অধ্যায় ৪৯ – বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও উপনিবেশ
খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ থেকে ৭২০ সালের মধ্যে গ্রিসে অলিম্পিক গেমস শুরু হয়। ইতোমধ্যে বাদবাকি গ্রিক শহর ও ইতালিতে রোম শহরের গোড়াপত্তন হয়।
গ্রিক বণিকরা এইজিয়ান সমুদ্রের এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যেতে লাগলেন। এশিয়া মাইনের উপকূল থেকে ক্রিট পর্যন্ত যেয়ে তারপর আবার মূল ভূখণ্ডে ফিরে আসা। হোমারের আমলে গ্রিক শহরগুলো থেকে আসা জাহাজগুলো বাণিজ্যিক কারণে পশ্চিমের উপদ্বীপেও যেত।
খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালের আগে, যখন মাইসেনীয়রা পূর্বাঞ্চলে তাদের ক্ষমতার চরম শিখরে ছিল, তখন ইতালীয় উপদ্বীপে ছোট ছোট, বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী বসবাস করত। তারা একে অপর থেকে দূরে দূরে থাকলেও তারা সবাই একই নকশার মাটির পাত্র বানাত। এ থেকে ধারণা করা যায়, তাদের সবার পূর্বসূরি একই।
এই উপনিবেশগুলো অ্যাপেন্নিনেস পর্বতমালার এত কাছাকাছি ছিল যে, প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই জনগোষ্ঠীকে ‘অ্যাপেন্নাইন সংস্কৃতি’ হিসেবে নামকরণ করেন।
গ্রিকদের অন্ধকার যুগে, অ্যাপেন্নাইন সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা তৈরি হতে শুরু করে। শুধুমাত্র মাটির পাত্রের নকশাই নয়, অস্ত্র ও বর্মেও পার্থক্য দেখা দেয়।
উপদ্বীপের বিভিন্ন অংশে লোহার তৈরি সরঞ্জাম ও অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং এ অঞ্চলের জনসংখ্যাও বাড়তে থাকে। একটি ছোট উপনিবেশ থেকে হাজারো জনগোষ্ঠীর শক্তিতে তারা বলীয়ান হয়। ১২০০ সালের আগ পর্যন্ত সকল ‘ইতালীয়’ তাদের মৃতদের কবর দেওয়ার চর্চা চালু রেখেছিল। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে উত্তরের বেশকিছু গ্রামবাসী তাদের মরদেহ পোড়াতে শুরু করল।
এই উপদ্বীপে বেশ কয়েক ধরনের আচার ও কৃষ্টি প্রচলিত ছিল, যেগুলোর মাধ্যমে প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রাচীন ইতালীয়দের আলাদা করতে সক্ষম হয়। যেসব গ্রামের বাসিন্দারা তাদের মৃতদের কবর দিতেন, তাদের ৩টি দল ছিল : ফোসসা, আপুলিয়ান ও মধ্য আড্রিয়াটিক। উত্তরের যেসব গ্রামবাসী তাদের মৃতদের দাহ করতেন, তাদের ছিল ৪টি দল। এরা ছিল গোলাসেক্কা, এস্তে, ভিল্লানোভান ও লাশিয়াল।
লাশিয়াল গোত্রের সদস্যরা তাদের মৃতদের ছাই কলস-আকৃতির একটি পাত্রে সংরক্ষণ করে সেগুলোকে আবার ছোট ছোট বাড়িতে রেখে দিতেন। জীবিত অবস্থায় তারা যে-ধরনের বাড়িতে থাকতেন, মৃত্যুপরবর্তী বাড়ির নকশাও হুবহু এক হত।
তাদের নিজেদের বাড়িগুলো খুবই সহজ-সরল ও অরক্ষিত ছিল। রোমান ইতিহাসবিদ ভাররো বলেন, তারা ‘প্রাচীর বা ফটক বিষয়ে কিছুই জানতেন না।’
এই ক্ষুদ্র গ্রামগুলো নিরাপত্তার জন্য পাহাড়ের ওপরে স্থাপন করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একটাই মিল : সবার কথ্য ভাষা একই। তারা ‘ল্যাটিন’ নামে একটি অখ্যাত ভাষায় কথা বলতেন। উপদ্বীপে মোট প্রায় ৪০ ধরনের ভাষা ও উচ্চারণরীতি প্রচলিত ছিল।
গ্রিস থেকে আসা জাহাজগুলো ইতালির দক্ষিণ উপকূলে এসে ভিড়ত। তারা মূল্যবান ধাতু ও শস্যের বাণিজ্য করত। তারা একইসঙ্গে পরবর্তীকালে সিসিলি নামে পরিচিতি পাওয়া দক্ষিণাঞ্চলের বড় দ্বীপটিতেও ভিড়ত। এই সফল বাণিজ্যের কারণে বিভিন্ন জায়গায় বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়, যেখানে গ্রিক বণিকরা শুধু জাহাজই ভেড়াতেন না, তারা সেখানে বছরের একটি অংশ বসবাসও করতেন।
৭৭৫ সাল নাগাদ উত্তর-পশ্চিমের গ্রিক শহর চালকিস ও পূর্বের শহর ইরিত্রিয়া থেকে বণিকদের একটি যৌথ দল আরও একটু উত্তরে একটি বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে এলেন। আধুনিককালের নেপলস উপসাগরীয় অঞ্চলের ওপরের দিকের উপকূলে এই বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হল। এটি ভিলানোভানদের বসতির কাছাকাছি ছিল। গ্রিকরা এঁকে টিরহেনিয়ান বলে অভিহিত করত। শিগগির ভিলানোভান নাগরিকদের কবরে গ্রিস থেকে আসা ফুলদানি দেখা যেতে লাগল। ভিলানোভানদের শিলালিপিতেও গ্রিক অক্ষরের অনুপ্রবেশ ঘটল।
চালকিস ও ইরিত্রিয়ার মধ্যে শুধু বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও ভাষাগত মিলই ছিল না, এই দুই জাতি নিজেদের প্রয়োজনে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেছিল। গ্রিক শহর অলিম্পিয়াতে অবস্থিত জিউস ও হেরার মন্দিরে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গ্রিক তীর্থযাত্রীদের আনাগোনা ছিল, যে কারণে এই মন্দিরগুলোর কলেবর বাড়ানো হয়। আরও উত্তরে, ডেলফিতে একটি ভিন্নধরনের মন্দির ছিল। এখানে একটি ওরাকল ছিল, যার মাধ্যমে পুরুষ ও নারী পুরোহিতরা গ্রিকদের পক্ষে নিয়ে দেবতাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। পরামর্শের বিষয় ছিল : গ্রিক নাগরিকদের জীবন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া। এই সুবিধা নেওয়ার জন্য দূরদূরান্ত থেকে গ্রিকরা ডেলফিতে যেতেন। এছাড়াও, ডেলোস দ্বীপে অ্যাপোলোর মন্দির ও দেবী আর্টেমিসের মন্দিরও অনেক জনপ্রিয়তা পায়।
এই পবিত্র ভূমিগুলো খুব দ্রুত ‘প্যান-হেলেনিক’ (সব গ্রিকদের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য বোঝানোর জন্য ইংরেজি শব্দ) হয়ে যাচ্ছিল। শুধু কাছাকাছি শহরই নয়, সকল গ্রিক ভাষাভাষীরা এসব জায়গায় দলে দলে আসতে লাগলেন। এভাবে একপর্যায়ে প্রথম গ্রিক রাজনৈতিক জোট তৈরি হয়। বেশকিছু শহর একত্র হয়ে ‘অ্যামফিকটিওনিস’ নামের সংস্থা গঠন করে, যাদের দায়িত্ব ছিল একটি মন্দির বা মিনারের রক্ষণাবেক্ষণ করা। এই সংস্থাকে প্রাচীন আমলের সমবায় সমিতি বলা যেতে পারে।
সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনাটি ছিল যখন সকল গ্রিক শহর একত্র হয়ে দেবতা জিউসের উদ্দেশে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ-ধরনের প্রথম উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৭৭৬ সালে, চালসিয়া ও ইরিত্রিয়ার যৌথ অভিযানের ঠিক এক বছরের মাথায়। পূজারিরা সবাই অলিম্পিয়া শহরে জমায়েত হয়েছিলেন।
কয়েক শতক ধরেই অলিম্পিয়া ধর্মীয় কার্যক্রমের কেন্দ্রে ছিল। বিভিন্ন ধরনের উৎসর্গ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে দৌড় প্রতিযোগিতাও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ৭৭৬ সালে অলিম্পিয়ার উত্তর-পশ্চিমের ছোট শহর এলিসের রাজা ডেলফির ওরাকলের (ভবিষ্যদ্বক্তা) কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কীভাবে গ্রিক শহরগুলোর মধ্যে চলতে থাকা যুদ্ধ-বিগ্রহের অবসান ঘটানো যায়। ওরাকল তাকে জানান, অলিম্পিয়ায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলোকে একটি আনুষ্ঠানিক উৎসবে রূপান্তর করতে। এই উৎসব চলাকালীন সর্বত্র যুদ্ধবিরতি চালু থাকবে।
সবচেয়ে পুরনো তথ্য ও সূত্র অনুযায়ী, এরপর থেকে অলিম্পিয়াতে প্রতি ৪ বছর অন্তর এই আনুষ্ঠানিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন হতে শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতার সময় সমগ্র গ্রিক দুনিয়া জুড়ে ‘অলিম্পিক যুদ্ধবিরতি’ চালু করা হত, যার মেয়াদ ছিল অন্তত এক মাস। পরবর্তীতে এটি বাড়িয়ে ৩ মাস করা হয়, যাতে দূরদূরান্তের গ্রিকরা অলিম্পিয়াতে নিরাপদে আসা-যাওয়া করতে পারেন।
তবে এই এলিসের রাজার প্রত্যাশা অনুযায়ী, এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে শান্তি আসেনি। তবে এর মাধ্যমে গ্রিক শহরগুলো একটি বিষয় অনুধাবন করতে পারে, তা হল, ভাষার পাশাপাশি তাদের মধ্যে বড় একটি মিল আছে, তা হল, তারা সবাই একই দেবতাদের উপাসনা করেন। এছাড়াও, তারা বুঝতে পারে, যুদ্ধ ছাড়াও অন্যান্য উপায়ে তারা নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম।
রোমানদের কালজয়ী ইতিহাস অনুযায়ী, ৭৭৬ সালে নুমিতর নামে এক রাজা ইতালীয় উপদ্বীপের দুইটি ল্যাটিন শহর শাসন করছিলেন। এই শহরগুলো তিবারের দক্ষিণে ছিল। প্রথম এবং অপেক্ষাকৃত পুরনো শহরটির নাম ছিল লাভিনিয়াম। লাভিনিয়ামে মানুষ বেড়ে যাওয়ার পর এর উপনিবেশ হিসেবে আলবা লাঙ্গা শহরটি আলবান পর্বতমালার পাশে নির্মাণ করা হয়।
দুশ্চরিত্র ছোটভাই আমুলিয়াসের আক্রমণে দেশ ছেড়ে নির্বাসনে চলে যেতে বাধ্য হন বড়ভাই নুমিতর। তিনি তার পরিবারকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হন। আমুলিয়াস সিংহাসন দখল করে নেন। তিনি তার ভাইয়ের ছেলেদের হত্যা করেন এবং ঘোষণা দেন, ভাইয়ের মেয়ে রাজকন্যা রিয়া সিলভিয়া আজীবন কুমারী থাকবেন। এভাবে তিনি নুমিতরের নাতি-নাতনিদের মাধ্যমে ভবিষ্যতে আবারও তার সিংহাসনের ওপর কোনো ধরনের দাবি আসার পথ রুদ্ধ করলেন।
কিন্তু এই উদ্যোগ সত্ত্বেও রিয়া সিলভিয়া অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। রোমান ইতিহাসবিদ লাইভি মন্তব্য করেন, সিলভিয়ার দাবি, দেবতা মার্স তাকে ধর্ষণ করেছেন। ‘সম্ভবত তিনি তা বিশ্বাস করতেন, কিন্তু বস্তুত তিনি তার অনুশোচনাকে লুকিয়ে রাখার একটি অজুহাত তৈরি করেছিলেন’, যোগ করেন লাইভি। তিনি যমজ পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, যারা উৎখাতকারী রাজার জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হন। গ্রিক আত্মজীবনীকার প্লুটার্ক আরও জানান, ‘এই পুত্রসন্তানরা সাধারণ মানুষের চেয়ে আকারে ও সৌন্দর্যের দিক দিয়ে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন’। এ বিষয়টিও আমুলিয়াসকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
আমুলিয়াস তার দুই শিশু-নাতিকে নদীর পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করার নির্দেশ দেন। তখন তিবার নদীর পানি উপচে দেশে বন্যা হচ্ছিল। শিশু দুইজনকে হত্যার দায়িত্ব ছিল এক চাকরের ওপর। তিনি তাদেরকে নদীর তীরে ফেলে দিয়ে চলে যান। কিংবদন্তি মতে, একজন নেকড়ে-মাতা তাদেরকে খুঁজে পেয়ে লালন-পালন করে। অল্পদিন পরেই রাজার পশুপালক তাদের খুঁজে পান এবং নিজের স্ত্রীকে তাদের লালন-পালনের দায়িত্ব দেন।
এই পশুপালক তাদের নাম দেন রমুলাস ও রেমাস। তিনি তাদেরকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বড় করে তোলেন। প্লুটার্কের মতে, নির্বাসনে থাকা নুমিতর তাদের শিক্ষাদীক্ষার জন্য গোপনে অর্থ পাঠাতেন। যখন তারা বড় হল, তখন তারা তাদের দুষ্ট দাদাকে (দাদার ভাই) হত্যা করল এবং নুমিতর তার সাম্রাজ্য ফিরে পেলেন।
দাদা সিংহাসন ফিরে পাওয়ার পর যমজ দুই ভাই আনুষ্ঠানিকভাবে তার আইনি উত্তরসূরির মর্যাদা পেলেন। লাইভির ভাষায়, দুই ভাইয়ের মনে হঠাৎ একটি খেয়াল চাপল। তারা ঠিক করলেন, যেখানে তাদেরকে ডুবে মরার জন্য রেখে যাওয়া হয়েছিল, সেখানে একটি উপনিবেশ তৈরি করবেন। রাজা অনুমোদন দিলেন, তৈরি হল ‘আলবা’। এই শহরটি লাভিনিয়ামের চেয়ে বড় হয়ে গেল এবং তৃতীয় একটি শহরের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। তবে এ পর্যায়ে এসে দুই ভাই তাদের দাদা ও দাদার ভাইয়ের মতো বিবাদে জড়িয়ে পড়লেন। নতুন উপনিবেশের শাসক কে হবেন, সেটি তারা ঠিক করতে পারলেন না। তারা দেবতাদের আহ্বান জানালেন কোনো ধরনের চিহ্ন বা নিশানা পাঠাতে। এরপর থেকেই পরিস্থিতির চরম অবনতি হতে শুরু করে।
এই উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে রমুলাস প্যালাটাইন পর্বতে গেলেন এবং রেমাস গেলেন অ্যাভেনটাইন পর্বতে। তার এই দুই জায়গায় বসে উপাসনা করতে লাগলেন, সেই ঐশ্বরিক নিশানার অপেক্ষায়। উপাখ্যান মতে, রেমাস প্রথম নিশানাটি দেখতে পেলেন। তিনি ৬টি শকুন উড়ে যেতে দেখেন। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, দেশের জনগণ এ খবর পেতে-না-পেতেই জানা গেল, রমুলাসের সামনে দিয়ে ১২টি শকুন উড়ে গেছে। দুই জনের অনুসারীরা নিজ নিজ প্রভুকে স্যালুট করলেন। এক পক্ষ দাবি করলেন, তাদের প্রভু আগে নিশানা পেয়েছেন। অপর পক্ষের দাবি, তাদের প্রভু ‘জোরালো’ নিশানা (৬-এর জায়গায় ১২টি শকুন) দেখেছেন। দুইপক্ষের মাঝে চেঁচামেচি থেকে হাতাহাতি শুরু হল। এই গোলযোগে রেমাস মারা পড়লেন।
লাইভি মন্তব্য করেন, রমুলাস এই নতুন উপনিবেশের চারপাশে একটি প্রাচীর নির্মাণ করছিলেন। তার এই প্রয়াসকে নিয়ে রেমাস ঠাট্টা-তামাশা করলে রমুলাস রেগে গিয়ে তাকে হত্যা করেন।
রমুলাসের নাম অনুসারে নবনির্মিত এই শহরের নামকরণ হয়। তিনি প্যালাটাইন পর্বতকে আরও সুরক্ষিত করেন এবং নতুন শহর ‘রোম’কে সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে নির্ধারণ করেন। বছরটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সাল।
তবে এই গল্পে কতটুকু সত্যতা রয়েছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৮০০ সালের মাঝে রোম শহরের গোড়াপত্তন হয়। তবে রোমান লেখকরা বিভিন্ন জায়গা থেকে গল্প সংগ্রহ করে তাদের ইতিহাস রচনা করেছেন। রমুলাস ও রেমাসের গল্পটিও পুরনো গ্রিক কিংবদন্তির বিভিন্ন গল্প থেকে অংশবিশেষ নিয়ে রচিত। এতে এমনকি সারগন ও মোজেসের গল্পেরও প্রভাব পাওয়া যায়। লাইভি খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সাল থেকে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। তিনি তার লেখার শুরুতে মন্তব্য করেন, ‘রোমের গোড়াপত্তনের আগের ঘটনাগুলোর বর্ণনা মূলত বিভিন্ন কাব্য থেকে সংগ্রহ করা। এতে প্রশ্নাতীত ইতিহাসের অংশ কমই আছে।’
এই গল্পের একমাত্র ঐতিহাসিক সত্যটি খুব সম্ভবত দুইভাইয়ের বিরতিহীন দ্বন্দ্ব। এক হাজার বছর আগে মিশরে সিংহাসনের দখল নিয়ে ওসাইরিস ও সেটের যুদ্ধগুলো রক্তসম্পর্কের আত্মীয়দের মাঝে অন্তর্কলহের উজ্জ্বল নিদর্শন ছিল। রমুলাসের গল্পে আমরা আত্মীয়দের দুইটি দলের মধ্যে যুদ্ধের আভাস পাই। প্রাচীন আমলের ধ্বংসাবশেষ থেকে আমরা একটা বিষয় জানতে পারি, সেটা হচ্ছে, রোমের সূচনা হয়েছিল দুইটি উপনিবেশের মাধ্যমে। এই উপনিবেশগুলো যথাক্রমে প্যালাটাইন ও এসকিলিন পর্বতের কাছে ছিল এবং এদের দখলে ছিলেন ল্যাশিয়াল গোত্রের দুইটি অংশ। খুব সম্ভবত একটি গোত্র রোমুলাসের সঙ্গে আলবান পর্বত থেকে নেমে এসেছিল। হয়তো তাদের উদ্দেশ্য ছিল এই ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর জন্য টাইবেরিয়ার উর্বর সমতলভূমি থেকে শস্য সংগ্রহ।
অপর দলটি সম্ভবত সেবাইন পর্বত থেকে এসেছিল। লাইভির মতে, প্যালাটাইন পর্বতের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর রমুলাস বড় একটি শহর নির্মাণ করেন। তবে জনসংখ্যার তুলনায় এই শহরের কলেবর অনেক বেশি বড় ছিল। ফলে তিনি সবধরনের যাযাবর ও পলাতক আসামিদের জন্য শহরের ফটক উন্মুক্ত করে দেন।
এই জনগোষ্ঠী এসে রোমকে পরিপূর্ণ করল, কিন্তু একটি বড় সমস্যার সমাধান তখনো পাওয়া যায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, রোমের এই জৌলুস শুধু এক প্রজন্মের; কারণ জনগোষ্ঠীতে আনুপাতিক হারে নারীর সংখ্যা একেবারেই কম ছিল।
দুই ভাইয়ের বিবাদের মতো, প্রতিবেশী গ্রামগুলোর মাঝেও ছিল বৈরী সম্পর্ক। তারা রোমে তাদের কন্যাদের পাঠাতে অস্বীকৃতি জানালেন। তারা নতুন এই সম্প্রদায়কে ঘৃণা করতেন, এবং একই সঙ্গে নতুন এই শক্তির উত্থানে ভীত ছিলেন। রমুলাস দেবতা নেপচুনের উদ্দেশে একটি বড় উৎসবের আয়োজন করলেন এবং প্রতিবেশীদের, বিশেষত সবচেয়ে কাছের ও বড় শহর থেকে সেবাইনদের দাওয়াত দিলেন। উৎসব চরম উৎকর্ষের মুহূর্তে, সব সেবাইন পুরুষ যখন আনন্দ-উল্লাসে মত্ত, তখন রোমান পুরুষরা এসে সব সেবাইন তরুণীদের অপহরণ করে তুলে নিয়ে গেলেন।
লাইভির বর্ণনায়, এই নারীরা কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তাদের রাগ ভুলে যান, কারণ তাদের নতুন স্বামীরা ‘মধুমাখা কণ্ঠে কথা বলত।’ তবে সেবাইন সেনাবাহিনী প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রোমের উদ্দেশে যাত্রা করল। তারা রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি পৌঁছে গেল এবং প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দিল। রোমানরা বাধ্য হয়ে প্রতিপক্ষের দখলে থাকা প্রাসাদে হামলা চালাল। দুই সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে একজন সেবাইন চ্যাম্পিয়ন ও মহান যোদ্ধা মেট্টিয়াস কার্টিয়াস তার বাহিনীর উদ্দেশে চিৎকার করে বললেন, ‘তাদেরকে দেখিয়ে দাও, যে মেয়েদের ধরে আনা আর পুরুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এক জিনিস না।’ তিনি চিৎকার করতে লাগলেন আর একপর্যায়ে রমুলাস তার সবচেয়ে শক্তিশালী রোমান যোদ্ধাদের নিয়ে আলাদা করে তাকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে গেলেন। ভয় পেয়ে মেট্টিয়াস কার্টিয়াস সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন।
সব মিলিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তের বন্যা বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। উভয় পক্ষেই প্রচুর হতাহতেরও সকল লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এ পর্যায়ে সেবাইন নারীরা দলে দলে দুই পক্ষের যোদ্ধাদের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে পড়তে লাগলেন। তারা এই দুই গোত্রের সদস্যদের যুদ্ধ থামানোর অনুরোধ জানালেন। তারা বললেন, এই যুদ্ধ চলতে থাকলে হয় তাদের স্বামীরা মারা পড়বেন আর নয়তো পিতারা। লাইভি বলেন, ‘তাদের এই আর্জির ফল ছিল তাৎক্ষণিক ও সুগভীর। যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে এল নীরবতা। আর একজন সেনাও অস্ত্র ওঠালেন না। এক মুহূর্ত পর, দুই পক্ষের অধিনায়ক এগিয়ে এসে নিজেদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করলেন। বিষয়টা এখানেও থেমে রইল না। দুইটি রাজ্য একটি একক সরকারের অধীনে একতাবদ্ধ হল এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে এল রোম।’ আলবা লংগার রাজাদের বংশধর রমুলাস ও সেবাইনদের রাজা টাইটাস টাটিয়াস যুগ্মভাবে দেশ শাসন করতে লাগলেন। তবে এ বন্দোবস্ত খুব বেশিদিন চলেনি। কয়েক বছর পর রায়ট চলাকালীন টাটিয়াস নিহত হন। বলা হয়ে থাকে, এ ঘটনায় যতটুকু দুঃখ না- পেলেই নয়, ঠিক ততটুকুই দুঃখ পেয়েছিলেন রমুলাস।
এই কিংবদন্তিগুলো গ্রিকদের প্রভাবযুক্ত হলেও, এতে দুইটি পাহাড়ের সমন্বয়ে গঠিত প্রাচীন রোমের প্রকৃত ইতিহাসের কথাই সম্ভবত বর্ণনা করা হয়েছে। এর একটিতে সেবাইন পাহাড়ের ল্যাটিন ও অপরটিতে আলবা পাহাড়ের ল্যাটিনরা বসবাস করতেন। এছাড়াও, রোমের একেবারে গোড়াপত্তনের ইতিহাসে প্রাথমিক পর্যায়ের শত্রুতার কথাও এখানে আখ্যায়িত করা হয়েছে। উচ্চ ও নিম্ন মিশরীয়দের মতো, এই মানুষগুলোরও ছিল একই ধরনের আচার-আচরণ, ভাষা ও দেবতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা এঁকে অপরের শত্রু ছিল। গ্রিকরা একতাবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছিলেন আর ল্যাটিনরা তাদের নিজেদের জ্ঞাতিভাইদের অস্বীকার করার চেষ্টা করছিলেন। রোমের সবচেয়ে প্রাচীন সংস্করণে দুই মেরুর বাসিন্দা ছিলেন, যারা এঁকে অপরের ছায়াও মাড়াতে চাইতেন না। কিন্তু তারপরও, তারা একই শহরে থাকতেন।
তবে এই উপদ্বীপের উর্বর ভূমিতে রোমই একমাত্র শহর ছিল না, যেটি বড় হচ্ছিল।
গ্রিক বণিকরা তাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্রের উদাহরণ দেখিয়ে নিজেদের দেশের মানুষকে এটা বোঝাতে সক্ষম হল, যে ইতালীয় উপকূল গ্রিক উপনিবেশ তৈরির জন্য বেশ উপযুক্ত একটি জায়গা। গ্রিক শহরগুলোও অভ্যন্তরীণ চাপে ছিল। ৮০০ থেকে ৭০০ সালের মাঝে এই শহরগুলোর জনসংখ্যা ৬ গুণ বেড়ে যায়। শহরের বাসিন্দাদের আরও ধাতু, পাথর, শস্য ও গবাদি পশু চরানোর তৃণভূমির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।
সব কিছুকে ছাপিয়ে ভূমির প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিল। গ্রিক শহরগুলো প্রাকৃতিক বাধাবিপত্তিতে জর্জরিত ছিল—পাহাড়ের ঢাল, পাথুরে ভূমির আধিক্য অথবা সমুদ্রের উপস্থিতি। মেসোপটেমীয় সমতলভূমির মতো, গ্রিক উপদ্বীপও ছিল ‘পরিধিকৃত কৃষি ভূমি’। প্রথাগতভাবে, একটি পরিবারের ছেলেসন্তানদের মাঝে জমি সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হত। অর্থাৎ, যেকোনো পরিবারের ভূমির পরিমাণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কমতে থাকত। অধিক পুত্রসন্তান থাকলে জমি কমার গতিও বৃদ্ধি পেত। অর্থাৎ, গ্রিক পরিবারগুলোর পুত্রসন্তানদের জন্য আর খুব একটা ভূমি বাকি ছিল না।
খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০ সালের আশেপাশে কোনো একসময় বোয়েওশিয়া প্রদেশে জন্ম নেন গ্রিক কবি হেসিওড। ‘ওয়ার্কস অ্যান্ড ডেজ’ নামে কবিতায় এক দুঃখজনক ঘটনার বর্ণনা দেন। যখন তার পিতা মারা যান, তাদের খামারটি তিনি এবং তার বড়ভাই পার্সেসের মাঝে সমানভাবে বণ্টন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পার্সেস ভেবেছিলেন ভাগ হয়ে গেলে তার নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণ করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জমি থাকবে না। এ বিবাদের মীমাংসাকারী বিচারকদের তিনি ঘুস দিয়ে নিজের পক্ষে রায় নিয়ে যান।
এটা ছিল গ্রিক শহরগুলোর একটি নিয়মিত ঘটনা। সীমিত সম্পদের কারণে গ্রিক নগরবাসীরা অনেক অন্যায় করতেন এবং ভূমির মালিক ও কর্মকর্তাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি মহামারির আকার ধারণ করে।
হেসিওড তার কাব্যের বেশকিছু স্তবকে একথাই বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, কঠোর পরিশ্রমী কর্মীদের তা-ই পাওয়া উচিত, যা তাদের প্রাপ্য। যেসব খামারি নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ফসলের আবাদ করেছেন, ফসল কাটার সময় তাদের নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নেওয়া উচিত। সবাইকে ঠিকমতো ও সময়মতো বেতন দেওয়া উচিত। দুর্নীতিবাজ বিচারকদের স্বর্গীয় শাস্তিভোগ করা উচিত। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবে ঘটত না। এবং এরকম বাস্তবতা আসারও তেমন কোনো সম্ভাবনা ছিল না, কারণ শহরগুলো সম্প্রসারিত হতে পারছিল না।
এক্ষেত্রে সংস্কার নয়, উপনিবেশ স্থাপনই ছিল একমাত্র সমাধান। ৭৪০ সালের আশেপাশে গ্রিক শহরের নেতারা সব পরিবারের ছোটভাইদের নতুন ভূমিতে চাষাবাদ করতে পাঠাতে লাগলেন। সবচেয়ে পুরনো উপনিবেশ স্থাপনকারীরা ইতালির চালকিস ও ইরিত্রিয়া শহর থেকে এসেছিলেন। তারা নেপলস উপসাগরের তীরে কুমায় নামে একটি নতুন গ্রিক শহরের গোড়াপত্তন করলেন। ৭৩৩ সাল নাগাদ আরও বেশকিছু শহর তৈরি হল সেখানে। এর মধ্যে আছে কোরিন্থ, সিসিলি, সিরাকিউস, নাকসুস, লেনতিনি, কাতানা ও রেজিয়াম। ৭০০ সাল নাগাদ ইতালীয় উপকূলের শহরগুলো দেখতে গ্রিক শহরের মতোই হয়ে দাঁড়াল।