1 of 2

৪৬. আবারও পশ্চিম থেকে পূর্বে গেল ঝৌরা

অধ্যায় ৪৬ – আবারও পশ্চিম থেকে পূর্বে গেল ঝৌরা

খ্রিস্টপূর্ব ৯১৮ থেকে ৭৭১ সালের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক, উভয় ধরনের সমস্যার কারণে ঝৌ রাজাকে পূর্বদিকে অগ্রসর হতে হয়।

আপনাদের হয়তো মনে আছে, রাজা ওয়েনের নাতি তার ভাইদেরকে ঝৌ রাজত্বের বিভিন্ন অংশে পাঠিয়েছিলেন, সরকারি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্য মাথায় রেখে। সেই ছোট ছোট চৌকিগুলো ততদিনে বড় হয়ে ছোট ছোট রাজত্বে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। যারা তখন এই শহরগুলো শাসন করছেন, তারা সেই মূল রাজকীয় ভাইদের বংশধর হলেও রক্তসম্পর্কের দিক দিয়ে মূল রাজপরিবার থেকে অনেকটাই দূরে চলে গেছেন। রক্তসম্পর্কের কারণে নয়, বরং প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতেই তারা রাজাকে টোল দিয়ে যাচ্ছিলেন।

অবধারিত ভাবেই, ‘৯ এলাকার প্রভুরা’ সেই প্রাচীন আমলের সীমানা মেনে মোটামুটি নিরপেক্ষভাবে শাসকের ভূমিকা পালন করছিলেন। তাদের রাজধানী শহরগুলোতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ব্রোঞ্জের তৈরি বিভিন্ন উপকরণ পেয়েছেন, যেগুলোর ওপর সেই প্রভুরা নিজেরাই শিলালিপি তৈরি করেছেন। এককালে এ-ধরনের শিলালিপি তৈরির একচ্ছত্র অধিকার ছিল শুধু রাজার। কিন্তু ততদিন ঝৌ রাজা সেই আধিপত্য হারিয়েছেন। এই শিলালিপি থেকে জানা যায়, স্থানীয় প্রশাসকরা তাদের নিজেদের বিভিন্ন উৎসব ও কৃষ্টি উপভোগ করছিলেন, যেগুলোর সঙ্গে রাজার কোনো যোগসূত্র ছিল না। তারা ‘স্বর্গের মুখপাত্র’ হিসেবে রাজার উদ্যোগের জন্য অপেক্ষা করতেন না, নিজেরাই নিজেদের দেখভাল করতেন।

অপরদিকে, ঝৌ-এর কেন্দ্রীয় প্রশাসন ধীরে ধীরে অবকাঠামোগত দিক দিয়ে উন্নতি করছিল। কারও ব্যক্তিগত বিশ্বস্ততার ওপর নির্ভর না করে কর্মকর্তাদের কঠোর আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল তখন। আগে সভাসদদের ‘লর্ড’ (প্রভু) বলে সম্বোধন করা হত এবং তারা প্রত্যেকেই রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য গড়পড়তা দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু নতুন প্রক্রিয়ায় তাদের সুনির্দিষ্ট পদবি দেওয়া হত, যেমন ‘ভূমি প্রশাসকের একধরনের কাজ ছিল, আবার ঘোড়া- প্রশাসকের কাজ ছিল পুরোপুরি ভিন্ন।

আগের স্বর্গীয় ম্যান্ডেটের মতো এই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার পেছনেও যুক্তি ছিল এটি রাজার ক্ষমতাকে সুরক্ষিত রাখবে। তবে বাস্তবে এতে তার কর্তৃত্ব আরও কমছিল। কারণ, এই ব্যবস্থা এটাই প্রমাণ করে যে শুধু চারিত্রিক দৃঢ়তা দিয়ে তিনি আর মানুষের বিশ্বস্ততা দাবি করতে পারছিলেন না—আইন-কানুন ও আমলাতন্ত্র দিয়ে তা আদায় করে নিতে হচ্ছিল।

খুব শিগগির এই ‘প্রভুদের’ সঙ্গে (অনেক অনুবাদে ‘ডিউক’ বলা হয়েছে) রাজার সমস্যা দেখা দিল। সিমা কিয়ানের বয়ান মতে, মু’র ছেলে কাং মি নামের একটি ছোট রাজ্যের প্রভুর সঙ্গে দেখা করতে রাজকীয় সফরে গেলেন। মি’র ডিউক তার হারেমের জন্য একই পরিবার থেকে তিন সুন্দরী নারী সংগ্রহ করেছিলেন। এমনকি, ডিউকের মাতাও এহেন আচরণকে অতিরিক্ত মনে করেন। তিনি তাকে বকা দিয়ে বলেন, ‘একই গোত্র থেকে তিন কন্যা নিয়ে আসা অতিরিক্ত! একজন রাজাও এমন আচরণ করে না, আর তোমার তো করাই উচিত না। তুমি একজন নীচ ও দুরাচার ব্যক্তি!’

মা উপদেশ দেন এই তিন নারীকে রাজার হাতে তুলে দিতে। ডিউক এতে রাজি হলেন না। এবং যতদূর জানা যায়, কুং রাজাও কোনো ঝামেলা ছাড়াই তার সফর শেষ করে রাজধানীতে ফিরে গেলেন। তবে ঠিক এক বছর পর, তিনি তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে এসে ডিউক মি-কে হত্যা করেন। তিনি তার রাজ্যের কোনো প্রভুকে তার চেয়েও বেশি বিলাসবহুল জীবনযাপন করার সুযোগ দিতে চাইতেন না।

তার উত্তরসূরি রাজা ইহ-এর আমলে বাইরের শত্রুরা তার ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করল। বাঁশের গায়ে লিখে রাখা ইতিহাস আমাদের জানায়, যাযাবর গোত্ররা ঝৌ-এর রাজধানীতে আক্রমণ চালায়। তারা কখনোই শ্যাং কিংবা ঝৌদের আধিপত্য মেনে নেয়নি এবং মেনে নেওয়ার কোনো ইচ্ছেও তাদের ছিল না।

যাযাবারদের পিটিয়ে বিদেয় করে দিলেও বাইরের হুমকির সঙ্গে যুক্ত হয় ভেতর থেকে আসা বিশ্বাসঘাতকতা। ইহ’র ভাই হিয়াও সিংহাসন দখল করে নেন। এই উৎখাতের বিস্তারিত ইতিহাস জানা যায় না, কিন্তু সেই ‘বাঁশের’ ইতিহাস আমাদেরকে বলেছে (না, কীভাবে এক ভাই আরেক ভাইকে বাঁশ দিয়েছে, সেভাবে লেখা হয়নি সেটি) যে, রাজা ইহ হঠাৎ করে রাজধানী ছেড়ে চলে যান এবং কোনো এক বিচিত্র কারণে তার ছেলে ই সিংহাসনের আইনি দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও ভাইয়ের মাথায় ওঠে মুকুট।

নির্বাসিত অবস্থায় ইহ’র মৃত্যু হয়। পরিশেষে উৎখাতকারী রাজা হিয়াও এরও মৃত্যু ঘটে। ইহ’র ছেলে ই প্রভুদের মৈত্রীর সহায়তায় ক্ষমতা দখল করেন। সিমা কিয়ানের ভাষায়, প্রভুরা ই’র ‘ক্ষমতায়ন’ করেন। তবে এই সমঝোতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তিনি প্রভুদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। হোয়াংহো নদের উত্তরাঞ্চলের কি’র ডিউকের সঙ্গে বেশ ভালো ঝামেলা হয় ই’র। কি রাজ্যটি ধীরে ধীরে বেশ শক্তিশালী হয়ে যাচ্ছিল। ই অবশেষে রাজকীয় বাহিনী নিয়ে কি আক্রমণ করতে এলেন। বাঁশের ইতিহাস মতে, তিনি কি’র ডিউককে আটক করেন এবং একটি ব্রোঞ্জের তৈরি বড় পাত্রে জ্যান্ত সিদ্ধ করে মারেন।

পরের বছর ই’র মৃত্যু হয়। তিনি তার ছেলে লি’র কাছে সিংহাসন রেখে যান। রাজার সঙ্গে গোত্রপ্রধানদের বিবাদ চলতে লাগল এবং একাধিকবার তা সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বাধ্য হয়ে লি একের পর এক যুদ্ধে অংশ নিতে লাগলেন, এবং ক্রমশ তার মধ্যে স্বৈরাচারী শাসকের সব বৈশিষ্ট্য দেখা দিতে লাগল। সিমা কিয়ানের মতে, তার নিজের প্রজারাই তার সমালোচনা করতে শুরু করে। মরিয়া হয়ে রাজা একজন গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর (প্রধান জেরাকারী) বা ‘জাদুকর’ নিয়োগ দিলেন, যার কাজ ছিল রাজার প্রতি বিশ্বস্ত নয়, এমন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা। এ অপরাধে যারা দুষ্ট, তাদেরকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসি দেওয়া হত।

‘সমালোচনা থেমে যায়, কিন্তু সামন্তপ্রভুরা রাজসভায় আসা বাদ দিলেন’, জানান সিমা কিয়ান। রাজা আরও একরোখা হয়ে যান। রাজধানীতে তার বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটাও করতেন না, শুধু সড়কে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।

চীনের বাসিন্দারা রাজার শোষণমূলক নীতিমালার জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে এক সময় তাদের ওপর ভিন্ন একধরনের দুর্ভাগ্য নেমে এল। খরা, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, অতিবৃষ্টির কারণে প্রচুর পরিমাণে ফসল ধ্বংস হল। লি’র রাজত্বের সময় লেখা একটি গানে সে আমলের দুর্দশার কথা উঠে এসেছে :

মৃত্যুর বৃষ্টি ও বিপদ নেমে এসেছে স্বর্গ থেকে
রাজা ও তার সিংহাসনকে ভাসাতে,
শস্যের কাণ্ড ও মূল ভেদ করেছে কেঁচো
সমগ্র ভূখণ্ডে এসেছে ক্ষুধা আর দুর্দশা!

অন্যান্য গানেও ক্ষুধা, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও বিদ্রোহের কথা বলা হয়েছে। যেসব প্রভু তখনও রাজার প্রতি অনুগত ছিলেন, তারা লি’কে জানান, ‘বিস্ফোরণ আসন্ন’। তারা বলেন, ‘মানুষের মুখ বন্ধ রাখা নদীর গতিপথ আটকে দেওয়ার চেয়েও খারাপ।’

শাও’র ডিউকও রাজাকে একই ধরনের সতর্কবাণী দেন।

তবে এতেও লি ভ্রুক্ষেপ করেননি। তিনি তার প্রধান জেরাকারীকে প্রত্যাহার করতে রাজি হননি। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রচুর পরিমাণে বিক্ষোভকারী এসে রাজপ্রাসাদ ঘিরে ফেলে ফটক ধরে নাড়াতে শুরু করে। লি কোনোমতে রাজধানী থেকে পালিয়ে গ্রামাঞ্চলের দিকে চলে যান। তার তরুণ উত্তরসূরি ছেলের ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন ছিল না। শহরে আটকে পড়া এই যুবক তার বাবার বিশ্বস্ত উপদেষ্টা শাও’র ডিউকের শরণাপন্ন হন। সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর জীবন বাঁচাতে শাও’র ডিউক তার নিজের ছেলেকে সিংহাসনে বসালেন।

এই বিকল্প ‘রাজা’ খুব শিগগির মারা গেলেন। এভাবেই শাও’র ডিউক রাজার প্রতি তার বিশ্বস্ততার প্রমাণ রাখতে নিজের ছেলের জীবন উৎসর্গ করলেন। তিনি তার নিজের বাসায় গোপনে রাজপুত্র হুয়ানকে লালনপালন করতে লাগলেন। ঝৌর শাসন তখন বিভিন্ন রিজেন্টের (রাজ-প্রতিনিধি) কাছে চলে গেল। অবশেষে নির্বাসিত লি মারা গেলেন এবং তার উত্তরাধিকারী রাজা হুয়ান এসে আবারও সিংহাসনের দখল নিলেন।

অর্থাৎ, বাস্তবে রাজা থেকে তার ছেলেদের রাজা হওয়ার চক্র তখনও বিঘ্নিত হয়নি। সিমা কিয়ান জোর দিয়ে জানান, লি’র মতো তার ছেলে হুয়ানও একরোখা রাজা ছিলেন। তিনিও তার উপদেষ্টাদের কথায় কান দেননি।

হুয়ানকেও বড় আকারে যাযাবরদের হামলার মুখোমুখি হতে হয়।

নতুন রাজার জন্য যাযাবরদের নিরন্তর হামলা এক বড় আকারের মাথাব্যথার কারণে পরিণত হয়। উত্তর ও পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চল থেকে যাযাবর গোত্রদের আবির্ভাব হতে থাকে। তারা খুব সম্ভবত ইন্দো-ইউরোপীয় ছিল। তাদের সঙ্গে হোয়াংহো নদীর তীরের যাযাবরদের কোনো মিল ছিল না। এই যাযাবররা ঘোড়ার পিঠে চড়ে জীবন কাটিয়ে দিতে অভ্যস্ত ছিল। তারা এক পর্বত থেকে আরেক পর্বতে ঘুরে ঘুরে তির দিয়ে পশু শিকার করে মাংসের অভাব মেটাতেন। যখন পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলত বা স্বাদ বদলের জন্য খাদ্যশস্যের প্রয়োজন পড়ত, তখন তারা ঝৌ চাষিদের ক্ষেত-খামার ও গোলাগুলোতে হামলা চালাতেন।

হুয়ানের আমলে সবচেয়ে ভয়ংকর গোত্রগুলো পশ্চিম থেকে আসত।

ঝৌ জাতির মানুষরা তাদেরকে ‘জিয়ানইউন’ নামে ডাকলেও এটি সম্ভবত কোনো গোত্রের নাম ছিল না। সামগ্রিকভাবে সব হামলাকারী যাযাবরদেরকে এই নামে ডাকা হত।

রাজা হুয়ান তার শাসনামলের পঞ্চম থেকে দ্বাদশ বছর পর্যন্ত জিয়ানইউনদের বিরুদ্ধে একের পর এক সামরিক অভিযান চালাতে লাগলেন। এভাবে তিনি তার রাজ্যকে বাইরের শত্রুর হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতেন। অন্য সব হামলাকারীদের চেয়ে জিয়ানইউনরা ভিন্ন ছিলেন, কারণ তারা যুদ্ধে রথের ব্যবহার করতেন এবং এ কারণে সেগুলো দীর্ঘ সময় ধরে চলত।

অবশেষে জিয়ানইউনরা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং কিছু সময়ের জন্য তারা ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যায়। কিন্তু এই যাযাবরদের বিরুদ্ধে জয়ী হলেও নিজ দেশবাসীর কাছে হুয়ানের ভাবমূর্তির কোনো উন্নয়ন হয়নি। অল্প সময়ের মাঝে তাকে আবার সামন্তপ্রভুদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে হয়। তার ধনসম্পদের পরিমাণও কমতে থাকে। এক উপাখ্যানে বলা হয়, ‘অসংখ্য প্রভু রাজকীয় নির্দেশনার বিরুদ্ধে যেয়ে বিদ্রোহ করে।’

রাজত্বের ৪৬ বছর পার করার পর হুয়ান মারা যান। তার ছেলে ইউ সিংহাসনে বসেন এবং ঝৌ সাম্রাজ্যের পতনের সম্ভাবনা জোরদার হয়। ইউ’র অভিষেকের প্রায় পরপরই এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প হয় এবং এর ফলে ভূমিধসের সূত্রপাত ঘটে। পাহাড় থেকে নেমে আসা পাথরের টুকরো সব নদীর গতিপথ বন্ধ করে দেয়। ফলে শহরে সুপেয় পানির সরবরাহ প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়।

এক সভাসদ দুঃখের সুরে বলেন, ‘যখন নদীর পানির উৎস বন্ধ হয়ে যায়, তখন নিশ্চিতভাবেই রাজ্য ধ্বংস হয়।’

সে বছরই তিনটি নদী পুরোপুরি শুকিয়ে যায় এবং আরও ভূমিধসের সূত্রপাত ঘটে।

ইউ’র দাদা লি মানুষের মুখ বন্ধ করেছিলেন। একইভাবে, ইউ’র আমলে নদীর মুখ বন্ধ হল। স্বভাবতই, এই দুই ঘটনার মাঝে মিল খুঁজে পান ইতিহাসবিদরা। কেউ কেউ দাবি করেন, ঝৌদের পাপের ফল হিসেবেই এত অশান্তি। মনে হলো যেন, ঈশ্বর তার স্বর্গীয় ম্যান্ডেট সরিয়ে নিয়ে গেছেন চীনের শাসকদের কাছ থেকে।

ইউ নিজেও ছিলেন একজন আরামপ্রিয় ও চরিত্রহীন শাসক। জ্যেষ্ঠ স্ত্রীর ঔরসে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়ার পর তিনি হারেমের নারীদের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি রানী ও তার পুত্রকে বিদায় করে তার এক রক্ষিতা ও জারজ সন্তানকে উত্তরাধিকারী বানাতে তৎপর হয়ে পড়েন। তার উপদেষ্টারা এই উদ্যোগে বাধা দেন, কিন্তু ইউ জোরাজুরি করতে থাকতেন। একপর্যায়ে উপদেষ্টারা ক্ষান্ত দেন। একজন বলেন, ‘দুর্যোগ ঘনীভূত হয়েছে এবং এ বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই।’

নতুন রানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এই রক্ষিতা পুরো রাজপরিবারকে ছারখার করে দেন। তার প্রিয় শখ ছিল সিল্কের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা। ফলে রাজপ্রাসাদে গজের পর গজ মূল্যবান সিল্ক আসতে লাগল। মজার বিষয় হচ্ছে, এই দামি শখ থেকেও তিনি খুব একটা আনন্দ পেতেন না-তার মুখে কখনোই হাসি দেখা যেত না, বা তিনি কখনো শব্দ করে হেসে উঠতেন না।

কথিত আছে, একবার ইউ তার রক্ষিতা-স্ত্রীকে আমোদিত করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন রাজপ্রাসাদের সব আলো জ্বালাবেন এবং জোরে ড্রাম বাজাবেন। বস্তুত এটি ছিল যাযাবর বাহিনী আক্রমণ করার সতর্কবাণী। স্বভাবতই, এত ডামাডোল শুনে রাজার প্রতি বিশ্বস্ত সব প্রভু তাদের সৈন্যসামন্ত নিয়ে রাজপ্রাসাদ প্রতিরক্ষা দিতে চলে আসেন।

তবে প্রভুরা এসে কোনো যাযাবর পেলেন না। তাদের বিস্মিত মুখভঙ্গি দেখে রক্ষিতা রানী খুবই আনন্দ পেয়েছিলেন। সম্ভবত সেবারই তিনি প্রথমবারের মতো জোরে হেসে উঠেন।

তবে রাখাল বালকের গল্পের মতো, খুব শিগগির যাযাবর যোদ্ধারা এল। এই দলটি ‘কুয়ান রং’ নামে পরিচিত ছিল। তারা ঝৌ ভূখণ্ডের উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে এসেছিলেন।

সীমানা পেরিয়ে এসে তারা শহরে হামলা চালালেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন রাজা ইউ’র প্রথম স্ত্রীর আত্মীয়স্বজনরা। বৈধ রানীকে উৎখাত করায় তার আত্মীয়রা স্বভাবতই ইউ’র ওপর খেপে ছিলেন। ফলে প্রথমবারের মতো চীনের ইতিহাসে ভেতরের ও বাইরের শত্রুরা একাট্টা হয়ে কাজ করতে লাগলেন। এই যৌথ হামলায় পুরো সাম্রাজ্য কেঁপে উঠল।

রাজা ইউ এবারও প্রাসাদের সব বাতি জ্বালিয়ে দিলেন। কিন্তু সামন্তপ্রভুরা এতে পাত্তা দিলেন না। একই ভুল দুইবার করতে চাইলেন না তারা।

ফলাফল, একাই যুদ্ধ করে গেলেন ইউ এবং শত্রুর হাতে নিহত হলেন। যাযাবররা রাজপ্রাসাদে লুটতরাজ চালাল, সেই রক্ষিতাকে অপহরণ করল এবং নিজেদের বাসস্থানে ফিরে গেল।

৭৭১ সালে এভাবেই ঝৌরাজের পতন হলো। পশ্চিমাঞ্চলে ঝৌদের আধিপত্যেরও এখানেই সমাপ্তি। তবে তখনও ঝৌ রাজবংশের নির্বাণ হয়নি। কিছু প্রভু তখনও ইউর জ্যেষ্ঠসন্তান পি’ইং-এর প্রতি অনুগত ছিলেন, যাকে রক্ষিতার ছেলের জন্য নিজের উত্তরাধিকার ত্যাগ করতে হয়েছিল।

এই প্রভুরা মিলে পি’ইংকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন।

তবে রাজধানী শহর হাও পি’ইং-এর জন্য নিরাপদ ছিল না। যাযাবররা চলে গেলেও পশ্চিম সীমান্ত তখনও সুরক্ষিত ছিল না এবং হাও এই সীমানার খুব বেশি কাছে ছিল। রাজা পি’ইং সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের আরও পূর্বদিকে, নিরাপদ অবস্থানে চলে যাবেন। সেখানে লোইয়াং শহরে বসে তিনি তার প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করলেন। এই শহরটি ঝৌ’র ডিউক কয়েক শত বছর আগে নিৰ্মাণ করেছিলেন।

চি’ইন নামের একটি ছোট গোত্রের প্রধান পি’ইংকে নিরাপদে তার নতুন রাজধানীতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তার সেনাদল পাঠালেন। তখনও চি’ইন গোত্রের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। তবে এই উদ্যোগে খুশি হয়ে নতুন রাজা পি’ইং চি’ইন গোত্রের প্রধানকে পদোন্নতি দিয়ে প্রভুর পদ দিলেন। তিনি চি’ইনের নতুন ডিউককে তার নতুন পদের সঙ্গে মানানসই উপহার হিসেবে প্রচুর পরিমাণে জমি দিলেন, যার মধ্যে ছিল সদ্য-পরিত্যক্ত পুরনো রাজধানী। ঝৌদের মাতৃভূমির বেশিরভাগ অংশ তখন নিম্নপর্যায়ের প্রভুদের হাতে চলে গেছে। রাজা পি’ইং তার নতুন পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানীতে বসে তার প্রতি অনুগত অল্পকিছু ডিউকের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ছোট এক রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। পশ্চিমা ঝৌ রাজবংশের পতন হলেও পূর্বাঞ্চলে গড়ে ওঠে নতুন এক ঝৌ সাম্রাজ্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *