৪০. দেশ ছেড়ে আসবার আগে

চল্লিশ

দেশ ছেড়ে আসবার আগে ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক আমাকে একটি আদেশ দিয়েছিলেন, প্রতি মাসে আমাকে একটি লেখা পাঠাতে হবে। সেই প্রথম কোনও পত্রিকার পক্ষ থেকে লেখার জন্য আমন্ত্রণ পাওয়া, তাও ‘দেশ’-এর মতন পত্রিকা, প্রতি সপ্তাহে যে পত্রিকার সূচিপত্র সংবাদপত্রে দেখার সময় বক্ষে দুরু দুরু শুরু হত এবং কোনও সপ্তাহে নিজের নামটি দেখতে পেলে লাফিয়ে ওঠার ইচ্ছে হত। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় মনে হত, শহরের সব লোক জেনে গেছে যে আগামী সপ্তাহে ‘দেশ’ পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপা হচ্ছে এবং সবাই আমাকে দেখছে! এ হেন পত্রিকার স্বয়ং সম্পাদকের আদেশ ও আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার সৌভাগ্য সত্ত্বেও আমি লেখা পাঠাইনি। ঠিক কী যে লিখতে হবে তা বুঝতে পারিনি, খবরের কাগজে ‘আমেরিকার চিঠি’, ‘জার্মানির চিঠি’ কিংবা ‘লন্ডন নোট বুক’ জাতীয় লেখা পড়েছি, যাতে সমসাময়িক নানা ঘটনার উল্লেখ থাকে, সে রকম কিছু লিখতে ইচ্ছে করেনি। আমার সাংবাদিকতার কোনও শিক্ষাই ছিল না, আগ্রহও ছিল না৷ গদ্য লেখা সম্পর্কেই ছিল আলস্যবোধ, এর আগে কয়েকখানা শখের ছোট গল্প ছাড়া লিখেছি শুধু রাশি রাশি ব্যক্তিগত চিঠি। ও না, বরণীয় মানুষ : স্মরণীয় বিচার নামে প্রচুর পড়াশুনো করে ও খেটেখুটে বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিদের বিচার কাহিনী লিখেছিলাম বটে আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় পৃষ্ঠায়, সেই নামে এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েও গেছে আমার প্রথম গদ্যগ্রন্থ। সেসব রচনা অর্থ উপার্জনের জন্য, এখানে সে প্রয়োজন নেই, তা হলে সাময়িক উপকরণ নিয়ে গদ্য লিখে সময় নষ্ট করার কী দরকার, তার বদলে কবিতা লিখলেই হয়!

আমার অনুপস্থিতিতে কৃত্তিবাস’-এর ভার নিয়েছিলেন শরৎকুমার ও প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, পত্রিকা আগের চেয়েও আকারে বর্ধিত হয়ে প্রকাশিত হচ্ছিল নিয়মিত, তার জন্য কবিতা পাঠাতাম। এবং অন্যান্য লিট্ল ম্যাগাজিনে। ভয়ে ভয়ে দেশ পত্রিকায় একটি কবিতা পাঠাতেই সাগরদা মৃদু ভর্ৎসনা করে চিঠি দিলেন, তোমার কবিতাটা ছাপছি, কিন্তু গদ্য কোথায়? শেষ পর্যন্ত সাগরদার বকুনির ভয়েই আমি এক বৎসরে কোনওক্রমে দুটি লেখা পাঠিয়েছিলাম, কোনওটাই সংবাদ ঘেঁষা নয়, বরং ভ্রমণমূলক। প্রথমটি, অ্যারিজোনার টুস্ন শহরের পাশে দৈত্যাকার ক্যাকটাসবহুল মরুভূমিতে ঘুরতে ঘুরতে আমার ঘুমিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা, আর দ্বিতীয়টি ‘দু’ রকম নিউইয়র্ক। এক দিকে বনেদি পাড়ায় প্লাজা হোটেলের মতন বিলাসবহুল হোটেলে চিত্রতারকা ও ধনকুবেরদের সঙ্গে কয়েকটি দিন যাপন, অন্য দিকে লোয়ার ইস্ট সাইডের মতন গরিব পাড়ায় প্রায় বস্তিবাড়ির মতন অ্যালেন গিনসবার্গের আখড়ায় বেকার, ভবঘুরে ও নেশাখোরদের সঙ্গে সারা দিন-রাত হই-হল্লা ও আড্ডা। ‘দেশ’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় সেই আমার খানিকটা দ্বিধাগ্রস্তভাবে গদ্য রচনার শুরু, ভবিষ্যতে এই পত্রিকায় যে আমাকে হাজার হাজার গদ্য-পৃষ্ঠা ভরাতে হবে, তা তখন আমার সুদূর কল্পনাতেও ছিল না, সে রকম কোনও বাসনাই ছিল না। এতদিন পর হিসেব করে দেখছি, ‘দেশ’ পত্রিকার ইতিহাসে আমার চেয়ে বেশি গদ্য পৃষ্ঠা আর কোনও লেখক লেখেননি। নিয়তি আর কাকে বলে!

কিছুদিনের জন্য এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে আবার ফিরে আসতাম আয়ওয়া শহরে আমার এক কক্ষের অ্যাপার্টমেন্টে। এর মধ্যে আমার ক্লাসে হাজিরা দেবার দায় ঘুচে গেছে, ইচ্ছে হলে যাই, সে রকম ইচ্ছে প্রায় দিনই হয় না। কিছু বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করে একটি সংকলন প্রস্তুত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, সেটিও অল্পদিন পরেই পরিত্যক্ত হয়, কারণ আমার সহযোগী হিসেবে যাকে দেওয়া হয়েছিল, তার সঙ্গে আমার কথায় কথায় মতান্তর হত, সেই যুবকটি ইংরেজির অধ্যাপক এবং হবু কবি, ভারত নামে দেশটি সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র জ্ঞান ছিল না, জানার আগ্রহও ছিল না, আচরণে খানিকটা ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেত। আমি তাকে গ্রাহ্য করতে যাব কী দুঃখে? অসমাপ্ত হয়ে রইল অনুবাদের কাজ। তাতেও অস্বস্তির কোনও কারণ ঘটেনি, কারণ পল এঙ্গেল বিদেশ থেকে আমন্ত্রিত লেখকদের ওপর কোনও রকম শর্ত চাপানোতে বিশ্বাস করতেন না, তাদের পুরোপুরি স্বাধীনতা দেওয়াই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য, কেউ যদি নিয়মিত ক্লাস করে ডিগ্রি নিতে না চায়, অন্য কোনও দায়িত্ব না নিয়ে নিজের ভাষায়, নিজের লেখা নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকতে চায়, তাতেও তিনি খুশি। মাঝে মাঝে তাঁর বাড়িতে সন্ধেবেলায় সাহিত্য সভার আয়োজন হত, তাতে তিনি কয়েকজন আমন্ত্রিত লেখকদের নতুন রচনা পাঠ করে শোনাবার অনুরোধ জানাতেন। যার যার নিজস্ব ভাষার রচনা, সম্ভব হলে তার ভাবানুবাদ। এক সন্ধ্যায় একজন স্প্যানিশ কবির কবিতা বিনা অনুবাদে শুনেছিলাম এক ঘণ্টা, প্রায় কিছুই বুঝতে পারিনি অর্থ। তবু অনুভব করেছিলাম, অর্থ না বুঝলেও শব্দের নির্বাচন, শব্দের চাপা ঝংকার শুনতে শুনতেও খানিকটা উদ্দীপ্ত হওয়া যায়।

এইসব দায়দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে আমার হাতে অঢেল সময় এসে গেল, এমনও হয়েছে, আমি দিনের পর দিন ঘর থেকে এক পাও বেরোইনি, বাইরে যেতে গেলেই শার্ট-প্যান্ট, মোজা-জুতো পরতে হয়, বিশেষত মোজা পরার ব্যাপারে আমার খুব আলস্য ছিল, আজও আছে, ঘরের মধ্যে দিব্যি পাজামা-গেঞ্জি পরে, শুয়ে বসে ইচ্ছেমতন বই পড়া কিংবা লেখালেখি করা যায়। বরাবরই আমার বাড়ির মধ্যে পাজামা পরে থাকা অভ্যেস, আমার বাবা লুঙ্গি পরতেন, আমি কখনও লুঙ্গি ধারণ করিনি। এ দেশে হাফ-প্যান্ট পরেও বাইরের লোকের সঙ্গে দেখা করা যায়, কিন্তু পাজামা পরে নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়ানোও তখন অভব্যতা বলে গণ্য হত। কেউ আমার ঘরের দরজায় টোকা দিলে আমি সন্ত্রস্তভাবে হুড়োহুড়ি করে পাজামা খুলে প্যান্ট-শার্ট পরে নিতাম, শার্টটা আবার প্যান্টের মধ্যে গুঁজে নিতে হয়। যখন তখন দরজায় করাঘাত করে নানারকমের ফেরিওয়ালা, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মেয়ে, একতলা থেকে কোনও প্রয়োজনে আসে আমার পোলিশ বন্ধু ক্ৰিস্তফ, আর মার্গারিট। একদিন মার্গারিট জিজ্ঞেস করল, তোমার দরজা খুলতে এত দেরি হয় কেন? আমার পাজামা সমস্যার কথা অকপটে তাকে জানালে সে খুব হাসল, পরদিন সে আমার জন্য কিনে আনল একটা তোয়ালের লম্বা ড্রেসিং গাউন। এ দেশে ড্রেসিং গাউন গায়ে জড়ানো থাকলেই সাত খুন মাপ, তলায় কিছু থাক বা না থাক, সকলের সামনে বেরোনো যায়। আমাদের তৎকালীন বাংলা সিনেমায় সব নায়িকার বাবা ড্রেসিং গাউন পরত, প্রথম দিন সেই ড্রেসিং গাউনটা জড়িয়ে আমার নিজেকেও মনে হচ্ছিল ছবি বিশ্বাসের মতন, হাতে শুধু একটা পাইপ নেই! ড্রেসিং গাউনটা পাবার পর এই সুবিধে হল, সকালে স্নান করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে কিছুই পরি না, দিগম্বর হয়ে ঘরের মধ্যে ঘোরাঘুরি করলেও তো দেখার কেউ নেই। ড্রেসিং গাউনটা রাখা থাকে চেয়ারের মাথায়। শীতকালেও এখানে এক একদিন ঘর এমন গরম হয়ে যায় যে শরীরে পোশাক রাখতে ইচ্ছে করে না। সেন্ট্রাল হিটিং কমাবার ব্যবস্থা নেই। জানলার বাইরে তুষারপাত হচ্ছে, ভেতরে গরমে ঘামছি।

পোশাক প্রসঙ্গে একদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। পল এঙ্গেল কিংবা মেরি প্রায়ই আমাকে ওদের বাড়িতে নৈশভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানান, তা ছাড়াও পল মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যান কোনও রেস্তোরাঁয়। আমেরিকায় পৃথিবীর সব দেশেরই রেস্তোরাঁ আছে, ইচ্ছে মতন যে কোনও দেশের খাবার খাওয়া যায়। সেইরকমই এক সন্ধ্যায় পল টেলিফোনে জানালেন, তিনি আমাকে একটি নতুন ধরনের রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে চান। আমাকে আধঘণ্টার মধ্যে তৈরি থাকতে হবে। জুন মাস, সেদিন দারুণ গরম পড়েছে। যে অঞ্চলে শীতকালে রাস্তার পাশে চার ফুট বরফ জমে থাকে, বিশ্বাসই করা যায় না যে সেখানেও গ্রীষ্মকালে অন্তত কয়েকটি দিন গরম অসহ্য হয়। এইসব দিনে আমেরিকান ছেলেরা খালি গায়েও রাস্তায় বেরোয়। কিংবা হাওয়াইয়ান শার্ট। পাতলা কাপড়ের এই ঢলঢলে জামাটি আমেরিকানদেরই অবদান, ইংরেজরা তখনও দু’চক্ষে দেখতে পারত না, কারণ, এই শার্ট গুঁজে পরতে হয় না, সঙ্গে টাই পরারও সুযোগ নেই। আমার পক্ষে এই শার্ট খুব সুবিধেজনক, বেশ রংচঙে দু’তিনখানা কিনেও ফেলেছি। যথারীতি সেই সন্ধেতেও মার্গারিটের সঙ্গে বসে কবিতা পড়ছিলাম, পল এঙ্গেলের ডাক শুনে তাকে ফেলে চলে যেতেই হল। পল আমাদের বাড়ির দরজায় এসে হর্ন দিলেন, আমি নেমে গিয়ে তাঁর গাড়িতে ওঠার পর তিনি বললেন যে পথে তাঁর এক বন্ধুকে তুলে নিয়ে যাবেন।

শহর ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে নিরিবিলি এলাকায় সেই বন্ধুর বাড়ি। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল, তিনি ভেতরে ডেকে নিয়ে বসালেন। তারপর দেখি যে দুই বন্ধুতে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কী যেন আলোচনা করছেন, আর মাঝে মাঝে চোরা চাহনি দিচ্ছেন আমার দিকে। এই রে, আমাকে নিয়ে কোনও সমস্যা হয়েছে নাকি! যে-রেস্তোরাঁয় যেতে চান, সেখানে কালো লোকদের ঢুকতে দেয় না? তা হলে আমি যেতেও চাই না। একটু পরে পল আমার কাছে এসে কাঁচুমাচুভাবে বললেন, সুনীল, আমরা যে রেস্তোরাঁয় যাব বলে ঠিক করেছি, সেটা খুবই ইন্টারেস্টিং, একটা নদীর প্রায় ওপরেই একটা পরিত্যক্ত পাওয়ার হাউসকে একটুও না বদল করে রেস্তোরাঁ বানানো হয়েছে, সেটা দেখতে যেমন অপূর্ব, তেমনই খাবারের খুব সুনাম। কিন্তু একটা মুশকিল এই, তুমি হাওয়াই শার্ট পরে আছ, সেখানে জ্যাকেট পরে যাওয়া বাধ্যতামূলক। তুমি শার্টের ওপর আমার বন্ধুর একটা জ্যাকেট চাপিয়ে নেবে?

বন্ধুটিও বললেন, তাঁর অনেকগুলি জ্যাকেট আছে, তার কোনও একটা আমার গায়ে ফিট করে যাবে। আমার আপত্তির সুযোগ এল না, দুজনে মিলে একটার পর একটা জ্যাকেট আমাকে পরিয়ে দেখতে লাগলেন, একটি বেশ মানানসই হয়েও গেল। জ্যাকেট পরলে শার্টটা ভেতরে গুঁজতেই হয়। আমি বেল্ট পরে আসিনি। শার্ট ভেতরে থাকলে বেল্ট ছাড়া কোমর ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে, সেটা রীতিবহির্ভূতও বটে। আমি সে সমস্যার কথা উত্থাপন করতেই বন্ধুটি দু’তিনটি বেল্টও এনে দিলেন, একটি আমার কোমরে লেগে গেল। সেই অবস্থায় আমাকে দেখে দু’জনে দারুণ হাসতে লাগলেন।

পল এঙ্গেলের এই বন্ধুটির নাম ভ্যান অ্যালেন, তিনি বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী, নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। মহাকাশে তাঁর আবিষ্কৃত একটি বলয়ের নাম ভ্যান অ্যালেন’স বেল্ট। সেই ভ্যান অ্যালেনের বেল্ট আমার কোমরে।

আমার সকাল শুরু হয় চিঠির বাক্স দেখে। ঘুম ভাঙতেই গায়ে ড্রেসিং গাউনটা জড়িয়ে ছুটে যাই নীচে। চিঠির বাক্স প্রতিদিনই ভর্তি থাকে, অথচ চিঠি থাকে না, অর্থাৎ থাকে অনেকগুলি বিজ্ঞাপনের চিঠি, এ দেশে যাকে বলে জাঙ্ক মেইল। কত রকম যে বিজ্ঞাপন। তার ইয়ত্তা নেই, নতুন নতুন সাবান, টুথপেস্ট, ক্রিম, রান্নার তেল ইত্যাদি। বিভিন্ন কোম্পানির ভোগ্যপণ্যের প্রতিযোগিতা। চিঠির সঙ্গে ছোট ছোট নমুনাও থাকে, পেস্ট, সাবান তো বটেই, এমনকী তেলের শিশি পর্যন্ত। আসল চিঠি, অর্থাৎ বন্ধুবান্ধব বা বাড়ির চিঠি যেদিন পাই, সেদিন একখানা চিঠি বারবার পড়েও যেন আশা মেটে না। বাংলা অক্ষরে চিঠির জন্য এত ব্যাকুলতা জীবনে কখনও বোধ করিনি। চিঠি পাবার জন্য আমি প্রথমে এসেই দেশের প্রায় সমস্ত চেনাশুননা মানুষকে আগেই নিজের ঠিকানা জানিয়ে একটা করে চিঠি লিখে পাঠিয়েছি, তারপর মনে মনে এক এক জনের কাছ থেকে উত্তর পাবার দিন হিসেব করি। হিসেব মেলে না, দিনের পর দিন পেরিয়ে যায়, তারপর এক একজন সম্পর্কে আশা ছেড়ে দিলে অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন উত্তর আসে। শক্তি ও সন্দীপনের সঙ্গে আমার সাময়িক মনোমালিন্য কেটে গেছে, ওরাও নিয়মিত লেখে। এরোগ্রামের চিঠিই সবচেয়ে শস্তা, আর সবচেয়ে বেশি সদ্ব্যবহার করতে জানে সন্দীপন। সে প্রথমে কালি দিয়ে লিখে পুরো জায়গাটা ভরিয়ে ফেলে, তারপর তারই ওপর দিয়ে আবার লেখে পেন্সিলে। অর্থাৎ একই কাগজে দুখানা চিঠি। কালিতে লেখা ও পেন্সিলের লেখার জন্য সন্দীপনের ভাষাও আলাদা হয়ে যায়। শক্তির চিঠিতে লেগে থাকে বিষাদের সুর, যা শক্তির ব্যবহারের সঙ্গে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মুখের কথার মানুষ আর চিঠির মানুষ প্রায়ই আলাদা হয়। সবচেয়ে মজার কথা লিখেছিল দিলীপ দত্ত, বন্ধুদের মধ্যে তার বিয়ে হয়েছিল একেবারে প্রথম, তার স্ত্রী প্রভাতী ছিল আমাদের সকলেরই বান্ধবীর মতন, আমরা বেকার থাকার সময় ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল দিলীপ, তার বাড়িতে প্রায়ই আড্ডা হত, অন্দরমহল থেকে আসত গরম গরম কচুরি ও মোহনভোগ। সেই দিলীপ লিখল, তুমি চলে যাবার পর অন্য বন্ধুরাও আর আসে না, আড্ডা জমে না, প্রায়ই সন্ধেবেলা মনে হয় কী করি, কী করি, তাই ভাবছি কিছুদিনের জন্য পাগল হয়ে যাব! পাগল হলে আর আড্ডার কথা ভাবতে হবে না।

চিঠিতেই জানলাম, সন্দীপন বিয়ে করতে চলেছে। বিদেশে আসার আগের কয়েকটা বছর শক্তি, সন্দীপন, শরৎকুমার, ভাস্কর ও আমি এই পাঁচজন ছিলাম প্রায় প্রতিদিনের নিত্যসঙ্গী, রাজদ্বারে কিংবা শ্মশানে পাশাপাশি। এই ইনার সার্কেলের মধ্যে সন্দীপন প্রথম বিয়ে করে। প্রথম খবরটা পড়ে মনে হয়েছিল, ও যেন আমাদের এই ঘনিষ্ঠ দল থেকে বেরিয়ে গেল! বিয়ের পর কি আর বন্ধুদের জন্য আগের মতন সময় দেওয়া যায়। তারপরই এল ভাস্করের বিয়ের চিঠি। তিরিশ বছরে পা দিয়ে একে একে প্রবেশ করছে সংসারে। তারাপদ রায়ের বিয়ে ও সেই সংক্রান্ত অনেক মজার গল্পও অন্যরা জানাল চিঠিতে।

আমি তখনও বিয়ের ব্যাপারটা চিন্তাই করতে পারিনি। একটি মেয়ের সঙ্গে জীবনটা জড়িয়ে ফেলা যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করার মতন, সেই জগতের সামনে দুলছে একটা রহস্যময় পর্দা, সেই পদাটা সরিয়ে সবটা দেখে নিতে কেমন যেন গা ছমছম করে। যেমন আছি, বেশ তো আছি, এরকমই মনে হয়।

মার্গারিটের সঙ্গে ভাব গাঢ় হবার পরেই ও নিজেই একদিন কাঁচুমাচু মুখে বলেছিল যে, প্রেম হলেও ও কিছুতেই আমাকে বিয়ে করতে পারবেনা। ওর বাবা-মা বেঁচে আছেন, ওদের পরিবার গোঁড়া ক্যাথলিক, ওর এক বোন সন্ন্যাসিনী হয়ে কনভেন্টে থাকে, মার্গারিটের নিজের ধর্মীয় গোঁড়ামি নেই, কিন্তু সে একজন হিন্দুকে বিয়ে করলে ওঁর পরিবার কিছুতেই তা মেনে নিতে পারবে না, বিশেষত ওর মা হয়তো মনের আঘাতে প্রায়োপবেশনে বসবেন! বিয়ে না করেও আমি কি মার্গারিটের বন্ধু থাকতে রাজি আছি?

সে কথা শুনে বিন্দুমাত্র আঘাত পাবার বদলে আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছিল। বিয়ের জন্য আমি তখন একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না, বিয়ের প্রশ্ন উঠলে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বজায় রাখা সম্ভব হত না। মার্গারিট সরল মেয়ে বলেই ওকে আমার অবস্থাটাও জানিয়ে দিলাম অকপটে। আমি গরিব পরিবারের ছেলে, চিরদিন আমেরিকায় থাকব বলে আসিনি, মা-ভাই-বোনদের সংসারেই ফিরে যেতে হবে, দু’খানা ঘরের সেই নাগেরবাজারের ফ্ল্যাটে হঠাৎ মেম-বউ নিয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। দু’জনের দিক থেকেই এই খোলাখুলি আলোচনার পর আমাদের সম্পর্কটা পরিষ্কার হয়ে গেল।

মার্গারিটের কাছ থেকে আমি যে ফরাসি সাহিত্যের অনেক কিছু জেনেছি তাই-ই নয়, পাশ্চাত্য সঙ্গীতেরও দীক্ষা নিয়েছি। দেশে থাকতে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্পর্কে আমার আগ্রহ জন্মেছিল, রাত জেগে জেগে গান-বাজনা শুনে খানিকটা কান তৈরি হয়েছিল, কিন্তু ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিক সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। বিথোভেন, মোৎসার্ট, বাখ প্রমুখদের শুধু নামই শুনেছি। মার্গারিটের একটা সেকেন্ড হ্যান্ড রেকর্ড প্লেয়ার ছিল, সেটা নিয়ে এল আমার ঘরে, পুরনো রেকর্ড কিনে এনে সে আমাকে শোনাত কোনটা নাইন্থ সিম্ফনি, কোনটা ব্লু ড্যানিউব। কনসার্ট আর চেম্বার মিউজিকের তফাত। সব আমি বুঝিনি, কিন্তু সত্যিকারের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একটা মর্মস্পর্শী আবেদন থাকেই। রেকর্ডে নাইন্থ সিম্ফনি বাজছে, আমরা হয়তো তা মন দিয়ে শুনছি না, অন্য কথা বলছি কিংবা কবিতা পড়ছি, কিন্তু ওই সঙ্গীতের আবহে মন অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়ে যায়।

মুখ বদলাবার জন্য মাঝে মাঝে আমরা শুনতাম আমেরিকান লোকসঙ্গীত কিংবা নিগ্রো ব্লুজ। কিছু কিছু ফরাসি লোকসঙ্গীতও মার্গারিট শোনাত, সবটা মানে না বুঝলেও তার দু’-একটি আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কালো লোকদের একটা গান ছিল, ‘গুডনাইট আইরিন’। সে গানটা নিয়ে মাঝে মাঝে মজা হত বেশ।

পরপর কয়েকদিন ঘরের মধ্যে বসে কবিতা পাঠ, মদ্যপান, রান্নাবান্না, হাসি-গল্পের পর একদিন হঠাৎ মনে হত, বাইরে টাটকা বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া দরকার। আবহাওয়া ভালো থাকলে ইচ্ছে হত কিছু পয়সা খরচ করতে। সে রাতে আর রান্নাবান্নার ঝামেলা নয়, পানাহার হবে কোনও পাবে। এরকম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহরের পাবে কত জাতের ছেলেমেয়ে, কত বিচিত্র পোশাক, কত রকম রঙ্গ। সকলের ভাষা প্রধানত ইংরেজি হলেও কেউ কেউ মাঝে মাঝে গান গেয়ে ওঠে নিজের ভাষায়। পাশের ছেলেমেয়েরাই অনুরোধ করে, তোমার ভাষায় একটা গান শোনাও! আমাকেও বাজখাঁই হেঁড়ে গলায় দু’-একবার বাংলা গান গাইতে হয়েছে।

সেই পাবে বিয়ার সার্ভ করে একটি ফুটফুটে ফর্সা তরুণী, কুড়ির বেশি বয়েস নয়, সে সকলের সঙ্গে হাসি-মস্করায় যোগ দেয় বটে, আবার পয়সার হিসেবেও বেশ টনটনে। রাত এগারোটা বেজে গেলেই সে সকলকে ওঠার জন্য তাড়া দেয়, কারও কারও হাত থেকে বিয়ার মাগ কেড়ে নেয়, তার ডিউটি শেষ, তাকেও তো বাড়ি যেতে হবে! মেয়েটির নাম আইরিন, সবাই শেষবেলায় তাকে অনুরোধ করে আর একটু থাকতে দাও আইরিন, আর এক পাত্তর চুমুক দিতে দাও! একদিন সে আমার কাছে এসে তাড়া দিতেই আমি পূর্ব পরিচিত গানটি গেয়ে উঠলাম :

গুডনাইট আইরিন

গুডনাইট আইরিন, গুডনাইট আইরিন

আই উইল সি ই ইন মাই ড্রিম…

এই গানটা আরও অনেকে জানে, সবাই গেয়ে উঠল সমস্বরে। সকলের বিয়ারের পাত্র আইরিনের দিকে তোলা।

একটি পানশালার পরিচারিকা, সারাদিন খেটেখুটে ক্লান্ত, এখন অনেকগুলি যুবক তাকে বন্দনা করছে, গানের মধ্য দিয়ে বলছে, তোমাকে আজ স্বপ্নের মধ্যে দেখব। লজ্জায় যেন কুঁকড়ে গেল তার শরীর, মুখখানা হয়ে গেল অরুণবর্ণ, দেখতে দেখতে যেন সে হয়ে উঠল এক রাজকন্যা। তারপর দু হাত তুলে, আর সব কিছু ভুলে, বিভোর হয়ে শুরু করল নাচ।

একচল্লিশ

আমেরিকা প্রবাসে বৎসর ঘুরতে না-ঘুরতে আমার জীবনে একটি নতুন সঙ্কট দেখা দেয়। খুবই কঠিন সঙ্কট।

আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাইটার্স ওয়ার্কশপের মেয়াদ ছিল ন’ মাস৷ আমার সতীর্থ অন্যান্য দেশের বেশ কয়েকজন লেখক-লেখিকা তারপরেও এ দেশে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত ও বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। বেশি আগ্রহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির লেখক-লেখিকাদের। নিজেদের দেশের পরিবেশ তাদের একেবারেই পছন্দ নয়। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও চেকোশ্লোভাকিয়ার কয়েকজন লেখকের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল, ওই সব দেশের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর পরিবেশ সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এই বন্ধুদের কথা শুনে বুঝেছিলাম, সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত হিসেবে এসব দেশে সমান অধিকার স্বীকৃত হলেও মূল রাশিয়ানরা এ দেশগুলিকে কলোনির মতন মনে করে, রুশ ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বাধ্যতামূলকভাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছোট ছোট দেশগুলির নিজস্ব ভাষা। পোল্যান্ডের লেখক ক্রিস্তফ আমার সবচেয়ে কাছাকাছি প্রতিবেশী, তার সমস্ত তির্যক রসিকতাই রুশ বিরোধী। সে অবশ্য জানিয়েছিল, নিজের দেশে এসব রসিকতা প্রকাশ্যে বলাবলি করার উপায় নেই, সব সময় গুপ্তচরদের খপ্পরে পড়ার ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। ক্রিস্তফের, বয়স আমার চেয়ে অনেকটাই বেশি, বিবাহিত, তার স্ত্রীর ছবি দেখিয়েছে কয়েকবার, কিছু একটা কৌশলে সে তার স্ত্রীকেও আনিয়ে নিল আমেরিকায় এবং তারপরই দু’জনে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইল।

রোমানিয়ার এক তরুণী লেখিকা এর মধ্যে বিয়ে করে ফেলল একজন আমেরিকান ফুটবল খেলোয়াড়কে। আরও দু’জন লেখকের বিয়ে হয়ে গেল এই ন’ মাসের মধ্যে, আমেরিকান নাগরিককে বিয়ে করে ফেলাই এ দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অধিকার পাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়। কিছুদিন পর সে বিয়ে ভেঙে গেলেও অধিকারটা চলে যায় না। এই জন্য অনেক নকল বিয়েও হয়, পরে জেনেছি।

অবশ্য বিয়ে না করেও থেকে যাবার অনেক উপায় আছে। সেই ষাটের দশকের গোড়ায় এ দেশে ইমিগ্রেশানের তেমন কড়াকড়ি ছিল না, অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই সুদৃঢ়, চাকরি-বাকরির সম্ভাবনা অঢেল। ভিসা পাওয়া যেত পাঁচ বছরের, অনেকেই পাঁচ বছর পর্যন্ত থেকে জীবিকা অর্জন করে, কিছু টাকাপয়সা জমিয়ে চলে যেত কানাডায়। তখন কানাডায় ভারতীয়দের ভিসাই লাগত না (তখন পর্যন্ত ভারতীয় পাসপোর্টের যথেষ্ট সম্মান ছিল, এখনকার মতন এমন হেনস্থা সহ্য করতে হত না, সুইডেন, উভয় জার্মানি, এমনকী ইংল্যান্ডেও ভিসার প্রয়োজন হত না। মাস ছয়েক কানাডায় কাটিয়ে আবার আমেরিকায় প্রবেশ করলে পাওয়া যেত আরও পাঁচ বছরের ভিসা। তারই মধ্যে গ্রিন কার্ড কিংবা নাগরিকত্বেরও ব্যবস্থা হয়ে যেত।

অনেকেই থেকে যাবার ব্যবস্থা করছে, আমি কী করব?

ততদিনে কিছু কিছু আসবাব, বইপত্র, থালা বাসন, কম্বলবালিশের মতন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে রীতিমতো সংসার পেতে বসেছি। মার্গারিট ও আমার যৌথ সংসার বলা যেতে পারে, একবেলা আমি রান্না করি, অন্য বেলা সে, চাটু-সসপ্যান মাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়ার কাজও ভাগাভাগি। দু’জনেরই টাকাপয়সা থাকে এক ড্রয়ারে, ইচ্ছে মতন খরচ হয়, মাসের শেষে ফুরিয়ে গেলে ধার করি ক্রিস্তফের কাছ থেকে। এর মধ্যে এরিক নামে একটি ছেলে আমাকে জোর করে গাড়ি চালানো শেখানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। ও দেশে গাড়ি চালাতে না জানা মানে প্রায় পঙ্গুর মতন অবস্থা, সব কিছুরই দূরত্ব এত বেশি, পাবলিক ট্রান্সপোর্টও ব্যয়বহুল, পোস্টম্যানরাও নিজস্ব গাড়ি চালিয়ে চিঠি বিলি করে। এরিক আমার শুভার্থী সেজে আমাকে তার গাড়িতে তুলে স্টিয়ারিঙে বসাত। এতে তার একটা স্বার্থপর মতলবও ছিল। সে তার পুরনো ঝরঝরে ফোর্ড গাড়িটা (এ দেশে এই ধরনের গাড়িকে বলে জ্যালোপি) আমাকে বিক্রি করতে চায়। যে গাড়ি চালাতেই জানে না, সে গাড়ি কিনবে কেন? পুরনো গাড়ি এক দারুণ সমস্যার ব্যাপার। এ দেশের মানুষের ঝোঁক নতুন নতুন মডেলের গাড়ি ব্যবহার করা, চাঙ্গা অর্থনীতিতে তার সুযোগও প্রচুর, গাড়ি কেনার পুরো টাকা ঋণ দেবার জন্য ব্যাঙ্কগুলি মুখিয়ে আছে, কিন্তু পুরনো গাড়িটি বর্জন করাই প্রধান বাধা। সেই সময় বেশি পুরনো গাড়ি, সেকেন্ড হ্যান্ড বা থার্ড হ্যান্ড, বিক্রি করা একরকম অসম্ভবই ছিল (এখন সে অবস্থা বদলে গেছে)। পুরনো গাড়ি কোনও জায়গায় ফেলে রাখারও নিয়ম নেই। কেউ কেউ চুপি চুপি গাড়িটা চালিয়ে কোনও পাহাড়ের ওপর নিয়ে গিয়ে রাত্তিরবেলা ফেলে দিত খাদে। সেটাও বে-আইনি। পুলিশ ঠিক গাড়ির মালিককে খুঁজে বার করে শাস্তি দেয়। আইনসম্মতভাবে পুরনো গাড়ি বাতিল করার একমাত্র উপায় অটোমোবিল গ্রেভইয়ার্ড অর্থাৎ গাড়ির কবরখানায় সেটি পাঠিয়ে দেওয়া। কবরখানার জমি যেমন কিনতে হয়, তেমনি বাতিল, অব্যবহৃত গাড়ি রাখার জন্যও দিতে হয় কিছু টাকা। সেই গাড়ির কবরখানার দৃশ্যও মনে রাখবার মতন, শত শত বিখ্যাত কোম্পানির গাড়ি নীরব, নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে এক জায়গায়, তাদের চেহারা কিন্তু মোটেই মলিন, রংচটা নয়, মৃত বা মুমূর্ষ বলে মনে হয় না, ইচ্ছে করলে যে-কোনও মুহূর্তেই আবার গড়গড়িয়ে চালানো যেতে পারে। আমাদের কলকাতায় ওদের চেয়ে অনেক পুরনো, রুগ্ণ, লঝ্ঝরে গাড়ি চলে স্বচ্ছন্দে, অবশ্য কলকাতায় মোটর গ্যারেজের মিস্তিরিরা, এমন কি হেঁড়া গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট-পরা বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা যে-রকম কৃতিত্বের সঙ্গে মেরামত করে এক একটা মুমূর্ষু গাড়িকেও সজীব করে দেয়, সে জ্ঞান তো আমেরিকান মিস্তিরিদের নেই। ওখানকার মিস্তিরিরা সুট-টাই পরে, তাদেরও নিজস্ব গাড়ি আছে, তাই যে-কোনও গাড়ি মেরামতের জন্য হাত ছোঁয়ালেই অনেক টাকা হাঁকে।

এরিক আমাকে ওর ফোর্ড গাড়িটা বিক্রি করতে চেয়েছিল তিরিশ ডলারে। তখনকার টাকার হিসেবেও দেড়শো টাকা। মাত্র দেড়শো টাকায় একটা চালু গাড়ি?

অর্থাৎ আমার নিজস্ব সুসজ্জিত ফ্ল্যাট, ফর্সা বান্ধবী এবং গাড়ির মালিক, আমার আর আমেরিকান হয়ে যেতে বাকি রইল কী? এসব ছেড়ে ধুলো-ধোঁওয়া-আবর্জনায় ভরা, ভেজাল খাদ্য ও রোগভোগ, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের মধ্যে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কোনও যুক্তি আছে। কি?

অনেকেই ধরে নিয়েছিল, আমি থেকে যাচ্ছি। আমি পল এঙ্গেলের বিশেষ স্নেহধন্য, সেজন্য সতীর্থদের মধ্যে কারও কারও কিছুটা ঈর্ষা ছিল, তারা বলতে লাগল, তোমার আর চিন্তা কী, পল তোমার জন্য সব ব্যবস্থা করে দেবেন। সত্যিই তাই, পল এঙ্গেল একদিন বললেন, তোমার বাড়িওয়ালাকে বলেছি, তোমার ফ্ল্যাটের লিজ আরও এক বছর বাড়িয়ে দিতে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে তোমার একটা চাকরিরও ব্যবস্থা হয়েছে, এখনকার স্কলারশিপের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি পাবে। কাজটা মোটেই শক্ত নয়, সময় পাবে অনেক, ইচ্ছেমতন পড়াশুনো করতে পারবে, লিখতেও পারবে।

তখনই কোনও উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এসে এক কোণে দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ। একেবারে স্থির, নিষ্কম্প, কাষ্ঠপুত্তলিবৎ। পলক পর্যন্ত পড়ছিল না চোখের, অথচ ঝড় বইছিল মনের মধ্যে। আমি আমেরিকায় থেকে যাব, সে জন্য কি এসেছিলাম? ভ্রমণে আমার প্রাণের টান, গিয়েছি কত পাহাড়চূড়ায়, সমুদ্রতীরে, গহন অরণ্যে, কত অপরূপ সুন্দর স্থানে, কোথাও তো আমার বেশিদিন থেকে যাবার বাসনা হয়নি। কলকাতার চেনা পরিবেশ, রাত্তিরে নিজের বিছানার পুরনো বালিশ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। এখানে যতই সুখ থাক, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা থাক, প্রমোদ থাক, তবু সে সবের মোহে আমি বাঁধা পড়ে যাব?

যুক্তি দিয়ে বিচার করলে অবশ্য ফিরে যাওয়াটা মূর্খের গোঁয়ার্তুমির মতনই মনে হবে। লাইব্রেরিতে চাকরি নিলে প্রতি মাসে অনেক বেশি টাকা পাঠাতে পারব মা, ভাই-বোনদের জন্য। জীবিকা অর্জনের জন্য অনেক ছেলেই তো প্রবাসে কিংবা বিদেশে থাকে। এখানে আমার পড়াশুনোর সুযোগ অনেক বেশি, বিশাল গ্রন্থাগারটি আমার খুব প্রিয় স্থান, একবার ঢুকলে আর বেরোতেই ইচ্ছে করে না। কলকাতায় ফিরে গেলে আমি কী পাব? পড়ব এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারি চাকরি থেকে বিনা অনুমতিতে পালিয়ে এসেছি, সে চাকরি তো নেই-ই, বরং উল্টে হয়তো শাস্তি পেতে হতে পারে। অন্য কোনও চাকরির জন্য আবার দাঁড়াতে হবে কত শত ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে? সংসার খরচ জুটবে কোথা থেকে? বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে আমার শূন্যস্থানটাও কি ফিরে পাওয়া সম্ভব? খাঁচার বাঘ কোনও ক্রমে জঙ্গলে ফিরে গেলে অন্য বাঘেরা আর তার গায়ের গন্ধ পছন্দ করে না। আমার গায়ে আমেরিকান গন্ধ পেয়ে যদি বন্ধুরা নাক সিঁটকোয়?

এরই মধ্যে আর একবার গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ানায় ব্লুমিংটন শহরে প্রতিভা বসু-বুদ্ধদেব বসুর কাছে। ওঁদের ছেলে শুদ্ধশীল অর্থাৎ পাপ্পা কয়েকবার এসে থেকে গেছে আমার কাছে। পাপ্পা আমায় খুব ভালোবাসত, কলকাতাতেও আমার সাহচর্য তার খুব পছন্দ ছিল, তার বুদ্ধিদীপ্ত, সরস কথাবার্তায় আমিও মুগ্ধ ছিলাম। আয়ওয়ায় এসে মার্গারিটের সঙ্গেও বেশ ভাব হয়েছিল পাপ্পার। এমনও হয়েছে, পাপ্পারই অনুরোধে একই বিছানায় তিনজন পাশাপাশি শুয়ে গল্প করেছি সারা রাত।

পাপ্পা ঘন ঘন টেলিফোন করত। তার ডাকেই আবার গিয়েছিলাম ব্লুমিংটন। দময়ন্তী অর্থাৎ রুমি সম্ভবত ততদিনে চলে গিয়েছিল অন্য বাড়িতে। প্রতিভা বসুর কাছাকাছি এলেই অনুভব করতাম একটা স্নেহের তরঙ্গ। আমার মা প্রতিভা বসুর রচনার ভক্ত ছিলেন, দু’জনে প্রায় একই বয়সি। আমি যে লাইব্রেরি থেকে মায়ের জন্য এনে দেওয়া প্রতিভা বসুর সবগুলি বইই পড়েছি, তা জেনে তিনি চমৎকৃত হয়েছিলেন। আর বুদ্ধদেব বসুর কাছে বসে তাঁর প্রতিটি কথা শোনার সময়ই আমি হয়ে উঠতাম শ্রুতিধর। যেন একটি শব্দও হারিয়ে না যায়, সব লিপিবদ্ধ হয়ে যেত মনে মনে।

বুদ্ধদেব বসুর কাছে পরামর্শ চেয়েছিলাম, পল এঙ্গেল আমাকে থেকে যেতে বলছেন, আমার কি থেকে যাওয়াই উচিত? একটুক্ষণ চিন্তা করে তিনি বলেছিলেন, যখন সুযোগ আছে, পাকাপাকি না হোক, তুমি আরও কয়েকটা বছর অন্তত থেকে যেতে পারো। কলকাতায় ফিরে আবার কেরানির চাকরি করবে? এ দেশে চার-পাঁচ বছর কাটিয়ে ফিরলে দেখবে দেশে তোমার কদর বেড়ে যাবে। এখানে নানারকম কোর্স আছে, পড়াশুনো করে তোমার যোগ্যতা বাড়িয়ে নিতে পারো। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব কিংবা সাহিত্য যদি পড়ে নাও, তা হলে দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ পেতে অসুবিধে হবে না। এ দেশে থেকেও লেখালেখি করতে পারো, অমিয়বাবু (চক্রবর্তী) যেমন করছেন।

বুদ্ধিভ্রংশ হলে গুরুবাক্যও মানুষ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। আমারও বোধহয় সে রকমই অবস্থা হয়েছিল, আমি ওঁর পরামর্শ শুনেও নিঃসংশয় হতে পারিনি। পাকাপাকি থাকা আর কয়েক বছর বসবাসে ডিগ্রি ও অর্থ উপার্জন করে নেওয়ায় তফাত আছে বটে, কিন্তু কয়েক বছরের চিন্তাটাই একটা দারুণ ফাঁদ। সুজিত নামে একটি ছেলে আমাকে বলেছিল, প্রথম এক বছরে অনেকেরই ফিরে যাবার একটা তীব্র ইচ্ছে কিংবা আদর্শবোধ থাকে, তারপর দু-তিন বছর কেটে গেলে সেই তীব্রতা মিলিয়ে যায়, তখন অনেক রকম উল্টো যুক্তি মাথায় আসে। অনেককেই তো এ রকম দেখছি! আপনি মশাই কয়েকটা বছর থাকুন, ফ্ল্যাটের বদলে আপনার নিজস্ব বাড়ি হবে। মেম বউ হবে, দু’-তিনটে ফরসা ফরসা ছেলেমেয়ের বাবা হবেন, রবিবার আপনি শর্টস পরে নিজের বাগানের ঘাস ছাঁটবেন, দু’-একটা ফুটফুটে বাচ্চা ড্যাডি ড্যাডি বলে দৌড়োবে আপনার চার পাশে, এ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ঠিক আমার যেমন হয়েছে!

সে দৃশ্য কল্পনা করেই আমি শিউরে উঠেছিলাম। আমার ড্রয়ারে একটি গোলাকার পৃথিবীব্যাপী বিমানের টিকিট ছিল। অর্থাৎ আমাকে যে টিকিটটি দেওয়া হয়েছিল, তা দিয়ে আমি পৃথিবীর যে-কোনও দেশে যেতে পারি। কিন্তু টিকিটটির মেয়াদ এক বছর। সে সময়সীমা উত্তীর্ণ হলেই টিকিট বাতিল হয়ে যাবে, তখন আমায় নিজের পয়সায় কাটতে হবে নতুন টিকিট। সে পয়সা উপার্জন করতে হলে আমাকে বাধ্য হয়ে নিতেই হবে চাকরি। তারপর যদি আবার মত বদলায়। চাকরি নেবার সঙ্গে সঙ্গেই তো টিকিট কেটে পালানো যায় না।

কিছুতেই মনস্থির করতে পারি না। সেই অনিশ্চয়তার যন্ত্রণা যেন ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণের মতন। এই সিদ্ধান্তের ওপর আমার জীবনের গতি নির্ভর করছে। ঝোঁকের মাথায় যদি ফিরে যাই, ফিরে গিয়ে যদি বিপদের মধ্যে পড়ি, অর্থ উপার্জনের কোনও পথ না পেলে যদি আমাদের পুরো পরিবারটিই অনাহারের সম্মুখীন হয়, তখন তো আর এখানে ফিরেও আসা যাবে না। অর্থচিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া খুব বড় ব্যাপার, এখানে থাকলে সে দুশ্চিন্তা আর থাকবে না, বরং আমাদের কলকাতার সংসারেও সচ্ছলতা আসবে। কিন্তু তার বিনিময়ে আমাকে কী মূল্য দিতে হবে? কলকাতা আর আয়ওয়া শহর পৃথিবীর ঠিক বিপরীত দুই গোলার্ধে, দু’দিকের জীবনও দু’রকম, আমি কোনটা বেছে নেব? এ সিদ্ধান্ত নেওয়া কি সহজ!

অনেকেই হয়তো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক কিছু পরিকল্পনা করে রাখে, কিছু ছক কষা থাকে, থাকে কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আমার সেরকম কিছুই ছিল না। শুধু বর্তমান নিয়ে বাঁচা। আমেরিকায় আসার সুযোগ পেয়ে উৎফুল্ল হয়েছিলাম খুবই, কিন্তু তারপর বাকি জীবনটা কীভাবে কাটাব ভাবিনি। অনেকে মিলে যখন বোঝাতে লাগল, আমার পক্ষে এ দেশে থেকে উপার্জনের পথ নিশ্চিন্ত করাই সবদিক থেকে যুক্তিসঙ্গত, তখন সেই যুক্তির বাঁধুনিতেও আমার যেন হাঁপ ধরে যেতে লাগল। একদিন দুপুরে স্নান করে বেরিয়ে এসে নিরাবরণ অবস্থায় প্রমাণ সাইজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ঠিক কী করা উচিত বলো তো? আয়নার প্রতিবিম্ব সবসময় উল্টো হয়, ডানদিক চলে যায় বাঁদিকে, তার ব্যবহারও কি অন্যরকম হতে পারে না?

মনে হল যেন আয়নায় প্রতিবিম্ব মুচকি মুচকি হাসছে, যেন আমার দ্বিধা, সংশয় ও অনিশ্চয়তার যন্ত্রণা দেখে সে বেশ মজা পেয়েছে। এক ধমক লাগিয়ে বললাম, হাসির কী আছে? উত্তর দাও! তখন সেই প্রতিবিম্ব বলল, আগে ঠিক করো, তুমি কীসে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাও? মানুষ তো শুধু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সন্ধানেই বাঁচে না, বাঁচে ব্যক্তিগত সিদ্ধির আনন্দের জন্য!

কীসে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাওয়া যায়, এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও তো সহজ নয়। ব্যক্তিভেদে আলাদা আলাদা। যোদ্ধার চরম আনন্দ যুদ্ধজয়ে, সন্ন্যাসীর আনন্দ ত্যাগে। আমি তার কোনওটাই নই। আমার আনন্দের তীব্রতা এক এক সময় এক এক রকম! একবার ভুটান সীমান্তে একটা পাহাড়ি নদীতে স্নান করে এমন আনন্দ হয়েছিল, যেন তা কোনও রমণী সম্ভোগের চেয়েও বেশি। আমাকে চিন্তাকুল দেখে আয়নার মূর্তিটিই বলল, আমি তো দেখি, যখন ঘরে আর কেউ থাকে না, তোমার বান্ধবীও না, মধ্যরাতে টেব্ল ল্যাম্প জ্বেলে তুমি বাংলায় কিছু কিছু লেখালেখি করো, তখন তোমার মুখে চোখে যে তীব্রতা ফুটে ওঠে, উচ্চাঙ্গের মদ্যপানের সময়, সুস্বাদুতম খাদ্য আস্বাদনে কিংবা বান্ধবী সংসর্গেও সেরকমটি হয় না। ওই সব লেখালেখি করে কী লাভ, তা জানি না, তবে সবচেয়ে বেশি আনন্দ যে পাও, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ওইটুকু আনন্দ নিয়েই জীবন কাটানো উচিত। কী, কী বলতে চাইছ, এখানে থেকেও লেখালেখি করা যায়? মূর্খ, যদি বাংলাতেই লিখতে চাও, তা হলে ফিরে যেতে হবে তোমার নিজের মাটিতে, যেখানে তোমার শিকড়, যেখানকার মানুষ তোমার ভাষায় কথা বলে, যে ভাষার অবিরাম বদল চলে সূক্ষ্মভাবে।

সেই দুপুরবেলাই আমার চরম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। একথা তো ঠিকই, একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারলে যে-রকম রোমাঞ্চ হয়, কোনও কিছুর সঙ্গেই তার তুলনা চলে না। বাংলা ভাষায় লিখতে হলে যেতেই হবে বাংলার পরিমণ্ডলে। অমিয় চক্রবর্তীর মতন প্রখ্যাত কবি বহুদিন আমেরিকাবাসী, তাঁর বিদেশিনী স্ত্রী, এখনও কবিতা লিখছেন, কিন্তু ইদানীংকার কবিতাগুলি নিরামিষ মনে হয় না? ভাব চমৎকার, কিন্তু ভাষায় যেন দাঁত নেই। কিংবা গুরু আছে, চণ্ডাল নেই। সাহিত্যের ভাষায় ওদুটিকে মেলাতেই হয়।

আমার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাহিত্যিক উচ্চাকাঙক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই। নিজের সম্পর্কে আমি কোনও ভুল ধারণা পোষণ করি না। আমি খুব ভালোভাবেই জানি, আমি লেখা বন্ধ করে দিলে বাংলা সাহিত্যের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না, কিছু বন্ধুবান্ধব ছাড়া কেউ লক্ষই করবে না। আমার মতন শত শত তরুণ কবিতা লেখার চেষ্টা করছে, তাদের মধ্যে অনেকেই হারিয়ে যায়, আমারই চেনা কয়েকজন ঝকঝকে ভাষা নিয়ে লিখতে এসেছিল, তারপর চলে গেছে ব্যস্ত জীবিকায়, সম্পর্ক ত্যাগ করেছে সাহিত্যের সঙ্গে। ক্রিকেট খেলায় বলে, দে অলসো র‍্যান, শারদীয় সংখ্যার সূচিপত্রে কয়েকজন কবির নামের পরে থাকে ইত্যাদি (এখন লেখা হয় প্রমুখ)। আমি কিছুদিন হয়তো ওই ইত্যাদির দলে থেকে তারপর হারিয়ে যাব দেশে ফিরে, তাতেও কিছু যায় আসে না, আপাতত আমার লেখালেখির বাসনা প্রবল, সে লেখা সার্থক হোক বা না হোক, রোমাঞ্চটাই সবচেয়ে উপভোগ্য। তা ছাড়া দেশে ফিরে গেলে যে অনিশ্চয়তার ঝুঁকি আছে, সেটাও যেন চ্যালেঞ্জের মতন, এর আগেও তো অনেক ঝুঁকি নিয়েছি, আমার মধ্যে খানিকটা জুয়াড়ি প্রবৃত্তি তো রয়েছেই, মৃত্যুর সঙ্গেও জুয়া খেলিনি কি?

ফ্রিজ খুলে দেখলাম, নানাবিধ মাংস ও অন্যান্য সুখাদ্য রয়েছে। কাবার্ডে অনেক রকম সুরার বোতল সাজানো, ঘরে ছড়িয়ে আছে মার্গারিটের ব্যবহার্য নানারকম জিনিসপত্র, সে সবের দিকে তাকিয়েও আমার মন দুর্বল হল না, বরং সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার জন্য শরীরটা বেশ হালকা বোধ হল।

যুক্তির চেয়েও আবেগ অনেক সময়ই প্রবল হয়। আমার এই মন ঠিক করাও আবেগের ব্যাপার। আবেগও নানারকম হয়, অন্য এক ধরনের আবেগের কেন্দ্রে রয়েছে মার্গারিট নামের তরুণীটি। সে তখন ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়েছিল একটা সেমিনারে যোগ দিতে। দু’দিন বাদেই ফিরে এল আমার জন্য রোজে ওয়াইনের বোতল নিয়ে। যাবার আগে সে জেনে গিয়েছিল, আমি লাইব্রেরির চাকরি নিচ্ছি, এবং তাতে আমাদের দুজনেরই কত সুবিধে হবে, তা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। সন্ধেবেলা দু’জনে মুখোমুখি বসে রেকর্ড প্লেয়ারে গান শুনতে শুনতে কয়েক পাত্র সেই নরম সুরা পান করার পর আমি তাকে চরম সংবাদটি জানালাম। ফরাসি মেয়েদের হর্ষ, বিষাদ, বিস্ময়, অভিমান ইত্যাদির অভিব্যক্তি খুব স্পষ্টভাবে মুখমণ্ডলে বা কণ্ঠস্বরে ফুটে ওঠে। প্রথমে বিস্ময়ে তার ভুরু উঠে গেল কপালে, অবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে লাগল যে এটা আমার ঠাট্টা। তারপর চেঁচামেচি, না, না, এ হতেই পারে না, কিছুতেই যাবে না ইত্যাদি। হঠাৎ চুপ করে গেল একসময়। আর কোনও কারণে নয়, আমি যে শুধু কবিতা লেখার জন্যই ফিরে যাচ্ছি, এটা কয়েকবার শোনার পর সে শান্তভাবে বলল, তা হলে তো তোমায় যেতেই হবে। এখানে থাকার জন্য যদি তোমার লেখা বন্ধ হয়ে যায়, তাতে আমারই পাপ হবে, আমি তো তুচ্ছ একটা মেয়ে, কিন্তু কবিতা বিশ্বজনীন।

আমার পক্ষে আর কোনওদিনই হয়তো আমেরিকায় যাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু মার্গারিট কলকাতায় আসতে পারে অনায়াসে। সে ফরাসি কনসুলেটে চাকরি নেবে, কিংবা আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজে পড়াবে। তা তো হতেই পারে, আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজে অল্প কিছুদিন পড়ার সময় আমি ফ্রান্স থেকে সদ্য-আসা তরুণী শিক্ষিকা দেখেছি। মার্গারিটকে অবশ্য দু’-আড়াই বছর অপেক্ষা করতে হবে, তার পি এইচ ডি থিসিস শেষ করার জন্য।

সিদ্ধান্তটা পল এঙ্গেলকে জানানো আরও কঠিন হয়েছিল। তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বারবার অবুঝের মতন বলতে লাগলেন, বাট হোয়াই? বাট হোয়াই? তিনি জানতেন, আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি, দেখেছেন আমাদের পারিবারিক অবস্থা। এখানকার নিশ্চিত চাকরির নিরাপত্তা ছেড়ে কেন আমি অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছি, তা তাঁকে বোঝানো যায় না। এখানে বসেও তো লেখা যায়, এমনকী ইংরেজিতেও লেখার চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু আমার মত বদলের আর কোনও প্রশ্নই নেই।

শুরু হয়ে গেল বাক্স-প্যাঁটরা গোছাবার পালা। জিনিসপত্র জমে গিয়েছিল অনেক, একটা খুব সুদৃশ্য ইলেকট্রিক ইস্ত্রি কিনেছিলাম, তার অনেক রকম কায়দা, ভারতে সে রকম জিনিস তখনও আসেনি, মার্গারিট বলেছিল, এটা সঙ্গে নিয়ে যাও। আমি রাজি হইনি। অনেক রান্নার সরঞ্জাম, কম্বল, টেবল ল্যাম্প, মার্গারিট হস্টেলের ঘরে থাকে, তার এসব জিনিস রাখার জায়গা নেই, আমি সব বিলিয়ে দিলাম নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। কারণ আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আমার পক্ষে আর কোনওদিন বিদেশে আসার সুযোগ ঘটবে না, সুতরাং ফেরার পথে যে কটা দেশ সম্ভব দেখে যেতে হবে, বেশি মোটঘাট সঙ্গে রাখা চলবে না। একটা হালকা স্যুটকেসই ভ্রমণের পক্ষে প্রশস্ত। তা ছাড়া আমার মনে হয়েছিল, বন্যেরা যেমন বনে সুন্দর, সেই রকম এইসব বিদেশি জিনিসপত্র বিদেশেই মানায়। কলকাতায় আমাদের বাড়িতে ফ্রিজ নেই, টেলিফোন নেই, ওয়াশিং মেশিন তখন পর্যন্ত কেউ চোখেই দেখেনি। হঠাৎ একখানা ঝাঁচকচকে ইলেকট্রিক ইস্ত্রি রাখার কি মানে হয়? কিংবা কফি-মেকার? বরং ভারতীয় হয়ে কোনও আমেরিকানকে কিছু দান করলে তৃপ্তি হয়।

ফেরার দিন এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে এসে শেষ মুহূর্তেও পল এঙ্গেল আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, সুনীল, এখনও ভেবে দেখো, এখনও অন্য ব্যবস্থা করা যায়। যদি আর একটা বছরও থেকে ধীরে সুস্থে কলকাতায় চিঠি লিখে কোনও চাকরির জোগাড় করতে পারো, আমিও কিছু সাহায্য করতে পারি…।

আমার জন্য একজন মানুষ এমন আন্তরিকভাবে ব্যাকুলতা প্রকাশ করছেন দেখলে চোখে জল আসবে না?

আয়ওয়া থেকে নিউ ইয়র্কে এসে অ্যালেন গিন্‌সবার্গের সঙ্গে কাটালাম কয়েকটি দিন। সেই দিনগুলির বিবরণ ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে লেখা হয়েছে। অ্যালেন অবশ্য আমার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত সমর্থনই করেছিল।

তারপর আকাশে উড়ে আটলান্টিক পেরিয়ে ইউরোপে। প্রথমে লন্ডন। কলকাতার ব্রিটিশ কাউনসিল থেকে আগেই আমাকে সংস্কৃতি বিনিময় ব্যবস্থায় ইংল্যান্ডে আতিথ্য দেবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমার হোটেল থেকে কয়েক পা গেলেই হাইড পার্ক। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রথমেই মনে হয়েছিল এই তা হলে সেই হাইড পার্ক, যার কথা কতবার কত বইতে পড়েছি। লন্ডনের বহু রাস্তা দ্রষ্টব্য স্থানের কথা আমাদের ছোটবেলা থেকেই মুখস্থ। পরাধীন আমলে বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হত ব্রিটিশ ইতিহাস, কোনও কোনও জায়গা স্বচক্ষে দেখে বেশ হতাশই হয়েছি। লন্ডনে আমার বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত কেউই ছিল না, সেজন্য দিনগুলি কাটাতে হয়েছে ইংরেজদের সাহচর্যে।

নিউ ইয়র্কে থাকার সময় একদিন দেখা হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী সালভাদর দালি’র সঙ্গে, অ্যালেনের সঙ্গে আমাকেও বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে কফি খাইয়েছিলেন নিজের হাতে বানিয়ে। সালভাদর দালি নিজের নামে কয়েকটি বারো-চোদ্দো মিনিটের ছোট ফিল্মও বানিয়েছিলেন, সেগুলির কিছু অংশ অ্যানিমেটেড। তার একটি দেখালেন আমাদের। ওরকম শিল্পসম্মত, কৌতুকময় চুড়ান্ত পর্নোগ্রাফি আমি আর কখনও দেখিনি। লন্ডনে এসে দেখা হল টি এস এলিয়ট এবং স্টিফেন স্পেন্ডারের সঙ্গে। এলিয়ট সাক্ষাৎকারের স্থান দিয়েছিলেন ফেবার অ্যান্ড ফেবার নামে প্রকাশনা সংস্থায় তাঁর নিজের ছোট্ট ঘরে। স্পেন্ডার নিজে এসেছিলেন আমার হোটেলে, অনেক রাতে, পরদিন দুপুরে তিনি আমার লাঞ্চ খাওয়াবার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারবেন না। বিশেষ কাজ পড়ে গেছে, সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে। টেলিফোনে সে কথা জানালেই যথেষ্ট ছিল, তবু যে নিজে এলেন, সেটাই ব্রিটিশ ভদ্রতা।

লন্ডন থেকে প্যারিসে, সেখানে আমার জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল মার্গারিট। সেসব দিনের কথাও লেখা হয়ে গেছে পূর্বোক্ত গ্রন্থে।

জুরিখে ছিল আমার বাল্যবন্ধু বিমান মল্লিক। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সুইজারল্যান্ড দেখা হয়ে গেল কিছুটা। কিছু টাকা আমি জমিয়ে এনেছি, কিন্তু হোটেলে থাকার সামর্থ্য নেই, সেইজন্যই বিমান ভাড়া না লাগলেও জার্মান কিংবা স্পেনে যাওয়া হল না, পরিচিত কেউ নেই বলে। তবে ঠিক করে রেখেছিলাম, জন্মের মধ্যে একবার যখন সুযোগ পেয়েছি, রোম আর ইজিপ্ট দেখে যেতেই হবে যে-কোনও উপায়ে। প্রাচীন ইতিহাস আমাকে দারুণভাবে টানে। রোম এবং কায়রো, এই দু’শহরেই আমাকে সস্তার হোটেল খুঁজে উঠতে হয়েছিল। সেসব ভ্রমণ বিবরণী এখানে অবান্তর হয়ে যাবে, তবে দুটি প্রশ্নের কথা আমার আজও মনে আছে।

কায়রোর হোটেলের ডাইনিংরুমে আমার পাশের এক ব্যক্তি আমাকে ভারতীয় বলে চিনতে পেরে ভাব জমিয়েছিলেন। ইজিপ্টের অনেক জায়গায়, পিরামিড দেখতে গিয়েও ভারতীয় পরিচয়ের জন্য বিশেষ খাতির পেয়েছি। তখন এই রকম অবস্থা ছিল। হোটেলের সেই ব্যক্তিটি বেশ পণ্ডিত, তিনি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনেছেন, তিনি কথায় কথায় বললেন, সুনীতিবাবুকে একটা প্রশ্ন করে উত্তরটা যদি জানাও, তা হলে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমরা মুসলমানরা আল্লাহকে মানি, আল্লার একটিই নাম, কিন্তু তোমাদের ভারতে ‘খোদা’ শব্দটিও চলে। এই শব্দটি কোথা থেকে এল? আমরা খোদা ব্যবহার করি না, ভারতীয় মুসলমানেরা (এবং পাকিস্তানিরা) ব্যবহার করে কেন? সুনীতিকুমার জীবিত ছিলেন আমি ফিরে আসার পরেও আরও কিছুদিন, কিন্তু তাঁকে এ-প্রশ্ন করার সুযোগ আমি পাইনি। আর লন্ডনে কথায় কথায় টি এস এলিয়ট জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমাদের যে ট্রিনিটি, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এঁদের মধ্যে বিষ্ণু ও মহেশ্বর অর্থাৎ শিবের প্রচুর ভক্ত। সারা ভারতে বিষ্ণু ও শিব মন্দির অসংখ্য কিন্তু সমান শক্তিসম্পন্ন হয়েও ব্রহ্মার মন্দির মাত্র এক-আধটি, তার ভক্ত সম্প্রদায়ই বা হয়নি কেন? কেন ব্রহ্মা সম্পর্কে এরকম হেলাফেলা?

এ প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর আমাকে কেউ দিতে পারেনি। পরে অবশ্য কিছু কিছু কাহিনী শুনেছি। মহাদেবের জ্যোতির্লিঙ্গের আদি-অন্ত নিরূপণ করতে হয়েছিল ব্রহ্মাকে। তিনি শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে পারেননি সেই বিশালত্বের কাছে, তাই মিথ্যা মিথ্যাভাষ করেছিলেন। সেই জন্য মহাদেবের অভিশাপে তাঁর পূজা পাবার অধিকার বন্ধ হয়ে যায়। এ কাহিনীটি বড়ই স্হূল, কারণ সমপর্যায়ের দেবতা হয়েও ব্রহ্মাকে কেন শিবলিঙ্গ পরিমাপ করতে বলা হবে, এবং এ ক্ষেত্রে অভিশাপও অধিকার বহির্ভূত। অন্য দুটি কাহিনীতে আবার অভিশাপ দিয়েছেন দুই নারী, মোহিনী নাম্নী এক স্বর্গবেশ্যা ব্রহ্মাকে কামনা করে প্রত্যাখ্যাত হন এবং তাঁর পূজা লোপের অভিশাপ দিয়ে প্রতিশোধ নেন। অন্যটিতে ব্রহ্মা যজ্ঞ সম্প্রদানে বসে সাবিত্রীকে আহ্বান করেন, কিন্তু ট্র্যাফিক জ্যাম অন্য যে কোনও কারণেই হোক সাবিত্রী ঠিক এসে পৌঁছোতে পারেননি। বিরক্ত হয়ে ব্রহ্মা গায়ত্রী নামে গোপকন্যাকে সহধর্মিণী হিসেবে বরণ করে নিয়ে যজ্ঞ সমাপন করেন। দেরি করে পৌঁছে ক্ষমা চাওয়ার বদলে ক্রুদ্ধ সাবিত্রী ব্রহ্মাকেই শাপ দেন, সেই পূজা লোপ। অভিশাপ এত শস্তা?

এসব কাহিনীগুলির গভীরতা বড়ই কম। মনে হয় ব্রহ্মার কোনও রোমান্টিক ইমেজ গড়ে ওঠেনি, তাঁর কল্পিত চেহারাটাও প্রেমিক হবার যোগ্য নয়, বরং ভয়াবহ। শিব ও বিষ্ণুর নায়কোচিত রূপ এবং তাঁরা আকর্ষণীয় কাহিনীর মধ্যমণি বলেই তাঁদের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ে, ব্রহ্মা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

যাই হোক, এসব অকিঞ্চিৎকর কারণগুলি টি এস এলিয়টকে লিখে জানাবার উপযুক্ত নয়। আর টি এস এলিয়টও এর পরে বেঁচে ছিলেন মাত্র পাঁচ মাস।

কায়রো থেকে আমার ইস্তানবুল ও বাগদাদ যাবার বাসনা ছিল, হোটেলের ঘরে একদিন হিসেব করে দেখি, আমার পকেট শুধু খুচরো পয়সায় ভর্তি, এ হোটেলের বিলও মেটানো যাবে কি না কে জানে! সুতরাং আর কোথাও বেড়ানো যাবে না, এবার বাড়ি ফেরার পালা। কোনওক্রমে কায়রোর হোটেলের বিল মিটিয়ে হাতে রইল দু’ডলার, অর্থাৎ দশ টাকা। এবারে চেপে বসলাম দমদমের প্লেনে।

আমার ফেরার দিনটি কারওকে জানানো হয়ে ওঠেনি, তাই বন্ধু-বান্ধব কিংবা আত্মীয়স্বজন কেউ যায়নি এয়ারপোর্টে। ইচ্ছে করে, খুবই ইচ্ছে করে সে সময় একটা চেনা মুখ দেখতে। কত লোক অন্যদের উদ্দেশে হাতছানি দিচ্ছে, হাসছে, নাম ধরে ডাকছে, আমি যেন এসেছি এক অচেনা দেশে, আমাকে কেউ চেনে না। সুটকেস হাতে এসে দাঁড়ালাম বাইরে, নিশ্বাস নিলাম বুক ভরে, এ বাতাস অন্তত চেনা।

পকেটে দশ টাকা থাকতে কে আর ট্যাক্সি নেয়! বাড়ি বেশি দূরেও নয়। চেপে বসলাম একটা সাইকেল রিকশায়। নাগেরবাজারের মোড় পেরিয়ে মনে হল, এ পর্যন্ত কোনও কিছুরই তো বদল দেখলাম না। আমিও কি কিছু বদলেছি?

বিয়াল্লিশ

কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের সিঁড়ির মুখে প্রতিদিন সিগারেট বিক্রি করে ইসমাইল, সে আমাকে দেখে একটা ছোট্ট স্মাইল দিয়ে জিজ্ঞেস করল, অনেকদিন আসোনি, কোথায় ছিলে? আমি তার একজন বিশিষ্ট ক্রেতা, কারণ ধারে কিনতে পারি, সুতরাং সে তো আমাকে মনে রাখবেই। মার্কিন দেশে আমার ব্র্যান্ড ছিল লাকি স্ট্রাইক, ফরাসি দেশে গোলোয়াজ, কলকাতায় আবার ফিরে এলাম চারমিনারে। একটা সিগারেট ধরিয়ে, যেন গতকালই আমি এখানে আড্ডা দিয়ে গেছি, সেই ভঙ্গিতে ঢুকলাম দোতলার হলে। আমার ফেরার খবর প্রায় কারওরই জানা ছিল না। দু’ তিনটি টেবিল থেকে সহর্ষ বিস্ময়ে স্বাগতম জানাল বন্ধুরা। শংকর চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বরই সবচেয়ে জোরালো। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর গালের রং দেখছি কমলালেবুর মতন হয়ে গেছে (সত্যি নয়, বড় জোর বেগুনি হতে পারে), চুলের ছাঁট ক্রু-কাট করেছিস কেন, এই লাল জামাটা আমাকে একদিন দিস, পরে দেখব। তখন শ্যামল আর আমার শরীরের গড়ন প্রায় এক রকম, যদিও শ্যামল অনেক বেশি সুপুরুষ। দু’জনের পদবি এক হওয়ায় শ্যামল অনেক জায়গায় বলত, আমরা দুই ভাই, আমাদের ঠাকুরদার নাম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (স্বর্ণলতা’র লেখক), আমাদের বাবা উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (শরৎচন্দ্রের মামা ও ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার সম্পাদক), আর নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের কাকা! জমজমাট কফি হাউসে চেয়ারের খুব অভাব, অনেক দূরের টেবিল থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে বসলাম এবং বলা যেতে পারে, ঝাঁকে মিশে গেলাম।

খানিক বাদেই প্রস্তাব উঠল, খালাসিটোলায় যাওয়া হোক, সেখানে পাওয়া যাবে কমলকুমার মজুমদারকে।

বন্ধুদের দলে সাবলীলভাবে মিশে থাকা সম্পূর্ণ অচেনা একজনকে দেখলাম, তার নাম বেলাল চৌধুরী। সম্পূর্ণ মেদহীন সুগঠিত শরীর, ফর্সা রং, নিস্পাপ, সুকুমার মুখখানিতে ঈষৎ মঙ্গোলীয় ছাপ। এই নিরীহ যুবকটি সম্পর্কে অনেক রোমহর্ষক কাহিনী (হয়তো পুরোটা সত্যি নয়, সব রোমহর্ষক কাহিনীই তো সত্যি-মিথ্যে-গুজব মিশ্রিত হয়ে থাকে) শোনা গেল। তার বাড়ি পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে, পেশা কুমির ধরা। একটা কুমির-শিকারি জাহাজে অনেক সাগর-উপসাগর পাড়ি দিতে দিতে সে হঠাৎ খিদিরপুরে এসে জাহাজ থেকে নেমে পড়েছে এবং পাসপোর্টটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মিশে গেছে কলকাতার জনারণ্যে। এবং সে একজন কবি, তাই জল যেমন জলকে টানে, সেইভাবে সে যুক্ত হয়ে গেছে কফি হাউসের কবির দঙ্গলে। পাকিস্তানের সঙ্গে তখন ভারতের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে দিনকে দিন, কয়েক মাস পরেই শুরু হবে একটি বালখিল্যসুলভ যুদ্ধ, সেরকম আবহাওয়ায় পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও সহায়সম্বলহীন অবস্থায় কলকাতায় বিচরণ করার জন্য প্রচণ্ড মনের জোর ও সাহসের দরকার। অবশ্য বেলালের একটা দারুণ সম্পদ ছিল, সেটা তার মুখের হাসি এবং সহজ আন্তরিকতায় মানুষকে আপন করে নেবার ক্ষমতা। পরে অনেকবার দেখেছি, যে-কোনও বাড়িতে গেলে সে পরিবারের বাচ্চা ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বুড়ো বুড়িরা পর্যন্ত কিছুক্ষণের মধ্যেই বেলালকে ভালোবেসে ফেলে। এর মধ্যে সে কমলদারও খুব চেলা হয়ে গেছে, দুজন অসমবয়সি মানুষের এমন গাঢ় বন্ধুত্বও দুর্লভ।

বেলালের মতন মানুষদের কোনও একটা বিশেষ দেশের সীমানায় গণ্ডিবদ্ধ করা যায় না, এরা সারা পৃথিবীর নাগরিক। বাউণ্ডুলেপনায় বেলাল শক্তিকেও অনেকখানি হার মানিয়ে দিয়েছিল।

বেলালের সঙ্গে পরে অনেকবার অনেক রকম রোমহর্ষক অভিযান করা গেছে, কিন্তু আলাপের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাটি চিরস্মরণীয়। হল কী, খালাসিটোলায় অত্যুৎসাহে বন্ধুদের সঙ্গে মেতে থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। বছর খানেক ধরে উত্তম স্কচ, বার্বন ও ফরাসি ওয়াইন পান করে আমার অভ্যেস খারাপ হয়ে গিয়েছিল, বাংলা মদের মতন অতি উপাদেয় পানীয় আমার সহ্য হল না, কোন মুহূর্তে যে চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পেল তা টেরও পাইনি। তখন আমার সেই জড় দেহ নিয়ে বন্ধুরা খুবই মুশকিলে পড়েছিল, তাদের তখনও ভালো করে নেশাই জমেনি, বেশি রাতও হয়নি।

আমার জ্ঞান ফিরে এল ভোরবেলা। চোখ মেলে প্রথমে বুঝতেই পারলাম না, কোথায় শুয়ে আছি। রাস্তাঘাটে নয়, শ্মশানে-মশানে, হট্টমন্দিরে নয়, একটা ঘরেই, সেরকম ঘরও কখনও দেখিনি। চ্যাঁচার বেড়া, ওপরে টিনের চাল, ঘরখানা এমনই ছোট যে মাঝখানে একটা তক্তপোশ ছাড়া আর নড়াচড়ার জায়গাই নেই বলতে গেলে। আমার পরনে সোয়েটার-প্যান্ট-শার্ট-জুতো সবই আছে, এখানে এলাম কী করে বা কার সঙ্গে, তা কিছুই মনে নেই। চিৎ হয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম একটুক্ষণ, পিঠে কীসের জন্য খোঁচা লাগছে, চাদরের তলায় হাত ঢুকিয়ে দেখি, একটা মোটা বই। সে বইটা টেনে সরাতেই সেদিকটা নিচু হয়ে গেল, তারপর ধড়মড় করে উঠে দেখি, তোশক বলতে কিছুই নেই, একটা কাঠের চৌকির ওপর নানান আকারের সাজানো বইয়ের ওপর চাদর পাতা। আমি এতগুলি বইয়ের ওপর রাত কাটিয়েছি? এটা কার ঘর, জায়গাটাই বা কোথায়? বাইরে যেন কাদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, সবই নারীকণ্ঠ, কান পেতে শুনলাম, কী নিয়ে যেন ঝগড়া চলছে, তার মধ্যে অনেক অশ্লীল গালিগালাজ, তার অধিকাংশই পুরুষদের পক্ষে প্রযোজ্য, অর্থাৎ পুরুষরা প্রতিপক্ষের মা-বোন সম্পর্কে যেসব কুপ্রস্তাব করে, মেয়েরাই বলছে সেইসব। দরজাটাও চাটাই ও কঞ্চির, টেনে খুলতে গেলে একটুখানি ফাঁক হল মাত্র, বাইরে থেকে তালাবন্ধ। ফাঁক দিয়ে দেখে মনে হল, বাইরেটা একটা কবরখানা, মাঝে মাঝে বাটনাবাটা শিলের মতন পাথর বসানো।

মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে ভাববার চেষ্টা করলাম, সবটাই কি দুঃস্বপ্ন? এটা বাস্তব হতেই পারে না। মাত্র ক’দিন আগেই আমি ছিলাম আমেরিকায়, সে ঘরের তিনদিকেই জানলা। আমার বিছানার গদিটি ছিল পালক ভরা, আর কাল রাতে আমি শুয়েছি তোশকহীন তক্তপোশে, উঁচু-নিচু বইয়ের ওপর, চ্যাঁচার বেড়ায় জানলাহীন ঘর, পরিবেশ কবরখানা, স্ত্রীলোকেরা গালাগালি বিনিময় করছে পুরুষদের ভাষায়, দরজায় তালা বন্ধ, এটা একটা সুররিয়াল দৃশ্য, এটা কারও অবচেতনের সৃষ্টি, আমি সেখানে একটা চরিত্র হয়ে গেছি। পাখি নয়, শুনছি শুধু চিলের ডাক, এরকম দৃশ্যে এমন আবহসঙ্গীতই মানায়। এখন আমার বসে বসে বইগুলি পড়া উচিত? আস্তে আস্তে মাথা পরিষ্কার হতেই পেটে খিদের কামড় টের পাই। নিশ্চিত কাল বিকেলের পর কিছু খাওয়া হয়নি, খালাসিটোলায় আদা আর ছোলা, কমলদার পরিহাসময় মুখ, এ ছাড়া আর কিছু মনে পড়ে না। এরকম চেতনা হারানো, এরকম অ্যামনেশিয়া আমার প্রথম হল। যে-ই আমাকে এখানে আনুক, দরজায় তালা লাগিয়ে রেখেছে কেন। দরজাটা ধরে ঝাঁকালাম কয়েকবার। কার নাম ধরে ডাকব জানি না। এখানে কে আছে, দরজা খুলে দাও, দরজা খুলে দাও! আমার চিৎকারে স্ত্রীলোকদের ঝগড়া স্তব্ধ হয়ে গেল, কয়েকজন উঁকিঝুকি মারল দরজার কাছে এসে। এই দৃশ্যটাও অলীক মনে হয়, একটা অচেনা স্থানে, অচেনা কারওর ঘরে আমি বন্দি, বাইরে কয়েকজন রমণী কৌতূহলী চোখে দেখছে। তারা কেউ এই বন্দিই আমার প্রাণেশ্বর’ বলল না, দৃশ্যটির মধ্যে রোমান্টিকতার ছিটেফোঁটাও নেই, রমণীরা কেউ সুন্দরী তো নয়ই, যুবতীও নয়, মধ্যবয়েসি দজ্জাল ধরনের, রমণী শব্দটাই এখানে প্রযোজ্য নয়, একজনের মুখ বন-বিড়ালের মতন, একজনের স্পষ্ট গোঁফ, একজনের হাতে একতাল গোবর। তাদের চোখে বিস্ময় নেই, কোনও মন্তব্যও করল না, একটু পরেই আবার সরে গেল দূরে।

অর্থাৎ আমাকে বন্দিই থাকতে হবে? কতক্ষণ? কী কী অপরাধ করেছি কাল রাতে? কিছু মনে করতে পারছি না বলে অপরাধবোধ আরও তীব্র হয়। অজ্ঞাত অন্যায়ের জন্য অনুশোচনায় সিরসির করে সর্বাঙ্গ। কাল রাতে বাড়ি ফিরিনি, বাড়িতে খবর দেবারও উপায় নেই, তখন টেলিফোনের এত চল ছিল না, মা দারুণ দুশ্চিন্তা করছেন, এটা ভেবেও লজ্জা-পরিতাপে অবশ লাগে। ঘরটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, বই ছাড়া আর প্রায় কিছুই নেই, এখন এরকম অবস্থায় কি বই পড়ে সময় কাটানো যায়? একটা বাঁশি থাকলেও না হয় সান্ত্বনা পাওয়া যেত, একজন বন্দি-মানুষ বাঁশির সুরে মগ্ন হয়ে আছে, এ দৃশ্যটাও এখানে মানিয়ে যায়।

ইচ্ছে করলে লাথি মেরে মেরে ভেঙে ফেলা যায় চ্যাঁচার বেড়ার দেওয়াল। কিন্তু কার ঘর আমি ভাঙব? দরজাটাও তেমন মজবুত নয়, টানাটানি করে সেটা ওপরের দিকে খানিকটা তোলা যায়, তলায় খানিকটা ফাঁক হয়। আমি মাটিতে শুয়ে পড়ে, গড়িয়ে গড়িয়ে দরজার তলা দিয়ে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করলাম বেশ কিছুক্ষণ ধরে, পিঠ ও হাত-পা ছড়ে গেল, দরজাটা পটপট শব্দে হেলে পড়ল এক দিকে, তারই মধ্যে কোনওক্রমে নিষ্ক্রান্ত হওয়া গেল। মুক্তি, মুক্তি! একজন বেশ ভালো, বিলিতি জামা কাপড় পরা মানুষ যাকে এখানকার কেউ আগে দেখেনি, সে কেন সারা রাত এই একটা ঘরে তালাবন্ধ ছিল, কেনই বা সে দরজা প্রায় ভেঙে বেরিয়ে এল, তা নিয়ে পূর্বোক্ত স্ত্রীলোকেরা কোনও প্রশ্ন করল না, ভ্রূক্ষেপও করল না। জায়গাটা একটা কবরখানাই বটে, এক দিকে বাঁশ ও দর্মার বেড়া দেওয়া এরকম আরও কয়েকখানা ঘর রয়েছে, মনে হয় জবরদখল। আরও খানিকটা জমি দখল করার বিবাদে সেই স্ত্রীলোকেরা প্রমত্ত বলেই মনে হল।

এ কবরখানা আগে দেখিনি, জায়গাটা কোথায়, তাও বুঝতে পারছি না। কলকাতা শহরটা আমি তন্ন তন্ন করে চিনি, আগে আমার এ-রকম শ্লাঘা ছিল, মাত্র এক বছরের প্রবাসে এমন বিভ্রম হয়ে গেল? সে কবরখানার বাইরে এসেও অচেনা মনে হচ্ছে অঞ্চলটি, পথ-ঘাটে মানুষজন প্রায় নেই-ই বলতে গেলে, গাড়ি-ঘোড়াও ক্কচিৎ। একটুক্ষণ উদভ্রান্তের মতন আধা দৌড়োবার পর হঠাৎ দেখতে পেলাম, একটা বাড়ির গায়ে লেখা রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল হস্টেল। আমার চমক লাগল, এ বাড়িটি তো আমার চেনা। আগে কয়েকবার এসেছি। শুধু তাই নয়, এ হস্টেলের সুপার আমাদের অতি প্রিয় ছোটকুদা। কবি ও সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সত্যপ্রসন্ন দত্ত, সবাই বলত, ওঁরা দু’জন হরিহর আত্মা। ইনি সেই সত্যপ্রসন্ন দত্তের ছোট ভাই, আমরা ছোটকুদা বলেই ডাকতাম, অতিশয় নরম মনের মানুষ, কলেজ স্ট্রিটে দৈবাৎ তাঁর দেখা পেলে আমাদের মধ্যে উল্লাসের স্রোত বয়ে যেত, শক্তি ওঁকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলত, ছোটকুদা, পনেরোটা টাকা দাও না, খুব খিদে পেয়েছে। ছোটকুদা কৃত্রিম ধমক দিয়ে বলতেন, না মোটেই খিদে পায়নি, টাকা নিয়ে তোমরা আজেবাজে জিনিস খাবে! শেষ পর্যন্ত দিয়েও দিতেন।

সেই প্রাতঃকালে ইন্টারন্যাশনাল হস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে হল, এখন ছোটকুদা হতে পারেন আমার ত্রাণকর্তা। কারণ, তখন আমি অন্য একটা সমস্যা নিয়ে দারুণ চিন্তিত। কবরখানা থেকে বেরিয়েই নজর করেছি যে, আমার প্যান্টের একটা পায়ের পেছন দিকে অনেকখানি ছিড়ে গিয়ে ঝুলছে, বেশ খারাপ জায়গায় ছেঁড়া, দেখা যাবেই। সেটা আগের রাত্রেই কখনও হয়েছে, কিংবা দরজার তলা দিয়ে বেরিয়ে আসবার সময়, তা কে জানে। আমার বিদেশি দামি প্যান্ট ছেঁড়ার আফসোসের চেয়েও বড় কথা, এই অবস্থায় আমি বাড়ি ফিরব কী করে? আগের রাত্রে না ফেরার জন্য কোনও মুমূর্মু বন্ধু সম্পর্কে করুণ কাহিনী না হয় বানানো যায়, কিন্তু এতখানি ছেড়া প্যান্টের কী ব্যাখ্যা হতে পারে?

দারোয়ানকে প্রায় ঠেলেই আমি উঠে গেলাম সুপারিনটেনডেন্টের কোয়ার্টারের দোতলায়। ঘড়ি পরার অভ্যেস আমি আগেই ছেড়ে দিয়েছি, ঘুম ভাঙার পর এত কাণ্ড করার পর আমার খেয়ালই হয়নি যে এখন মাত্র পৌনে ছটা বাজে, ছাত্ররাই কেউ জাগেনি, সুপারের এত তাড়াতাড়ি জেগে ওঠার কী দায় পড়েছে। আমার ডাকাডাকিতে ছোটকুদা চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। এরপর আমি যে কাণ্ডটা করলাম, সেটাও প্রায় সুররিয়ালিস্টিকই বলা যেতে পারে। তখন আমার চিন্তা সম্পূর্ণ একমুখী, ছেঁড়া প্যান্ট! ছোটকুদা জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার হে, এত সকালে? এদিকে কোথায় এসেছিলে? এর উত্তরে ভদ্রতাসূচক যে সব ভণিতা করা উচিত ছিল তা ভুলে গিয়ে আমি ব্যগ্রভাবে বললাম, ছোটকুদা, একটু সূচ-সুতো দিতে পারেন?

ছোটকুদা প্রথমে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, কী কইলা? কী চাইলা? আমি একইভাবে বললাম সূচ-সুতো। এই দেখুন প্যান্টটা ছিড়ে গেছে, সেলাই করতে হবে।

ছোটকুদা হতভম্বের মতন তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তাঁরও তো ঘুমের ঘোর কাটতে কিছুটা সময় লাগবে! কিন্তু তিনি জানতেও চাইলেন না, প্যান্টটা অমনভাবে কী করে ছিড়ল বা কোথা থেকে এসেছি আমি৷ হেসে বললেন, ঠিক আছে। বসো, আগে চা খাও। গরম গরম ফিস ফ্রাই খাবে। আমাদের কুক খুব ভালো ফিস ফ্রাই বানায়। আর প্যান্টটা ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে একটা তোয়ালে জড়িয়ে এস। সেলাইয়ের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

এবারে আমার হতভম্ব হবার পালা। এত সকালে ফিস ফ্রাই? কী হচ্ছে আজ ভোর থেকে? সবই অলীক, সবই অবাস্তব। জিজ্ঞেস করলাম, ছোটকুদা, আপনি চায়ের সঙ্গে ফিস ফ্রাই খান? তিনি বললেন হ্যাঁ, বললাম না, আমাদের কুক খুব ভালো বানায়, আগের রাত থেকে ম্যারিনেট করে রাখে।

সকালে প্রথম কাপ চায়ের সঙ্গে ফিস ফ্রাই খায়, এমন মানুষ কি ভূ-ভারতে আর দ্বিতীয়টি আছে? ছোটকুদা কি এই পৃথিবীর, না অন্য গ্রহের? কিংবা, এরকম কিছু কিছু মানুষ আছে বলেই। পৃথিবীটা এত বর্ণময়!

পরে জেনেছিলাম, আগের রাতে আমি অকস্মাৎ অচেতন এবং অসাড়-শরীর হয়ে যাবার ফলে বন্ধুরা খুব বিব্রত হয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য তারা যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমার নাগেরবাজারের বাড়ি অনেকেই চেনে না, তা ছাড়া ওই অবস্থায় ট্যাক্সিতে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই, তাতে অনেক ভাড়া। এরকম পরিস্থিতিতে কেউ কেউ দায়িত্ব এড়িয়ে সরে পড়ে, কেউ কেউ বুক দিয়ে আগলে রাখে। সেই প্রথম পরিচয়ের দিনেই বেলাল আমার দায়িত নিয়েছিল। তখন বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র উৎপলকুমার বসুই নিজের বাড়ি বিক্রি করে সাহেবি কায়দায় আধা সাহেব পাড়া রয়েড স্ট্রিটে একলা ফ্ল্যাটে থাকে, সেখানে অনেকেই হুল্লোড় শেষে রাত্রিযাপন করে। আমাকে সেখানেই শুইয়ে রাখা যেত, কিন্তু সিড়ি দিয়ে দোতলায় তোলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বেলাল আমাকে নিজের ঘরে রেখে আসে। বাইরে থেকে তালা দেবার কারণ, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার জ্ঞানও আমার ছিল না, দরজা খোলা রাখলে পাশের বস্তির ছেলেরা ভেতরে ঢুকে অনেক কিছু চুরি করে নিতে পারত। চুরি করার মতন সম্পদ বেলালের ঘরে প্রায় ছিলই না বই ছাড়া,তা কে আর নেবে! কিন্তু এ দেশের চোর-ডাকাতরা এমনই ছ্যাঁচড়া যে বেলালের চৌকির নীচে রাখা দু’-একখানা জামা কাপড় বা থালা-গেলাসও নিতে পারে, তা ছাড়া আমার গায়ের সায়েটারটা বেশ দামি। নেবার মতন কিছু না পেলে রাগের চোটে চোর-ডাকাতরা খুনও করে যায়!

জীবনে ওরকমভাবে অচৈতন্য আমি একবারই হয়েছি। পরের বহু বছর ধরে দেখেছি, ওরকম তুরীয় অবস্থায় পৌছবার অধিকার আসলে বেলালেরই একচেটিয়া। স্থান-কাল-পাত্র কিছুই সে গ্রাহ্য করে না। এমন অনেকবার দেখেছি, কোনও বাড়িতে সান্ধ্য আড্ডায় আমরা বেলালকে নিয়ে গেছি, হয়তো কোনও সম্ভ্রান্ত পরিবার, বেলালকে তারা আগে দেখেইনি৷ কিছুক্ষণ পানাহারের পর কথা বলতে বলতে বেলাল হঠাৎ অজ্ঞান এবং পাথর। তাকে বাধ্য হয়েই সেখানে শুইয়ে রেখে আমরা চলে গেছি, কিন্তু কোনও বাড়িতেই বেলাল সম্পর্কে সামান্যতম অভিযোগও শোনা যায়নি, বরং সেসব পরিবারের সঙ্গে বেলালের দীর্ঘস্থায়ী সুসম্পর্ক হয়ে গেছে। এবং তরুণীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা আমাদের কাছেও ঈর্ষণীয় ছিল।

অন্য দেশের নাগরিক হয়েও কলকাতার এক অজ্ঞাত কবরখানায়, জবরদখল জমির বাড়িতে, তাও কুড়ি-পঁচিশ টাকার ভাড়ায় বেলাল যে-ভাবে দিনযাপন করেছে তাতে মনে হয়েছে, এ ছেলে নিশ্চিত কোনও ছদ্মবেশী রাজকুমার। আমি সে রকমভাবেই বেলালকে গ্রহণ করেছি প্রথম দিন থেকে। এরকম বেপরোয়া সাহস আমার কোনওদিনই ছিল না। আমি নিজে যা পারি না, তা অন্য কারও সহজসাধ্য দেখলে আমার শ্রদ্ধা হয়।

কিছুদিন পর বেলাল ক্যামাক স্ট্রিটের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়ায় একটা ঘুপচি ঘর নিয়েছিল, সেখানেও চলত আমাদের তুমুল আড্ডা ও নানা রকম গোপন পরীক্ষা। সেসব কথা লেখার ভার রইল বেলালের ওপর।

দেশে ফেরার পর বেশ কিছু বন্ধুর উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেও বন্ধুত্বের ব্যাপারেই জীবনের প্রথম চরম আঘাতটাও পাই এই সময়। এর দু’-একদিনের মধ্যেই হাংরি জেনারেশানের সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সমীর কলেজ জীবন থেকেই আমার বন্ধু, চাইবাসা-ডাল্টনগঞ্জে তার বাড়িতে কত দিন ও রাত কাটিয়েছি, বন্ধুকৃত্যে সে অতি উদার, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকও সমীর। মলয়কেও চিনি তার ছোট বয়স থেকে। দু’জনেরই রচনা প্রকাশিত হয়েছে কৃত্তিবাস পত্রিকায়। হাংরি জেনারেশান আন্দোলন শুরু হয় আমার অনুপস্থিতিতে এবং অজ্ঞাতসারে। সেই সময়কার ইংল্যান্ডের আংরি ইয়ংমেন আর আমেরিকার বিট জেনারেশান, এই দুই আন্দোলনের ধারা মিলিয়ে সম্ভবত হাংরি আন্দোলনের চিন্তা দানা বেঁধেছিল, হয়তো অ্যালেন গিন্‌সবার্গের প্রেরণাও ছিল কিছুটা এবং মুখ্য ভূমিকা ছিল মলয়ের। এই নতুন আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে তৈরি হয়েছিল ইস্তাহার ইংরিজি বাংলা মিলিয়ে, আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যও ছিল এবং সে উদ্দেশ্য সফলও হয়েছিল কিছুটা, সাপ্তাহিক ‘টাইম ম্যাগাজিন ও আরও কিছু কিছু পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল কলকাতার এই অভিনব আন্দোলন সম্পর্কে।

শক্তি, সন্দীপন, উৎপলকুমার বসু প্রমুখ যারা কৃত্তিবাসের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত, তারাও প্রথম থেকে যোগ দিয়েছিল হাংরি আন্দোলনে। অর্থাৎ কৃত্তিবাসেরই একটা প্রধান অংশ নিয়ে এই আন্দোলন, কিন্তু আমাকে এ সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও জানানো হয়নি। আমার সমর্থন কিংবা বিমুখতার কোনও প্রশ্নই নেই, কেউ কিছু জিজ্ঞেসই করেনি আমাকে, প্রস্তুতিপর্ব চলছিল আমাকে গোপন করে। অকস্মাৎ একদিন ইস্তাহারটি হাতে পেয়ে আমি অনেকক্ষণ বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারিনি। যেসব বন্ধুদের সঙ্গে আমার প্রতিদিন ওঠা-বসা, তারা একটা নতুন কিছু করতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ আমাকে বাদ দিয়ে? এর কী কারণ থাকতে পারে, তা আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি। বন্ধুদের কাছে আমি অসহ্য হয়ে উঠেছি, কিংবা আমার হাতে নেতৃত্ব চলে যাওয়ার আশঙ্কা? একটা গভীর বেদনাবোধ আমি লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম।

একটা নতুন সাহিত্য আন্দোলন শুধু ইস্তাহার ও স্লোগান দিয়ে সার্থক করা যায় না। নতুন ধরনের লিখতে হয়। হাংরি-দলীয় কবি ও গদ্যকারগণ কিছু কিছু পরীক্ষা করছিলেন, আমি লক্ষ করছিলাম দূর থেকে, সেইসব নতুন ধরনের লেখার মধ্যে খুঁজেছি সাহিত্যমূল্য। হাংরি জেনারেশন এই ইংরিজি নামটি অবশ্য আমার কাছে অরুচিকর মনে হয়েছিল। অ্যালেন গিন্সবার্গকে আমি সমশ্রেণীর বন্ধু হিসেবেই গ্রহণ করেছিলাম, তার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা কিংবা তাকে অনুসরণ করার কথা কখনও আমার মনে আসেনি। সব ভাষারই আলাদা পরিমণ্ডল থাকে, সামাজিক অবস্থারও প্রতিফলন হয়। তার অনেক লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, সেও কিছু কিছু ব্যাপার শিখেছে আমাদের কাছ থেকে। আমেরিকায় সব ব্যাপার নিয়েই হুজুগ তৈরির চেষ্টা হয়। আমাদের দেশে সাহিত্যক্ষেত্রে তা দেখা হয় নিচু চোখে। লেখালেখি ছাড়াও হাংরি জেনারেশনের নামে কিছু কাণ্ড হতে লাগল৷ যেমন, কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির কাছে একটা করে মুখোশ পাঠিয়ে জানানো হল, এখন থেকে এই মুখোশ পরে থাকুন। একদিন একজন প্রখ্যাত লেখকের অফিসে ফোনে জানানো হল, আপনার ছেলে খুব অসুস্থ, শিগগির বাড়ি চলে যান! এগুলিকে কৌতুক বলা চলে না। সমর্থনও করা যায় না। যেহেতু হাংরি জেনারেশান নামের সঙ্গে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর অনেকেই জড়িত, তাই পত্রিকার এক সংখ্যায় আমাকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাতে হল যে হাংরি জেনারেশানের ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে কৃত্তিবাসের কোনও সম্পর্ক নেই।

বেশ কয়েক মাস প্রবলবেগেই চলেছিল হাংরি আন্দোলন, বেরিয়েছিল কয়েকটি পত্রিকা, তার পর তাদের ওপর পুলিশের হামলা হয়। আমার ফেরার কয়েকদিনের মধ্যেই কাকতালীয়ের মতন পুলিশ গ্রেফতার করে সমীর ও মলয়কে। তাতে কয়েকজন মনে করল, আমিই ওদের ধরিয়ে দিয়েছি। যেন, দমদমে পদার্পণ করেই আমি পুলিশ কমিশনারকে টেলিফোনে আদেশ করেছি, ওই কটাকে ধরে গারদে পুরুন তো! একজন আমাকে একটি কাতর চিঠি লিখে অনুরোধ জানাল, পুরনো বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করে আমি যেন ওদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করি।

এরকম অভিযোগে আমি নিদারুণ মর্মাহত হয়েছিলাম। মানুষ সবচেয়ে বেশি আঘাত পায়, যখন যে দোষ সে করেনি, সে বিষয়ে বিন্দুবিসর্গও জানে না, সেই দোষে অভিযুক্ত হয়। বিশেষত কোনও ঘনিষ্ঠজনের কাছ থেকে। আমেরিকা যাওয়ার জন্য আমার মান-মর্যাদা কি এতই বেড়ে গেছে যে পুলিশ কমিশনার আমার হুকুম মানবে? কে পুলিশ কমিশনার তাঁর নামও জানি না। এমনকী আমি পুলিশের কোনও দারোগাকেও চিনি না। আমি নিজের বন্ধু বা সমসাময়িক লেখকদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দিতে পারি, আমার সম্পর্কে কেউ এরকম খারাপ ধারণা পোষণ করে, এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছিল। বন্ধুত্ব ব্যাপারটা সম্পর্কেই প্রশ্ন জেগেছিল৷ স্কুলের শেষ দিন থেকেই বন্ধুদের প্রতি প্রায় সমকামীদের মতনই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম, নিজের বাড়ির লোকজন, আত্মীয়স্বজনের চেয়ে বন্ধুরাই ছিল বেশি আপন। কিন্তু এখন মনে হল, প্রকৃত বন্ধুত্ব কি সম্ভব? কিংবা কত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বন্ধত? পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে আমি বুঝেছি, আমার সত্যিকারের বন্ধু যে কয়েকজন আছে, তারা কেউই লেখক নয়। তারা ঘুণাক্ষরেও আমাকে ভুল বুঝবে না। বন্ধুত্ব আজীবনও থাকতে পারে, কিন্তু তারা এক পালকের পাখি নয়, যেমন ভাস্কর, সে আমার জন্য প্রাণও দিতে পারত।

পুলিশী তৎপরতার সূত্রপাতেই হাংরি জেনারেশানের প্রথম সারির নেতারা সবাই পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে জানিয়ে আসে, ভবিষ্যতে তারা ওই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। সমীরও ছাড়া পেয়ে যায়, মামলা হয় শুধু মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে, অশ্লীলতার অভিযোগ। সেই সময় কিছুদিনের জন্য মলয় খানিকটা একা হয়ে পড়ে। মামলা ওঠার আগে মলয় আমার বাড়িতে এসে অনুরোধ জানায় আমাকে তার পক্ষ নিয়ে সাক্ষ্য দিতে। আমি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে তাকে জানিয়েছিলাম, পৃথিবীর যে কোনও দেশেই সাহিত্যের ব্যাপারে পুলিশের হস্তক্ষেপের আমি বিরোধিতা করব। সাহিত্যের বিচার করতে পারে একমাত্র পাঠকেরা, সরকারের সে বিচার করার অধিকার নেই। মলয়ের পক্ষ নিয়ে আমি সম্পূর্ণ সমর্থন জানাতে রাজি আছি। কিন্তু যে কবিতাটি নিয়ে অভিযোগ, সেটাকে আমার সার্থক কবিতা মনে হয়নি মোটেই। শ্লীল-অশ্লীলের পার্থক্য নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না, তবে কবিতাটিকে রসোত্তীর্ণ বলা চলে না। মলয় জানাল যে, আমার এরকম সাক্ষ্যে পুরোপুরি কাজ হবে না, এটা আধা-সমর্থন, কবিতাটিকে বাদ দিয়ে শুধু কবিকে সমর্থন করলে বিচারক মানবেন না।

সেই প্রথম আমি দাঁড়ালাম আদালতে সাক্ষীর কাঠগড়ায়। সরকার পক্ষের উকিল অভিযুক্ত কবিতার কিছু আদিরসাত্মক শব্দসমন্বিত অংশ নির্দেশ করে বললেন, আপনি এই লাইনগুলি জোরে জোরে পড়ুন।

পড়লাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মতে কি এই ধরনের লেখা খুবই অশ্লীল নয়? এরকম লেখায় সমাজের ক্ষতি হয় না?

না। শুধুমাত্র কয়েকটি শব্দ দিয়ে অশ্লীলতার বিচার হয় না। এবং আমার মতে, এই রচনা কোনও ক্রমেই সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর নয়।

আপনার মতে, এটা কি একটা সার্থক কবিতা?

সামান্য দ্বিধা করে আমি বেশ জোর গলাতেই বলেছিলাম, হ্যাঁ—এটা একটা সার্থক কবিতা।

বন্ধুর ভাইয়ের জন্য এই সামান্য মিথ্যেটুকু বলতে আমার বিবেকে আঁচড় লাগেনি।

তেতাল্লিশ

বাঙালি লেখকদের মধ্যে ব্যস্ততম মানুষ ছিলেন সন্তোষকুমার ঘোষ, এবং গদ্য লেখক হয়েও তাঁর মতন কবিতাপ্রেমী আমি আর কারওকে দেখিনি। ছোটখাটো চেহারার মানুষটি সদা চঞ্চল, মাথার মধ্যে সবসময় যেন পাঁচরকম চিন্তা সমান্তরালভাবে ছোটে। কিনু গোয়ালার গলি’, ‘শেষ নমস্কার’, ‘শ্রীচরণেষু মাকে’র মতন উপন্যাস এবং দুর্দান্ত কিছু ছোট গল্পের জন্য এক সময় প্রবল খ্যাতি পেয়েছিলেন, শেষের দিকে তাঁর সাংবাদিক সত্তা তাঁর লেখক সত্তাকে অনেকখানি আড়াল করে দেয়। এক সময় ইংরেজি কাগজের সাংবাদিক হিসেবে থাকতেন দিল্লিতে, কলকাতায় এসে আনন্দবাজার পত্রিকার ভার অনেকখানি নিজের কাঁধে তুলে নেন। সে সময় আনন্দবাজার ও যুগান্তর-ই প্রধান বাংলা সংবাদপত্র, এক কালের বসুমতীর তখন পড়ন্ত দশা, সত্যযুগ, পশ্চিমবঙ্গ সংবাদ, লোকসেবক, স্বাধীনতা, জনসেবক এইসব পত্রিকা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। কিছুদিনের জন্য যুগান্তরের জনপ্রিয়তা আনন্দবাজারকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সন্তোষকুমার ভার নেবার পর আনন্দবাজার আবার প্রথম স্থান অধিকার করে নেয়। বাংলা সাংবাদিকতায় তিনি এনেছেন নতুন আঙ্গিক, নতুন ভাষা। যত দূর জানি, সাধু ভাষা ছেড়ে চলিত ভাষার প্রচলনও হয় তাঁর নির্দেশে। আনন্দবাজারের সম্পাদক এবং স্বত্বাধিকারী অশোককুমার সরকারকে অনেকে বলত রক্তকরবীর রাজার মতন, তিনি থাকেন উপরিতলে, তাঁকে প্রায় দেখাই যায় না, সন্তোষকুমারই তাঁর বকলমে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তিনি সর্বত্র পরিদৃশ্যমান।

সাংবাদিকতার পেশা তাঁর কাছে এমনই তীব্র নেশার মতন হয়ে গিয়েছিল যে তিনি দিনের মধ্যে পনেরো-যোলো ঘণ্টাই কাটাতেন অফিসে, কোনও কোনও সময় রাত্রেও বাড়ি ফিরতে পারতেন না। কিছুকালের জন্য আনন্দবাজার এবং এই সংস্থার ইংরেজি কাগজ হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডেরও বার্তা সম্পাদক ছিলেন একই সঙ্গে। এ হেন ব্যস্ত মানুষটি ছিলেন বিস্ময়কর রকমের পড়ুয়া, ছছাটখাটো লিটল ম্যাগাজিনের সব লেখাও পড়তেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, নতুন কারও কবিতা ভালো লাগলে মুখস্থ বলে দিতেন দু’লাইন, স্মৃতিশক্তিও ছিল অসাধারণ। তিনি অসম্ভব রবীন্দ্রভক্ত, নিজে গাইতে না পারলেও প্রায় সমস্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী তাঁর কণ্ঠস্হ, কোনও গায়ক-গায়িকা সামান্য হসন্ত ভুল করলেও তাঁর কান এড়াত না, এ সত্ত্বেও তিনি সাম্প্রতিকতম কবিতা পড়তেন সমান মনোযোগে।

আমি বিদেশ থেকে ফিরে বেকার অবস্থায় ঘুরছি বলে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এক সকালে আমাকে নিয়ে গেলেন সন্তোষকুমার ঘোষের বাড়িতে। অগ্রজ কবিদের মধ্যে নীরেনদার সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল বেশি। সরকারি চাকরি থেকে বিনা অনুমতিতে, ছুটি না নিয়ে প্রস্থান করেছিলাম বলে ভয়ে আর ও পাড়া মাড়াইনি, প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদি যা-কিছু জমেছিল তাও কখনও দাবি করিনি, নিজস্ব ড্রয়ারের কাগজপত্রও আনা হয়নি। মজার ব্যাপার এই, আমার এরকম অনুপস্থিতির জন্য কোনও রকম কৈফিয়ত চাওয়া হয়নি সরকার পক্ষ থেকে, আমাকে বরখাস্ত করারও চিঠি পাঠানো হয়নি। অনেক বছর ধরে বন্ধু-বান্ধবরা বলত, তুমি যখন বরখাস্ত হওনি, তার মানে চাকরি এখনও টিকে আছে, যে-কোনওদিন ওই অফিসে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়তে পারো। হয়তো গিয়ে দেখবে, এর মধ্যে তোমার প্রমোশানও হয়ে গেছে!

সন্তোষকুমার আমাকে চিনতেন, কিন্তু তখনও তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি। দু’চারটে কথা বলার পরই তিনি প্রস্তাব দিলেন, তুমি দুর্গাপুরে যাও! সেখানে আনন্দবাজারের নতুন অফিস খোলা হবে, তুমি হবে ইনচার্জ, কোয়ার্টার পাবে, জিপ গাড়ি পাবে, তোমার আন্ডারে কয়েকজন স্টাফ থাকবে।

আমি ভেবেছিলাম, দৈনিক পত্রিকায় আমার কিছু লেখাটেখার সুবিধে করে দেবার কথা বলবেন নীরেনদা, হঠাৎ চাকরির প্রস্তাব পেয়ে হকচকিয়ে গেলাম। সেই ষাটের দশকে দুর্গাপুর সম্পর্কে অনেক জল্পনাকল্পনা ছিল, অনেকে মনে করত, শিল্পনগরী হিসেবে এর গুরুত্ব কলকাতাকে ছাড়িয়ে যাবে, প্রচুর ব্যবসা-বাণিজ্য হবে, আর সেই টানে বহু মানুষ বসতি স্থাপন করবে সেখানে। কিন্তু আমি চাকরি নেবার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না, তা ছাড়া ফিরে এসেছি কলকাতার টানে, দুর্গাপুরে গিয়ে থাকতে যাবই বা কেন? আমি রাজি নই শুনে সন্তোষদা বেশ ধমকধামক দিলেন, তিনি ক্ষমতার আঁচে সব সময় ঝলমল করছেন, তাঁর যে কোনও প্রস্তাব মানেই আদেশ এবং সকলে তা মেনে চলছে, এটা দেখতেই তিনি অভ্যস্ত। লেখালেখির সঙ্গে জড়িত কোনও বেকার যুবকের পক্ষে আনন্দবাজারের লোভনীয় চাকরি প্রত্যাখ্যান করাও স্বাভাবিক নয়, কিন্তু আমি তখন ঠিক করেই ফেলেছি যে চাকরি না করেও জীবন চালানো যায় কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে, অ্যালেন গিন্‌সবার্গও আমার কানে ফুসমন্তর দিয়েছিল, সাহিত্য রচনা শুধু লিখতে বসার সময়টুকু নয়, চব্বিশ ঘণ্টার কাজ, ধরাবাঁধা কোনও জীবিকা নিলে তার বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যায়। জীবনযাপনের পদ্ধতিটাও রচনার একটা আঙ্গিক।

বন্ধু শরকুমার মুখোপাধ্যায়ও তখন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উঁচু অফিসার, তিনি তাঁর দফতরে আমার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন, শুধু নাম-কা-ওয়াস্তে একদিন ইন্টারভিউ দিতে হবে। শরতের সঙ্গে এক অফিসে প্রতিদিন দেখা হবে, এই প্রলোভনে প্রায় রাজিও হয়ে গিয়েছিলাম। নির্দিষ্ট দিনে বাড়ি থেকে সেজেগুজে বেরিয়েও মধ্যপথে ভাবান্তর হল। ইন্টারভিউতে মনোনীত হলে প্রতিদিন সুট-টাই পরে সাহেবি-অফিসে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ন’টায় হাজিরা দিতে হবে? জুতোর পালিশ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত রাখতে হবে নিখুঁত! তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, জীবনে আর কখনও কোনও ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে দাঁড়াব না। গলায় আর কোনওদিন টাই বাঁধব না তো বটেই, প্যান্টের সঙ্গে চটি পরার এবং যে দিন খুশি দাড়ি না কামাবার স্বাধীনতা আমায় রক্ষা করতে হবে।

নীরেনদা আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় বিভাগের সম্পাদক, তিনি আমাকে প্রতি সপ্তাহে কিছু লেখার বরাত দিলেন। আমি তখন নব নব বিচিত্র বিষয় খুঁজে বার করতাম সারা সপ্তাহ ধরে। সিনেট হলের ঠিক সম্মুখভাগে উপবিষ্ট মূর্তিটি কার, তরু দত্ত, অরু দত্ত’র সমাধি কোথায়, কলকাতার কোন অঞ্চলে ওয়ারেন হেস্টিংস ও ফিলিপ ফ্রান্সিস ডুয়েল লড়েছিলেন, ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে কয়েক মাইল অন্তর লম্বা লম্বা গম্বুজগুলো তৈরি হয়েছিল কেন ইত্যাদি। গত দু’তিন শতকের কলকাতা তথা বাংলার ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনোর শুরু তখন থেকে।

সাগরদাও একদিন ডেকে বললেন, তুমি আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিদেশি কবিদের সঙ্গে মিশেছ, অন্যান্য ভাষায় টাটকা কীসব লেখা হচ্ছে তা অনুবাদ হতে অনেক সময় লাগে, আমরা ঠিক মতন জানতে পারি না, তুমি দেশ পত্রিকায় প্রতি সংখ্যায় এইসব নিয়ে কিছু লেখো। শুরু হল, অন্য দেশের কবিতা’। বিংশ শতাব্দীতে, ইংরেজি বাদ দিয়ে, প্রধান পাঁচটি ইউরোপীয় ভাষায় কবিতা নিয়ে কী কী আন্দোলন হয়েছে তার পরিচয়, প্রতিনিধিস্থানীয় কবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও দুটি-একটি কবিতার ভাবানুবাদ। অনুবাদের মাধ্যমে কবিতার রস ও শব্দমাধুর্য অনেকটাই হারিয়ে যায় তা ঠিক, তবু তো অনুবাদের দরজা দিয়েই আমরা বিশ্ব সাহিত্যে কিছুটা প্রবেশের অধিকার পাই। দান্তের ডিভাইন কমেডির স্বর্গীয় পবিত্রতা হয়তো পুরোটা পাইনি, গ্যয়টের ফাউস্টের শয়তান ও শুভবুদ্ধি দ্বন্দ্ব হয়তো সবটা অনুধাবন করা যায়নি, তবু তো অনুবাদ হয়েছে বলেই কিছু জেনেছি!

আয়ওয়াতে আমি প্রচুর বইপত্র সংগ্রহ করেছিলাম, সেগুলি বিমানযাত্রায় সঙ্গে আনা সম্ভব ছিল না, অনেকগুলি প্যাকেটে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম জাহাজ ডাকে, সেগুলি এসে পৌঁছেছিল। অন্য ভাষার লেখক বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল চিঠিপত্রে, তাদের কাছ থেকেও সাহায্য চেয়েছি, তারা ডাকে বই-পত্র পত্রিকা পাঠিয়ে দিয়েছে। যেমন, আনতোনিও নামে একজন স্প্যানিশ বন্ধুর মুখে নিকোলাস গিলেন নামে একজন কবির কথা শুনেছি অনেকবার। বিংশ শতাব্দীতে স্প্যানিশ ভাষার বিখ্যাত কবি উনামুনো, হিমেনেথ, লোরকা, আলবের্তি, নেরুদা প্রমুখ কবিদের পরিচিতি সারা বিশ্বে, কিন্তু নিকোলাস গিলেনের কথা আমার জানা ছিল না। এর জন্ম কিউবায়, রচনার ভাষা স্প্যানিশ, কবিতা লিখেছেন আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের কালো মানুষদের ওপর অত্যাচার-অবিচার নিয়ে। ‘নিগ্রো’ নামে একটি কবিতা বড়ই মর্মন্তুদ, যখন সেটি লেখা হয়েছিল, তখনও কিউবায় ফিডেল কাস্ট্রোর নেতৃত্বে বিপ্লব হয়নি, সেখানকার ও আমেরিকার নিগ্রোদের অবস্থা একই রকম ছিল। আমার বন্ধুটিকে চিঠি লিখে নিকোলাস গিলেনের কবিতা ও তাঁর সম্পর্কে তথ্য আনিয়ে নিয়েছিলাম। আর ফরাসি কবিতা সম্পর্কে তো মার্গারিটের সাহায্য পাওয়া যায় সব সময়, সে-সপ্তাহে দুটি করে চিঠি লেখে। ফরাসিতেও আমি ককতো, এলুয়ার, আরাগঁ, আঁরি মিশো, রনে শার প্রমুখের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলাম লেওপোল্দ সেঙ্ঘর-কে। ইনিও মূল ফরাসি দেশের নন, উপনিবেশের কালো রঙের কবি।

‘অন্য দেশের কবিতা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সময় একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। তখন মধ্যরাত পেরিয়েও আরও অনেকক্ষণ আমরা আড্ডা দিতাম শ্যামবাজার মোড়ে, প্রায়ই সেখানে নানা রকম হুটোপাটি ও উৎপাত হত, একদিন সেরকমই একটা কিছুর মধ্যে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল শ্যামপুকুর থানায়। এই সব সময়ে পকেটে এতই কম পয়সা থাকে যে ঘুষ দিয়ে ছাড়া পাওয়ারও উপায় নেই, সারারাত আমাকে বসিয়ে রাখা হল একটা কাঠের বেঞ্চে। থানার বড়বাবু ওপরেই থাকেন, সকালে তিনি নেমে এসে কড়া গলায় আমাকে ধমক দিতে লাগলেন, আমার নামে গুণ্ডামি ও আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ, যদিও আসল কারণটি ছিল এক ট্যাক্সি চালকের সঙ্গে বিবাদ। পুলিশ আসার পর অন্য বন্ধুরা সরে পড়েছিল, আমি পারিনি। আমার পরিচয় দেবার মতন কিছু নেই, পুলিশের কোনও কর্তাকেও চিনি না, এইসব ক্ষেত্রে অপরাধ অস্বীকার কিংবা তর্কাতর্কি করে কোনও লাভ হয় না জানি! কয়েক বছর আগে প্রায় এই রকমই একটি কারণে শক্তি ও আমি গভীর রাতে বটতলা থানায় নীত হয়েছিলাম। তখন আমি জনসেবক পত্রিকায় পার্ট টাইম কাজ করি, সে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নাম থাকে অতুল্য ঘোষের, এবং তিনি তখন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান। যদিও ওই পত্রিকার কর্মী হিসেবে তাঁর সঙ্গে আমার কখনও একটিও বাক্য বিনিময় হয়নি, তবু সেই সূত্র ধরে শক্তি হুঙ্কার দিয়ে দারোগার দিকে আঙুল তুলে বলেছিল, সুনীল, এক্ষুনি অতুল্য ঘোষকে টেলিফোন করে এই লোকটাকে নর্থ বেঙ্গলে বদলি করে দাও তো। শক্তির এ কথার প্রতিক্রিয়া হল অপ্রত্যাশিত, দারোগাবাবুটি আমাদের ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মারতে মারতে বলেছিলেন, আমাকে অতুল্য ঘোষ দেখাচ্ছ? অতুল্য ঘোষের বাবাও আমাকে নর্থ বেঙ্গলে বদলি করতে পারবে না! (পরবর্তীকালে শক্তি একজন পুলিশ-বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিল, ডি আই জি, আই জি র‍্যাঙ্কের অনেক অফিসার ছিল তার ভক্ত, কিন্তু সেই সময়ে শক্তিও জানত না যে কলকাতা পুলিশ আর বাংলা পুলিশের প্রশাসন আলাদা, কলকাতা পুলিশের কোনও কর্মীকে সত্যিই জেলায় বদলি করা যায় না।) সেদিন শাস্তি হিসেবে দারোগাটি আমাদের পেট পাম্প করার জন্য পাঠিয়েছিলেন হাসপাতালে, সে অতি যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার, শেষ পর্যন্ত অব্যাহতি পাওয়া গিয়েছিল এই জন্য যে আর জি কর হাসপাতালের তরুণ হাউস সার্জেনদের মধ্যে একজন কবিতাপ্রেমী ছিল এবং সে কৃত্তিবাসের কবিদ্বয়কে চিনতে পেরেছিল।

এখানেও অনেকটা সেই ব্যাপারই হল আকস্মিকভাবে। থানার বড়বাবু আমাকে শাসাচ্ছেন আদালতে পাঠিয়ে জেল খাটাবেন বলে, হঠাৎ চোখে পড়ল তাঁর টেবিলের ওপর একটি নতুন সংখ্যা দেশ পত্রিকা। আমি বিনীতভাবে বললাম, আপনি দেশ পড়েন? ওই পত্রিকায় আমার ধারাবাহিক অন্য দেশের কবিতা বেরোচ্ছে, আমি লেখালিখি করি, গুণ্ডামি করা আমার কাজ নয়। ভদ্রলোক হঠাৎ থেমে গিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তাঁর মুখের রেখাগুলিই বদলে গেল, তিনি সবিস্ময়ে বললেন, সে কী! ওগুলো তো আমি নিয়মিত পড়ি। আপনি তো লার্নেড লোক মশায়, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, জার্মান কত ভাষা জানেন, আপনাকে ধরে এনেছে? ছি ছি ছি, আসলে কী হয়েছিল বলুন তো?

সত্যি কথা বলতে কী, আমি ফরাসি ভাষা খুব সামান্যই জানি বটে, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, জার্মান ভাষা সম্পর্কে আমার কোনও জ্ঞানই নেই, ওইসব কবিতা অনুবাদ করছিলাম ইংরেজি থেকে। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতিতে আগ বাড়িয়ে সে কথা জানিয়ে দেওয়া কি উচিত ছিল? আত্মরক্ষার জন্য, মুখে কিছু না বলে লাজুক হাস্যময় ওষ্ঠে ‘লার্নেড লোক’ সেজে থাকাই যুক্তিযুক্ত নয় কি? এর পরে ভদ্রলোক আমাকে চা-টোস্ট খাওয়ালেন ও বাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করলেন। তবে, ‘অন্য দেশের কবিতা’ যখন পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় তখন ভূমিকায় স্পষ্টভাবে সত্য কথা জানিয়েছিলাম যে আমি মোটেই বহু ভাষাবিদ নই। এই মোল্লাটির দৌড় মসজিদ পর্যন্ত।

বছরখানেক বাদে এই সিরিজটি শেষ হবার পরেও সাগরদা বললেন, তুমি আর একটি কিছু ধারাবাহিক শুরু করো, কী লিখবে তা তুমিই ঠিক করবে। আনন্দবাজারে তখন নানারকম ফিচার লিখছি, তাই দেশ পত্রিকার জন্য ঠিক করলাম একটা ছদ্মনাম। জন্ম হল নীললোহিতের। নামটি প্রমথ চৌধুরীর একটি চরিত্র থেকে নেওয়া, বেকার, বাউণ্ডুলে, ভ্রমণপ্রিয়, তখন আমার বয়স একত্রিশ, নীললোহিতের বয়স একটু কমিয়ে দিলাম, তার বয়স সাতাশের বেশি কখনও বাড়বে না। এই নীললোহিত নামের প্রথম সিরিজটির নাম বিশেষ দ্রষ্টব্য। এটাও শেষ করার পর সাগরদা থামতে দিলেন না, তিনি আমাকে ভার দিলেন প্রতি সপ্তাহে ‘সাহিত্য সংবাদ’ লেখার। এর জন্যও আমি গ্রহণ করলাম আর একটি নতুন নাম, সনাতন পাঠক। আমার দিদিমা আমাকে সনাতন নামে ডাকতেন, আর সনাতন পাঠক বলতে আল্টিমেট রিডারও বোঝানো যায়। আমার উপার্জনে সহায়তা করার জন্যই সাগরদা এরকম পর পর লেখার জন্য আদেশ দিতেন। অবশ্য এরকম এক একটি লেখার জন্য দক্ষিণা পনেরো-কুড়ি টাকার বেশি ছিল না।

সন্তোষকুমার ঘোষ মাঝে মাঝে আমাকে কিছু কিছু লেখার বরাত দিতেন, তিনি নজর রাখছিলেন আমার ওপর, হঠাৎ একদিন আমাকে আর একটি প্রস্তাব দিলেন। তখন সংবাদপত্রের অর্থনীতি অন্যরকম ছিল, এখনকার মতন এত বিজ্ঞাপনের প্রাবল্য ছিল না, লেখা থাকত প্রচুর, শুধু সংবাদ দিয়ে কুলোনো যেত না, দিতে হত নানারকম ফিচার। আনন্দবাজারের প্রতিদিন শেষ পৃষ্ঠা জুড়ে থাকত এক এক রকমের বিষয়, যেমন সোমবারের আনন্দমেলা’ ছিল পাতা জোড়া, সেই রকম প্রতি শনিবার দেশে দেশে’, তাতে থাকত শুধু আন্তর্জাতিক সংবাদ ও আকর্ষণীয় ফিচার। সন্তোষদা বললেন, তুমি কলকাতার বাইরে যেতে চাও না, এই সাপ্তাহিক পৃষ্ঠাটার ভার নাও। শুনে প্রথমে আমার খটকা লেগেছিল, এতদিন সেই পৃষ্ঠাটি দেখাশুনো করতেন আমার সমসাময়িক লেখক ও বন্ধু মতি নন্দী। কোনও কারণে কি সন্তোষদা মতিকে সরিয়ে দিয়ে আমাকে সেই জায়গায় বসাতে চান? যদি তাই-ই হয়, তা হলে এ কাজ গ্রহণ করা আমার পক্ষে মোটেই নীতিসম্মত নয়। প্রকৃত অবস্থাটা জানার জন্য আমি খুঁজে খুঁজে মতির বাড়িতে উপস্থিত হলাম এক দুপুরে। মতি খানিকটা অবাকই হয়েছিল। সে অবশ্য জানাল যে সে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার কিছু লেখার কাজ নিয়েছে, তা ছাড়া খেলার লেখা বিষয়ে মনঃসংযোগ করতে চায়, তাই দেশে দেশে’ পৃষ্ঠাটি ছেড়ে দেবার প্রস্তাব সে নিজেই দিয়েছে। অর্থাৎ ওই দায়িত্ব গ্রহণে আমার কোনও বাধা নেই। কাজটা অবশ্য তেমন সহজ নয়। পুরো এক পৃষ্ঠার অন্তত ছ’কলম লেখা আমাকে জোগাড় করতে হবে অর্থাৎ বিদেশি পত্র-পত্রিকা থেকে অংশবিশেষ অনুবাদ এবং আমার নিজের দেশবিদেশ ঘোরার অভিজ্ঞতাভিত্তিক ফিচার। নানারকম ছবি সংগ্রহের দায়িত্বও আমার। এবং প্রতি শুক্রবার রাত্তিরে প্রেসে গিয়ে আমাকেই করতে হবে পেজ মেকআপ। লেখা মাপে বেশি হলে কেটে বাদ দিতে হয়, কম পড়লে লাইন গুনে লিখে দিতে হয় প্রেসে বসে। তখনও হ্যান্ড সেট টাইপের যুগ, কিছুদিন পরে আসে লাইনো। প্রেসের কর্মীরা যাতে মেকআপ করতে অযথা দেরি না করেন, সেজন্য তাঁদের দাদা কাকা বলে অনুনয় করতে হত।

এই কাজের জন্য আমাকে আনন্দবাজার অফিসে এই প্রথম দেওয়া হল একটি টেবিল-চেয়ার। গৌরকিশোর ঘোষ, নিখিল সরকার, কিছুদিনের জন্য বরুণ সেনগুপ্ত যে-ঘরে বসতেন, আমার স্থান হল সেই ঘরে। বাইরের লোক এসে মনে করত, আমি বুঝি আনন্দবাজারে চাকরি নিয়েছি বা পেয়েছি, তা কিন্তু নয়, হাজিরা খাতায় আমার নাম ছিল না, মাস মাইনেও ছিল না। প্রতি শনিবার ওই এক পৃষ্ঠার রচনা ও মেকআপের জন্য আমার পারিশ্রমিক ছিল পঞ্চাশ টাকা। এ নিয়ে নির্মম কৌতুকও হত মাঝে মাঝে। শুক্রবার রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত প্রেসে থেকে খেটেখুটে পেজ মেকআপ করে চলে গেলাম হৃষ্টচিত্তে, পরদিন সকালে চক্ষু চড়কগাছ! অনিবার্য কারণবশত এ সপ্তাহে দেশে দেশে প্রকাশিত হল না, তার বদলে বাটা কোম্পানির নানারকম জুতোর ছবি। শেষ মুহূর্তে বড় বিজ্ঞাপন এসে গেলে প্রথম কোপ পড়ত ফিচার পৃষ্ঠার ওপরে। বিজ্ঞাপনই সংবাদপত্রের লক্ষ্মী। ওই বিজ্ঞাপনের জন্য কোম্পানির অতিরিক্ত লাভ হল, কাটা গেল আমার পঞ্চাশ টাকা, লেখা ছাপা না হলে টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই, আমার পরিশ্রম বৃথা। পুরনো হয়ে যাবে বলে অধিকাংশ লেখাই ব্যবহার করা যাবে না পরের সপ্তাহে। তবে আমার সান্ত্বনা ছিল এই, কোনও কোনও মাসে তো পাঁচটা শনিবারও হয়!

‘দেশে দেশে’ পৃষ্ঠায় অনুবাদগুলিতে নাম ব্যবহার করতাম না, মৌলিক রচনার জন্য গ্রহণ করলাম আর একটি নাম, নীল উপাধ্যায়। অর্থাৎ নিজের নাম ছাড়াও নীললোহিত, নীল উপাধ্যায় ও সনাতন পাঠক এই চারটি নামে আমার গদ্য-র দাপাদাপি চলতে লাগল অনবরত। অনেকেই জানত না, এই চারটি নামের আড়ালে আছে একই ব্যক্তি। কলেজ জীবনে যে গদ্যের খুঁতখুঁতুনির জন্য বাংলা পরীক্ষার সব কটি প্রশ্নের উত্তর লিখে শেষ করতে পারত না, সে-ই এখন জলবৎ বাংলা গদ্য লেখে বন্যার বেগে। পরবর্তীকালে আমার মনে হয়েছে, বাংলা সংবাদপত্রের যাবতীয় লেখকদের মধ্যে একমাত্র অমিতাভ চৌধুরী (প্রথম) ছাড়া আমার চেয়ে দ্রুত গদ্য বোধহয় আর কেউ লিখতে পারেন না। চাকরি করব না, শুধু লিখে জীবিকা অর্জন করতে হবে, এই জেদ আমি চালিয়ে গেছি ছ’ বছর, তার জন্য আমাকে আয়ুক্ষয়ও করতে হয়েছে অনেক।

মাথার মধ্যে কবিতা ও গদ্যের জন্য যেন দুটি আলাদা প্রকোষ্ঠ ভাগ করা ছিল। এই সময়ে কবিতাও লিখেছি তুলনামূলকভাবে বেশি। দেশে ফেরার এক বছরের মধ্যে প্রকাশিত হয় আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি। এরকম নামকরণে বন্ধুবান্ধবদের কয়েকজন বেশ আপত্তি জানিয়েছিলেন, তখন একজন কারওর বই বার করার উদ্যোগ নিলে অনেকে মিলে তার নাম, মলাট, হেডিং, বডি টাইপ ইত্যাদির আলোচনা ও প্রুফ দেখার কাজ হত। উদাস সিংহ কিংবা উড়ন্ত সিংহাসন এই দুটি নামও আমার মনে এসেছিল, কিন্তু আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’ এরকম চাঁছাছোলা গদ্য নামই আমার বেশি পছন্দ হল। কবিতার শব্দবন্ধে মুখের ভাষার সিনট্যাক্স প্রয়োগের যত দূর সম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছি, গীতি কবিতা থেকে সরে যাচ্ছি অনেক দূরে, সুতরাং লালিত্যময় নাম দেবার প্রশ্নই ওঠে না। ‘উড়ন্ত সিংহাসন’নামটি শক্তির খুব মনে ধরেছিল, পরে সে নিজের একটি কাব্যগ্রন্থে ওই নামটি ব্যবহার করে। ‘কৃত্তিবাস’ও তখন বেরোচ্ছে নিয়মিত, এরই মধ্যে কৃত্তিবাসের খরচও জোগাড় করতে হত, আমি চাঁদা তুলে পত্রিকা চালানোয় বিশ্বাসী ছিলাম না।

ধরাবাঁধা চাকরি না করলে উপার্জন অনিশ্চিত ও অনিয়মিত থাকে বটে, কিন্তু একটা সুবিধেও পাওয়া যায়, একটা স্বাধীন সত্তার অনুভূতি, সারা সপ্তাহে নটা-দশটার সময় নাকে-মুখে ভাত গুঁজে অফিসে ছুটতে হয় না। চাকুরিজীবীরা সমাজের সুবিধেভোগী শ্রেণী হলেও তারা সকালগুলো উপভোগ করতে পারে না। অস্থিরতায় ভুগতে হয়। আমার সকালগুলি খুব লম্বা, দুপুরও ঢিলেঢালা, খাওয়ার সময়ে ডাঁটা চিবোনো কিংবা কাঁকড়া খাওয়ার যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। সকালের দিকে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা কম, সকলেই কোনও না কোনও জীবিকায় যুক্ত হয়েছে, শক্তি শিয়ালদার কাছে একটা টিউটোরিয়াল হোম খুলে ফেলেছে, চোখমুখে বেশ একটা উদ্দীপনার চিহ্ন নিয়ে শক্তিকে বিভিন্ন মাস্টারদের পরিচালনা করতে দেখা যায়। কয়েকবার দেখতে গেছি বিকেলের দিকে, শক্তি আমাকেও পড়াবার জন্য অনুরোধ করেছিল, আমি উৎসাহ বোধ করিনি।

সকালগুলোতে অনেক সময় পাওয়া যায় বলে আমি সংবাদপত্রের চটজলদি লেখা ছাড়া অন্য কিছু রচনার চেষ্টায় অতৃপ্তি ও রোমাঞ্চে মেতে থাকতাম। বিদেশে শুরু করেছিলাম দুটি গদ্য রচনা, যুবক যুবতীরা’ নামে একটি উপন্যাস কিংবা উপন্যাসের মতন কিছু, যাতে টানা কোনও কাহিনী থাকবে না, নায়ক-নায়িকা থাকবে না, ন্যারেটিভ স্টাইল বর্জিত হবে এবং বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতা মিশ্রণের কিছুটা পরীক্ষা। প্রবাসে একটু একটু করে লিখেছি, এখানে বছর খানেকের মধ্যে সেটা শেষ হয়ে গেল। একটি ছোট পত্রিকার সম্পাদক কারও মুখে সে লেখাটির কথা শুনে চেয়ে পাঠালেন। পাণ্ডুলিপিটি জমা দিতেই মনোনীত হল ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের জন্য, কিন্তু প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পরই আমার হাড়-পিত্তি জ্বলে ওঠার উপক্রম। সম্পাদকমশাই যেখান থেকে সেখান থেকে প্রচুর লাইন বাদ দিয়েছেন। এই সম্পাদকমশাই একটি টিউটোরিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ, তার ছাত্র-ছাত্রীদের পত্রিকাটি কেনা বাধ্যতামূলক, আমার লেখাটিতে নাকি প্রচুর শব্দ অশ্লীল, ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠের অনুপযুক্ত, তাই তিনি ইচ্ছেমতন কাটছেন। আমি দেখা করে বললাম, আমি একটি শব্দও বাদ দিতে বা বদল করতে রাজি নই, আপনাকে ছাপতে হবে না। পাণ্ডুলিপি ফেরত দিন। আশ্চর্য, তিনি পাণ্ডুলিপি ফেরত দিতে রাজি নন, বরং চোখ রাঙিয়ে বললেন, তাঁর সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার নেই। দ্বিতীয় কিস্তিও ছাপা হল ছিন্নভিন্ন অবস্থায়। সুতরাং বাধ্য হয়েই আমাকে খানিকটা হুমকি দিতে হল, তাঁকে বললাম, একদল বন্ধুবান্ধব এনে তাঁর টিউটোরিয়ালটিই বন্ধ করে দেব এতে কাজ হল। পাণ্ডুলিপিটা ফেরত পাবার পর আমার চক্ষু লাল হওয়া স্বাভাবিক, কারণ পাণ্ডুলিপিটির অনেক লাইন লাল কালি দিয়ে কাটা, অতি কষ্টে সংযত করেছি নিজেকে। কফি হাউসে এই প্রসঙ্গ নিয়ে তপ্ত আলোচনা চলেছিল, তা শুনে উত্তরতরঙ্গ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক আগ্রহ করে নিয়ে গিয়ে একটি সংখ্যাতেই ছেপে দিলেন পুরো উপন্যাসটি, একটি শব্দও বাদ না দিয়ে। কফি হাউসের বন্ধুদের মধ্যে যাঁরা শুধু গদ্য লেখেন, তাঁরা যুবক-যুবতীরা পড়ে মুখ বিকৃত করেছিলেন, গল্প-উপন্যাসের এলাকায় আমার অনধিকারীর মতন উঁকিঝুঁকি মারা অনেকের পছন্দ হয়নি, একজন প্রবীণ লেখকও মনে করতেন, কবিদের গল্প-উপন্যাস লেখার চেষ্টা করাই উচিত নয়। তবে কবিরা কেউ কেউ পছন্দ করেছিলেন, আমার ওই রচনাটি।

পত্রিকায় ছাপা তো হল, এরপর সেটি পুস্তকাকারে প্রকাশের কী পদ্ধতি, আমার জানা ছিল না। অনেক লেখকের জীবনীতে পড়েছি অবশ্য যে, প্রথম জীবনে অনেক সংগ্রাম করে যেতে হয়, উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি বগলে নিয়ে ঘুরতে হয় প্রকাশকদের দরজায় দরজায়, একটু-আধটু অপমান গায়ে মাখলে চলে না, অনেক বিখ্যাত উপন্যাসও প্রথমে অনেক প্রকাশক ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু এই পদ্ধতি অনুসরণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব, আমি যে প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারি না, জীবনের প্রথম কবিতা ডাকে পাঠিয়েছি, ছাপা হয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত সব লেখাই ডাকে পাঠিয়েছি কিংবা কেউ চেয়েছে, উপযাচক হয়ে কোথাও লেখা দিতে যাইনি, সংগ্রাম-টংগ্রামও করতে হয়নি। প্রত্যাখ্যান সহ্য করার চেয়ে প্রত্যাশা না থাকাও ভালো, আমাকে যে লেখক হতেই হবে, তেমন মাথার দিব্যি তো কেউ দেয়নি! যুবক-যুবতীরা পত্রিকার পৃষ্ঠাতেই রয়ে গেল।

আর একটি লেখাও আমি শেষ করেছিলাম, সোনালি দুঃখ’। এটা ঠিক উপন্যাসও নয়, পুরোপুরি মৌলিক রচনাও নয়। মার্গারিটের সঙ্গে প্রায়ই আমার সাহিত্য নিয়ে বিনিময় প্রতিযোগিতা চলত, অর্থাৎ আমি কোনও বাংলা কবিতা বা গল্পের ভাবানুবাদ ওকে শোনালে ও সঙ্গে সঙ্গে তার সমতুল্য ফরাসি কোনও কবিতা বা গল্প খুঁজে বার করত। সেইরকমভাবেই আমি রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী সবিস্তারে জানাবার পর মার্গারিট বর্ণনা করল ত্রিস্তান ও ইসল্টের গভীর প্রণয় ও বিষাদময় এক মর্মান্তিক উপাখ্যান। এ উপাখ্যান শুধু ফরাসি সাহিত্যের নয়, মধ্য যুগে প্রচলিত ছিল ইউরোপের অনেক দেশে। এই অভিশপ্ত প্রণয়ী যুগলকে নিয়ে গান বেঁধেছে ত্রুবাদুররা, নাটক হয়েছে, এমনকী আধুনিককালে ভাগ্নারের মতন সঙ্গীতস্রষ্টা অপেরাও রচনা করেছেন। এ কাহিনী আমাদের এখানে তেমন পরিচিত নয়, অন্তত আমি আগে শুনিনি বা পড়িনি, সেটি এমনই মর্মস্পর্শী যে বাংলায় লিখে ফেলতে ইচ্ছে হয়েছিল। এ কাহিনীর নানারকম ভাষ্য আছে, সবগুলিই সংগ্রহ করেছিলাম, মার্গারিট সাহায্য করেছিল, সেগুলির নির্যাস নিয়ে এবং নিজস্ব কল্পনা মিশিয়ে, বিশেষত শেষ দৃশ্যে, আমি রচনা করি একটি নতুন ভাষ্য। নায়ক ত্রিস্তানের নামের অর্থ দুঃখ, আর ইসল্টের মাথার চুলের রং সম্পূর্ণ সোনালি, তার একটি মাত্র চুল নিয়েই কাহিনীর শুরু, তাই নামকরণ ‘সোনালি দুঃখ’। পরে বই হিসেবে প্রকাশের সময় আমি এটি উৎসর্গ করি মার্গারিটকে, উৎসর্গ পত্রে ইংরেজিতে লিখেছিলাম, টু মার্গারিট, ফর দা হেল্প অফ হার গুড হ্যান্ডস। ডাকে বইটি পাবার পর মার্গারিট চিঠিতে জানিয়েছিল, তুমি তো আমায় বাংলা পড়তে শেখাওনি, আমি বইটার মলাটে কতবার যে হাত বুলিয়েছি, আর কেন জানি না, আমার কান্না পাচ্ছিল! ততদিনে মার্গারিটের সঙ্গে শঙ্খ ঘোষ ও জ্যোতির্ময় দত্তের পরিচয় হয়ে গেছে ও দেশে এবং তার কলকাতায় আসা সুদূর পরাহত হয়ে যাচ্ছে।

এই বইখানির জন্য আমার পরম লাভ, বহু ভাষাবিদ এবং আমার প্রিয় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে পরিচয় ও সান্নিধ্য। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ অবশ্য মোটেই মধুর নয়। তিনি আমাকে চিনতেন না, তিনি রবীন্দ্রনাথে এমনই আপ্লুত যে রবীন্দ্র-পরবর্তী কোনও কবিতাই পড়বেন না ঠিক করেছিলেন, সুতরাং আমার মতন একজন অকিঞ্চিৎকর আধুনিক কবির অস্তিত্ব সম্পর্কেই তাঁর অবহিত থাকার কথা নয়, কিন্তু অন্য দেশের কবিতা সিরিজ লেখার সময় আমার একটা কৌতুকের চেষ্টা কেউ তাঁর নজরে এনেছিল এবং তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে পত্রিকায় মন্তব্যও করেছিলেন। ফরাসি শব্দের উচ্চারণ নিয়ে আমাদের এখানে নানারকম বিভ্রান্তি আছে, সঠিক উচ্চারণ বাংলা অক্ষরে প্রকাশ করাও বোধহয় সম্ভব নয়। ছেলেবেলা থেকে আমরা দেখে আসছি ভিক্তর হুগো, অথচ ফরাসি ভাষায় শব্দের প্রথমে এইচ অক্ষরটি থাকলে তার উচ্চারণ নিষিদ্ধ। ফরাসি শব্দগুলি ইংরেজি উচ্চারণে লিখলে ঝামেলা চুকে যায়। যেমন নেপোলিয়নকে নাপোলিয়ঁ দেখতে আমাদের চোখে লাগে। কেউ কেউ প্যারিসকে লেখেন পারি, অথচ ফ্রাঁস না, লিখি ফ্রান্স। তা হলে Arthur Rimbaud এই কবির নামের উচ্চারণ কী হবে? আর্থার রিমবড? কেউ কেউ লেখেন আর্তুর ‘র‍্যাঁবো’। কিন্তু মার্গারিট ও অন্য ফরাসিদের মুখে আমি শুনেছি, ‘র‍্যাঁবো’ উচ্চারণটিও সঠিক নয়, ওদের আর-এর উচ্চারণ ইংরেজি আর-এর মতন একেবারেই নয়, র-এর বদলে খ আর হ-এর মাঝামাঝি, যেমন রেডিয়ো শোনায় হ্রাদিও’র মতন। এবং এন-এর মতন এম-কে সব সময় চন্দ্রবিন্দু করা চলে না। সেই জন্যই উচ্চারণের জটিলতার ইঙ্গিত করে আমি লিখেছিলাম, র‍্যাঁবো’র বদলে হ্র্যাম্বো লিখলে কেমন হয়? সৈয়দ মুজতবা আলী তাতেই দারুণ চটে গিয়ে লিখলেন, আজকালকার ডেপো ছোঁড়ারা দু’পাতা ফরাসি শিখেই মনে করে দিগ্গজ হয়ে গেছে। হ্র্যাম্বো? কবি না পাঁঠার ডাক বোঝার উপায় নেই ইত্যাদি।

আমি তাড়াতাড়ি তাঁকে চিঠি লিখে সবিস্তারে ও সবিনয়ে জানালাম যে, আমি মোটেই ফরাসি জানি না, উচ্চারণ নিয়ে বিদ্যে ফলাবার স্পর্ধা দেখাবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি নেহাতই কৌতুক করেছি৷ আলী সাহেব আমার এই কৈফিয়ত গ্রাহ্য করলেন না, উত্তরও দিলেন না। তিনি পাকিস্তানি শাসন মেনে নিতে পারেননি বলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে এসেছিলেন, এক সময় ছিলেন কলকাতার বেতার কেন্দ্রের অধিকর্তা। কিছুদিন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় স্থান শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করেছেন, সেখানে তাঁর অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি, বিশ্বভারতী থেকে পদত্যাগ করলেও জেদের বশে বোলপুরে থাকতেন ঘরভাড়া নিয়ে, পঁয়ষট্টি সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁকে কিছু কিছু লাঞ্ছনাও সহ্য করতে হয়, তবু তাঁর রচনায় কখনও মালিন্যের ছাপ পড়েনি। ডালহাউসি স্কোয়ারে স্পেন্সেস হোটেলে (যেখানে মাইকেল মধুসূদন থেকেছেন কিছুদিন, এখন হোটেলটির অস্তিত্ব নেই) প্রায় প্রতি সন্ধেবেলা সাগরময় ঘোষকে কেন্দ্র করে একটি পানাহারের আড্ডা বসত, মুজতবা আলী সেখানে যোগ দিতেন মাঝে মাঝে, সাগরদার প্রশ্রয়ে আমিও কয়েকবার গেছি। একদিন মুজতবা আলী আমাকে দেখেই যেন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন, আকারে ইঙ্গিতে বোঝালেন যে আমার উপস্থিতি তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। আমি মনে আঘাত পেয়েছিলাম এই জন্য যে আমি যে তাঁর লেখার, বিশেষত ভাষা ব্যবহারের কতখানি ভক্ত তা তাঁকে বোঝাতেও পারছি না। একটা এলেবেলে কৌতুক করার জন্য এই শাস্তি! তারপর বোধহয় সাগরদাই আমার সোনালি দুঃখ’ তাঁকে পড়তে দিয়েছিলেন, হঠাৎ আমি সবুজ কালিতে লেখা রাবীন্দ্রিক অক্ষরে একটি চিঠি পেলাম আমার এই প্রিয় লেখকের কাছ থেকে। দীর্ঘ চিঠিটিতে তিনি লিখেছেন যে, ফরাসি ভাষা থেকে এই সুবিখ্যাত কাহিনীটি তিনি নিজেই কেন আগে লেখেননি, সে জন্য তাঁর আফসোস হচ্ছে, এবং এ বইখানি তিনি তাঁর শিয়রের কাছে রেখে দিয়েছেন।

শুধু চিঠি লিখেই ক্ষান্ত না হয়ে তিনি সাগরদাকে বলেছিলেন, ওই ছোঁড়াটাকে তুমি এক সন্ধেবেলা ডেকে পাঠাও। স্পেন্সেস হোটেলের সেই টেবিলে বসার অধিকার পাবার পর সৈয়দ মুজতবা আলী সুরার পাত্র তুলে বললেন, আজ থেকে তুমি আমাদের ইয়ার হলো আর যাই করো, কখনও ফরাসি উচ্চারণ ফলিও না। আমি কান মুলে বলেছিলাম, নাক খত দেব কী? তারপর অনেকদিন আমি তাঁর সান্নিধ্যে বসে অনেক রসিকতা ও বৈদগ্ধ্যপূর্ণ ইয়ার্কি শোনার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছি। দেখা না হলে, চিঠি লিখতেন মাঝে মাঝে, সেসব চিঠি বারবার পড়বার মতন। এখনকার সাহিত্যিকদের এরকম চিঠি লেখার অভ্যেস চলে গেছে।

চুয়াল্লিশ

উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কেন এবং কী কারণে হয়েছিল, তা ক’জন মনে রেখেছে? একাত্তর সালের যুদ্ধ ইতিহাসের মর্মে চিরকাল গাঁথা থাকবে, কিন্তু তার ছ’ বছর আগেকার যুদ্ধটাকে একেবারে বাচ্চা ছেলেদের ঝগড়া বলে মনে হয়, অথচ তারই জন্য কত রক্তপাত এবং দু’দেশের সম্পদ ক্ষয়। এক একটা যুদ্ধ মানেই দেশের অগ্রগতি থেমে যাওয়া কিংবা পিছিয়ে যাওয়া।

প্রথমে শুরু হয়েছিল কচ্ছের রান অঞ্চল, যেখানে শুধু বুনো গাধারা চরে বেড়ায়, সেই গুজরাত-সিন্ধু প্রদেশের সংলগ্ন প্রায় শুকনো লবণ হ্রদের অনেকটা অংশ পাকিস্তান দাবি করায়। দাবি মানে আলাপ-আলোচনা নয়, গোলাগুলি চালনা। পশুচারণার জন্য প্রয়োজনীয় জমির জন্য মরতে লাগল মানুষ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য একটা আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে সেই কচ্ছের রানের নব্বই ভাগ অংশ থেকে গেল ভারতের অধিকারে। যুদ্ধ কিন্তু থামল না, কারণটা আসল নয়, যুদ্ধ করতেই হবে, এটাই আসল কথা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, ঘৃণা গোলাবারুদের ধোঁয়ার চেয়েও বেশি। কয়েক মাস পরেই আবার বোমাবর্ষণ শুরু হয়ে গেল কাশ্মীরে। মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হল দু’দেশের স্থলবাহিনী।

কাশ্মীর অনেক দূরে, সেখানকার যুদ্ধের আঁচ পশ্চিমবাংলা কিংবা পূর্ব পাকিস্তানে লাগবার কথা নয়। শুধু সত্যি-মিথ্যে মিলিয়ে নানারকম উত্তেজক খবর আসে। পাকিস্তানের রেডিয়ো ও সংবাদপত্রে প্রচারিত হয় যে পাকিস্তানি বীর সৈনিকদের হাতে ভারতীয় সেনারা পোকা-মাকড়ের মতন মরছে। এক একজন পাকিস্তানি যোদ্ধা দশজন ভারতীয় সৈন্যের সমান, মরলে শহিদ আর মারলে গাজি হবার উদগ্র বাসনা নিয়ে তারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আর ভারতে প্রচারিত হচ্ছে যে, ভারতীয়দের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা দাঁড়াতেই পারছে না, ক্রমাগত পিছু হটছে, ছাম্ব সেক্টার থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে, হাজি পীর গিরিবর্ত্ম অনায়াসে ভারত দখল করে নিয়েছে ইত্যাদি। অঘোষিত যুদ্ধ, দূর থেকে ধনী ও শক্তিশালী দেশগুলি মুচকি মুচকি হাসছে, সেইসব দেশ থেকেই তো দামি দামি অস্ত্র কিনে এনে পরস্পরের দিকে ছোঁড়াছুঁড়ি করছে এই দুটি রাষ্ট্র, চলুক না এরকম আর কিছুদিন। হঠাৎ অবস্থাটা বদলে গেল, ভারতের সেনাপতি জয়ন্তনাথ চৌধুরী অতর্কিতে লাহোর সেক্টরে আক্রমণ করে বসলেন। পাকিস্তান যাবতীয় শক্তি সঞ্চয় করেছিল কাশ্মীর সীমান্তে, অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরা পড়ে গেল লাহোরে।

তা হলে কি এবার দু’ দেশে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হবে, যে-কোনও সময়ে পূর্ব পাকিস্তানও আক্রান্ত হতে পারে? সেখানকার বাঙালিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল এই আশঙ্কা। পশ্চিম বাংলার বাঙালিদেরও মনে হল, ওদিকে যেমন আচমকা লাহোর আক্রান্ত হয়েছে, তার প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানিরাও বোমা বর্ষণ করতে পারে কলকাতায়। দ্বিখণ্ডিত বাংলার বাঙালি জাতিসত্তা এই সময় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, এতদিন তবু যেটুকু যাতায়াত ছিল দু’দিকের মানুষের তা বন্ধ হয়ে গেল সম্পূর্ণভাবে, বই পত্র-পত্রিকার আদানপ্রদানও নিষিদ্ধ হল তো বটেই, এমনকী রবীন্দ্রসঙ্গীতও নিষিদ্ধ হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তানে। সেখানকার হিন্দুদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি ঘোষিত হল শত্রু সম্পত্তি হিসেবে, কারাগারে আটক করা হল বহু হিন্দুকে। পাকিস্তানে জারি আছে সামরিক শাসন, সেখানে আইনকানুনের তোয়াক্কা করে না সরকার। ভারতীয় গণতন্ত্রে এতখানি সম্ভব নয়, তবুও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল সাম্প্রদায়িকতা, হুমায়ুন কবীর ও শানওয়াজ খানের মতন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সম্পর্কেও ছড়াল সন্দেহ, গ্রেফতার হলেন অনেক মুসলমান নেতা। কিছু কিছু লোক আড়ালে সংস্কৃতিজগতের অনেক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের সম্পর্কেও ফিসফিস করতে লাগল অকথাকুকথা।।

বিমান আক্রমণের আশঙ্কায় কলকাতায় সন্ধে থেকে ব্ল্যাক আউট। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কুড়ি বছর পর আবার। দোকানপাট সব বন্ধ, রাস্তাঘাট নিশ্চিদ্র অন্ধকার। তা হলে আমরা যাই কোথায়, আমাদের তো সন্ধের সময় বাড়ি ফেরার অভ্যেস নেই। এই বোকা বোকা যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার একমাত্র উপায় সমস্ত বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করা। আমরা আড্ডা বন্ধ করিনি, গুলতানি করেছি কলেজ স্কোয়ারে, হোঁচট খেতে খেতে ঘুরেছি অন্ধকার রাস্তায়, যানবাহনের অভাবে বাড়ি ফিরেছি মধ্য রাত্রি পার করে পায়ে হেঁটে। আমাদের আড্ডায় প্রায় সময়ই অন্তত দু’জন মুসলমান উপস্থিত থাকত, বেলাল চৌধুরী ও শামসের আনোয়ার, কিন্তু তারা মুসলমান কি না কিংবা আমরা হিন্দু কি না, তা মনেই থাকে না। এরই মধ্যে আমরা কয়েকজন বেড়াতে চলে গেলাম ঝাড়গ্রামের কাছে বেলপাহাড়ি অঞ্চলে, ওদিকে কলাইকুণ্ডায় আছে সামরিক বিমানবাহিনীর ঘাঁটি, সেটি ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানি ছত্রীবাহিনীর অবতরণের গুজব ম ম করছে, আমরা সরল ও অবোধের মতন উন্মুক্ত স্থানে রাত্রিযাপন করতে গিয়ে ছত্রীবাহিনী সন্দেহে ধরা পড়ে গেলাম জনসাধারণের হাতে। এই জনসাধারণ সাধারণত যুক্তিটুক্তির ধার ধারে না, অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই রক্তলোলুপতা থাকে, সঙঘবদ্ধ হলেই তা প্রকট হয়, তখন একক অপরাধবোধ কাজ করে না, তা ছাড়া উগ্র দেশপ্রেম কৃত্রিম পেশীবল এনে দেয়। ওদের হাতে আমাদের শরীরগুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না, শেষ পর্যন্ত বেঁচে গিয়েছিলাম অনেকটাই বেলাল চৌধুরীর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে বলা যেতে পারে।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের হস্তক্ষেপে ভারত-পাকিস্তানের লড়ালড়ি শেষ পর্যন্ত থামল। পাকিস্তানের জঙ্গি শাসক আইয়ুব খান এর মধ্যে একটা হাস্যকর নির্বাচনের মারফত রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, ভারতে জওহরলাল নেহরুর পর প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। কাশীর পণ্ডিত বংশের ছেলে, ছোট্টখাট্টো চেহারার নিরীহ লালবাহাদুর শাস্ত্রী এত বড় একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন, এ তিনি কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি, বরং আইয়ুব খানের মুখে যুদ্ধ-হুংকার মানিয়ে যায়। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন এই দু’জনকে ডেকে নিয়ে গেলেন তাসকেন্ট, সেখানে কাশ্মীর নিয়ে দরাদরি চলল। যুদ্ধ বিরতির যে-কোনও শর্ত মেনে নিলে সেটা আইয়বের কাছে পরাজয়ের সমান, আর লালবাহাদুরও ভাবতে লাগলেন, ভারতে যে-রকম পাকিস্তান বিরোধী উন্মাদনা রয়েছে, তাতে আইয়ুবের কাছে কোনও রকম নতি স্বীকার করলে দিল্লিতে ফিরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারটিতে কি আর বসতে পারবেন? তাসকেন্টে আলোচনার কোনও অগ্রগতি নেই। বারবার ভেস্তে যাবার উপক্রম, শেষ পর্যন্ত কোসিগিনের পীড়াপীড়িতে একটা জোড়াতালি দেওয়া যুক্ত বিবৃতি তৈরি হল, ফটোগ্রাফারদের সামনে কাষ্ঠহাসি দিয়ে আইয়ব ও লালবাহাদুর হাত মেলালেন, তারপর ভোজসভায় কোনওক্রমে একটুখানি নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করে লালবাহাদুর শুতে চলে গেলেন তাড়াতাড়ি। এই যুক্ত বিবৃতির কী প্রতিক্রিয়া হবে দেশে, এই দুশ্চিন্তায় ঘুমের নামগন্ধ নেই, এতটা মানসিক চাপ তাঁর সহ্য হল না, রাত একটা পঁচিশে শুরু হল প্রবল বুক ব্যথা, সাত মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে গেল শেষনিশ্বাস।

পঁয়ষট্টি সালের যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তানের বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি। কারও অহংবোধও তৃপ্ত হয়নি, বরং ক্ষতির পরিমাণ বিপুল। ভারতে অর্থনৈতিক অবনতিতে সব দিকে অভাব, তার মধ্যে খাদ্যাভাব সবচেয়ে তীব্র। আমেরিকা বরাবরই পাকিস্তানের পক্ষপাতী, ভারতের জোট নিরপেক্ষতা নীতি আমেরিকার মতে আসলে ভণ্ডামি, তাই পাকিস্তানকে তারা সবরকম সাহায্য করে। চিনের সঙ্গেও সীমান্ত যুদ্ধের পর ভারতের সঙ্গে আর মুখ দেখাদেখিও নেই, চিনও ঝুঁকে আছে পাকিস্তানের দিকে, একমাত্র রাশিয়াই ভারতের ঘোষিত বন্ধু। কিন্তু বিপদের সময় রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র ও বিমান পাঠিয়ে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু ভারতকে খাদ্য সরবরাহ করার সামর্থ্য রাশিয়ার নেই। রাশিয়াকেই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়, কৃষিজমির ব্যক্তি মালিকানার বিলোপ করে যৌথ খামার ব্যবস্থার সুফল বিশেষ পাওয়া যায়নি।

যুদ্ধের পর পশ্চিম বাংলায় চাল-গমের দারুণ অনটন, র‍্যাশনিং ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার উপক্রম। শহরে তবু অনেকগুণ বেশি দাম দিয়ে কালোবাজার থেকে কিছু চাল কিনতে পারা যায়, গ্রামে গ্রামে একেবারে হাহাকার পড়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন সপ্তাহে প্রতি সোমবার বাঙালিদের না খেয়ে থাকার উপদেশ দিয়ে উপহাসের পাত্র হলেন। হোটেলগুলিতে দু’বেলা ভাত পরিবেশন নিষিদ্ধ হয়ে গেল, অর্থাৎ বেশি দাম দিয়ে গোপনে ভাত পাওয়া যাবে এবং চার-পাঁচ তারার বড় হোটেলগুলিতে পোলাও-বিরিয়ানি ঠিকই পাওয়া যাবে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কিংবা মফস্বল থেকে কলকাতায় চাল আনা-নেওয়া বন্ধ করার জন্য চেক পোস্ট বসিয়ে চালু হল করডনিং, অর্থাৎ আরও এক রকম ঘুষের ব্যবস্থা এবং গ্রামের সাধারণ মানুষ, বয়স্কদের সঙ্গে বাচ্চা ছেলেরাও, এমনকী ঘরের বউরাও নিযুক্ত হয়ে গেল চোরাচালানিতে, রেলের কামরায় সিটের তলায় চালের বস্তা নিয়ে লুকিয়ে শুয়ে থাকে বালক ও নারীরা। রেশনের চাল যে-টুকুও বা পাওয়া যেত, তাতে খুব কাঁকড় মেশানো। ভাত খেতে বসে যখন-তখন দাঁত ভেঙে যাবার উপক্রম হত। চিনিও বাজার থেকে আত্মগোপন করল, গুড় দিয়ে চা খেতে গিয়ে নষ্ট হল চায়ের স্বাদ। সর্ষের তেলে শিয়ালকাঁটার ভেজাল। ভেজাল প্রায় সব কিছুতেই। এমনকী বেবি ফুডে পর্যন্ত। কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা কমে যেতে লাগল হু হু করে, দারুণ এক খাদ্য আন্দোলনের সম্ভাবনা দেখা গেল দিগন্তে।

লালবাহাদুরের আকস্মিক মৃত্যুর পর ভাগ্য খুলে গেল ইন্দিরা গাঁধীর। প্রবীণ কংগ্রেসী নেতারা মনে করলেন, এই অনভিজ্ঞা তরুণীটিকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে তাঁরাই আড়াল থেকে সুতো টানাটানি করবেন, কিন্তু অচিরেই স্বমূর্তি ধরলেন জওহরলালের কন্যা এবং পিতৃস্থানীয় নেতাদের পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়ে দিল্লির মসনদে নেহরু বংশের ধারাবাহিক অধিকারের পথ প্রশস্ত করলেন, জাতীয় কংগ্রেসে শুরু হল ভাঙনের পর ভাঙন!

ওদিকে পাকিস্তানেও আইয়ুব খানের দম্ভ ও ক্ষমতা অনেকখানি চূর্ণ হয়ে টলমল করছে গদি, আর একটি সামরিক অভ্যুত্থান আসন্ন। উইংসের আড়ালে অপেক্ষমাণ জেনারেল ইয়াহিয়া খান। পূর্ব পাকিস্তানে সব রকম রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অধিকাংশ নেতা, এমনকী অনেক সংবাদপত্রের সম্পাদকও কারারুদ্ধ, তবু যুদ্ধ চলার সময় অধিকাংশ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ মনে করত, ভারতই আক্রমণকারী এবং পাকিস্তানকে ভাঙতে চায়, তাই সরকারকে সমর্থন করা উচিত। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার পর অন্য রকম উপলব্ধি হল, পূর্ব পাকিস্তান তো ছিল অরক্ষিত, সৈন্যবল ও অস্ত্রবল প্রায় সবই তো পশ্চিম পাকিস্তানে। এই সময় ভারতীয় বাহিনী যদি সত্যিই ঢাকা আক্রমণ করত, তা হলে তার প্রতিরোধ করার তো কোনও উপায়ই ছিল না। পাকিস্তানি শাসকদের কাছে পূর্ব বাংলা যেন অতি অবহেলিতা দুয়োরানি। আয়তনে ও জনসংখ্যার হিসেবে জাতীয় সম্পদের কিছুটা বেশি-ভাগ প্রাপ্য বাঙালিদের, কিন্তু তা পাওয়া তো দূরের কথা, সেনাবাহিনীতে, কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল সার্ভিসে বাঙালিদের সংখ্যা নগণ্য। গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তিত হলে ন্যায্য অধিকার আদায় করে নেওয়া যেত, কিন্তু এই পাকিস্তানে গণতন্ত্র সুদূর পরাহত। ধর্মের মিল থাকলেও সাম্য আসে না, ইসলামি রাষ্ট্র হয়েও পশ্চিমের ভূমিকা প্রভু ও শোষকের, আর পূর্বের মানুষ নির্যাতিত ও শোষিত। তা হলে আর এই রাষ্ট্রের বন্ধন টিকিয়ে রাখার কী অর্থ হয়? স্বশাসন কিংবা স্বাধীনতার দাবি গুঞ্জরিত হতে থাকল পূর্ব পাকিস্তানে।

এই যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আমাদের মন খারাপ লাগত। ওদিক থেকে আবার হাজার হাজার পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসতে শুরু করেছে এদিকে। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে আমি পুরনো ও দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ অভিযানে প্রায়ই যেতাম বিভিন্ন জায়গায়, এর মধ্যে একবার গিয়েছিলাম লালগোলায়। সেখান থেকে অদূরে একটি স্থানের নাম ভগবানগোলা। এই নামটি শুনলেই রোমাঞ্চ জাগে, এখানেই নদীর বুকে নৌকোয় ছদ্মবেশী, পলাতক নবাব সিরাজউদ্দৌলা ধরা পড়ে যান, এবং মহম্মদী বেগের ছুরিতে প্রাণ হারান। অবশ্য একটা অতি জনপ্রিয় নাটকেই এরকম ঘটনা আছে, আসলে সিরাজ ধরা পড়েছিলেন মালদার মানিকচক ও রতুয়া থানার মাঝখানে, কালিন্দী নদীর ধারে, দানসা ফকিরের দরগায়। সে যাই হোক, সেই ভগবানগোলায় গিয়ে নদীর ধারে একটা নির্জন জায়গায় ইন্দ্রনাথ ও আমি বসে রইলাম কিছুক্ষণ। নদীর মাঝখানে চরা পড়ে গেছে, সেখানে টোকা মাথায়, লুঙ্গি পরা কিছু লোক চাষের কাজে ব্যস্ত ওখান থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা। ইচ্ছে করলেই এক দৌড়ে চলে যাওয়া যায়, কিন্তু আসলে যায় না, কোথাও হয়তো ঘাপটি মেরে আছে পাকিস্তানি সীমান্ত রক্ষীরা। ওই যে ওইদিকে নদীর ধারে গাছপালায় ঢাকা, এখানকারই মতন একটা শান্ত গ্রাম, ওটা আসলে বিদেশ, খুবই দূরের দেশ, ওখানে আর কোনওদিনই যাওয়া হবে না। ইন্দ্রনাথের কাঁধের ঝোলায় কিছু না-কিছু থাকেই, একটা রামের বোতল বার করে চুমুক দিতে লাগলাম একটু একটু। ইন্দ্রনাথেরও জন্ম ওপার বাংলায়, এক সময় দু’জনেই ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিলাম কিছু একটা হাসির কথার মাঝখানে।

চাকরি-বাকরির ভরসা না করে, শুধু লেখালেখির জোরেই জীবন চালাবার যে ঝুঁকি নিয়ে আমি বিদেশ থেকে চলে এসেছিলাম, তা ব্যর্থ হয়নি। প্রচুর পরিশ্রম ও নানা ধরনের গদ্য লিখতে হত বটে, কিন্তু আমার উপার্জন মন্দ ছিল না। প্রথম দিকে অনেকেই বলেছিল আমায় ইংরেজি লেখার চেষ্টা করতে, ইংরেজির দক্ষিণা বেশি, শুধু বাংলা লিখে জীবিকানির্বাহ সম্ভব নয়, কিন্তু আমি এক ভাষার মানুষ, দুটি ভাষায় দু’নৌকোয় পা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার ইংরেজিজ্ঞানও তেমন ছিল না। এর মধ্যে আমার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, আমার ভাই দুটিও পড়াশুনো শেষ করে চাকরি পেয়েছে, সুতরাং আমার সাংসারিক দায় অনেক কম। কিন্তু তখনও আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। অর্থ উপার্জনের জন্য পত্র-পত্রিকায় লিখে যাচ্ছি গদ্য, সেগুলোর অন্য কোনও মূল্যই নেই আমার কাছে, নিজের শখে লিখে যাচ্ছি কবিতা, প্রকাশ করে যাচ্ছি কৃত্তিবাস পত্রিকা, যেন এমনভাবেই জীবন কেটে যাবে। তবে, এই সময় কয়েকটি বছর জীবনযাত্রা ছিল বড়ই উদ্দাম, অনেক সময় মৃত্যু নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছি, আচম্বিতে এই পৃথিবী থেকে সরে পড়া খুবই সম্ভব ছিল। কেন এই উদ্দামতা, কেন এত অস্থির ও অসহিষ্ণুভাবে নিজেকেই ভাঙার চেষ্টা, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। দেশ বা স্বাধীনতা সম্পর্কে নৈরাশ্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থাই কী এর জন্য দায়ী, তাও জানি না। সুস্থিরভাবে যে এ বিষয়ে চিন্তা করব, তারও যেন সময় ছিল না। কাব্যসাহিত্যে যৌবনেরই জয়গান হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে চিন্তা করে দেখেছি, আমার প্রথম যৌবন কেটেছে প্রায় একটা বোধহীন অবস্থায়। যা হচ্ছে হোক, এ রকম একটা বেপরোয়া মনোভাব ছিল, এবং বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র শক্তিই ঠিক এইভাবে তাল দিয়েছিল। সন্দীপনেরও ঝোঁক ছিল সম্পূর্ণ নৈরাজ্যের দিকে। বোধের গভীরতা, যদি কিছু এসে থাকে, তা আমাদের এসেছিল মধ্য যৌবনে।

পরপর দুটি প্রায় নাটকীয় ঘটনায় আমার জীবন আবার একটি অন্য দিকে বাঁক নেয়।

‘বিশ্বভারতী’ পত্রিকার এককালের সম্পাদক সুশীল রায় ছিলেন সাগরময় ঘোষের বিশেষ বন্ধু। তিনি কবিতাও লিখতেন এবং কবিতার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। বিশ্বভারতী পত্রিকার সম্পাদনা ছিল তাঁর জীবিকার অঙ্গ, কিন্তু নিজের শখে তিনি ধ্রুপদী’ নামে একটি ক্ষীণকায় কবিতা পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন দীর্ঘদিন। এই সুশীল রায়ের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয় রবীন্দ্ৰশতবার্ষিকীর সময়। সে সময় নানা রকম পাগলামি হয়েছিল, কবিতা-ব্যাধিও বলা যেতে পারে। কবিতা পত্রিকা প্রকাশের প্রতিযোগিতার একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল, ত্রৈমাসিক কবিতা পত্রিকা চালানোই ছিল বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার, আমরা কৃত্তিবাস’ পত্রিকা বছরে তিনটের বেশি বার করতে পারিনি, বুদ্ধদেব বসুর কবিতাও তখন অনিয়মিত, ময়ূখ’ সগৌরবে কিছুদিন চলার পর বন্ধ হয়ে গেছে, উত্তরসূরি’, শতভিষা, কবিপত্রও অনেক সময় চতুর্মাসিক, কিন্তু রবীন্দ্ৰশতবার্ষিকীর বছরে মাসিক কবিতার কাগজ, পাক্ষিকও বেরোতে লাগল, পঁচিশে বৈশাখের কবিপক্ষে আমাদের কবিতা সিংহ ও বিমল রায়চৌধুরী শুরু করলেন ‘দৈনিক কবিতা’, অর্থাৎ খবরের কাগজের মতন প্রতিদিন কবিতা পত্রিকা, সেটাকেও টেক্কা দেবার জন্য সুশীল রায় ঠিক করলেন, অন্তত পঁচিশে বৈশাখের দিনটিতে বেরুবে কবিতা ঘণ্টিকী। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় কবিতার বুলেটিন। বিমল রায়চৌধুরী আমাদের বন্ধু, সুশীল রায়ের অনুরোধে আমরা কবিতা ঘণ্টিকী’র মজাতেও যোগ দিলাম, অর্থাৎ শক্তির ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো’র মতন আমরা দৈনিক কবিতাতেও আছি, কবিতা ঘণ্টিকীতেও আছি। উভয় জায়গাতেই খাদ্য, পানীয় ও সিগারেট পাওয়া যাবে বিনা খরচে।

সুশীল রায় অত্যন্ত অতিথিবৎসল মানুষ, তাঁর স্ত্রী রন্ধনপটীয়সী ও অতি উদার-হৃদয় মহিলা, ওঁদের পাঁচটি কন্যাও ভারী মধুর স্বভাবের, শতবার্ষিকীয় হাঙ্গামা চুকে যাবার পরও ওঁদের কাঁকুলিয়ার বাড়িতে প্রায়ই আড্ডা ও খাদ্য-পানীয়ের আসর বসত। সাগরময় ঘোষই সেখানে মধ্যমণি, আমাদের মতন অর্বাচীনরা আমন্ত্রণ পেত মাঝে মাঝে। সাগরদা’র একটা বিশেষ গুণ ছিল, তিনি তাঁর বয়স, অভিজ্ঞতা ও ক্ষমতার বিকিরণ বুঝতে দিতেন না, সব বয়েসিদের সঙ্গে মিশতেন সমানভাবে। আমরা তাঁর হাঁটুর বয়েসি হলেও তিনি তাঁর সামনে আমাদের গেলাস ধরার এবং সিগারেট টানার অবাধ প্রশ্রয় দিতেন। প্রসঙ্গত বলা যায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্তও তাঁর সাহেবি পাড়ার আবাসে মাঝে মাঝে পানাহার ও সাহিত্য আলোচনার আসরে আমন্ত্রণ জানাতেন তাঁর ছাত্র, বন্ধু ও অন্যান্য কবিদের। সেখানে উপস্থিত থাকতেন বুদ্ধদেব বসু। আমার বন্ধুস্থানীয় কবিরা সুধীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র। তারা ওঁদের সামনে সুরার পাত্র গ্রহণ করার অনুমতি পেলেও সিগারেট টানত বারান্দায় গিয়ে গোপনে। এটা আমার কাছে মজার মনে হত, এবং যেহেতু আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও ওই দুই মহারথীর ছাত্র হইনি, তাই এই অদ্ভুত বিভাজন জানতাম না, ফস করে সিগারেট ধরিয়ে সুধীন্দ্রনাথের অননুমোদনের ভঙ্গিটি উপভোগ করতাম।

একদিন সুশীল রায়ের বাড়ির সান্ধ্য আসরের মাঝামাঝি অবস্থায় সাগরদা আমাকে চোখের ইঙ্গিতে বাইরে যেতে বললেন, এবং বারান্দায় নির্জনে হাত রাখলেন আমার কাঁধে। আমি হয়তো ঠিক সময়ে কোনও সাময়িক লেখা জমা দিইনি, এই কথা ভেবে বকুনি খাওয়ার জন্য সঙ্কুচিত, সাগরদা বকুনি দেবার চেয়েও বেশি গুরুতর মুখে বললেন, সুনীল, এবার শারদীয় সংখ্যায় দেশে তোমাকে উপন্যাস লিখতে হবে!

এটা ঠিক বিনা মেঘে বজ্রপাত বলা যায় না। ভূমিকম্পও ঠিক নয়। তবু আকস্মিকতার উপমায় সেই রকমই মনে হয়েছিল। এরকম অভিঘাতের কারণটি হয়তো এখনকার পাঠকবৃন্দ ঠিক বুঝতে পারবেন না, এখন প্রতি বছর শারদীয় সংখ্যার দেশ পত্রিকায় সাত-আটটি উপন্যাস ছাপা হয়, নানা বয়েসি লেখকের। সেই সময় শারদীয় দেশে উপন্যাস প্রকাশিত হত একটি মাত্র, সেটি লিখতেন কোনও সর্বজনমান্য প্রবীণ লেখক, অন্য বিশিষ্ট লেখকরা লিখতেন ছোট গল্প, তখন ছোট গল্পের বিশেষ গৌরব ছিল। প্রথম সারির লেখকরা তাঁদের সারা বছরের শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পটি জমিয়ে রাখতেন শারদীয় সংখ্যার জন্য। ছোট গল্পের এই গৌরবে আঘাত হানে সিনেমা পত্রিকাগুলি, তারাই প্রথম শারদীয় সংখ্যায় হঠাৎ পাঁচটি-ছ’টি নাম-করা লেখকের উপন্যাস ছাপতে শুরু করে এবং সেই দিকে আকৃষ্ট করে পাঠকদের। সে বছরই সাগরময় ঘোষ পূর্বতন প্রথা ভেঙে সিদ্ধান্ত নেন, প্রবীণ, মধ্যবয়স্ক ও নবীন, এই তিন বয়সের তিনজনের উপন্যাস প্রকাশ করবেন। কিন্তু নবীনদের প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে নির্বাচন করার তো কোনও যুক্তিই নেই! সাধারণ নিয়মটি ছিল এই, প্রথমে বেশ কয়েক বছর দেশ পত্রিকার সাধারণ সংখ্যায় গল্প লিখতে হবে, সেখানে যোগ্যতা প্রমাণিত হলে গল্প লেখার জন্য ডাক পাওয়া যাবে শারদীয় সংখ্যায়, সেখানেও বছরের পর বছর গল্প লিখে লিখে উপন্যাস লেখার সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে চুলদাড়িতে রীতিমতো পাক ধরা পর্যন্ত। কিন্তু আমি তখনও ‘দেশ’ পত্রিকার সাধারণ সংখ্যাতেও একটাও ছোট গল্প লিখিনি! অন্য অনেক ছোট গল্প লেখক রয়েছেন, ছোট গল্পের নতুন রীতি নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তাতেও আমি যোগদান করিনি, গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমি প্রকৃতই অনধিকারী, বহিরাগত আগন্তুক। দেশ’ পত্রিকায় শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস লেখার সম্মান সেই জন্যই আমার পক্ষে শুধু অভাবিত নয়, অবিশ্বাস্যও বটে।

আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল প্রত্যাখ্যানের। দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত, সেখানে দুর্বল কিছু লিখে পৃষ্ঠা নষ্ট করা আমার উচিত নয়। উপন্যাসের আঙ্গিক সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই, এক একটা পরিচ্ছেদ শেষ করতে হয় কোথায় এবং কেন? সাগরদাকে মৃদু স্বরে আপত্তির কথা জানাতেই ধমক দিয়ে বললেন, কোনও কথা শুনতে চাই না। তুমি কাল থেকেই লিখতে বসে যাও! সাগরদা দারুণ পড়ুয়া ছিলেন, সমস্ত পত্র-পত্রিকা (লিট্ল ম্যাগাজিনও বাদ দিতেন না) পড়ে নবীন লেখক-লেখিকাদের খুঁজতেন, একটি লিট্ল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত আমার ‘যুবক যুবতীরা’ও তিনি পড়েছিলেন, সেই সূত্র টেনে তিনি বললেন, তোমাকে ফর্মটর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, যা মনে আসবে লিখে যাবে।

সেটা সম্ভবত মে মাস, অর্থাৎ সাগরদা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বেশ দেরিতে, তখন হাতে টাইপ সাজানোর যুগ, কম্পোজ করতে অনেক সময় লাগে। শারদীয় সংখ্যার সব লেখা জুন মাসের মধ্যে জমা দিতেই হয়। উপন্যাস লেখার জন্য সময় দেওয়া হয় এক বছর, আমার মতন একজন অনভিজ্ঞ লেখককে জীবনের প্রথম অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে মাত্র এক দেড় মাসের মধ্যে? এ কখনও সম্ভব? পুরো উপন্যাসটি এক টানা লেখা, বারবার পড়ে কাটাকুটি-সংশোধনের সময়ও আমি পাইনি, প্রত্যেকদিন সকালে আমাদের নাগেরবাজারের বাড়িতে আদালতের পেয়াদার মতন হাজির হত দেশ পত্রিকার পিওন, আগের দিন দু-চার পাতা যা লেখা হয়েছে তাই-ই দিয়ে দিতে হত তার হাতে। তখনও জেরক্স চালু হয়নি, নিজের কাছে কপি রাখারও উপায় নেই। প্রেসের ভাষায় পৃষ্ঠাকে বলে স্লিপ, পিওনটি বলত, আজ ক’ছিলিপি? মোটে তিন? ক’দিনে শেষ করবেন?

উপন্যাসে নাকি একটা প্লট থাকতে হয়, প্রথম কয়েকটি দিন প্লট খোঁজার চিন্তায় বৃথা সময় নষ্ট করে তারপর মনে মনে বললাম, দুর ছাই, চুলোয় যাক প্লট! মনে পড়ে গিয়েছিল জ্যাক কেরুয়াকের একটা কথা। বিট জেনারেশানের লেখকদের মধ্যে জ্যাক কেরুয়াকই গদ্য লেখক হিসেবে খুব খ্যাতি পেয়েছিলেন, (অকস্মাৎ অকালমৃত্যুতে এই প্রতিভাবান লেখকটির রচনায় ছেদ পড়ে) সেই জ্যাক একদিন কথায় কথায় আমায় বলেছিলেন, আমায় প্লট খুঁজতে হয় না, নতুন উপন্যাস শুরু করার আগে আমি আমার জীবনের কোনও একটা ঘটনা মনে করার চেষ্টা করি, অমুক বছর অমুক মাসে আমি কী করছিলাম? মনে পড়লে, সেখান থেকে শুরু করি, তারপর লেখাটা নিজের মনে যেদিকে খুশি যায়। কেরুয়াকের একটাই উপন্যাস তখন পড়েছিলাম, ‘অন দ্য রোড’, সেটি এই রীতিরই রচনা। সমসাময়িক আরও কিছু বিদেশি উপন্যাসেও লক্ষ করেছি, কাহিনী যেন শুরু হয় চলমান জীবনের মাঝখান থেকে, পরিবেশ বা প্রকৃতি বর্ণনার ধানাইপানাই বাদ, চরিত্রগুলির চেহারা বা পোশাকটোশাকের বিবরণও অবান্তর, সে সব পরে দু-একটা আঁচড়ের অপেক্ষায় থাকে।

কয়েকদিন আগে, আমার এক বন্ধুর ভাই সকালে এসে আমার ঘুম ভাঙিয়েছিল, তার দাদা আগের রাত্রে বাড়ি ফেরেনি, আমার কাছে খোঁজ নিতে এসে সে কথা বলছিল চাপা ভর্ৎসনার ভাষায়, ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসটিও শুরু হল সেইভাবে, তার প্রথম বাক্যটিই এরকম সকালবেলা পরিতোষ এসে বলল, এ সব কী শুরু করেছেন আপনারা?’ এ উপন্যাসের নায়ক বা প্রধান চরিত্রের নামও সুনীল, উত্তমপুরুষে অর্থাৎ আমি আমি করে লেখা অভিনব কিছু নয়, কিন্তু এর আগে উত্তমপুরুষে লেখা যতগুলি উপন্যাস পড়েছি, সব কটিই লেখকের নাম আর নায়কের নাম এক নয়, অর্থাৎ লেখক বুঝিয়ে দেন, এটা তাঁর নিজের জীবনের কাহিনী নয়, এটা একটা আঙ্গিক মাত্র। কিন্তু সুনীল নাম দিয়ে আমি বোঝাতেই চেয়েছি যে এটা আমার নিজের জীবনের ঘটনা। কিন্তু আত্মজীবনী নয়। প্রকৃত ঘটনা দিয়ে শুরু করলেও লেখার নিজস্ব একটা যুক্তিতে নতুন নতুন প্রসঙ্গের নির্মাণ হয়। বাস্তবজীবনী ছাড়াও মানুষের একটা আলাদা ভাবজীবনী থাকে, তা আলাদা হতে বাধ্য, আবার কখনও কখনও বাস্তবজীবন ও ভাবজীবনী মিলেমিশেও যায়, যেমন সমান্তরাল দুটি রাস্তা কখনও এক জায়গায় মিশে গিয়ে, কিছুক্ষণ চলার পর আবার পৃথক হয়ে যায়। আত্মপ্রকাশের সুনীলও কখনও পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু পরিবারের এক উদ্ভ্রান্ত যুবা, কখনও সে ক্রুদ্ধ, অস্থির যুবসমাজের প্রতিনিধি। লিখতে লিখতে একটা মজা পেয়ে গিয়েছিলাম, তখন গল্পউপন্যাস লিখে প্রতিষ্ঠা পাবার কোনও উচ্চাকাঙক্ষা আমার মনে দানা বাঁধেনি, সাগরদার তাড়নায় এই একটিই লিখছি, ভবিষ্যতে আর লিখব না হয়তো, সুতরাং এই লেখায় কিছু মূল্যবোধ নিয়ে খেলা করলে মন্দ কী, পাঠকদের আঘাত লাগে তো লাগুক। ভাষাটাকেও ইয়ার্কি-ঠাট্টা মিশিয়ে যত দূর সম্ভব মুখের ভাষা করা যায়। এরকম সাবলীল ও যথেচ্ছভাবে অনেকখানি লেখার পর হঠাৎ আমার মনে হল, এ যা লিখে যাচ্ছি, গল্পের মাথামুণ্ডু নেই, এ কী সত্যি পাঠযোগ্য? নাকি নিতান্তই ভাবালুতা? অথবা সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় গর্ভস্রাব? পাঠকরা যদি বলেন, (অর্থাৎ আমার কিছু পরিচিত ব্যক্তি যাঁদের মতামতের আমি মূল্য দিই, সেই কয়েকজন পাঠক) এ সব এলোমেলো গদ্যপ্রবাহের কী মানে হয়? এই দ্বিধা ও সন্দেহ যেই মনে এল, অমনি ভয় ধরে গেল, দারুণ শীতের কাঁপুনির মতন অবস্থা। তবে কী পুরোটাই ছিঁড়ে ফেলে আবার লেখা উচিত? তারও তো সময় নেই। দু’-একদিন হতাশা-ব্যর্থতাবোধে ডুবে থাকার পর দেশ পত্রিকার পিওনের তাড়নায় আবার শুরু করতে হল লেখা, জোর করে ঢুকিয়ে দিলাম একটি উপকাহিনী। পূর্ববঙ্গের এক অভিনেত্রীর ঘটনাটি অন্যের মুখে শোনা, আমার নিজের অভিজ্ঞতার নির্যাস নয় বলেই বেশ কৃত্রিম, এবং আত্মপ্রকাশ উপন্যাসে সেই অংশটিই সবচেয়ে দুর্বল।

‘দেশ’ শারদীয় সংখ্যা প্রকাশের সময় আমি লজ্জায় ও আতঙ্কে কিছুদিন লুকিয়েছিলাম কলকাতার বাইরে। উপন্যাসটির জন্য নিন্দা ও প্রশংসা দুই জুটেছিল, তবে, নিন্দা, বিরূপ সমালোচনা এবং কটুক্তিই বেশি। আমার প্রধান সান্ত্বনা, সাগরদা বলেছিলেন, তুমি আমার মুখ রক্ষা করেছ। এবং দু’-একজন, তাঁদের মধ্যে খুবই আশ্চর্যজনকভাবে আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতন রবীন্দ্রবিমুগ্ধ এবং সত্য-শিব-সুন্দরের বন্দনাকারীও জানিয়েছিলেন, এই উপন্যাসে তিনি আন্তর্জাতিক আধুনিকতার স্বাদ পেয়েছেন। সেইটুকুই আমার পক্ষে যথেষ্ট।

হয়তো জীবনে আর কোনও উপন্যাসই লিখতে প্রবৃত্ত হতাম না, কিন্তু পরের বছরই আর একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটল। ‘জলসা’ নামের একটি সিনেমা পত্রিকা তখন খুব জনপ্রিয় ছিল। সে পত্রিকার সঙ্গে আমার কোনও সংস্রব ছিল না, কিন্তু সেই প্রেস থেকে ছাপা হত কৃত্তিবাস। পরপর দু’ সংখ্যায় ধার জমে গিয়েছিল, এর মধ্যে আমার খানিকটা পরিচিতি হয়েছে বলে টাকা মেরে দিয়ে পালানো সম্ভব নয়, আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে গিয়েও আমাকে ধরে ফেলা যায়। টাকার জন্য তাড়া দিতে দিতে সেই পত্রিকার মালিক একদিন একটি চমকপ্রদ প্রস্তাব দিলেন। আমি যদি ‘জলসা’র শারদীয় সংখ্যার জন্য একটি উপন্যাস লিখে দিই, তা হলে আমাকে আর প্রেসের ধার মেটাতে হবে না, তাঁরাও লেখাটার জন্য কোনও দক্ষিণা দেবেন না। কাটাকুটি! এ প্রস্তাব আমার কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতন। আমাকে আর টাকাটা শোধ দিতে হবে না। এর চেয়ে আর আনন্দের কী হতে পারে। কারও কাছে ধার থাকলে সর্বক্ষণ গায়ের জামাটা ঘামে ভেজা মনে হয়। ঋণমুক্ত হওয়া মানে সাঁতার কেটে স্নানের মতন অনুভব।

প্লট নিয়ে কোনও চিন্তাই করতে হল না। কিছুদিন আগেই আমরা চার বন্ধু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, ভাস্কর দত্ত ও আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম এক অনির্দিষ্ট অভিযানে, টিকিট না কেটে উঠেছিলাম ট্রেনে, এক সহযাত্রীর পরামর্শে নেমে পড়লাম ধলভূমগড়ে। সেই সময় ধলভূমগড় ছিল খুবই নিরিবিলি জায়গা, কাছেই জঙ্গল, তার মধ্যে মধ্যে আদিবাসীদের গ্রাম, এবং একটি আইনসঙ্গত পানশালা, যেখানে শুধু মহুয়ার মদ পাওয়া যায়। টিকিট না কাটলেও আমরা বিনা টিকিটের যাত্রী নই, চেকারকে পয়সা দিয়ে রশিদ নিয়েছিলাম, স্টেশনের ওভারব্রিজ পার হতে হতেই ঠিক করেছিলাম, আর খবরের কাগজের সঙ্গে অর্থাৎ বাকি পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখব না, ছদ্ম পরিচয়ে দখল করেছিলাম বনবাংলো এবং সন্ধেবেলার মিশমিশে অন্ধকারে মনে হয়েছিল, মিছিমিছি জামাকাপড় পরে থাকার দরকারই বা কী! ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাস শুরু হল ঠিক এইভাবে। তারপর কাহিনী একটা অবয়ব পায়। এর মধ্যে অনেক ঘটনা বাস্তবে সত্যি সত্যি সংঘটিত হয়নি, কিন্তু শিল্পেরও একটা অলীক বাস্তবতা থাকে। অনেকটা গুরুত্বহীনভাবে লেখাচ্ছলে লেখা। এই উপন্যাস কারও চোখে পড়বার কথা নয়, কিন্তু চোখে পড়ল সত্যজিৎ রায়ের। তিনি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ নিয়ে ফিল্ম করতে চাইলেন। সত্যজিৎ রায় তখন তাঁর খ্যাতির মধ্যগগনে, বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক রচনা-নির্ভর তাঁর চলচ্চিত্রগুলি, আধুনিকদের মধ্যে তিনি শুধু নরেন্দ্রনাথ মিত্রের একটি কাহিনী গ্রহণ করেছিলেন, সেই তুলনায় আমি তো প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল। সমস্ত পত্রিকায় এই প্রশ্নই ধ্বনিত হয়েছিল, সত্যজিৎ রায় এরকম একজন নবীন লেখকের কাহিনী নির্বাচন করলেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানার কথা নয়। (পরে জেনেছিলাম, ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসটি পড়েও সত্যজিৎ রায় সেটি নিয়ে ফিল্ম করার কথা চিন্তা করেছিলেন, কিছু বাস্তব অসুবিধের জন্য সে প্রকল্পটি মুলতুবি হয়ে যায়।)

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ অবলম্বনে ফিল্ম করার প্রস্তাব জানিয়ে সত্যজিৎ রায় যেদিন সন্ধেবেলা আমাকে ফোন করেন, সে রাতে কেন জানি না সারা রাত আমি একলহমার জন্যও ঘুমোতে পারিনি। এরকম একেবারে নিদ্রাহীন রাত কাটাবার অভিজ্ঞতা আর আমার মনে পড়ে না। এটা যে ঠিক আনন্দের অস্থিরতা, তাও নয়, খ্যাতি কিংবা অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনার উত্তেজনাও নয়, বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, আমার জীবনে নতুন কিছু ঘটতে যাচ্ছে, আমি যেন একটা বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে, কিন্তু অন্য দিকটা দেখতে পাচ্ছি না।

এর পরের উপন্যাসটিও আমি লিখি একটি অতি স্বল্পস্থায়ী সিনেমার পত্রিকায়। এটাও আমার নিজেরই বেকার জীবন এবং বহু চাকরির ব্যর্থ ইন্টারভিউ দেবার অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। এবং কিমাশ্চর্যম অতঃপরম, এই ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ও সত্যজিৎ রায়ের মনে ধরে গেল, এই উপন্যাস অবলম্বনেই তিনি সৃষ্টি করলেন তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্র। দুটি ছবিই আন্তর্জাতিক সুনাম পেয়েছে এবং প্রদর্শিত হয়েছে নানা দেশে, যে সব বিদেশি লেখক লেখিকার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, তাদের কয়েকজন চিঠি লিখে জানাল রে’র ফিল্মে কাহিনীকার হিসেবে তোমার নাম দেখলাম, তুমি কবে থেকে ঔপন্যাসিক হয়ে উঠলে? এর উত্তর তো আমি নিজেই জানি না। দেশের সবকটি বড় বড় পত্র-পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় ততদিনে কবিতার জন্য আমি আমন্ত্রণ পাই, এখন থেকে সম্পাদকরা বলতে লাগলেন, কবিতা দাও বা না দাও, তোমাকে উপন্যাস লিখতেই হবে, অন্ততপক্ষে বড় গল্প। স্বনামে তো বটেই, এমনকী নীললোহিতও হয়ে উঠল উপন্যাসকার। যেন ইচ্ছে-অনিচ্ছের প্রশ্ন নেই, একটা ঘূর্ণিপাকে পড়ে আমি ভাসতে ভাসতে চলে এলাম গদ্যের জগতে। পাকাপাকিভাবে, সেখান থেকে আর বেরুবার রাস্তা রইল না।

পঁয়তাল্লিশ

একদা উত্তর কলকাতার দেশবন্ধু পার্কে, সন্ধের পর জনবিরল হয়ে গেলে, একটা আলোর স্তম্ভের নীচে দশ-বারোজন বন্ধু গোল হয়ে বসে নিজেদের সদ্য রচিত গল্প-কবিতা পাঠ করে শোনাতাম। কিছুদিন পর সে আসর বন্ধ হয়ে গেলেও বেশ কয়েক বছর পর আবার চালু হয় দক্ষিণ কলকাতায় শংকর চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। আমাদের মধ্যে একমাত্র শংকরেরই ছিল নিজস্ব একটা বৈঠকখানা, সেখানে নিরবচ্ছিন্ন আড্ডায় ব্যাঘাত ঘটাত না কেউ, পাশের একটা দোকান থেকে অনবরত আসত ভাঁড়ের চা, এক একদিন ওপর থেকে মাসিমার তৈরি নানারকম সুখাদ্য। শংকরের মা ছিলেন সম্ভবত আমাদের সকলের জননীর তুলনায় বেশি বিদুষী, তিনি ইংরিজি উপন্যাস পড়ে সময় কাটাতেন। শুধু আড্ডা নয়, প্রতি রবিবার সন্ধেবেলা সেখানে অন্তত তিন-চারজনকে নতুন রচনা পড়তে হবে, আগে থেকে নির্দিষ্ট করা হত নামগুলি। আমি ছিলাম শ্রোতা, কারণ নিজের লেখা পকেটে নিয়ে ঘোরার অভ্যেস আমার ছিল না, বরং সঙ্কোচ ছিল। কিন্তু বেশিদিন পাশ কাটানো গেল না। এক রবিবার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এবং কয়েকজন চেপে ধরল, পরের রবিবার আমাকে একটি গল্প শোনাতেই হবে, নইলে আমার আর প্রবেশ-অধিকার থাকবে না। কবিতা শোনালেও চলবে না, শ্যামল এবং কয়েকজন গল্পকারের মতে, এক-আধ পাতার কবিতা নাকি নিতান্তই ফাঁকিবাজি।

সেই রবিবারটিতে আমি সকাল থেকে চেষ্টা করেও একটা গল্প লিখে উঠতে পারিনি। অথচ আড্ডার টানে মনটা খুবই অস্থির, গল্প নিয়ে যেতেই হবে, সন্ধে হয়ে গেছে, তবু আমি কোনওক্রমে হুড়হুড়িয়ে গল্পটা লিখে শেষ করার চেষ্টা করছি, এই সময় আমার ছোট ভাই এসে খবর দিল, কয়েকটি মেয়ে ও এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, তাঁরা অচেনা এবং গাড়ি করে এসেছেন। শুনে খুবই অবাক হতে হয়। কারণ অতদূর নাগেরবাজারের বাড়িতে বন্ধু- বান্ধব আর কৃত্তিবাসে রচনা প্রকাশেচ্ছু অত্যুৎসাহী তরুণ কবি ছাড়া আর কেউ আসে না, তাও দিনের বেলা, বিকেলের পর আমি কোনওদিনই বাড়ি থাকি না, সেদিনও আর দশ-পনেরো মিনিট পরে আমাকে পাওয়া যেত না। এবং গাড়ি-চড়া লোকেরা আমার খোঁজ করার কোনও কারণ নেই।

আমাদের মোটে দু’ঘরের ফ্ল্যাট। দু’দিকে দুটি প্রশস্ত বারান্দা আছে বটে, কিন্তু বৃষ্টির সময় ব্যবহার করা যায় না। সেটা বর্ষাকাল। আমার ঘরটিতে একটি খাট পাতা, তাতেই অনেকখানি ভরে গেছে, সে খাটে আমি ও আমার মেজ ভাই শুই, কোনওক্রমে এক কোণে একটি লেখাপড়ার টেবিল এবং দুটি মাত্র চেয়ার। সেখানেই আসতে বলা হল আগন্তুকদের। ভদ্রলোকটির বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি, তরুণী দুটি তিরিশের থেকে দূরে, অন্যজন বাচ্চা মেয়ে। তিনজনেরই চেহারার উজ্জ্বলতা ও সাজ পোশাকের রুচি দেখলেই বোঝা যায়, দক্ষিণ কলকাতার। পুরুষটিও সেই কথাই জানালেন, তারা আসছেন দক্ষিণ কলকাতা থেকে, এই ঠিকানায় পৌঁছতে অনেক খোঁজাখুঁজি ও ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। তা তো হবেই, দক্ষিণ কলকাতার লোক উত্তর কলকাতা প্রায় চেনেই না, নাগেরবাজার তখন নিতান্তই মফঃস্বল, ভি আই পি রোড পুরোপুরি তৈরি হয়নি, সল্টলেক নামের উপনগরীটির অস্তিত্ব নিছক কাগজে কলমে, এদিককার রাস্তাগুলি অন্ধকার-অন্ধকার, আমাদের বাড়ির সামনের খোলা জায়গাটিতে আলো জ্বালাবার কোনও ব্যবস্থাই নেই। অতদূর থেকে কষ্ট করে ওঁরা এসেছেন কেন? কারণটি অবিশ্বাস্য রকমের চমকপ্রদ। ওঁরা এক কপি কৃত্তিবাস পত্রিকা কিনতে চান।

আমার এই আস্তানার ঠিকানাই কৃত্তিবাসের কার্যালয় বটে, পত্রিকা আমরা বিভিন্ন স্টলে পৌঁছে দিই, দক্ষিণ কলকাতাতেও। কোনও স্টল থেকে না কিনে এতদূর চলে আসার কোনও মানে হয় না। আর যত ছোট পত্রিকাই হোক, আমি তাঁর সম্পাদক তো বটে, সম্পাদকের একটা মান-সম্মান আছে, সম্পাদক কখনও নিজে পত্রিকা বিক্রি করে না। তবে, সম্পাদক কারুকে কারুকে ইচ্ছে করলে কমপ্লিমেন্টারি কপি দিতে পারে। এ রকম উৎসাহী পাঠকদের সম্পাদক এক কপি পত্রিকা উপহার দিতে চাইলেও এই সান্ধ্য-আগন্তুকরা তা নিতে রাজি নয়। পত্রিকার দাম মাত্র এক টাকা, ভদ্রলোকটি একটি এক টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন, সম্পাদক তা কিছুতেই নেবে না, এই নিয়ে চলল ঝুলোঝুলি। ভদ্রলোকের কথা শুনলেই বোঝা যায়, কবিতা সম্পর্কে তাঁর বিশেষ কোনও আগ্রহ নেই, পত্রিকার নাম কৃত্তিবাস না কাশীরাম তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না। তিনি খুব সম্ভবত এসেছেন ওই তরুণীদের কোনও একজনের অনুরোধে। অচেনা লোকদের বাড়িতে গিয়ে মেয়েরা কখনও বিছানায় বসে না, চেয়ারের অভাবে মেয়েরা দাঁড়িয়েই আছে, কেউ কোনও কথা বলছে না। নামও বলা হয়নি। পুরুষ মানুষ হিসেবে আমি ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে আড়চোখে একাধিকবার দেখে নিয়েছি দুই তরুণীকে, তাদের মধ্যে বিশেষ একজনের চোখেই যেন রয়েছে বেশি কৌতূহল ও কবিতা-প্রবণতা। এটা কী করে বোঝা যায়। তা ব্যাখ্যা করা যায় না, তবু একটা কিছু তরঙ্গ টের পাওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত এক টাকার প্রশ্নটিতে আমার জেদ বজায় রইল, এবং ভদ্রতাবশত ওদের পৌঁছে দিতে গেলাম নীচের দরজা পর্যন্ত। বিদায় সম্ভাষণের পর সেই বিশেষ তরুণীটি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখ খুলল, জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, একটা কথা বলব? আমি উত্তর দেবার আগেই সে আমায় বলল, আচ্ছা থাক। সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরল এবং চারজনেই মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

আমি খানিকক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সব কিছুই যেন প্রহেলিকাবৎ! অতদূর থেকে গাড়ির পেট্রোল পুড়িয়ে সামান্য এক টাকার পত্রিকা কিনতে আসা, দু’জন নীরব তরুণীর একজন শেষ মুহূর্তে কিছু বলতে চেয়েও না বলে চলে যাওয়া… কী বলতে চেয়েছিল সে? মেয়েরাই পারে এ রকম রহস্যসৃষ্টি করতে। না-বলা বাণীর ঘনযামিনীতে আমি বিমূঢ়!

সে মেয়েটির মুখচ্ছবি আমার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে রইল। তার নাম জানি না, ঠিকানা জানি না, আর কোনওদিন তার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনাও নেই, জানা হবে না সে কী বলতে চেয়েছিল? একদিন যেন কলেজ স্ট্রিটে দেখলাম তাকে হেঁটে যেতে, সত্যিই সে কী না তা বুঝে নেবার আগেই সে মিলিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। ম্যাক্সমুলার ভবনে একদিন কাব্যপাঠের আসরে শ্রোতাদের মধ্যে পেছনের দিকে কি সে-ই বসেছিল, না কি তার মতন চেহারার কাছাকাছি অন্য কেউ? এ রকম মাঝেমাঝেই আমার দৃষ্টিভ্রম হতে লাগল। যেন চলতে লাগল লুকোচুরি খেলা। পথের বাঁকে মিলিয়ে যাওয়া কিংবা দোতলা বাসের জানলার ফ্রেমে বাঁধানো একটি মুখ এক ঝলক দেখা, যেন ঠিক সেই মেয়েটি। অথচ মুখোমুখি দেখা হয় না কেন? কবিতা পড়তে ভালোবাসে, যদি মাঝে মাঝে কলেজ স্ট্রিটে আসে, তা হলে আমার সঙ্গে দেখা হওয়া খুবই স্বাভাবিক, সেখানে আমার নিত্য হাজিরা।

কী বলতে চেয়েছিল সে? সেটা জানতে হবে, এবং ভেতরে ভেতরে তৈরি হতে লাগল প্রবল এক ইচ্ছাশক্তি, যার টানে ওই মেয়েটির সঙ্গে আর একবার দেখা হবেই হবে। একদিন আনন্দবাজার অফিসে বসে ‘দেশে দেশে’ বিভাগের জন্য ছবির ক্যাপশন লিখছি, সন্তোষকুমার ঘোষ আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর ঘরে তিনটি তরুণী বসে আছে, সমবয়সিনী হলেও ত্রিধারার মতন, তাদের মধ্যে একজন সেই না-বলা কথার রহস্যময়ী। সন্তোষদা বললেন, এরা আনন্দবাজার অফিস দেখতে এসেছে, মেশিন ঘরটর দেখা হয়ে গেছে, তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। অন্য দু’জনের নাম লক্ষ্মী চৌধুরী ও এষা মুখোপাধ্যায়, তাদের আগে দেখিনি, তৃতীয় জনের নাম শুনেই চমক লাগল। মাঝে মাঝে পাঠক-পাঠিকাদের কাছ থেকে চিঠিপত্র পাই, স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক পত্ৰলেখিকাকে দু’ তিনবার উত্তরও দিয়েছি, এই কী সে? তা হলে সেই সন্ধ্যায় কৃত্তিবাস সংগ্রহ করার উপলক্ষে সে আমাকে স্বচক্ষে দেখতে গিয়েছিল? আমিও তাকে আবার দেখতে চেয়েছি বলেই তো ইচ্ছাশক্তি দিয়ে টেনে এনেছি এখানে।

কথায় কথায় সেই যুবতীত্রয় জানাল যে দক্ষিণ কলকাতায় তাদের একটি ক্লাব আছে, সেখানে একদিন আমাকে কবিতা পাঠ করতে হবে। আমি তো যাকে বলে, এক পায়ে খাড়া, কেন না আবার দেখা হবে। সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে বোঝা গেল, বান্ধবীদের মধ্যে স্বাতীই সবচেয়ে লাজুক, খুব কম কথা বলে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ও আমার দৃষ্টির মধ্যে একটা সেতুবন্ধন হয়ে গেল, সেখানে কথার কোনও প্রয়োজন নেই। চোখের আড়াল হলে চিঠিতে বলা যায় অনেক কিছু, এরপর কয়েক সপ্তাহ ঘন ঘন পত্র বিনিময় হতে লাগল, চিঠি পড়লেই বোঝা যায়, মেয়েটির বাংলা ভাষায় জ্ঞান যথেষ্ট। প্রথম প্রথম নৈর্ব্যক্তিক ভাব বিনিময়, তারপর ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি আসার পর, বান্ধবীদের বাদ দিয়ে একদিন একা একা দেখা করার অনুরোধ জানালাম আমি। গঙ্গার ধার। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ন্যাশনাল লাইব্রেরির সামনের মাঠ (ওই লাইব্রেরিতে আমি বিনা পয়সায় পাখার হাওয়া খাওয়ার জন্য কয়েক ঘণ্টা কাটাতাম প্রায়ই), ময়দানের মধ্য দিয়ে হাঁটা, কিংবা ঘোর দুপুরে চিড়িয়াখানা। ভিক্টোরিয়া স্মৃতি উদ্যানের মধ্যে একটি ছোট রেস্তোরাঁ ছিল, ভোর থেকেই খুলত, নাগেরবাজার থেকে খুব ভোরে উঠে সেখানে চায়ের কাপ নিয়ে দু’জনে বসে থাকতাম অনেকক্ষণ। স্বাতীর চোখে মুখে এমন একটা সারল্য, যেন সে জানেই না পৃথিবীতে খারাপ কিছু আছে, লোভ, হিংসা, ঈর্ষা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে যে কত মানুষ অযথা সময় নষ্ট করে এ সম্পর্কে তার কোনও ধারণাই নেই, সে সর্বাঙ্গীণ রোমান্টিক, সাহিত্য ও গান বাজনার জগৎ ছাড়া তার অন্য বাস্তবতা বোধ নেই। তার এই সারল্যের কাছে মাঝে মাঝেই আমার মাথা হেঁট হয়ে যেত, মনে হত আমি অযোগ্য।

স্বাতী তখন বি এসসি পাশ করে একটি বাচ্চাদের স্কুলে শখ করে পড়ায় সকালবেলা, বিকেলে আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজে ও ম্যাক্সমুলার ভবনে ফরাসি ও জার্মান ভাষার পাঠ নেয় আর গান শেখে দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে। আমার পাল্লায় পড়ে ওর এই সবকটিতেই বিঘ্ন ঘটেছে। আমার যে তখন রোজই দেখা করা চাই। এক একদিন আমি দারুণ ভাবে অপ্রস্তুত অবস্থাতেও পড়েছি। আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজের সামনের ফুটপাথে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতাম, ক্লাস শেষ হবার পর স্বাতী বেরিয়ে এলে তাকে নিয়ে কোথাও একটুক্ষণ বসব, তারপর বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দেব। একদিন স্বাতী বেরিয়ে এল পাঁচ ছ’জন যুবক-যুবতী সমভিব্যহারে, আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর বলল, কোথাও বসে একটু চা-টা খেলে হয় না? কাছাকাছি পার্ক স্ট্রিটের দামি রেস্তোরাঁয় চা পানের পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার নেই, ঢোকা হল একটিতে, অন্যরা শুরু করল নানারকম গল্প, আমি একেবারে আড়ষ্ট, সমস্ত রোমকূপে কাঁটা, শুধু পয়সার চিন্তা করছি। আমার কাছে আছে মাত্র ন’টাকা, তাতে সেই ছেষট্টি সালে দু’জনের চা-জলখাবার বেশ ভালোই হয়ে যায় বড় দোকানে, কিন্তু পাঁচ-ছ’জনের হবে কি? যদিও নেওয়া হয়েছে শুধু স্যান্ডুইচ ও সকলের জন্য চা, তাতে কত বিল হবে? ফরাসি ক্লাসের এই ছাত্র-ছাত্রীদের গড় বয়েস আমার চেয়ে মাত্র সাত-আট বছর কম, তবু যেন মনে হচ্ছে অন্য প্রজন্ম, আমি যেন অনেক দূরের মানুষ এবং আমি সিনিয়র বলেই আমার বিল মেটানো উচিত। আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজে আমি কিছুদিনের জন্য পড়েছিলাম বলেই জানি, অধিকাংশ সচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েরাই এখানে আসে, চায়ের দোকানে কে বিল মেটাবে না মেটাবে তা নিয়ে এরা চিন্তাও করে না, কারণ যে-কেউ পারে। যদি টাকা কম পড়ে তা হলে আমি কী করব? অন্যদের কাছে চাইতে হবে? তার চেয়ে বোধহয় এই মুহূর্তে আমার মরে যাওয়াই ভালো। বিল এল চোদ্দো টাকার, আমি সঙ্গে সঙ্গে স্বাতীর হ্যান্ডব্যাগটি তুলে নিয়ে বললাম, দেখি, এর মধ্যে কী আছে? একটা খোপে কিছু টাকা পয়সা রয়েছে, তার থেকে ছ’সাতটা টাকা তুলে নিলাম অবলীলাক্রমে। অন্য কেউ লক্ষই করল না। হঠাৎ আমার মাথায় এ রকম বুদ্ধি এল কী করে? আমি মোটেই চালাক-চতুর, সপ্রতিভ ধরনের ছোকরা ছিলাম না, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আমার একেবারেই নেই, কখনও ধাঁধার উত্তর দিতে পারি না। এবং আমি এটাও জানতাম, বিনা অনুমতিতে মেয়েদের হাত ব্যাগ খুলে দেখা অতি গর্হিত কাজ, ফরাসিতে নাকি বলে mes affaire, তবু মরিয়া হয়েই ইন্‌সটিংকট্ বশে ও রকম করে ফেলেছি এবং মান বেঁচেছে।

এ রকম একটি সামান্য ব্যাপারও মনে থাকার কারণ, সেদিন স্বাতীকে তার বন্ধুদের সঙ্গে ট্যাক্সিতে তুলে দেবার পর আমার খেয়াল হয়েছিল আমি তো নিজের পকেট উজাড় করে দিয়েছি, এখন আমার বাড়ি ফেরার বাস ভাড়াও নেই। পার্ক স্ট্রিট থেকে নাগেরবাজার পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে? ক’দিন লাগবে? প্রেমে পড়লে মানুষ এমনই বোকা হয়ে যায়! একা একা খানিকক্ষণ হেসেছিলাম নিজেকে নিয়ে। পুরোটা হাঁটতে হয়নি অবশ্য, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে এসে বন্ধুবান্ধবদের পাওয়া গিয়েছিল।

প্রেমের পরবর্তী পর্যায় বি পূর্বক বহ্ ধাতু ঘঞ্! এই বিষয়ে আমি যেন খানিকটা বোধহীন ছিলাম। একটি মেয়ের জীবন পুরোপুরি আমার জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে, এ যেন আমার সমস্ত প্রত্যাশার অতীত। নারীর কাছে লাবণ্য ও মাধুর্যের আমি প্রার্থী, ছিটে ফোঁটা পাওয়াই তো যথেষ্ট। তা ছাড়া বিয়ে মানেই নিজস্ব সংসার, সে দায়িত্ব নেবার কি আমি যোগ্য? বিয়ের কোনও কল্পনাই আমার মনে সেই তেত্রিশ বছর বয়েস পর্যন্ত দানা বাঁধেনি। আমার মেজো ভাই অনিল আগেই বিয়ে করেছে, অঞ্জলির সঙ্গে তার পরিচয় হবার পর মধ্যবিত্ত পরিবারের রীতি অনুযায়ী দাদার বিয়ে হয়নি বলে সঙ্কোচে কিছু বলতে পারছিল না, কোনওক্রমে জানতে পেরে আমি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলাম। ছোট ভাই অশোকের সঙ্গে শীলারও বোধহয় ততদিনে আলাপ হয়েছে এবং দাদা বিয়েই করবে না এ রকম ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বাতীর সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা ও মাঝে মাঝে নিরালায় দেখা করা তো মাসের পর মাস চালিয়ে যাওয়া যায় না। এর বাড়িতেও বিয়ের চাপ আছে। ওরা পাঁচ বোন, স্বাতী দ্বিতীয়া, শুধু দিদির বিয়ে হয়েছে, আমার বাড়িতে যে ভদ্রলোক গাড়িতে ওদের নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই সন্তোষ মুখোপাধ্যায় ওর জামাইবাবু, ওর পরের তিন বোনও প্রেম ও পাত্র নির্বাচন করে মেজদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার উদ্গ্রীব প্রতীক্ষায় আছে। সব বোনই সুশ্রী, স্বাতীর জন্যও উপযুক্ত পাত্র কম ছিল না। ওর বাবা-মা কোনও সুযোগ্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে একেবারে ঠিকঠাক করার পরেও স্বাতী গোপনে সেই পাত্রকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিত, সে বিয়ে করতে রাজি নয়। কিন্তু এ কৌশল বারবার খাটে না, বাবা-মায়ের অবাধ্য হবার মতন স্বভাবই নয় এ মেয়েটির। এ সব শুনে আমার মনে হত, এ মেয়েটি অন্য কোনও পুরুষের ঘরণী হয়ে চলে যাবে, এ একেবারে অসম্ভব, পৃথিবী উল্টে গেলেও তা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমাকে গ্রহণ করতে যদি সে রাজি না হয়? সাংসারিক বিচারে আমার কোনও যোগ্যতাই নেই, আমি সুদর্শন যুবা নই, (স্বাতীর পরবর্তী তিন বোনের নির্বাচিত স্বামী দীপক সরস্বতী, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও পার্থ মুখোপাধ্যায় তিনজনই খুব সুপুরুষ) ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার সম্বন্ধ করা পাত্রদের তুলনায় আমি নগণ্য এক কবি এবং সাধারণ পরিবারের সন্তান। তবু কিছুদিন পরে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, আমি তার পাণিপ্রার্থী হলে প্রত্যাখ্যাত হতে হবে না। তার কারণ তার মনে বাস্তব অবস্থা বিচারের কোনও প্রশ্নই উঁকি মারে না, কবি-লেখকরা এমন এক কল্পলোকের মানুষ, যেখানে সে তার মনের মিল খুঁজে পায়। ততদিনে আমার কিছু বন্ধুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে এবং তাদেরও সে পছন্দ করে ফেলেছে। শংকর চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির আড্ডাতেও নিয়ে গেছি তাকে।

কিন্তু বিয়ের প্রস্তাবের আগে কতকগুলি ব্যাপার স্পষ্ট করা দরকার। যেমন, মার্গারিট নাম্নী এক ফরাসি তরুণীর সঙ্গে যে আমার বিশেষ সম্পর্ক ছিল সেটা স্বাতী একদিন না একদিন জানবেই, বিয়ের পরে জানার চেয়ে আগেই জানা উচিত। মার্গারিট আমাকে নিয়মিত চিঠি লেখে, আমার পরে যারা আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছে, যেমন শঙ্খ ঘোষ ও জ্যোতির্ময় দত্তের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে, কিন্তু তার কলকাতায় আসার সম্ভাবনা ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসছে নানাকারণে, তাকে তার বাবা-মায়ের ভার নিতে হয়েছে। স্বাতীকে মার্গারিটের কথা খোলাখুলি জানাবার পর মার্গারিটকেও চিঠিতে জানালাম স্বাতীর কথা। মার্গারিট সঙ্গে সঙ্গে স্বাতীকে সরাসরি এক চিঠি লিখে তার বন্ধুত্ব প্রার্থনা করল। এরপর মার্গারিট ও স্বাতীর চিঠি বিনিময় হয়েছিল বেশ কিছুদিন।

দ্বিতীয়ত, আমার যে কোনও চাকরি নেই এবং জীবিকার স্থিরতা নেই, সেটা গোপন করাও চলে না। আনন্দবাজার অফিসে আমি আলাদা চেয়ার-টেবিলে বসি, তা দেখে অনেকের ভুল ধারণা হতে পারে। কিন্তু সেখানে আমার দিন মজুরির মতন ফুরনের কাজ, যে-কোনও দিন বন্ধ হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। এ সব জেনেও স্বাতী বলেছিল, আমি গাছতলায় গিয়ে থাকতেও রাজি আছি। রোমান্টিক আর কাকে বলে!

তৃতীয়ত, মদ্যপান ও বেপরোয়া জীবনযাপন। একদিন ভিক্টোরিয়া স্মরণ উদ্যানে লর্ড বেন্টিঙ্কের মূর্তির সামনে বিকেল ছ’টায় দেখা করার কথা, দুপুর থেকে বন্ধু সংসর্গে কোথাও বসে ছ’সাত পেগ হুইস্কি টানার পর ঠিক ছ’টায় এসে অপেক্ষমাণা তরুণীটিকে বললাম, দেখো, বন্ধুদের সঙ্গে আমি মাঝে মাঝে এতটা পান করি, বেশ উপভোগ করি, তবে পা-টা বিশেষ টলে না, কথাও জড়ায় না। তা দেখে বা শুনেও মেয়েটি ভয় পায়নি। তখনও পর্যন্ত উত্তর কলকাতার অধিকাংশ পরিবারে মদ্যপান সাঙ্ঘাতিক ট্যাবু, বাংলা সিনেমায় মদ্যপায়ী মানেই অতিশয় দুর্বৃত্ত ও দুশ্চরিত্র। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতায় খানিকটা ইংরিজি-ঘেঁষা কালচারে মদ্যপান সম্পর্কে ও রকম ভীতি নেই, স্বাতী তার বাবাকে মাঝে মাঝে বিয়ার ও ব্র্যান্ডি পান করতে দেখেছে। দাদা ও তার বন্ধুদের সঙ্গে পার্টিতে নিজেও চুমুক দিয়েছে জিন-লাইমের গেলাশে। একদিন না জেনে, শুধু জল ভেবে জিন খেয়ে ফেলেছিল অনেকটা। এরিক মারিয়া রেমার্ক-এর ‘থ্রি কমরেডস’ উপন্যাসটি তার খুব প্রিয়, সে বইতে ভর্তি নানারকম মদ্যপানের অতি আকর্ষণীয় বর্ণনা। সুতরাং এতেও আমি পাশ।

কিন্তু জানাজানি হবার পর ওদের পরিবারে প্রবল আপত্তি উঠেছিল। সে আপত্তির ভিত্তি অতি বাস্তব। ওদের পরিবার বেশ সচ্ছল, সে পরিবারের সবচেয়ে সরল, নিষ্পাপ, কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত মেয়েটিকে যেন হরণ করে নিতে চাইছে এক দমদমের গুণ্ডা। কিছুদিন আগে অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে দমদমের পাড়ায় পাড়ায় ছেলেরা দল বেঁধে কিছু দোকানদারকে মারধর করে, ভয় দেখিয়ে চাল-ডাল থেকে মাছ-মাংস পর্যন্ত নির্দিষ্ট বাঁধা দরে বিক্রি করতে বাধ্য করেছিল। তার নাম হয়েছিল, দমদম দাওয়াই। সুতরাং দক্ষিণ কলকাতার লোকদের চোখে দমদমের সব ছেলেই গুণ্ডা, আর আমার চেহারাটাও তো গুণ্ডারই মতন বটে। তখনও মোটাসোটা ঠিক নয়, লোকে দূর থেকে বলত, ওই গুণ্ডা মতন চেহারার ছেলেটা, মাথার চুলও ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া। আমি কবিতা-টবিতা লিখি বটে, কিন্তু কোনও চালচুলো তো নেই। এবং বাঙাল হওয়াটাও একটা বড় অযোগ্যতা, খাঁটি পশ্চিমবঙ্গীয় পরিবারে বাঙালদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন তখনও খুবই দুর্লভ ঘটনা। এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমার উপার্জনের স্থিরতা নেই। আমি যদি আনন্দবাজারে পাকা চাকরি করতাম, তা হলেও সেটা স্বাতীদের পরিবারের চোখে তেমন সম্মানজনক হত না। তখনও পর্যন্ত শিক্ষক-অধ্যাপক এবং সংবাদপত্রের চাকুরিজীবীদের মনে করা হত, গরিব-আদর্শবাদী, বেতন ছিল খুব কম, একজন অধ্যাপক বা সাংবাদিকের মাইনে যে-কোনও ব্যাঙ্কের সাধারণ কর্মচারীর তুলনায় অর্ধেকও নয়। অর্থাৎ সাংবাদিকের চাকরিটা এসব কিছু নয়। আমার আবার সে চাকরিও নেই।

সেই বছরেই শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে ‘আত্মপ্রকাশ’। যে-হেতু নায়কের নাম সুনীল, তাই সমস্ত ঘটনাগুলিই অনেকে হুবহু সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। স্বাতীদের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে যারা কখনও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের তেমন কিছু পড়ে না, তারাও ‘দেশ’ শারদীয় সংখ্যায় আমার লেখাটি পড়ে নিয়ে বুঝে গেল, আমি কি সাঙ্ঘাতিক চরিত্রের ছেলে, জুয়া খেলা, মারামারি, বেশ্যালয়ে গমন, কিছুই বাদ নেই! মাঝে মাঝেই আমি আনন্দবাজার অফিসে টেলিফোন পাই, কোনও নারী বা পুরুষ নাম না জানিয়ে ব্যাকুলভাবে অনুরোধ করছে, আপনি আমাদের মেয়েটিকে ছেড়ে দিন! প্লিজ! এ বিয়ে হতেই পারে না। ওর বাবা এমন দুঃখ পাবেন যে হয়তো মরেই যাবেন। আমি হাসতে হাসতে বলতাম, ছেড়ে দেব কী, আমি ধরে তো রাখিনি! আপনাদের মেয়েটিকে বোঝন, তাকে বারবার জিজ্ঞেস করুন, তার যদি আপত্তি থাকে, আমাকে আর কোনওদিনই দেখতে পাবেন না। তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগও রাখব না। আর তার যদি আপত্তি না থাকে, তা হলে আপনারা জোর করবেন না প্লিজ, এ বিয়ে হবেই!

তখন গোপনীয়তা অনেকটা ঘুচে গেছে, স্বাতীকে নিয়ে চেনাশুনো কোনও কোনও বাড়িতে যেতাম, এক বিকেলে গিয়েছিলাম নাকতলায় বুদ্ধদেব বসু-প্রতিভা বসুর নতুন বাড়িতে। প্রতিভা বসু সব সময়ই খুব আপন করে কাছে টেনে নেন। পাপ্পার সঙ্গে স্বাতীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল প্রথম দিন থেকেই। বুদ্ধদেব বসু স্বাতীর নাম শুনে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন, ওঁর উপন্যাস ‘তিথিডোর’ খুবই জনপ্রিয়, তার নায়িকার নাম স্বাতী, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমার উপন্যাস থেকেই তোমার নাম রাখা হয়েছে নিশ্চয়ই? স্বাতী লাজুক ভাবে জানাল যে তা নয়, ওর জন্ম হয়েছে উপন্যাসটি প্রকাশের কিছু আগে। ওদের পাঁচ বোনের নামেই অন্ত্যমিল আছে, তপতী-স্বাতী জয়তী-গীতি-ব্রততী, একমাত্র দাদার নাম দেবব্রত। বুদ্ধদেব বসু আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নামের মানে জানো আশা করি? আমাদের সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে স্বাতী বলল, হ্যাঁ, খড়্গ! আমি আঁতকে উঠে ভাবলাম, এটা ও কী বলল? আমরা সবাই জানি, স্বাতী একটি লোহিতবর্ণ নক্ষত্র, প্রবাদ আছে, এই নক্ষত্রের অশ্রুবিন্দু সমুদ্রে পড়ে ঝিনুকের পেটে গেলে তাই মুক্তো হয়। লাজুক হলেও এ মেয়েটির পেটে পেটে দুষ্টুবুদ্ধি কম নয়, সবার জানা অর্থটি সে বলবে না। অভিধান এনে দেখা গেল, স্বাতী খড়্গরও নামান্তর।

শুভার্থীরা প্রায়ই বলে, তা হলে আর তোমরা দেরি করছ কেন? স্বাতীদের বাড়ির সবার অজান্তে রেজিষ্ট্রি বিয়ে করে ফেললেই হয়, কিন্তু স্বাতী কোনওভাবেই তার বাবা-মায়ের মনে আঘাত দিতে চায় না, ওঁদের রাজি করাতে হবেই। এক সকালে ওঁরা দু’জন আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। স্বাতীর মায়ের নাম কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাইবাহুল্য, সেই বিখ্যাত গায়িকা নন। অবশ্য, ইনিও ভালো গান করেন, নামের মিলের জন্যই প্রকাশ্যে গান করেননি বোধহয়, লাজুক ও মৃদুভাষী, দেখলেই বোঝা যায় বনেদি বাড়ির মেয়ে। বাবা অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি অনেক দিক থেকেই একজন অসাধারণ ব্যক্তি। তিনি শখ করে বিমান চালানো শিখেছিলেন, যৌবনে নানারকম অ্যাডভেঞ্চার করেছেন, তিনি নিজস্ব ট্র্যান্সমিটারে বিশেষ তরঙ্গে মধ্যরাত্রে দেশ-বিদেশের নানান ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন, এঁদের ইংরেজিতে বলে, ‘হ্যাম’, নেপালের মহারাজা কিংবা অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যানের মতন ব্যক্তিরা এই হ্যামের সদস্য। এ ছাড়াও তাঁর গান-বাজনা রেকর্ডিং-এর বিশেষ দক্ষতা ছিল, রবীন্দ্রনাথের নিজের কণ্ঠে গানের রেকর্ডিং-এ তিনি সহায়তা করেছিলেন, ‘দেশ’ পত্রিকার একটি প্রবন্ধে সে কথা পড়েছি। তিনি নিজে নানান ছোটখাটো যন্ত্র উদ্ভাবন করতেন, তা নিয়ে একটি কারখানা খুলেছিলেন। মারফি রেডিয়োখ্যাত ডেবসন্স কম্পানির মালিক দেবু চৌধুরী একদিন কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন, তুমি গণেশদার (অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাক নাম) মেয়েকে বিয়ে করছ? উনি তো ইলেকট্রনিক্সের জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া, আমাদের কখনও কোনও সমস্যা হলেই ওঁকে ফোন করি।

যাই হোক, ওঁর মেজ মেয়ে যে নিজেই নিজের স্বামী নির্বাচন করেছে সে কথা অনেক দিন ওঁকে জানানো হয়নি, শোনার পর নাকি বলেছিলেন, ছেলেটির কী বংশ, গরিব না বড়লোক, এখন কত উপার্জন করে না করে তাতে কিছু আসে যায় না। যে লাইনে কাজ করছে তাতে যদি খাঁটি উদ্যোগী হয়, সেটাই যথেষ্ট, তারপর আমার মেয়ের ভাগ্যে যা আছে তাই ঘটবে। আমাদের বাড়িতে এসে সামান্য কিছু কথাবার্তা বলে তিনি কী বুঝলেন কে জানে, দিন ঠিক হয়ে গেল। পরে শুনেছি, আমার মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ওঁদের দু’জনেরই খুব ভালো লেগেছিল।

এর মধ্যে দু’পক্ষেই নানারকম গুজব ছড়িয়েছিল। স্বাতীকে কেউ বলেছিল, আমি নাকি চেক লুঙ্গি পরে বাজারে যাই (আমি জীবনে কখনও লুঙ্গি পরিনি, আমার বাবা অবশ্য পরতেন), মদ খেয়ে আমি নাকি ল্যাম্পপোস্টের ওপরে চড়ে বসে থাকি, (আমি এক সময় পেয়ারা গাছে ও খেজুর গাছে অনেকবার উঠেছি, ল্যাম্প পোস্টে তো কোনও ফল ফলে না, তার ওপর চড়তে যাব কেন?) আমার আসল মতলব নাকি শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি গ্রাস করা ইত্যাদি। আমার বন্ধু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চোখ বড় বড় করে একদিন বলেছিল, তুই কাকে বিয়ে করছিস রে? আমার ভাইয়ের স্ত্রী ও পাড়ায় থাকে, সে বলেছে ব্যানার্জি বাড়ির মেয়েরা সবাই এক একটি পরী, ওরা হাতে গ্লাভ্স পরে ওয়াশিং মেশিনে কাপড় কাচে, ফ্রিজের ঠাণ্ডা জল ছাড়া অন্য জল খায় না, ও মেয়ে তোদের নাগেরবাজারের বাড়িতে একদিনও থাকতে পারবে? অন্য একজন বন্ধু বক্রভাবে বলেছিল, সুনীল মুখে জাত মানি না, ধর্ম মানি না এসব বড় বড় কথা বলে, কিন্তু বিয়ে করার সময় ঠিক বেছে নিয়েছে পাল্টি ঘরের বামুনের মেয়েকে! আমি অনেক সময় বলতাম বটে, যে যদি কখনও বিয়ে করি, তা হলে চাইব কোনও বিধবা কিংবা মুসলমানের মেয়ে, যেহেতু আমাদের পরিবারে সে রকম বিয়ে কখনও হয়নি। কিন্তু যদি বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের একটি মেয়ের সঙ্গে মনের মিল হয়, তবে শুধু ব্রাহ্মণ বলেই তাকে প্রত্যাখ্যান করার কোনও যুক্তি আছে কি?

বিয়ে তো ঠিক হল, কিন্তু তার তো একটা খরচ আছে। আমার তো দিন আনি দিন খাই অবস্থা। ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসের জন্য আমাকে কোনও প্রকাশক খুঁজতে হয়নি, দেশে প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বই হয়ে বেরিয়ে যায়। আনন্দ পাবলিশার্স তখন প্রায় একটি নতুন সংস্থা, তাঁরা একটা চমৎকার নিয়ম করেছেন, নতুন বা প্রবীণ লেখকদের একই রকম সমান রয়ালটি, এবং তাও যথেষ্ট বেশি, শতকরা কুড়ি ভাগ। কিন্তু আমার বই সদ্য বেরিয়েছে, বিক্রি হলে তবে তো রয়ালটি পাব। এখনকার বাদল বসু তখন প্রায় নবীন শিক্ষানবীশ, আনন্দ পাবলিশার্স পরিচালনা করতেন ফণিভূষণ দেব, খুব অমায়িক মানুষ এবং কাঠ বাঙাল, তাঁর কাছে একদিন কাঁচুমাচু ভাবে জানতে চাইলাম, কিছু অগ্রিম পেতে পারি কি না। এ রকম অসঙ্গত অনুরোধের কারণটি জেনে তিনি সহাস্যে বললেন, তবে তো চাইতেই পারো। হিসেব কষতে লাগলেন, বইয়ের দাম ছ’টাকা, এক সংস্করণের রয়ালটি হয় বারোশো টাকা, নতুন লেখকের বই, বিক্রি হবে কি না ঠিক নেই, যাই হোক, এক হাজার টাকা দেওয়া যেতে পারে। সেই এক হাজার আর ধারধোর করে আরও কিছু, তাতেই সম্পন্ন হল উৎসব। আমাদের বিয়ের তারিখটির একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যও আছে। এর মধ্যে পশ্চিমবাংলায় একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেছে। নিদারুণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অনটন, অরাজকতা, যখন তখন পুলিশের গুলি চালনা এই সবের পর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সব বড় বড় নেতা ধরাশায়ী। এমনকী মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন এবং কিং-মেকার হিসেবে পরিচিত অতুল্য ঘোষও শোচনীয় ভাবে হেরেছেন, স্বাধীনতার সাড়ে উনিশ বছর পর কংগ্রেস দল ক্ষমতাচ্যুত হল পশ্চিমবঙ্গে। গড়া হল একটি যুক্তফ্রন্ট, এককালের স্বাধীনতা সংগ্রামী ও শ্রদ্ধেয় নেতা অজয় মুখোপাধ্যায় কংগ্রেস দল থেকে চরম অপমানিত ভাবে বিতাড়িত হয়েছিলেন, এবার তিনিই হলেন যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী, আর অর্থমন্ত্রী হলেন দ্বিখণ্ডিত কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান শাখা সি পি আই (এম)-এর নেতা জ্যোতি বসু। আমার বিয়ের দিনেই এই মন্ত্রিসভা শপথ নেয়।

এই জোড়াতালি দেওয়া যুক্তফ্রন্ট বেশি দিন টিকতে পারেনি, মাত্র ন’মাস পরেই তার পতন হয়। ঠিক সেই দিনটিতেই আবার জন্ম হয় স্বাতী ও আমার প্রথম ও একমাত্র পুত্র সন্তান। নার্সিংহোমে ভোরবেলা আমি অপেক্ষা করছি, তখনও কিছু খবর পাওয়া যায়নি, আমার মনে পড়ছিল জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসটির কথা। ভাবী পিতা হিসেবে আমার কী করা উচিত, উৎকণ্ঠিত ভাবে পায়চারি এবং ঘন ঘন সিগারেট টানা? আমিও বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান, আমার জন্মের সময় বাবা কী করেছিলেন? অবশ্য আমার জন্ম গ্রামের বাড়ির উঠোনের আঁতুর ঘরে, আর আমার সন্তান জন্ম নিচ্ছে শহরের নার্সিংহোমে। নভেম্বর মাসের কুয়াশা মাখা ভোর, গাড়ি শূন্য, জনশূন্য রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছেন ডাক্তার শোভা ঘোষ। তাঁর চেহারায় এমনই একটা মধুর ব্যক্তিত্ব আছে যে দেখলেই ভরসা পাওয়া যায়। কিছু কথা না বলে, শুধু একটু হেসে তিনি উঠে গেলেন ওপরে। সিজারিয়ান হতে কতক্ষণ লাগে কে জানে! আমি বাবা হতে যাচ্ছি, পৃথিবীতে আর একটি নতুন শিশু আসছে…আমার হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ছিল বাবার কথা, তিনি এসব কিছুই জেনে গেলেন না, স্বাতীকেও দেখলেন না। সেদিনই বিকেলবেলা সন্তোষদার সঙ্গে দেখা, সুখবরটি শুনে তিনি ড্রয়ার থেকে একটি রামের বোতল বার করে বললেন, যাও, এক্ষুণি তোমার ছেলের ঠোঁটে একটু রাম ছুঁইয়ে এসো, আর তার নাম রাখবে রামানুজ।

নার্সিংহোমে গিয়ে রামের বোতল খোলার মতন নাটকীয় কাজ করার মতন সাহস আমার হয়নি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়-ইন্দ্রনাথ মজুমদারের মতন রামপ্রিয় বন্ধুরাই সে বোতলটির সদ্ব্যবহার করেছে এবং রামানুজ নামও পছন্দ হয়নি স্বাতীর। রামায়ণ-মহাভারত থেকে সে শ’খানেক নাম টুকে রেখেছিল, তার থেকেও কোনও নামে মনস্থির করা যাচ্ছিল না। ছেলেকে পুপ্লু কিংবা টুটুল নামে ডাকা হত। তার দেড়-দু’বছর বয়েস হবার পর অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রায়ই এসে এক একটা নাম প্রস্তাব করতেন, স্বাতী তাঁর সামনাসামনি না হলেও পরে নাকচ করে দিত। একবার অলোকরঞ্জন এসে বললেন, শৌভিক নামটি কেমন? আমি বা স্বাতী কিছু অভিমত দেবার আগেই সেই বাচ্চা ছেলেটি আমার নাম শৌভিক, আমার নাম শৌভিক, এই বলতে বলতে লাফাতে লাফাতে চলে গেল। এই শৌভিক নামটিই টিকে গেল শেষ পর্যন্ত।

প্রথম দিন, কৃত্তিবাস কেনার ছুতোয় আমাদের নাগেরবাজারের বাড়িতে জামাইবাবুর সঙ্গে এসে অসমাপ্ত বাক্যে স্বাতী কী বলতে চেয়েছিল, তা আর কখনও জানায়নি।

ছেচল্লিশ

আমরা ছেলেবেলায় শুনতাম, দমদম বিমানবন্দরটি নাকি এশিয়ার মধ্যে সর্ব বৃহৎ। এই দাবি পুরোপুরি সত্য হোক বা না হোক, কলকাতার এই বিমানবন্দরটির গুরুত্ব নিশ্চিত যথেষ্ট ছিল, আমরা চোখের সামনে দেখলাম, সেই গুরুত্ব কী ভাবে হ্রাস পাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই বিমানবন্দর আধুনিকভাবে সম্প্রসারিত হয়নি, সত্তরের দশকের শুরু থেকেই দিল্লি-মুম্বইয়ের তুলনায় কলকাতার বিমানবন্দরের মলিন অবস্থার শুরু। জলের জাহাজের বন্দরটির ক্রমাবনতির শুরু আরও আগে থেকে। গঙ্গা নদীর নাব্যতা একদিনে কমে যায়নি, আমরা উদাসীন থেকে এই নদীটিকে সূতিকা রোগিণীর মতন অবস্থা হতে দেখেছি। কলকাতা শহরের খ্যাতি ছিল প্রাসাদনগরী হিসেবে, শিল্প-বাণিজ্যেরও কেন্দ্র ছিল, সংস্কৃতি চর্চা নিয়ে ছিল কত গর্ব, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি, সবই ম্লান হয়ে যেতে লাগল। ষাটের দশকেও কলকাতা-যাদবপুরে কত বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের দেখেছি, এখন আর ক’জন আসে? কলকাতা শহর যেমন গুরুত্ব হারিয়েছে, পশ্চিমবাংলাও ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলির তুলনায় পিছিয়ে পড়তে থাকে অনেকদিক থেকে। শিল্পে বাণিজ্যে তো বটেই, এমনকী শিক্ষা বিস্তারে এবং স্বাস্থ্য পরিষেবায়।

এ রাজ্যের এমন অধঃপতনের অবধারিত ফল শাসক দল কংগ্রেসের প্রতি জনসাধারণের বিমুখতা। প্রায় দু’দশক ধরে কেন্দ্রে ও রাজ্যে কংগ্রেস দল ক্ষমতায় থাকলেও এই দলের সমর্থক সংবাদপত্রগুলিতে পর্যন্ত প্রায়ই লেখা হত ‘পশ্চিমবাংলার প্রতি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ’ আচরণের কথা। দেশভাগের ক্ষত পঞ্জাব বেশ দ্রুত প্রায় পুরোপুরি সামলে নিয়ে শষ্যশালিনী এবং সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে, কিন্তু বাংলায় সেই ক্ষত আরও দগদগে হয়েছে, বস্তুত পরবর্তী পঞ্চাশ বছরেও অধিকাংশ সমস্যার মূলে সেই র‍্যাডক্লিফের ছুরি।

একই ভাষা, সংস্কৃতি, আবহাওয়া, খাদ্যরুচির মানবগোষ্ঠীর শুধু ধর্মীয় বিভেদের জন্য মনের গতি দু’রকম হতে পারে না। প্রায় একই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবাংলায় যুবসমাজের মধ্যে বিপ্লবের চিন্তা দানা বাঁধতে শুরু করে। সে বিপ্লবের লক্ষ্য একই। রূপরেখা কিছুটা আলাদা। বাঙালি মুসলমানরাই পাকিস্তানের দাবিতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছিল, সেই বাঙালি মুসলমানরাই ষাটের দশকের শেষ দিকে উপলব্ধি করে যে পাকিস্তান সৃষ্ট হলেও তাদের প্রতি শোষণ ও বঞ্চনার অবসান তো হয়ইনি, বরং বেড়ে চলেছে ক্রমশ। পাকিস্তানে পর পর সামরিক শাসনে সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত, সেই সব অর্ধশিক্ষিত (কেউ কেউ দুশ্চরিত্র) সামরিক শাসনকর্তারা বাঙালি মুসলমানদের খাঁটি মুসলমান বলেও মনে করে না, যখন তখন চোখ রাঙায়। সুতরাং পাকিস্তানের অখণ্ডতা টিঁকিয়ে রাখা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, বিচ্ছিন্নতা ছাড়া অন্য পথ নেই, এরই পরিণামে একাত্তর সালের সাতই মার্চ শেখ মুজিবর রহমানের ঘোষণা, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।

পশ্চিমবাংলার বামপন্থী যুবসমাজ চাইল শ্রেণী সংগ্রাম ও সশস্ত্র বিপ্লব। তবে তা শুধু পশ্চিমবাংলাকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য নয়, তা হবে সর্বভারতীয়, যদিও তার কোনওই প্রস্তুতি ছিল না, তবু কয়েকটি স্ফুলিঙ্গ থেকে আগুন জ্বলতে লাগল পশ্চিমবাংলায়।

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে যখন কলকাতার নাম প্রায় মুছে যাচ্ছে, তখন পশ্চিমবাংলায় অখ্যাত একটি থানা নকশালবাড়ির নাম সকলকে চমকে দিল। প্রথম সূত্রপাত একটি সামান্য ঘটনায়। নকশালবাড়ির একটি গ্রামে একদিন একদল আদিবাসী কৃষক তীর-ধনুক-বর্শা-লাঠি-সোঁটা নিয়ে দৌড়ে এসে বসে পড়ল একখণ্ড জমির ওপর, সেই জমির চার পাশে লাল পতাকা পুঁতে দিয়ে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। এটা এমন কিছু অভিনব ব্যাপার নয়, জমি দখলের চেষ্টা ও জোর করে ফসল কেটে নেওয়া প্রতিবছরই ঘটে, আবার পরে পুলিশের সাহায্য নিয়ে জোতদাররা জমি থেকে জবর দখলকারীদের উচ্ছেদও করে দেয়। উত্তরবঙ্গের কিষাণ সভা সাতষট্টি সালে এরকম জমি দখল অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে যে একটা অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে যাবে, কংগ্রেস সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শাসনভার নেবে যুক্ত ফ্রন্ট এবং কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু হবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সে সম্ভাবনার কথা কল্পনাতেও ছিল না। জ্যোতি বসুর হাতেই পুলিশ বাহিনী, সেই পুলিশবাহিনী কি সংগ্রামী কৃষকদের বিরুদ্ধে যেতে পারে? প্রথমবারের সাফল্যে উদ্দীপিত হয়ে কিষাণ সভার নেতৃত্বে পরবর্তী দশ সপ্তাহের মধ্যে আরও ষাটটি জমি দখলের ঘটনা ঘটে গেল, বাধা এল সামান্য। কিষাণ সভার কিছু কিছু নেতার ধারণা হল, চাষি ও মজুরদের নিত্য ব্যবহার্য অস্ত্র দিয়েই শুরু হবে বিপ্লব।

কয়েক মাস পরে নকশালবাড়ির আর একটি গ্রামে জয়ের স্বাদ পাওয়া উগ্র কৃষিকর্মীদের সঙ্গে মুখেমুখি সংঘর্ষে গুরুতরভাবে আহত হল কয়েকজন পুলিশ, তাদের মধ্যে একজন ইন্সপেক্টর ওয়াংদির মৃত্যু হল হাসপাতালে দু’দিন পরে। সেইদিনই আর একদল পুলিশ ঘেরাও হল, সহকর্মীর হত্যায় পুলিশদের চোখে জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুন, সামান্য প্ররোচনাতেই তারা নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে সাতজন নারী ও দুটি শিশু সমেত হত্যা করে দশজনকে। এ যেন জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংসতারই ক্ষুদ্র সংস্করণ। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সব সময়ই কৃষক ও মজুরদের ওপর গুলি চালনার বিরোধী, এখন সেই দলেরই নেতা পুলিশমন্ত্রী, সুতরাং এই ঘটনায় সারা দেশ স্তম্ভিত! অবশ্য এরকম গুলি চালনার নির্দেশ নিশ্চিত রাইটার্স বিল্ডিংস থেকে আসেনি, জ্যোতি বসু সুদীর্ঘকাল বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন, শাসন কার্যভার পেয়ে এই অল্প কয়েক মাসে হয়তো সব দিক গুছিয়ে নিতে পারেননি। এরপর পুলিশকে সংযত হবার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হল বটে, কিন্তু জ্যোতি বসু সংবিধানের শপথ নিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন, তিনি সশস্ত্র কৃষকদের জমি দখলও সমর্থন করতে পারেন না। উত্তরবঙ্গে তাঁর দলের যে-সব নেতারা বিপ্লবের নামে এরকম সংঘর্ষের উস্কানি দিচ্ছিলেন, তাদের নিরস্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে বিতাড়িত করা হল দল থেকে, গ্রেফতার হলেন অনেকেই, কিছুদিনের মধ্যেই বিদ্রোহ স্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু একটি স্ফুলিঙ্গ নিভলেও ইতস্তত আরও স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠতে দেরি হয়নি। শুরু হল নকশালপন্থী বিপ্লব-প্রচেষ্টা। যাতে চুম্বক আকৃষ্টের মতন দলে দলে যোগ দিয়েছে হাজার হাজার মেধাবী, আদর্শবাদী তরুণ-তরুণী।

একটা ট্যাজেডি এই যে বিপ্লবের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ এই যুবসম্প্রদায়কে নেতৃত্বের জন্য একমুখী হয়ে চেয়ে থাকতে হয়েছিল চিনদেশের দিকে। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়ানের নেতাদের কাছ থেকে আর দেশে দেশে বিপ্লবের আহ্বান শোনা যায়নি, ভিয়েতনাম যুদ্ধে তাঁরা গা বাঁচিয়ে থেকেছেন। চিনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে, রাশিয়াকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে শোধনবাদী এবং মূলত সেই প্রশ্নেই ভাগ হয়ে গেছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। গরিষ্ঠ সংখ্যক সদস্যের দলটির নতুন নাম হল সি পি (এম), তারা চিনপন্থী হিসেবেই পরিচিত, কিন্তু সেই দলও যখন সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে পশ্চিমবাংলায় জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করল, তখন বহু তরুণ সদস্যদের মধ্যে দেখা দিল প্রবল বিক্ষোভ। তারা তো বিপ্লবের জন্য ফুঁসছে, তাদের মনে জ্বলজ্বল করছে লেনিনের উক্তি, পার্লামেন্ট আসলে শুয়োরের খোঁয়াড়। বিপ্লব একটা রোমাঞ্চকর স্বপ্ন, তার আহ্বানে প্রাণ দেওয়াও অতি তুচ্ছ, সব বিপ্লবে যুবশক্তিই প্রাণ দিতে ছুটে যায়। একশো কিংবা এক হাজার বছর আগেকার কোনও ধর্মগুরুর বাণী কিংবা উপদেশ যেমন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তাঁর অনুগামীরা, সেরকমই অন্য দেশের, অন্য কালের কোনও রাজনৈতিক তাত্ত্বিকের আক্ষরিক অনুসরণ কি সঙ্গত? ইতিহাসে এ রকম ভুল দেখা গেছে বারবার। দেশ এবং কাল ভেদে বিপ্লবের আঙ্গিকও পৃথক হতে বাধ্য।

কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে প্রথম যখন দেখি অগ্নি অক্ষরে বিপ্লবের নানারকম আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা, ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ তখনই আমাদের অনেকের খটকা লেগেছিল। নকশালবাড়ির বিপ্লব প্রচেষ্টার সঙ্গে চিনের সম্পর্কের তাৎপর্য আমি তখনও ঠিক বুঝতে পারিনি। কিংবা সেই সম্পর্কের প্রকৃত ইতিহাস এখনও উদ্ঘাটিত হয়নি। লেনিন-স্ট্যালিনের পর মার্কসবাদী দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জীবিত তাত্ত্বিক মাও সে তুঙ (এখন পরিবর্তিত উচ্চারণ মাও জে দঙ) কি সত্যিই এমন অপরিকল্পিত, এমন প্রস্তুতিহীন ভাবে তাড়াহুড়ো করে ভারতের মতন একটি বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্মের দেশে বিপ্লব শুরু করার প্ররোচনা দিয়েছিলেন? অথবা তাঁর অজ্ঞাতসারে চিন সরকারের এ ব্যাপারে অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল? পিকিং বেতার থেকে একটি মেয়ে অতীব ধারালো কণ্ঠস্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরিজিতে যে-সব খবর প্রচার করত, তা আমরাও দু’-একবার শুনেছি। সব ডাহা মিথ্যে কথা। মাও সে তুং-এর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতীয় জনগণ সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করে দিয়েছে! নকশাল বাড়ি অঞ্চলের তিনটি গ্রামের তিনটি থানা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, একজন অফিসারসহ দশজন পুলিশ খুন ইত্যাদি। বাংলার তরুণরা চিনের যে নেতাকে বিপ্লব তরণীর কর্ণধার বলে গণ্য করতে শুরু করেছিল, তাঁর নাম লিন পি আও। পরবর্তীকালে সেই লিন পি আও ক্ষমতালোভী এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রমাণিত হন, একটা বিমান নিয়ে চিন থেকে পালাতে গিয়ে নিহত হন রহস্যজনকভাবে।

শুধু তরুণরাই নয়, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট দলের কিছু কিছু প্রবীণ নেতাও আশু বিপ্লবের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। সৌরেন বোস, সরোজ দত্ত, এমনকী পার্টির মুখপত্র ‘দেশহিতৈষী’র সম্পাদক সুশীতল রায়চৌধুরী পর্যন্ত। অচিরকালের মধ্যে যখন বিপ্লবী দল গঠিত হয়, তাঁর প্রধান নেতা হন চারু মজুমদার, তাঁর নাম আমরা আগে শুনিনি। তাঁর রাজনৈতিক ক্ষেত্র উত্তরবঙ্গেই সীমাবদ্ধ ছিল, পার্টির কর্মীরা নিশ্চিত তাকে চিনতেন কিন্তু বাইরে তেমন পরিচিতি ছিল না। ক্রমশ জানা গেল, তিনি শিলিগুড়ির কংগ্রেসী নেতা বীরেশ্বর মজুমদারের ছেলে, ছাত্র বয়েস থেকেই রাজনীতিতে জড়িত, প্রথমে ছিলেন কংগ্রেসের সোসালিস্ট পার্টিতে, তারপর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেন কৃষক ফ্রন্টে, তেভাগা আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয় কর্মী, জেল খেটেছেন কয়েকবার। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক মাত্র পথ সশস্ত্র বিপ্লব এবং তার জন্য গড়িমসি করার প্রশ্নই ওঠে না। এই নিয়ে দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ লেগেই ছিল। অবশ্য এরই মধ্যে একবার সম্ভবত স্থানীয় সহকর্মীদের উপরোধে তিনি জলপাইগুড়ির উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর জামানত জব্দ হয়। অল্প বয়েস থেকেই তাঁর স্বাস্থ্য ভালো নয়, তবু দুর্বল শরীর নিয়েই তিনি সংগঠনের কাজ করেছেন গ্রামে গ্রামে, চা-বাগানে। চৌষট্টি সালে তাঁর একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। শরীরে কঠিন রোগ ছিল বলেই কি তিনি বিপ্লব শুরু করার এমন তাড়াহুড়োর পক্ষপাতী ছিলেন?

যে-দেশে একটি সুসংগঠিত সেনাবাহিনী আছে, সে দেশে বিপ্লব শুরু করতে গেলে জনসাধারণের হাতে অস্ত্র দিতে হবে না? এই বিপ্লবীদের মতে, অস্ত্রের দোহাই দিয়ে নিশ্চেষ্টভাবে বসে থাকাও আসলে শোধনবাদ। দা, কুড়ুল, কাস্তে, লাঠি এগুলোও অস্ত্র, গ্রামের মানুষ এই সব অস্ত্রই ব্যবহার করতে জানে, এ দিয়েই লড়াই শুরু করে গড়ে তুলতে হবে ছোট ছোট এলাকা ভিত্তিক মুক্তিসংগ্রাম। সুযোগ পেলেই কেড়ে নিতে হবে অত্যাচারীদের অস্ত্র। মাও সে তুং বলেননি যে, ‘শত্রুর অস্ত্রাগারই আমাদের অস্ত্রাগার?’ আবার সেই অন্য দেশের, অন্য পরিপ্রেক্ষিতের অন্ধ অনুসরণ! এর চেয়ে নিজের দেশে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ব্যর্থতার কারণগুলি অনুধাবন করা বেশি প্রয়োজনীয় ছিল বোধহয়।

নকশাল আন্দোলনের সময় আমি যদি উনিশ-কুড়ি বছরের কলেজের ছাত্র হতাম, তবে খুব সম্ভবত আমিও সে আন্দোলনে চোখ বুজে যোগ দিতাম। নিজের ছাত্র বয়েসে আমি বামপন্থীদের মিছিলে যোগ দিতে দিতে একসময় বাইরে বেরিয়ে এসেছি, রাজনীতির সঙ্গে আর সংস্পর্শ ছিল না, কিন্তু বিপ্লব শব্দটি আকৃষ্ট করত সব সময়। দেশের অবনতি দেখে আমিও মনে মনে ভাবতাম, একটা সর্বাত্মক বিপ্লব ছাড়া এ দেশের পচা-গলা শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে, আমার সে বিপ্লব-ধারণা ঠিক বাস্তব-ভিত্তিক নয়, তার রূপ রেখা সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না, অনেকটাই কল্পনারঞ্জিত। আমি তখন জীবিকা অর্জনের জন্য প্রায় সর্বক্ষণ ব্যাপৃত, সদ্য বিবাহিত এবং এক সন্তানের পিতা, তবু মনে হত, এক সময় বিপ্লব শুরু হবেই হবে, তখন আমার কাছেও ডাক আসবে, আমাকে যেতে হবে। এটাকে স্বপ্নের বিপ্লব-বিলাসও বলা যেতে পারে, পৃথিবীর অনেক মানুষের মধ্যেই বোধহয় এরকম মনোবাসনা থাকে। এই বাসনা থেকেই কবিতা লিখেছিলাম, ‘চে গুয়েভারার প্রতি’। ‘আমার স্বপ্ন’ নামে আর একটি কবিতায় দীনেশ গুপ্ত, প্রদ্যোত ভট্টাচার্য, ভবানী ভট্টাচার্য, সূর্য সেনের মতন স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের কথা লিখতে লিখতে শেষে যুক্ত করেছিলাম, ‘কানু-সন্তোষ-অসীমরা জেলখানার নির্মম অন্ধকারে বসে এখনও সে রকম স্বপ্ন দেখছে।’ সে আমলে সম্ভবত আর কোনও অ-রাজনৈতিক লেখকের রচনায় এই সব নকশাল বিপ্লবীদের নাম উল্লেখিত হয়নি।

নকশালরা অবশ্য আমাকে পছন্দ করত না মোটেই। তার কারণ, যে-পত্রিকাকে তারা মনে করে প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রধান দুর্গ, আমি তার সঙ্গে যুক্ত। আমেরিকা নামটিই তাদের কাছে ঘৃণ্য, আমার সে দেশ থেকে ঘুরে আসাও দোষের। আমার সে দেশে যাওয়াটাই তারা বড় করে দেখেছে, ফিরে আসার কারণটা জানতে চায়নি। (স্বয়ং কার্ল মার্কস একটি আমেরিকান বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে জীবিকা অর্জন করতেন, এক সময় তিনি ইংল্যান্ড ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে বসবাসের কথাও চিন্তা করেছিলেন।) তা ছাড়া আমি কয়েক বছর আগে কংগ্রেস দলের মুখপত্র জনসেবকেও রবিবাসরীয় বিভাগের সম্পাদকগিরি করেছি, সুতরাং আমাকে শ্রেণীশত্রু হিসেবে গণ্য করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। খতমের তালিকায় আমার নাম ছিল কি না তা-ও জানি না। একজন লেখককে যে প্রধানত তার রচনা থেকেই বিচার করা উচিত, তা অনেকেই মানে না, আমার লেখার মধ্যে কোথাও বিপ্লববিরোধী চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে কি না বিবেচ্য হয়নি। অনেক পরে এক প্রাক্তন নকশাল, অধুনা ঔপন্যাসিকের মুখে শুনেছি, তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল, আমার বা আমার মতো কয়েকজন কবির লেখা এক লাইনও পড়া চলবে না। আমি কিন্তু নকশালপন্থীদের পত্র-পত্রিকা, ইস্তাহার এবং কারওর কারওর গল্প-কবিতা পাঠ করতাম খুবই আগ্রহের সঙ্গে। ওদের প্রতি আমার প্রত্যাশা ছিল বিপুল, কিছু কিছু কাজের সমালোচনাও করতাম মনে মনে। গ্রামকে দিয়ে শহর ঘেরার প্রস্তাব খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল, কিন্তু ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’, এই ঘোষণা কিছুতেই পছন্দ করতে পারিনি। আগে ভালোভাবে অস্ত্রচালনা শিক্ষা না করে এলোমেলো ভাবে কনস্টেবল খুন করে বন্দুক-পিস্তল কেড়ে নেওয়াও সঠিক পথ বলে মনে হয়নি।

খতমের প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ে। তখন চতুর্দিকে খুন-জখম তো চলছেই, কে যে কেন খুন হচ্ছে, তাও বোঝার উপায় নেই। সেই সুযোগে যার অন্য কারওকে ব্যক্তিগত ভাবে অপছন্দ, তাকে ভয় দেখানোর হুমকিও চলছে যত্রতত্র। নকশাল আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেইসময় একদিন পশ্চিম জার্মানির কনসুলেটের একটি পার্টিতে সমর সেনের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি তার অনেকদিন আগেই কবিতা লেখা একেবারে ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি সাংবাদিক হয়েছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় ছিলেন কয়েক বছর, তারপর সে পরিচয় মুছে ফেলে ‘নাউ’ নামে একটি ইংরিজি পত্রিকার সম্পাদক হন, তারও পরে প্রকাশ করেন তাঁর নিজস্ব পত্রিকা ‘ফ্রন্টিয়ার’, সে পত্রিকা পুরোপুরি নকশাল বিপ্লবের সমর্থক, আগুন ঝরানো লেখায় তিনি তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে মান্য হন। সমর সেনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না, তবে কৃত্তিবাসে তাঁকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম। তাঁর কবিতার আমি খুবই অনুরাগী, তিনি কেন একেবারে কবিতা থেকে দূরে সরে গেলেন, এই অভিমান ও অভিযোগ নিয়েই সেই লেখা। শুনেছি, কেউ তাঁকে কৃত্তিবাস পত্রিকার সেই সংখ্যাটি দিলে তিনি কবিতাটি পাঠ করে পত্রিকাটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। যাই হোক, সমর সেন সদলবলে খানিক দেরিতে সেই পার্টিতে প্রবেশ করার পর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম অন্য এক কোণে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সামনে যেতে আমি সব সময়ই আড়ষ্ট বোধ করি, তবু অত্যুৎসাহী কেউ একজন আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। সমর সেন রামের গেলাশ হাতে নিয়ে প্রথম বাক্যটিই বললেন, এই সেই সত্যজিৎ রায়ের দালালটা না? এ যেন বিনা দোষে আচমকা এক থাপ্পড় খাওয়ার মতন। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিটি সদ্য মুক্তি পেয়েছে, আমি তার কাহিনীকার মাত্র, আমার কাহিনীও চলচ্চিত্রটিতে অনেক বদলে গেছে, কিন্তু আমাকে দালাল আখ্যা দেওয়া হবে কেন? আমি যতদূর সম্ভব বিনীত ভাবে বললাম, দেখুন, আমি তো উপযাচক হয়ে সত্যজিৎ রায়ের কাছে যাইনি, তিনি আমার উপন্যাসটি পছন্দ করেছেন। সে জন্য আমাকে দালাল বলছেন কেন? সরাসরি কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বোধহয় সমর সেনের স্বভাবে ছিল না। এর পরেই তিনি আমার ‘অর্জুন’ উপন্যাসটির প্রসঙ্গ টেনে আনলেন, সেটি সে বছরেরই শারদীয় সংখ্যা ‘দেশ’-এ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বললেন, রিফিউজিদের নিয়ে বেশ লেখাটা চলছিল, হঠাৎ তার মধ্যে একটি বড়লোকের মেয়ে নিয়ে এলে কেন? বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে এনে জাপটাজাপটি না করালে বুঝি বই বাজারে বিক্রি হয় না? আমার ‘অর্জুন’ উপন্যাসটিতে অনেক ত্রুটি থাকতে পারে, আছেও, আমি জানি, কিন্তু এই কি তার সমালোচনার ভাষা? এর পরেও কি আমি উত্তপ্ত হয়ে উঠব না? বিনয় আর হীনম্মন্যতা তো এক নয়। আমি খানিকটা তীক্ষ্নভাবে বললাম, আপনি ক্যাপিটালিস্ট পশ্চিম জার্মানির এই বড়লোকদের পার্টিতে মদ খেতে এসেছেন কেন? আমার মতন হ্যাংলা, গরিব, তরুণ কবিরা তবু আসতে পারে, কিন্তু আপনি গরিবও নন, তরুণও নন। তা ছাড়া এরা আপনাদের ঘোষিত শত্রু! এ কথারও উত্তর না দিয়ে সমর সেন তাঁর এক সঙ্গীর দিকে ফিরে বললেন, এ ছেলেটার নাম খতমের তালিকায় আছে না? কত নম্বরে?

তখন, জেল থেকে বউদিকে লেখা দীনেশ গুপ্তর চিঠির একটি লাইন আমার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, ‘আমি অমর, আমাকে মারিবার সাধ্য কাহারো নাই’।

হয়তো সমর সেন আমার মতন এক অর্বাচীনের সঙ্গে কৌতুক করতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই ইংরেজ-সুলভ শুষ্ক হিউমার আমি ঠিক অনুধাবন করতে পারিনি।

খতমের তালিকায় নাম থাক বা না থাক, সে সময় আলটপকা হঠাৎ খুন হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু ছিল না। সাতষট্টি থেকে একাত্তর সাল পর্যন্ত এরকমই অনিশ্চিত ছিল অনেকের জীবন। এক মে-দিবসে কলকাতার ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন জ্যোতি বসু, সেই ময়দানেরই অন্যপ্রান্তে আর এক সভায় কানু সান্যাল ঘোষণা করলেন এক নতুন দলের জন্মের কথা। সি পি আই (এম এল), দ্বিধা বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি এবার ত্রিধা হল। কিন্তু এই নতুন দলটি কেন্দ্রীয় ভাবে তেমন সুসংগঠিত হবার সময় পায়নি মনে হয়, বিভিন্ন অঞ্চলে যে-সব অ্যাকশান নেওয়া হচ্ছিল, তা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে কি না বোঝা যায়নি। যেখানে সেখানে বাংলা মাধ্যমের ইস্কুল বাড়িতে আগুন ধরানো, বিদ্যাসাগরের মূর্তির মুণ্ডু ভাঙা, বাসে আগুন লাগানো, শিক্ষক থেকে শুরু করে অনেক নিরীহ মানুষের গলা কেটে দেওয়া, চলন্ত বাসে বোমা ছোঁড়া, এ সবের মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা কিংবা বিপ্লবের কর্মসূচির পরিচয় পাওয়া যায়নি। বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে বেশ কিছু সমাজ-বিরোধীও এর মধ্যে ঢুকে পড়ে হত্যা ও লুঠতরাজ চালাচ্ছিল রাজনীতির নামে। ময়দানের মুক্তমেলায় নকশাল ছেলেরাই বোমা মেরেছিল, এ কথা আমার আজও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। পুলিশ থেকে সেরকমই বলা হয়েছিল, যদিও অনেক জায়গায় পুলিশই নানারকম কুকীর্তি করে নকশালদের নামে দোষ চাপাত, এ দৃষ্টান্তও বিরল নয়।

লন্ডনের হাইড পার্কের এক কোণে স্বাধীন ভাবে সব রকম মতামত প্রকাশ এবং গান-বাজনা করার জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান আছে। সেখানে ব্রিটিশ সরকারকে কোনও বক্তা চরম গালাগালি দিলেও পুলিশ বাধা দেয় না, কিংবা মুখোমুখি দুই পক্ষ সাংঘাতিক বাকযুদ্ধ শুরু করলেও যতক্ষণ না হাতাহাতি শুরু হয়, ততক্ষণ হস্তক্ষেপ করে না পুলিশ, পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় সেই রকমই মুক্তমেলা শুরু হয় কলকাতার ময়দানে, টাটা বিল্ডিং-এর উল্টোদিকে গাছতলায়। প্রতি শনিবার দুপুরে সেখানে জমায়েত হত, প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত, আমরাও কয়েকজন ছিলাম সঙ্গে, পরে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সেটা জমজমাট হয়ে ওঠে, কোনও সংগঠনের প্রয়োজন হয়নি। সেখানে কেউ এসে গান ধরে, একটু দূরে কেউ শুরু করে কবিতা পাঠ কিংবা দু’তিনজনের নাটিকা, কিংবা বক্তৃতা, কেউ ছবি আঁকে, যার যা খুশি, শ্রোতারা পছন্দমতন এক একজনকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ায়, পছন্দ না হলে আর একজনের কাছে চলে যায় কিংবা কারওর অনুষ্ঠান রুচিসম্মত না হলে ওরে পাগলা বসে পড় বলে থামিয়ে দেওয়া হয়। যারা কখনও রেডিয়োতে (তখনও টি ভি অশ্রুতপূর্ব) গান গাইবার কিংবা কোনও মঞ্চে ওঠার সুযোগ পায় না, সেরকম অনেক অচেনা গায়ক-গায়িকা, শিল্পী এবং বক্তা এই মুক্তমেলায় এসে জমিয়ে দিত। তাদের মধ্যে পরে কয়েকজন বেশ বিখ্যাতও হয়েছেন। শিল্পী প্রকাশ কর্মকার একদিন এসেছিলেন দামামা বাজাতে বাজাতে, অকালপ্রয়াত কবি তুষার রায় হয়েছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়। ছোট্টখাট্টো চেহারা, ছেঁড়া খাঁকি প্যান্ট ও পেঁজা পেঁজা বোতামবিহীন জামা পরা, মাথাটা একদিকে বেঁকিয়ে, বিচিত্র উচ্চারণে তুষার যখন অনর্গল কবিতা বলে যেত, তাকেই ঘিরে থাকত বহুসংখ্যক তরুণ-তরুণী। তুষার এক এক সময় সামনে কারওকে দেখে তাৎক্ষণিক কবিতাও বানিয়ে ফেলত, যেমন একদিন এক পুলিশের দিকে তর্জনী দেখিয়ে সে বজ্ৰনাদে বলে উঠেছিল, পুলিশ! কবিকে দেখে টুপিটা তুই খুলিস! কয়েকমাসের মধ্যেই ময়দানের এই মুক্তমেলা শনিবার দুপুরের একটা দারুণ আকর্ষণীয় উৎসব হয়ে দাঁড়াল, পয়সা খরচের কোনও ব্যাপার নেই, শিল্পী ও শ্রোতাদের মধ্যে আনন্দ বিনিময়ই একমাত্র উদ্দেশ্য। তবু কাদের যেন মনে হল, এটা অপসংস্কৃতির চর্চা। হঠাৎ একদিন একদল যুবক হৈ হৈ করে এসে বলল, ময়দানে এসব চলবে না, বন্ধ করে দিতে হবে। তাদের সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদে না গিয়ে অনুনয় করে বলা হল, তোমরা নিজেরা খানিকক্ষণ দেখো, শোনো, কোনটা খারাপ তা জানাও। দেখা ও শোনার ধৈর্য তাদের নেই, চলে গেল খানিকটা শাসানি দিয়ে। এক শনিবার আমি যাইনি, সন্ধেবেলা শুনতে পেলাম, সেদিন দুপুরে মুক্তমেলায় কারা যেন কয়েকটা বোমা ছুঁড়ে পালিয়ে গেছে, আহতদের মধ্যে রয়েছে দু’তিনটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে। শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কোনটা সংস্কৃতি আর কোনটা অপসংস্কৃতি তা আমরা বুঝি না, ওরা বেশি বোঝে? বোমা মেরে সংস্কৃতির শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে? এ তো ফ্যাসিজিমেরই নামান্তর। কেউ কেউ জোর করে তবু মুক্তমেলা চালিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন, কিন্তু অনেকে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আনে, তাদের জীবনের দায়িত্ব কে নেবে। আমরা আর যাইনি, বন্ধ হয়ে যায় মুক্তমেলা।

সেই ভয়াবহ দিনগুলিতেও আমাদের বেপরোয়া জীবনযাত্রার কোনও বদল হয়নি। আমার বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই অন্য বন্ধুরা, শক্তি, শরৎকুমার, সমরেন্দ্র, শ্যামল ও আরও অনেকে টপাটপ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, কিন্তু বাড়ি-টাড়ির দিকে মন দিতে আমাদের আরও কয়েকবছর সময় লেগেছে। সন্দীপনের বিয়ে হয়েছিল অনেক আগে, তবু নিজেকে সে বলত ম্যারেড ব্যাচেলার। এক বন্ধুর বিয়ের কয়েকমাস পরে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ খেয়াল হল, তার নবোঢ়া পত্নীর নামটা মনে নেই! বাড়ি গিয়ে স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে হবে তো, তাই সে অন্য এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করেছিল, আমার সঙ্গে কার বিয়ে হয়েছে বলো তো? নামটা পেটে আসছে, মুখে আসছে না!

তখন সিনেমাহলগুলিতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নাইট শো, বেশিরভাগ মানুষই সন্ধে হতে না হতে ঢুকে পড়ত বাড়ির মধ্যে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার অক্ষতভাবে ফিরে আসাটাই যেন একটা বিরাট ঘটনা। কিন্তু আমরা যে স্বভাবে নিশাচর, রাতপাখি, সন্ধের মধ্যে কুলায় প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নই ওঠে না। আড্ডায় আড্ডায় রাত অনেক বেড়ে যায়, তবু বন্ধুদের ছেড়ে যেতে মন চায় না। এখন বুঝতে পারি, অল্প বয়েসের সেই আড্ডাই ছিল কবিতা লেখারও প্রেরণা, হিংসা-বিদ্বেষ-পরশ্রীকাতরতার অনুপ্রবেশ ঘটেনি তখনও। কিন্তু প্রতিদিনই গভীর রাতে বাড়ি ফেরা ছিল দুঃসাহসিক অভিযানের মতন, অনেকবার আমরা বিপদে পড়েছি। আমাকে যেতে হত শেয়ারের ট্যাক্সিতে, বড় রাস্তার মুখ থেকে গলির মধ্যে খানিকটা অন্ধকার হাঁটাপথ। দমদমের দিকে প্রায়ই সকালে দু’একটা মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যেত রাস্তায়। সেই গলি দিয়ে যাওয়ার সময় আমি কোমর থেকে বেল্টটা খুলে হাতে নিতাম, সেটা যেন তলোয়ার, কেউ আক্রমণ করতে এলে লড়ে যেতে হবে! একদিন বেশ একটা ভয়াবহ হাস্যকর ঘটনা ঘটেছিল। যথারীতি শ্যামবাজার থেকে মধ্যরাতে শেয়ারের ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরছি, সাতগাছির মোড়ে আমার নেমে যাবার কথা, হঠাৎ আমার পাশের লোকটি ধমকের সুরে বলল, না, তোমার এখানে নামা চলবে না। আমি বিস্ময় প্রকাশ করতেই সে ফস করে একটা লম্বা ছুরি বার করে আমার পেটে চেপে ধরে বিশ্রী গালাগালি দিয়ে বলল, চল আমার সঙ্গে। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমার সমর্থনে কিছু বলতে গিয়ে ঘাড়ে একটা রদ্দা খেল। ভয় পেয়েছিলাম ঠিকই, ধড়াস ধড়াস করছিল বুক। এই লোকটি কোনও একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমার পেটে ছুরিটা ঢুকিয়ে দেবে? যদিও কী দোষ করেছি জানি না, তবু এরকম কিছু হঠাৎ একদিন ঘটে যেতে পারে, অবচেতনে এরকম ধারণাও ছিল। নাগেরবাজার, ক্লাইভ কলোনি, এয়ারপোর্টও ছাড়িয়ে একজায়গায় ট্যাক্সিটি থামানো হল। চতুর্দিক অন্ধকার, শুনশান। লোকটির ছুরির আস্ফালনে ট্যাক্সি ড্রাইভার ও আমাকে নেমে দাঁড়াতে হল। এইবারই কি সেই মুহূর্ত? ছুরিটা এতই বড় যে বাধা দেবার চেষ্টা করা বৃথা। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই লোকটি খুব জোরে দৌড়ে মিলিয়ে গেল একপাশের মিশমিশে অন্ধকারে। আমরা দু’জন হতভম্বের মতন একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, তারপর ট্যাক্সিতে উঠে চম্পট দিলাম। যেতে যেতে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ব্যাপারটা কী হল বলুন তো? শুধু শুধু কেন আমাকে এতটা দূরে নিয়ে এল? ড্রাইভারটি বললেন, বুঝলেন না, ও নিজেই ভয় পেয়েছে। ওকেও বোধহয় কেউ খুন করতে চায়, তাই একা আসতে সাহস করছিল না।

তখন নানান রকম সন্দেহে নিজেদের মধ্যেও খুনোখুনি শুরু হয়ে গেছে। বাঙালিরা সংঘবদ্ধ ভাবে কোথাও লড়াই করেছে, অনতিঅতীত ইতিহাসে এরকম নজির নেই, কিন্তু গুপ্তহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা, কিংবা তিনচারজন মিলে কাপুরুষের মতন কোনও নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা করার ব্যাপারে তারা বেশ পারঙ্গম। বিপ্লবের আহ্বানে কিছু কিছু মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি হয়েছিল, এবার সামরিকবাহিনী এসে সেসব গুঁড়িয়ে দিতে লাগল। পুলিশও সাঙ্ঘাতিক প্রতিশোধপরায়ণ, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও মেতে উঠল হত্যালীলায়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নাতি সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় কেন্দ্র থেকে প্রেরিত হয়ে পশ্চিমবাংলার ভারপ্রাপ্ত, বরানগরের মতন কয়েকটি জায়গায় বীভৎস গণহত্যাকাণ্ডের জন্য তাঁকে অপ্রত্যক্ষভাবে দায়ী করা হয়েছে।

আমরা বিপ্লবপন্থীদের সঙ্গে যোগ দিইনি, তাদের বিরুদ্ধতাও করিনি। তাদের নামে সংঘটিত কোনও কাজ, যেমন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত কোনও উপাচার্যকে হত্যা কিংবা বিদ্যাসাগরের মূর্তির মুণ্ডু ভাঙা সমর্থন করতে পারিনি, আবার এক একটি হিরের টুকরোর মতন সৎ, আদর্শবাদী যুবক কিংবা সরোজ দত্ত’র মতন মানুষ যখন মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়েছেন তখন দারুণ কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু এ রক্তপাত থামাবার কোনও উপায় তো আমাদের জানা নেই। তবু অন্তত নৈতিক প্রতিবাদ জানাবার জন্য আমরা কৃত্তিবাসের এক সংখ্যায় ঘোষণা করেছিলাম, ‘রক্তের বদলে রক্ত চাই’। অর্থাৎ দিকে দিকে বইছে অকারণের রক্তস্রোত, আমরা নিজে থেকে রক্ত দেব, আহত মানুষদের সেবার জন্য। একটা নির্দিষ্ট তারিখ জানিয়ে যোগাযোগ করা হল মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কের সঙ্গে। হা হতোস্মি! আশা করেছিলাম, কলকাতায় কবির সংখ্যা গণনাতীত, কৃত্তিবাসের পাঠক-অনুরাগীও কম নয়, দলে দলে সবাই রক্ত দিতে ছুটে আসবে। মেডিক্যাল কলেজের গেটের সামনে একঘণ্টা অপেক্ষা করেও রক্তদাতার সংখ্যা দাঁড়াল মাত্র চারজন। তাও আমার ছোট শ্যালিকার প্রেমিক পার্থ, যার সঙ্গে কবিতার কোনও সম্পর্ক নেই, সে বেচারি এমনিই সকালবেলা দেখা করতে এসেছিল আমার সঙ্গে, তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম সংখ্যা বাড়াবার জন্য। দেখা গেল, কবিরা রক্ত দিয়ে কবিতা লেখার কথা বলে বটে, কিন্তু অন্যের জন্য রক্ত দিতে রাজি নয়। মধ্যবিত্ত বাঙালির রক্তদান সম্পর্কে অনর্থক ভীতি আছে, অথচ মাঝে মাঝে রক্ত দিলে শরীরের কোনও ক্ষতি হয় না, তেমন ব্যথাও লাগে না, এটা জানা কথা!

যে-কোনও কারণেই হোক, নকশালপন্থী নেতাদের চোখে আমার মতন কবি-লেখকরা অবজ্ঞার পাত্র হলেও কয়েকজন তরুণ বিপ্লববাদী আমার সঙ্গে গোপনে দেখা করতে আসত। তর্ক-বিতর্ক হত। আবার দুপুরে আমাদের সঙ্গে দুটি ডাল-ভাত খেয়ে যেতে বললে আপত্তি জানাত না। তারা এনে দিত পত্র-পত্রিকা, রেড বুক, কয়েকটি চিনে উপন্যাসের বঙ্গানুবাদ। তারা কেউ দল বেঁধে আসত না, হয়তো একজনের কথা বলত না অন্যকে।

ততদিনে আমরা নাগেরবাজার ছেড়ে ফ্ল্যাটভাড়া নিয়েছি দক্ষিণ কলকাতায়। আমাদের এতদিনের একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে দেবার জন্য আমিই দায়ী। বাড়িতে তখন তিন পুত্রবধূ নিয়ে আমার মায়ের শান্তি ও সুখের সংসার, কোনওরকম মনোমালিন্য নেই, আমার মনে হয়েছিল সেটাই প্রকৃষ্ট সময়, কেন না রুচি-পার্থক্যের জন্য ভবিষ্যতে তিন বধূর মধ্যে মতপার্থক্যের সম্ভাবনা তো আছেই। তা ছাড়া আমার মায়ের একটা দোষ ছিল, তিনি তাঁর বড়ছেলের বউকে বেশি বেশি আদর করতেন, সেটা স্বাতীর পক্ষেও অস্বস্তির কারণ হত। আমার এই সিদ্ধান্তের আরও কয়েকটি কারণ ছিল, আমার দুই ভাইয়ের সঙ্গে আমার জীবনযাত্রা পদ্ধতির অনেক তফাত। আমার দু’একটি বন্ধু এসে মাঝে মাঝে উৎপাত ও শান্তিভঙ্গ করে। গভীর রাত্রে বাড়ি ফেরার অভ্যেসটি কিছুতেই শোধরাতে পারছি না। শ্যামবাজার থেকে শেয়ারের ট্যাক্সিতে ফেরা ক্রমশই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, মা ও স্বাতী আমার ফেরার অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন বারান্দায়, প্রতি রাতে এজন্য আমার লজ্জাবোধ হয়, পরদিন সকালে আবার ভুলে যাই। তা ছাড়া, আমি অনুভব করছিলাম স্বাতীর প্রতি বেশ অবিচার করা হচ্ছে, দক্ষিণ কলকাতায় তার জন্ম, সেখানেই লালিত ও বর্ধিত হয়েছে, সেখান থেকে তাকে শেকড়সুদ্ধু দমদমের মফঃস্বলে উপড়ে আনা হলেও সে মানিয়ে নিয়েছিল বেশ তাড়াতাড়ি, বাড়ির সকলের এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গেও ভাব হয়ে গেছে, কিন্তু বিয়ের আগে সে ফরাসি-জার্মান শিক্ষার ক্লাসে, গানের ক্লাসে যেত, বান্ধবীদের সঙ্গে বেড়াতে যেত এখানে সেখানে, বিয়ের পর সে নিতান্তই গৃহবধূ হয়ে গৃহে আবদ্ধ থাকবে, এটা মোটেই ঠিক নয়। এখন মেনে নিলেও কিছুদিন পরে নিশ্চয়ই তার মন বিদ্রোহ করবে। এদিককার অচেনা রাস্তাঘাটে সে একা একা বেরুতে পারে না। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতায় সে জলের মাছের মতন সাবলীল। মাঝেমাঝে বাপের বাড়ি যেতে চাইলে তাকে বাস বদল করে যেতে হয়, ভিড়ের বাসে শিশুপুত্রকে কোলে আঁকড়ে রেখে সেই সুদীর্ঘ যাত্রা মোটেই সুখকর নয়। তবে, বিয়ের সময় থেকেই আমি দমদমের বাড়ির আর একটি ফ্ল্যাট নিয়েছিলাম, বারান্দাবহুল খুব খোলামেলা, তিনদিকই উন্মুক্ত, সে ফ্ল্যাটটি স্বাতীর খুব পছন্দ ছিল।

দক্ষিণ কলকাতায় চলে আসার ইচ্ছে থাকলেও সেখানে ফ্ল্যাটভাড়া অনেক বেশি, সে সামর্থ্য আমার ছিল না, তাই অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছিল, অকস্মাৎ ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র জন্য পেয়ে গেলাম চার হাজার টাকা। তার অর্ধেক টাকা একে ওকে কিছু কিছু উপহার দেবার জন্য খরচ করে ফেলল স্বাতী, বাকি দু’হাজার টাকা সম্বল করেই আমি নিয়ে ফেললাম এক ঝুঁকি, তখনও কোনও চাকরি নেই, লেখায় উপার্জন প্রতিমাসে বাড়ে কমে, হঠাৎ একমাস অসুস্থ হয়ে পড়লেই লেখা বন্ধ, অর্থাগমও বন্ধ, তবু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে দুশো পঁচাত্তর টাকায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে এলাম ঢাকুরিয়া ব্রিজের কাছে। সঙ্গে নিয়ে এলাম মাকে, আমাদের শিশুপুত্রটি একা ঠাকুমার স্নেহ উপভোগ করার অতিরিক্ত সুযোগ পেয়ে গেল, আবার এদিকে দাদু-দিদার সাহচর্যও পেতে লাগল ঘন ঘন, এবং মাসি-মেসোদের আদর।

এখানে স্বাতী নতুন করে সংসার গুছিয়ে বসার কিছুদিন পর সেই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটেছিল। একটি নকশালপন্থী তরুণ, তার বয়েস কুড়ি-একুশের বেশি নয়, কখনও সখনও আমাদের বাড়ি আসত। একদিন সে রাত দশটার পরে হঠাৎ এসে উপস্থিত। সাধারণত সে সকালে বা দুপুরে আসে। তার মুখখানি খুবই সুশ্রী ও কোমল, কিন্তু সেদিন তার চোখ দুটি যেন অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল, হাসি নেই, ওষ্ঠে কঠিন রেখা, হঠাৎ স্বাতীকে ও আমাকে প্রণাম করে ফেলে সে বলল যে, সে একটি খাতা আমাদের কাছে রেখে যেতে চায়, সে যদি আর কখনও ফিরে না আসে তা হলে আমি যেন খাতার লেখাণ্ডলি কোথাও ছাপিয়ে দেবার চেষ্টা করি। স্বাতী বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ফিরে আসবে না মানে? কেন? সে জানাল যে আজ রাতেই তাকে একটা অ্যাকশানে যেতে হবে, ফিরে না আসার সম্ভাবনাই বেশি। অ্যাকশান-এর বিশেষ অর্থও স্বাতীর বোধগম্য নয়, সে কোথাও কাউকে খুন করতে যাচ্ছে আর কয়েকজনের সঙ্গে। কোথায় এবং কাকে, তাও বলা নিষেধ। স্বাতী বিহ্বলভাবে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ, এরকম একটি সুকুমার প্রকৃতির ছেলে খুনি হতে যাচ্ছে, এটা সে বিশ্বাসই করতে চাইছিল না। কেন যাচ্ছে, না যেতে হবে না, এসব বলেও কোনও লাভ নেই, তার আর ফেরার পথ নেই, এখন যদি সে না যায়, সেটা হবে তার সহযাত্রীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, তা হলে তারাই এই ছেলেটিকে চরম শাস্তি দেবে। স্বাতী প্রায় তার প্রেমিকার মতন কিংবা তার মায়ের মতন, কিংবা এই দুটি মিলিয়ে যে সত্তা হয়, সেই রূপ নিয়ে ছেলেটিকে নিবৃত্ত করতে চাইল হাত চেপে ধরে, কোনও লাভ হল না, সে জোর করে হাত ছাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল দপদপিয়ে।

তারপর স্বাতী এমন কান্না শুরু করল যে কিছুতেই তাকে থামানো যায়নি। তাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই। আমি খাতাটার প্রতিটি পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে দেখলাম। নানারকম ভাবে কাটাকুটি করা অধিকাংশই কবিতা, কিছু গদ্য, দিনলিপির মতন। উচ্চকণ্ঠে রাজনৈতিক বক্তব্য আছে, লেনিন ও মাও-এর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি আছে। তা ছাড়া অনেক কবিতাতেই ঝিলিক দিচ্ছে ব্যর্থ প্রেমের জ্বালা, এক অপ্রাপণীয়া তরুণীর মুখ। কোনও রচনাই মুদ্রিত হবার মতন ঠিক মানে পৌঁছয়নি, কিন্তু তার বিশুদ্ধ আবেগ আমাকে খুবই আলোড়িত করেছিল। অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবছিলাম, কবিতা জিনিসটার কী সাংঘাতিক মায়া, যে আর একদিনও বাঁচবে কি না ঠিক নেই। মৃত্যুর পর কী হয় জানে না। সেও এই কবিতাগুলি ছাপিয়ে তার মধ্যে বেঁচে থাকতে চায়।

স্বাতীর ব্যাকুল কান্নার মধ্যে প্রার্থনাও ছিল। প্রার্থনা যদি ইচ্ছাশক্তি হয়, তবে তার অবশ্যই জোর আছে। স্বাতীর সেই কান্নাই খুব সম্ভবত ছেলেটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তার সেদিনের অ্যাকশানের ফলাফল আমরা কখনও জানতে পারিনি। সংবাদপত্রেও কিছু প্রকাশিত হয়নি, তবে বছর কয়েক বাদে জেল থেকে বেরিয়ে এসে সে খাতাটি ফেরত নিয়ে যায়।

সাতচল্লিশ

সন্তোষকুমার ঘোষ সম্পর্কে আমরা অবাক হয়ে ভাবতাম, উনি ঘুমোন কখন। সারা দিন-রাতই তো তিনি ব্যস্ত। অফিসে তাঁর ঘরে একটা আরাম কেদারা ছিল, কখনও সেটাতে বসে কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে নিতেন, তাও বড় জোর আধঘণ্টা। সংবাদপত্রে শেষ পাতা ছাড়া হয় রাত্রি দেড়টা-দুটোয়, প্রায় রাতেই তিনি সেটা নিজে দেখে দিয়ে যেতেন, তার আগে বা পরে গাড়িতে চক্কর দিয়ে বেড়াতেন সারা শহর। চেনাশুনো কারও বাড়িতে তিনি হানা দিতেন যখন-তখন, রাত-বিরেত মানতেন না, আমাদের দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটে তিনি কয়েকজন সঙ্গীসহ রাত দুটোর সময়েও হাজির হয়েছেন কয়েকবার। স্বাতীকে জাগিয়ে তুলে বলতেন, খুব খিদে পেয়েছে, খিচুড়ি রান্না করো। স্বাতী সাদামাটা, এক রঙা মানুষদের চেয়ে এরকম ব্যতিক্রমী চরিত্রই বেশি পছন্দ করে, সন্তোষদার সঙ্গে তার প্রথম আলাপের পরই ভাব জমে গিয়েছিল এবং খিচুড়ি রান্নাতেও বেশ হাত পাকিয়ে ফেলেছিল।

লেখককুলের মধ্যে একমাত্র সন্তোষকুমারকেই তখন গাড়ি চড়তে দেখেছি, তাও তাঁর পদাধিকার বলে। ড্রাইভার ছিল, তবু এক এক মাঝ রাত্তিরে তাঁর নিজে গাড়ি চালাবার শখ চাপত। সে সময় তাঁর সঙ্গী হবার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাদের হয়েছে, তারা কখনও সে অভিজ্ঞতা ভুলবে না। ওঃ, কী খারাপ গাড়ি চালাতেন তিনি! একদিন বুদ্ধদেব-প্রতিভা বসুর নাকতলার বাড়ি থেকে ওঁর সঙ্গে ফিরছি, কী কারণে যেন ড্রাইভারের ওপর রাগ করে তাকে মাঝপথে নামিয়ে দিয়ে নিজে স্টিয়ারিং ধরলেন। গাড়ি একবার রাস্তার এপাশে আর একবার ওপাশে, কান ঘেঁষে বিকট শব্দে ব্রেক কষছে অন্য গাড়িগুলি, আমার প্রাণটা ওষ্ঠের কাছে এসে বেরিয়ে যাবার জন্য ধুকপুক করছিল। তবু যে তিনি কখনও দুর্ঘটনার শিকার হননি, তার কারণ, অনেকে বলত, সন্তোষকুমারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন আলাদা দেবতা চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি দেয়।

সংবাদপত্রের জন্য সমস্ত মন ও সময় নিবেদিত, নিজস্ব সাহিত্যরচনার ধারাটি প্রায় শুষ্ক, তবু প্রতিদিনের কিছুটা সময় সংবাদ-জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে সাহিত্যিকদের সঙ্গে কাটাতেন। কখনও ডেকে আনতেন সমরেশ বসুকে, কিংবা শক্তি, মতি নন্দী, সমরেশ মজুমদার কিংবা আমাকে, আলোচনা হত সাহিত্যের আঙ্গিকের খুঁটিনাটি নিয়ে। পেশার সাফল্যে ও নেশায় যে তাঁর সৃজনমূলক কাজ চাপা পড়ে যাচ্ছে, তা তিনি অনুভব করতেন ঠিকই, বেদনাবোধও ছিল, কিন্তু বেরুবার পথও বোধহয় আর ছিল না। সমরেশ বসুকে তখন বলা হত সাহিত্যের উত্তমকুমার, উচ্চতায় কিছুটা হ্রস্ব হলেও খুবই সুপুরুষ, নানারকম পোশাকে তাঁকে খুবই মানাত। তিনি নিয়ম করে প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বসতেন লেখার টেবিলে, তিনি কোথাও চাকরি করতেন না, লেখার ধরাবাঁধা সময়টাই ছিল চাকরির মতন, সন্ধের পর থেকে মুক্ত পুরুষ, সেজেগুজে বেরুতেন আড্ডা দিতে। সন্তোষকুমার ছাড়া আমার মতন কম বয়েসিরাই ছিল তাঁর বন্ধু। সন্তোষকুমার প্রায়ই সমরেশ বসুকে বলতেন, আমি তোকে ঈর্ষা করি। কিন্তু যখন ‘বিবর’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়, সন্তোষকুমারই তখন প্রথম সে উপন্যাসকে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে লিখিত অভিনন্দন জানান। বুকের দরজা খুলে দিয়ে তিনি অন্যের লেখার শর্তহীন প্রশংসা করতে পারতেন, এমন উদারতা খুবই দুর্লভ।

সন্তোষদা কিছুদিন ধরে স্বাতীকে বলতে শুরু করলেন, তোমার এই মূখ স্বামীটি যে ফ্রি লানসিং করে জীবন কাটাবে ঠিক করেছে, সে রকমভাবে কতদিন চলবে? খবরের কাগজের নীতি যখন-তখন পাল্টে যেতে পারে। নীল উপাধ্যায় নামে ও যে ‘দেশে দেশে’ পৃষ্ঠাটি চালায়, সেটা তুলে দেওয়া হবে, তাতে ওর উপার্জন অনেক কমে যাবে, তখন তোমরা খাবে কী? ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে না? এখন ওকে চাকরি নিতে বলো। স্বাতী আমার চাকরি করা কিংবা না-করা নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি, টাকা পয়সার ব্যাপারেও খুবই অন্যমনস্ক, তাই আমাকে জোর করেনি। সন্তোষদা কয়েকবার পেড়াপিড়ি করার পর রাজি হয়ে গেলাম আমি নিজেই। রম্যরচনার বিষয়বস্তু খুঁজতে খুঁজতে তখন আমার হন্যে হবার মতন অবস্থা। তা ছাড়া, আলাদা সংসার পাতার যা কিছু ঝক্কি-ঝামেলা, হঠাৎ হঠাৎ খালি হাত ও বাজার বন্ধ, বিয়ের নেমন্তন্নর উপহার কিনতে গিয়ে কিংবা ছেলের অসুখ হলে ডাক্তার দেখাবার জন্য কারও কাছ থেকে ধার করার গ্লানি, এসবই শুরু হয়ে গেছে। ‘দেশে দেশে’ পৃষ্ঠাটি বন্ধ হয়ে যাওয়াও বেশ দুঃসংবাদ। নিজের জীবন নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া যায়, কিন্তু এখন যে অন্য জীবনও জড়িয়ে গেছে! প্রায় ছ’বছর শুধু কলম সম্বল করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে গিয়ে আমাকে শেষ পর্যন্ত চাকরি নিতে হল সত্তর সালে। সেই সময় সন্তোষদা শক্তিকেও ডেকে নিলেন। শক্তি আর আমার একসঙ্গে একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল ‘যুগলবন্দী’ নামে। তখন থেকে শক্তি-সুনীল কিংবা সুনীল-শক্তি নামদুটি একসঙ্গে উচ্চারিত হত, দু’জনেই একসঙ্গে যুক্ত হলাম আনন্দবাজার পত্রিকার কাজে।

সন্তোষদাকে আমি জানিয়েছিলাম, কোনওরকম রাজনৈতিক লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, রিপোর্টারদের মতন ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহ কিংবা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেবার ব্যাপারেও আমি অযোগ্য, কারণ নতুন মানুষের সঙ্গে সহজে আলাপ জমিয়ে নিতে পারি না। আর সংবাদপত্রে ডে-ডিউটি, ইভনিং ডিউটি, নাইট ডিউটি— এরকম বিভিন্ন পর্যায় থাকে, তার থেকেও আমাকে অব্যাহতি দিলে ভালো হয়, কারণ সকাল ও সন্ধেগুলিতে নিজস্ব সময় না পেলে অন্য লেখা, কৃত্তিবাস চালানো সম্ভব হবে না। সন্তোষদা বললেন, রাজনৈতিক লেখার জন্য তোমার কলমের দরকার নেই, তার জন্য অনেকে তৈরি হয়ে আছে, তোমার বাকি দাবিগুলি পরে বিবেচনা করা যাবে, তার আগে তোমাকে সবরকম ডিউটি নিয়ে সব বিভাগের কাজ শিখতে হবে। সুতরাং পরবর্তী কয়েক মাস প্রুফ দেখা, পৃষ্ঠা সজ্জা, নিজস্ব প্রতিবেদন কিংবা অপর প্রতিবেদকদের রচনা সংশোধন, টেলিপ্রিন্টারে আগত ইংরিজি খবরের অনুবাদ, শিরোনাম দেওয়া ইত্যাদি শিক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হল সকালে, দুপুরে ও রাত্রে। কম্পিউটার যুগের বহু আগের কথা, তখন পুরো সংবাদ বিভাগটি ছিল বিশাল এক হল ঘরে, অনেকগুলি টেবিল, কাজের ফাঁকে ফাঁকে এ টেবিল থেকে ও টেবিলে মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া, হাসি ঠাট্টা, আড্ডায় জমজমাট ছিল পরিবেশ, সিগারেট সম্পর্কে কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। নাইট ডিউটি সম্পর্কে আমার অনীহা ছিল, পরে দেখা গেল সেটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। রাত্তিরের দিকেই গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলি আসে, এক একদিন হইচই, দৌড়োদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। মাঝ রাত্তিরে বিরাট কোনও দুঃসংবাদ এলে বদলে ফেলতে হয় প্রথম পৃষ্ঠা। রাত্তিরের কাজ শেষ হলে বাড়ি ফেরার প্রশ্ন ছিল না, বড় বড় টেবিলগুলো থেকে কাগজপত্র সরিয়ে বিছানা পেতে দেওয়া হত, কোম্পানিরই দেওয়া বিছানা, মাত্র দু’তিন ঘণ্টার জন্য ঘুমোবার চেষ্টা, ভোর হতে না হতেই বাইরে বেরিয়ে সামনের দোকানে চা-জিলিপি খাওয়া। কয়েক মাস পরে সন্তোষদা আমাকে বার্তাকক্ষ থেকে সরিয়ে নিয়ে বসিয়ে দিলেন সহকারী সম্পাদকদের ছোট ঘরে, শিফ্ট ডিউটির বদলে নির্দিষ্টভাবে বারোটা থেকে ছ’টা, কাজ ছিল চিঠিপত্র বিভাগ ও গ্রন্থ সমালোচনা বিভাগ দেখা, ‘কলকাতার কড়চা’ বিভাগটির দায়িত্বে ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ, কিছুদিন সে বিভাগটিও আমাকে দেখতে হয়েছিল। এসব কাজই আমার বেশ পছন্দের ছিল। সে ঘরের অন্যান্যদের তুলনায় আমার পদমর্যাদা ছিল নীচে, হংসদের মধ্যে বক হয়ে আমি বসে থাকলেও বাইরের লোকরা বুঝত না, আমিই বা জনে জনে ডেকে ডেকে ভুল ভাঙাই কী করে?

বিশেষ প্রতিবেদক হিসেবে আমাকে কখনও কখনও পাঠানো হয়েছে বাইরে, যেমন বিহারের চাসনালায় ভয়াবহ খনি দুর্ঘটনার সময়, যখন প্রায় চারশো কয়লা-শ্রমিক চাপা পড়ে গিয়েছিল খনি গর্ভে, কয়েকদিন ধরে জানাই যায়নি, তারা মৃত না তখনও জীবিত, আটাত্তর সালের বন্যার সময় হেলিকপ্টারে বা নৌকোয় বিভিন্ন জেলা ঘুরে দেখা, ইন্দিরা গাঁধীর হত্যার পর দিল্লির দাঙ্গা, কিংবা বার্লিন দেওয়ালের পতন। সংবাদপত্রের প্রতিবেদকরা ঘটনাস্থলে গিয়ে কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় মানুষ, আক্রান্ত বা তাদের আত্মীয়-পরিজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে কাহিনীর পুনর্নির্মাণ করেন। আমি তেমনটি পারি না, শুধু একা ঘুরে দেখি, কোথাও চুপ করে বসে থাকি, অন্যদের কথাবার্তা যা কানে আসে তাই শুনি, নিজে থেকে কারওকে কিছু জিজ্ঞেস করি না, সেভাবেই যতটা যা পেরেছি, লিখেছি। আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ কোনওদিনই আমাকে লেখার ব্যাপারে কোনও নির্দেশ দেননি, কোনও নীতি অনুসরণ করার জন্য চাপ দেননি, সুযোগ সুবিধে ও স্বাধীনতা দিয়েছেন অবাধ, এমনকী এই পত্রিকার কোনও কোনও নীতির বিরুদ্ধ মত প্রকাশের সুযোগ দেবার মতন উদারতা দেখিয়েছেন।

নাইট ডিউটির সময় এক একদিন বাকি রাতটুকু বিনিদ্র থেকে বেরিয়ে পড়তাম ব্রাহ্মমুহূর্তে। যে কোনও শহরেরই মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত অন্যরকম চেহারা। মধ্যরাত্রির রূপ অনেকবারই দেখেছি, কিন্তু ভোরে সচরাচর রাস্তায় নামা হয় না। উষালগ্নের বাতাস গায়ে লাগলে অবধারিত ভাবে মনে হবেই, বেঁচে থাকা কী সুন্দর! ট্রাম-বাসও চালু হয়নি, হাঁটতে শুরু করি মন্থর পায়ে, বাড়ি ফেরার তাড়া নেই, কেন না এখনই পৌঁছোলে মা ও স্বাতীর ঘুম ভাঙাতে হবে। পার্ক স্ট্রিটে এসেই সবচেয়ে বিস্ময় বোধ হয়েছিল। এটাই শহরের সবচেয়ে সুসজ্জিত রাস্তা, এক কালে বলা হত সাহেবপাড়া, তখনও বেশ কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাহেব-মেম দেখা যেত, আলো ঝলমল করত রাত্রির তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত, ভোরবেলা তার একেবারে অন্যরূপ। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ, একটু একটু কুয়াশা মাখা নির্জন নিস্তব্ধ পথ, বড় বড় বাড়িগুলি ঘুমিয়ে আছে চোখ বুজে। সব সময় যে রাস্তাটিকে যানবাহন ও জনবহুল দেখতেই অভ্যস্ত, সেখানে আর কেউ নেই, আমি একা, যেন প্রলয়ের পর এক নিঃসঙ্গ পথিক। আমার কোনওরকম অলৌকিক ব্যাপারে বিশ্বাস নেই, কিন্তু পরাবাস্তবতার দিকে একটা টান আছে। যেন এই দৃশ্যমান জগতের আড়ালে রয়েছে একটা অন্য জগৎ, হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায় তার এক ঝলক, যার ঠিক ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। একটা চিনে রেস্তোরাঁর সামনে কয়েকটি বেলুন উড়ছে, আরও কাছে গিয়ে দেখি, একটি চিনে কিশোর, ধপধপে সাদা পোশাক পরা, লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে সেই রঙিন বেলুনগুলি নিয়ে, বেলুনগুলিতে ঘুঁষি মেরে মেরে তুলছে ওপরে। আমি যে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, সে ভ্রূক্ষেপও করল না, খেলতেই লাগল, একসময় দারুণ শিহরিত হল আমার সর্বাঙ্গের রোমকূপ। ছেলেটি লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠছে, তারপর যেন ওপরেই থেমে থাকছে বেশ কয়েক মুহূর্ত। যাকে বলে লেভিটেশান। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ তুচ্ছ করে শূন্যে থেমে থাকা তো কিছুতেই সম্ভব নয়, এটা অবিশ্বাস্য। তবে কি চিনেদের মতন চেহারা হলেও এ ছেলেটি পৃথিবীর মানুষ নয়, এসেছে ভিন্ন গ্রহ থেকে, তার শরীরের স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি অন্য রকম? হঠাৎই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। বেলুনগুলো দুলছে, ছেলেটি নেই। মানুষের মতনই চেহারা, তবু অদৃশ্য হয়ে যায় কী করে? ছেলেটি কয়েকবার আমার দিকে দৃষ্টিপাত করেছে কিন্তু আমাকে দেখেনি, যেন আমার অস্তিত্বই নেই, তার চোখেও কি আমি অদৃশ্য ছিলাম? আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, ছেলেটিকে আর দেখা গেল না, সামনের চিনে দোকানটির দরজা জানলা সব আঁটা।

বিস্ময়ের সেখানেই শেষ নয়। খানিকটা এগিয়ে ক্যামাক স্ট্রিটের মোড়ে, পার্কের সামনের ফুটপাথে উবু হয়ে বসে আছে দশ-বারোজন মানুষ, তাদের সকলেরই পরনে একই রকম লুঙ্গি, সাদা ফতুয়া, মাথায় পাগড়ির মতন গামছা বাঁধা। প্রত্যেকের সামনে একটা করে বেতের চুবড়ি, ওরা বাঁশি বাজাচ্ছে, সাপুড়েদের বাঁশি। এতগুলি সাপুড়ে এ রকম ভোরে পার্ক স্ট্রিটে এসে জড়ো হল কী করে? আমি কলকাতার উত্তর ও দক্ষিণে বহু অলিতে গলিতে ঘুরেছি, কোথাও সাপুড়েদের আস্তানা দেখিনি। যারা রাস্তায় সাপ খেলা দেখায় তারা নিশ্চিত আসে মফঃস্বল থেকে, কিন্তু তারা এত জায়গা থাকতে পার্ক স্ট্রিটে বাঁশি বাজানো প্র্যাক্টিস করতে আসবে, এর কি কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়! আধ খোলা চুপড়ি থেকে ফণাও তুলছে কয়েকটি সাপ৷ আমি ছাড়া আর কোনও দর্শক নেই, সাপুড়েরাও আমাকে দর্শক হিসেবে গণ্য করছে না। চিনে ছেলেটির শূন্যে অবস্থান আমার দৃষ্টিবিভ্রম হলেও হতে পারে, কিংবা সে জাদুকর, কিন্তু এখানে একসঙ্গে এতগুলি সাপুড়ের সমাবেশ সম্পর্কে কোনও ভুল নেই, তাদের বাঁশির সুরে বাতাস দুলছে, ক্যামেরা থাকলে ছবি তুলে রাখা যেত। কয়েক মিনিট পরেই তারা একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে চুবড়ি মাথায় নিয়ে চলে গেল একই দিকে। এদের চোখেও যেন আমি অদৃশ্য।

তীব্র কৌতূহলে আমি পরের দিন ঠিক একই রকম ভোরে আবার এসেছিলাম পার্ক স্ট্রিটে, কিন্তু বেলুন নিয়ে লীলায় মেতে থাকা কোনও চিনে কিশোরের চিহ্ন সেখানে ছিল না, ক্যামাক স্ট্রিটের মোড়ে ছিল না সাপুড়েদের দল। সেদিনই বিকেলে চিনে রেস্তোঁরায় ঢুকেও দেখতে পাইনি সেই ছেলেটিকে, অবশ্য চিনেদের চেহারা একবার মাত্র দেখে আলাদাভাবে চেনা সহজ নয়, সেই বয়েসিও কেউ ছিল না। কয়েকদিন পর ভবানীপুরে গাঁজা পার্কের পাশে একজন সাপুড়েকে বেশ জমিয়ে খেলা দেখাতে দেখেছিলাম বটে, তার মুখ ভর্তি দাড়ি, আমার পার্ক স্ট্রিটের সাপুড়েদের সবারই মুখ ছিল মসৃণ। এ সব কিছু না, হয়তো কোনও তাৎপর্য নেই, তবু এই সব অতি নিভৃত ও নিজস্ব অবলোকন নিয়ে অনেকক্ষণ বেশ মেতে থাকা যায়।

অল্প বয়েস থেকেই কিছু কিছু অভিজ্ঞতা সম্পর্কে মনে একটা প্রশ্ন থাকে, অন্যদেরও কি এরকম হয়? যৌনতা সম্পর্কে এ সংশয় তো থাকে বহুদিন। আরও কিছু কিছু, যেমন হঠাৎ একটা গানের লাইন মনে পড়ল হাঁটতে হাঁটতে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল পাশের দোকানের রেডিয়োতে ঠিক সেই গানটাই বাজছে। তার মানে কি গানটা ক্ষীণভাবে আগেই শুনেছিলাম? তা হলে এর ব্যাখ্যা কী, সুচিত্রা মিত্র একটা গান থামিয়ে পরবর্তী গানটা ধরবেন, আমি মনে মনে বললাম, ‘আমার একটি কথা বাঁশি জানে, বাঁশিই জানে।’ সেটাই তিনি গেয়ে উঠলেন। প্রত্যেকবার এ রকম হয় না, এরকম মনেও পড়ে না, সমস্ত মনস্কতা একটা সূচের ডগার মতন তীক্ষ্ণও হয় না, হঠাৎ হঠাৎ হয়। কোনও একটা অচেনা জায়গায় জীবনে এলাম প্রথমবার, স্টেশান থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েই মনে হল, এ জায়গা আমি আগে দেখেছি, খেলার মাঠের পেছনে ওই যে গির্জা, পুকুরের কাছে একটা ঝুপসি অশ্বথ্ব গাছ…অথচ ছবিও দেখিনি, কোনও বর্ণনাতেও পড়িনি। কেউ কেউ বলেন, খুব ক্লান্ত অবস্থায় কোথাও পৌঁছোলে এমন হতে পারে, প্রথম দৃষ্টিপাতের পরই চোখ বুজে যায়, পরের পলক পড়ার মধ্যেই ঘটে যায় স্মৃতিবিভ্রম, আগের মুহূর্তটা মনে থাকে না, তবু মনে হয় চেনা লাগছে কেন? জানি না এ ব্যাখ্যা সত্যি কি না, এ রকম আমার প্রায়ই হয়। প্রথমবার বিদেশ থেকে ফিরে আমি মাঝে মাঝেই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতাম, এমন কোনও বিদেশি শহরের রাস্তা দিয়ে আমি হাঁটছি, যে শহরে আমি যাইনি। বাড়িগুলি অন্যরকম, গোল গোল স্থাপত্য, মানুষজনের পোশাকও আলাদা ধরনের, সবাই নিঃশব্দ। যেসব শহর ঘুরে এসেছি, সেগুলো একবারও দেখি না। এমনকী কোনও বন্ধুকে দেখতে পাই কোনও বাড়ির মধ্যে, দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। সেটা তার বাড়ি নয়, সে রকম বাড়ি বা বারান্দা আমিও দেখিনি কখনও বাস্তবে, হতে পারে তা স্বপ্নের নির্মাণ। কিন্তু স্বপ্নের স্থায়িত্ব তো মাত্র কয়েক মুহূর্ত মাত্র, তার মধ্যে সেই বাড়ির সিঁড়ি, জানলা, বারান্দার রেলিঙের গড়ন, এ সব ঠিক করল কে? আবছা তো নয়, একেবারে স্পষ্ট, খুঁটিনাটি পর্যন্ত দেখা যায়, আমিই কি সেই অলীক গৃহের স্থপতি? তা হলে আমি স্বপ্নের মধ্যে এত রকম রাস্তা বানিয়েছি, কোনও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও তত রাস্তা হয় না।

লিখতে বসেও এক একদিন বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। দমদমে মশার উপদ্রবে সন্ধে বা রাত্তিরে লেখার অভ্যেস আমার চলে গিয়েছিল, তা ছাড়া আড্ডার নেশা, সেইজন্যই আমার যাবতীয় লেখালেখি সকাল ও দুপুরে। মাঝে মাঝে অবশ্য ঘোরগ্রস্তের মতন মধ্যরাত্রে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে কবিতার খাতা খুলেও বসি। সকালে বা দুপুরে নির্জনতা বা নিস্তব্ধতা পাওয়া সম্ভব নয়। আমার কোনও লেখার আলাদা ঘর নেই, বাড়ির মধ্যে ঘোরাঘুরি করে নিজস্ব মানুষ। বাইরে থেকেও যখন তখন কেউ না কেউ দেখা করতে আসে, কাণ্ডজ্ঞানহীন তরুণ কবিযশোপ্রার্থীরা মেদিনীপুর বা মুর্শিদাবাদ থেকে এসে মনে করে, তারা যে অতদূর থেকে এসেছে সেটাই বড় কথা। আগে থেকে কিছু না জানিয়ে এসে পড়ে তারা একজনের সময় নষ্ট করছে কি না কিংবা তার লেখায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও মনে আসে না। যাই হোক, এরই মধ্যে কখনও টানা দু’তিন ঘণ্টা লেখার সুযোগ পেলে শরীরটা যেন গলে গলে যেতে শুরু করে, তারপর কিছু কিছু রহস্যময় ঘটনাও এসে পড়ে, কখনও শুনতে পাই কোনও রমণী কন্ঠে কান্নার শব্দ, চেনা কণ্ঠ নয়, সেই মুহূর্তে আমি কোনও কান্নার দৃশ্যও লিখছি না। অলৌকিক বা অতিবাস্তব কিছু নয়, রাস্তায় গাড়ির শব্দ যেমন শোনা যাচ্ছে, পাশের বাড়ির চেঁচামেচি, সেই রকমই খুব কাছেই কারও কান্না। দু’তিনবার শোনার পর কলম রেখে আমি উঠে সমস্ত ফ্ল্যাট ঘুরে দেখি, মা, স্বাতী, আর পুপ্লু ছাড়া আর কেউ নেই, তারা কাঁদতেই পারে। কিন্তু সেই মুহূর্তে তিনজনকেই অন্যভাবে ব্যস্ত দেখা যায়, বারান্দায় এসে রাস্তায় কিংবা পাশের দু’বাড়িতেও সে রকম কোনও উপলক্ষ চোখে পড়ে না। তবু ফিরে এসে কলম হাতে নিলে আর একবার শুনতে পাই সেই কান্না। আমি নিজেও কাঁদি, অন্যের লেখা প্রিয় গল্প-উপন্যাস পড়তে গেলে তো হয়ই, রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ ও সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ পড়তে পড়তে যে কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করেছি, তা তো মনে আছেই। এমনকী নিজের লেখার সময়েও, ‘একা এবং কয়েকজন’ উপন্যাসের শেষে সূর্যকে হত্যা করে আমি ফুঁপিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। আর একটা কথাও সত্যের খাতিরে সসঙ্কোচে লেখা দরকার, লিখতে লিখতে, দিন-দুপুরে অতি একাগ্রতার মধ্যে আচম্বিতে সমস্ত রোমকূপ খাড়া, ঘন ঘন নিশ্বাস, যৌন উত্তেজনা। অন্য লেখকদেরও এ রকম হয় কি না, তা কারওকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি।

চেনা কারও মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা কিংবা একদিন আগে তার কথা বেশি বেশি মনে পড়া অতীন্দ্রিয় অনুভূতির পর্যায়ে পড়ে কি না জানি না, আমার এরকম হয়, যখন মিলে যায়, তখন আমার এই অনুভূতিটা পছন্দ হয় না। অনেকদিন যে একটি চিঠি লেখেনি, তার কথা হঠাৎ মনে পড়লেই চিঠি আসে। সাধারণত এগুলি কাকতালীয় হয়, কিন্তু পর পর চার-পাঁচবার এ রকম মিল হলেই মনের মধ্যে একটা অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে। সেই জন্যই মনে হয়, আমরা সব সময় যুক্তিবাদী স্বাভাবিক মানুষ সেজে থাকলেও মাঝে মাঝে চলে যাই মনোজগতের এক গোলকধাঁধায়। দিনের বেলায় জাগ্রত অবস্থাতেও আমরা খানিকটা দিবাস্বপ্নের মধ্যে থাকি। ঘাড়র কাঁটা একদিকে চলে, জীবন মাঝে মাঝে তা উল্টে দেয়। অবশ্য আমি এ সবের মধ্যে কখনও ধর্মীয় অলৌকিকতার ছিঁটেফোঁটাও কল্পনা করিনি।

আমার যখন-তখন আকাশ দেখার বাতিক আছে। মানুষ এবং তার আত্মীয় বাঁদর-শিম্পাঞ্জিকুল ছাড়া পৃথিবীর আর সব প্রাণীই মাটির দিকে মুখ রেখে চলে। তবু সব মানুষ কি সারাদিনে একবারও ইচ্ছে করে আকাশের দিকে তাকায়? যখন-তখন আকাশ দেখা আমার মুদ্রাদোষের মতন। কোনও অচেনা জায়গায় গেলেই প্রথমে একবার আকাশ দেখে নিই, সব দেশের আকাশ কিন্তু একই রকম নয়, মেঘের গড়ন নিত্যনতুন বলেই আকাশের রূপও নানারকম, অরোরা বোরিয়ালিস দেখার রোমাঞ্চের তুলনা হয় না, কেনিয়ায় একবার হাই ওয়েতে দাঁড়িয়ে দূরের কিলিমাঞ্জারো পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে যেমন মেঘমণ্ডিত আকাশ দেখেছিলাম, তা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ছেলেবেলা উত্তর কলকাতায় থাকার সময় গ্রীষ্মকালে ছাদে শুতাম মাদুর পেতে। জ্যোৎস্না রাতে সমস্ত নক্ষত্রমণ্ডলী উদ্ভাসিত হয়ে উঠত চোখের সামনে। দূরত্ব শব্দটি যে কত সুদুর হতে পারে তা একমাত্র নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তাকিয়েই সঠিক উপলব্ধি করা যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সহজে ঘুম আসত না। এখন তো কতকাল আর ছাদে শুই না, তবু প্রায়ই রাত্তিরে আকাশ দেখার অভ্যেসটি রয়ে গেছে। এক একদিন মাঝ রাতে বা শেষ রাতে ঘুম ভেঙে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, স্বাতী হঠাৎ জেগে উঠে অবাক হয়।

আকাশের দিকে বেশ কিছুক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে কখনও-সখনও নতুন কোনও লেখার বিষয় কিংবা কবিতার প্রথম লাইন মাথায় এসে যায়। বলাই বাহুল্য, এটা দৈবপ্রেরণার মতন কিছু নয়। প্রেরণা ঠিক কাকে বলে, তাই-ই এখনও বুঝলাম না। আকাশের কোথাও অপরূপ স্বর্গরাজ্য আছে, সেখানে চিরতরুণ দেব-দেবীরা বিচরণ করেন, এমন একটা মোহময় রূপকথা আরও অনেকের মতন আমাকেও কৈশোরের অর্ধেক বয়েস পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তারপর তো সব রকম রূপকথার জগৎ থেকেই সরে এসেছি; কবেই তো জেনে গেছি যে দূরবীন আবিষ্কারের পর যোলোশো দশ সালের দশই জানুয়ারি গ্যালিলিও গ্যালিলি স্বৰ্গকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন (‘জানুয়ারি টেন, সিক্সটিন টেন, গ্যালিলিও গ্যালিলি অ্যাবলিশেস হেভেন’— ব্রেখ্টের কবিতা)। কবিতার লাইন আসে বিদ্যুৎ চমকের মতন। অথবা ঝলসে ওঠে কোনও দৃশ্য, যাতে রয়েছে কাহিনীর আভাস। এগুলি যেন মহাকাশের উপহার, নিশ্চয়ই অনেক লেখকই পান। মহাকাশ শুধু উল্কাই পাঠায় না।

ছেলেবেলায় গুরুজনেরা বলতেন, সকালবেলা উঠে সবুজ গাছপালার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে চোখ ভালো থাকে। এখন আমার ধারণা, মাঝে মাঝে রাত্রির আকাশের দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকলেই চোখের প্রকৃত শুশ্রূষা হয়।

সন্তোষদা আমাকে একটি আলাদা ঘরে স্থাপিত করে নির্দিষ্ট সময়ের মনোমতন দায়িত্ব দিলেও কয়েকমাস পরে আমি স্বেচ্ছায় সারা রাত সংবাদপত্রের কাজের জন্য মেতে উঠেছিলাম। তখন ভারতীয় উপ-মহাদেশে শুরু হয়ে গেছে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টির আকাঙক্ষা, সংগ্রাম ও দুঃসহ বিভীষিকা।

ভারতে নানান বাধাবিপত্তি ও কিছু কিছু বিষফোঁড়া থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্র মাথা উঁচু করে টিঁকে থাকতে পেরেছে। কিন্তু পাকিস্তান গণতন্ত্রের ধারণাটাই কিছুতেই হজম করতে পারেনি। একাত্তর সালে একটা সাধারণ নির্বাচন হল, নিয়মসঙ্গত ভাবে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামি লিগ জয়ী হল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে, কিন্তু সামরিক শাসকরা তা মানতে চাইলেন না, এমনকী জুলফিকার আলি ভুট্টোর মতন রাজনৈতিক নেতাও এই নির্বাচনের ফলাফলকে স্বীকৃতি দিলেন না। শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ দিলে পাকিস্তান ভাঙার প্রশ্ন উঠত না, কিন্তু ভাঙনের বীজ এর মধ্যেই উপ্ত হয়ে গেছে। শেখ মুজিবের সঙ্গে ভুট্টো সাহেব ও ইয়াহিয়া খানের আলাপ-আলোচনার বৈঠক ঢাকা শহরে কয়েকদিন চলল বটে, হঠাৎ কিছু ঘোষণা না করেই ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া খান চুপি চুপি সরে পড়লেন ইসলামাবাদে, শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হল কোনও অজ্ঞাত স্থানে। পঁচিশে মার্চ সামরিক বাহিনী ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে মেতে উঠল গণহত্যায়। পরে জানা গিয়েছিল, ওই ত্রিপাক্ষিক আলোচনার দিনগুলি নিতান্তই ছিল সময় হরণের ছলছুতো। সেই ফাঁকে রাশি রাশি সেনাবাহিনী নিয়ে আসা হচ্ছিল পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে। পশ্চিমের শাসকবর্গ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদের উস্কানি দেয় হিন্দুরা, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে আওয়ামি লিগ, সুতরাং হিন্দুদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে, আওয়ামি লিগের প্রত্যক্ষ সমর্থক সবাইকে হত্যা করলেই এদিককার সব আন্দোলন ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। লক্ষ লক্ষও নয়, কয়েক কোটি মানুষকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল ঠাণ্ডা মাথায়। পঁয়তাল্লিশ সালে হিটলারের মৃত্যু হলেও তার নতুন নতুন সংস্করণ এখনও বিভিন্ন জায়গায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

মাঝখানের পাঁচ বছর ঢাকা বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কোনওরূপ যোগাযোগই ছিল না। এদিককার সংবাদপত্রেও ওদিককার খবর থাকত না প্রায় কিছুই। সেই সময়েই বাঙালিজাতি সত্যিকারের দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল, সীমান্তে নিশ্ছিদ্র প্রাচীর। ঢাকা থেকে কেউ কলকাতায় ফোন করতে চাইলে প্রথমে ফোন করতে হত লন্ডনে, সেখান থেকে সংযোগ হত কলকাতার সঙ্গে। কী হাস্যকর ও করুণ অবস্থা! পঁচিশে মার্চের পর হঠাৎ পূর্ব পাকিস্তানই হয়ে উঠল এখানকার প্রধান সংবাদ। প্রথম প্রথম এত সব বীভৎস কাণ্ডের বিবরণ অবিশ্বাস্য মনে হত। নৃশংসতারও তো একটা মাত্রা থাকে। তা ছাড়িয়ে গেলে সবই যেন অসম্ভব মনে হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও একই রকম বিবরণ দিতে লাগল এবং হত্যা ও ধ্বংসলীলার ছবি, ছবি তো মিথ্যে হতে পারে না। কিছুদিন পরেই যেমন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা চলে আসতে শুরু করলেন কলকাতায়, তেমনই লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ প্রাণের দায়ে আশ্রয় নিতে এল সীমান্তের এপারে। আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ কবিদের সেই প্রথম দেখলাম, আলাপ হল ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান এবং প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক হাসান মুরশেদ, এম আর আখতার মুকুল, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীই ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির রচয়িতা এবং পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলে এম আর আখতার মুকুল নিয়মিত গ্রামীণ ভাষায় ভাষ্যপাঠে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন।

প্রথম দিকের আকস্মিক আঘাতে বেশ কিছু মানুষ প্রাণ হারালেও পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়ে প্রত্যাঘাতের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। কিন্তু একটি সুসংবদ্ধ সেনাবাহিনী, যাদের হাতে আধুনিকতম মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র, তাদের সঙ্গে শুধু আবেগ ও দেশাত্মবোধ দিয়ে লড়াই করা যায় না। একমাত্র চালিয়ে যাওয়া যায় গেরিলা যুদ্ধ, তারও সুফল পেতে লেগে যায় বছরের পর বছর। সেই প্রলম্বিত যুদ্ধের জন্য মনোবল, অস্ত্রবলও লাগে প্রচুর। গেরিলা যুদ্ধের জন্যও প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কিছু বাঙালি অফিসার, আধা সামরিক ও পুলিশের কিছু অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যোগ দিয়েছিল, তাদেরও অস্ত্র ও রশদ জোগাড় হবে কোথা থেকে? প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে পারে একমাত্র প্রতিবেশী ভারতীয় সেনাবাহিনী, কিন্তু ভারত সরকার এ রকম প্রকাশ্য সমর্থন দিতে পারে না, কেন না, পাকিস্তান রাষ্ট্রে গৃহবিপ্লব হোক বা যাই হোক, তাতে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনবিরুদ্ধ। পৃথিবীর সব দেশ এই নারকীয় হত্যালীলাকেও পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে নিশ্চুপ হয়ে আছে। আমেরিকা ও চিনের আগে থেকেই সমর্থন আছে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের প্রতি। গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী আমেরিকা পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ওপর এই ব্যাভিচার দেখেও উচ্চবাচ্য করেনি৷

আমাদের কোনও প্রতিবেশী যদি পেশীবলে উন্মত্ত হয়ে নারী ও শিশুদের গলা টিপে মারতে থাকে, তা হলে সেটাও ওদের সাংসারিক ব্যাপার ভেবে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারি? এই মানবিক সমস্যা ছাড়াও ভারতের আর একটি বাস্তব সমস্যা বিরাট আকার নিয়ে ফেলল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে পৌঁছল প্রায় এক কোটিতে। অকস্মাৎ এই জন-বিস্ফোরণে পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা ও আসামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গঠন পর্যুদস্ত হবার উপক্রম। এত মানুষের বাসস্থান, খাদ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা করতেই হিমসিম খেতে হয়। তার ওপর অন্য ভয়, যে-কোনও সময় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধার আশঙ্কা। পাকিস্তানি চরেরা সে চেষ্টাও কম করেনি, কিন্তু সে সময় পূর্ব ভারতের মানুষ আশ্চর্য সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা ও অন্যান্য প্রধান পশ্চিমি দেশগুলিতে বিনা আমন্ত্রণে ঘুরে বেরিয়েছেন এই সমস্যা সমাধানের আবেদন নিয়ে, কেউ সাড়া দেয়নি। এরপর একমাত্র উপায় পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ, আবার একটি যুদ্ধ, এবং যদি সর্বাত্মক যুদ্ধ হয় তা হলে, চিন ও আমেরিকা পাকিস্তানের সাহায্যে সসৈন্যে এগিয়ে এলে ভারতের পরাজয় অনিবার্য। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ানের সঙ্গে কুড়ি বছরের বন্ধুত্ব চুক্তি, অর্থাৎ ভারত আক্রান্ত হলে রাশিয়া তার পাশে এসে দাঁড়াবে, এ রকম শর্ত হবার পরই ইন্দিরা গাঁধী মুক্তিবাহিনীকে সরাসরি সাহায্য এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন।

সে সময় আমি আনন্দবাজার অফিসে প্রায়ই রাত জেগে বসে থাকতাম। নতুন নতুন খবর এলে তৎক্ষণাৎ তা লিখে ফেলা হত, পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে-পড়া আমাদের সাংবাদিকরা দ্রুত খসড়া প্রতিবেদন পাঠালে আমি তার সম্পূর্ণ রূপ দিতাম। সব মিলিয়ে এমনই উত্তেজনা ছিল যে, একটুও ক্লান্তিবোধ হত না। অফিসের কাছেই মিশন রো’র ওপরে একটি হোটেলে ঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছিল, সন্তোষদা মাঝে মাঝে সেখানে কয়েক ঘণ্টার জন্য বিশ্রাম নিতে যেতেন। কয়েকদিন আমাকে তাঁর মৌখিক রচনার শ্রুতিলিখন করতে হয়েছে, তিনি আর নিজের হাতে লিখতেন না। কয়েকদিন পরেই অবশ্য আমি বেঁকে বসে বলেছিলাম, ওঁর ভাষার শ্রুতিলিখন করতে গেলে আমার ভাষায় তার প্রভাব পড়ে যেতে পারে। আমি আর রাজি নই। তখন শ্রুতিলিখনের জন্য অন্য একজন নিযুক্ত হল, আমার নিজস্ব লেখাও চলতে লাগল পাশাপাশি।

লেখা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য খাদ্য, বস্ত্র ও ওষুধ সংগ্রহ করার কাজে মেতে উঠেছিলাম, মাঝে মাঝে সেই সব নিয়ে যেতাম সীমান্তের মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে। স্বাতীর বাবাও ছোট ছোট বেতার যন্ত্র তৈরি করে দিতেন। সেই সব শিবিরে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে শুনতে পেতাম কত রোমহর্ষক কাহিনী। পাকিস্তানি সৈনিকদের নিদারুণ নিষ্ঠুরতার (বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো) কাহিনী শুনে মনে হত, তারাও তো মানুষ তাদেরও স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আছে, তবু তারা এমনভাবে মানুষকে মারছে, মুসলমান হয়েও মুসলমানকে মারছে, কী কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের মগজে? আবার কিছুদিন আগেও যারা ছিল ছাত্র, অনেকে সচ্ছল পরিবারের সন্তান, কখনও বন্দুক-পিস্তল ধরেনি, এই কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁদের কি অস্বাভাবিক পরিবর্তন, সব সময় মৃত্যুকে পকেটে পুরে রেখেছে, এক একজনের অসম সাহসিক বীরত্বের কথা শুনে অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। বসিরহাটের কাছে একটা গোপন শিবিরে সন্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গোল হয়ে বসে মুড়ি আর কাঁচা লঙ্কা খেতে খেতে নানান অভিজ্ঞতার কথা শুনছি, পাশেই এক জায়গায় জড়ো করে রাখা এক গাদা লাইট মেশিন গান আর হ্যান্ড গ্রেনেড। কেউ অবহেলার সঙ্গে সামনে ফেলে রাখছে রিভলভার, গলায় বুলেটের মালা, হ্যাজাক বাতি জ্বলছে, দূরে হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে কামানের গর্জন। আমার মনে হত, দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলিতে এরকম যুদ্ধের কত বিবরণ পড়েছি, ফিল্মে দেখেছি, এদেশে কখনও যুদ্ধ দেখিনি। সত্যি সত্যি বাঙালির ছেলেরা যুদ্ধ করছে, পাশেই একটা সত্যিকারের যুদ্ধ এই মুহুর্তেও চলছে, ভাবতেও কেমন যেন লাগে। আমার তখন সাঁইতিরিশ বছর বয়েস, এই বয়েসটা কোনও গির্জার পক্ষে খুবই কম, কোনও ক্রিকেট খেলোয়াড়ের পক্ষে খুবই বেশি, এই বয়েসে নতুন করে সৈন্যবাহিনীতেও যোগ দেওয়া যায় না বোধ হয়। তবু এক একসময় মনে হত, কলম রেখে রাইফেল হাতে নিয়ে কি এই যুদ্ধে সহযোগী হওয়া যায় না? যায় না, তার আরও কারণ, এটা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করার যুদ্ধ, আমি তো ভারত তথা পশ্চিমবাংলার মানুষ। ফরিদপুরের গ্রামের পর গ্রাম আক্রান্ত হলে সেখানকার মানুষ যে-যেমনভাবে পারে প্রতিশোধ সংগ্রামে অংশ নেবে, কিন্তু আমার ফরিদপুরে জন্ম হলেও আমি তো আর সেখানকার কেউ না! আমি শুধু সেই সব বিবরণ পড়ব কিংবা শুনব।

শরণার্থীদের তাঁবু বনগাঁ থেকে শুরু করে যশোর রোডের দু’পাশ ধরে সল্টলেক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, কলকাতা গ্রাস করার উপক্রম। সেই সব শরণার্থীদেরও দেখতে যেতাম। একদিন কবি অ্যালেন গিন্‌সবার্গ আগে থেকে কিছুনা জানিয়ে হঠাৎ আনন্দবাজার অফিসে সাধারণ দর্শনার্থীদের মতন শ্লিপ লিখে উপস্থিত। অ্যালেন আমাকে জানাল, আমেরিকান সরকারের নীতি যাই-ই হোক, সে দেশের বহু বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও জনসাধারণ পাকিস্তানি অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছে। বব ডিলানের মতন তখনকার জনপ্রিয়তম গায়ক ভারতে শরণার্থীদের জন্য যত বেশি সম্ভব সাহায্য পাঠাতে চায়, সেই উদ্দেশ্যেই তারা প্রকৃত অবস্থা সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য অ্যালেনকে পাঠিয়েছে। একটা গাড়ি ভাড়া করে অ্যালেন ও একজন ফটোগ্রাফারকে সঙ্গে নিয়ে একদিন রওনা হলাম যশোর রোড ধরে। মাঝে মাঝেই থেমে অ্যালেন দেখছিল কোনওরকমে হোগলার ছাউনি দেওয়া ঘরে মানুষের জীর্ণ, শীর্ণ চেহারা। নিপীড়িত মানবতা। অঝোরেই বৃষ্টি পড়ছে, শুরু হয়ে গেছে বন্যা, গাড়িতে বেশি দূর যাওয়া গেল না, তবু অ্যালেনের অদম্য জীবনী শক্তি, গাড়ি ছেড়ে নেওয়া হল নৌকো। হ্যাঁ, যশোর রোড দিয়ে নৌকো চলেছিল, একেবারে সীমান্তে পৌঁছে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি, হঠাৎ উল্টোদিক থেকে শুরু হল গুলিবর্ষণ, একটা গুলি এসে লাগল আমার শরীর থেকে দু’তিন ইঞ্চি দূরে গাছের গুঁড়িতে।

একাত্তর সালের ডিসেম্বর শুরু হয়েছিল যুদ্ধ, ভারত সরকারের স্ট্র্যাটেজি ছিল, যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধের হেস্তনেস্ত করে ফেলা, যাতে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছতে না পারে। সে যুদ্ধের প্রতিদিনের ঘটনা আজও আমার মনে আছে, কিন্তু এখানে তার বিবরণ দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। পূর্ব পাকিস্তানের বিমানবাহিনী প্রথমেই ধ্বংস করে এবং ঢাকার বিমান বন্দর বোমার আঘাতে অকেজো করে দিয়ে ভারতীয় স্থলবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এগোতে থাকে, ওদিককার এক একটি দুর্গ বা ঘাঁটির পতন হয়। খুলনার সাতক্ষিরার পতন হয় এগারো-বারো তারিখের মধ্যে, পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চাৎ অপসরণ শুরু করে। কলকাতার ভূতপূর্ব পাকিস্তানি কনসুলেট অনেক আগেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ মিশন নাম নিয়েছে, সেখানকার প্রতিনিধিরা সাতক্ষিরায় গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলতে চান, আমরাও কয়েকজন সেই দলে জুটে গেলাম। বসিরহাটের পাশে ইছামতী নদী পেরিয়ে কয়েক মাইল পরে সীমান্ত, আমাদের ট্রাক এমনই ভর্তি যে দাঁড়িয়ে থেকেও পাশের মানুষের কাঁধ খিমচে ধরে আছি, যে-কোনও মুহূর্তের ঝাঁকুনিতে ছিটকে বাইরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা। তখনও অনেক জায়গায় মাইন পোঁতা রয়েছে, রাস্তার ধারে ধারে ফক্সহোল ও বাঙ্কার, কোথাও কোথাও পড়ে আছে মৃতদেহ, গোলাগুলিতে বিধ্বস্ত সব ফাঁকা বাড়ি, ঠিক যেন বিদেশি চলচ্চিত্রের মতন যুদ্ধক্ষেত্র, এবং বহু জায়গায় ছিন্ন শাড়ি, ব্রা, মেয়েলি জুতো। হিংস্র জন্তুর মতন পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী মরিয়া হয়ে বাঙালি মেয়েদের কামড়ে, ছিঁড়ে খেয়েছে। সে যাত্রায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন আমাদের সঙ্গী, লিখেছিলেন তাঁর স্মরণীয় রচনা, ‘ক্ষমা নেই’!

যোলোই ডিসেম্বর ঢাকায় ভারতীয় উপ সেনাপতি অরোরার কাছে পূর্ব পাকিস্তানের সেনাপতি নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন। নিয়তির এমনই পরিহাস, এরা দু’জনে নাকি ছিলেন একই সময়ে, একই জায়গায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বন্ধু। সেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম না, তবু মনশ্চক্ষে যেন সবই দেখেছি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ঢাকায় মুক্তির উল্লাস আমার মর্মস্পর্শ করেছিল। সেদিন কলকাতাতেও আমরা নিজস্ব উৎসব করেছিলাম এবং নিকটতম সুযোগে যেতে চেয়েছিলাম সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। শুধুই ভাষার প্রশ্নে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, পাকিস্তানে বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আন্দোলনের মাধ্যমে পাওয়া গিয়েছিল অনেক আগেই। মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক বৈষম্য, এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা রটিয়ে দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমানরা প্রকৃত মুসলমান নয়, সেইজন্যই বাঙালি মুসলমানদের হত্যা করতে সৈন্যরা বিবেকযন্ত্রণা অনুভব করেনি। যদিও ইয়াহিয়া খান কিংবা জুলফিকার আলি ভুট্টোর মতন নেতারাও কেউই সঠিক অর্থে মুসলমান নন, তাঁরা পশ্চিমি রীতিনীতিতে অভ্যস্ত, ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামি বিধি কিছুই মান্য করতেন না। তবুও সাধারণ মানুষদের তাঁরা ধর্মের নামে ধোঁকা দিতে ইতস্তত করেননি।

বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ আমার ঘটে গেল পরের মাসেই। তখনও যাতায়াতের পথ সুগম হয়নি, নদীবহুল বাংলাদেশের অনেক সেতুই বিধ্বস্ত, স্টিমার ফেরি চালু হয়েছে বটে কিন্তু খাদ্য সরবরাহের জন্য অগণিত ট্রাক যাচ্ছে ভারত থেকে, তারই মধ্যে মনোজ বসু নিজের জন্মস্থান দেখার জন্য ব্যাকুল হলেন। তাঁর দুই ছেলে মনীষী ও ময়ূখের সৌজন্যে সে গাড়িতে আমারও একটা জায়গা হয়ে গেল। আটচল্লিশ সালের পর তেইশ বছর বাদে এই আবার ফেরা, কিন্তু আগেকার যাত্রাপথের কথা আমার তেমন কিছুই মনে নেই। শ্যামবাজার থেকে যে-যশোর রোডের শুরু, বনগাঁ সীমান্ত পার হবার পর সেই একই রাস্তা, দু’পাশের গ্রাম্য বাড়ি-ঘর ও প্রকৃতি একই রকম, মানুষ একই আকার-প্রকারের, তবু কেন রোমাঞ্চ হয়?

ফিরে যাচ্ছি জন্মভূমিতে। রিটার্ন অফ দা প্রডিগাল সান? সে রকম তো অনুভূতি হচ্ছে না। আমার মা-মাসিরা যে গ্রাম্য ছবির কথা ভেবে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তা তো এতদিন জলছবি হয়ে গেছে। বাবা তাঁর অন্তিম দিনগুলিতে একবার বাড়ি যাবার জন্য অস্থির হয়েছিলেন, বহু বছর কলকাতা শহরে কাটালেও গ্রামের বংশানুক্রমিক বাড়িটাকেই তিনি নিজের বাড়ি ভাবতেন, কিন্তু সেখানে ফেরার কোনও উপায় ছিল না। যেন আমার গায়ে লাগছে বাবার সেই মানসিক যাতনার দীর্ঘশ্বাস, এটা খুবই লঘু সেন্টিমেন্ট হতে পারে, কিন্তু সে রকম অনুভূতি হচ্ছিল ঠিকই। পূর্ব বাংলার গ্রাম থেকে উৎপাটিত কিংবা বিতাড়িত হয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া কত মানুষের মহিমাহীন, মলিন, অসহায় মুখ আমি দেখেছি। আমার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত সকলেই আহার-বাসস্থানের সমস্যা ঘুচিয়ে ফেলতে পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের গলার আওয়াজ চুপসে গিয়েছিল। এতবড় একটা যুদ্ধ হয়ে গেল, দুই বাংলার মানুষের মধ্যে কত আবেগের আলিঙ্গন হল, তবু হিন্দু বা মুসলমান, এপার কিংবা ওপার থেকে কেউই আর ফিরতে পারবে না জন্মভিটেতে। আমি একা ফিরব কোথায়?

আবার ভাষার টানে, বাংলা ভাষার মানুষদের এই যুদ্ধ জয়ে এমনই রোমাঞ্চ হয় যে হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, এখানকার গাছগুলিও বাংলায় কথা বলে, বাতাসের শব্দও বাংলা। এটা নতুন বাংলাদেশ, বাংলা ভাষার দেশ, পশ্চিমবাংলায় বাংলার সেই মর্যাদা নেই! আমার একবার এমনও মনে হয়েছিল, কলকাতা ছেড়ে এসে বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে ঢাকায় বসবাস করব, কিন্তু বাংলাদেশের লেখক-বন্ধুরা কেউ কেউ পরে সহাস্যে বলেছিল, ইউফোরিয়া কাকে বলে জানো তো! সেটা এক সময় কেটে যাবেই, তখন বোঝা যাবে কত ধানে কত চাল, তখন আমরাই অনেকে তোমাকে তাড়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠব! এটা পরিহাস হতে পারে, কিন্তু সত্যিই আর ফেরা যায় না।

মনোজ বসুর পৈতৃক বাড়ি অনেকখানি জমি ও বাগান সমেত, আধা ধ্বংস স্তুপের মতন পড়েছিল, তিনি সেটিকে একটি হাসপাতাল হিসেবে দান করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। তারপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি তোমার গ্রামের বাড়ি দেখে যেতে চাও? আমরা তো ওই দিক দিয়েই ঢাকায় যাব। আমি সবেগে দু’দিকে মাথা নেড়েছি। আমাদের পাকা বাড়ি ছিল না, এতদিন অব্যবহারে, এবং প্রকৃতির নিয়মে এমনিতেই ধ্বংস হবার কথা, বাগান-পুকুর জবর দখল হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে পরিবর্তন আমি দেখতে চাই না। আমার মনের মধ্যে বৃষ্টি ভেজা টিনের চালের বাড়ি, ফলন্ত বাতাবি লেবুর গাছ, পুকুরের ধারে বাঁকা খেজুর বৃক্ষ সমন্বিত যে-চিত্রটি, সেটাই অক্ষয় হয়ে থাক।

অরিচা ঘাট পেরিয়ে ঢাকায় পৌঁছবার পর আমার আশ্রয় জুটেছিল কাজী সাহেব নামে একজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, উদার মানুষের কাছে, পরে অনেকবার তাঁর খোঁজ করেও সন্ধান পাইনি, তবে বেশির ভাগ সময় কাটাতাম কবি জসিমুদ্দিনের বাড়িতে। তাঁর বাড়ির সংলগ্ন নিজস্ব ধান খেত পর্যন্ত ছিল, শহরের মধ্যে এরকম ধান খেত রক্ষা করার জন্য তিনি গর্ব প্রকাশ করতেন। কবি সহৃদয় ব্যবহারে এবং নানারকম আহার্য পরিবেশনে আমাদের আপ্লুত করে রেখেছিলেন, কিন্তু একটা লজ্জার কথা বিশেষ করে আমার মনে আছে। তিনি জমিয়ে গল্প বলেছিলেন, হঠাৎ আমি বাধা দিয়ে কাঁচুমাচুভাবে আবেদন জানিয়েছিলাম, আমায় কিছু কাগজ দিতে পারেন? আমি একটু লিখব কোনও ফাঁকা ঘরে বসে। তিনি সবিস্ময়ে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলেন, যেন আমার মাথার দোষ আছে! আসলে, সে সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় আমার একটি ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছিল, বাংলাদেশ দেখার অত্যুৎসাহে আমি পরবর্তী সংখ্যার জন্য ইন্স্টলমেন্ট না দিয়েই চলে এসেছি, এমনিতে কখনও আমার লেখা কোনও সপ্তাহে বাদ পড়ে না, সাগরময় ঘোষের রক্তচক্ষু মনে পড়ছিল বারবার। জসিমুদ্দিনের এক ছেলে আমাকে এক তাড়া কাগজ ও পাঁচখানা কলম দিলেন, ওপরতলার একটি ঘরে বসে আমি দু’তিন ঘণ্টায় লিখে ফেললাম উপন্যাসের এক কিস্তি, তারপর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের এক পাইলটের হাত দিয়ে সেই লেখা ঢাকা থেকে কলকাতায় দেশ পত্রিকার অফিসে যথা সময়ে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

ঢাকায় সেই সময় মিছিল ও সভা-সমিতি চলছে অনবরত। রমনার মাঠে এক সভায় ঠেলেঠুলে ঢুকতে দেখেছিলাম জিয়ায়ুর রহমানকে, যিনি তখন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান নায়ক, পরে যদিও তাঁর পরিচয় বদলে যায়। দেখেছিলাম খালেদ মুশারফ ও রফিকুল ইসলামকে, এঁরা সবাই বাঙালি বীর সেনানী। এক সভায় ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ভারতীয় সৈন্যরা কি কখনও এ দেশ ছেড়ে যাবে, না এখানেই গেড়ে বসে থাকবে? এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানার কথা নয়। তখন নব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয়দের হাতে বন্দি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য প্রচুর ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের অনেকের আশঙ্কা, এত অর্থ ও গোলাবারুদ খরচ করে ভারতীয় সৈন্যরা জিতেছে, তারা সহজে ছাড়বে কেন, বাংলাদেশটাকে তারা ভারতের মধ্যে গিলে নেবে কিংবা কয়েক বছর ধরে শোষণ করে ছিবড়ে অবস্থায় ছেড়ে যাবে। আর ভারতের অধিকাংশ জনমত—এখানেই সমস্যার অন্ত নেই, এর ওপর বাংলাদেশের মতন একটা প্রায় নিঃস্ব দেশের দায়িত্ব নেবার কোনওই মানে হয় না, আমাদের সৈন্যরা যত তাড়াতাড়ি ফিরে আসে, ততই মঙ্গল! যাই হোক, আমি কিছু উত্তর দেবার আগেই বাংলাদেশেরই আর একজন ব্যক্তি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, সব ভারতীয় সৈন্য যে ফিরবে না, তা তো জানা কথা! যে বারো-চোদ্দো হাজার ইন্ডিয়ান আর্মি আমাদের মুক্তি যুদ্ধে সাহায্য করতে গিয়ে এখানে প্রাণ দিয়েছে, বাংলাদেশের মাটিতে যাদের গোর হয়েছে, তারা আর ফিরবে কী করে বলুন!

ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে তখন খোলা হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকার স্থানীয় দফতর। ভবিষ্যতের কত রকম পরিকল্পনা। অনেক রাত পর্যন্ত সেই হোটেলের একটি কক্ষে পানাহার, আড্ডা চলছে, দু’দিন আগে আলাপ হয়েছে কবি শামসুর রহমানের সঙ্গে, সন্তোষদাও তাঁর বিশেষ অনুরাগী। কলকাতা প্রত্যাগত অনেকেই এসেছেন, এ যেন বসেছে এক টানা বিজয়-উৎসব। রঙ্গ-রসিকতা, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক রুচিতে কোনও প্রভেদ নেই, তবু মাঝখানের এতগুলি বছরের কেন এই কৃত্রিম ব্যবধান? ধর্মের চেয়েও সংস্কৃতির জোর যে কিছুমাত্র কম নয়, তা ধর্মান্ধরা কেন কিছুতেই বুঝতে পারে না? ভাষার ব্যবধানে মানুষের ব্যবহার সহজ-সাবলীল হতে পারে না, এক ভাষার মানুষ দ্বিভাষীদের বদলে সমভাষার মানুষের মানুষদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হবেই। সামরিক শাসকরা মনে করে, কামান-বন্দুক চালিয়ে, কয়েক লক্ষ মানুষকে খুন করে একটা জাতিকে বরাবরের মতন পদানত রাখা যায়। তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, বারবার ভুল করে। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষদের জন্যও আমাদের সমবেদনা হচ্ছিল, তারা কবে স্বাধীন চিন্তার অধিকার, মুখ খোলার অধিকার পাবে?

এক সময় টাটকা বাতাসে নিশ্বাস নেবার জন্য আমি এসে দাঁড়ালাম বারান্দায়। শীতকালের মেঘহীন নক্ষত্র খচিত আকাশ। ছায়াপথে অণু-পরমাণুর মতন আকৃতির সব তারা, যেমন ছোটবেলায় ছাদে শুয়ে দেখেছি। তখন মনে হত, এই বিশাল মহাকাশে আমাদের এই পৃথিবী নামের গ্রহটি একটা বালুকণার মতনও নয়, তার চেয়েও অতি ক্ষুদ্র। তারই মধ্যে মানুষের সভ্যতা, সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষেরও কল্পনার জগৎ কত সীমাহীন, কালহীন, দিগন্তহীন? এই পৃথিবীরও অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে কত মানুষ দেশ থেকে দেশান্তরে গেছে, খাদ্য, পানীয় ও নিরাপত্তার সন্ধানে মানুষ জন্মস্থান ছেড়ে অজানার সন্ধানে যেতে দ্বিধা করেনি, পাড়ি দিয়েছে আপাতদৃষ্টিতে অকূল সমুদ্র। তা হলে আমার বাবা-কাকারা যে-কোনও কারণেই হোক ফরিদপুর ছেড়ে চলে গেছেন কলকাতায়, তা নিয়ে এত আদিখ্যেতা করারই বা কী আছে? মানুষ তো বাসস্থান বদলাতেই পারে। মাদারিপুরের সেই গ্রামের বাড়ির তুলনায় কলকাতায় আমরা তো তেমন খারাপ অবস্থায় নেই। প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হলেও যে নাগরিক উপভোগ পেয়েছি, তা কি কম আকর্ষণীয়? দেশ কি একটা ধোঁয়াটে আবেগময় ধারণা মাত্র নয়!

এইসব যুক্তিগ্রাহ্য চিন্তার পরেও বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দুটো একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। এটা আমার দেশ নেয়! এটা আমার দেশ নয়। তারপর আপনমনেই একটু হেসে আবার ঢুকে পড়ি আড্ডাখানার মধ্যে।

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *