২. গৃহযুদ্ধোত্তর ঘটনা

গৃহযুদ্ধোত্তর ঘটনা

যুদ্ধান্তের পর ঔরঙ্গজীব যখন হিন্দুস্থানের সম্রাট হলেন তখন রাজসভায় উজবেক তাতাররা ঔরঙ্গজীবের সমস্ত কার্যকলাপ আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করছিলেন। তাঁরা দেখলেন, একে—একে প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে ঔরঙ্গজীব রাজসিংহাসন দখল করলেন। তাঁরা জানতেন যে সম্রাট সাজাহান জীবিত আছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর পুত্র রাজ্যের অধীশ্বর হলেন। ঔরঙ্গজীবের প্রতি তাঁদের অতীতের বিশ্বাসঘাতকতার কথা তাঁরা ভোলেননি, তার জন্য তাঁদের আতঙ্ক ও সংকোচও ছিল যথেষ্ট। তবু উজবেক খাঁরা দুজনেই দূত পাঠালেন ঔরঙ্গজীবের দরবারে এবং তাঁদের বলে দিলেন, যথারীতি সম্রাটকে ‘মুবারক’ জানাতে (শুভেচ্ছা জানাতে)। যুদ্ধবিগ্রহের পর যদি স্বেচ্ছায় কেউ বন্ধুত্ব করতে চায় তাহলে তার কি মূল্য দেওয়া উচিত, দূরদর্শী ঔরঙ্গজীব তা বিলক্ষণ জানতেন। তিনি এও জানতেন যে উজবেক খাঁরা প্রতিশোধের ভয়ে, অথবা কোনো স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তাঁর কাছে রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছেন। তাহলেও তিনি তাঁদের যথারীতি ভদ্রভাবে অভ্যর্থনা জানাতে কুণ্ঠিত হননি। ঠিক এইসময় আমি রাজদরবারে নিজে উপস্থিত ছিলাম এবং স্বচক্ষে আমি সব দেখেছি। যা নিজে দেখেছি তার বিবরণ এখানে দিচ্ছি।

তাতার দূতের কথা

তিন—তিনবার কপাল থেকে মাটিতে হাত ঠেকিয়ে উজবেক রাষ্ট্রদূতেরা সম্রাটকে সেলাম করলেন। তারপর তাঁরা ঔরঙ্গজীবের এত কাছে এগিয়ে গেলেন যে সম্রাট স্বচ্ছন্দে তাঁদের হাত থেকে চিঠি ক—খানা নিজেই নিতে পারতেন, কিন্তু নিলেন না। একজন ওমরাহ এই পত্র উপহারের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করলেন। তিনি নিজে চিঠি গ্রহণ করলেন এবং খুললেন, তারপর সম্রাটের হাতে সেগুলি অর্পণ করলেন। সম্রাট সেই পত্র গম্ভীরভাবে পাঠ করলেন এবং পাঠান্তে আদেশ দিলেন রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যেককে ‘শিরোপা’ উপহার দিতে। অর্থাৎ পাগড়ি, জরির কারুকার্য করা মেরজাই এবং কোমরবন্ধনী তাতার দূতদের উপহার দিতে সম্রাট আদেশ দিলেন। তারপর উজবেক খাঁরা যে উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন, দূতরা তাই নিয়ে এলেন। তার মধ্যে ছিল কয়েক বাক্স উৎকৃষ্ট নীলরঙের নীলোপল বা বৈদুর্যমণি (Lapis Lazuli)। ভালো—ভালো তেজী তাতার অশ্ব কয়েকটি; উটের পিঠে বোঝাই নানারকমের ফল আপেল আঙুর ইত্যাদি। বোখারা সমরকন্দ থেকেই প্রধানত এইসব ফল দিল্লির দরবারে আমদানি করা হত। এছাড়া কয়েক জোড়া শুকনো বোখারাই ফলও ছিল তার মধ্যে।

উজবেক খাঁদের উপঢৌকনের প্রাচুর্য দেখে ঔরঙ্গজীব প্রীত হলেন এবং উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রত্যেকটি জিনিসের প্রশংসা করলেন। এমন ফল, এমন ঘোড়া, এমন উট নাকি আর কোথাও দেখা যায় না। তারপর সমরকন্দের মাদ্রাসা সম্বন্ধে কয়েকটি প্রশ্ন করে তিনি তাঁদের বিদায় দিলেন।

অভ্যর্থনাদির পর তাতার দূতরা ফিরে এলেন বেশ খুশি হয়ে। ভারতীয় রীতিতে মাথা হেঁট করে ‘সেলাম’ করার জন্য তাঁরা বিশেষ বিরক্ত হননি। ‘সেলামের’ পদ্ধতিটা বাস্তবিকই বিসদৃশ, কোথায় যেন একটা গোলামির চিহ্ন তার মধ্যে রয়েছে। সম্রাট যে নিজে হাতে করে তাঁদের কাছ থেকে পত্র নেননি, তাতেও তাঁরা তেমন ক্ষুব্ধ হননি। তাঁদের যদি মাটিতে মুখ দিয়ে সাষ্টাঙ্গে অভিবাদন করতে হত, অথবা তার চেয়েও লজ্জাকর কোনো উপায়ে, তাহলেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁরা তা বিনা দ্বিধায় করতেন। একথা ঠিক যে তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এইভাবে অভিবাদন জানাতে বলা হয়নি, অথবা ওমরাহ মারফত পত্রও গ্রহণ করা হয়নি। এই মর্যাদা একমাত্র পারস্যের রাষ্ট্রদূত মোগলদরবারে পেয়ে থাকেন, তাও সবসময় পান না।

উজবেক রাষ্ট্রদূতরা প্রায় চার মাস দিল্লিতে ছিলেন। দীর্ঘদিন থাকার জন্য তাঁদের স্বাস্থ্যহানি হয়। তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গরা অনেকে রোগে ভুগে মারাও যান। তাঁরা হিন্দুস্থানের অত্যধিক গরম সহ্য করতে না পেরে মারা গিয়েছিলেন কি—না তা অবশ্য সঠিক বলা যায় না। নিজেদের নোঙরা জীবনযাত্রার জন্য, অথবা হয়ত অত্যধিক ভোজনপটু যতটা পরিমাণ খাদ্য খাওয়া উচিত তার কম খাওয়ার জন্য, তাঁদের মৃত্যু হয়েছিল। এই উজবেক তাতারদের মতন সংকীর্ণচিত্ত ও অপরিচ্ছন্ন নোঙরা জাত আমি আর দেখিনি। দূতাবাসের কর্মীরা সম্রাট ঔরঙ্গজীবের কাছ থেকে যা হাতখরচ পেতেন, তা খরচ না করে কৃপণের মতন তাঁরা জমাতেন এবং দীনহীনের মতন জঘন্যভাবে দিন কাটাতেন। তা সত্ত্বেও এ—হেন জীবদের বিদায় দেওয়া হল মহাসমারোহে। সম্রাট প্রত্যেককে মূল্যবান শিরোপা দিলেন দুটি করে এবং নগদ আট হাজার করে টাকা। এছাড়া তিনি খাঁ—দের জন্য উপঢৌকনও পাঠালেন—সুন্দর সুন্দর শিরোপা, সোনারূপো ও জরির—কাজ—করা নানারকমের কাপড়, কয়েকখানা কার্পেট, এবং দুই খাঁর জন্য মনিরত্নখচিত দুখানি কৃপাণ।

আমার একজন উজবেক বন্ধু ছিলেন। তিনি আমাকে এই রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন সম্রাটের চিকিৎসক বলে। আমিও তিনবার দূতাবাসে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করি। আমার ইচ্ছা ছিল, তাঁদের কাছ থেকে তাঁদের দেশ সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য বিষয় কিছু সংগ্রহ করে নেব। কিন্তু দুঃখের কথা কি বলব! তাঁরা রাষ্ট্রদূত হলেও নিজের দেশ সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। এমনকি তাঁরা নিজের দেশের ভৌগোলিক সীমানাটুকুর সম্বন্ধেও অজ্ঞ। স্বদেশ সম্বন্ধে এরকম নিরেট অজ্ঞতা সচরাচর দেখা যায় না। তাতাররা যে একসময় চিন জয় করেছিল, সে সম্বন্ধেও তাঁরা কিছুই জানেন না। মোটকথা তাঁদের সঙ্গে আলাপ—আলোচনা করে আমি বিশেষ নতুন কিছু জ্ঞান সঞ্চয় করতে পারিনি। একবার আমার প্রবল বাসনা হল, তাঁদের সঙ্গে বসে খানা খাবার। খানাটেবিলে কাউকে বসতে দিতে তাঁদের অবশ্য বিশেষ আপত্তি নেই দেখলাম। নিমন্ত্রিত হয়ে একদিন খানা খেতে বসলাম। খাব কি? খাদ্য বলতে বিশেষ কিছু নেই, একমাত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘোড়ার মাংস ছাড়া। তাহলেও খেতে যখন বসেছি, তখন খেতে কিছু হবেই। না খেলে, আমার ব্যবহারে হয়ত তাঁরা ক্ষুণ্ণ হবেন। তাঁদের কাছে যা পরম সুস্বাদু খাদ্য, আমার কাছে তা যে অখাদ্য তা প্রকাশ করবার উপায় নেই। খাবার সময় আমি আর একটি কথাও বললাম না। দেখলাম, গোগ্রাসে তাঁরা পোলাও গিলতে লাগলেন। চামচ দিয়ে খেতে তাঁরা জানেন না। বেশ পেট ভরে খেয়েদেয়ে তাঁরা খোশমেজাজে দু—চারটে কথা আলাপ করতে লাগলেন। বুঝলাম, এতক্ষণে আলাপ করবার মতন তাঁদের মেজাজ হয়েছে। প্রথমেই তাঁরা আমাকে বোঝাতে চাইছেন যে, উজবেকদের মতন বলিষ্ঠ জাত আর নেই এবং তীরধনুকের ব্যবহারে তাঁদের কাছে কেউ দাঁড়াতে পারে না। কথাটা বলা মাত্রই তীরধনুক আনার হুকুম দেওয়া হল। হিন্দুস্থানের তীরধনুকের চেয়ে আকারে অনেক বড়ো। ধনুকে তীর চড়িয়ে একজন বললেন যে, এই তীর দিয়ে তাঁরা যে—কোনো ষাঁড় বা ঘোড়াকে এফোঁড়—ওফোঁড় করে দিতে পারেন। তারপর আরম্ভ হল উজবেক মেয়েদের বীরত্বের সব চমকপ্রদ কাহিনি। সে—কাহিনি আর শেষ হয় না। তার মধ্যে একটি কাহিনি শুনে আমিও চমৎকৃত হয়েছিলাম। উজবেকী ঢঙে তার বর্ণনা করব কি?

কাহিনিটি এই : ঔরঙ্গজীব একবার উজবেকদের দেশ জয় করতে গিয়েছিলেন। তার প্রায় পঁচিশ—ত্রিশজন অশ্বারোহী সৈন্য উজবেকদের একটি গ্রামে হানা দিয়ে লুঠতরাজ করছিল। সেই সময় এক উজবেক বৃদ্ধা রমণী এসে সৈন্যদের বলেন : ‘বাছারা, আমার কথা শোন। এইভাবে লুটতরাজ করো না। আমার মেয়েটি এখন বাড়ি নেই, কোথায় বেরিয়েছে তাই, তা না হলে টের পেতে। যাই হোক, কন্যার আমার ঘরে ফেরার সময় হয়ে গেছে, সময় থাকতে সরে পড়।’ বৃদ্ধার কথায় কেউ কর্ণপাত করল না, করবার কথাও নয়। তারা নিজেদের কাজ হাসিল করে, অশ্বপৃষ্ঠে লুঠের মাল বোঝাই করে নিয়ে চলতে থাকল। গ্রামের কিছু লোকজনও বন্দি করে নিয়ে চলল দাসদাসী হিসেবে, তার মধ্যে ওই বৃদ্ধাও একজন। কিছুদূরে যেতেই পথে বৃদ্ধার সেই গৃহাভিমুখী কন্যাকে দেখা গেল। বৃদ্ধা তো দেখেই হাঁউমাউ করে কেঁদে ফেললে। কন্যাকে কিন্তু তখনও স্পষ্ট দেখা বা চেনা যাচ্ছিল না। দুরন্তবেগে ধাবমান অশ্বের খুরোৎক্ষিপ্ত ধূলির ধূম্রজাল ভেদ করে ঘোড়সওয়ার উজবেক কন্যার মূর্তি দূর থেকে আবছা ভেসে উঠল বৃদ্ধা মায়ের চোখের সামনে। ক্রমে সেই মূর্তি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকল। দেখা গেল, অশ্বপৃষ্ঠে ধনুর্বানধারী উজবেক কন্যার দৃপ্ত মূর্তি, নির্ভীক যোদ্ধার মতন তেজোদ্দীপ্ত। দূর থেকে তখনও সে বলছে, কোনো প্রতিশোধ না নিয়ে সে শত্রুদের মুক্তি দিতে রাজি আছে, যদি সমস্ত লুঠের সম্পত্তি ও গ্রামের বন্দি লোকজনদের ফিরিয়ে দিয়ে তারা নির্বিবাদে নিজেদের দেশে ফিরে যায়। মোগল সৈন্যরা উজবেক যুবতীর কথায় কর্ণপাত করল না, বীরাঙ্গনার বীরত্বে তারা বিশ্বাসী নয়। মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুদ্বেগে তিন—চারটি তীর এসে সৈন্যদের গায়ে বিঁধল এবং সেই তিন—চারজনেরই তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হল। মোগল সৈন্যদের নিক্ষিপ্ত তীর বিচিত্র ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে উজবেক কন্যা আবার তীর ছাড়ল এবং ঠিক সেই এক—একটি তীরে একজন করে মারা গেল। এইভাবে সেনাদলের প্রায় অর্ধেক ধনুর্বাণে নির্মূল করে, উজবেক কন্যা তলোয়ার হাতে তাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং বাকি অর্ধেকের শিরশ্ছেদন করল।

তাতার রাষ্ট্রদূতরা দিল্লিতে যখন অবস্থান করছিলেন তখনই ঔরঙ্গজীবের কঠিন অসুখ হয়। জ্বরের প্রাবল্যে তিনি প্রায়ই ভুল বকতেন এবং মধ্যে মধ্যে তাঁর বাকরোধ হয়ে যেত। চিকিৎসকরা হতাশ হলেন এবং বাইরে রটে গেল যে তিনি মারা গেছেন। তাঁর অসুখের সংবাদটা অবশ্য নিজের কোনো গোপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য রৌশনআরা বেগম গোপন করে রেখেছিলেন। এই গোপনতাই হল গুজবের কারণ। শোনা গেল, রাজা যশোবন্ত সিংহ নাকি সম্রাট সাজাহানকে কারামুক্ত করবার জন্য সৈন্যসামন্ত নিয়ে যাত্রা করেছেন। মহবৎ খাঁ, যিনি নির্বিবাদে ঔরঙ্গজীবের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন, তিনিও শেষ পর্যন্ত কাবুলে সুবাদারি থেকে পদত্যাগ করে, লাহোরের মধ্য দিয়ে আগ্রার দিকে অগ্রসর হয়েছেন সম্রাট সাজাহানকে মুক্ত ও পুনরাভিষিক্ত করার জন্য। বন্দি সাজাহানের প্রহরী খোজা আতবর খাঁও সম্রাটের কারাগারের দ্বার উন্মুক্ত করার জন্য অস্থির।

এদিকে ঔরঙ্গজীবের জ্যেষ্ঠপুত্র সুলতান মুয়াজ্জম পূর্ণোদ্যমে ওমরাহদের সঙ্গে সিংহাসন দখলের সলাপরামর্শ করতে লাগলেন। ছদ্মবেশে তিনি গভীর রাত্রিতে রাজা যশোবন্ত সিংহের সঙ্গে দেখা করে, তাঁকে তাঁর পক্ষে যোগ দেবার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানালেন। অন্যদিকে রৌশন—আরা বেগম কয়েকজন ওমরাহ ও ফিদাই খাঁর (ঔরঙ্গজীবের বৈমাত্রেয় ভাই) সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঔরঙ্গজীবের তৃতীয় পুত্র সুলতান আকবরের (তখন সাত—আট বছরের ছেলে) পক্ষে ষড়যন্ত্রে যোগ দিলেন।

দুই দলেরই অভিপ্রায় হল সম্রাট সাজাহানকে মুক্তি দেওয়া। অন্তত বাইরে জনসাধারণকে তাই তাঁরা বোঝালেন। কিন্তু একমাত্র বাইরে মুখরক্ষা করা ছাড়া এই অভিপ্রায়ের মধ্যে অন্য কোনো সদুদ্দেশ্য ছিল না। আমি অন্তত আদৌ তাঁদের কোনো সদুদ্দেশ্যে বিশ্বাস করি না। আমি জোর করেই বলতে পারি যে রাজদরবারের আমির ওমরাহদের মধ্যে তখন অন্তত এমন একজনও ছিলেন না যিনি সম্রাট সাজাহানের মুক্তি ও পুনরভিষেক মনে—প্রাণে কামনা করতেন। একজন যশোবন্ত সিংহ ও মহবৎ খাঁ প্রকাশ্যে বৃদ্ধ সম্রাটের কোনো বিরোধিতা করেননি। তাছাড়া ওমরাহদের মধ্যে কেউ বৃদ্ধ সম্রাটের প্রতি ঔরঙ্গজীবের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিবাদ পর্যন্ত করেননি। তাঁদের ধর্মই তা নয়, ন্যায়বিচার বা সাধুতা সততার সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্কই নেই। যিনি যখন সিংহাসন দখল করেন, তাঁরা তখন তাঁর খোশামোদ করে আমিরত্ব বজায় রাখেন। ওমরাহরা খুব ভালোভাবেই জানতেন যে বৃদ্ধ সাজাহানকে কারামুক্ত করার অর্থ হল পিঞ্জরাবদ্ধ ক্রুদ্ধ সিংহকে মুক্ত করা। সকলেই বৃদ্ধ সম্রাটের ক্ষিপ্ত প্রতিহিংসার ভয় করতেন, খোজা আতবর খাঁ পর্যন্ত, কারণ বন্দি সাজাহানের প্রতি অকথ্য রূঢ় ব্যবহার সম্পর্কে খোজা খুবই সচেতন ছিলেন।

অসুস্থতার মধ্যেও ঔরঙ্গজীব স্থিরচিত্তে রাজকার্য পরিচালনা করতেন এবং বন্দি বৃদ্ধ পিতার দিকে নজর রাখতেন। যদি তাঁর মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে তাহলে বৃদ্ধ সাজাহানকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তিনি পুত্র সুলতান মুয়াজ্জমকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওদিকে আবার খোজা আতবর খাঁর কাছে প্রায়ই চিঠি লিখতেন, বৃদ্ধ সাজাহানের ওপর কড়া নজর রাখার জন্য। বাইরের গুজব বন্ধ করার জন্য অসুস্থ অবস্থায় তিনি একাধিকবার রাজদরবারে ওমরাহদের সামনে দর্শন দিয়েছেন। একবার অসুস্থ অবস্থায় মুর্ছা যান এবং মুর্ছার ঘোর সম্পূর্ণ কেটে যাবার আগে যশোবন্ত সিংহ ও কয়েকজন হোমরাচোমরা ওমরাহকে ডেকে পাঠান, তিনি জীবিত কি মৃত স্বচক্ষে দেখে যাবার জন্য। মূর্ছার পর থেকেই তিনি ক্রমে সুস্থ হতে থাকেন।

একটু সুস্থ হয়েই ঔরঙ্গজীব চেষ্টা করেন, দারার কন্যার সঙ্গে তাঁর পুত্র সুলতান আকবরের বিবাহ দেবার জন্য। কিন্তু চেষ্টা তাঁর ব্যর্থ হল। সাজাহান ও তাঁর কন্যা বেগমসাহেবার ওপরেই দারার কন্যার দায়িত্ব ছিল। তাঁরা কিছুতেই ঔরঙ্গজীবের প্রস্তাবে রাজি হলেন না। রাজকুমারীর মনে মনে ভয় হল এবং তিনি স্থির করলেন যে যদি তাঁকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে ঔরঙ্গজীব এই বিবাহ দেন, তাহলে আত্মহত্যা করা ছাড়া তাঁর উপায় থাকবে না। পিতৃহন্তার পুত্রকে তিনি প্রাণ থাকতে বিবাহ করবেন না।

সাজাহানের কাছে ঔরঙ্গজীব কিছু মণিরত্নও চেয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, বিখ্যাত ময়ূসিংহাসনটি আরও বেশি ঐশ্বর্যমণ্ডিত করা। বন্দি সাজাহান ক্রুদ্ধ হয়ে ঔরঙ্গজীবের দাবি প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাঁকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দিলেন যে তিনি যেন তাঁর রাজকার্য নিয়েই থাকেন, সিংহাসন নিয়ে মাথা না ঘামান। ধনদৌলত মণিরত্নের কোনো কথা সাজাহান আর শুনতে চান না, ওসবের প্রতি তাঁর আর কোনো আসক্তি বা আগ্রহ নেই। ধনরত্ন নিয়ে যদি বেশি কাড়াকাড়ি চলতে থাকে, তাহলে তিনি যে—কোনো মুহূর্তে লোহার হাতুড়ির আঘাতে মণিরত্নের সমস্ত সম্ভার চূর্ণ করে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে হুকুম দেবেন।

ডাচ দূতের কাহিনি

এই হল্যান্ডের পালা। ডাচদেরও দেরি হল না বাদশাহ ঔরঙ্গজীবকে ‘মোবারক’ জানাতে। দেরি হবার কথাও নয়। তাঁরাও স্থির করলেন যে, মোগল দরবারে একজন দূত পাঠাবেন এবং সুরাটের বাণিজ্য—কুঠির কর্মকর্তা মঁসিয়ে আদ্রিকানকে১০ দূত মনোনয়ন করলেন। আদ্রিকান বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। দরবারে দূত হয়ে গিয়ে তিনি তাঁর নিজের দেশের জন্য অনেক কাজ করে এসেছিলেন। যদিও ঔরঙ্গজীব অত্যন্ত অহঙ্কারী ও দুর্দমনীয় প্রকৃতির সম্রাট, গোঁড়া মুসলমান হিসেবেও অত্যন্ত সচেতন এবং খ্রিস্টধর্মীদের প্রতি সাধারণত বিরূপ মনোভাবাপন্ন, তাহলেও এক্ষেত্রে তিনি বিশেষ শিষ্টতা ও নম্রতার পরিচয় দিয়েছিলেন। রাজদরবারে তিনি যেভাবে ডাচ রাষ্ট্রদূতকে গ্রহণ করেছিলেন তা থেকেই তাঁর এই মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। মঁসিয়ে আদ্রিকান যখন ভারতীয় পদ্ধতিতে ‘সেলাম’ জানিয়ে দরবারগৃহে প্রবেশ করেন, তখন ঔরঙ্গজীব খুশি হয়ে তাঁকে বলেন সেলামের পরিবর্তে ইউরোপীয় পদ্ধতিতে ‘স্যালুট’ জানাতে। সম্রাটের কথায় আদ্রিকান সাহেবী কায়দায় জাতীয় ভঙ্গিতে স্যালুট করেন। সম্রাট অবশ্য ওমরাহ মারফত তাঁর পরিচয়পত্র গ্রহণ করলেন, নিজে হাতে নিলেন না। এটা তিনি কোনো অসম্মান দেখানোর জন্য করেননি, এইটাই হল বাদশাহী রীতি। উজবেক রাষ্ট্রদূতদের কাছ থেকেও এইভাবে তিনি পরিচয়পত্র গ্রহণ করেছিলেন।

প্রাথমিক অনুষ্ঠানটি শেষ হবার পর ঔরঙ্গজীব ডাচ রাষ্ট্রদূতকে তাঁর উপঢৌকন দিতে আদেশ করলেন। এটাও একটা রাজদরবারের রীতি। প্রথমে সম্রাট নিজে একটি শিরোপা উপহার দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করলেন। ডাচ দূত যেসব উপহার দিলেন তার মধ্যে লাল ও সবুজ রঙের কাপড়, বড়ো বড়ো ভালো আয়না, চিনা ও জাপানি—কাজ করা নানাবিধ জিনিস১১—তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল একটি পালকি ও একটি তখৎ—রওয়ান।১২ শিল্পকলার নিদর্শন হিসেবে দুটি জিনিসই চমৎকার।

বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের যতদিন সম্ভব বাদশাহ আটকে রাখতে চান। বোধ হয় তাঁর ধারণা এই যে বিদেশি দূতরা তাঁর রাজদরবারে উপস্থিত থাকলে বাইরের সাধারণ লোকের কাছে তাঁর সম্মান ও প্রতিপত্তি বাড়বে। তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে, তাঁর প্রভাব—প্রতিপত্তির জন্য বিদেশি সম্রাটরা তাঁর দরবারে সাগ্রহে প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। তা না হলে আর এমন কোনো কারণ নেই যার জন্য তিনি বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের এতদিন ধরে রাজধানীতে আটকে রাখতে পারেন। লোক—দেখানোই তাঁর উদ্দেশ্য। আমির ওমরাহদের সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা নানাবেশে রাজদরবারে শোভাবর্ধন করবেন, এইটাই হল বাদশাহের মনোবাসনা। মঁসিয়ে আদ্রিকানকে সেইজন্য তিনি সহজে ছাড়লেন না। আদ্রিকানের সেক্রেটারি মারা গেলেন, অন্যান্য কয়েকজন দূতাবাসের কর্মচারীরও মৃত্যু হল। তখন ঔরঙ্গজীব ডাচ রাষ্ট্রদূত আদ্রিকানকে রাজধানী ত্যাগের অনুমতি দিলেন। বিদায়কালে তিনি আর—একটি শিরোপা উপহার দিলেন তাঁকে এবং বাতাভিয়ার১৩ গবর্নরের জন্য একটি আলাদা শিরোপা দিলেন, অত্যন্ত মূল্যবান। তার সঙ্গে একটি ভোজালিও দিলেন, মণিমুক্তাখচিত স্বতন্ত্র একটি বিনয়পত্রে অভিনন্দন জানাতেও ভুললেন না।

ডাচ রাষ্ট্রদূতের আসল উদ্দেশ্য ছিল মোগল বাদশাহের নেকনজরে আসা এবং হল্যান্ড যে একটা উন্নত দেশ, ডাচরা যে একটা বিরাট ব্যবসায়ী জাত, এই উচ্চধারণা তাঁর মনে জাগানো। আদ্রিকান জানতেন যে যদি কোনোরকমে তিনি এইভাবে মোগল সম্রাটকে অভিভূত করতে পারেন, তাহলে হিন্দুস্থানে তাঁরা ব্যবসাবাণিজ্যের সুযোগ করে নিতে পারবেন। তাঁরা যেসব জায়গায় এর মধ্যে বাণিজ্যকুঠি প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেখানকার সুবাদারদের উৎপীড়ন ও বাধাবিপত্তি থেকেও তাঁরা মুক্তি পাবেন। শেষ পর্যন্ত ঠিক এই মর্মের একটি ফরমান তিনি ঔরঙ্গজীবের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন। বাদশাহকে তিনি বুঝিয়েছিলেন যে তাঁদের দেশের সঙ্গে হিন্দুস্থানের বাণিজ্যিক লেনদেন থাকলে হিন্দুস্থানেরই ঐশ্বর্য বাড়বে। কিন্তু হিন্দুস্থানের কতটা ঐশ্বর্য তাঁরা পাকেচক্রে ব্যবসায়ের নামে লুণ্ঠন করতে পারবেন, সেকথা আর জানানো দরকার বোধ করেননি।

ঔরঙ্গজীবের চরিত্রের অন্যদিক

ঠিক এইসময় একজন বিখ্যাত ওমরাহ বিশেষ ব্যস্ত হয়ে এসে একদিন সম্রাটকে বলেন যে সর্বক্ষণ তিনি যেরকম রাজকার্য নিয়ে চিন্তা করেন, তাতে তাঁর স্বাস্থ্যহানি হবার সম্ভাবনা আছে, এমনকি তাঁর মানসিক সজীবতা পর্যন্ত এতে নষ্ট হতে পারে। শুভাকাঙ্ক্ষী পরামর্শদাতার কথাগুলো সম্রাটের কানে পৌঁছল বলে মনে হল না। তিনি অন্য আর—একজন ওমরাহের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে যা বললেন তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর সেই নাতিদীর্ঘ বক্তৃতাটি আমি সেই ওমরাহের এক চিকিৎসক পুত্রের কাছ থেকে শুনেছি। পুত্রটি আমার বিশেষ বন্ধু। সম্রাট ঔরঙ্গজীব বলেছিলেন :

আপনারা সকলেই সুধীজন, বিদ্বান ও বুদ্ধিমান। আপনারা জানেন সংকটের সময় সম্রাটের কর্তব্য কি। জাতির বা দেশের সংকটকালে সম্রাটের একমাত্র কর্তব্য হল তাঁর নিজের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন করে, প্রয়োজন হলে নিজে তলোয়ার হাতে নিয়ে, প্রজাদের জন্য প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়া। রাজার এই কর্তব্য সম্বন্ধে নিশ্চয়ই আপনাদের মধ্যে মতভেদ নেই। কিন্তু তবু আমার এই শুভাকাঙ্ক্ষী ওমরাহটি আমাকে বোঝাতে চান যে প্রজাসাধারণের মঙ্গলের জন্য আমার নাকি মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তার জন্য একটি বিনিদ্র রাত্রিও যাপন করা আমার উচিত নয়, একদিনের জন্যও আমার আমোদ—প্রমোদ বর্জন করা ঠিক নয়। তাঁর মতে আমার উচিত সবসময় নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখা এবং আমার ভোগবিলাস সম্বন্ধে সচেতন হওয়া। হয়ত তিনি চান যে—কোনো একজন উজীবের ওপর সমস্ত রাজ্যের ভার দিয়ে আমি নিষ্কৃতি পাই। তিনি জানেন না বোধ হয় যে রাজার ছেলে হয়ে যখন জন্মেছি এবং রাজসিংহাসনে বসেছি, তখন ঈশ্বর আমাকে নিজের জন্য বাঁচার ও চিন্তা করার সুযোগ দেননি, আমার প্রজাদের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্যও চিন্তা করার আদেশ দিয়েছেন। যেখানে প্রজাদের সুখ নেই, সেখানে আমারও সুখ নেই। প্রজাদের সুখই আমার সুখ। প্রজাদের সুখ ও শান্তিই আমার সর্বক্ষণ চিন্তার বিষয়। একমাত্র ন্যায়বিচার, রাজকীয় কর্তৃত্ব ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য সাময়িকভাবে এচিন্তা বিসর্জন দেওয়া যায়, তাছাড়া অন্য কোনো সময় নয়। নিষ্ক্রিয়তা বা অন্যের ওপর নিজের দায়িত্ব চাপানোর ফলাফল যে কি রকম ভয়াবহ হতে পারে, সে সম্বন্ধে আমার হিতাকাঙ্ক্ষী পরামর্শদাতার বোধ হয় কোনো ধারণা নেই। এজন্যই তো মহাকবি সাদী বলেছেন : ‘রাজা হয়ে জন্মো না, রাজা হয়ো না! যদি রাজা হও, তাহলে প্রতিজ্ঞা করো যে তোমার রাজ্য তুমি নিজেই শাসন করবে।’ আমার ওই শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুটিকে গিয়ে বলুন যে তিনি যদি বাস্তবিকই আমার প্রিয়পাত্র হতে চান, তাহলে এরকম সদুপদেশ আমাকে দেওয়ার বা অকারণে আমার মোসাহেবি করার তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতে আর যেন কোনোদিন তিনি এই ধরনের অযাচিত উপদেশ দিতে না আসেন। সুখ—স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগবিলাসের জন্য মানুষের সহজ—প্রবৃত্তি এমনিতেই যথেষ্ট সজাগ, তাকে জাগাবার জন্য কোনো উপদেশের প্রয়োজন হয় না। ঘরে আমাদের স্ত্রীরাই সেকাজ অনেকটা করতে পারে, রাষ্ট্রীয় পরামর্শদাতার দরকার হয় না তার জন্য।

খোজার বিচিত্র প্রেমকাহিনি

এই সময় আরও একটি বেশ মজার ঘটনা ঘটে। বাদশাহের বেগমমহলে তাই নিয়ে রীতিমতো সাড়া পড়ে যায় এবং খোজারা কখনো প্রেমে পড়তে পারে না বলে আমার মনে যে বদ্ধমূল ধারণা ছিল, তাও বদলে যায়। ঘটনাটি বেশ মজার ঘটনা এবং সত্য ঘটনা। দিদার খাঁ নামে বাদশাহের হারেমের একজন খোজা ছিল, সে একটি আলাদা বাড়ি তৈরি করেছিল স্ফূর্তি করার জন্য এবং সেখানেই সে মধ্যে মধ্যে ঘুমুত। হঠাৎ সে এক হিন্দু কেরানির১৪ সুন্দরী ভগিনীর প্রেমে পড়ে। কিছুদিন দুজনের মধ্যে একটা গোপন সম্পর্কের কথা নিয়ে কানাঘুষা চলতে থাকে। কিন্তু কারও মনে ব্যাপারটা সন্দেহের গভীর রেখাপাত করতে পারেনি। যতই যাই হোক, খোজা তো! কি আর এমন ঘটতে পারে। কোনো মেয়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে খোজা আবার প্রেমে পড়বে কি! আর যদিও বা দৈবচক্রে পড়ে, তাহলেও এমন কিছু তাদের মধ্যে ঘটতে পারে না, যা নিয়ে কানাঘুষা চলতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খোজার প্রেম কবির প্রেমকেও ছাড়িয়ে গেল। প্রেমের জল অনেকদূর পর্যন্ত গড়াল। দিদার খাঁ ও কেরানি—ভগিনীর সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকল। প্রতিবেশিরা সকলে হিন্দু কেরানিকে সাবধান করে দিল। অনেকে কটু কথায় অপমান করতেও ছাড়ল না। কেরানি ভদ্রলোক তাদের কথায় বিচলিত ও অপমানিত হয়ে একদিন তাঁর ভগিনী ও খোজাটিকে ডেকে পরিষ্কার বলে দিলেন যে তাদের সম্বন্ধে যে—সব কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে তা যদি সত্য হয়, তাহলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। সত্য প্রমাণ হতে খুব বেশি দেরি হল না। একদিন দেখা গেল, এক ঘরে একই শয্যায় সেই ভগিনী খোজাসহ শয়ন করে আছে। হিন্দু ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে দিদার খাঁ ও তাঁর ভগিনীকে হত্যা করলেন। হারেম ও বেগম মহলে তুমুল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। হারেমের অন্যান্য খোজারা ষড়যন্ত্র করল, কেরানিকে তারা হত্যা করবে! কিন্তু ষড়যন্ত্রের কথা সম্রাট ঔরঙ্গজীবের কানে পৌঁছতেই তিনি ক্রুদ্ধ হলেন এবং চক্রান্তকারীদের শায়েস্তা করলেন। অবশ্য সম্রাট সেই হিন্দু কেরানি ভদ্রলোককে বাধ্য করলেন ইসলামধর্মে দীক্ষা নিতে। খোজা দিদার খাঁর অপূর্ব প্রেমকাহিনির এইভাবে শেষ হল।

রাজকুমারীর প্রেম

খোজার প্রেম শেষ হতে না হতে রাজকন্যার প্রেম আরম্ভ হল। ঠিক যে সময় দিদার খাঁর প্রেমের ব্যাপার ঘটে, সেই সময় রৌশন—আরা বেগম অন্তঃপুরে দুজন ভদ্রলোককে (?) প্রবেশের অধিকার দিয়েছেন বলে গুজব রটে। সম্রাট ঔরঙ্গজীব আদ্যোপ্রান্ত কাহিনি শুনে ক্রুদ্ধ হন। তাহলেও ঔরঙ্গজীব তাঁর ভগিনীর সঙ্গে শুধু সন্দেহের বশে কোনো দুর্ব্যবহার করেননি। সম্রাট সাজাহান যেভাবে তাঁর কন্যার প্রেমিককে ফুটন্ত গরম জলের টবে দগ্ধ করে হত্যা করেছিলেন, ঔরঙ্গজীব তা করেননি। ঘটনাটি আমি এক বৃদ্ধার মুখ থেকে যা শুনেছিলাম তাই এখানে বর্ণনা করছি। বৃদ্ধার অন্তঃপুরে অবাধগতি ছিল। দুজন যুবকের সঙ্গে রৌশন—আরার আলাপ—পরিচয় হয়েছিল এবং তার মধ্যে একজনের সঙ্গে আলাপ বোধ হয় প্রেমালাপ পর্যন্ত গড়িয়েছিল। রৌশন—আরা তাকে অন্তঃপুরে লুকিয়ে রেখেছিলেন শোনা যায়। একদিন তিনি সেই যুবকের ওপর ভার দিলেন, অন্তঃপুর থেকে তাঁর পরিচারিকাদের বাইরে পাঠিয়ে দিতে। রাত্রির অন্ধকারে যুবকটি যখন তাদের নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন প্রহরীর চোখে পড়ার জন্যই হোক বা আতঙ্কেই হোক, পরিচারিকারা পালিয়ে যায়। বিস্তীর্ণ উদ্যানের মধ্যে গভীর রাতে যুবকটি একাকী দিশেহারা হয়ে ঘুরতে থাকে। এমন সময় কোনো প্রহরী তাকে পাকড়াও করে আটকে রাখে এবং পরে সম্রাটের কাছে ধরে নিয়ে যায়। সম্রাট ঔরঙ্গজীব হঠাৎ উত্তেজিত না হয়ে তাকে প্রশ্ন করতে থাকেন। প্রশ্নের উত্তর থেকে তিনি শুধু এইটুকু জানতে পারেন যে রাত্রে প্রাচীর টপকে সে অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছিল। যুবকটির অপরাধের কোনো সঠিক প্রমাণ তিনি পেলেন না তার উত্তর থেকে। সুতরাং কোনো কঠোর দণ্ড না দিয়ে তিনি আদেশ দিলেন, যেভাবে যুবকটি এসেছিল ঠিক সেইভাবে প্রাচীর টপকে যেন চলে যায়। বাঁশের চেয়ে চিরকালই কঞ্চি দড়। সম্রাটের আদেশে ও বিচারে খোজাদের তুষ্টি হল না। যুবকটি যখন প্রাচীরের ওপর উঠল তখন খোজারা তাকে ওপর থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচের প্রাকারের মধ্যে ফেলে দিল। তারপর তার কি হল—না হল জানা যায়নি।

দ্বিতীয় প্রেমিকের বিচারও ঠিক এইভাবে করা হল। একদিন তাকেও গভীর রাতে বাগানের মধ্যে উদভ্রান্তের মতন ঘুরতে দেখা গেল। খোজারা তো তাকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে গেল বাদশাহের কাছে। সম্রাট তাকেও প্রশ্ন করে শুনলেন যে সে সামনের ফটক দিয়ে প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। সম্রাট আদেশ দিলেন তাকে সোজা ফটক দিয়ে প্রাসাদের বাইরে চলে যেতে। নিশ্চয় অন্যেরা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল। অপরাধীকে সোজা ফটক দিয়ে প্রাসাদের বাইরে চলে যেতে বলা আশ্চর্য ব্যাপার নয় কি? ঔরঙ্গজীব খোজাদের কঠিন দণ্ড দেবেন স্থির করলেন। কারণ তাদের পাহারার গুণে যদি সোজা ফটক দিয়েও বাইরের লোক অন্তঃপুরের প্রবেশ করতে পারে তাহলে বেশিদিন আর অন্তঃপুরে সম্মানরক্ষা করা সম্ভব নয়। শুধু সম্মানরক্ষা নয়, সম্রাটের আত্মরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্যও খোজাদের এই উদাসীন পাহারায় চলবে না। প্রেমিকের উত্তর শুনে সম্রাট তাকে না দণ্ড দিয়ে খোজাদের কঠোর দণ্ড দিলেন। এই ঘটনার কয়েকমাস পরে পাঁচজন রাষ্ট্রদূত দিল্লিতে এসে পৌঁছলেন, প্রায় একই সময়। প্রথম দূত এলেন মক্কার শরিফের কাছ থেকে। তিনি যা উপঢৌকন নিয়ে এলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, কয়েকটি আরবি ঘোড়া। একটি খেজুর পাতার ব্রাশও তিনি সঙ্গে এনেছিলেন। এই ব্রাশ দিয়ে মক্কার বিখ্যাত কাবা—মসজিদের প্রাঙ্গণ ঝাড়া হয়, সেইজন্যই এই উপহার। দ্বিতীয় দূত এলেন ইয়েমেন থেকে, তৃতীয় দূত বসরা থেকে। দুজনেই আরবি ঘোড়া উপহার এনেছিলেন সম্রাটের জন্য। আরও দুজন রাষ্ট্রদূত এসেছিলেন ইথিওপিয়া থেকে। প্রথম তিনজন দূতকে বিশেষ কোনো মর্যাদা দেওয়া হয়নি, কারণ তাঁরা এমন বেশে এসেছিলেন যে, তাঁদের রাজার দূত বলেই মনে হয় না। তাঁদের হাবভাব দেখে যে—কেউ মনে করবেন যে উপঢৌকন দিয়ে কিছু টাকাপয়সা আদায় করার জন্যই যেন তাঁরা হিন্দুস্থানের সম্রাটের কাছে এসেছেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা অনেক আরবি ঘোড়া এনেছিলেন নিজেরা ব্যবহার করবেন বলে। তার জন্য কোনো শুল্ক তাঁদের দিতে হয়নি। সেইসব আরবি ঘোড়া এবং আরও নানারকমের জিনিস যা তাঁরা সঙ্গে এনেছিলেন, তাই বেচে হিন্দুস্থানের অনেক মূল্যবান জিনিস কিনে তাঁরা বিনা শুল্কে দেশে পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের ব্যবসা করা, দৌত্যগিরি করা নয়। সেইজন্যই তাঁরা রাষ্ট্রদূতের যোগ্য মর্যাদা পাননি সম্রাটের কাছ থেকে, পেতেও পারেন না।

ইথিওপিয়ার সম্রাটের দূত ঠিক এক ধরনের ছিলেন না। হিন্দুস্থানের আভ্যন্তরিক ব্যাপার সম্বন্ধে তাঁর বেশ জ্ঞান ছিল এবং তিনি হিন্দুস্থানে তাঁর নিজের রাজ্যের সুনাম অর্জনের জন্য বিশেষ উদগ্রীব ছিলেন। সেইজন্যই তিনি দূত হিসেবে যাঁদের পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই শ্রদ্ধেয় ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। দুজনকে তিনি রাজপ্রতিনিধিরূপে মনোনয়ন করেছিলেন এবং দুজনেই খুব উপযুক্ত ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে একজন মুসলমান ব্যবসায়ী। এঁকে আমি চিনতাম, কারণ মক্কায় এঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তাঁকে পাঠানোর উদ্দেশ্য হল কিছু হাবসি ক্রীতদাস বিক্রি করে সেই টাকায় হিন্দুস্থানের মূল্যবান জিনিস কিছু কেনার ব্যবস্থা করা। হাবসি ক্রীতদাসদের এমনভাবে তখন বাজারে পণ্যের মতন বিক্রি করা হত। আফ্রিকার মহান খ্রিস্টান সম্রাটের এই দাস—ব্যবসাই ছিল অন্যতম ব্যবসা।

ইথিওপিয়ার দ্বিতীয় দূত হলেন একজন আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান ব্যবসায়ী, আলেপ্পোতে জন্ম এবং হাবসিদের দেশে ‘মুরাদ’ বলে পরিচিত। এঁর সঙ্গেও আমার মক্কাতেই পরিচয় হয়েছিল। মক্কাতে আমরা দুজন একটি ঘরে কিছুদিন একসঙ্গে বাস করেছিলাম। মুরাদই আমাকে হাবসি দেশে যেতে নিষেধ করেছিলেন। প্রত্যেক বছর মুরাদের প্রধান কাজ হল, ইংরেজ ও ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভুদের কাছে মনোরম উপহার নিয়ে যাওয়া এবং তার বিনিময়ে কিছু ভালো ভালো জিনিস প্রত্যুপহার আনা। ক্রীতদাস বিক্রি করার জন্যও তিনি প্রতি বৎসর মক্কাতে আসেন।*

দূতাবাসের খরচ—খরচার জন্য আফ্রিকার সম্রাট অর্থব্যয় করতে কার্পণ্য করলেন না। ব্যয় সংকুলানের জন্য তিনি ছেলে—মেয়ে মিলিয়ে বত্রিশজন ক্রীতদাস দিয়ে দিলেন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে, নগদ টাকাকড়ি বিশেষ দিলেন না। মক্কার বাজারে ক্রীতদাসদের বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। বিক্রির অর্থ যা পাওয়া যাবে তাতে দূতাবাসের খরচ স্বচ্ছন্দে কুলিয়ে যাবে। এক—আধজন নয়, বত্রিশজন ক্রীতদাস। তাও আবার বুড়ো—হাবড়া নয়, নওজোয়ান তরুণ—তরুণী। মক্কায় তখন জোয়ান ক্রীতদাসদের বাজারদরও ভালো, প্রায় পাঁচ—ছয় পাউন্ড (ষাট সত্তর টাকা আন্দাজ) করে প্রত্যেকের দাম। এছাড়াও সম্রাট বাছা—বাছা আরও পঁচিশজন ক্রীতদাস মোগল বাদশাহকে উপঢৌকন পাঠালেন। সকলেই বয়সে তরুণ, খোজা করবার মতো। খ্রিস্টান সম্রাটের উপযুক্ত উপঢৌকন বটে! কিন্তু আফ্রিকার এই খ্রিস্টানদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য আছে যথেষ্ট। রাষ্ট্রদূতরা আরও অন্যান্য ভেট সঙ্গে নিলেন। পনেরোটি তেজি ঘোড়া, আরবি ঘোড়ার মতন, ছোটো ছোটো একজাতীয় খচ্চর, সুন্দর ডোরাকাটা, বাঘের চেয়ে সুন্দর, এমন কি জেবরার চেয়েও। একজোড়া হাতির দাঁত—প্রত্যেকটি দাঁত এত বড়ো যে একজন জোয়ান লোক মাটি থেকে চেড়ে তুলতে পারবে না। তাছাড়া একজোড়া ষাঁড়ের শিঙ, এত বড়ো যে দিল্লিতে পৌঁছানোর পর আমি তার মুখের হাঁ মেপে দেখেছিলাম, প্রায় একফুট হবে।

ইথিওপিয়ার রাজধানী থেকে এসব দাসদাসি, ঘোড়া, খচ্চর, দাঁত, শিঙ ইত্যাদি নিয়ে রাষ্ট্রদূতরা রওয়ানা হলেন। লোকালয়হীন নির্জন প্রান্তরের ওপর দিয়ে তাঁরা চলতে লাগলেন। এক—আধদিনের পথ নয়, প্রায় দু—মাসের পথ। দু—মাস এইভাবে পথ চলে তাঁরা একটা বন্দরে পৌঁছলেন, ব্যাবেলম্যান্ডেলের কাছে, মক্কার বিপরীত তীরে। ক্যারাভ্যানের রাস্তা দিয়ে তাঁরা যাননি, তাহলে চল্লিশ দিনে পৌঁছান যেত। অন্য হাঁটাপথে গিয়েছিলেন, বিশেষ কারণে। বন্দরে পৌঁছে তাঁরা সমুদ্র পার হয়ে মক্কা যাবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কবে তরী ভিড়বে বন্দরে, আর কবে তাঁরা সাগরপারে মক্কায় পৌঁছবেন তার ঠিক নেই। বন্দরে বিশেষ কিছুই পাওয়া যায় না। খাদ্যদ্রব্যের নিদারুণ অভাবের জন্য অনাহারে কয়েকজন ক্রীতদাস মারা গেল, মক্কা পর্যন্ত তাদের আর পৌঁছানো হল না।

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত তরীও ভিড়ল বন্দরে এবং তাঁরা মক্কায় পৌঁছলেন। মক্কায় পৌঁছে তাঁরা দেখলেন যে ক্রীতদাসের বাজার মন্দা, আমদানির প্রাচুর্যের জন্য। অল্প দামেই দাস—দাসিদের বিক্রি করতে হল। উপায় নেই, টাকার দরকার। দাসদাসি বিক্রির নগদ মূল্য হাতে পেয়েই রাষ্ট্রদূতরা সমুদ্রপথে সুরাট যাত্রা করলেন এবং পঁচিশ দিন পরে হিন্দুস্থানের সুরাটে পৌঁছলেন। বাদশাহকে উপঢৌকন দেবার জন্য যে সব দাসদাসি ও ঘোড়া ছিল, তার মধ্যে কিছু মরে গেল, ঠিক মতন না খেতে পেয়ে। খচ্চরগুলোও সব বাঁচল না, তবে তাদের সুন্দর চামড়া ছাড়িয়ে রাখা হল বাদশাহের জন্য। মৃত ক্রীতদাস বা ঘোড়ার চামড়া আর ছাড়ানো হল না। সমুদ্রের জলেই তাদের ফেলে দেওয়া হল।

সুরাটে যখন রাষ্ট্রদূতরা পৌঁছলেন তখন বিদ্রোহী মারাঠা বীর শিবাজি লুঠতরাজ করে চারিদিকে ত্রাসের সঞ্চার করেছেন। ঘরবাড়ি আগুন জ্বালিয়ে তিনি পুড়িয়ে দিচ্ছেন। নবাগত দূতদের দূতাবাসও আগুনে পুড়ে গেল। বিশেষ কিছুই তাঁরা বাঁচাতে পারলেন না, কয়েকখানি চিঠিপত্র ছাড়া। ক্রীতদাসদের শিবাজি রেহাই দিলেন, কারণ তারা তখন অনাহারে ও রোগে ধুঁকছে। তাদের হাবসি পোশাক—পরিচ্ছদও তিনি লুঠ করেননি। খচ্চরের চামড়া বা ষাঁড়ের শিঙও নেননি কারণ, তার মধ্যে কোনোটাই তেমন লোভনীয় মূল্যবান বস্তু নয়। রাষ্ট্রদূতরা যখন রাজধানীতে পৌঁছলেন তখন তাঁদের দুঃখদুর্দশার কথা খুব ফলাও করে তাঁরা গল্প করলেন। তাঁদের ভাগ্য ভালো যে তাঁরা অনেক জিনিসপত্রসহ শিবাজির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে রাজধানী পৌঁছেছেন। শিবাজি ১৬৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে সুরাট লুণ্ঠন করেন।

রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে একজন ছিলেন আর্মেনিয়ান বণিক মুরাদ, আমার পুরোনো বন্ধু। সুরাটের ডাচ কুঠির প্রধান কর্তা মঁসিয়ে আদ্রিকান মুরাদকে একখানি পরিচয়পত্র দিয়েছিলেন, আমাকে দেবার জন্য। দিল্লি পৌঁছে সেই পত্রখানি নিয়ে মুরাদ আমার কাছে আসেন। পাঁচ ছয় বছর পরে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে মুরাদের সঙ্গে দেখা হতে আমি খুশি হয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করলাম। বললাম, আমার যতদূর সাধ্য তাঁদের সুযোগ—সুবিধা করে দেবার চেষ্টা করব। শুনে তিনি আশ্বস্ত হলেন, কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা হল। রাজদরবারের ওমরাহদের অনেকের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকলেও বাদশাহের সামনে এই রাষ্ট্রদূতদের উপস্থিত করার ব্যাপারে আমি বেশ মুশকিলে পড়লাম। তাঁদের শোচনীয় দুরবস্থাই প্রচণ্ড বাধা হয়ে দাঁড়াল। প্রায় রিক্ত হস্তে তাঁরা রাজধানীতে পৌঁছেছেন। উপঢৌকনের মধ্যে শেষ পর্যন্ত শুধু খচ্চরের চামড়া আর ষাঁড়ের শিঙ ছাড়া তাঁদের আর কিছু সম্বল ছিল না। তাই নিয়ে রাজদরবারে সম্রাটের সামনে কি করে তাঁরা হাজির হবেন, ভেবেই পেলাম না। তার ওপর তাঁদের নিজের নিজের চেহারা ও পোশাক পরিচ্ছদও প্রায় পথের ভিখিরির মতন হয়েছে। রাস্তাঘাটে তাঁরা বেদুইনদের মতন চলে ফিরে বেড়াতেন, পালকি চড়ার সামর্থ্য ছিল না। জীর্ণ গোরুর গাড়িতে প্রায় তাঁদের দিল্লির পথে দেখা যেত। পিছনে পায়ে হেঁটে চলত অবশিষ্ট সাত আটজন অর্ধ—নগ্ন ক্রীতদাস। সে এক বিচিত্র দৃশ্য হত রাজধানীর পথে, রাষ্ট্রদূতরা যখন রাস্তায় বেরুতেন। একটি ঘোড়া পর্যন্ত তাঁদের ছিল না। এক পাদরি সাহেবের একটি ঘোড়ায় তাঁরা চড়ে বেড়াতেন। আমার ঘোড়াটিও তাঁরা প্রায় চেয়ে নিয়ে যেতেন এবং সেটিকে প্রায় আধমরা করে ফেলেছিলেন। কি করব, কিছুই বলবার উপায় নেই।

মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। ভেবেচিন্তে কিছুই ঠিক করতে পারলাম না, তাঁদের কি হিল্লে করা যায়! লোকজনদের ধারণা তাঁরা ভিখিরি, কারও কোনো কৌতূহল নেই তাঁদের সম্বন্ধে, শ্রদ্ধা তো নেই—ই। এই অবস্থায় কি করে তাঁদের রাজদরবারে নিয়ে যাই। একদিন দানেশমন্দ খাঁর সঙ্গে নির্জনে ব্যাপারটা আলাপ করলাম। তাঁদের কথা ছেড়ে দিয়ে, ইথিওপিয়ার সম্রাটের ধনসম্পদ ঐশ্বর্য সম্বন্ধে অনেক কথা বললাম। কিছুটা অতিরঞ্জিত করেই বললাম, তাতেও যদি আগ্রহ হয়। অবশেষে আমার পন্থাই ঠিক প্রমাণ হল। সম্রাট ঔরঙ্গজীব তাঁদের দর্শন দিতে সম্মত হলেন। রাজদরবারে উপস্থিত হলে তাঁদের শিরোপা, কোমরবন্ধ ও পাগড়ি উপহার দেওয়া হল। প্রত্যেকটির কারুকার্য অত্যন্ত চমৎকার। সম্রাট তাঁদের অতিথির মতন দেখাশুনা করার আদেশ দিলেন এবং নগদ ছয় হাজার টাকাও দিলেন। টাকাটি কিন্তু দুজন রাষ্ট্রদূত সমানভাবে ভাগ করে নিলেন না। মুসলমান যিনি তিনি নিলেন চার হাজার টাকা, আর আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান ভদ্রলোক নিলেন দুহাজার টাকা।

ইথিওপিয়ার সম্রাটের জন্যও বাদশাহ উপহার দিলেন রাষ্ট্রদূতের কাছে, মূলবান শিরোপা, দুটি বড়ো বড়ো রূপার শিঙা, দুটি কাড়ানাকড়া এবং ত্রিশ হাজার সোনা ও রূপার মুদ্রা। মুদ্রাই বিশেষ উল্লেখযোগ্য উপহার বলে ইথিওপিয়ার সম্রাটের কাছে গণ্য হবে, তার কারণ নিজের কোনো টাকশাল বা মুদ্রা তখনও ছিল না। কিন্তু মুদ্রাগুলি শেষ পর্যন্ত ইথিওপিয়ায় পৌঁছবে কি না সে সম্বন্ধে সন্দেহ হল বাদশাহের মনে। হয়ত তাঁরা হিন্দুস্থানের পণ্যদ্রব্য কিনে সমস্ত মুদ্রা খরচ করে ফেলবেন। সম্রাটের সন্দেহই সত্য হল। সেই নগদ মুদ্রা নিয়ে রাষ্ট্রদূতরা নানারকম জিনিসপত্র কিনে ফেললেন। মশলাপাতি, ভালো ভালো কাপড়চোপড়, রাজারাণী ও তাঁদের একমাত্র বৈধ সন্তানের (ভবিষ্যতের রাজা) কোটপাতলুনের জন্য দামি রেশমি রঙিন কাপড়, কোর্তা বানাবার মতন বিলিতি লাল সবুজ কাপড় এবং হারেমের বাঁদি ও তাদের ছেলেপিলের জন্য আর সব নানারকমের কাপড় তাঁরা কিনলেন। সমস্ত পণ্যদ্রব্যই তাঁরা অন্যান্য রাষ্ট্রদূতদের মতন বিনা মাশুলেই নিজেদের দেশে রপ্তানি করবার অনুমতি পেলেন।

মুরাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও, তাঁর জন্য এত পরিশ্রম করা আমি পণ্ডশ্রম মনে করলাম এবং অনুতপ্ত হলাম। তার প্রথম কারণ হল, মুরাদ কথা দিয়েছিলেন যে তাঁর ছেলেটিকে আমার কাছে পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করবেন। কিন্তু পরে তিনি কথা রাখেননি। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তিনি পঞ্চাশ টাকার বদলে ছেলেটির জন্য তিনশো টাকা চাইলেন। একবার আমার মনে হল যে তিনশো টাকাতেই ছেলেটিকে কিনে নেব এবং অন্যদের দেখাব যে পিতা তার নিজের সন্তানকে এই দামে বিক্রি করেছে। ছেলেটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট, রঙ কুচকুচে কালো, নাক চওড়া, ঠোঁট পুরু—যেমন ইথিওপিয়ানদের চেহারা হয় ঠিক তেমনি। মুরাদ আমার পরিচিত বন্ধু হয়েও কথার খেলাফ করতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলাম।

এছাড়া আমি শুনলাম যে আমার আর্মেনিয়ান বন্ধুটি এবং তাঁর মুসলমান সঙ্গীটি সম্রাট ঔরঙ্গজীবকে কথা দিয়েছেন যে তাঁরা দেশে ফিরে গিয়ে তাঁদের সম্রাটকে অনুরোধ করবেন, ইথিওপিয়ার পুরাতন মসজিদটি সংস্কার করার জন্য। পর্তুগিজরা মসজিদটিকে ভেঙে দিয়েছিল এবং তারপর থেকে আর সংস্কার করা হয়নি। সম্রাট ঔরঙ্গজীব মসজিদটি সংস্কার করার জন্য ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রদূতদের দুহাজার টাকা দিয়েছিলেন। মসজিদটি একজন মুসলমান দরবেশের স্মৃতিরক্ষার্থে তৈরি হয়েছিল। তিনি ইথিওপিয়ায় ইসলামধর্ম প্রচারের জন্য গিয়েছিলেন। সুতরাং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে মসজিদটির গুরুত্ব খুব বেশি। সম্রাট ঔরঙ্গজীব এইজন্যই তার পুনর্গঠনের জন্য এত উদগ্রীব হয়েছিলেন এবং অর্থ দিয়ে সাহায্যও করেছিলেন।

তৃতীয় ঘটনা হল : মুরাদ সম্রাট ঔরঙ্গজীবকে ‘কোরআন শরীফ’ ও অন্যান্য মুসলমান ধর্মগ্রন্থ পাঠাবেন বলেছিলেন।

একজন খ্রিস্টান রাষ্ট্রদূত, খ্রিস্টান সম্রাটের প্রতিনিধিরূপে অন্য দেশে এসে যে এই রকমের জঘন্য কাজকর্ম করতে পারেন, তা বাস্তবিকই কল্পনা করা যায় না। এই ঘটনাবলি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, খ্রিস্টধর্মের কি চরম অবনতি হয়েছিল ইথিওপিয়ায়। আমি অবশ্য তা জানতাম এবং মক্কায় থাকার সময় এ—সম্বন্ধে অনেক খবর পেয়েছিলাম। ইথিওপিয়ায় ইসলামধর্মেরই প্রাধান্য ছিল এবং রাজা প্রজা সকলেই তার পক্ষপাতী ছিল। খ্রিস্টানদের সংখ্যা বরাবরই খুব নগণ্য ছিল এবং যারা খ্রিস্টান বলে পরিচয় দিত তারা আসলে অন্তরে ছিল ইসলামধর্মী। পর্তুগিজরা গায়ের জোরে খ্রিস্টধর্মকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে সার্থক হতে পারেনি। ইথিওপিয়া থেকে পর্তুগিজ বিতাড়ন ও পাদরিদের পলায়ন থেকেই তা পরিষ্কার বোঝা যায়।

দিল্লি থাকার সময় দানেশমন্দ খাঁ প্রায়ই রাষ্ট্রদূতদের তাঁর গৃহে আমন্ত্রণ জানতেন, নানাবিষয়ে আলাপ—আলোচনা করবার জন্য। তাঁদের দেশের আভ্যন্তরিক অবস্থা ও শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে অনেক কথা তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাছাড়া, নীলনদের উৎস সম্বন্ধে জানার কৌতূহলই ছিল তাঁর সবচেয়ে বেশি। মুরাদ এবং তাঁর একজন মোগল সঙ্গী নীলনদের উৎস পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। রাষ্ট্রদূত দুজন এমন অতিরঞ্জিত করে তাঁদের সম্রাট ও সৈন্যবাহিনী সম্বন্ধে বড়ো বড়ো কথা বললেন যে খাঁ সাহেবের তা বিশ্বাস হল না। কিন্তু তাঁদের মোগল সঙ্গীটি আসল সত্যটি ফাঁস করে দিলেন। রাষ্ট্রদূতরা বিদায় নেবার পর তিনি খাঁ সাহেবকে বললেন যে রাষ্ট্রদূতদের কথা অধিকাংশই মিথ্যা। তিনি নিজের চোখে যা দেখেছেন তাতে মনে হয়, ইথিওপিয়ার শাসন—ব্যবস্থা ও সৈন্যবাহিনী দুই—ই অত্যন্ত নিম্নস্তরের। মোগল সঙ্গীটি ইথিওপিয়ার ভিতরের খবর যা বললেন তা বিশেষ মূল্যবান। আমি আমার ‘জর্নালে’ তা লিখে রেখেছি। আপাতত মুরাদ নিজ মুখে যা বলেছিলেন তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জ্ঞাতব্য বিষয় আমি পাঠকদের কাছে নিবেদন করছি।

হাবসিদেশের কথা

মুরাদ বললেন : ইথিওপিয়ায় এমন কোনো লোক নেই যার একাধিক স্ত্রী নেই। বহু বিবাহপ্রথার প্রাধান্য তাঁদের সমাজে এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। মুরাদের নিজের দুজন স্ত্রী আছে। এই দুজন তাঁর বিবাহিত স্ত্রী ছাড়াও অতিরিক্ত। তাঁর বিবাহিত স্ত্রী আলেপ্পোতে থাকেন। ইথিওপিয়ার নারীরা হিন্দুস্থানের নারীর মতন পর্দানশীন নয়। সকলের সামনেই তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। সাধারণ স্ত্রীলোকেরা, বিবাহিতই হোক আর কুমারীই হোক, ক্রীতদাসই হোক আর স্বাধীন নাগরিকই হোক—পুরুষদের সঙ্গে যত্রতত্র অবাধে মেলামেশা করে। কোনো ঈর্ষা, বিদ্বেষ বা হিংসা বলে কিছু নেই তাদের মধ্যে। একজনের বিবাহিত স্ত্রী বা বাগদত্তা প্রেমিকা অন্যের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে বিহার করতে পারে, কোনো বাধা নেই, খুনোখুনি নেই। অর্থাৎ স্ত্রী—পুরুষদের মেলামেশার ব্যাপারটা ইথিওপিয়ার সমাজে জলবৎ—তরলম। স্ত্রীলোক হলেই জলস্রোতের মতন নীচু দিকে গড়িয়ে যাবে—এটা যেন স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। পুরুষরাও স্বেচ্ছাচারী হওয়া স্বাভাবিক। কোনো অভিজাত পরিবারের বিবাহিত স্ত্রী কোনো বীরপুরুষের প্রেমে পড়ে স্বচ্ছন্দে তাঁর সঙ্গে লীলাখেলা করতে পারেন, তাতে পৌরুষ বা আভিজাত্য কোনোটাতেই বাধে না। এই হল ইথিওপিয়ার সমাজ।

আমি যদি ইথিওপিয়ায় যেতাম তাহলে নাকি বিবাহ করতে বাধ্য হতাম। কয়েক বছর আগে নাকি একজন পাদরি সাহেবকে এইভাবে জোর করে একটি ইথিওপিয়ান মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয় এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, যে মেয়েটির সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেওয়া হয়, তাকে তিনি পুত্রবধূ করবেন স্থির করেছিলেন।

এইবার ইথিওপিয়ার বিবাহ ও সন্তানাদি সম্বন্ধে একটি মজার কাহিনি বলছি শুনুন। একবার কোনো এক অশীতিবর্ষ বৃদ্ধ সম্রাটের কাছে তার চব্বিশজন জোয়ান ছেলে নিয়ে এসে উপস্থিত হয়। উদ্দেশ্য বোধ হয়, ছেলেদের সৈন্যবাহিনীতে ভরতি করা। সম্রাট ছেলেদের দেখে জিজ্ঞাসা করেন, বৃদ্ধের এই ক—জন পুত্র ছাড়া আর কোনো সন্তান আছে কি না। বৃদ্ধ বলে যে পুত্রসন্তান তার আর নেই, মাত্র এই ছয় গণ্ডা বা চব্বিশটিই আছে, এছাড়া আরও কয়েকটি কন্যাসন্তান আছে। সম্রাট ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন : দূর হয়ে যাও, আমার সামনে থেকে—বৃদ্ধ গোবৎস কোথাকার। মাত্র চব্বিশটি সন্তানের পিতা হয়ে তুমি আমার সামনে এসে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহস করেছ দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। দূর হও, বেরিয়ে যাও, আমার সামনে থেকে। আমার রাজত্বে কি স্ত্রীলোকের অভাব হয়েছে বলতে চাও, উল্লুক কোথাকার! তোমার মতন একজন আশি বছরের বৃদ্ধ মাত্র দুই ডজন সন্তানের পিতৃত্বের বড়াই করছ কোন সাহসে?’ ব্যাপারটা একবার কল্পনা করুন। অর্থাৎ আশি বছরের বৃদ্ধের অন্তত গোটা ষাটেক সন্তান থাকলে হয়ত সম্রাট খুশি হতেন, কিংবা তারও বেশি। সম্রাটের ক্রুদ্ধ হবারই কথা। কারণ তাঁর নিজের প্রায় আশিটি ছেলেমেয়ে। হারেমে ও বেগমমহলে তাদের ভেড়ার পালের মতন ছুটোছুটি করে বেড়াতে দেখা যায়। কে কার গর্ভজাত তা বলবার উপায় নেই, তবে সকলেই সম্রাটের ঔরসজাত। তবু রাজবাড়ির মধ্যে অন্যান্য দাসদাসি ও বাঁদিদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যাতে একাকার হয়ে তারা মিশে না যায় এবং দেখলে অন্তত রাজকুমার কি রাজকুমারী বলে চেনা যায়, তার জন্য সম্রাট নিজে একটি করে রাজদণ্ডের মতন কাষ্ঠদণ্ড প্রত্যেককে তৈরি করে দিয়েছেন, হাতে নিয়ে বেড়াবার জন্যে। সেই দণ্ড হাতে করে রাজার ছেলেমেয়েদের অন্তঃপুরে ঘুরে বেড়াতে হয় সব সময়, তা না হলে গণ্ডগোল হয়ে যাবার সম্ভাবনা। এইরকম যাঁর পিতৃত্বের বহর এবং যিনি সর্বশক্তিমান সম্রাট, তিনি গরিব বৃদ্ধের মাত্র দুই তিন ডজন সন্তানের পিতৃত্বের পরিচয় পেয়ে যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন তাতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে?

সম্রাট ঔরঙ্গজীব বার দুই রাজদূতদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। খাঁ সাহেবের মতন তিনিও ভেবেছিলেন যে তাঁদের কাছ থেকে ইথিওপিয়া সম্বন্ধে তিনি কিছু জ্ঞান অর্জন করবেন। তাঁর বিশেষ কৌতূহল ছিল, ইথিওপিয়ায় ইসলামধর্মের অবস্থা সম্বন্ধে বিবরণ সংগ্রহ করার। সম্রাট খচ্চরের চামড়াগুলো দেখার জন্যও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এই চামড়াগুলো আমাকে উপহার দেবার কথা ছিল। কিন্তু সে কথা তাঁরা রাখেননি। যাই হোক, আমিই বললাম, সম্রাটকে খচ্চরের চামড়া ও ষাঁড়ের শিঙ, দুই—ই দেখাতে।

সুলতান আকবরের শিক্ষাব্যবস্থা

দিল্লিতে যখন ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রদূতরা অবস্থান করছিলেন তখনই সম্রাট ঔরঙ্গজীব তাঁর তৃতীয় পুত্র সুলতান আকবরের শিক্ষাদীক্ষার জন্য মৌলবী পণ্ডিতদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। সুলতান আকবরের শিক্ষার জন্য সম্রাট বিশেষ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, কারণ তাকেই তিনি হিন্দুস্থানের ভবিষ্যৎ সম্রাট করবেন বলে স্থির করেছিলেন। সম্রাট ঔরঙ্গজীবের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে উপযুক্ত শিক্ষাদীক্ষার অভাবেই রাজকুমাররা যখন রাজা হন তখন রাজ্যশাসন—ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। রাজা হতে হলে রাজার মতন শিক্ষা পাওয়া দরকার। যিনি একটা বিরাট দেশের সর্বময় অধীশ্বর হবেন, একটা বিশাল রাজ্য পরিচালনা করবেন তাঁকে উপযুক্ত শিক্ষালাভ করে ঠিক তেমনি বিরাট ও মহান হতে হবে ব্যক্তি হিসাবে। তবেই তিনি রাজা হবার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তাঁর বিদ্যা, তাঁর জ্ঞান, তাঁর বিচারবুদ্ধি ও বিবেচনাশক্তি, তাঁর ন্যায়—অন্যায় বোধশক্তি, কূটবুদ্ধি, দূরদর্শিতা ঠিক সম্রাটের মতন সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে রাজদণ্ড ধারণ করার এবং রাজসিংহাসনে বসার কোনো অধিকার তাঁর নেই। সম্রাট ঔরঙ্গজীব প্রায় বলতেন যে এশিয়ার সাম্রাজ্যের এত দুর্গতি ও অবনতির অন্যতম কারণ হল, এখানকার রাজকুমারদের অশিক্ষা ও কুশিক্ষা। বাল্যকাল থেকে তাদের পরিচারিকা ও খোজাদের হেফাজতে রাখা হয়। রাশিয়া, জর্জিয়া, আফ্রিকা, মঙ্গোলিয়া প্রভৃতি দেশের এই সব ক্রীতদাস—দাসিদের কুসংসর্গে থেকে এশিয়ার রাজপুত্ররা আশৈশব মানুষ হয়। তার ফলে তাদের কোনো সুশিক্ষা হয় না, কোনো শিষ্টতা, ভদ্রতা ও সদাচার তারা শেখে না। জ্যেষ্ঠ, প্রবীণ ও শ্রদ্ধেয়দের প্রতি উদ্ধত আচরণ করতে এবং আশ্রিতদের প্রতি অত্যাচার ও পীড়ন করতে শেখে। এই শিক্ষা পেয়ে এইরকম দুর্বিনীত ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে যখন তারা বড়ো হয়, রাজসিংহাসনে সম্রাট হয়ে গদীয়ান হয়ে বসে, তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করা ছাড়া আর কি তারা করতে পারে? রাজকর্তব্য সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই তাদের থাকে না। কি করে থাকবে? বাঁদিরা বা খোজারা কি সেই শিক্ষা দিতে পারে? রাজদরবারে যখন তারা হাজির হয়, তখন তাদের দেখলে মনে হয় যেন তারা এক ভিন্ন জগতের জীব, বাইরের জগৎ সম্বন্ধে একেবারে অনভিজ্ঞ। হবেই তো। অন্তঃপুরের বাঁদি, দাস—দাসি আর খোজাদের সান্নিধ্য ছেড়ে হঠাৎ রাজদরবারে আমলা—অমাত্য, আমীর—ওমরাহদের মধ্যে এসে সিংহাসনে উপবেশন করলে, এছাড়া আর কি মনে হবে? অন্ধকার এক নরক থেকে যেন হঠাৎ এক আলোর রাজ্যে এসে উপস্থিত হয় রাজকুমাররা। চারিদিক দেখেশুনে ঠিক শিশুর মতন ব্যবহার করতে থাকে। ঠিক শিশুর মতন যা শোনে তাই বিশ্বাস করে, যা দেখে তাতেই ভয় পায়। বিদ্যাবুদ্ধি বিবেচনাশক্তি কিছুই সম্বল থাকে না, থাকে শুধু উদ্ধত গোঁ আর রাজকীয় দম্ভ। সুতরাং সৎবুদ্ধি ও সুপরামর্শ তাদের কর্ণগোচর হয় না এবং একবার স্থূল মস্তিষ্কে যা বিঁধে যায় তাই নিয়ে চরম দৌরাত্ম্য করতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না। প্রথম প্রথম, সিংহাসনে বসে কেবলই যখন মনে হয় যে সে একজন সম্রাট, তখন একটা গাম্ভীর্যের ছদ্মবেশ ধারণ করার চেষ্টা করা হয়। দেখলে মনে হয় যেন কত গম্ভীর, কত দূরদর্শী, কত চিন্তাশীল, সত্যই সম্রাট হবার উপযুক্ত। কিন্তু গাম্ভীর্যের মুখোসটা বুদ্ধিমানের চোখে খসে যায়, ভিতরের আসল স্থূলবুদ্ধি রূপটা বেরিয়ে পড়ে। এই হল এশিয়ার সম্রাট! যাঁরা এশিয়ার রাজারাজড়াদের ইতিহাস জানেন, তাঁদের স্বচক্ষে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এই কথা যে বর্ণে বর্ণে সত্য তা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। এশিয়ার সম্রাটদের পশুর চেয়েও নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ করতে দেখা গেছে। কোনো বিচার নেই, বিবেচনা নেই, নিছক নিষ্ঠুর ব্যবহারে তারা পাশবিক উত্তেজনা ও আনন্দ বোধ করেছেন। মদ্যপানে, উচ্ছৃঙ্খলতায় ও বিলাসিতায় তাঁরা ভেসে গেছেন। স্ত্রী—সংসর্গে তাঁরা নিজেদের স্বাস্থ্য, বুদ্ধি, সমাজচেতনা সব জলাঞ্জলি দিয়েছেন। শিকারের আনন্দে প্রাত্যহিক রাজকার্যে অবহেলা করেছেন। শিকারের সময় শিকারি কুকুরের পালের দিকে তাঁদের যতটা নজর থাকে, তার শতাংশের একাংশও থাকে না তাঁর শিকারে সহযাত্রী গরিব প্রজাদের দিকে। তারা হয়ত অনাহারে, অনাশ্রয়ে, প্রচণ্ড শীতে ও দুর্যোগে পথের মধ্যেই মরে যায়। রাজার তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি তাঁর ঘোড়া, হাতি আর কুকুরের পাল নিয়েই শিকারে মত্ত থাকেন। বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ সম্রাট এশিয়ার মাটিতে খুব কমই জন্মেছেন। নিজেরা বুদ্ধিহীন অশিক্ষিত বলে, সাধারণত রাজ্যশাসনের ভার তাঁরা উজিরদের ওপর বা খোজাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছেন। তারা কেবল চক্রান্ত আর বেইমানি করেছে, এ ওর গলা কেটেছে, খুন করেছে। এই অবস্থায় রাজার রাজ্যের শৃঙ্খলা বা শান্তি কি করে বজায় থাকে?

সম্রাট ঔরঙ্গজীব তাঁর পুত্রের শিক্ষাপ্রসঙ্গে এই ধরনের মতামত প্রায় ব্যক্ত করতেন এবং তার শিক্ষা সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। বিশেষ করে তৃতীয় পুত্র ভবিষ্যতে রাজা হবে বলে তার শিক্ষা সম্বন্ধে তিনি বিশেষ সজাগ ছিলেন।*

পারস্যের দূত

অবশেষে সংবাদ এল, পারস্যের রাষ্ট্রদূত হিন্দুস্থানের সীমান্তে পৌঁছেছেন। মোগল দরবারের পারসি ওমরাহরা সংবাদ শোনা মাত্রই রটিয়ে দিলেন। যে অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপারের জন্য পারস্যের রাষ্ট্রদূত হিন্দুস্থানে এসেছেন। বুদ্ধিমান লোকেরা অবশ্য তাঁদের কথায় কর্ণপাত করলেন না। কারণ, পারসিদের এমন একটা হামবড়াই ভাব আছে যে নিজেদের জাতের কোনো ব্যাপার নিয়ে তিলকে তাল করতে তারা অভ্যস্ত। প্রচার করা হল যে পারস্যের রাষ্ট্রদূতকে রাজদরবারে নিয়ে আসার আগে যেন তাঁকে ভারতীয় রীতিতে সেলাম করতে শিক্ষা দেওয়া হয়, তা না হলে হঠাৎ তাঁকে সেলাম করানো যাবে না। পারসিরা এমনিতে খুব উদ্ধতভাব, তার ওপর তিনি রাজপ্রতিনিধি। সুতরাং হঠাৎ ঘাড় হেঁট করে সেলাম করতে হয়ত তিনি রাজি নাও হতে পারেন কিন্তু এসব কথা গালগল্প ছাড়া কিছু নয়। ঔরঙ্গজীবের এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসত ছিল না।

পারস্যের রাষ্ট্রদূত যখন রাজধানীতে প্রবেশ করলেন তখন তাঁকে মহাসমারোহে অভ্যর্থনা করা হল। বাজারের ভিতর দিয়ে তাঁর যাবার পথ সুসজ্জিত করা হল এবং কয়েক মাইল জুড়ে পথের দুই পাশে অশ্বারোহী সৈন্যরা সারবন্দি হয়ে দাঁড়াল। ওমরাহরা অনেকে—বাদ্যযন্ত্র নিয়ে শোভাযাত্রায় যোগ দিলেন। দুর্গদ্বারে রাষ্ট্রদূত যখন পৌঁছলেন তখন তোপধ্বনি করে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হল। ঔরঙ্গজীব তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন। পারসি কায়দাতে সেলাম জানানো সত্ত্বেও তিনি বিরক্ত হলেন না এবং সোজাসুজি রাষ্ট্রদূতের হাত থেকেই তাঁর পরিচয়পত্রখানি তিনি বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করলেন। একজন খোজা তাঁর চিঠিখানি খুলে দিতে তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে পড়তে লাগলেন। রাজপ্রতিনিধিকে যথারীতি কোর্তা, পাগড়ি, সোনারূপোর জরির—কাজ—করা শিরোপা ইত্যাদি উপঢৌকন দিতে আদেশ দেওয়া হল। তারপর যথাসময়ে পারস্যের দূতকে জানানো হল যে এইবার তিনি তাঁর উপহারাদি দেখাতে পারেন।

পারস্যের রাষ্ট্রদূত যে উপহার দিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পঁচিশটি সুন্দর ঘোড়া, বিশটি উট—দেখতে ঠিক ছোটো হাতির মতন, চমৎকার গোলাপ—জল, পাঁচ—ছ—খানি গালচে ইত্যাদি। ঔরঙ্গজীব উপহার দেখে খুব খুশি হলেন। প্রত্যেকটি জিনিস তিনি নিজে যত্ন করে দেখলেন এবং পারস্যের রাজার উদারতার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। রাজদূতকে তিনি ওমরাহদের মধ্যে বসতে বললেন এবং তাঁর পথের ক্লান্তির কথা বারবার উল্লেখ করে, প্রত্যহ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করে তাঁকে বিদায় দিলেন। রাজদূত প্রায় চার পাঁচ মাস দিল্লিতে রইলেন ঔরঙ্গজীবের খরচে এবং ওমরাহদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করে বেড়াতে লাগলেন। যখন তাঁকে স্বদেশে ফিরে যাবার অনুমতি দেওয়া হল, তখন বাদশাহ আবার তাঁকে ডেকে নানারকমের উপহার দিলেন।

পারস্যের রাষ্ট্রদূতকে ঔরঙ্গজীব যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও পারসি ওমরাহরা প্রচার করলেন যে পারস্যের সম্রাট দূত মারফত যে পত্র পাঠিয়েছেন তাতে তিনি ভারতসম্রাটকে নিন্দা করেছেন ভ্রাতৃহত্যার জন্য এবং বৃদ্ধ পিতা সাজাহানকে বন্দি করার জন্য। পারস্যের সম্রাট নাকি তাঁর ‘আলমগীর’ বা ‘বিশ্ববিজয়ী’ নামের জন্যও উপহাস করেছেন। ওমরাহরা চিঠির জবান পর্যন্ত মুখে মুখে রটনা করে দিলেন। তাতে নাকি লেখা ছিল : ‘আপনি যখন আলমগীর, তখন আল্লার নামে আপনাকে এই তলোয়ার ও ঘোড়াগুলি পাঠালাম। সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন।’ কিন্তু এসব কথা এত অতিরঞ্জিত যে একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কথায় রঙচড়ানোর বদ—অভ্যাস পারসিদের আছে, আগে বলেছি। খোশমেজাজি গালগল্প করতে তারা ওস্তাদ। এ—সম্বন্ধে অর্থাৎ পারস্যের সম্রাটের পত্রাদি সম্বন্ধে আমি যা শুনেছি তা বলছি। তিনি উদ্ধত কোনো ভাষা চিঠির মধ্যে প্রকাশ করেননি। ওটা পারসি ওমরাহদের অপপ্রচার ছাড়া কিছু নয়। আমার নিজের ধারণা, হিন্দুস্থানের মতন বিরাট দেশের বিরুদ্ধে পারস্যের সম্রাট অকারণে যুদ্ধবিগ্রহ করতে চাইবেন না। তিনি তাঁর নিজের রাজ্যের সীমান্ত রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। সাহ আব্বাসের১৫ মতন সম্রাটও পারস্যে সহজলভ্য হয়। তাঁর মতন দূরদর্শিতা, বুদ্ধি ও বিবেচনাশক্তি খুব কম সম্রাটের আছে। হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্ত করাই যদি পারস্যের রাজার উদ্দেশ্য হবে, সম্রাট সাজাহান বা ইসলামধর্মের প্রতি যদি তাঁর এত দরদ থাকবে, তাহলে বাস্তবিকই যখন দীর্ঘকালব্যাপী হিন্দুস্থানের মধ্যে ঘরোয়া চক্রান্ত ও গৃহযুদ্ধ চলছিল, তখন তিনি উদাসীন নিরপেক্ষ দর্শকের মতন দূরে দাঁড়িয়ে তা দেখছিলেন কেন? হিন্দুস্থান জয় করাই যদি তাঁর উদ্দেশ্য হবে, তাহলে তখন তো সচ্ছন্দেই তিনি তা করতে পারতেন। সাজাহান, দারা, সুলতান সুজা কারও কাকুতি—মিনতিতে তিনি কর্ণপাত করা প্রয়োজন মনে করেননি, এমন কি কাবুলের শাসনকর্তার কথাতেও না। তা যদি করতেন তাহলে সামান্য সেনাবাহিনী নিয়ে, অল্প খরচে তিনি অতি সহজে, বিনা বাধায় হিন্দুস্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূখণ্ডের অধীশ্বর হতে পারতেন, অন্তত কাবুল থেকে সিন্ধুনদের তীর পর্যন্ত বিরাট অঞ্চলের তো নিশ্চয়ই। তখন তাঁর আদেশেই হিন্দুস্থানের রাজা উঠতেন—বসতেন এবং আত্মকলহ বা দ্বন্দ্ব, সবই তিনি মিটিয়ে দিতে পারতেন।

পারস্য সম্রাটের পত্রের মধ্যে হয়ত কোনো আপত্তিকর ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছিল, অথবা রাষ্ট্রদূতের কথাবার্তায় ঔরঙ্গজীব হয়ত খুশি হননি। কারণ পারস্যের রাষ্ট্রদূত দিল্লি ছেড়ে যাবার দু—তিনদিন পর তিনি অভিযোগ করলেন যে পারস্যের সম্রাটকে তিনি যে ঘোড়াগুলি উপহার দিয়েছিলেন, সেগুলি রাষ্ট্রদূতের আদেশে নাকি রজ্জুবদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়েছে। ঔরঙ্গজীব তৎক্ষণাৎ হুকুম দিলেন, যে—কোনো উপায়ে ভারত—সীমান্তে রাষ্ট্রদূতকে বন্দি করতে এবং তাঁর কাছ থেকে সমস্ত ভারতীয় ক্রীতদাস কেড়ে নিয়ে আসতে। ভারতে ক্রীতদাসের বাজার খুব সস্তা দেখে পারসি দূত একদল ক্রীতদাস কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ভারতে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষের জন্য তখন বাজারে প্রচুর ক্রীতদাস পাওয়া যেত এবং দামও তাই সস্তা হয়েছিল। শুধু পারসি রাষ্ট্রদূত যে ক্রীতদাস কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন তা নয়, তাঁর অনুচরবর্গও নাকি অনেক শিশুসন্তান কিনে নিয়ে পালাচ্ছিলেন।

পারস্যের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সম্রাট ঔরঙ্গজীব অত্যন্ত ভদ্র ও শিষ্ট আচরণ করেছিলেন। সম্রাট সাহ আব্বাসের রাজত্বকালে তাঁর প্রতিনিধির সঙ্গে সাজাহান যে—রকম উদ্ধত আচরণ করেছিলেন, ঔরঙ্গজীব সে—রকম কিছু করেননি। সম্রাট সাজাহানের উদ্ধত আচরণ সম্পর্কে পারসিরা প্রায় নানারকমের গল্প বলে থাকেন। তার মধ্যে দু—একটি গল্প আমি এখানে বলছি :

সম্রাট সাজাহান যখন দেখলেন যে কিছুতেই পারস্যের রাষ্ট্রদূতকে ভারতীয় কায়দায় সেলাম করতে বাধ্য করানো যায় না, এবং আত্মমর্যাদাবোধ তাঁর এত উগ্র যে তাঁকে মাথা নোয়ানো পর্যন্ত মুশকিল, তখন তিনি এক অভিনব উপায় উদ্ভাবন করলেন। তিনি হুকুম দিলেন যে আমখাসের দিকে দরবারের যে প্রবেশপথ আছে সেটা বন্ধ করে দিত। শুধু সামান্য একটু ফাঁক থাকবে এক জায়গায় এবং সেই ফাঁকটুকু এমন নিচু হবে যে তার ভিতর দিয়ে ঢুকতে গেলেই রাষ্ট্রদূতকে বাধ্য হয়ে মাথা হেঁট করতে হবে সেলাম করার ভঙ্গিতে। সম্রাট সাজাহান সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবেন, অভ্যর্থনা জানাবার জন্য এবং তাতে গর্বোদ্ধত পারসি রাষ্ট্রদূতের ভারতীয় পদ্ধতিতে সেলাম না করার অহংকারও চূর্ণ হবে। সাজাহান ভেবেছিলেন যে তিনি তখন রাষ্ট্রদূতকে বরং বলবেন যে, অতটা মাথাটা হেঁট করে সেলাম করাটাও ভারতীয় রীতি নয়। কিন্তু গর্বিত ও বুদ্ধিমান পারসি দূত আগে থেকে সম্রাটের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে প্রবেশপথের কাছে এসে, সম্রাটের দিকে পিছন ফিরে নিচু হয়ে প্রবেশ করলেন। সাজাহান পারসি শঠতার কাছে হার মেনে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন : ‘হা আল্লা! আপনি কি মনে করলেন যে এখানে আপনার মতন গর্দভের আস্তাবল আছে যে ঐভাবে ঢুকলেন?’ পারস্যের দূত উত্তর দিলেন : ‘অবশ্য ঠিকই বলেছেন, আমি গর্দভই বটে। আমার চেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি পারস্যের রাজদরবারে আরও অনেক আছেন, কিন্তু যিনি যেমন সম্রাট তাঁর কাছে তেমনি দূত পাঠানো উচিত বলে আমাকেই তিনি আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।’

আর একবার আহারের নিমন্ত্রণ করে একত্রে খানা খেতে বসে সম্রাট সাজাহান পারস্যের দূতকে অপমান করেছিলেন। পারস্যের দূত খুব বেশি হাড় চিবুচ্ছেন দোখে সাজাহান বললেন : ‘কুকুরগুলোর জন্য কিছু রাখুন?’ পারস্যের দূত তার উত্তরে খিচুড়ি বা পোলাওয়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন : ‘ওই তো রেখেছি।’ সাজাহান পোলাও খেতে খুব ভালোবাসতেন এবং তখন খাচ্ছিলেনও। সুতরাং রাজদূতের উত্তরে তিনি খুব অপ্রস্তুত হয়েছিলেন।

সম্রাট সাজাহান তখন নতুন রাজধানী দিল্লি তৈরি করছেন। তিনি পারস্যের দূতকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন : ‘ইস্পাহান ভালো, না দিল্লি ভালো?’ উত্তরে পারস্যের দূত ‘বিল্লা বিল্লা’ (বি—ইল্লাহি) বলে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন : ‘ইস্পাহানকে দিল্লির ধুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায় না।’ সাজাহান উত্তর শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন, ভেবেছিলেন রাষ্ট্রদূত বোধ হয় তাঁর রাজধানীর প্রশংসাই করলেন। দিল্লির ধুলোর সঙ্গেও ইস্পাহানের তুলনা হয় না, সাজাহান এই অর্থ বুঝেছিলেন। কিন্তু অর্থ তা নয়। অর্থ হল দিল্লিতে এত ধুলো যে তার সঙ্গে ইস্পাহান নগরীর তুলনা করতে যাওয়াই বাতুলতা।

সাজাহান নাকি আর একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন—রাষ্ট্রীয় শক্তি হিসাবে হিন্দুস্থান বড়ো, না পারস্য বড়ো? উত্তরে পারস্যের দূত বলেছিলেন—হিন্দুস্থান পূর্ণচন্দ্রের মতন, আর পারস্য হল দ্বিতীয়ার চাঁদ। কথাটা শুনে প্রথমে সম্রাট সাজাহান খুব প্রীত হয়েছিলেন। পূর্ণিমার চাঁদের মতন হিন্দুস্থান বলতে তিনি তাকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র মনে করেছিলেন। কিন্তু পরে তাঁর কাছে অর্থ পরিষ্কার হয়। পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে তুলনা করার অর্থ হল, রাষ্ট্র হিসাবে হিন্দুস্থানের শ্রীবৃদ্ধির দিন শেষ হয়েছে, এবারে কৃষ্ণপক্ষে তার ক্রমিক ক্ষয় শুরু হবে। কিন্তু পারস্য হল দ্বিতীয়ার চাঁদ—অর্থাৎ তার ক্রমিক শ্রীবৃদ্ধি হবে। পারস্যের দূত যা বলতে চেয়েছিলেন তা সহজ কথায় হল হিন্দুস্থান বৃদ্ধ, পারস্য নওজোয়ান।

পারসিদের চতুরতার এই হল কয়েকটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু চতুর হলেই যে বুদ্ধিমান হতে হবে তার কোনো মানে নেই। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়। যিনি রাজপ্রতিনিধি হবেন, আমার মতে, তাঁর একটা নিজস্ব চারিত্রিক গাম্ভীর্য থাকা উচিত। হালকা রঙ্গতামাসা বা হেঁয়ালির অবতারণা করা তাঁর শোভা পায় না। পারস্যের দূত সাজাহানের মতন খেয়ালি সম্রাটকে ওইভাবে পদে পদে চালাকি বুদ্ধির জোরে বিব্রত ও ক্ষুব্ধ করে খুব বুদ্ধির পরিচয় দেননি। সাজাহান শেষ পর্যন্ত এতদূর বিরক্ত হয়েছিলেন যে পারস্যের দূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেই তিনি অত্যন্ত কটুবাক্যে তাঁকে সম্বোধন করতেন। শুধু তাই নয়। তিনি এত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে পারস্যের দূতকে সরু কোনো অলিগলির মধ্যে পথচলার সময় পাগলা হাতি লেলিয়ে দিয়ে বধ করতে বলেছিলেন। একদিন হাতি লেলিয়ে দেওয়াও হয়েছিল। পালকি চড়ে পারস্যের দূত রাজধানীর এক সরুগলির ভিতর দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন, সেই সময় পাগলা হাতি তাঁকে লক্ষ্য করে ছেড়ে দেওয়া হল। অন্য কোনো স্বল্প তৎপর বা সাহসী ব্যক্তি হলে নিশ্চয় মারা পড়তেন। পারস্যের দূত পালকি থেকে তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে পড়ে এত তাড়াতাড়ি হাতির শুঁড় লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তে লাগলেন যে হাতি ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল।

ঔরঙ্গজীবের শিক্ষাগুরু মোল্লা শাহের কাহিনি

পারস্যের দূত বিদায় নেবার পর ঔরঙ্গজীব তাঁর বাল্যকালের শিক্ষক মোল্লা শাহকে সম্বর্ধনা জানান।১৬ এ সম্বন্ধে একটি সুন্দর কাহিনি আছে। কাহিনিটি এখানে বিবৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। এই বৃদ্ধ লোকটিকে সাজাহান কিছু সম্পত্তি দান করেছিলেন এবং তিনি বৃদ্ধ বয়সে কাবুলের কাছে কোনো স্থানে অবসর—জীবন যাপন করেছিলেন। সেখানে থেকেই তিনি হিন্দুস্থানের গৃহযুদ্ধের খবর পান এবং জানতে পারেন যে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ঔরঙ্গজীব হিন্দুস্থানের সম্রাট হয়েছেন। খবর পেয়ে মোল্লা সাহেব তাড়াতাড়ি দিল্লি চলে আসেন। তাঁর বাসনা ছিল, হয়তো তাঁর শিষ্য তাঁকে ওমরাহের মর্যাদা দিয়ে গুরুদক্ষিণা দেবে। তার জন্য দরবারের সকলকেই তিনি অনুনয়—বিনয় করেছিলেন। রৌশনআরা বেগম পর্যন্ত তাঁর দাবি সমর্থন করেছিলেন। তিন মাস তিনি দিল্লিতে থাকার পর ঔরঙ্গজীব জানতে পারেন যে তিনি কোনো কাজের জন্য তাঁর কাছে এসেছেন এবং তাঁর কিছু বক্তব্য আছে। কিন্তু প্রতিদিন তাঁকে দরবারে উপস্থিত থাকতে দেখে তিনি শেষে তাঁকে নির্জনে দেখা করার জন্য বললেন। স্বতন্ত্রভাবে মোল্লা শাহের সঙ্গে ঔরঙ্গজীব সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন এবং বললেন যে হাকিম—উল—মুলক দানেশমন্দ খাঁ এবং আর তিন—চারজন আমির ছাড়া আর কেউ সাক্ষাৎকারের সময় উপস্থিত থাকবেন না। সাক্ষাৎকালে তিনি যা বলেছিলেন তার সঠিক বিবরণ আমি যা মোটামুটি সংগ্রহ করতে পেরেছি, তা বলছি। ঔরঙ্গজীব বলেন :

তারপর মোল্লাজী, আপনার মনোবাঞ্ছা কি? আমার সঙ্গে মোলাকাত করার কি উদ্দেশ্য আপনার? আপনি কি চান যে আমি আপনাকে ওমরাহের পদমর্যাদা দিয়ে আমার গুরুদক্ষিণা পরিশোধ করব? আমি আপনাকে শ্রেষ্ঠ রাজকীয় সম্মানে ভূষিত করতেও কুণ্ঠিত হতাম না, যদি বুঝতাম যে বাল্যকালে আপনি আমাকে এমন শিক্ষা দিয়েছেন যা আজ আমার জীবনে মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। হে গুরুদেব! বলতে পারেন, আপনার কাছ থেকে আমি কি শিক্ষা পেয়েছি? আপনি আমাকে শিখিয়েছিলেন যে ‘ফিরিঙ্গিস্থান’ সামান্য একটা দ্বীপ ভিন্ন কিছু নয় এবং সেই দ্বীপের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা হলেন পর্তুগালের রাজা, তারপর হল্যান্ডের রাজা এবং শেষে ইংল্যন্ডের রাজা। ফিরিঙ্গিস্থানের অন্যান্য রাজাদের সম্বন্ধে (যেমন ফ্রান্স ইত্যাদির) আপনি বলেছিলেন যে তাঁরা আমাদের হিন্দুস্থানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের নৃপতিদের মতন এবং হিন্দুস্থানের শক্তি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে অন্য কোনো দেশের তুলনাই হয় না। হিন্দুস্থানের সম্রাটরাও তাঁদের তুলনায় এত বড়ো যে তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, সাজাহান—এঁদের সমতুল্য কোনো রাজা ফিরিঙ্গিস্থানে নেই। হে ভৌগোলিক! হে ইতিহাসবিশারদ! আপনি কি আমাকে পৃথিবীর প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক জাতি সম্বন্ধে কিছু শিক্ষা দিয়েছিলেন? আপনি কি বলেছিলেন আমাকে তাদের অর্থ—সামর্থ্য, আচার—ব্যবহার, রীতি—নীতি, ধর্ম—কর্ম, যুদ্ধ—বিগ্রহ সম্বন্ধে কোনো কথা? আপনি কি আমাকে জানিয়েছিলেন, রাষ্ট্রের উন্নতি ও অবনতি হয় কেন, কেন দেশে দেশে, যুগে যুগে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিদ্রোহ বা বিপ্লব হয়? আপনি আমাকে কিছুই বলেননি, কিছুই শিক্ষা দেননি। এসব কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। আপনি তো আমার পূর্বপুরুষ, যাঁরা এই বিরাট মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, তাঁদের নাম পর্যন্ত বলেননি। আমি কিছুই জানতাম না তাঁদের সম্বন্ধে। প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলির ভাষাও কিছু—কিছু প্রত্যেক সম্রাটের জানা কর্তব্য। আপনি আমাকে আরবি লিখতে ও পড়তে শিখিয়েছেন, আর কোনো ভাষা শেখাবার প্রয়োজন বোধ করেননি। এমন একটি ভাষা (আরবি) আপনি আমাকে শিখিয়েছিলেন, যা সামান্য আয়ত্ত করতেও যে—কোনো বুদ্ধিমান লোকের অন্তত দশ—বারো বছর সময় লাগে। এইভাবে শুধু একটা জরদগব ভাষা শিখিয়ে আপনি আমার মূল্যবান কৈশোর ও যৌবনকাল নষ্ট করে দিয়েছেন। আরবি লিখতে পড়তে শিখেছি, আরবি ব্যাকরণ শিখেছি, জীবনে আর কিছু শিখিনি আপনার কাছে।

এই ভাষায় সম্রাট ঔরঙ্গজীব তাঁর গুরুকে সম্বোধন করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন; যে সম্রাট এখানেই ক্ষান্ত হননি। তিনি আরও অনেক কথা বলেছিলেন। সম্রাট বলেছিলেন :

আপনি কি জানেন না, মোল্লাজী, যে বাল্যকালই হল জীবনের শ্রেষ্ঠ কাল। শিক্ষা দেবার সুবর্ণ সুযোগ ছিল তখন আপনার। আপনি আমাকে আরবির মাধ্যমে প্রার্থনা করতে শিখিয়েছেন, আইনশাস্ত্র, বিজ্ঞান ইত্যাদি শিখিয়েছেন। নিজের মাতৃভাষায় যে—কোনো বিষয় কি আরও সহজে, আরও অনেক ভালোভাবে শেখানো যায় না, মোল্লাজী? আপনি আমার পিতা সাজাহানকে বলেছিলেন যে আমাকে দর্শনশাস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু আমি তো জানি, কি শিখিয়েছেন আপনি আমাকে? কতকগুলি দুর্জ্ঞেয় সূত্র, তার চেয়েও দুর্বোধ্য ভাষায় (আরবিতে) আপনি আমার মগজে জোর করে ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। কি মূল্য আছে তার বাস্তব জীবনে?

মোল্লাজী চুপ করে কথাগুলি শুনছিলেন। ঔরঙ্গজীব এতটুকু উত্তেজিত না হয়ে, অত্যন্ত ধীর, শান্ত ও সংযতভাবে কথাগুলি বলেছিলেন :

আপনি আমাকে রাজকর্তব্যও শিক্ষা দেননি। রাজপুত্র যে একদিন রাজসিংহাসনে বসতে পারে, একথা আপনার খেয়াল হয়নি। হিন্দুস্থানের রাজাদের এটা একটা চরম দুর্ভাগ্য। তাঁরা কোনোদিনই সত্যকার গুরুর কাছে উপযুক্ত শিক্ষা পাননি এবং পান না। আপনি আমাকে যুদ্ধবিদ্যাও শিক্ষা দেননি। যাই হোক, আমার ভাগ্য ভালো যে আপনার মতন বিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়াও আমি আরও কয়েকজনের কাছে শিক্ষা পেয়েছিলাম। তা না হলে আমার পরিণাম যে কি হত তা ভাবতেও ভয় হয় আমার। অতএব, হে সুধীপ্রধান! আপনি স্বগ্রামে অনুগ্রহ করে ফিরে যান। আপনি কে, এবং আপনি কেমন আছেন, তা কারও জানবার দরকার নেই।*

গণৎকারদের মজার গল্প

পারস্যের রাষ্ট্রদূত ও মোল্লাজীকে নিয়ে যখন এসব ব্যাপার চলেছে তখন গণৎকারদের নিয়ে হঠাৎ একটা গণ্ডগোল বেধে গেল। আমার কাছে ঘটনাটা বেশ উপভোগ্যই মনে হয়েছিল। এশিয়ার অধিকাংশ লোকই স্বর্গরাজ্যের সংকেত ও নির্দেশ সম্বন্ধে এত বেশি আস্থাবান যে পৃথিবীর কোনো ঘটনা যে ঊর্ধ্বলোকের ইশারা ছাড়া ঘটতে পারে, এ তারা কল্পনাই করতে পারে না। তাই পদে পদে তারা গণৎকারের শরণাপন্ন হয়। গণৎকারের পরামর্শ ছাড়া জীবনে এক—পাও তারা চলতে চায় না। যুদ্ধক্ষেত্রে দুই পক্ষের সেনাবাহিনি হয়তো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু যতক্ষণ না ‘সাহেৎ’ অনুষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ শুভমুহূর্ত বিজ্ঞাপিত হয়, ততক্ষণ সেনাধ্যক্ষরা যুদ্ধ আরম্ভ করার হুকুম দেন না। শুধু যুদ্ধবিগ্রহ নয়, জীবনের কোনো কাজই জ্যোতিষীর পরামর্শ ও আদেশ ছাড়া করা হয় না। সেনাপতি নিয়োগ করতে হবে, গণৎকারের পরামর্শ চাই; বিবাহ করতে হবে বা দিতে হবে, তাও গণৎকারের অনুমতি চাই; কোনো স্থানে যাত্রা করতে হবে, গণৎকার যাত্রার শুভক্ষণ বলে দেবেন। সর্বদা ও সর্বত্র মঁসিয়ে গণৎকার হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ পরামর্শদাতা ও বন্ধু। জীবনের অতি তুচ্ছ প্রাত্যহিক ঘটনাও গণৎকার নিয়ন্ত্রণ করেন। কেউ হয়ত একটি ক্রীতদাস কিনবেন, তাও গণৎকারকে জিজ্ঞাসা করা চাই। কেউ হয়ত বৎসরান্তে নতুন পোশাক পরবেন, তাও পরা উচিত কি না গণৎকার বলে দেবেন।

এই জাতীয় জঘন্য কুসংস্কার, কথায় কথায় গণৎকার, পদে পদে জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হওয়া—এ আমি আর কোথাও দেখিনি। মনে হয়, এদেশের লোক জন্ম থেকে জীবনটাকে যেন জ্যোতিষীর কাছে বন্ধক দিয়ে দিয়েছে। জ্যোতিষীর এই অখণ্ড প্রতিপত্তির ফলে অনেক সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যথেষ্ট। দেশের ও সমাজের, ব্যক্তির ও রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্ম, নীতি ও পরিকল্পনার সঙ্গে জ্যোতিষীদের সর্বাগ্রে পরিচয় হয়। যা হয়ত একান্তভাবে জনকল্যাণের স্বার্থে বা বৃহত্তর গোষ্ঠীর স্বার্থে গোপন রাখা প্রয়োজন, তাও গণৎকাররা পূর্বাহ্নেই জানতে পারেন। জানার ফলে স্বভাবতই অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, ঘটতে বাধ্য।

এইবার ঘটনাটি বলি। চমকপ্রদ ঘটনা। প্রধান রাজজ্যোতিষী যিনি তিনি হঠাৎ একদিন পুষ্করিণীর জলের মধ্যে পড়ে গেলেন এবং এমন পড়া পড়লেন যে আর উঠলেন না। অর্থাৎ জলে ডুবে রাজজ্যোতিষী ভবলীলা সংবরণ করলেন। সংবাদটি বাইরে প্রকাশ হওয়া মাত্র চারিদিকে হুলস্থূল পড়ে গেল, রাজদরবারেও যথেষ্ট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। গণৎকাররা রীতিমতো ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। অন্য কোনো কারণে নয়, তাঁদের জ্যোতিষী পেশার কথা ভেবে। রাজজ্যোতিষী যিনি জলে ডুবে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হলেন, তিনি সম্রাট ও তাঁর আমির—ওমরাহদেরই ভবিষ্যদ্বক্তা ছিলেন। সুতরাং বাইরের সাধারণ লোক তাঁকে খুব জবরদস্ত জ্যোতিষী মনে করত। তারা ভাবল, যিনি রাজা—রাজড়া ও আমির—ওমরাহদের জীবনের প্রত্যেক ছোটোবড়ো ঘটনা সম্বন্ধে এতদিন ধরে ভবিষ্যদ্বাণী করে এসেছেন, ভবিষ্যতের প্রত্যেকটি ঘটনা যিনি দিব্য চক্ষে দেখতে পেতেন, তিনি নিজে তাঁর মর্মান্তিক ভবিষ্যৎটি দেখতে পেলেন না কেন? কেন তিনি বুঝতে পারলেন না যে জলে নামলেই তিনি পড়ে যাবেন এবং পড়ে গেলে আর গাত্রোত্থান করবেন না? সকলের ভাগ্যবিধাতা ও ভবিষ্যদ্বক্তা যিনি, তিনি কেন নিজের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ দিব্যচক্ষে দেখতে পেলেন না? এ—প্রশ্ন সকলের মনেই উঁকি দিতে লাগল, কেউ তার কোনো সন্তাোষজনক জবাব পেলেন না। অনেকের মনে ফিরিঙ্গিস্থানের ‘বিজ্ঞান’ ও হিন্দুস্থানের ‘জ্যোতিষ’ সম্বন্ধে নানারকমের প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল।

জ্যোতিষীরা সকলে এই ধরনের কথাবার্তায় ও আলাপ—আলোচনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের পেশা সম্বন্ধে এসব বিরূপ মন্তব্য তাঁদের আদৌ মনঃপুত হত না। জ্যোতিষী সম্বন্ধে নানারকমের ঠাট্টাবিদ্রূপ যখন বাইরে পুর্ণোদ্যমে আরম্ভ হল, তখন তাঁরা রীতিমতো বিচলিত হয়ে উঠলেন। জ্যোতিষীদের সম্বন্ধে নানারকমের কাহিনিও রটনা হতে লাগল। তার মধ্যে একটি কাহিনির খুব বেশি প্রচার হয়েছিল এই সময়। কাহিনিটি পারস্যের সম্রাট শাহ আব্বাস সম্বন্ধে। কাহিনিটি এই :

পারস্যের সম্রাট সাহ আব্বাস একবার তাঁর জেনানামহলের মধ্যে একটি ছোটো সুন্দর বাগিচা করার বাসনা প্রকাশ করেন। সম্রাটের বাসনা বাস্তবে রূপ দেবার জন্য উদ্যানপালক উদযোগী হলেন এবং কয়েকটি ফলের বৃক্ষ রোপণের দিনও তিনি ঠিক করলেন। সংবাদ শুনে রাজজ্যোতিষী সম্রাটকে জানালেন যে শুভদিন দেখে যদি বৃক্ষরোপণ না করা হয়, তাহলে সেই বৃক্ষে ফল ধরার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। সম্রাট সাহ আব্বাস রাজজ্যোতিষীর কথার যৌক্তিকতা স্বীকার করলেন। জ্যোতিষী মশাই তাঁর পুঁথিপত্র নিয়ে দিন স্থির করতে বসলেন। পুঁথি দেখে তিনি গম্ভীরভাবে বললেন যে আর এক ঘণ্টার মধ্যে যদি বৃক্ষগুলি রোপণ করা না হয় তাহলে গ্রহনক্ষত্রের যোগাযোগের শুভ মুহূর্তটি কেটে যাবে এবং বৃক্ষে ফল ফলবে না। রাজজ্যোতিষীর এই সিদ্ধান্তের সময় উদ্যানপালক উপস্থিত ছিলেন না। সুতরাং অন্য লোকজন ডেকে তাড়াতাড়ি বৃক্ষ রোপণের ব্যবস্থা করা হল। মাটিতে গর্ত খোঁড়া হল, সম্রাট নিজের হাতে চারাগাছগুলি রোপণ করলেন। সমস্ত কাজ এইভাবে শেষ হয়ে যাবার পর, উদ্যানপালক ফিরে এসে দেখল তার করণীয় কর্ম কে শেষ করে রেখেছে। গাছগুলি সব উলটোপালটা করে রোপণ করা হয়েছে। আমের জায়গায় নোনা, নোনার জায়গায় আপেল লাগানো হয়েছে। এরকম বিসদৃশ কাণ্ডটা কে করেছে এবং কেন করেছে তা ভেবে দেখবার সময় হল না তার। রীতিমতো বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে উদ্যানপালক সমস্ত গাছ উপড়ে ফেলে দিল। তারপর চারাগাছগুলি সারারাত মাটিতে ফেলে রাখা হল সকালে যথাসময়ে রোপণ করার জন্য। খবরটি রাজজ্যোতিষীর কানে পৌঁছল এবং তিনিও তৎক্ষণাৎ সম্রাটের কানে সেটি পৌঁছে দিলেন। সম্রাট উদ্যানপালককে ডেকে পাঠালেন। উদ্যানপালক হাজির হল। সাহ আব্বাস ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন : ‘আমার নিজের হাতে লাগানো গাছ কে তোমাকে উপড়ে ফেলার আদেশ দিলে? দিনক্ষণ দেখে গাছ লাগানো হয়েছে, আর তুমি সেই গাছ কাউকে জিজ্ঞাসা না করে উপড়ে ফেললে কেন? এখন আর গাছের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, গাছ লাগালেও কিছু হবে না।’ উদ্যানপালক কিছুক্ষণ অবাক হয়ে সকলের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল : ‘হায় আল্লা! এই কি সাহেৎ? দ্বিপ্রহরে বৃক্ষ রোপণ করলে সন্ধ্যার সময় তা উপড়ে ফেলাই ভালো!’ সম্রাট সাহ আব্বাস গ্রাম্য উদ্যানপালকের কথায় হো—হো করে হেসে ফেললেন এবং রাজজ্যোতিষীর দিকে ফিরে মুচকি হেসে চুপ করে চলে গেলেন।

হিন্দুস্থানের ব্যক্তিগত সম্পত্তি

এখানে আমি আরও দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব যা থেকে হিন্দুস্থানের সামাজিক প্রথা সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা হবে। ঘটনা দুটি সম্রাট সাজাহানের রাজত্বকালে ঘটেছিল। ঘটনা দুটি বিবৃত করা প্রয়োজন, কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তি সম্বন্ধে মোগলযুগেও হিন্দুস্থানে যে কি রকম বর্বর প্রথা চালু ছিল, তা এই ঘটনা থেকে বুঝতে পারা যায়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোনো পবিত্রতা রক্ষা করা হত না, নিরাপত্তাও ছিল না। সম্পত্তি সব হল সম্রাটের। রাষ্ট্রের ও ব্যক্তির সমস্ত সম্পত্তির মালিক সম্রাট।* সম্রাটের অধীনে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোনো অধিকারই স্বীকৃত হয় না। তাঁদের মৃত্যুর পর যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হন সম্রাট নিজে। এইবার ঘটনা দুটি বলছি।

নায়েক খাঁ নামে মোগল দরবারের একজন প্রবীণ আমির ছিলেন। প্রায় চল্লিশ—পঞ্চাশ বছর রাজ—দরবারে নানা দায়িত্বপূর্ণ পদে তিনি নিযুক্ত থেকে যথেষ্ট ধনসম্পত্তি সঞ্চয় করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তি যে সম্রাটের করতলগত হবে তা তিনি জানতেন। তিনি জানতেন, এই বর্বর প্রথার জন্য কিভাবে ওমরাহদের মৃত্যুর পর তাদের বিধবা পত্নীরা দুর্দশার চরম সীমায় উপস্থিত হন এবং সামান্য ভাতার জন্য সম্রাটের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হন। তিনি জানতেন, কিভাবে মৃত ওমরাহদের পুত্ররা সামান্য জীবিকার জন্য অন্যান্য ওমরাহদের ব্যক্তিগত সেনাদলে নাম লেখাতে রাজি হন। নায়েক খাঁ যখন দেখলেন যে তাঁর অন্তিমকাল আসন্ন, তখন তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজন ও কর্মচারীদের ডেকে তাঁর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ বিলিয়ে দিলেন এবং সিন্দুকের মধ্যে মোহর ও টাকার বদলে লোহা ও হাড়ের টুকরো, পুরোনো ছেঁড়া জুতো, ছেঁড়া কাপড় ইত্যাদি ভরতি করে রেখে দিলেন। এইভাবে সিন্দুক ভরতি করে, শীলমোহর করে দিয়ে তিনি সকলকে জানিয়ে দিলেন যে সিন্দুকে যেন কেউ হাত না দেন, কারণ তাঁর মৃত্যুর পর এই সিন্দুকের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ সম্রাট সাজাহানের প্রাপ্য। নায়েক খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কথানুযায়ী সেই সিন্দুক সম্রাট সাজাহানের কাছে বহন করে নিয়ে যাওয়া হল। সম্রাট তখন রাজদরবারে আমলা—অমাত্য পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন। এমন সময় আমির নায়েক খাঁর সিন্দুক সেখানে বহন করে আনা হল। আনা মাত্রই সম্রাট সকলের সামনে তাদের সিন্দুক খোলার অনুমতি দিলেন। তারপর সিন্দুকের মধ্যে সযত্নে রক্ষিত দ্রব্যাদি দেখে তাঁর কি অবস্থা হল তা সহজেই অনুমান করা যায়। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সম্রাট সাজাহান তাঁর সিংহাসন থেকে উঠে দরবার ছেড়ে চলে গেলেন। এই হল প্রথম ঘটনা।

দ্বিতীয় ঘটনাটি একটি স্ত্রীলোকের উপস্থিত বুদ্ধির পরিচায়ক। একজন বিখ্যাত বেনিয়ানের মৃত্যুর পর ঘটনাটি ঘটে।* বেনিয়ান ভদ্রলোক দীর্ঘদিন সম্রাটের অধীনে নিযুক্ত ছিলেন এবং মহাজনি কারবার করে যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র পিতার সঞ্চিত অর্থের ভাগ চায়, কিন্তু বেনিয়ানের বিধবা পত্নী তা দিতে রাজি হন না। কারণ তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রটি অত্যন্ত অমিতব্যয়ী এবং কাঁচা পয়সা হাতে পেলে দুদিনে যে সে ফুঁকে দেবে তা তিনি জানতেন। টাকা না পেয়ে পুত্র মায়ের ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য পিতার সঞ্চিত অর্থের সংবাদ সম্রাটকে জানিয়ে দেয়। সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ হল দু—লক্ষ টাকা। সংবাদ পেয়ে সম্রাট বেনিয়ানের বিধবা পত্নীকে ডেকে পাঠালেন। ওমরাহদের সামনে তাঁকে বললেন যে অবিলম্বে যেন তিনি এক লক্ষ টাকা তাঁকে পাঠিয়ে দেন এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রকে দেন। এই কথা বলে তিনি বিধবা স্ত্রীলোকটিকে হলঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন।

স্ত্রীলোকটি কিন্তু সম্রাটের এই রূঢ় ব্যবহারে আদৌ বিচলিত হলেন না। জমাদাররা যখন তাঁকে হলঘর থেকে বাইরে বিতাড়িত করার জন্য উদ্যত, তখন তিনি বললেন যে তিনি সম্রাটকে আরও দু—একটি কথা জানাতে চান। সাজাহান শুনে বললেন : ‘বলতে দাও, কি বলতে চান উনি, শুনি।’ স্ত্রীলোকটি বললেন : ‘ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন! আমার কনিষ্ঠ পুত্র টাকা দাবি করেছেন পুত্র হিসাবে। তার অধিকার আছে, সে চাইতে পারে। আপনিও দেখছি টাকা চাইছেন। জানি না, আপনার সঙ্গে আমার মৃত স্বামীর সম্পর্ক কি? অনুগ্রহ করে যদি বলেন, আপনার সঙ্গে আমার স্বামীর আত্মীয়তার সম্পর্ক কি, তাহলে আমি আনন্দিত হব।’ সরল স্ত্রীলোকের এই সহজ উক্তি শুনে সম্রাট সাজাহান প্রীত হলেন এবং সামান্য একজন সুদখোর ব্যবসায়ী বেনিয়ানের সঙ্গে হিন্দুস্থানের সম্রাটের আত্মীয়তার প্রশ্নে বিদ্রূপের হাসি হেসে বললেন : ‘টাকা আপনার চাই না, আপনিই নিশ্চিন্তে ভোগ করুন।’

১৬৬০ সালে হিন্দুস্থানের ঘরোয়া যুদ্ধবিগ্রহ শেষ হবার পর থেকে ১৬৬৬ সালে আমার হিন্দুস্থান থেকে বিদায় নেবার সময় পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। তার বিস্তৃত বিবরণ এখানে আমার বিস্তৃত করার ইচ্ছা নেই। করতে পারলে অবশ্য ভালোই হত। আপাতত কয়েকজন ব্যক্তি সম্বন্ধে কিছু আমি বলতে চাই। যাঁদের সান্নিধ্যে আমি এসেছি এবং ব্যক্তিগতভাবে যাঁদের সম্বন্ধে কিছু বলবার অধিকার আমার আছে—এরকম কয়েকজন সম্বন্ধে এবারে কিছু আমি বলব। যাঁদের কথা বলব, তাঁরা প্রত্যেকেই ঐতিহাসিক চরিত্ররূপে উল্লেখযোগ্য।

সম্রাট সাজাহানের চরিত্র

প্রথমে সাজাহানের কথা বলি। যদিও ঔরঙ্গজীব তাঁর পিতাকে আগ্রার দুর্গে বন্দি করে রেখেছিলেন এবং অত্যন্ত কড়া পাহারার মধ্যে তাঁকে রাখতেন, তাহলেও বৃদ্ধ পিতাকে তিনি যথেষ্ট উদারতা ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। সাজাহানকে তিনি খুশি অনুযায়ী থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং তাঁর বেগমসাহেবা, জেনানা ও নর্তকীদেরও তাঁর সঙ্গে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ব্যক্তিগত বিলাস ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বৃদ্ধ সাজাহান যখন যা চেয়েছেন, তখন তা—ই তাঁকে মঞ্জুর করা হয়েছে। যখন ধর্মকর্ম করার ঝোঁক হল তাঁর, তখন মোল্লা—মৌলবীদেরও তাঁর কাছে কোরানপাঠের জন্য নিয়মিত যাবার অনুমতি দেওয়া হল। তাছাড়া, নানারকমের জীবজন্তু—ভালো ভালো ঘোড়া, বাজপাখি, হরিণ প্রভৃতি—যখন যা তিনি তলব করতেন, সব তাঁকে পাঠানো হত। সাজাহান জানোয়ারের ও পাখির লড়াই দেখতে ভালোবাসতেন। বাস্তবিকই, ঔরঙ্গজীব বরাবর তাঁর পিতার প্রতি যথেষ্ট উদার আচরণ করেছেন, এবং কোনোদিন তাঁর প্রতি রূঢ় ব্যবহার করেননি বা অশ্রদ্ধা দেখাননি। তিনি প্রায়ই তাঁর পিতাকে নানারকমের উপহার পাঠাতেন, গুরুতর ব্যাপারে পরামর্শও করতেন এবং অত্যন্ত ভদ্র ও নম্র ভাষায় চিঠিপত্রও লিখতেন। এই আচরণের জন্যই সাজাহানের ক্রুদ্ধ ও উদ্ধত স্বভাব শেষ পর্যন্ত শান্ত ও নম্র হয়েছিল। এমনকি, ঔরঙ্গজীবের প্রতি বিরূপ মনোভাব তাঁর আর ছিল না। রাজনৈতিক ব্যাপারে তিনি ঔরঙ্গজীবকে চিঠি লিখতেন, দারার কন্যাকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং যে মূল্যবান মণিরত্ন একদিন তিনি চূর্ণ করে ফেলবেন বলেছিলেন, তাও তাঁকে উপহার দিয়ে খুশি হয়েছিলেন। বিদ্রোহী পুত্রকে তিনি শেষে সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা করেছিলেন এবং আশীর্বাদও জানিয়েছিলেন।

এ পর্যন্ত যা বললাম তাতে মনে হয় যে ঔরঙ্গজীব বোধ হয় সবসময় তাঁর পিতাকে খুশি করবার চেষ্টা করতেন এবং কখনো কঠোর ব্যবহার করতেন না। কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। পিতাকে খুশি করবার জন্য তিনি অকারণে কখনো মাথা হেঁট করতেন না। বৃদ্ধ সাজাহানকে লেখা ঔরঙ্গজীবের এমন একখানা চিঠির কথা অন্তত আমি জানি যার মধ্যে তিনি তাঁর পিতার কোনো উদ্ধত উক্তির প্রতিবাদে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় জবাব দিয়েছিলেন। এই চিঠির কিছুটা অংশ আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম। এখানে তা উদ্ধৃত করছি :

আপনার ইচ্ছা যে আমি সনাতন প্রথা আঁকড়ে ধরে থাকি এবং আমার অধীন যে কোনো কর্মচারীর মৃত্যুর পর তার যাবতীয় ধনসম্পত্তি নিজে গ্রাস করে বসি। যখন কোনো আমীর বা কোনো ধনী ব্যবসায়ী মারা যান, এমন কি তাঁদের মৃত্যুর আগেই, আমরা তাঁর ধনসম্পত্তি সব গ্রাস করি, তাঁদের অধীন কর্মচারী ও ভৃত্যদের পদচ্যুত করে দূর করে দিই। সামান্য একটুকরো সোনাদানাও আমরা ফেলে দিই না। এইভাবে অপরের সঞ্চিত ধনরত্ন আত্মসাৎ করার হয়ত একটা অস্বাভাবিক আনন্দ থাকতে পারে, কিন্তু এর মতন নিষ্ঠুর ও অন্যায় আচরণ আর নেই। আমীর নায়েক খাঁ অথবা হিন্দু বেনিয়ানের সেই বিধবা পত্নী আপনার প্রতি যে ব্যবহার করেছিলেন এবং এই অন্যায় প্রথার যে সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন, তা অবাঞ্ছনীয় বা অপ্রীতিকর হলেও সম্পূর্ণ ন্যায়সংগত নয় কি?

সুতরাং আপনার অভিযোগ ও আদেশ আমি মান্য করতে পারলাম না এবং আপনি আমার ব্যক্তিগত চরিত্রের প্রতি যে কটাক্ষ করেছেন, তাও আমি স্বীকার করে নিতে অক্ষম। আজ আমি রাজতক্তে বসেছি বলে আপনি ভুলেও মনে করবেন না যে আমি অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে গেছি। প্রায় চল্লিশ বছরের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আপনি নিশ্চয়ই খুব ভালোভাবে জানেন যে রাজমুকুট মাথায় ধারণ করার দায়িত্ব, অশান্তি ও ঝঞ্ঝাট কতখানি।…

আপনার ইচ্ছা, রাজ্যের শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সুখসমৃদ্ধির জন্য আমি বিশেষ মনোযোগ না দিই এবং তার পরিবর্তে রাজ্যের সীমানাবৃদ্ধির জন্য যুদ্ধবিগ্রহের পরিকল্পনা বেশি করে রচনা করি। অবশ্য একথা আমি স্বীকার করি যে প্রত্যেক শক্তিশালী সম্রাটের উচিত যুদ্ধবিগ্রহে জয়লাভ করে রাজ্যের সীমানা বাড়ানো। আমার যদি সে ইচ্ছা না থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে আমি তৈমুরের বংশধর নই। সব স্বীকার করলেও আপনি আমাকে নিষ্ক্রিয় বলতে পারেন না। আমার সেনাবাহিনী যে কোনো যুদ্ধই করেনি এবং রাজ্যও জয় করেনি, এমন অভিযোগও করা যায় না। দাক্ষিণাত্যে ও বাংলাদেশে আমার সৈন্যরা এদিক দিয়ে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আপনাকে একথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, শুধু রাজ্য জয় করাই শ্রেষ্ঠ রাজাদের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য নয়। পৃথিবীর বহু দেশ ও বহু জাতি অসভ্য বর্বরদের পদানত হয়েছে এবং অনেক দিগ্বিজয়ী দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাটের সুবিস্তৃত সাম্রাজ্য পথের ধূলায় গুঁড়িয়ে গেছে। সুতরাং সাম্রাজ্য জয় করাই সম্রাটের অন্যতম কর্তব্য নয়। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য, রাজ্যের সমৃদ্ধির জন্য, ন্যায়সঙ্গতভাবে রাজ্য পরিচালনা করাই প্রত্যেক সম্রাটের অন্যতম কর্তব্য।*

মগ ও পর্তুগিজ বোম্বেটেদের কথা

বাংলাদেশের সুবাদার হয়ে এসে সায়েস্তা খাঁ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিলেন। কাজটি হল, বাংলাদেশকে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারের কবল থেকে মুক্ত করা। এ কাজের দায়িত্ব তাঁর পূর্বগামী শাসনকর্তা বিখ্যাত মীর জুমলা কেন গ্রহণ করেননি, তা তিনিই জানেন। সায়েস্তা খাঁ যে কি বিরাট দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলেন তা বুঝতে হলে তখনকার বাংলাদেশের অবস্থা সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। বাংলার সীমান্তে আরাকান রাজ্যে বা মগদের দেশে পর্তুগিজ ও অন্যান্য ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। গোয়া, সিংহল, কোচিন, মালাক্কা প্রভৃতি দেশ থেকে পালিয়ে এসে তারা এখানে আশ্রয় নিত। এমন কোনো অপকর্ম ছিল না যা তারা করতে পারত না। তারা নামেই শুধু খ্রিস্টান ছিল, কিন্তু তাদের মতন জঘন্য পিশাচ—প্রকৃতির লোক সচরাচর দেখা যেত না। খুনজখম, ধর্ষণ, লুঠতরাজ ইত্যাদি ব্যাপারে তাদের সমকক্ষ কেউ ছিল না। আরাকানের রাজা তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন নিজের স্বার্থে। মোগলদের ভয়ে সব সময় তিনি সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতেন এবং যুদ্ধবিগ্রহ আশঙ্কা করে এই ফিরিঙ্গি দস্যুদের তিনি নিজের দেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই পর্তুগিজ দস্যুরা মগদের প্রশ্রয় ও উস্কানি পেয়ে রীতিমতো যথেচ্ছাচার করতে আরম্ভ করল। বাংলার উপকূল অঞ্চলে জলপথে তারা লুঠতরাজ অত্যাচার করে বেড়াতে লাগল। এই সময় গঙ্গার অসংখ্য শাখানদী দিয়ে ভিতরে ঢুকে গিয়ে নিম্নবঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চলে তারা লুঠতরাজ করতে আরম্ভ করল। হাট—বাজারের দিন গ্রামের মধ্যে ঢুকে গ্রামের লোকদের তারা ক্রীতদাস করার জন্য বন্দি করে নিয়ে যেত। উৎসব—পার্বণের দিনও তারা এইভাবে গ্রামাঞ্চলে হানা দিত। অনেক সময় গ্রামের পর গ্রাম আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিত। নিম্নবঙ্গের কত শত গ্রাম এইভাবে যে তারা লুণ্ঠন করেছে এবং অত্যাচার করে জনশূন্য করেছে, তার হিসেব নেই। এই ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের অত্যাচারে নিম্নবঙ্গের অনেক জনবহুল গ্রাম লোকালয়শূন্য অরণ্যে পরিণত হয়েছে।১৭

ঔরঙ্গজীবের মহত্ত্ব

এইখানেই আমার ইতিহাস শেষ হল। পাঠকরা নিশ্চয় ঔরঙ্গজীবের সিংহাসন দখলের নিষ্ঠুর পদ্ধতি অনুমোদন করবেন না। আমিও করি না। না করাই স্বাভাবিক। যে কৌশলে ঔরঙ্গজীব তাঁর পিতার সিংহাসন দখল করেছিলেন, তা নিশ্চয় নিষ্ঠুর ও অন্যায় কৌশল। কিন্তু যেমন ইউরোপের রাজাদের আমরা বিচার করে থাকি, সেইভাবে বোধ হয় ঔরঙ্গজীবকে বিচার করা উচিত হবে না। ইউরোপে রাজার মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা হন উত্তরাধিকারসূত্রে। জ্যেষ্ঠপুত্রের এই অধিকার সেখানে বিধিবদ্ধ। হিন্দুস্থানে সেরকম কোনো আইন বা বিধান নেই। রাজার মৃত্যুর পর তাই রাজপুত্ররা সিংহাসন নিয়ে কলহ করেন, যুদ্ধবিগ্রহও করেন, কারণ তাঁরা জানেন যে যিনি সিংহাসন এইভাবে দখল করতে পারবেন তিনিই ভাগ্যবান, বাকি সকলকে সেই ভাগ্যবানের অধীনে হতভাগ্যের মতন জীবনযাপন করতে হবে। তা সত্ত্বেও যাঁরা সম্রাট ঔরঙ্গজীবকে নিন্দাবাদ করবেন, তাঁদের অন্তত এইটুকু স্বীকার করা উচিত যে সমস্ত দোষত্রুটি নিয়েও তাঁর মতন একজন প্রতিভাবান, শক্তিশালী, বিচক্ষণ ও মহান সম্রাট হিন্দুস্থানে খুব কমই জন্মেছিলেন।

………………

১. বার্নিয়েরের এই প্রত্যক্ষ বিবরণের মধ্যে মোগল রাজদরবারের রাষ্ট্রীয় আদবকায়দা সম্বন্ধে অনেক কিছু জ্ঞাতব্য বিষয় আছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিক দিয়ে এর মূল্য অস্বীকার করা যায় না। জ্ঞাতব্য বিষয়ের দিকে নজর রেখে এখানে তাই প্রত্যক্ষদর্শী বার্নিয়েরের এই বিবরণের আমি সারানুবাদ করেছি।—অনুবাদক।

২। ‘ওমরাহ’ কথাটি কিন্তু ‘আমির’ শব্দের বহুবচন, মোগল রাজদরবারের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু সাধারণত লেখকরা ও বিদেশি পর্যটকরা ‘আমীর’ ও ‘ওমরাহ’ একই অর্থে (একবচনে) ব্যবহার করেন।

 Amir. corruptly Emir .A nobleman, a Mohammedan of high rank.

 Amra or Umra corruptly Omrah. The nobles of a native Mohammedan court collectively–(Wilson’s Glossary)

৩। ‘Lapis-Lazuli’ গাঢ় নীলবর্ণের মূল্যবান পাথরবিশেষ নীলোপল বা বৈদুর্যমণি বলা হয়। এই পাথর গুঁড়ো করে পারস্য কাশ্মীর ও দিল্লির লিপিকররা পাণ্ডুলিপি চিত্রণের জন্য নীল রং তৈরি করতেন। বৈদুর্যমণিচূর্ণের এই নীলরঙের উজ্জ্বলতার সঙ্গে আজকালকার রাসায়নিক পদ্ধতিতে তৈরি নীলরঙের কোনো তুলনাই হয় না। এইসব মণিরত্ন রাষ্ট্রদূতরা উপটোকন দিতেন, বোধহয় তাজমহলের জন্য। তাজমহল তৈরি যদিও ১৬৪৮ সালে শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাহলেও তার কারুকাজ শেষ করতে নিশ্চয় আরও দীর্ঘদিন সময় লেগেছিল (‘built by Titans, finished by Jewellers’)। ১৮৬৯ সালে লাহোর থেকে প্রকাশিত একখানি ফারসি পাণ্ডুলিপির মধ্যে তাজমহল নির্মাণের বিস্তৃত বিবরণ আছে। তাতে বলা হয়েছে যে নীলোপল সিংহল থেকে আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু একথাও প্রসঙ্গত বলা হয়েছে যে তাজমহল নির্মাণে যেসব মূল্যবান মণিরত্ন ব্যবহার করা হয়েছে তার অধিকাংশই রাজামহারাজা—নবাবরা স্বেচ্ছায় উপহার দিয়েছেন অথবা বিদেশের রাজারা উপঢৌকন পাঠিয়েছেন।

৪। বোখারার এই শুকনো খেজুর, কিশমিশ ইত্যাদি ফলকেই আমরা ‘আলুবোখরা’ বা আলুবখরা (চলতি কথায়) বলি কি?

৫। সমরকন্দ এককালে তৈমুরের রাজধানী ছিল এবং তখন তার রূপ ছিল অন্যরকম। সমরকন্দের মধ্যস্থলে ছিল রিজিস্থান, একটি স্কয়ার, তার মধ্যে তিনটি বিখ্যাত মাদ্রাসা—উলুগবেগ, শের দর ও তিন্ন—করি। স্থাপত্যের সৌন্দর্যে ইতালি শহরের স্কয়ারগুলির সঙ্গে এর তুলনা করা চলে।…’ শের দর মাদ্রাসা ১৬০১ সালে তৈরি হয় এবং তার সিংহদ্বারের মাথায় দুটি সিংহ থেকে নাম হয় ‘শের—দর’। নীল, সবুজ, লাল ও সাদা এনামেল—করা ইট দিয়ে মাদ্রাসাটি তৈরি এবং সমরকন্দের উক্ত তিনটি মাদ্রাসার মধ্যে এই শের—দরই অন্যতম ও বৃহত্তম। ১২৮ জন মোল্লা এই মাদ্রাসার ৬৪ খানা ঘরে বাস করতেন। ‘তিন্ন—করি’ অর্থে ‘স্বর্ণাচ্ছাদিত’, ১৬১৮ সালে তৈরি এই মাদ্রাসার ৫৬টি ঘর ছিল। কিন্তু আয়তনে সবচেয়ে ছোটো হলেও ‘উলুগ—বেগ’ মাদ্রাসাই সবচেয়ে বিখ্যাত, ১৪২০ (বা ১৪৩৪) সালে তৈমুর নিজে তৈরি করেছিলেন। গণিত ও জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চার জন্য এই উলুগ বেগ মাদ্রাসা পঞ্চদশ শতাব্দীতে সমগ্র প্রাচ্য ভূখণ্ডে খ্যাতি অর্জন করেছিল।’ (Encyclopaedia Britannica 9th ed. 1886)

৬। ১১০০ খ্রিস্টাব্দে তাতারবাহিনী চিনে প্রথম অভিযান করেছিল। বার্নিয়ের বোধ হয় সেই অভিযানের কথা বলছেন না। তখন তাতাররা বিতাড়িত হয় এবং ১৬৪৪ সালে পুনরায় অভিযান করে চিন জয় করে। সুন—চি সম্রাট হন চিনের। বার্নিয়ের এই চিন বিজয়ের কথা বলছেন। তখন যে মাঞ্চু—তাতার রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়, ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁদের বংশধররাই চিনে রাজত্ব করেন।

৭. ফারসি ‘পিলাও’ থেকে ‘পোলাও’ কথার উৎপত্তি, মুসলমান আমলের বিখ্যাত খাদ্য। ওভিঙটনসাহেব তাঁর ‘A Voyage to Suratt in the year 1689’ নামক গ্রন্থে (১৬৯৬ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত) ‘পোলাও’ সম্বন্ধে এই বর্ণনা দিয়েছে : Palau that is Rice boiled so artificially, that every grain lies singly without being added together, with species intermixt and a boil’d Fowl in the middle, is the most common Indian Dish; and a dumpoked Fowl that is boil’d with butter in any small vessel, and stuff with Raisons and Almounds is, another.’ (৩৯৭ পৃষ্ঠা) পোলাও বিলাসিরা এই বর্ণনা পড়ে খুশি হবেন। নানারকমের মশলাপাতি ও ঘি দিয়ে চাল একইভাবে সিদ্ধ করে রান্না তার মধ্যিখানে একটি সিদ্ধ মুরগি, এই হল পোলাও অর্থাৎ মুরগির পোলাও। অবশ্য ওভিংটন বললেও, এই খাদ্য মোগলযুগে ‘common’ (সাধারণের খাদ্য) ছিল না, তিনি যে মহলে ঘেরাফেরা করতেন অর্থাৎ ওমরাহ—মহলে ও রাজদরবারে, সেখানে হয়ত ‘common dish’ ছিল। ‘Dumpoked’ কথাটি সাহেব কিন্তু ফারসি ‘দমপুথত’ থেকে ইংরেজি করেছেন, অর্থ হল ‘steam-boiled’ বাষ্পে সিদ্ধ। আজকালকার দিনে ‘দমপুথত’ বা ‘স্টীমসিদ্ধ’ মুরগির কথা নিশ্চয় ব্যাখ্যা করে বোঝাবার দরকার নেই।

৮. বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তের ডাচ সংস্করণে (আমস্টার্ডম ১৬৭২ সাল) এই কাহিনিটির একটি চমৎকার খোদাই—চিত্র আছে। ইংরেজি সংস্করণে ছবিটি নেই।

৯. ঔরঙ্গজীবের অসুখের তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে। ঔরঙ্গজীব পীড়িত হন—১৬৬২ সালের মে—আগস্ট (Indian Antiquary, ১৯১১)

১০। দার্ক ভ্যান্ আদ্রিকেন্ (Dirk Van Adrlchen) ১৬৬২ থেকে ১৬৬৫ সাল পর্যন্ত সুরাটের ডাচ কুঠির ডিরেক্টর ছিলেন। তিনিই বাদশাহ ঔরঙ্গজীবের কাছ থেকে একখানি ফরমান আদায় করে (দিল্লি ২৯ অক্টোবর ১৬৬২ সাল) বাংলাদেশে ও উড়িষ্যায় বাণিজ্যের নানাবিধ সুযোগ সুবিধা করে নিয়েছিলেন। মোগল দরবারে রাষ্ট্রদূত হয়ে গিয়ে তিনি এই ফরমানটি আদায় করে নিয়ে আসেন।

১১। মোগলযুগের ভারতীয় চিত্রকরের আঁকা রাজদরবারের ছবির মধ্যে জাপানি ও চিনা ফুলদানি ইত্যাদি যথেষ্ট দেখা যায়। তার থেকে বোঝা যায় যে চিনা ও জাপানি দ্রব্যাদি মোগল দরবারে অনেকে উপহার দিতেন।

১২। ‘তখ্ৎ—রওয়ান” কথার অর্থ ‘চলন্ত সিংহাসন’। ‘তখ্ৎ’ অর্থে আসন বা সিংহাসন এবং ‘রওয়ান’ অর্থ ভ্রাম্যমান, চলমান।

 Takhta or Takht-rawan : A plank or platform on which public performers, singers and dancers are carried on men’s heads in festival and religious processions–Wilson’s Glossary.

১৩। বাতাভিয়ার গবর্নর ‘ইস্ট ইন্ডিজে’র সমস্ত ডাচ বাণিজ্যকুঠির প্রধান কর্মকর্তা অর্থাৎ ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের গবর্নর—জেনারেল ছিলেন।

১৪। বার্নিয়েরের পাণ্ডুলিপিতে “Un Ecrivain Gentil’’ কথাটি আছে। অর্থ হল হিন্দু লেখক, লিপিকর বা কেরানি। এইসময় রাজস্ব আদায়, হিসাবপত্র রাখা, রাজদরবারের পত্রনবীশের কাজ করা প্রায় হিন্দুদেরই একচেটিয়া ছিল। হিন্দু চৌধুরি, হিসাবনবীশ ও পত্রনবীশরা সকলেই ফারসি ভাষায় রীতিমতো দুরস্ত ছিলেন। অধ্যাপক ব্লকম্যান ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ (No. CIV, 1871) পত্রিকায় “A Chapter from Muhammadan History” শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন : “The Hindus from the 16th century took so zealously to Persian education, that, before another century had clapsed they had fully come up to the Muhammadans in point of literary acquirements.”

* দাস—ব্যবসা  (Slave-trade) তখন কিরকম ব্যাপকভাবে চলত, এই কাহিনি থেকে তা অনেকটা অনুমান করা যায়।

* ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে সাধারণত সম্রাট ঔরঙ্গজীবের চরিত্র যেভাবে চিত্রিত করা হয়ে থাকে, তার সঙ্গে বার্নিয়ের অঙ্কিত এই চরিত্র—চিত্রের কোনো মিল হয় না। শুধু তাই নয়। বাইরের রাজকার্যের মধ্যে অনেক সময় সম্রাট ঔরঙ্গজীবের চরিত্রের প্রকাশ হয়েছে যেভাবে, তার সঙ্গেও তাঁর চরিত্রের এই মহত্ত্বের যেন কোনো সম্পর্ক নেই বলে মনে হয়। রাষ্ট্রীয় পরিবেশের চাপে অনেক সময় অনেক সম্রাটকে এমন অনেক কাজ করতে বাধ্য হতে হয়, যা দিয়ে তাঁদের ব্যক্তিগত চরিত্র ঠিক যাচাই করা যায় না, বা বোঝা যায় না। মধ্যযুগের সম্রাটদের ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। সম্রাটদের শিক্ষাদীক্ষা, আচার—ব্যবহার ইত্যাদি সম্বন্ধে ঔরঙ্গজীব যেভাবে সমালোচনা করেছেন, নিজে সম্রাট হয়েও, তার সত্যই তুলনা হয় না। সম্রাটের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্থে তাঁর কঠোর মন্তব্যও সাধারণত দুর্লভ। বেশ বোঝা যায়, বাইরের সম্রাট ঔরঙ্গজীব ও ভিতরের মানুষ ঔরঙ্গজীবের মধ্যে বরাবরই একটা পার্থক্য ছিল, যা তাঁর অন্তরঙ্গ দু—চারজন ছাড়া আর কারও চোখে ধরা পড়েনি—অনুবাদক।

১৫. সাহ আব্বাস ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের সম্রাট হন। ১৫৮৮ খ্রিঃ অব্দ থেকে ১৬২৯ খ্রিঃ অব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন। তিনিই ইস্পাহানে পারস্যের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং পারস্যকে বিরাট সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। তাঁর সংগঠনশক্তি কূটনৈতিক বুদ্ধি ও দুরদর্শিতার কথা জনপ্রবাদে পরিণত হয়েছে। তাঁর নাম ‘সাহ আব্বাস’ থেকেই নাকি ভারতবর্ষে ‘সাবাস’ বলে অভিনন্দন জানিয়ে থাকি। ওভিঙটন (ovington) তাঁর ‘Voyage to suratt in the year 1689’ নামক গ্রন্থে (London 1696)  লিখেছেন : ‘পারস্যের সম্রাট সাহ আব্বাসের নাম তাঁর মহৎ কীর্তি ও খ্যাতির সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে আজও কোনো উল্লেখযোগ্য কীর্তিকে আমরা ওই নামে সম্বর্ধনা জানিয়ে থাকি। ভারতীয়দের প্রশংসাসূচক কথাই হল ‘সাবাস’।

১৬। মোল্লা শাহ বাদকশানের বাসিন্দা। তিনি দারাশিকোর ‘মুর্শিদ’ বা দীক্ষাগুরু ছিলেন এবং সম্রাট সাজাহান তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। ঔরঙ্গজীবকেও তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন।

* সম্রাট ঔরঙ্গজীবের চরিত্রের এই সরলতা, দৃঢ়তা ও স্পষ্টবাদিতা বাস্তবিকই দুর্লভ। সাধারণ ইতিহাসের বই থেকে তাঁর চরিত্রের এই দিকটার কথা কিছুই জানা যায় না—অনুবাদক

* বার্নিয়েরের এই উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ইতিহাস আলোচনায় বার্নিয়েরের এই মন্তব্য প্রত্যেক অনুসন্ধানী ও চিন্তাশীল ব্যক্তির রীতিমতো চিন্তার খোরাক যোগাবে। ভারতবর্ষে মোগলযুগে পর্যন্ত ক্রীতদাসপ্রথা কি রকম চালু ছিল, সে সম্বন্ধেও বার্নিয়ের প্রচুর মূল্যবান উপকরণ সংগ্রহ করেছেন এবং তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে বিবৃত করেছেন। ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ সম্বন্ধেও বার্নিয়েরের এই বিবরণের ঐতিহাসিক মূল্য অসাধারণ। পাঠকদের পুনরায় মার্ক্স এঙ্গেলসের পত্র দুখানির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি (ভূমিকা দ্রষ্টব্য)।—অনুবাদক

* ‘বেনিয়ান’ কথাটি বার্নিয়েরের আমলে হিন্দু ব্যবসায়ীদের বলা হত। পরে ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের বাঙালি ব্যবসায়ী ও দালালদের ‘বেনিয়ান’ বলা হত।

* এরপর বার্নিয়ের মীর জুমলার বাংলা ও আসাম অভিযানের কাহিনি বর্ণনা করেছেন। মীর জুমলার পর সায়েস্তা খাঁ, ঔরঙ্গজীবের দুই পুত্র সুলতান মামুদ ও সুলতান মাজুম, কাবুলের শাসনকর্তা মহবৎ খাঁ, যশোবন্ত সিং, শিবাজী প্রভৃতির ঐতিহাসিক ভূমিকা ও চরিত্র সম্বন্ধেও তিনি আলোচনা করেছেন। এই অংশের অনুবাদ এখানে করা হল না, কারণ নিছক ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ ছাড়া এর মধ্যে বিশেষ কিছু নেই। শায়েস্তা খাঁ প্রসঙ্গে মগ ও পর্তুগিজদের অত্যাচার সম্বন্ধে যে মূল্যবান বিবরণ বার্নিয়ের দিয়েছেন, তার সারানুবাদ করা হল।—অনুবাদক

১৭। ১৭৮০ সালে প্রকাশিত রেনেলের মানচিত্র ‘Map of the Sunderbund and Baliagot Passages’-এর মধ্যে দেখা যায়, নিম্নবঙ্গের একটি অঞ্চল ‘Country depopulated by the Muggs’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বার্নিয়েরের এই বিবরণের সঙ্গে রেনেলের মানচিত্রের এই উল্লেখ আশ্চর্যভাবে মিলে যায়। পরবর্তীকালে অবশ্য গঙ্গার ধারা পরিবর্তনের জন্যও প্রাচীন ভাগীরথীর তীরবর্তী অনেক জনপদ ধ্বংস হয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *