গ্রামের নাম কাঁকনডুবি – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথম পর্ব
০১.
স্কুল ছুটির পর আমি আর মামুন কালী গাংয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছিলাম। বটগাছের কাছে এসে সড়কটা যেখানে পুব দিকে মোড় নিয়েছে, ঠিক সেখানে বলাই কাকুর চায়ের স্টল। বলাই কাকু মনে হয় সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে ভালো চা বানায়–তার একটা দোমড়ানো মোচড়ানো কেতলি আছে, সেখানে পানি গরম করলেই চায়ের লিকার বের হয়, সেটা গ্লাসে ঢেলে তার মাঝে যখন ঘন দুধ আর চিনি দিয়ে বলাই কাকু আচ্ছা মতন ঘুঁটে দেয়, তখন তার যা একটা স্বাদ হয়, সেটা বলার মতো না। চা খাওয়ার জন্য নগদ পয়সা আমাদের কারোরই থাকে না–কিন্তু যদি চায়ের স্টলে খরিদ্দার না থাকে তাহলে বলাই কাকু আমাদের ছোট ছোট গ্লাসে হাফ কাপ ফ্রি চা বানিয়ে দেয়। আমাদের জন্য দুধ-চিনি বেশি করে দেয়। তাই বাড়ি যাবার সময় আমরা প্রত্যেক দিনই বলাই কাকুর চায়ের স্টলে একটু উঁকি দিয়ে যাই।
আজকে উঁকি দেওয়ার আগেই শুনলাম ভেতরে কোনো একজন উঁচু গলায় কথা বলছে। গলার স্বরটা অপরিচিত, তাই স্টলের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। শার্ট-প্যান্ট, চোখে চশমা, হাতে সিগারেট কমবয়সী একজন মানুষ হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে, কী বলছে আমরা ভালো করে শুনতে পাচ্ছিলাম না। তার পরেও বুঝে গেলাম নিশ্চয়ই রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে। ইলেকশনের পর থেকে সবাই সব সময় আজকাল রাজনীতি নিয়ে কথা বলে। চশমা চোখের কমবয়সী মানুষটার সামনে আমাদের গ্রামের দুইজন মুরব্বি বসে আছে। তারা সব কথা বুঝে ফেলছে, সেই রকম ভান করে মাথা নাড়ছে, কিন্তু তাদের মুখ দেখেই বুঝে গেলাম তারা আসলে কিছুই বুঝতে পারছে না। হালচাষ, গরু-ছাগল ছাড়া তারা কিছুই বোঝে না।
চশমা চোখের কমবয়সী মানুষটাকেও আমরা চিনতে পারলাম না। আমাদের কাঁকনডুবি গ্রামের মানুষ না–কাঁকনডুবি গ্রামের সবাইকে আমরা চিনি। শুধু মানুষ না এই গ্রামের সব গরু-ছাগলকেও আমরা চিনি। এই মানুষটা অন্য জায়গা থেকে এসেছে, দেখে মনে হয় শহর থেকে এসেছে। শহরের মানুষদের দেখলেই চেনা যায়, তারা অন্য রকম করে চুল কাটে। তা ছাড়া গ্রামের মানুষদের চোখে কখনো চশমা থাকে না।
আমি মামুনকে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম–মানুষটা কে?
আমি যেহেতু চিনি না তাই মামুনেরও চেনার কথা না, কিন্তু মামুন আমার থেকে অনেক বেশি খবর রাখে। মানুষটাকে না চিনলেও কোথা থেকে এসেছে, কেন এসেছে সেটা জানতেও পারে। কিন্তু সেও চিনল না, মাথা নেড়ে বলল, চিনি না। আগে দেখি নাই।
কোনো বাড়িতে আসছে মনে হয়?
মনে হয় কোনো বাড়িতে আসে নাই।
তাহলে?
মামুন দাঁত বের করে হাসল, বলল, মনে হয় বিয়া করতে আসছে। কাঁকনডুবির জামাই।
জামাই?
মামুনের বুদ্ধি অনেক বেশি, এই সব বিষয় সে খুব ভালো অনুমান করতে পারে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাকে বিয়ে করবে?
মামুন মুখ টিপে হাসল, বলল, মনে হয় লতিফা বুবুকে।
লতিফা বুবু ছিল আমাদের লিডার, যখন ছোট ছিলাম তখন আমরা সবাই লতিফা বুবুর পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াতাম। লতিফা বুবু লেখাপড়াতেও খুব ভালো ছিল, আমাদের থেকে দুই ক্লাস উপরে পড়ত কিন্তু যখন একটু বড় হয়ে গেল তখন তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামের মেয়েরা যখন ছোট থাকে তখন স্কুলে যায়, যখন একটু বড় হয়। তখন তাদের লেখাপড়া বন্ধ করে তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। লতিফা বুবুর বিয়ের কথা হচ্ছে, মামুন মনে হয় ঠিকই বলেছে। এই চশমা পরা মানুষটা মনে হয় লতিফা বুবুকেই বিয়ের জন্য এসেছে। লতিফা বুবু যখন ছোট ছিল, আমাদের নিয়ে জঙ্গলে–মাঠে ঘুরে বেড়াত তখনই তার চেহারা খুব ভালো ছিল, এখন চেহারা আরো ভালো হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হয় না তাই বেশি দেখা হয় না কিন্তু যখন দেখা হয় তখন তাকে চিনতেই পারি না। শাড়ি পরলেই মেয়েরা অন্য রকম হয়ে যায়।
বলাই কাকুর চায়ের স্টল থেকে বের হয়ে আমরা আবার সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে আমাদের গ্রামের ভেতর ঢুকে গেলাম। সড়কটা গ্রামের ঠিক মাঝখান দিয়ে গিয়েছে, দুই পাশে ছোট ছোট বাড়ি, বাড়ির সামনে গাছপালা, বড় বড় বাঁশঝাড়। বাড়ির বাইরে গরু বেঁধে রেখেছে, গরুগুলো খুবই শান্ত ভঙ্গিতে খড় চিবিয়ে যাচ্ছে। তাদের মুখে কেমন যেন শান্তি শান্তি ভাব, মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় মানুষের থেকে বুঝি এই গরুদের মনেই শান্তি বেশি! অনেক মানুষ আছে তাদের মানুষ না হয়ে গরু হয়ে জন্ম হলেই মনে হয় ভালো ছিল।
সড়কের নরম ধুলায় পা ডুবিয়ে হাঁটতে কী মজাই না লাগে। জুতো জিনিসটা আবিষ্কার হয়েছে কেন, কে জানে? জুতো পরে এই নরম ধুলার মাঝে হাঁটার মধ্যে কি কোনো মজা আছে? তারপর যখন বৃষ্টির সময় আসবে তখন এই সড়কে যে কাদা হবে সেই কাদার মাঝে কার বাবার সাধ্যি আছে জুতো পরে হাঁটবে? মনে হয় সেই জন্যই কাঁকনডুবি গ্রামে জুতো–স্যান্ডেল পরে সে রকম মানুষ বলতে গেলে কেউ নাই।
আমি আর মামুন গল্প করতে করতে গ্রামের মাঝামাঝি চলে এলাম, মামুন তখন তার বাড়িতে ঢুকে গেল। বাকি পথটা ধীরে-সুস্থে একা একা হেঁটে আমি আমার বাড়িতে এসে উঠানে মাত্র পা দিয়েছি, তখনই নানি চিৎকার করতে শুরু করল। আমার মনে হয় সারা কাঁকনডুবিতে নানির মতো আর কারো গলায় জোর নাই।
আমাকে দেখেই নানি চিৎকার করে হাত-পা নেড়ে বলতে শুরু করল, এই যে! এই যে লাট সাহেবের বাচ্চা এখন বাড়ি এসেছেন। কখন স্কুল ছুটি হয়েছে আর লাট সাহেবের বাচ্চার এখন সময় হলো বাড়িতে আসার!
কথাটা সত্যি। স্কুল ছুটির পর কোনো দিনই আমি সাথে সাথে বাড়ি আসি না। এসে কী হবে? একটু ঘুরেফিরে বাড়ি আসি। আজকে অবশ্যি সে রকম দেরি হয়নি কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। নানি ধরে নিল দেরি হয়েছে আর হাত-পা নেড়ে বলতে থাকল, যদি পেটে কিছু দিতে না হইত তাহলে লাট সাহেবের বাচ্চা মনে হয় বাড়িতেই আসত না। বান্দরের মতো গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়াইত।
নানিকে খেপানোর জন্য বললাম, বান্দরই ভালো। বান্দরদের স্কুল নাই, লেখাপড়া নাই।
নানি ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর বান্দর।
আমি হি হি করে হেসে বললাম, আমি যদি বান্দর হই তাহলে তুমি হলে বান্দরের নানি বান্দরানী।
নানি তখন রেগেমেগে আমাকে ধরার চেষ্টা করল, পারল না। আমি নিজে থেকে ধরা না দিলে নানি কি কোনো দিন আমাকে ধরতে পারবে? মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছা করে ধরা দিই, নানি তখন আমার কান মলে দেয়, চুল ধরে টান দেয়–ভান করে খুব রেগেমেগে আমাকে শাস্তি দিচ্ছে, আসলে ওসব কিছু না। আসলে আমাকে একটু আদর করে দেয়। মাঝে মাঝে গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়, আধো আধো ঘুমের মাঝে আমি দেখি নানি আমার পাশে বসে আমার মাথায়, চোখে–মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। নানি ছাড়া আমার আর কেউ নাই, নানি আমাকে দেখেশুনে না রাখলে আমি কোথায় যে ভেসে যেতাম। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি না থাকলে নানিও নিশ্চয়ই এত দিনে মরে-টরে যেত।
নানি একেবারে হাল ছেড়ে দেবার ভান করে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, যা হাত-মুখ ধুয়ে একটু মানুষ হয়ে খেতে আয়।
খাওয়ার জন্য কেন হাত-মুখ ধুয়ে মানুষ হতে হবে, সেটা নিয়ে আমি আর নানির সাথে তর্ক করলাম না, কলসি থেকে টিনের মগে একটু পানি ঢেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত-মুখ ধোয়ার একটু ভান করলাম। নানি একটা সিঁড়ি দিল বসার জন্য তারপর থালায় ভাত বেড়ে দিল।
আমি যখন খেতে বসি নানি তখন পাশে বসে থাকে। তার নকশি করা পিতলের পানের বাটা থেকে পান বের করে, কুচি কুচি করে সুপারি কাটে, তারপর পানে চুন-সুপারি দেয়, জর্দা দেয় তারপর পানটা মুখে পুরে খুবই তৃপ্তি করে চিবুতে থাকে। তখন নানিকে দেখে মনে হয় তার থেকে সুখী মানুষ বুঝি পৃথিবীতে আর একজনও নাই।
নানির কথায়বার্তায় অবশ্যি সুখের কোনো নমুনা থাকে না। ফেস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথা বলতে শুরু করে। একা একা কথা বললে মানুষ পাগল বলে তাই নানির কথা বলার জন্য একজন মানুষ দরকার। আশপাশে কেউ থাকলেই নানি কথা বলতে শুরু করে, সেই মানুষটা তার কথা শুনছে কি না, নানির সেটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকে না। আজকেও নানি কথা বলতে শুরু করল, সেই একই কথা, যেটা আমি একশ বার শুনেছি।
রঞ্জু। ও রঞ্জু তুই ঠিক করে ক। এই কাজটা কি তোর বাপ-মা ঠিক করল? আমি বুড়া মানুষ, আমার ঘাড়ে তোর দায়িত্ব দিয়া তোর বাপ-মা দুইজন চইলা গেল? কাজটা কি ঠিক হইল?
আমি কোনো কথা না বলে খেতে থাকি। নানি আসলে আমার মুখ থেকে কোনো উত্তর শুনতে চায় না, এমনিই বলে।
আমি তোর বাপরে বললাম, দিনটা ভালো ঠেকে না। মনের মাঝে কু-ডাক দেয়। বাবা আজকে না গেলে হয় না? তোর বাপ হাসে। বলে আম্মাজান কুনো ভয় নাই। আপনার মেয়ের দায়িত্ব আমার। বুকে থাবা দেয় আর কয়, শরীলে যতক্ষণ দম আছে আপনার মেয়ের কিছু হতে দিমু না। তা কথা মিছা কয় নাই।
নানি তার আঙুলের ডগায় লাগানো চুন জিবের ডগায় লাগিয়ে বিড়বিড় করে বলল, শরীলে যতক্ষণ দম ছিল তোর মায়ের কিছু হইতে দেয় নাই। যখন দম শেষ তোর বাপ শেষ, তোর মাও শেষ। রাক্ষুসী কালী গাং তোর মুখে আগুন তোর চৌদ্দ গুষ্টির মুখে আগুন তুই জাহান্নামে যা, হাবিয়া দোজখে তুই জ্বলেপুড়ে মর। মুখে রক্ত উঠে তুই মর, তুই নির্বংশ হ, তোর বংশে বাতি দেওয়ার জন্য যেন কেউ না থাকে–
নানি এমন ভাবে কালী গাংকে অভিশাপ দিতে থাকে, যেন সেটা একজন মানুষ। নানির কাছে শুনেছি আমার বাবা-মা কালী গাংয়ে ডুবে মারা গেছে, নৌকা নিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা ঝড় উঠেছে, কিছু বোঝার আগে নৌকাটা পাক খেয়ে ডুবে গেছে। আমি ছোট, নানির কাছে ছিলাম বলে বেঁচে গেছি। বাবা খুব ভালো সাঁতার জানত, মাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে বাঁচতে পারে নাই। আমার কিছু মনে নাই, বাবা-মায়ের চেহারাও কোনো দিন দেখি নাই। বাড়িতে তাদের একটা ফটোও নাই।
নানি পান চিবুতে চিবুতে একটু এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে, রঞ্জু, ভাইডি তুই খুব সাবধানে থাকবি। বাপ-মা থাকলে তার দোয়া থাকে। তোর বাপও নাই, মাও নাই। তোর জন্য দোয়া করার কেউ নাই–
আমি বললাম, তুমি দোয়া করবা।
নানির দোয়া কামে লাগে না। বাপ-মা অন্য রকম–
তোমার দোয়া কামে না লাগলে আমার দোয়ার দরকার নাই। দোয়া ছাড়াই আমি থাকতে পারি নানি–
খুবই একটা ভয়ংকর কথা বলে ফেলেছি এ রকম ভান করে নানি বলল, ছি ছি ছি, এই রকম বলে না। দোয়া লাগে। সবার দোয়া লাগে।
নানি বিড়বিড় করে নিজের মনে কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, একটা কথা সব সময় মনে রাখবি রঞ্জু।
কী কথাটা আমার মনে রাখতে হবে আমি জানি, তার পরেও আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী কথা?
তুই কালী গাং থেকে দূরে থাকবি। সব সময় কমপক্ষে একশ হাত দূরে থাকবি। কালী গাংয়ের পানিতে নামবি না, গাংয়ের পাড়েও যাবি না।
কেন আমার কালী গাংয়ের কাছে যাওয়া নিষেধ, সেটাও আমি নানির কাছে অনেকবার শুনেছি। তার পরও আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেন নানি?
কালী গাং হচ্ছে রাক্ষুসী। তোর বাপরে খাইছে, মারে খাইছে, তোরেও খাইতে চায়। তার পানিতে নামলে তোরে খপ করে ধরে পানিতে ডুবায়া দিব, তোরে ছাড়ব না এই রাক্ষুসী তোরে ছাড়ব না–
নানির কথা শুনে আমার কেমন জানি গা শিরশির করে, মনে হয় সত্যিই বুঝি কালী গাং একটা নদী না–একটা রাক্ষুসী–আমার দিকে তাকিয়ে আছে! কিন্তু আমি অবশ্যি কালী গাংকে ভয় পাই না, অন্যদের সাথে কালী গাংয়ে লাফ দিই, শীতের সময় যখন পানি কম থাকে তখন সাঁতার দিয়ে পার হয়ে যাই। বর্ষার সময় যখন পানির খুব স্রোত থাকে, ঘোলা পানি নদীর মাঝখানে পাক খেতে থাকে, তখন অবশ্যি কোনো দিন পার হবার চেষ্টা করি নাই। কোনো এক বর্ষায় সেইটা করতে হবে। নানি অবশ্যি এগুলো কিছুই জানে না। জানার দরকার কী?
.
০২.
টিফিন ছুটির আগে ব্যাটারি স্যারের ক্লাস। এই স্কুলে সব স্যারদের একটা করে নাম আছে। নামগুলো কে দেয়, কেউ জানে না কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি ছাত্রছাত্রীদের কাছে আসল নামটা চাপা পড়ে যায়। যেমন ব্যাটারি স্যারের নামটা ব্যাটারি তার কারণ স্যার দেখতে ব্যাটারির মতো, খাটো গোল শরীর তার ওপর ছোট মাথা, কোনো ঘাড় নাই। ধর্ম স্যারের শুকনো শরীর, লম্বা গলা, মাথায় আরো লম্বা টুপি, তার নাম বোগলা স্যার। বকের সাথে মিল তাই বোগলা স্যার! ইংরেজি স্যারের তেলতেলে ফর্সা চেহারা ছোট ছোট নিষ্ঠুর চোখ, হাতে বেত নিয়ে ক্লাসে ঢোকেন, কথায় কথায় বলেন, ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দেব তাই তার নাম ডাণ্ডি স্যার। গায়ের রং কালো বলে বাংলা স্যারের নাম কাউলা স্যার। থুতনিতে ছাগলের মতো দাড়ি বলে উর্দু স্যারের নাম ছাগলা স্যার।
যাই হোক, আমরা যখন ব্যাটারি স্যারের জন্য অপেক্ষা করছি তখন খুবই বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল, ব্যাটারি স্যারের বদলে ক্লাসে ঢুকলেন টিবি স্যার (স্কুলের হেডমাস্টার কিন্তু যক্ষ্মা রোগীর মতো শুকনো বলে নাম টিবি স্যার) কিন্তু সেটা বিচিত্র না কারণ তার পিছু পিছু ক্লাসে ঢুকল কমবয়সী একজন মানুষ, শার্ট-প্যান্ট পরা, চোখে চশমা। আমি আর মামুন মানুষটাকে চিনে গেলাম, গতকাল বলাই কাকুর চায়ের স্টলে এই মানুষটা হাত-পা নেড়ে রাজনীতির কথা বলছিল।
টিবি স্যার চশমা পরা মানুষটাকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেই আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম, স্যার হাত নেড়ে আমাদের বসার ইঙ্গিত করলেন, আমরা তখন বসে গেলাম। টিবি স্যার একটু কেশে বললেন, তোমাদের মজিদ স্যারের অসুখ, কিছুদিন ছুটি নিয়েছেন (আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, এখন মনে পড়ল ব্যাটারি স্যারের আসল নাম আব্দুল মজিদ)। যে কয় দিন ছুটিতে আছেন তোমাদের বিজ্ঞানের ক্লাস নেবার জন্য আমি মাসুদকে অনুরোধ করেছি, মাসুদ পিকে, কলেজে বিএসসি পড়ে (টিবি স্যার অবশ্যি বিএসসি বললেন না, উচ্চারণ করলেন বি.এচ.চি) সে খুবই মেরিটরিয়াস ছাত্র, আমি তারে অনেক দিন থেকে চিনি। কলেজ বন্ধ এই গ্রামে বেড়াতে আসছে। আমি মজিদ স্যারের ক্লাসটা নিতে বলেছি, সে রাজি হয়েছে। তোমরা খবরদার মাসুদ স্যারকে জ্বালাবে না, মাসুদ স্যারের কথা শুনবে।
টিবি স্যার আরও কিছুক্ষণ কথা বললেন, তারপর মাসুদ স্যার নামে শার্ট প্যান্ট পরা চোখে চশমা কমবয়সী মানুষটাকে ক্লাসে রেখে চলে গেলেন।
কমবয়সী মানুষটা আমাদের দিকে তাকাল, মনে হলো একটু লজ্জা লজ্জা পাচ্ছে। একটু হেঁটে দুই পা এগিয়ে এসে বলল, শোনো, আমি কিন্তু তোমাদের স্যার না। আমিও তোমাদের মতো একজন ছাত্র। কলেজের ছাত্র। তাই কেউ আমাকে মাসুদ স্যার ডাকবে না।
মামুন জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী ডাকব?
ভাই। মাসুদ ভাই।
ঠিক কী কারণ জানা নেই। কথাটা শুনে আমাদের সবার কেমন জানি এক ধরনের আনন্দ হলো। স্কুল মানেই অত্যাচার, স্যার মানেই যন্ত্রণা–তখন যদি স্কুলের কমবয়সী একটা স্যার বলে আমাকে মাসুদ ভাই বলে ডাকবে তাহলে আনন্দ হতেই পারে। আমরা আনন্দে হি হি করে হাসলাম, আমাদের ক্লাসে যে অল্প কয়টা মেয়ে আছে, তারাও একজন আরেকজনের কানে কিছু একটা বলে একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে কুট কুট করে হাসল।
চশমা পরা কমবয়সী মানুষটা–যে আমাদেরকে মাসুদ ভাই বলে ডাকতে বলেছে একটু গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো বলল, আমি আসলে কখনো কাউকে পড়াই নাই। কেমন করে পড়াতে হয়, জানি না–তার পরও যখন আমাকে পড়াতে বলেছে, তখন কেন রাজি হয়েছি জানো?
আমরা মাথা নেড়ে বললাম যে জানি না। তখন মাসুদ ভাই নামের মানুষটা হাসি হাসি মুখে বলল, তার কারণ আসলে কেউ কোনো দিন কাউকে কিছু শিখাতে পারে না। যার যেটা দরকার, সে নিজেই সেটা শিখে নেয়। মাস্টারদের কাজ হচ্ছে উৎসাহ দেওয়া। আমি এসেছি। তোমাদের উৎসাহ দিতে।
শুনে আমাদের খুবই উৎসাহ হলো। শুধু যে মাসুদ ভাই ডাকব তা নয় মাসুদ ভাই কিছু পড়াবেও না, কোনো লেখাপড়া নাই, কী মজার কথা। কী আনন্দের কথা!
মাসুদ ভাই বলল, বলো, তোমাদের কী নিয়ে উৎসাহ দেব?
আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, এই ভাবে যে উৎসাহ দেওয়ার জন্য একটা বিষয় ঠিক করে দেওয়া যায়, সেইটাও জানতাম না। লেখাপড়া করতে কারোরই ভালো লাগে না, সেটা বলা যায় কিন্তু সেটা বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারলাম না–লেখাপড়া নিয়ে কথাবার্তা যত কম হয় ততই ভালো। এর মাঝে মামুন দাঁড়িয়ে গেল, বলল, আমাদের এই গ্রামটার অবস্থা খুবই খারাপ, এইখানে কিছু নাই। থাকার ইচ্ছা করে না।
মাসুদ ভাই নামের মানুষটা চোখ কপালে তুলে বলল, বলো কী? এই গ্রামে কিছু নাই? একটা ভরা নদীর পাশে একটা ছোট ছবির মতো গ্রাম! এত সুন্দর একটা স্কুল। কিছু নাই মানে?
আমরা আবার একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম! সুন্দর স্কুল? স্কুলের কোন জায়গাটা সুন্দর?
মাসুদ ভাই বলল, আমাদের দেশে আর কয়টা ভালো স্কুল আছে? এ রকম গ্রামের মাঝে বিশাল একটা স্কুল। আশপাশের দশ গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা এখানে লেখাপড়া করতে আসে। তোমরা যে এই নবকুমার হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রী, সেইটা নিয়ে গর্ব হওয়া উচিত।
গর্ব হওয়া উচিত কি না বুঝতে পারলাম না, তবে এটা সত্যি কথা আশপাশের সব গ্রামের ছেলেমেয়েরা এই স্কুলে পড়তে আসে। আমাদের স্কুলের পাকা দালান, সামনে বড় মাঠ, পাশে বিশাল দিঘি। এই এলাকায় আর কোথাও পাকা দালান নাই।
মাসুদ ভাই বলতে থাকল, শুধু কি তাই! তোমাদের গ্রামের নামটা কী সুন্দর। কাঁকনডুবি। কোনো দিন চিন্তা করেছ নামটা কোথা থেকে এসেছে?
মামুন আবার তার ফিচলে বুদ্ধি দিয়ে চেষ্টা করল, বলল, মনে হয় অনেক কাক ছিল–
মাসুদ ভাই দুই হাত নেড়ে বলল, না না না। কাঁকনডুবি নাম মোটেও কাক থেকে আসেনি। এসেছে কাঁকন মানে হাতের চুড়ি থেকে। নিশ্চয়ই এখানে একদিন কোনো একজন রাজকন্যা ছিল, সে কোনো একটা বড় দিঘিতে গোসল করতে নেমেছে তখন হাত থেকে কাঁকনটা খুলে ডুবে গেছে। সেই থেকে এই গ্রামের নাম কাঁকনডুবি।
আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, রাজকন্যা কোথা থেকে এল?
হয়তো এখানেই রাজার বাড়ি ছিল। সেখানে রাজা থাকত, রানি থাকত, রাজপুত্র-রাজকন্যা থাকত। তোমাদের গ্রামের উত্তরে যে বিশাল জঙ্গল সেখানে কোথাও হয়তো সেই রাজার প্রাসাদ মাটির নিচে লুকিয়ে আছে। কে বলবে?
মাসুদ ভাই এমনভাবে বলল যে আমার মনে হলো সত্যিই বুঝি আমাদের গ্রামের পেছনে জঙ্গলের ভেতরে কোথাও একটা রাজপ্রাসাদ আছে, গাছপালায় ঢেকে আছে কিন্তু ভেতরে অনেক রহস্য।
ঠিক তখন একটা খুবই আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আমাদের ক্লাসে যে মেয়েরা আছে তাদের একজন হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, বলল, স্যার।
মেয়েরা ক্লাসে কখনোই কোনো কথা বলে না, আমরা তাদের সবার নাম পর্যন্ত জানি না। এই বছর শেষ হবার পর এদের অর্ধেকই স্কুলে আসা বন্ধ করে দেবে। সে রকম একটা মেয়ে নিজ থেকে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আমরা সবাই অবাক হয়ে তাকালাম। এই মেয়েটার নাম নীলিমা, হিন্দুপাড়ায় থাকে।
মাসুদ ভাই মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। স্যার না। বলো মাসুদ ভাই–
মেয়েটা লজ্জায় লাল-নীল-বেগুনি হয়ে গেল, তার পরও সাহস করে বলল, মাসুদ ভাই। মেয়েরা যখন দিঘিতে স্নান করে তাদের হাতের কাঁকন তো এমনি এমনি খুলে যায় না!
মাসুদ ভাই বলল, অবশ্যই খুলে যায় না। তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু হয়তো মেয়েটি ছোট একটি মেয়ে ছিল, শখ করে তার মায়ের কাঁকন পরেছিল। ঢলঢলে কাঁকন হাত থেকে খুলে গিয়েছিল। কিংবা কিংবা মাসুদ ভাই কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, হয়তো মেয়েটার খুব অসুখ করেছিল শুকিয়ে কাঠি হয়ে গিয়েছিল, হাতের কাঁকন ঢলঢলে হয়ে গিয়েছিল, সুন্দর একটা দিঘির টলটলে পানি দেখে মেয়েটার সেই পানিতে স্নান করার ইচ্ছে করল। কে বলবে? কত কী হতে পারে। তোমরা কল্পনা করে নাও।
মামুন আমাকে ফিসফিস করে বলল, মাথায় গোলমাল আছে মনে হয়।
আমি কিছু বললাম না, মাথায় গোলমাল থাকলে থাকুক–কথাগুলো তো শুনতে ভালোই লাগে।
মাসুদ ভাই বলল, কল্পনা খুব বড় জিনিস। তুমি যত বেশি কল্পনা করবে তোমার পৃথিবীটা হবে তত বড়। তোমার যেটা নাই, তুমি কল্পনায় সেটা ইচ্ছা করলেই পেয়ে যেতে পারবে।
মামুন আবার তিড়িং করে লাফ দিল, বলল, না মাসুদ ভাই। এটা ঠিক না! ধরেন আপনার খুব খিদা লাগছে, তখন যদি আপনি কল্পনা করেন আপনি কোরমা-পোলাও খাচ্ছেন তাহলে কি লাভ হবে? খিদা তো কমবে না–
আর যদি কল্পনা না করো, তাহলে কি খিদে কমবে?
মামুন ইতস্তত করে বলল, না—তা–কমবে না।
তাহলে? খিদে কমানোর জন্য তোমাকে খাবার খুঁজে পেতে আনতে হবে, খেতে হবে। সেটা তো আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু তোমাকে কল্পনা করতে হবে। যদি কোরমা-পোলাও খাওয়ার কথা কল্পনা করো, তাহলে একদিন হয়তো কোরমা-পোলাও খাবে। তা না হলে সারা জীবন শুঁটকি ভর্তা খেতে হবে। প্রথমে কল্পনা করবে তারপর একদিন সেই কল্পনা সত্যি হবে। এটা আমার কথা না। এটা অনেক বড় মানুষের কথা।
কথা বলতে বলতে মাসুদ ভাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, আমি দেখলাম তার চোখটা জানি কেমন টুলু ঢুলু হয়ে গেল। মাসুদ ভাইয়ের নিশ্চয়ই কিছু একটা কল্পনা আছে, একদিন তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে তার কল্পনাটা কী। আর কল্পনার এই কথাটা কোন বড় মানুষ বলেছে। তার নামটাও জিজ্ঞেস করতে হবে। মাসুদ ভাই নামের মানুষটাকে আমার খুব পছন্দ হলো। মামুন যদিও মাথা নেড়ে আমাকে ফিসফিস করে বলছে, পাগল! বদ্ধ পাগল। কিন্তু আমি জানি মানুষটাকে মামুনেরও পছন্দ হয়েছে। মনে হয় সবারই পছন্দ হয়েছে।
সেদিন বিকেলে স্কুল ছুটির পর আমি আর মামুন যখন হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছি তখন আবার বলাই কাকুর চায়ের স্টলে দাঁড়ালাম। চায়ের স্টলে আজকে কেউ নাই, শুধু বলাই কাকু বসে বসে তার রেডিও শুনছেন। রেডিওতে উর্দুতে একজন মানুষ খবর পড়ছে। উর্দুতে কী বলে আমরা তার একটা-দুইটা শব্দ বুঝতে পারি। মাগরেবে পাকিস্তান মানে পশ্চিম পাকিস্তান, মাশরেকে পাকিস্তান মানে পূর্ব পাকিস্তান। যখন পূর্ব পাকিস্তানে দুইটা বাজে তখন পশ্চিম পাকিস্তানে একটা বাজে। কী আজ একটা ব্যাপার। একটা দেশের দুইটা অংশ একেকটা অংশে একেকটা সময়। দুই অংশেই এক সময় করে দিলে ক্ষতি কী ছিল? মাসুদ ভাইকে একদিন এই প্রশ্নটা করতে হবে।
বলাই কাকু আমাদের দুইজনকে দেখে বললেন, তোমাদের লেখাপড়া কেমন হচ্ছে?
বলাই কাকু আমাদের দেখলে সব সময় লেখাপড়ার খোঁজ নেন। আমরা বললাম, ভালো।
বলাই কাকু বললেন, হ্যাঁ। মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড। বুঝেছ?
আমরা মাথা নাড়লাম। বলাই কাকু এর পরে কী বলবেন–সেটাও আমরা জানি, বলবেন, লেখাপড়া করে যেই গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সেই। সত্যি সত্যি সেটা বললেন, আমরা তখন আবার মাথা নেড়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম–ফ্রি চা খেতে দেন কি না দেখার জন্য।
বলাই কাকুর মনে হয় ফ্রি চা দেবার কথা মনে নেই, ঘোট ঘোট কাঁচের গ্লাসগুলো পানিতে ধুতে ধুতে অন্যমনস্কভাবে রেডিও শুনতে লাগলেন। শুনতে শুনতে বললেন, মনে হয় না ক্ষমতা দেবে।
কে কাকে ক্ষমতা দেবে আমরা বুঝতে পারলাম না। মনে হয় রাজনীতির কোনো কথা বলছেন। ইলেকশনের পরে সবাই এখন রাজনীতির কথা বলে। মামুন জিজ্ঞেস করল, কাকে ক্ষমতা দেবে না বলাই কাকু?
শেখ সাহেবকে। ইয়াহিয়া খান মনে হয় না শেখ সাহবকে ক্ষমতা দেবে।
দেশে কী হচ্ছে আমরা কিছুই জানি না, তাই বুঝতে পারলাম না। কেন ইয়াহিয়া খান শেখ সাহেবকে ক্ষমতা দেবে না। মামুন আমার থেকে বেশি খোঁজখবর রাখে, সে বলল, ইয়াহিয়া খান মানুষ ভালো না। আইয়ুব খান হলে নিশ্চয়ই শেখ সাহেবকে ক্ষমতা দিয়ে দিত। তাই না বলাই কাকু?
বলাই কাকুর আইয়ুব খানের ওপরও খুব ভরসা আছে বলে মনে হলো না, অনিশ্চিতের মতো বললেন, কী জানি বাপু! আমি পাঞ্জাবিদের কাজকর্ম বুঝি না। যারা ভাত না খেয়ে রুটি খায়, তাদের বুদ্ধি আর কত হবে?
আমি আর মামুন একসাথে মাথা নাড়লাম, কথাটা সত্যি, যারা ভাত খেয়ে না রুটি খেয়ে থাকে তাদের বুদ্ধি খুব বেশি হবার কথা না, তাদের কাজকর্মে বোকামি থাকতেই পারে।
বলাই কাকু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সারা দেশে কী হচ্ছে কোনো খোঁজ পাই না। খুবই অস্থির লাগে।
তার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, সেটা শুনে আমি আর মামুন দুজনেই একটু ভয় পেয়ে গেলাম। মামুন জিজ্ঞেস করল, কী হচ্ছে বলাই কাকু?
শেখ সাহেব এতগুলো সিট পেয়েছে এখন তারে যদি ক্ষমতা না দেয় তাহলে বাঙালিরা কি বসে থাকবে? কিছু একটা গোলমাল শুরু হবে না?
মামুন সবকিছু বুঝে ফেলেছে এ রকম একটা ভঙ্গি করে বলল, বলাই কাকু, গোলমাল হলেও তো আমাদের কাঁকনডুবিতে কখনো গোলমাল হবে না! সব গোলমাল হয় ঢাকায়।
তা ঠিক।
আমাদের কোনো ভয় নাই। আছে বলাই কাকু?
মনে হয় নাই।
বলাই কাকুর সাথে রাজনীতির আলাপ করে আমরা যখন চলে আসছি তখন তার ফ্রি চায়ের কথা মনে পড়ল। আমাদের ডেকে কাঁচের গ্লাসে করে আধ কাপ চা বানিয়ে দিলেন, সাথে একটা কুকি বিস্কুট।
আমরা খুব তৃপ্তি করে চা-বিস্কুট খেলাম। খেতে খেতে আমি মামুনের সাথে রাজনীতির আলাপ করার চেষ্টা করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দেবে না–আইয়ুব খান হলে দিত তার কারণটা কী মামুন?
মামুন তার চায়ের গ্লাসের শেষ ফেঁটাটা খুব তৃপ্তি করে খেতে খেতে বলল, আইয়ুব খান হচ্ছে বাঘের বাচ্চা! কী চেহারা। আর ইয়াহিয়া খানের ছবি দেখেছিস?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, দেখি নাই।
ইয়াহিয়া খানের চেহারা একেবারে জানোয়ারের চেহারা। যেই মানুষের চেহারা জানোয়ারের মতো তার কাজকর্ম সবকিছু জানোয়ারের মতো।
এইটাই কারণ?
মামুন মাথা নাড়ল, বলল, এইটাই আসল কারণ।
.
মাসুদ ভাই অবশ্যি চেহারাটা আসল কারণ, সেটা বলল না। আমি যখন ক্লাসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম মাসুদ ভাই একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কারণটা এত সোজা না। এর কারণটা বুঝতে হলে অনেক কিছু বুঝতে হবে।
কী বুঝতে হবে, মাসুদ ভাই?
এইখানে আসলে তিনটা আলাদা আলাদা দেশ হওয়ার কথা ছিল। বাঙালিদের একটা দেশ, পাঞ্জাবিদের একটা দেশ আর ইন্ডিয়া। বাঙালিদের আলাদা দেশটা দেয় নাই–সেইটা পাকিস্তানের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে।
আমরা বিষয়টা বুঝে ফেলেছি সেইভাবে মাথা নাড়লাম।
পাকিস্তান হওয়ার পর কী হলো? মার্শাল ল-এর পর মার্শাল ল।
একজন জিজ্ঞেস করল, মার্শাল ল মানে কী?
মিলিটারি শাসন। খুব খারাপ জিনিস। আইয়ুব খানই বারো বছর ক্ষমতায় থাকল। দেশটারও বারোটা বাজিয়ে দিল।
মামুনকে একটু বিমর্ষ দেখলাম সে আইয়ুব খান, বিশেষ করে তার চেহারার, খুব ভক্ত।
মাসুদ ভাই বলতে থাকল, সংখ্যায় আমরা বেশি কিন্তু শাসন করে পাঞ্জাবিরা। পূর্ব পাকিস্তানকে চুষে চুষে খায়। আমাদের চাষিরা কত কষ্ট করে পাট চাষ করে সেই পাট বেচে যে টাকা আসে সেই টাকা নিয়ে যায় পাঞ্জাবিরা, উন্নতি হয় পশ্চিম পাকিস্তানের। যে-ই প্রতিবাদ করে তাকেই জেলখানায় আটকে রাখে। কী অত্যাচার চিন্তা করতে পারবে না।
আমরা একটু অবাক হয়ে মাসুদ ভাইয়ের কথা শুনছিলাম, আমরা এই সব কিছুই জানি না। আমাদের স্কুলে আমরা প্রত্যেক দিন সকালে পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ টানাই, এসেমব্লিতে পাকিস্তানের মহান আদর্শের কথা বলি। পাকিস্তানের সেবা করে আদর্শ মুসলিম দেশ তৈরি করার কথা বলি। এই দেশের এত সমস্যা, সেটা এত দিন কেউ বলে নাই কেন?
মাসুদ ভাই বলল, সব রাজনৈতিক নেতাদের জেলে ভরে রেখেছে, আন্দোলন করার কেউ নাই। তখন আন্দোলন করল কারা? ছাত্ররা। আমার মতো ছাত্ররা। তোমাদের মতো ছাত্ররা। ঊনসত্তরে সে কী আন্দোলন! আইয়ুব খানকে কানে ধরে সরানো হলো, জেলখানা থেকে নেতারা ছাড়া পেলেন। কী একটা সময়! মাসুদ ভাইয়ের মুখটা আনন্দে ঝলমল করতে থাকে।
মামুন মুখ শক্ত করে বসে রইল, তার পছন্দের মানুষ আইয়ুব খানকে কানে ধরে সরানো হয়েছে বিষয়টা সে মানতে পারছে না।
বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ছাড়া পেলেন—
একজন জিজ্ঞেস করল, বঙ্গবন্ধু কে?
মাসুদ ভাই প্রশ্নটা শুনে মনে হলো একটু অবাক হলো, বলল, শেখ সাহেবকে সবাই বঙ্গবন্ধু ডাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাই হোক বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ঘুরে ছয় দফার ডাক দিলেন। ইলেকশন হলো–ইলেকশনে পূর্ব পাকিস্তানের দুইটা ছাড়া সবগুলো সিট বঙ্গবন্ধুর।
এবারে আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, ইলেকশনের কথা আমাদের মনে আছে। আমাদের কাঁকনডুবিতে ইলেকশনের মিছিল হয়েছে, কয়েকটা শ্লোগানের কথা এখনও মনে আছে, সোনার বাংলা শ্মশান কেন? জবাব চাই জবাব চাই। ভোট দিবে কিসে? নৌকা মার্কা বাক্সে। বঙ্গবন্ধুর মার্কা ছিল নৌকা।
নৌকার বিপক্ষ পার্টির মার্কা ছিল গোলাপ ফুল। গোলাপ ফুলের মিছিলে লোক কম হতো, মিছিলের পর পান-বিড়ি খেতে দিত, তার পরও লোকজন বেশি হতো না। মজা দেখার জন্য আমরা অবশ্যি সব মিছিলেই থাকতাম।
মাসুদ ভাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ইয়াহিয়া খান বুঝতে পারে নাই ইলেকশনে বঙ্গবন্ধু এইভাবে জিতবে। যদি বুঝত তাহলে ইলেকশন দিত না। এখন তার কোনো উপায় নাই, এখন বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দিতে হবে। এই প্রথম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবে বাঙালি! মিলিটারিরা সেইটা সহ্য করতে পারছে না।
ঠিক কী কারণ জানি না, আমার কেমন জানি এক ধরনের উত্তেজনা হলো। বলাই কাকু কেন দুশ্চিন্তা করছিলেন এখন বুঝতে পারলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মিলিটারি যদি ক্ষমতা না দেয় তাহলে কী হবে মাসুদ ভাই?
মাসুদ ভাই একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, বাঙালিরা সেটা মেনে নেবে না। ক্ষমতা যদি না দেয় তাহলে কী হবে জানো?
কী হবে?
তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাব। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবে।
মাসুদ ভাই কেমন যেন জ্বলজ্বলে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম মাসুদ ভাই মনে মনে চাইছে ইয়াহিয়া খান যেন ক্ষমতা না দেয় আর আমরা যেন স্বাধীন হয়ে যাই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমরা স্বাধীন হলে দেশটার নাম কী হবে মাসুদ ভাই?
কে যেন বলল, পূর্ব বাংলা।
মাসুদ ভাই মাথা নাড়ল, বলল, না। বাংলাদেশ। দেশটার নাম হবে বাংলাদেশ।
আমি মনে মনে বললাম, বাংলাদেশ আর সাথে সাথে শরীরে কেমন জানি শিহরণ হলো। কেন হলো, কে জানে?
.
০৩.
কার কাছে যেন শুনেছিলাম সব গ্রামে নাকি একটা করে পাগল থাকে। কথাটা মনে হয় সত্যি, আমাদের গ্রামে একজন পাগল আছে, নাম হাবীবুর রহমান। আমাদের পাশের গ্রামেও একটা পাগল আছে, তাকে সবাই ডাকে নূরা পাগলা। তবে আমার মনে হয় সব গ্রামে শুধু পাগল না, কিছু ফালতু মানুষও থাকে। একজন পাগল আর কিছু ফালতু মানুষ না হলে একটা গ্রাম পুরো হয় না।
আমাদের গ্রামের যে পাগল হাবীবুর রহমান, তাকে দেখে বোঝাই যাবে না সে পাগল। সে খুবই স্বাভাবিকভাবে কথা বলে। কথা বলা শেষ করার পর হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর যেটা নিয়ে কথা বলেছে, সেটা নিয়ে বক্তৃতা দিতে থাকে। তখন হঠাৎ করে সবাই টের পায় যে মানুষটার মাথায় গোলমাল আছে। হাবীবুর রহমান খুবই শান্তশিষ্ট পাগল, বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া সে আর কোনো ঝামেলা করে না। সেই তুলনায় আমাদের পাশের গ্রামের নূরা পাগলা রীতিমতো ভয়ংকর। তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়, তার পরও পূর্ণিমা-অমাবস্যায় সে নাকি শিকল ভেঙে বের হয়ে যায়। হাতে দা নিয়ে সামনে যাকে পায় তাকেই কোপাতে থাকে। দশজন মানুষ মিলেও তখন নাকি তাকে ধরে রাখা যায় না। আমাদের যখন কোনো কাজ থাকে না তখন আমরা দলবেঁধে নূরা পাগলাকে দেখতে যাই। মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, লম্বা লম্বা নখ, সারা গায়ে মাটি, লাল লাল চোখ, একটু পরেই হিংস্র পশুর মতো শব্দ করছে। দেখলেই ভয়ে বুক কাঁপে। আমাদের খুবই কপাল ভালো কাঁকনডুবি গ্রামের পাগল হাবীবুর রহমান খুবই শান্তশিষ্ট পাগল।
আমাদের গ্রামের ফালতু মানুষটার নাম মতি। পুরো নাম মতিউর রহমান, লতিফুর রহমানের ছেলে। যারা গরিব মানুষ তাদের ফালতু হলে সংসার চলে না, তাদের সবাইকে কাজকর্ম করতে হয়। সকালে গরু নিয়ে মাঠে যায় সারা দিন হালচাষ করে, ধান বোনে, খেতে সার দেয়, ধান বড় হলে ধান কাটে, বাড়িতে আনে মাড়াই দেয়। মাথায় করে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে– তাদের ফালতু হবার সময় কোথায়? কিন্তু আমাদের মতিউর রহমানের বাবা লতিফুর রহমান গ্রামের মাতবর। মুসলিম লীগের নেতা, টাকা-পয়সা আছে, জমি-জিরাত আছে, তাই মতি কোনো কাজকর্ম করে না। তিনবার পর পর ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করেছে, তখন বাবা লতিফুর রহমান রেগেমেগে সব বই বাড়ির উঠানে পুড়িয়ে দিয়েছে। তার পর থেকে মতিউর রহমানের আর কিছুই করতে হয় না, খায়-দায় ঘুরে বেড়ায়। আমরা তাকে আড়ালে ফালতু মতি ডাকি।
আমি আর মামুন যখন স্কুল থেকে বাড়ি যাচ্ছি তখন লতিফা বুবুর বাড়ির সামনে ফালতু মতির সাথে দেখা হলো। একটা হাফ হাতা শার্টের হাতাটা আরেকটু গুটিয়ে রেখেছে, লুঙিটার একটা কোনা খুব কায়দা করে ধরে তুলে রেখেছে। মনে হয় পায়ে বরারের কালো জুতোগুলো যেন দেখা যায় সে জন্য।
আমাদের দেখে মুখের একটা কোনা উপরে তুলে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলল, ইস্কুল থেকে আসছিস?
আমরা মাথা নাড়লাম।
ফালতু মতি জিজ্ঞেস করল, লেখাপড়া হয় ইস্কুলে?
মামুন বলল, হয়।
মতি মুখটা আরো বাঁকা করে বলল, নাকি খালি রাজনীতি হয়?
আমরা খুবই অবাক হলাম, স্কুলে কেন রাজনীতি হবে? এটা আবার কী রকম কথা? মামুন বলল, কথাটা বুঝলাম না মতি ভাই।
নূতন একটা মাস্টার আসছে সে নাকি স্কুলের পোলাপানদের নিয়ে রাজনীতি করছে।
এবারে আমরা ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম, মাসুদ ভাইয়ের কথা। বলছে। ক্লাসে আমাদের সাথে কী বলেছে, সেটা ফালতু মতি জানল কেমন করে? মতি বলল, কলেজের ছাত্র কোনো পাস দেয় নাই কিছু নাই তারে মাস্টার বানাল কোন আক্কেলে? ইস্কুল কি হেডমাস্টারের বাপের সম্পত্তি? যারে-তারে নিয়া আসবে?
আমরা কিছু বললাম না, মতির সাথে কথা যত কম বলা যায়, তত ভালো। সে বুকপকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল, আরেকটা পকেট থেকে ম্যাচ বের করল, সে যে অন্যদের মতো বিড়ি খায় না, সিগারেট খায় সেটা বোঝাবার জন্য সিগারেটটা ধরিয়ে একটা টান দিয়ে আমাদের মুখে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, তোদের চ্যাংড়া মাস্টারকে বলিস মাস্টারি করার আগে যেন একটা-দুইটা পাস দেয়।
আমরা মাথা নাড়লাম। মতি তখন আবার তার লুঙিটার কোনা ধরে একটু উপরে তুলে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে। আমি আর মামুন কিছুক্ষণ মতিকে হেঁটে যেতে দেখলাম। মামুন গলা নামিয়ে বলল, মতি ভাই এইখানে হাঁটাহাঁটি করে কেন জানিস?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
তার লতিফা বুবুরে বিয়ে করার শখ। সেই জন্য সেজেগুঁজে এই বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করে।
মতি বিয়ে করবে লতিফা বুবুরে দৃশ্যটা চিন্তা করেই আমি আর মামুন হি হি করে হাসতে লাগলাম!
আমি আর মামুন হেঁটে হেঁটে আরেকটু সামনে গিয়েছি, লতিফা বুবুদের বাড়ির বাংলাঘরের পাশে দেখলাম শাড়ি পরা একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মহিলা আমাদের ডাকল, এই রঞ্জু, মামুন–
আমরা ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মহিলাটা আসলে আমাদের লতিফা বুবু, শাড়ি পরলে সব মেয়েকে এত বড় দেখায়! আমরা আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, লতিফাবু!
লতিফা বুবু হাসল, বলল কী হলো? তোরা আমার কোনো খোঁজ নিতেও আসবি না?
আমরা কী বলব বুঝতে পারলম না, লতিফা বুবু ছিল আমাদের লিডার, তার পিছু পিছু আমরা সারা কাঁকনডুবি চষে বেড়াতাম, সবার খোঁজ নিতাম। সেই লতিফা বুবু বলছে আমরা তার খোঁজ নিই না। আমি বললাম, লতিফাবু, তোমাকে দেখে আমি চিনতে পারি নাই। ভেবেছি অন্য কেউ।
লতিফা বুবু কিছু বলল না, কিছুক্ষণ আমাদের দেখল, আমাদের হাতের বইগুলোর দিকে তাকাল, তারপর বলল, দেখি তোদের বইগুলো।
আমি বইগুলো দিলাম, মাত্র কয়েক দিন হলো ক্লাস শুরু হয়েছে এর মাঝেই বইগুলো কাহিল হয়ে গেছে। লতিফা বুবু অবশ্যি সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না, বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখল তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফালতু মতির লেখাপড়া করার কোনো শখ নাই তার পরও সে তিনবার ম্যাট্রিক দিয়েছে, আর লতিফা বুবুর এত লেখাপড়া করার শখ তার স্কুল বন্ধ করে তাকে বাড়িতে আটকে রেখেছে!
মামুন জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কী করো লতিফাবু?
এই তো সংসারের কাজ করি।
বই পড় না?
বই? বই আমাকে কে দেবে?
আমি বললাম, আমাদের স্কুল লাইব্রেরি থেকে তোমাকে বই এনে দেব?
লতিফা বুবুর চোখ চক চক করে উঠল, দিবি? এনে দিবি?
মামুন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, স্কুলের লাইব্রেরিতে কোনো ভালো বই নাই। সব পুরান পুরান বই।
লতিফা বুবু মাথা নেড়ে বলল, হোক পুরান। তুই এনে দে।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, ঠিক আছে লতিফাবু।
আমরা আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম কিন্তু কথা বলার কিছু খুঁজে পেলাম না। কী আশ্চর্য ব্যাপার একসময় আমাদের কথা বলা নিয়ে কোনো সমস্যা হতো না, কে কার আগে কী বলবে, সেটা নিয়েই ঝগড়া লেগে যেত। ধান ক্ষেতে লতিফা বুবু হয়তো একটা ফড়িং ধরেছে, ধরে বলত, এই দেখ। কেমন করে হেলিকপ্টার বানাতে হয় তোদের দেখাই।
আমরা লতিফা বুবুকে ঘিরে দাঁড়াতাম, লতিফা বুবু তখন একটা লম্বা চোরাকাটা নিয়ে ফড়িংয়ের পেছনে ঠেলে ঢুকিয়ে দিত। তারপর ফড়িংটা ছেড়ে দিয়ে বলত, এই দেখ।
বেচারা ফড়িং সেই চোরাকাটা নিয়ে ওড়ার চেষ্টা করত, আমরা আনন্দে হাত তালি দিয়ে হি হি করে হাসতাম। মামুন বলত, হেলিকপ্টারের পাখা থাকে উপরে–এইটার পাখা উপরে হয় নাই।
লতিফা বুবু মামুনের মাথায় চাটি মেরে বলত, চুপ কর। তুই বেশি জানিস?
ঠিক তখন হয়তো আরেকজন চিৎকার করে লাফানো শুরু করেছে, তার পায়ে জোঁক ধরেছে। লতিফা বুবু বাঘ–সিংহকেও ভয় পেত না কিন্তু জোঁককে খুব ভয় পেত, দূরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকত, টেনে ছুটিয়ে দে–ছুটিয়ে দে।
আমরা জোঁক টেনে ছুটিয়ে এনে তখন সেটা দিয়ে লতিফা বুবুকে ভয় দেখাতাম, লতিফা বুবু একেবারে হাত জোর করে বলত, ভাইডি ভাইডি ভাইডি তোর আল্লাহর কসম লাগে, বড় পীর সাহেবের কসম লাগে–খোদার কসম লাগে–কাছে আনিস না। ফেলে দে পা দিয়ে পিষে ফেল–
জোঁকটাকে পা দিয়ে পিষে ফেলে আমরা লতিফা বুবুকে জিজ্ঞেস করতাম, তুমি জোঁককে এত ভয় পাও কেন?
লতিফা বুবু বলত, জোঁক খুব খারাপ। খুব ভয়ংকর।
কেন।
একবার হয়েছে কী, একটা মেয়ে পুকুরে সাঁতরাতে গেছে—
তারপর।
লতিফা বুবু হঠাৎ থেমে গিয়ে বলত, না। বলা যাবে না।
কেন বলা যাবে না।
লতিফা বুবু রেগে চুলের ঝুঁটি টেনে বলত, আমি বলেছি বলা যাবে, সেই জন্য বলা যাবে না।
সেই গল্প আর কখনো শোনা হয় নাই। সেই লতিফা বুবু এখন অন্য রকম হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য। তার পাশে দাঁড়িয়ে আমরা বলার কিছু খুঁজে পাই না!
.
পরদিন আমি আর মামুন স্কুলের লাইব্রেরিতে লতিফা বুবুর জন্য বই আনতে ঢুকলাম। কাজটা অবশ্য খুব সহজ হলো না। স্কুলের লাইব্রেরি ঘরটা বেশির ভাগ সময় তালা মারা থাকে। স্কুলের লাইব্রেরিয়ান নাই। চিকা স্যার (চেহারার মাঝে একটা চিকা ভাব আছে সেই জন্য নাম চিকা স্যার) দায়িত্বে থাকেন। চিকা স্যার অবশ্যি মানুষটা ভালো, লাইব্রেরি থেকে বই নিতে চাই শুনে খুশিই হলেন। দপ্তরি রসময়ের হাতে চাবি দিয়ে আমাদের জন্য লাইব্রেরি খুলে দিতে বললেন।
লাইব্রেরির ভেতরে ধুলা আর মাকড়সার জাল। আলমারি বোঝাই বই, বইগুলো বাঁধাই করা। আমরা খুঁজে খুঁজে দুইটা বই বের করলাম, একটা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস সমগ্র, আরেকটা ভেষজ উদ্ভিদের গুণাবলির ওপর। বইয়ের ভেতরে কী আছে তার চাইতে বেশি গুরুত্ব দিলাম বইয়ের সাইজের ওপর। মোটা বই হলে লতিফা বুবু অনেক দিন পড়তে পারবে।
বইগুলো নিয়ে ক্লাসে আসার পর একটা সমস্যা হয়ে গেল, সবাই জানতে চায় এত মোটা বই দিয়ে আমরা কী করব। মানুষ বই পড়ে, কাজেই খুবই সোজা উত্তর হচ্ছে যে আমরা বইগুলো পড়ব, কিন্ত সমস্যা হচ্ছে সবাই জানে। আমরা বই পড়ার মানুষ না, তাও এ রকম মোটা বাঁধাই করা বই! বইগুলো নিশ্চয়ই কেউ পড়বে কিন্তু কে পড়বে, সেটাই সবাই জানতে চাইছে। লতিফা বুবুর নামটা বলা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছিলাম না।
ক্লাস শুরু হবার পর মাসুদ ভাই এসেও আমাদের সামনে এই মোটা বই দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি এই মোটা বই পড়বে? বাহ্। কী চমৎকার। ভেরি গুড। বই পড়া খুব ভালো অভ্যাস। কী বই দেখি?
আমি মাথা চুলকে বইটা মাসুদ ভাইয়ের হাতে দিলাম। মাসুদ ভাই বইটা খুলে আরো অবাক হলো, বঙ্কিম রচনাবলি। তুমি বঙ্কিমের বই পড়ো। কী অসাধারণ।
ক্লাসের সব ছেলে তখন একসাথে আপত্তি করল, রীতিমতো চিৎকার করে বলল, না, মাসুদ ভাই। রঞ্জু কোনো বই পড়ে না–
মাসুদ ভাই একটু অবাক হয়ে বলল, বই পড়ো না? তাহলে এত মোটা বই কেন নিচ্ছ?
আমাকে তখন সত্যি কথাটা বলতে হলো। আমাদের লতিফা বুবুর খুব লেখাপড়ার শখ, এখন তার স্কুল বন্ধ। তাই বাড়িতে বসে থাকে, তার জন্য এই বই। লতিফা বুবুর কথা শুনে মাসুদ ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, একটা ছেলে থেকে একটা মেয়ের লেখাপড়া করা বেশি দরকার। আমরা এমন একটা সিস্টেম করে রেখেছি যে মেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে না।
মাসুদ ভাই এমনভাবে আমাদের দিকে তাকাল যে মনে হলো দোষটা আমাদের। তার কথাটা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করলাম না, আমার নানি লেখাপড়া জানে না, তার যন্ত্রণায় আমার জীবন শেষ। নানি যদি লেখাপড়া জানত তাহলে কী উপায় ছিল?
মাসুদ ভাই বলল, তোমাদের লতিফা বুবুর জন্যও মনে হয় বইগুলো একটু কঠিন হয়ে যাবে! দরকার শরৎচন্দ্রের বই, তা না হলে তারাশংকর কিংবা বিভূতিভূষণের বই। আরো সোজা হবে আশাপূর্ণা দেবী কিংবা শংকরের–হঠাৎ তার কিছু একটা মনে পড়ে গেল, তখন চোখ বড় বড় করে বলল, আমি আশাপূর্ণা দেবীর একটা বই পড়ছি। নাম হচ্ছে প্রথম প্রতিশ্রুতি! বইটা প্রায় শেষ, আর কয়েক পৃষ্ঠা বাকি। আমি নিয়ে আসব, তোমাদের লতিফা বুবুকে পড়তে দিতে পারো। পড়ে আবার ফেরত দিতে হবে কিন্তু।
আমি বললাম, ফেরত দেবে মাসুদ ভাই। লতিফা বুবুর কাছ থেকে আমি বই ফেরত এনে আপনাকে দেব।
মামুন তখন আমার দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে চোখ টিপে বলল, বলেছিলাম না।
কী বলেছিলি?
মাসুদ ভাই এই গ্রামের জামাই। এখনই বই দেওয়া-নেওয়া হচ্ছে। তারপর কী দেওয়া-নেওয়া হবে বুঝলি না?
আমি আসলেই কিছু বুঝলাম না। মামুনের অনেক কথাই আমি বুঝি না।
মাসুদ ভাই তখন আমাদের বিজ্ঞান পড়াতে শুরু করল। আর্কিমিডিসের সূত্র দিয়ে আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করল কেন লোহা ডুবে যায় কিন্তু লোহার তৈরি জাহাজ ভেসে থাকে। খুবই উৎসাহ নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু আমরা কিছুই বুঝলাম না। মাসুদ ভাই একটু পরে পরে জিজ্ঞেস করতে লাগল, বুঝেছ তো? আমরা কিছুই বুঝতে পারি নাই কিন্তু খুব জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগলাম যে সব বুঝে ফেলেছি। মাসুদ ভাই তখন আর্কিমিডিসের গল্পটা বলল, রাজার জন্য সোনার মুকুট তৈরি হয়েছে তার মাঝে খাদ আছে কি না সেটা আর্কিমিডিসকে বের করে দিতে হবে। আর্কিমিডিস সমস্যাটা চিন্তা করতে করতে গোসল করার জন্য পানির গামলায় নেমেছে, তখন হঠাৎ করে সমাধানটা মাথায় এসে গেছে। ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার করতে করতে রাস্তা দিয়ে ন্যাংটো হয়ে দৌড়াতে শুরু করেছে–
গল্পের এই জায়গায় মামুন মাসুদ ভাইকে থামাল, জিজ্ঞেস করল, মাসুদ ভাই, ন্যাংটো হয়ে কেন?
মাসুদ ভাই থতমত খেয়ে গেল, বলল, ইয়ে মনে হয় ওই সময় মানুষ ওইভাবে গোসল করত–
মামুন বলল, খুবই বেশরম মনে হয়।
এত বড় একজন বৈজ্ঞানিককে বেশরম বলায় মাসুদ ভাই মনে হলো একটু রাগ হলো কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না, আবার আর্কিমিডিসের সূত্র দিয়ে সোনার মুকুটের খাদ বের করা হয় সেটা বোঝাতে লাগল। আমরা। কিছুই বুঝলাম না, মাসুদ ভাই রাজনীতির কথা, দেশের কথা খুব ভালো বোঝাতে পারে কিন্তু বিজ্ঞান কিছুই বোঝাতে পারে না। তখন আমি শোনা বন্ধ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। লেখাপড়াটা আমার জন্য না। নানির যন্ত্রণায় স্কুলে আসতে হয়–এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। মনে হয় একদিন বন্ধ করে দিতে হবে।
কতক্ষণ বাইরে তাকিয়ে ছিলাম কে জানে হঠাৎ করে চমকে উঠলাম, শুনলাম মাসুদ ভাই গলা উঁচু করে বলছে, এই যে, এই যে ছেলে–
আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখি মাসুদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, জিজ্ঞেস করল, কী নাম তোমার?
রঞ্জু।
তা রঞ্জু, তুমি এত মনোযোগ দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছ। ব্যাপারটা কী? আমি ক্লাসে পড়াচ্ছি–
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম, বলতে তো পারি না যে, আপনি কী পড়াচ্ছেন তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি না।
মাসুদ ভাই বলল, দেখে মনে হচ্ছিল খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছিলে। কী ভাবছ?
আমি আসলে কিছুই ভাবছিলাম না। সব সময়েই কিছু একটা ভাবতে হবে কে বলেছে?
মাসুদ ভাই বলল, বলো, কী ভাবছিলে?
তখন আমার মাথায় মাসুদ ভাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা বুদ্ধি এল। বললাম, দেশের অবস্থা খুব খারাপ, কী গোলমাল হয় সেটা চিন্তা করে ভয় লাগছে!
পুরোপুরি মিথ্যা কথা কিন্তু আমার কথায় ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। মাসুদ ভাই একেবারে আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আরে রঞ্জু, তোমার ভয় পাওয়ার কী আছে? এটা আমাদের দেশ না? এখানে কে কী করবে?
আমি কিছু বললাম না, শুধু দেশের চিন্তায় খুবই কাহিল হয়ে আছি এ রকম একটা ভাব করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাসুদ ভাই জিজ্ঞেস করল, এইটা কী মাস?
মাঘ মাস।
ইংরেজি?
গ্রামের মানুষ আমরা বাংলা মাস দিয়েই কাজ চালিয়ে দিই, তাই ইংরেজি মাসটা বলতে পারলাম না। মাসুদ ভাই বলল, ফেব্রুয়ারি। এমনভাবে বলল যে ফেব্রুয়ারি মাসটা খুবই সম্মানিত একজন মানুষ! এটাকে রীতিমতো পা ছুঁয়ে সালাম করতে হবে।
ফেব্রুয়ারি মাসটা কিসের মাস জানো?
মেয়েদের ভেতরে কে একজন চিকন গলায় বলল, জানি। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম নীলিমা। নীলিমা মনে হয় সবকিছু জানে।
মাসুদ ভাই মনে হলো খুবই উৎসাহ পেল, বলল, বলো দেখি।
নীলিমা বলল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষার মাস।
মাসুদ ভাই উৎসাহে হাতে কিল দিয়ে বলল, ভেরি গুড। শুধু একজন জানলে হবে না। সবাইকে জানতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি হচ্ছে শহীদ দিবস। ঢাকা শহরে বিশাল শহীদ মিনার আছে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করে লক্ষ লক্ষ মানুষ খালি পায়ে ফুল দিতে যায়।
আমরা প্রত্যেক দিনই খালি পায়ে স্কুলে আসি তাই খালি পায়ে প্রভাতফেরি করে বাড়তি কী লাভ ধরতে পারলাম না। কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করলাম না, মাসুদ ভাই যত উৎসাহ নিয়ে বিজ্ঞান বোঝায় তার থেকে অনেক বেশি উৎসাহ নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এগুলো বোঝায়।
মাসুদ ভাই উৎসাহে টগবগ করতে করতে বলল, এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসটা অন্য রকম। সারা দেশে একটা উত্তেজনা! ঢাকা শহরে অন্য রকম অবস্থা, মানুষের মাঝে সাংঘাতিক রকম উৎসাহ-উদ্দীপনা। এই ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের একটা জবাব দেওয়া হবে–কথা বলতে বলতে হঠাৎ মাসুদ ভাই থেমে গেল, জানালার কাছে এসে বাইরে তাকাল, মাথা ঘুরিয়ে কী যেন দেখে আবার ক্লাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, তোমাদের সমস্যাটা কী জানো?
আমাদের অনেক সমস্যা, মাসুদ ভাই কোনটার কথা বলছে বুঝতে পারলাম না। মাসুদ ভাই আমাদের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না, বলল, তোমাদের সমস্যা হচ্ছে তোমাদের স্কুলে কোনো শহীদ মিনার নাই।
আমরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম, শহীদ মিনার?
হ্যাঁ। প্রত্যেকটা স্কুলে একটা শহীদ মিনার থাকতে হয়। একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করে সেখানে ফুল দিতে হয়।
একজন জিজ্ঞেস করল, শহীদ মিনার কী রকম হয়?
তোমরা কখনো শহীদ মিনার দেখ নাই?
আমরা মাথা নাড়লাম, না।
মাসুদ ভাই চক নিয়ে বোর্ডের কাছে শহীদ মিনার আঁকতে গেল। তারপর হঠাৎ করে থেমে গেল, ক্লাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, আমরা এই স্কুলে একটা শহীদ মিনার বানাব।
লেখাপড়া ছাড়া অন্য সব কাজে আমাদের উৎসাহের শেষ নাই। তাই আমরা সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম।
.
০৪.
আমি আর মামুন তাড়াতাড়ি হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন ফালতু মতি আমাদের পেছন থেকে ডাকল, হেই! হেই পোলাপান।
আমরা মোটেও পোলাপান না কিন্তু ফালতু মতির কথাবার্তা এই রকম। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম, তখন মতি তার বাহারি লুঙিটার কোনা ধরে খানিকটা উপরে তুলে হেঁটে হেঁটে আমাদের কাছে এল, ঠোঁটের এক পাশটা উপরে তুলে মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, কই যাস?
আমি বললাম, স্কুলে।
আজকে আবার কিসের স্কুল। আজকে শুক্রবার না?
হ্যাঁ। কিন্তু আমরা স্কুলে শহীদ মিনার বানাচ্ছি তো–
ফালতু মতির মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম সে শহীদ মিনার বানানোর খবর পেয়ে গেছে কিন্তু ভান করছে আমাদের মুখ থেকে প্রথম শুনছে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী বানাচ্ছিস?
শহীদ মিনার।
সেইটা আবার কী বস্তু? কী হবে এইটা দিয়ে?
মামুন বলল, একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করে ফুল দেব।
ফুল দিবি? মুসলমানের বাচ্চা ফুল দিবি মানে?
আমি আর মামুন একজন আরেকজনের মুখে তাকালাম। মামুন জিজ্ঞেস করল, ফুল দিলে কী হয়?
গুনাহ হয়। মুসলমানের বাচ্চা ফুলটুল দেয় না। ফুল দেয় মালাউনের বাচ্চারা। তোরা কি মালাউন?
ফালতু মতি হিন্দুদের হিন্দু না বলে মালাউন ডাকে। কেন ডাকে জানি না। আমরা কী বলব বুঝতে পারলাম না তাই চুপ করে থাকলাম। মতি বলল, এই সব কামকাজ ওই নূতন মাস্টারের। লেখাপড়া নাই কোনো পাস নাই তারে স্কুলের মাস্টার বানাইছে আর সেই চ্যাংড়া মাস্টার স্কুলের পোলাপানদের নিয়া রাজনীতি করে? স্কুলে শহীদ মিনার বানায়? কত বড় সাহস। আমি আজকেই নালিশ দিমু। লিখিত নালিশ।
আমি বললাম, নালিশ দিয়ে লাভ নাই মতি ভাই। এখন সব স্কুলে শহীদ মিনার থাকে। সারা দেশ এখন জয় বাংলা।
সারা দেশে কী?
জয় বাংলা।
মতি কী রকম যেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। জয় বাংলা কথাটা শুনে মনে হয় কেমন জানি টাশকি মেরে গেল!
আমি আর মামুন আর না দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটতে শুরু করলাম। খানিক দূর গিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি মতি উল্টো দিকে হাঁটছে। লতিফা বুবুর বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করা ছাড়া তার আর কোনো কাজ নাই। এই রকম মানুষ আমরা জন্মেও দেখি নাই।
স্কুলে গিয়ে দেখি হুলুস্থুল অবস্থা। অনেক ছেলে এসেছে। মেয়েদের মাঝে খালি নীলিমা। বড় বড় বাঁশ আনা হয়েছে। আমাদের গ্রামের কাঠমিস্ত্রী কালীপদ করাত দিয়ে সেই বাঁশ কাটছে। কয়েকজন মিলে মাটি কেটে স্কুলের এক কোনায়া উঁচু করে একটা ভিটে মতন তৈরি করছে। তার মাঝে মাসুদ ভাই কানে একটা কাঠপেন্সিল লাগিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে।
আমরা পৌঁছাতেই মাসুদ ভাই আমাদের কাজে লাগিয়ে দিল, স্কুলের পেছনে একটা দেয়াল ধসে পড়েছে, সেখানে অনেক ইট খুলে পড়েছে। মাসুদ ভাই আমাদেরকে ইট আনতে লাগিয়ে দিল। আমরা মহা উৎসাহে ভাঙা দেয়াল থেকে টেনে টেনে ইট আনতে লাগলাম।
বিকেলের মাঝে শহীদ মিনারটা দাঁড়িয়ে গেল। মিনার শব্দটার জন্য আমি ভেবেছিলাম ওপরে হয়তো গম্বুজের মতো কিছু একটা থাকবে। কিন্তু দেখা গেল সে রকম কিছু না। অনেকটা মইয়ের মতন, শুধু মইয়ের কাঠিগুলো আড়াআড়ি না হয়ে লম্বা লম্বি। মাঝখানে দুইটা, তার দুই পাশে একটু ছোট আরো দুইটা। শহীদ মিনার বানানো এত সোজা জানলে আমরা নিজেরাই বানিয়ে ফেলতে পারতাম।
শহীদ মিনার শেষ করার পর মাসুদ ভাই একটু দূর থেকে শহীদ মিনারটা দেখে তৃপ্তির একটা শব্দ করল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এইটাই শহীদ মিনার?
মাসুদ ভাই একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে নাক-মুখ দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বলল, এইটা আমাদের শহীদ মিনার। একেক জায়গায় একেক রকম শহীদ মিনার হয়। পিলারগুলো একটু চিকন হয়েছে, মোটা হলে আরেকটু ভালো হতো।
মামুন জিজ্ঞেস করল, এখন কী করব?
একুশে ফেব্রুয়ারির দিন প্রভাতফেরি করে ফুল দেব।
আর কিছু করব না?
বাঁশগুলো সাদা রং করতে হবে। পেছনে একটা লাল সূর্য দরকার। বাজার থেকে লালসালু কিনে আনতে হবে।
আমরা যখন চলে আসছিলাম তখন মাসুদ ভাই আমাদের থামাল, তারপর তার ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা মোটা বই বের করে আমাদের হাতে দিয়ে বলল, নাও। এই বইটা তোমাদের লতিফা বুবুর জন্য। পড়ে আবার ফেরত দিতে হবে কিন্তু।
আমি বইটা হাতে নেওয়ার আগেই মামুন খপ করে বইটা নিয়ে নিল, বলল, দেব মাসুদ ভাই। বইটা ফেরত দেব।
স্কুল থেকে বের হয়ে সড়কটার উপরে উঠতেই মামুন এদিক-সেদিক তাকিয়ে বইটা খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা খুজঁতে থাকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী খুজছিস? .
চিঠি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কার চিঠি?
বেকুব কোথাকার! তুই জানিস না বইয়ের ভেতর দিয়ে চিঠি চালাচালি হয়?
মামুন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও অবশ্যি ভেতরে কোনো চিঠি খুঁজে পেল না। মনে হলো সে জন্য খুবই বিরক্ত হলো।
.
লতিফা বুবু বইটা পেয়ে খুবই খুশি হলো। আমরা কোথা থেকে বইটা পেয়েছি জানতে চাইল, আমরা তখন মাসুদ ভাইয়ের কথা বললাম। মাসুদ ভাই যে শহীদ মিনার তৈরি করেছেন সেটাও বললাম, শহীদ মিনার যে কয়েকটা বাঁশের খাম্বা পুঁতে তৈরি করা হয়েছে সেটা অবশ্যি আর বললাম না! শহীদ মিনারের কথা শুনে লতিফা বুবু খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠল। বলল, আমাকে দেখাবি?
তুমি যাবে? স্কুলের মাঠের কোনায় তৈরি, এখনো রং দেওয়া হয় নাই। রং দিলে একেবারে চিনতেই পারবে না।
কী রং দিবি?
মামুন গম্ভীর হয়ে বলল, সাদা। শহীদ মিনার সব সময় সাদা হয়।
আমি বললাম, তুমি যদি যেতে চাও একুশে ফেব্রুয়ারিতে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি। খালি পায়ে যেতে হবে কিন্তু। প্রভাতফেরিতে সব সময়ে খালি পায়ে যেতে হয়।
খালি পা লতিফা বুবুর জন্য সমস্যা না–খালা-খালু হচ্ছে সমস্যা। খালা-খালু লতিফা বুবুকে এখন ঘর থেকেই বের হতে দেয় না।
একুশে ফেব্রুয়ারি যতই এগোতে লাগল আমাদের উত্তেজনা ততই বাড়তে লাগল। যাদের গানের গলা আছে তাদেরকে নিয়ে মাসুদ ভাই প্রভাতফেরির গান শেখাতে লাগল। মাসুদ ভাই কীভাবে কীভাবে জানি স্কুলের স্যারদেরকেও প্রভাতফেরি করতে রাজি করিয়ে ফেলেছে। পুরনো খবরের কাগজের ওপর কালো কালিতে একুশে ফেব্রুয়ারির উপর পোস্টার লেখা হলো, আমরা সেগুলো সারা গ্রামে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিলাম। সেই ইলেকশনের সময় গ্রামে একটু হইচই হয়েছিল তারপর এতদিনে আর কিছু হয় নাই। তাই গ্রামের লোকজন মনে হয় বেশ আগ্রহ নিয়েই ব্যাপারটা দেখল। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু ইলেকশনে সবগুলো সিট পাওয়ার পর সারা দেশেই একটু জয় বাংলা জয় বাংলা ভাব। আমাদের কাঁকনডুবিতেও একই অবস্থা। বিশ তারিখ রাত্রি বেলা ঘুমানোর আগে আমি নানিকে বললাম, নানি আমাকে খুব সকালে ঘুম থেকে তুলে দিবা।
নানি মুখের মাঝে একটা পান ঢুকিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, তুই সকালে ঘুম থেকে উঠবি? এই কথা তুই আমারে বিশ্বাস করতে বলিস? বেলা হওয়ার পরেও তোরে ঠেলা দিয়ে ঘুম থেকে তোলা যায় না–তুই উঠবি অনেক সকালে!
নানি কালকে প্রভাতফেরিতে যেতে হবে–একেবারে অন্ধকার থাকতে প্রভাতফেরি শুরু হবে।
নানি হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, তোরা কি চোর নাকি যে অন্ধকার থাকতে বের হবি?
আমি বললাম, নানি কালকে একুশে ফেব্রুয়ারি, শহীদ মিনারে ফুল দিতে হবে।
ফুল দিলে দিবি। তয় অন্ধকারে কেন?
সেইটা আমি জানি না। যেটার যে নিয়ম।
ফুল পাবি কই?
আমাদের কাঁকনডুবি গ্রামে কেউ ফুলগাছ লাগায় না। বনে জঙ্গলে কিছু জংলি ফুল আছে। কাজীবাড়ির সামনে কিছু ফুলগাছ আছে, বিকেল বেলা দেখে এসেছি। অন্ধকার থাকতে বের হওয়ার সেইটাই হচ্ছে আসল কারণ, সেখান থেকে ফুল চুরি করতে হবে। মহৎ কাজের জন্য এই রকম ছোটখাটো চুরিচামারি করলে দোষ হয় না। নানিকে অবশ্যি সেইটা বললাম না, হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভান করলাম।
বিছানায় ঢুকে কাঁথা গায়ে দিয়ে নানিকে বললাম, মনে আছে তো নানি? একেবারে শেষরাতে তুলে দেবে?
নানি বলল, মনে আছে।
ঘড়ির টাইমে সকাল পাঁচটা।
নানি দাঁত বের করে হাসল, কাঁকনডুবি গ্রামে কারো বাড়িতে কোনো ঘড়ি নাই! আমরা কেউ ঘড়ির সময়ে চলি না। তাই সকাল পাঁচটার কোনো অর্থ নাই!
ভোর রাতে সত্যি সত্যি নানি আমাকে তুলে দিল। সকালে ঘুম থেকে ওঠা আমার জন্য খুবই কঠিন একটা কাজ কিন্তু আজকে চট করে আমার ঘুম ভেঙে গেল। জানালার ঝাপিটা সরিয়ে বাইরে তাকালাম অন্ধকার কেটে ফরসা হতে শুরু করেছে। আমি তখন লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। দেরি করা ঠিক হবে না, আলো হয়ে গেলে ফুল চুরি করা কঠিন হয়ে যাবে।
আমি বালিশের নিচে ভাজ করে রাখা শার্টটা পরে নানিকে বললাম, নানি আমি গেলাম।
গেলি মানে কী? মুখে চাইরটা ভাত দিয়া যা।
না নানি। ভাত খাওয়ার সময় নাই।
হাত-মুখ ধুয়ে যা।
মসজিদের সামনে কলের পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নেব।
একটু মুড়ি খেয়ে যা–খিদা লাগবে তো।
দেও দেও নানি। তাহলে মুড়ি দেও তাড়াতাড়ি।
আমি অবশ্যি মুড়ি খেয়ে সময় নষ্ট করলাম না, দুই পকেট ঠেসে মুড়ি ভরে নিলাম, যেতে যেতে খাওয়া যাবে। ঘর থেকে বের হবার সময় নানি হাতে একটা কলা ধরিয়ে দিল।
আবছা অন্ধকারে আমি ছুটতে ছুটতে কাজীবাড়িতে হাজির হলাম। এই বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই দেশবিদেশে থাকে। বাসায় বেশি মানুষ নাই–যারা আছে তাদের কেউ নিশ্চয়ই এত সকালে ঘুম থেকে ওঠেনি কিন্তু আমি যেই বাড়ির সামনে বেড়াটা টপকে ভেতরে ঢুকেছি, তখনই একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। আমি কুকুরের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম–ডাকাডাকি করে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙিয়ে দিলেই সমস্যা। আমি চাপা গলায় তু তু করে কুকুরটাকে ডাকলাম, সে তখন খুব ভালো মানুষের মতো লেজ নাড়তে নাড়তে আমার কাছে এগিয়ে এল, আমি তখন তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলাম। কাঁকনডুবি গ্রামের সবাই সবাইকে চেনে– মানুষকেও চেনে,গরু-ছাগল-কুকুরকেও চেনে।
আমি সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ডাঁটাসহ কয়েকটা ফুল ভেঙে নিলাম, অন্ধকারে ফুলের রং বোঝা যায় না কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। শহীদ মিনারে কী রঙের ফুল দেয়া যায় তার নিশ্চয়ই কোনো নিয়ম নাই। কুকুরটা আমার পাশে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল, তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় সে ফুল চুরির ব্যাপারে আমাকে আরো সাহায্য করতে পারছে না বলে লজ্জিত এবং দুঃখিত!
আমি দেরি না করে ফুলগুলো হাতে নিয়ে আবার ছুটতে থাকি, কুকুরটা আমাকে সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। সড়কটাতে উঠে পকেট থেকে এক খাবলা মুড়ি বের করে চিবুতে লাগলাম। হিন্দুপাড়ার মুড়ি, খুবই মচমচে। খাওয়ার আগে দাঁত মেজে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়ার কথা, একদিন পরের কাজটা আগে আর আগের কাজটা পরে করলে কোনো দোষ নাই। সড়কটাতে কোনো মানুষজন নাই, মসজিদের কাছে এসে কয়েকজন মুসল্লিকে পেলাম, ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি যাচ্ছে। আমাকে দেখে একজন জিজ্ঞেস করল, এইটা কেডা? রঞ্জু না?
আমি বললাম, জি চাচাজি।
এত সকালে কই যাস?
প্রভাতফেরিতে।
সেইটা আবার কী জিনিস?
প্রভাতফেরি বিষয়টা কেমন করে বোঝাব চিন্তা করছিলাম। তখন পাশের মানুষটা বুঝিয়ে দিল, পোলাপানের কাম। স্কুলে মনে হয় ভ্যারাইটি শো হবি, তাই না রে?
আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলাম। এই মুরব্বিদের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন। মসজিদের সামনে টিউবওয়েলের পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে আমি আবার স্কুলের দিকে রওনা দিলাম। স্কুলের কাছাকাছি এসে দেখি এর মাঝে অনেকেই হাজির হয়ে গেছে। আবছা অন্ধকারে সবাইকে চেনা যায় না, শুধু আলাউদ্দিন চাচাকে চিনতে পারলাম। একটা গ্রামে যে রকম একজন পাগল থাকে আর একজন ফালতু মানুষ থাকে ঠিক সে রকম একজন গায়কও থাকে। আলাউদ্দিন চাচা আমাদের কাঁকনডুবির গায়ক। তার লম্বা ঝাঁকড়া চুল সেই চুলে ঝাঁকুনি দিয়ে যখন গানে টান দেয় সবাই তখন টাশকি মেরে যায়। আলাউদ্দিন চাচা কালী গাংয়ে খেয়া পারাপার করে। নিশুতি রাতে আমরা শুনি কালী গাংয়ের মাঝখান থেকে আলাউদ্দিন চাচা গান ধরেছে। আলাউদ্দিন চাচার সংসারে মন নাই, সেই জন্য বাড়িতে খুব অশান্তি। আজকে অবশ্যি আলাউদ্দিন চাচার ভাবভঙ্গিতে কোনো অশান্তির চিহ্ন নাই, একটা হারমোনিয়াম গামছা দিয়ে বেঁধে ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়েছে, তার মাঝে খুবই উৎসাহ, দেখে মনে হয় আলাউদ্দিন চাচা অনেক দিন পরে একটা মনের মতো কাজ পেয়েছে।
মাসুদ ভাই খুব ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছিল, আমাকে দেখে বলল, রঞ্জু, এসেছ। এই যে কালো ব্যাজ, সবাইকে লাগিয়ে দাও দেখি।
কালো ব্যাজ কেন পরতে হবে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মাসুদ ভাই নিজে আমাকে এত বড় কাজ দিয়েছে, গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল। আমি আমার ফুলগুলো বগলে চেপে মাসুদ ভাইয়ের হাত থেকে অনেকগুলো কালো ব্যাজ আর আলপিন নিয়ে সবার বুকে লাগানো শুরু করলাম।
আস্তে আস্তে অন্ধকার কেটে আলো ফুটে উঠতে লাগল, স্কুলের আরো ছেলেরা আসতে শুরু করল। শুধু ছেলেরা নয়, স্কুলের কয়েকজন মেয়েও চলে এসেছে, আমি নীলিমাকেও দেখতে পেলাম।
মাসুদ ভাই তখন আমাদের সবাইকে দুই লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। লাইনের সামনে আলাউদ্দিন চাচা তার সাথে আরো কয়েকজন, মাসুদ ভাই এই কয়েক দিন তাদের গান শিখিয়েছে। আলাউদ্দিন চাচা তখন তার মোটা গলায় গাইতে শুরু করল, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি! গানটা খুবই সোজা ঘুরেফিরে এই দুইটা লাইনই গাইতে হয় তাই একটু পরে আমরাও যোগ দিলাম, আমাদের গলায় কোনো সুর নাই কিন্তু তাতে সমস্যা কী?
আমাদের স্কুল খুবই কাছে কিন্তু মাসুদ ভাই আমাদেরকে নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল, পুরো গ্রাম ঘুরে এসে তারপরে আমাদের স্কুলের শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া হবে। খুবই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমরা সবাই ফুলগুলো হাতে ধরে রেখে আস্তে আস্তে হাঁটছি। যে যে রকম পারি সে রকম আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি গাইছি। আমার পাশেই মামুন সে হঠাৎ গান থামিয়ে আমাকে ডাকল, এই রঞ্জু।
কী?
তুই ফুল না এনে গাছের পাতা এনেছিস কেন?
আমি আমার হাতের দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি আমার হাতে কোনো ফুল নাই, শুধু কিছু পাতা। অন্ধকারে ফুল মনে করে আমি কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে এনেছি! আমি এদিক-সেদিক তাকালাম, সবার হাতেই কোনো না কোনো ফুল, শুধু আমার হাতে গাছের পাতা! নিজেকে বেকুবের মতো লাগছিল কিন্তু কী আর করব, শুধু গাছের পাতা নিয়েই হাঁটতে থাকলাম। পাজি মামুনটা ঘুরে ঘুরে সবাইকে বলতে লাগল, দেখ দেখ। রঞ্জুটা কী গাধা, ফুল না এনে কয়েকটা গাছের পাতা নিয়ে এসেছে। সবাই আমাকে দেখে হি হি করে হাসতে লাগল, আমি শুধু গম্ভীর হয়ে বললাম, ভালো হবে না কিন্তু। শহীদ দিবসে হাসাহাসি করছিস তোদের লজ্জা করে না? মাসুদ ভাইকে বলে দেব কিন্তু।
শহীদ দিবসে হাসাহাসি করা ঠিক হবে না ভেবে তখন সবাই অবশ্যি হাসাহাসি থামিয়ে মুখ গম্ভীর করে ফেলল।
আমরা গ্রামের সড়ক ধরে একেবারে শেষ পর্যন্ত গিয়ে হিন্দুপাড়াটা ঘুরে ফিরে এলাম। আমাদের গান শুনে সবাই বাড়ির ভেতর থেকে বের হতে লাগল। বাড়ির বউ-ঝিরা উঁকি দিয়ে আমাদের দেখতে লাগল। মজা দেখার জন্য ছোট ছোট বাচ্চারা আমাদের সাথে সাথে হাঁটতে লাগল। অনেকেই আমাদের প্রভাতফেরিতে যোগ দিতে লাগল। ফালতু মতির বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় আমরা মতিকে দেখলাম, সে একটা দাঁতন দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি ধরে রেখে তাদের বাংলাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি যখন মতির দিকে তাকালাম তখন মতি পিচিক করে মাটিতে থুতু ফেলল। আমরা যখন লতিফা বুবুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম লতিফা বুবুও বাড়ির ভেতর থেকে বাইরে এসে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের দেখে লতিফা বুবু হাত নাড়ল, আমরাও তখন জোরে জোরে হাত নাড়তে থাকলাম।
আমাদের প্রভাতফেরি যখন আমাদের স্কুলের শহীদ মিনারে এসে পৌঁছেছে তখন বেশ রোদ উঠে গেছে। শহীদ মিনারটাকে চুনকাম করে সাদা রং করা হয়েছে, ঠিক মাঝখানে লালসালু দিয়ে তৈরি গোল সূর্য। আসল শহীদ মিনার আমি দেখি নাই কিন্তু আমাদেরটা থেকে সেটা বেশি সুন্দর হবে বলে মনে হয় না।
শহীদ মিনারে গিয়ে সবাই একে একে ফুল দিতে লাগল। আমার হাতে ফুল নাই শুধু গাছের পাতা, তাই আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মাসুদ ভাই তখন শহীদ মিনারের বেদিতে আলাউদ্দিন চাচা আর অন্যদের বসার ব্যবস্থা করছিল, আমি তখন তার সাথে কথা বলার ভান করে বেদিতে উঠে খুবই সাবধানে আরেকজনের দেওয়া কয়েকটা ফুল তুলে নিলাম। একই দিনে দ্বিতীয়বার চুরি করতে হলো–মহৎ কাজে ছোটখাটো চুরিচামারি করলে কোনো দোষ হয় না।
তবে সমস্যা হলো মামুনকে নিয়ে, আমি যখন ফুল হাতে নিয়ে বেদির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখন সে চিৎকার করে উঠল, এই রঞ্জু। তুই এই ফুল কোথায় পেয়েছিস? নিশ্চয়ই চুরি করেছিস?
আমি বললাম, খবরদার কথা বলবি না। চুপ করে থাক। না হলে দাঁত ভেঙে দেব।
মামুন চুপ করে থাকত কি না জানি না, কিন্তু শহীদ দিবসে ঝগড়া করা ঠিক হবে না মনে করেই হয়তো শেষ পর্যন্ত চুপ করে রইল।
মাসুদ ভাই আমাদের সবাইকে শহীদ মিনারের সামনে বসিয়ে দিল। স্কুলের স্যারেরা বেদির উপরে বসলেন, তারপর বক্তৃতা শুরু হলো। স্যারদের বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস নাই তাই যার যা কিছু মনে আসে বলে গেলেন। চিকা স্যারের বক্তৃতাটা আমরা সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলাম, শুনলাম বলা ভুল হবে, বলা উচিত দেখলাম। তার কারণ বক্তৃতা দিতে দিতে স্যার কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগলেন, তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল, মুখে কেমন যেন ফেনা জমে গেল এবং স্যার কেমন যেন মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে শুরু করলেন। তখন অন্য কয়েকজন স্যার চিকা স্যারকে টেনে এনে বসিয়ে দিলেন। চিকা স্যার বসে থেকেই কেমন যেন তিরতির করে কাঁপতে থাকলেন। সবার শেষে বক্তৃতা দিলেন মাসুদ ভাই, বক্তৃতাটা পুরো বুঝতে পারলাম না, দেশের খুব বড় ঝামেলা হচ্ছে, সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কিছু একটা করে ফেলতে হবে, এ রকম কিছু কথা বলল কিন্তু কী করতে হন্ধে আমরা বুঝতে পারলাম না।
বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর গান শুরু হলো। আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা কয়টা গান গাইল। আমাদের ক্লাসের নীলিমাও একটা গান গেয়ে শোনাল, সে যে গান গাইতে পারে, আমরা কেউই জানতাম না। সবার শেষে গান গাইল আমাদের আলাউদ্দিন চাচা–পকেট থেকে মুড়ি বের করে চিবুতে চিবুতে আমি গান শুনতে লাগলাম, কী সুন্দর সেই গান, সেটা আর বলে বোঝানো যাবে না।
সব মিলিয়ে আমাদের ছোট কাঁকনডুবি গ্রামের সেই একুশে ফেব্রুয়ারিটা ছিল বিশাল একটা ঘটনা। ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু আমাদের সবারই মনে হতে লাগল আমরা বুঝি একটুখানি হলেও বড় হয়ে গেছি। মনে হতে লাগল এই যে কাঁকনডুবি গ্রাম, এখানকার গাছপালা, নদী–রাস্তা তার বাইরেও বড় কিছু একটা আছে। দেশ কথাটা আগে কতবার শুনেছি, কিন্তু সেটা কী আগে বুঝতে পারিনি, কেন যেন মনে হতে লাগল দেশ ব্যাপারটা একটু একটু বুঝতে পারছি। কার সাথে এটা নিয়ে কথা বলা যায় আমি শুধু সেটা বুঝতে পারলাম না।
.
০৫.
সোমবার স্কুল থেকে বের হয়েই টের পেলাম কিছু একটা হয়েছে কিন্তু কী হয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম না। মানুষজনের মাঝে একধরনের উত্তেজনা, নিজেরা কথা বলছে এবং খুবই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ছে, আমরা ছোট বলে কেউ আমাদের পাত্তা দেয় না। তাই ব্যাপারটা কী ঘটেছে কেউ আমাদেরকে বলছে না। ইলেকশনের পর যখন নৌকা মার্কা বলতে গেলে সবগুলো সিট পেয়ে গেল সেই দিন সারা গ্রামের মানুষের মাঝে এ রকম উত্তেজনা ছিল–কিন্তু সেই উত্তেজনাটা ছিল আনন্দের উত্তেজনা। আজকের উত্তেজনাটা কেমন যেন রাগী রাগী উত্তেজনা–মনে হয় ঢাকা শহরে বড় কিছু ঘটে গেছে।
আমি আর মামুন তাড়াতাড়ি হেঁটে বলাই কাকুর চায়ের স্টলের দিকে রওনা দিলাম, আর কেউ কিছু আমাদের না বললেও বলাই কাকু নিশ্চয়ই আমাদের বলবে।
বলাই কাকুর চায়ের স্টলে গিয়ে দেখি সেখানে অনেক ভিড়, বলাই কাকুর রেডিওটা চলছে আর সবাই খবর শোনার চেষ্টা করছে। মাসুদ ভাইও সেখানে আছে তার মুখটা কেমন জানি থমথম করছে, দুই আঙুলের ফাঁকে একটা সিগারেট, একটু পর পর সেটা টানছে।
ভিড় ঠেলে আমি মাসুদ ভাইয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মাসুদ ভাই, কী হয়েছে?
মাসুদ ভাই রাগী রাগী গলায় বলল, যেটা সন্দেহ করেছিলাম বদমাইসগুলি তাই করেছে।
কোন বদমাইশগুলি? কী করেছে?
পরশু দিন পার্লামেন্ট বসার কথা–ইয়াহিয়া খান আজকে বন্ধ করে দিয়েছে। সারা দেশে আগুন ধরে গেছে।
এখন কী হবে?
জানি না। বঙ্গবন্ধু হরতাল ডেকেছে।
বলাই কাকু কাঁপা গলায় বলল, রেডিও পাকিস্তানে কিছু বলে না, বিবিসি শুনতে হবে।
মাসুদ ভাই বলল, ফার্মগেটে মিলিটারি গুলি করে অনেক পাবলিক মেরে ফেলেছে।
একজন বলল, কত বড় সাহস।
বলাই কাকু বলল, শুধু ঢাকাতে না, খুলনা, যশোর, চিটাগাং সব জায়গায় গোলাগুলি হয়েছে। কারফিউ দিয়ে রেখেছে।
কারফিউ কথাটা শুনলেই ভয় লাগে। কারফিউয়ের সময় বের হলেই গুলি। কী ভয়ানক।
মাসুদ ভাই মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলল, এটা হতে পারে না, কিছুতেই হতে পারে না।
বলাই কাকুর চায়ের দোকানে তখন সবাই কথা বলতে লাগল, টেবিলে থাবা দিতে লাগল। বলাই কাকু চিন্তিত মুখে চা বানাতে লাগলেন, টেবিলে টেবিলে চা দিতে লাগলেন। আজকে আর আমাদের ফ্রি চা খাওয়ার কোনো আশা নাই, আমরা তাই আর অপেক্ষা না করে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
বাড়িতে এসে দেখি নানি উঠান ঝাড় দিচ্ছে। মানুষ বুড়ো হলে শুয়ে বসে থাকে, একটু আরাম করার চেষ্টা করে। নানি হচ্ছে তার উল্টো, সারাক্ষণই কাজ করছে–যখন কোনো কাজ থাকে না তখনো কীভাবে কীভাবে জানি কাজ আবিষ্কার করে ফেলে। আমাকে দেখে নানি অবাক হবার ভান করে বলল, কী ব্যাপার! আজকে লাট সাহেব এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে? ব্যাপারটা কী?
আমি মুখ গম্ভীর করে বললাম, নানি, দেশে খুব বড় বিপদ।
কী বিপদ?
ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে।
কী বন্ধ করে দিয়েছে?
পার্লামেন্ট।
সেইটা আবার কী?
সেইটা কী, আমি নিজেও জানি না তাই আলাপটা অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করলাম, বললাম, বঙ্গবন্ধু খুবই রাগ, হরতাল ডেকেছেন।
হরতাল আবার কী?
হরতাল জিনিসটা কী আমরা শিখে গেছি, তাই নানিকে বোঝালাম, হরতালের সময় কোনো গাড়ি-ঘোড়া চলে না, দোকানপাট খোলে না, সবকিছু বন্ধ থাকে–
নানির মুখে যা একটু দুশ্চিন্তার ভাব এসেছিল এবারে সেটা পুরোপুরি কেটে গেল। বলল, আমাগো কাঁকনডুবিতে গাড়ি-ঘোড়াও নাই, দোকানপাটও নাই, হরতাল হলে কী আর না হলেই কী?
নানি আবার উঠান ঝাড় দিতে যাচ্ছিল তখন আমি বললাম, সারা দেশে কারফিউ। মিলিটারি গুলি করে অনেক মানুষ মারছে। অনেক গোলমাল।
এইবারে নানির মুখের মাঝে একটা দুঃখের ছায়া পড়ল। একটু মাথা নেড়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আহারে। কার বুকের ধন, কে জানি কাইড়া নিল! ইশ রে!
আমি বইগুলো ঘরের ভেতর বিছানার উপরে রেখে বাইরে এলাম। নানি আবার গভীর মনোযোগ দিয়ে উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। ঝাড়ু দিতে দিতে কথা বলছে, একা একা যতক্ষণ ছিল কথা বলে নাই, এখন আমি এসেছি আর সাথে সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। এখন কথাগুলো হচ্ছে অভিশাপ আর গালি, যে মিলিটারিগুলো গুলি করে দেশের মানুষ মারছে তাদেরকে গালি, তোরা মর। তোরা গুষ্টি নিয়ে মর। মরে নির্বংশ হ। মুখে রক্ত উঠে মর–মরে দোজখে যা, জাহান্নামের আগুনে পুড়ে মর–
নানির গালিগুলো খুবই শক্তিশালী, নিঃশ্বাস না ফেলে নানি টানা গালি দিয়ে যেতে পারে, শুনতে খুবই ভালো লাগে।
বাড়িতে মন টিকছিল না বলে ভাত খেয়ে আবার বের হলাম। দুপুরের উত্তেজনাটা একটু কমেছে, পার্লামেন্ট বন্ধ করে দেবার পর বঙ্গবন্ধু কী বলেন সবাই এখন সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি একা একা কাঁকনডুবি গ্রামের ভেতর হেঁটে বেড়ালাম। ঠিক কী কারণ জানি না ভেতরে ভেতরে একটু অস্থির লাগছিল।
.
পরের কয়েকটা দিন খুবই উত্তেজনার মাঝে কাটল। তার কারণ মাসুদ ভাই আমাদেরকে জানাল বাংলাদেশ প্রায় হয়েই গেছে। বাংলাদেশের একটা ফ্ল্যাগ তৈরি করা হয়েছে সেটা এখন সারা দেশে উড়ছে। নূতন একটা দেশ হলে ফ্ল্যাগের সাথে সাথে একটা জাতীয় সঙ্গীত লাগে, সেটাও হয়ে গেছে। আমার সোনার বাংলা বলে নাকি রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে, সেটা হচ্ছে জাতীয় সঙ্গীত। এত কষ্ট করে মাত্র পাক সার জমিন সাদ বাদ গানটা শিখেছি এখন আবার নূতন করে সোনার বাংলা গানটা শিখতে হবে! নীলিমা মনে হয় এখনই সেটা জানে। বাংলাদেশ যে হয়েই গেছে তার আরও প্রমাণ আছে, আগে বলত রেডিও পাকিস্তান ঢাকা এখন বলে ঢাকা বেতার কেন্দ্র। আমি মাসুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম রেডিও বাংলাদেশ কেন বলে না, মাসুদ ভাই বলল যে এখনো বাংলাদেশের আসল ঘোষণাটা দেওয়া হয় নাই, সেই জন্য রেডিও বাংলাদেশ বলছে না। বঙ্গবন্ধু ৭ তারিখে ঢাকার রেসকোর্সের ময়দানে বাংলাদেশের ঘোষণা দেবেন তখন থেকে পুরোপুরি বাংলাদেশ হয়ে যাবে। আমার ভেতরে একই সাথে একধরনের আনন্দ উত্তেজনা আর ভয় কাজ করতে লাগল। যখন আশপাশে কেউ নেই তখন মাসুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ৭ তারিখে বাংলাদেশের ঘোষণা দিলে মিলিটারিরা আক্রমণ করবে না? ইয়াহিয়া খান এমনি এমনি মেনে নেবে?
মাসুদ ভাই তখন প্রথমে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর একটু মাথা চুলকে বলল, মেনে নেওয়ার কথা না। কিন্তু পুরো দেশটা এখন চলছে বঙ্গবন্ধুর কথায়। সারা দেশে এখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে কোথাও পাকিস্তানের পতাকা নাই। মিলিটারি কী করবে? তবে–
তবে কী?
দরকার হলে মিলিটারির সাথে যুদ্ধ করার জন্যও সবাই রেডি হচ্ছে। সব জায়গায় ছেলেমেয়েরা যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে।
উত্তেজনায় আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল, জিজ্ঞেস করলাম, আমরা ট্রেনিং নেব না?
মাসুদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, আমার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, যুদ্ধ হচ্ছে বড়দের ব্যাপার। বড়রা ট্রেনিং নেবে! তোমরা ছোট।
আমার একটু মন খারাপ হলো, মাসুদ ভাই আমাকে বিশ্বাস করছে না কিন্তু ঠিকই আমি ট্রেনিং নিতে পারব। লেখাপড়ায় আমি সুবিধা করতে পারি না কিন্তু দৌড়ঝাঁপ সাঁতার মারামারিতে আমার ধারে-কাছে কেউ নাই। যুদ্ধ তো এক রকম মারামারিই হাতে না করে বন্দুক দিয়ে করবে এই পার্থক্য।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বড়দের ট্রেনিং কি হবে?
চেষ্টা করছি। আমি তো মিলিটারি ট্রেনিং দিতে পারব না। মিলিটারি ট্রেনিং দিতে দরকার মিলিটারি মানুষ। শুনেছি পাশের এক গ্রামে একজন রিটায়ার্ড ইপিআর সুবেদার আছে তাকে নিয়ে আসব ভাবছি।
সব গ্রামে একজন পাগল একজন ফালতু মানুষ আর একজন গায়ক থাকে। কিন্তু সব গ্রামে রিটায়ার্ড ইপিআর সুবেদার থাকে না কোনো কোনো গ্রামে থাকে। আমাদের কাঁকনডুবিতে নাই।
আস্তে আস্তে আমাদের কাঁকনডুবিতে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। মার্চের ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়ে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ করে দেবেন সেই জন্য সবাই অপেক্ষা করে আছি। দেশের মানুষ অবশ্যি থেমে নেই, সব জায়গায় মিছিল করছে, পাকিস্তান মিলিটারি গুলি করে এখানে-সেখানে মানুষ মারছে। সেই জন্য বঙ্গবন্ধু রেগে আগুন হয়ে আছেন।
বলাই কাকুর চায়ের স্টলে গিয়ে একদিন আরেকটা ভয়ংকর খবর পেলাম, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মানুষটা পাঞ্জাবি হলেও নাকি ভালোই ছিল এখন তাকে সরিয়ে সেখানে টিক্কা খান নামে একটা জল্লাদকে বসিয়েছে। এই জল্লাদ তাদের দেশে এত মানুষ গুলি করে মেরেছে যে তাকে নাকি কসাই টিক্কা বলে ডাকে।
বলাই কাকুর চায়ে চুমুক দিতে দিতে একজন বলল, টিক্কা খানের চেহারা নাকি জানোয়ারের মতো, চোখ দুইটা সব সময় লাল।
আরেকজন বলল, গায়ের রং নিশ্চয়ই কুচকুচে কালো তা না হলে নাম টিক্কা কিসের জন্য।
কথাটাতে যুক্তি আছে, গ্রামের মানুষ হুঁকো খাওয়ার সময় যে টিকেতে আগুন জ্বালায় সেটা আসলেই কুচকুচে কালো। সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল।
আরেকজন বলল, তামুক খাওয়ার সময় টিক্কার পেছনে আমরা আগুন দিই না? এই টিক্কার পেছনেও আগুন দিয়ে তারে দেশ থেকে তাড়াতে হবে।
খুব ভালো একটা রসিকতা হয়েছে চিন্তা করে সবাই আনন্দে হা হা করে হাসল। আমাদের গ্রামের মানুষ খুবই সাদাসিধা ধরনের তারা অল্পতেই হাসে আবার অল্পতেই রেগে যায়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ তারিখের ভাষণটা রেডিওতে শোনাবে, সেই জন্য আমরা সেই দুপুর থেকে বলাই কাকুর চায়ের স্টলে হাজির হলাম। বলাই কাকু ছাড়াও যাদের বাড়িতে রেডিও আছে সেখানে সবাই ভিড় করল। ভাষণ শুরু হবার আগে একজন রেসকোর্সের বর্ণনা দিচ্ছে, সে বলল সেখানে নাকি কমপক্ষে বিশ লক্ষ মানুষ আছে। বিশ লক্ষ মানুষ! কী সাংঘাতিক ব্যাপার। এর আগে কি পৃথিবীর কোনো দেশে একটা ভাষণ শুনতে বিশ লক্ষ মানুষ হয়েছে? আকাশে হেলিকপ্টার উড়ছে। মিলিটারির হেলিকপ্টার, তাদের আবার কোনো বদ মতলব নাই তো?
ঠিক যখন ভাষণ শুরু হতে যাবে তখন রেডিও থেকে প্রচার বন্ধ করে দিল। যারা হাজির ছিল প্রথমে সবাই রেগে চিৎকার করে উঠল, তখন একজন বলল, রেসকোর্সে কিছু হয় নাই তো? মিলিটারি আক্রমণ করে নাই তো?
তখন সবাই কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল। সত্যিই তো রেসকোর্সে মিলিটারি আক্রমণ করে নাই তো? বঙ্গবন্ধুর কিছু হয় নাই তো?
বলাই কাকু তাড়াতাড়ি রেডিওর নব ঘুরিয়ে অন্যান্য স্টেশনে কী বলে শোনার চেষ্টা করলেন, আকাশবাণীতে শুনলেন, সবকিছু শুনে বুঝলাম বঙ্গবন্ধুর কিছু হয় নাই, শুধু পাকিস্তানিরা তার ভাষণটা প্রচার করতে দিচ্ছে না। রাগে আমার গা জ্বলে গেল! এই মুহূর্তে ঢাকার রেসকোর্সে যে বিশ লক্ষ মানুষ আছে শুধু তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটা শুনতে পাচ্ছে, আমরা কেউ শুনতে পাচ্ছি না।
বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি ছটফট করে বেড়ালাম, রাত্রিবেলা খবর পেলাম বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে নাকি এমন একটা ভাষণ দিয়েছেন যে রকম ভাষণ সারা পৃথিবীতে আগে কেউ কখনো দেয় নাই পরেও কেউ কখনো দেবে না! আজকে থেকে পূর্ব পাকিস্তান হচ্ছে বাংলাদেশ সেই কথাটা বলেন নাই কিন্তু পরিষ্কার বলে দিয়েছেন এই সংগ্রামটা এখন স্বাধীনতা সংগ্রাম! সবাইকে বলেছেন দরকার হলে যার কাছে যেটা আছে, সেটা নিয়েই যুদ্ধ করতে হবে। পাকিস্তানিরা এইটা মানতেও পারছে না, আবার কিছু করতেও পারছে না।
আমি যখন রাত্রে বাড়ি এসেছি তখন নানি পারলে আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলে। চিৎকার করে হাত-পা নেড়ে বলতে লাগল, ওরে আমার লবাবের বাচ্চা, দেখো কত রাতে বাড়িতে আসে–
আমি বললাম, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটা শুনতে চাচ্ছিলাম–
তুই ভাষণ শুনবি? আগে আমার ভাষণ শোন! দিন নাই, রাত নাই ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াবি, আমি বুড়া মানুষ আজকে আছি, কালকে নাই–আমার উপরে তোর মায়া-দয়া নাই? তোর বাপ-মা এইটা কেমন করে করল? আমার কাছে তোর দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল। আমি তোরে কেমন করে মানুষ করব? তোর নাকে টিপলে দুধ বের হবে আর তুই মাঝরাত্রে বাড়ি ফিরে আসিস, যত দিন যায় তত জংলি হয়ে বড় হচ্ছিস–
আমি বললাম, বেশি রাত হয় নাই নানি। কাজীবাড়ির ঘড়িতে দেখে আসছি মাত্র আটটা–
আমারে তুই ঘড়ির টাইম শুনাবি? আর কী শুনাবি তুই? আয় তুই কাছে, যদি তোর কান আজকে টেনে ছিঁড়ে না ফেলি।
নানির রাগ বেশিক্ষণ থাকে না, তাই আমি মুখের মাঝে একটা কাঁচুমাচু ভাব করে নানির কাছাকাছি ঘুরঘুর করতে লাগলাম। নানি টানা চিৎকার করতে লাগল, আমি ধৈর্য ধরে শুনতে লাগলাম। নানির চিৎকার শুনতে আমার ভালোই লাগে!
.
এর পরের দিনগুলো কেমন যেন অস্থির অস্থিরভাবে কেটে যেতে লাগল। এমনিতে কাঁকনডুবি গ্রামটা দেখে বোঝারই উপায় নাই সারা দেশে কত কী ঘটে যাচ্ছে। টিক্কা খানকে গভর্নর বানিয়েছে কিন্তু হাইকোর্টের জজ তাকে শপথ পড়াতে রাজি হন নাই, তাই টিক্কা খান নাকি মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে বলেছে বঙ্গবন্ধু যেন এখনই কিছু না করে ফেলেন–সে বঙ্গবন্ধুর সাথে মীমাংসা করার কথা বলতে আসছে। শুধু ইয়াহিয়া খান না পশ্চিম পাকিস্তানে ইলেকশনে জিতেছে যে মানুষ–জুলফিকার আলী ভুট্টো সেও আসছে। আমি অবশ্যি ভেবে পাই না একজন মানুষের নাম ভুট্টো হয় কেমন করে? ভুট্টা কিংবা ভুট্টো যদি নাম হতে পারে তাহলে মাষকলাইয়ের ডাল কেন নাম হতে পারে না? জুলফিকার আলী মাষকলাইয়ের ডাল! কেমন লাগে শুনতে?
একদিন খবর পেলাম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইয়াহিয়া খানের সাথে সাথে জুলফিকার আলী ভুট্টো আর ছোট-বড়-মাঝারি অনেক নেতা চলে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে মনে হয় সবার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। একজনের পর আরেকজন বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ করে যাচ্ছে। এত আলাপের কী আছে আমি বুঝি না। ঘাড় ধরে সবগুলোকে আমাদের দেশ থেকে বের করে দিলেই হয়!
একদিন বলাই কাকুর চায়ের স্টলে যখন কেউ নাই, বলাই কাকু তার কাঁচের গ্লাসে বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে আমাকে আধা গ্লাস ফ্রি চা বানিয়ে দিয়েছে তখন আমি চা খেতে খেতে বলাই কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বলাই কাকু, বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সাথে অন্য সবগুলোকে ঘাড় ধরে বের করে দেয় না কেন?
বলাই কাকু হেসে ফেললেন, কেমন করে বের করবেন?
মনে নাই তার ভাষণে বিশ লাখ লোক হয়েছিল! এই বিশ লাখ লোককে অর্ডার দেবেন, বলবেন যাও সবাইকে ঘাড় ধরে বের করে দাও।
বলাই কাকু এবারে হাসলেন না, বললেন, সেই কাজটা বেআইনি হতো। বঙ্গবন্ধু এখন পর্যন্ত একটা বেআইনি কাজ করেন নাই!
তারা বেআইনি কাজ করলে দোষ নাই, প্রত্যেক দিন গোলাগুলি করে, মানুষ মারে তখন কিছু হয় না। আর বঙ্গবন্ধু করলে দোষ?
বলাই কাকু মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ। প্রত্যেক দিনই কিছু না কিছু হচ্ছে। জয়দেবপুরে তো বাঙালিদের সাথে পাকিস্তানিদের একটা যুদ্ধই হয়ে গেল।
কোথায় কোথায় কীভাবে যুদ্ধ হয়েছে আমি জানতাম না, বলাই কাকু সেগুলোর গল্প শোনালেন। সোয়াত নামে একটা জাহাজে করে পাকিস্তানিরা অনেক অস্ত্র এনেছে, সেই অস্ত্র বাঙালিরা নামাতে দিচ্ছে না। যশোর থেকে খুলনায় মিলিটারিদের একটা ট্রেন যাচ্ছিল, সেই ট্রেন বাঙালিরা আক্রমণ করে বসেছে। সারা দেশে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব।
আমাদের কাঁকনডুবিতেও একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব শুরু হয়েছে। পাশের গ্রাম থেকে ইপিআরের সুবেদারকে খুঁজে বের করে মাসুদ ভাই মিলিটারি ট্রেনিং শুরু করেছে। স্কুলের মাঠে বিকেলবেলা ছেলেদের নিয়ে সুবেদার লেফট-রাইট করায়। সুবেদারের কেমন জানি রাগী রাগী চেহারা দেখলে ভয় লাগে। মাসুদ ভাই থানার সাথে যোগাযোগ করেছে তাদের রাইফেলগুলো ধার দেওয়ার জন্য। তাহলে সবাইকে রাইফেল চালানো। শেখাবে। আমরা বিকেলবেলা স্কুলের মাঠে বসে বসে ট্রেনিং দেখি। খুবই সোজা ট্রেনিং। ইচ্ছা করলেই আমরা এই ট্রেনিং নিতে পারি কিন্তু ছোট বলে আমাদের নেয় না। দুঃখে আমার হাত কামড়াতে ইচ্ছা করে।
মাসুদ ভাই বাংলাদেশের একটা পতাকাও তৈরি করে এনেছে। সবুজের মাঝখানে লাল একটা সূর্য, তার ভেতরে হলুদ রঙের পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ–এখন অবশ্যি আমরা কেউ পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ বলি না, বলি বাংলাদেশের ম্যাপ। বাংলাদেশের ম্যাপটা হওয়ার কথা সোনালি রঙের, সোনালি রং পাওয়া ঝামেলা বলে কাছাকাছি হলুদ রং তৈরি করা হয়েছে। বড় পতাকাটা স্কুলের মাঠে টানানো হয়, সবাই যখন লেফট-রাইট করে তখন এই পতাকাটাকে স্যালুট করতে হয়। মাসুদ ভাই বলেছে আরো ছোট ছোট বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ তৈরি করে দেবে, আমরা সেগুলো আমাদের বাড়িতে টানাব। সারা দেশে কারফিউ দিয়ে মানুষজনকে মারছে সেই জন্য বাংলাদেশের পতাকার পাশাপাশি কালো পতাকাও টানাতে হবে। কালো পতাকা বানানো অবশ্যি সোজা, একটা কালো কাপড়কে চারকোনা করে কাটলেই হয়ে গেল, সেই তুলনায় বাংলাদেশের পতাকা অনেক কঠিন। ম্যাপটা বানাতেই বারোটা বেজে যায়। সেটা সেলাই করে লাগানো আরো কষ্ট।
সবকিছু মিলিয়ে চারপাশে অস্থির অস্থির ভাব, কবে যে এই অস্থির ভাবটা শেষ হবে কে জানে।
.
মার্চ মাসের ২৫ তারিখ একটা ভাসা ভাসা গুজব শোনা গেল যে ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলাপ নাকি ভেঙে গেছে। ব্যাপারটা ভালো হলো না খারাপ হলো আমি বুঝতে পারলাম না। বিকেলবেলা স্কুলে যখন মিলিটারি ট্রেনিং হচ্ছে তখন মাসুদ ভাইকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, মাসুদ ভাইও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারল না। ছাত্ররা নাকি সারা ঢাকা শহরে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে যেন মিলিটারি কোথাও যেতে না পারে।
.
রাত্রিবেলা যখন শুয়েছি তখন শুনলাম একটা কুকুর ঠিক মানুষের কান্নার মতো শব্দ করে ডাকছে, শুনে কেমন জানি ভয় করে। নানি বলল, এই অপয়া কুত্তাটা এই রকম করে কান্দে কেন? এই কু-ডাক তো ভালো না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয় এইভাবে ডাকলে?
বিপদের সময় কুত্তারা এইভাবে কান্দে।
কুকুর বিপদের খবর আগে থেকে পায় তার কারণটা কী হতে পারে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম।
গভীর রাত্রে নানি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলল, বলল, এই রঞ্জু ওঠ। তাড়াতাড়ি।
আমি ধড়মড় করে উঠলাম, জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে নানি?
কী যেন হয়েছে। শুনতে পাচ্ছিস না?
আমি কান পেতে শুনলাম, আমাদের বাড়ির সামনে সড়কে মানুষের গলার শব্দ। তার মাঝে একজন কোনো একটা কিছুতে ঠনঠন করে শব্দ করল, তখন মানুষের গলায় শব্দ থেমে গেল, তখন একজন চিৎকার করে কিছু একটা বলতে লাগল। ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না তাই আমি দরজা খুলে ছুটে বাইরে বের হয়ে এলাম, নানি আমাকে থামাল না। নিজেও পেছনে পেছনে বের হয়ে এল।
বাড়ির সড়কে এই মাঝরাত্রেও অনেক ভিড়। একজনের হাতে হ্যারিকেন, সামনে একজনের হাতে একটু কেরোসিনের খালি টিন, মানুষটা এটাতে বাড়ি দিয়ে ঠনঠন শব্দ করে। সবার সামনে আমাদের গ্রামের নজু ভাই। মাসুদ ভাইয়ের মিলিটারি ট্রেনিংয়ে সব সময় থাকে। নজু ভাই চিৎকার করে বলছে, জাগো। গ্রামবাসী জাগো। জাগো দেশবাসী জাগো। জাগো বাঙালি জাগো। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাকিস্তান মিলিটারি ঢাকা শহরে আক্রমণ করেছে। পুলিশ ইপিআর ছাত্র-জনতা তাদের সাথে যুদ্ধ করছে। ঢাকা শহরে এখন ভয়ংকর যুদ্ধ হচ্ছে। এই যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ।
আমার বুকের ভেতরটা জানি কেমন করে উঠল। মানুষগুলো হেঁটে হেঁটে চলে যাবার পরও আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। শুনতে পেলাম দূর থেকে নজু ভাই চিৎকার করে ডাকছে, জাগো দেশবাসী জাগো। জাগো দেশবাসী জাগো!
নানি আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, আয়, ঘরে আয়।
আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, নানি। এখন কী হবে?
নানি উত্তর দেবার আগেই কুকুরটা ঠিক মানুষের কান্নার মতো শব্দ করে ডেকে উঠল। কী ভয়ংকর সেই ডাক।
নানি চাপা গলায় বলল, ফি আমানিল্লাহ! ফি আমানিল্লাহ!