৪. মক্কেলের যেন দুর্ভিক্ষ লাগিয়া গিয়াছে

সারা সপ্তাহ ধরিয়া নিধু একটি পয়সা রোজগার করিতে পারিল না৷ মক্কেলের যেন দুর্ভিক্ষ লাগিয়া গিয়াছে—সকাল হইতে তীর্থের কাকের মতন বাসায় বসিয়া ঘন-ঘন হাই তুলিয়া ও বাহিরের দিকে সতৃষ্ণ নয়নে চাহিয়া থাকিয়া নিধুর মোক্তারী ব্যবসাটার উপরই অশ্রদ্ধা ধরিয়া গেল৷ নিধুর মুহুরী বলে—বাবু, এ হপ্তাটার হল কি? মক্কেলের যেন আকাল পড়েচে দেখচি—

—চল, কোর্টে আসতে পারে৷

কিন্তু কোর্টেও কেহ আসে না৷ যদু-মোক্তার একদিন বলিলেন—ওহে সুনীলবাবুর কোর্টে তো তোমার খাতির আছে—এই জামিনের জন্যে মুভ করে জামিনটা করিয়ে দাও না?

নিধু কেস শুনিয়া বুঝিল এ ক্ষেত্রে জামিন হওয়া অসম্ভব৷ বাড়ীতে চোরাই মাল পাওয়া গিয়াছে—পুলিস যে রিপোর্ট দাখিল করিয়াছে—তাহার গতিকও খুব খারাপ৷ যদু-মোক্তার নিজের নাম খারাপ করিতে রাজী নন, তিনি খুব ভালোই জানেন কোর্ট জামিন দিতে রাজী হইবে না৷ খাতিরে পড়িয়া যদি সুনীলবাবু জামিন মঞ্জুর করেন—ইহাই যদুবাবুর ভরসা৷

সে বলিল—কাকাবাবু, এ আমার দ্বারা সুবিধে হবে না—

—কেন হবে না? যাও না একবার—

—মাপ করুন কাকাবাবু, সুনীলবাবু কি মনে করবেন!

—চেষ্টা করতে দোষ কি? যাও একবার—

যদুবাবুর অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া নিধু গিয়া জামিনের দরখাস্ত দিয়া জামিনের প্রার্থনা করিল৷

সুনীলবাবু জামিন মঞ্জুর করিলেন৷

মক্কেল নিধুকে দুইটি টাকা দিল৷ নিধু সে দুটি টাকা লইয়া গিয়া যদুবাবুর হাতে দিতে তিনি কোনো কথা না বলিয়া তাহা পকেটস্থ করিলেন—কারণ মক্কেল আসলে তাঁহার৷ অবশ্য জামিননামার টাকাটা নিধু পাইল৷

বাসায় আসিয়া সে দেখিল সাধন-মোক্তার তাহার জন্যে রোয়াকে বসিয়া অপেক্ষা করিতেছেন৷ তাহাকে দেখিয়া সাধন বলিলেন—তোমার জন্যে বসে আছি হে নিধিরাম—

—আজ্ঞে, বসুন বসুন৷ বড় কষ্ট হয়েছে৷

—কিছু কষ্ট নয়৷ তুমি জামা কাপড় ছেড়ে সুস্থ হও—আমি একটা বিশেষ দরকারে এসেচি৷ ওবেলা তোমার কেসটা বেশ ভালো হয়েচে—কিন্তু যদুদা নাকি তোমায় টাকা দেননি?

—কে বললে আপনাকে?

—আমি সব জানি হে—আমার কাছে কি লুকোনো থাকে কিছু? তাই কিনা?

—আজ্ঞে না, তা নয়৷ তবে ওঁরই মক্কেল—

—কিসে ওঁর মক্কেল? তুমি জামিনের দরখাস্ত দিয়ে জামিন মুভ করে জিতলে—তবে ওঁর মক্কেল হল কি করে, মক্কেলের গায়ে লেখা আছে নাকি কার মক্কেল?

—আজ্ঞে ওঁর কাছেই প্রথম তারা গিয়েছিল, আমার কাছে তো আসে নি৷ তাই—

—তবেই ওঁর মক্কেল হয়ে গেল? অত সূক্ষ্ম ওজন-জ্ঞান করে মোক্তারী ব্যবসা চলে না ভায়া! হরি আমায় বলছিল, যদুদার আক্কেলটা দেখলে? ছোকরা জামিন মঞ্জুর করিয়ে দিলে—আর যদুদা দিব্যি টাকাটা গাপ করে ফেললে বেমালুম৷ ঘোর কলি! আমার পরামর্শ শোনো আমি বলি—

—আজ্ঞে কি?

—সুনীলবাবুর কোর্টে তোমার খাতির হয়ে গিয়েচে সবাই জানে৷ ইতিমধ্যে প্রচার হয়ে গিয়েচে৷ তুমি এখন যদুদার হাত থেকে কেস পেলেও ফি-এর টাকা তাঁকে দিও না৷ যদুদা চিরকাল ওই করে এলেন—যার সঙ্গে যার খাতির, তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে নাম কেনেন নিজে৷

নিধিরাম দেখিল সাধন-মোক্তারের কথায় সামান্য মাত্র সায় দিলেও আর রক্ষা নাই—ইনি গিয়া এ কথা অন্য কোথাও গল্প করিবেন৷ সে ব্যক্তি যদুবাবুর কানে কথা উঠাইলে তাহার উপর যদুবাবু চটিয়া যাইবেন৷ তাহার ব্যবসার প্রথম দিকে তাঁহার মতো প্রধান মোক্তারের সাহায্য ও উপদেশ হইতে বঞ্চিত হইলে নিজের সমূহ ক্ষতি৷ সে একটু বেশ জোরের সঙ্গেই বলিল—না সাধনবাবু—আমি তা মনে করি না, যদুবাবু খুব বিচক্ষণ মোক্তার—সত্যিকার কাজের লোক৷ আমার তিনি পিতৃবন্ধু—আমায় ছেলের মতো দেখেন৷

সাধন বিদ্রূপের সুরে বলিলেন—ছেলের মতন দেখেন—তা তো বেশ বোঝাই গেল! মুখে ছেলের মতন দেখি বললেই তো হয় না—সে রকম দেখাতে হয়—দুটো টাকার লোভ ছাড়তে পারলেন না—ছেলের মতো দেখেন!

—যাক ও নিয়ে আর—

—তুমি আমার দুটো মক্কেলের কেস কাল নাও না? আমার প্রাপ্য টাকার অর্ধেক তোমায় দেব, করবে?

—কেন করব না, বলুন! দেবেন আপনি—

নিধু একটু আশ্চর্য হইয়া গেল যে সাধন এবার তাহাকে বিবাহ সংক্রান্ত কোনো কথাই জিজ্ঞাসা করিলেন না৷

হঠাৎ সাধন বলিলেন—হ্যাঁ হে, সেদিন ওঁরা বুঝি তোমার বাড়ীতে—

—আমার বাড়ী কোথায়? লালবিহারীবাবু মুন্সেফ আছেন আমার প্রতিবেশী—তাঁর বাড়ীতে গিয়েছিলেন৷

—তুমি বাড়ী নিয়ে গিয়ে খাতির করেছিলে তো?

—হ্যাঁ তা অবিশ্যি সামান্য—আমার আর কি ক্ষমতা—

—বেশ বেশ! সেই কথাই বলচি—ভালো কথাই তো৷ তোমার সঙ্গে সুনীলবাবুর বেশ আলাপ হয়ে গিয়েচে, একথা শুনে অনেকেরই খুব হিংসে তোমার ওপর, জানো তো?

নিধু আশ্চর্য হইয়া বলিল—সে কি! এর জন্যে কিসের হিংসে?

—তুমি কেন হাকিমদের সঙ্গে আলাপ করবে, বাড়ী নিয়ে যাবে—যখন বারে এত প্রবীণ মোক্তার রয়েচে—কই, আর কারো বাড়ী তো হাকিম যায় নি?

—এসব নিয়ে কথাবার্তা হয় নাকি?

—তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে, বারের প্রবীণ মোক্তারেরা পর্যন্ত এই নিয়ে বলাবলি করচে! সবারই হিংসে৷

করুক গিয়ে৷ ভালোই তো, আমার একটু পসার হবে হয়তো ওতে৷

—না ভায়া—মক্কেল ভাঙিয়ে নিতেও পারে৷ হিংসে করে যদি তোমার পেছনে সবাই লাগে—তবে তোমার মক্কেল পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে৷ আমি তোমার হিতৈষী বলেই তোমায় বলে গেলাম৷

সাধন কি মতলবে আসিয়াছিল নিধু বুঝিতে পারিল না৷ কিন্তু তাহার মনে হইল সাধনের কথার মূলে হয়তো সত্য আছে৷ বার-লাইব্রেরীসুদ্ধ সব মোক্তার তাহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইল নাকি? নতুবা সারা সপ্তাহে সে একটি পয়সা পাইল না কেন?

শনিবার দিন সকালে বাড়ীওয়ালার লোক ও গোয়ালা আসিয়া তাগাদা দিল৷ নিধু তাহাদের বুঝাইয়া দিল, এ চাকুরি নয় যে মাসকাবারে মাহিনা হাতে আসে—টাকা দিতে দু-চার দিন বিলম্ব হইবে৷ কিন্তু বাড়ীওয়ালার লোক যেন তাড়াইল—বাড়ীতে আজ যাইবার সময় জিনিসপত্র সওদা করিয়া লইয়া যাইতে হইবে—হাতে এদিকে একটি পয়সা নাই৷ তাহার আয়ের উপরই আজকাল সংসার চলে—খরচ দিয়া না আসিলে পরবর্তী সপ্তাহে সংসার অচল৷

নিধুর মুহুরী এই সময় আসিয়া বলিল—বাবু, আজ বাড়ী যাবেন?

—তাই ভাবচি৷ কি নিয়ে যাই, একটা পয়সা তো নেই হাতে—

—মোক্তারী ব্যবসার এই মজা৷ মাঝে মাঝে এমন হবেই বাবু৷ মক্কেল কি সব সময়ে জোটে? যদুবাবুর কাছে একবার যান না?

—কোথাও যাব না৷ ওতে আরো ছোট হয়ে যেতে হয়৷ না হয় আজ বাড়ী যাব না, সেও ভালো৷

শুধু সে শনিবার নয়, পরের শনিবারেও নিধুর বাড়ী যাওয়া হইল না৷ মক্কেলের দেখা নাই আদৌ, মুদী ধারে জিনিসপত্র দেয়, তাই বাসাখরচ একরূপ চলিল, কিন্তু অন্যান্য পাওনাদারের তাগাদায় নিধু অস্থির হইয়া উঠিল৷ ইতিমধ্যে সে বাড়ী হইতে বাবার চিঠি পাইল—শনিবার বাড়ী কেন আসে নাই—সংসারে খুব কষ্ট যাইতেছে—বাড়ীসুদ্ধ লোককে অনাহারে থাকিতে হইবে যদি সে সামনের শনিবারে না আসে—আসিবার সময় যেন হেন আনে তেন আনে—জিনিসপত্রের একটা লম্বা ফর্দ পত্রের শেষে জুড়িয়া দেওয়া আছে৷ চিঠিখানা ছাড়া হইয়াছে শুক্রবার—রবিবার সকালে সে চিঠি পাইল৷ সে সম্পূর্ণ নিরুপায়—হাতে পয়সা না আসিলে বাড়ী গিয়ে লাভ কি!

.

সোমবার সে কি কাজে একবার সুনীলবাবুর কোর্টে গিয়েছিল, তাহাকে দেখিয়া সুনীলবাবু বলিলেন—নিধিরামবাবু, আপনি এ শনিবারে বাড়ী যান নি তো!

—না, একটু অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম৷

—আমি গিয়ে আপনাকে কত খুঁজলাম, তা সবাই বললে আপনি যান নি৷

—ও, আপনি গিয়েছিলেন বুঝি?

—হ্যাঁ—আমি গিয়েছিলাম মানে যাবার জন্যে বিশেষ করে পত্র দিয়েছিলেন পিসিমা—মানে লালবিহারীবাবুর স্ত্রী—আমাদের এক পাড়ার মেয়ে কিনা৷

—ও৷ আপনি একা গিয়েছিলেন?

—এবার একাই৷ সেই জন্যেই তো বিশেষ করে আপনার খোঁজ করলাম৷ কার সঙ্গে বসে দু’দণ্ড কথা বলি! লালবিহারীবাবু প্রবীণ লোক—তাঁর সঙ্গে কতক্ষণ গল্প করা যাবে—আপনি যে যাবেন না—আমার সে কথা মনেই হয় নি৷ আপনিও তো গত সপ্তাহে আমার কোর্টে একদিনও আসেন নি কিনা!

নিধু মনে মনে ভাবিল, কেস থাকিলে তো কোর্টে আসিবে৷ মক্কেল নামক জীব হঠাৎ পৃথিবীতে যে কত দুর্লভ-দর্শন হইয়া উঠিয়াছে—তাহার খবর হাকিমের চেয়ারে বসিয়া কি করিয়া রাখিবেন আপনি?

মুখে বলিল—আজ্ঞে হ্যাঁ—আমি যদি জানতাম আপনি যাচ্ছেন, তাহলে নিশ্চয় যেতাম৷ তা তো জানি না—

সন্ধ্যার সময় সুনীলবাবুর আরদালি আসিয়া নিধুর হাতে একখানি চিঠি দিল—বিশেষ দরকার, নিধিরামবাবু কি দয়া করিয়া একবার তাঁহার বাসার দিকে আসিতে পারেন?

নিধু গিয়া দেখিল বাহিরের ঘরে একা সুনীলবাবুই বসিয়া আছেন—মুন্সেফবাবু এ সময় এখানে বসিয়া আড্ডা দেন, আজ তিনি আসেন নাই৷ নিধুকে দেখিয়া সুনীলবাবু চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া বলিলেন—আসুন আসুন—সেদিন আপনাদের বাড়ী গিয়ে আদর-যত্নে বড় আনন্দ পেয়েছিলাম৷ বসুন—

নিধু লজ্জিতমুখে বলিল—আমাদের আবার আদরযত্ন! আপনাদের মতো লোককে কি আমরা উপযুক্ত আদর-অভ্যর্থনা করতে পারি? সামান্য অবস্থার মানুষ আমরা—

—ও সব বলবেন না নিধিরামবাবু৷ ওতে মনে কষ্ট পাই—বসুন, আমি দেখি চায়ের কি হল—আপনার সঙ্গে খাব বলে বসে আছি—আপনি চা খান না বুঝি আবার! একটু মিষ্টিমুখ করে—

চা ও জলযোগপর্ব চুকিয়া গেলে সুনীলবাবু বলিলেন—আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে৷

নিধু একটু বিস্মিত হইলেও মুখে তাহা প্রকাশ করিল না৷ তাহার মতো লোকের সঙ্গে কি কথা আছে একটা মহকুমার সেকেণ্ড অফিসারের, সে ভাবিয়াই পাইল না৷

—লালবিহারীবাবুকে আপনি তো ভালো করেই জানেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, তা জানি বৈকি৷ এক গাঁয়ের লোক৷ তবে উনি এবার অনেকদিন পরে গাঁয়ে এলেন৷ একবার দেখেছিলাম ছেলেবেলায়—আর এই দেখলাম এবার—বাবার সঙ্গে খুব আলাপ—

—তা তো হবেই৷ আপনার বাবাকে এ রবিবারেও দেখলাম লালবিহারীবাবুর বৈঠকখানাতেই৷ ওঁরা সমবয়সী প্রায়—

—ঠিক সমবয়সী নয়, বাবার বয়েস বেশি৷

—আচ্ছা আপনি লালবিহারীবাবুর মেয়ে মঞ্জরীকে দেখেচেন তো?

নিধু প্রায় চমকাইয়া উঠিয়া সুনীলবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—মঞ্জরী?—ও মঞ্জু! আজ্ঞে হ্যাঁ, তাকে দেখেচি বই কি, তা—

সুনীলবাবু সম্ভবত নিধুর ভাবান্তর লক্ষ্য করিলেন না৷ তিনি সহজ সুরেই বলিলেন—তাকে দেখেচেন তাহলে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ—দেখেচি বই কি৷ কেন বলুন তো?

সুনীলবাবু সলজ্জ হাসিয়া বলিলেন—সেদিন লালবিহারীবাবু ওর সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব করলেন কিনা, তাই বলচি৷

—কার বিবাহ?

—মানে আমার সঙ্গেই৷

—ও!

—আপনি কি রকম মনে করেন? মেয়েটি ভালোই—কি বলেন? আপনাদের গাঁয়ের মেয়ে, তাই জিগগেস কচ্চি৷

—ইয়ে—হ্যাঁ—ভালো বৈকি৷ বেশ ভালো৷

—অবিশ্যি আমার মতে হবে না৷ আমার বাবা কর্তা, তাঁকে জিগগেস না করে কোনো কাজ হতে পারে না৷ তাঁরা মেয়েটি দেখেচেন, কারণ একই পাড়ায় ওর মামার বাড়ী, সেখানে থেকে স্কুলে পড়ে৷ আমাদের বাড়ীও ওদের যাতায়াত আছে—তবে আমি কখনো দেখি নি—কারণ আমি থাকি বিদেশে৷ কলকাতায় থাকি আর কদিন?

—কেন, রবিবারে তাকে দেখলেন না?

—ঠিক মেয়ে দেখার উদ্দেশ্য ছিল না৷ তা ছাড়া বাবা মেয়ে না দেখে গেলে আমার দেখায় কিছু হবেও না৷ তবুও ওঁরা একবার মেয়েটিকে দেখাতে চাইলেন তাই দেখলাম৷ দেখতে ভালোই অবিশ্যি—সে আমি আগেও শুনেছিলুম৷ কিন্তু শুধু বাইরে দেখে—

নিধুর মনের ভিতর হইতে কে যেন বলিল, একথার উত্তর তাহার দেওয়া উচিত৷ মঞ্জুকে সে সব সময় সর্বত্র বড় করিয়াই রাখিতে চায়৷ কাহারও মনে তাহার সম্বন্ধে ছোট ধারণা না হয়, এটা দেখা তাহার সর্বপ্রথম কর্তব্য৷ সুতরাং সে বলিল—আজ্ঞে না, শুধু বাইরে নয়—মেয়েটি সত্যিই ভালো৷

সুনীলবাবু একটু আগ্রহের সুরে বলিলেন—আপনার তাই মনে হয়?

—আমার কেন শুধু, আমাদের গ্রামের সকলেরই তাই মত৷ সত্যিই ওরকম মেয়ে আজকাল বড় একটা দেখা যায় না—

—বেশ, বেশ৷ আপনার মুখে একথা শুনে খুব খুশি হলাম৷ দেখুন মশাই, কিছু মনে করবেন না—যার সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে হবে—তাকে অন্তত একটু যাচাই না করে নিয়ে—আমার অন্তত তাই মত৷ বাবা যা দেখবেন, সে তো দেখবেনই৷

নিধু একথায় বিশেষ কোন জবাব দিল না৷

নিধুর মনের মধ্যে কেমন এক প্রকার অব্যক্ত যন্ত্রণা৷ সুনীলবাবুর শেষ কথাটা তাহার কানে যেন অনবরত বাজিতেছিল৷ সারাজীবন মঞ্জুর সঙ্গে থাকিবেন কে, না সুনীলবাবু!

মঞ্জু সুনীলবাবুর জীবনসঙ্গিনী?

বাসায় ফিরিবার পথে সুনীলবাবু তাহার সহিত গল্প করিতে করিতে খানিকদূর পথ আসিলেন৷ শুধু মঞ্জুর সম্বন্ধেই কথা৷ নানা ধরনের আগ্রহভরা প্রশ্ন, কখনো খোলাখুলি, কখনো প্রশ্নের উদ্দেশ্য নিধুর কাছে ঠিক বোধগম্য হইল না৷

—আচ্ছা নিধিরামবাবু, মঞ্জু কিরকম লেখাপড়া জানে বলে আপনার মনে হয়?

—বেশ জানে৷ এবার তো ফার্স্ট ক্লাসে উঠবে—

—আমি তা বলচি নে—পড়াশুনোতে কেমন বলে মনে হয় আপনার? বেশ কালচার্ড?

—নিশ্চয়ই৷ হাতের লেখা কাগজ বার করবে শিগগির৷ লেখাটেখার ঝোঁক আছে, গান করে ভালো—

—গান শুনেচেন আপনি?

এখানে কি ভাবিয়া নিধু সত্যকথা বলিল না৷ তাহার সামনে বসিয়া মঞ্জু গান গাহিয়াছে, এ কথা এখানে বলিবার আবশ্যক নাই, না বলাই ভালো৷ সে বলিল—কেন শুনব না৷ দেখেচেন তো আমাদের বাড়ীর সামনেই ওদের বাড়ী৷ মাঝে মাঝে গান করে ওদের বাড়ীতে, আমাদের বাড়ী থেকে শোনা যায় বই কি৷

মোটের উপর নিধুর মনে হইল, মঞ্জুকে দেখিয়া সুনীলবাবু মুগ্ধ হইয়াছেন৷ মঞ্জুর চিন্তাই এখন তাঁহার ধ্যান-জ্ঞান—ইঁহার প্রশ্নোত্তর ও কথাবার্তা সবই এখন রূপমুগ্ধ তরুণ প্রেমিকের প্রলাপের পর্যায়ভুক্ত৷

বাসায় আসিয়া নিধু মোটেই স্থির হইতে পারিল না৷ মনের সেই যন্ত্রণাটা যেন বড় বাড়িয়াছে৷ মঞ্জু সুনীলবাবুর সারাজীবনের সাথী হইবে—একথা যেন সে কিছুতেই সহজভাবে গ্রহণ করিতে পারিতেছিল না৷

সেদিন আর রাঁধিল না৷ চাকর জিজ্ঞাসা করিল—কি খাওয়ার যোগাড় করে দেব বাবু?

—তুই দুটো পয়সা নিয়ে গিয়ে বরং চিঁড়ে কিনে আন—তাই খাব এখন৷ শরীর ভালো নয়, রান্না আজ পারব না৷

—সে কি বাবু! চিঁড়ে খেয়ে কষ্ট পাবেন কেন? আমি সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি—

—না, না—তুই যা এখন৷ আমার শরীর ভালো না—আর কিছু খাব না৷

আহারাদির পরে তিনঘণ্টা কাটিয়া গেল৷ রাত প্রায় একটা৷ নিধু দেখিল সে মাথামুণ্ডু কি যে ভাবিতেছে! নানা অদ্ভুত চিন্তা! জীবনে সে কখনো এরকম ভাবে নাই৷

গভীর রাত্রে ঠাণ্ডা হাওয়ায় তাহার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক একটু শীতল হইল৷ আচ্ছা, সে এত রাত পর্যন্ত কি ভাবিয়া মরিতেছে? কেন তাহার চক্ষে ঘুম নাই? মঞ্জু যাহারই জীবনের সাথী হউক—তাহার তাহাতে আসে-যায় কি?

আজ একটি সপ্তাহের মধ্যে যে একটি পয়সা আয় করিতে পারে নাই—তাহার পক্ষে মঞ্জুর চিন্তা করাও অন্যায়৷ কখনো কি সম্ভব হইবে মঞ্জুকে তাহার জীবনসঙ্গিনী করা!

আকাশকুসুমের আশা ত্যাগ করাই ভালো৷

মঞ্জুর বাপ-মা তাহার সঙ্গে কখনো কি মঞ্জুর বিবাহ দিবেন বলিয়া সে ভাবিয়াছিল? সে নিজের মনের মধ্যে ডুবিয়া দেখিল, এমন কোনো দুরাশা তাহার মনে কোনোদিনই জাগে নাই৷ তবে আজ কেন সে সুনীলবাবুর কথায় এত বিচলিত ও উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে? মঞ্জুর সঙ্গে মুখের আলাপ আছে মাত্র৷ ইহার অতিরিক্ত অন্য কিছুই নয়৷

অপরপক্ষে মঞ্জু বড়মানুষের মেয়ে—সে লালিত হইয়াছে সচ্ছলতার মধ্যে, প্রাচুর্যের মধ্যে, অন্য ধরনের জীবনের মধ্যে৷ সুনীলবাবুর সঙ্গে বিবাহ হইলে মঞ্জু জল হইতে ডাঙায় পড়িবে না—নিজেদের শ্রেণীর মধ্যেই সে থাকিতে পারিবে৷ চিরাভ্যস্ত জীবনযাত্রায় জোর করিয়া পরিবর্তন নিতান্ত আবশ্যক হইয়া পড়িবে না৷

সুনীলবাবুর ঘরে সে মঙ্গলময়ী গৃহলক্ষ্মীরূপে—

না, কথাটা ভাবিতে গেলে আবার যেন বুকের মধ্যে খচ করিয়া বাজে৷

.

পরদিন সকালে জন-দুই মক্কেল আসিল৷ ধানের জমি লইয়া মারপিটের মোকর্দমা, তবে নিধুর মনে হইল ইহারা যাচাই করিয়া বেড়াইতেছে কোন মোক্তারের কত দর—শেষ পর্য্যন্ত যদুবাবুর কাছে গিয়াই ভিড়িবে৷

নিধু নিজের দর কিছুমাত্র কমাইল না—কিন্তু বিস্ময়ের সহিত দেখিল, লোক দুটি তাহাকেই মোক্তার নিযুক্ত করিল৷ ঘণ্টাখানেক ধরিয়া তাহাদের লইয়া ব্যস্ত থাকিবার পর নিধু বলিল—তোমরা যাও, বাজার থেকে খাওয়া-দাওয়া সেরে এস—প্রথম কাছারীতেই তোমাদের মোকর্দমা রুজু করে দেব—আমার টাকা আর কোর্টের খরচটা দিয়ে যাও—

—কত ট্যাকা বাবু?

—এই যে বললাম সবসুদ্ধ চারটাকা সাড়ে ন’আনা—

—বাবু, ট্যাকা কাছারীতেই দেবানু—

—না বাপু, ওসব দেবানু-টেবানু শুনচিনে—টাকা দিয়ে যাও—ডেমি কিনতে হবে, আর্জির স্ট্যাম্প কিনতে হবে—সে-সব কে কিনবে ঘরের পয়সা দিয়ে?

—বাবু, এখন তো মোদের কাছে নেই—

—কাছে নেই তো মোকর্দমা করতে এসেচ কেন মরতে? জানো না যে রামনগরে এলেই পয়সা সঙ্গে করে আনতে হয়?

—তবে বাবু যদি আপনি একটা ঘণ্টা সময় দেন—প্রথম কাছারীতেই মোরা ট্যাকা দেবানু—ট্যাকা না পেলে আপনি মোদের মোকর্দমা করবেন না—

ইহারা চলিয়া কিছুদূর যাইবার পরেই আরও জনচারেক মক্কেল আসিয়া হাজির হইল৷ তাহাদের সহিত কথা কহিয়া নিধু বুঝিল—ইহারা পূর্বের মারপিটের মোকর্দমারই ফরিয়াদি পক্ষ৷ ইহারাই মার খাইয়াছে৷ একজন প্রহৃত ব্যক্তি মাথায় লাঠির দাগসমেত আসিয়াছে৷

ইহাদের মোড়ল বলিল—বাবু, আমাদের হক মোকর্দমা—মাথায় এই দেখুন লাঠির দাগ—ট্যাকা যা লাগে আপনাকে দেবানু—এখুনি এই পাঁচটা টাকা রাখুন আপনি—মোকর্দমার এজাহারটা করিয়ে দিন—

যদিও ইহাদের কথাবার্তা শুনিয়া নিধুর মনে হইল ইহারাই ঠিক কথা বলিতেছে—টাকাও দিতে এখুনি প্রস্তুত—তবুও নিধু দুঃখিতচিত্তে বলিল—বাপু, আমি অপরপক্ষের কেস নিয়ে ফেলেচি—তোমাদেরটা নিতে পারব না—

—বাবু, আপনি যা লাগে নেন মোদের কাছ থে৷ ক’ট্যাকা দিতে হবে বলুন আপনারে, মোরা দিয়ে যাই৷ মোদের গাঁয়ের একটা মোকর্দমায় আপনি জামিন করিয়ে দিয়েছিলেন—বড্ড সুখ্যাতি পড়ে গিয়েচে৷ মোক্তার যদি দিতে হয় তবে আপনারেই দেব—

—না, সে হবে না৷ আমি তাদের কথা দিয়েচি—

নিধুর মুহুরী আড়ালে ডাকিয়া লইয়া বলিল—নিয়ে ফেলুন ওদের কেস বাবু, মনে হল পয়সা দেবে—পয়সা হাতে আছে এদের৷ অপরপক্ষ তো আপনাকে টাকা দেয়নি, তবে কিসের বাধ্য-বাধকতা তাদের সঙ্গে?

—না হে, যখন কথা দিয়ে ফেলেচি, কেস নেব বলেচি—তখন কি আর টাকার লোভে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ানো চলে?

—টাকা পেলে না হয় সে কথা বলতে পারতেন বাবু—কিন্তু টাকা তো আপনি হাত পেতে নেননি তাদের কাছে?

—ও কি একটা কথা হে! মুখের কথা টাকার চেয়েও বড়—

—বাবু, এ মহকুমায় এমন কোনো উকিল-মোক্তার নেই যিনি এমনধারা করেন৷ মক্কেল টাকা দিলে না তো কিসের মক্কেল?

—না, সে আমার দ্বারা হবে না৷ অপরে যা করেন, তাঁদের খুশি৷ আমি তা করতে পারব না—

অগত্যা ইহারা চলিয়া গেল৷ কিন্তু কোর্টে গিয়া নিধু সবিস্ময়ে শুনিল ধরণী-মোক্তার পূর্ব-পক্ষের মোকর্দমা রুজু করিতে সুনীলবাবুর কোর্টে ছুটিতেছেন৷

নিধুর মুহুরীই বলিল—দেখলেন বাবু, বললাম তখন আপনাকে! ধরণীবাবুকে ওরা মোক্তার দিয়েচে—আপনার কাছে যাচাই করতে এসেছিল—টাকার কথা বলতেই পিছিয়ে পড়েচে—

—এ তো ভারি অন্যায় কথা৷ ধরণীবাবুই বা আমার কেস নিতে গেলেন কেন?

—ওরা তো ধরণীবাবুকে আপনার কথা কিছু বলে নি? তিনি হয়তো কম টাকাতে রাজী হয়েচেন—

—ওদের একজনকে আমার কাছে ডেকে আনতে পার?

—তারা বাবু আসবে না৷ আমি কত খোশামোদ করলাম ওদের৷ ধরণীবাবু মোক্তার-নামায় সই করেচেন—তাঁর মুহুরী ডেমি লিখে ফেলেচে—

—এ পক্ষ?

—তারা যদুবাবুকে মোক্তার দিয়েচে৷ যদুবাবু সাবডেপুটিবাবুর এজলাসে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর মক্কেল নিয়ে—

—এ কিরকম ব্যাপার হল হে?

—এই রকমই হয় এখানে৷ আপনি নতুন লোক, এসব জানবেন কোথা থেকে? তাই তো তখন আপনাকে বললাম, ওদের টাকা নিয়ে ফেলুন—

—টাকার জন্যে একটা অন্যায় কাজ আমি তো করতে পারিনে৷ তাহলেও ধরণীবাবুকে আমি একবার বলব—

—বলবেন না বাবু, তাতে উল্টে ধরণীবাবু ভাববেন মক্কেলের জন্যে আমার সঙ্গে ঝগড়া করচে৷ সেটা বড় খারাপ দেখাবে৷ ধরণীবাবুর তো কোনো দোষ নেই—তিনি না জেনেই কেস নিয়েচেন৷ আমার কথাটা শুনবেন বাবু, এই কাজ করে করে আমার মাথার চুল পেকে গেল—এখানে মোক্তারে-মোক্তারে কমপিটিশন—উকিলে-উকিলে কমপিটিশন—যিনি যত কম হাঁকবেন, টাকা বাকি রাখবেন, তাঁর কাছে তত মক্কেল যাবে৷

—তাহলে তুমি কি ভাব না যে ধরণীবাবু আমার মক্কেল ভাঙিয়ে নিয়েচেন?

—মোক্তারনামায় সই যখন করেন নি, টাকা তারা যখন দেয় নি—শুধু মুখের কথায় কি কেউ কারো মক্কেল হয় বাবু? আপনি মুখের কথার দাম দিলেন, আর কেউ যদি না দেয়? সবাই কি আপনার মতো? সত্যি কথায় এসব লাইনে কাজ হবে না বাবু, সে আপনাকে আমি আগেই বলেচি৷ মফঃস্বলে সর্বত্রই এই অবস্থা দেখবেন৷

বারের মধ্যে নিধুর বয়সী আর একজন ছোকরা মোক্তার ছিল৷ তাহার নাম নিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়—সেও নিধুর মতোই গরীব গৃহস্থ পরিবারের ছেলে—নিধু তবুও কিছু-কিছু উপার্জন করিত—সে বেচারীর অদৃষ্টে তাহাও জুটিত না—বেচারী তাহার মাসীমার বাড়ী থাকিয়া মোক্তারী করে বলিয়া অনাহারের কষ্টটা ভোগ করিতে হয় না—কিন্তু কিছু করিতে পারিতেছে না বলিয়া তাহার মন বড় খারাপ৷ নিধুর কাছে মাঝে মাঝে সে মনের কথা বলিত৷ নিধুর মনে খুব দুঃখ হইয়াছিল এই ব্যাপারে—সে নিরঞ্জনের কাছে ঘটনাটি সব বলিল৷

নিরঞ্জন হাসিয়া বলিল—তোমার মতো লোকের মোক্তারী করতে আসা উচিত হয়নি নিধিরাম—

—কেন হে! কি দেখলে আমার অনুপযুক্ততা!

—এত সরল হলে এ ব্যবসা চলে? যে কোনো ঘুঘু মোক্তার হলে কৌশলে তার কাছে টাকা বার করে নিতো!

—আমি ভেবেচি যদুকাকাকে কথাটা বলব৷ তিনি কেন আমার মক্কেল নিলেন?

—তোমার কথা শুনে আমার হাসি পাচ্ছে হে! ছেলেমানুষের মতো কথা বলচ যে! একথার মানে হয়? মক্কেলের গায়ে কি নামের ছাপ আছে নাকি? শোনো আমার পরামর্শ, যদুবাবু তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী—তাঁকে মিথ্যে চটিও না৷ তুমি তবুও কিছু-কিছু পাও—আমার অবস্থাটা ভেবে দেখো তো? মাসীমার বাড়ী না থাকলে না খেয়ে মরতে হত—

—আর ব্যবসা চলে না—অচল হয়েচে ভাই৷ এক পয়সা আয় নেই আজ দু-হপ্তা—

—দু-হপ্তা তো ভালো৷ আমি তোমার এক বছর আগে বসেচি, এ পর্যন্ত তেত্রিশ টাকা মোট উপার্জন হয়েচে৷ তবুও ভাবচি, ভবিষ্যতে হতে পারে—নইলে কোথায় যাব?

—বুড়োগুলো না ম’লে আমাদের কিছু হবে না৷ যদুবাবু, ধরণীবাবু, শিব ভটচাজ, হরিহর নন্দী—এগুলো পলাশীর যুদ্ধের বছর জন্মে আজও বার জুড়ে বসে আছে! এরা সরলে তবে যদি আমাদের—তা সবাই অশ্বত্থামার পরমায়ু নিয়ে এসেচে—

—সেই ভরসাতেই থাক—ওহে, একটা কথা শুনেছ?

—কি?

—সাধনবাবু নাকি ওর ভাইঝির সঙ্গে সাবডেপুটিবাবুর বিয়ের চেষ্টা করচে—

নিধু আশ্চর্য হইয়া বলিল—সে কি!

নিরঞ্জন হি-হি করিয়া হাসিয়া বলিল—সে বড় মজা! সাধন-মোক্তার আর তার মামা দুর্গাপদ ডাক্তার দু’জনে গিয়ে আজ সকালে সুনীলবাবুর বাসায় খুব ধরাধরি করেচে—আজ ওবেলা বাড়ীতে চায়ের নেমন্তন্ন করেচে—উদ্দেশ্য মেয়ে দেখানো৷

—তুমি জানলে কি করে?

—দুর্গাপদ ডাক্তারের ছেলে আমার ক্লাসফ্রেণ্ড, সে বলছিল—সে আবার একটু বোকা মতো, তার বিশ্বাস এ বিয়ে হয়ে যাবে৷ মেয়ে নাকি ভালো৷

নিধু আপন মনেই বলিল—ও, তাই!

—তাই কি?

—কিছু না, এমনি বলচি—

—আমি একটা কথা বলি শোনো৷ সিরিয়াসলি বলচি৷ তুমি বার ছেড়ো না, তোমার হবে৷ তোমার মধ্যে ধর্মজ্ঞান আছে, তোমার ধরনের মোক্তার বারে নেই৷ বুড়োগুলো সব বদমাইস, স্বার্থপর৷ তোমার অনেষ্টি আছে, বুদ্ধিও আছে, তুমি এরপরে নাম করবে, তোমার গুণ বেশিদিন চাপা থাকবে না৷

—বই নেই যে?

—বরাত ভাই, সব বরাত—নইলে সি. ডবলিউ. এন. আর. সি. এল. জে-র লাইব্রেরী নিয়ে বসে থাকলেও কিছু হয় না৷ যদুবাবু বা হরিহর নন্দী এরা ইংরিজি পড়ে বুঝতে পারে না, সেকালের ছাত্রবৃত্তি পাশ মোক্তার—ওদের হচ্চে কি করে? তবে আমাকে বোধ হয় শিগগির ছাড়তে হবে—

—ছাড়বে কেন? বুড়োগুলো মরুক—অপেক্ষা কর—

—ততদিনে আমার বাড়ীর সব না খেয়ে মরে যাবে—বিষয়সম্পত্তি বেচে চলচে এখন—

—যদুকাকাকে বলে তোমায় দু’চারটে জামিননামা দেব—জামিনের ফি’টা পাবে এখন৷

—তোমার নিজের পেলে তাতে উপকার হবে—তুমি আমায় দেবে কেন?

—যদি আমি দিই—

—সেই জন্যেই তো বলচি৷ তোমার মতো অনেস্ট লোক বারে আসে নি—অন্তত রামনগরের বারে৷ তুমি অনেক দূর যাবে—

নিধু বাসায় আসিবার পথে সাধন-মোক্তারের কাণ্ডটা ভাবিয়া আপন মনেই হাসিল৷ তাই আজকাল তাহার সঙ্গে এতবার দেখা হওয়া সত্বেও বিবাহের কথা একবারও মুখে আনে না—এখন বড় গাছে বাসা বাঁধিবার দুরাশায় তাহার মতো নগণ্য জুনিয়ার মোক্তারের কথা ভুলিয়াই গেল বেমালুম৷ ভালোই হইয়াছে—নতুবা একে পয়সার টানাটানি—তাহার উপর সাধন-বুড়োর বিবাহের ঘটকালির উৎপীড়নে ও তাগাদায় তাহাকে রামনগর ছাড়িয়া পলাইতে হইত এতদিন৷ সপ্তাহের বাকি দিনগুলিও ক্রমে কাটিয়া আসিল৷ একটি মক্কেলও আসিল না৷

.

আশ্বিন মাসের প্রথম সপ্তাহ৷ পূজা আসিয়া পড়িল৷ রামনগরে পূজাকমিটি দু’দিন মিটিং করিল, তাহার পাঁচ টাকা চাঁদা ধরিয়াছে—তাহার নামে চিঠিও আসিয়াছে৷ এদিকে বাড়ীওয়ালা তাগাদার উপর তাগাদা করিয়া হয়রান হইয়া গেল—এখনও ভদ্রতা দেখাইয়া চলিতেছে বটে—কিন্তু পূজার ছুটির আগেও যদি টাকা না দিতে পারে—তবে হয়তো বাড়ী ছাড়িবার নোটিশ আসিয়া হাজির হইবে একদিন৷

শনিবার৷

আগের দিন যদু-মোক্তারের অনুগ্রহে একটা জামিনের ফি পাওয়া গিয়াছে—আরও অন্তত দুটি টাকা হইলে আজ বাড়ী যাওয়া চলে৷ নইলে শুধুহাতে বাড়ী গিয়া লাভ কি?

বার-লাইব্রেরীতে বসিয়া বসিয়া নিধু ফন্দি আঁটিতেছে—কি উপায়ে তাহার মুহুরীর কাছে দুটি টাকা ধার লওয়া যায়—কারণ নিধুর অপেক্ষা তাহার মুহুরীর অবস্থা ভালো—বাড়ীতে জায়গা জমি, চাষবাস—এখানেও তাহার দাদা স্ট্যাম্পভেণ্ডারি করিয়া এই কোর্টের প্রাঙ্গণ হইতেই মাসে দেড়শ-দুশ টাকা রোজগার করে—দুটি টাকা দিতে তাহার কষ্ট হইবার কথা নয়—কিন্তু বাবু হইয়া ভৃত্যের কাছে সোজাসুজি টাকা ধার করা চলিবে না—কোনো একটা কৌশল খাটাইতে হইবে৷

এমন সময় সাধন-মোক্তার ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া বলিলেন—এই যে নিধু, বসে আছ! ওহে একটা জামিনের দরখাস্ত মুভ করবে? তিনটে টাকা পাবে যদি মঞ্জুর করে দিতে পার৷ মক্কেলের সঙ্গে আমি ঠিক করে ফেলেচি৷ ছেলে আসামী, বাপ টাকা দিয়ে কেস চালাচ্চে, টাকা নির্ঘাত আদায় হবে৷

নিধু নির্বোধ নয়—সাধন-মোক্তারের আসল উদ্দেশ্য সে বুঝিয়া ফেলিল৷ বুঝিয়া জিজ্ঞাসা করিল—কার কোর্টের কেস?

—সাবডেপুটির কোর্টে৷

এই কথাই নিধু ভাবিয়াছিল৷ শক্ত কেসের আসামী, জামিন সহজে মঞ্জুর হইবার সম্ভাবনা কম, সুনীলবাবুর সঙ্গে আজকাল নিধুর খাতির জমিতেছে একথা বারে রাষ্ট্র হইতে দেরি হয় নাই৷ তাহার খাতিরের চাপে যদি জামিন মঞ্জুর হইয়া যায়—জামিননামা সই করিয়া শতকরা সাড়ে বারো টাকা জামিনের ফি মারিবেন সাধন-মোক্তার৷

সে বলিল—কত টাকার জামিন হবে মনে হয়?

—যা মঞ্জুর করাতে পার—পাঁচশ টাকার কম হবে বলে মনে হয় না৷

অনেকগুলি টাকা জামিনের ফি৷ সাধন-মোক্তার তাহাকে ভাগ দিবে না বা তাহার চাওয়াও উচিত নয়—তবে সে যদি জামিন মঞ্জুর করাইতে পারে—সে নিজেই জামিন দাঁড়াইবে না কেন? কথাটা সে বলিয়াই ফেলিল৷ সাধন বিস্ময়ের ভান করিয়া বলিলেন—তুমি জামিন দাঁড়াবে অত টাকার? বড্ড রিসক! তারপর ধর যদি পালিয়ে-টালিয়ে যায়—বেলবণ্ড বাজেয়াপ্ত হলে অতগুলো টাকা গুনোগার দিতে হবে—

—তা সে তখন পরে দেখা যাবে—

—না হে না—আমি তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী, আমি তোমায় সে রিসকের মধ্যে যেতে দিতে পারি নে—এ লোকটা বদমাইশ, যদি পালিয়ে যায় তোমাদের মতো জুনিয়র মোক্তারের এখন এসব বিপদের মধ্যে যাওয়া ঠিক নয়৷

নিধু আর বেশি কিছু বলিতে পারিল না—টাকার ভাগ লইয়া প্রবীণ সাধন-মোক্তারের সঙ্গে ইতরের মতো তর্কাতর্কি করিতে তাহার প্রবৃত্তি হইল না৷ সে শুধু বলিল—বেশ, তাই হবে৷ তবে জামিন মুভ করার ফি আমায় কিছু বেশি করিয়ে দেন, তিন টাকায় পারব না—

সাধন নিধুর দিকে চাহিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিলেন—বল কি হে! জুনিয়র মোক্তারেরা কেন, অনেক সিনিয়র মোক্তার দু-টাকায় এ কেস করবে—তুমি বেশি পাচ্চ শুধু আমার বলা কওয়ায়, নইলে যদুদা বা হরিবাবু রয়েচেন কি জন্যে? তোমায় স্নেহ করি বলে আমি ওদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তোমার কাছে নিয়ে আসচি—ভাবলাম—যদি পায় তো, আমাদের আপনার লোকেই টাকাটা পাক—

নিধুর রাগ হইল৷ সাধন সবদিক হইতেই তাহাকে ফাঁকি দিতে চাইবেন—এ তাহার পক্ষে অসহ্য৷ সে দৃঢ় কণ্ঠে বলিল—আজ্ঞে না, আমি পাঁচ টাকার কমে পারব না—আপনি আসামীদের বলে দেবেন—

—সে কি হে! তুমি আবার ফি ডিকটেট করতে আরম্ভ করলে নাকি?

—আজ্ঞে মাপ করবেন৷ আমি ওর কমে পারব না—আর একটা কথা, ফিয়ের টাকা আগাম দিতে হবে—

—নাঃ, তোমাদের মতো ছোকরাদের নিয়ে দেখচি মহাবিপদ! তোমরা বুঝলেও বুঝবে না৷ তা নিও, তাই নিও৷ কি আর করব? আপনার লোকের মতো দেখি তোমাকে—

.

সুনীলবাবুর এজলাসে জামিন মঞ্জুর করাইতে বেলা তিনটা বাজিয়া গেল৷

তাহার সাফল্য দেখিয়া হয়তো বা কোনো-কোনো প্রবীণ মোক্তার কিছু ঈর্ষান্বিত হইয়া উঠিবেন ভাবিয়া নিধু এজলাসে উপস্থিত হরিহর নন্দীর কাছে গিয়া বলিল—হরিবাবু, কোনো ভুল করি নি তো?

হরিহর মোক্তার বলিলেন—কেন ভুল করবে? চমৎকার সওয়াল জবাব—

নিধু বিনীতভাবে বলিল—আপনাদের কাছেই শিখেছি হরিদা৷ আপনাদের দেখে-দেখেই শেখা—এখন আশীর্বাদ করুন—

হরিহর নন্দী অতিমাত্রায় উৎফুল্ল হইয়া বলিলেন—না, না, আশীর্বাদ তোমায় কি করব—তুমি ব্রাহ্মণ, ওকথা বলতে নেই৷ তোমরা ছেলে-ছোকরা তাই বোঝ না৷ তোমরা আমাদের প্রণম্য—তবে তোমার কল্যাণ কামনা করচি, উন্নতি তুমি একদিন করবে—

কোর্ট হইতে চলিয়া আসিবার সময় সুনীলবাবু বলিলেন—নিধিরামবাবু আজ দেশে যাবেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ—

—আমার খাসকামরায় একবারটি আসেন যদি, একটা কথা আছে—

কোর্টে উপবিষ্ট অনেকগুলি তরুণ ও প্রবীণ মোক্তারের ঈর্ষান্বিত দৃষ্টির সম্মুখে নিধু ত্রস্তপদে সুনীলবাবুর খাসকামরায় প্রবেশ করিল৷

সুনীলবাবু বলিলেন—আপনার সঙ্গে একটা চিঠি দেব৷

—বেশ, দিন না—আমি দেব এখন৷

—আর একটা কথা—আপনি সাধনবাবুকে কতটা জানেন?

—ভালোই জানি৷ কেন বলুন তো স্যর?

—উনি লোক কেমন?

—লোক মন্দ নয়৷

সুনীলবাবু একটু ভাবিয়া বলিলেন—তাই জিগগেস করচি৷ আচ্ছা, আপনি সোমবারে আসুন, একটা কথা বলব আপনাকে৷

—বেশ, স্যর৷

—লালবিহারীবাবুকে আমার প্রণাম জানাবেন—আর আপনি তো বাড়ীর মধ্যে যান, পিসিমাকে বলবেন সামনের শনিবারে আমায় নেমন্তন্ন করেচেন, কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আসবেন সেদিন—দু’দিন থাকবেন—সুতরাং কোথাও যাওয়া-আসা যাবে না৷ আপনারও যাওয়া হবে না৷

—আমার? কেন?

—আপনার সঙ্গে ইণ্টারভিউ করিয়ে দেব ম্যাজিস্ট্রেটের৷

—আমার মতো লোকের সঙ্গে ইণ্টারভিউ!

—এসব ভালো৷ আপনার পসারের পক্ষে এগুলো বড় কাজের হবে৷

—আপনার যা ইচ্ছে, স্যর৷

.

শনিবারে কোর্ট বন্ধ হইতে চারিটা বাজিল৷ নিধু সঙ্গে সঙ্গে বাসায় আসিয়া কোর্টের পোশাক ছাড়িয়া সাধারণ পোশাক পরিয়া কিছু খাইয়া লইল৷ পরে বাসার চাবি চাকরের হাতে দিয়া কুড়ুলগাছি রওনা হইল৷

এতদিন সে ভাবিবার অবসর পায় নাই৷ নানা গোলমালে দিন কাটিয়াছে৷ জামিন মুভ করিবার ফি না পাইলে আজ বাড়ী যাওয়াই ঘটিত না৷ এতদূর রাস্তা হাঁটিয়া বাড়ী পৌঁছিতে সন্ধ্যা হইয়া যাইবে৷ তা হইলেই বা কি! মঞ্জুর সঙ্গে সে আর দেখা করিবে না৷ তাহার সঙ্গে মঞ্জুর আর দেখাশোনা হওয়া ভুল৷ দু’দিন পরে সে পরস্ত্রী হইতে চলিয়াছে—এখন তাহার সঙ্গে মেলামেশা মানে কষ্ট ডাকিয়া আনা৷ অতএব আর গিয়া সে মঞ্জুর সহিত দেখা করিবে না—মিটিয়া গেল৷ কিন্তু সে যতই গ্রামের নিকট আসিতেছিল—তাহার সঙ্কল্পের দৃঢ়তা সম্বন্ধে নিজের মনেই সন্দেহ জাগিল৷ মঞ্জুকে না দেখিয়া থাকিতে পারিবে তো? কেন পারিবে না? কতদিনেরই বা আলাপ? খুব পারিবে এখন৷ পারিতেই হইবে৷

নিধুর মা বলিলেন—বাবাঃ, কি ছেলে তুমি! এতদিন পরে মনে পড়ল?

—কি করি বল? এক পয়সা রোজগার নেই, এসে কি করব?

—না-ই বা থাকল রোজগার৷ তোকে দেখতে ইচ্ছে করে না আমাদের? কালী, জল নিয়ে আয়৷

নিধু হাত ধুইয়া খাবার খাইয়া মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া গল্প করিতে লাগিল৷ হঠাৎ নিধুর মা মনে পড়িয়া যাওয়ার সুরে বলিয়া উঠিলেন—ভালো কথা, তোকে যে মঞ্জু কতবার ডেকে পাঠিয়েছিল! আগের দু’শনিবারও ঠিক সন্দের আগে লোক পাঠিয়েচে খোঁজ নিতে তুই এসেচিস কিনা৷ একবার গিয়ে দেখা করিস সকালে৷ আজ বড্ড রাত হয়ে গেল৷

কথা ভালো করিয়া শেষ হয় নাই, এমন সময় বাহির হইতে নৃপেনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল—ও কালী, ও পুঁটি দিদি, নিধুদা আসে নি?

নিধু তাড়াতাড়ি বাহিরে গিয়া বলিল—এই তো এলাম৷ এস, এস, ভালো আছ নৃপেন?

—আমি আসব না, আপনি আসুন নিধুদা৷ বাবাঃ, আপনাকে খুঁজে খুঁজে—

—এত রাত্রে যাব? নটা সাড়ে নটা হবে যে!

—দিদি পাঠিয়ে দিলে দেখতে আপনি এসেচেন কিনা—

—কিন্তু নিয়ে যেতে তো বলে নি! কাল সকালে যাব—

—আসুন আপনি—কিছু রাত হয় নি৷ আমাদের বাড়ীর খাওয়া-দাওয়া মিটতে রাত বারোটা বাজে রোজ৷ এখন আমাদের সন্দে৷

মঞ্জু অনেক অনুযোগ করিল৷ এতদিন কি হইয়াছিল—গ্রামের কথা কি এমন করিয়া ভুলিতে হয়? কি হইয়াছিল তাহার?

নিধু বলিল—পয়সার অভাব মঞ্জু৷ বাড়ীভাড়া দিতে পারি নি বলে দুবেলা তাগাদা সইচি৷ কি করে বাড়ী আসি বল! কথাটা ঝোঁকের মাথায় বলিয়া ফেলিয়াই নিধু ভাবিল টাকা-পয়সা বা নিজের কষ্ট-দুঃখের কথা মঞ্জুর কাছে বলা উচিত হয় নাই৷ কিন্তু নিধুর উক্তি মঞ্জুর মুখে কেমন এক পরিবর্তন আনিল৷ সে সহানুভূতির সুরে বলিল—সত্যি নিধুদা?

—মিথ্যে বলব কেন?

—আপনি চলে এলেন না কেন? টাকা আমি দিতাম—আমায় বললেন না কেন এসে, মঞ্জু, আমার টাকার দরকার—দাও৷

সেখানে অন্য কেহ তখন ছিল না—থাকিলে মঞ্জু একথা বলিতে পারিত না৷ নিধু বলিল—কেন তোমাকে অনর্থক বিরক্ত করব?

মঞ্জু তীব্রকণ্ঠে বলিল—অনর্থক বিরক্ত করা ভাবেন এতে নিধুদা? বেশ তো আপনি?

মঞ্জুর রাগ দেখিয়া নিধু অপ্রতিভ হইল—কিন্তু পরক্ষণেই তাহার কথার মধ্যে একটা অভিমানের সুর আসিয়া পৌঁছিয়া গেল৷ সে বলিল—সে জন্যে না মঞ্জু৷ তোমার টাকা নেব—তারপর পুজোর পর এখান থেকে চলে যাবে তোমরা, টাকাটা শোধ দিতে হয়তো দেরি হবে—

—এ ধরনের কথা আপনি বললেন আমায়! বলতে পারলেন আপনি!

—কেন পারব না? তোমার সঙ্গে আর দেখা করা উচিত নয় আমার—জানো মঞ্জু?

মঞ্জু বিস্ময়ের সুরে বলিল—কেন?

—জানো না, কেন? আর দু’দিন পরে তোমরা চলে যাবে এখান থেকে৷ আবার হয়তো আসবে না কতদিন—হয়তো দু-দশ বছর! আমরা সামান্য অবস্থার মানুষ—বিদেশে যাওয়ার পয়সা নেই—দেখাই হবে না আর!

—ওঃ, এই! নিশ্চয়ই দেখা হবে৷ আমরা আসব মাঝে মাঝে৷

—তাতে কি? তোমার আর কতদিন, দু’দিন পরে পরের ঘরে চলে গেলেই ফুরিয়ে গেল!

—কেন নিধুদা, এসব কথা আপনার মাথার মধ্যে আজ এল কেন শুনি?

—কারণ না থাকলে কার্য হয় না৷ ভেবে দ্যাখ—

মঞ্জু ব্যস্তসমস্ত আগ্রহে বলিল—কি হয়েছে নিধুদা? কি অন্যায় করে ফেলেচি আমি? এমন কি কথা—

—আমি কিছু বলতে চাইনে৷ তুমি বুদ্ধিমতী—বুঝে দেখ—

মঞ্জু অল্প কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলিল—বুঝেচি নিধুদা৷

—ঠিক বুঝেচ?

—হ্যাঁ৷

—তবেই ভেবে দ্যাখ, তোমার সঙ্গে আর আমার দেখা হওয়া উচিত মঞ্জু? তুমি বড়লোকের মেয়ে—ভুলে যাবে, কিন্তু আমি গরীব জুনিয়র মোক্তার—আমার প্রথম জীবনে যদি উৎসাহ ভেঙে যায়—উদ্যম নষ্ট হয়ে যায়—আর কিছু করতে পারব না বার-এ৷ সব ফিনিশ—

মঞ্জু নিরুত্তর রহিল৷ নিধু চাহিয়া দেখিল, তাহার বড় বড় চোখ দুটি জলে টসটস করিয়া আসিতেছে—এখনি বুঝি বা গড়াইয়া পড়িবে৷

নিধু বলিল—রাগ আমি করি নি, তোমার কোনো দোষ নেই তাও আমি জানি৷ দোষ আমারই, আমারই বোঝা উচিত ছিল—ভুল আমার৷

মঞ্জু এবারও কিছু বলিল না, নতমুখে সিমেন্টের মেঝের দিকে চাহিয়া রহিল৷ নিধু বলিল—ও কথা আর তুলব না, থাক গে৷ তোমাদের প্রতিমা কই মঞ্জু? পুজো তো এসে গেল?

মঞ্জু জলভরা চোখে নিধুর দিকে চাহিল৷ কোনো একটা অন্যায় কাজ করিয়া ফেলিলে ছোট মেয়ে বকুনি খাইবার ভয়ে যেমনভাবে গুরুজনের দিকে চায়—মঞ্জুর চোখে তেমনি মিনতি মাখানো ভয়ের দৃষ্টি৷ যেন সে এখনি বলিয়া ফেলিবে—যা হয়ে গিয়েচে, হয়ে গিয়েচে—আমায় আর বকো না তুমি!

নিধুর মন এক অপরূপ দয়া ও সহানুভূতিতে ভরিয়া উঠিল৷

তাহার কপালে যাহাই থাক—এই সরলা করুণাময়ী বালিকাকে সকল প্রকার ব্যথা ও লজ্জার হাত হইতে বাঁচাইয়া লইয়া চলাই যেন তাহার জীবনের কাজ৷

সে বলিল—বললে না, প্রতিমা হচ্চে না কেন? পুজো হবে না?

—প্রতিমা এখানে হচ্ছে না তো৷ দেউলে-সরাবপুরের কুমোরবাড়ী ঠাকুর গড়া হচ্চে—সেখান থেকে দিয়ে যাবে৷

—তোমরা সেই প্লে করবে তো?

—আপনি যে রকম বলেন—

মঞ্জু যেন হঠাৎ ভরসাহারা ও অসহায় হইয়া পড়িয়াছে৷ যে মঞ্জু চিরকাল হুকুম করিতে অভ্যস্ত, নিজের ইচ্ছার পথে কোনো বাধা যে কোনোদিন পায় নাই, বাপ-মায়ের আদরের মেয়ে বলিয়াও বটে, সচ্ছল অবস্থার মধ্যে লালিত-পালিত বলিয়াও বটে—আজ যেন সে তাহার সমস্ত কাজের জন্যে নিধুর পরামর্শ খুঁজিতেছে৷ নিধু মঞ্জুর করিলে তবে যেন সে কাজে উৎসাহ পাইবে৷ একথা ভাবিতেই নিধুর মন আবার যেন সতেজ হইয়া উঠিল, মধ্যের দুঃখ ও অবসাদের ভাবটা কাটিয়া গেল৷

—তা তুমি কর না মঞ্জু, আমি পেছনে আছি—

—পেছনে থাকলে চলবে না, আপনাকে পার্ট নিতে হবে—

—যদি বল, তাও নেব৷

—আপনি পার্ট নেবেন না, প্লে-র মধ্যে থাকবেন না শুনলে আমার ওতে আর মন যায় না, উৎসাহ চলে যায়৷

—কেন এরকম হল মঞ্জু? কোথায় তোমরা ছিলে, কোথায় আমরা ছিলাম ভাব তো!

—সে তো সব জানি৷ কিন্তু তা বললে মন কি বোঝে নিধুদা? মনে যা হয়, তাই হয়—বোঝালে কি কিছু বোঝে?

—কি বই করবে ঠিক করলে?

—বড়দা বলে গিয়েচেন রবি ঠাকুরের ‘ফাল্গুনী’ করতে—ওঁদের কলেজে এবার করবে৷ উনি শিখিয়ে দেবেন৷ পড়েচেন আপনি?

—পাগল তুমি মঞ্জু! আমাদের বিদ্যেবুদ্ধি জানতে তোমার আর বাকি নেই৷ নাম শুনেচি, এই পর্যন্ত৷

—কবিতা পড়েন নি তাঁর?

—খুব কম৷

—আমার কাছে ‘চয়নিকা’ আছে—নিয়ে যাবেন৷ ভালো বই—

—সে তো জানি৷ তাই থেকে সেবার ‘কচ ও দেবযানী’ করেছিলে—চমৎকার হয়েছিল, এখনো যেন দেখতে পাই চোখের সামনে৷

—আর লজ্জা দেবেন না নিধুদা৷ ওকথা থাক৷ আপনাকে পার্ট নিতে হবে—নেবেন তো?

—তুমি বললেই নেব৷ কবে থেকে মহলা দেবে?

—কি দেব?

—তোমরা যাকে বল রিহার্স্যাল—কবে থেকে শুরু করবে?

—আপনার কথা শুনে এমন হাসি পায় আমার নিধুদা! দুঃখের মধ্যেও হাসি পায়! আমার মনে হয় আপনি সব সময় আমাদের মধ্যে থাকুন—আপনি যখন নিজের বাড়ী চলে যান জ্যাঠাইমার কাছে খেতে—আমি তখন কতদিন মাকে বলেচি, নিধুদা এখানেই তো দুপুরবেলা পর্যন্ত থাকে, বাড়ী যাবে কেন খেতে, তার চেয়ে এখানে কেন খেতে বললে না? মা বলতেন—দূর, রোজ রোজ ও যদি তোদের বাড়ী না খায়! আমার কিন্তু মনে হত, বা রে, আমরা নিধুদার পর হলাম কি করে? তা কেন লজ্জা করবে নিধুদার?

—আমিও তাই ভাবতাম কিন্তু৷ যদি যেতে না হয়, যদি সব সময় তোমাদের বাড়ীর আমোদ-আহ্লাদের মধ্যে থাকি—

—আচ্ছা, রামনগরে থাকবার সময়ে আমাদের বাড়ীর কথা আপনার মনে পড়ে না?

—পড়ে৷

—কার কার কথা মনে পড়ে?

—কাকাবাবুর কথা, কাকীমার কথা, বীরেনের কথা, নৃপেনের কথা, বুড়ো ঝিটার কথা, কুকুরটার কথা, বেড়ালটার কথা—

মঞ্জু মুখে আঁচল দিয়া ছেলেমানুষের মতো খুশিতে খিল-খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল৷

—উঃ, মোক্তারী আপনি করতে পারবেন বটে নিধুদা! কথার ঝুড়ি সাজিয়ে ফেললেন যে! এদের সকলের কথা মনে পড়ে—না?

—যা পড়ে, তাই বলেচি৷

—ভালোই তো৷ আমি কি বলেচি আপনি তা না বলেচেন! আমি আর কে, যে আমার কথা মনে পড়বে!

—তা পড়লেই বা কি?

—আপনি মনে ব্যথা দিয়ে বড্ড কথা বলেন কিন্তু—সত্যি বলচি নিধুদা—কেন ওরকম করেন? আমার মন তো পাথরে তৈরি নয়?

মঞ্জু এইমাত্র হাসিবার সময় যে আঁচল মুখে দিয়াছিল—তাহাই তুলিয়া চোখে দিল৷ নিধু দেখিল সত্যই তাহার চোখ জলে ভরিয়া আসিতেছে৷ সেকেণ্ড ক্লাসে পড়ে, শিক্ষিতা মেয়ে—অথচ কি ছেলেমানুষ মেয়ে মঞ্জু! আর কি অদ্ভুত লীলাময়ী! হাসি অশ্রু একই সময়ে মুখে চোখে বিরাজমান৷

নিধু হাসিয়া বলিল—আচ্ছা সত্যি মঞ্জু, তুমি ভাবলে এসব সত্যি? আর সকলের কথা মনে পড়েচে—আর তোমার কথাই পড়ল না! এ তুমি বিশ্বাস কর?

—দেখুন মন যা বলে, মাঝে মাঝে মানুষের কাছ থেকে তার জন্যে উৎসাহ পাওয়া চাই, তবেই মন খুশি হয়ে ওঠে৷ মুখে শোনা এজন্যে বড় দরকার—বলুন এবার?

—না, যা বলেচি, তার বেশি আর কিছু শুনতে পাবে না আমার কাছে মঞ্জু৷

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *