ফুলকীগুলো উপরে উঠে যায়
৪৭. উপথে যাত্রা
তার নাম ক্যারিনা, আঠারো বছর বয়স। যদিও এটাই তার কুমারের নৌকায় রাত্রের আঁধারে প্রথম ভ্রমণ। তবে অবশ্যই তার প্রথম শোয়া নয়। সেই কুমারের পছন্দের মেয়ে, এমন একটা কথা অনেকেই বলে থাকে।
সূর্য অনেকটা আগেই ডুবে গেছে। ভিতরের চাঁদটা পৃথিবীর চাঁদের চাইতেও অনেক কাছে এবং তার উজ্জ্বল ঠান্ডা, নীল আলো আধমাইল দূরের সৈকতকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। পাম গাছের সারি থেকে আধমাইল দূরে আগুন জ্বলছে। সেখানে এখনও উৎসব চলছে। সবচেয়ে কম শক্তিতে চলতে থাকা ইঞ্জিনের মৃদু শব্দ ছাড়িয়েও মাঝে মাঝে হালকা গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। কুমারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এবং আর কিছু চাইবার ইচ্ছে তার আপাতত নেই। খুব ভালো নাবিক বলেই সে মাঝে মাঝে স্বয়ংক্রিয় চালককে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল এবং চার পাশ দেখছিল। কুমার ক্যারিনাকে সত্যিকারের সুখের কথা বলছিল। নৌকার মৃদু দোলানীটা যখন বাতাসের কুশনে (যার উপরে তারা শুয়ে আছে) আরও বেড়ে যায় তখন তার মধ্যে খুব উত্তেজক একটা অনুভূতি থাকে। এর পরে শুকনো জমিতে ভালোবাসাবাসি করতে কি ক্যারিনার আর ভালো লাগবে? কুমার ক্যারিনার পরিচিত আর দশটা যুবকের চাইতে অনেক বেশী সংবেদনশীল, সহনশীল। সে ওরকম নয় যারা শুধু নিজের তৃপ্তি খুঁজতেই ব্যস্ত। অন্যজন উপভোগ না করলে তার আনন্দ সম্পূর্ণ হয় না। ক্যারিনা ভাবল যখন সে আমার মধ্যে থাকে মনে হয় যে আমি বিশ্বের একমাত্র মেয়ে, যদিও আমি ভালোভাবেই জানি তা নয়।
ক্যারিনা মৃদুভাবে টের পাচ্ছিল তারা গ্রাম ছেড়ে আরো দূরে যাচ্ছে, তবে সে কিছু মনে করেনি। তার মনে হচ্ছিল যদি এ সময় না ফুরাতো- যদি এই নৌকাটা চলতেই থাকতো। তীর থেকে দূরে গিয়ে পুরো গ্রহকে চক্কর মেরে আবার তা ফিরে আসত। কুমার অবশ্য ভালোভাবেই জানতো সে কি করছে। তার বিশ্বাসটাও ক্যারিনাকে আনন্দ দিচ্ছিল। কুমারের নিরাপদ বাহুর আশ্রয়ে কোন ভয় নেই, সমস্যা নেই, কোন ভবিষ্যত সামনে দাঁড়িয়ে নেই, আছে শুধু অন্তহীন বর্তমান।
তবুও সময় যায়। এখন ভেতরে চাঁদ আকাশের অনেক উপরে। ভালোবাসার দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন তাদের ঠোঁটগুলো শরীরের ভালোবাসার খাজগুলো আবিষ্কারে ব্যস্ত তখন পানির জেট এবং নৌকাটা থেমে গেল।
-আমরা এসে গেছি, কুমার বলল। তার গলায় হালকা উত্তেজনা।
এসে গেছি’ মানেটা কি? ক্যারিনা অলসভাবে ভাবল। ঘন্টা খানেকের মতো। তারা তীরের দিকে তাকায়নি। যদিও এটা দৃষ্টিসীমার মধ্যেই আছে। নৌকার মৃদু দোলানীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। সে বড় বড় চোখ করে তাকালো তার সামনের স্বপ্নের জায়গাটার দিকে, যেটা কিছু দিন আগেও ছিল ম্যানগ্রোভ বনের পরিত্যক্ত ভূমি।
অবশ্য উচ্চত, প্রযুক্তির সঙ্গে এটাই তার প্রথম সাক্ষাত নয়। ফিউশন প্ল্যান্ট এবং প্রধান রেপ্লিকেটর আরও বড় এবং গুরুগম্ভীর। কিন্তু চকচক করে চলতে থাকা জটিল পাইপের সারি, এই সংমিশ্রণের প্রতিটি জিনিস যা মানুষের উপস্থিতি ছাড়াই নিঃশব্দে কাজ করছে তা সত্যিই অপার্থিব। কুমারের নোঙর ছোঁড়ার শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে ফেলল।
–এস আমি তোমাকে একটা জিনিস দেখাব।
–না।
–আমি বহুবার এখানে এসেছি। নিশ্চয়ই একা নয়, আমি নিশ্চিত ক্যারিনা ভাবল। কিন্তু কোন মন্তব্যের আগেই সে নিজেকে আবিষ্কার করল কুমারের পাশে। কোমড় সমান পানি দুপুরের রোদে এখনও অস্বস্তিকর রকমের গরম। হাতে হাত ধরে তীরে উঠে শীতল বাতাসে দুজনের ভেজা শরীর জুড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছিল তারা যান্ত্রিক কোন বেহেস্তের আদম হাওয়া।
কুমার বলল, চিন্তা কোর না। আমি সবটা চিনি। ড. লোরেনসন আমাকে সব বুঝিয়ে বলেছেন। কিন্তু আমি একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছি, যা তিনি জানেন না।
তারা মাটি হতে মিটার খানেক উপরে থাকা বেশ ভালো আবরণী দেয়া একটি পাইপ ধরে চলছিল। এবং এই প্রথম ক্যারিনা পাইপের ভেতর ছুটে যাওয়া ঠান্ডা পানির শব্দ পেল। এখন তারা সেই চৌবাচ্চার সামনে, যেখানে বিখ্যাত কাঁকড়াটাকে পাওয়া গিয়েছিল। খুব অল্প পানিই দেখা যাচ্ছে। উপরটা গুল্ম দিয়ে প্রায় পুরোটা ভর্তি। যদিও থ্যালসায় কোন সরীসৃপ নেই, তারপরও গুল্মের মোটা কান্ড ক্যারিনাকে সাপের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
তারা অনেকগুলো কালভার্ট এবং ছোট সুইজ গেইট পার হল। তারপর মূল প্ল্যান্টের বাইরে একটা বড়, খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। তারা মূল কাঠামো ছেড়ে যাবার সময় কুমার একটা ক্যামেরার লেন্সের দিকে ভেংচি কাটল। কেউই বলতে পারেনি কেন এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ক্যামেরাটা বন্ধ ছিল। বরফের পাত, কুমার বলল। প্রত্যেকটার ওজন ছয়শ টন। পঁচানব্বই ভাগ পানি আর পাঁচ ভাগ গুল্ম। হাসির কি দেখলে?
-হাসির নয় তবে অদ্ভুত, তখনও ক্যারিনা হাসছে। চিন্তা করো তারা আমাদের সামুদ্রিক জঙ্গলের একটা অংশ তারার রাজ্যের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেটার জন্য নিশ্চয়ই তুমি আমাকে আননি।
-না, আস্তে করে কুমার বলল। দেখ…
সে কি দেখাতে চাইলো ক্যারিনা প্রথম বুঝতেই পারলনা। তারপর একদম দৃষ্টিসীমার প্রান্তে এক জ্বলজ্বলে ছায়া দেখতে পেল। তখন সে বুঝল।
এটা অবশ্য সেই পুরানো ম্যাজিক। মানুষ হাজার বছর ধরে বহু জায়গায় এটা করেছে কিন্তু নিজের চোখে তা দেখার ব্যাপারটা সত্যিই অবিস্মরণীয়।.
এবার তারা শেষ ট্যাংক পর্যন্ত হেঁটে গেল, যাতে ভালোভাবে দেখা যায়। সূক্ষ্ম আলোর সুতো কয়েক সেন্টিমিটারের চেয়ে মোটা নয়, সোজা উঠে গেছে তারাদের দিকে আলোর বীমের মতো। ক্যারিনা যতদূর পর্যন্ত দেখা যায়, দেখল। কোথায় যে এটা হারিয়ে যায় বোঝা মুস্কিল। তারপর সে নিজেই খুঁজে বের করল। অনেক উপরে একটা ছোট্ট স্থির তারা। অন্য প্রাকাক সঙ্গীরা তাকে ছেড়ে পশ্চিমে চলে যাচ্ছে। একটা নাক্ষত্রিক মাকড়সার মতো ম্যাগেলান তার সুতো ছাড়ছে নীচের পৃথিবীর উপহারের জন্য। এখন তারা দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষারত বরফ চাকের একদম প্রান্তে। এখানে আরেকটা বিস্ময় ছিল। এর উপরটা, চকচকে হলুদ ফয়েলে যেন মোড়ানো বাচ্চাদের জন্মদিনের উপহার বাবা-মা যেমন মুড়িয়ে দেয়।
-বর্ম, কুমার বোঝালো। এটা সত্যিকারের সোনা, প্রায় দুই অনু পুরু। এটা না থাকলে ওঠানোর আগেই অর্ধেক বরফ গলে যেত।
বর্ম আছে কি নেই তা বোঝা না গেলেও ক্যারিনা তার পায়ের নীচে বরফের ঠান্ডা কামড় টের পাচ্ছিল। ডজন খানেক পা চালাতেই তারা একদম মাঝখানে চলে গেল সেখানে ত্রিশ হাজার ওপরের আকর্ষণে টানটান হয়ে থাকা অধাতব রিবনগুলো একত্রে বরফ ওপরে নিয়ে যায়। রিবনগুলো শেষ হয়েছে এক ড্রামে। যার যন্ত্রপাতি এবং জেটগুলো বুঝিয়ে দেয় যে এটা সচল বুদ্ধিমান ক্রেন, যা ওপর আসা রশিকে লক্ষ্যভেদে সাহায্য করে। পুরো জিনিসটাই একটা উন্নত পরিণত প্রযুক্তির সরলতা প্রকাশ করে।
ক্যারিনা হঠাৎ কেঁপে উঠল। শীতের জন্য নয়, সেটা এখন টেরই পাওয়া যাচ্ছে না।
-তুমি কি নিশ্চিত কোন বিপদ নেই, সে উদ্বিগ্ন স্বরে শুধাল।
-অবশ্যই। তারা সব সময় মাঝরাতে তোলে। সেটা এখনও আধঘন্টা দেরী। সেটা দেখতে খুবই সুন্দর। কিন্তু এতোক্ষণ বোধহয় থাকা যাবেনা।
এবার কুমার বসে পড়ল। হাটু মুড়ে গ্রহ আর মহাকাশযানের মধ্যের সংযোগকারী রিবনগুলোর ওপর কান পাতল। যদি এটা উঠে যায়, তাহলে কি তারাও উড়ে যাবে, ক্যারিনা ভাবল?
–শোন, কুমার ফিসফিসিয়ে বলল।
ক্যারিনার জানা ছিল না কি আশা করা উচিৎ। অনেক সময় পরবর্তী বছরগুলোতে যখন তার সহ্য ক্ষমতা বেড়েছিল সে ওই মুহূর্তগুলোকে আবার মনে করতে চাইত। পারত কি না কে জানে! প্রথম মনে হয়েছিল যে বিশ্বজুড়ে এক সেতারের সবগুলো তার এক সঙ্গে বেজে উঠেছে। এটা তার মেরুদন্ডে শীতল স্রোত বইয়ে দিল। সে টের পেলো তার ঘাড়ের পেছনের ছোট রোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ভয়ে- যা মানুষ পেত আদিম জঙ্গলে।
অভ্যস্ত হবার পর পর সে বুঝল যে, বরফের পাতগুলো মৃদু শব্দ করে সরছে। সন্দেহাতীতভাবে একটার সঙ্গে আর একটা লেগে যাচ্ছে। যদিও এখন বেশ দৃশ্যত নিরাপদই কিন্তু অবিশ্রান্ত সমুদ্রের গর্জনের মতোই এটা বন্ধ হচ্ছে না।
যতই সে শুনতে লাগল, ততই ক্যারিনার মনে হচ্ছিল নির্জন সৈকতে অশান্ত ঢেউয়ের শব্দের কথা। তার মনে হল সে যেন বিশ্বজুড়ে আছড়ে পরা মহাশূন্যের সমুদ্রের গর্জন শুনছে–এমন এক গর্জন যা মহাবিশ্বের মহাশূন্যতার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে আতংকের জন্ম দেয়।
এবং এরই মধ্যে সে এই জটিল ঐকতানের অন্যান্য উপাদানগুলো সম্বন্ধেও সচেতন হল। থেকে থেকে রিবনগুলোর সঙ্গে দৈত্যর মতো আংটাগুলো লাগার টুংটাং ধ্বনি ভেসে আসছিল। উল্কা? তা তো নয়ই। সম্ভবত থ্যালসার সামুদ্রিক আবহাওয়ার কোন বৈদ্যুতিক ফুলিঙ্গ? কিন্তু কুমার তখন নক্ষত্রের রাজ্য হারিয়ে গেছে। সুরময় রিবনে মাথা ঠেকিয়ে অর্ধেক মুখ খুলে সে যেন সম্মোহিত হয়ে গেছে সেই অদ্ভুত সুরে। সে খেয়ালই করল না কখন ক্যারিনা রেগে এবং ভয় পেয়ে বরফ পেরিয়ে পরিচিত মৃত্তিকার উষ্ণতায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন কুমার নতুন একটা চড়া সুরের বাজনা শুনতে পাচ্ছে। এটা যেন তূর্য নিনাদ, যা কেবল কল্পনা করা যায়। সেটা এতো বিষণ্ণ আর দূরাগত। এটা কাছিয়ে আসছে, বাড়ছে- এ এমন এক রোমাঞ্চকর শব্দ যা কুমার কখনোই শোনেনি। এটা তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে স্থির করে রাখল। এবং এর পরই কুমার লিওনার্দ শেষ বারের মতো তার ঘুমন্ত বিশ্বের ভঙ্গুর সৌন্দর্যকে চোখ ভরে দেখল। দেখল তার সঙ্গের মেয়েটির ঊর্ধ্বমুখী, ভীত মুখখানি যে কিনা তার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এই ঘটনা স্পষ্ট মনে রেখেছিল।
তখন খুব দেরী হয়ে গেছে লাফাবার জন্যও। এবং তাই ছোট্ট লিওনার্দ উঠে গেল নির্বাক নক্ষত্রের মাঝে-নগ্ন এবং একা।
৪৮. সিদ্ধান্ত
ক্যাপ্টেনের মনে সমস্যাটা বিধে আছে। এবং একজন দূতের ওপর দায়িত্ব দিতে পেরে সে স্বস্তি পাচ্ছে। এবং কোন অবস্থাতেই লোরেন লোরেনসনের চাইতে উপযুক্ত এই ব্যাপারে আর কেউ নেই। সে যদিও কখনও তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়নি। এবং এখনও পরিচিত হওয়াটা সুখকর কিছু নয়। মিরিসা তার সঙ্গে যেতে চাইলেও সে রাজী হয়নি। ল্যাসানরা তাদের বৃদ্ধদের সম্মান করে এবং তাদের সুখস্বাচ্ছন্দের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে। লাল এবং নিকরি লিওনার্দ দক্ষিণ সৈকত ধারে ছোট্ট, স্বয়ংসম্পূর্ণ অবসর ভোগীদের জন্য বানানো কলোনীর একটায় বাস করে। তাদের ছয় রুমের বাসাটায় আছে শারীরিক পরিশ্রম কম লাগে এমন সব যন্ত্র। এমনকি সর্বক্ষণ রোবট সাহায্যকারী, যা লোরেন সারা দক্ষিণ দ্বীপে আগে দেখেনি। পৃথিবীর হিসেবে এদের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। প্রাথমিক সৌজন্য পরিচয়ের পর তারা বারান্দায় বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিল। রোবটটা পানীয় এবং ফল পরিবেশন করছিল। লোরেন জোর করে কিছু মুখে দিল। এবার সে সাহস সঞ্চয় করে তার জীবনের কঠিনতম কাজে হাত দিল।
–কুমার, নামটা তার গলায় আটকে গেল এবং তাকে আবার শুরু করতে হল। কুমার এখনও মহাকাশযানে। আমি আমার জীবনের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ। সে আমাকে বাঁচাতে একবার তার জীবন বিপন্ন করেছিল। আপনারা হয়ত বুঝবেন তার। জন্য আমার কেমন লাগছে। আমি তার জন্য যে কোন কিছু করতে পারি।
আবার সে সময় নিল নিজেকে গুছিয়ে আনতে। তারপর সার্জন কমান্ডার নিউটনের মতো সে যথাসাধ্য দ্রুত এবং বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করল।
-তার শরীর প্রায় অক্ষতই। কারণ পচন শুরু হতে দেরী হয় আর দ্রুত সে জমে গিয়েছিল। কিন্তু সে শরীর তত্ত্বীয়ভাবে মৃত সপ্তাহখানেক আগে আমার মতোই।
কিন্তু ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। আমার শরীর মস্তিষ্কের ক্ষতি হবার আগেই উদ্ধার হয়েছিল। সুতরাং তাড়াতাড়ি আমি ফিরে এসেছিলাম।
কিন্তু কুমারকে উদ্ধার করতে ঘন্টা খানেক সময় লেগেছিল। গঠনে যদিও তার মস্তিষ্ক আগের মতোই আছে কিন্তু তাতে কোন স্পন্দন নেই। কিন্তু তার পরেও খুব উচ্চ প্রযুক্তিতে হয়তো একে ফেরানো যাবে। সারা পৃথিবীর রেকর্ড ঘেটে আমরা দেখেছি এরকম আগেও হয়েছে এবং সাফল্যের হার প্রায় ষাট ভাগ।
এবং এটা আমাদের দোটানায় ফেলে দিয়েছে। যেটা ব্যাখ্যা করতে ক্যাপ্টেন বে আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। সঠিক ভাবে বলতে সেরকম অপারেশন করার মতো যন্ত্রপাতি এমুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। তবে তিনশ বছর পরে হয়ত…
আমাদের ঘুমন্ত কয়েকশ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের ভেতরে ডজনখানেক মস্তিষ্ক বিশেষজ্ঞ আছেন। সেখানে আরও আছে টেকনিসিয়ান যারা যে কোন সার্জিকেল যন্ত্রপাতি তৈরী এবং চালাতে পারে। আমরা সাগান-২ এ পৌঁছুলেই পৃথিবীর সব কিছুই আবার ফিরে আসবে… তাদের চিন্তা করার জন্য সে বিরতি দিল।
আমরা চেষ্টা করব, বলা যায় খুশী হব কুমারের জন্য যতটুকু করা যায় তা করতে পারলে। আমরা যদিও কথা দিতে পারি না তবুও হয়তো সে একদিন বেঁচে উঠবে। আপনারা চিন্তা করুন।
সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আপনাদের প্রচুর সময় আছে। বৃদ্ধ দম্পতি দীর্ঘক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোরেন তাকাল সমুদ্রের দিকে। কি শান্ত সেটা। সে এখানে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে সুখী হতো, নাতি নাতনিরা মাঝে মাঝে আসত…
তারনার অনেক কিছুর মতো এটাও প্রায় পৃথিবীর মতোই। সম্ভবত ইচ্ছে করেই আশে পাশে কোন ল্যাসান উদ্ভিদ নেই, সবই বড় পরিচিত। কিন্তু কিছু একটা এখানে নেই, কিছু একটা যা তাকে বহুদিন ভাবিয়েছে, যখন থেকে এই গ্রহে পা দিয়েছে। এবং হঠাৎ তার স্মৃতি উস্কে দিয়েছে। সে বুঝছে কি নেই এখানে। এখানে কোন গাংচিল নেই, নেই তাদের বিষণ্ণ ডাক।
লাল লিওনার্দ এবং তার স্ত্রী যদিও একটা শব্দও বিনিময় করেনি, তাও লোরেন লোরেনসন বুঝল কোন একভাবে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
কমান্ডার লোরেনসন-আপনার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ। ক্যাপ্টেন বেকেও ধন্যবাদ পৌঁছে দেবেন। কিন্তু আমরা এটা গ্রহণ করতে পারছি না। যাই হোক না কেন- কুমার চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। এমনকি যদি আপনারা সাফল্য পানও, যদিও তার নিশ্চয়তা নেই, সে জাগবে এক সম্পূর্ণ অচেনা জগতে। এবং সে জানবে, সে কোনদিনই আর তার প্রিয় ঘরে ফিরে যেতে পারবে না। তার প্রিয় জগত শতাব্দীরও বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। এটা সহ্যের বাইরে। আপনারা ভালোর জন্য বলছেন- কিন্তু সেটা তার জন্য ভালো হবেনা। আমরা তাকে তার প্রিয় সমুদ্রের কাছেই ফিরিয়ে দেব।
আর কিছু বলবার ছিল না। লোরেন একই সঙ্গে এক অন্তহীন বিষাদ এবং বিশাল মুক্তির অনুভূতি পেল।
সে তার দায়িত্ব পালন করেছে। এবং এই সিদ্ধান্তটিই সে আশা করেছিল।
৪৯. সৈকতে বহ্নি
সেই ছোট্ট কায়াকটা কোনদিনই আর সম্পূর্ণ হবে না। তবুও সেটি তার প্রথম এবং শেষ অভিযানে যাচ্ছে।
সূর্যাস্তের সময় শান্ত সমুদ্রের পানির প্রান্তে এটা হয়েছিল। অপ্রত্যাশিত নয়, তবুও শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের দল দেখে লোরেনের শূন্য লাগছিল। পুরো তারানাই এখানে। পুরো দক্ষিণ দ্বীপ এমনকি উত্তর দ্বীপ থেকেও মানুষ এসেছে। এই অচিন্তনীয়, অস্বাভাবিক মৃত্যু সমগ্র গ্রহকেই বিষণ্ণ করেছে আর কৌতূহলে অনেকে আসলেও, লোরেন কখনও এরকম খাঁটি শোক দেখেনি। লোরেন কখনোই ভাবেনি ল্যাসানদের এতো গভীর অনুভূতি থাকতে পারে। সান্তনার আর্কাইভে মিরিসার খুঁজে পাওয়া একটা বাক্য তার স্মরন আসল ‘সমগ্র বিশ্বের ছোট্ট বন্ধু কে লিখেছিল জানা যায়নি, কেনই বা এটা এতোদিন সংরক্ষিত হল সেটাওনা।
অব্যক্ত সহানুভূতিতে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া মিরিসার পরিবারকে সে মিরিসা এবং ব্র্যান্টের সঙ্গে ছেড়ে এল। দুই দ্বীপ থেকে তাদের প্রচুর আত্মীয় এসেছে। সে তাদের সঙ্গে থাকতে চাইছিল না। এই অপরিচিতরা কি ভাবছে সে জানে, সে তোমাকে একবার রক্ষা করেছে, কিন্তু তুমি পারনি। এই বোঝা তাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
সবচেয়ে বড় মহাকাশযানের একজন জেষ্ঠ্য কর্মকর্তার জন্য বেমানান চোখের পানি লুকিয়ে রাখার জন্য সে ঠোঁট কামড়ে ধরল এবং অনুভব করল তার মনের একটা প্রতিরোধ শক্তি তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। প্রচন্ড দুঃখের সময় এমন কিছু একটা আসে যা সাময়িক ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে হয়তো সেটা সম্পূর্ণই অন্য জিনিস অথবা হাস্যকর কোন স্মৃতি।
হা, মহাবিশ্বের বিচিত্র কৌতুক বোধ আছে। লোরেন জোর করে হাসিটা মুছে ফেলল। তার প্রতি শেষ কৌতুক করতে কুমারের কেমন লেগেছিল। অবাক হয়ে না, কমান্ডার নিউটন মর্গের দরজা খুলে শীতল ফরমালিনের গন্ধে ভরা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন। এটা প্রায়ই হয়। তোমরা যা ভাবো তার চাইতে বেশী। কখনও এটা হয় শেষ খিচুনী হয়তো মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তির শেষ চেষ্টা। এখানে সেটা হবে হয়তো বাইরের চাপ এবং শীতলতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য।
বরফের ক্রিস্টালগুলো এই শরীর ধরে রেখেছে। লোরেনের মনে হলো কুমার আসলে ঘুমিয়ে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখছে।
মৃত্যুতে যেন ছোট্ট লিও আগের চাইতে আরও পুরুষালী হয়েছে।
পশ্চিমের নীচু পাহাড়গুলোর পেছনে সূর্য প্রায় লুকিয়ে পড়েছে। সাগর থেকে একটা শীতল বাতাস বয়ে এল। কায়াকটা পানিতে নেমে গেল। ব্র্যান্ট আর কুমারের তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেটা নিয়ে যাচ্ছে। শেষ বারের মতো লোরেন তার জীবনের জন্য ঋনী বাচ্চাটার মুখ দেখল।
এতক্ষণ ফেঁপানী শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু চারজন সাতারু যখন কায়াক নিয়ে তীর ছেড়ে সরে যেতে লাগল, সমবেত ভিড় থেকে বিলাপের শব্দ শোনা গেল। লোরেন আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না– কে দেখল, তাতে তার কিছু আসে যায় না।
চারজন শক্তিশালী সারথীর হাতে কায়াকটা ধীরে ধীরে তীর থেকে সরে যেতে লাগল। দুটি বীকনবাতি যা খোলা সাগর নির্দেশ করে, তার মাঝ পর্যন্ত যেতে যেতে থ্যালসায় দ্রুত রাত নেমে এল। এর পরে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল ঢেউয়ের মাঝে।
শোক প্রকাশ থেমে গেছে। সবাই অপেক্ষা করছে। তারপরই হঠাৎ অন্ধকার আকাশ ভেদ করে একটা আলোকরশি সমুদ্রের বুক থেকে উঠে এল। এটা প্রায় ধোয়াহীন ভাবেই উজ্জ্বল ভাবে পুড়তে লাগল। কতক্ষন লোরেন জানে না-সময় স্তব্ধ হয়ে গেছে। তারপর হঠাৎ আগুন নিভে গেল, সমুদ্রে ফিরে এল। এক মুহূর্তের জন্য সব আঁধার হয়ে গেল। আগুন আর সমুদ্র মিলতেই আকাশে কিছু স্ফুলিঙ্গ বিস্ফোরিত হল। কিছু সাগরে ফিরে এল, আর প্রায় সবই উড়ে গেল আকাশে।
এবং দ্বিতীয় বারের মতো কুমার লিওনার্দ তারার পানে যাত্রা করল।