অধ্যায় ৪০ – গ্রিসের অন্ধকার যুগ
খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ১০৫০ সালের মধ্যে গ্রিসে ডোরিয়ান আগ্রাসনকারীরা এক অন্ধকার যুগের সূত্রপাত ঘটান।
ট্রয়ের যুদ্ধে বড় আকারে জয়লাভের পর মাইসেনীয় জাহাজগুলো শম্বুকগতিতে নিজেদের দেশে ফিরে গেল। গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে ফিরে যেয়ে বীরযোদ্ধারা দেখলেন তাদের শহরগুলোর জাঁকজমক কমে গেছে এবং বিভিন্ন : ধরনের গোলযোগ দেখা দিয়েছে। ওডিসিয়াস ১০ বছরব্যাপী যুদ্ধশেষে নিজের বাড়িতে ফিরে আবিষ্কার করলেন শত্রুরা তার পৈতৃক নিবাস ধ্বংস করে রেখেছে। আগামেমনন নিজের স্ত্রীর কাছে ফিরলেন, কিন্তু শান্তি পেলেন না। অল্পদিনের মধ্যেই স্নানের সময় তিনি তার স্ত্রী ও স্ত্রীর গোপন প্রেমিকের কাছে প্রাণ হারালেন।
কিন্তু এ ছিল শুধুই আসন্ন দুর্যোগের পূর্বাভাস মাত্ৰ।
১২০০ সাল নাগাদ পুরো উপদ্বীপে দাবানল ছড়িয়ে পড়ল। স্পার্টা শহর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। মাইসেনী শহরও এই নজিরবিহীন শত্রুবাহিনীর মুখোমুখি হল। যুদ্ধে দুর্গের তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও, প্রাচীরের বাইরের সব বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে এগুলো আর কখনোই পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। একইভাবে, পাইলোসও আগুনে পুড়ে যায়।
আরও বেশকিছু শহরও বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হয়।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরগুলোতে পরবর্তী সময়ে নতুন করে মানুষ এসে বাসা বেঁধেছে। তবে এই নবাগতরা লিখতে জানতেন না, তাদের পাথর বা ইট দিয়ে ঘর-নির্মাণের কোনো দক্ষতা ছিল না এবং তারা ব্রোঞ্জের ব্যবহার সম্পর্কেও অবগত ছিলেন না। ধারণা করা হয়, এই নতুন যাযাবরদের আগমন ঘটেছিল উপদ্বীপের উত্তর অংশ থেকে। তাদেরকে পরবর্তীতে ইতিহাসবিদরা ‘ডোরিয়ান’ নাম দেন।
ইতিহাসবিদ থুসিদিদেস ও হেরোডোটাস উভয়ই ডোরিয়ানদের বিষয়ে ভিন্নধর্মী বর্ণনা দেন। দুইজনের সুরই এক। তাদের মতে, ডোরিয়ানরা বড় আকারের সামরিক অভিযান চালিয়ে মাইসেনীয় শহরগুলোর দখল নেয়। হেরোডোটাস অ্যাথেন্সের চারপাশ ঘিরে থাকা অঞ্চল আট্টিকায় ৪ বার ডোরিয়ানদের হামলা চালানোর বর্ণনা দেন। তার মতে, কোডরাস যখন অ্যাথেন্সের রাজা ছিলেন, তখন প্রথম হামলাটি আসে। পরবর্তীকালে, গ্রিক লেখক কোনোনও তার বর্ণনায় এই প্রথম হামলার কথা উল্লেখ করেন। তার গল্পটি এরকম : ডোরিয়ানদের শিবিরের এক গণক ভবিষ্যৎবাণী দেন, অ্যাথেন্সের সঙ্গে যুদ্ধে ডোরিয়ানরা জয়ী হবে। তবে শর্ত একটি। দেশটির রাজা কোডরাসকে কোনোভাবেই হত্যা করা চলবে না। কোডরাস এই ভবিষ্যৎবাণীর কথা জানতে পেরে একজন সাধারণ অ্যাথেনীয় নাগরিকের ছদ্মবেশ ধারণ করে ডোরিয়ানদের শিবিরে যান। সেখানে তিনি একজন সশস্ত্র ডোরিয়ান যোদ্ধার সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন, যা মল্লযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। এই যুদ্ধে তিনি (স্বভাবতই) প্রাণ হারান বলে ভবিষ্যৎবাণী মতে তার শহর রক্ষা পায়।
ডোরিয়ানরা কোডরাসের এই মহান আত্মত্যাগে অভিভূত। তারা অ্যাথেন্সে হামলা বন্ধ করে শিবির গুটিয়ে পিছিয়ে গেল। তবে এই পিছু হটা ছিল কেবলই সাময়িক। এই হামলা শেষ হতে হতে, থুসিদিদেসের মতে, ডোরিয়ানরা গ্রিক উপদ্বীপের সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থিত অঞ্চল পেলোপন্নেসের অধিকর্তা হয়ে গেছে।
থুসিদিদেশ ও হেরোডোটাস, দুইজনই বীরদের ভূমির চারিদিকে ভয়ানক হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দেন। মিশরের ইতিহাসবিদরা যেমন হিকসোসের হামলার কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন, একইভাবে, এই দুই জনও ঝটিকা হামলা ছাড়া তাদের পূর্বপুরুষদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তবে মাইসেনীয় শহরগুলোর ধ্বংসস্তূপ আমাদের কিছুটা ভিন্ন গল্প শোনায়। পাইলোস ও মাইসেনী পুড়ে যাওয়ার মাঝে রয়েছে ৯০ বছরের ব্যবধান। অর্থাৎ, প্রায় ১০০ বছর ধরে ডোরিয়ানদের আগ্রাসন ধীরে ধীরে উপদ্বীপের উত্তর থেকে দক্ষিণ অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। একে কোনোদিক দিয়েই ‘অপ্রত্যাশিত’ হামলা বলার উপায় নেই। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মাইসেনীয় গ্রিকদের হাতে প্রচুর সময় ছিল I
কিন্তু এই অভিজ্ঞ যোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও তা এই নবাগত ডোরিয়ানদের জন্য কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। ডোরিয়ানদের তেমন কোনো উন্নত যুদ্ধকৌশলও ছিল না, বা তারা খুব বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্নও ছিলেন না। কোনো কোনো শহরে যুদ্ধের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুই ইতিহাসবিদের বর্ণনায় অ্যাথেন্সের প্রবল প্রতিরোধের কথা শোনা যায়। সকল মাইসেনীয় শহরের মধ্যে শুধু অ্যাথেন্সই সমর্থ হয় আগ্রাসী ডোরিয়ানদের প্রতিহত করতে। তবে ভিন্ন এক বাস্তবতাই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়—অ্যাথেন্সে কোনো হামলাই হয়নি সম্ভবত!
মাটি খুঁড়ে প্রাচীন অ্যাথেন্সে কোনো ধ্বংসযজ্ঞ বা আগুনে পোড়ার চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
তা সত্ত্বেও, অ্যাথেন্সের জনসংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে। ট্রয়ের যুদ্ধের প্রায় ১৫০ বছর পর, ১১০০ সালে অ্যাথেন্সের অ্যাক্রোপলিসের (শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এক উঁচু পাথর। শহরটির সবচেয়ে নিরাপদ ও প্রতিরোধযোগ্য স্থাপনা) উত্তর-পূর্ব অংশ থেকে শান্তিপূর্ণভাবে জনবসতি সরে গেছে। ডোরিয়ানদের পুড়িয়ে দেওয়া স্পার্টা ততদিনে খালি হয়ে গেছে। শহরটির বাসিন্দারা বেশ কয়েক বছর আগেই সেখান থেকে চলে গেছেন। একটি দুর্বল ও এলোমেলো দক্ষিণাঞ্চলে উত্তর থেকে গণহারে মানুষ আসতে শুরু করল।
নিঃসন্দেহে মাইসেনীয় শহরগুলোর ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার পেছনে ট্রয়ের যুদ্ধের কোনো-না-কোনো অবদান রয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে থুসিদিদেস মন্তব্য করেন : ‘ট্রয় থেকে হেলেনের বিলম্বিত প্রত্যাবর্তনের কারণে মাইসেনীয়দের মধ্যে এতটাই তিক্ততা দেখা দেয় যে, তারা অনেকেই নিজ শহর ছেড়ে চলে যান। তবে এই বৈরী পরিস্থিতির পেছনে অন্যান্য কারণও ছিল। যেমন, টানা ২/৩ বছর বিরূপ আবহাওয়া, যুদ্ধের কারণে মিশর ও এশিয়া মাইনর থেকে শস্য আসা বন্ধ থাকা এবং সঙ্গে নিজেদের উৎপাদনেও বিঘ্ন—সব মিলিয়ে অঞ্চলটিতে বড় আকারের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। হয়তো মাইসেনীয় শহরগুলো একে অপরের সঙ্গে খাবারের জন্য কাড়াকাড়ি শুরু করে। ক্ষুধার কারণে মানুষে মানুষে যুদ্ধ লেগে যায়, শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় অসংখ্য মানুষ। এছাড়াও, আইরিশ ওক গাছ ও এশিয়া মাইনরের কিছু গাছপালা ১১৫০ সালে খরা মৌসুমের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে।
আরও ভয়ানক এক শত্রুও হয়তো মাইসেনীয়দের অনুসরণ করেছে।
ইলিয়াডের প্রথম দৃশ্যে ট্রোজান পূজারি খ্রাইসেস দেবতা অ্যাপোলোর কাছে এক বিশেষ আর্জি জানান। তিনি আক্রমণকারী গ্রিকদের উদ্দেশে মহামারি পাঠানোর অনুরোধ জানান দেবতাকে। কারণ, গ্রিক যোদ্ধা আগামেমনন খাইসেসের মেয়েকে অপহরণ করেছে।
অ্যাপোলো তার প্রার্থনার জবাব দিলেন এবং অগ্নিযুক্ত তিরের মাধ্যমে শত্রুদের জাহাজে মহামারি পাঠালেন। ফলাফল ছিল মারাত্মক।
‘তিনি একটি জ্বলন্ত বায়ু তৈরি করলেন!
যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে মহামারি ছড়িয়ে পড়ল।
সামান্য যোদ্ধা থেকে সেনাপতি, কেউ নিস্তার পেল না,
সবাই অসুস্থ হল এবং মারা গেল।
শুধুমাত্র তাদের নেতাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে।’
খুব সম্ভবত সমুদ্রের তীরের শিবিরে থাকা মাইসেনীয়রা মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এটি সম্ভবত বিউবোনিক প্লেগ ছিল।
অন্য সব প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মতো, ট্রোজানরাও বিউবোনিক প্লেগ কীভাবে ছড়ায়, সে-বিষয়ে কিছুই জানত না। তবে তারা এটুকু জানত যে এই রোগের সঙ্গে ইঁদুরের কোনো একধরনের যোগসূত্র আছে। যে দেবতা রোগ ছড়ান, তাকে ট্রোজানরা সম্মান জানালেন। এশিয়া মাইনরের বাসিন্দাদের কাছে অদ্ভুত লাগলেও, তারা অ্যাপোলোকে ‘অ্যাপোলো স্মিন্থিয়ান’, বা ‘ইঁদুরের প্রভু’ নামে ডাকতেন। ইলিয়াড থেকে আমরা আরও জানতে পারি, অ্যাপোলো স্মিন্থিয়ানের তীরে শুধু মানুষই নয়, ঘোড়া ও কুকুরও ছিল। এভাবে প্রাণীদের মাধ্যমে বিউবোনিক প্লেগ ছড়ানোর বিষয়টি প্রাচীন ইতিহাসে ধারাবাহিকভাবে স্থান পেয়েছে। প্রায় ১ হাজার ৫০০ বছর পর গ্রেগরি অব ট্যুরস লেখেন, ‘এই পঙ্গপাল শুধুমাত্র গৃহপালিত পশুর মাঝেই নয়, এমনকি বন্য প্রাণীর ওপরও হামলা চালায়।’
যুদ্ধজয়ী মাইসেনীয় বীরযোদ্ধারা হয়তোবা তাদের সঙ্গে করে মৃত্যু নিয়ে এসেছিলেন। জাহাজে কোনো অসুস্থ মানুষ না-থাকলেও, হয়তো পাটাতনের নিচে প্লেগবাহক ইঁদুর লুকিয়ে ছিল। মহামারির পর আসে দুর্ভিক্ষ। জাহাজের মাধ্যমে এক শহরের শস্য আরেক শহরে যায় এবং সে শস্যের মাঝে থাকে প্লেগের বাহক ইঁদুরগুলো। এভাবেই নজিরবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে প্রাচীন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল।
একটি পাথুরে শুষ্কভূমির উপর তৈরি হওয়া সভ্যতার ভারসাম্য নষ্ট করে দেওয়ার জন্য মহামারি, খরা ও যুদ্ধ—এই তিন উপকরণই যথেষ্ট। যখন বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়াল, তখন সুস্থ ও সবলরা অঞ্চল ছেড়ে চলে গেলেন।
অর্থাৎ, শুধু মাইসেনীয়রাই নয়, বরং ক্রিট ও এইজিয়ান দ্বীপের বাসিন্দারাও তাদের জন্মভূমি ছেড়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নতুন বাসস্থানের খোঁজে বের হয়ে গেলেন। কেউ কেউ ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে কাজ নিলেন। মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সমুদ্র থেকে আসা জলদস্যুদের মধ্যে ঠিক কতজন ভাড়াটে সৈনিক ছিলেন, তা এখন আর জানা সম্ভব নয়। তবে মিশরের বর্ণনায় জানা যায়, সমুদ্র থেকে হামলা আসার আগে ফারাও রাজা পশ্চিমের মরুভূমিতে লিবিয়া থেকে আসা হামলার মোকাবিলা করার জন্য এইজিয়ানদের মধ্য থেকে সেনা ভাড়া করেছিলেন। একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মাইসেনীয়দের বদলে ডোরিয়ানদের কাছে দক্ষিণের আধিপত্য চলে যায় এবং নিলামে সবচেয়ে বেশি দর যারা দিতে পারতেন, মাইসেনীয় সেনারা তাদের হতে লাগলেন।
ডোরিয়ানদের কোনো রাজা বা রাজসভা ছিল না, তাদের ছিল না কোনো কর বা নজরানা দেওয়ার ব্যবস্থা। এমনকি, তারা বহির্বিশ্বের সঙ্গে সমুদ্রপথে কোনো বাণিজ্যও করত না। তারা চাষাবাদের মাধ্যমে জীবনযাপন করতেন। কোনোকিছু লিখে রাখার প্রয়োজন দেখেনি এই জাতি। ডোরিয়ানদের দখলে যাওয়ার পর গ্রিক উপদ্বীপের অন্ধকার যুগের সূচনা হয়। লিখিত তথ্যপ্রমাণের অভাবে আমরা এ বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানতে পারিনি।