৪. শীত পড়তে শুরু করেছে

শীত পড়তে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে চার পাঁচটা মাস কেটে গেল। এর ভেতরে অনেক কিছু হয়ে গেছে। ইদ্রিস এখন এদের ভাষায় চমৎকার কথা বলতে পারে। তার কথা শুনে বুঝবার উপায় নেই সে ভাটির দেশের মানুষ। গোড়াতেই সে বুঝেছিল এদের মন জয় যদি করতে হয়, বিশ্বাস জন্মাতে হয় তাহলে এদের ভাষা শিখতে হবে। ভাটি থেকে আগে যারা এসেছিল, তাদের উদ্দেশ্যও খুব ভালো ছিল না, এদের ভাষা শেখার দরকারটাও তারা টের পেত না। বরং হাসাহাসি করত ভাষা শুনে।

ইদ্রিসের এখানে এক নাম চালু হয়ে গেছে। কলা খাওয়া ডাক্তার। একদিন হাটে গিয়ে দেখে সোনার টুকরোর মতো কড়ে আঙ্গুল সাইজের কলা বিক্রি হচ্ছে। নাম কী বাহে এই কলার?

চিনিচাম্পা।

বাহ, ভারী সুন্দর নাম তো।

কী দর দিছেন তোমরা?

সুকি সুকি পণ।

অর্থাৎ এক পণ এক সিকি। আশিটা চার আনায়।

আধ পণ ধরি দে মোক।

চল্লিশটা কলা নিয়ে সেখানেই একটা ছাড়িয়ে মুখে দিল ইদ্রিস। ভারী মিষ্টি আর তেমনি সুঘ্রাণ। কর্পূরের মতো মাতাল করা। খেতে খেতে কলার খোসার স্থূপ জমে গেল পায়ের কাছে।

তাকিয়ে দেখে ছোট খাটো একটা ভিড়ও জমে তার চারদিকে। গায়ের লোকেরা সওদা করতে এসে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে এই কাণ্ড দেখে! মুখ টিপে হাসছে। ফিসফিস করছে এ ওর কানে। ভারী মজা লেগেছে তাদের।

কী হে?

চল্লিশটার শেষ কলাটা মুখে পুরতে পুরতে ইদ্রিস বলে।

না, কিছু নোয়ায়।

দে, মোক আরো আধ পণ দে।

আরো চল্লিশটা কিনল ইদ্রিস।

চোখ কপালে উঠল জনতার। ইদ্রিস আরো গোটা দশেক খেল। মাথা দুলিয়ে বলল, অমৃত বুঝিস?

তাক আবার কী?

বুঝিস না। কী বুঝিস তাহলে? তোমরার চিনিচাম্পা অমৃত লাগিল আমার।

কী বুঝল, খুব হাসল সবাই।

সেই থেকে ইদ্রিসের নাম ছড়িয়ে পড়ল কলা খাওয়া ডাক্তার।

দূর দূরান্তে রোগী দেখতে গেলে, গাঁয়ের লোক তাকে এখন কলার ছড়া দেয়। বলে, খান তোমরা।

ইদ্রিস টের পায় ভেতর বাড়ির বৌ–ঝিয়েরাও উঁকি দিয়ে দেখছে তার কলা খাওয়া। খুব আমোদ লাগে তার।

আগে রোগী বাড়ি গেলে কিছু খেত না। চিড়ে মুড়ি মুড়কি দৈ ধরে দিত। ফিরিয়ে দিত। তাতে মনে কষ্ট পেত কেউ কেউ। কলার কথাটা চাউর হয়ে যাওয়ার পর সুবিধে হয়েছে। বাড়িওলাও ক্ষুণ্ণ হয় না, খিদেটাও যায়।

এদিকে তিস্তা থেকে কুড়িগ্রাম মিটার গেজ লাইন বসছে। কাজ শুরু হয়ে গেছে। হাজি সাহেব মাঝে মাঝেই যান দেখতে। বলতে গেলে তাঁর একার চেষ্টায় এত বড় একটা কাজ হচ্ছে এ অঞ্চলে। তার রাত দিনের ভাবনা এখন—- রেললাইন। রেললাইন ছাড়া মুখে কোনো কথা নেই। ভাইসরয় কী বললেন, রেল কোম্পানির লাল মুখো আইরিশ এঞ্জিনিয়ার ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তাকে রেলপথ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে শুনে কী রায় দিয়েছিলেন, তার আপত্তি কোন কোন যুক্তিতে খণ্ডালেন হাজি সাহেব—- এইসব কথা এখন পতিদহের কাঁচারি বাড়ি গরম করে রাখে।

 এঞ্জিনিয়ার বলেছিল, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা বড় এঁকেবেঁকে গেছে। তার ওপরে রেললাইন পাতা মানেই রেলও যাবে এঁকেবেঁকে। এতে গাড়ি খুব স্পীডে যেতে পারবে না। বড় জোড় ঘন্টায় পনেরো কুড়ি মাইল।

তা হোক।

হাজি সাহেব বলেছিলেন, নতুন পথ কাটতে সময়ও লাগবে, টাকাও লাগবে। এ অঞ্চলে মিটার গেজ লাইন আশু হওয়া দরকার। হাজার হাজার মণ উদ্বৃত্ত ধান চাল পাট শুপারি মহকুমার বাইরে যেতে পারছে না শুধু এই লাইনটার জন্যে। সরকারের কত বড় ক্ষতি। দেশের কতখানি অপচয়।

শেষ অবধি সেই ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার ওপরেই রেললাইন বসছে। ইদ্রিসের বড় ইচ্ছে ছিল একবার দেখে আসবে কী করে রেল বসায়। কিন্তু সময় পায় না। আজকাল রোগী এত হচ্ছে যে একদণ্ড বিশ্রাম নেবার ফুরসৎ হয় না তার।

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ডিস্পেন্সরীতে রোগী দেখে। দুপুরে গোসল করে চারটি খেয়ে নিয়ে নামাজ পড়ে। তারপর লিখতে বসে রিপোর্ট। রিপোর্ট শেষ হতে না হতেই কল আসে। বেরুতে হয় এ গাঁয়ে সে গাঁয়ে রোগী দেখতে।

গাঁয়ের লোক ডাকতে আসতো ঘোড়া নিয়ে। ঘোড়ার পিঠে যাবেন ডাক্তার। কিন্তু ইদ্রিসের ভারী অস্বস্তি হয় ঘোড়ার পিঠে চড়ে। কথাটা হাজি সাহেব জানতে পেরে সাইকেল কিনে দিয়েছেন তাকে। ঝকঝকে নতুন, তিন বন্দুক মার্কা বি–এস–এ সাইকেল। রডের সঙ্গে পাম্প মেশিন আঁটা। সাইকেলের ত্রিভুজাকৃতি পেটে কাপড়ের থলে লাগিয়ে নিয়েছে সে। তাতে থাকে স্টেথসকোপ, ওষুধের বাক্স, নামাজ পড়বার জন্যে টুপি গামছা। সিটের পেছনে চামড়ার খাপে লিক মেরামতের সাজসরঞ্জাম। বিকেল হতে না হতেই এখন কুয়াশা নেবে আসে। থোকা থোকা কাশফুলের মতো ভেসে বেড়ায় মাঠের ওপর, ঝুলে থাকে গাছের নিচু ডালে, খড়ের চালায়। কেমন শান্ত স্তব্ধ মনে হয় চারদিক। মনে হয়, খুব ভালো, খুব মিষ্টি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরে। গলা পর্যন্ত বোম লাগিয়ে হাঁটতে বেরোয় ইদ্রিস। একা লাগে আরো বেশি করে পথের ওপরে উদ্দেশ্যহীন চলতে গিয়ে। একাকীত্বটুকু নেশার মতো জড়িয়ে ধরে ইদ্রিসকে। মনটা ক্ষমাশীল হয়ে ওঠে। পৃথিবীতে যত দুঃখ আছে সব মিথ্যে মনে হয়। যত বিরোধ, যত দ্বন্দ্ব সব তুচ্ছ হয়ে যায় তার কাছে। ক্ষমাই এই মুহূর্তের মূল সুর হয়ে ওঠে তার মনে। কোথায় কোন্ ছেলেবেলায় শীত রাতে এক যাত্রা শুনতে গিয়ে গানটা ভারী ভালো লেগেছিল। অতল অতীত তোলপাড় করে কথাগুলো মনে পড়ে তার। একটু একটু। আবার মনে পড়ে না। খানিকটা স্মৃতি থেকে, খানিকটা নিজে বানিয়ে ইদ্রিস গুণগুণ করে, নিশি না পোহালে মন অভাগিনীর ভরসা কী? তারপর সন্ধ্যে হয়। আকাশটা নীলাক্ত লাল দেখায়। ডানা ঝটপট করে পাখিরা বাসায় ফেরে। এক দুই তিন চার। কালো কালো পাখিরা কোন্ মাঠঘাট পেরিয়ে তাল সুপারির বনের পাশ দিয়ে চলেছে। কোথা থেকে আজানের সুর ভেসে আসে। মনে হয় কোনো মানুষ নয়, প্রকৃতিই যেন ডাক দিচ্ছে যোজন দূর থেকে। পথের পাশে কারো বাড়িতে হাঁক দেয় ইদ্রিস। নামাজটা। সেখানেই সেরে নেয় সে। তারপর ঘরমুখো হয়।

ঘরে এসে বারান্দায় কড়ি কাঠ থেকে ঝোলানো লণ্ঠন নাবিয়ে চিমনি সাফ করে। সলতে টেনে তোলে। আলো জ্বালে। দূরে শেয়ালের আনাগোনা শুরু হয়। দুদ্দাড় করে এক আধটা দৌড়ে মাঠ পেরোয়। কোনদিন ইদ্রিস চিঠি লেখে বসে বসে, ডাক্তারি বই পড়ে কোনদিন, আবার এক একদিন অমিয় ধারা খুলে মনে মনে আবৃত্তি করে।

এশার নামাজের আগেই বছির এসে হাঁক দেয়, ভাত দেইম গো ডাক্তারের ব্যাটা?

হাঁকটা অভ্যাসবশত দেয় সে। হাতে গামলা ধরাই থাকে। যতক্ষণ সে খায় বছির পাশে। দাঁড়িয়ে গল্প করে। তার গল্পের প্রধান বক্তব্য : বিশ্বসংসারের সবাই পাগল, এত পাগল নিয়ে সে আর পারে না।

আবার কোনো কোনো দিন রোগী দেখে ফিরতে রাত হয়ে যায় ইদ্রিসের। এক প্রহর, দুই প্রহর। ফিরে এসে দেখে লণ্ঠনটা কে জ্বালিয়ে সলতে ছোট করে রেখেছে। টেবিলের ওপর ঢাকা দেয়া আছে ভাত তরকারি। সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধোয় ইদ্রিস। বারান্দায় রাখা বালতির পানিতে মুখ গলা পা ধুয়ে খেতে বসে সে। পাশের ঘর থেকে মসজিদের মৌলবি সাহেব সাড়া দেন, ডাক্তার সাব নি?

জি হ্যাঁ।

একটু পরে মৌলবি সাহেব এসে জাঁকিয়ে বসেন। কী করে যে আলাপটা রোজ জ্বীন পরীর দিকে চলে যায় তা ভেবে পায় না ইদ্রিস। রোজই সে অন্যমনস্কতা থেকে জেগে উঠে দেখে কোথায় কার বৌকে কবে জ্বীন ধরেছিল সেই গল্প শুরু হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে মৌলবি সাহেবের উৎসাহ অসীম। মাথাটাও খুব খোলে। বর্ণনা দেন জীবন্ত ভাষায়। রূপ বর্ণনায় রীতিমত প্রতিভাবান মনে হয় তাকে। সব গল্পের শেষেই মৌলবি সাহেব দেখা দেন উদ্ধার কর্তা রূপে।

অসহ্য, অশ্লীল মনে হয় লোকটাকে। ইদ্রিস হুঁ হাঁ ছাড়া বিশেষ প্রায় কিছুই বলে না। কিন্তু পার পাওয়া যায় না তাতে। লেবি সাহেব প্রতিদিনই হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশ্ন করেন, জ্বীন পরীতে ইদ্রিসের বিশ্বাস আছে কিনা!

প্রতিদিনই ইদ্রিস বলে, আমার ঘুম পাচ্ছে মৌলবি সাহেব। কাল আলাপ হবে আবার। মৌলবি সাহেব বিরস মুখে ঘোঁৎ ঘোৎ করতে করতে খড়মের আওয়াজ তুলে পাশের ঘরে চলে যান।

সেদিন এমনি রোগী দেখে ফিরতে রাত দশটা হয়ে গেল। রোগীটাকে বাঁচাতে পারে নি ইদ্রিস। সান্নিপাতিক জ্বর। কিছুদিন থেকে চিকিৎসা চলছিল তার হাতেই। আজ বিকেলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ায় কল দিয়েছিল তাকে।

বেরিয়ে পড়েছিল আছরের নামাজ পড়েই। রোগী বাড়িতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। গিয়ে দেখে কান্নার রোল পড়ে গেছে বাড়িতে। খড়ের ঘ্রাণ আর মায়ের কান্না মিলে মিশে ভারী করুণ হয়ে উঠেছে আবহাওয়া। হাত ধরে বুঝল, নাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না রোগীর। একটা ওষুধ দিল সে। মালিশের ব্যবস্থা করল। ঘর থেকে ভিড় সরিয়ে দিল। কিন্তু শেষ অবধি কিছুতেই কিছু হলো না। আটটার দিকে নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল।

হায়াত না থাকলে সে করবে কী? তবু যেন মনে হলো এ তারই পরাজয়। সে দুর্বল বলেই আজরাইল জয়ী হয়ে গেল আজ। মাথা নিচু করে সাইকেল ঠেলে বেরিয়ে এলো সে পথের ওপর। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল তারা ঝকঝক করছে দিগন্তের ওপরে। মা বলতেন, মানুষ মরে আকাশের তারা হয়ে যায়। একটা করে তোক মরলে আকাশে একটা তারা বাড়ে। সদ্য একজনকে মরতে দেখে এসে একাকী অন্ধকারে পথের ওপর দাঁড়িয়ে কথাটা যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়।

দূর, দূর! এ সব কী ভাবছে! কদিন হলো দেখছে ইদ্রিস, তার ভেতরটা যেন তার কাছেই অচেনা হয়ে উঠেছে। সে তো অনেক দিন থেকেই একা; কিন্তু আগে সেটা চোখে পড়ত না, এখন পড়ে। কদিন থেকে বাড়ির কথা মনে পড়ে কারণে অকারণে। পৃথিবীতে অসম্ভব অবাস্তব যা কিছু হতে পারে সব যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। কিংবা হতে চায়। নিজেকে মনে হয় দুর্বল, অসহায়।

মনে হয়, খুব প্রবল একটা স্রোতে ভেসে চলেছে সে। তার নিজের যেন করণীয় কিছু নেই। যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকেই যাবে সে।

কৃষ্ণপক্ষ চলছে। পথ–ঘাট ভালো করে কিছু দেখা যায় না। প্রায় সবটাই আন্দাজের ওপর সাইকেল চালাতে হচ্ছে। তার দরুণ এক ঘণ্টার পথ পেরুতে লাগছে দুঘণ্টা। এই হরিরামপুরের শ্মশান পেরুলো। চিতা জ্বলছে একটা। অন্ধকারের একটা পাড়ে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। সেদিকে তাকাতে যাচ্ছিল ইদ্রিস। হঠাৎ দেখে, দুটো লোকের ঘাড়ে সাইকেল তুলে দিচ্ছিল সে। এ অঞ্চলে সাইকেল আছে, একমাত্র তার। কাজেই অন্ধকারেও তারা চিনতে পারল তাকে। হেঁকে বলল, কাই বাহে, কলাখাওয়া ডাক্তার?

হা। তোমরা?

হরিরামপুরের অছিমদ্দি আর হাগুরা খাও।

ছাওয়া ভাল আছে তোমার?

এককোণা আসেন না কেনে হামার বাড়ি? ছাওয়াক দেখি যাইবেন। গুয়া পানও খাইবেন। অছিমদ্দির ছেলেটা কৃমিতে ভারী কষ্ট পাচ্ছিল। তার ওপরে ম্যালেরিয়া তো আছেই। এক বাঁক পরেই তার বাড়ি। এত কাছে যখন একবার দেখে গেলে হয়। সাইকেল ফেরাল ইদ্রিস। জাম গাছের সঙ্গে সাইকেলটা ঠেস দিয়ে রাখল সে। বলল, তাড়াতাড়ি করো ভাই অছিমদ্দি। অছিমদ্দি ভেতরে যাবার পরেই ভেতর থেকে তার কুদ্ধ গলা শোনা গেল। আর পরক্ষণে প্রহারের আওয়াজ। অছিমদ্দির ছেলেটা কেঁদে কঁকিয়ে উঠল।

ডিবে এক হাতে, আরেক হাতে ছেলেটাকে টানতে টানতে অছিমদ্দি এলো সামনে।

ব্যাপার কী?

কন কেনে ডাক্তারের ঘর। মুই মানা করি গেছং গুড় খাবু না, আসি দ্যাঁহো গুড় খাবার নাইগছে জানোয়ার কোন্টেকার।

ইদ্রিসই মানা করেছিল ছেলেটাকে মিষ্টি কিছু দিতে। সে বলল, আহা ছেলেমানুষ তো। ছাওয়া পোওয়াক তাই বুলি মারেন তোমরা?

ডিবেটা ধরে শিউরে উঠল ইদ্রিস। ছেলেটার চোখ কংকালের মতো ভেতরে বসে গেছে। কালি পড়েছে। বুকের সবকটা হাড় গোনা যাচ্ছে। ঝুলে পড়েছে ঢাকের মতো পেটটা। কোমরে ঘুনসি ছাড়া পরনে আর কিছু নেই। শেষ যখন দেখেছিল প্লীহাটা তখনো এত বড় ছিল না। ছেলেটা তখনো ফুলে ফুলে উঠছে কান্নায়। ঠোঁট গাল দুহাত চটচট করছে আখের গুড়ের রসে।

পেটটা একবার টিপে দেখল তার। নাড়ি দেখল। কিছু জিজ্ঞেসাবাদ করল। তারপর বলল, কাল ডিস্পেন্সরীতে আসেন তোমরা। ওষুধ দেমো ভাল দেখি।

যান কোটে? গুয়া পান মুখোৎ দিয়া যান।

পেছন থেকে অছিমদ্দি ডাকে। কিন্তু সে আর থামে না। অন্য সময় হলে হয়ত দুদণ্ড দাঁড়াতো। আজ ছেলেটাকে দেখেই তার মনে হয়েছে, বাঁচবে না। এ রকম একটা দুধের শিশু মারা যাবে, ভাবতেই ভেতরটা শিউরে উঠেছে তার। এক মুহূর্ত আর দাঁড়াতে পারেনি সে।

কাঁচা সড়ক দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ফিরতে ফিরতে তার মনে পড়ে গেল বড় ভাইয়ের কথা। প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই কুড়িটা টাকা সে মনিঅর্ডার করে দিয়েছিল। লিখেছিল, বড় ভাই যেন একজোড়া ভালো জুতো কিনে নেন, আর মাকে একটা মখমলের জায়নামাজ কিনে দেন। কুপনটা ফেরৎ এসেছে অনেকদিন। কিন্তু কোনো চিঠি পায় নি সে। বড় ভাইও দেন নি, মাও না। মা তো লিখতেই জানেন না। বড় ভাই যদি লিখে না দেন তো মার হাত পা বাঁধা।

বড় ভাই বোধহয় এখনো তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন। দোষ তো তারই। তবু ইদ্রিস সব ভুলে গিয়েছে। পতিদহে এসেই চিঠি দিয়েছে এমনভাবে যেন দুভায়ে কোনোদিনই কিছু হয় নি, আগের মতোই সদ্ভাব আছে। সে চিঠির উত্তরও পায় নি সে।

খুব দুঃখ হলো ইদ্রিসের। ছেলেবেলায় একবার তার জ্বর হয়েছিল, বড় ভাই সারারাত জেগে মাথায় পানি দিয়েছিল তার। সে ভাই বুঝি মারা গেছে। আর কোনোদিন তার দেখা পাবে না সে।

যা কিছু হয়ে গেছে, তার জন্যে তো সে দেশ ছেড়েই চলে এসেছে। এখনো যদি সে কথা মনে রাখেন বড় ভাই, তাহলে অবিচার করা হয়।

ইদ্রিসের ইচ্ছে হয়, বড় ভাই যদি গোঁয়ারতুমি না করে কোনো একটা কাজকর্ম ধরতেন! আজকাল ইংরেজি লেখাপড়া না জানলে বড় হওয়া যায় না। তাই নিজে জেদ ধরে বড় ভাইকে টেনে নিয়ে এসেছিল সে ইংরেজি, ইস্কুলে। কিন্তু কিছুই লাভ হলো না শেষ অবধি। ইদ্রিস মনে মনে ভাবে, সে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, একটু গুছিয়ে নিতে পারে, তাহলে বড় ভাইকে নিয়ে আসবে দেশ থেকে। আর কিছু না হোক, হোমিওপ্যাথি শিখতে বলবে তাঁকে। দেশে ডাক্তারের বড় অভাব। ইদ্রিস একা বড় হতে চায় না, সে যদি বড় হবে তো বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়েই হবে।

এই সব ভাবতে ভাবতে ঘরে এসে পৌঁছে ইদ্রিস। দেখে মৌলবি সাহেব আর বছির কথা বলছে। তাকে দেখেই মৌলবি সাহেব দৌড়ে এলেন। বললেন, আইলেননি ভাই ছাব!

 দেখছেনই তো।

এক কাম হই গেছে।

মৌলবি সাহেবের চোখ চকচক করতে থাকে। কানের কাছে মুখ এনে বলেন, বুবুজানেরে জ্বীনে ধইচ্ছে।

তাকে উপেক্ষা করে ইদ্রিস বছিরকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে রে?

যা শোনা গেল তা এই সন্ধ্যের সময় ওজু করতে পুকুর ঘাটে গিয়েছিল হাজি সাহেবের ভাগনি আয়েশা বিবি। সেখানে কী হয়েছে কেউ বলতে পারে না। এক ঝি গিয়ে দেখে দাঁত কপাটি লেগে ঘাটের ওপর পড়ে আছে আয়েশা। তাকে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হয়েছে ভেতরে। মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। জ্ঞানও ফিরে এসেছে। কিন্তু মানুষ চিনতে পারছে না। ভুল বকছে। থেকে থেকে চিৎকার করে উঠছে। তারপর আবার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো। যাচ্ছে। এদিকে হাজি সাহেব বাড়িতে নেই। তিনি দুদিন হলো সদরে গেছেন কী একটা কাজে।

হাজি সাহেবের স্ত্রী ইদ্রিসকে ডেকে পাঠাতে বলেছিলেন। বছির এসে দেখে, ইদ্রিস রোগী দেখতে বেরিয়ে গেছে। সেই থেকে বাড়ির সবাই পথ চেয়ে তার জন্যে। এক্ষুণি তাকে ওষুধ দিতে হবে।

ইদ্রিস বলে, চল বাবা, দেখি কী হয়েছে।

সাইকেল রেখে সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়াল ইদ্রিস। মৌলবি সাহেব সঙ্গী হলেন। বলতে লাগলেন, দাওয়াইর কাম ন ডাক্তার ছাব। আঁই ভালা দোয়া জানি, আঁই কই পারি, দোয়া পড়ি ঝাড়ি দিলে ভালা হই যাইতো।

অন্দর মহলের বার দরোজায় এসে থামলো ইদ্রিস। বছির ভেতর থেকে এক চট্‌কা ঘুরে এসেই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল অন্দরে। বসবার ঘরে চেয়ার টেনে দিল তাকে। মৌলবি সাহেব নিজেই একটা আসন টেনে বসে পড়লেন।

ভেতরে এর আগে আর কখনো আসেনি ইদ্রিস। চোখ যেন জুড়িয়ে গেল তার। মেহগিনি কাঠের কী সুন্দর নকশা তোলা সব আসবাব! গালিচা বিছানো। দেয়ালে বাঁধানো ফটোগ্রাফ। এক পাশে লেখাপড়ার টেবিল। মোটা মোটা বই তাতে সাজানো। মাথার ওপরে জ্বলছে ঝকঝকে চোদ্দ ল্যাম্প।

হাজি সাহেবের স্ত্রী পর্দার ওপাশে এসে দাঁড়ালেন। কথা হতে লাগল বছিরের মারফৎ। নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। বছির আগে যা বলেছিল তাই আরেকবার বললেন উনি। ইদ্রিস বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। মানে

ইতস্তত করল সে। সে যা বলতে চাইছিল তা হচ্ছে, রোগিনীকে একবার দেখা দরকার। কিন্তু কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা তা বুঝতে পারছিল না। এতদিন সে আছে এখানে, মনে হয় এরা পর্দা মানেন ষোলআনা। পর পুরুষকে ঘরের মেয়ে দেখতে দেবে না।

এদিকে মৌলবি সাহেব সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তিনি আম্মা বলে এক লম্বা হাঁক পেড়ে নিবেদন করলেন, ডাক্তারের ওষুধ তারা নিতে পারেন, কিন্তু রোগিনী ভালো হবে না। কারণ, তিনি স্পষ্ট লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন, জ্বীন আছর করেছে। জ্বীনের দাওয়াই আল্লার কালাম। বুবুজানের হাল শুনেই তিনি ছুটে এসেছেন। এখন যদি তারা অনুমতি করেন তো তিনি গিয়ে। ঝাঁড়ফুক করতে পারেন। সবশেষে তিনি আরেকবার বললেন, এবং বেশ জোরের সঙ্গেই, ওষুধে কিছু কাজ হবে না।

অন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা হাজি সাহেবের স্ত্রীর মনোভাব চট করে বাইরে থেকে টের পাওয়া গেল না। ইদ্রিস এটুকু অনুভব করতে লাগল। এর প্রতিবাদ করা দরকার। কিন্তু হাজি সাহেবের স্ত্রী কী বলেন সেটা আগে শোনা ভালো।

বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন দুপক্ষ।

মৌলবি সাহেব আবার হাঁক দিয়ে উঠলেন, আম্মা। ইয়ে জরুর জ্বীন কা কাম হ্যাঁয়। আপ বড়া দেখকে তামাকা এক বর্তন লাইয়ে পানি ভরকে। হাম দো মিনিট মে জ্বীন কো ভাগ্যা দেবতা হু।

আর বছিরকে বললেন, খাড়া খাড়া কেয়া দেখতা হ্যয়? জলজি করো।

ইদ্রিসের গোড়া থেকেই খারাপ লাগছিল বিনা আমন্ত্রণে মৌলবি সাহেবের অন্দর মহলে ঢোকাটা। তার ওপরে তার মুখে উর্দু শুনে তার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সে বছিরকে বলল, আম্মা হুজুরাণীকে বলো যদি ঝাড়ফুক করাতে হয় তো আমি চলি। মৌলবি সাহেব রইলেন। বছির নিবেদন করে জবাব শুনে এলো। বলল, তোমরাও থাকেন ডাক্তারের ঘর। আম্মা কইলে, ডাক্তারের থাকা যাইবে।

ইদ্রিস বুঝতে পারল, ঝাড়ফুকটাই ভালো মনে করছেন হাজি সাহেবের স্ত্রী। তাকে থাকতে বলা শুধু ভদ্রতার খাতিরে। সে উঠে দাঁড়াল। বলল, না বছির, আমি রোগী দেখে ফিরেছি বহুদূর থেকে। ঘরে যাচ্ছি। দরকার হলে খবর দিও। আমাকে একটু পথ দেখাও বাবা। ভেতর থেকে শাড়ির খসখস চুড়ির রিনিঝিনি উঠলো। মৌলবি সাহেব ঠোঁট ফোলানো হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন ইদ্রিসের দিকে। ইদ্রিস বেরিয়ে এলো।

বার দরোজায় দাঁড়িয়ে পড়ে বছিরকে সে বলল, মৌলবি সাহেবকে আগে ডাকলেই পারতি। আমার জন্যে রাত দুপুর করার কী দরকার ছিল?

মুই কী জানো।

আচ্ছা যা, তোকে আর কী বলব। ভাত দিয়েছিস?

আছে তোমার ঘরৎ।

ইদ্রিস মাঠটা লম্বা লম্বা পায়ে অতিক্রম করে এসে হাত মুখ ভালো করে ধুলো। মাথায় পানি দিল। পানি পড়তেই ভারী আরাম লাগলো তার। একটু কষ্ট হলো আয়েশার জন্যে, সেই না দেখা তরুণীর জন্যে, যে তাকে একদিন দুধ পাঠিয়ে দিয়েছিল শরীর খারাপ শুনে। এতক্ষণে মৌলবি তার কেরামতি দেখাতে শুরু করেছে নিশ্চয়ই।

আয়েশার কথা বারবার মনে হচ্ছিল তার। তাকে সে চোখে দেখেনি কখনো। আয়েশা তার কাছে শুধু একটা নাম। এখন যেন সেই নামটাকে অবলম্বন করে অস্পষ্ট একটা মূর্তি গড়ে উঠতে লাগল। হাজি জয়েনউদ্দিন সুপুরুষ। তাঁর ভাগনি নিশ্চয়ই দেখতে সুন্দরী হবে। একবার বিয়ে হয়েছিল শুনেছে ইদ্রিস। তালাক হয়ে গেছে। কেন হয়েছে? বছিরের কাছ থেকে স্পষ্ট কিছু জানা যায় নি। আর তারও এর আগে তেমন কৌতূহল কিছু ছিল না।

ঘুম আসে না ইদ্রিসের।

মৌলবি সাহেব অন্দর থেকে এখনো ফেরেন নি। রাত কত হলো! বছির যদি একবার আসতো তাহলে ভেতরের সংবাদ জানা সেত। সে থেকে গেলেই পারত অন্দর বাড়িতে। তাতে অন্তত এই অস্বস্তি ভোগ করতে হতো না।

বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে অন্ধকারে হাঁটতে লাগল ইদ্রিস। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। কনকন করছে উত্তুরে হাওয়া। গায়ে কাঁপন উঠছে। ভেতর থেকে চাঁদর এনে গায়ে জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইদ্রিস এলো কাঁচারি বাড়ির বারান্দায়। চৌকিদার ঘুমিয়ে আছে একটা হেলনা বেঞ্চে পা গুটিয়ে হাতের ওপরে মাথা রেখে। পরে পরে আরও কয়েকটা বেঞ্চ। অতিথ পথিক রায়ত এলে বসে এখানে। দিনের বেলায় ভারী সরগরম হয়ে থাকে বারান্দাটা।

ইদ্রিস একটা বেঞ্চের দিকে লক্ষ্য করে এগুতেই কিসের সঙ্গে হোঁচট খেল প্রচণ্ড। বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটা টনটন করে উঠলো। ইস। বেঞ্চের ওপর বসে পায়ে হাত বুলোতে লাগল সে।

হঠাৎ মনে পড়ল, সে যখন বিয়ে করতে যাচ্ছিল হোঁচট খেয়েছিল এমনি। খুব দূরে কেউ ডেকে উঠল। শীতে এখানে কখনো কখনো বাঘ দেখা যায়। কান পাতল ইদ্রিস। অনেকক্ষণ পর ফেউটা আবার ডাকলো। মনের মধ্যে কেমন ভয় ভয় করল একবার। তবু সে বসে রইল সেখানে।

মা তাকে বলেছিলেন, শুভ কাজে বাধা পড়ল, একটু দাঁড়িয়ে যা।

আগে এই সব কথা মনে করে ভারী রাগ হতো তার। একটা কিছু প্রতিশোধ নেবার জন্যে নিসপিস করত হাতটা। পতিদহে এসে অবধি সে ভাবটা কী করে যেন কেটে গেছে। আজ সন্ধ্যেই তার মন কাঁদছিল বড় ভাইয়ের জন্য। দুঃখ হচ্ছিল তিনি একটা চিঠি দিলেন না বলে। গল্পের মতো মনে হয় সব।

ব্ৰহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে শিবালয়ে পৌঁছুতে হবে। শিবালয় থেকে গয়নার নৌকোয় রহিমগঞ্জ। রহিমগঞ্জে সম্বন্ধ ঠিক হয়েছে ইদ্রিসের। বরযাত্রী বলতে বড় ভাই আর চাচা মিয়া।

চাচা মিয়া পথঘাট চেনেন। জানেন গয়নার নৌকো কখন ছাড়ে। শিবালয়ে এসে ভোর হলো। সারি সারি মিষ্টির দোকান আছে ঘাটে। সেখানে পেট পুরে মিষ্টি খেল ওরা। ইদ্রিস ভাল করে কিছু খেতে পারল না। হাজার হোক, বিয়ে করতে যাচ্ছে। মনের মধ্যে একটা কী হয় কী হয় ভাব। পাকস্থলী একেবারে কঠিন হয়ে আছে উদ্বেগে।

আগ বাড়িয়ে নেবার জন্যে শিবালয়ে লোক আসার কথা ছিল। কিন্তু তার দেখা পাওয়া গেল না। চাচা মিয়া অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন তাকে। বাজারের কয়েকটা দোকানে জিগ্যেসাবাদ পর্যন্ত করলেন। কিন্তু কোনো সন্ধানই মিলল না।

কেমুন কথা বাজান।

চাচা মিয়া চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

আমরাই রওয়ানা দেই গা। কইছিল লোক পাঠাইবো। অবশ্য সঠিক কইরা কিছু কয় নাই। আল্লা ভরসা। দেরি করমু না আর। আসো। রহিমগঞ্জে কোন্ গয়না যায় গো?

পারে দাঁড়িয়ে চাচা হাঁক পাড়েন।

এক নাও থেকে মাঝিরা আওয়াজ দেয়, আসেন, এই নায়ে আসেন। তারপর ভালো করে এক মাঝি নিরিখ করে তাদের। বলে, মিয়া সাবরা রহিমগঞ্জে কার বাড়িতে যাইবেন?

ক্যান, তা দিয়া কী দরকার?

না, জিগাইলাম। বরযাত্রী মনে অয়।

তাই বাপু।

তাইলে আসেন। আপনাগো লইয়া যওনের লিগা এক ব্যাটা আইছিল। কাইল রাইত ভরা নায়ে বইসা গাঞ্জা টানছে। আহেন, এই নায়েই বেহুঁশ অইয়া পইড়া আছে হে।

কও কী?

মাঝিরা দাঁত বের করে হাসে। খুব মজা পেয়েছে তারা। বিয়ের বরকে আগু বাড়িয়ে নিতে এসে গাঁজা টেনে চিৎ হয়ে আছে, আর ওদিকে বর ঘুরছে বোকা বলদের মতো।

আহেন, আহেন মিয়া সাবরা।

কাণ্ড দেখে তো বড় ভাই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।

শালার এরা ভদ্রলোকই না। গাঁজাখোররে পাঠায় ভদ্রলোক হলে? কেমুন জাগায় সম্বন্ধ করছেন চাচা মিয়া।

ন্যাও বাপু আর দিক কইরো না। ভালো খারাপ দুই জাত নিয়াই দুনিয়া। হের তুমি করবা কী?

বেলা তিনটে নাগাদ নাও এসে ভিড়ল রহিমগঞ্জের ঘাটে। না এখানে কোনো ত্রুটি নেই অভ্যর্থনার। নৌকো থেকেই দেখা যাচ্ছিল পাড়ে কয়েকজন প্রৌঢ় এক পাল ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের সবার পরনে পরিষ্কার করে কাঁচা কাপড়, মাথায় টুপি, পায়ে পাম্পশু। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল বর নিতে এসেছে তারা।

তাদের ভেতরে একজনকে চাচা মিয়া চিনলেন। নৌকো থেকেই সালাম বিনিময় হলো। সালামালাইকুম।

অন্যান্য যাত্রীরা নেমে যাবার পর কলিদার টুপি পরা লোকটা পাড় থেকে নৌকোয় উঠে বড় ভাইর হাত ধরে বললে, আসেন।

চাচা মিয়া তড়বড় করে বলে উঠলেন, আরে, হে জামাই না। জামাই ইনি। আর ইনি জামাইর বড় ভাই।

অপ্রস্তুত হয়ে লোকটা বলল, ঐ এ্যাক কথাই অইলো।

ঘাট থেকে কয়েক রশি পরেই বাড়িটা। হেঁটেই চলল সকলে। লোকটা দুঃখ করতে লাগল, বুছ লাইন ভাই সাব। গায়ের সে অবস্থাও নাই, জলুসও নাই। আগে তিন তিনখান পালকি আছিল। এহন একখানও পাইবেন না। বহুৎ কোশিস করছি পালকির জইন্যে। মাফ কইরা দিয়েন।

বাংলা ঘরটাকে সাজানো হয়েছে বিয়ের জন্যে। ঘর থেকে সব কিছু বের করে সারা মেঝে জুড়ে ধবধবে ফরাস পেতে দেয়া হয়েছে। তার মাঝখানে মখমলের জায়নামাজ বিছানো। সেখানে হাত ধরে বসানো হলো ইদ্রিসকে। শরবৎ এলো, পাখা এলো। ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল বৌ ঝিয়েরা।

একটু পরে লোকটা এসে খবর দিল, গোসল করনের ব্যবস্থা অইছে। দামাদ মিয়া আসেন। আপনেরাও চলেন।

গোসল করে পোর্টম্যান্টো খুলে আচকান পাজামা বের করে পরল ইদ্রিস। বড় ভাই মাথায় বাঁধলেন দশ প্যাঁচের পাগড়ি। চোখে ঘন করে সুরমা দিলেন। যুবক দরবেশের মতো ধবধব করতে লাগল তার চেহারা। ছবিটা ইদ্রিসের চোখে এখনো লেগে রয়েছে।

বাংলা ঘরের পাশে এই ঘরটা বরযাত্রী দুজনের জন্যে। সেখানেই কাপড় বদলানো হচ্ছিল। চাচা মিয়া বললেন, ইদ্রিস তুমি বসো বাজান আমরা ঘুরনা দিয়া আসি।

আধ ঘণ্টার মতো একা ছিল ইদ্রিস! ঠিক একা বলা যায় না বাড়ির কিছু ছেলেপুলে ঘিরে রেখেছিল তাকে। গলা জড়াজড়ি করে তাকে দেখছিল ওরা বড় বড় চোখে। ইদ্রিস দুএকজনের সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সুবিধে হয় নি।

ইদ্রিসের পরে মনে হয়েছে, ঐ আধঘণ্টা যে বড় ভাই আর চাচা মিয়া বাইরে ছিলেন, কথাটা হয়েছে তখনই।

আধঘণ্টা পরেই সেই কল্লিদার টুপি পরা লোকটার সঙ্গে এলেন চাচা মিয়া। বড় ভাইকে দেখা গেল না।

তারা দুজন এসে ইদ্রিসের দুদিকে বসলেন চৌকির পরে। লোকটা ছেলেদের দিকে তাকিয়ে কৌতুককণ্ঠে বলল, কী রে পোলাপান, দুলা পছন্দ অইছে?

হি হি করে হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে আর কী!

যাহ, ভাগ এহান থনে। শীগগীর বাইরা। গেলি!

হুড়মুড় করে ছেলেদের দল চলে গেল। একটু পরে আরো কয়েকজন মুরুব্বি এসে সমস্বরে সালাম আলাইকুম দিয়ে বসে গেলেন চৌকির ওপর। চৌকিতে মানুষ আর ধরে না।

সদালাপ হলো খানিকক্ষণ। তারপর এক প্রৌঢ় এক বুড়োকে ঠেলা দিয়ে বললেন, কথাডা কইয়া ফালান চাচা। সময় নষ্ট কইরা লাভ কী?

চমকে উঠল ইদ্রিস। বিয়ের বর, মাথা তুলতে নেই। মাথা নিচু করেই সে রইলো। কিন্তু কানটা সজাগ হয়ে উঠলো, কঠিন হয়ে এলো হাত পা। কী কথা বলতে এসেছেন ওরা?

অনেকক্ষণ কেউ কিছু বললেন না। থমথম করতে লাগল ঘর। সবাই অস্বস্তিতে উসখুস করতে লাগলেন।

অবশেষে একজন বললেন, দুলামিয়া, আমরা দশজনে আপনের কাছে একড়া কথা কইবার চাই। কথাডা কিছু না। দ্যাহেন, হায়াত মউত রিজিক দৌলত আল্লার হাতে। বিয়ে শাদি যার। যেহানে লেখা আছে আল্লার খাতায়, আল্লা ভিন্ন কেউ তারে খণ্ডাতি পারে না। তা আপনে। এই বাড়ির দুলাহ্ অইবেন। আমরা কিন্তুক, খালি আপনেরে না, আপনের মিয়া ভাইরেও দুলাহ্ কইরা রাইখতে চাই।

অবাক হয়ে ইদ্রিস তাকাল চাচা মিয়ার দিকে।

চাচা মিয়া মাথা নামিয়ে নিলেন।

মুরুব্বিদের আরেকজন বললেন, কথাডা ভাইঙ্গাই কওনা ছোট মিয়া। দুলামিয়া শিক্ষিত লেহাপড়ি জানা মানুষ, হে খুশিই অইবো শুইনা। দুই ভাই এক জোটে দুই বৌ নিয়া দ্যাশে যাবি অ্যারচে খুশির কথা আর কী অইবার পারে!

ইদ্রিস নিচু গলায় চাচাকে জিজ্ঞেস করল, মিয়া ভাই কেনে? এনারা কইতাছেন কী?

চাচা মাথা নিচু রেখেই কম্পিত গলায় বললেন, আমি কিছু জানি না ইদ্রিস। আমার মতই আছিল না। কিন্তু হঠাৎ এই কথা হইয়া গেল। এহন কী করি? তুমিই কও। বিয়া না কইরা যদি ঘরে যাও মাইনষে ছি ছি কইরবে, ছ্যাব দিবে, তোমার মায়ে যে কী কইরা বইসবে তা আল্লাই জানে।

এসব কথার একবর্ণ ইদ্রিসর বোধগম্য হলো না। সব অসম্বন্ধ; অসম্ভব বলে মনে হলো তার। বড় ভাইকে এরা দুলাহ্ করতে চায় অর্থ কী? এই তো সেদিন পর্যন্ত তাকে কত বোঝানো হলো তিনি রাজি হলেন না। এখন হঠাৎ কিসের গুণে কী হয়ে গেল?

অবশেষে সব কথাই প্রকাশ পেল। যে বাড়িতে ইদ্রিস বিয়ে করতে এসেছে সে বাড়িতে দুই মেয়ে। বাপ নাই, মা আছে। দুঃখে কষ্টে সংসার চলে। বড় মেয়ের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছে ইদ্রিসের। এখন গাঁয়ের লোক বড় ভাইকে দেখে এবং তিনি অবিবাহিত শুনে ঠিক করেছে বড় মেয়ের সঙ্গে বড় ভাইয়ের আর ছোট মেয়ের সঙ্গে ইদ্রিসের বিয়ে দেবে তারা।

শুনে হতভম্ব হয়ে গেল ইদ্রিস। কী বলবে, কী করবে, কী করা উচিত কিছু বুঝতে পারল না সে। চাচা মিয়া কফ ফেলার নাম করে কাশতে কাশতে বাইরে চলে গেলেন। গাঁয়ের মুরুব্বিরা হাত চেপে ধরলো ইদ্রিসের—- তাদের কথা তাকে রাখতেই হবে। এদের বাপ নাই। জানেনই তো, দুঃখের সংসার। দুই মেয়ের বিয়ে এক সঙ্গে হয়ে গেলে ঝামেলা যায়। তাছাড়া এই বিয়েতে যে খরচ হচ্ছে তা জোগাতেই মেয়ের মা প্রায় সর্বস্ব বাধা দিয়েছেন। ডাক্তার দুলা বলেই কোন দিকে তাকান নি তিনি। এখন ইদ্রিসেরও তো এ বাড়ির জামাই হিসেবে দায়িত্ব একটা হবে, শালীকে বিয়ে দিতে হবে নিজের খরচে। তার চেয়ে এই ব্যবস্থাই ভালো নয় কি? দুই ভাই দুই বোন। বোনে বোনে ভাইয়ে ভাইয়ে ছাড়াছাড়ি নেই। এক সংসারে গলাগলি হয়ে থাকবে। এর চেয়ে সুখের আর কী হতে পারে?

ইদ্রিস কিছু বলল না। পাথর হয়ে বসে রইলো।

কয়েকজন উঠে দাঁড়াল। তাদের ভেতরে একজন বলল, তাইলে সুখবরটা দিয়া দেইগা মজলিশে।

হাজার চেষ্টা করেও ইদ্রিস নিজের কণ্ঠে একটি ধ্বনিও ফোঁটাতে পারল না। জীবনে এত বড় বিস্ময় তার হয় নি।

অভিভূতের মতো বিয়ের মজলিশে গিয়ে বসলো সে। প্রথমে বড় ভাইয়ের বিয়ে পড়ানো হলো। তারপর তার। আলহামদুলিল্লাহর মিলিত ধ্বনিতে বারবার মুখরিত হয়ে উঠল মজলিশ। গোলাপপাশ থেকে গোলাপজলের ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়ে গেল একবার। মিছরির টুকরো হাতে হাতে ফিরতে লাগল।

ইদ্রিসের শুধু দুটি কথাই মনে হয়েছিল। আর সে কথা দুটিই তাকে দুর্বল করে ফেলেছিল। বড় ভাই বাপের অবর্তমানে বাপের মতো–তার ইচ্ছে মান্য করা ছোট ভাইয়ের কর্তব্য। আর মনে হয়েছিল, তাদের বংশে কেউ কখনো বিয়ে করতে এসে ফিরে যায় নি।

চাচা যখন পাত্রী খুঁজতে বেড়িয়েছিলেন, জিজ্ঞেস করেছিলেন ইদ্রিসকে, তার কিছু বক্তব্য আছে কিনা। উত্তরে ইদ্রিস বলেছিল, আমি টাকা পয়সা চাই না, বড় ঘরও চাই না, তবে মেয়ে যেন সুন্দরী হয়।

রহিমগঞ্জ থেকে ফিরে গিয়ে চাচা বলেছিলেন, পাত্রী যা দেইখা আসছি একশ জনের মইধ্যে একজন। যেমুন রং তেমুন চেহারা। দেইখলে ইরানি বুইলা ধন্দ হয়। পান খাইলে গলা দিয়া পানের পিক নাইমতে দেখা যায়। আর কী চাও?

ইদ্রিস ধরেই নিয়েছিল ছোট বোনও তেমনি সুন্দরী হবে।

বাসর ঘরে ঢুকে দেখে লাল শাড়ি জড়ানো ছোট্ট পুঁটুলির মতো একটা বাচ্চা মেয়ে পড়ে আছে। এ যে একবারে সাত বছরের বালিকা! একে তো সে আশা করে নি। দপ করে আগুন ধরে গেল মাথার ভেতরে। এক হাতে মুখটা তুলে দেখেই আর্তনাদ করে পিছিয়ে এলো ইদ্রিস। কোথায় দুধে আলতা রং, আর কোথায় ছবির মতো চেহারা, ঘোর শ্যামবর্ণ, ঠোঁট পুরু, নাক খাটো, কপাল উঁচু তার।

দুই বোনে এত পার্থক্যও হয়?

গুম হয়ে বসে রইলো সে সারারাত। না, চৌকিতে না। ঘরের কোণে জলচৌকি ছিল একটা তাতে।

পরদিন ভোরে কাক ডাকার আগে বেরিয়ে পড়ল ইদ্রিস। সঙ্গে কিছু টাকা ছিল। ঘাটে এসে শুনলো গয়নার নৌকো ছাড়বে বেলা এক পহর হলে। একটা ছোট্ট নৌকা এক টাকায় ভাড়া। করে এলো শিবালয়। সেখান থেকে গোয়ালন্দ হয়ে কলকাতা। কলকাতায় নেবে সোজা প্রিন্সিপাল খানের কাছে। মাকে একটা চিঠি দিয়েছিল পরদিন। কিন্তু গায়ে ফিরে যায় নি। পতিদহে আসবার আগে পর্যন্ত মায়ের কাছে দ্বিতীয় চিঠিও লেখেনি সে। পতিদহে কাছারি বাড়ির বারান্দায় রাত দুপুরে অতীত পরিক্রম করে এলো ইদ্রিস ডাক্তার। কার কপালে কী। লেখা আছে কেউ বলতে পারে না। কোথায় পতিদহ, ইহজীবনে এখানে আসা দূরে থাক নাম। পর্যন্ত জানার কথা নয়। অথচ পতিদহই এখন তার কাছে একমাত্র আশ্রয়, একমাত্র সত্য হয়ে উঠেছে।

বারান্দা থেকে নেমে এসে আবার হাঁটতে লাগল ইদ্রিস। নাহ্, শীত জোর পড়েছে। চাঁদর টেনে কানমুড়ি দিল সে। ভারী ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। চোখ জড়িয়ে আসছে। এবার বোধহয় ঘুম আসবে।

হঠাৎ রাতের অন্ধকার যেন খানখান হয়ে গেল নারী কণ্ঠের চিৎকারে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ইদ্রিস। কান থেকে নামিয়ে দিল চাঁদর। তারপর প্রায় দৌড়ে অন্দর মহলের বার দরোজায় এসে চিৎকার করে ডাকল, বছির, বছির।

সঙ্গে সঙ্গে বছির এসে তার গায়ের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বলল, কই ডাকেন? তোমরাই? মুই তোমার আগোৎ যাবার ধরছিনু। আম্মা তোমাক বোলায়।

কেনে? তোমার বুবুজান চিরি উঠিল কেনে?

কাঁই কবার পায়। আইসেন তোমরা। ওমরা কত ঝাড়ন ঝাড়িল, কিছুই হইল না। বুবু আরো দাপেয়া ওঠে থাকি থাকি।

আয়েশার চিৎকারটা যেন তখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারিদিকে। ইদ্রিস বলে, চল দেখছি।

ভেতরে এসে দেখে মৌলবি সাহেব গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। তার দিকে দ্বিতীয় বার আর তাকাল না ইদ্রিস। বছিরকে বলল, খবর দে। মুই রোগী দেখি। ফির ওষুধ দিম্।

অল্পক্ষণের মধ্যেই ভেতরে ডাক পড়ল তার। প্রকাণ্ড উঠোন পেরিয়ে পুবের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। ঢুকে দেখে বিছানার ওপর এক তরুণীকে ঘিরে কয়েকজন বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন। তরুণী আপাতত সঙ্গাহীন। মেঝের ওপরে পানি ভর্তি তামার ডেক রয়েছে একটা। এক পাশে মাটির হাঁড়িতে খানিকটা আগুন তখনো ধিকিধিকি করে জ্বলছে, ধোঁয়া উঠছে। প্রথমেই সে বছিরকে বলল, এসব বাইরে নিয়ে যেতে! জানালাটা খুলে দিতে। জানালা খুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ধোঁয়া পরিষ্কার হয়ে গেল। ঘরের ভেতরে গুমোট ভাবটা কেটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল শীতল স্নিগ্ধতা।

ইদ্রিস প্রশ্ন করতে লাগল বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য না করে।

পুকুরঘাটে সঙ্গে কেউ গিয়েছিল?

বৃদ্ধাদের ভেতর একজন ইতস্তত করে উত্তর দিল,। এর পরে সে–ই মুখপাত্রী হিসেবে অন্যান্য প্রশ্নেরও উত্তর দিতে থাকল। সব শুনে ইদ্রিসের মনে হলো, আসলে ভয় পেয়েছে আয়েশা। সন্ধ্যার অন্ধকারে একাকী পুকুরঘাটে একটা বেড়াল দেখেও ভয় পাওয়া বিচিত্র কিছু নয়।

ইদ্রিস বলল, নাড়িটা দেখতে হবে।

ওরা একটু দূরে সরে দাঁড়াল।

আয়েশার হাত তুলে নিল ইদ্রিস। শরীরে যেন বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হয়ে গেল তার। আর কোন দিন কোনো নারীকে স্পর্শ করে এরকম অনুভূতি তার হয় নি। শীতল, অবিশ্বাস্য কোমল, অসহায় একটি হাত। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, এমন রূপও মানুষের হয়! গোলাপের মতো অবিকল বর্ণ। ছিপছিপে নাক, সুগঠিত চিবুক, পাতলা ঠোঁট, দীর্ঘ গ্রীবা। ভরা একটা নদীর মতো স্বাস্থ্যের সম্ভার। ইতিহাসের বই পড়ে নূরজাহান, মমতাজমহল এদের ছবি যেমন কল্পনা করা যায়, ঠিক তেমনি। মোহগ্রস্তের মতো হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে ইদ্রিস। চোখ ফেরাতে পারে না। অথচ সে চোখে যেন সে কিছু দেখতেও পাচ্ছে না। যেন একখণ্ড স্বপ্নের সঙ্গে বেহেস্তের সঙ্গে আজ মধ্যরাতে তার হঠাং সাক্ষাৎ হয়ে গেছে। পরমুহূর্তে গ্লানিতে ভরে উঠল তার মন। ছি, ছি, এ কী হলো তার। এ কেমন মন নিয়ে সে অসুস্থের শয্যা পাশে দাঁড়িয়ে আছে! সচকিত হয়ে উঠল তার শরীর। কঠিন হয়ে গেল। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলেছিলেন, মাতৃজ্ঞানে পর–রমণীর চিকিৎসা করবে। তা যদি না পারো তাহলে তার চিকিৎসাই কোরো না।

জীবনে এমন মতিভ্রম তার হয় নি।

ইদ্রিস সমস্ত ইন্দ্রিয়কে কঠিন শাসন করে নাড়ি দেখল আয়েশার। অত্যন্ত ক্ষীণভাবে বইছে। বছিরকে থার্মোমিটার স্টেথসকোপ আনতে বলল। তুমুল জ্বরের ঘোরেই অচেতন হয়ে পড়ে আছে আয়েশা।

স্টেথসকোপ দিয়ে এবারে বুক দেখল তার।

সারাক্ষণ নিজের সঙ্গে প্রবল লড়াই চলতে লাগল ইদ্রিসের। এ রকম সমস্যায় জীবনে সে পড়ে নি। ডাক্তার হয়ে মাতৃজ্ঞানে নারীকে দেখতে পারছে না, এই সত্যটা ছুরির মতো তার বুকে বারবার বিদ্ধ হতে লাগল। সে বেরিয়ে এলো।

এসে ডিস্পেন্সরী খুলে ওষুধ পাঠিয়ে দিল বছিরের হাতে।

মৌলবি সাহেব একবার কী বলবার জন্যে কাছে এলেন। কিন্তু ইদ্রিসের কঠিন মুখভাব এবং চিন্তান্বিত ভ্রূকুটি দেখে সাহস পেলেন না।

ইদ্রিস এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়।

অন্ধকারে ভেতরের অস্থিরতা যেন শতগুণ হয়ে উঠল তার। কেবলি এপাশ ওপাশ করতে লাগল সে। একদিকে নিষিদ্ধ আকর্ষণ, আরেক দিকে চিকিৎসকের কর্তব্য। একবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল আয়েশার মুখ, শরীর; আরেকবার মনে পড়তে লাগল প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

লণ্ঠনের আলোয় মোহময়ী হয়ে উঠেছিল আয়েশা। অচেতন হয়ে পড়ে আছে। অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ওপর নেই তাই শাসন বারণ। বৃদ্ধারা খানিকটা ঢেকেঢুকে দিয়েছিল বটে কিন্তু তাতে আরো রহস্য সৃষ্টি হয়েছে মাত্র। চকিতে একটা শুভ্র গোড়ালি দেখা গিয়েছে। দেখেছে ফিকে গোলাপি আভা বাহুমূলের। ভেতরের সুপ্ত যন্ত্রণায় আর জ্বরের উত্তাপে বিযুক্ত হয়ে আছে দুই ঠোঁট একটা লীলায়িত ভঙ্গিতে কঠিন হয়ে আছে আয়েশা। বালিস ডুবিয়ে বিছানার ওপর ঢলে পড়েছে একরাশ কালো রেশমি চুল। নিটোল গালে নীল শিরা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল তার। একটি মাত্র মুহূর্ত। তার ভেতরে আগুন জ্বলে উঠল। আগুন জ্বলতে তো এক মুহূর্তের বেশি লাগে না। আর আগুন সবভুক। নীতি, আদর্শ, চেতনা, বিবেক সব সে পোড়ায় যেমন পোড়ায় কাঠ, মাংস, অরণ্য, মৃত্তিকা।

তার ব্যর্থ বাসরে এই এলায়িত যুবতাঁকেই সে কল্পনা করেছিল। সে রাতে যদি এমন হতো! সে রাতে যদি সাত বছরের কুশ্রী সেই বালিকার বদলে থাকত আয়েশা!

নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে ইদ্রিসের। উপুড় হয়ে দুহাতে মাথা চেপে সে শান্ত হবার চেষ্টা করে। দূরে ফেউ ডেকে ওঠে আবার। অন্ধকার বিলে যেন ঢিল পড়েছে—-তরঙ্গ কাঁপতে কাঁপতে সুদূরে মিলায়, আবার ফিরে আসে, আবার মিলায়।

শরীরটাকে ঘুরিয়ে চিৎ হয়ে শোয় ইদ্রিস। উঠে বসে। না এ তার ভাবা উচিত নয়। অবাক হয়ে সে লক্ষ্য করে, এতক্ষণ যাকে এড়িয়ে চলেছে, তার হাতেই সে বন্দি। সে আয়েশার কথা ভাবছে।

আয়েশার কথা ভাবা তার উচিত নয়। আয়েশা তার রোগী, সে চিকিৎসক। যে নারীকে মাতৃজ্ঞান করতে না পারবে, তার চিকিৎসা কোরো না। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের ভ্রূকুটি স্পষ্ট দেখতে পায় ইদ্রিস। সে মনে মনে তওবা করে। এক থেকে একশ পর্যন্ত গোনে। আবার একশ থেকে উল্টো দিকে গুনতে গুনতে একে ফিরে আসে। অতীতে যখন তার মনে হয়েছে। নিজেকে শাসনে রাখতে পারছে না, চেতনা গুলিয়ে যাচ্ছে, সংকটে অবশ হয়ে যাচ্ছে চিন্তা, তখন এমনি সংখ্যা গণনা করে শান্তি পেয়েছে সে।

আজ সে সংখ্যা গণনা কোন কাজে এলো না।

জীবনে যে পূর্ণিমা সে কামনা করেছে, সে পূর্ণিমা কি এভাবে এলো?

এ পূর্ণিমা স্নিগ্ধ করে না, পোড়ায়। ছোবল দেয়। শরীর নীল করে দেয় বিষে।

ইদ্রিস একবার ভাবল, পতিদহ থেকে চলে যাবে সে। হাজি সাহেব ফিরে এলে পদত্যাগপত্র পেশ করবে তার কাছে। জীবনে এই প্রথমবারের মত পরাজিত মনে হয় নিজেকে, ধিকৃত মনে হয়। এই ধিক্কার, এই পরাজয় বাইরের কেউ জানুক বা না জানুক তাতে কী? সে নিজে কী করে বহন করবে এই অপরিসীম গ্লানি। তাকে বড় হতে হবে, ছেলেবেলা থেকে এই কথাটা কানে শুনতে পেত নদীর স্রোতে, অরণ্যের মর্মরে, বাতাসের প্রবাহে। কিন্তু কীভাবে বড় হবে, সেটা আজো জানা হয় নি তার। আজ এই নিশুতি রাতে মনে হলো, সত্য যদি তার সঙ্গে থাকে, নিজের কাছে নিজেই যদি মাথা উঁচু করে থাকতে পারে তবেই সে বড়। তক্ষুণি উঠে সে বাতি জ্বালিয়ে পদত্যাগপত্র লিখল।

লেখার সঙ্গে সঙ্গে অসীম শান্তিতে ভরে উঠল মন। এতক্ষণ চাঁদর ছিল না গায়ে। তবু শীত করছিল না। এখন শরীরে আবার টের পেল বাতাসের স্পর্শ। গায়ে চাঁদর জড়িয়ে নিল ইদ্রিস। বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়ল সে।

খোলা জানালা দিয়ে এক ঝলক দুরন্ত বাতাস কখন অস্থির করে তুলল তার পদত্যাগপত্র। এক সময়ে ঝটপট করে কাগজটা পড়ে গেল মেঝেয়। চৌকির নিচে ঘুমিয়ে থাকা বেড়ালটা সজাগ হয়ে তাকাল চারদিকে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কাগজটার পরে। তীক্ষ্ণ নখরে কুটিকুটি করে পদত্যাগপত্রটা ছিঁড়ে ফেলল লাওয়ারিশ ক্রুদ্ধ বেড়ালটা।

লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা
ফেব্রুয়ারি ১৯৬২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *