৪০. পুশকিন
অন্য কোনও নদীর পাশে দাঁড়িয়ে ওঠে ঘুম
গাছের পাতায় শেষ হল প্রায় বাদামি মরসুম
কাঁধের ঝোলা, রুপোর লকেট, ফেরত আসা খাম
শূন্য আমার বুকপকেটে তোমাকে রাখলাম
তুমিও রেখো আমার তারা, নৌকোবেলার ছই
এই জন্মের অনেক আগেই আমরা কিছু হই
ভাবতে আমার ভালই লাগে! ভাবতে জীবন শেষ…
তোমার থেকে দূরের বলেই, দিন যেন দরবেশ
ভিক্ষে আমার রাজার মোহর, অন্ন সোনার ক্ষীর!
আমার হয়ে তোমার কাছে থাকুক জোনাকি…
গাড়ির সামনে বসে স্মরণ গোটা লেখাটা সময় ধরে বলে গেল।
বিকেল নামছে এখন। বাইপাসে গাড়িরা হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিনের ডিপ্রেশনের পরে, আকাশ ভরে রোদ উঠেছে কলকাতায়। ঠান্ডাটাও পড়েছে তার সঙ্গে। নতুন বছরের উৎসবের আমেজ শহরের চোখে-মুখে লেগে রয়েছে এখনও! আর, এই সময়ে ওকে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে! পুশকিনের হাসি পেল। জীবন এক অদ্ভুত জার্নি! যখনই ওর মনে হয়েছে যে, গন্তব্য পেয়ে গিয়েছে তখনই জীবন এক মোচড়ে সব উলটে-পালটে দিয়েছে। আবার এমন জায়গায় এনে ফেলেছে যেখান থেকে নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়েছে ওকে।
আজ সন্ধের ফ্লাইটে দিল্লি যাচ্ছে পুশকিন। তারপর সেখান থেকে কাল বুদাপেস্ট। হাঙ্গেরির এক অদ্ভুত সুন্দর শহর। সেখানে দু’বছরের জন্য চলে যেতে হচ্ছে পুশকিনকে।
স্মরণ পেছন ফিরে বলল, “ডায়েরিটার সব লেখা আর পড়ার মতো নেই। কিন্তু চার-পাঁচটা পাতা যা পড়া যাচ্ছে, তার মধ্যে এটা আমার বেশ লেগেছে। তাই না রে নোঈ?”
পুশকিন কিছু না বলে হাসল। দেখল পাশে বসা নোঈর মুখ থমথমে। স্মরণের কথাটা যেন শুনলই না!
স্মরণ বুঝল, ওর এখন কথা বলা বিশেষ ঠিক হবে না। ও সামনে ঘুরে নিজের মনে শুধু বলল, “যাঃ শালা! সব মেয়েই কেমন প্যাঁওয়ের মতো হয়ে যাচ্ছে!” তারপর কোলে রাখা ব্যাগ থেকে একটা ইয়ারফোন বের করে মোবাইলের সঙ্গে লাগিয়ে কানে গুঁজে নিল।
পুশকিন আলতো করে নোঈর হাতটা ধরল এবার। নোঈ তাকাল মুখ তুলে। ফরসা মুখটা গোলাপি হয়ে আছে। চোখ দুটো বেশ লাল।
পুশকিন আলতো গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? এমন মুখ করে আছ কেন?”
নোঈ কিছু না বলে তাকিয়েই রইল।
পুশকিন হাসল, “কী পাগলি দ্যাখো! এমন কেউ করে? কিছু তো বলো! সেই বাড়ি থেকে বেরোনোর পর একটাও কথা বলোনি! কী হয়েছে?”
নোঈ মাথা নামিয়ে নিয়ে বলল, “আমি কী আর বলব! আপনি তো ছেড়েই চলে যাচ্ছেন! দু’বছরের জন্য। তা হলে? আর কিছু কি বলার থাকতে পারে? আমি জানি লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ টেকে না। আমার তাই কিছু বলার নেই।”
পুশকিন হাসল।
“আপনি হাসছেন?” নোঈ আহত চোখে তাকাল ওর দিকে, “আপনার কাছে হয়তো সহজ এটা, কিন্তু আমার কাছে মোটেও সহজ নয়।”
পুশকিন নোঈর হাতে অল্প চাপ দিল। তারপর বলল, “দেখাই যাক না কী হয়।”
নোঈ চোয়াল শক্ত করে বলল, “কী দেখার আছে এর মধ্যে! আপনি চলে গেছেন আমাকে ছেড়ে। এন্ড অফ স্টোরি।”
পুশকিন মাথা নামিয়ে নিল। নোঈকে কী বলবে ও? আর তো বলার কিছু বাকি নেই। সব তো জানা-বোঝা হয়ে গেছে।
“আর শুনুন,” নোঈ আবার ডাকল।
পুশকিন মুখ তুলে তাকাল আবার।
“ওই ব্যাপারে আপনার কোনও দোষ নেই। ছিলও না। আর নেইও! শুধু-শুধু নিজেকে আর টরমেন্ট করবেন না!”
পুশকিন হাসল। স্মিতার ব্যাপারে ওর দোষ ছিল কি ছিল না, সেটা নিয়ে আজও ওর সংশয় আছে। এটা কাউকে বলেনি আজ পর্যন্ত। কিন্তু নোঈকে বলেছে! নোঈকে সব কিছু বলতে পারে ও!
বাড়ির অমতে স্মিতাকে বিয়ে করেছিল পুশকিন। বাড়ি থেকে একরকম বের করেই দেওয়া হয়েছিল ওকে। তবে তাতে কষ্ট পেলেও ভেঙে পড়েনি পুশকিন। মা মারা যাওয়ার কিছু সময় পরে চাকরি নিয়ে প্যারিস চলে গিয়েছিল ও। স্মিতার সঙ্গে কী ভাল কেটে ছিল প্রথম দুটো বছর। তারপর কাজের চাপ বাড়তে লাগল। স্মিতার সঙ্গে সময় কাটানোটা কমতে লাগল একটু-একটু করে। আর জীবনের ঠিক এই জায়গায় স্মিতার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল তমালের।
স্মিতা যে ওর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছে, সেটা কিছুদিন পরে বুঝতে পেরেছিল পুশকিন। ফোন সারাক্ষণ কানে। সব সময় অন্যমনস্ক। কাছে আসতে চাইছে না। খিটখিট করছে।
পুশকিন তাই সোজা একদিন ধরেছিল ওকে। জিজ্ঞেস করেছিল, কী এমন হয়েছে যে স্মিতা এমন করছে? কিন্তু উত্তর পায়নি। কথা কাটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল স্মিতা। বলেছিল না, কিছুই হয়নি। সবই ঠিক আছে।
মিথ্যের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, বেশিদিন চাপা থাকে না। এটাও থাকেনি। এক শুক্রবার অফিস ফেরার পথে তমাল আর স্মিতাকে একটা রোড সাইড ক্যাফেতে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল পুশকিন। সারা পৃথিবী ভুলে দু’জন দু’জনকে আঁকড়ে ধরে চুমু খাচ্ছিল!
পুশকিন নড়তে পারেনি। বিশ্বাস করতে পারেনি। এটা কী দেখছে ও চোখের সামনে? এটা সত্যি স্মিতা তো? আর তমাল এখানে কী করছে! স্মিতাই বিয়ের আগে ওকে তমালের ছবি দেখিয়েছিল। তাই তমালকে চিনতে ওর অসুবিধে হয়নি।
পুশকিন কী করবে বুঝতে পারছিল না। বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ওদের সামনে। স্মিতা চুম্বনের আবেশে প্রথমে বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। তারপর পুশকিনকে চিনতে পেরে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল। তমালও উঠে দাঁড়িয়েছিল স্মিতার পাশ থেকে। তারপর আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল ওখান থেকে।
স্মিতা কী বলবে বুঝতে পারছিল না। থরথর করে কাঁপছিল শুধু। মুখ-চোখ লাল হয়ে গেছিল। ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে আর কিছুই বলতে পারছিল না।
পুশকিন শুধু বলেছিল, “তোমায় এই অবস্থায় রেখে ও দৌড়ে চলে গেল! পালিয়ে গেল!”
পরের দু’সপ্তাহ কী করে কেটেছিল, সেটা আর স্পষ্ট মনেও নেই পুশকিনের। সব কেমন ঘষা কাচ দিয়ে ঢাকা যেন। পুশকিন অফিস যায়নি। কারও ফোন ধরেনি। কিছু করেনি। শুধু নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রেখে মদ খেয়ে গেছিল। সারা জীবন যে-মানুষটা মাত্র দুই বা তিনবার মদ ছুঁয়েছিল, সে ওই দু’সপ্তাহের গোটাটাই ডুবেছিল অ্যালকোহলে। স্মিতা কিছু বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শোনেনি পুশকিন, কিচ্ছু শোনেনি।
ও তো সরেই গেছিল। সামনেও তো যায়নি। তা হলে কেন ওকে জোর করে নিজের জীবনে নিয়ে এসেছিল স্মিতা! ও স্মিতার জন্য সব ছেড়েছে। কারও কথার কোনও গুরুত্ব দেয়নি। সেখানে স্মিতা এটা করতে পারল? এই কি প্রেম? এই ভালবাসা? মানুষ কেন অন্যের ইমোশন নিয়ে, জীবন নিয়ে খেলে? কী পায় খেলে? বাবা মায়েরা কি এদের ছোটবেলায় পুতুল কিনে দেয়নি, খেলনা কিনে দেয়নি যে, বড় হয়ে মানুষকে নিয়ে খেলে সেই অভাব পূর্ণ করতে হবে?
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল পুশকিন। যেন কুয়াশার কোনও শহরে চলে গিয়েছিল। আর তেমনই একটা আবছা রাতে আচমকা কী যেন পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়েছিল ও। কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি। মাথা টলছিল। কিছু স্পষ্ট হচ্ছিল না পুশকিনের কাছে। মনে হয়েছিল সত্যি কিছু শুনেছিল কি? মনের ভুল নয় তো? তাই সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল আবার।
তারপর অনেক রাতে ঘুম ভেঙেছিল। নেশা কাটলেও টলমল করছিল মাথা। মনে হচ্ছিল নৌকোয় ভেসে আছে যেন। ও কোনওরকমে ঘর থেকে বেরিয়েছিল বাথরুম যাবে বলে। আর তখনই দেখেছিল ব্যাপারটা।
দেখেছিল, রান্নাঘরের সামনে পড়ে আছে স্মিতা। মুখ-চোখ নীল! স্থির! এটা কী হল? ও প্রায় দৌড়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসেছিল স্মিতার সামনে। স্মিতার ঠোঁটে পাঁউরুটির গুঁড়ো লেগে ছিল। পাশে পড়েছিল আধখাওয়া একটা রুটি।
কী হয়েছে বুঝতে পারছিল না পুশকিন। ও দ্রুত মোবাইল নিয়ে ওয়ান ওয়ান টু নম্বরে ডায়াল করেছিল। মেডিক্যাল সার্ভিস চেয়েছিল। আর, কী করবে বুঝতে পারছিল না। সাধ্যমতো স্মিতার গলার কাছে, হাতে, পালস পাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পাচ্ছিল না। কেমন একটা লাগছিল পুশকিনের। কী হল এটা? ও এদিক-ওদিক দেখছিল। কী খেল স্মিতা? কী করে হল এমন? আর তখনই চোখ পড়েছিল একটা আধখোলা কৌটোয়। গায়ে কোনও লেবেল নেই। ও দ্রুত ভেতরের আঠালো জিনিসটা আঙুলে তুলে মুখে দিয়েছিল। পি নাট বাটার। পাশেই আর-একটা প্যাকেট খোলা ছিল। প্রন চিপ্স। আরে, বাদাম আর চিংড়িতে তো স্মিতার ভয়ংকর অ্যালার্জি! ও এ দুটো খেয়েছে কেন? ও তো জানত এটা খেলে খুব শরীর খারাপ করে! তা হলে? লেবেল ছিল না বলে বুঝতে পারেনি! স্মিতার অ্যালার্জি হলে শরীরের ভেতরে হয়! বাইরে বিশেষ লক্ষণ দেখা যায় না! আর এই ব্যাপারটা যে মারাত্মক, সেটা তো ডাক্তার বলে দিয়েছিল বারবার!
ইমার্জেন্সি মেডিকাল সার্ভিসের লোকজন এসেছিল। ওরা বের করে নিয়ে যাচ্ছিল স্মিতাকে। পুশকিন কী করবে বুঝতে পারছিল না! ওকে ওরা প্রশ্ন করছিল নানারকম। কী হয়েছে? কী করে হয়েছে? সব জানতে চাইছিল। কিন্তু স্পষ্ট করে উত্তর দিতে পারছিল না পুশকিন। ওরাও বুঝতে পারছিল যে, ও সুস্থ নেই!
অ্যাম্বুলেন্সে বসে স্মিতার দিকে তাকিয়েছিল পুশকিন। নিথর দেহ! ওরা নানারকমভাবে চেষ্টা করছিল। কিন্তু স্মিতার সাড় ছিল না কোনও। হাতটা কেমন ঠান্ডা। মুখটা নীলচে। পুশকিনের চোখ ঝাপসা হয়ে গেছিল। কী করল এটা স্মিতা! ও কি বুঝতে পারেনি? ও কি নিজেও মানসিক চাপে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল? পুশকিন কি দায়ী এর জন্য? সেই শব্দটা তা হলে সত্যি শুনেছিল! সেটা তা হলে স্মিতার পড়ে যাওয়ার শব্দ ছিল! স্মিতা তো ওর ঘরে আসত না। কিন্তু ওই অবস্থায় একবারও কি ওকে বলতে পারত না যে, শরীর খারাপ লাগছে! কেন এমন করল স্মিতা? কীসের জন্য এমনটা হল? পুশকিন কেন শব্দটা শুনে বেরিয়ে গেল না একবার?
পুশকিন গাড়ির মেঝের মধ্যে বসে স্মিতার হাতে মুখ গুঁজে দিয়েছিল। দু’সপ্তাহের জমে থাকা কান্না যেন সব বেরিয়ে আসছিল হু হু করে। নিজেকে আটকাতে পারছিল না পুশকিন। গাড়িতে থাকা প্যারামেডিকরা ওকে জাপটে ধরে সরিয়ে নিতে চাইছিল। কিন্তু পুশকিন কিছুতেই ছাড়ছিল না স্মিতার হাত। মনের মধ্যে ভেসে আসছিল সেই প্রথম দিন বেঞ্চে বসে থাকা স্মিতা! একসঙ্গে বাড়ি ফেরা স্মিতা! সেই ভারী বৃষ্টির মধ্যে গাড়ির মধ্যে ওর পাশে বসে থাকা স্মিতা! যার জন্য সব ছাড়ল, সে যদি এমন করে চলে যায় তা হলে আর কী থাকে মানুষের? নিজেকে শূন্য, একাকী আর ভাঙা মনে হচ্ছিল ওর।
স্মিতা যে মারা গেছে, সেটা মেনে নিতে অনেকদিন লেগেছিল পুশকিনের! চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছিল। কারও সঙ্গে মিশত না। কথা বলত না। যোগাযোগ রাখত না। কেমন একটা একলা মানুষ হয়ে গিয়েছিল ও। শুধু মনে হত, ওর জন্যই কি মারা গেল স্মিতা! ও-ই কি মেরে ফেলল মেয়েটাকে? যে ওর সঙ্গে থেকে খুশি নয়, তাকে তো ছেড়ে দেওয়াই ভাল। কিন্তু ও অমন ব্যবহার করেছিল বলেই কি স্মিতা মেনে নিতে পারেনি? কিছু বুঝত না পুশকিন। মাথা পুরো সাদা হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে মনে হত মরুভূমির মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে একা।
পাক্কা এক বছর এমন একলা হয়ে ছিল পুশকিন। তারপর ধীরে-ধীরে নিজেকে সামলেছিল। নিজের দিকে তাকিয়েছিল। কাজ খুঁজে, ইন্টারভিউ দিয়ে আবার চাকরি পেয়েছিল একটা। বিদেশের পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে এসেছিল। আবার নতুন করে জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করেছিল।
বাবা আর ভাইও ক্রমে ওকে নিজেদের জীবনে মেনে নিতে, ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছিল। ছেড়ে যাওয়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সংসারের লোকজন আবার কাছে আসতে শুরু করেছিল। ধীরে হলেও সময় কাটছিল। আর তারপর গতবছর ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকা থেকে এসেছিল ওর ভাই। দীনবন্ধু। তার মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা হয়েছিল। বাবা জোর করেই পুশকিনকে পাঠিয়েছিল ডিনোর সঙ্গে। পুশকিনের ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু, তাও গেছিল ও। ভেবেছিল, অনেক নিজের ইচ্ছেয় চলা হয়েছে। আর নয়। ওর মনে হয়েছিল এবার অন্যদের কথাও কিছু শোনা উচিত।
তবে বাবার কথা শোনাটা খারাপ কিছু হয়নি। ডিনোর জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে থমকে গিয়েছিল পুশকিন। নোঈ এসে বসেছিল ওদের সামনে। গম্ভীর মুখ। মাথা নিচু। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এভাবে এসে বসতে হচ্ছে বলে মোটেও খুশি নয়।
ডিনো কথা বলতে শুরু করাতে মুখ তুলে তাকিয়েছিল মেয়েটা। আর পুশকিন দেখেছিল কী বিশাল চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল জীবন!
পুশকিনের একটা অদ্ভুত ভাললাগা আসছিল হঠাৎ! এতদিন পরে আবার সব কিছু ভাল লাগছিল ওর। কেন কে জানে মনে হচ্ছিল জীবনের আসলে মানে আছে এখনও। এখনও কিছু ফুরিয়ে যায়নি। নতুন করে সত্যি যে শুরু করা যেতে পারে সেটা নিজের কাছে ক্রমশ আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছিল।
কিন্তু পাশাপাশি নিজেকে আটকাচ্ছিলও পুশকিন। কীসের জন্য এরকম মনে হচ্ছে, এই কারণটা কিছুতেই মনের মধ্যে আসতে দিতে চাইছিল না। কিন্তু আমাদের মন বড্ড একরোখা। গোঁয়ার। কিছুতেই সে লুকোনো জিনিসকে লুকিয়ে থাকতে দেয় না। ঘাড় ধরে বের করে আনে। তাই আইকা যেদিন রবীন্দ্র সদন মেট্রোর সামনে ওর সঙ্গে আবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল নোঈর, সেদিনই পুশকিন বুঝেছিল জল বিপদসীমা পার করেছে!
কিন্তু ইচ্ছেই কি সব? আমাদের চাওয়াগুলোই কি সব? ওর জীবনের সঙ্গে এভাবে মিশলে নোঈর কোনও ক্ষতি হবে না তো! আর জয় বলে ছেলেটি ওর চেয়ে কমবয়সি। তাকে একসময় খুব ভালবাসত নোঈ। সে যদি আবার তমালের মতো ফিরে আসে? আবার ওকে যদি দেখতে হয় সেই ক্যাফের মতো দৃশ্য? তা হলে? ভয় হয় পুশকিনের। কষ্ট পেতে এখন বড় ভয় করে। তার চেয়ে একাই তো ভাল। নোঈ যদি ওকে কষ্ট দেয় সেটা আর ও নিতে পারবে না।
“আমি জানি আপনি আমায় খারাপ মেয়ে ভাবেন!” নোঈ গম্ভীরভাবে বলল।
পুশকিন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সামান্য। নোঈর কথায় ওর দিকে তাকাল।
নোঈ আবারও বলল, “আপনার মনে হয় যে, আমি জয়কে ভালবাসতাম সে এখন কী করে আপনাকে… কিন্তু মানুষ তো ভুল করে! আমি জানি স্মিতার ব্যাপারের পর আপনার পক্ষে কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু পুশকিনদা, আমায় ভরসা করা যেত। এভাবে না চলে গেলেও পারতেন।”
পুশকিন হাসল, “আমি কি নিজের ইচ্ছেয় চলে যাচ্ছি? আমার তো কাজ। বস বললেন তাই… আর তো কোনও কারণ নেই!”
“মিথ্যে কথা! এখানে এত কাজ এখন। আপনি একবার বললে বস আপনাকে বারণ করতেন? আপনি ইচ্ছে করে… সেদিন দুপুরে আমি নিজে থেকে আপনার কাছে এলাম বলে আপনি এমন করে চলে গেলেন!”
“না নোঈ! কী বলছ!” পুশকিন নোঈর হাতে হাত রাখল।
নোঈ হাতটা সরিয়ে নিল। রাগের গলায় বলল, “সোনাঝুরির এত কাজ কে সামলাবে এখন?”
“কেন? তুমি আছ, স্মরণ আছে। আর মেনলি তো কাগজপত্র। সেটা তো আমাদের ল ডিপার্টমেন্ট সামলে নেবে। তারপর প্রজেক্টের লোকজন চলে আসবে দিল্লি থেকে! এত টেনশন করছ কেন! প্লাস আমি তো আছি। স্কাইপ আছে। ডোন্ট ওয়ারি।”
“না আপনি নেই! আমায় ছেড়ে চলে গেছেন আপনি!” নোঈর গলায় অভিমান।
পুশকিন বলল, “ওরকম বলে না। কিছু হয়নি তেমন। আর তোমরা ঠিক পারবে। শুধু বিজনকাকুর সঙ্গে যোগাযোগ রেখো। ওদের নিয়ে যে বোর্ডটা তৈরি হয়েছে সেটার সঙ্গে যেন ভুল বোঝাবুঝি না হয়।”
নোঈ মাথা নাড়ল, “আচ্ছা। বিজনবাবুর সঙ্গে আমি ঠিক যোগাযোগ রাখব। তবে আপনি নেই শুনলে খুব কষ্ট পাবেন। আপনার কথাতেই কিন্তু উনি গিয়েছিলেন দীপমালাদেবীর কাছে।”
কথাটা সত্যি। বিজনকে পুশকিন বুঝিয়েছিল যে, ওদের গ্রুপের কাজ শুধু ব্যাবসা করা নয়। পাবলিক ওয়েলফেয়ারও এদের একটা লক্ষ্য। বিজন ঠান্ডা মাথার মানুষ। সব শুনে রাজি হয়েছিলেন যেতে।
তবে নিজেরই যেন দ্বিধা ছিল। বলেছিলেন, “পরি বলল বটে, কিন্তু পেখমদি আমার কথা শুনবে?”
দীপমালাদেবীর সময় পেতে একটু অসুবিধে হয়েছিল। তাঁর সেক্রেটারি কিছুতেই সময় দিতে চাইছিল না। বলছিল, উনি আসছেন না। কী নাকি ব্যক্তিগত কাজে আটকে আছেন। কিন্তু পুশকিন অনেক বলে-কয়ে আধঘণ্টা মতো সময় বের করেছিল।
বিজন শেষমুহূর্তে একটু দোনোমনা করছিলেন। যাওয়ার দু’দিন আগে এক সকালে ফোনে বলেছিলেন, ওঁর খুব কাছের একটি ছেলের গুলি লেগেছে। ওঁর বাড়ির কাছেই। নিশান নাম। খবরটা শুনে চমকে গিয়েছিল পুশকিন। আরে, এ তো নোঈর কাজ়িন! ও সঙ্গে-সঙ্গে ফোন করেছিল নোঈকে। নোঈ বলেছিল, ও নাকি নার্সিং হোমেই আছে।
তবে নিশানের তেমন কিছু হয়নি। পেট ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে গুলি। আর পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেছে। বাদল নামে ওরই এক বন্ধু নাকি গুলিটা করেছিল। ছেলেটা ধরা পড়েছে।
নোঈ সেদিন রাতে ফোন করেছিল ওকে। বলেছিল, “ওদের পার্টির মধ্যের গোলমাল। সবাই সন্দেহ করছে, তারক চক্রবর্তী এই কাণ্ডটা করিয়েছে। কিন্তু বাদল বলে যে ধরা পড়েছে, সে কিছু বলছে না! আর জানেন পুশকিনদা, কে বাঁচিয়েছে নিশানদাকে? মাহির। সেই লম্বা-চওড়া ছেলেটি। যে এসেছিল আমাদের কাছে। ও নাকি বিজনদার যাতে ক্ষতি না হয়, সেটা দেখার জন্য ওখানে ছিল। রিতুদা ওকে পাঠিয়েছিল। ভাবুন! কাকে বাঁচাতে গিয়ে কাকে বাঁচাল! আমার তো হাত-পা কাঁপছে এখনও! বাদল নাকি নিশানদার পুরনো বন্ধু। এই বন্ধু!”
বিজনকে পরের দিন ফোন করেছিল পুশকিন। আর অন্যদিকের কোনও কথা শোনার আগেই নিজে বলেছিল, “কাকু, যারা এমনটা করল, আপনি চান তারা আবার কোনও পার্টিকে ঢুকিয়ে দিক? দীপমালাদেবীর সঙ্গে আপনার দেখা হওয়া খুব দরকার। ওঁকে আপনি একটু বলুন। আমি ওঁর সময় নিয়ে নিয়েছি।”
কাঠের ঘর বলেই বোধহয় এই শীতেও গরম ছিল ঘরটা। স্মরণ আর নোঈকে ভেতরে নিয়ে যায়নি পুশকিন। বিজন আর ও শুধু গিয়েছিল।
বিকেল নামছিল তখন কলকাতায়। কাচের জানলা দিয়ে মেঘলা আকাশ আর বৃষ্টি দেখা যাচ্ছিল। ডিপ্রেশন কাটছিল না কিছুতেই। ঘরে আলো জ্বলছিল। আর তাতে এই বয়সেও দীপমালাদেবীকে মোমের মূর্তির মতো লাগছিল ঠিক। এখনও কী করে কেউ এত সুন্দর থাকে! সোনালি রিমলেস চশমা আর কাঁচায়-পাকায় ঢেউ খেলানো চুল। দেখলেই কেমন একটা দম আটকে আসে! মনে হয় এঁর সামনে কথা বলবে কী করে!
ওরা কাছে গিয়ে দাঁড়াতে, দীপমালাদেবী হাত দিয়ে ওদের বসতে বলেছিলেন।
বড় মেহগনি কাঠের টেবিল। দুটো নরম গেস্ট চেয়ার। ঘরে আসবাব খুব কম। টেবলেও একটা ইন্টারকম আর দুটো পেন ছাড়া ঠাকুরের ফোটো ছিল মাত্র। সবেতেই কেমন একটা পরিমিতির ছাপ। কেমন একটা নির্জনতা।
ওরা বসার পরে, পুশকিনের দিকে তাকিয়ে দীপমালাদেবী বলেছিলেন, “আপনি এখনও হাল ছাড়েননি। আমি তো বলেছি, মিলটা নিন। পাশের জমিও নিন। কিন্তু ওই বাড়ি পরিত্যক্ত হলেও আমি এখন দেব না। আমার উত্তর না পেলে আমি দেব না।”
পুশকিন হেসেছিল। তারপর বলেছিল, “সেই জন্যই আমি এসেছি ম্যাম। উনি…”
কিন্তু পুশকিনকে হাত দিয়ে থামিয়েছিলেন বিজন। তারপর সোজা তাকিয়েছিলেন দীপমালাদেবীর দিকে। বলেছিলেন, “আমায় একটুও চিনতে পারলে না পেখমদি? আমি সত্যি এত বুড়ো আর দূরের হয়ে গিয়েছি!”
দীপমালাদেবী থমকে গিয়েছিলেন একদম। সোজা হয়ে বসে তাকিয়েছিলেন সামনে। মুখটা কেমন যেন লাল হয়ে গিয়েছিল আচমকা! চোখের দৃষ্টি পালটে গিয়েছিল নিমেষে! এই বয়স্ক মানুষটাকে ছিঁড়ে কবেকার পুরনো দীপমালা বেরিয়ে আসতে চাইছিল যেন!
বিজন বলেছিলেন, “শুধু কি তোমরা দু’জনই জানতে? আমি কি একটুও কিছু জানতাম না পেখমদি!”
দীপমালাদেবী যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছিলেন। পলক পড়ছিল না চোখের। শুধু অস্ফুটে বলেছিলেন, “বিজন! বিজু!”
বিজন বলেছিলেন, “কাজুদা চলে যাওয়ার পর তুমি সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলে। কিন্তু আমি কী করেছিলাম পেখমদি? আমার কী অন্যায় ছিল? আমি তো কিছু করিনি! আমি তো তোমার সঙ্গে কতবার যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম। দাদুর দোকানে গেলাম। তোমাদের বাড়ি সামনে গেলাম। একবারও তুমি আমায় ডাকলে না। কথা বললে না। আমি তো দেখেছিলাম, সেই মেঘলা রাতে কী হয়েছিল। আমি তো ফিরে-ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমি নিরুপায় হয়ে দেখেছিলাম সবটা। আর আমার পাশে বসে সবটা দেখেছিল আর-একজন। ঝিকুদা।”
দীপমালাদেবী কথা বলতে পারছিলেন না। থরথর করে কাঁপছিলেন।
বিজন উঠে গিয়ে দীপমালাদেবীর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে হাতটা ধরেছিলেন। বলেছিলেন, “তুমি আমার কথাও শুনতে চাওনি। জানতে ইচ্ছে করেনি, কী হল মানুষটার? তোমায় মানুষটা তো ভালবাসত খুব পেখমদি!”
“ইচ্ছে করেছিল তো রে বিজন। কিন্তু মা, কাকিমা, ছোটকা… আমায় কীভাবে ঘরে আটকে রেখেছিল সেটা জানিস না। ওরা বলল কাজুদা বোমা মেরেছে। দু’জন মারা গেছে বোমায়। কাজুদা বোমা মারবে? এটা হয়?”
পুশকিন দেখেছিল দীপমালাদেবী কাঁদছেন! যেন ভুলেই গিয়েছিলেন পুশকিন বসে রয়েছে সামনে!
বিজন বলেছিলেন, “যাদবকাকা বিক্রি হয়ে গিয়েছিল পেখমদি। আমি তো আর জানতাম না! আমি তাই বলে দিয়েছিলাম, কোথায় আছে কাজুদা। বদমাশটা বলে দিয়েছিল ওদের। আর ওরা… আমার মনে কেমন একটা কুডাক দিয়েছিল জানো! তাই ফিরে গিয়েছিলাম। আর দেখেছিলাম… আমি দৌড়ে যেতে গিয়েছিলাম, কিন্তু ঝিকুদা যেতে দেয়নি। শুধু বলেছিল, আমাকেও বিলকিস করে দেবে। আমি আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই… আজও!” মাথা নিচু বিজনের চোখ দিয়ে জল পড়ছিল টপটপ করে।
দীপমালাদেবী কোনও কথা বলছিলেন না।
বিজন আবার বলেছিলেন, “আমি সব দেখেছি পেখমদি… সব… কে-কে ছিল… কী হল, সব!”
“ওরা মেরে ফেলেছিল কাজুদাকে! আর জানিস আমায় বলেছিল, গা-ঢাকা দিয়েছে ও! মানুষ মেরে নাকি গা ঢাকা দিয়েছে! কিন্তু আমি জানি তা নয়। জানি তা হতেই পারে না,” দীপমালাদেবী অসহায়ের মতো তাকিয়েছিলেন বিজনের দিকে।
“পারে না-ই তো পেখমদি। আমি দেখেছি ওদের। ওরা মেরে তুলে নিয়ে গেল। লাশটা কোথায় গুম করে দিল। নদীতে ভাসাল না পুঁতে দিল… কে জানে! আর যাদবকাকা কাজুদার সাইড ব্যাগটা মাটি খুঁড়ে পুঁতে দিয়েছিল জোনাক-বাড়ির পেছনের জঙ্গলে।”
দীপমালাদেবী তাকিয়েছিলেন বিজনের দিকে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামছিল! কোনওমতে বিজনের মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, “কেন এটা হল বিজু, কেন হল রে? কী ক্ষতি করেছিল লোকটা? আমি না হয় সরে আসতাম! আমি না হয়…”
“নয়নাদি!” মাথা নামিয়ে নিয়েছিলেন বিজন।
পুশকিন বুঝতে পারছিল না এসব কী হচ্ছে! কীসের গল্প শুনছে ও! কাজু, নয়না, ঝিকু এরা কারা?
বিজন বলেছিলেন, “তোমায় আর কাজুদাকে সেদিন আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানে দেখে ফেলেছিল নয়নাদি। তুমি ওকে বলেছিলে না যে, কাজুদার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। ও নিজেও এসেছিল অন্য পথে। আর দেখেছিল সব। বাজ পড়ছিল মনে আছে সেদিন? খুব ঝোড়ো আবহাওয়া ছিল। নয়না তোমাদের ছবি তুলেছিল। ওই বাজের আলো। আবছা কাঁপা ছবি… তারপর দেখিয়েছিল…”
“নয়না!” দীপমালাদেবী অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়েছিলেন, “কাকে?”
বিজন ঠোঁট কামড়ে সময় নিয়েছিলেন একটু। তারপর বলেছিল, “তোমার হাজ়ব্যান্ড এমনিতেই তো রেগে ছিল জুট মিল নিয়ে। তোমার শ্বশুরমশাইও। তার সঙ্গে এমন একটা ছবি! তাই…”
দীপমালাদেবী তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিলেন বিজনের দিকে, “কী তাই? নয়না সুজিতকে ছবি দেখিয়েছিল? সুজিতকে?”
বিজন কিছু না বলে মাথা নামিয়ে নিয়েছিলেন।
“বল বিজু! আজ আমায় বল। চুপ করে থাকিস না! আমি এতগুলো বছর ভেবেছি কী হল লোকটার। ওই লোক মানুষ মারবে? নয়না সুজিতকে পেল কোথায় যে, ছবি দেখাবে? বল আমায়!” দীপমালাদেবী বিজনকে ধরে ঝাঁকিয়েছিলেন।
বিজন মাথা নামিয়ে বলেছিল, “শুনতে পারবে তো?”
“পারব, বল!” দীপমালাদেবী চশমাটা খুলে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়েছিলেন বিজনের দিকে।
বিজন সময় নিয়েছিলেন আরও। পুশকিন বুঝতে পারছিল এই গল্পের মধ্যে ও সম্পূর্ণ অনাহূত। বুঝতে পারছিল, আজ এমন কিছু বেরিয়ে আসছে যা টাকা, পয়সা, জায়গা, জমি, সম্পত্তির চেয়ে দীপমালাদেবীর কাছে অনেক দামি!
বিজন ঢোঁক গিলে বলেছিলেন, “নয়নাদি ছবিটা দেখিয়েছিল তোমার বাবাকে। সবুজজেঠুকে।”
“কী!” দীপমালাদেবীর হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল চশমা, “বাবা! আমার বাবা!”
বিজন বলেছিলেন, “কাজুদা মারা যাওয়ার পরে নয়নাদি কেমন যেন পাগলি-পাগলি হয়ে গিয়েছিল। নিজেই তো বলেছিল আমায়। বলেছিল এটা হবে বুঝতে পারেনি। সবুজজেঠু, তোমার হাজ়ব্যান্ড, সবার মোটিভগুলো এক হয়ে গিয়েছিল শেষে। তাই আর ওরা বাঁচতে দেয়নি কাজুদাকে। কিন্তু ভাবো পেখমদি, ছেলেটার দোষটা কী ছিল? তোমায় ভালবেসেছিল আর যাদবকাকাদের বাঁচাতে চেয়েছিল! এই তো! ভাল কাজ করলে বুঝি এই হয়!”
দীপমালাদেবী ধীরে-ধীরে মাথা নামিয়ে ফেলেছিলেন। কথা বলতে পারছিলেন না। টপটপ করে জল পড়ছিল টেবিলে।
“পেখমদি! পেখমদি!” বিজন ঝুঁকে পড়েছিলেন। দীপমালাদেবী বিজনের শরীরে ভর দিয়ে, বিজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন! বাচ্চাদের মতো কাঁদছিলেন!
বিজন পুশকিনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “বাইরে খবর দে পুশকিন। পেখমদি বাড়ি যাবে। আজ আর কথা নয়।”
পুশকিনের নিজেকে কেমন যেন বাচ্চা ছেলে মনে হচ্ছিল! ও দ্রুত বাইরে গিয়ে জানিয়েছিল দীপমালাদেবীর শরীর ভাল লাগছে না। গাড়ির ব্যবস্থা করতে। শোনামাত্র লোকজন ঢুকে এসেছিল ঘরে। কিন্তু দীপমালাদেবী আর কারও সঙ্গে কথা বলেননি। বিজন দীপমালাদেবীকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
দু’দিন পরে মালিক গ্রুপ থেকে ডাক এসেছিল পুশকিনের। সে সময় অফিসে বেরোনোর তোড়জোড় করছিল ও। কিন্তু জরুরি তলব বলে রাজারহাট না গিয়ে মালিক গ্রুপের অফিসে দৌড়েছিল। দেখেছিল, অল্পবয়সি একটা মেয়ে বসে আছে দীপমালাদেবীর ঘরে।
নামটা জেনেছিল পুশকিন। রাধিয়া মালিক।
রাধিয়া বলেছিল, “এই যে সব পেপার্স। তবে একটা কথা। বিজনদাদুকে নিয়ে আমি যাব জোনাক-বাড়িতে। একটা জায়গা খুঁড়তে হবে। কী একটা নাকি পাওয়া যাবে মাটির তলায়। আপনারা কি যাবেন?”
মেয়েটা বাচ্চা। কিন্তু খুব ভদ্র আর স্মার্ট। পুশকিনের মনে হয়েছিল এমন একটা মেয়ে এই বয়স থেকে অফিসে আসতে শুরু করল!
রাধিয়া বলেছিল, “দেখবেন, যেমন প্রমিস করেছেন, তেমন যেন কাজ হয়। মিল যেন বন্ধ না হয়। এর জন্য অন্য একজন মানুষকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে।”
পুশকিনরা গিয়েছিল জোনাক-বাড়িতে। স্মরণ আর পুশকিন, সঙ্গে রিতুদাও ছিল সেদিন। আর সবাইকে অবাক করে সঙ্গে গিয়েছিলেন দীপমালাদেবী!
জোনাক-বাড়ির পেছনে বিজনের কথামতো খোঁড়া হয়েছিল মাটি। বেশ অনেকটা খোঁড়ার পর পাওয়া গিয়েছিল রাবারের পাতলা শিটে জড়ানো বাঁধানো একটা খাতার খুব ঝুরঝুরে কিছু অংশ আর একটা লকেট। চৌকো রুপোর লকেট। খাতার যে সামান্য দু’-চারটে পাতা পড়া যাচ্ছিল, স্মরণ সেই অংশগুলোর ছবি তুলে নিয়েছিল। পুশকিন অবাক হয়ে দেখেছিল অন্যদিনের চেয়ে স্মরণ সেদিন চুপ করেছিল একদম। মোবাইলে ফোটো তোলার সময় ছেলেটার মুখ-চোখ কেমন যেন লাল হয়ে গিয়েছিল!
ডায়েরির সামান্যটুকু আর হারটা বিজন দিয়েছিলেন দীপমালাদেবীকে। রাধিয়া বসেছিল পাশে।
দীপমালাদেবী ধীর গলায় বলেছিলেন, “এই বাড়িতে একসময় আমি আসতাম। প্রচুর জোনাকি উড়ত এখানে। অদ্ভুত একটা আলো ভেসে থাকত হাওয়ায়। এখানে মাঝে মাঝে বসে থাকত কাজুদা। ওর সাইকেল ছিল একটা। আমাদের বাড়িতে সেই সাইকেল নিয়ে যেত। যেদিন আমাদের বাড়িতে প্রথম আসে, আমি একটা লাল চাদর গায়ে দিয়ে দু’হাতে দুধের গেলাস ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাজুদা এসেছিল একটা লাল-হলুদ ডোরাকাটা মাফলার আর নীল রঙের ফুলহাতা সোয়েটার পরে। রোদের ঢালু মিনারের ভেতর সোনাকুচির মতো ধুলো উড়ছিল। তার মধ্যে কাজুদার হালকা দাড়ি আর টানা-টানা চোখ কেমন যেন স্বপ্ন থেকে উঠে আসা মানুষের মতো লেগেছিল আমার। প্রেম হওয়ার পরে, আমি বলেছিলাম আমার সঙ্গে যেন পালিয়ে যায়। কাজুদা প্রথমে যেতে চায়নি। কিন্তু তারপর সেই গেল… একা… সবার আড়ালে! পুশকিন, এই বাড়িটাকে ভাল করে সারিয়ে তুলো। কোনও অযত্ন যেন না হয়! অনেক ভরসা করে এটা দিলাম কিন্তু তোমার দায়িত্বে। মনে রেখো, সোনাঝুরির সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা একসময় এখানে থাকত। এখানে থাকতেন বেঞ্জামিন কূজন সরকার।”
এয়ারপোর্টের সামনে গাড়িটা দাঁড়াতেই স্মরণ পেছনে ঘুরে বলল, “স্যার, আপনারা বসুন। আমরা লাগেজ নামাই। দু’জনে বসুন, কেমন?” বলেই পাশের ড্রাইভারকে একরকম ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে নিয়ে গেল গাড়ির বাইরে।
পুশকিন বুঝতে পারল, কেন! হাসি পেল ওর। দেখল পেছনের ডিকি উঠে গেছে। তার আড়ালে স্মরণ আর ড্রাইভার দাঁড়িয়ে!
নোঈ এখনও মুখ ভার করে আছে।
ও বলল, “আমার প্রায় সাঁইত্রিশ বছর বয়স। এটা মাথায় আছে তো?”
“আমারও ছাব্বিশ। আমি বাচ্চা নই। আর হঠাৎ বয়স দিয়ে কী হবে? আপনি চলে যাচ্ছেন যান!”
পুশকিন হাসল এবার। তারপর কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে হাতে দিল নোঈর। বলল, “এটা খোলো। আমার সামনে এখনই প্যাকেটটা খোলো।”
নোঈ অবাক হল সামান্য। কিন্তু কিছু বলল না। ও যত্ন করে প্যাকিংটা বাঁচিয়ে খুলল প্যাকেটটা। আর খুলেই অবাক হয়ে গেল। আরে, এটা কী!
নোঈ দেখল, কাচের স্বচ্ছ গোলক। তার মধ্যে অদ্ভুত দেখতে একটা প্লাস্টিকের পোকা। ও অবাক হয়ে তাকাল, “কী এটা?”
পুশকিন হাত বাড়িয়ে গোলকটার তলার একটা বোতাম টিপে দিল। আর নোঈ দেখল, পোকাটার নীচের দিকে জ্বলে উঠল হলদে-সবুজ নরম এক আলো। সেই আলোয় ভরে গেল নোঈর করতল।
“জোনাকি!” নোঈ অবাক হয়ে তাকাল পুশকিনের দিকে!
পুশকিন বলল, “আমার হয়ে তোমার কাছে থাকুক জোনাকি।”
নোঈ তাকিয়ে রইল পুশকিনের দিকে। তাকিয়েই রইল। ওর চোখে জল এসে গেল প্রায়।
পুশকিন আলতো করে কাছে টানল নোঈকে। তারপর নরম বলল, “এই রাস্তায়, এই শহরে, এই রোদে, হাওয়ায় তোমার গন্ধ লেগে আছে নোঈ! আমি তোমার কাছ থেকে দূরে গিয়ে থাকতে পারব না! আমি…”
নোঈ আর কথা শেষ করতে দিল না। পুশকিনের জামাটা খামচে ধরে কাছে টেনে আনল। তারপর ঠোঁটে চেপে ধরল ঠোঁট। জিভ দিয়ে স্পর্শ করল জিভ। এবং সমস্ত রোদ আর মেঘ একসঙ্গে পালটাপালটি করে নিল সেই ছোঁয়ায়! পালটাপালটি করে নিল গ্রহ, তারা, উল্কা আর গোটা সৌরমণ্ডল! তারপর পুশকিনের গলার কাছে মুখ গুঁজে বলল, “আমি মরে যাব!”
গাড়ি থেকে নেমে পুশকিন দেখল একটা ট্রলি নিয়ে এসে তাতে সব লাগেজ তুলে দিয়েছে স্মরণ। ও হাসল ছেলেটাকে দেখে। সেই একই রয়ে গেল। সেই আধগোঁজা জামা, না-আঁচড়ানো চুল! টেরিকটের প্যান্টের সঙ্গে সবুজ স্নিকার! নাক থেকে বারবার নেমে যাওয়া চশমা!
ও হাত বাড়িয়ে ধরল স্মরণের হাত। বলল, “পরের বার যখন আসব, প্যাঁওকে দেখব কিন্তু!”
স্মরণ হেসে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “কী জানি! প্যাঁও যা রাগী! কে জানে কী করবে!”
নোঈ একটু পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ লাল। পুশকিন হাসল শুধু। তারপর দু’জনের দিকে হাত নেড়ে এগিয়ে গেল গেটের দিকে।
গেটের কাছে গিয়ে সামনে দাঁড়ানো বন্দুক হাতে সিকিয়রিটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। বলল, “জাস্ট আ সেকেন্ড,” বলে লাগেজের ট্রলিটা এক পাশে রেখে আবার দৌড়ে ফিরে এল গাড়ির কাছে।
দেখল, ওকে এভাবে আসতে দেখে স্মরণ আর নোঈ একটু ঘাবড়ে গিয়েছে!
স্মরণ তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস, “কী হয়েছে স্যার?”
পুশকিন হাত তুলে ওকে থামিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, “তোমাদের একটা কথা বলা হয়নি। আচ্ছা, তোমাদের পাসপোর্ট আছে?”
“মানে?” স্মরণ ঘাবড়ে গিয়ে তাকাল।
“মানে পাসপোর্ট! দেশের বাইরে যায়… সেই পাসপোর্ট! আছে?”
নোঈ আর স্মরণ মাথা নাড়ল একসঙ্গে!
পুশকিন চিন্তিত মুখে বলল, “ও আছে! আচ্ছা!”
“কেন?” নোঈ অবাক হল।
পুশকিন সময় নিল একটু। তারপর বলল, “না, আসলে, বুদাপেস্টের কাজের জন্য বস আমায় টিম ঠিক করতে বলেছিলেন। তো আমি তোমাদের নাম বলেছি। বস রাজি। দু’মাসের মধ্যে এখানকার পেপারওয়ার্ক শেষ করে এই প্রজেক্টটা কনস্ট্রাকশন টিমকে হ্যান্ডওভার করে দিয়ে তোমাদের চলে আসতে হবে ওখানে। বাড়িতে সেভাবে বলে দাও। আর স্মরণ, নো প্যাঁও এক্সকিউজ় দিস টাইম। মনে থাকবে?”
নোঈ থমকে গেল যেন। তারপর সব ভুলে আচমকা “শয়তান!” বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুশকিনের ওপর!
নোঈর দু’হাতের মধ্যে ডুবে যেতে-যেতে পুশকিন শুনল স্মরণ বলছে, “নাঃ, সব মেয়ে প্যাঁওয়ের মতো নয়। প্যাঁও হলে জড়িয়ে ধরত না, কামড়ে দিত!”
তারও বেশ কিছু সময় পরে প্লেনের জানলায় বসে বাইরের দিকে তাকাল পুশকিন। সবে মাটি ছেড়ে আকাশে উঠেছে ওরা। আর নীচে ছোট-ছোট বাড়িঘরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে তাদের আলো। অসংখ্য ছোট-ছোট আলো। যেন জোনাকি!
পুশকিন ভাবল, এই তো আসল জোনাকিদের বাড়ি! অন্ধকারের মধ্যেও জ্বলে থাকার জেদ আছে যার, সেই জোনাকিদের বাড়ি! জানলার কাচে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল পুশকিন। আর দেখতে পেল বহু দশকের ওপার থেকে কোন এক জোনাকি যেন আলো জ্বেলেছিল। আর সেই আলোটুকু বুকে নিয়ে আজও এক বৃদ্ধা বেঁচে আছেন!
এই আলোটুকুই মানুষের সম্বল। অন্ধকারে তার পথ দেখানোর প্রদীপ। তার বিশ্বাস… তার বেঁচে থাকা… অন্ধকারের মুখে ছুড়ে দেওয়া তার সাহস। এই আলোই তার ধ্রুবতারা। এই আলোই তার জোনাকি। এই আলোই আসলে তার জীবন।
.
“আর তারপর আমি নিয়ে এসেছি পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এক ইতিহাসের অংশ! বলা হয় এটির প্রচলন হয়েছিল চিনদেশে! পাঁচ হাজার বছর আগের চিনদেশে! সে সময় ফারাওরা রাজত্ব করছে ইজিপ্টে! ভারতের উত্তর-পশ্চিমে মহেঞ্জোদাড়ো-হরপ্পা ছড়িয়ে দিয়েছে নিজের ডালপালা। ব্যাবিলনে, অ্যাসেরিয়ায় জমজমাট শহর। আর ইউরোপের মানুষ বাস করছে গুহায়! হ্যাঁ বন্ধুরা, আমি নিয়ে এসেছি তখনকার এক ঐতিহাসিক পানীয়! আচমকা আবিষ্কৃত এই পানীয়টি চিনের সম্রাট থেকে প্রবাহিত হয়ে অতীশ দীপঙ্করের পেয়ালা ছুঁয়ে এসে পৌঁছেছে মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রাতরাশের টেবিলে। আমি সেই পানীয় নিয়ে এসেছি যা বন্ধুত্বের হাইফেন, আড্ডার সূত্রধর, একাকী মানুষের অপেক্ষার সঙ্গী, অবহেলিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার শেষ সকালের প্রাতরাশ, ঠিকে ঝিয়ের মাইনের বাইরের আহ্লাদ, ছোট বাচ্চার বড়দের মতো হয়ে ওঠার চাবিকাঠি, বিকেলের মাথা ধরার ওষুধ, ভিনদেশি রেল স্টেশনের উত্তাপ, ট্র্যাফিক পুলিশের ‘আঃ’, অফিসের করিডরে পিএনপিসি-র অনুপান, স্ট্রাগলার ছেলেটার সারা দুপুরের খিদে মারার উপায়! ইতিহাস থেকে নেমে আসা এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী পানীয়টি আজ আমি এনেছি আপনাদের জন্য। এই হরি সামন্তর চা আসলে চা নয়, এক তরল ইতিহাসের সাক্ষী। এমন সুযোগ হারালে আপনাকে ইতিহাস ক্ষমা করবে না! মাত্র পাঁচ টাকার বিনিময়ে আপনি নাম লেখান ইতিহাসে! এ সুযোগ হারাবেন না! এখনই আসুন, পান করুন, পান করান— চা!”
নীচ থেকে আসা এই ভাষণ শুনে অবাক হয়ে গেল নোঈ। ছাদে পাশে বসা স্মরণের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা কে? কোথা থেকে পাড়ায় ধরে আনলি?”
স্মরণ হাসল, “আগে খেলনা বিক্রি করত। এখন চা ধরেছে। তাও পাড়ায়-পাড়ায় মাইক নিয়ে। নিশ্চয় কোনও মিউজ়িয়াম ভেঙে বেরিয়ে আসা পাবলিক!”
নোঈ হাসল সামান্য। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথা ঘুরিয়ে বলল, “পুশকিনদার প্লেন উড়ে গেছে, না রে?”
স্মরণ বলল, “কীভাবে যাবে? যা বেঁধে রেখেছিস!”
“দূর, বল না!”
“হ্যাঁ রে…” স্মরণ আকাশের দিকে হাত তুলল, “ওই দেখ!”
নোঈ দেখল সন্ধের গাঢ় নীল আকাশের অনেক ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটা প্লেন। ছোট-ছোট আলো জ্বলছে তার শরীরে! ও অস্ফুটে বলল, “জোনাকি!”
“সামনেও, ওই দেখ ওই দূরের বড়-বড় বাড়িগুলো দেখ!” স্মরণ হাত তুলল, “আমাদের চারিদিকেও দেখ কেমন জোনাকিদের বাড়ি! ছোট-ছোট আলো। তার তলায় ঢেকে থাকা কত গল্প! জীবন! আমার জেঠুও এমন জোনাকিদের বাড়িতে থাকত, জানিস। কিন্তু কেউ থাকতে দিল না!”
“তোর জেঠু? মানে?” নোঈ তাকাল অবাক হয়ে।
“হ্যাঁ, আমার জেঠু। বাবার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। বাবার বড়দা। বেঞ্জামিন কূজন সরকার। যার গল্প শুনলি, সেই কাজুদা!”
নোঈ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল স্মরণের দিকে! বলল, “তোর নাম তো স্মরণ সরকার! তাই না?”
স্মরণ হাসল, “আমার পুরো নাম বেঞ্জামিন স্মরণ সরকার! জেঠুর নামে নাম রেখেছিল বাবা! আর দেখ জেঠুর মতো আমরাও জোনাক বাড়িতেই থাকি! তাই না?”
নোঈ হাসল। তারপর হাতের পাতায় ধরা পুশকিনের দেওয়া জোনাকিটা তুলে ধরল সামনে! করতল ভরিয়ে জোনাকি জ্বলছে। নোঈ মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল। এমনই আকাশ দিয়ে ওর প্রিয় মানুষ কোনও এক আলোর যানে চেপে পাড়ি দিচ্ছে বহু দূরের দেশে। নোঈ দেখল, সন্ধে নেমে আসছে মাথার ওপর। জ্বলে উঠছে তারা। দেখল, দূরের বাড়িঘরের জানলায়-জানলায় জ্বলে উঠছে সার-সার টিপটিপে আলো। ওসব কাদের গল্পের আলো? কাদের জীবনের ফুলকি? কারা ভালবাসায়, বেদনায় সাজিয়েছে এই সব আলোর সংসার? সমস্ত ভালবাসা দিয়ে, বুকে করে, কারা ঝড়বাদলে আগলে রাখছে এই সব আলোর ফোঁটা? এই সব বাড়িঘর— এসব কাদের বাসস্থান! কারা থাকে এখানে? কারা ক্রমাগত মরে গিয়েও বেঁচে ওঠে আবার! ভালবাসে আবার! বিশ্বাস করে আবার! আবার ঝুলন সাজায়! এ কাদের ঝুলন-শহর? কাদের এই বাড়ি? এ কি সত্যি জোনাকিদের বাড়ি?
—