১০. গাঁধীজিকে স্বচক্ষে দেখেছি

দশ

আমি গাঁধীজিকে স্বচক্ষে দেখেছি মাত্র দু’বার।

প্রথমবারের দেখাটি নামমাত্র। দেশবন্ধু পার্কের একটি জনসভায় তিনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, খুব উঁচু মঞ্চ, প্রচুর ভিড়, তার শেষে দাঁড়িয়ে এই বালকটি পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে ডিঙি মেরে দেখার চেষ্টা করছিল সেই নগ্নগাত্র, শীর্ণকায় মানুষটিকে। হিসেব অনুযায়ী তখন আমার বয়েস বারো বছর মাত্র, কেন গিয়েছিলাম সেখানে? বারো বছরের বালকরা কি রাজনৈতিক বক্তৃতা শুনতে যায়? হয়তো তখন আবহাওয়াই এমন উত্তপ্ত ছিল। কিংবা বহুশ্রুত গাঁধী নামের মানুষটিকে একবার সশরীরে দেখার কৌতূহল। কিংবা, দেশবন্ধু পার্কে সেই সময় খেলতে গিয়েছিলাম, এমনিই একবার উঁকি মারা। ভাষণ দিয়েছিলেন হিন্দিতে, তার একটি বর্ণও স্মরণে নেই। শুধু এইটুকু মনে আছে, তাঁর কণ্ঠস্বর ধীর এবং ভাঙা ভাঙা, মেঠো বক্তৃতার মতন গলা চড়াতেন না।

আমি যে পরিমণ্ডলে বর্ধিত হয়েছি, সেখানে গাঁধীজি একেবারেই জনপ্রিয় ছিলেন না। অনেকেই সুভাষচন্দ্র বসুর ভক্ত, বামপন্থার দিকে ঝোঁকও ক্রমশ বাড়ছে। গাঁধীজিকে নানান অভক্তিসূচক নামে ডাকা হত। এক ধরনের পোকা আছে, সেগুলো হাত দিয়ে ধরলেই আঙুলে বিচ্ছিরি গন্ধ হয়, হিন্দিতে তার নাম বোধহয় গন্ধা পোকা, বাংলায় তার নাম দেওয়া হয়েছে গাঁধী পোকা। নামটি এখনও চলছে, অবিলম্বে বদলানো উচিত, অথবা সেই পোকার প্রজাতিটিকে নির্বংশ করে দিলে হয়।

গরিষ্ঠ সংখ্যক বাঙালিই গাঁধীজির সমর্থক ছিল না। সাধারণভাবে বলা যায়, সারা ভারতেই গাঁধীজির গুরুত্ব তখন ক্ষীয়মাণ, কিন্তু তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি বৃদ্ধি পেয়েছিল খুবই। অহিংস গাঁধীবাদ নামক রাজনৈতিক দর্শনটিই পশ্চিমি মানুষদের কাছে অভিনব।

এখানে অনেকেরই ধারণা ছিল, গাঁধীজি বাঙালি-বিদ্বেষী। বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবীদের প্রতি সমর্থন দূরে থাক, তিনি কখনও সহানুভূতিও জানাননি। এবং কংগ্রেস দলের সভাপতি নির্বাচনে পট্টভি সিতারামিয়ার সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গাঁধীজি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘সিতারামিয়াস ডিফিট ইজ মাই ডিফিট,’ তাতে বাঙালিদের ওই ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছিল। গাঁধীজি সত্যিই বাঙালি বিদ্বেষী ছিলেন কি না, কিংবা, তাঁর মতন মানুষের পক্ষে কোনও জাতিগত বিদ্বেষ পোষণ করা সম্ভব কি না, তা আমি জানি না। তবে, গাঁধীজি তাঁর আত্মজীবনীতে তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয়বার কলকাতা আগমনের বর্ণনা দিয়েছেন, দুটি অভিজ্ঞতাই তাঁর পক্ষে সুখকর হয়নি।

প্রথমবার এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যারিস্টার মিস্টার এম কে গাঁধী, পাক্কা সাহেবী পোশাক, উঠেছিলেন গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। কলকাতা শহরে কারুক্কে, চেনেন না। এর আগে একবার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরার জাহাজ থেমেছিল কলকাতা বন্দরে, জাহাজ থেকে নেমেই সোজা হাওড়া গিয়ে ট্রেনে চেপেছিলেন, শহর দেখা হয়নি মোটেই। তবে এই শহর সম্পর্কে জানেন অনেক কিছু। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা ধর্ম, সমাজ-সংস্কার, শিল্প বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র, বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাও শিক্ষা দীক্ষায় অগ্রণী, সম্প্রতি তারা রাজনীতিতেও মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে। ইয়ং বেঙ্গলের দলের নানা রকম প্রথা ভাঙার কথাও তিনি শুনেছেন, স্কুলে পড়ার সময় এক সহপাঠীর পাল্লায় পড়ে, ইয়ং বেঙ্গলের দৃষ্টান্তে, কট্টর নিরামিষাশী পরিবারের সন্তান হয়েও নিষিদ্ধ ও মাংস ভক্ষণেও দীক্ষা নিয়েছিলেন। আধুনিকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বেশ্যালয়ে গমন করতেও দ্বিধা হয়নি, মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে সে সবই অবশ্য পরিত্যাগ করেছেন এখন।

তরুণ গাঁধীর সেই প্রথমবার আগমনের কারণটি বিচিত্র। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের অবস্থার কথা এখানকার মানুষদের জানাতে চান। সকলেই মনে করে যে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষকে ইংরেজরা কুলি কামিন হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় চালান করেছে। কিন্তু তারা সবাই এখন আর নিছক শ্রমদাস নয়, বুদ্ধি ও অধ্যবসায় বলে তারা অনেকে সে দেশে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করেছে, বিস্তর সম্পত্তির মালিক হয়েছে, ইংরেজ প্রভুরা কুলিদের এই রূপান্তর সহ্য করতে পারছে না, অত্যাচার চালাচ্ছে নানাপ্রকার, এসব কথা মূল ভূখণ্ডের মানুষ জানে না।

গাঁধী প্রথম দেখা করেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁকে অনুরোধ জানান, একটি জনসভার ব্যবস্থা করার জন্য, যেখানে গাঁধী ওই বিষয়ে বক্তৃতা দেবেন। সুরেন্দ্রনাথ প্রখ্যাত ব্যক্তি ও অতিশয় ব্যস্ত, অন্যরা সভা সংগঠন করে তাকে সভাপতি ও বক্তা হিসেবে চায়, তিনি একজন অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তির জন্য সভা ডাকতে যাবেন কেন? এ রকম অদ্ভুত প্রস্তাব শুনে তিনি যদি অপ্রসন্ন হন, তবে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। তিনি দু’কথায় গাঁধীকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। এর পরেও গাঁধী উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক মতিলাল ঘোষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একই অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কেউই পাত্তা দেননি তাঁকে। এমনকী তৎকালীন জনপ্রিয়তম বাংলা সাপ্তাহিক বঙ্গবাসীর সম্পাদক যোগেশচন্দ্র বসুর সঙ্গেও দেখা করেছিলেন, যোগেশচন্দ্র তাঁর কোনও কথাই শুনতে চাননি। বাঙালিদের কাছ থেকে কোনও রকম সহযোগিতা না পেয়ে সেবারে গাঁধীকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে হয়।

গাঁধীজি দ্বিতীয়বার কলকাতায় এসেছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে একজন সাধারণ প্রতিনিধি হিসেবে। সুরেন্দ্রনাথেরই রিপন কলেজ ছুটি দিয়ে সেখানে বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিদের রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল, ঘরগুলি মানুষে ঠাসাঠাসি, বারান্দাতেও বিছানা পাতা। কিন্তু এত মানুষের প্রাতঃকৃত্যের জন্য প্রায় কোনও বন্দোবস্তই ছিল না, অল্প কয়েকটি শৌচালয় পুরীষে পরিপূর্ণ, মেথর-মুদ্দোফরাসরা ধারে কাছে নেই। তরুণ গাঁধীজি নিজেই ঝাঁটা-বালতি নিয়ে শৌচালয় পরিষ্কার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

কংগ্রেসের বহিরাগত প্রতিনিধিরা মূল অধিবেশনের আগে খাওয়া-দাওয়া ও গুলতানি করেই সময় কাটায়। গাঁধীজি আলস্য কাকে বলে জানেন না, তিনি স্বেচ্ছায় কিছু কাজ করার জন্য কংগ্রেস নেতাদের কাছে আবেদন জানান, তাঁকে পাঠানো হয় জানকীনাথ ঘোষালের কাছে। জানকীনাথের নাম একালে অনেকটাই বিস্মৃত, সে সময় তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, ঠাকুরবাড়ির এই তেজস্বী জামাতা কংগ্রেস পার্টি সংগঠনের অন্যতম স্থপতি, সেবারের কংগ্রেস অধিবেশনের সম্পাদক। একালে তিনি স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী এবং সরলা দেবী চৌধুরানীর পিতৃপরিচয়ে স্মরণীয় হতে পারেন।

জানকীনাথ গাঁধীজির চেহারা ও পোশাক দেখে অতি সাধারণ ধরনের মানুষ বলে ধরে নিয়েছিলেন, একে তিনি কী কাজ দেবেন? টেবিলের ওপর জমে থাকা একটি চিঠির স্তূপ দেখিয়ে বলেছিলেন, আমার কাছে অসংখ্য চিঠি আসে, সব পড়ে দেখার সময় হয় না, পড়ার যোগ্যও না। তুমি এই চিঠিগুলো পড়ে প্রয়োজনীয়গুলো আমার জন্য বেছে রাখো। গাঁধীজি বিনা আপত্তিতে একজন কনিষ্ঠ কেরানির মতন বসে গেলেন চিঠি পড়তে। সেদিনই তাঁর একটা কৌতুককর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। জমিদার নন্দন জানকীনাথ নিজে জুতোর ফিতে বাঁধতে পারতেন না, কোটের বোতামও লাগাতে পারতেন না, সে সব কাজের জন্য সব সময় একজন ভৃত্য প্রস্তুত থাকত। বিকেলবেলা কাজ শেষ করে জানকীনাথ উঠে দাঁড়িয়ে ভৃত্যকে ডাকাডাকি করতে লাগলেন, সে লোকটি তখন ধারে কাছে ছিল না, জানকীনাথ অসহায় ভাবে জুতোয় পা গলিয়ে, কোট হাতে নিয়ে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে, তখন গাঁধীজিই এগিয়ে এসে তাঁর জামা ও কোটের বোতাম লাগিয়ে দেন। পরে অবশ্য জানকীনাথ গোখলের কাছে জেনেছিলেন যে ওই মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধী নামে তরুণটি বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার, যাকে দিয়ে তিনি কেরানি ও আর্দালির কাজ করিয়েছেন।

সে বারে গাঁধীজি সারা কলকাতা শহর একা-একা ঘুরে দেখেন, বিখ্যাত বাঙালিদের সাক্ষাৎপ্রার্থী হন কোনও দাবি না নিয়েই। স্বামী বিবেকানন্দকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর, পায়ে হেঁটে হাওড়া থেকে বেলুড় মঠেও গিয়েছিলেন, কিন্তু মাত্র কয়েক মিনিট আগে বিবেকানন্দ অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন।

কলকাতায় তাঁর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয় কালীঘাটের মন্দিরে। রাশি রাশি পাঁঠা-ছাগল বলি, মন্দির প্রাঙ্গণে থকথকে রক্ত, কাঠগড়ায় গলা দেওয়া অজ-বৎসের ব্যাকুল ডাক ঢাকা দেওয়ার জন্য উদ্দাম ঢোল বাদ্য, আশেপাশে অজস্র নির্বিকার মানুষজন, এসব দেখে তাঁর গা গুলিয়ে উঠেছিল। এ রকম পৈশাচিক কাণ্ড তাঁর অভিজ্ঞতায় প্রথম। দেবতার নামে কেন এই অসহায় পশুবলি? অনেক বুদ্ধিজীবী বাঙালি ভদ্রলোকদের তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ধর্মের নামে এই বীভৎস প্রথার যৌক্তিকতা কী? কারুর কাছ থেকেই সন্তোষজনক উত্তর পাননি।

বহু বছর পরে, ছেচল্লিশের দাঙ্গায় গাঁধীজি দেখলেন কলকাতার পথে পথে রক্তস্রোত, পশুর নয়, মানুষের, ধর্মের নামে মানুষ মানুষকে নির্বিবেক হত্যা করে। পশুর মাংস তবু খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সে জন্য কিছু উপযোগিতা থাকতে পারে, তাই ধর্মের নামে সেই মাংস কিছুটা শুদ্ধ করে নেওয়া হয়। কিন্তু মানুষ তো মানুষের মাংস খায় না! পৃথিবীতে কিছু কিছু নরখাদক উপজাতি ছিল, যাদের আমরা অসভ্য, বর্বর আখ্যা দিয়েছি, তারা নিশ্চয়ই সবিস্ময়ে ভেবেছে, কেন শিক্ষিত ও সভ্যতাগর্বী মানুষরা নরহত্যার মতন অপচয় করে?

দাঙ্গার সময় গাঁধীজি ভেঙে পড়েছিলেন। কলকাতার পরে আরও ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয় নোয়াখালি এবং কুমিল্লার টিপকরা ও সন্দীপে। তিনি একা একা সেখানে ঘুরেছেন মানুষের মনে শুভবুদ্ধি ফিরিয়ে আনার জন্য। অর্ধনগ্ন শীর্ণকায় মানুষটি হাতে একটা লাঠি নিয়ে হেঁটেছেন গ্রামের মাঠে, আলপথে, দাঙ্গাকারীদের দিকে হাত তুলেছেন, ব্যাকুল আবেদন জানিয়েছেন, কিন্তু গাঁধীজির ব্যক্তিত্বের জাদু তখন ক্ষীয়মাণ, সেই সব উন্মত্ত মানুষেরা তাঁকে গ্রাহ্য করেনি, বরং বিদ্রুপে প্রত্যুত্তর দিয়েছে। নোয়াখালির আগুন জ্বলতে লাগল, অন্যদিকে আগুন লাগল বিহারে, গাঁধীজি ছুটলেন সেখানে। ইংরেজ লেখক পেন্ডেরাল মুনের মতে সারা ভারতে দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা দুই থেকে দশ লক্ষের মধ্যে, অর্থাৎ প্রকৃত সংখ্যাটা কোনওদিনই জানা যাবে না, নিরুদ্দিষ্টদের সংখ্যাও এর মধ্যে নেই।

কলকাতায় দাঙ্গা মাঝে মাঝে থেমেছে, বেরিয়েছে শান্তি মিছিল, আবার হঠাৎ হঠাৎ ভূমি ভেদ করা অগ্ন্যুৎপাতের মতন শুরু হয়েছে খুনোখুনি। এরকম মধ্যবর্তী কোনও সময়ে বহু স্কুল কলেজের ছেলে গিয়েছিল গাঁধীজির সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন বেলেঘাটার মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে একটি বাড়িতে তাঁবু গেড়েছিলেন। সেবারেই জাতির পিতা নামে মিথ্যাভাবে খ্যাত সেই মানুষটিকে সামনা সামনি দেখার সুযোগ ঘটে। অমন মহান একটি মানুষ যদি কোনও জাতির পিতা হন, তা হলে সেই জাতি এত অপরিণামদর্শী, এত হিংসাপরায়ণ হয় কী করে?

উঠোনের মধ্যে একটি খাটিয়ায় তিনি শুয়েছিলেন, কী করুণ, কী জীর্ণ শরীর! মুখখানি বিষাদে মাখা। যেন সারা জীবন লড়াই করে এসে, জীবন উপান্তে তিনি পড়ে আছেন এক ধ্বংসস্তূপে, মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন চরম পরাজয়। ছেলেরা সারবদ্ধ হয়ে তাঁকে প্রণাম করে। যাচ্ছে, তাঁর দেহে যেন কোনও স্পন্দনই নেই। অদূরে দাঁড়িয়ে আছে একদল মুসলমান ছেলে, তাদের মাথায় ফেজ টুপি, একসময় গাঁধীজি তাদের দিকে আঙুল তুলে ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, ইন লোগোঁকো পানি পিলা দেও।

অমনি শুরু হয়ে গেল একটা হুড়োহুড়ি। মুসলমান ছেলেরা জগে করে জল আর কাঁসার গেলাস নিয়ে এল, আমরা হুড়োহুড়ি করে তা পান করতে লাগলাম। এতখানি বয়েস পর্যন্ত আমরা জল খেয়ে এসেছি, এবারে মুসলমানদের হাত থেকে পানি খেলাম। মনে হল যেন অমৃত। যেন সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে গেল, এরপর থেমে যাবে সব দাঙ্গাহাঙ্গামা। দুই সম্প্রদায়ের বালকদের সেই আগ্রহ দেখে গাঁধীজির শীর্ণ ওষ্ঠে ফুটে উঠেছিল কি কৌতুকের হাসি?

এরপর সারাজীবন জল আর পানি শব্দটি নিয়ে অনেক মজা পেয়েছি। শুধুমাত্র বাঙালিদের মধ্যেই জল আর পানি, এই দুটি শব্দের ব্যবহারেই হিন্দু-মুসলমান জানা যায় কেন? অভিধানে দুটি শব্দেরই ব্যুৎপত্তি একই। জল তো বটেই, পানি বা পানীও এসেছে সংস্কৃত প্রাকৃতের পথ বেয়ে। বঙ্গীয় শব্দকোষে আছে : সং পানীয়ন্তু লি পানী, প্ৰা পাণি অন্তু বা পাণি, পাণী। কোনও এক রহস্যময় কারণে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অধিকাংশ ভারতীয়ই পানি ব্যবহার করে, বাঙালি হিন্দুরা জল। মুঘল আমলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন জাত ও বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকদের মধ্যে একটি সাধারণ ভাষা গড়ে ওঠে, যার নাম উর্দু, এর মধ্যে সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, হিন্দি নানা রকম শব্দ মিশে আছে, সেখানেও জলের বদলে পানি। যে সব বাঙালি হিন্দু মনে করে পানি একটা মুসলমানী শব্দ, তাদের মতন মূর্খ আর হয় না। আর যেসব বাঙালি মুসলমান মনে করে জল হিন্দু শব্দ, কিন্তু পানি তাদের ধর্মীয় ভাষার, তারাও একই রকম, নির্বোধ। জওহরলাল নেহরু ও জিন্না সাহেব দু’জনেই পানি বলতেন, যেমন গাঁধীজি, যেমন ফজলুল হক ও সুরাবর্দি, বল্লভভাই প্যাটেল ও লিয়াকৎ আলি। কট্টর হিন্দু সাভারকর আর মৌলানা আক্রম খাঁ পানির বন্ধনে বাঁধা।

বাঙালি হিন্দুরাও বাংলার সীমান্ত পেরিয়ে বিহারে পৌঁছেই পানি বলতে শুরু করে। ট্রেনের জানলা দিয়ে ডাকে, পানি পাঁড়ে। পানিফল খায়। এমনকী কলকাতাতেও রয়াল বা নিজাম হোটেলে গিয়ে পানি চায়। সেই বাঙালি হিন্দুই কোনও মুসলমান বন্ধুর মুখে পানি শুনলে চমকে ওঠে। বাংলাদেশে হিন্দুরা এখন আর প্রকাশ্যে জল বলে না, পশ্চিমবাংলার মুসলমানরাও অনেকে জল বলা অভ্যেস করছে। যারা হিন্দু-মুসলমান এই সাম্প্রদায়িক বিচারের উর্ধ্বে, তারাও মনে করে, জল বাংলা শব্দ, পানি অবাঙালিদের। যদিও সংখ্যার হিসেবে বাংলাভাষীদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেশি।

আমি ব্যক্তিগতভাবে জল শব্দটিকে বেশি শ্রুতিমধুর মনে করি। জলপ্রপাত, ধারাজল, সজল চোখ, জলজ প্রাণী, অতল জল ইত্যাদি বাক্যবন্ধে পানি বিকল্প হতে পারে না। আবার গেলাসে একটু পানি ঢালো, অকূল দরিয়ার পানি, জিরা পানি ইত্যাদিতে পানির ব্যবহার সাবলীল। যিনি স্টাইপেন্ড বা স্কলারশিপ বা হাত খরচ হিসেবে জলপানি শব্দটি তৈরি করেছিলেন, তিনি অতি বুদ্ধিমান, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিনা দ্বিধায় ব্যবহার করে। সেই রকম জল ও পানি এই দুটি শব্দই ইচ্ছে মতন যে কোনও জায়গায় প্রয়োগ করলেই সম্প্রদায়গত ব্যবধান কিছুটা ঘুচে যায়। কিন্তু মূর্খ ও নির্বোধদেরই শক্তি বাড়ছে দিন দিন। ব্যবধান যত বাড়ে, ততই তাদের উল্লাস।

দিল্লিতে তখন যে ধরনের সাম্প্রদায়িক পাশাখেলা চলছে, সে সম্পর্কে আমি অবহিত ছিলাম না। খবরের কাগজ-পড়া অভ্যেস হয়নি তখনও। ভোরবেলা সদর দরজার কাছে পড়ে থাকা খবরের কাগজ কুড়িয়ে এনে বাবাকে দিতে হত, তখন প্রথম পৃষ্ঠায় একবার চোখ বুলিয়ে নিতাম। খুব বড় খবর কাঠের ব্লকে ব্যাবড়া হরফে ছাপা হত। ‘প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ডেড’, এই আট কলম হেডিং মনে আছে। অন্যান্য দিন কী সব ক্যাবিনেট মিশনের কথা থাকে, তা জানার আগ্রহ ছিল না। ভারত সম্রাটের নাম ষষ্ঠ জর্জ, তা জানি, তিনি অবশ্য এ দেশে আসেন না, রুপোর টাকায় তাঁর কাটা মুণ্ডের ছবি থাকে। দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বড়লাট, এই সেদিনও তাঁর নাম ছিল লর্ড ওয়াভেল, এখন তাঁর জায়গায় বদলি হয়ে এসেছেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। বড় লাটরা সবাই লর্ড, আমাদের ইতিহাসে পড়তে হয়েছে লর্ড কর্নওয়ালিস, লর্ড ডালহৌসি, লর্ড কার্জনদের কথা। লর্ড থেকেই লাট এসেছে, কিন্তু বাংলার গভর্নরদের বলা হয় ছোট লাট, তারা কিন্তু সবাই লর্ড নয়। আমরা উত্তর কলকাতার ছেলেরা তখনও ময়দানের মনুমেন্ট পর্যন্ত চিনি, তার ওপারে সাহেবপাড়া, অনেক টম টম আর ফিটন গাড়ি চলে, পার্ক স্ট্রিট নামে একটি রাস্তা নাকি অমরাবতী তুল্য, তা স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।

উত্তর কলকাতাতেও কিছু কিছু সাহেব আসে। ফেরিওয়ালাদের মধ্যে চিনেম্যান প্রচুর। আর দেখা যায় কাবুলিওয়ালাদের পাহাড়ের মতন চেহারা, গায়ে পরতের পর পরত জামা, মাথায় পাগড়ি, তখনও রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা গল্পটি পড়িনি, তাই তাদের দেখতাম দূর থেকে শঙ্কামিশ্রিত চোখে। তারা হিং, আখরোট, কিসমিস বিক্রি করে, কিন্তু তাদের প্রধান পেশা গরিবদের টাকা ধার দিয়ে চড়া হারে সুদ নেওয়া। কাবুলিওয়ালাদের টাকা ফাঁকি দেবার কোনও উপায় ছিল না, অধমর্ণরা কে কোথায় কাজ করে তা তারা জানত, মাস পয়লায় দাঁড়িয়ে থাকত, কেউ পালাবার চেষ্টা করলে চওড়া থাবায় টুটি চেপে ধরত তার। যেন শালিক পাখিকে ধরেছে এক বাজপাখি। কেরানি-কাবুলিওয়ালা সম্পর্ক নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত ছিল ঘরে ঘরে। আমার মামার এক বন্ধু নাকি কোনও এক কাবুলিওয়ালার মুখ থেকে অপমানজনক কথা শুনে তার দাড়ি টেনে ছিড়ে দিয়েছিলেন, তাকে শুইয়ে দিয়েছিল মাটিতে। বাঙালিদের মধ্যে এ রকম বীরপুরুষ অতি দুর্লভ, সেই ব্যক্তির বীরত্ব কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছিল মতিঝিল অঞ্চলে। পরে রবীন্দ্রনাথের গল্প পাঠ করেই শুধু নয়, সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনা পড়ে মনে হয়েছে, অধিকাংশ কাবুলিওয়ালাই বড় সড় চেহারার অতি সরল শিশুর মতন।

গ্রামের মতন, শহরের স্কুলেও আমি হেঁটে যাই। একেবারে বাড়ির সামনে থেকে ট্রামে চড়েও যাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিদিন পয়সা খরচ করবে কে?

গ্রে স্ট্রিট পেরিয়ে একটা গলি দিয়ে রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট, তারপর একটু গেলেই লাহা কলোনির বিস্তীর্ণ প্রান্তর। যুদ্ধের সময় সেখানে ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছিল, তখনও বোজানো হয়নি। সেখানে লুকোচুরি খেলা হয়। লাফিয়ে লাফিয়ে ট্রেঞ্চগুলি পার হওয়া ছিল আমারও প্রতিদিনের খেলা। পরবর্তীকালে যুদ্ধ কাহিনীতে যেখানেই ট্রেঞ্চের বর্ণনা পড়েছি, আমার ওই লাহা কলোনির কথা মনে পড়েছে।

তারপর আর একটি রাস্তা ধরে শ্যামপুকুর স্ট্রিটে, ডানদিকে। এই রাস্তায় তখনও অনেক ধনীদের প্রাসাদ অটুট ছিল। বড় গেটের ফাঁক দিয়ে দেখা যেত প্রাঙ্গণে শ্বেত পাথরের নগ্ন নারী মূর্তি। যাবার সময় সতৃষ্ণ নয়নে একবার সেই মর্মর রমণীকে দেখে নিতাম এক ঝলক, পরক্ষণেই লজ্জায় মুখ নিচু হয়ে যেত। প্রত্যেক দিন সেই বাড়ির কাছাকাছি এসে মনে হত, আজ কি গেট খোলা থাকবে, না বন্ধ? দেখা হবে, কি হবে না? ওই রাস্তার সবচেয়ে সুদৃশ্য, উদ্যানশোভিত প্রাসাদটি মিত্রদের, কয়েক বছর পরেই আমি সে বাড়িতে অবাধ প্রবেশ অধিকার পেয়ে গিয়েছিলাম।

ওই সব ধনীদের অনেকের বাড়িতেই তখনও ছিল জুড়ি গাড়ি। মোটর গাড়ির যুগ এসে গেছে বটে, তবুও বনেদিয়ানা ধরে রাখার শেষ চেষ্টায় কেউ কেউ জুড়ি গাড়ি বজায় রেখেছেন। ঘোড়াগুলি খুবই দর্শনীয়। জনসাধারণের জন্য ট্রাম-বাসের পাশাপাশি ছ্যাকড়া গাড়ির সংখ্যাও প্রচুর। এই সব গাড়ির চেহারাও যেমন মলিন, ঘোড়াগুলিও হাড় জিরজিরে। শিয়ালদা থেকে আসা কিংবা হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার জন্য এই ছ্যাকড়া গাড়িগুলিই প্রশস্ত, কারণ এর ছাদে যত ইচ্ছে মালপত্র, পোঁটলা-পুঁটলি রাখা যায়, ভেতরেও গাদাগাদি করে বসতে পারে পুরো পরিবার। আমার কলকাতা দর্শনের প্রথম বাল্যস্মৃতি ঘোড়ার গাড়ির জানলা দিয়ে মুহুর্মুহু ব্যাকুল উন্মোচন।

এই সব ঘোড়াগাড়ির পেছনে সহিসের সহকারীর দাঁড়াবার একটা জায়গা থাকে, সেই সহকারী অনুপস্থিত থাকলে রাস্তার ছেলেরা দৌড়ে গিয়ে সেখানে বসে পড়ে কিছুটা যায়। সহিস টের পেয়ে গেলে উল্টোদিকে ছপটি মারে, উটকো যাত্রীটি গুটিশুটি মেরে বসলে সেই ছপটি গায়ে লাগানো শক্ত। এটাও একটা খেলা। অনেক সময় আমারও এই খেলাটি খেলতে ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু আমি যে ভদ্রলোকের বাড়ির ছেলে, আমাদের ওসব করতে নেই।

আমার স্কুল-জীবন সুখের ছিল না। স্কুলমাস্টারের ছেলের অনেক জ্বালা। কখনও প্রাণ খুলে দুষ্টুমি করতে পারিনি। কোনও কোনও সহপাঠীর সঙ্গে ঝগড়া করার অদম্য ইচ্ছে দমন করতে হয়েছে। ক্লাসে গল্প করা কিংবা লুকিয়ে গল্পের বই পড়ার উপায় ছিল না। প্রত্যেকটি মাস্টারমশাই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, ক্লাসে ঢুকে প্রথমেই নজর দেন আমার দিকে। হোমটাস্ক পুরো না করলে কিংবা আমার ব্যবহারে সামান্য পান থেকে চুন খসলে মাস্টারমশাইরা হুংকার দিতেন, তোর বাবাকে বলে দেব! তাঁরা কেউ সত্যি সত্যি বাবাকে নালিশ জানালে আমাকে বাড়িতে শাস্তি পেতে হত অপরাধের তুলনায় অনেক বেশি। পিতৃ-সম্মান রক্ষা করাই আমার প্রধান কর্তব্য! ইস্কুলমাস্টারের ছেলের বখাটে হবার কোনও উপায় নেই? ইস্কুল ছাড়ার পরেই আমার সে সাধ আমি পুরোপুরি মিটিয়ে নিয়েছি। আমার সহপাঠী সত্যময় মুখোপাধ্যায়ের বাবাও একই স্কুলের শিক্ষক, সে শান্ত প্রকৃতির ভালো ছাত্র, পরবর্তী জীবনে সে বিশিষ্ট বিদ্বান ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব শাখার প্রধান হয়েছিল।

আমি ভালো ছাত্র ছিলাম না। গল্প কবিতা পড়ার নেশা তখনই এমন ধরে গেছে, যে নিরস পাঠ্য পুস্তকে মন বসে না। ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কখনও পোষণ করিনি, শুধু জানতাম, পাশ করতে হবে। পরীক্ষার আগের কয়েকটা দিন তেড়েফুড়ে পড়াশুনো করে পাশ করে যেতাম মাঝারি ধরনে।

সেই সময় স্কুলের ছেলেদের ব্রতচারী, বয়েস স্কাউট কিংবা মণিমালা কিংবা ছোটদের পাততাড়ি নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের সুযোগ ছিল। আমি প্রথম তিনটির সঙ্গেই যুক্ত হয়েছিলাম বিভিন্ন সময়ে, এর মধ্যে ব্রতচারীতেই আদি দীক্ষা। প্রখ্যাত আই সি এস গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক। পরবর্তীকালে কারুকে কারুকে বলতে শুনেছি নিছক দেশাত্মবোধ বা যুব সমাজের উপকারের আদর্শে নয়। ইংরেজ সরকারই উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁকে এই কাজে নিযুক্ত করেছিল, যাতে অল্প বয়েসি ছেলেরা বিপ্লবী না হয়, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে না গিয়ে নাচে গানে মেতে থাকে। এটা নিছক রটনা বা চরিত্র হননের চেষ্টাও হতে পারে, অনেকে যে কোনও ভালো কাজের পেছনেই কিছু না কিছু অভিসন্ধি খোঁজে। গুরুসদয় দত্ত এমন কতকগুলি গান রচনা করেছিলেন যেগুলির আবেদন কিশোর মনে খুবই দাগ কাটে। দশ-বারো বছরে শেখা সেইসব গান আমি আজও ভুলিনি। এখনকার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাও সেই সব গান শিখলে উপকার ছাড়া ক্ষতির কোনও প্রশ্ন নেই।

কয়েকটা গান এই রকম :

বাংলার মানুষ আমরা, বাংলার সন্তান দল

কর্মে খুঁজি মুক্তি, ঐক্যে গড়ি বল

……………পাল রাজার বীর্য গরিমা

চণ্ডীদাস জয়দেবের ছন্দ মহিমা…..

বাংলার পুকুর-খাল-বিল সব কচুরিপানায় ভরা। ম্যালেরিয়া কলেরা উদরাময় প্রভৃতি রোগ এই কচুরিপানায় দূষিত জল থেকেই বেশি ছড়ায়। সারা দেশকে এই কচুরিপানা থেকে মুক্ত করা এমন কিছু শক্ত নয়, কিন্তু সে ব্যবস্থা কখনও গ্রহণ করা হয়নি। গুরুসদয় যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গান বেঁধেছিলেন :

চল আয় কচুরি নাশি

এই রাক্ষুসী যে বাংলাদেশের দিচ্ছে গলায় ফাঁসি।

চল, আয় কচুরি নাশি….

গুরুসদয় দত্তর ব্রতচারীতে আর একটি গান এখনও সুর সমেত আমার মনে আছে, কোনও বাচ্চাদের সমাবেশে গেলে গেয়ে শোনাতে ইচ্ছে করে। অনেক বক্তৃতার চেয়ে এরকম একটি গান বেশি কার্যকর।

আমার ঠাকুরের নাই কোনো আচার

ওগো নাই কোনো নাম, নাই কোনো ধাম।

নাই কো জাত বিচার

কেউ বলে আল্লা হো আকবর

কেউ বলে বনমালী, শ্যাম নটবর

আবার যীশু নামে বেথলেমেতে

হলো গো প্রচার

আমার ঠাকুরের নাই কোনো আচার।

ছেচল্লিশের ১৬ অগাস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক ও বীভৎস দাঙ্গার পর এক বছর পূর্ণ না হতেই শোনা গেল, স্বাধীনতা এসে যাচ্ছে। একটা পরাধীন দেশের পক্ষে স্বাধীনতার স্বপ্নই সবচেয়ে মধুর, সেই স্বপ্ন কখনও সত্য হবার সম্ভাবনা দেখা দিলেই আনন্দের অবধি থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাদের কাছে এই বার্তা এল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন!

এগারো

দেশ স্বাধীন হল, আমরা দেশ হারালাম। এই বাক্যটি শুনতে অদ্ভুত না? এই অদ্ভুত ব্যাপারটিই নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল আমাদের ঘটমান বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।

দেশবিভাগ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, আমি আর সে জঞ্জাল বাড়াতে চাই না। তবে সেই প্রসঙ্গ উঠলে এখনও ক্রোধবহ্নি জ্বলে ওঠে, সেই দুষ্কর্মের হোতাদের ক্ষমা করতে পারি সেই সময় যে-সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস ও অসূয়া তৈরি হয়েছিল, তাতে ভারত বিভাগ হয়তো অবধারিত ছিল। কিন্তু যাতে কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনের দিশা বদলে যাবে, সেই কাজ কি অত দ্রুততার সঙ্গে করা যায়? হিন্দু ও মুসলমান নেতারা কেন বুঝতে পারেননি যে তাঁরা তখনও আসলে ইংরেজ শাসকদের ক্রীড়নক। যে স্বাধীনতার জন্য এত সংগ্রাম, এত আত্মত্যাগ, সেই স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত অর্জন করা গেল না। শেষ হাসি হেসে গেল ইংরেজরা। ত্যাগ করে যাবার আগে এ দেশকে চিরতরে দুর্বল করে যাওয়াতেই ছিল তাদের প্রকৃত স্বার্থ। শাসন করেছে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’—এই নীতিতে, তাদের শেষতম নীতি ‘ডিভাইড অ্যান্ড কুইট’। হিন্দুদের প্রতি অবিশ্বাসে মুসলমান নেতারা পাকিস্তানের দাবি চূড়ান্ত করে তুলেছিলেন, কিন্তু তাঁদের উস্কানিদাতা ছিল ইংরেজরা। নেহরু অনেক সময় তিতিবিরক্ত হয়ে বলেছেন, বোঝাপড়ার আলোচনা এগোতে পারে না, সাদা মোল্লা’-দের জন্য। সাদা মোল্লাদের এই কূট কৌশল মুসলমান নেতৃবৃন্দ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি, প্রতিরোধ করতে পারেননি কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ।

পাকিস্তানের দাবিদার বাঙালি মুসলমান নেতারাও তখনও পর্যন্ত অনুমান করতে পারেননি যে, তাঁরা স্বাধীন হচ্ছেন না, তাঁরা একটি নতুন দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হতে চলেছেন। প্রায় শেষ মুহূর্তে আবুল হাসেমের মতন নেতার চৈতন্য হল, তিনি বললেন, হিন্দুই হোক, মুসলমানই হোক, শেষ পর্যন্ত সবাই বাঙালি। সকলের ভাষা এক, সংস্কৃতি এক। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা কেন হাজার মাইল দূরের পাকিস্তানি শাসন মেনে নেবে? কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ওদিকে সুরাবর্দি, এদিকে শরৎ বসুর মতন নেতারা অখণ্ড বাংলা রক্ষার জন্য দৌড়দৌড়ি করেছিলেন, সে দাবি নস্যাৎ হয়ে যায়। র‍্য্যডক্লিফ সাহেব ততদিনে ছুরি দিয়ে বাংলাকে কেটে ফেলেছেন।

পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজ তার সৃষ্টির মধ্যেই উপ্ত ছিল। জিন্না সাহেবও কায়েদ-ই-আজম হবার পরেই বললেন, এ পোকায় কাটা পাকিস্তান নিয়ে আমি কী করব? আর ভারতের ললাটে রয়ে গেল কাশ্মীররূপী চির অশান্তি।

স্বাধীনতার দিনটিতে আমরা কলকাতাতেই ছিলাম। সকাল থেকেই প্রভাতফেরী ও নানা রকম মিছিল যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। কিন্তু আমাদের বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি যে একটি বিশাল ঘটনা, তা উপলব্ধি করার মতন বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু বাড়ির লোকদের ম্রিয়মাণ মুখগুলি দেখে মনে হয়েছিল, এর মধ্যে গভীর শোকের ব্যাপারও রয়েছে। কিছু কিছু পূর্ববঙ্গজ আত্মীয়স্বজন এসেছেন বাড়িতে, তাঁরা কথা বলছেন নিচু স্বরে। দেশভাগের পুরোপুরি তাৎপর্য তখনই বোঝা সম্ভব ছিল না। এঁরা সবাই পড়াশুনো বা চাকরিসূত্রে কলকাতায় অস্থায়ী বাড়িতে থাকেন, গ্রামের বাড়িই আসল বাড়ি। সেখানে কি আর ফেরা যাবে? কিংবা সেখানে যে কাকা-জ্যাঠা, মাসি-পিসিরা রয়েছেন, তাঁরাই বা টিকতে পারবেন কতদিন? ব্যক্তিগতভাবে এঁদের সকলেরই মুসলমান বন্ধু আছে, মুসলিম লিগ এঁদের বুকে বজ্ৰ হানলেও মুসলমানদের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ তৈরি হয়নি, কিন্তু প্রায় এক বছর ধরে বীভৎস, হিংস্র দাঙ্গা চলছে বলে অবিশ্বাস ও আশঙ্কা জমেছে মনে মনে।

আমার বাবা দেশভাগ কিছুতেই মানতে পারেননি। তাঁর মতে, এটা সম্পূর্ণ অবাস্তব, ইংরেজরা তাড়াহুড়ো করে কাটা ছেড়া করে দিয়ে গেছে, দেশের মানুষ আবার মিলেমিশে যাবে, মুছে ফেলবে এই কৃত্রিম সীমারেখা, বারবার জোর দিয়ে তিনি বলেছিলেন এই কথা, এবং আমৃত্যু তাঁর এই বিশ্বাস ছিল।

শোনা যায়, গাঁধীজি সেদিন কেঁদেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমার কাছে আজ উৎসবের দিন নয়, কান্নার দিন। তবু, অধিকাংশ বাঙালিই দেশভাগের জন্য অনেকটাই দায়ী করেছে সেই মানুষটিকে। সকলেরই ধারণা, গাঁধীজি জোর দিয়ে বললে, ভারত বিভাগের বিরোধিতা করলে, তা অমান্য করার সাধ্য নেহরু-পটেল প্রমুখের ছিল না। না হয় জিন্নাকেই করা হত অখণ্ড স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী! অনেক ব্যাপারেই গাঁধীজি আমরণ অনশনের সঙ্কল্প নিয়ে অনেক সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছেন, এমন একটি গুরুতর ব্যাপারে তিনি কেন অনশনে বসলেন না? গাঁধীজির প্রায়োপবেশনকে আগে অনেকবার ইংরেজরাও অগ্রাহ্য করতে পারেনি, সেক্ষেত্রে তাদের বিশ্ব জনমতের কথা চিন্তা করতে হয়েছে। নাথুরামের গুলিতে প্রাণ দেবার বদলে ভারত বিভাগের বিরোধিতা করে গাঁধীজি যদি অনশনে প্রাণ দিতেন, তা হলে তাঁর মর্যাদা বেড়ে যেত শতগুণ। নিহত হবার আগেই যেন তিনি বিগত মহিমা, প্রাণশক্তিও প্রায় নিঃশেষিত, তাঁর নামের ম্যাজিকও আর কাজ করে না। তিনি বললেন, স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস পার্টি ভেঙে দিতে, কর্ণপাত করলেন না কেউ। ওদিকে জিন্নাও ক্ষমতার সিংহাসনে বসার জন্য অধীর হয়ে দেশটা দু’ভাগ করলেন, সে সিংহাসন তিনি পুরো একটি বছরও ভোগ করতে পারলেন না। গাঁধীজির আট মাস পর পৃথিবী থেকেই প্রস্থান করতে হল জিন্নাকে। জাতির পিতা নামে অভিহিত এই দু’জনই দুটি দেশকে মহা অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়ে সরে পড়লেন।

দেশভাগের সময় সরকারি চাকুরেদের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল যার যে-দেশ পছন্দ সেখানে চলে যাবার। বে-সরকারি চাকুরিজীবীদের সে সুযোগ নেই, তারা বাঁচুক বা মরুক, তাতে কার কী আসে যায়। পাকিস্তানের উদগাতারা ধর্মের প্রশ্নে দেশ ভাগ করলেন, কিন্তু ভারতে পড়ে থাকা কোটি কোটি মুসলমানের ভাগ্য নিয়ে চিন্তা করলেন না, তেমনই ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী ভারতীয় নেতারা চিন্তা করলেন না পাকিস্তানের হিন্দুদের নিরাপত্তার কথা। ফলে, দু’ দিকেই শুরু হল শরণার্থীদের প্রবল স্রোত। পরিসংখ্যান অনুযায়ী হিন্দু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। পশ্চিম পাকিস্তানে তো হিন্দুরা নিশ্চিহ্নই হয়ে গেল প্রায়।

আমাদের ফরিদপুর অঞ্চলে ঠিক কী ধরনের দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়েছিল, তা আমার স্মরণে নেই, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও ছিল না। তবে আমাদের আত্মীয়স্বজনরা সকলেই চলে এসেছিলেন। নিতান্ত বাধ্য না হলে কি কেউ পিতৃ-পিতামহের ভিটে-মাটি ছেড়ে অনিশ্চিতের উদ্দেশে পাড়ি দেয়? মাটির টান অতি সাংঘাতিক। বিশেষত রমণীরা সাজানো সংসার ছেড়ে যেতে চায় না কিছুতেই। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা যে ভারতের দিক থেকে কোনও সোনালি হাতছানি দেখতে পেয়েছিলেন, তা নয়। ছিল না সাদর অভ্যর্থনার সামান্যতম ইঙ্গিত। বরং শরণার্থী হয়ে এসে তারা পেয়েছে উপেক্ষা, অবহেলা, বিদ্রুপ, অনেক ক্ষেত্রে প্রতিরোধ। তবু তারা এসেছে, বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে, পায়ে হেঁটে কিংবা নৌকোয়। নেহাত আমার বাবা দেশ ভাগের আগে থেকেই কলকাতার স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, আমরা থাকতাম এখানেই, সেই জন্য আমাদের ওরকম তাড়া-খাওয়া উদ্বাস্তু হতে হয়নি, তবু ওই দিন থেকে আমরা হয়ে গেলাম শিকড়হীন। আমাদের প্রতিবেশীরা আগে আমাদের বলত বাঙাল কিংবা বাঙাল দেশের লোকে, এখন থেকে বলতে লাগল রিফিউজি।

এক কাকা আমাদের সঙ্গেই থাকতেন, আর এক কাকা কিছুদিন স্রোতের শ্যাওলার মতন এদিক ওদিক ভাসবার পর হয়ে গেলেন রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী। পরবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে দেখেছি, তাঁর যে তেমন আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা ছিল তা নয়, মানব সেবার মহান আদর্শও তাঁকে টানেনি, তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়েছিলেন স্রেফ খাওয়া-থাকার চিন্তা ঘুচে খাবে বলে। গ্রামীণ পরিবেশে মানুষ, তেমন কিছু লেখাপড়া শেখেননি, কখনও শহর বাসের উচ্চাকাঙক্ষা ছিল না, গ্রাম্য, ভূমি-নির্ভর জীবনে এই সব মানুষকে মানিয়ে যায়, কিন্তু অন্য পরিবেশে এলে এদের দিশেহারা অবস্থা হয়। তিনি তখনও বিবাহ করেননি, আর সে প্রশ্নও ছিল না, কোনওক্রমে মিশনে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি বেঁচে যান। গেরুয়াধারী হলেও উচ্চতর মহারাজদের ফাই-ফরমাস খাটা ছাড়া আর বিশেষ কিছু যোগ্যতা ছিল না তাঁর।

আমার এক জ্যাঠামশাই সপরিবারে দেশত্যাগ করে খুবই বিপদে পড়ে যান এখানে এসে। পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের কিছু কিছু সৌভাগ্যবান হিন্দু পশ্চিমবাংলার কিছু কিছু মুসলমানের সঙ্গে বাড়িঘর-সম্পত্তি বদলাবদলি করার সুযোগ পেয়েছিল, প্রধানত ঢাকা-চট্টগ্রাম- যশোর ইত্যাদি শহরের মানুষদেরই সেই সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু আমাদের বাড়ি ছিল প্রত্যন্ত গ্রামে, বিষয়-সম্পত্তিও বলতে গেলে যৎসামান্য, সুতরাং বদলাবদলির কোনও সুযোগই ঘটেনি। তা ছাড়া পরিবেশ নিশ্চিত হঠাৎ খুব বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল, তাই তড়িঘড়ি অস্থাবর জিনিসপত্রও না নিয়ে স্ত্রী-পুত্র-কলত্রের প্রাণ রক্ষার জন্য চলে আসেন কলকাতায়। পরিবারে আমার বাবাই একমাত্র চাকুরিজীবী, সুতরাং তাঁকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল সকলের। জ্যাঠামশাইয়ের বিশেষ ডিগ্রি ছিল না, কিন্তু সংস্কৃত জানা বিদ্বান ব্রাহ্মণ, তখন সেই বিদ্যার কোনও মূল্যই নেই। যুদ্ধ শেষ হবার পর চতুর্দিকে ছাঁটাই ছাঁটাই রব, ঘরে ঘরে বেকার, এর মধ্যে আমার জ্যাঠামশাইয়ের মতন মানুষের কোনও চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, তবু আমার বাবা সম্ভবত মরিয়া হয়েই সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। যেহেতু অনেক ছাত্রের অভিভাবকদেরই তিনি চেনেন, এবং তাঁদের অনেকেই চাকরিতে উচ্চপদস্থ কিংবা সফল ব্যবসায়ী, তাই তাঁদের ধরাধরি করে কোনওক্রমে মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানিতে একটি নিচু কেরানির চাকরি সংগ্রহ করে দেন জ্যাঠামশাইয়ের জন্য। তিনি আলাদা বাসা ভাড়া করলেন। খুব বাল্যকালে দেখেছি, আমার, জ্যাঠামশাই দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ, সুপুরুষ, গ্রাম্য জল-মাটি ছেড়ে কলকাতায় আসার পর তিনি রোগা হতে শুরু করেন, কয়েক বছরের মধ্যেই একেবারে কঙ্কালসার চেহারা, গলার আওয়াজও খোনা খোনা হয়ে যায়। এমন সর্বাংশে ভেঙে পড়া মানুষ আমি আর দেখিনি।

আমার এক পিসিমাও তাঁর সন্তানদের নিয়ে কিছুদিন আমাদের কাছে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার সামান্য উপার্জনে বাবা নিজের সংসার চালাতেই হিমসিম খেয়ে যেতেন, তার ওপর এত সব দায়িত্বের বোঝা এসে পড়ায় তিনি কী করে সামলাতেন, তখন বুঝিনি। কথায় বলে, উদয়াস্ত পরিশ্রম, আমার বাবার ক্ষেত্রে সেটা ছিল দীর্ঘতর, ভোর থেকে প্রায় মধ্যরাত্রি, প্রায় দিনই বাবাকে আমরা প্রায় চক্ষেই দেখতাম না। উপার্জন বাড়ার অন্য তিনি পাগলের মতন টিউশনি করতেন।

সে সময়কার নারদের কোনও তিক্ততার স্মৃতি তার নেই। পরবর্তীকালে ভাতে বেশ মজাই লেগেছে। মরে তো যাইনি, বেঁচে আছি, তাই-ই যথেষ্ট। দুটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য।

আমাদের প্রধান বিলাসিতা ছিল মাছ নিয়ে। ডাল-তরকারি যাই-ই থাকুক, অন্তত এক টুকরো মাছের ঝোল না থাকলে ভাত খাওয়া যেন সম্পূর্ণই হয় না। মা মাছ ছাড়া খেতেই পারেন না। প্রতিদিন বাজার এলেই প্রথমে বলেন, কী মাছ দেখি! স্বাধীনতা প্রথম ধাক্কায় আমাদের মাছ কেড়ে নেয়। পরিজনের সংখ্যা বেড়ে গেলে সকলের জন্য মাছ কেনার প্রশ্নই ওঠে না। নিরামিষ আহারে সকলের মুখেই অতৃপ্তির ছাপ। ধোঁকার ডালনা কি মাছের বিকল্প হতে পারে? গরমমশলা দিয়ে রান্না এঁচোড়ের তরকারি খেয়ে আমরা নিজেদেরই প্রতারণা করে বলতাম, ঠিক মাংসের মতন। এঁচোড়ের নামই হয়ে গিয়েছিল গাছ-পাঁঠা! মাঝে মাঝে হাঁসের ডিমের ঝোল হত। তাও প্রত্যেকের জন্য একটা আস্ত ডিম না, আধখানা। প্রথমে কয়েকটি ডিম সেদ্ধ করে তারপর সুতো দিয়ে খুব সাবধানে দ্বিখণ্ড করা। এ অতি সূক্ষ্ম কারুকাজ, আমার মা এতই ভালো পারতেন যে সেই আধখানা সেদ্ধ ডিম ভেঙে ঝোল করার পরেও একটুও ভাঙত না, সামান্য কুসুমকণাও বিচ্যুত হত না। শ্রীমতী মীরা দেবী ধনী পরিবারে পালিত হয়েছিলেন, তবু অবস্থার চাপে পড়ে এমন সূক্ষ্ম রন্ধনকলা শিখে নিয়েছিলেন। মেয়েরা সব পারে। সে রকম আধখানা ডিমের ঝোল আমি আর পরে কোথাও দেখিনি।

সেবারে দোলের সময় আবিষ্কার করলাম, আমার জামার সংখ্যা মাত্র একটি। জ্যাঠতুতো পিসতুতো ভাইদের অন্য জামা দিয়ে দিতে হয়েছে। উত্তর কলকাতার দোল মানে রং মেখে একেবারে ভূত হতে হয়। রুপোলি, সোনালি রং, আলকাতরা, রাস্তার কাদা কিছুই বাদ যায় না। সেদিনের জামাটি পুরোপুরি বিসর্জন দিতে হয়। আমার একটি মাত্র জামা, পরের দিন ইস্কুলে যাব কী করে? আমি তো আর বস্তির ছেলেদের মতন খালি গায়ে বাড়ি থেকে বেরোতে পারি না! সুতরাং দোল খেলা বন্ধ। কিন্তু স্কুলের সহপাঠী, পাড়ার ছেলেরা অনবরত ডাকছে, আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে কাঁপার ভান করে নাকি নাকি গলায় বলছি, জ্বর, খুব জ্বর। প্রয়োজনে মানুষ অভিনয় ভালো শেখে, ভিখিরির বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও কত উত্তম অভিনেতা। গ্লিসারিন লাগে না, যখন তখন চোখে জল আনতে পারে। আমিও জ্বরো-রুগীর ভূমিকায। ভালোই অভিনয় করেছিলাম। রাস্তায় রাস্তায় প্রবল হই হল্লা, বাড়ির মধ্যেও অন্যান্য ভাড়াটেদের ছেলেমেয়েরাও রং মেখে হুড়োহুড়ি করছে, আমি ছটফট করছি মনে মনে।

দুপুর দুটো-তিনটে পর্যন্ত চলে এই রকম দোল খেলার দাপট। তারপর কিছুক্ষণ সব শান্ত। বিকেলের দিকেও অনেকে বাড়ি বাড়ি যায়, তখন শুধু আবীর বা ফাগ মাখানো হয়, সেটা বেশ ভদ্র ব্যাপার, ওতে জামা-কাপড়ের কলঙ্ক হয় না। বিকেলবেলা বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়, আশুদের বাড়ি থেকে গল্পের বই নিতে হবে, ওদের বাড়িতে যদি আবীর খেলা হয়, তাতেও ঘোলে মিটবে দুধের স্বাদ। খানিকটা যেতেই একটা গলির মুখে, আমার চেয়েও বাচ্চা একটি ছেলে ফস করে ছোট একটা পিচকিরি থেকে রং দিয়ে দিল আমার জামায়। সারা বুক ভিজে গেল ক্যাটকেটে লাল রঙে। শুধু রাগ নয়, অভিমানে আমার চেখে জল এসে গেল। জামাটা যদি নষ্টই হবে, তা হলে আমি সকালে দোল-উৎসবের মাতামাতি থেকে বঞ্চিত হলাম কেন? ছেলেটার ঝুঁটি ধরে সপাটে লাগালাম তার গালে একখানা চড়। ছেলেটি কান্না-ভরা অভিযোগে চেঁচিয়ে উঠল, ম্যাজিক কালার! ম্যাজিক কালার! অর্থাৎ বিকেলবেলা জল রং দিয়েও সে কোনও বেআইনি কাজ করেনি, এটা একধরনের প্র্যাক্টিক্যাল জোক। সত্যিই সেই রং মিলিয়ে গেল আস্তে আস্তে। ছেলেটিকে চড় মারার জন্য বহুকাল অনুতাপ বোধ করেছি৷

দেশের স্বাধীনতা আমাকেও একধরনের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল, একা একা বাড়ির বাইরে ঘুরে বেড়াবার অনুমতি। ঠিক অনুমতি নয়, কৌশলে আদায় করে নেওয়া। বাবা রাত সাড়ে দশটার আগে বাড়ি ফেরেন না। মা ছোট ভাই-বোন ও অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, আমাকে শাসন করবে কে? এত ব্যস্ততার মধ্যেও মা বই পড়ার নেশা ছাড়তে পারেননি। রান্না করতে করতেও বই খুলে রাখতেন, লাইব্রেরি থেকে আমাকেই বই এনে দিতে হয়। মা বয়েজ ওন লাইব্রেরির সদস্যা হয়েছিলেন, নামটা তখন ঠিক বুঝতাম না, বলতাম বয়েজোন। সেখানে ছোট ছেলেদের বদলে বয়স্কদেরই ভিড় দেখছি বেশি। সেখানে গ্রন্থের সংখ্যা প্রচুর, প্রতি সন্ধেবেলা বই আনতে যেতাম, কতক্ষণ লাগবে, তা তো বলা যায় না, এক একদিন ভিড় থাকলে সত্যিই অনেক সময় লাগত, কোনওদিন তাড়াতাড়ি হয়ে গেলে আমি ঘুরে বেড়াতাম এদিক-ওদিক। অর্থাৎ সন্ধেবেলা নিজের পড়া ফাঁকি দিয়ে আমি এই শহরের অলি গলি ঘুরে ঘুরে বাড়িয়ে ফেলতাম আমার চেনা জগতের পরিধি। সেটা সিনেমা থিয়েটারের পাড়া। প্রথমে স্টার থিয়েটার, তারপর রূপবাণী সিনেমা, তার পাশে একটা বিশাল পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ি, অত উঁচু বাড়ি উত্তর কলকাতাতে তো বটেই তখন সারা কলকাতাতেই অঙ্গুলিমেয়, সেই বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তা, সেইখানে লাইব্রেরি, তার একটু পরেই শ্রীরঙ্গম রঙ্গমঞ্চ। প্রবাদপ্রতিম নট শিশিরকুমার ভাদুড়ী সেখানে তাঁর জীবনের শেষ কিছু অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে স্বচক্ষে দেখেছি কয়েকবার, মঞ্চের বাইরে। তখনকার দিনের বিখ্যাত গায়ক ও অভিনেতা ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে, তিনি অন্ধ, তাই লোকের মুখে তাঁর ডাকনাম ছিল কানাকেষ্ট, এই নামটি লেখা হয়তো উচিত হল না, কিন্তু অনেক পোস্টারেও এইনাম ছাপা দেখেছি। এঁরই ভাইপো এখনকার প্রখ্যাত গায়ক মান্না দে। শিশিরকুমার ও কৃষ্ণচন্দ্র খুব বন্ধু ছিলেন, মাঝে মাঝে দেখতাম, ওঁরা দু’জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে খেতে মগ্নভাবে কথা বলছেন। একটি কিশোর একটু দূরে থমকে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকত ওঁদের দিকে। কিশোরটির তখন হাফপ্যান্টের নীচে ঠ্যাংদুটো বিসদৃশ রকমের লম্বা দেখায়, নাকের নীচে সূক্ষ্ম রোমের রেখা, গলার আওয়াজ ভাঙতে শুরু করেছে। কিশোরটি অবাক হয়ে ভাবত, শিশিরকুমার ও কৃষ্ণচন্দ্র, ওঁরা নক্ষত্রলোকের মানুষ। ওঁরাও সাধারণ মানুষের মতন রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খান মাটির খুরিতে? কিশোরটি একদিন গুটি গুটি পায়ে ওঁদের খুব কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, ওঁদের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য। হায়, ওঁরা নাট্য বা সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করছিলেন না, খুব। দুশ্চিন্তিত ছিলেন টাকা-পয়সার অভাব বিষয়ে।

সে সময়ে কিশোর সাহিত্যের সংখ্যা এতই কম ছিল যে আমার উপযোগী পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা অচিরে ফুরিয়ে যায়। এদিকে ক্ষুধা সাঙ্ঘাতিক, বাধ্য হয়েই আমাকে ঢুকে পড়তে হয় বড়দের বইয়ের জগতে। মায়ের জন্য দু’খানা করে বই আনি, সেগুলি আমিই আগে শেষ করি। বুঝি না বুঝি, তাতে কিছু আসে যায় না। উই পোকা কি বইয়ের অর্থ বুঝে খায়? মনে আছে, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই কী করে যেন হাতে আসে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা। সেটা পড়ছি, এক মামা আমার কান ধরে বলেছিলেন, অ্যাঁ, খুব এঁচোড়ে পাকা হয়েছিস? তবু বইখানা শেষ করেছিলাম, এবং বুঝিনি, কতটা এঁচোড়ে পাকা হলাম। মা শরৎচন্দ্র, নরেশ সেনগুপ্ত, উপেন গঙ্গোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী প্রমুখের রচনা বেশি পছন্দ করতেন, আমি সে সবই পড়তা, ক্রমশ আমার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ গড়ে ওঠে। কল্লোল যুগের লেখকরা আমাকে বেশি টানে। ক্যাটালগে এক একজন লেখকের নাম ধরে ধরে তাঁদের সব বই পড়ে ফেলতাম। যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ…….। পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আমি তাঁর বহুকাল ছাপা না থাকা কোনও কোনও বইয়ের উল্লেখ করায় তিনি হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, যখন তিনি ও তাঁর বন্ধুরা অর্থসঙ্কটে ছিলেন তখন দেবসাহিত্য কুটির বা অন্য দু’একটি প্রকাশকের জন্য অনেক ছোট ছোট উপন্যাস লিখেছিলেন, সেগুলি হারিয়েই গেছে বলে ধরে নেওয়া হত, শুধু কয়েকটি লাইব্রেরিতে সেসব বইয়ের অস্তিত্ব টিকে ছিল। আমি বুদ্ধদেব বসুকে সবিনয়ে বলেছিলাম, ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত আপনার এমন কোনও লেখা নেই, যা আমি পড়িনি।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কবি ও অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক সময় আমার বাংলা বই পড়া নিয়ে প্রতিযোগিতা হত। মানবেন্দ্র ছাড়া, অন্য কোনও লেখক বা চেনাশুনো কেউ আমার চেয়ে বেশি বাংলা বই পড়েনি৷ পাঁচকড়ি দে থেকে শশধর দত্ত, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় থেকে প্রবোধকুমার সান্যাল, এমনকী নীহাররঞ্জন গুপ্ত কিংবা রোমাঞ্চ সিরিজে প্রতুল লাহিড়ীর গোয়েন্দা কাহিনী কিছুই বাদ দিইনি। মানবেন্দ্রর সঙ্গে আমার তফাত এই, এত বেশি বাইরের বই পড়েও সে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনাতেও কৃতবিদ্য, সেদিকে আমার কিছুই হয়নি!

তৎকালীন লেখকদের সম্পর্কে কিছু কিছু কৌতুক কাহিনী প্রচলিত ছিল। অধুনা বিস্মৃত সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় একসময় বেশ জনপ্রিয় এবং বহু গ্রন্থের লেখক ছিলেন। তাঁর ভাষার বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি অনেক বাক্যই ডট ডট দিয়ে শেষ করতেন, যেমন, সে জানালার দিকে চাহিয়া রহিল….., কিংবা সে এখন কী করিবে….. এই লেখকের কন্যা সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়ই এখনকার স্বনামধন্যা গায়িকা সুচিত্রা মিত্র। তখন অনেকে বলত, এই সুচিত্রা হচ্ছে সৌরীন্দ্রমোহনের ডটার! রবীন্দ্রনাথ ছবিও আঁকতেন বলে তখন অনেক লেখকও ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন। যেমন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল। তারাশঙ্কর নাকি ছবি আঁকতে আঁকতে তাঁর ছেলে সনৎকে ভুল করে রথী বলে ডেকে উঠতেন। মোহন সিরিজের লেখক শশধর দত্ত সম্পর্কে ধারণা ছিল, তিনি বহু দেশ ঘোরা, সাহসী, বলশালী পুরুষ। একসময় জানা গেল, তিনি উত্তর কলকাতারই একটি মেস বাড়িতে থাকেন। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তাঁর সঙ্গে। নিতান্তই এক রোগা সোজা নিরীহ বাঙালি, কথা বলতে বলতে থুতু ফেলেন মেঝেতে, খুব আফসোসের সঙ্গে জানালেন, ওই রকম এক-একটা রোমহর্ষক বইয়ের জন্য তিনি মাত্র পঞ্চাশ টাকা করে পান। এঁর ডাকনাম ছিল, কী হইতে কী হইয়া গেল বাবু। কারণ, এঁর বইতে, দুর্ধর্ষ নায়ক মোহনকে কোনও দুবৃত্ত একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে, তার রিভলভার মোহনের গলায় ঠেকানো, মোহনের বাঁচার কোনও উপায়ই নেই, তবু নায়ককে উদ্ধার করার জন্য তিনি এরকম অবস্থায় প্রায়ই লিখতেন, তাহার পর কী হইতে কী হইয়া গেল, দুবৃত্তের রিভলভার মোহনের হাতে!

আমার প্রধান দোষ আমি বই পড়তে পড়তে বড় কাঁদি। মৃত্যু দৃশ্য বা করুণ দৃশ্যে নয়, ভুল বোঝাবুঝির দৃশ্যে আমার চোখে বেশি জল আসে। একজন আর একজনকে ভুল বুঝছে, অথচ ভালোবাসার অভাব নেই, এরকম আমি সহ্য করতে পারি না। মনে আছে, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ প্রথমবার পড়ার সময় মা, বাবা ও দুই ভাইয়ের ভুল বোঝাবুঝির কাহিনীতে আমি এত জোরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম যে মা ভয় পেয়ে পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে ব্যাকুলভাবে জানতে চেয়েছিলেন, কী হয়েছে? তখন শুধু লজ্জা পেয়ে চোখের জল মুছতে হয়। এ জীবনে আমি বই পড়ে যতবার কান্নাকাটি করেছি, প্রিয়জন বিচ্ছেদের কান্না সে তুলনায় অনেক কম।

ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে বড়দের বই পড়লে চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। কতবার বকুনি খেয়েছি এজন্য। স্কুলের বই ছাড়া অন্য কোনও বই হাতে দেখলেই বাবা চোখ রাঙিয়ে বলতেন, নভেল-নাটক পড়া হচ্ছে? আবার যদি ফের দেখি-। নভেল একনম্বর ভিলেইন, নাটক তো পাঠযোগ্যই নয়। মহাপুরুষদের জীবনী তবু চলতে পারে। আমি কোনও নিষেধাজ্ঞা মানিনি, যা পেয়েছি, সব পড়েছি, পরীক্ষার আগের দিনও ইংরিজি টেক্সট বুকের তলায় লুকিয়ে পড়েছি গোয়েন্দা গল্প। অন্যরা বলাবলি করত, প্রবোধকুমার সান্যালের ‘আঁকাবাঁকা’, নাকি অশ্লীল বই, যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুষ্কোণ’। ওসব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছি গোঁফ গজাবার আগে। কই, তাতে তো বখেও যাইনি, চরিত্রও নষ্ট হয়নি।

কিংবা হয়েছে হয়তো। বোধহয় আমার চরিত্র বলে কিছুই নেই।

বারো

দেশ বিভাগের ফলে ফরিদপুরের আমগ্রামে আমার মায়ের মামাবাড়ির দুর্গাপুজো স্বাভাবিক কারণেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তখনও সকলের দৃঢ় বিশ্বাস বা সংস্কার ছিল যে পুজো-টুজো হঠাৎ বন্ধ করলে দারুণ পাপ হয় এবং নির্বংশ হবার সম্ভাবনা থাকে। বলাইবাহুল্য, এসব পরান্নজীবী ব্রাহ্মণদেরই রটনা। সুতরাং সুরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিবার গ্রামের সেই পুজো চালিয়ে যেতে থাকেন তাঁদের মতিঝিল কলোনির বাড়িতে। কিছুদিন পরে যখন কলকাতার আশেপাশে শত শত রিফিউজি কলোনি গজিয়ে ওঠে, তখন কলোনি’ শব্দটিতে মতিঝিলবাসীদের আপত্তি হতেই পারে। নাগেরবাজারের কাছে এই সুদৃশ্য ও সুপরিকল্পিত পল্লীটি তৈরি হয় স্বাধীনতার অনেক আগেই, বিশিষ্ট এবং ধনবান ব্যক্তিরাই এখানে বসতি স্থাপন করেন এবং মতিঝিল নামে একটি ঝিল সেখানে সত্যিই ছিল, এখন মরে হেজে গেছে। যুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকার প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে এই কলোনির অনেক বাড়িই অধিগ্রহণ করে, সুরেন্দ্রমোহনের উদ্যান সমন্বিত ভবনটিও বাদ যায়নি। গোলাপ বাগানে বসানো হয়েছিল কামান। ঝিলের জলে দাপাদাপি করত প্রায়-উলঙ্গ মার্কিন সৈন্য, যাদের ডাক নাম টমি। যুদ্ধ শেষে বিপর্যস্ত অবস্থায় বাড়িটি ফেরত পাওয়া যায়, সরকার থেকে ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাড়িটির শোভা আর পুনরুদ্ধার হয়নি। পরিবারের জনসংখ্যা হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়ায় অপরিকল্পিতভাবে আরও ঘর বাড়ানো শুরু হয় এবং আয় বৃদ্ধির জন্য বাগান গ্রাস করে তৈরি হয় ভাড়াবাড়ি।।

মতিঝিলের বাড়ির পুজোর সঙ্গে গ্রামের পুজোর কোনও তুলনাই চলে না। গ্রামে চলত প্রায় এক মাসব্যাপী উৎসব, স্থায়ী পূজামণ্ডপ, বিশাল প্রতিমা, নানারকম গানবাজনা, যাত্রা-থিয়েটার, পুজোর তিনদিন গ্রামসুদ্ধ সকলের পাত পেড়ে খাওয়ার আমন্ত্রণ। আর এখানে প্রায় নমো নমো করে পুজো সারা যাকে বলে। প্রতিবছরই প্রতিমার আকার ছোট হতে থাকে, এবং টিম টিম করতে করতে সুরেন্দ্রমোহনের মৃত্যুর দু’এক বছর আগে পরে পুজো একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ততদিনে বাস্তব অবস্থার চাপে পড়ে পাপ-ভীতি বা সংস্কার লোপ পেয়ে গেছে। বহু হিন্দু পরিবারেই আর দুর্গাপুজো চালিয়ে যাবার সামর্থ্য থাকে না। দেশ বিভাগের পর থেকেই প্রকৃতপক্ষে মা দুর্গা বারোয়ারি হয়ে যান।

সেই থেকে দুর্গাপুজোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘুচে গেলেও আর কয়েকটি বছর আমি জড়িত ছিলাম সরস্বতী পুজোর সঙ্গে। স্কুলে তো পুজো হবেই, আর ক্লাস নাইন-টেনের ছেলেদের ওপরই থাকে চাঁদা তোলা এবং সবকিছু ব্যবস্থাপনার ভার। টাউন-স্কুলের সমস্ত ছাত্রকে খাওয়ানো হত লুচি, ছোলার ডাল আর বেগুন ভাজা, আঃ, কী অপূর্ব সেই ছোলার ডালের স্বাদ, এখনও যেন জিভে লেগে আছে।

সব পাড়ায় পাড়ায় একটি করে ক্লাব, আমাদের পাড়ার ক্লাবটির নাম ‘সবুজ সঙঘ’, তার সরস্বতীপুজো হয় একেবারে আমাদের বাড়ির সামনের গলিতে। পাড়ার ছেলে হিসেবে আমাকে সেখানে হাজিরা দিতে হয়ই, কিন্তু অন্যান্য গাঁট্টাগোঁট্টা ছেলেদের তুলনায় সেখানে আমার ভূমিকা নগণ্য। আর একটি পুজো একেবারেই আমাদের নিজস্ব।

তখন আনন্দবাজার পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠা পুরোটা জুড়ে প্রকাশিত হত আনন্দমেলা, তার সম্পাদক বিমলচন্দ্র ঘোষ ওরফে মৌমাছি। সেই মৌমাছির নেতৃত্বে মণিমেলা নামে একটি সংস্থা গড়ে উঠেছিল, ছোটখাটো নয়, সুবিশাল, রাজনৈতিক দলের মতনই তার অজস্র শাখা, শুধু কলকাতাতে নয়, সুদূর মফঃস্বলেও, কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সেই সব শাখায় পাঠানো হত নানারকম নির্দেশ। বার্ষিক সম্মেলনে প্রত্যেকটি শাখা থেকে দু’তিনজন প্রতিনিধি আহ্বান করা হত, তাতেই জড়ো হত কয়েক হাজার কিশোর-কিশোরী। সে রকম একটি বার্ষিক সমাবেশে আমি শুনেছিলাম মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের বক্তৃতা। কী খারাপ বাংলা বলতেন তিনি।

আনন্দবাজারের প্রধান প্রতিযোগী দৈনিক যুগান্তর, তারও একদিনের শেষ পৃষ্ঠা ছোটদের জন্য বরাদ্দ ছিল, তার সম্পাদক অখিল নিয়োেগী ওরফে স্বপনবুড়ো, তাঁর নেতৃত্বেও ‘সব পেয়েছির আসর’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, তারও অনেক শাখা ছিল। আমরা মণিমেলা’র একটা শাখা গড়েছিলাম। প্রত্যেক শাখারই আলাদা নাম থাকে, আমাদেরটি ‘শুভকামী মণিমেলা’, নামটি বোধহয় আমারই দেওয়া, আমি তার সম্পাদক কিংবা সহ-সম্পাদক কিছু একটা হয়েছিলাম। আশুদের বাড়ির ঠাকুরদালানে বসত তার আসর, আনন্দমেলায় প্রকাশিত মৌমাছির সুদীর্ঘ উপদেশপূর্ণ চিঠিটি প্রথমে পাঠ করা হত ভক্তিভরে, তারপর কিছু কিছু ব্যায়াম, গান-বাজনা, কবিতা পাঠ, মুখে মুখে গল্প রচনা ইত্যাদি। নিছক স্কুল ও পারিবারিক গণ্ডিবাঁধা জীবনের বাইরে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ অল্প বয়েসিদের পক্ষে বিশেষ উপকারীই ছিল। খেলাধুলো, গানবাজনা, শিল্পরুচি বিকাশের সুযোগ ছিল তো বটেই, ছেলেমেয়েরা সমানভাবে মিশত বলে কৈশোরিক প্রেমের উদগমও হত এখানেই। সেটাও আমার মতে স্বাস্থ্যকর। পাড়ার রকে-বসা, শিস-দেওয়া, মেয়েদের দিকে কদর্য ইঙ্গিত করা বখাটে ছেলেদের সঙ্গে মণিমেলা বা এই ধরনের সংস্থার ছেলেদের ছিল স্পষ্ট তফাত। প্রেমে পড়লেই ছেলেরা সব মেয়েদের প্রতিই সৌজন্য দেখাতে শেখে। অপ্রেমই তো যত সমস্যার মূল।

সেই মণিমেলা থেকে আমরা একবার সরস্বতী পুজো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সরস্বতী বাকদেবী, সাধারণ মানুষ তাকে বিদ্যার দেবী মনে করে। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে অন্য সব ঠাকুর- দেবতার তুলনায় সরস্বতীর জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। ঘরে ঘরে তার পুজো। এবং এই পুজোয় ধর্মীয় রীতিনীতি কঠোরভাবে না মানলেও চলে। কিছু প্রসাদ, ফুল আর সামনে কতগুলো বই রেখে অঞ্জলি দেওয়াই আসল ব্যাপার। ওই দিনটিতে পুরুত জোগাড় করাও খুব কঠিন। পেশাদার পুরোহিতরা ওই দিনে অনেক বিখ্যাত ডাক্তারদের চেয়েও বেশি ব্যস্ত। অনেকে পাড়ার যে-কোনও ব্রাহ্মণকে ধরে আনত। আমার জন্ম যদিও ব্রাহ্মণ পরিবারে, কিন্তু তখনও পর্যন্ত আমার পৈতে হয়নি বলে পুজোর মন্ত্র পাঠের যোগ্যতা অর্জন করিনি, উপনয়ন না হলে ব্রাহ্মণ-সন্তানও দ্বিজ হয় না। ক্রমশ পুরোহিত কিংবা ব্রাহ্মণ জোগাড় করতে করতে হয়রান হয়ে গিয়ে এখন অনেক জায়গায় যে-কোনও একজন পুজো সেরে দেয়, মেয়েরাও পুজোর অধিকারিণী হয়েছে, এই সামাজিক পরিবর্তনটি শুভই বলতে হবে। হিন্দুধর্মের এই একটা সুবিধে আছে, অনেকে যেমন কট্টর মৌলবাদী হয়, আবার অনেকে ধর্ম নিয়ে ছেলেখেলাও করতে পারে, সেখানে মৌলবাদীরা চোখ রাঙাবার সাহস পায় না। অলঙ্ঘনীয় তেমন কোনও শাস্ত্রও নেই।

মণিমেলায় প্রথমবারের সরস্বতীপুজোর আগের রাত্রিটি আমার কাছে চিরস্মরণীয়। একটু বিস্তৃতভাবেই বলতে হবে। সেই প্রথম আমি বাড়ির বাইরে রাত কাটাবার অনুমতি পাই। তার উপযুক্ত কারণও ছিল। কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা কিনে আনতে হবে, সেখানে অসম্ভব ভিড় ও ঠেলাঠেলি, আমাদের মতন অল্পবয়েসিরা ভেতরে ঢোকার সুযোগই পাই না। শেষ পর্যন্ত পছন্দমতন প্রতিমা ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে আসতে আসতে বেজে গেল রাত নটা। এরপর প্রতিমাকে বেদীতে বসাতে হবে, ডাকের সাজ পরাতে হবে, মণ্ডপ সাজাতে হবে, অনেক কাজ, সবই সেরে ফেলতে হবে রাত্তিরের মধ্যে, কারণ সকাল থেকেই তো পুজো। বাড়িতে গিয়ে তাড়াতাড়ি নাকে মুখে কিছু খাবার খুঁজে, অনুমতি আদায় করে ছুটে এসেছি পূজামণ্ডপে। তারপর তিন-চারজন বন্ধু মিলে শুরু হল কাগজের শিকলি বানানো এবং অন্যান্য অনেক কাজ। প্রায় মাঝরাত্তিরে অন্য বন্ধুদের খেয়াল হল, স্বার্থপরের মতন আমি আগেই খেয়ে এসেছি, তারা কিছুই খায়নি। খিদে পেয়েছে তো বটেই, তা ছাড়া বাড়ির লোক রাগ করবে, তারা খেতে চলে গেল আমাকে প্রহরায় বসিয়ে।

নিঃশব্দ, নিবিড় রাত্রি, আমি বসে আছি, আমার সামনে একটি মাটির মূর্তি ছাড়া আর কিছু নেই। বসে আছি, তো বসেই আছি, হঠাৎ সময় প্রসারিত হয়ে গেল। মনে হল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে, ওরা কেউ আসছে না ফিরে। ওরা কি আর আসবেই না, আমাকে একলা বসে থাকতে হবে? এ রাত্রিও যেন শেষ হবে না। প্রতিমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় সর্বাঙ্গে শিহরন হল। কী অপূর্ব সুন্দর মুখ এই শ্বেতবসনা রমণীর! আয়ত চক্ষু, স্ফুরিত ওষ্ঠ, ভরাট, বর্তুল দুটি স্তন। সরু কোমর, প্রশস্ত উরুদ্বয়। হয়তো এ ভাবে আলাদা করেও দেখিনি, সব মিলিয়ে এক শিল্প সৃষ্টি, তার অভিঘাতে তছনছ হয়ে যেতে লাগল আমার কৈশোর, জেগে উঠল পুরুষার্থ, অল্প অল্প শীতেও উষ্ণ হয়ে উঠল শরীর। না, আমার কোনও অলৌকিক অনুভূতি হয়নি, পিগম্যালিয়ানের মতন সেই মাটির মূর্তিকে জীবন্তও মনে হয়নি, মাটিরই প্রতিমা, একটি নারী, পরিপূর্ণ নারী। চোরের মতন সতর্কভাবে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে আমি হাত রাখলাম দেবী মূর্তির বুকে। ‘জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচ যুগ শোভিত মুক্তহারে…’, সেই কুচযুগে আমার আঙুল, আমার শরীর আরও রোমাঞ্চিত হল, কানদুটিতে আগুনের আঁচ। আমি প্রতিমার ওষ্ঠ চুম্বন করলাম, আমার জীবনের প্রথম চুম্বন।

সিঁড়িতে কারুর পায়ের শব্দ শুনে চট করে সরে গেলাম সেখান থেকে। বন্ধুরা ফিরে এল। কারুকে কিছু বলার প্রশ্নই ওঠে না, আমার শরীর তখনও কাঁপছিল, অনেকক্ষণ অন্যমনস্ক ছিলাম, কারুর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। পরদিন, সেই উচ্ছিষ্ট মূর্তিরই পুজো হল, কেউ কিছু জানতে পারেনি, কোনও অঘটনও ঘটেনি।

এর দু’এক বছর পর ঠিক ওই একই রকম পরিবেশে, ঠাকুরদালানে, গভীর রাত্তিরে আমি একটি রক্তমাংসের কিশোরীকে চুমু খেয়েছিলাম, চকিত সুযোগ পেয়ে এবং তার আগ্রহ মেশানো সম্মতিতে। তারপরই যে কথাটা তাকে বলেছিলাম, সে কথাটাও মনে আছে স্পষ্ট। বলেছিলাম, কই, শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলিয়া গেল না তো? গল্প-উপন্যাসে চুম্বনের দৃশ্যে এরকমই কিছু বর্ণনা থাকত, আমার ধারণা ছিল, ওই কর্মটি করলে সত্যিই বুঝি ইলেকট্রিক শক খাবার মতন কিছু হয়! তেমন কিছুই হল না, বরং আগেরবার উত্তেজনা যেন বেশি ছিল! এবং আগেরবার কোনও বিঘ্ন না ঘটলেও এবারে মাটির প্রতিমা বোধহয় ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিলেন, সে বছরে পরীক্ষায় রেজাল্ট কিছুটা খারাপ হল, বিশেষত বাংলায় নম্বর পেলাম বেশ কম।

এখানে আর একটি স্বীকারোক্তিও করা যেতে পারে। সব আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথাই তো স্বীকারোক্তি, যে জন্য রুশো তাঁর আত্মজীবনীর নামই দিয়েছেন, কনফেশান। যে-কোনও কারণেই হোক, ধর্মীয় ব্যাপারে পাপ-পুণ্যের কোনও বোধই আমার জন্মায়নি। গুরুজনদের নির্দেশে ঠাকুর-দেবতাদের সামনে প্রণাম করেছি ঠিকই, কিন্তু অনেকে সেই সময় অনেক কিছু প্রার্থনা করে, আমি কখনও কিছু চাইনি, এই চাওয়া ব্যাপারটাই অবান্তর মনে হয়েছে, খড়-মাটি কিংবা পাথরের মূর্তি আমায় কী দেবে? উপোস করে অঞ্জলি দিতে হয়, লুকিয়ে খেয়ে নিয়েছি বিস্কুট, পুজো শেষ হবার আগেই প্রসাদের থালা থেকে গোপনে তুলে নিয়েছি সন্দেশ। একবার স্কুলের পুজোয় আমাদের ওপর ভার ছিল চাঁদা তোলার। কাজটি বেশ আনন্দের। আমাদের ক্লাস করতে হয় না, আমরা অন্য ক্লাসগুলিতে ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলি। রশিদ দেবার কোনও ব্যাপার নেই, সঙ্গে থাকে একটি কাপড়ের ঝুলি, ছেলেরা তার মধ্যে সিকি, আধুলি, টাকা যা খুশি দেয়, কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, প্রত্যেককেই আগের দিনে বাড়ি থেকে কিছু আনতে বলে দেওয়া থাকে, কম-বেশির কোনও তারতম্য করা হয় না। তারপর আমরা সেই চাঁদার টাকা পয়সা গুণে গেঁথে তুলে দিই কোনও ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের হাতে। শুধু ওই চাঁদার টাকাতেই পুজোর সব সরঞ্জাম ও লুচি-ছছালার ডালের ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়, বাকি টাকাটা ভর্তুকি দেওয়া হয় স্কুল-ফান্ড থেকে। বিকেলে মাঠের এক কোণে বসে টাকা-পয়সা গণনা চলছে, মাঝে মাঝে আসছে দমকা হাওয়া, কিছু নোট উড়তে শুরু করলে আমরা ধাওয়া করে ফিরিয়ে আনি। কাজটি সম্পন্ন হলে, কাগজে লিখে সবসুদ্ধ দিয়ে আসা হল শিক্ষক মহাশয়ের হাতে। তার কিছু পরে, জল খাবার জায়গার পাশের নালায় আমি দেখতে পেলাম তিন খানা নোট পড়ে আছে, কিছুটা ভেজা। নিশ্চিত চাঁদারই টাকা, উড়ে এসেছে অনেকটা দূরে, ভেজা নোট নষ্ট হয় না, শুকিয়ে ব্যবহার করা যায়। পুজোর চাঁদার টাকা, সেগুলি কুড়িয়ে নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের কাছে দিয়ে আসা উচিত। শুরু হয়ে গেল আমার মধ্যে সৎ অসতের দ্বন্দ্ব। ভালো ছেলেরা এই টাকা ফেরত দেয়। যাদের পাপের ভয় আছে, তারা কোনও রকম চিন্তা না করে টাকা ফেরত দিয়ে পুণ্য অর্জন করবে। আমি ভালো ছেলে নই, পাপেরও ভয় নেই। বাড়িতে সবসময় অভাব আর অভাবের কথা, মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই বাজার কমতে থাকে, মায়ের সঙ্গে বাবার মন কষাকষি, আমি কিছুই হাত খরচ পাই না। সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের পক্ষে ভালো ছেলে ও পুণ্যলোভী হওয়া সহজ। মোট সাত টাকা, ওই টাকা ফেরত দেওয়া না দেওয়ায় পুজো কিংবা লুচি-ছোলার ডালের কিছু হেরফের হবে না, কিন্তু আমি ইচ্ছে করলে দু’একটা বইখাতা কিনতে পারি, একদিন অন্তত লালসা মিটিয়ে জিলিপিও খেতে পারি। এটা পাপ, না পুণ্য? দ্বিধা করিনি। টপ টপ করে নোটগুলো তুলে পকেটে ভরে নিয়েছি। হয়তো আমার এই কীর্তিটিকে টেকনিক্যালি চাঁদার টাকা তছরুপ বলা যায় না, তবু এক ধরনের চুরি তো বটেই!

আমাদের বাড়ির মধ্যে তেমন কোনও ধর্মীয় আবহাওয়া ছিল না। বাবা নাস্তিক ছিলেন না মোটেই, তবে নিয়ম করে কিংবা ভক্তিভরে কোনও ধর্মীয় আচরণ করার ঝোঁকও ছিল না। তিনি পৈতেধারী, সেই সব দিনে ব্রাহ্মণরা দুবেলা আহ্নিক করতেন, বাবা তার সময় পেতেন না। শুধু একটাই ব্যাপার দেখেছি, দুপুরে খাওয়ার আগে, থালার বাইরে পাঁচটি ভাত ফেলে, জল ছিটিয়ে দেবতাকে উৎসর্গ করতেন, আর খাওয়া শেষ হলে তালুতে একটু জল নিয়ে ঠোঁটে ছুঁইয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়তেন কিছু একটা। তাও খুব হুড়োহুড়ি করে, যাতে আধমিনিটও সময় নষ্ট না হয়। আমাকে ইংরিজি ও অঙ্ক শেখাবার ব্যাপারে তাঁর যত ঝোঁক ছিল, তেমন কোনও আগ্রহই ছিল না ধর্মশিক্ষা দেবার।

আমার মা প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজো করতেন। তাও অতি যৎসামান্য উদ্যোগ যাকে বলে। দুটি মাত্র ঘর, তার একটিতে শুই আমি আর কাকা। অন্য ঘরটিতে আর তিন ভাই বোনকে নিয়ে মা আর বাবা। দিনের বেলা আমাদের ছোট ঘরটিই সব ভাই বোনদের পড়ার ঘর, আবার দৈবাৎ কোনও বাইরের লোক এসে গেলে, সেটাই তাঁদের বসবার ঘর, তখন আমাদের বাইরে চলে যেতে হত। মায়েদের ঘরখানি জিনিসপত্রে ঠাসা, তারই এক দেয়ালের তাকে একটি লক্ষ্মী ঠাকরুনের ছোট মূর্তি, আর কয়েকটা ছবি, সামান্য কিছু ফুল, কোষাকুষি। আর পেতলের রেকাবিতে প্রসাদের জন্য বরাদ্দ চার পয়সার বাতাসা বা গুজিয়া। বেস্পতিবার সন্ধেবেলা মা স্নান করে এসে নিজেই পুজো করতেন, পুজো মানে ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি ও ব্রতকথা’ নামে একটি পুস্তিকা পাঠ। কোনও কোনও বেম্পতিবারে সেই পুজোর ভার নিতে হত আমাকে, কারণ নারীরা রজঃস্বলা হলে কোনও পূজায় অংশগ্রহণ করতে নেই। আমি মাতৃভক্ত ছেলে, কারণ মায়ের কাছে কাকুতি-মিনতি করলে তবু দু’-চার পয়সা পাওয়া যায়, বাবার কাছে সে রকম কোনও দাবি উত্থাপনের সাহসই ছিল না। বাবাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতাম। সেইসময় গ্রাম দেশে বাবাকে আপনি ও মাকে তুই বলার রেওয়াজ ছিল, বিদ্যাসাগর মশাই পর্যন্ত মাকে তুই বলতেন, আমরা অবশ্য মাকে তুমি বলতেই শিখেছি।

মায়ের দায়িত্বটি পালন করতে রাজি হলেও সন্ধেবেলা স্নান করা আমার ধাতে সয় না। বাইরের জামা প্যান্ট বদলে, মাথায় একটু গঙ্গাজলের ছিটে দিয়ে শুদ্ধ হয়ে বসে যেতাম তুলোর আসনে। দুলে দুলে পড়তাম লক্ষ্মীর পাঁচালি, এখনও তার অনেক পঙক্তি মনে আছে :

দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ

মৃদু মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস

মলয় পর্বতে বসি লক্ষ্মী নারায়ণ

মনোসুখে দুইজনে করে আলাপন…

এরপর ঋষি নারদ এসে লক্ষ্মীকে বললেন :

নরলোক পানে মাগো চাহ একবার

মর্ত্যবাসী অন্নাভাবে করে হাহাকার

বল মাগো কৃপা করি কী পাপের ফলে

মর্ত্যবাসী নরনারী সদা দুঃখে জ্বলে…

তা শুনে লক্ষ্মী দেবীর উত্তর :

লজ্জা আদি গুণ যত রমণীর আছে

ক্ষণিক সুখের লাগি বর্জন করেছে

স্বামীরে না মানে তারা না শুনে বচন।

ইচ্ছা মত হেথা সেথা করিছে ভ্রমণ…

কয়েক বার পাঠ করলেই পুরো চটি বইটি মুখস্থ হয়ে যায়। এর একটা বিশেষ উপকারিতা পেয়েছি পরবর্তী জীবনে। পুরো বর্ণনাই পয়ার ছন্দে, চোদ্দ মাত্রা। আমায় কেউ শিখিয়ে দেয়নি, অবচেতনেই ছন্দের কান তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। কাকে পর্ব বলে, কার নাম মাত্রা, কিছুই জানি না, তবু, কপালে না থাকে যদি লক্ষ্মী দিবে ধন’, এটা পড়তে গিয়ে কপালে না থাকে যদি’, এখানে একটু থামি, তারপর লক্ষ্মী দিবে ধন। অর্থাৎ আট ছয়, আট ছয়, পয়ারে যাহারে কয়। যেমন, মহাভারতের কথা/ অমৃত সমান।, কাশীরাম দাস ভণে/ শুনে পুণ্যবান,’! ওই লক্ষ্মীর পাঁচালির পদ্যকার ছন্দে খুব একটা দক্ষ নন, কেন না, তাতে এরকমও পংক্তি আছে, সাত ভাই দৈবকে বলে করিয়া বিনয়, এটা আমি বারবার উচ্চারণ করি আর আমার কানে খটকা লাগে। সাত ভাই দৈবকে বলে/করিয়া বিনয়, এর মধ্যে কিছু একটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। অস্বস্তি বোধ হয়, মাথা নাড়ি। রবীন্দ্রনাথ শিশু বয়সে প্রথম পাঠে জল পড়ে, পাতা নড়ে’ থেকেই ছন্দ-মিল চিনতে শিখেছিলেন, আর আমার ফাইভ-সিক্স স্কুল বয়েস থেকে লক্ষ্মীর পাঁচালি মুখস্থ করে ছন্দ শিক্ষা শুরু হয়।

স্কুলের শেষ দিকে আমি মণিমেলা ছাড়া বিয়েজ স্কাউট’-এও যোগ দিয়েছিলাম, সেখানে খাঁকি হাফপ্যান্ট ও সাদা শার্ট পরে, গলায় নীল স্কার্ফ বেঁধে ড্রিল করতে হত, শিখেছিলাম অনেক ইংরিজি গান। যেমন ‘জন ব্রাউনস বডি,’হি ইজ আ জলি গুড় ফেলো’ ইত্যাদি। কোনও কোনও বৃহস্পতিবার বয়েজ স্কাউটে ইংরিজি গান গেয়ে মার্চ শেষ করেই বাড়ি ফিরে বসতে হত লক্ষ্মীপুজোয়। বাইরের পোশাক ছাড়তেই হবে। কিন্তু অন্য কোনও কাচা প্যান্ট যদি না থাকে (রোজ কাচা হয় না), তা হলে অগত্যা বসে পড়তে হবে কোমরে গামছা জড়িয়ে। অর্থাৎ, যে ছেলেটি একটু আগে গলায় স্কার্ফ বেঁধে ইংরিজি গান গাইছিল, সে-ই এখন গামছা পরে লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করছে। পুজো শেষ করে কয়েকবার শাঁখ বাজাতে হয়। শুধু সে-ই ব্যাপারটি ওই ছেলেটি রপ্ত করতে পারেনি।

কোন কারণে বাড়ির সেই লক্ষ্মীপুজো বন্ধ হয়ে গেল জানি না, আমার ভাই-বোনদের বোধহয় সে পুজোয় কখনো বসতে হয়নি, মাকেও কখনও আফসোস করতে শুনিনি। এরপর থেকে আমাদের বাড়িতে আর কখনও কোনও পুজো-পাট হয়নি।

মণিমেলা, বয়েজ স্কাউট ছাড়াও আমি অল্প দিন যুক্ত হয়েছিলাম ‘কিশোর বাহিনী’তে, এটি কমিউনিস্ট পার্টির ছোটদের শাখা। সেখানকার পরিবেশ খুবই ভালো লাগত, কিন্তু কিশোর বাহিনীর অনুষ্ঠান হত বলরাম বোস স্ট্রিটে কাটু বোসের বাড়িতে, সেটা আমাদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূর। তাই নিয়মিত যাওয়া সম্ভব হত না। সেখানেই দু’-একবার দেখেছি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে। তখনই শুনেছিলাম, এই কৃশকায়, ধুতি-শার্ট পরা দাদাটি একজন কবি।

আমাদের গ্রে স্ট্রিট পাড়াতেও একজন কবি ছিল, তার নাম মনে নেই। তার একেবারে খাঁটি কবি কবি চেহারা। বেশ সুন্দর, স্বাস্থ্যবান, মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত। ধুতি-পাঞ্জাবির সঙ্গে কাঁধে একটি চাদর, পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে, কেউ অনুরোধ করলেই দু’চার লাইন করিতা শুনিয়ে দিত। সুকান্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গে তার কোনও মিলই নেই, তবু, সেই ব্যক্তিটির ডাক নামই হয়ে গিয়েছিল কবি, সবাই বলত, ওই যে কবি যাচ্ছে। অনেক বাড়িতেই তার সহজ যাতায়াত ছিল, কিছুদিন পর এক ডাক্তারের নাবালিকা কন্যাকে নিয়ে সে উধাও হয়ে যায়। তারপর থেকে এ পল্লীতে কবি শব্দটি একটি গালাগালি হিসেবে ব্যবহৃত হতে লাগল।

আমি আর কাকা যে-ঘরটিতে থাকি, তার শুধু একদিকের দেওয়ালে দুটি জানলা, তাই দিনের বেলাতেও পুরোপুরি অন্ধকার ঘোচে না। পাশেই গলি, চোরের উপদ্রব আটকাবার জন্য জানলায় শক্ত মোটা জাল দেওয়া। গলি দিয়ে কত রকম মানুষ যায়, হরেক রকম ফেরিওয়ালা, তাদের কত বিচিত্র সুর। হরিদাস নামে একজন ফেরিওয়ালা চানাচুর বিক্রি করত, তার চানাচুরের নাম ছিল কুড়মুড় ভাজা। এই সুস্বাদু চানাচুর বিক্রেতার দুটি গুণ ছিল, তার গানের গলা চমৎকার, এবং আমাদের কাছে পয়সা না থাকলেও পুরনো দু’-একখানা খাতা দিলে তার কাছ থেকে চানাচুর পাওয়া যেত। খাতার পাতা ছিড়ে ঠোঙা বানাত সে। তার গান ছিল, ‘আমাদের এই হরিদাসের কুড়মুড় কুড়মুড় ভাজা, খাস্তা ভাজা, খেতে মজা, লাগে যেন জিভে গজা’। এই গান এমনই বিখ্যাত হয়েছিল যে পরবর্তীকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই গানটি গেয়ে রেকর্ড বার করেছিলেন।

সন্ধের পর প্রায়ই শোনা যেত মাতালদের হৈ হল্লা। আমরা পড়াশুনো করছি, পাশের গলি দিয়ে ছুটছে মাতালেরা। মদ সম্পর্কে তখন পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের লোকদের প্রবল শুচিবাই ছিল, আমার বাবা-কাকা, মামা-মেসো-পিসেদের মধ্যে কেউ কখনো মদ্য স্পর্শ করেছেন বলে শুনিনি। কিন্তু উত্তর কলকাতার খাঁটি সন্তানরা একটু লায়েক হলেই মদ ধরবে, এটা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। রাস্তাঘাটে দেখা যেত, কোনও মাতাল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, রিকশার ওপর এলিয়ে আছে মাতাল, কোনও বাড়িতে দুই ভাই ঝগড়া করছে, দু’জনেই পরস্পরকে দূর শালা মাতাল বলে অভিহিত করছে। অনেক বাড়ির ছেলেই স্কুলের পড়া শেষ করে না, কিংবা স্কুলের গণ্ডি পার হলে আর কলেজে যাবার প্রয়োজনবোধ করে না। লেখাপড়ায় জেদ বাঙালদের বেশি, বিশেষত উদ্বাস্তু হবার পর তারা বুঝে গিয়েছিল, পশ্চিমবাংলায় তাদের ভিটেমাটি নেই, লড়াই করে দাঁড়াবার জায়গা আদায় করে নিতে হবে, এবং শিক্ষা কিংবা কয়েকখানা ডিগ্রি ছাড়া লড়াইয়ের আর কোনও অস্ত্রও তো নেই। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বাড়িতেও পড়াশুনোর চাপ ছিল খুব বেশি, রাস্তায় গণ্ডগোল হলেও উঁকি মেরে দেখার উপায় নেই। জানলা বন্ধ করে পড়তে হবে। তখন পাখা ছিল না, গরমকালে জানলা বন্ধ করলে অসহ্য অবস্থা, দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে, তবু বই ছেড়ে বাইরে যাবার অনুমতি নেই।|

একটা জানলায় তারের জাল কোনও কারণে ফুটো হয়ে গিয়েছিল, আমরা টেনে টেনে ফুটোটা বড় করে ফেলেছিলাম, যাতে হাত গলে যায়। গলি দিয়ে চানাচুর, পকৌরি, আলু কাবলি, বুড়ির মাথার পাকা চুল বা শোন পাপড়ির ফেরিওয়ালা গেলে ওই ফুটো দিয়ে কেনা হত। ফেরিওয়ালারাও চিনে গিয়েছিল ফুটোটা, তারা ওইখানে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রলোভন দেখাত আমাদের। কিন্তু সবদিন তো পয়সা থাকে না, দু’পয়সা চার পয়সা জোগাড় করাও শক্ত, মায়ের কাছেও পরপর দু’দিন চাওয়া যায় না, সুতরাং প্রায়ই পাঁঠার ঘুগনি কিংবা তিলকুটো চন্দ্রপুলির আহ্বান শুনেও শুকিয়ে ফেলতে হত জিভের জল।

হঠাৎ কোনও সকালে সেই জানলার সামনে এসে দাঁড়াতেন এক আশ্চর্য আগন্তুক, খুবই ছোটখাটো চেহারা, মাথার চুল কদমছাঁট, অত্যন্ত বিনীত মুখের ভাব, তিনি নিয়ে আসতেন অভাবনীয় সব উপহার। এক ছড়া মর্তমান কলা, গলদা চিংড়ি, ভীম নাগের সন্দেশ ইত্যাদি, খুব কাঁচুমাচু গলায় বলতেন, এইগুলি রাখো তো ভাইটি। মাকে আমার প্রণাম জানিয়ো! এঁর নাম হরিনারায়ণবাবু, আমার বাবা কাউকে ধরে করে এঁকে একটা চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলেন, সেই কৃতজ্ঞতায় তিনি এসব দিতে আসেন। ইনি আসতেন বাবা বেরিয়ে যাবার একটু পরেই, বাবা নিতে তো চাইবেনই না, বরং বকাবকি করবেন, সেইজন্যই গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখে নিতেন আগে। মা-ও আপত্তি জানাতেন খুবই, এমনকী তাঁকে বলা হত, সব ফিরিয়ে নিয়ে যান, আপনার বাড়ির জন্য নিয়ে যান, কিন্তু হরিনারায়ণবাবু নাছোড়বান্দা, ঠায় ওই জানলায় দাঁড়িয়ে কাকুতি মিনতি করতেন, একটা একটা করে জিনিসগুলো গলিয়ে দিতেন। এবং কিছুতেই বাড়ির মধ্যে আসতে চাইতেন না। তাঁর জিনিসগুলির নির্বাচন দেখেও তাক লেগে যেত। অত ভালো মর্তমান কলা খুবই দুর্লভ, অত বড় আকারের গলদা চিংড়ি কেনার সাধ্য আমাদের কোনওদিনই ছিল না, সন্দেশগুলিও সবচেয়ে দামি। বাবা তাঁকে কী আর এমন চাকরি জোগাড় করে দেবেন, সাধারণ কিছুই হবে, তাঁর পোশাকও মলিন, অথচ তাঁর নজর কী করে অত উঁচু হল সেটাই বিস্ময়কর। অনেক টাকা থাকলেও বহু লোক এমন শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলি কিনতে পারে না।

একবার দু’বার নয়, বছরের পর বছর মাঝে মাঝেই হরিনারায়ণবাবু ওই রকম সব উপহার নিয়ে হাজির হতেন। প্রত্যেকবারই সর্বোৎকৃষ্ট। বাবা সাধ্যমতন অনেক লোেককেই চাকরি বা টিউশানি জোগাড় করতে সাহায্য করতেন, তাদের অনেকের কথা পরে তাঁর মনেও থাকত না, তারাও মনে রাখত না। হরিনারায়ণবাবুর কৃতজ্ঞতাবোধ অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। একদিন বাবা তাঁকে হাতেনাতে ধরে ফেললেন, তাঁর ঘাড় ধরে গলি থেকে হিড়হিড় করে টেনে আনলেন বাড়ির মধ্যে। দারুণ একজন অপরাধীর মতন মাথা নিচু করে রইলেন তিনি। বাবা তাঁকে প্রতিজ্ঞা করালেন যে, যদি কিছু দিতে ইচ্ছে হয়, তা হলে তিনি রেডক্রস ফাণ্ডে পয়সা দিতে পারেন, আমাদের বাড়িতে কোনও উপহার দ্রব্য আনা চলবে না।

মানুষের স্মৃতির মধ্যে যদি কোনও প্রতিকৃতির গ্যালারি থাকে, তা হলে আমার সেই গ্যালারিতে হরিনারায়ণবাবুর স্থান প্রথম সারিতে।

তেরো

আমার মায়ের সেজোমামা কলকাতা শহরে অনেক আগে থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর চার ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া শিখেছে কলকাতায়। কিন্তু বড়মামার ছেলেরা থেকেছে গ্রামেই, .জমি-বাগান-পুকুরের আয় থেকেই তাদের সচ্ছল সংসার, সে কারণে বেশি লেখাপড়া শেখা কিংবা চাকরি-জীবিকার দিকে মন দেননি। দেশ বিভাগে সমস্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তছনছ হয়ে গেল, তবু সেই বড়মামার বড় ছেলে শরণার্থী হয়ে কলকাতায় আসতে অস্বীকার করলেন। গ্রামে তিনি বর্ধিত হয়েছেন সম্মানে, চলাফেরা করেছেন মাথা উঁচিয়ে, সেই মানুষ কলকাতায় এসে অতি সাধারণের মতন চাকুরিপ্রার্থী হবেন, এটা তাকে মানায় না। তাঁর নাম গোবিন্দ, তেজী ও বলশালী পুরুষ, কালো রঙের শরীরটি যেন লোহায় গড়া, দৃষ্টিতে চাপা অহংকার। একবার তিনি বল্লম দিয়ে একটি পাগলা কুকুর মেরেছিলেন, কখনও-সখনও ওদিকে দু’-একটা বাঘ ছিটকে যেত, বাঘডাসা নামে আর একটি হিংস্র প্রাণীরও উপদ্রব হত মাঝে মাঝে, গোবিন্দ গাঙ্গুলি বর্শা হাতে নিয়ে অকুতোভয়ে সেসব তাড়া করে যেতেন। আশেপাশের বহু হিন্দু-মুসলমান তাকে মান্য করে, সুতরাং পাকিস্তান সৃষ্টি তাঁকে তেমন স্পর্শ করল না। বরং যেসব হিন্দু পরিবার জমিবাড়ি পরিত্যাগ করে চলে আসছিল, তাদের কাছ থেকে তিনি সম্পত্তিগুলি কিনে নিতে লাগলেন নামমাত্র মূল্যে, সেই সঙ্গে প্রত্যেককে এই আশ্বাসও দিলেন যে, তারা ফিরে এলে সব সম্পত্তি ফেরত পাবে। অর্থাৎ সেগুলি তার কাছে গচ্ছিত থাকছে, যাতে অন্য কেউ বেদখল করে নিতে না পারে।

গোবিন্দ তখনও অবিবাহিত। গ্রামের কুমার কুমারীরা, এমনকী শহরেরও অনেকেই তো বিয়ে করে না, তাদের বিয়ে হয়। নিজের বিয়ের কথা কেউ মুখ ফুটে বলবেই না, সেটা অশোভন ব্যাপার। অন্য কেউ, বা অভিভাবকরা উদ্যোগ না নিলে অনেকে সারা জীবন অবিবাহিতই থেকে যায়। আমার বাবা, অত ব্যস্ততার মধ্যেও যেমন চাকরির ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতেন, সেই রকমই উপযুক্ত পাত্র ও অনূঢ়া কন্যাদের মধ্যে বিবাহরূপ সেতুবন্ধনের কাজেরও শখ ছিল তার। অনেকগুলি বিবাহের কার্যকারণের হোত তিনি। আমার মায়েরও এই শখ আছে। বর্তমানে তার জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূরও এই ব্যাপারে খুবই উৎসাহ।

বাবা তাঁর নিজের গ্রামের চ্যাটার্জি বাড়ির প্রভা নাম্নী এক কুমারীর সঙ্গে গোবিন্দর বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করে ফেললেন। দুই পরিবারের আর্থিক অবস্থার বেশ তারতম্য আছে বটে, কিন্তু পালটি ঘর যাকে বলে, জাত-ধর্ম-শ্রেণী সব ঠিকঠাক। সেই বিয়ের বরযাত্রী হয়ে যাওয়াটাই আমার পাকিস্তানি পূর্ববঙ্গে প্রথম ও শেষবার গমন। তখনও ভিসা-পাসপোর্ট প্রবর্তিত হয়নি৷ ফজলুল হকের বিশ্বাস ছিল, ওসবের কোনও প্রয়োজনও নেই, পরে সেই বিশ্বাসের কথা প্রকাশ্যে বলায় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে ধমক খেয়েছিলেন।

আমগ্রামের মামারবাড়ির অবস্থা দেখে বুকে একটা ধাক্কা লেগেছিল। কত উৎসব, কত জাঁকজমক দেখেছি সেখানে, এখন নিরানন্দ, নিঝুম পরিবেশ। অতগুলি ঘর, প্রায় সবই খালি পড়ে আছে, শূন্য আটচালা, শূন্য পূজামণ্ডপ। গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটলেও একটা থমথমে ভাব টের পাওয়া যায়। কেউ জোরে হাসে না, কেউ জোরে কথা বলে না। (যদিও বাঙালদের চেঁচিয়ে কথা বলাই স্বভাব!) একের পর এক বাড়ি জনশূন্য। দরজা, জানলা বন্ধ। যেসব বাড়ি দু’বছর আগেও কলরবমুখর দেখে গেছি, সেগুলিকে এমন নিঃশব্দ অবস্থায় দেখলে দিনের বেলাতেও কেমন যেন অশুভ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আমার খেলার সঙ্গীরাও কেউ নেই। যে কয়েকটি পরিবার তখনও রয়ে গেছে, তাদের মুখগুলি বিহুলতা মাখা। ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা জানে না, কোনও সিদ্ধান্তও নিতে পারছেনা। কিছু কিছু মুসলমান ভদ্রলোকেরও প্রায় একই রকম অবস্থা। তারাও বুঝতে পারছেন না, দলে দলে হিন্দুরা কেন ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। গ্রাম-প্রতিবেশী হিসেবে অনেকের সঙ্গেই সদ্ভাব ছিল। বিপদে-আপদে পরস্পরের কাছে এসেছে। অনেক মুসলমান নিজেদেরই অপরাধী মনে করছেন, অনেকে হিন্দুদের বলছেন, আপনারা যাবেন কেন, আমরা জান দিয়েও আপনাদের রক্ষা করব। এসব যেমন সত্যি, তেমনই আড়ালে নানা রকম উস্কানিমূলক প্রচার এবং যখন-তখন দাঙ্গার আগে অগ্ন্যুৎপাতও ছিল অবশ্যই।

আমার দিদিমা তখনও আমগ্রামে রয়েছেন, কিংবা বিবাহ উপলক্ষে তাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। রাত্তিরে তার পাশে শশাওয়া, তার মুখের গল্প শোনা আমার কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়। কিন্তু তার সব গল্প যেন ফুরিয়ে গেছে, বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কী যে হয়ে গেল! কী যে হয়ে গেল! খাবার-দাবারের অভাব নেই, যত্নের কোনও ত্রুটি থাকার কথাও নয়। তবু, সব কিছুই কেমন নিপ্রাণ!

দিদিমার যিনি সবচেয়ে বড় ভাই, গোবিন্দর বাবা, যিনি ছিলেন এই পরিবারের অধিপতি, তাকে দেশবিভাগের গ্লানি দেখে যেতে হয়নি, তিনি কয়েক বছর আগেই প্রস্থান করেছেন। তাঁর মৃত্যুরাতটি আমার মনে আছে। তখন আমি নিতান্তই বালক, ঘুমিয়েছিলাম, রাত্রির তৃতীয় প্রহরে দিদিমা আমাকে জাগিয়ে তুলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোর কাছে কড়ি আছে? চোখ কচলাতে কচলাতে বাইরে এসে দেখি, উঠোনের মাঝখানে শোওয়ানো হয়েছে বড়দাদুকে, তাকে ঘিরে গুঞ্জন করছে অনেক মানুষ। মৃতের শেষকৃত্যে কড়ি কোন কাজে লাগে জানি না; কলকাতায় তো কখনও দেখিনি। হয়তো এটা গ্রাম্য লোকাচার। অনেক বাড়িতেই তখন কড়ি থাকত। অনেক বছর আগে কড়ি ছিল বিনিময় মুদ্রা, টাকাকড়ি’ শব্দটিতে তার ইতিহাস রয়ে গেছে, কানাকড়ি’ শব্দটিও ভাষা থেকে বাদ পড়েনি। মুদ্রা হিসেবে কড়ির প্রচলন আমরা দেখিনি, কড়ি নিয়ে খেলতাম, বাসরঘরেও বর-বধূ কড়ি খেলত।।

আমগ্রামের মামাবাড়ি থেকে বরযাত্রী হয়ে আমি গিয়েছিলাম মাইজপাড়ায় নিজেদের গ্রামে। গিয়েছিলাম নৌকোয়। দু’-একটি অকিঞ্চিৎকর ঘটনা অনেক প্রধান ঘটনাকেও বিস্মৃতিতে ঠেলে দিয়ে স্মরণে উজ্জ্বল হয়ে থেকে যায়। সেই রকমই একটা ঘটনা, আমার জুতো হারাননা। শুধু বরযাত্রী নয়, সম্ভবত নিতবর ছিলাম বলেই আমাকে একটি নতুন জামা ও একজোড়া পাম্পশু কিনে দেওয়া হয়েছিল। বর্ষাকাল, নৌকোয় উঠতে গিয়ে জুতো দুটো কাদায় মাখামাখি হয়ে যায়! নৌকোযাত্রায় আমার অভ্যেস ছিল গলুইয়ের কাছে উপুড় হয়ে শুয়ে একটা হাত জলে ডুবিয়ে রাখা, তাতে বড় আরাম, মনে হয় যেন হাতটা জল কেটে কেটে যাচ্ছে। এজন্য বকুনিও খেতে হয়েছে অনেক, কারণ, তখন পদ্মানদীতে অনেক কুমির তো ছিলই, আমি নিজের চোখেই দেখেছি, অনেক নদী-খালেও কুমির দুর্লভ ছিল না। সেবারেও আমি চলন্ত নৌকোয় উপুড় হয়ে শুয়ে জলে হাত ডুবিয়ে রয়েছি, এক সময় মনে হল, জুতোর কাদা তো এইভাবে ধুয়ে ফেলাও যায়। এক পাটি বেশ ভালোই ধোওয়া হল, দ্বিতীয় পাটিটি জলে ডোবানো মাত্র পিছলে গেল হাত থেকে। চিৎকার করেও লাভ নেই, ভরা বর্ষার নদী, মুহূর্তের মধ্যে সেটা তলিয়ে গেছে। ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ অসাড়। এমনিতেই জুতো জোটে না, তার ওপর নতুন জুতো খোওয়ানো, এ জন্য কী শাস্তি যে পেতে হবে…। একটু পরেই বাবা ব্যাপারটা টের পেয়ে গেলেন, তিনি শুধু বললেন, বোকার মতন এক পাটি জুতো হাতে ধরে রেখেছিস কেন? পৃথিবীতে কোনও দোকানে শুধু একপাটি জুতো কিনতে পাওয়া যায়? ওটাও ফেলে দে!

সত্যিই, কোনও দোকানে শুধু এক পাটি জুতো কিনতে পাওয়া যায় না কেন? এটা অন্যায়। কত কারণে এক পাটি জুতো নষ্ট হয়ে যেতে পারে, কুকুরে নিয়ে যেতে পারে, হঠাৎ ছিঁড়ে যেতে পারে। সব দোকানেই ডান ও বাঁ পায়ের এক পাটি করে জুতোও বিক্রির জন্য রাখা উচিত। সে রকম ব্যবস্থা থাকলে শরৎচন্দ্রকেও অমন বিব্রত হতে হত না। শরৎচন্দ্র একবার শ্রীরঙ্গম বা নাট্যভারতীতে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলেন, নিজেরই উপন্যাসের নাট্যরূপ। শিশিরকুমার ভাদুড়ী তাঁকে খাতির করে বসিয়েছিলেন দোতলার বক্সে। শরৎচন্দ্র চটি খুলে সোফায় পা তুলে বসেছিলেন, অনুষ্ঠান শেষে দেখা গেল তাঁর মূল্যবান চটিজুতোর এক পাটি নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেল না। শরৎচন্দ্র ভাবলেন, কোনও চোর তাঁর এক পাটি সরিয়েছে, দ্বিতীয়টা নেওয়ার সময় পায়নি, নিশ্চিত আশে পাশে তক্কে তক্কে আছে। চোরকে জব্দ করার জন্য তিনি অন্য পাটিটি রেখে না গিয়ে কাগজে জড়িয়ে নিলেন সঙ্গে। তিনি তখন হাওড়ার কাছে শিবপুরে থাকেন, ঘোড়ার গাড়িতে হাওড়া ব্রিজ পার হবার সময় তিনি সেই দ্বিতীয় পাটিটি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন গঙ্গায়। পরদিন সকালে শিশির ভাদুড়ী এসে ওই জুতোর ব্যাপারে দুঃখপ্রকাশ করে বললেন, একটা পাটি সোফার পেছন দিকে নিচু জায়গায় পড়ে গিয়েছিল, এই নিন, সেই পাটি! জুতোর ব্যাপারে শরৎচন্দ্র বরাবরই স্পর্শকাতর। একবার রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অনেক লেখককে আহ্বান জানিয়েছিলেন ঘরোয়া আলোচনার জন্য। শরৎচন্দ্র তাতে যোগ দিতে এসে ঘরের বাইরে অনেক জুতো দেখে তার মধ্যে নিজের জুতো মেশাতে চাইলেন না। নিজের জুতো জোড়া কাগজে এমনভাবে মুড়ে নিলেন যে মনে হবে কোনও বই। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বুঝতে পেরে সহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন, কী হে শরৎ, তোমার বগলে ওটা কী, পাদুকাপুরাণ নাকি? আমার জীবনে আরও কয়েকবার এক পাটি জুতো নষ্ট বা নিরুদ্দিষ্ট হয়েছে। তারাপদ রায়ের হাবড়া কিংবা পণ্ডিতিয়ার বাড়িতে যারাই গেছে তাদের কেউ না কেউ খালি পায়ে ফিরতে বাধ্য হয়েছে। তারাপদর পোষা কুকুর গণেশ যেসব অতিথিদের পছন্দ করত না, তাদের এক পাটি জুতো খেয়ে নিত। কুকুররা কোনওদিনই আমাকে পছন্দ করে না।

সে যাই হোক, বিয়েবাড়িতে আমাকে যেতে হয়েছিল খালি পায়ে। সেটা এমন কিছু দ্রষ্টব্যের ব্যাপার হয়নি, গোটা উৎসবটাই ছিল ম্রিয়মাণ। ছেচল্লিশের দাঙ্গার পর আর আমি দেশের বাড়িতে আসিনি, সেবারে নিজেদের বাড়িটাকে দেখাই যে শেষ দেখা, সে উপলব্ধিও হয়নি। বাড়ির ডান পাশে বড় বাতাবিলেবুর গাছ, পেছনের উঠোনে জামরুল গাছ, রান্নাঘরের পাশ দিয়ে পুকুরে যাবার সরু পথ, পুকুরঘাটের পাশে বাঁকা খেজুর গাছ, এই চিত্রটি স্মৃতিতে স্থির আলেখ্য হয়ে আছে। সে বাড়ি নিশ্চিত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, গাছগুলিও আর নেই, সেখানে অন্য কেউ বাড়ি তুলেছে না জংলা হয়ে পড়ে আছে জানি না। কিন্তু সেই ছবিটি কিছুতেই মুছে যাবার নয়।

আমাদের পরিবারে আর্থিক অনটন থাকলেও এক হিসেবে আমি ভাগ্যবান, আমার সমবয়সি বালক ও কিশোরদের তুলনায় আমি ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি অনেক বেশি। স্বাধীনতার আগে প্রতি বছরই একাধিকবার ট্রেনে-স্টিমারে-নৌকোয় পূর্ববঙ্গে যাওয়া-আসা তো ছিলই, যুদ্ধের সময় ছিলাম কাশীতে, এ ছাড়াও বিহার-ওড়িশায় বেড়াতে গেছি বাচ্চা বয়েসে। সেই সময় ‘চিলড্রেনস ফ্রেস এয়ার অ্যান্ড এক্সকারশান সোসাইটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। শুনেছি, কোনও এক সহৃদয়া ধনবতী বাঙালি রমণী গরিবদের ছেলেমেয়েদের জন্য গড়েছিলেন এই প্রতিষ্ঠান। (হায়, সে রকম সহৃদয় ধনবতী বাঙালি রমণীরা একালে কোথায় চলে গেলেন!) যে-সব বাবা-মা তাঁদের ছেলেমেয়েদের কখনও বেড়াতে নিয়ে যেতে পারেন না, শুধু তাদেরই এখানে আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হত, সমিতির একটা বাংলা নামও ছিল, ‘মুক্তবায়ু সেবন সমিতি’, মাত্র পাঁচ টাকায় এক একটি ছেলে বা মেয়েকে পনেরো দিনের জন্য নিয়ে যাওয়া হত বিহার-ওড়িশার কোনও স্বাস্থ্যকর, দর্শনীয় স্থানে। ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ার সময়ই আমি এই সমিতির সঙ্গে গেছি দেওঘর, মধুপুর, ভুবনেশ্বরে। আমাদের বাড়িতে শাসনের কড়াকড়ি ছিল, কিন্তু বাবা এই ধরনের ভ্রমণে উৎসাহ দিতেন, সেই থেকেই সারা জীবন আমার ভ্রমণের নেশা ধরে যায়।

মুক্তবায়ু সেবন সমিতির সঙ্গে বাইরে যাওয়ার উপকারিতা ছিল অনেক। অসীম দত্ত নামক ‘একজন জাঁদরেল স্কাউট মাস্টার হতেন সর্বাধিনায়ক, তিনি কঠোর শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষা দিতেন সকলকে। ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায় শয্যাত্যাগ, তারপর ছ’টার সময় ড্রিল, এক ঘণ্টা পরে জলখাবার, তারপর দু ঘণ্টা পড়াশুনো, তারপর মার্চ করে কোনও দ্রষ্টব্য স্থানে যাওয়া, সাড়ে বারোটায় স্নান, দেড়টার মধ্যে মধ্যাহ্নভোজন শেষ, এক ঘণ্টা বিশ্রাম, এরপর খেলাধুলো, আবার জলখাবারের বিরতি, সন্ধের পর গোল হয়ে বসে ক্যাম্পফায়ার। এই রুটিনের এক চুলও এদিক ওদিক করা যাবে না। কেউ এই নিয়মানুবর্তিতা ভঙ্গ করলেই অসীম দত্ত কড়া ধমক দিতেন। তাঁকে আমরা সবাই ভয় পেতাম, আবার কখনও যদি তিনি অকস্মাৎ মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে কথা বলতেন, তা হলেই যেন জীবনটা ধন্য মনে হত। এ রকম সংগঠকই আদর্শ, তিনি সবাইকে তটস্থ রেখে শৃঙ্খলারক্ষায় বাধ্য করতেন আবার সদয় ব্যবহার ও স্নেহ দেখাতেও কার্পণ্য করতেন না। এক এক দিন তিনি নিজেই নিয়ম ভঙ্গ করে এক ঝুড়ি জিলিপি এনে সকলকে খাওয়াতেন অসময়ে।

সবচেয়ে উপভোেগ্য ক্যাম্পফায়ারের সময়, মাঝখানে কাঠের আগুন জ্বেলে সবাই মিলে গোল হয়ে বসা, তারপর এক এক করে প্রত্যেককেই কিছু না-কিছু শোনাতে হবে, গান বা কবিতা গল্প, নাটকের অংশ, চুটকি রসিকতা, কারও বাদ যাওয়ার উপায় নেই। যে যত ভুল করে, তারটা তত উপভোগ্য। আমার তখন নজরুলের কবিতার আবৃত্তি শিল্পী হওয়ার পর্ব চলছে, আমার কোনও অসুবিধেই নেই। গড়গড় করে লম্বা কবিতা বলে যাই, কিন্তু শ্রোতাদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায় না, এখানে তো শিশুশিল্পী হিসেবে আলাদা খাতির পাবার কোনও প্রশ্ন নেই! কয়েকদিন পর আমি ইচ্ছে করে ভুলে যাবার ভান করতেই প্রচুর হাস্যরোল উপহার পেয়েছিলাম। আরও কিছু কিছু উপহারও পাওয়া যেত, রেড ক্রশ এবং অন্যান্য দু’-একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান এই সমিতিকে কিছু কিছু সাহায্য করতেন, তাই আমাদের দেওয়া হত বিনামূল্যে টুথপেস্ট, টুথ ব্রাশ, বিলিতি লজেন্স-বিস্কুট ইত্যাদি।

সপ্তাহে দুদিন বাড়িতে চিঠি লেখাও ছিল বাধ্যতামূলক। দুপুরবেলা সার বেঁধে সবাই বসে যেত পত্র রচনায়, অসীমা পরিদর্শন করতেন, পরীক্ষার হলের মতন ঘুরতে ঘুরতে হাঁক দিতেন, কী, শেষ হল? প্রত্যেককেই লিখতে হবে, অসীমদা নিজে সেগুলি সংগ্রহ করে পাঠাতেন ডাকঘরে। চিঠি অবশ্য তিনি পড়বেন না, বা সেন্সর করবেন না, শুধু একবারই আমাকে চিঠি লিখতে নিষেধ করেছিলেন।

সেবারে দেওঘরে। নন্দন পাহাড়, ত্রিকূট পাহাড়, আরও সব চমৎকার চমৎকার জায়গায় ঘোরাঘুরি করে অপূর্ব দিন কাটছিল, হঠাৎ একদিন আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলে ব্যথা শুরু হল। ব্যথা মানে অসহ্য ব্যথা, আঙুল ফুলে কলাগাছ যাকে বলে, এবং সেই আঙুলটার রং হয়ে গেল হলুদ। প্রথম দু’-একদিন কারুকে বলিনি, তারপর ব্যথার চোটে এসে গেল জ্বর। ক্যাম্পের পরিচালকদের নজরে পড়ায় তাঁরা ডাক্তার দেখালেন। সে অসুখটার নাম আঙুলহারা, এখনও মনে আছে, ডাক্তারটি প্রেসক্রিপশনে ইংরেজিতে লিখেছিলেন whitlow. আঙুলহারা মানে আঙুলটাই হারাতে হবে? ডান হাতের বুড়ো আঙুলের ব্যবহার থেকেই পশুজগৎ থেকে মানুষ আলাদা হয়ে যায়, বুড়ো আঙুল ব্যবহার করতে জানে বলেই মানুষ অস্ত্র ধরতে শেখে, কলম চালাতে পারে। আমার সেই আঙুলটিই চলে যাবে? তা হলে আমি বিবর্তনের কয়েক ধাপ পিছিয়ে বাঁদর হয়ে যাব? ডাক্তারটি বললেন, অপারেশন করা ছাড়া গতি নেই। তিনি নিশ্চিত একজন হাতুড়ে ডাক্তার ছিলেন, হাসপাতালে বা অপারেশন টেবিলে নেবার প্রশ্ন নেই, লোকাল অ্যানেসথেসিয়ার ব্যবহারও বোধহয় জানতেন না, তাঁর চেম্বারের টেবিলে শুইয়ে দিয়ে তিনি আমার আঙুলে ছুরি চালালেন। দু’জন সহকারী আমাকে চেপে ধরেছিল, তিনি আমার আঙুল কাটতে লাগলেন, আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারালাম। প্রাণে বেঁচে গেলাম। বটে, এবং আঙুলও রক্ষা পেয়েছিল, কিন্তু অপারেশনটি এতই খারাপ হয়েছিল যে সারাজীবনের মতন আমার সেই আঙুলটির আকার বিকৃত হয়ে যায়। পরে, কলেজজীবনে, অনেক সখের জ্যোতিষী আমার হাত জোর করে দেখতে গিয়ে ওই আঙুলটি নিয়ে ধাঁধায় পড়েছে। কেউ কেউ বিজ্ঞভাবে মন্তব্য করেছে যে চিরো (নাকি, কিরো?) নামে এক হস্তরেখা বিশেষজ্ঞের বইতে ছবি আছে, যাদের বুড়ো আঙুল ওই প্রকার, তারা মানুষ-খুনি হয়। এ মন্তব্য শুনে আমি আশ্বস্ত বোধ করেছি। খুন করার অধিকার যখন আমার আছে, তখন একটা খুন করলেই তো হয়। এতগুলি বছর কেটে গেল, কিন্তু ঠিক কাকে যে খুন করব, সে ব্যাপারে মন স্থির করতেই পারিনি। ক্যান্ডিডেট যে অনেক! ওই সব শখের জ্যোতিষীরা কেউ বুঝতেই পারেনি যে আমার ওই আঙুলটির আকার জন্মগত নয়। এক হাতুড়ে ডাক্তারের কীর্তি! সেই আঙুল নিয়ে লেখালেখি দিব্যি চালিয়ে যেতে কোনও অসুবিধে হয়নি।

অপারেশনের পর আমার আঙুলে একটা মস্ত ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সে রকম অবস্থাতেই আমি নির্দিষ্ট দিনে অন্যদের সঙ্গে চিঠি লিখতে বসেছিলাম, একসময় অসীমদা আমার পাশে এসে কোমল কণ্ঠে বললেন, এবারে তোমাকে চিঠি লিখতে হবে না, উঠে এসো, আমরা অন্য জায়গায় বসে গল্প করব!

পরে বুঝতে পেরেছি, বাড়িতে আমার ওই রোগ ও অপারেশনের কথা চিঠি লিখে জানালে.. মা বাবা খুব উদ্বিগ্ন হবেন, অসীমদা এটা চাননি। এতদিকে ছিল তাঁর নজর। তিনি নমস্য।

আঙুলহারা রোগটি কি বিলুপ্ত হয়ে গেছে? কারও হয়েছে বলে তো শুনি না। স্মল পক্স বা পান বসন্তের মতন মারাত্মক রোগটি পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়ে গেছে জানি, আমাদের ছেলেবেলায় এই রোগে অনেকে প্রাণ হারাত। ওই রোগের এক দেবীও ছিল, তার নাম শীতলা, খুব হাঁকডাক করে তাঁর পুজোও হত। বেচারি দেবীটির ইদানীং নামও শোনা যায় না। আমাদের ছেলেবেলায় আরও কতকগুলো বিচ্ছিরি রোগ ছিল, যেমন খোস, পাঁচড়া ও দাদ। খোস-পাঁচড়ায় ভোগেনি এমন কে আছে? ঊরু থেকে পা পর্যন্ত গ্রীষ্মকালে ভরে যেত বিচ্ছিরি খোস-পাঁচড়ায়, বড় বড়, চাকা চাকা, তার পুঁজ লেগে যেত জামা-প্যান্টে। দাদের ছিল প্রবল প্রতাপ, কোমরের কাছে কোনও না কোনও সময়ে দাদ হবেই। সেই জন্য দাদের মলমের বিজ্ঞাপন চতুর্দিকে। ঢোল কোম্পানির দাদের মলম এমনই বিখ্যাত এবং এত বেশি বিক্রি যে তার বিজ্ঞাপন থাকত বাংলা সংবাদপত্রগুলির শিরোনামের পাশে। সেসব অসুখ অন্তর্হিত হয়ে গেছে। এমনকী ঘামাচি, যার জন্য গরম কালে সাহেবরা ত্রাহি ত্রাহি রব তুলত, সেই ঘামাচিও এখন আর হয় না। শুধু ম্যালেরিয়া, যার কবল থেকে নিস্তার পাবার কোনও উপায় ছিল না, আমিও ম্যালেরিয়ায় ভুগেছি বাংলায় এর নাম ছিল পালা জ্বর, অর্থাৎ মাঝে মাঝে বেঁকে বেঁকে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে, সেই ম্যালেরিয়াকে উৎখাত করল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমেরিকানরা প্যালুড্রিন নামে এক ওষুধ দিয়ে, সেই ম্যালেরিয়া গত এক দশক ধরে আবার ফিরে এসেছে প্রবলভাবে।

একবার ডায়মন্ডহারবারে বয়েজ স্কাউটদের সঙ্গে ক্যাম্প করতে গিয়ে আমাকে ম্যালেরিয়ায় ধরে। ম্যালেরিয়া ছিল গ্রামবাংলারই অসুখ, কলকাতা শহরে বিশেষ হত না। এখন ব্যাপারটি উল্টে গেছে। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কলকাতার মতন শহরেই বেশি, এবং ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় টপাটপ মানুষ মরে। তখনকার ম্যালেরিয়া ঠিক মৃত্যুরোগ ছিল না। মাঝে মাঝেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসত, এ রকম চলত মাসের পর মাস। মৃত্যু বরং ভালো, তার বদলে এই রোগটি পুরো বাঙালি জাতটাকেই দুর্বল এবং নিরুদ্যম করে দিয়েছিল।

আমি ম্যালেরিয়ার জ্বর বেশ উপভোগই করতাম। কয়েকদিন বেশ ভালো আছি, ভালো আছি, হঠাৎ একদিন বিকেলে খেলাধুলো সেরে ফেরার পর অনুভব করতাম, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে, অবসন্ন হচ্ছে শরীর, অর্থাৎ এবার জ্বর আসছে, জ্বর আসছে, প্রথম দিকটা বেশ নেশার মতন, তারপরই এমন শীত যে তিন-চারটে লেপ কম্বল চাপা দিলেও কাঁপুনি কমে না। খুব জ্বরের মধ্যে আচ্ছন্ন অবস্থায় কত কী দেখা যায় মানসপটে, কত দৃশ্য, কত রং, (খুব গাঁজা টানলেও এ রকম হয়) কোনও বেদনার অনুভূতি নেই, যেন স্বপ্নের প্রশান্ত মহাসাগরে ভাসমান অবস্থা। জ্বর কমলেই সমস্যার শুরু। তখন শরীর খুব দুর্বল, জিভে তিক্ত স্বাদ, অথচ খুব খাই-খাই মনোভাব। জ্বরের মধ্যে পথ্য শুধু বার্লি অথবা সাবু। এর মতন বিস্বাদ, কুৎসিত আর কিছু হয় না। কোন মহা নির্বোধরা এই পথ্যের সুপারিশ করেছিল কে জানে! তখন জ্বর হলে স্নানও বন্ধ থাকত। এখন বলা হয়, জ্বরের সঙ্গে স্নান বন্ধের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং বেশি জ্বর হলে ভালোভাবে স্নান করানো উচিত, এবং পথ্য হিসেবে দেওয়া উচিত পুষ্টিকর, পছন্দসই খাবার। আমরা নাক টিপে, কোনও রকমে, দারুণ বিতৃষ্ণার সঙ্গে খেতাম লেবুর রস দেওয়া বার্লি, এখন অনেকে জ্বরের সময়ও মাংস রুটি খায়। কিংবা ভাত-মাছের ঝোল। তখন জ্বরের সঙ্গে ভাতের ছিল ভাসুর-ভাদ্দর বউ সম্পর্ক, জ্বর হলেই ভাতের মুখ দেখা নিষিদ্ধ। মনটা সব সময় ভাত-ভাত করত, জ্বরের উপশমের পরের দিনও নয়, তার পরের দিনে দেওয়া হত ভাত, তার সঙ্গে কাঁচকলা দিয়ে সিঙ্গিমাছের ঝোল। সে রকম বিস্বাদ ঝোল আর পৃথিবীতে হয় না। কে বলেছে, সিঙ্গিমাছ আর কাঁচকলা সবচেয়ে সহজপাচ্য? সম্ভবত এটা কবিরাজি ধারণা, অ্যালোপাথরাও পরিবর্তনের ঝুঁকি না নিয়ে সে রকম নির্দেশই দিতেন! কোথায় গেল সেই সব বার্লির কৌটো? কট্টর বিধবারাও বোধহয় এখন আর সাবু খান না।

আমি ম্যালেরিয়ার জ্বর উপভোগ করতাম এই কারণে যে, সে সময় বাড়িতে বেশ খাতির পাওয়া যেত। মা প্রায়ই এসে বসতেন শিয়রের পাশে। খুব বেশি জ্বর বাড়লে হাতপাখার বাতাস করতেন, কপালে লাগাতেন জলপট্টি। একটা বেশ মা-মা গন্ধ পাওয়া যেত। আমিই হতাম সকলের মনোযোগের কেন্দ্র। অর্থাৎ বাচ্চাদের মতন আবদার আর কী! সে সময় প্রকাশ্যে স্কুলের বইয়ের বদলে গল্পের বই পড়ার অগাধ স্বাধীনতা। একবার জ্বর থেকে সেরে ওঠার পরই মনে মনে প্রার্থনা করতাম, আবার কবে জ্বর আসবে! বাল্যকাল থেকেই আমার আভ্যন্তরিক স্বাস্থ্য ভালো থাকার জন্য কখনও জ্বর-টরে আমি বিশেষ কাবু হয়ে পড়তাম না।

মুক্তবায়ু সেবন সমিতিতে অন্তর্ভুক্ত হবার জন্য বয়েসের একটা সীমারেখা ছিল। সেটা পার হবার পর, আমি বয়েজ স্কাউট হয়েও অনেক আউটিং, ক্যাম্প ও এক্সকারশানে গেছি। আমার বাবা ছিলেন টাউন স্কুলের স্কাউট মাস্টার। আর একজন স্কাউট মাস্টার কমল দাস পিতৃবন্ধু এবং তিনি আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। সেই সুবাদে, স্কাউটদের যে-কোনও আউটিংয়ে আমার স্থান পাওয়া ছিল অবধারিত। কাছেই গঙ্গানগর, কিংবা বেশ দূরে রাঁচি, ডাক পাওয়া মাত্রই আমি প্রস্তুত। আরও কিছুটা বেশি বয়সে, কাশ্মীরের ক্যাম্পে আমি আমার বন্ধু শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়কেও নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলাম, যদিও শরৎকুমারের সঙ্গে স্কাউটিং-এর কোনও সম্পর্কই ছিল না। অবশ্য শরৎ তাঁর নিজস্ব প্রফুল্ল স্বভাবগুণে স্কাউট সদস্যদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলেন।

বয়েজ স্কাউট বা অন্য কোনও সমিতি কিংবা গুরুজনদের সঙ্গ ছাড়াও ভ্রমণে বেরোতে শুরু করি স্কুল বয়েসেই। সম্ভবত তখন ক্লাস টেন, আমার বন্ধু আশুকে প্ররোচিত করেছিলাম। চলো, মুর্শিদাবাদ ঘুরে আসি। নির্মলেন্দু লাহিড়ী-অভিনীত সিরাজউদ্দোল্লা নাটকটি সেসময় যখন- তখন রেডিয়ো এবং যত্রতত্র রেকর্ডে বাজে। যতবার শুনি, মন উদ্বেল হয়ে ওঠে। তখন ইতিহাসজ্ঞান খুবই ভাসা ভাসা, তাই সিরাজের নামেই আপ্লুত হয়ে উঠি, নাটকের সংলাপগুলিকেই মনে হয় সত্যিকারের এক ট্র্যাজিক নায়কের কণ্ঠস্বর। স্বদেশি আন্দোলনের সময় হিন্দু নেতারা মুসলমানদের মধ্য থেকে নায়ক খোঁজার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিলেন, তাড়াহুড়ো করে তাঁরা তরুণ সিরাজের মতন এক দুর্বল, অপরিণামদর্শী, দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠুর যুবককে প্রতীক-নায়ক হিসেবে বেছে নেন, তাঁদের ইচ্ছে অনুসারেই নাট্যকাররা সিরাজকে গড়ে তোলেন এক রোমান্টিক, আদর্শবাদী, হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়সাধক হিসেবে, আমরাও সেই বয়েসে তাই-ই গিলে নিয়েছিলাম। আশু আর আমি টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে উপস্থিত হলাম বহরমপুরে। এক হোটেলে চার টাকা দিয়ে ভাড়া করলাম একটি ঘর। হোটেলের মালিক আমাদের মতন গোঁফ না-গজানো দুটি ছেলেকে দেখে কৌতূহলের চোখে তাকিয়েছিলেন, কিন্তু আপত্তি করেননি ঘর দিতে। সেখান থেকে মুর্শিদাবাদে গিয়ে হাজার দুয়ারি কিংবা জগৎশেঠের গোলাপ বাগান দেখেও তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু গঙ্গার অপর পারে, খোসবাগে, নবাব পরিবারের সমাধিক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে, সেখানকার রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং উদাসীন মনোভাব দেখে হঠাৎ এমনই আঘাত পেয়েছিলাম যে জল এসে গিয়েছিল চোখে।

সেই অশ্রু কি সিরাজের জন্য, না বর্তমান দেশের অবস্থার জন্য? তখনই তো আমরা বামপন্থীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, ভুলো মাৎ, ভুলো মাৎ, বলতে শুরু করেছি।

চোদ্দো

অতিরিক্ত পরিশ্রমে বাবার শরীর ভাঙতে শুরু করে। তাঁর ধারণা তিনি দৈত্যের মতন পরিশ্রম করতে পারেন, কিন্তু প্রকৃতি তা মানবে কেন? তাঁর রক্তে উচ্চ চাপ এবং শর্করার আধিক্য শুরু হয়। বিশেষত দ্বিতীয় রোগটি খুবই ভীতিজনক, তখনকার দিনে নিদান ছিল ভাত একেবারে বাদ। আলু অস্পৃশ্য, আহার্য শুধু দু’তিনখানা হাতে গড়া রুটি। (এখন অবশ্য এসব তত্ত্ব অনেক বদলে গেছে, আলু বেচারি জাতে উঠে ভাত-রুটির সমপর্যায়ভুক্ত হয়েছে।) বাঙালদের ভাত বন্ধ করা কঠিন শাস্তিস্বরূপ, দুতিন দিন ভাত না খেলে তাদের মনে হয় জীবনটাই বৃথা, সুতরাং শুধু রুটি বরাদ্দ হলে আহারের রুচিই নষ্ট হয়ে যায়, সে জন্য শরীর আরও দুর্বল হতে থাকে। ইস্কুলের চাকরি টিকে থাকলেও বাবা টিউশনির সংখ্যা কমাতে বাধ্য হন। ফলে, আগে থেকেই টানাটানির সংসারে টানাটানি করার মতন ব্যাপারগুলিও ফুরোতে থাকে। যুদ্ধ বা মন্বন্তরের সময় এরকম সংকটে আমরা কিছুদিনের জন্য দেশের বাড়িতে গিয়ে থেকেছি। সেখানে অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই এবং কিছু না কিছু খাদ্য জুটে যেত, কিন্তু এখন আর আমাদের দেশ বলে কিছু নেই। রিফিউজি মানেই তো জীবন্ত নিরালম্ব। ‘

স্বাধীনতার পরেও অনেকগুলি বছর, এই সেদিন পর্যন্ত, স্কুল শিক্ষকরা ছিলেন সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত শ্ৰেণী। সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর একটি অবিস্মরণীয় গল্পে এক স্কুলের পণ্ডিতের মর্মন্তুদ অনুভূতির কথা লিখে গেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পোষা কুকুরের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ শুনে সেই পণ্ডিতমশাই হিসেব করেছিলেন, তাঁর উপার্জন কুকুরটার এক ঠ্যাঙেরও পরিচর্যার সমান নয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক রচনায় এবং মনোজ বসুর মানুষ গড়ার কারিগর’ উপন্যাসে এরকম আরও অনেক চিত্র বিধৃত আছে। তখন এরকম একটা ধারণারই সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছিল যে শিক্ষকদের টাকা পয়সার প্রয়োজন নেই, তাঁরা তো আদর্শবাদী, ছাত্রসমাজকে গড়ে তোলার ব্রত নিয়েছেন, তাঁর স্ত্রী বিনা চিকিৎসায় মরুক, তাঁর ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যাক, তবু তাঁকে মহান দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। পরাধীন আমলে সত্যিই কিছু কিছু আদর্শবাদী ব্যক্তি শিক্ষকতা গ্রহণ করে স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণ করে নিতেন। স্বাধীনতার পর স্কুল-শিক্ষকতা সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীবিকা হিসেবে গণ্য হতে থাকে, যারা অন্য কোনও চাকরি পায় না, তারাই শুধু বাধ্য হয়ে শেষ আশ্রয় হিসেবে শিক্ষকতা গ্রহণ করে এবং সেই জন্য শিক্ষার মানও নামতে থাকে হু হু করে। মিশনারি স্কুলগুলি সম্পর্কে এ কথা প্রযোজ্য নয়, সেখানে মাইনে বেশি, ছুটি কম, নিয়ম শৃঙ্খলাও কঠোর। সত্তরের দশক থেকে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরা খেয়ে না খেয়ে ছেলে-মেয়েদের ওই সব স্কুলে পাঠাতে শুরু করে, তার কারণ, ততদিনে বাংলা স্কুলগুলি সম্পর্কে অভক্তি জন্মে গেছে। সেই সময় আমাদের নকশালপন্থী তরুণ বিপ্লবী বন্ধুরা এক অদ্ভুত ভ্রান্ত নীতিতে বাংলা স্কুলগুলি বন্ধ করে দেওয়া, আগুন লাগানো ও শিক্ষক হত্যা শুরু করায় শিক্ষা ব্যবস্থাই বিপর্যস্ত হয়ে যায়, কিন্তু সেই বিপ্লবীরা মিশনারি স্কুলগুলি স্পর্শও করেননি, সে জন্য ওই সব স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।

এখন অবশ্য সে অবস্থা বদলেছে। সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলির শিক্ষকদের সেরকম দুরাবস্থা কিংবা দুরবস্থা নেই, বেতনহার অনেক ভদ্রস্থ হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার মান উন্নত করার তেমন কোনও চেষ্টা হয়নি। তা ছাড়া, শোনা যায়, বেতনহার উচ্চ হবার ফলে এ চাকরিও আকর্ষণীয় হয়েছে, এখন এমনকী গ্রামের স্কুলেও চাকরি পেতে গেলে পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। যারা ঘুষ দিয়ে চাকরি কেনে, তারা কখনও সে কাজের প্রতি মনোেযোগী হতে পারে? তাঁদের পাকা চাকরি, কিছু না পড়ালেও বরখাস্ত করা যাবে না। সুতরাং বাংলা স্কুলগুলির অবস্থা যে তিমিরে ছিল, এখনও সে তিমিরেই।।

তখনকার বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকদের বেতন তো অতি কম ছিলই, হঠাৎ কোনও শিক্ষক অসুস্থ হয়ে এক-দেড় মাস শয্যাশায়ী হয়ে থাকলে সেই ছুটির বেতনও পেতেন না। এরকম অবস্থায় সংসার খরচ চালাবার জন্য আমাদেরও সাধ্যমতন অংশগ্রহণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমার ছোটকাকা যে-কোনও পরিস্থিতি সামলাবার জন্য উপস্থিত বুদ্ধিতে দড় ছিলেন, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব কথাটা তাঁর সম্পর্কে খাটে, তিনি মাঝে মাঝে বিচিত্র উপায়ে কিছু কিছু উপার্জন করতেন। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকে আমি শুরু করি টিউশনি।।

আমার প্রথম ছাত্র একটি বস্তির ক্লাস সিক্সের বালক। শ্রী-উত্তরা সিনেমা হলের পেছন দিকে ছিল সেই বস্তি, প্রতিদিন দু’ঘণ্টা পড়াতে হবে, মাইনে দশ টাকা। ছাত্রের বাবা খুব ছোট একটি মুদিখানার কর্মচারী, আমাকে প্রায়ই বলতেন, মাস্টারবাবু, ছেলেটাকে পাশ করাতে হবে কিন্তু, আমি লেখাপড়া শিখিনি, ছেলে যেন শেখে, রক্ত জল করা টাকায় মাস্টার রেখেছি কী সাধে! ছেলেটির ঘাড়ের ওপর একটা মাথা ছিল বটে, কিন্তু যাকে বলে পড়াশুনোর মাথা, তা একেবারেই ছিল না। সে অঙ্ক কিছুতেই বুঝবে না বলে যেন প্রতিজ্ঞা করেই জন্মেছে। পড়ানো ছাড়াও আমার একটি অতিরিক্ত কাজ ছিল, ছেলেটির বাবা শেষ দিকে বাড়ি ফিরে এসে দোকানের হিসেব লেখাতেন আমাকে দিয়ে। বস্তিতে বিদ্যুৎ-সংযোগ ছিল না, হারিকেনের আলোয় মেঝেতে বসে পড়ানো, কাছাকাছি অন্যান্য ঘরে নানারকম গোলমাল ও ঝগড়াঝাঁটি এবং আমার পক্ষে অশ্রুতপূর্ব আদিরসাত্মক খিস্তি। ছাত্রের বাবা ঘর্মাক্ত শরীরে ফিরে, একখানা বিড়ি ধরিয়ে হিসেব লেখাতে লেখাতে আচমকা জিজ্ঞেস করতেন, পোঁয়োররা ট্যাকা আট আনা মন দরে আড়াই সেরের দাম কত হল গে? কিংবা, দুটাকা ছ’আনা হিসেবে আট সের? অর্থাৎ, এ সবই সুকৌশলে আমার অঙ্ক জ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়া। দোকানের কর্মচারীরা লেখাপড়া না শিখলেও এই সব হিসেবের ব্যাপারে খুব ধুরন্ধর হয়, চোখের পলক ফেলার আগে সঠিক বলে দেয়।

উনি অবশ্য আমাকে জব্দ করতে পারেননি, স্কুলে পড়ার সময় আমি অঙ্কে খারাপ ছিলাম না, পরীক্ষায় আশি-নব্বই পেতাম, কোনও একবার পুরো একশো পেয়ে বাবাকে পর্যন্ত অবাক করে দিয়েছিলাম। কলেজ জীবনে কবিতা এসে আমার মাথা থেকে তাড়িয়ে দেয় অঙ্ককে। তার ফলে আমাকে অনেক ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছে। কবিতার সঙ্গে অঙ্কের সম্পর্ক যেন সপত্নীবৎ। অঙ্কের অপর নাম যুক্তি, সব সময় যুক্তিসিদ্ধ হলে কবিতা বোধহয় ধারে কাছে আসতে পারে না, কারণ কবিতা অনেকটা স্বপ্নের মতন, জাগ্রত কল্পনার চেয়েও যা অনেক বেশি বিমূর্ত।

আমার সেই ছাত্রের পিতাটি একটি অন্যায় করতেন। অমনোযোগী ছাত্রটি ছিল নিদ্রাপ্রবণ। যখন তখন সে ঘুমে ঢুলে পড়ত। তা দেখলেই তার বাবা ধাঁই ধাঁই করে কিল মারতেন তার পিঠে। আমার সামনে আমার ছাত্রকে শাস্তি দেওয়া মানে শিক্ষকের অধিকার ক্ষুন্ন করা নয়? সেই সময় আমি বসে থাকতাম আড়ষ্ট হয়ে।

রাত সাড়ে আটটা-নটায় বস্তির অন্ধকার গলি দিয়ে বাড়ি ফিরত চোদ্দো বছরের খুদে মাস্টারবাবুটি, পায়ে টায়ারের চটি, (যুদ্ধের পর এটা চালু হয়েছিল, চামড়া ও রবার দুর্লভ হওয়ায় গাড়ির পুরনো টায়ার কেটে বানানো অতি শস্তার চটি, যার আকার ডিঙি নৌকোর মতন) ধুতির ওপর হাফ শার্ট, (হাফ প্যান্ট পরলে আরও ছোট দেখায়, ধুতি ছাড়া মাস্টারকে মানায় না) কুকুর ঘেউ ঘেউ করে বলে ভয়ে বুকটা কাঁপে বটে, তবু সে বেশ আত্মপ্রসাদও অনুভব করে। সময় ও শ্রমের বিনিময়ে সে কিছু উপার্জন শুরু করেছে।

সেই প্রথম-টিউশনিতে আমি একটি অনৈতিক কাজ করেছিলাম। অভিভাবকটি আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিতেন যে তাঁর ছেলেকে পাশ করাতেই হবে। অনেক চেষ্টা করেও আমার ধারণা হয়েছিল, ছেলেটি অঙ্কে পাঁচ-দশ পাবে কি না তাতেও সন্দেহ আছে। সে কোনওক্রমে যোগ, বিয়োগ আর ভাগ কিছু কিছু পারে, কিন্তু গুণ একেবারেই তার মাথায় ঢোকে না। সাত দু’গুণে চোদ্দোর চার, হাতে রইল এক, এই হাতে রাখার ব্যাপারটা সে কিছুতেই বুঝবে না। সব সময় তার হাত খালি। গুণ ছাড়া অঙ্ক হয়? নভেম্বর মাসে, পরীক্ষার ঠিক আগে আমি সেই বস্তিতে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম বিনা নোটিসে। পরীক্ষার আগে গৃহ শিক্ষকের পলায়ন বলতে গেলে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর, কিন্তু আমি কী করব, আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল, পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে মুদিখানার কর্মচারীটি নির্ঘাত আমাকেই মেরে বসবেন! দশ টাকার বিনিময়েও আমি মার খেতে রাজি নই। অবশ্য পরের মাসেই আমাকে আর একটি টিউশনি জোগাড় করতে হয়েছিল।

আমার স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে আর কেউ বোধহয় টিউশনি করেনি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা প্রায় সবাই সচ্ছল পরিবারের সন্তান। কিন্তু টিউশনির সূত্রে আমি তাদের সকলের চেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান, আমি যত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তারা সে সুযোগ পাবে কী করে? গৃহশিক্ষক হিসেবে আমি বস্তির ঘুপচিঘর থেকে রাজপ্রাসাদে পর্যন্ত প্রবেশ অধিকার পেয়েছি। সত্যিই আমি কিছুদিন পড়িয়েছি শোভাবাজার রাজবাড়িতে, এবং লর্ড সিনহার এক নাতনিকে, তবে রাজবাড়ির চেয়েও বস্তির মধ্যে নিয়মিত যাতায়াতের সুযোগ পাওয়া আরও শক্ত নয় কি?

আমার টিউশনি-অভিজ্ঞতা নিয়ে পুরো একটি মহাভারত লেখা যায়। উনিশশো উনপঞ্চাশ সাল থেকে তেষট্টি সাল পর্যন্ত এক টানা চলেছিল এই পর্ব, তারপর আমার জীবনে একটা আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে। যারা কখনও গৃহ শিক্ষকতা করেনি তাদের কথা আলাদা, কিন্তু যারা করেছে, তাদের কাছে আমি ঈর্ষার পাত্র হতে পারি। বাবা স্কুল শিক্ষক বলে আমার পক্ষে টিউশনি জোগাড় করা খুব সহজ ছিল, ইচ্ছে মতন বদলাতেও পারতাম, মাঝখানে কয়েকটি বছর দিনে তিন জায়গাতেও পড়িয়েছি। বেকার অবস্থায় যখন শুধু টিউশনিই আমার জীবিকা, তখন কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধুরা বলেছিল, তুমি পয়সা নিয়ে এত ছেলেমেয়েদের পড়াও, বিনা পয়সায় কয়েকজনকে পড়াতে পারো না? তাদের অনুরোধে তাদের স্টাডি সার্কেলে কিছুদিন বাগবাজারে বস্তির ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে শ্লাঘা বোধ করেছি। জানি না, কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে এখনও স্টাডি সার্কেল জাতীয় কিছু চালু আছে কি না।

টিউশনিতে আমার পদোন্নতি হয় ধাপে ধাপে। বস্তি থেকে শুরু, তারপর বিভিন্ন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে, রেট-ও বেড়েছে, দশ থেকে পনেরো, তারপর কুড়ি, সর্বোচ্চ পেয়েছি। পঁচাত্তর টাকা, কোনও কোনও বাড়িতে বেতনের অতিরিক্ত কিছু কিছু খাবারও পেতাম, আহিরিটোলার একটি বাড়িতে চায়ের সঙ্গে দেওয়া হত দু’খানা থিন অ্যারারুট বিস্কুট, অত বিস্বাদ চা আমি আর জীবনে খাইনি, চায়ের বদলে তাতে সাবানের গন্ধ, বিনা প্রতিবাদে তা-ই গলাধঃকরণ করতাম নিয়মিত। একটি পরিবারে ঠাকুর-চাকর-দারোয়ানদের সঙ্গে মাস্টারকেও পুজোর সময় একটি ধুতি দেওয়া হত।

দুটি অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতন। শ্যামপুকুর স্ট্রিটে, টাউন স্কুলের প্রায় উল্টো দিকে বিখ্যাত মিত্তির বাড়ি। এ রকম কিছু কিছু বাড়ির জন্যই কলকাতা এক সময় সুন্দর শহর হিসেবে গণ্য হত। সে বাড়ির বর্ণনা এখন প্রায় রূপকথার মতন শোনাবে। প্রকাণ্ড লোহার গেটের পাশে ঘণ্টাঘর, একজন দ্বারবান সাতটার সময় সাতবার, এগারোটার সময় এগারোবার, অর্থাৎ প্রত্যেক ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঘন্টা বাজিয়ে সময় জানিয়ে দিত পথচারীদের। ভেতরে দুটি প্রাসাদ ও উদ্যান, যার এক প্রান্ত থেকে শেষ দেখা যায় না। মধ্যে ফোয়ারা ও শ্বেত পাথরের নারীমূর্তি। একপাশ দিয়ে সুরকি বিছানো পথ। বাড়িটির সেই রূপ আর এখন নেই। বর্তমানে কলকাতার কিছু কিছু বাড়িকে হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে চিহ্নিত করে রক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে, কিন্তু মাঝখানের বছরগুলিতে আমাদের ঔদাসীন্যে কত সুদৃশ্য হৰ্য হারিয়ে গেছে। এখন কি কেউ বিশ্বাস করবে যে ঝামাপুকুরে একটি বাড়িতে সদর থেকে অন্দরমহলে যাতায়াতের জন্য ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা ছিল?

আমি ওই মিত্রবাড়ির বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে গিয়ে দ্বিতীয় প্রাসাদটিতে দুটি ফুটফুটে ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছি বেশ কয়েক বছর। ছেলেটির নাম বাবলু, মেয়েটির নাম সীতা। বাইরের দিকের একটি ঘরে বসে থাকতেন এক বৃদ্ধ, সম্ভবত তিনিই গোষ্ঠীপতি, অধিকাংশ দিনই দেখতাম তিনি চোখ বুজে রয়েছেন, একজন মাইনে করা লোক গীতা কিংবা উপনিষদ পাঠ করে তাঁকে শশানাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ তিনি চোখ খুলে হুঙ্কার দিয়ে বকতেন কোনও দাস কিংবা দাসীকে। পাশের বৃহৎ হল ঘরটিতে সোফা সেট ও প্রচুর দামি আসবাব, দেয়ালে নানা আকারের ও নানা ধরনের অনেকগুলি ঘড়ি। কাজের লোেক ধুলো ঝাড়তে গিয়ে কোনও ঘড়ি বা ছবি বেঁকিয়ে ফেললে তাঁর নজর এড়াত না।

প্রথম দিকে আমি পড়াতাম হলঘরটির অন্য পাশের একটি ঘরে। একটি শ্বেতপাথরের টেবিল ঘিরে কয়েকটি চেয়ার, সে রকম চেয়ারে আমি আগে কখনও বসিনি। পাশে একটা শ্বেতপাথরের ভাস্কর্য ছিল, সেটার দিকে বারবার চোখ চলে যেত আমার, এক রমণীর পায়ের কাছে বসে আছে পাদ্রীর মতন পোশাক-পরা একজন পুরুষ। একজন পাদ্রী কেন একটি নারীর পদতলে বসে থাকবে? নিশ্চিত কোনও পশ্চিমি কাহিনী, কিন্তু সেটা জানি না বলে দারুণ কৌতূহল অবরুদ্ধ বাতাসের মতন ঘুরত আমার মাথার মধ্যে। অনেকদিন পরে এক ফরাসি কাহিনী পড়লাম, আবেলার নামে এক পাদ্রী এলোইস নামে এক তরুণীর প্রেমে পাগল হয়েছিলেন, সম্ভবত সেই কাহিনীই মূর্ত হয়েছিল ওই ভাস্কর্যে। সেটার দাম কত হতে পারে তা আমার ধারণা ছিল না। ভাস্কর্যটির প্রতি আমি এমনই আকৃষ্ট হয়েছিলাম, যে প্রায়ই মনে মনে ভাবতাম, সেটা তো অবহেলাতেই পড়ে আছে এক ধারে, ওরকম শিল্প সৃষ্টি আরও অনেক আছে এ বাড়িতে, আমার এক বছরের মাইনের বদলে যদি ওটা আমাকে দিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে আমি ধন্য হব। তবে ওরকম একটি শিল্পকে সাজিয়ে রাখার মতন জায়গা যে আমাদের ভাড়া বাড়িতে নেই, সে খেয়াল ছিল না।

বনেদি বাড়ির রীতি অনুযায়ী সীতার মা মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে কথা বলতেন আড়াল থেকে, তাঁকে দেখা যেত না। তার বাবা ডাক্তার, পাশ দিয়ে যাতায়াত করতে দেখেছি, কখনও কথা হয়নি। তিনি একসময় উচ্চশিক্ষার্থে সপরিবারে বিলেত চলে গেলেন, তখন আমি শুধু বাবলুকে পড়াই। বছরখানেক বাদে সীতা ফিরে এসে আবার আমার ছাত্রী হল, আমি সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম, তার আচরণের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। সেই সময় বিলেত-যাওয়া চাট্টিখানি কথা ছিল না, বিলেত-ফেরতদের চালিয়াতি নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত ছিল, তারা অকারণে ইংরিজি বলে, যখন তখন আমি যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম’ শুরু করে। সীতা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে, তবু সে নির্ভুল বাংলা বলে, বাংলা গল্পের বই দারুণ ভালোবাসে, প্রসঙ্গ এসে গেলেও সে বিলেত বলে না, বলে ওদেশে। তার মা-ও আবার পর্দানসীনা।

সেই বনেদি বাড়ির ভিতরের চিত্রটি আমার মনে এমন গেঁথে যায় যে পরবর্তীকালে ‘সেই সময়’ নামে উপন্যাসটি রচনার সময় তা খুব কাজে লেগেছে। ওঁদের কথাবার্তা খুব মনোেযোগ দিয়ে শুনে আমি খাস কলকাতার ভাষাও রপ্ত করেছিলাম। বাবলুর বাবা মাঝে মাঝেই আমাকে বলতেন, আপনার কথা শুনে তো বোঝা যায় না যে আপনি বাঙাল! আমার মামা বাড়ি ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে তখনও বাঙাল ভাষা প্রবলভাবে প্রচলিত। পূর্ববঙ্গে লোকেরা নিজেদের ভাষা নিয়ে গর্ব বোধ করে, কলকাতায় এসে তারা স্থানীয় ভাষা বললেও বাড়ির মধ্যে ছ্যামরা-ছেমরি, পোলাপান, জম্বুরা, গোইয়া, বোরোই, ইত্যাদি এবং ছ-কে স-এর মতন উচ্চারণ অবাধে চালিয়ে যায়।

সীতার বাবা মিহিরকুমার মিত্র প্রখ্যাত চিকিৎসক এবং একসময় ক্যালকাটা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বহুবছর বাদে, কোনও এক পুরস্কার বিতরণী সভায় তিনি সভাপতি, প্রধান অতিথি হিসেবে তাঁর পাশে আমার স্থান। আমি তাঁর দিকে ফিরে মৃদু স্বরে বললাম, আমাকে চিনতে পারছেন না, আমি একসময় আপনাদের বাড়ির মাস্টার ছিলাম, সীতাকে পড়িয়েছি। তিনি দারুণ অবাক হয়ে বললেন, আপনার নাম জানি, বইও পড়েছি, কিন্তু আপনিই যে সেই, তা তো জানতাম না! সভাপতির অন্য পাশে বসা সীতার মাকে স্বচক্ষে দেখলাম সেই প্রথম! সীতা এবং তার স্বামীর সঙ্গে মাঝে মাঝেই দেখা হয়, পুরনো অভ্যেসবশত সর্বসমক্ষে সে আমাকে মাস্টারমশাই বলে ডেকে ফেলত, কিন্তু আমার মধ্যে মাস্টারত্ব আর কিছুই অবশিষ্ট নেই বলে এখন সে সুনীলদা বলে।

অন্যরা কেন আমাকে ঈর্ষা করবে, তার দ্বিতীয় কারণটা এবার বলি। থার্ডইয়ারে পড়ার সময় আমার বন্ধু সুনন্দ ওরফে বুঢ়ঢ়া একদিন আমায় বলল, তুই আমার কাকার ছেলে আর মেয়েকে পড়াবি? ওরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে, বাংলায় কাঁচা। আমি রাজি হয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে। তখন ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীদের বাংলায় পাশ করা বাধ্যতামূলক ছিল, তাদের ডিগ্রির নাম ছিল সিনিয়ার কেমব্রিজ, এখন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেকেই মাতৃভাষা এড়িয়ে যায়।

সেই প্রথম উত্তর কলকাতা থেকে আমার সুদূর দক্ষিণ কলকাতায় পাড়ি দেওয়া। হ্যাঁ, সত্যিই সুদূর। দক্ষিণ কলকাতার বেশির ভাগ মানুষই উত্তর কলকাতা চেনে না, অনেকে সারা জীবনে কখনও বোধহয় কলেজ স্ট্রিটের ওপাশে পা দেয়নি। আর উত্তর কলকাতার ছেলেরা মাঝে মাঝে দক্ষিণ কলকাতায় বেড়াতে আসে বাসে চেপে। উত্তরের তুলনায় দক্ষিণ কলকাতার রাস্তাঘাট অনেক সুন্দর। মানুষ কম, ফাঁকা ফাঁকা, প্রচুর গাছপালা, এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় এখানকার সুবেশা তরুণীরা স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়। হিমানীশ গোস্বামী লিখেছিলেন, দক্ষিণ কলকাতার মেয়েরা খুব খোলামেলা হয়, সাউথ ফেসিং কিনা?

ছাত্র-ছাত্রীর নাম ভাইয়া ও মুনা, তখনও ঠিক কৈশোরে পৌঁছোয়নি, বাড়ি সাদার্ন এভিনিউতে। এসব দিক আমার একেবারেই অচেনা। গুহঠাকুরতারা পূর্ববঙ্গের বিখ্যাত পরিবার, এঁদের অনেক কৃতী সন্তান ছড়িয়ে আছে সারা ভারতে ও বিদেশেও। আমার বন্ধু বুঢ়্যার বাবা প্রভু গুহঠাকুরতা সম্পর্কে শুনেছি, তিনি ভারতে সবচেয়ে কম বয়সে পি এইচ-ডি করেছিলেন, খুবই রূপবান ও গুণী পুরুষ ছিলেন তিনি, বুদ্ধদেব বসু তাঁর স্মৃতি কথায় এঁর বিষয়ে লিখেছেন। আমার ছাত্র-ছাত্রীর বাবা প্রভু গুহঠাকুরতার ছোট ভাই, তিনি বুদ্ধদেব বসুকে ‘বুন্ধুদা’ বলে ডাকতেন। সে সময়ের প্রখ্যাত অভিনেত্রী অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়, কারুর কারুর মতে তিনি ছিলেন সুচিত্রা সেনের চেয়েও বেশি রূপসী এবং উচ্চাঙ্গের শিল্পী, ছিলেন এই পরিবারেরই মেয়ে। আমার ছাত্র-ছাত্রীর মায়ের নাম কৃষ্ণা, তাঁর মতন সুন্দরী ও কমনীয়া নারী আমি সে পর্যন্ত দেখিনি। আমি শুধু গৃহশিক্ষক নই, তাঁর দেওরপোর বন্ধু। সেই সুবাদে তিনি আমার সঙ্গে অতিরিক্ত সুব্যবহার করতেন, কতরকম সরবত ও অনাস্বাদিতপূর্ব মিষ্ট দ্রব্য যে সে বাড়িতে খেয়েছি তার ঠিক নেই। অল্প বয়েস থেকে সেই ছেলেমেয়েদুটিকে বেশ বড় বয়েস পর্যন্ত পড়িয়েছি, একজন সেন্ট জেভিয়ার্স, অন্যজন লোরেটো, সপ্তাহে দু’দিন শুধু বাংলা পড়ানো আমার কাজ। ছেলেটি খুব মেধাবী কিন্তু অত্যন্ত চঞ্চল, খেলাধুলোর দিকেই বেশি ঝোঁক, মেয়েটি নম্র, শান্ত, সেও ভালো সাঁতারু, তার পোশাকি নাম অনুরাধা। একদিন সে বলেছিল, মাস্টারমশাই, আপনার কি কখনও স্টেটসম্যানে ছবি বেরিয়েছে? আমি তখন কিছু লেখালেখি করি। দু’একটা বাংলা কাগজে কখনও সখনও নাম ছাপা হয়। কিন্তু স্টেটসম্যানের মতন উচ্চ ভুরু কাগজ আমার মতন অকিঞ্চিত্বর লেখককে পাত্তা দেবে কেন? অনুরাধা গুহঠাকুরতা সর্বভারতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় একটি বিষয়ে প্রথম হওয়ায় তার ছবি ছাপা হয়েছিল স্টেটসম্যান পত্রিকায়! মাস্টারের চেয়ে ছাত্রীর খ্যাতি অনেক বেশি।

এই বাড়িতে টিউশানি নেওয়ার পরই আমার ভাগ্য খুলে যায় যাকে বলে। অনুরাধা বাংলায় ভালো রেজাল্ট করতেই তার বান্ধবীদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়, তাদেরও একজন বাংলার টিচার চাই, এবং আমাকেই চাই! কারণ, আমার যোগ্যতা প্রমাণিত হয়ে গেছে। সবই ধনী পরিবারের ফুটফুটে চেহারার বুদ্ধিমতী মেয়ে, ইংরিজিতে তুখোড়, বাংলায় খুব কাঁচা। আমার এক মামিমার ছোট বোনকেও পড়াতে যেতে হত বরানগরে, মেয়েটির নাম নূপুর, সে তার নামের বানানও ভুল করে, কোষ্টা হ্রস্ব-ই, কোন্টা দীর্ঘ-ঈ মনে রাখতে পারে না। আমি তাকে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের দু’লাইন গাইতে শিখিয়ে দিই: ‘রাজার পুরে তমাল গাছে/নূপুর শুনে ময়ূর নাচে’, এতে রবীন্দ্রনাথ এমন সুর দিয়েছেন যে নূপুর বানান সবাইকে শিখিয়ে ছাড়বেনই, নূ-উ-উ-উ পুর! আর একটি মেয়েকে সবাই আল্লা বলে ডাকে, অনেকদিন পর আমি তার ভালো নাম জেনে স্তম্ভিত! জাতবেদাঃ! অর্থাৎ তার বাবা-ঠাকুর্দাদের কেউ সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন নিশ্চিত, সেই মেয়ে নিজের নামের মানে তো জানেই না, ঝঞা, বাতায়ন এইসব শব্দও তার কাছে দুর্বোধ্য। আলা অবশ্য পরে ভালো বাংলা শিখেছিল নিজেরই উৎসাহে এবং নামকরা ইংরিজির অধ্যাপিকা হয়েছিল।

এই সময় কয়েক বছর আমি শুধু সুন্দরী ধনীকন্যাদের পড়াই, তাও শুধু বাংলা, এবং মাইনেও ভালো। বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই যে আমাকে এজন্য হিংসে করবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! কিন্তু আমি যে বস্তির ছেলেকে দশ টাকা মাইনে থেকে শুরু করেছি, তা কেউ মনে রাখতে চায় না। মাস্টার হিসেবে আমি ভালো এবং খারাপ দুই-ই! অর্থাৎ পড়ানোতে ফাঁকি দিই না, হাজিরায় ফাঁকিবাজ! সুন্দরী মেয়েদের চেয়েও বন্ধুদের প্রতি টান তখন বেশি। ততদিনে কৃত্তিবাস পত্রিকাকে কেন্দ্র করে কফি হাউসে প্রতি বিকেলেই তুমুল আড্ডা জমে, তার মাঝখান থেকে টুক করে উঠে আমাকে টিউশানিতে যেতে হয়, এক একদিন কিছুতেই যেতে মন চায় না, সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়েও কেউ যেন ঘাড় ধরে টেনে আনে। কখনও কখনও পুরো সপ্তাহই অনুপস্থিত, এবং তার কারণ হিসেবে কত যে মিথ্যে গল্প বানিয়েছি। যে-ঠাকুমাকে চোখেই দেখিনি, তাঁর মৃত্যু বর্ণনা, এক মামাকে কামড়েছে পাগলা কুকুর, আমার পায়ে বইয়ের র্যাক ভেঙে পড়েছে বলে সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটার অভিনয়… কৃষ্ণা গুহঠাকুরতা এইসব কাঁচা মিথ্যে অম্লান বদনে বিশ্বাস করতেন। কিংবা তিনি এতই সহৃদয় ছিলেন যে ওই সব গল্প যে মিথ্যে তা বুঝে ফেলেও আমার নকল বিপদগুলির জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করতেন, ঘুণাক্ষরেও কখনও আমার প্রতি বিরাগের ভাব দেখাননি।

অনুরাধা একদিন আমাকে দারুণ উৎকণ্ঠায় ফেলে দিয়েছিল। ওরা সবাই মিলে মাঝে মাঝেই বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে বেড়াতে যায়, ‘কবিতা ভবন’, ২০২ রাসবিহারী অ্যাভেনিউ কাছেই। একবার অনুরাধা আমাকে বলল যে, কাল এ বাড়িতে গিয়ে সে বুদ্ধকাকাকে আমার কথা বলেছিল। তারপর চুপ। বুদ্ধদেব বসুর কাছে আমার নাম বলেছিল, কী কী উত্তর দিলেন তিনি? চিনতে পেরেছেন? এর মধ্যে কবিতা পত্রিকায় ডাকে পাঠানো আমার দু’তিনটি কবিতা ছাপা হয়েছে, সম্পাদককে চাক্ষুষ দেখিনি। কত তরুণ কবিরই তো রচনা ছাপা হয়, সবার নাম কি সম্পাদকের খেয়াল থাকে? বুদ্ধদেব বসু যদি আমায় চিনতে না পারেন, তা হলে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আমার সম্মান কমে যাবে না? কৌতূহল দমন না করতে পেরে ছাত্রীটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কী বললেন? কী বললেন? ছাত্রীটি জানাল যে সে বুদ্ধদেব বসুকে বলেছিল, আমার মাস্টারমশাই একজন কবি। নাম শুনে বুদ্ধদেব বসু খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বলেছিলেন, হ্যাঁ, আমার কাগজে লিখেছে, অনেকদিন লেখা পাঠায়নি তো, পাঠাতে বলো।

বুদ্ধদেব বসু আমার নাম শুনে চিনতে পেরেছেন, এর চেয়ে বড় আনন্দ যেন আর হয় না! সারা শরীরময় উত্তেজনা। বাড়ি ফেরার পথে অনবরত জপ করেছি, উনি আমাকে চেনেন, আমাকে চেনেন, তা হলে আমি একেবারে এলেবেলে নই!

কলেজে ওঠার পর অনুরাধা আমাকে প্রায়ই চুপি চুপি অনুরোধ করত, আপনি তো কত গল্প লেখেন, একটা লেখার নায়কের নাম রাখবেন সিদ্ধার্থ! কেন ওই নাম রাখতে হবে, কাহিনীটা কী, তা সে কিছুতেই বলবে না। বোঝাই যায়, ওই নামের এক যুবকের সঙ্গে তার বেশ প্রণয় হয়েছে, কিন্তু বাড়িতে সে কথা প্রকাশ করা যাবে না। তার অনুরোধে আমি সত্যিই ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’উপন্যাসের নায়কের নাম সিদ্ধার্থ রেখেছিলাম, শুধু নামটাই, কাহিনীর কোনও মিলই নেই। আসল সিদ্ধার্থের সঙ্গে, দুই পরিবারের কিঞ্চিৎ আপত্তি প্রশমিত হলে, যথাসময়ে অনুরাধার শুভ পরিণয় হয়, তারা দু’জনেই এখন আমাদের পারিবারিক বন্ধু।

পনেরো

দশম শ্রেণীতে অভীক্ষার পর বিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঘুচে যায়। ‘অভীক্ষা’ শব্দটির কি মানে বোঝা গেল? যাকে বলে টেস্ট পরীক্ষা। অভীক্ষা শব্দটি খটোমটো মনে হলে টেস্ট-এর বদলে যাচাই পরীক্ষা’ বলা যেতে পারে। কিন্তু তা কি কেউ বলবে? ক্লাস টেনের বদলে দশম শ্রেণীও প্রায় কেউ মুখে বলে না। কেন আমরা এত ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করি? সারা ভারত ঘুরে দেখেছি, অন্য আর কোনও রাজ্যের মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষায় এমন বেশি ইংরিজি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটায়নি। অন্য ভাষা থেকে শব্দ আহরণ করলে ভাষা প্রগতিশীল হয়, তা অবশ্যই মান্য, ইংরিজি ছাড়াও আরবি-ফার্সি, পোর্তুগিজ-ফরাসি এমনকী গ্রীক শব্দও আমরা প্রচুর গ্রহণ করেছি, কিন্তু নিজের ভাষার প্রচলিত শব্দগুলিকে হটিয়ে দিলে তো শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবার বদলে সঙ্কুচিত হতেই থাকে ক্রমশ। কৃত্রিম বা কষ্টকল্পিত বা উচ্চারণে অসুবিধাজনক পরিভাষা ব্যবহার করার বদলে অন্য ভাষার পরিচিত শব্দ অবশ্যই ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন আমি হাইড্রোজেন, অক্সিজেন রেখে দেওয়ার পক্ষপাতী, কিন্তু রেজাল্টের বদলে ফলাফল, পাস-এর বদলে উত্তীর্ণ, ইত্যাদি চালু না রাখলে যে এসব শব্দ হারিয়ে যাবে এক সময়। অনেক প্যান্ট-পরা বাঙালি লোকসমক্ষে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে স্ত্রী বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়, বলে আমার ওয়াইফ কিংবা আমার মিসেস।

ইস্কুল শব্দটি দিব্যি বাংলা হয়ে গেছে, বিদ্যালয়ের পাশাপাশি চলতে পারে, বাংলা কথার মধ্যে স্কুল-এর বদলে ইস্কুল শুনতে বেশি মিষ্টি লাগে। আমার ইস্কুল-জীবন শেষ হয়ে এল। ইস্কুল থেকে কয়েকজন অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে সঞ্চয় করেছি, যাদের সঙ্গে সম্পর্ক থেকেছে আজীবন, তা ছাড়া স্কুল জীবনে আমার তেমন কোনও সুখ-স্মৃতি নেই। কয়েকজন শিক্ষকের কথা মনে দাগ কেটে আছে, তাঁদের মধ্যে একজনের নাম কালীকান্ত গৌতম, ইনি আমাদের সংস্কৃত পড়াতেন৷ ধুতি-ফতুয়া ও বিদ্যাসাগরী চটি পরা দীর্ঘকায় পুরুষ, মাথায় মোটা টিকি, কথা বলতেন কৌতুকের সুরে। অসাধারণ এঁর স্মৃতিশক্তি, কোনও নতুন ছাত্রের নাম ও বাবার নাম শুনেই ইনি জাদুকরের মতন গড়গড় করে বলে দিতেন তার বংশপরিচয়। বাংলার ইস্কুল থেকে সংস্কৃত-পণ্ডিতদের এই প্রজাতিটি এখন লুপ্ত হয়ে গেছে। তার ফল কি ভালো হয়েছে? দেবনাগরী লিপি রপ্ত করায় আমি হিন্দি পড়তে পারি অনায়াসে, গৌতমবাবু যেটুকু সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন, তার সুফল এখনও অনুভব করি।

একটি মজার অভিজ্ঞতার কথা বলে ইস্কুল-পর্ব শেষ করা যেতে পারে। উঁচু শ্রেণীর ছাত্রদের ওপর সরস্বতী পুজোর ভার, সেবারে শুক্রবার পুজো বলে টানা তিনদিন ছুটি, আমরা ঠিক করলাম, শেষ দিকে একটি নাটকের অভিনয় করা হবে। পূর্ণাঙ্গ নাটক, শচীন সেনগুপ্ত-র ‘সিরাজদৌল্লা’, তখন খুবই জনপ্রিয়। রেকর্ডে নির্মলেন্দু লাহিড়ির কাঁপা কাঁপা গলায় ঘাতকের সামনে সিরাজের শেষ আবেদন শুনে চোখে জল আসে না, এমন পাষণ্ড কে আছে? নামভূমিকাটি আমাকে কেন দেওয়া হয়েছিল, তা ঠিক মনে নেই। অন্য বন্ধুদের তুলনায় কবিতা আবৃত্তি করায় কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা ছিল আমার। লুৎফুন্নেসা সাজতে কি কেউ রাজি হয়েছিল? সম্ভবত, স্ত্রী-ভূমিকা বর্জিত কিশোরদের উপযোগী কোনও সংস্করণ পাওয়া যেত ওই নাটকটির। সবচেয়ে ভালো মানিয়েছিল আমার বন্ধু ভাস্কর দত্তকে, লর্ড ক্লাইভের ভূমিকায়। বনেদি বাড়ির ছেলে ভাস্করের গায়ের রং একেবারে সাহেবদের মতন। সিরাজদৌল্লা’রও গায়ের রং ফর্সা হবার কথা, আমার কুচকুচে কালো মুখখানায় জিংক অক্সাইড মাখিয়ে সাদা করার চেষ্টা হয়েছিল।

আমার অভিনয় জীবন কণ্টকাকীর্ণ ও বিয়বহুল। শিশু বয়েসে আমগ্রামে মামার বাড়িতে রান্নার ঠাকুরদের যাত্রা পালায় কৃষ্ণ সেজে আছাড় খাওয়ার কথা আগেই লিখেছি, এবারের ব্যর্থতা আরও বিরাট, এত মুখস্থ করা, এত মহড়া সবই গেল বিফলে। অনেক স্কুলের মতন টাউন স্কুলেরও কোনও হল নেই, একতলায় নিচু শ্রেণীগুলি কাঠের অস্থায়ী দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা, সরস্বতী পুজো কিংবা পুরস্কার বিতরণীর মতন উৎসবে সেই কাঠের দেওয়ালগুলি সরিয়ে দেওয়া হয় এক পাশে। নাটক অভিনয়ের জন্যও সেইভাবে হল তৈরি করা হয়েছে, দর্শকদের জন্য বেঞ্চি পাতা, এক পাশে তৈরি হয়েছে মঞ্চ, সবই নিজেদের উদ্যোগে, মাস্টারমশাইদের কোনও সাহায্য বা পরামর্শও নেওয়া হয়নি। টিকিটের কোনও ব্যাপার নেই, ছাত্ররাই দেখবে। সেখানেই হয়েছিল আসল ভুল।

ঐতিহাসিক নাটকের পোশাক ভাড়া পাওয়া যায়, সেগুলি অবশ্য বয়স্ক অভিনেতাদের জন্য, আমাদের গায়ে ঢল ঢল করে, নানা জায়গায় সেফটি পিন দিয়ে আঁট করা হল, মুখে রং মেখে, সেজেগুজে শুরু হল নাটক। অভিভাবকদের আমন্ত্রণ করা হয়নি, দর্শকদের বয়েসের গড় এগারো। বেঞ্চের জায়গা দখল নিয়ে তারা চেল্লামেল্লি করছে, একজন মাস্টারমশাই মাঝে মাঝেই সাইলেন্স, সাইলেন্স বলে ধমক দিয়ে তাদের থামাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন, কেউ কেউ পরামর্শ দিল, নাটক শুরু হলেই গোলমাল থামবে। কিন্তু থামল না, বাইরে থেকে আরও কিছু ছেলে ঢুকে পড়ল, তাদের বসবার জায়গা নেই। আরও অনেক ছাত্র ঠেলাঠেলি করছে ঢোকার জন্য! বেঞ্চগুলিতে বসবার জায়গা বড়জোর আড়াইশো-তিনশো জনের, স্কুলের ছাত্রসংখ্যা এক হাজারের বেশি, আমাদের নাটক দেখার জন্য তারা সবাই এসে পড়েছে? আমরা সংলাপ বলছি, কিন্তু বাচ্চাদের চ্যাঁচামেচি, হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলিতে কিছুই শোনা যাচ্ছে না! কয়েক মিনিট পর সিরাজদৌল্লা স্বয়ং নাটকের সংলাপের বদলে চোখ পাকিয়ে বলল, অ্যাই, সব চুপ! লর্ড ক্লাইভ তলোয়ার তুলে খাঁটি উত্তর কলকাতার উচ্চারণে বাংলায় বলল, বাচ্চারা চুপ করে বোস, নইলে প্যাঁদানি খাবি! তাতেও কোনও ফল হয় না, বাইরে থেকে আর একটি ঢেউ পেছন দিকে এমন প্রবল ধাক্কা মারল যে সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ছেলে আছড়ে পড়ল মঞ্চের গায়ে, পরবর্তী লণ্ডভণ্ড কাণ্ডে এক পাশে হেলে পড়ল নড়বড়ে মঞ্চটি। এরপর উপায়ান্তর না দেখে সিরাজদৌল্লা, মিরজাফর, লর্ড ক্লাইভ প্রমুখের একসঙ্গে পলায়ন! আসল ইতিহাসে, ১৭৫৭ সালে গণ-অভ্যুত্থানে যদি এমন ব্যাপার ঘটত, তা হলে কী ভালোই না হত। বলাই বাহুল্য, আমাদের নাট্যপ্রয়াসের সেখানেই করুণ যবনিকা।

আমাদের সময় বিদ্যালয় ত্যাগের পরীক্ষাটির নাম ছিল ম্যাট্রিকুলেশান, সংক্ষেপে ম্যাট্রিক। বহু বছর ধরে যত ছাত্র ম্যাট্রিক পাশ করেছে, তাদের অধিকাংশই এই শব্দটির মানে জানে না। এর মানে, প্রবেশিকা, অর্থাৎ যে-পরীক্ষা পাশ করলে বিদ্যালয় ছেড়ে মহাবিদ্যালয়ে (স্কুল ছেড়ে কলেজে) প্রবেশের অধিকার পাওয়া যায়। সবাই বলত, এই পরীক্ষাটাই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা, সুকুমার রায়ের কবিতার সৎপাত্রটি উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামলো শেষে’! আমরা পঞ্চাশের ব্যাচ, তার দু বছর বাদেই ম্যাট্রিক উঠে যায়, তারপর স্কুল ফাইনাল, সেকেন্ডারি, হায়ার সেকেন্ডারি নামে নানারকম পরীক্ষা চলেছে।

যাচাই পরীক্ষা ও চূড়ান্ত পরীক্ষার মাঝখানে আড়াই মাসের মতন সময় পাওয়া যায়। প্রথা হচ্ছে, এই আড়াই মাস অধ্যয়নকেই তপস্যা করতে হবে ছাত্রদের, অধ্যয়ন শুধু পাঠ্যপুস্তকের, অ-পাঠ্য অর্থাৎ গল্পের বই ছোঁওয়া পাপ, বাড়ি থেকে বেরোনো চলবে না, বন্ধুরা বাড়িতে আসবে, সিনেমা-থিয়েটার দেখার চিন্তাও নিষিদ্ধ। আমাকে অবশ্য টিউশানির জন্য বাড়ির বাইরে বেরোতেই হত, আর জল বিনা মীনের মতন গল্পের বই ছাড়া আমার পক্ষেও বেঁচে থাকা দুষ্কর। বাবার ভয়ে পড়ার বইয়ের তলায় গল্পের বই রেখে পড়েছি কতদিন। ইংরেজি পরীক্ষার আগের রাতে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুষ্কোণ’ উপন্যাসটি শেষ করেছিলাম, স্পষ্ট মনে আছে। তখন একটি কিশোরীর সঙ্গে আমার ভাব-ভালোবাসা হয়ে গেছে, দু’এক দিন অন্তর তাকে অন্তত এক পলক না দেখলে যে জীবন উষর হয়ে যায়। মেয়েটির একটি নাম থাকা দরকার। তার নাম অপর্ণা। ভাব-ভালোবাসা মানে কী, কোনও প্রেমের কথা হয়নি। তখনও শরীর ছোঁয়াছুঁয়ির কথা মনে আসেনি। বিরলে মুখোমুখি বসারও সুযোগ নেই, শুধু অনেক লোকের মাঝখানেও হঠাৎ চোখাচোখি, সে রকম দৃষ্টি মাত্র একজনের জন্যই সংরক্ষিত, যেন মুহূর্তে দুজনের চোখের মাঝখানে তৈরি হয়ে যায় এক অদৃশ্য সেতু, তা দিয়ে যাতায়াত করে অব্যক্ত ব্যাকুলতা।

বয়েসে আমার থেকে মাত্র এক বছরের ছোট, অপর্ণা সেই বয়েসেই পাগলের মতন কবিতা পড়ে। মাঝে মাঝেই সে এমন কবিতার লাইন বলত, যা আমার অজানা। কখনও রবীন্দ্রনাথ থেকে দু’ পঙক্তি উদ্ধৃতি দিয়ে জিজ্ঞেস করত, এর পরে কী বলো তো? আমি হেরে যেতাম প্রায়ই। অপর্ণা যদি খেলোয়াড়দের ভক্ত হত, আমি নিশ্চিত খেলায় মন দিতাম, যদি গায়কদের পছন্দ করত, আমি গলা সাধতাম, তাকে খুশি করার একমাত্র উপায় নতুন কোনও কবিতা মুখস্থ বলা, তাই আমার কবিতা পাঠ শুরু হল নতুন উদ্যমে।

ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতার কারণে অনেক দিন স্কুল বন্ধ ছিল বলে দু’-এক বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উদারভাবে নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রায় সকলকে। তখন সবাই বলত, সাতচল্লিশের ম্যাট্রিকে গোরু-ঘোড়া, চেয়ার-টেবিলও পাশ করে গেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী বছরগুলিতে পরীক্ষা বেশি কঠোর হয়। আমাদের বারে অঙ্ক প্রশ্নপত্রের চেহারাটাই ছিল ভয়াবহ। যাই হোক, পরীক্ষা তো শেষ হল। এবার?

আগের আড়াই মাস যেমন বাড়িতে থাকার কড়াক্কড়ি, পরীক্ষা ও ফল প্রকাশের মাঝখানের তিন মাস তেমনই যথেচ্ছ স্বাধীনতা। এখন যেমন জয়েন্ট এন্ট্রান্স কিংবা বিভিন্ন কলেজে ভর্তির জন্যও পরীক্ষা দিতে হয়, তাই এই ছুটিতেও ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, তখন সে সব বালাই ছিল না, কলেজগুলোই ছাত্র-ছাত্রীদের নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে ডাকাডাকি করত। এই ছুটিতেই ছেলে-মেয়েরা কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়, দুটি করে ডানা গজায়, মুখের ভাষারও বদল হয় খানিকটা। আমার বেলায় হল তার বিপরীত, বাবার কড়া নির্দেশ, দুপুরবেলা কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরোনো চলবে না, এবং বিকেলে খেলাধুলো করতে গেলেও বাড়ি ফিরতে হবে শেষ সূর্যের আলো গায়ে মেখে, বাইরে রাত্রি ছোঁয়া নিষেধ। বাবার ধারণা, পড়াশুনোহীন এই সময়টাতেই ছেলেদের মাথায় শয়তানের কারখানা চালু হয়। বাবার নির্দেশ অমান্য করার সাহস আমার ছিল না, বাঙাল পরিবারের অধিপতিদের অনায়াসে হিটলারের সঙ্গে তুলনা দেওয়া যেত। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবা দুপুরবেলা বাড়িতে থাকেন, পালাবই বা কী করে।

শুধু বাড়িতে আবদ্ধ থাকাই যথেষ্ট নয়। কী করে যেন একখানা টেনিসনের কাব্যসমগ্র বাড়িতে ছিল। বাবা আদেশ দিলেন, প্রতিদিন তার থেকে দুটি কবিতা আমায় অনুবাদ করতে হবে। এটা কাব্য চর্চার জন্য নয়, আমাকে ইংরিজি শেখাবার প্রয়াস। কী কষ্টই যে হত তখন, সেই সব দুপুরে বন্ধুরা সিনেমা দেখার জন্য লাইনে দাড়িয়েছে, কিংবা তাস খেলছে, কিংবা অন্য কোনও বন্ধুর বোনের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করছে, আর আমি এক হতভাগ্য বন্দি, নির্জন দুপুরে এক প্রায়ান্ধকার কারাকক্ষে বসে ইংরিজি শব্দের মানে খুঁজছি। বাবাকে তো কিছু বলতে পারি না, মনে মনে টেনিসনকেই অভিশাপ দিতাম। এই কবিটা জন্মেছিল কেন, কে ওকে এইসব খটোমটো কবিতা লেখার মাথার দিব্যি দিয়েছিল? এই বইখানাই বা আমাদের বাড়িতে এতদিন টিকে রইল কী করে?

কিছুদিন পর খানিকটা নিষ্কৃতির উপায় খুঁজে পেলাম। একমাত্র গ্রীষ্মের ছুটিতেই বাবা বিশ্রাম পেতেন, দিবানিদ্রা দিতেন। তিনি ঘুম থেকে ওঠামাত্র খাতাটা বাড়িয়ে দিতাম, আমার অনুবাদের অপপ্রয়াস দুটি দেখে ছাড়পত্র দিলেই আমি ছুট লাগাতাম রাস্তার দিকে। দিন দশেক পরে লক্ষ করলাম, সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে বাবা আর অনুবাদের প্রতিটি শব্দ মিলিয়ে দেখেন না, এক পাশে টেনিসনের বইয়ের পৃষ্ঠা খোলা, অন্য পাশে আমার খাতা, দু দিকে চোখ বুলিয়ে মূল কবিতা ও অনুবাদের আকার সমান হলেই তিনি সন্তুষ্ট হয়ে টিক মেরে দেন। তা হলে আর আমার কষ্ট করে ইংরিজি বাক্যের অর্থ বোঝার পরিশ্রম করার দরকার কী? ওপরে টেনিসনের একটি আঠেরো লাইনের কবিতার শিরোনাম লিখে তলার আঠেরো লাইন নিজে বানালেই তো হয়! সেইভাবেই দিব্যি পাশ করে যেতে লাগলাম। নিজে যেগুলো বানাই, তা অনেকটা কবিতা কবিতাই শোনায়, ছন্দ মিল দিতে অসুবিধে হয় না। এরকম হাত পাকাতে পাকাতে একদিন লিখে ফেললাম একখানা প্রেমের কবিতার মতন কিছু একটা, কোনও নারীর প্রতি স্বগতোক্তি বা চিঠি। অবশ্যই অপর্ণা নামী সেই কিশোরীর উদ্দেশে। দুঃখ থেকেই তো কবিতার জন্ম, আমারও সেই বন্দিদশা থেকেই কবিতা উৎসারিত হয়েছিল।

কিন্তু সেটা সত্যিই কবিতা পদবাচ্য হয়েছে কি না বুঝব কী করে? কোনও বন্ধুকে পড়ে শোনাবার প্রশ্নই ওঠে না, তারা হাসি মস্করা করবে। অপর্ণাকে পড়াবার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ নেই, প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে গোপনে চিঠি চালাচালির নানা রকম কায়দা আছে তা পরে জেনেছি, সে সময় আমার মাথায় ওসব আসেনি, অপর্ণার সঙ্গে নিভৃতে দেখা হয় না, তা ছাড়া পদে পদে ভয়, সবচেয়ে বেশি ভয় সেই মেয়েটিকেই, তার প্রতি হৃদয়-দুর্বলতার কথা তো কখনও প্রকাশ করিনি, সে-ও করেনি, শুধু আলাদা চোখে তাকায় মাত্র, যদি আমার এরকম প্রগলভতা দেখে সে রাগ করে? কয়েক মাস পরে একটি উপায় মাথায় এল। আমাদের বাড়িতে একটি খবরের কাগজ ছাড়া অন্য পত্র-পত্রিকা রাখা হয় না, ওদের বাড়িতে ‘দেশ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা দেখেছি। সেই পত্রিকায় গদ্য রচনাগুলির তলায় মাপ মতন পদ্য ছাপা হয়, অপর্ণা সেগুলিও পড়ে। কারা লেখে ওই সব পদ্য? পত্রিকাটির ঠিকানা দেখে একদিন খামে ভরে পাঠিয়ে দিলাম আমার সেই কবিতাটি, নাম দিলাম ‘একটি চিঠি’। কবিতা রচনা করে কোনও রকম যশোকাঙক্ষা তখনও আমার মস্তিষ্কে স্থান পায়নি, ওরকমভাবে ডাকে পাঠালে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতনামা কারও রচনা ছাপা হয় কি না, সে সম্পর্কেও আমার কোনও ধারণা ছিল না। সাময়িক উত্তেজনা প্রশমিত হলে সেটার কথা ভুলেই গেলাম। বেশ কয়েক মাস পরে আমার নামে একটি বড় খাম দিয়ে গেল পোস্টম্যান, তার মধ্যে একটি ‘দেশ’ পত্রিকা, এবং কিমাশ্চর্যম অতঃপরম, সূচিপত্রে জ্বলজ্বল করছে আমার নাম, কোনও একটি পৃষ্ঠার পাদদেশে অবিকৃতভাবে মুদ্রিত হয়েছে আমার সেই প্রেম-উচ্ছাস! ছাপার অক্ষরে সেই প্রথম আমার নাম ও রচনার প্রকাশ।

যাকে উদ্দেশ করে লেখা, সে কবিতাটি পড়লও বটে, যেহেতু আমি তাকে কিছুই বলিনি, তাই সে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি যে সেটি আমার রচনা, আমাকে বলেছিল, দ্যাখো দ্যাখো, তোমার সঙ্গে নাম মিলে গেছে একজন নতুন কবির! শুধু ওইটুকুই, কবিতাটি ভালো না মন্দ, সে সম্পর্কে কোনও মন্তব্য নেই।

ছাপার অক্ষরে সেই স্বীকৃতি দেখে আমার বুক ধকধক করেনি, প্রবল উল্লাসে ফেটে পড়তে বা পাগলের মতন নাচতে ইচ্ছে করেনি। তবে, পত্রিকাটি হাতে পেয়ে আমার আবার কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়েছিল। তত দিনে বন্দিদশা ঘুচে গেছে, টেনিসন পর্ব চুকে গেছে, অনুবাদের নামে ছলনা করার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, তবু যে লিখতে ইচ্ছে হল, তার কারণটি অতি সরল, একটি কবিতা ছাপা হলে একটি পত্রিকা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। দেশ’ পত্রিকায় সে সময় নবীন কবিদের জন্য সম্মান-দক্ষিণা চালু হয়নি, সে সব জানতামও না। একটি পত্রিকা পাওয়াই তো যথেষ্ট। আবার একটি পাঠালাম ‘দেশ’ পত্রিকায়, তখন ‘অগ্রণী’ নামে একটি মাসিক প্রকাশিত হত নিয়মিত, তাতে একটি কবিতা পাঠিয়ে পেয়ে গেলাম পত্রিকা। এমনকী আমার জীবনের চতুর্থ কবিতাটি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় পাঠাবার তিনদিনের মধ্যে মননানয়ন পত্র পেয়ে হতবাক! তারপর থেকে যাকে বলে, এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে?

ম্যাট্রিক পরীক্ষায় আমার বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র দীপক মজুমদার ছাড়া আর কেউই অকৃতকার্য হয়নি। অথচ দীপকই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। সে অনেক আগে থেকেই কবিতা লেখে ও ছাপা হয়, প্রবন্ধও লিখে ফেলেছে, সব সময় তার হাতে থাকে মোটা মোটা বই, বহু নাম-ডাকওয়ালা লেখকদের সঙ্গে তার ঘোরাফেরা, গোপাল হালদার বা বিনয় ঘোষের মতন যে সব সুদূরের মানুষদের আমি চোখেও দেখিনি, তাদের দীপক যথাক্রমে সম্বোধন করে গোপালদা ও বিনয়দা, শান্তিদেব ঘোষ নামক রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধারক তার শান্তিমামা। দীপক ম্যাট্রিকে ফেল করেছিল বলে কেউ তার প্রতি সামান্য অবজ্ঞা বা করুণা দেখায়নি, বরং তা সত্ত্বেও সে সকলের চোখে হীরো। কারণ, দীপক-এর মধ্যে একবার জেল খেটেছে! সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি থেকে নানা রকম প্রতিরোধ আন্দোলন চলছে, স্কুলের ছাত্র হয়েও দীপক তারই কোনও একটিতে সামিল হয়ে জেলে চলে যায়। সেটা আমাদের কাছে রীতিমতো ঈর্ষণীয় ব্যাপার! কত বড় বড় নেতার সঙ্গে জেলের মধ্যে সাক্ষাৎ পরিচয় হয়েছে তার। এ রকম একটা বিরাট কাজ যে করেছে তার পক্ষে ম্যাট্রিক পরীক্ষা নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার! প্রায় কিছু না পড়েই সে পরীক্ষায় বসেছিল, যেন খেলাচ্ছলে, পাশ না করলেও কিছু আসে যায় না। রাজনৈতিক বন্দিদের বিশেষ মর্যাদা। জেল থেকে বেরোবার সময় তার হাতে নতুন সুটকেস ও চমৎকার একটি কম্বল, আমরা তার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছিলাম। দীপক মেধাবী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও বাকপটু। কিন্তু স্কুলের পড়ায় তার একেবারেই মন ছিল না, প্রথমবার ম্যাট্রিক পাশ না করেও সে দমেনি, পরের বছরও ফেল করেছিল। দীপক স্কুলে আমার সহপাঠী হলেও পরে দু’ বছর পিছিয়ে যায়। আসলে স্কুলপাঠ্য বিষয় থেকে দীপক অনেকখানি এগিয়ে ছিল, অষঙ্কট নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাতে চায়নি, পরবর্তীকালে কলেজে এসে কলা বিভাগে সে সাবলীল হয়ে যায়।

অন্য বন্ধুরা যখন বিভিন্ন কলেজের ফর্ম আনার জন্য ব্যস্ত, তখন আমার মাথায় বজ্রাঘাত হল। বাবা বললেন যে আমার আর কলেজে পড়ার দরকার নেই, এখন চাকরির চেষ্টা করা দরকার, শর্টহ্যান্ড ও টাইপ রাইটিং শিখলে বরং কাজে দেবে। বাবা ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন, ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন ভেতরে ভেতরে, সংসারের রাশ আর টানতে পারছিলেন না এবং অনেক দুঃখ থেকেই যে এই কথা বলেছিলেন, তা বোঝার মতন মানসিকতা তখন আমার ছিল না। সেই বয়েসের ছেলেরা নিজের কথাই বেশি ভাবে, পরিবারের লোকজনের চেয়ে বন্ধু-বান্ধবরা বেশি আপন হয়, বহির্বিশ্ব চুম্বকের মতন টানে। বন্ধুরা কলেজে পড়তে যাবে, আর আমি যাব চাকরি করতে? কলেজ মানেই তো স্বাধীনতা, তা থেকে আমি বঞ্চিত হব? স্কুলের শেষ দিক থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতাম কলেজের। নিশ্চয়ই খুব কান্নাকাটি করেছিলাম এবং কাকুতিমিনতি করেছিলাম মায়ের কাছে। মা’র প্রশ্রয়ে বাবা শেষ পর্যন্ত কলেজে ভর্তি করাতে রাজি হলেন কিন্তু এক শর্তে, বিকেলবেলা শর্টহ্যান্ড ও টাইপ রাইটিংও শিখতে হবে, এবং যদি কোনও চাকরি জুটে যায়, তা হলে আর কলেজীয় পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়া হবে না, কারণ পড়াশুনো তো চাকরির জন্য। আমার ক্ষেত্রে যে কোনও চাকরি।

এর পর কলেজ নির্বাচনের প্রশ্ন। স্বাভাবিকভাবেই আমার প্রথম পছন্দ প্রেসিডেন্সি কলেজ। সে আবেদন এক বাক্যে নাকচ করে দেওয়া হল, কারণ সেখানে ছেলেরা মেয়েরা একসঙ্গে পড়ে! প্রেসিডেন্সি কলেজের এই অযোগ্যতার কথা শুনে এখনকার ছেলেমেয়েরা হাসবে। আমি সে কলেজের ফর্মও এনে রেখেছিলাম, ভর্তির অন্য কোনও অসুবিধেই ছিল না। তখনকার দিনে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কত কম ছিল, তা বোঝাবার জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট, প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীর ফলাফল ছাপা হত খবরের কাগজে! প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া অনেক বন্ধু ও পরিচিতজন এখনও খানিকটা গর্বের সুরে কথা বলে, আমি যে কেন সে কলেজে পড়তে পারিনি, সে কারণটা জানাতে পারি না। বাড়ির খুব কাছে স্কটিশচার্চ কলেজ, সে কলেজেরও ওই একই দোষ। শেষ পর্যন্ত সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ব্যবস্থা হল, যার ধার কাছ দিয়েও মেয়েরা হাঁটে না।

এখনকার ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাক্রম সম্পর্কে অভিভাবকরা আগে থেকেই নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে রাখেন, ছেলে-মেয়েদেরও নিজস্ব মতামত গড়ে ওঠে। আমার শিক্ষার ব্যাপারে বাবা কোনও পরিকল্পনা করেননি, আমার মতামতেরও মূল্য দেননি। সেজন্য তিনি আমার ছাত্রজীবন নষ্ট করে দিয়েছেন। আমার কলেজ জীবন পুরোপুরি ব্যর্থ। প্রবেশিকা পরীক্ষায় আমার ইংরেজি ও বাংলায় বেশ ভালো নম্বর ছিল, অঙ্কে বেশ কম, অর্থাৎ কলা বিভাগই আমার পক্ষে স্বাভাবিক পছন্দ হওয়া উচিত, কিন্তু বাবা আমাকে ভর্তি করে দিলেন বিজ্ঞানে। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও অঙ্ক, চতুর্থ বিষয় জীব-উদ্ভিদ বিদ্যা। প্রথম তিনটিতে প্রচুর অঙ্ক লাগে৷ সিটি, বিদ্যাসাগর কলেজের তুলনায় সুরেন্দ্রনাথ কলেজে নাকি বিজ্ঞান শাখাটি ভালো পড়ানো হয়। একেই পয়সার টানাটানি, গ্রে স্ট্রিট থেকে শিয়ালদার কাছে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে যেতে গেলে যে দু’বার বাস-ট্রাম বদল করতে হয়, তা বাবা খেয়ালই করেননি আগে।

বন্ধুরা নানা কলেজে ছড়িয়ে পড়ল, শুধু আশু, সম্পন্ন পরিবারের ছেলে, বাড়ির দিক থেকে কোনও আপত্তি নেই, সে প্রেসিডেন্সি-স্কটিশে পড়তে পারত অনায়াসে, তবু সেও সুরেন্দ্রনাথে ভর্তি হল শুধু আমার সঙ্গ ছাড়বে না বলে। আমার জন্য আশু’রও পড়াশুনোর ক্ষতি হয়েছে। আমার সঙ্গে রোজ কলেজে যাবে, এক সঙ্গে ফিরবে, এই ছিল তার ইচ্ছে, সে ব্যাপারেও আমি তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমাকে সুরেন্দ্রনাথ পরিত্যাগ করতে হয় এক বিচিত্র কারণে।

সুরেন্দ্রনাথ কলেজের এক বছরে আমার দুটি সূখকর অভিজ্ঞতা আছে। সেখানকার পড়াশুনোর পরিবেশ মোটেই সুবিধের মনে হয়নি, একগাদা ছাত্র, কে কতটা ফাকি দিচ্ছে তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনও মাথাব্যথা ছিল না, যেমন চলছে চলুক ধরনের মনোভাব প্রকট। সব সময় হই হই রই রই। এরই মধ্যে একদিন এলেন সত্যেন বসু, সমস্ত বিজ্ঞানের ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা দিলেন। সুদর্শন পুরুষ, মাথার চুল ধপধপে সাদা, সঞ্জীবচন্দ্রের ভাষায় ‘প্রসন্নতা ব্যাঞ্জক ওষ্ঠ’, বিজ্ঞান বিষয়ে বক্তৃতা দিলেন পুরোপুরি বাংলায়, একটি ইংরিজি শব্দও ব্যবহার করেননি। এখন অনেকে সত্যেন বসুকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিজ্ঞানী বলছেন, কিন্তু তাঁরা এবং এখনকার বিজ্ঞানীরাও সত্যেন্দ্রনাথের বাংলা ভাষাপ্রীতির কথা উল্লেখ করেন না। আইনস্টাইনের নামের সঙ্গে যুক্ত হবার মতন তত্ত্ব যিনি অবিষ্কার করেছেন, তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে গর্ব বোধ করতেন কত!

আমাদের সময় কলেজের প্রথম দু’বছর বিজ্ঞানে আই এস সি, পরের দু’বছর বি এসসি, কলা বিভাগে যেমন আই এ এবং বি এ। বিজ্ঞান নিলেও অবশ্য ইংরিজি ও বাংলা পড়তে ও পাশ করতে হত। ওই দুই ক্লাসেই ছিল আমার বেশি আকর্ষণ, বাংলা ক্লাসে আমি গোপনে একটি মজা করতাম। অধ্যাপকরা তখন প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে রচনা লিখতে দিতেন, আমাদের লিখতে হত সাধু বাংলায়; তখনও স্কুল-কলেজে চলতি বাংলা গ্রাহ্য হয়নি। সেই সব রচনার ফাঁকে ফাঁকে যে যত বড় বড় লেখকদের উদ্ধৃতি দিতে পারে, তার তত কৃতিত্ব। আট-দশ ছত্র পর পরই, তাই তো কবি বলিয়াছেন’ লিখে কোনও কবিতার কয়েকটি পঙক্তি ছিটিয়ে দিতে হয়। আমি এই সব রচনায় তাই তো কবি রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন’-এর পর যে পঙক্তিগুলি দিতাম, সে সব কবিতা রবীন্দ্রনাথ কস্মিনকালেও লেখেননি। অবিকল রাবীন্দ্রিক ভাষায় ছন্দ-মিল দিয়ে কয়েকটি পর্ভুক্তি বানানো আমার পক্ষে নস্যি, অনর্গল মুখে মুখে বানাতে পারি। আমি দেখতে চাইতাম, কোনও অধ্যাপক আমার এই জালিয়াতি ধরতে পারেন কি না। একজনও ধরতে পারেননি। অগাধ সমুদ্রের মতন রবীন্দ্রসাহিত্যে কোথাও যে এ রকম পঙক্তি নেই, তা ক’জন জোর দিয়ে বলতে পারে?

অঙ্কের তাড়নায় আমি ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি সম্পর্কে ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলাম, কিন্তু বায়োলজি-বোটানির ক্লাস ভালো লাগত, বিশেষত প্র্যাকটিকাল। গাছের পাতা মাইক্রোস্কোপের তলায় রেখে দেখার একটা রোমাঞ্চ আছে। কিছু পোকা ও প্রাণী ব্যবচ্ছেদও করতে হত। সেজন্য বায়োলজিক্যাল বক্স কিনতে হয়েছিল, তা নিয়ে যেতাম কলেজে। জ্যান্ত আরশোলা ও ব্যাঙ কেটেছি অনেক। বড় বড় কোলা ব্যাঙ, ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে তারপর পেট চিরে দেখা। সবচেয়ে আনন্দ হত গলদা চিংড়ি ব্যবচ্ছেদের দিনে। চিংড়ি মাছের দেহতত্ত্ব খুব বিশেষ না জানলেও চলে, এক বন্ধু ফিসফিস করে কানে কানে বলেছিল, কোনও রকম রি-এজেন্ট লাগাস না, মাছটা ফেলিস না। তখন বড় বড় চিংড়ি মাছও নিশ্চিত এত দামি ছিল না, তাই দেওয়া হত প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে, এখনকার ছেলে-মেয়েরা বোধহয় পায় না। আমরা যে যার মাছ কাগজে মুড়ে নিয়ে আসতাম কাছাকাছি এক রেস্তোরাঁয়, সেখানকার মালিককে বলতাম, ভাজা করে দিন তো রতনদা? আমরা মহানন্দে সেই চিংড়ি মাছ ভাজা খেতাম, আর কলা বিভাগের ছেলেরা তাকিয়ে থাকত হ্যাংলার মতন। তখন অবশ্য বুঝিনি যে ওরকম বড় সাইজের কোলা ব্যাঙগুলোও ফেলে দেওয়া উচিত হয়নি। ব্যাঙের ঠ্যাংও দিব্যি ভাজা খাওয়া যায় এবং অতি সুখাদ্য। ব্যাঙের ঠ্যাং ভাজা খেয়েছি অনেক পরে।

ষোলো

উনিশ শো পঞ্চাশ সালে পুনরপি দাঙ্গা শুরু হয় পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে। এবারে উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের সংখ্যা অনেক বেশি। এক সঙ্গে এত মানুষের ঢল নেমে আসে যে তা সামলানো সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ত্রাণ শিবিরের সংখ্যা যৎসামান্য, লক্ষ লক্ষ পরিবার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় উন্মুক্ত আকাশের নীচে, গাছতলায়, রেল স্টেশনে। দেশ ভাগের প্রথম তিন বছরের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় বাষট্টি লক্ষ। এই বাংলাতেও বিক্ষিপ্তভাবে অনেক জায়গায় দাঙ্গা হয়েছে, অনেক মুসলমান এ রাজ্য ছেড়ে চলে গেছে, তবে তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

শিয়ালদা স্টেশন তখন উদ্বাস্তুদের অধিকারে চলে গেছে, কোনও প্ল্যাটফর্মে একটুও পা ফেলার জায়গা নেই, চতুর্দিকে থিক থিক করছে নারী-পুরুষ, বুড়োবুড়ি। শিশুরা প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম সারতে বাধ্য হয় প্রকাশ্যেই, তাদের আহার-নিদ্রা ও অন্যান্য কাজ রেলের নিত্যযাত্রীদের চোখের সামনেই চলে। তাদের প্রায় গায়ের ওপর পা ফেলে নিত্যযাত্রীরা দৌড়য়, আবর্জনা ও দুর্গন্ধে সুস্থ মানুষেরও অসুস্থ হয়ে পড়ার মতো অবস্থা।

সেই সময় অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক হয়ে উদ্বাস্তুদের কিছু সাহায্য করার কাজে যোগ দিয়েছিল, আমিও ছিলাম সেই দলে। রেড ক্রশ থেকে গুঁড়ো দুধ আর রুটি বিলি করার ব্যবস্থা হয়েছিল, সে-দায়িত্ব স্বেচ্ছাসেবকদের। কাজটি কিছুটা বিপজ্জনকও বটে। উদ্বাস্তুদের সংখ্যার তুলনায় সাহায্যের পরিমাণ কখনও যথেষ্ট নয়। আমরা দুধের বালতি কিংবা রুটি ভর্তি ঝুড়ি নিয়ে এগোলেই ক্ষুধার্ত ও মরিয়া উদ্বাস্তুরা ঝাঁপিয়ে পড়ে কাড়াকাড়ি করে, তাতে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক আহতও হয়েছে।

আমি গিয়েছিলাম বয়েস স্কাউটদের সদস্য হিসেবে, খাঁকি হাফ প্যান্ট ও সাদা হাফ শার্ট পরা। ওই অসহায় মানুষগুলির মধ্যে রুটি বিলি করতে করতে আমার এক বিচিত্র অনুভূতি হত। আমি স্বেচ্ছাসেবক হয়েছি পশ্চিমবাংলার নাগরিকদের পক্ষ থেকে, কিন্তু আমি নিজেই তো উদ্বাস্তু। একটু এদিক ওদিকে হলে আমার স্থানও ওদের মধ্যেই হতে পারত। ভাগ্যিস আমার বাবা স্বাধীনতার আগে থেকেই কলকাতায় চাকরি করতেন, এখানে আমাদের মাথা গোঁজার মতন একটা আস্তানা আছে, নইলে আমাদেরও হয়তো শুতে হত এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। মনে প্রশ্ন জাগত, এই অসহায় মানুষগুলির মধ্যে আমাদের কোনও আত্মীয়-স্বজন কিংবা গ্রামের মানুষ কি থাকতে পারে? সকলকে তো চিনি না। যারা আমাকে খুব ছোট দেখেছে, তারাও আমার সদ্য গোঁফ গজাননা মুখ ও লম্বা ঠ্যাং দেখে চিনতে পারবে না। একটি বুড়ি একেবারে হাত জড়িয়ে ধরে ভিক্ষে চাইত, মনে হয় সে চোখে ভালো দেখে না, হঠাৎ আমার মনে হতো, এই কি আমার সেই ধাই-মা, যার নাম ছিল বোঁচার মা? স্মৃতির কুয়াশা ভেদ করে সেই মুখটি জ্বলজ্বল করে ওঠে। সেই মুখের সঙ্গে যেন এই মুখের খুব মিল। তোমার নাম কী, তোমার নাম কী—বারবার জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাই না, সে একেবারেই বধির হয়ে গেছে। আমার জন্মের পর গোলাপ জল দিয়ে যে-ধাইমা আমার চোখ ফুটিয়েছিল, তাকে আমি চিনতে পারছি না? সত্যিই সে আমার ধাই মা হলেও তাকে আমি আর কী সাহায্য করতে পারতাম!

শরণার্থীদের সংখ্যা আরও বাড়তেই থাকে। উনিশ শো পঞ্চাশ সালের এপ্রিল মাসে জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের বৈঠকের পর দু’দেশের সংখ্যালঘুদের বিষয়ে একটি চুক্তি হয়। চুক্তির বয়ান শুরুতে বেশ ভালো, দুই নেতা ঘোষণা .করলেন যে, দুটি রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা ধর্মনির্বিশেষে নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার পাবে, তাদের জীবন, সম্পত্তি ও সংস্কৃতি রক্ষার আশ্বাস দেওয়া হয়, মত প্রকাশের ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতাও স্বীকৃত হল। শুধু তাই নয়, দেশত্যাগী উদ্বাস্তুরা ইচ্ছে করলে আবার ফিরে গিয়ে পৈতৃক ভিটে বাড়ি ও সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে, এমন ব্যবস্থাও করা হবে।

কিন্তু চুক্তি হলেই যে তা কার্যকর হবে, তার কি কোনও মানে আছে? পাকিস্তান এই চুক্তির তোয়াক্কা করেনি, বরং সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক কিছু কিছু আইন প্রণয়ন করে ইস্লামিক রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগোচ্ছে। প্রশাসনও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা রক্ষার দিকে উদাসীন। কোনও হিন্দু উদ্বাস্তুই পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ফেলে যাওয়া সম্পত্তির অধিকার চাইতে সাহস পায়নি। পাকিস্তানের কট্টর সমর্থকরা সাধারণ মানুষের মধ্যে এরকম একটা ধারণার সৃষ্টি করে দিয়েছিল যে, হিন্দুদের কিছুটা ভয় দেখালেই তারা বাড়ি-জমি ফেলে পালাবে আর সেগুলো দখল করে নেওয়া যাবে। ভারত থেকে মুসলমানদের দেশত্যাগের স্রোত এই চুক্তির ফলে অনেক কমে যায়, কিছু কিছু মুসলমান উদ্বাস্তু অসম ও পশ্চিমবাংলায় ফিরেও আসে। ভারত যে এই চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে তা নয়, কোথাও কোথাও মুসলমানদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে, কিন্তু ভারতে প্রথম থেকেই একটা গণতান্ত্রিক বাতাবরণ ছিল এবং বিভিন্ন নাগরিক কমিটি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অংশ নিয়েছে। একান্ন সালের জনগণনায় দেখা যায়, পশ্চিমবাংলার জনসংখ্যার প্রায় কুড়ি শতাংশ মুসলমান, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের সংখ্যা কমে গেছে অনেক।

নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি সত্ত্বেও পশ্চিমবাংলায় উদ্বাস্তুদের ঢল অব্যাহত থাকায় দিল্লির লোকসভায় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবাংলার মধ্যে হিন্দু-মুসলিম লোেক বিনিময়ের প্রস্তাব ওঠে। নেহরু সে প্রস্তাব উড়িয়ে দেন, এটা তাঁর মহৎ আদর্শের বিরোধী, তিনি টু নেশান থিয়োরিতে বিশ্বাস করেন না। যদিও দুই পঞ্জাবের লোক বিনিময়ের সময় নেহরু তাঁর এই মহৎ আদর্শ কাবার্ডে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

বহু বছর পর, দূর থেকে এই সব ঘটনা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, কীভাবে একটু একটু করে ইতিহাসের বদল ঘটছে। এক কালের সমৃদ্ধ পশ্চিমবাংলা এই উদ্বাস্তু সমস্যার জন্যই য। ধ্বংসের পথে যাচ্ছে, সে-সম্পর্কে অনেকেই সচেতন নন, গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই উদ্বাস্তু সমস্যাই পশ্চিমবাংলাকে খাঁক করেছে।

রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, আধপেটা খেয়ে, পুষ্টির অভাবে, চিকিৎসায় বঞ্চিত হয়ে হাজার হাজার উদ্বাস্তু প্রাণ দিচ্ছে প্রতিদিন। যুদ্ধ কিংবা রাষ্ট্র বিপ্লব নয়, দুর্ভিক্ষ নয়, এমনিই মরছে মানুষ। এরই মধ্যে আড়কাঠিরা একটু স্বাস্থ্যবতী মেয়েদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে পতিতালয়ে, শিশু কেনা-বেচাও চলছে। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে উদ্বাস্তুরা ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে তারা শুরু করল জবর দখল। কলকাতায় আশেপাশে সরকারি জমি, যে- কোন খালি জমি ও ধনীদের বাগান বাড়িগুলিতে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে লাগল এবং মাটি কামড়ে পড়ে রইল। হাত ছাড়া হয়ে গেল এদিককার অনেক মানুষের সম্পত্তি, তছনছ হয়ে গেল বহু প্রমোদ ভবন। এই জবর দখল কাজটি অবৈধ হলেও তখন উদ্বাস্তুদের বাধা দেবার শক্তি সরকারেরও নেই।

এই সময় থেকে পশ্চিমবাংলার অনেকের মনে শরণার্থীদের সম্পর্কে অবজ্ঞা ও ঘৃণা বাড়তে থাকে। এরা কেন আসতে বাধ্য হচ্ছে কিংবা কত অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে, সেগুলো তলিয়ে না-বুঝে এরা কত সমস্যার সৃষ্টি করছে, সেদিকেই লোকে বেশি জোর দেয়। রেফিউজি শব্দটাই তখন গালাগালি হয়ে যায়, তার সঙ্গে যোগ হয় হারামজাদা, শুয়োরের বাচ্চা ইত্যাদি। আমার সামনেই যখন পরিচিত কেউ বলত, ‘হারামজাদা রিফউজিরা’, আমার গায়ে তা ঠিক চাবুকের মতন লাগত। রিফিউজিদের প্রতি একাত্মতা বোধ আমার মন থেকে কখনও মুছে যায়নি।

আমার বন্ধু আশুদের একটি বিশাল ও অতি সুদৃশ্য বাগানবাড়ি ছিল নাগেরবাজার-ষাটগাছি অঞ্চলে। তার মধ্যে কত রকম গাছপালা। দুটি পুকুর, একটি জালঘেরা অর্কিড হাউস, মূল বাড়িটিতে ঝাড়লণ্ঠন শোভিত নাচঘর। বাচ্চা বয়েসে আমরা বেশ কয়েকবার সেখানে পিকনিক করতে গেছি, কত ডাব, কত রকম ফল খেয়েছি। তখন অবশ্য বাবু কালচারের দিন শেষ হয়ে এসেছে, বাগান বাড়িতে যোচ্ছব করার সামর্থ্য ও সময় আর অনেকেরই নেই, একটি মাত্র দারোয়ান সে বাড়ি পাহারা দেয়। ওই অঞ্চলের অন্যান্য বাগান বাড়িগুলির মতন আশুদের বাড়িটিতেও জোর করে ঢুকে পড়ে শরণার্থীরা। কোণঠাসা বেড়ালের মতন তারা এমনই হিংস্র হয়ে উঠেছে, যে বাড়ির মালিকরা আর সে সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের সাহস পায়নি। জবর দখলকারীরা বাগানটা তছনছ করে দেয়, বহু গাছ কেটে কুঁড়ে ঘর বানায়, অর্কিড হাউসের দুর্লভ নমুনাগুলি নির্মূল হয়ে যায়, নাচঘর ভেঙে চুরে হয় রান্নাঘর। এই নিদারুণ দুঃসংবাদ শুনে আশুদের পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল।

এই ঘটনায় আমারও মন দ্বিধান্বিত হয়ে যায়। অমন চমৎকার একটি বাড়ি, সবুজ ছায়া-ঘেরা বাগান ধ্বংস হয়ে গেল, এ জন্য কষ্ট হয়। আমার বন্ধুদের অমন একটা মূল্যবান জমি-বাড়ি বেহাত হয়ে গেল, তাতে সমবেদনা আসাও স্বাভাবিক। অপর পক্ষে, ওইসব বাড়ি ও জমি, প্রায় সারা বছর খালি পড়ে থাকে, বড়জোর দু’একদিন পিকনিক হয়। অত বড় বড় সব জায়গা খালি পড়ে থাকবে, আর রিফিউজিরা উন্মুক্ত আকাশের তলায় থেকে পোকা-মাকড়ের মতন মরবে? তারা তো স্বেচ্ছায় নিজেদের ভিটে-মাটি ছেড়ে আসেনি। দেশ বিভাগের শর্ত মেনে নিয়ে যারা স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করতে চেয়েছে, সেই সব আহাম্মক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যদি এদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে না পারে, তবে তারা তো নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নিতে বাধ্য হবেই। এখানে বাঁচা-মরার প্রশ্ন, এখানে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অন্য রকম। বাড়িগুলো জবরদখল করছে, বেশ করছে!

এক কালের প্রমোদ উদ্যানভবনগুলির নাম হয়ে গেল রিফিউজি কলোনি। কলকাতার উত্তর ও দক্ষিণে, এই রকম কলোনি অজস্র। অনেক বছর পর ওই নাগেরবাজার-ষাটগাছি অঞ্চলে আমরা একটা ভাড়াবাড়িতে থেকেছি। সেই বাড়ি থেকে যাওয়া-আসার পথে আশুদের বাগানবাড়িটির রূপান্তর প্রত্যক্ষ করেছি, চেনা ছবিটি মুছে গেছে, ভেতরে শুধু ছোট ছোট ঘর। সেই কলোনি এবং সেখানকার মানুষজনদের মধ্যেই অর্জুন’ উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের খুঁজে পেয়েছিলাম।

পশ্চিমবাংলায় আমরা ভূমিহীন, তখনকার জমি দখলের হিড়িকে আমাদেরও কিছুটা ভূমি পাওয়ার সুযোগ এসেছিল। যাদবপুরের দিকে অনেকখানি জমি দখল করে যে-কলোনিটি গড়ে উঠেছিল, সেখানে ছিল আমাদের মামাবাড়ির গ্রামের কিছু মানুষ। তাদের সঙ্গে আমার বাবার যোগাযোগ হয়। তারা সহৃদয়ভাবে আমাদের জন্য কিছুটা জমি বরাদ্দ করার প্রস্তাব দেয়, একজন লেখাপড়া জানা, কলকাতা শহর ও সরকারের লোকজনদের চেনে এমন কারওকে প্রতিবেশী পেলে তাদেরও সুবিধে। তিন কাঠার মতন জমি, বাবা দু’-একবার গিয়ে দেখেও এলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই জমি নেওয়া হয়নি নৈতিক কারণে। প্রকৃত অর্থে আমরা খাঁটি রিফিউজি নই, আমরা পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থী হইনি। আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে, আরও অসংখ্য উদ্বাস্তু এখনও কোথাও আশ্রয় পায়নি, সুতরাং আমাদের জমি পাওয়া শুধু প্রকট স্বার্থপরতা নয়, তঞ্চকতা বলা যেতে পারে। বাবা অসম্মত হয়ে আত্মসম্মান বজায় রেখেছিলেন। আমরা ভাড়াটে হয়েই রইলাম, যদিও এই সময় থেকেই বাড়ি ভাড়া হু হু করে বাড়তে থাকে, বাড়ির মালিকরা পুরননা, অল্প টাকার ভাড়াটেদের উৎখাত করার জন্য তৎপর হয়। গ্রে স্ট্রিটের যে-বাড়িতে আমরা ভাড়াটে ছিলাম, তার মালিক পরিবার থাকতেন দোতলায় তাঁদের সঙ্গে বেশ ভাব ছিল, পান্নালাল নামে সমবয়েসি একটি ছেলে ছিল আমার বন্ধু, কিন্তু এখান থেকে আমাদের বিদায় করে দেবার জন্য চাপ সৃষ্টি হয়, সম্পর্কে চিড় ধরে। যুদ্ধের আগে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটেদের ডেকে ডেকে আনতেন, স্বাধীনতার পর ভাড়ার অতিরিক্ত সেলামি নামে একটা থোক টাকা দেওয়ার রীতি চালু হয়, শুরু হয় কালো টাকার খেলা।

পশ্চিমবাংলায় আকস্মিক এত জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে বিপর্যস্ত হয়ে যায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা। সেই বিপর্যয় আজও অব্যাহত। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় কিছু কিছু স্কুল ও কলেজ খোলা হয়, প্রয়োজনের তুলনায় তা অবশ্য অপ্রতুল। সেরকমই একটা কলেজ খোলা হল দমদম-মতিঝিলে। এই কলেজটি আমার জীবনের একটি বাঁক ঘুরিয়ে দিল বলা যেতে পারে।

আমার দাদু সুরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় মতিঝিলের একজন বিশিষ্ট নাগরিক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক, কয়েকটি অঙ্ক পাঠ্য পুস্তকের রচয়িতা, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তিনি ওই কলেজের পরিচালনা সমিতির সভাপতি কিংবা হোমড়া-চোমড়া কিছু হয়েছিলেন। নতুন কলেজে প্রথম প্রথম ছাত্র ভর্তি হতে চায় না, বিশেষত বিজ্ঞান বিভাগে। ছাত্র ধরে ধরে আনতে হয়। আমার দাদু আমার বাবাকে প্রস্তাব দিলেন যে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ছেড়ে আমি যদি দমদম-মতিঝিল কলেজে এসে ভর্তি হই, তা হলে আমার অর্ধ বেতনের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে। বাবা সেই প্রলোভনে রাজি হয়ে গেলেন।

দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে-না-উঠতেই আমার কলেজ পরিবর্তন হল। আমার অভিভাবকরা এ কাজটা ভালো করেননি, একটি ছেলের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আমার বন্ধু আশু তো সহপাঠী ছিলই, অন্যান্য কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, কয়েকজন অধ্যাপকের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল। সেখান থেকে আমাকে উৎপাটিত করে নিয়ে আসা হল এক সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে। মফঃস্বলের ছেলেরা কলকাতার কলেজে পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে, আমাকে কলকাতার কলেজ ছেড়ে প্রতিদিন যেতে হবে মফঃস্বলে, এ রকম অদ্ভুত কাণ্ডের জন্য অনেকেই ঠাট্টা বিদ্রুপ করত আমাকে। হাফ-ফ্রি’র প্রস্তাবটাও হাস্যকর, পেনি ওয়াইজ পাউন্ড ফুলিশ যাকে বলে, সারা মাসের বাস ভাড়া কলেজের অর্ধ বেতনের চেয়ে বেশি! দুপুরে আমাকে যেতে হবে সুদূর উত্তরে, সন্ধেবেলা টিউশনি করতে যাই সুদূর দক্ষিণ কলকাতায়, বাসে-ট্রামেই যদি এত সময় কাটাতে হয় তা হলে পড়াশুনো করব কখন? এর ওপর আবার চাকরি-যোগ্যতা অর্জন করার জন্য আমাকে বিকেলবেলা একটা শর্টহ্যান্ড-টাইপ রাইটিং স্কুলে যেতে হত। হাতিবাগান বাজারের ওপরে সেই স্কুলে কয়েকদিন গিয়েই আমার আক্কেল গুড়ুম হওয়ার মতন অবস্থা। যাঁরা শর্টহ্যান্ড জানেন, তাঁরা আমার নমস্য। কয়েকটা আঁকা বাঁকা দাগ থেকে কোনও ভাষা উদ্ধার করার জন্য যে প্রতিভা লাগে, তা আমার একেবারেই নেই, শর্টহ্যান্ডে আমি মন বসাতে পারিনি। টাইপিং কিছুটা শিখেছিলাম, তাও দশ আঙুলে নয়, দু’তিনটে আঙুলে, অর্থাৎ শ্লথ গতি। সেই কারণেই কোনও সওদাগরি অফিসে স্টেনো-টাইপিস্টের চাকরি পাবার সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। (এখন যেগুলিকে প্রাইভেট ফার্ম বলে, তখন সেগুলিকে মার্চেন্ট অফিস বা সওদাগরি অফিস নামে চিহ্নিত করা হত।)।

এ রকম অবাস্তব ও অন্যায়ভাবে কলেজ বদল কী এখনকার ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই মেনে নেবে না, বিদ্রোহ করবে। আমি মেনে নিয়েছিলাম কেন? আমি কি শান্তশিষ্ট, অতি সুবোধ বালক ছিলাম? কলেজে এসেই অনেক ছেলে বিড়ি-সিগারেট টানতে শুরু করে। আমি গরিবের ছেলে এবং কিছুটা আদর্শবাদী, তাই ওসব কখনও ছুঁইনি। যে কোনও নেশার দ্রব্যকে ঘৃণা করতাম, পরিবারের কারওর নির্দেশের বিরুদ্ধতা তো দূরের কথা, উঁচু গলায় কথাও বলিনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফুঁসতাম নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, তখন তথাকথিত ভালো ছেলেই ছিলাম বলা যেতে পারে, দু’এক বছরের মধ্যেই সেই ভালোত্ব খসে গিয়ে আমার আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে।

সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ার সময় একদিনও কলেজ কামাই করিনি, শিয়ালদা থেকে ফেরার পথে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে বসতাম কিছুক্ষণ। আমার তুলনায় আশু হাতখরচ অনেক বেশি পায়, সে খাওয়াত কফি, আর কোনওদিন একটা মান ওমলেট খেলে মনে হত জীবনটা ধন্য হয়ে গেছে। কফি হাউসের পরিবেশ দিন দিন ভালো লাগতে শুরু করে, কিছু কিছু বিখ্যাত লোকের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকি। আমার দু’চারটে কবিতা ততদিনে ছাপা হয়েছে বটে, কিন্তু কোনও পত্রিকাগোষ্ঠী বা লেখকদলের সঙ্গে পরিচয় হয়নি, আমাকে কেউ চেনে না, আমিও কারওকে চিনি না। একদিন কেউ আঙুল তুলে এক দীর্ঘকায়, মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল ও প্রসন্ন হাস্যময় যুবা পুরুষকে দেখিয়ে বলল, উনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শুনেই তো আমার দম বন্ধ হবার মতন অবস্থা! আর একদিন কফি হাউসের নীচের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি, ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতে নিয়ে একজন গাঁট্টাগোট্টা ব্যক্তি হেঁটে যাচ্ছেন, কেউ বলল, এই তো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ তো আমার স্বপ্নের মানুষ। ইচ্ছে হয়েছিল, ছুটে গিয়ে প্রণাম করি, চক্ষুলজ্জায় যেতে পারিনি, তাঁকে আর কোনওদিনই প্রণাম করা হয়নি।

তখন বাংলার ঔপন্যাসিকদের মধ্যে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়েরই প্রাধান্য। তাঁদের মধ্যে বিভূতিভূষণ ও মানিক দীর্ঘজীবী হননি। যতদূর মনে পড়ে, নাট্যকার জর্জ বার্ণাড শ এবং বিভূতিভূষণ একই দিনে বা দু’-একদিন আগে পরে মারা যান। জর্জ বার্ণাড শ-এর তখন এমনই জনপ্রিয়তা, এমনকী বাংলাতেও, যে তাঁর শোক সংবাদ ও জীবনীই খবরের কাগজে প্রাধান্য পেয়েছিল, বিভূতিভূষণের প্রস্থান তেমন মনোযোগই পায়নি। তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলারও সুযোগ হয়নি।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দু-তিনবার মাত্র দেখেছি ‘পরিচয়’ পত্রিকার দফতরে। আমি তাঁর খুবই ভক্ত ছিলাম, তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্বের (অর্থাৎ যখন থেকে তিনি ঘোষিত সাম্যবাদী) রচনাগুলি নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক ছিল, কফি হাউসের তরুণ লেখকদের মধ্যে প্রবল বাদানুবাদের মধ্যে অনেকেরই মত ছিল, দ্বিতীয় পর্বে তার শিল্পীসত্তা চাপা পড়ে যাচ্ছে, আমি ছিলাম এর বিরোধী, আমি তাঁর প্রতিটি রচনারই মুগ্ধ পাঠক। আমার বন্ধু দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (পরে যে ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিল) সঙ্গে আমার অনেক বিষয়ে মতভেদ হত, কিন্তু এই বিষয়ে ছিলাম দু’জনেই সমমতা।

‘পরিচয়’ দফতরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বচক্ষে দেখেছি বটে, কিন্তু বসে থাকতাম পেছনের সারিতে, কথা বলা হয়নি। এই তেজস্বী ও অহংকারী মানুষটি তখন প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। মনে আছে, একবার কেউ একজন জিজ্ঞেস করেছিল, মানিকবাবু, চা খাবেন? তিনি বেশ রাগের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, না! তারপর সকলের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে বলেছিলেন, তোমরাও আর চা খেয়ো না! সন্ধের পর চা খেলে লিভার খারাপ হয়!

তারাশঙ্করের সঙ্গে কয়েকবার সাক্ষাৎ পরিচয় হয়েছে। সে প্রসঙ্গ অন্যত্র লিখেছি। এঁদের ঠিক পরবর্তী লেখক যাঁরা, যেমন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, ননী ভৌমিক, সন্তোষকুমার ঘোষ, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র প্রমুখ, তাঁরা ছিলেন অনেকটাই আমাদের কাছের মানুষ।

সুরেন্দ্রনাথ কলেজ প্রসঙ্গে একদিনের কথা বিশেষ স্মরণীয়। বিজ্ঞানের সমস্ত ছাত্রদের একটি সমবেত ক্লাসে একদিন হঠাৎ বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি যে কত বড় বিজ্ঞানী, সে সম্পর্কে তখন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। পরে শুনেছি, আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর থিয়োরি যুক্ত হওয়ার কৃতিত্বই শুধুনয়, তাঁর তত্ত্ব নিয়ে এখনও পৃথিবীতে গবেষণা চলেছে। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ, তিনি যে নোবেল পুরস্কার পাননি, সেটা নোবেল কমিটিরই ব্যর্থতা ও লজ্জার কথা।

মাথা ভর্তি ধপধপে সাদা চুল, সৌম্য, সহাস্য মুখ, তিনি একঘণ্টা বক্তৃতা দিলেন পদার্থ বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিষয়ে, এবং কী আশ্চর্য, সে বক্তৃতায় একবারও একটিও ইংরিজি শব্দ উচ্চারণ করলেন না!

যখনই কেউ বলে, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা কিংবা উচ্চশিক্ষা সম্ভব নয়, তখনই আমার সত্যেন বসুর সেই বক্তৃতার কথা মনে পড়ে।

কলেজ বদলের ব্যাপারে বাবা কিংবা দাদু আমার মতামত জানতে চাননি, নতুন জায়গায় আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। ছাত্রদের মধ্যে যারা প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে, তারা সবাই পরস্পরকে চেনে, একমাত্র আমিই বহিরাগত। বহিরাগতকে কেউ সহজে ঘনিষ্ঠ মহলে নিতে চায় না, ক্লাসের বাইরে ছেলেরা এক এক জায়গায় জটলা করে গল্পে মেতে থাকে, আমি একা একা শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াই। নিজে থেকে যেচে গিয়ে আলাপ পরিচয় করার মতন স্বভাবও যে আমার নয়! বন্ধুদের মধ্যে আমি বাক্যবাগীশ, অচেনা জায়গায় মুখচোরা।

এর ফলে যা হবার তাই হল, আমি কলেজ ফাঁকি দিতে শুরু করলাম। কলেজে না গেলে বাসভাড়া বেঁচে যায়, সেই পয়সায় বসা যায় কফি হাউসে। দীপক মজুমদার যদিও তখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি, কিন্তু বইপাড়া ও কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে সে নিয়মিত ঘোরাফেরা করে। বিকেলের দিকে কফি হাউসে গেলে অন্য চেনা কেউ না থাকুক, দীপক থাকবেই। কবিতা রচনার সূত্রে দীপকের সঙ্গেই তখন আমার হৃদ্যতা সবচেয়ে বেশি। কত মানুষকে সে চেনে! আমাদের বন্ধুদের বৃত্তে দীপকের কণ্ঠস্বরই সবচেয়ে জোরালো, এবং সে তখনই পাকাপাকি কবি, আমি শিক্ষানবীশ মাত্র। একবার দীপক আমাকে নিয়ে গিয়েছিল পূর্ণেন্দু পত্রীর কাছে। পূর্ণেন্দু একই সঙ্গে নামকরা কবি এবং শিল্পী, থাকে শোভাবাজারের কাছে কোথাও, তার কাকা নিকুঞ্জ পত্রীর সঙ্গে। ঘরের মধ্যে রং-তুলি ছড়ানো, ক্যানভাস ফ্রেমে আঁটা, আর একটি সরস্বতী মূর্তি। দীপকই কথাবার্তা, বলল, আমি তার পেছনে ছায়ার মতন, একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি, পূর্ণেন্দু আমার নামও জানতে চায়নি। পূর্ণেন্দুও গ্রাম থেকে এসেছে কলকাতায়, কিন্তু তারই মধ্যে তার কণ্ঠস্বরে অহংকারের ছাপ ফুটে ওঠে, যেন দুটো এলেবেলে বাচ্চা কবি এসে তার সময় নষ্ট করছে!

কলেজে না গিয়ে ঘোর দুপুরবেলা কোথায় যাওয়া যায়? কফি হাউসে তিনটে-চারটের আগে কেউ যায় না। তখন যেতাম সেই মেয়েটির কাছে, সে তখন স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাড়ির মধ্যে ঢুকতে সঙ্কোচ হত, কদাচিৎ তার ঘরে গেছি, সে যে-ঘরে পড়ে, পাশের গলিতে সেই ঘরের জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তার পড়াশুনোয় বিঘ্ন হচ্ছে বলে সে আমায় বকুনি দিত। আবার দু’দিন না গেলেই অনুযোগ করত, কেন আসনি? শরীরের ছোঁয়াছুঁয়ি একেবারেই হত না, কথাও বিশেষ নেই, শুধু চেয়ে থাকা, আর চিঠি লেখা। প্রতিদিন দেখা হলেও চিঠি ডাকে নয়, হাতে হাতে, আমার চিঠিটি নিয়ে কয়েক ভাঁজ করে সে রেখে দিত তার ব্লাউজের মধ্যে। আমার হাতের লেখা তার স্তনের স্পর্শ পাচ্ছে, এতেই আমার স্বর্গ সুখ। তার নিজের চিঠিও সে ব্লাউজের ভেতর থেকে বার করে দিত আমার হাতে, সঙ্গে সঙ্গে পড়ার প্রশ্ন নেই, নিয়েই চলে যেতাম, তারপর অনেকক্ষণ ধরে গন্ধ শুকতাম সেই চিঠির। সেই গন্ধেই যেন উপভোগ করতাম আমার মানসীর শরীর। তিন-চার বছরে তাকে আমি অন্তত পাঁচ-সাত শো চিঠি লিখেছি, সেই চিঠিগুলিতেই আমার গদ্য লেখা মকশো হয়।

সেই চিঠিগুলির মধ্যে কতখানি ছিল সেই কিশোরীটির প্রতি প্রেম, আর কতখানি ভাষার প্রতি ভালোবাসা? সচেতন ভাবে এরকম কোনও তফাত ছিল না নিশ্চিত, আবেগের বশেই তো লেখা, কিন্তু পরবর্তীকালে মনে হয়েছে, তার মধ্যে গদ্য নিয়ে পরীক্ষা করার একটা ঝোঁকও ছিল খুব। মেয়েটির রূপ বা গুণের বর্ণনা তো পাঁচশো বার লেখা যায় না। তা একমাত্র অতি মূর্খরাই সে রকম এক ঘেয়েমির দিকে ঝোঁকে। নিজের সম্পর্কেও সাত কাহন করে বলাটা রুচিহীনতার লক্ষণ, তা হলে অতগুলি চিঠি লেখা হচ্ছে কোন বিষয় নিয়ে? কোনও বিষয়ই নেই, প্রতিদিনের ছোট ছোট ঘটনা, কিছু অনুভূতি, কিছু স্বপ্ন, তা লেখার জন্য এমন একটা গদ্য ভাষা চাই, যা আকর্ষণীয় হবে। সেই জন্যই বারবার কাটাকুটি করে লেখা সেই সব চিঠি। যার বিষয়বস্তুর চেয়েও ভাষার নতুনত্বই প্রধান। সুতরাং, প্রেমিক পত্রলেখক যখন মনে করে, তার হৃদয়েশ্বরীর চেয়ে পৃথিবীর আর কোনও কিছুকেই সে বেশি ভাললাবাসে না, তখনও আসলে হয়তো সে ভাষাকেই বেশি ভালোবাসে।

আমার এই দুপুরের অভিসারের কথা সযত্নে গোপন রাখতাম বন্ধুদের কাছ থেকে। সেখান থেকে চলে যেতাম কফি হাউসে, মেতে উঠতাম অন্য রকম আলোচনায়। তখন ছাত্রদের মধ্যে বামপন্থী হাওয়া প্রবল, কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র শাখার নাম স্টুডেন্ট ফেডারেশন, ফরোয়ার্ড ব্লকের ছাত্র শাখা স্টুডেন্ট ব্লকও বেশ জনপ্রিয়, আমি যোগ দিয়েছিলাম স্টুডেন্ট ফেডারেশনে। অনেক মিছিলে অংশ নিয়েছি। এমনও হয়েছে, আমার পকেটে প্রেমিকার চিঠি, সদ্য এসেছি তার সন্নিধান ছেড়ে, তারপর কলেজ স্ট্রিটে মিছিলে যোগ দিয়ে হাত ছুড়ে ছুড়ে স্লোগান দিয়েছি কষুকণ্ঠে।

পূর্ববঙ্গ বা পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমেই কমে আসছে। চিঠিপত্রও সহজে আসে না। এদিককার কাগজে ওদিককার খবর সংক্ষিপ্ত। এরই মধ্যে একদিন দীর্ঘ শিরোনামে সংবাদপত্রে ছাপা হল ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি চালানোর বার্তা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সেখানে প্রাণ দিচ্ছে ছাত্ররা। সালাম, বরকত এইসব নিহতদের নাম পড়ে বুক কেঁপে ওঠে। এই নামে আমার সহপাঠী ছিল ওখানকার ইস্কুলে, তাদেরই কেউ? সেই মুখগুলি যেন দেখতে পাই। আমার সহপাঠী হোক বা না হোক, নিবিড় একাত্মতা বোধ করি ওই সব নামের সঙ্গে। ততদিনে বাংলা শব্দ ও অক্ষরের মাদকতা ছড়িয়ে গেছে রক্তে, বাংলা ভাষার অপমানের কথা শুনলেই গা জ্বলে ওঠে। ইচ্ছে করে তখনই ঢাকায় ছুটে যেতে, সেখানে যারা মিছিলে মিছিলে শহরময় তুলকালাম করছে, তাদের সঙ্গে মিশে যেতে।

কিন্তু তা সম্ভব নয়। সে তো অন্য দেশ। মানুষের জন্মভূমি আর স্বদেশ সব সময় এক থাকে না। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার জন্মভূমি বিদেশ হয়ে গেছে।

সতেরো

হায়দরাবাদ রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে আছে দুটি কিশোর, মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ঝমঝমিয়ে আসছে ট্রেন। তখন কিছুক্ষণের জন্য সরগরম হয়ে উঠে স্টেশন, কুলি ও হকারদের চেঁচামেচি, নামন্ত ও উঠন্ত যাত্রীদের ঠেলাঠেলি, টিউবওয়েলের ক্যাঁচক্যাঁচ। একটু পরেই আবার সব নিঝুম। বেঞ্চে বসে থাকা কিশোর দুটির চোখে ঘুম নেই, শীতে কাঁপছে ঠক ঠক করে। এতদিন পরেও ছবিটি স্পষ্ট।

স্কুলের গণ্ডি পেরোবার আগেই ভ্রমণের দারুণ নেশা পেয়ে বসেছিল, কলেজের দু’-এক বছরের মধ্যে আমি ভারত দর্শন অনেকটা সেরে ফেলেছি। অভিভাবকদের সঙ্গে মোটেই না। এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকাপয়সা না নিয়েও অত কম বয়সে হিল্লি-দিল্লি, উত্তর ও দক্ষিণ ভারত ঘোরাঘুরি কী করে সম্ভব? কাছাকাছি, ছছাটখাটো জায়গাগুলির বিবরণ আপাতত বাদ দিচ্ছি, দূরপাল্লার ভ্রমণ অভিযানের রহস্য এখন ব্যক্ত করা যায়।

স্কুলে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একজনের নাম প্রশান্ত দাশগুপ্ত, তার বাবা ছিলেন রেলের উচ্চ কর্মচারী। রেলের এইসব অফিসাররা তাঁদের পরিবারের সকলের জন্য দেশের যে-কোনও প্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণের পাস পেতেন। প্রশান্ত প্রায়ই আমাদের বলত, ইচ্ছে করলেই সে যে-কোনওদিন জম্মু কিংবা ন্যাকুমারী চলে যেতে পারে বিনা পয়সায়। কিন্তু প্রশান্ত শান্ত, ভদ্র ও পড়ুয়া ধরনের ছেলে, তার ওরকম ইচ্ছে হতে দেখিনি কখনও। প্রশান্তর কাছে অনেক কাকুতি-মিনতি করে তার এবং তার ছোট ভাইয়ের নামে দু’খানা পাস বার করে তা ব্যবহার করতাম আমি আর কোনও বন্ধু। বেশ কয়েকবারই আমার এই অনির্দিষ্ট যাত্রার সঙ্গী হয়েছে দীপক মজুমদার।

আমার বাবা খুব কড়া শাসক হলেও আমার ভ্রমণ আকাঙক্ষায় কখনও বাধা দেননি। দীপকের বাধা দেবার কেউ ছিলইনা, অতি শৈশবেই সে পিতৃহীন, সংসারের একমাত্র অবলম্বন তার মা, আর কোনও ভাইবোন নেই। দীপকের মা একটি প্রাথমিক ইস্কুলের শিক্ষিকা, খুবই শীর্ণকায়, পুরনো ঘিয়ের মতন গায়ের রং, খুব নরম ও নিচু গলায় কথা বলেন। ক্ষীণ দীপশিখার সঙ্গে খুব মিল।

আমার তবু টিউশনির উপার্জন ছিল, দীপকের কিছুই না। তবে অন্য বন্ধু-বান্ধবরা তাকে ধার দিত। ধার শব্দটি অবশ্য দীপক ব্যবহার করত নিজস্ব অর্থে। যেমন, কোনও বন্ধুর কাছে টাকা ধার চেয়ে দীপক বলত, সামনের মাসেই শোধ দিয়ে দেব। তার সঙ্গে সে জুড়ে দিত আশ্বাসবাক্য, দিই বা না দিই, কথার ঠিক রাখব।

দুজনে মিলে তিরিশ-চল্লিশ টাকা জোগাড় করতে পারলেই বেরিয়ে পড়তাম। তখনকার রেলের পাসে সুযোগসুবিধে ছিল সীমাহীন, এখনও সে রকম আছে কি না জানি না। যেমন, ধরা যাক আমাদের গন্তব্য লিখিয়ে নেওয়া হল সিমলা। তারপর হাওড়া থেকে আমরা চেপে পড়তে পারি যে-কোনও ট্রেনে, নেমে পড়তে পারি যে-কোনও স্টেশনে। সিমলার দিকে যাচ্ছি, আর তিন মাসের মধ্যে ভ্রমণ সমাপ্ত করতে হবে, এই শুধু শর্ত। অত কম টাকায় কোথাও কোনও হোটেলে থাকার প্রশ্নই ওঠেনা, কোনও শ্লথগতির ট্রেনে চেপে রাত কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিংবা কোনও বড় স্টেশনে নেমে, যেমন আগ্রায়, লেক্ট লাগেজে জমা দিলাম আমাদের ব্যাগ, তারপর সারাদিন টো টো করে ঘোরাঘুরি, চাঁদের আলোয় তাজমহল দেখা, রাতটা কাটানো স্টেশনের ওয়েটিং রুমে, পরের দিন আবার আগ্রা দুর্গে এক বেলা, এবং দিনের বেলাই বা তাজমহল দেখব না কেন? প্রথম তাজমহল দর্শনের সঙ্গে ভালোলাগা, মন্দলাগা দুটোই মিশে আছে। যার খ্যাতি যত বেশি, তার সম্পর্কে প্রত্যাশাও তত বেশি হয়, এবং কল্পনায় আমরা যে তাজমহল নির্মাণ করি, তার সঙ্গে বাস্তব কিছুতেই মিলতে পারে না। দিনের বেলা তাজমহল ছোট হয়ে যায়, শ্বেতমর্মরকে মনে হয় সাদা চুনকাম, তাজমহল দেখতে হয় ঠিক সূর্যাস্তের সময়, তখন যেন তার আকার হঠাৎ অনেক বৃদ্ধি পায়, জুড়ে থাকে চোখের সামনের দিগন্ত।

অন্যান্য বন্ধুরা যখন কলকাতায় মন দিয়ে পড়াশুনো করছে, কিংবা পারিবারিক নিরাপত্তায় বেড়াতে যাচ্ছে দেওঘর কিংবা ঘাটশিলায়, আমি আর দীপক তখন রাত কাটাচ্ছি সুদূর উত্তরে ভারতের কোনও রেল স্টেশনে। দিনের পর দিন এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের গায়ে খড়ি উঠে যায়, একটু মাছের ঝোল ভাত খাওয়ার জন্য মন আনচান করে। দিল্লির মতন শহর দু’একদিনে দেখা যায় না। যুগের পর যুগের ইতিহাস-চিহ্ন সেখানে ছড়ানো, পরবর্তীকালে রোম ও ইস্তানবুলের সঙ্গে দিল্লির মিল খুঁজে পেয়েছি, সেখানে আতিথ্য নিয়েছি এক বাড়িতে। আমার বা দীপকের কোনও আত্মীয় নেই দিল্লিতে, এক বন্ধুর মামার ঠিকানা নিয়ে এসেছিলাম। আগে থেকে চিঠিপত্রে কিছু জানানো হয়নি, হঠাৎ বিনা নোটিসে আমাদের আবির্ভাব, তাঁরা অবাক হয়ে থাকতে দিয়েছিলেন, যদিও বিনয়নগরে তাঁদের অপরিসর ফ্ল্যাটে অতিরিক্ত ঘর ছিল না। সম্পূর্ণ অচেনা ও অনাত্মীয় দুটি ছেলেকে তবু যে তাঁরা আশ্রয় দিয়েছিলেন, সেটা তাঁদের মহানুভবতা। ইংরিজিতে একটা কথা আছে, মাছ এবং অতিথি দু’দিনের বেশি থাকলে পচা গন্ধ বেরোয়। আমরা তো তখন সে প্রবাদ জানি না, দিনের পর দিন মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি, দুপুর রোদে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ছি হুমায়ুনের সমাধিতে কিংবা লোদি বংশের বাগানে, ক্রমশ আমাদের আশ্রয়দাতারা সকালবেলা আমাদের জলখাবার দিতে ভুলে যাচ্ছেন, একটু রাত করে ফিরলে দেখছি, সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছেন, টেবিলে কিছু ঢাকা দেওয়া নেই, গৃহকর্তা দরজা খোলার পরই বলছেন, তোমরা খেয়ে এসেছ নিশ্চয়ই!

দীপক আর আমার যুগ্ম তহবিল কার কাছে থাকবে, তা নিয়ে মতান্তর ও মনান্তর হয় প্রায়ই। দীপকের খরচের হাত খুব বেশি, অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনার ব্যাপারটা তার চরিত্রে একেবারেই নেই। একদিন সামান্য এক গেলাস জল উপলক্ষ করে আমাদের দারুণ ঝগড়া হয়ে গেল। দিল্লিতে প্রবল গ্রীষ্মকালে লালকেল্লার সামনের ময়দানে গেলাসে করে ঠাণ্ডা জল বিক্রি হত। দীপক হঠাৎ চার পয়সা দিয়ে এক গেলাস জল কিনে চুমুক দিতে লাগল। আমি হতবাক। আমাদের প্রতিটি পয়সা টিপে টিপে হিসেব করে খরচ করতে হয়। আমাদের জন্য সরকার বাহাদুর রাস্তায় কল বানিয়ে রেখেছেন, সেখান থেকে বিনা পয়সায় জল পান করা যায়, তোক না তা গরম! চার পয়সায় পাওয়া যায় দুটো পরোটা, তার বদলে এক গেলাস জল? দীপক যদিও চুমুক দিতে দিতে হাত তুলে ইঙ্গিতে জানাল যে সে অর্ধেকটা আমাকে দেবে, কিন্তু এরকম বিলাসিতা আমার সহ্য হল না, এখনও অনেক পথ বাকি, দিল্লি থেকে যেতে হবে সিমলা পর্যন্ত, তারপর ফেরা, এর মধ্যেই অর্ধেকের বেশি খরচ হয়ে গেছে। তর্কের সময় দীপকের গলার জোরই বেশি, আমরা তাকে বলতাম কস্তুকণ্ঠ, যদিও তা বেশ সুরেলাও ছিল। ঝগড়া এমনই তুঙ্গে উঠল যে দীপক ঘোষণা করল যে আমরা আর একসঙ্গে থাকব না, সে যেদিকে ইচ্ছে যাবে, আমাকেও নিজের পথ দেখে নিতে হবে। হন হন করে সে হাঁটা দিল উল্টো দিকে। কিন্তু কত দূরে যাবে? আমরা যে শ্যামদেশীয় যমজের মতন, বিচ্ছিন্ন হবার কোনও উপায় নেই। দু’জনের টিকিট তো আলাদা নয়, একখানা কাগজে দু’জনের নাম লেখা, এবং সেই কাগজটি আমার কাছে!

তারপর ঠিক হল, দু’জনের টাকা আলাদাভাবে দু’জনের পকেটে থাকবে, একজন এক বেলা সব খরচ করবে, আর একজন অন্য বেলা।

ছোট ট্রেনে সুড়ঙ্গের পর সুড়ঙ্গ পার হয়ে সিমলা পৌছনোর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা কোনওদিন ভুলবার নয়। জীবনে এরকম অনেক কিছুই প্রথমবার দেখার ছাপ গাঢ়ভাবে অঙ্কিত হয়ে থাকে। এক একটা নতুন জায়গায় পা দিয়েই মনে হত, আমরা সে স্থানটি যেন জয় করতে এসেছি। অভিভাবকদের শাসন নেই, আমরা যা খুশি তাই-ই করতে পারি। যেন দুজনের হাতে রয়েছে দুটি অদৃশ্য তলোয়ার, শুধু পকেট দুটিই বড় হালকা, এই যা অসুবিধে। সিমলা রেল স্টেশনটি খুবই অকিঞ্চিৎকর। সেখানে রাত্রে থাকা যায় না, তা ছাড়া শীত। ওখানে বাঙালিদের কালীবাড়ি নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, খুবই সস্তায় থাকাখাওয়া যায়, মাত্র দৈনিক দু’টাকায় বিছানা সমেত খাট পাওয়া যায়। সিমলা শহরে আপার বাজার ও লোয়ার বাজারের চরিত্র একেবারে আলাদা। লোয়ার বাজারে স্থানীয় মানুষদের ছোট ছোট দোকানপাট, আর আপার বাজারে সাহেবি আমলের কেতাদুরস্ত রেস্তোরাঁ ও বাড়িঘর। আমরা লোয়ার বাজারে গিয়ে রুটি মাংস খেতাম, দোকানগুলো নোংরা নোংরা হলেও খাবারের স্বাদ বেশ ভালো এবং অবিশ্বাস্য রকমের কম দাম, আর বেড়াতাম ওপরের দিকে। চলে যেতাম পাহাড়ে। তখনও আমি দার্জিলিং যাইনি, সিমলা গিয়েই প্রথম হিমালয় দর্শন হল।

সিমলায় একদিনের বৃষ্টি স্মৃতিতে বিধৃত হয়ে আছে, ওরকম বৃষ্টি আর কখনও দেখিনি। বৃষ্টি তো নয়, যেন বর্গির আক্রমণ, লোকজন ভয়ার্তভাবে ছোটাছুটি শুরু করল, আকাশ থেকে বড় বড় পাথরের টুকরো নেমে আসছে। শিলাবৃষ্টি আমরা অনেক দেখেছি, বাংলায় বরফের টুকরোগুলো ছোট ছোট, টিনের চালে খটাখট শব্দ হয় বটে, কিন্তু মাটিতে পড়তে না পড়তে গলে যায়। সিমলায় শিলাবৃষ্টি যেন সত্যিই কঠিন পাথরের টুকরোর মতন, লোকে মাথা বাঁচাবার জন্য দৌড়োয়।

এক দুপুরে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে নামতে নামতে দীপক হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে ভূত দেখার মতন মুখ করে জানাল যে তার মানিব্যাগটি পকেটে নেই। কোথাও পড়ে গেছে কিংবা কেউ তুলে নিয়েছে। দীপক পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, আমি ধুতির ওপর ফুল শার্ট, ম্যাট্রিক পাস করার পর একটি লম্বা প্যান্টও পেয়েছিলাম। সব পকেট উল্টেপাল্টে দেখা হল, নেই তো নেই। দীপক অনেক ব্যাপারে সৌখিন, সম্বল তো বড়জোর কুড়ি-পঁচিশ টাকা, তবু তার মানিব্যাগটি দেখবার মতন, তার এক খোপে খুচরো, এক খোপে এক টাকার নোট, এক খোপে পাঁচ টাকা ইত্যাদি ও অন্য একটি খোপে নিজের ছবি। আমি সারা জীবনেই বলতে গেলে তিনটি জিনিস ব্যবহার করিনি। মানিব্যাগ, হাতঘড়ি ও রোদ-চশমা। এগুলো বাদ দিয়েও দিব্যি জীবন কেটে যায়। টাকাপয়সা রাখি জামার বুকপকেটে, ঘড়ি না থাকলেও আকাশ দেখে সময় বোঝা যায় এবং কালো কাচের চশমা পরে পৃথিবীর স্বাভাবিক রং দেখা থেকে নিজেকে কখনও বঞ্চিত করিনি। মানিব্যাগটি হারানো নিয়ে দীপক যখন খুবই শোকগ্রস্ত, তখন আমার আরও বেশি দুশ্চিন্তা, এরপর আমাদের চলবে কী করে? কালীবাড়িতে আমাদের তিনদিনের বিছানা ভাড়া দিতে হবে বারো টাকা, আমার কাছে রয়েছে মাত্র এগারো টাকা আট আনা। সেই টাকাটা জমা দিয়ে, আজই যদি ফেরার জন্য রওনা দিই, দিল্লিতে ট্রেন বদল করে কলকাতায় পৌছতে তিন-সাড়ে তিনদিন লেগে যাবে। এই ক’দিন আমরা খাব কী? সেই বয়সে সর্বক্ষণ খিদে পায়, পেট ভরলেও মন ভরে না, আইসক্রিম-কেক-পেসট্রির দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হ্যাংলার মতন তাকাতে তাকাতে যাই, সবচেয়ে কম খরচের রুটি-তরকা খেতে হয়। অনাহারের সম্ভাবনাতেই বুক কেঁপে ওঠে, হাতে একটাও পয়সা থাকবে না, দীর্ঘ তিনদিনের ট্রেন যাত্রা।…কালীবাড়িতে ফিরে গালে হাত দিয়ে ভাবতে ভাবতেও কূলকিনারা পাইনা। শেষ পর্যন্ত একটাই উপায় মনে আসে, দুপুরের দিকে বিশেষ কেউ থাকে না এখানে, ম্যানেজার কর্মচারীরা বিশ্রাম নেয়, ব্যাগ দুটি হাতে নিয়ে আমাদের নিঃশব্দ পলায়ন, দৌড়ে গিয়ে রেল স্টেশনে একগাদা বস্তার আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকি চোরের মতন, ট্রেন আসতে এখনও দেড় ঘণ্টা দেরি, প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, এই বুঝি কালীবাড়ির লোকেরা পুলিশ নিয়ে আমাদের ধরতে আসবে, ধরার পর জেলে দেবার আগে খুব মারবে! অল্প বয়স থেকেই দীপকের চোখে চশমা, মার খাওয়ার সময় চশমা ভেঙে গেলে কী হবে, সেই চিন্তায় দীপক বেশি কাতর।

এরপর দীর্ঘকাল সেই বারো টাকা ফাঁকি দেবার জন্য অনুশোচনা বোধ করেছি। অনেকবার মনে হয়েছে, আবার সিমলায় গেলে কালীবাড়িতে সেই টাকাটা শোধ দিয়ে আসব। কিন্তু সিমলায় আর দ্বিতীয়বার যাওয়ার কোনও উপলক্ষ ঘটেনি। এত বছর বাদে বারো টাকা শোধ দিতে গেলে ওরা কত টাকা সুদ চাইবেন কে জানে! তাতে ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যেতে পারে। অবশ্য সেই আমলের খাতাপত্রেও আমাদের নাম পাওয়া যাবে না, আমরা তো ভ্রমণ করেছি প্রশান্ত ও সুশান্ত দাশগুপ্তর ছদ্মনামে!

প্রোন্তর কাছ থেকে পাস নিয়ে আমরা কয়েক বছর এরকম অভিযান চালিয়েছি, মাঝে মাঝে ছোটখাটো বিপদে পড়তে হয়েছে বটে, সে এমন কিছু না। শুধু যে বহু শহর ও ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য স্থানে ঘুরেছি তাও নয়, দেখেছি মানুষ, নানা রকমের মানুষ, বহু ভাষাভাষী মানুষ, বাংলার বাইরে গিয়ে ভারত নামে দেশটার রূপও বোঝা গেছে। ভাষার জন্য তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি, তামিল-তেলেগুদের দেশে গিয়েও ভাঙা ভাঙা ইংরিজি ও আকার-ইঙ্গিতে কাজ চলে গেছে। দু’-একবার মজাও হয়েছে বেশ। ট্রেনে রিজার্ভেশনের কোনও বালাই ছিল না, ঠেলাঠেলি করে উঠে পড়তে হত থার্ড ক্লাস কামরায়। তখন টু-টিয়ার, থ্রি-টিয়ার চালু হয়নি, তলার বেঞ্চ যাত্রীদের, ওপরের তাক মালপত্র রাখার জন্য। আমাদের সঙ্গে মালপত্র সামান্য, কোনওক্রমে ওপরের তাকে উঠে শুয়ে পড়তাম পা ছড়িয়ে। পাঁউরুটি আর জ্যামের শিশি থাকত সঙ্গে, এবং কলা, যাত্রাপথে তাই দিয়েই ক্ষুন্নিবৃত্তি হত। একবার সেইরকমভাবে প্রাতরাশ সেরেছি, গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে নীচে নেমে হাত ধোওয়ার প্রবৃত্তি হয় না। দীপকের একটি সুদৃশ্য বড় ফ্লাক্স ছিল, সেই ফ্লাস্কের ঢাকনায় জল ঢেলে আঙুল ডুবিয়ে নেওয়া, তারপর সেই ময়লা জল ফেলতে হবে, দীপক ঝুঁকে পড়ে নীচের তলার এক ব্যক্তির দিকে ঢাকনাটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ফেক দেও না ভাই! লোকটি একবার দীপকের মুখের দিকে একবার ঢাকনাটার দিকে তাকাল, তারপর সেটা ফেলে দিল চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে। দীপক আঁতকে উঠে হা-হা করতে লাগল, হাসতে লাগল অন্য যাত্রীরা, সেই লোকটি সরল মুখে এদিকে চাইছে, তাকে ফেলে দিতে বলা হয়েছে, সে ফেলে দিয়েছে, এতে দোষ কী হয়েছে সে বুঝতেই পারছে না! ঢাকনার অভাবে কানা হয়ে গেল ফ্লাক্সটা! একপাটি জুতোরই মতন ফ্লাস্কেরও শুধু ঢাকনা কোথাও কিনতে পাওয়া যায় না।

আমাদের দুই সদস্যের দলটির দীপকই নেতা। অন্যান্যদের সঙ্গে বেশির ভাগ কথাবার্তা সে-ই বলে। সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কয়েক মিনিটের মধ্যে ভাব জমিয়ে ফেলার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। মাঝে মাঝে গোলমালও করে ফেলত। যে কামরায় একজনও বাঙালি নেই, সেখানে সে অন্য যাত্রীদের নিয়ে রসিকতা করত বাংলায়, এক একজনের নাম দিয়ে দিত, যেমন, কেউ হোঁদলকুতকুত, কেউ কাকেশ্বর কুচকুচ, কেউ গজেন্দ্রগামিনী। আমাদের দু’জনেরই ঘড়ি নেই, সময় জানতে হত অন্যদের কাছ থেকে। একবার দুপুরে এক স্থানে ট্রেন অনেকক্ষণ থেমে আছে, দারুণ গরম আর অস্বস্তিকর অবস্থা, নীচে একদল লোক দুর্বোধ্য ভাষায় গলা চড়িয়ে তর্ক করছে অনেকক্ষণ, দীপক আমাকে বলল, ওই বেড়ালচোখে কালো মানিকটাকে জিজ্ঞেস করো তো কটা বাজে! আমি সেই লোকটির দিকে হাত তুলে, কবজিতে আঙুল ছুঁইয়ে ইঙ্গিতে সময় জানতে চাইলাম। লোকটি পরিষ্কার বাংলায় বলল, পৌনে তিন। আমার গায়ের রং কালো বলে কালোমানিক বানালে, কিন্তু বেড়ালচোখো কেন বললে ভাই?

এরকম অবস্থাকেই বলে, ধরণী দ্বিধা হও!

ভ্রমণের সময় আমাদের নাম প্রশান্ত ও সুশান্ত, কিন্তু দীপক নিজের নামটি এমন ভালোবাসে যে অন্য নাম মনে থাকে না। অনেক জায়গায় লেক্ট লাগেজে আমি প্রশান্ত দাশগুপ্ত নামে ব্যাগ জমা দিয়েছি, ফিরে এসে সেগুলো ছাড়াবার সময় আমার ভাই সই করেছে দীপক মজুমদার! একবার চলন্ত ট্রেনে চেকার এসে পাসটি পরীক্ষা করতে করতে আমাদের নাম জিজ্ঞেস করল, আমি কিছু বলার আগেই আমার ভাই বলে বসল দীপক মজুমদার! চেকার সাহেবের ভুরু কুঁচকে যেতেই সে-বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ডানাম, ওটা ওর ডাকনাম, বাঙালিদের তিন-চার রকম ডাকনাম হয়, আমাদের আসল নাম দাশগুপ্ত! চেকার চলে যাবার পর দীপককে ভর্ৎসনা করতে যেতেই সে এক অকাট্য যুক্তি দিয়ে বসল। বলল, নোকটা যদি বাবার নাম জিজ্ঞেস করত? তুমি নিজের নাম যা-খুশি বলতে পারো, কিন্তু বাপের নাম বদলাতে পারবে?

যেবার ওয়ালটেয়ারের দিকে যাই, সেবারে মজা হয়েছিল খুব। এখন বিশাখাপত্তনম বা ভাইজাগ নামেই সকলে শহরটিকে চেনে, তখন ওয়ালটেয়ার নামটিই প্রচলিত ছিল বেশি, অনেক সাহেব-সুবো তখনও রয়ে গিয়েছিল সেখানে। নীল সমুদ্র ও শৈলশিখর সমন্বিত সেইনগরটি বড়ই মনোহর। সেখানে কী করে যেন আমরা একটা যাযাবর দলের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিলাম। যাযাবর কিংবা নৌটঙ্কির দলও হতে পারে, পনেরোকুড়ি জন নারী-পুরুষের একটি গোষ্ঠী, তারা পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, হঠাৎ জনবহুল কোথাও থেমে গিয়ে গান ও নাচ শুরু করে, একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় বেশ কিছু পয়সা পড়ে, দুপুরে কোনও মাঠের মধ্যে ইটের উনুন বানিয়ে নিজেরাই রান্না করে খায়, রাত্তিরে শুয়ে থাকে কোনও মন্দিরের চাতালে। অর্থাৎ ‘ভোজনং যত্র তত্র, শয়নং হট্ট মন্দিরে’ একেবারে আক্ষরিকভাবে সত্য ওদের জীবনে। দীপকের উদাত্ত গানের গলা, বাংলা ছাড়াও অনেক রকম গান জানে, ‘পিয়া মিলন কো জানা আ আ আ, এই গানটি হাত-পা ছুড়ে চমৎকার গায়, আমিও মোটামুটি দোয়ারকির কাজ চালাতে পারি, আমাদের দু’জনকে তারা বিনা প্রশ্নে দলে নিয়ে নিল। আমরা অবশ্য রাত্তিরবেলা শুতে যেতাম এক ধর্মশালায় আর ওদের সঙ্গে খেতাম শুধু দুপুরে। আমাদের বয়স আর একটু বেশি হলে ওই দলের কোনও যাযাবরীর প্রেমে পড়ে তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসের নায়কের মতন হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু ছিল না, কিন্তু আমরা প্রেমিক হলেও মেয়েরা পাত্তা দেবে কেন!

মাত্র চারদিন ছিলাম সেই দলের সঙ্গে। নির্দিষ্ট কোনও বাসস্থান নেই, মাথার ওপর আচ্ছাদন পর্যন্ত নেই, আগামীকাল কী করে খাদ্য জুটবে তারও ঠিক নেই, ঝড়বৃষ্টি হলে রাস্তার নাচ-গানের দর্শক-শ্রোতা জোটে না, এর ওপর আছে পুলিশের উৎপাত, তবু ওরা কী করে এমন আনন্দে মেতে থাকে, সেটাই রহস্য। সব সময় ইয়ার্কি-ঠাট্টা, হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে, একজনের পাত থেকে আর একজন খাবার তুলে নেয়, তাতে নকল বিবাদ হয়, অন্যরা তখনও হাসে। মনে হয় যেন এদের চেয়ে সুখী আর কেউ নয়! চারদিন কেন, সারা জীবনই হয়তো আমরা ওদের সঙ্গে মিশে যেতে পারতাম, কিন্তু হঠাৎ দুটি ছেলের ভেদবমি শুরু হয়ে গেল, অর্থাৎ কলেরা, কলেরা অত্যন্ত ছোঁয়াচে, তখন চিকিৎসাও তেমন কিছু ছিল না, বিদেশ বিভুই-এ কলেরায় প্রাণত্যাগ করতে তেমন ইচ্ছে হল না আমাদের, সুতরাং ওদের কাছ থেকে বিদায় নিতেই হল।।

ওই দলের এক তরুণীর নাম ছিল চুলবুলি, হ্যাঁ, এরকমই নাম অন্যদেরও। সে খুব একটা সুন্দরী ছিল না, আধ-ময়লা রং, সামান্য ট্যারা এবং তার বাঁ হাতের পাঞ্জাটা সম্পূর্ণ কাটা, মনে হয় যেন কেউ এক কোপে তার কবজি থেকে কেটে নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, সে কাহিনী শোনা হয়নি। তবু তার জীবন-স্ফুর্তি কম ছিল না একটুও, সেই নুলো হাত দিয়েই রঙিন ঘাগরা পরে সে এমন নাচের তরঙ্গ তুলত যে চোখ ধাঁধিয়ে যেত। পরবর্তীকালে দীপক যখন ‘বেদনার কুকুর ও অমল’ নামে একটি নাটক লেখে তখন বেদনার চরিত্রে এসেছিল ওই চুলবুলির অনেকখানি আদল। দীপক লিখেছিল বলেই ওই বিষয়টি আমি কখনও স্পর্শ করিনি।

ঠিক বিপদ নয়, মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল হায়দরাবাদে। হায়দরাবাদ তখনও নেটিভ স্টেট। কাশ্মীরের গরিষ্ঠ সংখ্যক অধিবাসী মুসলমান, কিন্তু রাজা ছিলেন হিন্দু। সেই কাশ্মীর ভারতে যুক্ত হওয়ার ফলে যে চরম দুর্ভোগ শুরু হয়, তা আমরা এখনও ভোগ করছি। ভারতের মধ্যস্থলে হায়দরাবাদ রাজ্যটির নিজাম মুসলমান, অধিবাসীরা মিশ্রিত, নিজাম ভারত ইউনিয়নে যোগ দিতে চাননি, যদিও ভৌগোলিক কারণেই পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার অসুবিধে ছিল, তবু একদল রাজাকার বাহিনী ঝঞ্ঝাট পাকিয়ে তুলছিল। সে সময় ভারতের সেনাবাহিনীর অধিনায়ক এক বঙ্গসন্তান, প্রমথ চৌধুরীদের পরিবারের জয়ন্তনাথ চৌধুরী, তিনি সসৈন্যে হায়দরাবাদে ঢুকে নিজামকে ক্ষমতাচ্যুত করেন, কাশ্মীরের মতন পাকিস্তানি বাহিনী এত দূর এসে দখলদারি দাবি করতে পারেনি।

আমরা যখন হায়দরাবাদে যাই তখনও সেখানে নিজামের রাজত্ব চলছে। নিজাম তখন ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি, তার কৃপণতার নানা কাহিনীও প্রচলিত ছিল। শোনা যায়, তাঁর একটা খাবার টেবিল ছিল সম্পূর্ণ স্বর্ণময়, তাতে একসঙ্গে ষাটজন লোক বসে খেতে পারে। কিন্তু একসঙ্গে ষাটজন লোক খাইয়ে পয়সা খরচ করতে নিজাম মোটেই রাজি ছিলেন না। তখনও সেই স্বতন্ত্র দেশীয় রাজ্যে নিজামের নিজস্ব মুদ্রা চলছে। তার মূল্যমান ভারতীয় মুদ্রার চেয়ে কিছু কম। আমরা কোনও দোকানে ঢুকে বারো আনার (পঁচাত্তর পয়সা) খাবার খেয়ে ভারতীয় পাঁচ টাকা দিলে পাঁচ টাকা দু’আনা ফেরত পেয়ে কৌতুক বোধ করতাম খুব। জিনিসপত্রের দাম অবিশ্বাস্য রকম সস্তা। দীপক সব ব্যাপারেই সৌখিন। মাঝে মাঝেই সে তার কাবুলি জুতো পালিশ করায়। ওখানে এক মুচিকে দিয়ে জুতো পালিশ করে ভারতীয় আট আনা দিয়েছিল। মুচিটি দারুণ অবাক হয়ে মুদ্রাটি নেড়েচেড়ে দেখে হঠাৎ তার সব সরঞ্জাম গুটিয়ে নিয়ে চলে গেল। পরে জেনেছিলাম, ওখানে জুতো পালিশের রেট মাত্র চার পয়সা, সে আট আনা পেয়েছে, তাও ভারতীয় মুদ্রায়, সেটাই বলতে গেলে তার সারা দিনে উপার্জন। সে ভেবেছিল আমরা ভুল করে দিয়েছি, আবার ফেরত চাইতে পারি।

হায়দরাবাদে সকালবেলা পৌঁছে আমরা যথারীতি হোটেল না খুঁজে, স্টেশনের লেক্ট লাগেজে ব্যাগ দুটো জমা করে বেরিয়ে পড়েছি। হায়দরাবাদ-সেকেন্দ্রাবাদ এই যুগ্ম শহরে দ্রষ্টব্য বস্তু অনেক। সলারজং মিউজিয়ামের তো তুলনা নেই। সারাদিন ঘোরাঘুরি করছি, সবচেয়ে বেশি আহ্লাদ হচ্ছে দারুণ বিরিয়ানি-গোস্ত পাওয়া যাচ্ছে অতি অল্প দামে। এত কম খরচ বলেই সন্ধেবেলা আমরা ঠিক করলাম, একবার অন্তত কোনও ভদ্রগোছের হোটেলে চেয়ার-টেবিলে বসে খাব। ঢুকে পড়লাম এক আলো ঝলমলে রেস্তোরাঁয়। মিনিউ কার্ডে খাবারদাবারের দাম দেখে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, অর্ডার দিতে যাচ্ছি, দীপক হঠাৎ বলে উঠল, আগে সে একটু মদ খাবে। মদ? আমি প্রবল আপত্তি তুললেও সে গ্রাহ্য করল না, আমি ও জিনিস কখনও ছুঁয়ে দেখিনি, কিন্তু দীপক জানাল, সে আগে খেয়েছে, বালিগঞ্জ অঞ্চলে বিখ্যাত ব্যক্তিদের বাড়িতে নাকি সবাই পান করে। শেষ পর্যন্ত দীপক শুধু নিজের জন্য এক গেলাসের অর্ডার দিল।

মদ্যপানের প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধু বিমান মল্লিকের কথা মনে পড়ে। বিমান হাওড়ার এক বনেদি বাড়ির ছেলে। কয়েক বছর পর সে আমাকে লাইট হাউসে একটা সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন লাইট হাউসের দোতলায় অত্যন্ত সাজানো-গোছানো একটি রেস্তোরাঁ কাম-বার ছিল, সেখানকার বেয়ারাদের পোশাকের কী জাঁকজমক, মোগল-পাঠানদের মততা, মাথায় সুদৃশ্য পাগড়ি, গম্ভীর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যবহার। ফিল্ম শুরু হতে দেরি আছে, সেই রেস্তোরাঁয় নিয়ে এসে কিছু খাবারের অর্ডার দিতে দিতে বিমান নিচু গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করল, একটু ড্রিঙ্ক করবে নাকি? ততদিনে আমার নীতিবাগিশতা কিছুটা কমে এসেছে, মনে হল, একবার চেখে দেখলে মন্দ কী! এক দীর্ঘকায় বেয়ারাকে ডেকে বিমান ফিসফিস করে বলল, আমাদের এমন কোনও মদ দিতে পারেন, যাতে মুখে গন্ধ পাওয়া যাবে না? বেয়ারাটি মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। অবিলম্বে সে নিয়ে এল তলার দিকে সরু, ক্রমশ ওপরের দিকে চওড়া দুটি লম্বা সুদৃশ্য গেলাস ভর্তি পানীয়। সেটার নাম বলল গিমলেট। অর্থাৎ জিন ও লাইম। বিমানেরও সেই প্রথম হাতেখড়ি। সভয়ে এদিক ওদিকে তাকিয়ে দু’জনে চুমুক দিলাম একসঙ্গে, তারপরই মুখ দুটি উদ্ভাসিত হয়ে গেল এক দিব্য আনন্দে। এর নাম মদ? এত অপূর্ব সুস্বাদু? তবে লোকে এর এত বদনাম করে কেন?

এরও বেশ কয়েক বছর পর বিমান মল্লিকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল লন্ডন শহরে। বিমান এখন সেখানকার খ্যাতনামা ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। প্রথম যখন লন্ডনে দেখা হল, তখন সে আর্ট কলেজে পড়তে পড়তে সন্ধেবেলা কোনও পানশালায় আংশিক কাজ করে। কথায় কথায় সে জিজ্ঞেস করেছিল, সুনীল, তোমার মনে আছে লাইট হাউসের সেই রেস্তোরাঁয় আমাদের মদ খাওয়া? বাচ্চা ছেলে দেখে ব্যাটা আমাদের গালে চড় মেরেছিল। দাম নিয়েছিল মদের, কিন্তু এক ফোঁটাও মদ ছিল না, স্রেফ সরবত! এখন আমি জানি, আর যারই গন্ধ লুকোনো যাক, জিনের গন্ধ লুকোনো যায় না!

যাই হোক, সেবারে হায়দরাবাদে দীক কী পান করেছিল জানি না, ছোট গেলাসে দিয়েছিল সবুজ রঙের পানীয়। সেইটুকু শেষ করেই দীপক ইংরিজি বলতে লাগল, রাস্তায় বেরিয়ে দু’হাত ছড়িয়ে বলল, আই অ্যাম ফ্লাইং! তারপর সে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে, আমাকে ধরে আনতে হয়। এইসব হুটোপাটির পর আমাদের স্টেশনে ফিরতে এগারোটা বেজে গেল। রাত দশটায় লেফট লাগেজ রুম বন্ধ হয়ে গেছে, আমাদের ব্যাগ দুটি ফেরত নেবার উপায় নেই। রাত্তিরেই অন্য ট্রেন ধরার কথা ছিল, তা আর সম্ভব নয়, এর মধ্যে বেশ শীত লাগতে শুরু করেছে। সেটা সেপ্টেম্বর মাস, দিনের বেলা বেশ গরম ছিল, ঘামে ভিজেছি পর্যন্ত, অথচ রাত্তিরে এমন শীত, এ কী আজব শহর! যত রাত বাড়ে, তত শীতও বাড়ে। থার্ড ক্লাসের যাত্রীদের অপেক্ষাগার উন্মুক্ত জায়গায়, সেখানে তিল ধারণের স্থান নেই। আমাদের বসে থাকতে হবে বেঞ্চে। ব্যাগে আমাদের সোয়েটার আছে, চাদর আছে, লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে ব্যাগ দুটো দেখাও যায়, শেষ পর্যন্ত আমরা ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে দোষারোপ করতে লাগলাম পরম্পরকে। ঝগড়ায় তবু যদি গা গরম হয়!

মধ্যরাত্রি পার হয়ে যাবার পর, প্ল্যাটফর্ম একেবারে শব্দহীন, শুনশান, তখন দুটি ভিখিরি কিংবা কুলিজাতীয় ব্যক্তি আমাদের অদূরে দুটি পুঁটলি নিয়ে বসল মেঝেতে। বেশ যত্ন করে তারা বিছানা পাতল, একটা বিড়ি শেষ করে শুয়ে পড়ল কম্বল চাপা দিয়ে। তাতে আমাদের শীতবোধ বেড়ে গেল অনেকগুণ, ওরা কী আরামে ঘুমোচ্ছে, আমাদের তুলনায় ওরা এখন রাজার মতন সুখী। কিছুক্ষণ পর দীপক আর সহ্য করতে পারল না, ওদের একজনের পাশে শুয়ে কম্বলটা টেনে নিল। লোকটি ঘুমের মধ্যে উঃ আঃ করে ঠেলল কয়েকবার, তারপর উঠে বসে দীপককে দেখল। দীপকের করুণ, ভয়ার্ত মুখ দেখে তার বোধহয় মায়া হল, বিনা বাক্য ব্যয়ে সে শুয়ে পড়ল আবার।।

দ্বিতীয় ব্যক্তিটির পাশে গিয়ে আমি কিন্তু শুতে পারলাম না। একটু চেষ্টা করেও উঠে আসতে হল৷ একজন ভিখিরি কিংবা কুলির পাশে শোব না, কম্বলটায় দুর্গন্ধ, এসব ভাবিইনি। আমার মুশকিল এই, আমি অন্যপুরুষ মানুষের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কিছুতেই শুতে পারি না, মামা কাকা-দাদা স্থানীয়দের সঙ্গেও না, আমার দারুণ অস্বস্তি হয়। লোকটির গায়ের সঙ্গে সেঁটে, ওইটুকু কম্বলের ভাগ নেওয়ার চেয়ে সারারাত শীত সহ্য করাও ভালো।

আঠারো

ভ্রমণের নেশা যত পেয়ে বসে, শুধু দূরদূরান্তে নয়, একটু সুযোগ পেলেই টুকটাক কাছেপিঠে, ততই আমার কলেজীয় পড়াশুনোর অবনতি হতে থাকে। কলেজ বদলের গ্লানি ও পাঠ্য বিষয়ের প্রতি অনাগ্রহ, তার ফলে কবিতার খাতার পৃষ্ঠাগুলি ভরে যায়। দ্বিতীয় বছরের শেষে যাচাই পরীক্ষায় আমার ফল হল ভয়াবহ, কেমিস্ট্রি ও অঙ্কে পাস নম্বরের চেয়েও অনেক কম, ফিজিক্স ও বায়োলজিতে মোটামুটি পাস, ইংরিজি ও বাংলায় সকলের চেয়ে বেশি। কলেজ কর্তৃপক্ষ তবু আমাকে যাকে বলে অ্যালাউ’ করে দিলেন। তাই শেষের দু’এক মাস রাত জেগে পড়াশুনো করে কোনওক্রমে আই এসসি উত্তীর্ণ হওয়া গেল। বিজ্ঞানের ছাত্র কিংবা গবেষক হওয়া যে আমার ললাটলিপি নয়, তা এর মধ্যেই বোঝা গেছে। যদিও দু’বছর এই সামান্য বিজ্ঞান পড়াশুনোই দারুণ কাজে লেগেছে পরবর্তী জীবনে। ডিগ্রি অর্জনের পাঠ শেষ করার পরই বিজ্ঞানের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মায়, বিশেষত আকৃষ্ট হই ফিজিক্স বা পদার্থবিদ্যার প্রতি। গোটা বিংশ শতাব্দী জুড়েই বিজ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতিতে প্রধান ভূমিকা ফিজিক্সের। তার মধ্যেও আমার বিশেষ আকর্ষণ অ্যাস্ট্রোনমির অসীম রহস্যে। অ্যাস্ট্রোলজি বা জ্যোতিষশাস্ত্রে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই, কিন্তু অ্যাস্ট্রোনমির প্রতি আমি প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতন সারা জীবনের জন্য বাঁধা পড়ে আছি।

আমি জ্যোতিষীদের কাছে কখনও যাইনি, কিন্তু দু’-একটি মজার অভিজ্ঞতা আছে। উত্তর কলকাতায় ডাক্তার, কবিরাজদের মতনই জ্যোতিষীদের বহু চেম্বার ছিল, এ ছাড়া পথেঘাটে অনেক সাধু-সন্ন্যাসী ঘুরে বেড়াত এবং ভীরু-বিশ্বাসীদের ভবিষ্যদ্বাণী করত টাকা রোজগারের জন্য। স্নাতক পরীক্ষার পর ফলাফল প্রকাশের মাত্র কয়েক দিন আগে এক নির্জন দুপুরবেলা বাইরের ঘরে একা বসে আমি কিছু পড়ছি বা লিখছি, হঠাৎ জানলার পাশে একজন সাধু এসে দাঁড়ালেন এবং বললেন, তাঁকে দুটি টাকা দিতে হবে এবং তিনি আমার হাত দেখবেন। অন্য সময় হলে হাঁকিয়ে দিতাম, কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবার আগে সকলেরই মন একটু দুর্বল থাকে বোধহয়। এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, দেখুন তো আমার পরীক্ষার রেজাল্ট কেমন হবে? সাধুবাবাজি অনেকক্ষণ ধরে আমার হাত নিরীক্ষণ করলেন, কয়েকবার চকিত, বিস্মিত দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন আমার মুখের দিকে। তারপর হঠাৎ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে, কিছু না বলে, হন হন করে চলে গেলেন। আমার হতবাক অবস্থা! এর মানে কী, ডাহা ফেল? সত্যি কথা বলতে কী, ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল! লোকটি তো অনায়াসে আমাকে মিথ্যে কোনও স্তোকবাক্য দিয়ে দুটি টাকা উপার্জন করতে পারত। টাকা না নিয়েই চলে গেল, অর্থাৎ আমার এতই খারাপ অবস্থা যে তার বিবেকে বেধেছে! পুরো বিকেলটা বিমর্ষভাবে কাটিয়ে, তারপর দুশ্চিন্তা ঝেড়েই ফেললাম। বলাই বাহুল্য, সেবারে আমার পাস করা আটকায়নি! সেই সাধুটি প্রতারক নন, নিজের জ্যোতিষজ্ঞানের ওপর দৃঢ় আস্থা, অথচ সেই জ্ঞানটাই ভ্রান্ত।

এর বেশ কয়েক বছর পর এক সকালে থলি নিয়ে বাজারে চলেছি, হঠাৎ আমার সামনে পথ জুড়ে দাঁড়ালেন এক বিশাল চেহারার পুরুষ, মাথায় সর্পকুণ্ডলীর মতন জটা, মুখভর্তি দাড়ি, গায়ে একটি কালো কম্বল জড়ানো এবং চোখের দৃষ্টি তীব্র ধরনের। অত্যন্ত দুর্বোধ্য হিন্দিতে তিনি যা বললেন, তার মর্ম এইটুকু বোঝা গেল যে তিনি আসছেন হিমালয় থেকে, যাবেন গঙ্গাসাগরে, সেখানে কিছু একটা যজ্ঞ করবেন, তাতে পাঁচ কিলো ঘি লাগবে, সেই বাবদ আমাকে পঞ্চাশ টাকা সাহায্য করতে হবে। এর থেকে হাস্যকর প্রস্তাব আর কী হতে পারে? নিজেরাই ঘি খেতে পাই না, উনি কোথায় যজ্ঞের নামে ঘি পোড়াবেন, তাতে আমাকে সাহায্য করতে হবে? তিনি জলদগম্ভীর স্বরে আবার বললেন, ওই টাকা দিলে আমার পুণ্য হবে অনেক। আমার কপালে পুণ্যরেখা আছে … যে-মানুষ পরলোকে বিশ্বাস করে না, সে পুণ্যলোভী হতে যাবে কেন? তা ছাড়া আমি জ্ঞানত পাপ-টাপ কিছু করি না, সুতরাং বললুম, পথ ছাড়ুন, আমার কাছ থেকে কিছু সুবিধে হবে না। এবার তিনি কম্বল অনাবৃত করে দু’হাত দু’দিকে ছড়ালেন এবং বললেন, নাগা সন্ন্যাসী! তাঁর সম্মুখশরীর সম্পূর্ণ উলঙ্গ, রোমশ ও বলিষ্ঠ, কিন্তু তা দেখেই বা আমি ঘাবড়ে যাব কেন? সাধুটি চকিতে ডান হাতে আমার কপালে একটা টোকা মারলেন, তারপর সেই হাতটা দেখালেন আমাকে। হাতে একটা কোনও গাছের কাঁটা! হেসে তিনি বোঝাতে চাইলেন, আমার ললাটে বা ভাগ্যে এই কাঁটা বিধে ছিল, সেটা তুলে আনা হল। কাঁটাটি টিপতে লাগলেন দু’আঙুলে, সেটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল, সেই ধুলোর মতন কণ্টকচূর্ণ নস্যি ধরার মতন দু আঙুলে রেখে টিপতে লাগলেন কিছুক্ষণ, তার থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল বেরুতে লাগল, রীতিমতন টপ টপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে রাস্তায়। কী অলৌকিক কাণ্ডই না বটে! পকেট থেকে দুটো টাকা বার করে বললাম, তুমি তো বেশ ভালোই ম্যাজিক শিখেছ! ওই সব যজ্ঞফজ্ঞের কথা না বলে ম্যাজিক দেখাও না কেন? যাই হোক, তুমি একজন জাদুশিল্পী, তাই তোমাকে এই দর্শনী দিলাম!!

চেয়েছিলেন পঞ্চাশ, দুটো টাকা পেয়েই বেশ খুশি, এ যে প্রায় চোরবাজারের দরাদরি!

আরও অনেক বছর পর, একজন প্রসিদ্ধ জ্যোতিষী, যিনি এক সংবাদপত্রে প্রতিদিন মানুষের জন্মতারিখ মিলিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, একশো জন বাঙালির হাতের পাঞ্জার ছবি ছাপিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করতে চান। তিনি আমার ডান হাতের তালুটি নির্বাচন করেছিলেন, আমি ছবি তুলতে দিতে অস্বীকার করে জানিয়েছিলাম, আমারটা নিয়ে কোনও লাভ নেই, মাতৃগর্ভে হাত মুঠো করে শুয়ে থাকার সময় তালুতে যেসব আঁকিবুকি রেখা ফোটে, তাতে মানুষের ভূত- ভবিষ্যতের ইতিহাস লিখিত হওয়া সম্ভব, এ আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। জ্যোতিষীটি প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে বিস্মিত করেছিলেন আমাকে। ঝপ করে আমার ডান হাত ধরে বলেছিলেন, আপনি যে হাত দেখায় বিশ্বাস করেন না, সেটাও লেখা আছে আপনার হাতের রেখায়!

জ্যোতিষীদের সঙ্গে সেটাই আমার শেষ সংসর্গ।

অবশ্য ছাত্রজীবনে শখের জ্যোতিষী অনেকেই সাজে। তরুণী মেয়েদের নবনীত কোমল হাত অনেকক্ষণ ধরে রাখার সেটাই তো একমাত্র নীতিসম্মত উপায়। আমিও অনেক মেয়ের করকমল দুহাতে ধরে বক-জ্যোতিষী সেজে অনর্গল মিথ্যে বলেছি। আমার সারা জীবনে কোনও সহপাঠিনী ছিল না, স্কটিশ চার্চ কলেজে একসময় আড্ডা দিতে যেতাম, বসন্ত কেবিনের আড্ডায় কে যেন দুষ্টুমি করে রটিয়ে দিয়েছিল যে আমি পণ্ডিতবাড়ির ছেলে, ভালো হাত দেখতে পারি। এই ধরনের রটনা যত অস্বীকার করা যায়, তত লোকের ভক্তি বাড়ে। তখন আমিও বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, ছেলেদের পারি না, শুধু মেয়েদের পারি। এক একজনের হাত ধরে অনেকক্ষণ বসে থাকতাম ধ্যানীর মতন, সেই হাতের ঘ্রাণ নিতাম। প্রত্যেকের হাতের ঘ্রাণ বিভিন্ন। প্রত্যেকটি মেয়েকেই বলতাম, তুমি একবার খুব দুঃখ পাবে। শুধু মিষ্টি মিষ্টি কথার বদলে এই কথাটা শুনে তাদের আয়ত চোখে বিশ্বাস ফুটে উঠত। সুখ সম্পর্কে নানারকম মতভেদ থাকতে পারে কিন্তু সকলেই দুঃখকে বিশ্বাস করে, জানে যে দুঃখ অমোঘ। সেই কতকাল আগে গৌতম বুদ্ধ বলে গিয়েছিলেন এই কথা।

আই এসসি’র পর বিজ্ঞান শাখায় আমি আর ভর্তি হব না ঠিক করে ফেলেছিলাম, বাবাও আপত্তি করেননি। আমার বড় সাধ ছিল ডাক্তারি পড়ার। ছেলেবেলা থেকেই ডাক্তারদের সম্পর্কে আমার মনে একটা বীরপূজার ভাব ছিল। মনে হত, ডাক্তাররাই মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু, তাঁরা যে শুধু অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচান তাই-ই নয়, অনেক পরিবারকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করেন। বাল্যকাল থেকে যে ক’জন চিকিৎসককে দেখেছি, প্রত্যেকেরই চেহারা সুন্দর, ব্যবহার মার্জিত, মনে হত, তাঁরা সাধারণ মানুষদের থেকে একেবারে আলাদা। আমার যেহেতু আদর্শের ভাবালুতা ছিল, তাই অনেক সময় স্বপ্ন দেখতাম, ডাক্তারি পাস করে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে গরিব- দুঃখী মানুষদের পাশে পাশে থাকব। (অনেক ডাক্তারি ছাত্রই সম্ভবত জীবনের শুরুতে এরকম কিছু ভাবে, তারপর জীবন তাদের অন্য দিকে নিয়ে যায়!) তখন ছাত্রসংখ্যা এরকম ভয়াবহ ছিল না, টাকা থাকলে ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হওয়া কঠিন ছিল না এমন কিছু। কিন্তু আমার পক্ষে ওই স্বপ্নটি একেবারেই অলীক, পাঁচ বছর ধরে ডাক্তারি পড়ার অর্থ-সামর্থ্য আমি কোথায় পাব? সুতরাং বিজ্ঞান ছেড়ে কলা বিভাগ, এখন যাকে বলে হিউম্যানিটিজ। দু’বছরের অনার্স, আমার পক্ষে ইংরিজি কিংবা বাংলা নেওয়াই স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু অস্বাভাবিক কোনও পথে ঠেলে দেওয়াই যে আমার নিয়তি। তখন সকলেরই ধারণা, ইংরিজি-বাংলা পড়লে চাকরি পাবার কোনও সম্ভাবনাই থাকে না, তাই বাবা আদেশ দিলেন, আমাকে অর্থনীতি পড়তে হবে। অর্থনীতি নিয়ে পাস করলে ব্যাঙ্কের চাকরি পাওয়া যায় এবং ব্যাঙ্কের চাকরি লোভনীয়। এবারেও প্রেসিডেন্সি বাদ, যেতে হবে ছাত্রীবর্জিত কোনও কলেজে, সিটি কলেজের অর্থনীতি বিভাগটি নাকি জোরালো। আমহার্স্ট স্ট্রিটের সে কলেজটি আমাদের গ্রে স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়।

কিছুদিন বেশ উৎসাহের সঙ্গেই অর্থনীতির ক্লাস করেছি। গোড়ার দিকে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনৈতিক বিজ্ঞান যুগ্মভাবে থাকে, তার ইতিহাসের দিকটা আমাকে আকৃষ্ট করে। তারপর শুরু হয় অঙ্ক, ক্রমশ কঠিন অঙ্ক, খুব জোর করে মনঃসংযোগের চেষ্টা করলেও সেই অঙ্কের জটিলতায় আমি চক্ষে ধাঁধা দেখি, খুব অসহায় বোধ হয়। ক্লাসে বসে থাকতে থাকতে বুঝতে পারি, আমার মুখখানা স্লান, ম্রিয়মাণ, অন্যরা আমার দিকে অবাকভাবে তাকায়। দু’-একটা পত্রপত্রিকায় তখন আমার কবিতা ছাপা শুরু হয়েছে, এক সহপাঠী একজন অধ্যাপককে সে কথা জানিয়ে দিতেই তিনি বিদ্রুপ করে বললেন, অ্য, কবি হয়ে তুমি ইকোনমিক্স পড়তে এসেছ? কবিতার সঙ্গে যে এর অহিনকুল সম্পর্ক! তোমাদের এক কবি লর্ড বায়রন অঙ্ক সম্পর্কে কী বলেছিলেন জানো? দুই আর দুইয়ে কেন পাঁচ হবে না? হ্যা হবে, বেশ করবে হবে!

হাত খরচের টানাটানিতে হ্যারল্ড ল্যাস্কির গ্রামার অফ পলিটিক্স বইখানা যেদিন কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানে বিক্রি করে দিই, সেদিনই বুঝেছিলাম, অর্থনীতিতে স্নাতক হওয়া আমার ইহজীবনে হবে না, কোনওরকমে পাস কোর্সে উতরে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। তখন আর অনার্সের বিষয় বদল সম্ভব ছিল না।

আমাদের সমসাময়িক ছিলেন অমর্ত্যকুমার সেন, প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি বিভাগে, সম্ভবত আমাদের চেয়ে এক বর্ষ ওপরে। তখনই খুব সুখ্যাত ছাত্র। এই সেদিন অমর্ত্যকুমার সেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাবার পর আমি একটি পত্রিকায় মন্তব্য করেছিলাম, এই মুহূর্তে অমর্ত্য সেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অর্থনীতিবিদ, আর আমি নিকৃষ্টতম!

মধ্য পথেই অর্থনীতির ক্লাস এড়িয়ে বাংলা অনার্সের ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতাম। সেখানে মোহিত চট্টোপাধ্যায়, শিবশঙ্কু পাল, ফণিভূষণ আচার্যের মতন উদীয়মান কবিদের সঙ্গে পরিচয় এবং একাত্মতা হয় সহজেই। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তখন সিটি কলেজের অধ্যাপক, তাঁর গল্প কবিতার আমি সে সময়ে বিশেষ অনুরক্ত, তাঁকে দেখা ও তাঁর কথা শোনার আগ্রহও দারুণ। বিভূতি চৌধুরী এবং জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তীও অত্যন্ত উচ্চমানের অধ্যাপক! তরুণ শঙ্করীপ্রসাদ বসু তখন সবেমাত্র সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেছেন। আমি বাংলা অনার্সের পরীক্ষা দিতে পারব না, তবু ওই সব ক্লাসেই কাটাই বেশি সময়।

ইতিমধ্যে দীপক মজুমদারও স্কুলের গণ্ডি শেষ পর্যন্ত পেরিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। আগেই বলেছি, স্কুলের ছাত্র হিসেবে দীপক একেবারেই বেমানান ছিল, কলেজে, এসে তার যথার্থ স্বরূপ বিকশিত হল, গানে-গল্পে কবিতা-আবৃত্তিতে সে জনপ্রিয় হয়ে উঠল অচিরেই। এরই মধ্যে দীপক দ্বিতীয়বার জেল খেটে এসেছে, তার উপলক্ষটি ঘটেছিল আমাদের চোখের সামনেই। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস থেকে আমরা কয়েক বন্ধু পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছি, তখন প্রায়ই হেঁটে ফিরতাম পয়সা বাঁচাবার জন্য, তখন প্রতিটি দিনই ছিল ঘটনাবহুল। নানারকম সরকার-বিরোধী আন্দোলন লেগেই ছিল, যখন তখন মিছিল, অবরোধ, ট্রাম-বাস বন্ধ, সোডার বোতল ছোঁড়াছুঁড়ি ও টিয়ার গ্যাস। সেদিনও সেরকম কিছু শুরু হয়েছিল, ঘন ঘন পুলিশের গাড়ি, লোকজন ছুটছে, এখানে সেখানে পথ-অবরোধ, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ট্রাম- বাস, তারই মধ্য দিয়ে অম্লানবদনে গল্প করতে করতে হাঁটছি আমরা। হেদো ছাড়িয়ে, রংমহল থিয়েটারের কাছাকাছি এসে হঠাৎ দীপক বলে উঠল, এখানে একটা রোড ব্লক করলে হয় না? আমাদের মতামতের অপেক্ষা না করেই সে রাস্তার ধারের একটা বড় টিনের ডাস্টবিন ধরে টানাটানি শুরু করল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাশের গলি দিয়ে বেরিয়ে এল একটা পুলিশের গাড়ি, টপাটপ পুলিশরা নেমে পড়তেই আমরা চোঁ চোঁ দৌড় লাগালাম, হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল শুধু দীপক।

তখনও আমাদের সন্ধের মধ্যেই বাড়ি ফেরার অভ্যেস, রাত সাড়ে আটটা-নটার সময় দীপকের মা আমাদের বাড়িতে খোঁজ নিতে এলেন। উত্তর কলকাতায় দীপকদের আর আত্মীয়স্বজন কেউ নেই, দীপকের মা একা, অসহায়, চক্ষু দুটি সজল। দীপক ধরা পড়েছে আর আমরা পালিয়ে এসেছি, এজন্য আমার অপরাধবোধ হয় তাঁর কাছে। সেই রাতেই আশু আর আমি গেলাম বড়তলা থানায়, দারোগাবাবুর কাছে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে কাকুতি-মিনতি করে বললাম, আমাদের বন্ধুকে ছেড়ে দিন, ও ওর মায়ের একমাত্র সন্তান, সামনেই পরীক্ষা …। দারোগাবাবু চোখ পাকিয়ে বাজখাঁই গলায় বললেন, সবই তো এক দলের। কেউ বাইরে, কেউ ভেতরে। তোমাদেরও কি ভেতরে যাবার সাধ হয়েছে নাকি? তিনি উঠে দাঁড়াতেই আমরা আবার দৌড় লাগালাম, পরীক্ষা নষ্ট করে জেল-খাটা বীরপুরুষ হবার সাধ আমাদের ছিল না!

সেবারে দীপকের দশ বারো দিন হাজতবাস হয়েছিল শুধু, আগেরবারের মতন রাজনৈতিক বন্দির সম্মান পায়নি, এটা পেটি কেস, ডাস্টবিন টানার জন্য ক্রিয়েটিং পাবলিক নুইসেন্স। দীপকের বিচারের দিনে আমরা কয়েক বন্ধু গিয়েছিলাম আদালতে। জীবনে সেই প্রথম আমার আদালত-দর্শন। ব্যাঙ্কশাল কোর্ট কিংবা স্মল জজেস্ কোর্ট, (কেন ব্যাঙ্কশাল কোর্ট নাম, তা আজও জানি না, এরকম কত শব্দ আমরা অর্থ না জেনে উচ্চারণ করে যাই।) সেখানে একটি কক্ষে সকাল দশটা থেকে বসে আছি। একটা কাঠের খাঁচার ওপাশে এক দল আসামীর মধ্যে দেখতে পাচ্ছি দীপককে, এর মধ্যে যেন আরও রোগা হয়ে গেছে, আমাদের সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই, ইঙ্গিত চলছে চোখে চোখে, একের পর এক আসামীর বিচার চলছে, দীপকের কখন ডাক পড়বে তার ঠিক নেই। অনেক বছর পর বিনয় মজুমদারকে ছাড়াতে আমি আর তারাপদ রায় গিয়েছিলাম আদালতে, কিন্তু দীপকের বেলায় এই প্রথমবার একটা সাঙ্ঘাতিক নাটকীয় ব্যাপার আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম।আদালতকক্ষটিতে বেশ ভিড়, দর্শক বা শ্রোতা বা পার্টির ঘেঁষে বসে আছে পাঁচ-সাতটি স্ত্রীলোক, তাদের মধ্যে কেউ আবার মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। এক সময় বিচার চলছে একটি যুবকের, চোখ দুটি এমন লাল যে মনে হয় তখনও নেশাগ্রস্ত, পান-খাওয়া ঠোঁট, চুল খাড়া খাড়া, লুঙ্গি ও সবুজ গেঞ্জি পরা, দেখলেই মনে হয় চোর কিংবা স্মাগলার কিংবা গুণ্ডা এরকম কিছু ছাপ মারা আছে তার গায়ে। সরকারি উকিলের একঘেয়ে বিবরণ চলছে, এরই মধ্যে হঠাৎ সেই যুবকটি এক লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল আসামীর কাঠগড়া থেকে, হিংস্র-ভাবে ছুটে এল সেই স্ত্রীলোকদের দিকে। ভয় পেয়ে সবাই সরে গেল, প্রায় চোখের পলকে কিছু বুঝতে না-বুঝতেই আমরা দেখলাম, ওদের মধ্যে একটি স্ত্রীলোককে হিঁচড়ে বার করে যুবকটি তার মুখ চেপে ধরেছে, গলগল করে বেরিয়ে এল রক্ত। প্রথমে ভেবেছিলাম বুঝি সে স্ত্রীলোকটির একটা চোখ উপড়ে নিচ্ছে, তা নয়, যুবকটির হাতে লুকনো ছিল একটি ব্লেড, তা দিয়ে সে নাকটা কেটে দিয়েছে ওই স্ত্রীলোকটির। কয়েক মুহুর্তের ব্যাপার, তার পরেই আদালতের রক্ষীরা এসে যুবকটিকে জাপটে ধরে পেটাতে শুরু করে, স্ত্রীলোকটির আধখানা নাক পড়ে আছে মাটিতে। আমরা তখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক, এসব ঘটনার মর্ম বোঝার কথা নয়, তবু অভিজ্ঞতা সব শিখিয়ে দেয়। লোকজনদের পরবর্তী সরব আলোচনা থেকে বোঝা গেল, যাকে আন্ডার ওয়ার্লড বলে, ওই যুবক ও স্ত্রীলোকেরা সেখানকার বাসিন্দা, ওদের নিজেদের মধ্যে কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে, তবে তার নাক কেটে দেওয়াই প্রতিশোধের রীতি। স্ত্রীলোকটি ঠিক কীভাবে বিশ্বাসঘাতিনী সে গল্প জানা হয়নি, কিন্তু যুবকটির জেদ ও সাহস দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম!

দীপকের সঙ্গে স্কটিশ চার্চ কলেজে আড্ডা দিতে গিয়ে আলাপ হয় তার সহপাঠী আনন্দ বাগচীর সঙ্গে, তখনই প্রচুর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয় তার কবিতা। ওদের আর এক সহপাঠী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গল্প লেখে; দীপেন শারীরিকভাবে ছোটখাটো কিন্তু মানুষ হিসেবে খুব বড় মাপের, পরবর্তীকালে তার সঙ্গে আমার গভীর সখ্য হয়। সেই বয়েসেই দীপেন ‘আগামী: মাঝি’ নামে একটি উপন্যাস লিখে ফেলেছিল। আর এক বন্ধুর নাম স্বপন দাস, সেও বেশ লেখালেখি করে, ছবি আঁকে, সব সময় হাসতে ভালোবাসে। একদিন মাঝ রাত্তিরে একা ঘরে বসে বাঘের ছবি আঁকতে আঁকতে হঠাৎ তার ঘর বাঘের গায়ের গন্ধে ভরে যায়, ভয় পেয়ে সে ছবি আঁকা বন্ধ করে ফেলে!

কফি হাউসের আড্ডার সময়ও বাড়তে থাকে ক্রমশ। শুধু সাহিত্য নয়, রাজনীতির প্রসঙ্গ নিয়ে তর্কাতর্কিই হয় বেশি। সারা দেশের হাওয়া খুব গরম, সেই আঁচ থেকে গা বাঁচানো কারও পক্ষে সম্ভব নয়। দীপক তখন কমিউনিস্ট পার্টির উগ্র সমর্থক, দীপেনের পরিবার কংগ্রেসী। তার এক দিদি ও পিসি পশ্চিমবাংলার মন্ত্রীও হয়েছিলেন, কিন্তু দীপেন দৃঢ়ভাবে বামপন্থী। আমিও ওদেরই সহগামী। কমিউনিস্ট পার্টির স্টাডি সার্কেলে আমি তখন বস্তির ছেলেদের বিনা পয়সায় পড়াই, আবার দাদাদের কাছে রাজনীতির পাঠ নিই, ছাত্রদের মিটিং-মিছিলে যাই নিয়মিত। আমার রাজনৈতিক জীবন স্বল্পস্থায়ী, এই সময়কার দু’বছর তা তুঙ্গে উঠেছিল। ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারতে প্রথম যে সাধারণ নির্বাচন হয়, তাতে কলকাতার উত্তর-পূর্ব কেন্দ্রের কমিউনিস্ট প্রার্থী হন অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, আমাকে একটি বুথে তাঁর পোলিং এজেন্ট হতে হয়েছিল। সে দায়িত্ব পেয়ে বেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীর ভাব হয়েছিল, যদিও আমার নিজেরই তখন ভোট দেবার বয়েস হয়নি। সেবারে প্রায় সমস্ত বামপন্থী দলগুলি জোট বেঁধে সংযুক্ত সমাজবাদী সংস্থা গড়েছিল। বটকৃষ্ণ পাল এভিনিউয়ের একটি বুথে আমি পোলিং এজেন্ট হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম, সামনে ভোটার লিস্ট, হাতে পেন্সিল, সন্দেহজনক ভোটারদের বাবার নাম, বয়েস ইত্যাদি নিয়ে জেরা করাই কাজ। সকাল ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ডিউটি,এর মধ্যে আমাকে হাতখরচ দেওয়া হয়েছিল ছ’আনা (সাঁইত্রিশ পয়সা), আর আমার পাশে বসা কংগ্রেসের পোলিং এজেন্ট সগর্বে জানিয়েছিল, তার বরাদ্দ তিন টাকা, তা ছাড়াও কারা যেন। চটা পর্যন্ত ডিউটি, এর মধ্যে একবার কিছু খেতে হবে তো, আর কয়েকবার চা, সে জন্য আমাকে হাতখরচ দেওয়া হয়েছিল ছ’আনা (সাঁইত্রিশ পয়সা), আর আমার পাশে বসা কংগ্রেসের পোলিং এজেন্ট সগর্বে জানিয়েছিল, তার বরাদ্দ তিন টাকা, তা ছাড়াও কারা যেন তাকে পাঠাচ্ছিল বিরিয়ানির প্যাকেট, ঘন ঘন চা। কিন্তু দৈন্যই যেন আমাদের গর্ব, শুধু রুটি আলুর দম খাওয়ার মধ্যে আছে আত্মত্যাগের আদর্শ, সে ছেলেটি চা খাওয়াতে চাইলে প্রত্যাখ্যান করেছি। সেই নির্বাচনে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সসম্মানে জয়ী হওয়ায় আমরা দল বেধে নাচানাচি করেছি রাস্তায়।

শুধু পোলিং এজেন্টের দায়িত্বই নয়, কাছাকাছি সময়ে একটি উপ-নির্বাচনে নকল ভোট দেওয়ার দীক্ষাও হয়ে গেছে। কাজটা তেমন কঠিন কিছু নয়, ভোটার লিস্ট দেখে খুঁজে বার করতে হয় কাছাকাছি বয়েসের ক’জনের নাম আছে, তাদের কে কে ভোট দেয়নি, সেই নাম মুখস্থ করে ছুটে যাওয়া। একবার ভোট দিলে আঙুলের ডগায় কালো টিপ দিয়ে দেয়, কে যেন আবিষ্কার করল দেশলাই কাঠির বারুদের দিকটা জলে ভিজিয়ে ঘষাঘষি করলে সেই দাগ উঠে যায়। সত্যি তাই, মিনিট পাঁচেক লাগে। বাগবাজারে বিভিন্ন বুথে শক্তি আর আমি একদিনে তিনটে ভোট দিয়েছি।

এর চেয়েও বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছি ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে। ট্রাম চলাচল ব্যবসার মালিক তখনও এক ব্রিটিশ কোম্পানি। ওই সময় সরকারের অনুমোদন নিয়ে কোম্পানি ভাড়া বাড়ায় এক পয়সা। এখন এক পয়সা চোখেই দেখা যায় না, সে সময় মাত্র ওই এক পয়সার জন্য কী ধুন্ধুমার কাণ্ড হয়েছিল তা প্রত্যক্ষদর্শী কারও কারও হয়তো মনে আছে। তখন যে-কোনও উপলক্ষে কংগ্রেস সরকারকে বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত করে ভোলাই বিরোধী দলগুলির উদ্দেশ্য। এই ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ আন্দোলনে জনসমর্থনও পাওয়া যায় প্রবলভাবে। সে সময় মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় বিদেশে, প্রফুল্ল সেন অস্থায়ী দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তিনি প্রতিবাদীদের শক্তি ও জনরোষ বুঝতে পারেননি, ১৪৪ ধারা জারি করে, পুলিশকে লাঠি-গুলি চালাবার নির্দেশ দিয়ে আগুন আরও বাড়িয়ে দেন। যাত্রীরা ট্রামে উঠে পুরনো ভাড়া দেবে, কন্ডাকটার তা নেবে না, বচসা শুরু হবার একটু পরেই কীভাবে যেন ট্রামে আগুন লেগে যায়। প্রচুর ট্রাম বাস পুড়েছিল, বোধহয় সেই সময় থেকেই ট্রাম-বাসে আগুন দেওয়া শুরু হয়। রাস্তার যেখানে সেখানে দেখা যেত দগ্ধ ট্রামের কঙ্কাল। প্রত্যেকদিন আমরা ছুটে যেতাম ওয়েলিংটন স্কোয়ারে, সেটাই আন্দোলনের কেন্দ্র, শুরু হত পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ, তাড়া খেয়ে আমরা পালাতাম অলিতে- গলিতে, আবার ফিরে এসে ছুঁড়তাম আধলা ইট। লাঠির ঘা আমার পিঠে পড়েনি, তবে টিয়ার গ্যাসে কেঁদেছি প্রচুর। ইট তো ছুঁড়েছিই, একবার খানিকটা বেশি সাহস দেখিয়ে পায়ের কাছে এসে পড়া একটা টিয়ার গ্যাসের সেল সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মেরেছি এক পুলিশের মাথায়।

রাজশক্তি বা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে আমার সশস্ত্র সংগ্রামের ভূমিকা শুধু ওই পর্যন্ত। না, বোমা ছুঁড়িনি, নিজের হাতে কোনও ট্রাম-বাসে আগুনও ধরাইনি, বন্দুক পিস্তল কখনও ছুঁয়ে দেখি নি। এরপর ক্রমশ রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পর্ক আলগা হতে থাকে। দাদা শ্রেণীর নেতারা যখন কবিতা লেখা বিষয়ে উপদেশ ও খবরদারি শুরু করলেন, তখনই বুঝে গেলাম, এঁদের সংস্রবে আমি বেশিদিন টিকতে পারব না! কিছুদিন পর, ট্রাম ভাড়া আন্দোলনে সরকার শেষ পর্যন্ত পিছু হটে নতি স্বীকার করেছে বলে ছাত্রদের উদ্দীপনা তুঙ্গে। আর একটি কোনও তুচ্ছ কারণে কলেজ স্ট্রিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে আকস্মিকভাবে মারামারি শুরু হয়ে যায়, দু’পক্ষেরই হিংস্রতা বাড়তে বাড়তে গুলি চলতে লাগল, পুলিশের তাড়া খেয়ে আমরা এক দল সিনেট হলের এক পাশ দিয়ে ছুটে একটা গলির মতন জায়গায় ঢুকে টিনের দরজার পাল্লা বন্ধ করে দিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে একটা গুলি সেই দরজা ফুটো করে এল। চোখ বুজে রইলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য, শুধু ভাবছি, মরে গেছি না বেঁচে আছি? গুলিটা আমার বুকে লাগতেই পারত,লেগেছে পাশের ছেলেটির কাঁধে,সে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।তাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে মনে হল, যদি গুলিটা আমার বুকে লাগত, আমি প্রাণ দিতাম, সেই প্রাণদান কীসের জন্য? তা দেশের কোন্ উপকারে লাগত? এ তো নিতান্তই নির্বোধের মতন মৃত্যু। এই ছেলেটিও কি বাঁচবে? কিংবা এর ডান হাতটাই যদি অকেজো হয়ে যায়, তাতেই বা কোন আদর্শ জয়ী হবে?

না। এভাবে প্রাণ দিতে আমি রাজি নই। এ পথ আমার নয়।

উনিশ

এক একটি বিকেল অন্যরকম।

এখন বাড়ির চেয়ে বাইরে থাকার সময় অনেক বেড়ে গেছে। এখন কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, বাবার হাতে মার খাবার আর ভয় নেই, শুধু বকুনি আর ভ্রূকুটিতে আমাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না, এখন গমন-আগমন যদৃচ্ছ। এই সময়টায় মা-বাবা-ভাই-বোনের চেয়েও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গ প্রিয়তর হয়ে ওঠে।

সকালবেলা টিউশানি করতে বেরিয়ে পড়ি, ফিরে এসেই গরম ডাল-ভাত খেয়ে কলেজ অভিমুখে দৌড়, সেখানে সব কটি ক্লাসে হাজিরা দেওয়া কিংবা না-দেওয়া প্রতিদিনের ইচ্ছে বা মেজাজের ওপর নির্ভরশীল, তারপর কফি হাউসে এসে সুদীর্ঘ আড্ডা, একফাঁকে টুক করে উঠে গিয়ে আর একটি টিউশানি শেষ করে ফিরে এসে আবার আড্ডার মাঝখানে একটি চেয়ারে বসে পড়া। আমার নিজস্ব পড়াশুনো রাত্রে বাড়ি ফেরার পর। আড্ডার প্রধান বিষয় সাহিত্য, রাজনীতি এবং নারী-রহস্য। বেশ কয়েক বছর আমাদের আড্ডা ছিল সিগারেট ও নারীবর্জিত, পরে বন্ধুপত্নী হিসেবে কবিতা সিংহ যোগ দেন। অপর্ণা নাম্নী কিশোরীটির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল অতি গোপন, বন্ধুবান্ধবদের সম্পূর্ণ অগোচরে আমি তার সঙ্গে দেখা ও চিঠি বিনিময় করতাম।

কিন্তু এক একটি বিকেল একেবারে অন্যরকম। যেন বুকের মধ্যে ঘুরপাক খেত এক প্রকারের গরম বাতাস, উল্টোপাল্টা হয়ে যেত প্রতিদিনের জীবনযাত্রা। কলেজ থেকে সহপাঠীদের কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি একা, কফি হাউসে যাই না, হাঁটতে থাকি দিকশূন্যভাবে, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কিছুই মনে আসে না, অপর্ণার সঙ্গে দেখা করতেও ইচ্ছে করে না। দুপুরে সে এক নির্জন ঘরে বসে পড়াশুনো করে, বাড়িতে শাড়ি পরে না, স্কার্ট-ব্লাউজ, চুল খোলা, রাস্তার ধারে জানলা, সেই জানলায় লোহার শিক, সেখানে দাঁড়ালে যেন জেলখানার গরাদের এপাশে ওপাশে আমরা দু’জন, হাত ছোঁওয়া যায়, চিঠি দেওয়া যায়। ইচ্ছে করলেই আমি সেখানে যেতে পারি, যাই না। বিকেলে সে গানের স্কুলে যায়, সেই স্কুল কখন ছুটি হয় জানি। গানের স্কুলের সামনের পার্কে সেই সময় অপেক্ষা করলে তার সঙ্গে দেখা হয়, কয়েক পা এক সঙ্গে হেঁটে এক ট্রামে ওঠা, জীবন ধন্য করার সুযোগ, তবু যাই না। শুধু শুধু ঘুরি দেশবন্ধু পার্কের পাশ দিয়ে, গঙ্গার ধারে, এমন সব রাস্তায় যেখানে চেনা কারুর সঙ্গে দেখা হবে না। কেন সকলকে এড়িয়ে যাবার এই অদ্ভুত বাসনা জাগে এক এক বিকেলে, বুঝি না নিজেই। ঘুরতে ঘুরতে মনে হয়, আমি কী যেন একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি, কেউ টের পায়নি এখনও। কিছু একটা অন্যায় করে ফেলেছি, সেজন্য আমার স্বীকারোক্তি দেওয়া উচিত, কিন্তু অন্যায়টা নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়।

এই যে অজ্ঞাতসারে গভীর কোনও দোষ করে ফেলার অনুভূতি, এটা প্রায়ই ফিরে ফিরে আসে। এক এক সময় সেই অপরাধবোধ এমনই তীব্র হয় যে তারপরেই মনে হয়, বেঁচে আছি কেন? টুপ করে মরে গেলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়। সেই মৃত্যুচিন্তা বড় মোহময়, যেন এক অনন্ত রহস্যের হাতছানি। রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতন ঘুরছি আর মনে হচ্ছে, এই পৃথিবী থেকে নিঃশব্দে হারিয়ে যাওয়াই তো সবচেয়ে ভালো। এইটাই একমাত্র সিদ্ধান্ত, যা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এই হারিয়ে যাওয়া মানে কি আত্মহত্যা? সেরকমও ভেবেছি কয়েকবার। অথবা, কোনও বৃহত্তর কারণে প্রাণদান, যদি কোনও গৃহযুদ্ধ বা বিপ্লব শুরু হয়, ছুটে যেতে হবে একেবারে সামনে, কোথাও নাম থাকবে না, মুছে যাবে সব কিছু।

যোলো-সতেরো থেকে একুশ-বাইশ বছর পর্যন্ত সময়সীমাটা অতি ভয়ঙ্কর, যেন আগুনের মধ্য দিয়ে পার হওয়া। এই বয়েসের ছেলেরা (মেয়েদের কথা জানি না) অতি তুচ্ছ কারণে প্রাণ। দিতে পারে, এরাই যে-কোনও যুদ্ধে কামানের খাদ্য হয়, রাজনৈতিক নেতারা এদেরই সামনে ঠেলে দেয়। এর থেকে উত্তীর্ণ হওয়া অতি কঠিন পরীক্ষা। যৌবনের আগমনের অসহনীয় তীব্রতাই কি এর কারণ?

রাত্রে পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে কবিতা লেখা, তখনও মনে হত, কেন এসব লিখছি? কয়েকটি পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, দু’চারজন বাহবা দিচ্ছে, সেটাই কি সার্থকতা? শব্দ সাজানো, শব্দসন্ধান, মনোমতন সঠিক শব্দটি না পাওয়ার জন্য মধ্যরাত্রির ছটফটানি, এর কি কোনও মূল্য আছে? এক এক সময় সব কিছু ছিঁড়ে-ফিরে দিতে উদ্যত হয়েছি, কখনও কবিতার খাতা মাটিতে ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়েছি তার ওপর, আপন মনে বলেছি, চাই না, এসব কিছু চাই না।

লেখার নেশা তখনও আমার ধরেনি, কিন্তু পড়ার নেশা রক্তে মিশে গেছে। একা থাকলেই চোখের সামনে ছাপা অক্ষর কিছু না-কিছু চাই-ই। ততদিনে প্রচুর বাংলা বই শেষ করে ইংরেজি বই ধরেছি। মনে আছে। স্কুলজীবনের শেষ দিকে আমি প্রথম যে ইংরেজি উপন্যাসটি সম্পূর্ণ পাঠ করি, সেটি অস্কার ওয়াইল্‌ডের ‘দা পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে’। সব ইংরেজি শব্দের মানে বুঝি না, তবু ঠিক করেছিলাম অভিধান না দেখেই পড়ে যাব, সেরকমভাবেই শেষ করেছি, বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কলেজে রাশিয়ান উপন্যাসগুলি মোহিত করে রেখেছিল, আমি সবচেয়ে ভক্ত হয়েছিলাম ডস্টয়েভস্কি’র। তাঁর ‘নোট্‌স ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ পড়ে একেবারে হতবাক। কবিতায় এক এক সময় এক এক জনের নাম হাওয়ায় ভাসে। তখন ইংরেজি কবিতায় টি এস এলিয়টের পর অডেন ও স্পেন্ডারকেই মনে করা হয় আধুনিকতম, এলিয়টের গুরু এজ্‌রা পাউন্ড নাৎসি বাহিনীর সমর্থক ছিলেন বলে অবজ্ঞার পাত্র। কফি হাউসে রাইনের মারিয়া রিল্‌কেই সবচেয়ে বেশি আলোচ্য, অনেকেরই হাতে রিল্‌কের কাব্যগ্রন্থ। কয়েক মাস বাদেই ঝোঁক গেল ফরাসি কবিতার দিকে, বদলেয়ার ও র‍্যাঁবো একসঙ্গে, ভের্লেইন তেমন পাত্তা পাননি, আর মালার্মের নাম উচ্চারণ করাই উচ্চভুরু বুদ্ধিজীবী হওয়ার লক্ষণ। আমার বেশি পছন্দ হয়েছিল পরবর্তীকালের আঁরি মিশো’র কবিতা।

বিদেশি সাহিত্যপাঠ তখন নব্য কবি-লেখকদের মধ্যে ফ্যাশন দস্তুর ছিল, কে নতুন কী পড়েছে তা নিয়ে বাগাড়ম্বর চলত প্রায়ই। কেউ কেউ অবশ্য শুধু মলাট মুখস্থ করে আসত, কারও কারও হাতে থাকত ভারী ভারী বই, তাদের একটু টেপাটেপি করলেই বোঝা যেত, বইগুলি বহন করাই তাদের কাছে বিদ্যার পরাকাষ্ঠা। কোনও কোনও অধ্যাপকেরও ক্লাসে হঠাৎ কোনও টাটকা বিদেশি বইয়ের নাম উল্লেখ করার বাতিক ছিল, একজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অর্নেস্ট হেমিংওয়ের সদ্য প্রকাশিত ‘দা ওল্‌ড ম্যান অ্যান্ড দা সি’ উপন্যাসটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন একদিন, বইটি সংগ্রহ করে পড়ে ফেললাম, তারপর সেই অধ্যাপকের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে দেখি, তিনি সমালোচনা পড়েছেন মাত্র, মূল বইটি ছুঁয়েও দেখেননি।

বাংলায় তখন চমৎকার সব অনুবাদও প্রকাশিত হত সিগনেট প্রেস থেকে। এরিখ মারিয়া, রেমার্ক হয়তো খুব উচ্চাঙ্গের সাহিত্যিক নন, কিন্তু তাঁর ‘অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ এবং ‘থ্রি কমরেডস’ মাতিয়ে রেখেছিল তরুণ মন। ‘থ্রি কমরেডস’-এর সাবলীল বাংলা অনুবাদ ‘তিন বন্ধু’, বন্ধুত্বের এমন মর্মস্পর্শী কাহিনী পড়ে অশ্রু সংবরণ করা কঠিন ছিল। রেমাের্কর আরও ভালো উপন্যাস ‘দা রোড ব্যাক’, সেটিও বন্ধুত্বের কাহিনী কিন্তু সে বই কেন বাংলায় অনুবাদ হয়নি জানি না। রেমার্ক সৈনিক হিসেবে প্রথম মহাযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, সেই অভিজ্ঞতাভিত্তিক লেখাগুলিতে ছিল, যাকে বলে অথেনটিসিটির সৌরভ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ নিয়েও তিনি কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন, তা পরোক্ষ জ্ঞান থেকে রচিত বলেই কৃত্রিম লাগে লটারিতে অনেক টাকা জিতে রেমার্ক আমেরিকায় গিয়ে থাকতে শুরু করেন, হলিউডের এক নায়িকাকে জয় করার জন্য ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস-এর মতন অভিনেতা ও ক্ষমতাবান পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন বলে শোনা যায়। সে যাই হোক, রেমার্ককে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কি আমেরিকানদের পছন্দ করেন? রেমার্ক বলেছিলেন, না। তবে কি জার্মানদের? না। ফরাসিদের? না। ইংরেজদের? না। তা হলে কোন জাতের মানুষদের পছন্দ করেন? রেমার্ক বলেছিলেন, আমি পছন্দ করি আমার বন্ধুদের! বন্ধুত্বের জয়গাথা যিনি রচনা করেছেন, আমাদের সেই বয়েসে তাঁকে তো ভালো লাগবেই!

আমার প্রতিদিনের সঙ্গী ছিল একখানি বই, মহাভারত। কালীপ্রসন্ন সিংহের গদ্য অনুবাদ সবকটি খণ্ড একসঙ্গে বাঁধানো, আমি কিনেছিলাম প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনের রেলিং-এর পুরনো বইয়ের দোকান থেকে, খুব শস্তায়। পাতাগুলি হলদেটে, অতি সন্তর্পণে ওলটাতে হয়, রোজ একটু একটু করে পড়ি, যে-কোনও জায়গা থেকে। এর আগে কাশীরামদাসের পদ্যানুবাদে মন বসাতে পারিনি, পরেও দেখেছি, যে-কোনও ক্লাসিক গ্রন্থের অনুবাদ পদ্যের চেয়ে গদ্যেই বেশি আকর্ষণীয় হয়। রাজশেখর বসুর গদ্য সারানুবাদ ভাষাগুণে ক্লাসিক হিসেবে গণ্য হবার যোগ্য, কিন্তু মূলের যে ছড়ানো এলোমেলো ভাব, কাহিনীর মধ্যে কাহিনী, অতীত-বর্তমান- ভবিষ্যতের যখন তখন স্থানবদল (ম্যাজিক রিয়েলিজম?), ভদ্রতা-সভ্যতার দৃষ্টান্ত, এক একটি চরিত্রের গাম্ভীর্য ও বিষাদ, তার তুলনা অন্য কোনও গ্রন্থে পাইনি। আমার অনেক মনখারাপের দিনে মহাভারত পড়ে সান্ত্বনা পেয়েছি। না, সান্ত্বনা কথাটা হয়তো ঠিক হল না, বাস্তব বিস্মৃত হয়ে চলে তো গেছি সেই যুগে। আমার এক সাহিত্যবোদ্ধা মুসলমান বন্ধু মহাভারত পড়েনি, সে বলেছিল মহাভারত তাদের পাঠযোগ্য নয়, শুনে অবাক হয়েছিলাম। মুসলমানদের ধর্মান্তর গ্রহণের আগেকার যা কিছু ভারতীয় ঐতিহ্য, তার অধিকার তারা গ্রহণ করবে না কেন? মহাভারত হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ নয়, রাজা-রাজড়াদের যুদ্ধকাহিনী, অবশ্য তার মধ্যে অনেক দেবদেবীর সশরীর উপস্থিতি আছে। ক্রিশ্চানরা কি গ্রিক ও রোমান পুরাণ কাহিনীগুলো পড়ে না যাতে প্যাগান দেবদেবীর কথা আছে? এমনকী এখনও তাদের ক্যালেন্ডারে দিনের নাম, মাসের নামে সেইসব দেবদেবীর নাম জড়িত (যেমন থার্সডে, জানুয়ারি), সেগুলি তো তারা বর্জন করেনি। মীর মশারফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়ে আমি কত কেঁদেছি, সেটি আমার অন্যতম প্রিয় বই। আমার সেই বন্ধুটির নাম মইনুদ্দিন হুসাইন, সে লেখালেখির জগতে থাকেনি, অনেক বছর পর সে আমেরিকা থেকে চিঠিতে জানিয়েছিল যে সেখানে সে সংক্ষিপ্ত ইংরেজি অনুবাদে মহাভারত পড়েছে এবং মুগ্ধ হয়েছে, আমার কাছ থেকে রাজশেখরের বইটি চায়, আগে পড়েনি বলে অনুতপ্ত। সৈয়দ মুজতবা আলীর সঙ্গে আলোচনা করে দেখেছি, মহাভারত-জ্ঞানে তিনি ঢের ঢের বামুন পণ্ডিতকে জব্দ করে দিতে পারেন। এখন অনেক বাঙালি মুসলমানের রচনায় মহাভারতের উল্লেখ শুধু নয়, নিজস্ব ভাষ্য পর্যন্ত দেখতে পাই।

বরানগরের এক কবিতাপাঠের আসর থেকে ফেরার পথে দীপক হঠাৎ বলে বসল, আমাদের কবিতার বই ছাপা হবে না কেন? বই না থাকলে কি কেউ কবি হয় নাকি? অবিলম্বে উদ্যোগ নিতে হবে। তখনও পর্যন্ত আমার সাকুল্যে দশ-বারোটি কবিতা ছাপা হয়েছে, দীপকের অনেকগুলি, তার বই ছাপা হতে পারে, আমার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু দীপক জেদ ধরল, ছাপা হবে যুগ্ম কাব্যগ্রন্থ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজের প্রথম বই যেভাবে বেরিয়েছিল। দীপকের বাড়ি মহারানী হেমন্তকুমারী স্ট্রিটে, পরদিনই সে পাড়ার এক প্রেসে দীপক হাজির হল তার ছায়াসঙ্গী সমেত। সে প্রেসের মালিক এই গোঁফ-না-ওঠা কবিদ্বয়কে দেখে নিশ্চিত কৌতুকবোধ করেছিলেন, তিনি আমাদের ভেতরের একটি ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে কয়েকজন ইয়ার-বক্সী নিয়ে বিয়ার পান করতে করতে বললেন, পড়ো তো ভাই, তোমাদের কবিতা পড়ে শোনাও! আমরা পড়ছি, তিনি মাটিতে চাপড় মারতে মারতে বলছেন, বাঃ বাঃ, খাসা। অনেক পাকা পাকা কথাও জানো দেখছি! কয়েক বোতল বিয়ার উড়িয়ে দিয়েও কিন্তু তাঁর বিষয়-জ্ঞান অন্তর্হিত হল না, শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন, বই ছাপতে তো ভাই টাকা লাগে! তোমরা কি টাকা জোগাড় করতে পারবে? বরং কোনও প্রকাশক পাকড়াও করো।

তখন পত্রপত্রিকার সংখ্যা ছিল অঙ্গুলিমেয়, নিজ ব্যয়ে কবিতাপুস্তক ছাপার রেওয়াজও তেমন চালু হয়নি। বই ছাপার খরচ সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। সুতরাং প্রকাশক ছাড়া গতি নেই। কেউ আমাদের বই প্রকাশ করতে রাজি হবে কি না, সে চিন্তাও দীপকের মাথায় এল না, সে অন্যান্য সব প্রকাশকদের বাতিল করে দিয়ে তৎকালীন বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ প্রকাশক সিগনেট প্রেসকে মনোনীত করে ফেলল, যেন সিগনেট প্রেসই আমাদের বই ছাপিয়ে ধন্য হবে!

সিগনেট প্রেস তখন বাংলা বইয়ের জগতে যুগান্তর এনে দিয়েছে। এঁদের আগে একমাত্র বিশ্বভারতীর বইগুলিরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল, তা ছাড়া বাদবাকি সমস্ত প্রকাশনাতেই ছাপা, মলাট, বাঁধাইতে রুচির অভাব ছিল প্রকট। আনন্দ পাবলিশার্সের তখন অস্তিত্ব ছিল না। সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্ত, ওরফে ডি কে, বাংলা প্রকাশনাকে বিশ্বমানের কাছাকাছি পৌঁছে দেন। প্রভু গুহঠাকুরতার স্ত্রী নীলিমা দেবী দিলীপকুমার গুপ্তের শাশুড়ি, সেই নীলিমা দেবী নিজে একজন শিল্পী এবং ইংরেজি ভাষার কবি এবং তিনি ছিলেন জওহরলাল নেহরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের বান্ধবী। সিগনেট প্রেসের প্রকাশনা শুরু হয় ইংরেজি বই দিয়ে, পরে গল্প শুনেছি, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত এক সময় নীলিমা দেবীকে বলেছিলেন, আমার দাদা জেলে বসে একটা বই লিখেছে, তোরা ছাপার ব্যবস্থা করতে পারবি? জওহরলাল নেহরুর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া প্রকাশিত হয় সিগনেট প্রেস থেকে।

বাংলার আপামর পাঠকসাধারণ সিগনেট প্রেসকে চেনে সুকুমার রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বইগুলির জন্য। সুকুমার রায়ের বইগুলি কিছুকাল অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সিগনেট প্রেস থেকে সুকুমার রায়ের ছেলের আঁকা ছবি সংযুক্ত করে চমৎকার নতুন সংস্করণ বেরোল ‘আবোল তাবোল’ তারপর তাঁর অগ্রন্থিত কবিতাগুলি নিয়ে ‘খাই খাই’, যার বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল ‘মৃত্যুর সাতাশ বছর পর লিখে পাঠিয়েছেন’। এ ছাড়াও উপেন্দ্রকিশোর, কুলদারঞ্জন, সুখলতা রাও, লীলা মজুমদার প্রমুখ, রায়চৌধুরী পরিবারের প্রায় সকলের বই, শিশুসাহিত্যে যে পরিবারের ছিল একাধিপত্য, প্রকাশ হতে থাকে সিগনেট প্রেস থেকে। অবনীন্দ্রনাথের রাজকাহিনী, ক্ষীরের পুতুল, বুড়ো আংলা, শকুন্তলা দারুণ জনপ্রিয় হয়। দিলীপকুমারের সাহিত্যরুচি অতি আধুনিক, তিনি প্রকাশ করলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের বই, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর উপন্যাস। বিশেষত কবিতার প্রতি তাঁর টান-ভালোবাসা ছিল খুবই বেশি, জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ সিগনেট সংস্করণ প্রকাশের পরই ওই কবি প্রথম ক্ষুদ্র পাঠকগোষ্ঠীর বাইরে পরিচিতি পান। জীবনানন্দ দাশের অন্য বইগুলির নতুন সংস্করণের পর পর আকস্মিকভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া গেল ‘রূপসী বাংলা’, সে অবশ্য আরও পরের কথা। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখ প্রধান কবিদের প্রত্যেকেরই বই বেরিয়েছে সিগনেট প্রেস থেকে, শুধু তাই নয়, তখনকার দু’জন তরুণ কবি, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও নরেশ গুহ’র বইও প্রকাশ করা হল সমান গুরুত্ব দিয়ে, দেশ পত্রিকায় প্রায় পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন, প্রচ্ছদ ও বিজ্ঞাপনের ভাষাতেও অভিনবত্ব এনেছে সিগনেট প্রেস, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ ‘নীল নির্জনে’র প্রচ্ছদে গভীর সমুদ্রের ঢেউ, আর নরেশ গুহর ‘দুরন্ত দুপুরে’র হলুদ ‘দুপুর রঙের মলাট’।

সিগনেট প্রেস থেকে নিয়মিত প্রচার করা হত ‘টুকরো কথা’, তাতে শুধু নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপন নয়, সমস্ত উল্লেখযোগ্য বাংলা প্রকাশনার পরিচিতি, সাহিত্য সম্পর্কিত নানান সংবাদ এবং ধাঁধা। বিনামূল্যে, যে-কেউ নাম পাঠালেই বাড়িতে পাওয়া যেত ডাকে। শোনা যায়, এক সময় সাড়ে ন’ হাজার গ্রাহককে পাঠাননা হত টুকরো কথা, ডাকব্যয়ও সিগনেট প্রেসের। এ যেন ব্যবসায় নয়, বাংলা সাহিত্য প্রসারের সাধনা। কবিতার বই ছাপিয়ে কোনও প্রকাশকের সমৃদ্ধি হতে পারে না, সবাই জানে, কিন্তু দিলীপকুমার কী যত্ন করেই না ছাপতেন কবিতার বইগুলি, এক একটি নতুন বই হাতে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে হত। পরে শুনেছিলাম, ‘অন্য বই যে – কোনও দিনই ছাপা হতে পারে, কিন্তু দিলীপকুমার কাব্যগ্রন্থগুলি ছাপার মেশিনে চাপাতে দিতেন শুধুমাত্র মেঘলা দিনে। কটকটে রোদুরের দিনে নাকি কবিতার মুদ্রণ সুশোভন হয় না।

ব্যবসায়িক সাফল্যের দিকে খুব একটা মনোযোগ ছিল না দিলীপকুমারের। অত বড় বড় বিজ্ঞাপন, দামি কাগজে ছাপা, অথচ বইয়ের দাম তুলনামূলকভাবে কম। পঞ্চাশের দশকে একখানি বাংলা বই হঠাৎ অসাধারণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, সেটি যাযাবর নামে এক ছদ্মনামধারী লেখকের ‘দৃষ্টিপাত’। গল্পও নয়, উপন্যাসও নয়, রম্য রচনা ধরনের, তবু নতুন ধরনের লিখনরীতির জন্য খুবই জনসমাদৃত হয়েছিল। সেই বইটির পাণ্ডুলিপি প্রথমে সিগনেট প্রেসে আসে, দিলীপকুমার সেটি পড়ে মনোনীতও করেছিলেন, বুঝেছিলেন এর সাফল্য সম্ভাবনা, তবু ছাপতে চাননি একটি বিশেষ কারণে। যাযাবর-এর প্রকৃত নাম বিনয় মুখোপাধ্যায়, তিনি দীর্ঘজীবী হয়েছেন ও আরও কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, কিন্তু সেই প্রথম বইটি প্রকাশের সময় তিনি আত্মগোপন তো করেছিলেন বটেই, তা ছাড়া ভূমিকায় লেখা ছিল যে লেখক অকালমৃত। সেইসবের জন্য পাঠকদের মনে আরও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু চোখের সামনে লেখককে বসে থাকতে দেখতে পাচ্ছেন অথচ প্রকাশককে লিখতে হবে যে লেখক জীবিত নেই, এটা দিলীপকুমারের কাছে মনে হয়েছিল অনৈতিক, পাঠকদের সঙ্গে ছলনা, তাই তিনি পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়েছিলেন। অন্য প্রকাশক সেই এক বই ছেপে রাতারাতি ধনী হয়ে যায়।

সিগনেট প্রেসের ছোটদের বইগুলি ভালোই চলত, অন্য একটি বই থেকে অভাবনীয় সাফল্য আসে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এক সময় অশ্লীল লেখক হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন, পরবর্তীকালে তিনি মুন্সেফ হিসেবে বাংলার মফস্বলে ঘুরে ঘুরে যতন বিবি, সারেঙ-এর মতন কয়েকটি অবিস্মরণীয় গল্পে বাংলার গরিব হিন্দু মুসলমানের চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন, তিনি হঠাৎ প্রবলভাবে ধার্মিক হয়ে গেলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত হয়ে লিখলেন তাঁর জীবনী, চার খণ্ডে ‘পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ’, শ্ৰীম রচিত কথামৃত সব সময়েই পাওয়া যায়, শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যান্য জীবনীও আছে কয়েকটি, তবু এই বইটি যেন উন্মাদনা সৃষ্টি করে পাঠকদের মধ্যে, শুধু ভক্ত নয়, সাহিত্যপিপাসু পাঠকরাও বইটি সংগ্রহ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। দোকান খোলার আগেই সকাল থেকে এই বইটির জন্য ক্রেতাদের লাইন, এমনটি আর আগে কখনও দেখা যায়নি। বিজ্ঞাপনে দেখেছি, অল্প সময়ের মধ্যে এই বইয়ের ছিয়ানব্বই হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল৷ দুঃখের কথা এই যে এ গ্রন্থের এত বিরাট সাফল্যের জন্যই নাকি সিগনেট প্রেসের পতন শুরু হয়। এখন যে আর সিগনেট প্রেসের নামও শোনা যায় না, তার অপ্রত্যক্ষ কারণ ওই শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী।

দিলীপকুমার গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক হয়েও কবিতা ভালোবাসেন, কিন্তু আমাদের মতন অর্বাচীন কবির সংখ্যা তো অনেক, তাঁদের সকলেরই কবিতার বই ছাপতে তিনি রাজি হবেন, এ চিন্তাও বাতুলতাযোগ্য। কিন্তু দীপক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কলেজ স্ট্রিটে সিগনেট বুকশপের কাউন্টারে একটি সুদর্শন যুবককে দেখা যায়, তার কাছ থেকে জানা গেল, রবিবার সকালে বাড়িতে গেলে। ডি কের সঙ্গে দেখা হতে পারে। সেই রবিবারের আগেই দীপক মলাট আঁকার বন্দোবস্ত করে ফেলতে চায়, এক সন্ধেবেলা হাজির হল সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তখনও চলচ্চিত্রের কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়নি, তিনি ডি জে কিমার নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানে শিল্পী হিসেবে চাকরি করেন, দিলীপকুমার গুপ্তও সেই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার, তিনি সিগনেটের বইগুলির মলাট সত্যজিৎ রায়কে দিয়ে আঁকান। সত্যজিৎ রায় মলাট-শিল্পী হিসেবেই সকলের কাছে পরিচিত। দরজা খুলে দাঁড়ালেন সেই দীর্ঘকায় মানুষটি, আমাদের চেয়ে যেন প্রায় দেড়গুণ উচ্চতা, খুবই ভারী কণ্ঠস্বর, সেই তুলনায় দৃষ্টি স্নিগ্ধ। দীপক তাঁর কাছে যে প্রস্তাব দিল, তা ভাবলে আমি আজও লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। দীপকের অটোগ্রাফ খাতায় রামকিঙ্কর বেইজের একটি অকিঞ্চিৎকর স্কেচ ছিল, দীপকের দাবি, ওই ছোট্ট স্কেচটা মাঝখানে রেখে বাকি প্রচ্ছদপটটি আঁকতে হবে সত্যজিৎ রায়কে, অর্থাৎ প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে দু’জনের নাম যুক্ত থাকবে। এরকম প্রস্তাব শুনে সত্যজিৎ রায় যদি আমাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতেন তা হলে তাঁকে কিছুমাত্র দোষ দেওয়া যেত না। কিন্তু অতি ভদ্র মানুষটি সব শুনে মৃদু হাস্যে বললেন, কবিতাগুলি না পড়ে তো মলাট আঁকা যায় না! কবিতার মেজাজ বুঝতে হবে, একদিন পাণ্ডুলিপি নিয়ে আসবেন, আমি দেখব নিশ্চয়ই।

সিগনেট প্রেসের অফিস ও মালিকদের বাড়ি এলগিন রোডে। উত্তর কলকাতা থেকে আমার ওদিকে বিশেষ যাওয়া হয় না, দীপক অবশ্য সব চেনে। এক রবিবার সকালে আমরা বাস থেকে নামলাম এলগিন রোডের মোড়ে, তারপর অনেকটা হেঁটে, শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বাড়ি ছাড়িয়ে, আর. সেনের জাহাজমার্কা বাড়ির পাশ দিয়ে এগোলাম একটা পাতাঝরা নির্জন রাস্তা দিয়ে। তখনও আমি জানি না, আমার প্রতিটি পদক্ষেপে আমি চলেছি একটা দারুণ পরিবর্তনের দিকে। এরপর আমার জীবনটাই বদলে যাবে। সেদিনের ঘটনার ছাপ পড়েছে আমার বাকি জীবনে। দীপক আমার সঙ্গে গেলেও ওর জীবনে কিন্তু সেই ছাপ পড়ল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *