৪০. ডাক্তার আসকার

অধ্যায় ৪০

“দাঁড়ান!”

দাঁতে দাঁত পিষে বললেন ডাক্তার আসকার।

ছফা তার দিকে তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন ভদ্রলোক। তার শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আসলাম। দরজার নবের দিকে হাত বাড়াতে উদ্যত সে।

“আমি নিজেই এনে দিচ্ছি।” কথাটা বলে নুরে ছফার জবাবের অপেক্ষা করেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

আসলামকে ইশারা করলো ছফা, দরজার নবটা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো সে। ডাক্তার তার শোবার ঘরে ঢোকার সাথে সাথে সে-ও ঢুকে পড়লো ভেতরে। দরজাটা হাট করে খুলে রাখা হলো, সেই খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ডাক্তার তার ওয়াল ক্যাবিনেট খুলে কী যেনো খুঁজছেন। তাকে শ্যেনদৃষ্টিতে বিদ্ধ করে রেখেছে আসলাম।

ডাক্তার নীলরঙের একটি পাসপোর্ট বের করে আসলামকে দেখাচ্ছেন, গানম্যান সেটা হাতে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আবার ফিরিয়ে দিলো তাকে, তারপর পুরো ঘরটা তল্লাশি করতে নেমে পড়লো। হতভম্ব ডাক্তার তাকালেন ছফার দিকে, হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করলো সে। দূর থেকেই বুঝতে পারলো, ডাক্তারের বৃটিশ পাসপোর্ট রয়েছে।

হাল ছেড়ে দিয়ে ডাক্তার আসকার চুপচাপ ড্রইংরুমে ফিরে এলেন। “আমি আসলেই মোবাইলফোন আর ইউজ করি না…আগে করতাম।”

ছফা এ কথার কোনো জবাব দিলো না। এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য কথা। তার মতো একজন মানুষ মোবাইলফোন ব্যবহার না করে থাকতেই পারে না।

“আপনারা চাইলে আমার ল্যান্ডফোনটা ট্র্যাক করে দেখতে পারেন।”

“দরকার হলে সব কিছুই করবো আমি,” জবাব দিলো ছফা। হাত বাড়িয়ে দিলো ডাক্তারের দিকে।

ভদ্রলোক আস্তে করে পাসপোর্টটা দিয়ে দিলেন তাকে।

“তাহলে আপনি ডুয়েল সিটিজেন,” প্রশ্নের মতো শোনালো না ছফার কথাটা।

ডাক্তার এই পাসপোর্ট দিয়ে তিন বছর আগে যে আমেরিকায় গেছিলেন সেটার সত্যতা পাওয়া গেলো ভিসার সিল দেখে। কিন্তু নুরে ছফা অবাক হলো, খুব বেশি ভ্রমণের উল্লেখ নেই তাতে। এই পাসপোর্ট দিয়ে তিন বছরে পাঁচ বার বিদেশ যাবার নজির আছে। দু-বার আমেরিকায় আর বৃটেনে, একবার কানাডায়। শেষ বার তিনি যে আমেরিকায় গেছিলেন সেই সময় ওখানে মাত্র এক মাস ছিলেন, তারপরই ফিরে আসেন দেশে।

অবাক হয়ে তাকালো সে। “আপনি আপনার ড্রাইভারকে বলেছেন, খুব যাওয়া-আসার মধ্যে থাকেন, তাই তাকে নিয়মিত রাখার দরকার নেই?”

এমন তথ্য শুনে আসকার ইবনে সায়িদ চমকে উঠলেন একটু। “আমার ড্রাইভার?!”

“হ্যাঁ। আপনার আগের ড্রাইভার,” ছফা আত্মতুষ্টির সাথে বললো। “ওর সাথে কথা হয়েছে। ও বলেছে, আপনি অনেকটা সময় বাইরে থাকেন, দেশে আসেন অল্প সময়ের জন্য তাই রাখার দরকার নেই। কিন্তু এখানে যা দেখছি তাতে তো কথাটা সত্যি বলে মনে হচ্ছে না?”

গভীর করে দম নিয়ে নিলেন ডাক্তার। “আমি আসলে ওকে ভুল বলেছিলাম।”

“কেন?”

“ওকে রাখবো না তাই।”

“কেন রাখবেন না? সমস্যা কি ছিলো?”

“আমি খুবই কম বাইরে যাই এখন,” গভীর করে দম নিয়ে নিলেন। “এতো অল্প মুভ করি যে, তার জন্যে ড্রাইভার রাখার কোনো দরকার দেখি না। তাছাড়া, চাইলে আমি হাসপাতালের গাড়ি ব্যবহার করতে পারি…নিজের জন্য আলাদা ড্রাইভার রাখার কোনো দরকার নেই।”

ছফা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

“বুঝতেই পারছেন, সহজ অঙ্ক…সহজ হিসেব।”

এমন সময় গানম্যান আসলাম সবুজ রঙের একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতে নিয়ে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

ডাক্তারের দিকে তাকালো ছফা। আসলামের দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছেন, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। তার কপালে রীতিমতো বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে।

সবুজ রঙের পাসপোর্টটা ছফার দিকে বাড়িয়ে দিলো গানম্যান। “আমার মনে হয় এই লোক তার মোবাইলফোনটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছে, স্যার।”

ডাক্তারের দিকে তাকালো নুরে ছফা। পরাজিত সৈনিকের মতো লাগছে তাকে। হাল ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। দৃষ্টিতে শূণ্যতা।

“ভেঙেটেঙে কমোডে ফ্ল্যাশও করে দিতে পারে,” আসলাম যোগ করলো।

দেশি পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলো ছফা। “আপনার কথাই ঠিক,” পাসপোর্টের পাতাগুলো উল্টে উল্টে দেখতে লাগলো সে। “আপনি ঘন ঘন বিদেশে যান।”

কপালে সদ্য জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিলেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। কোনো কথা বললেন না।

ভুরু কুঁচকে গেলো ছফার। পাসপোর্টের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললো, “ইন্ডিয়াতে গেছেন অনেক বার!”

আসকার ইবনে সায়িদ অনেক চেষ্টা করেও চোখেমুখে ভড়কে যাবার অভিব্যক্তিটা লুকাতে পারলেন না।

ডাক্তারের দিকে স্থিরচোখে তাকালো নুরে ছফা। “কলকাতায়!”

আস্তে করে শ্বাস নিয়ে নিলেন ভদ্রলোক। “ওখানে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন থাকে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “তা থাকতেই পারে কিন্তু আপনি সেটা লুকানোর চেষ্টা করলেন কেন? আর এই পাসপোর্টটার কথাই বা চেপে গেলেন কেন?”

ডাক্তার ভড়কে গেলেন সামান্য।

“বৃটিশ পাসপোর্ট দেখিয়ে বিভ্রান্ত করলেন…এই পাসপোর্টটা, যেটা দিয়ে আপনি ঘন ঘন কলকাতায় যাতায়াত করেছেন, সেটা লুকিয়ে রাখার

চেষ্টা করলেন…কেন?”

আসকার ইবনে সায়িদ কিছুই বললেন না। সম্ভবত বলতে পারলেন না।

“আপনি কিছু না বললেও উত্তরটা আমি জানি, ডাক্তার, নুরে ছফা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রবীন চিকিৎসককে বিদ্ধ করলো যেনো। “মুশকান থাকে ওখানে!”

চোখ বন্ধ করে ফেললেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ।

“আমি নিশ্চিত!” ডাক্তারকে চুপ থাকতে দেখে আবার বললো ছফা, “ওখানে কোথায় থাকে সে? আপনাকে বলতেই হবে।” শেষ কথাটা বেশ ধমকের সাথে বললো।

ডাক্তারকে দেখে মনে হচ্ছে, ছফার ধমকে তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়েছেন তিনি।

.

অধ্যায় ৪১

ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ যে কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না তাতে নুরে ছফার রাগ হবার কথা কিন্তু এ মুহূর্তে সে বরং উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে আছে ভদ্রলোকের দিকে। বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে, শুধু দেখতে পাচ্ছে প্রবীন লোকটির কপালে ঘাম ছুটছে, নিজের বুকের উপর একটা হাত রেখে মেসেজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে তীব্র ব্যথা হচ্ছে বুকে।

একটু আগে ছফার প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার নিশ্চপ ছিলেন বলে আসলাম তাকে ভয় দেখানোর জন্য কোমর থেকে পিস্তল বের করেছিলো, এরপরই ভড়কে যায় ভদ্রলোক। এই কাজটা করার কোনো দরকারই ছিলো না। খুব সহজেই ছফা তার কাছ থেকে জরুরী তথ্যটা আদায় করে নিতে পারতো।

“কী হয়েছে?” বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো সে। “বুকে ব্যথা হচ্ছে আপনার?”

আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলেন আসকার ইবনে সায়িদ। তার চোখেমুখে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে।

মনে মনে প্রমাদ গুণলো ছফা। “ঘরে এসি আছে?” জানতে চাইলো।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডাক্তার। সোফার সামনে টেবিলের উপর থাকা সাদা রঙের একটি রিমোট দেখিয়ে দিলেন ইশারায়।

“এসিটা ছাড়ো, আসলাম।”

নিজের পিস্তলটা কোমরে রেখে, রিমোটটা হাতে নিয়ে এসিটা অন করে দিলো গানম্যান।

“আপনার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?” ছফা ঝুঁকে এলো ডাক্তারের দিকে।

খুব কষ্টে মাথা নেড়ে সায় দিলেন ভদ্রলোক। “আ-আমাকে…” কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার, “…হাসপাতালে নিয়ে যান…”-প্লিজ!”

কয়েক মুহূর্তের জন্য ছফা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না, এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে।

যন্ত্রণাকাতর অবস্থায়ই আঙুল তুলে সোফার এক পাশে ল্যান্ডফোনটার দিকে ইশারা করলেন তিনি। “৯-১১…”

ছফা উঠে গিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে নিলো।

“…৪-৬-৭-৮-৪-২…আমার হাসপাতালে…ওদেরকে বলুন আমার কথা…এ-একটা অ্যাম্বুলেন্স…” ডাক্তারের শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে পড়লো। “এ-এক্ষুণি…” কথা জড়িয়ে এলো তার।

উদ্বিগ্ন হয়ে অরিয়েন্ট হাসপাতালে ফোন করে ডাক্তার আসকারের বাসায় দ্রুত একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর অনুরোধ করলো সে। রিসিভারটা ক্র্যাডলের উপর রেখে চেয়ে রইলো যন্ত্রণাকাতর ডাক্তারের দিকে। আসলাম মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, কোনো রকম করুণা কিংবা সহানুভূতি দেখা যাচ্ছে না তার অভিব্যক্তিতে। বরং ডাক্তারের আচমকা শরীর খারাপ হওয়ায় যারপরনাই বিরক্ত সে।

নুরে ছফার আশঙ্কা, বৃদ্ধ এই চিকিৎসক হয়তো হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে আছেন। ডাক্তারের কাছ থেকে মুশকান জুবেরির অবস্থানের ব্যাপারে মূল্যবান তথ্য জানা দরকার, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা সম্ভব নয়। এরকম অবস্থায় ভদ্রলোককে চাপ দিয়ে কিছু আদায় করাটা বিপজ্জনক। তার নাজুক হৃদপিণ্ড হয়তো সহ্য করতে পারবে না। মরেটরেও যেতে পারেন!

তার চেয়েও বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ডাক্তার যদি এ যাত্রায় বেঁচেও যান, তাহলে বলে দেবেন, ছফা আর আসলাম তার বাড়িতে বেআইনীভাবে ঢুকে পিস্তল দিয়ে ভয় দেখিয়েছিলো তাকে, বিনা ওয়ারেন্টে সার্চ করেছে তার ঘর।

ডাক্তার মরে গেলে ছফা আরো বেশি বিপদে পড়ে যাবে। এ বাড়ির দারোয়ান ছেলেটা তাদেরকে দেখেছে। পুলিশকে সে জানাবে তাদের কথা।

প্রধানমন্ত্রীর পিএস হয়তো সব কিছু সামলাতে পারবে, কিন্তু সেই পদ্ধতিটা যে কী হতে পারে, ভেবে গা শিউরে উঠলা-নিরপরাধ মানুষ হত্যা?

কক্ষনোই না!

মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলো ছফা, “আপনার এখন কেমন লাগছে?”

মাথা দোলালেন আসকার ইবনে সায়িদ, যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বললেন, “বুকে ব্যথা হচ্ছে…খু-উ-উ-ব!”

সর্বনাশ! যা ভেবেছিলো তা-ই। লোকটা হার্ট অ্যাটাকের শিকার! কিংবা কে জানে, এরইমধ্যে হয়ে গেছে কিনা!

সোফা থেকে উঠে একটু দূরে গিয়ে পকেট থেকে দ্রুত ফোনটা বের করে পিএসের নাম্বারে কল দিলো সে।

“হ্যালো, স্যার?” নীচুস্বরে বললো।

“কী হয়েছে?” ওপাশ থেকে জানতে চাইলো পিএস।

ছফা তাকে জানালো, ডাক্তার আসকারকে জেরা করতে গেলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সম্ভাব্য হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে।

এ কথা শুনে প্রধানমন্ত্রীর পিএস শান্তকণ্ঠে বললো, “অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই আপনি আসলামকে নিয়ে ওখান থেকে চলে যান। এ মুহূর্তে ওখানে থাকার কোনো দরকার নেই আপনাদের।”

“কিন্তু এরকম অবস্থায় ডাক্তারকে একা রেখে যাওয়াটা কি ঠিক হবে, স্যার?” নুরে ছফা দ্বিধাভরা কণ্ঠে জানতে চাইলো।

এ প্রশ্নের জবাবেও একই কথা বললো প্রধানমন্ত্রীর পিএস আর সেটা আগের চেয়েও জোর দিয়ে, “আপনারা এক্ষুণি ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। অ্যাম্বুলেন্স চলে আসার আগেই।

“কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স চলে আসার আগেই যদি ডাক্তারের কিছু হয়ে যায়?” ছফা আতঙ্কের সাথে বললো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশেক মাহমুদ। “সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন সময় নষ্ট না করে ওখান থেকে চলে আসুন।”

“ঠিক আছে, স্যার।” নুরে ছফা মোবাইলফোনটা পকেটে রেখে কয়েক মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে। আসকার ইবনে সায়িদের কাছে এসে জানতে চাইলে সে, “এখন কী অবস্থা, আপনার?”

“বুকে ব্যথা হচ্ছে!” ডাক্তার তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে শুধু এটুকুই বলতে পারলেন, তার চোখমুখ কুঁচকে আছে।

“অ্যাম্বুলেন্স এসে পড়বে এক্ষুণি,” কথাটা বলে আসলামকে নিয়ে ঘরের এক কোণে চলে গেলো সে, নীচুকণ্ঠে বললো, “এই পাসপোটার সবগুলো পেইজের ছবি তুলে নাও…আমাদেরকে এক্ষুণি এখান থেকে চলে যেতে হবে।”

পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে পকেট থেকে মোবাইলফোন বের করে ঝটপট ছবি তুলতে শুরু করে দিলো আসলাম। “বুড়া অ্যাক্টিং করছে…” ছবি তুলতে তুলতেই নীচু কণ্ঠে বললো সে।

ছফা কিছু বললো না। তার কাছে মনে হচ্ছে না ডাক্তার অভিনয় করছেন। লক্ষণ বলছে, হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন ভদ্রলোক।

*

প্রায় পাঁচ মিনিট পর অসুস্থ ডাক্তার চোখ খুলে তাকালেন। তার ঘরে এখন কেউ নেই। একটু আগে দু-জন মানুষ কোনো কিছু না বলে তাকে একা রেখে চলে গেছে। সামনের টেবিলের উপর তার বৃটিশ আর বাংলাদেশি পাসপোর্ট দুটো পড়ে আছে। নিজের শারীরিক অবস্থার কথা বাদ দিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন, এই পাসপোর্ট থেকে নুরে ছফা নামের ঐ ডিবি অফিসার কী-ই বা বের করতে পারবে?

আর যাই হোক, ওর ব্যাপারে কিছু জানার কথা নয়! অবশেষে নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন তিনি।

.

অধ্যায় ৪২

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নিজ বাড়ির বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছেন রমাকান্তকামার। চারপাশ ঘিরে থাকা গাছগাছালি থেকে ঝিঁঝিপোকার দল একচ্ছত্র সুনসান পরিবেশকে বিরামহীন হুমকি দিয়ে যাচ্ছে যেনো। কালচে আকাশটার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। সেখানে অন্ধকারের সাথে পেরে উঠছে না ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলো। দৃশ্যটা একটু উদাস করে দিলো তাকে। তাহলে কি আবারো তার জীবনে কালোছায়া নেমে এলো?

সারা দিন স্কুলে সময় দিয়ে বিকেলের দিকে চলে যান রবীন্দ্রনাথে, সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়-আজও তার ব্যতিক্রম করেননি, কিন্তু অন্যসব দিনের মতো ঘরে বসে বই পড়ে কিংবা স্কুলের কাগজপত্র নিয়ে না বসে একমনে ভেবে যাচ্ছেন। একটু আগে ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিন খোন্দকার তাকে ফোন করেছিলো। ভদ্রলোক অনেকটা ক্ষোভের সাথেই জানতে চেয়েছেন, চিরকুটের বিষয়টা নুরে ছফা নামের ডিবি অফিসারকে তিনি কেন বলতে গেলেন! ভদ্রলোককে নাকি পিস্তল দেখিয়ে বাধ্য করেছে স্বীকার করতে, চিরকুটটা ডাক্তার আসকার তাকে দিয়েছিলেন। উকিলের কাছ থেকে সব শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন রমাকান্তকামার।

এ জীবনে কখনও সজ্ঞানে আইন ভঙ্গ করেননি তিনি, অপরাধীর সাথে যোগাযোগ রাখার তো প্রশ্নই ওঠে না। সমাজের হীন আর কুটিল লোকজনকে ঘেন্না না করে বরং সব সময়ই এড়িয়ে চলেন-এটাই তার নীতি। ঐ ছফাকেও এড়িয়ে যেতেন, কিন্তু সে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোক, তাকে সাহায্য করা নৈতিক কর্তব্যই নয়, আইনত বাধ্যও তিনি। তাই চিরকুটের ব্যাপারে সত্যিটা বলেছিলেন। বেনামি একটি চিরকুট পাঠিয়ে শুধু নির্দোষ একটি অনুরোধ করেছিলো মহিলা-অদ্ভুত নামের রেস্টুরেন্টটির জায়গায় একটি গ্রন্থাগার করা। রাশেদের স্ত্রী এমন অনুরোধ না করলেও সুন্দরপুরে রবীন্দ্রনাথের নামে একটি লাইব্রেরি করতেন মাস্টার-আর সেটা হতো বহুকাল আগের বিস্মৃত আর ধ্বংস হওয়া একটি প্রতিষ্ঠানকে পুণরুজ্জীবিত করার শামিল।

তিন বছরেরও বেশি আগে, রাশেদ জুবেরির স্ত্রী সুন্দরপুর ছাড়ার আগে তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলো। সত্যি বলতে, এখানে আসার পর থেকে বার কয়েকই চেষ্টা করেছিলো ভদ্রমহিলা তার সঙ্গে কথা বলার জন্য, কিন্তু মাস্টার এড়িয়ে গেছেন। মহিলা যে রাশেদের স্ত্রী সেটা নিয়ে তার মনে ছিলো সন্দেহ। তবে সমস্ত সন্দেহ, সংশয় আর দূরত্ব ঘুচিয়ে অবশেষে দেখা করেছিলেন। তাদের মধ্যে যে কথা হয়েছে সেটা তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানে না। মহিলা তাকে বলেছিলো, সুন্দরপুরের আগের এমপি আসাদুল্লাহর কারণেই এই ট্রাস্টের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। যদি সে ট্রাস্টের ঘোষণা দিতো, এমপি নির্ঘাত মাস্টারের ক্ষতি করতো। আর সেটা যে কী, বললেও চলে। তাই আসাদুল্লাহর লোলুপ দৃষ্টি থেকে জমিগুলো আগলে রাখার চেষ্টাই করে গেছে এতো দিন। মাস্টারের কাছেও মনে হয়েছে, কথাটার মধ্যে সত্যতা রয়েছে। আসাদুল্লাহর রূপ তো তিনি কম দেখেননি।

ক্ষয়িষ্ণু চাঁদটার দিকে তাকালেন রমাকান্তকামার। তিনি এখনও বিশ্বাস করেন গাছের সাথে মানুষের পার্থক্য আছে। আম গাছে জাম হবে না, আমই হবে। কিন্তু মানুষের বেলায় এটা খাটে না। চোরের ছেলে চোর হবে এমন কোনো কথা নেই। আবার সাধুর ছেলে যে চোর হবে না তা-ও জোর দিয়ে বলা যায় না। তারপরও বাস্তবতা হলো, অনেক সময়ই দেখা যায় চোরের ছেলে চোরই হয়! এ হলো সঙ্গদোষের ব্যাপার। পরিবেশ আর সময় তাকে প্রভাবিত করে। জন্মের পর মানবশিশু সাদা কাগজের মতোই নিষ্কলঙ্ক থাকে, কিন্তু তাতে দাগ ফেলে তার অভিভাবক, পরিবার, পরিবেশ আর সময়। এসব যদি শিশুর অনুকূলে না থাকে, সে শিশু মানুষ হবে কিভাবে? কয়জন পারে নিজের চারিত্রিক দৃঢ়তা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রতিকূল পরিবেশ আর সময়কে জয় করতে?

সুন্দরপুরের মুসলিম লীগের পাণ্ডা হামিদুল্লাহর ছেলে আসাদুল্লাহ কি তার বাপের মতো হয়নি?

হামিদুল্লাহ ছিলো আগাগোড়া সাম্প্রদায়িক একজন মানুষ। সুন্দরপুরসহ আশেপাশের এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিলো তার দুচক্ষের বিষ জমিদার থেকে মুচি; ব্রাহ্মণ থেকে নমশূদ্র, এমনকি ব্রাহ্মরা পর্যন্ত। তার কাছে তাদের সবার পরিচয় ছিলো একটাই-মালাউনের বাচ্চা! ইন্ডিয়ার দালাল! ব্রাহ্মরা যে হিন্দু না এটা বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান থাকলেও রাজনৈতিক আর জাগতিক ফায়দার কথা ভেবে চেপে যেতো। এই ঘেন্নার রাজনীতি তাকে শেষ পর্যন্ত অমানুষে পরিণত করে। একাত্তরের দীর্ঘ নয় মাস সুন্দরপুরের সবাই সেই অমানুষটাকে দাপিয়ে বেড়াতে দেখেছে।

কী একটা সময়ই না ছিলো!

নিজের অজান্তেই, কখন যে স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন টেরই পেলেন না রমাকান্তকামার। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি বড় বেশি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন। এই নিঃসঙ্গ জীবনে শত ব্যস্ততার মধ্যেও আগের চেয়ে অনেক বেশি পুরনো স্মৃতি তাকে কাতর করে তোলে। এই যেমন এখন, একাত্তরের নানান ঘটনা তার মানসপটে ভেসে উঠতে শুরু করেছে।

রাশেদ জুবেরির মায়াভরা মুখটা ভেসে উঠলো মনের পর্দায়। কী সহজ সরল আর ভালো মানুষই না ছিলো! এতো সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও জাগতিক বিষয়ে এক ধরণের বৈরাগ্য ছিলো তার মধ্যে। সম্ভবত এক লহমায় বাবা-মা, নানাসহ পরিবারের সবাইকে হারানোর কারণে তার এই বৈরাগ্যভাবের জন্ম। সেদিন যমের তালিকায় সে-ও ছিলো, কিন্তু রমাকান্তকামারের বাসায় থাকার দরুন বেঁচে যায়। বইয়ের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণই তাকে টেনে এনেছিলো এই বাড়িতে। সুন্দরপুরে সপরিবারে বেড়াতে এসে হাপিয়ে উঠেছিলো সে। একটাও লাইব্রেরি নেই, এ কেমন মফশ্বল! কিন্তু সে তখনও জানতো না, এক সময় এই সুন্দরপুরে ছিলো রবীন্দ্রনাথের নামে সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার, ঘেন্নার রাজনীতিতে সেই রবীন্দ্রনাথ পুড়ে খাক হয়ে গেছিলো। তবে রবীন্দ্রনাথের অমূল্য সম্পদের বিরাট একটি অংশ রক্ষা করতে পেরেছিলেন মাস্টার। পয়ষট্টি থেকে গত বছর রবীন্দ্রনাথের নামে লাইব্রেরিটি পুণরায় দেবার আগ পর্যন্ত সযত্নে নিজের বাড়িতে আগলে রেখেছেন বইগুলো। একটা বইও পোকায় খেতে পারেনি, অনাদরে নষ্ট হয়নি। সন্তানের স্নেহে সেগুলো আগলে রেখেছেন দীর্ঘ পঞ্চাশটি বছর।

রাশেদের মা অঞ্জলি জানতো এটা। মাস্টারের সাথে তার ছিলো বেশ ভালো সম্পর্ক। অঞ্জলিই ছেলেকে গল্পটা বলেছিলো-এক সময় সুন্দরপুরে ছিলো রবীন্দ্রনাথের নামে সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি, আর সেটা দিয়েছিলেন ত্রিলোকনাথ বসু। পয়ষট্টির দাঙ্গায় লাইব্রেরিটা কিভাবে পুড়ে যায়, আর বইগুলো কিভাবে মাস্টার রমাকান্তকামার রক্ষা করেছিলেন, এই গল্পটাও করেছিলো সে। রাশেদ সব শুনে আগ্রহী হয়ে ওঠে, মাস্টারের বাড়িতে হানা দেয়। বইয়ের সংগ্রহ দেখে ছেলেটার ভুরু কপালে উঠে গেছিলো। বহু দুষ্প্রাপ্য বই তাকে আকর্ষিত করেছিলো পতঙ্গের মতোই। বইয়ের টানে মাস্টারের বাড়িতে পড়ে থাকার সময়ই ঘটে সেই মর্মান্তিক ঘটনাটি। সুন্দরপুরে হানা দেয় পাক-হানাদাররা, আর তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলো সেই জঘন্য লোকটি-আসাদুল্লাহর বাপ, মুসলিম লীগার হামিদুল্লাহ্। নয়টা মাস সে কখনও যমের দোসর ছিলো তো কখনও নিজেই যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কতো মানুষ হত্যা করেছে, কতো লুণ্ঠন আর ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিলো কে জানে। তার নয় মাসের পশুরাজত্ব শেষ হয় পনেরোই ডিসেম্বর-স্বাধীনতা পাবার ঠিক এক দিন আগে।

একাত্তরের মোলোই ডিসেম্বরের আগের দিন সুন্দরপুর যখন মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা মুক্ত করে ফেললো তখন হামিদুল্লাহ্ পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে তার লুণ্ঠিত ধনসম্পদের কিছু অংশ নিয়ে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ধরে ফেলে। নিয়তির নির্মম পরিহাস, যে বাড়িতে মিলিটারি ক্যাম্প করে মানুষজন হত্যা করতো, নির্যাতন করতো সেই জমিদার বাড়িতে নিয়ে গিয়েই তাকে গুলি করে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা। অনেক বছর পর সেই আল-বদর নেতার ছেলে যখন এলাকার এমপি হয়ে গেলো তখন মাস্টারকে একদিন ডেকে নিয়ে গেছিলো একটা কথা জানার জন্য-মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দলে রাশেদ জুবেরি ছিলো কিনা!

রমাকান্তকামার জানতেন, এতোদিন পর এই লোক এটা কেন জানতে চায়-জমিদারের সম্পত্তিগুলো জবর দখল করার জন্য যুৎসই একটি বাহানা খুঁজছে বাপের যোগ্য ছেলে!

মাস্টার তাকে বলেছিলেন, ঐদিন রাশেদকে দেখেননি তিনি। তখন সে সুন্দরপুরে এসেছিলো কিনা তা-ও তার জানা নেই। তার সাথে জুবেরির দেখা হয়েছিলো সতেরোই ডিসেম্বর সকালে। সমগ্র জীবনে সজ্ঞানে মাত্র তিনটি মিথ্যা বলেছিলেন তিনি দ্বিতীয় মিথ্যাটি বলার সময় তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা বা অপরাধবোধ তৈরি হয়নি। যুধিষ্ঠিরকেও তো মিথ্যে বলতে হয়েছিলো সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য! নিজেকে এভাবেই বুঝ দিয়েছিলেন মাস্টার।

তবে এটাও ঠিক, তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না আসলেই ঐদিন মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি হামিদুল্লাহকে হত্যা করেছিলো সেই দলে রাশেদ ছিলো কিনা। যুদ্ধফেরত ছেলেটার সঙ্গে তার দেখা হয় হামিদুল্লাহর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর। নরম স্বভাবের রাশেদ জুবেরির চোখমুখ দেখে মাস্টার শুধু কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন।

স্বাধীনতার পর, মাঝেমধ্যে কিছু দিনের জন্য সুন্দরপুরে এসে মাস্টারের বাসায় উঠতো রাশেদ, নানার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেও যেতো না। সম্ভবত ওখানে বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছিলো বলে পারিবারিক বধ্যভূমিটা এড়িয়ে চলতো সে। তো, এরকমই একদিন রাশেদ জুবেরি মাস্টারের বাড়িতে বেড়াতে এসে এ কথা ওকথা বলার এক পর্যায়ে বলেছিলো, যুদ্ধের আগে একটা মুরগি কাটতে দেখলেও তার বুক কেঁপে উঠতো, মায়া হতো, এমনকি যুদ্ধের সময় হানাদার পাকবাহিনী মারতেও তার মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি কাজ করতো, কিন্তু খুন হবার আগে হামিদুল্লাহর করুণ চেহারাটা দেখলে নাকি তার একটুও মায়াদয়া হতো না!

নাকি হয়নি?!

মাথা থেকে আবারো পুরনো স্মৃতিগুলো বিদায় করে হাই তুললেন মাস্টার। বর্তমান সমস্যাটা নিয়ে আবার ভাবতে লাগলেন। ট্রাস্টের সদস্য ডাক্তার আসকার কোথায় আছে সেটা নাকি ময়েজ উদ্দিন বলে দিতে বাধ্য হয়েছে। ভদ্রলোকের সাথে ছফা কী করে কে জানে! তাকে আগেভাগে বলে দিলেই পারতেন! কিন্তু জীবনে প্রথম তিনি স্বার্থপরের মতো হাতপা গুটিয়ে রেখেছেন। আর এটা মোটেও নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য নয়-তার স্বপ্নের গায়ে যাতে আঁচড় না লাগে সেজন্যে।

.

অধ্যায় ৪৩

ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের বাড়ি থেকে দশ-পনেরো গজ দূরে, ছায়াঘন এক জায়গায়, ইনসাইড লাইট বন্ধ করে গাড়ির ভেতরে বসে আছে নুরে ছফা আর আসলাম। গাঢ় হয়ে উঠেছে সন্ধ্যা, জ্বলে উঠেছে রাস্তার বাতিগুলো।

একটু আগে ডাক্তারের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার পর তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। এখনও কোনো কথা হচ্ছে না। দু-জনেরই দৃষ্টি ডাক্তারের সুনশান বাড়িটার দিকে। ওখান থেকে বের হবার আগে দারোয়ানকে অবশ্য ডাক্তারের অসুস্থতার কথা বলে এসেছে। আরো বলেছে, কিছুক্ষণ পরই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে, চিন্তার কিছু নেই, সে যেনো ডাক্তারের সাথে থাকে।

এ কথা শুনে দারোয়ান যা বলেছে সেটা নিয়ে নুরে ছফা এখন চিন্তিত। লোকটা তাদের দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিলো যেনো, দু-দুজন দস্যু জোর করে বাড়িতে ঢুকে ডাক্তারকে হত্যা করার জন্য পয়জন ইনজেকশান দিয়ে চলে যাচ্ছে!

“হায় আল্লাহ! স্যারে আপনেরা কী করছেন?”

লোকটা ভয়ার্ত চোখেমুখে এ প্রশ্ন করলে আসলাম রেগেমেগে তার কলার ধরে বসেছিলো, অবশ্য ছফা তাকে বিরত রাখে। তার নিজেরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিলো দারোয়ানের এমন কথা শুনে। তারপরও রাগ সামলে ঠাণ্ডা মাথায় বলেছিলো, এসব উল্টাপাল্টা কথা যেনো সে না বলে। তার স্যারের তেমন কিছু হয়নি। বৃদ্ধ মানুষ, একটু জিজ্ঞাসাবাদের কারণে ঘাবড়ে গেছেন। সম্ভবত তার প্রেসার বেড়ে গেছে, তাই বুকে একটু ব্যথা হচ্ছে। তার নিজের হাসপাতালে ফোন করা হয়েছে, কিছুক্ষনের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে।

কিন্তু সেই অ্যাম্বুলেন্স এখনও আসেনি। ছফার চিন্তা এখন একটাই-ডাক্তারের না আবার খারাপ কিছু হয়ে যায়!

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলার জন্য গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলো সে। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা আসলাম তাকালো তার দিকে। “স্মোক করবো,” আস্তে করে বললো ছফা। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে একটাতে আগুন ধরালো। সিগারেটে যখন দ্বিতীয় টানটা দেবে তখনই দেখতে পেলো অরিয়েন্ট হাসপাতালের লোগো আর নাম লেখা একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির ডাক্তারের বাড়ির সামনে। তড়িঘড়ি দারোয়ান ভেতর থেকে গেটটা খুলে দিলো, অ্যাম্বুলেন্সটা বাড়িতে ঢুকতেই বন্ধ করে দিলো আবার।

“সব ভুগিচুগি,” আসলাম বিরক্ত হয়ে কথাটা বললো।

তার দিকে তাকালো ছফা। বিরক্তভরা দৃষ্টি নিয়ে ডাক্তারের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে পিএসের গানম্যান।

“অ্যাক্টিং করেছে,” দৃঢ়ভাবে বললো সে। “আমি একদম শিওর।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছফা, তবে কিছুই বললো না। ডাক্তার যদি অভিনয় করে থাকেন তাহলে বলতেই হবে, তিনি বেশ পাকা অভিনেতা। কিন্তু ভদ্রলোকের ঘর্মাক্ত কপাল, যন্ত্রণাকাতর চোখমুখ-এসব দেখে অভিনয় বলে মনে হয়নি তার কাছে। এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে সেটা বের করে দেখলো পিএস আশেক মাহমুদ কল দিয়েছে। সন্দেহ নেই, তার মতোই ক্ষমতাধর এই মানুষটিও চিন্তিত।

“স্যার?”

“এনি আপডেট?” ওপাশ থেকে জানতে চাইলো আশেক মাহমুদ, তার কণ্ঠেও উদ্বিগ্নতা।

“অ্যাম্বুলেন্স এসেছে,” ছফা বললো। “এখন বাড়ির ভেতরে ঢুকেছে…ডাক্তারকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।”

“আপনারা কোথায়?”

“ডাক্তারের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে আছি, স্যার।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে পিএস বললো, “মরেটরে যাবে না তো?”

“বুঝতে পারছি না।”

“আচ্ছা, ঐ দারোয়ান ছাড়া আর কে দেখেছে আপনারা বাড়িতে ঢুকেছেন?”

জবাবটা দেবার আগে একটু সময় নিলো ছফা। পিএস কি উইটনেস এলিমিনেট করার কথা ভাবছে?! চিন্তাটা আবারো ভড়কে দিলো তাকে।

“আর কেউ না, স্যার,” বললো সে। “কিন্তু ঐ দারোয়ান সম্ভবত অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে হাসপাতালে যাবে।” ছফার আশঙ্কা, পিএস হয়তো তার গানম্যানকে নির্দেশ দেবে, একমাত্র সক্ষি দারোয়ানকে সরিয়ে দিতে, কিন্তু সেটার জন্যেও যে একটু দেরি হয়ে গেছে, তাই যেনো বলতে চাইলো।

কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো পিএস। “আরেকটু পর আমি আবার কল দেবো আপডেট জানতে। দেখা যাক কী হয়।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

ফোনটা পকেটে রেখে আনমনা হয়ে গেলো ছফা। ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা আসলামের দিকে চকিতে তাকালো। গানম্যানের দৃষ্টি এখনও গেটের দিকেই নিবদ্ধ। সামনের দিকে তাকালো সে। দারোয়ান নির্ঘাত এরইমধ্যে তাদের কথা অ্যাম্বুলেন্সে করে আসা লোকজনকে বলে দিয়েছে। তাছাড়া, ডাক্তার যদি মারা যাবার আগে হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে পারেন, তাহলেও তাদের কথা জানিয়ে দিতে পারবেন নিজেই। সব দিক থেকে ভালো হয়, ডাক্তার যদি এ যাত্রায় টিকে যান। নুরে ছফা মনে মনে সেই কামনাই করলো।

“মরবে না,” আস্তে করে বললো আসলাম, যেনো ছফার আশঙ্কাটা টের পেয়ে গেছে সে। “চিন্তার কিছু নেই।”

গানম্যানের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি এখনও সামনের দিকেই নিবদ্ধ। এই লোকটা কি তার মনের কথা পড়তে পেরেছে? নাকি তার উদ্বিগ্নতা আঁচ করতে পেরেছে?

“হুম।” সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। ডাক্তার যেনো এ যাত্রায় বেঁচে যান!

কিছুক্ষণ পরই ডাক্তারের বাড়ির মেইন গেটটা খুলে গেলো আবার। অ্যাম্বুলেন্সটা বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে একটু সময়ের জন্য থামলো। এই ফাঁকে মেইনগেট বন্ধ করে তালা মেরে অ্যাম্বুলেন্সের সামনের সিটে উঠে বসলো দারোয়ান। কোনো রকম সাইরেন না বাজিয়ে, অনেকটা চুপিসারে চলে গেলো গাড়িটা।

ওটা ফলো করো-এরকম কোনো আদেশ দিতে হলো না ছফাকে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটাকে অনুসরণ করতে শুরু করে দিলো আসলাম।

কিন্তু ছফাকে হতাশ করে দিয়ে সংক্ষিপ্ত এই অনুসরণ পর্বটি শেষ হলো অরিয়েন্ট হাসপাতালে গিয়েই। দূর থেকে তারা দেখতে পেলো অ্যাম্বুলেন্সটি ঢুকে পড়ছে হাসপাতালের ভেতরে।

“ওখান দিয়ে তো লাশ বের করে,” আসলাম বললো সন্দেহের সুরে। “আমি এই হাসপাতালে এর আগেও এসেছি…ওটা এমার্জেন্সি এন্ট্রান্স না।”

তার দিকে তাকালো নুরে ছফা। “লাশ বের করে ওখান দিয়ে?” কথাটা বলার সময় তার কাছে মনে হলো ডাক্তার বুঝি মারাই গেছেন।

“গত বছর আমার এক খালাতো ভাই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছিলো এই হাসপাতালে, ওর লাশটা ওখান দিয়েই বের করেছিলো।”

ছফা কিছুই বললো না।

“বুড়ো অ্যাক্টিং করেছে,” আসলাম আবারো বললো কথাটা।

পিএসের গানম্যানের দিকে তাকালো সে, তার চোখেমুখে রাগ, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।

.

অধ্যায় ৪৪

“তাহলে আপনি মনে করছেন ঐ মহিলা কলকাতায় আছে?”

“জি, স্যার,” বললো ছফা। “আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর।”

তারা এখন বসে আছে গুলশান নিকেতনের একটি ফ্ল্যাটে, জায়গাটা ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের বনানীর বাসা আর অরিয়েন্ট হাসপাতাল থেকে খুব একটা দূরে নয়। আসলাম তাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে আবার চলে গেছে অরিয়েন্ট হাসপাতালে। ডাক্তার সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়েছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে গেছে সে।

“ডাক্তারের পাসপোর্ট সেটাই বলছে। উনি যে ঘন ঘন কলকাতায় যান সেটা লুকানোর চেষ্টা করেছেন। এর মানে একটাই-মুশকান জুবেরি কলকাতায় আছে। তা না-হলে ভদ্রলোক এটা করতেন না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “হুম। ইট ডাজ মেক সেন্স।”

ছফা বুঝে উঠতে পারছে না, ডাক্তার যে নতুন গল্পটা বলেছেন মুশকানের ব্যাপারে সেটা পিএসকে বলবে কিনা। তার কাছে মনে হচ্ছে, আগেভাগে না বলাই ভালো, আরেকটু খতিয়ে দেখা দরকার। ঐ ভদ্রলোকের কোন কথাটা যে সত্যি, সে নিজেও জানে না। একটা প্রহেলিকা তৈরি করেছেন বৃদ্ধ ডাক্তার। গোলকধাঁধাতুল্য সেই প্রহেলিকা থেকে বের হবার একটাই উপায়-মুশকানকে হাতের মুঠোয় নেয়া।

“তাহলে “খন কী করবেন?” ছফাকে চুপ থাকতে দেখে জানতে চাইলে পিএস আশেক মাহমুদ।

ছফা কোনো সময় না নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো, “আমার কলকাতায় যাওয়া দরকার। বেশি দেরি করলে ঐ মহিলা ওখান থেকেও সটকে পড়তে পারে।”

“এতোক্ষণে সটকে পড়েছে কিনা কে জানে,” তিক্তমুখে বললো পিএস।

“আমার তা মনে হয় না, স্যার, জোর দিয়ে বললো। “ডাক্তার যদি এরইমধ্যে মুশকানকে সব জানিয়েও দেন, অতো দ্রুত কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না মহিলা।”

“আপনার কেন এটা মনে হচ্ছে?”

“ডাক্তার জানেন আমি কেবল তার ঘনঘন কলকাতায় যাবার বিষয়টি আবিষ্কার করেছি…তিনি ওখানে কোথায় উঠতেন, কোথায় যেতেন সেটা আমি জানি না। তাছাড়া আমার মনে হয় না, ডাক্তারের সাহায্য ছাড়া ঐ মহিলা আবারো নতুন কোনো আশ্রয় খুঁজে নিতে পারবে সহজে। একটু সময় লাগবেই।”

“হুম,” গম্ভীরভাবে বললো পিএস।

“কলকাতার মতো শহরে একজন মানুষকে খুঁজে বের করা অসম্ভব না হলেও অনেক কঠিন আর সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।”

“তাহলে আপনি তাকে কিভাবে খুঁজে বের করবেন?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো আশেক মাহমুদ।

একটু ভেবে নিলো ছফা। প্রথমেই তার মনে পড়লো কেএস খানের কথা। সাবেক এই ইনভেস্টিগেটর তাকে নিশ্চয় এ ব্যাপারে ভালো সাহায্য করতে পারবে। “ঐ মহিলাকে খুঁজে বের করার একটা উপায় বের করতে হবে দ্রুত,” বললো সে।

মাথা নেড়ে সায় দিলো পিএস।

“ওখানে এক পুলিশ অফিসারের সাথে আমার বেশ ভালো জানাশোনা আছে, আশা করছি তার কাছ থেকে সাহায্য পাবো।”

“তাহলে আপনি কবে যেতে চাইছেন?” একটু থেমে আবার বললো পিএস, “আপনার কি ভিসা আছে?”

“আমার পাঁচ বছরের ভিসার মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি, স্যার।”

“গুড। আপনি তাহলে আমাকে জানান, কবে যেতে চান। এয়ার। টিকেট নিয়ে ভাববেন না। রিগ্যাল এয়ারওয়েজের মালিক আমার পরিচিত। টিকেট না থাকলেও যখনই চাইবেন, আপনার জন্যে একটা সিটের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে সে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”

“ঐ ডাক্তার যাতে বিদেশে চলে যেতে না পারে সেটার ব্যবস্থাও করা যাবে। আপনি তার পাসপোর্টের ছবি আসলামের ফোনে সেন্ড করে দেবেন। আমি ইমিগ্রেশনে বলে দেবো, ঐ ডাক্তার দেশের বাইরে যেতে পারবে না।” ছফা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবার বললো, “ঐ ডাক্তার যদি বেঁচে থাকে তাহলে আপনি ওখান থেকে ফিরে এসেও তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন।”

“আমি খুব দ্রুতই যেতে চাইছি, স্যার…কাল-পরশুর মধ্যেই।”

“হুম,” গম্ভীর হয়ে সায় দিলো পিএস। “একটা কথা। আপনি যদি ওই মহিলাকে ওখানে ট্র্যাক ডাউন করে ফেলতে পারেন তখন কী করবেন?”

“মুশকানকে ওখানে খুঁজে পেলেও তাকে গ্রেফতার করে দেশে আনাটা সহজ হবে না। ওদের সাথে আমাদের এক্সট্রাডিশান প্যাক্ট রয়েছে, কিন্তু সেটা করতে অনেক সময় লাগে, মামলার নথিপত্রও সবমিট করতে হয়। এ কাজটা আমি একটু অন্যভাবে করতে চাই।”

“কিভাবে?”

“আমার ধারনা ঐ মহিলা অবৈধভাবে ওখানে গেছে। এখান থেকে সরকারীভাবে অনুরোধ জানালে তাকে পশ্চিবঙ্গের অথরিটি খুব সহজেই পুশব্যাক করে দিতে পারবে সীমান্ত দিয়ে। সেখান থেকে আমি তাকে নিজের হেফাজতে নিয়ে নেবো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো পিএস। এভাবে অসংখ্য পুশব্যাকের মাধ্যমে আসামি আদানপ্রদান করে দুই প্রতিবেশী দেশ। “আর মহিলা যদি বৈধভাবে ওখানে গিয়ে থাকে, তাহলে?”

“তাতেও সমস্যা নেই। তার বিরুদ্ধে যে কেসগুলো আছে সেগুলো ওদেরকে জানাবো, আসামিকে পুশব্যাক করতে বলবো।”

একটু ভেবে নিলো পিএস। “সে যদি ওখানকার সিটিজেনশিপ বাগিয়ে নেয়? তিন বছর আগে গিয়ে থাকলে তো এই দীর্ঘ সময়ে নাগরিকত্ব নিয়ে নেয়াটা অসম্ভব কিছু না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। এটারও সম্ভাবনা আছে।

“নিরাপদ থাকার জন্য, সম্পূর্ণ নতুন নামে, নতুন পরিচয়ে ভিন্ন একটি দেশের নাগরিক হয়ে যেতে পারে ঐ মহিলা।”

একটু চিন্তায় পড়ে গেলো নুরে ছফা। ওখানকার নাগরিকত্ব নিয়ে নিলে মুশকানকে দেশে নিয়ে আসাটা সহজ হবে না।

“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না,” ছফাকে আশ্বস্ত করে বললো আশেক মাহমুদ। “ওরকম কিছু হলে তাকে সবার আগে নিজের কজায় নিয়ে নিরাপদ কোথাও রেখে দেবেন, বাকি সব কিছুর ব্যবস্থা আমি করতে পারবো।”

.

অধ্যায় ৪৫

গভীর করে শ্বাস নিয়ে আশেপাশে তাকালো আসলাম। অরিয়েন্ট হাসপাতালের ইনটেনসিভ কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটের সামনে যে ওয়েটিং এরিয়াটি আছে সেখানে বসে আছে সে। অন্য রোগীদের উদ্বিগ্ন আত্মীয়স্বজনও আছে বাকি চেয়ারগুলো দখল করে। কেউ কেউ পায়চারী করছে চিন্তিত মুখে। তাকে দেখলে, ঐসব আত্মীয়স্বজনদেরই একজন বলে মনে হবে। আদতে সে এসেছে চতুর আর ধূর্ত ডাক্তার আসকারকে নজরদারি করতে-আসলাম পুরোপুরি নিশ্চিত, বুড়োটা অসুস্থ হবার ভান করেছে।

এরকম কাজ পিএসের গানম্যান হিসেবে চাকরি নেবার পর আরো দুয়েক বার করেছে, সুতরাং সে জানে, কতটা বিরক্তিকর হতে পারে এটা। চূড়ান্ত ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদ এমনিই তাকে নিয়োগ দেয়নি। যদিও মুরে ছফার মতো অনেকেই জানে না, সে আসলে পিএসের নিছক কোনো গানম্যান নয়। আশেক মাহমুদের এমন সব ব্যক্তিগত কাজ সে করে দেয় যেগুলো অন্য কাউকে দিয়ে করানো যায় না। গানম্যান কিংবা গানম্যান থেকে তার কাজ আরো বিস্তৃত-বহুমুখি!

নিয়ম অনুযায়ি, প্রধানমন্ত্রীর পিএস হিসেবে পুলিশ বাহিনী থেকে একজন গানম্যান পায় আশেক মাহমুদ, কিন্তু ওকে নিয়ে খুব একটা ঘুরে বেড়ায় না, কেবলমাত্র সরকারী অনুষ্ঠানেই ওই গানম্যান তার সঙ্গে থাকে, বাকি সময়ে তার সারাক্ষণ সঙ্গী হয় আসলাম।

এ মুহূর্তে তার হাতে একটি পত্রিকা, মাঝে মাঝে ওটা খুলে পড়ার ভান করছে, তবে তার নজর আসলে ইনটেনসিভ কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিটের দরজার দিকেই নিবদ্ধ। এর আগেও এক আত্মীয়ের হার্ট অ্যাটাক হলে এই হাসপাতালে এসেছিলো, তখন দেখেছে কিভাবে এই হাসপাতালটি চলে। এখন অপেক্ষা করছে, ডাক্তারের সত্যিকারের হালহকিকত জেনে নিতে।

আসলাম জানে, তাকে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। এই ইউনিটে এখন পর্যন্ত পাঁচজন রোগীর নাম সে মুখস্ত করেছে। সিকিউরিটি অফিসার-কাম-রিসেপশনিস্ট বসে আছে সে মাঝেমধ্যেই রোগীর নাম ধরে তার আত্মীস্বজনদের খোঁজ করছে। একজন রোগীর নাম উচ্চারণ করে আর ওয়েটিং এরিয়ায় বসে থাকা উদ্বিগ্ন আত্মীয়ের দল ছুটে যায় তার কাছে। সে তখন জানায় তাদের মধ্যে একজন ভেতরে ঢুকতে পারে রোগীকে দেখার জন্য। রোগী নিজেই নাকি বলেছে অমুকের সাথে দেখা করতে চাইছে।

আবার অনেক সময় রোগীর আত্মীয়েরা হন্যে হয়ে খোঁজ নেয় রিসেপশনিস্টের কাছে তাদের রোগীর অবস্থা জানতে। তখন ঐ লোক ইন্টারকমের মাধ্যমে ভেতরের ডাক্তারের সাথে কথা বলে একজন-দুজনকে অনুমতি দেয় দেখা করার জন্য।

শিকারির মতো ধৈর্য নিয়ে আসলাম এখন বসে আছে ওয়েটিং এরিয়ায়। ক্ষিদেয় তার পেট চৌ চৌ করলেও সেটা দমিয়ে রেখেছে। সব কিছু দেখে তার মনে হচ্ছে, একটু পরই আইসিসিইউতে ঢোকার সুযোগ পেয়ে যাবে।

যেহেতু ডাক্তারের কোনো আত্মীয়স্বজন এখনও আসেনি, ইচ্ছে করলে সে আত্মীয় সেজে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু সে জানে, এটা করা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি বিরাট বড় বোকমি হবে। এই হাসপাতালটি ডাক্তারের নিজের, তার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এখানে ঢোকা সম্ভব নয়। এখানকার অনেকেই লোকটার নিকটাত্মীয়দের চেনে। তাছাড়া, অন্য রোগীর তুলনায় তার বেলায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। বুড়োটা যদি ভান করে থাকে, তাহলে সতর্কতার মাত্রা হবে আরো বেশি। আসলাম তাই অন্যভাবে কাজটা করবে।

একটা হাই তুলে পত্রিকাটা চোখের সামনে মেলে ধরলো আবার। কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেলো রিসেপশন থেকে বলা হচ্ছে :

“আবিদুর রহমানের লোক আছে এখানে?”

ওয়েটিং এরিয়ার দিকে তাকালো আসলাম, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। সম্ভবত এই রোগীর আত্মীয়স্বজন নীচে গেছে চা-সিগারেট খেতে। চট করে উঠে দাঁড়ালো সে, এগিয়ে গেলো রিসেপশনের দিকে।

“কি হয়েছে, বলুন?” উদ্বিগ্ন আত্মীয় হিসেবে জানতে চাইলো সে।

“আপনার সাথে ডাক্তারসাহেব কথা বলবেন…ভেতরে যান,” বললো রিসেপশনের লোকটা।

আসলাম আর কোনো কথা না বলে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। ভেতরে ঢোকার পর একজন পুরুষ নার্স তাকে গাউন আর হেডক্যাপ পরতে বললো। দরজার পাশে থাকা র‍্যাক থেকে গাউন আর হেড-ক্যাপটা নিয়ে পরে ফেললো সে। এরপর নার্স ইশারা করলো বিশাল বড় রুমটায় ঢোকার জন্য।

আইসিসিইউ’র বিশাল রুমের দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো আসলাম। দু-পাশে সারি সারি বেড, প্রত্যেকটাই কার্টেন দিয়ে আড়াল করা। প্রত্যেক বেডের পাশেই অনেকগুলো যন্ত্রপাতি আর মনিটর আছে। রোগীদের বেশির ভাগ অক্সিজেন মাস্ক পরা। এক দু-জন বাদে সবাই নিথর হয়ে পড়ে আছে। ঘরের শেষ মাথায় কম্পিউটার আর কিছু মেশিনসংবলিত বিশাল একটি ডেস্কের ওপাশে অ্যাপ্রোন পরা এক ডাক্তার বসে আছে। বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ নার্স থাকলেও তারা বলতে গেলে নিঃশব্দেই চলাফেরা করছে এক বেড় থেকে আরেক বেডের দিকে।

আসলাম ভালো করে দু-পাশে তাকালো, ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে যেতে দেখে গেলো কোন্ বেডে ডাক্তার আসকার আছেন। তার এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু ধীরগতির ভ্রমণটি শেষ হলো ঘরের শেষ মাথায় থাকা ডেস্কের সামনে এসে।

এখানে ডাক্তার নেই! বিস্ময়ের সাথেই আবিষ্কার করলো সে।

“আমি আবিদুর রহমানের ছোটোভাই,” ডেস্কে বসে থাকা ডাক্তারকে বললো আসলাম। “আমার রোগীর কী অবস্থা, বলেন?” কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টাও করলো না।

ডেস্কের ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে করুণ মুখে বললো, “আপনার রোগীর অবস্থা তো ভালো না। তার হার্ট মাত্র টোয়েন্টি পার্সেন্ট কাজ করছে, অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল।”

আসলামের মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না। এখন কী করবো তাহলে?”

“অবস্থা বেশি খারাপ হলে কি লাইফ সাপোর্ট দেবো?”

শালার বানচোতের দল! গালিটা মনে মনেই দিলো সে। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কখনও কোনো রোগী বাঁচাতে পেরেছিস! অভিজ্ঞতা থেকে সে এটা জানে, তারপরও বিলের অঙ্ক ভারি করার জন্য হাসপাতালগুলো এ কাজ করতে দারুণ তৎপর থাকে সব সময়।

“না। তার কোনো দরকার নাই,” কাটাকাটাভাবে বললো সে। অচেনা রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের টাকা বাঁচিয়ে দেবার মতো পূণ্য কাজটা করলো।

ডাক্তার কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো আসলামের দিকে, যেনো পাষণ্ড কোনো ছোটোভাইকে দেখছে।

“আমার ভাই বলে দিয়েছেন তাকে যেনো লাইফ সাপোর্টে দেয়া না হয়।”

“ওহ্,” আশাহত ডাক্তার শুধু এটুকুই বললো, তারপর ফিরে তাকালো কম্পিউটার মনিটরের দিকে।

আসলাম তিক্তমুখে ঘুরে দাঁড়ালো, যা বোঝার বুঝে গেছে সে। মাত্র পা বাড়াবে দরজার দিকে অমনি একটা বুদ্ধি খেলে গেলো তার মাথায়। আবারো ফিরলো ডেস্কের দিকে।

“আচ্ছা, আমি শুনেছি এখানে ডাক্তার আসকার অ্যাডমিট…উনার কী অবস্থা?”

তরুণ ডাক্তার বেশ অবাক হলো কথাটা শুনে। “ডাক্তার আসকার অ্যাডমিট?!”

“হুম, সেরকমই তো শুনলান। আমার বাবার বন্ধু উনি,” মিথ্যেটা সুন্দরভাবে বললো পিএসের গানম্যান। এখানে আসার পর শুনলাম উনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে…অ্যাডমিট হয়েছেন আজই।”

ডাক্তার কী বলবে ভেবে পেলো না, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “উনি তো এখানে অ্যাডমিট হননি,” অবশেষে বললো সে। “আমি এরকম কিছু শুনিওনি।”

“তাহলে কি উনাকে এমার্জেন্সি থেকেই রিলিজ দিয়ে দেয়া হয়েছে?”

ঠোঁট ওল্টালো তরুণ ডাক্তার। “নিজের হাসপাতালে এলে ইমার্জেন্সি থেকে চলে যাবেন?” মাথা দোলালো। “মিনিমাম কয়েক দিন অবজার্ভেশনে থাকবেন না?”

আসলাম কিছুই বললো না।

মাথা দোলাতে দোলাতে তরুণ ডাক্তার কম্পিউটার মনিটরের দিকে মনোযোগ দিলো আবার। নীচের ঠোঁট কামড়ে আছে এখনও। ডাক্তার আসকারের এমন খবর শুনে সে-ও ভিরমি খেয়েছে।

উল্টো দিকে ঘুরে চুপচাপ আইসিসিইউ থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ালো আসলাম।

ডাক্তার এই হাসপাতালে নেই।

.

অধ্যায় ৪৬

সুবিশাল একটি ড্রইংরুমে বসে আছে আশেক মাহমুদ। ঢাকা শহরে তিনটি ফ্ল্যাটের মধ্যে এই ফ্ল্যাটটায় মাঝেমধ্যেই রাত্রি যাপন করে। তার বোন যে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে আছে সেটার উপর তলায় থাকে সে। এছাড়া অন্য ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে।

গুলশান নিকেতনের এই ফ্ল্যাটটা বলতে গেলে খালিই পড়ে থাকে, তবে বিশেষ দরকারে এখানে আসে-একাকীত্ব ঘোচায়! আজ রাতেও সেটা করবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা উপঢৌকন চলে আসবে তার কাছে!

হাতে দামি হুইস্কির গ্লাসটায় চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে, কিন্তু তার ভাবনা বার বার চলে যাচ্ছে নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ের দিকে। প্রথম প্রথম বৌ-বাচ্চাদের যখন কানাডায় পাঠিয়ে দিলো, তখন প্রতিদিন বাসায় ফিরে তাদের সাথে ভিডিও কলে কথা হতো, তারাও খোঁজখবর নিতে তার। ইদানিং সেটা ক্রমশ হ্রাস পেতে পেতে সপ্তাহে একবারে গিয়ে ঠেকেছে। এর কারণ এই নয় যে, তার ব্যস্ততা। বরং অবাক হয়েই লক্ষ্য করেছে, তার স্ত্রী আর সন্তানেরা ফাস্ট ওয়ার্ল্ডে গিয়ে নিজেদের নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যে, তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেও হিমশিম খায়। তবে মাস শেষ হবার আগে এই যোগাযোগ সামান্য একটু বেড়ে যায় ওদের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে তার স্ত্রী তখন প্রতিদিনই খোঁজ নেয়। এই নশ্বর পৃথিবীর আসল ঈশ্বর যে কী, সেটা আশেক মাহমুদ বুঝে গেছে এতো দিনে।

এখন তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠজন হলো আসলাম। তার সব গোপন কাজের তদারকি করে সে। হোক সেটা ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক।

সরকার থেকে গানম্যান পেলেও তাদেরকে নিয়ে সবখানে যাতায়াত করে না। করা সম্ভবও নয়, আর সেজন্যেই পিএসের চাকরিটা পাবার পর থেকেই একজন বিশ্বস্ত আর সাহসী লোকের দরকার পড়েছিলো। আসলাম ছিলো পুলিশের একজন এসআই, নিজের অবিশ্বস্ত বৌকে পুলিশ সোর্স দিয়ে হত্যা করিয়ে ফেঁসে যায় সিসিক্যামেরার ফুটেজের কারণে। তদন্তে বেরিয়ে আসে সব কিছু। কিন্তু পুলিশে তার অতীত কর্মকাণ্ডের অবদানের পাশাপাশি, পুলিশ বাহিনীর সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয়া হয় উচ্চপর্যায় থেকে। তারা চায়নি, জনগণ জেনে যাক এই বাহিনীতে এমন লোকও রয়েছে যে নিজের স্ত্রীকে খুন করাতে পারে!

আসলাম স্ত্রী হত্যা মামলা থেকে রেহাই পেলেও চাকরিটা বাঁচাতে পারেনি। স্বয়ং ডিআইজি ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলো, তাকে বাঁচিয়ে দেয়া হবে যদি সে নিজ থেকে চাকরিতে ইস্তফা দেয়-আসলাম সেই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে পারেনি। এরপরই এক ঘনিষ্ঠ লোকের পরামর্শে তাকে গানম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় আশেক মাহমুদ। আজ প্রায় চার বছর ধরে আছে সে। দিন দিন বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে।

কলিংবেলটা বেজে উঠলে বর্তমানে ফিরে এলো আশেক মাহমুদ। আসলামের কাছে এই ফ্ল্যাটের বাড়তি একটা চাবি আছে, তাকে উঠে গিয়ে দরজা খুলতে হবে না।

একটু পরই এক মেয়েকে নিয়ে ঢুকলো গানম্যান। প্রধানমন্ত্রীর পিএসকে দেখে নিঃশব্দে সালাম ঠুকলো মেয়েটি।

“ওই ঘরে যাও…আমি আসছি,” বেডরুমের দিকে ইশারা করে মেয়েটাকে বললো।

চুপচাপ শোবার ঘরে চলে গেলো মিডিয়াতে একটু-আধটু নামকরা অভিনেত্রী মেয়েটি।

আসলাম দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। এরকম মুহূর্তে সে বলতে গেলে কথাই বলে না।

“ঐ ডাক্তারের কী খবর?”

“আমি আইসিসিইউতে গিয়ে দেখেছি, ডাক্তার ওখানে নেই। লোকটা হাসপাতালে অ্যাডমিট কিনা ওখানকার কেউ জানে না, স্যার।”

মুচকি হাসলো পিএস, মদের গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিলো। “মনে হচ্ছে, তোমার কথাই ঠিক-ডাক্তার অভিনয় করেছে।”

আসলামের মুখে সামান্য হাসি দেখা দিলো। লোকটা যে ধোঁকা দিয়েছে সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু ঐ ডিবি অফিসার ছফা ধরতে পারেনি। সে যতোই তুখোড় ইনভেস্টিগেটর হোক না কেন, এক বুড়ো ভামের অভিনয়ে পটে গেছে। ছফা যদি ডাক্তারকে তার হাতে ছেড়ে দিতো তাহলে পাঁচ মিনিটেই সব কথা তার পেট থেকে বের করে ছাড়তো সে। কিভাবে করতো সেটা নিয়ে তাকে খুব একটা মাথাও ঘামাতে হতো না। সরাসরি নাইন এমএমের পিস্তলটার নল ঠেকাতো বুড়োর কপালে, তারপর চোখমুখ শক্ত করে যা জানতে চাইতো সবই বলে দিতো ঐ শয়তানটা।

“ওটা ওর নিজের হাসপাতাল, সত্যি সত্যি অসুস্থ হলে হৈচৈ পড়ে যেতো। অথচ কেউ কিছু জানে না!”

মাথা নেড়ে সায় দিলো গানম্যান। “কিন্তু সে এখন কোথায় আছে সেটা তো বের করতে হবে।”

“আমি কি আবারো ডাক্তারের বাড়িতে যাবো? ঐ দারোয়ান ব্যাটা-”

“না।” আসলাম কথা শেষ করার আগেই বললো পিএস। “কোনো দরকার নেই। আমি এটা জেনে নিতে পারবো…অন্যভাবে।”

হাফ ছেড়ে বাঁচলো গানম্যান, তবে সেটা তার অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করলো না। ডাক্তার এখন কোথায় আছে সেটা বের করা সহজ কাজ হতো না। তবে আশেক মাহমুদের বসবাস ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রে, সবখানে তার লোক আছে। এসব খবর বের করা তার পক্ষে খুব একটা কঠিন কিছু হবে না নিশ্চয়।

“তুমি বাসায় যাও…বিশ্রাম নাও।” কথাটা বলেই হুইস্কির গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে রেখে ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো পিএস।

“জি, স্যার।” ঘর থেকে চলে গেলো আসলাম। কাল সকালে তাকে আবারো আসতে হবে এখানে। যেটাকে নিয়ে এসেছে সেটাকে আবার পৌঁছে দিয়ে আসবে।

বাইরের দরজাটা বন্ধ হবার শব্দ কানে গেলে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো আশেক মাহমুদ। একবার রিং হবার পরই তার কলটা রিসিভ করা হলো। এরকম লোকজন তার কল পেলে ধন্য হয়ে যায়। সরকারদলীয় ডাক্তারদের যে অঙ্গসংগঠনটি আছে সেটার মধ্যমগোছের নেতা সে।

“ওয়ালাইকুম আসোলাম। কেমন আছো, ডাক্তার?” প্রধানমন্ত্রীর পিএস হাসিমুখে বললো।

ওপাশ থেকে গদগদ ভঙ্গিতে কথা বলে গেলো সেই ডাক্তার। পিএসের ফোন পেয়ে যে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছে, সেটা প্রকাশ করতে মোটেও কুণ্ঠিত হলো না। কিছুক্ষণ এ কথা ও কথা বলার পর আসল কথায় চলে এলো আশেক মাহমুদ।

“আসকার ইবনে সায়িদ তোমাদের হাসপাতালের একজন ওনার না?”

“জি, ভাই। বলতে গেলে উনিই মালিক। লায়ন শেয়ার তো উনারই।”

“হুম। ভদ্রলোক কি এখন তোমাদের হাসপাতালে অ্যাডমিট?”

“নাহ তো!” বিস্ময় ঝরে পড়লো ওপাশ থেকে। “এরকম কোনো কথা শুনিনি, ভাই। কে বললো আপনাকে?”

“শুনলাম আর কি।” একটু থেমে আবার বললো, “তুমি একটু খোঁজ নিয়ে কাল সকালে আমাকে জানাও। ব্যাপারটা জরুরী, বুঝতে পেরেছো?”

“জি, ভাই। কাল সকালে আমি খোঁজ নিয়েই আপনাকে জানাচ্ছি।”

“ওকে।”

কলটা কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো পিএস। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো শোবার ঘরের দিকে। খোলা দরজার কাছে আসতেই টের পেলো কড়া পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে।

এসব মেয়েরা কেন যে সব সময় কড়া মেকআপ আর এরকম সেন্ট ব্যবহার করে সে জানে না।

.

অধ্যায় ৪৭

সকালে নাস্তা করেই কেএস খান একটি বই নিয়ে বসেছে-খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়ছে সেটা। নাকের উপরে থাকা রিডিংগ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখছে অক্ষরগুলো। গতকাল থেকে পড়তে শুরু করার পর আর বিরতি দেয়নি। এ মুহূর্তে, দূর থেকে তাকে দেখলে মনে হবে গবেষণার কাজে মগ্ন একজন অধ্যাপক।

খোদাদাদ শাহবাজ খান সব সময় নিজের বিছানায় শুয়ে-বসে বই পড়ে। ঘরে একটা টেবিল আছে কিন্তু ওটাতে বসে পড়ার অভ্যেস তার নেই। বিছানায় শুয়ে দু-পা ক্রশ করে পড়তেই বেশি ভালো লাগে। অবশ্য পাশে গরম চা থাকলে তার এই পাঠ আরো বেশি সুখকর হয়ে ওঠে। অল্পবয়সী আইনস্টাইন সেটা জেনে গেছে এততদিনে, সাবেক ইনভেস্টিগেটরকে বই পড়তে দেখলেই এক কাপ চা বানিয়ে বেডসাইড টেবিলে রেখে যায় সে।

বইয়ের দিকে চোখ রেখেই বেডসাইড টেবিলে হাত বাড়ালো কেএস খান, কিন্তু সেখানে কোনো কাপ-পিরিচের নাগাল পেলো না।

পড়া থেকে বিরতি দিয়ে তাকালো পাশের ঘরের দরজার দিকে। আধখোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আইনস্টাইন মেঝেতে বসে টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে-মটু-পাতলু নামের স্কুল এক কার্টুন দেখছে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।

প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। ছেলেটা যতোই পাকনামি করুক, তার শৈশব এখনও অটুট আছে।

খোদাদাদ শাহবাজ খান আবারও নজর দিলো বইয়ের পৃষ্ঠায়। এখন যে বইটা পড়ছে সেটা পল্টনের ফুটপাত থেকে কয়েক দিন আগে কিনেছে মাত্র আশি টাকা দিয়ে। দোকানির বইয়ের স্তূপে অবহেলায় পড়েছিলো। গ্রাহাম হ্যাঁনককের বেস্টসেলার নন-ফিকশন ম্যাজিশিয়ান্স অব দি গডস যে পল্টনের ফুটপাতে গড়াগড়ি খাবে সেটা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি। বইয়ের কাভারটা ছেঁড়াফাড়া হলেও ভেতরের পাতাগুলো সব অক্ষত ছিলো। দোকানি সম্ভবত কাভারের করুণ দশার জন্য বেশি দাম হাঁকেনি তার কাছে।

এই লেখকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট অব গড আগেই পড়া ছিলো তার। ম্যাজিশিয়ান্স পড়ে আরো মুগ্ধ হচ্ছে। তুরস্কের গোবেলি তেপে নামক একটি জায়গায় প্রায় ১২০০০ বছরের প্রাচীন পূরাকীর্তি পাওয়া গেছে, আর সেটা নাকি তৈরি করেছিলো মহাপ্লাবন সংঘটিত হবার পর বেঁচে যাওয়া উন্নত প্রজাতির কিছু মানুষ! লেখক বলার চেষ্টা করছেন, এরা সেই আটলান্টিসের অধিবাসী যাদের উন্নত মহাদেশটি তলিয়ে গেছিলো জলরাশির তলে।

এমন সময় কেএস খানের ফোনটা বেজে উঠলে বিরক্তি ভর করলো চোখেমুখে। পড়ার সময় দু-জন মানুষের ফোন তাকে বিরক্ত করে না। একজনের ফোন পেলে বরং খুশিই হয়, আর অন্যজনের ফোন নিয়মিত ব্যাপার, অনেকটা তার দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো, এদের কেউ না, ফোনটা দিয়েছে ডিবির ইনভেস্টিগেটর নুরে ছফা। সঙ্গে সঙ্গে চোখেমুখে কৌতূহল ফুটে উঠলো তার।

“আরে, ছফা যে…কী খবর আপনের?” হাসিমুখে বললো খোদাদাদ শাহবাজ খান।

“স্যার, খবর ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

“আছি ভালাই…আপনের খবর বলেন, সুন্দরপুরেই আছেন নাকি ঢাকায়?”

সুন্দরপুর থেকে ফিরে এসে কেএস খানের সঙ্গে দেখা করেনি ছফা, এমনকি ফোনও দেয়নি, সোজা চলে গেছিলো অ্যাডভোকেট ময়েজ উদ্দিনকে ধরার জন্য। “আমি কালকে এসেছি, স্যার।”

“ঐখানকার খবর কি? কিছু পাইলেন?” আগ্রহী হয়ে উঠলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর।

“জি, স্যার…দারুণ খবর আছে, সেজন্যেই আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম। আপনি কি ফ্রি আছেন?”

“বলেন, আমি বাসায়ই আছি…কোনো ক্লাস নাই আজ।”

এরপর টেলিফোনেই ছফা সংক্ষেপে জানালো মাস্টার রমাকান্তকামারের ঘর থেকে মুশকান জুবেরির চিরকুট পাবার কথা, সেখান থেকে ট্রাস্টের উকিল ময়েজ উদ্দিনকে ধরা, তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের বনানীর বাসায় গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা, আর ডাক্তারের পাসপোর্টের কথাটা। কিন্তু বৃদ্ধ ডাক্তার অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে যে নতুন কাহিনীটা তাকে বলেছে সেটা একেবারে চেপে গেলো। তার ধারণা, ঐ কাহিনী শোনার পর কেএস খান মাথা ঘামাতে শুরু করে দেবে। ছফার আশঙ্কা, সম্ভবত কাহিনীটায় বিশ্বাসও করে বসবে তার সিনিয়র। সব সময় যৌক্তিক বিষয়েই তার পক্ষপাতিত্ব থাকে বেশি। আর ডাক্তারের নতুন গল্পটি যে অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ভদ্রলোকের কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। লোকটা ধূর্ত। তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য, ঐ মহিলাকে রক্ষা করার জন্য সম্ভবত নতুন একটি গল্পের অবতারণা করেছেন।

“আপনের মতো আমার মনে হইতাছে, ঐ ডাক্তারই মুশকান জুবেরিরে কলকাতায় নিয়া গেছে, সব শোনার পর বললো মি. খান।

“জি, স্যার। ভদ্রলোক এটা লুকানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। আমি নিশ্চিত, তিন বছর আগে ডাক্তার যখন আমেরিকায় চলে যাওয়ার কথা বলে দেশ ছাড়লেন তখনই মুশকান জুবেরিকে নিয়ে কলকাতায় চলে গেছিলেন।”

“হুম,” গম্ভীর কণ্ঠে বললো কেএস খান। “এতো জায়গা থাকতে কলকতায় কেন, সেইটা বুঝবার পারতাছি। বাড়ির একেবারে পাশে…পাসপোর্ট ছাড়াও বর্ডার দিয়া যাওন যায়।”

“জি, স্যার। ইন্ডিয়ান বর্ডার কিন্তু সুন্দরপুর থেকে বেশি দূরেও নয়…ঘণ্টাখানেকের পথ সম্ভবত।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সাবেক ডিবি অফিসার।

“তাছাড়া কলকাতায় ডাক্তারের পরিচিত মানুষজনও থাকতে পারে।”

“হুম…তা হইতে পারে। নামকরা ডাক্তার, দেশ-বিদেশে ঘুইরা বেড়ায়, বিরাট বড় হাসপাতালের ওনার…রিসোর্সফুল তো হইবোই।”

“ডাক্তারের পাসপোর্ট বলছে, তিনি অনেক বছর আগে থেকেই ফ্রিকোয়েন্টলি কলকাতায় যাতায়াত করছেন।”

“এইটা একটা ভালা পয়েন্ট,” কৌতূহলি হয়ে বললো কেএস খান। “তার মাইনে, ঐখানে ডাক্তারের রিসোর্স আছে, জানাশোনা লোকজন আছে।”

“জি, স্যার। কিন্তু উনার পেট থেকে সব কথা বের করার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন, এখন আছেন আইসিসিউতে…মনে হয় না সপ্তাহখানেকের মধ্যে তার নাগাল পাবো।”

“আমার তো মনে হয় ভদ্রলোক দেশ ছাড়বো। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চইলা গেলে তারে কেমনে আটকাইবেন?”

“উনার পক্ষে সেটা করা সম্ভব হবে না, স্যার। পিএস আশেক মাহমুদ এই বিষয়টা দেখবেন, ইমিগ্রেশনে বলে দিয়েছেন তিনি।”

“ও,” মি. খান আর কিছু বললো না। সব ধরণের ক্ষমতার অপব্যবহার তার ভীষণ অপছন্দ, সেটা যদি তদন্তের কাজে সাহায্য করে তারপরও।

“আমার তো ইচ্ছে, আজকের দুপুরের ফ্লাইটেই কলকাতায় চলে যাওয়া, কিন্তু অতো বড় শহরে কী করে মুশকান জুবেরিকে খুঁজে বের করবো বুঝতে পারছি না, স্যার।”

“হুম।” গম্ভীর হয়ে বললো ছফার সিনিয়র। চিন্তিত মুখে ঘরের সবচাইতে দূরের দেয়ালের দিকে তাকালো। আইনস্টাইনের জিভ বের করে রাখা সাদাকালো ছবিটার দিকে তাকালেই একটা কথা মনে পড়ে যায় তার : জটিল চিন্তা বোকারহদ্দরা করে! বুদ্ধিমানেরা করে সহজ চিন্তা!

কিন্তু সহজ চিন্তা যায় না করা সহজে!

তারপরই বলার মতো কিছু একটা পেয়ে গেছে এমন অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে। “শুনেন…মনে হইতাছে মুশকান জুবেরিরে ট্রেস করার সহজ রাস্তা একটাই আছে।”

“সেটা কী, স্যার?” ফোনের ওপাশে থাকা নুরে ছফা খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলো।

গভীর করে দম নিয়ে নিলো সবেক ইসভেস্টিগেটর। “মানুষ সব কিছু পাল্টাইতে পারে, সিটিজেনশিপ, ধর্ম, এমনকি চেহারাও বদলাইতে পারে, কিন্তু অভ্যাস…এইটা বদলানো এতো সহজ না। মনে রাখবেন, অভ্যাসের চায়া বদঅভ্যাস হইলো আরো কঠিন জিনিস।” একটু থেমে আবার বললো, “আপনে মহিলার বদঅভ্যাসটা ফলো করেন।”

.

অধ্যায় ৪৮

সকাল দশটায় পিএসের সেই ফ্ল্যাটে আবারো ফিরে এসেছে আসলাম, যেখানে গত রাতে এক মেয়েকে নিয়ে এসেছিলো। একটু আগে আশেক মাহমুদ তাকে ফোন করে জানিয়েছে, মেয়েটাকে ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে যাবার জন্য।

পিএস আরো সকালে উঠে পিএমের অফিসে চলে গেছে। সারা রাত যতোই মদ্য পান করুক, মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করুক, সকাল সাতটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়ে, তারপর দ্রুত রেডি হয়ে বের হয়ে পড়ে কর্মক্ষেত্রে যাবার জন্য।

আশেক মাহমুদের এই ফ্ল্যাটের বাড়তি একটি চাবি আছে তার কাছে। পিএস ফ্ল্যাট থেকে বের হবার সময় বাইরে থেকে দরজা লক করে গেছে। আসলাম এসে দরজা খুলে মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে তার বাসায়-এমনটাই সব সময় হয়ে আসছে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য আসলাম ভাবলো, সে যদি ফ্ল্যাটে যাবার পথে অ্যাকসিডেন্টের শিকার হয়, কিংবা খারাপ কিছু হয়ে যায় তার, তাহলে কী হবে? মেয়েটা নির্ঘাত আটকা পড়ে যাবে। পিএসের ফোন নাম্বার এসব মেয়ের কাছে থাকে না, আর নিরাপত্তার কারণে মেয়েটাকেও সঙ্গে করে মোবাইলফোন আনতে দেয়া হয় না। ফলে তাকে কোনোভাবেই জানাতে পারবে না যে, ফ্ল্যাটে আটকা পড়ে গেছে সে। বাধ্য হয়ে তখন চিৎকার চেঁচামেচি করে লোকজনকে ডাকবে সাহায্যের জন্য, আর সেটা হবে আশেক মাহমুদের জন্য বিরাট কেলেংকারির ব্যাপার।

মুচকি হাসলো সে। আসলে এরকম কিছু হবে না। তার যদি কিছু হয়, তাহলে আধঘণ্টার মধ্যেই পিএস সেটা জেনে যাবে। সেই সাথে এটাও বুঝতে পারবে, তার ফ্ল্যাটের মেয়েটা নিশ্চয় আটকা পড়েছে। তখন অন্য কাউকে দিয়ে মেয়েটাকে জায়গামতো পৌঁছে দেয়া হবে। এরকম লোকজনের কোনো অভাব নেই আশেক মাহমুদের।

মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে পিএসের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে ডোর লকের ভেতরে চাবি ঢোকাতেই এক ধরণের শিহরণ বয়ে গেলো তার মধ্যে। আস্তে করে দরজা খুলে ঢুকে পড়লো ভেতরে।

পুরো ফ্ল্যাটটা সুনশান-তার মানে মেয়েটা এখনও ঘুমাচ্ছে। এরকমটিই হয় সব সময়। এরা বেশ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে।

শোবার ঘরের সামনে এসে দেখতে পেলো দরজাটা খোলাই আছে, বিছানায় পড়ে আছে প্রায় নগ্ন সেই মেয়েটি।

ঘরে ঢুকে মেয়েটাকে ভালো করে দেখলো আসলাম। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ঘুমাচ্ছে। তাকে দেখে চেনাই যাচ্ছে না। মুখের কড়া মেকআপের কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন। আশেক মাহমুদের লালসায় ধুয়েমুছে তার আসল রূপ বেরিয়ে পড়েছে, আর সেটা মোটেও আকর্ষণীয় নয়। তবে তার দেহসৌষ্ঠব কামনা জাগানোর জন্য যথেষ্ট।

পাশ ফিরে শুয়ে আছে মেয়েটি। টিভিতে টুকটাক অভিনয় করে। একটি টেলিকমের অ্যাডেও দেখা গেছে কিছু দিন আগে। ঐ টেলিকমই কর-ফাঁকির এক তদন্তে ফেঁসে গিয়ে পিএসের দ্বারস্থ হয়েছিলো। আশেক মাহমুদ সেটা মিটমাট করে দেবার ব্যবস্থা করে দিলে, বিনিময়ে যেমন বেশ মোটা অঙ্কের টাকা ঢুকেছে তার অ্যাকাউন্টে, তেমনি উপঢৌকন হিসেবে দেয়া হয়েছে। এটাকে!

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েটাকে দেখে গেলো সে। ধীরে ধীরে নিজের ঘুমন্ত কামনা মাথাচাড়া দিতে শুরু করলো। এর আগেও এরকম কাজ করেছে আসলাম। পিএসের পরে সে-ও একটু পরখ করে দেখেছে। ভালো করেই জানে, এ ধরণের মেয়েগুলো চুপচাপ এসব ব্যাপার হজম করে নেয়। কেউ কেউ খুশি হয়েও নিজেকে সমর্পণ করে, কখনও কারোর উপরে জোর খাটাতে হয়নি তাকে।

কিন্তু এখন তার খুব জোর খাটাতে ইচ্ছে করছে! ইচ্ছে করছে অন্যভাবে কামনা মেটাতে। দিনকে দিন স্বাভাবিক ব্যাপার-স্যাপার থেকে তার আগ্রহ উবে যাচ্ছে! মর্ষকামীতার পাশাপাশি ধর্ষক সত্তাটাও যেনো জন্ম নিচ্ছে ক্রমশ।

এই মেয়েটাকে ধর্ষণ করলে কী হবে?

বিচার দেবে? কার কাছে?

মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার লম্পট ঠোঁটে। এ সমাজে বেশ্যাদের ধর্ষণ করা জায়েজ। যারা টাকার বিনিময়ে অন্য পুরুষের সাথে শোয়, তাদের সাথে জোর খাটালে কী আর এমন হবে! পিএসের কাছেও নালিশ দেবে না। এর আগে টাকার বিনিময়ে পুরুষ মানুষের সাথে শুতে যেয়ে কত বার ধর্ষিতা হয়েছে কে জানে!

আসলাম জানে, প্রতিটি পুরুষের মধ্যেই একজন ধর্ষক বাস করে দরবেশ থেকে প্রতিবন্ধী-সব পুরুষই জোর করে পেতে আনন্দ পায়। সম্ভবত পৌরুষের অংশ এটা। আদিমকাল থেকেই চলে আসছে। আদিপুরুষেরা বীরভোগ্যা ছিলো। নারীকে জোর করে ভোগ করাটা বীরত্বই ছিলো তখন। জৈবিক তাড়না থেকে যে সঙ্গম হয় সেখানে এরকম ব্যাপার স্যাপার হতেই পারে!

তার খুব ইচ্ছে করছে ঘুমন্ত মেয়েটার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে। টের পাচ্ছে, তার শরীর রীতিমতো কাঁপছে ধর্ষণ করার প্রবল বাসনায় নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। একটু উপুড় হয়ে যেই না মেয়েটার উপরে হামলে পড়বে অমনি তার ফোনটা বেজে উঠলো।

মাথায় খুন চেপে গেলো আসলামের। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেগই পেলো সে। কিন্তু যেই না দেখলো কলটা করেছে পিএস, হকচকিয়ে গেলো। এরকম সময় আশেক মাহমুদ সচরাচর তাকে ফোন দেয় না।

কলটা রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলো, ভেতরের সমস্ত উত্তেজনা দপ করে নিভে গেছে। নেতিয়ে পড়েছে তার ধর্ষকামী ছোট্ট পশুটি!

.

অধ্যায় ৪৯

কলকাতা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে দমদম নামক স্থানে যে বিমানবন্দরটি অবস্থিত সেটার অফিশিয়াল নাম ‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’, কিন্তু লোকমুখে দমদমই বেশি উচ্চারিত হয়।

এই বিমানবন্দর দিয়ে কলকাতায় প্রবেশের অভিজ্ঞতা ছফার জন্য নতুন নয়, তবে বিগত দু-বছরে এই প্রথম পদার্পণ করলো সে। ছাত্রজীবনে বন্ধুবান্ধবদের সাথে অবশ্য দুয়েকবার সড়কপথে যশোর-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যাবার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে চাকরি জীবনে ঢোকার পর যতোবারই গেছে কাজের প্রয়োজনেই গেছে। দু-বছর আগে, এক স্ত্রী আর তার পাঁচ বছরের শিশুকন্যার রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হবার যে কেসটা তদন্ত করেছিলো সেটার এক পর্যায়ে তাকে কলকাতায় যেতে হয়। ঐ সময়ই প্রথমবারের মতো কলকাতা পুলিশ ফোর্সের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তার, আর তখন বেশ কিছু পুলিশ অফিসারের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেই সব অফিসাররা ছফার মতোই উচ্চপদে অধিষ্ঠিত। তাদের কারো কারোর সাথে বিদেশের মাটিতে ইন্টারপোলের সম্মেলনে দুয়েকবার দেখাও হয়েছে, তবে নিয়মিত যোগাযোগ মাত্র একজনের সাথেই হয়-ছফার গন্তব্য এখন সেই মানুষটির অফিস।

কোনো এক অদ্ভুত কারণে, প্রিয় মানুষজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারে না সে। এক ধরণের অনীহা জেঁকে ধরে তাকে। এমন না যে, ঐসব মানুষের সঙ্গ কিংবা আলাপচারিতা তার ভালো লাগে না। সম্ভবত দীর্ঘকাল একা একা থাকার কুফল এটি।

রিগ্যাল এয়ার ওয়েজের বিমানটি রানওয়ে স্পর্শ করতেই নুরে ছফার মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি তৈরি হলো। তার মন বলছে এখানেই আছে মুশকান জুবেরি। যুক্তিবুদ্ধিও তাতে পুরোপুরি সায় দিচ্ছে। ইনভেস্টিগেটর হিসেবে সে কখনও এমনও দেখেছে, যুক্তি নয়, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে পরিচালিত করে নিয়ে গেছে সত্যের কাছাকাছি। কিন্তু এবার তার যুক্তি-বুদ্ধি আর সজ্ঞা একই কথা বলছে!

কলকাতায় আসার আগেই ওখানকার পুলিশ হেডকোয়াটারের সহকারী নগরপাল সুশোভন মিত্রের সাথে সে যোগাযোগ করেছে। বয়সে তার থেকে কয়েক বছরের বড় হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে দারুণ সখ্যতা। সুশোভনকে এই সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংক্ষেপে ওয়াকিবহাল করেছে সে। তবে কাজটা কিভাবে করবে সে নিয়ে কিছু বলেনি। অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, সব কথা আর অনুরোধ টেলিফোনে সেরে ফেলাটা বোকামি। ঢাকা থেকে কলকাতায় উড়ে এসে কোনা অনুরোধ করলে সেটা রক্ষা করার তাগিদ অনেক বেশি অনুভব করবে। সেজন্যে ছফা শুধু জানিয়েছে, তার কাছে। নিশ্চিত তথ্য আছে, বাংলাদেশ থেকে এক সাসপেক্ট কলকাতায় আত্মগোপন করে আছে, তাকে ট্র্যাক ডাউন করতে চাইছে সে। এ কথা শুনে সুশোভন তাকে আশ্বাস দিয়েছে যথাসম্ভব সাহায্য করার জন্য।

ছফাও জানে তার কাছ থেকে ভালো রকম সাহায্য পাওয়া যাবে, কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। এই সাহায্যের আবেদনটি ইন্টারপোলের মাধ্যমে করা হয়নি, কিংবা দু দেশের পুলিশ বিভাগের মধ্যেকার কোনো অনুরোধের ভিত্তিতেও নয়-এটা হচ্ছে একান্তই ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে। এর কারণও রয়েছে-মুশকান জুবেরির বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ আনা যায়নি যে, ইন্টারপোলে মহিলাকে ফেরারি আসামি হিসেবে তালিকাভূক্ত করানো যাবে। তাছাড়া, মুশকানের সত্যিকারের কাহিনীটাও কারো কাছে বলেনি ছফা। তাই অন্য অনেকের মতো সুশোভন মিত্রের কাছেও গোপন রেখেছে।

আমি কি তাকে উদ্ভট গল্পটা বলবো? কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কেউ এটা বিশ্বাস করবে?

নিজেকে অনেকবার এ প্রশ্ন করেছে। কেউ যদি মুশকানের এই গল্পটা বিশ্বাসও করে, তাতেও ঝুঁকি আছে। যে কারনে খোদাদাদ শাহবাজ খান তাকে ছাড়া আর কাউকেই বলেনি, মানুষের শরীরের বিশেষ একটি প্রত্যঙ্গ খেয়ে মুশকান জুবেরি নিজেকে চিরযৌবনা করে রেখেছে। গল্পটা যে বিশ্বাস করবে সে হয়তো হন্যে হয়ে জানতে চাইবে, ঠিক কোন প্রত্যঙ্গটি খেলে এমন আরাধ্য লাভ করা যায়-আর এটা করার একটাই উপায় আছে-মুশকান জুবেরিকে নিজের কজায় নিয়ে, নির্যাতন করে তার কাছ থেকে তথ্যটা জেনে নেয়া। সিক্রেটটার আর্থিক মূল্য হতে পারে কয়েক কোটি টাকা। আর এজন্যে যেকোনো কিছু করতেও পিছপা হবে না এ পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ।

বিমানবন্দর থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছফা চলে গেলো লালবাজারে অবস্থিত কলকাতা পুলিশ ফোর্সের সদর দপ্তরে, সুশোভন মিত্র বর্তমানে সেখানেই কর্মরত আছে। লালবাজারের লাল ইটের বিশাল আর মনোরম ভবনের সামনে যখন ছফার ট্যাক্সিটা থামলো তখন বিকেল প্রায় চারটা।

মেইন গেটের সিকিউরিটিকে আগেই বলে দিয়েছিলো সুশোভন, তাই পরিচয় দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলে দেয়া হলো কতো তলার কলো নম্বর রুমে যেতে হবে।

“আরে ছফা, তুমি দেখি একই রকম আছো, তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে নিজের ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়ালো সুশোভন মিত্র। “একটুও বদলাওনি! ঘটনা কি?” সহাস্যে বললো কলকাতা পুলিশ ফোর্সের সহকারী নগর পাল।

অমায়িক হাসি দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলো নুরে ছফা। “তুমিও তো খুব একটা বদলাওনি, দাদা…আগের চেয়ে একটু স্লিমও হয়ে গেছে।”

হা-হা করে প্রাণখোলা হাসি দিলো সুশোভন। “তার কারণ ডায়েট নয়…কাজের ভীষণ চাপ। সেই সাথে তোমার বৌদির দারোগাগিরি।”

হেসে ফেললো ছফা।

“বসো,” ডেস্কের সামনে চেয়ারে বসার ইশারা করে নিজেও বসে পড়লো। “এক বছর ধরে আমাকে ভেজ থাকতে বাধ্য করছে সে।”

“বৌদি কিন্তু ঠিকই করছে,” বললো ছফা। “এখন বলল, আছো কেমন?”

কাঁধ তুললো সুশোভন মিত্র। “চলে যাচ্ছে। তোমার কি খবর? ক-টা প্রমোশন বাগালে?”

“মাত্র দুটো, তবে কাজের অনেক চাপ বেড়ে গেছে।”

“হুম, চাপে না পড়লে কি ঢাকা থেকে উড়ে আসতে কলকাতায়,” হেসে বললো নগর পাল। “কততদিন থাকছে এখানে?”

“সত্যি বলতে, কাজটা করতে কতোদিন লাগবে সে-ব্যাপারে আমার কোনো ধারনাই নেই। বুঝতে পারছি না কতো দিন থাকতে হবে।”

“সাসপেক্ট ট্র্যাক-ডাউন করাটা খুবই কঠিন কাজ, সুন্দর করে ছাটা পুরু গোঁফের বামপ্রান্ত মোচড়াতে মোচড়াতে বললো সুশোভন মিত্র। এই গোঁফ নিয়ে তার বাতিকের কথা ছফা জানে তাদের মধ্যে দ্বিতীয় সাক্ষাতের সময় থেকেই। ফ্রান্সের লিওঁতে ইন্টারপোলের সদর দফতরে এক সেমিনারে দেখা হয়েছিলো, তারা উঠেছিলো একই হোটেলে। রাতে ছফার রুমে এসে বেশ গল্প করতো নগরপাল।

“এক হপ্তায় তোমার কাজ হয়ে যাবে কিনা বুঝতে পারছি না।”

“না হলে আর কি, তোমাকে আরেকটু জ্বালাতে হবে,” হেসে বললো। “তবে কাজটা দ্রুত করার তাড়া আছে।”

“ইনভেস্টিগেশনের টাইমফ্রেম দেয়া আছে নাকি?”

“হুম।”

“তাহলে কঠিন হয়ে যাবে তোমার জন্য।”

“তা বলতে পারো।” পকেট থেকে মুশকান জুবেরির একটা ছবি বের করে দেখালো সে। “সাসপেক্টের ছবি।”

ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে ভুরু কুঁচকে ফেললো সুশোভন। “এটা কবেকার?”

ভিরমি খেলো ছফা। ছবিটা যে বেশ পুরনো সেটা যেকোনো অভিজ্ঞ চোখ ধরে ফেলে, এ কারণে ডিবির ফটো রিকন্সট্রাকশন করে যে ছেলেটা তাকে দিয়ে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড কাট-আউট করে নিয়েছে যাতে করে পেছনের পার্কে থাকা অন্যসব মানুষজনের সত্তুর দশকের বেলবটম প্যান্ট পরা কাউকে দেখে সময়টা ধরতে না পারে। তারপরও সুশোভনের অভিজ্ঞ পুলিশি চোখ ধরে ফেলেছে, এটা বেশ পুরনো ছবি। ছফা যদি বলে এটা ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে তোলা তাহলে মুশকানের বয়স এখন সত্তুরেরও বেশি! এই বয়সের একজন সাসপেক্ট বেশ কিছু তরতাজা যুবকের অন্তর্ধানের সাথে জড়িত, এমন কথা কোনো মানুষ বিশ্বাস করতে চাইবে না। আর সেই মানুষটা যদি পুলিশ হয় তাহলে তো কথাই নেই।

“কতো পুরনো জানি না, মনে হয় নব্বইয়ের দিকে হবে,” অবশেষে মিথ্যেটাই বললো ছফা।

সুশোভনের কপালের ভাঁজ আরো ঘন হলো। “নব্বই!? বলো কী! দেখে তো মনে হচ্ছে আরো পুরনো,” ছবির দিক থেকে মুখ না তুলেই বললো। “হেয়ারস্টাইলটা একেবারে মিড-সেভেন্টির মতো।”

মনে মনে প্রমাদ গুনলো ছফা।

“আচ্ছা, তুমি কী সাসপেক্ট করছো?”

কয়েক মুহূর্তের জন্য ছফা বুঝতে পারলো না কী বলবে। “কী সাসপেক্ট করছি?” প্রশ্নটাই আওড়ালো আবার। “এই মহিলা হিউম্যান অগ্যান পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িত বলে সন্দেহ করছি।”

“তুমি বলেছিলে সে একজন মেডিকেল ডক্টর?”

“হুম, দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিলো, ওখানেই পড়াশোনা করেছে। তারপর বেশ কবছর আগে বাংলাদেশে চলে আসে। তবে আমার মনে হয়, এখানে আসার পর ঐ চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ে মহিলা।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সুশোভন। “মহিলা দেখতে কিন্তু সেই রকম মাইরি।” কথাটা বলেই হেসে ফেললো সে। “সি হ্যাড দ্য গ্ল্যামার ইন হার আর্লি এইজ।”

এখনও তা-ই আছে, মনে মনে বললো সে। সত্যিটা তুমি যদি জানতে!

“তুমি শিওর, মহিলা একাই অপারেট করে?”

একটু গাল চুলকালো ডিবির নুরে ছফা। “সম্ভবত…তবে নিশ্চিত নই।”

“আমার তো মনে হয় না সে একা একা অপারেট করে,” ছবিটা ডেস্কের উপর রেখে বললো সুশোভন। “অগ্যান স্মাগলারদের চক্রটা বেশ বড় হয়ে থাকে। অনেকগুলো ধাপ থাকে, প্রতিটি ধাপেই থাকে একাধিক লোক। আমাদের এখানেও এরকম কিছু চক্র রয়েছে। ওদের সাথে এই মহিলার কোনো যোগসাজশ নেই তো?”

কাঁধ তুললো ছফা। “এটা তো জানি না। তবে আমার ধারণা এই মহিলা ওভাবে কাজ করে না, সে একা একাই কাজ করে। কালেক্ট করার পর হয়তো তার পরিচিত স্মাগলারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেজন্যে তার সম্পর্কে তথ্য আদায় করা সহজ হয়নি, শক্ত কোনো প্রমাণও জোগাড় করতে পারিনি।”

“এরকম একজন বয়স্ক মহিলা কী করে এটা করে? এ ছবিটি যদি নব্বইর দিকের হয়ে থাকে তাহলে তো এখন তার বয়স কম হবে না।”

অবাকই হলো কলকাতা পুলিশের সহকারী নগরপাল।

“মহিলা একজন মেডিকেল ডক্টর,” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বললো ছফা। “তার কাজের ধরণটাও বেশ আলাদা। সে প্রতিটি ভিক্টিমের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে তাদেরকে নিজের ডেরায় নিয়ে কাবু করে ফেলে।” কথাটা বলার পর পরই নিজের কাবু হওয়ার ঘটনাটির কথা মনে পড়ে গেলো তার। মুশকান জুবেরির ঘরে ঢোকার পর কী বোকার মতোই না সে নাকাল হয়েছিলো!

মাথা দোলালো সুশোভন মিত্র। “তুমি শিওর, মহিলা এখন কলকাতায় আছে?”

“হুম। যতোটুকু জানি, সে পালিয়ে এখানেই চলে এসেছে।”

“আচ্ছা,” মাথা নেড়ে সায় দিলো কলকাতা পুলিশ ফোর্সের নগরপাল। “তাহলে কিভাবে কাজটা শুরু করতে চাইছো তুমি?”

“বিগত তিন বছরে কলকাতা মহানগরীতে যেসব মানুষ নিখোঁজ হয়েছে তাদের তালিকাটা আমার দরকার…ইন ডিটেইল্স।”

“শুধু কলকাতার?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো সুশোভন।

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। মুশকান জুবেরি সুন্দরপুর নামক প্রত্যন্ত এক মফশ্বলে বসে শিকার করলেও তার সব শিকার এসেছিলো ঢাকা শহর থেকে। অন্তত ছফার জানা যে কয়জন শিকার আছে তাদের বেলায় এ কথা খাটে। সুতরাং মহিলা কলকাতায় থাকলেও এখান থেকেই শিকার খুঁজে বের করবে। শহুরে শিকার!

“সাসপেক্ট পুরো রাজ্যে অপারেট করছে না, কী করে শিওর হলে?”

একটু ভাবলো ছফা। “প্রথমে আমি শুধু কলকাতা মহানগরীর তালিকাটাই খতিয়ে দেখবো, যদি ওখান থেকে কিছু না পাই তাহলে পুরো পশ্চিমবঙ্গের তালিকা দেখতে হবে।”

চোখ কপালে তুললো সুশোভন। “গোটা রাজ্যে প্রচুর মানুষ নিখোঁজ হয় প্রতি বছর। সংখ্যাটা অনেক হবে কিন্তু!”

“তা জানি, তবে শুধুমাত্র ২০ থেকে ৩৫ বছরের পুরুষ মানুষই খুঁজবো…আর অবশ্যই মার্জিত এবং শিক্ষত।”

অবাক হলো সুশোভন। “মার্জিত আর শিক্ষিত? বাপরে! অগ্যান সিলেক্ট করার বেলায় মহিলা এসবও দেখে নাকি!”

ছফা একটু হাসার চেষ্টা করলো। “তা জানি না, তবে এখন পর্যন্ত সে এভাবেই টার্গেট সিলেক্ট করেছে। এটা তার প্যাটার্ন বলতে পারো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো নগরপাল। “তারপরও সংখ্যাটা নেহায়েত কম। হবে না মনে হচ্ছে।”

“সবার ডেটা তো থাকে তোমাদের কাছে, তাই না?”

“তা থাকে। রাজ্যের সবগুলো পুলিশস্টেশন থেকে সব ধরণের ক্রাইমের ডেটাই সংরক্ষণ করা হয়। বিশাল ডেটা-বেইজ। তবে মার্ডার, হাইজ্যাক, ছিঁচকে চুরি থেকে শুরু করে নিখোঁজদের তালিকাগুলো ক্যাটাগরাইজড করা আছে।”

ছফা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তাদের ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ এখনও পুরোপুরি ডিজিটাল হতে পারেনি। যেটুকু তথ্য সংরক্ষণ করা হয় তা বেশ অপ্রতুল। ওসব তথ্য থেকে খুব কম সময়ই সাহায্য পাওয়া যায়।

“ডেটা বেইজ থেকে তথ্যগুলো পেতে কি কোনো সমস্যা হবে?” এবার আসল প্রসঙ্গে চলে এলো সে।

“উমমম…” একটু ভেবে নিলো সুশোভন। “অফিশিয়াল রিকোয়েস্ট ছাড়া ডেটাগুলো অন্য কারোর সাথে শেয়ার করি না আমরা। তবে, আমি চাইলে তোমাকে সেটা দিতে পারবো। আমার অ্যাকসেস আছে ওটাতে। মাঝেমধ্যে এরকম রিকোয়েস্ট আমরা নন-গভমেন্ট অর্গানাইজেশন থেকেও পেয়ে থাকি। বিভিন্ন ধরণের অপরাধের স্ট্যাটিস্টিক্স চায় তারা। প্রেসও চায়। তারপরও বলবো, তুমি যদি তোমাদের ওখান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রিকোয়েস্ট করো তাহলেই বরং বেটার হয়। নইলে সাসপেক্টকে লোকেট করার পর অ্যারেস্ট করতে পারবে না। বুঝতে পেরেছো তো?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “আমিও সেটা বুঝি। কাল-পরশুর মধ্যেই ওখান থেকে একটা রিকোয়েস্ট করা হবে। তবে আমি চাইছি তার আগেই সাসপেক্ট লোকেট করার কাজটা শুরু করে দিতে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সুশোভন। “আচ্ছা, তুমি ইন্টারপোলের হেল্প নিচ্ছো না কেন?”

“অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। খুব দ্রুত মহিলাকে ট্র্যাক করতে না পারলে সে হয়তো এখান থেকেও সটকে পড়বে, তাই আমি সময় নষ্ট করতে চাইছি না। তোমার কাছ থেকে একটু হেল্প পেলেই আশা করি কাজটা শুরু করতে পারবো। “

“ওকে,..কালকেই পেয়ে যাচ্ছো ওটা।”

“থ্যাঙ্কস দাদা।”

“এখন বলো, উঠবে কোথায়? তুমি তো সঙ্গে করে ছোট্ট একটা হ্যান্ডলাগেজ ছাড়া আর কিছুই আনননি দেখছি।”

ছফা কখনও ভ্রমণের সময় বড়সর লাগেজ বয়ে বেড়ায় না। ব্রিফকেস আকারের ছোট্ট একটা হ্যান্ডলাগেজই তার সম্বল। প্রয়োজনীয় জামা-কাপড় আর দরকারি জিনিসপত্র ছাড়া বাড়তি কিছুই সঙ্গে নেয়নি।

“কোথায় উঠলে সুবিধা হয়, বলো তো?”

সুশোভন একটু ভেবে বললো, “চাইলে হোটেলের খরচাটা সেভ করতে পারো। তবে শেষ পর্যন্ত ওটা অবশ্য জলেই যাবে!” চোখ টিপে দিলো নগরপাল।

হেসে ফেললো ছফা। জলে যাবে বলতে, মদের পেছনে যে ব্যয় করতে হবে সেটা বুঝতে পারছে।

“তোমার বৌদি বাপের বাড়িতে আছে এখন। তুমি আমার ওখানেই উঠছে, ঠিকাছে?”

“বাপের বাড়িতে চলে গেছে? ঝগড়া করেছো নাকি?”

“আরে না, মেয়েছেলেদের সাথে আমি ঝগড়া-টগড়া করি না। ওকে কয়েকটা মাস ওখানেই থাকতে হবে।”

“কেন? অসুখ করেছে?”

“হুম।”

সুশোভনের মুখের হাসি দেখে ছফা অবাক হলো, কারণটাও ধরতে পারলো না সে।

“আরে, সিরিয়াস কিছু না…সি কন্সিড।”

“ওহ্,” হেসে ফেললো ছফা। হাতটা বাড়িয়ে দিলো সুশোভন মিত্রের দিকে। “কগ্র্যাচুলেশন্স।”

“থ্যাঙ্কস, করমর্দন করতে করতে বললো সহকারী নগরপাল।

“ফার্স্ট ইস্যু?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সুশোভন। “তুমি তাহলে আমার ওখানেই উঠছে।”

মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *