২০. অনেক কিছু বদলে গেছে

অধ্যায় ২০

প্রায় তিন বছর পর এলেও পথটি তার ঠিকই মনে আছে। যদিও অনেক কিছু বদলে গেছে এই সময়ে।

রবীন্দ্রনাথের পাশ দিয়ে যে মেঠো পথটি চলে গেছিলো জমিদার অলোকনাথ বসুর পৈতৃক বাড়ির দিকে, সেটা এখন পাশাপাশি দুটো রিক্সা যেতে পারে এমন প্রশস্ত পিচঢালা পথ। খুব বেশি হলে এক বছরের পুরনো হবে রাস্তাটি। পথের দু-ধারে কিছু দিন আগে লাগানো হয়েছে গাছের চারা, সেগুলো ছোটোছোটো গোলাকার বাশের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত।

নুরে ছফা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে গেলো সেই পথ দিয়ে। পথের দু পাশের বিস্তীর্ণ ফসলিজমি আগের মতোই রয়েছে। মহাসড়ক থেকে সবুজ ফসলি জমির বুক চিড়ে চলে গেছে কালো পিচের রাস্তা। মাথার উপরে দগদগে সূর্য। চোখ ধাঁধানো প্রকৃতি চারপাশে। তার নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ে গেলো। প্রতিটি গ্রামই প্রায় একই রকম লাগে তার কাছে।

হাঁটতে হাঁটতে জমিদার বাড়ির কাছে চলে এলে দেখতে পেলো, সদর দরজাটা আর আগের মতো নেই, বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণটিও বেশ বদলে গেছে। দেখেই বোঝা যায়, নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়। এক সময়কার জমিদার বাড়ির মূল ফটকটি এখন শক্ত মজবুত লোহার গ্রিলের বিশাল দরজায় বদলে গেছে। সেই দরজার উপরে অর্ধ-বৃত্তাকারের খিলান সদৃশ একটি সাইনবোর্ড : সুন্দরপুর শান্তিনিকেতন উচ্চবিদ্যালয়।

ভুরু কপালে উঠে গেলো নুরে ছফার। এমন রবীন্দ্রপ্রীতির গূঢ় রহস্য কি বুঝে উঠতে বেগ পেলো না। মুশকান জুবেরির ভুত মাস্টারের ঘাড়েও চড়ে বসেছে! নাকি মুশকান জুবেরির ইচ্ছে বাস্তবায়ন করেছেন রমাকান্ত মাস্টার? প্রশ্নটা ছফার মনে উদয় না হয়ে পারলো না।

স্কুলগেটটা আগলে রেখে যে দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে সে যেমন বলশালি তেমনি কঠিন। চোখেমুখে সেই কাঠিন্য ধরে রেখে যেনো জানান দিচ্ছে, এখান দিয়ে অযাচিত কেউ ঢোকার কথা স্বপ্নেও যেনো না ভাবে।

ছফা পা বাড়ালো সেদিকে। “গেট খোলো,” হুকুমের স্বরে বললো সে।

মনে হলো দারোয়ান এমন হুকুম শুনতে অভ্যস্ত নয়। চোখদুটো গোল গোল করে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “আপনে কে…কী জন্যে আসছেন?” বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে জানতে চাইলো সে।

“আমি ঢাকার ডিবি অফিস থেকে এসেছি।”

দারোয়ান সন্দেহের দৃষ্টিতে ছফাকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। “আইডিকার্ড আছে?”

কথাটা শুনে খুব অবাক হলো, তারপরও পকেট থেকে পরিচয়পত্রটা বের করে দেখালো লোকটাকে। সম্ভবত দারোয়ান এর আগে কোনো পুলিশের পরিচয়পত্র দেখেনি। ছফার আইডিটা হাতে নিয়েও সন্দেহ দূর হলো না তার।

কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো দারোয়ান। “এই কার্ডটা যে নকল না সেইটা কেমনে বুঝুম?”

ভুরু কপালে উঠে গেলো ছফার। গ্রামের স্কুলের দারোয়ানের কাছ থেকে এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে। ঢাকা শহরের শিক্ষিত আর কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষজনও কখনও তার কার্ড দেখে এই প্রশ্ন করেনি। বলতে গেলে, পুরো কর্মজীবনে এই কার্ডটা হাতেগোনা মাত্র কয়েকবারই দেখিয়েছে। আর যাদেরকে দেখিয়েছে তারা বিনাবাক্য ব্যয়ে বিশ্বাস করে নিয়েছে।

“তুমি কি আমার সাথে মশকরা করছো?” দাঁতে দাঁত পিষে বললো সে।

আইডিকার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে দারোয়ান বললো, “আপনের কার্ড দেইখ্যা আমি কিছুই বুঝতে পারতাছি না, ভাই। এইটা নকলও হইতে পারে।”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো ছফা। লোকটা যে তাকে ভাই বলে সম্বোধন করছে সেটাও খেয়াল করেছে। তার মানে, সত্যি সত্যি সে বিশ্বাস করছে না ছফা পুলিশের লোক। অনেক কষ্টে নিজের রাগ দমন করে বললো, “এটা তো স্কুল, নাকি?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো দারোয়ান। “হ। এখন বলেন, আপনে এইখানে কার কাছে আসছেন?”

“মাস্টারসাহেবের কাছে এসেছি…উনি আছেন না স্কুলে?”

“উনি ভিতরে আছেন…অফিসে, দারোয়ান লোকটা বললো।

“তাহলে উনার কাছে খবর পাঠাও,” আদেশের সুরে বললো সে। “বলো, ঢাকা থেকে নুরে ছফা আসছে।”

“নুরে সাফা?” দারোয়ান তার নামটা ধরতে পারলো না।

মাথা দোলালো নামের মালিক। এটা তার জন্য মোটামুটি নিয়মিত একটি ব্যাপার। প্রথমবার খুব কম মানুষজনই তার নামটা ঠিকমতো ধরতে পারে। “সাফা না, ছফা…ঠিক আছে?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো দারোয়ান, তারপরই গেটের ভেতরে ঢুকে কাউকে ডাকলো সে। ছফা দেখতে পেলো বাইশ-তেইশ বছরের এক যুবক দৌড়ে চলে এলো গেটের কাছে।

“মাস্টরসারে গিয়া বলো, ঢাকা থিইক্যা নুরে ছফা নামের এক পুলিশ আইছে…স্যারের লগে দেখা করতে চায়।”

দারোয়ানের কথা শুনেই ছেলেটা আবার দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো। “ক-দিন ধরে এখানে কাজ করো?” জানতে চাইলো ছফা।

“এই স্কুলের শুরু থেইক্যাই আমি আছি,” গর্বিত ভঙ্গিতে জবাব দিলো দারোয়ান। “দেড় বছর তো অইবোই।”

“এর আগে কোথায় চাকরি করতে?”

“এইটাই আমার পথম চাকরি।”

“তাই নাকি? তোমার ভাবসাব দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ অভিজ্ঞ এই কাজে।”

দারোয়ান কিছু বললো না।

গ্রিলের গেটটা দিয়ে ভেতরে তাকালো ছফা। জমিদার বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণটি বেশ বদলে গেছে। মাঝখানে যে ফোয়ারাটা ছিলো সেটা আর নেই। সবুজ ঘাসের জায়গাটি এখন ইট বিছানো একটি চত্বর। জমিদার বাড়ির সেই পুরনো ভবনটিও নেই, সেখানে গড়ে উঠেছে একতলার একটি টিনশেড ভবন।

ছফার মনে পড়ে গেলো তিন বছর আগে এক রাতে কিভাবে সে দেয়াল টপকে এখানে ঢুকেছিলো, ফোয়ারাটার কাছে এসে ঘাপটি মেরে ছিলো কিছুক্ষণ। রোমাঞ্চকর একটি অভিযান ছিলো সেটা। গল্প করার মতোই ঘটনা। কতোটাই না ভড়কে গেছিলো ভবনের পেছনে, জোড়পুকুরের পাশে মাটি চাপা দেবার দৃশ্যটা দেখে। তারপর মুশকান জুবেরির সেই চাহনি, দ্রুত ঝোঁপের আড়াল থেকে পালিয়ে…

“আসেন।”

দারোয়ানের কথায় স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে এলো সে।

“স্যার আপনেরে ভিতরে যাইতে বলছেন।”

ছফা মুচকি হাসি দিয়ে গেটের ভেতরে পা রাখলো। সেই বিশ-বাইশ। বছরের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি নিয়ে, সম্ভবত তার পুলিশ পরিচয়ের কারণে।

“তুমি উনারে স্যারের কাছে নিয়া যাও, শ্যামল,” ছেলেটাকে বললো দারোয়ান।

তিন বছর পর নুরে ছফা মেইন গেটটা পেরিয়ে এক সময়কার জমিদার বাড়ির ভেতরে পা রাখলো আবার।

.

অধ্যায় ২১

ছোট্ট এই জীবনে অনেক চুরি করেছে বল্টু। শুরুটা হয়েছিলো মায়ের আঁচলে বেঁধে রাখা টাকা-পয়সা সরানো থেকে। তার মা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতো রান্না করার সময় আঁচল থেকে চুপিসারে টাকা সরাচ্ছে সে। কী নিখুঁতই ছিলো তার হাত! সেই প্রথম থেকেই।

একটু বড় হবার পর বুঝেছিলো, ঘরের টাকা চুরি করার মধ্যে বীরত্ব যেমন নেই, তেমনি লাভজনকও না। অর্থনীতির জটিল সমীকরণে না গিয়েই সে বুঝে গিয়েছিলো, ঘরের বাইরে নজর দিতে হবে। সেই থেকে চুরি করার বিদ্যেটা ভালোমতোই কাজে লাগাতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের পকেট কেটে বিখ্যাত হারুকাটা একদিন হাতেনাতে ধরে ফেলে তাকে। পাশে ছাতা রেখে চায়ের দোকানে বসে এক মুরুব্বি চা খাচ্ছিলো, বল্ট সেই ছাতাটা সবার অলক্ষ্যে মেরে দেয়, কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা হারুকাটা পকেটমার তাকে ধরে ফেলে হাতেনাতে।

ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলো সে। ওটাই ছিলো তার প্রথম ‘কট খাওয়া’র কেস। কিন্তু হারু যখন বললো, “গাধার বাচ্চা, বুইড়ার পকেটে কয়েক শ’ ট্যাকা থাকতে বালের এই বিটিশ আমলের ছাত্তিটা মারলি ক্যান?” তখনই সে বুঝে গেছিলো, যোগ্য ওস্তাদের খপ্পরেই পড়েছে।

এরপর থেকে হারু তার ওস্তাদ বনে যায়। কিভাবে পকেট কাটতে হয়, তালা খোলা যায়, কিভাবে বুঝবে কার পকেটে টাকা আছে আর কার পকেটে আছে বিড়ি-গুলের মতো অপ্রয়োজনীয় জিনিস-সবই শিখিয়ে দিয়েছিলো। বিনিময়ে প্রথম দু-বছর তাকে হারুর চ্যালা হয়ে কাজ করতে হয়। ইনকামের প্রায় বেশির ভাগই নিয়ে নিতো হারুকাটা। ততোদিনে তার বাবা আরেক মহিলাকে বিয়ে করে ফেলেছে, আর তাকে ফেলে চলে গেছে জন্মদাত্রি মা। কার সাথে কোথায় যে গেছে সেটা আজো জানতে পারেনি বল্টু। এরপর থেকে তার আশ্রয় জোটে হারুকাটার ঘরে। ভোরে উঠেই তাকে চলে যেতে হতো বাসস্টেশনে, ‘ইনকাম করার পরই কেবল নাস্তা জুটতো কপালে। ওস্তাদ হিসেবে এমনই কঠিন ছিলো হারু।

সারাটা দিন টই টই করে ঘুরে বেড়িয়ে পকেট মারতো, চুরি করতো। তবে আলতু ফালতু জিনিস চুরি করলে হারুকাটার লোহার মতো শক্তহাতের থাপ্পড় জুটতো দুই গালে। সেই থাপ্পড়ের ভয়ে চুরিবিদ্যেটা আরো শাণিত করে নেয় সে। বড় বড় দান মারতে শুরু করে কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হতো না। দিনকে দিন হারু তার শশাষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।

অনেক রাত শুয়ে শুয়ে বল্টু ভেবেছে, হারুর কাছে তার যে ঋণ সেটা শোধ হয়ে গেছে অনেক আগেই-এখন তাকে মুক্তি পেতে হবে। তার ছোট্ট মাথা থেকে অবশ্য কোনো উপায় বের হতো না। এক পর্যায়ে সে ধরেই নিয়েছিলো, হারুকাটার সাথেই কাটিয়ে দিতে হবে বাকি জীবনটা।

সেটা অবশ্য হয়নি। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবেই মুক্তি পেয়ে যায় সে। পাশের এক টাউনে পকেট মারতে গিয়েছিলো তার ওস্তাদ, বড় দান মারতে বেছে নিয়েছিলো বিয়ে বাড়ির মতো একটি অনুষ্ঠান। কপাল খারাপ ছিলো, ধরা পড়ে যায় হাতেনাতে। মারমুখি জনতার গণপিটুনি আর সহ্য করতে পারেনি, ভবের লীলা সাঙ্গ করে হারুকাটা চলে যায় পরপাড়ে।

ওস্তাদের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর একটু মন খারাপ করেছিলো বল্টু। ইশ, ওস্তাদ যদি তার মতো গণপিটুনি খাওয়ার সময় পায়খানা করে দিতো। সেই পায়খানা হাতে নিয়ে লোকজনকে দেখিয়ে বলতো : আর মাইরেন না…দেহেন, হাইগ্যা দিসি!-তাহলে তার মতোই বেঁচে থাকতো এখন। বল্টু এই পদ্ধতি খাঁটিয়ে বেশ কবার বেঁচে গেছে। লোকজন জ্যান্ত মানুষকে মারতে ভয় পায় না, কিন্তু মানুষের গু নিজের হাতে-পায়ে-শরীরে লাগাতে ভয় করে! শেষ অস্ত্র হিসেবে এটা খুবই কার্যকরী। কাঁদো কাঁদো হয়ে মানুষের মায়া-মমতা আদায় করার যে পুরনো টেকনিক তার ওস্তাদ তাকে শিখিয়েছে সেটা এখন আর কাজে লাগে না। মানুষ বড়ই পাষান হয়ে গেছে!

বল্টুর হাতে অনেক সময় আছে। মাস্টার এখন আছেন স্কুলে, তার আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়। সেজন্যে তাড়াহুড়ো করার কোনো মানেই হয় না।

মাস্টারের ভিটের কাছে এসে সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশটা দেখে নিলো আরেক বার। রমাকান্ত মাস্টার থাকেন এমন এক ভিটায়, যার চারপাশে খুব কম বাড়িঘরই আছে। ভিটার চারদিকে ক্ষেতিজমি, সেইসব জমিতে কিছু কামলা আগাছা সাফ করতে ব্যস্ত। মাস্টারের ভিটা থেকেও তাদের অবস্থান বেশ দূরে। তার চেয়েও বড় কথা, সবাই মাথা নিচু করে কাজ করে যাচ্ছে। তারা আজাইরা আর অকর্মা মানুষ নয় যে, আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে। সেদিকে নজর রাখবে।

বল্টু আস্তে করে উঁচু ভিটাতে উঠে গেলো সবার অগোচরে। পুরো বাড়িটা যেনো শশ্মানের মতোই খাঁ-খাঁ করছে। চারদিকে গাছগাছালি থেকে পাখির কিচিরমিচির ডাক ছাড়া আর কিছু নেই। আমগাছের মুকুল থেকে গন্ধ ভেসে আসছে।

মাস্টারের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে আরেকবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো। এরকম সতর্কতা তাকে শিখিয়েছে হারুকাটা ওস্তাদই-ভুলেও ধরে নেয়া যাবে না, আশেপাশে কেউ নেই।

বল্টুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এখন যে কাজটা করতে যাচ্ছে সেটা পানির মতোই সহজ। এখানে ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। একটা মাঝারি আকারের চায়নিজ তালা মারা আছে মাস্টারের ঘরের দরজায়। ওটা খোলার জন্য তেমন কিছুই করতে হবে না। তার কাছে একটা মাস্টার-কি আছে, সেটা দিয়ে সুন্দরপুরের অর্ধেক তালা খোলা যাবে!

মানুষের বোকামির কথা ভেবে হাসি পায় বল্টুর। তালা কেনার সময়ই তারা সবচেয়ে বেশি কিপ্টেমি করে। লাখ টাকার জিনিস পাহারা দিতে কিনা পঞ্চাশ টাকা দামের তালা কেনে!

পকেট থেকে মাস্টার কি-টা বের করে তালাটা খুলে ফেললো সে। ঘরটাতে বেশি কিছু নেই। তবে মানুষ কোথায় কী রাখতে পারে সেই ট্রেনিংও দিয়েছে তার ওস্তাদ।

ঘরে কাপড়-চোপড় রাখার একটা আলনা, পুরনো দিনের নক্সাওয়ালা পালং, বই, নানান রকম ফাইলভর্তি একটি আলমিরা আর পড়ার টেবিল চেয়ার। বল্টু প্রথমে টেবিলের ছোট্ট ড্রয়ারটার দিকেই হাত বাড়ালো। এটারও লক রয়েছে, সেই লক খুলতেও বেগ পেতে হলো না।

ড্রয়ারের ভেতরে কিছু চিঠিপত্র আর একটা মোবাইলফোন আছে চাজারসহ।

বল্টুর চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠলো। চিঠিগুলোসহ ফোনটা নিয়ে নিলো সে। চাজারটা নেবার দরকার না থাকলেও বাকি জিনিসের সাথে ওটা পকেটে ভরে নিলো। সস্তা চায়নিজ ফোনের চার্জার, কিন্তু বিশ টাকা হলেও চোরাই মার্কেটে বিক্রি করা যাবে। তার কাজ শেষে হয়ে গেলেও স্বভাবগত কারণেই ঘরের আশেপাশে নজর বুলালো আরেকবার। মাস্টার এখন বিশাল সম্পত্তি দেখাশোনা করেন, বিরাট বড় একটা স্কুল আর লাইব্রেরি চালান, প্রচুর টাকা খরচ করতে হয় তাকে। নিশ্চয় ঘরে কিছু না কিছু থাকবে।

পরক্ষণেই আতর আলীর সাবধান বাণীটা তার মগজে উচ্চারিত হলো : কোনো কিছু যদি সরাইছোস তো তুই শ্যাষ! এক্কেবারে কব্জি থেইক্যা হাত কাইট্যা ফালামু!

সঙ্গে সঙ্গে চার্জারটা আবার ড্রয়ারে রেখে দিলো বল্টু। আতর আলী তার ওস্তাদ না হতে পারে, কিন্তু এই লোককে জমাখরচ দিয়ে চলতে হয়। থানার সাথে তার সেইরকম খাতির। তাকে বিগড়ানো ঠিক হবে না।

এই প্রথম বল্টু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় খালি হাতেই বের হয়ে এলো কোনো বাড়ি থেকে! তবে বের হবার সময় দরজার তালাটা আর লাগালো না। আবারও তাকে আসতে হবে-একটু পরই। কী দরকার লক করে রাখার।

.

অধ্যায় ২২

এটা যে ঘটবে, রমাকান্তকামার জানতেন। গতকাল লোকটাকে দেখার পরই বুঝতে পেরেছিলেন, তার কাছে এসে আবারো সেই একই কথা জানতে চাইবে। তিন বছর আগে যখন অলোকনাথের নাতবৌ জমিদার বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো, তার সপ্তাহখানেক পরই এই লোক দ্বিতীয়বারের মতো সুন্দরপুরে এসেছিলো, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। লোকটার সন্দেহগ্রস্ত মানসিকতা পছন্দ করেন না তিনি। জগতের সবকিছুকে সন্দেহের চোখে দেখাটা এক ধরণের বাতিক। এটাকে তিনি সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে দেয়া অভিশাপ বলেও মনে করেন।

দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। আবারো সেই একই প্রশ্ন করবে এই লোক-আপনাকে কেন ট্রাস্টি করে দিয়ে গেলো মুশকান জুবেরি? সে এখন কোথায়? তার সাথে আপনার কি যোগাযোগ আছে?

রমাকান্তকামার জানেন, তার দিক থেকে জবাবটা আগের মতোই হবে-এটা আপনি ঐ ভদ্রমহিলাকেই জিজ্ঞেস করলে ভালো হয়। তার খবর আমি রাখি না।

ভদ্রমহিলা?!

ঐদিন ছফা নামের লোকটা যেনো ক্ষেপে গেছিলো কথাটা শুনে। আপনি তাকে ভদ্রমহিলা মনে করেন? বলেছিলো সে, মাথা দোলাতে দোলাতে। তারপর কিছু একটা বলতে গিয়েও বলেনি। শুধু বলেছিলো, তার নাকি কোনো ধারনাই নেই ঐ মহিলা কী করে।

“এসব জেনে আমি কী করবো?” রমাকান্তকামার সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছিলেন। “উনার সাথে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো লেনদেন নেই।”

ডিবি অফিসার মুচকি হেসেছিলো কথাটা শুনে। “কিছুই নেই, তারপরও আপনাকেই ট্রাস্টি করে এতো বড় সম্পত্তি দিয়ে গেলো?”

রমাকান্তকামার বিরক্ত হয়েছিলেন কথাটা শুনে। “আমাকে উনি একরত্তি সম্পত্তিও দিয়ে যাননি। আপনি ভুলে গেছেন, উনি একটি ট্রাস্টে দান করে গেছেন সবকিছু।”

“আর সেটার ট্রাস্টি করে গেছেন আপনাকে!”

লোকটার চোখেমুখে সন্দেহ উপচে পড়ছিলো। যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন তিনি, তবে সেটা প্রকাশ করেননি, বরং যুক্তি দিয়ে কথা বলেছিলেন। “ঐ ভদ্রমহিলা এটা করতে বাধ্য হয়েছেন।”

কথাটা শুনে ছফার ভুরু কপালে উঠে গেছিলো। “বাধ্য হয়েছেন?!”

“হুম। সম্পত্তিটা যার নামে, সেই রাশেদ জুবেরি এটা চেয়েছিলেন, একটু থেমে আবার বলেছিলেন, “আর মহিলা সেটাই করেছেন।”

“তাহলে এতো দিন পরে কেন? পালিয়ে যাবার ঠিক আগেই?”

“সেটা ঐ মহিলাই ভালো জানেন,” বলেছিলেন রমাকান্তকামার। “ধরে নিলাম উনি আসলেই একজন অপরাধী…তাতে কী? সম্পত্তিটা তো উনার ছিলো না।”

ডিবি অফিসার এ কথার কোনো জবাব দেয়নি।

“উনার অপরাধ প্রমাণিত হয়ে থাকলেও সম্পত্তিগুলো দান করার অধিকার উনি রাখতেন…যদি না আদালত এ ব্যাপারে কোনো বাধা দিতো।”

তার এমন কথায় মুচকি হাসি ফুটে উঠেছিলো লোকটার ঠোঁটে। “আইন-কানুন সম্পর্কে তো দেখি ভালো ধারণাই রাখেন।”

টিটকারিটা গায়ে না মেখে তিনি বলেছিলেন, “তা রাখি না। তবে জগতের সকল আইন-কানুন তৈরি হয়েছে কাণ্ডজ্ঞান থেকে, সেটা নিশ্চয় আমার আছে।”

এ কথা শোনার পর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে চলে গেছিলো ডিবি অফিসার। সেই যে গেলো আর আসেনি। বিগত তিন বছরে তার টিকিটাও দেখা যায়নি সুন্দরপুরে। তবে লোকটার ছায়া ঠিকই মাস্টারকে অনুসরণ করে গেছে পরবর্তী কয়েকটি মাস।

এই সুন্দরপুরের সবাই তাকে পুলিশের ইনফর্মার হিসেবেই চেনে। চুরি থেকে শুরু করে মাদক বিক্রি, হেন কাজ নেই সে করে না। মাস্টার লক্ষ্য করেছেন, লোকটা কেমন ছায়ার মতো অনুসরণ করতে শুরু করেছিলো। তাকে। তিনি যেখানেই যেতেন, পিছু নিতো আতর।

একদিন পোস্ট অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, ঢাকা থেকে জরুরী একটা চিঠি এসেছিলো তার। ডাক হরকরা সুবিদ মিয়া তাকে দেখে পোস্ট অফিসে নিয়ে গিয়ে এক কাপ চা খাইয়ে চিঠিটা দিয়ে দেয়। সেই চিঠি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বিশাল বড় এক বটবৃক্ষের নিচে একটু জিরিয়ে নেন তিনি। বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে চিঠিটা পড়তে গিয়ে টের পান দূর থেকে আতর আলী উৎসুক চোখে তাকে দেখছে। তিনি চিঠিটা পড়ার পর ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেন পাশে, তারপর উঠে রওনা দেন বাড়ির দিকে। কিছুটা পথ যাবার পর একটা পুরনো শিব মন্দিরের ধ্বংস্তূপের কাছে এসে পেছনে ফিরে দেখেন আতর সেই চিঠির টুকরোগুলো কুড়াতে ব্যস্ত। এই দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিলো তার ভেতর থেকে।

এখনও সেই একই দীর্ঘশ্বাস আর ভাবনা তাকে পেয়ে বসলো।

“আদাব, মাস্টারসাহেব।”

রমাকান্তকামারের ভাবনায় ছেদ পড়লো, দরজার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন ডিবি অফিসার নুরে ছফা দাঁড়িয়ে আছে।

“আপনি তো দেখি বিশাল কাজ করে ফেলেছেন, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো সে।

চোখেমুখে নির্বিকার ভঙ্গি মাস্টারের। “বসুন,” তার ডেস্কের সামনের চেয়ারগুলোর একটা দেখিয়ে বললেন।

মাস্টারের এই অফিস ঘরটি এককালে জমিদার বাড়ির মূল ভবনের পাশে যে লাগোয়া দোতলাটি ছিলো সেটার নিচতলায় অবস্থিত। ভেতরে এবং বাইরে, পুরোপুরি নতুন করে সাজানো হলেও মূল স্থাপনাটি একই আছে।

একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো ছফা। “কেমন আছেন?”

“ভালো,” ছোট্ট করে জবাব দিলেন রমাকান্তকামার।

“স্কুলটার খুব নামডাক হয়ে গেছে। এতো অল্প সময়ে দারুণ কাজ করেছেন মনে হচ্ছে।”

স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন মাস্টার। এসব আলগা কথাবার্তায় তার কোনো আগ্রহ নেই। আসল কথার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।

“এখানকার নিরাপত্তা দেখি সেই রকম!” কথাটা প্রশংসার মতো শোনালো না অবশ্য। “আমি তো খুবই অবাক হয়েছি। ঢাকার স্কুলেও এরকম নিরাপত্তা দেখিনি। ভালো, খুব ভালো।”

“এটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল,” আস্তে করে বললেন মাস্টার। এখানে। ছাত্র-ছাত্রিদের দুটো ডরমিটরি আছে। এর সাথে অন্য স্কুলের তুলনা করলে ভুল করবেন।”

ভুরু কপালে তুলে বললো ছফা, “তা অবশ্য ঠিক।”

“এখন বলুন, আমার কাছে আবার কীজন্যে এসেছেন।”

মাস্টারের কণ্ঠস্বরে আন্তরিকতাবিবর্জিত সুরটা ধরতে বেগ পেলো না। “আপনার কি তাড়া আছে?”

“হুম। যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।”

“আচ্ছা, মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো ছফা। “ঐ মহিলা…মুশকান জুবেরি কি আপনার সাথে যোগাযোগ করেছিলো এরপর?”

আস্তে করে গভীরভাবে দম নিয়ে নিলেন রমাকান্তকামার। “না।”

“এ কয় বছরে একবারও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি?”

এবার শুধু মাথা দুলিয়ে জবাব দিলেন মাস্টার।

“অন্য কারোর মাধ্যমেও না?” রমাকান্তকামারের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আবার বললো, “এতো কিছু করলেন আর মহিলা একটা ধন্যবাদও দিলো না আপনাকে? অন্তত কাউকে দিয়ে তো এটুকু বলতেই পারতো, ‘মাস্টারসাহেব, আপনি দারুণ কাজ করেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ’?”

মাস্টার কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে একটু চমকে গেলেন কথাটা শুনে।

“রবীন্দ্রনাথের নামে লাইব্রেরি দেবার জন্যে হলেও মহিলার উচিত ছিলো আপনাকে ধন্যবাদ জানানো,” আফসোসের সুরে বললো নুরে ছফা। “তার সাধের রেস্টুরেন্টটা না থাকলেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ঠিকই টিকে আছে। লোকে আগেও বলতো রবীন্দ্রনাথে যাই, এখনও সেটাই বলে।”

“আপনি ধরেই নিয়েছেন এমন নামকরণের সাথে ঐ ভদ্রমহিলার সম্পর্ক আছে,” একটু রুষ্ট হয়ে বললেন রমাকান্তকামার।

মুচকি হাসলো ছফা। “ধরে নেবার কিছু নেই, যুক্তিবুদ্ধি সেটাই বলে।”

“আপনি সম্ভবত জানেন না, রবীন্দ্রনাথের ‘ন্দরপুরে আসার উপলক্ষ্যে এখানে একটি লাইব্রেরি উদ্বোধন করার কথা ছিলো। সেজন্যে অলোকনাথ বসুর পিতা ত্রিলোকনাথ চমৎকার একটি লাইব্রেরি করেছিলেন।”

নুরে ছফা ভুরু কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মাস্টারের দিকে।

“বটগাছের কাছে, এখন যেখানে পেট্রলপাম্পটা আছে…ওখানেই ছিলো পয়ষট্টি সাল পর্যন্ত। এর পর রায়টের সময় ওটা পুড়িয়ে দেয় দাঙ্গাবাজেরা।”

ছফাও জানে, সব যুগেই দাঙ্গাবাজ আর ধর্মান্ধদের আক্রমণের শিকার হয়েছে গ্রন্থাগার। পশ্চাদপদ চিন্তাভাবনার সাথে গ্রন্থাগারের বিরোধ সুপ্রাচীন।

“পরে আর ওটা মেরামত করার চেষ্টা করেনি জমিদার বাড়ির কেউই। অলোকনাথ বসু অবশ্য আমাকে বলেছিলেন লাইব্রেরিটা আবার নতুন করে করার কথা ভাবছেন তিনি। এরপর একাত্তর চলে এলো, জমিদারের বংশ শেষ!” দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললেন তিনি। “স্বাধীনের পর সরকার মহাসড়ক বানানোর জন্য জমিদারদের সম্পত্তির বেশ কিছু অংশ অধিগ্রহণ করে…লাইব্রেরিটা যেখানে ছিলো, ওটার উপর দিয়েই চলে যায় নতুন সড়কটি।”

“তাই আপনি ঠিক করলেন আবার একটা লাইব্রেরি করা দরকার ওখানে?”

মাস্টার কিছুই বললেন না।

“বুঝলাম। কিন্তু এটা বুঝলাম না, মহিলার রেস্টুরেন্টের সাইনটা রেখে দিলেন কেন?”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রমাকান্তকামার। রেস্টুরেন্টটার সাইন যখন সরানো হচ্ছিলো তখন তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সেটা। ডান দিক থেকে সাইনটার একেকটি শব্দ খুলে ফেলা হচ্ছিলো। শেষে যখন ‘রবীন্দ্রনাথটা খুলতে যাবে তখন মাস্টারের মন সায় দিলো না। এ নামেই তো লাইব্রেরিটা হবে, তাহলে নামটা থেকে গেলে কী আর সমস্যা! লাইব্রেরি যদি আলোর আধার হয়ে থাকে, তাহলে আলোকিত রবীন্দ্রনাথ থাকতেই পারে! সত্যি বলতে, রবীন্দ্রনাথ নামটা অপসারণ করতে তার মন সায় দিচ্ছিলো না।

“শুনুন ছফাসাহেব,” বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মাস্টার। “রবীন্দ্রনাথ শুধু একজনের পছন্দের মানুষ নন। তাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে, অনুসরণ করে এরকম মানুষ এই ভূ-ভারতে অনেক আছে। আমিও তাদের একজন। তাই বলে ভাববেন না, আমার ইচ্ছেয় নামটা দিয়েছি। সত্যিটা হলো, অলোকনাথ বসুর পিতা যে লাইব্রেরিটি দিয়েছিলেন, স্বয়ং কবিগুরুর যেটা উদ্বোধন করার কথা ছিলো, সেটার নাম ছিলো ‘শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণগ্রন্থাগার।’ এটা সুন্দরপুরের খুব কম মানুষই এখন জানে। বিস্মৃত ইতিহাস বলতে পারেন। আমি শুধু নতুন করে ওটা আবার দিয়েছি।”

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। “আপনি এবার আসতে পারেন।”

ছফা কিছু বলতে যাবে অমনি ঘরটা ভরে উঠলো মাদকতাপূর্ণ একটি গন্ধে।

“রমাকান্ত মশাই…” সুললিত একটি কণ্ঠ বলে উঠতেই মাঝপথে থেমে গেলো।

পেছন ফিরে ছফা দেখতে পেলো এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। তাতের শাড়ি পরা মেয়েটিকে দেখেই মনে হলো পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে জড়ো হওয়া হাজারো তরুণীদের একজন।

মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হলো ছফার। মাস্টারের ঘরে অপরিচিত কাউকে দেখতে পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সে।

“আপনি মনে হচ্ছে ব্যস্ত, আমি তাহলে পরে আসি?”

“কোনো সমস্যা নেই, বলুন, কী বলতে এসেছিলেন,” বললেন রমাকান্তকামার।

ছফার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাস্টারের দিকে ফিরলো তরুণী। “বোশেখের অনুষ্ঠানে তানপুরাটার তার ছিঁড়ে গিয়েছিলো, ওটার তার কেনা লাগবে।”

“শ্যামলকে বলে দিচ্ছি, ও কিনে নিয়ে আসবে।”

“ঠিকাছে।” বলেই ছফার দিকে আবার আড়চোখে তাকিয়ে ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে গেলো মেয়েটি।

আশ্চর্য হলেও সত্যি, মেয়েটাকে দেখে নুরে ছফার কেন জানি মুশকান জুবেরির কথাই মনে পড়ে গেলো! এটার কারণও সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারলো সে-তাদের দুজনের বাচনভঙ্গি আর সাজপোশাকের বেশ মিল আছে। মেয়েটা প্রমিত বাংলায় কথা বলে, মুশকান জুবেরিও এভাবে কথা বলতো। বলে। শুধরে দিলো নিজেকে। ঐ মহিলা তো আর লোকান্তরিত হয়ে যায়নি। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথাও, আর শিকার করে যাচ্ছে।

“আমাদের গানের শিক্ষিকা।”

“ও,” আস্তে করে বললো ছফা। “আপনার ফোন নাম্বারটা একটু দেয়া যাবে?”

রমাকান্তকামার কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন ছফার দিকে, তারপর আস্তে করে ড্রয়ার থেকে একটা কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিলেন।

কার্ডটা হাতে নিয়ে হতাশ হলো সে-ল্যান্ডফোনের নাম্বার। “এটা তো এখানকার অফিসের নাম্বার?”

“হুম।”

“আপনার নিজের কোনো ফোন নেই?”

“আপনি এই নাম্বারেই আমাকে পাবেন।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ছফা। “ঠিক আছে, আমি তাহলে আসি।” দরজার দিকে যেতেই আবার ঘুরে দাঁড়ালো। “আপনার স্কুলটা কি ঘুরে দেখতে পারি? অনেক পুরনো স্মৃতি আছে এখানে, বুঝতেই পারছেন। তাছাড়া, স্কুলটার অনেক প্রশংসা শুনে ফেলেছি, তাই একটু ঘুরে দেখার লোভটা সামলাতে পারছি না।”

স্থিরচোখে তাকিয়ে বললেন মাস্টার, “ঘুরে দেখতে পারেন, সমস্যা নেই।”

“ধন্যবাদ, আপনাকে।” কথাটা বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো ছফা।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রমাকান্তকামারের ভেতর থেকে। ডেস্কের বেলটা বাজাতেই কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকলো মাঝবয়সী এক লোক।

“স্যার?”

“আলী, একটু আগে আমার ঘর থেকে যে লোকটা বের হয়ে গেলো তাকে একটু চোখে চোখে রেখো। সে কী করে না করে লক্ষ্য রাখতে হবে।”

“ঠিক আছে, স্যার।”

আলী নামের লোকটা ঘর থেকে চলে গেলে আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রমাকান্তকামার। এরকম কাজ করার কোনো ইচ্ছে কিংবা রুচি নেই তার, কিন্তু এখন না করেও পারলেন না। নুরে ছফা নামের লোকটাকে তার সুবিধার বলে মনে হয়নি কখনও। তার চাইতেও বড় কথা, এর মতিগতি বুঝতে পারছেন না।

.

অধ্যায় ২৩

মাস্টার রমাকান্তকামারের অফিস থেকে বের হয়ে চারপাশে তাকালো নুরে ছফা। জমিদার বাড়িটা বেশ বদলে গেছে। এক সময় জমকালো পুরনো ভবনটি আর নেই। ওটা যে তিন বছর আগে আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে সে-কথা তার চেয়ে ভালো কে জানে!

তবে বাড়িটার চৌহদ্দি আগের মতোই আছে, ভেতরে কিছু নতুন স্থাপনা তৈরি হওয়াতে প্রথম দেখায় মনে হয় অন্য কোনো জায়গা বুঝি। সামনের প্রাঙ্গনটা একেবারে পাল্টে ফেলা হয়েছে। ওটা এখন ইট বিছানো একটি চত্বর। চত্বরটাতে সাদা রঙ দিয়ে দাগ টানা। ছাত্রছাত্রিরা এখানে জড়ো হয় ক্লাস শুরুর আগে। তারপর হালকা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করে-ছফারা যেটাকে বলতো পিটি ক্লাস।

আরামে দাঁড়াও…সোজা হও।

স্কুলের পিটি স্যারের পুরু গোঁফের মুখটার ছবি ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়। সাদা গেঞ্জি আর সাদা প্যান্ট পরা থাকতো, মাথায় থাকতো সানক্যাপ। একটা হুইসেল বাজিয়ে তাদেরকে অর্ডার দিতেন। খুবই জাঁদরেল ছিলেন, নানান ধরণের খেলাধূলায় উৎসাহ দিতেন। লোকটার ভুড়ি ছিলো বলে আড়ালে আবডালে তাকে তারা পেটালি’ বলেও ডাকতো।

প্রাঙ্গনের মাঝখানে ফ্ল্যাগপোলটা চোখে পড়লো এবার। সবই আছে, পতাকাটা নেই। ক্লাস শুরুর আগে, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় ওটাতে ফ্ল্যাগ লাগানো হয় নিশ্চয়। এখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রিরা গেয়ে ওঠে : আমার সোনার বাংলা…আমি তোমায় ভালোবাসি।

ছফা পা বাড়ালো সেদিকে। চত্বরটা ঘুরে দেখলো সে। সীমানা প্রাচীরটা আরো উঁচু করা হয়েছে, তার উপরে লাগানো হয়েছে তিন ফুটের মতো উঁচু লোহার নেট। সীমানা প্রাচীরের যেদিক দিয়ে ছফা এখানে অনুপ্রবেশ করেছিলো একরাতে, সেদিকে দিকে তাকালো। গাছটা এখনও অক্ষত আছে, তবে সেটার গোঁড়ার দিক থেকে কোমর সমান উচ্চতায় সাদা রঙ করা।

মাঝখানে যে ফোয়ারাটা এখন নেই সেটা ঢোকার সময়ই দেখেছিলো। এখন দেখতে পেলো, মেইন গেটের পাশে আগের দারোয়ানের যে ঝুপড়ি ঘরটা ছিলো সেটাও নেই। পুরো জায়গাটা যথেষ্ট পরিস্কার।

জমিদার বাড়ির দোতলা স্থাপনাটির জায়গায় এখন নতুন একটি একতলা ভবন গড়ে উঠেছে। টিনের চালার এই ভবনটি স্কুলের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেই ভবনের অনেকগুলো দরজা-জানালা। সম্ভবত শিক্ষকেরাও এখানেই বসে।

ছফা এবার ভবনের পাশ দিয়ে ইট বিছানো রাস্তা ধরে পেছনের দিকে চলে গেলো। আগের রাস্তাটা আরো চওড়া করা হয়েছে। পুরনো ইটগুলোর বদলে বসানো হয়েছে নতুন ইট। ভবনের পেছনে যে বাগানটা ছিলো, যেখানে লুকিয়ে থাকার সময় ছ্যাঙ্গার কবলে পড়েছিলো ছফা সে-জায়গাটা আর নেই। ওখানে তিনদিক ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছে তিন তিনটি ভবন। কেবল উত্তর দিকটা খোলা আছে। সেদিক দিয়ে সীমানা প্রাচীর ঘেষে চলে গেছে নতুন রাস্তাটি।

নবনির্মিত ভবনগুলোর দেয়াল ইটের তৈরি, ছাদগুলো টিনের। সারি সারি দরজা জানালা বলে দিচ্ছে এগুলোই স্কুলের ক্লাসরুম। দরজা বন্ধ থাকলেও কিছু খোলা জানালা দিয়ে সে দেখতে পেলো বেঞ্চগুলো।

রাস্তাটা ধরে পুকুর পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলো ছফা। ঠিক এভাবেই রাতের অন্ধকারে সে এগিয়ে গেছিলো রহস্যময়ী মুশকান জুবেরিকে অনুসরণ করে, তারপর কয়েক মুহূর্তের জন্য ধোঁকা খেয়েছিলো দুটো দেয়ালের কারণে।

আশ্চর্য হয়ে ছফা দেখতে পেলো, দেয়াল দুটো এখনও আছে। এতে কিছুর পরিবর্তনের মধ্যে এরকম একটি দেয়াল কেন টিকিয়ে রাখা হলো সেটা বুঝতে পারলো না।

ঠিক তখনই শুনতে পেলো, দূর থেকে ভেসে আসছে একদল ছেলেমেয়ের সমবেত কণ্ঠের গান :

…আজ আমাদের ছুটি ও ভাই
আজ আমাদের ছুটি…
আহা হাহা হা

আরেকটু এগিয়ে গেলো সে। গানের আওয়াজ বেড়ে গেলো এবার।

কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি
আহ হাহা হা…

দেয়ালের প্রবেশ মুখ দিয়ে ঢুকে ছফা এবার ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ঠিক এ জায়গাতেই, একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে সে দেখেছিলো মুশকান জুবেরিকে কিছু একটা মাটি চাপা দিতে। মহিলার সঙ্গে ছিলো গোরখোদক ফালু। তবে এখন আর কোনো ঝোঁপ নেই। জায়গাটা বেশ পরিস্কার। পুকুর পাড়ের চারপাশ ঘিরেই সবুজ ঘাসের চত্বর।

মুশকান জুবেরি যেখানে বস্তাবন্দী করে রেডওয়াইন মাটির নিচে পুঁতে ফেলছিলো, ঠিক সেখানেই একদল ছেলেমেয়ে বসে আছে শতরঞ্জির উপরে। তাদের সামনে বেতের মোড়াতে বসে আছে ঐ তরুণী-মাস্টারের

অফিস রুমে একটু আগে যাকে দেখেছিলো।

কেয়া পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে
তালদীঘিতে ভাসিয়ে দেব চলবে দুলে দুলে।
রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে…

ছেলেমেয়েরা সমবেত কণ্ঠে গান গেয়ে যাচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে কথা আর সুর ঠিক আছে কিনা লক্ষ্য রাখছে সেই তরুণী, কিন্তু মেয়েটা চকিতে ছফাকেও দেখে নিলো। তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। একজন আগন্তুক যে দূর থেকে তাদেরকে দেখছে সেটা গান গাইতে থাকা বাচ্চাগুলো অবশ্য এখনও টের পায়নি।

“আমাদের গানের মাস্টার।”

ছফা চমকে তাকালো পেছনে, দেখতে পেলো বাদামি রঙের কুতা আর পায়জামা পরা মাঝবয়সী এক লোক নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

“খুবই ভালো গান করে…শান্তিনিকেতন থেকে এসেছে।”

ভুরু কপালে তুললো ছফা। “তাই নাকি।”

“জি।”

“আপনি…?”

“আমি এখানকার কেয়ারটেকার। আপনি কে? কোত্থেকে এসেছেন?”

“ঢাকা থেকে এসেছি,” আর কিছু বললো না ছফা। পুকুর পাড়ের ওপাশে, যেখানকার ডোবায় মুশকান জুবেরি কুমির চাষ করতো, সে জায়গাটার দিকে চোখ গেলো তার। একদমই বদলে গেছে। মাটি ফেলে জায়গাটা উঁচু করা হয়েছে এখন, সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে দুটো ভবন-মূল স্কুল ভবনের আদলেই তৈরি করা হয়েছে ওগুলোইটের দেয়াল আর টিনের ছাদ।

তবে দুটো ভবনের মাঝখানে প্রাচীর দিয়ে পৃথক করা।

“ওগুলো ডরমিটরি,” ছফার চোখ অনুসরণ করে কেয়ারটেকার বললো। “ছেলে আর মেয়েদের আলাদা আলাদা দুটো।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা, দেখতে পেলো ডরমিটরিতে ঢুকতে দুটো আলাদা মেইন গেট আছে, আর পুরো জায়গাটা উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা।

প্রশংসার অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে। “মাস্টারসাহেব দেখি ছোটোখাটো শান্তিনিকেতন বানিয়ে ফেলেছেন!”

হেসে ফেললো কেয়ারটেকার। “এটা উনার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিলো।”

“বিশাল কাজ করেছেন,” সত্যি সত্যিই বললো ছফা, কথাটার মধ্যে টিটকারির লেশমাত্রও নেই।

মাথা নেড়ে সায় দিলো মাঝবয়সী কেয়ারটেকার। মুখে এখনও হাসি ধরে রেখেছে।

“কিন্তু এতো কিছু কিভাবে করলেন?”

লোকটার হাসি মিইয়ে গেলো। ছফার এ প্রশ্নের মধ্যে কেমনজানি একটা ইঙ্গিত আছে। “কিভাবে মানে?”

“এই যে, বিরাট একটি আবাসিক স্কুল, এতো বড় আয়োজন, এসব করতে তো অনেক টাকা লাগার কথা।”

আবারো হাসি ফিরে এলো কেয়ারটেকারের মুখে। “ট্রাস্টের জমিজমার পরিমাণ তো অনেক। তাছাড়া স্থানীয় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ভোনেশন দিয়েছে। আমাদের নতুন এমপি আবার মাস্টারসাহেবের ছাত্র ছিলেন,

অনেক সাহায্য করেছেন উনি, সরকারী অনুদানের ব্যবস্থাও করেছেন।”

“হুম,” মাথা নেড়ে বললো ছফা।

“কিন্তু আপনি কে, সেটা তো বললেন না?”

লোকটার দিকে স্থিরচোখে তাকালো ছফা। “আমি ঢাকা থেকে এসেছি…ঢাকার ডিবি অফিস থেকে। আমার নাম নুরে ছফা।”

কেয়ারটেকার একটু বিস্মিত হবার ভান করলো। “কিছু হয়েছে নাকি আমাদের এখানে?”

বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো ছফার ঠোঁটে। “এ প্রশ্নের উত্তর তার কাছ থেকেই জেনে নেবেন, যিনি আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন আমাকে চোখে চোখে রাখার জন্য।”

.

অধ্যায় ২৪

মাস্টারের স্কুল থেকে সোজা নিজের হোটেল রুমে ফিরে এসেছে নুরে ছফা। হোটেল রুমের ছোট্ট ঘরটায় পায়চারী করার মতো জায়গা কমই আছে, তবুও সে পায়চারী করতে করতে একটা কথাই ভেবে যাচ্ছে-সুন্দরপুরে মাস্টার রমাকান্তকামারের ঘর থেকে কী পাওয়া যেতে পারে। সে নিশ্চিত, সেলফোন অবশ্যই আছে, তবে সঙ্গত কারণেই সেটা লুকিয়ে রাখেন।

মাস্টার এখন খুবই শক্তিশালী মানুষ। যদিও ক্ষমতার দাপট দেখান না, নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতেই নিমগ্ন থাকেন সব সময়, তারপরও তিনি যদি জেনে যান ছফা তার ঘরে চোর পাঠিয়েছিলো তাহলে হয়তো এমপির কাছে নালিশ দেবেন, তাই ছফাকে এ ব্যাপারে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। আতরকেও বলে দিয়েছে, খুব সাবধানে কাজটা করা দরকার।

এমন সময় দরজায় নক হলে ছফার ভাবনায় ছেদ পড়লো।

“আতর?”

“হ, স্যার।” দরজার ওপাশ থেকে বলে উঠলো ইনফর্মার। তার কণ্ঠের খুশিখুশি ভাবটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

নুরে ছফা দরজা খুলে দিলে আতর আলী রুমে ঢুকে পড়লো। কোনো কিছু না বলে পকেট থেকে একটা কমদামি চায়নিজ মোবাইলফোন আর কিছু চিঠিপত্র বের করে আনলো সে।

“এই লন,” এমনভাবে দু-হাতে ধরে রাখলো ওগুলো যেনো দামি কোনো উপহার তুলে দিচ্ছে। “কইছিলাম না বলুই পিরবো।”

ছফা প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালে ফোনটার দিকে। দ্রুত সেটা চালু করলো সে। উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইলো আতর আলী। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই হতাশা ভর করলো ছফার চোখেমুখে। রেগেমেগে ফোনটার পেছনের অংশ খুলে ফেললো।

“ধুর!” প্রচণ্ড রাগে বলে উঠলো সে।

“কী হইছে?” আতর কিছুই বুঝতে পারছে না। রবীন্দ্রনাথ দুই-৮

“এটার তো সিমই নেই!”

“সিম নাই?!” অবিশ্বাসে বলে উঠলো ইনফর্মার। “কন্ কি!”

ছফা কিছু বললো না।

“সিম না থাকলে কি কুননা কামে দিবো না এইটা?”

আতরের দিকে তাকালো নুরে ছফা। ফোনের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টি, মানে আইএমইআই নাম্বার দিয়েও যে সিমের হদিস বের করা যায় সেটা এই স্বল্পশিক্ষিত ইনফর্মারকে বললেও বুঝবে না। তাছাড়া কাজটা করা একটু সময়সাপেক্ষ। সিম থাকলে অনেক সহজেই কল হিস্ট্রি বের করা যেতো।

সিম নেই দেখে আতর মুখ বেজার করে বসে আছে।

এখন একটা ব্যাপারে ছফা নিশ্চিত-রমাকান্তকামার নিজের মোবাইলফোনটা গোপন রাখেন, তারচেয়েও বড় কথা, সেই ফোনের সিম খুলে রাখেন নিরাপদ কোনো জায়গায়! ভদ্রলোক এতোটা সতর্ক কেন-এ প্রশ্নের জবাব তার কাছে আছে-কারো সাথে তার যোগাযোগের ব্যাপারটা যেনো ফাঁস না হয়ে যায় তাই সদা সতর্ক থাকেন। আর এরকম একজন মানুষই আছে-মুশকান জুবেরি!

মাস্টারের মোবাইলফোনটার ব্যাটারির পেছনে থাকা আইএমইআই নাম্বারটার ছবি তুলে রাখলো নিজের মোবাইলফোনের ক্যামেরায়। তারপর যে চিঠিগুলো বল্টু চুরি করে এনেছে সেগুলোর দিকে নজর দিলো সে। একটু নেড়েচেড়েই বুঝতে পারলো, সবগুলো অফিশিয়াল চিঠি। খামের উপরে প্রেরক আর প্রাপকের জায়গায় বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা দেখে সেগুলো আর ঘেঁটে দেখার ইচ্ছে করলো না। নতুন স্কুল আর লাইব্রেরি দেবার মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ করতে গিয়ে বিভিন্ন সরকারী আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান আর ব্যক্তির সাথে চিঠিপত্র আদান প্রদান করেছেন মাস্টার।

“মনে লয় মাস্টর টের পায়া গেছে, অবশেষে বিজ্ঞের মতো বললো আতর আলী।

“উনি কিভাবে টের পাবেন?” ছফা বিরক্ত হয়ে বললেও তার কাছে এখন মনে হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথে প্রথম দিন দেখা হয়ে যাওয়াটাই ভুল হয়ে গেছে। তার উচিত হয়নি ওখানে যাওয়া। কে জানতো, মাস্টার ঐ সময় লাইব্রেরিতে থাকেন।

“হে অনেক বড় পণ্ডিত,” ব্যাখ্যা করতে শুরু করলো ইনফর্মার। “সব কিছু আগে থেইক্যা বুইজ্যা ফালায়। মাথা তো না যে কমপিটার।”

ছফা কিছু বললো না। মাস্টার যে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফোনের ব্যাটারিটা আবার লাগিয়ে নিলো সে।

“এখন তাড়াতাড়ি এগুলো জায়গামতো রেখে আসা দরকার।”

মোবাইল ফোনসহ চিঠিপত্রগুলো ইনফর্মারের দিকে বাড়িয়ে দিলো ছফা। এমন সময় দুটো খাম পড়ে গেলো মেঝেতে। যেই না ও দুটো। তুলতে যাবে আতর তখনই ছফার নজরে কিছু একটা ধরা পড়লো-দুটো খামের মাঝখানে ছোট্ট একটা চিরকুট আছে। উপুড় হয়ে নিজেই চিরকুটটা তুলে নিলো। অন্য চিঠিগুলোর খামে ভরা থাকলেও এটার কোনো খাম নেই। বাকিগুলো কম্পিউটারে টাইপ করা হলেও চিরকুটটা হাতেলেখা। লেখাটা বেশ সুন্দর। মনোযোগ দিয়ে পড়লো সেটা :

সম্পদ-সম্পত্তি খারাপ মানুষের হাতে পড়লে দশের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি। ভালো মানুষের হাতে পড়লে মহৎ কিছুর জন্ম হয়। আপনি এ সম্পত্তি নিয়ে কি করবেন সে নিয়ে আমার মধ্যে কোনো সংশয় নেই। শুধু ছোট্ট একটি অনুরোধ, রবীন্দ্রনাথকে চমৎকার একটি লাইব্রেরি বানাবেন। বইয়ের চেয়ে শক্তিশালী খাবার এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি! ওই লাইব্রেরিটা যদি রবীন্দ্রনাথের নামে হয় তাহলে আমি ভীষণ খুশি হবো। একটা কথা মনে রাখবেন, এটা আমি আপনাকে দেইনি। রাশেদ জুবেরি তার জীবন বাঁচানোর জন্য আপনার কাছে চিরটাকালই কৃতজ্ঞ ছিলো। সে হয়তো মুখ ফুটে সেটা কখনও বলতে পারেনি।

ভালো থাকবেন।

বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো ছফার ঠোঁটে।

.

অধ্যায় ২৫

স্কুল দেবার পর দুপুরের আগে কখনও নিজের ঘরে ফিরে এসেছেন কিনা স্মরণ করতে পারলেন না মাস্টার রমাকান্তকামার। এমনকি ছুটির দিনেও তিনি বিকেল পর্যন্ত স্কুল আর লাইব্রেরিতে গিয়ে কাজ করেন। কিন্তু আজকে যে এর ব্যতিক্রম করলেন সেটার কারণ যুক্তিবুদ্ধি নয়-তার স্বজ্ঞা!

নুরে ছফার কিছু কথা, কিছু আচরণ তাকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে : রবীন্দ্রনাথের নামে লাইব্রেরি দেবার জন্যে হলেও মহিলার উচিত ছিলো আপনাকে ধন্যবাদ জানানো-এরকম কথা কেন বললো ঐ ডিবি অফিসার? সে কি কোনোভাবে টের পেয়ে গেছে, রাশেদের স্ত্রী, ঐ মহিলা তার সাথে যোগাযোগ করেছিলো? সেজন্যে তার সন্দেহ, মহিলা আবারো যোগাযোগ করে থাকবে হয়তো?

অসম্ভব!

এ কথা সে কিভাবে জানতে পারবে? সবটাই কি তাহলে অহেতুক ভয়?

ডিবি অফিসার তার কাছে তার ফোন নাম্বারটা চেয়েছিলো-আপনার নিজের কোনো ফোন নেই? তিনি সচেতনভাবে সত্যি-মিথ্যে কিছুই বলেননি, এড়িয়ে গেছেন।

নুরে ছফা স্কুল থেকে চলে যাবার পরই রমাকান্তকামার এই দোলাচলে দুলেছেন। তার অন্তরাত্মা বলছিলো, ঐ চিরকুটটা রেখে দিয়ে মোটেও ভালো কাজ করেননি। যদিও এতোদিনে ওটার কথা প্রায় ভুলেই গেছিলেন।

অনেকক্ষণ স্কুলের অফিসে বসে থাকার পর হুট করেই উঠে পড়েন তিনি। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিলো, ছফা নামের ঐ ডিবি অফিসারের ভাবসাব মোটেও ভালো নয়। এক ধরণের আশঙ্কা করতে থাকেন তিনি, সেটা যে কী, নিজেও জানেন না। জরুরী একটা দরকারে বাসায় যাচ্ছেন বলে সোজা চলে আসেন নিজের বাড়িতে।

এখন ঘরে ঢুকতে গিয়েই মাস্টার দেখতে পাচ্ছেন তার ঘরের তালাটা খোলা! দরজার সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, এরপর আস্তে করে ঘরে ঢুকে চারপাশটা দেখে নিলেন। কেমনজানি একটা অনুভূতি হলো তার। টের পেলেন, প্রচ্ছন্ন একটি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে তার পরিচ্ছন্ন ছোট্ট ঘরটাতে। তিনি যথেষ্ট সাফ-সুতরো থাকেন। তার ঘরে আর যাই হোক, বাজে গন্ধ ভেসে বেড়ানোর কথা নয়-গাঁজার গন্ধ তো দূরের কথা!

দেখে মনে হচ্ছে, ঘরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তারপরও পকেট থেকে চাবি বের করে ড্রয়ারটা খুলতে গিয়ে দেখলেন, সেটাও খোলা আছে-ঠিক দরজার তালাটার মতোই!

ড্রয়ারটা খুলে দেখলেন এবার। যে আশঙ্কা করেছিলেন সেটাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে : জরুরী অনেক চিঠিপত্রের সাথে তার মোবাইলফোনটা নেই! তারচেয়েও বড় কথা, ঐ চিরকুটটাও হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।

মাস্টারের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। আইনের লোক হয়ে বেআইনীভাবে আরেকজন মানুষের ঘরে চোর পাঠিয়ে তার কাগজপত্র হাতিয়ে নেবার জন্য মনে মনে ভীষণ রুষ্ট হলেন। তিনি নিশ্চিত, ঐ নুরে ছফা লোকটি সম্ভবত আতর আলীকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছে। এক সময় ঐ লোকের পেশা তো চুরিই ছিলো। যেকোনো সময় পুরনো পেশায় ফিরে যাওয়াটা তার জন্য এমন আর কী।

রমাকান্তকামার চুপচাপ নিজের বিছানায় বসে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। গভীর করে নিশ্বাস নিলেন। তিনি যে বুদ্ধের মতো অক্ৰোধি সেটা দাবি করেন না, তবে সজ্ঞানে সব সময়ই চেষ্টা করেন রেগে না যেতে। কিন্তু এ মুহূর্তে ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে, তিল তিল করে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার পর উটকো এক লোক এসে সব কিছু তছনছ করে দেবার পায়তারা শুরু করে দিয়েছে।

এই নুরে ছফা লোকটা কি সুন্দরপুরে পা রাখার পর জমিদার বাড়িটা পুড়ে খাক হয়ে যায়নি?

নিজের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে মাস্টার রমাকান্তকামার বেশ রক্ষণশীল হয়ে উঠেছেন, ঠিক যেভাবে কোনো মা তার সন্তানের অমঙ্গল চিন্তা করে রক্ষণশীল হয়ে ওঠে, আগলে রাখার চেষ্টা করে। কততক্ষণ বিছানায় মূর্তির মতো বসেছিলেন তিনি জানেন না। কিছু একটা শব্দ পেয়ে সম্বিত ফিরে পেলেন।

কেউ তার বাড়ির আঙিনায় পা রেখেছে।

জন্ম থেকে আজ অবধি, আশি বছর ধরে এ বাড়িতে বাস করছেন, বাড়িটা তার দেহেরই অংশ হয়ে গেছে। এখানকার সব কিছু যেনো তার সঙ্গে কথা বলে। কেউ তার বাড়ির চৌহদ্দিতে পা রাখলে তিনি টের পেয়ে যান-যেনো কেউ তার শরীর স্পর্শ করছে।

রমাকান্তকামার আস্তে করে উঠে আলনার পেছনে গিয়ে কাপড়চোপড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকলেন, কিছুক্ষণ পরই দেখতে পেলেন, দরজা ঠেলে সতর্ক পদক্ষেপে ঘরে ঢুকলো এক কিশোর। ছেলেটাকে চিনতে কোনো সমস্যাই হলো না তার। সুন্দরপুরের সবাই তাকে চেনে, তার নাম জানে। খারাপ সঙ্গ আর মাতৃপিতৃহীন এই ছেলেটি অকালেই নষ্ট হয়ে গেছে।

আড়াল থেকে তিনি দেখলেন, বল্টু তার সব কাগজপত্রের সাথে মোবাইলফোনটাও ড্রয়ারে রেখে সেটা চাবি দিয়ে বন্ধ করে বের হয়ে গেলো। তারপরই শুনতে পেলেন, বাইরে থেকে দরজার তালা লাগাচ্ছে। সে।

“তালা মারার দরকার নেই…আমি ঘরে আছি!” আড়াল থেকে বের হয়ে রমাকান্তকামার বেশ শান্তকণ্ঠে বললেন।

এরপর শুধু দৌড়ে চলে যাবার শব্দটাই শুনতে পেলেন তিনি।

প্রচণ্ড রাগ হলো তার। বিছানায় বসে কয়েক বার গভীর করে নিশ্বাস নিয়ে নিলেন। পাজামার পকেট থেকে চশমার কেসিংটা বের করে সেটার ভেতর থেকে একটা সিম বের করে আনলেন এবার। ড্রয়ার থেকে ফোনটা বের করে তাতে সিমটা ভরলেন। কিছুক্ষণ পর একটা নাম্বারে ডায়াল করলেন মাস্টার।

একজনের সাথে জরুরী কথা বলা দরকার।

.

অধ্যায় ২৬

সুরুত আলীর সানমুন হোটেলে বসে বসে সিগারেট ফুকছে আর আতরের জন্য অপেক্ষা করছে ছফা।

একটু আগে ইনফর্মার মাস্টারের ফোনসহ চিঠিপত্রগুলো নিয়ে চলে যাবার আগে তাকে আশ্বস্ত করে বলেছে, কিছুক্ষনের মধ্যেই মাস্টারের ফোন নাম্বারটা জোগাড় করে নিয়ে আসছে সে।

হাতঘড়িতে সময় দেখলো ছফা। বুঝতে পারছে না, আতর আলী কোত্থেকে মাস্টারের নাম্বারটা জোগাড় করবে। ধোঁয়ার কারণে ঘরটা গুমোট হয়ে গেছে, জানালাটা খুলে দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো। এখন সে পুরোপুরি নিশ্চিত, মাস্টারের সাথে মুশকান জুবেরির যোগাযোগ আছে। তার অনুরোধেই লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ। অথচ মাস্টার তার কাছে এটা স্বীকার করেননি। কী সব পুরনো ইতিহাস কপচে গেছেন।

দ্বিতীয় সিগারেটটা শেষ হবার আগেই আবারও তার রুমের দরজায় টোকা পড়লো।

“আসো।”

হাসিমুখে ঘরে ঢুকেই আতর আলী বলে উঠলো, “নম্বর তো পায়া গেছি, স্যার।”

“তাই নাকি?!” দারুণ অবাক হলো ছফা। “এতো দ্রুত কিভাবে জোগাড় করলে?”

দাঁত বের করে হাসলো ইনফর্মার, যেনো ছফার বিস্ময় উপভোগ করছে, সেই সাথে নিজের কেরামতি দেখাতে পেয়ে বেশ খুশি।

“মাস্টর ফোন লুকায়া রাখবার পারে, সিমও খুইল্যা রাখবার পারে,” রহস্য করা ভঙ্গিতে বলে যেতে লাগলো সে, “কিন্তু ফোনে তো টাকা ভরনই লাগে, লাগে না?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। তার মাথায় এটা আগে আসেনি। মনে মনে ইনফর্মারের বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলো না। মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। ফোনে ব্যালান্স ভরার জন্য মাস্টারকে নাম্বারটা দিতেই হয়।

“তাইলেই বুঝেন।” হেসে ফেললো সুন্দরপুরের বিবিসিখ্যাত আতর আলী। “এইহানে তো ফোনের দোকান একটাই…আমাগো শামসু মিয়া চালায়, হের লগে আমার আবার হট টেরাম।”

মনে মনে আরেক বার ইনফর্মারের বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না সে।

“মাস্টরের একটা পোলা আছে, স্কুলে কাম করে, ঐ পোলায় মাজেমইদ্যে ফোনে টাকা ভরনের লাইগ্যা শামসুর দোকানে যায়। হের তো নিজের ফোন নাই…আমি পুরা শিওর, নম্বর দুইটা মাস্টরেরই হইবো।”

“দুটো নাম্বার?” আশাহত হলো ছফা।

“হ, স্যার। পোলাটা দুইটা নম্বরে ট্যাকা ভরে। ওয় হইলো মাস্টরের ডাইনহাত,” কথাটা বলেই ছোট্ট একটা ময়লা কাগজ বের করে ছফার দিকে বাড়িয়ে দিলো সে।

কাগজটা হাতে নিয়ে দুটো ফোন নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইলো নুরে ছফা। দুটোই একই টেলিকমের। তার মন বলছে, এই নাম্বার দুটোর একটা অবশ্যই মাস্টারের-আবার দুটো নাম্বারও তিনি ব্যবহার করতে পারেন। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এই নাম্বার দুটো থেকেই জানা যাবে মুশকান জুবেরির ফোন নাম্বারটা-যদি মাস্টারের সাথে তার যোগাযোগ থেকে থাকে।

সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বের করে তার সহকারী জাওয়াদের নাম্বারে ডায়াল করলো সে।

*

সুন্দরপুর ছাড়ার সময় হয়ে গেছে!

হন হন করে হেঁটে টাউনের বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে ভাবলো। বল্টু। কী ভয়টাই না পেয়েছিলো সে। রাতবিরাতে ভুতের সাথে দেখা হয়ে গেলেও এতোটা ভয় পেতো কিনা সন্দেহ। যে ঘরে কোনো মানুষ নেই, পুরো ফাঁকা দেখেছে, পনেরো-বিশ মিনিট পরই সেখানে মাস্টার কিভাবে চলে এলো সে জানে না।

একটু আগে আতর আলীর কাছ থেকে মাস্টারের ঘর থেকে চুরি করা জিনিসগুলো আবার রেখে যেতে গেছিলো জায়গামতো, তখনও সবই ঠিকঠাক ছিলো, পুরো ভিটেটা ছিলো সুনশান। কাজের সুবিধার্থে সে মাস্টারের ঘর আর ড্রয়ারের তালা দুটো আর লাগায়নি, ধরেই নিয়েছিলো এটা করার দরকার নেই, একটু পরই তো চুরি করা জিনিসগুলো জায়গামতো রেখে দিতে হবে। কিন্তু জিনিসগুলো জায়গামতো রেখে যেই না দরজা লাগাতে যাবে অমনি ঘরের ভেতর থেকে মাস্টারের গম্ভীর কণ্ঠটা বলে ওঠে, দরজা লাগানোর দরকার নেই।

এটা কিভাবে সম্ভব হলো?!

বল্টুর মাথায় ঢুকছে না। এখনও তার বুক ধরফর করছে। কী দৌড়টাই

দিয়েছিলো। পড়িমরি করে দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেছিলো সে, শরীরের কয়েক জায়গায় ছিলেও গেছে। কিছুক্ষণ তো মনেই হয়েছিলো, কণ্ঠটা মাস্টারের নয়, ভুতের!

বল্টুর স্পষ্ট মনে আছে, মাস্টারের ঘরে দ্বিতীয় বারের মতো যখন। ঢুকলো তখনও ঘরে কাউকে দেখেনি। মুহূর্তে কী করে ওখানে একজন চলে এলো?

কণ্ঠটা ভুত হলে তার বিপদ কমই হবে, কিন্তু সে ভালো করেই জানে। ওটা মাস্টারের কণ্ঠস্বর। তার মানে, আগামি কয়েক সপ্তাহ সুন্দরপুরে না থাকাই ভালো। সে এমন মানুষের ঘরে চুরি করেছে, যাকে এখানকার এমপি পর্যন্ত সালাম দেয়, সম্মান করে। এমপির ছেলেপেলেগুলো তার হাত-পা বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে বেদম পেটাচ্ছে-এরকম একটি দৃশ্য ভেসে উঠলো বল্টুর চোখে। নিশ্চয় তার মুখ থেকে সব কথা বের না করা পর্যন্ত চলবে এই পিটুনি। এক পর্যায়ে সব কিছু স্বীকার করতে বাধ্য হবে সে।

বাসস্টেশনে আসতেই তার মাথায় অন্য একটা চিন্তা চলে এলো পালিয়ে গেলে বিপদ কমবে না, বাড়বে। তারচেয়ে বরং সুন্দরপুরে ফিরে যাওয়াই ভালো। কী করলে এ যাত্রায় রেহাই পাবে সেই বুদ্ধিটাও চট করেই মাথায় এসে গেছে।

উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলো বল্টু। মনে মনে একটাই প্রতীজ্ঞা করলো, এ জীবনে আর কখনও আতর আলীর কাজ করবে না।

.

অধ্যায় ২৭

দুপুরে খেয়েদেয়ে সুরুত আলীর হোটেল সানমুনের ছোট্ট ঘরটায় পায়চারী করছে নুরে ছফা। আজকে তার হোটেল রুমেই খাবার পাঠিয়েছে মুশকানের মালিক ফজলু। এটা যে আতর আলীর কাজ, বুঝতে বাকি নেই তার।

যাই হোক, আতরের সংগ্রহ করা দুটো সেলফোন নাম্বার হাতে পাবার পর কাজটা সহজ হয়ে গেছে এখন। নইলে আইএমইআই নম্বর দিয়ে প্রথমে সিমের হদিস বের করা লাগতো, তারপর সেই সিম দিয়ে মাস্টার কোন্ কোন্ নাম্বারে ফোন করেছেন, তাকেই বা কোন্ কোন্ নাম্বার থেকে কল করা হয়েছে সেসব বের করা হতো।

এখন এসবের দরকার নেই। জাওয়াদকে নাম্বার দুটো দিয়ে বলে দিয়েছে, কার নামে সিম দুটো রেজিস্টার্ড করা, আর সেগুলো থেকে বিগত এক মাসে যেসব নাম্বার থেকে আউটগোয়িং-ইনকামিং কল করা হয়েছে-সবকিছু জেনে নিতে হবে। কাজটা সময়সাপেক্ষ হলেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাধর পিএসের কল্যাণে দ্রুততম সময়েই করা যাবে।

সে এখন অপেক্ষা করছে জাওয়াদের ফোনের জন্য। তার উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠে গেলো ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই। সঙ্গে সঙ্গে কলটা রিসিভ করতে যেয়ে থমকে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। একটা অপরিচিত নাম্বার। মেজাজ বিগড়ে গেলো তার। দরকারের সময় এরকমটা হলে মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। কলটা রিসিভ করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, “হ্যালো…কে বলছেন?”

“আপনে ক্যারে! উসমান কই?” ফোনের ওপাশ থেকে একটা খসখসে কণ্ঠ বলে উঠলো।

“আপনি ভুল নাম্বারে ফোন দিয়েছেন।”

“আপনে ক্যাঠায়…অ্যাঁ? কই থাহুন?”

ছফার মেজাজ গেলো বিগড়ে। “ফোন রাখ, বানচোত!” কলটা কেটে দিয়ে জোরে জোরে সিগারেটে টান দিতেই আবার বেজে উঠলো সেটা, তবে ডিসপ্লেতে কলার আইডি দেখে তার সমস্ত রাগ কৌতূহলে পরিণত হলো।

“হ্যাঁ, জাওয়াদ…বলো?”

“স্যার, আশেকসাহেবের রেফারেন্স ভালোই কাজে দিয়েছে,” ওপাশ থেকে ডিবির জুনিয়র ইনভেস্টিগেটর বলে উঠলো। “খুব দ্রুতই অনেক ইনফো কালেক্ট করেছি। দুটো সিমই শ্যামল কুমার দাস নামে রেজিস্টার্ড করা…মদনগঞ্জের ঠিকানা দেয়া আছে। আমি গুগলিং করে দেখেছি, ওটা সুন্দরপুরের খুব কাছেই।”

“হুম,” বললো নুরে ছফা।

“ঐ দুটো সিম থেকে বিগত এক সপ্তাহে যেসব আউটগোয়িং-ইনকামিং কল করা হয়েছে তার সবকিছু আমি আপনাকে মেইল করে দিয়েছি।”

“এক মাসের কল-হিস্ট্রিটাও আমার দরকার হবে।”

“ওটা করতে একটু সময় লাগবে। কালকের মধ্যে দিতে পারবো আশা করি।”

“ওকে।”

“স্যার, একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, দুটো নাম্বার দু-জন মানুষ ব্যবহার করে,” জাওয়াদ বললো।

“কিভাবে বুঝলে?” আগ্রহী হয়ে উঠলো ছফা।

“নাম্বার দুটো নিজেদের মধ্যেও কল করেছে কয়েক বার।”

“আচ্ছা,” মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “ঠিক আছে, যতো দ্রুত পারো বাকি ইনফোগুলো পাঠিয়ে দিও।”

“ওকে, স্যার।”

ফোনটা রেখে জানালার বাইরে তাকালো। দুটো নাম্বার দু-জন মানুষ ব্যবহার করে! শ্যামল কুমার দাস! মনে মনে বলে উঠলো সে। কে হতে পারে এই লোক? মাস্টারের আত্মীয়?

আতর আলীকে কল দিলো এবার। “শ্যামল কুমার দাস নামের কাউকে তুমি চেনো?”

“আরে, আমি যে পোলার কথা কইছিলাম আপনেরে, তার নামই শ্যামল! মাস্টরের ডাইনহাত।”

“যে ছেলেটা ফোনের ব্যালান্স ভরে?”

“হ।”

“ও তাহলে স্কুলের কর্মচারী, প্রশ্নের মতো করে বললো না ডিবির নুরে ছফা।

“হ। মাস্টর ওরে দিয়াই সব কাম করায়।”

“তাহলে ওর সাথে কথা বলতে হবে।”

“ঐ হালারপুতেরে ধরবেনুনি, স্যার?”

“হ্যাঁ।” নাম্বার দুটো কে বা কারা ব্যবহার করে সেটা বের করার সহজ উপায় হলো শ্যামলের স্বীকারোক্তি। যদিও সে নিশ্চিত, একটা নাম্বার অবশ্যই মাস্টার রমাকান্তকামার ব্যবহার করেন। কিন্তু ছেলেটাকে স্কুলে গিয়ে ধরতে চাইছে না সে। যদিও, চাইলে এখানকার যে কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। তারপরও, স্কুলের বাইরে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ছেলেটা নাজুক অবস্থায় থাকবে। কারোর কাছ থেকে সত্য কথাটা বের করার সময় ভঙ্গুর আর নাজুক নার্ভই বেশি কার্যকরী।

“কিন্তু স্কুলে গিয়ে ওর সাথে কথা বলাটা ঠিক হবে না। স্কুলের বাইরে ধরতে হবে ওকে।”

“ঐ পোলায় রোজ বিকালে ফজলুর হোটেল থিকা কার লাইগা জানি খাওন নিয়া যায়,” আতর জানালো।

“তাহলে তুমি আর আমি একটু পরেই চলে যাবো রহমান মিয়ার দোকানে…ছেলেটা তো ওখান দিয়েই যাবে, নাকি?”

“হ, স্যার, “ বললো আতর।

“তাহলে তুমি আমার হোটেলে চলে আসো একটু পর।”

.

অধ্যায় ২৮

রহমান মিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে, বেচা-বিক্রি ভালো হয়নি আজ। শহর থেকে কোনো কাস্টমারও আসেনি বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐ রেস্টুরেন্টের খোঁজে। এরকম কেউ চলে আসার পর যখন দেখে ওটা লাইব্রেরিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে তখন খুবই অবাক হয়, তারচেয়েও বেশি হয় হতাশ। রহমান তখন আগ বাড়িয়ে তাদের হতাশা দূর করে দেয়ার কাজটা করে-”ঐ হুটেল তো এহন টাউনে সইরা গেছে…এইখান থিকা রিস্কা দিয়া গেলে দশ টাকা নিবো।”

এমন কথায় বেশ কাজে দেয়। খাদ্যরসিকেরা এতো দূর এসে বিমুখ হয়ে ফিরে যায় না। তারা রহমানের নির্দেশনা পেয়ে খুশিমনে চলে যায় হিটলুর ঐ রেস্টুরেন্টে। কেউ কেউ এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দোকানিকে উপকারের প্রতিদান দেয়, কেউ বা হাসিমুখে ধন্যবাদ দিয়ে রিক্সা ধরে-তাতে অবশ্য রহমানের কোনো আক্ষেপ থাকে না। প্রতিটি কাস্টমারের জন্য হিটলু তাকে দশ টাকা করে দেয়।

রহমান অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছে, এখন পর্যন্ত কোনো কাস্টমারই হিটলুর চালাকিটা ধরতে পারেনি। জমিদারের বৌয়ের রেস্টুরেন্টের নামটা হুবহু নেয়নি সে, কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, খেতে এসে কোনো খাদ্যরসিক ‘খেতে’টা যে নেই, সেটাই লক্ষ্য করে না। বড়জোর পুরনো কাস্টমাররা বলে, আগের মতো আর অতো স্বাদের হয় না খাবারগুলো। তবে একদম নতুন যারা আসে, তারা সেটাও বুঝতে পারে না।

তিক্ত মুখে রহমান ওয়াক করে থুতু ফেললো দোকানের পাশে, আর তখনই শব্দটা কানে গেলো তার। আতর আলী আসছে মোটরসাইকেলে করে, তার পেছনে বসে আছে শহর থেকে আসা পুলিশের সেই লোকটি। সুন্দরপুরে যে আবারো খারাপ কিছু ঘটবে সেটা নিশ্চিত। তারপরও আপাতত দু-জন কাস্টমার পেয়ে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

বাইকটা দোকানের সামনে এসে থামতেই শহুরে লোকটা নেমে গেলো আস্তে করে।

“রহমান মিয়া, কেমন আছেন?”

“ভালা, ছার। আপনে কিমুন আছেন?” বিগলিত হাসি দিয়ে বললো দোকানি।

“আমি ভালো আছি। তা, আপনার ব্যবসা কেমন চলছে?” নুরে ছফা দোকানের সামনে একটা বেঞ্চে বসে পড়লো।

“ব্যবসা মন্দা…কাস্টমার নাই,” হাসিমুখটা আবারো বেজার করে বললো টঙের মালিক।

“আমাগো কি কাস্টমার মনে করো না তুমি?” বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে বললো আতর আলী।

“তা ক্যান মনে করুম না। আমি কইতাছি সারাদিনের কথা।”

“হুম,” আতর বিজ্ঞের মতো বলে বসে পড়লো ছফার পাশে। “এহন পেচাল বাদ দিয়া দুই কাপ গুড়ের চা বানায়া ফালাও জলদি।”

“প্যাচাল পাড়লাম কুনহানে!” মর্মাহত হলো রহমান। “তুমার খালি আজাইরা কথা।” এই বলে চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।

“মাস্টর কি ওইহানে আছেনি?” রাস্তার অপর পাশে রবীন্দ্রনাথের দিকে ইশারা করে বললো ইনফর্মার।

“হ, বিকালে তো ওইহানেই থাহে,” চামচ নেড়ে নেড়ে চায়ের সাথে গুড় মিশিয়ে বললো রহমান। সারা দিন স্কুলে কাম করার পরও মাস্টর জিরায় না…এইহানে আহে আবার। বিয়াশাদিও তো করে নাই, বাড়িত গিয়া করবোটা কী।” কথাটা বলে ছফা আর আতরের দিকে কাপ দুটো বাড়িয়ে দিলো। “আপনেরা কি স্কুলে যাইবেনি?”

রহমানের প্রশ্নটা শুনে বিরক্ত হলো আতর। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো-আদার বেপারি তুমি, এতো জাহাজের খবর লও ক্যান-কিন্তু সে প্রসন্নভাবে হেসে বললো, “না…শ্যামরে একটু দরকার আছিলো। হেরে দেখছোনি?”

শ্যামলের কথা শুনে রহমানের ভুরু কুঁচকে গেলো। “হেরে আবার কী দরকার?”

“সব কথা তোমার জানোন লাগবো, না?” এবার আর বিরক্তি লুকালো ইনফর্মার। “সুন্দরপুরের বিবিচি হইবার চাও মনে হইতাছে।”

“ওইসব হওনের কুনো শখ আমার নাই,” আস্তে করে বললো রহমান। “নিজের কাম নিয়া থাহি, অইন্যের খবর জাইন্যা আমার কী লাভ!”

আতর কিছু বলতে যাবে কিন্তু ছফার চোখের ইশারা পেয়ে থেমে গেলো।

“শ্যামল কি স্কুল থেকে বের হয়েছে?” নুরে ছফা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানতে চাইলো।

গাল চুলকালো রহমান। “হেয় তো একটু আগে ঐদিকে গ্যাছে,” টাউনের দিকটা দেখিয়ে বললো সে।

“কততক্ষণ আগে?”

“দশ-পোন্ডা মিনিট তো হইবোই।”

নুরে ছফা আর আতর আলী একে অন্যের দিকে তাকালো। রহমানের টঙে বসেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো তারা।

চা শেষ করে ছফা যখন সিগারেট ধরাবে তখনই আতর তাকে ইশারা করলো সুন্দরপুরের মহাসড়কের দিকে। এক তরুণ হাতে পলিব্যাগ নিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে।

ছফার ইশারা পেয়ে উঠে দাঁড়ালো আতর। তাকে রাস্তার দিকে যেতে দেখে রহমান মিয়ার কৌতূহলি চোখ স্থির হয়ে রইলো যেনো।

ছেলেটাকে ইশারায় ডাকলো ইনফর্মার। অবাক হলো শ্যামল।

রহমান মিয়া এখন চোখের পলকই ফেলছে না। পুরো নাটকটার এক মুহূর্তও মিস করতে চাইছে না সে-রসিয়ে রসিয়ে মানুষের কাছে যখন গল্পটা বলবে তখন যেনো বর্ণনায় একটুও খামতি না থাকে।

শ্যামল কিছুটা ভিরু পায়ে এগিয়ে এলো আতরের কাছে, আর ঠিক তখনই রহমান মিয়ার দোকানে নুরে ছফাকে দেখতে পেলো। এই লোক যে পুলিশ এরইমধ্যে জেনে গেছে সে। তার চোখেমুখে ভয় জেঁকে বসলো।

“এই যে, আমাগো ছফাস্যার,” রহমানের দোকানের কাছে এসে বললো আতর আলী। “সেলাম দে স্যারে।” ধমকে উঠলো শ্যামল নামের ছেলেটাকে। “তরে কিছু পুছতাছ করববা…ভালায় ভালায় সব কইবি, ঠিক আছে?”

শ্যামল ভ্যাবাচ্যাকা খেলো, রহমানের দিকেও তাকালো চকিতে। দোকানি হঠাৎ করেই গুড়ের পিণ্ডের উপর থেকে মাছি সরানোর কাজে ব্যস্ত। হবার চেষ্টা করলো, কিন্তু একটা মাছিও নেই সেখানে।

“তোমার নাম কি শ্যামল?” নুরে ছফা সিগারেটে টান দিয়ে জানতে চাইলো।

“হ,” ছেলেটা ঢোঁক গিলল।

“তুমি মাস্টারের স্কুলে কিসের কাজ করো?”

“আ-আরদালির, “ ছেলেটা নার্ভাস ভঙ্গিতে জবাব দিলো।

ছফা আর প্রশ্ন না করে পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিলো। “এই নাম্বার দুটো কার?”

কাগজটার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো শ্যামল, যেনো কিছুই বুঝতে পারছে না।

“তোর তো নিজের ফোন নাই, তাইলে এইগুলান কার নম্বর?” চোখমুখ শক্ত করে বললো আতর।

শ্যামল আস্তে করে আবারো ঢোঁক গিলল।

“তুই এই নম্বরে ট্যাকা ভরোস। ভালা কইরাই জানোস কার নম্বর এইগুলা। না চিনার তো কথা না।”

“চিনুম না ক্যান, আজিব, ঢোঁক গিলে বললো ছেলেটা। “এইগুলা আমাগো মাস্টকাকা আর দিদির নম্বর।”

আতর আর নুরে ছফা দৃষ্টি বিনিময় করলো। “দিদি?” ইনফর্মারই প্রশ্নটা করলো অবশেষে। “কার কথা কস?”

“ঐ যে, আমাগো গানের টিচার…এইটা ওই দিদির নম্বর।” দুটো নাম্বারের একটা দেখিয়ে বললো শ্যামল।

“কিন্তু এই সিম দুটো তো তোমার নামে রেজিস্টার্ড করা।”

ছফার দিকে অবাক হয়ে তাকালো শ্যামল। “হ, আমিই কিনছিলাম আমার কার্ড দিয়া।”

“তাদের সিম তুমি কেন তোমার নামে কিনলে?”

“মাস্টকাকা তো আইডিকার্ড হারায়া ফেলছেন সেই কবে। ঢাকায় গেছিলেন, বাসে কইরা ফিরার সময় ব্যাগ হারায়া ফেলছিলেন, হের পর আর কার্ড তোলেন নাই।”

ছফা ছেলেটার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “আর তোমাদের গানের টিচার? তারও কি আইডি কার্ড হারিয়ে গেছে?”

“দিদি তো শান্তিনিকেতন থেইকা আসছে, তার কেমনে কার্ড থাকবো?”

“হুম।” মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। কথাটা আগেও শুনেছে।

“এইজন্যেই মাস্টকাকা আমারে কইলো আমি যে আমার আইডি দিয়া দিদির জইন্যও একটা সিম কিইন্যা দিই।”

“ব্যাটা, তুই এক নামে এতোগুলান সিম কিনছোস ক্যান, অ্যাঁ? কাহিনী কি?” ধমকের সুরে বললো আতর।

“একটা কার্ড দিয়া সাতটা সিম কিনা যায়…এইটা সরকারী নিয়ম, ব্যাখ্যা করে বললো শ্যামল।

আতর কিছু বলার আগে তাকে ইশারায় থামিয়ে দিলো ছফা। ছেলেটা মিথ্যে বলেনি। একটা কার্ড দিয়ে সর্বোচ্চ সাতটা সিম কেনা যায়। ফালতু নিয়ম! মনে মনে গজ গজ করলো সে। “কার জন্য এই খাবার নিয়ে যাচ্ছো?” ছেলেটার হাতে থাকা পলিব্যাগের দিকে ইশারা করলো।

“এইগুলান দিদির…ফজলুর হোটেলের ক্র্যামচপ দিদি খুব পছন্দ করে।”

“ঠিক আছে, তুমি যাও,” ছফার আর কিছু জানার নেই এই ছেলের কাছ থেকে।

তবে আতরকে দেখে মনে হলো সে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। শ্যামলকে আরো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা ভাবছিলো, এতো দ্রুত এই পর্ব শেষ হবে আশা করেনি।

ছেলেটা চুপচাপ চলে গেলো, একবার পেছনে ফিরেও তাকালো সন্দেহগ্রস্ত দৃষ্টি নিয়ে।

“পোলাটা মাস্টরের কিমুনজানি আত্মীয় হয়,” রহমান মিয়া বলে উঠলো এবার, অনেকক্ষণ ধরে চুপ ছিলো সে। “গানের মাস্টনিও মনে লয় মাস্টরের আত্মীয়। হিন্দু মানুষ তো, কলকাতায় আত্মীয়স্বজন থাকবারই পারে।”

ছফা কিছু বললো না। রহমান মিয়া হয়তো নির্দোষভাবেই কথাটা বলেছে। পকেট থেকে টাকা বের করে দোকানিকে দিয়ে এবার আতরকে বললো, “তুমি এখানেই থাকো, আমি আসছি।”

ইনফর্মার কিছু জানতে চেয়েও চাইলো না, সে দেখতে পেলো নুরে ছফা রাস্তা পার হয়ে রবীন্দ্রনাথের দিকে যাচ্ছে।

.

অধ্যায় ২৯

পড়ন্ত বিকেলে রমাকান্তকামার নিজের অফিসে বসে আছেন। প্রায় প্রতি দিনই স্কুল থেকে বের হয়ে সুন্দরপুর মহাসড়কের পাশে অবস্থিত এই রবীন্দ্রনাথ স্মৃতি গ্রন্থাগারে গিয়ে বসেন। এখানে সময় কাটাতে তার অদ্ভুত রকমের আনন্দ হয়।

দিন দিন লাইব্রেরির সদস্য বাড়ছে, বাড়ছে পড়ুয়াদের আগমন। নিত্য নতুন বইয়ের খোঁজ করে তারা। মাস্টার সে-সব টুকে রাখেন, মাস শেষে সেখান থেকে বাছাই করা বইগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। যে বইগুলো যুগ যুগ ধরে আগলে রেখেছিলেন সেগুলোর একটা সদগতি হয়েছে দেখাটা তার কাছে ভীষণ আনন্দের, তারচেয়েও বেশি আনন্দ পান যখন দেখেন অল্পবয়সীরা সে-সব বই পড়ছে। ছোট্ট একটা কামরায় বসে জানালা দিয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখেন পড়ুয়াদের।

এ মুহূর্তেও তিনি সেটাই করছেন, কিন্তু আজকে সেই আনন্দে ভাটা পড়েছে খানিকটা। আইনের লোক হয়ে তার ঘরে চোর পাঠিয়েছে। কিছু জিনিস ফিরিয়ে দিলেও ঐ চিরকুটটা আর ফেরত দেয়া হয়নি। এটা নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন হলেও মাস্টারের মানসপটে ভেসে উঠলো কিছু দগদগে স্মৃতি।

সদ্য মেট্রিকুলেশন পাস করেছেন, দিনের বেশির ভাগ সময় পড়ে থাকেন শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণগ্রন্থাগারে। তার কাছে সুন্দরপুরের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিলল ওটাই। কী মনোরম পরিবেশ! বিশাল এক বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ার নীচে অবস্থিত দোচালা ঘরের মাঝারি আকৃতির একটি পাঠাগার। দু-পাশে অসংখ্য জানালা, সেই জানালা দিয়ে যতোদূর চোখ যেতে দেখা যেতো সুন্দরপুরের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমেও সুশীতল বাতাসের কমতি ছিলো না। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। বইয়ে ডুবে থাকার জন্য চমৎকার একটি জায়গা।

তারপরই একদিন শুরু হলো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। সুন্দরপুর থেকে হাজার মাইল দূরে কাশ্মীর নিয়ে দুই প্রতিবেশীর লড়াই। সেই লড়াইয়ের হিংস্র উত্তাপ ছড়িয়ে পড়লো সুন্দরপুরেও। চারদিকে ফিসফাস শোনা যেতে শুরু করলো। এক বিকেলে বাল্যবন্ধু কিসমত এসে জানালো, তার কাছে নাকি পাক্কা খবর আছে, আজ সন্ধ্যায় মুসলিমলীগার হামিদুল্লাহর নেতৃত্বে একদল দাঙ্গাবাজ লোক রবীন্দ্রনাথ-এর নামনিশানা মুছে দেবে-সেরকমই পরিকল্পনা হয়েছে। থানার পুলিশকেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা যেনো চোখকান বন্ধ রাখে!

রমাকান্তকামারের বুক ভেঙে গেছিলো কথাটা শুনে। তার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না হিংস্র আর ধর্মান্ধ রাজনীতির শিকার হতে পারে একটা লাইব্রেরি! তারপরই মনে পড়ে গেলো, যারা দেশ চালাচ্ছে তারা কোন্ প্রকৃতির মানুষ। এরাই কি ক্ষমতায় আসার পর রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিষিদ্ধ করার মতো জঘন্য কাজ করেনি? বাঙলাভাষার অন্যতম সাহিত্যিককে শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করেনি, শুধুমাত্র হিন্দু হবার কারণে? যদিও মূর্খ আর ধর্মান্ধগুলোর জানা ছিলো না, কবিগুরু ধর্মে ছিলেন ব্রাহ্ম! হিন্দু আর ব্রাহ্মর মধ্যে তফাৎ বোঝার মতো মানুষ অবশ্য তারা ছিলো না।

রমাকান্তের আরো মনে পড়ে গেলো সেই বিকেলের শেষ দিকে, কিসমতকে নিয়ে তিনি কী করেছিলেন। তারা দুই বন্ধু গেছিলেন জমিদার অলোকনাথের সাথে দেখা করে এ কথাটা বলার জন্য। সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বয়োজ্যেষ্ঠ জমিদার বলেছিলেন, তিনি কীই বা করতে পারবেন। নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়েই এখন চিন্তিত, লাইব্রেরি নিয়ে ভাবার সময় কই!

জমিদারের এমন অসহায় অবস্থা দেখে রমাকান্তকামার আর দেরি করেননি, একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন দ্রুত। কিসমতকে সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়েন রবীন্দ্রনাথকে রক্ষা করার কাজে। লুটেরা আর দাঙ্গাবাজদের হিংস্র আগুনে রবীন্দ্রনাথ পুড়ে যাবার আগেই ওটার মূল্যবান সম্পত্তিগুলো রক্ষা করতে হবে : দেশ মানে যদি মৃন্ময় না হয়ে চিন্ময় হয়ে থাকে, তো গ্রন্থাগার মানে দোচালার একটি ঘর নয়, এর সমস্ত বইগুলো!

চটের বস্তায় সেই বইগুলো ভরে, ক্ষেতের আইল ধরে মাথায় করে দৌড়ে দৌড়ে নিয়ে গেছে তারা দুই বন্ধু। এভাবে সন্ধ্যার আগে রবীন্দ্রনাথ যখন অর্ধেক রক্ষা করে ফেললো তখনই দূর থেকে দেখতে পায় আগুনের মশাল নিয়ে দাঙ্গাবাজেরা ধেয়ে আসছে।

অ্যাকশন অ্যাকশন! ডাইরেক্ট অ্যাকশন!

ভারতের দালালেরা নিপাত যাক নিপাত যাক!

এমন শ্লোগান তাদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলো। রমাকান্তকামার আর তার বন্ধু কিসমত অসহায়ের মতো শেষ একটি প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো তারপরও, কিন্তু এক বস্তার বেশি বই সংগ্রহ করার আগেই হিংস্র লোকগুলো চলে আসে রবীন্দ্রনাথের সম্মুখে। ভেতর থেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয় কিসমত। অবশ্য দরজা খোলার চেষ্টাও করেনি দাঙ্গাবাজেরা, তারা লাইব্রেরির চারপাশে কেরোসিন ঢেলে নিজেদের হাতের মশালগুলো নিক্ষেপ করতে থাকে ঘৃণ্য উল্লাসে। কেউ কেউ জানালা ভেঙে ভেতরেও ছুঁড়ে মারে আগুনের মশাল। দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ!

রমাকান্তকামার আর কিসমত পেছনের একটা জানালা ভেঙে এক বস্তা বই নিয়ে বের হতে সক্ষম হয়। তারা যখন মাথায় বস্তা নিয়ে একটু দূরে ক্ষেতের আইলের উপর দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকায়, দেখতে পায় সন্ধ্যার ফিকে হয়ে আসা আলোকে সমৃদ্ধ করে জ্বলন্ত চিতার মতোই জ্বলছে রবীন্দ্রনাথ।

সবগুলো বই রক্ষা করতে না পারার আক্ষেপটা সারা জীবনই তাকে পীড়া দিয়ে গেছে। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশাল পরিমাণের বই রক্ষা করার আনন্দটাও কম ছিলো না।

ছোট্ট জানালাটা দিয়ে লাইব্রেরির ভেতরে আরেকবার চোখ বুলালেন রমাকান্তকামার। এখন অজস্র নতুন বইয়ের ভীড়ে সেই সব দুষ্প্রাপ্য বইগুলো এই গ্রন্থাগারের মূল্যবান সম্পত্তি হয়ে শোভা বর্ধন করছে।

একাত্তরে পাক-বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। ধরেই নিয়েছিলেন, সংগৃহীত বইগুলো শেষ হয়ে গেছে, সেই সাথে তার মৃত্যুও সন্নিকটে। ধীরস্থিরভাবে মৃত্যুকে মেনে নেবার জন্য মানসিকভাবে তৈরিই ছিলেন। কিন্তু এরপরই দিলুমিয়া নামের স্থানীয় এক ছোকরা, যে কিনা মসজিদের পাশে নিমের মাজনসহ তসবিহ, টুপি, আতর বিক্রি করতো, সে তাকে প্রস্তাব দেয় ধর্মান্তরিত হবার জন্য আল্লাহর পাকিস্তানে মালাউনদের কোনো ঠাই নাই! ধর্মান্তরিত হয়ে গেলে রমাকান্তকামর বেঁচে যাবেন। পাকবাহিনী তো সাচ্চা মুসলমান, তারা কি আরেক মুসলমানকে হত্যা করবে?

দিলুর এ কথা শুনে পরিহাসের হাসি ফুটে উঠেছিলো মাস্টারের ঠোঁটে। পাকবাহিনী যে অকাতরে মুসলমানও হত্যা করে বেড়াচ্ছে সেটা কে না জানতত। তাদের কাছে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ই ছিলো বাঙালি। তবে অস্বীকার করবার উপায় নেই, হিন্দুদের উপরে নির্যাতনের মাত্রাটা অনেক বেশি ছিলো।

দিলুমিয়া যখন জানায়, ধর্মান্তরিত না হলে মিলিটারিরা তাকে তো মেরে ফেলবেই, তার ঘরে আগুন দিয়ে ভিটায় ঘু ঘু চড়াবে। কথাটা শুনে তিনি আৎকে ওঠেন-তার ঘরে আছে সেই সব দুষ্প্রাপ্য বইপত্র! আর কোনো দ্বিধা

করে তিনি ধর্মান্তরিত হবার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।

যুদ্ধশেষে অনেক বছর পর সুন্দরপুরে আবারো কালোছায়া নেমে আসে-কোলাবরেটর হামিদুল্লাহর ছেলে আসাদুল্লাহ এই এলাকার এমপি হয়ে যায়। স্বাধীনতাবিরোধী বদনাম ঘোচাতে স্কুলের নামকরন করতে চাইলো বাবার নামে, বাধা হয়ে দাঁড়ালেন মাস্টার, তার সঙ্গে যোগ দিলো আরো অনেকে। কিন্তু এমপিকে থামানোর মতো শক্তি তাদের কারোর ছিলো

। মাস্টারের পুরনো অনেক ছাত্র সরকারী চাকরিতে বড়সর পদে অধিষ্ঠিত আছে, তাদের সাহায্য নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী হামিদুল্লাহর নামে স্কুলের নামকরণের পায়তারা থামিয়ে দিতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত। এই ঘটনার পর ক্ষুব্ধ এমপি মাস্টারের চাকরিটা খেয়েছিলো রিটায়ারমেন্টের অল্প কিছু দিন আগেই। এতেও ক্ষান্ত হয়নি আসাদুল্লাহ, লোক দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে গেছিলো, অনেক শাসিয়েছিলো কিন্তু তার চোখ রাঙানিকে একটুও পাত্তা দেননি রমাকান্তকামার।

স্মৃতি থেকে ফিরে এসে ছোট্ট জানালাটা দিয়ে লাইব্রেরির ভেতরে তাকাতেই তার কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো।

এই লোক আবার কেন তার কাছে আসছে!

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *