০১. পেখম

০১. পেখম

আকাশজুড়ে জোনাকিদের বাড়ি
বুকের নীচে পাগলা রাজার ঘোড়া
তখন থেকে সবার সঙ্গে আড়ি
তখন থেকে আমার শহর পোড়া!
ধ্বংস ঘেঁটে তোমায় পেলাম মোহর
তোমার আলোয় বাঁচল আমার প্রাণী
কক্ষ থেকে ছিটকে যেত গ্রহ…
উল্কা তোমার কাচের ফুলদানি!
কেমন ছিল সেসব ধুলোখেলা!
কেমন ছিল সাগরপারের রানি!
এই জীবনের নরম বিকেলবেলায়…
আমরা দু’জন, কেবল দু’জন জানি
আমরা দু’জন, মাত্র দু’জন জানি।

আজ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। কাঁঠালচাঁপার গন্ধ চৌধুরীদের ওই লম্বা পাঁচিল টপকে, ঝুমাদিদের কলতলা ঘুরে, হেমন্তকাকুর সাইকেলের কেরিয়ারে বসে চলে আসছে এই এত দূরে, দীপমালা মানে পেখমের কাছে। আজ হাওয়াও দিচ্ছে খুব। ওই দূরে চ্যাটার্জিপাড়ার দিকের জলট্যাঙ্কের পিছন থেকে হাওয়া ভেসে আসছে। হাওয়া উড়ে আসছে। আর ডুবিয়ে দিচ্ছে পেখমকে। ডুবিয়ে দিচ্ছে সোনাঝুরি নামে এই ছোট্ট মফস্‌সলটিকে।

পেখম সামনের দিকে তাকাল। জ্যোৎস্নার হলুদ লেগে রয়েছে কাজুর মুখে। কাজুর চোখ দুটো বন্ধ। এতক্ষণ নরম গলায় কবিতাটা বলে এখন চুপ করে আছে। যেন হাওয়ায় তুলোর বীজ উড়িয়ে দিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছ! যেন দূরে, আরও দূরে সেইসব বীজ উড়িয়ে, ছড়িয়ে দিতে চাইছে। এই জ্যোৎস্নার নীচে ভাসিয়ে দিতে চাইছে অক্ষর!

পেখম কিছু বলল না। তাকিয়েই রইল। এই বাসন্তী লুকোচুরি আলোয় ও তাকিয়ে দেখল কাজুকে। একমাথা কোঁকড়া চুল। নরম ঘাসের মতো দাড়ি-গোঁফ। টানা ভুরুর তলায় বড়-বড় চোখ। বন্ধ। পেখমের বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে। মনে হয় পৃথিবীর আর সব কিছু ভুল। আর সব কিছু বাড়তি! শুধু কাজু সঙ্গে থাকলেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে ও।

পেখম তাকিয়ে রইল চোখ বন্ধ করে বসা কাজুর দিকে। আজ ইলেকট্রিক চলে গিয়েছে। ওদের এই ছোট্ট একতলা পাড়াটা কেমন যেন নিঝুম! কাজু পড়াতে এসেছিল ওকে। কিন্তু ঘরে আলো না থাকায় ওরা উঠে এসেছে ছাদে।

পেখম জানে, মা থাকলে ওকে এমন করে কাজুর সঙ্গে ছাদে আসতে দিত না। কিন্তু মা আজ নেই। শুক্রবার বলে পাঠ শুনতে গিয়েছে। কাছেই শানিপাড়ায় গীতাপাঠ হয় শুক্রবার করে। ‘দ্য লাইফ’-এর কাকিমার সঙ্গে মা যায় সেই পাঠ শুনতে।

‘দ্য লাইফ’ এই সোনাঝুরির সবচেয়ে বড় ওষুধের দোকান। খুব চলে। সারাক্ষণ লোকজন ভরতি থাকে। কাকিমার আসল নাম মিতু।

মিতুকাকিমাদের বাড়িটা পেখমদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে। হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিট মতো লাগে। খুব বড় বাড়ি কাকিমাদের। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ঢালাই লোহার নকশা করা দরজা। মাথার উপর কাগজফুলের কেয়ারি করা।

পেখমের কী ভাল লাগে! মনে হয়, এমন একটা বাড়ি যদি ওদের থাকত!

কিন্তু ওদের এমন বাড়ি হবে কোথা থেকে? ওদের বাড়িটা তো ছোট্ট। একতলা। মাথায় ছাদ থাকলেও গায়ে প্লাস্টার নেই। ঠাকুরদা ভাড়া নিয়েছিল পনেরো বছর আগে। সেই পঞ্চাশ সালে, যখন ওরা সকলে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে এসেছিল, তখনই ভাড়া নেওয়া হয়েছিল এই বাড়িটা।

পেখমের আবছা মনে পড়ে। তখন তো ওর মোটে পাঁচ বছর বয়স। তাই প্রতিটি স্মৃতিই কেমন যেন আবছা, ঘষা কাচের ওপারে রাখা কোনও ছবি! ভাল মনে পড়ে না। এই বাড়িতেই ওর জ্ঞান হওয়া, বড় হওয়া। তাই এই বাড়ি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না পেখম। কিন্তু তাও ওই মিতুকাকিমাদের বাড়িটা দেখলে মনে হয়, ইস, এমন যদি একটা বাড়িতে থাকতে পারত!

পেখমের ঠাকুরদা বগলাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় এই অঞ্চলে একটা টেলারিং শপ চালান। ওই দেশ থেকে আসার পর ঠাকুরদা কী করবেন বুঝতে না পেরে শেষে এই দোকানটি নেন। ঠাকুরদার যৌবন কেটেছিল কুমিল্লায়। সেখানেই ঠাকুরদাদের মামার বড় কাপড়ের দোকান আর টেলারিং শপ ছিল। এই দর্জির কাজ সেই মামাদের কাছ থেকেই শিখেছিলেন ঠাকুরদা।

দোকানটার নাম মুখার্জি ব্রাদার্স। তবে শুধু টেলারিং নয়, সঙ্গে চা, চানাচুর, বাদাম, বিস্কিটও রাখা হয়। সোনাঝুরি জায়গাটা বড় নয় খুব। কিন্তু যেহেতু একটা বড় জুটমিল আছে, তাই লোকজনের আনাগোনা খুব। ঠাকুরদার দোকানটা খারাপ চলে না।

পেখমের বাবা চাকরি করে পুলিশে। লোকাল থানার মেজবাবু। লোকজন শ্রদ্ধা-ভক্তি করে বেশ। তবে পেখম বোঝে আসলে এটা ভয়। কেন কে জানে সাধারণ লোকজন পুলিশকে বেশ ভয় খায়। কিন্তু ওই ভয়টুকুই যা আছে। তাতে তো আর পেট ভরে না! পেখম প্রায়ই মাকে গজগজ করতে শোনে। মাইনে তো আর বেশি নয়। তবে পেখম শুনেছে বাবাদের চাকরিতে উপরির বন্দোবস্ত আছে। কিন্তু বাবা ওসব দিকে যায় না। লোকে বলে “সবুজবাবু খুব সৎ।” কথাটা শুনলে বাবা রাগই করে। বাবার কথা হল, “আমি যা কাজ করি, তার জন্য সরকার আমায় টাকা দেয়। আমি কেন উপরি রোজগার করতে যাব? আর এই মাইনে যে পাব, সেটা জেনেই তো কাজে ঢুকেছিলাম!”

পেখম জানে সকলে বাবার মতো ভাবে না। কেন ভাববে? মায়ের ভাষায় সবাই তো আর ‘বোকা’ নয়!

তবে ভাল বাড়িতে থাকতে না পারলেও ওদের অভাব নেই। পেখমের কলেজের মাইনে। টিউশনির খরচ। গানের স্যারের খরচ। এসব চালাতে বাবার অসুবিধে হয় না।

ওদের ছোট্ট বাড়িটায় পেখমদের সঙ্গে ওর ছোটকাকুরাও থাকে। ছোটকাকু মানে তপন মুখার্জি। সবাই কাকুকে রেফারি হিসেবে চেনে। কলকাতার মাঠে ফুটবল খেলায় রেফারি হয় ছোটকাকু, মানে ছোটকা। তবে সেটা করলে তো আর সংসার চলে না। কাছের সোনাঝুরি জুটমিলের ফোরম্যান হিসেবে চাকরি করে ছোটকা।

ছোটকাকিমা জামসেদপুরের মেয়ে। একটু চুপচাপ ধরনের। আর ওদের একমাত্র ছেলে, প্লাবন। প্লাবনকে টেটু বলে ডাকে সবাই। টেটু এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। লেখাপড়ায় ভাল ছেলেটা। আর পেখমের খুব ন্যাওটা।

পেখম নিজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। বি এ। মায়ের ইচ্ছে ছিল না পেখম পড়ুক। কিন্তু পেখম জেদ ধরেছিল। আর তাতে ঠাকুরদাও সায় দিয়েছিলেন।

ঠাকুরদা বলেছিলেন, “জীবনে লেখাপড়াই আসল। তুই যতদিন পারবি পড়বি।”

মা যতই রাগী হোক, ঠাকুরদার মুখের উপর কথা বলে না। কেউই বলে না। ঠাকুরমা মারা গিয়েছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু তাতে সাময়িকভাবে ভেঙে পড়লেও অল্প দিনেই নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন ঠাকুরদা।

পেখম অবাক হয়েছিল, “তুমি তো খুব শক্ত মনের!”

ঠাকুরদা বলেছিলেন, “মৃত্যু তো কম দেখলাম না! দেশভাগের সময় কত জনকে মারা যেতে দেখলাম চোখের সামনে। তবে হ্যাঁ, রাণু আমার সবটা ছিল। ও ছিল বলেই এমন বয়সে দেশ, মাটি ছেড়ে এমন বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে বাস করতে পারলাম। এত মনের জোর আর তো কারও দেখলাম না! তাই কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু জীবন কি থেমে থাকে? এক শহরের সামনে দিয়ে নদী কি অন্য শহরের দিকে বয়ে যায় না?”

পেখমের খুব ভাল লাগে ঠাকুরদার সঙ্গে গল্প করতে। রাত ন’টায় ঠাকুরদার দোকান বন্ধ হয়। ইন্দবাবু বলে একজন কারিগর আছেন ঠাকুরদার দোকানে। ন’টার সময় ইন্দবাবুই দোকান বন্ধ করেন। তারপর ঠাকুরদাকে চাবি দিয়ে চলে যান।

ঠাকুরদার দোকানটাও কাছে। হেঁটে দশ মিনিটের মতো লাগে। সোয়া ন’টার মধ্যে ঠাকুরদা বাড়ি চলে আসেন। তখন পেখম কিছুক্ষণ এসে বসে ঠাকুরদার কাছে। গল্প করে। ঠাকুরদাও সারা দিনের রোজগার থেকে বাঁচিয়ে এক টাকা করে দেন পেখমকে।

একটা ঘট আছে পেখমের। তামাটে রঙের। মাটির। গতবছর পুজোয় কিনে দিয়েছিল ঠাকুরদা। সেটাতেই ওই বড় কয়েনটা ফেলে দেয়। টাকা জমায় পেখম। কেন জমায় জানে না। কিন্তু ভাল লাগে। আসলে ওর তো তেমন খরচ কিছু নেই। কলেজের মাইনে, ট্রেনের মান্থলি সবটাই বাবা কেটে দেয়। মা বাড়ি থেকে টিফিন করে দেয়। তবে পথে কিছু সমস্যা হলে যাতে অসুবিধে না হয় তাই পাঁচ টাকা করে দেওয়া হয় পেখমকে।

তবে অসুবিধে আর কী হবে? ট্রেনে করে বালিগঞ্জ যেতে চল্লিশ মিনিটের মতো লাগে। সোনাঝুরি স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে ওরা। চার বোগির ট্রেন। স্টিম ইঞ্জিনে টানে। খুব বেশি ভিড় হয় না। ওর সঙ্গে নয়না বলে আর-একটা মেয়েও যায়। কয়েকটা ছেলেও যায় ট্রেনে। কিন্তু ওদের সঙ্গে কথা বলে না। নয়না বলে মনোজ কুমারের মতো দেখতে একটা ছেলে নাকি তাকায় খুব ওর দিকে। কিন্তু পেখম পাত্তা দেয় না। আসলে কাজু ছাড়া পৃথিবীতে আর কাউকেই তাকানোর মতো ছেলে বলে মনে হয় না ওর।

কাজুর পুরো নাম বেঞ্জামিন কূজন সরকার। ক্যাথলিক ক্রিশ্চান ওরা। গঙ্গার কাছে সাহেবপাড়ায় থাকে। তবে সাহেবপাড়া মানে বিরাট কোনও ব্যাপার নয়। আগে, যখন ভারত স্বাধীন হয়নি, তখন সোনাঝুরি জুটমিলে বেশ কয়েকজন সাহেব কাজ করত। তারা এখানে থাকত। সেই থেকে জায়গাটার নাম সাহেবপাড়া।

এখন অবশ্য সাহেবরা নেই। তাদের ফেলে যাওয়া অনেকটা জায়গা আর জঙ্গল নিয়ে চারটে বিশাল বড় বড় বাসি দুধ-চা রঙের বাড়ি পড়ে আছে। লোকে বলে জোনাক-বাড়ি! তবে বাড়িগুলো ময়লা, রং না-করা, ইটের পাঁজর বের করা। সেখানে গাদাগাদি করে বেশ কিছু পরিবার থাকে। কাজুও সেখানেই থাকে। দুটো ঘরের সংসার কাজুদের। বাবা, মা, এক ছোট ভাই, এক বোন, মায়ের এক আন্টি আর ঠাকুরমা। পেখম একবার গিয়েছিল কাজুর সঙ্গে ওদের বাড়ি। তবে লুকিয়ে। বাড়িতে জানে না। জানলে মা আর আস্ত রাখবে না।

ক্লাস নাইনে কাজু পড়াতে এসেছিল ওকে। এই সোনাঝুরিতে কাজুর খুব নাম। লেখাপড়ায় খুব ভাল। স্কুল ফাইনালে ফিফ্‌থ হয়েছিল। খবরের কাগজেও নাম বেরিয়েছিল। সেই থেকে সবাই সমীহ করে চলে কাজুকে।

কাজুর এক বন্ধু আছে, সতু। ভাল ফুটবল খেলে। তার সূত্রেই কাজুর আলাপ হয়েছিল ছোটকার সঙ্গে। বাবা তখন পেখমকে বাড়িতে পড়াবে এমন কাউকে খুঁজছিল। ছোটকার কথায় কাজু রাজি হয়েছিল পেখমকে পড়াতে।

যেদিন প্রথম কাজু এসেছিল পেখমদের বাড়ি, সেই দিনটা ওর আজও মনে আছে!

জানুয়ারি মাস ছিল সেটা। সকালের আলোর ভিতর কেমন যেন একটা পাতলা দুধের সরের মতো কুয়াশা পড়েছিল। পেখমদের ছোট্ট বাড়িটার পাশের পুকুরের জলে তখনও ভাল করে সূর্য এসে দাঁড়ায়নি। পেখম একটা লাল চাদর গায়ে দিয়ে দু’হাতে গরম দুধের গেলাস ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল।

কাজু এসেছিল একটা লাল হলুদ ডোরাকাটা মাফলার আর নীল রঙের ফুলহাতা সোয়েটার পরে।

ওদের বাড়িতে ঢুকেই একদম পেখমের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল কাজু। আর কেন কে জানে, থমকে দাঁড়িয়েছিল। পেখমও গেলাস হাতে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কাজুর দিকে। অমন হালকা দাড়ি। টানা চোখ। অমন শীতের রোদ্দুরের মতো দৃষ্টি! পেখমের বুকের ভেতরে যে কী হয়ে গিয়েছিল, সেও নিজেও বুঝতে পারেনি। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিল, আজ থেকে ওর জীবনটা আর শুধু ওর রইল না।

প্রেম ব্যাপারটাকে পেখম ছোট থেকেই খুব ভয় পায়। ওদের অঞ্চলের ঝিকুদা তো কোন একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে পাগলই হয়ে গেল। এখন ঝিকুদাকে দেখা যায় কখনও চক্রবর্তীর চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে, কখনও মামুর ইলেকট্রিকের দোকানের টুলে বা ঘোষ বাইন্ডিং-এর সামনের বারান্দায় একা-একা বসে আছে। কারও সঙ্গে কথা বলে না। কারও দিকে তাকায় না। পেখমের মনে হয় সোনাঝুরির সবাই বোধহয় ঝিকুদার কাছে স্বচ্ছ কাচের তৈরি।

নয়না খুব ডানপিটে ধরনের মেয়ে। ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারে। সাইকেল চালায়। এমনকী, লুকিয়ে সিগারেটও খায়। একদিন তো নয়না গিয়ে ধরেছিল ঝিকুদাকে। বলেছিল, “তুমি এমন ক্যালানের মতো বসে থাকো কেন গো? একটা মেয়ে ছেড়ে গেল বলে? ন্যাকামিটা কি প্র্যাকটিস করে আয়ত্ত করেছ না জন্মগত?”

পেখম পাশেই ছিল নয়নার। ওর তো ভয়ে ঢিপঢিপ করছিল বুক। কী কেলেঙ্কারি করছে মেয়েটা? ও শুনেছে ঝিকুদা নাকি মাঝে মাঝেই মারমুখী হয়ে ওঠে। তাকে এসব কী বলছে নয়না? ঝিকুদা রেগে গিয়ে এবারও যদি কিছু করে?

কিন্তু ঝিকুদা কিছুই করেনি। শুধু পেখমদের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল একটু। তারপর ফুড়ুৎ গলায় বলেছিল, “বিলকিস।”

মা নয়নাকে পছন্দ করে না। মা কাকিমাকে পছন্দ করে না। মা কাজুকেও পছন্দ করে না। মা আসলে সেই মানুষদের মধ্যে পড়ে যার মাথা আর চোখ আতসকাচ দিয়ে তৈরি। সব কিছুকে খুঁটিয়ে না দেখলে মায়ের মন ভরে না। আবার দেখার পর তো আরওই ভরে না! পেখম মাকে ভয় পায় বেশ।

কাজু সেই যে এসেছিল সকালবেলা আর পেখমকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, সেটা ঠিক লক্ষ করেছিল মা। তাই বাবা কাজুকে পড়ানোর জন্য ঠিক করলেও মায়ের মনঃপূত হয়নি ব্যাপারটা।

বাবাকে বলেছিল, “এটা কি ঠিক হল? এমন উঠতি বয়সের একটা ছেলে! পেখমকে দেখেই তো ওর জিভ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল! নিজের মেয়ের রূপ দেখে বোঝো না যে, ওকে সাবধানে রাখতে হবে? আমি কত শাসনে রাখি। আর তুমি সেখানে খাল কেটে কুমির ঢোকালে!”

বাবা বলেছিল, “তুমি পাগল হয়ে গেলে? ও তো বাড়িতেই পড়াতে আসছে। আর কত ভাল ছেলে লেখাপড়ায়! সক্কলে ওর নাম জানে। তুমি সব কিছুতেই এমন কোরো না তো!”

মা বলেছিল, “ভাল হলেই ভাল। না হলে…”

বাবা শুধু বলেছিল, “না হলে আমি তো আছি।”

সেই কাজুর পড়াতে আসার শুরু। সপ্তাহে তিনদিন করে সন্ধের দিকে আসত ও। ছোট্ট ঘরটার বিছানায় বসত পেখম আর লাগোয়া টেবিলের পাশে চেয়ার নিয়ে বসত কাজু। একমনে পড়াত। মা চা দিয়ে যেত। মুড়ি মেখে দিয়ে যেত। কিন্তু খেয়ালই থাকত না ওর। ও শুধু পড়িয়ে যেত। আর পড়াতে-পড়াতে দেশ-বিদেশের কথা বলত। নানা মানুষের গল্প বলত। বলত যুদ্ধের ইতিহাস। বলত দক্ষিণ মেরুর গল্প। অঙ্ক করাতে গেলে ইউক্লিডের সময়কার গল্পও বলত অনায়াসে। আর পেখম রোজ একটু-একটু করে ডুবে যেত। চারিদিকে গোলাপি তুলোর ভিতর কে যেন ওকে ডুবিয়ে দিত আস্তে আস্তে। এক-একটা পড়ানোর দিন শেষ হলে মনের ভিতরে কেমন একটা কষ্ট হত। মনে হত আবার কবে আসবে কাজু! কেন সপ্তাহে মাত্র তিনদিন আসবে? রোজ এলে ক্ষতি কী? তারপর পড়ানোর সময় হলে তো পেখমের বুকের ভিতরটায় কী যেন একটা হত। একই সঙ্গে ভাল লাগা আর ভয়, কষ্ট আর আনন্দ, বন্ধন আর মুক্তির স্বাদ পেত পেখম।

বাল্‌বের আলোয় চকচক করত কাজুর মুখ। হাত নেড়ে, চুলে হাত ডুবিয়ে ঠিক করতে-করতে কাজু কত কী যে বলত! পেখম বুঝত দু’ঘণ্টার শেষে কাজুর মুখটুকু ছাড়া আর কিছুই মাথায় ঢোকেনি! এমন করতে-করতে ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজ়াল্ট বেরোল। আর সবাই অবাক হয়ে দেখল পেখম ফেল করতে করতে কোনওমতে পাশ করল!

প্রথম ঝড়টা তুলেছিল মা! এত ভাল ছাত্রী, তার এ কী দশা! এ কেমন করে হল? এই মাস্টার ভাল ছাত্র হতে পারে, কিন্তু পড়াতে পারে না একদম।

রাতে খেতে বসে মা তো চিৎকার করে বলেছিল, “কোথা থেকে ঠাকুরপো একে জোগাড় করে এনেছে! বড় বড় বুলি শুধু! এই পড়ায়? একে তুমি টাকা দিয়ে রেখেছ? কেন রেখেছ? কীসের জন্য? কাল এলে ওকে বিদায় করবে। একদম ধুলোপায়ে বিদেয় করবে। ঠাকুরপো অনেক উপকার করেছে। আর আমার মেয়ের ভবিষ্যতের বারোটা বাজাতে হবে না।”

বাবা রুটির টুকরো ছিঁড়ে চুপ করে বসেছিল। পাশের ঘর থেকে সব শোনা যায়। পেখমের ভয় লাগছিল খুব। ছোটকার নামে মা এসব বলছে! ছোটকা না-হয় নাইট ডিউটিতে গিয়েছে, কিন্তু কাকিমা তো সব শুনতে পাবে!

পেখম একবার বলেছিল, “মা, কাজুদার দোষ নেই। আমিই ফাঁকি দিয়েছি।”

“তুই চুপ কর!” মা ধমক দিয়েছিল খুব, “তোকে বড়দের মধ্যে কথা বলতে বারণ করেছি না?”

বাবা তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। তারপর শান্ত গলায় বলেছিল, “তুমি চুপ করো একটু। আর কথা বাড়িয়ো না। ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল আজকে। ও নিজেই বলেছে আর পড়াবে না।”

আর পড়াবে না! নিজে বলেছে! পেখমের মনে হয়েছিল, কেউ বুঝি ওর বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে দিয়েছে! কী বলছে এসব! এমন হয় নাকি? পড়াবে না বললেই হল! হাত কাঁপছিল পেখমের। ঝাপসা লাগছিল সবকিছু। তবু তার মধ্যেও শুনেছিল, মা অনবরত বলে চলেছে, “আমি সব বুঝি। পড়াবে না! সাধু সাজা! আর তুমি সব শুনলে? কিছু বলতে পারলে না? হুঃ, পুলিশ না ছাই! বললে না কেন যে, শুধু কি চা-মুড়ি ধ্বংস করতে আসত!”

পেখমের চোখে জল এসে গিয়েছিল এবার। এসব কী বলছে মা? কাজু তো কিছুই খায় না! পেখম কতবার বলে বলে খাওয়ায়। আর খাওয়া দেখেই বোঝে এসব কিছুতেই কোনও আগ্রহ নেই ওর। শুধু বই-খাতায় ডুবে থাকে ছেলেটা! কতই-বা বয়স! ইসকুল যেতে-আসতে তো কাজুর বয়সি ছেলেদের দেখে পেখম। সব এক-একটা বখাটে। শুধু সাইকেল নিয়ে চক্কর মারবে। চিঠি ছুড়বে। দেব আনন্দের গান গাইবে! এত বিরক্ত লাগে পেখমের! এরা কী ভাবে? জীবনটা হিন্দি সিনেমা? এরা বোঝে না কোনও মেয়ে এসব অসভ্যতা পছন্দ করে না? কাজুর ওই আনমনা ভাবটাই পেখমকে টানে। ওই যে কোনও কিছুতেই কিছু যায় আসে না। কিছু না হলেও চলে যায়, এমন ভাবটাই পেখমকে দুর্বল করে দেয়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে! কাজুকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে।

সেই কাজুকে আসতে বারণ করে দেবে বাবা! তবে ওর কী হবে? নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করছিল পেখমের। এসব কী করল ও? এমন বোকার মতো জিনিসটা বুঝতে পারল না? কাজু যখন পড়াতে আসত, মা তো সারাক্ষণ নানা অছিলায় ঘরে ঢুকত। আড়চোখে দেখত কাজুকে। পেখম বুঝত, মা বিরক্ত হচ্ছে! কেন হচ্ছে সেটাই শুধু বুঝত না। আর তাই তো পেখমের উচিত ছিল আরও ভাল করে পড়া। ওর তো বোঝা উচিত ছিল যে, রেজ়াল্ট খারাপ হলে মা প্রথমেই কাজুর আসা বন্ধ করে দেবে।

সেদিন রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি পেখম। ওর ছোট্ট ঘরটার জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। মশারির ভেতর শুয়ে পেখম এপাশ-ওপাশ করেছিল বহুক্ষণ। তারপর একসময় আর থাকতে না পেরে উঠে বসে খুলে দিয়েছিল জানলা। তাকিয়েছিল বাইরের দিকে। আকাশের দিকে। আর তখনই দেখেছিল জোনাকিদের! বাড়ির পাশের বড় ঝোপের মধ্য থেকে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছিল জোনাকির দল। সবুজাভ আলোয় আশপাশের সব কিছু কেমন যেন মায়াবী হয়ে উঠেছিল। পেখম অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সেই দিকে। আকাশের দিকে কেন উড়ে যাচ্ছে জোনাকিরা? কী চায় ওরা? কাদের কাছে পৌঁছতে চায়? আকাশের সব তারাই কি একসময় মাটির এই জোনাকি ছিল?

কতক্ষণ বসেছিল মনে নেই পেখমের। শুধু যখন পুব আকাশে লাল রং লেগেছিল, যখন মাধব বৈরাগী খোল-করতাল নিয়ে বেরিয়েছিল নামগান করতে আর ঠাকুরদার গলায় কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম শুনেছিল, তখন সংবিৎ ফিরেছিল পেখমের। আর তখনই বুঝতে পেরেছিল ওর কী করা উচিত। ঠাকুরদা! এমন বিপদে ঠাকুরদাই ভরসা। বাড়িতে কেউ ঠাকুরদার ওপর কথা বলে না। ঠাকুরদা আছেন বলেই এখনও বিরাট বড় কোনও ঝগড়া হয় না এই বাড়িতে। ঠাকুরদার সামনে কেউ গলা তুলে কথা বলে না।

ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ঠাকুরদা ভগবানের নাম করেন। তারপর নিজেই ছোট্ট একটা হিটার জ্বালিয়ে চা বানিয়ে নেন। সঙ্গে দুটো পটল বিস্কুট বের করেন ডালডার টিন থেকে। তারপর বারান্দায় বসে খান সময় নিয়ে। খাওয়া শেষ হলে ঠাকুরদা মাফলার জড়িয়ে বেরিয়ে পড়েন হাঁটতে। পাশের বাড়ির ফুলুদাদুও হাঁটেন ঠাকুরদার সঙ্গে। দু’জনেই একসঙ্গে এই দেশে এসেছিলেন। ফুলুদাদু ঠাকুরদার ছোটবেলার বন্ধু। খুব মজার মানুষ ফুলুদাদু। পেখমের সঙ্গে একদম বন্ধুর মতো মেশেন!

ঠাকুরদা হাঁটতে যাওয়ার সময় মা ওঠে। দরজা জানলা খোলে। তারপর ধীরে ধীরে দিনের কাজ শুরু করে।

পেখম বুঝেছিল ঠাকুরদাকে ধরতে হলে এখনই ধরতে হবে। মা উঠে পড়লে আর হবে না।

নিজের ছোট ঘরের দরজাটা খুলে পা টিপে-টিপে বেরিয়েছিল পেখম। শীতকাল। মেঝে যেন বরফ দিয়ে তৈরি! গায়ে চাদরটাকে ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে ও গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঠাকুরদার কাছে।

ঠাকুরদা সবে চা বানিয়ে বড় একটা কাপে ঢালছিলেন। এমন সময় পেখমকে দেখে কেমন যেন অবাকই হয়েছিলেন।

পেখম চুপ করে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সামনে।

“কিছু বলবি?” ঠাকুরদা তাকিয়েছিলেন।

“ঠাকুরদা, তুমি বাবাকে একটু বলবে?”

“আমি?” ঠাকুরদা অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন, “কী হয়েছে তোর? এমন মুখ-চোখ কেন? রেজ়াল্ট খারাপ হয়েছে বলে তোর মনখারাপ? অমন হতেই পারে।”

“কাজুদা আমায় আর পড়াবে না বলেছে!”

“কে?” ঠাকুরদার বুঝতে যেন একটু সময় লেগেছিল।

“আমায় যে পড়ায়। ওই যে ছেলেটা। খুব ভাল স্টুডেন্ট। বলেছে, এমন রেজ়াল্ট করেছি তো, তাই পড়াবে না। তুমি বাবাকে বলবে একটু যে, ও-ই যেন আমায় পড়ায়!”

“কেন?” ঠাকুরদা চায়ে চুমুক দিয়ে সামান্য নাক কুঁচকেছিলেন। তারপর রান্নাঘরের তাক থেকে চিনির কৌটো পেড়ে নিয়ে এসে বলেছিলেন, “কী হয়েছে কী?”

“আমায় অপমান করেছে কাজুদা, মানে ওই ছেলেটা,” পেখম ঠোঁট কামড়ে তাকিয়েছিল ঠাকুরদার দিকে।

ঠাকুরদা কি ওর মিথ্যেটা ধরতে পারলেন?

ঠাকুরদা একচামচ চিনি নিয়ে কাপে গুলতে গুলতে বলেছিলেন, “ছেলেটা নিজেই পড়াবে না বলেছে?”

“হ্যাঁ,” পেখম অভিনয়টা যথাসাধ্য বজায় রেখে বলেছিল, “আমি নাকি বাজে লেখাপড়ায় বলে পড়াবে না! আমি দেখিয়ে দিতে চাই ওকে ঠাকুরদা। তুমি বাবাকে বলো।”

ঠাকুরদা সময় নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলেছিলেন, “তাই?”

বাইরে থেকে হাওয়া আসছিল। বারান্দার পাশেই বড় পুকুর। শীতের এত ভোরে ঠান্ডা হাওয়ায় শিরশির করছিল পেখমের শরীর। ঘুমও আসছিল। সারারাত জেগে থাকার শোধ তুলছিল শরীর। তাও চোখ টান করে তাকিয়েছিল পেখম। মুখটাকে অপমানের ওজনে ভার করে রেখেছিল!

ঠাকুরদা বলেছিলেন, “অন্য মাস্টার পড়ালে হবে না?”

“না,” জেদি গলায় বলেছিল পেখম, “ওকেই আমি মজা দেখাব।”

ঠাকুরদা হেসেছিলেন শুধু। আর কিছু বলেননি।

রেজ়াল্ট বেরোনোর পরের ছুটি চলছিল স্কুলে। অন্যদিন হলে বান্ধবীদের বাড়িতে যেত পেখম। কিন্তু সেদিন কোথাও যায়নি। বুকের মধ্যে কেবল ছটফট করছিল একটা কাঠবেড়ালি! কেবলই মনে হচ্ছিল, কী হবে? কাজুকে কি বলবে বাবা? মা কী বলবে? ঠাকুরদা কি বলে দেবে বাবাকে যে, পেখম ওসব বলেছে?

সারা দিন কেমন একটা ম্যাজম্যাজে শরীর নিয়ে কেটেছিল। বুকের ভিতর একটা কষ্ট। মনখারাপ। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। টেটু এসেছিল গল্প করতে, পেখম ওকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল। কথা বলেনি। দুপুরে খায়নি ভাল করে। মা এসে কপালে হাত দিয়ে দেখেছিল জ্বর এসেছে কি না। পেখম ওসব খেয়াল করেনি।

তারপর সারা বিকেল চুপ করে ও পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। ওই পাড়ে ঘোষদের বাড়ি। অন্য পাশে সর্দারদের বাঁশবাগান। পেখম দেখছিল কীভাবে আকাশের র‌ং পালটে, গাছের পাতাদের রং পালটে, পুকুরের জলের রং পালটে সূর্য ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে পশ্চিমের আকাশে। হাওয়া দিচ্ছিল চ্যাটার্জিপাড়ার দিক থেকে। ঝিরিঝিরি নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল ডিসেম্বরের আলো। শীতের বিকেলগুলোয় যে এত মনখারাপ জমা হয়ে থাকে, সেদিনই যেন জানতে পেরেছিল ও! আর এর মধ্যে পেখমের কেবলই মনে পড়ছিল ওই কোঁকড়া চুল, পাতলা খাড়া নাক। মনে পড়ছিল নরম ঘাসের মতো দাড়ি! এত কষ্ট হচ্ছিল যে, নিজের মনটাকে কিছুতেই সামলাতে পারছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, বাবা কি শুনবে ঠাকুরদার কথা?

ছোটকার সেদিন ডে শিফট ছিল। রাতে সকলে একসঙ্গেই খেতে বসেছিল ওরা। বাবার মুখ দেখে পেখম বুঝতে পারছিল, কিছু একটা হয়েছে। ও রুটির টুকরোগুলো ছিঁড়ছিল, ডালে ডোবাচ্ছিল, কিন্তু খেতে পারছিল না। মা অবাক হয়েছিল খুব। তাকাচ্ছিল বারবার। এমন তো করে না পেখম। আজ তবে কী হল?

কথাটা শুরু করেছিলেন ঠাকুরদাই। বলেছিলেন, “সাবু, তুই কি ওই মাস্টারের সঙ্গে কথা বলেছিলি?”

বাবা চট করে একবার তাকিয়ে নিয়েছিল মায়ের দিকে। তারপর আলতো গলায় বলেছিল, “হ্যাঁ বাবা, ওই কাজুকে বলেছি পড়াতে আসতে!”

“কী?” মায়ের গলায় যে-চকোলেট বোমাটা ফেটেছিল সেটার ওপর শেষ মুহূর্তে মা নিজেই বালি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আসলে ঠাকুরদার সামনে কেউ গলা তোলে না! তাও শব্দের গুণ বালিতে ঢাকা পড়েনি খুব একটা! পেখম সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে।

বাবা বলেছিল, “বাবা বললেন, তাই… মানে…”

বাবার ফেলে রাখা অসমাপ্ত বাক্য শেষ করেছিলেন ঠাকুরদা। বলেছিলেন, “সাবুকে আমি বলেছি ওই মাস্টারকে বলতে। দোকানে শুনি আমার নাতনি নাকি খারাপ লেখাপড়ায়। তাই নাকি ওই চ্যাংড়াটা বলে বেড়াচ্ছে ওর দ্বারা কিছু হবে না! আমাদের বাড়ির মেয়েদের লেখাপড়া হবে না? বললেই হল? আমি তাই সাবুকে বলেছি ওকেই পড়াতে বলতে। পেখম ওকে এবার দেখিয়ে দেবে, কার কী হবে আর কী হবে না!”

মায়ের মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল একদম। ঠাকুরদার সামনে কিছু বলতে পারছিল না, কিন্তু আবার সহ্যও করতে পারছিল না। শুধু থালা-বাসনের ঝংকার বেড়ে গিয়েছিল এর পর।

রাতে চাপা গলায় মা বলেছিল, “তোমার আমায় বিয়ে করা উচিত হয়নি। কোনও ক্রীতদাসীকে নিয়ে আসা উচিত ছিল!”

বাবা বলেছিল, “নমি, এমন বোলো না। জানোই তো, বাবার মুখের উপর কিছু বলা যায় না। তা ছাড়া রাস্তায় এসব শুনে বাবার রাগ হয়েছে। সোনাঝুরির মতো ছোট জায়গায় সব কথাই তো ওড়ে! তাই…”

“তুমি দেখো, একদিন কী হয়! সেদিন, সেদিন কিন্তু…” মায়ের কথাগুলো ডুবে গিয়েছিল কান্নায়। পাশের ঘর থেকে পেখম শুনেছিল বাবা বলছে, “আমি তো আছি নমি। তোমার মেয়ের কিছু হতে দেব না। দেখো।”

পরের দিন সকালে দোকানে যাওয়ার আগে পেখমের ঘরে এসেছিলেন ঠাকুরদা। তারপর নিচু স্বরে বলেছিলেন, “দেখিস, আবার কেলেঙ্কারি কিছু বাঁধাস না। মনে রাখিস, আমাদের সমাজ কিন্তু কাজুদের সমাজ নয়।”

“তুমি কী ভাল কবিতা বলো!” পেখম আলতো গলায় বলল।

এবার চোখ খুলল কাজু। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল, “আমি আস্তে আস্তে জমাচ্ছি, জানো! কবিতা জমাচ্ছি।”

“বই করবে?” পেখম আগ্রহভরে তাকাল কাজুর দিকে।

কাজু দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, “তার জন্য টাকা দরকার। আমার নিজের টাকায় বই করা হবে না। তবে কেউ যদি করে… কলকাতায় কেউ যদি…”

পেখম আলতো করে হাতটা ধরল কাজুর। বলল, “ঠিক হবে, দেখো।”

হাতটা সরিয়ে নিল কাজু, “এমন কোরো না পেখম। জানোই তো সব। তোমার কাকিমা নীচে আছেন। বললেন, একটু পরেই চা নিয়ে আসবেন। তা ছাড়া তোমার মা যদি এসে যান…”

পেখম বলল, “ওসব বাদ দাও। আমায় কবিতার বইটার কথা বলো। কতগুলো হয়েছে?”

কাজু বলল, “হয়েছে কিছু। একটা ডায়েরিতে ফ্রেশ করে রাখছি। তোমায় দেখাব একদিন।”

“সত্যি?” পেখম বড়-বড় চোখ করল। দেখল, কাজু আবার তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আজ ভরা পূর্ণিমা। নিকানো আকাশে টলটল করছে আলোভরতি একটা বেলুন! পেখমের কষ্ট হচ্ছে শরীরে। মনে হচ্ছে আর দূরে থাকতে পারছে না কাজুর কাছ থেকে। সেই নাইন থেকে এই সেকেন্ড ইয়ার। কম দিন তো হল না!

পেখমের বলতে ইচ্ছে করেনি, কিন্তু তবু নিজের অজান্তেই যেন বলে ফেলল, “তুমি চাকরির কিছু করলে? আর কতদিন ওইসব পার্টি-টার্টি করবে?”

এবার তাকাল কাজু। যেন কিছুটা সময় নিল শব্দগুলোকে নিজের মনের মধ্যে বসে যেতে দিতে। তারপর বলল, “তুমি যা চাও, তা কি হবে কোনওদিন?”

“কেন হবে না?” পেখমের গলা শক্ত হল এবার, “এমন খারাপ কিছু ভেবো না।”

কাজু বলল, “না হলেও আমার কবিতা থাকবে। তোমায় নিয়ে লেখা সব কবিতা।”

“আমার ওসব চাই না!” পেখম দ্রুত চুপ করিয়ে দিতে চাইল কাজুকে। বলতে চাইল কাজুকেই শুধু চায় ও। আর কিছু নয়। কিন্তু বলতে পারল না। বরং কেমন এক অভিমান এসে বুজিয়ে দিল ওর গলা! কাজু সব সময় কেন এমন মনখারাপের কথা বলে! কেন কাছে এসেও আবার এমন সরে-সরে যায়!

কাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর শান্ত গলায় বলল, “যদি আমরা এক হতে নাও পারি, তাও এই সময়গুলো তো আর মিথ্যে নয় পেখম। এই রাত। এই জ্যোৎস্না। এই সব কবিতা তো আর মিথ্যে নয়! যে যার মতো যা খুশি ভাবুক, আমি আমার লেখা তোমার জন্য রেখে যাব। আমার বাদামি ডায়েরির সব লেখা শুধুমাত্র তোমার জন্য রেখে যাব। আমি যদি তোমায় খুঁজে নাও পাই, সেই ডায়েরি তোমায় খুঁজে পাবে পেখম। সেইসব কবিতা তোমায় খুঁজে পাবে। আর এই শব্দগুলোর অর্থ কেবল আমরাই জানব। মাত্র আমরা দু’জন জানব!”

.

০২. মাহির

বুটটা খুলে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেখল মাহির। পায়ে কী যেন একটা খোঁচা দিচ্ছিল। কাঁকর নয়। থাকলে ঝাড়লেই বেরিয়ে যেত। কিন্তু বেরোয়নি। ও হাত ঢুকিয়ে দেখল। আঃ। কী এটা? আঙুলটা বের করল মাহির। ছোট্ট এক বিন্দু রক্ত ফুটে উঠেছে আঙুলের ডগায়। ভেতরে কি পেরেকটা জেগে উঠল!

বিরক্তিতে মাহিরের মুখটা বেঁকে গেল। আচ্ছা জ্বালাতন তো! এই তো সেদিন বুটটা ঠিক করাল, এর মধ্যেই আবার পেরেক বেরিয়ে এসেছে!

শালা, বুটটাকে বিরক্তিতে পাশে ছুড়ে মারল মাহির। পরশুদিন খেলা আর আজই বুটটা বেগড়বাই করছে! কপাল তো নয়, যেন টালি নালা!

সামনের দিকে তাকিয়ে মেজাজটাই খিঁচড়ে গেল মাহিরের। সকলে প্র্যাকটিস করছে আর ও বসে বসে ছিঁড়ছে! এখনই পতাদা খিস্তি করবে ওকে এমনভাবে বসে থাকতে দেখলে। বলবে, টিম থেকে লাথি মেরে বের করে দেবে, যদি না পরিশ্রম করে! পরিশ্রম! নিজে বিরাট ভুঁড়ি নিয়ে বাঁশি মুখে পিঁ পিঁ করে হুমদো হয়ে ঘুরবে, আর দূর থেকে চেঁচাবে, সে বেলায় কিছু নয়! ভাটের যত কথা! পরিশ্রম!

পতাদা মানে পতঞ্জলি লাহিড়ি, লেক অ্যাভিনিউ ক্লাবের সেক্রেটারি কাম কোচ। নিজে দীর্ঘদিন কলকাতার মাঠে খেলেছে। তারপর লেক অ্যাভিনিউতে এসেছে। মাহিরকে পতাদাই এই সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাবটায় নিয়ে এসেছে বছরদুয়েক হল। কিন্তু তা বলে মাথা কিনে নিয়েছে নাকি?

জার্সি, মোজা, প্যান্ট আর রুটি-কলা, ঘুঘনি-পাঁউরুটি ছাড়া ওদের কিছু দেয় ক্লাব? কিচ্ছু না। তবে অত “পরিশ্রম, পরিশ্রম” করে চেঁচায় কোন মুখে? এই টিম কি আর সেকেন্ড ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হবে কোনওদিন? কোনওদিন হবে না। তাই বেকার খেটে লাভ কী? তার চেয়ে রিতুদার কথাটা মেনে নিলেই ভাল হবে বোধহয়!

মাহির আবার বুটটা তুলে ভেতরে সাবধানে হাত ঢোকাল। এই তো পেরেকটা। বেশ কিছুটা বেরিয়ে আছে পাশ থেকে। তাই ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে লাগছিল। শালা গিয়ে ছোটনের মুখে ছুড়ে মারবে। এই সারিয়েছে? নিজেকে মুচি বলে কোন মুখে?

টিটি ঠিক বলেছিল। ছোটনকে দেওয়াই ঠিক হয়নি। হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপ পালটে পালটে মালটার অভ্যেসটাই বিগড়ে গিয়েছে! বাঁদরের হাতে বন্দুক পড়লে যা হয়, তাই হয়েছে!

মাহির দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুতোটা সরিয়ে রাখল। এক-একটা ভাল বুটের কী দাম! শুনলে মাথায় জাঙিয়া পরতে ইচ্ছে করে। ওসব কেনার সাধ্য নেই মাহিরের। এই ছাব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেল ওর, তাও কিছু কাজ তো জোটাতে পারল না। মায়ের আয়ার চাকরির উপর ভরসা। তার উপর ভাই আছে। ভাইয়ের পিছনেই তো দেদার টাকা যায়! সেখানে কোন মুখে মাকে বলবে, বুটটা আর চলছে না! পরশু ম্যাচে কী পরবে!

মাহির ব্যাগের ভিতর বুটটা ঢুকিয়ে নিল। তারপর প্লাস্টিকে জড়ানো হাওয়াই চটিটা বের করে পায়ে পরে নিল। জার্সি আর প্যান্টটা বাড়ি গিয়ে ছাড়বে।

“কী রে, গুটিয়ে ফেললি?”

মাহির পেছন ফিরে তাকাল। সুমিত দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সুমিত সামান্য হাঁপাচ্ছে। হাতের গ্লাভসটা খুলে বসে পড়ল মাটিতে। তারপর আবার বলল, “পতাদা মাইরি লাল সুতো, নীল সুতো বের করে দিচ্ছে! আমি মাইরি গোলকিপার, আমায় ছ’বার মাঠ চক্কর মারাচ্ছে কেন? আমি অলিম্পিকে দশ হাজার মিটার দৌড়োব নাকি?”

মাহির দেখল, পতাদা বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কুল ডাউন এক্সারসাইজ় শুরু করে দিয়েছে। মানে আজকের মতো প্র্যাকটিস শেষ!

ও বলল, “প্র্যাকটিস তো শেষ।”

“তুই তো আগে থেকেই বসে গেলি। পতাদা দেখেছে কিন্তু। খিস্তি করবে।”

“আমার এইটা,” মাহির রেগে গিয়ে বুড়ো আঙুল দেখাল, “করুক খিস্তি। আমার বুটের হাল খারাপ খুব। কবে থেকে পতাদাকে বলছি, তুমি বুটটা দাও। শোনে কথা?”

সুমিত হাসল, “আরে, দেবে কোথা থেকে? ক্লাবের হাল জানিস না?”

“কেন, স্পনসর?” মাহির তাকাল সুমিতের দিকে।

সুমিত নিজের ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করে মাথাটা মুছল। তারপর হাসল।

শীত শেষ হয়ে গিয়েছে কলকাতায়। তবে এখনও সেই গরমটা পড়েনি। ফেব্রুয়ারির এই তৃতীয় সপ্তাহে আকাশটা কেমন যেন ব্লটিং পেপারের মতো হয়ে আছে।

মাহির বলল, “হাসছিস কেন? স্পনসরের কথা যে বলল সেদিন। বলল কুড়ি লাখ টাকা দেবে নাকি তারা?”

“টাকা গাছে ফলে?” সুমিত এবার জল খেল একটু। তারপর বোতলের মুখটা বন্ধ করে বলল, “শোন, ওসব ছেঁদো কথা। গত্তি নেই। আমাদের টিম কি বার্সেলোনা নাকি? সেকেন্ড ডিভিশনের মাঝামাঝি একটা টিম। চ্যাম্পিয়ন হব, সেই দম নেই আমাদের। কে টাকা দেবে? কেনই-বা দেবে?”

মাহির কী বলবে বুঝতে পারল না। গত সপ্তাহে ফ্রেন্ডস ইউনিয়নের সঙ্গে খেলায় জিতেছে ওরা। পরিষ্কার টু-নিল। তারপর মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে পতাদাই স্পনসরের কথাটা বলেছিল।

বলেছিল, “আজকের মতো যদি খেলতে পারিস তবে আর চিন্তা নেই। পরের চারটে ম্যাচ জিতলেই আমরা কিন্তু টপ থ্রি-তে পৌঁছে যাব। একটা সিমেন্টের কোম্পানির সঙ্গে কথা হয়েছে। ওরা বলেছে কুড়ি লাখ টাকা দেবে। ভাবতে পারছিস ব্যাপারটা? তোদেরও কিছুটা দেখতে পারব। সুতরাং, ঢিলে দিবি না। জান লড়িয়ে দে। ফার্স্ট ডিভিশনে উঠতে পারলে ভাবতে পারিস কী হবে?”

সেদিন থেকে কুড়ি লাখ টাকা মাথায় ঘুরছে মাহিরের। মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকাও যদি ক্লাব দেয়, তবেই তো অনেক। ও তো মনে মনে ভেবেই নিয়েছিল সহজে কাউকে ডিফেন্স দিয়ে বল নিয়ে গলতে দেবে না।

“কী রে, কী ভাবছিস?” সুমিত ঠেলল মাহিরকে।

মাহির মাথা নাড়ল, “কিছু না। পতাদা হেবি ঢপবাজ। ধুর, আমি আর খেলব না।”

“কেন?” সুমিত চোখ গোলগোল করল।

মাহির উত্তর দিতে গিয়ে সামলে নিল নিজেকে। প্র্যাকটিস শেষ করে পতাদা এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। বাকিরাও যে যার মতো মাঠে ছড়িয়ে বসে আছে।

লেকের দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে এখন। আপ বজবজ লোকাল লেক গার্ডেন্স ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বালিগঞ্জের দিকে। আর পাখি উড়ছে। আকাশে ভুরু এঁকে পাখির ঝাঁক হাওড়ার দিকে থেকে উড়ে যাচ্ছে বারুইপুরের দিকে। কেমন একটা মনখারাপ করা আলো যেন ভাসছে। সূর্য নেই, তবু তার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে যাওয়া আলোয় দিনটা কেমন যেন নিচু হয়ে এসে মাথায় লাগছে মাহিরের।

ক’টা বাজে? আলো দেখে সময় বলে দিতে পারে মা। ও পারে না। কিন্তু ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করতেও লজ্জা করছে। গতকাল হাত থেকে পড়ে গিয়ে মোবাইলটার পেছনের দিকের ঢাকনাটা খুলে গিয়েছে। কিছুতেই আর আটকাতে পারেনি। পরানদার দোকানেও নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরানদা বলেছে, এমন করে ভেঙেছে আর জোড়া লাগানো যাবে না। গোটা ফেসিয়া পালটাতে হবে। কিন্তু এত পুরনো মডেল, ফেসিয়া পাওয়াও নাকি কঠিন।

পরানদা বলেছিল, “আরে, নতুন ফোন নিয়ে নে। এসমার্ট ফোন। বড় স্কিরিন! ভাল করে ছবি আর ভিডিয়ো দেখতে পাবি।”

শেষের কথাটা বলার সময় চোখ টিপেছিল পরানদা। কিন্তু মাহির ওসব পাত্তা দেয়নি। বড় স্ক্রিন! স্মার্ট ফোন! কে দেবে টাকা? পরানদা? না পরানদার বাপ?

গতকাল থেকে একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে ফোনটাকে পেঁচিয়ে রেখেছে ও, না হলে ব্যাটারিটা পড়ে যেতে পারে। খুব বদখত লাগছে দেখতে। তাই সবার সামনে সেটা বের করতে ইচ্ছে করছে না। লজ্জা করছে।

“কী রে, তুই কুল ডাউনের আগেই বসে পড়লি কেন?” পতাদা এসে কোমরে হাত দিয়ে সামনে দাঁড়াল।

মাহির মাথা তুলে তাকাল। বিরাট বড় ভুঁড়িটার জন্য কেমন একটা লাগছে। গায়ের টি-শার্টটা কোমরের দিকে উঁচু হয়ে আছে। পইতেটা সামান্য বেরিয়ে ঝুলছে। পতাদার মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। মাথার চুলের আসল রং কলপের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ায় মাথাটা কেমন যেন দোয়েল পাখির মতো লাগছে।

মাহির এসব দেখতে-দেখতে তাকিয়ে থাকল।

“কী রে শালা?” পতাদা খিঁচিয়ে উঠল, “বয়রা হয়ে গেছিস? উত্তর দে! ডিসিপ্লিন নেই কিছু? শো-কজ় করব?”

মাহিরের মনে হল বাছা-বাছা কিছু গালাগালি দেয়! শো-কজ়! পাজামার বুক পকেট!

কিন্তু নিজেকে সামলাল ও। তারপর বলল, “বুটটা গিয়েছে পতাদা। ছোটনকে দিয়েছিলাম সারাতে। কিন্তু পারেনি ভাল। পেরেক বেরিয়ে গিয়েছে।”

“তো?” পতাদা বলল, “জানিস, আমরা কেমন খেলেছি? পেরেক-ফেরেক কিচ্ছু মানিনি। একবার ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলা ছিল। কৃশানু, বিকাশ, চিমা। কে নেই ওদের টিমে! কিন্তু আমরা যা ফাইট দিয়েছিলাম না! আমারও সেদিন বুটে প্রবলেম ছিল। কিন্তু আমি কি পিছিয়ে এসেছি? আজও সবাই বলে সেই ম্যাচটার কথা।”

মাহিরের মুখটা আপনা থেকেই বেঁকে গেল! পতাদা এত বাতেলা করে না! সবাই জানে, পতাদার মতো ভুলভাল ঢপ কেউ মারে না!

ও বলল, “কিন্তু পতাদা, পা কেটে যাবে। ওই বুটে খেলা যাবে না।”

“তবে?” পতাদা তাকাল, “পরশু ম্যাচ আছে। তুই আমার রাইট ব্যাক। তোকে ভেবেই টিম করেছি। এখন বলছিস বুট খারাপ? আর বুট নেই?”

মাহির মাথা নাড়ল, “পরার মতো নেই। পুরনোটা আছে, কিন্তু স্টাডস গিয়েছে।”

পতাদা চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “ঠিক আছে, কাল আয়, দেখব। কী যে করিস! কত নম্বর পা তোর? দশ?”

মাহির আবার মাথা নাড়ল, “এগারো।”

“এগারো?” পতাদা অবাক হল, “মাইরি! রাবণ নাকি তুই?”

শরীরটা ওর বড়সড়। ছ’ফুট দু’ইঞ্চি লম্বা। চওড়া কাঁধ আর বুক। ভুঁড়ি নেই একটুও। ঢালাই লোহার শরীর। বাদামি চামড়ায় মাছি পিছলে যায়। রেশমি বলত, “তোর সঙ্গে কে প্রেম করবে? চেপে ধরলে আমি মরেই যাব।”

মরে যাবে? রেশমিকে এমনভাবে কেন চেপে ধরবে যে, ও মরে যাবে? রেশমি মরে গেলে ওর কী হবে?

ফরসা, রোগা মেয়ে ছিল রেশমি। একমাথা বাদামি চুল। গালে একটা তিল। ওকে দেখলেই দম বন্ধ হয়ে আসত মাহিরের। রেশমিকে বলতও সেই কথা। শুনে রেশমি হাসত, বলত, “ছেলেগুলোকে চিনি না? বদের বাসা! হিট উঠে গেলে যা খুশি তাই বলে! শুধু শোওয়ার ধান্দা!”

কিন্তু মাহিরের সেসব উদ্দেশ্যই ছিল না। সেই ক্লাস ইলেভেন বয়সটায় রেশমি বললে ও গলফ গ্রিনের টিভি টাওয়ার থেকে ঝাঁপও দিতে পারত।

কিন্তু রেশমি সেসব বুঝল না। ফাগুন মাহাতোর সঙ্গে এক সপ্তমী পুজোর দিন পালিয়ে গেল।

ন’বছর হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আজও মাহিরের ভিতরের জ্বালাটা মরেনি। ও চলে যাওয়ার পর তো পড়াটাও ছেড়ে দিয়েছিল মাহির। সারাক্ষণ ঘর অন্ধকার করে বসে থাকত। খেতে চাইত না। খালি মনে হত বজবজ লোকালে গলা দেয়! মনে মনে দেখত ফাগুন আদর করছে রেশমিকে। সম্ভাব্য সমস্ত রকম আদর যেন মনে মনে দেখতে পেত ও। আর বুকের পাঁজরে আগুন লেগে যেত! সারা শরীর পুড়তে শুরু করত ওর! পাগলের মতো লাগত মাহিরের। মনে হত সাপে কেটেছে ওকে। বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা দেহে। বুঝত, এই বিষ বাকি জীবন বয়ে যাবে ওর শিরায় শিরায়।

সারা জীবন? সত্যি? না, সারা জীবন আর নয়। সত্যি করে বলতে গেলে সেভাবে হয়তো প্রেম আর নেই, কিন্তু কোথায় যেন একটা হেরে যাওয়া আছে। জ্বালাটা যে হারের সেটা বুঝতে পারে এখন। বুকের ভিতরের রাবার গাছ থেকে সারাক্ষণ টপ-টপ করে রস চুঁইয়ে পড়ে! খালি মনে হয় আধবুড়ো ফাগুনের কী ছিল, যা ওর ছিল না? উত্তরটা অবশ্য খুঁজতে হয় না। উত্তরটা ও জানে। টাকা। জমি-ব্যাবসার দালালির টাকা।

টাকাটাই মেরে দিল মাহিরকে। সব কিছুতেই পিছন থেকে টেনে ধরল। সেই রেশমি থেকে এই বুট অবধি। টাকা কিছুতেই এগোতে দেয় না ওকে।

পতাদা চলে যাওয়ার আগে বলল, “কী করিস, একটা বুটও কিনতে পারিস না!”

মাহির উত্তর দিতেও পারত, কিন্তু দিল না। কী হবে মুখ নাড়িয়ে। পতাদা বলবেই। তার চেয়ে একটা নতুন বুট পেলে ভাল হবে।

সুমিত উঠল, “কী রে, তোকে ছেড়ে দেব?”

মাহির মাথা নাড়ল, “না, আমি হেঁটেই চলে যাব। টিটি আসবে জাহাজবাড়ির সামনে।”

সুমিত কাঁধ ঝাঁকাল, “কী যে করিস মাহির! এখনও বলছি এইচএস-টা দিয়ে দে প্রাইভেটে। খেলার পাশে অন্তত এইচএস-টা হয়ে থাকলে সুবিধে পাবি।”

মাহির হাসল। বিষণ্ণ হাসি। সুমিত বুঝবে না। ওকে তাই বলে লাভ নেই। লেখাপড়ায় তো খারাপ ছিল না মাহির। মাধ্যমিকে লেটার ছিল চারটে। স্টার পেয়েছিল। ওদের ওই স্কুল থেকে মাত্র দুটো ছেলে পেয়েছিল স্টার। তার মধ্যে এই মাহির বসু একজন। ইংরেজিতে খুব ভাল ছিল ও। স্যার বলতেন, “মন দিয়ে পড়িস মাহির। জীবনে সব কিছু আমাদের ছেড়ে যায়, কিন্তু অর্জন করা বিদ্যে কখনও ছেড়ে যায় না। এর চেয়ে ভাল বন্ধু আর কেউ নেই।”

স্যারের কথা আজও খুব মনে পড়ে মাহিরের। ইলেভেন থেকে টুয়েলভে ওঠার পরীক্ষায় ইংরেজিতে একশোয় বিরাশি পেয়েছিল মাহির। স্যার নিজে ওকে একটা বই দিয়েছিলেন। ইংরেজিতে লেখা আইনস্টাইনের জীবনী। বইটা আজও আছে মাহিরের কাছে। শুধু বইটাই আছে। আর সব যেন হারিয়ে ফেলেছে ও! রেশমি চলে গিয়েছে, সঙ্গে করে বাকি জীবনটাও নিয়ে গিয়েছে।

সুমিত বলল, “হাসছিস? কিন্তু একদিন এর ফলটা ভুগবি। আমি ঠেকে শিখেছি। আটাশ হল আমারও। যদি বিএসসি-তে ব্যাকটা ক্লিয়ার করে রাখতাম, আজ শালা দাদার লেদের কারখানায় ঘানি ঘোরাতে হত না!”

ওরা মাঠের বাইরের দিকে হাঁটতে লাগল।

বড় রেলিং দিয়ে মাঠটা ঘেরা আছে। সন্ধের ঘোলাটে আলো বিশাল প্লাস্টিকের মতো এসে নামছে শহরের মাথায়। আস্তে-আস্তে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের আলো জ্বলছে। চিড়িক চিড়িক করে জেগে উঠছে বড়-বড় বিলবোর্ড। গাড়ির ছবি। বড় হাউজ়িং-এর ছবি। বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার প্যাকেজের ছবি। প্রতিদিন মাঠ থেকে বেরোনোর আগে এই বিলবোর্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে মাহির। এত টাকা মানুষ পায় কোথা থেকে? কে দেয় এত টাকা তাদের? ওর মা মাসে আট হাজার মতো পায়। তাতে ওদের তিনজনের চলতে দম ফুরিয়ে যায়! সেখানে এসব কেনে কারা?

মাঠের বাইরে এসে ফুটপাথের উপর স্ট্যান্ড করা মোটরবাইকটার সামনে দাঁড়াল সুমিত। পিছনের ক্যারিয়ারে ব্যাগটা আটকে রেখে বলল, “কী রে, আজ এত ডাউন কেন? বাড়িতে প্রবলেম?”

মাহির উত্তর দিল না। দেখল, মাঠ থেকে বিশু, সঞ্জয়, মইদুল, মনা, সুব্রত, বাবু এক-এক করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ ওকে দেখে হাসছে। কেউ পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। সবার মুখই কেমন যেন ম্লান! কেমন যেন ইস্ত্রি-বিহীন সব হাসি। এখানে কেউ আলো টাঙিয়ে দিয়ে যায়নি!

সুমিত বলল, “এই মাহির, কী হয়েছে তোর? তেমন হলে বলিস আমি তোকে জুতো কেনার টাকা ধার দেব। ভাবছিস কেন?”

মাহির হাসল এবার। সুমিত সেটা দিতেই পারে। যতই বলুক ওর দাদার লেদের কারখানায় ও ঘানি ঠেলছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেছে মাহির। যথেষ্ট ভাল অবস্থা। না হলে কেউ এমন আশি হাজার টাকার বাইক কিনতে পারে? মাহির জানে কারও-কারও দুঃখ নিয়ে বিলাসিতা করার একটা অভ্যেস থাকে। সুমিতেরও তেমন আছে। পড়ত ওর মতো ঘরে! থাকত অমন বস্তিতে! সবার সঙ্গে লড়াই করে জল নিতে হত। মাতালদের চিৎকারের মাঝখানে ঘুমোতে হত। আচমকা মারামারির মধ্যে, বোমাবাজির মধ্যে বাড়ি ফিরতে হত, তখন এসব বাতেলা বেরিয়ে যেত।

মাহির দেখে, সবাই যেন দিলীপ কুমার! ট্র্যাজিক হিরো! সবারই এত্ত বড়-বড় কষ্ট। আর সেই সব সহ্য করে বেঁচে থেকে যেন গোটা পৃথিবীকে উদ্ধার করে দিচ্ছে। মরে যেতে পারলে যেন সবাই বেঁচে যেত। এদিকে পেছনে লঙ্কাপটকা ফাটলে খাটের তলায় গিয়ে লুকোবে সব।

হুঃ! হতে পারে ছাব্বিশ বছর বয়স, কিন্তু জীবন কম দেখল না মাহির। যার বাপ নিজের মাসির সঙ্গে পালায় ছোটবেলায়! যাকে আধখ্যাপা, অসুস্থ একটা ভাই আর ক্লান্ত বিষণ্ণ মাকে টেনে বেড়াতে হয়, সে জানে জীবনের কোন ধানে কী ধরনের চাল হয়।

সুমিত ওকে ভালবাসে। বন্ধু হিসেবেই দেখে। কিন্তু ওর এই টাকা ধার দেওয়ার ভঙ্গিটা ভাল লাগল না মাহিরের। তবে কিছু বলল না ও। আসলে ও কিছুই বলে না। বোঝে, এই পৃথিবীতে কাউকে কিছু বলে কিছু হয় না। যে যা করার সেটাই করে।

সুমিত বাইকে উঠে বলল, “তুই এমন মুখ করে থাকিস না। চিয়ারফুল থাক। পরশু কিন্তু ভাইটাল ম্যাচ। জিততে হবে। জিতলে…”

“জিতলে?” মাহির তাকাল সুমিতের দিকে।

সুমিত বলল, “সুপার ডিভিশনের টিম থেকে স্পটাররা আসবে। অল্প টাকায় ভাল ছেলে খুঁজছে ওরা।”

মাহিরের হাসি পেল। এ আর-এক মিথ্যে কথা। ম্যাচের আগে পতাদা এমন একটা কথা ছড়ায়। আগেও হয়েছে। আসলে কেউই আসে না। কারও খেয়েদেয়ে কাজ নেই ওদের স্পট করতে আসবে। যেন ফুটবলারের অভাব পড়েছে!

ও বলল, “স্পনসরের কথাটা ধরতে পারলি আর এটা পারলি না?”

সুমিত বাইকে বসে স্টার্ট দিয়ে বলল, “এবার আর বুলু দিচ্ছে না। আজ বিকেলে শুনেছি ফোনে কথা বলতে। ওরা আসবে। তুই দেখিস।”

মাহির আর কিছু বলল না। এটাও পতাদার চাল। একে ওকে শুনিয়ে কথা বলার ভান করে। জানে, তা হলে খবর ছড়াবেই। ওসবে আর ভুলছে না মাহির।

সুমিত বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল, “শোন, যদি কাল বুটের ব্যবস্থা না হয় আমি করে দেব। তুই ভাবিস না। শুধু পরশু ইউনিয়নের লেফট আউটটাকে দেখে নিস। মালটার ব্যাপক স্পিড! আর আউট স্টেপে একটা অদ্ভুত ফল্‌স আছে। কেটে যাস না ভাই।”

সুমিতের বাইক গাড়ির তোড়ে নিমেষের মধ্যে মিলিয়ে গেল। মাহির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দূরে ওদের ক্লাবঘরের আলো জলছে। মাহির জানে পতাদার সঙ্গে আরও কয়েকজন আছে ভিতরে। ওরা অনেক রাত অবধি থাকে।

আশপাশে কেউ নেই। এবার ব্যাগের ভিতর থেকে ওর রাবার-ব্যান্ড লাগানো মোবাইলটা বের করল মাহির। বোতাম টিপল। আর সঙ্গে-সঙ্গে জোনাকি রঙের আলো জ্বলে উঠল স্ক্রিনে। প্রায় ছ’টা বাজে। চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। টিটিও বোধহয় এসে পড়েছে জাহাজবাড়ির সামনে। তবে বাড়িটা এখান থেকে কাছেই। পা চালিয়ে হাঁটলে বড়জোর মিনিটচারেক লাগবে।

মোবাইলটাকে এবার পকেটে ঢোকাল মাহির। তারপর ব্যাগটা কাঁধে ফেলে হাঁটতে লাগল।

এদিকটায় আলো থাকলেও সামান্য আবছায়াও আছে। আসলে চারিদিকে অনেক গাছ। মা বলে এই রাস্তাটায় আগে নাকি আরও অনেক গাছ ছিল। কিন্তু এখন কিছুটা কমেছে। কে জানে! এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না মাহির। এতে তো আর ভাত জুটবে না! শহরটা সুন্দর থাকুক বা কুৎসিত তাতে ওর কী? মানুষরাই যদি ভাল না থাকে তা হলে এসব ওপরের চটকবাজি দিয়ে কী হবে?

পাশ দিয়ে হুসহাস করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। আলতো হাওয়া দিচ্ছে গোলপার্কের দিক থেকে। আচমকা আকাশে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে উঠল। এই রে, বৃষ্টি হবে নাকি?

আকাশের দিকে তাকাল মাহির। বিকেলে তো মেঘ ছিল না! তবে? এবার পা চালাল ও। ভিজলে চলবে না।

সিগনাল টপকে ওই দিকে ফুটপাথে উঠে বাঁ দিকে কিছুটা হাঁটলেই জাহাজবাড়ি। সামনেই টিটি দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে দেখে ‘গুরু’ বলে এগিয়ে এল।

টিটির চেহারাটা স্কেল দিয়ে টানা লাইনের মতো। রোগা। বেঁটে। কালো। শুধু মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কেমন যেন ছোট ঝুলঝাড়ুর মতো দেখতে! আর সব সময় মাথায় একটা হেয়ার ব্যান্ড পরে থাকে। আজও পরে আছে।

টিটি নেশা করে খুব। মানে গাঁজা, চরস, হেরোইন থেকে আঠা, সব ধরনের নেশায় টিটি ক্যাপ্টেন!

মাহির সামান্য হাসল। ভোল্টেজ কমে যাওয়া বাল্‌বের মতো হাসি। মাথার ভিতরটা কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। মনখারাপের ছোট্ট ধূপ কে যেন জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে মনের কোণে!

“কী কাকা, এমন ড্যামেজ চোপা নিয়ে ঘুরছ কেন?” টিটি খ্যালখ্যাল করে হাসল।

মাহির দেখল লিলিপুটের মতো টিটিকে। অনেকটা যেমন মানুষ দোতলার বারান্দা থেকে একতলায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে দেখে, সেভাবে।

টিটি থমকে গেল। বুঝল হাওয়া খারাপ। মাথার ব্যান্ডটাকে ঠিক করে নিয়ে টিটি এবার সংযত গলায় বলল, “কী রে, এমন ডাউন মেরে আছিস কেন?”

মাহির সময় নিল একটু। একটা দীর্ঘশ্বাস আসছিল, সেটাকে মাঝপথে আটকে দিয়ে বলল, “না রে, কিছু না। বল, কী জন্য এখানে ডেকেছিস?”

টিটি ছাড়ল না। কাছে ঘেঁষে এসে বলল, “কী হয়েছে তোর? শালা আজও কি রেশমি এসে ঘাড়ে চেপেছে! শালা, এই জন্য প্রেম মারাতে নেই! আমার কাকা সোজা হিসেব। লাগাও আর ছাড়ো! তলপেটই ঠিক আছে। কেস বুক অবধি গড়িয়েছে কী তোমার মারা গেল।”

মাহির অন্যদিন হলে হাসত। কিন্তু আজ হাসল না। আসলে কোথায় যেন টিটি ঠিক। সব কষ্ট-দুঃখগুলোই যেন একটাই নদীর সঙ্গে বাঁধা। সব জল শেষমেশ সেই নদীতে গিয়েই যেন পড়ে! নিজেকে মনে মনে একটা তাগড়া গালি দিল মাহির। এসব বিলাসিতা ওকে মানায় না। কোথাকার কে একটা মেয়ে, ওকে কাঁচকলা দেখিয়ে আধবুড়োর সঙ্গে পালাল, সেটা নিয়ে ছিরকুটে মেরে পড়ে থাকবে কেন ও? জীবনে কাজ নেই? ওর পাড়ার প্রায় সবাই কিছু না-কিছু করে এখন। কেউ ওর মতো এমন মায়ের ঘাড়ে বসে খায় না! এখন জীবনে সেই দিকেই লক্ষ দিতে হবে ওকে। এই ফুটবল-টল খেলে কিছু যে হবে না সেটা বুঝতে পারছে। বড় চেহারাটাই আছে ওর, স্কিল তেমন নেই। নিজেই বোঝে। কিন্তু কীভাবে যে রোজগার করা যায়! ওই যে বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জীবন, তেমন জীবন কিন্তু ও কল্পনা করে না। ওর একটা সাধারণ জীবন হলেই হয়। প্রতি মাসের শেষের ওই অন্ধকার সপ্তাহটা আর নিতে পারে না ও। খুব কষ্ট হয় ওরকম আধপেটা খেয়ে থাকতে। মায়ের গালাগাল খেতে।

মাহির টিটির দিকে তাকাল। রোগা বেঁটে একটা ছেলে। ওরও তো জীবনটা কষ্টের। কিন্তু কী করে এমন সব সময় টগবগে থাকে কে জানে! কালীঘাটের ওই বড় গলিতে ওর বাড়ি। ইটের গাঁথনি দেওয়া ছোট্ট টালির ঘর। দুটো কামরা। একটায় ও থাকে। অন্যটাতে ওর মা। মায়ের কাছে যখন ক্লায়েন্ট আসে টিটি বাড়ির বাইরে গিয়ে বসে। কী যে জীবন ছেলেটার! তাও কখনও টিটিকে ও গোমড়ামুখে থাকতে দেখে না! সারাক্ষণ হাসে, নেশা করে। ইকিরমিকির কথা বলে।

টিটিদের বাড়িতে বহুবার গিয়েছে মাহির। আসলে ওইখানেই একটা স্কুলে পড়ত তো। যদিও ইলেভেন পাশ করে আর পড়েনি। তবু ক্লাস ফাইভ থেকে ইলেভেন অবধি ওই পাড়াতেই তো গিয়েছে। জানে তো কী পরিবেশে সেখানে মানুষজন থাকে!

টিটিও ওদের সঙ্গে পড়ত। তবে ক্লাস নাইনের পর আর পড়েনি। কিন্তু বন্ধুত্বটা ঠিক টিকে গিয়েছে। টিটির জীবন ওদের বন্ধুত্বের ব্যাপারে কোনওদিন অসুবিধে করেনি। বরং স্কুলে পড়ার সময় তো মাঝে মাঝেই ওদের ওখানে যেত মাহির। আড্ডা মারত। খেলত। ওদের ওখানকার অনেকের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ আছে মাহিরের। এখনও কখনও-সখনও মাহির ওখানে যায়, আড্ডা মারে। তবু টিটির মতো কিছুতেই হতে পারে না ও। চেষ্টা করে কষ্ট নামক অতিরিক্ত বোঝাটা নামিয়ে রাখতে। কিন্তু কে যেন সেটাকে ওর শরীরের সঙ্গে সেলাই করে দিয়েছে।

টিটি বলল, “কী রে? শালা, আজকাল তোদের পতাদা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ধ্যান করা শেখাচ্ছে নাকি! মাইরি তোকে বুঝতে পারি না আমি। এক-একদিন এক-এক কিসিমের ক্যালানে হয়ে যাস। এসব আর কতদিন চলবে?”

“কী জন্য এখানে দেখা করতে বলেছিস বল,” মাহির ব্যাগটা কাঁধ বদল করে বলল।

টিটি হাসল। হলুদ কালোর ছোপ-ধরা উঁচু দাঁত। হাসলে বড় মাড়ি দেখা যায়। ও বলল, “রিতুদা ডেকেছে তোকে। আর্জেন্ট কাজ।”

“আমায়?” মাহির অবাক হল সামান্য!

“কেন? তোকে তো আগেও ডেকেছে অনেকবার! তুই তো ঢ্যামনামো মেরে যাসনি। আমি গতসপ্তাহে বলেছিলাম তোর কথা। আসলে কাকিমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কাকিমাকে দেখে কষ্ট হল আমার। আর কত লোকের গু-মুত ঘাঁটবে বল তো! এবার একটু মাকে রেহাই দে। আমি তো আমার মাকে বলেছি। আর বছরখানেক, তারপর ঘরে বাবু বসানো বন্ধ। অনেক হয়েছে শালা। আর না। ছোটবেলা থেকে শালা লাগানোর আওয়াজ আর স্টিম ইঞ্জিনের হেঁচকি শুনে বড় হলাম। আর পোষায় না।”

মাহির বলল, “ঠিক আছে। চুপ কর। কী কাজ বল।”

“আরে শালা, চল না,” এবার টিটি হাত ধরে টানল ওকে, “আগে থাকতেই হাজার প্রশ্ন! রিতুদা এখানকার নেতা। পার্টিতে ঘ্যামা হোল্ড। শালা যত ফ্ল্যাট হয় তার থেকে টাকা আসে। আমাদের পাড়া থেকে টাকা আসে। আরও হাজারটা গলতা আছে টাকা রোজগারের। প্লাস ইট-বালি-পাথর-সিমেন্টের সাপ্লাই থেকে টাকা আসে। এত সোর্স! সব তো আর নিজে দেখাশোনা করতে পারে না। দেখিস না নেতাদের পাশে ক্যালানের মতো মুখ করে বেশ কিছু মানুষ ঝুলে থাকে সবসময়? তুইও থাকবি। আমেরিকায় তো জন্মাসনি যে, কর্পোরেশনের মইয়ের মতো চেহারা বলে বাস্কেটবল খেলতে নিয়ে নেবে! এখানে শালা গতরটার ডিসপ্লে দে। রিতুদার সঙ্গে থাক। পার্টি অফিসে এসে বোস। প্লাস রিতুদা পার্টিতে আরও ওপরে ওঠার ফিকির খুঁজছে। এমনভাবে কিছু উন্নয়ন না ভাটের কী করে পার্টির উপরমহলের চোখে পড়তে চায়। শুধু এমপি-তে পোষাচ্ছে না। মন্ত্রী হতে চায়। কিন্তু সেসব ঘুঁটি সাজাতে গেলে একটা টিম তো চাই। তোকে চায় টিমে। কোনও বেআইনি কাজ নয়। সোজা কাজ। চল।”

মাহির তাকাল টিটির দিকে। এসব ব্যাপারগুলো খুব ভাল বোঝে ও। রিতুদাকেও সামান্য চেনে। বছর পঞ্চাশের মতো বয়স। মোটা। বেঁটে। মাথায় টাক। সারাক্ষণ লজেন্স খায়। কাঁধে সব সময় একটা তোয়ালে থাকে। মাহির দেখেছে, লোকটা শীতকালেও কুলকুল করে ঘামে! ও ভাবে কর্পোরেশনের কল যদি এই লোকটার মতো হত!

এর আগেও রিতুদা ওকে লোক মারফত ডেকে পাঠিয়েছে। কাজ দেবে বলেছে। কিন্তু মা করতে দেয়নি। আর সত্যি বলতে কী, মাহিরেরও ইচ্ছে ছিল না। তাই মা যখন বলেছে, “ওই মোটার কাছে যেতে হবে না। হেন খারাপ কাজ নেই ও করে না! পুলিশের ঘানি ঘোরাতে চাস? না গুলি খেয়ে মরতে চাস? জানিস না ওদের পার্টির ভিতরেই দশখানা পার্টি আছে? ভাগ আছে? জানিস না, রিতুর সবচেয়ে বড় শত্রু মনা পান্ডে? দু’জন দু’জনকে পারলেই দেখে নেয়! আর এসব বলছিস কেন? আমার রোজগারে তোর চলছে না? আর আমি তো কয়েকজনকে বলেছি। হাসপাতালে ওয়ার্ড বয় বা হোটেলে বেয়ারার কাজ ঠিক হয়ে যাবে। তবে খেলে যদি কিছু পাস, তবে তো কথাই নেই! কিন্তু ওর কাছে যাবি না।”

মায়ের কথা থেকে সব বাদ দিয়ে শুধু অসমর্থনটুকু নিজের মনে তুলে নিয়েছিল মাহির। ভেবেছিল মা যখন বারণ করছে, তখন যাবে না। মনা পান্ডের সঙ্গে রিতুদার আকচাআকচি সবাই জানে। ঝিলের মাঠে মাঝে মাঝে বোমাবাজি হয়। পেপারে বেরোয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। কিন্তু রিতুদা বলে অপজ়িশন হামলা করেছিল! সবাই সব জানে, তাও সব অন্ধ হয়ে বসে আছে! মাহির একটা জিনিস খুব বোঝে, টাকার চেয়ে বড় শাসক আর কেউ নেই। এর চেয়ে বড় চাবুক আর কিছু নেই।

মাহির বলল, “তুই এমন করতে গেছিস কেন? মা পছন্দ করে না!”

“ওরে আমার ন্যাকাখোকা! মায়ের কথা শুনে কত চলিস! মনে নেই, একদিন মাল খেয়ে আমাদের পাড়ার প্রতিমাদির ঘরে গিয়েছিলি? ওকে নাকি রেশমির মতো দেখতে! মাকে জিজ্ঞেস করেছিলি? শোন, হাওয়াটা বোঝ মাহির। এমন স্টাইলের নাম নিয়ে ঘুরলেই হবে! ঘটে কিছু থাকবে না? বড়-বড় শিল্পী সাহিত্যিকরা সুযোগ বুঝে পাল তুলে দিয়ে নৌকো বাইছে! আর সেখানে তুই আতাক্যালানে! রিতুদার এই কাজটা ভাল। এক নম্বরি। চল। ভাল দেবে। দু’মাসের মধ্যে বাইক নিয়ে ঘুরবি!” কথাটা বলে পকেট থেকে বিড়ি বের করল টিটি।

মাহির বিরক্ত হয়ে দেখল সেটা। ও কালে-ভদ্রে মদ খায়, কিন্তু কখনওই বিড়ি বা সিগারেট খায় না। গন্ধেই কেমন একটা গা গুলোয় ওর। বিশেষ করে এই বিড়ি জিনিসটা।

ও বিরক্ত হয়ে তাকাল টিটির দিকে। টিটি পাত্তা দিল না। নেশা নিয়ে টিটি কারও কথা শোনে না। বরং বলল, “শোন, আগেও বলেছে রিতুদা। কিন্তু এবারেরটা ভাইটাল। নতুন কাজ। খুব জটিল কাজ। ভাল টিম না হলে চলে না।”

“কী জটিল কাজ?” মাহির ভুরু কোঁচকাল।

“সে আমি কী জানি! কিন্তু রিতুদা যখন বলেছে, তখন জটিল! ব্যস! বেকার জেরা করবি না তো! রিতুদার অনেকদিন তোর উপরে চোখ আছে। জানে তো তুই একসময় ক্যারাটে করতিস।”

“সে তো আগে। লাস্ট দু’বছর তো করি না। আর আমি কি রিতুদার হয়ে মারামারি করব নাকি?” মাহির চোয়াল শক্ত করল।

টিটি সময় নিল একটু। বিড়িতে বড় করে একটা টান দিয়ে গাল ফুলিয়ে ধোঁয়াটাকে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর রাস্তার হলুদ আলোর মুখে ছুড়ে দিল নীলচে মিহি রুমাল! মাহির দেখল ধোঁয়ার ছোট্ট মেঘটাকে। দেখল, পুঁচকি মেঘটা ধীরে-ধীরে ছিঁড়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল সন্ধের বাতাসে। নাকটা কুঁচকে গেল মাহিরের। গন্ধটা বড্ড বাজে! যারা রাস্তাঘাটে এসব খায় বা খেতে খেতে হাঁটে, তারা বোঝে না ব্যাপারটা কতটা বিরক্তিকর অন্যদের পক্ষে। অনেক বাতেলা বক্তৃতা করা লোককে দেখেছে মাহির, যারা এইসব সাধারণ অসভ্যতা নিয়ে ভাবে না। আসলে সেই বোধটাই নেই!

“শোন বোকা, যা বলছি কর। আমার আর কী! আমি তো ঢুকে গেছি। তোকে ভালবাসি। তাই বলছি। আর কথাটা শুনতে কী আছে বে? কান দিয়েছে ভগবান, সেটা শালা কাজে লাগাবি না? শোন, রিতুদা বাণী দেবে আর তুই শুনবি। আমাদের কাছে রিতুদার বাণী হল দৈববাণী! আর অত ভাটের নখরামোর কী আছে! রিতুদা বাইক পাঠিয়েছে তোর জন্য। বোঝ রে গান্ডু! চল।”

মাহির অবাক হয়ে গেল! বাইক পাঠিয়েছে রিতুদা! ওর জন্য! সামান্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে টিটির দিকে তাকাল। বলে কী ছেলেটা! ও এত গুরুত্বপূর্ণ হল কবে থেকে!

মাহির এদিক-ওদিক তাকাল। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে একের পর এক। রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের দিকের ফুটপাথে সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনেই মেনকা সিনেমা। সন্ধের শো কি শুরু হল?

এই রাস্তাটায় বড়-বড় গুলমোহর, কিছু রেনট্রি আর অশ্বত্থগাছ রয়েছে। রাস্তার হলুদ আলো এই গাছগুলোয় ধাক্কা খেয়ে ছোট-ছোট ছায়ায় ভেঙে ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। কিন্তু তার ভিতর তো কোনও বাইক নেই! টিটি কী সব হাবিজাবি বলছে!

টিটি বুঝল ব্যাপারটা। পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করে কানে লাগাল। বলল, “কী বে? কোথায় গেলি? তোর গাঁজা কেনা হয়নি? শালা, গাছ লাগাচ্ছিস নাকি বে!”

মাহিরের মুখটা বিরক্তিতে বেঁকে গেল। বুঝল, বাইক নিয়ে কেউ একটা গাঁজা কিনতে গিয়েছে। এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটা গাঁজার ঠেক আছে। টিটির দৌলতে মাহিরও সেসব চিনে গিয়েছে। ও তাকাল টিটির দিকে।

টিটি ওকে পাত্তা না দিয়ে বলল, “ও, এসে গেছিস? তাই বল। দেরি করিস না।”

মাহির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রিতুদার সামনে ওকে যেতেই হবে! কী আপদ! এমন একটা মানুষ। কিছু বললে, কী করে মুখের ওপর না করবে! আর মা? মাকে কী বলবে? মাহির নিজের মনটাকে শক্ত করল। এটাই ওর সমস্যা, বড্ড বেশি আগাম ভেবে নেয় ও। আগে কী বলে দেখা যাক। তারপর না হয় চিন্তা করবে। আর সৎ কাজ হলে করবে না কেন? মা-ও নিশ্চয় বুঝবে ব্যাপারটা। সারা জীবন আর কত অনিশ্চয়তার ভিতর থাকবে!

“ওই এসে গিয়েছে।”

টিটির গলা শুনে তাকাল মাহির। একটা হলুদ কালো বাইক এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তার পাশে। যে ছেলেটা চালাচ্ছে, তার মুখটা চেনা। আন্ডারকাট চুল। সামনেটা ব্রোঞ্জের মতো রং। বাইকটা দাঁড় করিয়ে মাটিতে পা রেখে ছেলেটা লুকিং গ্লাসে নিজের চুল ঠিক করছে।

টিটি মাহিরকে ইঙ্গিত করে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল।

ছেলেটা সোজা হয়ে বসে এবার তাকাল মাহিরের দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে মুখটা হাসিতে ভরে গেল, “আরে! মাহিরদা!”

মাহির অবাক হল। ও ছেলেটার মুখ চেনে। নাম জানে না। কিন্তু ছেলেটা ওকে চেনে!

ছেলেটা বলল, “আমি নকু। মানে নকুলেশ্বর। আমি তোমায় চিনি। তুমি তো হেবি খেলো! গতমাসে ওই কবরডাঙায় খেলতে গিয়েছিলে না? হায়ার করে নিয়ে গেছিল তোমায়! আমার মামার বাড়ি তো ওখানে। আমি দেখেছিলাম। আমার খুব ফুটবল খেলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু…”

মাহির হাসল।

টিটি নকুকে কথা শেষ করতে দিল না। মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আর ফ্যাচকাস না! ফুটবল খেলবে! গাঁজার ছিলিম চুষে ফুসফুস কয়লার বস্তা করে ফেলেছে! শালা! শোন, তুই সোজা রিতুদার অফিসে নিয়ে যাবি। এখন দাদা চেম্বারে আছে। আমি পরে যাব।”

মাহির অবাক হল, “তুই যাবি না?”

টিটি আবার সেই শ্যাওলা-ধরা দাঁত দেখিয়ে বলল, “যাব, আগে আমার কাজটা শেষ করি।”

কথাটা শেষ করে নকুর দিকে হাত বাড়াল টিটি। বলল, “দে। রিফার করে রেখেছিস তো?”

নকু হাত বাড়িয়ে একটা প্যাকেট দিল টিটিকে। মাহির মাথা নাড়ল শুধু। গাঁজা ভরা সিগারেট। আর সিগারেটের মাথাটা পাকানো। টিটি নেশা করেই একদিন শেষ হবে!

নকু বাইকটা স্টার্ট করে তাকাল মাহিরের দিকে। বলল, “বোসো দাদা।”

মাহির বলল, “হেলমেট?”

“আরে দূর! ওসবের দরকার নেই। বোসো,” নকু বাইকের হাতল ঘুরিয়ে ভ্রুম ভ্রুম শব্দ তুলে রেস দিল।

মাহির ব্যাগটা সামলে বসল।

টিটি বলল, “মুখটা অমন ক্যালানের মতো করে রাখিস না। হাস। শালা, তোকে কেউ ফাঁসি দিতে নিয়ে যাচ্ছে না! কত ছেলে রিতুদার সঙ্গে চিপকাবার জন্য লাইন দিয়ে পড়ে আছে। সেখানে রিতুদা নিজে তোকে ডাকছে, আর তুই পোঁদ দোলাচ্ছিস! তোর হেবি তেল! যা। ভাল করে কথা বল। কাজ শুরু করে দে। বুঝলি?”

পার্টি অফিসের সামনে বাইকটা থামিয়ে পেছন ফিরে নকু বলল, “মাহিরদা, এই যে। তুমি সোজা ভেতরে চলে যাও। কোনও চাপ নেই!”

মাহির বাইক থেকে নেমে হাসল। তারপর এগিয়ে গেল সামনের দিকে। প্রতাপাদিত্য রোডের উপর একটা নতুন তৈরি মাল্টিস্টোরেডের নীচের তলায় পার্টি-অফিস।

সামনে চওড়া ফুটপাথ। সেখানে প্লাস্টিকের চেয়ারে বেশ কিছু লোকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে রয়েছে। তাদের মুখে একটা ‘মার দিয়া’ টাইপের ভাব। এদের মুখ চেনে মাহির। সবক’টাই রিতুদার ল্যাংবোট। সকাল-সন্ধে এখানে বসে থাকে। চা খায়। হ্যা হ্যা করে। রিতুদার সঙ্গে এদিক-ওদিক যায়। আর পৃথিবীর সব কিছু নিয়ে শেষ মন্তব্যটা করে! দেখলেই জুতো খুলে পেটাতে ইচ্ছে করে মাহিরের। তেল দেওয়াটাও এখন একটা কাজ হিসেবে নিয়ে নিয়েছে বাঙালি! বুদ্ধিজীবী থেকে দুর্বুদ্ধিজীবী সবাই ব্যাপক হারে এটা দিয়ে চলেছে! স্যার বলতেন, “এরা ঘুণপোকা! দেশটাকে এরাই ভেতর থেকে শেষ করছে।” স্যারের কথাগুলো আজও মনে আছে মাহিরের।

মাহির এগিয়ে গেল অফিসের দরজার সামনে। দুটো ছেলে বসে মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছিল। ওর দিকে তাকাল। তারপর চিনতে পেরে হাসল। একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ও এসে গেছ! যাও ভেতরে। দাদা বলেছেন তুমি আসবে।”

অফিসের দরজাটা আসলে একটা রোলিং শাটার। ফলে সামনেটা গোটাটাই খোলা! কিন্তু ভিতরে একটা পার্টিশান দিয়ে তৈরি করা ঘর রয়েছে। রিতুদার চেম্বার!

অফিসের ভিতরে পা দিয়েই থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মাহির! আচমকা সামনের ওই চেম্বারটার দরজা খুলে ঝড়ের মতো বেরিয়ে এল একটা মেয়ে। একটা স্লিভলেস কুর্তি, সঙ্গে জিন্‌স পরা। গলায় একটা স্কার্ফ। মেয়েটার ফরসা মুখটা টকটকে লাল হয়ে আছে। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে মেয়েটা।

উত্তেজনার বশে মেয়েটা দেখতে পায়নি, চেম্বারের বাইরে একটা পাপোশ রয়েছে। তাতে নিমেষে পা জড়িয়ে গেল মেয়েটার। সে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু একটা টেবিল ধরে টাল সামলাল। তবে হাতের ফাইলগুলো ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। মেয়েটা থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

মাহির এগিয়ে গেল। তারপর ধীরে-ধীরে ফাইলগুলো গুছিয়ে তুলে দিল মেয়েটার হাতে। মেয়েটা এখনও ফুঁসছে! কিন্তু ফাইলগুলো পেয়ে সামান্য থমকাল। তারপর চোয়াল শক্ত করে দেখল মাহিরকে।

“থ্যাঙ্কস,” মেয়েটা ছোট্ট করে বলল।

“ইটস অলরাইট!” মাহির মাথা নাড়ল।

মেয়েটা থমকে গেল যেন। চোখে কি সামান্য বিস্ময়! ওকে দেখে কি মনে হয়নি যে, এটুকু ইংরেজি ও জানবে! মনের ভিতরের আত্মসম্মানের ঘরটা ক্রমশ ছোট হয়ে গিয়েছে মাহিরের। জীবনের চাপে পড়েই যেন কীরকম হাওয়া-কমা বেলুনের মতো দিনদিন চুপসে যাচ্ছে সেটা। কিন্তু সেটাতেও একটা ছোট্ট লাল পিঁপড়ে কামড়াল। মেয়েটার চোখ থেকে ছিটকে আসা বিস্ময়ের ভিতরের একটা হুল এসে বিঁধে রইল ওই ঘরে। মাহির মনে মনে ভাবল, মেয়েটা তো জানে না, ইলেভেন থেকে টুয়েল‌্‌ভে ওঠার পরীক্ষায় একশোয় ও বিরাশি পেয়েছিল ইংরেজিতে। স্যার বলেছিলেন, “মন দিয়ে পড়! তোর হবে!”

কিছু হয়নি মাহিরের। কিচ্ছু হয়নি! রেশমি আচমকা চলে গিয়ে ওকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল। আর সেই নিকষ কালোয় হারিয়ে গিয়েছিল ওর সবটুকু! কিন্তু সেই অন্ধকারের ভিতর নিভে আসা, ছোট হয়ে আসা একটা ঘর এখনও যে রয়ে গিয়েছে, সেটা এই হুলটা না বিঁধলে জানতেই পারত না মাহির!

ও পিছন ফিরে দেখল। মেয়েটা বেরিয়ে যাচ্ছে অফিস থেকে। বাইরে আলতো একটা ধোঁয়াশা! স্ট্রিট লাইটের আলোর ভিতর ভেসে আছে দুধের সরের মতো ধূলিকণা। মেয়েটার ফরসা পিঠের পাশ দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে ব্রেসিয়ারের কালো স্ট্র্যাপ। যেন একটা দাগ! একটা রেখা! যার ওই দিকে দাঁড়িয়ে মেয়েটা এখনও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে মাহিরের দিকে। সেই মাহির! যে একদিন একশোতে বিরাশি পেয়েছিল ইংরেজিতে!

.

০৩. আইকা

এই শহরটাকে পিঁপড়ের বাসার মতো মনে হয় আইকার। এই দশতলার উপর থেকে রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয়, সার বেঁধে পিঁপড়েরা বেরিয়েছে খাবার খুঁজতে। কোনওদিকে যেন নজর নেই! আগ্রহ নেই! শুধু পেটের চুম্বক যেন তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক বিন্দু থেকে আর-এক বিন্দুতে।

আইকা তাকিয়েই থাকে। সামনে খোলা কম্পিউটার, ডায়েরি, পেন, পাশে রাখা চায়ের কাপ— সব কিছু থেকে কীভাবে যেন আলাদা হয়ে যায় ও। একা হয়ে যায়। মনে হয় ও নিজেও তো তাই। পিঁপড়ে! পেটের ভিতর ওরও তো একটা চুম্বক রয়ে গিয়েছে! আর তার প্রবল টানে ও নিজেও তো ঘুরে মরছে!

টুংটুং করে বেজে ওঠা মোবাইলের শব্দে আইকার সংবিৎ ফিরল এবার। স্ক্রিনটা উজ্জ্বল হয়ে আছে। ও ফোনটা হাতে তুলে দেখল। মেসেজ। সার্ভিস প্রোভাইডারের! মেসেজটা ডিলিট করে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে চোখ রাখল আইকা। ফেব্রুয়ারির শেষ এখন। তাতেই কী গরম! নেহাত এসি রয়েছে তাই বাঁচোয়া। ইয়ার এন্ড হতে আর মাসখানেক মতো বাকি। এখনই খুব একটা চাপ নেই কাজের। তাও আইকা কাজ ফেলে রাখে না। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে এই ‘হোমওয়ার্ড বাউন্ড রিয়েলটরস’-এর সিনিয়র ম্যানেজার স্টোরস-এর পদটা তো আর কোম্পানি ওর মুখ দেখে দেয়নি! কাজ করে বলেই সব হয়েছে।

জীবনে কাজ ছাড়া আর কিছু বোঝেনি আইকা। এর জন্য সব ছেড়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর ও তো দেখেছে কী হয়েছিল ওদের সঙ্গে! জেঠুরা তো প্রায় কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছিল বাড়ি থেকে। ওদের পাওনা দেয়নি। মাকে খুব কষ্ট করতে হয়েছিল। বাবার সামান্য পেনশন আর মায়ের প্রাইমারি স্কুলের চাকরি ভরসা করে যাদবপুরে খুব ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল ওরা! ক্লাস সেভেনে পড়ত তখন। ছোট্ট দুটো ঘর। একটুখানি একটা বেসিন। আবছা অন্ধকার একটা বাথরুম। দু’মিনিট টানা কল খুলে রাখলে বাড়িওয়ালি জেঠিমা দোতলার বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে গালাগাল করত। কাপড় কাচলে বলত, “এটা বস্তি নয় যে, এমন আওয়াজ করছ!” কথায়-কথায় জেঠিমা জিরাফের মতো গলা বাড়াত। চিৎকার করত। উঠে যাওয়ার হুমকি দিত। এমনকী, একদিন তো মাকে বেশ্যা পর্যন্ত বলেছিল, ঠিকমতো মেন গেট আটকায়নি বলে। তবে এই শেষ কথাটা মেনে নিতে পারেনি আইকা। তখন ও ক্লাস নাইনে পড়ে। যা ঝগড়া সেদিন ও করেছিল! জেঠিমা তো শেষপর্যন্ত ভয় পেয়ে গিয়েছিল! কোনওদিনই অন্যায় মেনে নিতে পারে না ও। সেদিনও পারেনি। আজও পারে না! সেই ঘটনার কথা মনে পড়লে কোথায় যেন একটা ভাললাগা এখনও মনে আসে! জেঠিমার ওই ভয় পেয়ে যাওয়া মুখটা এখনও চোরা একটা তৃপ্তি দেয় ওকে। তবে সত্যি বলতে কী, সেসব দিনগুলো আর ভাবতে চায় না আইকা।

কম্পিউটারের দিকে মনোযোগ দিল এবার আইকা। ইনভেন্ট্রির লিস্ট পাঠানো হয়েছে ওকে। এসব ওর আর নিজে না দেখলেও চলে। কিন্তু তাও দেখে ও। স্টোরের লোকজন চুরি করে। সাইটে মাল পাঠানোর সময় দরকারের চেয়ে বেশি মাল নিয়ে যায়, কিন্তু চালান-এ সেটা দেখায় না। তাই আপ টু ডেট ইনভেন্ট্রি লিস্ট মিলিয়ে নিতে হয়। কতটা মাল গেল আর কতটা থাকল দেখে নিতে হয়।

স্টোরের বড়বাবু রমেন মণ্ডল লোকটা ঘোড়েল। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, তেল দিয়ে পালিশ করা চুল, লাল বেদানার মতো দাঁত নিয়ে দরকারের চেয়ে বেশি হেঁ হেঁ করে! এমন হেঁ হেঁ করা মানুষ দেখলে বড্ড রাগ হয় আইকার। উপরের প্লাস্টিকের হাসির তলায় লুকোনো দাঁত-নখগুলো ভালই চিনতে পারে ও। জীবন ওকে এইসব জিনিস চিনিয়ে দিয়েছে।

আগে লোকটার উপর ভরসা করত আইকা। কিন্তু এখন আর করে না। লোকটা যে জিনিস সরায়, সেটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু হাতেনাতে ধরতে পারেনি। কিছু বললেই বলে, ওয়েস্টেজ বেশি। লেবাররা শয়তানি করে। কনস্ট্রাকশানে নানা ঝামেলা। তাই এমন বাড়তি ব্যয় হচ্ছে! আরে বাবা, দিব্যি ভাল ওয়্যার হাউস। লেবারদের খবরও অন্যদের থেকে পায়! সেখান থেকে ওয়েস্টেজ কী করে বেশি হবে?

কিন্তু এসব তো আর মুখের কথায় হয় না। প্রমাণ চাই। তাই আজকাল নিজেই আচমকা মাঝে মাঝে ওয়্যার হাউসে যায় আইকা। মাঝে মাঝে সাইটেও যায়! আর ওকে সামনে দেখলে রমেন এখনও হেঁ হেঁ করে। কিন্তু আজকাল ওই হাসির আড়ালে বসে থাকা শয়তানটাকে চিনতে পারে ও।

আইকার সাড্‌ন ভিজ়িটের জন্য চুরি কিছুটা কমেছে। ও নিজে গিয়ে সব মালপত্তর মিলিয়ে রমেনবাবুকে দিয়ে ইনভেন্ট্রি লেজারে সই করিয়ে নেয়। লোকটা পাঁকাল মাছের মতো, ঢিলে দিলেই কিছু একটা করে বসবে।

আইকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনটা আজ কেন কে জানে ছিটকে যাচ্ছে বারবার। কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে! একটা ফড়িং ঢুকে গিয়েছে যেন মাথার ভিতর। যতই টেনেটুনে মনটাকে বসানোর চেষ্টা করছে, ততই মনটা কীরকম যেন পিছলে যাচ্ছে! কাজ করতেই ইচ্ছে করছে না। এখানে বসে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। কিছুই ইচ্ছে করছে না। আজ দিনের সব কিছুই ‘না’ দিয়ে তৈরি! কারণ, শুধু মনে পড়ছে আজকের তারিখটার কথা! আজই ওর বিয়ে হয়েছিল না! বিয়ের তারিখটা আজই তো!

“কী রে আইকা? বাড়ি যাবি না?”

মুখ তুলে দূর্বাকে দেখল আইকা। মেয়েটা তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। কিন্তু সেটাও বুঝতে আজ সামান্য সময় লাগল ওর। তারপর বলল, “বাড়ি?”

দূর্বা হেসে বলল, “ক্যালানে হয়ে গেলি? ক’টা বাজে দেখেছিস? সওয়া পাঁচটা। আজ তোর নোঈ-এর ওই ব্যাপারটা আছে না? বলেছিলি তো আমায় নিজেই। তোকে তো যেতে হবে।”

আরে, তাই তো! আইকা চমকে উঠল। সব ভুলে যাচ্ছে! কী কাণ্ড! ও চট করে ঘড়ি দেখল। ছ’টায় ছেলের বাড়ির লোকরা আসবে। এখন সওয়া পাঁচটা বাজে। ওর তো মিষ্টি কিনে নিয়ে যাওয়ার কথা। তিনরকম মিষ্টি আর দু’রকম নোনতা। কী কাণ্ড!

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল আইকার। মেয়ে দেখতে এসে এসব গান্ডেপিন্ডে গেলাটা জাস্ট সহ্য করা যায় না। কিন্তু কী করবে! পুটুমাসি পইপই করে বলে দিয়েছে, আইকা যেন মনে করে কিনে নিয়ে যায় এসব। বাড়িতে তেমন কিছু ঝামেলা করছে না!

পুটুমাসি মায়ের বান্ধবী। ওদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। পুটুমাসিরা আগে শ্যামবাজারে থাকত। কিন্তু বছরছয়েক হল ফ্ল্যাট কিনে চলে এসেছে এই ভবানীপুরে। আইকারাও তখনই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল! মা আর পুটুমাসি বলতে গেলে একসঙ্গে যুক্তি করে কিনেছে ফ্ল্যাট দুটো!

আইকার মনে পড়ে গেল আবার। ফ্ল্যাটটা তো কেনাই হত না যদি না ওর জীবনে আজকের দিনটা থাকত!

“মাইরি! কী রে?” দূর্বা এবার এগিয়ে এসে ঠেলল আইকাকে, “এমন স্পেসড আউট হয়ে আছিস কেন?”

“না তো, কই!” আইকা হাসার চেষ্টা করল।

দূর্বা বলল, “আমিও আজ তাড়াতাড়ি কাটব। মায়ের শরীরটা ভাল নয়। ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে হবে। ব্রতীন তো নেই কলকাতায়।”

আইকা দূর্বার দিকে তাকিয়ে হাসল। আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। দূর্বা ওর খুব বন্ধু, তাই কিছু বলতেও পারছে না। কিন্তু এক-একদিন থাকে যখন কিছুই ভাল লাগে না। রোদের রং, হাওয়ার ওড়না, আকাশ থেকে নেমে আসা আলো, সবেতেই কেমন একটা মনখারাপ লেগে থাকে যেন। যেন মনে হয় সবই অনর্থক! সবই শূন্য! সব কিছুই কেবল থাকার জন্যই রয়েছে!

আইকা আবার একবার জানালার দিকে তাকাল। আলো নরম হয়ে এসেছে অনেক! শহরের শিরা-ধমনির মতো রাস্তাগুলো অনেকটাই ম্রিয়মাণ। কিন্তু পিঁপড়েরা চলেছে! মনখারাপ আর অন্ধকার ভেঙে তাদের সারি এগিয়ে চলেছে। একসঙ্গে। একাকী।

“কী হয়েছে তোর?” দূর্বা পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল এবার, “এমন মুখ করে আছিস কেন? সত্যি মাইরি! তোকে নিয়ে আর পারি না! আর কত বোঝাব বল তো? ছত্রিশ বছর বয়সটা কি তোর হাওয়ায় হল? আরে বাবা, বর কি কারও মারা যায় না? তবে? এবার একটা বিয়ে কর। কত ছেলে তো লাইন দিয়ে রেখেছে! একজনকে বেছে তারপর বিয়ে করে নে।”

আইকা হাসল। কী বলে মেয়েটা! আসলে সবটা তো আর জানে না। কাউকে বলেও না। কী হবে বলে? পুরনো কথা মাটি খুঁড়ে বের করে আনলে দুর্গন্ধই বেরোবে! এখনকার আপাতশান্ত জীবনটা বিঘ্নিত হবে। তার চেয়ে যা অলক্ষ্যে ও অতীতে রয়েছে, তা অলক্ষ্যেই থাকুক।

দূর্বা বলল, “দেখ আইকা, এভাবে মুখ বুজে থাকলে হবে না। আমার তো চল্লিশ হল। আমি কম ঘাটের জল খাইনি! তোর মতো আমারও ছোট থেকে বাবা নেই। সবটা আমাকে আর মাকে করতে হয়েছে। ব্রতীন আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। ওকেও কিন্তু দেখতে হয় আমাকেই। হতে পারে মাল্টিন্যাশনালের ভিপি, কিন্তু জানিস তো ডান দিকে ফিরলে বাঁ দিকটা ভুলে যায়! আগেই জানতাম ও এমনটাই। মা বলেওছিল, অফিস করে এমন ছেলেকে সামলাতে পারবি তো! কিন্তু আমি দূরের সময়টা দেখেছিলাম। ফিউচার ইজ় মাই কনসার্ন। তাই ওকে বিয়ে করব ঠিক করছি। এখনও বয়স আমাদের দিকে। শরীরে, মনে জোর আছে। কিন্তু সারা জীবনটা তো এমন যাবে না! আঠাশে তোর হাজ়ব্যান্ড চলে গেল। তারপর আট বছর কেটে গিয়েছে বস! এবার কিছু কর। বেকার কষ্ট পেয়ে কী লাভ?”

আইকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাউসটা ধরে নাড়াল সামান্য। তারপর বলল, “তুই এত কথা বলিস কেন?”

“যাঃ শালা!” দূর্বা ওর খোলা চুলটাকে আঙুল দিয়ে কানের পিছনে নিয়ে গিয়ে বলল, “বলছি তোর ভালর জন্য রে!”

আইকা হেসে একবার দ্রুত ইনভেন্ট্রি লিস্টটায় চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর বন্ধ করে বলল, “আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু যাকে-তাকে বিয়ে করে নেব? এতটা ডেসপারেট হইনি এখনও।”

দূর্বা হাসল, “যাকে-তাকে কী বলছিস! তোর জন্য যা লাইন, তা পেট্রোলের দাম বাড়ার আগের রাতের পেট্রোল পাম্পকেও হার মানাবে।”

আইকা জানে দূর্বা ইয়ারকি করছে! ও ওরকমটা করে। মেয়েটা খুবই ভাল। পরিশ্রমী। তাই কোম্পানিতে ভাল পোস্টে আছে। আর আইকাকে ভালওবাসে খুব। কিন্তু তা হলেও আইকা ওকেও সবটা বলতে পারেনি! কাউকেই পারেনি কোনওদিন। পারে না। ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়া আর তার পরবর্তী জীবনের কষ্ট আর সংগ্রামটাই কোথায় যেন পালটে দিয়েছে ওকে। রাগী, অভিমানী আর জেদি করে দিয়েছে। আর তাই তো আজ ওর জীবনটা এরকম হয়ে গেল! জীবনে টাকা আর স্থিতিশীলতার জন্য একের পর এক যা করেছে, তা ওকে আজ এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। সেই স্কুলজীবন থেকেই ও টিউশনি করত। তারপর কলেজে উঠে পার্টটাইম কাজ করে নিজের পড়ার খরচ চালিয়েছে। এমনকী মায়ের যখন শরীর খারাপ হল, জীবনবিমার এজেন্ট হিসেবেও কয়েকমাস কাজ করেছিল বাড়তি রোজগারের জন্য। আর অল্পবয়সি, সুন্দরী মেয়ে বলে কম নোংরামো তো ওকে সামলাতে হয়নি! কাজ যেমন হত, তেমন মানুষজন নানা খারাপ কথা, ইঙ্গিত আর প্রস্তাবও দিত। জীবন দোধারী তরোয়ালের মতো। একদিকে ওর বাঁধনগুলো যেমন কেটেছে, তেমন ওকেও কেটেছে অন্য দিকে!

কম্পিউটারটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল আইকা। এবার যেতেই হবে, না হলে পুটুমাসি রাগ করবে। আর সত্যি তো, ছেলের বাড়ির লোকজন এসে যাওয়ার আগেই ওর যাওয়া উচিত। রাঙামেসো আর পুটুমাসি ঠিক সামলাতে পারে না কিছু। তাই আইকাকে থাকতেই হয়।

পুটুমাসি মায়ের ছোটবেলার বন্ধু। তবে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না। মায়ের বিয়ের চার বছরের মধ্যে দু’বছরের জন্য বাবার বদলি হয়ে গিয়েছিল মধ্যপ্রদেশ। তখন থেকেই আর যোগাযোগ ছিল না। ফলে ওদের ওই ভয়ংকর সময়টার কথা পুটুমাসিরা জানত না। তবে মায়ের ওই সময় পুটুমাসির কথা মনে থাকলেও মা সেখানে যায়নি। সাহায্য চায়নি। কারও কাছেই যায়নি। দু’জনেই যতটা পেরেছে সব সামলেছিল!

শুভ মারা যাওয়ার পর আবার যোগাযোগ হয়েছিল পুটুমাসির সঙ্গে। এখনও মনে আছে আইকার। শুভর শ্রাদ্ধের চারদিন পর মাকে নিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়েছিল আইকা। পুটুমাসিরাও এসেছিল ব্যাঙ্কে। অ্যাকাউন্ট খুলতে। মা আর পুটুমাসি তো দু’জন দু’জনকে দেখে কিছুক্ষণ নড়তেই পারেনি! কেমন যেন থমকে গিয়েছিল! থমকে গিয়েছিল সময়! তারপর দু’জনে জড়িয়ে ধরেছিল একে অপরকে। আর কী কান্না কী কান্না! মা একদম ছেলেমানুষের মতো আঁকড়ে ধরে কাঁদছিল পুটুমাসিকে। পুটুমাসিও কাঁদছিল। ব্যাঙ্কে লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিল গোটা ব্যাপারটা! কেউ কেউ হাসছিলও। সকলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আইকার খুব এমব্যারাসড লাগছিল। মনে হচ্ছিল মা এমন বাড়াবাড়িটা না করলেই পারত। কিন্তু কিছু বলতেও পারেনি। কী বলবে! আসলে এই বহুবছর পরের দেখা হওয়াটার ভিতর যে অনেক অনেক মেঘ জমে ছিল! মানুষকে মাঝে মাঝে কাঁদতেও দিতে হয়। দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তখন। তাকে সান্ত্বনা দিতে নেই। তাকে প্রবোধ দিতে নেই। কিছু বোঝানোর চেষ্টা করতে নেই। তাকে শুধু কাঁদতে দিতে হয়। আইকা জানে, কান্না আসলে খুব ব্যক্তিগত একটা অভিব্যক্তি। খুব সৎ একটা প্রকাশ। সান্ত্বনার মতো বাহ্যিক আড়ম্বর দিয়ে তাকে সব সময় লঘু করার মানে হয় না।

সেই মায়ের সঙ্গে আবার পুটুমাসির যোগাযোগের শুরু। সেই যোগাযোগ থেকেই একসঙ্গে ফ্ল্যাট কেনাও হয়েছে। আসলে শুভর সঙ্গে বিয়ের পর টাকাপয়সার সব অভাব মিটে গিয়েছিল আইকার। তাই শুভ মারা যাওয়ার পরে পঞ্চান্ন লক্ষ টাকা দিয়ে এই ফ্ল্যাটটা কিনতে ওদের কোনও অসুবিধে হয়নি।

শুভর সঙ্গে ওর আলাপ হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়। ইংলিশে এম এ করছিল আইকা। শুভদের ছিল সোনার ব্যাবসা। গোটা কলকাতায় ছ’টা সোনার দোকান ছিল ওদের। শুভ নিজে দেখত দুটো দোকান। তার একটা ছিল কলেজ স্ট্রিটে। সেখানেই একদিন আলাপ হয়েছিল ওর সঙ্গে শুভর। রথের দিন ছিল সেটা। আজও মনে আছে আইকার।

শুভ লম্বা ছিল খুব। গায়ের রং মিশকালো। মোটা গোঁফ, দাড়ি। গম্ভীর মুখ। আইকার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড় ছিল শুভ।

একটা ছোট বই কিনতে গিয়েছিল আইকা। আটত্রিশ টাকা দাম ছিল সেটার। সঙ্গে খুচরো ছিল না ওর। আইকা পাঁচশো টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়েছিল। দোকানদার লোকটি বিরক্ত হয়েছিল খুব। আইকাও বুঝতে পারছিল যে, বিরক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। এতটা খুচরো সব সময় যে থাকবে তা তো নয়। সেটা ও ভাল করে বলতেও গিয়েছিল। কিন্তু লোকটা শুনছিল না কিছুতেই।

পাশেই একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়েছিল শুভ। হাতে মাটির খুরিতে চা নিয়ে ও যে গোটা ব্যাপারটাই দেখছিল, সেটা বুঝতে পারেনি আইকা!

দোকানদার লোকটাকে কিছুতেই বোঝাতে না পেরে আইকা যখন বইটা না কিনেই চলে আসছিল, ঠিক তখনই এগিয়ে এসেছিল শুভ।

আইকার লজ্জা লাগছিল খুব! এমনিতেই দোকানদারটি ওকে সামান্য হলেও অপমান করেছিল, তারপর একদম অচেনা একজন এমন করে গায়ে পড়ে উপকার করছে দেখে লজ্জাটা যেন বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ। কিন্তু বইটাও দরকার ছিল খুব। তাই শুভ টাকাটা খুচরো করে দিতে চাইলে আর আপত্তি করেনি। শুভ বিশেষ কথা বলেনি। শুধু জানতে চেয়েছিল, কী পড়ে আইকা।

আইকা বলেছিল। শান্ত নরম গলায় ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এসেছিল দোকান থেকে। কিন্তু পরের দিন ইউনিভার্সিটি ছুটির পরে দেখেছিল বিদেশি দামি বাইকে হেলান দিয়ে ফুটপাথের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুভ! প্রচণ্ড অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল আইকা। কী করছে লোকটা এখানে? টাইট জিন্‌স, বুকের একটা বোতাম খোলা সাদা জামা আর বিশাল বড় একটা বিদেশি বাইক! লোকজন রীতিমতো দেখছিল বাইকটা। আইকা কী করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু শুভ একদম সামনে চলে আসায় এড়াতে পারেনি। সৌজন্যবশত সামান্য হেসেছিল! শুভ ভাবলেশহীন মুখে বলেছিল, “আজও যদি খুচরো লাগে, তাই চলে এলাম!”

ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল আইকা। সামনের কাচে নিজেকে দেখে ছোট করে কাটা চুলগুলো ঠিক করে নিল। তারপর টেবলে রাখা বোতলটা থেকে জল খেল একটু।

“শোন, স্যারের সঙ্গে একবার দেখা করে যাস,” দূর্বা নিজের কিউবের দিকে যেতে-যেতে বলল, “তোকে একবার খুঁজছিলেন।”

“তো এতক্ষণে বলছিস!” আইকার বিরক্ত লাগল, “আমায় বেরোতে হবে! আসল কথা না বলে এসব জ্ঞান তোকে কে দিতে বলেছে! আর উনি বেয়ারা দিয়ে কল করাননি কেন?”

দূর্বা বলল, “আরে, আমি ঘরে গিয়েছিলাম তাই আমাকেই বললেন! জাস্ট দু’মিনিট লাগবে। মনে হয় ঝাড়খণ্ডের ওই প্রজেক্টটা নিয়ে কিছু বলবেন।”

আইকা মাথা নাড়ল বিরক্তিতে। তারপর ঘড়ি দেখল। সেই লেট হবেই! ভাগ্যিস ওর নিজের গাড়ি। সত্যি দূর্বাকে নিয়ে আর পারা যায় না। ও আর অপেক্ষা না করে এগিয়ে গেল স্যারের চেম্বারের দিকে। স্যার মানে ওদের কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার রুপিন মেহতা। দেখা যাক, স্যার কতক্ষণ আটকান।

ওর কিউবিকল থেকে বেরিয়ে একটা টানা লম্বা করিডর। আশপাশের কিউবিকলে এখনও লোকজন কাজ করছে। আইকা সেইদিকে তাকাল না। শুধু ঘড়ি দেখল। দূর্বাটা যেন কী একটা! কাজের কথা না বলে এটা-সেটা নিয়ে বেশি ব্যস্ত! মেয়েটা খুব ভাল। কিন্তু দরকারের চেয়ে বেশি সেন্টিমেন্টাল। এত বেশি সেন্টিমেন্টাল, যে মাঝে মাঝে অফিসেই কেঁদে ফেলে! বিরক্ত লাগে আইকার। নিজের মনের গোপন ভাঁজগুলো নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি ভাল লাগে না ওর। জীবনে যখনই সেন্টিমেন্ট আর কার্যকারিতার মধ্যে বাছবিচার করতে হয়েছে, কার্যকর হবে যেটা ওর পক্ষে, সেটাই সব সময় বেছে নিয়েছে আইকা।

“তুই এমনটা করতে পারলি!”

আচমকা কথাটা মনে পড়ায় থমকে গেল আইকা! ভুরু কুঁচকে গেল ওর। কী হল ব্যাপারটা! হঠাৎ এটা মনে পড়ল কেন! আইকা চোখ বন্ধ করল একটু সময়ের জন্য। হঠাৎ এতদিন পরে এটা মনে পড়ল কেন? সেন্টিমেন্ট-কার্যকারিতা এসব নিয়ে ভাবছে বলেই কি এটা মাথায় এল? কিন্তু সে তো প্রায় উনিশ বছর হয়ে গিয়েছে! সেই স্কুললাইফের ব্যাপার। তবে? বয়স বাড়ছে বলেই কি আচমকা মনে পড়ে গেল ওর কথা?

করিডরের শেষ প্রান্তে রুপিনস্যারের কেবিন। তার আগের এই জায়গাটা স্টেনলেস স্টিলের পাত দিয়ে মোড়া। সামান্য বাঁকাচোরা হলেও প্রতিফলন দেখা যায়।

আইকা মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে দেখে নিল আর-একবার! ছোট করে কাটা চুল। বেবি পিঙ্ক রঙের শার্টের সঙ্গে কালো ট্রাউজ়ার। সারা দিনের ক্লান্তির পরেও দেখতে খারাপ লাগছে না! ভালই তো আছে আইকা! নিজের ফ্ল্যাট। মা। বন্ধুবান্ধব। ঋষি। সব নিয়ে খারাপ নেই তো! তবে?

ঋষির কথা মনে পড়তেই হাসি পেল আইকার। ঋষি আগরওয়াল। আলিপুরে থাকে ছেলেটা। বিশাল বড়লোকের ছেলে। চাল, পেঁয়াজ, ডাল আরও কীসবের ব্যাবসা আছে। মদেরও একটা ব্রুয়ারি আছে। কিন্তু সেসব দিকে ঋষির মন নেই।

ঋষি বিবাহিত। কিন্তু বউয়ের দিকেও মন নেই। আইকা বউয়ের কথা তুললে ঋষি বলে, “আরে, ওটা সমঝোতা। বাবার বিজ়নেস বাড়বে ওতে! পলকের বাবুজির বিশাল কারোবার। তুমি তো বোঝো আইকা। শি ডাজ়নট নো হাউ টু লাভ! হাউ টু ফ্‌… ইউ নো!”

আইকা হাসে। ঋষি ওর চেয়ে আট বছরের ছোট। অফিসের একটা পার্টিতেই আলাপ হয়েছিল বছরদুয়েক আগে। তারপর থেকেই আঠার মতো লেগে থাকে ওর সঙ্গে!

ঋষির একটা ফ্ল্যাট আছে রাজারহাটে। বেশ বড়। প্রায় তিন হাজার স্কোয়ার ফিট। সেখানে মাঝে মাঝে যায় ওরা। ঋষি পাগলামো করে! শরীর নিয়ে মেতে ওঠে! তারপর বিছানাতেই বসে প্রচুর খাওয়া-দাওয়া করে ওরা। বড় টিভিতে ফিল্ম দেখে। আড্ডা মারে। কিন্তু ওইটুকুই। আর কিছু নয়। শুধু টাইম পাস। কোনও মন নেই। গভীরতা নেই। ফিরে আসার সময় পিছুটান নেই। কিচ্ছু নেই। কেবলমাত্র ফান-টাইম। ব্যস। এটা কতদিন থাকবে, সেটাও ও জানে না।

রুপিন মেহতার কেবিনটা বেশ বড়। চারিদিকে বাদামের খোসার রঙের ফার্নিচার। এককোণে বড় লাউঞ্জার। প্রায় নিঃশব্দে এসি চলছে। বড় একটা টেবলের উলটো দিকে বসে রয়েছেন রুপিন। ছোটখাটো মানুষ। গোলাপি ফরসা গায়ের রং। মাথায় পাট করে আঁচড়ানো চুল। দাড়িগোঁফ কামানো। চোখে রিমলেস চশমা। ঘন ভুরুর আড়ালে আঁশফলের বীজের মতো চোখ! দেখলে বোঝা যায় না লোকটার পঞ্চাশ বছর বয়স!

আইকা ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই রুপিন চোখ তুলে তাকালেন। তারপর হাত দিয়ে বসতে বললেন সামনের চেয়ারে। আইকার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। এই রে! বসতে বলছেন! তার মানে দেরি হবে। রুপিন ওর বস। তাঁর সামনে তো আর বিরক্তি দেখাতে পারে না আইকা! তাই যথাসম্ভব ক্যাজ়ুয়াল থেকে আড়চোখে ঘড়িটা আবার দেখল আইকা। আজ নির্ঘাত মা আর পুটুমাসির কাছে ঝাড় খাবে! পাত্রপক্ষ চলে এলে মুশকিল হবে। নোঈও রাগ করবে।

নোঈ পুটুমাসির ছোট মেয়ে। বড় মেয়ে এখানে থাকে না। বিয়ে হয়ে গিয়েছে। নিউ জার্সিতে থাকে। প্রায় ওর মতোই বয়স। আর সেখানে নোঈ মাত্র ছাব্বিশ! এই বয়সে আজকাল কেউ কারও বিয়ে দেয়! হয়তো দেয়! আইকার মনে হয় এখনও নোঈ বিয়ে করার মতো হয়নি।

আইকার বিরক্ত লাগে। মানুষ যে কী করে না! পুটুমাসিদের কথাবার্তা শুনে তো মনে হয় মনে আলো হাওয়া লেগেছে! কিন্তু তারাও এটা কী করে করছে কে জানে! রাঙামেসোর সঙ্গে আইকার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। তাই নোঈ-র এখন বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নিয়ে রাঙামেসোকে চেপে ধরেছিল আইকা।

রাঙামেসো মানুষটা ভাল। চুপচাপ ধরনের। ঝগড়াঝাঁটি বা তর্ক পছন্দ করে না। সব প্রায় মেনেই নেয়।

আইকার ভাল লাগে রাঙামেসোকে। সারাদিন হয় বই, নয়তো ল্যাপটপে মুভি নিয়ে বসে থাকে। কাউকে জ্বালায় না। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ‘চা দাও’ বলে চিৎকার করে না। কিন্তু মাঝে মাঝে রাঙামেসোর এই নন-এনগেজিং ধরনটা ভাল লাগে না আইকার। মনে হয়, এভাবে জীবন-বিমুখ হয়ে কী করে থাকে কেউ! পুটুমাসিই যা করার করে, যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেয়। রাঙামেসো যেন বাড়ির একটা ফুলদানি!

গত সপ্তাহে নোঈ-র এই বিয়ের সম্বন্ধের কথাটা ওদের বলেছিল পুটুমাসি। সন্ধেবেলাটায় মা পুটুমাসিদের বাড়িতেই থাকে। অফিস থেকে ফিরে আইকাও যায়। কখনও ও খাবার কিনে নিয়ে যায় আবার কখনও পুটুমাসি কিছু খাবার বানায়। সেদিন ও নিজে পিৎজ়া নিয়ে এসেছিল। খাবারটা ভাগ করে দিতে দিতে পুটুমাসিই তুলেছিল কথাটা!

পুটুমাসি বলেছিল, “তোদের একটা খবর দেওয়ার ছিল রেখা।”

আইকা তাকিয়ে দেখেছিল মাকে। মা চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছিল সবে। পুটুমাসির কথা শুনে থমকে গিয়েছিল।

পুটুমাসি বলেছিল, “পরের সপ্তাহে নোঈকে দেখতে আসবে।”

“দেখতে আসবে মানে?” মা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল পুটুমাসির দিকে।

“মানে বিয়ের জন্য,” হেসেছিল পুটুমাসি, “গত জানুয়ারিতে আমরা একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলাম। ওই মুকুন্দপুরের ওইদিকে। সেখানে ওঁরা দেখেছিলেন নোঈকে। খুব পছন্দ হয়েছিল। তাই খবর দিয়েছে।”

“নোঈ-র জন্য!” মা বলেছিল, “এখনই বিয়ে দিয়ে দিবি?”

পুটুমাসি সামনের চেয়ারটায় বসে হেসেছিল। তারপর গদগদ মুখে বলেছিল, “হ্যাঁ। ছেলেদের অবস্থা ভাল। ডাক্তার। বাপ-ঠাকুরদাও ডাক্তার। ওদের আগ্রহ খুব। তা ছাড়া নোঈ তো আর কচি খুকি নয়!”

নোঈকে দেখতে ভাল। ফরসা। টিকালো নাক। বড়-বড় চোখ। চশমা পরে। থুতনিতে একটা হালকা টোল আছে। হাসিটাও সুন্দর। ঝকঝকে। পছন্দ হওয়ার মতোই মেয়ে।

মা বলেছিল, “তাও ওর বয়সটা দেখ!”

পুটুমাসি বলেছিল, “ওর মতো বয়সে আমার বড় মেয়ে টটি হয়ে গিয়েছে! ছাব্বিশটা খুব একটা কম বয়সও নয়। ছেলের তেত্রিশ। একদম ঠিক আছে।”

আইকা আর কথা না বলে থাকতে পারেনি। ও পাশে বসে মোবাইল নিয়ে খুটখুট করতে থাকা নোঈকে বলেছিল, “কী রে, তুই কিছু বলছিস না কেন?”

“আমি আর কী বলব!” নোঈ মোবাইল থেকে চোখ না তুলেই বলেছিল, “বললে কি মা শুনবে? শুনবে না।”

কথাটা সত্যি। পুটুমাসি কারও কথাই শোনে না। আর রাঙামেসো যেহেতু নির্বাক চলচিত্রের পার্শ্বচরিত্র, তাই পুটুমাসিই সমস্ত ডায়ালগের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে।

আইকা ছাড়েনি। বলেছিল, “তুই কারও সঙ্গে প্রেম করিস না?”

নোঈ এবার তাকিয়েছিল আইকার দিকে। বলেছিল, “তোকে কতবার বলব দি? না, করি না।”

“আহা, সত্যিটা বল না।” আইকা চাপ দিয়েছিল।

“ও ওসব করে না। ছোট মেয়ে, কী প্রেম করবে? আর করলে ঠ্যাং ভেঙে দেব না?”

“ছোট মেয়ে?” আইকা চোখ গোল করেছিল, “তা হলে বিয়ে দিচ্ছ কেন?”

“ও তুই বুঝবি না। আমরা বয়সে তোদের চেয়ে বড়। আমরা জানি কোনটা ঠিক কোনটা ভুল।”

পুটুমাসির গলায় অধৈর্য লক্ষ করেছিল আইকা। মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গিয়েছিল ওর।

এই ব্যাপারটা সহ্য করতে পারে না আইকা। বড় বলেই সব জানে? তাই যদি হত, তা হলে ইতিহাসে এত যুদ্ধবিগ্রহ কেন? এত কোটি-কোটি লোকের এত দুঃখ-দুর্দশা কেন? যা খুশি তাই বললেই হল?

আইকা চোয়াল শক্ত করে কিছু বলতে গিয়েছিল, কিন্তু মা পাশ থেকে চেপে ধরেছিল হাতটা। মা আইকাকে ভালই চেনে। তাই জানে কখন কোথায় ওকে আটকাতে হয়। না আটকালে আইকার মুখে কিছু আটকায় না।

আইকা শুধু তাকিয়েছিল নোঈর দিকে। নোঈ একমনে মোবাইলে কাউকে একটা মেসেজ করে যাচ্ছিল। যেন এই ঘরে ও নেই। এই ঘরের সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্কই নেই।

আইকা টেবিল থেকে খাবারের একটা প্লেট তুলে ভেতরের ঘরের দিকে গিয়েছিল। রাঙামেসো ভেতরের ঘরে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল একা।

আইকা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মেসোকে দেখছিল। ঠিক নোঈর ফোটোকপি! বাপ আর মেয়ের এই চুপ করে, একা হয়ে থাকায় কী মিল! ওই ঘরে মেয়ে বসে মোবাইলের মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়েছে। আর এই ঘরে বাবা ল্যাপটপে।

খাবারের প্লেটটা নিয়ে গিয়ে ঠকাস করে টেবিলে রেখেছিল আইকা। মেসো তাকিয়েছিল ওর দিকে। মুখে সামান্য হাসি।

রাগটা মনের মধ্যে পাক খাচ্ছিল আইকার, হাসিটা যেন সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল একদম।

ও দাঁত চেপে বলেছিল, “হাসো যত পারো! মেয়েটা তোমার তো? ঠিক জানো?”

রাঙামেসোর সঙ্গে এভাবেই কথা বলে আইকা। একদম যা মনে হয় বলে। মেসো কিছু মনে করে না। বরং কেন কে জানে প্রশ্রয় দেয়।

মেসো ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিয়েছিল। তারপর বলেছিল, “কী হয়েছে তোর? এত খেপে আছিস কেন?”

আইকা বলেছিল, “নোঈর এই বয়সে বিয়ে দিয়ে দেবে পুটুমাসি! আর তুমি এখানে ল্যাপটপে বিদেশি মিনি সিরিজ় দেখছ!”

“আজ কি বিয়ে হচ্ছে?” মেসো হাসিমুখে তাকিয়েছিল আইকার দিকে।

“মানে?”

“মানে, আজই কি বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে?”

আইকা থমকে গিয়েছিল।

মেসো বলেছিল, “শোন, সারাক্ষণ এত উত্তেজিত থাকিস কেন? এত অস্থির হলে হয়! একটা বাড়ি থেকে নোঈকে পছন্দ করেছে। করুক। দেখতে আসবে। আসুক। বিয়ে তো হচ্ছে না।”

আইকা বলেছিল, “তোমায় দেখে অবাক হয়ে যাই! এত ঠান্ডা থাকো কী করে? পুটুমাসি যেভাবে ছেলের গুণগান করছে, সময় থাকলে নিজেই হয়তো বিয়ে করে নিত!”

মেসো হেসেছিল খুব। তারপর বলেছিল, “শোন, নোঈ যাকে পছন্দ করবে তাকেই বিয়ে করবে। সে পুটু যাই বলুক।”

আইকা মুখ বেঁকিয়েছিল ইচ্ছে করে। তারপর বলেছিল, “তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। আমি জানি তোমায়। তুমি ভিতু।”

মেসো ল্যাপটপের স্ক্রিনটা নামিয়ে দিয়ে রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল আইকার দিকে। তারপর বলেছিল, “জানিস, পুটুকে ওদের বাড়ির লোকজন আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়নি। হাইলি পলিটিক্যালি কানেক্টেড ছিল ওদের বাড়ি। সব রকম চেষ্টা করেছিল আমাকে আটকাতে। মারতেও চেষ্টা করেছিল।”

“তারপর?” অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আইকা।

মেসো হেসেছিল শান্তভাবে। তারপর বলেছিল, “নোঈ না চাইলে ওর বিয়ে কেউ দিতে পারবে না।”

“আর ইউ ইন আ হারি?” রুপিন ফাইল থেকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন।

আইকা বাঁ হাতের ঘড়িটা ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল, “একটু স্যার। বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে।”

“ও, ইজ় দ্যাট সো!” রুপিন ফাইলটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর হাত দিয়ে চুলটা ঠিক করে নিয়ে বললেন, “আমি তা হলে ব্যাপারটা ছোট করে বলি। কাল ডিটেলে ডিসকাস করব। কেমন?”

আইকা মাথা নাড়ল। আসলে ক্লান্ত লাগছে ওর। রুপিনের কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। আবার অন্যদিকে বাড়িতে গিয়ে ওইসব পাত্রী দেখার মধ্যেও পড়তে ইচ্ছে করছে না। একবার খ্যাপাটে চিন্তা এল মাথায়। ভাবল সব উচ্ছন্নে যাক! একবার কি ঋষিকে ডেকে নেবে? কিন্তু সেটাও ভাল লাগছে না। ছেলেটা শরীর নিয়ে বড্ড হামলে পড়ে! বিরক্ত লাগে।

“শোনো,” রুপিন বললেন, “এবার আমরা ডিপার্টমেন্টাল কিছু রদবদল করব। ম্যানেজমেন্ট চাইছে যাতে লোকজন স্ট্যাগন্যান্ট না হয়ে পড়ে! সেই জন্য তোমায় আমরা স্টোর থেকে সরিয়ে নিয়ে ফিল্ডে প্লেস করব! আমাদের ডেভেলপমেন্টের জন্য যে জমি বা বাড়ি অ্যাকোয়্যার করতে হয়, সেটার চার্জে তোমায় রাখা হবে।”

“আমায়?” একটু অবাক হল আইকা।

“হ্যাঁ, ইটস আ প্রোমোশন আইকা। ইনক্রিমেন্ট, ফেসিলিটিস, সব পাবে। প্লাস লাস্ট দু’বছর আগে তুমি তো বলেইছিলে তোমায় ফিল্ডে দিতে। এবার সেটা হয়েছে। দিনকে দিন কমপিটিশন বাড়ছে। ফলে টাফ হচ্ছে ল্যান্ড পাওয়া। কোম্পানি তোমার পারফরম্যান্সে খুশি। তাই তুমি এটা দেখো। কেমন? আমি আনঅফিশিয়ালি জানালাম। দু’দিনে ইট উইল বি অফিশিয়াল। তুমি এই দু’দিনে তোমার নেক্সট ম্যান চঞ্চলকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ো।”

আইকা হাসল, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আই উইল।”

“ইউ মে টেক ইয়োর লিভ। আজ এটুকুই।”

রুপিন বাড়তি কথা খুব একটা বলেন না। আজও বললেন না। পেনটা খুলে আবার ডুবে গেলেন ফাইলে। খুব মৃদু স্বরে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল এসি-র গুঞ্জন। স্তব্ধতা।

আইকা ঘরের বাইরে এসে থমকে দাঁড়াল। আজ ওর প্রোমোশন হল। খুব ভাল খবর। কিন্তু ওর তেমন একটা ভাল লাগছে না কেন? ওর মনটা কেমন যেন সেই নেতিয়েই আছে। মনে হচ্ছে কী হবে এসব নিয়ে? কাজে ডুবে থেকে সব কিছু ভুলে যাবে ভেবেছিল, কিন্তু সেটা তো হল না। কেন হল না? কাজ কি তা হলে কিছুই ভরাট করতে পারে না?

ফ্ল্যাটের নীচে পার্কিং লটে গাড়িটা রেখে আকাশটা দেখল আইকা। সন্ধে নেমে গিয়েছে। সাড়ে ছ’টা বাজে। বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে আজ। যা ট্র্যাফিক! শহরটা আস্তে-আস্তে মজে যাওয়া, শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো হয়ে যাচ্ছে। সব কিছু কেমন যেন থেমে আছে। সঙ্গে কেমন একটা বিজবিজে গরম পড়তে শুরু করেছে! শীতের শেষের এই সময়টা কেমন যেন শুকনো লাগে। আইকার ঠোঁটটা টানছে বেশ।

তবে ভরসা একটাই যে, নোঈকে দেখতে লোকজন এই সবে এসেছে। পুটুমাসি ফোন করেছিল আসার পথে।

গাড়িটার পেছনের সিট থেকে খাবারের বড় প্লাস্টিকগুলো নামিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল আইকা। তারপর রিমোট টিপে লক করে দিল গাড়ি।

“দিদি।”

আইকা ঘুরে দেখল, সুশান্ত। ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার। আইকা তাকাল।

“দিদি, একটু দরকার ছিল।”

“কী?”

“শ’তিনেক টাকা লাগবে। মানে, মেয়েটাকে একটু ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব।”

“কী হয়েছে?” আইকা উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল।

সুশান্ত ছেলেটা এই ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার। গ্যারেজ-স্পেসের পাশের একটা ঘরে থাকে। সঙ্গে ওর বউ আর বাচ্চা মেয়েও থাকে। মেয়েটা সত্যি খুব ছোট। বছরদেড়েক বয়স। ফরসা। গোলগাল। একমাথা কোঁকড়া চুল। আইকাকে খুব চেনে। দেখলেই হাত বাড়ায়। আইকার কী যে ভাল লাগে! মেয়েটাকে ‘মাগো’ নামে ডাকে আইকা। ছুটির দিনে বেশির ভাগ সময় নিজের কাছেই রাখে মাগোকে।

“জ্বর হয়েছে দিদি।”

“সে কী?” আইকা চোয়াল শক্ত করল, “তুই এখন বলছিস? কখন হয়েছে এটা?”

“বিকেলে দিদি,” সুশান্ত ঢোঁক গিলল।

“আর এখন বলছিস? মাকে বলিসনি কেন? আমায় ফোন করিসনি কেন? তোকে জুতোপেটা করতে হয় জানোয়ার!” আইকা চিৎকার করল। তারপর নিজেই দ্রুত হেঁটে গেল ওর ঘরের দিকে।

দরজাটা আলতো করে টানা ছিল। আইকা ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। মাগো শুয়ে রয়েছে বিছানায়। চোখ বন্ধ। চড়াই পাখির ডানা ঝাপটানো শব্দের মতো আলতো শ্বাস পড়ছে।

“মাগো!” হাতের প্যাকেট বিছানায় রেখে আইকা ঝুঁকে পড়ল।

মাগো ঘুমের মধ্যে চোখ খুলল আলতো। হাসল কি? তারপর নরম পালকের মতো হাতটা তুলে আইকার গালে রাখল।

আইকার জল এসে গেল চোখে। আচমকা, কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই জল এসে গেল। গলার কাছটা কেমন যেন দলা পাকিয়ে উঠল। ভীষণ টনসিলের ব্যথা গলা থেকে বুকের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ল।

মাগো চোখ বন্ধ করে ফেলল আবার। আইকা সামলাল নিজেকে। কোন বন্ধন এটা? ওর কে হয় এই একরত্তি মেয়ে? কেন এমন বুকের ভেতর গোটা সমুদ্র নড়ে ওঠে এমন আলতো হাতের ছোঁয়ায়? নিভৃতে বসে আসলে কে ছোঁয় আইকাকে?

আইকা ব্যাগটা খুলে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে তাকাল সুশান্তর দিকে। তারপর চাপা গলায় বলল, “যা এখুনি। আর ফিরে এসে জানাবি আমায় কী হল।”

লিফ্‌টে উঠে চোখ বন্ধ করল আইকা। গালটা এখনও শিরশির করছে! মাগোর হাতের ছোঁয়া লেগে রয়েছে। পালকের মতো হালকা, ঠান্ডা একটা স্পর্শ! গলার কাছটা ব্যথা করছে আইকার। কষ্ট হচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে আর কতদিন এই পিঁপড়ের মতো জীবন? আর কতদিন এভাবে এক গর্ত থেকে আর-এক গর্তে দৌড়ে বেড়াবে ও? কোথায় এর শেষ! প্রতিটা দিনের শেষে কি ওর জন্য কোনওদিন এমন স্পর্শ অপেক্ষা করবে না!

শুভর মুখটা মনে পড়ল ওর। আর সঙ্গে সঙ্গে ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। শুভকে কি ও সত্যি কোনওদিন ভালবেসেছিল?

ছ’তলার করিডরে বেরিয়ে নিজেকে ঠিক করল আইকা। পুটুমাসি আর ওদের ফ্ল্যাট দুটো পাশাপাশি। কিন্তু আইকা জানে মা পুটুমাসিদের ফ্ল্যাটেই আছে।

পুটুমাসিদের ফ্ল্যাটের দরজাটা বেশ সুন্দর। কাঠের ওপর কাস্ট আয়রনের ছোট ছোট মূর্তি বসানো। দরজার ওপরে একটা ছোট্ট উইন্ড-চাইম ঝুলছে। পুটুমাসির ফেং-শুইয়ে খুব ভরসা। আসলে রাঙামেসোর ওপরে ছাড়া পুটুমাসির সব কিছুতেই ভরসা। জ্যোতিষ থেকে শুরু করে ঝাড়ফুঁক— শুনলেই হল, পুটুমাসি ছুটবে! মাকেও ট্যাঁকে করে নিয়ে যায়। রাগ হয় আইকার। মাকে বারণ করে, কিন্তু মা শোনে না। বলে, “পুটু জোর করে, কী করব!” কিন্তু আসল ব্যাপারটা অন্য বলে মনে হয়। আইকার মনে হয়, মা নিজেও ক্রমে-ক্রমে এসবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। শুধু ওর ভয়ে কিছু বলে না।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চুলটা ঠিক করে নিল আইকা। ঘরে বাইরের লোকজন রয়েছে। অফিস থেকে তো বিধ্বস্ত হয়ে ফিরেছে! তাও হাত দিয়ে যেটুকু সামাল দেওয়া যায় আর কী।

ডোরবেলটা বাজিয়ে একটু সরে দাঁড়াল আইকা। হাতের প্যাকেটে খাবার আছে। এগুলোকে সাজিয়ে দেওয়াটা ওকেই মনে হয় করতে হবে। এত খাবারের কী দরকার, আইকা বোঝে না! পুটুমাসি এত বাড়াবাড়ি করে না!

সকালে শুনেছিল পুটুমাসি মাকে বলছে, “এমন পাত্র হাতছাড়া করলে হবে না বুঝলি। যেভাবেই হোক একে জামাই করতে হবে! মেয়েসন্তান। কখন যে কী হয়!”

কথাটার মধ্যে এমন একটা দৈন্য ছিল যে, আইকার কেমন যেন গা ঘিনঘিন করছিল! নোঈ খুব ভাল মেয়ে। লেখাপড়াতেও খুব ভাল। এম কম করেছে। চাকরি করছে একটা ফার্মে। ঠিক সময়ে নিজে যখন বুঝবে পছন্দ করে বিয়ে করবে। কিন্তু এই যে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া! এই যে মেয়ে বলে, তার শরীরে আর মনে একটা রেগুলেটর বসিয়ে দেওয়া, এটা ভাবলেই মাথায় আগুন জ্বলে আইকার! বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে আর ওকে তো কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি! আর সেটা হয়েছে ওরা দু’জন মেয়ে বলেই।

দিনকে দিন পুটুমাসি কেমন যেন হয়ে উঠছে। এত ডেসপারেশন কীসের? বিয়ে করে কী মোক্ষ লাভ হবে? আর ‘মেয়েসন্তান! কখন কী হয়!’ এসবের মানে কী? যত্তসব রিগ্রেসিভ ধারণা!

আইকার মনে হচ্ছিল, একবার গিয়ে চেপে ধরে পুটুমাসিকে। কিন্তু শেষে মত বদলেছে। মা বলে, “পুটু ওরকম। পাগলি। ছোট থেকেই পাগলি। ওর কথা ধরবি না! ওর মনটা খুব ভাল!”

মনটা খুব ভাল হওয়া যেমন জরুরি, তেমন কথাবার্তাগুলো ঠিক হওয়াও জরুরি। আমাদের দেশে, ‘ওর মন ভাল’ এই দোহাই দিয়ে অনেক লোকের খারাপ ব্যবহারকে পাশ নম্বর দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা আছে!

মা এসে দরজাটা খুলে দিল। আইকা ঘরে ঢুকে একটু দাঁড়াল। মা আইকার হাত থেকে খাবারের প্যাকেটগুলো নিয়ে বলল, “তুই আজকে না এলেও পারতিস!”

আইকার ভুরু কুঁচকে গেল। মা এমনভাবেই কথা বলে রেগে গেলে।

মা বলল, “যা গিয়ে বোস ওখানে। তিনজন এসেছে। পাত্র আর সঙ্গে দু’জন। ওখানে রাঙাদা আছে। পুটুও আছে। তবে নোঈ এখনও ওদের সামনে যায়নি! তুই গিয়ে বোস। কেমন ছেলে ভগবান জানে! তিন বামুনে কখনও মেয়ে দেখতে আসে!”

আইকা ভাবল একবার বাথরুমে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নেবে। কিন্তু তারপরেই মত বদলাল। কী হবে? ওর তো বিয়ে নয়!

ও জুতোটা খুলে বসার ঘরের দিকে এগোল।

ঘর থেকে পুটুমাসির গলা পাওয়া যাচ্ছে! ও দেখল সোফায় বসে রয়েছে তিনজন। দু’জনকে পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে আর একজনের মাথার পেছনটা দেখা যাচ্ছে।

আইকা গিয়ে দাঁড়াল ঘরের মধ্যে। পুটুমাসি কিছু বলছিল। কিন্তু এবার থমকাল। তাকাল ওর দিকে। সেই সঙ্গে বাকিরাও তাকাল। আইকা দেখল ওর দিকে পেছন করে বসে ছিল যে-মানুষটি, সেও মাথা ঘোরাল!

আর সঙ্গে-সঙ্গে দূরে, বহুদূরে কোথায় যেন একটা বরফের পাহাড় ভেঙে পড়ল। আর তার শব্দে শরীরের ভেতরটা নড়ে উঠল আইকার!

ও দেখল মাথা ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে উনিশ বছর আগে ফেলে আসা একটা সময়! অতীতে ফেলে আসা এক জীবাশ্ম! ওর মনে হল, ওই বিকেলেই ওর কথা মনে হয়েছিল না!

.

০৪. নিশান

“তোমার মনখারাপের মধ্যে আমার জন্ম। তোমার শব্দের মধ্যে আমার মাতৃভাষা। তোমার বুকের নীচে বয়ে চলা জলধারা থেকে জল পান করে আমার মৃতপ্রায় সব হরিণেরা। তুমি ছিলে তাই আমিও আজ দাঁড়িয়ে রয়েছি এই বকুলবীথিতে। তুমি শ্বাস নাও তাই গাছ হাওয়া পায়। মেঘ বয়ে যায় নদী থেকে আকাশের দিকে। তুমি স্নেহের দৃষ্টিতে তাকাও তাই গাছেরা ফুল ফোটায়। মৌমাছি জমিয়ে তোলে বিন্দু বিন্দু মধু। তুমি চোখ মেলে আকাশ দেখো, তাই গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষায় পৌঁছতে পারে প্রকৃতি। তুমি গান গাও তাই পাখি ডাকে, মাঝি নৌকো বায়, শিশুরা মায়ের স্তন্য খুঁজে নেয় আলগোছে। তুমি হাসো, তাই হারানো বন্ধু ফিরে পায় মানুষ। পাথর হয়ে যাওয়া বুক ফাটিয়ে আলোর দিকে হাত বাড়ায় ফুলগাছ। নতুন ভাতের গন্ধে দৃষ্টি ফিরে পায় অন্ধ ভিক্ষুক। তুমি ছিলে তাই সুর পাঠালেন ঈশ্বর। তুমি ছিলে তাই স্তব গেঁথে রাখলেন বৈদিক ঋষি। তুমি ছিলে তাই অন্ধকার আকাশ ভেঙে প্রতিদিন তোমায় দেখবে বলে উঠে আসেন অর্কদেব। আজ তোমার মনখারাপের মধ্যে আমার জন্ম। আজ তোমার আনন্দের মধ্যে আমার জীবন্ত হয়ে ওঠা।”

ঘরটা ছোট। আবছায়া। একটুকরো জানলা দিয়ে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়ছে অর্ধেক মুখে। গালের ওপর পড়ে রয়েছে দু’-চারটে অন্যমনস্ক চুলের রেশম। নরম আলোয় দেখা যাচ্ছে চোখ দুটো। বাইরের দিকে, আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা পাথর রঙের চোখ দুটো।

মেঘলা প্রায়ই বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে এভাবে। গঙ্গার পাশেই ওদের এই ছোট বাড়ি। ইটের দেওয়াল। মাথার ওপর টালি দেওয়া। মেঘলার বাবা মানিক ভটচাজ পুজোআচ্চা করতেন। এখন আর নেই। মারা গিয়েছেন। মেঘলার এক বড় দাদা রয়েছে। নাম বাদল। কিন্তু বর্তমানে ও জেলে। ওয়াগন ভাঙতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। দু’বছরের জেল হয়েছে ওর। সারা দিন বাড়িতে মা আর মেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে নিশান যায় ওদের বাড়িতে। এমনিই যায়। কারণ নেই।

ওদের ঘরে গিয়ে চৌকিতে একটু বসে। তেল-মুড়ি মাখা খায়। দু’-চারটে কথা বলে। তারপর উঠে আসে।

বাদল আর নিশান একসঙ্গে পড়ত। কিন্তু হায়ার সেকেন্ডারির পরে বাদল আর পড়েনি। নিশান যখন কলেজে ভরতি হয়েছিল, তখন বাদল বালুরঘাটে তেলের ডিপোয় কাজ নিয়ে ঢুকে পড়ে!

মেঘলাকে ছোট থেকে চেনে নিশান। মেয়েটা চোখে দেখতে পায় না। মাথাটাও মাঝে মাঝে ভারসাম্য হারায়। তখন মেঘলা খুব চিৎকার করে। হাত-পা ছোড়ে। আঁচড়ে-কামড়ে দেয়। কিন্তু তারপর আবার যখন সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন দেখলে বোঝাই যায় না মেঘলার কোনওদিন কোনও অসুখ ছিল।

নিশান আজ দুটো নারকেল নিয়ে এসেছে। ওদের বাড়িতে চারটে নারকেল গাছ এখনও অবশিষ্ট আছে। বাবা সেখান থেকে নারকেল পাড়িয়েছে আজ দুপুরবেলা। তখনই মা বলেছিল মেঘলাদের বাড়িতে যেন দুটো নারকেল নিয়ে যায়!

সাইকেলের ক্যারিয়ারে দড়ি দিয়ে বেঁধে এনেছে নিশান। কাকিমা অর্থাৎ মেঘলার মা খুশি হয়েছে খুব। বলেছে, নারকেলের যা দাম, কিনে খাওয়ার কথা আর ভাবে না।

সোনাঝুরির একপাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে গঙ্গা। মোহনার কাছাকাছি বলে নদী এখানে বেশ চওড়া, কিন্তু তার গতি বেশ মন্থর।

মেঘলাদের বাড়িটা নদীর একদম পাড়েই। খুব বৃষ্টি হলে, নদীর জল এসে ওদের উঠোন ডুবিয়ে দেয়।

এখানে আসতে খুব ভাল লাগে নিশানের। সবসময় সুন্দর একটা হাওয়া দেয়। ঘর থেকে বসে জাহাজ দেখা যায়। তার সঙ্গে চারপাশ কী নির্জন। কানে বাতাসের শব্দ এসে লাগে।

মেঘলা সারাদিন বাড়িতে বসে থাকে। নিশানের এনে দেওয়া ব্রেইলের কিছু বই পড়ে। নিশান চেষ্টা করছে ওকে কিছু একটা কাজ জোগাড় করে দিতে। মাঝেরহাটের কাছে একটা দৃষ্টিহীন বাচ্চাদের স্কুল আছে। সেখানে মেঘলার একটা চাকরি করে দেওয়ার চেষ্টা করছে নিশান। জানে না পারবে কি না!

আসলে নিশান সকলের জন্য চেষ্টা করে। বাবা বলে, “শুধু নিজের জন্য কিছু করলি না। অপোগণ্ড একটা!”

নিশান হাসে মনে মনে। নিজের জন্য বলতে কী বোঝায়? টাকা রোজগার? তা টাকা ওদের কম কিছু নেই। সোনাঝুরিতে ওদের বড় তেলকল আছে। জমি আছে। দশ ঘর ভাড়াটে আছে। টাকার অভাব তো হওয়ার নয়। তা হলে কেন বলে বাবা? তেলকলে বসে না বলে? মাস গেলে ঘুরে-ঘুরে ভাড়া তোলে না বলে? হবে হয়তো। এই পৃথিবীতে কেউ টাকা রোজগার না করতে পারলে তাকে সকলে অপোগণ্ড বলে দাগিয়ে দেয়!

নিশান ভাবে এমন অপোগণ্ডই ভাল। কবিতা লেখা, কবিতা-পত্রিকা করা, রাজনীতি করা আর দায়ে-দরকারে মানুষের পাশে দাঁড়ানো নিয়ে ও খারাপ তো নেই।

দরজায় শব্দ হল এবার। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল নিশান। মেঘলা জানলা থেকে মুখ না সরিয়ে বলল, “মা, এসেছে।”

নিশান হাসল নিজের মনে। মেঘলা এমন হঠাৎ হঠাৎ কিছু না দেখেও সঠিক বলে দিতে পারে!

কাকিমা ঘরে ঢুকে ব্যস্ত হয়ে বলল, “তোকে বাবু একটু মুড়ি মেখে দিই? টকঝাল চানাচুর আছে আজ। দেব?”

নিশান বলল, “না কাকিমা, আজ খাব না। দেরি করে খেয়েছি দুপুরে। তারপর কেমন যেন অম্বল হয়ে গিয়েছে।”

“জোয়ান দেব একটু?” কাকিমা উদ্বিগ্ন হল।

নিশান জানে এই উদ্বেগটা লোক দেখানো নয়। কাকিমা সকলের জন্য ভাবে। করেও। পাড়ায় যার যা দরকার তাতেই ছুটে যায়। সাধারণত কোনও বাড়ির ছেলে জেলে গেলে তাদের একঘরে করে রাখা হয় এলাকায়। কিন্তু কাকিমার এই পরোপকার করার স্বভাবের জন্য কেউ ওদের খারাপ চোখে দেখে না। বরং প্রতিবেশীরাও নানাভাবে কাকিমাদের পাশে দাঁড়ায়।

মেঘলা যখন মাঝে মাঝে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে, পাড়ার লোকজনই তো আসে সামলাতে। না হলে কাকিমার একার সাধ্য কী মেঘলাকে সামলায়!

“কী রে বাবু, দেব একটু জোয়ান?”

নিশান বলল, “দাও। আর-একটা কথা, তুমি কি গিয়েছিলে বাদলের কাছে?”

কাকিমা সামনের একটা ছোট্ট তাক থেকে জোয়ানের শিশিটা পাড়ল। তারপর সেটা এনে এগিয়ে দিল নিশানের দিকে। বলল, “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম গতকাল।”

নিশান শিশির মুখটা খুলে অল্প একটু জোয়ান ঢেলে নিল হাতে।

“দাও,” নিশান দেখল, বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকেই ওর দিকে বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে মেঘলা।

“আবার বাঁ হাত?” কাকিমা সামান্য বকুনি দেওয়ার গলায় বলল, “কতবার বলেছি এমন করে বাঁ হাত বাড়িয়ে দিবি না! বাঁ হাতে কেউ কিছু নেয়! ডান হাতে নিবি।”

মেঘলা শুনল না। বরং বাঁ হাতটা অধৈর্যের সঙ্গে নাড়িয়ে বলল, “দাও, দাও, দাও।”

নিশান আলতো করে হাত ধরল মেঘলার। তারপর জোয়ান ঢেলে দিল হাতের পাতায়।

মেঘলা হাতটা টেনে নিল এবার। তারপর বলল, “খাবারের নাম জোয়ান! আচ্ছা বৃদ্ধ বলেও কি কোনও খাবার হয়?”

কাকিমা এর উত্তর দিল না। বরং আগের কথার খেই ধরে বলল, “আর বলিস না বাবু, ছেলেটা রোগা হয়ে গিয়েছে!”

নিশান কী আর বলবে! ও চুপ করেই থাকল। ও নিজেও কয়েকবার গিয়েছে বাদলকে দেখতে। আলিপুর জেলে আছে। খুবই খারাপ অবস্থা! প্রথমত, দেখা করাটাই ঝক্কির। তারপর ভেতরে ঢুকলেও হাজারটা ঝামেলা। ছোট জালের ওপার থেকে সকলের মধ্যে দাঁড়িয়ে কথা বলাও দুষ্কর।

কাকিমা বলল, “জানিসই তো টাকাপয়সা দিতে হয়। আমাদের তো এই অবস্থা! কোথা থেকে মাসে মাসে ওকে এত টাকা দিই বল তো!”

নিশান দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মাথা নামাল। ও নিজে যে ক’বার গিয়েছে বাদলের সঙ্গে দেখা করতে, বেরিয়ে আসার পর ওর নিজেরই কেমন যেন অসুস্থ লেগেছে। আর ভেবেছে ওসব জায়গায় মানুষ থাকে কী করে! আমাদের দেশের এই জেলগুলোকে সংশোধনাগার বলা হয়। কিন্তু সত্যি বলতে কী, মানুষের কতটা সংশোধন হয় এখানে কে জানে।

কাকিমা এবার এসে বসল ওর পাশে, “বাবু, তুই বলেছিলি না, কিছু সেলাইয়ের কাজ জোগাড় করে দিবি? মনে আছে তোর?”

নিশানের মনে পড়ল। সত্যি কয়েকমাস আগে কাকিমাকে এটা বলেছিল বটে। বলেছিল, কাকিমাকে কিছু সেলাইয়ের কাজ জোগাড় করে দেবে।

সোনাঝুরির কাছেই হাকিমপাড়া। বহু পুরনো অঞ্চল ওই হাকিমপাড়া। ওস্তাগরদের পাড়া ওটা। সেখান থেকে সেলাইয়ের কাজ পাওয়া যায়।

নিশানের বন্ধু রহিমদের নিজেদেরই বড় দরজির ব্যাবসা আছে। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় জামাকাপড় সাপ্লাই করে ওরা। কাপড় আর ডিজ়াইন পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওদের। রহিমরা সেলাই করে ফিনিশড গুডস পাঠিয়ে দেয়।

তাতে বাচ্চাদের জামা থেকে শুরু করে জিন্‌সের প্যান্ট সব থাকে।

রহিমরা নিজেরা জামাকাপড় সেলাই করলেও জামাকাপড়ের লেবেলগুলো আশপাশ থেকে পার পিস হিসেবে সেলাই করিয়ে নেয়।

ঠিকমতো করতে পারলে মাসে হাজারদুয়েক টাকা রোজগার করাই যায়। নিশান জানে কাকিমাদের কাছে সেটাই বড় ব্যাপার।

কাকিমা বলল, “বুঝিসই তো দিনকাল। তোর কাকুর আর ক’টা টাকা জমানো আছে বল! যদি পাওয়া যেত!”

নিশান হাসল সামান্য। জোয়ানটা চিবিয়ে সামান্য রস গিলে নিয়ে বলল, “তুমি মনে করিয়ে দেবে তো! রহিমকে বললেই হবে। আমি ঠিক ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু চোখের খুব স্ট্রেন হয়। ওটা দেখো। বুঝেশুনে কাজে নেমো!”

কাকিমা হাসল, “আর ওসব ভাবার সময় নেই বাবু। টাকার দরকার রে। বাদলটা যে কী করল! জানি না কী হবে! তুই একটু দেখিস।”

“কী দেখবে?” আচমকা জানলার দিক থেকে মুখ ঘোরাল মেঘলা, “খুব মাগুনে বুড়ি হয়েছ তো! অতই যদি তোমার টানাটানি থাকে রোজ মাছ করো কেন? কেন গন্ধসাবান কেনো? কেন পোস্ত খাও? আর নিজের অপদার্থ ভাইদের হাতে টাকা গোঁজো কেন তুমি? তারা তো সব জুটমিলে কাজ করে। তাও তোমার কাছে এসে নাকে কাঁদে কেন? আর তুমিই-বা তাদের হাতে টাকা দাও কেন? জানো না, তোমার দুই ভাই-ই লম্পট! মাতাল! যার নিজের পায়ের তলায় মাটি নেই, সে কী করে অন্যকে টেনে শক্ত মাটিতে দাঁড় করাতে চায়! নিশানদা এলেই তুমি বারবার বলো এটা চাই, ওটা চাই। আর নাকে কাঁদো। এসব অসহ্য লাগে আমার। বিরক্তিকর লাগে। একদম এসব করবে না।”

কাকিমা চুপ করে গেল আচমকা। নিশানও থমকে গেল। এই মেঘলার বিপদ! কখন যে কী বলে বসবে! কী করবে তার ঠিক নেই। একটু আগে কী বলছিল, আর এখন কী বলছে! ওর লজ্জা লাগল খুব। কাকিমার মুখটা অপমানে কালো হয়ে গিয়েছে। নিশানের মনে হল একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এইসব অবস্থায় বসে থাকাও বিড়ম্বনার।

কাকিমা কোনওমতে বলল, “তুই চুপ করবি!”

“কেন চুপ করব?” এবার ঘুরে বসল মেঘলা, “আমায় চুপ করাতে চাও কেন সবাই মিলে? কী হবে চুপ করিয়ে? আমি চুপ করে থাকলে সত্যিটা কি মিথ্যে হয়ে যাবে? বাবাও তোমায় এই নিয়ে বলত। এগুলো শোনো না কেন? আর নিশানদা কত করবে? তোমার অপদার্থ ছেলেকে সারাজীবন লাই দিয়ে গেলে। লেখাপড়া করল না। বাবা যখন বকত, তুমি বাবার সঙ্গে ঝগড়া করতে। বাবার কাছ থেকে দাদার অন্যায়গুলো লুকিয়ে রাখতে। যখন লেখাপড়া ছেড়ে দিল, তখন কিছু বললে না। তারপর যখন চুরির টাকা এনে তোমার হাতে দিত, তখন বাবাকে বলতে বাবার মুরোদ নেই এত টাকা আনার। আর এখন এসব নাকে কাঁদছ। বাবা মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে।”

“তুই চুপ করবি!” এবার কাকিমাও তেড়ে উঠল, “খুব চোপা হয়েছে না তোর? দিনকে দিন বাড়িতে বসে গিলে-গিলে খুব চোপা হয়েছে? একপয়সা রোজগারের মুরোদ নেই আবার কথা!”

মেঘলা হাসল সামান্য। তারপর বলল, “সেই তো, অন্ধ মেয়ের রোজগারের দিকে তাকিয়ে আছ এখন! কিন্তু কী করব বলো তো? আমায় তো এভাবেই পয়দা করেছ।”

কাকিমা এবার চাপা গলায় চিৎকার করল, “চুপ করবি তুই! এসব কী বলছিস? জানোয়ার হয়ে গিয়েছিস পুরো! তুই চাস আমি মরে যাই?”

মেঘলা, নদীর পাথরের মতো চোখগুলো তুলে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর বলল, “তুমি মরে গেলে তো তোমার ভাইদের অসুবিধে হবে। নিজের সোনার চুড়িও তো গতমাসে তোমার নবাবপুত্তুর ছোটভাইকে দিয়েছ। আমি জানি না? আমার চোখ নেই, কিন্তু কান তো আছে! নাকি সেটাও নেই ভাবো?”

“মুখপুড়ি, তোর এতবড় জিভ হয়েছে! আমার জিনিস যাকে খুশি দেব। তোর কী?”

“দাও, সব দিয়ে দাও! আর লোকের কাছে নাকে কাঁদো। ভিক্ষে করো। এরপর আর কাকে-কাকে বলবে আমি দেখব,” মেঘলা আচমকা গলা চড়াল এবার।

“আঃ, মেঘলা!” নিশান আর পারল না। চিৎকার করে উঠল, “চুপ করবি তুই? এসব বলছিস কেন? কাকিমা আমায় আগেই বলেছিলেন তো! আর আমাকেই তো বলছেন! তুই এমন করে অসভ্যতা করছিস কেন রে?”

মেঘলা আবার জানলার দিকে মুখ ফেরাল। নিশান জানে জানলার বাইরে শুধু অন্ধকার এখন। সন্ধে হয়ে গিয়েছে। গঙ্গায় শুধু দু’-চারটে নৌকো ভাসছে। আর আলো বলতে তাদের গলুইয়ের নীচে জ্বলা আগুন। মাঝিরা রান্না করছে। বাকিটা অন্ধকার। তবু ওই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কী দেখতে চায় একটা মেয়ে? কাকে দেখতে চায় নিজের অমন দৃষ্টি দিয়ে?

নিশানের বকুনি খেয়ে মেঘলা চুপ হয়ে যাওয়ায় ঘরের ভেতরটা আচমকা নিঝুম হয়ে গিয়েছে। নদী থেকে হাওয়ার শব্দ ভেসে আসছে শুধু। মাথার ওপর পুরনো দিনের ডিসি পাখা শব্দ করে ঘুরে চলেছে। দাঁত-নখ বের করা স্বরযুদ্ধের পরের নিস্তব্ধতা তুচ্ছ শব্দদেরও প্রকট করে দিচ্ছে এখন।

নিশানের খুব অস্বস্তি হল। মনে হল উঠে চলে যায়। মেঘলাটা কীসব বলে না মাঝে মাঝে! হ্যাঁ, সবাই জানে যে, ওর মানসিক অবস্থা আর-পাঁচজনের মতো নয়। কিন্তু সারাক্ষণ তো আর সেসব মনে রাখা যায় না। অভাবের সংসার শুধু তো ভাতের হাঁড়িতে টান দেয় না, মনের ভেতরেও একটা ক্লান্তি আর অসহিষ্ণুতা তৈরি করে! কাকিমার রেগে যাওয়াটা তাই বুঝতে পারে নিশান।

কাকিমার বাপের বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। জলাফটক এই সোনাঝুরি থেকে সাইকেলে মিনিট চল্লিশেক দূরে। কাকিমার ভাইরা সেখানেই থাকে। বাদলের সঙ্গে ওই বাড়িতে কয়েকবার গিয়েওছে নিশান। মাটির বাড়ি। তাও ভাঙাচোরা। কাকিমার দুই ভাই জুটমিলে কাজ করলেও তিন-চারটে করে ছেলেপুলে দু’জনের। তাই ওদের সংসার সারাক্ষণ ঘাটতিতে চলে। ফলে দায়ে-দফায় দিদির কাছে এসে হাত পাতে দু’জনে। কাকিমার মনটা নরম। ফেরাতে পারে না কাউকে।

নিশান বোঝে সমস্যাটা। কিন্তু এটাও ভাবে যে, সারা জীবন যদি কেউ সেভাবে পরিশ্রম না করে কেবল নাকে কেঁদে কিছু পেয়ে যায়, তা হলে একটা সময় পর সেটাই তার অভ্যেসে পরিণত হয়ে যায়।

নিশান ঘড়ি দেখল। সন্ধে হয়ে গিয়েছে। এবার উঠতে হবে। পার্টি-অফিসে একবার যেতে বলেছে বিজনদা। কীসব দরকার আছে! বিজনদার কথা খুব মানে নিশান।

বিজন সরখেল অকৃতদার মানুষ। ভাঙা রেললাইনের পাশে একাই থাকেই পার্টি-অফিসের পাশের একটা ছোট বাড়িতে। ইট বের করা, মাথার ওপর টালি দেওয়া বাড়িটায় গিয়েছে নিশান। বড় রাস্তা থেকে ভাঙা রেললাইন ধরে হেঁটে যেতে হয় কিছুটা!

চ্যাটার্জিপাড়ায় বিজনদাদের বড় বাড়ি থাকলেও লোকটা কেমন একা সন্ন্যাসীর জীবন কাটায়! খুব অবাক লাগে নিশানের! এমনও কেউ পারে! এই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন কেউ আছে, যার কিছু দরকার নেই! বিজনদা নিজেই রান্না করে। সাতষট্টি বছর বয়সেও লোকটা এখনও মজবুত খুব। চোদ্দো বছর বয়স থেকে পার্টির হয়ে কাজ করছে এই অঞ্চলে। সকলে এক ডাকে বিজনদাকে চেনে।

নিশান জানে ওকে নিজের সন্তানের মতোই ভালবাসে বিজনদা। জুটমিলটায় প্রায়ই নানা ঝামেলা লেগে থাকে। এখনও চলছে। ইউনিয়নটা নিশানদের পার্টির দখলে। তাই দায়িত্ব ওদের বেশি। বিরোধীরা তো একটা করে নতুন ইসু তৈরি করতেই থাকে। নিশানদের নেতা তারক চক্রবর্তী। বাবার পরিচিত এই লোকটা। তবে সুবিধের লোক নয়। বিজনদার চেয়ে জুনিয়র হয়েও পার্টিকে ধরে এখানে মগডালে উঠেছে! তবে ও দেখেছে, এই নিয়ে বিজনদার কোনও ক্ষোভ নেই! আর এ-ও দেখেছে, তারকদাও বিজনদার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাতে যায় না!

“কাকিমা, আমি হাকিমপাড়ার ওদের সঙ্গে কথা বলব। তুমি ভেবো না,” নিশান উঠে দাঁড়াল।

কাকিমা মুখ তুলে তাকাল নিশানের দিকে। চোখে জল টলটল করছে। খারাপ লাগল নিশানের। মেঘলা কী যে করে না!

কাকিমা বলল, “আমি আর কী বলি তোকে? দেখলি তো সব! শুনলি তো! নিজের মেয়ের কাছ থেকে এসব শুনতে হয়। মায়ের পেটের ভাই আমার। এসে এমন করে কথা বলে! ওদের বাচ্চাগুলো খেতে পায় না। সব শুনে কী করে চুপ করে থাকি বল?”

নিশান জোর করে হাসার চেষ্টা করল। পরিস্থিতিটা দমচাপা হয়ে আছে। ও বলল, “আরে, ছাড়ো না। আমি জানি তো। প্লাস মেঘলাকেও তো চিনি। তুমি এসব ভেবো না।”

নিশান এবার মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই, আমি আসি। মাথা ঠান্ডা রাখ। বুঝলি?”

মেঘলা ওর দিকে তাকাল না। কিন্তু তাও ওকেই জিজ্ঞেস করল, “‘তোমার মনখারাপের মধ্যে আমার জন্ম’— এমন লেখা আর লেখো না কেন নিশানদা? কবে পড়ে শুনিয়েছিলে, আমার আজও মনে আছে। তেমন কিছু লেখো না কেন?”

নিশান থমকে গেল। সেই তেইশ-চবিবশ বছর বয়সের লেখা। তখন এসে মাঝে মাঝে মেঘলাকে পড়ে শোনাত ও। এই অংশটা বারবার শুনতে চাইত মেয়েটা। সেটা এখনও মনে আছে দেখে আজ অবাকই হয়েছিল ও।

নিশান হাসল। বলল, “বয়সের সঙ্গে তো চিন্তাও পালটায়, তাই না?”

মেঘলা বলল, “তাও ওরকম লিখো আবার। ওরকমটাই শুনতে ভাল লাগে।”

নিশান “আসি,” বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

জীবনে অনেক কিছু সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে কী করে যেন আবছা হয়ে মিলিয়ে যায়। হারিয়ে যায় অজানা বাঁকে। আজকাল নিশানের যেন মনেও পড়ে না ও এমন লিখত। সেই নিশানটা যেন এই নিশান নয়!

সাইকেলটা রাখা ছিল উঠোনের পাশে। অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। তবে রাস্তায় আলো আছে। তার সামান্য ভাঙাচোরা টুকরো এসে পড়েছে এই জায়গাটায়।

সোনাঝুরির মূল টাউনশিপটায় এখন আলোর বন্যা। কিন্তু এমন গলিঘুঁজি বা ব্যাক পকেটের মতো জায়গাগুলোয় এখনও চল্লিশ পাওয়ারের স্ট্রিট বাল্‌ব ঠিলঠিল করে জ্বলছে!

গেট পেরিয়ে সাইকেলে উঠল নিশান। রাস্তাটা কংক্রিট করা। কিন্তু জায়গায় জায়গায় ভেঙে গিয়েছে। আবছা আলোয় সবটা স্পষ্ট নয়। রাস্তার দু’পাশে ঝোপ। ঝিঁঝি ডেকে চলেছে টানা। মাঝে মাঝে দু’-একটা ছোট বাড়ি আর তার জানলা দিয়ে ঠিকরে আসা আলোয় পুরো জায়গাটাকেই ভুতুড়ে লাগছে নিশানের। ও সাবধানে প্যাডেল করতে লাগল।

রাস্তাটা সোজা গিয়ে বাঁধের ওপর উঠেছে। তারপর বাঁধটা টপকে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে মূল শহরের ভেতর।

বাঁধ টপকালেই ঘন জনবসতি। বহুব্রীহি ক্লাব। পুরনো গলি। মরচে পড়া বাড়িঘর। আধা ঝিম-ধরা দোকানপাট। আর তারপরেই সোনাঝুরির বড় রাস্তা। ওদের পার্টি অফিস ওই রাস্তা দিয়ে সোজা অনেকটা গিয়ে ভাঙা রেললাইনের পাশে।

বাঁধের ওপর সাইকেল নিয়ে উঠে একটু থমকাল নিশান। আরে, মণীশ আসছে না!

মণীশ ছেলেটা ভাল ফুটবল খেলে। বয়স কম। আঠারো-উনিশ মতো। কলকাতার একটা সেকেন্ড ডিভিশনে খেলছে এখন। তবে নিশান নিশ্চিত, বড় ক্লাবেও ও খেলবে। ছেলেটা একটু রগচটা ধরনের আছে। কিন্তু মনটা ভাল। বিজনদা বেশ কয়েকবার নিশানকে বলেছে, মণীশকে পার্টি অফিসে নিয়ে আসতে। নতুন রক্ত না আনলে তো আর দল বাঁচবে না!

সবাইকে ডেকে-ডেকে পার্টিতে ঢোকানোয় বিশ্বাস করে না নিশান। ভাল লাগে না ওর। ইচ্ছের বিরুদ্ধে, অবলিগেশনে ফেলে কাউকে কিছু করানোর মানে হয় না। কারণ, তাতে আসল কাজটা হয় না। যেখানে মন, হৃদয় অনুপস্থিত সেখানে সবটাই ফাঁকি।

তাও বিজনদার কথা মেনে চলে বলে, মণীশকে পার্টির কথা বলে নিশান। অফিসে আসতে বলে। কিন্তু ছেলেটা কেমন যেন পাশ কাটিয়ে যায়।

হ্যাঁ, ছেলেটা মণীশই তো! এই আলোছায়ার চেককাটা দৃশ্যের মধ্যেও ছেলেটার হেঁটে আসা দেখে ঠিক চিনতে পেরেছে নিশান!

সাইকেলে বসেই মাটিতে পা দিয়ে সাইকেলটাকে দাঁড় করাল ও। মণীশ কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলতে বলতে আসছে। বাঁ হাতে ফোনটা কানের সঙ্গে চেপে ধরে মাটির দিকে চোখ রেখে হাঁটছে ছেলেটা।

“এই মণীশ!” গলা তুলে এবার ডাকল নিশান। বাঁধ থেকে নেমে যাওয়ার রাস্তাটা সামনেই। মণীশ ওই দিকে বাঁক নিয়ে নিয়েছিল প্রায়।

আচমকা ডাকে থমকে দাঁড়াল মণীশ। কান থেকে বাঁ হাতটা সামান্য সরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর আবছায়ার ভেতরে নিশানকে দেখতে পেয়ে থমকাল একটু। হাসল। ডান হাত তুলে এগিয়ে এল।

নিশানের সামনে এসে দাঁড়াল মণীশ। ফোনে বলল, “আরে, খেপ খেলবে না কেন? বলছি না একটা ম্যাচের জন্য দেড় হাজার টাকা দেবে। ধান্যকুড়িয়ায় যেতে হবে খেলতে। আমি তোমার কথা বলেছি মাহিরদা। বেকার ভয় পেয়ো না তো। পতাদা জানবে কেমন করে? আগেও দুটো চান্স ছেড়েছ। আর বলব না বলে দিচ্ছি।”

ওদিক থেকে কী উত্তর এল, বুঝতে পারল না নিশান। শুনল, মণীশ বলছে, “দূর বাবা, বলছি কালকের মধ্যে জানাতে হবে! বেকার নকশা মারাচ্ছ কেন? তবে এটাই লাস্ট চান্স। পতাদাকে অতই ভয় পেলে যাও পতাদার পা ধরে বসে থাকো। রাখছি।”

ফোনটা কেটে চার অক্ষরের একটা গালি দিয়ে নিশানের দিকে তাকাল মণীশ। বলল, “এই জন্য শালা লোকের উপকার করতে নেই! বারবার বলি খেপ খ্যালো, টাকা পাবে। টাকার দরকার, কিন্তু পেছনে যত রাজ্যের ভয়! কী না পতাদা নাকি বকবে। বেকার ভুঁড়িওয়ালা একটা পিস! এর আগেও দু’বার কথা দিয়ে আসেনি। আমার শালা ভাল লাগে না। যেচে কিছু করতে গেলে লোকে বিশাল ভাও খায়।”

নিশান হাসল। মণীশের মাথাটা গরম। মুখটাও খুব কিছু ভাল নয়। ছোট-বড় জ্ঞান নেই ওর। গালি দিতে পারলেই যেন বাঁচে। কিন্তু এই এবড়োখেবড়ো ছেলেটার ভেতরে অন্যের জন্য ভাল কিছু করার তাগিদ আছে। বিজনদার চোখ আছে। রগচটা ছেলেটার ভেতরে ভাল মানুষটাকে ঠিক চিনতে পেরেছে।

আসলে চারিদিকে তো কেবল মুখোশ পরা মানুষের ভিড় দ্যাখে নিশান। পাউডার-মাখা হাসি। টিপ-কাজল সাজানো ভালবাসা। ভুরু প্লাক করা বন্ধুত্ব। সকলেই সকলের প্রশংসা করছে। বাঁ হাতে ছোরা লুকিয়ে ডান হাতে পিঠ চাপড়াচ্ছে! কেউ আসলে আর সত্যিকারের ভালবাসছে না কাউকে। শুধু শপিং মলের মতো হাসিখুশি আর আলোময় মুখ নিয়ে একে-অপরের সামনে দাঁড়াচ্ছে। এর ভেতরে এই ধরনের মণীশরা ক্রমশ গুলিয়ে যাচ্ছে, ঢেকে যাচ্ছে।

নিশান বলল, “এত ভাবিস কেন! কে কী করল, না করল, সেই নিয়ে উত্তেজিত হোস কেন তুই?”

“হব না?” মণীশ চোখ বড় করল, “জানো, মাহিরদা আমাদের টিমে খেলে। ডিফেন্স। বিশাল চেহারা। টেকনিক ভাল নয়, কিন্তু ডিফেন্ডার তো, তাই চেহারা দিয়ে পুষিয়ে দেয়। হয় বল যায়, নয়তো ম্যান যায়। দুটো একসঙ্গে যেতে দেয় না। স্টেশন মোড়ের বেণুবীণা ক্লাব আছে না, ওরা ধান্যকুড়িয়ায় খেলতে যাবে। জিতলে এক লাখ টাকা দেবে। বড় রুপোর কাপ দেবে। আরও নানা পুরস্কার আছে। ওরা আমায় কলকাতা থেকে তিনজন এনে দিতে বলেছে। একটা ডিফেন্ডার, একটা হাফ আর একটা স্ট্রাইকার। দেড় হাজার টাকা করে দেবে ম্যাচ পিছু। তাও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে খেলতে হবে। কিন্তু শালা ঢ্যামনামো করছে!”

নিশান হাসল, “তোর কী দরকার পড়েছে? আর প্লেয়ার নেই?”

“আরে বাবা, মাহিরদার বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। একটা অসুস্থ ভাই আছে। মা আয়ার কাজ করে। মাহিরদা বেকার। বাবা তো নেই। নিজেই বলেছিল এসব। শুনলে কষ্ট লাগে না, বলো? পার ম্যাচ দেড় হাজার। যাতায়াত, থাকা-খাওয়া ফ্রি। আর ফাইনালে জিতলে বোনাস হিসেবে পাঁচ হাজার! লোকের শালা ভাল করতে নেই! এখন বলেছি, বলে পতাদা, মানে আমাদের কোচ, সে নাকি বকবে! ন্যাংটো খোকা আমার!”

“অত রাগ করতে নেই,” নিশান হাসল শব্দ করে, “সবাই একরকম হয় না। কিন্তু এভাবে একজন একজন করে আর কতজনকে হেল্‌প করবি! নিজে তো আর বাড়ি-বাড়ি এসব করতে পারবি না। মানুষের জন্য কাজ করতে হলে চাই ওয়ার্কফোর্স। চাই সংগঠন। সেটা পেলে তোর মতো ছেলেরা দেশে সোনা ফলাবে!”

মণীশ ভুরু কুঁচকে তাকাল। তারপর বলল, “বিজনবুড়ো তোমায় ছেলেধরা বানিয়েছে, না?”

নিশান হাসল, “শোন, বিজনদা তো ফুটবল-পাগল, তোর খেলা পছন্দ করে। তোকেও খুব পছন্দ করে।”

মণীশ বলল, “পছন্দ করে মানে?”

“ওঃ, তোর খেলা পছন্দ করে। তোর অরগানাইজ়িং যে ক্যাপাসিটি, সেটা পছন্দ করে। গত ডিসেম্বরে রক্তদান শিবির করলি, সরস্বতী পুজোর সময় দুঃস্থ বাচ্চাদের বইখাতা দিলি। বিজনদা সব খেয়াল করেছে।”

“মহা কেলো তো!” মণীশ বলল, “আমি একা করেছি নাকি? আমাদের ক্লাব থেকে করেছে। আমিও ছিলাম। এই মাত্র।”

“যাই হোক, বয়স্ক মানুষ এত করে বলছেন। একদিন আয় না পার্টি অফিসে। কাছেই হুলোর চপের দোকান আছে। ব্যাপক ভেজিটেবল চপ বানায়। খেয়ে যাবি,” নিশান হাসল সামান্য।

মণীশ মোবাইলটা টিপে সময় দেখল, “ওরে বাবা, লেট হয়ে গিয়েছে। সামনে ইলেভেনের পরীক্ষা। দু’-দু’বার গাড্ডা মেরেছি। এবারও যদি মারি, বাপ লাথ মেরে গঙ্গায় ফেলে দেবে। আমি চলি নিশানদা।”

“আমি তোকে ছেড়ে দেব? কেরিয়ারে উঠে বোস।”

“দূর, ওই কেরিয়ারে কে বসবে!” মণীশ বিরক্ত হল, “শোনো, এখন সকলেই বাইক চালায়। পার্টি করে কী ছিঁড়লে? দ্যাখো না, পার্টিতে ঢুকেই গলায় সোনার চেন আর বাইক নিয়ে নেয় সবাই। সে শালা টিপছাপ থেকে এম এ পাশ সবার এক কেস। বাঙালির পাছা এখন সেনসিটিভ হয়ে গিয়েছে! তোমার সাইকেলের কেরিয়ার তার ভাল লাগবে না। আমরা বাইকের নরম গদিতে বসতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। বুঝেছ?”

নিশান বলল, “তা হলে তুইও আয়। বাইক হয়ে যাবে তোরও।”

মণীশ আচমকা চোয়াল শক্ত করল। তারপর বলল, “শোনো নিশানদা, কারা তেল দেয় জানো? যাদের ট্যালেন্ট নেই। যাদের নিজেদের ওইখানে জোর নেই। আমার আছে। আমি নিজের রোজগারে বাইক কিনব। গাড়ি কিনব। অপদার্থ তেলখোর, চোর-চোট্টাগুলোকে তেল দিতে যাব না। বাই।”

নিশান জানে মণীশের কথাটা ঠিক। এই তেল দেওয়ার ব্যাপারটা এখন এমন একটা পর্যায় পৌঁছে গিয়েছে যে, ওর মনে হয় অধিকাংশ লোকের বোধহয় তেলের খনি আছে!

মণীশ যেতে গিয়েও থমকে গেল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আচ্ছা নিশানদা, জোনাক-বাড়ির কেসটা কী বলো তো!”

“জোনাক-বাড়ির আবার কী কেস?” নিশান অবাক হল।

“যা! তুমি জানো না? গতকাল বাবা জেঠুকে বলছিল। জোনাক-বাড়ি নাকি বিক্রি হয়ে যাবে! সত্যি?”

“দূর! অত পুরনো একটা ব্যারাক-বাড়ি, অত বড় জায়গা নিয়ে তৈরি! বিক্রি হয়ে যাবে বললেই হল? ওর ভেতরের বাগানে কত গাছ আছে দেখেছিস? প্লাস ওটা আমাদের সোনাঝুরির একটা আইডেন্টিটি!” নিশান পাত্তাই দিল না মণীশের কথার।

“তাই?” মণীশ কাঁধ ঝাঁকাল, “কে জানে! শুনলাম বলে বললাম। তোমরা পার্টির লোক। তোমরা তো জানবে। তবে ওই তারক চক্কোত্তি পারে না এমন কোনও কাজ নেই! পারলে গঙ্গাটাকে বিক্রি করে দেয়! শুনছি সোনাঝুরি জুট মিলটাকেও নাকি হুজ্জতি করে বন্ধ করে দিতে চাইছে। তারপর প্রোমোটারকে বিক্রি করে দেবে। সত্যি?”

চোয়াল শক্ত করল নিশান। কথাটা ও নিজেও শুনেছে। পার্টির ভেতর এটা ওদের বলা হয়েছে যে, জুট মিল তুলে সেখানে নাকি আবাসন হবে। গঙ্গার ধারে বড়-বড় ফ্ল্যাট আর বাংলো হবে। কে জানে! তবে জুট মিল তোলা অত সহজ নয়। ব্রিটিশ আমলের মিল। মালিক গ্রুপ বহু দশক ধরে চালাচ্ছে। এখনও সাড়ে ছ’হাজার শ্রমিক আছে। এ তো আর ফুটে প্লাস্টিক পেতে বসা দোকান নয় যে, হল্লাগাড়ি এসে ইচ্ছেমতো তুলে দেবে!

নিশান বলল, “ওসব কিছু নয়। বেকার কথা। হলে আমরা জানব না? জোনাক-বাড়িতে অত অত বড় বাগান। প্লাস বাড়িটার একটা হেরিটেজ ভ্যালু আছে। বিক্রি করব বললেই হল?”

মণীশ হাসল, “বাগান কই আর! এখন তো জঙ্গল! তবে বিক্রি হয়ে গেলে বেকার হবে কিন্তু। জায়গাটা সুন্দর। যাকগে, কাটি গো। পরে কথা হবে।”

নিশান বাঁধের ধার বেয়ে নামতে থাকা মণীশের উদ্দেশে সামান্য চেঁচিয়ে বলল, “অফিসে কাল-পরশু করে আসিস একবার। ভুলিস না কিন্তু।”

বড়রাস্তায় উঠে ডান দিকে বাঁক নিল নিশান। সন্ধের সময় জায়গাটা বেশ জমজমাট থাকে। দোকানপাটে ভিড় থাকে বেশ। তাই লোকজনের মধ্যে দিয়ে জোরে সাইকেল চালানো মুশকিল।

ওর সামনেই এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে হা-হা হি-হি করতে করতে হাঁটছে। নিশান বুঝল টিউশন থেকে ফিরছে সব। কিন্তু এরা এমন করে হাঁটছে যে, সাইকেল নিয়ে গলে যাওয়ার জায়গা নেই!

টিংটিং করে বেল বাজাল নিশান। কিন্তু কেউ সরার নাম করল না। বিরক্ত লাগল ওর। আচ্ছা মুশকিল! ও ভাবল একবার জায়গা পেলেই সুট করে সাইকেলটা গলিয়ে দেবে।

তার আগেই “নিশান,” বলে একটা মেয়েলি গলার ডাক শুনতে পেল ও। সাইকেলটাকে ব্রেক করে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল নিশান। কেয়াদির গলা! চোয়াল শক্ত করল ও। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়।

কেয়াদি মানে কেয়া বটব্যাল। সোনাঝুরির সবচেয়ে বড় নাচের স্কুলটা কেয়াদিই চালায়। সঙ্গে একটা প্রাইমারি স্কুলও আছে। আর এই অঞ্চল থেকে বেরোনো লিটল ম্যাগ ‘সন্দর্ভ’-ও কেয়াদিই সম্পাদনা করে।

ওই ম্যাগে প্রতি সংখ্যায় লিখতে হয় নিশানকে। তবে এখন মূলত রাজনৈতিক লেখা লেখে ও। কেয়াদি নিশানকে খুব স্নেহ করে। আর তাতেই সমস্যাটা হয়েছে। কারণ, নিশানকে দেখলেই কেয়াদির নানা কাজ করার কথা মনে পড়ে যায়।

চোয়ালটা শক্ত করে নিশান ভাবল, এখন আবার কী করে দিতে হবে ভগবান জানে!

কেয়াদি হন্তদন্ত হয়ে কাছে এল। হাঁটা দেখে হাসি পেল নিশানের। কেয়াদি কেমন একটা আলখাল্লা ধরনের জামার সঙ্গে বড় ঢোলা প্যান্ট পরে। কাঁধে সারাক্ষণ একটা রংবেরঙের ঝোলা থাকে। মাথার কাঁচা-পাকা চুলগুলো একদম কদম ফুলের মতো করে ছাঁটা। কানে ঢাউস দুল। কপালে কালো রম্বস আকৃতির টিপ! ওদের মফস্‌সলে কেয়াদিকে কেমন মঙ্গল গ্রহ থেকে আসা প্রাণীর মতো লাগে নিশানের।

কেয়াদির বিয়ে হয়েছিল দু’বার। কিন্তু দু’বারই বিয়ে ভেঙে গিয়েছে। এক মেয়ে আছে। ফলসা। সে বেঙ্গালুরুতে চাকরি করে।

কেয়াদি বলে, “আমার বাষট্টি বছর বয়স হতে পারে, কিন্তু মনটা এখনও কুড়ি, বুঝলি?”

নিশানের হাসি পায়। মানুষের তো বয়স হবেই! সমস্ত পৃথিবীতে সব মানুষের বয়স বাড়েই। কিন্তু দেখেছে সেটা নিয়ে কত মানুষের মনে কতরকমের জটিলতা। বয়স নিয়ে কিছু মানুষ অযথা ডিফেনসিভ হয়ে পড়ে!

কেয়াদি যখন কথায়-কথায় কুড়ি বছর বয়সের কথা বলে, নিশানের মনে হয়, ও এমন কিছু কুড়ি বছরের ছেলেপুলেকে চেনে, যারা গাম্ভীর্যে দুশো কুড়ি বছর ছুঁয়ে ফেলেছে! বয়স দিয়ে কে কতটা মানসিকভাবে নবীন আর তাজা, সেটা বোঝানোর খুব কিছু দরকার আছে বলে মনে হয় না নিশানের।

কেয়াদি একটু নাচতে-নাচতে হাঁটে। এখনও একরাস্তা লোকের মধ্যে দিয়ে প্রায় নাচের ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বলল, “কী রে, তুই কোথায় যাচ্ছিস? ওই বুড়োটার কাছে?”

নিশান হাসি চাপল কোনওমতে। বিজনদাকে কেয়াদি কেন কে জানে, সহ্য করতে পারে না! কথা উঠলেই বলে, “শালা মেনিমুখো! পার্টি করে! লেনিনকে কী উচ্চারণ করত জানিস? লেলিন! আমার বাবার পায়ের কাছে বসে থাকত। আর কাজুদার চামচা হয়ে ঘুরত। সে কিনা এখন সং সেজে ঢং করছে! তুই যাস কেন দেড়েলটার কাছে? যাবি না একদম!”

কেয়াদিরা এই অঞ্চলের পুরনো বাসিন্দা। অনেক কিছু চেনে। আসলে নিশানরা আগে এখানে থাকত না। মুর্শিদাবাদে বাবার ব্যাবসা ছিল। পরে ওরা সোনাঝুরিতে চলে আসে জমিজায়গা কিনে। নিশানের তখন পাঁচ বছর বয়স। দেখতে-দেখতে তারপর চব্বিশ বছর কোথা দিয়ে যে কেটে গেল!

কেয়াদির কাছে সোনাঝুরির কথা শোনে নিশান। পুরনো সোনাঝুরির কথা। শোনে সেই সময়কার স্কুল, গঙ্গার পাড়, জোনাক-বাড়ির কথা। আর শোনে একটা ছেলের কথা। অল্পবয়সি, ফরসা, একমাথা কোঁকড়া চুল আর গালে হালকা দাড়িওয়ালা একটা ছেলের কথা। কেয়াদি তার কথা বলতে গেলেই কেমন আবছাভাবে তাকায় দূরের দিকে। তারপর অস্ফুটে বলে, “সত্যি, অদ্ভুত মানুষ ছিল কাজুদা!”

“কাজুদা? মানে?” প্রথমবার শুনে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল নিশান।

কেয়াদি বলেছিল, “সে ছিল একজন। পুরো নাম বেঞ্জামিন কূজন সরকার।”

“কথা কানে যায় না?” কেয়াদি ঝংকার দিয়ে উঠল, “আমায় কেয়াদি বলিস ঠিক আছে, কিন্তু জানবি আমি তোর মায়ের বয়সি। কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিবি।”

নিশান হাসল, “এই বলো বয়স কুড়ি। আবার এই বলছ মায়ের বয়সি! এত কনফিউজ়ড কেন তুমি?”

“আমি কনফিউজ়ড?” কেয়াদি চোখ বড়-বড় করল।

“বিজনদা ঠিকই বলে…” কথাটা অসমাপ্ত রেখে চুপ করে গেল নিশান। বিজনদার নাম শুনলে চিড়বিড় করে ওঠে কেয়াদি। এই চিড়বিড়ানিটা দেখতে খুব মজা পায় ও।

“কী বলে দেড়েলটা? আমায় নিয়ে কথা বলে ও? ওর দাড়ি যদি না ছিঁড়েছি আমি! আমার নাম পালটে দিস!” রাস্তার মধ্যে প্রায় লাফাতে লাগল কেয়াদি।

নিশানের আবার হাসি পেল খুব। অবশ্য তার সঙ্গে হঠাৎ ভালও লাগল। আসলে কুড়ি নয়, কেয়াদির বয়স বড়জোর তেরো। নেহাত কপাল খারাপ, তাই ওই মনটা একটা বাষট্টি বছরের শরীরে আটকে আছে!

“বলো ডাকলে কেন? আমি বিজনদার কাছে যাব। আলুর চপ নিয়ে যাব। বিজনদা রোজ সন্ধেবেলা মুড়ি দিয়ে খায়।”

“রোজ?” কেয়াদি চোখ বড়-বড় করে তাকাল, “বুড়োর রস কম নয়তো! রোজ ওই মোবিলে ভাজা চপগুলো গেলে? মরার ইচ্ছে হয়েছে? হলে বলিস আমি গিয়ে গলা টিপে দিয়ে আসব।”

“আহা, তুমি বলো না, কী কেস? ডাকলে কেন?” নিশান এবার সত্যি অধৈর্য হল। কেয়াদি এত কথা বলে যে, একবার ধরলে ছাড়া পাওয়া মুশকিল।

কেয়াদির যেন মনে পড়ে গেল কথাটা। চট করে একবার হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল, “আরে, তুই আমার সব গুলিয়ে দিস! শোন, এখনই একবার সোনাঝুরি স্টেশনে চলে যা।”

“কী? কেন?” অবাক হল নিশান।

“আরে, ফলসা এসেছে আজ। কাল ওর জন্মদিন না?” কেয়াদি এমন করে বলল, যেন ফলসার জন্মদিনটা পাবলিক হলিডে।

“তোমার মেয়ে এসেছে?” অবাক হল নিশান।

“আসবে না? সেই গতবছর পুজোর পর এই এল। তা, ওর কয়েকজন বান্ধবী এসেছে আমাদের বাড়িতে। থাকবে।”

“ভাল কথা,” নিশান বলল, “তাতে আমি স্টেশনে যাব কেন? ট্রেনের গার্ড আর ড্রাইভাররাও আসবে নাকি?”

“আরে, কথাটা শোন! খালি বাজে বকবক! দেড়েলটার সঙ্গে থাকতে থাকতে তুইও ক্যালানে হয়ে গেছিস।”

“কেয়াদি,” নিশান বলল, “কী সব ভাষা ব্যবহার করো!”

“ওরে আমার নাড়ু!” কেয়াদি চটাস করে একটা চাঁটি মারল নিশানের হাতে, “ছেলেরা বলতে পারে আর আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি? শভিনিস্ট পিগ!”

নিশান হেসে বলল, “তা পিগ স্টেশনে গিয়ে কী করবে?”

“ওর একটা বান্ধবীকে নিয়ে আসবি। বেচারি আগে কোনওদিন ট্রেনে করে আসেনি। খুব বড়লোক বাড়ির মেয়ে। এই সোনাঝুরি জুট মিলটার মালিকের মেয়ে! ট্রেনে-ফেনে চড়ার অভ্যেস নেই। কিন্তু গাড়িতেও আসবে না। ওর ইচ্ছে লোকাল ট্রেনে একবার উঠবে। তুই স্টেশনে গিয়ে ওকে রিসিভ করে রিকশা করে আমাদের বাড়িতে এখনই নিয়ে আয়। ওর ট্রেন আর কুড়ি মিনিটের মধ্যে ঢুকবে।”

নিশান কিছু বলার আগে কুঁইকুঁই করে ওর মোবাইলটা বেজে উঠল। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ও দেখল নোঈ কল করেছে!

নোঈ ওর মাসতুতো বোন। ভবানীপুরে থাকে ওরা। পুটুমাসি আর রাঙামেসো খুব ভালমানুষ! নোঈও খুব ভাল মেয়ে। তবে আজকাল আর সেই ছোটবেলার মতো যোগাযোগটা নেই!

ফোনটা দেখলেও ধরল না নিশান। পরে কলব্যাক করে নেবে।

“আমায় মেয়েটি চিনবে কী করে?”

“আরে, আমি ওকে তোর ছবি মেসেজ করে দিয়েছি। তুই টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াবি, ও চিনে নেবে,” কেয়াদি ঝরঝর করে একনিশ্বাসে বলে গেল কথাগুলো।

ওকে না জিজ্ঞেস করেই করে দিয়েছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশান। এই ভয়টাই করেছিল ও। কেয়াদি মানেই একটা না-একটা কাজের ফরমায়েশ!

ও বলল, “আচ্ছা, যাচ্ছি।”

“শোন, তোর ওই পার্টির লেকচার দিবি না মেয়েটাকে। ও ভাল মেয়ে। কত বড়লোক বুঝতে পারছিস?” কেয়াদি সাবধান করে দেওয়ার মতো গলায় বলল।

“ভাল মেয়ে মানে? আমরা কি খারাপ ছেলে?” নিশান ভুরু কোঁচকাল, “এমন মেয়ে, যার কাছে লোকাল ট্রেন চড়াটা অ্যাডভেঞ্চার, তাকে পার্টির কথা বলে আমি কেন বেকার আমার ব্যাটারি খরচ করব!”

“এইসব কথা বলবি না ওকে একদম। বুঝলি?” কেয়াদি সাবধান করে দিল, “ওর নাম রাধিয়া। রাধিয়া মালিক! মনে রাখবি নামটা। এখন যা।”

নিশান সাইকেলটা ঘুরিয়ে উঠে বসল তার ওপর।

কিন্তু প্যাডেল করার আগেই কেয়াদি সাইকেলের হ্যান্ডেলটা চেপে ধরে বলল, “‘লেলিন’ রোজ ওই তেলেভাজা-মুড়ি খায় নাকি? হুলোটা যা তেলে ভাজে, ওতে তো হাতিও মারা যাবে রোজ খেলে!”

নিশান থমকে গেল একটু। কেয়াদি তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। বড়-বড় চোখ স্থির।

নিশান বলল, “ম্যাক্সিমাম দিন। কেন?”

কেয়াদি আলতো করে ছেড়ে দিল সাইকেলের হ্যান্ডেলটা। তারপর বলল, “আত্মহত্যা করবে বলেছিল চল্লিশ বছর আগে। কিন্তু সেটা যে এভাবে রোজ চপ-মুড়ি খেয়ে করবে তা বুঝতে পারিনি তখন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *