চতুর্থ পর্ব
২০.
আমরা প্রায় সারা রাত হেঁটে হেঁটে ভোররাতের দিকে ক্যাম্পে পৌঁছেছি। যেখানে তারা ক্যাম্প বসিয়েছে সেখানে রাজাকার আর মিলিটারি দূরে থাকুক কাকপক্ষীও সেটা খুঁজে পাবে না। যখন ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছেছি তখন একটা গাছের ওপর থেকে কে যেন চিৎকার করে বলল, হলট! হু কামস দেয়ার?
সেই বিকট চিৎকার শুনে আমি আর ডোরা রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম, মাসুদ ভাই বলল, হয়েছে হয়েছে পাইকার, এখন গাছ থেকে নাম।
গাছের ওপর থেকে যে চিৎকার করেছে সে বলল, কভি নেহি। আমাকে পাসওয়ার্ড না বলা পর্যন্ত যেতে দেব না। বলেন পাসওয়ার্ড।
মাসুদ ভাই বলল, পাসওয়ার্ড জানি না।
ভেরি গুড। হয়েছে।
কেমন করে হলো?
গাছ থেকে পাইকার নামের মানুষটা নামতে নামতে বলল, তার কারণ আজকের পাসওয়ার্ড হচ্ছে জানি না। কালকের পাসওয়ার্ড ছিল, ভুলে গেছি। আমরা সব সময় খুব বুদ্ধিমানের মতো পাসওয়ার্ড দিই। তাই না কমান্ডার?
মাসুদ ভাই বলল, অনেক হয়েছে। এখন তুমি ঘুমাতে যাও। কাসেমকে পাহারায় পাঠাও।
পাইকার নামের মানুষটা আমাকে আর ডোরাকে দেখে বলল, ইয়া মাবুদ! মাসুদ ভাই, আপনি কি জানেন আপনার কাঁকনডুবি থেকে একটা ট্যাবলেট আনার কথা ছিল, আপনি দুইটা নিয়া আসছেন?
জানি। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, এ হচ্ছে রঞ্জু। যাকে আনার জন্য গিয়েছিলাম। আর এ হচ্ছে খোকন–রঞ্জুকে আনতে গিয়ে আমরা খোকনকে ফ্রি পেয়ে গেছি।
পাইকার বলল, এই রকম আণ্ডা-বাচ্চা আমরা কয় হালি আনব? এদের জন্য আমাদের তো এখন দুধের বোতল কিনতে হবে।
সেইটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। এরা খুবই টায়ার্ড, মাকে ঘুম থেকে তোলো। এদের কিছু খেতে দাও, তারপর ঘুমানোর ব্যবস্থা করো।
জো হুকুম কমান্ডার , বলে পাইকার অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমাদের অন্ধকারের ভেতর একটা ঘরের মতো জায়গায় নেয়া হলো। সেখানে মাটিতে খড় রেখে তার ওপর একটা কাঁথা বিছিয়ে বিছানা করা হয়েছে। নূতন জায়গায় এসে আমার আর ডোরার দুজনেরই একটু অস্বস্তি লাগছিল। আমাদের জন্য বাটিতে মুড়ি আর কলা আনা হয়েছে, আমরা দুজন প্রায় রাক্ষসের মতো সেগুলো খেয়ে ফেললাম। তারপর আমি বিছানায় শুয়ে কিছু বোঝার আগেই ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙল পরের দিন বেলা হবার পর। আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল ডোরা, বলল, বাইরে আয়। দেখ।
আমি বাইরে এসে অবাক হয়ে গেলাম। গভীর জঙ্গলের মাঝখানে অনেক পুরনো একটি দালান, তার বেশির ভাগ মাটির ভেতর গেঁথে আছে। ইটগুলো অনেক চিকন। দালানগুলো লতাপাতা দিয়ে ঢাকা–তার অনেকটুকু পরিষ্কার করে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প তৈরি হয়েছে।
ক্যাম্পের এক পাশে প্রায় পনেরো-বিশজন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং করছে। আধবুড়ো একজন মানুষ একটা হুংকার দিতেই সবাই মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে সামনে এগোতে থাকে, আবার হুংকার দিতেই তারা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আরেকটা হুংকার দিতেই তারা দৌড়াতে থাকে। আধবুড়ো মানুষটার মনে কোনো দয়ামায়া নাই, মুক্তিযোদ্ধাগুলো দরদর করে ঘামছে দেখে মনে হয় আর এক সেকেন্ডও দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তার পরও তাদেরকে দৌড়িয়ে নিতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত আধবুড়ো মানুষটার মনে হলো একটু দয়া হলো, তখন সবাইকে থামতে বলতেই সবাই মাটির ওপর নেতিয়ে পড়ে মুখ হাঁ করে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে থাকে। আধবুড়ো মানুষটা তখন গালাগাল শুরু করল, হেই ইন্দুরের বাচ্চারা! তোরা কি মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিংয়ের জন্য আসছস, নাকি রাজাকারদের ট্রেনিংয়ের জন্য আসছস? এইটা রাজাকারের ট্রেনিং না যে একটা লাঠি নিয়া দুই কদম লেফট-রাইট করবি। এইটা মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং। নিজের জান কবজ কইরা যুদ্ধ করা লাগব! যুদ্ধ করতে মাথার মাঝে বুদ্ধি থাকতে হয়, বুকের মাঝে সাহস থাকতে হয় আর শরীলে শক্তি থাকতে হয়। তোদের মাথার মাঝে কোনো ঘিলু নাই, বুকের মাঝে কোনো সাহস নাই, শরীলে জোর নাই। দেখলে মনে হয় কয়টা বুইড়া মানুষ কুঁই কুঁই কইরা হাঁটে। তোগো দেখলে মনে হয় গলায় হাত দিয়া বমি কইরা দিই–এই ইন্দুরের বাচ্চাদের নিয়া আমাগো যুদ্ধ করা লাগব? তোদের দিয়া দেশ স্বাধীন করতে হলে একশ বছর যুদ্ধ করা লাগব। তারপর হুংকার দিয়ে বলল, খাড়া হ।
সবাই তখন এক লাফে উঠে দাঁড়াল। আরেকটা হুংকার দিতেই সবাই ঝপ করে মাটিতে পড়ে গেল। আরেকটা হুংকার দিতেই কনুইয়ে ভর দিয়ে সবাই গিরগিটির মতো সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে ভালো দেখা যাচ্ছে না কিন্তু নিশ্চয়ই এতক্ষণে সবার কনুইয়ের ছাল উঠে গেছে।
ঠিক তখন আমি দেখলাম একটা ফাঁকা জায়গায় মাসুদ ভাই একটা বাক্স খুলে ভেতরে কী যেন দেখছে। আমি আর ডোরা তার কাছে হেঁটে গেলাম। আমাদের দেখে মাসুদ ভাই বলল, ঘুম হয়েছে রাত্রিবেলা?
হয়েছে।
গুড। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখছেন?
গ্রেনেড। কয়টা আছে গুনছি। কাল-পরশু একটা অপারেশনে যাব তো।
কোথায়?
কালী গাংয়ের উজানে। আমাদের অনেক বড় একটা অস্ত্রের চালান আসছে। অস্ত্রবোঝাই নৌকাটা যেন ঠিকমতো আসতে পারে সেই জন্য মিলিটারি পাহারাকে একটু ব্যস্ত রাখতে হবে।
আমি বললাম, মাসুদ ভাই।
কী হলো?
আমাদের আপনাদের সাথে নিয়ে যাবেন? মাসুদ ভাই চোখ কপালে তুলে বলল, তোমাদের?
হ্যাঁ, আমরা কখনো যুদ্ধ দেখি নাই।
মাসুদ ভাই হাসল, বলল যুদ্ধ তো থিয়েটার না যে সবাই বসে বসে দেখবে। যুদ্ধ খুব ভয়ানক ব্যাপার। যুদ্ধে একদল আরেক দলকে মারে! এখানে দেখার কিছু নাই।
ডোরাও আমার সাথে যোগ দিল, বলল, আমরা অনেক দূর থেকে দেখব। আপনাদের গুলির বাক্স নিয়ে দেব।
মাসুদ ভাই এবার শব্দ করে হেসে আঙুল দিয়ে ট্রেনিং নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দেখিয়ে বলল, ঐ দেখেছ, মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে ট্রেনিং নিচ্ছে? এই রকম ট্রেনিং না নিয়ে কেউ যুদ্ধে যায় না! তোমরা ঐ ট্রেনিং নিতে পারবে?
আমি আর ডোরা একসাথে বললাম, পারব।
গুড। তাহলে ট্রেনিংটা নিয়ে নাও।
আমি আড়চোখে ট্রেনিং নিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা আর হুংকার দিতে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললাম, মাসুদ ভাই।
কী হলো?
ঐ লোকটা কে?
ই.পি.আরের একজন সুবেদার। কেন?
উনি মুক্তিযোদ্ধাদের এত গালাগালি করেন কেন?
মাসুদ ভাই আবার হাসল, এইটা হচ্ছে মিলিটারি ট্রেনিংয়ের একটা অংশ।
ডোরা বলল, খুবই নিষ্ঠুর মানুষ। মুক্তিযোদ্ধাদের কত কষ্ট দিচ্ছেন।
মাসুদ ভাই বলল, ট্রেনিংয়ের সময় যত বেশি কষ্ট করবে, যুদ্ধটা হবে তত সহজ।
আমি বললাম, এইভাবে কষ্ট দিলে সবাই তো পালিয়ে যাবে।
না। পালাবে না। কেউ পালায় নাই। এদের একজনকেও তো আমরা ধরে আনি নাই, এরা নিজেরা এসেছে। কাউকে আমরা এক টাকা বেতনও দিই না। তবু এরা আছে।
নাই-নাই-আমি নাই। কথা শুনে আমরা ঘুরে তাকালাম, গলার স্বর শুনে বুঝতে পারলাম মানুষটা পাইকার। কাল রাতে যখন আসছিলাম তখন সে পাহারায় ছিল। গলার স্বর শুনে ভেবেছিলাম বয়স্ক মানুষ, এখন দেখছি কমবয়সী একজন ছেলে।
মাসুদ ভাই আবার তার বাক্সের ভেতর থেকে গুনে গুনে গ্রেনেড বের করতে করতে বলল, কেন তুমি নাই?
গত পরশু শুঁটকি দিয়ে ভাত খেয়েছি, গতকালও ছিল শুঁটকি, আজকেও শুঁটকি। আমি আর নাই। আমি কাঁকনডুবি গিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেব। মিলিটারি ক্যাম্পে প্রত্যেক দিন গরুর গোশত।
খুব ভালো আইডিয়া পাইকার। শুধু খোঁজ নাও রাজাকাররা গরুর গোশতের ভাগ পায়, নাকি তারাও খালি শুঁটকি খায়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। প্রত্যেক দিন মিলিটারির গা-হাত-পা টিপে দিতে হবে। পারবে তো!
ছি! ঐ হারামজাদাদের গা-হাত-পা টিপতে হবে–তাহলে আমি এইখানে আছি। শুঁটকিই সই! দরকার হলে কচু খেয়ে থেকে যাব!
পাইকার তখন আমাদের দুইজনের দিকে তাকাল, মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমাদের আণ্ডা-বাচ্চা মুক্তিযোদ্ধাদের কী খবর?
ডোরা বলল, আমরা যদি আণ্ডা-বাচ্চা মুক্তিযোদ্ধা হই তাহলে আপনি কী?
পাইকার বলল, তা তো জানি না! মনে হয় বাছুর মুক্তিযোদ্ধা।
শুনে আমি আর ডোরা দুইজনেই হি হি করে হাসলাম। ডোরা বলল, আপনার নাম তো পাইকার। তাই না?
হ্যাঁ। তাতে কোনো সমস্যা আছে?
সমস্যা নাই। কিন্তু এই নামটা আমি আগে কখনো শুনি নাই।
কেমন করে শুনবে? পৃথিবীতে মাত্র হাতে গোনা অল্প কয়েকজন পাইকার আছে। পাইকার হচ্ছে অমূল্য ধন।
কিন্তু পাইকার ভাই, এই নামটা কেমন করে এসেছে?
ও! সেটা তো বিরাট কাহিনি। আমার বাবা-মায়ের কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। তখন আমার মা বাবাকে বলল, হ্যাঁ গো, আমাদের কোনো ছেলেমেয়ে নাই। ঘরটা খালি খালি লাগে, তুমি বুধবারের হাট থেকে কয়টা ছেলেমেয়ে কিনে আনো না গো।
ডোরা হি হি করে হেসে বলল ইশ! কী মিথ্যুক। ছেলেমেয়ে কেউ কোনো দিন হাট থেকে কিনে আনে?
পাইকার ভাই অবাক হবার ভান করে বলল, ও মা! হাটবাজার থেকে না কিনলে ছেলেমেয়ে আসে কোথা থেকে?
ডোরা বলল, মিথ্যুক! মিথ্যুক!
পাইকার ভাই খুবই দুঃখ পাবার ভঙ্গি করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস না করলে থাক। আমি তাহলে বলবই না।
আমি আর ডোরা তখন বললাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি বলেন।
মিথ্যুক বলবে না তো?
না, বলব না।
ঠিক আছে, তাহলে শোনো। বাবা বাজারে গিয়ে দোকানে দোকানে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে টিপে টুপে দেখে কিন্তু পছন্দ হয় না। শেষে একটা দোকানে বাচ্চাগুলো দেখে খুব পছন্দ হলো। বাবা জিজ্ঞেস করল, কত করে দাম? দোকানদার বলল, খুচরা না পাইকারি? বাবা বলল পাইকারি। দোকানদার বলল এক দাম, জোড়া দুইশ টাকা। বাবা তখন পাইকারি দরে পাঁচ জোড়া বাচ্চা কিনে আনল। বাজার থেকে পাইকারি কিনেছে বলে আমাদের নাম পাইকার।
ডোরা আবার হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, মিথ্যুক। মিথ্যুক!
পাইকার ভাই চোখ গরম করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হলো? ঠিক আছে যুদ্ধ শেষ হলে আমি তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। আমার মাকে জিজ্ঞেস করো আমি সত্যি কথা বলছি, না মিথ্যা বলছি।
মাসুদ ভাই মুখ টিপে হাসছিল, বলল, পাইকার! এই রকম গাঁজাখুরি গল্প তোমার স্টকে কয়টা আছে?
একটাও নাই। আমার স্টকে যা আছে, সব সত্যি! কোনো ভেজাল নাই!
ডোরা বলল, আপনি একজন জোকার। তাই না?
পাইকার ভাই বুকে থাবা দিয়ে বলল, আমি মোটেও জোকার না।
তার বলার ভঙ্গি দেখেই আমি আর ডোরা হি হি করে হাসতে লাগলাম। মানুষটাকে আমাদের খুবই পছন্দ হলো।
.
বিকালবেলা পাইকার ভাই আমাকে আর ডোরাকে নিয়ে পুরো ক্যাম্পটা দেখাতে বের হলেন। পুরনো দালানটা দেখিয়ে বলল, এইটা কিসের দালান কেউ জানে না। ভাসা ভাসাভাবে শুনেছিলাম মোগল আমলে এইখানে একজন রাজপুত্রকে নির্বাসন দিয়েছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
কে বলবে কেন? রাজা-বাদশাহরা সিংহাসনে বসার জন্য এক রাজপুত্র অন্য রাজপুত্রকে মেরে ফেলে, না হলে চোখ কানা করে দেয়।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। এই জন্যই তো আমি ইতিহাস বই পড়ি না, পরীক্ষায় সেই জন্য গোল্লা পাই। যাই হোক, রাজপুত্রের জন্য এইখানে নদীর তীরে এই রাজপ্রাসাদ তৈরি করে দিল। সে তার এক ডজন বউ, দুই ডজন দাসি বান্দি, তিন ডজন পাহারাদার, চার ডজন পোলাপান নিয়ে থাকতে এল। তখন একদিন
ডোরা জিজ্ঞেস করল, নদীটা কই?
নদীটা সরে গেছে।
নদী সরে গেছে? নদী কি জ্যান্ত মানুষ যে সরে যাবে?
পাইকার ভাই মাথা নাড়ল, বলল, আমি এত কিছু জানি না। যেটা শুনেছি, সেটা বলছি। পছন্দ না হলে কানে আঙুল দিয়ে রাখো।
ঠিক আছে, ঠিক আছে আপনি বলেন।
যাই হোক এই রাজপুত্র এক জোছনা রাতে নদীর তীরে বসে মদ গাঞ্জা এই সব খাচ্ছে
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মদ-গাঞ্জা?
হ্যাঁ। রাজা-বাদশাহরা সব সময় সময় কাটানোর জন্য মদ-গাঞ্জা খায়। যাই হোক তখন ডাকাতেরা আক্রমণ করল। সবাইকে কচুকাটা করে সবকিছু লুটপাট করে নিল! ছোট বাচ্চা আর মেয়েদের ধরে নিয়ে বিক্রি করে দিল।
বিক্রি করে দিল?
হ্যাঁ। আগের যুগে সব সময় মানুষকে ধরে বিক্রি করে দিত। যাই হোক শুধু একজন রাজকন্যা বেঁচে গেল। সে একা একা এখানে ঘুরে বেড়াত। সবাই মারা যাওয়ার পরও সে একা এইখানে থেকে গেল! তারপর একদিন সে নিজেও মারা গেল–তার পরও সে এখানে থেকে গেল।
মারা যাওয়ার পরে?
পাইকার ভাই মাথা নাড়ল বলল, হ্যাঁ। ভূত হয়ে। এখনো আছে।
আমি আর ডোরা চিৎকার করে উঠলাম, এখনো আছে?
হ্যাঁ। গভীর রাত্রে যদি ঘুম থেকে ওঠো শুনবে সেই রাজকন্যা কাঁদতে কাঁদতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সত্যি?
আমার কথা বিশ্বাস না করলে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে বসে থেকো। তোমাদের যদি কপাল ভালো হয় তাহলে জোছনা রাতে দেখতেও পেতে পারো।
ডোরা বলল, থাক বাবা, আমার দেখার কোনো দরকার নাই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, পাইকার ভাই। আপনি কি কখনো ভূত দেখেছেন?
দেখি নাই আবার!
কী রকম ছিল ভূতটা?
দিনের বেলা ভূতের গল্প বলে কোনো মজা নাই, অন্ধকার হোক তখন বলব। এখন চলো ক্যাম্পের পেছন দিকটা দেখাই।
ক্যাম্পের পেছন দিকে গিয়ে দেখলাম একজন মহিলা একটা মাটির চুলায় বড় বড় ডেকচিতে রান্না করছেন। চুলায় আগুন ধরাতে সমস্যা হচ্ছে, তাই একটা চোঙা দিয়ে ফুঁ দিচ্ছেন, চুলা থেকে আগুন বের না হয়ে ধোয়া বের হচ্ছে আর মহিলা ধোয়া থেকে মাথাটা সরানোর চেষ্টা করছেন।
পাইকার বলল, এই যে ইনি হচ্ছে আমাদের মা। মা শুনে ভেবেছিলাম বুঝি মা-খালাদের মতো বয়স্কা একজন মহিলা হবেন কিন্তু যখন ঘুরে আমাদের দিকে তাকালেন, তখন দেখলাম কমবয়সী একটা বউ। কাল রাতে আমাদের মুড়ি-কলা দিয়েছিলেন তখন অন্ধকারে চেহারা দেখতে পারি নাই, এখন দেখতে পাচ্ছি খুবই ফুটফুটে চেহারার কমবয়সী একটা মেয়ে। ডোরা ফিসফিস করে বলল, ইশ! কী সুইট!
পাইকার ভাই বলল, এই হচ্ছে মা, আর আমরা সবাই তার দামড়া-দামড়া ছেলে। পাইকার ভাই তখন মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, মা, এই যে তোমার আরো দুইটা ছেলে! এইগুলি আমাদের মতো দামড়া সাইজের না এরা আণ্ডাবাচ্চা।
মা মুখ টিপে হেসে বললেন, দুইটা ছেলে না, একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে।
পাইকার ভাই চোখ কপালে তুলে বলল, কী বলেন আপনি?
ঠিকই বলি।
পাইকার ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, কী সর্বনাশ! কোনটা ছেলে কোনটা মেয়ে? দুইটাই তো দেখতে একই রকম?
ডোরা ফিক করে হেসে বলল, একসময় আমাদের একজন মেয়ে ছিল, এখন আমরা দুইজনই ছেলে। তাই নারে রঞ্জু?
আমি মাথা নাড়লাম। পাইকার ভাই ডোরার দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তুমি নিশ্চয়ই মেয়ে!
ডোরা মাথা নাড়ল আর পাইকার ভাই এমন একটা ভাব করল যে একটা রাজ্য জয় করে ফেলেছে।
মা তখনো চোঙা দিয়ে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে, তখন পাইকার ভাই এগিয়ে গিয়ে বলল, দেন আমার কাছে দেন, আমি আগুনটা ধরিয়ে দিই।
মা বললেন, লাগবে না। আমিই পারব।
আপনি তো পারবেনই। আপনি কোন কাজটা পারেন না! এর পরেরবার আপনাকে যুদ্ধে নিয়ে যাব। একটা মেশিনগান দিয়ে বসিয়ে দেব। মিলিটারিগুলোকে ছাতু করে দেবেন। মোরব্বা বানিয়ে দেবেন।
পাইকার ভাই চোঙাটা নিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা ফুঁ দিতেই দপ করে আগুনটা জ্বলে উঠল। পাইকার ভাই নিজের বুকে থাবা দিয়ে এমন একটা ভান করল যে এবারে শুধু রাজ্য না, আস্ত একটা সাম্রাজ্য জয় করে ফেলেছে। খুব অল্পতেই পাইকার ভাই খুশি হয়ে ওঠে।
মা ডেকচির ঢাকনা সরিয়ে ভেতরের তরকারিটা একটা বাঁশের হাতা দিয়ে নেড়ে দিতে থাকলেন। পাইকার ভাই সেটা দেখতে দেখতে বলল, মা আসার আগে আমাদের ভাতের অর্ধেক থাকত চাউল, বাকি অর্ধেক থাকত জাউ। ডালের রং হতো কলেরা রোগীর ইয়ের মতো। মাছের তরকারির মাঝে আমরা একদিন এত বড় একটা কোলা ব্যাঙ পেয়েছিলাম। ব্যাটা সিদ্ধ হয়ে গেছে! খাওয়া ছিল শূল বেদনার মতো যন্ত্রণা। আমরা ভেউ ভেউ করে কাঁদতাম আর খেতাম। খেতে খেতে বলতাম ওরে শালার ইয়াহিয়া তোর জন্য আজকে আমাদের এত কষ্ট।
ডোরা বলল, আর এখন?
এখন মায়ের রান্না এতই ভালো যে যদি মা একটা কোলা ব্যাঙকে রেন্দে দেয় সেইটাই আমরা কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেলব। ভাত রাঁধলে মনে হয় পোলাও। বেগুন ভর্তা বানালে মনে হয় কোরমা। পাইকার ভাই হাতে কিল দিয়ে বলল, যখন দেশ স্বাধীন হবে তখন আমি কী করব জানো?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী?
ঢাকা শহরে একটা রেস্টুরেন্ট দেব, রেস্টুরেন্টের নাম হবে দ্য গ্রেট মা রেস্টুরেন্ট, মা রাঁধবে আর আমি কাস্টমারদের খাওয়াব। এক সপ্তাহে লাখপতি হয়ে যাব।
মা পাইকারের কথা শুনে কোনো কথা না বলে মুখ টিপে হাসতে হাসতে রাঁধতে লাগলেন।
পাইকার ভাই তারপর ক্যাম্পের পেছন থেকে আমাদের ক্যাম্পের সীমানা পর্যন্ত নিয়ে গেল। একদিকে একটা খাল, সেখানে জংলি কাঁটা গাছে বোঝাই। তিন দিকে জঙ্গল। সেখানে বড় বড় গাছে মুক্তিযোদ্ধারা সব সময় পাহারায় থাকে।
ক্যাম্পের এক পাশে পানির জন্য একটা কুয়া করা হয়েছে। গভীর কুয়ার নিচে টলটলে পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘুমানোর জন্য ব্যারাক করা হয়েছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ওপরে খড়ের ছাউনি। মাটিতে খড় বিছিয়ে সেখানে ঘুমানের ব্যবস্থা।
দালানের ভেতরে একটা ঘরের মাঝে সব গোলাবারুদ আর অস্ত্র সাজানো। সেই ঘরের সামনে একজন সব সময় একটা স্টেনগান নিয়ে পাহারা দেয়।
পাইকার ভাই আমাদের বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচয় করানোর কায়দাটা খুবই মজার। যেমন দূর থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখিয়ে বলল, ঐ যে সবুজ গেঞ্জি দেখেছ? এ হচ্ছে আমাদের উত্তম কুমার। প্রত্যেক দিন সকালে মুখের মাঝে সাবান ঘষে একটা ব্লেড হাত দিয়ে ধরে ক্যাড় ক্যাড় করে দাড়ি কামিয়ে ফেলে। উত্তম কুমার সব সময় ক্লিন শেভ। তারপর আরেকজনকে দেখিয়ে বলল, ঐ যে লাল গামছা দেখেছ শুকনো মতন মানুষ? সে হচ্ছে বকর। বকরকে শুকনা দেখলে কী হবে সে হচ্ছে এক নম্বর খাদক। তার কপালের দুই ইঞ্চি বাদে পুরোটা পেট। বকর একা দশজনের খাবার খেয়ে ফেলে। শুধু নুন দিয়ে দুই গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারে। তারপর আরেকজনকে দেখিয়ে বলল, ঐ যে সাদা পায়জামা দেখেছ। তার নাম জলীল, জলীলের ধারে-কাছে কখনো যাবা না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
পাইকার ভাই বলল, তার কারণ জলীল হচ্ছে আমাদের জ্ঞানী মানুষ। দুনিয়ার সবকিছু জানে। জলীলের কাছে বসলেই জ্ঞান দিতে শুরু করে। দেশ নিয়ে জ্ঞান, বিদেশ নিয়ে জ্ঞান, রাজনীতি নিয়ে জ্ঞান, যুদ্ধ নিয়ে জ্ঞান–দুই মিনিটে জ্ঞানের চাপে পাগল হয়ে যাবে। পাইকার ভাই গলা নামিয়ে বলল, আমরা কী ঠিক করেছি, জানো?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী?
আমরা ঠিক করেছি এর পরেরবার যুদ্ধ করতে যাবার সময় জলীলকে মিলিটারি ক্যাম্পে রেখে আসব।
কেন?
সে তখন মিলিটারিদের এতই জ্ঞান দিতে শুরু করবে যে মিলিটারিরা বাপ বাপ করে দেশ ছেড়ে পালাবে। দুই দিনে দেশ স্বাধীন!
পাইকার ভাইয়ের কথা শুনে আমরা হি হি করে হাসতে থাকলাম।
.
মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে রাত্রিবেলা রেডিওটা অন করে সবাই সেটাকে ঘিরে বসেছে। কাঁকনডুবিতে যখনই কেউ রেডিও শুনেছে তখন ভলিউম খুব কমিয়ে শুনত গ্রামে রাজাকাররা ঘোরাঘুরি করে, তারা যদি জানতে পারে কেউ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই ক্যাম্পে সেই ভয় নাই তাই রেডিওটা একেবারে ফুল ভলিউমে চালু করা হয়েছে যারা দূরে বসেছে তারাও যেন ঠিক করে শুনতে পারে। রেডিওতে খবর শোনাল, কোথায় কোথায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে কয়টা পাকিস্তানি মিলিটারিকে মেরেছে তার হিসাব দিল। তারপর বজ্রকণ্ঠ শোনাল, বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার একটা-দুইটা লাইনকে বলে বজ্রকণ্ঠ। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেলে কেমন আছেন কে জানে! বেঁচে আছেন না মেরেই ফেলেছে সেটাই বা কে জানে। তারপর কয়েকটা গান শোনাল। আমার সবচেয়ে প্রিয় গান, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে কিন্তু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি সেটা যখন শোনাচ্ছিল তখন সবাই হাত নেড়ে নেড়ে মাথা দুলিয়ে তাল দিচ্ছিল। তারপর শুরু হলো চরমপত্র, সবাই তখন নড়েচড়ে বসল। চরমপত্র থেকে মজার অনুষ্ঠান মনে হয় সারা পৃথিবীতে একটাও নাই। নাকি গলায় একজন বলতে লাগল, বাঙালি পোলাপান বিচ্ছুরা দুইশ পঁয়ষট্টি দিন ধইরা বাঙাল মুলুকের কেদো আর প্যাকের মইদ্যে ওয়ার্ল্ড ফাইটিং পজিশন পাইয়া আরে বাড়ি রে বাড়ি! ভোমা ভোমা সাইজের মুছুয়াগুলা ধক ধক কইরা দম ফালাইল… ইরাবতিতে জনম যার ইছামতিতে মরণ তার।… আমাগো বকশীবাজারের ছক্কু মিয়া ফাল পাইরা উঠল। বাইসাব, ১৯৭১ সালে বাঙাল মুলুকে মুছুয়া নামের মাল আছিল। হেগো চোটপাট বাইড়া যাওনের গতিকে হাজার হাজার বাঙালি বিচ্ছু হেগো পিঁপড়ার মতো ডইলা শেষ করছে!…
শুনে আমরা সবাই হেসে গড়াগড়ি খেতে থাকি।
রাত যখন আরো গম্ভীর হলো তখন ডোরা শুতে গেল মুক্তিবাহিনীর মায়ের সাথে। আমাকে শুতে দেয়া হলো ব্যারাকের এক কোনায় আলাদা একটা বিছানায়।
শুয়ে শুয়ে আমি জঙ্গলের বিচিত্র সব শব্দ শুনতে লাগলাম। মাঝে মাঝে চাপা গলায় হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। নিশ্চয়ই যারা পাহারা দিচ্ছে তারা গল্পগুজব করছে। পাইকার ভাই বলেছে, জোছনা রাতে নাকি রাজকন্যার ভূতকে দেখা যায়, কোনো একদিন দেখতে হবে। তবে পাইকার ভাইয়ের গল্পকে বিশ্বাস করা মনে হয় ঠিক হবে না।
শুয়ে শুয়ে আমার নানির কথা মনে পড়ল। বেচারি নানি একা একা কেমন আছে?
.
২১.
সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল আজকের দিনটা একটু অন্য রকম। সবাই মনে হয় সব কাজকর্ম ফেলে বসে বসে খুব যত্ন করে তার রাইফেল, এসএলআর কিংবা স্টেনগান পরিষ্কার করছে। কারণটা একটু পরেই বুঝতে পারলাম, আজ সন্ধ্যাবেলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল অপারেশনে যাবে। অন্যান্য দিনে সবাই যে রকম হইচই-চেঁচামেচি করে আজকে সে রকম নেই, সবাই মনে হয় একটু চুপচাপ। মনে হয় যুদ্ধে যাবার আগে সবাই এ রকম চুপচাপ হয়ে যায়।
দুপুরে মা সবাইকে ভাত বেড়ে দিল। বেশি কথা না বলে সবাই খেয়ে নিল। খেতে খেতে ডোরা আমাকে ফিসফিস করে বলল, মা এখানে কোথা থেকে এসেছে জানিস?
না। কোথা থেকে?
রাজাকাররা মাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন মাসুদ ভাইয়ের দল অ্যামবুশ করেছে।
সত্যি?
হ্যাঁ। মাকে উদ্ধার করে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে তখন কী হয়েছে জানিস?
কী হয়েছে?
তার বাড়ি থেকে বলেছে তাকে বাড়িতে রাখবে না।
কেন?
রাজাকাররা মাকে অত্যাচার করেছিল সেই জন্য। আমি ছোরার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম ডোরা থামিয়ে দিয়ে বলল, তখন মাসুদ ভাই মাকে তাদের সাথে ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে এখানে তাকে মা ডাকে!
তুই কেমন করে জানিস?
মা আমাকে বলেছে।
সত্যি? নিজে বলেছে?
হ্যাঁ। মা বলেছে কাউকে জন্ম না দিয়েই তার এতগুলো ছেলে!
ক্যাম্পের সবাই যে আসলেই মাকে মা মনে করে আমরা সেটাও দেখলাম। যখন গুলির বেল্ট গলায় ঝুলিয়ে, গ্রেনেডগুলো গামছায় পেঁচিয়ে কোমরে বেঁধে, রাইফেল এসএলআর ঘাড়ে নিয়ে সবাই সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছে তখন মাসুদ ভাই বলল, মা, আপনি আসেন।
মা বললেন, আমার লজ্জা করে।
লজ্জা করলে হবে না। আসেন। আমাদের দোয়া করেন।
মা এসে দাঁড়ালেন, তখন সবাই তার পা ছুঁয়ে সালাম করল। মা সবার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ফি আমানিল্লাহ।
মাসুদ ভাই তার দলটা নিয়ে যখন রওনা দিয়েছে তখন পাইকার ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে তার হাতের এসএলআরটা ওপরে তুলে হুংকার দিয়ে বলল, যাই! কয়টা মিলিটারি মাইরা আই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কয়টা মারবেন পাইকার ভাই?
পাইকার ভাই বলল, তুমি বল।
আমি কিছু বলার আগেই ডোরা বলল, একশটা।
পাইকার ভাই সাথে সাথে বলল, ঠিক আছে।
আজকে ক্যাম্পে মানুষজন কম, রেডিওতে খবর শুনে আমরা সকাল সকাল শুয়ে পড়েছি। গভীর রাতে উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আকাশে মেঘ, মাঝে মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে। মেঘের আড়ালে চাঁদ, তাই চারদিকে কেমন জানি আবছা একধরনের আলো। এর মাঝে মুক্তিযোদ্ধারা দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছে।
আমি উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, শোনো।
আমি কান পেতে শুনলাম সত্যি সত্যি বহুদূর থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে। একজন বলল, ঐ শোনো, জি থ্রি রাইফেল। পাকিস্তানিরা গুলি করছে।
আরেকজন বলল, এখন নাইন এম এম কারবাইন। এটা মাসুদ ভাই।
মুক্তিযোদ্ধারা গুলির শব্দ শুনেই বুঝে ফেলে কোনটা কে গুলি করছে। শুনতে শুনতে আমিও একসময় বুঝতে শুরু করলাম। পাকিস্তানি জি থ্রি রাইফেল কেমন জানি ট্যাক-ডুম-ট্যাক-ডুম শব্দ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র থেকে টানা কর্কশ শব্দ।
একটা বিস্ফোরণের শব্দ হতেই একজন বলল, গ্রেনেড। নিশ্চয়ই পাইকার।
প্রথম প্রথম পাকিস্তানিদের গুলি বেশি হচ্ছিল, আস্তে আস্তে তাদের গুলির শব্দ কমে এল। গ্রেনেডের শব্দ হলো অনেকগুলো, তারপর শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের শব্দ।
ক্যাম্পের সবাই তখন আনন্দের মতো শব্দ করে চিৎকার করতে থাকে।
.
মাসুদ ভাইয়ের দল ফিরে এল পরের দিন দুপুরের দিকে। গত ছত্রিশ ঘণ্টা তাদের খাওয়া নাই, ঘুম নাই কিন্তু তাদের সবার মুখে হাসি। এ রকম যুদ্ধ তারা প্রায়ই করে। মাঝে মাঝেই সবাই ফিরে আসে না, এবার সবাই সুস্থ শরীরে ফিরে এসেছে আনন্দটা সে জন্য। এবারের আনন্দটা একটু বেশি, কারণ তারা একজন পাকিস্থানি মিলিটারিকে ধরে এনেছে।
পাকিস্তানি মিলিটারিটা প্রায় তালগাছের মতো লম্বা, কম বয়স, মুখে একটা ছেলেমানুষি ভাব, শুধু তাই নয়, চেহারায় ভয় বা আতঙ্ক কিছু নাই, বরং এক ধরনের আনন্দের ভবি। হাত দুটো পেছনে বাঁধা। এছাড়া তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে পাকিস্তানি মিলিটারি, তাদের সাথে এই দেশের মানুষ যুদ্ধ করছে।
কারণটা একটু পরে বোঝা গেল। মাসুদ ভাই একটা গুলির বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে সবাইকে ডেকে বলল, তোমরা সবাই শোনো।
হইচই-চেঁচামেচি সাথে সাথে থেমে গেল। মাসুদ ভাই বলল, আল্লাহর কাছে হাজার পুকুর এই অপারেশন ষোলো আনার ওপর আনার ওপর আঠারো আনা না, একেবারে ছত্রিশ আনা সাকসেসফুল!
সবাই ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে উঠল। মাসুদ ভাই বলল, যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় হঠাৎ দেখি একজন পাকিস্তানি মিলিটারি দুই হাত ওপরে তুলে আমাদের দিকে ছুটে আসছে আরেকটু হলে তাকে গুলি করে ফেলে দিতাম কিন্তু হাতে কোনো অস্ত্র নাই, দুই হাত ওপরে তুলেছে সারেন্ডার করার মতো তাই গুলি করলাম না–এত গোলাগুলির মাঝে যে তার শরীরে গুলি লাগে নাই সেইটা আল্লাহর কুদরত।।
সে এসে আমাদের মাঝখানে হাজির, আমাদের পাশে শুয়ে কী বলল জানো?
কী?
প্রথম কথাই হচ্ছে হাম জয় বাংলা হায়! হামকো গুলি মত করো–
আমরা সবাই অবিশ্বাসের শব্দ করলাম! মাসুদ ভাই বলল, আমরা তাই আর গুলি করি নাই। নদীর ঘাটে যে কয়টা পাকিস্তানি মিলিটারি ছিল তারা পালিয়ে যাবার পর
একজন মাঝখানে জিজ্ঞেস করল, কয়টারে ফালাইছেন?
পাইকার ভাই বলল, খোকন আমাদের একশর টার্গেট দিছিল, মনে হয় টার্গেট পুরা হয় নাই।
আরেকজন বলল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতে হবে তাহলে সঠিক খবর পাওয়া যাবে।
মাসুদ ভাই বলল, মিলিটারি রাজাকার পালিয়ে যাবার পরই এই জয় বাংলা পাকিস্তান মিলিটারি বলয়ে সে বেলুচিস্তানের মানুষ। তার নাম ইউসুফ শাহ। পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের ওপর যে রকম অবিচার করে, ঠিক সে রকম বেলুচিদের ওপর অত্যাচার করে। বেলুচিরা মুখ বুঝে অত্যাচার সহ্য করছে, বাঙালিরা করে নাই। বাঙালিরা বাঘের বাচ্চা। শিয়ালের জাতি হয়ে সে বাঘের বাচ্চাদের সাথে যুদ্ধ করতে পারবে না। যদি তার কপালে থাকে তাহলে দেশ স্বাধীন হবার পর যুদ্ধবন্দি হিসেবে তার মা-ভাই-বোনের কাছে ফিরে যাবে। আর কপালে যদি না থাকে তাহলে এই বাঙাল মুলুকেই সে মরতে চায়।
ইউসুফ শাহ মাসুদ ভাইয়ের কোনো কথা বুঝে নাই কিন্তু তার পরও সে খুব জোরে মাথা নাড়তে লাগল। আমি মাসুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, এ যদি জয় বাংলা হয় তাহলে তার হাত কেন বেঁধে রেখেছেন? হাতটা খুলে দেন?
মাসুদ ভাই বলল, এখনো খুলি নাই তার একটা কারণ আছে। যত যাই বলি এই মানুষটা পাকিস্তানি মিলিটারি, তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় কি না এখনো জানি না। সে আমাদের যুদ্ধবন্দি, যুদ্ধবন্দিকে যুদ্ধবন্দির মতো রাখতে হবে।
মাসুদ ভাই কী বলছে ইউসুফ শাহ এবারে ঠিক বুঝতে পারছিল না, তাই খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়ে একবার মাসুদ ভাইয়ের দিকে আরেকবার আমাদের দিকে তাকাতে লাগল।
পাইকার ভাই বলল, কমান্ডার, আমি তো এই মক্কেলের সাথে পুরা রাস্তা কথা বলতে বলতে আসছি, আমি আপনাদের বলতে পারি এই লোক পুরা জয় বাংলা! আমি এরে নিয়ে পরের অপারেশনে যেতে পারি, আমাগো সাথে হে যুদ্ধ পর্যন্ত করতে পারে।
মাসুদ ভাই বলল, হতে পারে। তবু আমি এত বড় ঝুঁকি নিতে পারব না।
জলীল নামের জ্ঞানী মুক্তিযোদ্ধা বলল, আমি একে বিশ্বাস করি না। পাঞ্জাবিরা আমাদের সাথে যে অবিচার করেছে বেলুচিদের সাথে তার এক কণাও করে নাই। বাংলাদেশে বেলুচ রেজিমেন্ট জামালপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করতেছে। তারা সেইখানে মানুষ মারতেছে। আমি এদের বিশ্বাস করি না।
একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, আমার মনে হয় আপনারা কয়েকজন মিলে ঠিক করেন কী করবেন! সবাই মিলে আলোচনা করে এটা ঠিক করতে পারবেন না।
শেষ পর্যন্ত তাই হলো, কয়েকজন মিলে অনেকক্ষণ নিজেরা নিজেরা কথা বলল, তারপর সেটা ইউসুফ শাহকে বলা হলো। ইউসুফ শাহ মাথা নেড়ে রাজি হলো। তারপর তার হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হলো কিন্তু আমরা দেখলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা স্টেনগান নিয়ে কাছাকাছি বসে আছে। ঠিক করা হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা একজন মুক্তিযোদ্ধা স্টেনগান নিয়ে তাকে পাহারা দেবে। ইউসুফ শাহ খুবই আনন্দের সাথে এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধার যে দলটা অপারেশন করতে গিয়েছিল, আমরা তাদের পেছনে ঘুরঘুর করতে লাগলাম যুদ্ধের গল্প শোনার জন্য। সবাই ঠিক করে গল্প করতে পারে না, কিন্তু গল্প বলার মাঝে পাইকার ভাইয়ের তুলনা নাই। সে হাত-পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে অভিনয় করে মুখ দিয়ে শব্দ করে যুদ্ধের যা একটা বর্ণনা দিল সেটা আর বলার মতো না! যারা তার সাথে যুদ্ধ করে এসেছে তারাও পর্যন্ত যুদ্ধের পুরো ঘটনাটা পাইকার ভাইয়ের মুখ থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে শুনল।
গল্প শেষ করার পর যখন পাইকার ভাইয়ের আশপাশে কেউ নেই তখন আমি আর ডোরা তার কাছাকাছি গিয়ে গলা নামিয়ে বললাম, পাইকার ভাই, আপনাকে একটা কথা বলি?
বলো।
আগে বলেন আপনি করবেন।
কথাটা না বললে আমি কেমন করে বলব যে আমি করব? মনে করো এখন তুমি যদি আমাকে বলল যে শরীরে তেল মেখে ইউসুফ শাহের সাথে কুস্তি করতে হবে তাহলে আমি কোনো দিন রাজি হব না।
না, না, আপনাকে কারো সাথে কুস্তি করতে হবে না।
তাহলে আগে বলো আমাকে কী করতে হবে?
আমাকে আর ডোরাকে অস্ত্র চালানো শিখাবেন? রাইফেল স্টেনগান দিয়ে কেমন করে গুলি করতে হয়। কেমন করে গ্রেনেড ছুঁড়তে হয়–
তোমরা এত বাচ্চা! তোমরা গোলাগুলি শিখতে চাও?
ডোরা বলল, এখন তো যুদ্ধের সময়। যুদ্ধের সময় তো সবাইকে সবকিছু শিখতে হয়।
পাইকার ভাই বলল, ঠিক আছে দেখি। কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করে দেখি। যদি রাজি হয়–
আমরা নিঃশ্বাস ফেললাম। মাসুদ ভাইকে রাজি করানো খুবই কঠিন। তার ধারণা, যুদ্ধ খুবই খারাপ জিনিস, আমরা ছোট মানুষ, তাই যুদ্ধ থেকে আমাদের একশ হাত দূরে থাকতে হবে।
পাইকার ভাই কীভাবে কীভাবে জানি মাসুদ ভাইকে রাজি করিয়ে ফেলল, তারপর আমাদের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল। পাইকার ভাই খুব যত্ন করে আমাদেরকে রাইফেল, এসএলআর, স্টেনগান, কারবাইন চালানো শেখাল। সত্যিকারের গুলি দিয়ে শেখানো গেল না, তাহলে শব্দ হবে আর শব্দ শুনে পাকিস্তানিরা জেনে যেতে পারে আমরা এখানে আছি।
আমাদেরকে মর্টার দিয়ে কেমন করে শেল ছোঁড়া হয় সেটা দেখাল। তারপর গ্রেনেড কেমন করে ছুঁড়তে হয় সেটা শেখাল। ভেতর থেকে ডেটোনেটর খুলে আমাদের হাতে একটা গ্রেনেড দিয়ে কেমন করে সেফটি পিন খুলে লিভারটা জোরে চেপে ধরে রেখে দূরে ছুড়ে দিতে হয় সেটা শেখাল।
আমরা খুবই আগ্রহ নিয়ে গ্রেনেড ছোড়া শিখলাম। দুজনে মিলে অনেকবার প্র্যাকটিস করলাম। কে কতদূরে ছুঁড়তে পারি সেটা নিয়ে আমি আর ডোরা দুজনে মিলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করে দিলাম।
পাইকার ভাই খুবই খুশি হয়ে বলল, তোমরা দুজন খুবই ভালো গ্রেনেড ছোঁড়া শিখেছ। শুধু একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। সেফটি লিভার ভোলার চার থেকে পাঁচ সেকেন্ড পরে তো এটা ফাটবে, তাই এটা ছোঁড়ার পরে, এই সময়ের মাঝে তোমাদের ঘাপটি মেরে শুয়ে পড়তে হবে। তা না হলে নিজের গ্রেনেড়ে নিজেই মোরব্বা হয়ে যাবে।
পাইকার ভাই তারপর আমাদের ক্রলিং করা শেখাল, যুদ্ধের সময় নাকি মাথার ওপর দিয়ে গুলি যেতে থাকে, তখন একেবারে মাটির সাথে মিশে কনুইয়ে ভর দিয়ে ক্রলিং করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যেতে হয়।
আমি আর ডোরা তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাটিতে ক্রলিং করে সময় কাটালাম। দেখতে দেখতে আমাদের কনুইয়ের চামড়া খসখসে হয়ে উঠল।
আমরা যখন পাইকার ভাইয়ের কাছ থেকে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিই তখন ইউসুফ শাহ গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত, মাঝে মাঝেই কেমন যেন অবাক হয়ে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ত। আমাদের মতো ছোট বাচ্চারা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে পারি সেটা সে বিশ্বাসই করতে পারত না।
সপ্তাহ খানেক পর ইউসুফ শাহকে বর্ডার পার করে পাঠানোর জন্য মাসুদ ভাই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে রেডি করল। তারা কাঁকনডুবি গ্রামের কাছে দিয়ে যাবে, তাই মাসুদ ভাই আমাকে আর ডোরাকে জিজ্ঞেস করল আমরা বাড়িতে কোনো চিঠি পাঠাতে চাই কি না।
ডোরা অনেক সময় নিয়ে লম্বা একটা চিঠি লিখল, সেখানে ক্যাম্পের সব খবর আছে। আমরা যে খুব ভালো আছি সেটা সে ভালো করে বুঝিয়ে দিল। সবাই আমাদের যত্ন করে, বিশেষ করে ক্যাম্পের মা ডোরাকে আলাদাভাবে দেখে-শুনে রাখে, সেটাও সে খুব গুছিয়ে লিখে দিল।
আমি জীবনে চিঠি লিখি নাই, নানিও লেখাপড়া জানে না, তাই চিঠি লিখে কী লাভ হবে বুঝতে পারলাম না। ডোরা তখন আমাকে ধমক দিয়ে বলল ঢং করবি না। সুন্দর করে একটা চিঠি লেখ–
বাধ্য হয়ে আমি চিঠি লিখলাম :
নানি,
আমার কদমবুচি লইবেন। পর সমাচার এই যে মুকতি বাহিনির কেম্পে আমরা ভালা আছি। আমার জন্য তুমি চিন্তা কুনু করিও না। আমি খুবই ভাল আছি। চিন্তার কুনু কারণ নেই। তুমি কেমন আছ? আশা করি তুমি ভালা আছ। আমি ভালা আছি। আমার জন্য দুয়া করিও এবং ডোরার জন্য দুয়া করিও। একই সাথে সব মুকতি বাহিনির জন্য দুয়া করিও।
ইতি
রঞ্জু।
আমার চিঠিটা দেখে ডোরা খুবই বিরক্ত হলো, বলল, এটা কী রকম ফালতু একটা চিঠি লিখেছিস?
আমি রেগে বললাম, আমার ইচ্ছে হলে আমি ফালতু চিঠি লিখব। তাতে তোর কী?
এক কথা বারবার। আমি ভালো আছি, তুমি কেমন আছ। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? তার ওপর কতগুলো বানান ভুল।
আমি বললাম, তাতে তোর সমস্যা কী? নানি লেখাপড়া জানে না– বানান ভুল থাকলেই কী আর না থাকলেই কী, কেউ একজন তাকে পড়ে শোনাবে
ডোরা তার পরও গজগজ করতে লাগল।
যাবার আগে ইউসুফ শাহ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেল। ঠিক রওনা দেয়ার আগে মা এসে দাঁড়ালেন। মুক্তিযোদ্ধা দুইজন মায়ের পা ধরে সালাম করল, মা তাদের মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ফি আমানিল্লাহ।
ইউসুফ শাহও হঠাৎ কী মনে করে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করল। মা এক মুহূর্ত ইতস্তত করে ইউসুফ শাহের মাথার হাত রেখে বললেন, ফি আমানিল্লাহ।
ইউসুফ শাহ হাত দিয়ে চোখ মুছে তার নিজের ভাষায় কী যেন বলল। তার কথাটা কী, আমরা কেউ বুঝতে পারলাম না।
কিন্তু কী বলতে চাইছে, সেটা বুঝতে আমাদের কারো কোনো সমস্যা হলো না।
.
২২.
আমরা আস্তে আস্তে ক্যাম্পে দিন কাটানোতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। মুক্তিবাহিনী প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই একবার-দুবার করে অপারেশনে যায়। তারা এই অপারেশনগুলোকে বলে হিট অ্যান্ড রান–অর্থাৎ আক্রমণ করে সরে যাওয়া। সেই জন্য ক্ষয়ক্ষতি হয় খুব কম। কখনো কখনো দূর থেকে মর্টারের গোলা ফেলে চলে আসে। মাঝে মাঝে তাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে। সারা রাত গোলাগুলি করে। সকাল হবার আগে চলে আসে। সবচেয়ে সোজা অপারেশন রাজাকার আর শান্তি কমিটির মেম্বারদের শাস্তি দেওয়া অপারেশন। এই অপারেশনগুলোর কারণে রাজাকারে যোগ দেওয়া কমে গেছে।
আগে আমাদের অস্ত্র খুব বেশি ছিল না, হঠাৎ করে অনেক অস্ত্র এসে গেছে। কয়েকদিন আগে মাসুদ ভাইয়েরা খবর পেয়েছে অস্ত্রের বিশাল একটা চালান আসছে। রাজাকাররা রাত জেগে নদীতে পাহারা দেয়, নৌকা দেখলেই সার্চ করে, তাই তাদের ওপর দায়িত্ব হলো রাজাকার বাহিনীকে শেষ করে দেওয়া। মাসুদ ভাইয়েরা সময়মতো অপারেশন চালিয়েছে গোলাগুলি শুরু হতেই রাজাকারগুলো জান নিয়ে পালিয়েছে তখন অস্ত্রের নৌকাগুলো ভেতরে নিয়ে এসেছে। সেই অস্ত্রের ভাগ মাসুদ ভাইও পেয়েছে দুই নৌকা অস্ত্র। তাই মাসুদ ভাইয়ের মন-মেজাজ খুব ভালো। সেই অস্ত্র আমাদের ক্যাম্পে আনা হয়েছে, মাসুদ ভাই এখন সময় পেলেই সেই অস্ত্র হাত বুলিয়ে দেখে, মিষ্টি দেখে আমাদের জিবে যে রকম পানি চলে আসে, এই অস্ত্রগুলো দেখে মাসুদ ভাইয়ের জিবে সে রকম পানি চলে আসে।
শুধু যে অস্ত্র এসেছে তা নয়, একসাথে গ্রামের কমবয়সী অনেকগুলো মানুষ এসেছে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে। ইপিআরের সেই নিষ্ঠুর সুবেদার এই নূতন মুক্তিযোদ্ধাদের অত্যাচার করে যাচ্ছে! ক্রলিং করতে করতে তাদের কনুই আর হাঁটুর ছাল উঠে গেছে।
একদিন রাতে আমরা রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছি। কোনো একটা কারণে আজকে রেডিও শোনার জন্য খুব বেশি মানুষ নাই। নূতন যারা এসেছে, তাদের বেশ কয়েকজন বসে বসে চরমপত্র শুনতে শুনতে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। জামাতে ইসলামীর ছাত্ররা কীভাবে নিয়াজীর পায়ের তলা ফেটে যাচ্ছে সেটা নিয়ে যখন টিটকারি করছিল তখন হঠাৎ একজন মানুষ উঠে দাঁড়াল। আমি খুবই অবাক হলাম, চরমপত্র এত মজার একটা অনুষ্ঠান সেটা শুনতে শুনতে কেউ উঠে যেতে পারে না। হয়তো তার খুবই বাথরুম চেপেছে–কিন্তু তবু আমার কেন জানি সন্দেহ হলো। তাই আসলেই বাথরুম করতে গিয়েছে কি না, দেখার জন্য আমি মানুষটার পেছনে পেছনে গেলাম। দেখলাম সে মোটেই বাথরুম করতে যায়নি। ব্যারাকে তার জায়গায় বসে বিছানার নিচ থেকে একটা নোটবই বের করে একটা টর্চলাইটের আলোতে কিছু একটা লিখছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মানুষটা ভীষণ চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, কে?
আমি বললাম, আমি।
মানুষটা আমার মুখে টর্চের আলো ফেলে প্রায় ধমক দিয়ে বলল, আমি কে?
আমি রঞ্জু।
তুমি কী চাও।
কিছু চাই না।
তাহলে?
তাহলে কী?
মানুষটা আমার কথায় খুবই বিরক্ত হলো। বলল, তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, এমনি। ছোট হওয়ায় অনেক সুবিধা। কিছু বুঝি না, কিছু জানি না, হাবাগোবা মানুষের মতো ভান করে থাকা যায়। তাই আমি হাবাগোবা ধরনের মানুষ, এ রকম ভান করে দাঁড়িয়েই থাকলাম। মানুষটা তখন খেঁকিয়ে উঠে বলল, যাও! যাও এখান থেকে।
আমি বললাম, আচ্ছা। তারপর হেঁটে হেঁটে চরমপত্র শুনতে চলে এলাম। ডোরা জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলি?
ঐ তো।
ডোরা বিরক্ত হয়ে বলল, ঐ তো মানে আবার কী?
আমি গলা নামিয়ে বললাম, মনে হয় এইখানে একজন রাজাকার ঢুকেছে।
রাজাকার।
হ্যাঁ।
ডোরা ফিসফিস করে বলল, তুই কেমন করে বুঝতে পারলি?
এখনো পুরাপুরি বুঝতে পারি নাই। চরমপত্রটা শেষ হোক, তারপরে বলব।
ডোরা শোনার জন্য অধৈর্য হয়ে গেল। তাই তাকে নিয়ে এক কোনায় গিয়ে যা কিছু বললাম শুনে ডোরাও খুব উত্তেজিত হয়ে গেল। বলল, চল, রাজাকারকে গিয়ে ধরি। গুলি করে দিই।
আমি মাথা চুলকে বললাম, এখনো তো প্রমাণ হয় নাই সে রাজাকার। যদি রাজাকার না হয়?
তাহলে?
আগে দেখি মানুষটা কী করে।
কীভাবে দেখবি?
আমি আবার মাথা চুলকালাম, বললাম, এক কাজ করলে কেমন হয়?
কী কাজ?
খাওয়ার সময় তুই মানুষটাকে ব্যস্ত রাখবি, আমি তখন তার বিছানাপত্র জামাকাপড় খুঁজে দেখব কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় কি না।
ডোরা বলল, ঠিক আছে।
কাজেই খেতে বসে আমি খুব তাড়াতাড়ি গপগপ করে খেয়ে শেষ করে উঠে গেলাম। ডোরা মানুষটার পাশে বসে থাকল, মানুষটা যখন আধাআধি খেয়েছে তখন ধাক্কা মেরে তার খাবারের থালাটা ফেলে দিল। ইচ্ছে করে থালাটা ফেলেনি–হঠাৎ করে ধাক্কা লেগে পড়ে গেছে, এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলে আবার নূতন করে তাকে খাবার দেয়া হলো।
আমি ততক্ষণে তার বিছানার নিচ থেকে একটা রুলটানা খাতা বের করেছি, প্রথম দিককার পৃষ্ঠাতে অনেক কিছু লেখা, আবছা অন্ধকারে পড়ার কোনো উপায় নেই। আমি বেশি ঝামেলায় না গিয়ে খাতার পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে নিলাম। খাতার সাথে একটা বলপয়েন্ট কলমও ছিল। আমি কলম দিয়ে সাদা পৃষ্ঠাতে হিজিবিজি লিখে ভরে ফেললাম। খাতাটা খুলে পরীক্ষা করলেও অন্ধকারে বুঝতে পারবে না যে পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে নিয়েছি। খোঁজাখুঁজি করে আমি একটা বোতল পেলাম, বোতলের ছিপি খুলে গন্ধ নিতেই বুঝতে পারলাম ভেতরে কেরোসিন। আমাদের ক্যাম্পে কেরোসিন খুব হিসাব করে খরচ করতে হয়। তার মাঝে এতোটা কেরোসিন এই মানুষটা সরিয়ে নিল কেমন করে? তার চাইতে বড় কথা কেরোসিন দিয়ে আগুন জ্বালায়, এই কেরোসিন দিয়ে সে কোথায় আগুন জ্বালাবে? কেন জ্বালাবে?
আমার চিন্তা করার বেশি সময় নাই। তাই কেরোসিনের বোতলটা নিয়ে বের হয়ে গেলাম ব্যারাকের পেছনে। একটা ভাঙা মাটির হাড়ি পড়েছিল, সেখানে বৃষ্টির পানি জমে আছে। আমি পানিটা ফেলে সেখানে কেরোসিনটা ঢেলে রাখলাম। এখন বোতলটাতে কোনো রকম তরল ভরে রাখতে হবে। সেটা অবশ্যি সমস্যা হলো না, ভীষণ বাথরুম পেয়েছিল, কাজটা বাইরে না করে বোতলের ভেতরে করে ফেললাম–এক ধাক্কায় দুটো কাজ হয়ে গেল।
ততক্ষণে খাওয়া শেষের দিকে, আমি ডোরার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলাম কাজ শেষ। ডোরাও তখন মানুষটার সামনে থেকে সরে এল।
ক্যাম্পের পেছনে বড় বড় মাটির চুলোয় তখনো গনগনে কয়লার লালচে একটা আলো রয়েছে, সেই আলোতে আমরা মানুষটার কাগজে কী লেখা আছে পড়ার চেষ্টা করলাম। সেখানে লেখা :
রাইফেল প্রায় ত্রিশটা
এসএলআর প্রায় ১৫টা
এনারগা আনুমানিক ১০টা
এলএমজি চারটা
স্পেয়ার ব্যারেল চারটা
স্পেয়ার ম্যাগাজিন চার-পাঁচটা
দুই ইঞ্চি মর্টার সাতটা
তিন ইঞ্চি মর্টার একটা
গ্রেনেড একশোর বেশি
গুলি আনুমানিক দশ হাজার রাউন্ড
অন্য একটা কাগজে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, তার পাশে কে কোন গ্রামের, বাবার নাম কী এবং তার পাশে কোথাও লেখা আওয়ামী লীগ, কোথাও ন্যাপ, কোথাও হিন্দু লেখা!
পড়ে আমাদের কোনো সন্দেহই থাকল না, মানুষটা নিশ্চয়ই রাজাকার। তা না হলে অস্ত্রপাতির তালিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের নাম-ঠিকানা কাগজে লিখেছে কেন?
ডোরা বলল, মাসুদ ভাইয়ের কাছে চল।
আমরা মাসুদ ভাইকে খুঁজে পেলাম না। শুনলাম কোনো এক জায়গায় বসে জরুরি বৈঠক করছে। পাইকার ভাইকেও খুঁজে পেলাম না, মনে হয় একই সাথে একই মিটিংয়ে আছে। আমি কয়েকজনকে বলার চেষ্টা করলাম মাসুদ ভাইকে দরকার, খুবই জরুরি কিন্তু কেউ আমাদের একটুও পাত্তা দিল না। ছোট হওয়ার এই হচ্ছে সমস্যা কেউ গুরুত্ব দেয় না।
আমি বললাম, কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি।
ডোরা বলল, যদি তার মাঝে কিছু একটা হয়ে যায়?
আমি বললাম, হবে না। আমি তো এই রাজাকারের সাথে একই ঘরে, সারা রাত চোখে চোখে রাখব। কিছু করতে চাইলেই চিল্লিয়ে সবাইকে জাগিয়ে দেব।
রাত্রি বেলা আমি সত্যি সত্যি মানুষটাকে চোখে চোখে রাখলাম, না ঘুমিয়ে জেগে রইলাম। কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম, নিজেই জানি না। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি যে জেগে আছি তাই ঘুমিয়ে গেছি, সেটাও বুঝতে পারছি না।
গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আর আমি ধড়মড় করে জেগে উঠলাম। সাথে সাথে আমার মনে পড়ল আমার রাজাকারটাকে চোখে চোখে রাখার কথা। আবছা অন্ধকারে তাকিয়ে দেখলাম মানুষটা তার বিছানায় নাই। আমি সাথে সাথে উঠে বসে চারদিকে তাকালাম। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি বাইরে আবছা অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো একজন নড়ছে। আমি চুপি চুপি বের হয়ে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম মানুষটা কী করছে। ঠিক বুঝতে পারলাম না, মনে হলো একটা কাপড় টানাটানি করে সেখানে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করছে।
আমি তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললাম, সাবধান! রাজাকার! রাজাকার!
মানুষটা ঝট করে ঘুরে আমার দিকে তাকাল, তারপর হাতের সবকিছু নিচে ফেলে জঙ্গলের দিকে দৌড়াতে লাগল।
আমার চিৎকারে অনেকে ঘুম থেকে উঠে গেছে, কয়েকজন হাতে স্টেনগান নিয়ে ছুটে এসে বলল, কোথায়? কোথায় রাজাকার?
মানুষটা যেদিকে দৌড়ে গিয়েছে আমি হাত দিয়ে দেখালাম। ঠিক কী হয়েছে কেউ বুঝতে পারছে না, সবাই অন্ধকারে ছোটাছুটি করছে। ডোরাও উঠে এসেছে। একসময় মাসুদ ভাই বের হয়ে এল, জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
আমি বললাম, মাসুদ ভাই, রাজাকার।
কোথায় রাজাকার? আমি তখন পকেট থেকে কাগজগুলো বের করে মাসুদ ভাইকে দিলাম, বললাম, এই দেখেন।
এগুলো কিসের কাগজ?
যে মানুষটা জঙ্গলে পালিয়ে গেছে তার নোটবইয়ে এগুলো লেখা ছিল।
তুমি কেমন করে পেলে?
আমি তখন সবকিছু খুলে বললাম, মাসুদ ভাই সবকিছু শুনে তখন তখনই মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটা দলকে পাঠাল রাজাকারটাকে জঙ্গলের ভেতর থেকে ধরে আনতে।
ঘরের বাইরে কেরোসিনের বোতলটা পাওয়া গেল। বোতলের মুখে কাপড়ের সলতে লাগিয়ে সেখানে আগুন দিয়ে বোতলটাকে অস্ত্রের ঘরে ছুড়ে মারার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যেহেতু ভেতরে কেরোসিন নেই, অন্য কিছু আছে তাই কিছুতেই আগুন ধরাতে পারেনি। কেরোসিনের বদলে ভেতরে কী আছে, সেটা আমি পরিষ্কার করে না বললেও মাসুদ ভাই বোতলটা হাতে নিয়েই বুঝে গেলেন এবং সবাই তখন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিল।
শুধু ডোরা বলল, ছিঃ! নোংরা খবিস কোথাকার!
রাজাকারটাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেল না।
ভোরবেলা নাস্তা করতে করতে মাসুদ ভাই বলল, এখন সবাই রেডি হও, যেকোনো দিন মিলিটারি আমাদের আক্রমণ করতে আসছে!
পাইকার ভাই বলল, ভালোই হলো। আগে যুদ্ধ করার জন্য আমাদের মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো। এখন কোনো পরিশ্রম নাই। আমাদের যুদ্ধ করতে যেতে হবে না। যুদ্ধ আমাদের কাছে চলে আসছে!
মাসুদ ভাই হাসল, হেসে বলল, এই ভাবে দেখলে ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা হচ্ছি গেরিলা। গেরিলারা তিন রকম যুদ্ধ করে। রেইড মানে শক্রর ঘাঁটিতে ঝটিকা আক্রমণ, অ্যামবুশ মানে তারা যখন কোথাও যায় তখন লুকিয়ে তাদের আক্রমণ আর স্নাইপিং–অর্থাৎ দূর থেকে গুলি করা। গেরিলা যুদ্ধের কোনো কেতাবে লেখা নাই আমরা আরাম করে বসে বসে অপেক্ষা করব কোন সময় তারা আমাদের আক্রমণ করবে!
আমাদের এখানে আসা সোজা কথা না তাদেরকে এই পর্যন্ত আসতে দেব না, তার আগেই অ্যামবুশ করব।
মাসুদ ভাই মাথা চুলকাল, কিন্তু তারা আমাদের পজিশন জেনে গেছে দূর থেকে মর্টার দিয়ে শেলিং করে ছাতু বানিয়ে দেবে। প্লেন ডাকিয়ে এনে প্লেন থেকেও স্ট্রাফিং করতে পারে।
পাইকার ভাই একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে আর ডোরাকে দেখিয়ে বলল, এই বাচ্চাগুলো যখন বলেছে খুবই জরুরি দরকার আমার সাথে দেখা করার, তখন যদি তাদের কথাকে গুরুত্ব দিতে তাহলে এই ঝামেলা হতো না! রাজাকারটা তাহলে এইভাবে পালাতে পারত না!
একজন মুক্তিযোদ্ধা অপরাধী মুখে বলল, আসলে বুঝতে পারি নাই। ভাবছি ছোট বাচ্চা তাদের আবার জরুরি কাজ আর কী হবে?
মাসুদ ভাই বলল, যাই হোক, যা হবার হয়েছে, এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। আমরা এখন কী করব, সেটা ঠিক করা যাক।
খুব কম কথা বলে সেই রকম একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, আসলে আমাদের এখন এই ক্যাম্পটা গুটিয়ে আশপাশের গ্রামে চলে যাওয়া উচিত। একটা একটা গ্রাম মুক্ত করে মুক্তাঞ্চল তৈরী করার সময় হয়েছে।
মাসুদ ভাই বলল, ঠিকই বলেছ। আমাদের এখন লুকিয়ে থাকার সময় শেষ– এখন পাকিস্তানিদের লুকিয়ে থাকার সময় শুরু।।
তখন মাসুদ ভাই অন্য সব মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কীভাবে কী করা যায়, সেটা নিয়ে আলাপ করতে লাগল। প্রথম দিকে আলাপটা সহজ ছিল, আমরা সেটা বসে বসে শুনলাম, আস্তে আস্তে আলাপটা জটিল হয়ে গেল, তখন আমি আর ডোরা উঠে গেলাম।
আমি ডোরাকে বললাম, একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে।
কী ভালো হয়েছে?
আমরা এত দিন থেকে বলছি আমাদেরকে যুদ্ধে নিয়ে যেতে, আমাদের নিয়ে যায় নাই! এখন যখন যুদ্ধটা এখানেই হবে, এখন তো আমরা যুদ্ধটা দেখতে পারব!
খালি দেখব না, যুদ্ধ করব। ডোরা মুখ শক্ত করে বলল, করবই করব।
মুক্তিবাহিনী যখন আক্রমণ করে তখন তারা হঠাৎ করে গোপনে আক্রমণ করতে পারে। যদি অবস্থা ভালো থাকে যুদ্ধ চালিয়ে যায়, অবস্থা একটু খারাপ হলেই সরে পড়তে পারে। পাকিস্তান মিলিটারির সেই সুবিধা নাই, তাদের আক্রমণ করতে হলে অনেক লটবহর নিয়ে আক্রমণ করতে হয়–তারা কবে কখন কোন দিকে যাচ্ছে, সেই খবর অনেক আগেই পৌঁছে যায়। তাই যেদিন পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে আসবে আমরা একদিন আগেই তার খবর পেয়ে গেলাম।
রাত্রি বেলা খাওয়ার আগে মাসুদ ভাই সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং করল। একটা গুলির বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে মাসুদ ভাই বলল, আমরা এর আগে অনেক অপারেশন করেছি, মিলিটারির সাথে যুদ্ধ নূতন কিছু না। কিন্তু কালকের যুদ্ধটা অন্য রকম–এই প্রথমবার আমরা এক জায়গায় বসে থাকব আর মিলিটারি আমাদের সেই জায়গায় আক্রমণ করবে। আমরা আগে কখনো এই রকম যুদ্ধ করি নাই সত্যি কথা বলতে কী–আমি এই যুদ্ধ করতে চাই না। কাজেই কালকের যুদ্ধটা হবে শুধুমাত্র ঠেকিয়ে রাখা।
আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে আমাদের অস্ত্র। আমাদের গোলাগুলি। তাই সেগুলো আমাদের রক্ষা করতে হবে। কাল সবাইকে অস্ত্র ভাগাভাগি করে দেওয়া হবে–আমরা রঞ্জু-খোকনকেও একটা করে অস্ত্র দেব। মাকেও একটা অস্ত্র দেব।
কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু আমি আর ডোরা আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। মাসুদ ভাই বলল, বাকি অস্ত্র আমরা এখান থেকে সরিয়ে লুকিয়ে ফেলব। আমি মনে করি না পাকিস্তানি মিলিটারি এত দূর আসতে পারবে–তার পরও আমরা কোনো ঝুঁকি নিব না।
আমরা যে জঙ্গলে আছি সেখানে ঢুকতে হলে একটা খাল পার হতে হয়। আমরা সেই খালের ওপর তাদেরকে অ্যামবুশ করব। সেখানে ফাঁকা জায়গা, কভার নেয়ার জায়গা নাই। দুপুরের আগে তারা সেখানে পৌঁছাতে পারবে না, যদি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে পারি তাহলেই যথেষ্ট। রাত্রে তারা এখানে থাকবে না। এই জঙ্গলে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলে তারা জন্মেও আমাদেরকে খুঁজে পাবে না।
মাসুদ ভাই আরও অনেক কিছু বলল, উত্তেজনার জন্য আমি তার বেশির ভাগই শুনতে পাচ্ছিলাম না কাল আমাদেরও অস্ত্র দেবে–কী। সাংঘাতিক! কোন অস্ত্র দেবে? ইশ! যদি একটা স্টেনগান পেতাম কী মজা হতো! সাথে একশ রাউন্ড গুলি আর দুইটা গ্রেনেড!
উত্তেজনায় আমার চোখে ঘুম আসছিল না। শেষ পর্যন্ত যখন ঘুমিয়েছি তখন মনে হলো প্রায় সাথে সাথে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়েছে। তারপর একজন একজন করে সবাইকে অস্ত্র বুঝিয়ে দেওয়া শুরু হলো। আমি আর ডোরা সত্যি সত্যি একটা করে স্টেনগান পেয়েছি। সাথে একশ রাউন্ড করে গুলি আর দুইটা গ্রেনেড। আমরা নিজেদের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছি না। স্টেনগানের কালো শীতল নলে হাত বোলাতে গিয়ে আমার শরীরে কেমন জানি শিহরণ হতে থাকে।
অন্ধকার থাকতেই আমরা পুরো ক্যাম্প খালি করে বের হয়ে গেলাম। বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধা অবশ্যি রাত থাকতেই খালের পাড়ে গিয়ে পজিশন নিয়েছে। আমরা যখন খালের পাড়ে গিয়েছি তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম গিয়ে দেখব সবাই বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছে, কিন্তু কী অবাক ব্যাপার কোথাও কেউ নেই! আমি যখন খোঁজাখুঁজি করছি তখন হঠাৎ একটা ঝোঁপ নড়ে উঠল আর তার ভেতর থেকে পাইকার ভাইয়ের মাথা বের হয়ে এল! পাইকার ভাই বলল, এই যে আণ্ডা আর বাচ্চা! দেখি অস্ত্র হাতে তোমাদের কেমন লাগে!
আমি আর ডোরা হাতের স্টেনগান উঁচু করে ধরতেই আশপাশে অনেকগুলো ঝোপ নড়ে উঠল, সেখান থেকে অনেকগুলো মাথা বের হয়ে এল এবং সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। আমাদের একই সাথে একটু লজ্জা লাগছে, আবার আনন্দে বুকটা ফেটেও যাচ্ছে। চারদিকে তাকিয়ে সুঝতে পারলাম অনেকগুলো ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে, তার ভেতরে সবাই অপেক্ষা করছে। গাছের ডালপাতা ঝোঁপঝাড় দিয়ে তাদের ঢেকে দেয়া হয়েছে দেখে কেউ বুঝতে পারবে না, এখানে এতজন মুক্তিযোদ্ধা অপেক্ষা করছে। জঙ্গলের আরো ভেতরে আরো মুক্তিযোদ্ধাও লুকিয়ে আছে।
মাসুদ ভাই বলল, রঞ্জু আর খোকন! তোমরা পেছনে চলে যাও।
পেছনে? পেছনে কেন?
তোমরা ছোট, সে জন্য। তোমাদের যতদূর সম্ভব দূরে থাকতে হবে।
কাজেই আমি আর ডোরা মন খারাপ করে অনেক দূরে সরে গেলাম। যেখানে গেলাম সেই জায়গাটাও খালের কাছে কিন্তু রাস্তা থেকে অনেক দূরে। সেখানে একটা ট্রেঞ্চের ভেতরে ঢুকে গেলাম। উপরে গাছপালা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে, দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে কেউ আছে। এই ট্রেঞ্চের ভেতরে আরো দুইজন মুক্তিযোদ্ধা আছে–একজন জলীল ভাই, তাকে নিয়ে পাইকার ভাই আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল, তার কারণ জলীল ভাই সব সময় জ্ঞানের কথা বলে, সবার কান ঝালাপালা করে দেয়। পাইকার ভাইয়ের কথা ভুল নয়। সত্যি সত্যি জলীল ভাই কিছুক্ষণের মাঝে আমাদেরকে জ্ঞান দিয়ে কথা বলতে লাগল, বুঝলে রঞ্জু আর খোকন, এই যুদ্ধে আমরা খুব বেকায়দায় আছি। পাকিস্তানের পক্ষে আছে আমেরিকা আর চীন। শুধু তা-ই না, সব মিডল ইস্টের দেশ। আমাদের সাথে খালি ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়ার সাথে রাশিয়া। ইন্ডিয়ার নিজেরই ঠিক নাই, আমাদের সাহায্য করবে কীভাবে? তার উপরে তাদের ঘাড়ে আছে এক কোটি শরণার্থী। তারা কি শরণার্থীদের খাওয়াবে, নাকি আমাদের সাহায্য করবে? তবে এই অবস্থায় একটা সুবিধা আছে। ইন্ডিয়া কত দিন এক কোটি মানুষকে খাওয়াবে? কাজেই বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাদের লাভ। তাই তাদের ইচ্ছা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু সমস্যা হলো… কিছুক্ষণের মাঝেই আমার আর ডোরার মাথা ধরে গেল।
যুদ্ধের পরিকল্পনাটা সবাইকে ভালো করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। মাটির সড়ক ধরে পাকিস্তান মিলিটারির দলটা খালের সামনে পৌঁছানোর পর যখন তারা খালটা পার হতে শুরু করবে তখন আক্রমণ শুরু করা হবে। সবাইকে একশবার করে বলে দেয়া হলো মাসুদ ভাই যখন তার এলএমজি দিয়ে গুলি শুরু করবে ঠিক তখন সবাইকে গুলি শুরু করতে হবে। তার আগে কেউ একটা গুলিও করতে পারবে না। মাসুদ ভাই সবাইকে বলে দিয়েছে কেউ যেন আগে গুলি না করে, যদি করা হয় তাহলে মিলিটারিকে অতর্কিতে আক্রমণ করার সুযোগটা নষ্ট হয়ে যাবে। সব মুক্তিযোদ্ধা রাজি হয়েছে। প্রথম প্রথম এটা নিয়ে সমস্যা হতো, নার্ভাস হয়ে আগেই কেউ না কেউ গুলি করে দিত। এখন সমস্যা হয় না। ঠাণ্ডা মাথায় অপেক্ষা করে।
ট্রেঞ্চের ভেতরে আমরা চুপচাপ অপেক্ষা করছি। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে বাইরে দেখছি। এখান থেকে দূরে মাটির সড়কটা আবছাভাবে দেখা যায়। মিলিটারিগুলো সেই সড়কে হাজির হওয়ার পরই যুদ্ধ শুরু হবে, তার আগে কারো কিছু করার নেই। অন্যেরা শুধু অপেক্ষা করবে। আমার আর ডোরার কপাল খারাপ, অপেক্ষা করার সময় আমাদের জ্ঞানী মুক্তিযোদ্ধার গভীর জ্ঞানের কথা শুনতে হবে।
ডোরা একটু পরে পরে মাথা বের করে উঁকি দিচ্ছিল–একবার উঁকি দিয়ে মাথাটা ভেতরে ঢোকানোর আগে কী মনে করে উল্টো দিকে তাকাল তারপর ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। আমিও মাথা বের করলাম, দেখলাম খালের তীর ধরে মিলিটারিদের বিশাল একটা বাহিনী আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। তারা মোটেও সড়ক ধরে এসে খালটা পার হচ্ছে না। উত্তর দিকে কোনো একটা জায়গায় খালটা আগে পার হয়ে নিয়েছে, এখন আমাদের দিকে আসছে! ওরা মোটেও সামনে দিয়ে আক্রমণ করবে না, ওরা আক্রমণ করবে পেছন দিক দিয়ে। সর্বনাশ!
আমি ডোরার দিকে তাকালাম, ডোরা আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, এখন কী হবে?
ডোরা বলল, মাসুদ ভাইদের জানাতে হবে!
হ্যাঁ। বলে আমি আর ডোরা লাফ দিয়ে ট্রেঞ্চ থেকে বের হয়ে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেলাম। আমাদের জ্ঞানী মুক্তিযোদ্ধা হতবাক হয়ে বলল, কী করো? কী করো?
ডোরা বলল, মিলিটারি চলে এসেছে! উল্টো দিক দিয়ে।
মিলিটারিগুলো যেন আমাদের দেখতে না পায় সেই ভাবে গাছের আড়ালে আড়ালে ছুটে আমি আর ডোরা মাসুদ ভাইয়ের ট্রেঞ্চটা বের করলাম, মাসুদ ভাই তার এলএমজিটার পেছনে বসে সিগারেট খাচ্ছিল, আমাদের দেখে আঁতকে উঠল, ধমক দিয়ে বলল, কী করছ তোমরা? বাইরে কেন?
আমি আর ডোরা একসাথে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, মিলিটারি!
মিলিটারি?
হ্যাঁ। আমি হড়বড় করে বললাম, খাল পার হয়ে গেছে, পেছন থেকে আসছে।
ডোরা বলল, এদিক দিয়ে আসবে না
মাসুদ ভাই হকচকিয়ে গেল, কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিল, দুই-এক সেকেন্ড কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, জঙ্গলে ঢোকার আগে অ্যামবুশ করতে হবে। সবাই বের হও।
আমরা দেখলাম ট্রেঞ্চের ভেতর থেকে পিলপিল করে মুক্তিযোদ্ধারা বের হতে শুরু করল, তারপর গুঁড়ি মেরে মিলিটারিদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। আমি আর ডোরা তাদের পিছু পিছু যেতে লাগলাম। তোমরা ছোট, তোমরা পেছনে থাকো, এ রকম কথা বলার মতো অবস্থা কারো নেই।
কয়েক সেকেন্ডে যুদ্ধের পুরো পরিকল্পনাটা পাল্টে দিতে হলো। মুক্তিযোদ্ধারা ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে গেল। আমি আর ডোরা একটা বড় গাছের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। এখান থেকে মিলিটারি দলটাকে দেখা যাচ্ছে। দলের সামনে একটা বাঙালি চেহারার মানুষ। সে পথ দেখিয়ে আনছে, কাছাকাছি পৌঁছানোর পর মানুষটাকে আমি চিনতে পারলাম। এই মানুষটা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের সেই রাজাকার! মানুষ কেমন করে রাজাকার হয়?
মিলিটারিগুলো মোটামুটি একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছাতেই মাসুদ ভাইয়ের এলএমজি গর্জন করে উঠল। সাথে সাথে চারপাশের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র একসাথে গর্জন করে উঠল। আমি আর ডোরাও জীবনের প্রথমবার স্টেনগানের ট্রিগার টেনে ধরলাম, স্টেনগানটা আমাদের হাতে জীবন্ত প্রাণীর মতো কেঁপে কেঁপে উঠল, প্রচণ্ড গুলির শব্দে আমাদের কানে তালা লেগে গেল।
সামনে থাকা মিলিটারিগুলো কাটা কলাগাছের মতো নিচে পড়ে যেতে শুরু করল, অন্যগুলোও সাথে সাথে শুয়ে পড়েছে, কভার নেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড গুলির জন্য কেউ মাথা তুলতে পারছে না–গড়িয়ে গড়িয়ে খালের দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। গাছের আড়ালে থেকে গুলি করছে। একজন দাঁত দিয়ে পিন খুলে একটা গ্রেনেড ছুড়ে দিল। বিকট শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল।
আমি পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছিলাম না, গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ, বারুদের গন্ধ, আর ধোয়ায় চারদিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মিলিটারিরা গুলি করতে শুরু করেছে, আমাদের মাথার ওপর দিয়ে গুলি ছুটে যাচ্ছে। গাছের ডাল ভেঙে পড়ছে, গাছগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। এই তাহলে যুদ্ধ? যুদ্ধ তাহলে এ রকম? এই রকম যুদ্ধ করে আমাদের বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে? এই যুদ্ধে কেউ কি মারা যাবে? আমি কি মারা যাব? কিন্তু আমার ভেতরে কোনো ভয় নেই, কোনো আতঙ্ক নেই। মনে হতে থাকে বেঁচে থাকা মরে থাকায় কিছু আসে যায় না। মনে হতে থাকে আকাশ-বাতাস, গাছপালা, মাটি-নদী, চাঁদ-সূর্য কোথাও কিছু নেই। মনে হতে থাকে সারা পৃথিবীতে শুধু আমরা, শুধু আমাদের হাতে আছে অস্ত্র আর জীবন্ত প্রাণীর মতো সেই অস্ত্র কেঁপে কেঁপে উঠছে।
কতক্ষণ যুদ্ধ হয়েছে আমরা জানি না, আমরা কি যুদ্ধে জিতেছি, না হেরেছি, সেটাও জানি না, কিন্তু হঠাৎ দেখলাম গুলির শব্দ কমে এসেছে, দেখতে পেলাম মুক্তিবাহিনী জয় বাংলা চিৎকার করতে করতে ছুটে যাচ্ছে।
আমি আর ডোরাও জয় বাংলা’ জয় বাংলা’ চিৎকার করতে করতে ছুটে যেতে লাগলাম। মাসুদ ভাই আমাদের থামাল, বলল, ওদের পালিয়ে যেতে দাও। পালিয়ে যেতে দাও।
আমরা থামলাম। মাসুদ ভাই তখন ঘুরে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, সবাই ঠিক আছে?
দূর থেকে একজন ভাঙা গলায় বলল, না কমান্ডার।
মাসুদ ভাই সেদিকে ছুটে যেতে লাগল। আমাদের বুকটা ধক করে উঠল। ঠিক নাই মানে কী? গুলি খেয়ে আহত হয়েছে, নাকি কেউ মারা গিয়েছে?
আমি আর ডোরা মাসুদ ভাইয়ের পেছনে পেছনে ছুটে যাচ্ছিলাম কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা আমাকে থামাল। সে ঠোঁট কামড়ে আছে আর চোখ থেকে পানি পড়ছে, আমাদেরকে বলল, তোমরা যেয়ো না।
কেন?
দৃশ্যটা ভালো না।
কে?
জলীল। আমি আর ডোরা একসাথে চিৎকার করে উঠলাম, জলীল ভাই?
হ্যাঁ।
আমরা একটু আগে একটা ট্রেঞ্চে বসেছিলাম। জলীল ভাই আমাদেরকে জোর করে দেশ-বিদেশের কথা বলছিল, আমরা অধৈর্য হয়ে যচ্ছিলাম। আমি কি জানতাম জলীল ভাই আর কোনো দিন জ্ঞানের কথা বলে আমাদের অধৈর্য করে দেবে না? আমার কেমন জানি দুর্বল লাগতে থাকে।
আমি আর ডোরা দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম সবাই মিলে কিছু একটা করছে। জলীল ভাইয়ের শরীরটাকে কাপড়ে ঢেকে সরিয়ে আনতে থাকে।
ডোরা বলল, আয়, ওদিকে যাই।
কোন দিকে?
একটু আগে যেখানে পাকিস্তানি মিলিটারি ছিল ডোরা হাত দিয়ে সেই দিকটা দেখাল। আমি বললাম, চল।
আমি আর ডোরা এগিয়ে গেলাম। মাটিতে অসংখ্য গুলির খোসা বারুদের গন্ধ। মাটিতে রক্ত। বুটের ছাপ। একটু আগেই এখানে কী ভয়ংকর যুদ্ধ হচ্ছিল, এখন কিছু নেই। কী আশ্চর্য।
ডোরা হঠাৎ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, শ স স স।
আমি ফিসফিস করে বললাম, কী হয়েছে?
শোন।
আমি কান পেতে শুনলাম। অস্পষ্টভাবে একজন মানুষের গোঙানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমরা এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কোথাও কেউ নেই কিন্তু চাপা গোঙানোর শব্দটা এখনো আসছে। মাঝে মাঝে থেমে যায় তারপর আবার শুরু হয়। আমরা স্টেনগান হাতে নিয়ে শব্দটা লক্ষ করে একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম একটা ঝোঁপের আড়ালে একজন মানুষ চিত হয়ে পড়ে আছে, পায়ে গুলি লেগেছে, রক্তে সাদা পাজামা ভেসে যাচ্ছে। আমরা আরেকটু এগোতেই মানুষটা ঘোলা চোখে আমাদের দিকে তাকাল। আমরা তখন মানুষটাকে চিনতে পারলাম। এটা হচ্ছে সেই রাজাকার মানুষটি, যে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, যে পাকিস্তান মিলিটারিগুলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছিল।
আমি আর ডোরা মানুষটার দিকে স্টেনগানটা তাক করে রাখলাম, মানুষটা আমাদের দিকে ঘোলা চোখে তাকিয়ে রইল। কী অদ্ভুত একটা দৃষ্টি!
ডোরা বলল, আপনি রাজাকার?
মানুষটা কোনো কথা বলল না। ডোরা আবার জিজ্ঞেস করল, আপনি কেন রাজাকার হলেন?
মানুষটা এবারেও কিছু বলল না, ডোরা আবার জিজ্ঞেস করল, মানুষ কেমন করে রাজাকার হয় বলবেন?
মানুষটা বিড়বিড় করে বলল, আমারে মাইরা না। আল্লাহর কসম।
কী আশ্চর্য! মানুষটা ভাবছে আমরা তাকে গুলি করব। একটু আগে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলার জন্য সে মিলিটারিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছিল, এখন সে আমাদের কাছে জান ভিক্ষা চাচ্ছে। আমি ডোরাকে বললাম, ডোরা। তুই এখানে থাক, আমি মাসুদ ভাইকে ডেকে আনি।
ডোরা মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে কোলের ওপর তার স্টেনগানটা রেখে বলল, যা।
মাসুদ ভাইয়ের সাথে আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এল, একজন তার রাইফেলটা রাজাকারের মাথার দিকে তাক করে হিংস্র গলায় বলল, শুয়রের বাচ্চা তোর জন্য তোর জন্য– তারপর তার শরীরে অনেক জোরে একটা লাথি দিল, লাথি খেয়ে রাজাকারটা যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে।
মাসুদ ভাই ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, তুমি শান্ত হও তো–
কেন শান্ত হব? কেন? এই শুয়রের বাচ্চার জন্য জলীল ভাই- মানুষটা কথা শেষ করতে পারল না, হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
দুইজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে টেনে সরিয়ে নিল। মাসুদ ভাই রাজাকারটার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি রাজাকার?
মানুষটা কোনো কথা বলল না, শুধু তার ঠোঁট দুটি নড়তে লাগল। মাসুদ ভাই বললেন, তুমি কি দেখেছ পাকিস্তান মিলিটারি যারা মরেছে, যারা গুলি খেয়েছে, আহত হয়েছে তাদের সবাইকে নিয়ে গেছে। তোমাকে নেয় নাই?
রাজাকারটা কোনো কথা বলল না। ফ্যাকাশে মুখে মাসুদ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মাসুদ ভাই বলল, নিজের দেশের সাথে বেইমানি করে তুমি কী পেলে? তুমি যে পাকিস্তানি মিলিটারির পা চাটো সেই মিলিটারিরাও তোমাকে বেইমান জানে। তোমাকে বিশ্বাসঘাতক জানে। সে জন্য তারাও তোমাকে ফেলে গেছে।
মানুষটা কোনো কথা বলল না, দর দর করে ঘামতে লাগল। মাসুদ ভাই বলল, বলো, তুমি কী করো? মুসলিম লীগ, না জামাতে ইসলামী?
মানুষটা এমনভাবে মাসুদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে কোনো কথা বুঝতে পারল না। একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, আমি একে চিনি। এর নাম কাদের। এ জামাতে ইসলামী। পি কে কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি।
মাসুদ ভাই উঠে দাঁড়াল, আমার আর ডোরার দিকে তাকিয়ে বলল, রঞ্জু, খোকন, তোমরা যাও।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন মাসুদ ভাই?
মাসুদ ভাই কঠোর মুখে বলল, প্রশ্ন করো না। যাও।
আমরা তখন সরে গেলাম। জঙ্গলের দিকে হেঁটে যেতে যেতে ডোরা জিজ্ঞেস করল, রাজাকারটাকে মনে হয় মেরে ফেলবে, তাই না?
আমি বললাম, মনে হয়।
.
২৩.
আমরা আবার আমাদের ক্যাম্পে ফিরে এসেছি, কিন্তু এখন এটা আগের মতো না। আগে এটা ছিল আমাদের ঘাঁটি, কিন্তু এখন এটা আমাদের ঘাঁটি না। এখন এখানে আছি অল্প সময়ের জন্য। আমরা এখান থেকে যেকোনো সময় চলে যাব। সবাই এখন নিজের কাছে তার অস্ত্র রাখে। আমি মাথার কাছে স্টেনগান নিয়ে ঘুমাই। আমার মাথার নিচে গ্রেনেড থাকে। কেউ যদি কয়েক দিন আগেও আমাকে বলত আমার নিজের একটা স্টেনগান থাকবে, গুলি থাকবে, গ্রেনেড থাকবে, তাহলে সেটা আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম না।
মায়েরও একটা স্টেনগান আছে। স্টেনগানটা পাশে রেখে মা রান্না করে। যখন সবার পাতে খাবার তুলে দেয় তখন মায়ের ঘাড়ে একটা স্টেনগান থাকে! দেখতে খুবই মজা লাগে। যারা খায় তাদের হাতের কাছেও একটা রাইফেল না হয় এসএলআর থাকে। সব সময়েই একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব।
মিলিটারির সাথে সামনাসামনি যুদ্ধে জলীল ভাই মারা গিয়েছে, তাকে খালের পাড়ে কবর দেওয়া হয়েছে। আহত হয়েছে দুইজন। একজন বেশি একজন কম যে বেশি আহত হয়েছে তাকে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা বর্ডার পার করিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সত্যি সত্যি হাসপাতালে নিয়ে পৌঁছাতে পেরেছে কি না, আমরা জানি না। যে কম আহত হয়েছে সে ক্যাম্পেই আছে। তার বাম হাতের একটা আঙুল উড়ে গেছে, সে সময় পেলেই অবাক হয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় তার যে একটা আঙুল কম, সেটা সে এখনো মেনে নিতে পারছে না। একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনার কি আঙুলে খুব ব্যথা করে?
না। ব্যথা খুব বেশি নাই। কিন্তু—
কিন্তু কী?
আমার যে আঙুলটা নাই মাঝে মাঝে সেই আঙুলটা চুলকায়।
শুনে আমি আর ডোরা প্রায় হেসেই ফেলছিলাম কিন্তু সে একটুও হাসল না। বলল, আমি মিছা কথা বলছি না। সত্যি কথা বলছি।
তখন আমরা অবাক হয়ে গেলাম, যেটা নাই সেটা কেমন করে চুলকাতে পারে?
.
খুব শীত পড়েছে, তাই আমরা আগুন জ্বালিয়ে সেটা ঘিরে বসে হাত-পা গরম করছি। আমি আর ডোরা পাইকার ভাইয়ের দুই দিকে বসে তার গল্প শুনছি। পাইকার ভাই খুব মজা করে গল্প করতে পারে, হাত-পা নেড়ে বলল, বুঝলি আস্তা-বাচ্চা, একবার একটা পাকিস্তান মিলিটারির ক্যাম্প আক্রমণ করেছি। হঠাৎ একটা পাকিস্তানি মিলিটারি একটা চায়নিজ রাইফেল নিয়ে বের হয়ে এসেছে। আমি তখন আমার স্টেনগান দিয়ে তার মাথায় গুলি করলাম। ফটাস করে একটা শব্দ হলো আর মাথার খুলিটা উড়ে গেল। তারপর কী হলো বল দেখি?
ডোরা মুখ বিকৃত করে বলল, মগজটা বের হয়ে এল?
পাইকার ভাই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, না না–পাকিস্তানিদের মাথায় কোনো ঘিলু নাই! খুলিটা যখন উড়ে গেল তখন দেখি সেখানে কিছু নাই।
ডোরা বলল, যাহ।
হ্যাঁ। মিলিটারিটা তখনো তার রাইফেল নিয়ে ছুটে আসছে আমার কাছে এসে বলল, খামোশ।
মাথা ছাড়া।
হ্যাঁ। মাথা ছাড়া।
ডোরা হি হি করে হেসে বলল, তুমি এত মিথ্যুক পাইকার ভাই।
পাইকার ভাই গম্ভীর মুখে বলল, আমি মোটেও মিথ্যুক না। সব সত্যি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপরে কী হলো?
মিলিটারিটা আমার কাছে এসে চায়নিজ রাইফেলটা আমার দিকে তাক করেছে তখন আমি কোনো উপায় না দেখে তার হাঁটুতে দিলাম একটা লাথি! তখন কী হলো বল দেখি?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো?
মিলিটারিটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল!
অজ্ঞান হয়ে?
হ্যাঁ। অজ্ঞান হয়ে। কেন বল দেখি?
আমি আর ডোরা জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
তার কারণ হচ্ছে পাকিস্তানি মিলিটারিদের মগজ থাকে তাদের হাঁটুতে! বলে পাইকার ভাই নিজেই হা হা করে হাসতে থাকল। আমরাও হি হি করে হাসতে থাকলাম। ডোরা পাইকার ভাইকে কিল দিতে দিতে বলল, মিথ্যুক! মিথ্যুক! কত বড় মিথ্যুক!
পাইকার ভাই বলল, তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করলে না? মাঝে মাঝে দেখবে হাঁটতে হাঁটতে একটা পাকিস্তানি মিলিটারি দাঁড়িয়ে গেছে, তখন সামনেও যায় না। পেছনেও যায় না কেন বল দেখি?
কেন?
তখন তাদের ডান হাঁটু বলে সামনে যাও। বাম হাঁটু বলে পেছনে যাও– তখন সামনেও যেতে পারে না, পেছনেও যেতে পারে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে।
ডোরা বলল, মিথ্যুক! মিথ্যুক!
পাইকার ভাই বলল, তখন কী করে জান?
কী করে?
তখন পেছন থেকে এসে একজন কষে তাকে একটা লাথি দেয় তখন সে আবার চলতে থাকে!
পাইকার ভাই আবার হি হি করে হাসতে লাগল আর তাকে দেখে আমরাও হাসতে লাগলাম। কাছেই মাসুদ ভাই বসে ছিল, মাসুদ ভাইও হাসতে হাসতে বলল, পাইকার! যখন দেশ স্বাধীন হবে তখন তুমি পাকিস্তানি মিলিটারি কৌতুক নামে একটা বই বের করো অনেক বিক্রি হবে!
পাইকার ভাই মাথা নাড়ল, বলল, দেশ যখন স্বাধীন হবে তখন যে আমি কত কী করব, সেটা বলে শেষ করতে পারব না। প্রথম এক সপ্তাহ আমি স্টেডিয়াম, কার্জন হল, আর্টস বিল্ডিংয়ে হাঁটব আর যার সাথেই দেখা হবে তারেই বলব, জয় বাংলা! দৃশ্যটা কল্পনা করে পাইকার ভাইয়ের মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল!
মাসুদ ভাই কিছুক্ষণ পাইকার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, তাহলে স্বাধীনতার জন্য কাজ শুরু করে দেওয়া যাক, দেরি করে লাভ নাই।
পাইকার ভাই সোজা হয়ে বসে বলল, কী করতে হবে, কমান্ডার?
আমরা কাঁকনডুবি গ্রামের মিলিটারি ক্যাম্পটা দখল করে ফেলি।
আমি আর ডোরা আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। মাসুদ ভাই আমাদের চিৎকার করতে দিল, তারপর বলল, কয় দিনের ভেতরে মুক্তিবাহিনীর অনেক বড় আক্রমণ হবে। হেড কোয়ার্টার থেকে আমার কাছে খবর এসেছে এই ক্যাম্পটা নিউট্রালাইজ করে দিতে। বড় রাস্তাটা তাহলে ক্লিয়ার হয়।
পাইকার ভাইয়ের হাসিখুশি মুখটা একটু গম্ভীর হলো, বলল, কমান্ডার, এই অপারেশনটা কিন্তু অন্যটা অপারেশনের মতো না। এর আগে আমরা যেটা করেছি, সেটা হচ্ছে হিট অ্যান্ড রান। আমরা আক্রমণ করেছি তারপর সরে গেছি। সেই জন্য আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় নাই।
মাসুদ ভাই মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। এইটা কিন্তু হিট অ্যান্ড রান। এটা হচ্ছে হিট অ্যান্ড ক্যাপচার। আমাদের ক্যাম্পটা দখল করতে হবে। বুঝেছ?
পাইকার ভাই আর আশপাশে যারা আছে, সবাই মাথা নাড়ল। মাসুদ ভাই বলল, সে জন্য এবারে অনেক বেশি রেডি হতে হবে। প্রথমবার কিছু ভারী অস্ত্র ব্যবহার করব।
একজন বলল, রেকি শুরু করে দিতে হবে।
হ্যাঁ, কাল থেকে রেকি শুরু করে দেব। আমি এই স্কুলটাতে মাস্টারি করেছি, তাই স্কুলটা কী রকম, ভালো করে জানি। এইটা একটা সুবিধা।
আমি বললাম, আমিও এই স্কুলটার ছাত্র। আমিও জানি।
মাসুদ ভাই মাথা নেড়ে বলল, রঞ্জু আরো ভালো করে জানে। মিলিটারি ক্যাম্প হওয়ার পরে আমরা কেউ ভেতরে যাই নাই, রঞ্জু গিয়েছে।
আমার হঠাৎ করে সেই সময়টার কথা মনে পড়ে গেল, হাত দুটি একটা টেবিলের পায়ার সাথে বেঁধে আমাকে মারছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করছি আর চিৎকার করছি আর চিৎকার করছি সেই ঘটনাটার কথা মনে পড়তেই আমি কেমন জানি শিউরে উঠলাম।
পরদিন থেকে রেকি শুরু হয়ে গেল। দুইজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হলো জেলে সাজিয়ে। হাতে জাল, কোমরে মাছ রাখার টুকরি, মাথায় গামছা। কালী গাংয়ে মাছ ধরে স্কুলের পাশ দিয়ে ঘুরে আসবে। তারা সারা দিন রেকি করে গভীর রাত্রে ফিরে এল। পরের দিন আরো দুইজনকে পাঠানো হলো সবজিওয়ালা সাজিয়ে। তারাও ফিরে এল প্রায় ভোররাতের দিকে। মাসুদ ভাই তাদের সাথে সবাইকে নিয়ে কথা বলল। কীভাবে কী করা হবে, সেগুলো ঠিক করা হলো। পরের দিন সবাই বিশ্রাম নিল। এর পরের দিন ক্যাম্প আক্রমণ করা হবে। শুধু আক্রমণ না, দখল করে নেয়া হবে। কত দিন আগে হলেও মিলিটারির এ রকম একটা ক্যাম্প দখল করার কথা কেউ এত সহজে চিন্তাও করতে পারত না। কিন্তু দেখতে দেখতে সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে। মিলিটারিরা এখন ভয়ে ভয়ে থাকে, তাদের মনের জোর বালে কিছু নেই। মাসুদ ভাই সব সময় বলে, যুদ্ধ আসলে অস্ত্র দিয়ে হয় না, যুদ্ধ হয় মনের জোর দিয়ে। আমাদের মতো মনের জোর এখন আর কারো নাই।
আমাদের বাহিনী বিশাল। সবাই মিলে রওনা দেওয়ার আগে ভারী ভারী অস্ত্রগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এগুলো কালী গাংয়ে নৌকা করে কাঁকনডুবি গ্রামে চলে যাবে। এই জঙ্গলে অপরিচিত গ্রামের মানুষ আসতে থাকল এবং যেতে থাকল। তারা মাসুদ ভাই আর অন্যদের সাথে কথা বলতে লাগল। আমরা তাদের কথাবার্তা থেকে ভাসা ভাসা বুঝতে পারলাম যে কাঁকনডুবিতে আমরা কোথায় উঠব, কী খাব–সেই সব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমার অবশ্যি চিন্তার কিছু নাই, নানিকে এত দিন পর দেখতে পাব সেটা চিন্তা করেই আমার আর সময় কাটছে না। মাসুদ ভাইয়েরা আমাকে এখন নানির সাথে দেখা করতে দেবে কি না, সেটা হচ্ছে প্রশ্ন।
আমরা রওনা দিলাম খুব ভোরে। রওনা দেবার আগে মাসুদ ভাই সবাইকে দাঁড় করিয়ে একটা বক্তৃতা দিল। কঠিন কঠিন শব্দ দিয়ে বক্তৃতা– সবাই সবকিছু বুঝল বলে মনে হলো না। শুধু জয় বাংলা শ্লোগানটা আমরা সবাই বুঝতে পারলাম আমরাও তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম, জয় বাংলা!
সারা দিন ধরে আমরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলাম। কাঁকনডুবি গ্রামে যখন পৌঁছেছি তখনো সূর্য ডোবেনি। আমরা তাই জঙ্গল থেকে বের হলাম না। আমি গাছের ফাঁক দিয়ে কাঁকনডুবি গ্রামের দিকে তাকিয়ে রইলাম, দূরে হিন্দুপাড়া সড়ক ধরে সোজা গিয়ে বাম দিকে গেলে আমার বাড়ি, আরো সামনে গেলে কালী গাং। বাম দিকে মাইল খানেক গেলে আমাদের নবকুমার হাইস্কুল, যেটার নাম এখন গাঁজালা ইয়াকুব হাইস্কুল! ক্যাম্পটা দখল করে প্রথমেই আমাদের স্কুলের নামটা ঠিক করতে হবে। গাঁজালা ইয়াকুব–কী কুৎসিত একটা নাম!
মাসুদ ভাই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একটা আলোচনা করে যেতে লাগল। সবাই মিলে কিছু একটা ঠিক করে, কিছুক্ষণ আলাপ করে, নিজেরা নিজেদের ভেতর তর্ক করে, তারপর আবার অন্য একটা জিনিস ঠিক করে। শেষ পর্যন্ত মনে হয় তারা মোটামুটি ঠিক করতে পারল, ঠিক কীভাবে কী করা হবে।
তখন সবাই গাছে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে রাত গম্ভীর হওয়ার জন্য। আমি আর ডোরা পাইকার ভাইয়ের দুই পাশে বসে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম ভয়ংকর একটা যুদ্ধ হচ্ছে, বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, তার মাঝে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার নানি চিৎকার করে বলছে, শুয়ে পড় রঞ্জু, শুয়ে পড়! শুয়ে পড়।
আমি তবু দাঁড়িয়েই আছি!
.
২৪.
পাইকার ভাই ঘুরে বসে হাত দিয়ে আড়াল করে খুব সাবধানে তাঁর সিগারেটটা জ্বালাল, পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্প থেকে যদি ম্যাচের আগুন দেখে ফেলে তারা বুঝে ফেলতে পারে আমরা এখানে আছি। পাইকার ভাই তার সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, শীতের রাত্রে শরীর গরম করার জন্য সিগারেটের উপরে জিনিস নাই!
আমি আর ডোরা আবছা অন্ধকারে একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, আমরা দুইজন শীতে কাঁপছি, সেটা যেন তার নজরেই পড়ছে না। আমি দুই হাত ঘষে একটু গৰ্ম করার চেষ্টা করে বললাম, পাইকার ভাই, কখন যুদ্ধ শুরু হবে?
সবাই পজিশন নেবার পর মনে হয় শেলিং শুরু করবে।
শেল আমাদের উপরে পড়বে না তো?
পাইকার ভাই হাসল, বলল, পড়ার কথা না। মর্টার পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে শুরু করে আস্তে আস্তে কমাবে।
এটার মানে কী আমি বুঝলাম না, ডোরা মনে হয় বুঝল, সে মাথা নাড়ল। পাইকার ভাই বলল, রকীব মর্টারের এক্সপার্ট। শেলিং শুরু হলে তাকে বলে দিতে হবে, একবার লাইন রেঞ্জ ঠিক করে ফেললে আর চিন্তা নাই!
এই কথাটার মানেও আমি কিছু বুঝলাম না, কিন্তু ডোরা মনে হয় বুঝল, সে আবার মাথা নাড়ল। ঠিক তখন হুশ করে একটা শব্দ হলো আর তার কিছুক্ষণ পর দূরে কোথাও মর্টারের একটা শেল পড়ে একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো। পাইকার ভাই মাথা নিচু করে বলল, অ্যাটাক শুরু হয়ে গেছে।
মিলিটারি ক্যাম্পের ভেতর দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল, চিৎকার করে মিলিটারিগুলো কথা বলতে লাগল, একটু পরেই আমরা মেশিনগানের গুলি শুনলাম। মিলিটারিগুলো মেশিনগান দিয়ে গুলি শুরু করেছে।
আমাদের কেউ একজন বলল, লাইন ঠিক আছে, আরো বিশ গজ ভেতরে শেলিং করতে বলল। এবারে আমি বুঝতে পারলাম, মর্টারটা ঠিক দিকেই আছে, গোলাটা আরেকটু ভেতরে ফেলতে হবে।
কিছুক্ষণের ভেতরে আবার হুশ করে শব্দ হলো, তারপর একটা শেল পড়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো। আমরা দেখলাম এবারে শেলটা মিলিটারি ক্যাম্পের খুব কাছে পড়েছে। কেউ একজন চিৎকার করে বলল, আরো দশ গজ!
আবার হুশ শব্দ করে একটা শেল পড়ল। এবারে ঠিক ক্যাম্পের ভেতরে! প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে মিলিটারিদের চিৎকার শুনতে পেলাম। এবারে ভেতর থেকে মিলিটারিগুলো টানা গুলি করতে শুরু করল।
পাইকার ভাই খুবই শান্তভাবে সিগারেটের আগুনটা ঢেকে সেটাতে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, ফার্স্ট ক্লাস!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কখন গুলি করব?
এখন না। অনেক পরে। আগে কিছু শেলিং হোক।
মর্টার থেকে শেল পড়তে লাগল। একটা-দুইটা বাইরে পড়ল কিন্তু বেশির ভাগ ক্যাম্পের ভেতরে।
মুক্তিযোদ্ধাদের দলটাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগ স্কুলের গেটের সামনে। এক ভাগ পাশে। অন্য ভাগ রয়েছে ছোটাছুটি করার জন্য। পাইকার ভাই বলল, সারা রাত যুদ্ধ হবে, কালকে সারা দিন ধরেও হতে পারে, গুলি শেষ হয়ে গেলে গুলি পৌঁছে দিতে হবে, খিদে লাগলে খাবার এনে দিতে হবে, তাই একটা দলকে ছোটাছুটি করার জন্য রাখা হয়েছে।
পাইকার ভাইয়ের সাথে আমরা এক পাশে পজিশন নিয়েছি। আমাদের এখন কিছু করা নিষেধ, পাকিস্তানিদের বুঝতে দেয়া হবে না আমরা এখানে পজিশন নিয়েছি। স্কুলের প্রাচীর এদিকে ভাঙা, ভেতরে ঢোকার একটা সুযোগ আছে। স্কুলের গেটের সামনে যে দলটি আছে তারা গোলাগুলি শুরু করবে।
পাইকার ভাই খুব মনোযোগ দিয়ে শেলিংয়ের শব্দ শুনল, পাকিস্তানিদের গুলির শব্দ শুনল, মাঝে মাঝে তাকে খুব খুশি হতে দেখা গেল, পাইকার ভাই কীভাবে কীভাবে জানি বুঝে ফেলতে পারে কয়টা মিলিটারি ঘায়েল হয়েছে।
একসময় শেলিংয়ের শব্দ থেমে গেল আর আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে শুরু করল। প্রচণ্ড গুলির শব্দের সাথে সাথে তারা জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে, আমারও চিৎকার করার ইচ্ছা করছে কিন্তু আমাদের কোনো রকম শব্দ করা নিষেধ, তাই নিঃশব্দে মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম। গোলাগুলির শব্দ বেড়ে যায়, আবার কমে আসে, আবার বাড়তে থাকে। মর্টার থেকে আবার শেলিং শুরু হয়ে যায়। এবারে আগেরটার সাথে তিন ইঞ্চি মর্টারটাও শেলিং শুরু করেছে। আমাদের স্কুলটাকে মনে হয় একেবারে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলবে–একদিক দিয়ে ভালোই হবে, যখন দেশ স্বাধীন হবে তখন আর লেখাপড়া করতে হবে না।
একসময় আমাদেরও গুলি করার সিগন্যাল দেয়া হলো, তখন আমরাও গুলি শুরু করলাম। স্কুলের ভেতরে একটা হইচই শুরু হয়ে গেল। বোঝা গেল, আমাদের ঠেকানোর জন্য কিছু মিলিটারি এই পাশে চলে আসতে শুরু করেছে। পাইকার ভাই তার এলএমজি দিয়ে টানা গুলি করে যেতে লাগলেন–প্রচণ্ড শব্দ, গুলির খোসা ছিটকে ছিটকে বের হচ্ছে, বারুদের গন্ধ, ব্যারেলটা দেখতে দেখতে আগুনের মতো গরম হয়ে যায়।
পাইকার ভাই বলেছিল সারা রাত যুদ্ধ হবে, তখন তার কথা আমি বিশ্বাস করিনি কিন্তু সত্যি একসময় চারদিক ফর্সা হতে শুরু করল, আমরা আশপাশে দেখতে শুরু করলাম। স্কুলের বিল্ডিংটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠল, এমনকি মাঝে মাঝে একটা-দুইটা পাকিস্তানি মিলিটারিকেও ভেতরে ছুটে যেতে দেখলাম, পাইকার ভাই একটাকে গুলি করে ফেলেও দিল!
পাকিস্তানি মিলিটারিগুলো কুৎসিত ভাষায় আমাদের গালাগাল করতে লাগল, সেই গালাগালও আমরা শুনতে পেলাম। পাইকার ভাইও চিৎকার করে পাল্টা গালাগাল দিল, তারপর আমাকে আর ডোরাকে বলল, তোমরা আণ্ডা-বাচ্চারা আমার কাছে আছ তাই তৃপ্তি করে হারামজাদাগুলিকে গালি দিতে পারছি না!
আমি বললাম, আপনি গালি দেন পাইকার ভাই, কোনো সমস্যা নাই।
ডোরা বলল, হ্যাঁ, গালি দেন! আচ্ছা মতন গালি দেন।
পাইকার ভাই ডোরার মাথায় হাত দিয়ে তার ছোট ছোট এলোমেলো চুলগুলো আরো এলোমলো করে দিয়ে বলল, নাহ্! খোকন এখানে আছে–একজন ভদ্রমহিলা! তার সামনে খারাপ গালি দেব নাকি? ছি! তার চাইতে হারামজাদাদের গুলি করি! কথা শেষ করে পাইকার ভাই তার এলএমজি দিয়ে টানা গুলি করে যেতে লাগল। গুলির খোসা ছিটকে ছিটকে বের হতে লাগল। পাইকার ভাইয়ের মুখ পাথরের মতো শক্ত, দেখে মনে হয় প্রত্যেকটা গুলি যেন এলএমজির ব্যারেল থেকে নয়– তার চোখের ভেতর থেকে বের হচ্ছে।
যখন সূর্যের প্রথম আলোটা আমাদের ওপর এসে পড়ছে তখন পাইকার ভাই গুলি খেল। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, হঠাৎ যন্ত্রণায় একটু শব্দ করে পাইকার ভাই এক পাশে ঢলে পড়ল। আমি ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে পাইকার ভাই?
পাইকার ভাই নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, কিছু না! কেউ একজন এলএমজিটা ধরো।
আমি আবার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম, পাইকার ভাই! কী হয়েছে?
পাইকার ভাইকে উত্তর দিতে হলো না, আমি দেখতে পেলাম টকটকে লাল রক্তে তার কাপড় ভিজে এসেছে, মাটিটা রক্তে ভিজে যাচ্ছে। ডোরা ডুকরে কেঁদে উঠল, পাইকার ভাই!
পাইকার ভাই অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাল, অনেক কষ্ট করে ডোরার মাথায় হাত রাখল, ফিসফিস করে বলল, কাদার কিছু নাই। কাঁদে না বোকা মেয়ে।
আমি পাইকার ভাইকে ধরে চিৎকার করে বললাম, পাইকার ভাইয়ের গুলি লেগেছে–গুলি লেগেছে–
মাথার ওপর দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, তার মাঝে কয়েকজন বুকে ঘষে ঘষে চলে এল, তাঁকে টেনে পেছনে সরিয়ে নিতে চাইছিল, পাইকার ভাই হাত দিয়ে থামাল, বলল, আমাকে টানাটানি করো না তোমরা যাও–
একজন টান দিয়ে তাঁর শার্টটা খুলে গুলির ক্ষতটা দেখার চেষ্টা করল, গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে, শার্টটা দিয়ে আবার ক্ষতটা চেপে ধরার চেষ্টা করল। পাইকার ভাই দুর্বলভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল, ফিস ফিস করে বলল, তোমরা যাও! নিজের পজিশনে যাও, খোদার কসম–
এদিক থেকে গুলি কমে এসেছে দেখে কয়েকটা মিলিটারি বাংকার থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছিল, তাই সবাই আবার নিজেদের অস্ত্র হাতে গুলি করতে শুরু করেছে। মিলিটারিগুলো আবার বাংকারে ঢুকে গেল।
.
আমি পাইকার ভাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলাম–ডোরা সাবধানে তাঁর মাথাটা কোলে তুলে নিল কানের কাছ দিয়ে বিপজ্জনকভাবে শিসের মতো শব্দ করে কয়েকটা গুলি চলে গেল, ডোরা সেটা লক্ষ্যও করল না।
পাইকার ভাই ফিসফিস করে কিছু একটা বলল, আমি তার কথা ঠিক শুনতে পারলাম না, মাথাটা তাঁর মুখের কাছে নিয়ে গেলাম, তখন শুনলাম ফিসফিস করে বলল, দেশ স্বাধীন হবে খোদার কসম–
ডোরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, যাবেন না পাইকার ভাই। যাবেন না–থাকেন। আপনি থাকেন।
পাইকার ভাই হাসার চেষ্টা করল, বলল, আছি। আমি আছি। আমি যাব না–আমি সব সময় থাকব আমি দেখলাম তার ঠোঁটের কোনা দিয়ে এক ফোঁটা রক্ত বের হয়ে চিবুক দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। ডোরা হাত দিয়ে রক্তটা মুছে দেয়, তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। পাইকার ভাই হাতটা তুলে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল ডোরা হাতটা ধরে রাখল। আমি আরেকটা হাত ধরে রাখলাম। তাঁর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, একবার চোখ খুলে তাকাল, কী বিচিত্র একটা দৃষ্টি, তারপর চোখ বন্ধ করল, আর তাকাল না।
পাইকার ভাই গুলি খেয়ে মারা যাওয়ার কারণে সবার মন ভেঙে গেল। যুদ্ধ প্রায় থেমেই যাচ্ছিল, সবাই অস্ত্র গুটিয়ে চলেই যাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত গেল না শুধুমাত্র আমার আর ডোরার কারণে।
ডোরার কোলে মাথা রেখে পাইকার ভাই যখন মারা গেল তখন ডোরা আমার দিকে তাকাল, আমি ডোরার দিকে তাকালাম। ডোরার চোখ টকটকে লাল, চোখ মুছে ডোরা বলল, চল, তুই আর আমি গিয়ে ঐ বাংকারটাতে দুইটা গ্রেনেড ফেলে আসি।
বাংকারে মেশিনগান বসিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি করছে, এর মাঝে সেই বাংকারে গিয়ে আসলে কেউ কোনো দিন একটা গ্রেনেড ফেলে আসতে পারবে না। কিন্তু আমি সেটা চিন্তা করলাম না। আমি কিড়মিড় করে দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, চল।
তখন স্টেনগানটা পিঠে ঝুলিয়ে হাতে একটা করে গ্রেনেড নিয়ে আমি আর ডোরা ক্রলিং করে এগোতে লাগলাম। সবাই চিৎকার করে উঠল, কী করো! কী করো! আমি আর ডোরা কিছুই শুনলাম না একেবারে মাটির সাথে ঘষে ঘষে এগোতে থাকলাম। আর তখন আমাদের পিছু পিছু অন্য সব মুক্তিযোদ্ধাও বুকে ঘষে ঘষে এগোতে লাগল। শুয়ে শুয়ে গুলি করে আর অগ্রসর হয়। হঠাৎ মনে হতে লাগল সারা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে উড়ে যাবে–মনে হয় আমার হাতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার সেই অস্ত্র! আমার স্পষ্ট মনে আছে কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ আমি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, জয় বাংলা! তারপর ছুটতে ছুটতে বাংকারের কাছে গিয়ে দাঁত দিয়ে গ্রেনেডের পিনটা টেনে খুলে ফেললাম–সূক্ষ্ম একটা ধোঁয়া বের হলো, চার সেকেন্ড পর এটা ফাটবে, আমি মনে মনে গুনলাম এক হাজার এক, এক হাজার দুই, এক হাজার তিন–তারপর গ্রেনেডটা বাংকারের ভেতর ছুড়ে দিলাম। দেখলাম বাংকারের ভেতর একজন মিলিটারি বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার অবাক হবারও শক্তি নাই।
প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ হলো, সাথে সাথে আরেকটা। নিশ্চয়ই এটা ডোরার গ্রেনেড আর ঠিক তখন সব মুক্তিযোদ্ধা জয় বাংলা বলে চিৎকার করতে করতে হাতের অস্ত্র দিয়ে গুলি করতে করতে স্কুলের ভেতরে ঢুকে গেল।
আমি উঠে বসলাম, কাছেই ডোরা, সে কেমন জানি অবাক হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। স্কুলের ভেতরে যে প্রায় মুখোমুখি যুদ্ধ হচ্ছে সেটা তখনো আমরা বুঝতে পারছিলাম না।
আমি আর ডোরা স্কুলের প্রাচীরে হেলান দিয়ে বসে রইলাম, কেমন যেন ঘোরের মাঝে বসে আছি, চারপাশে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। বেঁচে আছি না মরে গেছি, সেটাও যেন বুঝতে পারছি না। যুদ্ধটা কখন শেষ হয়েছে, আমরা সেটাও জানি না। একসময় শুনতে পেলাম মাসুদ ভাই চিৎকার করে ডাকছে, রঞ্জু, খোকন–ডোরা–
আমি আর ডোরা উঠে দাঁড়ালাম, পুরো স্কুলটা একটা ধ্বংসস্তূপ। এখানে-সেখানে বড় বড় গর্ত। পাকিস্তানি মিলিটারি মরে পড়ে আছে। স্কুলের মাঠে অনেকগুলো মিলিটারি দুই হাত মাথার পেছনে দিয়ে বসে আছে। তাদের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নাই। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাদের দিকে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার পায়ে গুলি লেগেছে, সে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছে, একজন তার পায়ে ব্যান্ডেজ লাগানোর চেষ্টা করছে। মুক্তিযোদ্ধারা ব্যস্ত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে।
আমাকে আর ডোরাকে দেখে মাসুদ ভাই এগিয়ে এল আমাদের পিঠে হাত রাখল আর আমরা দুইজন ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলাম। মাসুদ ভাই হাঁটু গেড়ে বসে আমাদের দুইজনকে জড়িয়ে ধরল আর আমরা কাঁদতেই থাকলাম। মাসুদ ভাই ফিসফিস করে বলল, তোমাদের দুইজনের জন্য আমরা আজকে যুদ্ধে জিতেছি। পাইকারের মতো তোমাদের গুলি খাওয়ার কথা ছিল। তোমরা যেভাবে গিয়েছ তোমাদের বাঁচার কথা ছিল না। কিন্তু তোমরা বেঁচে আছ। তোমরা গুলি খাও নাই, খোদা নিজের হাতে তোমাদের রক্ষা করেছে। নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য দোয়া করেছে। পাইকারের দোয়া খোদা শুনেছে। বুঝেছ? পাইকার এখন ওপর থেকে তোমাদের দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছে! তোমরা কেঁদো না–পাইকার কখনো কাঁদে নাই
আমরা তবু কাঁদতেই থাকলাম।
ঠিক তখন দুইজন মুক্তিযোদ্ধা একজন মিলিটারির পেছনে একটা রাইফেল ধরে তাকে ঠেলে ঠেলে মাসুদ ভাইয়ের কাছে নিয়ে এল। কাছে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে মাসুদ ভাইয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে একজন বলল, কমান্ডার–এইটাকে একটা বাংকারে পাওয়া গেছে। মনে হয় অফিসার।
আমি মিলিটারিটার মুখের দিকে তাকালাম, সাথে সাথে তাকে চিনতে পারলাম, মানুষটা মেজর ইয়াকুব। মেজর ইয়াকুবের মুখ পাথরের মতো কঠিন, সেখানে কোনো ভয়, আতঙ্ক, ক্রোধ বা অন্য কোনো অনুভূতির চিহ্ন নাই। মাসুদ ভাই মেজর ইয়াকুবের দিকে তাকিয়ে থেকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, তুমি মেজর ইয়াকুব?
মেজর ইয়াকুব কোনো উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। মাসুদ ভাই হঠাৎ ধমক দিয়ে উঠল, উত্তর দাও। তুমি মেজর ইয়াকুব?
মেজর ইয়াকুব ইংরেজিতে বলল, হ্যাঁ। আমি মেজর ইয়াকুব।
মাসুদ ভাই হঠাৎ আমাকে ধরে মেজর ইয়াকুবের সামনে দাঁড়া করাল, বলল, তুমি এই ছেলেটাকে চেনো?
মেজর ইয়াকুব আমার দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে সে আমাকে চিনতে পারল, তার চোখে এক সেকেন্ডের জন্য একটা অস্বস্তি খেলা করল, কিন্তু সে কোনো কথা বলল না।
মাসুদ ভাই আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি চেনো এই ছেলেটাকে? মেজর ইয়াকুব কোনো কথা বলল না, তখন মাসুদ ভাই আবার ধমক দিয়ে উঠল, চিৎকার করে বলল, উত্তর দাও! চেনো এই ছেলেটাকে?
মেজর ইয়াকুব মাথা নাড়ল। মাসুদ ভাই ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই বাচ্চা ছেলেটার ওপরে অত্যাচার করেছিলে?
মেজর ইয়াকুব কোনো কথা বলল না। খুব ধীরে ধীরে অপরাধীর মতো তার মাথা নিচু করল। মাসুদ ভাই বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও মেজর ইয়াকুব। তুমি এই বাচ্চা ছেলের ওপর কি অত্যাচার করেছিলে?
মেজর ইয়াকুব কোনো কথা বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মাসুদ ভাই আমাকে ঘুরিয়ে দাঁড়া করে পিঠের শার্টটা টান দিয়ে উপরে তুলল, আমার পিঠে মিলিটারির চাবুকের দাগগুলো দেখিয়ে বলল, এই দেখো! তোমরা এই বাচ্চাটাকে কীভাবে অত্যাচার করেছিলে, নিজের চোখে দেখো।
মেজর ইয়াকুব কোনো কথা বলল না। মাসুদ ভাই হিংস্র গলায় বলল, এই বাচ্চাটির কাছে মাফ চাও। তার ওপরে তোমরা যে অত্যাচার করেছ সেইজন্য তার কাছে মাফ চাও।
মেজর ইয়াকুব একবার মাথা তুলে তাকাল, তারপর আবার মাথা নিচু করল। মাসুদ ভাই হঠাৎ চিৎকার করে বলল, মাফ চাও ছেলেটার কাছে। না হলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।
মাসুদ ভাই এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে মেজর ইয়াকুব পর্যন্ত চমকে উঠল। তার চিৎকার শুনে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কী হচ্ছে দেখার জন্য এগিয়ে এল।
মাসুদ ভাই আমাকে ধরে রেখেছিল, তাই আমি বুঝতে পারছিলাম যে প্রচণ্ড ক্রোধে তাঁর শরীর থর থর করে কাঁপছে। হঠাৎ করে আমাকে ছেড়ে দিয়ে মাসুদ ভাই মেজর ইয়াকুবের কাছে এগিয়ে গেল, তারপর তার ডান হাতটা তুলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার গালে এত জোরে একটা চড় দিল যে মেজর ইয়াকুব হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেল। মেজর ইয়াকুবের মতো এত বড় একজন মানুষকে শুধু চড় দিয়ে নিচে ফেলে দেওয়া সম্ভব, সেটা আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
মেজর ইয়াকুবের ফর্সা গালটা লাল হয়ে উঠেছে। মাসুদ ভাইয়ের হাতের পাঁচটা আঙুলের ছাপ তার গালে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেজর ইয়াকুব খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মাসুদ ভাই আবার তার দিকে এগিয়ে গেল তখন মেজর ইয়াকুব খুব নিচু গলায় প্রায় ফিসফিস করে আমাকে বলল, বেটা, হাম সরি হায়।
আমি মেজর ইয়াকুবের মুখে থুঃ করে থুথু দিয়ে বললাম, তোম আসলে সরি নেহি হয়। তোম আসলে এখন ভয় পাইতা হায়!
মেজর ইয়াকুব হাত দিয়ে তার চোখ থেকে আমার থুথুটা মুছে নেওয়ার চেষ্টা করল। মাসুদ ভাই দুইজন মুক্তিযোদ্ধাকে বলল মেজর ইয়াকুবকে নিয়ে অন্যদের সাথে বসিয়ে রাখার জন্য। একটু পরে দেখলাম সে অন্যদের মতো দুই হাত উপরে তুলে মাথার পেছনে হাত দিয়ে বসে আছে। অন্যান্য পাকিস্তানি মিলিটারিগুলো একটু অবাক হয়ে তাদের মেজরের দিকে তাকিয়ে আছে।
.
২৫.
ডোরা কিছুক্ষণ মেজর ইয়াকুবের দিকে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, এই মানুষটা তোকে টর্চার করেছিল?
নিজে করে নাই। আরেকজনকে অর্ডার দিয়েছিল।
একই কথা। ডোরা স্কুলটার দিকে তাকিয়ে বলল, কোনখানে তোকে টর্চার করেছিল?
ক্লাস নাইন সেকশন বি।
সেইটা কোথায়?
আয় দেখাই। বলে আমি ডোরাকে আমাদের স্কুলের ক্লাস নাইন সেকশন বি’তে নিয়ে গেলাম। রুমটা খালি, শুধু মেঝেতে শুকনো রক্ত। ভাঙা কয়েকটা বেঞ্চ এখানে-সেখানে ছেঁড়া কাপড়। কয়েকটা জংধরা দা-চাকু-লোহার রড পড়ে আছে। ডোরা বলল, কী ভয়ংকর।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, কেন ডোরার কাছে রুমটা এত ভয়ংকর মনে হচ্ছে। এটা তো একটা খালি ঘর এখানে কেউ নাই, আমাকে যেদিন ধরে এনেছিল, সেদিন রুমটা ছিল ভয়ংকর।
আমরা যখন ঘরটা থেকে বের হয়ে যাচ্ছি, ঠিক তখন মনে হলো পাশের ঘরে কোনো মানুষ নিচু গলায় কথা বলল। আমি স্টেনগানটা ধরে এগিয়ে গেলাম। রুমটার দরজার কড়া দুটো একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। দরজাটা খুলে আমি আর ডোরা ভেতরে উঁকি দিলাম। দরজা-জানালা বন্ধ, আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলাম ঘরের ভেতরে বেশ কয়েকটা মেয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। ময়লা চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছে, মনে হচ্ছে শরীরে আর কোনো কাপড় নেই–শীতে তিরতির করে কাঁপছে।
মেয়েগুলো আমাদের দিকে তাকাল, চোখের দৃষ্টি এত আশ্চর্য যে আমার বুকটা ধক করে উঠল। এত তীব্র দৃষ্টি আমি কখনো দেখিনি, সেখানে কোনো ভয় বা আতঙ্ক নেই, দৃষ্টিটা আশ্চর্য রকম তীক্ষ্ণ। আমি কী বলব, বুঝতে পারলাম না। ঢোঁক গিলে বললাম, আপনাদের আর কোনো ভয় নাই। যুদ্ধ শেষ।
কথাটা শুনে মনে হলো তাদের মাঝে একটুও পার্থক্য হলো না, তাদের চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হলো, যুদ্ধ শেষ হলে কিংবা শেষ না হলেও তাদের কিছু আসে যায় না। আমার মনে হলো, হয়তো তারা আমার কথাটা বুঝতে পারেনি। আমি আবার বললাম, খোদার কসম। যুদ্ধ শেষ।
লালচে চুলের একটা মেয়ে, যার চোখের দৃষ্টি সবচেয়ে ভয়ংকর আস্তে আস্তে প্রায় ফিসফিস করে বলল, তোমাদের যুদ্ধ শেষ। আমাদের যুদ্ধ শুরু।
আমি এই বিচিত্র উত্তরটা শুনে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তখন ডোরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, তুই যা। ঘর থেকে বের হয়ে যা। মাকে খুঁজে বের করে নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি।
আমি আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, ডোরা শুনতে রাজি হলো না, আমাকে বলল, যা, তুই যা। তারপর মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ছেলেদের কাপড় পরে থাকলেও আসলে আমি মেয়ে। আমি আপনাদের কাছে আসি?
মেয়েগুলো অবাক হয়ে ডোরার দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ কোনো কথা বলল না। ডোরা আস্তে আস্তে তাদের দিকে দুই পা এগিয়ে গেল।
সবগুলো মেয়ে আমাদের দিকে তাকালেও একজন তখনো মাথা নিচু করে মুখ ঢেকে রেখেছে। আমি তার চেহারা দেখতে পারছি না যেটুকু দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে, এই মেয়েটা বুঝি লতিফা বুবু! লতিফা বুবু?
আমি এক পা এগিয়ে গেলাম, ডোরা তখন চিৎকার করে বলল, তুই বের হয়ে যা।
আমি কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো বের হয়ে এলাম। আমি এদিকে সেদিকে খুঁজে মাসুদ ভাইকে বের করলাম। তার হাত ধরে বললাম, মাসুদ ভাই।
কী হয়েছে?
স্কুলের একটা ঘরে অনেকগুলো মেয়ে।
মাসুদ ভাইয়ের মুখটা জানি কেমন হয়ে গেল। আমি বললাম, ডোরা ভেতরে আছে, আমাকে বলেছে মা’কে খুঁজে নিয়ে যেতে।
মাসুদ ভাই বলল, আমি দেখছি।
আমি বারান্দায় বসে রইলাম। মাসুদ ভাই ছোটাছুটি করে মাকে নিয়ে এল। সাথে আরো কয়েকজন মহিলা। তারা ঘরের ভেতরে ঢুকল। কিছুক্ষণ পর ডোরা বের হয়ে এল। আমাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে আমার কাছে এগিয়ে এল। আমি বললাম, ডোরা।
ডোরা বলল, কী?
আমার মনে হলো—
কী মনে হলো?
মনে হলো ভেতরে লতিফা বুবু আছে।
ডোরা মাথা নাড়ল। বলল, না। লতিফা বুবু নাই।
সত্যি?
সত্যি। ডোরা আমার পাশে বন্ধে বলল, আমাদের লতিফা বুবু নাই, কিন্তু অন্য লতিফা বুবু আছে। অন্য জোহরা আপু আছে। অঞ্জনা বৌদি আছে।
আমরা দুইজন চুপ করে বসে রইলাম।
.
মাসুদ ভাই কোথা থেকে জানি একটা বাংলাদেশের পতাকা বের করেছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, দেন কমান্ডার। পাকিস্তানের ফ্ল্যাগটা নামিয়ে এটা টানিয়ে দিই।
মাসুদ ভাই মাথা নেড়ে বলল, তোমরা না, এই ফ্ল্যাগটা টানাবে রঞ্জু আর খোকন, মানে রঞ্জু আর ডোরা! তারপর পতাকাটা আমাদের হাতে দিয়ে বলল, তোমরা পারবে না?
আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, পারব।
মাসুদ ভাই বলল, মাঠের মাঝখানে টানালে হবে না, স্কুলের উপরে উঠে সেখানে একটা লম্বা বাঁশ বেঁধে টানাতে হবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে!
মাসুদ ভাই পতাকাটা আমাদের হাতে দিয়ে বলল, যাও।
আমি আর ডোরা পতাকাটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। মাঠের মাঝখানে পুঁতে রাখা বাঁশটা টেনে তুলতেই মুক্তিযোদ্ধারা কাড়াকাড়ি করে পাকিস্তানি পতাকাটা খুলে সেটাকে পা দিয়ে মাড়াতে লাগল। একজন একটা ম্যাচ দিয়ে ফ্ল্যাগটাতে আগুন ধরিয়ে দিল। আমি দেখলাম পাকিস্তানি মিলিটারিগুলো পাথরের মতো মুখ করে সেদিকে তাকিয়ে রইল।
আমি আর ডোরা বাঁশটাকে নিয়ে স্কুলের বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাঁশটাকে স্কুলের দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে বিল্ডিংয়ের দেয়ালের ফাঁকফোকরে পা রেখে দুইজন উপরে উঠতে থাকি। আমরা অনেকবার স্কুলের ছাদে উঠেছি এখন গোলাগুলিতে স্কুলের দেয়ালে অনেক গর্ত হয়েছে, তাই উপরে ওঠা অনেক সোজা হয়েছে। ডোরা অবশ্যি আমার মতো এত সহজে উঠতে পারছিল না, তাই থেকে থেকে তাকে হাত ধরে সাহায্য করতে হচ্ছিল।
স্কুল বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে আমরা বাঁশটাকে টেনে উপরে তুলে আনলাম। বাঁশের আগায় পতাকাটা বেঁধে যখন সেটাকে উপরে তুলছি তখন নিচ থেকে সব মুক্তিযোদ্ধা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। পতাকা লাগানো বাঁশটাকে দেয়ালের ফাঁকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলাম। তারপর সেটার পাশে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালাম। তখন খুব বিচিত্র একটা দৃশ্য চোখে পড়ল, কাঁকনডুবি গ্রামের সব মানুষ ছুটতে ছুটতে স্কুলের দিকে আসছে। শুধু পুরুষ মানুষ নয়, মেয়েরাও আসছে। ছোট বাচ্চারাও আসছে। সবাই আনন্দে চিৎকার করছে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে জয় বাংলা! জয় বাংলা! মুক্তিযোদ্ধারা রাইফেল এসএলআর স্টেনগান উপরের দিকে মুখ করে গুলি করছে। আমরাও আমাদের স্টেনগান দিয়ে আকাশের দিকে এক পশলা গুলি করলাম।
আমি আর ডোরা নিচে তাকিয়ে দেখলাম পাইকার ভাইয়ের শরীরটাকে মাঠের মাঝখানে রেখে সেটা একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ তার পাশে বসে তাকে ধরে রেখেছে। আমি হঠাৎ এক পাশে উত্তেজিত গলার শব্দ শুনতে পেলাম। সেদিকে তাকিয়ে দেখি কয়েকজন ছেলে মিলে মতি রাজাকারকে ধরে আনছে, সবাই তাকে কিল-ঘুষি মারছে। একজন তার চুল ধরে টেনে আনছে তাই মাথা নিচু করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকে হাঁটতে হচ্ছে। সবাই মিলে হঠাৎ তাকে মারতে শুরু করল, সে মনে হয় পিটুনি খেয়েই মরে যেত। মাসুদ ভাই তাকে পিটুনি থেকে উদ্ধার করে মিলিটারিদের পাশে বসিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মাঝে অন্য রাজাকারদেরও ধরে আনা হলো। তারাও প্রথমে কিছু মার খেল, তারপর দুই হাত মাথার পেছনে রেখে স্কুলের মাঠে বসে রইল।
আমি হঠাৎ মেয়েলি গলায় একটা চিৎকার শুনলাম, রঞ্জু!
তাকিয়ে দেখি লতিফা বুবু। লতিফা বুবুকে দেখে আমার কী যে ভালো লাগল সেটা আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। নিচ থেকে লতিফা বুবু আমার আর ডোরার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। আমি আর ডোরাও হাত নাড়লাম। হঠাৎ ডোরা চোখ বড় বড় করে বলল, ঐ যে আম্মু!
আমি তাকিয়ে দেখি ডোরার বড় বোন নোরা আর তার মা প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছেন। ডোরা স্কুলের ছাদ থেকে চিৎকার করে ডাকল, আম্মু!
আমি দেখলাম ডোরার আম্মু কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে ডোরার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হয় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।
ডোরা বলল, চল, নিচে নামি।
আমি বললাম, চল।
আমরা নিচে নামামাত্র চারদিক থেকে সবাই আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। আমি মামুনকে দেখলাম, সে জাপটে ধরে আমাকে ঝাঁকাতে লাগল। ডোরাকে ধরে তার আম্মু হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। এর মাঝে লতিফা বুবুও আমাকে আর ডোরাকে জাপটে ধরে ফেলল। আমার তখন নানির কথা মনে পড়ল। আমার বুড়ো নানি তো এখানে আসতে পারবে না। আমি তখন সবার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম।
মাসুদ ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে নিচু গলায় কিছু একটা বলছিল, আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, মাসুদ ভাই, আমি আমার বাড়ি থেকে আসি?
মাসুদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সাথে কাউকে দেব?
না। লাগবে না।
তাড়াতাড়ি চলে এসো, আমরা পাইকারের জানাজা পড়াব, দাফন করব।
ঠিক আছে বলে আমি ছুটতে লাগলাম। স্কুলঘর থেকে বের হয়ে সড়কের ওপর দিয়ে ছুটতে থাকি, কালী গাংয়ের তীর ধরে ছুটতে থাকি, বলাই কাকুর চায়ের স্টলের পাশ দিয়ে ছুটতে থাকি, কাজী বাড়ির সামনে দিয়ে ছুটতে ছুটতে আমি আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই, হাঁপাতে হাঁপাতে আমি উঠানে পা দিলাম। নানি বারান্দার একটা জলচৌকিতে বসে আছে। আমি কখনো নানিকে কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকতে দেখিনি। তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে এত অবাক লাগছিল যে আমি এক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। নানি অন্যমনস্কভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল, তাই আমাকে দেখতে পায়নি। আমি ডাকলাম, নানি।
নানির শরীরে কেমন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল, তারপর নানি খুব ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাল। মনে হচ্ছিল নানি বুঝি মাথা তুলে তাকাতে ভয় পাচ্ছে, যদি মাথা তুলে দেখে আসলে কেউ নাই!
নানি আমার দিকে তাকাল, তারপর হাত দুটো বাড়িয়ে দিল। আমি ছুটতে ছুটতে এসে নানিকে জড়িয়ে ধরলাম। নানি তার শুকনা দুর্বল হাত দিয়ে আমাকে ধরল। এমনভাবে আমাকে ধরে রাখল যে মনে হলো নানির বুঝি মনে হচ্ছে তার হাতটা একটু আলগা করলেই আমি বুঝি হারিয়ে যাব। কত দিন থেকে আমি এই মুহূর্তটার কথা ভাবছিলাম! আমি কত দিন থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম প্রথমবার যখন নানির সাথে দেখা হবে তখন নানিকে বলব, জানো নানি–আমি কিন্তু সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা! আমি আর ডোরা! নানি, আমরা সত্যি সত্যি যুদ্ধ করেছি, মাসুদ ভাই বলেছে আমরা না থাকলে আজকে যুদ্ধে আমরা জিততে পারতাম না। আমরা পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ নামিয়ে স্বাধীন বাংলার ফ্ল্যাগ টানিয়েছি। ঐ যে গুলির শব্দ শুনছ নানি, এটা কিন্তু যুদ্ধের গুলি না! এইটা আনন্দের গুলি!
আমি নানিকে কিছুই বলতে পারলাম না, নানিকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম।
.
শেষ কথা
কাঁকনডুবি গ্রামে যুদ্ধ করে মিলিটারি ক্যাম্প দখল করে নেয়ার ঠিক দশ দিন পরে ঢাকায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা আত্মসমর্পণ করেছিল।
কাঁকনডুবি গ্রামটি যেভাবে স্বাধীন হয়েছিল, সেদিন ঠিক সেইভাবে যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।
.
তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। মাসুদ ভাই তার কলেজে লেখাপড়া করতে ফিরে গেছে। লতিফা বুবুর বিয়ে হয়ে গেছে–ছেলেটা স্কুলের মাস্টার। আমাদের খুব ইচ্ছা ছিল লতিফা বুবুর সাথে মাসুদ ভাইয়ের বিয়ে হোক, হয় নাই। মতি রাজাকার আর তার বাবা লতিফ চেয়ারম্যান জেলে। তাদের বাড়িটাতে এখন কেউ থাকে না। কেমন করে থাকবে? গ্রামের মানুষ বাড়িটা জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আমি অনেক দিন অপেক্ষা করেছিলাম নীলিমাদের ফিরে আসার জন্য। নীলিমারা আর ফিরে আসেনি। তাদের কোনো খবরও জানি না। তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে, তাও জানি না। যখন দেখলাম নীলিমারা ফিরে আসছে না, ফিরে আসবে বলেও মনে হয় না, তখন একদিন আমি তাদের বাড়ির তুলসীতলা খুঁড়ে নীলিমা কী পুঁতে রেখেছে সেটা বের করলাম। একটা বাঁধানো খাতা। খাতাটা আসলে একটা ডায়েরির মতন। সেখানে কত রকম কথা, গানের লাইন, কবিতা, খবরের কাগজ থেকে কেটে রাখা ছবি, শুকনো ফুলের পাপড়ি, গাছের পাতা। দেখেই বোঝা যায়, এটা নীলিমার খুব নিজস্ব একটা জিনিস কিন্তু সাথে করে নিতে পারেনি। যখন কেউ দেশ ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায় তখন কেউ এগুলো সাথে নেয় না। আমি খাতাটা বাঁচিয়ে রেখেছি, যদি কোনো দিন নীলিমার সাথে দেখা হয় তাকে ফিরিয়ে দেব।
অবস্থা যখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে তখন একদিন ডোরা তার আম্মু আর বোনের সাথে শহরে চলে গেল। আমার মনে আছে, ঠিক বিদায় নেবার আগে আমরা যখন কালীগাংয়ের ঘাটে দাঁড়িয়ে আছি তখন ডোরা আমাকে ফিসফিস করে বলল, রঞ্জু, তোকে একটা কথা বলি?
আমি বললাম, কী কথা?
যখন আমি তোকে ছেড়ে চলে যাব তখন কিন্তু তুই মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকবি না। তাহলে তোকে দেখলেই আমার চোখে পানি চলে আসবে। আমার খুব অল্পতে চোখে পানি চলে আসে।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
ঠিক যখন ডোরা আলাউদ্দিন চাচার নৌকাতে উঠতে যাচ্ছে আমি তখন জোর করে মুখটা হাসি হাসি করে রাখলাম। ডোরা যে শুধু তার মুখটা হাসি হাসি করে রাখল তা না, শব্দ করে হাসতে শুরু করল যেন খুবই মজার একটা ব্যাপার হচ্ছে।
হাসতে হাসতে একসময় ডোরার চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি পড়তে লাগল। ডোরা এমন ভান করল যেন সে জানেই না যে তার চোখ থেকে পানি পড়ছে। হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, রঞ্জু, তুই আমাকে চিঠি লিখবি।
আমি বললাম, লিখব।
ডোরা বলল, লম্বা লম্বা চিঠি লিখবি।
লিখব।
কাঁকনডুবির সবার খবর দিবি।
দিব।
সত্যি দিবি তো?
আমি বললাম, দিব। সত্যি দিব।
তখন ডোরা ঘুরে আলাউদ্দিন চাচার নৌকায় উঠে গেল। আমি শেষ পর্যন্ত হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম, চেষ্টা করলাম যেন চোখ থেকে পানি বের না হয়। যখন ডোরা, তার আম্মু আর বোনকে নিয়ে নৌকাটা কালীগাংয়ের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে দূরে সরে যেতে লাগল, আস্তে আস্তে ছোট হয়ে ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল তখন আমার চোখ থেকে পানি বের হয়ে এল।
আশপাশে কেউ নেই তাই আমি চোখ মোছারও চেষ্টা করলাম না।
কী হবে চোখের পানি মুছে?