১. আজকাল কত সুবিধে

অচিন্ত্য পূর্ণিমা – সৈয়দ শামসুল হক

আজকাল কত সুবিধে। তিস্তা থেকে মিটার গেজ লাইন বেরিয়ে গেছে। সকালে একটা আর রাতে একটা লোক্যাল ছাড়ে। চলে যাও সোজা শেষ স্টেশন কুড়িগ্রাম পর্যন্ত। স্টেশনের পরেই। নদী। খেয়া পেরোও। পেরিয়ে বাস। বাস একেবারে পতিদহ পর্যন্ত যায়। ব্যাস, পৌঁছে গেলে গন্তব্যে।

কিন্তু তখন এ সব কিছুই ছিল না। মার্টিন কোম্পানির লাইট রেলওয়ে ছিল বটে কুড়িগ্রাম অবধি, কিন্তু তার সময়সূচি বলতে কিছু ছিল না। যাত্রীতে বগি ভরে উঠলে গাড়ি ছাড়ত, নইলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। বংশ গরিমায় আর ধনের মহিমায় যারা টগবগ করত তারা নাইট ট্রেনে চড়তেন না। নাক সিটকোতেন। তাদের জন্যে পালকি আসত, বেহারা আসত, তাজি ঘোড়া মওজুদ থাকত।

তিস্তা তখন দার্জিলিং মেলের পথে ছোট্ট একটা স্টেশন মাত্র। তিস্তা নদীর ব্রীজ পেরোবার আগে একটা লম্বা সিটি দিতে হয় মাত্র। স্টেশন মাস্টার রাতে হলে সবুজ বাতি দেখান, দিনে ছেঁড়া নিশান। এক ঝলক উদ্দাম স্বপ্নের মতো হুহু করে বেরিয়ে যায় কলকাতার গাড়ি, আসামের গাড়ি।

তবে হ্যাঁ, প্ল্যাটফরমের দুই মাথায় যে দুটো বুড়ো শিমুল গাছ এখনো দেখা যায়, দেখা যায় মৌসুমের সময় আগুন রং ফুলের কিরীট পরে থাকতে, সে গাছ দুটো তখনো ছিল। একেবারে এইটুকুন। কাটিহারের কোন্ এক ঘরবিরহী কুলি সর্দার শখ করে লাগিয়েছিল চারা দুটো।

সেই সেদিনের তিস্তায় এসে নাবলেন ইদ্রিস ডাক্তার আর পতিদহের বড় তরফ হাজি জয়েনউদ্দিন।

স্টেশন ঘরের সামনে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে কাঁচের ড্ডামের ভেতর। তাতে স্টেশনের নাম লেখা। পেছনে বাঁশের জঙ্গল থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। যেন মহোৎসব লেগে গেছে তাদের রাজত্বে। চারিদিকে জনমনিষ্যির সাড়া শব্দ নেই।

পার্বতীপুরে মিটার গেজ গাড়িতে চড়বার পর থেকে দুজনের মধ্যে প্রায় কোনো কথাই হয়নি। এবারে গলা সাফ করে ইদ্রিস ডাক্তার বলল, এই বুঝি তিস্তা?

হা, সন্ধ্যে হয়েছে। নইলে নদীটাও দেখতে পেতেন। বর্ষার সময় ভীষণ মূর্তি হয়ে ওঠে। তাই নাকি?

নিজের কাছেই নিজের গলার স্বর কেমন অদ্ভুত ঘরঘরে শোনায়। ইদ্রিস ডাক্তার আবার গলা সাফ করে। সেটা লক্ষ্য করে হাজি সাহেব আবার বলেন, ইচ্ছে করলে এখনো ফিরে যেতে পারেন। রাত দুটোয় একটা ফিরতি ট্রেন আছে।

কোথায়?

কেন, কলকাতায়। ইচ্ছে করলে সিরাজগঞ্জেও যেতে পারবেন। সেখানেই আপনার দেশ বলেছিলেন না?

হ্যাঁ।

যাবেন ফিরে?

স্টেশন ঘরের বাতিতে ইদ্রিস ডাক্তারের ঘন শ্যামল মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়। লজ্জিত হয়ে হাসে সে একবার। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ফেরৎ যাবার কথা ভাবলে তো আর বেরুতামই না।

তবু

তবু কী?

বলছিলাম, এখনো ভেবে দেখতে পারেন। ছিলেন কলকাতায়। সে এক বিরাট শহর। আপনার মতো লোকের একটা না একটা রুজি হয়েই যেত সেখানে। তাছাড়া আপনার প্রিন্সিপ্যাল সাহেবও খুব স্নেহ করে আপনাকে। আপনি চাইলে তিনি আপনার ভালো ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন কলকাতায়।

সে আমি জানি।

আর ভেবে দেখুন পতিদহ এক গগ্রাম। এখান থেকে ঝাড়া পঞ্চাশ মাইল। বর্ষা শুরু হলে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। থিয়েটার বায়োস্কাপ নেই। গড়ের মাঠের হল্লোড় নেই। রোশনি নেই। মন টিকবে পতিদহে?

কেন একথা জিজ্ঞেস করছেন বারবার?

এই জন্যে করছি, আপনার মতো শহুরে লোক হুট করে পতিদহের দাঁতব্য ডিস্পেন্সারীতে ডাক্তারী নিতে চাইবে, আমার যেন ভালো করে বিশ্বাস হতে চায় না। আমি যখন ডাক্তারের খোঁজে কলকাতা গিয়ে আপনার প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে দেখা করলাম তখন এক রকম ধরেই নিয়েছিলাম কেউ রাজি হবে না আসতে।

সে ভুল তো আপনার ভেঙেছে।

হ্যাঁ, তা ভেঙেছে। সেই জন্যেই আরেকবার ভাবতে বলছি। কী জানেন, আমি সবসময়ই খোলামেলা কথা পছন্দ করি। কারো ওপরে জোর করি না। নিজেই ভালো করে জানি, পতিদহে কী আছে? পতিদহে কেন আপনার মতো শিক্ষিত মানুষ যাবে? ক টাকাই বা মাইনে দেব?

আচ্ছা, সে কথা এখন থাক।

ইদ্রিস ডাক্তার থামিয়ে দিল হাজি সাহেবকে। একটু পর বলল, রাতেই কি রওয়ানা দেবেন?

না, এখানে রাতটা কাটিয়ে ভোর বেলায়

পতিদহের বড় তরফ হাজি জয়েনউদ্দিন মাথা দুলিয়ে দাড়ি খেলাল করলেন বার কয়েক। বললেন, পাগল হয়েছেন? এই রাতে রওয়ানা দিতে চান?

ক্ষতি কী?

এটা কলকাতার রাজপথ নয় ডাক্তার সাহেব। সিঙারদাবড়ি হাটের পর থেকে বন শুরু হয়েছে। সে বনে বাঘও আছে বলে লোকে বলে। আমি দেখিনি নিজে। বাঘের মুখে। উৎসাহের তোড়ে প্রাণ দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

ও।

হাজি সাহেবের সঙ্গে এসেছে দুই খানসামা আর এক পাইক। তারা ততক্ষণে স্টেশনের বিশ্রাম ঘর খুলিয়ে বিছানা করে ফেলেছে। রাতের রান্নার যোগাড় দেখছে এখন তারা। একজন বাজারে বেরিয়ে গেছে চাল ডাল কিনতে।

ইদ্রিস ডাক্তার সব শুনে বলল, আমি তাহলে একটু হেঁটে আসি।

রাতে আবার কোথায় হাঁটতে যাবেন ডাক্তার?

প্ল্যাটফরমেহ।

দেরি করবেন না। শীত পড়তে শুরু করেছে। মাথায় হিম বসে গেলে শরীর খারাপ করবে। কথাটা ইদ্রিসের মনে প্রবল নাড়া দেয়। এক মুহূর্তের জন্য অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। এরকম করে কত বছর কেউ তাকে কথা বলেনি। শুনে যেন চমকে উঠতে হয়। ইদ্রিস ডাক্তার ইতস্তত করে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে এসে নুড়ি বিছানো রুক্ষ প্ল্যাটফরমের ওপর জমাট অন্ধকারের ভেতর আনমনে হাঁটতে থাকে। মাথায় হাত দিয়ে দেখে হিম পড়ছে সত্যি সত্যি।

কাল দুপুরের কথাগুলো আবার ভিড় করে আসে তার মনে। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের বৌবাজারের ডিস্পেন্সারীতে বসে তখন রোগী দেখছিল সে। এমন সময় চাকর এসে খবর দিল দুপুরে প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বাসায় ডেকেছেন খেতে।

এ রকম তো কত দিন প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ডেকেছেন। তাঁর হোমিওপ্যাথিক কলেজে পড়াশোনা করেছে ইদ্রিস। ইচ্ছে ছিল, কলকাতায় এসেছিল সে, এলোপ্যাথি পড়বে বলে। ক্যামবেল পাশ ডাক্তার হবে বলে। কিন্তু এক বছর পড়বার পড় সামথ্যে আর কুলোলো না। বাবার এন্তেকালের পর বড় ভাই সংসার দেখতে এগিয়ে এলেন না। তিনি তখন মহম্মদী হয়েছেন। লম্বা লম্বা চুল রাখেন, চোখে দেন সুরমা, মাথায় বিরাট সাদা পাগড়ি বাঁধেন। চেহারা ছিল এমনিতেই নুরানি। এই লেবাসে মনে হতো বড় ভাইকে যেন ইরান তুরানের বাদশাহর ছেলে স্বপ্নাদেশে ফকিরি নিয়ে পথে বেরিয়েছে। ঘর–ছাড়া বড় ভাই মাঝে মাঝে ঘরে আসতেন টাকার জন্যে। বাবার কাছে তা পাওয়া যেত না। রাত দুপুরে বাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় মাকে ডাকতেন। মা বেরিয়ে এসে আঁচল আড়াল দিয়ে তাকে রান্নাঘরে বসিয়ে খেতে দিতেন। ঘুমন্ত স্বামীর বালিশের নিচ থেকে চাবি চুরি করে টাকা বের করে দিতেন। বড় ভাই সেই রাতেই গ্রাম ছেড়ে আবার চলে যেতেন মাস দুমাসের জন্যে। কোথায় কোন সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে থাকতেন, কোন মাজারে বসে জেকের করতেন, হানাফিদের সঙ্গে বিবাদ পাকিয়ে তুলতেন তার সঠিক খবর কেউ জানতো না।

বাবা মারা যাবার পরও সে আদত গেল না বড় ভাইয়ের। সংসার ভেঙ্গে পড়তে লাগল। মার পক্ষে সম্ভব হলো না সব জমিজমা থেকে ধান আদায় করা, তার বিলি বন্দোবস্ত করা। গাছের আম–কাঁঠাল পাড়া পড়শি পেড়ে খেতে লাগল, চুরি হতে শুরু করল, মা কিছু করতে পারলেন না। ঘরে এক সোমত্ত মেয়ে আর তিনি, আর তো কোনো ব্যাটা ছেলে নেই। বড় ভাইকে কতবার বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন মা, তবু তিনি ফিরলেন না। মা বললেন, বাবা তোর ফকিরি করতে হয়, জেকের করতে হয়, বাহাস করতে হয় ভিটেয় এসে কর। কেউ তোকে বাধা দেবে না। তোর বাবা তুই মুহম্মদী হয়েছিস বলে বাড়িতে উঠতে না দিলেও আমি কিছু বলব না। তুই যেমন চাস তেমনি হবে।

কিন্তু বড় ভাইর মনে যেন তখন ঘোর লেগেছে। কঠিন হাতে মার বাড়ানো হাত সরিয়ে দিয়ে বলতেন, সংসারের লোভ আমাকে দেখিও না মা। যে সংসারের সন্ধান আমি পেয়েছি তার খবর তুমি কী জানো?

ভণ্ড, পাষাণ্ড! ইদ্রিস ডাক্তার দাতে দাঁত চেপে তিস্তার প্ল্যাটফরমে হাঁটতে হাঁটতে উচ্চারণ করল। বলল, তাই যদি হবে তাহলে অনাথা মায়ের কাছে হাত পাততে আসিস কোন লজ্জায়? ফকিরের আবার টাকার দরকার কী? এত যে আল্লাবিল্লা করিস তাও তো আকাশ কুঁড়ে টাকার বৃষ্টি হয় না। টাকার জন্যে তো সেই সংসারেই আসতে হয়। ভণ্ড কোথাকার। নিজের সঙ্গেই এতগুলো কথা বলবার পর ভেতরের উত্তেজনা খানিকটা কমে এলো ইদ্রিসের। মা টাকা পাঠাতে পারেনি বলে যে এলোপ্যাথি পড়তে সে পারেনি তার জন্যে মনটা তেতো হয়ে গেল না আবার। কেমন মমতায় ভরে উঠল বুকটা। এমনকি বড় ভাইয়ের জন্যেও একটু টনটন করে উঠল শরীরের ভেতরে কেথায় যেন।

একবার তো সে ভেবেছিল নাম যখন ক্যামবেল থেকে কাটাই গেল মাইনে আর মেস ভাড়ার অভাবে। সে ফিরে যাবে সিরাজগঞ্জে, তার গণ্ড গ্রামে। সংসার দেখবে। বোনটাকে বিয়ে দেবে। মার সেবাযত্ন করবে। শেষ বয়সে মা যেন একটু শান্তিতে থাকতে পারেন তার ব্যবস্থা করবে। আর তার নিজের ভবিষ্যৎ? হোক না, যা কপালে লেখা আছে, তাই হোক। হালচাষ নিয়ে থাকতে খুব যদি খারাপ লাগে তো গাঁয়ের মকতবে মাস্টারি করবে। মাস্টারি করাটাও একটা বড় কাজ।

আসলে সারাজীবন সে একটা কিছু করতে চেয়েছে, বড় একটা কিছু। কিন্তু সেই বড় কাজটা কী, তা নিজেও কোনদিন ভালো করে বুঝে উঠতে পারে নি। বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ কেউ ইংরেজি পড়েনি। সে জেদ করে, বাবার সঙ্গে বিস্তর ঝোলাঝুলি, কাদাকাটি করে চৌবাড়ির স্কুলে ইংরেজি পড়তে গিয়েছে। পরীক্ষায় ভালো ফল করার দরুণ বাড়ি এসে চৌবাড়ির সেকেণ্ড টিচার যখন বাবাকে বলে গিয়েছিলেন, আপনার ছেলেটা লেখাপড়া শিখলে কালে একজন মানুষ হবে, তখন সেই প্রশংসা শুনে বাবার মনটাও বেশ নরোম হয়ে গিয়েছিল।

শুধু সে নিজে ভর্তি হয়েই ক্ষান্ত হয় নি। বড় ভাই পড়তেন মকতবে, তাকেও বুঝিয়ে শুনিয়ে ইংরেজি স্কুলে টেনে নিয়ে এসেছিলেন। তখন বড় ভাই তার কথা শুনতেন। তখন বড় ভাই ইদ্রিস ছাড়া কাউকে বুঝতেন না।

সেই ছেলেবেলাতেই ইদ্রিস স্বপ্ন দেখত, দুভাই তারা ইংরেজি পড়ে মস্ত বড় হয়ে গেছে। দেশের লোক হাটমাঠ ভেঙ্গে আসছে তাদের দেখতে। জেলার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট খাস হুকুমবরদার পাঠাচ্ছেন বড় চাকরির পয়গাম দিয়ে। ইদ্রিস কল্পনায় দেখতে পেত কলকাতাকে বুড়ি দাদির কিস্সায় শোনা বাগদাদ দামেস্কের মতো ঝলমলে, মণিমুক্তো পথে পথে ছড়ানো, রং বেরংয়ের রোশনাই জ্বলা, বাদ্য বাজনায় ডগমগ করতে থাকা কলকাতা। সেই কলকাতায় যাবে তারা।

তা হলো অন্যরকম। সেকেণ্ড ক্লাশে পড়তে পড়তে বড় ভাই মহম্মদী হয়ে গেলেন। কোথা দিয়ে যে কী হয়ে গেল তা জানতেও পারল না ইদ্রিস। তবে কানাঘুষোয় শুনেছিল শাজাদপুরের কোন এক জেলার মেয়ের রূপ নাকি তাঁকে টেনেছিল। তারা ছিল মহম্মদী। বড় ভাইও তাই হলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়েটা কেন হয়নি তা ইদ্রিস শত চেষ্টা করেও জানতে পারে নি। তাছাড়া তখন চলছিল তার এন্ট্রান্স পাশের পড়া। দম নেবার ফুরসৎ ছিল না। বলতে গেলে।

পাশ করেছিল ভালোভাবে, কলকাতায় গিয়াছিল ডাক্তারী পড়তে। চৌবাড়িতে একবার কঠিন অসুখ হয়েছিল তার। বড় ভাই যে বাড়িতে জায়গির থাকতেন সে বাড়ির মিয়া সাহেব দয়াপরবশ হয়ে টাকা খরচ করে ডাক্তার আনিয়েছিলেন। সেই ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে ভালো হয়েছিল ইদ্রিস।

ভারী ভালো লেগেছিল ডাক্তারকে তার। লম্বা নল দিয়ে বুক পরীক্ষা করছেন। চোখ কপালে তুলে জিভ একটু বের করে নাড়ি টিপে দেখছেন। খসখস করে লিখে দিচ্ছেন ব্যবস্থা। মনের মধ্যে গভীর দাগ কেটে গিয়েছিল সেই ছবিগুলো। আজরাইলের সঙ্গে লড়াই করা সে কি সহজ!

 ইদ্রিসের যেন মনে হয়েছিল, লেখাপড়া শিখে যদি কিছু হতে হয় তো ডাক্তার হবে সে। আজরাইলকে কাবু করার ফন্দি সন্ধি জানার চেয়ে চূড়ান্ত আর কী দিতে পারে ইংরেজি শিক্ষা? সে ডাক্তার হবে।

বাবা এন্তেকাল করার পর টাকার অভাবে যখন তার পড়াশোনা বন্ধ হলো, তখন একবার এক ঝলক মনে হয়েছিল বেঁচে থেকে কী লাভ? মনে হয়েছিল, এক ফুয়ে কে যেন বিরাট এক ঝলমলে ঝাড়বাতি নিবিয়ে দিল। কলকাতার ব্যস্ত রাজপথে চলমান মানুষগুলোকে তার মনে হয়েছিল অন্য জগতের মানুষ, কত সুখী তারা, কত সজীব, পায়ের নিচে শক্ত মাটি তাদের। আর একমাত্র সে–ই এদের মধ্যে দলছুট। তার মনে হচ্ছিল যেন, রাস্তার লোকেরাও তা জেনে গেছে; তাকে ভারী অদ্ভুত আর বেখাপ্পা দেখাচ্ছে সবার ভেতরে। এখুনি যেন সবাই হা হা করে হেসে উঠবে।

দুহাতে মুখ ঢেকে দৌড় দিতে যাবে, এমন সময় চোখের সম্মুখে এক দৃশ্য চোখে পড়ল। দেখল কয়েকজন যুবক একটা দরোজা দিয়ে সার বেধে বেরিয়ে আসছে। হাতে তাদের বই খাতা। দরোজার ওপরে সবুজ সাইনবোর্ড। তাতে সূর্যোদয়ের ছবি আঁকা। সেই সূর্যের ওপরে আধখানা বৃত্তের আকারে লেখা প্রিন্সিপ্যাল খানস সানরাইজ হোমিও কলেজ। তার নিচে লাল কালিতে লেখা দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।

আল্লাহরই কুদরত বলতে হবে। নইলে এই বৌবাজার দিয়ে কত কত দিন সে গিয়েছে, কিন্তু কই, আগে তো এ সাইনবোর্ড চোখে পড়েনি। ঐ যে বড় বড় করে লেখা দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়—-লেখাটা টকটক করছে; এত বড় লাগছে যে তার রীতিমত বিস্ময় হয় সে কি তবে এতকাল চোখ বুজে পথ চলত?

সোজা সে ঢুকে গিয়েছিল দরোজা দিয়ে। প্রিন্সিপ্যাল খান তখন ক্লাস ছুটি দিয়ে ডিস্পেন্সারীতে যাচ্ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী চাই তোমার?

গরিব আর মেধাবী ছাত্রদের কী সুবিধা দেওয়া হয় তাই জানতে এসেছি। সালাম না আদাব না, কোনো ভনিতা নয়, এমনকি দ্বিধা বা ভয়ও নয়—- একেবারে সরাসরি এ রকম প্রশ্ন ডাঃ খান আগে শোনেন নি। স্মিত হেসে বললেন, তুমি পড়তে চাও?

জানি না।

অবাক হয়ে এক মুহূর্তের জন্য ঐ তুললেন ডাঃ খান। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ি কোথায়?

সিরাজগঞ্জ।

কী পাশ করেছ?

এন্ট্রান্স।

কলকাতায় কদ্দিন আছো?

দুবছর।

এসো আমার সঙ্গে। ডিস্পেন্সারীতে তিনি নিয়ে গেলেন ইদ্রিসকে। বাইরে তখন বেশ কয়েকজন রোগী অপেক্ষা করছে। খাস কামরায় ঢুকে ইদ্রিসকে একটা টুল দেখিয়ে বললেন, বোসো এখানে।

অভিভূতের মতো বসলো ইদ্রিস। তার সঙ্গে আর একটি কথাও বললেন না ডাঃ খান। রোগী দেখে চললেন একের পর এক। একজন জিজ্ঞেস করল, ভিজিট কত দিতে হবে? ডাঃ খান হেসে বললেন, ভিজিট তো বাড়ি না গেলে নিই না। ওষুধের দাম দিলেই হবে।

রোগী যেন আর শেষ হতে চায় না। বেলা পাঁচের ঘরে এসে পৌঁচেছে। ইদ্রিসের এক সময় যেন সব অবাস্তব বলে মনে হলো। মনে হলো সে এখানে কেন? কী করছে? কোথা থেকে এসেছে? নিজের নামটাও যেন আরেকজনের নাম বলে মনে হতে লাগল তার কাছে। এই তো সে কাল রাতেও ভাবছিল দেশে ফিরে যাবে সংসার দেখবে, বোনটাকে বিয়ে দেবে, মকতবে মাস্টারী করবে। আজ, এখন, এই মুহূর্তে মনে হলো তার, সে সিদ্ধান্ত আর কেউ নিয়েছিল। কেন সে নিজেকে নষ্ট করবে এভাবে? বড় ভাই যদি সংসার না দেখে পার পেয়ে যান তো সে–ই বা কেন পার পাবে না? ছোট হয়ে তারই বা কী এমন দায়িত্ব! আর সে যদি গাঁয়ে ফিরেই যায় তো সংসারের তাতে লাভ হবে কতটুকু? মা না খেয়ে থাকবেন না, সে না গেলেও। বোনটার বিয়ে সে কলকাতা থেকে গিয়েও দিয়ে আসতে পারবে। শুধু ক–টা বছর। এই বছর ক–টা দাঁতে দাঁত চেপে কোন মতে পার করে দিতে পারলেই তার আবাল্য সেই স্বপ্ন সফল হতে পারে, সে ডাক্তার হতে পারে। লোকে হয়ত এ কবছর বলবে, বড় ভাই না হয় ফকির হয়ে গেছে, তুই তো বুড়ি মা আর বোনকে দেখতে পারতিস! তা ডাক্তার হয়ে সে যখন গাঁয়ে ফিরে যাবে তখন—

চমক ভাঙ্গলো ডাঃ খানের কথায়। তিনি বললেন, খাও। তাকিয়ে দেখে গরম জিলিপি পিরিচে করে রাখা। আর ঠাণ্ডা দু গেলাশ পানি। ইতস্তত করল সে। ডাঃ খান বললেন, খাও। আমিও নিচ্ছি।

তবু ইতস্তত করছে দেখে তিনি আবার যোগ করলেন, আহা, তোমার জন্য বিশেষ করে আনাই নি। ক্লাশ শেষে রোগী দেখে এটুকু নাস্তা করি। নাও।

সে একটা জিলিপি নিল। বাবার কথা মনে গড়ে গেল তার। চৌবাড়িতে সে যখন পড়ত বাবা মাঝে মাঝে দেখতে আসতেন। হাতে থাকত খাবারের পুটুলি। রাগ করে সে বলত, কেন আপনি এ সব বয়ে নিয়ে আসেন। বাবা হাসতেন। পরে করতেন কী, খাবার আনতেন ঠিকই; কিন্তু বলতেন না যে তার জন্যে আনা। বলতেন, তোর মা আমারই নাস্তার জন্যে সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিল, তা তুইও খা আমিও খাই।

পানি খেতে খেতে ইদ্রিস ভাবল, না হয় নাই এলো এলোপ্যাথি পড়া। হোমিওপ্যাথিই বা মন্দ কী। দামে শস্তা। খেতেও ভালো। কোনো বদ ক্রিয়া করে না। দেশ গায়ের লোকেরা দুবেলা পেট পুরে খেতে পায় না। এলোপ্যাথির পয়সা জোগাবে তারা কোত্থেকে। হোমিওপ্যাথি শিখলে সবার সেবা করতে পারবে ইদ্রিস। গায়ের অবস্থা তার চেয়ে ভালো তো আর কেউ জানে না। বরং আল্লার ফজলে এই ভালো হলো। সে হোমিওপ্যাথি পড়বে।

মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিল। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো। এ–কী আকাশ কুসুম সে বানাচ্ছে? তার তো কলকাতায় একবেলা থাকবার মতো সঙ্গতি নেই। আজ দেড় দিন পেটে ভাত পড়ে নি। মেসওলা বলে দিয়েছে কাল পর্যন্ত টাকা দিতে না পারলে সে যেন সীট ছেড়ে দেয়। এত সৌভাগ্য কি তার হবে যে সে হোমিওপ্যাথিই পড়তে পারবে? না হয় কিছু সুবিধে করে। দেবেন ডাঃ খান। কিন্তু তাতে তো আর খাওয়া পরার সমস্যা সমাধান হবে না। মনটা একেবারে নিভে যায় ইদ্রিসের। সে মাথা নিচু করে বসে থাকে।

তা কলকাতায় এতদিন কী করছিলে?

ডাঃ খান প্রশ্ন করেন।

ক্যামবেলে পড়তাম।

ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন ডাঃ খান। বললেন, ক্যামবেল?

জ্বি হ্যাঁ।

তারপর?

সব খুলে বলল ইদ্রিস। শুনে ডাঃ খান চোখ বন্ধ করলেন। চেয়ারের পেছনের দুপায়ে শরীরটাকে ঠেলে ভর দিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। রোগী এলো আরেকজন। তখন আবার সোজা হয়ে বসলেন। সব শুনে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন তার। তারপর ইদ্রিসের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আমার এখানে যারা পড়ে তারা সবাই প্রায় তোমার মতো। আমার কিছু বাধা রোগীপত্র আছে। তাদের কেউ খানসামা, কেউ রাজমিস্ত্রী, কেউ বই বাঁধানোর বা ছাপাখানার কাজ করে। নিজেরা গরিব হলেও ওরা বাড়িতে থেকে ছেলে পড়িয়ে নিজেরা পড়াশোনা করে। পারবে তুমি?

আগ্রহে দুহাত জড়ো করে উজ্জ্বল চোখে ইদ্রিস উত্তর করে, হ্যাঁ পারবো। খুব পারবো। কিন্তু কলেজের মাইনে?

সেটা? সেটা না হয় তুমি আপাতত নাই দিলে। আমার ডিস্পেন্সারীতে আরেকজন লোক দরকার লেবেল কাটা, শক্তি লেখা, কর্কের মাথায় ব্লকের ছোপ দেবার জন্যে। কিন্তু প্রথম বছরের পরীক্ষায় যদি ফল খারাপ হয় তাহলে এ সুবিধে আর পাবে না। মোট চার বছর পড়তে হবে।

আমি পড়ব স্যার। আমি চেষ্টা করব ভালো ফল করতে স্যার।

প্রথম বছরেই পড়াশোনায় ইদ্রিস এত ভালো করল যে ক্লাশের ভেতরে প্রথম হলো সে। ছকু খানসামা লেনে জায়গির পেয়েছিল। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বৌবাজার আসতো সকাল নটায়। ক্লাশ করতো। পড়াতেন ডাঃ খান নিজে। আর কোনো প্রফেসর ছিল না কলেজে। নিজেই অর্গানস, ফিজিওলজি, অ্যানাটমি, মেটিরিয়া মিডিকা, প্র্যাকটিস অব মেডিসিন সব সাবজেক্ট পড়াতেন। ক্লাশ শেষে ইদ্রিস গিয়ে বসতো ডিস্পেন্সারীতে। সেখানে সন্ধ্যে পর্যন্ত ওষুধ ঢালা, লেবেল লাগানো, প্যাক করা, পয়সা গুণে রাখা, মেমো কাটা এই করত সে। সন্ধ্যের পর যখন বাসায় ফিরত প্রায়ই সঙ্গে নিয়ে আসত ডাঃ খানের লেখা বইয়ের পাণ্ডুলিপি। রাত জেগে নকল করে দিত ইদ্রিস। বই ছাপাতেন ডাঃ খান নিজেই। সে বই তার নিজের কলেজেই পাঠ্য ছিল। আর কিনত মফস্বলের মুসলমান হবু হোমিওপ্যাথরা।

এক বছর পরে একদিন ডাঃ খান ইদ্রিসকে ডেকে বললেন, আমার বাসায় তো বাইরের ঘরটা পরেই থাকে। চলো এসো।

মানে স্যার?

গর্ধব কোথাকার। মানে আবার কী? আমার বাসায় থাকবে আজ থেকে।

ডাঃ খানের প্রিয় ছাত্র ইদ্রিস সম্মানের সঙ্গে ফাইন্যাল পাশ করল। ডাঃ খান নিজের খরচে তার ছবি ছাপিয়ে দিলেন সাপ্তাহিক মোহাম্মদী আর শিক্ষা–সমাচারে। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ইদ্রিস বিদায় নিল। ফিরে এলো তার গায়ে। ততদিনে বড় ভাই মহম্মদী নাম ঘুচিয়ে আবার হানাফি হয়েছেন। সংসার করছেন। ইদ্রিস ফিরে এলে বললেন, এবার বিয়ে করে সংসারী হ।

সে কেমন করে হয়? বড় ভাই থাকতে ছোট ভাই আগে বিয়ে করবে সে কী কথা?

কিন্তু কিছুতেই তাকে বোঝানো গেল না। আর ইদ্রিসেরও পণ বড় ভাই বিয়ে না করলে সেও বিয়ে করবে না। ইতিমধ্যে বোনের বিয়ে ফরজ হয়ে পড়েছে।

এক বিকেলে কাণ্ড হলো একটা। গায়ে ঘোড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। কে এক দিব্যকান্তি তরুণ ঘোড়ার পিঠে চড়ে ধীরে ধীরে মাঠ ঘাট ভেঙে গাঁয়ের ভেতরে ঢুকেছে।

মকতবের হেড মোদাররেস কাঁপতে লাগলেন থরথর করে। বোধহয় স্কুল ইনেসপেক্টর এসেছে মকতব দেখতে, খাতা দেখতে। কোথায় তাকে বসায়, কী দিয়ে খাতির করে ভেবে না পেয়ে গলদঘর্ম হলেন। নাম জিজ্ঞেস করলেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন, ধাম জিজ্ঞেস করলে আমতা আমতা করেন।

কিন্তু একটু পরেই হেড মোদাররেস সাহেবের কেমন সন্দেহ হলো। স্কুল ইনেসপেক্টরের মতো রুক্ষ মেজাজ নয়, ধমক দিয়ে কথা বলেন না। খাতাও দেখতে চাইলেন না, এ আবার কে বটে?

তাই বলো শাজাদপুরের উত্তর পাড়ার তালুকদার বাড়ির বড় ছেলে। বাপ মরার পরে গদিতে বসেছেন।

তা হুজুর কী মনে করে? ওরে শরবৎ আন। পাখা আন। হারামজাদাগুলো গেল কোথায়? তালুকদার হাসলেন। বললেন, অনর্থক কেন তালবেলেমদের হারামজাদা বলছেন মৌলবী সাহেব। ব্যস্ত হবেন না। আমি দুদণ্ডের জন্যে এসেছি। ঘোড়ার পিঠ থেকে নামবও না।

কেন? কেন? হাঁ হাঁ করে উঠলেন হেড মোদাররেস। খাতিরদারিতে কোনো কসুর হবে না। দয়া করে এসে পড়েছেন যখন, বসবেন না, সে কী কথা?

আস্তে আস্তে শোনা গেল সব। তালুকদার সাহেব নিজের জন্যে পাত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছেন এ গায়ে সে গাঁয়ে। খাঁটি সোনা চান তিনি। রূপে যেন জাহাঙ্গীর বাদশার বেগম মেহেরুন্নিসাকেও হার মানাতে পারে সে মেয়ে। গরিব হোক ক্ষতি নেই। নিচু বংশ হোক পরোয়া নেই। ঘরে বৌ এলে স্বামীর পরিচয়ে পরিচিতা হবে সে। আছে তেমন?

হেড মোদাররেস সাহেব জাফরান রাঙানো দাড়ি ঝাড়লেন বার কয়েক মাথার টুপি হাপরের মতো উঠানামা করিয়ে শীতল করলেন চাঁদি। তারপর হাসিতে বিগলিত হয়ে বললেন, আছে, অবশ্যই আছে। দুবেলা কোরান পড়ান তাকে তিনি। কিন্তু এত কথা তো ঘোড়ায় জিন দিয়ে থাকলে হয় না! নামতে হবে, বসতে হবে, দশ দিক বুঝে শুনে কথা চালাতে হবে।

সেদিন মগরেবের আগেই মেয়ে দেখে পছন্দ করলেন তালুকদার সাহেব। সাতদিনের মাথায় বিয়ে হয়ে গেল। লোকে বলাবলি করল, বাপের ভাগ্য ছিল বটে! নইলে এত বড় ঘরে এ মেয়ে যায়!

ইদ্রিস আর তার ভাই বোনের বিয়েতে খরচ করল সাধ্যাতীত। একমাত্র বোন ছিল সে। চলে যেতেই বাড়িটা যেন খাঁখা করতে লাগল।

মা ধরে বসলেন, এবারে তোরা বউ আন ঘরে। নইলে একবস্ত্রে আমি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবো।

বড় ভাই বললেন, সংসারে মন দিয়েছি বলে মনটা তো সংসারী হয়ে যায় নি। আমি সেই ফকিরই আছি। আমার হুজুর বলেছেন, সংসার সাধনার পথে বাধা। বিয়ে আমি করবো না। মা যদি আত্মত্যাগী হন তো ইদ্রিসের একগুয়েমির জন্যেই হবেন।

অতএব ইদ্রিসকে রাজি হতে হল। পদ্মার ওপারে শিবালয়ের মেয়ে পছন্দ হলো। পছন্দ করে এলেন ওদের বাপের চাচাতো ভাই। দিন–ক্ষণ দেখে ইদ্রিস বড় ভাই আর চাচাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিয়ে করতে। এখনো মনে আছে ইদ্রিসের বিয়ে করতে বেরুনোর সময় চৌকাঠে হোঁচট খেয়েছিল। মা বললেন, দাঁড়িয়ে যা। ইদ্রিস দাঁড়িয়ে গেল খানিকক্ষণ।

তারপর যে কাণ্ড হলো, ইদ্রিসের মনে পড়লে এখনো গায়ের রক্ত টগবগ করে ওঠে। সে কথা আর কোনদিন ভাবতে চায় না সে। বিয়ে করা নতুন বৌ ফেলে ভোর রাতে কারো মুখদর্শন পর্যন্ত না করে সোজা চলে এলো ডাঃ খানের কাছে।

তিনি তখন ডিস্পেন্সারীতে কেবল এসে বসেছেন। সকাল বেলায় একঘণ্টা বিনি পয়সায় ওষুধ দেয়া হয়। ভিড়ে থইথই করছে এক ফালি বারান্দাটা। ইদ্রিস এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে দাঁড়াল।

কী ব্যাপার? ঔষুধ কিনতে এলে? প্রাকটিস কেমন? আছো কেমন? খুশিতে একের পর এক প্রশ্ন করে চললেন ডাঃ খান। এতদিন পরে কৃতি ছাত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যেন আনন্দ আর ধরছে না।

ইদ্রিস বলল, থাকতে এসেছি স্যার।

থাকতে মানে?

আপনার কাছে। যদি জায়গা দেন আপনার ডিস্পেন্সারীতে বসব। যদি যোগ্য মনে করেন কলেজে ছাত্র পড়ানোয় সাহায্য করব। দেশে আর ফিরে যাবো না।

ও।

স্যার, আপনাকে একটা কিছু কথা দিতেই হবে।

আচ্ছা তুমি বোসো তো।

কথা না পেলে বসবো না স্যার।

কী পাগলামো করছ? বোসো বোগী বিদেয় করে নি, পরে তোমার কথা শুনব। উঠেছ কোথায়?

ধমক খেয়ে নরম হয়ে গিয়েছিল ইদ্রিস। বিনীত গলায় উত্তর করল, শেয়ালদা থেকে সোজা এখানে এসেছি।

বেশ করেছে। বাসায় যাও। গোসল করে কিছু খেয়ে নাও। দুপুরে কথা বলব।

ইদ্রিস বহুদিন পরে প্রিন্সিপাল সাহেবের বাসায় গেল। দেখল, আরেক ছাত্র জায়ণির রয়েছে সেখানে। তার সঙ্গে গল্প করল খানিক। ভেতর থেকে বিবি সাহেবা—-তাকে আম্মা বলত ইদ্রিস—- সে এসেছে শুনেই নাস্তা পাঠিয়ে দিলেন। ইদ্রিসের মনে হলো অনেকদিন পরে নিজের বাড়িতে যেন ফিরে এসেছে সে।

সেদিন কলেজ ছিল ছুটি : ক্লাশ পড়ানো ছিল না প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের। দুপুরে ইদ্রিসকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বসলেন তিনি। বললেন, হ্যাঁ এবার বলো, কী হয়েছে?

পিড়াপিড়ি করেও একবর্ণ বার করতে পারলেন না প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ইদ্রিসের পেট থেকে। সে শুধু এক কথা বলে, আপনার এখানে জায়গা দিন, দেশে আর ফিরে যাবো না।

প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, সে তুমি যতদিন খুশি থাকো এখানে। কিন্তু এভাবে নিজেকে নষ্ট করবে কেন?

নষ্ট করবার কী আছে স্যার? আপনার সঙ্গে প্র্যাকটিস করবো। কলেজ দেখবো।

ফাইন্যাল ইয়ারে যখন পড়ত ইদ্রিস, ডাঃ খান তাকে মাঝে মাঝে নতুন ছেলেদের ক্লাশ নিতে বলতেন। মন ঢেলে পড়াতো সে। আম্মা সাহেবার কাছে একদিন ইদ্রিস শুনেছে, স্যার বলেছেন, চমকার পড়ায় ছেলেটা। সেই প্রশংসার ভরসায় ইদ্রিস কলেজে সাহায্য করার প্রস্তাব দিচ্ছিল বারবার।

প্রিন্সিপাল সাহেবকে হঠাৎ বড় করুণ এবং অসহায় দেখালো। বললেন, তোমার কাছে লুকিয়ে রাখব না ইদ্রিস। কলেজের অবস্থা সুবিধের নয়। আমার বিরুদ্ধে জোর প্রচার। চালিয়েছে ডাঃ সেন আর ডাঃ চক্রবর্তীর দল। ছাত্র কমে গেছে আমার। এবার মাত্র পাঁচজন ভর্তি হয়েছে।

অবাক হয়ে গেল ইদ্রিস।

সে কী স্যার!

সেন আর চক্রবর্তীর দোষই বা কী দেব? প্রিন্সিপ্যাল সাহেব খেদের ভঙ্গিতে হাতের পিঠ ঘষতে লাগলেন। দোষ আমাদেরই। আমার কলেজে হিন্দু ছেলে পড়তে আসবে এ আশা কোনদিন করিনি। ওদের জাতপ্রীতিটা বড় কঠিন। কিন্তু মুসলমান ছেলেরাও আজকাল কি বলে জানো?

কী স্যার?

বলে, হিন্দুর কলেজে পড়লে ডাক্তার হিসেবে নাম পোক্ত হয়। একে হোমিওপ্যাথি পড়ছি। তাও যদি মুসলমান প্রিন্সিপ্যালের কাছে পড়ি তো আর রোগী দেখে পেটের ভাত জুটাতে হবে না।

কিন্তু আমাদের সময়ে তো এরকম ছিল না স্যার?

ছিল না, তখন দুদিনের জন্য একটা উদ্দীপ; এসেছিল মুসলমান সমাজে। নেতাই নেই তো সে উদ্দীপনা টিকিয়েই রাখবে কে আর তা কাজেই বা লাগাবে কে? মুসলমান লেখাপড়া করে, টাকা করে, ভেতরে কিছু পার্টস থাকলে সমাজের কাজে তা না লাগিয়ে গভর্ণর ভাইসরয়ের নেকনজরে পড়বার জন্য ঝুলোঝুলি কামড়াকামড়ি লাগিয়ে দেয়। মেম্বার হয়, কাউন্সিলর হয়, করদ রাজ্যের দেওয়ান হয়। এই তো অবস্থা।

এত কথা ইদ্রিস আগে কখনো ভাবে নি, চোখেও পড়েনি তার। গুম হয়ে বসে থাকে সে। পায়ের নিচে যেন মাটি দেখতে পায় না। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলে চলেন, ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। দেখি কী হয়? এদিকে আমার বইগুলোরও সেই এক দশা। মুসলমানের বই পড়ে ডাক্তার হওয়া যায় কেউ যেন বিশ্বাসই করতে চায় না। কলকাতায় এতগুলো হোমিওপ্যাথির দোকান, কোন একটা দোকান আমার বই রাখতে রাজি হলো না। একবার ভেবেছিলাম সীজন টিকেট করে নিজেই সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াবো, বই ক্যানভাস করব। তা শরীরে কুলোয় না। ইচ্ছে পর্যন্তই, কিছু করতে পারলাম না।

এ যেন এক অন্য মানুষ। এ মানুষকে ইদ্রিস আগে দেখেনি। ভালো করে তাকিয়ে দেখে, সত্যি বুড়ো হয়ে গেছেন প্রিন্সিপ্যাল সাহেব। মুখের চামড়া ঢিলে হয়ে এসেছে। দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে বলে চোখ কুঁচকে তাকান। হাত কাঁপে। গায়ের জামাটাও নুন ময়লা, এখানে ওখানে জ্যালজেলে হয়ে পড়েছে, একটু টান লাগলেই ছিঁড়ে যাবে। অথচ এই প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে সে দেখেছে ধবধবে ধোয়া দুধের মতো শাদা টুইলের শার্ট পরতে, তাতে রূপোর বোতাম লাগানো। তার অনুকরণে ইদ্রিসও টুইলের শাদা শার্ট পরতে শুরু করে দিয়েছিলো। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের চেহারা দিয়ে যেন আলো ঠিকরে বেরুতো। সে আলো আজ নেই। সারারাত জ্বলবার পর নিভে যাওয়া অপরিচ্ছন্ন সলতের মতো দেখাচ্ছে তাকে।

ইদ্রিস মাথা নিচু করে রইলো।

প্রিন্সিপ্যাল সাহেব শেষ অবধি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে মুখে বিষণ্ণ হাসি ফুটিয়ে বললেন, থেকে যাও আমার এখানেই। আমি তো কিছু দিতে পারবো না। সে সামর্থ্য নেই। আগের মতো খাবে–পরবে, বাড়ির ছেলের মতো থাকবে।

সেই আমার যথেষ্ট স্যার।

তবু বলি, তোমার মতো গুণী ছেলেকে এভাবে নষ্ট হতে আমি দেখতে পারবো না। সুযোগ পেলে সুযোগ ছেড়ো না, এই একটা উপদেশ তোমাকে দিই।

যে আঘাত ইদ্রিস পেয়েছে তার ফলে মনটাই যেন অসাড় হয়ে গেছে তার। নিজেকে নষ্ট করেছে কী করছে না সে উপলব্ধিটুকু ধরে এমন মন তার আর নেই।

সে বলল, আপনি যদি কখনো কোথাও সুযোগ করে দিতে পারেন তো না হয় যাবো। আমার এমন পয়সা নেই যে নিজে প্র্যাকটিসে নামতে পারি আর আপনার কাছে যদি না থাকতে পারি তো কলকাতাতেই থাকবো না।

থাকো কিছুদিন। দেখি কী হয়।

প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ঐ রকম মানুষ। দেখি কী হয় বলা যেন তার মুদ্রাদোষ। ইদ্রিস জানে, তাকে পেয়ে তিনি খুশিই হয়েছেন। এই ভেঙ্গে পড়ার মুহূর্তে তার কাছে থাকতে পেরে সে নিজেও কৃতার্থ বোধ করছে। তাকে সে শুধু শিক্ষক হিসেবেই দেখেনি, দেখেছে পিতা হিসেবে, প্রাণদাতা হিসেবে, তার স্বপ্ন সফলের পেছনে সবল বাহু হিসেবে।

রয়ে গেল ইদ্রিস। সকালে উঠে কলেজে যায়। নিচের ক্লাশে পড়ায়। ছাত্র সাকুল্যে আটজন। ইদ্রিস প্রায় শূন্য ক্লাসঘরে বক্তৃতা করে এমন উচ্চকণ্ঠে যেন পঞ্চাশ একশ ছাত্রে গমগম করছে কক্ষ। প্রাণ ঢেলে পড়ায়। রাত জেগে পড়াশোনা করে পড়াশোনার জন্যে। ডাঃ সেন আর। ডাঃ চক্রবর্তীর কলেজের ছাত্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে এমন ছাত্র গড়ে তোলার কাজে যেন প্রাণপাত করবার প্রতিজ্ঞা নিয়েছে সে। বিকেলে রুগী দেখে ডিস্পেন্সারীতে বসে। ডাঃ খানের দস্তুর মতো সেও পয়সা নেয় না, শুধু ঔষধের দাম ছাড়া।

সে আসার পর থেকে অনেকটা ভারমুক্ত হয়েছেন ডাঃ খান। এখন বেশ অবসর পেয়েছেন। তিনি। ইদ্রিসের অনুরোধে বৃহৎ মেটেরিয়া মেডিকা লিখছেন বাড়িতে বসে।

কিন্তু বই লেখার মতো অবসর পেয়েও ডাঃ খান তেমন উৎসাহ পেতেন না বই লেখার। বিবেক তাকে দংশন করত। ইদ্রিস বিনি পয়সায় তার কলেজ চালাচ্ছে, ডিস্পোরী দেখছে। আর তিনি তার সুযোগ নেবেন এরকম ধাতের মানুষ তিনি নন। গোপনে গোপনে চেষ্টা করতেন কোথাও যদি একটা হিল্লে করে দেয়া যায় ইদ্রিসের। কিন্তু মুসলমান দরিদ্র একজন হোমিওপ্যাথ, হোক না সে যতই প্রতিভাবান, এই কলকাতায় তার প্রতিষ্ঠা খুব সহজে সম্ভব নয়। অথচ একটা ডিস্পেন্সরী করে দেবেন ইদ্রিসকে এমন পয়সাও ডাঃ খানের নেই। যদি তা পারতেন তাহলে কী আনন্দ হতো তার সেই কথাটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সঙ্গে বারবার স্মরণ করেন তিনি আর বিষণ্ণ হন। এভাবেই চলছিল। তারপর গেল কাল এলেন হাজি জয়েনউদ্দিন। পতিদহের বড় তরফ। ভাইসরয় কাউন্সিলের মেম্বার, উত্তর বাংলার প্রতাপশালী জমিদার প্রৌঢ় হাজি জয়েনউদ্দিন।

তখন ডিস্পেন্সারীতে ছিল ইদ্রিস। হাজি সাহেব এসে ডাঃ খানের খোঁজ করলেন। ডাঃ খান। তখন ছিলেন না। শুনে হাজি সাহেব বললেন, তার সঙ্গে দেখা করবার জন্যই আমি এ যাত্রা কলকাতা এসেছি। আজকেই দেখা হওয়া দরকার। সম্ভব হলে আজ রাতেই কিংবা কাল সকালে আমি পতিদহে ফিরে যাবো। তা আপনি কে?

ইদ্রিস জবাব দিয়েছিল, ওঁর ছাত্র ছিলাম। ওঁর সঙ্গেই আছি।

বেশ, বেশ। তা একটা খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারেন? বলবেন পতিদহের হাজি সাহেব এসেছেন।

সেকেণ্ড ইয়ারের একটা ছেলে তখন বসেছিল। সে বলল, আমি স্যারের বাসায় যাচ্ছি খবর দিতে।

হাজি সাহেবের নাম শুনে তখুনি এলেন ডাঃ খান। হাজি সাহেব তাঁকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে দুজনে মোসাফা করলেন। কুশল বিনিময় হলো। সারাক্ষণ সসম্ভ্রমে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো ইদ্রিস। সে এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে অতিথি সাধারণ কেউ নন এবং প্রিন্সিপ্যাল সাহেব তাঁকে অসীম শ্রদ্ধাভক্তি করেন।

হাজি সাহেব বললেন, সময় কম। কথাটা বলেই ফেলি। আমার একজন ডাক্তার দরকার।

ডাক্তার দিয়ে কী করবেন?

লোকে ডাক্তার দিয়ে কী করায় শুনি, আঁ?

প্রিন্সিপ্যাল সাহেব লজ্জিত হেসে বললেন, তাতো বটেই।

হ্যাঁ, একজন ডাক্তার আমাকে দিতে হবে। কাছারি বাড়িতে দাঁতব্য ডিস্পেন্সরী খুলেছি। জানেন তো, এলোপ্যাথি আমার দুচোখের বিষ। আর হোমিওপ্যাথির ভক্ত হলাম তো আপনার জন্যেই। আপনাকে পতিদহে নিয়ে যাই এতবড় সৌভাগ্য আমার হবে না। তাছাড়া কলকাতায় আপনার কলেজ আছে, ছাত্র তৈরি করছেন; পতিদহে চেরিটেবল ডিস্পেন্সরীর মেডিক্যাল অফিসারের চেয়ে এ অনেক বড় কাজ। আপনার কোনো পাশ করা ভালো। চরিত্রবান ছাত্র থাকলে তাকে সাথে করেই নিয়ে যেতাম।  

একই সঙ্গে দুজনের চোখ পড়ল দুজনের দিকে। ইদ্রিস আর প্রিন্সিপ্যাল খান। ইদ্রিস চোখ নামিয়ে নিয়ে সরে গেল। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব কুঞ্চিত করে ভাবতে লাগলেন।

কী, আছে তেমন কেউ?

প্রশ্ন করলেন হাজি সাহেব।

ভাবছি।

সাথে করেই নিয়ে যাবো। কাল থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট। থাকা–খাওয়া ফ্রি। মাইনে দেবো চল্লিশ টাকা।

হুঁ।

অবশ্য পতিদহ বড় ব্যাকওয়ার্ড জায়গা। সে কথাটাও পরিষ্কার বলা ভালো। সেই জন্যেই চল্লিশ টাকা দিচ্ছি। ডাক্তার হলেই শুধু চলবে না, দেশ গাঁয়ের মানুষকে ভালোবাসে, আল্লা রসুলের পাবন্দ এমন ছেলে চাই। আর জানেন তো, দিতে আমি কার্পণ্য করি না। নিজের ছেলেপুলে নেই। এই নিয়েই থাকি। পতিদহে গেলেই যে জীবন নষ্ট হয়ে যাবে এমন নয়। আমিও তার ভবিষ্যৎ দেখব।

সে আমি জানি। জানি বলেই ভাবছি, কাকে দেওয়া যায়।

হাজি সাহেব বসে বসে তার দাঁতব্য ডিস্পেন্সারীর বর্ণনা দিতে লাগলেন। বললেন, ওষুধপত্তর যা দরকার হবে তারও একটা লিস্ট চাই। সাজসরঞ্জামেরও।

ডাঃ খান ইদ্রিসকে ডাকলেন। বললেন, পতিদহে যাবে?

ইদ্রিস কোনো উত্তর দিল না। এ রকম আকস্মিক প্রশ্নের উত্তর চট করে তার মাথায় এলো না। যখন বুঝল হাজি সাহেবও তাকিয়ে আছেন তার দিকে, তখন উত্তর না দেয়াটা অভদ্রতা হয়ে যাচ্ছে বিবেচনায় সে বলল, আপনি বললে নিশ্চয়ই যাবো স্যার।

তখন ডাঃ খান হাজি সাহেবকে বললেন, ওর সামনে বলেই বলছি না। আমার কলেজ থেকে এরকম ছেলে বেরোয়নি। ওর চেয়ে যোগ্য আর কাউকে দেখি না। শুধু গরিব বলে এতদিন কিছু করতে পারে নি, আমার এখানেই পড়ে আছে। আপনি সুযোগ দিলে ওর একটা বড় উপকার হয়।

হাজি সাহেব তখন ইদ্রিসের নাম পরিচয় জিগ্যেস করলেন। তারপর হাজি সাহেব ডাঃ খানকে বললেন, ওষুধপত্র যা যা লাগে আর সাজ–সরঞ্জাম আপনিই দিয়ে দিন।

কিন্তু আজ রাতের ভেতরে তো সব তৈরি হয়ে উঠবে না। তাছাড়া কলকাতায় এসেছেন আমার গরিবখানায় দাওয়াত কবুল করবেন না, সে হতেই পারে না।

বেশ তো। কাল সকালের মেলে যাতে রওয়ানা হতে পারি সে রকম ব্যবস্থা করে নি। আমি এখন বেরুচ্ছি। ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার।

সেখানে গেলে কি আর রাতে আমার গরিবখানায় আসতে পারবেন?

খুব পারবো। রাত দশটা হোক এগারোটা হোক আসবোই। আর ডাক্তার– ইদ্রিসকে লক্ষ্য করে হাজি সাহেব বললেন, আপনি তৈরি হয়ে নিন। যা যা লাগে সব দেখে শুনে নিন। এখন তো আপনি আমারই লোক। ভালো কথা, বিশটা টাকা রেখে যাচ্ছি। নিজের কিছু কেনাকাটা থাকলে এ থেকে করে নেবেন।

আপত্তি করাবার আগেই দশ টাকার নোট দুটো তিনি গুঁজে দিলেন ইদ্রিসের হাতে।

তিনি চলে গেলে ইদ্রিস ডাঃ খানকে বলল, স্যার!

কী?

কিছু বলতে পারল না ইদ্রিস। অনেকক্ষণ পরে শুধু উচ্চারণ করল, কিছু না স্যার।

হাঁটতে হাঁটতে প্ল্যাটফরমের শেষ মাথায় চলে গিয়েছিল ইদ্রিস। সেখানে কাঠের ফলকে বড় বড় করে নাগরী, বাংলা আর ইংরেজিতে লেখা তিস্তা। অনেকক্ষণ যেন বোধগম্য হলো না, এ কোথায় আছে সে? তিন ভাষাতেই লেখাটার আলাদা আলাদা অক্ষর পড়ল সে। তারপর সম্মুখে তাকিয়ে দেখল অন্ধকারে মাটির ওপরে লাল একটা বড় তারা যেন নেমে এসেছে। তিস্তা ব্রীজের ওপর জ্বলছে লাল বাতি।

হাওয়া বইছে সোঁ সোঁ করে। একটু ঠাণ্ডা করছে। মাথার চাঁদিতে হাত দিয়ে দেখল হিমে বরফ হয়ে আছে চুলগুলো। সে ফিরল।

প্ল্যাটফরমের এক কোণায় বেহারি কুলিরা বসে জটলা করছে। পিঠের সঙ্গে ভাঁজ করা হাঁটু গামছা দিয়ে বাঁধা। চমৎকার একটা ছবি বিশ্রামের। একজন হেড়ে গলায় চোখ বুজে গান করছে। বাকি সবাই শুনছে তন্ময় হয়ে। তার সে উচ্চ কণ্ঠ বহুদূর পর্যন্ত শোনা যেতে লাগল।

সব কিছু কেমন আপন মনে হতে লাগল ইদ্রিসের।

সে দূরে দাঁড়িয়ে গান শুনলো খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ দেখল হাজি সাহেবের হুকুমবরদার যেন অন্ধকার ফুড়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

কী ব্যাপার?

রান্না হয়ে গেছে। হুজুর আপনার জন্যে বসে আছেন।

তাই তো বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

সেই সময়ে একটা কুকুর কেঁদে উঠল কোথাও। গা–টা শিরশির করে উঠল তার। অকারণে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, বিয়ে করতে বেরুবার সময় চৌকাঠে হোঁচট খেয়েছিল সে। অর্থহীন এই মনে পড়া।

দূর, দূর।

কিছু বললেন?

হুকুমবড়দার প্রশ্ন করল।

না, কিছু না। চলো।

এসে দেখে, হাজি সাহেব জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়ছেন। পাশে খাবার সাজানো। ধোঁয়া উঠছে গরম ভাত থেকে। সে বলল, এখানে পানি কোথায়? আমিও নামাজ পড়ে নি। সালাম ফিরিয়ে হাজি সাহেব বললেন, কোথায় ছিলেন? আপনাকে না দেখে জামাতের জন্যে আর দেরি করলাম না।

ভারী লজ্জিত হলো ইদ্রিস। সে এককোণে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে শুরু করে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *