দুই বাড়ি – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
রামতারণ চৌধুরী সকালে উঠিয়া বড় ছেলে নিধুকে বলিলেন—নিধে, একবার হরি বাগদীর কাছে গিয়ে তাগাদা করে দ্যাখ দিকি৷ আজ কিছু না আনলে একেবারেই গোলমাল৷
নিধুর বয়েস পঁচিশ, এবার সে মোক্তারী পরীক্ষা দিয়া আসিয়াছে, সম্ভবত পাশও করিবে৷ বেশ লম্বা দোহারা গড়ন, রঙ খুব ফরসা না হইলেও তাহাকে এ পর্যন্ত কেউ কালো বলে নাই৷ নিধু কি একটা কাজ করিতেছিল, বাবার কথায় আসিয়া বলিল—সে আজ কিছু দিতে পারবে না৷
—দিতে পারবে না তো আজ চলবে কি করে? তুমি বাপু একটা উপায় খুঁজে বার কর, আমার মাথায় তো আসচে না৷
—কোথায় যাব বলুন না বাবা? একটা উপায় আছে—ও পাড়ার গোঁসাইখুড়োর বাড়ীতে গিয়ে ধার চেয়ে আনি না হয়—
—সেইখানে বাবা আর গিয়ে কাজ নেই—তুমি একবার বিন্দুপিসীর বাড়ী যাও দিকি৷
গ্রামের প্রান্তে গোয়ালাপাড়া৷ বিন্দু গোয়ালিনীর ছোট্ট চালাঘরখানি গোয়ালপাড়ার একেবারে মাঝখানে৷ তাহার স্বামী কৃষ্ণ ঘোষ এ গ্রামের মধ্যে একজন অবস্থাপন্ন লোক ছিল—বাড়ীতে সাত-আটটা গোলা, পুকুর, প্রায় একশর কাছাকাছি গরু ও মহিষ—কিছু তেজারতি কারবারও ছিল সেই সঙ্গে৷ দুঃখের মধ্যে ছিল এই যে কৃষ্ণ ঘোষ নিঃসন্তান—অনেক পূজামানত করিয়াও আসলে কোনো ফল হয় নাই৷ সকলে বলে স্বামীর মৃত্যুর পরে বিন্দুর হাতে প্রায় হাজার পাঁচেক টাকা পড়িয়াছিল৷
বিন্দুর উঠানে দাঁড়াইয়া নিধু ডাকিল—ও পিসী, বাড়ী আছ?
বিন্দু বাড়ীর ভিতর বাসন মাজিতেছিল, ডাক শুনিয়া আসিয়া বলিল—কে গা? ও নিধু! কি বাবা কি মনে করে?
—বাবা পাঠিয়ে দিলে৷
—কেন বাবা?
—আজ খরচের বড় অভাব আমাদের৷ কিছু ধার না দিলে চলছে না পিসী৷
বিন্দু বিরক্তমুখে পিছন ফিরিয়া প্রস্থানোদ্যত হইয়া বলিল—ধার নিয়ে বসে আছি তোমার সকালবেলা৷ গাঁয়ে শুধু ধার দ্যাও আর ধার দ্যাও—টাকাগুলো বারোভূতে দিয়ে না খাওয়ালে আমার আর চলছে না যে৷ হবে না বাপু, ফিরে যাও—
নিধু দেখিল এই বুড়িই অদ্যকার সংসার চলিবার একমাত্র ভরসা, এ যদি এভাবে মুখ ঘুরাইয়া চলিয়া যায়—তবে আজ সকলকে উপবাসে কাটাইতে হইবে৷ ইহাকে যাইতে দেওয়া হইবে না৷ নিধু ডাকিল—ও পিসী, শোনো একটা কথা বলি৷
—না বাপু, আমার এখন সময় নেই৷
—একটা কথা শোনো না৷
বিন্দু একটু থামিয়া অর্ধেকটা ফিরিয়া বলিল—কি বল না?
—কিছু দিতে হবে পিসী৷ নইলে আজ বাড়ীতে হাঁড়ি চড়বে না বাবা বলে দিয়েচে৷
—হাঁড়ি চড়বে না তো আমি কি করব? এত বড় বড় ছেলে বসে আছ চৌধুরী মশাইয়ের, টাকা পয়সা আনতে পার না? কি হলে হাঁড়ি চড়ে?
—একটা টাকার কমে চড়বে না পিসী৷
—টাকা দিতে পারব না৷ ধামা নিয়ে এস—দু-কাঠা চাল নিয়ে যাও৷
—বা রে৷ আর তেল-নুন মাছ-তরকারির পয়সা?
—চাল জোটে না—মাছ-তরকারি৷ লজ্জা করে না বলতে? চার-আনা পয়সা নিয়ে যাও আর দু’কাঠা চাল৷
—যাকগে পিসী, দাও তুমি আট-আনা পয়সা আর চাল৷
বিন্দু মুখ ভারি করিয়া বলিল—তোমাদের হাতে পড়লে কি আর ছাড়ান-কাড়ান আছে বাবা? যথাসর্বস্ব না শুষে নিয়ে এ গাঁয়ের লোক আমায় রেহাই দেবে কখনো? যাও তাই নিয়ে যাও—আমায় এখন ছেড়ে দ্যাও যে বাঁচি৷
নিধু হাসিয়া বলিল—তোমায় বেঁধে রাখিনি তো পিসী—টাকা ফেল—ছেড়ে দিচ্ছি৷
বিন্দু সত্যিই বাড়ীর ভিতর হইতে একটা টাকা আনিয়া নিধুর হাতে দিয়া বলিল—যাও, এখন ঘাড় থেকে নেমে যাও বাপু যে আমি বাঁচি—
নিধু হাসিয়া বলে—তা দরকার পড়লে আবার ঘাড়ে এসে চাপব বৈকি!
—আবার চাপলে দেখিয়ে দেব মজা৷ চেপে দেখ কি হয়—
নিধু বাড়ী আসিয়া বাবার হাতে টাকা দিয়া বলিল—বিন্দুপিসীর সঙ্গে একরকম ঝগড়া করে টাকা নিয়ে এলাম বাবা৷ এখন কি ব্যবস্থা করা যাবে?
পিতাপুত্রের কথা শেষ হয় নাই, এমন সময় পথের মোড়ে গ্রামের ছনু জেলেকে মাছের ডালা মাথায় যাইতে দেখা গেল৷ রামতারণ হাঁক দিলেন—ও বাবা ছনু, শুনে যা—কি মাছ, ও ছনু?
ছনু জেলে ইঁহাদের বাড়ীর ত্রিসীমা ঘেঁষিয়া কখনো যায় না৷ সে বহুদিনের তিক্ত অভিদ্ভ্রজ্ঞতা দিয়া বুঝিয়াছে এ বাড়িতে ধার দিলে পয়সা পাইবার কোনো আশা নাই৷ আজ রামতারণের একেবারে সামনে পড়িয়া বড় বিব্রত হইয়া উঠিল৷ রামতারণ পুনর্বার হাঁক দিলেন—ও ছনু, শোনো বাবা—কি মাছ?
ছনু অগত্যা ঘাড় ফিরাইয়া এদিকে চাহিয়া বলিল—খয়রা মাছ—
—এদিকে এস, দিয়ে যাও—
গ্রামের মধ্যে ভদ্রলোকের সঙ্গে বেয়াদবি করা ছনুর সাহসে কুলাইল না, নয়তো মনের মধ্যে অনেক কড়া কথা রামতরণ চৌধুরীর বিরুদ্ধে জমা হইয়া ছিল৷
সে কাছে আসিয়া ডালা নামাইয়া কহিল—কত সের মাছ নেবেন?
—দাও আনা দুইয়ের—দেখি—বলিয়া রামতারণ চুপড়ির ভিতর হইতে নিজেই বড় বড় মাছ বাছিয়া তুলিতে লাগিলেন৷ ছনু বলিল—আর নেবেন না বাবু, দু-আনার মাছ হয়ে গিয়েচে—
—বলি ফাউ তো দিবি? দু-আনার মাছ এক জায়গায় একসঙ্গে নিচ্চি, ফাউ দিবিনে?
মাছ দিয়া ডালা তুলিতে তুলিতে ছনু বিনীতভাবে বলিল—বাবু, পয়সাটা?
রামতারণ বিস্ময়ের সুরে বলিলেন—সে কি রে? সকালবেলা নাইনি ধুইনি, এখন বাক্স ছুঁয়ে পয়সা বার করব কি করে? তোর কি বুদ্ধিসুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেল রে ছনু?
ছনু মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল—না, না, তা বলিনি বাবু, তবে আর-দিনের পয়সাটা তো বাকি আছে কিনা৷ এই সবসুদ্ধ সাড়ে চার-আনা পয়সা এই দুদিনের—আর ওদিকের দরুন ন-আনা৷
রামতারণ তাচ্ছিল্যের ভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন—যা, এখন যা—ওসব হিসেবের সময় নয় এখন৷
গ্রামের ভদ্রলোক বাসিন্দা যাঁরা, তাঁরা চিরকাল এইভাবে গ্রামের নিম্নশ্রেণীর নিকট হইতে কখনো চোখ রাঙাইয়া কখনো মিষ্ট কথায় তুই করিয়া ধারে জিনিসপত্র খরিদ করিয়া চালাইয়া আসিতেছেন—ইহা এ গ্রামের সনাতন প্রথা৷ ইহার বিরুদ্ধে আপীল নাই৷ সুতরাং ছনু মুখ বুজিয়া চলিয়া যাইবে ইহাই নিশ্চিত, কিন্তু সন্ধ্যাবেলা রামতারণ চৌধুরী কাছারীবাড়ীর ডাক পাইয়া তথায় উপস্থিত হইয়া বিস্ময়ের সহিত দেখিলেন ছনু তাহার প্রাপ্য পয়সার জন্য কাছারীতে নালিশ করিয়াছে৷ কাছারীর নায়েব দুর্গাচরণ হালদার—ব্রাহ্মণ, বাড়ী নদীয়া জেলায়৷ এই গ্রামের কাছারীতে আজ দশ-বারো বছর আছেন৷ নায়েব মহাশয়ের হাঁকডাক এদিকে খুব বেশি, সুবিবেচক বলিয়া তাঁহার খ্যাতি থাকায় জেলা কোর্টে আজ বছরকয়েক জুরি নির্বাচিত হইয়াছেন৷
অজ্ঞ প্রজাদের কাছে তিনি গল্প করেন—বাপু হে, সাতদিন ধরে জেলায় ছিলাম—মস্ত বড় খুনের মামলা৷ আসামীর ফাঁসি হয়-হয়, কেউ রদ করতে পারত না৷ আমি সব দিক শুনে ভেবে-চিন্তে বললাম, তা হয় না, এ লোক নির্দোষ৷ জজসাহেব বললেন, নায়েবমশায়ের কথা ঠিক, আমি আসামীকে খালাস দিলাম, এক কথায় খালাস হয়ে গেল—
রামতারণ কিছু বলিবার পূর্বেই নায়েবমহাশয় বলিলেন—চৌধুরীমশায়, এসব সামান্য জিনিস আমাদের কাছে আসে, এটা আমরা চাইনে৷ ছনু বলছিল, সে নাকি আপনার কাছে অনেকদিন থেকে মাছের পয়সা পাবে৷
রামতারণ গলা ঝাড়িয়া লইয়া বলিলেন—তা আমি কি দেব না বলেচি?
—না, তা বলেননি৷ কিন্তু ও বেচারাও তো গরীব, কতদিন ধার দিয়ে বসে থাকতে পারে? দু-একদিনের মধ্যে শোধ করে দিয়ে দিন৷ আচ্ছা যা ছনু, তোর হয়ে গেল, তুই যা—
ছনু চলিয়া গেলে রামতারণ বলিলেন—দেব তো নিশ্চয়ই, তবে আজকাল একটু ইয়ে—একটু টানাটানি যাচ্ছে কিনা—
—সে আমার দেখবার দরকার নেই চৌধুরীমশায়৷ নালিশ করতে এসেছিল পয়সা পাবে, আমি নিষ্পত্তি করে দিলাম দুদিনের মধ্যে ওর পয়সা দিয়ে দেবেন—মিটে গেল৷
—দুদিন নয়, এক হপ্তা সময় দিন নায়েবমশায়, এই সময়টা বড় খারাপ যাচ্ছে—
—কত পয়সা পাবে? দাঁড়ান, সাড়ে বারো-আনা মোট বোধ হয়৷ এই নিন একটা টাকা—ওর দাম চুকিয়ে দিন৷ ও ছোটলোক, একটা কড়া কথা যদি বলে, ভদ্দরলোকের মানটা কোথায় থাকে বলুন তো? ওর দেনা শোধ করুন, আমার দেনা আপনি যখন হয় শোধ করবেন৷
রামতারণ হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন৷ হঠাৎ তাঁর মনে হইল নায়েবমশায়কে তাঁহার সংসারের সব দুঃখ খুলিয়া বলেন৷ বলেন—নায়েবমশায় কি করব, বড় কষ্টে পড়েছি৷ দুবেলা খেতে অনেকগুলি পুষ্যি, বড় ছেলেটি সবে পাশ করেচে, এখনো কিছু রোজগার করে না৷ আমি বুড়ো হয়ে পড়েচি—জমিজমাও এমন কিছু নেই তো আপনি জানেন—যা সামান্য আছে তাতে সংসার চলে না৷ এই সব কারণে অনেক হীনতা স্বীকার করতে হয়, নইলে সংসার চলে না নায়েবমশায়—
মনে-মনে এই কথাগুলি কল্পনা করিয়া রামতারণের চক্ষে জল আসিল৷ মুখে অবশ্য তিনি কিছু বলিতে পারিলেন না, নায়েবমহাশয়কে নমস্কার করিয়া চলিয়া আসিলেন৷
এমন অপমান তিনি জীবনে কখনো হন নাই—শেষে কিনা জমিদারী-কাছারীতে ছনু জেলে তাঁহার নামে নালিশ করিল!
কালে-কালে সবই সম্ভব হইয়া উঠিল—রামতারণের বাল্যকালে বা যৌবন-বয়সে গ্রামে এরূপ একটি ব্যাপার সম্ভবই ছিল না৷ সে দিন আর নাই৷
.
নিধু পিতার পদধূলি লইয়া বলিল—তাহলে যাই বাবা—
রামতারণের চোখে জল আসিল৷ বলিলেন—এস বাবা, সাবধানে থেকো৷ যা-তা খেও না—আমি যদুবাবুকে লিখে দিলাম তিনি তোমাকে দেখিয়ে-টেখিয়ে দেবেন, সুলুক-সন্ধান দেবেন৷ অত বড়লোক যদিও আজ তিনি, এক সময়ে দুজনে একই বাসায় থেকে পড়াশুনো করেচি৷ তিনিও গরীবের ছেলে ছিলেন, আমিও তাই৷ গাড়ী যেন একটু সাবধানে চালিয়ে নিয়ে যায় দেখো৷
কথাটা ঠিক বটে, তবে রামতারণ যে গরীব সেই গরীবই রহিয়া গিয়াছেন, যদু বাঁড়ুয্যে আঙুল ফুলিয়া কলাগাছ হইয়া খ্যাতি-প্রতিপত্তি, বিষয়-আশয় এবং নগদ টাকায় বর্তমানে মহকুমা আদালতের মোক্তার-বারের শীর্ষস্থানীয়৷ যদু বাঁড়ুয্যের বাড়ী প্রাসাদোপম না হইলেও নিতান্ত ছোট নয়, যে সময়ের কথা হইতেছে, তখন সারা টাউনের মধ্যে অমন ফ্যাশানের বাড়ী একটিও ছিল না—আজকাল অবশ্য অনেক হইয়াছে৷
নিধু ফটকের সামনে গরুর গাড়ী রাখিয়া কম্পিতপদে উঠান পার হইয়া বৈঠকখানাতে ঢুকিল৷ মহকুমার টাউনে তার যাতায়াত খুবই কম—কারণ সে লেখাপড়া করিয়াছে তাহার মামা-বাড়ীর দেশ ফরিদপুরে৷ যদু বাঁড়ুয্যে মহাশয়কে সে কখনো দেখে নাই৷
সকালবেলা৷ পসারওয়ালা মোক্তার যদু বাঁড়ুয্যের সেরেস্তায় মক্কেলের ভিড় লাগিয়াছে৷ কেহ বৈঠকখানার বাহিরের রোয়াকে বসিয়া তামাক খাইতেছে, কেহ কেহ নিজ সাক্ষীদের সঙ্গে মকদ্দমা সম্বন্ধে পরামর্শ করিতেছে৷
নিধু ভিড় দেখিয়া ভাবিল, ভগবান যদি মুখ তুলিয়া চান, তবে তাহারও মক্কেলের ভিড় কি হইবে না?
যদুবাবু সামনেই নথি পড়িতেছিলেন, নিধু গিয়া তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল৷ যদুবাবু নথি হইতে মুখ তুলিয়া বলিলেন—কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
—আজ্ঞে আমি কুড়ুলগাছির রামতারণ চৌধুরীর ছেলে৷ এবার মোক্তারী পাশ করে প্র্যাকটিস করব বলে এসেছি এখানে৷ বাবা আপনার নামে একটা চিঠি দিয়েচেন—
যদুবাবু একটু বিস্ময়ের সুরে বলিলেন—রামতারণের ছেলে তুমি? মোক্তারী পাশ করেচ এবার? লাইসেন্স পেয়েচ?
—আজ্ঞে হ্যাঁ৷
—বাসা ঠিক আছে?
—কিছুই ঠিক নেই৷ আপনার কাছে সোজা আসতে বলে দিলেন বাবা৷ আমাদের অবস্থা সব তো জানেন—
যদুবাবু চিন্তিতভাবে বলিলেন—তাই তো, বাসা ঠিক কর নি? তোমার জিনিসপত্র নিয়ে এসেচ নাকি? কোথায় সেসব?
—আজ্ঞে, গাড়ীতে রয়েচে?
যদুবাবু হাঁকিয়া বলিলেন—ওরে লক্ষ্মণ, ও লক্ষ্মণ, বাবুর জিনিসপত্তর কি আছে নামিয়ে নিয়ে আয়৷ বাবাজি তুমি এখানেই এবেলা খাওয়া-দাওয়া কর, তারপর যা হয় ব্যবস্থা করা যাবে৷
নিধু বিনীতভাবে জানাইল যে সে বাড়ী হইতে আহারাদি করিয়াই রওয়ানা হইয়াছে৷
—এত সকালে? এর মধ্যে খাওয়া-দাওয়া শেষ? রাত থাকতে উঠে না খেলে তো তুমি কুড়ুলগাছি থেকে এতটা পথ গরুর গাড়ী করে আসতে পারোনি!
—আজ্ঞে, মা বললেন দধিযাত্রা করে বেরুতে হয়, তাই ঘরে পাতা দই দিয়ে দুটো ভাত খেয়ে ভোরবেলা—
—হুঁ, তা বটে৷ তবে কথা কি জানো বাবা, সব বরাত৷ ও দধিযাত্রাও বুঝিনে, কিছুই বুঝিনে—বরাতে না থাকলে দধিযাত্রা কেন, তোমার ও ঘোলযাত্রা, মাখনযাত্রাতেও কিছু করার যো নেই, বুঝলে বাবা?
কথা শেষ করিয়া যদু বাঁড়ুয্যে চারিপাশে উপবিষ্ট মুহুরী ও মক্কেলবৃন্দের প্রতি সগর্ব দৃষ্টি ঘুরাইয়া আনিলেন৷ পরে আবার বলিলেন—এই মহকুমায় প্রথম যখন প্র্যাকটিস করতে এসেছিলাম—সে আজ পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা৷ একটা ঘটি আর একটা বিছানা সম্বল ছিল৷ কেউ চিনত না, শ্যাম সাউদের খড়ের বাড়ী তিন টাকা মাসিক ভাড়ায় এক বছরের জন্য নিয়ে মোক্তারী শুরু করি৷ তারপর কত এল কত গেল আমার চোখের সামনে, আমি তো এখনো যাহোক টিঁকে আছি৷
একজন মক্কেল বলিল—বাবু, আপনার সঙ্গে কার কথা? আপনার মতো পসার জেলার কোর্টে কজনের আছে?
অনেকেই মোক্তারবাবুর মন যোগাইবার জন্য একথায় সায় দিল৷
যদু-মোক্তার নিধুর দিকে চাহিয়া বলিলেন—বাবাজি, সারা পথ গরুর গাড়ীতে এসেচ, তোমাদের গ্রাম তো এখেনে নয়, সেখানে যাওয়ার চেয়ে কলকাতায় যাওয়া সোজা৷ একটু বিশ্রাম করে নাও, তারপর কথাবার্তা হবে এখন বিকেলে৷
মহকুমার টাউন থেকে কুড়ুলগাছি পাঁচ মাইল পথ৷ নিধু মাঝে মাঝে ম্যালেরিয়ায় ভোগে, স্বাস্থ্য তত ভালো নয়, এইটুকু পথ আসিয়াই সত্যই সে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল৷ যদু বাঁড়ুয্যের বৈঠকখানায় ফরাসের উপর শুইবামাত্র সে ঘুমাইয়া পড়িল৷
.
বৈকালের দিকে যদুবাবু কোর্ট হইতে ফিরিলেন, গায়ে চাপকান, মাথায় শামলা, হাতে একতাড়া কাগজ৷ নিধুকে বলিলেন—চা খাও তো হে? বস, চা দিতে বলি—
নিধু সলজ্জভাবে বলিল—থাক, আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না কাকাবাবু৷
—বিলক্ষণ, বস আসচি—
প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে চাকর আসিয়া নিধুকে বলিল—কর্তাবাবু ডাকচেন বাড়ীর মধ্যে৷
নিধু সসঙ্কোচে বাড়ীর মধ্যে ঢুকিল চাকরের পিছু-পিছু৷ যদুবাবু রান্নাঘরের দাওয়ায় পিঁড়ি পাতিয়া বসিয়া আছেন, তাঁহার পাশে আর একখানা পিঁড়ি পাতা৷
যদুবাবু রান্নাঘরের খোলা দরজার দিকে চাহিয়া বলিলেন—ওগো, এই এসেচে ছেলেটি৷ খাবার দাও৷
মোক্তারগৃহিণী আধ-ঘোমটা দিয়া বাহির হইয়া আসিতেই নিধু তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল৷ তিনি তাহার পাতে গরম লুচি, বেগুনভাজা ও আলুর তরকারি দিয়া গেলেন৷ নিধু চাহিয়া দেখিল, যদুবাবু মাত্র এক বাটি সাবু খাইতেছেন৷
নিধু ভাবিল, ভদ্রলোকের নিশ্চয় আজ জ্বর হইয়াছে৷ সে জিজ্ঞাসা করিল—কাকাবাবু, আপনার শরীর খারাপ হয়েছে নাকি? সাবু খাচ্ছেন যে?
মোক্তারগৃহিণী এবার জবাব দিলেন—বাবা, ওঁর কথা বাদ দ্যাও৷ বারোমাস সাবু জলখাবার দুবেলা৷
যদুবাবু বলিলেন—হজম হয় না বাবাজি, আর হজম হয় না৷ আর কি তোমাদের বয়েস আছে? এই এক বাটি সাবু খেলাম, রাত্রে আর কিছু না৷ বড্ড খিতে পায় তো দুখানি সুজির রুটি আর একটু মাছের ঝোল৷ তা সব দিন নয়৷
নিধু এবার সত্যিই অবাক হইল৷ সে পাড়াগাঁয়ের ছেলে, শখ করিয়া যে কেউ সাবু খায়, ইহা সে দেখে নাই৷ তাহার বাবাও তো যদুবাবুর সমবয়সী, তিনি এখনো যে পরিমাণে আহার করেন, যদুবাবু দেখিলে নিশ্চয়ই চমকাইয়া যাইবেন৷
জলযোগের পরে বাহিরের ঘরে আসিতেই চাকর ফরসিতে তামাক সাজিয়া দিয়া গেল৷ যদুবাবু তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন—তারপর একটা কথা জিগগেস করি বাবাজি, কিছু মনে কোরো না, মোক্তারী করতে এলে, সঙ্গে কত টাকা এনেচ?
নিধু প্রশ্নের উত্তর ভালো বুঝিতে না পারিয়া বলিল—আজ্ঞে টাকা? কিসের টাকা?
—বসে বসে খেতে হবে তো, খরচ চালাতে হবে না?
—আজ্ঞে তা বটে৷ টাকা সামান্য কিছু—ইয়ে—মানে হাতে আছে কিছু৷ চাল এনেচি দশ সের বাড়ী থেকে—তাই খাব৷
যদুবাবু হাসিয়া বলিলেন—বাবাজি, একেই বলে ছেলেমানুষ৷ দশ সের চাল তোমার বাবা তোমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েচেন খাবার জন্যে৷ অর্থাৎ এই চাল কটা ফুরোবার আগেই তুমি রোজগার করতে আরম্ভ করে দেবে, এই কথা তো?
—আজ্ঞে হ্যাঁ—তা বাবা সেই ভেবেই দিয়েচেন৷
নিধু সব কথা ভাঙিয়া বলিল না৷ এক টাকার ধান ধারে কিনিয়া আনিয়া নিধুর সৎমা চালগুলি কাল সারা বিকেলবেলা ধরিয়া ভানিয়া কুটিয়া তৈরি করিয়া দিয়াছেন৷ নিধুর আপন মা নাই, আজ প্রায় পনেরো-ষোলো বৎসর পূর্বে নিধুর বাল্যকালেই মারা গিয়াছেন৷
যদুবাবু বলিলেন—বাবা, খেজুর গাছ তেলপানা নয়৷ তোমার বাবা যা ভেবেচেন তা নয়৷ সেকাল কি আর আছে বাবাজি? আমরা যখন প্রথম বসি প্র্যাকটিসে—সে কাল গিয়েচে৷ এখন ওই কোর্টের অশত্থতলায় গিয়ে দ্যাখো—একটা লাঠি মারলে তিনটে মোক্তার মরে৷ কারো পসার নেই৷ আবার কেউ কেউ কোটপ্যান্ট পরে আসে—মক্কেল কিছুতেই ভোলে না—
নিধুর মুখে নিরাশার ছায়া পড়িতে দেখিয়া তিনি তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন—না, না, তুমি তা বলে বাড়ী ফিরে যাও আমি তা বলিনি৷ ছেলে-ছোকরা, দমবে কেন? আমি বলচি কাজ খুব সহজ নয়৷ হঠাৎ বড়লোক হওয়ার কাল গিয়েচে৷ লেগে যাও কাজে—আমি যতদূর পারি সাহায্য করব৷ তবে একটি বছর কলসীর জল গড়িয়ে খেতে হবে৷
—আজ্ঞে, কলসীর জল?
—তাই৷ বাড়ী থেকে জমানো টাকা এনে খরচ করতে হবে বাবাজি৷ দশ সের চালে কুলুবে না৷ রাগ কোরো না বাবাজি৷ অবস্থা গোপন করে তোমাকে মিথ্যে আশা না দেওয়াই ভালো৷ আমি স্পষ্টবাদী লোক৷ বাসা ভাড়া দিতে পারবে কত?
—আজ্ঞে দু-তিন টাকার মধ্যে যাতে হয় তাই করে নেব৷ তার বেশি দেবার ক্ষমতা নেই৷ বাবার অবস্থা সব জানেন তো আপনি৷
যদুবাবু বলিলেন—আচ্ছা, সস্তায় একটা বাসা তোমায় দেখে দেব এখন৷ দু-চারদিন এখান থেকে কোর্টে যাতায়াত করতে পারবে অনায়াসেই কিন্তু তাতে তোমার পসার হবে না৷ উকীল মোক্তার নিজের বাসায় না থাকলে সম্মান হয় না৷ তোমার ভবিষ্যৎটা তো দেখতে হবে৷
সেদিন যদুবাবু নিধুর জন্যে একটা ছোট বাসা পাঁচ টাকা ভাড়ায় ঠিক করিয়া দিলেন৷
যদু বাঁড়ুয্যের খাতিরে নিধু দু-একটি মক্কেল পাইতে আরম্ভ করিল৷ নিধু বড় মুখচোরা ও লাজুক, প্রথম প্রথম কোর্টে দাঁড়াইয়া হাকিমের সামনে কিছু বলিতে পারিত না—মনে হইত এজলাসসুদ্ধ মোক্তারের দল তাহার দিকে চাহিয়া আছে বুঝি৷ ক্রমে ক্রমে তাহার সে ভাব দূর হইল৷ যদুবাবু তাহাকে কাজকর্ম সম্বন্ধে অনেক উপদেশ দিলেন৷ বলিলেন—দ্যাখ, জেরা ভাল না করতে পারলে ভাল মোক্তার হওয়া যায় না৷ জেরা করাটা ভাল করে শেখবার চেষ্টা কর৷ যখন আমি কি হরিহর নন্দী জেরা করব, তুমি মন দিয়ে শুনো, উপস্থিত থেকো সেখানে৷
নিধু কিন্তু এক বিষয়ে বড় অসুবিধায় পড়িল৷
যদুবাবুর সেরেস্তায় সকালে সে প্রায়ই উপস্থিত থাকিয়া দেখিত—মক্কেলকে তিনি বড় মিথ্যা কথা বলিতে শেখান৷ আসামী, ফরিয়াদী বা সাক্ষীদের তিনঘণ্টা ধরিয়া মিথ্যা কথার তালিম না দিয়া তাঁহার কোনো মোকর্দমা তৈরি হয় না৷
একদিন সে বলিল—কাকাবাবু, একটা কথা বলব?
—কি বল?
—ওদের অত মিথ্যা কথা শেখাতে হয় কেন?
—না শেখালে জেরায় মার খেয়ে যাবে যে৷
—সত্যি কথা যা তাই কেন বলুক না?
—তাতে মোকর্দমা হয় না বাবাজি৷ তা ছাড়া অনেক সময় সত্যি কথাই ওদের বার বার শেখাতে হয়৷ শিখিয়ে না দিলে ওরা সত্যি কথা পর্যন্ত গুছিয়ে বলতে পারে না৷ আমাদের ওপর অবিচার কোরো না তোমরা—এমন অনেক সময় হয়, মক্কেল বাপের নাম পর্যন্ত মনে করতে পারে না কোর্টে দাঁড়িয়ে৷ না শেখালে চলে?
—আমাকেও অমনি করে শেখাতে হবে?
—যখন এ পথে এসেচ, তা করতে হবে বৈকি৷ আর একটা কথা শিখিয়ে দিই, হাকিম চটিও না কখনো৷ হাকিম চটিয়ে তোমার খুব ইস্পিরিট দেখানো হল বটে, কিন্তু তাতে কাজ পাবে না৷ হাকিম চটালে নানা অসুবিধে৷ মক্কেল যদি জানে, অমুক মোক্তারের ওপর হাকিম সন্তুষ্ট নয়—তার কাছে কোনো মক্কেল ঘেঁষবে না৷
নিধু মাসখানেক মোক্তারী করিয়া যদুবাবুর দৌলতে গোটা পনেরো টাকা রোজগার করিল৷ তার বেশির ভাগই জামিন হওয়ার ফি বাবদ রোজগার৷ যদুবাবু দয়া করিয়া তাহাকে দিয়া জামিন-নামা সই করিয়া লইয়া মক্কেলের নিকট ফি পাওয়াইয়া দিতেন৷
একদিন একটি মক্কেল আসিয়া তাহাকে মারপিটের এক মোকর্দমায় নিযুক্ত করিতে চাহিল৷
নিধু জিজ্ঞাসা করিল—অপরপক্ষে কে আছে জানো?
—আজ্ঞে যদু বাঁড়ুয্যে—
নিধু মুখে কিছু না বলিলেও মনে মনে আশ্চর্য হইল৷ প্রবলপ্রতাপ যদু বাঁড়ুয্যের বিপক্ষে তাহার মতো জুনিয়র মোক্তার দেওয়ার হেতু কি? লোকটি তো অনায়াসে যদু বাঁড়ুয্যের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রবীণ মোক্তার হরিহর নন্দী কিংবা অন্নদা ঘটক অভাবপক্ষে মোজাহার হোসেনের কাছেও যাইতে পারিত৷
কথাটা ভাবিতে ভাবিতে সে কোর্টে গিয়া যদু বাঁড়ুয্যেকে আড়ালে ডাকিয়া বলিয়া ফেলিল৷
যদুবাবু বলিলেন—ও, ভালোই তো বাবাজি৷ কিন্তু তোমার মক্কেলের মনের ভাব কি জানো না তো? আমি বুঝেচি৷
—কি কাকাবাবু?
—আমি তোমাকে স্নেহ করি, এটা অনেকে জেনে ফেলেচে৷ তোমাকে কেস দেওয়ার মানে—আমি বিপক্ষের মোক্তার, কেসে মিটমাটের সুবিধে হবে৷
—কেস মেটাতে চায়?
—নিশ্চয়ই৷ নইলে তোমাকে মোক্তার দিত না৷ অন্য মোক্তারের কথা যদি আমি না শুনি? যদি কেস চালাবার জন্যে মক্কেলকে পরামর্শ দিই? এই ভয়ে তোমাকে মোক্তার দিয়েচে৷ ভালো তো! ওর কাছে থেকে বেশ করে দু-চারদিন ফি আদায় কর, দু-চারদিন তারিখ পাল্টে যাক—হাতে কিছু আসুক—তারপর মিটমাটের চেষ্টা দেখলেই হবে৷
—বড্ড অধর্ম হবে কাকাবাবু—আজই কেন কোর্টে মিটমাটের কথা হোক না?
—তাহলেই তুমি মোক্তারী করেচ বাবা! মাইনর পাশ করে সেকালে মোক্তারীতে ঢুকেছিলাম—আজ চুল পাকিয়ে ফেললাম এই কাজ করে৷ তুমি এখনো কাঁচা ছেলে—যা বলি তাই শোনো৷ তোমার মক্কেল মিটমাটের কথা কিছু বলেচে?
—আজ্ঞে না৷
—তবে তুমি ব্যস্ত হও কেন এখুনি? আগে বলুক, তারপর দেখা যাবে৷
.
একমাস শহরে মোক্তারী করিয়া নিধু বাড়ী যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিল৷ যদু মোক্তার বলিলেন—বাবাজি, সোমবার যেন কামাই করো না৷ শনিবার যাবে, সোমবারে আসবে৷ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও আসবে৷ নতুন প্র্যাকটিসে ঢুকে কামাই করতে নেই একেবারে৷
নিধু ‘যে আজ্ঞে’ বলিয়া বিদায় লইয়া মোক্তার-লাইব্রেরী হইতে বাহির হইয়া নিজের বাসায় আসিল৷ অনেকদিন পরে বাড়ী যাইতেছে কাল—ভাইবোনগুলির জন্য কি লইয়া যাওয়া যায়? বাবার জন্য অবশ্য ভালো তামাক খানিকটা লইতেই হইবে৷ মায়ের জন্যই বা কি লওয়া উচিত?
সারাদিন ভাবিয়া-চিন্তিয়া সে সকলের জন্যই কিছু-না-কিছু সস্তাদামের সওদা করিল এবং শনিবার কোর্টের কাজ মিটিলে বড় একটি পুঁটুলি বাঁধিয়া হাঁটাপথে বাড়ী রওনা হইল৷ পাঁচ-ছ ক্রোশ পথ—গাড়ী একখানা দুই-টাকা আড়াই-টাকার কমে যাইতে চাহিবে না—অত পয়সা নিজের সুখের জন্য ব্যয় করিতে সে প্রস্তুত নয়৷
বর্ষাকাল৷
সারাদিন কালো মেঘে আকাশ অন্ধকার, সজল বাদলার হাওয়ায় ভ্রমণে ক্লান্তি আনে না—পথের দু’পাশে ঘন সবুজ দিগন্তপ্রসারী ধানক্ষেত, আউশ ধানের কচি জাওলার প্রাচুর্যে চোখ জুড়াইয়া যায়৷ তবে কয়েকদিনের বৃষ্টিতে কাঁচা রাস্তায় বড় কাদা—জোরে পথ হাঁটা যায় না মোটেই৷
এক জায়গায় পথের ধারে বড় একটা পুকুর৷ পুকুরে অন্য সময় তত জল থাকে না, এখন বর্ষার জল পাড়ের কানায়-কানায় ঘাসের জমি ছুঁইয়া আছে, জলে কচুরিপানার নীলফুল, ওপারে ঘন নিবিড় বনঝোপে তিৎপল্লার হলুদ রঙের ফুল৷
নিধুর ক্ষুধা পাইয়াছিল—সঙ্গে একটা ঠোঙায় নিজের জন্য কিছু মুড়কি কিনিয়া আনিয়াছিল৷ মোক্তারবাবুর যেখানে-সেখানে বসিয়া খাওয়া উচিত নয়—সে এদিক-ওদিক চাহিয়া ঠোঙা হইতে মুড়কি বাহির করিয়া জলযোগ সম্পন্ন করিল৷
বেলা পড়িয়া আসার সঙ্গে সঙ্গে সে তাহাদের গ্রামের পাশের গ্রাম সন্দেশপুরে ঢুকিল৷
সন্দেশপুর চাষা-গাঁ—রাস্তার ধারে তালের গুঁড়ির খুঁটি লাগানো মক্তবঘর, মক্তবের মৌলবী সাহেব তখনো ছাত্রদের ছুটি দেন নাই—যদিও আজ শনিবার—তাহারা মক্তবঘরের সামনের প্রাঙ্গণে সারি দিয়া দাঁড়াইয়া তারস্বরে নামতা পড়িতেছে৷
মৌলবী ডাকিলেন—ও নিধিরাম, শুনে যাও হে—
মৌলবী সাদা-দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ ব্যক্তি, তাহার বাবার চেয়েও বয়েসে বড়৷ নিধিরামকে তিনি এতটুকু দেখিয়াছেন৷
নিধিরাম দাঁড়াইয়া বলিল—আর বসব না মৌলবী সাহেব, যাই—বেলা নেই আর৷ এখনো ইস্কুল ছুটি দাওনি যে?
—আরে এস না—শুনে যাও৷
—নাঃ, যাই৷
মৌলবী সাহেব স্কুল-প্রাঙ্গণ ছাড়িয়া আসিয়া নিধিরামের রাস্তা আটকাইলেন৷
—চল, বস না একটু৷ এস—ওরে একখানা টুল বের করে দে মাঠে৷ আরে তোমরা শহরে থাক, একবার শহরের খবরটা নিই—
নিধিরাম অগত্যা গেল বটে—তাহার দেরি সহিতেছিল না—কতক্ষণে বাড়ী পৌঁছিবে ভাবিতেছে, না আবার এই উপসর্গ! সে ঈষৎ বিরক্তির সুরে বলিল—কি আবার খবর?
—কি খবর আমরা জানি? তুমি বল শুনি৷ মোক্তারি করচ শুনলাম সেদিন কার কাছে যেন৷ তারপর কেমন হচ্চে-টচ্চে?
—নতুন বসেচি, এখুনি কি হবে বল৷ যদু-মোক্তার খুব সাহায্য করচে৷
—যদু-মোক্তার? ওঃ, অনেক পয়সা কামাই করে৷ সবই নসীব, বুঝলে? মাইনর পাস করি আমরা একই ইস্কুল থেকে৷ অবিশ্যি আমার চেয়ে সাত-আট বছরের ছোট৷ দ্যাখ আমি কি করচি—আর যদু কি করচে৷
—বাবারও তো ক্লাসফ্রেন্ড—বাবাই বা কি করচেন তাও দ্যাখ—
—তাই বলচি সবই নসীব৷ একটা ডাব খাবে?
—পাগল! শ্রাবণ মাসের সন্দেবেলা ডাব খাব কি! ঠাণ্ডা লেগে যাবে যে!
—তুমি তো তামাকও খাও না৷ তোমাকে দিই কি?
—তামাক খেলেই কি তোমার সামনে খেতাম মৌলবী সাহেব, তুমি আমার বাবার চেয়ে বড়৷
—তোমরা মান-খাতির রেখে চল তাই—নইলে নাতির বয়সী ছোকরারা আজকাল বিড়ি খেয়ে মুখের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে দ্যায়৷ সেদিন আটঘরার দাশরথি ডাক্তারের ডাক্তারখানায় বসে আছি—
সন্ধ্যার অন্ধকার নামিবার বেশি দেরি নাই, নিধিরাম ব্যস্ত হইয়া বলিল—আমি আসি মৌলবী সাহেব, সন্দের পর যাওয়ার কষ্ট হবে—সুমুখে আঁধার রাত—
—আরে, তোমাদের গাঁয়ের পাঁচ-ছটা ছেলে পড়ে এখানে৷ দাঁড়াও না, নামতাটা পড়ানো হয়ে গেলেই ওরাও যাবে৷ একসঙ্গে যেও৷
—এখনো আজ ইস্কুল ছুটি দাওনি যে! রোজই এমন নাকি? আজ তার ওপর শনিবার!
—আরে বাড়ী গিয়ে তো চাষার ছেলে ছিপ নিয়ে মাছ মারতে বসবে, নয়তো গরুর জাব কাটতে বসবে—তার চেয়ে এখানে যতক্ষণ আটকানো থাকে একটু এলেমদার লোকের সঙ্গে তো থাকতে পারে, দুটো ভালো কথাও তো শোনে, বুঝলে না? আমার রোজই সন্দের আগে ছুটি৷
.
সন্ধ্যার পর নিধু গ্রামে ঢুকিল৷
নিজের বাড়ী পৌঁছিবার আগে সে একবার থমকিয়া দাঁড়াইল৷ তাহাদের বাড়ীর ঠিক সামনে সরু গ্রাম্য-রাস্তার এপাশে লালবিহারী চাটুয্যেদের যে বাড়ী সে ছেলেবেলা হইতে জনশূন্য অবস্থায় পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াছে—সে বাড়ীতে আলো জ্বলিতেছে! এক-আধটা আলো নয়, দোতলার প্রত্যেক জানালা হইতে আলো বাহির হইতেছে—ব্যাপার কি?
সে বাড়ীর সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়া চাহিয়া দেখিল বৈঠকখানায় অনেক গ্রাম্য ভদ্রলোক জড় হইয়াছেন, তাহার বাবা রামতারণ চৌধুরীও আছেন তাঁহাদের মধ্যে৷ একজন স্থূলকায় প্রৌঢ় ভদ্রলোক সকলের মাঝখানে বসিয়া হাত নাড়িয়া কি বলিতেছেন৷
নিধু নিজের বাড়ীর মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল৷
তাহাকে দেখিয়া প্রথমে ছুটিয়া আসিল নিধুর ভাই রমেশ৷
—ওমা, ও কালী, দাদা বাড়ী এসেচে—দাদা—
তখন বাকি সবাই ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল, সম্মিলিত ভাবে নানা প্রশ্ন করিতে লাগিল৷ নিধুর মা আসিয়া বলিলেন—তোরা সরে যা, ওকে আগে একটু জিরুতে দে—বস নিধু, পাখা নিয়ে আয় কালী—
নিধু জিজ্ঞাসা করিল—মা, কারা এসেচে ও-বাড়ীতে?
—জজবাবু বাড়ী এসেচেন ছুটি নিয়ে৷ এবার নাকি পুজো করবেন বাড়ীতে—
—লালবিহারীবাবু!
—হ্যাঁ৷ তোর কাকা হন, কাকাবাবু বলে ডাকবি৷ বড়লোক—এতে কি?
—ভালো কথা, ওতে একটা মাছ আছে, দে-গঙ্গার বিলে ধরছিল, কিনে এনেছি৷
—ও পুঁটি, তোর দাদা মাছ এনেচে—আগে কুটে ফ্যাল দিকি, পচে যাবে—বলিয়া নিধুর মা ঘরের মধ্যে চলিয়া গেলেন এবং অল্পক্ষণ পরে একঘটি জল ও গামছা আনিয়া নিধুর সামনে রাখিয়া বলিলেন—হাত-মুখ আগে ধুয়ে ফেল বাবা, বলচি সব কথা৷
নিধুর আপন-মা নাই, ইনি সৎমা এবং রমেশ নিধুর বৈমাত্রেয় ভাই৷ রমেশ বলিল—দাদা একটা ডাব খাবে? আমি একটা ডাব এনেছিলাম বন্ধুদের গাছ থেকে৷
নিধুর মা ধমক দিয়া বলিলেন—যাঃ, বর্ষাকালের রাত্তিরে এখন ডাব খায় কেউ? তারপর জ্বর হোক৷ তুই হাত-মুখ ধুয়ে নে—আমি খাবার নিয়ে আসি—
খাবার অন্য কিছু নয়, চালভাজা আর শহর থেকে সে বাড়ীর জন্য যে ছানার গজা আনিয়াছে তারই দুখানা৷ জলপান শেষ করিয়া নিধু কৌতূহলবশতঃ লালবিহারীবাবুর বৈঠকখানার বাহিরে গিয়া দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল৷ সেই স্থূলকায় ভদ্রলোকটি তাহাকে দেখিতে পাইয়া বলিলেন—ওখানে দাঁড়িয়ে কে? ভেতরে এস না—
নিধু সসঙ্কোচে বৈঠকখানার ভেতরে ঢুকিতে রামতারণ চৌধুরী ব্যস্তসমস্ত হইয়া বলিলেন—নিধু কখন এলে? এটি আমার ছেলে—এরই কথা বলছিলাম তোমাকে৷ মোক্তারীতে ঢুকেচে এই সবে—
স্থূলকায় ভদ্রলোকটিই লালবিহারী চাটুয্যে—নিধু তাহা বুঝিল৷ সে বাবাকে ও লালবিহারীকে আগে প্রণাম করিয়া পরে একে একে অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ প্রতিবেশীদেরও প্রণাম করিল৷
লালবিহারী চাটুয্যে বলিলেন—বস, বস৷ তারপর পসার কেমন হচ্ছে?
নিধু বিনীত ভাবে বলিল—আজ্ঞে, এক রকম হচ্চে৷ সবে তো বসেচি—
লালবিহারী পূর্বস্মৃতি মনে আনিবার ভাবে বলিলেন—তোমার মতো আমিও একদিন প্র্যাকটিস করতে বসেছিলাম বহরমপুরে৷ তিনবছর ওকালতি করেছিলাম৷ সে-সব দিনের কথা আজও মনে আছে—বেশ ভালো করে খেটো হে মক্কেলের জন্যে৷ ফাঁকি দিও না, তাহলেই পসার হবে৷ মক্কেল নিয়ে ব্যবসা তোমার মতো আমিও একদিন করেছি, জানি তো৷
পুত্রগর্বে রামতারণের বুক ফুলিয়া উঠিল৷ এত বড় একজন লোক, একটা মহকুমার ডিক্রি-ডিসমিসের মালিক—তাঁহার ছেলে নিধুর সহিত সমানে সমানে কথা কহিতেছেন৷ কই, আরও তো কত লোক গাঁয়ের বসিয়া আছে, কজনের ছেলে আছে—উকীল, মোক্তার?
লালবিহারী পুনরায় বলিলেন—তুমি কাল যাবে না পরশু যাবে?
নিধু উত্তর দিল—পরশু সকালে উঠেই চলে যাব—
—তাহলে কাল আমার বাড়ী দুপুরে খেও, দু-একটা কথা বলব৷
রামতারণ একবার সগর্বে সকলের দিকে চাহিয়া লইলেন৷ ভাবটা এইরূপ—কই, তোমাদের কাউকে তো লালবিহারী খেতে বললে না? মানুষেই মানুষ চেনে!
নিধু বিনীতভাবে বলিল—আজ্ঞে তা বেশ৷
—আমার ছেলে অরুণকে তুমি দ্যাখ নি—আলাপ করিয়ে দেব এখন—সেও ল’ পড়চে৷ সামনের বছর এম. এ. দেবে৷ তোমার বয়সী হবে৷
নিধু বলিল—আচ্ছা, এখন তাহলে আসি কাকাবাবু—
নিধুর মা শুনিয়া বলিলেন—বড়লোক কি আর এমনি হয়! মন ভালো না হলে কেউ বড়লোক হয় না৷ তবে কর্তা যেমন, গিন্নি কিন্তু তেমন নয়৷ একটু ঠ্যাকারে আছে—তা থাক, আমরা গরীব মানুষ, আমাদের তাতে কিই বা আসে যায়৷ আমরা সকলের চেয়ে ছোট হয়েই তো আছি—থাকবও চিরকাল—
.
পরদিন সকালে রমেশ ছুটিয়া আসিয়া নিধুকে বলিল—দাদা, শিগগির এস, জজবাবুর ছেলে তোমায় ডাকচে—
নিধুদের বাহিরের ঘর নাই—তবে রোয়াকের উপর একখানা খড়ের চালা আছে, নিধু বাহিরে গিয়া দেখিল একটি ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে চালার নিচে রোয়াকে বসিয়া কি একখানা বইয়ের পাতা উল্টাইতেছে৷
নিধু ছেলেটিকে রোয়াকে মাদুর পাতিয়া বসাইল৷ ছেলেটি বলিল—আপনাদের বাড়ীতে কোনো বাংলা বই আছে?
নিধু ভাবিয়া দেখিয়া বলিল—না, বই তেমন কিছু নেই তো! বাংলা রামায়ণ মহাভারত আছে—
—ও সব না৷ আমার বোন মঞ্জু বড্ড বই পড়ে৷ তার জন্যে দরকার—সে পাঠিয়ে দিলে—
—তোমাদের বাড়ী বই নেই?
—সব পড়া শেষ৷ মঞ্জু একদিনে তিনখানা করে বই শেষ করে—সিমলের বান্ধব লাইব্রেরী, অত বড় লাইব্রেরী, তার জন্যে ফেল—বই যুগিয়ে উঠতে পারে না—
—তোমার বোন কি কলকাতায় থাকে?
—ও যে মামার বাড়ী থেকে পড়ে—এবার সেকেন ক্লাসে উঠল৷ সামনের বার ম্যাট্রিক দেবে৷ বাবা মফঃস্বলে বেড়ান, সব জায়গায় মেয়েদের হাইস্কুল তো নেই, তাই ওকে মামার বাড়ী কলকাতায় রেখেছেন পড়ার জন্যে৷
দুপুরে সেই ছেলেটিই তাহাকে খাইবার জন্য ডাকিয়া লইয়া গেল৷ নিধু উহাদের বাড়ীর মধ্যে ঢুকিয়া অবাক হইয়া গেল৷ বড়লোকের বাড়ী বটে৷ চকমিলানো দোতলা বাড়ীর বারান্দা হইতে দামী দামী সুদৃশ্য ভিজা শাড়ী ঝুলিতেছে, বারান্দায় সুবেশা সুন্দরী মেয়েরা ঘোরাফেরা করিতেছে, কোন ঘরে গ্রামোফোন বাজিতেছে—লোকজনে, ভিড়ে, হৈচৈয়ে সরগরম৷ এই বাড়ীটি সে পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া আসিতেছে বাল্যকাল হইতে৷ কখনো ইহারা দেশে আসেন নাই—নিধু বাড়ীটার মধ্যে কখনও ঢুকিয়া দেখে নাই এর আগে৷ বাবার মুখে সে শুনিয়াছে তাহার যখন বয়স চারি বৎসর, তখন একবার ইহারা দেশে আসিয়া ঘরবাড়ী মেরামত করে ও নতুন করিয়া অনেকগুলি ঘর বারান্দা তৈরি করে—কিন্তু সে কথা নিধুর স্মরণ হয় না৷
একটা প্রৌঢ়া মহিলা তাহাকে যত্ন করিয়া আসন পাতিয়া বসাইলেন এবং কিছুক্ষণ পরে একটি পনেরো-ষোলো বছরের সুন্দরী মেয়ে তাহার সামনে ভাতের থালা রাখিয়া গেল৷ কিছুক্ষণ পরে মহিলাটি আবার আসিয়া তাহার সামনে বসিলেন৷ নিধু লজ্জায় মুখ তুলিয়া চাহিতে পারিতেছিল না৷ মহিলাটি বলিলেন—লজ্জা করে খেও না বাবা৷ তোমাকে সেবার এসে দেখেছিলাম এতটুকু ছেলে, এর মধ্যে কত বড়টি হয়েচ৷ ও মঞ্জু, এদিকে আয় তোর দাদার খাওয়া দ্যাখ, এখানে দাঁড়া এসে, আমি আবার ওদিকে যাব৷ মেয়েটি আসিয়া মায়ের পাশে দাঁড়াইল৷ বলিল—বা রে, আপনি কিছু খাচ্চেন না যে!
নিধু সলজ্জভাবে বলিল—আপনাকে বলতে হবে না—আমি ঠিক খেয়ে যাব—
মেয়ের মা বলিলেন—ওকে ‘আপনি’ বলতে হবে না বাছা৷ ও তোমার ছোট বোনের মতো—এক গাঁয়ে পাশাপাশি বাড়ী, থাকা হয় না, আসা হয় না তাই৷ নইলে তোমরা প্রতিবেশী, তোমাদের চেয়ে আপন আর কে আছে? তোমার মাকে ওবেলা আসতে বোলো৷ বসে খাও বাবা—মঞ্জু, দাঁড়া এখানে—
গৃহিণী উঠিয়া চলিয়া গেলেন৷ মেয়েটি বলিল—আমি মাংস এনে দিই—
—মাংস আমি খাইনে তো!
মেয়েটি আশ্চর্য হইবার সুরে বলিল—খান না? ওমা, তবে মাকে বলে আসি৷ কি দিয়ে খাবেন?
নিধু এবার হাসিয়া বলিল—সেজন্যে তোমায় ব্যস্ত হতে হবে না৷ এই যা আয়োজন হয়েছে, আমার পক্ষে এত খেয়ে ওঠা শক্ত৷ সঙ্গে সঙ্গে সে ভাবিল, ইহার অর্ধেক রান্নাও তাহাদের বাড়ীতে বিশেষ কোনো পূজাপার্বণ কি উৎসবেও কোনোদিন হয় না৷ বড়লোকেরা প্রত্যহ কি এইরূপ খাইয়া থাকে?
মহকুমায় যদু-মোক্তারের বাড়ী সে খাইয়াছে—ইহার অপেক্ষা সে অনেক খারাপ৷ বহুলোক সেখানে খায়—সে একটা হোটেলখানা বিশেষ৷
খাওয়ার পরে সে বাহিরে আসিতেছিল, ছেলেটি তাহাকে বলিল—আসুন, আমার আঁকা ম্যাপ আর মঞ্জুর হাতে-গড়া মাটির পুতুল দেখে যান৷
এই সময়ে লালবিহারীবাবু কোথা হইতে বেড়াইয়া ফিরিলেন৷ নিধুকে দেখিয়া ব্যস্ত হইয়া বলিলেন—খাওয়া হয়েচে বাবা?
—আজ্ঞে এই উঠলাম খেয়ে৷
—বেশ, পেট ভরেচে তো? আমি তো দেখতে পারলুম না, মাঠে একটি পৈতৃক জমি আজ তিন-চার বছর বেদখল করেচে, তাই দেখতে গিয়েছিলুম—
—না কাকাবাবু, সেজন্যে ভাববেন না৷ অতিরিক্ত খাওয়া হয়ে গেল৷ খুড়ীমা ছিলেন বসে—
লালবিহারীবাবু ঘরের মধ্যে ঢুকিলেন—ছেলেটির নাম বীরেন, সে নিধুকে অন্তঃপুরের একটা ছোট ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া বসাইল৷ কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া তাহার হাতে পানের ডিবা দিয়া বলিল—পান খান দাদা—আমার পুতুল দেখেন নি বুঝি? দাঁড়ান দেখাই—
মঞ্জু একটা আলমারির ভিতর হইতে এক রাশ মাটির কুমীর, কুকুর, রাধাকৃষ্ণ, সিপাই প্রভৃতি বাহির করিয়া বলিল—দেখুন, কেমন হয়েচে?
—ভারি চমৎকার৷ বাঃ—
মঞ্জু হাসিমুখে বলিল—আমাদের স্কুলে এসব তৈরি করতে শেখায়৷ আরও একটা জিনিস দেখাব—কাল আসবেন তো?
নিধু বলিল—না, সকালেই যেতে হবে৷ এখন নতুন মোক্তারীতে ঢুকে কামাই করা চলবে না৷ তা ছাড়া কেস রয়েচে৷
—বিকেলে এসে চা খাবেন কিন্তু৷
—চা তো আমি খাইনে—
—চা না খান, জলখাবার খাবেন—সেই সময় দেখাব৷ আসবেন কিন্তু দাদা অবিশ্যি—
এই সময় বীরেন ঘরে ঢুকিয়া বলিল—মঞ্জু কিন্তু বেশ গান গাইতে পারে৷ শোনেন নি বুঝি নিধুদা? ওবেলা গান শুনিয়ে দে না মঞ্জু—
মঞ্জু বেশ সপ্রতিভ মেয়ে৷ বেশ নিঃসঙ্কোচেই বলিল—উনি ওবেলা জল খেতে আসবেন, নেমন্তন্ন করেচি—সেই সময় শোনাব৷
নিধু বাড়ী আসিলেই তাহার মা জিজ্ঞেস করিলেন—ভালো খেলি?
—খুব ভালো৷
—কি কি খেলি বল৷ গিন্নির সঙ্গে দেখা হল?
—হ্যাঁ, তিনি তো খাবার সময়ে বসে ছিলেন৷
—আর কার সঙ্গে আলাপ হল?
—আর ওই যে বীরেন বলে ছেলেটি, বেশ ছেলে৷
আশ্চর্যের বিষয়, নিধুর মনের প্রবলতম ইচ্ছা যে সে মায়ের কাছে মঞ্জুর কথা বলে, সেটাই কিন্তু সে বলিতে পারিল না৷ মঞ্জুর সম্পর্কিত কোনো উল্লেখই সে করিতে পারিল না৷
নিধুর মা বলিলেন—গিন্নির সঙ্গে আমার ইচ্ছে যে একটু আলাপ করি৷ বড়লোকের বউ, আলাপ রাখা ভালো৷
—তা তুমি গিয়ে আলাপ করলেই পার—তিনি কি তোমার এখানে আসবেন, তোমায় যেতে হবে৷
—একা যেতে ভয় করে—
—তুমি যেন একটা কি! প্রতিবেশীর বাড়ী যাবে, এতে ভয় কি? বাঘ না ভাল্লুক? তোমায় টপ করে মেরে ফেলবে নাকি?
—তুই যদি যাস, তোর সঙ্গে যাই—
—তা চল না৷ আমায় তো—ইয়ে—ওরা বিকেলে জল খেতে বলেচে ওখানে—
নিধুর মা আগ্রহের সহিত বলিলেন—কে, কে বললে তোকে? গিন্নি বললে নাকি?
—হাঁ তাই—ওই গিয়ে ঠিক গিন্নি ছিলেন না সেখানে, তবে ওই গিন্নিই বলে পাঠালেন আর কি!
—তোকে বোধহয় গিন্নির খুব ভালো লেগেচে—
মায়ের এই সব কথা বড় অস্বস্তিকর৷ নিধু দেখিতেছে চিরকাল তার মায়ের ব্যাপার—বড়লোক দেখিলে অত ভাঙিয়া-নুইয়া পড়িবার যে কি আছে! তাহাকে ভালো লাগিলেই বা কি, উহারা তো তাহার সহিত মেয়ের বিবাহ দিতে যাইতেছে না! সুতরাং ভাবিয়া লাভ কি এসব কথা? মুখে উত্তর দিল—তা কি জানি! হয়তো তাই!
নিধুর মা সগর্বে বলিলেন—ভালো লাগতেই হবে যে৷ না লেগে উপায় কি?
নাঃ, মা’র জ্বালায় আর পারিবার যো নাই৷ এত সরল আর ভালোমানুষ লোক হইলে আজকালকার কালে জগতে তাহাকে লইয়া চলাফেরা করাও মুশকিল৷
পৃথিবীতে যে কত খারাপ, জুয়াচোর, বদমাইস লোক থাকে, নিধুর ইতিপূর্বে কোনো ধারণা ছিল না সে সম্বন্ধে৷ কিন্তু সম্প্রতি মোক্তারীতে ঢুকিয়া সে দেখিতেছে৷ মা’র মতো সরলা এ পৃথিবীতে চলে না৷
বেলা ছটার সময় বীরেন বাহির হইতে ডাকিল—নিধু-দা, আসুন—ও নিধু দা—
নিধু বাহিরে আসিতেই বলিল—দেরি করে ফেললেন যে! মঞ্জু কতক্ষণ থেকে খাবার সাজিয়ে বসে—আমায় বললে ডাক দিতে৷
নিধুর মনে হঠাৎ বড় আনন্দ হইল৷ এ অকারণ পুলকের হেতু প্রথমটা সে নির্ণয় করিতে পারিল না—পরে ভাবিয়া দেখিল, মঞ্জু তাহার জন্য খাবার লইয়া বসিয়া আছে—এই কথাটা তাহার আনন্দানুভূতির উৎস৷
—বেশ দাদা, এই বুঝি আপনার বিকেল?
নিধু রোয়াকের একপাশে গিয়া গো-চোরের মতো বসিল৷ এবার সে আরও বেশি সঙ্কোচ বোধ করিতে লাগিল—কারণ বিকালে আরও দু-তিনটি মহিলা সাজগোজ করিয়া এদিক-ওদিক ত্রস্ত লঘুপদে ঘোরাফেরা করিয়া সংসারের ও রান্নাঘরের কাজকর্ম দেখিতেছেন৷
—চা খাবেন না ঠিক?
—না, শরীর খারাপ হয় খেলে৷ অভ্যেস নেই তো—
—তবে থাক৷ একটু শরবৎ করে দেব?
—ও সবের দরকার নেই, থাক৷ কিন্তু আমি যে জন্যে আরও এলাম—
মঞ্জু বিস্ময়ের সুরে বলিল—কি জন্যে?
এটা মঞ্জুর ভান৷ নিধু কি বলিতেছে তাহা সে কথা পাড়িতেই বুঝিয়াছে৷
নিধু বলিল—তোমার গান শুনব—তা ছাড়া আমার মা আসবেন এক্ষুনি—
—জ্যাঠাইমা! বাঃ একথা তো বলেন নি এতক্ষণ?
মঞ্জু মাকে ডাক দিয়া বলিল—ও মা শুনচো, জ্যাঠাইমা পাশের বাড়ীর, আজ এক্ষুনি আসবেন আমাদের বাড়ী৷ গিয়ে নিয়ে আসব?
—না, তোকে যেতে হবে কেন? তুই বরং নিধুকে খাবার দে—পাশের বাড়ী, তিনি ঠিক আসবেন এখন৷
মঞ্জু নিধুকে খাবার দিয়া ঘর হইতে চলিয়া গেল এবং পরক্ষণেই আবার আসিয়া সামনে দাঁড়াইল৷
নিধু জিজ্ঞাসা করিল—তুমি কোন ক্লাসে পড়?
—সেকেন ক্লাসে৷
—কোন স্কুলে?
—সিমলে গার্লস হাইস্কুল৷
নিধু শিক্ষিতা মেয়ের সঙ্গে কখনো মেশে নাই৷ এসব পাড়াগাঁয়ে মেয়েরা হাইস্কুলে পড়া দূরের কথা, অনেকে বাংলা লেখাপড়াই ভালো জানে না৷ নিধুর মনে হইল সে এমন একটি জিনিস দেখিতেছে, যাহা সে কখনো পূর্বে দেখে নাই৷ তাহার মনে চিরকাল সাধ ছিল, ভালো লেখাপড়া শিখিবে—কিন্তু দারিদ্র্যবশত সে সাধ পূর্ণ হইল না৷ তবুও লেখাপড়ার কথা বলিতে সে ভালোবাসে৷ এ পাড়াগাঁয়ে লেখাপড়া-জানা লোক নাই, কলা কুমড়া চাষের কথা শুনিতে বা বলিতে তাহার ভালো লাগে না, অথচ এখানকার গ্রাম্য মজলিসে ওসব কথা ছাড়া অন্য বিষয়ের আলোচনা করিবার লোক নাই৷
নিধু বলিল—আচ্ছা তোমার হিস্ট্রি আছে? এ্যাডিশনাল কি নিয়েচ?
—এ্যাডিশনাল হিস্ট্রিই তো নিয়েচি, আর সংস্কৃত৷
—অঙ্ক না?
—উঁহু, ও সুবিধে হয় না আমার৷
নিধু হাসিয়া বলিল—সেদিক থেকে বেশ মিলেচে বটে! আপনি কোন বছর ম্যাট্রিক দিয়েছিলেন?
—আজ ছ-বছর হল—
—কোথায় পড়তেন?
—মামার বাড়ী থেকে৷
এই সময় মায়ের গলার আওয়াজ পাইয়া নিধু ব্যস্তভাবে বলিল—মা এসেচেন—
মঞ্জু বলিল—আপনি খান—আমি দেখচি—
খানিক পরে গিন্নির সহিত নিধুর মাকে রান্নাঘরের সামনের রোয়াকে বসিয়া কথা বলিতে দেখা গেল৷ নিধুর মা অত্যন্ত সঙ্কোচের সহিত কথা বলিতেছেন, পাছে তাঁহার কথার মধ্যে অত বড়লোকের গিন্নি কোনো দোষ-ত্রুটি ধরিয়া ফেলেন, এই ভয়েই যেন তিনি জড়সড়৷
গিন্নি বলিলেন—আচ্ছা এখানে ম্যালেরিয়া কেমন?
নিধুর মা বলিলেন—আছে বৈকি দিদি৷ ভয়ঙ্কর ম্যালেরিয়া—
—এখানে বারোমাস কিন্তু বাস করা চলে না, যাই বলুন—
—আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না দিদি, আমরা কি তার যুগ্যি? আপনি বয়সেও বড়, মানেও বড়৷
গিন্নি খুশি হইয়া বলিলেন—সে আবার কি কথা! আচ্ছা তাই হবে৷ তুমিই বলব এর পরে—
নিধুর মা বলিলেন—আপনি বলচেন বারোমাস বাস করা চলে না—বাস না করে যায় কোথায় সব৷ এ গাঁয়ে কারো কি ক্ষমতা আছে?
—সে যাই বল৷ আমি তো এই সাতদিনও আসে নি, এর মধ্যেই হাঁপিয়ে পড়েচি৷ ওঁকে বলছিলাম চল এখান থেকে যাই—উনি বলেন পৈতৃক ভিটেটা—এবার পুজোটা করব ভেবেচি, তা আমি বলি—চোখ-কান বুজে থাকি একটা মাস, আর কি করব?
—আপনারা রাজা লোক দিদি, আপনাদের কথা আলাদা৷ আমরা আর যাব কোথায়, তেমন ক্ষমতাও নেই, সুবিধেও নেই৷ কাজেই কাদায় গুণ পুঁতে পড়ে থাকা—
—ওঁকে বলি, বালিগঞ্জে একটা বাড়ী করে ফেল এই বেলা৷
—সে কোথায় দিদি?
—বালিগঞ্জ কলকাতায়৷ খুব ভালো জায়গা৷ আমার কাকা আলিপুরে বদলি হলেন এবার—সবজজ ছিলেন দিনাজপুরে—আমায় বললেন, হৈম, জামাইকে বল আমার বাড়ীর পাশে একটু জমি নিয়ে বাড়ী করতে৷ কাকা আজ বছর-দুই বাড়ী কিনেচেন কিনা বালিগঞ্জে, দুই খুড়তুতো ভাই বড় চাকরি করে, একজন মুন্সেফ, একজন সবডেপুটি—খুব বড় ঘরে বিয়েও হয়েচে দুজনের৷ দানসামগ্রী আর ফার্নিচার দুখানা ঘরে ধরে না—
এই সময় মঞ্জু আসিয়া নিধুর মাকে পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল৷
গিন্নি বলিলেন—এই আমার বড় মেয়ে৷ কলকাতায় পড়ে—
নিধুর মা মঞ্জুর দিকে চাহিলেন এবং সম্ভবত তাহার সাজগোজের পারিপাট্য ও রূপের ছটায় এমন আশ্চর্য হইয়া গেলেন যে আশীর্বাদ দূরে থাক, কোনো কিছু কথা পর্যন্ত বলিতে ভুলিয়া গেলেন৷
গিন্নি বলিলেন—নিধুকে খাবার দিয়েচিস?
মেয়ে বলিল—নিধুদা খাচ্চে বসে৷ খুড়ীমা, আপনি চা খান তো?
নিধুর মা বলিলেন—না মা, চা খাওয়ার অভ্যেস তো নেই!
নিধুর মায়ের প্রত্যেক কথায় ও ব্যবহারে প্রকাশ পাইতেছিল যেন ইহাদের বাড়ী আসিয়া এবং ইহাদের সঙ্গে মিশিবার সুযোগ পাইয়া তিনি কৃতার্থ হইয়া গিয়াছেন৷
মঞ্জু খানিকটা নিধুর মা’র কাছে থাকিয়া আবার নিধুর কাছে চলিয়া গেল৷ বীরেন সেখানে বসিয়া গল্প করিতেছিল৷
বীরেন মঞ্জুকে দেখিয়া বলিল—নিধুদা তোকে কি গান করতে বলচেন—
নিধু বলিল—ও-বেলা বলেছিলে যে! জল খাওয়ার সময়ে গান করবে—
মঞ্জু বেশ সহজ সুরে বলিল—বেশ, করব এখন৷ খুড়ীমা তো শুনবেন—ওঁরা গল্প করচেন যে৷
—আমি মাকে ডাকব?
—না, না, এখন থাক৷ আমি করব এখন গান, ততক্ষণ ওঁদের গল্প হয়ে যাক৷
নিধুর আগ্রহ বেশি হইতেছিল—মেয়েদের মুখে গান সে কখনো শোনে নাই৷ এ সব দেশে মেয়েরা গান গাহে না৷ মেয়ে হারমোনিয়ম বাজাইয়া পুরুষের সামনে গান গাহিতেছে, এ একটা নূতন দৃশ্য যাহা সে কখনো দেখে নাই!
কিছুক্ষণ পরে মঞ্জু সত্যিই হারমোনিয়ম বাজাইয়া গান গাহিল৷ অনেকগুলি গান৷ তাহার কোনো লজ্জা-সঙ্কোচ নাই, বেশ সহজ সরল ব্যবহার৷ নিধুর মা তো একেবারে মুগ্ধ৷ মেয়েটির দিক হইতে তিনি আর চোখ ফিরাইতে পারেন না৷
গান যে ধরনের, সে ধরনের গান তিনি কখনো শোনেন নাই—অনেক জায়গায় কথা বুঝিতে পারা যায় না—কি লইয়া গান—তাহাও বোঝা যায় না৷ শ্যামা-বিষয় বা রামপ্রসাদী গান নয়৷ দেহতত্বও নয়৷ অবিশ্যি এতটুকু মেয়ের মুখে দেহতত্বের গান ভালোও লাগিত না৷
শুনিতে শুনিতে নিধুর মায়ের মনে হইল—তিনি যেন কোথায় মেঘলোকে চলিয়া যাইতেছেন উড়িয়া৷ সেখানে যেন—বাল্যকালে তাঁহার বাপের বাড়ীতে যেমন ফাল্গুন-চৈত্র মাসে শুকনো ধুরফুলের উড়ন্ত পাপড়ি ধরিয়া আনন্দ পাইতেন—বাবুরহাটের সেই পুকুরের ধারে, সেই ফুলগাছতলায় বসিয়া বারো বছরের বালিকাটির মতো আবার ধুরফুলের পাপড়ি ধরিতেছেন—আবার সেই আনন্দভরা বাল্যকাল তাঁহার স্নেহময় পিতাকে লইয়া ফিরিয়াছে, যে পিতার মুখ মনের মধ্যে স্পষ্ট হইয়া এখন আর ফোটে না৷ কথাবার্তাও অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে৷
নিজের অদ্ভ্রজ্ঞাতসারে কখন নিধুর মা’র চোখে জল আসিয়া গেল৷
ইতিমধ্যে হারমোনিয়মের আওয়াজ পাইয়া পাড়ার আরও অনেকগুলি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ছুটিয়া আসিয়াছিল; কিন্তু তাহারা বাড়ীর মধ্যে ঢুকিতে সাহস না করিয়া দরজার সামনে ভিড় করিতেছে দেখিয়া মঞ্জু বীরেনকে বলিল—দাদা, ওদের ডেকে নিয়ে এস বাড়ীর মধ্যে—
নিধুও মুগ্ধ৷ মঞ্জুর মুখের গান শুনিয়া তাহার মনে হইল এ কেমন এক ধরনের জীবন, যাহার মধ্যে সে এই প্রথম প্রবেশ করিল৷ জীবনে এত ভালো জিনিসও আছে! শুধু সাক্ষী শেখানো, কেস সাজানো, যদু-মোক্তারের ব্যবসার সম্বন্ধে উপদেশ—মক্কেল ও হাকিমকে তুষ্ট রাখিবার নানা কলাকৌশল সম্বন্ধে বক্তৃতা—বাড়ীর দারিদ্র্য, অভাব-অভিযোগ—এ সবের ঊর্ধ্বেও এমন জগৎ আছে—আকাশ যেখানে নীল, সূর্যোদয় অরুণরাগারক্ত, সারাদিনমান বিহঙ্গকাকলীমুখর৷ যেখানে উদ্বেগ নাই, গাউনপরা উকীল-মোক্তারের ভিড় নাই, হাকিমদের গম্ভীর গলার আওয়াজ নাই, জেরায় প্রতিপক্ষের মোক্তারের ধূর্ত চোখের দৃষ্টি নাই৷ নিধু বাঁচিল, সে বাঁচিয়া গেল আজ, জগতের সম্বন্ধে তাহার বিশ্বাস বদলাইয়া গেল—সৌন্দর্যের অস্তিত্ব সে খুঁজিয়া পাইল এতদিনে৷
ইতিমধ্যে কখন নিধুর ছোট ভাই রমেশ আসিয়া দাদার কাছে দাঁড়াইয়াছে৷
নিধু বলিল—তুই কখন এলি রে?
রমেশ হাসিয়া বলিল—এই এলাম—
আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল—দিদির গলা শুনে—একবার ভাবলাম, যাব কি না যাব, তারপর আর পারলাম না—
নিধু বলিল—তা আসবিনে কেন? বেশ করেচিস—
সে আরও তৃপ্তি পাইল যে তাহার মা ও রমেশ এমন গান শুনিতে পাইল, কখনো শোনে না তো এসব!
মঞ্জু বলিল—আপনার ছোট ভাই বুঝি?
নিধু ঘাড় নাড়িল৷
—পড়ে?
—পড়ার সুবিধে হয় না এখানে, তবে ওকে মামার বাড়ী রেখে কিংবা নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে এবার পড়াব—খুব বুদ্ধিমান ছেলে৷
—আমরা যদি কলকাতায় বাড়ী করি, আমাদের বাড়ীতে রেখে দেবেন না?
মঞ্জুর উদারতায় নিধু মুগ্ধ হইয়া গেল৷ এরকম কেহ বলে না৷ মঞ্জু ছেলেমানুষ, মন এখনো সরল—তাই বোধ হয় বলিল৷ পরের ঝঞ্ঝাট কে সহজে আজকাল ঘাড়ে করিতে চায়!
রমেশ লজ্জায় ঘাড় গুঁজিয়া বসিয়া রহিল৷
বীরেন বলিল—রমেশ ফুটবল খেলতে পার? একটা ফুটবল টিম করব ভাবচি৷
নিধু রমেশের হইয়া উত্তর দিল—ফুটবল এখানে কে খেলবে? অনেকে চোখেও দেখেনি! তবে ও খেলা শিখে নিতে পারবে চট করে৷ গাছে উঠতে, সাঁতার দিতে, দৌড়াদৌড়িতে ও খুব মজবুত৷
.
বাড়ী ফিরিয়া পর্যন্ত নিধুর মায়ের মন ছটফট করিতে লাগিল, জজবাবুর বাড়ী যে তিনি ও তাঁহার ছেলেরা এত খাতির পাইয়া আসিলেন, কথাটা কাহার কাছে গল্প করেন!
তাঁহার জীবনে এত বড় সম্মান আর কখনো কেহ তাঁহাকে দেয় নাই৷ ওদের দরের লোকের সঙ্গে মিশিয়াছেনই বা কবে!
পুকুরের ঘাটে গা ধুইতে গিয়া দেখিলেন পুবপাড়ার প্রৌঢ়া জগোঠাকরুণ বাসন মাজিতেছেন৷
জগোঠাকরুণ গর্বিতা ও ঝগড়াটে প্রকৃতির বলিয়া গ্রামের সকলেই তাঁহাকে সমীহ করিয়া চলে৷ তাহার উপর জগোঠাকরুণের অবস্থাও ভালো৷ কিন্তু কথাটা যে না বলিলেই নয়! নিধুর মা সহজভাবে ভূমিকা ফাঁদিলেন৷
—ও দিদি, আজ যে এত দেরিতে বাসন মাজচ?
জগোঠাকরুণ বাসনের দিকে চোখ রাখিয়াই বলিলেন—সময় পাই নি৷ আজ ওবেলা দুজন কুটুম্ব এল বাড়ীতে, তাদের জন্যে রান্নাবান্না করতে দেরি হয়ে গেল৷ তারপর বড় ছেলে এসে বললে—মা, খাবার তৈরি করে দাও, আটঘরার হাটে যাব৷ এইসব করতে বেলা গেল একেবারে—
নিধুর মা বলিলেন—আমারও আজ বড্ড দেরি হয়ে গেল৷ অন্য দিন এর আগেই ঘাট সেরে চলে যাই—
জগোঠাকরুণ চুপ করিয়া আপনমনে বাসন মাজিতে লাগিলেন৷
নিধুর মা পুনরায় বলিলেন—মঞ্জু কি চমৎকার গান করলে দিদি!
জগোঠাকরুণ মুখ তুলিয়া বলিলেন—কে?
—ওই যে জজবাবুর মেয়ে মঞ্জু! ওরা আজ খুব খাতির করেচে নিধুকে৷ ওকে চা দিয়ে খাবার দিয়ে জজবাবুর মেয়ে নিজে কাছে বসে গান শোনালে৷ বেশ লোক জজগিন্নিও—তিনি তো ভারি ব্যস্ত, বলেন—নিধুকে আগে দে জলখাবার, ও আমার ছেলের মতো৷ আমায় তো কাছে বসিয়ে কত সুখদুঃখের কথা—
কথাটা জগোঠাকরুণের তেমন ভালো লাগিল না৷
তিনি মুখ ঘুরাইয়া বলিলেন—বাদ দাও ওসব বড়মানুষের কথা! বলে, বড়র পীরিতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ৷ কারু বাড়ী যাইওনে, সময়ও নেই৷ ওদের সঙ্গে মেলামেশা কি আমার সাজে? তুমি বড়লোক আছ, বড়লোক আছ৷ আমি কেন যাব তোমার বাড়ী খোশামোদ করতে? আমার ও স্বভাব নেই—তা তোমরা বুঝি দেখা করতে গিয়েছিলে?
—ওমা, এমনি দেখা করতে যাব কেন? নিধুকে যে জজবাবু নেমন্তন্ন করে নিয়ে গিয়ে দুপুরবেলা কত যত্ন করে খাওয়ালে৷ আবার বিকেলে জলখাবারের নেমন্তন্ন করলে তার ওপর৷ নিধু তো লাজুক ছেলে—কিছুতেই যাবে না, ওরাও ছাড়বে না৷ শেষে জজবাবুর ছেলে নিজে এসে আমাকে, নিধুকে ডেকে নিয়ে গেল৷ একেবারে নাছোড়বান্দা—
জগোঠাকরুণ সংক্ষেপে বলিলেন—বেশ৷
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ৷ পরে নিধুর মা-ই নীরবতা ভঙ্গ করিয়া বলিলেন—না, বেশ লোক কিন্তু ওরা৷
জগোঠাকরুণ মুখ খিঁচাইয়া কহিলেন—কি জানি বাপু, কারো ছন্দাংশেও কোনোদিন থাকিনি—থাকবও না৷ বেশ হোক, খারাপ হোক, যারা আছে তারাই আছে, মেয়েটার নাম কি বললে?
—মঞ্জু৷ কি চমৎকার মেয়ে দিদি!
—বয়েস কত?
—এই পনেরো-ষোলো হবে৷ ধপধপে ফরসা রঙ কি! চেহারা কি!
—তাতে তোমারই বা কি আর আমারই বা কি? বেল পাকলে কাকের কি? ওরা নিধুর সঙ্গে ওদের মেয়ের বিয়ে দেবে?
—না, না—তা আমি বলচিনে৷ তাই কি কখনো দেয়৷
—তবে চুপ করে থাক৷ চেহারা হবে না কেন বল? তোমার মতো আমার মতো পুঁইশাক খেয়ে তো মানুষ নয়? নির্ভাবনায় দুধ-ঘি খেলে তোমারও চেহারা ভালো হত, আমারও চেহারা ভালো হত৷
—সে কথা তো ঠিক দিদি৷
—অত বড় পনেরো-ষোলো বছরের ধিঙ্গী মেয়ে যে নিধুর সামনে মা-বাপের সামনে হারমোনি বাজিয়ে গান করবে—এতেই দেখ না কেন! তোমার বাড়ীর মেয়ে আমার বাড়ীর মেয়ে করুক দিকি, কালই গাঁয়ে ঢি-ঢি পড়ে যাবে এখন৷ বড়মানুষের ওপর কথা বলে কে? ওরা জানচে আজ এসেচি এগাঁয়ে, কাল যাব চলে হিল্লি-দিল্লি—আমাদের নাগাল পায় কে? তাই বলি ওদের সঙ্গে আমাদের মিশতে যাওয়াই বেকুবি—আমি যাচ্চি দেখাশুনো করচি ভেবে, ওরা ভাবে খোশামোদ করতে আসচে!
শেষের দিকের কথায় বেশ কিছু শ্লেষ মিশাইয়া জগোঠাকরুণ তাঁহার বক্তৃতা সমাপ্ত করিলেন এবং মাজা বাসনের গোছা তুলিয়া লইয়া পুকুরের ঘাট ত্যাগ করিলেন৷