্ধে যা প্রচলিত আছে তা মনে করিয়ে দেওয়া মন্দ নয়। তার অভ্যাস ছিল উপুড় হয়ে শোওয়া। বালিশে মাথা রাখলেই তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন না। নিদ্রার জন্য চোখ বন্ধ করলেই তিনি মধ্যে এক জ্যোতির্বিন্দু দেখতে পেতেন। পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ এই জ্যোতি দেখার কথা শুনে বলেছিলেন, ধ্যানসিদ্ধরা এই রকম জ্যোতি দেখতে পায়। এ বিষয়ে আধুনিক চিকিৎসকদের কোনো মতামত আছে কি না তা জানবার কৌতূহল হয়।

স্বদেশে এবং বিদেশে পরিভ্রমণরত বিবেকানন্দ যে কতবার অসহায়ভাবে কিছুক্ষণের নিদ্রার জন্য অপেক্ষা করছেন নানা চিঠিপত্রে তার উল্লেখ রয়েছে। পুরো বিবরণ দিতে গেলে লেখার আকার বড় বড় হয়ে যায়। যখন কোথাও কোনদিন দুদণ্ডের ঘুম হলো তা নিয়ে স্বামীজির কত না আনন্দ।

আসলে জীবনের কোনদিন কখন তিনি ঘুমোতে সফল হয়েছেন তা তাঁর স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকতো। যেমন মহাপ্রয়াণের আগের বছর মে মাসে (১৯০১) তিনি প্রিয়ভক্ত স্বামী-শিষ্য সংবাদের লেখক শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছেন, ঢাকায় নাগমশায়ের বাড়িতে যাবার কথা।”বাড়িখানি কি মনোরম–যেন শান্তি-আশ্রয়। ওখানে গিয়ে পুকুরে সাঁতার কেটে নিয়েছিলুম। তারপর, এসে এমন নিদ্রা দিলুম যে বেলা আড়াইটা। আমার জীবনে যে কয়দিন সুনিদ্রা হয়েছে, নাগ-মহাশয়ের বাড়িতে নিদ্রা তার মধ্যে একদিন।”

ভক্ত নাগ মহাশয়ের সঙ্গে ১৮৯৯ সালের প্রারম্ভে বেলুড় মঠে বিবেকানন্দর দেখা হয়েছিল। স্বামীজি : “কাজ করতে মজবুত শরীর চাই; এই দেখুন, এদেশে এসে অবধি শরীর ভাল নয়; ওদেশে বেশ ছিলুম।”

নাগমশায় উত্তর দিলেন, “শরীর ধারণ করলেই ঠাকুর বলতেন–ঘরের টেক্স দিতে হয়। রোগশোক সেই টেক্স। আপনি যে মোহরের বাক্স; ঐ বাক্সের খুব যত্ন চাই। কে করবে? কে বুঝবে? ঠাকুরই একমাত্র বুঝেছিলেন।”

শরীর খারাপ, কিন্তু শরীরচর্চায় এই সময়েও বিশ্বাস হারাননি বিবেকানন্দ। ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি প্রিয় শিষ্যকে বলছেন, “এখনও রোজ আমি ডামবেল কষি।” দেহ ও মন সমানভাবে চলা যে। বিশেষ প্রয়োজন তা বিবেকানন্দ তার প্রিয়জনদের বারবার বলেছেন।

১৮৯৮ সালে বলরাম বসুর বাড়িতে বিনিদ্রাবেদনায় জর্জরিত স্বামীজির আরও একটা মর্মস্পর্শী ছবি পাওয়া যায়। সে সময় তাঁর খুবই ইচ্ছা হতো যে একটু ঘুম হোক, শরীরের ক্লান্তি একটু দূর হোক, মস্তিষ্ক একটু বিশ্রাম লাভ করুক।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে, চারদিকে শাঁখ বেজে উঠলো এবং স্ত্রীকণ্ঠের উলুধ্বনি শোনা গেল। “স্বামীজি বলিলেন, ‘ওরে গেরন লেগেছে–আমি ঘুমোই, তুই আমার পা টিপে দে।’ এই বলিয়া একটুকু তন্দ্রা অনুভব করিতে লাগিলেন…গ্রহণে সর্বগ্রাস হইয়া ক্রমে চারিদিকে সন্ধ্যাকালের মতো তমসাচ্ছন্ন হইয়া গেল। গ্রহণ ছাড়িয়া যাইতে যখন ১৫।২০ মিনিট বাকি আছে, তখন স্বামীজি উঠিয়া…শিষ্যকে পরিহাস করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘লোকে বলে, গেরনের সময় যে যা করে, সে নাকি তাই কোটিগুণে পায়; তাই ভাবলুম মহামায়া এ শরীরে সুনিদ্রা দেননি, যদি এই সময় একটু ঘুমুতে পারি তো এর পর বেশ ঘুম হবে, কিন্তু তা হ’ল না; জোর ১৫ মিনিট ঘুম হয়েছে।”

গেরনে ঘুমিয়ে সত্যিই যে স্বামীজির কিছু লাভ হয়নি তার সাক্ষী শিষ্য শরচ্চন্দ্র নিজেই। কয়েক বছর পরেও (১৯০২) বেলুড় মঠের ছবি আঁকতে আঁকতে তিনি লিখছেন, স্বামীজির ঘুম নেই বললেই চলে। রাত্রি তিনটে থেকে শয্যাত্যাগ করে উঠে বসে থাকেন।

আরও এক রাতের বর্ণনা আমাদের কাছে আছে। স্থান : বলরাম বসুর বাড়ি। সময়: ভোর সাড়ে চারটে। বিনিদ্র স্বামীজি অধৈর্য হয়ে বললেন, খিদে পেয়েছে। ভক্তিময়ী সরোজিনী সেই খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে লুচি, হালুয়া, কি কি ভাজা সেই ভোররাতে তৈরি করে ফেললেন। স্বামীজি হাসতে হাসতে তুলসী মহারাজকে বললেন, “দেখছিস আমার কেমন শিষ্য?”

অসুস্থ অবস্থায় পরিবেশ যাতে স্বামীজির ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায় তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় অনুরাগী ও শিষ্যদের সে কি ব্যাকুলতা। আলমোড়ায় একসময় (১৮৯৭) যে বাড়িতে ছিলেন সেখান থেকে মেরি হেলবয়েস্টারকে স্বামীজি লিখছেন, “আমার শরীর খুবই খারাপ…আশা করি খুব শীঘ্রই সেরে উঠবো।…আলমোড়ার কোন ব্যবসায়ীর একটি চমৎকার বাগানে আছি–এর চারদিকে বহুক্রোশ পর্যন্ত পর্বত ও অরণ্য।…রোজ রাত্রে কুকুরগুলিকে বেশ কিছুটা দূরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে, যাতে তাদের চেঁচামেচিতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।

আহা! ঘুম নিয়ে কি হাহাকার। আলমোড়ার চিঠির কয়েক মাস আগে (১৮৯৬) নিউইয়র্কে বিনিদ্র রজনীতে ক্ষতবিক্ষত বিবেকানন্দ তাঁর ধীরামাতা মিসেস সারা বুলকে লিখেছেন : “আমার শরীর প্রায় ভেঙে পড়েছে। এখানে আসা পর্যন্ত আমি এবছরে একদিনও ভালভাবে ঘুমোইনি…আমার ইচ্ছে হয় মহাসমুদ্রের গভীরে গিয়ে মনের সাধে লম্বা একটা ঘুম দিই।”

প্রায় একই সময়ে বিনিদ্র বিবেকানন্দ একই কথা লিখেছেন মেরি হেলকে–”এবারের শীতে আমি একটা রাত্রিও ঘুমোতে পারিনি।”

পদ্মপলাশলোচনের কথা বলতে গিয়ে আমরা যে-চোখে ঘুম আসতে না তার আলোচনায় চলে গিয়েছিলাম। এই ঘুম না আসার রোগ ইনসোমনিয়া, চিকিৎসা মাঝে মাঝে হয়েছে, কিন্তু রোগী যে কখনও তেমন সুফল লাভ করেননি তা শতবর্ষের দূরত্ব থেকেও আমরা সহজে বলতে পারি।

*

স্বামীজির রোগজর্জরিত শরীর সম্বন্ধে আমরা নানা কথা নানা জায়গায় পড়ে থাকি, কিন্তু এ-সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা এখনও গড়ে ওঠেনি। সাধারণ পাঠকদের মনে।

আমরা শুধু জানি, তার পারিবারিক রোগ মধুমেহ বা ডায়াবিটিসের কথা এবং আরও জানি তার জীবিতকালে ডায়াবিটিসের তেমন কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। এর ফলে অ্যালোপ্যাথ, হোমিওপ্যাথ, কবিরাজ ছাড়াও বারবার দেশবিদেশের হাতুড়ে ডাক্তারদের দ্বারস্থ হয়েছেন বিবেকানন্দ, নানা আজব পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়েছে তাঁর শরীরের ওপরে।

এইসব চিকিৎসা ব্যবস্থায় ক্লান্ত হয়েই বোধ হয় অন্তিমপর্বে রোগের উপশম সম্পর্কে স্বামীজি বলেছেন (জুন ১৯০১), “উপকার অপকার জানিনে। গুরুভাইদের আজ্ঞাপালন করে যাচ্ছি।”

শিষ্যের মন্তব্য : “দেশী কবিরাজী ঔষধ বোধ হয় আমাদের শরীরের পক্ষে সমধিক উপযোগী।”

স্বামীজির ঐতিহাসিক উত্তর : “আমার মত কিন্তু একজন সায়ান্টিফিক চিকিৎসকের হাতে মরাও ভাল; হাতুড়ে যারা বর্তমান বিজ্ঞানের কিছুই জানে না, কেবল সেকেলে পাঁজিপুঁথির দোহাই দিয়ে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছে, তারা যদি দু-চারটে রোগী আরাম করেও থাকে, তবু তাদের হাতে আরোগ্যলাভ আশা করা কিছু নয়।”

রোগের আরও খবরাখবর নেওয়ার আগে বিবেকানন্দ-অবয়বের আরও কিছু বর্ণনা যা আমরা মেজভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তর স্মৃতি থেকে পাই, তা এইখানে লিপিবদ্ধ করে রাখলে মন্দ হয় না।

স্বামীজির পায়ের তলার সামনেটা ও পিছনটা মাটিতে ঠেকতো, একে খড়ম-পা বলে। তার পা পাতলা, সরু এবং অপেক্ষাকৃত লম্বা। হাতের আঙুল : সরু, লম্বা ও অগ্রভাগ ছুঁচলো।নখ : মুক্তার মত উজ্জ্বল ও কিঞ্চিৎ রক্তাভ। মুখ : গোল ও পুরুষ্টু। ঠোঁট : পাতলা, ইচ্ছামত দৃঢ় করতে পারতেন। নাসিকা : উন্নত–সিঙ্গি নাক। হাত : সুডৌল, সরু ও লম্বা। মাথার পিছন : চ্যাপ্টা, মাথার সামনের দিক এবং ব্রহ্মতালু; উঁচু।

মন্মথনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের আন্দাজ, বিবেকানন্দের উচ্চতা পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি। আরও যা বিবরণ তিনি দিয়েছেন : “বলিষ্ঠ গঠন, চওড়া ছাতি, কিন্তু হাতপা খুবনরম।…তার হাড় চওড়া ছিল–হাতের কব্জি এতখানি বুকও এতখানি।…পায়ের থেকে কোমরের ভাগ দীর্ঘ ছিল। হাতদুটো লম্বা আজানুলম্বিত।”

ডাক্তারদের কাছে লেখা স্বামীজির চিঠি আমাদের হাতে বেশি নেই। এরমধ্যে তার শরীরের দীর্ঘ ইতিহাস দিয়ে শশী ডাক্তারকে আলমোড়া থেকে লেখা (২৯ মে ১৮৯৭) চিঠিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

স্বামীজির ছেলেবেলায় স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা এই চিঠি থেকে সহজেই করা যায়। “ছেলেবেলায় যখন কুস্তি করতাম, আমার তখন সত্যই বোধ হত যে শরীর থাকা একটা আনন্দের বিষয়। তখন শরীরের প্রতি ক্রিয়াতে আমি শক্তির পরিচয় পেতাম এবং প্রত্যেক পেশীর নড়াচড়াই আনন্দ দিত।”

সেই উৎফুল্লভাব যে আলমোড়ায় কমে গিয়েছে তা ডাক্তারকে জানিয়েছেন বিবেকানন্দ। “তবু আমি নিজেকে বেশ শক্তিমান বোধ করি।” এই চিঠির ক্ষেত্রেই বিবেকানন্দ লিখেছেন মৃত্যুহীন প্রাণের কথা। “ডাক্তার, আমি যখন আজকাল তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গের সম্মুখে ধ্যানে বসে উপনিষদ থেকে আবৃত্তি করিন তস্য রোগোন জরান মৃত্যু: প্রাপ্তস্য যোগাগ্নিময়ং শরীর’–সেই সময় যদি তুমি আমায় একবার দেখতে!” উপনিষদের এই মন্ত্রটির অর্থ–যে যোগাগ্নিময় দেহ লাভ করেছে, তার রোগ জরা মৃত্যু কিছুই নেই।

সময়ের সিঁড়ি ধরে এবার একটু পিছিয়ে আসা প্রয়োজন। কমবয়সে নরেন্দ্রনাথের শরীর ও স্বাস্থ্য যে বেশ ভালই ছিল তা বাল্যবয়সের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না। আমরা শুধু একটি দুর্ঘটনার খবর পাই, যার ফলে তাকে চোখের ওপরে একটা কাটা দাগ সারাজীবন ধরে বহন করতে হয়। আর একটি ইস্কুলের মাস্টারের কাছে অকারণ নিগ্রহ, যার ফলে তার কান দিয়ে বেশ রক্তপাত হয়। এতো রক্ত বেরোয় যে ইস্কুলের ড্রেশ ভিজে গিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে এই আঘাতের ফল সুদূরপ্রসারী হয়নি। প্রাণবন্ত নরেন্দ্রনাথ খেলাধুলা ও স্বাস্থ্যচর্চায় নিজেকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রেখে হৈ-হৈ করে বেড়ে ওঠেন।

প্রথম জীবনের সুস্বাস্থ্যের কথা নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত বিবেকানন্দ পরবর্তীকালে প্রসন্ন মনে স্মরণ করেছেন। মনে রাখতে হবে, সেকালের অস্বাস্থ্যকর কলকাতায় ছিল কলেরা-টাইফয়েডের প্রবল দাপট। বিবেকানন্দ-জননী ভুবনেশ্বরী দেবী তার কনিষ্ঠপুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথকে একবার বলেন, কলকাতায় কলের জল আসবার আগে প্রতি গরমে কলেরা হত, এসময় প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই দু’একজন মারা যেত।

দাহকার্যে সহায়তা করা তরুণ নরেনের প্রিয় কর্তব্য ছিল। মেজভাই মহেন্দ্রনাথ স্মরণ করেছেন, “নরেন তিরিশ পঁয়ত্রিশটা মড়া ফেলেছে… বিকেলে এসে ওই কাজ ছিল, বাবা রাগ করতেন। দারুণ স্বাস্থ্য না থাকলে, এইভাবে শ্মশানযাত্রীর কাজ সম্ভব নয়।”

.

তবু আদিপর্বে নরেন্দ্রনাথের শারীরিক অসুস্থতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে পারিবারিক সূত্র থেকে। পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পরে বিধ্বস্ত নরেন্দ্রনাথ সারাক্ষণ কঠিন শিরঃপীড়ায় কাবু–যন্ত্রণামুক্তির জন্য তিনি ঘনঘন কর্পূরের ন্যাস নিচ্ছেন। এই শিরঃপীড়া উচ্চ রক্তচাপের আদি লক্ষণ কি না তা এতদিন পরে কে বলতে পারে?

নরেন্দ্রনাথের পিতৃবিয়োগের পর থেকে মহাসমাধি পর্যন্ত প্রায় দু’দশক বিভিন্ন রোগভোগের খবর বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করার চেষ্টা করা যাক। শেষ দিকে প্রিয় শিষ্য স্বামী বিরজানন্দকে মায়াবতীতে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার অভিজ্ঞতা দেখে শেখ। অত কষ্ট করে শরীরটাকে মাটি করিস না। আমরা শরীরটাকে বেজায় কষ্ট দিয়েছি। তার ফল হয়েছে কি?–না জীবনের যেটা সবচেয়ে ভাল সময়, সেখানটায় শরীর গেল ভেঙে। আর আজ পর্যন্ত তার ঠেলা সামলাচ্ছি।”

কলম্বো থেকে প্রথম প্রবাস সম্পূর্ণ করে মাদ্রাজে ফিরে এলেন বিবেকানন্দ, সেখান থেকে জাহাজে চড়লেন কলকাতার উদ্দেশে। শরীর তখন ভাঙতে শুরু করেছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ তিনি নিজেই লিখছেন, “আমি এখন মৃতপ্রায়…আমি ক্লান্ত–এতই ক্লান্ত যে যদি বিশ্রাম না পাই, তবে আর ছ’মাসও বাঁচব কি না সন্দেহ।”

বলাবাহুল্য এই সময়েই তার ডায়াবিটিস ধরা পড়ে। স্বামীজির সন্ন্যাসী শিষ্য কৃষ্ণলাল মহারাজের স্মৃতিচিত্র থেকে আমরা জানতে পারি স্বামীজির ডায়াবিটিস সায়েবডাক্তারদের চোখ এড়িয়ে গেলেও প্রথম ধরা পড়ে কলম্বোয়। তখনও ডায়াবিটিসের ইনসুলিন আবিষ্কার হয়নি। ডাক্তারদের পরামর্শ–প্রতিকার চাইলে নিয়মিত খাওয়াদাওয়া এবং গভীর চিন্তা থেকে বিরতি প্রয়োজন।

বিভিন্ন সময়ে স্বামীজি যেসব অসুখে আক্রান্ত হয়েছিলেন তার একটা তালিকা তৈরি করলে একনজরে এইরকম দাঁড়ায় :

• শিরঃপীড়া

• টনসিল

• সর্দিকাশি

• হাঁপানি

• টাইফয়েড

• ম্যালেরিয়া

• নানাবিধ জ্বর

• লিভার সংক্রান্ত ব্যাধি

• বদহজম ও অন্যান্য পেটের গোলমাল

• উদরী বা পেটে জল হওয়া

• ডায়ারিয়া

• ডিসপেপসিয়া

• পাথুরি

• লাম্বেগো বা কোমরের ব্যথা

• ঘাড়ে ব্যথা।

• ব্রাইটস ডিজিজ

• কিডনির গোলযোগ

• ড্রপসি–শোথ বা পা ফোলা

• অ্যালবুমিনিউরিয়া

• রক্তাক্ত চক্ষু

• একটি চোখে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা

• নিদ্রাহীনতা

• অকালে চুল দাড়ি সাদা হয়ে যাওয়া

• স্নায়ু রোগ–নিউরোসথেনিয়া

• রাত্রে খাবার পর প্রচণ্ড গরম অনুভব করা

• গরম সহ্য করতে না পারা

• অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া

• সমুদ্রযাত্রা ব্যাধি বা সি-সিকনেস

• সান স্ট্রোক

• ডায়াবিটিস

• হৃদরোগ।

বিভিন্ন চিঠিপত্রে এবং স্মৃতিকথায় এইসব রোগের যৎসামান্য অথবা বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে এতো শারীরিক যন্ত্রণা নিয়েও তিনি কেমনভাবে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় এতো অল্পসময়ের মধ্যে এমন সব অবিশ্বাস্য কাজ করে গেলেন যা বহুযুগ ধরে মানুষের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করবে। যাঁরা সামান্য শারীরিক যন্ত্রণায় ব্যাকুল হয়ে কর্মবিরতির আবেদন জানান, তাঁদের কাছে স্বামীজির শরীর ও ধৈর্য এক দুয়ে রহস্য।

ব্যাধি যত মারাত্মকই হোক, অসামান্য মনোবলের অধিকারী বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন, রোগকে প্রশ্রয় দিলে তার আরদ্ধ কাজগুলো কোনোদিন সম্পূর্ণ হবে না। কিন্তু তাকে নিয়ে প্রিয় সন্ন্যাসীভ্রাতাদের সারাক্ষণের দুশ্চিন্তা।

.

১৮৯৭ সালে ২০ মে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে আলমোড়া থেকে বিবেকানন্দ যা লেখেন তা আমাদের চোখ খুলে দেয়। বুঝতে পারা যায় এই পৃথিবীতে মৃত্যুঞ্জয়ী হতে গেলে কী ধরনের মানসিকতা প্রয়োজন।

স্বামীজি তার প্রিয় গুরুভ্রাতাকে লিখছেন : “তুমি ভয় পাও কেন? ঝট করে কি দানা মরে? এই তত বাতি জ্বলল, এখনও সারারাত্রি গাওনা আছে। আজকাল মেজাজটাও বড় খিটখিটে নাই, জ্বরভাবগুলো সব ওই লিভার–আমি বেশ দেখছি। আচ্ছা, ওকেও দুরস্ত বানাচ্ছি–ভয় কি?”

দু’মাস পরে স্বামী অখণ্ডানন্দকে স্বামীজি আবার লিখছেন, “আমিও ‘ফের লেগে যা’ আরম্ভ করেছি। শরীর তো যাবেই, কুঁড়েমিতে কেন যায়? মরচে পড়ে মরার চেয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরা ঢের ভাল। মরে গেলেও হাড়ে ভেল্কি খেলবে। তার ভাবনা কি?”

যে অসুখটি প্রায় সারাজীবন স্বামীজিকে যথেষ্ট বিব্রত করেছে তার গেরস্ত নাম পেটের অসুখ। এই অসুখের শুরু শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর বরানগরের সন্ন্যাসজীবনে। এই সময়ে আজীবন সযত্নে লালিত নরেন্দ্রনাথের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন হয় এবং সেই সুযোগে নানা রকমের ব্যাধি তাকে আক্রমণ শুরু করে। কখনও রাজকীয় সুখ এবং কখনও চরম দারিদ্র্য–এই বিরতিহীন ওঠানামা বিবেকানন্দর নজর এড়ায়নি।

দ্বিতীয়বার বিদেশযাত্রার সময় মানসকন্যা নিবেদিতাকে তিনি জাহাজে বলেছিলেন, “আমার মতো মানুষেরা চরমের সমষ্টি। আমি প্রচুতম খেতে পারি, একেবারে না খেয়ে থাকতে পারি; অবিরাম ধূমপান করি, আবার তাতে সম্পূর্ণ বিরত থাকি! ইন্দ্রিয়দমনে আমার এত ক্ষমতা, অথচ ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যেও থাকি; নচেৎ দমনের মূল্য কোথায়!”

এই বৈপরীত্য সম্বন্ধে স্বামীজি আরও একবার নিবেদিতাকে চিঠি লিখেছিলেন নিউইয়র্ক থেকে : “এ জাতীয় স্নায়ুপ্রধান শরীর কখনও বা মহাসঙ্গীতসৃষ্টির উপযোগী যন্ত্রস্বরূপ হয়, আবার কখনও বা অন্ধকারে কেঁদে মরে।”

জ্বর ও পেটের গোলমালের ইতিবৃত্ত লিখতে গেলে সব দায়ই বরানগর মঠকে দেওয়া বোধ হয় যুক্তিযুক্ত হবে না।

স্বামী গম্ভীরানন্দ তার যুগনায়ক বিবেকানন্দ বইতে স্পষ্ট বলেছেন, এফ এ পড়ার সময় প্রথম বর্ষের শেষে ছাত্র নরেন্দ্রনাথ “ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হইয়া যথানিয়মে কলেজে আসিতে পারিতেন না; কাজেই নিয়মানুসারে বৎসরে যতদিন উপস্থিত থাকা আবশ্যক, তাহা সম্ভব হইল না এবং যথাকালে এফ এ পরীক্ষার অনুমতিপ্রাপ্তির বিষয়ে গোল বাধার সম্ভাবনা দেখা গেল।”

এর কিছুদিন পরেই ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ প্রিয় নরেনের শরীরের লক্ষণ পরীক্ষা করে বলেছিলেন, “তোর শরীরের সকল স্থানই সুলক্ষণাক্রান্ত, কেবল দোষের মধ্যে নিদ্রা যাইবার কালে নিঃশ্বাসটা কিছু জোরে পড়ে। যোগীরা বলেন, অত জোরে নিশ্বাস পড়িলে অল্পায়ু হয়।”

বরানগরের কঠিন কঠোর দৃশ্যগুলি ভাবীকালের জন্য অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আঁকা রয়েছে। দুর্ভাবনা ও অনাহারের ফলে, ১৮৮৭ সালের গ্রীষ্মের প্রারম্ভে, নরেন্দ্রনাথের এক উৎকট পীড়া হইল। জ্বর-বিকার বড় ভয়ের কারণ হইয়া উঠিল। ভিতরকার বড় ঘরটিতে একটি বিছানায় তাহাকে রাখা হইয়াছে; শুইয়া আছেন। চন্দ্র ডাক্তার আসিয়া ঔষধ দিয়া যাইতেছেন।…বলরামবাবু নরেন্দ্রনাথের মাতাকে সংবাদ দেওয়ায় তিনি নরেন্দ্রনাথের এক ভ্রাতাকে সঙ্গে লইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন। নরেন্দ্রনাথের কিছু জ্ঞান আছে কখনও নিস্তব্ধ–অর্ধ-অজ্ঞান অবস্থায় বলিতেছেন, এখানে কেন স্ত্রীলোক ঢুকিতে দিলে? আমিই নিয়ম করলুম, আর আমার বেলায়ই নিয়ম রদ হল? বড্ড গায়ের জ্বালা, রাত্রে ব্যামো বৃদ্ধি হইল, নরেন্দ্রনাথের নাড়ীও একটু খারাপ হইল, বাবুরাম মহারাজ আর চুপ করিয়া না থাকিতে পারিয়া উচ্চৈস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। নরেন্দ্রনাথ জোর করে…অস্পষ্টস্বরে বলিতে লাগিলেন…”কাঁদিস না, আমি এখন মরব না। তুই ভয় করিসনি। আমায় ঢের কাজ করতে হবে, আমি কাজগুলো যেন চোখে দেখতে পাচ্ছি, মরবার সময় নেই।”

এই বরানগরপর্বেই নরেন্দ্রনাথের ‘গ্রেভেল স্টোন বা পাথুরির ব্যারাম ধরা পড়ে, তিনি কিছুদিন মাতুলালয়ে এসে থাকতে বাধ্য হলেন। চিকিৎসা করতে এলেন ডাঃ রাজেন্দ্রলাল দত্ত। অবিশ্বাস্য হলেও জেনে রাখুন এই। বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ রোগী দেখতে যাবার সময় উপহার হিসেবে কিছু খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যেতেন। নরেনের জন্যে তিনি নতুন বাজার থেকে মস্ত একটা বেল নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর চিকিৎসায় নরেন্দ্রনাথ যন্ত্রণামুক্ত হন।

বরানগরে নরেন্দ্রর তৃতীয় অসুখ পেটে। “কিছুই হজম হয় না, অনবরত পেট নামাইতেছে।” স্বামী সারদানন্দ তার বাবার ওষুধের দোকান থেকে এক শিশি ‘Fellows Syrup’ নরেনের দিদিমার বাড়িতে দিয়ে গেলেন। বৈকুণ্ঠ সান্যাল মশায় এনেছিলেন নতুন বাজার থেকে এক হাঁড়ি মাগুরমাছ।

১৮৮৭ সালের মে-জুন মাসে নরেন্দ্রনাথের আর এক রোগের খবর পাওয়া যাচ্ছেটাইফয়েড ব্যামো।

মহেন্দ্রনাথ দত্ত বরানগরে নরেনের উদরাময় রোগের কারণ হিসেবে বলেছেন, তার মাংস খাওয়ার অভ্যাস ছিল, কিন্তু সাধু হয়ে মুষ্টিভিক্ষার অন্ন এবং অনিশ্চিত অন্ন আহারে শরীর ভেঙে পড়ে।

ভক্ত বলরাম বসু এই সময় নরেনকে দু-একদিন নিজের বাড়িতে এনে রাখেন। রোগীর পথ্য মোটেই পছন্দ নয় নরেন্দ্রনাথের, তিনি ভাবিনী নামে কাজের মহিলাটিকে গোপনে রুটি ও কুমড়োর ছক্কা তৈরি করতে অনুরোধ করেন। “আশ্চর্যের বিষয় এই যে ভক্তিমতী ভাবিনীর রুটি খাইয়া তাহার উদরাময় রোগ তখনকার মত ভাল হইয়াছিল।”

এই পর্বের আরও দুটি অসুস্থতা সংবাদ আমরা পাই নরেন্দ্রনাথের রচনা থেকে। গিরিশচন্দ্র ঘোষের ভাই অতুলবাবুর বাড়িতে বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাক্তার সালজার এসেছিলেন।

“নরেন্দ্রনাথের তখন গলার আলজিভ ফুলিয়াছিল এবং এই ব্যাধিটি তাহার আত্মীয়দের সকলেরই আছে।…ডাক্তার সালজার বলিলেন, ‘ঔষধের কোন আবশ্যক নাই, ঠাণ্ডা জল দিয়া কুলকুচি করিবে এবং গলায় ঠাণ্ডা জল লাগাইবে।নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনায় ডাক্তার এতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে কাজকর্ম ভুলে তিন-চারঘণ্টা সময় ব্যয় করেছিলেন। বলাবাহুল্য টনসিলসমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে পরিব্রাজক জীবনে উত্তর ভারতের বিখ্যাত ডাক্তার দিল্লির হেমচন্দ্র সেনকে একই বিষয়ে চিকিৎসা করতে হয়েছিল।

বরাহনগর-পর্বে পেটের অসুখের সমস্যা যে চিন্তার কারণ হয়েছিল তার প্রমাণ, কেউ কেউ রোগ আয়ত্তে আনবার জন্য নরেন্দ্রনাথকে অল্প পরিমাণে অফিম খেতে বললো। “তাহাতে শরীরের বড় যন্ত্রণা হয়। অতুলবাবু আফিমের কথা শুনিয়া অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া পড়িলেন এবং কয়েকদিন ধরিয়া বলিতে লাগিলেন, এরা কি কচ্ছে, নরেন্দ্রনাথকে আফিম খাওয়ান শেখাচ্ছে? এমন তীক্ষ্ণবুদ্ধি লোকটাকে নষ্ট করবে।”

.

পত্রাবলীর প্রথম দিকে স্বামীজি তার বিভিন্ন চিঠিতে যেসব শারীরিক সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে জ্বর ও পেটের গোলমালই প্রধান।

নতুন একটি উপসর্গ কোমরের ব্যথা। ১৮৮৯-এর গোড়ায় বরাহনগর থেকে বারাণসীতে প্রমাদাস মিত্রের কাছে লেখা চিঠি থেকে আমরা কামারপুকুর যাবার পথে বিবেকানন্দর অসুস্থতার ইঙ্গিত পাই। ”গুরুদেবের উক্ত গ্রামে যাইবার পথে অত্যন্ত জ্বর হইল ও তৎপরে কলেরার ন্যায় ভেদবমি হইয়াছিল। তিন চারিদিনের পর পুনরায় জ্বর হইয়াছে; এক্ষণে শরীর এ প্রকার দুর্বল যে দুই কদম চলিবার সামর্থ্যও নাই…আমার শরীর এপথের নিতান্ত অনুপযুক্ত।”

প্রমদাদাসবাবুকে লেখা পরের চিঠিতে (মার্চ ১৮৮৯) জানা যাচ্ছে, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা চলছে, কিন্তু “শরীর এক্ষণে অত্যন্ত অসুস্থ, মধ্যে মধ্যে জ্বর হয়, কিন্তু প্লীহাদি কোন উপসর্গ নাই।”

কয়েকমাস পরে (আগস্ট ১৮৮৯) প্রমদাবাবুকে স্বামীজি আবার চিঠি লিখলেন…”পুনরায় জ্বর হওয়ায় উত্তরদানে অসমর্থ ছিলাম…মধ্যে মাস দেড়েক ভাল ছিলাম, কিন্তু পুনরায় ১০/১২ দিন জ্বর হইয়াছিল, এক্ষণে ভাল আছি।” চারমাস পরে (ডিসেম্বর ১৮৮৯) বৈদ্যনাথ থেকে চিঠি: “শরীর বড় ভাল নহে–বোধহয় লৌহাধিক্যের জন্য।”

পরিব্রাজকরূপে গাজীপুরে এসে পরের বছরের জানুয়ারি মাসে স্বাস্থ্যের ভাল রিপোের্ট। “…যে কয়টি স্থান দেখিয়া আসিয়াছি, তন্মধ্যে এইটি স্বাস্থ্যকর। বৈদ্যনাথের জল বড় খারাপ, হজম হয় না…কাশীতে যে ক’দিন ছিলাম দিনরাত জ্বর হইয়া থাকিত–এত ম্যালেরিয়া।”

কিন্তু পরের মাসেই (ফেব্রুয়ারি ১৮৯০) স্বামীজির নতুন শারীরিক উপসর্গ। “লাম্বেগো (কোমরের ব্যথা) বড়ই ভোগাইতেছে, নহিলে ইতিপূর্বেই যাইবার চেষ্টা দেখিতাম।”

এপ্রিল-এর শুরুতেই (১৮৯০) পরিস্থিতি যে ভাল নয় তার ইঙ্গিত গাজীপুর থেকে অভেদানন্দকে লেখা স্বামীজির চিঠিতে–”কোমরের বেদনাটা কিছুতেই সারে নাক্যাডাভারাস (জঘন্য)।”

মে মাসে স্বামীজি বরানগরে ফিরে এসেছেন। কাশীতে প্রমাদাসবাবুকে চিঠি, “পুনরায় জ্বর হওয়ায় আপনাকে পত্র লিখিতে পারি নাই।”

এই প্রমদাদাস মিত্র ছিলেন স্বামীজির খুব কাছের লোক। স্বামীজির পারিবারিক অবস্থার কথা জেনে তিনি সবিনয়ে সামান্য অর্থ সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। স্বামীজির উত্তর : “আপনি ২০ টাকার এককেতা নোট পাঠাইয়াছিলেন। আপনি অতি মহৎ; কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, মহাশয়ের প্রথমোদ্দেশ্য পালনে আমার মাতা ভ্রাতাদির সাংসারিক অহংকার প্রতিবন্ধক হইল; কিন্তু দ্বিতীয় উদ্দেশ্য আমি আমার কাশী যাইবার জন্য ব্যবহার করিয়া চরিতার্থ হইব।”

বহু বছর পরে শেষবার কাশীধাম পরিদর্শনের সময় প্রমদাদাস মিত্রর পুত্র কালিদাস মিত্র এসেছিলেন বিবেকানন্দকে দেখতে। সেই সাক্ষাৎকারটি মর্মস্পর্শী। স্বামীজি বেশ অসুস্থ, ডায়াবিটিসে কষ্ট পাচ্ছেন। তার গায়ে একটা সোয়েটার ও পায়ে একজোড়া গরম মোজা। তিনি সামনের তাকিয়ায় হাত রেখে বাঁকাভাবে বসে আছেন এবং অতি কষ্টে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন।

স্বামীজি বললেন, “শরীরটা ভগ্ন, বড় কষ্ট পাচ্ছি।” কালিদাসবাবুর প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজি আরও বললেন, “কি ব্যারাম তা বলতে পারি না। প্যারিসে ও আমেরিকায় অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, তারা রোগ নির্ণয় করতে পারেন নি, ব্যাধিরও প্রতিকার বা উপশম করতে পারেননি।”

স্বামীজি যখন জ্বর ও ডিসপেপসিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে প্রবলবিক্রমে নিজের অসম্পূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন তখন একবার রসিকতা করেছিলেন, “আমার অধিকাংশ রোগ পেটে। পেটের রোগগ্রস্ত লোকরা কি প্রায় নিরুৎসাহ ও বৈরাগ্যবান হয়?” সন্দেহটা যে সব সময় সত্য নয় তার চলমান প্রমাণ তিনি নিজেই। শরীর, বিশেষ করে পেটকে নো তোয়াক্কা করেই তিনি টোটো করে সমস্ত ভারত চষে বেড়িয়েছে।

আরও আশ্চর্য ব্যাপার যে মানুষ পেটের রোগকে কিছুতেই আয়ত্তে আনতে পারছেন না এবং শরীরের এই অবস্থা মনে রেখে খেতড়ির মহারাজা যাঁকে আমেরিকা যাবার সময় উচ্চ শ্রেণীর টিকিট কিনে দিলেন, তিনিই জাহাজ থেকে খেতড়িকে চিঠি লিখেছিলেন, “আগে দিনে লোটা হাতে করে ২৫ বার পায়খানা যেতে হত, কিন্তু জাহাজে আসা অবধি পেটটা বেশ ভাল হয়ে গেছে, অতবার আর পায়খানায় যেতে হয় না।” প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণেরও পেটের ব্যারাম ছিল, ভুগে ভুগে একসময় দু’খানা হাড় হয়ে গিয়েছিলেন।

জাতীয় স্বাস্থ্যের ওপর ডিসপেপসিয়া রোগের প্রতিক্রিয়া নিয়ে স্বামীজির বিরামহীন ভাবনাচিন্তা ছিল।

শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। তাঁকে স্বামীজি বলেছিলেন, “শুনেছি, পূর্ববাংলার পাড়াগেঁয়ে লোকে অম্বলের ব্যারাম কাকে বলে তা বুঝতেই পারে না।” শিষ্য : “আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের দেশে অম্বলের ব্যারাম বলিয়া কোন ব্যারাম নাই। এদেশে এসে এই ব্যারামের নাম শুনিয়াছি। দেশে দু’বেলাই মাছ ভাত খাইয়া থাকি।”

স্বামীজি; “তা খুব খাবি। ঘাসপাতা খেয়ে যত পেটরোগা বাবাজীর দলে দেশ ছেয়ে ফেলেছে।…ওসব মহাতমোগুণের…। তমোগুণের লক্ষণ : হচ্ছে আলস্য, জড়তা, মোহ, নিদ্রা এইসব।”

আর একবার একটি রোগা ছেলেকে প্রশ্ন করে স্বামীজি জানলেন সে ক্রনিক ডিসপেপসিয়ায় ভুগছে। স্বামীজির মন্তব্য : “আমাদের বাংলা দেশটা বড় সেন্টিমেন্টাল কিনা, তাই এখানে এত ডিসপেপসিয়া।”

মার্কিন মুলুক থেকে ফেরার পরে আবার যে পেটের রোগ ফিরে এসেছিল তার যথেষ্ট ইঙ্গিত স্বামীজির বিভিন্ন চিঠিতে রয়েছে। একবার আলমোড়া থেকে (মে ১৮৯৮) স্বামী ব্রহ্মানন্দকে তিনি লিখেছিলেন, “আমার শরীর অপেক্ষাকৃত অনেক ভাল, কিন্তু ডিসপেপসিয়া যায় নাই এবং পুনর্বার অনিদ্রা আসিয়াছে। তুমি যদি কবিরাজী একটা ভাল ডিসপেপসিয়ার ওষুধ পাঠাও তত ভাল হয়।”

*

পরিব্রাজক জীবনের অন্যান্য অসুখবিসুখগুলোর কথা এবার ঝটপট সেরে নেওয়া যেতে পারে।

কামারপুকুরে যাবার পথে স্বামীজির জ্বর ও ভেদবমির কথা আমরা জানি। ফিরে এসে বরানগরে তার প্রায়ই জ্বর আসত। তখন শিমুলতলায় যান, সেখানে গ্রীষ্মের আতিশয্যে উদরাময় হয়।

এরপরে ১৮৯০ সালে স্বামীজি গাজীপুরে যান পওহারী বাবার সন্ধানে। ইনি থাকতেন গঙ্গার ধারে এক দীর্ঘ সুড়ঙ্গের মধ্যে, আহার করতেন একমুঠো নিমপাতা অথবা গোটা কয়েক লঙ্কা। এইসময় দুমাস ধরে স্বামীজি কোমরের ব্যথায় ভোগেন। একই সঙ্গে তিনি যে পেটের অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন তা কারও অজানানয়।ভিক্ষালব্ধ খাদ্য তাঁর বোধহয় সহ্য হতোনা। তবে বাসস্থানে প্রচুর লেবু গাছ থাকায় তিনি যথেষ্ট লেবু খেতেন।

আলমোড়া থেকে বদরীনারায়ণের পথে, সলড়কাড় চটিতে স্বামীজি ও তার সহযাত্রী অখণ্ডানন্দ একই সঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বামীজির জ্বর এবং অখণ্ডানন্দের কাশি। সেবার তার যাত্ৰাসঙ্গী ছিলেন সারদানন্দ অখণ্ডানন্দ, কৃপানন্দ ও একজন মালবাহক।

পরিব্রাজক স্বামীজির পরবর্তী রোগের খবর পাওয়া যাচ্ছে হৃষীকেশে। ওই জায়গাটি তখন ছিল ম্যালেরিয়ার অবাধ বিচরণ ভূমি। কাছাকাছি কোনো ডাক্তারও ছিলনা। স্বামীজি জ্বরে পড়লেন এবংযথাসময়ে তাবিকারে পরিণত হয়। চিকিৎসার অভাবে জীবনসংশয়।স্বামীগম্ভীরানন্দের রচনায় আমরা এই অবস্থার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা পাই : “সেদিন ক্রমাগত ঘর্মনিঃসরণের পর শরীর হিম হইয়া নাড়ী ছাড়িয়া গেল–যেন অন্তিমকাল উপস্থিত।” একজন অচেনা সাধু থলি থেকে কিঞ্চিৎমধু ও পিপুলচূর্ণ একত্রে মাড়িয়া রোগীকে ধীরে ধীরে খাওয়ালেন। “অমনি আশ্চর্য ফল ফলিল, স্বামীজি ক্ষণকালের মধ্যে চক্ষু মেলিয়া অস্পষ্টস্বরে কি যেন বলিতে লাগিলেন।”

এরপর মীরাট। অসুস্থ অখণ্ডানন্দকে দেখতে তিনি ডাক্তার ত্রৈলোক্যনাথ ঘোষের বাড়িতে গেলেন। স্বামীজি তখন খুব রোগা হয়ে গিয়েছেন। তাঁর রোগজীর্ণ শরীর দেখে অখণ্ডানন্দ চিন্তিত : “স্বামীজিকে এত রুগ্ন আমি কখনও দেখিনি, ঠিক যেন একখানি ছায়ামূর্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। মনে হয়েছিল তিনি যেন তখনও হৃষীকেশের সাংঘাতিক পীড়া থেকে উদ্ধার পাননি।”

নিজের চিকিৎসার জন্যও স্বামীজি দিন পনেরো ডাঃ ত্রৈলোক্যনাথ ঘোষের আশ্রয়ে থেকে গেলেন। জ্বরের প্রতিক্রিয়া ও পুনরাবির্ভাব প্রতিরোধের জন্য স্বামীজি তখন নিয়মিত ওষুধ খেতেন। ঠিক কতদিন মীরাটে থাকা হয়েছিল তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে, কারও মতে কয়েক সপ্তাহ, কারও ধারণা তিন মাসের অধিক কাল–অখণ্ডানন্দের স্মৃতিকথার মতে চার-পাঁচমাস। ১৮৯১ সালের জানুয়ারিতে স্বামীজি মীরাট ছেড়ে দিল্লির পথে অগ্রসর হলেন। এখানেই ডাক্তার হেমচন্দ্র সেনের কাছে। টনসিলের চিকিৎসা করানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

দেশে দেশে ঘুরতে ঘুরতে রাজস্থানের আলোয়ারে এসে একজন বাঙালি ডাক্তারের সঙ্গে স্বামীজির আকস্মিক পরিচয় হয়, এঁর নাম গুরুচরণ লস্কর।

ডাক্তার লস্করই স্বামীজির থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এখানেই এক মন্ত্রশিষ্য স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করেন, “তেল মাখার কি কোন উপকার আছে?”

স্বামীজি উত্তর দিলেন, “আছে বই কি! এক ছটাক তেল ভাল করে মাখলে এক পোয়া ঘি খাওয়ার কাজ করে।”

অনেক পথ পেরিয়ে মাণ্ডবীতে স্বামীজির সঙ্গে স্বামী অখণ্ডানন্দের আবার দেখা হলো। ততক্ষণে স্বামীজির স্বাস্থ্যের যে বিশেষ উন্নতি হয়েছে তা অখণ্ডানন্দের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।

অখণ্ডানন্দ দেখলেন, স্বামীজি যেন এক অপরূপ নবকলেবর প্রাপ্ত হয়েছেন। “তিনি রূপলাবণ্যে ঘর আলো করে বসে আছেন।”

.

ডাক্তারি সম্পর্কে স্বামীজির কিছু মতামত পাওয়া যাচ্ছে বেলগাঁওয়ের ফরেস্ট অফিসার হরিপদ মিত্রর বাড়িতে।

হরিপদবাবু স্বাস্থ্যের জন্য অনেকরকম ওষুধ খাচ্ছেন জেনে স্বামীজি বললেন, “যখন দেখিবে কোন রোগ এত প্রবল হইয়াছে যে শয্যাশায়ী করিয়াছে, আর উঠিবার শক্তি নাই, তখনই ওষুধ খাইবে, নতুবা নহে। স্নায়বিক দুর্বলতা প্রভৃতি রোগের শতকরা নব্বইটা কাল্পনিক…যতদিন বাঁচ আনন্দে কাটাও।”

চিকিৎসা সম্পর্কে স্বামীজির একটা স্পষ্ট মতামত পাওয়া যাচ্ছে, যদিও পরবর্তীকালে তিনি নিজেই স্নায়বিক রোগের বলি হয়েছিলেন।

অনেকদিন পরে স্যানফ্রানসিসকো থেকে ব্রহ্মানন্দকে (মার্চ ১৯০০) স্বামীজি লিখছেন, “আমি সত্য সত্য বিরাম চাই, এ রোগের নাম নিউরোসথেনিয়া–এ স্নায়ু রোগ। এ একবার হলে বৎসরকতক থাকে। তবে দু-চার বৎসর একদম বিশ্রাম হলে সেরে যায়।…এদেশ ঐ রোগের ঘর। এইখান থেকে উনি ঘাড়ে চড়েছেন। তবে উনি মারাত্মক হওয়া দূরে থাকুক দীর্ঘ জীবন দেন। আমার জন্যে ভেবো না। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে যাব।”

.

বোম্বাই থেকে জাহাজে অজানার সন্ধানে প্রথম আমেরিকা যাত্রা পর্যন্ত সময়কালে স্বামীজির স্বাস্থ্যের একটা ছবি কোনোরকমে উপস্থিত করা গেল। ১৮৯৩ সালে জুন মাসে জাহাজে তার অপ্রত্যাশিত স্বাস্থ্যোন্নতির খবরও আমরা পেয়ে যাচ্ছি খেতড়ির মহারাজা অজিত সিংকে লেখা চিঠি থেকে।

সৌভাগ্যবশত অপরিচিতপ্রবাসেজীবনসংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে স্বামীজির বড়রকম অসুখবিসুখের কোনো ইঙ্গিত নেই। এই সময় শরীর বিদ্রোহ করলে তার মিশন অবশ্যই ব্যর্থ হতে পারতো। নানা পথ পেরিয়ে অপরিচিত দেশে সহায়সম্বলহীন সন্ন্যাসী যে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন তার পিছনে ছিল অপরিসীম মনোবল ও অমানুষিক পরিশ্রম। বিরামহীন এই শ্রম যে ভিতরে ভিতরে স্বামীজির শরীরকে আক্রমণ করছে তা প্রকট হতে কিছু সময় লেগেছিলো। এমন যে হতে পারে তা আশঙ্কা করেই বোধ হয় কর্মযজ্ঞে স্বামীজির তাড়াহুড়ো। পরবর্তীকালে হরিমহারাজকে (স্বামী তুরীয়ানন্দ) স্বামীজি বলেছিলেন, “২৯ বছরের মধ্যে সব সেরে নিয়েছি।”

কিন্তু আমরা জানি ১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বিশ্ববিজয়টাই তার শেষ বড় কাজ এদেশে নয়, তার থেকেও সুদূরপ্রসারী কর্মযজ্ঞ স্বদেশে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠা। ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে এই কাজের গুরুত্ব ইউরোপ-আমেরিকা জয় থেকে অনেক বড়।

*

আমেরিকায় স্বামীজির শরীর ভাঙার প্রথম সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ১৮৯৬ সালের শুরু থেকে নিউ ইয়র্কে। ১৮৯৫-এর বড়দিনেও তার ছিল দুর্ধর্ষ শরীর ও অমানুষিক পরিশ্রম করার ক্ষমতা। নববর্ষের চিঠিতে (মিসেস ওলি বুলকে লেখা) রয়েছে তার সমর্থন : “দৈহিক ও মানসিকভাবে আমি খুব ভাল আছি।”

কিন্তু স্বামীজির পরের চিঠিতেই (৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬) অশনিসংকেত। “আমার শরীর প্রায় ভেঙে পড়েছে। নিউ ইয়র্কে আসা পর্যন্ত আমি একরাতও ঘুমোতে পারিনি।”

এমন যে হতে পারে তা আশঙ্কা করছিলেন বিদেশী শিষ্য স্বামী কৃপানন্দ। তিনি লিখছেন, “দৈত্যর মতন পরিশ্রম করছেন বিবেকানন্দ, ঘরভাড়া, বিজ্ঞাপন, মুদ্রণ ইত্যাদির খরচ সামলাতে গিয়ে তিনি প্রায় না খেয়ে থাকছেন।” শিষ্যের আশঙ্কা স্বামীজি না অসুখে পড়ে যান।

নিষ্ঠুর আশঙ্কাটি সত্য হলো, ১৮৯৬ জানুয়ারি থেকেই স্বামীজির শরীর যখন ভাঙতে আরম্ভ করলো তখন তার বয়স মাত্র তেত্রিশ।

এই সময় একটা আজব কাণ্ড ঘটেছিল। মার্কিনী অনুরাগিণী ব্রুকলিন নিবাসিনী মিস্ এস ই ওয়ালডোকে স্বামীজি একবার বলেছিলেন, “এলেন, একটা অদ্ভুত কাণ্ড, আমি কেমন দেখতে তা আমি মনে রাখতে পারছি না, আমি আয়নার দিকে বারবাব তাকিয়ে থাকি। কিন্তু যে মুহূর্তে আমি মুখ ফিরিয়ে নিই, আমি কেমন দেখতে তা সম্পূর্ণ ভুলে যাচ্ছি।”রাল এমার্সনের আত্মীয়া এই নিষ্ঠাবতী শিষ্যাটির স্বামীজি নাম দিয়েছিলেন হরিদাসী।

মনে রাখা ভাল, ৬ ডিসেম্বর ১৮৯৫ স্বামীজি জাহাজযোগে ইউরোপ থেকে নিউ ইয়র্কে ফিরে আসেন। সমুদ্র যাত্রাটি মোটেই সুখকর হয়নি। ৮ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক থেকে স্বামীজির চিঠি : “দশদিন অতিবিরক্তিকর দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর আমি গত শুক্রবার এখানে পৌঁছেছি। সমুদ্র ভয়ানক বিক্ষুব্ধ ছিল এবং জীবনে এই সর্বপ্রথম আমি সমুদ্রপীড়ায় অতিশয় কষ্ট পেয়েছি।”

নিউ ইয়র্কে ফিরে এসে দারুণ শীতে প্রায়ই সর্দিতে ভুগতে লাগলেন স্বামীজি। “আমার ঠাণ্ডা লেগেছে”–জানুয়ারির প্রবল ঠাণ্ডায় কে কারে ব্রুকলিন ব্রিজ বারবার পেরোতে হলে অসুখটা অস্বাভাবিক নয়।

.

১৮৯৬ সালের এপ্রিল মাসে আবার লন্ডনে ফিরে আসার পরে মেজভাই মহেন্দ্রনাথের সঙ্গে স্বামীজির দেখা হয়। তার যে এখানেই মৃদু হলেও হার্ট অ্যাটাক হয় তার বিবরণ আমরা যথাসময়ে বিশ্বস্ত সূত্র থেকে দেবো।

এবার জাহাজে সমুদ্রপীড়া এড়াবার জন্য আমি নিজেই কিছু চিকিৎসা করেছিলাম।”

লন্ডনে স্বামীজির বিচিত্র জীবনের নানা খবরাখবর পাঠক-পাঠিকারা এই বইয়ের শুরুতে ইতিমধ্যেই পেয়েছেন। আগস্ট মাসে কিছুটা ছুটি ও কিছুটা স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য স্বামীজি সুইজারল্যান্ডে উপস্থিত হয়েছেন।

সাবধানী পাঠক লক্ষ্য করে থাকবেন লুসার্ন থেকে স্বামীজি লিখছেন, “আমি বিশ্রী রকম সর্দিতে ভুগছি।”

মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাঁর চিন্তার শেষ নেই। মিস্টার ই টি স্টার্ডিকে স্বামীজি লিখছেন, “আশা করি রাজার কাছ থেকে মহিমের টাকা ইতিমধ্যেই তোমার জিম্মায় এসেছে। এসে থাকলেও আমি যে টীকা তাকে দিয়েছিলাম তা ফেরৎ চাই না। তুমি ওর সবটাই ওকে দিতে পার।”

১৬ই ডিসেম্বর ১৮৯৬ সালে সেবারের মতন পশ্চিমের পালা শেষ করে স্বামী বিবেকানন্দ লন্ডন ত্যাগ করলেন এবং ১৫ জানুয়ারি ১৮৯৭ কলম্বো পৌঁছলেন।

সিংহলে বিপুল অভ্যর্থনার স্রোতে এবং অবিরাম পথশ্রমে স্বামীজি যে অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন এবং তা যে ডায়াবিটিসের লক্ষণ তা যথাসময়েই জানা গেল। তার এই রোগ কোথায় প্রথম ধরা পড়লো? কলম্বো, মাদ্রাজ না কলকাতায় তা আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট নয়। আমরা শুধু দেখছি, মাদ্রাজ থেকে জাহাজে কলকাতা আসবার সময় ডাক্তাররা তাঁকে জলের বদলে ডাব খাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং সে জন্য জাহাজে প্রচুর ডাব তুলে দিয়েছিলেন অনুরাগীরা। সত্য কথাটি হলো স্বামীজি ভাঙা শরীর নিয়েই কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন।

.

ভগ্নস্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯৬ সালের প্রারম্ভকেই অন্তিমলীলাপর্বের শুরু বলাটা বোধ হয় অন্যায় হবে না। এই পর্বের তিনটি অধ্যায়, যার প্রথমটির বিস্তার স্বামীজির স্বদেশে অবস্থিতি পর্যন্ত, দ্বিতীয় পর্যায়ের বিস্তৃতি দ্বিতীয়বার বিদেশ গমন থেকে আকস্মিক আবার ভারতে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত। তৃতীয় পর্যায়ের শেষপ্রান্তে বেলুড়ে ৪ঠা জুলাই ১৯০২ এ মহাসমাধি।

১৯শে ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ স্বামীজি কলকাতায় ফিরে এলেন আর ডাক্তারদের পরামর্শে ৮ই মার্চ তাকে দার্জিলিং যেতে হলো। এই সময় স্বামীজির গরম একেবারেই সহ্য হচ্ছে না। এর আগেও তিনি প্রচণ্ড গরমকে এড়িয়ে শরীর বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।

প্রচণ্ড গরমে তার মাথার ঘিলু যে টগবগ করে ফোটে একথা তিনি আগেই লিখেছেন। দার্জিলিঙে প্রথম দিকে স্বাস্থ্যপরিস্থিতি যে খুব উদ্বেগজনক নয় তার প্রমাণ স্বামীজি খেতড়ির রাজা অজিত সিংকে দেখবার জন্য ২১ মার্চ কলকাতায় ফিরে এলেন। মহারাজ অজিত সিং কলকাতা ত্যাগ করেন ২৬ মার্চ এবং স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে দার্জিলিঙে ফিরে যান।

মেরি হেলকে দার্জিলিঙের চিঠি (২৮ এপ্রিল ১৮৯৭), “আমার চুল গোছ গোছ পাকতে আরম্ভ করেছে এবং মুখের চামড়া অনেক কুঁচকে গেছে–দেহের এই মাংস কমে যাওয়াতে আমার বয়েস যেন আরও কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। [এই সময় স্বামীজির বয়স ৩৪] এখন আমি দিন দিন ভয়ঙ্কর রোগা হয়ে যাচ্ছি, তার কারণ আমাকে শুধু মাংস খেয়ে থাকতে হচ্ছে–রুটি নেই, ভাত নেই, আলু নেই, এমনকি আমার কফিতে একটু চিনিও নেই!!…আমি এখন মস্ত দাড়ি রাখছি; আর তা পেকে সাদা হতে আরম্ভ হয়েছে–এতে বেশ গণ্যমান্য দেখায়।…হে সাদা দাড়ি, তুমি কত জিনিসই না ঢেকে রাখতে পারো! তোমারই জয় জয়কার।”

“ব্যারাম-ফ্যারাম দার্জিলিং-এ একেবারেই পালিয়েছে। কাল আলমোড়া নামক আর একটি শৈলাবাসে যাচ্ছি–স্বাস্থ্যোন্নতি সম্পূর্ণ করবার জন্য, কলকাতায় আলমবাজার মঠ থেকে মিসেস সারা বুলকে স্বামীজি চিঠি লিখছেন ৫ই মে ১৮৯৭।

আলমোড়া থেকে “অভিন্নহৃদয়” স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা দু সপ্তাহ পরের চিঠি (২০ মে ১৮৯৭): “জ্বরভাবটা সব সেরে গেছে। আরও ঠাণ্ডা দেশে যাবার যোগাড় দেখছি। গরমি বা পথশ্রম হলেই দেখছি লিভারে গোল দাঁড়ায়।…আজকাল মেজাজটাও বড় খিটখিটে নাই, ও জ্বরভাবগুলো সব ঐ লিভার–আমি বেশ দেখছি। আচ্ছা, ওকেও দুরস্ত বানাচ্ছি–ভয় কি?”

কলকাতা থেকে প্রিয় শশী ডাক্তারের চিঠি ও দু বোতল ওষুধ এসে গিয়েছে। ২৯ মে শশী ডাক্তারকে স্বামীজির চিঠি : “যোগেন কি লিখছে, তা হৃক্ষেপ করবে না। সে নিজেও যেমন ভয়-তরাসে, অন্যকেও তাই করতে চায়। আমি লখনৌ-এ একটি বরফির ষোল ভাগের একভাগ খেয়েছিলাম; আর যোগেনের মতে ঐ হচ্ছে আমার আলমোড়ার অসুখের কারণ।”

এবার ১ জুন স্বামী শুদ্ধানন্দকে শুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় লেখা চিঠি : “অব্যাহতবায়ুসেবনেন মিতেন ভোজনেন সমধিকব্যায়ামসেবয়া চ সুদৃঢ়ং সুদৃশ্যং চ সঞ্জাতং মে শরীর।” সেই সঙ্গে আশীর্বাদং বিবেকানন্দস্য। “মুক্তবায়ু সেবন, মিতাহার এবং যথেষ্ট ব্যায়ামের ফলে আমার শরীর বিশেষ সুদৃঢ় ও সুদৃশ্য হয়েছে।”

পরের দিন, ২রা জুন ১৮৯৭ ইংরিজিতে লেখা চিঠি মেরি হেলবয়েস্টারকে পুনরায় বিলেতে যাওয়া সম্পর্কে–”আমার চিকিৎসকরা এত শীঘ্র আমাকে কাজে নামতে দিতে নারাজ। কারণ ইউরোপে যাওয়া মানেই কাজে লাগা। তাই নয় কি? সেখানে ছুটি নিলে রুটি মেলে না। এখানে গেরুয়াকাপড়খানাই যথেষ্ট, অঢেল খাবার মিলবে।…নিদ্রা আহার ব্যায়াম এবং ব্যায়াম আহার নিদ্রা–আরও কয়েক মাস শুধু এই করে আমি কাটাতে যাচ্ছি।”

পরের দিনে জনৈক এক আমেরিকান ভক্তকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট, স্বামীজি আবার অজীর্ণরোগে মাঝে মাঝে ভুগছে এবং তা সারাবার জন্যে “নিজের বিশ্বাস বলে রোগ সারানোর (ক্রিশ্চান সায়ান্স মত অনুযায়ী) বিশেষ চেষ্টাও করছি। দার্জিলিং-এ শুধু মানসিক চিকিৎসাসহায়েই আমি নীরোগ হয়েছিলাম।…যদি শেষপর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভেঙেই পড়ে, তাহলে এখানে কাজ একদম বন্ধ করে দিয়ে আমি আমেরিকায় চলে যাব। তখন আমাকে আহার ও আশ্রয় দিতে হবে–কেমন, পারবে তো?”

এদিকে ডায়াবিটিসের প্রকোপ বোধ হয় কমের দিকে। স্বামীজি এবার ব্রহ্মানন্দকে লিখছেন, “আমি সেরেসুরে গেছি। শরীরে জোরও খুব; তৃষ্ণা নাই…কোমরে বেদনা-ফেদনা নাই; লিভারও ভাল। শশীর ঔষধে কি ফল হ’ল বুঝতে পারলাম না কাজেই বন্ধ।”

শরীরে নানা রোগের প্রকোপ, কিন্তু জর্জরিত বা পরাজিত নন আমাদের বিবেকানন্দ।

এই সময় তিনি যেসব বৈপ্লবিক কাজকর্মের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন তা আজও মানুষকে বিস্মিত করে। আলমোড়া থেকেই আপনজনদের কাছে যুগনায়ক পাঠাচ্ছেন তার মৃত্যুঞ্জয়ী বাণী, “হে মূর্খগণ, যে-সকল জীবন্ত নারায়ণে ও তাঁর অনন্ত প্রতিবিম্বে জগৎ পরিব্যাপ্ত, তাকে ছেড়ে তোমরা কাল্পনিক ছায়ার পিছনে ছুটেছ! তার–সেই প্রত্যক্ষ দেবতারই উপাসনা করো এবং আর সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।”

পরের দিনই (১০ জুলাই, ১৮৯৭) অভিন্নহৃদয় বন্ধু স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি জানাচ্ছেন, রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম দুর্ভিক্ষ সেবাকার্য “অতীব সুন্দর।…

ফিলসফি, যোগ, তপ, ঠাকুরঘর, আলোচাল, কলা মূলো–এসব ব্যক্তিগত ধর্ম, দেশগত ধর্ম; পরোপকারই সার্বজনীন মহাব্রত।”

সারাক্ষণই শরীরকে ডোন্টকেয়ার করে বিবেকানন্দ ভাবছেন তার প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘের কথা। পরের দিনই স্বামী শুদ্ধানন্দকে লিখছেন, “এখন মনে হচ্ছে–মঠে অন্তত তিনজন করে মহান্ত নির্বাচন করলে ভাল হয়; একজন বৈষয়িক ব্যাপার চালাবেন, একজন আধ্যাত্মিক দিক দেখবেন, আর একজন জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করবেন।”

আরও লিখছেন, “মঠ দর্শন করতে কেবল কলকাতার বাবুর দল আসছেন জেনে বড় দুঃখিত হলাম। তাদের দ্বারা কিছু হবে না। আমি চাই সাহসী যুবকের দল–যারা কাজ করবে; আহাম্মকের দল দিয়ে কি হবে?”

প্রিয় শিষ্যদের তিনি বলছেন, “তোমরা মনে রেখো, আমি আমার গুরুভাইদের চেয়ে আমার সন্তানদের নিকট বেশী আশা করি–আমি চাই, আমার সব ছেলেরা, আমি যতবড় হতে পারতাম, তার চেয়ে শতগুণ বড় হোক।”

মনে রাখতে হবে, স্বামীজি যখন এইসব চিন্তা করছেন, তখন তার “উঠতে বসতে হাঁপ ধরে…পূর্বে আমার দুইবার সর্দি-গরমি হয়, সেই অবধি রৌদ্র লাগিলেই চোখ লাল হয়, দুই তিনদিন শরীর খারাপ যায়।”

নিজের শরীরযন্ত্রণার কথা ভুলে স্বামীজি তাঁর গুরুভাই রামকৃষ্ণানন্দের শরীর নিয়ে অনেক বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন।”তোমার শরীরের ওপর বিশেষ লক্ষ্য রাখবে-তবে বিশেষ আতুপুতুতে শরীর উল্টে আরও খারাপ হয়ে যায়।”

রোগভোগের কথা স্বামীজি একেবারেই মনে রাখতে চান না। কিন্তু মধ্যিখানের কিছু চিঠি থেকে বোঝা যাচ্ছে টনসিল, জ্বর ইত্যাদি কিছুতেই তাঁকে ছাড়তে রাজি নয়, যদিও “ধর্মশালা পাহাড়ে যাইয়া শরীর অনেক সুস্থ হইয়াছে।”

কাশ্মীর থেকে (৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৭) স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে স্বামীজি সুখবর পাঠাচ্ছেন, “এবার শরীর অনেক সুস্থ হওয়ায় পূর্বের ভাবে পুনরায় ভ্রমণ করিব, মনস্থ করিয়াছি।”

সেই সঙ্গে রয়েছে বিপুল আর্থিক দুশ্চিন্তা : “এদেশের লোক ত এখনও এক পয়সা গাড়িভাড়া পর্যন্ত দিলে না–তাহাতে মণ্ডলী লইয়া চলা যে কি কষ্টকর বুঝিতেই পার। কেবল ঐ ইংরেজ শিষ্যদের নিকট হাত পাতাও লজ্জার কথা। অতএব পূর্বের ভাবে কম্বলবন্ত’ হইয়া চলিলাম।”

কম্বলবন্ত অবশ্যই আবার চলমান! সন্ন্যাসী চষে বেড়াতে চাইছেন সমস্ত ভারতবর্ষ, কিন্তু রোগ কিছুতেই তাকে ছাড়তে রাজি নয়।

এই সময়ে স্বামীজির শারীরিক ছবিটা এই রকম : আলমোড়া থেকে কাঠগোদাম যাবার পথে অসুস্থ স্বামীজি একদিনের জন্যে বন্দী ভীমতালে। ৯ই আগস্ট ১৮৯৭ বেরিলী পৌঁছে আবার ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত জ্বরের বেশ প্রকোপ। কিন্তু ওই সময় হাতগুটিয়ে বসে না থেকে, স্বামীজি একের পর এক বক্তৃতা করছেন, আবার এরই মধ্যে আর্যসমাজের স্বামী অচ্যুতানন্দকে বলছেন, আর পাঁচ-ছ বছরের বেশি মরজগতে থাকবেন না।

১২ আগস্ট স্বামীজি আম্বালায় উপস্থিত। এবার জ্বর নয়, কিন্তু প্রবল উদর বেদনা। তাই নিয়েই দেড়ঘণ্টা হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা করলেন স্বামীজি, কিন্তু অনাহারে রইলেন।

ধর্মশালার পথে অমৃতসরে স্বামীজি যে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তার খবর আছে, বাধ্য হয়ে তিনি টাঙ্গা-গাড়িতে মারী-তে গেলেন। সেখানেও কিন্তু স্বামীজি শয্যাশায়ী হতে রাজি নন, ভগ্ন শরীর নিয়ে স্থানীয় গুণগ্রাহীদের অনেকক্ষণ ধরে ধর্মসঙ্গীত শোনালেন।

নিজেকে যখন তিনি তিলে তিলে ক্ষয় করছেন, সেই সময় স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি লিখছেন (১১ অক্টোবর ১৮৯৭), “আজ দশ দিন পর্যন্ত সমস্ত কাজ যেন একটা ঝেকে করেছি বলে মনে হচ্ছে। সেটা শরীরের রোগ হোক বা মনেরই হোক। এক্ষণে আমার সিদ্ধান্ত এই যে, আমি আর কাজের যোগ্য নই।…তোমার উপর অত্যন্ত কটু ব্যবহার করেছি বুঝতে পারছি, তবে তুমি আমার সব সহ্য করবে জানি; ও মঠে আর কেউ নেই যে সব সইবে। তোমার উপর অধিক অধিক কটু ব্যবহার করেছি; যা হবার তা হয়েছে কর্ম! আমি অনুতাপ কি করব, ওতে বিশ্বাস নাই–কর্ম! মায়ের কাজ আমার দ্বারা যতটুকু হবার ছিল ততটুকু করিয়ে শেষ শরীর-মন চুর করে ছেড়ে দিলেন মা। মায়ের ইচ্ছা!..দু-একদিনের মধ্যে আমি সব ছেড়ে দিয়ে একলা একলা চলে যাব; কোথাও চুপ করে বাকী জীবন কাটাব। তোমরা মাপ করতে হয় করো, যা ইচ্ছা হয় করো।… আমি লড়াইয়ে কখনও পেছপাও হইনি; এখন কি…হবো? হার-জিত সকল কাজেই আছে; তবে আমার বিশ্বাস যে, কাপুরুষ মরে নিশ্চিত কৃমিকীট হয়ে জন্মায়। যুগ যুগ তপস্যা করলেও কাপুরুষের উদ্ধার নেই–আমায় কি শেষে কৃমি হয়ে জন্মাতে হবে?…আমার চোখে এ সংসার খেলামাত্র–চিরকাল তাই থাকবে। এর মান অপমান দুটাকা লাভলোকসান নিয়ে কি ছমাস ভাবতে হবে?…আমি কাজের মানুষ! খালি পরামর্শ হচ্ছে–ইনি পরামর্শ নিচ্ছেন, উনি দিচ্ছেন; ইনি ভয় দেখাচ্ছেন, তো উনি ডর! আমার চোখে এ জীবনটা এমন কিছু মিষ্টি নয় যে, অত ভয়-ডর করে হুঁশিয়ার হয়ে বাঁচতে হবে।…লড়াই করলুম কোমর বেঁধে–এ আমি খুব বুঝি; আর যে বলে কুছ পরোয়া নেই, ওয়া বাহাদুর, আমি সঙ্গেই আছি’..তাকে বুঝি, সে বীরকে বুঝি, সে দেবতাকে বুঝি।…তারাই জগৎপাবন, তারাই সংসারের উদ্ধারকর্তা। আর যেগুলো খালি বাপ রে এগিও না-ওই ভয়, ওই ভয় ডিসপেপটিকগুলো প্রায়ই ভয়তরাসে। তবে আমার মায়ের কৃপায় মনের এত জোর যে, ঘোর ডিসপেপসিয়া কখনো আমায় কাপুরুষ করতে পারবে না। কাপুরুষদের আর কি বলব, কিছুই বলবার নাই।”

মৃত্যুচিন্তার যে অবসান নেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লাহোর থেকে ইন্দুমতী মিত্রকে লেখা চিঠিতে : “কলিকাতায় এক মঠ হইলে আমি নিশ্চিন্ত হই। এত যে সারা জীবন দুঃখ কষ্টে কাজ করিলাম, সেটা আমার শরীর যাওয়ার পর নির্বাণ যে হইবে না, সে ভরসা হয়।”

একই দিনে (১৫নভেম্বর ১৮৯৭) স্বামীজি জানাচ্ছেন স্বামীব্ৰহ্মানন্দকে, “আমার শরীর বেশ আছে। তবে রাত্রে দু-একবার উঠিতে হয়। নিদ্রা উত্তম হইতেছে। খুব লেকচার করিলেও নিদ্রার ব্যাঘাত হয় না, আর এক্সারসাইজ রোজ আছে। ভাত তো আজ তিন মাস রোজ খাই, কিন্তু কোনও গোল নাই। এইবার উঠে-পড়ে লাগো।”

দশদিন পরেই স্বামীজি ডেরাডুন থেকে স্বামী প্রেমানন্দকে পুরনো ঘি পাঠাতে অনুরোধ করছেন, কারণ “ঘাড়ের একটা বেদনায় অনেকদিন যাবৎ ভুগিতেছি।” এই ঘি কোথা থেকে সংগ্রহ হবে? “হাবু, শরৎ (উকিল)-এর নিকট নিশ্চিত পাইবে।”

ঐ বছরের শেষ পর্বে আর একটি মাত্র রোগের খবর পাওয়া যাচ্ছে, দিল্লিতে স্বামীজি সর্দির প্রকোপ এড়াতে পারছে না।

.

আরও কয়েকটা মাস ঝপঝপ করে এগিয়ে যাওয়া যাক। স্বামীজি কাজের মাধ্যমে নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে ফেললেন। তিনি নিবেদিতাকে (২৫ আগস্ট ১৮৯৮) কাশ্মীর থেকে লিখছেন, “কাজের চাপে নিজেকে মেরে ফেলো না যেন। ওতে কোন লাভ নেই; সর্বদা মনে রাখবে কর্তব্য হচ্ছে যেন মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো–তার তীব্র রশ্মি মানুষের জীবনী শক্তি ক্ষয় করে।”

এর আগে ১৭ জুলাই ১৮৯৮ শ্রীনগর থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজির চিঠি, “যদি উত্তম ঘর হয় এবং যথেষ্ট কাঠ থাকে এবং গরম কাপড় থাকে, বরফের দেশে আনন্দ বই নিরানন্দ নাই। এবং পেটের রোগের পক্ষে শীতপ্রধান দেশ ব্রহ্মৌষধ।..আমার শরীর বেশ আছে। রাত্রে প্রায় আর উঠিতে হয় না, অথচ দু-বেলা ভাত আলু চিনি যা পাই তাই খাই। ওষুধটা কিছু কাজের নয়-ব্ৰহ্মজ্ঞানীর শরীরে ঔষধ ধরে না। ও হজম হয়ে যাবে কিছু ভয় নাই।”

কিন্তু ঠিক দুমাস পরে (১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮) শ্রীনগর থেকে শ্রীযুক্ত হরিপদ মিত্রকে অবসন্ন স্বামীজির চিঠি মনকে বড় কষ্ট দেয়। “মধ্যে আমার শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ায় কিঞ্চিৎ দেরি হইয়া পড়িল, নতুবা এই সপ্তাহের মধ্যে পঞ্জাবে যাইবার পরিকল্পনা ছিল।…ডাক্তার যাইতে নিষেধ করিতেছেন।”

মাত্র পঞ্চাশটি টাকার জন্য অসুস্থ স্বামীজি চিঠি লিখছেন হরিপদ মিত্রকে। অনুরোধ করছেন টেলিগ্রামে টাকা পাঠাতে। “আমার এখানকার সমস্ত খরচপত্র উক্ত আমেরিকান বন্ধুরা দেন এবং করাচি পর্যন্ত ভাড়া প্রভৃতি তাহাদের নিকট হইতেই লইব। তবে যদি তোমার সুবিধা হয়, ৫০ টাকা টেলিগ্রাম করিয়া ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, চিফ জজ, কাশ্মীর স্টেট, শ্রীনগর এঁর নামে পাঠাইলে অনেক উপকার হইবে। কারণ সম্প্রতি ব্যারামে পড়িয়া বাজে খরচ কিছু হইয়াছে এবং সর্বদা বিদেশী শিষ্যদের নিকট টাকা ভিক্ষা করিতে লজ্জা করে।”

একই দিনে চিঠির মাধ্যমে খেতড়ির মহারাজা অজিত সিং-এর শরণাপন্ন হয়েছে স্বামীজি।”এখানে আমি দু’সপ্তাহ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।… আমার কিছু টাকার টান পড়েছে।..অসুখ করলে খরচের বহর অনেক বেড়ে যায়। এই জগতে শুধু একজনের কাছেই আমার কিছু চাইতে লজ্জা হয় না এবং তিনি হলেন আপনি।”

.

ডায়াবিটিস, বিনিদ্রা এবং হার্টের ট্রাবল নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে স্বামীজিকে বড় ডাক্তারের শরণ নিতে হলো। তার আর্থিক অবস্থা তখন কেমন তা আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি।

স্বামী ব্রহ্মানন্দ যে খ্যাতনামা ডাক্তার কে এল দত্তর চেম্বারে গেলেন ব্যবস্থার জন্য তা আমরা তার ডায়রি থেকে জানতে পারছি। ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসীকে সে যুগের বড় ডাক্তারকে কত দিতে হল তা সকলের জেনে রাখা ভাল। ওষুধের খরচ দশ টাকা, কিন্তু ফি বাবদ চল্লিশ টাকা! ১৮৯৮ সালের অক্টোবর মাসের চল্লিশ টাকা আজকের মূল্যায়নে কত টাকা তা আন্দাজ করতে অনুরোধ জানাই পাঠক-পাঠিকাদের।

স্বামীজির স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রিয় গুরুভাইরা হাতগুটিয়ে বসে থাকতে মোটেই রাজি নন। তারা বড় ডাক্তারের বড় কড়ি জমা দিয়ে, কবিরাজেরও ব্যবস্থা করেছিলেন।

কিন্তু ডাক্তারের বড় চিকিৎসাতে স্বাস্থ্যের উন্নতি না হওয়ায়, বায়ু পরিবর্তনের জন্য স্বামীজি ১৯ ডিসেম্বর ১৮৯৮ ব্রহ্মচারী হরেনকে নিয়ে দেওঘরে গেলেন। কলকাতায় ফিরে আসেন ২২ জানুয়ারি ১৮৯৯। দেওঘরে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ভবনে হাঁপানির প্রবল আক্রমণে স্বামীজির জীবন সংকটাপন্ন।

যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দের সংযোজন : “সময় সময় এত শ্বাসকষ্ট হইত যে মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিত, সর্বাঙ্গে আক্ষেপ হইত এবং উপস্থিত সকলে মনে করিতেন, বুঝিবা প্রাণবায়ু নির্গত হইয়া যাইবে। স্বামীজি বলিতেন, এইসময় একটি উঁচু তাকিয়ার উপর ভর দিয়া বসিয়া মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিতেন।”

বেলুড় থেকে আমেরিকান শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে (২৬ জানুয়ারি ১৮৯৯) স্বামীজি মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি হবার খবর দিচ্ছেন। “ডায়াবিটিস উধাও, কিন্তু পরিবর্তে যা এসেছে তাকে কোনো কোনো ডাক্তার অ্যাজমা, আবার কেউ কেউ ডিসপেপসিয়া বলেন। দুশ্চিন্তা ঘটাবার মতন অসুখ, দিনের পর দিন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার মতন অবস্থা। যদি মার্চের মধ্যে সুস্থ হই তাহলে ইউরোপে যাব।”

ফেব্রুয়ারির গোড়ায় মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে স্বামীজির চিঠি, “বৈদ্যনাথে বায়ু পরিবর্তনে কোন ফল হয়নি। সেখানে আটদিন আট রাত্রি শ্বাসকষ্টে প্রাণ যায় যায়। মৃতকল্প অবস্থায় আমাকে ফিরিয়ে আনা হয়। এখানে এসে বেঁচে উঠবার লড়াই শুরু করেছি।”

ডাক্তার সরকার যে এইসময় তার চিকিৎসা করছেন তাও মিস ম্যাকলাউডকে জানিয়েছেন তিনি। “আগের মতো হতাশ ভাব আর নেই অদৃষ্টের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। এটা আমাদের পক্ষে বড় দুর্বৎসর।”

“দু’বৎসরের শারীরিক কষ্ট আমার বিশবছরের আয়ু হরণ করেছে,” স্বামীজি এক চিঠিতে লিখেছিলেন ১৮৯৯ এপ্রিল মাসে। “ভাল কথা, কিন্তু এতে আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না। হয় কি? সেই আপনভোলা আত্মা একই ভাবে বিভোর হয়ে তীব্র একাগ্রতা ও আকুলতা নিয়ে ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে আছে।”

এই সময়ে স্বামীজির কোষ্ঠী পরীক্ষা করিয়ে প্রবল বকুনি খেয়েছিলেন নিবেদিতা। কোষ্ঠীর ভাষ্য : স্বামীজির লগ্নে বৃহস্পতি, অতএব নয় বছর কোন ভয় নেই, তবে শরীর অসুস্থ থাকবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীকে স্বামীজি কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

*

২০ জুন ১৮৯৯। স্বামী তুরীয়ানন্দ ও মানসকন্যা নিবেদিতাকে নিয়ে বিবেকানন্দ বিদেশের উদ্দেশে গোলকুন্ডা জাহাজে উঠলেন কলকাতা বন্দর থেকে। যাঁরা তাঁকে জাহাজে তুলে দিতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন শচীন্দ্রনাথ বসু। তাঁর মতে, “সত্যি কথা বলতে কি তাকে মোটেই সুস্থ দেখাচ্ছিল না।”

জাহাজে ধূমপান, জলপান, ইত্যাদি কমিয়ে দিয়ে স্বামীজি বেশ ভাল ছিলেন। নিবেদিতাকে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার মতন মানুষেরা চরমের সমষ্টি, আমি প্রচুর খেতে পারি, একেবারে না খেয়ে থাকতে পারি; অবিরাম ধূমপান করি, আবার তাতে সম্পূর্ণ বিরত থাকি। ইন্দ্রিয় দমনে আমার ক্ষমতা অথচ ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যেও থাকি। নাহলে দমনের মূল্য কোথায়?”

৩১ জুলাই ১৮৯৯ লন্ডনের টিলবেরি ডকে স্বামীজিকে জাহাজ থেকে নামতে দেখে জনৈকা ভক্তিমতী লিখলেন, “তিনি খুব রোগা হয়ে গিয়েছিলেন, তাকে দেখে মনে হল যেন ঠিক একটি বালক।”

সমুদ্রগামী জাহাজে স্বামীজির শরীর ভাল ছিল। কিন্তু ডাঙায় নামার সঙ্গে সঙ্গে পেটে বায়ুর প্রকোপ।

স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি লিখলেন (১০ আগস্ট) “একজন বড় ডাক্তার বললে, নিরামিষ খাও, আর ডাল ছুঁয়ো না। ইনি এখানকার একজন মুরুব্বি ডাক্তার। এঁর মতে ইউরিক এসিড-গোলমালে যত ব্যারাম হয়। মাংস এবং ডাল ইউরিক এসিড বানায়; অতএব ত্যাজ্যং ব্রহ্মপদং’ ইত্যাদি। যা হোক আমি তাকে সেলাম করে চলে এলাম।… এগজামিন করে বললে চিনি-ফিনি নেই-আলবুমেন আছে। যাক! নাড়ী খুব জোর, বুকটাও দুর্বল বটে। মন্দ কি, দিনকতক হবিষ্যাশী হওয়া ভাল।”

দু’চারদিনের মধ্যেই আমেরিকা-যাত্রার ইঙ্গিত রয়েছে স্বামীজির এই চিঠিতে। বিবেকানন্দ সেবার নিউ ইয়র্কে পৌঁছলেন ২৬ আগস্ট ১৮৯৯।

.

স্বামীজির স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য মার্কিনী ভক্তরা বড় ডাক্তারের সঙ্গে হাতুড়ে ডাক্তারদের খোঁজখবর করতেও অনুৎসাহিত নন।

সেপ্টেম্বর মাসে রিজলি ম্যানর থেকে স্বামীজি তাঁর স্নেহের মেরী হেলকে লিখছেন, “তোমার চিকিৎসা (ক্রিশ্চান সায়ান্স) দিয়ে আমাকে ভাল করতে পারলে না। তোমার রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা সম্বন্ধে আমার আস্থা বেশ কিছুটা কমে যাচ্ছে।…আমার চুল তাড়াতাড়ি পেকে যাচ্ছিল, এখন কোনক্রমে তা বন্ধ হয়েছে। দুঃখের বিষয় এখন সবেমাত্র কয়েকটি পাকা চুল আছে; অবশ্য ভাল করে সন্ধান করলে আরও অনেক বেরিয়ে পড়বে। শুভ্র কেশ আমার বেশ পছন্দ।”

একই চিঠিতে স্বামীজি সরসভাবে মিস মেরী হেলকে লিখছেন, “তুমি কি অস্থিবিজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু জানো? নিউ ইয়র্কে একজন এসে বাস্তবিক অবাক কাণ্ড করছে। এক সপ্তাহ পরে তাকে দিয়ে আমার হাড়গোড় দেখানো হবে।”

২২ ডিসেম্বর তার ধীরামাতা মিসেস সারা বুলকে চৌম্বক-চিকিৎসার খবর দিচ্ছেন স্বামীজি। “সম্প্রতি আমার আবার শরীর খারাপ হয়েছিল। তাই চিকিৎসক রগড়ে রগড়ে আমার ইঞ্চি কয়েক চামড়া তুলে ফেলেছে। এখন আমি তার যন্ত্রণা বোধ করছি।”

পরের দিন সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজির রিপোর্ট, “সত্যি আমি চৌম্বক চিকিৎসা-প্রণালীতে ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছি।…আমার শরীরের কোন যন্ত্র কোনকালেই বিগড়ায়নি-স্নায়বিক দৌর্বল্য ও অজীর্ণতাই আমার দেহে যা-কিছু গোল বাধিয়েছিল।”

ম্যাগনেটিক হাতঘসার মহিলা চিকিৎসকটি জুটিয়েছিলেন মিস। জোসেফিন ম্যাকলাউড।”হাতঘসা চিকিৎসার ফলেই হোক, ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ওজোন’ বাষ্পের ফলেই হোক, অথবা বর্তমান কর্মের দশা কেটে যাবার ফলেই হোক, আমি সেরে উঠছি। পেটভরা খাবার পরে তিনমাইল হাঁটতে পারা একটা বিরাট ব্যাপার নিশ্চয়।” এই রিপোর্ট স্বামীজি স্বয়ং দিচ্ছেন তাঁর ধীরামাতা মিসেস বুলকে লস্ এঞ্জেলেস থেকে ২৭ ডিসেম্বর ১৮৯৯।

ভগ্ন স্বাস্থ্যের কথা স্বামীজি আর কত বলবেন। ১৯০০ সালের মার্চ মাসে স্যানফ্রানসিসকো থেকে মিসেস বুলের কাছে তার দাবি :”সম্ভবতঃ স্বাস্থ্যের উন্নতিই হচ্ছে–যদিও অজ্ঞাতসারে। আমি ৩০০০ শ্রোতাকে শোনাবার মতন উঁচু গলায় বক্তৃতা দিতে পারি; ওকল্যান্ডে আমায় দু’বার তাই করতে হয়েছিল। আর দু’ঘণ্টা বক্তৃতার পরেও আমার সুনিদ্রা হয়।”

ঠিক তিনদিন পরেই (৭ মার্চ) কিন্তু দুঃসংবাদ।”দিনকয়েক যাবৎ আমার শরীর খারাপ হয়েছে এবং বড় বিশ্রী বোধ হচ্ছে। আমার বোধ হয়, রোজ রাত্রে বক্তৃতা দেবার ফলেই এরকম হয়েছে। আমার আশা আছে যে, ওকল্যান্ডের কাজের ফলে অন্তত নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত ফিরে যাবার টাকা সংগ্রহ করতে পারব।” নিউ ইয়র্কে পৌঁছে ভারতে ফেরবার টাকা যোগাড়ের স্বপ্ন দেখছেন আমাদের স্বামীজি।

রোগ-জর্জরিত স্বামীজি স্যানফ্রান্সিস্কো থেকে নিজেকে খুলে ধরেছেন স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে ১২ মার্চের এক চিঠিতে: “শরৎকে বলল যে, আমি বেশি খাটছিনা আর। তবে পেটের খাওয়ার মতো না খাটলে শুকিয়ে মরতে হবে যে।…আমি সত্য সত্য বিরাম চাই, এ রোগের নাম নিউরোসথেনিয়া–এ স্নায়ুরোগ। এএকবার হলে বৎসর কতক থাকে। তবেদু’চার বৎসর একদম রেস্টহলে সেরে যায়।..এদেশ এই রোগের ঘর। এইখান থেকেই উনি ঘাড়ে চড়েছে। তবে উনি মারাত্মক হওয়া দুরে থাকুক, দীর্ঘ জীবন দেন। আমার জন্য ভেবো না। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে যাব।”

.

১৮৯৯ নভেম্বর দ্বিতীয় সপ্তাহে স্বামীজি একজন বিখ্যাত ডাক্তার ভক্তর (ডাক্তার এগবার্ট গার্নসি) নিউ ইয়র্কের বাড়িতে চলে আসেন রিজলি ম্যানর থেকে। ডাক্তার গানসির পরামর্শ, অস্টিওপ্যাথ ডাক্তার হেলমারের চিকিৎসায় থাকুন স্বামীজি। ওঁর কথা শোনেন স্বামীজি। কিন্তু ডাক্তারের আতিথেয়তায় থাকতে থাকতেই তাঁর প্রবল সর্দিজ্বর হয়। সে বিবরণ মার্কিনি ভক্তরা সংগ্রহ করেছেন।

হাতুড়ে মিসেস মিল্টনের চৌম্বক চিকিৎসা! ইনি লিখতে পড়তে পারতেন না। কথা বলতেন নিগ্রো ডায়ালেক্টে। তার হাতে রোগীর কি হলো? “আমার বেলায় বুকে অনেকগুলি বড় বড় লাল লাল দাগ ফুটে উঠেছে।” আরোগ্যের ব্যাপারে কতদুর কী হয়, তা পরে বিস্তারিত জানাবার প্রতিশ্রুতি স্বামীজি দিচ্ছেন জননীসমা মিসেস বুলকে।

শরীরের অন্য সব সমস্যার সমাধান না হোক, স্বামীজি এই সময় বিনিদ্রার হাত থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়েছিলেন মনে হয়। নিবেদিতাকে তিনি লিখছেন, “আমি এখন সকাল-সন্ধ্যা খুব খাঁটি, যখন যা পাই খাই, রাত্রি বারটায় শুতে যাই, আর কি গভীর নিদ্রা! আগে কখনও আমার এমন ঘুমোবার শক্তি ছিল না।”

শেষ পর্যন্ত চৌম্বক চিকিৎসা যে কিছু করতে পারলো না তা কয়েকদিনের মধ্যেই স্বামীজিকে স্বীকার করতে হলো মিস ম্যাকলাউডকে লেখা চিঠিতে। “যাই হোক আমার চলে যাবে।”

এপ্রিল মাসে আলমেডা থেকে লেখা মিসম্যাকলাউডকে লেখা স্বামীজির আর এক চিঠিতে বিষণ্ণ বিদায়ের সুর, শরীরের চেয়ে মনের শান্তি স্বচ্ছতাই খুব বেশি বোধ করছি, লড়াইয়ে হার-জিত দুই-ই হ’ল–এখন পুটলি-পাঁটলা বেঁধে সেই মহান মুক্তিদাতার অপেক্ষায় যাত্রা করে বসে আছি।”

এপ্রিলের শেষেও স্বামীজির অসুস্থতা ও জ্বর। সেই সঙ্গে স্নায়ুরোগ। ২রা মে ১৯০০ নিবেদিতাকে তিনি লিখছেন, “আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম-মাসখানেক ধরে কঠোর পরিশ্রমের ফলে আবার রোগের আক্রমণ হয়েছিল। যাই হোক, এতে আমি এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে আমার হার্ট বা কিডনিতে কোন রোগ নাই, শুধু অতিরিক্ত পরিশ্রমে স্নায়ুগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।”

স্নেহময় ডাক্তার লোগানের উল্লেখ রয়েছে এই সময়ের চিঠিতে। তার ঠিকানা ৭৭০ ওক স্ট্রিট। ডাক্তার লাগানের নির্দেশ, সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোনো যাত্রার ধকল নয়। এই ডাক্তার আমাকে সবল করে ছাড়বে! আমার পেট ভাল, নার্ভ ফাইন।”

এই সময় আমরা আর এক ডাক্তারের খোঁজ পাচ্ছি। ডাক্তার উইলিয়াম ফস্টার, ঠিকানা ১৫১০ মার্কেট স্ট্রিট, তাঁর কাছেও চিকিৎসা হয়েছিল। অসুস্থ স্বামীজির কিন্তু রসবোধের কোন অভাব নেই। ২৩ জুন মেরি হেলকে নিউইয়র্ক থেকে লিখছেন, “তোমার চিঠিটা হজম করতে পারিনি, কারণ গত কয়েকদিন অজীর্ণতা কিছু বেশীরকম ছিল।”

আগস্টের মাঝামাঝি বিবেকানন্দকে আমরা মানুষের মহাতীর্থ প্যারিসে কর্মব্যস্ত দেখছি। স্বামী তুরীয়ানন্দকে তিনি লিখছেন (সেপ্টেম্বর ১৯০০), আগামীকাল যার ফ্ল্যাটে থাকবেন তার বাড়ি দেখে এসেছেন, ছ’তলার ফ্ল্যাট, কিন্তু লিফট নেই। “চড়াই-ওতরাই। ওতে কিন্তু আমার আর কষ্ট হয় না।”

তুরীয়ানন্দকে লেখা আরও এক চিঠি : “শরীর একরকম গড়মড় করে চলছে। খাটলেই খারাপ, না খাটলেই ভাল, আর কি? মা জানেন।”

*

প্যারিসে একদিন মধ্যাহ্নভোজের সময় কিংবদন্তি গায়িকা মাদাম এমা কালভে তার বান্ধবী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে বললেন, তিনি মিশরে যাচ্ছেন। মিস ম্যাকলাউড যখন বললেন তিনিও সহযোগী হবেন, অমনি মাদাম কালভে স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আমার অতিথি হিসেবে মিশরে যাবেন কি?”

স্বামীজি সম্মত হলেন। মিশরে কী হয়েছিল তা যথাসময়ে জানা যাবে। মাদাম কালভে স্বামীজিকে বাবা বলতেন।

পূর্ব থেকে পশ্চিম নয়, প্রজ্বলিত সূর্য এবার পশ্চিমে থেকে ফিরে আসছেন পূর্বগগনে।

প্যারিস থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৪ অক্টোবর ১৯০০। ঐদিন মাদাম কালভের বিশিষ্ট অতিথি স্বামী বিবেকানন্দ প্যারিসের রেল স্টেশন থেকে ভুবনবিদিত ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের যাত্রী হলেন। এবারের ভ্রমণপর্ব শেষ হয়েছিল ২৬ নভেম্বর ১৯০০, যেদিন মিশরের পোর্ট তাফিক থেকে বিবেকানন্দ বোম্বাইমুখী ইতালীয় জাহাজ এস এস রুবাত্তিনোতে উঠে বসলেন স্বদেশ ফিরে যাবার ব্যাকুলতা নিয়ে।

এই ভ্রমণের সময় স্বামীজির শারীরিক অসুস্থতার তেমন বহিঃপ্রকাশ ছিল না। বরং তিনি সীমাহীন প্রাণশক্তিতে পূর্ণ। শুধু নব নব দেশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখছেন এবং অবসর সময়ে উদ্বোধন পত্রিকার জন্য পরিব্রাজক’ এর কিস্তি রচনা করছেন তা নয়, স্বামীজি সারাক্ষণ যেখানে যাচ্ছেন সেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং মাতিয়ে রাখছেন যাত্রাসঙ্গিনী ও সঙ্গীদের। সেসব দিনের হৃদয়গ্রহী বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে মাদা কালভে ও মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউডের স্মৃতিকথায়। পরিব্রাজক-এর পাঠক-পাঠিকারাও তার কিছুটা স্বাদ পেয়েছেন।

একনজরে স্বামীজির ভ্রমণসূচিটি এরকম : ২৪ অক্টোবর ১৯০০ সারারাত ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস দক্ষিণ ফ্রান্স দিয়ে চললো, পরের দিনের বেশির ভাগ সময় দক্ষিণ জার্মানি। ২৫ তারিখে ভিয়েনা পৌঁছে পরের দিন ভিয়েনাদর্শন হলো। এই শহর সম্বন্ধে লেখক বিবেকানন্দর মতামত : “ভিয়েনায় তিনদিন–দিক করে দিলে! প্যারিসের পর ইউরোপ দেখা চর্ব চূষ্য খেয়ে তেঁতুলের চাটনি চাখা; সেই কাপড়চোপড়, খাওয়া-দাওয়া, সেইসব এক ঢঙ,দুনিয়াসুদ্ধ, সেই এক কিম্ভুত কালো জামা, সেই এক বিকট টুপি।”

৩০ অক্টোবর ১৯০০ : স্বামীজির দল কনস্টান্টিনোপল পৌঁছলেন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে। এই ট্রেন বলকান দেশগুলির মধ্য দিয়ে চলে এসেছে। লঙ্কাপ্রেমী স্বামীজির আনন্দের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এখানকার লঙ্কায় এমন ঝাল যে মাদ্রাজীদেরও কঁদিয়ে দেবে!

কনস্টানটিনোপল, অর্থাৎ ইস্তাম্বুলে, ক’দিন থাকা হয়েছিল? কারুর মতে দু’তিন দিন, আর মিস ম্যাকলাউডের স্মৃতি অনুযায়ী নদিন। গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক ন’দিনকেই নির্ভরযোগ্য মনে করেন। এই সময়েই ঘুরতে ঘুরতে এঁরা এক সুফি ফকিরের তাকিয়া দেখেন। এখানকার দরবেশরা রোগ সারায়। প্রথমে ঝুঁকে পড়ে কলমা পড়ে, তারপর নৃত্য করে; তখন ভাব হয় এবং ভাবাবেশে রোগীর শরীর মাড়িয়ে দিয়ে রোগ আরাম করে। রাস্তায় বেরিয়ে স্বামীজির ছেলেমানুষের স্বভাব সর্বদা ছিল। স্বামী গম্ভীরানন্দের বর্ণনায় : সুতরাং বালকসুলভ ভোলাভাজা দেখিয়া উহা কিনিয়া খাইলেন, সঙ্গীদের সহিত তুর্ক-দেশীয় অন্যান্য সুখাদ্যও আস্বাদন করিলেন।

১০ নভেম্বর কনস্টান্টিনোপল থেকে গ্রীসের উদ্দেশে যাত্রা। সেবার গ্রীসে তিন দিন থেকে ১৩ অথবা ১৪ নভেম্বর মিশরের উদ্দেশে যাত্রা। জাহাজের নাম ‘জার’। সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে দিগ্বিজয়ী বীরের মতন স্বামীজি কিভাবে গ্রীস জয় করে মিশরে উপস্থিত হয়েছিলেন তার বিবরণ বিভিন্ন স্মৃতিকথায় রয়েছে।

মনে রাখা ভাল, ইউরোপের যশস্বিনী মিউজিক বার্ড মাদাম কালভে এক দুঃসময়ে প্রাণঘাতিনী হবার চেষ্টা করেছিলেন, মার্কিন মুলুকে বিবেকানন্দ-সান্নিধ্যে এসে তিনি নবজীবন লাভ করেন।

এবার লক্ষ্যস্থল কায়রো। মিশরীয় সভ্যতার ওপর নতুন আলোকপাত করে সহযাত্রীদের রোমাঞ্চিত করছেন বিবেকানন্দ। এমনই রোমাঞ্চিত তারা, যে কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে তারা ট্রেনও ফেল করছেন! এই কায়রোতেই সবান্ধব বিবেকানন্দ পথ হারিয়ে পতিতাপল্লীতে ঢুকে পড়েছিলেন। সেখানে অসহায় অর্ধনগ্না রমণীদের দর্শনে যে প্রাণস্পর্শী নাটকের সৃষ্টি হয়েছিল তার বিবরণ বিবেকানন্দ অনুরাগীদের অজানা নয়। নাটকের চরমপর্বে চোখের জল ফেলতে ফেলতে এক ক্রন্দনরতা হতভাগিনী স্পেনীয় ভাষায় বলে উঠেছিল Hombre de Diosঈশ্বরের প্রেরিত মানুষ!

কায়রোপর্ব সম্বন্ধে অনেক কথাই অনেকদিন এদেশে অজানা ছিল। বিবেকানন্দর দেহাবসানের বহু বছর পরে মাদাম এমা কালভে মুখ খুলেছিলেন। পরলোকগত প্রকাশক রঞ্জিত সাহার সঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের নিবিড় যোগাযোগ ছিল দীর্ঘদিন। তিনি নিবেদিতার ইংরিজি পত্রাবলী ও ভূপেন্দ্রনাথ রচিত বিবেকানন্দ জীবনীর প্রকাশকও বটে। ওঁর কাছে শুনেছি, বিবেকানন্দর পারিবারিক সূত্রের ধারণা, কায়রোতে স্বামীজিকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। কিন্তু তার কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। আমরা স্বামীজির জীবনীর মাধ্যমে প্রথম দিকে জেনেছি, প্রিয় ভক্ত মৃত্যুপথযাত্রী ক্যাপটেন সেভিয়ারের জন্য ব্যাকুল হয়ে তিনি আচমকা মাঝপথে সব প্রোগ্রাম বাতিল করে দেশে ফিরতে চাইলেন।

কায়রোপর্ব সম্বন্ধে প্রধান প্রধান বিবেকানন্দ-বিশারদরা আজও কিছুটা আলো-আঁধারিতে থেকে গিয়েছেন মনে হয়। বিবেকানন্দ জীবনীকারের মতে, স্বামীজি কায়রোর যাদুঘর, স্ফিংকস (অর্ধনারী-সিংহ মূর্তি) ও পিরামিড দেখলেন। “বিগতগৌরব প্রাণহীন এইসব বিশাল স্মৃতিচিহ্নগুলি তাহার মনে এক অবসাদ আনিয়া দিল এবং তিনি তথা হইতে দূরে–স্বদেশে চলিয়া যাইবার জন্য ব্যগ্র হইয়া পড়িলেন।”

মিস ম্যাকলাউড ও এমা কালভে তাদের স্মৃতিকথায় কিছু নতুন খবর দিয়েছেন। কিন্তু এঁদের দুজনের সঙ্গেই কথা বলে মাদাম ভার্দিয়ার যে বিস্তারিত নোট অগ্রন্থিত অবস্থায় রেখে গিয়েছেন তার থেকেই বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

মাদাম কালভে অন্যত্র গান গাইতে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে মিস ম্যাকলাউডের কাছে শুনলেন, স্বামীজি খুব বিষণ্ণ অবস্থায় রয়েছেন। মাদাম কালভে জানতে চাইলেন, কেন স্বামীজি মাঝপথে যাত্রাভঙ্গ করতে চাইছেন? বিমর্ষ বিবেকানন্দ বললেন, তিনি তার গুরুভাইদের কাছে ফিরে যেতে চান। তাকে আশ্বস্ত করা হল, টাকা পয়সার জন্যে চিন্তা নেই, প্রয়োজন হলে ফিরে যাবার টিকিট অবশ্যই কিনে দেবেন মাদাম কালভে। কিন্তু কেন আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন?” জিজ্ঞেস করলেন মাদাম কালভে।

বিবেকানন্দর চোখ এবার জলে ভরে উঠলো। মাদাম কালভের ভাষায়, এরপর তিনি বললেন, “আমি দেশে ফিরতে চাই, মরবার জন্য, আমার গুরুভাইদের কাছে যেতে চাই আমি।”

কালভে বললেন, “আপনাকে আমরা মরতে দিতে পারি না, আমাদের প্রয়োজন আপনাকে।”

তারপরেই বিস্ফোরণ! কালভেকে স্বামীজি জানালেন, ৪ঠা জুলাই আমার মৃত্যু হবে।

২৬ নভেম্বর ১৯০০ স্বামীজি মিশর থেকে বোম্বাই বন্দরের উদ্দেশে রুবাত্তিনো জাহাজে চড়লেন একাকী।

তিনদিন পরে মিস ম্যাকলাউডের চিঠি তাঁর বান্ধবী সারাকে: “স্বামীজির খবর ভাল নয়। তার আর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল–এখন ভারতে ফিরে যাচ্ছেন।”

আমাদের প্রশ্ন : “আর একটা কথার মানে কি দ্বিতীয় আক্রমণ? সেক্ষেত্রে বেলুড়ে ৪ জুলাই ১৯০২ সন্ধ্যায় তৃতীয় হার্ট অ্যাটাকেই কি তাঁর মতলীলার অবসান?

বিদেশিনী গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাককে তেমন গুরুত্ব দিতে পারছেন না। কারণ মিশর ভ্রমণপর্বে তাকে কখনও প্রচণ্ড অসুস্থ দেখায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *