অধ্যায় ৪৪ – ভারতের যুদ্ধ
৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উত্তরাঞ্চলে রাজা ও রাজত্বের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় বেশকিছু গোত্রের মধ্যে সংঘাতের সূচনা হয়।
চীনে ঝৌ রাজারা বিভিন্ন স্তরের গোত্রদের সঙ্গে দরকষাকষি করছিলেন আর এদিকে ভারতের লোকেরা ভূমির দখল বাড়িয়ে উত্তরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন।
আর্য ও হরপ্পাদের সমন্বয়ে গঠিত জনগোষ্ঠী সিন্ধুনদ থেকে দূরে, বহুদূরে ছড়িয়ে পড়ে। তারা আধুনিক দিল্লির পূর্বের এলাকা দোয়াবে বসবাস করতে শুরু করে। এটা ছিল গঙ্গা ও যমুনা নদের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত একটি অবতলভূমি। মহাভারতের উপাখ্যান মতে রাজা শান্তনু দেবী গঙ্গার প্রেমে পাগল হন এবং তাকে বিয়ে করেন। খুব সম্ভবত এটি আর্যদের গঙ্গা নদের উপত্যকায় যাত্রা করার ঘটনার মহাকাব্যিক বর্ণনা।
আর্যরা আসার আগে এখানে কারা থাকত, সে বিষয়ে আমরা তেমন কিছু জানি না। ঋগ্বেদে ‘দাসা’ (দাস) নামের একটি গোত্রের কথা বলা হয়েছে, যারা প্রাচীরঘেরা শহরে বসবাস করতেন। তবে আর্যরা এসে তাদের এসব প্রাচীর ভেঙে দেয় এবং বাসিন্দাদের নিজেদের অধীনস্থ ‘দাসে’ পরিণত করে। অনেকে মনে করেন দাস বলতে হরপ্পাদের কথাই বোঝানো হয়। তবে এ ধারণা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ আর্যরা সেখানে আসার অনেক আগেই হরপ্পাদের শহরগুলো ধ্বংস হয়ে গেছিল। আর যদি ‘দাস্যু’ বলতে গঙ্গা উপত্যকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের কথা বলা হয়ে থাকে, তাহলেও এটা ভুল, কারণ তাদের আমলের আরও অনেক পরে প্রাচীরঘেরা শহরের আবির্ভাব ঘটেছে। তারা মূলত গ্রামেই থাকতেন।
খুব সম্ভবত আর্যদের বিস্তারের সময় অন্য সব গোত্রের মানুষদের এই এক নাম, ‘দাস’ হিসেবে অভিহিত করা হত। এমনকি দাসদের মধ্যেও অনেকে আর্য বংশের ছিল; তারা ভারতের অন্যান্য অংশে অভিযোজন করেছিল। আর্যরা যখন দাসদের সঙ্গে মারামারি করছিল, তখন দাসদের নিজেদের মধ্যেও চলছিল বিভেদ আর হানাহানি। অনেক কিংবদন্তি আর্য রাজের নামের সঙ্গে দাস ও দাহ উপাধি যুক্ত থাকতে দেখা যায়, যা থেকে ধারণা করা হয়, তারা এই তথাকথিত দাসদের বিয়েও করেছেন।
১০০০ থেকে ৬০০ সালের মধ্যে গঙ্গার চারপাশের উর্বর ভূমির ওপর জন্মেছিল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গল, জলাভূমি, যার ওপরের অংশটি ঢেকে ছিল এক রহস্যময়, ঘন সবুজ উপকরণে। এসব জঙ্গল নিয়ে প্রাচীনতম গল্পগুলোতে বলা হয়েছে এগুলোতে বিভিন্ন বিভীষিকাময় ভূত-প্রেতের আড্ডা ছিল। তবে তার মানে এই না যে, নবাগত আর্যদের প্রতি সেখানকার ‘জীবিত’ বাসিন্দারা সহিংস আচরণ করতেন। সেখানে জঙ্গলই ছিল মানুষের শত্রু। গাছগুলোকে উপড়ে ফেলার প্রয়োজন হলেও, এ ব্যাপারে সে-অঞ্চলের বাসিন্দাদের তেমন কোনো দক্ষতা ছিল না।
জঙ্গলের গাছগুলোর গোঁড়া শক্ত এবং মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত গেছিল। এগুলোকে মাটি থেকে খুঁড়ে বের করলেই তবে গাছ কাটা সম্ভব হতো। জঙ্গলের গভীরে বিষাক্ত সাপসহ বিভিন্ন জানা-অজানা প্রাণীর আনাগোনা ছিল।
তবে সামন্তপ্রভুরা পিছু হটেনি। এর আগে তরবারি ও বর্শা নির্মাণে ব্যবহার হলেও গাছকাটার কুড়াল আর মোটা মোটা লাঙল তৈরিতে প্রচুর পরিমাণে লোহা ব্যবহৃত হতে লাগল। ঋগ্বেদের ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ অংশে আগুনের দেবতা ‘অগ্নির’ পূর্বদিকে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে বনজঙ্গল খেয়ে ফেলার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। খুব সম্ভবত সেখানে আগুন জ্বালিয়ে বন সাফ করার কথাই বলা হয়েছে।
কয়েক শতাব্দী লেগে যায় পুরো জঙ্গল সাফ হতে। এভাবেই সিন্ধুনদের তীরের কৃষিপ্রধান জীবনের শুরু হয়, যার মাধ্যমে ছোট ছোট শহরে আবাদি জমিকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক নতুন সভ্যতা।
হটাৎ করেই ছন্দপতন ঘটে—শুরু হয় এক মহান যুদ্ধ। সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমি নামে পরিচিত এক জায়গায় দুইপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। গঙ্গার উত্তরে বসবাসকারী ও সিন্ধুনদের পূর্বদিকের বাসিন্দাদের মধ্যে এই যুদ্ধ শুরু হয়। জায়গাটা হিমালয় পর্বতমালার ঠিক দক্ষিণে।
যদিও এ যুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে, তবুও, পরবর্তী যুগের কবিরা একে মহাভারতের মহাকাব্যিক যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেমনটি হোমার ট্রয়ের যুদ্ধকে অমর বানিয়েছেন। হোমারও মহাভারতের লেখকদের মতো প্রকৃত ইতিহাসের ওপর তার নিজ আমলের রীতিনীতি অনুযায়ী রঙ চড়িয়েছেন। মহাভারত মতে, এই যুদ্ধের নেপথ্যে রয়েছে এক জটিল, বংশগত কোন্দল। কুরু গোত্রের রাজা মারা গেছেন, কিন্তু কোনো উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারেননি। অর্থাৎ কুরু রাজবংশের ‘বাতি’ জ্বালিয়ে রাখার মতো আর কেউ নেই এবং বংশটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে শুধু বেঁচে আছেন রানীমাতা, মৃত রাজার দুই সন্তানহীন স্ত্রী এবং তার বড়ভাই ভীষ্ম। তবে এক্ষেত্রে ভীষ্ম কোনো কাজে আসছেন না, কারণ বছরকয়েক আগে তিনি এক কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছেন, যার সারমর্ম হল, তিনি কোনোদিন ভাইয়ের সিংহাসন দাবি করবেন না এবং কখনোই বিয়ে করবেন না।
দ্বিধান্বিত রানী তার পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এক বেপরোয়া পদক্ষেপ হাতে নিলেন। তিনি এক মহান তপস্বী ও ঋষি, ভিয়াসাকে খবর দিলেন। এ রহস্যময় ব্যক্তির অপর নাম ছিল কৃষ্ণ, কারণ তার ‘গায়ের রঙ কালো ছিল। ভিয়াসা আসার পর রানী তার কাছে একটি কৃপা ভিক্ষা চাইলেন। তিনি তার দুই ছেলে-বউকে (মৃত রাজার দুই স্ত্রী) সন্তানসম্ভবা করে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করলেন কৃষ্ণের ওপর, যাতে তারা রাজকীয় উত্তরাধিকারীর জন্ম দিতে পারে।
তবে ভিয়াসা শুধু প্রয়াত রাজার জ্যেষ্ঠ স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে সম্মত হলেন। শর্ত দিলেন, ‘যদি তিনি আমার দেহ, আমার মুখাবয়ব, মলিন পোশাক ও গায়ের গন্ধে বিরক্ত না হন’, তবেই তিনি এতে রাজি। রাজকন্যা চোখ বন্ধ করে নিজেকে কৃষ্ণের কাছে সমর্পণ করলেন। এবং ‘সময়মতো এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন, যে সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর মর্যাদা পেল। ধৃতরাষ্ট্র নামের সন্তানটি জন্ম থেকেই ছিল অন্ধ।
রানীমাতা অন্ধ রাজার রাজত্বের আশঙ্কায় ভিয়াসার কাছে ২য় পুত্রবধূকেও পাঠিয়ে দিলেন, এবং যথাসময়ে তিনিও পাণ্ডু নামের এক পুত্রসন্তানের মা হলেন। সিংহাসনের দাবি আরও দৃঢ় করতে রানীমাতা প্রথম পুত্রবধূকে আবারও ভিয়াসার কাছে পাঠালেন, যাতে তিনি আরও এক পুত্রসন্তানের মা হতে পারেন। কিন্তু ভিয়াসার গায়ের ‘অসহ্য দুর্গন্ধ’র কথা চিন্তা করে রাজকন্যা তার পরিচারিকাকে পাঠান। এই মেয়েটিও অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে এবং যথাসময়ে ভিয়াসার তৃতীয় পুত্র সন্তান, বিদুরের জন্ম হয়।
এবার ৩ সৎভাই রাজা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন—তাদের ৩ জনেরই লালন পালন করেন চাচা ভীষ্ম। তিনি তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে উপযুক্ত রাজ-উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রস্তুত করে তোলেন। ৩ ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বিচক্ষণ ও মানবজাতির প্রতি অনুরক্ত ছিল বিদুর। পাণ্ডু ছিলেন অসামান্য ধনুর্বিদ আর ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হলেও অসামান্য শক্তির অধিকারী ছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রকেই কুরুর সিংহাসনের প্রাথমিক দাবিদারের মর্যাদা দেওয়া হয়।
এই উপাখ্যান এমন সময়ের বর্ণনা দেয়, যখন ভারতের কুরু-গোত্র যাযাবর জীবন থেকে উত্তরাধিকারভিত্তিক রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে আগাচ্ছিল। আগে যেমন একদল সেনাবাহিনী পুরো গোত্রের ভালোমন্দ দেখত, সে-যুগে এসে তা রূপান্তরিত হয়ে নিয়মতান্ত্রিক ও বংশগত শাসনব্যবস্থার দিলে হেলে পড়ছিল। ৩ ভাইয়ের জোড়াতালি দেওয়া বংশ-পরিচয় থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, সে- যুগে সরাসরি এক রাজা থেকে তার সন্তানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঐতিহ্য চালু ছিল, তবে তা অতটা বলিষ্ঠ ছিল না। তখনো, ইটানার আমলের মতো, পিতা থেকে পুত্রের কাছে ক্ষমতা যাওয়ার বিষয়টির সঙ্গে ঐশ্বরিক ব্যাপার-স্যাপার জড়িত ছিল, যা পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আরও ভালো করে জানা যাবে।
উত্তরের গান্ধারা গোত্রের ধর্মপ্রাণ ও সুন্দরী রাজকন্যা গান্ধারীকে বিয়ে করেন ধৃতরাষ্ট্র। তিনি চাইতেন তার ১০০টি পুত্রসন্তানের জন্ম হবে, যাতে কোনো পরিস্থিতিতেই তার স্বামীর প্রয়াণের পর উত্তরাধিকারী খুঁজে পেতে সমস্যা না হয়। এ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি তার শ্বশুর ভিয়াসার কাছে ধর্না দেন। অলৌকিকভাবে, ভিয়াসার আশীর্বাদে টানা দুই বছর অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন গান্ধারী। যখন গান্ধারীর সন্তান অবশেষে পৃথিবীর আলো দেখে, সেটি কোনো সন্তান ছিল না, বরং ছিল একটি ইস্পাত-কঠিন মাংসপিণ্ড। ভিয়াসা একে কেটে ১০০ ভাগে ভাগ করেন, এবং টুকরোগুলো শিশুতে পরিণত হয়।
যদিও প্রতিটি সন্তানের বয়স এক ছিল, তবুও ‘দুর্যোধন’কে জ্যেষ্ঠ সন্তান ও রাজার উত্তরাধিকারীর মর্যাদা দেওয়া হয়।
ইতোমধ্যে দ্বিতীয় ভাই পাণ্ডুও বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। তবে তিনি তার বড়ভাইয়ের চেয়ে এক ডিগ্রি এগিয়ে ছিলেন—তিনি দুই প্রতিবেশী গোত্রের (ইয়াদু ও মাদ্রা) দুই রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। তার জ্যেষ্ঠ স্ত্রী যুধিষ্ঠির নামের এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। যেহেতু গান্ধারী ২ বছর অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, যুধিষ্ঠির গান্ধারীর ১০০ সন্তানের আগেই ভূমিষ্ঠ হন। এ কারণে, যুধিষ্ঠির তার পরিবারের সর্বজ্যেষ্ঠ উত্তরাধিকারী হওয়ার দাবি তুলতে পারতেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ ঘটনার অল্প কিছুদিন আগে এক রগচটা ঋষির অভিশাপে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা হারান পাণ্ডু। অর্থাৎ, কোনো এক অজ্ঞাত ব্যক্তি গোপনে তার স্ত্রীর সঙ্গে মেলামেশা করছিলেন, এবং এটি একবারের ঘটনা ছিল না। তার স্ত্রী আরও দুই পুত্রের জন্ম দেন আর অপরদিকে তার কনিষ্ঠ স্ত্রী যমজ সন্তানের মা হন।
অর্থাৎ, অন্যভাবে বলতে গেলে, পুরো কুরু-গোত্রে কোনো ‘নিষ্কণ্টক’ বংশপরম্পরা ছিল না। এক্ষেত্রে বংশগত শাসনক্ষমতার পুরো ধারণাই অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়ায়।
এই অনিশ্চয়তার হাত ধরে আসে সংঘর্ষ। ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু উভয়ই তাদের নিজ পরিবারকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এসেছিলেন। শিগগির ধৃতরাষ্ট্রের ১০০ সন্তান (‘কৌরব’ নামে পরিচিত ভাইদের নেতা ছিলেন দুর্যোধন) ও পাণ্ডুর ৫ সন্তান (‘পাণ্ডব’ নামে পরিচিত এই ভাইদের নেতৃত্বে ছিলেন বড়ভাই যুধিষ্ঠির)।
গঙ্গার ওপরের দিকের অংশে অবস্থিত কুরু রাজ্যের রাজধানী হস্তিনাপুরাকে ঘিরে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। কৌরবরা প্রাথমিকভাবে শহরটির দখল নিয়ে নেয়।
ইতোমধ্যে, মহাভারত মতে, পাণ্ডুর ৫ ছেলের সবাই একই মহিলাকে বিয়ে করেন। পূর্বাঞ্চলের গোত্র পাঞ্চালার রাজার অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়ে দ্রৌপদী মহাভারতের কেন্দ্রীয় নারীচরিত্র।
দ্রৌপদীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে : ‘কৃষ্ণ গাত্রবর্ণ ও ফুলের পাপড়ির মতো চোখ’। তার শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনা ও পূর্বাঞ্চলে বসবাসের উপাখ্যান থেকে ধারণা করা যায়, তিনি এক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর রাজার কন্যা ছিলেন। ভিয়াসাকে কৃষ্ণবর্ণের হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যা থেকে পাঞ্চালা গোত্রকে আর্যদের থেকে খুব একটা আলাদা বলে বোধ হয় না। নিশ্চিতভাবে, বেশ কয়েক যুগ ধরে আর্যরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে মেলামেশা করে আসছিলেন।
তবে পূর্বাঞ্চলের গোত্রগুলোতে আর্য রক্ত কম ও স্থানীয়দের আধিপত্য বেশি ছিল। গঙ্গার পূর্ব-উপত্যকায় যারা বসবাস করতেন, তাদের জন্য আর্যদের বিশেষ একটি নাম ছিল—স্লেচ্ছ। পাঞ্চালা গোত্রও এরকম একটি ম্লেচ্ছ গোত্র ছিল।
কৌরব ভাইরা অন্যান্য আর্য গোত্রদের সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছিল। কিন্তু পাণ্ডব ভাইরা স্থানীয়দের সঙ্গে কৌশলগত আঁতাত গড়ে তোলে।
পাঞ্চালার মিত্র হওয়ার কয়েক বছর পর পাণ্ডবরা কৌরবদের দখল-করা ভূমির দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে ইন্দ্রপ্রস্থ নামের জায়গায় আরেকটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করলেন। তারা তাদের সবচেয়ে বড়ভাই যুধিষ্ঠিরের অভিষেক অনুষ্ঠান করে তাকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন। এটা ছিল হস্তিনাপুরার কৌরব রাজের কর্তৃত্বের প্রতি ছুড়ে দেওয়া সরাসরি চ্যালেঞ্জ।
স্বভাবতই কৌরবরা এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, বিশেষত নতুন রাজপ্রাসাদের শানশওকতের বিবেচনায়। প্রাসাদটিতে সোনালি রঙের পিলার ছিল, যেগুলো চাঁদের মতো ঝলমল করত এবং রাজসভার হলে ছিল বিশাল একটি অ্যাকুরিয়াম, যার মধ্যে ছিল ‘অসংখ্য পদ্ম ফুল, বিভিন্ন ধরনের পাখি, কচ্ছপ ও মাছ।’ কৌরবদের রাজা দুর্যোধন তার চাচাতো ভাইয়ের প্রাসাদ দেখতে এলেন। প্রাসাদের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি ‘প্রতিপক্ষ’কে বাজিয়ে দেখাও ছিল তার অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রাসাদে ঢুকে তিনি মোটামুটি হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি যখন আয়নার মতো স্বচ্ছ মেঝেযুক্ত হলঘরে পৌঁছালেন, তখন তিনি সেটাকে পানি ভেবে কোমর পর্যন্ত পোশাক তুলে আগাতে উদ্যত হলেন। প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিনি খুবই বিব্রত হলেন। তারপর পুকুরপাড়ে এসে সেটাকে কাচ ভেবে নির্ভয়ে এগিয়ে গেলেন দুর্যোধন। স্বভাবতই, পানিতে পড়ে গিয়ে সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে ফেললেন তিনি। মহাভারত আমাদের জানায়, এই বোকামিতে ‘প্রাসাদের চাকর-চাকরানীরা হেসে কুটি কুটি হলেন। একইসঙ্গে হাসলেন পাণ্ডব-ভাইরা, তাদের চাচা ভীমা ও ‘বাকি সবাই’, এবং দুর্যোধন তাদের এই উপহাস মেনে নিতে পারলেন না।
তবে তখনো চাচাতো ভাইদের মাঝে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়নি। দুর্যোধন ঠিক করলেন, একটি সূক্ষ্ম চাল চালবেন। তিনি পাণ্ডব ভাইদের নিজের প্রাসাদ দেখতে ডাকলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে পাশা খেলার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন।
ভাইদের পক্ষে খেলায় অংশ নিতে রাজি হলেন যুধিষ্ঠির। প্রথমে তিনি তার সব হীরে-জহরত হারালেন। এরপর তিনি তার সব ধনসম্পদ, সৈন্যবাহিনী এবং অবশেষে রানী দ্রৌপদীকেও বাজিতে হারালেন।
সবশেষে তিনি তার পুরো রাজত্ব বাজি ধরলেন। যদি তিনি হারেন, তবে তিনি ও তার ভাইরা ইন্দ্রপ্রস্থ ছেড়ে ১২ বছরের নির্বাসনে চলে যাবেন—এ শর্তেও রাজি হয়ে গেলেন।
ঋগ্বেদে একটি কবিতা আছে, যেখানে এক হতভাগা জুয়াড়ির কথা বলা হয়েছে, যার পরিত্যক্তা স্ত্রী দেনা, ভয় ও অর্থের অভাবে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে রাতের আঁধারে ঘুরে বেড়াতে থাকে। এ থেকে বোঝা যায়, সে আমলের ভারতীয়দের মাঝে জুয়াখেলার মরণনেশা ভালোভাবেই জাঁকিয়ে বসেছিল। এই জুয়া-জ্বরেই সব হারালেন যুধিষ্ঠির। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার ভাইকে তার পেছন পেছন বনবাসে চলে যেতে বাধ্য হলেন। ইতোমধ্যে দুর্যোধন ও অন্যান্য কৌরবরা তাদের প্রাসাদ ও ভূখণ্ডের দখল নিলেন।
তাদের বনবাস হয়েছিল পূর্বাঞ্চলের সেই রহস্যে ঘেরা ও সভ্যতার ছোঁয়া বিবর্জিত জঙ্গলে। তবে এই ১২ বছরের বনবাস বৃথা যায়নি; পাণ্ডবদের প্রত্যেকের যুদ্ধকৌশল ও শক্তিমত্তা বেড়ে যায়। উপাখ্যান মতে, তাদের নতুন ধনুক ও তিরগুলো ভাঙা সম্ভব ছিল না, কারণ সেগুলো ঐশ্বরিক আশীর্বাদ পেয়েছিল। তবে প্রকৃত সত্য হতে পারে এটাই যে, সেগুলো নতুন জাতের কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল—যেমনটি এর আগে সিন্ধুনদের তীরে বসবাসকারীরা দেখেননি।
১৩তম বছরে পাণ্ডবরা ফিরে এলেন, কিন্তু দুর্যোধন তাদের প্রাসাদ ও ভূমি ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার জানালেন। ফলে ভাইদের মধ্যে দেখা দিল দ্বন্দ্ব, যা রূপ নিল ‘ভারত যুদ্ধে’।
পাণ্ডব ভাইরা বিভিন্ন স্থানীয় গোত্র ও পাঞ্চালা গোত্রসহ তাদের অন্যান্য আত্মীয়দের নিজেদের দলে টানতে সমর্থ হলেন। তবে দল ভারীর কাজে কৌরবরা কিছুটা ভালো অবস্থানে ছিল। তারা দ্বিধান্বিত অবস্থায় থাকা সকল আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্য গোত্রদের বোঝাতে সমর্থ হলেন যে, তারাই সিংহাসনের প্রকৃত দাবিদার। ফলে পাণ্ডবদের ৭ ডিভিশন সেনার চেয়ে কৌরবরা ১১ ডিভিশন সেনা নিয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকল।
সেনাবাহিনীর এক ডিভিশনে প্রথাগতভাবে যত সেনা নিয়োগ দেওয়া হয়, সেভাবে হিসেব করলে কৌরবের বাহিনীতে ২ লাখ ৪০ হাজার রথ ও সমসংখ্যক হাতি-যোদ্ধা ছিল। সঙ্গে ৭ লাখ ঘোড়সওয়ার ও ১০ লাখ পদাতিক সেনাও ছিল। অপরদিকে পাণ্ডবদের পক্ষে ৭ লাখ ৫০ হাজার পদাতিক সেনা, ৪ লাখ ৬০ হাজার ঘোড়সওয়ার, ১ লাখ ৫৩ হাজার রথ ও একই সংখ্যক হাতি ছিল। এই সংখ্যাগুলো খুব সম্ভবত অতিরঞ্জিত, তবে নিঃসন্দেহে এই বড় আকারের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অনেক সেনা হতাহত হয়।
হোমার যেভাবে ট্রয়ের যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন, কিছুটা একইভাবে মহাভারতেও সে আমলের প্রাগৈতিহাসিক যুদ্ধকৌশলের পরিবর্তে আরও পরবর্তী যুগের (অর্থাৎ মহাভারতের লেখকদের যুগের) রীতিনীতির কথা বলা হয়েছে। মহাভারত মতে, এই যুদ্ধে ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করতে বেশকিছু নিয়ম নির্ধারণ করা হয়েছিল। একা একজন সৈন্যকে প্রতিপক্ষের ‘সেনাদল’ আক্রমণ করতে পারবে না। দুজন সেনা একে অপরের মুখোমুখি হলে দুজনের হাতে একই অস্ত্র থাকতে হবে। আহত বা অজ্ঞান কোনো সেনাকে হত্যা করা ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ। একই সঙ্গে, পেছন থেকে কোনো সেনাকে আক্রমণ করাও ছিল বেআইনি। এছাড়াও, প্রতিটি অস্ত্র ব্যবহারের বিস্তারিত ও সূক্ষ্ম নিয়ম-কানুন ছিল, যা অনুসরণ না-করার কোনো উপায় ছিল না।
এ-ধরনের নিয়মের অস্তিত্ব থেকে মনে হয়, এটি বেশ সভ্য একটি যুদ্ধ ছিল। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, আরও কয়েক শত বছরের আগে এসব নিয়মের কথা কেউ ভাবতেও পারেনি।
নিঃসন্দেহে, মহাভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত অংশটি হচ্ছে ‘ভগবৎ গীতা’ বা ‘ভগবানের গান’। এই অংশটিতে যুদ্ধের সময়কালীন বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। পাণ্ডবের অন্যতম রাজপুত্র অর্জুনের (যে ছিল মধ্যম পুত্র এবং সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত) বাহিনীর রথচালকের ছদ্মবেশে ছিলেন কৃষ্ণ নিজে। তিনি অর্জুনকে এক নৈতিক দ্বিধা থেকে বের হয়ে আসতে সহায়তা করেন। যেহেতু যুদ্ধের উভয় পক্ষে তাদের আত্মীয়-স্বজনরাই মূলত অংশ নিচ্ছিলেন, তার মনে সন্দেহ আসে—কোটা বেশি ভালো হবে : আক্রমণ করা, নাকি আত্মীয়-বধ না করে নিজেই তাদের কাছে প্রাণদান করা?
তবে প্রাচীন এই যুদ্ধটি এমন কিছু মানুষের মাঝে বেঁধেছিল, যারা অল্পদিন আগেও যাযাবর যোদ্ধা-নিয়ন্ত্রিত গোত্রের সদস্য ছিলেন। মহাভারত তার চরিত্রদের বিভিন্ন নৈতিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে সুন্দর করে উপস্থাপন করলেও, ক্ষেত্রবিশেষে এই যুদ্ধের সহিংস প্রকৃতিও উঠে এসেছে গল্পে। পাণ্ডব ও কৌরব, উভয়ের আত্মীয় ভীষ্ম কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে তিনি পাণ্ডব রাজপুত্র ও তার নিজের চাচাতো ভাই দুঃশাসনকে হত্যা করেছিলেন। তারপর যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি দুঃশাসনের রক্ত পান করেন এবং জয়ের আনন্দে নাচানাচি করতে থাকেন—একেবারে বন্য পশুর মতো।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবরা জয়লাভ করে, সঙ্গে তাদের মিত্র হিসেবে ছিল বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা। কিন্তু এই জয় পেতে তাদেরকে অনেক বড় মূল্য চোকাতে হয়। কৌরবরা আত্মসমর্পণ করার আগে তাদের বেশিরভাগ সেনা নিহত হয়েছিল।
মহাভারতে যুদ্ধের এই রক্তাক্ত উপসংহার নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। কাহিনির শেষ অংশে পাণ্ডব রাজপুত্র যুধিষ্ঠির পরকালে যাওয়ার পর পবিত্র গঙ্গানদীতে ডুব দেন। তারপর তিনি তার মানবদেহ ত্যাগ করে আবারও উঠে আসেন। মহাভারত আমাদের জানায়, ‘এই পুণ্যস্নানের মাধ্যমে’, তিনি সবধরনের শত্রুতা ও দুঃখবোধ থেকে চিরতরে মুক্তি পান। তিনি স্বর্গীয় রাজ্যে তার সব ভাই ও চাচাতো ভাইদের খুঁজে পান। তারাও সবধরনের ঘৃণা থেকে মুক্ত হয়েছেন। সেখানেই, ‘মানবিক রাগমুক্ত বীর হিসেবে’ সেখানেই পাণ্ডব ও কৌরবরা বসবাস করতে থাকেন—একে অপরের সান্নিধ্যে, সবধরনের জাগতিক সংঘাত ও রাজা- বাদশাহদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে থেকে