৩. সন্ন্যাসীর চা পান

সন্ন্যাসীর চা পান

চা বনাম কফি! যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বনাম হরিদাস পাল! তুলনার যোগ্যই নয়। কিন্তু ঢাকঢোল নিরন্তর বাজাতে পারলে একুশ শতকের বাজারে সব অসম্ভবই সম্ভব হয়ে ওঠে! যেমন ধরুন আমরা মিষ্টি দইকে ছেড়ে দিয়ে আইসক্রিমের দিকে ঝুঁকে পড়লাম এই ক’বছরে। রসনার রণাঙ্গণে স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দের দেশবাসীরা এমন বেরসিক কাজ কিভাবে করে ফেলেলেন তা খোঁজবার জন্যে কমিশন বসানো যেতে পারে–মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণ হুশিয়ার!

সারাজীবন চা-প্রেমী, আমাদের হাওড়া ইস্কুলের সিনিয়র পটলাদা সেবার আমাকে বলেছিলেন, “দূরদর্শী সাহেবরা অনেকদিন আগেই কিন্তু সাবধান করে দিয়েছেন, নিরেস জিনিস সব সময়ই সরেসকে বাজার থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। এইটাই ভবিতব্য, এইটাই গ্রেশাম সাহেবের আইন। প্রথমে তিনি টাকা সম্বন্ধে একথা বলেছিলেন, পরে দেখা গেল জীবনের সর্বক্ষেত্রে একই আইনের অমোঘ শাসন চলছে!”

পটলাদা উঁচু ক্লাসে হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে পড়তেন তা আপনাদের অজানা নয়। খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে তার যে একটু বাড়তি কৌতূহল ছিল তাও আপনারা জানেন। ইস্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পটলাদার ব্রেক ফেল করতো, নির্ধারিত কোটার একটু বেশি খেয়ে ফেলতেন; তাই ছাত্রমহলে একটু বদনামও ছড়িয়েছিল। আমার ভাবমূর্তিতেও কালিমা লেপন উচিত ছিল, কিন্তু পটলাদা বলতেন, তুই মুখুজ্যে বামুন, অতিভোজনে তোর তো জন্মগত অধিকার! মুশকিল হলো, তোর লোভ আছে কিন্তু সাহস নেই, তাই ইস্কুলের কোন অনুষ্ঠানে একাধিক প্রসাদ প্যাকেট তুই তুলে নিতে পারিস না, ফলে তোর নোলার নিবৃত্তি হয় না। আমি ক্ষত্রিয় তেজে যা প্রাণ চায় তা করে ফেলি। মাঝে মাঝে বিপদে পড়ে যাই।

পটলাদা ও আমার মধ্যে সেই স্কুলজীবন থেকে অবিচ্ছেদ্য ভালবাসা গড়ে উঠেছিল। পটলাদা তখন থেকেই স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের নানা দুষ্প্রাপ্য ঘটনাবলী নিয়ে খোঁজখবর করে বলতেন, এই একটা লোকই দুনিয়ার সমস্ত অনাহারী অর্ধাহারী লোকদের মুখে অন্ন তুলে দিতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। পটলাদার মন্তব্য, শুধু কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ এটসেটেরা নয়, মানুষটা দুনিয়ার সবাইকে খাওয়াতে ভালবাসতেন। পটলাদাই আমাকে বলেছিলেন, এ-সংসারের কিছু স্বার্থপর লোক চিরকাল কণ্ঠা-থেকে কুঁচকি পর্যন্ত খাবারে বোঝাই করেছে, কিন্তু ভুলেও অপরের খিদের কথা একটু ভাবেনি।

পটলাদার শব্দ প্রয়োগে একটু কর্কশভাব রয়েছে বলতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। পটলাদাই জানালেন, কণ্ঠা-থেকে কুঁচকি শব্দটি স্বামী বিবেকানন্দই সানন্দে সৃষ্টি করেছেন।

বিমুগ্ধ আমি পটলাদাকে যে নোট বই উপহার দিয়েছিলাম, সেই বইতেই বহু বছর নিষ্ঠার সঙ্গে ধরে তিনি ভোজন, অতিভোজন ও অনাহার সম্বন্ধে নানা তথ্য সংগ্রহ করে যাচ্ছেন।

অনাহার ও অর্ধাহার সম্বন্ধে ভাবনা-চিন্তা করে অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার জন্য আমাদের সমবয়সী একজন ভারতীয় যে সেই পঞ্চাশের মন্বন্তর থেকে কাজ করে যাচ্ছেন তা জানা থাকলে পটলাদা কোনোসময়ে তার নোটবইটা অমর্ত্য সেনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতেন। অসুবিধাও ছিলো না, কারণ স্বয়ং পটালাদাও ভাগ্যচক্রে এন আর আই হয়েছেন, নিজের এবং পরিবারের অন্নসমস্যার সমাধান করেছেন, কিন্তু বিবেকানন্দের খাওয়া-দাওয়া এবং খাওয়ানো দাওয়ানো সম্পর্কে নানা তথ্য তিলে তিলে ইউরোপে, আমেরিকায় এবং ভারতীয় উপমহাদেশে সংগ্রহ করে চলেছেন।

পটলাদা মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্য বিদেশ থেকে হাওড়ায় এসে আমার সঙ্গে ভাব বিনিময় অব্যাহত রেখেছে। ইদানীং তিনি লক্ষ্য করেছেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসীরা উদার হস্তে অতিথিদের চা-পানে আপ্যায়িত করেন। তার থেকেই পটলাদার সাজেশন, “আমাদের চা এবং চায়ের আমরা–এবিষয়ে আমিও একটু মাথা ঘামাই।”

উত্তম প্রস্তাব। উনিশ ও বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালিরা প্রায় সবাই চা বলতে অজ্ঞান, এমন কি যাঁরা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ‘চা-পান না বিষপান’ এই প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হয়েছে তারাও প্রাণভরে চা খেতে থেকে তাদের চা বিরোধী বক্তব্য পেশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ দুজনেই চা-পান থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন, যদিও দু’জনের চানুরাগের মধ্যে তাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের ছাপ রেখে গিয়েছেন। চাইনিজ চা, জাপানী চা, ভারতীয় চা ইত্যাদির সমন্বয়ের মধ্যে বিশ্বকবি তাঁর বিশ্বপথিকের দৃষ্টিভঙ্গি অক্ষত রেখেছেন আর স্বামী বিবেকানন্দের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার কারণ, তিনি যথেষ্ট চা-কে মাদকাশক্তির কালিমা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। মুক্তিসন্ধানী সন্ন্যাসীদের কাছেও কোনোক্রমে নিষিদ্ধ পানীয় নয় এই চা। যদিও এ বিষয়ে উচ্চতম স্তরে সরসিকতা করেছেন রামকৃষ্ণানুরাগী মহাকবি গিরিশচন্দ্র ঘোষ। নিজের পানাসক্তির দুর্বলতাকে লুকিয়ে না রেখে তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, বিশ্ব সংসারে ‘মোদোমাতাল’-এর মতো ‘চেয়োমাতাল’ও আছেন অনেক। বিবেকানন্দ-ভ্রাতা দার্শনিক ও সুরসিক মহেন্দ্রনাথ দত্ত নিজেকে চেয়োমাতাল বলে মেনে নিতে লজ্জাবোধ করেননি।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গের যশস্বী লেখক স্বামী সারদানন্দ ছিলেন চায়ের প্রবল ভক্ত। চায়ে টান না থাকলে অত শক্ত শক্ত বিষয় নিয়ে অমন জলের মতো সহজ বই লেখা যায় না।

বিবেকানন্দ-ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ একবার সারদানন্দকে প্রশ্ন করেছিলেন, “তুমি এতো চা খেতে শিখলে কোথা থেকে?”

এবার একটি বৃহৎ বিস্ফোরণ। স্বামী সারদানন্দের উত্তর: “তোমার ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে। তোমাদের বাড়িতে যে চায়ের রেওয়াজ ছিল সেইটা বরাহনগর মঠে ঢুকিয়ে দিলে, আর আমাদের চাখোর করে তুললে। তোমরা হচ্ছে একটা নার্কটিকের ফ্যামিলি।”

মহেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬৮ সালে। তার লেখা থেকেই দেখা যাচ্ছে, বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হিসেবে চায়ের স্বীকৃতি মাত্র সেদিনের। “আমরা যখন খুব শিশু তখন একরকম জিনিস শোনা গেল–চা, সেটা নিরেট কী পাতলা কখনও দেখা হয়নি। আমাদের বাড়িতে তখন আমার কাকীর প্রসব হইলে তাহাকে একদিন ঔষধ হিসেবে চা খাওয়ানো হইল। একটি কালো মিসে (কেটলী) মুখে একটি নল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তার ভিতর কুঁচো পাতার মোন কি দিলে, গরম জল দিলে, তারপর ঢাললো। একটু দুধ চিনি দিয়ে খেলো।” মহেন্দ্রনাথ এরপরই জানিয়ে দিয়েছে তখন চীন থেকে চা আসতো, “ভারতবর্ষে তখন চা হয়নি।”

পটলাদা বললেন, “শেষ কথাটা ঠিক সত্যি নয়। কারণ আমরা এর আগেই দেখেছি কলকাতার দূরদর্শী বাঙালি ব্যবসায়ীরা এবং স্বয়ং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এর আগেই চায়ের ব্যবসার জন্যে বিখ্যাত আসাম কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। একদা ভুবনবিদিত এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠা ১৮২০ সালে। আরও দেখা যাচ্ছে, স্বয়ং বিবেকানন্দর বয়স যখন এক তখন এদেশ থেকে তিরিশ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের চা লন্ডনের মিনসিং লেনের নীলামে বিক্রির জন্য পাঠানো হচ্ছে।

তবে মহেন্দ্রনাথ যা বলেছেন, প্রথম পর্বে এদেশের সব চা ছিল দেবভোগ্য, অতএব তাদের গন্তব্যস্থল সোজাসুজি লন্ডনের মিনসিং লেনে।”

চায়ের গল্পে বাড়তি চিনি মেশালেন পটলাদা। বললেন, নরেন্দ্রনাথ যে অল্পয়বয়সে পাকা চাখোর হয়ে উঠছেন তার সাক্ষীও মহেন্দ্রনাথ। দ্যাখ, বড়দা একবার নিলামে ফিরিঙ্গিপাড়া থেকে পাঁচ আনা দিয়ে কেটলি কিনে আনলো। উপরটা কালিঝুলি মাখা, যেন অচ্ছেদ্দা, অবহেলার জিনিস। ওমা, ভুসোগুলো চাচতে চঁচতে দেখি, ভিতরটা খাঁটি রুপো।”

যখন নরেন্দ্রনাথের পিতৃবিয়োগের পর পরিবারে প্রবল অর্থাভাব তখনও দত্তবাড়িতে আমরা চায়ের মস্ত ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি!– বন্ধু কালী (পরে স্বামী অভেদানন্দ)-কে নিয়ে রামতনু বসু লেনের বাড়িতে এসেছেন নরেন্দ্রনাথ। অভাবের সংসার, কিছু খাওয়ার সুযোগ জুটলো না। এদিকে প্রবল ঠাণ্ডা। গভীর রাতে ক্ষুধার তাড়নায় এবং শীতে

অতিথির প্রাণ ওষ্ঠাগত। তখন নরেন্দ্রনাথ শীত ও ক্ষুধাকে একই সঙ্গে বিতাড়নের জন্য কোথা থেকে কেটলি যোগাড় করে এনে চা বানালেন, তখনকার মতন সঙ্কট কাটলো। মনে রাখতে হবে তখন এল পি জি বা বিদ্যুৎ কোনটাই কলকাতায় আসেনি, সুতরাং মাঝরাতে চা বানানো খুব সহজ ব্যাপার ছিল না।

পটলাদা চা নিয়ে যে বিশেষ গবেষণা চালিয়েছে তাতে কিছু বিশেষ খবরও পাওয়া যাচ্ছে। পরবর্তীকালে স্বামী সারদানন্দ বলছেন, “ওহে! শিবরাত্রির উপোস করে আমাদের চা খেতে কোনও দোষ নেই। কেন জান?”

যেদিন কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগ হয় (১৮৮৬, ১৬ আগস্ট) সকলেই বিষণ্ণ, খাওয়া-দাওয়া কিছু হলো না। কেই বা উনুন জ্বালে? আর কেই বা রান্না করে। অবশেষে দরমা জ্বালিয়ে কেটলি করে জল গরম করে চা করা হলো, আর ঢকঢক করে খাওয়া গেলো। অমন শোকের দেহত্যাগের দিনেও চা খেয়েছিলুম তো শিবরাত্রির সামান্য উপোস করে চা কেন খাওয়া চলবে না বলো?”

পটলাদা বললেন, “গয়া থেকে ফিরে স্বামীজির এক গুরুভাই চা-কে এমনই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, চা দিয়ে তর্পণ করলে কেমন হয় তার এক্সপেরিমেন্টও করেছিলেন। স্বয়ং স্বামীজির পাশে বসে বরানগরে স্বামী শিবানন্দ মন্ত্রপাঠ করলেন, অনেন চায়েন।”

কিন্তু প্রশ্ন উঠলো চা স্ত্রীলিঙ্গ কিনা? সেক্ষেত্রে তো বলা উচিত, অনয়া চায়য়া!

বরানগরে ভাত জুটুক না জুটুক ত্যাগী সন্ন্যাসীদের চা খাওয়ার ধুম ছিল, গুঁড়ো চা কিছুটা সবসময় থাকতো, আর ছিল তলায় খুরো দেওয়া কয়েকটা গোল চীনামাটির বাটি। তখনকার কাপে আজকের কাপের মতন হাতল থাকতো না, এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে!

আর একজন সন্ন্যাসী পরিব্রাজক আসাম ভ্রমণে বেরিয়ে চায়ের নতুন গুণাবলী আবিষ্কার করেছিলেন। “আমরা যেমন ভাতের সঙ্গে ঝোল খাই, তেমন কোথাও কোথাও ঝোলের বদলে ভাতের সঙ্গে চা মেশায়।”

আর এক পরিব্রাজক সন্ন্যাসী আরও দুঃসাহসী হয়ে তিব্বতে গিয়েছিলেন। তিব্বতীরা চা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। তারা একটি হাঁড়িতে জল দেয়, তাতে ব্রিক-টি বা জমাট করা চা খানিকটা ফেলে দেয়। তারপর শুকনো মাংসের গুঁড়ো দেয়, তারপর ছড়িয়ে দেয় ছাতু। সবটা টগবগ করে ফুটলে দেয় মাখন। ভারি রসিক জাত এই তিব্বতী, হাড়ে হাড়ে বুঝেছে চায়ের কদর, তাই সর্বদা সঙ্গে রাখে একটা গরম করার পাত্র, যার নাম ‘সামবার। খানদানি তিব্বতী যেখানে বসবে সেখানে একটু চা তৈরি হবেই।

এতো সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেও চায়ের কাহিনী যে শেষ হয় না তা আমরা দেখতে পাচ্ছি লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনযাত্রার মধ্যে। সময় ১৮৯৬ সাল, বিবেকানন্দের সঙ্গে লন্ডনে দেখা হয়ে গেল ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের। তিনি ওখানে হঠাৎ গিয়েছেন ব্যারিস্টারি পড়বার বাসনা নিয়ে।

উনিশ শতকের শেষ দশকে বিলেতে সাহেব-মেমদের চা-বিলাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য এবং অত্যন্ত উপাদেয় বর্ণনা আমরা মহেন্দ্রনাথের কলম থেকে পেয়েছি।

বিবেকানন্দ তখন বিশিষ্ট সাহেবদের আতিথ্যে বেলা চারটার সময় চা খেয়ে নানা আলাপ-আলোচনায় মগ্ন হতেন।

মহেন্দ্রনাথ, স্বামীজির ক্ষিপ্রলিপিকার গুডউইন, ফক্স ও স্বামী সারদানন্দ একদিন সাড়ে চারটের সময় চা-পানে বসলেন। “বাটিতে একজন বুড়ি ঝি বা হাউস-কিপার ছিল, সে চা লইয়া আসিল। একটা টি-পট করিয়া চা, একটি ছোট জা-এ করিয়া কাঁচা দুধ, পিচ বোর্ডের মতো পাতলা পাতলা মাখন দেওয়া পাউরুটি কাটা ও লাম্প সুগার! আর একটা বড় জাগ-এ গরম জল থাকে; যিনি পাতলা চা খান, তাকে গরম জল দেয়। সাধারণত ইংরেজরা পাতলা চা খায়, বাঙালিদের মতো কড়া চা খায় না। খালাসিরা কড়া চা খায় বলিয়া সেইজন্য তাহাকে ‘সেলার্স টি’ বলিয়া থাকে।”

মহেন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন, “গুডউইন কর্তা হইয়া সকলের বাটিতে চা ঢালিয়া দিলেন–সকলেই চা ও রুটি দু’টুকরা করিয়া খাইলেন। ইংরেজের দেশে দুধ গরম করিয়া খায় না, সর্বদা কঁচা থাকে। একবার বর্তমান লেখক গরম দুধ খাইয়াছিলেন কিন্তু এত লবণ বোধ হইতে লাগিলো যে, খাইতে কষ্ট হইতে লাগিলল। গোরুকে ইহারা অতিরিক্ত লবণ খাওয়ায়। ইহারা দুধ কাঁচা খায় বলিয়া বাংলাদেশে যাহাকে দুধের সর বলে তাহা তথায় নাই। সেইজন্য দুধের সরের কোন ইংরাজি কথাও নাই।”

মহেন্দ্রনাথের পরবর্তী ব্যাখ্যা, “চিনি হইতেছে বিট সুগার, অর্থাৎ বিট পালঙের চিনি। এক ইঞ্চি স্কোয়ার এবং তিনখানা রাখিলে কিউব হয়। ইহাকে বলে লাম্প সুগার।…লাম্প সুগার লইবার প্রথা হইতেছে যে, একটি জার্মান-সিলভার বা ঐরূপ কোন সাদা ধাতুর বাহারি চিমটার দুই দিকটা ডগাতে সরু সরু আঙুলের মতো কাঁটা দেওয়া আছে–চিনির টুকরো সেই কাটা দিয়া টিপিয়া ধরিয়া ইচ্ছামতো চায়ের বাটিতে দিতে হয়। হাত দিয়া চিনি তুলিয়া লওয়া নিষিদ্ধ।”

লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ “একদিন প্রায় বেলা চারটার সময় ফিরিয়া আসিলেন এবং চায়ে দুধ না দিয়া লেবু দিয়া খাইতে লাগিলেন। সিট্রন বা গোঁড়া লেবুর মতো গোল গোল একরকম বড় লেবু হয়, তাহাকে দু’ভাগ করিয়া কাটিয়া জাপানী চার বাটিতে চা ঢালিয়া সেই লেবুর রস ও অল্প পরিমাণে চিনি দিয়া (লাম্প সুগার) স্বামীজি ধীরে ধীরে এক বাটি চা খাইতে লাগিলেন এবং বলিতে লাগিলেন, চা ভাল লাগে না খেতে। আর দুধ দিয়ে চা খাওয়া ঠিক নয়, উহাতে পেটের গোলমাল হয়। আমেরিকায় অনেকে লেবু দিয়া চা খায় সেটা বেশ।”

বিবেকানন্দ এরপর বললেন, “আরে, আমেরিকানদের সব বাড়াবাড়ি। চা খাবে লেবু দিয়ে, তাতে আবার এক চাপ বরফ দেবে। গরমকালে তারা আইস টি খুব খায়। আরে খাবে তত এইটুকু কিন্তু থালায় নেবে এতটা। ওদের সব বেয়াড়া।”

আর এক বিদেশিনী মহিলার লন্ডনে বসে তরিবৎ করে চা পানের বর্ণনা আমাদের হাতের গোড়ায় রয়েছে লেখক মহেন্দ্রনাথের দাক্ষিণ্যে। “মিস মুলার একটি জাপানী বাটিতে গরম জল ঢালিলেন এবং ঝাজরিওয়ালা ছোটদের ঝুমঝুমির মতো হাতলওয়ালা একটি জিনিস লইলেন না। ঝুমঝুমির যেখানে কৌটা থাকে তার ঢাকনি খুলিয়া দিয়া জাপানী চা বা ‘গ্রীন টি’ ভরিয়া দিয়া ঢাকনিটা আবার টিপে বন্ধ করিলেন। সেই জিনিসটি রূপার ছিল, হাতলটি ধরিয়া জাপানী চায়ের বাটিতে গরম জলে ডুবাইয়া মাঝে মাঝে নাড়া দিতে লাগিলেন। খানিকক্ষণ পর বাটির সমস্ত জল বেশ লাল হইয়া উঠিলো এবং তাহাতে দুধ চিনি মিশাইয়া খাইতে লাগিলেন এবং যন্ত্রটা অন্যত্র রাখিলেন।”

চিনি ছাড়া যারা চায়ের কথা ভাবতেও পারেন না তাদের জন্যও সেকালের লন্ডনের বেশ কিছু খবরাখবর আমাদের কাছে রয়েছে। সমসাময়িক কালের জীবনযাত্রার সুনিপুণ ভাণ্ডারী স্বামীজির সঙ্গী এই মহেন্দ্রনাথ! “ভারতবর্ষের চিনি, সাদা বা কালো হইলেও, সবই গুড়া চিনি। আর আমরা যাকে মিছরি বলি, ওরূপ পদার্থ ইংল্যান্ডে নাই। ইংল্যান্ডের চিনি লাল্‌চে–উহাকে ব্রাউন সুগার বলে। সাদা দোব্‌রা চিনিও পাওয়া যায়, কিন্তু কম।…আর একরকম চিনি আছে, উপর দিকে মোটা ও নিম্নদিকে সরু–একরকম চোঙ্গার মতো। ইহাকে বলে লোফ সুগার। এই চিনিও যথেষ্ট ব্যবহৃত হয়। লবণের ন্যায় ইহাও জল হইবার আশঙ্কায় চাপ দিয়া চাকা চাকা টুকরা বা ডেলা করিয়া রাখা হয়।”

পটলাদা জিজ্ঞেস করলেন “চিরঞ্জীব বনৌষধির অবিস্মরণীয় লেখক পণ্ডিত শিবকালী ভট্টাচার্যকে চিনতিস তুই?”

“চেনা মানে! আমি তার স্নেহধন্য ছিলাম। স্রেফ ভালবেসে প্রাচীন ভারতের কত খবরাখব্ব দিয়ে গিয়েছেন এই অধমকে। সেসব তথ্য যোগ্য পাত্রে পড়লে সারা বিশ্বে হৈ চৈ পড়ে যেত। শিবকালীই তো বলেছিলেন, একটা নয়, চায়ের পাঁচ-পাঁচটা খাঁটি সংস্কৃত নাম আছে, যা প্রমাণ করে চীনাদের প্রসাদ পেয়ে আমরা চেয়োমাতাল হইনি। এই পঞ্চ নাম আমি মুখস্থ করে রেখেছি, যদি কখনও চায়ের নতুন টি ব্রান্ড চালু করার সময়ে কেউ এই অধমের পরামর্শ চায়–শ্লেষ্মরী, গিরিভিৎ, শ্যামপর্ণী, অতন্দ্রী ও কমলরস! চা প্রসঙ্গে আর একটা শব্দ আমাকে শিখিয়েছিলেন শিবকালীবাবু—‘ফান্ট’।

বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন পটলাদা। “সাহেবরা যে ফান্টা’ পানীয় বার করেছে তার একটা প্রাচ্যদেশীয় উৎস সূত্র তাহলে পাওয়া যাচ্ছে।”

শিবকালী ভট্টাচার্যমশায় বলেছিলেন, “ওরে বাবা, গরম জলে কোনো জিনিসকে ভিজিয়ে ভালোভাবে চাপা দিয়ে কিছুক্ষণ রাখার পর গরম থাকতে থাকতে হেঁকে নিলে যে গরম পানীয় পাওয়া যায়, তাকেই প্রাচীন ভারতে বলতো ফান্ট! এদেশের গিরি পর্বতবাসীরা এইভাবেই চা উপভোগ করতেন। এর সঙ্গে দুধ-চিনির কোনো সম্পর্ক ছিল না।”

তা হলে দুধ-চিনির ব্যাপারটা কি আমরা সাহেবদের কাছ থেকে শিখে চায়ের ব্যাপারে অধঃপতিত হলাম?

পটলাদা বললেন, “চায়ের ব্যাপারে ইংরেজ এমন দেমাকী ভাব দেখায় যেন লিপটন ব্রুকবন্ড এঁরাই ইন্ডিয়াকে চা খাওয়াতে শিখিয়ে পতিত জনকে উদ্ধার করলেন। অথচ ১৬৫৯ সালের আগে খোদ লন্ডনেই কোনো চায়ের দোকান ছিল না।

একটু থেমে পটলাদা বললেন, “চায়ের ব্যাপারে আমরা হাওড়ার লোকরাও একটু স্পেশাল গর্ব করতে পারি। শিবপুরের কোম্পানিবাগানেই পলাশির যুদ্ধের তিরিশ বছর পরে কিড সাহেব ভারতের প্রথম চা গাছের পত্তন করেছিলেন।”

“কিন্তু পটলাদা, কিড সাহেব তো জানিয়েছিলেন এ জায়গা চায়ের উপযুক্ত নয়।”

পটলাদা বললেন, “সময় কীভাবে এগিয়ে চলে! এখন আই আই টির প্রচেষ্টায় খোদ খড়গপুরেও চায়ের চাষ হচ্ছে। সেই চা আমিও খেয়েছি, খারাপ লাগেনি!”

শিবকালীবাবু বলতেন, “চায়ের পাতা তিন থেকে পাঁচ মিনিটের বেশি ভেজাতে নেই, তাহলে চায়ের ট্যানিন বেশি আসবে না, কিন্তু বেশি ভেজালেই বা সেদ্ধ করলেই দ্বিগুণ মাত্রায় ট্যানিন ফান্টে চলে আসে।”

অতন্দ্ৰী নামটি নিয়েও সামান্য সন্দেহ থেকে যায়। চা কি মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়?

শিবকালী ভট্টাচার্য আমাকে বকুনি লাগিয়েছিলেন। “ওটা তো কফির কথা হয়ে গেল। যাদের ঘুম হয় না তারা রাতে কফিকে বাঘের মতো ভয়। পায়। কিন্তু অতন্দ্রী যখন চা, তখন তার অর্থ হলো, অসময়ের ঢুলু ঢুলু ভাবটা চা পান করলে কেটে যাবে, অথচ শরীরের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না।”

অতন্দ্রী না হয় বোঝা গেল, কিন্তু ওই শ্যামপর্ণী ব্যাপারটা? পর্ণ তো আমরা জানি পাতা, কিন্তু কৃষ্ণের নামকেই একটু ভদ্রভাবে শ্যাম বলা?

শিবকালীবাবুর ব্যাখ্যা, শ্যান ঠিক সবুজও নয় আবার কালোও নয়, তারপরই নতুন সারপ্রাইজ দিয়েছিলেন শিবকালীবাবু। “ব্রাদার, সংস্কৃত অভিধান খুললে দেখবে, শ্যাম একটি অতি গোলমেলে শব্দ, এর মানে উজ্জ্বল গৌরও হতে পারে।”

পটলাদার ফান্ট শব্দটি খুব ভাল লেগেছে। “হাজারখানেক বহু ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দকে গরম জলে চুবিয়ে ঢেকে রেখে তৈরি করে রাখলে পাঠক ও লেখক দুই পার্টির খুব উষ্কার হবে।”

পটলাদা আবার স্বামী বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে ফিরতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। “মস্ত মানুষ, সবসময় সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ সাধ-আহ্লাদের কথা ভাবতেন। চায়ের ভক্ত হয়েই বুঝেছিলেন, সারা দেশকে এই পানীয় যথার্থ আনন্দ দিতে পারবে। মনে রাখতে হবে, সেই সময় পণ্ডিতরা চারদিকে চায়ের বদনাম ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, বলছেন, শরীর স্বাস্থ্যের সর্বনাশ করবে এই নেশা। বিবেকানন্দ উলটোপথের বিপ্লবী, নিজের মঠে মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ করলেও চা-কে সম্মান ও স্বীকৃতি দিলেন। বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ পাঠ করো, সেই সঙ্গে চা খাও কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু আমাদের এই হাওড়া সন্ন্যাসীর সঙ্গে এবিষয়ে ভালো ব্যবহার করেনি। বেলুড় মঠের উপস্থিতি যেখানে সেই বালি মিউনিসিপ্যালিটির তঙ্কালীন চেয়ারম্যান মঠের ট্যাক্সো প্রচুর বাড়িয়ে দিলেন, যুক্তি এটা নরেন দত্তের তো বাগানবাড়ি, যেখানে ঘন ঘন চা খাওয়া হয়।”

“অ্যাঁ!”

“অ্যাঁ নয়, স্বামী বিবেকানন্দও অন্যায় সহ্য করবার পাত্র নন, পুরসভার বিরুদ্ধে দিলেন মামলা ঠুকে চুঁচড়ো জেলা কোর্টে। সেই মামলায় মঠে চা পানের ব্যাপারে সাক্ষী-সাবুদ নেওয়া হলো, সাক্ষীরা অস্বীকার করনে না তারা চা খান। জজ সাহেব আধুনিকমনস্ক, বুঝলেন ব্যাপারটা, আলতী নির্দেশে সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট ঘোড়ায় চড়ে বেলুড় মঠে তদন্ত করতে এলেন, এবং চা পানের অভিযোগকে পাত্তা দিলেন না।”

“তদন্ত করতে এসে গোরাসাহেব কি বেলুড় মঠে চা পান করেছিলেন?”

“ঠিক জানি না, তুই এ-বিষয়ে বেলুড় বাজারে খোঁজখবর নিয়ে, নথিপত্তর দেখে আলোকপাত করতে পারিস। তবে এটা জেনে রাখ, সেকালের কলকাতায় মণ্ডামিঠাই, কচুরি-জিলিপি-গজার অসংখ্য দোকান ছিল, কিন্তু ছিল না কোনো চায়ের দোকান, ছিলো না ডবল হাফ, ছিলো না ভড়। কিন্তু দূরদ্রষ্টা বিবেকানন্দ সেই কবে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, একদিন পাড়ায় পাড়ায় চপ কাটলেটের দোকান হবে। এবং বুঝতেই পারছিস, চপ কাটলেট টোস্ট এটসেটরার পর চা আসতে বাধ্য, এর উল্লেখ পর্যন্ত প্রয়োজন হয় না। সাহিত্যে এবং শিল্পে একে বলে পরিমিতিবোধ, ঠিক জায়গায় থেমে যেতে পারলে ইঙ্গিতে অনেক বেশি বলা হয়ে যায়।”

পটলাদার সংযোজন, “শুধু আদালতে মামলা করা নয়, চা নিয়ে এদেশে এতো চিন্তা-ভাবনা বিবেকানন্দর মতো কেউ করেননি। লেখার মধ্যে যেখানেই পেয়েছে চায়ের কথা ঢুকিয়েছেন, দুনিয়ার যেখানে গেছেন সেখানে চা-কে মন দিয়ে স্টাডি করেছেন। পরিব্রাজক বইতে স্বামীজি দুঃখ করছেন, চায়ের চল–ইংল্যান্ড ও রাশিয়া ছাড়া অন্যত্র বড়ই কম।…চা পানের ধুম রাশিয়াতে অত্যন্ত–বেজায় ঠাণ্ডা, আর চীন-সন্নিকট। চীনের চা খুব উত্তম চা–তার অধিকাংশ যায় রুশে। রুশের চা-পানও চীনের অনুরূপ, অর্থাৎ দুগ্ধ মেশানো নেই। দুধ মেশালে চা বা কফি বিষের ন্যায় অপকারক। আসল চা-পায়ী জাতি চীনে, জাপানী, রুশ, মধ্য এশিয়াবাসী বিনা দুগ্ধে চা পান করে..তবে রাশিয়ায় তার মধ্যে এক টুকরো পাতি লেবু এবং এক ডেলা চিনি ফেলে দেয়।”

পটলাদা বলে চললেন, “এরপর মারাত্মক কয়েকটা লাইন রয়েছে। বিবেকানন্দ জানাচ্ছেন, গরিবরা এক ডেলা চিনি মুখের মধ্যে রেখে তার উপর দিয়ে চা পান করে এবং একজনের পান শেষ হলে, আর একজনকে সে চিনির ডেলাটা বার করে দেয়। সে ব্যক্তিও সে ডেলাটা মুখের মধ্যে রেখে পূর্ববৎ চা পান করে।”

পটলাদা আর একটা পয়েন্ট তুললেন। “ভাল চা ভালভাবে পান করবার লোক সংসারে কম নেই। তারা যে ভাল লোক তাও মেনে নিচ্ছি, কিন্তু ক’জন নামীদামী লোক নিজেই চা তৈরি করতে পেরেছেন? রবীন্দ্রনাথ চা রসিক, কিন্তু তাঁকে রান্নাঘরে ঢুকে চা করতে দেখা গিয়েছে এমন বর্ণনা আজও আমার নজরে পড়েনি। বিবেকানন্দের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, যিনি হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি বা পলান্ন রাঁধতে পিছপা নন তার পক্ষে চা তৈরি তো নস্যি! এর ভূরি ভূরি বর্ণনা রয়েছে, মাঝরাতেও এইসব বাই উঠেছে, কিন্তু লোকশিক্ষকরা নিজেরা কিছু করেই হাত গুটিয়ে নেন না, অন্যদেরও মাঠে নামান।

আমি বললাম, “পুণাতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এই কাণ্ডটা করেছিলেন। স্বহস্তে শ্যামপর্ণী প্রস্তুত করে এই অধমকে খাইয়েছেন, তারপর শিষ্যকেও সুযোগ দিয়েছে পরের রাউন্ডটা খেলবার। আমার উইকেট পতন হয়নি, এই কারণে যে, ছাত্রাবস্থায় ইস্কুলের হেডমাস্টারমশাই বিবেকানন্দ-পাগল হাঁদুদা ওরফে সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্যের বাড়িতে অভ্যাগতদের জন্য বহুবার চা তৈরি করতে হয়েছে। তবে ফুল মার্কস পাওয়া সম্ভব নয়, কারণ প্রেসার স্টোভ জ্বালানোর দক্ষতা আমি শত চেষ্টাতেও অর্জন করতে পারিনি। হায়, তখন যদি এল পি জি গ্যাস থাকতো তা হলে একশ’র মধ্যে একশ আমিও পেতাম।”

পটলাদা বললেন, “বিখ্যাত লেখক শরদিন্দু একজন অখ্যাত লেখককে দয়াপরবশ হয়ে চা তৈরির ঘরানা দিলেন, এটা প্রমাণ করে যে তিনি ছিলেন স্নেহপ্রবণ, দয়ার শরীর তার। কিন্তু চাপ্রেমী বিবেকানন্দর মধ্যে ছিল মিশনারি মনোবৃত্তি। শোন, স্বয়ং বালগঙ্গাধর তিলককে স্বামীজি আসরে নামিয়ে দিয়েছিলেন। রেকর্ডে রয়েছে, বেলুড় মঠে এসে ‘মোগলাই’ চা প্রস্তুত করে লোকমান্য তিলক সকলকে চা খাইয়েছিলেন। জায়ফল, জয়ত্রী, ছোট এলাচ, লবঙ্গ, জাফরান ইত্যাদি একসঙ্গে সিদ্ধ করিয়া ঐ সিদ্ধ জলের কাথে চা, দুধ, চিনি মিশাইয়া এই চা প্রস্তুত হইয়াছিলো।”

ভীষণ ব্যাপার! বেলুড় মঠে টিবয়ের ভূমিকায় স্বয়ং তিলক। “কিন্তু পটলাদা, ঐ মোগলাই ব্যাপারটায় একটু খটকা লাগছে। মোগলসম্রাট আকবর কি কখনও চা খাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন? আইন-ই আকবরিতে তো কোন চায়ের উল্লেখ নেই। চাকফি-কোকো এবং সেই সঙ্গে লঙ্কা এটসেটরা এদেশের আসর আলোকিত করলো মোগলসম্রাট শাজাহানের আমল থেকে। তার আগে আমাদের নোলাতে ছিল অবিশ্বাস্য অপূর্ণতা। সপ্তদশ শতকে এক সাহেব (ওডিংটন) সুরাটের বেনেদের আসরে চা-পানের বর্ণনা দিচ্ছেন। সেই চায়ে চিনি নেই, কিন্তু আছে মাথাধরা ছাড়াবার জন্যে নানারকম মশলা ও কণেক ফোঁটা লেবুর রস।

পটলাদা বললেন, “ইতিহাসে একটু-আধটু উল্লেখ যেখানেই থাকুক, বিশ শতকটাই চায়ের শতক–চেয়ো বাঙালি প্রাণভরে চায়ের সায়রে ডুব দিলো, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উপদেশ সে কানেই নিলো না। ভাড়ে চা, কাপে চা, রুপোর সরঞ্জামে চা, কাগজের পাত্রে চা, প্লাস্টিকের আধারে চা। শুনেছি এক-আধজন রসিক মাঝে মাঝে সাবেকি বাঙালি কায়দায় বেলের। খোলাতেও চা পানের এক্সপেরিমেন্ট করেছে।”

একটু থেমে পটলাদা বললেন, “অনেকে বদনাম দিয়েছে, বাঙালির বদহজম, ডিসপেপসিয়া ইত্যাদির পিছনে চায়ের অবদান নিতান্ত কম নয়। খালি পেটে চা-খাওয়ার এমন দুঃসাহস পৃথিবীর খুব কম জাতই দেখাতে পেরেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, চা আমাদের মস্ত উপকার করেছে, আমাদের চেয়ে মাতালরা এদেশের মোদো মাতালদের সবসময় দাবিয়ে রেখেছে। মাদকতার প্রসার যতটা হতে পারতো এই বঙ্গভূমে ততটা হয়নি স্রেফ এই চায়ের জন্যে।”

“টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি শেষ হয়ে গিয়েছে। একবিংশ শতকেও আমাদের এই কলকাতায় চা যুগ যুগ জিও!”

পটলাদা এবার কিন্তু মোটেই উৎসাহ দেখালেন না। “অনেকদিন পরে এলাম, পরিস্থিতি মোটেই সুবিধের নয় মুখুজ্যে। কলকাতার পুরনো চায়ের দোকানগুলো আরও মলিন হয়ে ধুকছে–চায়ের সঙ্গে তারুণ্যের সম্পর্কটা খালি চোখে ধরা পড়ছে না। মনে হচ্ছে, কফির অভাবনীয় অনুপ্রবেশ ঘটছে।”

“সে তো পঞ্চাশ বছরের ওপর চলছে পটলাদা, কফি হাউস ইনটেলেকচুয়ালরা তো সব বাহাত্তুরে হতে চললো।”

“ওরে সে তো মাত্র দু’খানা কফি হাউসে কলেজ স্ট্রিটের অ্যালবার্ট হলে আর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে কটা আর তোক ধরতো, বাকি সবাই তো চায়ের খদ্দের। জেনুইন বাঙালি তো বাড়িতে কখনও কফি ঢুকতে দেয়নি, কফি বোর্ডের প্রাণান্ত প্রচার সত্ত্বেও। এবার তো পদে পদে দুঃসংবাদ, পাড়ায় পাড়ায় বারিস্তা, কাফে কফি এটসেটার সমারোহ শহরের ছেলেমেয়ে, বুড়োবুড়ি সবাই ওইসব জায়গায় দ্বিগুণ-ত্রিগুণ দামে কফি পান করতে বদ্ধপরিকর। চায়ের বাঙালি এবং বাঙালির চা মস্ত চোট খেতে চলেছে।”

“বাঙালির রক্তে চায়ের লিকার রয়েছে, কেউ কিসসু করতে পারবে না পটলাদা, পোড়া শালপাতার গন্ধওয়ালা কফি এবং দার্জিলিঙের শ্যামপেনসম চা যে এক বস্তু নয় তা বাঙালির পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়।”

“চোখ বুজে থাকাই আমাদের জাতীয় স্বভাব। বিয়েবাড়িতে মিষ্টি দই উঠে গেল। নিমন্ত্রিতরা আইসক্রিম চাখছে এটাও তো ভাবা যেতো না, শেষ হয়ে গেল মিষ্টি দইয়ের সাংস্কৃতিক আধিপত্য। মাটির খুরিকে দাবড়াচ্ছে প্লাস্টিক কাপ, ভাবা যায় না! রসনার রাজত্বেও সংখ্যালঘু হবার দুঃখ কি তা তোরা এখনও বুঝতে চেষ্টা করছিস না।”

পটলাদা বললেন, “বিশেষ একটা লবি তিনশ বছর ধরে কফিকে জাতে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে, অথচ এঁরা জানতেন সুরসিক সম্রাট চতুর্দশ লুই প্রথমে কফি পান করে মোটেই সন্তুষ্ট হননি। অথচ ফ্রান্সে প্রচারের ধাক্কায় কফির এমন প্রমোশন হলো যে লেখা হলো, ইংরেজের চা, জার্মানদের বিয়ার, স্প্যানিয়ার্ডের চকোলেট, তুর্কের আফিম আর ফরাসির কফি এক জিনিস। এই পানীয়কে জনপ্রিয় করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্যাস্কাল নামে এক ভদ্রলোক, যাঁকে কফি মিশনারি বলা যেতে পারে। প্যারিসের এক মেলায় উর্দিপরা ওয়েটাররা গরম কফি ফেরি করতে লাগলো। মেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্যাস্কাল এক কফি বুটিক খুলেছিলেন। খরিদ্দারের ভিড় থাকায় প্যাস্কালকে পাড়ায় পাড়ায় গরম কফির ফেরিওয়ালা পাঠাতে হতো। তারপর ডাক্তাররা কফির গুণে মোহিত হয়ে নাকি রোগীদের বলতে লাগলেন কফি খাও।”

পটলাদার দুঃখ চায়ের প্রচারের জন্য কেউ কিছু করে না, কলকাতার চায়ের দোকানগুলোর সঙ্গে কফির দোকানগুলোর তুলনা করলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। “বাঁচতে হলে বিবেকানন্দর প্রদর্শিত পথে তোদের ফরাসী সাহায্য ভিক্ষা করতে হবে। জপল স্টেশনের কাছে একটা টি সালো আছে যেখানে কুড়িটা দেশের তিনশো রকম চা মজুত থাকে, আর আছে দুশ রকমের টি-পট, রসিকের মর্জি অনুযায়ী চা পরিবেশন করবে ফরাসী সুন্দরীরা। আমাদের এই শহরে চা আছে, টি-পট আছে, দোকান আছে, সুন্দরীরাও অঢেল, নেই শুধু আইডিয়া এবং উদ্যম, ফলে দার্জিলিঙের এতো কাছে থেকেও আমরা বিবেকানন্দের শহর কলকাতাকে চায়ের ওয়াটারলু করে তুলেছি।”

বললাম, “এক সময় ব্যান্ডেল স্টেশনেই দশ রকম গরম চা পাওয়া যেতো, রসিকরা জানতেন কোন্ ভেন্ডারের কেটলিতে কি জিনিস আছে।”

“কলকাতার কপালে অনেক দুঃখ! ভড়কে চায়ের প্রচারে নিয়োগ না করে তা দিয়ে পূজামণ্ডপ বানানো হচ্ছে,” পটলাদার খেদোক্তি।

“তা হলে কিংকর্তব্যম, পটলাদা?”

“খোদ কলকাতায় কফির হাতে চায়ের পরাজয় হবার আগেই যেন আমার কলকাতায় আসা বন্ধ হয়। কফির সঙ্গে পাঞ্জা লড়া, প্রয়োজনে কফির দোকানের সামনে অবস্থান প্রতিবাদ করা, লোককে বলা, কলকাতার সেরা মানুষরা কখনও কফিকে প্রশ্রয় দেননি, বড়জোর নিষিদ্ধ পানীয় হিসেবে নমাসে ছ’মাসে একবার কফি হাউসে পদার্পণ করেছেন। অমন যে অমন স্বামী বিবেকানন্দ তিনিও খোদ প্যারিসে সূর্যাস্তের পর কফি পান করতেন না, ওতে ওঁর ঘুমের বারটা বেজে যায়।”

আমি পটলাদার পয়েন্টগুলো নোট করে নিচ্ছি। পটলাদা বললেন, “বাঙালির বাঙালিত্ব বলতে ওই চটনা ওঠা চায়ের কাপটুকুই পড়ে আছে, ওটা কিছুতেই আমরা ছাড়বো না, আমাদের চূড়ান্ত দাবি, কফি দূর হটো! বিবেকানন্দের চা, যুগ যুগ জিও। যুগ যুগ জিও।” এই বলে পটলাদা উঠে পড়লেন। এন আর আই মানুষ, কলকাতা ছাড়বার আগে ক্যামেরায় কলকাতার বিলুপ্তপ্রায় চায়ের দোকানগুলোর ছবি তাকে তুলে নিতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *