৪. দিল্লি ও আগ্রা

দিল্লি ও আগ্রা

[বার্নিয়েরের এই পত্রখানি কেবল মোগল সম্রাটদের রাজধানী দিল্লি ও আগ্রার প্রাচীন ঐতিহাসিক বিবরণের জন্য উল্লেখযোগ্য নয়, রাজ—দরবারের জীবনযাত্রা, তখনকার লোকসমাজের আচার—ব্যবহার, রীতি—নীতি ইত্যাদির বিশ্বস্ত ও বিস্তৃত কাহিনি হিসেবেও অত্যন্ত মূল্যবান। এককথায়, এই পত্রখানিকেও মঁশিয়ে কলবার্টের কাছে লিখিত পত্রের মতো, ভারতের সামাজিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা চলে। এই পত্রখানি ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের ১৬৬৩ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সের মঁশিয়ে দ্য লা ভেয়ারের কাছে লিখেছিলেন। নৃবিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান ও ইতিহাসের বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন দ্য লা ভেয়ার*। তদানীন্তন ফরাসি বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের মধ্যে তাঁর অসাধারণ প্রতিপত্তি ছিল। বার্নিয়ের ছিলেন দ্য লা ভেয়ারের বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু। ভেয়ার যখন মৃত্যুশয্যায় তখন বার্নিয়ের তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। বার্নিয়েরকে দেখেই মুমূর্ষু দ্য লা ভেয়ার উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন : কি সংবাদ মঁশিয়ে, হিন্দুস্থানের মোগল সাম্রাজ্যের সংবাদ কি বলুন।]

মঁশিয়ে ভেয়ারের কাছে লিখিত বার্নিয়েরের পত্র

মঁশিয়ে, আমি জানি আমি স্বদেশে ফিরে আসবার পর আপনি প্রথমেই আমাকে হিন্দুস্থানের রাজধানী দিল্লি ও আগ্রা শহরের কথা জিজ্ঞাসা করবেন। সৌন্দর্যে, আয়তনে ও লোকজনের বসবাসের দিক দিয়ে ফরাসি শহর প্যারিসের সঙ্গে দিল্লি ও আগ্রার তুলনা হয় কিনা, সেকথা জানবার জন্য এবং আমার কাছ থেকে শোনবার জন্য আপনি ব্যাকুল হয়ে উঠবেন। আপনার সেই ব্যাকুলতা ও কৌতূহল—নিবৃত্তির জন্যই আমি এই চিঠি লিখছি। শুধু শহরের বিবরণ নয়, চিঠির মধ্যে এমন আরও অনেক কথা প্রসঙ্গত বলব, যা আপনার কাছে চিত্তাকর্ষক মনে হবে।

পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য শহর

দিল্লি ও আগ্রার সৌন্দর্য—প্রসঙ্গে প্রথমেই একটি কথা আমি বলতে চাই। আমি দেখেছি, অনেক সময় ইয়োরোপীয় পর্যটকরা বেশ একটা উদাসীন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হিন্দুস্থানের এইসব শহরের কথা বলে থাকেন। তাঁদের মন্তব্য শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। পাশ্চাত্য শহরের সঙ্গে এইসব শহরের সৌন্দর্যের তুলনা করেন যখন তাঁরা তখন একটি কথা একেবারেই ভুলে যান যে ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুযায়ী স্থাপত্যের বিভিন্ন স্টাইলের বিকাশ হয়। প্যারিস, লন্ডন বা আমস্টার্ডামের স্থাপত্য আর হিন্দুস্থানের দিল্লির স্থাপত্য এক ও অভিন্ন হতে পারে না। কারণ ইয়োরোপে যা বাসোপযোগী, হিন্দুস্থানে তা ব্যবহার্য নয়। কথাটা যে কতখানি সত্য তা রাজধানী স্থানান্তরিত করলেই বোঝা যেতে পারে। ইয়োরোপের শহর যদি হিন্দুস্থানে স্থানান্তরিত করা যায়, তাহলে তা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে নতুন পরিকল্পনায় আবার গড়ে তোলার দরকার হবে। ইয়োরোপের শহরের সৌন্দর্য অতুলনীয় স্বীকার করি। কিন্তু তার একটা নিজস্ব রূপ আছে, যেটা শীতপ্রধান দেশের শহরের রূপ। সেইরকম দিল্লিরও একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, যেটা গ্রীষ্মপ্রধান দেশের শহরের সৌন্দর্য। হিন্দুস্থানে গরম এত বেশি যে কেউ সেখানে পায়ে মোজা পরে না, এমন কি স্বয়ং সম্রাটও না। চটিই হল পায়ের একমাত্র আচ্ছাদন। মাথার আভরণ পাগড়ি, তাও অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাপড়ের। অন্যান্য পোশাক—পরিচ্ছদও সেই অনুপাতে খুব সূক্ষ্ম ও হালকা। গ্রীষ্মকালে সাধারণত কোনো ঘরের দেওয়ালে হাত দেওয়া যায় না, অথবা কোনো বালিশে মাথা দিয়ে শোয়াও যায় না। বছরে ছ’মাসেরও বেশি সকলে প্রায় বাইরের খোলা জায়গায় শুয়ে ঘুমোয়। সাধারণ লোক রাস্তাতেই শুয়ে থাকে। বণিক বা অন্যান্য ধনিক ব্যক্তিরা তাঁদের বাগানে বা খোলা বারান্দায় শুয়ে নিদ্রা যান। তা না হলে ভাল করে ঘরের মেঝে জলে ধুয়ে, তারপর ঘুমোন। এই অবস্থায়, একবার কল্পনা করুন যে আমাদের এই সব শহরের কোনো রাস্তা যদি তার ঘিঞ্জি ঘরবাড়িসহ হিন্দুস্থানের কোনো শহরে স্থানান্তরিত করা যায়, তাহলে কি হতে পারে? ঘিঞ্জি ঘরবাড়ি, তার উপর প্রত্যেকটি বাড়ির উপরতলার শেষ নেই যেন। এইসব বাড়িতে এইভাবে কি সেখানে মানুষের পক্ষে বসবাস করা সম্ভবপর? রাতে কি সেখানে এইসব বাড়ির বদ্ধঘরে ঘুমিয়ে থাকা যায়, যখন বাইরে হাওয়া পর্যন্ত থাকে না এবং গরমে দম বন্ধ হয়ে আসে? মনে করুন, একজন ঘোড়ায় চড়ে বহুদূর ঘুরে ক্লান্ত হয়ে ফিরলেন। গ্রীষ্মের উত্তাপে তিনি প্রায় অর্ধমৃত, ধূলায় আচ্ছাদিত, নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলতে পারছেন না। এমন অবস্থায় যদি তাঁকে একটি সংকীর্ণ ঘুপচি সিঁড়ি ভেঙে চারতলা—পাঁচতলার কোনো কক্ষে উঠতে হয় এবং সেখানেই বিশ্রাম নিতে হয়, তাহলে কি অবস্থা হয় তাঁর? হিন্দুস্থানে এসবের কোনো বালাই নেই। এক গ্লাস ভাল ঠান্ডা পানীয় পান করে, পোশাক—পরিচ্ছদ ছেড়ে, মুখ—হাত—পা ধুয়ে আরামকেদারায় আপনাকে সেখানে শুয়ে পড়তে হবে এবং পাখাওয়ালাকে বলতে হবে, টানাপাখা টানতে। সে যাই হোক, এখন আমি আপনাকে দিল্লি শহরের আসল বর্ণনা সবিস্তারে দিচ্ছি, তাহলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যে, দিল্লিকে সুন্দর শহর বলা চলে কি না, অথবা দিল্লির কোনো নিজস্ব সৌন্দর্য আছে কি—না।

দিল্লির কাহিনি

প্রায় চল্লিশ বছর আগে বর্তমান বাদশাহ ঔরঙ্গজীবের পিতা সাজাহান দিল্লি শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন, নিজের নাম অমর করার জন্য। নতুন রাজধানীর নামকরণ তাঁর নামেই হবে, এই ছিল তাঁর বাসনা; করেছিলেনও তাই। দিল্লি শহর যখন নতুন তৈরি হল, তখন তার নাম রাখা হল ‘শাহজাহানাবাদ’, সংক্ষেপে ‘জাহানাবাদ’। অর্থাৎ সম্রাট সাজাহানের বাসস্থান। সাজাহান স্থির করলেন যে, নতুন দিল্লিতেই তিনি তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করবেন, কারণ আগ্রায় গ্রীষ্মের উত্তাপ এত বেশি যে, সেখানে তাঁর পক্ষে বাস করাই সম্ভব নয়। প্রাচীন দিল্লির ধ্বংসাবশেষের উপর নতুন দিল্লি নগরী গড়ে উঠল। হিন্দুস্থানে এখন আর কেউ দিল্লিকে ‘দিল্লি’ বলেন না, ‘জাহানাবাদ’ বলেন। ‘জাহানাবাদ’ নতুন নাম, এখনও বাইরে তেমন পরিচিত হয়নি, তাই ‘দিল্লি’ নামেই আমি এখানে তার বর্ণনা করছি।

দিল্লি নতুন শহর, যমুনা নদীর তীরে বেশ প্রশস্ত জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। লোয়ের নদীর সঙ্গে যমুনার তুলনা করা যায়। যমুনার তীরে শহরটি গড়ে উঠেছে ঠিক যেন একফালি চাঁদের মতো, দুটি কোণ দুই দিকে এসে তীরের সঙ্গে মিশেছে। এক দিকে নৌকার একটি সেতু দিয়ে অন্য তীরে যাওয়া যায়। যেদিকে যমুনা নদী প্রবাহিত, সেইদিক ছাড়া অন্য সবদিক ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীর তেমন মজবুত নয়, এবং দুর্গের চারিদিকে যেমন খাত থাকে, সেরকম কোনো খাতও নেই। প্রাচীরের পর কেবল চার—পাঁচ ফুট আন্দাজ চওড়া মাটির একটা প্ল্যাটফর্ম মতন আছে, আর প্রায় একশ পা অন্তর তোরণ আছে একটি করে। এমন কিছু বিরাট ব্যাপার নয়। আমি নিজে শহরের এই প্রাকার ঘুরে দেখেছি, তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগেনি। যদিও আমি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরেছিলাম তাহলেও ঘণ্টায় এক* লিগের বেশি জোরে যাইনি। শহরতলির কথা বলছি না, কেবল দিল্লি শহরের কথা বলছি। শহরের তুলনায় শহরতলির আয়তন আরও অনেক বড়ো। শহরের একদিকে প্রায় লাহোর পর্যন্ত সারবন্দি গৃহশ্রেণি চলে গেছে—প্রাচীন শহরের বিস্তৃত ধ্বংসাবশেষ এবং তিন—চারটি ছোটো ছোটো শহরতলি অঞ্চল। এইভাবে শহরটি আয়তনে এত বড়ো হয়ে উঠেছে যে দিল্লির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সরলরেখা টানলে প্রায় দেড় লিগ দৈর্ঘ্য হবে। বৃত্তের ব্যাস সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে পারব না, কারণ শহরতলিতে বাগান ও খোলা জায়গা আছে যথেষ্ট। তাই সব মিলিয়ে, আয়তনের দিক দিয়ে দিল্লি শহরকে বেশ রীতিমতো বড়ো শহর মনে হয়।

দুর্গের অভ্যন্তর

অন্তর্দুর্গের মধ্যে রাজপ্রাসাদ আছে, জেনানামহল আছে এবং আরও অন্যান্য সব রাজকীয় বিভাগাদি আছে। তার বিস্তৃত আলোচনা যথাসময়ে করব। দুর্গটি অর্ধবৃত্তাকার। সামনে নদী। প্রাসাদ ও নদীর মধ্যে বালুকাময় প্রশস্ত ব্যবধান। এই প্রশস্ত স্থানে, নদীতীরে হাতির লড়াই হয়, বাদশাহ দেখেন। আমির—ওমরাহ, রাজামহারাজাদের সৈন্যসামন্তের কুচকাওয়াজ হয়। রাজপ্রাসাদের গবাক্ষ দিয়ে বাদশাহ এইসব ক্রীড়া ও কুচকাওয়াজ দেখেন। অন্তর্দুর্গের প্রাচীর ও তার গোলাকার গোপুরগুলি কতকটা বাইরের নগরের প্রাচীর ও গোপুরের মতো, কিন্তু অন্তর্দুর্গের প্রাচীর ইট ও লাল পাথরের তৈরি বলে আরও বেশি সুন্দর দেখায়। নগর—প্রাচীরের চেয়ে অন্তর্দুর্গের প্রাচীর অনেক বেশি মজবুত ও দৃঢ় এবং তার মধ্যে ছোটো ছোটো কামান বসানো থাকে, নগরের দিকে মুখ করে। নদীর অন্যান্য দিক পরিখা দিয়ে খেরা। পরিখায় জল থাকে, মাছ থাকে, আর তার সামনে থাকে বিশাল বিশাল প্রস্তরখণ্ড। এসব অবশ্য বাইরে থেকে দেখতে যতটা জমকালো মনে হয়, আসলে ততটা নয়। আমার ধারণা, পরিমিত পরিমাণে যুদ্ধোপকরণ নিয়ে এই ধরনের আত্মরক্ষার দুর্গ সহজেই ধূলিসাৎ করা যায়।

পরিখাসংলগ্ন বিরাট উদ্যান, নানারকমের ফুল ও গাছপালায় সাজানো। বিশাল লাল রঙের প্রাচীরের পাশে এই সুবিস্তৃত সবুজের সমাবেশ অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। বাগানের পাশেই বাদশাহী বাগ এবং তার ঠিক উল্টো দিকে শহরের দুটি বড়ো বড়ো রাজপথের সংযোগস্থল। যেসব হিন্দু রাজা মোগল বাদশাহের বাধ্যতা স্বীকার করেছেন এবং তাঁর জায়গির বা তনখা পান, তাঁরা প্রতি সপ্তাহে যখন দিল্লিতে কুচকাওয়াজ করতে আসেন তখন এই বাগের মধ্যে তাঁবু ফেলে থাকেন। তাঁরা চারদেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে চান না—মুক্তস্থানে স্বাধীনভাবে থাকতে চান। প্রধানত এই রাজারা রাজপুত রাজা। দুর্গের মধ্যে সাধারণত ওমরাহ ও মনসবদাররা কুচকাওয়াজ করার জন্য অবস্থান করেন।

এই স্থানেই বাদশাহের ঘোড়াগুলিকে নিয়ে নিয়মিত দৌড় করানো হয়। এখান থেকে বাদশাহী অশ্বশালা খুব বেশি দূর নয়। এখানেই যেসব অশ্ব নতুন আমদানি হয় বাদশাহের আস্তাবলে, তাদের পরীক্ষা করা হয়। যদি তুরকি অশ্ব হয়, অর্থাৎ তুরকিস্থান থেকে আমদানি হয় এবং যদি দেখা যায় যে তার যথেষ্ট শক্তিসামর্থ্য ও তেজ আছে তাহলে তার উরুতে বাদশাহি মোহর অঙ্কিত করে দেওয়া হয়। তাছাড়া যে আমিরের অধীনে সেই অশ্ব থাকবে, তারও একটা ছাপ দেওয়া হয়। ছাপ দেগে দেওয়ার উদ্দেশ্য হল, একই ঘোড়া কুচকাওয়াজের সময় যাতে অন্যের ঘোড়ার সঙ্গে মিশে যেতে না পারে।

বাজারের গণৎকার

কাছেই একটি বাজার আছে যেখানে এমন কোনো জিনিস নেই যা পাওয়া যায় না। বিচিত্র সব পণ্যদ্রব্য নানাদেশ থেকে আমদানি হয় সেখানে। জিনিসের মতো নানারকমের সব লোকজনেরও সমাবেশ হয় সেইখানে। যতরকমের ভণ্ড, বুজরুক, হাতুড়ে বৈদ্য, জাদুকর ইত্যাদি রাজ্যে আছে সব এসে জমা হয় বাজারে। গণৎকার ও জ্যোতিষীদেরও বেশ ভিড় হয় এবং তাদের মধ্যে হিন্দুও আছে, মুসলমানও আছে। ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমানের এইসব বিচক্ষণ ব্রহ্মজ্ঞানীরা মাটিতে শতরঞ্জ বা আসন পেতে চুপ করে বসে থাকে, হাতে থাকে নানারকমের কাঁটাকম্পাস, সামনে খোলা থাকে অদৃষ্টশাস্ত্রের একটি বিশাল গ্রন্থ এবং তার পাশে থাকে গ্রহ—উপগ্রহাদির স্থানান্তরিত একটি চিত্রপট। যাত্রীরা তাই দেখে আকৃষ্ট হয় এবং মনে করে যে গণৎকাররা যেন ভগবানের সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। তাদের মুখ দিয়ে যা উচ্চারিত হবে তা কখনও মিথ্যা হতে পারে না, সাধারণ লোকের এই বিশ্বাস। অত্যন্ত গরিব যারা তারা হয়ত সামান্য একটি পয়সা দিয়েই তাদের ভবিষ্যৎ জানবার সুযোগ পায়। সুযোগটা সামান্য নয়। গনৎকার প্রত্যেক মক্কেলের হাত ও মুখ ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে, তারপর গণনার ভান করে নানারকমের দুর্বোধ্য ভাষায় কি সব আবোল—তাবোল বিড়বিড় করে বলে বইয়ের পাতা উল্টোয়। দেখাতে চায় যেন সে কত বড় পণ্ডিত এবং গণৎকারিটা কত শ্রমসাপেক্ষ ব্যাপার। এইসব ভড়ং দেখিয়ে সে মক্কেলকে একেবারে বশ করে ফেলে এবং তারপর সেই শুভ মুহূর্তটির কথা তার কানে কানে বলে দেয়। অমুক মাসে অমুক দিনে ওই সময়ে যদি তার মক্কেল ওই ব্যবসা আরম্ভ করে তাহলে তার সাফল্য ও উন্নতি সুনিশ্চিত, কেউ তার লাভের পথ রোধ করতে পারবে না। শুধু পুরুষ মক্কেলরাই যে হাত দেখাতে আসে তা নয়। আমি দেখেছি, স্ত্রীলোকেরাও হাত দেখাতে ও ভাগ্য গণাতে আসে। আপাদমস্তক সাদা ওড়নায় ঢেকে স্ত্রীলোকেরা বাজারে এসে গণৎকারের সামনে হাত বার করে বসে এবং নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে এমন কোনো গোপন কথা নেই যা তারা ঈশ্বরের মূর্তিমান প্রতিনিধি এই গণৎকারদের কাছে বলে না। অপরাধীরা যেমন করে তাদের অন্যায় স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়, ঠিক তেমনি করে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের সব গোপন কথা গণৎকারদের কাছে স্বীকার করে এবং মুক্তির পন্থা জানতে চায়। এইসব অশিক্ষিত, কুসংস্কারগ্রস্ত লোকদের দৃঢ়বিশ্বাস যে গ্রহ—উপগ্রহের একটা বিরাট প্রভাব আছে মানুষের জীবনে এবং সেটা এই মাটির পৃথিবীতে গণৎকাররাই নিয়ন্ত্রণ করে।

পর্তুগিজ গণৎকার

এই গণৎকারদের মধ্যে একজনের কথা আমি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করছি। একজন বিধর্মী পলাতক পর্তুগিজ গণৎকারের কথা। এই ব্যক্তিও ঠিক অন্যান্য গণৎকারদের মতন একটি আসন পেতে চুপ করে বসে থাকত বাজারের মধ্যে এবং তারও যথেষ্ট মক্কেল ছিল, যদিও লেখাপড়া কিছুই সে জানত না। বহুদিনের পুরনো একটি নাবিকের কম্পাস ছিল তার একমাত্র সম্বল, এবং তাই দিয়েই সে অন্যদের মতো মানুষের নাড়ীনক্ষত্র ও ভাগ্য গণনা করত। জ্যোতিষশাস্ত্রের কোনো বই তার থাকার কথা নয়, জানেও না সে কিছু। পর্তুগিজ ভাষায় পুরনো দু’একখানি প্রার্থনাপুস্তক খুলে সে বসে থাকত এবং তার ভিতরের ছবিগুলি মক্কেলদের দেখিয়ে বলত—’এগুলো হল গ্রহ—নক্ষত্রের পর্তুগিজ চিত্র।’ লজ্জা সরমের কোনো বালাই ছিল না তার। একবার এক রেভারেন্ড জেসুইট ফাদার তাকে বাজারের মধ্যে হাতেনাতে ধরে ফেলে জিজ্ঞাসা করেন : ‘এরকম বিধর্মীর মতো আচরণ করার কারণ কি?’ উত্তরে পর্তুগিজ গণৎকারটি বলে, ‘যস্মিন দেশে যদাচারঃ—যে দেশের যা আচার, তাই পালন করা কর্তব্য।’ ফাদার অবাক হয়ে চলে যান।

আমি শুধু এখানে প্রকাশ্য বাজারের গণৎকারদের কথা বললাম। যারা রাজা—বাদশাহ, আমির—ওমরাহদের দরবারে আনাগোনা করে, তারা বাজারের গণৎকারের মতো স্বল্পবিত্ত নয়। তারা রীতিমতো ধনী ব্যক্তি এবং প্রতিপত্তি তাদের যথেষ্ট। যেমন অর্থ তাদের, তেমনি তাদের খাতির ও খ্যাতি। শুধু হিন্দুস্থানে নয়, সমগ্র এশিয়া মহাদেশের প্রায় সর্বত্র আমি এই কুসংস্কারে মোহমুগ্ধ দেখেছি সাধারণ লোককে, সর্বস্তরের লোককে। রাজা—মহারাজারা, নবাব—বাদশাহরা এইসব জ্যোতিষী, গ্রহাচার্য ও গণৎকারদের রীতিমতো উচ্চহারে বেতন দেন এবং সর্বব্যাপারে, তা সে যত সামান্যই হোক, তাদের উপদেশ ও পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। গ্রহাচার্য ও গণৎকারদের আদেশ ছাড়া তাঁরা একপাও পথ চলেন না জীবনে। আচার্যরা পাঁজিপুথি দেখে, গ্রহ—উপগ্রহ গুণে, শুভযাত্রার বা কার্যারম্ভের দিনক্ষণটি বলে দেন। হিন্দুরা পাঁজিপুথি খুলে বলেন, মুসলমানরা বলেন কোরান খুলে।

বাইরের শহর

বাদশাহি বাগের সামনে শহরের যে দুটি রাজপথ এসে মিশেছে বলে আগে উল্লেখ করেছি, তাদের প্রস্থ পঁচিশ—ত্রিশ পায়ের বেশি নয়। আঁকাবাঁকা পথ নয়, সরলরেখার মতো সোজা পথ, যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর দেখা যায়। যে পথটি লাহোর ফটক পর্যন্ত গেছে তার দৈর্ঘ্য অনেক বেশি। ঘরবাড়ির দিক থেকে দুটি রাজপথের দৃশ্য প্রায় এক। আমাদের দেশের ‘প্লেস রয়ালে’র মতো, রাস্তার দুই দিকেই তোরণশ্রেণি। পার্থক্য শুধু এই যে হিন্দুস্থানের তোরণগুলি কেবল ইটের তৈরি এবং উপরে কেবল একটি চাতাল ছাড়া আর কোনো গৃহ নেই। আমাদের ‘প্লেস রয়ালে’র সঙ্গে তার আরও একটা উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল এই যে, একটি তোরণ থেকে অপর তোরণের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন যোগ নেই। মধ্যবর্তী স্থানে খোলা দোকানঘর। দিনের বেলা এইসব দোকানঘরে নানাশ্রেণির কারিগররা কাজ করে, মহাজনরা বসে বসে বাণিজ্যিক লেনদেন করে এবং ব্যবসায়ীরা তাদের জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখে। তোরণের ভিতর দিকে একটি ছোটো দরজার মধ্য দিয়ে গুদামঘরে যাওয়া যায়। রাত্রে মালপত্র সব ওই গুদামঘরেই বন্ধ থাকে।

তোরণের পিছন দিকে গুদামঘরের উপর বণিকদের বসতবাড়ি। রাস্তা থেকে বেশ সুন্দর দেখায় এবং মনে হয় বেশ বড়ো বড়ো কামরাওয়ালা বাড়ি। ঘরে যথেষ্ট আলোবাতাস আসে এবং রাস্তার ধুলো থেকে ঘরগুলি অনেক দূরে। দোকানঘরের উপরের ছাদে চাতালে তারা রাত্রে ঘুমিয়ে থাকে। সারা রাস্তা জুড়ে ঘরগুলি তৈরি নয়। মধ্যে মধ্যে তোরণের উপরেও বেশ ভাল ভাল ঘরবাড়ি আছে দেখা যায়। সাধারণত সেগুলি খুব নিচু, রাস্তা থেকে বড় একটা দেখা যায় না, বা বোঝা যায় না। অবস্থাপন্ন ধনিক ব্যবসায়ী যাঁরা তাঁরা অন্য মহল্লায় বাস করেন এবং দিনের বেলা কাজের সময় এখানে আসেন।

আরও পাঁচটি রাস্তা আছে শহরের মধ্যে, কিন্তু যে দুটি রাস্তার কথা বলেছি আগে, তাদের মতো লম্বা বা চওড়া নয়। অন্যান্য দিক থেকে রাস্তাগুলি দেখতে প্রায় একরকমই বলা চলে। এছাড়া আরও অনেক ছোটোখাটো রাস্তা ও অলিগলি আছে, তোরণও আছে রাস্তায় অনেক। কিন্তু রাস্তাগুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজাবাদশাহের তৈরি বলে তাদের পরিকল্পনার মধ্যে কোনো সামঞ্জস্যবোধের পরিচয় নেই। এইসব রাস্তার উপর আমির—ওমরাহ, মনসবদার, কাজি, বিচারক, বণিক প্রভৃতির বাড়িঘর বিক্ষিপ্তভাবে তৈরি। দেখতে মোটামুটি ভালোই। ইট—পাথরের তৈরি বাড়ির সংখ্যা খুব অল্প, অধিকাংশই মাটি ও খড়ের তৈরি বাড়ি। মাটি ও খড়ের তৈরি হলেও, বেশ খোলামেলা এবং দেখতে বেশ সুন্দর। বাড়ির সামনে খোলা জায়গা ও বাগান এবং ভিতরেও ভাল আসবাবপত্র আছে। লম্বা লম্বা শক্ত ও সুন্দর বেতের উপর বেশ পুরু খড়ের ছাউনি। দেওয়াল মাটির, তার উপর চুনের প্রলেপ দেওয়া। দেখতে সত্যিই সুন্দর।

এইসব সুন্দর বাড়ির মধ্যে প্রচুর ছোটো ছোটো খড়ের চালাঘর। এইসব চালাঘর সাধারণ সৈনিক, সিপাই ও অন্যান্য নিম্নশ্রেণির সাধারণ ভৃত্যদের বসবাসের জন্য তৈরি। দিল্লি শহরের মধ্যে এইরকম অসংখ্য খড়ের চালাঘর থাকার জন্য এত ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আগুন যখন লাগে এবং বছরে দু—একবার লাগেই, তখন চারিদিকে শহরময় অতি সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। সারা দিল্লি শহর জুড়ে মনে হয় যেন আগুন জ্বলছে। এই গত বছরেই এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল দিল্লিতে, প্রায় ষাট হাজার খড়ের ঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। গ্রীষ্মকালে যখন মধ্যে মধ্যে ঝড় বইতে থাকে তখনই আগুন লাগে বেশি, এবং ঝড়ের জন্যই আগুন অতিদ্রুত ভয়াবহ ব্যাপক রূপ ধারণ করে। গত বছর এইভাবে তিন বার আগুন লাগে দিল্লি শহরে (অর্থাৎ ১৬৬২ সালে)। ঝড়ের জন্য এত দ্রুত আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে যে বহু ঘোড়া ও উটও আগুনে পুড়ে মারা যায়। প্রাসাদের ও হারেমের অনেক স্ত্রীলোকও আগুনের শিখায় দগ্ধ হয়ে অসহায় অবস্থায় মারা যায়। এইসব স্ত্রীলোক এত অসহায় ও লাজুক যে ঘরে আগুন লাগলেও বাইরে বেরিয়ে মুখ দেখাতে তারা লজ্জা পায়। সেইজন্য জেনানামহলের স্ত্রীলোকেরা অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগুনে পুড়ে মরে যায়।

মধ্যযুগের শহর

দিল্লির এইসব মাটির চালাঘরের আধিক্যের জন্য আমার সব সময় মনে হয়, দিল্লি আধুনিক অর্থে শহর ও নগর নয়, কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি মাত্র। অথবা মনে হয়, দিল্লি একটি বিরাট সামরিক শিবির, তা ছাড়া কিছু নয়। সামরিক শিবিরে যেসব সুযোগ—সুবিধা আছে, দিল্লিতেও তাই আছে। তার বেশি কিছু নেই। আমির—ওমরাহদের ঘরবাড়ি যদিও নদীর তীরে ও শহরতলিতেই বেশি, তাহলেও তার মধ্যে কোনো পরিকল্পনার চিহ্ন নেই। চারিদিকে সব ছড়ানো, অবিন্যস্ত ঘরবাড়ি। গ্রীষ্মপ্রধান দেশের সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি হল উন্মুক্ত বাড়ি, চারিদিক খোলা বাড়ি। আলোবাতাস প্রচুর পরিমাণে যে বাড়িতে পাওয়ার সুবিধা আছে, সেই বাড়িই এখানে সুন্দর। সুতরাং ভাল বাড়ির সামনে খোলা জায়গা, বাগান, গাছপালা, পুকুর, বড় হলঘর, ঠান্ডা নিচের ঘর ইত্যাদি থাকবেই। মাটির নিচে যে ঠান্ডা ঘর করা হয় সেখানে টানাপাখা টাঙানো থাকে এবং দিনের বেলায় প্রচণ্ড উত্তাপের সময় সেখানে গৃহস্বামী আশ্রয় নেন। অনেকে দরজা—জানালায় খসখসের পর্দা ঝুলিয়ে রাখেন। অবস্থাপন্ন গৃহস্থদের বাড়ি খসখস তো থাকেই, তার কাছাকাছি জলের চৌবাচ্চাও থাকে, ভৃত্যেরা সেখান থেকে জল নিয়ে খসখসের পর্দায় ছিটিয়ে দেয়। খসখস সব সময় ভিজে থাকলে বাইরের গরম হাওয়া ভিতরে ঢুকতে পারে না এবং ঘর ঠান্ডা থাকে। এখানকার লোক মনে করে যে বেশ সুন্দর আরামপ্রদ বসতবাড়ি যদি তৈরি করতে হয় তাহলে একটি সুন্দর ফুলবাগান তো বাড়ির সঙ্গে চাই—ই, উপরন্তু বাড়ির চার কোণে চারটি মানুষ—সমান উঁচু বসবার জায়গা থাকা চাই, যেখানে বসে সমস্ত শরীরে মুক্ত আলো—বাতাস লাগানো যেতে পারে। বাস্তবিকই প্রত্যেক ভাল বাড়িতে এইরকম উঁচু চাতাল আছে এবং সেখানে গ্রীষ্মকালে বাড়ির লোকজন রাতে শুয়ে থাকে। বাইরের চাতাল থেকে ভিতরে শোয়ার—ঘরে যাবার পথ আছে এবং সহজেই যাওয়া যায়। হঠাৎ বৃষ্টি হলে বা বর্ষার দিনে, খাটিয়া স্বছন্দে শয়নকক্ষে তুলে নিয়ে যাওয়া যায়। কেবল বর্ষার সময় নয়, হিমের সময়ও এইভাবে বাইরে থেকে উঠে গিয়ে ভিতরে শোবার দরকার হয়।

এইবার ভিতরের ঘরের বর্ণনা দিচ্ছি। ভালো ভালো বাড়ির ভিতরের ঘরের মেঝের উপর প্রায় চার ইঞ্চি পুরু গদি পাতা, তার উপরে সাদা ধবধবে চাদর বিছানো থাকে, গ্রীষ্মকালে এবং শীতকালে সিল্কের কার্পেট। ঘরের বিশেষ কোণে আরও ছোটো ছোটো দু—একটি গদি পাতা থাকে, এবং তার উপর সুন্দর ফুললতাপাতার কারুকাজকরা চাদর বিছানো থাকে। এগুলি গৃহস্বামীর নিজের বসবার জন্য, অথবা তাঁর বিশেষ সম্মানিত অতিথিঅভ্যাগতের জন্য। এইসব ফরাসের উপর ভালো ভালো তাকিয়া ফেলা থাকে, দিব্য হেলান দিয়ে বসে গল্পগুজব করার জন্য। নানারকমের কারুকাজকরা ভেলভেটের তাকিয়া, মখমল ও সার্টিনের তাকিয়াই বেশি। মেজে থেকে পাঁচ—ছয় ফুট উঁচুতে দেওয়ালের গায়ে কুলুঙ্গি থাকে অনেক, নানা আকারের ও নক্সার কুলুঙ্গি। কুলুঙ্গিতে নানারকমের জিনিসপত্র থাকে—ফুলদানি, গ্লাস ইত্যাদি। উপরের সিলিং গিল্টি—করা ও রং করা, কিন্তু মানুষ বা জন্তুজানোয়ারের কোনো চিত্র অঙ্কিত নয়। মানুষ বা জানোয়ারের চিত্র সিলিং—এ আঁকা নাকি ধর্মনিষিদ্ধ। সেইজন্য শুধু গিল্টি—করা ও রং—করা সিলিংই বেশি দেখা যায়।

এই হল সংক্ষেপে দিল্লি শহরের ঘড়বাড়ির বিবরণ এবং সুন্দর বাড়ির বিস্তৃত পরিচয়। এইরকম সুন্দর বাড়িঘড় দিল্লি শহরে যথেষ্ট আছে। সুতরাং একথা স্বচ্ছন্দেই বলা যেতে পারে, ইয়োরোপের শহরের প্রসঙ্গ উত্থাপন না করেও, যে হিন্দুস্থানের রাজধানী দিল্লি কুৎসিত নয়, যথেষ্ট সুন্দর এবং প্রচুর মনোরম ঘরবাড়ি দিল্লিতে আছে। ইয়োরোপের শহরের সঙ্গে তার কোনো সাদৃশ্য নেই এবং তার সঙ্গে তুলনা করাও উচিত নয়।

দোকানপত্তরের কথা

সুন্দর ঝকঝকে দোকানপত্তরের জন্যও ইয়োরোপীয় নগরের সৌন্দর্য বাড়ে। দিল্লিতে সেরকম কোনো দোকানপাতি নেই, যদিও দিল্লি শহর মোগল সম্রাটের শ্রেষ্ঠ রাজধানী এবং নানারকমের মূল্যবান জিনিসপত্তরেরও আমদানি হয় সেখানে, তাহলেও দিল্লি শহরের মধ্যে আমাদের এখানকার শহরের মতন পথঘাট নেই, এমন কি সারা এশিয়া মহাদেশেই নেই বলা চলে। মূল্যবান পণ্যদ্রব্য সাধারণত সেখানে গুদামজাত করে রাখা হয় এবং দোকানপাতি কখনও সাজানো হয় না। দোকান—সাজানো ব্যাপারেই যেন দিল্লির ব্যবসায়ীরা অভ্যস্ত নয়। কদাচিৎ এক—আধটি দোকান এরকম দেখা যায়, যেখানে ভালো ভালো দামি রেশমি বস্ত্র, সোনারুপোর জরির কাজ করা নানারকমের ঝালর, শিরস্ত্রাণ ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু এরকম একটি দোকানের বদলে পঁচিশটি দোকান দেখা যায় যেখানে কিছুই সাজানো থাকে না দেখবার মতো। মাটির পাত্রভরা তেল, ঘি, মাখন, বস্তা বস্তা চাল গম ছোলা ডাল ইত্যাদি নানারকমের খাদ্য মজুত করা থাকে স্তূপাকারে। এসব অধিকাংশই হল হিন্দু ভদ্রলোকশ্রেণির খাদ্য, যাঁরা মাংস খান না বেশি। দরিদ্র নিম্নশ্রেণির মুসলমানরাও অবশ্য তাই খায় এবং সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে অধিকাংশেরই এই খাদ্য খেতে হয়।

এছাড়া একটি ফলের বাজার আছে, যা বাস্তবিকই দেখবার মতো। ফলের বাজারে দোকানের সংখ্যাও যথেষ্ট এবং গ্রীষ্মকালে এইসব দোকান নানারকমের ফলে ভর্তি হয়ে যায়। নানাদেশ থেকে ফলের আমদানি হয় দিল্লির বাজারে। পারস্য থেকে, বলখ বোখারা, সমরকন্দ থেকে ফলের আমদানি হয় ঝুড়ি—ঝুড়ি। কতরকমের ফল তার ঠিক নেই—পেস্তা, বাদাম, আখরোট, খুবানি ইত্যাদি। এসব গ্রীষ্মকালে আমদানি হয়। শীতকালে আসে চমৎকার আঙুরফল, সাদা কালো রঙের। ওইসব একই দেশ থেকে আসে, সযত্নে তুলোয় ঢাকা। তিন—চার রকমের আপেল, ডালিম—বেদানাও আসে প্রচুর। আর আসে তরমুজ, সারা শীতকাল থাকে, নষ্ট হয় না। অত্যন্ত দামি ফল এই তরমুজ, এক—একটির দাম প্রায় দেড় ক্রাউন করে। এর চেয়ে নাকি অভিজাত ফল আর কিছু নেই। আমির—ওমরাহদের তরমুজ—খরমুজ না হলে চলে না। এই ফলের জন্য তাঁরা প্রচুর খরচ করেন। ফল—মূল এমনিতেও অবশ্য তাঁরা যথেষ্ট খান। আমার কর্তা যিনি ছিলেন তিনিই প্রায় দৈনিক বিশ ক্রাউন করে নিজের ফলের জন্য খরচ করতেন।

গ্রীষ্মকালে তরমুজের দাম সস্তা হয়, কিন্তু তখন খুব ভাল জাতের তরমুজ সংগ্রহ করাও খুব কষ্টকর। পারস্য থেকে বীজ আনিয়ে অত্যন্ত যত্ন করে মাটি তৈরি করে তাতে সেই বীজ বুনে দিতে হয়। সাধারণত অভিজাত—শ্রেণির লোক ছাড়া অন্যেরা তরমুজের চাষ করতে পারে না। ভাল তরমুজ পাওয়া সেইজন্য খুব শক্ত; কারণ যে—কোনো মাটিতে তরমুজ হয় না এবং মাটি খুব ভাল না হলে এক বছরেই তরমুজের বীজ নষ্ট হয়ে যায়।

আম্রফল বা আম গ্রীষ্মকালে মাস দুই খুব সস্তা হয় এবং প্রচুর পরিমাণে পাওয়াও যায়। কিন্তু দিল্লি অঞ্চলে বিশেষ ভালো আম তেমন পাওয়া যায় না। ভালো—ভালো উৎকৃষ্ট আম আসে বাংলদেশ থেকে, আর গোলকুণ্ডা ও গোয়া থেকে। অদ্ভুত সুস্বাদু ফল এই আম। আমের চেয়ে বোধহয় কোনো মিষ্টান্নই সুস্বাদু নয়। তরমুজ সারা বছর ধরে যথেষ্ট পাওয়া যায়, কিন্তু দিল্লি অঞ্চলের তরমুজের রঙ বা মিষ্টতা নেই। ভালো তরমুজ সাধারণত ধনীলোকদের গৃহেই দেখা যায়, কারণ তাঁরা বাইরে থেকে বীজ আনিয়ে রীতিমতো খরচ করে ও যত্ন করে তার চাষ করেন।

ময়রার দোকান দিল্লি শহরে অনেক আছে, কিন্তু মিষ্টান্নের তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, রুচি বা আস্বাদ কোনো দিক থেকেই নেই। মিষ্টান্ন খাবার তো বটেই, তাছাড়া মাছি ও ধুলোতে ভর্তি—আহারের যোগ্য নয়। রুটিওয়ালাও শহরে অনেক আছে, কিন্তু তাদের চুল্লি আর আমাদের এদেশের রুটিওয়ালাদের চুল্লি এক নয়। চুল্লি ঠিকমতো বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি নয়। সেইজন্য রুটি ভালোভাবে তৈরি করা সম্ভব হয় না এবং সেঁকাও হয় না। প্রাসাদদুর্গের মধ্যে যে রুটি তৈরি হয়, সেগুলো অনেকটা ভালো। আমির—ওমরাহরা সাধারণত নিজেরা ঘরেই রুটি তৈরি করে নেন, বাইরের রুটিওয়ালাদের রুটি খান না। রুটি তৈরি করবার সময় টাটকা মাখন, দুধ বা ডিম দিতে তারা কোনো কার্পণ্য করে না, কিন্তু এত করা সত্ত্বেও রুটির আস্বাদ কিরকম যেন পোড়া—পোড়া মনে হয়, খেতে তেমন ভাল হয় না। ঠিক রুটির যে স্বাদ তা যেন হয় না, কতকটা কেকের মতো হয়। আমাদের এখানকার রুটির সঙ্গে তার কোনো তুলনাই করা চলে না।

বাজারে অনেক দোকান আছে, যেখানে নানারকমের রান্না মাংস বিক্রি হয়। কিন্তু সেইসব বাজারের রান্না মাংস বিশ্বাস করে খাওয়া যায় না, কারণ, কিসের মাংস যে রান্না করা থাকে, তা অনেক সময় বলা মুশকিল। ঘোড়ার মাংস, উটের মাংস, এমনকি ব্যাধিগ্রস্ত মৃত ষাঁড়ের মাংসও রান্না করে বাজারের দোকানে বিক্রি করা হয়। সুতরাং বাজারের খাদ্যের উপর নির্ভর করাই যায় না। বাড়িতে রান্না করা ছাড়া তৃপ্তি করে কোনো খাদ্য খাওয়ার উপায় নেই। শহরের প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলে মাংস বিক্রি হয়, কিন্তু পাঁঠার মাংসের বদলে ভেড়ার মাংস পাঁঠা বলে বেশি চালানো হয়ে থাকে। সেইজন্য মাংস, কেনার সময় খুব হুঁশিয়ার হয়ে মাংস কিনতে হয়, কারণ, গরু ও ভেড়ার মাংসের উত্তাপ বেশি এবং সহজপাচ্য নয়। সাধারণত কচি পাঁঠার মাংসই ভাল, কিন্তু তার জন্য জ্যান্ত পাঁঠা কেনা দরকার। জ্যান্ত একটা গোটা পাঁঠা কেনা মুশকিল, কারণ পাঁঠার মাংস বেশিক্ষণ রেখে খাওয়া যায় না, তেমন সুগন্ধও নেই। ছাগমাংস যা বাজারে বেশি বিক্রি হয় তা ছাগীর মাংস, অত্যন্ত শক্ত ও ছিবড়ে।

কিন্তু আমার দিক থেকে এইভাবে অভিযোগ করা বোধহয় অন্যায় হবে; কারণ হিন্দুস্থানের লোকজনের সঙ্গে এমনভাবে আমি মিশেছি এবং তাদের আচার—ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, আমি যে রুটি ও মাংস খেতে পেয়েছি, তার মধ্যে অভিযোগ করার মতো কোনো ত্রুটি দেখতে পাইনি। সাধারণত ভাল খাদ্যই আমি খেতে পেতাম। আমার ভৃত্যকে পাঠিয়ে দুর্গের ভিতর থেকে আমি খাবার কিনে আনতাম। তারাও ভালো খাদ্য দিত, কারণ খাদ্য তৈরির খরচ তাদের বিশেষ লাগত না, অথচ আমি যথেষ্ট দাম দিয়ে কিনতাম। রাজদুর্গের ভিতর থেকে এইভাবে খাবার কিনে খাই শুনে আমার মনিব হাসতেন। বুদ্ধি খাটিয়ে এই উপায় উদ্ভাবন না করলে, সামান্য দেড়শ ক্রাউন আমি যে মাসিক বেতন পেতাম, তাতে আমার উপোস থাকতে হত। অথচ ফ্রান্সে আমি যদি আট আনা খরচ করি খাদ্যের জন্য, তাহলে রাজার খাদ্য যে মাংস তাও বোধহয় আমি নিয়মিত খেতে পারি।

ভাল জাতের খাসি মোরগ তেমন পাওয়া যায় না, একরকম দুর্লভই বলা চলে। ওদেশের মানুষের জীবজন্তুর প্রতি দয়াটা যেন একটু বেশি মনে হয়। মোরগ বেগমখানার জন্যই প্রধানত বরাদ্দ থাকে। বাজারে সাধারণ মুরগি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, বেশ ভাল মুরগি এবং সস্তাও। নানাজাতের মুরগি পাওয়া যায়, তার মধ্যে একরকমের আছে খুব ছোটো ছোটো, কচি ও নরম। আমি তার নাম দিয়েছি ‘ইথিয়োপিয়ান’ মুরগি বা হাবগী মুরগি, কারণ তার গায়ের চামড়াটা রীতিমতো কালো। পায়রাও বাজারে বিক্রি হয়, কিন্তু ছোটো পায়রা নয়, কারণ বাচ্চা পায়রার উপর ভারতীয়দের মমতা খুব বেশি। একরকমের ছোটো ছোটো পাখিও বাজারে বিক্রি হয়। জাল ফেলে ধরা পাখিগুলো এবং অনেক দূর থেকে বাজারে আনা হয়। পাখির মাংস মুরগির মতো খেতে সুস্বাদু নয়।

দিল্লি অঞ্চলের লোকেরা সেরকম ভাল মৎস্যশিকারী নয়। মাছ ধরতে ভাল জানে না। মধ্যে মধ্যে ভাল মাছ বাজারে আমদানি হয়, কিন্তু তার অধিকাংশই শিঙ্গি ও রুই মাছ। আমাদের এদেশের একজাতীয় মাছের সঙ্গে তার তুলনা হয়। ঠান্ডা পড়লে লোকে আর মাছ খেতে চায় না, কারণ শীত বা ঠান্ডাকে তারা ভয়ানক ভয় করে, ইউরোপীয়রা গরমকে যা ভয় করে তার চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং শীতকালে যদি কোনো মাছ বাজারে আসে তখনই খোজারা তা কিনে নেয়। খোজারা বিশেষ করে মাছ খুব বেশি ভালোবাসে। কেন বাসে জানি না। আমির—ওমরাহরা চাবুকের ভয় দেখিয়ে জেলেদের মাছ ধরতে পাঠায়। লম্বা—লম্বা চাবুক তাঁদের দরজার সামনে সব সময় ঝোলে।

মোটামুটি যে বিবরণটুকু দিলাম তা থেকে আপনি বুঝতে পারবেন যে, প্যারিস ছেড়ে দিল্লি শহরে একবার বেড়াতে যাওয়া উচিত কি না। বড়—বড় ধনী লোক যাঁরা, তাঁরা অবশ্য বেশ আরামে ও আনন্দেই থাকেন; কারণ তাঁদের হুকুম তামিল করার জন্য চাকরবাকরের অভাব থাকে না। টাকার জোরে তো বটেই, চাবুকের জোরেও তাঁরা লোকজনকে দিয়ে নানারকমের কাজ করিয়ে নেন।

দিল্লি শহরে কোনো মধ্যবর্তী স্তরের বা অবস্থার লোকের অস্তিত্ব নেই। দুই শ্রেণির লোক দিল্লিতে সাধারণত বেশি দেখা যায়। হয় উচ্চশ্রেণির ধনী লোক, আর না—হয় নিম্নশ্রেণির দরিদ্র লোক। মধ্যশ্রেণির বা মধ্যবর্তী স্তর বলতে কিছু নেই।

ভোজনের বিবরণ

আমি নিজে যথেষ্ট টাকা উপার্জন করি এবং খরচ করতেও কুণ্ঠিত হই না। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় এমন অবস্থা হয় যে আমার অদৃষ্টে কোনো খাদ্য জোটে না। বাজারে কিছুই পাওয়া যায় না অধিকাংশ দিন এবং যা—ও বা পাওয়া যায় তা ধনিকদের ভুক্তাবশেষ বা উচ্ছিষ্ট ছাড়া কিছু নয়। ভোজনপর্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যে মদ, তাও দিল্লির একটিমাত্র দোকানে পাওয়া যায়, আর কোথাও পাওয়া যায় না। অথচ মদ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেতে পারে, কারণ দেশি আঙুর থেকে হিন্দুস্থানে বেশ উত্তম মদ তৈরি হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মদ বাইরের দোকানে বিক্রি হয় না, কারণ হিন্দুদের শাস্ত্র ও মুসলমানদের শরিয়তে মদ্যপান নিষিদ্ধ। যৎকিঞ্চিৎ মদ্য আমি মধ্যে মধ্যে আমেদাবাদ ও গোলকুণ্ডায় পান করেছিলাম, তাও ডাচ ও ইংরেজদের গৃহে অতিথি হয়ে, কিন্তু সে—মদের আস্বাদ তেমন ভালো নয়। মোগল রাজ্যের মধ্যে মদ যা পাওয়া যায় তা সাধারণত দু—রকমের—শিরাজ ও ক্যানারি। ‘শিরাজ’ পারস্যদেশ থেকে আমদানি হয়। পারস্য থেকে বন্দর আব্বাসি হয়ে সুরাটে এসে পৌঁছয় এবং সেখান থেকে দিল্লিতে আসে ৪৬ দিনে। ‘ক্যানারি’ মদ ডাচরা নিয়ে আসে সুরাটে। কিন্তু এই দু—রকমের মদেরই দাম এত বেশি যে, তার আস্বাদ দামের জন্যই নষ্ট হয়ে যায়।১০ অর্থাৎ অত বেশি দাম দিয়ে মদ খেতে হলে তা খেতে ভাল লাগে না। প্যারিসে যে মদের পাঁইট বিক্রি হয়, সেইরকম তিন পাঁইট মদের দাম দিল্লিতে ছয়—সাত ক্রাউন। একরকমের দেশি মদ চিনি বা গুড় থেকে চোলাই করে ওদেশে তৈরি হয়। তাও প্রকাশ্য বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। লুকিয়ে—চুরিয়ে লোকে খায়, খ্রিস্টানরা প্রকাশ্যেই খায়। দেশি আরকজাতীয় মদ পোল্যান্ডের ধেনো মদের চেয়ে অত্যন্ত কড়া, খাবার সময় রীতিমতো গলা থেকে বুক পর্যন্ত পুড়ে যাচ্ছে মনে হয়। বেশি খেলে নানারকমের শারীরিক ও মানসিক ব্যাধির উপসর্গ দেখা দেয়। বিচক্ষণ ও মিতাচারী ব্যক্তি যাঁরা তাঁরা বিশুদ্ধ জল পান করেন অথবা সোডা—লেমনেড জাতীয় কিছু পানীয়। দামেও সস্তা, দেহেও সহ্য হয়, সুতরাং যত খুশি প্রাণভরে পান করতে কোনো বাধা নেই।১১ সত্য কথা বলতে কি, খুব কম লোকই ভারতবর্ষে মদ্যপান করে। মদের প্রতি সেরকম কোনো বিশেষ আসক্তি ভারতবাসীদের মধ্যে দেখা যায় না। এদিক থেকে তাদের মিতাচারী ও সংযমী বলা যায়। দেশের আবহাওয়ার গুণে লোকে হাঁপানি রোগে ভোগে খুব বেশি। কিন্তু বাত, পেটের অসুখ, স্টোন ইত্যাদি ব্যাধির বিশেষ কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। এই জাতীয় ব্যাধি নিয়ে যদি কেউ বাইরে থেকে আসে তাহলে তার সম্পূর্ণ আরোগ্য হতেও বেশি সময় লাগে না। আমার নিজের এই ব্যাধি ছিল এবং আমি কিছুদিনের মধ্যেই সেরে উঠেছিলাম। এমনকি উপদংশ রোগেরও (veneral disease) হিন্দুস্থানে বেশ প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও, তেমন মারাত্মক আকারে দেখা যায় না এবং অন্যান্য দেশের মতো তার ফলাফলও খুব ভয়াবহ নয়।১২ সাধারণ লোকের স্বাস্থ্য বেশ ভালই বলা চলে, কিন্তু তাহলেও শীতপ্রধান দেশের লোকের মতো তারা কর্মঠ ও পরিশ্রমী নয়। বোধ হয়, অত্যধিক গরমের জন্য দেহ ও মনের জড়তা তাদের বেশি, কাজেকর্মে তেমন উদযোগ ও উৎসাহ নেই। শৈথিল্য ও অবসাদই তাদের সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাধি। অবসাদের হাত থেকে যেন মুক্তি নেই হিন্দুস্থানে। নির্বিচারে সকল শ্রেণির লোককে এই জড়তা ও অবসাদ আচ্ছন্ন করে ফেলে। এমন কি, বিদেশি ইয়োরোপবাসীরাও এর হাত থেকে মুক্তি পান না। বিশেষ করে, গ্রীষ্মের পরিবেশে যাঁরা তেমন অভ্যস্ত হতে পারেননি, তাঁদের তো কথাই নেই।

কারিগরদের কথা

দিল্লিতে সুদক্ষ কারিগরদের ভাল কারখানা বেশি নেই। অন্তত সেদিক থেকে গর্ব করার মতো বিশেষ কিছু নেই দিল্লির। তার মানে, ভাল ভাল কারিগর যে ভারতবর্ষে নেই তা নয়। সুদক্ষ কারিগর ভারতের প্রায় সর্বত্রই আছে এবং যথেষ্ট আছে। উঁচুদরের কারুশিল্পের প্রচুর নিদর্শন দেখা যায়, যা কারিগররা যন্ত্রপাতি বিশেষ না থাকা সত্ত্বেও, এবং কোনো গুরুর কাছ থেকে কোনোরকম শিক্ষা না পেয়েও তৈরি করে।১৩ এক—এক সময় বিদেশি ইয়োরোপীয় শিল্পদ্রব্য তারা এমন নিখুঁতভাবে নকল করে যে আসল কি নকল তা সহজে ধরা যায় না।১৪ ভারতীয় কারিগররা বেশ চমৎকার বন্দুক বানাতে পারে। সোনার নানারকমের অলঙ্কার এত সুন্দর তারা তৈরি করে যে, তার কারুকাজ দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। ইউরোপের স্বর্ণকাররা এইদিক থেকে কারিগরিতে ভারতীয় স্বর্ণকারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারবে কি না সন্দেহ। ভারতীয় চিত্রকরদের ছবির প্রশংসা আমি অনেকবার করেছি। বিশেষ করে ছোটো ছোটো চিত্রের নৈপুণ্য ও কলাকুশলতার তুলনাই হয় না। একটি চিত্রিত ঢাল দেখেছিলাম একবার, আকবর বাদশাহের আমলের।১৫ তখনকার দিনের বিখ্যাত কোনো চিত্রকর সাত বছর ধরে ওই ঢালের চিত্রগুলি এঁকেছিলেন। চিত্রায়নের সূক্ষ্মতা ও দক্ষতা বিস্ময়কর। এরকম বিচিত্র কলাকুশলতা সচরাচর দেখা যায় না। ভারতীয় চিত্রকরদের, আমার মনে হয়, চিত্রের সামঞ্জস্যবোধ বা প্রমাণবোধ (Sense of proportion) তেমন সজাগ নয়। অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ, বিশেষ করে মুখের মধ্যে সামঞ্জস্যবোধের তেমন পরিচয় পাওয়া যায় না। এইসব ত্রুটিবিচ্যুতি সহজেই শুধরানো যেতে পারে, কোনো গুরুর কাছে শিক্ষা পেলে। শিল্পকলার পদ্ধতি ও রীতি সম্বন্ধে জ্ঞান থাকার দরকার এবং তার জন্য দরকার শিক্ষার। ভারতীয় শিল্পীদের এই শিক্ষার অভাব আছে বলে মনে হয়।১৬

সুতরাং কেবল প্রতিভার অভাবের জন্যই যে দিল্লি শহরে ভাল শিল্পকলার নিদর্শন তেমন দেখা যায় না, তা নয়। শিল্পীরা যদি প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও উৎসাহ পেতেন, তাহলে ভারতবর্ষে শিল্পকলার আশ্চর্য বিকাশ হত। কিন্তু কোনো উৎসাহই ভারতীয় শিল্পীরা পান না। সাধারণত শিল্পীরা অবজ্ঞার পাত্র এবং তাঁদের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মেহনতের জন্য তাঁরা উপযুক্ত মজুরিও পান না। ধনী লোক যাঁরা, তাঁরা সস্তায় জিনিস কিনতে চান, অর্থব্যয় করতে চান না। কোনো আমির বা মনসবদার যদি কোনো কারিগরকে দিয়ে কিছু কাজ করাতে চান, তাহলে তাকে বাজার থেকে লোক পাঠিয়ে ধরে নিয়ে আসেন। অনেক সময় জোর করে, ভয় দেখিয়ে ধরে আনেন এবং হুমকি দিয়ে তাকে নিযুক্ত করেন। কাজটি যখন শেষ হয়ে যায় তখন প্রভু তাকে যা মজুরি দেন তা তার মেহনত অনুপাতে নয়। দয়া করে যা দেন, তাই তাকে ঘাড় হেঁট করে নিতে হয়। কোনোরকম বাদ—প্রতিবাদ করার অধিকার নেই তার। কারণ তাহলে দানের সঙ্গে আমির বেত্রাঘাত দক্ষিণা দিতেও দ্বিধা করেন না। এই শোচনীয় অবস্থার মধ্যে ভারতীয় শিল্পীদের কাজ করতে হয়। সুতরাং কোথা থেকে তাঁরা কাজের প্রেরণা পাবেন? কি জন্য তাঁরা শিল্পোন্নতির চেষ্টা করবেন? যশ, খ্যাতি, সম্মান, এসবের প্রতি কোনো আকর্ষণই তাঁদের থাকে না। খেয়ালি ধনী ব্যক্তিদের খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য কোনোরকম কাজের নামে তারা দায় উদ্ধার করতে চান। তা না হলে খেয়ে—পরে বেঁচে থাকাই তাঁদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। তাই একটুকরো রুটির জন্য তাঁরা আমির—ওমরাহদের হুকুম তামিল করেন। এই হল সাধারণ শিল্পীদের অবস্থা। যে সব শিল্পীর প্রতিষ্ঠা আছে বা মর্যাদা আছে, তাঁরা সাধারণত রাজা—বাদশাহের অনুগ্রহজীবী, অথবা বড় বড় আমির—ওমরাহ তাঁদের পৃষ্ঠপোষক। তাঁরা একটু ভাল খেতে পরতে পান ও আরামে থাকেন। তাঁদেরই প্রতিষ্ঠা হয়। তা না হলে অর্থাৎ রাজা—বাদশাহের মতো পৃষ্ঠপোষক না থাকলে, শিল্পীর কোনো কদর নেই হিন্দুস্থানে।১৭

রাজপ্রাসাদের বর্ণনা

রাজদুর্গের মধ্যে বেগমমহল ও অন্যান্য রাজকীয় ভবন আছে। কিন্তু ‘লুভের’ বা ‘এসকিউরিয়ালে’র অট্টালিকাদির মতো নয়।১৮ ইয়োরোপীয় ঘরবাড়ি গঠনের সঙ্গে তার কোনো সাদৃশ্যই নেই। থাকা উচিতও নয়। কেন নয় তা আমি আগেই বলেছি। ফরাসি বা স্পেনীয় স্থাপত্যের সঙ্গে তার তুলনা করা উচিতও নয়। যদি পরিবেশোপযোগী নিজস্ব আভিজাত্য তার থাকে, তা হলেই যথেষ্ট।

দুর্গের প্রবেশদ্বারের এমন কোনো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নেই। দুটি বড়ো—বড়ো পাথরের হাতি আছে দুদিকে। একটি হাতির উপর চিতোরের রাজা জয়মলের প্রস্তর প্রতিমূর্তি, অন্যটির উপর তাঁর ভাইয়ের। এই দুজন দুঃসাহসী বীর ও তাঁদের বীর জননী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন, কারণ আকবর বাদশাহ যখন চিতোর অবরোধ করেছিলেন তখন তাঁরা অমিতবিক্রমে যে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তা অতুলনীয়।১৯ সেই প্রতিরোধ যখন চূর্ণ হয়ে গেল, যখন দেশরক্ষার আর কোনো উপায় রইল না, তখন তাঁরা তাঁদের জননীসহ যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হননি। তবু তাঁরা উদ্ধত শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। মাথা উঁচু করেই তাঁরা মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন। তাঁদের এই অপূর্ব বীরত্বে মুগ্ধ হয়েই তাঁদের শত্রুরা এই মর্মরমূর্তি তৈরি করেছিল। যখনই আমি এই দুটি হাতির পিঠে এই বীরের মর্মরমূর্তির দিকে চেয়ে দেখি, তখন আমার এমন এক অনুভূতি জাগে মনে, যা আমি ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না।

এই প্রবেশদ্বার দিয়ে নগরদুর্গের মধ্যে প্রবেশ করলে একটি সুদীর্ঘ প্রশস্ত রাস্তা দেখা যায় সামনে। রাস্তাটির (দিল্লির প্রাচীন ‘চাঁদনি চক’ নামে রাস্তাটি) মাঝখান দিয়ে একটি জলের খাল বয়ে গেছে। রাস্তার দু পাশে লম্বা উঁচু বাঁধ, প্রায় পাঁচ—ছয় ফুট উঁচু এবং চার ফুট চওড়া। বাঁধের পাশেই সারিবদ্ধ তোরণ রাস্তা বরাবর চলে গেছে। এই বাঁধের উপরেই বাজারের রাজকর্মচারীরা তাঁদের খাজনা ট্যাক্স শুল্ক ইত্যাদি আদায় করেন এবং রাস্তার ওপর দিয়ে ঘোড়া, মানুষ ইত্যাদি চলাচল করে। মনসবদাররা নিম্নপদস্থ ওমরাহরা বাঁধের ওপর ঘোড়ায় চড়ে পাহারা দেন। খালের জল বেগমমহলের অন্দরে পর্যন্ত চলে গেছে। নানা জায়গার ভিতর দিয়ে এঁকে—বেঁকে গিয়ে খালের জল দুর্গের বাইরের পরিখায় গিয়ে পড়েছে। খালটি দিল্লির প্রায় পাঁচ—ছয় লিগ দূর যমুনা নদী থেকে, বিশেষ যত্ন ও মেহনত করে, কেটে আনা হয়েছে। অনেক মাঠের ওপর দিয়ে, পাথুরে মাটির বুক চিরে এসেছে খালটি।২০

অন্য দুর্গদ্বার দিয়ে ভিতরে ঢুকলে আরও একটি লম্বাচওড়া রাস্তা দেখা যায়। তারও দুদিকে বেশ উঁচু ও প্রশস্ত বাঁধ দেওয়া আছে। কেবল বাঁধের পাশে সারবন্দি তোরণের বদলে আছে দোকান।

রাস্তাটি আসলে একটি বাজারই বলা চলে। গ্রীষ্মে ও বর্ষায় বিশেষ কোনো অসুবিধা হয় না, কারণ রাস্তাটির ওপরে ছাদ আছে। আলোবাতাসের অভাব নেই। ছাদের মধ্যে যথেষ্ট বড়ো—বড়ো ফাঁক আছে আলোবাতাসে প্রবেশের জন্য।

এই দুটি প্রধান রাস্তা ছাড়াও, নগরদূর্গের মধ্যে, ডাইনে—বামে আরও অনেক ছোটো—ছোটো রাস্তা আছে। সেই সব রাস্তা দিয়ে ওমরাহদের বাসাঞ্চলে যাওয়া যায়। পর্যায়ক্রমে চব্বিশ ঘণ্টা করে ওমরাহরা প্রত্যেকে সেখানে পাহারা দেন, সেই স্থানগুলি সত্যিই খুব মনোরম। নিজেরা খরচ করে তাঁরা সেই স্থান সাজান। প্রশস্ত উঁচু বাঁধ বা ঘরের মতন জায়গা, চারিদিকে তার ফুলবাগান, ছোটো—ছোটো জলের খাল, ঝরনা ইত্যাদি। যাঁরা পাহারা দেন অর্থাৎ পাহারাদার ওমরাহরা সম্রাটের কাছ থেকে খাদ্য পান। যথাসময়ে রাজপ্রাসাদ থেকে খাদ্য আসে এবং যথারীতি আদবকায়দা সহকারে ওমরাহরা সেই খাদ্য ভোজনের জন্য গ্রহণ করেন। খাদ্যের থালার সামনে দাঁড়িয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে ফিরে তাঁরা তিনবার সেলাম করেন এবং কুর্নিশের ভঙ্গিতে ওঠানামা করে খাদ্যের পাত্রটি হাত পেতে গ্রহণ করেন।২১

এই রকম আরও অনেক বড়ো বড়ো উঁচু বাঁধ ও তাঁবু আছে নগরের মধ্যে। সাধারণত ব্যবসাবাণিজ্যের লেনদেন ও আফিসের কাজকর্মের স্থান হিসেবে সেগুলি ব্যবহার করা হয়।

কারখানার বর্ণনা

বড়ো—বড়ো হলঘর অনেক জায়গায় দেখা যায়। তাকে ‘কারখানা’ বলে।২২ কারিগরদের ওয়ার্কশপের নাম কারখানা। কোনো হলঘরে দেখা যায় সূচিশিল্পের কাজ হচ্ছে, ওস্তাদ তদারক করছেন। কোনো হলঘরে স্বর্ণকাররা কাজ করছে, কোথাও চিত্রকররা। কোথাও বার্নিশ, পালিশ ও লাক্ষার কাজ হচ্ছে। কোথাও চর্মকার, দরজি ও সূত্রধররা কাজ করছে। কোথাও কাজ করছে রেশম—ব্রকেডের কারিগররা, কোথাও সূক্ষ্ম মসলিন ইত্যাদি কাপড় তৈরি হচ্ছে। তাই দিয়ে শিরোপা, কোমরবন্ধ, কামিজ ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে কোথাও, সোনালি ফুলের ঝালর দেওয়া ও বিচিত্র কারুকাজ করা। মেয়েদের পোশাক তৈরি হচ্ছে কোথাও, এত সূক্ষ্ম যে একরাত্রির বেশি হয়তো ব্যবহার করা চলে না। এই ধরনের একরাত্রির পোশাক, কয়েকঘণ্টার পোশাক, সূক্ষ্ম সূচের কারুকার্যের জন্য হয়তো দশ—বারো ক্রাউন পর্যন্ত দামে বিক্রি হতে পারে।

কারিগররা প্রতিদিন সকালে উঠে কারখানায় যায় এবং সারাদিন কারখানায় খেটে সন্ধ্যার সময় ঘরে ফিরে আসে। এইভাবে কারখানার নির্জন হলঘরের কোণে সকলের অগোচরে একাগ্রচিত্তে মেহনত করে তাদের জীবনের দিনগুলি কেটে যায়। জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা বলে কারও কোনো কিছু থাকে না এবং নিজেদের জীবনযাত্রার কোনোরকম উন্নতির জন্যেও কেউ সচেষ্ট হয় না। যে অবস্থা ও পরিবেশের মধ্যে তারা জন্মায়, সেই অবস্থার মধ্যেই তারা সারাজীবন একভাবে থাকে। সূচিশিল্পী যে, সে তার পুত্রকেও সূচিশিল্পের শিক্ষা দেয়; স্বর্ণকার যে, সে তার  পুত্রকে করে স্বর্ণকার এবং শহরের বৈদ্য যে, সে তার পুত্রকেও বৈদ্য করতে চায়। সমধর্মী শিল্পীগোষ্ঠীর মধ্যেই সকলে বিবাহাদি করে। এই সামাজিক বিধি হিন্দু—মুসসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কারিগররা কঠোরভাবে পালন করে। এর কোনোরকম ব্যতিক্রম আইনের চোখে পর্যন্ত নিষিদ্ধ। এই সামাজিক বিধানের ফলে অনেক সুন্দরী মেয়েদেরও আজীবন হয়তো অবিবাহিত কুমারী জীবন যাপন করতে হয়, কারণ সমধর্মী শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে অনেক সময় ভাল পাত্র পাওয়া যায় না এবং সেক্ষেত্রে ভিন্নধর্মী উচ্চ বা নিম্নস্তরের কোনো কারিগরগোষ্ঠীর সঙ্গে বিবাহও সম্ভবপর নয়।২৩

আমখাসের কথা

‘আমখাসে’র কথা বলি। আমখাসের ( যে দরবার—গৃহে সম্রাট প্রজাদের দর্শন দেন) কথা সত্যই ভোলা যায় না। এইসব রাস্তাঘাট, বাঁধ তোরণ ইত্যাদি পার হয়ে অবশেষে আমখাসে এসে পৌঁছতে হয়। সুন্দর গঠন এই আমখাসের, স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে চমৎকার। বিশাল চতুষ্কোণ কোর্ট একটি, অনেকটা আমাদের ‘প্লেস রয়ালে’র মতো, চারিদিকে তার তোরণ দিয়ে ঘেরা। তোরণের উপরে কোনো ঘরবাড়ি কিছু নেই। তোরণের মধ্যে মধ্যে প্রাচীরের ব্যবধান, কিন্তু তার ভিতর দিয়ে যাতায়াত করার জন্য দরজা আছে। কোর্টের একদিকে মাঝখানে একটি খোলা উঁচু জায়গা আছে, তার উপর ‘নাকাড়াখানা’। যেখানে থেকে বাদ্যকররা নাকাড়া বাজায় তাকে ‘নাকাড়াখানা’ বলে। নাকাড়াখানায় কাড়ানাকাড়া দুন্দুভি ইত্যাদি বাদ্য থাকে এবং বাদ্যকররা দিনরাত্রির নির্দিষ্ট ঘণ্টায়—ঘণ্টায় নানারকম সংকেতধ্বনির জন্য সেগুলি বাজায়। বিদেশি ইয়োরোপবাসীর কাছে নাকাড়াখানার বাদ্যকরদের এই বাজনা বিচিত্র বলে মনে হয়, কারণ বিশ—পঁচিশজনের একত্রে এই বাজনা শুনতে আমরা অভ্যস্ত নই। বড় বড় শানাই, কাড়ানাকাড়া ও মন্দির যখন একত্রে বাজতে থাকে তখন বাস্তবিকই অদ্ভুত শোনায়। শানাইয়ের আকার কি? একটি শানাই দেখেছি, তার নাম ‘কর্ণ’, বিশাল লম্বা এবং নিচের চাবিকাঠিগুলি প্রায় একফুট জুড়ে রয়েছে। কাঁসা ও লোহার মন্দিরাগুলি খুব বড়ো—বড়ো। আওয়াজ তার কিরকম হতে পারে তা সহজেই কল্পনা করা যায় এবং নাকাড়াখানা থেকে এই সব বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত শব্দ যে কতখানি জোরালো হতে পারে, তাও অনুমান করতে কষ্ট হয় না। আমি প্রথম দিন এই বাজনা শুনে রীতিমতো হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার কান এমনভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, এই কাড়ানাকাড়া সানাই—মন্দিরার ঐকবাদন আমার কাছে অপূর্ব শ্রুতিমধুর বলে মনে হয়। রাত্রে বিশেষ করে, যখন দূরে কোনো অট্টালিকা—শীর্ষের শয়নকক্ষে আমি শুয়ে থাকি, তখন দূর থেকে ভেসে আসা নাকাড়াখানার এই ঐকবাদন আমার কাছে সুন্দর, সুগম্ভীর ও সুশ্বৈর্যময় বলে মনে হয়। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই অবশ্য। কারণ বাদ্যকররা সকলেই প্রায় বাল্যকাল থেকে বাদ্যচর্চা ও সুরচর্চা করে, সুরের তাল তান, মীড়—মূর্ছনায় অপূর্ব দক্ষতা অর্জন করে। সেইজন্য এই সব বাদ্যযন্ত্রের বিচিত্র শব্দধ্বনি ও সুরের মিশ্রণে তারা চমৎকার শ্রুতিমধুর ঐকতান রচনা করতে পারে এবং দূর থেকে তা শুনতে এত ভাল লাগে যে বলা যায় না। নাকাড়াখানা সম্রাটের প্রাসাদ থেকে দূরে তৈরি করা হয় এবং উঁচু মঞ্চের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, যাতে সম্রাট বাজনার সুর শুনতে পান, অথচ তার তীব্রতা বা কটুতা (কাছে থাকার জন্য) তাঁর কানে না পৌঁছায়।

সম্রাট সন্দর্শনের প্রথা

সিংহদরজার উল্টো দিকে, কোর্ট পার হয়ে, সামনে বিরাট একটি হলঘর। হলঘরের মধ্যে সারবন্দি স্তম্ভ। ছাদ ও স্তম্ভ দুই—ই সুন্দরভাবে চিত্রিত, সোনার কাজ করা। অপূর্ব দেখতে। জমি থেকে বেশ উঁচুতে হলঘরটি তৈরি, প্রচুর আলোবাতাস খেলে। তিন দিক খোলা, বাইরের চত্বরটির দিকে। মধ্যে একটি প্রাচীর, তার ওপাশে বেগমমহল। প্রাচীরের মধ্যস্থলের কাছাকাছি মানুষের চেয়েও উঁচু একটি বেদি—মঞ্চ এবং সেখানে জানালার মতো একটি বড়ো গবাক্ষ আছে। সেইখানে সম্রাটের সিংহাসন। প্রতিদিন প্রায় মধ্যাহ্নকালে সম্রাট সেই সিংহাসনে এসে একবার করে বসেন, দক্ষিণে ও বামে রাজকুমাররা বসে থাকেন। খোজারা পাশে দাঁড়িয়ে ময়ূরের পাখা ও চামর দিয়ে বাতাস করে। কেউ—কেউ বিনম্র ভঙ্গিতে দাসানুদাসের মতো সব সময় তটস্থ হয়ে অপেক্ষা করে, কখন কি আদেশ হয় সেইজন্য। রাজসিংহাসনের ঠিক নিচে একটি স্থান আলাদা রুপোর রেলিং দিয়ে ঘেরা থাকে, পদস্থ আমির—ওমরাহ দেশীয় রাজা ও বিদেশি রাজদূতদের জন্য। তাঁরা সকলে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন, নিচের দিকে চোখ নামিয়ে, ঘাড় হেঁট করে, হাত দুখানি সামনের দিকে ক্রস করে। আরও একটু দূরে মনসবদাররা ও সাধারণ ওমরাহরা দাঁড়িয়ে থাকেন, ঠিক ওই একই ভঙ্গিতে, নতশিরে। বাকি জায়গায়, হলঘরে ও চত্বরে সবরকমের লোক থাকে, নানা স্তরের ও নানা শ্রেণির লোক,—পদস্থ ও সাধারণ, ধনী ও নির্ধন। সকলেরই সেখানে প্রবেশের অধিকার আছে, কারণ এই হলঘরেই মোগল সম্রাট প্রতিদিন একবার করে সকলকে দর্শন দেন, উচ্চ—নিচু ভেদাভেদ নির্বিশেষে। সেইজন্যই এই হলঘরের নাম ‘আমখাস’, অর্থাৎ সর্বসাধারণের রাজদর্শন—গৃহ।

রাজদর্শনের অনুষ্ঠানটি প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে। অশ্বশালার ভাল ভাল ঘোড়াগুলিকে সিংহাসনের সামনে দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, কারণ সম্রাট স্বচক্ষে দেখতে চান তাদের কি অবস্থায় কেমন যত্নে রাখা হয়েছে না হয়েছে। অশ্বশালায় ঘোড়ার পর পিলখানার হাতিরা মন্থরগতিতে চলে যায় সিংহাসনের সামনে দিয়ে। পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন সব হাতি, কালো কুচকুচে রঙ করা, কপাল থেকে শুঁড়ের ডগা পর্যন্ত দুটি লাল রঙের রেখা অঙ্কিত। সুন্দর সব কারুকাজ—করা নানারঙের কাপড়চোপড় দিয়ে হাতিগুলি সাজানো। দুটি বড়ো বড়ো রুপোর ঘণ্টা পিঠের দু পাশে রুপোর শিকল দিয়ে ঝুলানো থাকে এবং কানের দু পাশ তিব্বতী গরুর সাদা লেজ লম্বাকারে বাঁধা থাকে গুম্পের মতো। হাতিগুলি এক অপূর্ব দৃশ্য রচনা করে। দুটি ছোটো ছোটো হাতি তার মধ্যে সবচেয়ে জমকালো পোশাক পরিচ্ছদে সুশোভিত হয়ে অন্য বড়ো বড়ো হাতির সামনে এমনভাবে নড়েচড়ে বেড়ায় যে দেখলে মনে হয় যেন তারা বড়ো হাতির আজ্ঞাবহ ভৃত্য মাত্র, প্রভুদের হুকুমের অপেক্ষা করছে। পোশাক—পরিচ্ছদ হাতিরই সবচেয়ে জমকালো এবং মনে হয় সে সম্বন্ধে যেন তারা বেশ সচেতন। পরিপার্শ্ব সম্বন্ধে সজাগ হয়েই যেন তারা নিজেদের দেমাকে হেলেদুলে হোমরাচোমরাদের মতো চলতে থাকে। চলতে—চলতে যেমন একে—একে তারা সম্রাটের সিংহাসনের সামনে এসে দাঁড়ায়, অমনি মাহুত ডাঙ্গশের একটি ঘা মেরে, পিঠের উপর শুয়ে পড়ে কানে—কানে কি যেন তাদের বলে দেয় মনে হয়। চুপ করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, একটি জানু বাঁকিয়ে নত হয়ে, কপালের দিকে শুঁড় উঁচুতে তুলে গর্জন করে ওঠে হাতি। অর্থাৎ সম্রাটকে হাতিও সশ্রদ্ধ সেলাম জানায়।

হাতির পর অন্যান্য জন্তুদের পালা। পোষা হরিণের দল যায়, হরিণের লড়াই দেখবার জন্য সম্রাট অনেক রকমের হরিণ পোষেন। নীল গাই, গণ্ডার যায়। বাংলাদেশের বড়ো বড়ো মহিষ যায়, লম্বা লম্বা পাকানো তাদের শিঙ। এই শিঙ দিয়ে তারা বাঘ—সিংহের সঙ্গে লড়াই করে, সম্রাট দেখে আনন্দ পান। পোষা প্যানথার ও চিতাবাঘ যায়, হরিণ শিকারের জন্য যত্ন করে পোষা। উজবেকিস্থানের সব ভাল ভাল খেলোয়াড় শিকারি কুত্তা যায়, প্রত্যেকটি কুত্তার পায়ে একটি করে লালরঙের কোর্তা জড়ানো। সবার শেষে নানারকমের শিকারি পাখি ও বাজপাখি যায়, শুধু পাখি খরগোস ইত্যাদি শিকারেই যে তারা অভ্যস্ত তা নয়, হরিণ পর্যন্ত শিকারেও নাকি ওস্তাদ। বন্য হরিণের ঘাড়ের উপর বিদ্যুৎবেগে ছোঁ দিয়ে পড়ে হরিণের মাথাটি ঠুকরে ঠুকরে ঘায়েল করে দেয়। বড়ো বড়ো ডানা ঝাপটে তাদের দিশাহারা করে দিয়ে ধারালো থাবায় আঁচড়ে ধরাশায়ী করে।২৪

জন্তুজানোয়ারের এই বিচিত্র শোভাযাত্রা ছাড়াও; দু—চারজন ওমরাহের অশ্বারোহী সেনারাও সামনে দিয়ে যায়। অশ্বারোহী সৈন্যরা ভাল—ভাল পোশাক পরে থাকে, এবং সেদিন ঘোড়াগুলিকে নানারঙের রঙিন সাজ—সজ্জায় সজ্জিত করা হয়।

আর—একটি দৃশ্য দেখতে সম্রাট ভালোবাসেন, তলোয়ার দিয়ে মৃত মেষ কাটার দৃশ্য। মৃত মেষটির নাড়িভুঁড়ি ছাড়িয়ে, চার পা বেঁধে সম্রাটের সামনে নিয়ে আসা হয়। তরুণ ওমরাহ, মনসবদার ও গুরজ—বরদাররা নিজেদের কারদানি ও শক্তি দেখাবার জন্য মেষটিকে এক কোপে এফোঁড়—ওফোঁড় করবার চেষ্টা করেন।

কিন্তু এত সব বিচিত্র অনুষ্ঠান—পর্ব গৌণ ব্যাপার মাত্র। আসল কাজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সম্রাট তাঁর অশ্বারোহী সেনাদের একবার দেখেন তো নিশ্চয়; গৃহযুদ্ধের অবসানের পর থেকে তিনি প্রত্যেক সৈনিকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হতেও চান। নিজে সব স্বচক্ষে তদারক করেন এবং নিজের বুদ্ধি—বিবেচনা অনুযায়ী কারও তনখা ও পদমর্যাদা বাড়িয়ে দেন, কারও বা কমিয়ে দেন; কাউকে আবার নোকরি থেকে বরখাস্তও করেন। আমখাসে সমবেত প্রজাদের মধ্যে থেকে যেসব আরজি আবেদনপত্র পেশ করা হয়, সেগুলি সম্রাটের কাছে এনে, তাঁর সামনেই পড়া হয়, যাতে তিনি শুনতে পান। তারপর আবেদনকারীদের প্রত্যেককে একে—একে সম্রাটের সামনে ডাকা হয়, তিনি নিজে স্বচক্ষে তাদের দেখেন এবং সামনা—সামনি অনেক সময় অধিকাংশ ন্যায়—অন্যায়ের বিচার করেন। অন্যায়ের জন্য অপরাধীদের দণ্ডও দেন। সপ্তাহে একদিন নিভৃতে বসে তিনি সাধারণ প্রজাদের ভিতর থেকে দশজনের আবেদপত্র নিজে বিচার করেন। আদালতখানাতেও সপ্তাহে একদিন করে যান এবং সেখানে সাধারণত দুজন কাজির সঙ্গে বসে আবেদন—অভিযোগের বিচার করেন। সম্রাটের এই কাজগুলি দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, এশিয়ার সম্রাটদের বর্বরতা ও অবিচার সম্বন্ধে আমাদের মতো বিদেশিদের যে ধারণা আছে তা সম্পূর্ণ সত্য নয়।

মোসাহেবির নমুনা

আমখাসের অনুষ্ঠানাদির যে বিবরণ দিলাম তা নিন্দনীয় নিশ্চয় নয়। তার মধ্যে যুক্তি ও মহত্ত্বের পরিচয় যথেষ্ট আছে। কিন্তু এইসব অনুষ্ঠানের মধ্যে একটি ব্যাপার আমার কাছে অতি জঘন্য ও অসহ্য বলে মনে হয়েছে। এখানে তার উল্লেখ না করা অন্যায় হবে। সেটা হল, মোসাহেবি, স্তোকবাক্য ও প্রশস্তি। সম্রাটের মুখ দিয়ে যখনই কোনো একটি কথা বেরোয়, তা সে যে কথা বা যত নগণ্য কথাই হোক—না কেন, সঙ্গে সঙ্গে সমবেত লোকসভায় তার ধ্বনি—প্রতিধ্বনি হতে থাকে। প্রধান ওমরাহরা সঙ্গে—সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে আশমানের দিকে হাত বাড়িয়ে, দেবতার আশিস প্রার্থীর মতো কাতরকণ্ঠে ‘কেয়ামত, কেয়ামত’ ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকেন। অর্থাৎ প্রভু কি কথাই বললেন, কেউ আর কোনোদিন এমন কথা বলেননি, বলবেনও না কোনোদিন! কি আশ্চর্য কথা! কি সুবিচার! কি দূরদৃষ্টি! পারস্যভাষায় একটি লোকপ্রবাদ আছে, তার অর্থ হল : ‘শাহ যদি বলেন দিনটাকে রাত, তাহলে সঙ্গে—সঙ্গে অন্যেরা বলবেন, আহা! কি সুন্দরই না চাঁদ উঠেছে আকাশে, কি চমৎকার তারার ঝলমলানি।’ মোগল দরবারেও ঠিক তাই হয়ে থাকে।

স্তাবকতা মোসাহেবি যেন অস্থিমজ্জায় সকলের মিশে রয়েছে, সর্বস্তরের লোকের মধ্যে। যদি কোনো মোগলের আমার কাছে কোনো কাজ থাকে, তাহলে তিনি আমার মতো ব্যক্তিকেও বলবেন : ‘আপনি? আপনার মতো লোক আর দেখা যায় না। আপনি আরিস্ততল, আপনি হিপোক্রেটিস আপনিই বর্তমান যুগের আবিসিন্না—উজ—জমান।’ প্রথম প্রথম আমি তো ঘাবড়েই যেতাম এবং আমার সহানুভূতি—প্রার্থীদের আমি বোঝাবার চেষ্টা করতাম যে, আমি কিছুই নই, সামান্য একজন লোক মাত্র; আমার এমন কিছু বিদ্যা—বুদ্ধি—প্রতিভা নেই যে ওই সব মহান ব্যক্তিদের সঙ্গে আমার নাম উচ্চারণ করা যেতে পারে! কিন্তু দেখলাম শেষ পর্যন্ত যে আমার অনুনয়—বিনয়ে কোনো কাজ হয় না, বরং উল্টো ফল ফলে, এবং স্তাবকতা ক্রমে বাড়তেই থাকে। সুতরাং কানটাকে ক্রমে অভ্যস্ত করে নেওয়াই ঠিক করলাম এবং তাদের কোনো স্তোকবাক্যেই আর আমার মনে এখন কিছুই হয় না। এখানে একটি ছোট্টো কাহিনি উল্লেখ করব। বিশেষ ক্ষেত্রে উল্লেখ না করে পারছি না। একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে আমি আমার আগাসাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আগাসাহেবকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজয়ী বীরপুরুষদের সঙ্গে তুলনা করে, নানারকমের সব আজগুবি চাটুবাক্য বর্ষণ করে, পণ্ডিত মশায় শেষকালে বললেন তাঁকে : ‘আপনি যখন আগাসাহেব আপনার অশ্বারোহী সেনার আগে—আগে ঘোড়ার পিঠে জিনে পা লাগিয়ে চলতে থাকেন, তখন মনে হয় যেন আপনার পায়ের তলায় মেদিনী পর্যন্ত কেঁপে উঠছে। যে আটটি হাতির মাথার উপর মেদিনীটা অবস্থান করছে, তারা আর তখন আপনার ভার সইতে না পেরে মাথা নাড়তে থাকে এবং মেদিনী টলমল করে ওঠে।’ পণ্ডিতের এই চাটুবাক্যের বর্ষণ শেষ হবার পর শ্রোতাদের মনে কি তার প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা বুঝতেই পারছেন। আমি তো হো হো করে সজোরে হেসে উঠলাম। আগাসাহেবকে আমি ঠাট্টা করে বললাম : ‘আপনার উচিত আরও সাবধানে ঘোড়ায় চড়া কারণ আপনার ঘোড়ায় চড়ার জন্যে যদি ভূমিকম্প হয়, তাহলে তো মারাত্মক ব্যাপার!’ আগাসাহেব বুদ্ধিমান ও রসিক ব্যক্তি। আমার কথার উত্তরে তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন : ‘তা তো বটেই। সেইজন্যই তো ভয়ে পারতপক্ষে আমি ঘোড়ায় চড়ি না, পালকিতেই চড়ে বেড়াই!’

গোসলখানার বর্ণনা

আমখাসের বিশাল হলঘরের ভিতর দিয়ে আর একটি নিভৃত ঘরে যাওয়া যায়, তার নাম ‘গোসলখানা’।২৫ গোসলখানা হাতমুখ ধোওয়া ও স্নানাদি করার ঘর বলা হয়। গোসলখানায় অবশ্য সকলের প্রবেশ নিষেধ, এবং তার আয়তনও আমখাসের মতো বিশাল নয়। তা না হলেও ঘরটি বেশ বড়ো, হলঘরের মতো এবং চমৎকারভাবে রঙিন চিত্র ও নকশায় সুশোভিত, দেখতে অতি সুন্দর ও মনোরম। চার—পাঁচ ফুট উঁচু ভিতের উপর তৈরি, বড়ো প্ল্যাটফর্মের মতো। সাধারণত, এই গোসলখানার নির্জন কক্ষে সম্রাট একটি চেয়ারে বসে, আমির—ওমরাহ পরিবেষ্টিত হয়ে, সঙ্গোপনে রাজ্যের বিবরণাদি শোনেন, জরুরি আরজি—আবেদনপত্রাদির বিচার করেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সলাপরামর্শ করেন। সকালের দিকে আমখাসে যেমন ওমরাহরা উপস্থিত থাকেন, তেমনি সন্ধ্যার দিকে গোসলখানায় তাঁদের উপস্থিত থাকতে হয়। দুবেলা হাজিরা দিতে তাঁরা বাধ্য, তা না হলে তাঁদের অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। প্রতিদিন দুবেলা, আমখাসে ও গোসলখানায়, হাজিরা দেওয়া তাঁদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। একজন ব্যক্তি কেবল এই দৈনন্দিন বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত, তিনি আমার মনিব আগাসাহেব, দানেশমন্দ খাঁ। তাঁকে স্বাধীনতা দেবার কারণ হল, সম্রাট তাঁকে তাঁর রাজ্যের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগুণী বিচক্ষণ ব্যক্তি বলে মনে করেন এবং সেইজন্য তাঁকে দৈনন্দিন দরবারি রীতিনীতি মানতে বাধ্য করেন না। সেই সময়টা তাঁকে অধ্যয়নাদির জন্য মুক্তি দেওয়া হয়। সপ্তাহে একদিন মাত্র, প্রতি বুধবারে তাঁকে আমখাসে ও গোসলখানায় একবার হাজিরা দিতে হয়। এবং ওই দিনই তাঁর উপর গার্ড দেওয়ার ভার পড়ে। প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় দুবার করে রাজসভাগৃহে হাজিরা দেবার এই প্রথা খুব প্রাচীন। কোনো আমির এই প্রথার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারেন না, কারণ সম্রাট নিজেও দুবেলা এইভাবে নিয়মিত হাজিরা দেন এবং দেওয়া তাঁর অন্যতম কর্তব্য বলে মনে করেন।২৬ বিশেষ গুরুতর কোনো ব্যাপার না ঘটলে, অথবা অসুখবিসুখ না হলে, সম্রাট নিজে দুবেলা যথারীতি আমখাসে ও গোসলখানায় তাঁর দৈনন্দিন রাজকার্যের জন্য উপস্থিত হন। সম্রাট ঔরঙ্গজীব যখন সাংঘাতিকভাবে পীড়িত হয়েছিলেন, তখনও তাঁকে প্রতিদিন অন্তঃপুর থেকে শায়িত অবস্থায় হয় আমখাসে, না হয় গোসলখানায়, যে—কোনো এক সভাগৃহে একবার করে বহন করে নিয়ে আসা হত। তিনি নিজে এইভাবে অন্তত দৈনিক একবার করে বাইরের সকলের সামনে ‘দর্শন’ দেবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করতেন। কারণ রাজ্যের আভ্যন্তরিক অবস্থা তখন এমন ভয়াবহ ছিল যে একদিন তিনি দর্শন না দিলেই বাইরে তাঁর মৃত্যুর গুজব পর্যন্ত রটনা হতে পারত এবং গণবিদ্রোহ ও ব্যাপক বিশৃঙ্খলার মধ্যে তার অনিবার্য প্রতিক্রিয়াও দেখা দিত।

গোসলখানায় বসে সম্রাট যদি এইসব কাজকর্ম করেন, তাহলেও আমখাসের মতো আদবকায়দা সেখানেও বজায় রাখা হয়। তবে দিনের শেষে কাজ শুরু হয় বলে এবং গোসলখানার সংলগ্ন কোনো মুক্ত চত্বর না থাকার জন্য, ওমরাহদের পক্ষে অশ্বারোহী সেনার কোনো কুচকাওয়াজ দেখানো সেখানে সম্ভব হয় না। গোসলখানার সান্ধ্য সভায় একটি উৎসব বিশেষভাবে পালন করা হয় দেখেছি। মনসবদার যাঁরা পাহারা থাকেন তাঁর সম্রাটের সামনে দিয়ে একবার করে সমারোহে ‘সেলাম’ করে যান। তাঁদের হাতে নানারকমের ‘প্রতীক’ থাকে এবং দৃশ্যটি নানাদিক থেকে বিশেষ উপভোগ্য হয়। প্রতীকের মধ্যে অনেকগুলি রুপোর মূর্তি থকে, রুপোর দণ্ডের উপর বসানো। তার মধ্যে দুটি মূর্তি হল বড়ো বড়ো মাছের মূর্তি; দুটি হল বৃহদাকার কিম্ভূতকিমাকার জন্তুর মূর্তি, নাম ‘আশদাহ’—একরকমের ড্রাগন বিশেষ। এছাড়া দুটি সিংহের মূর্তি, দুটি হাতের পাঞ্জার মূর্তি, একজোড়া দাঁড়িপাল্লা এবং আরও অনেক কিছুর মূর্তি প্রতীকরূপে মনসবদাররা বহন করে নিয়ে যান। এইসব প্রতীকের নাকি একটা গভীর তাৎপর্য আছে। মনসবদারের সঙ্গে গুর্জবদাররাও থাকে, দীর্ঘাকৃতি সুপুরুষ সব। তাদের কাজ হল সভাকালীন শৃঙ্খলা বজায় রাখা, রাজাদেশ পালন করা এবং প্রয়োজন হলে সম্রাটের হুকুম বিদ্যুৎগতিতে তামিল করা।

হারেমের বর্ণনা

এইবার আপনাকে মোগল বাদশাহের হারেম বা জেনানা—মহলের সামান্য পরিচয় দেব। কিন্তু জেনানা—মহলের গৃহবিন্যাস বা স্থাপত্যাদি সম্বন্ধে কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই, কোনো পর্যটকেরই নেই। সম্রাটের সেই হারেমের অন্দরমহল দেখার সৌভাগ্য কারও হয়নি আজ পর্যন্ত। মধ্যে মধ্যে দিল্লি থেকে সম্রাট যখন চলে যেতেন বাইরে, তখন আমি দু—একবার অনেক চেষ্টা করে জেনানা—মহলের মধ্যে ঢুকেছি এবং কিছুটা দেখেছি। একবার সম্রাট বেশ কিছুদিনের জন্য দিল্লি থেকে অনুপস্থিত ছিলেন। সেইসময় জেনানা—মহলের কোনো মহিলার কঠিন অসুখ হয়। বাইরে আসা, যে—কোনো কারণে, তাঁদের নিষেধ। পর্দাপ্রথা সনাতন প্রথা। সুতরাং চিকিৎসক হিসেবে আমাকেই অন্দরমহলে যেতে হল। যেতে যখন বাধ্য হলাম তখন দুচোখ খুলে যাওয়া সম্ভব হল না। একটি বড় কাশ্মিরী শাল দিয়ে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে দেওয়া হল। অতঃপর একজন খোজা এসে আমাকে হাত ধরে অন্দরমহলে নিয়ে গেল। অন্ধের মতো আমি বেগমমহলে প্রবেশ করলাম। কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু আমার পথপ্রদর্শক খোজার মুখে হারেমের কথা শুনে যা বুঝলাম, তাই আপনাকে বলছি।

খোজারা বলল—জেনানা—মহলে সুন্দর সুন্দর সব কামরা আছে। বেশ বড়ো বড়ো কামরা, প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র, এক কামরার সঙ্গে অন্য কামরার কোনো যোগাযোগ নেই। কামরার বাহার ও বাইরের পরিপাটিও আছে যথেষ্ট। যেমন জেনানা, তেমনি তাঁর কামরা। যিনি উচ্চপদস্থ, যাঁর রোজগার বেশি, তাঁর কামরাটিও তেমনি বাহারে। যিনি সেরকম নন, তাঁর কামরারও তেমন বাহার নেই। চারিদিকেই বাগান আছে জেনানা মহলে, সুন্দর সাজানো বাগান ও বাগিচা আছে। প্রত্যেক কামরার দরজার কাছে একটি করে জলের ট্যাঙ্ক আছে। সুন্দর সুন্দর মনোরম রাস্তা, ছায়াঘেরা কুঞ্জবন, ঝরনা, ভূগর্ভস্থ কক্ষ, উঁচু মঞ্চ ও তোরণ ইত্যাদিও আছে। এমনভাবে সব ব্যবস্থা করা আছ যে, জেনানা—মহলের সীমানার মধ্যে গ্রীষ্মের উত্তাপ কিছু বোঝা যায় না। সূর্যকে আড়াল করে আনন্দ করার মতো আরামকুঞ্জ আছে, আবার উচ্চমঞ্চের উপর শুয়ে বসে চাঁদের আলো ও ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করবার মতো ব্যবস্থাও আছে। নদীর সামনে একটি ছোটো মিনারের পঞ্চমুখে প্রশংসা করতে শুনেছি খোজাদের। মিনারটি নাকি সোনার পাত দিয়ে মোড়া, আগ্রার দুটি মিনারের মতো। তার কক্ষগুলিও স্বর্ণমণ্ডিত এবং নানারকম রঙিন চিত্রে সুশোভিত। বড়ো বড়ো আয়নাও আছে দেওয়ালের গায়ে লাগানো (বার্নিয়ের ‘খাসমহলে’র কথা বলছেন)।

এবার রাজদুর্গ থেকে বিদায় নেবার আগে আর একবার আমখাসের কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই। মনে করিয়ে দেবার বিশেষ কারণ আছে। আমখাসে আমি কতকগুলি বাৎসরিক উৎসব—পার্বণের অনুষ্ঠান দেখেছি। বিশেষ করে গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরে যে অনুষ্ঠান হয়েছিল, সমারোহ ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে তার তুলনা হয় না। আমি অন্তত আর কখনও সেরকম অনুষ্ঠান দেখিনি।

আমখাসের উৎসব

আমখাসের হলঘরের প্রান্তে সিংহাসনের উপর সম্রাট রাজপোশাক পরে উপবেশন করেন। সাদা ধবধবে সার্টিনের মের্জাই গায়ে, রেশম ও সোনার সূক্ষ্ম কারুকাজ করা তার উপর। শিরস্ত্রাণও স্বর্ণখচিত কাপড়ের তৈরি, মাথার গোড়ায় নানা আকারের হীরে বসানো। মধ্যে একটি ওরিয়েন্টাল ‘পুষ্পরাগ’ বা পোখরাজ, সূর্যের কিরণের মতো দ্যুতি বিস্ফারিত হয়ে আসে তার ভিতর থেকে। তুলনা হয় না তার সৌন্দর্যের।২৭ গলায় একটি মুক্তার মালা, উদর পর্যন্ত লম্বা। হিন্দুস্থানের অন্যান্য ভদ্রলোকরাও এরকম মালা পরেন, প্রবালের মালা। সিংহাসনের দুটি পায়া একেবারে নিরেট সোনার, তার উপর হীরে, পান্না, চুনি তারার মতো ছড়ানো। কতরকমের মণিমুক্তারত্ন এবং তার মূল্যই বা কত, তা সঠিকভাবে আমি আপনাকে বলতে পারব না, কারণ আমি জহুরি নই এবং সবরকমের মণিরত্ন সকলের পক্ষে চেনাও মুশকিল। তবে আমার মনে হয়, সিংহাসনটির মূল্য অন্তত চার কোটি টাকার কম নয়। একশ হাজারে এক লক্ষ, এবং একশ লক্ষতে এক কোটি হয়। সুতরাং সিংহাসনের মূল্য প্রায় চারশ লক্ষ টাকার সমান হয়। সম্রাট ঔরঙ্গজীবের পিতা সাজাহান এই সিংহাসনটি তৈরি করিয়েছিলেন। প্রচুর মূল্যবান মণিরত্ন রাজকোষে মজুত হয়েছিল, দেশীয় নৃপতিদের ও পাঠান রাজাদের কাছ থেকে লুণ্ঠন করা মণিরত্ন, বাৎসরিক নজর ও উপঢৌকনরূপে পাওয়া মণিরত্ন, আমির—ওমরাহদের কাছ থেকে বিশেষ বিশেষ উৎসবে উপহার পাওয়া রত্ন। সম্রাট সাজাহান তার সদ্ব্যবহার করেছিলেন এই সিংহাসনটি তৈরি করে। সিংহাসন নির্মাণ কৌশল বা কারিগরি তার মণিরত্নের উপাদানের তুলনায় তেমন উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয় না। কেবল মণিমুক্তাখচিত ময়ূর দুটি প্রশংসার যোগ্য। পরিকল্পনা ও কারিগরি দুইই ভালো।২৮ একজন খুব ক্ষমতাশালী শিল্পী এই ময়ূর দুটি তৈরি করেছিল, ফরাসি শিল্পী, নাম।২৯ অদ্ভুত কৌশলে নকল মণিরত্ন দিয়ে ইউরোপের রাজাদের প্রতারণা করে, তিনি শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে পালিয়ে এসে হিন্দুস্থানের মোগল সম্রাটের রাজদরবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মোগল দরবারে কাজ করে ফরাসি শিল্পীর ভাগ্য ফিরে গিয়েছিল।

রাজসিংহাসনের পায়ের কাছে আমির—ওমরাহরা একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর, জমকালো পোশাক—পরিচ্ছদ পরে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্ল্যাটফর্মটি একটি রুপোর রেলিং দিয়ে ঘেরা, মাথায় সোনার ঝালর দেওয়া চাঁদোয়া। হলঘরের স্তম্ভগুলিতে সোনার কাজ করা দামী ব্রকেড ঝুলানো থাকে। ফুলতোলা সার্টিনের চাঁদোয়া আগাগোড়া টাঙানো, লাল রেশমি দড়ি দিয়ে বাঁধা এবং সেই বাঁধনের কাছ থেকে বড়ো বড়ো রেশমের ও সোনারা সব ট্যাসেল ঝুলানো। মেঝেটি সিল্কের কার্পেট দিয়ে মোড়া। এত বড়ো কার্পেট বা গালিচা দেখা যায় না। একটি প্রকাণ্ড তাঁবু বাইরে খাটানো থাকে, হলঘরের চাইতেও বড়ো। তাঁবুর সঙ্গে হলঘরের যোগও থাকে। প্রাঙ্গণের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে তাঁবু খাটানো হয়, চারিদিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা, রুপোর পাত দিয়ে মোড়া। তাঁবুর ভার বহন করে মোটা মোটা থামের মতো পোস্ট, কয়েকটা বেশ মোটা, বড়ো জাহাজের মাস্তুল পোস্টের মতো। অন্যগুলি ছোটো। তাঁবুর উপরের দিকটা লাল রঙের, ভিতরের দিকটা চমৎকার মসলিপত্তনের কাপড় দিয়ে সাজানো। কাপড়টিতে বড়ো বড়ো ফুল তোলা। নানা রঙের ফুল। এত স্বাভাবিক দেখতে ফুলগুলি এবং এত উজ্জ্বল রং যে তাঁবুটি যেন সত্যিই ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা মনে হয়।

চারিদিকে যেসব গ্যালারি ও আর্কাদ আছে, সেগুলি ভাল করে সাজাবার ভার পড়ে ওমরাহদের উপর। এক—একজন আমির একটি করে গ্যালারি সাজাবার দায়িত্ব নেন। তার জন্য প্রত্যেকেই চেষ্টা করেন যাতে তাঁর নিজের গ্যালারিটি সবচেয়ে ভাল সাজানো হয় এবং সম্রাট দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি হন ও বাহবা দেন। তার ফলে গ্যালারি সাজানো খুব চমৎকার হয়, এবং প্রত্যেক আর্কাদ ও গ্যালারি আগাগোড়া গালিচা ও ব্রকেড দিয়ে ঢাকা থাকে।

উৎসবের তৃতীয় দিনে সম্রাট এবং সম্রাটের পরে তাঁর আমির—ওমরাহরা দাঁড়িপাল্লায় নিজেদের ওজন করান। দাঁড়িপাল্লা ও বাটখারা দুই নিরেট সোনার তৈরি। আমার বেশ মনে আছে, যে—বছরের কথা আমি বলছি, সেই বছরের উৎসবের সময় সম্রাট ঔরঙ্গজীবের ওজন নিয়ে যখন দেখা গেল যে তার আগের বছরের তুলনায় দুই পাউণ্ড বেড়েছে, তখন সকলে তুমুল হর্ষধনি করে উঠল।

এইরকম উৎসব প্রত্যেক বৎসরেই অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু যে—বৎসরের কথা আমি বলছি বা যে অনুষ্ঠান আমি দেখেছি, সেরকম জাঁকজমক ও সমারোহ সাধারণত কোনো বৎসর হয় না। শোনা যায়, উৎসবের এই সমারোহের বিশেষ একটা কারণ ছিল। গৃহযুদ্ধের জন্য দেশের ব্যবসা—বাণিজ্য, বিশেষ করে রেশম, ব্রকেড ইত্যাদি বিলাসদ্রব্যের কেনাবেচা একরকম ছিলই না বলা চলে। সম্রাট ঔরঙ্গজীব এই উৎসবের মাধ্যমে কয়েক বছরের সঞ্চিত দ্রব্য বিক্রয়ের সুযোগ করে দিয়েছিলেন বণিকদের। ওমরাহদের যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছিল এই উৎসবে, তা কল্পনাতীত। কিছুটা এই অর্থের অংশ সাধারণ সেপাইয়ের ভাগ্যেও জুটেছিল, কারণ ওমরাহরা তাদের মের্জাই তৈরি করার জন্যও ব্রকেড কিনতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এই বাৎসরিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে বহুকালের একটি প্রচলিত প্রথাও পালন করা হয়ে থাকে। প্রথাটি ওমরাহদের কাছে খুব প্রীতিকর নয়। প্রথাটি হল, বাৎসরিক উৎসবের সময় সম্রাটকে পদমর্যাদা ও তনখা অনুযায়ী প্রত্যেক ওমরাহের পক্ষ থেকে ভেট বা উপঢৌকন দেওয়ার প্রথা। কেউ কেউ অবশ্য এই সুযোগে বেশ মূল্যবান উপঢৌকন দিয়ে সম্রাটকে খুশি করার সুযোগও পান। অনেক কারণে তাঁরা এই সুযোগ খোঁজেন। সরকারি কর্মচারি যিনি যা অপকর্ম, অত্যাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, যাতে সে সম্বন্ধে কোনো তদন্ত না হয়, অথবা সম্রাট তার জন্য কোনো কৈফিয়ত না তলব করেন, তার জন্যও কেউ কেউ অপ্রত্যাশিতভাবে বহু মূল্যবান উপঢৌকন নিয়ে সম্রাটের কাছে হাজির হন। কেউ কেউ আবার ভাল সেলামি দেন নিজেদের পদোন্নতি বা তন্খা বৃদ্ধির জন্য। কেউ উপঢৌকন দেন বহু মূল্যবান মণিরত্ন—হীরে জহর পান্না চুনি ইত্যাদি; কেউ দেন সোনার পাত্র, রত্নখচিত; কেউ দেন সোনার মোহর। একবার এই উৎসবের সময় সম্রাট ঔরঙ্গজীব জাফর খানের কাছে গিয়েছিলেন, তাঁর উজীর বলে নয়, আত্মীয় বলে। জাফর খাঁ তাঁকে এক লক্ষ ক্রাউন মূল্যের সোনার মোহর, সুন্দর সুন্দর মুক্তা, চুনি ইত্যাদি প্রায় চল্লিশ হাজার ক্রাউন মূল্যের রত্ন উপহার দিয়েছিলেন। অবশ্য সম্রাট সাজাহান নাকি এইসব রত্নের মূল্য আরও অনেক কম বলে ধার্য করেছিলেন, পঁচিশ ক্রাউনেরও কম। তাতে অনেক বড়ো বড়ো সাচ্চা জহুরি পর্যন্ত বোকা বনে গিয়েছিলেন। কারণ তাঁরাও তার সঠিক মূল্য যাচাই করতে পারেননি।৩০

হারেমের মেলার বর্ণনা

এই উৎসবের সময় হারেমে বা জেনানা—মহলে একটি অদ্ভুত ধরনের মেলা হয়।৩১ মেলা পরিচালনার দায়িত্ব নেন আমির ওমরাহদের পত্নীরা, সাধারণত তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে রূপবতী স্ত্রী যাঁরা তাঁরা। বড়ো বড়ো আমির—ওমরাহ ও মনসবদারদের সুন্দরী ভার্যারাই হারেমের এই বিচিত্র মেলার পরিচালিকা। যে সমস্ত দ্রব্য মেলায় সাজানো হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জরির ফুললতাপাতা তোলা রেশমি কাপড়, ভাল ভাল সূচীশিল্প, সোনার কারুকাজ—করা শিরস্ত্রাণ, দামি মসলিন ইত্যাদি সব বিলাসের সামগ্রী। মেলার বিশেষত্ব হল, সুন্দরী পরিচালিকারা (আমির ও মনসবদারদের স্ত্রী) বিচিত্র বেশবিন্যাস করে বেচাকেনার কাজ করেন। তাঁরাই বিক্রেতা সাজেন। ক্রেতা হলেন সম্রাট, তাঁর বেগমরা এবং হারেমের নামজাদা মহিলারা। যদি কোনো আমির—পত্নীর কোনো বয়স্কা সুন্দরী কন্যা থাকে, তাহলে তিনি তাকেও সঙ্গে করে সাজিয়ে—গুছিয়ে মেলায় নিয়ে যান, যাতে কন্যাটির দিকে সম্রাট ও তাঁর বেগমদের নজর পড়ে এবং তার সঙ্গে তাঁরা পরিচিত হন। মেলার প্রধান আকর্ষণ হল, কেনাবেচার চমৎকার হাস্যকর অভিনয়টি। সম্রাট নিজে ঘুরে ঘুরে সাজানো জিনিসপত্তর দেখেন এবং সুন্দরী বিক্রেতা আমির—মনসবদার—পত্নীদের সঙ্গে দরদস্তুরও করেন। দরদস্তুরের ভঙ্গিমাটি খুব মজার। অনেক সময় দু—চার পয়সা নিয়ে সম্রাট দর কষাকষি করেন সুন্দরীদের সঙ্গে এবং এমন ভাব দেখান যে তিনি তার চেয়ে এক কড়িও বেশি মূল্য দিতে নারাজ। সম্রাট বলেন—’তোমরা বেশি দাম চাইছ, যেরকম জিনিস নয় তার চেয়ে বেশি। তাহলে রইল তোমাদের জিনিস, আমি চললাম অন্য কারও কাছে, দেখি যদি ওই দামে কেউ বিক্রি করে।’ এই রকমের অনেক কেনাবেচার কথাবার্তা হয়। সুন্দরীরাও তখন সম্রাটকে নানাভঙ্গিতে জিনিস গছাবার চেষ্টা করেন এবং তাঁকে নিয়ে বেশ টানাটানি চলে। সম্রাটও সহজে ছাড়ার বান্দা নন। দুই পক্ষে যখন টানাটানি ও কষাকষির অভিনয় চলে তখন সম্রাট যদি কিছুতেই রাজি না হন, তাহলে সুন্দরী আমির—পত্নী ও মনসবদার—পত্নীরাও মুখ ঘুরিয়ে বেশ জোর গলায় দু—চার কথা শোনাতে ছাড়েন না। তাঁরাও সম্রাটকে বলেন—’না নেবেন, না নেবেন! আপনি এসব জিনিসের কদর বুঝবেন কি করে? দেখেছেন কখনও এমন জিনিস? বেশ, না নেন যদি তাহলে দেখুন অন্য কোথাও সুবিধে পান কি না’—ইত্যাদি। এইভাবে কেনাবেচার একটা রংতামাসা চলতে থাকে মেলার মধ্যে। সম্রাটের বেগমরা সস্তায় কেনার আগ্রহ আরও যেন বেশি করে দেখান এবং নানারকম অভিনয় করেন দর নিয়ে। মধ্যে মধ্যে আমির—পত্নী ও মনসবদার—পত্নীদের সঙ্গে সম্রাট ও তাঁর বেগমদের দরাদরি ও তর্কবিতর্ক রীতিমতো কলরবে পরিণত হয় এবং সমস্ত ব্যাপারটি মিলে একটি চমৎকার কৌতুকনাট্যের অভিনয় করা হয় বলে মনে হয়। অবশেষে সুন্দরীরা অবশ্য জিনিস বিক্রি করতে রাজি হন সম্রাট ও বেগমদের কাছে। তখন সম্রাট ও তাঁর বেগমরা অনবরত জিনিস কিনতে থাকেন মেলা থেকে, এবং অনর্গল টাকা দিতে থাকেন। তারই ফাঁকে ফাঁকে হয়ত সম্রাট দাম ছাড়াও দু—চারটে সোনার মোহর সুন্দরী বিক্রেতা অথবা তাদের রূপসী কন্যাদের বিতরণ করেন পুরস্কার—স্বরূপ। ‘সাধু ব্যবসায়ী’ বলে তিনি পুরস্কার দেন। গোপনেই সকলে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন এবং হাসিঠাট্টা রঙ্গ—তামাসার মধ্যে এইভাবে হারেমের মেলাটি শেষ হয়ে যায়।

কাঞ্চনবালার কাহিনি

সম্রাট সাজাহানের নারীর প্রতি অনুরাগ ছিল যথেষ্ট এবং তিনিই নাকি এইসব উৎসবে এই জাতীয় মেলার প্রবর্তন করেছিলেন। তার জন্য ওমরাহরা নাকি বিশেষ খুশি হতেন না।৩২ সাজাহান তাঁর হারেমে বাইরের নাচওয়ালীদের প্রবেশাধিকার দিয়ে নিশ্চয় শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করেছিলেন বলতে হবে। তিনি তাঁর হারেমে বাইরের যে নর্তকীদের নিয়ে আসতেন নাচগানের জন্য, তাদের ‘কাঞ্চন’ বলত। কাঞ্চনবর্ণ রূপসী যুবতী মেয়ের দল। বাইরে থেকে হারেমের মধ্যে তাদের সম্রাট নিয়ে আসতেন এবং রাতভোর আটকে রেখে দিতেন। তারা কিন্তু বাজারের বারাঙ্গনা নয়। গৃহস্থ ও ভদ্রঘরের মেয়েই বেশি। আমির—ওমরাহ ও মনসবদারদের বিবাহোৎসবে এরা নাচগান করার জন্য আমন্ত্রিত হয়। অধিকাংশ কাঞ্চনবালা বেশ সুন্দর দেখতে, পোশাক—পরিচ্ছদে সুসজ্জিত, এবং নৃত্যগীতকলার রীতিমতো পারদর্শী। যেমন নাচিয়ে, তেমনি গাইয়ে। দেহের গড়ন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমন নরম ও কোমল যে নৃত্যের প্রতিটি ভঙ্গিমা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে যেন লীলায়িত হয়ে ওঠে। তাল ও মাত্রাজ্ঞানও চমৎকার। কণ্ঠের মিষ্টতাও অতুলনীয়। অথচ এই কাঞ্চনবালারা সাধারণ ঘরের মেয়ে। সম্রাট সাজাহান তাদের যে শুধু মেলাতেই নিয়ে আসতেন তা নয়। প্রতি বুধবারে আমখাসে তাদের হাজিরা দিতে হত সম্রাটের সামনে। এটা নাকি অনেক কালের প্রাচীন প্রথা। সম্রাট সাজাহান কেবল তাদের একবার চোখে দর্শন করেই মুক্তি দিতেন না। প্রায়ই তিনি সারারাত তাদের আটকে রাখতেন এবং রাজকর্মের শেষে তাদের নৃত্যগীত উপভোগ করতেন। তাদের সঙ্গে মস্করা করে সময় কাটাতেন। ঔরঙ্গজীব তাঁর পিতার চেয়ে অনেক বেশি গোঁড়া ধর্মানুরাগী ও আত্মসংযত পুরুষ ছিলেন। তিনি কাঞ্চনবালাদের হারেমে প্রবেশ করতে দিতেন না। তবে বহুকালের প্রথানুযায়ী তাদের প্রতি বুধবারে একবার করে আমখাসে আসবার হুকুম দিয়েছিলেন। আমখাসে এসে বহুদূর থেকে তারা সম্রাটকে সেলাম করে তৎক্ষণাৎ চলে যেত।

বার্নাড বৃত্তান্ত

উৎসব—অনুষ্ঠান, মেলা, কাঞ্চনবালা ইত্যাদি প্রসঙ্গে আমার বিশেষ করে ‘বার্নার্ড’ (Bernard) নামে একজন স্বজাতীয় ও স্বদেশিয়ের কথা মনে পড়ছে। এখানে বার্নার্ড—সংক্রান্ত একটি ছোট্টো কাহিনির উল্লেখ না করে পারছি না। প্লুটার্ক (Plutarch) ঠিকই বলেছিলেন যে নগণ্য ঘটনা বা বিষয় কখনও উপেক্ষা করা বা গোপন করা উচিত নয়, কারণ বাইরে থেকে যা সামান্য মনে হয়, ঐতিহাসিকদের কাছে তার অসামান্য মূল্য থাকতে পারে। সামান্য ব্যাপারের মধ্যে অনেক সময় লোকচরিত্র ও লোকপ্রতিভার বিশেষত্বের যে পরিচয় পাওয়া যায়, অসামান্য ঘটনার মধ্যে সাধারণত তা পাওয়া যায় না। এইদিক থেকে বিচার করলে আমার বার্নার্ড কাহিনি যদিও হাস্যকর, তাহলেও গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে। বার্নার্ড সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে থাকতেন, তাঁর রাজত্বের শেষদিকে। ভাল চিকিৎসক ও সার্জেন বলে তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল তখন। তিনি মোগল বাদশাহের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং প্রায় সম্রাটের সঙ্গে এক টেবিলে খানাপিনায় যোগদান করতেন।৩৩ অনেক সময় তাঁরা দুজনেই খুব বেশি পরিমাণে সুরাপান করতেন শোনা যায়। দুজনেরই রুচি একই রকমের ছিল প্রায়। সম্রাট জাহাঙ্গীর সর্বক্ষণ তাঁর নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কথা চিন্তা করতেন এবং রাষ্ট্রীয় কর্তব্য বা দায়িত্ব যা কিছু তা সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের উপর দিয়েই নিশ্চিন্ত থাকতেন। নূরজাহান বিদুষী ও বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন এবং রাজকার্য এমন সুন্দর নিখুঁতভাবে তিনি করতেন যে কোনোদিন কারও হস্তক্ষেপ করবার প্রয়োজন হত না। তাঁর স্বামী সম্রাট জাহাঙ্গীরও তাঁর উপর রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের দায়িত্ব চাপিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন। বার্নার্ডের দৈনিক তনখা ছিল দশ ক্রাউন করে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি উপরি অর্থ তিনি রোজগার করতেন নিয়মিত হারেমের মহিলাদের ও ওমরাহদের চিকিৎসা করে। কঠিন অসুখ—বিসুখ সারিয়ে অনেক উপঢৌকনও তিনি পেতেন। হারেমের মহিলারা ও আমির ওমরাহরা পাল্লা দিয়ে ভাল ভাল উপহার দিয়ে তাঁকে খুশি করবার চেষ্টা করতেন। সুতরাং চিকিৎসক বার্নার্ড সাহেবের অর্থের অভাব ছিল না। উপহার পাবার আরও একটা কারণ হল, সকলেই জানতেন যে তিনি সম্রাটের খুব প্রিয়পাত্র ও অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাই সকলে তাঁকেও ভেট দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু বার্নার্ড সাহবের অর্থের প্রতি বিশেষ মমতা ছিল না। যা তিনি পেতেন, তার অধিকাংশই তিনি নিজে আবার বিলিয়ে দিতেন উপহার দিয়ে। তার জন্য সকলেই তাঁকে আরও ভালোবাসত। বিশেষ করে নর্তকী কাঞ্চনবালাদের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি, কারণ তাঁর অর্থের বেশিরভাগ তিনি তাদের জন্যই ব্যয় করতেন। তাঁর গৃহে কাঞ্চনবালারা নিয়মিত আসত এবং নৃত্যগীত করে তাঁকে খুশি করত। এইভাবে বার্নার্ডের দিন কেটে যায়। কিন্তু এর মধ্যে একটি কাণ্ড ঘটে গেল। বার্নার্ড একটি কাঞ্চনবালার প্রেমে পড়ে গেলেন। প্রচণ্ডভাবে প্রেমে পড়লেন। কাঞ্চনের নৃত্যভঙ্গিমায় বার্নার্ড বিমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য বার্নার্ড সেই কাঞ্চনের পাণিপ্রার্থী হলেন। কিন্তু কাঞ্চনরা সাধারণত কুমারীই থাকে, তাদের বাপ—মারা তাদের বিবাহ দিতে চান না, কারণ বিবাহ করলে তাদের রূপযৌবন বেশিদিন স্থায়ী হবে না এবং অর্থোপার্জনে বিঘ্ন ঘটবে, এই তাঁদের ধারণা। সুতরাং বার্নার্ড—প্রেয়সীর জননী যখন বুঝতে পারলেন যে বার্নার্ড সাহেব তাঁর কন্যার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন, তখন থেকে তিনি খুব সতর্ক দৃষ্টি রাখতে লাগলেন তাঁর কন্যাটির উপর, যাতে কোনোরকম অঘটন কিছু না ঘটে। বার্নার্ডের করুণ কাকুতি—মিনতি দিনের পর দিন কাঞ্চনবালা প্রত্যাখ্যান করে ঘরে ফিরে যায়। বার্নার্ডের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং ক্রমেই তিনি হতাশ হয়ে ভেঙে পড়েন। এমন সময় একদিন হঠাৎ আমখাসে সকলের সামনে সম্রাট জাহাঙ্গীর ঘোষণা করলেন যে, বার্নার্ডের সুচিকিৎসার জন্য তিনি তাঁকে পুরস্কৃত করবেন। হারেমে কোনো মহিলার দুরারোগ্য ব্যাধির সার্থক চিকিৎসা করেছিলেন বলে সম্রাট তাঁকে পুরস্কার দিতে চান। আমখাসে সকলের সামনে এই ঘোষণার পর বার্নার্ড উঠে বলেন : ‘সম্রাট! মার্জনা করবেন। আমি আপনার এই মূল্যবান উপহার গ্রহণ করতে অক্ষম। আমার বিনীত নিবেদন, যদি আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে কোনো উপহার দিতে ইচ্ছুক হন, তাহলে কাঞ্চনবালাদের দলের মধ্যে ওই যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাকে সেলাম করার জন্য, ওকে উপহার দিন আমাকে।’ সভায় সমস্ত লোকজন বার্নার্ড সাহেবের উক্তি শুনে হো—হো করে হেসে উঠল। সম্রাটের উপহার প্রত্যাখ্যান করার ধৃষ্টতা এবং খ্রিস্টান হয়ে মুসলমানকন্যাকে উপহার চাওয়ার স্পর্ধা তাদের কাছে হাস্যকরই মনে হবার কথা। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীরের কোনোদিনই ধর্মের গোঁড়ামি ছিল না কিছু। বার্নার্ডের প্রস্তাব শুনে তিনি নিজেও অট্টহাসি হাসলেন এবং হেসে হুকুম দিলেন, কাঞ্চনকন্যাকে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারসাহেবকে দান করে দিতে। সম্রাট বললেন : ‘মেয়েটিকে দল থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে এসে ডাক্তারের কাঁধে এখনই বসিয়ে দাও এবং তাকে কাঁধে বসিয়ে নিয়ে ডাক্তারকে চলে যেতে বলো।’ যেমন বলা, তেমনি করা। বলা মাত্রই সভাসুদ্ধ লোক হৈ—হৈ করে মেয়েটিকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে এসে আমখাসের মধ্যেই ডাক্তার বার্নার্ডের স্কন্ধের উপর চাপিয়ে দিল এবং বার্নার্ড সাহেবও কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বিজয়ী বীরের মতো সগর্বে কাঞ্চনবালাকে কাঁধে নিয়ে হলঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

হাতির লড়াই

উৎসবের শেষে একরকমের ক্রীড়া হয় যা আমাদের দেশ ছাড়া ইউরোপে দেখা যায় না। ক্রীড়াটি হল—হাতির লড়াই। নদীর তীরে বালুভূমির উপর সকলের সামনে এই হাতির লড়াই হয়। সম্রাট নিজে, রাজান্তঃপুরের মহিলারা, আমির ও ওমরাহরা প্রত্যেকে যে যার স্বতন্ত্র গবাক্ষ থেকে এই হাতির লড়াই দেখেন ও রীতিমতো উপভোগ করেন।

তিন—চার ফুট চওড়া এবং পাঁচ—ছয় ফুট উঁচু একটি মাটির দেওয়াল তৈরি করা হয়। দুটি বৃহদাকার জন্তু (অর্থাৎ হাতি) দেওয়ালের দুদিক থেকে মন্থরগতিতে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। প্রত্যেক হাতির পিঠে দুজন করে মাহুত থাকে। প্রথম মাহুতটি, যে কাঁধের উপর বসে লোহার ডাঙ্গুস নিয়ে হাতি চালায়, সে যদি কোনোরকমে বেকায়দায় পড়ে যায় তাহলে যাতে পিছনের দ্বিতীয় মাহুতটি তৎক্ষণাৎ এসে তার স্থানটি দখল করে কাজ চালিয়ে নিতে পারে, তার জন্য এই জোড়া—মাহুতের ব্যবস্থা। মাহুতরা হয় আদর করে মিষ্টিকথা বলে, অথবা নানারকম সাঙ্কেতিক ভাষায় গালাগালি দিয়ে, কাপুরুষ ইত্যাদি বলে হাতিদের সম্মুখসমরে প্ররোচিত করে। পাদানিতে পা চেপেও তারা হাতিকে উৎসাহিত করে। অবশেষে ওই মাটির দেওয়ালের দুদিকে দুটি হাতি এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। প্রথম আঘাতটি মারাত্মক। দেখলে অবাক হতে হয় ভেবে যে কি করে তারা পরস্পরের গজদন্ত, মাথা ও শুঁড়ের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করে বেঁচে থাকে। লড়াই একটানা চলে না, মধ্যে মধ্যে উভয়—পক্ষই বিশ্রাম নেয়, আবার প্রচণ্ডভাবে পুনরাক্রমণ হয়। ক্রমে মাটির দেওয়ালটি মাটিতে মিশিয়ে যায় এবং বেশি দুর্ধর্ষ হাতিটি অন্য হাতিটিকে তাড়া করে নিয়ে গিয়ে মাটির সঙ্গে শুঁড় বা দাঁত দিয়ে চেপে ধরে। এমন ভয়ঙ্করভাবে চেপে ধরে যে কোনোভাবে আর দুজনকে ছাড়াবার উপায় থাকে না। তখন নিরুপায় হয়ে চরকি জ্বালিয়ে, বাজি ফুটিয়ে তাদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করা হয়। কারণ এই একটি মাত্র অস্ত্র যা হাতিরা যমের মতো ভয় করে। আগুন তারা সহ্য করতে পারে না, এবং পটকা বা বোমার আওয়াজ শুনলে ভয়ানক সন্ত্রস্ত হয়। এইজন্য আগ্নেয়াস্ত্রের যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে হাতির ব্যবহার একেবারে অচল হয়ে গেছে। যুদ্ধে আর হাতির কোনো কদর নেই। সিংহলের হাতি সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ও সাহসী, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের ট্রেনিং না দিয়ে আগে কখনও যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় না। বছরের পর বছর কানের কাছে বন্দুকের আওয়াজ করে, এবং পায়ের কাছে পটকা বোমার শব্দ করে, তাদের অভ্যস্ত করা হয়, ট্রেনিং দেওয়া হয়। তারপর তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হয়, তার আগে নয়।

এই হাতির লড়াই দেখতে হলে অনেক সময় খুব নিষ্ঠুরের মতো দেখতে হয়। কারণ মাহুতরা কেউ কেউ মধ্যে মধ্যে হাতির পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে গিয়ে পদতলে দলিত হয়ে তৎক্ষণাৎ মারা যায়। হাতির লড়াইয়ে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। দুই পক্ষের হাতিই তার প্রতিদ্বন্দ্বী হাতির পিঠ থেকে মাহুতকে ফেলে দেবার চেষ্টা করে এবং তার জন্য অনেক সময় শুঁড় দিয়ে মাহুতকে জড়িয়ে ধরতে যায়। এ ভয় সবসময় থাকে। তাই হাতির লড়াইয়ের দিনে যে মাহুতদের উপর হাতিতে চড়ার পালা পড়ে তারা তাদের স্ত্রীপুত্রআত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে আসে। যেন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামী, মৃত্যুর মঞ্চারোহণ করতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। তাদের একমাত্র সান্ত্বনা হল এই যে যদি তারা কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরতে পারে এবং যদি তাদের হাতির লড়াই দেখে সম্রাট খুশি হন, তাহলে তাদের মাসিক তন্খাবৃদ্ধি হবে এবং তারা এক থলে পয়সা (পঞ্চাশ ফ্রাঙ্ক আন্দাজ) পুরস্কার—স্বরূপ পাবে। হাতির পিঠ থেকে নামা মাত্রই তাদের ওই পয়সার থলেটি পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে।৩৪ তাদের আরও একটা মস্তবড় সান্ত্বনা এই যদি তাদের মৃত্যু হয় তাহলে তাদের বিধবা পত্নীরা তাদের তনখা ভাতাস্বরূপ পাবে এবং তাদের যোগ্য পুত্র থাকলে সেই চাকরিতে বহাল হবে। কিন্তু হাতির লড়াইয়ের মর্মান্তিক মজার শেষ হয়নি এখনও। আরও কিছুটা বাকি আছে, বলা হয়নি। প্রায়ই দেখা যায়, হাতির লড়াইয়ের সময় মাহুতরাই যে মরে তা নয়, দর্শকদের মধ্যেও কেউ কেউ বেকসুর প্রাণটা হারায়। উন্মত্ত হাতি মধ্যে মধ্যে দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে ছুটে চলে এসে আতঙ্কের সঞ্চার করে। ঘোড়া, মানুষ, যে যেখানে থাকে ভয়ে প্রাণপণে ছুটতে থাকে এবং কেউ হাতির পায়ের তলায় পড়ে, কেউ বা ভিড়ের চাপে পড়ে মারা যায়। এতে প্রচণ্ডভাবে ঠেলাঠেলি ছুটোছুটি আরম্ভ হয় যে, কারও কোনো দিকবিদিক জ্ঞান থাকে না। দ্বিতীয়বার আমি যখন এই হাতির লড়াই দেখেছিলাম তখন আমিও কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম কেবল আমার দুরন্ত ঘোড়াটির জন্য এবং আমার অনুচর ভৃত্যটির প্রাণপণ চেষ্টার জন্য।

দিল্লির মসজিদ ও সরাই

এইবার দুর্গ ত্যাগ করে আবার শহরে ফিরে যাই, কারণ দিল্লি শহরের দুটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যের নিদর্শনের কথা উল্লেখ করতে ভুলে গেছি।* তার মধ্যে একটি হল জুম্মা মসজিদ। শহরের মধ্যে একটি উঁচু টিলার উপর প্রতিষ্ঠিত বলে মসজিদটিকে দূর থেকে অদ্ভুত দেখায়। টিলার উপরটা আগেই সমতল করে নেওয়া হয়েছিল এবং তার আশপাশের অনেকটা জায়গা পরিষ্কার করে স্কোয়ারের মতো করা হয়েছিল। এইখানে চারটি বড় বড় রাস্তা এসে চারদিক থেকে মিলিত হয়েছে মসজিদের ঠিক চারদিকে। মসজিদের প্রধান ফটকের ঠিক সামনে একটি, পিছন দিকে একটি; দুপাশের দুটি ফটকের প্রধান ফটকের ঠিক সামনে একটি, পিছন দিকে একটি; দুপাশের দুটি ফটকের সামনে আর দুটি রাস্তা। তিন দিকের তিনটি ফটকে উঠতে হলে পঁচিশ থেকে ত্রিশটি করে সিঁড়ি পার হতে হয়। পিছন দিকটি একেবারে টিলার সঙ্গে লাগানো, যেন একসঙ্গে গেঁথে তোলা। তিনটি ফটকই শ্বেতপাথরের তৈরি, দেখতে অতি সুন্দর এবং তার দরজাগুলিতে তামার পাত বসানো। প্রধান ফটকটি অন্যান্য ফটকের তুলনায় অনেক বেশি জমকালো দেখতে এবং তার উপর ছোটো ছোটো সাদা মিনার আছে অনেক। দেখতে অপূর্ব দেখায়। মসজিদের পেছনে তিনটি বড় বড় গম্বুজ আছে, তার মধ্যে মাঝখানের গম্বুজটি সবচেয়ে বড় ও উঁচু। গম্বুজগুলিও শ্বেতপাথরের তৈরি। প্রধান ফটক ও তিনটি গম্বুজের মধ্যবর্তী স্থানটি উন্মুক্ত। প্রচণ্ড গরমের জন্য এই উন্মুক্ততার প্রয়োজন আছে। বড় বড় শ্বেতপাথরের চাঁই বসানো মাঝখানে। আমি স্বীকার করি যে মসজিদটি স্থাপত্যবিদ্যার সূত্র অনুযায়ী নিখুঁতভাবে তৈরি হয়নি। সেদিক দিয়ে বিচার করলে অনেক ত্রুটি—বিচ্যুতি যে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবু রুচিসম্মত নয় এমন কিছু ত্রুটি মসজিদের গড়নের মধ্যে কোথাও নেই। প্রত্যেকটি অংশ তার নিখুঁতভাবে তৈরি। সমতা ও সামঞ্জস্যবোধ তার মধ্যে সুপরিস্ফুট। আমি অন্তত মনে করি যে এই মসজিদের মতো যদি কোনো গির্জা থাকত প্যারিসে, তাহলে স্থাপত্যের নিদর্শনরূপে তা সকলের কাছে প্রশংসা অর্জন করত। গম্বুজ আর মিনারগুলি কেবল শ্বেতপাথরের তৈরি। এছাড়া বাকি অংশ লাল বেলেপাথরের।

সম্রাট প্রতি শুক্রবারে মসজিদে যান প্রার্থনা করতে। আমাদের যেমন রবিবার, মুসলমানদের তেমনি শুক্রবার। যে রাস্তা দিয়ে তিনি মসজিদে যান, সেই রাস্তায় জল ছিটানো হয় আগে থেকে, ধুলো ও উত্তাপ দুইই কমানোর জন্য। দুর্গের ফটকের কাছ থেকে মসজিদের ফটক পর্যন্ত রাস্তার দুদিকে সারবন্দি হয়ে বন্দুকধারী সৈন্যেরা দাঁড়িয়ে থাকে। পাঁচ—ছয়জন অশ্বারোহী সামনে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে যায় এবং তারা অনেকটা এগিয়ে থাকে সামনে, পাছে তাদের চলার পথের ধুলো সম্রাটের বিরক্তির কারণ হয়। এইভাবে সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হয়ে গেলে, সম্রাট মসজিদের পথে যাত্রা করেন। হয় সুসজ্জিত হাতির পিঠে চড়ে যান, আর তা না হলে আটজন বাহকের স্কন্ধে সিংহাসনে চড়ে যান। নানারকমের রঙ—বেরঙের কাপড়, বনাত ইত্যাদি দিয়ে হাতির হাওদা ও সিংহাসন সাজানো থাকে। সম্রাটের অনুগমন করেন একদল ওমরাহ, কেউ ঘোড়ায় চড়ে কেউ বা পালকিতে চড়ে। ওমরাহদের সঙ্গে অনেক মনসবদারদেরও দেখা যায়। অন্যান্য অনুষ্ঠানাদির সময় যেরকম জমকালো শোভাযাত্রা হয়, মসজিদে প্রার্থনা করতে যাবার সময় ঠিক সেরকম কিছু না হলেও, যা হয় তাও কম রাজকীয় নয়।

জুম্মা মসজিদের পর উল্লেখযোগ্য হল দিল্লির বেগমসরাই। সম্রাট সাজাহানের জ্যেষ্ঠা কন্যা বেগমসাহেবা এই সরাইটি তৈরি করেছিলেন বলে এর নাম বেগমসরাই। শুধু বেগমসাহেবা নন, ওমরাহরাও এইভাবে শহরের শ্রীবৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেন। বেগমসরাই অনেকটা খোলা স্কোয়ারের মতো, চারদিকে তোরণপথ। তোরণগুলি রাজপ্রাসাদের তোরণের মতো, কেবল পৃথকভাবে পার্টিশন দেওয়া। ভিতরে ছোটো ছোটো কামরা আছে অনেক। ধনী পারসি, উজবেক ও অন্যান্য বিদেশি বণিকদের বিশ্রামের স্থান এই সরাই। কামরা খুলে তাঁরা সরাইয়ে স্বচ্ছন্দে নিরাপদে থাকতে পারেন, কারণ রাতে প্রধান ফটকটি বন্ধ করে দিলে ভিতরে প্রবেশ করা যায় না। চমৎকার ব্যবস্থা অতিথিদের জন্য। প্যারিসে যদি এই ধরনের সরাই কয়েকটা থাকত তাহলে বাইরের যাত্রীদের বিশেষ অসুবিধা হত না। তাঁরা প্যারিসে এসে প্রথমে কয়েকদিন এই সরাইয়ে ধীরেসুস্থে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করতে পারতেন।

দিল্লির লোকজন

দিল্লির বিবরণ শেষ করার আগে আরও দু—একটি প্রশ্নের আমি উত্তর দিতে চাই। আমি জানি, এই প্রশ্ন হয়ত আপনাদের মনে জাগবে। দিল্লির লোকসংখ্যা কত, এবং তার মধ্যে ভদ্রশ্রেণির সংখ্যাই বা কত? ফ্রান্সের রাজধানীর সঙ্গে তার তুলনা হয় কি না? প্যারিসের কথা যখন ভাবি তখন মনে হয় যেন তিন—চারটি শহরের সমাবেশ হয়েছে একসঙ্গে। তার আগাগোড়া অট্টালিকা ও লোকজনে পরিপূর্ণ। গাড়ি—ঘোড়ার অন্ত নেই যেন। কিন্তু সেই অনুপাতে খোলা জায়গা, স্কোয়ার, বাগান—বাগিচা ইত্যাদি নেই। দেখলে মনে হয় প্যারিস যেন পৃথিবীর নার্সারি এবং ভাবা যায় না যে দিল্লির লোকসংখ্যা প্যারিসের সমান। আবার দিল্লি শহরের বিশাল আয়তন এবং অসংখ্য দোকানপাটের কথা ভাবলে অন্যরকম মনে হয়। তার সঙ্গে দিল্লির লোকসংখ্যার কথা ভাবলেও অবাক না হয়ে পারা যায় না। আমির—ওমরাহ ছাড়াও দিল্লি শহরে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার সৈন্য ও বহু দাসদাসী থাকে, তাদের প্রভুরা থাকেন। প্রত্যেকে স্বতন্ত্র কোঠায় বাস করে, স্ত্রী—পুত্র—পরিবার নিয়ে। এমন কোনো গৃহ নেই যা স্ত্রী পুত্র ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ নয়। বাইরের গ্রীষ্মের উত্তাপ যখন একটু কমে যায়, যখন লোকজন রাস্তায় চলাফেরা করার জন্য বেরিয়ে আসে, তখনও দিল্লির পথের দৃশ্য দেখে মনে হয় না যে দিল্লির লোকসংখ্যা কম। গাড়ি—ঘোড়ার ভিড় রাস্তায় বিশেষ না থাকা সত্ত্বেও, লোকের ভিড়ে প্রায় পথ চলা যায় না। সুতরাং লোকসংখ্যার দিক থেকে দিল্লি ও প্যারিসের তুলনামূলক আলোচনা করার আগে এসব কথা বিবেচনা করা উচিত। বিবেচনা করলে মনে হয় যে প্যারিসের সমান লোকসংখ্যা না হলেও, দিল্লির লোকসংখ্যা প্যারিসের চেয়ে বেশি কম নয়।

অবস্থাপন্ন ও ভদ্রশ্রেণির লোকের কথা ধরলে অবশ্য অন্যরকম মত প্রকাশ করতে হয়। প্যারিসে এই শ্রেণির লোকসংখ্যা দিল্লির তুলনায় অনেক বেশি। প্যারিসের প্রতি দশজন লোকের মধ্যে অন্তত সাত—আটজন ভদ্রবেশী, পোশাক—পরিচ্ছদ দেখলে মনে হয় মোটামুটি অবস্থাপন্ন কিন্তু দিল্লি শহরে ঠিক বিপরীত দৃশ্য দেখা যায়। প্রতি দশজনের মধ্যে সাত—আটজন দরিদ্র ও জীর্ণবেশী, আর দু—একজন মাত্র ভদ্রবেশী। এইসব দরিদ্র লোক শহরে আসে সৈন্যবাহিনীতে চাকুরির লোভে। অবশ্য আমি নিজে যাঁদের সঙ্গে মেলামেশা করি এবং সাধারণত যাঁদের সঙ্গে আমার দেখা—সাক্ষাৎ হয়, তাঁরা অধিকাংশই অবস্থাপন্ন। খুব মূল্যবান পোশাক—পরিচ্ছদ তাঁরা ব্যবহার করেন এবং সব সময় খুব ফিটফাট থাকেন। আমির—ওমরাহ, রাজা—রাজড়া ও মনসবদাররা যখন আমখাসে বা অন্য কোনো সময় রাজদরবারে যাওয়ার জন্য সমবেত হন দুর্গের সামনে, তখন সত্যিই উপভোগ করবার মতো দৃশ্য হয়। মনসবদাররা চারিদিক থেকে ঘোড়ায় করে দৌড়ে আসেন, চারজন করে ভৃত্য সঙ্গে নিয়ে এবং প্রভুদের জন্য পথ পরিষ্কার করতে থাকেন। তারপর ওমরাহ ও রাজারা কেউ ঘোড়ার পিঠে, কেউ বা হাতির পিঠে চড়ে দরবার অভিমুখে যাত্রা করেন। অধিকাংশই অবশ্য ছয় বেহারার সুসজ্জিত পালকিতে চড়ে যান, মখমলের গদিতে হেলান দিয়ে বসে, পান চিবুতে চিবুতে। পান খাওয়ার উদ্দেশ্য হল মুখের সুগন্ধ ছড়ানো এবং ঠোঁট দুটি টুকটুকে লাল করা। আমিরি ভঙ্গিতে পালকিতে তাকিয়া হেলান দিয়ে বসে ওমরাহ ও রাজারা সুগন্ধি পান চিবুতে থাকেন এবং পালকির সঙ্গে একজন ভৃত্য দৌড়তে থাকে পিকদান নিয়ে। পোর্সেলিন বা রুপোর পিকদান। ওমরাহ ও রাজারা পিকদানে পিক ফেলতে ফেলতে যান। পালকির একদিকে এইভাবে পিকদান হাতে ভৃত্য দৌড়তে থাকে, আর একদিকে আরও দুজন ভৃত্য ময়ূরপুচ্ছের পাখা নিয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে ও ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে যায়। তিন—চারজন নোকর পালকির সামনে দৌড়তে থাকে, পথের লোকজন ও জন্তু—জানোয়ার হটাতে হটাতে এবং কয়েকজন বাছাই—করা দুরন্ত অশ্বারোহী পালকির পিছনে ছুটতে থাকে।৩৫

দিল্লির পাশের অঞ্চলগুলি খুব উর্বর বলে মনে হয়। নানারকমের ফসল উৎপন্ন হয় এইসব অঞ্চলে। চিনি, নীল, চাল, তিন—চার রকমের ডাল প্রচুর পরিমাণে হয়। দিল্লি শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে আর একটি উল্লেখযোগ্য মসজিদ আছে, কুতবউদ্দিনের নামের সঙ্গে জড়িত। আর একদিকে, কয়েক মাইল দূরে সম্রাটের বাগানবাড়ি, নাম ‘শালিমার’।৩৬ দিল্লি ও আগ্রার মধ্যে আর বিশেষ উল্লেখযোগ্য কোনো ভাল শহর নেই। সমস্ত পথটা একঘেয়ে ও বিরক্তিকর, দেখবার মতো কোথাও কিছু নেই। কেবল মথুরা শহরটি উল্লেখযোগ্য, কারণ এই প্রাচীন শহরটিতে অনেক সুন্দর সুন্দর দেবালয়, পান্থশালা ইত্যাদি আছে। এছাড়া আর কিছু নেই। রাস্তার দুপাশে বড়ো বড়ো গাছ সারবন্দি করে বসানো, পথচারীর ছায়ার জন্য। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আদেশে এই সব গাছ রোপণ করা হয়েছিল। এক ক্রোশ অন্তর একটি করে উঁচু মিনার, পথের নির্দেশক বা নিশানারূপে নির্মিত। এগুলিকে ‘ক্রোশমিনার’ বলা হয়। ৩৭ পথের মধ্যে মধ্যে কুয়ো আছে, পথিকের পিপাসা নিবারণের জন্য এবং গাছপালায় জলসেচনের জন্য।

আগ্রার কথা

দিল্লি শহরের যে বর্ণনা করেছি তাই থেকে আগ্রা শহর সম্বন্ধে, অনেকটা ধারণা করতে পারবেন। যমুনার তীরে শহরের অবস্থান সম্বন্ধে, রাজপ্রাসাদ ও দুর্গাদি সম্বন্ধে এবং বড়ো বড়ো অট্টালিকা সম্বন্ধে। কিন্তু আগ্রা শহর দিল্লির চাইতেও প্রাচীন শহর, সম্রাট আকবর বাদশাহের রাজত্বকালে তৈরি। সেইজন্য আগ্রার প্রাচীন নাম ছিল আকবরাবাদ। দিল্লির চাইতে অনেক বড়ো শহর, আমির—ওমরাহ রাজা—রাজড়াদের বাড়িঘরও অনেক বেশি। পাকাবাড়ি, ইটপাথরের বাড়ির সংখ্যা দিল্লির চাইতে আগ্রায় বেশি, ক্যারাভান—সরাইয়ের সংখ্যাও বেশি। দুটি বিখ্যাত কীর্তিস্তম্ভের জন্য আগ্রার এত খ্যাতি। আগ্রার রাস্তাঘাট অবশ্য দিল্লির মতো সুপরিকল্পিত নয়। ব্যাবসা—বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র চার—পাঁচটি রাস্তা মোটামুটি সুন্দর, ঘরবাড়িও মন্দ নয়। তা ছাড়া বাকি সব রাস্তা এত সংকীর্ণ, ঘিঞ্জি ও আঁকাবাঁকা যে বলা যায় না। দিল্লির তুলনায় এইদিক দিয়ে আগ্রাকে অনেকটা মফঃস্বল শহরের মতো মনে হয়। আমির—ওমরাহ, রাজা—রাজড়াদের ঘরবাড়ি অনেকটা বাগানবাড়ির মতো উদ্যান—পরিবেষ্টিত। তারমধ্যে ধনী হিন্দু বেনিয়ান ও ব্যবসায়ীদের বাড়িগুলি ঠিক প্রাচীন দুর্গের মতো দেখায়। প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বিচার করলে আগ্রা শহর দিল্লির তুলনায় অনেক বেশি মনোরম মনে হয়। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে সবুজের সমারোহ যে কত মনোমুগ্ধকর তা বর্ণনা করা যায় না। ফ্রান্সে বা প্যারিসে যে এরকম প্রাকৃতিক পরিবেশের অভাব আছে তা নয়।

আগ্রার পাদরি সাহেব

আগ্রা শহরে জেসুইটদের একটি গির্জা আছে। একটি প্রতিষ্ঠানও আছে পৃথক বাড়িতে, তাকে ‘কলেজ’ বলা হয়। প্রায় পঁচিশ—ত্রিশটি খ্রিস্টান পরিবারের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের এখানে খ্রিস্টানধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া হয়। কোথা থেকে কিভাবে এই খ্রিস্টান পরিবারগুলি এখানে জুটল তা জানি না। এইটুকু জানি যে জেসুইটদের আর্থিক দানের লোভেই তারা এখানে এসেছে এবং তার উপর নির্ভর করেই তারা বসবাস করছে। এই পাদরি সাহেবরা আকবর বাদশাহের আমলে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন এখানে। ভারতবর্ষে পর্তুগিজদের প্রতিপত্তি ছিল যখন খুব বেশি, তখন সম্রাট আকবর এই ধর্মযাজকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন। সম্রাট আকবর এই পাদরিদের একটা বাৎসরিক আয়েরই যে ব্যবস্থা করেছিলেন শুধু তাই নয়, আগ্রায় ও লাহোরে তাঁদের গির্জা নির্মাণ করার অনুমতি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। জেসুইট পাদরিরা অবশ্য আকবর বাদশাহের পুত্র জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে আরও বেশি সহযোগিতা ও সমর্থন পান। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র সাজাহানের কাছ থেকে তাঁরা পান প্রচণ্ড বিরোধিতা ও শত্রুতা। সম্রাট সাজাহান পাদরি সাহেবদের ভাতা বন্ধ করে দেন এবং নানাদিক থেকে অত্যাচার করে তাঁদের নির্মূল করার চেষ্টা করেন। তিনি লাহোর ও আগ্রার গির্জাগুলি ধ্বংস করে ফেলেন। আগ্রার একটি বিখ্যাত গির্জার চূড়ো পর্যন্ত তিনি ধূলিসাৎ করে দেন। একসময় এই গির্জার ঘড়ির শব্দ সারা আগ্রা শহরে শোনা যেত।

জাহাঙ্গীরের খ্রিস্টান-প্রীতি

সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে পাদরি সাহেবরা একরকম নিশ্চিন্ত ছিলেন এই ভেবে যে হিন্দুস্থানে খ্রিস্টানধর্মের অগ্রগতি কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না। অবশ্য একথা ঠিক যে জাহাঙ্গীরের মোটেই ধর্ম—গোঁড়ামি ছিল না এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও কোরানের ধার তিনি বিশেষ ধারতেন না। খ্রিস্টানধর্মের প্রতি তাঁর যে বিশেষ অনুরাগ ছিল তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। তিনি তাঁর দুজন ভ্রাতুষ্পুত্রকে খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষা নিতে অনুমতি দিয়েছিলেন, এমন কি মির্জাকেও সম্মতি দিতে দ্বিধাবোধ করেননি, কারণ তাঁর মতে মির্জা খ্রিস্টান পিতামাতার সন্তান। মির্জার মা ছিলেন আমেরিকান এবং তাকে হারেমে আনা হয়েছিল সম্রাটের ইচ্ছানুক্রমেই।

জেসুইটরা বলেন যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের খ্রিস্টান—প্রীতি এত প্রবল ছিল যে তিনি দরবারের সমস্ত পোশাক—পরিচ্ছদ ইয়োরোপীয় ধরনে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। তার জন্য তিনি অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসরও হয়েছিলেন এবং পোশাকও তৈরি করিয়ে ফেলেছিলেন। একদিন ইয়োরোপীয় পোশাকে সেজেগুজে সম্রাট নিজে তাঁর একজন পিয়ারের ওমরাহকে ডেকে পাঠান এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন যে নতুন পোশাকে তাঁকে কেমন মানিয়েছে। ওমরাহ তার এমন জবাব দেন যে সম্রাট সেইদিন থেকে ইয়োরোপীয় পোশাকে দরবারে যাবার সমস্ত পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন। এত লজ্জা পান তিনি সমস্ত ব্যাপারটার জন্য যে শেষ পর্যন্ত ওমরাহদের কাছে বলতে বাধ্য হন যে তিনি এমনি কৌতুক করছিলেন মাত্র।৩৮

জেসুইট সাহেবরা এমন কথাও বলেন যে সম্রাট জাহাঙ্গীর নাকি তাঁর মৃত্যুশয্যায় খ্রিস্টানরূপে মরবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এবং সেইজন্য তিনি খ্রিস্টান যাজকদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছা বা বাণী বাইরে প্রকাশ করা হয়নি। অনেকে বলেন, এ কাহিনির কোনো ভিত্তি নেই। জাহাঙ্গীর কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি কোনো প্রগাঢ় আস্থা বা শ্রদ্ধা নিয়ে মরেননি। তাঁর একান্ত বাসনা ছিল, কতকটা তাঁর পিতা আকবার বাদশাহের মতো যে তিনি পয়গম্বরের মতো নতুন কোনো ধর্ম প্রবর্তন করে মরবেন।

সম্রাট জাহাঙ্গীর সম্বন্ধে আর একটি কাহিনি আমাকে একজন মুসলমান ভদ্রলোক বলেছিলেন। এই ভদ্রলোকের পিতা ছিলেন জাহাঙ্গীরের পারিবারিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। কাহিনিটি এই : একবার সম্রাট জাহাঙ্গীর মদ্যপানে বিভোর হয়ে কয়েকজন বিচক্ষণ মোল্লা ও একজন খ্রিস্টান পাদরি সাহেবকে ডেকে পাঠান। পাদরি সাহেবকে তিনি ‘ফাদার আতশ’ বলে ডাকতেন। ‘আতশ’ অর্থে আগুন। পাদরি সাহেবের মেজাজ খুব গরম ছিল বলে তিনি তাঁর এই নাম রেখেছিলেন। ফাদার আতশ এসে প্রথমে ইসলামধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় বক্তৃতা করেন, মহম্মদের বিরুদ্ধে যা খুশি উক্তি করেন এবং নিজের খ্রিস্টধর্ম ও যিশুখ্রিস্টের স্বপক্ষে অনেক বড়ো বড়ো কথা বলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর আদ্যোপান্ত শুনে সিদ্ধান্ত করেন যে, ধর্ম নিয়ে পাদরি ও মোল্লার এই বাকযুদ্ধের একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। তিনি হুকুম দিলেন : ‘একটা গর্ত খোঁড়া হোক মাটিতে এবং তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হোক। ফাদার আতশ তাঁর বাইবেল হাতে করে, এবং মোল্লা তাঁর কোরান হাতে করে সেই আগুনের কুণ্ডের মধ্যে ঝাঁপ দিন। আগুন যাঁকে দগ্ধ করতে পারবে না, আমি তাঁর ধর্মে দীক্ষা নেব।’ সম্রাটের অগ্নি—পরীক্ষার আহ্বানে ফাদার আতশ সন্তুষ্টচিত্তে রাজি হলেন, কিন্তু মোল্লা ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। তখন সম্রাট উভয়েরই অবস্থা দেখে করুণার হাসি হেসে তাঁদের মুক্তি দিলেন।৩৯

কাহিনিটি যাই হোক, সত্য বা মিথ্যা, তাতে কিছু যায় আসে না। একথা ঠিক যে জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে জেসুইটদের বেশ প্রতিপত্তি ছিল দরবারে এবং সম্রাটও তাঁদের যথেষ্ট শ্রদ্ধাভক্তি করতেন। সুতরাং পাদরি সাহেবরা যদি মনে করে থাকেন যে হিন্দুস্থানে খ্রিস্টান ধর্মেরই ভবিষ্যৎ তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। কিন্তু জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর হিন্দুস্থানে যেসব ঘটনা ঘটেছে (দারার সঙ্গে পাদরি বুসের সম্পর্কের ঘটনা ছাড়া) তাতে মনে হয় না যে খ্রিস্টানধর্মের এরকম সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার কোনো সার্থকতা আছে। যাই হোক, পাদরি সাহেবদের সম্বন্ধে অনেক কথা প্রসঙ্গত বলে ফেলেছি। যখন বলে ফেলেছি তখন এ সম্বন্ধে আরও দু—চারটে দরকারি কথা এখানে আমি বলতে চাই।

খ্রিস্টান ও ইসলামধর্ম

ধর্মপ্রচারের এই পরিকল্পনা আমি সম্পূর্ণ সমর্থন করি। যে পাদরি সাহেবরা ধর্মপ্রচারের মহান উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছেন তাঁরা যে প্রশংসা ও শ্রদ্ধার যোগ্য, তাও স্বীকার করি। বিশেষ করে কাপুচিন ও জেসুইটরা এত শান্ত ও সংযতভাবে ধর্মকথা বলেন যে, তাঁদের শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। তাঁদের বক্তৃতাদির মধ্যে বিদ্বেষের কোনো ঝাঁজ নেই। ক্যাথলিক, গ্রিক, আর্মেনিয়ান, নেস্টরিয়ান, জেকোবিন প্রভৃতি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের খ্রিস্টানদের প্রতি এই যাজকদের মনোভাব অত্যন্ত উদার ও সহনশীল। তাঁরা সত্যই পীড়িত ও ব্যথিতকে সান্ত্বনা দিতে পারেন ধর্মের বাণী শুনিয়ে এবং তাঁদের নিজের বিদ্যা ও চারিত্রিক গুণের জোরে তাঁরা অজ্ঞ ম্লেচ্ছদের নানারকম কুসংস্কার ও গোঁড়ামির কথা স্মরণ করাতে পারেন। কিন্তু সকলের চরিত্রে যে এরকম প্রশংসনীয় এবং পাদরি সাহেব মাত্রই যে শ্রদ্ধার যোগ্য তা নয়। অনেকের স্বভাব চরিত্র অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল এবং যাজক—সম্প্রদায়ের উচিত তাঁদের চরিত্র সংশোধন করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা। ধর্মপ্রচারকের ছাপ মেরে তাঁদের বাইরে পাঠানো কোনোমতেই উচিত নয়। খ্রিস্টানধর্মের প্রচারে ও প্রসারে তাঁরা কোনোরকম সাহায্য তো করেনই না, উপরন্তু ধর্মকে কলঙ্কিত করেন। অবশ্য সকলেই যে এরকম অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির তা আমি বলছি না। যাজকতার বিরোধীও আমি নই। বরং আমি তার সমর্থক। ধর্ম প্রচারকের প্রয়োজন আছে, আমি স্বীকার করি। পৃথিবীর সর্বত্র যে ধর্মপ্রচারক পাঠানো দরকার খ্রিস্টানধর্মের প্রসারের জন্য, তাও আমি স্বীকার করি। অবশ্য খ্রিস্ট ও তাঁর ভক্তদের যুগ কেটে গেছে অনেকদিন। এখন সেই সরল বিশ্বাসের যুগ আর নেই। একথাও মনে রাখা দরকার। তখন ধর্মপ্রচার করা ও মানুষকে ধর্মে দীক্ষিত করা যতটা সহজ ছিল, এখন আর ততটা সহজ নয়। আধুনিক যুগে মানুষকে ধর্মান্তরিত করা অত্যন্ত কঠিন। দীর্ঘকাল ধরে আমি ম্লেচ্ছদের প্রত্যক্ষ সম্পর্কে জড়িত, কিন্তু তবু তাদের প্রতি আমার সেরকম কোনো আস্থা নেই। বিশেষ করে ভারতবর্ষের মুসলমানধর্মীদের সম্পর্কে আমার কোনো আশাভরসা বিশেষ নেই। প্রাচ্যাঞ্চলের নানাস্থানে আমি ঘুরেছি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলছি যে, হিন্দুদের যদিও বা ধর্মান্তরিত করা সম্ভবপর দু—চারজনকে, মুসলমানদের করার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। দশ বছরের মধ্যে যদি একজন মুসলমানকে খ্রিস্টান করা সম্ভব হয়, তাহলে জানবেন যথেষ্ট হয়েছে। মুসলমানরা যে খ্রিস্টানদের বা খ্রিস্টানধর্মকে শ্রদ্ধা করে না তা নয়। যিশুখ্রিস্টের নাম তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে। তারা যিশুর দেবত্বও অবিশ্বাস করে না। কিন্তু তাহলেও একথা কল্পনাও করবেন না যে তারা তাদের নিজেদের ইসলামধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টানধর্ম বা অন্য কোনো ধর্ম কোনোদিন গ্রহণ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করবে। প্রাণ থাকতে করবে না। তবু খ্রিস্টানধর্ম—প্রচারকদের সর্বপ্রকার সাহায্য করা উচিত। মহান কাজে তাঁদের উৎসাহিত করাও উচিত। প্রধানত ইয়োরোপীয়ানদেরই উচিত এই সব প্রচাররকদের ব্যয়ভার বহন করা। অন্যদেশের জনসাধারণের স্কন্ধে সে ভার চাপানো উচিত নয়। প্রচুর পরিমাণে প্রচারকদের অর্থসাহায্য করা উচিত এবং অর্থের ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করা ঠিক নয়, কারণ অর্থাভাবেও অনেক সময় পাদরিরা হীন কাজ করতে বাধ্য হন। সুতরাং প্রত্যেক খ্রিস্টান রাষ্ট্রের কর্তব্য, ধর্মপ্রচারকদের মুক্তহস্তে অর্থ সাহায্য করা।

মুসলমান বা ইসলামধর্ম সম্বন্ধে আমাদের ধারণা খুব পরিষ্কার নয়। আমরা কল্পনা করতে পারি না, সাধারণ মুসলমানদের উপর ইসলামধর্মের প্রভাব কতখানি। ধর্মের প্রতি মুসলমানদের গোঁড়ামি ও অন্ধ উন্মত্ততা যে কত তীব্র তা বাস্তবিকই খ্রিস্টানদের পক্ষে ধারণা করা শক্ত। কারণ খ্রিস্টানধর্মে অন্ধ উন্মত্ততার বিশেষ কোনো স্থান নেই বা প্রকাশের সুযোগ নেই। আমার নিজের ধারণা—মুসলমান ধর্মের ভিত্তি মারাত্মক ও ভয়াবহ। অস্ত্রবলের জোরে তার প্রতিষ্ঠা হয়েছে যেমন, তেমনি সেই অস্ত্রের জোরেই তার প্রচার ও প্রসার হয়েছে। সহনশীলতা বা উদারতার কোনো স্থান নেই তার মধ্যে। খ্রিস্টানদের উচিত কৌশলে মুসলমানদের ধর্মগোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াই করা। চিন ও জাপানের দৃষ্টান্ত দেখে আমরা শিখতে পারি এবং জাহাঙ্গীরের জীবন থেকে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। পাদরি সাহেবদের আরও একটি বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে হবে। গির্জার মধ্যে দেবতার বেদির সামনে দাঁড়িয়ে খ্রিস্টানরা যে লঘুচিত্ততার পরিচয় দেন, তা নিন্দনীয়। মসজিদে আল্লার কাছে প্রার্থনা করার সময় মুসলমানরা একটিবারও ঘাড় পর্যন্ত বেঁকায় না। তাদের একাগ্রতা, দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা বাস্তবিকই অনুকরণযোগ্য।

ডাচ বণিকদের কথা

ডাচদের একটি কুঠি আছে আগ্রায়। প্রায় চার—পাঁচজন লোক থাকে কুঠিতে। আগে ডাচ বণিকরা আগ্রা শহরে কাপড়, ছোটো বড়ো আয়না, নানারকমের সোনা—রুপোর কাজ—করা ফিতা, লোহা—লক্কড় ইত্যাদির ব্যবসা করত। তাছাড়া আগ্রার কাছাকাছি অঞ্চল থেকে তারা নীল কিনত এবং সেই নীলের ব্যবসা করত। কাপড়ের ব্যবসাতেও তাদের বেশ প্রতিষ্ঠা ছিল। জালালপুর ও লক্ষ্নৌ শহর থেকে তারা কাপড় কিনত। প্রতি বছর তারা লক্ষ্নৌতে কয়েকজন ফ্যাক্টর বা কর্মচারী পাঠাত কাপড় কেনা—কাটার জন্য। এখন মনে হয় এই ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যের অবস্থা তেমন ভাল নয়। আর্মেনিয়ান বণিকদের প্রতিযোগিতার জন্য এবং আগ্রা থেকে সুরাটের দূরত্বের জন্য ব্যাবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। পথে ক্যারাভানের নানারকম দুর্গতি ঘটে এবং বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হতে হয়। দুর্গম রাস্তা ও পাহাড়—পর্বত এড়িয়ে যাবার জন্য তারা গোয়ালিয়র থেকে বহরমপুরের সোজা পথ ধরে যায় না। তার বদলে আমেদাবাদ দিয়ে ঘুরে বিভিন্ন রাজার রাজ্যের ভিতর দিয়ে তাদের যাতায়াত করতে হত। তবে যত অসুবিধা ও বাধাবিপত্তি থাকুক না কেন, আমার মনে হয় না যে ডাচ বণিকরা ইংরেজ কুঠিয়ালদের মতো আগ্রার কুঠি ছেড়ে চলে যাবে। এখনও ডাচরা ব্যবসা—বাণিজ্যের যথেষ্ট সুবিধা পায় এবং দরবার—সংশ্লিষ্ট লোকজনদের অনুনয়—বিনয় করে, বাংলাদেশে, পাটনা, সুরাট, আমেদাবাদ প্রভৃতি স্থানে তাদের বাণিজ্যকুঠি পরিচালনার সুযোগ তৈরি করে নেয়। প্রাদেশিক শাসকদের অন্যায়—অবিচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে প্রতিকার করারও অসুবিধা হয় তাদের।

আগ্রার তাজমহল

এইবার আগ্রার দুটি প্রধান কীর্তিস্তম্ভের কথা উল্লেখ করে ‘দিল্লি ও আগ্রা’ সম্বন্ধে এই চিঠি শেষ করব। আগ্রার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল এই স্তম্ভ দুটি। একটি সম্রাট জাহাঙ্গীরের তৈরি আকবর বাদশাহের স্মৃতিস্তম্ভ। আর একটি সম্রাট সাজাহানের তৈরি বেগম মমতাজের স্মৃতিসৌধ ‘তাজমহল’। আকবর বাদশাহের সমাধি সম্বন্ধে এখানে বিশেষ কিছু বলব না। কারণ তার যা সৌন্দর্য তা তাজমহলের মধ্যে আরও চমৎকারভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।*

তাজমহল বাস্তবিকই বিস্ময়কর কীর্তি। হয়ত বলবেন যে আমার রুচি অনেকটা ভারতীয় ধরনের হয়ে গেছে, দীর্ঘকাল ভারতবর্ষে থাকার জন্য। কিন্তু তা নয়; আমি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি যে মিশরীয় পিরামিড আগ্রার তাজমহলের তুলনায় এমন কিছু আশ্চর্য কীর্তির নিদর্শন নয়। মিশরের পিরামিডের কথা অনেক শুনেছি এবং দু—দুবার নিজে চোখে দেখেও যে আমি ব্যক্তিগতভাবে আনন্দ পাইনি, একথা স্বীকার করতে আমার কোনো কুণ্ঠা নেই। নিরাকার পাথরের স্তূপ ছাড়া মিশরীয় পিরামিড আমার কাছে আর কিছু মনে হয়নি। বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই স্তরে স্তরে সাজিয়ে একটা কিমাকার কিছু গড়ে তুললেই বিস্ময়কর কীর্তি হয় না। তার মধ্যে মানুষের কল্পনা বা কারিগরির কিছু নেই, কিন্তু আগ্রার তাজমহলের মধ্যে তা আছে।

………….

* প্রকৃত নাম ফ্রান্সেয়া দ্য লা মোথ লো ভেয়ার (১৫৮৮—১৬৭২) পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। চিঠিপত্রের মাধ্যমে বার্নিয়ের—এর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।

* ১ লিগ দূরত্ব ১.৪ মাইল বা ২.২ মি. মি.

১। আকবর বাদশাহ অত্যন্ত অশ্বপ্রিয় ছিলেন। আকবরের আমলে ইরাক, রুম, তুর্কিস্থান, বাদকসান সিরবান, তিব্বত, কাশ্মীর প্রভৃতি দেশ থেকে ভালো ভালো অশ্ব হিন্দুস্থানে আমদানি হত। আকবর বাদশাহের অশ্বশালায় সর্বদাই প্রায় বারো হাজার অশ্ব মজুত থাকত। ভাল অশ্ব যখনই আমদানি হত, তখনই তিনি পুরাতন অশ্ব আমির—ওমরাহদের দান করে দিয়ে নতুন অশ্ব কিনতেন। হিন্দুস্থানে যেমন ভালো ভালো অশ্ব ছিল, তেমনি অশ্ব বিদ্যাবিশারদ বড়ো বড়ো পণ্ডিতও ছিলেন। ভারতের কচ্ছ প্রদেশে অতি উত্তম শ্রেণির অশ্ব পাওয়া যেত, আরবি অশ্বের তুলনায় কোনো অংশেই নিকৃষ্ট নয়। বাংলার উত্তরে কোচপ্রদেশে তুর্কি অশ্বের ঔরসজাত এবং পাহাড়ি ভুটিয়া অশ্বিনীর গর্ভজাত একপ্রকার অশ্ব জন্মাত, তার নাম ছিল ‘টাঙ্গন’ অশ্ব। বাদশাহ এত অশ্বপ্রিয় ছিলেন যে, ভারতবর্ষে যেসব ব্যবসায়ী অশ্ব বিক্রি করতে আসতেন, তিনি তাদের আদর—অভ্যর্থনা করার জন্য ‘আমির কারাভানসরাই’ ও ‘তেপচকি’ নামে দুজন সরকারি কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। অশ্বশালায় সাধারণত দুটি বিভাগ থাকত—একটি খাসবিভাগ, আর একটি সাধারণ বিভাগ। খাসবিভাগে আরবি, পারসি ও কচ্ছপ্রদেশের অশ্ব থাকত এবং সাধারণ বিভাগে থাকত ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অশ্ব। মোগল আমলে অশ্বযান ব্যবহৃত হত না, লোকে অশ্বের পিঠে আরোহণ করে বেড়াত। অশ্বারোহণে অপটু পুরুষ সমাজে নিন্দনীয় হতেন। বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সময় যখন ইংরেজদূত স্যার টমাস রো ভারতে এসেছিলেন তখন তিনি বাদশাহকে উপঢৌকন দেবার জন্য দু—তিনরকমের ঘোড়ার গাড়ি সঙ্গে এনেছিলেন। জাহাঙ্গীর সেই বিলিতি গাড়ির নকলে কয়েকখানি ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করান। এখনও আগ্রা অঞ্চলে সেই পুরাতন ঢঙের ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহৃত হয়। ভারতবর্ষে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন এই সময় থেকেই হয়। তার আগে এক্কাগাড়ি ছিল বটে, কিন্তু তাতে ভালো অশ্ব বিশেষ জোতা হত না।—’আইন—ই—আকবরী’ থেকে সংকলিত—অনুবাদক।

২। নাবিকের কম্পাস চিনদেশের গণৎকাররা অনেক আগে থেকেই ভাগ্য গণনার জন্য ব্যবহার করতেন—অনুবাদক।

৩। বার্নিয়ের এখানে বোধ হয় মুদির দোকান ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের দোকানের কথাই বলতে চেয়েছেন। তাঁর প্রধান বক্তব্য হল যে, দামি পোশাক—পরিচ্ছদ বা অন্যান্য পণ্যদ্রব্যাদির সাজানো বাহারে দোকান দিল্লিতে বেশি ছিল না—মুদির দোকান ও খাদ্যের দোকানই বেশি ছিল।

৪। ‘আম’ ও ‘আম্র’ উত্তর ভারতের প্রচলিত শব্দ। আমের তামিল নাম হল ‘মানকে’। এই ‘মানকে’ থেকে পর্তুগিজরা করেন ‘মঙ্গ’ এবং তাকে ইংরেজি করা হয় ‘ম্যাঙ্গো’।—অনুবাদক

৫। বার্নিয়েরের এই মন্তব্য এখন অনেকের কাছে অদ্ভুত মনে হবে। ছাগলের মাংস যে ভেড়ার মাংসের চেয়ে উপাদেয়, একথা এখন, আর কেউ মনে করেন কিনা সন্দেহ, কিন্তু একসময় করতেন বলে মনে হয়।—অনুবাদক

৬। বার্নিয়েরের কথা আজও যে কত সত্য, তা মাংসাশী মাত্রই জানেন। খাদ্যের প্রতি, এমন কি মাংসের প্রতিও বার্নিয়েরের সজাগ দৃষ্টি পড়েছিল। ঈশ্বর গুপ্তের অনেক আগে ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের কচি পাঁঠার তারিফ করে গিয়েছিলেন। তাছাড়া, বাজারে যে পাঁঠার চেয়ে ছাগীর মাংস বেশি বিক্রি হয়, তাও তিনি লক্ষ্য করেছিলেন।—অনুবাদক

৭। বানিয়েরের সজাগ দৃষ্টির এটি আর—একটি দৃষ্টান্ত। অন্যান্য পর্যটকরা মাংস কালো রঙের বলেছেন, কিন্তু বার্নিয়ের বলেছেন যে, গায়ের চামড়াই কালো। সামান্য মুরগির ক্ষেত্রেও তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণশক্তির যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা অন্যান্য কোনো সমসাময়িক পর্যটকদের মধ্যে পাওয়া যায় না।—অনুবাদক

৮। ভারতীয় সমাজের গঠনবিন্যাস সম্বন্ধে বার্নিয়েরের এই মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষভাবে প্রাণিধানযোগ্য। ‘মধ্যবিত্তশ্রেণি’ বলতে আমরা যা বুঝি, তার বিকাশ হয়েছে আধুনিক শিল্পযুগে। মধ্যযুগে ‘মধ্যশ্রেণি’ বলে বিশিষ্ট ও উল্লেখযোগ্য কোনো সামাজিক শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল না।

৯। ভোজনবিলাসী বার্নিয়েরের মন্তব্য থেকে মনে হয়, এককালে দেশি মদ বোধহয় বিলাতি মদের চেয়েও ভাল ছিল।

১০। ফ্রায়ার (Fryer) লিখেছেন : বোম্বাই ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইংরেজদের মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেশি, কিন্তু পর্তুগিজরা ও দেশীয় লোকেরা বেশ বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত দীর্ঘজীবী। তার কারণ তারা অত্যন্ত সংযমী এবং মদ্য পান করে না। ইংরেজরা খুব বেশি মদ্যপান করে বলে অকালে মারা যায়। বরং বৃদ্ধবয়সে কিছু কিছু মদ্যপান করা উচিত, কিন্তু অল্প বয়সে নয়।’ (A New Account of East India and Persia : Hakluyt. Sec. Vol., P. 180)

১১। ভারতীয় পানীয়ের মধ্যে ‘শরবত’ অন্যতম। শরবতের প্রচলন হিন্দুযুগেও ছিল, কিন্তু তার বৈচিত্র্য তেমন ছিল না। লেবুর রস ও ফলের শরবত ইত্যাদি নানারকমের শরবতের প্রচলন হয় মুসলমান যুগে। অতিথিকে শরবত পান করতে দেওয়া (চা বা মদ্য নয়) ভারতীয় সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য রীতি।

১২। ভারতীয় ব্যাধি সম্বন্ধে বার্নিয়েরের এই মন্তব্য বিস্ময়ের উদ্রেক করে। বার্নিয়ের বলেছেন যে, হাঁপানি রোগই ভারতবর্ষে বেশি দেখা যায় এবং গ্রীষ্মজনিত চারিত্রিক অবসাদ ও জড়তাকেও তিনি ব্যাধি বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাত বা পেটের পীড়া ভারতবর্ষে নেই বললেই হয়—বার্নিয়েরের এই মন্তব্য আজকাল রীতিমতো বিস্মিত হবার কথা। উপদংশ—রোগ সম্বন্ধে মন্তব্যও কৌতূহল উদ্রেক করে।—অনুবাদক

১৩। কারিগরদের সম্বন্ধে বার্নিয়েরের উক্তি থেকে ভুল বোঝার সম্ভাবনা আছে। কারিগরদের ‘গিল্ড’ বা শ্রেণি ও সংঘ বিশেষ উল্লেখযোগ্য এবং তার বৈশিষ্ট্য হল বংশানুক্রমে কারিগরিবিদ্যায় দীক্ষা দেওয়া। কারিগরদের অনেকের যন্ত্রপাতি নেই বলতে তিনি নিঃস্ব দরিদ্র কারিগরদের কথাই বলতে চেয়েছেন মনে হয়।—অনুবাদক

১৪। ভারতীয় শিল্পকলায়, বিশেষ করে কারুশিল্পে, ইয়োরোপীয় প্রভাব মোগলযুগ থেকেই লক্ষ্য করা যায়। বার্নিয়েরের এই উক্তি তার প্রমাণ।—অনুবাদক

১৫। এইরকম একটি চিত্রিত ঢালের বিবরণ ১৮৯১ সালের ২০ মার্চ তারিখের বিলিতি ‘টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ঢালটির নাম ‘রামায়ণ ঢাল’। জয়পুরের শ্রেষ্ঠ শিল্পী গঙ্গা বক্স এই ঢালটিতে রামায়ণের কাহিনি সম্পূর্ণ চিত্রায়িত করেন, জয়পুর মিউজিয়মের অধ্যক্ষ মেজর হেগুলের তত্ত্বাবধানে। রামায়ণের সম্পূর্ণ কাহিনি ফলকাকারে ঢালের উপর রূপায়িত করা হয়। আকবর বাদশাহের আমলের বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রের অনুকরণে গঙ্গা বক্স এই ঢাল চিত্রায়িত করেন। পরে নাকি হেগুলে সাহেব এইরকম একটি মহাভারতের কাহিনি চিত্রিত ঢালও তৈরি করান। জয়পুরের মিউজিয়মে এই ঢালগুলি এখনও রক্ষিত থাকবার কথা।—অনুবাদক

১৬। ভারতের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার নিখুঁত বর্ণনায় বার্নিয়ের তাঁর সমসাময়িক পর্যটকদের মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলা চলে। কিন্তু এখানে ভারতীয় শিল্পীদের সম্বন্ধে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তা হয়ত সাধারণ শ্রেণির শিল্পীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু সর্বশ্রেণির শিল্পীদের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই প্রযোজ্য নয়। বোঝা যায়, অন্যান্য বিষয়ে বার্নিয়ের অসাধারণ জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণশক্তির পরিচয় দিলেও, শিল্পকলা সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ জ্ঞান ছিল না। বিশেষ করে, ভারতীয় শিল্পকলার ঐতিহ্য, পদ্ধতি ও রীতি সম্বন্ধে তিনি প্রায় অজ্ঞ ছিলেন বলা চলে। থাকাও স্বাভাবিক। তখনকার দিনের একজন বিদেশি পর্যটকদের পক্ষে ভারতীয় শিল্পকলার মতন বিষয় সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞের জ্ঞান থাকা সম্ভবপর নয়।—অনুবাদক

১৭। ভারতীয় শিল্পকলার গুণাগুণ সম্বন্ধে বার্নিয়েরের মন্তব্যের মধ্যে ত্রুটি থাকলেও, শিল্পীদের অবস্থা সম্বন্ধে তিনি যে বিবরণ দিয়েছেন তার ঐতিহাসিক মূল্য অসামান্য বলা চলে।—অনুবাদক

১৮। ফার্গুসন সাহেব তাঁর ‘The History of Indian Architecture’ গ্রন্থের মধ্যে (১৮৭৬) বলেছেন : ‘দিল্লির রাজপ্রাসাদ প্রাচ্যের সমস্ত রাজপ্রাসাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল, এমনকি সারা পৃথিবীর রাজপ্রাসাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ, এমন সুন্দর স্থাপত্যের পরিকল্পনা রাজপ্রাসাদ—নির্মাণে আর অন্য কোথাও দেখা যায় না।’ মোগল সম্রাটের রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে হারেম, বেগমমহল ও অন্যান্য গোপন বিভাগের যে আয়তন ছিল এবং যতটা স্থান জুড়ে ছিল, ইয়োরোপের সম্পূর্ণ রাজপ্রাসাদেরও ততটা বিস্তৃতি ছিল না। আকারে, আয়তনে, বৈচিত্র্যে, ঐশ্বর্যে ও পরিকল্পনায় দিল্লির রাজপ্রাসাদ পৃথিবীর মধ্যে স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে গণ্য ছিল। —অনুবাদক

১৯। আকবর চিতোর অবরোধ করে অধিকার করেছিলেন ১৫৬৮ সালে। এই মর্মরমূর্তি দুটির বিস্তৃত বিবরণ ও ইতিবৃত্ত কৌতূহলী পাঠকরা H.G. Keene-এর A Handbook for Visitiors to Delhi and Its Neighbourhood (৪র্থ সং) গ্রন্থের মধ্যে (Appendix ‘A’) পাবেন। মর্মরমূর্তি দুটি এখন দিল্লির মিউজিয়মে সংরক্ষিত আছে এবং হাতি দুটির একটি সাধারাণ উদ্যানে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় হাতিটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ১৮৬৩ সালে হস্তীসহ এই মর্মরমূর্তি দুটি দুর্গের মধ্যস্থ আবর্জনাস্তূপের তলা থেকে খুঁড়ে বার করা হয়।—অনুবাদক

২০। দিল্লির এই বিখ্যাত ‘কেন্যাল’ বা খালটি আলি মর্দন খাঁ কাটিয়েছিলেন। আলি মর্দন খাঁ সুদক্ষ শাসনকর্তা ছিলেন এবং দক্ষতার জন্য তিনি কাবুল ও কাশ্মীরের গভর্নর হয়েছিলেন। জলকল্যাণকর কাজে (Public Works) তাঁর মতন উদযোগী শাসক তখন খুব অল্পই ছিলেন। অনেক কীর্তি তাঁর আছে, তার মধ্যে দিল্লির এই খালটি একটি। ১৬৫৭ সালে তিনি মারা যান।—অনুবাদক

২১। মনসব, জায়গির, খিলাত, হাতি ঘোড়া ইত্যাদি উপহার, যা কিছু হোক, সম্রাটের কাছ থেকে গ্রহণ করার সময় তিনবার সেলাম করাই হল প্রথা (আইন—ই—আকবরী)

২২। মোগলযুগের অর্থনৈতিক ইতিহাস জানতে হলে এই ‘কারখানা’ গুলি সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকা একান্ত প্রয়োজন। বার্নিয়েরের মতন বিচক্ষণ পর্যটক স্বচক্ষে এই সব কারখানার কাজকর্ম—প্রণালী দেখেছিলেন এবং তাঁর বিবরণও অত্যন্ত মূল্যবান। বার্নিয়ের ছাড়া তাভার্নিয়ের (Tavemier). মানুচ্চি (Manucci) প্রমুখ পর্যটকরাও তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে এইসব কারখানার বিবরণ দিয়ে গেছেন। ‘আইন—ই—আকবরী’তেও এইসব কারখানার বিস্তৃত বিবরণ আছে। ‘আইন—ই—আকবরী’ গ্রন্থে ২৬টি প্রধান কারখানার স্বতন্ত্র বিবরণ ছাড়াও আরও ১০টি কারখানার উল্লেখ আছে—অর্থাৎ মোট ৩৬টি কারখানার কথা আছে। অন্যান্য অনেক মূলগ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে মোগলযুগের ‘কারখানা’ সম্বন্ধে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন শ্রীযদুনাথ সরকার তাঁর (‘Mughal Administration’) গ্রন্থের মধ্যে (৪র্থ সং পৃঃ ১৬৫—১৭৫)। —অনুবাদক।

২৩। কারিগররা বিভিন্ন ‘গিল্ডে’ বিভক্ত ছিল পেশানুযায়ী। ‘গিল্ডে’র সামাজিক বিধিনিষেধ কতকটা আদিম ‘ক্ল্যানে’র (Clan) মতো ছিল—অর্থাৎ আধুনিক যুগে আমরা যে ‘স্বজাতি’ বা ‘গোত্র’ বলি তার মতো। মধ্যযুগীয় সমাজের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সর্বত্র এই গিল্ড।—অনুবাদক

২৪। নানারকম শিকারের, শিকারি জন্তুর ও শিকারি পক্ষীর চমৎকার বিবরণ আছে ‘আইন—ই—আকবরী’ (ব্লকম্যান অনুদিত ও Phillot সংশোধিত দ্বিতীয় সংস্করণ) গ্রন্থের ‘শিকার’ ও ‘আমোদ—প্রমোদ’—সম্পর্কিত অধ্যায়গুলি পড়তে পারেন (পৃঃ ২৯২—২৯৬, এবং পৃঃ ৩০৮—৩১৩)।—অনুবাদক

২৫। ‘গোসলখানা’ স্নান—প্রক্ষালনাদির গৃহ হলেও, সম্রাটের গোপন সভাকক্ষও বটে। গোপনে ও নিভৃতে যেসব বিষয় রাজ—কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন, তা আমখাসের বদলে গোসলখানাতে বসেই করা হত। মোগলযুগের প্রচলিত রীতি ছিল তা।

২৬। প্রতিদিন দুবার করে সভাগৃহে দর্শন দেবার এই রীতির কথা ‘আইন—ই—আকবরী’ গ্রন্থেও উল্লিখিত আছে (আইন—ই—আকবরী—১ম খণ্ড, ১৫৭)।

২৭। এই রত্নটিই মনে হয় পর্যটক তাভার্নিয়েরকে (Tavernier) দেখানো হয়েছিল, ১৬৫৫ সালের ২ নভেম্বর তারিখে (Tavernier, Travels, Vol.1. P. 400)। তাভার্নিয়ের রত্নটির বর্ণনা করেছেন —‘of very high colour, cut in eight panels’– বলে। রত্নটির ওজন ‘ইংরেজি’ ১৫২ ক্যারেটের কিছু সামান্য বেশি বলে তিনি উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে গোয়া থেকে এটি মোগল বাদশাহের জন্য ১৮১,০০০ টাকায় কেনা হয়।

২৮। পর্যটক তাভার্নিয়েরও এই সিংহাসনের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর ভ্রমণ—কাহিনির মধ্যে (Travels, Vol1., P.381-385)। তেহরাণ ট্রেজারিতে পারস্যের শাহার দখলে এখন এই সিংহাসনটি রয়েছে। নাদির শাহ যখন ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি লুণ্ঠন করেন, তখন এই সিংহাসনটি পারস্যে নিয়ে যাওয়া হয়।

২৯। বার্নিয়ের শিল্পীর নামটি প্রকাশ করেননি কেন জানা যায় না, কিন্তু বার্নিয়েরের ভ্রমণ কাহিনির স্টুবার্ট সংস্করণে (কলিকাতা ১৮২৬) “La Grange” এই নামটি পাওয়া যায়। নামটি সত্য কি মিথ্যা তা অবশ্য বলবার উপায় নেই।

৩০। তাভার্নিয়েরের বিবরণ থেকে জানা যায়, সম্রাট ঔরঙ্গজীব একবার নাকি সাজাহানকে একজন জহুরি মনে করে, এইসব মণিরত্নের যথার্থ মূল্য জিজ্ঞাসা করেছিলেন।

৩১। প্রতি মাসের উৎসবের তৃতীয় দিনে সম্রাট একটি করে সভা আহ্বান করেন, বিশ্বের সুন্দর সুন্দর সামগ্রীর বিষয় প্রশ্নাদি করার জন্য। তখনকার বণিকরা তাতে যোগদান করতেন এবং পণ্যদ্রব্যের পসরা সাজাতেন। সম্রাটের হারেমের মহিলারা এবং অন্যান্য মহিলারাও তাতে আমন্ত্রিত হতেন। একটা মেলার মতন সেখানে কেনাবেচা চলত। সাধারণত দিনেই সম্রাট তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেন, নানা জিনিসের মূল্য ঠিক করে দিতেন। দেশের উৎপন্ন দ্রব্যাদি সম্বন্ধে তিনি প্রত্যক্ষ জ্ঞানও আহরণ করতেন। সারা সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরিক অবস্থা, দেশের কারখানাদির ত্রুটি—বিচ্যুতি ইত্যাদি সব এই মেলায় ধরা পড়ত। এই মেলামেশা ও পণ্য বিনিময়ের দিনটিকে সম্রাট বলতেন—’খুশরোজ’—অর্থাৎ ‘খুশির দিন।’ (আইন—ই—আকবরী)

৩২। গোঁড়া ধর্মান্ধ মুসলমানরা সাধারণত এই ধরনের মেলার বিরোধী ছিলেন। বাদাউনি (Badaoni) ছিলেন আকবর বাদশাহের আমলের সবচেয়ে নির্ভীক ঐতিহাসিক (আঃ ১৫১৬ খ্রীঃ)। মেলা সম্বন্ধে তাঁর উক্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন : ‘আমাদের ইসলামধর্মের নীতিকে আঘাত করার জন্যই যেন মনে হয় যে বাদশাহ এই বাৎসরিক মেলার (নববর্ষের সময়) বেগমদের, হারেমের মহিলাদের ও অন্যান্য বিবাহিত স্ত্রীলোকদের ইচ্ছানুযায়ী যোগদান করার ও পণ্যদ্রব্যাদি ক্রয়বিক্রয় করার আদেশ দিয়েছেন। এই ধরনের মেলায় বাদশাহ নিজেও প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করেন। তাছাড়া হারেমের মহিলাদের অনেক গোপনীয় ব্যাপার, বিবাহাদির কথাবার্তা, যুবক—যুবতীদের প্রেমের সূত্রপাত, সবই এই মেলাতেই ঘটে থাকে।

৩৩। কাক্র (Catrou) জাহাঙ্গীর সম্বন্ধে বলেছেন; ‘আগ্রার ফিরিঙ্গিদের সম্রাটের কাছে স্বচ্ছন্দ গতিবিধি আছে, কারও উপর কোনো বিধিনিষেধ নেই। সম্রাট এই ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে মিশে সারারাত মদ্যপান করেন। প্রধানত মুসলমান পরবের দিনই তাঁর এই রাত্রিব্যাপী মদ্যপান ও স্ফূর্তি চলতে থাকে’।

৩৪। পিলখানার প্রত্যেক হাতির একজন করে নির্বাচিত প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে, লড়াইয়ের জন্য। সম্রাটের হুকুম পেলেই তাদের লড়াইয়ের জন্য বাইরে আনা হয়। লড়াইয়ের সময় কৃতী মাহুতদের পুরস্কার দেবার থলে—ভর্তি পয়সা থাকে। প্রায় এক হাজার ‘দাম’ বা পয়সার এক—একটি থলে (‘দাম’ ও পয়সা ঠিক এক নয় অবশ্য) আনুমানিক পঁচিশ টাকার বেশি পুরস্কারের মূল্য নয়।

* দিল্লি ও আগ্রা’ সম্বন্ধে চিঠির বাকি অংশটুকুতে বার্নিয়ের জুম্মা মসজিদ, বেগম সরাই ও আগ্রার তাজমহলের বর্ণনা দিয়েছেন। মোগলযুগের শেষে ভারতবর্ষে খ্রিস্টানধর্মের ক্রমবিস্তারের কাহিনিটুকু ছাড়া, এই অংশে মূল্যবান সামাজিক ইতিহাসের উপকরণ বিশেষ কিছু নেই; এইজন্য এই অংশটুকু মধ্যে মধ্যে মর্মানুবাদ করেছি। খ্রিস্টান পাদরিদের কার্যকলাপ প্রসঙ্গে বার্নিয়েরের বক্তব্য অবশ্য যথাযথ অনুবাদ করেছি।—অনুবাদক

৩৫। জুম্মা মসজিদ ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট সাজাহান নির্মাণ করতে আরম্ভ করেন এবং ছয় বছরে নির্মাণের কাজ শেষ হয়। মসজিদ সম্বন্ধে বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ফার্গুসন বলেছেন—‘It is one of the few mosques either in India or elsewhere, that is designed to produce a pleasing effect externally’– (History of Indian and Eastern Architecture, 2nd Ed. Vol II. P. 318)

৩৬। ‘শালিমার’ উদ্যান সম্রাট সাজাহানের রাজত্বের চতুর্থ বৎসরে, ১৬৩২ সালে রচিত হয়। কাত্রু (Catrou) বলেন যে উদ্যানের পরিকল্পনাটি নাকি একজন ভেনিসিয়ান তৈরি করেছিলেন।

৩৭। প্রায় ১৬৮টি এইরকম ক্রোশ—মিনারের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ১০৫টি হল রাজপুতনায়। দিল্লির কাছাকাছি ক্রোশ—মিনার কয়েকটি মেপে দেখা গেছে যে তাদের দূরত্ব প্রায় ২ মাইল ৪ ফার্লং ১৫৮ গজের মতো।

৩৮। এই কাহিনির অন্যরকম বিবরণ দিয়েছেন কাত্রু (Catron)। তিনি লিখেছেন : জাহাঙ্গীর কোরানের বিধিনিষেধে ক্রমেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, বিশেষ করে পানাহারের ব্যাপারে। আহার্যের মধ্যে কয়েকটি জন্তুর মাংস ভক্ষণ করা কোরানে নিষিদ্ধ। এই বিধিনিষেধে ক্রমে অতিষ্ঠ হয়ে সম্রাট একদিন জিজ্ঞাসা করেন : ‘এমন কোনো ধর্ম আছে দুনিয়ায় যাতে খাদ্যদ্রব্য সম্বন্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই?’ সকলে বলেন যে খ্রিস্টান ধর্মে এরকম কোনো নিষেধ নেই। সম্রাট বলেন : ‘তাহলে আমার মনে হয় যে আমাদের সকলের খ্রিস্টান হওয়া উচিত।’ এই কথা বলে সম্রাট দরজিদের ডাকতে হুকুম দিলেন এবং বললেন যে, এখনই আমাদের যাবতীয় পোশাক—পরিচ্ছদ খ্রিস্টান পোশাকে রূপান্তরিত করা হোক। মোল্লা—মৌলবিরা সম্রাটের কথায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। ভয়ে তাঁরা দিশাহারা হয়ে কাঁপতে লাগলেন, কি করা যায় কিছুই ভেবে পেলেন না। অবশেষে তাঁরা অনেক ভেবেচিন্তে বললেন যে, কোরান—শরিফের বিধিনিষেধ সম্রাটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় সবসময়। সম্রাট কোনো অন্যায় করতে পারেন না আল্লার কাছে। অতএব সম্রাটের পানাহারের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে।

৩৯। কাত্রু বলেন যে ফাদার আতশের আসল নাম নাকি ফাদার জোসেফ দ্য কস্তা। তিনি নাকি সম্রাটের অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে রাজি হয়েছিলেন। ফাদার দ্য—কস্তা বলেছিলেন : ‘আগুন জ্বালানো হোক এবং আগুনের মধ্যে ইসলাম—ধর্মের ধারক ও বাহক মোল্লা কোরান হাতে করে ঝাঁপ দিন, আর খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিভুরূপে আমি বাইবেল হাতে করে ঝাঁপ দিই। তারপর দেখা যাক ঈশ্বর কার পক্ষে রায় দেন এবং যিশু ও মহম্মদের মধ্যে কে বড়ো বলে ঘোষণা করেন।’ ফাদারের কথা শুনে সম্রাট মোল্লার দিকে ফিরে চাইলেন। চেয়ে দেখলেন মোল্লা ভয়ে কাঁপছেন। তখন সম্রাটের করুণা হল এবং পরীক্ষার দরকার নেই বললেন। সেইদিন থেকে ফাদার জোসেফকে সম্রাট জাহাঙ্গীর ‘ফাদার আতশ’ বা ‘ফাদার আগুন’ বলে ডাকতেন।

* তাজমহলের বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন বার্নিয়ের, প্রায় চার পৃষ্ঠাব্যাপী। তার সম্পূর্ণ অনুবাদ করার কোনো প্রয়োজন নেই এখানে, কারণ ‘তাজমহলে’র রূপবর্ণনা এদেশের পাঠকরা অনেক পড়েছেন। তাই চিঠির এই অংশটুকু থেকে বার্নিয়েরের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্যের (তাজমহল সম্বন্ধে) অনুবাদ করে বাকি অংশটুকু বাদ দিয়েছি।—অনুবাদক

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *