৪. প্রাইভেট ক্লাব

১০.

সাদার্ন অ্যাভেনিউর সেই প্রাইভেট ক্লাবটা খুঁজে বার করতে অসুবিধা হল না। চার্লি রাস্তার উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ট্যাক্সি থেকে নামতেই দৌড়ে এল। ভাড়া-টাড়া মিটিয়ে তাকে জিগ্যেস করলাম, আজকের এক্সপিরিয়েন্স কী?

চার্লি যা জানাল তা এইরকম। কালকের মতো আজ আর তাকে চরকি কলে ঘুরতে হয়নি। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড থেকে সোজা এখানেই চলে এসেছে শমিতা। চার্লিও তার ছায়া হয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। কাল খাওয়া-দাওয়া কিছু হয়নি; আজ ফাঁক বুঝে ফুটপাতের একটা ছাতুওয়ালার কাছ থেকে ছাতু-ফাতু কিনে খেয়েছে। তবে স্নানটা হয়নি; সেই কারণে চোখ-টোখ এবং মাথার চাঁদি জ্বালা করছে। এক দমে কথাগুলো বলে হিপ পকেট থেকে একগাদা নোট আর রেজগি বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, নাও। তুমি যে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিল তার এই ব্যালান্স–বললাম, ওটা ফেরত দিতে হবে না; তোমার কাছেই রাখো।

অল রাইট-নোট-টোট আবার হিপ পকেটে পুরতে পুরতে চার্লি বলল, ডিউটি হ্যান্ডওভার করে দিচ্ছি। তুমি ক্লাবে ঢুকে যাও লর্ড; আমি ওফ হয়ে যাচ্ছি।

ঠিক আছে বলতে বলতেই ডরোথির কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটা আমার জন্যে চৌরঙ্গীর একটা রেস্তোরাঁয় বিকেলে বসে থাকবে। আচমকা আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসে গেল। চার্লিকে বললাম, তোমাকে আরেকটা ডিউটি দিয়ে দিচ্ছি। অ্যান্ড ইটস এ ড্যাম গুড থিং

কীসের ডিউটি?

আমার হয়ে তোমাকে এক জায়গায় প্রক্সি মারতে হবে। ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে বলো তো

চৌরঙ্গীর যে রেস্তোরাঁয় ডরোথির অপেক্ষা করার কথা তার নাম, কেবিনের নম্বর এবং সময়টা জানিয়ে বললাম, একজন আমার জন্যে ওখানে ওয়েট করবে। তুমি গিয়ে ওকে একটু ম্যানেজ করে নিও-ইচ্ছা করেই ডরোথির নামটা আর বললাম না।

চার্লি জিগ্যেস করল, খাওয়াবে-টাওয়াবে তো?

তুমি যা খেতে চাও

চার্লি দারুণ খুশি হয়ে চলে গেল। আর আমি পায়ে পায়ে ক্লাবটার গেটের দিকে চলে এলাম। ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছি, ঝকঝকে উর্দি পরা দারোয়ান দৌড়ে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। বলল, সাব, ইয়ে প্রাইভেট ক্লাব। আপ কেয়া মেম্বার হ্যায়?

বুঝলাম ক্লাবের মেম্বারশিপ না পেলে এখানে প্রবেশ নিষেধ। সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় একটা পরিকল্পনা এসে গেল, চোখ-কান বুজে তাকে জানালাম, আমার এখানে আসার কথা; ক্লাবের একজন মেম্বার আসতে বলেছে। আমি তার গেস্ট।

দারোয়ানটা এক পলক আমার পা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত জরিপ করে নিল। তারপর জিগ্যেস করল, আপ কিসকা গেস্ট?

শমিতা বোস মেমসাবকে। বলেই টের পেলাম, ভেতরে ভেতরে বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছি। কেননা দারোয়ানটা যদি আমাকে শমিতার কাছে নিয়ে যায় আর শমিতা যদি আমাকে চিনতে না পারে, অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? গোটা ব্যাপারটা ভেবে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। ম্যাক্সিমাম আমায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে।

দারোয়ানটা আমার সঙ্গে গেল না। দারুণ উদারভাবে বলল, আন্দার যাইয়ে? মেমসাব সুইমিং পুলকা পাশ হ্যায়–

ভেতরে ঢুকেই নুড়ির রাস্তা। তার দুধারে সবুজ লন। লনের পর তিনতলা বিশাল ক্লাব বিল্ডিং। বিল্ডিং-এ ঢুকতেই বাঁদিকে সুইমিং পুল চোখে পড়ল। কাচের  মতো স্বচ্ছ জলে ক’টি মেয়ে সাঁতার কাটছিল। মনে হচ্ছিল যেন কটা লাল-নীল মাছ। পুলটার পারে চারদিক ঘিরে মোজেক করা চত্বর। সেখানে নানারকম ফ্যাশানেবল চেয়ারে বা সোফায় ইন্ডিয়ান এবং নন-ইন্ডিয়ান বেশ কিছু মহিলা আর পুরুষ বসে আছে।

আমি জলের ধারে নীচু ডাইভিং বোর্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পুলের মাঝখান থেকে কে যেন বলে উঠল, হ্যাল্লো

আমি তাকাতেই শমিতাকে দেখতে পেলাম। জলের ওপরে একটা হাত তুলে সে আবার বলল, ওয়েট-বলেই জল কেটে-কেটে পুলটার ধারে এসে অ্যালুমিনিয়ামের স্ট্যান্ড বেয়ে ওপরে উঠে এল।

হে মহান জনগণ, শমিতার দিকে তাকিয়ে আমার নাক দিয়ে ধোঁয়া ছুটতে লাগল। তার পরনে যে সুইমিং কস্টিউমটা রয়েছে, সেটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। নাভির ছইঞ্চির নীচে বিকিনি ধরনের একটা জাঙ্গিয়া; বুকে কালো ব্রা। একটা কালো ফিতে দিয়ে ব্রা আর জাঙ্গিয়াটা সামনের দিকে আটকানো।

একটা চেয়ার দেখিয়ে শমিতা বলল, প্লিজ, দশ মিনিট বসুন; আমি আসছি। দশ মিনিট লাগল না; তার আগেই শমিতা ফিরে এল। এখন তার পরণে হট প্যান্ট আর শার্ট; পায়ে স্ট্রাপে-বাঁধা জুতো।

হে মহান জনগণ, আগেও বলেছি মেয়ে-টেয়ে নিয়ে এ পর্যন্ত অর্থাৎ লাইফের ছত্রিশ-পঁইত্রিশটা বছর মাথা ঘামাইনি। কিন্তু এই মেয়েটা অর্থাৎ শমিতাকে দু-বার মোটে দেখলাম। আমি বলতে পারি এ রকম প্রচণ্ড আকর্ষণীয় ফিগার আগে আর কখনও দেখিনি। এটা আমার ফ্র্যাঙ্ক কনফেসান-অকপট স্বীকারোক্তি। ওকে দেখলেই নার্ভের ভেতর কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়। শমিতা আমার মুখোমুখি আরেকটা চেয়ারে বসল। বলল, আপনাকে এখানে দেখব, ভাবতেই পারিনি; ইটস এ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ।

শমিতা এখন ড্রিংক করে টিপসি বা বেঁহুশ মাতাল হয়ে নেই। এখন সে আশ্চর্য স্বাভাবিক আর স্বচ্ছন্দ। তাকে দারুণ ভালো লাগছিল। যাই হোক তারই নাম করে যে এখানে ঢুকতে পেরেছি সেটা আর বলালম না। যা বললাম তা এই রকম, এখানে একজনের খোঁজে এসেছিলাম। তার সঙ্গে দেখা হল না। তার বদলে পেয়ে গেলাম আপনাকে। সারপ্রাইজটা আমার কাছেও কম প্লেজান্ট না। একটু চুপ করে থেকে আবার বললাম, জানেন, আজ সকালবেলা উঠবার পর আপনার কথাই ফাস্ট মনে পড়ে গিয়েছিল।

রিয়ালি?

সুয়্যার

ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম। শমিতা হাসল, নিশ্চয়ই ভেবেছিলাম এ রকম থার্ড ক্লাস মেয়ে আগে আর কখনও দ্যাখেননি।

নো–আমি মাথা নাড়লাম, ভেবেছি আপনার সঙ্গে আবার কখন দেখা হবে, দেখা হলে চিনতে পারবেন কিনা–

কাল বারো পেগ খাবার আগেই আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বারো পেগের পর দেখা হলে ডেফিনিটলি চিনতে পারতাম না। এখন বলুন কী খাবেন? হুইস্কি, রাম, জিন-এনিথিং ইজ অ্যাভেলেল হিয়ার। বলতে বলতে আচমকা উঠে পড়ল, না, এখানে নয়।

আমি একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম। শমিতা আবার বলল, অ্যাবাউট থ্রি আওয়ার্স আমি এখানে আছি। বোরিং লাগছে। চলুন, অন্য কোথাও গিয়ে ড্রিংক করব।

আমাকে সঙ্গে করে ক্লাব বিল্ডিং-এর বাইরে লনের পাশের পার্কিং জোনে চলে এল শমিতা। এখানে তার ফিয়েট গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। চাবি ঘুরিয়ে ডানদিকের দরজাটা খুলে ড্রাইভারের সিটে বসতে বসতে বাঁদিকের দরজা খুলে দিল সে। বলল, উঠে পড়ুন

আমি উঠতেই শমিতা স্টার্ট দিল। একটু পর আমরা সাদার্ন অ্যাভেনিউতে চলে এলাম। উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে চোখ রেখে শমিতা বলল, আপনার সঙ্গে কাল আলাপ হয়েছে, রাত্রে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন–অথচ আপনার নামটাই জানি না।

আমার যা প্রফেসান তাতে নিজের নাম বলার অসুবিধা আছে। কেউ জিগ্যেস করলে যা হোক একটা কিছু বলে দিই। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের অজান্তে দুম করে আমার আসল নামটাই বলে ফেললাম।

শমিতা বলল, আমার নাম শমিতা বসু।

ওর নাম বলার দরকার ছিল না। কিন্তু শমিতা কী করে জানবে তার নামটা আমি আগেই জেনে গেছি।

এবার বলল, আপনার এখন কোনও জরুরি কাজ-টাজ নেই তো?

মনে মনে বললাম, তোমার পিছনে লেগে থাকাটাই আমার একমাত্র জরুরি কাজ। মুখে অবশ্য বললাম, না। আই অ্যাম টোটালি ফ্রি।

শমিতার মুখ দেখে মনে হল সে খুশি হয়েছে। বলল, ফাইন! তাহলে অনেকক্ষণ আপনার সঙ্গ পাওয়া যাবে।

উইথ প্লেজার।

নানা রাস্তা ঘুরে ঘুরে কখন যে আমরা পার্ক সার্কাসে চলে এসেছিলাম, খেয়াল নেই। আচমকা একটা বিরাট অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিল শমিতা। বলল, ড্রিংকের আগে চলুন একটু আড্ডা দিয়ে যাই। সুতরাং, হে মহান জনগণ, আমাকে নামতেই হল। শমিতাও নেমে পড়েছিল। গাড়িটা লক করে আমাকে নিয়ে সে লিফট বক্সে পুরে ফেলল। দুমিনিটের মধ্যে হাউইয়ের মতো ফিফটিন্থ ফ্লোরে উঠে এসে একটা সুইটের সামনে আমরা দাঁড়ালাম। শমিতা কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দিল একটা নন বেঙ্গলি যুবক। চেহারা দেখে গুজরাটিই মনে হয়-উচ্ছ্বাসের গলায় চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাল্লো

শমিতাও বলল, হ্যাল্লো

এবার ছোকরা এক কাণ্ডই করে বসল। এক হাতে শমিতার মসৃণ সুগোল গ্রীবা বেষ্টন করে হে মহান জনগণ, এই প্রকাশ্য দিবালোকে এবং আমারই চোখের সামনে চকাত করে তার কাঁধে একটা চুমু খেয়ে বলল, আফটার এ লং টাইম ডার্লিং

চোকরার আদরে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি বোধ করল না শমিতা। এটা যেন খুবই একটা নর্মাল ব্যাপার। আস্তে আস্তে গলার থেকে ছোকরার হাতটা নামিয়ে দিয়ে সে বলল, অনেকদিন কোথায়? লাস্ট উইকেও তো এসেছিলাম।

তোমাকে এক দিন না দেখলে মনে হয় এক বছর দেখিনি।

ইউ সোয়াইন, প্লিজ স্টপ ইওর ফ্ল্যাটারি।

এবার আমার দিকে চোখ পড়ল ছোকরার। জিগ্যেস করল, ইনি?

শমিতা বলল, রাজীব সরকার-আমার নতুন বন্ধু। ছোকরাকে দেখিয়ে আমাকে বলল, আর এ হল হরিশ দেশাই-ওল্ড ফ্রেন্ড।

হরিশ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল; কাজেই আমাকেও বাড়াতে হল।

 তারপর একই সঙ্গে দুজনে বলে উঠলাম, গ্ল্যাড টু মিট ইউ।

 শমিতা এবার হরিশকে বলল, বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি?

 হরিশ ব্যস্তভাবে বলল, সরি! এসো

 ভেতরে যেতে যেতে শমিতা জিগ্যেস করল, তুমি ছাড়া আর কে কে আছে?

সুধাময়, অমিত আর রবিন্দর সিং

ওনলি?

এই বিকেলে এর বেশি লোক হয় নাকি। ভিড় বাড়বে সন্ধের পর।

ওদের সঙ্গে ভেতরের একটা ঘরে এসে দেখলাম গোল টেবল ঘিরে তিনটে যুবক রানিং ফ্ল্যান্স খেলছে। চারপাশে এই রকম আরো কটা টেবল সাজানো হয়েছে। তবে সেখানে কেউ নেই। দেখেশুনে মনে হল এটা একটা পার্মানেন্ট জুয়ার আড্ডা। শমিতা কি জুয়াড়িদের সঙ্গে ভিড়ল, ভাবতে পারছিলাম না।

যাই হোক, ওই যুবক তিনটি শমিতাকে দেখে তাস-ফাস ফেলে হরিশের মতোই চেঁচিয়ে উঠল। এবং শমিতা কেন বোজ আসে না, এই নিয়ে খানিকক্ষণ হইচই করল। পরে তাদের উচ্ছ্বাস কমলে যথারীতি আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হল। আলাপের হর হরিশ শমিতাকে বলল, কী, খেলবে নাকি?

শমিতা বল, সিওর—

হরিশ এবার আমার দিকে ফিরল, আপনি?

হে মহান জনগণ, আমি মানুষের উইকনেসের যাবতীয় সুযোগ নিয়ে থাকি।

সেটাই আমার প্রফেসান কিন্তু জুয়া-ফুয়ার ব্যাপারে আমার মাথায় ঢোকে না। বললাম, আজ আমি দেখব।

ও-কে। ওরা খেলতে শুরু করল। আর আমি, মানে আপনাদের এই রাজীব সরকার সাক্ষীগোপাল হয়ে দেখতে লাগলাম।

খেলার মধ্যে একসময় হরিশ বলল, ড্রিংক দিতে বলব?

শমিতা ঘাড় কাত করল, নো। গ্যাম্বলিং-এর সময় গ্যাম্বলিং, ড্রিংকের সময় ড্রিংক। দুটোকে একসঙ্গে আমি ব্লেন্ড করি না।

ভেরি নাইস ফিলজফি।

ঘণ্টা দেড়েক খেলার পর শখানেক টাকা হেরে দুম করে উঠে দাঁড়াল শমিতা!

আমাকে বলল, চলুন—

 হরিশ বলল, কী হল!

বোরিং লাগছে। আচ্ছা চলি। বাই-শমিতা হাত নাড়ল।

 লিফটে করে নীচে এসে আমরা গাড়িতে উঠলাম। এতক্ষণে সন্ধে নেমে গেছে। রাস্তার দুধারে কর্পোরেশনের টিউবলাইটগুলো জ্বলে উঠেছে।

মসৃণ গতিতে গাড়িটা ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছিল শমিতা। দুধার থেকে বাড়ি-ঘর দোকানপাটের, নানা দৃশ্যপট মুহূর্তে মুহূর্তে সরে যাচ্ছিল। আমি কিন্তু সে-সব, দেখছিলাম না। অন্যমনস্কর মতো শমিতার কথাই ভাবছিলাম। সেই বিকেলে থেকে ঘণ্টা দুয়েক তার সঙ্গে সঙ্গে আছি। এর মধ্যে দুজায়গায় গেছে সে। কিন্তু কোথাও বেশিক্ষণ থাকেনি। আসলে কোথায় যেন তার মধ্যে দারুণ একটা অস্থিরতা রয়েছে।

গাড়িটা সুর্কালার রোডে এলে শমিতা হঠাৎ বলল, কী ভাবছেন?

চমকে উঠলাম। চমকটা থিতিয়ে গেলে বললাম, কিছু না তো।

শমিতা হাসল, নিশ্চয়ই ভাবছিলেন। ভাবছিলেন আচ্ছা পাল্লায় পড়া গেছে।

আমি হাসলাম, কোনও উত্তর দিলাম না।

 শমিতা এবার বলল, যাক গে, এখন কোথায় যাবেন বলুন—

কোথায় বলতে?

দুটো হোটেলে আমি ধারে ড্রিংক করতে পারি। আপনি যেখানে বলবেন নিয়ে যাব। বলেই হোটেল দুটোর নাম করল। দুটোই ফাইভ স্টার হোটেল। বললাম, আমার কোনও চয়েস নাই। যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই যাব।

একটু ভেবে শমিতা বলল, কালকের হোটেলটাতেই চলুন

কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা চৌরঙ্গীর সেই বিশাল মাল্টি-স্টোরিড হোটেলটায় চলে এলাম। তারপর সেভেন্থ ফ্লোরের বল রুম-কাম-বার-এ।

চারদিকে লোক গিজ গিজ করছিল। ওধারে ফ্লোর ডান্স চলছে। শমিতাকে দেখে সব টেবল থেকেই একজন দুজন করে জড়ানা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, হোয়-য়–অন ডার্লিং

শমিতা হাত নাড়ল। অর্থাৎ কারো টেবলেই যাবে না। আমাকে নিয়ে এক কোণে একটা ফাঁকা টেবলে গিয়ে বসল। আমরা বসতে না বসতেই একটা ওয়েটার দৌড়ে এল। শমিতা বলল, দো হুইস্কি

ওয়েটার চলে গেল। আমি আন্দাজ করে নিলাম, শমিতা এখন সমানে হুইস্কি টেনে যাবে। যতক্ষণ না সে আউট হয়ে মদ্যপানটা চলবেই।

কাল এবং আজ এই দুদিন শমিতাকে দেখছি। লক্ষ্য করেছি দুটো ব্যাপারে তার দারুণ অ্যাডিকশান। এক নম্বর হল ড্রিংক, দুনম্বর জুয়া। আরো কত ব্যাপারে সে জড়িয়ে আছে, কে জানে। মনোবীণা সান্যল আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন সেটা পালন করতে হলে গ্যাম্বলিং এবং ড্রিংক থেকে শমিতাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, কিন্তু সেটা দু-একদিনের কাজ নয়। হে মহান জনগণ, এই সব অ্যাডিকশন শমিতার রক্তের ভিতর ঢুকে গেছে। একটা কথা মনে হতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালাম। শমিতা অবাক হয়ে বলল, কী হল? বললাম, একটু বসুন, আমি আসছি।

আমি সোজা বার-এর কাউন্টারে চলে এলাম। বার-বয়রা এখন থেকেই খদ্দেরদের জন্যে ড্রিংক-ট্রিংক নিয়ে যাচ্ছে। এক ধারে গাবদা-গোবদা চেহারার বার-ম্যানেজার দাঁড়িয়ে ছিল; সে কাছে এগিয়ে এল, ইয়েস স্যার

আমার আসার উদ্দেশ্যটা তাকে জানিয়ে দিলাম। বললাম, এখন থেকে শমিতাকে যে ড্রিংক সার্ভ করা হবে তাতে যেন অর্ধেক জল মেশানো থাকে।

বার-ম্যানেজার বলল, কিন্তু স্যার, এটা তো ডিজ-অনেস্টি জানাজানি হলে আমাদের রেপুটেশন নষ্ট হবে।

জানাজানি হবে না। আসলে কথাটা কী জানেন, শমিতার লিভারটাকে বাঁচানো দরকার। এ ব্যাপারে প্লিজ আমার সঙ্গে একটু কো-অপারেট করুন। আমিও আপনার সঙ্গে কো-অপারেট করব। ম্যানেজারকে শমিতার লিভারের কথা বললাম। কিন্তু আদতে আমি যে ধীরে ধীরে তাকে অ্যাডিকশান থেকে সরিয়ে নেবার প্ল্যান করেছি তা বলা গেল না। কারণ সেটা বলার রিস্ক আছে। শমিতার মতো ক্লায়েন্ট চলে গেলে বিজনেসের ক্ষতি। কে আর জেনেশুনে ক্ষতিটা চায়।

ম্যানেজার বলল, আপনার কে-অপারেশনের ব্যাপারটা তো বুঝলাম না।

 হাফ জল মেশালেও বিলটা আপনি ফুলই পাবেন।

থ্যাঙ্ক ইউ। কিন্তু আপনাকে আগে আর কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। মিস শমিতা বসু আপনার কেউ হন নাকি?

দুসেকেন্ড চুপ করে থেকে বললাম, তা বলতে পারেন। আচ্ছা চলি। ড্রিংকে জল দেবার কথা মনে রাখবেন।

শমিতার কাছে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরেই হুইস্কি এসে গেল। এলোমেলো কথা বলতে বলতে খেতে লাগলাম। এর মধ্যে যে সব নতুন নতুন কাস্টমার আসছে তারা সবাই শমিতার দিকে হাত তুলে বলে যাচ্ছে, হ্যালো–

শমিতাও হাত তুলছে, হ্যালো

দশ পেগ হয়ে যাবার পর হঠাৎ যেন খেয়াল হল শমিতার। বলল, এটা কী হল বলুন তো?

 কোনটা? আমি সোজা শমিতার চোখের দিকে তাকালাম।

দশ পেগ খাওয়া হয়ে গেল কিন্তু একটুও টিপসি লাগছে না! কী হুইস্কি সার্ভ করছে! একটুও কিক নেই! আপনি কোনও কিক পাচ্ছেন?

হে মহান জনগণ, দশ পেগ মদ্যপান করলেও আসলে শমিতা খেয়েছে পাঁচ পেগ; বাকিটা টালা ট্যাঙ্কের বিশুদ্ধ ফিলটারড় ওয়াটার। সে যা মাতাল তাতে পাঁচ পেগে কী করে কিক পাবে?

শালা ম্যানেজার মওকা বুঝে আমার হুইস্কিতেও জল মিশিয়ে দিয়েছে। আমিও মাছের জল খাওয়ার মতো ড্রিংক করতে পারি। পাঁচ পেগ হুইস্কি আমার পেটে কিঞ্চিৎ নিম্নচাপ সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। কিন্তু সে কথা তো শমিতাকে বলা যাবে না। বললাম, হ্যাঁ, দারুণ কিক পাচ্ছি

এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল শমিতা, ওয়েটার–

ওয়েটার দৌড়ে এল। আমার ভয় হল, হুইস্কির ব্যাপার নিয়ে শমিতা চেঁচামেচি করবে। কিন্তু কিছুই করল না সে। শুধু বলল, জলদি বিল লাও–বিলে সই করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাকে নিয়ে হোটেলের পার্কিং জোনে চলে এল শমিতা। তাই সেই ফিয়েট গাড়িটায় আমাকে তুলে নিজে উঠল। তারপর বাইরে বেরিয়ে বলল, হোটেলে বোরিং লাগছিল। চলুন, আপনাকে একটু ওপের এয়ারে ড্রিংক করাব।

হে মহান জনগণ, ওপেন-এয়ারের বাংলা যেন কী? ও হা—মুক্তাঙ্গন। খোলা আকাশের নীচে মুক্তাঙ্গনে শমিতা আমাকে ড্রিংক করাতে চাইছে। দেখাই যাক আমার নাকে বঁড়শি লাগিয়ে শমিতা কোথায় কতদুরে টেনে নিয়ে যায়। ভবানীপুর এসে একটা গলির ভিতর গাড়ি ঢোকাল শমিতা। তারপর সোজা যেখানে গিয়ে থামল সেটা একটা বাংলা মদের দোকান। আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে একটু হেসে বলল, স্কচে কিছুই হল না; একটু কান্ট্রি লিকার খেয়ে দেখা যাক। বলেই জোরে হর্ন বাজাল।

আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল, এ শহরের যাবতীয় খুঁড়িখানা-দিশি বা বিলিতি–সবই চেনে শমিতা–হর্নের শব্দে দোকান থেকে একটা ছোকরা ছুটে এল। তার হাতে দাম দিয়ে এক বোতল কালীমার্কা বাংলা মদ আনতে বলল শমিতা।

কিছুক্ষণের মধ্যে সেই বোতলটি নিয়ে আমরা গঙ্গার পাড়ে চলে এলাম। ওপেন এয়ারে। মুক্ত অসীম আকাশের তলায় দুজনে মুখোমুখি বসে বোতলটি যখন শেষ করলাম শমিতা পুরোপুরি আউট হয়ে গেছে। আমার মাথার ভেতরেও একটানা জোরালো কনসার্ট বেজে যাচ্ছে। তবে শমিতার মতো বেহুশ হয়ে যাইনি; চেতনার একটু আধটু তলানি তখনও পড়ে আছে।

শমিতা আউট হয়ে গেলেও শুয়ে পড়েনি; বসেই ছিল। তার ঘাড় ভেঙে মাথাটা বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। হাতদুটো আলগা হয়ে শরীর থেকে যেন ঝুলছে।

এই ফাঁকা নির্জন জায়গায় আর বসে থাকার মানে হয় না। শমিতাকে টেনে তুলে কোনওরকমে গাড়িতে নিয়ে এলাম। ড্রাইভ করার মতো ওর অবস্থা নয়। আমিই গাড়িটা চালিয়ে ইডেন গার্ডেন, আকাশবাণী ভবন, নেতাজী স্ট্যাচু ইত্যাদির পাশ দিয়ে যখন রেড রোডে এসে পড়েছি শমিতা অতি কষ্টে মাথাটা তুলে জড়ানো গলায় জিগ্যেস করল, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?

বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।

নেশায় শমিতার চোখ বুজে গিয়েছিল। সেটা আধাআধি খুলে আরক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সে। তারপর বলল, আমি বাড়ি যাব না।

দারুণ নেশার মধ্যেও চমকে উঠলাম, তা হলে কোথায় যাবেন?

এনি হোয়ার। হেভেন অর হেল–যেখানে ইচ্ছা নিয়ে চলুন।

রেড রোড় বাঁয়ে ফেলে আমরা পার্ক স্ট্রিটের কাছে চলে এসেছিলাম। আমার ইচ্ছা ক্যামাক স্ট্রিট, সাকুলার রোড হয়ে গুরুসদয় রোডে পড়ব; সেখানে থেকে ডাইনে ঘুরে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। শমিতা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ইউ সোয়াইন, বললাম না বাড়ি যাব না। গাড়ি ঘেরাও

কলকাতার রাস্তাঘাটের ম্যাপ ভুলে যায়নি শমিতা। যাই হোক স্কচ এবং বাংলা পাকস্থলীতে চালান করবার পরও এই রকম সেটুকু এখনও আমার আছে যে এত রাত্তিরে খামখেয়ালি মাতাল যুবতী মেয়েকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাকে তার নিজের ঠিকানাতেই জমা করে দেওয়া দরকার। হে মহান জনগণ, চৌরঙ্গী পেরিয়ে পার্ক স্ট্রিটে ঢুকিয়ে দিলাম।

এবার শমিতা আমার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে স্টিয়ারিংটা ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। আর সমান চিৎকার করতে লাগ, ইউ বাস্টার্ড, সান অফ এ বিচ–আমার কথা তোমার কানে ঢুকছে না!

এত রাত্রে রাস্তা প্রায় ফাঁকাই; গাড়ি-টাড়ি তেমন নেই। কিন্তু যেভাবে শমিতা স্টিয়ারিংটার ওপর হামলা করছে তাতে গাড়িটা ফুটপাতে উঠে ল্যাম্পপোস্ট-টোস্টে ধাক্কা মেরে অ্যাকসিডেন্ট বাধিয়ে দিতে পারে।

অগত্যা কী আর করা, গাড়িটা ঘুরিয়ে নিলাম এবং এত রাত্তিরে কোথায় আর যাব; সোজা এন্টালিতে নিজের সেই আস্তানায় ফিরে এলাম।

হে মহান জনগণ, মেয়ে ফুসলে কিডন্যাপ করার চার্জে না পড়ে যাই। আপনারা কিন্তু সাক্ষী হয়ে রইলেন।

যাই হোক গাড়িটা লক করে শমিতাকে ধরে ধরে তেতলার ছাদে উঠতে উঠতে হাতঘড়িটা একবার দেখে নিলাম, এখন সাড়ে বারোটা বাজে। এই মধ্যরাতে গোট বাড়িটা ঘুমিয়ে পড়েছে।

ছাদে আসতে চোখে পড়ল, দু-ঘরেই লাইট জ্বলছে; আর মেঝেতে বসে দুই হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে ঢুলেছে চার্লি। চার্লির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। তার মাথায় এবং হাতে দুটো বড় ব্যান্ডেজ।

পায়ের শব্দে চার্লি চোখ মেলে তাকাল। আমার সঙ্গে শমিতাকে দেখে মেঝেতে হাতের চাপ দিয়ে বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়াল। তার ব্যান্ডেজ-ট্যান্ডেজগুলো দেখিয়ে জিগ্যেস করলাম, তোমার এ অবস্থা হল কী করে?

চার্লি বলল, আমার কথা পরে শুনো। লর্ড, তুমি সত্যিই লর্ড। চোখের কোণ দিয়ে শমিতাকে দেখাতে দেখাতে গলার স্বরটা ঝপ করে অনেকখানি খাদে নামিয়ে দিল, কালকে ফাস্ট দেখলে আর আজই বাড়িতে এনে তুললে! ইউ আর রিয়ালি গ্রেট। কী করে ম্যানেজ করলে বলো তো?

শমিতাকে আমার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললাম, সব বলব। তার আগে চট করে আমি একটা ফোন করে আসছি। তুমি একে একটু দেখো।

আমি বেরিয়ে গেলাম। মনোবীণা সান্যালকে একটা ফোন করতে হবে। আমাদের বাড়ির প্রায় উল্টোদিকে একটা পেট্রোল পাম্প রয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত সেটা খোলা থাকে। সেখান থেকে পয়সা দিলে ফোন করা যায়।

সোজা পেট্রোল পাম্পে এসে ডায়াল করতেই মনোবীণাকে পাওয়া গেল। আমার অবশ্য ভয় ছিল এত রাত্রে তাকে পাব কিনা। সে যাক, ওধার থেকে তার জড়ানো বিরক্ত কর্কশ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হু দা ডেভিল ইউ আর?

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মহিলা যথেষ্ট পরিমাণে মদ্যপান করেছেন। তার কণ্ঠস্বর রীতিমতো জড়ানো। বললাম, আমি রাজীব-রাজীব সরকার।

এ রকম নাম আমি কখনও শুনিনি।

প্রায় দশ মিনিট নিজের সম্বন্ধে এবং তিনি যে শমিতার দায়দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়েছেন সে সম্বন্ধে বলবার পর মনোবীণা একটু একটু চিনতে পারলেন যেন। বেশ রুক্ষ স্বরেই বললেন, তা এত রাতে কী?

তাকে জানালাম, শমিতাকে আমার এখানে আনতে হয়েছে। কেননা সে বাড়ি যেতে চাইছে না।

মনোবীণা বললেন, সো হোয়াট? আপনাকে রেসপনসিবিলিটি দেওয়া হয়েছে। যা ভালো বুঝবেন করবেন—

না, ব্যাপারটা আপনাকে জানানো দরকার। তাই

কিছু দরকার নেই। মাঝরাত্রে এভাবে আর যেন বিরক্ত করবেন না। লাইনটা ঝড়াৎ করে কেটে দিলেন মনোবীণা।

আমি ফিরে এসে দেখলাম, শমিতা ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই বিকেল থেকে হুইস্কি আর বাংলা মদ ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়েনি তার। খাবার জন্যে তাকে অনেক ডাকাডাকি করলাম কিন্তু শমিতার ঘুম ভাঙানো গেল না।

সুতরাং চার্লিকে আর আমি পাশের ঘরে খেয়ে সেখানেই পাশাপাশি বিছানা পেতে নিলাম। আর তখনই চাাকে জিগ্যেস করলাম, তোমার মাথায় হাতে ব্যান্ডেজ কেন? অ্যাকসিডেন্টে পড়েছিলে নাকি?

চার্লি খাড়া উঠে বসল, দারুণ উত্তেজিতভাবে বলল, ইট ইজ ফর ইউ লর্ড।

কেন, আমি কী করলাম?

চৌরঙ্গীর রেস্তোরাঁর কাছে প্রক্সি দিতে পাঠিয়েছিলে! যদি জানতাম ওখানে ডরোথি বসে আছে, ও গড, আমি কিছুতেই যেতাম না; জানো তোমার বদলে আমি গেছি শুনেই প্লেট কাপ ছুঁড়তে আরম্ভ করল। তারপর ফর্ক-টক দিয়ে অ্যাটাক করল। সেই জন্যেই আমার এই হাল।

শুনে দারুণ হাসতে লাগলাম। হাসির তোড়ে আমার শরীর বেঁকে যেতে লাগল। চার্লির ব্যাপারটা খুবই দুঃখের, সেই সঙ্গে ভীষণ মজারও।

চার্লি এক পলক আমাকে দেখল। তারপর ভয়ানক রেগে গিয়ে আমার দিকে পিছন ফিরে আবার শুয়ে পড়ল। বলল, ডোন্ট লাফ লর্ড ইটস নট ফান; লাইফ অ্যান্ড ডেথের কোশ্চেন। শি ইজ এ টাইগ্রেস-ইয়েস, এ টাইগ্রেস।

আমি হাসতেই লাগলাম।

.

১১.

পরের দিন বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে গেল। চোখ ফেলতেই লক্ষ্য করলাম যে ঘরে আমি শুই, সেখানে নেই। আরো দেখলাম আমার দেড় ফুট দূরে ময়লা চিটচিটে বিছানায় কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে চার্লি।

একটু ভাবতেই কাল রাতের সব ঘটনা মনে পড়ে গেল। ধড়মড় করে উঠে প্রথমে গেলাম পাশের ঘরে। নিজের বিছানার দিকে তাকাতেই আচমকা ফোর ফর্টি ভোল্টের বিদ্যুৎ আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে গেল যেন। শমিতা ডানদিকে ঈষৎ হেলে শুয়ে আছে। তার হট প্যান্টের কটি বোতাম খোলা, নাভির অনেকটা জায়গা উন্মুক্ত। শার্ট এবং ব্রার হুক আলগা করে দেবার জন্যে সোনার দ্বীপের মতো তার দুটি বুক বেরিয়ে এসেছে। ঘুমের ঘোরেই হয়তো ব্রা-টা খুলে ফেলেছে শমিতা।

মণিমোহন মল্লিকের কথা আমার মনে পড়ে গেল। শমিতার ন্যুড ছবি তুলে দেবার দায়িত্ব সে আমাকে দিয়েছে। হে মহান জনগণ, আমার পেক্ষ সেটা কি সম্ভব? আফটার অল আমার শরীরে ভদ্দরলোকের কিঞ্চিৎ রক্ত তো রয়েছে। তাড়াতাড়ি একটা পাতলা চাদরে শমিতার শরীর ঢেকে দিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।

আধ ঘণ্টা বাদে ফিরে এসে দেখি চার্লি কখন যেন উঠে পড়েছে। বিছানা-টিছানা গুটিয়ে এখন সে চা বানাচ্ছে। ও ঘরে শমিতাও উঠে বিছানায় বসে অবাক হয়ে চারদিক দেখছিল। আমি সোজা তার কাছে চলে এলাম। বললাম, গুড মর্নিং। কাল রাত্রে ভালো ঘুম হয়েছে?

আমার কথায় উত্তর না দিয়ে শমিতা জিগ্যেস করল, কাল রাত্তিরে কি আমি এই ঘরে ঘুমিয়েছি?

হ্যাঁ।

এখানে আমি এলাম কী করে?

হে মহান জনগণ, আমার শিরদাঁড়ার ভোর দিয়ে ঠান্ডা বরফ নেমে গেল। বলে কী মেয়েটা? শেষটায় আমাকে ফাঁসিয়ে দেবে না তো? বললাম, আপনার মনে পড়ছে না?

ভুরু কুঁচকে কী ভাবল শমিতা। একটু একটু করে কাল রাত্রের ব্যাপারটা যেন মনে পড়ল তার। বলল, আমি বাড়ি যেতে চাইনি; তাই আপনি এখানে নিয়ে এসেছেন–তাই না?

আমি নিজেকে খুবই স্টেড়ি রাখতে চাইছি। বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ

আচ্ছা এটা কি আপনার বাড়ি?

হ্যাঁ।

কে কে থাকে এখানে?

 আমি আর আমার এক বন্ধু চার্লি।

একটু চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে নিল শমিতা। তারপর বলল, কাল রাত্তিরে আমি কি একাই এ-ঘরে শুয়েছিলাম?

অবাক হয়ে বললাম, হ্যাঁ—

আপনি কোথায় শুয়েছিলেন?

 চার্লি আর আমি ওই পাশের ঘরটায় শুয়েছিলাম।

দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে শমিতা বলল, স্ট্রেঞ্জ! বাড়িতে নিয়ে এলেও কোনওরকম চান্স নিলেন না?

শমিতা আমাকে রেপ কেসে-টেসে ফাঁসিয়ে দিতে চায় নাকি? আমার কানের ডগা গরম হয়ে উঠল। টের পেতে লাগলাম, ব্লাড প্রেসারটা একটা বিপজ্জনক সীমায় পৌঁছে গেছে। বললাম, ইউ মে টেক মি ফর এ জেন্টলম্যান–আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দ্রুত একবার দেখে নিয়ে বলল, হয়তো তাই। তবু জেন্টলম্যান বা ব্রুট–আমাকে এ অবস্থায় পেলে কেউ ছাড়ত না। সবাই তো বলে আমার মধ্যে দারুণ সেক্স আছে; আমি দুর্দান্ত অ্যাট্রাক্টিভ; আমার ফিগার দেখলে নাকি স্ট্রোক হয়ে যায়। আপনি কী বলেন?

উত্তর দিলাম না।

শমিতা আমার দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বলল, আপনি তো আমার প্রায়-নুড শরীর দেখেছেন; তবু ভদ্রলোক হয়ে ছিলেন?

চমকে বললাম, কে বললে আমি দেখেছি?

সকালে উঠে আমি নিজের দিকে একবার তাকিয়েছিলাম। তা ছাড়া আমার গা একটা চাদর দিয়ে টাকা ছিল। মনে আছে কাল চাদর গায়ে দিয়ে শুইনি। এটা কে দিয়েছে? আপনি?

হ্যাঁ। মানে

চাদরটা দেবার সময় আমার ফিগার আপনি দ্যাখেননি?

সাঁতার-না-জানা মানুষের মতো গভীর জলে ডুবতে ডুবতে কী বলতে যাচ্ছিলাম, চার্লি এসে বাঁচিয়ে দিল। সে আমাদের জন্যে চা নিয়ে এসেছে।

শমিতাও আর ওই ব্যাপারটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করল না। চা খেয়ে বাথরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বলল, এবার বাড়ি যাব।

বললাম, এখনই যাবেন!

হ্যাঁ। সকালেই আমি স্নান করি। বাড়ি গিয়ে স্নানটা করতে হবে

 দুম করে নিজের অজান্তেই বলে বসলাম, এখানেও তো জল আছে

শমিতা বলল, কিন্তু শাওয়ার নেই। শাওয়ার ছাড়া আমার আবার স্নান করে আরাম হয় না।

হে জনগণ, পৈতৃক প্রপার্টি হিসেবে পাওয়া এই চল্লিশ টাকার ভাড়া বাড়িতে শাওয়ার কোথায় পাব? আমি চুপ করে রইলাম।

শমিতা এবার উঠে পড়ল। বলল, আমার গাড়িটা কোথায়?

বললাম, নীচে রয়েছে।

চলুন, একটু দেখিয়ে দেবেন।

শমিতাকে সঙ্গে করে নীচের রাস্তায় এলাম। গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে শমিতা বলল, আপনার এই বাড়িটার অ্যাড্রেস যেন কী?

বাড়ির নম্বর এবং রাস্তার নাম বললাম।

শমিতা বলল, ঠিকানাটা মনে করে রাখলাম। ড্রিংক-ট্রিংক করে রাত্রে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে না করলে কিন্তু এখানে চলে আসব।

উইদাউট হেজিটেসন।

একটু চুপ করে থেকে এক পলক আমাকে দেখল শমিতা। তারপর বলল, আই হ্যাভ স্টার্টেড লাইকিং ইউ। তারপর আমি কিছু বলার আগেই শমিতা গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে আবার বলে উঠল, আবার কখন দেখা হচ্ছে?

বললাম, আপনিই বলুন।

সন্ধের সময় পার্ক স্ট্রিটে চলে আসুন। বলে একটা হোটেলের নাম করল শমিতা। আমি ঘাড় হেলিয়ে দিলাম, যাব।

শমিতা চলে গেল। আমি বাড়িতে ঢুকে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে আবার ছাদের দিকে উঠতে লাগলাম। তেতলার ল্যান্ডিং-এর কাছে আসতেই ডরোথির চিৎকার কানে এল, ইউ স্কাউনড্রেল ব্রুট–

চমকে তাকিয়ে দেখি ডরোথি তাদের ফ্ল্যাটের সামনের প্যাসেজটায় দাঁড়িয়ে আছে। ডরোথিকে দেখে দাঁত বার করে হাসলাম। কেননা পালাবার আর উপায় নেই; আমি একটা ফঁদে পড়ে গেছি যেন।

হাসিতে গলল না ডরোথি। বরং আরো ক্ষেপে উঠল, কাল রেস্তোরাঁয় কাকে পাঠিয়েছিলে? সান অফ এ বিচ একটা থার্ড ক্লাস চোরকে পাঠাতে তোমার লজ্জা করল না?

বারকতক ঢোক গিলে বললাম, মানে আমি একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম। ভাবলাম তুমি একা-একা বসে থাকবে। তাই চার্লিই–

কাজ চালিয়ে নিক–ডরোথি রক্ষাকালীর মতো হিংস্র হয়ে উঠল, রাসকে বিস্ট, প্ল্যান করে তুমি আমাকে ইনসাল্ট করেছ। বলেই হাতের খবর কাগজটা ছুঁড়ে মারল।

টক করে কাগজটা লুফে নিতে নিতে বললাম, বিশ্বাস করো, মা দুর্গার দিব্যি, তোমাদের যীশুর দিব্যি-ইনসাল্ট করার কোনও ইচ্ছে ছিল না।

নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিতে দিতে ডরোথি, বলল, তোমার সঙ্গে আজ থেকে অল রিলেসান কাট অফ। সোয়াইনি, ব্রুট

হে মহান জনগণ, চার্লির জন্যে ডরোথির হাত থেকে বোধহয় চিরকালের জন্যে রক্ষা পাওয়া গেল। মনে মনে তার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে বললাম–চার্লি হেন্ডারসন, যুগ যুগ জিয়ো–বলেই সিঁড়ি টপকে টপকে ছাদে চলে এলাম।

.

১২.

অনেকদিন পর চার্লি আর আমি আজ একসঙ্গে দিনের বেলায় বাড়িতে আছি। চার্লি বলল, লর্ড টাকা দাও; চিকেন আর সবজি-টবজি নিয়ে আসি। ফলে খাওয়া-দাওয়া সেরে অফিসে আসতে বেশ দেরি হয়ে গেল আমার।

কাচের  দেয়ালের ওপারে লতিকা তার জায়গায় বসে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছিল। আমাকে দেখেই লাইনের ওধারের অদৃশ্য ব্যক্তিটিকে ব্যস্তভাবে বলে উঠল, একটু ধরুন, উনি এসে গেছেন। তারপর টেলিফোনটা কাচের  দেয়ালের ফুটোর ভেতর দিয়ে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, মণিমোহন মল্লিক।

মণিমোহনের সঙ্গে কীভাবে কথা বলব, দু-চার সেকেন্ড ভেবে নিলাম। তারপর ফোনটা কানে লাগিয়ে বললাম, নমস্কার মিস্টার মল্লিক। বলুন–

লাইনের ওধার থেকে মণিমোহনের কণ্ঠ ভেসে এল। প্রতি-নমস্কার জানিয়ে তিনি বললেন, খবর তো আপনার কাছে। কাজটা শুরু করে দিয়েছেন?

নিশ্চয়ই। আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি; কাজটা তো করে দিতেই হবে। মনে মনে বলাম, শালা শুয়োরের বাচ্চা ইহজন্মে তুমি আমাকে দিয়ে ওই কর্ম করাতে পারবে না।

মণিমোহন বললেন, কাজের নেচারটা মনে আছে?

নিশ্চয়ই।

বলুন তো? কী রকম মনে আছে দেখি

শমিতা বোসের ন্যুড ফোটো আর বেডরুমের ছবি–এই তো?

ভেরি গুড। বেশ তারিফের সুর মণিমোহন বললেন, মনে হচ্ছে আমার কাজের জন্য রাইট লোককেই ধরেছি। ফোটোগুলো কবে পাচ্ছি?

আপনি তো আমাকে দুমাস সময় দিয়েছেন

তা দিয়েছি। তবে আগে দিতে পারলে এই কাজটা নিয়ে অতদিন আমাকে থাকতে হয় না; আমিও নিজের কাজ শুরু করে দতে পারি।

ফোটোগুলো নিয়ে কী করবেন বলুন তো স্যার?

আপনাকে সেদিনই বলে দিয়েছি এ নিয়ে কোনওরকম প্রশ্ন করা চলবে না।

নিষেধাজ্ঞাটা আমার মনে ছিল। তবু ইচ্ছা করেই কথাটা আবার জিগ্যেস করেছি। হে মহান জনগণ, আমি স্রেফ একটা চান্স নিয়েছিলাম। অসাবধানে দুম করে মণিমোহন হয়তো নিজের উদ্দেশ্যটা বলেও ফেলতে পারেন। কিন্তু লোকটার স্নায়ু-টায়ু দারুণ সজাগ।

কিন্তু আমার নামও রাজীব সরকার। তাই একটু ভেবে বললাম, স্যার, ফোটোগুলো আপনার কী কাজে লাগবে-তা নিয়ে আমার হেড-এক নেই। তবে জানতে পারলে আমার কাজের একটু সুবিধা হত। মানে আপনার পারপাস বুঝে সেই অ্যাঙ্গেল থেকে শমিতার ফোটো তুলতাম।

তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন না মণিমোহন। মনে হল, আমার শেষ কথাটায় কাজ হয়েছে। আফটার অল, বাবা মণিমোহন তুমি যদি ডালে ডালে ঘোরো তবে আমি চলি পাতায় পাতায়। তোমার মতো বহু মালকে আমি চড়িয়ে বেড়াই। কয়েক সেকেন্ড বাদে মণিমোহন বললেন, ব্ল্যাকমেল শব্দটা শুনেছেন?

আমি চমকে উঠলাম, নিশ্চয়ই

ওটা মাথায় রেখে ফোটো তুলে যান। ও-কে?

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই লাইনটা কেটে দিলেন মণিমোহন। ফোনটা কাচের  দেয়ালের ফেঁকর গলিয়ে লতিকাকে ফেরত দিতে দিতে বললাম, জানো লতিকা, কাল রাত্তিরে শমিতা একটা দারুণ।

আমার কথা শেষ হবার আগেই লতিকা বাকিটুকু বলে উঠল, কাণ্ড করেছে-এই তো? তোমার এক্সপিরিয়েন্সের কথা পরে শুনব। আগে তুমি আমার কথাটা শুনে নাও

বলো–

কাল তুমি বেরিয়ে যাবার পর থেকে আজ বেলা বারোটা পর্যন্ত বাইশ জন লোক এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে গেছে। এদের কেউ এমপি হতে চায়, কেউ এম-এল-এ, কেউ কাউন্সিলার কেউ মিনিসিপ্যাল কমিশনার।

যা খুশি হতে চাক। কিন্তু কেউ কিছু হবে না।

লতিকা আমার কথা হয়তো শুনতে পেল না। নিজের মনেই বলে যেতে লাগল, কয়েকটা মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকসান আসছে মাসেই হচ্ছে। এখন থেকেই তাহলে ক্যাম্পেনের কাজ

শুরু করতে হবে। তাই ভাবছিলাম–

বললাম, এইড-ইলেকসানের এবার গণেশ উল্টে দেওয়া দরকার–কেমন?

হ্যাঁ! বেশিদিন ওটা রাখলে অ্যাডভান্সওলারা এসে ট্রাবল ক্রিয়েট করবে।

বেশ তো; দাও উল্টে—

আমার ইচ্ছা কাল-পরশুর মধ্যেই ওখানে অন্য অফিস বসিয়ে দেব।

কী অফিস বসাতে চাও?

সেটাও আমি ভেবে রেখেছি। ওখানে একটা জ্যোতিষের অফিস বসাব।

একটু চিন্তা করে বললাম, নট-এ ব্যাড আইডিয়া

 লতিকা বলল, নামটাও আমি ঠিক করে রেখেছি-ভূত-ভবিষ্যৎ।

বললাম, নামটা কোয়াইট গুড। তবে ওটা চলবে না। ইংরেজি নাম দিতে হবে। কারণ নন-বেঙ্গলি ক্লায়েন্টও তো আছে। তাদেরও ফাঁদে ফেলা দরকার। তা ছাড়া বাংলা নাম-ধাম অচল; যতই যা-ই হই, ভেতরে ভেতরে আমরা আজও ইংরেজিয়ানার চাকর হয়ে আছি।

মিনিটখানেক চিন্তা করে লতিকা বলল, তাহলে নাম দেওয়া যাক পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার।

আমি প্রায় চেঁচিয়েই উঠলাম, ইটস এ বিউটি। এই নামই দেওয়া হবে।

তাহলে মাইন-বোর্ডওলা আর ইন্টেরিয়র ডেকরেটরদের খবর দিই? কারণ বসার অ্যারেঞ্জমেন্ট-ট্যারেঞ্জমেন্টগুলো তো বদলে দিতে হবে।

নিশ্চয়ই। আর নেক্সট উইকে সব কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে দাও। ইংরেজি-বাংলা। দুই ল্যাঙ্গুয়েজেই ভালো করে দুটো রাইট-আপ তৈরি করে ফেলল।

আচ্ছা

আর আমাদের এইড-ইলেকসানে এখন সমরেশ বসছে তো? ওর জায়গায় পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারে অন্য কাউকে বসাতে হবে। কারণ অ্যাডভান্স যারা দিয়েছে তারা নিশ্চয়ই এসে হানা দেবে। তখন সমরেশকে দেখলে ছিঁড়ে ফেলবে। ওর বদলে কাকে বসাতে চাও?

বর্ধমানের দুটো ছেলে কিছুদিন ধরে চাকরির জন্যে আসছে। বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ। ভাবছি ওদের একজনকে অফিসার, আরেকজনকে বেয়ারা করে ওখানে বসাব।

ঠিক আছে।

কথা শেষ করেই সাইনবোর্ড এবং ইন্টেরিয়ার ডেকরেটরকে ফোন করে কালই চলে আসতে বলল লতিকা। প্রতিবারই অফিস তুলে দিয়ে নতুন অফিস বসবার আগে ভেতরের সাজসজ্জা, চেয়ার-টেবল, দেয়ালের রঙ সব বদলে দিই। এই কাজটা আমরা এক রাতের মধ্যেই সেরে ফেলি। পরের দিন পুরনো কনসার্নের খদ্দেররা এসে নতুন অফিস নতুন লোকজন দেখে একেবারে হাঁ হয়ে যায়। তারা বুঝতেই পারে না পুরোনো ম্যানেজমেন্টই এই নতুন অফিস খুলেছে। লতিকার ফোন হয়ে গেলে আমি আবার সেই আগের কথায় ফিরে গেলাম। বললাম, এবার শমিতার ব্যাপারটা শোনো

লতিকা হেসে হেসে বলল, শমিতার ব্যাপারে তোমার আরো অনেক এক্সপিরিয়েন্স হবে। একটু একটু করে শুনে সাসপেন্সের মধ্যে থাকতে আমার ভালো লাগে না। এক্সপিরিয়েন্সটা কমপ্লিট হোক; একসঙ্গে পুরোটা শুনব। বলতে বলতে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সে।

জিগ্যেস করলাম, উঠলে যে?

আমাকে বাড়ি যেতে হবে। মায়ের শরীরটা খুব খারাপ।

কী হয়েছে? আমি যাব?

না-না, তেমন সিরিয়াস কিছু নয়। তোমার যাবার দরকার নেই।

লতিকা চলে গেল। সত্যিই কি ওর মায়ের শরীর খারাপ হয়েছে? কেনই বা শমিতার কথা ও শুনতে চাইল না? মায়ের অসুস্থতার নাম করে আমাকে কি এখন এড়াতে চাইল? সব কিছু কেমন যেন অস্পষ্ট আর ধোঁয়াটে মনে হতে লাগল আমার।

ছটা পর্যন্ত চুপচাপ অফিসে বসে রইলাম। বাইরে যখন অন্ধকার নামল, রাস্তায় কর্পোরেশনের মার্কারি ল্যাম্পগুলো জ্বলে উঠল সেই সময় আমার মনে পড়ে গেল সন্ধেবেলা পার্ক স্ট্রিটের হোটেলে শমিতার সঙ্গে দেখা করার কথা আছে। হিপনোটিজমের বাংলা যেন কী-ও হ্যাঁ, সম্মোহন–মেয়েটা সম্মোহনের মতো দুরন্ত আকর্ষণে আমাকে তার দিকে টানতে লাগল।

.

১৩.

হে মহান জনগণ, দেখতে দেখতে আরো সাত-আট দিন কেটে গেল। এর মধ্যে কর্পোরেশনের জায়গায় পাস্ট প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারের সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। রাতারাতি ইন্টেরিয়র ডেকরেসন আর দেয়ালের রঙ বদলে ঝকঝকে এবং দারুণ মডার্ন একটা জ্যোতিষ গণনার অফিস বসিয়ে দিয়েছে লতিকা। সমরেশের বদলে যে ছেলেটি ওখানে এখন বসছে তার নাম বিমল। আর বেয়ারার কাজ দেওয়া হয়েছে অজয়কে। এ ছাড়া আরো কয়েকটি ছেলেকেও আমাদের এই ডিপার্টমেন্টে নিয়েছি।

বিশেষ করে আরো যাদের নেওয়া হয়েছে তারা হল অ্যাস্ট্রোলজার, তান্ত্রিক, অবধূত, পিশাচসিদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ছাড়া কপাল দেখে, নাক দেখে, কুঁচকি দেখে, কণ্ঠা দেখে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে–এমন মহাপুরুষও আছে ডজন ডজন। কিন্তু আমরা শোম্যানশিপ আর পাবলিশিটির ব্যাপারটা ভালো করেই জানি। ওটা ছাড়া এ-যুগে কোনও বিজনেস বা প্রফেসান চালানো প্রায় অসম্ভব।

তাই খবরের কাগজে পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারের নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছি, হাজার হাজার হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে বিলি করছি, পোস্টারে পোস্টারে কলকাতার দেয়াল ঢেকে দিচ্ছি। বিজ্ঞাপনে, হ্যান্ডবিলে, পোস্টারে, সর্বত্র লেখা আছে–আমরা হিমালয়ের ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষকে দিয়ে সব রকম প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকি। বিশেষ করে রেসে কোন ঘোড়া জিতবে, আপনি বম্বের ফিল্মস্টার হতে পারবেন কিনা, সেলস্-ট্যাক্স ইনকাম-ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েও আপনি রেহাই পাবেন কিনা, ব্ল্যাক টাকার পাহাড় জমিয়েও পার পাবেন কিনা এবং ইলেকসানে জিততে পারবেন কিনা–এই চারটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমাদের বিশেষত্ব। প্রতি প্রশ্নের উত্তরের জন্য দক্ষিণা মাত্র পঞ্চাশ টাকা। প্রশ্ন এবং দক্ষিণা জমা দেবার পর দু-মাস অপেক্ষা করতে হয়। কারণ হিমালয়ের ঐশী শক্তিসম্পন্ন ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষের কাছে লোক পাঠিয়ে প্রশ্নের উত্তর আনতে এই সময়টা তো লাগবেই। সুতরাং আপনারা দু-মাস পরের যে বিষয় জানতে চান সে সম্বন্ধে এখনই প্রশ্ন করুন এবং ফি পাঠান।

হে মহান জনগণ, দু-মাস সময় কেন নিয়েছি বুঝতেই পারছেন। এর মধ্যে প্রশ্ন গণনার জন্যে কিছু টাকা অ্যাডভান্স পেয়ে গেলেই দুম করে পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচারের গণেশ উল্টে দেওয়া যেতে পারে।

এছাড়া আমাদের এই অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টটাতে রাতারাতি গ্ল্যামার আনার জন্যে আরো কিছু প্ল্যান-ট্যান নিয়েছি। অজয় আর বিমল বাদে অন্য যে ছেলেগুলোকে এই ডিপার্টমেন্টে জুড়ে দিয়েছি তারা অফিসে বসে না। তাদের দেওয়া হয়েছে নানারকমের ফিল্ডওয়ার্ক। তারা নামকরা ফিল্মস্টার, লিডার, বিজনেসম্যান, ডাক্তার, ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইত্যাদির পারিবারিক এবং গোপন খবর অর্থাৎ তারা স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে কোথায় কার সঙ্গে ঘোরে, কোন মেয়ের সঙ্গে মেশে–এসব খবর নিয়ে আসে। আর আমি করি কী প্রত্যেকের ঠিকানায় সেই সব তথ্য ভরে চিঠি পাঠাই। সেই চিঠিতে আরো লিখিখবরের কাগজে আপনার যে ছবি বেরিয়েছে সেই ছবিতে আপনার কপাল দেখে আমার এসব মনে হয়েছে।

আমি কপাল দেখে ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারি। যদি আপনার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক এই সব তথ্য সত্যি হয়, তাহলে সামনে আপনার ভয়ানক বিপদ। এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আজই আড়াইশো টাকা পাঠান। হিমালয়ের ত্রিকালজ্ঞ মহাপুরুষের কাছ থেকে মন্ত্রসিদ্ধ মাদুলি আনিয়ে আপনাকে পাঠাব।

হে মহান জনগণ, প্রফেসান বা বিজনেস যা-ই বলুন না–এই নতুন ডাইভার্সিফিকেসনের ফল দারুণ হয়েছে। রেস, ইলেকসানের রেজাল্ট, ব্ল্যাকমানি ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রতিদিন ডাকে গাদা গাদা প্রশ্ন এবং সেই সঙ্গে ফি-এর টাকা আসছে। আর ফিল্মস্টার, ডাক্তার, প্রফেসর ইত্যাদিদের কাছ থেকে মাদুলি বাবদ অজস্র টাকা। এভাবে চললে দু-মাসের মধ্যেই কয়েক লাখ টাকা আমাদের হাতে এসে যাবে।

.

১৪.

একদিকে আমাদের প্রফেসানটা দুর্দান্ত চলছে। আরেক দিকে-হে মহান জনগণ, আমি সেই ক্যাঁচাকলটায় আরো ভালো করে আটকে যাচ্ছি। অর্থাৎ শমিতার ব্যাপারটা বলছি আর কী।

এই সাত-আট দিন তার সঙ্গে রোজ দেখা হয়েছে। যদিও আমিই শমিতাকে শোধরাবার দায়-দায়িত্ব নিয়েছি, আমারই তার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা; তবু বলব শমিতাই আমার সে ঝামেলা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। তার মুভমেন্টের ওপর নজর রেখে আমাকে ফোন করার জন্যে এখন আর চার্লিকে পাঠাবার দরকার হয় না। পরের দিন কোথায় তার সঙ্গে দেখা হবে সেটা আগের দিনই শমিতা আমাকে জানিয়ে দেয়।

একদিন ওর সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে আন্দাজ করতে পেরেছি, আলাপটা অল্প দিনের হলেও সে আমাকে মোটামুটি পছন্দ করে। বিশেষ করে সেদিন তাকে বেহেড মাতাল অবস্থায় আমার ছাদের ঘরে নিয়ে যাবার পরও যখন কোনওরকম সুযোগ নিইনি তখন থেকেই সে আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। আমাকে স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছে, রাত্রে নেশার ঘোরে যখন পুরোপুরি আউট হয়ে যাবে তখন আমি যেন তাকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড়ে পৌঁছে দিই। কিংবা ইচ্ছা হলে এন্টালিতে আমার সেই ছাদের ঘরেও নিয়ে যেতে পারি। এ কদিনের মেলামেশায় আমরা পরস্পরকে তুমি বলতে শুরু করেছি।

হে মহান জনগণ, সাত-আটদিন যদিও খুবই অল্প সময় তবু এরই মধ্যে শমিতা সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত কীভাবে কাটায় সেটা আমার জানা হয়ে গেছে। লক্ষ্য করেছি বারোটার আগে শমিতা বাড়ি থেকে বেরোয় না। আগের দিন যে পরিমাণ হুইস্কি বা বাংলা মাল সে টেনে যায় তার হ্যাংওভার কাটাতে কাটাতেই তার অনেক বেলা হয়ে যায়। তারপর স্নান-টান করে কোনওদিন লাঞ্চ সেরে, কোনওদিন বা না খেয়েই বেরিয়ে পড়ে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে চলে যায় ক্লাবে। হোল ক্যালকাটার সাত-আটটা ক্লাবের সে মেম্বার। এক ক্লাব থেকে আরেক ক্লাব, তারপর আরেক ক্লাব কিংবা জুয়ার আড্ডা অথবা ফিগার স্কুল-এইভাবে শাটুল-ককের মতো ঘুরতে ঘুরতে সে চলে আসে হোটেলে। সেখানে ড্রিংকের ফাঁকে ফাঁকে চলে ফ্লোর ডান্স। বাঙালি-পাঞ্জাবি-সিন্ধি-পার্শি, ইন্ডিয়ান, নন-ইন্ডিয়ান–নানা জাতের লোকের সঙ্গে তার জানাশোনা। এক নজর তাকিয়েই বুঝতে পারি সবার চোখ শমিতার দারুণ সুন্দর আর সেক্সি শরীরটার দিকে। প্রায় সবাই চায় সে আউট হয়ে গেলে তাকে পৌঁছে দেবার নাম করে কোনও প্রাইভেট অ্যাপার্টমেন্টের বেডরুমে ঢোকাতে। কিন্তু আমি তা হতে দিই না।

আজ সন্ধেবেলা নানা ক্লাব ঘুরে শমিতা পার্ক স্ট্রিটের সেই বড় হোটেলটায় আমাকে নিয়ে এল। এসেই হুইস্কির অর্ডার দিল।

যে সব জায়গায় শমিতা বিলে সই করে মদ খায় সেই জায়গায় বার-এ জল-মেশানো হুইস্কি সার্ভ করতে বলে দিয়েছি।

যাই হোক ড্রিংক এসে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে গেলাসে চুমুক দিতে দিতে বললাম, তোমার সঙ্গে কদিন ধরে মিশছি। নাউ উই আর গুড ফ্রেন্ডস-এটা বলা যেতে পারে তো?

শমিতা হাসল, অফ কোর্স

তাহলে একটা কথা বলব?

শিওর।

তুমি বড় বেশি ড্রিংক করো

তাই নাকি। তবে তো তুমি আমার মাকে দেখোনি। শি ড্রিংকস লাইক ফিশ। এনিওয়ে তুমি যা বলছিলে বলে ফেলো। তবেফর গডস্ সেক, সারমন-টারমন দিও না।

আমি একটু হাসলাম, সারমন দেব আমি! হাসালে। কিন্তু একটা কথা আমার মনে হয়–তুমি তোমার লাইফটা টোটালি ওয়েস্ট করছ।

আই হ্যাভ গট এভরি রাইট টু ওয়েস্ট ইট।

চমকে উঠলাম, মানে!

শমিতা উত্তর দিল না। কোনও কথাও বলল না। পনেরো মিনিটের মধ্যে সটাসট আরো তিন পেগ খেয়ে ফেলল। অর্ধেক জল মেশানো থাকলেও বাকি অর্ধেকটা তো হুইস্কি। পাঁচ পেগে আড়াই পেগ হুইস্কি তার পেটে চলে গেছে। শমিতার মুখ লালচে হয়ে উঠতে লাগল।

আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি বললাম, তোমার আপত্তি থাকলে শুনতে চাই না। আই মিন কোনও ভাবে তোমাকে হার্ট করলাম নাকি?

একটুও না–শমিতা হাসল। বলল, আমার লাইফের কথা বলতে হলে নিজেকে একটু প্রিপেয়ার করে নিতে হবে। তাই পাঁচ পেগ হুইস্কি টেনে মুডটাকে ঠিক করে নিলাম। নাউ আই মে স্টার্ট

আমি চুপ করে রইলাম। শমিতা বলতে লাগল, আমার মাকে দেখেছ?

 বললাম, দেখেছি

শমিতা সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাল, কী করে দেখলে?

বা রে, রোজই তো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসছি। তখন দেখেছি–আরে তাই তো। শমিতা বললে, মাকে তো দেখেছ; সেই লোকটাকে দেখোনি? অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, কার কথা বলছ?

দ্যাট ম্যান-মানে অরিন্দম সান্যাল?

অরিন্দম সান্যালকে নিশ্চয়ই দেখেছি। একটু চুপ করে থেকে বললাম, তোমাকে পৌঁছে দিতে গিয়ে তাকেও দেখেছি। তোমার বাবা তো?

আমার কথা শেষ হল কি হল না, তার আগেই হে মহান জনগণ, একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। এই পাঁচ-তারা-মার্কা হোটেলের বারকে চমকে দিয়ে শমিতা চেঁচিয়ে উঠল, ওই স্কাউড্রেল সান-অফ-এ বিচটাকে আমার বাবা বলছ! আমি বোস আর ও সান্যাল। হাউ দ্যাট স্ট্রিট ডগ ক্যান বি মাই ফাদার?

হে মহান জনগণ, এই কথাটা আমিও অনেকবার ভেবেছি। মনোবীণা সান্যালের মেয়ে শমিতা বোস হয় কী করে? যাই হোক, শমিতার দিকে তাকিয়ে বললাম, কিন্তু তোমার মা তো বললে মিস্টার সান্যাল তার হাসব্যান্ড

তার হাসব্যান্ড হতে পারি কিন্তু আমার বাবা নয়

আমার মাথায় চরকি খেলে যেতে লাগল। বললাম, তবে?

আমার কথা এবার খুব সম্ভব শমিতার কানে ঢুকল না! সে দারুণ উত্তেজিত ভাবে বলতে লাগল, আমার মা আর দ্যাট বাগার অরিন্দম সান্যাল-এই দুজনে মিলে আমার লাইফটাকে হেল করে দিয়েছে। বিলিভ মি, আই ওয়াজ নট লাইক দিস–বলেই শমিতা একসঙ্গে ডাবল পেগের অর্ডার দিল।

বুঝতে পারছিলাম শমিতা তার লাইফের সব কথা আজ আমাকে বলবে। আমি চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

হুইস্কি এসে গিয়েছিল। এক চুমুকে ডবল পেগ শেষ করে আরক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সত্যি সত্যি শুরু করে দিল শমিতা। থেমে থেমে ভেঙে ভেঙে কখনো হিস্টিরিয়ার রোগীর মতো হাত-পা ছুঁড়ে, কখনো ভয়ানক উত্তেজিত ভাবে, আবার কখনও বিষাদের গলায় সে যা বলে গেল তা এইরকম।

শমিতার বাবার নাম দেবতোষ বোস। তিনি একটা ইউনিভার্সিটিতে লিটারেচারের অধ্যাপক ছিলেন। দারুণ ডেডিকেটেড মানুষ। ইউনিভর্সিটি, ছাত্র-ছাত্রী, পড়াশোনা, নানা রকম সেমিনার–এইসব নিয়েই প্রায় সারাক্ষণ ডুবে থাকতেন। স্ত্রী মনোবীণা আর মেয়ে শমিতাকে নিয়ে তাঁর ছিল খুবই ছোট্ট ফ্যামিলি। নিজের পড়াশোনা এবং কাজকর্মের মধ্যেও স্ত্রী এবং মেয়েকে যতটা সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়া যায়, দিতেন। কিন্তু মনোবীণা তাতে খুশি নন। অধ্যাপকের স্ত্রীর ম্যাড়মেড়ে প্যানপেনে লাইফ তার পছন্দ নয়। তিনি প্রতি মুহূর্তে, এক্সাইটমেন্ট চান, কিক চান, হাউইয়ের মতো উড়তে চান। প্রফেসরের স্ত্রীর জীবনে এসব সুযোগ কোত্থেকে জুটবে?

কিন্তু জুটে গেল। দেবতোষ একদিন তার এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুকে বাড়ি নিয়ে এলেন। নাম অরিবন্দ সান্যাল। জানতেন না নিজের হাতে সুড়ঙ্গ কেটে কাকে এনে ঢোকালেন। এই অরিন্দম সান্যাল একটা পারফেক্ট সোয়াইন, পায়ের তলা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত নাম্বার ওয়ান স্কাউন্ট্রেল–এমনিতে দেখতে সুপুরুষ। অনেক দিন ওয়েস্ট জার্মানিতে কাটিয়ে তখন কলকাতায় ছোটখাটো একটা কনসালট্যান্ট ফার্ম খুলেছে। চমৎকার কথা বলতে পারত, দুর্দন্ত স্মার্ট। মোট কথা, লোককে বিশেষ করে মেয়েদের আকর্ষণ করার মতো সবকিছুই ছিল তার মধ্যে। এই লোকটা ফাস্ট লাইফের নেশাটাকে তাতিয়ে তাতিয়ে একেবারে এক্সপ্লোসান ঘটিয়ে ছড়ল। তারপর একদিন সে যখন মনোবীণা আর শমিতাকে নিয়ে পালাল সেইদিন অধ্যাপক দেবতোষ বোস বুঝতে পারলেন তার বন্ধু, তার গ্রেট ফ্রেন্ড অরিন্দম সান্যাল হোল ওয়ার্ল্ডের সামনে তাকে একেবারে ন্যাংটো করে ফেলে দিয়ে গেছে। তার চারপাশ থেকে সবাই যেন ফিসিফিসিয়ে সমানে বলে গেছে, এই লোকটা নিজের স্ত্রীকে মেয়েকে সামলে রাখতে পারে না। হেঁ-হেঁ–এই লোকটা–

এই সব চোদ্দো-পনেরো বছর আগের ঘটনা। যাই হোক, মনোবীণা চলে যাবার পর ইউনিভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়ে কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন দেবতোষ। সেখান থেকে অরিন্দমকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, তুমি পারফেক্ট বন্ধুর কাজ করেছ। যাই হোক দু-চারদিন ফুর্তি করে মনোবীণাকে রাস্তায় ছুঁড়ে দিও না কিংবা তাকে রক্ষিতা করেও রেখ না। তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিও। উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে আমার নামে অ্যাডালটারি বা অন্য যে কোনও চার্জ, মানে যা আনলে ডিভোর্স হতে সুবিধা হয় নিয়ে এসো। আমি কেস কনটেস্ট করব না, খুব সহজেই মনোবীণা ডিভোর্স পেয়ে যাবে। তারপর তুমি ওকে বিয়েটা করে নিও।

 বিয়ে অবশ্য শেষ পর্যন্ত করেছিলেন অরিন্দম সান্যাল। কিন্তু এই নাম্বার টু বিয়েটা হয়ে যাবার পর কোন ফাঁদে পা দিয়েছেন, বুঝতে পেরেছিলেন মনোবীণা। ছোট কনসাল্টিং ফার্মটাকে বড় করবার জন্যে তাকে, মানে তার দারুণ সুন্দর আকর্ষণীয় শরীরটাকে কাজে লাগিয়েছেন অরিন্দম। বড় বড় অর্ডার পাবার জন্যে মনোবীণাকে অনেকের বেডরুমে যেতে হত।

প্রথম প্রথম আপত্তি করেছেন মনোবীণা। তারপর আস্তে আস্তে যা হয়, সব ব্যাপারটা হ্যাঁবিন্টের মধ্যে এসে গেছে। হ্যাবিট ইজ দি সেকেন্ড নেচার না কী যেন বলে, এ হল তাই। এর নিট ফল হয়েছে এই, ব্যাঙ্কে টাকার পাহাড় জমেছে অরিন্দম সান্যালের, ছোট্ট কনসালট্যান্ট ফার্মটা এখন ফরেন কোলাবরেসনে বিরাট হয়ে উঠেছে। বালিগঞ্জ সার্কুলারে প্রকাও বাড়ি করেছেন অরিন্দম। এ ছাড়া বম্বেতে ফ্ল্যাট আছে, দার্জিলিঙে বাংলো, দিল্লিতে বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট। এখন প্রতিদিন পার্টি, প্রতিদিন ড্রিংক, ডান্স ইত্যাতি ইত্যাদি। হাউইয়ের মতো আকাশের দিকে উড়তে উড়তে না মনোবীণা সান্যাল, না অরিন্দম সান্যাল-কারোরই লক্ষ্য ছিল না শমিতার দিকে। অবশ্য তার আরাম বা সুখের সব রকম ব্যবস্থাই ওঁরা করে দিয়েছেন। শমিতার জন্যে আলাদা একটা গাড়ি, একজন গভর্নের্স, একটা চাকর, একটা সব সময়ের মেড়-সারভেন্ট কোথাও কোনও ত্রুটি নেই। কিন্তু যা না হলে হিউম্যান গ্রোথ অসম্পূর্ণ থেকে যায় তার নাম মা-বাবার স্নেহ, তাদের পার্সোনাল কেয়ার–সেটি পায়নি শমিতা।

হে মহান জনগণ, তেরো-চোদ্দো বছর আগে মনোবীণা যখন অরিন্দমের সঙ্গে পালিয়ে আসেন তখন শমিতার বয়স দশ। তারপর থেকে শমিতা একটা জঘন্য অ্যাবনরম্যাল পরিবেশের মধ্যে আছে। এতগুলো বছর এই নোংরা অ্যাটমসফিয়ার আর মা এবং তার দ্বিতীয় স্বামীটির নানারকম কীর্তিকলাপ শমিতার নার্ভের ওপর দারুণ প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে দিয়েছে। তার ক্রমাগত মনে হয়েছে একটা অদ্ভুত ভ্যাকুয়ামের অর্থাৎ শূন্যতার মধ্যে সে ক্রমাগত ঢুকে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার চামটা তার কাছে একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আত্মহত্যার কথা দু-একবার ভেবে দেখেছে সে। এমনকী, একবার ব্লেড দিয়ে কর্জির শিরাও কেটে ফেলেছিল। বাড়ির একটা চাকর দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ফোন করে দেয়; ফলে বেঁচে গিয়েছিল শমিতা।

অ্যাটেস্পট অফ মার্ডার সেই একবারই। তারপর কিছুদিন শমিতাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের ট্রিটমেন্টে থাকতে হয়েছে; কারণ সবই ধারণা তার এই আত্মহত্যার অ্যাটেম্পট সম্পূর্ণ মানসিক কারণে। ইট ইজ এ মেন্টাল কেস। শমিতার পরিষ্কার মনে আছে এই সময়টা দিনরাত সে চুপচাপ আর বিষণ্ণ থাকত। যাই হোক, সাইকিয়াট্রিস্টের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার নেচারটা একেবারে পাল্টে গেল। সে ভাবলস, এভাবে ভূতের মতো ঘরের কোণে ওয়ার্ল্ডের সব বিস্বাদ আর দুঃখের বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে বসে থাকার কোনও মানে হয়। লাইফটাকে দু-হাতে উড়িয়ে দাও।

বাড়িতেই ছোটখাটো একটা ফ্যামিলি-বার রয়েছে। একদিন সেখান থেকে হুইস্কির বোতল বার করল সে। ওপেনিং সেরিমনিটা সেদিনই হয়ে গেল। তারপর আর তাকে বাড়িতে আটকে রাখা গেল না। অনেকগুলো পশ ক্লাবের মেম্বার হল সে; হোটেলে অ্যাকাউন্টে ড্রিংকের ব্যবস্থা করল। সেই সঙ্গে জুয়া, রেস ইত্যাদির মধ্যে ক্রমশ ডুবে যেতে লাগল।

এই নিয়ে অরিন্দম আর মনোবীণার মধ্যে অনেক গোলমাল হয়েছে। এখনও হয়। কেননা মাসে দশ-পনেরো হাজার টাকা নিয়ে দিচ্ছে শমিতা। স্ত্রীর আগের পক্ষের মেয়ে এভাবে টাকা ওড়াক, অরিন্দম সান্যাল তা চান না। কিন্তু এ ব্যাপারে মনোবীণা মেয়ের পক্ষে। তিনি বলেন ও তোমার বাবা কিংবা চোদ্দ পুরুষের টাকা নষ্ট করছে না। নিজের শরীর দিয়ে আমি তোমার যে ফরচুন তৈরি করে দিয়েছি তার থেকে নষ্ট করছে। দ্বিতীয় স্বামীটিকে মহিলা প্রচণ্ড ঘৃণা করেন। অবশ্য গোপনে মেয়েকে ফেরাতে চেষ্টা করেছেন মনোবীণা। বলেছেন, বি নর্মাল ভোরা; বি ডিসেন্ট—

শমিতা বিদ্রুপের সুরে বলেছে, নরম্যালসি আর ডিসেন্সির কথা তোমার মুখে অন্তত মানায় না। রোজ যা ম্যাজিক দেখাচ্ছ! বলেই মায়ের গালে আদরের ভঙ্গিতে আলতো টোকা দিয়েছে, মামণি, তুমি তোমার অরবিটে ঘুরতে থাকো; আমি আমার অরবিটে ঘুরি। এসো, আমরা একটা ভদ্রলোকের চুক্তি করে ফেলি। কেউ কারোকে ডিসটার্ব করব না।

যাই হোক দিনরাত শমিতা এই যে ড্রিংক-ডান্স-জুয়া-রেসের মধ্যে তলিয়ে থাকে এটা শুধু সময় কাটাবার জন্যে। কিন্তু বেশিক্ষণ কোনওটাই ভালো লাগে না। খানিকটা পর এ সব তার খুবই বোরিং মনে হয়। তবে ক্লান্তি আর একঘেয়েমি কাটাবার জন্যে আবার এই ড্রিংক, এই রেস, এই সব হুল্লোড়বাজি।

হে মহান জনগণ, কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার চোখের সামনে শমিতা তার চব্বিশ-পঁচিশ বছরের জীবনের একটা পেন্সিল স্কেচ এঁকে দিয়ে বলল, এবার বলো, নিজের লাইফটা ওয়েস্ট করার রাইট আমার আছে কিনা

কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না। আমি চুপ করে রইলাম।

আমার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করল না শমিতা। ওয়েটারকে ডেকে আবার হুইস্কির অর্ডার দিল। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ফরগেট অল দ্যাট ব্লাডি বোগাস থিং। লেটস এনজয় ড্রিংক। এই পেগটা খেয়ে একটু নাচবে নাকি?

বললাম, আমার আপত্তি নেই।

ড্রিংক এসে গিয়েছিল। খেয়েই শমিতা আমাকে বলরুমে নিয়ে গেল।

নাচতে নাচতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলাম। তা ছাড়া ফ্লোরডান্সে আমি একেবারেই আনাড়ি। কাজেই স্টেপিংটা এলোমেলো পড়তে লাগল।

সেদিন বেহুঁশ অবস্থায় নেচেছিল শমিতা। আজ সাত পেগ খেলেও তার অর্ধেকটাই জল। কাজেই তার চোখকে আজ ফাঁকি দেওয়া গেল না। সে বলল, কী হল, স্টেপিংটা মেলাও–

আমি কেন, আমার ফোরটিন জেনারেসনও ফ্লোরডান্সে স্টেপ মেলাতে পারবে না। বললাম, এই যে মেলাচ্ছি–

কিন্তু কিছুতেই পা মেলানো যাচ্ছে না। খানিকক্ষণ লক্ষ্য করে শমিতা বলল, তোমাকে খুব আনমাইন্ডফুল দেখাচ্ছে।

এ কথাটা সত্যি। আমার অন্যমনস্কতার কারণ যে শমিতাই, সে কথাটা আর বলা গেল না। ঝোঁকের মাথায় যেদিন তাকে ফেরাবার এবং শোধরাবার দায়িত্ব নিয়েছিলাম সেদিন জানতাম না এই মেয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডে এইসব ঝামেলার ব্যাপার রয়েছে। মেয়েটার জন্যে আমি কি দুঃখ বোধ করছি।

হে মহান জনগণ, আমার কাজ হল মানুষের দুর্বলতা থেকে কিছু প্রফিট উঠিয়ে সরে পড়া। কারো ব্যাপারেই আমার কোনও সেন্টিমেন্ট নেই। কিন্তু এই মেয়েটা আমাকে ফ্যাসাদে ফেলে দিল দেখা যাচ্ছে। এর কথা না ভেবে পারা যাচ্ছে না। হে মহান জনগণ, জালে আঠা লাগিয়ে পাখি ধরতে গিয়ে আমিই যেন আঠায় জড়িয়ে গেছি।

শমিতা আবার বলল, তুমি আজ অফ মুডে আছ। চলো, আর নাচতে হবে না। ড্রিংকই করা যাক

আবার আমরা বার-এ ফিরে এলাম। কিন্তু বারো পেগের কোটা কমপ্লিট করার পরও শমিতা আউট হল না। চোখ অবশ্য ছ-সাত পেগের পরই লাল হয়ে উঠেছিল। বিরক্তভাবে সে বলল, কদিন ধরেই দেখছি বারো পেগে আমার কিছু হচ্ছে না। মনে হয় হুইস্কি কোম্পানিগুলো বাজে থার্ড ক্লাস জিনিস বাজারে ছাড়ছে। আমি ওদের এগেনস্টে ল-ইয়ারের চিঠি দেব।

আমি চুপ করে রইলাম।

 শমিতা বলল, চলো, স্কচে যখন কিছু হচ্ছে না, কান্ট্রি লিকারই খাব–

হে মহান জনগণ, বার ম্যানেজারদের সঙ্গে অ্যারেঞ্জমেন্ট করে হুইস্কিতে না হয় জল মেশাবার ব্যবস্থা করেছি কিন্তু দিশি বাংলা মদ খাওয়াটা ওর আটকাব কী করে? রেস-টেস এবং অন্য অ্যাডিকশান থেকেই বা ওকে ফেরাব কোন উপায়ে? আমার মাথার ভেতরটা চরকির মতো ঘুরতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *