২. আমি থাকি এন্টালিতে

০৩.

আমি থাকি এন্টালিতে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের মনোবাণী সান্যালের বিরাট কম্পাউন্ডওলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় খানিকক্ষণ এলোমেলো ঘুরলাম। তারপর সাড়ে দশটার সময় এন্টালিতে নিজের কোটরে ফিরে এলাম।

ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, আপনাদের কেউ যদি আমার সঙ্গে এসে থাকেন অনুগ্রহ করে এই বাড়িটার অবস্থান লক্ষ্য করুন।

চারধারে টালি আর টিনের চালের ঘিঞ্জি বস্তি; মাঝখানে ধসে পড়া যে তিনতলা বাড়িটা কোমর বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খুব সম্ভব কলকাতার আদি পিতা জব চার্নক নিজের হাতে তার ভিত গেঁথেছিলেন। এটাই আমার হোম–সুইট হোম। এই বাড়িতেই একদা আমি জন্মেছিলাম। জন্মের পর থেকে দেখে আসছি এ বাড়িতে কখনও হোয়াইট ওয়াশ করা হয়নি; সাঁইত্রিশ বছর ধরে বাড়িটা এই রকম বিপজ্জনক ভাবে হেলে রয়েছে। অথচ কী আশ্চর্য কাণ্ড, বাড়িটা কিন্তু পড়ে না।

এটার আদি রঙ কী ছিল বুঝবার উপায় নেই। রোদে আর বৃষ্টিতে দেয়ালের আস্তর খসে গিয়ে কবেই ইট বেরিয়ে পড়েছে। এখন তার ওপর তিন ইঞ্চি পুরু কাঁচে শ্যাওলা জমে আছে। দেয়াল আর ভিতের ভেতর নানা আগাছা পঞ্চম বাহিনীর মতো শেকড় চালিয়ে ধ্বংসের কাজ ক্রমাগত এগিয়ে রাখছে। এরই ছাদে অ্যাসবেস্টসের দু-খানা ঘর নিয়ে আমি বসবাস করি।

এ বাড়ির প্রত্যেক ফ্লোরে ছটা করে কামরা। তিনটে ফ্লোরে আঠারোখানা কামরায় মোট নটি ফ্যামিলি থাকে। ফ্যামিলি পিছু এখানে দুটো করে ঘর। এ বাড়ির একতলায় থাকে একটা চীনা ফ্যামিলি, একা বিহারি মুসলিম ফ্যামিলি, আর থাকে দুটো কাবলিওলা। কাবলিওয়ালাদের অবশ্য স্ত্রী ছেলেমেয়ে নেই। দোতলায় আছে একটা তেলেঙ্গী, একটা মারোয়াড়ি আর একটা বর্মিজ ফ্যামিলি। তিনতলায় থাকে একটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, একটা নেপালি আর একটা শিখ ফ্যামিলি। আর এই বিশ্বসুদ্ধ জাতির মাথায় অর্থাৎ ছাদের ওপর থাকি আমি।

আমার যারা প্রতিবেশী তাদের সব আজব জীবিকা। কেউ সুদে টাকা খাটায়, কেউ রেসের বুকী, কেউ ড্রাইভার। কেউ সদর স্ট্রিটে মেয়েমানুষের দালাল, কেউ মাংসের দোকানদার, কেউ চামড়ার ব্যবসায়ী..ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এক জায়গায় সবার আশ্চর্য ছিল। বাংলা মদটি সকলেই নিয়মিত পান করে থাকে।

এমন একটি ইউনাইটেড নেশনের হেড কোয়ার্টার আমি কেমন করে খুঁজে পেলাম? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় এ কৃতিত্ব আমার নয়। আমার জন্মদাতা পিতা ঈশ্বর ভারতচন্দ্র সরকার এটি খুঁজে বার করেছিল এবং আজ থেকে চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর আগে মাত্র দশ টাকা ভাড়ায় এখানে এসে ম্যারেড লাইফ স্টার্ট করেছিল। তিন সাড়ে তিন যুগ আগের সেই দশ টাকা ভাড়া বেড়ে এখন পঁচিশ টাকায় উঠেছে। বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ভাড়াটে বাড়ির দু-খানা অ্যাসবেস্টসের ঘর ছাড়া আর কিছুই পাইনি। মার পঁচিশ টাকায় ওয়ার্ল্ডের সেভেন্থ সিটি এই কলকাতার হার্টের কাছাকাছি তেতলা বাড়ির ছাদে যে থাকতে পারছি, একমাত্র এই কারণটার জন্যে আমি বাবার কাছে কৃতজ্ঞ। যাক গে, বাবার কথা এখন নয়-পরে।

এখন এই রাত সাড়ে দশটায় বাড়িটার ভেতর ঢুকে দেখলাম একতলায় বিহারি মুসলমান আর কাবলীদের ঘরে এর মধ্যে আলো নিভে গেছে। তবে চীনেরা একটা খাঁটিয়ায় বসে সপরিবারে যুগপৎ রাতের খাবার আর বাংলা মাল খাচ্ছে। ওদের ফ্যামিলির কর্তা–নামটা কিছুতেই মন থাকে না; বাজারে ওদের জুতোর দোকান আছে-আমাকে দেখে রক্তাভ হলদে মুখে একটু হাসল। বলল, রিতারনিং? লোকটা ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারে; হিন্দিটা অবশ্য অনর্গলই বলে। তবে উচ্চারণ আধো-আধো; অনেকটা বাচ্চাদের মতো সব চীনারই উচ্চারণ বোধ হয় এইরকম।

যাই হোক আমিও একটু হাসলাম, ইয়েস। এভরিথিং অলরাইট?

ইয়েস। কাম অন, জয়েন আস।

ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আজ নয়–আরেকদিন ওদের সঙ্গে খাব। তারপর বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দোতলার বাঁকে এসে দেখলাম দোতলার বর্মিজ ফ্যামিলির বড় ফেলে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দোতলার বাঁকে এ ছেলেটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার মুখ থেখে ভক ভক করে দিশি মদের গন্ধ বেরিয়ে আসছে। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে কম করে তিনশো ষাট দিন রাত্রি দশটা থেকে বারোটার মধ্যে ওই ছোকরাকে সিঁড়ির মুখে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

ওর পাশ কাটিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। এই মুহূর্তে এখানকার দুই পরিবার মারোয়াড়ি আর তেলেঙ্গীদের মধ্যে কোনও বিষয়ে তুমুল ঝগড়া চলছিল। এ বাড়িতে এই রকম ঝগড়া কোনও না কোনও ফ্লোরে সব সময়ই চলতে থাকে। আঠারোটা ঘরে বিশ্বসুদ্ধ জাতির সহাবস্থান ঘটলে এই রকম কাণ্ডই হয়। এটা আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে। ওদের ভেতর দিয়ে আমি বর্মিজদের দরজায় গিয়ে টোকা দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে খুলে হেড অফ দি ফ্যামিলি, তার পিছনে তার গিন্নী এবং গিন্নীর পিছনে একগাদা কাচ্চাবাচ্চার মোঙ্গলীয় মুখ উঁকি মারল।

ফ্যামিলির কর্তা ভীতভাবে জিগ্যেস করল, ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া

লোকটা কী করে, সংসার কী ভাবে চালায়–সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছরেও আমি জানতে পারিনি। কেউ বলে লোকটা চোরা চালানদার, কেউ বলে কোকেনের ব্যবসা করে। অসটেনসিল মিস অফ ইনকাম বলতে যে কথাটা আছে সেটা ওর নেই। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি লোকটা সর্বক্ষণ সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। বললাম, তোমার বড় ছেলে সিঁড়ির মুখে নেশার ঘোরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

লোকটা বলল, রহনে দেওয়া শালেকো। শালে হামারা জান বরবাদ কর দিয়া।

এক নিশ্বাসে লোকটা যখন নিজের ছেলে সম্বন্ধে দু-দুবার শালা শব্দটা উচ্চারণ করল তখন আমার আর বলবার কিছু নেই। সুতরাং আমি তেতলায় উঠে এলাম। এখানে কারোকেই দেখা গেল না। তবে তিন পরিবারের দুটো ঘরেই আলো জ্বলছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় কেউ ঘুমোয়নি। এই মুহূর্তে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ঘরে প্রচণ্ড জোরে জ্যাজ বাজনার রেকর্ড বাজছে। জানলার ফাঁক দিয়ে দেখলাম ওই ফ্যামিলির দুই মেয়ে বাজনার তালে তালে নেচে যাচ্ছে; তাদের প্রচণ্ড মোটা মা আর বাবা চেয়ারে বসে সিগারেট খেতে খেতে মেয়েদের নাচ দেখছে। উল্টোদিকে শিখেদের ঘরে তারস্বরে বিবিধ ভারতী চলছে। এই দুটো ফ্যামিলি পাল্লা দিয়ে সারাদিন রেডিও আর জ্যাজ চালায়।

অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বড় মেয়েটা, নাম যার ডরোথি; কোন একটা ব্রিটিশ কোম্পানির টেলিফোন অপারেটর–আমাকে দেখলে এখনই মেয়েটা ছুটে আসবে; হাত ধরে টানাটানি শুরু করবে। মেয়েটা আমাকে ভীষণ লাইক করে। সবার সামনেই জড়িয়ে-উড়িয়ে ধরে এমন কাণ্ড করে বসে যাতে আমি যে আমি; আমার পর্যন্ত নাক-মুখ দিয়ে ঝুঁজ বেরুতে থাকে। হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মহান জনগণ, ডরোথির কাছ থেকে আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই-এখনও পা টিপে টিপে তেতলার ছাদে উঠে এলাম।

এই গোটা ছাদটা দুখানা অ্যাসবেস্টসের ঘর সুন্দু পুরোপুরি আমার দখলে। এখান খেকে প্রকাণ্ড আকাশ আর গ্রেট ক্যালকাটা মেট্রোপলিসের অনেকখানি স্কাইলাইন চোখে পড়ে। যাই হোক, তালা খুলে আলো জ্বেলে ফেললাম। একটা ঘরে ঢুকলেই ভেতরের দরজা দিয়ে আরেকটা ঘরে যাওয়া যায়।

আমার এই ঘরটার একধারে পুরনো আমলের একটা ধবধবে বিছানা পাতা রয়েছে। আরেকধারে ছোট আলমারি, টেবল, বুক শেলফে কিছু বই-টই, দেয়ালে আয়না এবং একটা র‍্যাকে সেভিং বক্স, চিরুনি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার খাটের তলায় তেলচিটে আরেকটা বিছানা রয়েছে। সেটা চার্লির। ব্রিফকেসটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে জুতা খুলে ফেললাম। তারপর মাঝখানের দরজা দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলাম। এটাকে মোটামুটি কিচেন-কাম-ডাইনিং রুম বলা যেতে পারে। চোখে পড়ল টেবলের ওপর আমার রাতের খাবার ঢাকা দেওয়া রয়েছে। এ নিশ্চয়ই চার্লির কাজ। রোজই আমার জন্যে রাতের খাবার তৈরি করে বিছানা-টিছানা পেতে, ময়লা ট্রাউজার-ফাউজার থাকলে ধুয়ে ইস্তিরি করে রেখে যায় সে।

চার্লির সঙ্গে ক্বচিৎ কখনো আমার দেখা হয়। সে কখন আসে কখন যায় আমি জানি না। তবে একবার আসেই। এবং রান্না-বান্না থেকে ঘরের যাবতীয় কাজ-কর্ম করে রেখে যায়। আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর। চার্লি একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চোর! সারারাত কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় নিজের ধান্দায় ঘুরে বেড়ায় সে। আর মওকা পেলেই সুরুত করে কোনও বাড়িতে ঢুকে কিছু হাতের কাজ করে ফেলে। মাঝে মাঝেই চার্লি ধরা পড়ে; তখন কিছুদিনের জন্যে জেলে গিয়ে মুখ বদল করে আসে। সেই সময়টা আমার ভীষণ অসুবিধা হয়।

আগেই বলেছি, চার্লির আসা-যাওয়ার ঠিক-ঠিকানা নেই। আর সে আমার মতো সিঁড়ি বেয়েও আসে না। হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মহান জনগণ, আমার এই ঘরের ডানদিকের জানালার দুটো শিক আলগা। ও দুটোর ওই অবস্থা চালিই করে রেখেছে। ওই জানালাটার ধার ঘেঁসে একটা ঢ্যাঙা চেহারার নারকেল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। চার্লি যখনই আসুক, নারকেল গাছ বেয়ে আলগা শিক দুটো খুলে ভেতরে ঢোকে। তারপর শিক দুটো আবার জায়গা মতো বসিয়ে দেয়। যায়ও সে ওইভাবেই। কাজেই, ছাদের দিক থেকে তালা লাগানো থাকলেও তার যাতায়াতের কোনও অসুবিধা ঘটে না। কিন্তু চার্লি কথাও এখন না।

থিয়েটার রোডে আমার অফিস থেকে বেরিয়ে মনোবীণা সান্যালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভদ্রমহিলা এক কাপ চা-ও খেতে বলেননি। অবশ্য ওঁদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনও রেস্তোরাঁ কি খাবারের দোকানে ঢুকে কিছু খেয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু মনোবীণা সান্যাল যে কাজের দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়েছিলেন সেটা আমাকে এমনই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে খাওয়ার কথা মনে পড়েনি। এখন টের পাচ্ছি প্রচণ্ড খিদে পাচ্ছে।

কিচেন-কাম-ডাইনিং রুমে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকলাম না। বেড রুমে ফিরে দ্রুত একটা তোয়ালে কাঁধে চাপিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।

দশ মিনিটের ভেতর হাত-মুখ ধোয়া এবং খাওয়ার পালা চুকিয়ে লাইট-টাইট নিভিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম।

ঘরের ভেতর অন্ধকার। কিন্তু খোলা জানালা দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত কলকাতার স্কাইলাইন দেখা যাচ্ছে। আর চোখে পড়ছে নীচে রাস্তাঘাট, কর্পোরেশনের আলো। ট্রাম বাস এবং অন্যান্য গাড়ি চলার শব্দ ভেসে আসছে। সারাদিন আমার নানারকম ঝঞ্ঝাটের ভেতর দিয়ে কাটে। রাত্রে ফিরে এসে শোওয়ামাত্র আমার চোখ বুজে যায়। কিন্তু একেকদিন কী যে হয়, কিছুতেই ঘুমোতে পারি না আজ আমার ঘুম এল না।

ঘুম না এলে কেন না জানে, আমার ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছরের এই লাইফ, তার ব্যাকগ্রাউন্ডে হুড়মুড় করে আমার চোখের সামনে এসে হাজির হয়। উজান টানে ভাসতে ভাসতে তখন আমি পিছন দিকে ফিরে যাই।

.

 হে মহান জনগণ, আমার বাবা ভরতচন্দ্র সরকারকে দিয়েই শুরু করা যাক। বাবা ইংরেজ আমলে কোনওরকমে আপার প্রাইমারিটা পাশ করে মার্চেন্ট ফার্মে সাতাশ টাকার একটা লেজার-কিপারের চাকরি জোটাতে পেরেছিল। তখন টাকার দাম ছিল; সাতাশ টাকায় চলে যেত। সেই চাকরির ওপর ভরসা করে দুম করে একটা বিয়ে করে ফেলেছিল বাবা। তারপর? তখন তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং ছিল না, দো আউর তিন বাচ্চের স্লোগানও ওঠেনি। জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি–এই প্রোভাবখানা চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখে পটাপট পাঁচটি ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়ে বসল।

এদিকে ওয়ার্ল্ডের হালচাল বদলে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে সেকেন্ড গ্রেট ওয়ার এসে গেল। ইনফ্লেসনের বাজারে হু-হুঁ করে চাল ডাল জামা কাপড়ের দর চড়তে লাগল। বাবার মাইনেও কিছু কিছু বাড়ল। কিন্তু দুই বাড়ার মাঝখানে অনেকখনি ফারাক। দুটো এজ মেলাতে বাবার নাক দিয়ে ফেনা উঠে যেতে লাগল।

তারপর ওয়ার্ল্ড ওয়ার থামল, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম সেই যে চড়তে শুরু করেছিল, সেটা ক্রমাগত আকাশের দিকে উঠতেই লাগল, উঠতেই লাগল। এদিকে দেশ স্বাধীন হল, আমাদের পাঁচ ভাইবোনের পাকস্থলীর মাপও দিনকে দিন বাড়তে লাগল। লেট ভরতচন্দ্র সরকারের অবস্থাখানা বুঝে দেখুন। প্রকৃতির নিয়মে কিছুই নাকি ফাঁকা থাকার কথা না; সুতরাং আমাদের পাকস্থলিগুলো আর শূন্য থাকে কী করে? সেগুলো ভরাট করতে বাবার কণ্ঠার হাড় গজালের মতো ঠেলে বেরিয়ে পড়ল; বুকের মাপ ছইঞ্চি ছোট হয়ে গেল আর কঁচা চুলগুলো কবছরে পেকে সাদা ধবধবে হয়ে গেল।

তবু একটা কথা বলব, বাবার ওই রকম স্ট্রাগলের মধ্যেও একটু উচ্চাশা ছিল। সেটা তার ছেলেমেয়েদের ঘিরে। বাবা হয়তো ভেবেছিল নিজের জীবনটা কষ্টে-টষ্টে কাটল; ছেলেমেয়েগুলো যেন ভালো থাকে। তাই লোকটা করেছিল কী, নিজে অফিসে টিফিন না খেয়ে ট্রামে-বাসে না চড়ে সেই পয়সা বাঁচিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে মানুষ করে তুলতে চেয়েছে।

কিন্তু বিশ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিনও তো বিগড়ে যায়; এ তো মানুষের শরীর। ফলতঃ যা হবার তাই হল। টার্গেটে পৌঁছুবার ঢের আগেই বাবা মুখ থুবড়ে পড়ল। সেই যে পড়ল আর উঠল না।

ভরতচন্দ্র সরকার তো নামের আগে একখানা চন্দ্রবিন্দু যোগ করে বেঁচে গেল। কিন্তু আমরা? আমি তখন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসে পড়ি। আমার পর দুবছর বাদে একটা করে ভাই অথবা বোন। আমরা দুই ভাই, তিন বোন। আমি ছাড়া বাদবাকিরা পড়াশোনা করছে।

মৃত্যুর আগে বাবা প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকাপয়সা তুলে একটা বোনের বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিল। ব্যস, ওই পর্যন্ত। তার মৃত্যুর পর, যেহেতু আমি বড়, বাকি তিন ভাই-বোন এবং বিধবা মায়ের দায়িত্ব এসে পড়ল আমার কাঁধে। অথচ একটি পয়সা রেখে যায়নি বাবা।

অতএব প্রথম ধাক্কাতেই আমাদের পড়াশোনা গেল বন্ধ হয়ে। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি। টিগ্রিগুলো পকেটে পুরে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ আর ডালহৌসিতে যত আফিস-টাফিস আছে সব জায়গায় ঢু মারতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও একটা দরজা খুলল না। যেখানেই যাই সেখানেই এক রেকর্ড বেজে যায়–নো ভ্যাকান্সি।

দেখতে দেখতে দু-তিনটে বছর কেটে গেল। এর মধ্যে ডিগ্রি-টিগ্রিগুলো পকেটে ঘুরে ঘুরে ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে গেছে; আমার গাল বসে গেছে, চোখের কোণে কালি পড়েছে।

হে মহান জনগণ, নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন লোয়ার মিডিল ক্লাসের একেবারে নীচের স্তরের মানুষ আমরা। যার বাবা সামান্য একজন লেজার কিপার ছিল, যার কোনও জোরালো রকমের মামা বা মেসো নেই তার পক্ষে চাকরি জোটানো অসম্ভব। আমারও চাকরি-টাকরি হল না।

এর ফলে আরো অনেক ফ্যামিলিতে যা-যা ঘটেছে আমাদের বেলাতেও তাই তাই ঘটল। হে মহান জনগণ, আপনারা জানেনই কী ঘটতে পারে। তাই অংশটা খুব সংক্ষেপেই সেরে ফেলা যাক। আমার একটা বোন চাকরির খোঁজে রোজ দুপুরে বেরিয়ে যেত; ফিরত মাঝরাতে। ও কোথায় যায় আন্দাজ করলেও আমার মুখ বুজে থাকতাম। তারপর বলা নেই কওনা নেই, দুম করে মেয়েটা একদিন আত্মহত্যা করে বসল। আর তখনই জানা গেল, সে তিন মাসের প্রেগনান্ট ছিল। কী বোকা মেয়ে! আজকাল কত ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট বেরিয়েছে, তার কোনও খোঁজই রাখত না! হে মহান জনগণ, এই কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে ও সংসার বাঁচাবার জন্যে ঘরের বাইরে পা দিয়েছিল! যাকগে, আমার আরেকটা বোন একদিন একটা পাঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেল। আর ছোট ভাইটা স্মাগলার না ওয়াগন-ব্রেকার কাদের দলে যেন ভিড়ে বাড়ি ছাড়ল। লস্ট জেনারেসন বলে একটা কথা আছে না, ও তাদেরই একজন হয়ে গেল। বাকি রইলাম মা আর আমি। মা খুবই নরম ধাতের মানুষ। এই সময়ের পক্ষে একবারেই অচল। এখন বেঁচে থাকতে হলে নার্ভগুলোকে স্টিল দিয়ে তৈরি করে নিতে হয়। কিন্তু মায়ের নার্ভ ছিল মোমের তৈরি; একটুতেই গলে গেল। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে এতগুলো পারিবারিক বিপর্যয় দেখে দেখে ভদ্রমহিলার মাথাটা একেবারে গোলমাল হয়ে গেল। কিছুদিন বাড়িতে রেখে ট্রিটমেন্ট করার চেষ্টা করেছিলাম। কিছুতেই কিছু হল না। শেষ পর্যন্ত মাকে মেন্টাল হসপিটালেই পাঠাতে হল।

হে মহান জনগণ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। চাকরি-বাকরি না পেলেও অনেকগুলো টিউশনি পেয়েছিলাম। সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত হোল ক্যালকাটা ঘুরে তাই করে যেতাম। কিন্তু মেন্টাল হসপিটালে মাসে দুশো করে টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে হাতে কিছুই প্রায় থাকত না। ফলে কর্পোরেশনের কলের বিশুদ্ধ জল খেয়ে বেশির ভাগ দিন আমার কেটে যেত।

এদিকে টিউশানি-ফুইশানিগুলো একেবারে মরসুমী ব্যাপার। পরীক্ষার সীজনে আঁক বেঁধে যেমন আসত, আবার চলে যেত। তখন আমি দারুণ ঝামেলায় পড়ে যেতাম। বাড়িভাড়া বাকি পড়ত, ঠিক সময়ে মেন্টাল হসপিটালে টাকা দিতে পারতাম না। মোটামুটি এইভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল।

একবার হল কী, পরীক্ষার শেষে একটাও টিউশানি নেই। কী করব, ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুম আসছিল না। মাথার ভেতর থেকে নাক-মুখ দিয়ে আগুন বেরিয়ে আসছিল। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে কিছুক্ষণ ছাদে ঘুরেছিলাম। তারপর নিজের অজান্তে কখন যে সিঁড়ি টপকে নীচে নেমে এসেছি, কখন এন্টালির আঁকাবাঁকা সরু গলি পিছনে রেখে লোয়ার সার্কুলার রোডে চলে গেছি, তারপর হাঁটতে হাঁটতে ল্যান্সডাউন রোডে–নিজেরই খেয়াল নেই। তখন অনেক রাত। রাস্তায় লোকজন চোখে পড়ছিল না। তবে দু-চারটে পুলিশ আর রাত-জাগা টলটলায়মান মাতালকে এখানে-ওখানে দেখা যাচ্ছিল। আর মাঝে মধ্যে ফাঁকা রাস্তায় ঝড় তুলে দু-একটা ট্যাক্সি কি প্রাইভেট কার উধাও হয়ে যাচ্ছিল।

ল্যান্সডাউন রোডের ফুটপাথ ধরে দূরমনস্কর মতো হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা অন্ধকার মোড়ের মাথায় আসতে চোখে পড়ল দশ-বারো বছরের একটা ছেলে দেয়ালে একটা পোস্টার মারছে।

পোস্টার-টোস্টারগুলো রাজনীতিক দলের ওয়ার্কাররাই বেশির ভাগ সময় মেরে থাকে। আর মারে সিনেমা-থিয়েটারওয়ালা কিংবা ছোটখাটো কোম্পানির লোকেরা। এতটুকু একটা বাচ্চাকে পোস্টার মারতে আগে আর দেখিনি। তা ছাড়া তার যা বয়েস, চেহারা এবং ময়লা ছেঁড়া খোঁড়া জামা-প্যান্ট–তাতে তাকে ভিখিরিদের ছেলে বলে সনাক্ত করা যায়।

কী পোস্টার মারছে ছেলেটা? কৌতূহলের বসে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। দেখলাম, সাদা কাগজের ওপর লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে : কবি সাতকড়ি পুততুণ্ডর ষাট বছরের পদার্পণ। এই উপলক্ষে বারো নম্বর গোলোক চাটুজ্যে রোডে জাতির পক্ষ থেকে এক সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। দলে দলে যোগদান করুন।

বাংলা সাহিত্যের একটু-আধটু খবর আমি রাখি। বি-এ পর্যন্ত বাংলা ছিল আমার একটা সাবজেক্ট। তা ছাড়া গল্প-উপন্যাস কবিতা-টবিতা পড়ার ঝোঁক আছে। নিয়মিত একটা সাপ্তাহিক আরেকটা মাসিক আমি কিনে থাকি। কিন্তু সাতকড়ি পুততুণ্ড নামে কোনও কবির নাম আগে শুনেছি বলে মনে হয় না। ছেলেটাকে জিগ্যেস করলাম, এটা তোকে কে লাগাতে বলেছে?

খানিকটা দূরে একটা মোটর দেখিয়ে ছেলেটা বলল, একজন মোটা বাবু; ওই গাড়িতে বসে আছে। একটু থেমে আবার বলল, আমি রাস্তায় শুয়ে ছিলাম, বাবু আমাকে তুলে বলল, এ রকম দশটা কাগজ দেয়ালে সাঁটতে পারলে একটা টাকা দেবে। বলেই আবার পোস্টারটা লাগাতে শুরু করল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

কিন্তু ছোট ছোট হাতে অত বড় একটা কাগজ ঠিক সামলাতে পারছিল না ছেলেটা। বললাম, দে, আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।

ছেলেটা সন্দিগ্ধ ভাবে তাকাল, তুমি আমার টাকাটা নিয়ে নেবে না তো?

আরে না। তোর টাকা তুই পাবি। পারছিস না তো, তাই লাগিয়ে দিচ্ছি।

ছেলেটা এবার তার হাতের পোস্টারটা আমাকে দিল। আমি সেটা চমৎকার করে দেয়ালে সেঁটে দিলাম।

ছেলেটা বলল, একটা যখন লাগিয়ে দিয়েছ, এগুলোও লাগিয়ে দাও

দেখলাম আরো নটা পোস্টার রয়েছে, এবং সবগুলোতে একই কথা লেখা আছে। খানিকটা দূরে দূরে ভালো জায়গা দেখে পোস্টারগুলো মেরে দিলাম। সেই সঙ্গে মোটরটার ওপর লক্ষ্যও রেখেছিলাম; সেটা নিঃশব্দে অনুসরণ করছিল।

সুচারুরূপে পোস্টার লাগানোর কাজটি শেষ হয়ে যাবার পর ঘুরে দাঁড়াতেই চোখে পড়েছিল, মোটরের দরজা খুলে গোলগাল থসথসে চেহারার একটা লোক বেরিয়ে আসছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি তাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম।

লোকটা আমার কাছাকাছি সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, ধন্যবাদ।

দশ ফুট হাঁটলেই যে লোক হাঁপিয়ে যায় তার ফুসফুসের জোর যে খুব বেশি নয়, বুঝতে পারছিলাম। যাই হোক, জিগ্যেস করেছিলাম, ধন্যবাদ কেন?

আমরা পা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত দ্রুত এক পলক দেখে নিয়ে তুমি কি আপনি বলবে, খুব সম্ভব কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়েছে লোকটা। তারপর বলেছে, এই যে তুমি পোস্টারগুলো মেরে দিলে সেই জন্যে।

ধন্যবাদের দরকার নেই। আপনি এই টাকাটা দিয়ে দিন। আমি সেই ছেলেটাকে দেখিয়ে বলেছিলাম।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই-পকেট হাতড়ে এটা মোটা পার্স বার করেছিল লোকটা; তার থেকে একটি টাকা বার করে ছেলেটাকে দিয়েছিল।

টাকা পেয়েই চলে গিয়েছিল ছেলেটা। আমারও আর দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। তবু আচমকা প্রশ্ন করে বসেছিলাম, কবি সাতকড়ি পুততুণ্ড কে?

আমি। কেন?

 সেটাই আন্দাজ করেছিলাম। বলেছি, কিছু মন করবেন না, একটা কথা জিগ্যেস করব?

 সাতকড়ি পুততুণ্ড বলেছে, অবশ্যই।

 এভাবে পোস্টার লাগাচ্ছিলেন কেন?

সাতকড়ি পুততুণ্ড এর উত্তরে যা বলেছিল, তাতে আমার চোখের তারা স্থির হয়ে গেছে। চল্লিশ বছর বয়স থেকেই সে নিজের জন্মদিন করে আসছে কিন্তু স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে এবং চাকর-বাকর ছাড়া কেউ নাকি সে উৎসবে ঘেঁষে না। তাই এবার পলিটিক্যাল মিটিং-এর পোস্টারের মতো দেয়ালে দেয়ালে নিজের জন্মদিনের বিজ্ঞাপ্তি লাগিয়ে লোক জড়ো করতে চেয়েছে।

এমন এক্সপিরিয়েন্স আগে আর কখনও হয়নি। কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ আমার কী যেন হয়ে গিয়েছিল। বলেছিলাম, আপনি চান, জন্মদিনে প্রচুর লোকজন আসুক, হই-চই হোক, আপনাকে নিয়ে সবাই মাতামাতি করুক–এই তো?

ঠিক ধরেছ। দেখো, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার কিছু পয়সা-টয়সা হয়েছে। ছেলেবেলা থেকে পোয়েট্রি লিখছি কিন্তু ফেমটা তেমন হল না। আমার খুব ইচ্ছে ফেম হোক।

কিন্তু এভাবে পোস্টার মেরে কিছু লাভ হবে কি?

তবে?

দুসেকেন্ড চিন্তা করে বলেছিলাম, আপনি যদি বিশ্বাস করে আমার ওপর দায়িত্ব দেন ফেমের ব্যাপারটা দেখতে পারি। আপনার জন্মদিনের উৎসবটাও অর্গানাইজ করতে পারি।

সাতকড়ি পুততুণ্ড মধ্যরাতের ফাঁকা রাস্তায় প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল, মনে হচ্ছে তুমি পারবে। কাল একবার আমাদের বাড়ি এসো না।

কালই?

হ্যাঁ হ্যাঁ, কালই। সাতকড়ি পুততুণ্ডর আর তর সইছিল না, এই নাও ঠিকানা। পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে আমাকে দিয়েছিল সে।

তখন আমি পুরোপুরি বেকার, কোনও কাজকর্ম নেই। কবি সাতকড়ি পুততুণ্ড আমাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করছিল। মনে আছে, পরের দিনই তার ভবানীপুরের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।

পুরনো আমলের প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি সাতকড়ি পুততুণ্ডর। শ্বেতপাথরের মেঝে, শ্বেত পাথরের সিঁড়ি, খড়খড়ির জানালা, রঙিন কাচের  শার্সি, ঘরে ঘরে বার্মা টিকের ভারী ভারী খাট-আলমারি ইত্যাদি। সিঁড়ির বাঁকে বাঁকে বড় বড় দাঁড়ে কাকাতুয়া, ময়না নতুবা টিয়া পা দিলেই টের পাওয় যায় পয়সাওলা লোকের বাড়ি।

সাতকড়ি পুততুণ্ড আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। প্রথমে রুপোর থালায় ডজনখানেক বিরাট-বিরাট সাইজের সন্দেশ খাইয়ে নিজের লাইফ-হিস্ট্রিটা এক নিশ্বাসে মুখস্থ বলার মতো বলে গিয়েছিল। চার জেনারেসন ধরে তাদের বিলিতি মদের বিজনেস; লিসে স্ট্রিটে প্রকাণ্ড দোকান রয়েছে। সেখান থেকে বছরে কম করে তিন লাখ টাকা ইনকাম তবে মদটা ছোঁয় না সাতকড়ি পুততুণ্ড। তার একমাত্র নেশা কবিতা লেখা এবং এ-ব্যাপারে কিঞ্চিৎ নাম করা। কিন্তু নামটা কিছুতেই হয়ে উঠছে না। পনেরো-ষোলো বছর বয়স থেকে লিখছে সে; মোট ছহাজার কবিতা এর মধ্যে লিখে ফেলেছে। তবে তিরিশ পঁয়তিরিশটার বেশি এ পর্যন্ত ছাপা হয়নি। সবশুন্ধু তিনটি সন্তানের জনক সাতকড়ি পুততুণ্ড। দুটি মেয়ে, একটি ছেলে। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেটি মদের দোকানে বসে। সুতরাং নির্বিঘ্নে কবিতার চাষ করে যেতে পারে সাতকড়ি পুততুণ্ড।

সংক্ষেপে অটোবায়োগ্রাফি শেষ করে সাতকড়ি পুততুণ্ড চাকরকে দিয়ে চল্লিশ-পঞ্চাশখানা চামড়া বাঁধানো মোটা মোটা কবিতার খাতা এনে আমার সামনে ডাঁই করে রেখেছিল। খাতাগুলোর, কোনওটার গায়ে সোনার জলে লেখা রয়েছে কবিতার ফুলবাগান, কোনওটার গায়ে কাব্য কুসুম, সৌরভ ইত্যাদি। তার তলায় লেখা আছে–কবি সাতকড়ি পুততুণ্ড।

পাতা উল্টে দু-একটা কবিতার নমুনা দেখতেই টের পাওয়া গিয়েছিল সম্পাদকার অন্ধ আর কালা না হলে এসব কোনওদিনই ছাপা হবে না। কিন্তু আমার পাকস্থলীতে তখন এক ডজন দামি সন্দেশ রয়েছে, তা ছাড়া জন্মদিন অর্গানাইজ করার দায়িত্ব নিয়েছি; সুতরাং মাথা ঝাঁকিয়ে কবিতাগুলোর তারিফ করেছি। সাতকড়ি পুততুণ্ড সেই বোধহয় প্রথম তার লেখার একজন সমঝদার পেয়েছিল। প্রায় হাতে চাঁদ পাবার মতো ব্যাপার। বিগলিত হেসে সে বলেছিল, তা হলে ভাই জন্মদিনের ব্যাপারে লেগে যাও। টাকা-পয়সা যা লাগে চেয়ে নেবে। মোটে লজ্জা করবে না।

সত্যি সত্যি কবি সাতকড়ি পুততুণ্ডর ষাট বছরের জন্মদিনটা দারুণভাবে অর্গানাইজ করেছিলাম। ডেকরেটরকে দিয়ে চমৎকার একখানা প্যাণ্ডেল বানিয়ে নাম করা নার্সারীর লোকদের দিয়ে পাতার ওপর সাদা ফুল গেঁথে লিখিয়ে নিয়েছিলাম কবি সাতকড়ি পুততুণ্ডর শুভ জন্মদিনে সবার নিমন্ত্রণ। সেই ফুলের লেখাটা প্যান্ডেলের সামনে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের এন্টালিতে যে-সব ক্লাব আছে তাদের খাবার-দাবারের লোভ দেখিয়ে লরি বোঝাই করে জন্মদিনের সভায় নিয়ে এসেছিলাম। উঁচু একটা ডায়াসের ওপর নতুন ধুতি আর নতুন গরদের পাঞ্জাবি পরিয়ে, কপালে চন্দনের ফোঁটা আর গলায় জুইয়ের মালা দিয়ে সাতকড়ি পুততুণ্ডকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর শুরু হয়েছিল সভার কাজ।

আমি যে কলেজে পড়তাম সেখানকার এক রিটায়ার্ড বাংলার প্রফেসারকে সভাপতি করে নিয়ে এসেছিলাম। ভদ্রলোক খুবই নিরীহ আর ভালোমানুষ। তাকে দিয়ে সাতকড়ি পুততুণ্ডর প্রতিভা সম্বন্ধে ঘন্টাখানেক বক্তৃতা দিইয়ে ছিলাম। তাছাড়া সাতকড়ির কিছু কবিতার আবৃত্তি এবং কিছু কবিতায় সুর দিয়ে গানও গাওয়ানো হয়েছিল। ফোটোগ্রাফারকে দিয়ে সভার নানা অ্যাঙ্গেল থেকে অনেক ছবিও তুলিয়েছিলাম। পরের দিন প্রায়-অচল এক খবরের কাগজের অ্যাসিস্টান্ট নিউজ-এডিটরের হাতে-পায়ে ধরে সভার বিবরণ আর সাতকড়ি পুততুণ্ডর একখানা ছবি ছেপে দিয়েছিলাম।

এই জন্মদিনের ব্যাপারে প্রচুর খরচ করেছিল সাতকড়ি পুততুণ্ড। কোনও কারণে একশো টাকা চাইলে লোকটা তিনশো বার করে দিয়েছে। হে মহান জনগণ, অকপটে স্বীকার করছি, এই জন্মদিনের ব্যাপারে নিট পাঁচশোটি টাকা আমার লাভ হয়েছিল।

যাই হোক, ওই দিনটার পর সাতকড়ি পুততুণ্ড আমাকে আর ছাড়ে না। তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল ইচ্ছা করলে আমি তাকে নোবেল প্রাইজও পাইয়ে দিতে পারি। সে যেমন আমাকে ছাড়েনি, আমিও চিটেগুড়ের গায়ে মাছির মতো তার গায়ে আটকে ছিলাম। প্রায়ই সাতকড়ি পুততুণ্ডর বাড়িতে কাব্য পাঠের আসর বসাতাম, লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের ধরে মাঝে-মধ্যে তার দু-একটা কবিতা ছাপিয়ে দিতাম। অবশ্য নানা খরচের নাম করে সাতকড়ির কাছ থেকে টাকা বার করে টু পাইস নিজের পকেটে পুরে ফেলতাম।

এই ভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন সাতকড়ি পুততুণ্ড দারুণ আবেগের গলায় বলেছিল, তুমি আমার জন্যে এত করছ, কই কখনও তো কিছু চাও না

মনে মনে এই দিনটার জন্যে যেন অপেক্ষা করছিলাম। জানতাম, সাতকড়ি পুততুণ্ডের মুখ থেকে একদিন এই রকম একটা কথা বেরুবেই। কিন্তু আমি কোনও আগ্রহ দেখালাম না। অত্যন্ত নিরাসক্তভাবে বললাম, কী চাইব।

তোমার যা ইচ্ছা।

সাতকড়ি পুততুণ্ডকে দেখার পর থেকে আমার মনে হয়েছিল কিছু কিছু পয়সাওলা লোকের মধ্যে দু-একটা উইক স্পট মানে দুর্বল জায়গা থাকে। এদের কেউ চায় দারুণ নাম করতে, কেউ চায় প্রতিষ্ঠা, কেউ রাজনীতিক ক্ষমতা। এই উইকনেসগুলো কাজে লাগাতে পারলে কাজ গুছিয়ে নেওয়া যায়।

মনে মনে ভেবেও রেখেছি, আমার তো চাকরি-বাকরি হবে না, সার্ভিসের বয়স পারও হয়ে যাচ্ছে, যদি কিছু ক্যাপিটাল পাই বড়লোকদের দুর্বলতার ওপর বড় আকারে কাল্টিভেসন চালিয়ে যাব। এই ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান ডিস্ট্রিক্টে কম করে এক কোটি লোক থাকে। তার ফাইভ পারসেন্ট যদি বড়লোক হয় তাহলে অঙ্কটা দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষে। পাঁচ লক্ষের শতকরা বিশজনেরও যদি নানারকম দুর্বলতা থেকে থাকে তাহলে এক লক্ষ লোককে আলাদা করে নেওয়া যায়। আর এই লাখ লোকের টেন পারসেন্টকেও যদি ফঁদে ফেলতে পারি আমার লাইফ কেটে যাবে। আমি প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিলাম, মানুষের দুর্বলতাগুলো নিয়ে একটা লার্জ স্কেল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলব। কিন্তু ক্যাপিট্যালটা পাওয়া যাচ্ছিল না। বললাম, আমার একটা বিজনেস স্টার্ট করার ইচ্ছে; কিন্তু টাকার জন্যে ওটা আটকে আছে।

কত টাকা হলে তোমার চলবে?

 হাজার দশেক।

আমি এতটা আশা করিনি, কিন্তু পরের দিনই পুরো দশ হাজার টাকাই আমাকে দিয়েছিল সাতকড়ি পুততুণ্ড। এবং খুবই আশ্চর্যের ঘটনা, টাকাটা দেবার দুদিন বাদে চার ঘণ্টায় দু-দুবার করোনারি অ্যাটাক হয়ে লোকটা মারা গেল।

সাতকড়ি পুততুণ্ড মারা যাওয়ায় দুঃখ পেয়েছিলাম। লোকটার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। কেননা সে-ই আমাকে মানুষের দুর্বলতার সন্ধান দিয়েছিল।

যাই হোক, সাতকড়ি পুততুণ্ডর সেই দশ হাজার টাকায় থিয়েটার রোডে প্রথমে একখানা ঘর নিয়ে বিজনেস স্টার্ট করেছিলাম। তারপর দ্রুত এক্সপ্যানসন করতে হয়েছে। এখন একটার জায়গায় চারখানা ঘর নিয়ে আমাদের অফিস। এক্সপ্যানসানের জন্যে লোকজনও নিতে হয়েছে। কলকাতা শহরে অফিস খুললেই চাকরির জন্যে ছেলেমেয়েরা কিউ লাগায়। গ্র্যাজুয়েট হলেই হল, আমার অফিসে কিছু কাজ তার জন্যে বরাদ্দ। তবে সারা বছরের জন্যে হয়তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে পারি না। পালা করে বছরে একমাস, দু-মাস কি ম্যাক্সিমাম তিন মাসের জন্যে ওদের কাজ দিয়ে থাকি। তিন মাস পর আবার নতুন ছেলে কি মেয়ে আসে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে একটা চমৎকার বোঝাপড়া আছে। চাকরি-বাকরির যা বাজার তাতে এই রকম ভাগাভাগি করে না নিলে কী করে চলবে। মোদ্দা কথা হল, আমরা মোটামুটি ভালোই আছি, সুখেই আছি। আমাদের পরিবার সুখী পরিবার। আওয়ার্স ইজ এ হ্যাপি ফ্যামিলি।

হে মহান জনগণ, মানুষের দুর্বলতা নিয়েই আমাদের কাজ-কারবার। এই বিজনেসটা শুরু করার আগে ধারণা ছিল না, মানুষের কত রকমের উইকনেস থাকতে পারে। মনুষ্যজাতির দুর্বলতার ওপর ফসল ফলাতে গিয়ে বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে আরো নতুন নতুন রাস্তা খুলে গেছে। এখন রোজই দেখি, শুধু দুর্বলতা নয়–মানুষের নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত হবি আর সাধ আছে, আছে অদ্ভুত ধরনের সব ক্ষ্যাপামি আর মানসিক বিকার। এগুলো আছে বলেই আমরা মোটামুটি চালিয়ে যাচ্ছি।

রোজই দেখি নানারকমের লোকজন আশে। এক কালের নামকরা কোনও অভিনেতা বা নৃত্যশিল্পী এখন তাকে লোকে ভুলে গেছে–এসে হয়তো বলেন তার জন্যে সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্যে যত টাকা দরকার তিনি দেবেন। মোট কথা, সময় তাঁকে অচল পয়সার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিলেও তিনি পিপলের চোখের সামনে থাকতে চান। কোনও পয়সাওলা বাপ এসে ছেলের গতিবিধির ওপর নজর রাখবার জন্যে আমাদের সাহায্য চায়। কোনও ভাগ্নে আসে আমাদের দিয়ে তার মালদার শাঁসালো মামাকে ব্ল্যাকমেল করতে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিজনেস স্টার্ট করার পর প্রথম কিছুদিন ক্লায়েন্টদের মনোরঞ্জনের জন্যে আমরা কিছু কিছু কাজ করেছি। তবে এখন কিছুই করি না। আজকাল শুধু অ্যাডভান্সের টাকা নিই। অনেকের কাছ থেকে অ্যাডভান্স নিয়ে নিয়ে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা হাতে এসে গেলে কোম্পানির লালবাতি জ্বালিয়ে আবার নতুন কোম্পানি ফেঁদে বসি।

হে মহান জনগণ, আমার সব কথাই বলেছি। শুধু লতিকার প্রসঙ্গ ছাড়া।

লতিকা যদিও আমার চাইতে বছর দুয়েকের ঘোট, একসঙ্গে এম-এ পড়তাম। তারপর আমার বাবা ভরতচন্দ্র সরকার টুক করে মারা গেলে আমাকে ইউনিভার্সিটি ছাড়তে হয়েছিল। তারপর বেশ কয়েক বছর লতিকার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। অবশ্য ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় লতিকার সঙ্গে তেমন কোনও ঘনিষ্ঠতা আমার হয়নি। তবে এক ধরনের বন্ধুত্ব ছিল। একসঙ্গে অন্য বন্ধুতের মতো লতিকার সঙ্গেও কফি হাউসে আড্ডা-টাড্ডা দিতাম। মাঝে মধ্যে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা যখন কঁক বেঁধে সিনেমা দেখতে যেতাম সেই দলে লতিকাও থাকত। ব্যস, ওই পর্যন্ত। অনেক কাল বাদে দারুণ নাটকীয়ভাবে আবার লতিকার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল।

মনে আছে থিয়েটার রোডে আমার বিজনেস স্টার্ট করার তিন-চার বছর পর একদিন সন্ধেবেলা এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করতে লেকের দক্ষিণের নতুন স্যাটেলিট টাউনশিপ লেক গার্ডেনসে গিয়েছিলাম। কথাবার্তা সেরে অনেক রাত্রে রেললাইন পেরিয়ে লেকের দিকে আসতে আসতে হঠাৎ চোখে পড়েছিল অনেক দুরে-সেই গড়িয়াহাটা ওভারব্রিজের তলা থেকে বজবজ লাইনের একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দুর্দান্ত স্পিডে ছুটে আসছে। গাড়িটার সামনের দিকে যে হেডলাইট জুলছিল তার আলোয় দেখতে পেয়েছিলাম, একটি মেয়ে রেললাইন ধরে উদ্ভ্রান্তের মতো ট্রেনটার দিকে ছুটছে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। এক পলক তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম মেয়েটার উদ্দেশ্য কী। সঙ্গে সঙ্গে আমার মেরুদণ্ডের ভিতর দিয়ে আগুনের হলকা বইতে শুরু করেছিল। কী করব, ভাবতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কেউ যেন পেরেক ঠুকে আমার পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে দিয়েছে।

ওদিকে ট্রেনটা ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে; মেয়েটাও উল্টোদিক থেকে ছুটে যাচ্ছে। দু-চার মিনিটের মধ্যে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যাবে।

আচমকা আমার শরীরে কোত্থেকে যেন দশ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিনের মতো শক্তি নেমে এসেছিল। মাটি থেকে পা দুটো টেনে তুলে শ্বাসরুদ্ধের মতো সামনের দিকে ছুটেছিলাম। তারপর ট্রেনটা যখন মাত্র পঁচিশ-তিরিশ গজ দূরে সেই সময় মেয়েটাকে পিছন দিক থেকে জাপ্টে ধরে টানতে টানতে রেললাইনের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা আমাদে গা ঘেঁষে ক্ষ্যাপা জানোনায়ারের মতো গাঁক গাঁক করে বেরিয়ে গিয়েছিল।

ট্রেনটা চলে যাবার পর মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে চাবুকের মতো তীব্র গলায় সে বলেছিল, কেন, কেন আপনি আমাকে বাঁচালেন?

আমি কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই মেয়েটার মুখ চোখে পড়ে গিয়েছিল। কেননা রেললাইনের ধারে ধারে যে রিফিউজি কলোনি গজিয়ে উঠেছে সেখান থেকে আলো এসে পড়েছিল তার ওপর। যাই হোক দেখা মাত্র চমকে উঠেছিলাম। বলেছিলাম, এ কী লতিকা-তুমি!

লতিকাও ততক্ষণে আমাকে চিনতে পেরেছে। সেও খানিকটা অবাক। কয়েক সেকেন্ড স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দুহাতে মুখ ঢেকেছিল লতিকা। এবার খুব ক্লান্ত স্বরে বলেছিল, আমাকে না বাঁচালেই পারতে।

একটু মজা করে বলেছিলাম, তোমার শরীরটা হল ন্যাশনাল প্রপার্টি; এটাকে ধ্বংস করার কোনও রাইট নেই তোমার। একজন অনেস্ট নাগরিক হিসেবে তোমাকে বাঁচাতে আমি বাধ্য হয়েছি।

লতিকা কী বলতে যাচ্ছিল; তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, এখানে দাঁড়িয়ে কোনও কথা নয়। চলো, কোথাও গিয়ে একটু বসি।

তাকে নিয়ে রেললাইন পেরিয়ে সাদার্ন অ্যাভেনিউতে চলে এসেছিলাম। তারপর বিশাল রাস্তার মাঝখানে যে সারি সারি সবুজ ঘাসের আইল্যান্ড রয়েছে তার একটাতে দুজনে পাশাপাশি বসেছিলাম। লতিকার বসবার ভঙ্গিটা অত্যন্ত ক্লান্ত, ভেঙেপড়া। রেললাইন ধরে ট্রেনের দিকে ছুটবার সময় তার মধ্যে যে ক্ষ্যাপা উদ্ভ্রান্ত মরিয়া ভাবটা কাজ করছিল, তখন আর তা নেই। হাত-পায়ের জোড় তখন আলগা হয়ে গিয়েছিল; দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে ভাঙাচোরা কোনও মূর্তির মতো সে বসে ছিল।

অত রাতে সাদার্ন অ্যাভেনিউতে তেমন লোকজন ছিল না। যা দু-চারজন ছিল, চোখ কুঁচকে আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যাচ্ছিল। কেউ কেউ যাবার সময় দু-একটা রগরগে টিপ্পনিও ছুঁড়ে দিচ্ছিল। ওদের আর দোষ কী, মাঝরাতে লেকের কাছে এক জোড়া যুবক-যুবতাঁকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখলে গলা খুসখুস তো করবেই, গ্ল্যান্ডগুলোও অশ্লীল হয়ে উঠবে।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বলেছিলাম, এবার বলো, আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে কেন?

লতিকা নিজবি গলায় বলেছিল, আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না।

ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় তুমি তো দারুণ ঝকঝকে মেয়ে ছিলে। হঠাৎ এত পেসিমিস্ট হয়ে উঠলে কেন?

তুমি আমার ফ্যামিলির কথা কিছুই জানে না রাজীব। জানলে বুঝতে কেন পেসিমিস্ট হয়েছি, কেন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম।

আমি শব্দ করে বেশ জোরেই হেসে উঠেছিলাম।

 চমকে হাঁটুর ফাঁক থেকে মুখ তুলছেল লতিকা, কী হল, হাসছ যে!

বলেছিলাম, তোমার ফ্যামিলির কথা না জেনেও বুঝতে পারছি তোমার দুঃখ। কিন্তু আমার ফ্যামিলির কথা যদি জানতে তাহলে বলতে, আমার একবার না, বারদশেক আত্মহত্যা করা উচিত। কিন্তু আত্মহত্যার ব্যাপারটা ভাবতেই পারি না। তোকা হেসে হেসেই দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। একটু থেমে আবার বলেছিলাম, আচ্ছা বলো, তোমার ফ্যামিলির কথা শুনি–

লতিকা যা বলেছিল, সংক্ষেপে এই রকম–টালিগঞ্জের এক ভাড়া বাড়ির একতলার দুটো ঘর নিয়ে ওরা থাকত (এখনও থাকে)। মা-বাবা আর চার ভাইবোন নিয়ে ওদের মাঝারি মাপের সংসার। বাবা যোশেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস একসময় ভালোই চাকরি-বাকরি করত। কিন্তু লোকটার ক্যারেক্টার বলতে কোনও ব্যাপারই নেই। জুয়াড়ি, মাতাল এবং প্রথম শ্রেণির ফেরেব্বাজ সে। ওয়ার্ল্ডে যত রকম জুয়ো আছে–রেস, রামি, সাট্টা, মাটিকা–কোনও কিছুতেই তার অরুচি নেই। এছাড়া মেয়েমানুষের দোষও ছিল। এত বিভিন্ন দিকে নিজের প্রতিভাকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে ঠিক সময় অফিসে হাজিরা দিতে পারত না লোকটা, ফলে তার চাকরি যায়। একটা চাকরি যাবার পর অবশ্য আবার নতুন চাকরি সে জুটিয়ে নেয়। কিন্তু দু-চার মাসের মধ্যে সেটাও থাকে না। এইভাবে যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস প্রায় ডজন দেড়েক অফিসের অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারে অটোগ্রাফ রেখে গেছে। দশ-পনেরো দিন কামাই করার পরও অফিস থেকে সে যা মাইনে পেত সেটা আর বাড়িতে আসত না। রেসের মাঠে, মদের দোকানে কিংবা জুয়োর আড্ডায় সেটা জমা দিয়ে আসতে হত। যাই হোক, এই করে করে, অর্থাৎ অফিসে না গিয়ে গিয়ে শেষ চাকরিটাও সে খুইয়েছিল।

হেড অফ দি ফ্যামিলি যদি এই হয়, সংসারের হাল কী দাঁড়াতে পারে সহজেই আন্দাজ করা যায়। লতিকার মা লোকের বাড়ি থেকে অর্ডার-টর্ডার এনে জামা-প্যান্ট সেলাই করে সংসারটাকে জোড়াতালি দিয়ে বাঁচাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কি সংসার বাঁচে। রোজ দুবেলা খাওয়াই জুটত না। লতিকার ঠিক পরের ভাইটার ছিল ক্যান্সার। ডাক্তাররা তার সম্পর্কে সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের ধারণা, ম্যাক্সিমাম আর এক বছর সে বাঁচবে।

যার ফ্যামিলির রেখাচিত্র এই, সেই যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস কিন্তু পরম নিশ্চিন্তে দিন কাটিয়ে যাচ্ছিল। স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের দিকে সে ফিরেও তাকাত না। বরং নেশা আর জুয়োর পয়সায় টান পড়লে লতিকার মাকে মেরে ধরে টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে যেত। এ নিয়ে সংসারে খিটিমিটি লেগেই থাকত।

তবু এরই মধ্যে দুবেলা দুটো টিউশানি করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে লতিকা। তার আশা ছিল ইউনিভার্সিটির শেষ ডিগ্রিটা নিয়ে বেরোতে পারলে একটা কিছু হয়ে যাবে। শ চারেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে এক আঁকে এম-এ-টা পাশ করে বেরিয়েও ছিল সে। একে বাংলায় এম-এ তার ওপর খুব নীচের দিকের একটা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিল। এতে চাকরি হয় না। বছর তিনেক নানা স্কুল, সরকারি আর মার্চেন্ট অফিসে ঘোরাঘুরির পর সেই আত্মহত্যার দিন দুপুরে ক্যামাক স্ট্রিটের এক প্রাইভেট ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কনসানে গিয়ে সোজা ডিরেক্টরের চেম্বারে ঢুকে পড়েছিল।

ডিরেক্টর মিস্টার সোনি–পঞ্চান্নর মতো বয়স, টকটকে গায়ের রঙ, চওড়া হাড়ের ফ্রেমে মজবুত শরীর, কাঁচা পাকা চুল, চোখে পুরু লেন্সের চশমা, বেশ সুপুরুষই বলা যায় তাকে-সহানুভূতির সঙ্গে লতিকার সব কথা শুনেছেন, সুন্দর সহৃদয় ব্যবহার করেছেন, কফি খাইয়েছেন, বলেছেন চাকরি নিশ্চয়ই দেবেন এবং সেটা তখনই।

কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গিয়েছিল লতিকার। রুক্ষ কর্কশ ওয়ার্ল্ডে সেই প্রথম একজন হৃদয়বান মানুষের দেখা পেয়েছিল সে। কিন্তু কী ধরনের কাজ তাকে করতে হবে, জানতে গিয়েই ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছিল।

মিস্টার সোনি জানিয়েছিলেন, কাজটা তেমন কিছু নয়। তিনি বিপত্নীক এবং একেবারেই নিঃসঙ্গ। ছেলেমেয়েরা বিয়ে-টিয়ে করে এবং কাজের সূত্রে দূরে দূরে থাকে। এদিকে অফিসের কাজটুকু বাদ দিলে বাকি সময়টা তিনি বড় একা হয়ে যান। এই সময়টার জন্যে তার একজন সঙ্গিনী দরকার। স্নিগ্ধ, মধুর, সফট টাইপের একটি মেয়ে চাই-ঠিক যেমনটি লতিকা। মিস বিশ্বাস যেন ঈশ্বর-প্রেরিত হয়েই তার কাছে এসেছে।

মিস্টার সোনি আরও বলেছিলেন, কাজটা হোল-টাইমের। লাউডন স্ট্রিটে তাঁর তিন হাজার স্কোয়ার ফুটের প্রকাণ্ড ফ্ল্যাট আছে। লতিকাকে সেখানে গিয়ে থাকতে হবে। মাঝেমধ্যে ভাই-বোন মা-বাবাকে সে দেখে আসতে পারে। তা ছাড়া বছরে দু-তিনবার মিস্টার সানিকে ইওরোপ-আমেরিকা যেতে হয়, লতিকাকেও তখন তার সঙ্গে যেতে হবে।

লতিকা বুঝতে পারছিল, এই মধ্যবয়সি নোকটা মহানুভবতার মুখোস এঁটে তাকে তার মিস্ট্রেস হয়ে থাকতে বলছে। ইউনিভার্সিটির শেষ ডিগ্রিটা হাতে নিয়ে আসার পরও কেউ যে এমন একটা চাকরির কথা বলতে পারে–এটা ভাবতে গিয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছিল লতিকার; মাথার ভেতর কোথায় যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছিল, গলগল করে ঘামতে শুরু করেছিল সে। একটা কথাও আর না বলে মিস্টার সোনির ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল লতিকা। তারপর অন্ধের মতো রাস্তায় নেমে একটা বাস ধরে বাড়ি ফিরেছিল। ফিরেই দ্যাখে ক্যান্সারের রুগী ভাইটার অবস্থা খুব খারাপ; অসহ্য যন্ত্রণায় তার শরীর বেঁকে যাচ্ছে। মা এবং অন্য ভাইবোনরা তাকে ঘিরে বসে সমানে কাঁদছে।

দুপুরে যখন লতিকা ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট অফিসে চাকরির খোঁজে যায় তখন ভাইটার অবস্থা এ রকম ছিল না। যাই হোক, যন্ত্রণা বাড়লে ওকে পেইনকিলার ট্যাবলেট দেওয়া হয়। তাড়াতাড়ি একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছিল লতিকা; কিন্তু কষ্ট কমেনি। তখন পর পর আরো দুটো ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছিল লতিকা। কিন্তু তাতেও যখন কিছু হল না তখন তার বুকের ভিতরকার শিরা-টিরা মুচড়ে-টুচড়ে কী রকম যেন হয়ে যাচ্ছিল।

ঠিক এই সময় বাবা যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস বাড়ি এসে ঢুকেছিল। সঙ্গে কালো গাবদা গাবদা রক্ষাকালীর মতো চেহারা এক মহিলা আর দুটো বাচ্চা। যোসেফ গঙ্গাপদ আনুষ্ঠানিকভাবে মহিলা এবং বাচ্চা দুটির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। লতিকাকে বললেও, কথাটা সবারই উদ্দেশ্য। ওই মহিলাটি গঙ্গাপদর দ্বিতীয় স্ত্রী, অর্থাৎ লতিকার ছোট মা এবং ছেলে দুটো তার ভাই। এতদিন বেহালার ওদিকে ভাড়া বাড়িতে ওরা থাকত। এখন যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস সিদ্ধান্ত করেছে, ওদের আর দূরে থাকার মানে হয় না। সে বলেছিল, সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকবি-বুঝলি লতু! তোর ফাস্ট মাদার, সেকেন্ড মাদার, আমি, তোরা ভাইবোনেরা সবাই মিলে আমরা একটা হ্যাপি ফ্যামিলি; সুখী পরিবার।

বাবা যে লুকিয়ে লুকিয়ে আরেকটি বিয়ে করেছে এবং সন্তান-সন্ততি উৎপাদন করে বসে আছে, এ খবরটা ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি। প্রসেসান করে দ্বিতীয় পক্ষের সংসারটিকে নিয়ে আসায় এই ব্যাপারটা আচমকা বাজ পড়ার মতো ঘটনা। বাবার কথা শেষ হতে না হতেই লতিকার আসল মা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। আর তখন লতিকার মাথার ঠিক ছিল না; বাড়ি থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো সে বেরিয়ে পড়েছিল। সারাদিনে যা ঘটনা ঘটে গেছে সবগুলো মেন্টাল ব্যালান্স অর্থাৎ মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। অনেকক্ষণ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে সে স্থির করে ফেলেছিল আত্মহত্যা করবে।

নিজের কথা শেষ করে লতিকা আমার দিকে তাকিয়েছিল। এবার তুমিই বলো–আমার আত্মহত্যার অধিকার আছে কিনা।

বলেছিলাম, তখনও বলেছি, এখনও বলছি-নেই। এখন বাড়ি চলো। অনেক রাত হয়ে গেছে।

না। তুমি চলে যাও।

আমি গেলে আরেকটা সুইসাইডের অ্যাটেম্পট নেবে বুঝি! কিন্তু ও প্রচেষ্টা তোমাকে চালাতে দেব না। শোনো লতিকা, লাইফের একটা সাইড তো দেখলে। এটুকুই কিন্তু শেষ নয়। বেঁচে থাকার অনেক মজা আছে, সেটা দেখবে না?

বেঁচে থাকার যে মজা আছে–সে কথা শুনেছি কিন্তু কখনও দেখিনি।

তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও; সেই মজাটা তোমার হাতে তুলে দেব। যদি না পারি, তোমার যা ইচ্ছে কোরো। চলো এখন, তোমাদের বাড়ি চলো।

একটা ট্যাক্সি ডেকে লতিকাকে তুলে নিয়েছিলাম। পাশাপাশি বসে যেতে যেতে থিয়েটার রোডে আমার অফিসের ঠিকানাটা দিয়ে বলেছিলাম, কাল নিশ্চয়ই আমার অফিসে আসবে।

পরের দিন আমার অফিসে লতিকা আসতেই প্রথমে জিগ্যেস করেছিলাম, তোমার পিতৃদেব, দ্বিতীয় মাতৃদেবী এবং তস্য ছানাপোনাদের খবর কী?

লতিকা বলেছিল, মা অজ্ঞান হয়ে যাবার পর ওরা পালিয়ে গেছে।

ভেরি গুড। ওদের ভাগাবার একটা অস্ত্র হাতে পাওয়া গেল। মাকে বলবে ওরা এলেই যেন অজ্ঞান হয়ে যায়।

লতিকা হেসে ফেলেছিল।

আমি বলেছিলাম, এবার কাজের কথায় আসা যাক। তুমি আমার কনসার্নে জয়েন করো। মাসে আপাতত হাজারটাকা করে পাবে।

সেই থেকে লতিকা আমার বিজনেস পার্টনার। সুখে-দুঃখে এবং মজাসে আমরা দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। তবে একটু ঝামেলা দুজনেরই আছে। আমার মা মেন্টাল পেসেন্ট, আর লতিকার বাবা মাঝে মাঝেই এসে মেয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। লতিকা বাবার ওপর ক্ষেপে যায়, একটা মাতাল জুয়াড়িকে টাকা দিতে চায় না। আমি হেসে হেসে বোঝাই, আরে বাবা, আফটার অল লোকটা তোমার জন্মদাতা পিতা। জন্মটা যখন ওর জন্যেই হয়েছে এখন ওল্ড-এজ পেনসানটা দিয়ে যাও।

লতিকার আরেকটা সমস্যা অবশ্য মিটে গেছে। ওই ক্যান্সারের পেসেন্ট ভাইটা মারা গেছে। এর মধ্যে দুটো বোনের বিয়ে দিয়ে ফেলেছে সে, মাকে আর বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেলাইয়ের অর্ডার আনতে দেয় না। মোট কথা, এ লাইফে এই প্রথম একটু সুখ-সচ্ছলতার মুখ দেখতে পেয়েছে সে। এ জন্যে আমার কাছে তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। প্রায়ই বলে, তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। আমি কিছু বলি না, হাসি।

লতিকা আবার বলে, আর যে প্রফেসানে এনে ঢুকিয়েছ তাতে যে কত রকমের মানুষ, কত রকমের মজা!

এবার বলি, তাহলে লাইফের একটু আধটু মজা দেখতে পাচ্ছ!

শুধু কৃতজ্ঞতাই না, কিছুদিন ধরে আমার নার্ভে কিছু কিছু গোলমেলে ব্যাপার ধরা পড়েছে। অফিসে কাচের  দেয়ালের এধারে বসে থাকতে থাকতে আচমকা হয়তো চোখে পড়ে যায়, গভীর দৃষ্টিতে লতিকা আমাকে লক্ষ্য করছে। কখনও-সখনও আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কিংবা ময়দানের সবুজ ঘাসে গিয়ে বসি। তখন লতিকা আমার একটা হাত নিয়ে খেলা করতে থাকে। দুম করে কোনও কোনও দিন সে আমার এন্টালির বাড়িতে চলে আসে; কোমর বেঁধে রান্না করে ঘর গুছিয়ে দেয়; তারপর চলে যায়। একেকদিন গাঢ় গলায় সে বলে, আমার আর ভালো লাগে না।

আমি জিগ্যেস করি, কেন?

জানি না।

ব্যাপারটা বোধহয় সংক্রামক। আর আমিও একটা মানুষ। মানুষের সব প্রপার্টি যখন আমার আছে তখন লতিকা কাছে এলে, শুদ্ধ ভাষায় কী যেন বলে-হৃদয়ের শব্দ, হ্যাঁ তাই আমি শুনতে পাই। সে-ও কি আমার হৃদয়ের শব্দ শোনে? বুকের ভেতরকার এই শব্দটা তো ব্যান্ড পার্টির আওয়াজ নয়। কাজেই জোর করে কিছু বলতে পারি না। তবে আমার মনে হয় ও একদিন কিছু বলে ফেলবে। কিংবা গ্ল্যান্ডগুলো ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়লে আমিও দুম করে কিছু বলে ফেলতে পারি। দেখা যাক, কে আগে বরফ গলায়? মোটামুটি এই লতিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক।

.

হে মহান জনগণ, এখন অনেক রাত। কোথাও কোনও শব্দ নেই। কলকাতায় স্নায়ু একেবারেই ঝিমিয়ে পড়েছে।

এতক্ষণ নিজের লাইফ হিস্ট্রি, লতিকার লাইফ হিস্ট্রি, প্রফেসান–সব আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কিন্তু এখন সমস্ত সরিয়ে সেই মহিলাটি, যার নাম মনোবীণা সান্যাল, তাঁর মেয়ে শমিতা, তার স্বামী এবং শমিতার কানাড়াবাসী বাবা–এরা আবার পুরনো রেকর্ড নতুন করে বাজার মতো স্নায়ুর ভেতর ফিরে আসতে লাগল। এদের কথা ভাবতে ভাবতে ক্রমশ আমার চোখ জুড়ে আসতে লাগল।

.

০৪.

ঘুম ভাঙতে প্রথমেই যাঁদের কথা মনে পড়ল তাঁরা হলেন মনোবাণী সান্যাল, তার স্বামী অরবিন্দ সান্যাল, তার মেয়ে শমিতা এবং শমিতার কানাডায় থাকা বাবা। কাল রত্তিরে এদের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

এখনও ভালো করে সকাল হয়নি। জানালার বাইরে আবছা আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে দু-একটা ট্রাম কি হরিণঘাটার দুধের গাড়ি কিংবা খবর কাগজের ভ্যান চলার শব্দ আসছিল।

ওই সব শব্দ-টব্দ আমার কানে ঢুকছিল না। জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম ঠিকই, কিন্তু ঝাপসা অন্ধকার, ভোরের আকাশ কিংবা অন্য দৃশ্যাবলী, কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনোবীণা সান্যালদের চিন্তাটা আমাকে পেয়ে বসেছে।

অথচ মহিলার কাছ থেকে দুহাজার টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছি। অ্যাডভান্স নেওয়া হয়ে গেলেই আমার কাজ শেষ। তখন পিছন দিকে ফিরেও তাকাই না। কিন্তু ওই মহিলা–মনোবীণা সান্যাল ফিক্সেসানের মতো আমার মাথার ভেতর আটকে গেছে।

আস্তে আস্তে পাতলা অন্ধকার কেটে গিয়ে রোদ দেখা দিল। শুয়ে শুয়েই জানালা দিয়ে নীচের রাস্তায় এখন প্রচুর লোকজন দেখতে পাচ্ছি; অজস্র গাড়ি-টাড়ি চোখে পড়ছে। হঠাৎ আমি ঠিক করে ফেললাম, মনোবীণা সান্যালের মেয়ে শমিতার দায়িত্ব নেব। ডাইনির মতো মন্ত্র পড়ে ওরা যেন আমাকে টানছিল। ব্যাপারটা মনে মনে স্থির করে বিছানা থেকে নামতে গিয়েই চোখে পড়ল মেঝেতে চিটচিটে নোংরা বিছানায় কুকুরে মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে চার্লি। কাল রাত্তিরে আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর নারকেল গাছ বেয়ে জানালার শিক সরিয়ে কখন ও ঘরে ঢুকেছে, টের পাইনি।

চার্লির বয়স বাহান্ন-তিপান্ন। লোকটা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। পোড়া ব্রোঞ্জের মতো গায়ের রঙ। শরীরে মাংসের চাইতে হাড় বেশি। এবড়ো-খেবড়ো লম্বাটে মুখ; চোখ দুটো ইঞ্চিখানেক ভেতরে ঢোকানো; গালে খাপচা খাপচা দাড়ি। তামাটে রঙের পাতলা চুল অযত্নে সব সময় এলোমেলো হয়ে থাকে। পরনে তাল-মারা ঠেটি ট্রাউজার আর চক্কর-বক্কর লাগানো স্পোর্টস গেঞ্জি।

চার্লি আমাদের এই এলাকার নামকরা ছিঁচকে চোর। তবে ওর লোভ কম, হয়তো সাহসও। কোনও জিনিসের দাম পঞ্চাশ টাকার বেশি হলে ও তা ছোঁয় না।

চার্লি জেলখানার পোষা পাখি; ইংরেজিতে যাকে জেল-বার্ড বলে ঠিক তাই। বাহান্ন-তিপন্ন বছরের মধ্যে কম করে ছাব্বিশ-সাতাশ বছর তার জেলেই কেটেছে। আমাদের এই অঞ্চলে ছোটখাটো কিছু চুরি হলে পুলিশ চার্লিকে ধরে হাজতে চালান করে দেয়।

মা বাবা-ভাই-বোন বউ-বাচ্চা, কেউ নেই চার্লির। ওর থাকারও কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। আমার সঙ্গে দেখা হবার আগে জেলখানার বাইরে যে কটা দিন সে থাকত সে দিন কটা এর-ওর বারান্দায় শুত। ট্রাম রাস্তার ধারে দুটো আস্তাবল আছে। কখনও-সখনও সেখানে গিয়েও পড়ে থাকত।

আমার সঙ্গে চার্লির আলাপ হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে। আমাদের এই এলাকার থানায় আগে মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে যেতাম। আমার এক বন্ধু সমীর ছিল ওখানে সাব-ইন্সপেক্টার।

সেবার কলকাতায় দারুণ শীত পড়েছে। মাসটা ছিল জানুয়ারি। রাত নটার সময় কফি খেতে খেতে সমীরের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ চার্লি এসে হাজির। লম্বা স্যালুট সে সমীরকে বলেছিল, স্যার, বড় বিপদে পড়ে গেছি। প্লিজ সেভ মি। ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে কথা বলে সে।

এই থানার সবাই চার্লিকে চেনে। ভুরু কুঁচকে সমীর জিগ্যেস করেছিল, কী ব্যাপার?

চার্লি বলেছিল, স্যার, এবার দারুণ শীত পড়েছে–ট্রিমেণ্ডাস কোল্ড। বাইরে পড়ে থাকতে থাকতে হিমে জমে যাচ্ছি। প্লিজ এই উইন্টারটা আমাকে জেলখানায় পুরে রাখুন। নইলে স্রেফ মরে যাব–আই উইল ডাই।

ভাগ

আমি আপনাদের বাঁধা ক্লায়েন্ট। মরে যাব, এটা কি ভালো হবে। আমার কেসটা কনসিডার করুন।

তুই কি চুরি করেছিস যে জেলে পুরব! খারাপ কাজ না করলে জেলে পোরা যায়?

যাই, তাহলে একটা চুরি-ফুরিই করে আসি। চার্লি চলে গিয়েছিল।

আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম; আবার মজাও লাগছিল খুব। এমন ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার আগে আর কখনও দেখিনি।

যাই হোক, কিছুক্ষণ বাদে সমীরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সার্কুলার রোডের কাছাকাছি আসতেই চার্লির সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল। আমি নিজে ডেকে ওর সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। দারুণ মজার লোক চার্লি। ওর জীবন এবং কথা বলার ভঙ্গি আমাকে প্রচণ্ড আকর্ষণ করেছিল। ফলে রাস্তা থেকে ওকে সোজা আমার ডেরায় নিয়ে এসেছিলাম। হে মহান জনগণ, একটা লোক জেলে যেতে পারবে না বলে শীতে কষ্ট পাবে, তা তো আর হতে পারে না। বিশাল ছাদে দু-দুটো ঘর নিয়ে আমি একা থাকি; এখানে আরেকটা লোকের জায়গা সহজেই হয়ে যেতে পারে। চার্লিকে বলেছিলাম, এখন থেকে তুমি আমার এখানেই থাকবে।

চার্লি গভীর কৃতজ্ঞতায় আমার হাত দুটো চেপে ধরে বলেছিল, ইউ আর মাই সেভিয়র; মাই লর্ড। মনে হচ্ছে তোমার জন্যে এই শীতটা টিকে গেলাম।

সেই থেকে চার্লি আমার কাছেই আছে। মাঝে মাঝে অবশ্য হাওয়া বদলাবার জন্যে জেলে চলে যায়। তখন আমি একাই থাকি। ও আমাকে লর্ড বলে ডাকে।…

…কয়েক পলক ঘুমন্ত চার্লির দিকে তাকিয়ে থেকে আমি বাথরুমে চলে গেলাম। আধ ঘণ্টা পর ফিরে এসে দেখি চার্লির ঘুম ভেঙে গেছে। শুধু তাই না, নিজের তেলচিটে বিছানাটা খাটের তলায় চালান করে ঘর-টর সাফ করে ফেলেছে। তারপর চা বানিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

আমাকে দেখেই চার্লি বলে উঠল, গুড মর্নিং লর্ড

আমিও বললাম, গুড মর্নিং

আমার হাতে একটা চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে চার্লি বলল, অনেকদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হল লর্ড।

হে মহান জনগণ, আপনাদের আগেই জানিয়েছি আমরা একই ঘরের বাসিন্দা হলেও দেখা-টেখা আমাদের খুব কমই হয়ে থাকে। কেননা আমি যখন ঘরে থাকি; চার্লি তখন বাইরে। আবার চার্লি যখন ঘরে ঢোকে আমি তখন বাইরে ঘুরে বেড়াই।

হেসে বললাম, হ্যাঁ, তা তোমার হাতের কাজ কী রকম চলছে?

হাতের কাজ বলতে চুরি-চামারি। হতাশ এটা ভঙ্গি করে চার্লি দু-হাত উল্টে দিল। বলল, ভেরি ব্যাড লর্ড।

কেন?

লোকজন খুব কেয়ারফুল হয়ে গেছে। মাল-টাল আর সরানো যাচ্ছে না। ভাবছি হ্যাঁন্ডিক্র্যাফটের কাজটা ছেড়েই দেব। তার ওপর কাল যা একখানা এক্সপিরিয়েন্স হল নাকী বলব!

কী এক্সপিরিয়েন্স? আমার রীতিমতো কৌতূহলই হল।

রাত বারোটায় আমাদের এই এন্টালিতেই একটা গলিতে ঢুকলাম। মনে হল কেউ জেগে নেই। সামনের একটা তেতলা বাড়ির তিনতলার বারান্দায় দেখলাম একটা ওয়াল-ক্লক রয়েছে। ওটা সরাবার জন্যে রেন-ওয়াটার পাইপ বেয়ে যেই উঠতে যাব অমনি একটা ট্যাক্সির হেডলাইট এসে পড়ল আমার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সিটা থেমে গেল আর দরজা খুলে এক বাবু বেরিয়ে এল। মাল খেয়ে বাবুটি চুর হয়ে আছে। টলতে টলতে আমার কাছে এসে সে বলল, এই ব্যাটা, তুই নির্ঘাত চোর। আমি ভীষণ নার্ভাস হয়ে গেলাম। বুঝলাম কট যখন হয়েই গেছি তখন স্বীকার করাই ভালো। বললাম, স্রেফ পেটের দায়ে এই প্রফেসানটা নিতে হয়েছে স্যার। আর কখনো চুরি করব না। দারুণ টলছিল লোকটা। সেই অবস্থায় আমাকে দেখতে দেখতে বলল, তুই বুঝি এ পাড়ায় আজই প্রথম চুরি করতে এসেছিস? ভয়ে ভয়ে বললাম, হ্যাঁ স্যার। বাবুটি বলল, তাই জানিস না, রাত বারোটায় এ পাড়ায় কোনও চোর ঢোকে না। কারণ এ-সময় আমি মানে নিশিকান্ত সেনগুপ্ত মলে খেয়ে ফিরি। তা তোর নাম কী বল? বললাম, চার্লি। বাবুটি বেশ ফানি। বলল, চার্লি চ্যাপলিন নাকি? বললাম, না চার্লি হেণ্ডারসন। বাবুটি বলল, তার মানে খ্রিশ্চান! তোকে পেয়ে খুব ভালো হল। কদিন ধরেই বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের ব্যাপারটা বুঝবার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। বুঝিয়ে দে তো ব্যাপারটা। লাইফে কোনওদিন চার্চে যাইনি, বাইবেল চোখে দেখিনি। আমার গা দিয়ে ঘাম ছুটল। বললাম, আমাকে ছেড়ে দিন স্যার, আর কক্ষনো এখানে আসব না। বাবুটি ঢুলুঢুলু চোখে আমাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ ঘাড়ে এক রদ্দা কষিয়ে বলল, যাও শালা, গেট আউট–। আমি এক দৌড়ে গলিটা ক্রস করে ট্রাম রাস্তায় চলে এলাম।

চার্লির কথা শুনতে শুনতে দারুণ মজা লাগছিল। হাসতে হাসতে বললাম, দারুণ এক্সপিরিয়েন্স তো

চার্লি বলল, সবটা আগে শুনে নাও

এখনও বাকি আছে নাকি?

ইয়েস লর্ড। বলে চার্লি আবার শুরু করল, গলি থেকে বেরিয়ে এলেও ব্লাডি ঘড়িটা আমার মাথায় আটকে ছিল। এদিক ওদিক ঘুরে রাত দুটোয় আবার ওখানে গেলাম। রেন-ওয়াটার পাইপে উঠতে গিয়ে এবার সান অফ এ বিচ একটা প্রাইভেট কারের হেডলাইট এসে পড়ল আমার ওপর। গাড়ি থামিয়ে ঢ্যাঙা ল্যাস্কি চেহারার আরেক মাতাল নেমে এল। আমার ঘাড়ে আস্তে টোকা মেরে বলল, তোর সাহস তো কম না! রাত দুটোয় আমি এই ভূতনাথ চাকলাদার নেশা করে ফিরি, আর তুই কিনা এ সময় চুরি করতে ঢুকেছিস! নাম বল-ভয়ে ভয়ে নামটা বললাম। চাকলাদার সাহেব জিগ্যেস করল, তুই ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল? ইয়েস স্যার, আমার জন্ম-কর্ম সব এখানে। চাকলাদার বলল, ভেরি গুড! এবার ন্যাশনাল অ্যানথেম মানে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ বলে যা তো দেখি। আরেকবার আমার ঘাম ছুটল। দু-চারটে লাইন বলবার পর সব গোলমাল হয়ে গেল। চাকলাদার সাহেব ভয়ানক রেগে গেলেন, শালা, ভারতীয় নাগরিক হয়ে তুমি জাতীয় সঙ্গীত পুরো বলতে পারছ না! অ্যাবাউট টার্ন-ভয়ে ভয়ে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। চাকলাদার সাহেব তখন তার লম্বা পা দিয়ে আমার পাছায় টেনে একটি কিক হাঁকালেন। আমি উড়ে গলির মুখে সে পড়লাম।

শুনে হাসতে হাসতে আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। বললাম, চার্লি, আমি মরে যাব। আই শ্যাল ডাই সিম্পলি। |||||

||||| চার্লি বলল, শেষটুকু শুনে নাও। তারপর মরো। চাকলাদারের লাথি খেয়ে তো পালিয়ে এলাম। কিন্তু ঘড়িটাকে কিছুতেই মাথার ভেতর থেকে আউট করে দিতে পারছিলাম না। সাড়ে চারটের সময় গুটি গুটি আবার গলিতে ঢুকলাম। রেন-ওয়াটার পাইপ বেয়ে থার্ড টাইম উঠতে যাব, ঠুং টুং করে রিশার শব্দ কানে এল। কিছু বুঝবার আগেই রিকশা থেকে কে যেন আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। দেখলাম ছাই-টাই মাখা এক ইয়োগী (যোগী) চোখ দুটো তার টেরিফিক রেড। আমার গলাটা চেপে ধরে সে বলল, পাপী, জানিস না, আমি ভীমভৈরব অবধূত এ সময় শ্মশান থেকে মহাদেবের প্রসাদ চড়িয়ে ফিরি! বললাম, সাধু মহারাজ, আমি আর কখনও এখানে আসব না। ইয়োগী বলল, না, আসবি না। এসে সুবিধে হবে না। এ পাড়ায় রাত বারোটায় মাল খেয়ে নিশিকান্ত ফেরে, ভূতনাথ ফেরে রাত দুটোয়, আর আমি ফিরি সাড়ে চারটেয়। সারা রাতে ফঁকটা কোথায় যে চুরি করতে ঢুকবি! বলেই রিকশা থেকে একটা ত্রিশূল নামিয়ে তার বাঁটটা দিয়ে কোমরে মারলে এক খোঁচা, আমি ছিটকে আবার গলির বাইরে এসে পড়লাম। বলে একটু থামল চার্লি। পরক্ষণে আবার শুরু করল, তুমিই বলো লর্ড, এরপর আর এই প্রফেসান কি চালানো যায়? ভাবছি এটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু করব। উইল ডু সামথিং এ

পাদ্রি বাবা হয়ে যাবে নাকি?

চার্লি আবার কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আচমকা মনোবীণা সান্যাল আর শমিতার মুখ আবার আমার মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় একটা প্ল্যান এসে গেল। চার্লিকে সেই প্ল্যানটায় লাগিয়ে দেওয়া যায়। বললাম, তোমাকে একটা কাজ দিতে পারি চার্লি। করবে?

চার্লি বলল, জেন্টলম্যানের কাজ দিলে কিন্তু পারব না লর্ড।

আমাকে কি জেন্টলম্যান মনে হয় যে তোমাকে ভদ্রলোকের কাজ দেব!

তা হলে কী করতে হবে বলে ফেললো।

আমি আমার সেই ব্রিফকেসটা এনে তার থেকে শমিতার ফোটো বার করে বললাম, এটা দেখো

ছবিটা দেখতে দেখতে চার্লি বলল, ওহ গড়, এ যেন এলিজাবেথ টেলর! একে তুমি কোথায় পেলে?

চার্লি এলিজাবেথ টেলরের দুর্দান্ত ফ্যান। এলিজাবেথের যে-কোনও ছবি আসুক, সে দেখবেই।

যেখানেই পাই, তোমার কাজটা হল এর ওপর নজর রাখা। পারবে?

গ্ল্যাডলি। চুরি-ফুরির চাইতে বিউটিফুল মেয়েদের পেছনে ঘোরা অনেক ভালো প্রফেসান। আহ হেভেন! অনবরত সুন্দরী মেয়ে দেখলে চোখ ভালো হয়ে যায়, না কী বলো!

হাসলাম। তারপর মনোবীণা সান্যালের ঠিকানাটা দিয়ে বললাম, এখনই তুমি ওখানে চলে যাও। বাড়ির ভেতরে ঢুকবে না; বাইরে ট্যাক্সি নিয়ে ওয়েট করবে। মেয়েটা কোথায় যায় লক্ষ্য রাখবে। যদি দেখো কোথাও বেশিক্ষণ থাকছে আমার অফিসে একটা ফোন করে দেবে। আমি এগারোটার পর অফিসে থাকব।

ঠিক আছে লর্ড। কিছু ক্যাশ দেবে না? ট্যাক্সি-ফ্যাক্সির খরচ আছে।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মনোবীণা সান্যাল যে টাকাটা অ্যাডভান্স করেছিল তার থেকে পঞ্চাশটা টাকা চার্লিকে দিলাম।

টাকাটা এবং সেই সঙ্গে শমিতার ফোটোটা পকেটে পুরতে পুরতে চার্লি বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। তারপর জানালা পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। গলা নামিয়ে বলল, ব্যাপারটা কী লর্ড?

কী জানতে চাইছ?

শমিতার ফোটোটা দেখিয়ে চার্লি বলল, ইঁদুরকলে পা ঢুকিয়ে দাওনি তো? মেয়ে-ঘটিত বিষয়গুলোকে চার্লি ইঁদুর-কল বলে থাকে।

আমি হাসাম, বুঝতে পারছি না। তুমি এখন যাও।

চার্লি জানালার শিক সরিয়ে নারকেল গাছ বেয়ে নীচে নেমে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *